তিন ভুবনের পারে

এক

চার গাড়ি ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে কবি-অধ্যাপিকা জোন স্টোন এবং আমি বেরিয়ে পড়লুম কলোরাডো স্প্রিংস থেকে, মাইনাস পনেরো ডিগ্রি ফারেনহাইট তখন রেডিও বলছে। কলোরাডো স্প্রিংস রকি মাউন্টেনের মধ্যে, এইসব পাহাড় পর্বত পেরিয়ে ওপারের উপত্যকায় বাকা, পাক্কা তিন ঘণ্টার রাস্তা। বাকা যাচ্ছি শুনেই সহকর্মীরা সমস্বরে বলতে লাগলেন—কী সৌভাগ্য, কী সৌভাগ্য, দারুণ জায়গা, অনেকগুলো স্পিরিচুয়াল সেন্টার আছে। জায়গাটির নিজস্ব একটা আধ্যাত্মিক চরিত্র আছে, শান্তির ও আত্মোন্নতির জায়গা। এর স্থানমাহাত্ম্যের কথা আমেরিকান ইনডিয়ানদের কিংবদন্তীতে আছে, সেই থেকেই নানান ধর্মের লোকেরা এসে ওখনে বানপ্রস্থ নেবার, সন্ন্যাস নেবার, ধ্যান করবার, তপস্যা করবার আশ্রম গড়তে চেষ্টা করছেন।

যাঁরই সঙ্গে দেখা হয় তিনিই বলে ওঠেন—বাকা’-তে যাচ্ছো? যেমন সেখানকার অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জনহীন কুমারী প্রকৃতি, তেমনি অপরূপ শান্তিময় আধ্যাত্মিক পরিবেশ। দেখো, মনে প্রাণে পরিপূর্ণ শান্তি নিয়ে ফিরবে।—কিন্তু প্রশ্ন করলেই শুনতে পাই, প্ৰায় সকলেই শোনা কথা বলছেন। স্বয়ং সেখানে গেছেন মাত্র দু’ একজনই।

যে জায়গার স্থান-মাহাত্ম্য এমন ঘোরতর সম্প্রচারিত, সেখানে যাবার ইচ্ছে যে আমার মধ্যে ক্রমেই বাড়বে তা বলা বাহুল্য। ছোট্ট গ্রাম ‘বাকা’-য় নাকি নানান ধর্মপীঠের সহাবস্থান। যাঁরা সেখানে বাস করেন, তাঁরা বানপ্রস্থী, আর বহিরাগতদেরও সেখানে নাকি মাঝে মাঝে গিয়ে কিছুদিনের মতো সাময়িক আশ্রমিক জীবনযাপনের সুবন্দোবস্ত আছে—কিন্তু এ বিষয়ে কেউই স্পষ্ট করে কিছু জানেন না। ‘বাকা’-তে আর কিছুই কি নেই? নাঃ। এটা কোনো ট্যুরিস্ট স্পট নয়। সোনার খনি নেই, রিজার্ভ ফরেস্ট নেই। তেমন দর্শনীয় রেডইন্ডিয়ান কুটির শিল্পও নেই। হ্যাঁ, ফাঁকা ঝর্নাটর্নাও নেই। পাহাড় পর্বত আছে বটে চারধারে, এটা একটা সমতল উপত্যকায় অবস্থিত। শান্ততা ও নির্জনতাই এর প্রধান উৎপন্ন দ্রব্য। ‘বাকা’ যাবার পথ অনেক পাহাড় পেরিয়ে। প্রথমটা খুব সুন্দর অঞ্চল দিয়ে গিয়ে শেষটা কেবলই সমতলভূমি। বরফের চাদরে পুরো ঢাকা রাস্তার দুপাশ। দূরে ঘিরে আছে তুষারমৌলী পর্বতমালা।

তুষার যে কেবল নিজেই নিঃশব্দে ঝরে তা নয়, চারিদিকে একটা শব্দবিরোধী আবহাওয়াও তৈরি করে নেয়। তুষারের ওপর একটা শুকনো পাতা খসে পড়লেও যেমন তা শোনা যায় না, শোনা যায় না তেমনি বুট জুতো পরা পায়াভারি মানুষের পদশব্দও। “বাকা গ্র্যান্ড” ছোট্ট গ্রামটি এমনিতেই বড্ড নির্জন, বড্ড নিস্তব্ধ—কিন্তু এমন এই তুষারাচ্ছন্নতা তার নৈঃশব্দ্য অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। পথ দিয়ে হঠাৎ ছুটে যাওয়া মোটর গাড়ি আর তারই পিছু পিছু দৌড়ে চেঁচিয়ে ওঠা ‘পথের পাহাড়ী কুকুরের গলা ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই এখানে। নেই কোনও পাখির ডাক। এই গভীর শীতে তারা সবাই পলাতক। যখন এখানকার প্রাণী অন্যত্র পালাচ্ছে, তখন আমরা এলুম এখানে। কবিতা লেখা, কবিতা শেখার এমন যোগ্য পরিবেশ আর কোথায় আছে?

দিনে ২-৩ ঘণ্টা একটানা ক্লাস হয়, বাকি সময়টা বরফঢাকা শূন্য সাদা বাকা-তে আমি আধ্যাত্মিক আশ্রমের খোঁজ করি। ক্লাস কবিতা লেখার : না, ছাত্রদের লিখিত কবিতার উন্নতিসাধনের বলাই ভাল। অর্থাৎ ছাত্রদের কবিতার আত্মিক উন্নতি একদিকে, আর একদিকে মাস্টারের আত্মিক উন্নতির খোঁজখবর। ‘বাকা’-র টেলিফোন ডিরেক্টরিটা ৪-৫ পৃষ্ঠার। সমস্ত ‘একক সাধনা’র আশ্রমগুলিতেই ফোন আছে। ‘বাকা’ এবং আরও তিনটি গ্রামের একত্র ডিরেক্টরি ওই ৪-৫ পৃষ্ঠাতেই সম্পূর্ণ। তাতেই বুঝুন কতজন মাত্র অধিবাসী ওই অঞ্চলে।

গ্রামটি অত্যন্ত ছোট্ট। একটি মুদির দোকান, একটি পোস্টাপিস, একটি গ্যাস স্টেশন, একটি রেস্তোরাঁ। ব্যস্। কয়েকটি বাড়ি। উত্তরকাশীর যে উতরোল গঙ্গা, তা ‘বাকা’-তে নেই, কিন্তু হিমালয়ের যে গম্ভীর সৌন্দর্য তা ‘বাকা’-র আছে। আমাদের দেশে সাধুসন্তদের হিমালয়ে চলে যাওয়ার রেওয়াজ বহু প্রাচীন, হিমালয়ের কোলে কোলে হরিদ্বার হৃষিকেশ থেকে উঠতে উঠতে উত্তরকাশী রুদ্রপ্রয়াগ পর্যন্ত নানা বিভিন্ন মতের সাধুসন্তদের গুরুদেবদের আশ্রম, বিভিন্ন দেবতার মন্দির, মঠের ছড়াছড়ি। গোটা অঞ্চলটাই পুণ্যভূমি, পুণ্য অঞ্চল, স্থানমাহাত্ম্যের গুণেই ওখানে প্রাণে শান্তি আসে, চিত্তচাঞ্চল্য কমে যায়। অনেক বিরাট এক প্রাকৃতিক মহিমার সকাশে এসে দাঁড়িয়ে জীবনের তুচ্ছতা ক্ষুদ্রতাগুলিকে ক্ষুদ্র বলে চিনতে পারা যায়। ‘বাকা’ এমনি এক জায়গা। সাংগ্রে দি ক্রিস্টো (‘যীশুর রক্ত’) আর সানহুয়ান (‘সেন্ট জন’) এই দুই পর্বতের মাঝে সান লুইস (সেন্ট লুইস) উপত্যকার মধ্যে সাংগ্রে দি ক্রিস্টোর বরফ-সাদা পাথুরে বুকেই ছোট্ট একটি পাহাড়ী গ্রাম ‘বাকা’। এখানেও ছোট্ট একটি নদী আছে, শান্তশিষ্ট পাহাড়ী ঝরনা, যাকে কোনওমতেই উত্তাল অলকানন্দার সঙ্গে তুলনা করা ধৃষ্টতামাত্র। কিন্তু ‘বাকা গ্র্যান্ড’ নামের ছোট্ট গ্রামটিকে উত্তরকাশীর সঙ্গে তুলনা করতে আমার বাধছে না।

আশ্রমে আশ্রমে ভর্তি ‘বাকা’ গ্রামটি অধ্যাত্মবাদ চর্চার একটি নির্জন, নিরুপদ্রব কেন্দ্র। যেখানে রেল, বাস, কিছু যায় না। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলতে প্রাইভেট গাড়ি। আর গ্রামের ভিতর পা-গাড়ি। লোকে হাঁটে, সাইকেল চড়ে, আর গাড়ি চালায়। কয়েকটি বাগানবাড়ি আর এক গুচ্ছ টাউনহাউস আছে, তারই কিছুটাতে কলোরাডো কলেজের ক্যাম্পাস, ‘সেমিনার হল’ ইত্যাদি। বাকিগুলি ব্যক্তিগত সম্পত্তি। বাকার তিন মাইলের মধ্যেই ৬-৭টি আধ্যাত্মিক আশ্ৰম রয়েছে, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। বরফে গোঁজা একটি হিন্দু আশ্রম, একটি কারমেলাইট ক্যাথলিক সাধুদের আশ্রম, একটি Zen বৌদ্ধ আশ্রম, একটি তিব্বতী লামাদের আশ্রম, একটি শ্রীঅরবিন্দ শিক্ষা আশ্রম—এ ছাড়া তৈরি হচ্ছে সুফীদের সেন্টার, শার্লি ম্যাকলেইনের আধ্যাত্মিক সেন্টার, মার্কিনী রেড ইন্ডিয়ানদের একাধিক স্থানীয় প্রজেক্ট চলছে—তাঁদের ধর্ম সংস্থাপনের চেষ্টাও। এইটুকুনি তো জায়গা, তাতে এতগুলি আধ্যাত্মিক আশ্ৰম!

আমার খুব উৎসাহ হল সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে বাজিয়ে দেখতে— কেমনভাবে, কারা, কেনই বা এসব করেছেন, কীভাবে চলছে। ব্যাপারটা কী? এতে সন্দেহ নেই যে আশ্রম তৈরির পক্ষে, ধ্যান করার পক্ষে, সন্ন্যাসগ্রহণের পক্ষে বাকা আদর্শ জায়গা। কিছু বরফের দেশের রূপবান বলশালী কুকুরের বরফের মধ্যে ছুটোছুটি খেলা ভিন্ন প্রাণের চিহ্ন নেই সর্বশুক্লা তুষারাচ্ছন্ন বাকাতে। রাতের তাপমাত্রা মাইনাস তিরিশ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছিল, আমরা যখন ছিলুম। বাপ-বাপ বলিয়ে সন্ন্যাস নিইয়ে ছাড়ে। বিদ্যুৎ আছে, কিন্তু কারুরই টেলিভিশন নেই— মাঝেমাঝে খবরের কাগজ আসে, প্রত্যহ আসে না। লোকে রেডিও শোনে খুব। যেন স্বেচ্ছাদ্বীপান্তরী সব। ব্যক্তিগত মোটরগাড়ি ছাড়া ট্রান্সপোর্ট নেই

দুই

ঠিক করলুম প্রথমে হিন্দু আশ্রমেই যাব। হাইডাখণ্ডী ইউনিভার্সাল আশ্রমে ফোন করতে তার প্রেসিডেন্ট এসে আমাকে সযত্নে তাঁর গাড়ি করে আশ্রমে নিয়ে গেলেন। তাঁর নাম রাধেশ্যাম, তিনি আইনজীবী ছিলেন, একসময়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন এবং তাঁকে রাশিয়াতে মিশনে পাঠানো হয়েছিল। পরে তিনি ভারতবর্ষে যান, রানীক্ষেতের কাছে হাইডাখণ্ডী বাবাজীর আশ্রমে গিয়ে পড়ে ওখানেই ৭-৮ বছর থেকে যান চাকরি ছেড়ে দিয়ে, সংসার ছেড়ে দিয়ে। এখন এখানে আশ্রমিক।

রাধেশ্যাম আমাকে একটি সুন্দর কাঠের বাড়িতে নিয়ে গেলেন, সেটাই আপাতত আশ্রম। বড় আশ্রমের জায়গা মিলেছে, আশ্রম তৈরিও হচ্ছে। ছোট আশ্রমে রাধেশ্যাম ছাড়া বাস করেন এক দম্পতি, রামদাস ও রামলতি। সকলেই মার্কিনী। পোশাক-আশাকও মার্কিনী। শয়নকক্ষগুলি কিন্তু দিশি। ওঁরা মেঝেতেই গদি পেতে শতরঞ্চি, কম্বল ইত্যাদি বিছিয়ে শোন। প্রত্যেকের নিজস্ব ঘর আছে।

রামদাস রামলতির ছেলেরা স্কুল-কলেজে পড়ছে ক্যালিফোর্নিয়াতে। ওঁরাও অনেকদিন ভারতবর্ষে হাইডাখণ্ডী বাবাজীর আশ্রমে ছিলেন। স্বামী তো সাতবছর। স্ত্রী বাচ্চাদের নিয়ে যাতায়াত করতেন। হাইডাখণ্ডী বাবাজীর তিরোধানের পর এঁরা মার্কিন দেশে ফিরেছেন এবং বাবাজীর আশ্রমের অনুসরণে আশ্রম গড়তে চেষ্টা করেছেন। বাবাজী নিজে হিন্দু, আদি কৈলাস পর্বতগুহায় তাঁর সিদ্ধি। কিন্তু তিনি বিশ্বাসী নন ধর্মান্তরণে, অহিন্দুকে তিনি হিন্দু করেন না। কেবল তাদের “কর্ম” ও “কর্মযোগ” এই দুটিতে বিশ্বাসী করে তোলেন। দু’বেলা নামকীর্তন, যজ্ঞ, নিত্য পূজা, গুরুর আরাধনা, আশ্রমে তো সবই দেখলাম হয়। দোতলায় মন্দির রয়েছে, যজ্ঞের জন্য অগ্নিকুণ্ডও রয়েছে, ওঁরা যাকে ‘হবম’ বলছেন, আর রয়েছে ভারতীয় সামগ্রীর দোকান। ধূপকাঠি, বাবাজীর ছবি, বইপত্র, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, মালা চুড়ি, নামাবলী, কোষাকুষি, ঘট, পুষ্প পাত্র, কারি পাউডার, চন্দন তেল সবই বিক্রি হচ্ছে।

আমি ‘ওঁ নমঃ শিবায়’ লেখা একটি সাদা পোস্টার কিনতে চাইলুম। দশ ডলার দাম নিয়ে নিলেন রামলতি, সবিনয়ে তৎক্ষণাৎ।

বাবাজীর বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলে তিনজনের কেউই থামতে পারেন না, তাঁদের ধ্যানজ্ঞান ভালবাসা সব ওই বাবাজী। এই তীব্র ভক্তি দেখে ভাল না লেগে উপায় নেই, কিন্তু আরো ভাল লাগে বাবাজীর ধর্মীয় মতামত। তিনি সর্বধর্মসমন্বয়ে বিশ্বাসী। জাতপাত মানেন না, ব্রাহ্মণ-শূদ্র ভাগ করেন না, একসঙ্গে থাকাখাওয়া, বড়দিনে যীশু উৎসব, নানকের জন্মদিনে গ্রন্থসাহেব পাঠ, ঈদের পরব, ইহুদীদের হানুকা, যখনকার যা, সবই নিয়ে উৎসব করেন, যদি আশ্রমে তখন সেই ধর্মাবলম্বী শিষ্য থাকে। শিষ্যরা যে যার স্বধর্মে থেকেও তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে পারে। তাঁর শিক্ষা হল : সত্য, সারল্য, প্রেম। “Truth, Simplicity, Love” বলে চতুর্দিকে পোস্টার মারা। গুরুদেব নিজে যে দেবীর পূজারী—তিনি পৃথিবীমাতা। তাঁর ছবি তিনি স্বপ্নে পেয়ে মুখে বর্ণনা দিয়ে ছবি আঁকিয়েছেন। সেই ছবি থেকে এখানকার জন্য অন্য এক মূর্তি তৈরি হয়েছে। দেবীর ছবি দেখলুম সাদা পাথরের মেমমূর্তি, দিব্যি নীলচোখ, কটা চুল। পরনে শাড়ি অবশ্য। আমি সেটা উল্লেখ করলুম। মেম কেন? ওঁরা বললেন—”এ দেশে এ মূর্তি থাকবে, সবাই যাতে আইডেন্টিফাই করতে পারে। তাছাড়া ইউনিভার্সাল আশ্রম তো, ইন্ডিয়ান তো নয়।” সত্যি কথা। এখনও ‘সভ্য জগতে’ “ইউনিভার্সাল” মানেই যে সাদা, সেটা কেন ভুলে গিয়েছিলুম। গুরুজীর স্বপ্নে দেখা মাতৃ-মূর্তিটি খুব সুন্দরী, খুব ভারতীয়া, নন্দলাল বসুর ছবির মতন। উপবিষ্টা। এঁদের বানানো মূর্তিটি দণ্ডায়মানা, মেম মাতৃকা। আমার মনে ধরেনি। যদিও, ওঁদের আদর্শটি খুবই মনে ধরার মতো।

ওঁরা ‘কর্মযোগী’ হতে চান। ‘কর্ম’ বলতে ওঁরা চান পৃথিবী মাতার কিছু সেবা করতে। আপাতত পলিউশান দূর করাই ওঁদের লক্ষ্য। ওঁদের মতে সাদারা চিরকাল পৃথিবীকে ব্যবহারই করেছে, কিন্তু পুজো করেনি, রেড ইন্ডিয়ানরা ও ভারতীয়রা সর্বদাই পৃথিবী ও পঞ্চভূতের আরাধনা করেছে। এই আশ্রমের তাই উদ্দেশ্য হবে পৃথিবীর ইকলজির উন্নতি। সূর্যের আলো থেকে এরা বিদ্যুৎ তৈরি করে আশ্রম চালাবেন, আলো ও উত্তাপের জন্য। এ অঞ্চলে সূর্যদেব সর্বদাই থাকেন—ঠাণ্ডা যতই পড়ুক না কেন—তাই এটা সম্ভবপর হবে।

ওঁদের মন্দির ও আশ্রম যেখানে হচ্ছে পাহাড়ের ওপর, সেখানে আমাকে নিয়ে গেলেন। প্রচুর জমি আছে—প্ল্যান দেখালেন। মন্দিরটি কাঠের। তৈরি হয়ে গেছে। পূজারীর ঘরও তৈরি। ভারত থেকে শাস্ত্রীজী এসে পুজো করে মন্দির তৈরি শুরু করে দিয়ে গিয়েছিলেন। রেড ইন্ডিয়ান পুরোহিতকেও ডেকে এনে এঁরা ভূমিপূজা করিয়ে তাঁদের দেবতাদের আশীর্বাদ গ্রহণ করে তবে মন্দির আরম্ভ করেছিলেন, কেননা এসব জমিই তো আদতে রেড ইন্ডিয়ানদের দেবতাদের। তাঁদের অভিশাপ যেন না লাগে।

যেখানে এঁদের মন্দির দেখলুম সেখান থেকে অল্প নিচে ৬-৭টি পাথরের তৈরি ইগলুর মতো কুটির আছে। ছোট্ট দরজাওলা গোল গোল ঘর। কেউ বলেন ওগুলি রেড ইন্ডিয়ান সাধু-সন্ন্যাসীদের থাকার জায়গা, ওঁরা এই বনে পাহাড়ে ধ্যানে আসতেন। ডিভাইন “ভিশনকোয়েস্ট”, দৈব দর্শনের খোঁজে, সত্যদর্শনের খোঁজে। কেউ বলে এখানে যে গ্রাম ছিল ওগুলি আসলে রেড ইন্ডিয়ান মেয়েদের মাসিক হলে থাকার জায়গা এবং আঁতুড়। কেউ বলে তা নয় ওগুলি ওদের খাদ্যশস্য জমা করবার গোলাঘর। যে যাই বলুক, এঁরা বিশ্বাস করেন ওগুলি ওদের ‘হার্মিটেজ’। বানপ্রস্থ আশ্রম। তাই তার কাছাকাছি জমি নিয়ে আশ্রম বানাচ্ছেন, স্থানমাহাত্ম্য আছে তো। “তোমাদের যেমন কাশী, গয়া, হরিদ্বার, উত্তরকাশী, হৃষিকেশ। যেখানে সব বিভিন্ন হিন্দু গুরুদের আশ্রম হয়েছে, স্থানমাহাত্ম্যের জন্যেই তো? বাকাও তেমনি। এরা একে পুণ্যভূমি বলে মানে। এখানে ‘ব্লাংকা’ শিখর রেড ইন্ডিয়ানদের কাছে হিমালয়ের মতো পবিত্র।”

“তোমরা কি হিন্দু?”

আমার প্রশ্নের উত্তরে রামদাস হেসে বললেন—”না, আমরা তো ক্রিশ্চান।”

“তবে রোজ ভোর ছটায় উঠে দু’বেলা স্নান করে নামকীর্তন করো, জপ করো, যজ্ঞ করো, অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দাও, এ সব কেন?”

“ভাল লাগে বলে করি। বাবাজী কক্ষনো ধর্মান্তরণে বিশ্বাস করতেন না।”

“নাম বদলেছো কেন তবে?”

“বাবাজী খেলাচ্ছলে নাম বদলে দিতেন।

বাড়িতে ডার্করুম বানিয়ে, রামদাস পেশায় এখন ফোটোগ্রাফার। আগে ছিলেন ফিজিয়োথেরাপিস্ট। আমাকে তাঁর কার্ড দিলেন, তাতে তাঁর সাহেবী নামটাই ছাপানো আছে।

রাধেশ্যামের কার্ডে কিন্তু দুটি নামই ছিল।

এঁরা নিয়মিত একটি বুলেটিন বের করেন—রামলতি যার সম্পাদিকা—সারা আমেরিকাতে নাকি প্রচারিত হয় সেই বুলেটিন। হাউডাখণ্ডী বাবার মন্দির আরো কয়েকটি আছে আমেরিকাতে।

বাড়ির মধ্যেকার মন্দিরের আবহাওয়াটি সুন্দর ছিল, চাপা ধূপের গন্ধ ভরা। এই খোলা বরফের মধ্যে পাহাড়ের গায়ের মন্দির এখনও অসম্পূর্ণ, তার ভিতরে যাবার পথ বরফে বন্ধ। তবে জুলাই মাসের মধ্যে সংকীর্তনের নাট্যমন্দিরও নাকি তৈরি হয়ে যাবে। মূর্তি প্রতিষ্ঠা ও বড় মন্দির উন্মোচন করা হবে জুলাইতে। যাঁরা ধ্যান করতে আসবেন, তাঁদের জন্য ছোট ছোট ঘর তৈরি হবে, আশ্রম তৈরি হবে, এর আশেপাশেই। মন্দির নদীর তীরে। জল আসবে সেখান থেকে। বাকি সব সূর্য থেকে। পাহাড়ে বিদ্যুৎ নেই, জলব্যবস্থা নেই

তিন

এঁরাই পৌঁছে দিলেন লিনডিসফার্নে। এই পাহাড়েই, আরো মাইল দেড়েক দূরে, আরেকটু উঁচুতে, লিনডিসফার্নের বিখ্যাত ধ্যানঘর। “পবিত্র জ্যামিতিক হিসেব” মতে তৈরি কাঠের বিশাল ধ্যানঘর, বাইরে থেকে দেখতে এক বিশাল তাঁবুর মতন। গোল, জানলা নেই। মাথার ওপর মাঝখানে শুধু কাঠের গোল স্কাইলাইট, সেখান থেকে আলো এসে বিরাট ঘরটি আলোকিত। ভিতরেও শূন্য সার্কাসের তাঁবুর মতোই দেখাতো, শূন্য মেঝেটি যেহেতু ধুলোমাটির, যদি দেয়ালগুলিতে অপূর্ব পালিশ করা সূক্ষ্ম কাঠের কারুকার্য না থাকতো। কোনও আলোর ব্যবস্থা ছাড়াই আলোকিত এই চ্যাপেল’—যে কোনও ধর্মের মানুষ যে কোনো সময়ে এসে এখানে বসে ঈশ্বরের সাধনা করতে পারে। দেয়ালের ধারে ধারে মাটির দাওয়া, তাতে আসন ও কুশন পাতা, চ্যাপেলটি এতই সুন্দর যে ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করে না, মনে হয় বসে বসে অজস্র কাগজ কলম নিয়ে শুধু লিখি। যার যা সাধনা। মাঝখানে একটি মাটির তৈরি সুশ্রী দীপদানে একটিমাত্র মোম জ্বলছে। যেন সমস্ত আকাশের আলো থেকেই সে ধার করছে তার সামান্য আলোটুকু। সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শেই এই লিনডিসফার্ন চ্যাপেল তৈরি করেছিলেন নিউইয়র্কের এক দার্শনিক অধ্যাপক আর তাঁর এক Sacred geometry ও Sacred archi- tecture বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বন্ধুতে মিলে। তাঁদের নাম উইলিয়াম টমসন ও কীথ ক্রিচলো। কিন্তু কয়েকবছর পরেই দার্শনিকটির উৎসাহ কমে যায়। তিনি কলোরাডো ছেড়ে আবার পূর্বতীরে ফিরে যান। সেদিকেও তিনি একাধিক আশ্রম গড়েছেন। যাবার সময় চ্যাপেলটি ও বাসস্থান ইত্যাদি তাঁর আরেক বন্ধুকে দান করে যান। এই বন্ধুটি জাপানে গিয়ে Zen ধর্ম শিখে এসেছিলেন, ষাটের দশকে। সুজুকি রোশি, অ্যালেন গিনসবার্গ, গ্যারি স্নাইডার ইত্যাদি প্রসিদ্ধ কবিদের যিনি Zen গুরু ছিলেন, তিনিই এঁরও দীক্ষাগুরু। ইনি গ্যারি-অ্যালেনদের বন্ধু ছিলেন। আমি গ্যারি, অ্যালেনদের চিনি শুনে আমার সে কি খাতির! ভদ্রলোক এখন সান্টাফে-তে আছেন, তাঁর নাম রিচার্ড বেকার। তাঁর শিষ্যরা ডাকেন বেকার-রোশি। তিনি নিজেই এখন একজন Zen দীক্ষাগুরু হয়ে গেছেন— Zentatsen Richard Baker roshi বলে, নিজের নাম লেখেন, Zen নিয়েই তাঁর জীবন। সপ্তাহে একবার ‘বাকা’-তে আসেন উপাসনা করতে। কলোরাডো স্প্রিংসে ফিরে একদিন একটি স্থানীয় কাগজে দেখেছিলুম বেকার রোশি খুব অসুস্থ—তাঁর কালরোগ এইড্স হয়েছে—তিনি মৃত্যুর দ্বারে।

এই খবরটি যে আমার মতোই আরো অনেককেও বিচলিত করেছে তাতে সন্দেহ নেই। বিশেষত তাঁর যাঁরা শিষ্য-শিষ্যা, তাঁরা নিশ্চয়ই ভেঙে পড়েছেন। ইনি সমকামী শিল্পী ছিলেন বটে এক সময়ে, কিন্তু তার জন্য রোগ হল এখন? কিন্তু এসব খবর আমি জেনেছি ‘বাকা’ থেকে ফিরে আসার পরে। যখন তাঁর আশ্রমে গেছি—তখন কিছুই জানতুম না। এতদিনে তিনি বেঁচে আছেন কিনা, তা সুদ্ধ জানি না। অবশ্য, খুব সম্ভবতই নেই। কে এখন ‘বাকা’-র Zendo-র গুরু—আমার জানতে ইচ্ছে করে। হয়তো কখনও এসে পৌঁছুবে তাদের কোনও বুলেটিন—সর্বত্র ঠিকানা রেখে এসেছি।

গেরাল্ড বলে সাড়ে ছ’ফুট লম্বা কংকালসার যে মিষ্টি জর্মন ছেলেটি আমাকে Zen ধর্ম বোঝাচ্ছিলেন, তিনি সস্ত্রীক এই আশ্রমে আছেন দু’বছর। বউয়ের নাম গিজেলা, আরও দুটি জর্মন ছাত্রছাত্রী ছ’মাসের জন্য এসেছে। বেশি লোক থাকার জায়গাও নেই এখানে। বাসস্থানটি অপূর্ব। চমৎকার রান্নাঘর দিয়ে ঢুকতে হয়, বসার ঘরটিরও ছাদ কাচের। তাতে খুব সুরুচিসম্পন্ন ও আরামপ্রদ কৌচ পাতা, টেবিলে টেবিলে সুন্দর মৃৎশিল্প। সেই সব মাটির কারুকাজ কিছু গিজেলার তৈরি। কিছু তৈরি এখানকার বিখ্যাত এক মৃৎশিল্পী বার্থার। বার্থা গিজেলাকে শিখিয়েছেন। এগুলি বিক্রয়ার্থে রাখা। কিন্তু মূল্য শুনে বুঝলুম আমাদের মতো মানুষের জন্য নয়। ঘরটিতে অনেক গাছপালাও আছে। প্রতিটি উদ্ভিদ প্রাণচঞ্চল। বাইরের প্রবল শীতের ছোঁওয়া তাদের গায়ে লাগেনি। বরং তারা কাচের ছাদ দিয়ে রোদ পাচ্ছে সমানে। ঘরটি অতি সুন্দর। যিনি লিনডিসফার্ন গোলঘর উপাসনাগৃহ বানিয়েছেন, এবাড়িও তাঁরই তৈরি। কীথ ক্রিচলো। তিনিই নিজে এবাড়িতে বাস করতেন কিছুদিন।

খিড়কিদুয়ার দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে হয়। কাচের তৈরি উদ্ভিদঘর দিয়ে। তারপর রান্নাঘর—মস্তবড়, নীল ফুলকাটা টালির তৈরি অপরূপ রসুইখানা (ও খাবার ঘর) দিয়ে মূল বাড়িতে ঢোকা। কয়েকটি শোবার ঘর আছে। ওই অপূর্ব সুন্দর বসার ঘরের ওপাশে একটি স্টাডি আছে বলে মনে হল। বাড়ির প্রধান অংশ, আধখানা জুড়েই Zen উপাসনা গৃহটি। মূল প্রবেশ দ্বার সম্ভবত এই Zen মন্দিরেরই প্রবেশদ্বার। সেটা এঁরা ব্যবহার করেন না। গেরাল্ড আমাকে উপাসনাগৃহে নিয়ে গেলেন।

মস্তবড় উপাসনাগৃহ, নাম Zendo সেখানে বুদ্ধের থাংকা, পবিত্র ভষ্ম, ধুপ ইত্যাদি রাখা আছে, মাঝখানে প্রণামের জন্য কুশন পাতা (মাটিতে হাঁটু গেড়ে প্রণাম সম্ভবত এই শীতে দুঃসাধ্য) দু’পাশে প্রার্থনার জন্য সারি সারি কালো কুশন। কালো জামা পরে Zen-দের পুজো করতে হয়। গেরাল্ড একটি লাল গেঞ্জি পরেছিলেন, ওই ঘরে ঢোকার আগে গিয়ে কালো আলখাল্লাটি চড়িয়ে এলেন। ওই ঘরে লাল জামা পরে ঢোকা ওঁর কাছে দুঃসহ নিয়মভঙ্গের মতো মনে হয়। একটি কাঠের তৈরি ঘণ্টি আছে, কাঠের হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে বাজাতে হয়। দিনে তিনবার সময় ঘোষণা করেন ঘণ্টিদার। বনবাদাড় থেকেও নাকি শোনা যায়। দূর থেকে সবাই বুঝতে পারে প্রার্থনার সময় হল বা ডিনারের। কুড়ি-পঁচিশ জন একসঙ্গে প্রার্থনা করতে পারেন উপাসনাগৃহে। গেরাল্ড ও গিজেলা জর্মন, দুই যুবক-যুবতী ছাত্রছাত্রীও। সবাই পশ্চিম জর্মনীর লোক। গেরাল্ডরা কোলোনের, অন্যরা ফ্রাংকফুর্টের। শুধু গেরাল্ডকে অত্যন্ত মনোযোগী ছাত্র মনে হলেও অন্যদের আমার তেমন ধ্যানী টাইপের বলে মনে হল না। সবচেয়ে ধ্যানী মনে হল সোফার ওপর ওদের দুটি চমৎকার লোমশ বিড়ালকে। বিড়াল পুষতে Zen ধর্মে বাধা নেই।

আমি যখন গেলুম ওখানে তখন ওঁরা লাঞ্চে বসেছেন, আমাকে কিন্তু যোগ দিতে ডাকা হল না। গেরাল্ড বরং না খেয়েই ইন্টারভিউ দিতে চলে এলেন। আমার তখন, ইন্টারভিউ নেব কি, প্রচণ্ড খিদেয় মাথা ঝিমঝিম করছে। আর গেরাল্ড আমাকে Zen ধর্ম বোঝাচ্ছেন— “আমিও যা, ওই গাছও তাই। মনঃসংযোগ করতে পারলে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সঙ্গে এক হতে পারা যায়। তখন তোমার সঙ্গে আমার কোনও তফাৎ আমি দেখতে পাবো না।”

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, শুনছি ও টুকছি, আর কেবল খাবারের গন্ধ শুঁকছি। Zenরা অতিথিদের খেতে বলে না, এটা ওর বক্তৃতায় না থাকলেও আমি শিখলুম। দিনে চারবার করে প্রার্থনা প্রত্যেকবার ৪০ মিনিট—দিনে ১৬০ মিনিট প্রার্থনার সময়। নানান “সূত্র” ওঁরা পড়েন। তার একটি “সূত্র” এখানে তুলে দিচ্ছি—নাম—”মহাপ্রজ্ঞা পারমিতা হৃদয় সূত্র” ওরা ডাকেন “The Heart Sutra” এই ডাকনামে। এটি একটি মন্ত্র—অতি সুন্দর স্তোত্রের মত কবিতা!

হৃদয়সূত্র

“অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্ব
যখন গভীরভাবে প্রজ্ঞাপারমিতা ধ্যানে,
তখন দেখলেন যে পঞ্চ স্কন্ধই
তাদের আত্মার মধ্যে শূন্য
–এবং সব যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হলেন।
হে সারিপুত্ত,
আকার ও শূন্যতায় ভেদ নেই,
শূন্যতা ও আকারে ভেদ নেই।
যা সাকার তাই নিরাকার,
যা নিরাকার তাই সাকার।
অনুভূতি, দৃষ্টি,
আবেগ ও চেতনার ক্ষেত্রেও তাই সত্য।
হে সারিপুত্ত,
সবর্মই শূন্যতার দ্বারা চিহ্নিত,
তারা আবির্ভূতও হয় না অবলুপ্তও হয় না,
তারা মলিনও হয় না শুদ্ধও হয় না,
তাদের বৃদ্ধিও নেই হ্রাসও নেই। তাই শূন্যতার মধ্যে
নেই আকার, নেই আবেগ,
নেই দৃষ্টি, নেই অনুভূতি, নেই চেতনা, নয়ন নেই, শ্রবণ নেই,
ঘ্রাণ নেই, জিহ্বা নেই,
ত্বক নেই, মন নেই,
বর্ণ নেই, শব্দ নেই,
গন্ধ নেই, স্বাদ নেই,
স্পর্শ নেই, মনের আধেয় নেই।
দৃষ্টির রাজত্ব নেই যতক্ষণ না
মানস-চেতনার রাজত্ব থাকে।
 অজ্ঞানতা নেই, তার বিনাশও নেই
জরামৃত্যু না থাকা পর্যন্ত,
এবং তারও বিনাশ নেই
যন্ত্রণা নেই, সৃজন নেই,
শেষ নেই, পথ নেই,
চেনা নেই, প্রাপ্তি নেই।
কিছুই যখন পাবার নেই
বোধিসত্ত্ব প্রজ্ঞাপারমিতার ওপর নির্ভর করেন
আর তাঁর মনে কোনও বিঘ্ন ঘটে না।
বিঘ্ন নেই তাই ভীতিও নেই।
সমস্ত বিকৃত ধারণার চেয়ে বহু দূরে
—তিনি রয়েছেন নির্বাণে।
ত্রিভুবনের সকল বুদ্ধই
নির্ভর করেন প্রজ্ঞাপারমিতার উপরে।
এবং চরম, অতুল্য, সম্পূর্ণ,
অভ্রান্ত আলোকপ্রাপ্ত হন।
তাই, প্রজ্ঞাপারমিতাকে জানো
এই হল মুক্তির মন্ত্র
এই উজ্জ্বলতম মন্ত্র
এই চরমতম মন্ত্র
এই পরমতম মন্ত্র
যা মানুষকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়
এবং যা সত্য, যা মিথ্যা নয়।
তাই প্রজ্ঞাপারমিতা মন্ত্র উচ্চারণ করো
সেই মন্ত্র উচ্চারণ করো,
যা বলে গতে, গতে পরাগতে, পরাসঙ্গতে।
বোধি! স্বাহা!”

Zen-দের সূত্র ছাড়াও আছে ‘কোয়ান’ (koan) বলে এক প্রশ্নোত্তরের আচার। ১০ম ১১শ শতকে চীনে এই শিক্ষাপ্রণালীর শুরু চান্-বৌদ্ধদের মধ্যে। গুরু অদ্ভুত সব প্রশ্ন করেন, শিষ্যকে তার উত্তর দিতে হবে। এই ‘কোয়ান’ বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না। বিশ্বাসী বিশ্বাস দিয়ে এর অর্থ পায় উত্তর পায়, আমার মতো অদীক্ষিত বাইরের লোকের কাছে এই সব প্রশ্নোত্তর দুইই গোলোকধাঁধা মাত্র। কিন্তু Zen শিষ্যদের কাছে এর মূল্য অপরিসীম। দ্বৈতবাদী চিন্তার ফাঁদ থেকে মনকে মুক্ত করে এই কোয়ান। যেমন, গুরু বল্লেন— “দুই হাতে তালি মারা কী জিনিস তা তুমি জানো। একহাতে তালি বাজানো কী বস্তু, আমাকে তা দেখাও।” শিষ্যকে তক্ষুনি উত্তর দিতে হবে না, তবে ভেবে এসে বলতে হবে। একই প্রশ্নের নানান উত্তর হতে পারে। যে যেমনভাবে ভাববে। গুরু সেটা মানলেই হল। তেমনি শিষ্যও গুরুকে প্রশ্ন করতে পারেন। Zen মতে সব প্রাণীই মূলত বুদ্ধ-স্বভাব নিয়ে জন্মায়, সেটিই প্রাণীগণের “প্রাথমিক মুখ”, মৌল ভাব। শিষ্য প্রশ্ন করলেন গুরুকে—”তাহলে কি কুকুরদেরও মূলত বুদ্ধ-স্বভাব থাকে?” গুরু উত্তর দিলেন—”মু-উ-উ” (‘হাম্বা’র মতন) এখন বুঝ সাধু যে জানো সন্ধান!

Za-Zen মানে মনকে শান্ত করা। Zen মানে আত্মমগ্নতা। সম্পূর্ণ মগ্ন হয়ে যাওয়া। Zen-রা যা নিজের অভিজ্ঞতার মধ্যে নেই তাতে বিশ্বাস করেন না—কিন্তু কর্মযোগে বিশ্বাসী। গেরাল্ডের গুরু বেকার-রোশি বলেন Zen-এর মূল কথাটি হল—’nothing special’, কিছুই ‘বিশেষ না’। সকালে তিনবার সন্ধ্যায় একবার দিনে চারবার ৪০ মিনিট ধরে প্রার্থনার সময় ছাড়া তাঁরা সব কিছুই করেন। রান্নাবাজার ঘরকন্না বাসন মাজা সবই এই সন্ন্যাসের অন্তর্গত—প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার সঙ্গে প্রার্থনাকে মিলিয়ে নেওয়াই Zen ধর্মের বিশেষত্ব। ওদের মূল ঝোঁকটা শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণের ওপরে। কেননা নিঃশ্বাস বায়ুই বাইরের বায়বীয় জগতের সঙ্গে আমাদের দৈহিক জগতের যোগসূত্র। “প্রাণায়ামের” কথা জিজ্ঞেস করতে গেরাল্ড বললেন শব্দটি কখনও শোনেননি।

গেরাল্ডদেরও বিদ্যুৎ নেই। নদী থেকে জল আসে পাইপে, চার সপ্তাহে একবার। সৌরবিদ্যুৎ প্রস্তুত করে তাদের রান্না, আলো, ঘর গরম করা সব চলে। এই শীতে নদীর জল জমে গিয়ে তাদের খুব কষ্ট। টয়লেটে একটা নির্দেশ আঁটা আছে ইংরিজিতে “ফ্লাশ টেনো না, শুধু যদি হিসি করো।” অতীব দুরবস্থা! সন্দেহ নেই!

এই গেরাল্ডের স্ত্রী গিজেলা খুব অদ্ভুত। আমাকে চলে আসার সময়ে জিজ্ঞেস করলেন—” কিছু খেতে চান?”

আমি বললুম—”আমার খুব বেশি খিদে পেয়েছিল, যখন আপনারা খাচ্ছিলেন, কিন্তু এখন আর নেই।”

গিজেলা বললেন, “কেন? আপনি কি অন্তঃসত্ত্বা? এত খিদে পায় কেন?”

আমি বললুম—”তখন বেলা দেড়টা ছিল বলে। তখন স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই অন্তঃসত্ত্বা হন। প্রকৃতির এমনই জাদু।”

গিজেলার সঙ্গে অন্য জর্মন মেয়েটিও চলল (বছর আঠারো বয়স) গাড়ি করে আমাকে তিব্বতীদের বাসস্থানে পৌঁছে দিতে। সঙ্গে দু’ ঝাঁকা ময়লা কাপড় চোপড়। জলের অভাবে ওখানে কাচতে পারে না, গ্রামে গিয়ে একজনদের বাড়িতে কেচে আনবে। সত্যি সত্যি যথেষ্ট কৃচ্ছ্রসাধন ক’রে এদের দিনযাপন। তার মধ্যেই ভারি সুন্দর গাছগাছালি করেছে। আর দুটি খুব গোলগাল নধর মার্জার—মার্জারী Zen আশ্রমের সদস্য। বাগানে পাখিদের জন্য কাঠের ঘর বাঁধা আছে। মৌমাছিদের জন্যও একরকম বাক্স বেঁধে রেখেছে গাছে। এখন শীতে সেখানে নাকি অনেক রকমের পোকামাকড় আশ্রয় নেয়। পাখিরাও আশ্রয় নেয় ওদের বানানো বাড়িতে। এরা তাদের খাইয়ে আসে রোজ। জীবজন্তু পশুপাখির প্রতি এদের যে নজর—ভারতীয় মানুষের প্রতি তার এককণাও কিন্তু দেখলুম না।

হাইডাখণ্ডী আশ্রমের প্রেসিডেন্ট ওঁদের নির্দেশ দিয়ে না এলে আমাকে গ্রামে পৌঁছে দিতেন কিনা কে জানে! গাড়িতে বসে গিজেলা একটিও কথা বললেন না। অন্য মেয়েটির সঙ্গে কথা কইতে কইতে এলুম। সে আর তার তরুণ বয়ফ্রেন্ড এসেছে ছ’মাসের জন্য Zen প্রার্থনা শিখতে। সে স্কুলের গণ্ডি পার হয়নি। একটি ফার্মে কাজ করে। তার বয়ফ্রেণ্ড কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে “ড্রামা”-র ছাত্র। এই ছ’মাস সে পড়ছে না। ভাঙা ভাঙা ইংরিজি আর জর্মন মিশিয়ে আমরা কাজ চালিয়ে নিলুম ভালই।

—”তুমি ফিরে গিয়ে কী করবে?”

—”ফার্মে কাজ করবো। আর Zen উপাসনা করব।” সহজ হেসে উত্তর দিল।

এদেরও অনেক জমি আছে, Zen আশ্রমের আরো বাড়িঘর হবে। লোক আসে গ্রীষ্মে, এখন না! তখন পঁচিশ জনও উপাসনায় আসে।

চার

গেরাল্ডদের কাছ থেকে গেলুম তিব্বতীদের ওখানে। ওটা এখনও গড়ে ওঠেনি বটে, তবে চমৎকার প্ল্যান তৈরি হয়েছে, জমিটমি পেয়েছেন তাঁরা মরিস ও হানা স্ট্রং-এর কাছে। এই কানাডিয়ান দম্পতি ‘বাকা’তে বানপ্রস্থী। বাকার পার্বত্য অঞ্চলের প্রায় একচ্ছত্র জমিদারও বটেন। এবং আশ্রমের নাম শুনলেই তাঁরা বিনা অর্থে জমি দান করে দেন, এরকম দানশীল দম্পতি দেখা যায় না। কলোরাডো কলেজকেও অতগুলি ঘরবাড়ি বছরে এক ডলার হিসেবে লীজ দেন। “এতে দানধ্যান দয়াদাক্ষিণ্য আয়করের সুবিধের জন্যও হতে পারে,” আমার ছাত্রদের মধ্যে একজন সবিনয়ে জানালো। সে যে জন্যেই হোক, দিচ্ছেন তো। তাই বা কে দেয়? ওঁদের স্বপ্ন ‘বাকা’ একদিন আধ্যাত্মিকতার কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে। তাই তিল তিল করে সর্বধর্মের সমন্বয় ঘটাচ্ছেন স্বামী-স্ত্রীতে।

“কর্ম-ত্রিযান-ধর্মচক্র” তিব্বতী বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের যে গুম্‌ফা হবে তার প্ল্যানই দেখলুম শুধু। এখনও কিছুই হয়নি। হানা স্ট্রংয়ের ছোট বোন মেরি-অ্যান একজন তিব্বতী দোভাষীকে বিয়ে করেছেন যিনি কর্মপা-র দোভাষী। কর্মপা হচ্ছেন দলাইলামার মতোই আরেকটি শাখার লামা গুরু।

আমাদের দলাই লামার সঙ্গে তাঁর একত্রে অনেক ছবি দেখলুম ঘরভর্তি টাঙানো। আপাতত কর্মপা তিরোহিত হয়েছেন। সিকিমের বিখ্যাত রুমটেক গুম্‌ফাতে তাঁর দেহ ভস্মীভূত হয়েছে। তাঁর দেহরক্ষা যদিও ঘটেছিল শিকাগোতে।

সিকিমের রুমটেকই তাঁর প্রধান আশ্রম। এছাড়াও সারা পৃথিবীতে তাঁর অনেক আশ্ৰম আছে। দলাই লামার সঙ্গে কর্মপার ধর্মশিক্ষার বিশেষ তফাৎ নেই, শুধু আচার-বিচারের কিছু পার্থক্য, কিন্তু সেটি কী, মেরি-অ্যান বলতে পারলেন না। তবে জেন্-এর সঙ্গে এই তফাৎ যে মেরিঅ্যান তখন তাঁর বাচ্চাদের দুধ বিস্কুট খাওয়াচ্ছিলেন, আমাকেও কফি-বিস্কুট যত্ন করে খাওয়ালেন।

আপাতত যতদিন মঠ না হচ্ছে ওঁদের একটি বাড়ি আছে। এক আমেরিকান ভক্ত শিষ্য বাড়িটি কিনে ওঁদের ব্যবহার করতে দিয়ে গেছেন। সেখানে তিব্বত থেকে লামারা ও শিক্ষাগুরু ‘রিপো ছে’রা এসে বসবাস করেন ও শিক্ষা দেন। “সান লুইস ভ্যালি টিবেটান প্রজেক্ট হাউস” তার নাম। বাড়িটি পাহাড়ে নয়, গ্রামেই। মস্ত বড়, অতি আধুনিক বাসগৃহ। তার বৈঠকখানাতে প্রায় শ’খানেক মানুষের মাটিতে বসে প্রার্থনা করবার ঠাঁই হয়।

প্রত্যেক বুধবার সন্ধ্যাবেলা তাঁরা ওখানে একঘণ্টার ধ্যানসভা করেন, ধ্যান মানে শ্বাসপ্রশ্বাস সংযত করা, ইচ্ছার অনুগত করা। Zen-দের মতোই এখানেও শ্বাস-প্রশ্বাসের ওপর জোর। যখন গুরুরা আসেন তখন পুজোও হয়। গুরুরা না এলে পুজো করবার যোগ্যতা এঁদের নেই। এঁরা শিষ্য, ছাত্র, ভক্ত মাত্র। তাই নিত্যপূজা হয় না।

মেরি-অ্যানের বাচ্চাগুলি তিব্বতী-মার্কিনী মেশানো, ভারি মিষ্টি। খুব সহজভাবেই তিনি তিব্বতী সংস্কৃতি নিয়ে মুগ্ধ হয়ে আলোচনা করতে পারেন। রান্নাঘরে দেখলুম নানা রকমের ডাল। মুগ ভিজোনো। ভারতীয় রান্না করো? হ্যাঁ, অনেকবারই তিনি ভারতবর্ষে গেছেন, তাঁর স্বামী দার্জিলিং-এর মিরিক নামক একটি জায়গা থেকে এসেছেন। বাগডোগরা দিয়ে যেতে হয়।

—”কলকাতায় গিয়েছো?”

—”না তো।”

—”সে কি গো?”

“আমরা দিল্লি, পাটনা, কাশী, এমন জায়গা থেকে সোজা বাগডোগরা চলে যাই—কিন্তু কলকাতা? কখনও যাওয়া হয়নি। জানি না হয়তো আমার স্বামী গেছেন!”

শুনে আমি হতবাক। পাটনাও গেছেন, অথচ কলকাতা যাননি। পশ্চিমবঙ্গেই তো জন্ম হয়েছে তার স্বামীর। মিরিক কোথায় ছিল? পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে ট্যুরিস্ট স্পট করে গড়ে তুলেছে। লোকে নাম শুনছে। কেমন করে তিনি তিব্বতী সংস্কৃতিতে উৎসাহ পেলেন জিজ্ঞেস করতে মেরি-অ্যান, যিনি ক্লাসিক্যাল পশ্চিমী সুন্দরী, নীল চোখ শুভ্র-সোনালি চুল, অথচ চোখেমুখে বুদ্ধির ধার যথেষ্ট, বললেন তাঁদের মূল মাতৃভূমি ডেনমার্ক। তাঁরা কানাডাতে থাকতেন। একবার কিছু তিব্বতী উদ্বাস্তু তাঁদের বাড়িতে এসে পড়াতে তাঁদের সঙ্গে প্রথম তিব্বতের যোগাযোগ হয়। তারপর প্যারিসে তাঁদের মা-বাবা ভাই বোন সবাই মিলে গিয়ে এক তিব্বতী লামার সঙ্গে দেখা করেন। সেই দেখা যেন বহুজন্মের চেনা বলে মনে হল। সেই থেকেই পুরো পরিবারই তিব্বতী ধর্মকর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে মগ্ন হয়ে আছেন—এই তিব্বতী স্বামীকে তিনি কানাডাতেই পেয়েছেন যখন তিনি কর্মপা-লামা মহারাজের দোভাষী হয়ে আসেন। তিনি সাধারণ তিব্বতী যুবক, ভাল ইংরিজি শিখেছেন, ধর্মকর্মের কেউ নন। ওঁদের বিয়ে হয়েছিল দিল্লিতে, তিব্বতী পন্থায়। লামা ওদের মন্ত্র উচ্চারণ একসঙ্গে করিয়েছিলেন মঠে।—”হত্যা করবো না, চুরি করবো না, মিথ্যা বলবো না, মাতাল হরোনা, অপর স্ত্রী-পুরুষে গমন করবো না।’

ব্যস্‌, বিয়ে হয়ে গেল! আমার তো খুব পছন্দ হল এ রকম বিয়ের মন্ত্র। সমাজমুখী মন্ত্ৰ। হিন্দুবিবাহের মন্ত্রের মতো পরিবারমুখী বা পরস্পরমুখী নয়।

কর্মপার সঙ্গে দলাই লামার শুনলুম মূল বিশ্বাসে তফাৎ নেই, শুধু পূজার পদ্ধতি-প্রকরণে তফাৎ। তিরোহিত কর্মপা নাকি পুনর্জাতও হয়েছেন, দেড়বছর হল। তবে এখনও সবাইকে জানাননি ঠিক কোথায়। তাই এখন পর্যন্ত অন্যান্য লামারা, রিপো-ছে’রা কাজ চালাচ্ছেন। নয়া ‘কর্মপা’র পরিচয় ঠিকানা জানা গেলেই তাঁকে নিয়ে আসা হবে রুমটেকে। তা তিনি যত শিশুই হোন। কর্মপা নাকি মৃত্যুর আগেই নিজের পরজন্মর জন্য ছোট্ট ছোট্ট পোশাক তৈরি করে ঘর বোঝাই করে চাবি দিয়ে গেছেন। মেরিঅ্যান জানালেন। আমিও শুনলুম।

দেশে ফিরে এসে শুনছি রুমটেক গুম্‌ফায় এই নভেম্বর ডিসেম্বরে নতুন কর্মপা নিযুক্ত হবেন। সারা গ্যাংটক জুড়ে প্রস্তুতি চলছে সেই উৎসবের। জানি না হয় তো ‘বাকা’ থেকে মেরি-অ্যানও সপরিবারে চলে আসবেন এই উৎসবে যোগ দিতে।

মেরি-অ্যান হানা স্ট্রং এর ছোট বোন। তাঁদের অর্থের প্রাচুর্য বাকাতে কিংবদন্তী হয়ে দাঁড়িয়েছে। হুট্‌ করে গ্যাংটক চলে আসা ওঁদের কাছে কিছুই না। ওই লামার সঙ্গে যোগাযোগ হওয়া থেকেই হানা স্ট্রংয়েরও মনে এই ধর্মকেন্দ্র স্থাপন করার উদ্যম জেগেছিল। সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে এসেছিলেন এই ‘বাকা’-র শূন্যবুকের পুণ্যভূমিতে।

ছবি দেখে মনে হয় তিব্বতী আশ্রমটি দেখতে সুন্দর হবে। এখানেও দূরে দূরে ধ্যানীদের কুটির-গুচ্ছ থাকবে, বড় মঠের বাইরে। ধ্যানের আশ্রয়ই সকলের মূল উদ্দেশ্য যা দেখছি। তবে এত বড় বড় মঠ কেন? এইসব মঠ ভরলে নির্জনতার কী হবে?

মেরি-অ্যানকে খুব ভাল লাগলো। তাঁর বাচ্চা মেয়ে তাঁর প্রতিবেশীর বাচ্চা ছেলে ও বিশাল কুকুর সমেত তিনি আমাকে আমার বাসস্থানে নামিয়ে দিয়ে এলেন। বারবার দুঃখ করলেন তাঁর স্বামীর সঙ্গে দেখা হল না বলে।

পাঁচ

এতগুলি আশ্রম নিরীক্ষণ পূর্বক আহ্লাদে ভাসতে ভাসতে হলেও এত বেলাতে ফিরেছি, জোন খুব ভাবনা করছিলেন—একবাটি স্যুাপ নিয়ে বসে ছিলেন আমার জন্যে। আমি ধন্য হয়ে সুরুয়া খেয়ে (জোনের হাতের রান্না অপূর্ব—এ টিনের রেডি-মেড স্যুপ নয়) নিয়েই ফোন কোলে করে বসে যাই। ডিরেক্টরিতে “শ্রীঅরবিন্দ লার্নিং সেন্টার” খুঁজতেই সাবিত্রী হাউসের ঠিকানা পাওয়া গেল। কর্ত্রীর নাম সিরিল শোশেন।

আর কি? তৎক্ষণাৎ “সাবিত্রী হাউসে” ফোন করে সিরিল শোশেনকে চাইলুম। কলকাতা থেকে এসেছি শুনেই সিরিল মহানন্দে বললেন, “কি আনন্দ। তুমি শ্রীঅরবিন্দের জন্মস্থান থেকে এসেছো? বাঃ! আজই সন্ধ্যা ৬-৩০ এ “বিস্ত্রো”-তে আমার সঙ্গে সাপার খেতে এসো। আমি ফুলের দোকানের সামনে থাকব। তোমাকে মীট করতে আমি ব্যাকুল হয়ে আছি।”

সাড়ে ছ’টা আর যেন বাজে না! যখন গেলুম সিরিল শোশেন আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।

“বিস্ত্রো” আমাদের টাউনহাউসের কমপ্লেক্সের মধ্যেই। এখানে যে এমন সুন্দর ফুলের দোকান আছে, তা আমি জানতেই পারিনি। সিরিল বললেন, “তুমি যাও একটা টেবিল বেছে নাও, আমি আসছি।” তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলেন এক বৃদ্ধ। আমি একটা টেবিল বেছে নিই। একটু পরে ব্যস্ত পায়ে সিরিল আসেন। তিনি সুপ ও স্যালাড নিলেন। আমার খুব “জাঙ্ক ফুড” খেতে ইচ্ছে করছিল, আমি বিদ্রোহীর মতো একটা হ্যামবার্গার নিই। মার্কিন দেশের আধুনিক খাদ্যাভাসের ফ্যাশানে, ‘ইহা মহালজ্জাকর!’ এখানে ভদ্রলোকে ‘হেল্থ ফুড’ খায়।

আমরা খেতে বসলুম। এমন সময়ে আরও দুজন মহিলা এসে সিরিলকে জড়িয়ে ধরলেন। সিরিলের ১৯১৫-তে জন্ম, বয়েস হয়েছে। প্রফেশনাল থিয়েটারে ছিলেন বলে, এখনও চোখেমুখে স্টেজের মতোই মেক-আপ। তবুও বয়েস তার পতাকা পুঁতেছে সর্বত্র। এই নবাগতা মহিলারা মাঝবয়সী। একজনের মাথায় বিবেকানন্দ স্টাইলে পাগড়ি। পাগড়িটি নামাবলী দিয়ে বাঁধা। তাঁর পরনে সব সাদা, গলায় একগোছা পুঁতির মালা ও রুদ্রাক্ষের মালা। কোনও প্রসাধন নেই। মহিলা অত্যন্ত সুন্দরী। নাম বললেন ভবানী।

অন্যজন সুন্দরী নন, সাধারণী, নাম শার্লি। ভবানী ও শার্লিও আমাদের সঙ্গে বসলেন। ভবানী বললেন তিনি জুইশঘরে জন্মালেও এখন “ভীষণ শৈব হিন্দু”। “শৈবাইট” শব্দটি জোর দিয়ে বলে তিনি “জয় জয় রাধে গোবিন্দ জয়” গান করতে লাগলেন। তিনি বললেন তাঁর মস্তকমুণ্ডিত তাই তিনি পাগড়ি বাঁধেন। আগের দিন হাইডাখণ্ডী মঠেও দেখেছি “ওঁ নমঃ শিবায়” লেখা পোস্টার, আর লোকেদের নাম রাধেশ্যাম, রামদাস, রামলতি। প্রশ্ন করে জেনেছি বাবাজী শিব ও বিষ্ণুতে তফাৎ করেন না। তাঁর কাছে ওসব শৈব-শাক্ত-বৈষ্ণব ভাগাভাগি নেই। হিন্দু ক্রিশ্চানে ইহুদীতেও নেই। ভবানীও বাবাজীর শিষ্যা হয়েছিলেন ১৯৭৫-এ। বহুকাল ভারতে সাধু হয়ে ঘুরেছেন। এখনও সাধু। এখন এদেশেও তাঁর কোনও নিজস্ব ঘর বা ঠিকানা নেই। বন্ধু-বান্ধবের বাড়ি ঘুরে ঘুরে থাকেন। তিনি নাকি মা ভবানী, জগতে সবাই তাঁর সন্তান এবং বহু পূর্বে তিনিই ছিলেন জিপসিদের উপাসিতা দেবী সেন্ট সারা আমি সেন্ট সারাকে নিয়ে একটি শিশুদের উপন্যাস লিখেছি শুনে ভবানী শিশুর মতো উত্তেজিত হয়ে বললেন—”সবই পূর্বনির্ধারিত তাই আমাদের দেখা হল!” গতজন্মে তিনি বললেন, বাঙালি ঘরেরই তিনি এক অল্পবয়সী হিন্দু বিধবা ছিলেন। সাদা পরতে বাধ্য হতেন, মাছ-মাংস খেতেন না। অনেক কষ্ট করতেন। তাই এখনও তাঁর মাছ মাংস ভাল লাগে না। সাদা ভাল লাগে। শার্লির সঙ্গে তাঁর আলাপ হল কোথায়? বাবাজীর আশ্রমেই আলাপ। ভারতবর্ষে হিমালয়ে।

“দুজনে একই গুহায় ছিলাম। তাই না শার্লি?”

এই রেটে আধ্যাত্মিক আলোচনায় এদিকে আমার তো পাগল-পাগল অবস্থা। একদিকে ভবানী তো এইসব বলছেন, অন্যদিকে যেজন্য আসা, “সাবিত্রী হাউসের” পক্ষ থেকে সিরিল বলছেন-

“১৯৬৯-এ মাত্র ২৮ দিনের রিটার্ন টিকিটে ভারতবর্ষ দেখতে টুরিস্ট হিসেবে গিয়েছিলুম। অরোভিলের তখন উদ্বোধন হয়ে গেছে। ‘মাদার’কে দেখে আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে একটানা দশবছর থেকে গিয়ে এই ক’মাস হল ফিরেছি। কোথায় ২৮ দিনের জন্য যাওয়া, কোথায় ন’ দশবছর। আমার স্বামী ইতিমধ্যে মারা গেছেন। আমার ছেলে আমাকে “স্বেচ্ছাচারী” বলে। কিন্তু মাদারের আদেশ আমি কি ফেলতে পারি?’

—শুনে আমি ছেলেকেই সাপোর্ট করব কিনা বুঝতে না-পেরে চুপ করে থাকি।

উনি “সাবিত্রী হাউসের” ছবি দেখাতে দেখাতে আমাকে বোঝান SALC কী। শ্রীঅরবিন্দ লার্নিং সেন্টার। শ্রীঅরবিন্দের ও মাদারের শিক্ষা এখানে প্রদান করা হবে। এবং ফেইথ হীলিং-এর ব্যবস্থাও আছে। অরোভিলের সঙ্গে বাকা-র একটি গভীর আত্মীয়তা গড়ে তোলাই তাঁর উদ্দেশ্য।

প্রতি রবিবার বিকেলে প্রার্থনা ও ধ্যান হয় “সাবিত্রী হাউসে”। তিনিও হানা, মরিসদের কাছে জমি পেয়েছেন। তিনি দশবছর অরোভিলের “মাতৃমন্দিরে” কাজ করতেন মাদার-এর আদেশ অনুযায়ী। এখানে এসে তিনি শ্রীঅরবিন্দ ও মাদারের বাণীপ্রচারের জন্য একাধিক নাটক লিখে মঞ্চস্থ করেছেন বাকা-র অধিবাসীবৃন্দকে দিয়ে। বাকাতেও সিরিল “মাতৃমন্দিরে”র মতোই কিছু গড়তে চান। সিরিল খুব সামাজিক মানুষ। আর “বিস্ত্রো” বাকা-র একমাত্র রেস্তরাঁ। প্রত্যেক টেবিলেই তাঁর চেনা লোক। হয় তাঁরা এখানে আসছেন, নয় উনি উঠে অন্য যাচ্ছেন।

একসময়ে উনি একপাক ঘুরে এসে শার্লিকে জিজ্ঞেস করলেন—”তোমার কোষাগারের অবস্থা কীদৃশ? ভবানীর খরচ কে দেবে?”

সলজ্জ হাস্যে শার্লি বললেন “আমার কোষাগার অশেষ, ভবানীর খরচ আমার।”

সিরিল চলে গেলেন। ওয়েট্রেস এসে আমাদের তিনজনকে তিনটি বিল দিয়ে গেল। আমার খরচ তার মানে সিরিল দেননি। শার্লি এতই অদ্ভুত ভালো মানুষ, আমার বিলটিও তুলে নিলেন, এবং ছুটে গিয়ে দিয়ে এলেন। ভাগ্যিস আমি মাত্র তিন ডলারের খেয়েছিলুম, খিদে ছিল না—তবু সিরিলের নিমন্ত্রিত হয়ে খেতে গিয়ে তাঁর এই আচরণে খুবই অবাক হয়ে গেলুম।

সিরিল নিজেও আর ফিরে এলেন না। দেখি তিনি ওই কাউন্টারে গিয়ে দাম দিচ্ছেন। টেবিলে শার্লিই টিপ্‌সটাও রেখে গেলেন।

ভবানীর কাছে শুনলুম শার্লি ম্যাক্রোবায়োটিক রাঁধুনি—রান্নাবান্না করেন, ওটাই ওঁর জীবিকা। আর রোজ সন্ধ্যাবেলা কীর্তন করেন। “পুয়েব্‌লো” শহরে থাকেন। একদিন আসবেন বললেন দুজনে আমার বাড়িতে—কলোরাডো স্প্রিংসয়ে। কীর্তন গাইবেন। ভবানী তো সৰ্বদাই নামকীর্তন করছেন, শার্লিও। এইটুকু বাকা-তে এত ধরনের ভারতীয় উদ্দীপিত মার্কিনি সাধু ও অধ্যাত্মবাদিনী দেখে অবাক না হয়ে উপায় নেই।

ওইখানেই আরেকজনের সঙ্গে আলাপ হল, তিনি সুফী মতাবলম্বী এক মার্কিনি বৃদ্ধ অধ্যাপক। তাঁর প্রয়াস একটি সুফী আশ্রম ও সুফী প্রচার গোষ্ঠী গড়ে তোলা বাকা-তে। তাঁর নাম প্রফেসর রবার্ট ফিলেও। তিনি বললেন, সুফী ধর্মের দুজন শিক্ষাগুরু এখনই এ দেশে উপস্থিত আছেন, একজন ওয়াশিংটনে আর একজন নিউইয়র্কে। তাঁদের নিয়ে এসে সুফী শিক্ষাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ওঁর স্বপ্ন। ওয়াশিংটনে তিনি অধ্যাপনা করতেন যখন, তখন ওই সুফী ধর্মগুরুও সেখানেই অধ্যাপনা করতেন। নামগুলি জেনে নিতে ভুলে গেলুম। তবে তিনি এখনও জমি পাননি, যদিও হানা স্ট্রং তাঁকেও জমি দিতে চেয়েছেন। তাঁর পরিকল্পনা এখনও কাঁচা অবস্থায়। স্বপ্ন হয়েই আছে।

যেমন শার্লি ম্যাকলেইনের। তিনি নাকি ৮০০ একর জমি কিনছেন। কাগজে ছাপার হরফে দেখালেন বাকা-র মানুষেরা, তাঁর প্রেস-অ্যাটাশে কনফারেন্সে বলেছেন। মিথ্যে গুজব নয়। এখানে স্পিরিচুয়াল সেন্টার খুলবেন। তিনি বহুদিন হানা ও মরিস স্ট্রংয়ের বন্ধু। তাঁরাও ওঁকে চান। এ নিয়ে বাকা বাসীদের কিন্তু দ্বিমত হয়েছে। কেউ বলেছেন তাতে শান্তি নষ্ট হবে, সিনেমার লোক চাই না। কেউ বলছেন ভালই হবে। বাকার লোকেদের এতে কর্মসংস্থান হবে। স্ট্রংরা জমি বেচলে কে বাধা দেবে? বন্ধু বলে ব্যাপার। তবে কিছুই এখনও পাকা হয়নি।

শার্লি ম্যাকলেইন এখন কিন্তু মার্কিন দেশে বেশ প্রসিদ্ধ গ্রন্থকর্ত্রী। আমরা তাঁকে এদেশে চিনি শুধু চিত্রতারকা হিসেবেই। কিন্তু তাঁর আত্মজীবনীর ও নানান আধ্যাত্মিক, ধ্যানধারণা মূলক বইয়ের খুব বিক্রি বাজারে। তাঁর একটি বই “আউট অন দ্য লিম্ব” তো সবার বাড়িতেই আছে। তিনি জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী—তাঁর পূর্বজন্মের কাহিনি হঠাৎ হঠাৎ কিছু মনে পড়ে। আমি তাঁর কোনও বইই পড়িনি। “আউট অন দ্য লিম্ব” সেকেন্ড হ্যান্ডে কিনেও ভুলে ফেলে এসেছি, পড়া হয়নি। কিন্তু মহিলাকে, লোকে মুখে যা শুনেছি তাতে, বেশ ‘অনন্যা’ ব্যক্তি বলে মনে হয়, ইংরিজিতে যাকে বলে “ইন্টারেষ্টিং”। (তার যথার্থ বাংলা হয় কি?) শার্লি ম্যাকলেইন ‘বাকা’-তে এলে ‘বাকা’-র কোনও ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না। ওই আটশো একর জমির এককোণে তিনি আর কতটুকু নিয়েই বা থাকবেন? আর কতক্ষণই বা থাকবেন? তাঁর তো অন্য কাজও অনেক আছে অন্যত্র।

আমি আর জোন বাকা-তে কলোরাডো কলেজের যে বাড়িটিতে থাকতুম, তার দেখাশুনো করতেন এক যুবক। আজ কেন বাথরুমের জল রান্নাঘরে ঝরে পড়ছে, কাল আগুন কেন জ্বলছেন না, পরশু দোর কেন খুলছে না—এরকম নানান সমস্যা আমাদের রোজই হত। তিনি এসে সমাধান করে দিতেন। তাঁর কাছে ‘বাকা গ্র্যান্ড’ গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবন-যাত্রার গল্প শোনা যেত। তাঁর বাবা-মা থাকেন ওহায়োতে! তিনি একবার কার্যক্রমে একটা সরকারি বাগানের দেখাশুনোর কাজ পেয়ে যান কলোরাডোতে। তারপর ‘বাকা’-তে এক আত্মীয়ের বাড়িতে এসে ভাল লেগে গেল। তিনি সেই ভাল সরকারি কাজ ছেড়ে এখানেই থেকে গেলেন। হানা-স্ট্রং এর চাকরি করেন। এই টাউন হাউসগুলোর পূর্ণ দেখাশুনো। ছুতোর, কামার, প্লাম্বার, ইলেকট্রিশিয়ান, সবই তিনি। গ্রীষ্মে এখানে বাগানও করেন। রাস্তা থেকে বরফও সাফ করেন। পথের কুকুরগুলো ওঁকে গভীর ভালবাসে। সম্ভবত রোজ ওদের খেতেও দেন উনিই, অপাংক্তেয় কুকুরগুলি স্বাস্থ্যবান যথেষ্ট।

“বাকা’ গ্রামের লোকেরা নানান ধর্মের উৎসবে সবেতেই যোগ দেন। কতরকমের গানবাজনা নাটক হয়—শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমের শেষ নাটকে আমাদের এই বন্ধুটিই নায়কের ভূমিকায় ছিলেন। তাঁর কাছেই প্রথম শুনি এপ্রিল-মে নাগাদ এখানে একটি কবি-সম্মেলন হবে নানা ভাষার মেয়েদের। জোন এবং আমি যখন মেয়ে কবি, তখন আমরাও কেন আসব না?

পরে সিরিল ‘বিস্ত্রো” তে খাবার সময়ে আমাকে এই আসরে আসতে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা নিজের। খরচপত্তরও সব নিজের। শুনে আমি আমার অক্ষমতা জ্ঞাপনে মুহূর্তমাত্রও বিলম্ব করিনি।

—“‘বাকা’ গ্রাম একটেরে হলে কি হবে, এখানে প্রচুর সংস্কৃতিমনস্ক মানুষজন থাকেন। নানাধরনের সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন হয়”—বলেছিলেন কাঠের গায়ে হাতুড়ী ঠুকতে ঠুকতে হাস্যবদন, কোঁকড়াচুল বিশ্বকর্মা সেই ইহুদী যুবকটি—যাঁর স্ত্রী এই ‘বাকা’ পছন্দ নয় বলে স্বামীকে পরিত্যাগ করে চলে গেছেন কিছুদিন হল।

“ইহুদীদের কোনও সংস্থা নেই এখানে?”

—”নাঃ—বেশি ইহুদীই তো নেই এখানে। তাছাড়া আমি খুব একটা ধার্মিক ইহুদী নই। আমা দ্বারা ওসব সংস্থা টংস্থা করাই সম্ভব নয়। আমার কাছে সব ধর্মই সমান। সবারই তো একই ঈশ্বর। এতগুলো মঠ দিয়ে বলুন তো এরা করবে কী? এখানে সবচেয়ে পুরনো মঠটা দেখেছেন? কারমেলাইট সাধুদের মঠ। সেও অবশ্য খুব একটা পুরনো নয়—কারমেলাইটরা যেমন পুরনো! ‘বাকা’-তে তো কিছুই খুব একটা পুরনো নয়। যা পুরনো তা হচ্ছে (রেড) ইনডিয়ানদের সংস্কৃতি। সেটাকে পুনরুদ্ধারের খুব চেষ্টা চালাচ্ছেন হানা স্ট্রং। “গবেষণাকেন্দ্র” স্থাপন করেছেন। এই তো আপনাদের পাশের বাড়িতেই। যাবেন কিন্তু সেখানেও! অনেক খবর পাবেন।”

সবচেয়ে পাকা এখানকার কারমেলাইটদের মঠ। ফোন করতে শুনলুম এটা ভুল সপ্তাহ। এ সপ্তাহে মঠের সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীরা সবাই মৌনী। তপস্যা করছেন একা একা। কেউ দেখা করবেন না, কথা বলবেন না। ধ্যানস্থ

—”তবে আপনিই কথা বলুন? আমি যে কালই চলে যাচ্ছি? আপনি তো মৌনী নন।” ফোন যিনি ধরেছিলেন তিনি হেসে উঠলেন—”বেশ তো, চলে আসুন।”

ছয়

“দ্য স্পিরিচুয়াল লাইফ ইনস্টিট্যুট” ছাড়াও মঠটির নাম—”নাদা হার্মিটেজ।” এটি অমন উঁচুতে পাহাড়ের গায়ে নয় Zen বা হাইডাখণ্ডী মন্দিরের মতো। উপত্যকাতেই, অনেকটা দূরত্বে, বরফঢাকা বালিয়াড়ির মধ্যে অবস্থিত। রাস্তা উঁচুনিচু, সর্পিল। পৌঁছে দুটি বাড়ি চোখে পড়ল একটি ‘চ্যাপেল’ অন্যটি ‘আগাপে’। কোথায় যাবো? ‘আগাপে’-মার্কা তীর ধরে যেটি গির্জে নয় সেই বাড়িতেই কড়া নাড়ি। এখানে কোথাও কলিংবেল নেই, কড়া নাড়া, দোর ঠেলার প্রচলন। আমার কলোরাডো স্প্রিংসের বাড়িতেও তাই।

“নাদা হার্মিটেজে” মাত্র ৭/৮ জন সন্ন্যাসী সন্ন্যাসিনী আছেন এবং ৯টি বাড়ি আছে। তার ৪টি ৪ জন বাইরের লোককে ধ্যান করবার সুযোগ করে দেবার জন্যই তৈরি।

কারমেলাইটদের এই ব্যবস্থাটি আমার খুব ভাল লাগল। স্ত্রী-পুরুষ ভাগাভাগি করে আলাদা মঠ নয়, সংযমই যখন তাঁদের আরাধ্য, তখন একই মঠে বসবাস কেন নয়? এটি যেহেতু ‘হার্মিটেজ’ সবাই হার্মিটের জীবন যাপন করেন, এঁরা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা বাড়িতে থাকেন। সংঘবদ্ধ জীবন ঠিক নয়, শুধু সপ্তাহে তিনবার একত্রে খান। প্রত্যেকে ক্লয়েস্টারের জীবনযাপন করেন, শান্ত একাকিত্বের সাধনা করতে।

ছোট ছোট বাড়িগুলিতে একজনের মতো সব বন্দোবস্ত আছে। অতিথিদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীও একত্রে থাকতে পারেন শুনে আমি তো থ’। স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে নির্জনতার সাধনা করতে আসবেন? তাহলে তো সংসারও সঙ্গে আসবে। স্ত্রীর কর্তব্য ফুরোবে না। স্ত্রী ধ্যানটা আর করবেন কখন? স্বামী-স্ত্রী সমান সমান সংসারের কাজ কবে যে করবেন— সেদিন পূর্বপশ্চিম দুই দিগন্ত জুড়ে ইন্দ্রধনু জেগে উঠবে। সেই ইন্দ্রধনুর অপেক্ষায় আছি। কিছু কিছু স্বামী ঘরের কাজ করেন—তা সেটা যেন তাঁর কর্তব্যের বাইরে, অনুগ্রহ, বিকৃতি অথবা আদর্শবাদ। স্বাভাবিক নয়, আশাতীত, স্বভাববহির্ভূত সৌন্দর্য সেটা সমাজে।—”উনি খুবই আশ্চর্যরকম ভাললোক—স্ত্রীকে গৃহকর্মে সাহায্য করেন!” আমার কথা শুনে, আমাকে ‘কে’ নাম্নী সাধিকা বললেন (তিনি এই মে-মাসে পুরোপুরি মন্ত্র দীক্ষিত সন্ন্যাসিনী হবেন, এখনও হননি, বয়েস মাত্র সাতাশ, ভারি মিষ্টি, দেখলে মনে হয় সতেরো), অনেকেই আলাদা বাড়িতেও এসে থাকেন অবশ্য! পাহাড়ের ওপরে ওঁদের সবচেয়ে সুদূর ধ্যানগৃহটি অবস্থিত, প্রত্যেকেই একা দফায় দফায় পালা করে ওখানে কাটিয়ে আসেন সাতদিন। এত নির্জনতা যেন কল্পনারও অতীত। সন্ন্যাসিনীরাও যান, সন্ন্যাসীরাও, গৃহী ধ্যানপিপাসুরাও।

–আপাতত ওখানে কে আছেন?

—”একজন হিন্দু সাধক”, বললেন ‘কে’।

—হিন্দুদেরও থাকতে দেওয়া হয় বুঝি কারমেলাইট সাধুদের মঠে?

—”অবশ্যই। যে কেনো ধর্মের সাধক-সাধিকা ধ্যানপিয়াসী মানুষ স্বাগত এখানে।“

একটি কুকুর এসে আমার সঙ্গে খুব খেলতে থাকল—’কে’ জানালেন, সেও একজন অতিথি সাধকের সঙ্গে এসেছে। ধ্যানী সারমেয়।

‘আগাপে’র লাইব্রেরি, রান্নাঘর, খাবার ঘর, ফুলের ঘর, অফিসঘর, সব ঘুরে ঘুরে দেখিয়ে ‘কে’ আমাকে চ্যাপেলে নিয়ে যাবার পথে বললেন—”সপ্তাহে তিনবার সবাই একসঙ্গে খাই। সন্ন্যাসীরাও, অতিথিরাও। বাকি সময় নিজে নিজে একা।”

আগাপের সঙ্গে চ্যাপেল একটি কাঠের সেতু দিয়ে জোড়া। বরফের জন্যও বটে, দুটি শৈলের গায়ে দুটি বাড়ি, মাঝে ফাঁক বলেও বটে, এই সেতুবন্ধনের প্রয়োজন ছিল।

‘কে’ আমাকে বোঝালেন, সব বাড়িগুলি দক্ষিণমুখী যাতে সবচেয়ে বেশি সূর্যালোক আসে। এখানেও সৌরচুল্লীতে রান্না, সৌর উত্তাপে ঘরদোর গরম। সর্বত্রই মোমবাতি ও হারিকেন লণ্ঠন আছে দেখলুম।

“সাংগ্রে দি ক্রিস্টো” চ্যাপেলটি খুব শান্ত, সহজ, ছোট্ট। পালিশ করা কাঠের দেয়াল, ছাদ, মেঝে। কোণের বেদীটি শুধু তিনটি পাথর সাজিয়ে তৈরি, খুব কঠোর, খুব সুন্দর দেখতে। একটি পোলিশ গির্জের বেদীর অনুকরণে তৈরি। পাথরগুলির রং সবজে কালো। বেদীটির দু’ধারে দুটি রঙিন কাচের জানলা আছে, চ্যাপেল মাত্রেই যা মানানসই। কিন্তু যেহেতু এই চ্যাপেলের ১৯৮৫-তে উদ্বোধন হয়েছে, এর ঝলমলে রং করা কাচের জানলার ছবিগুলি আধুনিক, এবং অসাধারণ বিষয়বস্তু নিয়ে আঁকা।

সেন্ট টেরেসার চার্চ, তাতে সেন্ট টেরেসার ছবি থাকবে, অন্যান্য কারমেলাইট সাধুসন্তদের ছবি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ছবি একেবারে আলাদা। প্রসঙ্গত, এঁরা মাদার টেরেসাকে খুব শ্রদ্ধা করেন। কলকাতা এঁদের কাছে মাদার টেরেসার শহর।

আমি কলকাতা থেকে এসেছি শুনেই ‘কে’ জিজ্ঞেস করলেন তাঁকে চিনি কিনা, তাঁর সম্বন্ধে দেশের লোকেদের কেমন ধারণা। কলকাতায় কারমেলাইটদের ইস্কুলপত্তর আছে শুনে ‘কে অবাক এবং খুশি।

আমি কবিতা লিখি শুনে ‘কে’ আমাকে একটি কবিতা দিলেন। এখানে সন্ন্যাসী ব্রাদার টম রেনো কবি। “Body And Blood of Christ” বিষয়ে দীর্ঘ কবিতা। কবিতাটি পড়তে গিয়ে দেখি চ্যাপেলের জানলার থীমের সঙ্গে অদ্ভুত মিল, কিন্তু কবিতাটি জানলার আগে লেখা এবং বাতায়নশিল্পীও কবিতাটি পড়েননি, ‘কে’-কে প্রশ্ন করে জানলুম। কবিতার কিছুটা তুলে দিচ্ছি—

“ডাশাউ-য়ের শরীর
সায়গনের রক্ত
পোলানডের শরীর
ইরানের রক্ত
স্বামীদের শরীর
সন্তানের রক্ত
হায়, সেইসব জীবনের
শুরুর আগেই যারা সারা।
উদ্বাস্তুদের শরীর,
তারা ছুটছে,
যেন অন্ধ
যে মাটি ফেলে এলো
তার রক্তের গন্ধ
শরীর, যেটি পড়ে আছে
শহরের রাজপথে
রক্ত, উঁচু প্রাসাদে,
ঝাঁ চক্‌চকে রথে।
তোমার সমগ্র সৃষ্টি
তোমায় ডেকে কাঁদছে,
হে ঈশ্বর!”

প্রথমে চ্যাপেলের ডানদিকের জানলাটি দেখা যাক। কবিতার সঙ্গে আশ্চর্য মিল চোখে পড়বেই। একদিকে লাল টকটকে একটি পাহাড়। ‘কে’ ওটিকে বললেন, এখানকার ‘সাংগ্রে দি ক্রিস্টো’ (যীশুর রক্ত) পর্বত, সূর্যাস্তে-সূর্যোদয়ে রোজ বরফে সূর্যালোক পড়ে রক্তিম করে দেয়—তাই এইরকম নাম।

কিন্তু আসলে ওটি মাউন্ট ক্যালভারি, যেখানে যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। সেখানে তিনজন মানুষের ছবি। একজন মানুষ ক্রাচ নিয়ে পর্বতে উঠছে (পঙ্গুর গিরিলঙ্ঘন?), জগতের সব রুগ্ন মানুষের প্রতিনিধি সে, পরেরজন আউশভিৎসের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ডোরাকাটা পোশাকপরা, জগতের সব রাজনৈতিক অত্যাচারিতদের এবং ইহুদীদের প্রতিনিধি সে, তারপর একটি ক্লান্ত চুল খোলা মেয়ে একটি কুকুরকে নিয়ে বসে পড়েছে। কুকুরটিকে আদর করছে। সে জগতের সব নারীর চিত্রিত প্রতিনিধি, যারা গৃহকর্মে পরিশ্রান্ত, যাদের অতিরিক্ত কাজের মূল্য কেউই দেয় না। কুকুরটি গৃহপালিত পশুদের ‘প্রতিনিধি। হার্মিটেজ-এর গির্জেতে এভাবে তীব্র সামাজিক চিন্তার মমতাময় ছবি দেখতে পাবো, আশা করিনি। অন্য জানলাটিতেও একটি পাহাড়, মাউন্ট কারমেল। মাউন্ট ক্যালভারিতে একটি ঘন সবুজ গাছ আছে, পাতায় পাতায় ছেয়ে আছে, লাল পাহাড়ের গায়ে, কেননা যীশু ওখানে আত্মদান করেছিলেন। মাউন্ট কারমেলে সবুজ গাছপালা নেই—অনেক বেশি কঠোর। এখানেও ধাপে ধাপে মানুষ উঠছে। ধ্যান মানেই ধাপে ধাপে আধ্যাত্মিক উন্নয়ন। সবচেয়ে ওপরে একটি কালো মানুষ (নিগ্রো যাদের আর বলা হয় না) তার পরে টোকামাথায় একটি ভিয়েতনামী কৃষাণী, তার সঙ্গে একটি শিশু, নিচে একজন আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ান উঠছে, সবচেয়ে নিচে একটি নেকড়ে বন্য পশুদের প্রতিনিধি সে। ‘নাদা’ চ্যাপেলের জানলার কাচের ছবিগুলি আধুনিক পশ্চিম জগতের সভ্যতার বিবেককে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে।

আমি চোখ ফেরাতে পারছিলুম না। ধর্মকর্মের তো এটাই কাজ—রাজনীতি, সমাজনীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে নয়, অঙ্গীভূত হয়েই যে সাধনা, সেই সাধনাতে আত্মার মুক্তি।

কারমেলাইটদের ছোট্ট গির্জেটি যেমন সুন্দর লিনডিসফার্নের সর্বধর্মের বিশাল মন্দিরটি তেমনিই শান্তিপূর্ণ লেগেছিল। সেটি আরো সরল, তাতে ছবি নেই, আছে শুধু শূন্যতা, স্পেস, আরেক ধরনের। ধ্যানের উপযোগী মুক্ত কিন্তু ঘেরা জায়গা। হাইডাখণ্ডীদের দোতলার ধূপের গন্ধে ম-ম করা ছোট্ট মন্দিরটিতেও শান্তির গন্ধ ছিল।—”আমাদের বাড়িগুলি বালিয়াড়ির মধ্যে ডুবিয়ে তৈরি, গির্জেটিও,”“কে” বলছিলেন,—”যাতে এখানকার স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের হানি না হয়, যত কম দেখা যায় ততই ভাল। আমরা প্রকৃতিকে যতখানি সম্ভব অক্ষত রেখে, প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে বাস করতে চেষ্টা করি। আদিম যুগের প্রথম কারমেলাইটরা সন্ন্যাস নিয়ে গিরিগুহায় থাকতেন। আমাদের গিরিগুহা নেই বলে বাড়ি বানাতে হয়েছে; যেমন যথাসাধ্য নিচুগলায় আমরা কথা বলি, বাড়িগুলিও তেমনি যথাসাধ্য নিচু, গির্জেও তাই। আমাদের মোটো Nil Sine Numine, nothing without God—প্রকৃতিতেও ঈশ্বরের করুণারই প্রকাশ।” বাকা-তে দেখলুম কি হিন্দু, কি Zen, কি তিব্বতী, কি কারমেলাইট ক্যাথলিক—সকলেরই চেষ্টা প্রকৃতিকে লঙ্ঘন না করে, খণ্ডন না করে, প্রকৃতিকে পরিতৃপ্ত, অক্ষত রেখে, ধরিত্রী মায়ের ধ্যানভঙ্গ না করে, সন্তর্পণে নিজেদের ধ্যানগৃহ গড়ে নেওয়া

অতি আধুনিক হাইডাখণ্ডী বাবাজীর শিষ্যরাও তাঁদের ‘কর্মযোগে’ চান পলিউশান রোধ করতে, সেইভাবেই পৃথিবী মায়ের সেবা করতে। তাঁরাও মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন সর্বধর্মসমন্বয়ে। এই আদিম কারমেলাইট সন্ন্যাসীরাও চান পৃথিবীকে বিরক্ত না করে এক কোণে মানিয়ে নিয়ে থাকতে, আর চান প্রতিদিনের প্রার্থনার সময়ে পৃথিবীর কিছু কিছু মানুষকে মনে রাখতে : জগতের যত রোগীদের, অত্যাচারিতদের, শোষিতদের, দুর্বলদের, সমাজের নিপীড়িতদের। ভয়াবহ এই ফান্ডামেন্টালিজমের দিনে যখন ইংলন্ডে উপন্যাসের বই লেখার জন্য রুশদির মাথার দাম প্রায় ছ’মিলিয়ন ডলার বলে ঘোষণা করছেন অমিতবিক্ৰমে খোলা গলায় অন্য দেশের একজন ধর্মযাজক, এবং বিশ শতকের সভ্য জগতের আইন তাঁকে কিছুই বলছে না, যখন সরকারি হুইপ জারি করে গণতান্ত্রিক দেশে মুসলিম নারী ডিভোর্স বিল পাস হচ্ছে, যখন জগৎ জুড়ে বিকট সুরে মৌলবাদীদের হুক্কাহুয়া শুরু হয়েছে, সর্ব ধর্মের সমন্বয়েরই অন্য এক বিচিত্র দিক–হিন্দু, মুসলমান, ক্রিশ্চান, ইহুদী এখন সকলের মধ্যেই মৌলবাদের ঐকিক সূত্র চাগিয়ে উঠেছে তাবৎ বিশ্ব জুড়ে—তখন ‘বাকা’ যেন এক স্বপ্নের রাজ্য।

ধর্মকর্ম নিয়েই গ্রামটি মেতে আছে। আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের কোনও মঠ-মন্দির দেখলুম না, তবে তাদেরও একটি “অগ্নিকুণ্ড” আছে—যেখানে তাদের যজ্ঞ, “ফায়ার সেরিমনি” করা হয় মাঝে মাঝে, পুরোহিত এনে। “ফায়ার সেরিমনি” যজ্ঞের মতো এক পুণ্য ক্রিয়াকর্ম। এই ‘অগ্নিকুণ্ডে” একটা কেলেংকারি করে ফেলেছিল আমাদের ছাত্রছাত্রীরা। কুণ্ডটিকে ধর্মীয় স্থান বলে চিনতে না পেরে, তারা “বনফায়ারে”র জায়গা ভেবে, সেখানে অতি কষ্টে বরফ সাফ করে আগুন জ্বালিয়ে, গান গেয়ে, নেচে, বিয়ার টিয়ার খেয়ে, ঐ আগুনে মাংস-টাংস ঝলসে পিকনিক করে ফেললে। তারপর শুরু হল হৈ হৈ কাণ্ড। ধৰ্মীয় পীঠস্থান নোংরা করেছে তারা। শূন্য বিয়ারের ক্যান ছড়িয়েছে তো বটেই! তাছাড়া ওই “পুণ্য অগ্নিকুণ্ড’ তো আর “বারবিকিউ” করে মাংস খাবার জন্যে নয়! ছাত্রে মাস্টারে অনেক মাপ-টাপ চেয়ে নিয়ে জায়গাটি পরিষ্কার করে, অনেক টাকা জরিমানা দিয়ে, যাতে পুরোহিতকে এনে জায়গাটিকে শোধন করে নেওয়া যায় তার বন্দোবস্ত করে তবে না মুক্তি? এই গ্রামের জমিদারনী স্বয়ং শ্রীমতী হানা স্ট্রং মধ্যস্থতা না করলে মিটমাট হওয়া খুবই মুশকিল ছিল। কিংবদন্তি বলে, জগৎ যখন ধ্বংস হয়ে যাবে শাদা মানুষদের লোভ, ক্রোধ ও অন্যায়ের ফলে, তখনও পবিত্র চার-পর্বতের মধ্যবর্তী এই অংশটুকু নাকি অক্ষয় থাকবে। রেড ইন্ডিয়ানদের একাধিক জাতির ভিন্ন ভিন্ন কিংবদন্তিতে একই কথা বলা আছে, এই অঞ্চলটি পুণ্যভূমি, এর স্থানমাহাত্ম্য আছে।

তবে হ্যাঁ, একটি জিনিস খেয়াল না করে উপায় নেই, প্রত্যেকটি আশ্রমেরই বিজ্ঞাপনের দিকে যথেষ্ট নজর। প্রত্যেকের ফোল্ডার আছে, আশ্রমে থাকতে সাদর আহ্বান জানিয়ে ডাক আছে, থাকতে হলে যে ডোনেশন দিতে হবে, কত দিতে হবে, ইত্যাদি তাতে বলাও আছে। প্রায় প্রত্যেক আশ্রমই শুধু বুকলেটই ছাপায় না, নিয়মিত নিউজ লেটারও বের করে—আশ্রমে কে এল গেল, কী উৎসব হল, কী বক্তৃতা, কী যজ্ঞ, কী প্রার্থনা হল, সব কিছু জানিয়ে। ‘বাকা’তে লোকজন নেই। এত এত পাঠ্যবস্তু পড়ে কারা? সব দিগ্বিদিকে ডাকে বিলি হয়। যাতে ‘প্রচার’ হয় যার যার আশ্রমের গুণপনার। নাঃ, ‘প্রচারবিমুখ’ বলা যাবে না, এদের। তবে রিট্রিটে যাওয়া কেন? একটা উত্তর—বাইরে থেকে লোকজন না এলে, দানধ্যানের, টাকাকড়ি না উঠলে, আশ্রমগুলি চলবে কেন? অর্থসামর্থ্যে স্বনির্ভর হয়ে ওঠা ‘বাকা’র মতো জায়গায় খুবই কঠিন। তাই ধ্যানী পূজারী আশ্রমিকরা সকলেই প্রচারে উন্মুখ। আমি লেখক শুনে তাঁদের খুব উৎসাহ—”লিখবে তো আমাদের নিয়ে, তোমাদের দেশের কাগজে?” আশ্রমগুলিতে রাজনীতির গন্ধ নেই, কেবল তিব্বতী মঠে কিঞ্চিৎ চীন-বিরোধী মনোভাব ধরা পড়ল। ‘বাকা’-বাসিন্দারা প্রধানত ডেমোক্র্যাট বলেই মনে হল পোস্টার ইত্যাদি পড়ে।

ছোট্ট একটি গ্রামে মাত্র তিনমাইলের মধ্যে কী করে যে এতগুলি অধ্যাত্মচর্চার কেন্দ্র গড়ে উঠেছে এ সত্যিই বড় বিচিত্র। তবে যখন বড় বড় মঠ মন্দির আশ্রমগুলি তৈরি হয়ে যাবে তখন আর তিন মাইলের মধ্যে থাকবে না। পাহাড়ের গায়ে গায়ে দূরে দূরে ছড়িয়ে পড়বে, কেননা প্রত্যেকেরই বহু একর করে জমি রয়েছে। ধর্মকর্মের নাম শুনলেই এখন ভয় করে। সর্বত্র মৌলবাদের ভ্যাপসা পচা (ধর্মের শবদেহের) দুর্গন্ধ।

‘বাকা’তে খোলামেলা বাতাস। সব ধর্মই সব ধর্মকেন্দ্রে স্বাগত। (অন্তত এখনও পর্যন্ত। হানা স্ট্রংয়ের স্বপ্ন এই মারমুখী, বিষয়মুখী আত্মমুখী পৃথিবীতে এমন একটি গ্রাম গড়ে তোলা যেখানে আত্মচর্চা না হয়ে অধ্যাত্মচর্চা হবে, মারের বদলে, প্রেম, বিষয়ের বদলে ধ্যান নিয়ে মানুষ আনন্দ পাবে। ভারতীয়, তিব্বতী, জাপানী ছাড়াও আসার কথা রয়েছে এক নাইজিরীয় ধর্মগোষ্ঠীর। তাঁরা এখনও এসে পৌঁছননি। হানা এখানে শুধু সর্বধর্মের নয়, বিভিন্ন সংস্কৃতিরও আদান-প্রদান চান। ছোট্ট “গ্লোবাল ভিলেজ” করে গড়ে তুলতে চান ‘বাকা’কে রেড ইন্ডিয়ানদের নিয়েও তিনি নানা ধরনের গবেষণার কাজ করেছেন। এ সব শুনতে শুনতে দেখতে দেখতে মনে হয় সত্যি সত্যি বুঝি অন্য জগতের অঙ্কুর এখানে উদ্‌ভিন্ন হচ্ছে। ‘বাকা’র সুস্থ, শুদ্ধ বাতাসে নিজেকে এতই অনভ্যস্ত রকমের পবিত্র লাগছে যে ফিরে এসে তখুনি তখুনি চটপট একটা কোনো অকম্মোকুকম্মো একটা কোনও ভারি মন্দ কাজ না করলে যেন ব্যালান্স থাকবে না মনে হচ্ছে। ভুরু কুঁচকে “এত ভাল ভাল নয়” বলব কিনা ভাবছি। স্বভাবটাই হয়ে গেছে মন্দ, সন্দেহবাতিক। ভাল দেখলেই ভাবনা হয়, সত্যি তো? এর পিছনে আর কিছু নেই তো?

পরিশিষ্ট

মানুষ যা ভাবে, জীবনে যদি তাইই শুধু ঘটতো, তবে জীবনটা অনেক সোজাসুজি হয়ে যেত। “বাকা’ ভ্রমণ যেমন “হঠাৎ-হাওয়ায়-ভেসে-আসা ধন,” পরিকল্পনার বাইরে কুড়িয়ে পাওয়া অভিজ্ঞতা, কলোরাডো বাসের বাকিটাও তেমনি আকস্মিকতায় ভরে গেল। পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রায় কিছুই হল না।

হ্যাঁ, মার্চ মাসের ছুটিতে টুম্পা আমার কাছে এল। তাকে নিয়ে পার্থ আর চিকুর সঙ্গে “কন্টিনেন্টাল ডিভাইডে” বেড়াতে গেলুম। রকি মাউন্টেনের সেই সব পটে-আঁকা পুরনোদিনের গ্রামগুলিতে, পরিত্যক্ত স্বর্ণখনিতে তাকে ঘুরিয়ে আনলুম, তার পরই বড় মেয়ের ফোন এল। আমার মা কলকাতাতে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তক্ষুনি চাকরির চুক্তি ভঙ্গ করে, মাঝপথে চাকরি ছেড়ে দিয়ে দিনে দুবেলা মোট ছ’ঘণ্টা করে প্রত্যহ বক্তৃতা দিয়ে প্রথম কোর্সটি, যা পড়ানো শুরু হয়ে গিয়েছিল, তা আর এক হপ্তার মধ্যেই শেষ করে, মেয়েকে তার ছুটি ফুরোবার আগেই হার্ভার্ডের হস্টেলে ফেরত পাঠিয়ে, সবগুলি শহরের কবিতা পাঠের আমন্ত্রণ ফোনে বাতিল করে, গ্লোরিয়াকে আসতে বারণ করে দিয়ে, পয়লা এপ্রিল জোনের কাছে বিদায় নিয়ে কলকাতা রওনা হলুম।

জোনের আর আমার একই থীমের কবিতা নিয়ে একটি যুগলবন্দী কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরিকল্পনা করছিল কলেরাডো কলেজ, সেই পরিকল্পনাতে সবচেয়ে খুশি হবার কথা যাঁর তিনি আমার মা। জোন বললেন, “স্থগিত রইল, বাতিল হল না কিন্তু!”

সারা পথ মায়ের জন্যে মন উতলা, সেই উতলা মনে যেন ঝলসাতে থাকল সাংগ্ৰে দি ক্রিস্টো পর্বতের তুষারশিখরগুলিকে ধুইয়ে দেওয়া যীশুর রক্তের মতো লাল টকটকে ক্রুদ্ধ সূর্যের দীপ্র আগ্নেয়প্রভা—মার কাছে ফিরে যাচ্ছি, মার সঙ্গে দেখা হবে তো? মা, যিনি আমার সব গল্পের প্রথম শ্রোতা, সব কবিতার প্রথম পাঠক, কলোরাডোর আশ্চর্য কাহিনি তাঁর কোলের কাছে বসে শোনাতে পারব তো? শুনে মা কী বললেন?

.

দেশে ফিরে মার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কিন্তু মাকে আর কোনও গল্পই শোনান হয়নি। ‘বাকা’র গল্পটাও না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *