দক্ষিণফ্রান্সের চিঠি

দক্ষিণফ্রান্সের চিঠি

AIX-EN-PROVENCE

২৩।৮।৭৮

সুনীল,

কৃত্তিবাসের গদ্যসংখ্যায় লেখা দিয়ে আসা হল না। আপাতত দক্ষিণ ফ্রান্সে, এইক্স-অঁ-প্রভস নামের ছোট শহরে। এইমাত্র প্যারিস থেকে মার্সাই হয়ে এসে পৌঁছেছি। লুরমারাঁ নামের ছোট একটি পাহাড়ি গ্রামে যাবার কথা লাঞ্চ খেতে যেখানে গির্জের একধারে কাম্যু শুয়ে আছেন। আর ডিনার খাবার কথা এমন একটি রেস্তরাঁয়, যার নাম রেস্তরাঁ র‍্যাঁবো। এইক্সের চারপাশেই এইরকম। এটাকে বলে সেজান-কান্ট্রি, এখানে গাছে, পাতায়, মাটিতে, আকাশে, সেজানের চোখে তাকালেই সেজানের ছবি চোখে পড়বে। ঠিক যেমন, একটু দূরে গেলে, আর্ল অঞ্চলের সূর্যে, সাইপ্রাসবীথিতে, সূর্যমুখীতে নিসর্গ ভরা ভ্যান গখের স্বাক্ষর। আর্ল-অঞ্চলের এই নিসর্গই ভ্যান গখের ছবিতে আমরা দেখি, যেমন এইক্স-অঞ্চলকে দেখি পোল সেজানে। এখানে একটি গ্রন্থাগারের নাম পোল সেজান গ্রন্থাগার। এখানে টাউন হলে স্যাঁ জঁ পের্স-এর বই সংগ্রহ আর পাণ্ডুলিপির প্রদর্শনী হচ্ছে। এই সব। আমি অবশ্য অতি অলস হয়ে পথের ধারে রঙিন ছাতার নিচে একটি কাফে-তে বসে বসে সেই অতি উপাদেয় আর দুর্লভ পানীয় বরফ ও সুগন্ধী লেবু সহযোগে পান করছি, যার নাম…?…উহুঁ! হল না! যা ভাবছ তা নয়। উত্তরে- কোকা কোলা!

রোদ ঝলমলে দিন, রাস্তাটা খুবই চওড়া। দুধারে বয়স্ক বৃক্ষের সারি, আর তার নিচে নিচে বেঞ্চিপাতা। সারাটা রাস্তাই প্রায় ছায়া করে রেখেছে গাছের দল। পাথর বাঁধানো চওড়া ফুটপাতে আমি এবং আমার মতো অনেকে। পথের দু’পাশের বাড়িগুলো অষ্টাদশ শতকে তৈরি, ‘বারোক্’ স্টাইলের বাড়ি, খুব সুদর্শন। “Cours Mirabeau” রাস্তাটার নাম প্যারিসের একটি সেতুর নাম “Pont Mirabeau” আর তাই নিয়ে আপোলিনেয়ারের কবিতাটা মনে আছে?”Sous le pont Mirabeau/ Coule la Seine” ইত্যাদি? এবারেও প্যারিস আগের মতোই প্রাণহরণ করেছে আমার। এই চিরযৌবনা সুন্দরীর সঙ্গে পাল্লা দিতে কম শহরই পারে। শেষবার এসেছি ৫ বছর আগে ১৯৭৩এ। প্রথম এসেছিলুম নেহাৎ বাল্যকালে, বাবামার সঙ্গে, আইফেলটাওয়ার, অপেরায় স্যামসন-ডেলাইলা, আর ফোলি বেরজের-এর একটি দৃশ্য ছাড়া মনে কিছু পড়ে না। অবশ্য এইক্সেও আগে এসেছি। আমার থীসিসের কিয়দংশ এখানে বসেই লেখা। অথচ তখন এইক্স কিছুই প্রায় দেখিনি। ঘাড় গুঁজে কেবল টাইপ করে গেছি ঘরে বসে। বিশ্রী স্মৃতি। এবারেও ভাল লাগছে না। খুব মন কেমন করছে কলকাতার জন্য। থাক এসব মন-কেমন-করা প্রসঙ্গ। বরং লিখি—এখানে সব মেয়েদেরই পরনে একরকম স্ট্র্যাপ দেয়া শেমিজ, আর চুলখোলা আর চোখে, (শুধু চোখেই) প্রভূত রংঢং। ভ্রূপল্লবে ডাক দিলে জলপাইবনে দেখা হবেই হবে। বেঞ্চিতে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে ক্লান্ত প্রেমিক প্রেমিকার গুচ্ছ, পথে হাঁটছে হাত ধরাধরি প্রেমিক প্রেমিকার গুচ্ছ, ছাতার নিচে বসেও আছে ঠান্ডা মদের গেলাস নিয়ে প্রেমিক প্রেমিকার গুচ্ছ, এদের বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশুকিশোর, এরা সব কই? এত প্রেম দেখলে কিন্তু সত্যি প্রাণ থেকে প্রেম উড়ে যায়। প্রেমিকাদের বগলে আবার প্রায়ই একটি করে উপ-প্রেম—ক্ষুদে কুকুর! একটু আগে দেখলুম প্রেমিকা একটি আইসক্রিম কোন নিজে খাচ্ছেন আরেকটি ক্রোড়পুত্র কুকুরকে খাওয়াচ্ছেন। প্রেমিক সতৃষ্ণ নয়নে কুকুরের সৌভাগ্য চেয়ে চেয়ে দেখছেন, বিয়ারের গেলাসে হাত রেখে। রাস্তায় গাড়ি বেশি নেই, কিন্তু সব গাড়িই নতুন, সব গাড়িরই গতি এবম্বিধ, যাতে আমার জোরে গাড়ি চালানোর আর তোমরা নিন্দে করবেনা—গাড়ি তো নয়, রকেটের মতো বেরিয়ে যাচ্ছে। আগস্ট মাসটা ফ্রান্সে ছুটির মাস, কোনও শহরেই তখন স্থানীয় বাসিন্দারা থাকে না—এটাই বোধহয় শিশুর-বৃদ্ধের না থাকার ব্যাখ্যা! গতকাল প্যারিসে রেডিও খুলেই কর্ণাটকি গান শুনতে পেলুম! তারপর ঘোষণা হল, যামিনী কৃষ্ণমূর্তির নাচের অ্যাকমপানিমেন্টটা শোনান হচ্ছে। এইক্সেও, “Le mois a Aix “ গাইডবই খুলে দেখি প্রথমেই শহরের মিউনিসিপ্যাল উদ্যানে ৩রা আগস্ট এ মাসের প্রথম উৎসবটি কী? না, “মণিপুরী নৃত্য!” নাঃ এসব সত্যি প্রগতি! বলো? আমাকে এখনও কেউ আঙুল বাড়িয়ে জিগ্যেস করেনি “তোমার কপালে ওই লাল গোল দাগটা কিসের?” গতবারে অবধি করেছে!

এখানে বই খাতা খাদ্য বস্ত্র সবই অত্যন্ত মহার্ঘ হয়ে গেছে, আমি তো ভিখিরির অবস্থায় পড়েছি। অতি করুণ পরিস্থিতি। একটা সাধারণ খাতার দাম তিনফ্র্যাংক, মানে ছ টাকার বেশি। এককাপ কফি চার ফ্র্যাংক—সাড়ে আট টাকা। ভারত সরকার তো ক’টি মাত্র ডলার হাতে দিয়ে পাঠিয়েছেন,–এদিকে ডলার এখন সফ্ট কারেন্সির মতো ধড়-ফড়িয়ে অধঃপতিত হচ্ছে।

এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসে বসলেন। তাঁর টাক ঘিরে শুভ্র রেশমের গুচ্ছ। তিনি হেসে হেসে ইংরিজিতে আমাকে বলছেন—”তুমিও কি Modern Languages and Literatures Con- ferenceএ এসেছ?” হায়। আমাকে কি দেখলেই মনে হয় কনফারেন্সিয়াল? কন্‌ফিডেনসিয়াল মনে হয় না? ভদ্রলোকের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল। এ পর্যন্ত জানা যাচ্ছে—উনি ফিলাডেলফিয়ার প্রফেসর। নাম মোর্স। এক স্ত্রী। দুই ছেলেমেয়ে ৩৮,৩১। জয়েস পড়ান। জয়তু ভাষা ইংরিজি! চিঠি এখানেই শেষ। কেননা এই ছাতার নিচে এখন থেকে গল্প গুজব শুরু হচ্ছে। ভালবাসা নিও, স্বাতী-পু-সহ। নবনীতা ২৬।৮।৭৮

সেদিন আমরা Vaucluse বলে এক উপত্যকায় গিয়েছিলুম। সেখানে পেত্রার্কের জন্ম, লরারও। যে-প্রেমে জীবৎকালে সার্থকতা আসেনি, মৃত্যুর ছ’শো বছর বাদে সেই প্রেমের সে কী রমরমা, যদি দেখতে! প্রত্যেকটা কাফে, হোটেল, দোকান লরাপেত্রার্কের যুগ্ম নামাঙ্কিত, কত ছবি তাদের এখানে ওখানে। একটা পোস্টকার্ডে “Laure de Petrarca বলেই লেখা আছে—যা জীবনে ঘটেনি, তাই মরণে ঘটেছে। ওখানে আশ্চর্য সব গুহার সারি আছে, পাহাড়ের গায়ে (নীলগিরিতেও ঐরকম দেখেছি, ট্রাইব্যালরা থাকে বলেও শুনেছি) তাতে প্রাগৈতিহাসিক নরনারী সংসার করত। অনেক পরে খৃষ্টান সন্ন্যাসীরাও জপতপ করে গেছেন ওখানে। গুহাচিত্র নেই, তবে ভাঙাপাত্র পোড়াকাঠ ইত্যাদি আছে। আর দেখলাম একটা নদীর উৎস। হয়তো এই প্রথম আমার একটা নদীর উৎস দেখা, অথচ বড় হতাশ করেছে। একটা গুহায়, একচৌবাচ্চা শান্ত নীল জল বসে আছে। কিন্তু একটু নিচেই, অদৃশ্য ফুটো থেকে প্রচণ্ড উদ্দামবেগে জলপ্রপাত ঝরছে। ওই শান্ত চৌবাচ্চাই যে তার উৎস, কে বলবে। এছাড়া আভিনিয়ঁ শহর বেড়ালুম, সেই যে বিখ্যাত সেতু, “Sur la pont d’ Avignon danse, danse, toet le monde”—সারা পৃথিবী নাচবে কি, আধখানা ব্রিজ ভাঙা! কী মন খারাপের কথা বলো?

তোমাদের সবচেয়ে মজা লাগতো যদি বেচারী আমার বদলে St. Tropez তে আসতে তোমরা। আমি আর সে স্বর্গীয় শোভার কী বা বর্ণনা দেব? St. Tropez ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরার সবচেয়ে ফ্যাসানদুরস্ত সৈকত (ব্রিজিৎ বার্দোর প্রাসাদের প্রসাদে ইদানীং আরও মূল্যবান! ) ফরাসি শুধু নয়, ইয়োরোপের তাবৎ ধনীদের বেড়ানোর জন্যে তৈরি—তায় আবার Artists’ Colony—সমুদ্রতীর জুড়ে কেবল ধনীদের Yatcht, আর শিল্পীদের ইজেল, আর রৌদ্রস্নানরত রমণীদের শরীর। এখানে সবাই মুক্ত ঊর্ধ্বাঙ্গাসনে যোগরূঢ়। ছেলেরা কেউ কেউ কিছুই পরেনি। মেয়েরাও অনেকে কিছুই পরেনি। পুলিশে ধরছে না অবশ্য জামাকাপড় পরা থাকলে। নগ্নিকাদের ওখানে জলে ভদ্র সুইমিং সুট পরা অবস্থায় ঠিক বোরখা পরা মেয়েদের মতো দেখাচ্ছিল আমাকে। উঃ সমুদ্রের কী রঙ। স্বচ্ছ স্ফটিক রং। “লাল আর সবুজ রং দিয়ে আমি মানবজীবনের সব কথা বলে যাব”–বলেছিলেন পাগ্‌লা ভ্যান গখ। আলোর প্রাখর্য, রঙের বৈপরীত্যের জন্যেই তিনি এসেছিলেন হল্যান্ড ছেড়ে দক্ষিণ ফ্রান্সে। কেন এসেছিলেন, তা সত্যিই বোঝা যায়। এখানকার রোদের রঙই আলাদা।

এখানে একটা জিনিস ভারি মজার। একদিকে বাঙালি, ফুলের গাছ। করবী, ফুরুস, সন্ধ্যামালতী, যুঁই, গাঁদা, গুলঞ্চ, সোনাঝুরি, বাঁদরলাঠি, পঞ্চমুখীজবা, সূর্যমুখী! আবার যত উঁচু উঁচু বিলিতি গাছও। ওক, মেপলফার, পাইন, সাইপ্রাস, পলার, অলিভ! অশ্বত্থ, পিপুল, শিশু গাছও আছে।

আজকে আর্ল শহরে ঘুরলাম—প্রচুর রোমান ধ্বংসাবশেষের মধ্যে সারাটা দিন কাটল। আর্ল শহরেও ভ্যান গখ অনেকদিন ছিলেন। কাল যেখানে যাব, San Remy, সেখানে উনি (কান-কাটার ঘটনার পরে) মানসিক চিকিৎসার জন্য দু বছর ছিলেন। স্যাঁ-জঁ-পের্স রেনেশার, এমিল জোলা, সেজান, পিসারো, মানে, মোনে, সোরা—সবাই এই প্রভঁসের ছেলে। আজ একটা উইন্ড মিল দেখলুম যেখানকার কথা আলফাস দোঁদে লিখে গেছেন তাঁর প্রসিদ্ধ বইতে। কাম্যুর কবর যে গ্রামে, সে গ্রামের ভেতরে গেলুম,—পিকাসোর কবর যে-গ্রামে, তার নিচের রাস্তাটা দিয়ে গেলুম। কত স্মৃতিই যে জড়ানো এই প্রভঁস অঞ্চলের ধুলোয় ঘাসে। লেখক আর শিল্পীদের অতি প্রিয় জায়গা এই দক্ষিণ ফ্রান্স। মাঝে মাঝে এখানে শ্যাটো আছে বড়লোকদের—যেখানে তাঁরা লেখক পুষতেন। এখনও ফরাসি সরকার লেখক পোষার, এবং শিল্পী পোষার জন্য কিছু প্রাসাদ রিজার্ভ করে রেখেছেন অবশ্য। প্যারিসে এই সেদিনও মালরো একটা বাড়ি বানিয়ে গেছেন—বিদেশি শিল্পীরা যেখানে এসে নামমাত্র খরচে একটা স্টুডিও ভাড়া নিতে পারে। এরা খুব ভাবে বাপু শিল্পীদের কথা, লেখকদের কথা! এখানে রাস্তাঘাটের নামে তাই চেনাশোনা নামের এত বাহুল্য।

এ চিঠি পাঠাতে কত খরচ হবে ভেবে শিউরে উঠছি। এখানে এসে এবারে তেমন মন বসছে না। মন বড্ড কলকাতা কলকাতা করছে। বক্তৃতার পালা শুরু হবে পরশু থেকে। আর অবশ্য মন কেমনের ফাঁক থাকবে না সারাদিনের মধ্যে। এরই মধ্যে পক্ষিরাজের উপন্যাস লিখতে হচ্ছে। বন্য কামার্গ-অঞ্চল নিয়ে লিখছি সকাল আটটা থেকে রাত আটটা অবিশ্রান্ত ঘোরার পরে! পু স্বাতী সমেত ভালবাসা নিও। আমাদের বাড়িতে একটা খবর নিও।—ন

২৩।৮।৭৮, AIX – EN- PROVENCE

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *