ঝাঁকি দর্শন মস্কৌনগরী ১৯৮২

ঝাঁকি দর্শন মস্কৌনগরী ১৯৮২

দুটো দিনও নয়। তার মধ্যে আর কীইবা দেখতে পাব? তবুও…ঝাঁকি দর্শন হলেও দর্শন তো? লন্ডন থেকে দুটি দিনের স্টপ ওভারের জন্যে টিকিট কেটেছি। এসে দেখা গেল সেটা দুদিন ঠিক নয়। এক সন্ধ্যায় এসে পৌঁছুচ্ছি পরের রাত্রেই তল্পি গুটিয়ে হাওয়া। রাত ১২টার ক’মিনিট পরে উড়ছে হাওয়াই জাহাজ, তবে ইংরিজি মতে তারিখ পড়ছে পরের দিনের। দেখাশুনো যা কিছু সবই আসলে তিরিশ ঘণ্টার মামলা।

প্রথমেই প্রভূত অকারণ ঝামেলা হল পাসপোর্ট আর কাস্টমসএ। যদিও আমার ভিসা আছে এবং নিষিদ্ধ কোনও বস্তুই সঙ্গে নেই। জগতের যত সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মানসিকরুগীদের ধরে এনে ইমিগ্রেশনের চাকরিতে বসিয়ে দেওয়া সব সরকারেরই রেওয়াজ : তবে এদেশে সেটার বাড়াবাড়ি দেখা গেল। শেষ পর্যন্ত মনে হতে লাগল—”কেন যে মরতে এলুম? দূর দূর না এলেই হত। নাইবা দেখা হত টলস্টয়-চেখফ্ –গোর্কীর শহর। আমায় তো কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি দেখবার জন্যে! এমন করবে জানলে কে আসত?” ঘণ্টাদুই বাদে যখন বেরুলুম, বিধ্বস্ত মনে, ক্লান্ত শরীরে, তখন দেখি দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি। সারথি হাসিমুখে আমার বাক্স প্যাটরা ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে আমায় সুদ্ধ তুলে নিয়ে ছুটলেন শহরে। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে দেখছি চারদিকে গাছপালা। আকাশপথে মস্কো পার হয়েছি যতবার, নিচে আশ্চর্য ঘনসবুজ গাছ-গাছালি দেখে অবাক হয়েছি বটে। শহরের মধ্যে এতটা সবুজ বড় একটা দেখা যায়না। মস্কোর নামই গ্রিন সিটি। পলিউশন এখানে আশ্চর্যরকম কম!

যে হোটেলে উঠলুম এসে, সেটা আগে জারদের প্রাসাদ ছিল। বিপ্লবের পরে হোটেল হয়েছে। বলশয় থিয়েটারের পাশেই। একটু ওপাশে তাকালেই দেখা যাচ্ছে ক্রেমলিন। লেনিন মসৌলিয়ামও ওইদিকেই। লেনিন মিউজিয়াম খুবই কাছে। রেড স্কোয়্যারের পাশে। সেও এখানেই। খুব সুবিধাজনক জায়গায় আছি। এই হোটেলেই পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসে উঠেছিলেন। অবশ্য হোটেলে তাঁর কোনো স্মৃতি ধরে রাখা নেই, বা তাঁর থাকার কোনও খোঁজখবরও নেই। একটা স্মৃতি ফলক তো থাকবে? বিশাল প্রাসাদ, মানুষ ও অনেক। সাড়ে তিনশো ঘর। তবে নতুন হোটেল রুমকীতে নাকি ছয় হাজার অতিথি থাকতে পারেন শুনেছি। সে তুলনায় পুরনো প্রাসাদ হোটেল মেট্রোপোল তো তুচ্ছ। ধর্মশালা মাত্র!

নামেই তিরিশ ঘণ্টা। ঘোরাঘুরির জন্যে আসলে হাতে সময় খুবই অল্প। ঠিক বারো ঘণ্টা। সকাল ন’টা থেকে রাত্রি ন’টা তার মধ্যে দেখে নিতে হবে যতটা সম্ভব। দেশ দেখার আমার যা প্রিয় পন্থা, অর্থাৎ গিমিশলা, সবুজ গাইড বইটি কিনে নিয়ে আপনমনে পথে পথে ঘোরা সেটা সম্ভব নয়। অতএব অনিচ্ছা এবং অরুচি সত্ত্বেও কয়েকটি ট্রাডিশনাল উপায় গ্রহণ করা ভিন্ন পথ নেই। একদিকে আছে ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে দুপুরের পর দুপুর, আর অন্যদিকে এল মুখার্জির নোটবই। আপাতত আমার আর এল. মুখার্জি ছাড়া গতি নেই। অতএব ধরে ফেলি একটা টুরিস্ট বাসে সাইট সীয়িং ট্যুর। অব্ দেখ্‌ তো লে মস্কোনগরী? সকালটা যাক এই ব্যাপার! যত হালকা, আঁখিপল্লবগ্রাহীই হোক তবু একটা চাক্ষুষ চেনাশোনা তো হবে শহরটার সঙ্গে? একটা দেখা সাক্ষাৎ? দুপুরটা থাক আত্মিক যোগাযোগের জন্যে। তখন ঘুরবো জাদুঘরে। অর্থাৎ সকালটা হবে ব্রড বেড, স্টাডি। এত মোটে একটাই শহর! হতাম যদি মার্কিন ট্যুরিস্ট বারো ঘণ্টায় অন্ততপক্ষে দু’খানা তো শহর মেরেই দিতাম?

কোনওকালে ভালবাসি না এমন গাইডেড সাইট সীয়িং ট্যুর। শহরটার জল বাতাস মাটি ঘাসের গন্ধস্পর্শ কিছু পাওয়া যায় না তাতে। না হয় কোনও মানুষজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, আলাপ-পরিচয়, না ঘটে কোনও জীবনভিত্তিক অভিজ্ঞতা। এইসব বাস এক একটা দ্বীপের মতো শূন্যে সময়হীন তিন ঘণ্টা ভেসে থাকে, তাতে ভর্তি থাকে ভিনদেশী লোক, যারা সবাই যার যার নিজের দেশে দায়িত্ববান বুদ্ধিমান! কেউ ছুঁদে উকিল, কেউ বড় ডাক্তার, কেউ কারখানার মালিক, কেউ ট্রেডইউনিয়নের নেতা। কেউ সাত ছেলের বাবা, কেউ উনিশটা বই লিখেছে। কিন্তু এই বাসে উঠে, বাগ্পটু গাইডটার হাতের তেলোয় প্রত্যেকেই তারা সুতোয় বাঁধা পুতুল। অসহায়। হাবাগোবা। না জানে ভাষা, না সংস্কৃতি, না আদবকায়দা, না রাস্তাঘাট। সকলকেই নার্সারি কিনডার গারটেনের ছেলেমেয়ের মতো, বা হাফ উইটের মতো মনে করে অনেকের ওপর-চালাকি করে গাইড। কোনও জটিল গভীর প্রশ্ন করলে কিন্তু উত্তর পাবে না। গাইড যা জানে তুমিও কেবল সেটুকুই জানতে অধিকারী। অনেক সময়ে ভুলভালও বলে দেয়। অনেক সময়ে আবার সর্বজন-বিদিত বিষয়টাও গাইড জানে না। ছেলেবেলা থেকে বাবা-মার সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়ে আমার এই জ্ঞান হয়েছে। এখন স্বাধীন ব্যক্তি হয়েছি। আর ওপাল্লায় চট করে পড়ি না। যেমন ওস্তাদ তীর্থযাত্রী পাণ্ডার খপ্পরে পড়ে না। ওস্তাদ ভ্রমণকারীও সাইটসীয়িং টুরের ফাঁদে পা দেয় না। অবশ্য একসেপশন আছেই। মাঝে মাঝে রিসার্চ ছাত্রছাত্রীরা গাইডের কাজ করেন—অনেক সময় প্রফেশনাল ট্যুরিস্টগাইড রিসার্চ ছাত্র না হয়েও অসামান্য জ্ঞানী হ’ন—তাও দেখছি।

আমাদের ঝরঝরে ইংরাজিভাষী গোলাপী সিল্ক আর সাদা লেসের ফ্রকপরা গাইডটি কেবল চুল ঠিক করছিলেন, চুলটি দুহাতের আঙুল দিয়ে টেনে এনে কানের দুপাশে বেশ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সাজাচ্ছিলেন। পুরো তিনঘণ্টাই তিনি খুব মন দিয়ে এইটে করলেন। সঙ্গে মুখের অবশ্য বিরাম ছিল না। ট্যুর যখন শেষ হয়ে গেল তাঁর চুল তখনও হায় ঠিকমতো বসল না। এর চেয়ে শুয়োরের ন্যাজ টানলেও সোজা হয়ে যেত এতক্ষণে। উনি বললেন, “রুশরা খুব বই পড়ে, আমাদের অর্থাৎ রুশদের জাতীয় ‘হবি’ হচ্ছে বই পড়া। সর্বত্র, বাসে, মাঠে পার্কের বেঞ্চিতে আপনারা দেখবেন রুশরা বই পড়ছেন।” রুশ দেশ থেকে যে পরিমাণে অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তাতে আমারও ধারণা ছিল, রুশরা নিশ্চয় ভয়ানক রেটে বই পড়েন। মস্কো নগরীর যাবতীয় রুশ বাসিন্দে কিন্তু অতিব্যস্ত ছিলেন সেই দিনটিতে। অন্তত সেদিন একজনকেও দেখিনি বসে বসে বই পড়তে। অবশ্য মেট্রোতে চড়া হয়নি, শুনেছি সেখানেও চলমান লোকে খুব বই পড়ে। আমার মেট্রোতে না-চড়াটা বিশেষ একটা ক্ষতি হয়েছে, শায়লার মতে। মাটির নিচের প্রাসাদগুলি না দেখেই মস্কো ছেড়ে যাওয়া, যেন আধখানা মস্কোই না দেখে চলে যাওয়া।—”না ঢুকলে ক্রেমলিনের ভেতরে, না দেখলে লেনিনের শরীর না দেখলে একটা মেট্রো স্টেশন! তোমাকে আসতেই হবে ফিরে আরেকবার মস্কোতে। এমনকী একটা রুশ দোকানেও ঢুকলে না। ওই যে চিলড্রেন্‌স্‌ ওয়ার্লড বলে একবাড়ি ভর্তি বিরাট ছোটদের দোকান, ওর ভেতরেও তো একবার ঢুকতে হত?”

—নাঃ, কোথাও ঢুকিনি। উড়নচাক্কির মতন বাস আমাকে হুশ করে উড়িয়ে নিয়ে ফেলছিল এখান থেকে ওখানে। এ দোর থেকে ও দোরে ছেলেবেলায় হাঁটু গেড়ে ফুটপাতে বসে কাচের চোঙ্গায় এক চোখ রেখে—”বম্বইকা জাহাজ দেখো দিল্লিকা কুতুব দেখো”র মতন করেই যে মস্কৌকা নগরী দেখলুম।

একটা মজার ব্যাপার ঘটল বাসে ওঠার ঠিক আগে। হোটেল মেট্রোপোল থেকে আমাকে হেঁটে ইন্‌-ট্যুরিস্ট বাস টার্মিনালে যেতে হবে। বলশয় থিয়েটারের একদম গা ঘেঁষে রাস্তা, দু’বার মাটির নিচের সাবওয়ে দিয়ে বড় রাস্তা পার হতে হয়, আর একবার ওপর দিয়েই রাস্তা পেরুনোর কথা। বিরাট সাবওয়ে, কী চমৎকার ঝকঝকে পাথরের মেঝে আলো ঝলমল সুড়ঙ্গ। মানুষের কী ভীড়! হঠাৎ দেখি এক দঙ্গল আশ্চর্য মেয়ে।

বুঝতে অসুবিধে হয় না, এরা সব জিপ্‌সী। লম্বা কালো চুল জটবাঁধা, পরনে নোংরা ছেঁড়া তালিমারা ঘাঘ্রা কয়েকজনের পায়ে ছেঁড়া চটি, আর কয়েকজনের পায়ে ভারী স্নোবুট। কাঁধে পুঁটলিবাঁধা, ঝুড়িভরা মালপত্র। একটি জিপ্‌সী মেয়ে হঠাৎ কী মনে করে আমাকে ঘিরে ঘিরে নেচে নেচে অঙ্গভঙ্গি সহকারে গান গাইতে শুরু করে দিল! বেশ মিষ্টি গলায়, সুন্দর সুরে গান। অন্যরা সঙ্গে সঙ্গে তালি দেয় আর হাসে। হাতে তারের বাজনাও আছে—কি ভাগ্যি বাজাচ্ছে না! আমার তো অসম্ভব অস্বস্তি হচ্ছে কী করি, কোথায় পালাই! যথাসাধ্য দ্রুত হেঁটে প্রায় ছুটে পালাতে থাকি। বেদেনীরাও ছুটতে থাকে। ভয়ে আমি ব্যাগটা আঁকড়ে ধরি ওদের কিছু ভিক্ষেটিক্ষে চাইবার আছে তো মনে হয় না। আমাকে স্রেফ্ খেপানোই উদ্দেশ্য। পরনের শাড়ি কপালের টিপ সব কিছুই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে চায়, হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ ব্যাগটা কেড়ে নেবে না তো? কি জানি বেদে বলে কথা! বলতে গেলে আমাকে প্রায় ঘেরাও করে ফেলেছে বেদেনীরা। মুখের কাছে হাত নেড়ে নেড়ে গান গাইছে। যেন একটা অ্যাবসার্ড নাটক দেখছি—তথাৎ কেবল এই যে আমিও মঞ্চে, এবং প্রধান ভূমিকায়। কী চায় এই মেয়েরা? কেন এমন বিরক্ত করছে আমাকে? যেন সেরানেড করা হচ্ছে। পথের লোকজন সবাই দেখছে, কেউ ওদের বারণ করছে না। সবাই অফিসে যাচ্ছে, ব্যস্তবাগীশ মূর্তি প্রত্যেকের। কেবল ওদেরই অনন্ত ফুর্তির সময় আছে। এবার আমি বেশ ভয় ভয় পাচ্ছি। ছুটতে ছুটতেই ওপরে রাস্তায় উঠি। সিঁড়ি দিয়ে ওরাও ওঠে। রাস্তায় উঠেও ওরা কিন্তু আমার সঙ্গ ছাড়ে না। বড় রাস্তা দিয়েও সমানে পাল্লা দিয়ে ছুটতে থাকে, গান গেয়ে, হাততালি দিয়ে, জোর হাসি মস্করা করতে করতে আমাকে পথচারী সকলের নজরে এনে। লজ্জায় মরমে মরে গিয়ে হঠাৎই রাস্তাটা এক দৌড়ে পার হয়ে যাই আমি। যদিও সেটা রাস্তা পার হবার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা নয়। যদিও রাস্তায় ছুটন্ত তখন বহু গাড়ি। যদিও সেখানটা দিয়ে কেউই রাস্তা পেরুচ্ছে না। কিন্তু এই বেদেনীদের ঠাট্টা তামাশা আমাকে সত্যি সত্যি খেপিয়ে পাগল করে দিচ্ছে। গানের কথা তো কিছুই বুঝছি না। রাস্তার লোকেরা সবাই তাকিয়ে আমায় দেখছে। কী ভাবছে কে জানে? ভাবছে আমিও নিশ্চয় ওদেরই দলের। ওদের দেখেই বোঝা যায় অন্নবস্ত্রের নিশ্চয়তা নেই। ছেঁড়া পোশাক দেখলুম এই একবারই মাত্র। ওরা ছাড়া মস্কো শহরে আমি আর কোনও গরীব দেখিনি। পথে মাতাল দেখিনি। ভিখিরি দেখিনি। পাগল দেখিনি। দেয়ালে বিজ্ঞাপন, কি থুথু দেখিনি। পথে মিছিল, কিংবা ঘেরাও দেখিনি। আমিই যা ঘেরাও হওয়া অবস্থায়, মিছিল করে গরীব মানুষ পরিবৃত হয়ে পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছিলুম।

শায়লা শুনে খুবই অবাক্ হল বলল—”শহরে জিপসীদের তো ঢোকাই বারণ। ওরা বড্ড উৎপাত করে।” শুনে আমার তখুনি মন খারাপ হয়ে গেল। বারণ? ঠিক যেন বিশ্বাস হল না কথাটা। এই সিদ্ধ সমাজতন্ত্রের দেশে কিনা গরীবদের রাজধানীতে প্রবেশ নিষেধ? তবে আর লাভ কী হল? জিপ্‌সীদের বোধ হয় আইনকানুনের আওতায় কিছুতেই ঢোকানো যায় না—তাই কি সরকারি পরাজয় স্বীকার? হাঙ্গারিতে শুনেছিলুম জিপ্সীরা নিজেদের ভারত উদ্ভূত মনে করে—এ গান কি তবে স্বাগত সম্ভাষণ? স্বজাতীয়কে?

বাস চলতেই শুরু হল নগরদর্শন। প্রথমে মস্ত একটা প্রাসাদোপম দীর্ঘ একতলা বাড়ি দেখিয়ে গাইড বললেন—”এটা আগে ছিল জার-এর আস্তাবল, এ ছাড়া এর ভেতরেই ঘোড়ায় চড়া শেখার ইসকুলও ছিল।” দেখালেন রাশিয়ার বৃহত্তম আর পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম লাইব্রেরি, লেনিন লাইব্রেরী। দেখালেন মস্কো নদী আর তার তীরে ক্রেমলিন প্রাসাদের অসংখ্য ছোট বড় মাঝারি গির্জে। আর তাদের যত সোনালি রূপোলী গম্বুজ। গির্জে ছাড়াও মিনার অনেক আছে। সেই সব মিনারের চূড়োয় ঝলসাচ্ছে জ্বলন্ত লাল তারা—খাঁটি সোনার গিটি করা ফ্রেমে বাঁধান রুবির নক্ষত্র, তার ভেতরে বিজলীবাতি জ্বলে। এক একটার ওজন একদেড় টন! অত উঁচুতে থাকে বলে মনেই হয় না ওরও আবার ওজন থাকতে পারে। ইভান দি টেরিবলের বিয়ে হয়েছিল যে গির্জেয় সেটা যখন দেখাচ্ছিলেন, আমার চোখের ওপর আইজেনস্টাইনের ছবিতে দেখা সেই দেয়াল জোড়া ইভানের বিশাল ছায়ামূর্তিটা যেন ভেসে উঠল। ক্রেমলিনের ভেতরে নিয়ে যায় অন্য একটি বাস ট্রিপ, তাতে প্রাসাদের যত অস্ত্রশস্ত্র, রত্নালঙ্কার, রাজমুকুট, রাজ পরিচ্ছদ বর্মচর্ম সমস্ত দেখানো হয়। কিন্তু আমার তো সময় নেই। দুপুরটা হাতে রেখেছি মিউজিয়ামগুলোর জন্য।

রেড স্কোয়্যারে পৌঁছে সেই বহুরঙা বিশ্রী বাইজেন্টাইন ক্যাথিড্রালটি দেখেই চিনতে পারলুম,—এই জয়স্তম্ভ বানিয়ে, ইভান দ্য টেরিবল এর স্রষ্টাকে অন্ধ করে দিয়েছিলেন যাতে সে এরকম দ্বিতীয় একটি গড়তে না পারে অর্থাৎ, এই তো সেই রেড স্কোয়্যার। অনেক অনেক ছবি দেখা আছে। এ দেশের যত মিছিল, যত শোভাযাত্রা, সব এখানে হয়। লেনিনের মসৌলিয়ামের পাশে দেখি অতিদীর্ঘ, অত্যাশ্চর্য, অন্তহীন একটি লাইন চলেছে। দর্শনার্থীর। যতদূর চোখ যায়। ব্যাপার কী? শুনলুম বিশ্বনাথ কি জন্ননাথদর্শনের মতন গ্রামগঞ্জ থেকে প্রতিদিন রুশী মানুষরা দলে দলে দেখতে আসে লেনিনকে—সৌধের ভিতরে কাচের কফিনে লেনিনের শবদেহ এখনও সাজিয়ে রাখা আছে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। সাদের পুলদানিতে যেমন থাকে ফুল। কিন্তু লাইনে চার ঘণ্টা সময় লাগে কাছে পৌঁছতে বিদেশীদের জন্য নাকি আলাদা দুটো দিন ঠিক করা আছে। (অবশ্য আজকে তার একটাও নয়।) আশে পাশে আরও অনেক খ্যাতনামা লোকের সমাধি, য়ুরি গ্যাগারিন ইত্যাদি। একসঙ্গে সবই দেখা যায়। লেনিন মসৌলিয়াম আমার দেখা হল না। যদিও আমাকে বলা হল যে শাড়ি ও পাসপোর্ট ও টিকিট দেখিয়ে অনুরোধ করলে পুলিশ লাইন ডিঙোতে দেবে। আমার সাহস হল না। পরে এক ভারতীয় ছাত্র দেখি তাই করেই দেখে এল।

প্রতি ঘণ্টায় এখানে প্রহরীবদল হয়— ক্রেমলিনের বড় ঘড়িটায় যখন ঘণ্টি বাজে ঢং ঢং। (সেটার শব্দ বিগ বেনের মতন গম্ভীর, মস্কো রেডিওতে শোনা যায়।) কিন্তু আমাদের যে বাসে ফিরে যেতে হবে এগারোটা বাজতে পাঁচে। অতএব প্রহরীবদলও দেখা হবে না। আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে রেড স্কোয়্যারে বেড়াতে আর ফটো তুলতে। ওঃ একটা আইসক্রিমওলা নেই, একটা চায়ের দোকান নেই, চেস্টনাট কি চীনেবাদামওলা, কিছু নেই। পৃথিবীর আর কোনও শহরে এমনতর একটা পাবলিক ভ্রমণের জায়গায় একটাও খাবার জিনিস বিক্রি হচ্ছে না, এ যেন ভাবাই যায় না। কত লোক এসেছে, বেড়াচ্ছে, সবাই ভাবগম্ভীর। নিখাকী। আমার তেষ্টা পেয়েছিল খুব। জল টল নেই। (কোকাকোলার তো প্রশ্নই নেই!

এগারোটা বাজতে পাঁচে গুটি গুটি করে গিয়ে বাসে উঠে বসি। রেড স্কোয়্যার এই মুহূর্তে বাসের জঙ্গল। অন্তত শ’খানেক বাস এসেছে ঠিক আমাদের মতন। আমাদেরটার নম্বর খুঁজে খুঁজে দেখে, তবে বেরুল। এবার উঠতে পারি। সবাই উঠে বসেছি, বাস কিন্তু আর ছাড়েও না। কে? না—একজন কেউ আসেননি! গুনতিতে মিলছে না। তিনি কে? কে? কে? মনেই পড়ে না কেন! আন্দাজেই শেষটা ড্রাইভার তাঁকে খুঁজতে গেলেন। আর গাইড বেচারী নেমে ঠায় বাইরে রোদে দাঁড়িয়ে রইলেন, দিগ্‌ভ্রান্ত পথিকের শুকতারা হয়ে। অবশেষে হেলতে, দুলতে হারানো যাত্রী ফিরে এলেন। দু’গালে তিনটে করে ট্রাইবালমার্ক ক্ষতচিহ্ন, কাচা, সুট বুট পরা, এক মধ্যবয়স্ক আফ্রিকান ভদ্রলোক। এখানে হার্ট সার্জেনদের একটা সভা হয়ে গেল সম্প্রতি। উনি তাতেই যোগ দিতে এসেছেন বললেন আফ্রিকা থেকে।

“হারিয়ে গিয়েছিলেন বুঝি?” উদ্বিগ্ন হয়ে গাইড প্রশ্ন করে। “দূর! হারাব কেন?” সগর্বে উত্তর দেন তিনি।” আমি তো চেঞ্জিং অব দ্য গার্ডস দেখছিলুম। এগারোটা থেকে।” “সে কি?” বাসসুদ্ধ চমৎকৃত। “এগারোটা বাজতে পাঁচেই তো আমাদের ফেরার কথা ছিল বাসে। ওটা তো এগারোটায় শুরু হবার কথা!”

“তাতে কি? আমি দেখব না বুঝি? মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য? আবার কবে আসা হবে এদেশে? উনিই এগারোটা বাজতে পাঁচ করে খুব খারাপ টাইমিং করেছেন। চেঞ্জিংটা দেখানোই উচিত ছিল!”

যুক্তি যতই শুদ্ধ হোক, কর্মটি হয়েছে অসামাজিক। যাত্রীরা সবাই মুখচাওয়া চাউই করলেন। আমিও লজ্জা পেলুম। এতক্ষণ এতজনকে দাঁড় করিয়ে রাখার মধ্যে যে স্বার্থকেন্দ্রিক অসৌজন্য আছে, সেটা ভদ্রলোকের মোটে খেয়ালই হয়নি। কালো মানুষ বলেই আমার আরও লজ্জা করল। জাত ভাই।

এরপর কখনও দেখছি ইজভেস্তিয়া অফিসের বাড়ি, কখনও প্রাভদা অফিসের জানলা, কখনও জুগার্ডেনের পাঁচিল এই বুঝি পুশকিন স্কোয়্যারে দেখলুম বিরাট পুশকিন দাঁড়িয়ে আছেন বেশ কবি কবি ভঙ্গিতে—আর ওই যে দ্যাখ্ দ্যাখ্ চলে গেল, মায়াকস্কি স্কোয়্যারে দুই পকেটে হাত গুঁজে উদ্ধত হয়ে দাঁড়ান মায়াকস্কি

রাস্তাগুলোরই বা নাম কী? সব চেনা নাম। গোর্কী স্ট্রীট মস্কোর সবচেয়ে জরুরি রাস্তা, সেখানে গোর্কীর স্মৃতিস্তম্ভ আছে। যেতে যেতে ছোট-খাটো একটা বাড়ি দেখিয়ে, গাইড বললেন—”ফিয়েওডোরোভ্, রুশ দেশের প্রথম পুস্তক মুদ্রকের বাড়ি এটা। ষোড়শ শতাব্দীর লোক। এখানেই পুরনো শহরের প্রাকার। এঁর নামেও একটা স্মৃতি সৌধ আছে।”

মস্কো শহর কলকাতা নয়, বরং লন্ডনের কি বারানসীর মতো। মধ্যযুগের গোড়ার ইতিহাস থেকে একাদশ শতক থেকেই এ শহরের গল্প শুরু। খুব পুরনো শহর এটা রুশদেশের। বাইরে থেকেই দেখা হল বিশাল ‘চাইকফস্কি কনসার্ট হল’। এক ফাঁকে কখন আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন চাইকফস্কির বাড়ি, শালিয়াপিনের বাড়িও। বিশাল প্লানেটোরিয়ামের রূপোলি গম্বুজটি একবার দেখিয়েই ওপাশে একটা ছোট লাল টুকটুকে দোতলাবাড়ি দেখালেন গাইড “এই যে, প্রখ্যাত সাহিত্যিক চেখফের বাড়ি। এখন হয়েছে চেখফ জাদুঘর।” মনে মনে তক্ষুনি নোট করে ফেললুম, আসতে হবে দুপুরবেলায়।

হঠাৎ এক ঘনসবুজ পার্কের এককোণে দেখি মস্ত একটি মূর্তি। ও কে? টলস্টয় না? হ্যাঁ টলস্টয়ই তো বসে আছেন বলে মনে হচ্ছে। প্রায় সেই জুপিটারের মূর্তির মতন বিপুল দায়িত্বভারে মাথা একটু নত, দাড়িভরা মুখে চোখে দৈব আত্মবিশ্বাস, পা ছড়িয়ে সিংহাসনে বসে আছেন। তবে জুপিটার সাদা, টলস্টয় কালো। আর জুপিটারের মূর্তি মানুষ মাপের (যতদূর মনে পড়ছে), ইনি অতিকায়। মনে হচ্ছে একটাই পাথর কুঁদে তৈরি মনোলিথ।”—”এর কাছাকাছিই আছে মহান লেখক টলস্টয়ের স্মৃতি সৌধ” মহিলা বললেন, “উনিশ বছর টলস্টয় যে বাঁসগৃহে ছিলেন মস্কোতে, সেই বাড়ি এখন টলস্টয় মিউজিয়ামে পরিণত। একুশ নম্বর বাড়ি লিও টলস্টয় স্ট্রিট।’ খাতায় টুকে নিই। আরেকটাও প্রতিজ্ঞা করি দুপুরে আসব।

হঠাৎ শুনি মহিলা বলছেন এখানে…”কবরস্থ আছেন বিখ্যাত সব লেখকেরা। চেখভ গোগোল”….”কই? কই? নামবো। নামতে চাই!” “উঁহু। নামা হবে না। ও…গোরস্থান চাবি দেওয়া। সরকারি অনুমতিপত্র বিনা প্রবেশ নিষিদ্ধ।” গাইড নিষেধে মাথা নাড়েন। বাইরে থেকে উঁচু গারদের মতো পাঁচিল, আর লৌহকপাটের গেট ছাড়া কিছু দেখা যায় না।

একটু খেদোক্তি বেরিয়ে যায় ঠোঁট থেকে—কবরেও অনুমতি? পাহারা? চাবি?—”বারে? চাবি চাই না? কবর বলে কি চুরি-ডাকাতি—কিছু কম? কেন, মনে নেই চার্লি চ্যাপালিনের শবদেহ নিয়ে কী হয়েছিল? আমরা তাই সাবধান থাকি আগে থেকে।”

—তা বটে। চুপ করে যাই। মানুষ বড়ই বিচিত্র প্রাণী। পারীর কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে লন্ডনের কথা। প্রসিদ্ধ মানুষের কবরখানা সব যেখানে জনসাধারণের জন্য খোলা।

বাস থামে এসে নানারিতে। পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত, বড়ঘরের মেয়ে, বা যদি কোনও কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়তেন, তাঁদের ঠাঁই হত শেষ পর্যন্ত এইখানে, এই মধ্যযুগীয় সন্ন্যাসিনীদের মঠে। এখানে গাইড নামতে দিলেন যাত্রীদের। যাও বাছারা, ছবি তোলো গিয়ে। যাক্! এখানে একজন আইসক্রিমওলা দাঁড়িয়ে আছে। সবাই আইসক্রিম খেতে খেতে সিটে ফেরে। আজ জুলাই একত্রিশে। এবার বড্ড গরম। এই মস্কো নগরও গরমে খৈ-ফোটা, কাঠ ফাটা। অথচ শীতকালে এরই মূর্তি হয় প্রায় উত্তর মেরুর মতন!

মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় আর লেনিন হিলস দেখতে যাবার পথেই পড়ল অলিম্পিক স্টেডিয়ামগুচ্ছ। তারপর অনেকগুলি মঞ্চ, মাঠ, সুইমিং পুল স্কোরবোর্ড ‘স্টেডিয়াম কি একটা?” সগৌরবে দেখালেন গাইড, দেখেই আমার মনে হয় আমাদের দিল্লিতেও তৈরি হচ্ছে এখন এশিয়াডের স্টেডিয়াম গুচ্ছ। পরে বিদেশী টুরিস্টদের ঠিক এমনি করেই সগৌরবে দেখানো হবে। অলিম্পিক স্টেডিয়ামের পরের দৃশ্য মস্কো বিশ্বাবিদ্যালয়। এই মুহূর্তে এখানে যাদবপুর থেকে আমার বিভাগের তিনজন ছাত্রী পড়তে এসেছে, পাঁচ বছরের জন্যে। সময় নেই যে তাদের একটু খোঁজ নিয়ে যাব। কত ভাল লাগত, সেই মেয়েদের সঙ্গে যদি পাঁচ মিনিটও দেখা হত? নেহাৎ ছেলেমানুষ সব। স্কলারশিপ পেয়ে বি.এ. সেকেন্ড ইয়ারেই চ এসেছে, বয়েস কারো কুড়ি একুশের বেশি হবে না। কিন্তু সময় আর হল না। বাস থামল মাত্র দশ মিনিট। অনেক দূরে। এবং ফেরত চলল সবেগে। ইউনিভার্সিটির বাড়ির পাঁচিলের ভেতরে ঢোকাই হল না। তার বাগ-বাগিচায় ঘুরে বেড়ানোই সার—হায় রে!

নাঃ। এ দেখায় সুখ নেই। এ জানায় সার নেই। এ প্রেমের মর্ম নেই। আমি বহুদিন হল কোথাও এমন ট্যুরিস্ট হয়ে যাই না।

যদিও পায়ে চাকা বাঁধা আছে, এই একটি বিষয়ে লক্ষ্মীর সঙ্গে মিল। ঘুরে বেড়াই, কিন্তু কিছু না কিছু কাজে। বেড়ানোর জন্যই বেড়ানোর অভিজ্ঞতা অনেককাল হয়নি। বছর ছয়েক আগে একবার ভিয়েনার এক দুপুরে এমনি একা একা বাস-ট্রিপ নিয়েছিলুম, প্রাসাদশহর ভিয়েনার প্রাসাদগুলি ঘুরে দেখব বলে। আর সন্ধ্যায় গিয়েছিলুম অপেরায়। একা। তারপর এই সন্ধেবেলা বলশয় থিয়েটারে নাও যদি টিকিট পাই অন্য যে কোনও একটা থিয়েটার (ভাষা না বুঝলেও) দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। মস্কোতে থিয়েটার ধনীজন বিনোদনের মাধ্যম নয়। টিকিট সস্তা। সবার ক্ষমতার মধ্যে। আর সিনেমার টিকিট তো একটা আইসক্রিমের কোনের সমান। এক রুবল থেকে মাত্র সাড়ে তিন রুবল পর্যন্ত থিয়েটারের টিকিট। আর সিনেমার টিকিট? দিনের বেলায় গেলে পঁচিশটি কোপেক, রাত্রে যেতে হলে ত্রিশ থেকে, সত্তর কোপেক পর্যন্ত। এমন সাংস্কৃতিক সুযোগ ফ্রান্সে নেই। ইংলন্ডে নেই। আমেরিকায় নেই। ইংলন্ডে থিয়েটারের টিকিট তিন চার থেকে পনেরো ষোলো পাউন্ডেও উঠতে পারে, সিনেমার টিকিটও পিকাডিলি অঞ্চলে হলে ৩৪ পাউন্ডের কমে নেই। নিউ ইয়র্কে ব্রডওয়েতে এই সেদিন লিভ্ উলম্যানের অভিনীত নতুন নাটক ইবসেনের “গোস্টস্”-এর টিকিট কাটতে চেয়ে শুনলুম কুড়ি ডলারের তলায় কোনও সীটই বাকি নেই! তাও বুক করতে হবে অগ্রিম। এখন তো সত্তর পঁচাত্তর কোনো ব্যাপার নয় ব্রডওয়েতে। “গোস্টস্” আর দেখা হল না। তেমনি লন্ডনে এলিজাবেথ টেলারের লিটল ফক্সেস” থিয়েটার চলছে অনেকদিন ধরেই। দেখতে হলে আট পাউন্ডের কমে সীট নেই। অথচ মাত্র চার বছর আগেও তিন পাউন্ডের টিকিটে ইনগ্রিড বার্গম্যানের নাটক দেখেছি। আরও কিছু আগে দেড় পাউন্ডে অনায়াসেই মঞ্চে দেখেছি লরেন্স অলিভিয়ের, জন গিলগুড়, অ্যালেক গিনেস, রেক্স হ্যারিসন মাইকেল রেডগ্রেভদের। ইংলন্ডে এখন থিয়েটার খুব খরচসাপেক্ষ বিলাস।

কিন্তু হবে না। কেননা সময় নেই থিয়েটার দেখবার। তার চেয়ে যতগুলো পারি মিউজিয়াম দেখে যাই। না, ছবি দেখা নয়। তার জন্যে বহু সুযোগ পেয়েছি জীবনে। ইউরোপ আমেরিকার প্রসিদ্ধতম যাদুঘরে দিনের পর দিন হেঁটে হেঁটে পা ব্যথা করে ফেলে পশ্চিমের শিল্পকলার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি এখানে দেখাব অন্য তীর্থস্থান দেখব টলস্টয়ের বাড়ি গোর্কির খাতা চেখফের ঘর, আর ডস্টয়েস্কি…আরে, সত্যিই তো? এত লেখকের নাম শুনছি, কৈ এত প্রিয় ডস্টয়েস্কির নাম তো একবারও কানে এল না? এখানে ডস্টয়েভস্কির ‘নামে তো কোনও রাস্তা বা স্কোয়্যারও চোখে পড়ল না? কিংবা টুর্গেনিভের নামে? কেবলই দেখি গোর্কি পুশকিন আর টলস্টয়। বড়জোর। চেখখ। এমনকী মায়াকোফস্কিও আছেন।

“—ডস্টয়েস্কির মিউজিয়ামটা কোথায় বলুন তো?” চমকে উঠলেন গাইড।

“—ডস্টয়েস্কি? কী জানি। আমি জানি না”।

“-–কেন আপনাদের কাছে কোনও ছাপা গাইড বই নেই? দেখে বলুন না?” মহিলা ছোট্ট একটা পকেট ডায়েরির মতো বই বের করলেন হ্যান্ডব্যাগ খুলে। উল্টে পালটে নেড়ে চেড়ে মাথা দুলিয়ে দুঃখপ্রকাশ করলেন।—”নেই। কিন্তু লেখা দেখছি না তো? এ শহরে বোধ হয় কিছুই নেই।” বোধ হয় কেন, বোধ হবে কেন? নিশ্চিত কেন নও? এই তো তোমার শহর, এই তো তোমার কাজ। ডস্টয়েস্কির নামকরণই বারণ ছিল বহু দিন। এখন তো শুনছি নাকি নিষেধ উঠে গেছে! এবার তো গাইডবইতে ঠাঁই পাওয়া উচিত ডস্টয়েস্কি ঠাকুরের। “—আপনি ডস্টয়েস্কির লেখা পড়েছেন? গাইড বিব্রতমুখে হেসে বললেন—”সবাই পড়েছে।” তারপরই ব্যাপ্ত গলায় ঘোষণা করলেন “আমাদের যাত্রার এখানেই সমাপ্তি” বেলা গড়িয়ে দুপুর হতে চলেছে। কালমার্কসের মূর্তির সামনে এনে ছেড়ে দিল আমাদের, সেখানে লেখা আছে—”ওয়ার্কার্স অফ দ্য ওয়ার্লড ইউনাইট!” বাসট্রিপ খতম। আমরা এখন জনগণ। আমরা এবার মুক্ত। এককাপ কফি আর একখানা স্যান্ডউইচের খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আমার। ও ব্যাপারটা সেরেই ছুটতে হবে পরের পর চার জায়গায়। হোটেল পাড়াতেই আছে লেনিন মিউজিয়াম, এক। তারপর টলস্টয় মিউজিয়াম, দুই, ওটা ৫টায় বন্ধ হয়। তারপর তিন, গোকী মিউজিয়াম, ওটা ৬টায় বন্ধ, তারপর চার, চেখফ্ মিউজিয়াম ওটা আজ ৯টা অবধি খোলা। আমাকে প্লেনে তুলতে সরকারী গাড়ি আসবে রাত সাড়ে দশটায়। অনেক সময় আছে। মুশকিল ভাষা জানি না বলে! কিন্তু ভাবনা কি? বসুধৈব যাদের কটুম্বকম্ সেই সুভাষদা গীতাদির বন্ধু রাজা আর শায়লা আছেন মস্কোতে হোটেল ইউক্রাইনের উল্টোদিকে তাঁদের বাসা। তাঁরাই কাল রাতে দারুণ ডিনার খাইয়েছেন আমাকে। শায়লা বলেছে তিনটের সময়ে অফিস ফেরত এসে আমাকে নিয়ে জাদুঘরে যাবে। ততক্ষণ পাড়ারটাই : (লেনিনটা) তো দেখে রাখি। আর ঘুরে ফিরে দেখে রাখি বলশয় থিয়েটারের মতো বাড়িটা। লেনিন মিউজিয়ামে সবকিছু বর্ণনা রুশ ভাষায়। মাঝে মাঝে ছোট একটু ইংরিজিতে ক্ষুদ্র বিজ্ঞপ্তি সাঁটা আছে। তা থেকেই যা বুঝতে পার বুঝে নাও। লেনিনের বইয়ের অনুবাদের মধ্যে হিন্দি, বাংলা বই দেখে আহ্লাদ হল যৎকিঞ্চিৎ। কেবল নিচের তলাটিই ঘুরে ঘুরে দেখে কফি সান্ডুইচের খোঁজে ইনট্যুরিস্টের হোটেলে যাই। পথে না পড়ল কোনও ছোট রেস্তরাঁ, না একটা কাফে বা কাফেটেরিয়া জাতীয় দোকানপাট। কিছুই নেই। ইনট্যুরিস্টের বিশ তলায় একটা ছোট ক্যাফেটেরিয়া আছে। সেখানেই কফি খেতে গিয়ে লিডস্‌ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক জন হ্যারিস (বা হ্যারিসন, ঠিক করতে পারিনি নামটা) এর সঙ্গে আলাপ হল। চমৎকার মানুষ। এক সঙ্গে লাঞ্চটা বেশ কাটল। ইংরিজিতে গল্প করে মনে হল, আহা, যেন মাতৃভাষায় আরাম পাচ্ছি। অথচ এমনিতে তো তা মনে হয় না। রুশভাষার পরিপ্রেক্ষিতেই ইংরিজিকে এত “সাতজন্মের প্রিয়া” জাতীয় লাগছে। শায়লা এসে পড়ল দেখতে দেখতে ট্যাক্সি নিয়ে। এবারে যাত্রা খোদ টলস্টয়ের বাড়িতে। “চলো লেভ তলস্তোয়া রাস্তা, একুশ নম্বর।”

পথে যেতে যেতে শ্রীডাঙ্গের ছোট মেয়ে, রুশ সাহিত্যে পারদর্শিনী শায়লা আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল—”হতে পারে ঝাঁকিদর্শন। তবু কিছুই যে দেখা হয়নি, যাত্রা একেবারে মূল্যহীন, এমন তো নয়? এই তো এক ঝাঁক বিদেশী তোমার মতোই দেখলেন। একেবারে না দেখার চেয়ে তো এই দেখাটা ঢের ভাল?” হঠাৎ খেয়াল হল। তাইতো, আমি কোথায়? কী করছি? আমি মস্কোর রাস্তা দিয়ে, সশরীরে ছুটে যাচ্ছি, টলস্টয়ের বাড়ির দিকে, এক্ষুনি গিয়ে নামবো, কোথায়? না টলস্টয়ের ঠিকানায়! ভাবতেই সারা গায়ে কাঁটা দিল। আর তক্ষুনি বুঝলুম, হ্যাঁ—আসা সার্থক!

টলস্টয়ের বাড়ি বেড়ানোর গল্প আর একদিন লিখতে হবে। পুরো একদিন ধরে। আর গোর্কী মিউজিয়ামও তাই। যেন দুজনের সঙ্গে চেনা হল ভাগ্যিস। গেলুম মস্কৌ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *