নজরুল-প্রতিভা
নজরুল ইসলাম
কবি নজরুল ইসলামের সাহিত্যিক জীবনের চারিটি স্তর নির্দেশ করা যেতে পারে।
প্রথম স্তর-তাঁর সাহিত্যিক জীবনের সূচনা থেকে বিদ্রোহী’ প্রকাশের পর্যন্ত।
দ্বিতীয় স্তর-’বিদ্রোহী’ প্রকাশের পর থেকে তার রাজনৈতিক জীবনের অবসান পর্যন্ত।
তৃতীয় স্তর-তাঁর সঙ্গীত রচনার, বিশেষ করে গজল রচনার যুগ।
চতুর্থ স্তর-তার যোগী-জীবন।*
[* এটি পঠিত হয়েছিল কবির ৪৩তম জন্মোৎসবে-১৩৪৮ সালে। তার পরের বৎসর থেকে কার দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন।]
প্রথম স্তর
শরৎচন্দ্রের মতো নজরুল ইসলামও অতি অল্পদিনে বাংলার সাহিত্য-জগতে সুপরিচিত। হয়ে ওঠেন। বিদ্রোহী’ প্রকাশের পূর্বেই তাঁর নবীনতা অথবা উদ্দামতা আর ছন্দ সামর্থ্যের প্রতি বাংলার সাহিত্যিকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। সাহিত্য-ক্ষেত্রে তাঁর প্রবেশ আর বিদ্রোহী’ রচনা এর মধ্যে কালের ব্যবধান সামান্য-বোধ হয় দুই বৎসরের বেশি নয়। তবু তাঁর সাহিত্যিক-জীবনের কথা ভাবতে গিয়ে তার ভাব-জীবনের এই স্তরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করবার প্রয়োজন আছে। বিদ্রোহী’ থেকে তার মানসজীবনের গতি যে-মুখী হলো তার সঙ্গে তার পূর্বেল ভাব-জীবনের সঙ্গতি অসঙ্গতি দুইই রয়েছে। তার এই যুগের একটি বিশিষ্ট রচনা তার বাঁধন-হারা’ পত্রোপন্যাস। এতে কবি যে তাঁর তরুণ জীবন কিছু পরিমাণে চিত্রিত করেছেন, অনেকে বোধ হয় তা জানেন। এই রচনায় দেখা যাচ্ছে-কবি একজন অসাধারণ ভাববিলাসী ও অভিমানী, ব্যর্থপ্রেমের বেদনায় গভীরভাবে আহত। কিন্তু এই আঘাত যত বড়ই হোক এতে মুহ্যমান তিনি হননি। এই নিষ্করুণ আঘাতে তার অন্তর থেকে উৎসারিত হয়েছে একটি মধু-স্রোত; কিন্তু এতে লাঞ্ছিত এমন কি ম্রিয়মাণও তিনি হননি। তবে তিনি অবলম্বন করেছেন এক দায়িত্বহীন ভবঘুরের জীবন-সেই দায়িত্বহীনতায় তাঁর সুনিবিড় আনন্দ।
এই যুগের ভাবে-ভোলা কবি ছিলেন রবীন্দ্র-সঙ্গীতে, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের যৌবনের প্রেমসঙ্গীতে, আত্মহারা; রবীন্দ্রনাথের পরে সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর প্রিয় কবি; আর তার প্রিয় ছিলেন ইরানী-কবিতিলক হাফিজ-তাঁর সুফী-তত্ত্বের জন্যে নয়। তার প্রেমের উন্মাদনার জন্যে।
আর এক শ্রেণীর ভাবুকদের প্রতিও কবির গভীর শ্রদ্ধা ছিল-তারা বাংলার সন্ত্রাসবাদীর দল।
দ্বিতীয় স্তর
রবীন্দ্রনাথের যেমন ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ অথবা ‘এবার ফিরাও মোরে’, নজরুলের তেমনি ‘বিদ্রোহী’। জীবনে হঠাৎ একটি বৃহৎ চেতনার আবির্ভাবের গৌরব এ-সবে বিধৃত। কিন্তু এই দুই কবির জীবন-ধারার উপরে তাদের এই ভাবোচ্ছ্বাসের প্রভাবে কিছু পার্থক্য দেখা যায়। ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ অথবা ‘এবার ফিরাও মোরে’ রবীন্দ্রনাথের কবি-চিত্তে যত বড় দোলা-ই দিক, এ-সবের প্রভাবে তাঁর জীবনের সাধারণ ধারায় যে-পরিবর্তন এসেছে তা লক্ষ্যযোগ্য হয়নি দীর্ঘ দিন। মনে হয়, কবি যেন সর্বংসহা প্রকৃতি-যত বড় ঝড়-বৃষ্টিই সেই প্রকৃতির বুকের উপরে তাণ্ডব জমিয়ে তুলুক, পরদিন সূর্যোদয়ে হাসি মুখে জেগে উঠতে তার বাধে না। নজরুল ইসলামও ‘বিদ্রোহী’ রচনার পরে যে একেবারে বদলে গিয়েছিলেন ঠিক তা নয়; ‘বিদ্রোহী’ কবিতাতেও দেখা যাচ্ছে, একদিকে তিনি যেমন নিজের ভিতরে অনুভব করছেন সাইক্লোনের শক্তি অন্যদিকে তেমনি তিনি মুগ্ধ চপল মেয়ের কাকন চুড়ির কঙ্কনে’র ছলনায়। তবু এ কথা সত্য যে, ‘বিদ্রোহী’র আকর্ষণ কবিকে বাস্তবিকই ঘর-ছাড়া করেছিল। সেই দিনে তার সাম্যবাদ প্রচার আর বেপরোয়া শিকল-ভাঙার গানের কথা যাদের মনে আছে, তাঁরা স্মরণ করতে পারেন-প্রচন্ড ধূমকেতুর মতো কি এক ভীষণ-মনোহর জীবন কবির ভিতরে সূচিত হয়েছিল।
১৩২৬ সালে-ইংরেজি ১৯১৯ সালে-নজরুল ইসলাম যখন কলকাতার সাহিত্যিক সমাজে পরিচিত হন তখনই এক হিসেবে তিনি ছিলেন বিদ্রোহী। সেদিনে বাংলার সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল সে কথা বলা হয়েছে; সেই সঙ্গে এই কথাও স্মরণ করা যেতে পারে যে, ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের পূর্বেই ‘শাতিল আরব’ ‘মোহররম’ ‘কোরবাণী’ প্রভৃতি যে-সব জনপ্রিয় কবিতা তিনি লিখেছিলেন সে-সবে ব্যক্ত হয়েছিল মুসলমানসমাজের গতানুগতিক জীবনের প্রতি ধিক্কার, এক বলিষ্ঠ নব জীবনারম্ভের জন্য তীব্র কামনা, আর অস্ত্রশস্ত্রের শক্তি ও মহিমায় তার প্রত্যয়। এটি ছিল ভারতীয় মুসলমানদের জন্য খেলাফত যুগ। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের ওহাবী-বিদ্রোহ দমনের [দ্র: বাংলার মুসলমানের কথা] পরে থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের স্বদেশী আন্দোলন পর্যন্ত বাংলার মুসলমানের ইতিহাস মোটের উপর এক গভীর নৈরাশ্যের ইতিহাস। সেই নৈরাশ্যের কালো-মেঘ তাদের চোখের সামনে খানিকটা কেটে গেল স্বদেশী আন্দোলনের যুগে যখন আধুনিক শিক্ষার দিকে তাদের মন স্পষ্টভাবেই ঝুঁকে পড়লো। সেই দিনে বাংলার মুসলমানের জন্য-অন্তত শিক্ষিত মুসলমানের জন্য আদর্শ-স্থানীয় ছিল বাংলার শিক্ষিত হিন্দু-সমাজ যদিও স্বদেশী আন্দোলনে পুরোপুরি ঝুঁকে পড়া এই শিক্ষিত মুসলমানদের অনেকের পক্ষে সম্ভবপর হয়নি। মনে পড়ে, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ স্বদেশী আন্দোলনের কিছু পরে, কলকাতায় সদ্য-আগত তরুণ নজরুল ইসলামকে মোহম্মদ এয়াকুব আলি চৌধরীর মতো একজন চরিত্রবান্ ও ধর্মনিষ্ঠ মুসলমান সাহিত্যিক বলেছিলেন:
“আপনাকে মুসলমান বারীন ঘোষ হতে হবে।” স্বদেশী আন্দোলনে বাংলার হিন্দুর যে সাফল্য, মুখ্যত তাইই প্রেরণা জুগিয়েছিল মুসলমানের এই খেলাফত আন্দোলনে। কিন্তু হিন্দুর আয়োজনের ব্যাপকতা তাঁদের ছিল না, ফলে সফলতা তাঁদের জন্য হচ্ছিল সুদূরপরাহত। তাঁদের কেবল লাভ হচ্ছিল দিগ্দেশবিহীন এক বিক্ষুব্ধ মানসিকতা। তরুণ নজরুল, অর্থাৎ বিদ্রোহী’ রচনার পূর্বের নজরুল, এক হিসেবে ছিলেন এই খেলাফতযুগের প্রতিনিধিস্থানীয় কবি। তাঁর ‘মোহররম’ কবিতার অধুনা-পরিত্যক্ত শেষ দুটি চরণ এই সম্পর্কে স্মরণ করা যেতে পারে
দুনিয়াতে দুর্মদ খুনিয়ারা ইসলাম–
লহু লাও, নাহি চাই নিষ্কাম বিশ্রাম।
কিন্তু ‘বিদ্রোহী’তে তার মানসিক কুয়াসা এতখানি কেটে যায় যে, তিনি যেন এক নতুন জীবন নিয়ে জেগে ওঠেন, নিজেকে ও জগৎকে দেখতে আরম্ভ করেন এক নতুন দৃষ্টিতে।
বাংলাদেশে এক শ্রেণীর সাহিত্যরসিক আছেন যারা নজরুল ইসলামকে জ্ঞান করেন একজন যুগ-প্রবর্তক কবি। আজকার দিনে তাদের সংখ্যা-শক্তি কেমন জানি না, তবে নজরুলের প্রতি তাদের কারো কারো অন্তরের গভীর অনুরাগের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। তাঁদের প্রতিপাদ্যের প্রধান অবলম্বন এই ‘বিদ্রোহী’। তাদের ধারণা, এমন একটা ওজস্বিতা নজরুলের এই বিদ্রোহী’ কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে যা বাংলা সাহিত্যে, সম্পূর্ণ নূতন-বাংলার দার্শনিক আবহাওয়ায় এ চিন্তালেশহীন ভাস্বর-ললাট চির-তারুণ্য, এই দ্বিধাহীন দুর্মদ তারুণ্যই বাংলা সাহিত্য নজরুল-প্রতিভার চিরগৌরবময় দান।
যাঁদের এই মত, মনে হয় না নজরুলের এই তারুণ্য বাস্তবিকই তারা বুঝতে চেষ্টা করেছেন। প্রথমেই স্মরণ করা দরকার, রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’র যুগে নজরুল-প্রতিভার উন্মেষ।
আমরা চলি সমুখ পানে
কে আমাদের বাঁধবে,
রইল যারা পিছুর টানে।
কাঁদবে তারা কাঁদবে
অথবা
ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,
ওরে অবুঝ, ওরে সবুজ,
আধ-মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা
অথবা
শিকল দেবীর ঐ যে পূজা-বেদী
চিরকাল কি রইবে খাড়া,
পাগলামি তুই আয় রে দুয়ার ভেদি’।
ঝড়ের মাতন বিজয়-কেতন নেড়ে
অট্টহাস্যে আকাশখানা ফেড়ে
ভোলানাথের ঝোলাঝুলি ঝেড়ে
ভুলগুলো সব আন্ রে বাছা বাছা
আয় প্রমত্ত, আয় রে আমার কাঁচা
ইত্যাদি ছত্র সে-যুগের বাংলার শিক্ষিত তরুণ-সমাজে উন্মাদনার সৃষ্টি করেছিল-এক হিসেবে বাংলার তরুণ-আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয়েছিল এই বলাকা কাব্যের সাহায্যে। দ্বিতীয়ত, নজরুলের লেখনীতে যে-তারুণ্য রূপ পেয়েছে তার সাহিত্যিক মর্যাদা কেমন সেটিও একটি বড় অনুধাবনের বিষয়। একটু মনোযোগী হলেই চোখে পড়ে, নজরুলের রচনা, বিশেষ করে তার বিদ্রোহী’যুগের রচনা, অনবদ্য নয়। শ্রেষ্ঠ কবিদের বিশেষ বিশেষ কবিতায় কবি-কল্পনার যে পূর্ণাঙ্গতা প্রকাশ পায় নজরুলের রচনায় সেটির অভাব মাঝে মাঝে প্রায় বেদনাদায়ক হয়েছে। নজরুল যে পূর্ণাঙ্গ কবিতার রচয়িতা তেমন নন, তাঁর কবি-প্রতিভা বরং প্রকাশ পেয়েছে উৎকৃষ্ট চরণের রচনায়, এ উক্তি করা যেতে পারে। অবশ্য এমন সাহিত্য-রসিক আছেন যারা কোনো কবিতার, বিশেষ করে দীর্ঘ কবিতার, সমগ্রতার সৌন্দর্যে মনোযাগী হওয়া তেমন প্রয়োজনীয় বিবেচনা করেন না; তাঁদের কাছে কবিতা বরং উৎকৃষ্ট চরণের অথবা বাক্যাংশের সমষ্টি-মুক্তার মালা যেমন মুক্তার সমষ্টি। এই শ্রেণীর সাহিত্য-সমঝদারদের যুক্তির সারবত্তা স্বীকার করেও বলা যায়, কবিতার বিভিন্ন চরণ অথবা বাক্যাংশ যখন একত্র গ্রথিত করবার প্রয়োজন, হয় তখন তাদের একত্র-সমাবেশ যাতে অদ্ভুতদর্শন না হয় সেদিকে মনোযোগী হওয়া কবির জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ যুগের অনেক কবিতায় দেখা যাবে-’বিদ্রোহী’ও সে-সবের অন্তর্গত-বিভিন্ন ভাবের একত্রসমাবেশের সঙ্গতি সুষমা অথবা যৌক্তিকতা বিষয়ে কবি বেশ উদাসীন হয়েছেন। কিন্তু এত ত্রুটি সত্ত্বেও এমন একটা প্রাণশক্তির ছাপ তার বিদ্রোহী’-যুগের অনেক কবিতায় মুদ্রিত হয়েছে যার জন্য তার মাহাত্ম স্বীকার না করেও উপায় নেই। বাস্ত বিক, আমাদের সাহিত্যে এক ভয়ভাবনাহীন তারুণ্যের তিনি স্রষ্টা পুরোপুরি না হলেও লালয়িতা। কিন্তু সাহিত্য-শিল্পী হিসেবে এই যুগে তাঁর রেখাপাতে অপরিচ্ছন্নতাও এতখানি প্রকাশ পেয়েছে যে তাঁর সাহচর্য রসিক পাঠককে আনন্দ যা দেয় দুঃখও সেই তুলনায় কম দেয় না।
এই যে নজরুলের অত্যাশ্চর্য শক্তি, অথচ সাহিত্যে তার অনবদ্য প্রকাশের অভাব, এটি তার সাহিত্যের পাঠকদের দুঃখের বা ক্ষোভের কারণ না হোক-এটি বরং তাদের অন্তরে সঞ্চারিত করুক তীক্ষ্মতর জিজ্ঞাসা। সেই জিজ্ঞাসায় প্রবৃত্ত হলে দেখা যাবে, কবি তিনি নিঃসন্দেহ-অনুভূতির গোপন আয়োজন তার জগতে কখনো কখনো ঘটায় বাণীর অপূর্ব বিদ্যুৎ-দীপ্তি-কিন্তু কবি তিনি যত বড়, তার চেয়েও বড় তিনি যুগ-মানব। যুগের বেদনা ও উন্মাদনা তাতে এত প্রবল যে, কবির কল্পনা-লোকে অবস্থান তার পক্ষে যেন দুঃসাধ্য। এর দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায় তাঁর শ্রেষ্ঠ ইসলামী কবিতা ‘খালেদ’। খালেদের মহিমা উদাত্ত কণ্ঠে গাইবার চেষ্টাই তিনি করেছেন; কিন্তু দেখা যাচ্ছে, খালেদের বীরমূর্তি পূর্ণভাবে রূপায়িত করার চেয়ে তার মনে প্রবলতর তাঁর সমসাময়িক মুসলমান-সমাজের জন্য বেদনা অথবা অস্থিরতা। অবশ্য কবির সৃষ্টি আকাশ-কুসুম নয় কখনো, কবির কাব্য-ফুল মাটির গাছেরই ফুল, অন্য কথায়, যুগধর্মের বেদনায় কবিমানস লালিত ও গঠিত। তবু গাছ আর ফুল যেমন এক জিনিস নয়, কোনো যুগের জীবন ও সেই যুগের কাব্যও ঠিক এক জিনিস নয়। Literature is Journalism that lasts (যে সাংবাদিকতা টিকে যায় তার নাম সাহিত্য) সাহিত্যের এই এক চমৎকার সংজ্ঞা একজন সাহিত্য-রসিক দিয়েছেন।[Robert Lynd] কিন্তু এই যে শেষের কথা that lasts যা টিকে যায়, এরই মধ্যে রয়েছে সাহিত্যের মূল তত্ত্ব। সাংবাদিকতা স্থায়ী হয় না, কিন্তু সাহিত্য স্থায়ী হয়, এই জন্য যে, সাংবাদিকতা প্রতিদিনের জীবনের মতো অস্থির, অপূর্ণাঙ্গ, নিয়ত-পরিবর্তনশীলতা যেন প্রতিদিনের জীবনের ফটোগ্রাফ। কিন্তু সাহিত্য ঠিক তা নয়, তা অনেকখানি অচঞ্চল, অনেকখানি পূর্ণাঙ্গ, কেননা, ঠিক বাস্তব লোকে নয়, কল্পনা-লোলাকে অথবা সৌন্দর্য-লোকে তার অধিষ্ঠান। কিন্তু এই কল্পনা লোকে বা সৌন্দর্য-লোকে প্রতিষ্ঠিত হবার অবসর যেন নজরুলের নেই, রুচিও যেন তার তাতে নেই-প্রতিদিনের জীবনের তাড়নায় তীব্রভাবে তাড়িত হয়েই তিনি চলেছেন, আর এই তাড়না-ভোগে তার যেন গভীর আনন্দ। এটি দোষও বটে, গুণও বটে, এবং এর জন্যই নজরুলকে এ-যুগের একজন অসাধারণ কবি ভাবা কঠিন, [দ্র: ‘আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্ণিশ’] কিন্তু এ-যুগের একজন অসাধারণ ব্যক্তি তিনি অবিসংবাদিতরূপে।
বলা হয়েছে, প্রতিদিনের জীবনের তীব্র তাড়নায় তাড়িত হয়ে চলায় কবি নজরুলের বেশ আনন্দ। কথাটি আর একটু বিশ্লেষণ করবার প্রয়োজন আছে। প্রতিদিনের হাসি-কান্নার জীবন চিরদিনই মানুষকে আনন্দ দিয়ে এসেছে। নইলে জগৎ শ্মশানে পর্যবসিত হতো। কিন্তু প্রকৃত মানুষের মনোভাব যাহাই হোক শিক্ষিত মানুষ প্রতিদিনের জীবনকে সব সময়ে যে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখেছেন তা নয়। বরং মধ্যযুগ বলতে মানুষের ইতিহাসের যে স্তর নির্দেশ করা হয় তাতে দেখা যায় সংসারের প্রতিদিনের জীবনের প্রতি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতেই শিক্ষিতেরা তাকিয়েছেন। আধুনিক যুগ এক হিসেবে তার প্রতিবাদ, আর এই প্রতিবাদ আরম্ভ হয়েছে আজকে থেকে নয়। আমাদের দেশেও এই প্রতিবাদ আরম্ভ হয়েছে ইংরেজ রাজত্বের প্রায় সূচনায়। কিন্তু আমাদের সাহিত্যে এই প্রতিবাদ পূর্ণাঙ্গ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের যৌবনকালে। এই প্রতিবাদ আজ আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত ব্যক্তির এক creed, ধর্ম-বিশ্বাস, এক সময়ে যেমন তাদের ধর্ম-বিশ্বাস ছিল বৈরাগ্য। নজরুল একালের তেমনি প্রত্যয়শীল একজন ব্যক্তি। তবে তার বিশেষত্ব এই যে, এই প্রত্যয় তাতে অনেকের চেয়ে বলবত্তর-এতখানি প্রবলতা তার এই বিশ্বাসে বিদ্যমান যে, আপাতদৃষ্টিতে যে-সব মনে হয় অদ্ভুত খেয়াল খুশি সে-সবকেও মহত্তর মর্যাদা দিতে তাঁর বাধে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে তার ‘আলেয়া’ নাটক। নরনারীর প্রেমের সম্বন্ধের যথার্থ নিরূপণ এ-ক্ষেত্রে তার একটি সমস্যা। অবশ্য তীব্র সমস্যা নয়। সমাধান এই দাঁড়ালো যে, কার মন যে কখন কোন্ দিকে ঝুঁকে পড়বে তার কিছুই ঠিক-ঠিকানা নেই। আরো একটি সমাধান দাঁড়ালো যে, শক্তিমান জীবন ভোগ করে যাবেন, সে-ভোগ যদি অন্যের জন্যে হয় দুর্ভোগ তবু চলবে তার ভোগের অভিযান। কথাটি যে আপত্তিকর কবি সে-বিষয়ে সজাগ, কিন্তু এই বলে তিনি কথাটি চুকিয়ে দিচ্ছেন যে, যৌবন-বেগের এই ত ধারা। বলা বাহুল্য, যে-সমস্যার অবতারণা কবি করেছিলেন তার কোনো ভালো সমাধান তিনি দিতে পারলেন না, ভোগের পথও কুসুমাস্তীর্ণ নয়। কিন্তু সমস্ত অকৃতকার্যতার মধ্যে কবি এক বিষয়ে আশ্চর্যভাবে কৃতকার্য হলেন-সহজ সরল কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করতে পারলেন, জীবন তাঁর কাছে মধুময়; আরো ঘোষণা করতে পারলেন-এত সুষমাময় চমৎকারিত্বময় যে জীবন তার মায়ায় চিত্ত তাঁর বন্দী হয়ে পড়েছে না, ভুল-ভ্রান্তি, ভোগ-দুর্ভোগ, সমস্তের ভিতর দিয়ে চলেছেন তিনি সামনের দিকে। একালের এই জীবনবাদ ও গতিবাদের যারা শ্রেষ্ঠ কবি, যেমন Walt Whitman ও রবীন্দ্রনাথ, তাঁদের বাণীর সঙ্গে তুলনায় নজরুলের বাণীর ত্রুটি অনেকক্ষেত্রে চোখে পড়ে; কিন্তু সেই সঙ্গেই চোখে পড়ে, বাণীর ত্রুটি তাতে যতই থাকুক জীবনের উপলব্ধি তার সুগভীর। তাঁর বিখ্যাত কবিতা-সমষ্টি “সাম্যবাদী” সম্বন্ধেও এ-কথা খাটে। এতে তার যুক্তিতর্ক যেমন প্রচুর তেম্নি দুর্বল। কিন্তু সে-সবের মধ্যে দিয়ে যে বেদনাময় চিত্তের প্রকাশ ঘটেছে তা পরম শ্রদ্ধার্য।
নজরুলের কবি-প্রকৃতি সম্বন্ধে আরো একটি বড় ব্যাপার লক্ষ্য করবার আছে। নজরুলের ভিতরে তারুণ্য চমৎকার, জীবনের আনন্দ তিনি সহজভাবে অনুভব করতে পারেন, নানা দিক দিয়ে তিনি একজন সহজ মানুষ;এ-সবের কিছুই মিথ্যা নয়। কিন্তু এই সঙ্গে এ-কথাও বুঝবার আছে যে, অন্তরের গোপনতম প্রদেশে তিনি তাত্ত্বিক-আর সেই তাত্ত্বিকতা তার যেন জন্মগত। তাঁর এই পরম প্রিয় তত্ত্বের নাম দেওয়া যেতে পারে লীলাবাদ-ইংরেজিতে যা সাধারণত pantheism নামে পরিচিত। এই দৃষ্টিতে ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য শেষ পর্যন্ত নেই-ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য, জন্ম-মৃত্যু, উত্থান পতন, সব কিছুই ভগবানের লীলা। এই তত্ত্বকে বলা যায় একই সঙ্গে অদ্বৈতবাদ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ। হিন্দু-চিন্তার এটি যে মর্মকথা তা না বললেও চলে, সুফী-চিন্তারও এটি মর্মকথা-এক-হিসেবে প্রাচীনকালের ভাবুকদের এটি পরম আশ্রয়। এই হিন্দু মুসলমানের মাথা-ভাঙাভাঙির দিনেও নজরুল যে অবলীলাক্রমে শ্যামাসঙ্গীত ও বৃন্দাবন-গাথা রচনা করে চলেছেন, তৌহীদেরও (একেশ্বর-তত্ত্বের) শক্তিশালী ব্যাখ্যা দিতে পারছেন, তার রহস্য নিহিত রয়েছে তাঁর এই মূল বিশ্বাসের ভিতরে। কিন্তু এই বিশ্বাস যে তাঁর কাব্যসৃষ্টিতে কিঞ্চিত বিষ্মও ঘটিয়েছে সেইটিই আমাদের প্রধান বক্তব্য। কবিদের অথবা শিল্পীদের কেউই হয়ত সর্বপ্রকারে “বিশ্বাস” বর্জিত নন, কিন্তু তাদের বিশেষত্ব এই যে কোনো ব্যক্তি বা বস্তু বা ঘটনার যথার্থ উপলব্ধির আশ্চর্য ক্ষমতা তাদের থাকে-সেই উপলব্ধির সময়ে তারা যেন সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত রাগদ্বেষবর্জিত ও অপূর্বভাবে সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে ওঠেন। এই যে পূর্ণ আত্মবিস্মরণ ও বিষয়-নিষ্ঠতা এটি নজরুলের পক্ষে তার শ্রেষ্ঠ মুহূর্তেও প্রায় অসম্ভব হয়েছে লীলাবাদে তাঁর অপরিসীম আনন্দের জন্যে। এই লীলাবাদ তার জন্য এক ধরণের আত্মবিস্মৃতি এনে দিয়েছে, তাকে আশ্চর্যভাবে নিরহঙ্কার ও সৌন্দর্য-পিপাসু করেছে, কিন্তু কবিত্বের পূর্ণ বিকাশের পথে এটি এই বাধা উপস্থিত করেছে যে এর ফলে বহির্মুখী না হয়ে অন্তর্মুখী তিনি হয়েছেন অনেক বেশি; রূপ-বৈচিত্র্য অঙ্কনের চেয়ে Type বা প্রতীক সৃষ্টির দিকে তার মন ঝুঁকেছে।
“বিদ্রোহী” কবিতাটি সম্পর্কে আরো একটু আলোচনা হয়ত অসঙ্গত নয়। প্রাক ‘বিদ্রোহী’ ও ‘বিদ্রোহী’ যুগের পার্থক্য সম্বন্ধে ইঙ্গিত করা হয়েছে। বিদ্রোহী’তেই কবি নিজের শক্তি-সম্ভাবনা সম্বন্ধে বিশেষভাবে সচেতন হয়ে ওঠেন। সেই চেতনার দুটি ধারা-এক দিকে তার অন্তরে জাগে অপরিসীম আত্মপ্রত্যয়, অন্যদিকে তিনি নিজেকে জ্ঞান করেন জাতিধর্ম-নির্বিশেষে দুঃস্থ মানবতার অগ্রনায়ক।
এর ‘বিদ্রোহী’ নামকরণ সঙ্গত হয়েছে বলা যায়, কেননা হঠাৎ যে গভীর উন্মাদনা কবির অন্তরে সঞ্চারিত হয়েছে তা গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে এত তীব্র বিদ্রোহই বটে। কিন্তু বাস্তবপক্ষে এ এক অপূর্ব উন্মাদনারই কবিতা, কোনো বিদ্রোহীবাণী এতে বিঘোষিত হয়নি। এর যে বিখ্যাত চরণ ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন’ এটিও ঠিক বিদ্রোহ-বাণী নয় বরং এক হিসেবে গভীর ঈশ্বর-নির্ভরতার বাণী। এ-সম্পর্কে তার এই কালেরই রচনা দুর্দিনের যাত্রী’র এই কথাগুলো অর্থপূর্ণ:
এমন যার কোনো শুরু বা বিধাতা নেই যাকে ভয় বা ভক্তি করে সে নিজের আত্মাকে ফাঁকি দেয় শুধু সেই সত্য স্বাধীন, মুক্ত স্বাধীন। এই অহম্-জ্ঞান আত্মজ্ঞান-অহঙ্কার নয়, এ হচ্ছে আপনার ওপর-নিজের বিপুল শক্তির ওপর অটল বিরাট বিশ্বাস।
অন্যত্র :
…’যার অন্তরে আপন সত্য আপন ভগবান সহজে জাগেনা তাদের ভগবান্ এম করে বুকে লাথি খেয়ে তবে জাগে।‘
অন্যত্র :
…’বিদ্রোহের মতো বিদ্রোহ যদি করতে পার, প্রলয় যদি আনতে পার তবে নিদ্রিত শিব জাগবেই-কল্যাণ আসবেই।‘
দুর্বল, এমন কি অনাবশ্যক, চরণ থেকে বিদ্রোহী’ মুক্ত নয়। এ ত্রুটি মারাত্মক। কিন্তু এত ত্রুটি সত্ত্বেও বাংলা কাব্যে ‘বিদ্রোহী’র জন্য যে একটি সম্মানিত স্থান নির্দিষ্ট হয়েছে তা নিঃসন্দেহ। সমস্ত অদ্ভুততত্ত্ব সত্ত্বেও এর উন্মাদনা অপূর্বভাবে প্রাণপূর্ণ।
যে-লীলাবাদে বিশ্বাস কবির মজ্জাগত বলেছি, তারও সঙ্গে আমাদের প্রথম স্পষ্ট পরিচয় হচ্ছে এতে, বিশেষ করে’ এর এই সব চরণে–
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ
স্বর্গ পাতাল মর্ত।
আমি উন্মাদ আমি উন্মাদ–
আমি চিনেছি আমারে আজিকে আমার
খুলিয়া গিয়াছে সব বাধ।
‘বিদ্রোহী’তে কবির ঈশ্বর-বিদ্রোহ প্রকাশ পায়নি বটে, কিন্তু এর পরের ‘ধূমকেতু’ কবিতায় সে বিদ্রোহ পুরোপুরি প্রকাশ পেয়েছে
জানি ঐ ভূয়ো ঈশ্বর দিয়ে হয়নি যাহাও হবে তাও,
তাই বিপ্লব আনি বিদ্রোহ করি….
ইত্যাদি।
বলা বাহুল্য, রাশিয়ার সাম্যবাদের দিকে কবি এখানে বিশেষভাবে ঝুঁকেছেন বোধ। হয় তার এই সময়ের প্রধান বন্ধু কমরেড মুজফফর আহমদের প্রভাবে। তার ‘বিদ্রোহী’-যুগের প্রায় সমস্ত কবিতায় এই সাম্যবাদের প্রভাব সুস্পষ্ট। কিন্তু পুরোপুরি সাম্যবাদী নজরুল কখনো হননি, হলে তার এই সাম্যবাদ প্রচারের দিনে ‘খালেদ ‘ওমর’ জগলুল প্রভৃতি প্যান-ইসলামী ভাবের কবিতা লেখা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর হতো না। সাম্যবাদের প্রভাবে তার ভিতরে ঘনীভূত হয়েছে দুঃস্থ ও বঞ্চিত মানবতার জন্য তার দরদ। তার ঈশ্বর-দ্রোহ মানব-সমাজের দুর্বল ন্যায়-অন্যায়-বোধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-অভিমানের ভঙ্গিতে; তার বেশি কিছু বলে মনে হয় না।
তৃতীয় স্তর
‘বিদ্রোহী’-যুগ নজরুল-সাহিত্যের আলোচনায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কেননা তার জনপ্রিয়তার মূলে এই যুগের রচনা। কিন্তু এই যুগ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এই বিদ্রোহী’ যুগের উদ্দীপনা পূর্ণ-পরিণতি লাভ করবার পূর্বেই বিস্মিত দেশবাসী তার কণ্ঠে শুনতে পেলে-বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিসনে আজি দোল’ অথবা আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায় কে গো দরদি ইত্যাদি গজল।
‘বিদ্রোহী’-যুগ নজরুলের জন্য জনপ্রিয়তা আনলেও তার কাব্য-সাধনা ব্যাপক সার্থকতা লাভ করেছে তাঁর গানে, এ বিষয়ে বাংলার কাব্যরসিকরা বোধ হয় একমত। রেখাপাতের যে অপরিচ্ছন্নতা ‘বিদ্রোহী’-যুগের অনেক রচনায় লক্ষ্য করা গেছে, তা যে ‘গানের যুগে প্রায় অন্তর্হিত হয়েছে, শুধু অনবদ্য চরণ নয় অনবদ্য কবিতা তার কলম থেকে উৎরেছে, তা মিথ্যা নয়। তাঁর রচিত গান সম্বন্ধে একটি উপভোগ্য রচনা তার বুলবুল সঙ্গীত-গ্রন্থের ভূমিকারূপে ব্যবহার করা হয়েছে। লেখক তাতে নজরুলের অনেক চরণের সৌন্দর্য সম্বন্ধে যে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন তা সমর্থনযোগ্য। শুধু একটি ব্যাপার তিনি সেখানে লক্ষ্য করেন নি, সেটি এই যে, নজরুলের এই সব সময় প্রেমের কবিতা সংখ্যা কম, আর শীগগিরই পুনরুক্তি-দোষ তাঁতে ঘটেছে। Tv> প্রতীক সৃষ্টির দিকে তাঁর যে বিশেষ ঝোঁক তারও প্রমাণ এই সব গানে রয়েছে।
যিনি খ্যাতি লাভ করলেন বিদ্রোহী রূপে, কাব্য-লক্ষ্মীর প্রসাদ অজস্র ভাবে es লাভ করলেন প্রেম-সঙ্গীতের রচয়িতা রূপে! বাংলা সাহিত্যে এ ব্যাপারটি কিন্তু নন। নয়। বীররস, মহাকাব্য, এ-সব বাংলার ধাতে যেন সহ্য হয় না। মধুসূদন বিকার আয়োজন করলেন, কিন্তু সে-চেষ্টায় বীররস যতখানি সৃষ্টি হলো তার চেয়ে অনেক বেশি হলো করুণ রস। হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্র তো নাস্তানাবুদ হলেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলার এই ধাত বুঝে’ এ পথে পা দিলেন না, তবে নিজের বিরাট জীবনসাধনার গুণে অজানিতভাবে বীররসের সৃষ্টি করলেন কোনো কোনো কবিতায়-যেমন বর্ষশেষে’। হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম রণ-দামামা আর লেক্ট রাইট মার্চের ধ্বনি কানে নিয়ে ঘরে ফিরলেন। এর সঙ্গে তাঁর নতুন উন্মাদনা লাভ হলো রাশিয়ার লাল-পল্টনের রণ-হুঁঙ্কারে। এই বিপুল উত্তেজনা ও উন্মাদনা যে তাঁর কাব্য-প্রয়াসে ব্যর্থ হলো তা বলা যায় না, কিন্তু সার্থকতা যা লাভ হলো চেষ্টার অনুপাতে তা কত কম! অথচ করুণ রস, বিরহ, এ-সব বাংলায় জমে ওঠে যেন সহজে। সেকালে চণ্ডীদাস অমর বিরহ-গাথা রচনা করে গেছেন, বাংলার মাঠে বাটে আজো তার ধুয়া শোনা যায়। এর কারণ মনে হয় বাংলার বিশেষ জীবন-ধারা। বৃহত্তর জীবন সৃষ্টির চেষ্টা বাংলায় যে না হয়েছে তা। নয়, কিন্তু কেমন করে যেন সে-সব শেষ পর্যন্ত জমে ওঠে নি। শেষ পর্যন্ত বাঙালির অবলম্বন হয়েছে তার নগণ্য গৃহ, তার বহতা নদী, তার সবুজ গাছপালা, ফসল ক্ষেত। আর নীল আকাশ, আর তার প্রেমময়ী নারী। এই পরিবেষ্টনে বীররস আর মহাকাব্য যদি না জমে তবে দুঃখ করা চলে না। এই প্রসঙ্গে লক্ষ্য করা যেতে পারে যে, বাংলার যে আবহমান প্রাণ-ধরা তার সঙ্গে নজরুলের যোগ আশ্চর্যভাবে নিবিড়।
নজরুল যে প্রেম-সঙ্গীত রচনা করেছেন তা বুঝতে গেলে সহজেই চোখে পড়ে, তার বাঁধন-হারা’ পত্রোপন্যাসে তাঁর প্রথম জীবনের যে ব্যর্থ প্রেমের ছবি তিনি অঙ্কিত করেছিলেন সেইটিই হয়ে রয়েছে তার সারা জীবনের ধুয়া। কিন্তু তার প্রেম যেমন রাধিকার ‘তনু-মন-ধন জীবন যৌবন তব পায়ে সমর্পণের প্রেম নয়, তার বিরহও তেমনি রাধিকার বুক-ভাঙা বিরহ নয়। যে-বিরহচ্ছবি তাকে মুগ্ধ করেছে সেটি সংসার অনভিজ্ঞ, অবুঝ, কিশোর-কিশোরীর বিরহ। এ বিরহে তাদের জীবন যে ব্যর্থতায় তিক্ত হয়ে উঠেছে ঠিক তা নয়, হয়ত দৈনন্দিন জীবন তাদের চলেই যাচ্ছে, কিন্তু এ বিরহ-বোধ তাদের জন্য হয়েছে যেন জীবনের এক অতুলনীয় অভিজ্ঞতা-জীবন যেন পরম সমৃদ্ধ হয়েছে এই বিরহের স্পর্শমণির ছোঁয়ায়। ভাব-বিলাসিতা বলে এই বিরহের নিন্দা যে না করা যায় তা নয়; পরবর্তীকালের সমঝদারদের জন্য এই বিরহ ছবি আজকার মতো এতখানি মনোরম না-ও হতে পারে; কিন্তু এ সত্য যে কবির সমসাময়িকেরা কবির এই বিরহ-সঙ্গীত নিবিড়ভাবে উপভোগ করেছেন ও করছেন, এর প্রভাব বাংলার সমসাময়িক গানের উপরেও অসামান্য।
এই সব প্রেমসঙ্গীত রচনার সঙ্গে সঙ্গে নজরুল ইসলামী সঙ্গীত, শ্যামাসঙ্গীত ও বৈষ্ণব সঙ্গীত রচনায় মন দেন। ইসলামী সঙ্গীতের অধিকাংশ প্রচলিত উর্দু গজল ও ‘নাতিয়া’র (প্রশস্তি) ভঙ্গিতে রচিত। কবির নিজের কাছে এই সব সঙ্গীত যথেষ্ট মূল্যবান, কেননা এই সব সঙ্গীতের ভিতর দিয়েই বাংলার মুসলিম জনসাধারণের চিত্তে তিনি প্রবেশ-পথ পেয়েছেন। মুসলিম জনসাধারণও এতে যে কিছু প্রীত না হয়েছে তা নয়। কিন্তু আমরা এ-বিষয়ে কবির সঙ্গে একমত হতে নারাজ। এক শ্রেণীর সুফীর যে উৎকট গুরুভক্তি, মুখ্যত তাইই রূপ পেয়েছে এই সব গানে। ভাব-বিলাসিতাও এ-সবে প্রচুর। কিন্তু মনে হয়, ধর্ম সম্পর্কে এই ভাব-বিলাসিতার দিন উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এর চেয়ে হজরত মোহম্মদের সবল কাণ্ডজ্ঞান, চরিত্র মাহাত্ম, এ-সব কেন্দ্র করে যদি গান রচনা সম্ভবপর হতো তবে তার সার্থকতা হতো অনেক বেশি। ইসলাম এক হিসেবে ধর্ম-জগতে এক বিদ্রোহের সূচনা করেছে প্রতীক-চর্চায় আপত্তি জানিয়ে; আর বিদ্রোহী যে তার সত্যিকার মহিমা নিরন্তর বিদ্রোহে।
ইসলামী সঙ্গীতের চেয়ে শ্যামাসঙ্গীত রচনায় নজরুল সার্থকতা অর্জন করেছেন অনেক বেশি। বাংলার শ্যামাসঙ্গীত বাংলা সাহিত্যের এক গৌরবের বস্তু, বিশেষ করে রামপ্রসাদের শ্যামাসঙ্গীত। কিন্তু বাংলার প্রচলিত শ্যামাসঙ্গীতের মধ্যে নজরুলের শ্যামাসঙ্গীতে একটি বিশিষ্টতা ফুটেছে। কাব্যে রূপ-বর্ণনা একই সঙ্গে রূপ ও অরূপের বর্ণনা। কিন্তু অধিকাংশ শ্যামাসঙ্গীতে-যেমন অনেক ধর্মসঙ্গীতে-রূপ স্কুল হয়ে উঠেছে, অরূপের মহিমা ক্ষুণ্ণ হয়েছে বড় বেশি। কিন্তু নজরুলের কোনো কোনো শ্যামাসঙ্গীত উপভোগ্য কবিতা হয়েছে।
বৈষ্ণব সঙ্গীতে শ্যামাসঙ্গীতের মতো সাফল্য সাধারণত নজরুলের লাভ হয়নি। তার কারণ বোধ হয় তাঁর অনুভূত প্রেমের চাঞ্চল্য। বৈষ্ণব পদকর্তারা এক্ষেত্রে এত বড় সাফল্য অর্জন করে গেছেন যে, তাঁদের পরে তাঁদেরই ভঙ্গিতে তাঁদের সেই গান জমানো সুকঠিন। কিন্তু সম্প্রতি নজরুল যে অনুভূতির ভিতর দিয়ে চলেছেন তার ফলে তার এখনকার বৈষ্ণবসঙ্গীত অপরিসীম মাধুর্যমণ্ডিত হয়ে দেখা দিয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায় তাঁর সম্প্রতি-রচিত “অভিসার” সঙ্গীত-সমষ্টি। [কলিকাতা বেতারকেন্দ্রে এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল।] প্রেমের চাঞ্চল্য, দেহ-চেতনা, এ-সব আশ্চর্য ভঙ্গিতে উঠে গেছে এক উন্নততর স্তরে। তার এখনকার প্রেমের গান পূর্ণ আত্মনিবেদনের গান হয়ে উঠেছে, এবং মনে হয়, তার পূর্বের অনেক শ্রেষ্ঠ প্রেমসঙ্গীত তার এখনকার ভাবধারার আলোকে নূতন মহিমা লাভ করেছে।
তবে তার আধুনিক জীবনের পরিণতি কোথায়, বলা সোজা নয়। এর ফলে তার কবি-জীবনের অবসান ঘটাও বিচিত্র নয়-যে তাত্ত্বিকতা তাঁর জীবনের মর্মমূলে আমরা দেখেছি তাই হয়ত জয়ী হবে পূর্ণভাবে। অথবা, এর ফলে সমৃদ্ধতর চিত্ত ও তীক্ষ্মতর দৃষ্টি নিয়ে তিনি নূতন করে জীবনে ও সাহিত্যে প্রবেশ করতে পারেন।
কবি নিঃসঙ্গ ব্যক্তি নন-কোনো সমাজের বা জাতির তিনি প্রতিনিধি। নজরুল এ যুগের বাঙালি জাতির প্রতিনিধিত্ব করেছেন প্রধানত জড়তার বিরুদ্ধে বারবার সংগ্রাম ঘোষণা করে’ ও নির্যাতিত জনসাধারণের পক্ষ সমর্থন করে; আর মুসলমান-সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তাদের মনে নব নব আশা উদ্দীপনার সঞ্চার করে, বিশেষ করে বাংলার বা ভারতের আবহমান প্রাণ-ধারার সঙ্গে তাদের প্রেমের নিবিড় যোগ স্থাপন করবার আহ্বান জানিয়ে।
কবি একই সঙ্গে জ্ঞানী ও প্রেমিক। জ্ঞানী যদি তিনি কিছু কম হন তবু খুব ক্ষতি হয় না, কিন্তু প্রেমিক হওয়া চাই তাঁর পুরোপুরি। সেই প্রেমের সাধনাই মুখ্যত নজরুলের সাধনা হয়েছে। দেশ ও জাতির প্রতি সেই প্রেমে, সেই পূর্ণ আত্মনিবেদনে নজরুল এ-কালে মুসলমানদের মধ্যে, অথবা হিন্দু-মুসলমান সবার মধ্যে, এক সম্মানিত ব্যক্তি-যে বৃহৎ জীবনের অথবা জাতীয় জীবনের চেতনা দেশে অনুভূত হয়েছে। তাতে তারও প্রতিভার স্পর্শ লেগেছে। এই জনজাগরণের দিক দিয়ে দেখলে সহজেই। চোখে পড়ে নজরুলের ঐতিহাসিক মর্যাদা কত বড়।
১৩৪৮
প্রতীক-প্রীতি
নজরুল বাঙালি মুসলমানের প্রিয় হয়েছেন তাঁর ইসলামী কবিতা ও ইসলামী গান দিয়ে। তার প্রভাবে সে-সমাজে নব উদ্দীপনা এসেছে, এ-কথাও সর্বাদিসম্মত। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি গেয়েছেন হিন্দু দেবদেবীর মহিমার গান-এইটি তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের যথেষ্ট মনোদুঃখের কারণ।
কিন্তু আশ্চর্য এই, নজরুলের প্রতিভায় একই সঙ্গে ইসলাম-প্রীতি আর প্রতীক প্রীতি কেন দেখা দিল সে-সম্বন্ধে প্রশ্ন তাদের মনে তেমন জাগে না-অথচ নজরুল একই সঙ্গে ইসলামী কবিতা আর দেবদেবীর স্তোত্র লিখে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।
এ ব্যাপারটা কিছু বোঝা যাবে যদি ইতিহাসের এই দুটি ঘটনার কথা আমরা ভাবি : ইয়োরোপের রেনেসাঁস (নবজন্ম) আর ফেরদৌসীর প্রভাবে ইরানের রেনেসাঁস।
এই দুই ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, অতি-প্রাচীন স্মৃতি মানুষের মনে নূতন করে সক্রিয় হয়েছে, জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে ব্যাপকতর বোধ তার মধ্যে জেগেছে। আর এই দুই ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে হিব্রু ঐতিহ্যের যে প্রতীক-দ্বেষ তার প্রতি অনাদর আর নব প্রতীক-প্রীতি। অবশ্য এই রেনেসাঁসের কালে ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশ ও ইরান যে খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্ম বর্জন করেছে আর নূতন করে প্রতিমা-পূজক হয়েছে তা নয়, তবে তাদের কয়েক শতাব্দীর উৎকট প্রতীক-দ্বেষ বাস্তবিকই অন্তর্হিত হয়েছে, অরূপ আর রূপ উভয়ের গভীরতর অর্থ তারা যেন বুঝতে পেরেছে, আর জীবনের মহত্তর সম্ভাবনার পথে নব যাত্রা শুরু করেছে।
ইসলামের যে রেনেসাস শুরু হয়েছে খ্যাতনামা মুসলিম কবি ইকবাল সে-কথা বলেছেন-তুর্কীর সংস্কার-চেষ্টায় তিনি তা দেখতে পেয়েছেন, যদিও তুর্কীর সে-চেষ্টায় পুরোপুরি খুশি তিনি হতে পারেন নি; আর নিজে অবলম্বন করেছেন যে-ধারা তাকে রেনেসাঁস না বলে রিফরমেশন (সংস্কার আন্দোলন) বলাই উচিত।
অবশ্য ইয়োরোপে রেনেসাঁস আর রিফরমেশন পিঠ পিঠ এসেছিল। বাংলার উনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু-সমাজেও প্রায় সেই ব্যাপার ঘটেছিল। মুসলমানদের মধ্যেও যদি রেনেসাঁস আর রিফরমেশন এক সঙ্গে আসে, তাতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। শুধু একটু সচেতন হওয়া দরকার, আমরা কে কোন্ পথে চলেছি সে-সম্বন্ধে-রেনেসাঁসের দিকে, না রিফরমেশনের দিকে।
নজরুলের প্রতীক-প্রীতি যে রেনেসাঁস-ধর্মী তা ভাবা যায় এই সব কারণে :
১। বাংলার মুসলমানের পূর্বপুরুষ যে প্রধানত হিন্দু, অর্থাৎ বৌদ্ধ ও হিন্দু, তা অনস্বীকার্য। প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে যোগ গভীর না হলে কখনো রসের অনুভূতি জাগে না। রসের অনুভূতির সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত আত্মশক্তির পূর্ণ বোধ, অর্থাৎ রেনেসাঁস। তাই জীবনের সার্থকতাকামী বাঙালি মুসলমানের জন্য তার পরিবেষ্টনের মাধুর্য আর পূর্বপুরুষের সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ মর্যাদা উপলব্ধি একান্ত প্রয়োজনীয়-ফেরদৌসী যেমন একান্ত প্রয়োজন বোধ করেছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষদের মহিমার সঙ্গে যোগযুক্ত হবার। এ-ব্যাপারটা যেন বৃক্ষের মূল দিয়ে মাটির গভীর রস আহরণ করার মতো।
২। নজরুলের প্রতীক-প্রীতি আর একজন সাধারণ হিন্দুর প্রতীক-উপাসনার মধ্যে পার্থক্য এই যে, নজরুল প্রতাঁকের ভাবের মাধুর্য গ্রহণ করেছেন পূর্ণভাবে, কিন্তু জীবনে তিনি অরূপেরই পূজারী-যে-অরূপ নিজেকে প্রকাশ করে চলেছে অনন্ত কল্যাণ প্রচেষ্টায়। তাই নজরুল একালের সর্বহারাদের কবি, নিষ্ক্রিয় দেব-পূজারী নন।
৩। বাংলার মুসলমান, বাংলার হিন্দু থেকে পৃথক, এই আত্মচেতনা মুসলমানকে দিয়েছে আত্মরক্ষার সামান্য শক্তি, অর্থাৎ নিজেকে কোনো রকমে বজায় রাখবার শক্তি; কিন্তু মাত্র আত্মচেতনা ব্যাধি; আত্মচেতনার সঙ্গে যুক্ত হওয়া চাই আত্মবিসর্জনের ক্ষমতা। প্রতীক-প্রীতির ভিতর দিয়ে নজরুল মুসলমানকে ইঙ্গিত দিয়েছেন এই লোভনীয় আত্ম-বিসর্জনের দিকে, অর্থাৎ দূর-অতীতের স্মৃতি ও পরিবেষ্টনের মাধুর্য উভয়ের শক্তিতে সঞ্জীবিত হতে, অন্য কথায়, স্বদেশ-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে। কবি ইকবাল এই আত্মবিসর্জন-শক্তি মুসলমানকে লাভ করতে বলেছেন বিশ্ব-মুসলিম-রাষ্ট্রে আত্ম-বিসর্জন দিয়ে। পাঞ্জাবী মুসলমানের জন্য এ অসম্ভব না-ও হতে পারে, কেননা একটু চেষ্টা করলেই সে বিরাট মুসলমান-জগতের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারে-অন্তত ভৌগলিক সংস্থানের দিক দিয়ে। কিন্তু মানস-চেতনার দিক দিয়ে এ-চেষ্টা সার্থক হবে কি না সেটি সন্দেহের বিষয়, কেননা ভাষার যোগ অতি বড় যোগ। আর। বাঙালি মুসলমানের জন্য এটি তো অসম্ভব-যেমন অসম্ভব ভারতীয় খ্রিস্টানদের ইয়োরোপীয় খ্রিস্টানদের আপনার জন হওয়া।
প্রশ্ন হতে পারে-এ তো জাতীয়তার যুগ নয়, বিশ্ববোধের যুগ।
নিশ্চয়: কিন্তু জাতীয়তা-চেতনা বাদ দিয়ে এই বিশ্ববোধ নয়। যেমন দেহ বাদ দিয়ে আত্মা নয়, অর্থাৎ বৃক্ষের মাটির রস উপেক্ষা করে আলো-বাতাস থেকে খাদ্য আহরণ নয়।
নজরুল অবশ্য দার্শনিক নন-কবি। তাই বাংলার মুসলমানের নব-জীবন, জিজ্ঞাসার উত্তর তিনি দিয়েছেন কবির সহজ জীবনানন্দের ভিতর দিয়ে। হিন্দ দেবদেবীতে তাঁর আনন্দ বাস্তবিকই অর্থপূর্ণ। এই আনন্দের ভিতর দিয়ে তিনি উপলব্ধি করেছেন জন্মভূমির সঙ্গে তাঁর যুগযুগান্তরের যোগ। নিজেকে এমন ব্যাপকভাবে ও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে, একই সঙ্গে সহজ মানুষ ও শক্তিমান হওয়া সম্ভবপর নয়।
অবশ্য এ-পথে বিপদ যে নেই তা নয়। মানুষ যথেষ্ট দুর্বল, সৃষ্টি-ধর্মী না হয়ে সহজেই সে হয় অনুকরণপ্রিয়-অতীতের প্রেমিক না হয়ে হয় অতীতের পূজারী। কিন্তু জীবনের পথ ভয় ও অনুকরণের পথ নয়, প্রেমের পথ-জগতে যেখানে যা সুন্দর ও মহৎ আছে সবকে আহরণ করে’-অবশ্য সর্বাগ্রে পরিবেষ্টনের সৌন্দর্য ও মহত্ত্ব নিঃশেষে আত্মস্থ করে’।
১৯৪৩
‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ’
প্রায় বিশ বৎসর পূর্বে ঢাকার কয়েকজন খ্যাতনামা খান-বাহাদুর নজরুলের সঙ্গে এক আলাপ-আলোচনার আয়োজন করেছিলেন। ঠিক হয়েছিল বুড়ীগঙ্গায় এক বজরায় তারা কবির সঙ্গে মিলিত হবেন। নির্দিষ্ট সময়ে খান-বাহাদুররা সেই বজরায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। কিন্তু কবির দেখা নেই। অনেক কষ্টে কবিকে উদ্ধার করা গেল এক বন্ধু সম্মেলন থেকে, তার উচ্চ হাসি হয়ত দিয়েছিল তার সন্ধান। কিন্তু যখন কবিকে বলা হলো, সম্মানিত খান বাহাদুররা অনেকক্ষণ ধরে তার জন্য অপেক্ষা করছেন, তখন কবি বলেছিলেন : “আমি দেশের কবি, খান-বাহাদুররা আমার জন্য অপেক্ষা করবেন না তবে কী করবেন? আমি রাজপথ দিয়ে চলবো, দেশের খান-বাহাদুর, রায়-বাহাদুররা রাস্তার দুই পাশ থেকে আমাকে কুর্নিশ জানাবেন, আমি সেই কুর্নিশ গ্রহণ করতে করতে এগিয়ে যাব, এই তো আমাদের মধ্যেকার সত্যিকার সম্পর্ক।”-নিঃস্ব গুণীর এমন আত্মমহিমা-বোধের ইতিহাসবিত দৃষ্টান্ত বেটোফনে।* আমাদের দেশে নজরুল ভিন্ন আর কোনো দরিদ্র গুণী এমন কথা বলতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই। এই কবি যে বলেছিলেন, “আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ-’এটি তার এক খেয়ালী কথা নয়, এটি তার ভিতরকার একটি স্থায়ী ভাব-প্রধান ভাব। বলা বাহুল্য, এমন আত্মমহিমা-বোধ দুর্লভ-খুব উঁচু দরের প্রতিভার মধ্যেই এর সন্ধান মেলে।
[* কবিগুরু গ্যেটে দ্বিতীয় খণ্ডে ‘বেটোফন’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।]
কিন্তু নজরুলে এই দুর্লভ আত্মমহিমা-বোধের সঙ্গে যুক্ত অদ্ভুত উদাসীনতা-খাস বাংলায় যাকে বলা হয় ঢিলে-ঢালা ভাব। খাওয়া-পরা, চলা-ফেরা ইত্যাদি দৈনন্দিন জীবনের ব্যাপারে তার উদাসীনতার কথা সবাই জানেন, রচনার সৌকর্য সম্বন্ধেও তিনি যে কত উদাসীন, তা জানেন তার অভিনিবিষ্ট পাঠকরা। এজন্য এমন সাহিত্য-রসিকের অভাব নেই যারা কবি হিসেবে নজরুলকে যথেষ্ট মর্যাদাবান্ জ্ঞান করতে কুণ্ঠিত। কিন্তু দুর্লভ আত্মমহিমা-বোধ তার রচনায় যে স্বাক্ষর রেখে গেছে, এজন্য অনন্ত ক্রটি সত্ত্বেও তিনি একজন মর্যাদাবান কবিই। নজরুলকে বিদ্রোহী-রূপে দেখা, সাম্যবাদী-রূপে দেখা, হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়কারী-রূপে দেখা অসার্থক নয়, বরং এক হিসেবে যথেষ্ট সার্থক এইজন্য যে, এমনি করে দেখে কবিকে আমরা আরো নিকটে পাই; কেননা, এ সব ভাবের দ্বারা আমরাও অনুপ্রাণিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার বিদ্রোহ, সাম্যবাদ, হিন্দু মুসলমানের সমন্বয়, সবের মূলে তার এই আত্মমহিমাবোধ-এই আত্মমহিমাবোধ থেকে এই সব ভাব বিশেষ রস ও রূপ পেয়েছে।
তার এই মহার্ঘ মূল ভাব তিনি লাভ করেছিলেন কোথা থেকে, কেমন করে, সে সম্বন্ধে সঠিক খবর জানবার উপায় নেই; কেননা, ব্যক্তিত্ব দুরহগাহ্য। তবে অল্প বয়সেই তার নাকি পল্লীর যাত্রার দলের সঙ্গে সংস্রব ঘটে-হয়ত সেখান থেকেই লাভ হয়েছিল তার বেদুয়িনী-সেই সংস্রব থেকে হিন্দু-পুরাণের সঙ্গে তার নিবিড় পরিচয়, আর হিন্দুপুরাণ থেকে তাঁর পরমপ্রিয় ‘সোহহ’ তত্ত্ব লাভ অনুমান করা যায়। এর উপরে তরুণ বয়সে তিনি যখন যুদ্ধে গিয়েছিলেন তখন তাঁর পরিচয় হয় হাফিজ-ভক্ত এক পশ্চিমী মুসলমানের সঙ্গে-এই সূত্রে সুফী-তত্ত্ব ‘আনাল হক’-ও তাঁর লাভ হওয়া বিচিত্র নয়।* কিন্তু দেখবার আছে এই পরিচিত ‘সোহহম” বা “আনাল হক” তত্ত্ব তার ভিতরে যে বিশেষ প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার করেছিল সেইটি। এই সব তত্ত্বের প্রভাবে তার কাব্য যে অনেক ক্ষেত্রে ক্ষুণ্ণ হয়েছে, তার বাণী বৈশিষ্ট্য-বর্জিত হয়েছে-তার বাণী প্রখর্য তত লাভ করেনি, যত হয়েছে তত্ত্বময় ও উজ্জ্বাসময়–তা মিথ্যা নয়; কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে মাঝে মাঝে এই ‘সোহহ’ বা ‘আ’নাল হক তত্ত্ব তার জন্য হতে পেরেছে এক প্রবল গভীর প্রেরণার ব্যাপার-তাতে তাঁর চিত্তে যে চেতনা জেগেছে সেই অপূর্ব সম্পদও তাঁর কাব্যে বিধৃত হয়েছে।
এই অদ্ভুত ও বিচিত্র প্রতিভা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসু হ’বার দিন দেশের সাহিত্য-রসিকদের এসেছে।
১৯৪৬
[* নাট্টকার শ্রীযুক্ত শচীন সেনগুপ্তের মতে সোহহম-তত্ত্বে নজরুল সুপ্রতিষ্ঠিত হন শ্রীঅরবিন্দের কলকাতার ভক্তগোষ্ঠীর সংস্পর্শে এসে।]