হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ

হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ

[বিশ্বভারতীতে প্রদত্ত নিজাম-বক্তৃতা, ১৯৩৫]

ভূমিকা

এদেশে হিন্দুমুসলমান-বিরোধের বিভীষিকায় মন যখন হতাশ্বাস হয়ে পড়ে, এই বর্বরতার অন্ত কোথায় ভেবে পায় না, তখন মাঝে মাঝে দূরে দূরে সহসা দেখতে পাই দুই বিপরীত কূলকে দুই বাহু দিয়ে আপন করে আছে এমন এক-একটি সেতু। আব্দুল ওদুদ সাহেবের চিত্তবৃত্তির ঔদার্য সেই মিলনের একটি প্রশস্ত পথ রূপে যখন আমার কাছে প্রতিভাত হয়েছে, তখনি আশান্বিত মনে আমি তাকে নমস্কার করেছি। সেই সঙ্গে দেখেছি তার মননশীলতা, তার পক্ষপাতহীন সূক্ষ্ম বিচারশক্তি, বাংলাভাষায় তার প্রকাশশক্তির বিশিষ্টতা। তাই একদিন সমাদরপূর্বক তাঁকে শান্তিনিকেতন আশ্রমে আহ্বান করেছি, অনুরোধ করেছি বিশ্বভারতীর বিদ্যাভবনে বক্তৃতা করবার জন্যে। আমার সাগ্রহ প্রত্যাশা ক্ষুণ্ণ হয়নি এই আনন্দটুকু জানাবার অভিপ্রায়ে আমার এই কয়টি ছত্র লেখা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শান্তিনিকেতন,
২১ মাঘ, ১৩৪২

নিবেদন

বিশ্বভারতীতে “নিজাম বক্তৃতা”র বিষয় ‘মুসলিম সংস্কৃতি’। “হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ”

“নিজাম বক্তৃতার বিষয়রূপে গণ্য করে বিশ্বভারতীর কর্তৃপক্ষ শুধু যে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন তা নয়, তাদের সুপরিচিত সজাগ মনের পরিচয়ও দিয়েছেন। বিশেষ বিশেষ দেশের বা জাতির সংস্কৃতি বা চিত্তাকর্ষ মানুষের শিক্ষিত মনের জন্য একশ্রেণীর কৌতূহলরস-রূপে আহরণ করা অনেক পণ্ডিত ও ভাবুক ব্যক্তির সাধনা। তাঁদের সে সাধনা সুচিরস্থায়ী হোক। কিন্তু জাতীয় বা দেশগত সংস্কৃতি প্রকৃতপ্রস্তাবে মানুষের প্রতিদিনের জীবনের ভালোেমন্দের সঙ্গে জড়িত, তার অবসর-বিনোদনের বিষয়মাত্র নয়। হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ বলতে আমাদের দেশের যে বিপর্যস্ত মানসিকতা বোঝায়, দেশের সর্বব্যাপী সৃষ্টির ক্ষেত্রে তার সাংঘাতিকতার গুরুত্ব সম্বন্ধে চেতনা বিশ্বভারতীর মতো জাগ্রত জ্ঞানকেন্দ্রের পক্ষে সম্পূর্ণ শশাভণ হয়েছে সন্দেহ নেই। আর যার নামের সংস্রব বহন করে এই সব বক্তৃতা গৌরবান্বিত তাঁরও শুভাকাঙ্ক্ষার মর্যাদা এতে সার্থক বৈ ক্ষুণ্ণ হয় নি, কেননা, যে-চিত্তোৎকর্ষের রসায়নে তাঁর মানসলোক সঞ্জীবিত-তার নানা ফর্মানে যার প্রকাশ-তা, ভারতের মোগল-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ বৈভব-বিলাস নয়, দেশের বুকে এক নব সৃষ্টির প্রয়াসের প্রেরণা তার মর্মমূলে।

এই গুরু বিষয়ের আলোচনায় আমি অগ্রসর হয়েছি জ্ঞানের স্পর্ধায় নয়, দুঃখের তাড়নায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আনন্দিত আশীর্বাদে আমার সেই সামান্য প্রয়াস মহিমান্বিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবিকই আমি ভাগ্যবান্ হব যদি আমার দেশবাসীর কাছে এই একটিমাত্র কথা পৌঁছে দিতে পেরে থাকি যে, হিন্দুমুসলমান বিরোধ সম্বন্ধে তাঁদের ঔদাসীন্য জ্ঞানীর বা শক্তিমানের ঔদাসীন্য নয়, সে-সম্বন্ধে তাদের সুপরিচিত সিদ্ধান্তও স্বস্তিপ্রিয়তার অন্য নাম।

গ্রন্থকার
ঢাকা,
ফেব্রুয়ারী, ১৯৩৬

মুসলমানের পরিচয়

স্যার সুরেন্দ্রনাথ তাঁর A Nation in Making গ্রন্থে বলতে চেয়েছেন, হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের সূচনা স্বদেশী আন্দোলন থেকে, তার পূর্বে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক মধুর ছিল। এ-ধারণা শুধু স্যার সুরেন্দ্রনাথের নয়, আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত ব্যক্তির। এর বিশেষ অর্থের আলোচনা আমার তৃতীয় বক্তৃতায় করবো। আপাতত বলা যায়, কোনো কোনো অর্থে একথা সত্য, যেমন রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-”বিচ্ছিন্ন জিনিষ জড়ের মত পড়িয়া থাকিলে তবু টিকিয়া থাকে, কিন্তু কোনো উপায়ে কোনো বায়ুবেগে তাহাকে চালনা করিতে গেলেই সে ছড়াইয়া পড়ে, সে ভাঙিয়া যায়, তার এক অংশ অপর অংশকে আঘাত করিতে থাকে; তাহার অভ্যন্তরের সমস্ত দুর্বলতা নানা মূর্তিতে জাগিয়া উঠিয়া তাহাকে বিনাশ করিতে উদ্যত হয়।” [দ্র: ‘পথ ও পাথেয়] স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে যে রাজনৈতিক স্বার্থ-বোধ দেশে জাগলো, তার ফলে দেশের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিরোধ উত্তরোত্তর প্রবল হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের পূর্বে এ দেশে হিন্দু ও মুসলমানের সম্বন্ধ মধুর ছিল, ঐতিহাসিক সাক্ষ্য তার বিরুদ্ধে। এমন কি, দেশের এই দুই সম্প্রদায়ের সম্বন্ধ শুধু অপরিচয়ের সম্বন্ধ ছিল এও বলা যায় না। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ফরিদপুরে ও যশোহরে মুসলমান চাষী ও নমঃশূদ্রদের ভিতরে দীর্ঘকালব্যাপী একাধিক দাঙ্গা হয়েছিল, তাতে সেই অঞ্চলের হিন্দু-মুসলমানদের অনেকে দুই পক্ষে যোগ দিয়েছিল। [ফিরোজাবাদের দাঙ্গার তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীতেও এই ধরণের দাঙ্গা সেখানে হয়েছিল।] মোগল-শাসনের শেষভাগে গুজরাটে ও কাশ্মীরে যে দুটি ভীষণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল, বিখ্যাত ইতিহাস ‘সিয়ারুল মোতা আখেরীন’-এ তার উল্লেখ আছে এই ভাবে:

সম্রাট ফেরোখশিয়ারের সিংহাসনারোহণের বৎসরে আহমদাবাদে এক হিন্দু গৃহস্থ হোলির সময়ে তার বাড়ির উঠানে হোলি জ্বালালে। তখন হোলির সময়ে বিষম মাতামাতি হতো। আঙিনা-সংলগ্ন ও আঙিনার অতি অল্প অংশের অধিকারী মসলমান গৃহস্থেরা তাতে আপত্তি করলে। হিন্দু গৃহস্থ সে আপত্তি শুনলে না, বললে, প্রত্যেকের তার নিজের বাড়িতে সর্বময় কর্তৃত্ব আছে। পরের দিন পড়লো হজরত মোহাম্মদের মৃত্যুবার্ষিকী। সেই উপলক্ষে মুসলমান গৃহস্থেরা একটি গরু কিনে এনে সেই আঙিনায় জবাই করলে। এতে সেই অঞ্চলের সমস্ত হিন্দু উৎক্ষিপ্ত হয়ে মুসলমানদের আক্রমণ করলে, মুসলমানেরা পালিয়ে যে যার বাড়িতে আশ্রয় নিলে। তখন সেই উৎক্ষিপ্ত হিন্দ জনতা গোহত্যাকারী কশাইয়ের সন্ধান করলে; তাকে না পেয়ে তার চোদ্দ বৎসর বয়সের ছেলেকে এনে প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ সেই গো-হত্যার স্থানে বলি দিলে। তখন শহরের সমস্ত বিক্ষুব্ধ মুসলমান ও আফগান-সৈন্য কাজীর বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলো। কাজী জানতেন শাসনকর্তা দায়ূদ খাপণী এ ব্যাপারে হিন্দুদের পক্ষ নিয়েছেন, তিনি এদের মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারা উত্তেজিত হয়ে কাজীর বাড়ির সদর দরজা ভাঙলে-হয়ত কাজীরই গোপন ইঙ্গিতে-ও তারপরে আরম্ভ করলে শহরের হিন্দ দোকানে আগুন দিতে। অচিরেই কাপূর চাঁদ নামক একজন রত্ন-বণিক লোকজন ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাদের বাধা দিলে। কয়েকদিন এই ভাবে গণ্ডগোল চললো। শেষে শাসনকর্তা মুসলমানদেরই বেশি দোষী সাব্যস্ত করলেন।

কাশ্মীরের দাঙ্গাটি এর কিছুকাল পরে ঘটে। সেখানকার আবদুল নবী ওরফে মাহতাবী খা হিন্দু-বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। এই অরাজকতার কালে একদল ভবঘুরে। উজ্জ্বল মুসলমান জুটিয়ে তাদের নেতা হয়ে সে স্থানীয়-শাসনকর্তা ও কাজীর কাছে এই প্রস্তাব করলে যে, এর পরে হিন্দুদের আর কোনো সম্ভমসূচক যানবাহন বা বস্ত্রাদি ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না; বাগান ও স্নানের ঘাটও তাদের জন্য নিষিদ্ধ হবে। সহকারী-শাসনকর্তা ও কাজী বললেন-মহামান্য বাদশাহের যা হুকুম তাই-ই কাশ্মীরে চলবে। বলা বাহুল্য এতে মাহতাবী খাঁ সন্তুষ্ট হলো না। এর পর তার কাজ হলো সুবিধা পেলেই হিন্দুদের আক্রমণ করা ও তাদের উপরে অত্যাচার করা। একদিন সাহাব রায় নামক জনৈক সম্ভ্রান্ত হিন্দু এক বাগানে উৎসব করছিলেন। সেই নিরপরাধ লোকদের উপরে সে তার দলবল নিয়ে হামলা করল এবং যত পারলে খুন জখম করল। সাহাব রায় পালিয়ে সহকারী-শাসনকর্তার বাড়ীতে আশ্রয় নিলেন। তার বাড়ী এই মাহতবী খার দল ইচ্ছামত লুটতরাজ করল। সেই অঞ্চলের কোনো হিন্দুবাড়ি বাদ গেল না। এই সব বাড়িতে আগুন দেওয়াও চল্‌লো। যে সমস্ত মুসলমান এই হতভাগ্যদের জন্য দুকথা বলতে এলেন তারাও খুন জখম হলেন। এই মাহতাবী খাঁর দলের সঙ্গে কাশ্মীরের রাজপুরুষেরা এঁটে উঠতে পারলেন না, তারা পালিয়ে গেলেন। তাঁদের আশ্রিত হিন্দুদের উপরে তখন হলো অকথ্য অত্যাচার। জয়ী হয়ে মাহতাবী খ স্থানীয় জুমা মসজিদে নিজেকে “দীনদার খা” (ধর্মরক্ষক) বলে ঘোষণা করল ও শাসন-কাজ চালাতে লাগলো। রাজপুরুষদের একজনের চক্রান্তে মাহতাবী ও তার দুই শিশুপুত্র নিহত হলে তার দল উৎকট হত্যাকাণ্ড চালাল। প্রায় তিন হাজার লোক তাদের হাতে মারা পড়লো-তার অধিকাংশই মোগল। কয়েক মাস ধরে এই দাঙ্গা চলে।

শেষের এই ঘটনাটি “সিয়ারুল মোতা’ আখেরীন”-এর লেখক বলেছেন একদল শয়তানের কাজ। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ যারা বুঝতে চান, তাঁদের জন্য সেকালের এই দুটি ঘটনাই খুব অর্থপূর্ণ। একালের কলকাতা, ঢাকা, কানপুর, চাটগা প্রভৃতি স্থানের হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার সঙ্গে এসবের আশ্চর্য মিল রয়েছে।

হিন্দু ও মুসলমানের বিরোধের মূল কারণ সম্বন্ধে মহাত্মা গান্ধী বলেছেন-The Muhammadan is a bully and the Hindu is a coward (মুসলমান গুণ্ডা আর হিন্দু কাপুরুষ)। এই কথাই কেউ কেউ তত্ত্বের ভাষায় বলেছেন-মুসলমান রাজসিক, হিন্দু সাত্ত্বিক, তবে দুই-ই কিছু কিছু বিকৃত। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে প্রকৃতির ভেদ আছে; তাও সাত্ত্বিক রাজসিক তামসিক এমন স্পষ্ট ভেদ আছে কি না সন্দেহ। সেক্ষেত্রে দুটি বিরাট ধর্ম-সম্প্রদায়কে মানস প্রকৃতির দিক থেকে স্পষ্ট দুইভাগে ভাগ করবার চেষ্টায় বিপত্তি ঢের। বাস্তবিক, কি সেকালের দাঙ্গা কি একালের দাঙ্গা, কোনোখানেই হিন্দুর শুধু কাপুরুষতার ও মুসলমানের শুধু জঙ্গবাহাদুরীর পরিচয়ই যে আছে তা নয়। কোনো কোনো শ্রেণীর হিন্দু মুসলমানের ভিতরে কিছু পার্থক্য থাকলেও এই দুই বিরাট সমাজের ভিতরে আশ্চর্য কোনো পার্থক্য যে নেই তার প্রমাণ স্বরূপ এই ক’টি কথার উল্লেখ করা যেতে পারে:

প্রথমত, গুণ্ডার ভাব দুপক্ষের প্রকৃতিতেই আছে, কেননা, নৃশংসতার পরিচয় কোনো পক্ষে কম নেই, দাঙ্গায় অগ্রণী হবার অপরাধ থেকেও কোনো পক্ষ মুক্ত নয়; ভীরুতাও দুই পক্ষেই আছে, ঢাকার দাঙ্গায় দেখেছি হিন্দুরা মুসলমানের ভয়ে পালিয়েছে, মুসলমান-বস্তি সারারাত জেগে কাটিয়েছে এই ভয়ে যে কখন হিন্দুরা এসে ঘর জ্বালিয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত, যারা বলেন, ভারত বিশেষভাবে অহিংসার ও পরধর্মপ্রীতির দেশ, তাদের দৃষ্টি এই ঐতিহাসিক ব্যাপারের দিকে আকৃষ্ট হওয়া উচিত-(ক) হিন্দু ও বৌদ্ধের বিরোধিতায় বৌদ্ধ নিশ্চিহ্ন হয়েছে, বৌদ্ধদের উপরে যে অত্যাচার হয়েছিল কোনো কোনো খ্যাতনামা ঐতিহাসিকের এই মত,* বৌদ্ধদের যে একটি বিরাট সংস্কৃতি ছিল একাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে মনীষী আলবেরুনী তার ব্রাহ্মণ আচার্যদের কাছ থেকে সে-সম্বন্ধে কোনো নির্দেশ পাননি। (খ) যদি চাণক্যের অর্থশাস্ত্র ও বৌদ্ধজাতক ভারতীয় জীবনের সঙ্গে সম্পর্কশূন্য মনে করা না হয় তবে বলা যায়, স্বজন-শোণিত-রঞ্জিত সিংহাসন শুধু পাঠান ও মোগল ভারতের বিশেষত্ব নয়, হয়ত ভারতের বিশেষত্ব। তৃতীয়ত, মুসলমানের ইতিহাস হিন্দুর মতন দীর্ঘ না হলেও কম দীর্ঘ নয়, ঘটনাবহুল তো বটেই। দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদ ও নাস্তিক্য, একত্ববাদ ও বহুত্ববাদ, একান্ত দৈবানুগত্য ও একান্ত পুরুষকারবাদ, একান্ত শাস্ত্ৰনুগত্য ও একান্ত মুক্তবুদ্ধিপ্রবণতা, প্রেম ও অহিংসা এবং সংকীর্ণ দৃষ্টি ও পরধর্ম-বিদ্বেষ-এর কিছুই হিন্দু ও মুসলমান কারো ইতিহাসে দুর্লভ নয়। আর সব চেয়ে বড় কথা এই-এই দুই সম্প্রদায়ই জীবন্ত, কারো অভিব্যক্তি থেমে যায়নি।

[* ভারতীয় বিশেষজ্ঞ শ্যাম শাস্ত্রীয় মতে ব্রাহ্মণেরা বৌদ্ধদের কৌশলে পর্যদস্ত করেছিল বলে নয়। ‘Evolution of Indian Polity” দ্রষ্টব্য।]

হিন্দু ও মুসলমানের বিরোধের কারণ কি সোজাসুজি ভাবে এই দুরূহ প্রশ্নের সম্মুখীন না হওয়াই ভাল। তার পরিবর্তে মুখ্যত তাদের বর্তমান চিন্তা-ভাবনার আশা আকাক্ষার সঙ্গে পরিচিত হতে পারলে এ-বিরোধ মীমাংসার, অন্তত এ বিরোধে অভিভূত না হবার, কিছু শক্তি আমাদের লাভ হবার সম্ভাবনা আছে। মুসলমান কম পরিচিত, সেজন্য তার পরিচয় আগে নেবার দরকার। কিন্তু তার একালের পরিচয়। লাভের জন্যও অল্প-বিস্তর পূর্বাভাসের প্রয়োজন।

ইয়োরোপীয় পণ্ডিতেরা হজরত মোহাম্মাদের প্রচার-জীবন সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করে দেখেন-মক্কার জীবন ও মদিনার জীবন। তারা বলেন মক্কার জীবনে তিনি ছিলেন ধর্মপ্রচারক-অন্যান্য ধর্মপ্রচারকের মতো সত্যদ্রষ্টা মানব-প্রেমিক নীতির প্রবর্তক এ-সব বিশেষণ তখন তার জন্য শোভন; কিন্তু মদিনার জীবনে তিনি বিজয়ী বীর ও রাষ্ট্রের অধিনায়ক। অপরপক্ষে মুসলমান চিন্তাশীলেরা তার মদিনার জীবনকেই বেশি মর্যাদা দেন, কেননা মুসলমান-মণ্ডলী তাঁদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন নির্দেশ তার মদিনার জীবন থেকেই লাভ করে আসছেন। এই দুই চিন্তাধারার মধ্যে রয়েছে দুই রকমের ভুল। অমুসলমান দলের ভুল-তারা ধর্ম বলতে প্রধানত প্রাচীন আচার্যদের জীবনাদর্শ ও মতামতই বোঝেন; কোনো নূতন আদর্শ ও মত হজরত মোহাম্মদের জীবনে ও সাধনায় রূপ লাভ করেছে কিনা, সে-কথাটি বুঝে দেখবার মতো ধৈর্যের ও বিনয়ের তাঁদের অভাব। আর মুসলমান দলের ভুল-যাকে তারা ধর্মগুরু জ্ঞান করেছেন, তার সব কাজই তারা মনে করেন বিচারের অতীত।

যাই-ই হোক, হজরত মোহাম্মদের মদিনার জীবনের প্রভাবেই মুসলমান-জগৎ গড়ে উঠেছে। সেই জীবনের ভূমিকা হচ্ছে মুসলমানমণ্ডলীর প্রতি পৌত্তলিক ও ইহুদি আরবদের নির্মম শত্রুতা যার জন্য নায়কের একান্ত অনুবর্তিতা, একচিত্ততা, বিপক্ষের প্রতি সন্দেহশীলতা, প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের জন্য অবশ্য কাম্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু যারা বলেন, মদিনার মোহাম্মদ মুখ্যত রাষ্ট্রনেতা, তারা এই বড় ব্যাপারটা লক্ষ্য করতে ভুলে যান যে, তাঁর জীবনের এই কালে তাঁর প্রেরণালব্ধ কোআনে যেসব নির্দেশ প্রকাশ পেয়েছে, আর মুসলমান-সমাজে সেসবের যে-রূপ লাভ হয়েছে, তা তাঁর শিক্ষার চিরন্তন রূপ না বলে সাময়িক রূপও বলা যেতে পারে। একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। মদিনায় অবতীর্ণ একটি “সুরা”র শেষে বলা হয়েছে-”হে বিশ্বাসিগণ, আল্লাহ্র রোষে যারা পতিত হয়েছে সেই দলের লোকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করো না (৬০ : ১৩)। টীকাকার বলেছেন, এখানে ইহুদিদের কথা বলা হয়েছে। সমসাময়িক মুসলমানেরা হয়ত এই কথাই ভাল করে বুঝেছিলেন এবং তাঁদের অনুবর্তিতায় পরবর্তী মুসলমানেরা হয়ত বুঝে নিয়েছেন-যারা মুসলমান-সম্প্রদায়ভুক্ত নয় তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব কোরআনের অনভিপ্রেত। কিন্তু এই ব্যাখ্যায় এই বাক্যের সত্যিকার মর্যাদা যে ক্ষুণ্ণ হয়েছে, সে কথা বলাই বাহুল্য। একথা স্বীকার করা যেতে পারে যে, সেই দিনে মুসলমান বিশেষভাবে ধর্মপ্রাণ ছিলেন, আর তাদের ধ্বংসকামী গর্বিত ইহুদি ধর্মপ্রাণ ছিলেন না। কিন্তু ধর্মপ্রাণতা কোনো সম্প্রদায়ে সীমাবদ্ধ নয়, তাই কালে কালে এমন অবস্থার উদয় সম্ভবপর, যখন মুসলমান-সমাজের ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের বন্ধু সেই সমাজে দুর্লভ হতে পারে ও সেই সমাজের বাইরে সুলভ হতে পারে-এ-সম্ভাবনার কথা মুসলমান অমুসলমান উভয়পক্ষই যে কোরআনের এই ধরণের বাণীর ব্যাখ্যাকালে বিস্মৃত হয়েছেন একে শোচনীয় না বলে উপায় নেই। তবে মুসলমানের ঐতিহাসিক অভিব্যক্তির ধারায় এই স্কুল ব্যাখ্যাই একমাত্র সত্য নয়, যদিও প্রবল সত্য; মুসলমান দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকেরা ও ভক্তরা অনেকখানি স্বতন্ত্রভাবে কোআন ও হজরত মোহাম্মদের জীবন বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন। এর একটি দৃষ্টান্ত বড় অদ্ভুত। যে যুগে সুলতান মাহমুদ ভারতের মন্দির ধ্বংস করে ধনরত্ন আত্মসাৎ করছিলেন, সেই যুগে ইসলামে-পরম-শ্রদ্ধান্বিত না নেী অশেষ যত্নে ও শ্রদ্ধায় হিন্দুর জ্ঞান-বিজ্ঞানের সন্ধান করছিলেন, তার উৎকর্ষাবকর্ষের বিচার করে জ্ঞানীদের দরবারে উপহার দিচ্ছিলেন।

ইসলামের পরিস্ফুর্তির মূলে এই যে বিশেষ রাজনৈতিক প্রভাব, একই সঙ্গে এটি ইসলামের শক্তির ও দুর্বলতার কারণ হয়েছে। শক্তির কারণ এই জন্য যে, ধর্মাদর্শের সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপলাভ তার সার্থকতার জন্য একান্ত বাঞ্ছিত, নইলে তা রয়ে যায় শুধু সম্ভাব্যতার দেশের ব্যাপার। এর দৃষ্টান্ত-ইসলামে সাম্য-নীতি। অন্যান্য ধর্মাচার্যও সাম্য-নীতি প্রচার করেছিলেন, কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপের অভাবে তা রয়ে গেছে শুধু শুভ ইচ্ছা। আর দুর্বলতার কারণ এই জন্য যে, ধর্মাদর্শের কোনো বিশেষ রূপই তার চরম রূপ নয়; আদর্শের বিকাশ আছে তার রূপেরও বিকাশ আছে; কিন্তু ধর্মাদর্শ সাধারণত কঠিন-দেহ, কোনো ধর্মাদর্শ যদি একবার কোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপ লাভ করে, তবে তারও রূপান্তর সহজসাধ্য হয় না। এর দৃষ্টান্ত–বিপক্ষের সঙ্গে মুসলমানের সম্বন্ধ। সেক্ষেত্রে একবার যে তলোয়ারের সম্বন্ধ বড় হয়েছিল, তারপর সে-তলোয়ারকে কোষবদ্ধ করা দুঃসাধ্য হচ্ছে; যদিও হজরত মোহাম্মদের বহু কর্মে ও কোরআনে বিপক্ষের সঙ্গে সম্পর্কে প্রীতি অগ্রগণ্য হয়েছে, মুসলমান সভ্যতায়ও মাঝে মাঝে এর প্রকাশ মনোজ্ঞ হয়েছে।

মুসলমানের চিন্তার ইতিহাসে খুব বড় যে ব্যাপারটি চোখে পড়ে সেটি হচ্ছে, বিচার-বুদ্ধি ও শাস্ত্রানুগত্য এই দুইয়ের ভিতরে কঠোর সংগ্রাম, আর সে-সংগ্রামে জনসাধারণের প্রাধান্য। ভারতেও বিচার-বুদ্ধি ও বেদনানুগত্যের ভিতরে যে-সংগ্রাম হয়েছিল তা কঠোর, কিন্তু সে-সংগ্রামে জনসাধারণ সাধারণত হয়েছিল অনুবর্তী, নেতা নয়। এর বড় কারণ হয়ত এই যে, ইসলামের বাহন হয়েছিল একটি দুর্ধর্ষ চির-স্বাধীন জাতি। বহু বিরুদ্ধতার পরে একবার তারা হজরত মোহাম্মদের বিরাট ব্যক্তিত্বের কাছে মাথা নত করেছিল; কিন্তু বিকাশশাখ মানুষকে যে নানা মতবাদের কাছে বারবার মাথা নত করতে নয়, অবশ্য কৌতূহলে ও অনুরাগে, সে-কথা ভাল করে বুঝবার মতো অনুকূল অবস্থার সৃষ্টির পূর্বেই আর একটি দুর্ধর্ষ জাতি, অর্থাৎ তাতার জাতি, এসে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল ইসলামের পরিচালনার। তাই ইসলামের আবির্ভাব থেকে প্রায় চার শত বৎসরের মধ্যে চিন্তার প্রভূত বৈচিত্র্য মুসলমান জগতে প্রকাশ পেলেও সর্বসাধারণ মুসলমানের জন্য একাল পর্যন্ত বিশেষ শ্রদ্ধার সামগ্রী হয়ে আছে দুইটি বিষয়- কোরআন ও হজরত মোহাম্মদের বাণী, অথবা, সোজাসুজি-ভাবে এই দুইয়ের অনুবর্তিতা। এর বাইরে আর একটি ব্যাপারও দীর্ঘকাল তাদের চিত্ত আকৃষ্ট করেছিল-সুফীর আধ্যাত্মবাদ বা অন্তজ্যোতিবাদ, বিরাট-ব্যক্তিত্বশালী ইমাম গাজ্জালীর প্রভাবে এই মতবাদের বিস্তার ঘটে। কিন্তু শাস্ত্রানুগত্যের সঙ্গে যেভাবে যুক্ত করে এই তত্ত্ব তিনি জনসাধারণকে দিয়েছিলেন তারই ভিতরে নিহিত হয়েছিল এর ভবিষ্যৎ অসার্থকতার বীজ।

মুসলমানের চিন্তার ইতিহাসে বিচার-বুদ্ধির পরাভব ব্যাপারটি বেশ বুঝে দেখবার মতো। মুসলমান চিন্তাশীলদের তিনটি বড় দলে ভাগ করে দেখা যেতে পারে-বিচারপন্থী, মধ্যপন্থী, একান্ত-শাস্ত্রানুগত্যপন্থী। বিচারপন্থীরাও এক হিসেবে শাস্ত্রানুগত্য-পন্থী, তবে মাস্ত্রবাক্যেল ব্যাখ্যায়। বিচার-বুদ্ধির সহায়তা তারা বিশেষভাবে গ্রহণ করতেন। এই দলের এক আদি ব্যক্তি আব্বাসীয় শাসনের প্রারম্ভের ইমাম আবু হানিফা। তাঁর মতানুবর্তী হানাফী-দল মুসলমান-জগতে, বিশেষ করে ভারতবর্ষে, সংখ্যাগরিষ্ঠ; কিম্ভ নামে হানাফী হলেও তাঁর শিষ্যদের প্রভাবে প্রায় প্রথম থেকেই তাঁরা মধ্যপন্থী। অর্থাৎ শাস্ত্রানুগত্যই তাঁদের জন্য বড় কথা, তবে বিচার-বুদ্ধির সাহায্যও তারা কখনো কখনো নেন। একান্ত-শাস্ত্রানুগত্য-পন্থীর দল মুসলমানের গৌরব-যুগে, যেমন- আব্বাসীয় যুগে, তেমন প্রবলপ্রতাপ হননি। কিন্তু এই আব্বাসীয় যুগেই বিচারপন্থীরা এই দলের নেতা ইমাম হাম্বলের উপরে যে কঠোর অত্যাচার করে, তার ফলে বিচার-পন্থীদের প্রতি মুসলমান-জনসাধারণের ঘৃণা ও অবিশ্বাস প্রবল হবার সুযোগ পায়। এর পরে সর্বপ্রকার যুক্তিবাদের অসারতা ইমাম গাজ্জালী যখন বিশেষ দক্ষতা সহকারে প্রতিপন্ন করলেন এবং শাস্ত্রানুতগত্য ও অন্তর্জোতিতত্ত্ব সত্যান্বেষীদের জন্য শ্রেয়ঃ জ্ঞান করলেন তখন বিচার-বাদ স্বভাবতঃই দুর্দশাগ্রস্ত হলো। ইমাম গাজ্জালীর মত খণ্ডন করে বিচার-বাদের ধ্বজা পুনবার উত্তোলন করতে চেষ্টা করেন স্পেনীয় দার্শনিক ইবনে রোশদ (Averroes)। কিন্তু তিনিও যুক্তিবাদ জনসাধারণের জন্য কাম্য জ্ঞান করেননি। তাঁর মতের সমাদর হয় ইহুদিদের কাছে ও তাঁদের সহায়তায় ইয়োরোপে। ইয়োরোপীয় বুদ্ধির মুক্তির ইতিহাসে (Averroes)-এর আসন যে গৌরবের ইয়োরোপীয় পণ্ডিতেরা সে-কথা স্বীকার করেন। ইসলামের বিচার-বাদ এইভাবে যে সাগর-পার হয়ে গেছে, তারপর তাকে ফিরিয়ে আবার কিছু সজাগ চেষ্টা করেছেন স্যার সৈয়দ আহমদ ও আমির আলি। তাদের পূর্বে রামমোহনের ভিতরে এই বিচারবাদের প্রভাব বুঝতে পারা যায়।

আব্বাসীয় যুগের ইমাম হাম্বলের পরে একান্ত শাস্ত্রানুগত্যবাদের বড় নেতা ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের ইমাম ইবনে তায়মিয়া। “আদিম ইসলামে প্রত্যাবর্তনবাদকে তার অসাধারণ শাস্ত্রজ্ঞানের সাহায্যে তিনি পূর্ণাঙ্গতা দান করেন। কেবল কোবৃআন ও বিশ্বস্তসূত্রে প্রাপ্ত হজরত মোহাম্মদের বাণী মুসলমানদের নির্ভরযোগ্য, এভিন্ন, খলিফা ইমাম, দার্শনিক সুফী কারো মতামতই মুসলমানদের জন্য নির্ভরযোগ্য, নয়, একমাত্র আল্লাহ্র কাছেই প্রার্থনা জানানো যায়, পয়গাম্বর ইমাম সুফী এঁদের কাছে প্রার্থনা জানানো ধর্মবিরুদ্ধ- এইসব মত তিনি উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেন। সুফীর অন্ত-জ্যোতিতত্ত্ব তিনি আদৌ শ্রদ্ধা করতেন কি না বলা শক্ত, তবে কোআন ও হজরত মোহাম্মদের বাণীর সহজ অর্থের একান্ত আনুগত্য তিনি মুসলমানদের জন্য যে বিশেষ প্রয়োজনীয় মনে করেছিলেন এ সর্বদিসম্মত। তদানীন্তন সমাজের সুফী প্রাধান্যের জন্য তাকে নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছিল; কিন্তু জনসাধারণের বিশেষ শ্রদ্ধা তিনি লাভ করেন। তাঁর অষ্টাদশ শতাব্দীর শিষ্য আবদুল ওয়াহহাব ও তাঁর অনুবর্তিগণ এই মতবাদের প্রচারে সফলকাম হন, আবদুল ওয়াহহাবের নাম অনুসারে এই চিন্ত ধারার সাধারণ নাম হয়েছে ওয়াহহাবী বা ওহাবী মত। সত্য বটে পীর-পূজা প্রভৃতি ওহাবী-নিন্দিত কর্ম ও মত এখনো মুসলমান সমাজে লোপ পায়নি, কিন্তু এ-সব শাস্ত্রবিরুদ্ধ অতএব প্রশস্ত নয়, এই বাণী মুসলমান জনসাধারণের কর্ণেও প্রবেশ করেছে।

এই ওহাবী মত বা “আদিম ইসলামে প্রত্যাবর্তন”-বাদ বর্তমান মুসলিম-জগতে, বিশেষ করে ভারতের মুসলমানদের মধ্যে, প্রবলতম মত। উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এ-দেশে এই মতের প্রাদুর্ভাব ঘটে। পাঞ্জাবে মুসলমানদের উপরে শিখেরা অত্যাচার করে; ওহাবীরা সেখানে জেহাদ ঘোষণা করে। এই সংঘর্ষ ক্রমে ইংরেজ ও ওহাবী বর্তে। ওহাবীদের দমন করতে ইংরেজ গবর্ণমেন্টকে বেগ পেতে হয়েছিল। কিন্তু ওহাবী মত তখন যা ছিল এখন তার কিছু কিছু বদল হয়েছে। ভারতবর্ষ অমুসলমান রাজ্য, মুসলমান ধর্মকর্ম এখানে বাধাগ্রস্ত, এই বিবেচনায় ওহাবীরা একে “দারুল হরব” বলে ঘোষণা করে। “দারুল হরব”-এ শাসনকর্তার বিরুদ্ধে প্রয়োজন মত জেহাদ ঘোষণা করা ধর্মকর্ম। [Imperial Gazetter, Vol. VII P. 437 দ্রষ্টব্য।] কিন্তু এখন ভারতবর্ষকে সাধারণত “দারুল হরব” বলে গণনা করা হয় না, “দারুল্ ইসলাম” বলা হয়, কেননা, এখানে মুসলমানদের ধর্মকর্ম বাধাগ্রস্ত নয়। কাজেই ওহাবী মত এখন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধং দেহি ভাব পরিত্যাগ করে (এর মতে) ভারতের তথাকথিত মুসলমানদের মুসলমানীকরণে মন দিয়েছে। তাই বাংলার সাধু-সংকল্প হিন্দু যখন দুঃখিত হয়ে বলেন-মুসলমান চাষীরা তো আগে আমাদের পূজা-আর্চায় বেশ যোগ দিত, আমাদের বাড়িতে খেতেও তাদের আপত্তি ছিল না, কিন্তু দিন দিন সব কেমন হয়ে যাচ্ছে-তখন তাঁর প্রতিবেশীদের ঘরের খবর সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞতার পরিচয় তিনি দেন।

এই ওহাবী মত ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে এমন প্রভাব বিস্তার করল কেন সে কথাটি বুঝে দেখবার মতো। কিন্তু বিশাল ভারতের চেয়ে এই সমস্যাটি মুখ্যতঃ বাংলা দেশে সংকীর্ণ করে দেখাই নানা কারণে সঙ্গত মনে করি। এই সম্পর্কে বাংলার মুসলমানের উৎপত্তি-কথার কিঞ্চিৎ আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের আদম-সুমারির রিপোর্টে মি. বেভেলি (Mr. H. Beverley) বলেন, বাংলার অধিকাংশ মুসলমান বাংলার হিন্দুসমাজের নিম্নশ্রেণী থেকে উদ্ভূত; ইস্লামের তলোয়ারের জোরে তারা মুসলমান হয়। রিজলি সাহেব তার Tribes and Castes of Bengal গ্রন্থে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সহকারে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে বাংলার মুসলমান, বিশেষ করে মুসলমান চাষী, বাংলার নিম্নশ্রেণীর হিন্দুর বংশধর। এই মতের প্রতিবাদ করেন মুর্শিদাবাদের দেওয়ান খোন্দকার ফজলে রব্বি। তাঁর The Origin of the Mussalmans of Bengal গ্রন্থে (এটি তার পার্শীতে লেখা “হকিকত-ই মুসলমানান-ই-বাঙ্গলা”-র ইংরেজি অনুবাদ) তিনি এই ভাবে এ মত খণ্ডন করতে চেষ্টা করেন:

(১) তলোয়ারের জোরে এদেশে ইসলাম প্রচার হয়ে থাকলে উত্তর-ভারতে মুসলমানের সংখ্যা অনেক বেড়ে যেত। সেখানে মুসলমানের তলোয়ারের জোর বাংলার চেয়ে কম ছিল না।

(২) বাংলার মুসলমান বাংলার উচ্চ বা নিচ কোনো স্তরের হিন্দুর বংশধর যে মুখ্যতঃ নয় তার ঐতিহাসিক প্রমাণ এই:

(ক) “তারিখ-ই-ফেরিশতা,” আবদুল কাদির বদাউনির “মন্তাখাবাত্তাওয়ারিখ” প্রভৃতি ইতিহাস-গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, বাংলায় মুসলমানের আগমন থেকে আরম্ভ করে’ নবাব সুজাখার রাজত্বকাল পর্যন্ত বাংলার মুসলমান-শাসকরা এদেশে মুসলমানদের বসবাসের সুবিধার জন্য বিশেষ চেষ্টা করেছিলেন। তারা অনেক মুসলমান-পরিবারকে জায়গীর প্রভৃতি দান করে বাংলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেন। বহু মুসলমান সৈন্যও এদেশে আগমন করে।

(খ) দিল্লী রাষ্ট্রবিপ্লবের কেন্দ্রস্থল ছিল বলে অনেক মুসলমান সুদূর বাংলায় বসতি স্থাপন নিরাপদ মনে করতেন।

(গ) সম্রাট আকবর অনেক স্বধর্মনিষ্ঠ মুসলমানকে বাংলায় নির্বাসিত করেন।

(ঘ) সমুদ্রপথে অনেক বিদেশি মুসলমান বাংলায় আগমন করে ও বসতি স্থাপন। করে।

(ঙ) বাংলায় হিন্দু ও মুসলমানের ভিতরে ভাষাগত পার্থক্য আছে। দুজনেই বাংলা বলে কিন্তু ঠিক এক বাংলা নয়। মুসলমানের বাংলায় আরবী ফারসী শব্দের সংখ্যা অনেক বেশি।

(চ) রিজলি সাহেবের পদ্ধতি নির্ভুল নয়। কেননা, তিনি সব শ্রেণীর মুসলমানের নাকের মাপ নিয়ে গড় কষেননি, বেছে বেছে নিম্নশ্রেণীর মুসলমানের নাকের মাপ নিয়েছেন।

দেওয়ান সাহেবের গবেষণায় অন্ততঃ এই কথাটি প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলায় বাংলার বাইরের মুসলমান কম আসেন নি, অবশ্য দেশের সমগ্র লোকসংখ্যার কত ভাগ তা বলা শক্ত। কিন্তু তার সমস্ত যুক্তির বিরুদ্ধে এই বড় যুক্তিটি দাঁড় করানো যেতে পারে, যুক্তিটি মুসলিম-ইতিহাসবেত্তা ঢাকার হাকিম হবিবর রহমানের। বিজেতারা সাধারণত বিজিত দেশে থেকেই স্ত্রী গ্রহণ করে থাকেন, ভারতবিজয়ী মুসলমানদের বেলায়ও এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে নি, হিন্দুস্থানী সৈয়দ, হিন্দুস্থানী শেখ, হিন্দুস্থানী মোগল ও হিন্দুস্থানী পাঠানের উদ্ভব এই ভাবে-এই তাঁর মত। এ-মত যে গ্রহণযোগ্য তাতে সন্দেহ নেই। তাহলে দেওয়ান সাহেব যে বাংলার মুসলমানকে হিন্দু-রক্তের সংস্রবশূন্য মনে করেছেন, তা আর টেকে না। এদেশের প্রাচীন মুসলমানদের স্ত্রী-গ্রহণ সম্পর্কে একটি কৌতুকাবহ ব্যাপার ইবনে বতুতার ভ্রমণ-কাহিনীতে আছে। মুসলমান রাজত্বের প্রায় সূচনায় তিনি এদেশে আসেন। তিনি লিখেছেন, এদেশে স্ত্রীরূপে গ্রহণযোগ্য দাসী অল্প মূল্যে পাওয়া যেত, তার সামনে একটি সুন্দরী যুবতী বিক্রীত হয়েছিল এক স্বর্ণ দিনারে অর্থাৎ দশ টাকায়। তিনিও প্রায় এই মূল্যে একটি অতি সুন্দরী দাসী কিনেছিলেন। অবশ্য এই সব দাসী কোন জাতীয়া ছিল তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে শুধু মুসলমানদের কন্যাই যে এই ভাবে বিক্রীত হতো তা মনে করবার হেতু নেই।

দেওয়ান সাহেব রিজলি সাহেবের মত যেভাবে খণ্ডন করতে চেয়েছেন তাও আপত্তিকর। বাংলার চাষী সম্প্রদায়ের অনেকে হিন্দুর সন্তান, এই তাঁর প্রতিপাদ্য। সে-ক্ষেত্রে সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের তিনি যদি তার গবেষণার বিষয় বলে গণ্য না করে থাকেন, তবে তাঁর সেই কাজটাই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির দিক দিয়ে অসঙ্গত হয় না। অবশ্য আজকাল নাকের গঠন দিয়ে জাতি নির্ণীত হয় কি না, তা নৃতত্ত্ববিদেরাই ভাল জানেন।

দেওয়ান সাহেবের প্রতিপাদ্যের বিরুদ্ধে আর একটি যুক্তি হান্টার সাহেবের গেজেটিয়ারে আছে। তিনি বলেছেন, কিছুদিন পূর্বেও বাংলার অনেক মুসলমান দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী প্রভৃতি হিন্দু দেবদেবীর পূজা করতো।

কিন্তু হান্টার সাহেবের এই যুক্তির বিরুদ্ধেও যুক্তি আছে। বাংলার কোনো কোনো সম্ভ্রান্ত মুসলমানও দুর্গা, কালী প্রভৃতি দেবীর পূজা করতেন একথা সুপ্রসিদ্ধ। এর বড় কারণ বোধ হয় এই যে, ওহাবী প্রভাবের পূর্বে মুসলমানদের মানসিক অবস্থা প্রতীকচ্চার একান্ত বিরোধী ছিল না। পীরের কবরে বিশেষ ভক্তিপ্রদর্শন, দিনক্ষণ পুরোপুরি মেনে চলা, সমাজে এক শ্রেণীর জাতিভেদ স্বীকার করা, এসব ব্যাপারে মুসলমানের মনোভাব প্রায় হিন্দুর মতোই ছিল। তাছাড়া মুসলমান-লিখিত কাব্যে প্রতিমা পূজারির ভক্তিনিবেদনের সৌন্দর্য অনেকদিন থেকে বর্ণিত হয়ে আসছিল; কাব্য কল্পনায় আর বাস্তব জীবনে ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলার চেষ্টা অনেক সময় মানুষের সমাজে হয়।

বাংলায় হিন্দু ও মুসলমানের ভাষাগত যে-পার্থক্যের কথা দেওয়ান সাহেব এবং একালের কোনো কোনো পদস্থ মুসলমান বলেছেন, সে-সম্বন্ধে এই কথা বলা যায় যে পূর্বে হিন্দুর ব্যবহৃত বাংলা ভাষায়ও আরবী ফারসী শব্দের সংখ্যা এখনকার চেয়ে অনেক বেশি ছিল, টেকচাঁদের সাহিত্য তার এক প্রমাণ। একালে বাংলা সাহিত্য যে ভাবে গড়ে উঠেছে, তার সঙ্গে মুসলমানের চেয়ে হিন্দুর যোগ অনেক বেশি বলে হিন্দুর মুখের ভাষায় অনেক পরিবর্তন ঘটেছে।

দেওয়ান সাহেব তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আর একটি যুক্তি খণ্ডন করতে ভুলে গেছেন। অথবা ইচ্ছা করেই সেটি তোলেন নি। সেটি এই যে, অনেক মুসলমান ফকিরের অলৌকিক ক্ষমতা দেখে এদেশের অনেক লোক মুসলমান হয়েছিল। শ্রীহট্টের শাহজালালের প্রভাবে সেই অঞ্চলের বহু অধিবাসী যে মুসলমান হয়েছিল, ইবনে বতুতার ভ্রমণ-বৃত্তান্তে তার উল্লেখ আছে।

বাংলাদেশের নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদের বেশভূষা যে উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের সঙ্গে তুলনায় স্বতন্ত্র রকমের ছিল–এখনও যেমন আছে-সে কথা সিয়ারু মোতা’ আখেরীন এর অনুবাদক প্রায় দেড়শত বৎসর পূর্বে উল্লেখ করে গেছেন। তিনি তাদের নামে মাত্র মুসলমান বলেছেন, কেননা তারা মুসলমানী রীতিনীতি আচার ব্যবহার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তাদের মাথায় যে টুপি নেই, এটি মুসলমানের পক্ষে তিনি খুব অদ্ভুত বিবেচনা করেছেন।

দেখা যাচ্ছে দেওয়ান সাহেবের মতের বিপক্ষেই যুক্তি প্রবল। বাংলার অধিকাংশ মুসলমান বাংলার নিমশ্রেণীর হিন্দুর সন্তান, কি উচ্চশ্রেণীর হিন্দুর সন্তান, সে-তর্ক অবশ্য অর্থহীন। ছোট বড় হয়, বড় ছোট হয়। কোনো একশ্রেণীর লোককে সম্ভাবনার দিক দিয়ে বড় ভাবা কুসংস্কার। তাছাড়া বাংলার হিন্দু ও মুসলমান উভয়েরই বাংলার বিশাল বৌদ্ধ-সমাজ থেকে উদ্ভূত হবার সম্ভাবনা বেশি। [দ্র: বাংলার মুসলমানের কথা]

কিন্তু দেওয়ান সাহেব প্রমুখ মুসলিমস্বাতন্ত্রবাদীদের যুক্তি অপ্রবল হলেও এ কথাটি মানতেই হবে যে, হিন্দু ও মুসলমান চাষীদের ভিতরে চরিত্রগত পার্থক্য বিদ্যমান। হিন্দু চাষী-শ্রেণীর লোকদের চেয়ে মুসলমান চাষী কম শান্ত ও কষ্টসাধ্য কাজে মাথা দিতে বেশি অগ্রসর। এর কারণ কি? হিন্দু ও মুসলমানের এ রকম পার্থক্য শত বৎসর পূর্বে রামমোহনও লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এর কারণ মাংসাহার। কিন্তু পল্লীর মুসলমান মাংস অতি অল্পই খায়। হিন্দু-মুসলমানের একালের মারামারির পরে থেকে হিন্দুমতে-নিষিদ্ধ মাংসের প্রতি আকর্ষণ তাদের হয়তো কিছু বেড়েছে, কিন্তু বাস্তবিকই তা নগণ্য। খাদ্যের দিক দিয়ে হিন্দু ও মুসলমানের ভিতরে এতদিন বড় পার্থক্য ছিল পেঁয়াজ আর রসুনের ব্যবহারে। কিন্তু এদুটি যদি এমন মহাশক্তি হবে, তবে উচ্চশ্রেণীর মুসলমানেরা দিন দিন হীনবীর্য হয়ে পড়ছেন কেন?

চিন্তা ও বিশ্বাস-আদির পার্থক্য এই চরিত্রগত পার্থক্যের প্রধান কারণ বলে মনে হয়। এমতের সমর্থন পাওয়া যায় বাংলার হিন্দুসমাজের উচ্চ ও নিমস্তরের লোকদের চরিত্রগত পার্থক্যের কথা ভাবলে। বাস্তবিকই চরিত্রগত পার্থক্য একালের বাংলার হিন্দু সমাজের এই দুই অংশের ভিতরে প্রকট হয়েছে। বহুদোষ সত্ত্বেও সে-সমাজের উচ্চস্তরের লোকদের বলা যায় সাহসী ও চলন্ত-মন-বিশিষ্ট, বহুগুণ সত্ত্বেও তার নিমস্ত রের লোকদের এই সব বিশেষণে বিশেষিত করা যায় না। হিন্দুসমাজের নানা আচার ও সংস্কারের চাপ থেকে সে-সমাজের উচ্চস্তরের লোকেরা কিছু অব্যাহতি পেয়েছে জ্ঞানকৃত চেষ্টায়, আর বাংলার মুসলমান-সমাজের নিম অংশের লোকেরা জীবনে কিছু সহজ সরল হতে পেরেছে, উচ্চস্তরের লোকদের অবহেলার ফলে বাংলার মুসলমান সমাজের উচ্চস্তরের লোকেরা বাংলার হিন্দুসমাজের নিম্নস্তরের লোকদের মতো কেন দিন দিন মুখ্যতঃ আচার-ধর্মী হয়ে পড়ছে, তার উত্তর পাওয়া যাবে এই বিবরণের বহুস্থানে।

বাংলার এই মুসলমান-সমাজ, বিশেষ করে এর সুবিশাল নিম অংশ, যে অসার্থক। জীবন যাপন করতো না, তার পরিচয় রয়েছে সেকালের লোক-সাহিত্যে ওহাবীপ্রভাবের পূর্বে মুসলমানসমাজের উপরে প্রবল ছিল সুফী-প্রভাব। মোটের উপর সেটি উদার মানবতার প্রভাব, কিন্তু আচারপরায়ণতা অলৌকিকতাপ্রীতি এসবও ছিল তার সঙ্গে যুক্ত।

এই সমাজ মানস শক্তির দিক দিয়ে তেমন সবল না হলেও, ওহাবী-প্রভাবকে বাধা দিতে যে চেষ্টা না করেছে তা নয়। লালন ফকির প্রমুখ উনবিংশ শতাব্দীর মুসলমান বাউলদের গানে রয়েছে সেই প্রতিবাদের ঝ০ঙ্কার। সে-চেষ্টা সফল হয়নি কেন সে সম্বন্ধে এই ক’টি কথার উল্লেখ করা যেতে পারে:

(১) অলৌকিকতার উপরে সুফী ও ওহাবী দুই মতেরই শ্রদ্ধা। কাজেই ওহাবীরা যখন পরম অলৌকিক কোরআন ও হজরত মোহাম্মদের পয়গাম্বরত্বের দোহাই দিলেন মুসলমান হিসেবে তখন অপর পক্ষের প্রায় কোনো উত্তরই রইল না।

(২) অনুবর্তিতা দুইয়েরই ধর্ম। সে-ক্ষেত্রে পীরের অনুবর্তিতার চেয়ে পয়গাম্বরের অনুবর্তিতার মহিমা বেশি মনে হওয়া স্বাভাবিক।

(৩) এই মুসলমান-সমাজে কদাচার যথেষ্ট ছিল। প্রাচীন ইসলামের উন্নততর আচারের সামনে সেসব নতশির না হয়ে পারে নি।

কিন্তু দীর্ঘকালের জীবনধারার প্রতি মানুষের যে স্বাভাবিক মমতা তাকে এই সব যুক্তি জয় করতে পারতো না যদি রাজনৈতিক কারণ এর সহায়-রূপে এসে না দাঁড়াত। বস্তুত অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ওহাবী আন্দোলনকে এক রাজনৈতিক আন্দোলন বলেও গণ্য করা যেতে পারে-ধ্বংসশীল মুসলিম জগতের গা ঝাড়া দেবার ও এক চেষ্টা। ভারতে অথবা বাংলায় রাজনৈতিক কারণ যে এর প্রভাবের মূলে, তা বোঝা যায় ব্রিটিশ শাসন-কালে মুসলমানদের অবস্থার ইতিহাসের কথা ভাবলে। ব্যাপারটি সংক্ষেপে এই:

হিন্দুসমাজের পদস্থ ব্যক্তিদের আনুকূল্যে বাংলায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই পরিবর্তনে মুসলমানেরা যে খুব বিচলিত হয় নি তা বোঝা যায় এই দুটি ব্যাপার থেকে–

(১) ইংরেজের অধিকৃত বাংলায় প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কলিকাতা-মাদ্রাসা ইংরেজের আনুকূল্যে মুসলমানদের লাভ হয়;

(২) ইংরেজ শাসনের সূচনায় হিন্দু প্রধানত রাজস্ববিভাগে ও মুসলমান প্রধানত বিচার-বিভাগে নিযুক্ত থেকে জীবিকা অর্জন করতে থাকে। সেদিনে বাংলার মুসলমান যে বাংলাদেশে উন্নততর সম্প্রদায় ছিল, রামমোহন রায় তার বিলাতে সাক্ষ্যদানকালে ও হান্টার সাহেব তার Indian Mussalmans গ্রন্থে সে কথা বলেছেন-”When the country passed under our Rule the Muslims were the superior race.”

মুসলমানদের অবস্থার পরিবর্তন আরম্ভ হলো দশসালা বন্দোবস্ত থেকে, আর তাদের সম্ভ্রান্তদের আর্থিক দুর্গতি চরমে পৌঁছলো সনদ দেখাতে না পেরে। যখন তাঁদের বহু নিষ্কর জমিজমা বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল-ইংরেজিতে এর নাম Resumption Proceedings-আর যখন আদালতের ভাষা পাশীর পরিবর্তে ইংরেজি হলো। দশমালা বন্দোবস্তের ফলে মুসলমানদের আর্থিক অবস্থার কেমন পরিবর্তন হলো সে-সম্বন্ধে হান্টার সাহেবের উক্তির সারাংশ এই:

Muslim landlords or collectors of revenue did not directly deal with the Muslim peasants, and they employed Hindu bailiffs to collect the revenue dircct from the peasantry. So the Hindus in fact formed a Subordinate Revenue Service, and took their share of the profits before passing the collection on to the Muslim Superiors. The latter however were responsible to the Emperor and formed a very essential link in the Musliin fiscal system. The series of changes introduced by Lord Cornwallis and Sir John Shore ending in the Permanent Settlement in 1793 put an end to this fiscal system of the Muslims.

The Permanent Settlement most seriously damaged the position of Muhamedan houses. for the whole tendency of the settlement was to acknowledge as the landlords the subordinate Hindu Officers who dealt directly with the husbandmen.

It elevated Hindu collectors, who upto that time had held but unimportant posts to the position of the landlords, gave them a proprietory right in the soil and allowed them to accumulate wealth which would have gone to the Muslims under their own Rule. [১০৪-৫ পৃষ্ঠায় হান্টার সাহেবের মূল বক্তব্য দ্রষ্টব্য।]

এসব ব্যবস্থা যে মুসলমানদের শক্তিহীন করবার জন্যই করা হয়েছিল তা মনে হয়, রাজস্ব যাতে বেশি পাওয়া যায় ও নিশ্চিতরূপে পাওয়া যায়, এইই ছিল শাসকদের প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু এর ফল মুসলমানদের জন্য শোচনীয় হলো। এই সময়ে ভারতে আসে ওহাবী আন্দোলন। বাংলার ওহাবী আন্দোলন যে মুখ্যত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তা বোঝা যায় বাংলার ওহাবী নেতা তিতুমিরের বিদ্রোহ থেকেওঃ

Titu belonged to the Wahhabi Sect of Muhammadan fanatics, and was excited to rebellion in 1831 by a beard-tax imposed by Hindu landholders. He collected a force of insurgents 3,000 strong, and cut to pieces a detachment of Calcutta militia which was sent against him. The magistrate collected reinforcements but they were driven off the field. Eventually the insurgents were defeated by a force of regulars and their stockade was taken by assault. (Imp. Gazt. Vol. XXIV-p. 71.)

ওহাবীরা ইংরেজের হাতে যখন অনেকখানি নিস্তেজ হলো, তখন ইংরেজ ও মুসলমানে সম্পর্ক দাঁড়াল এই-ইংরেজ সহজেই সকল মুসলমানকে শত্রুপক্ষ ভাবলো এবং তাদের সঙ্গে ব্যবহারে সদয়তা তার পক্ষে সম্ভবপর হলো না; মুসলমানদের সবাই যে ওহাবীমতাবলম্বী হলো তা নয় কিন্তু ইংরেজের প্রতি বিরূপতা তাদের ভিতরে ব্যাপক হলো। পাশীর পরিবর্তে ইংরেজিকে রাজভাষা করা হলে, মুসলমানরা প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু প্রতিবাদে ফল না পেয়ে তারা ইংরেজি শিখতে এগোলো না। হান্টার সাহেব বলেছেন-ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক-বিবর্জিত শিক্ষা মুসলমানেরা পছন্দ করতে পারল না। কিন্তু মুসলমানদের খুব বড় অন্যায় এই হলো যে, নতুন ব্যবস্থা সম্বন্ধে না-ই তারা বলল, ভাল করে বাঁচতে হলে কোন কোন ব্যাপারে হাঁ-ও বলতে হবে সে-চেতনা তাদের ভিতরে দেখা দিল না। অচিরেই তাদের অবস্থা এমন হীন হয়ে পড়লো যে সিপাহীবিদ্রোহের পরে স্যার সৈয়দ আহমদ প্রধান কর্তব্য জ্ঞান করলেন শাসকদের বিষদৃষ্টির পরিবর্তে প্রসন্ন দৃষ্টি মুসলমানদের জন্য লাভ করা।

মুসলমানদের দুর্গতির সঙ্গে চললো হিন্দুদের উন্নতি-চেষ্টা ও তাদের প্রতি শাসকদের আনুকুল্য। তাই ওহাবীরা যখন শান্ত হয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে মুসলমানের ধর্ম ও সমাজের সংস্কারকরূপে এলেন, তখন মুখে তাঁদের অনুবর্তিতা তেমন ব্যাপকভাবে স্বীকৃত না হলেও ধীরে ধীরে এদেশের দুর্দশাগ্রস্ত মুসলমানদের মনে এ ধারণা দৃঢ়মূল হওয়া বিচিত্র নয় যে, ধর্মের আদিম ব্যবস্থার দিকে ফিরে যাওয়া ভিন্ন ইহকাল ও পরকালের জন্য তাদের আর কি করবার থাকতে পারে। হিন্দু-সমাজে সূচিত জাগরণ এ প্রতিক্রিয়া রোধ করতে সমর্থ হলো না কেন, দ্বিতীয় বক্তৃতায় তার উত্তর দিতে চেষ্টা করা হবে।

আমরা দেখলাম ওহাবী প্রভাবে এদেশের মুসলমানদের একটি বিশেষ চেতনা লাভ হলো। এ আন্দোলনে তাদের কোনো উপকার যে না হয়েছে তা নয়-এর ফলে ভাববিলাসিতা থেকে কিছু উদ্ধার তারা পেয়েছে, কিছু সঙ্বদ্ধও তারা হয়েছে। কিন্তু আদর্শ হিসেবে এর দুর্বলতা এইখানে যে এ অতীতের ব্যবস্থার দিকে ফিরে যাওয়াই সব চেয়ে বড় কাজ মনে করে-সেই ব্যবস্থাই এর কাছে চিরন্তন ধর্ম। বলা বাহুল্য এ-মত সর্বপ্রকার চিন্তার সম্প্রসারণের বিরোধী; সমস্ত রকমের নূতন পরীক্ষা সন্দেহের চোখে দেখা এর প্রকৃতি। এ-মত যে উন্নতিকামী জাতীয়তাবাদী আধুনিক মুসলিম জগতে বর্জিত হচ্ছে তা বুঝতে পারা যাচ্ছে। কিন্তু ভারতের মুসলমান একে বর্জন করতে পারছে না, তার নিজের দুর্বলতা সম্বন্ধে চেতনা তার এ-মতের বর্জনের পথে বাধা হচ্ছে।

এই দশা থেকে এদেশের মুসলমান কি মুক্তি পাবে? না, নানা দিক থেকে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে এইখানেই তার দৃঢ়স্থিতি হবে! এর সদুত্তর নির্ভর কছে অনেকগুলো ব্যাপারের উপরে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বক্তৃতায় সে-সবের আলোচনার চেষ্টা হবে।

২৬ মার্চ, ১৯৩৫

দেশের জাগরণ

মুসলমানের গত কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস ক্ষয়িষ্ণুতার ইতিহাস; তাই ওহাবী-প্রতিক্রিয়া যে বর্তমানে তার প্রধান পরিচয়-স্থল হবে সে-কথা বোঝা কঠিন নয়। কিন্তু একালের হিন্দুর ইতিহাস তার জাগরণ-চেষ্টার ইতিহাস, তাই হিন্দুর সত্যিকার পরিচয়, অর্থাৎ তার শক্তি ও দুর্বলতা, সেই জাগরণ-চেষ্টার ভিতরেই খুঁজতে হবে। আর হিন্দুর এই জাগরণ চেষ্টা শুধু হিন্দুতে সীমাবদ্ধ থাকে নি, দেশের অন্যান্য সম্প্রদায়েও সংক্রামিত। হয়েছে। অর্থাৎ সমস্ত দেশ জাগ্রত হবার চেষ্টা করেছে বলা যায়। দেশ যে বিরোধ ব্যাধিতে ভুগছে তা থেকে উদ্ধার পাবার মতো জীবনীশক্তি দেশের লোকদের মধ্যে আছে কিনা, তারও সন্ধান পাওয়া সম্ভব দেশের এই বিচিত্র জাগরণ-চেষ্টার মধ্যেই।

দেশের একালে জাগরণ প্রধানত তিনটি কেন্দ্রে হয়েছে-বঙ্গদেশ, মহারাষ্ট্র ও উত্তর ভারত। এই তিনের আদি ও প্রধান কেন্দ্র বঙ্গদেশ। মহারাষ্ট্রের ও উত্তর ভারতের জাগরণ-চেষ্টা তার সঙ্গে নানাভাবে সম্পর্কিত।

বাংলায় ইংরেজের কুঠির পত্তন হয় আড়াইশ’ বছর আগে। সেই সময় থেকেই বাণিজ্য-ব্যাপারে হিন্দু বাঙালিদের সঙ্গে ইংরেজের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে। ইংরেজের নির্মিত শহর অনেকখানি নিরাপদ জ্ঞান করে প্রায় সেই সময় থেকেই সেসব শহরে হিন্দুদের বসতি স্থাপনের চেষ্টা চলে আসছে। সেইজন্য বাংলাদেশে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে হিন্দুসমাজের মধ্যে যে-জাগরণের সূচনা হোলো তাকে ইয়োরোপীয় সংস্রবের ফল বলে দেশের অনেক চিন্তাশীল ব্যক্তি মত প্রকাশ করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ থেকে ১৮৭৬ সালের সুরেন্দ্রনাথের Indian Association স্থাপনা পর্যন্ত, অথবা ১৮৮৫ সালের ভারতীয় কংগ্রেস স্থাপনা পর্যন্ত, অথবা একাল পর্যন্ত, এই জাগরণ নানা ধারায় নানা ভঙ্গিতে আত্মপ্রকাশ করেছে বা করে আসছে। কাজেই, ইয়োরোপীয় সংস্রবের পরিচয় যে এর মধ্যে কখনো কখনো সুস্পষ্ট না হয়েছে তা নয়। তবু, সেই সংস্ৰবই এর প্রধান পরিচয় কিনা সেটি বিচার্য।

এই জাগরণের আদিপুরুষ রামমোহনের যে সমস্ত রচনা পাওয়া গেছে, সেসবের মধ্যে তুহফাতুল্ মুওহিদীন-ই বোধ হয় প্রাচীনতম। এর ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকায় স্বর্গীয় রাজনারায়ণ বসু মন্তব্য করেছিলেন-রামমোহনের ধর্মজীবনের সূচনা এখানে, এর পরে তাঁর সে-জীবন পূর্ণাঙ্গতা লাভের পরিচয় আছে ব্রাহ্মসমাজের Trust Deed-এ! কিন্তু তুহফাতুল মুওহিদীন-এর সঙ্গে রামমোহনের পরে পরের রচনা তুলনা করলে এইই দেখা যায় যে, ঈশ্বরের ধারণা সম্বন্ধে কোনো পরিবর্তন পরে তাঁর। ভিতরে দেখা দেয় নি, শুধু তুহফাতুল মুওহিদীন-এ অবতার পয়গম্বর ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা তিনি যে অস্বীকার করেছিলেন, পরে আর সেসব তেমন ভাবে অস্বীকার করেন নি বরং স্বীকার করেছেন। আমি দেখাতে প্রয়াস পেয়েছি যে, যেভাবে তিনি পরে মধ্যবর্তী পয়গম্বরাদি স্বীকার করেছেন, তা প্রকারান্তরে অস্বীকার করা-অর্থাৎ সাধারণত তাদের যেভাবে পরিত্রাতা বা পরিত্রানের ভারপ্রাপ্ত বলে স্বীকার করা হয়, তা তিনি মানেন নি। [দ্র: রামমোহন রায়।] তবে তুহফাতুল মুওহিদীনে ও পরে পরের গ্রন্থসমূহে-যেমন হিন্দুশাস্ত্রের আলোচনা ও খ্রিস্টান শাস্ত্রের আলোচনা-বড় পার্থক্য এই দেখা দিয়েছে যে, তুহফাতুল মুওহিদীন এ রামমোহন সংস্কারক ঠিক নন কিন্তু পরে তিনি সংস্কারক। তুহফাতুল মুওহহিদীন-এ তিনি মনীষী-সত্য তন্ন তন্ন করে’ সন্ধান করছেন ও তা যোগ্য ভাষায় প্রকাশ করতে চেষ্টা করছেন। এখানে তার যে প্রখর যুক্তিবাদ প্রকাশ পেয়েছে, তাতে অষ্টাদশ শতাব্দীর ইয়োরোপীয় যুক্তিবাদের প্রভাব আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল দেখেছেন। তা সত্য হলেও সে-যুক্তিবাদের সঙ্গে রামমোহনের যুক্তিবাদের বড় পার্থক্য এই যে, রামমোহন একই সঙ্গে প্রখর যুক্তিবাদী ও ঈশ্বরে-সমর্পিত-চিত্ত। তাঁর অবলম্বিত যুক্তি-পদ্ধতি মুসলিম নৈয়ায়িকদের একথা তুহফাতুল মুওহহিদীন-এর প্রথম ইংরেজি অনুবাদক মাওলানা ওবেদুল্লাহ্ স্বীকার করেছেন। মুসলিম দার্শনিকদের যুক্তিপদ্ধতিও তিনি ব্যবহার করেছেন। সেই দার্শনিকদের মধ্যে স্পেনীয় দার্শনিকরা নিরঙ্কুশ যুক্তিবাদের বিশেষ ভক্ত ছিলেন, অথচ ঈশ্বরে বিশ্বাসও তাঁদের অক্ষুণ্ণ ছিল। তাদের প্রভাবে রামমোহনের মানস-জীবন গঠিত হয়েছিল একথা স্বীকার করার পথে কোনো বাধা নেই অথচ একথা স্বীকার করলে তাঁর প্রতিভার স্বরূপ-নির্দেশ কিছু সহজসাধ্য হয়। পণ্ডিতেরা বলেন যে, মুসলিম দর্শন শেষ পর্যন্ত ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক-শূন্য হয় নি; রামমোহনের যুক্তিবাদের সঙ্গেও ঈশ্বর নিত্যযুক্ত। রামমোহনের প্রতিভার বেশ স্পষ্ট দুইটি ধারা-একদিকে তিনি মনীষী, বিচারকুশল; অন্যদিকে তিনি মানব-প্রেমিক–সমস্ত জ্ঞান ও বিচারের সামাজিক মূল্য বড় করে দেখছেন। তাঁর অনন্যসাধারণ পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও এই শেষোক্ত লক্ষণ তাঁর প্রতিভার বড় লক্ষণ হয়ে রয়েছে। মধ্যযুগের সাধকদের সঙ্গে রামমোহন সুপরিচিত ছিলেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে তাঁর বড় পার্থক্য এই যে, তাদের মতো তিনি ভক্ত ও কবি নন, তিনি ভক্ত ও মানবহিতাকাক্ষী-সে হিতাকাঙ্ক্ষার লক্ষ্য মানুষের দৈনন্দিন সাংসারিক জীবনের উৎকর্ষ-সাধন। মধ্যযুগের সাধকদের সঙ্গে তুলনায় তার আধুনিকতা এইভাবে সহজেই বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু তার সেই আধুনিকতারও স্বরূপ বোঝা যাবে তার সমসাময়িক ইয়োরোপীয় মনীষী গ্যেটের সঙ্গে তুলনায়। ফাউস্ট-এ গ্যেটের যে কথা, যে ভুল করা মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক, সেই ভুলের ভিতর দিয়ে তার কল্যাণাভিসারী পথ, সে-কথা হয়ত রামমোহনেরও; তার “ধর্ম যদি ঈশ্বরের, রাজনীতি তবে কি শয়তানের” কথাটির এই ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ভিলহেলম্ মেইস্টার-এ গ্যেটে যে একটি আদর্শ শিক্ষা-ব্যবস্থার ছবি এঁকেছেন, তাতে ঈশ্বর সম্বন্ধে উপদেশ পরিত্যক্ত হয়েছে মানুষ শক্তিমান হয়ে প্রকৃতির উপরে ও নিজের উপরে অধিমিত্ব লাভ করবে, মানুষের এই রূপই গ্যেটে যেন সেখানে দেখেছেন, ভক্তিবাদকে তিনি যেন অবিশ্বাস করেছেন-এতে রামমোহন রাজি হতেন কি না তাইই ভাববার কথা। বাস্তবিক, প্রখরযুক্তিবাদী, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের উৎকর্ষাবর্ষ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন, রামমোহন যে অন্তরে অন্তরে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন ঈশ্বরানুরাগের উপরে, শুধু অন্তরে নয় সমাজ-জীবনেও তার প্রকাশ কাম্য জ্ঞান করেছিলেন, এ থেকেই বাংলার (অথবা ভারতের) ঊনবিংশ শতাব্দীর জাগরণের বৈশিষ্ট্য সূচিত হয়েছে। আমরা বলতে চাই, বাংলার উনবিংশ শতাব্দীর জাগরণ মোটের উপর একটি ধর্মান্দোলন; কর্মান্দোলনও তার সঙ্গে হয়েছে, কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে অতি-নিন্দিত ঊনবিংশ শতাব্দীর ইয়োরোপে অথবা ইয়োরাপের কোনো প্রধান দেশে যা হয়েছে, তার সঙ্গে তার তেমন তুলনা হয় না। আর রামমোহনের পরে সেই কর্মের প্রবাহ তো যথেষ্ট অল্পপরিসর।

রামমোহনের পরে দেবেন্দ্রনাথ, কেশবচন্দ্র, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ (সামাজিক কর্মী হিসেবে) যে মুখ্যত ভগবৎ উপলব্ধি-কামী, অন্তত, প্রধানত কামনার জন্য তাদের জীবনকে তারা ধন্য মনে করেছেন, সে-কথার প্রমাণ দেবার দরকার করে না। কেবল ডিরোজিও ও বঙ্কিমচন্দ্রকে কিছু ভিন্ন প্রকৃতির মনে হয়, বিচারপন্থী হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যয়শীলতা যে ডিরোজিওর অন্তরপ্রকৃতির বড় ধর্ম ছিল, তা বোঝা যায় ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তার কবিতা থেকে। বঙ্কিমচন্দ্রকে বোঝাই শক্ত। তাঁর প্রতিভায় বড় গুণের ও বড় দোষের এমন একত্রসমাবেশ ঘটেছে যে, তার কোন রূপ সত্যরূপ তা বোঝা প্রায় অসম্ভব। তাঁকে বলা হয়েছে, স্বদেশপ্রেমের পুরোহিত। কিন্তু তাঁর স্বদেশপ্রেমে সৃষ্টিধর্মের চেয়ে প্রলয়ধর্ম বলবত্তর। তার ধর্ম ও সমাজ-বিষ্যত রচনাগুলোর বেশি মূল্য দেবার উপায় নেই, কেননা, তিনি নিজে সে-সবের বেশি মূল্য দেন নি, সে-সবে বাদ-প্রতিবাদের ঝাঁজ মরে নি। হয়ত শেষ পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দকে সাহিত্যিক অর্থাৎ রস-স্রষ্টা হিসেবেই দেখতে হবে। সে-হিসেবে মধুসূদনের মতো তাকেও যদি দেখা হয় এই ধর্মান্দোলন-যুগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাতে যুগের প্রকত রূপ আচ্ছন্ন হয় না। [বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে আলোচনা দ্রষ্টব্য।] বিদ্যাসাগরকেও এযুগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা দরকার, কেননা, তাঁর বিধবা-বিবাহ আন্দোলন শাস্ত্র-সমর্থিত হলেও, তিনি নিজে একে জানতেন কাণ্ডজ্ঞানানুমোদিত সামাজিক ব্যাপার বলে, এই মনে হয়।

রামমোহনের আবির্ভাব থেকে সুরেন্দ্রনাথের Indian Association স্থাপনা পর্যন্ত মোটামুটিভাবে এই ধর্মান্দোলন যুগের স্থিতিকাল বলা যায়, কেননা সুরেন্দ্রনাথ ভারতীয় রাজনীতির প্রবর্তক। নিজেকে তিনি অবশ্য জানতেন ধর্মপ্রাণ ম্যাসিনির শিষ্য বলে; কিন্তু তিনি ছিলেন রাজনৈতিক আন্দোলনেরই পরিচালক, শিক্ষিত ভারতবাসী কেমন করে ইংরেজ শাসকদের মতো সুযোগ সুবিধা লাভ করে সম্মানিত জীবন যাপন করবে, এই ছিল তার লক্ষ্য, একথা বললে তার প্রতি অবিচার করা হয় না। Indian Association-এর দশ বৎসর পরে ভারতীয় কংগ্রেস স্থাপিত হয়, আর কংগ্রেস রাজনীতিকে ধর্ম থেকে পৃথক করে দেখতে প্রয়াস পেয়েছিলেন। তবে এক্ষেত্রেও আনন্দমোহন প্রমুখ কর্মীর সেবা দেশের লাভ হয়েছিল, যারা রাজনীতিকে জীবনের অন্যান্য প্রয়াস থেকে বিচ্ছিন্ন করে’দেখেন নি, বরং জীবনের সমস্ত প্রয়াস এক বড় আদর্শের অঙ্গীভূত করে দেখেছিলেন। কংগ্রেসের পূর্বে দেশে রাজনৈতিক আন্দোলন। তেমন প্রবলপ্রতাপ হয়নি, এই বিবেচনা থেকে কংগ্রেসস্থাপনার পূর্ব পর্যন্ত ধর্মান্দোলনের স্থিতিকাল বললে বেশি সঙ্গত হতেও পারে। এর পরে যে সব ধর্মপ্রাণ কর্মীর আবির্ভাব দেশে হয়েছিল-যেমন বিবেকানন্দ ও অশ্বিনীকুমার-তারা রাজনীতিক্ষেত্র থেকে নিজেদের দূরেই রেখেছিলেন বেশি। সেইজন্য ভিন্ন কালে জন্মেও ধর্মান্দোলন-কালের সঙ্গে তারা নিবিড়ভাবে যুক্ত।

এই ধর্মান্দোলন-যুগ শুধু যে বাংলার গৌরব তা নয়, সমগ্র ভারতের গৌরব। পৃথিবীর বড় বড় ধর্মান্দোলন-যুগের সঙ্গে এর তুলনা করলে, এর ত্রুটি সহজেই চোখে পড়ে-চারপাশের দুর্বলতার সঙ্গে এর সংগ্রাম তেমন প্রবল হয় নি। তবু এই যুগের সাধকরা মাঝে মাঝে এমন দুই একটি কাজ করেছেন, দুই একটি কথা বলেছেন, যাতে ধূলিলুণ্ঠিত চতুস্পার্শ্বের জীবনকে যেন মুহূর্তের জন্য, এক সুউচ্চ গ্রামের শোভা-সৌন্দর্য দেখবার শক্তি দান করা হয়েছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ উল্লেখ করা যায়-রামমোহনের শিক্ষাসম্বন্ধে পত্র ও ব্রাহ্মসমাজের ট্রাষ্টডীড, ডিরোজিওর ভারত-বন্দনা, দেবেন্দ্রনাথের দুর্বহ পিতৃঋণ সর্বান্তঃকরণে স্বীকার, কেশবচন্দ্রের “The term Brahmo is not included in the term Hindu”, রামকৃষ্ণের সমস্ত ধর্মের সাধন- চেষ্টা, বিবেকানন্দের “জীবে প্রেমে করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর”, রবীন্দ্রনাথের “বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়।” এরকম আরো কীর্তি ও বাণী ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের আছে, যার ভিতর দিয়ে মানুষের সৃজনী প্রতিভার পরমমননাজ্ঞ রূপ উৎসারিত হয়েছে। এ যুগের অনেক কাজে ও কথায় অভিনবত্বের ছটা অবশ্য কম। কিন্তু তাতে সেসবের মাহাত্ম ক্ষুণ্ণ হয় না। ফুল পুরাতন, কিন্তু প্রতিদিন বাগানে বাগানে নতুন হয়ে ফুটছে। এ যুগ আমাদের এই সুপ্রাচীন দেশের যে একটি শ্রেষ্ঠ যুগ সে সম্বন্ধে আমাদের দেশের শিক্ষিতেরা দিন দিনই বেশি সচেতন হচ্ছেন।

কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষিত-সাধারণের সঙ্গে একালের বাংলার এই স্রষ্টাদের কি সম্পর্ক, সে-কথাটি ভাল করে বুঝে দেখবার প্রয়োজন আছে। এ-প্রশ্ন আমাদের শিক্ষিতদের মনে তেমন ওঠে না, তাঁরা মনে করেন, দেশের মানস জীবনের সহজ ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা পোষণ করবার কারণ উপস্থিত হয় নি। দুশ্চিন্তা অবশ্য অসার্থক; কিন্তু দেশের মানসজীবনের ক্রমবিকাশ যে বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং দেশের একালের স্রষ্টাদের সঙ্গে দেশের শিক্ষিত-সাধারণের সম্পর্ক যে, সাধনা ও সাধনার উত্তরাধিকারের সম্পর্ক নয়, কৃতী পিতার ভদ্রাসন ও প্রতিপত্তির সঙ্গে পুত্রের যে সাধারণ সম্পর্ক সেই সম্পর্ক, এ কথা আমরা বলতে প্রয়াস পেয়েছি। [বাংলার জাগরণ’ ও ‘রামমোহন রায়’ দ্রষ্টব্য।] কেন এমন হয়েছে সে কথাটি সংক্ষেপে বলা যায় এই ভাবে:

রামমোহন থেকে দেশে যে নব চেতনা এলো, তার বড় প্রকাশ হলো দুই ক্ষেত্রে-হিন্দু কলেজে ও ব্রাহ্মসমাজে। এ দুটিই হলো হিন্দু-সমাজের জন্য সংস্কার আন্দোলন-অবশ্য সংস্কারের চেয়ে আন্দোলন বেশি। এই সময়েই হিন্দু-সভ্যতার লাভ হলো বৈদেশিক পণ্ডিতদের [পরিশিষ্ট (ক) দ্র:] শ্রদ্ধা। ফলে এই অনেকখানি দুর্বল সংস্কারকদের সংস্কার চেষ্টাকে, দাম্ভিকতা বলে’ ভাববার সাহস হিন্দু-সমাজের ভিতরে জাগলো। প্রেম ও সৃষ্টি ধর্মী রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দকে তাদের দলে পেয়ে, তাদের অভ্রান্ততা-বোধ বিশেষভাবে বর্ধিত হলো। মুসলমানের চিন্তার ইতিহাসে ইমাম গাজ্জালীর প্রভাব যে-ফল ফলিয়েছিল, একালের হিন্দুর চিন্তাধারায় রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রভাবও সেই ফল ফলালো; অর্থাৎ, সর্বসাধারণের কাছে সংস্কার-চেষ্টা একশ্রেণীর দুর্বলতা আর প্রাচীন সুপরিচিত ধারা নূতন মহিমায় মণ্ডিত হলো।

কিন্তু দেশের একালের এই সংস্কার-চেষ্টা বা নবজীবন লাভের চেষ্টা, এর চেয়েও বড় আঘাত পেল, দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের তরফ থেকে। রাজনীতি অবশ্য মানুষের সমাজজীবনের খুব বড় ব্যাপার। কেউ যদি একে মানুষের জীবনের সব চেয়ে বড় ব্যাপার জ্ঞান করেন, তার সঙ্গে তর্ক না করলেও চলে। কিন্তু আমাদের দেশের ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদের রাজনীতি নামে ও ধরণধারণে রাজনীতি হলেও প্রকৃতপ্রস্তাবে দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কিছু পদমর্যাদা-বচ্ছিন আন্দোলনমাত্র–রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন আবেদন নিবেদনের থালা বহন। শুধু এই ব্যাপারটি দেশের মানস-জীবনের জন্য মারাত্মক হতো না; এটি মারাত্মক হলো এই বিশেষ কারণে যে, এই সামান্য উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য এর তরফ থেকে এমন ঢক্কা-নিনাদ দেশের দিকে দিকে বিঘোষিত হলো যে আত্ম-অম্বেষণের কঠোর প্রয়াস সহজেই দেশের লোকদের কাছে স্বাদহীন মনে হলো, পর-চর্চার স্বাদুতার সামনে। কেউ কেউ হয়ত বলবেন, এক সময়ের এই সৌখিন রাজনীতি চিরদিন সৌখিন থাকে নি-স্বদেশী আন্দোলন, একালের রাজনৈতিক আন্দোলন, নানাজনের নানা ধরণের আত্মদান তার প্রমাণ। যারা এমন কথা বলেন, তাদের মধ্যে অনেক হৃদয়বান্ ব্যক্তি আছেন। তাই পরম বিনয়ে এই কথাটি তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, জীবনের সার্থকতার পথ ক্ষুরধার, যা প্রচণ্ড বা মোহকর তার গতি সেই পথে অবাধ যে হবেই এমন কথা নেই; আর জীবনে যা অসার্থক তাকে সৌখিন না বলে উপায় কি। আত্মদান অবশ্য অশ্রদ্ধার সামগ্রী নয় কখনো, কিন্তু নবতর অন্ধতার জন্মও যে তার থেকে সম্ভবপর, সে-সম্বন্ধে চেতনার অভাব মারাত্মক।

আমাদের দেশের রাজনীতি-চর্চা একটি ক্ষুদ্র দলে আবদ্ধ বলে যে, তাকে আমরা অসার্থক বলতে সাহসী হয়েছি তা নয়। একটি দল কেন একজনের মধ্যেও রূপ লাভ করতে পারে, সমগ্র দেশের কল্যাণ-সম্ভাবনা। আমাদের দেশের রাজনৈতিক অসার্থকতার মূলে, আমাদের শিক্ষিতদের শোচনীয় আত্ম-সর্বস্বতা ও অপ্রেম। যদি বলা যায় যে, দেশের রাজনৈতিক চেতনার প্রারম্ভে তাঁরা পূজারি হয়েছিলেন, পরিতোষ দেবতার আর আজ পূজারি হয়েছেন, অসন্তোষ-দেবতার তবে অপ্রিয় কথা বলা হয় সত্য, কিন্তু অসত্যকথা হয়ত নয়। দেশ বলতে যে বহু শ্রেণীর বহু মানসিক স্তরের লোক বোঝায়, আর দেশসেবা বলতে যে সেই সব মানুষের উন্নয়নের জন্য অক্লান্ত সাধনা বোঝায়, এসব কথা বলবার মতো লোক আমাদের দেশে কম জন্মাননি; কিন্তু যারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রের কর্মী, দেশের এই সমস্যার গুরুত্ব তাদের বোঝানো সম্ভবপর হয়নি। তার চেয়ে তারা প্রয়োজনীয় জ্ঞান করেছেন, তাঁরা যে সংখ্যায় যথেষ্ট অতএব গণনীয় এই কথাটা বিদেশী শাসকদের বোঝাতে। তারা যে তীক্ষ্ণবুদ্ধি সে-কথা মানতে হবে; কিন্তু এই অপ্রিয় সত্যের সম্মুখীন তারা হচ্ছেন না যে, সব জয় জয় নয়, অনেক জয় পরাজয়েরই অন্য নাম, এইখানেই কর্মী হিসেবে তাদের শোচনীয় দুর্বলতা। ভাবার ক্ষমতার সঙ্গেই যুক্ত থাকে গড়বার তাগিদ, এ সুচিন্তা নয়–মোহ; এর বিপরীতটি অবশ্য সত্য-গড়ার ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত থাকে ভাবার তাগিদ। যার গড়বার ক্ষমতা ভাবার তাগিদের পূর্ববর্তী হয় নি, তাঁকে অনায়াসে বলা যায় কুকর্মা। কর্ম ও জ্ঞান এর কোনো ক্ষেত্রে আমাদের দেশের রাজনীতি যে সৃষ্টিপ্রবণ হয় নি, যারা সৃষ্টিপ্রবণ হয়েছেন তাঁদের প্রভাব সে-ক্ষেত্রে নগণ্য হয়েছে, একথা অস্বীকার করবার উপায় আছে মনে হয় না। অথচ, এই রাজনীতির আকর্ষণে আকৃষ্ট হয়েছে দেশের সমস্ত মন।

দেশের দ্বিতীয় জাগরণ-কেন্দ্র মহারাষ্ট্র। বাংলার জাগরণের সঙ্গে তার যোগ নিবিড়। তবে মহারাষ্ট্রও স্বকীয়তা-বিবর্জিত নয়।

মহারাষ্ট্রের জাগরণের নেতা মহাদেব গোবিন্দ রাণাডে। রামমোহনের সাধনার শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার সেকালে তারই লাভ হয়েছিল মনে হয়। রামমোহনের মতোই তিনি স্বদেশ-প্রেমিক আর তার স্বদেশপ্রেমও নিরভিমান। দুর্লভ মনীষারও তিনি অধিকারী; তার A theist’s confession of faith সহজেই ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় চিন্তার গৌরব-স্বরূপ। বাংলায় তার চেয়ে সূক্ষ্মতর চিন্তার বিকাশ হয়েছে, কিন্তু তাঁর মতো স্থিতধী প্রতিভা বাংলায় দুর্লভ।

এই রাণাডে জননায়করূপে নিজেকে যেভাবে প্রকাশ করেছিলেন, সেটি বেশ বুঝে দেখবার মতো। তার মনীষাকে তিনি আবৃত করেননি, ধর্মে ও সমাজে হিন্দুর যে-সব আচার ও চিন্তা তিনি উন্নত জীবনের পরিপন্থী মনে করেছিলেন সে-সব সম্বন্ধে অকুণ্ঠিত তাঁর মতামত। তবু কর্মক্ষেত্রে তিনি বড় জ্ঞান করেছিলেন মতবাদের পরিচ্ছিন্নতা তত নয়, যত তার চারপাশের লোকদের সঙ্গে নিবিড় যোগ ও তাদের দৈনন্দিন জীবনের উৎকর্ষের জন্য অতন্দ্রিত কিন্তু অনুৎকট প্রয়াস। এতে চিন্তার বিচিত্র প্রকাশ তার অঞ্চলে হয়ত আজো তেমন হয় নি; কিন্তু পশ্চিম ভারতের লোকদের অর্থনৈতিক বোধ যে বাঙালির চেয়ে উন্নততর তার সঙ্গে তাঁর সাধনার যোগ বুঝতে পারা যায়। বিশেষ করে’, দেশের সৃষ্টিধর্মী রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁর শিষ্য গোপালকৃষ্ণ গোখেল যেরূপ কৃতী হয়ে গেছেন, তাতে পরিচয় রয়েছে তাঁর সাধনার মাহাত্মের আশ্চর্য এই যে, ইতিহাসে মারাঠাজাতির পরিচয় নির্মম লুণ্ঠনকারীরূপে অথচ সেই জাতির ভিতরে জন্মগ্রহণ করেছেন এমন মানবপ্রেমিক মনীষী। এ বিষয়ে রাণাডে নিজেও হয়তো সজাগ ছিলেন-তিনি নিজেকে উত্তরাধিকারী জ্ঞান করেছেন, মারাঠা জাতির সাধুসন্তদের ও সেই সঙ্গে জাতি-ধর্মনির্বিশেষ ভারতের যুগ-যুগান্তরের ঋষি ও প্রেমিকদের।

মারাঠা জাতির সত্যিকার নেতা রাণাডেই, অন্তত দূর থেকে তাইই আমাদের মনে হয়। কিন্তু এই মারাঠা দেশে আর একজন শক্তিমান্ ব্যক্তিরও জন্ম হয়েছিল, বৃহত্তর দেশের রাজনীতির উপরে তার প্রভাব অসামান্য; তিনি বালগঙ্গাধর তিলক। দেশ তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেছে দুঃসাহসী নেতা জ্ঞানে। কিন্তু তার শক্তি হয়ত বাংলার বঙ্কিমচন্দ্রের মতো প্রলয়ঙ্কর শক্তি-দুর্যোগরাত্রির বিদ্যুৎ-ঝলক তাতে, পথের নির্দেশ তার কাছে কেউ আশা করে না।

কিন্তু ভাবুক বাঙালি ও কান্ডজ্ঞানপ্রিয় মারাঠা দুয়েরই কাছে এই জাগরণ নাম পেল হিন্দু-জাগরণ। হিন্দু-সম্প্রদায়ে সূচিত হলো এই জাগরণ, তাতে উৎফুল্ল হয়ে সাধারণ শিক্ষিত হিন্দু এর এই নামকরণ করলেন তা নয়। দেশের এই নবচেতনা যাদের দ্বারা। সূচিত হলো সেই বরেণ্য স্রষ্টাদেরও অনেকের কাছে এই নাম সমর্থন পেল। এই হিন্দুজাগরণ কথাটা দেশের জীবনধারায় এত বড় জায়গা দখল করেছে যে এ’কে ভাল করে বুঝে দেখবার প্রয়োজন আছে।

এই হিন্দু-জাগরণ কথাটার ভিতরে মোটামুটি ভাবে তিনটি চিন্তাধারা রয়েছে। প্রথমত, হিন্দু-জাগরণ বলতে বোঝা হয়েছে পতিত হিন্দু-সমাজের সহজ ও সবল মনুষ্যত্বের স্তরে উত্থান। অন্যান্য উন্নত সমাজের মানুষ যেমন জগতে সম্মানিত জীবন যাপন করে যাচ্ছে, হিন্দু দীর্ঘকাল তা থেকে বঞ্চিত থাকলেও আবার তার সুদিনের উদয় হয়েছে, এই এ-মতের চিন্তাশীলেরা বলেন। এঁরা বিভিন্ন জাতি বা সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য চিরস্থায়ী মনে করেন, আর সেই বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে জাতিতে জাতিতে অথবা সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সহযোগিতা কামনা করেন। দ্বিতীয়ত, হিন্দু-জাগরণ বলতে বোঝা, হয়েছে হিন্দু-সভ্যতার অন্তর্নিহিত ‘অনন্যসাধারণ শক্তির জাগরণ। হিন্দু-সমাজ অতি পুরাতন-বর্তমান সভ্য জগতে প্রাচীনতম; তার সমবয়সী সব সভ্যতা বিধ্বস্ত হয়ে গেলেও কেবল সে-ই আজো ধ্বংসমুখে পতিত হয় নি; অতএব সিদ্ধান্ত এই যে, তার গঠনের মূলে অতি আশ্চর্য বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা রয়েছে, তার এমন দীর্ঘ পরমায়ুর কারণ সেই বৈজ্ঞানিকতাই। এই মতের চিন্তাশীলদের ধারণা, হিন্দু-সভ্যতা জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা, হিন্দু-জাগরণের অর্থ সেই আশ্চর্য শক্তির জাগরণ-জগতের কল্যাণের জন্য। তৃতীয়ত, হিন্দু-জাগরণ বলতে বোঝা হয়েছে, ভারতের সর্বব্যাপী এক বিশেষ প্রভাবের জাগরণ। এই মতের চিন্তাশীলেরা বলতে চান, ভারতে আর্য অনার্য দ্রাবিড় শক হুন প্রভৃতি বিচিত্র জাতির মিলনে মুসলমানের আগমনের পূর্বে একটি বিশেষ মনোভাবের জাতির সৃষ্টি হয়েছিল। এই মিশ্রিত জাতির সাধারণ নাম হিন্দু। মুসলমানেরা আপনাদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে খুবই চেষ্টা করেছিল। তাদের স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হয় নি; কিন্তু তাদেরও অধ্যাত্ম-দৃষ্টিতে, সঙ্গীতে, স্থাপত্যে, নানা আচারে, হিন্দু-প্রভাব অর্থাৎ ভারতবর্ষের প্রভাব পড়েছিল। সে-প্রভাব দিন দিন গভীরতর হচ্ছিল। সেই ভারতীয়ত্ব কিছুদিন নিষ্প্রভ হয়েছিল, আবার তার শক্তি বোঝা যাচ্ছে। হিন্দু-জাগরণের অর্থ-এই ভারতীয়ত্বের জাগরণ। এদেশের সকলেরই শ্রদ্ধার বস্তু হওয়া উচিত এটি, কেননা এই ই জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে দেশের সকলের সার্থকতা-লাভের পথ। কোনো সমাজের স্বাতন্ত্র্য নষ্ট করে দেওয়া এর স্বভাব নয়, তবে দেশের সব রকমের স্বাতন্ত্র যেন হয় এই মূল ভারতীয়ত্বের সঙ্গে সুসঙ্গত।

হিন্দু-জাগরণের এই তিন অর্থের কিছু বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন হবে তৃতীয় বক্তৃতায়, আপাতত দেখবার দরকার হিন্দুর প্রধান সহকর্মী ও প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলমানের চিন্তা ও কর্মের উপরে এর প্রভাব। সেক্ষেত্রে বোঝা যাচ্ছে, এই হিন্দু-জাগরণের প্রথম অর্থটি শিক্ষিত মুসলমানের অশ্রদ্ধেয় নয়। তৃতীয় অর্থটি সম্বন্ধে শ্রদ্ধার ভাব পোষণ করবার লোকও মুসলমান সমাজে আছে। কিন্তু এর দ্বিতীয় অর্থটি তাদের একান্ত অপ্রিয়। হিন্দু-জাগরণের এই অপ্রিয় অর্থটি দিন দিন মুসলমানের চোখে কেমন স্পষ্টতর হচ্ছে, তার পরিচয় রয়েছে ভারতীয় মুসলিম-জাগরণের নেতা স্যার সৈয়দ আহমদ খান ও তাঁর পদাঙ্ক-অনুসরণকারীদের প্রচেষ্টায়।

স্যার সৈয়দ বাল্যে মোগল সংস্কৃতির আবহাওয়ায় লালিত হয়েছিলেন। বোধ হয় সেইজন্যই স্বধর্ম ও স্ব-সম্প্রদায়ের প্রতি একান্ত অনুরাগ সত্ত্বেও ওহাবী অসহিষ্ণুতার কবলে তিনি কখনো পতিত হন নি। মোগল সংস্কৃতি সেই সৌজন্যই তাঁকে হয়ত শক্তি দিয়েছিল, দেশের সম্ভ্রান্ত হিন্দুদের গভীর শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে। ধর্ম-বিশ্বাসের পার্থক্য সত্ত্বেও শুধু একদেশবাসী হিসেবে মানুষে মানুষে যে আর্থিক ও রাজনৈতিক যোগ আছে। সে-সম্বন্ধে তিনি ছিলেন যথেষ্ট সচেতন। একটি বক্তৃতায় তিনি নিজেকে জাতি হিসেবে বলেছিলেন হিন্দু অর্থাৎ হিন্দুস্থানের অধিবাসী। উন্নতিপ্রবণতার জন্য বাঙালিজাতির প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিল; কলিকাতা হাইকোর্টের বিচারক একজন বাঙালি হিন্দু নিযুক্ত হয়েছিলেন দেখে, ভারতবাসী হিসেবে তার আনন্দের সীমা ছিল না। তবু শিক্ষা ও রাজনীতির ক্ষেত্রে মুসলিম-স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে যেতে তিনি কুণ্ঠিত হন নি। মৌলানা মোহাম্মদ আলি কোকনদকংগ্রেসে তার অভিভাষণে স্যার সৈয়দের রাজনৈতিক মনোভাব বিশেষভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন। জীবনের সব ক্ষেত্রে মুসলমানেরা বড় বেশি পেছনে পড়ে গিয়েছিল, এই জন্যই স্যার সৈয়দ মুসলমানদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা প্রয়োজনীয় মনে করেছিলেন, এই ছিল তাঁর বক্তব্য। তার কথা মিথ্যা নয়। সিপাহী বিদ্রোহের ফলে মুসলমানদের অপরিসীম দুঃখে পতিত হতে হয়েছিল, তার জন্য দেশের রাজনৈতিক জাগরণ, অর্থাৎ শাসকদের সঙ্গে যোঝাবুঝি, স্যার সৈয়দ যে মুসলমানদের জন্য অবাঞ্ছিত মনে করবেন, এ বোঝা যায়। কিন্তু এ ভিন্ন অন্য একটি উদ্দেশ্যও যে তার ছিল তা বুঝতে পারা কষ্টসাধ্য হওয়া উচিত নয়। তিনি ইসলামকে বলেছিলেন, “এক লাজওয়াব নূর” (তুলনাহীন জ্যোতিঃ)-যা চিরউজ্জ্বল চিরপূর্ণাঙ্গ। হিন্দু-জাগরণ বলতে যাঁরা বোঝেন জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার জাগরণ, তাঁদের সেই ব্যাখ্যার সঙ্গে তার এই ইসলাম-ব্যাখ্যার মিল রয়েছে। এই দিক থেকে দেখলে বোঝা যায়, মুসলিম স্বাতন্ত্র্য স্যার সৈয়দ চেয়েছিলেন শুধু যে মুসলমানের দুর্বলতার জন্য, তা হয়ত সত্য নয়। মুসলিম সভ্যতার খ্যাতি জগৎজোড়া, সেই সভ্যতার উত্তরাধিকারী ভারতীয় মুসলমান আপাতত হতশ্রী হলেও কেন চেষ্টা করে দেশের অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকদের মতো সম্মানের পাত্র হবে না, তাদের চেয়ে বেশি শ্রদ্ধার্য হওয়াও তাদের পক্ষে কিছুমাত্র অসম্ভব নয়-এই ধরণের চিন্তায় অনুপ্রাণিত হওয়া সেদিনে তাঁর পক্ষে কত স্বাভাবিক ছিল, তা বোঝা যায় এই কথা ভাবলে যে সে-যুগে রাণাডের মতো মনীষী ও স্বদেশবৎসল ব্যক্তি সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠতে চেষ্টা করেও ভারতীয় জাতীয় জীবন বলতে হিন্দু-জীবনই বুঝেছিলেন বেশি। সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সৌহার্দ্য তখন ছিল জাতীয় জীবন সম্বন্ধে উচ্চতম ধারণা। হিন্দু-জাগরণ’, ‘মুসলিম জাগরণ এ-সব দেশের জাগরণের সঙ্গে কিভাবে সম্বদ্ধ সে-ধারণা তখন দেশের শ্রেষ্ঠদের মনেও ছিল অস্পষ্ট। তবু পূর্ণাঙ্গ জীবন সম্বন্ধে অনেকখানি ধারণা স্যার সৈয়দ ও তাঁর কোনো কোনো সহকর্মীর ছিল– যেমন, তাদের সমসাময়িক শ্রেষ্ঠ হিন্দুজাগরণকামীদের ছিল। যা সত্য নয় তা ইসলাম নয়’-তার এই ইসলাম-ব্যাখ্যা কল্যাণপ্রসূ হবে আশা করা যায়। কিন্তু মুসলমানদের জন্য একটি শক্তিশালী আধুনিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা তিনি যে জীবনের ব্রত করেছিলেন, মনে হয় এরই ভিতরে রয়েছে তার প্রতিভার সত্যিকার মর্যাদা।

স্যার সৈয়দের পরে মুসলিম জাগরণের বড় বাহ সৈয়দ আমির আলি ও স্যার মোহাম্মদ ইকবাল। আমির আলি অনেক বিষয়ে ছিলেন স্যার সৈয়দের যোগ্য পরবর্তী। স্যার সৈয়দ জ্ঞানী হলেও প্রধানত ছিলেন কর্মবীর, মুসলমানের দুর্দশা ঘুচিয়ে তাকে আধুনিক কালের লোকদের সঙ্গে সহজভাবে চলবার সামর্থ্য দেবার সাধনা ছিল তার। আমির আলির চেষ্টা হয়েছিল-অনেকখানি স্যার সৈয়দেরই অনুবর্তিতায়-মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত নিষ্করুণ সমালোচনার সৌজন্যময় প্রতিবাদ ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলমানের সুমহৎ সম্ভাবনা প্রদর্শন। এঁরা দুজনেই যুক্তিবাদী; আমির। আলি নিজেকে বলেছিলেন মোতাজেলাপন্থী। ইসলামতত্ত্ববিদ ডক্টর ম্যাকডোন্যাল্ড এতে ঘোর আপত্তি করেছেন। তাঁর মতে এই নব ভারতীয় মোতাজেলাবাদ ইয়োরোপীয় যুক্তিবাদের ছদ্মনাম মাত্র। তাঁর কথায় সত্য আছে, কিন্তু ইয়োরোপীয় যুক্তিবাদের সঙ্গে মোতাজেলাবাদের দূর-সম্পর্ক যখন আছে, তখন তার এত আপত্তি অশোভন। তাছাড়া আমির আলির দাবীর সত্যতা বোঝা যায়, তাঁর স্বসম্প্রদায়ের শিক্ষিত-সাধারণের উপরে তার প্রভাবের স্বরূপের কথা ভাবলে। তাঁর প্রভাবে তাঁদের স্বধর্মানুরাগ কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় নি অথচ সেই সঙ্গে জ্ঞান ও উদারতার প্রতি কিছু অনুরাগ তাদের মনে জেগেছে।

কিন্তু আমির আলির নেতৃত্ব তাঁর স্বসম্প্রদায়ের লোকদের জন্য স্যার সৈয়দের মতনও কল্যাণপ্রসূ হয়নি, তার নিজের একটি মারাত্মক দুর্বলতার জন্যে। যে-দেশে তার জন্ম সে-দেশে ভিন্নধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের মধ্যে চিন্তা ও কর্মের যত আন্দোলন চলেছিল, সে-সবের সঙ্গে তার সম্পর্ক যে নেই তা নয়, কিন্তু বড় অসম্পূর্ণ ও খণ্ডিত সে-সম্পর্ক। সুরেন্দ্রনাথের Indian Association এর পরে ও কংগ্রেসের আবির্ভাবের পূর্বে তিনি Central Mohamedan Association-এর প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার রাজনীতির প্রশংসা আমরা করতে পারি নি, কিন্তু সেই রাজনীতির সঙ্গে তুলনায়ও আমির আলির রাজনীতি অদ্ভুত বলে মনে হয়। তাঁর Central Mohamedan Association-এর প্রেরণায় বাংলার বহুস্থানে নানা শ্রেণীর ‘আঞ্জুমান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু মনে হয় তাতে বলবার বিষয় মাত্র এই দাঁড়িয়েছিল যে, মুসলমান হিন্দু থেকে স্বতন্ত্র। স্যার সৈয়দের সঙ্গে এ ক্ষেত্রে তার পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। স্যার সৈয়দ স্বাতন্ত্রবাদী হলেও সৃষ্টি-ধর্মী, কিন্তু আমির আলি, অন্তত কর্মক্ষেত্রে, শুধু স্বাতন্ত্র্যবাদী। বাংলার ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদের রাজনীতির যে আদিরূপ-শিক্ষিত সম্প্রদায়ের আপন পদমর্যাদার জন্য অন্তহীন উপরোধ-আমির আলি তাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিলেন মনে হয়। তবে আমির আলির ভিতরে রাজনীতির চেয়ে জ্ঞানানুরাগ প্রবল, তাই তাঁর স্বাতন্ত্র্যবাদ উৎকট আকার কখনো ধারণ করে নি।

স্যার ইকবাল সমসাময়িক ব্যক্তি। হিন্দু ও মুসলমানের বিচ্ছিন্নতা ও বিরোধ যখন দেশে উৎকট হয়েছে, তখন তিনি দাঁড়িয়েছেন মুসলিম নেতৃত্বের দাবী নিয়ে। তাই তাকে বুঝবার জন্য তাঁর বিরুদ্ধ পক্ষকে বোঝা দরকার। এই বিরুদ্ধ পক্ষ কে? ঠিক হিন্দু-সমাজ নয়, তার বিরুদ্ধ পক্ষ হিন্দু-সমাজে হিন্দুত্ব সম্বন্ধে একটি মনোভাব। হিন্দুজাগরণ বলতে যারা বোঝেন জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শের জাগরণ, আর যারা বোঝেন ভারতের প্রকৃতি হিন্দু-প্রকৃতি, এই উভয় মতের এক অদ্ভুত মিশ্রণ ঘটেছে। তাতে। হিন্দুত্বের এই যে রুদ্র মূর্তি এর সঙ্গে ইসলামের ওহাবী মতের আশ্চর্য মিল রয়েছে। দুয়ের উৎপত্তি-সূত্রও একই। মুসলমান জগতের শক্তিহীনতা থেকে ওহাবী প্রতিক্রিয়া জন্মলাভ করেছে, তেমনি হিন্দুর যুগযুগান্তের শক্তিহীনতা ও ব্যর্থতা-বোধ থেকে জন্ম হয়েছে এই রুদ্র-হিন্দুত্বের। হিন্দুত্বের এই রূপ হিন্দুসমাজে যে ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে তা নয়, কিন্তু মুসলমানের চোখে সে শুধু মাত্রার ভেদ। মুসলিম-বিদ্বেষ হিন্দুত্বের অতি বড় পরিচয়চিহ্ন বলে একালের মুসলমানদের মনে হয়েছে।

ইকবাল সেই কথাই খুব বড় করে বলছেন এই ভাবে-হিন্দুর অবলম্বিত জাতীয়তাবাদ দেশে সর্বব্যাপী হিন্দু-প্রাধান্য স্থাপনের ছদ্মনাম। তার সঙ্গে আরো তিনি বলছেন-মুসলমান তাতে রাজি হতে পারে না এই জন্য যে, জগতের একটি অতি বড় আদর্শের সে বাহন, তাহলে সেই আদর্শ তাকে বিসর্জন দিতে হয়। অথচ এই মনোভাবের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নব্য তুর্কীর প্রতি শ্রদ্ধাবান যদিও তিনি জানেন যে নব্য তুর্কী তার ইসলাম-ব্যাখ্যা গ্রহণ করে না। অকৃত্রিম স্বদেশপ্রেমের পরিচয়ও তাঁর কাব্যে আছে, তার নয়া শিবালয়’ কবিতায় স্বদেশ-দেবতার পূজাকে তিনি বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। অল্পদিন পূর্বের একটি অভিভাষণেও তিনি বলেছিলেন-ভারত যদি কবীর বা আকবরের মত গ্রহণ করতো, তাহলে কথা ছিল না; কিন্তু তা যে হয় নি সেজন্য বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আদর্শ অম্লান রাখা ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদের একমাত্র কর্তব্য বলে তিনি মনে করেন। [All-India Muslim League-এ অভিভাষণ, ২৯ ডিসেম্বর, ১৯৩০।]

বোঝা যাচ্ছে ইকবাল পণ্ডিত হলেও দুর্বল চিন্তা-নেতা-সমসাময়িক বিপর্যস্ত ভারতীয় জীবনের দ্বারা বিশেষভাবে বিক্ষুব্ধ। কিন্তু তিনি কবি, যখন যা বলেন সমস্ত অন্তর দিয়ে বলেন, তাতে তার বাণীর প্রভাব কম হচ্ছে না। ভারতের মুসলমানকে সব বিষয়ে হুশিয়ার হতে হবে, এই বহুকালের অর্ধস্ফুট কথা আপাতত দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত মুসলমানের বুকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছে।

হিন্দুসমাজের কর্মীদের আমরা দুই ভাগে ভাগ করেছি-স্রষ্টা ও শিক্ষিতসাধারণ। এই দুইয়ের ভিতরে সাধনার যোগ ঠিক নেই, এই আমরা বলতে প্রয়াস পেয়েছি। মুসলমান-সমাজেও তেমনি স্যার সৈয়দকে ভাবা যায় স্রষ্টা আর তার পরের কর্মীরা প্রায় সবাই শিক্ষিত মাত্র। সৃষ্টিধর্মী রাজনীতি নয় রাজনৈতিক স্বার্থবুদ্ধি উভয় সমাজের এই শিক্ষিত-সাধারণের প্রধান পরিচয়চিহ্ন। দেশের বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদের সঙ্গে একালের স্রষ্টাদের যে সহজ ও নিবিড় যোগ একালের এই শিক্ষিত-সাধারণ সেদিক দিয়ে দুর্ভাগ্য।

দেশের জাগরণ-চেষ্টার যে পরিণতি হলো তা বেদনাদায়ক। হিন্দু-জাগরণ, ‘মুসলিম-জাগরণ’-কামীদের কাছে যে অর্থে ব্যক্ত হলো তা নাও হতে পারতো। হিন্দুসমাজে সূচিত এই জাগরণকে হিন্দু-জাগরণ বলে পরিচিত করবার আগ্রহ হিন্দু সমাজে এমন প্রবল না হলেও অস্বাভাবিক-কিছু হতো না। রাজনীতি খেয়ালী না হয়ে সৃষ্টিধর্মীও হতে পারতো। কিন্তু অতীতের উপরে ফরমস করা চলে না, তাই বর্তমানের প্রয়োজন-সংযতভাবে দেশের এই নিষ্ঠুর বিরোধের দিকে তাকিয়ে দেখা, আর এর হাত থেকে দেশের লোকদের অব্যাহতি লাভের কি উপায় আছে তারই সন্ধান করা। এই বিরোধ সম্বন্ধে আরো কিছু বলবার প্রয়োজন হবে তৃতীয় বক্তৃতায়, আপাতত সংক্ষেপে এই কথাটা বলা যায় যে, একদিকে মুসলমানের ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত শক্তি-দৈন্য, যার জন্য নবজাগরণ সহজ হতে পারে নি, তার ভিতরে অধিকন্তু সন্দেহশীলতা তাতে হয়েছে দৃঢ়মূল, অন্যদিকে হিন্দুর নবজীবন লাভের অকৃত্রিম প্রয়াস কিন্তু তারই সঙ্গে তার অদ্ভুত আত্মসম্পূর্ণতাবোধ, যার জন্য নবজাগরণ সহজেই তার ভিতরে রূপান্তরিত হয়েছে বিভিন্ন ধরণের মানসিক সৌখিনতায়-এই যে দেশের দুই বিবদমান সম্প্রদায়ের দ্বিবিধ দুঃখ এর কোনোটিই যেন আমাদের সতর্ক দৃষ্টির প্রহরা এড়িয়ে না যায়। এই দুই সমাজের দুঃখের স্বরূপ যদি দেশের লোকেরা বাস্তবিকই উপলব্ধি করতে পারে, তবে সে-দুঃখ জয় করা তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য না হওয়াই স্বাভাবিক।

২৭ মার্চ, ১৯৩৫

ব্যর্থতার প্রতিকার

হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ আমাদের সামনে যে-রূপ নিয়ে দাঁড়াচ্ছে, আমাদের দেশের অনেক চিন্তাশীল ব্যক্তি তাকে অবিশ্বাস করেন। তারা বলেন-হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বহু রকমের পার্থক্য আছে, তার জন্য তাদের মধ্যে সৌহার্দ্য কম, এ-সব কথা মানা যায়, কিন্তু তাদের যে উৎকট বিরোধ আজ দেশে জেগেছে। তার যথেষ্ট কারণ এই ধরণের মনোমালিন্যই নয়, তাদের বিরোধের যা কারণ রাজনীতির ক্ষেত্রে তা সনাতন, তার ইংরেজি নাম Divide and Rule.-এর উত্তর বহুবৎসর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এ ভাবে সমস্যাটাকে দেখলে এর কোনো মীমাংসা খুঁজে পাওয়া যাবে না, কেননা আমরা, অর্থাৎ দেশের হিন্দু ও মুসলমান, বড় দুর্বল আর যারা divide and rule করছেন তারা অত্যন্ত সবল, বিচ্ছিন্ন কোনো দিন মিলিতের সঙ্গে বিরোধে জয় লাভ করতে পারে না।

কিন্তু সম্প্রতি তাঁরও মতের পরিবর্তন হয়েছে মনে হয়। অন্তত তাঁর “রাশিয়ার পত্রে” এই কথাই বিশেষভাবে বলা হয়েছে যে, ভারতের সাম্প্রদায়িক বিরোধের জন্য মুখ্যত দায়ী ভারতের শাসকবর্গ। রবীন্দ্রনাথ যখন রাশিয়ায় তখন ঢাকার দাঙ্গা হয়। পরজাতির সামনে তাঁর স্বদেশবাসীদের সেই মূঢ়তা ও বর্বরতা তার যে গভীর লজ্জার কারণ হয়েছিল, মনে হয়, তারই জন্য এমন একটি ক্ষোভের সৃষ্টি তার মধ্যে হয়েছিল।

যারা বলেন সরকারি Divide and Rule নীতি দেশের সাম্প্রদায়িক বিরোধের জন্য দায়ী, তাদের মোট বক্তব্য এই-ভারতে এখন হিন্দু কিছু প্রবল হয়েছে, তাকে দমিয়ে দেওয়া রাজনীতির দিক দিয়ে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কিন্তু এই নীতি যদি বাস্তবিকই দেশের পরিচ্ছন্ন শাসন-নীতি হতো, তাহলে সাম্প্রদায়িক বিরোধে এক পক্ষেরই বেশি জয়ী হওয়া স্বাভাবিক হতো। তা অবশ্য হয় নি। খবরের কাগজের কথা যদি বিশ্বাস করতে হয় তবে বলতে হয়, এই সব বিরোধে কোনো কোনো স্থানে হিন্দু বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কোনো কোনো স্থানে মুসলমান বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে, এমন ধরণের দাঙ্গা অনেক সময়ে হয়ে ওঠে হাটের মারামারির মতো; হাটে মারামারি লাগলে কে যে কার শত্রু অনেক সময়ে সেই জ্ঞানই পায় লোপ, কেবল চলে অন্ধ আঘাত আর প্রতিঘাত; কেউ নিরপেক্ষও থাকতে পারে না; সেইভাবে কোনো কোনো সরকারি কর্মচারীর কখনো কোনো পক্ষে ভিড়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। আর নারদমনোবৃত্তিসম্পন্ন কর্মচারীও একান্ত দুর্লভ না হতে পারেন। রাজশক্তির তরফ থেকে দেশের অনুন্নত শ্রেণীর লোকদের অকৃত্রিম উন্নতি-চেষ্টা দেশের উন্নত সম্প্রদায়ের লোকদের মনোদুঃখের কারণ হলেও প্রকৃষ্ট রাজনীতি-ভেদনীতি নয়।

কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিরোধে স্পষ্ট ভেদ-নীতির দোষ শাসকদের না থাকলেও অন্য রকমের দোষ থেকে তারা মুক্ত নন। সেটি হচ্ছে এ দেশের সমাজ ও ধর্ম-সংক্রান্ত ব্যাপারে হস্তক্ষেপে তাঁদের ভীতি। সিপাহীবিদ্রোহের স্মৃতি হয়ত তারা মনে থেকে মুছে ফেলবার প্রয়োজন অনুভব করেন নি। সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে ভারতবাসীর মনোভাবে যতটা অন্ধতা ছিল, তার প্রভাব তাদের উপরে যে কম হয়েছে এ কথা স্বীকার করাও তারা হয়ত সুবিবেচনা মনে করেন না। কিন্তু অন্ধতার প্রতিকার অন্ধতার দ্বারা হয় না। এদেশ যদি আচার-প্রধান হয়, অর্থাৎ বিচার এদেশের লোকদের কাছে সমাদৃত না হয়, তবে দেশের শাসনকার্যের লক্ষ্য হবে সেই সব বিচিত্র আচারকে শুধু বিবদমান হতে না দেওয়া-এ-নীতিতে বুদ্ধির পরিচয় থাকলেও, দৃষ্টি ও শক্তির পরিচয় নেই। সেই জন্য এ-নীতি শান্তির প্রার্থী হলেও পায় অশান্তিই; কেননা, বিবাদের অবসানরূপ যে শান্তি জীবনে তা লাভ করা সম্ভবপর নয়। জীবনে শুধু লাভ করা যায় সৃষ্টিধর্মের যে শান্তি, অর্থাৎ দেশের বিভিন্ন শ্রেণীর পরস্পরের প্রতি বর্তমান শ্রদ্ধা, তাই।

কাজেই যারা ভেদনীতিকে দেশের সমস্ত ব্যাধির মূল কারণ বলে বুঝেছেন, তাঁদের মত বদলাবার ক্ষমতা আমাদের না থাকলেও, তাদের মতের বিরুদ্ধে যে যুক্তি আছে সে-কথা বলবার অবসর আমাদের আছে। হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের যত কারণই থাকুক, তাদের নিজেদের বহুকালের বিকৃত বুদ্ধি যে তার মূলে এ কথাটা সূত্র স্বরূপ ধরে নেওয়া সঙ্গত বৈ অসঙ্গত নয়, কেননা শুধু ইতিহাস নয় বিচার ও আত্মবিশ্বাস এর অনুকূলে। পল্লীর খড়ের ঘরে যে আগুন লাগে তার আশু-কারণ হয়ত আগুন ও গৃহস্থের অসাবধানতা, কিন্তু যিনি এর প্রতিকারে অগ্রসর হবেন তাঁর কাজ হবে সহজ-দাহ্য এই গৃহগুলির সংস্কার। আর এ সংস্কারে গৃহস্থের অগ্রহাতিশয্যই স্বাভাবিক।

হিন্দু ও মুসলমানের বিকৃত বুদ্ধিই যে তাদের বিরোধের মূলে, এ চিন্তা আমাদের দেশের গত কয়েক শতাব্দীর শ্রেষ্ঠদেরও। তারা এর নিরাকরণের চেষ্টাও কম করেন নি। তাদের সেই সব চেষ্টার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক।

হিন্দু ও মুসলমানের সংঘর্ষ এদেশে যখন হয়েছে, তাদের মিলনের চেষ্টাও প্রায় তখন থেকে হয়ে আসছে। পাঠান-যুগের অনেক সাধু-সন্তের বাণীতে তার পরিচয় রয়েছে। কিন্তু এ-চেষ্টা বেশ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে কবীর ও আকবরের মধ্যেই। আকবরের হিন্দু মুসলমানের মিলনের চেষ্টার মূল্য তেমন দেওয়া হয় নি। তাতে অন্যায় তেমন হয়েছে মনে হয় না, কেননা আকবর অপর্ব প্রতিভার অধিকারী হলেও তার হিন্দ মুসলমানের সমন্বয়-চেষ্টায় খেয়ালিত্ব রয়েছে ঢের। তিনি যে বিভিন্ন ধর্মের কিছু কিছু আচার গ্রহণ করেছিলেন, সে-সমম্বয় তার নিজেরই জন্য, সেটি সকলের হোক এ কামনা তিনি করেছিলেন ভাবা কঠিন। আকবরের ভিতরে কবি-প্রকৃতি ছিল, বিভিন্ন রূপের পূজায় তার সৌন্দর্যবোধ তৃপ্ত হতো। এর দাম কম নয়। কিন্তু তাঁর সমন্বয়চেষ্টা মুখ্যত ব্যক্তিগত ব্যাপার বলেই মনে হয়। হিন্দু-মুসলামান-বিরোধ সম্পর্কে তাঁর বড়। কীর্তি হচ্ছে অহিংসা ও মৈত্রীর বাণী প্রচার, মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠদের বা সর্বযুগের প্রেমিকদের যা সাধারণ ধর্ম।

মধ্যযুগের সমন্বয়কারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান বোধ হয় কবীরের ও তার পরে দাদু ও রজ্জবজীর। এক হিসেবে হিন্দু-মুসলমান বিরোধের শ্রেষ্ঠ সমম্বয় এঁদের চিন্তায়ই রয়েছে। মানুষকে এঁরা সব স্থূল আবরণ উন্মোচিত করে দেখেছেন, আর সেই দেখাই যে সত্যকে দেখা, সে-কথা পরম মনোহর ভাষায় প্রকাশ করে গেছেন। তাই তাদের চিন্তা সমসাময়িক রূপ যা পেয়েছিলেন, তাইই সে সবের চরম রূপ নয়। সব বিক্ষোভের ভিতরে সত্যকে শান্ত হয়ে দেখবার সঙ্কেত এসবে আশ্চর্যভাবে সঞ্চিত আছে।

কিন্তু এঁদের চেষ্টায় যে আশানুরূপ ফল ফলে নি তার কারণ শুধু জনসাধারণের অক্ষমতাই নয়। এই ব্যর্থতার কারণ এঁদের বাণীর ভিতরেই নিহিত আছে মনে হয়। হিন্দু ও মুসলমানের যে বিরোধ দেশে জাগলো তা শুধু চিন্তা-ধারার বিরোধ নয়, সেই বিরোধের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক রূপও প্রবল। কিন্তু সে-সবের মীমাংসায় এই জ্ঞানীদের। দৃষ্টি তেমনভাবে আকৃষ্ট হয় নি। কবীর বললেন-বেদ ও কোরআন ভব-বন্ধন স্বরূপ, ও-সবের ভিতরে তুমি কেবল ঘুরপাক খেয়ে মরবে। তার এ কথায় হিন্দু ও মুসলমানের আচার-পৃজা যযাগ্যভাবেই তিরস্কৃত হলো। কিন্তু বৃহত্তর সমাজ-জীবনে আচার অর্থাৎ কানুন বিসর্জন সম্ভবপর নয়, তাই বেদ ও কোরআনের প্রবর্তিত আচার যদি গ্রহণ করা না হয়, তবে অন্য কি আচার গ্রহণ করতে হবে সে-সম্বন্ধে স্পষ্ট নির্দেশ আবশ্যক। বলা বাহুল্য, মানুষের বৃহত্তর সমাজ-জীবনের প্রয়োজন এই জ্ঞানীদের বাণীতে মেটে নি। বলে’ এঁদের বাণীর বিদ্যুচ্ছটায় মানুষের অন্তর আলোকিত হয়েছে, কিন্তু বিদ্যুতের। মতোই ক্ষণকালের জন্য। সে-উপলব্ধিকে সমাজ-জীবনে সার্থক করা যাবে কি উপায়ে, সে-সম্বন্ধে তেমন কোনো নির্দেশ না পাওয়ার ফলে প্রাচীন চিরাচরিত পন্থাই তাদের জন্য পন্থা রয়ে গেছে।

উচ্চ চিন্তার এই যে সামাজিক রূপ গ্রহণে কুণ্ঠা, মনে হয় এ ভারতীয় চিন্তার মজ্জাগত দুর্বলতা। একে যদি কেউ ভারতীয় চিন্তার বৈশিষ্ট্য বলতে চান তিনি তা বলতে পারেন। এর স্বপক্ষেও কিছু বলা যে না যায় তা নয়। কিন্তু এ দুর্বলতাই কেননা, শুধু সুবিবেচনা নয় ভয়ও এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। বহুকাল পূর্বে এদেশে বহু জাতি ও সম্প্রদায়ের যে একত্র-সমাবেশ ঘটেছিল, তার ফলে আচার-প্রাধান্যের সাহায্যে দেশে শৃঙ্খলা বিধানের চেষ্টা হওয়া বিচিত্র নয়। সেই থেকে আচার-ধর্ম এদেশে যে বড় ধর্ম হয়ে আছে, তা বার বার কিছু কিছু আঘাত পেলেও মোটের উপর বিশেষ প্রতিপত্তিই। সম্ভোগ করে আসছে। মধ্যযুগের জ্ঞানীরাও এদেশের সমাজ-জীবনে হস্তক্ষেপ করতে সঙ্কুচিত হয়েছেন এ কথা বলা যায়। এই আচার-প্রধান্যের জন্যই এদেশে উচ্চ চিন্তা অনেকটা মানস সৌন্দর্যের ব্যাপার রয়ে গেছে। আর এই সব চিন্তা যে মানসলোক থেকে কর্ম-লোকে পদার্পণ করতে এমন সঙ্কোচ বোধ করেছে, সেজন্য অদ্ভুতত্বের সঙ্গে এসবের সংস্রব দুর্লভ হয়নি। চৈতন্যচরিতামৃতে আছে-একদিন মহাপ্রভু চিন্তিত হলেন এই কথা ভেবে যে যবন-জাতি “গোব্রাহ্মণ হিংসা করে মহাদুরাচার, তাদের উদ্ধারের কোনো উপায় দেখা যায় না; তখন হরিদাস বললেন তাদেরও মুক্তি অনায়াসে হবে, কেন না হারাম হারাম বলে তারা প্রকারান্তরে রাম নাম উচ্চারণ করে-নৃসিংহ পুরাণে আছে “দ্রংষ্ট্রীদ্রংষ্ট্র হতে স্নেচ্ছো হারামেতি পুনঃ পুনঃ উক্তাপি মুক্তিমাপ্লেতি কিং পুনঃ শ্ৰদ্ধয়া গৃণ” (অন্ত্যলীলা, তৃতীয় পরিচ্ছেদ)। এ প্রসঙ্গ বাস্তবিকই চৈতন্যদেবের সঙ্গে হয়েছিল, না নাম-মাহাত্ম সম্বন্ধে এটি ভক্তদের অতি-রঞ্জন, তা বলা শক্ত; তবে “চৈতন্যচরিতামৃতের মতো একখানি প্রামাণিক গ্রন্থে এ কথা যে স্থান পেয়েছে এই থেকে অনেকটা বোঝা যাচ্ছে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠদের চিন্তা-ভাবনার ধারা। সত্যকে নানা রকমে বার বার পরীক্ষা না করে পূর্ণ সত্য বলে গ্রহণ করার যে মনোবৃত্তি মোটের উপর তা অজ্ঞানতার সঙ্গে আপোষ। আর সত্যের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক রূপ লাভ না হোলে তাকে পরীক্ষাই করা হোলো না বলা যায়।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে দেশে যে জাগরণ এলো মধ্যযুগের মতন মুখ্যত তা ধর্মান্দোলন একথা আমরা বলতে প্রয়াস পেয়েছি। কিন্তু সেদিক দিয়ে মধ্যযুগের চেয়ে এযুগের আন্দোলন দুর্বল, কেননা ব্যাপকভাবে মানুষের আত্মিক উৎকর্ষের কথা এ যুগের নায়করা যতটা ভেবেছেন, তার চেয়ে বেশি ভেবেছেন নিজেদের সম্প্রদায়ের লোকদের পারমার্থিক ও আর্থিক উৎকর্ষের কথা। (ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র বলেছিলেন বটে, ব্রাহ্ম হিন্দুর অংশ-মাত্র নয়, কিন্তু সেটি এক অমূল্য মুহূর্তের প্রেরণার ফল, নিজেকে হিন্দু বলে পরিচিত করবার আগ্রহ তারও ভিতরে কম নয়)। হিন্দু-মুসলমানবিরোধের মীমাংসা-চেষ্টা এযুগে হয়েছে গৌণভাবে, মুখ্যভাবে নয়। তবু এই গৌণ চেষ্টার মূল্যও কম নয়। দেশের একটি স্থানে যদি প্রকৃত উন্নতি-চেষ্টা চলে, তবে তার প্রভাব সর্বত্র সঞ্চারিত হওয়া স্বাভাবিক। ঊনবিংশ শতাব্দীর জাগরণ-চেষ্টা যে সমাজধর্মী হয়েছিল এজন্য দেশের সর্বাঙ্গীন উন্নতির ক্ষেত্রে তার মর্যাদা মধ্যযুগের সাধনার চেয়ে কম নয় বরং বেশি। সেই চেষ্টা কিভাবে রাজনৈতিক মরীচিকায় বিভ্রান্ত হয়েছে তা আমরা দেখেছি। বাস্তবিক, দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভিতরে যে প্রকৃত সংস্কার-চেষ্টা আরম্ভ হয়েছিল, এইই হয়ত হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ বলতে যা বোঝায়, দেশের সেই দুরবস্থা উত্তরোত্তর অপনোদন করে’ চলত। এতেই এ সমস্যার মীমাংসা হয়ত হতো না, তবু বর্তমানে এ বিরোধ যে ঘৃণিত রূপ ধারণ করেছে, তা থেকে দেশ রক্ষা পেতে।

দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আত্ম-অম্বেষণ-চেষ্টা অনেকটা রুদ্ধ হলেও বিড় মুসলান-বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা বরাবরই হয়ে আসছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সে-চেষ্টা অপ্রবল, কিন্তু চিন্তার ক্ষেত্রে তার প্রাবল্য কম নয়। এই চিন্তার ক্ষেতে একালের দুজনের চেষ্টাই বিশেষ শ্রদ্ধার্য হয়েছে-রামকৃষ্ণের ও রবীন্দ্রনাথের।

রামকৃষ্ণ দেবের “যত মত তত পথ” বাণী জগতের বিরোধসামঞ্জস্যের এক বড়ো মন্ত্র বলে কোনো কোনো মনীষী মত প্রকাশ করেছেন। সে চিন্তা-পদ্ধতিতে সত্য-দৃষ্টির চেয়ে শুভ ইচ্ছা যে বড়ো, একথা আমরা বলতে প্রয়াস পেয়েছি; কেননা পথ নির্দিষ্ট আছে এ সত্য নয়, পথ বারবার আবিষ্কার করতে হয় এইই সত্য-রামকৃষ্ণ দেবের পথও চিরাচরিত পথ নয়, আবিষ্কৃত পথ। [দ্র: রামমোহন রায়] তবে দেশের লোকদের যে অবস্থা তাতে এ চিন্তারও বিশেষ মূল্য আছে। দেশের লোকে যদি অন্তত এই কথাটা বুঝতে পারে যে, মানুষ বিচিত্র, মানুষের মতও বিচিত্র, সব এক ছাঁচে-ঢালাই সম্ভবপর নয়, তাহলেও বিরোধ-শান্তির অনেকটা সহায়তা হয়। “যত মত তত পথ” কথাটিতে নবসৃষ্টি-প্রবণতা যতখানি তার চেয়ে সমাজ ও ধর্মের প্রাচীন রূপের পূজার আগ্রহ বেশি। এর মধ্যে যে কাব্যসৌন্দর্য আছে তাতেই আকৃষ্ট হয়েছে অনেক ভাবুক ব্যক্তির চিত্ত, কিন্তু মানুষ আজ এত কাছাকাছি এসে হাজির হয়েছে যে, তাদের দেশকালের পটে সাজিয়ে সাজিয়ে কল্পনার চোখে না দেখে সহজভাবে খোলা চোখে দেখবার প্রয়োজন বেশি হয়ে পড়েছে।

রবীন্দ্রনাথের সমন্বয়-বাদের দুইটি ধারা। একদিকে, তাকেও বলা যায় “যত মত তত পথ” বাদী-বিভিন্ন শ্রেণীতে ও দেশগত বৈশিষ্ট্যর দিকে তার দৃষ্টি শ্রদ্ধাপূর্ণ; আর এক দিকে তিনি বিশেষভাবে সৃষ্টিধর্মী-মানুষকে দেশে কালে বিভক্ত না দেখে এক অখণ্ড বিকাশমান সমাজের সভ্যরূপে দেখেছেন, সমাজ-জীবনে উৎকর্ষলাভ যার জন্য পরম সত্য। তার Religion of Man-গ্রন্থে তার এই মত বিশদভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। এই যে বিকাশ-ধর্মী মানুষ সমাজজীবনে অক্লান্তভাবে সৃষ্টিশীল হয়ে চলা যার জন্য সার্থকতার পথ, এর অভ্যুদয় দেশে না হলে হিন্দু-মুসলমানবিরোধ বলতে আমাদের যে দুঃখ বোঝায় তা দূর হবে না এইই আমাদেরও প্রধান নিবেদন।

এই বিকাশ-ধর্ম অথবা সৃষ্টিধর্ম কি? খুব ঘোরালো না করে সহজভাবে বলা যায়-জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে মানুষের যে অন্তহীন কৌতূহল, সেইটি হল সৃষ্টিধর্ম। শুধু নতুন কিছু করবার ঝোঁককে সৃষ্টি-ধর্ম বলা অসাধারণ, কেননা, জ্ঞান সেখানে তেজোহীন। যুগে যুগে মানুষ যে জীবনের সর্বক্ষেত্রে নূতন সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখেছে, নূতন নূতন কর্মের উদযাপনে প্রাণপাত করেছে, সে-সব তার সৃষ্টিধর্মেরই প্রেরণায়। এর অর্থ অবশ্য এ নয় যে সৃষ্টিধর্মের প্রভাবে মানুষ রাতারাতি আগাগোড়া বদলে গিয়ে অদ্ভুত-কিছু হয়ে ওঠে। হয়ত অন্তরের নূতন উপলব্ধির গাঢ়তার দিক দিয়ে সে বদলেই যায়; কিন্তু আসলে, মানুষ জীবনের পথে ধীরে ধীরেই চলে, একেবারে নূতন হয়ে ওঠা তার শক্তির বাইরে। চারপাশের জীবনের সঙ্গে মানুষ যে নিবিড় যোগে যুক্ত সৃষ্টি-ধর্ম তাকে কখনো অস্বীকার করে না, বরং পূর্ণভাবে স্বীকার করে তাতে ফুটিয়ে তোলে নূতন সম্ভাবনা-আর ক্রমাগত চলে এর কাজ।

এই যে মানুষের ক্ষমতা-পরিবেষ্টনকে নিয়ে নূতন হয়ে ফুটে ওঠা-এ শুধু পরমাশ্চর্য নয় অত্যাবশ্যক, যেমন- অত্যাবশ্যক দেহের কোষাণুসমূহের অক্সিজেনসংস্পর্শে প্রতিমুহূর্তে দগ্ধ ও পুনর্গঠিত হওয়া। আর যে-কারণে দেহ-শুদ্ধির এই প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত জন্মে-অর্থাৎ স্বাস্থ্যরক্ষায় অমনোযোগ অথবা ব্যাপক অমনোযোগ-সেই কারণেই ব্যাহত হয় সমাজজীবনে সৃষ্টিধর্ম। সমাজ-জীবনে এই অমনোযোগ বহুরূপে আত্মপ্রকাশ করে, এত রূপে যে সে-সবের নামকরণ অসম্ভব, যেমন স্বাস্থ্যের এক নাম কিন্তু ব্যাধির নামের অন্ত নেই-তবে আমাদের দেশে এর বড় পরিচয়স্থল হয়েছে ধর্মসম্বন্ধে আমাদের ধারণা। সে-ধারণায় অমনোযোগ, অন্যকথায় চারদিকের জীবনের সঙ্গে সংস্রবের অভাব এবং মোহের প্রভাব, এমন আশ্চর্য পরিণতি লাভ করেছে যে তার প্রাচীনত্ব রীতিমত সম্ভ্রমের সামগ্রী হয়ে উঠেছে।

হিন্দু-জাগরণ সম্বন্ধে আমাদের আরো আলোচনা করবার আছে। সেই জাগরণ তত্ত্বেও দেখা যাবে, সেই প্রাচীন অমনোযোগের প্রভাব। হিন্দু-সমাজে সূচিত হয়েছিল এই জাগরণ, এজন্য যদি একে হিন্দু-জাগরণ বলতে হয় তবে জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের সাধনার সাম্প্রদায়িক রূপকে অসঙ্গতভাবে বড় করে দেখা হয়। তার চেয়ে, এ জাগরণে হিন্দুত্ব কতখানি অহিন্দুত্বই বা কতখানি তা বোঝা যাবে, যারা জাগ্রত হয়েছিলেন তাঁদের দিকে ভাল করে চেয়ে দেখলে। যে সব কর্ম, যে সব চিন্তা, এমন কি যেসব ব্যক্তি থেকে তাঁরা প্রেরণা লাভ করেছিলেন সেসবে হিন্দুত্ব যতখানি আছে অহিন্দুত্ব তার চেয়ে মোটেই কম নেই; আর যারা প্রেরণা লাভ করেছিলেন, প্রগাঢ় স্বজনপ্রীতি সত্ত্বেও, কোনটি হিন্দু কোনটি অহিন্দু এই বিবেচনার দ্বারা তারা প্রেরণালাভের পথে চালিত হননি। বাস্তবিক, যারা সৃষ্টিধর্মী, সত্য ও সৌন্দর্যের প্রেরণা তারা যে জগতের যে কোনো স্থান থেকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেন, দেশ জাতি কাল এর কোনো ব্যবধান তাদের জন্য ব্যবধান হয় না, এই দিনের আলোর মতো সুস্পষ্ট কথা আমাদের দেশের অনেক সৃষ্টিধর্মী ব্যক্তিও যে মাঝে মাঝে কেমন করে বিস্মৃত হয়েছেন, একথা ভাবলে বিস্ময়ে বিহ্বল হতে হয়। এর মুখ্য কারণ বোধ হয় এই যে, সৃষ্টি-প্রবণতা তাঁদের মধ্যে স্বল্পক্ষণস্থায়ী হয়েছে, আর দেশের উচ্চশ্রেণীর ভিতরেও অজ্ঞানতার বহুবিস্তারের জন্য বিচারের পথ তাঁদের মনে হয়েছে দুস্তর।

দেশের একালের এই জাগরণের মূলে যত বিচিত্র প্রভাবের ক্রিয়া আছে সেসব বিস্মৃত হয়ে এবং সমস্ত দেশের জন্য এ-জাগরণ কত অর্থপূর্ণ সেই বৃহৎ দায়িত্বের পাশ কাটিয়ে হিন্দু-সমাজে আরব্ধ জাগরণ যে শুধু হিন্দু-জাগরণ নাম পেল এই মোহ অথবা অমনোযোগ ধর্ম-মোহ নাম পাবারই যোগ্য। ধর্মের যে গোড়ার কথা মনুষ্যত্ব-বোধ তার সঙ্গে মোহের নিত্য-বিরোধ; এ-ধর্ম হচ্ছে দীর্ঘকালের বিচারহীন আচারপ্রিয়তা সাংসারিক জীবনের প্রচ্ছন্ন ব্যর্থতাবোধ এই আচার-মোহকে অথবা ধর্ম-মোহকে এমন মধুর করেছে মনে হয়। ধর্ম-মোহই যে এদেশে মানুষের অন্তর্নিহিত সৃষ্টি-ধর্মের ব্যর্থতার প্রতিরূপ তার একটি বড় পরিচয় এই যে, হিন্দু-জাগরণের প্রতিক্রিয়ায় দেশের মুসলমানদের ভিতরে বিশেষভাবে জাগুলো সাম্প্রদায়িক ধর্ম-বুদ্ধি।

কিন্তু ধর্মকে যারা আগাগোড়া মোহ বলেন তাদের মত আমরা গ্রহণ করি না। কেননা জীবনের সার্থকতা ধর্ম-বোধে, অর্থাৎ, সত্যে অথবা কোনো আদর্শে সমর্পিতচিত্ততায়। প্রচলিত ধর্ম-সম্প্রদায়গুলোর মধ্যেও এরূপ সমর্পিতচিত্তদের জন্য হয়েছে। কাজেই এই প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদের হতে হয়-প্রত্যেক ধর্মসম্প্রদায়কে মোহ থেকে মুক্ত করে প্রকৃত ধর্ম-প্রীতিতে প্রতিষ্ঠিত করাই কি দেশের চিন্তাশীল কর্মীদের শ্রেষ্ঠ কাজ নয়? এই ভাবেই কি মানুষের সৃষ্টি-ধর্ম বা বিকাশ-ধর্ম সক্রিয় করে তোলা হবে না?

বলা বাহুল্য আমাদের দেশে এতদিন প্রধানত এই চেষ্টাই হয়েছে। তাতে ফল যে হয় নি সে-কথা না বললেও চলে। কিন্তু ফল হয় নি চেষ্টার দোষও বটে; দেশের বিভিন্ন ধর্মকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার না করে শুধু এই বিশ্বাসকে পাথেয়রূপে অবলম্বন করা হয়েছে যে, সব ধর্মের ভিতরেই জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সত্য নিহিত রয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের অর্থাৎ ধর্ম-বিধানের জীবননিয়ন্ত্রণের অধিকার পুরোপুরি স্বীকৃত হয়েছে।

এ-অনর্থের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভবপর হয়, যদি ধর্মকে চিরস্থির বিধানরূপে গণ্য না করে আবিষ্কারের বিষয় বলে ভাবা যায়, তাহলে ধর্মগ্রন্থ ও মহাপুরুষ হবেন জগতের চিন্তাশীল ও তাঁদের বাণীর মতো মানুষের শ্রদ্ধার বস্তু-তার পূজা-আরতির বস্তু নয়। কিন্তু ধর্ম-বিধানের পূজারি যারা তারা, তাদের সাধ্যানুসারে উদারতম হয়েও এতে স্বীকৃত হবেন মনে হয় না। ধর্মবিধানের উপরে বিচার-বুদ্ধির স্থান দান তাদের চোখে ঘোর অধর্ম বলে বিবেচিত হওয়াই স্বাভাবিক, যদিও জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে তারা প্রতিনিয়ত বিচার-বুদ্ধিকে বিধানের উপরে স্থান দান করছেন, কেননা বিধানের ব্যাখ্যার পরিবর্তন নিয়তই হচ্ছে।

আমাদের দেশে ধর্মের যা প্রকৃতি তাকে নিছক আচার-পূজা না করে উপায় নেই, সৃষ্টি-ধর্ম তাই তার তরফ থেকে বাধাই বিশেষভাবে পায়। এহেন ধর্মকে জীবন নিয়ন্ত্রণের ভার দেওয়া বাস্তবিকই বিপত্তিকর। কতখানি বিপত্তিকর তা বোঝা গেছে মহাত্মা গান্ধীর চেষ্টা থেকে। তিনি প্রত্যেক ধর্মকে এমন পূর্ণাঙ্গ জানেন যে ধর্মান্তর-গ্রহণ তাঁর চিন্তার অতীত। তিনি সজাগভাবেই এ-মত প্রকাশ করেছেন। ধর্ম বলতে তিনি যা বোঝেন তার ভিতরে আচার- প্রিয়তা থাকলেও প্রবল বিচার-বুদ্ধি বেশি করে আছে; তাই তাকে জীবন-নিয়ন্ত্রণের ভার দেওয়া অসঙ্গত বা অশোভন হয় না। কিন্তু তার চিন্তার সেই অভিনবত্বের দিকে জনসাধারণের দৃষ্টি তেমন ভাবে আকৃষ্ট না করে’, তিনি যে তাদের হতে বলেছেন স্বধর্মে নিষ্ঠাবান এতে প্রকৃত ধর্ম-ভাব নয় ধর্মমোহই দেশে প্রবল হবার সুযোগ পেয়েছে। একালের বিবর্ধিত হিন্দু-মুসলমান বিরোধের জন্য তিনি আংশিকভাবে দায়ী একথা তাই বলা যায়। অসাবধানতা জীবনের সর্বক্ষেত্রেই বিপজ্জনক। ধর্মের ক্ষেত্রে যারা তাকে মনে করেন সার্থকতার পথ, এত অভিজ্ঞতার পরে আমাদের বলতেই হবে, তারা ভুল করেন।

কাজেই এই যে সুপরিচিত সিদ্ধান্ত যে হিন্দু হিন্দুত্বে নিষ্ঠাবান হলে এবং মুসলমান মুসলমানত্বে নিষ্ঠাবান হলে তাদের মিলন সম্ভবপর হবে এর উপরে যাদের নির্ভর তাঁরা। সাধু-উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েও অন্ধকারে পা বাড়ান। এ-সিদ্ধান্তে উপনীত হবার পূর্বে তাদের যাচাই করা উচিত হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্ব বলতে তাঁরা কি বোঝেন। কিন্তু তেমন ভাবে যাচাই করতে গেলে তাদের অবলম্বন হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্ব হবে না, হবে এই দুয়েরই অন্তর্নিহিত সৃষ্টিধর্ম। অন্যভাবে কথাটা বললে দাঁড়ায়, হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্ব অতীতে ও বর্তমানে যে-রূপ পরিগ্রহ করেছিল ও করেছে তাইই সে-সবের প্রকৃত রূপ একথা অর্থহীন, তার পরিবর্তে এই সব ধর্ম ভবিষ্যতে কি ভাবে মানুষের জ্ঞান ও কর্ম শক্তির সূতিকাগার হবে এইই হওয়া চাই হিন্দু মুসলমান সব সম্প্রদায়ের লোকদেরই বিশেষ সাধনার বিষয়। এই কথাই রয়েছে রবীন্দ্রনাথের এই বাণীতে-যা শাস্ত্র তাই বিশ্বাস্য নয়, যা বিশ্বাস্য তাই শাস্ত্র। [পরবর্তীকালে মহাত্মা গান্ধীও এই অভিমত প্রকাশ করেন: লিখিত শাস্ত্রই পূর্ণাঙ্গ ধর্মশাস্ত্র নয়, ধর্ম হচ্ছে চিরন্তন বিবেক।]

এই সৃষ্টি-ধর্ম অদ্ভুত বা দুঃসাধ্য কিছু যে নয়, প্রতিদিন তা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। মানুষ আরো বড় হবে, আরো সুন্দর হবে এ-বিশ্বাস মানুষের মর্মমূলে। এত যে ধর্ম জগতে প্রবর্তিত হয়েছে, এত বিচিত্র সভ্যতার বিকাশ হয়েছে, এত জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রচার হচ্ছে, সৃষ্টি-ধর্ম বা বিকাশ-ধর্ম ভিন্ন এসবের মূলে আর কিসের প্রেরণা থাকতে পারে! তবে, মানুষ সৃষ্টিধর্মী হলেও জাগ্রত ভাবে নয়। জগতের মানুষ একালে প্রায় একপরিবারভুক্ত হয়ে পড়েছে, তাদের সজাগ চেষ্টার পরিমাণ তাই যথেষ্ট বাড়াবার প্রয়োজন।

সৃষ্টি-ধর্মী না হলে দেশের যুগযুগান্তরের সংগৃহীত আচারের দাসত্বই যে দেশের লোকদের জন্য বড় হয়ে থাকবে, দেশের মনোজীবন ও সমাজ-জীবনের নব নব সম্ভাবনা তাদের মনে হতে থাকবে দুরাশামাত্র, একথাটা আমরা মহামূল্য জ্ঞান করি বলেই যে-সব চিন্তাশীল বলেন, ভারতের যে বিশেষ প্রকর্ষ-ধারা জ্ঞাতসারে হোক বা অজ্ঞাতসারে হোক, তারই হওয়া উচিত ভারতবাসীর জীবনের নিয়ামক, তাঁদেরও কথা আমাদের মনে কিছু সন্দেহের উদ্রেক করে। এই চিন্তাধারা যাদের তারা খুব বড় এই কথাটি বলেন যে, দেশের যে বহুকালের ভৌগোলিক পরিস্থিতি ও জীবন-ধারা তা সেই দেশের লোকদের স্বভাবের অঙ্গীভূত হয়ে যায়, সেই স্বভাবের দিকে দৃষ্টি রেখে না চলে স্বভাব সময়ে ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নেয়। এরা আহার-বিহার পোষাক-পরিচ্ছদ থেকে আরম্ভ করে বিশেষ বিশেষ আদর্শের অনুসরণ পর্যন্ত জীবনের সর্ব ব্যাপারে দেশের লোকদের, যে দেশের প্রকৃতির দিকে লক্ষ্য রেখে চলতে বলেন, এ খুব সঙ্গত কথাই বলেন। কিন্তু এই চিন্তাধারার ভিতরে দুর্বলতা এই যে স্বভাব যে, সৃষ্টিশীল আর সেই সৃষ্টিশীলতা মন্দ-গতি হলেও অশ্রান্ত-গতি, মানুষের কোনো দুর্বলতার প্রতি তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যেমন তার স্বভাব নয়, তেমনি কোনো দুর্বলতাকে চরম দুর্বলতা জ্ঞান করাও তার স্বভাব নয়-এই বড় কথাটা এর শ্রদ্ধার বিষয় তেমন নয়। একটু ভাবলেই বোঝা যায়, এই চিন্তার অধিনায়করা বেশ একটি সাবধানতার বাণী উচ্চারণ করলেও মোটের উপর নির্দেশহীন এদের বাণী। ভারতীয় সংস্কৃতি বলতে কোন সংস্কৃতি বোঝ হবে-বৈদিক, বৌদ্ধ, পৌরাণিক, মরমী, মোগল অথবা ব্রিটিশ?-যদি এসবের মিশ্রণ হয়, তবে কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে সে-মিশ্রণ কি কি ধরণের হবে, কেন হবে?–এসব প্রয়োজনীয় কথা সম্বন্ধে এঁদের কোনো সদুত্তর নেই। আসলে, এসব কথা যারা বলেন তাঁদের শ্রেষ্ঠরা সৃষ্টিধর্মী, সেই সৃষ্টির ব্যাপারে তারা ভারতের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় থেকে কিছু কিছু প্রেরণা গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁদের বোঝা উচিত, তাদের মতো সবাই যে কেবল ভারতের ইতিহাস থেকে প্রেরণা গ্রহণ করবেন এ সম্ভবপর নয়, অপ্রয়োজনীয় এবং কতকটা অসম্ভবও বটে। তারাও কেবল ভারতের ইতিহাস থেকে প্রেরণা গ্রহণ করেন নি। শুধু বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় নয়, জীবনের অনেক ব্যাপারে বিশ্বজোড়া একাকারত্ব একালে যেমন অপরিহার্য তেমনি বাঞ্ছনীয়। এর পরও বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য মানুষের জন্য দুর্লভ হবে না, যেমন এক পরিবারে বহু রুচির লোকের জন্ম হয়, একই ভাষায় বহু মতের সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটে।

একালের হিন্দুচিন্তাশীলদের (ভারতীয় না বলে হিন্দু বলাই সঙ্গত কেননা এক্ষেত্রে মুসলমান চিন্তাশীলেরা হিন্দুচিন্তাশীলদের অনুকারী মাত্র) এই যে বৈশিষ্ট্য-প্রীতি, এটি ভাল করে বুঝে দেখবার সময় এসেছে। কিছু আত্মসম্মানজ্ঞান, অর্থাৎ গড্ডলিকাপ্রবাহে ভেসে না যাওয়ার ভাবটি, যে এর মধ্যে আছে সেটি অবশ্য ভাল, কিন্তু এ ভিন্ন এর বাকি সবটাই মনে হয় প্রচ্ছন্ন অভিমান, আরো সংকীর্ণ করে বলা যায়, প্রচ্ছন্ন জাতি অভিমান অথবা ব্রাহ্মণত্বের অভিমান। যাদের রাজনৈতিক ভাগ্য মন্দ, তাদের পক্ষে এমন অভিমানও মন্দ নয়, কারো কারো এই মত; কিন্তু অভিমানের জন্যও যে মন্দ ভাগ্য অচল হয় তা যথার্থ, কেননা অভিমান ও সৃষ্টি-ধর্ম পরস্পর-বিরোধী। এই অভিমান হিন্দুর জীবনী-শক্তির এক পরিচয়-চিহ্ন, এই মত দেশে প্রসার লাভ করেছে। কিন্তু হিন্দুর জীবনী-শক্তি বলতে যে ব্যাপারটার প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করা হয়, সেটি এত প্রশংসাৰ্হ কি না তাও ভাবা দরকার। হিন্দু বেঁচে আছে এ যতটা সত্য, নিজের চোখে ও জগতের চোখে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে বেঁচে আছে, এ তার চেয়ে কম সত্য নয়। তার চেয়ে গ্রীক মরে গেছে কিন্তু মরে গিয়েও সে জগতের প্রেরণা-স্থল হয়ে আছে, এর গৌরব হয়ত বেশি। শুধু বেঁচে থাকাই অবশ্য গৌরবের নয়, তাহলে সে-গৌরব হিন্দুর প্রাপ্য নয়। হিন্দুর গৌরব এই জন্য যে এক সময়ে তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের জন্ম হয়েছিল, তাদের প্রভাব আজো তাদের জীবনে সক্রিয়। কিন্তু তাইই যদি সত্যি হয়, তবে অভিমানের অবকাশ নেই, কেননা শ্রেষ্ঠদের প্রভাব সক্রিয় হয় তাদের পূজা প্রদক্ষিণে বা গৌরবকীর্তনে নয়, তাঁদের মতো সৃষ্টিশীলতায়-আর সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে একান্ত যোগ বিনয় ও সত্যানুসন্ধিৎসারই। ভারতীয় সংস্কৃতিবাদ প্রভৃতি চিন্তা জীবনের দায়িত্ব পূর্ণভাবে স্বীকার না করারই নামান্তর বলে মনে হয়। পরিবেষ্টনের সঙ্গে নিবিড় যোগের বাণী যে এতে প্রচারিত হয়েছে, সেটি মহামূল্য সন্দেহ নেই, কিন্তু সৃষ্টির ব্যাপারে স্বদেশ বিদেশ সবই উপকরণের ক্ষেত্র, একথাও পুরোপুরি স্বীকার করতে হবে। যে সৃষ্টিধর্মী সে স্বদেশ-দেবতার অর্চনা করে বিশ্বজ্ঞান ও বিশ্বসৌন্দর্যের আলোকে।

পরিবেষ্টনের সঙ্গে নিবিড় যোগ-এই কথাটি দেশের হিন্দু ও মুসলমানদের দুই ভাবে বুঝবার প্রয়োজন আছে মনে হয়। মুসলমান-সমাজের নিম অংশ সহজেই দেশের সঙ্গে নিবিড় যোগে যুক্ত। এই বাংলাদেশে তাদের সেই যোগের অনবদ্য পরিচয় রয়েছে লোক-সাহিত্যে ও লোক-সঙ্গীতে। কিন্তু মুসলমান-সমাজের উচ্চ বা সম্ভ্রান্ত অংশ সম্বন্ধে একথা তেমন ভাবে বলা যায় না। অথচ অল্প কিছুকাল পূর্বেও এই সম্ভ্রান্ত অংশ, নিজেদের পূর্ণভাবে স্বধর্মনিষ্ঠ জেনেও জাতিধর্ম নির্বিশেষে দান, অতিথি-সৎকার, দেশের গুণীদের সমাদর, ইত্যাদি ব্যাপারে পরাজুখ ছিলেন না। তাদের বর্তমান আর্থিক অস্বাচ্ছল্য এর একটি বড়ো কারণ, তা সহজেই বোঝা যায়, কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কারণ যে তাদের পরিবর্তিত মনোভাব বা “ওহাবী প্রতিক্রিয়া” সে-কথা আমরা বলতে প্রয়াস পেয়েছি। তার কারণ যাইই হোক, দেশের সঙ্গে সহজ প্রীতির যোগের অভাব তাদের মধ্যে যে ঘটেছে, এ শুধু তাঁদের জন্য লজ্জার কথা নয়, শঙ্কার কথাও বটে, কেননা, এ তাদের জীবনের ব্যর্থতার এক নিদারুণ পরিচয়-চিহ্ন। আর হিন্দুর জন্য এই পরিবেষ্টনের সঙ্গে যোগ অনেকটা স্বাভাবিক মনে হলেও প্রকৃতপ্রস্তাবে তা নয়। হিন্দুর সমাজজীবনে উচ্চ ও নিচের ভিতরে যে ঘোর ব্যবধান, তাইই তার জন্য প্রিয় করেছে রক্ষণশীলতা-বিচিত্র ধরণের আত্ম-সম্পূর্ণতায় যার প্রকাশ। সে-রক্ষণশীলতায় জীবন কোনো রকমে রক্ষা পেলেও তার বিকাশ অথবা সৃষ্টি-ধর্ম যে কেবলই বাধা পায়, সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে শিক্ষিত হিন্দুর অপারগতা শিক্ষিত মুসলমানের দেশাত্মবোধের অভাবের মতনই ভয়ঙ্কর। এক হিসেবে ভারতের যুগযুগান্তরের ইতিহাস ব্রাহ্মণ-শূদ্রের ইতিহাস। হিন্দু, মুসলমান, ইংরেজ, সব যুগেরই এই রূপ-ব্রাহ্মণ বা সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায় রাজাশ্রিত আর জনসাধারণ ভারবাহী। এমন ব্যাপার প্রাচীনকালে অবশ্য সব দেশেই ঘটেছে; কিন্তু এ-ব্যবস্থা ভারতে যে এমন চিরস্থায়ী হবার উপক্রম করেছে, মনে হয়, তার মূলে দেশের সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের উৎকট রক্ষণশীলতাই পরিবেষ্টনের সঙ্গে যোগ যেখানে বিকৃত।

এই দুই ভাগ্যবিড়ম্বিত দলের বিরোধ বর্তমানে এমন দশায় এসে পৌঁছেছে যে, একটিকে নির্মূল করে বিরোধশান্তির কথা ভাবা অপরটির পক্ষে বিচিত্র নয়। এটি আসুরিক অতএব নিন্দনীয় এই কারো কারো মত। কিন্তু আসলে এ সম্ভবপর নয়। দেশের হিন্দু ও মুসলমান কারো গায়ে এত জোর নেই যে, অপরকে পর্যুদস্ত করতে পারে। তাই সে-চেষ্টায় অগ্রসর হোলে কিছুকাল মারামারি ও তার পর রেষারেষি এই হবে সার। যারা বলেন এমন মারামারিতে দেশের লোকদের ক্ষাত্রতেজ বাড়বে, তাদের মহাতেজা ক্ষত্রিয়দের কুরুক্ষেত্রে সম্মিলিত হওয়ার কথা স্মরণ করা ভাল। শুভ ও শুভ ইচ্ছা চিরদিনই অশ্রান্ত সাধনার অপেক্ষা রাখে।

কিন্তু এমন সাধনার দিকে দেশের লোকের মন রুজু হতে পারার অবস্থায় আছে কি না, সেটিও অবশ্য জিজ্ঞাস্য। দেশের অনেক কর্মও চিন্তানেতা যে, ভগ্নোৎসাহ হয়ে পড়েছেন তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু সে-নৈরাশ্য তাঁদের ব্যক্তিগত দুর্বলতা বলে’ ভাবাই ভাল। হিন্দু-মুসলমান-বিরোধ-ব্যাধি থেকে দেশকে মুক্ত করবার চেষ্টা যথেষ্ট হয় নি এ মিথ্যা নয়। মধ্যযুগ থেকে একাল পর্যন্ত এই বিরোধ-মীমাংসার যত চেষ্টা দেশে হয়েছে, সেসব থেকে নূতন প্রেরণাই আমরা লাভ করে’ বলব, যদি সেসবের সত্যিকার মূল্যের দিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি থাকে, আর এই জ্ঞানের অভাব আমাদের ভিতরে না হয় যে, দেশকে সুন্দর ও সার্থক করতে আমাদের অক্ষমতা, আমাদের জীবনের চরম অসার্থকতার নামান্তর।

এইখানেই বড় প্রয়োজন সৃষ্টিধর্মী নব নেতাদের। অতীতের প্রতি তারা হবেন শ্রদ্ধাষিত, তার পূজারি কখনো নয়-তাদের প্রধান লক্ষ্য হবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। সেইজন্য সুপ্রাচীন “হিন্দু” ও “মুসলমান”-এর মিলন তাদের কাম্য হবে না, কেননা তা অসত্য ও অসম্ভব, তাঁদের কাম্য হবে একটি নব জাতি গঠন-যার সূচনা নানা ভাবে বহুকাল ধরে দেশে হয়েছে, দেশের একালের জীবনের জন্য যার প্রয়োজনের অস্ত নেই। মনোজীবন ও রাষ্ট্রজীবন দুই ক্ষেত্রেই অশ্রান্তভাবে চলবে তাদের সৃষ্টির কাজ। একালের যে ধর্ম-সম্প্রদায়গত রাষ্ট্রজীবন সেটি কদাচ তাদের সমর্থনের বিষয় হবে না, কেননা, তার ফলে এদেশের অভিশাপ-রূপ জাতি-ভেদ নব নব সম্ভাবনা লাভ করে’ চলবে; তাদের সাধনার বিষয় হবে দেশের জনসাধারণের সর্বাঙ্গীন উৎকর্ষ, কেননা, তারই ভিতরে নিহিত রয়েছে দেশের রাষ্ট্র-জীবনের, অথবা জীবনের সত্যিকার বিকাশ সম্ভাবনা।

আমাদের দেশের এক শ্রেণীর রাজনীতিজ্ঞের অভিমত কতকটা এই। তবে মনে হয় তারা বেশি খেয়ালী। তাঁরা যে বলেন যে বৈদেশিক শাসনের ফলে দেশের আর্থিক ও অন্যান্য বহুবিধ দুঃখ যত বেড়ে গেছে, সেসব থেকে দেশকে মুক্ত করে তবে তার শ্রীবৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে, এ মোটের উপর চমকপ্রদ কথাই বেশি। এর পরিবর্তে সৃষ্টিধর্মী কর্মীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়া উচিত জাপানের দিকে। মাঝে মাঝে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ক্ষতি-স্বীকার তার নিয়তি কিন্তু সেই নিষ্ঠুর নিয়তি স্বীকার করে চলেছে। তার উন্নতি-চেষ্টা। মহাত্মা গান্ধী তাঁর কোনো এক কর্ম-পদ্ধতি সম্বন্ধে একবার বলেছিলেন, one step is enough for me এক পা বাড়াতে পারলেই আমি খুশি-কর্মের ক্ষেত্রে এ পাকা কথা। কোনো রকমের মোহ নয়, সত্যাশ্রয়িতা, প্রতিপদে সৃষ্টিধর্মী কর্মীদের অবলম্বন।

ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা নয় জ্ঞান ও জাতীয়তা দেশের লোকদের শরণ্য হবে, নিঃসন্দেহে; কিন্তু জাতি বলতে কি বোঝা হবে? বাঙালি, মাদ্রাজী, পাঞ্জাবী?-না ভারতীয়? ভারতবর্ষ বহুকাল ধরে একটি দেশ। ভৌগোলিক পরিস্থিতির জন্য ভারতীয় না হয়ে ভারতবাসীর পরিত্রাণও নেই। তবু আপাতত বাঙালি, মাদ্রাজী ও পাঞ্জাবী হওয়াই বেশি ভাল মনে হয়; কেননা তা বেশি স্বাভাবিক ও কম কষ্টসাধ্য। অবশ্য ভারতীয়ত্বের বিরোধী যে বাঙালিত্ব মাদ্ৰাজীত্ব পাঞ্জাবীত্ব তা কদাচ কাম্য নয়।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন-ভারতীয় জাতীয়ত্বের রূপ হবে ইসলাম-দেহ ও বেদান্ত-মস্তিক। তার চেয়ে এই কথা বলাই ভাল, ভারতীয় জাতীয়ত্বের রূপ হবে পূর্ণাঙ্গ মানব-দেহ ও পূর্ণাঙ্গ মানব-মস্তিষ্ক, সৃষ্টিশক্তির প্রকাশ যার ভিতরে হবে অবাধ। ইসলাম ও বেদান্ত মানুষের সৃষ্টিশক্তিরই পরিচয়-চিহ্ন। মানুষের সেই সৃষ্টিশক্তি কোনো দিন নিঃশেষিত হবে না, চিরদিন অক্লান্ত ও অম্লান থাকবে, এইই তার জন্ম। অধিকার। সে-অধিকার সত্য হোক।

২৮ মার্চ, ১৯৩৫।

পরিশিষ্ট

(খ)

প্রমাণ-পঞ্জী (সংক্ষিপ্ত)

[গ্রন্থে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি এমন কয়েকজন গ্রন্থকার ও তাঁদের গ্রন্থের নাম।

প্রথম বক্তৃতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-রাজাপ্রজা।

আবদুল কাদের-ওহাবী বিদ্রোহ (জয়তী)

নলিনীকান্ত গুপ্ত-হিন্দুমুসলমান। (ও প্রদীপ)।

Vincent A. Smith-History of India. Ibn Batuta in Bengal-Dr. N. K. Bhattasali’s Early Independent Sultans of Bengal.

Macdonald-Muslim Theology Cambridge History of India Jurisprudence and Constitutional thought.-Vols. V & VI.

O’Leary-Arabic thought and its Nur Ahmad-Notes added to place in history. Momen Committee’s Report on Muhammadan Education. Muhammad Ali-English Tran-হাকিম হাবিবুর রহমানের অভিভাষণ-slation of the Quran. শিখা, ৫ম বর্ষ (ঢাকা)।

S. Khuda Buksh-Muhammad (Essay). Encyclopaedia Britannica Wahhabism.

দ্বিতীয় বক্তৃতা

Rammohạn Centenary Booklet of Religious thought in Islam. No. 1.রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-আত্মপরিচয়। Natesan–Eminent Mussalmans.ভূদেব, মুখোপাধ্যায়-সামাজিক প্রবন্ধ, মুসাদ্দাস-ই-হালী।

পারিবারিক প্রবন্ধ। হায়াত-ই-জাবেদ।

স্যার সৈয়দ আহমদ-কোরআনের আবুল হুসেন-স্যার সৈয়দ (শিখা, ৩য় উর্দুভাষ্য। বর্ষ, ঢাকা)।

Sir Muhammad Iqbal-Six Lectures on the Reconstruction

তৃতীয় বক্তৃতা

ক্ষিতিমোহন সেন-ভারতীয় মধ্যযুগে আবুল হসেন-তরুণের সাধনা (সওগাত সাধনার ধারা-১৩৩৬)।

Lawrence Binyon-Akbar.অন্নদাশঙ্কর রায়-হিন্দুমুসলমান Romain Rolland Ramkrishna & (বুলবুল-১৩৪১)

Vivekananda. S. Radhakrishnan-Hindu View of Life.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *