সমাজ ও সাহিত্য

সমাজ ও সাহিত্য

[ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধ করা হয়নি]

রামমোহন রায়

বাল্যজীবন

১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে রামমোহনের জন্ম। মিস্ কলেটের এই মত মেনে নেবার যোগ্য।

তাঁর বালক-কালের দুইটি ব্যাপার বেশ চোখে পড়বার মতো; একটি, তার মেধাশক্তি, অপরটি, গৃহে প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহে ভক্তি। প্রথমটির বাঞ্ছিততম পরিণতি তাঁর পরবর্তী জীবনে ঘটেছিল একথা সবাই জানেন; দ্বিতীয়টির পরিণতি কিছু অদ্ভুত। কোনো কোনো ইতিহাস-প্রসিদ্ধ পুরুষের জীবনে এমন পরিণতি দেখতে পাওয়া গেছে, যেমন বাল্যের চঞ্চল ও তার্কিক নিমাই হয়েছিলেন ভক্তিরসাপুত শ্রীচৈতন্য। কিন্তু অনেকের জীবনে এমন পরিণতি দেখতে পাওয়া যায় না। বালক-বুদ্ধদেবকে আমরা দেখতে পাই সহানুভূতিসম্পন্ন ও পর্যবেক্ষণশীল; বালক-মোহাম্মদ সম্বন্ধে যে-সব বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় সমসাময়িক উছুঙ্খল জীবনের ভিতরে তার স্বাতন্ত্র; আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় নাকি পুরোহিতের সন্তান হয়েও দেবতার সম্মুখে নিবেদিত নৈবেদ্য গ্রহণ করতে পারতেন না। তবে রামমোহনের বাল্যের এই ভক্তিপ্রবণতা উত্তরকালে একটি সুন্দর পরিণতিও লাভ করেছিল। রামমোহনের যোচূবেশ বন্ধুর চোখে এত মহিমময় ও শত্রুর চোখে এত নিষ্করুণ যে, তার অন্তরের পরমাশ্চর্য কোমলতা তাঁদের চোখে পড়বার অবকাশ পায় না। একটি অন্তঃপ্রবাহী ভক্তি ধারা তার ভিতরে ছিল, শুষ্ক জ্ঞানমাগী তিনি ছিলেন না, একথা আজ সুবিদিত; তার সঙ্গে একথাও আমরা জানি যে, এই পুরুষসিংহ অভিনয়ের চমৎকারিত্বে মুগ্ধ হয়ে অশ্রু সংবরণ করতে পারেন নি, বিগতজীবন বন্ধুর স্মৃতির উদ্দেশে অশ্রু-তর্পণ তার জন্য ছিল অতি স্বাভাবিক। ইংল্যান্ডের লোকদের তাঁর সম্বন্ধে যে ধারণা হয়েছিল-The oriental gentleman, versatile, emotional yet dignified, এটি যথার্থ ধারণা।

এই মেধাবী বালকের ভবিষ্যৎ যাতে গৌরবোজ্জ্বল, হয় পিতা রামকান্তের সে কামনা ছিল। তৎকালের শ্রেষ্ঠশিক্ষা লাভের ন্য বাল্যশিক্ষা সমাপনান্তে রামমোহন পাটনায় প্রেরিত হন নয় বৎসর বয়সে।

রামমোহন ও মুসলিম-সাধনা

পাটনায়* কিশোর-রামমোহনের অবস্থিতিকাল সুদীর্ঘ নয়। কিন্তু তাঁর জীবনের উপরে এর প্রভাব গভীর। এই প্রভাবের স্বরূপ একটু বুঝতে চেষ্টা করা যাক।

[* (তিনি) একজন প্রাচ্যদেশীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি-বহু বিষয়ে অভিজ্ঞ, ভাবপ্রবণ, কিন্তু প্রভাববান।-কথাটি মিস্ কলেটের লিখিত জীবনীতে আছে।
* রামমোহনের বিরুদ্ধপক্ষের বক্তব্য দ্রষ্টব্য]

হিন্দু ও খ্রিস্টান শাস্ত্রের যে-সব আলোচনা রামমোহন করেছিলেন, সৌভাগ্যক্রমে সে-সবের অধিকাংশই আমাদের জন্য রক্ষিত আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে মুসলমান-শাস্ত্র সম্বন্ধে যে-সব সুসম্বন্ধ ও বিস্তৃত আলোচনা তিনি করেছিলেন, অথবা করবেন আশা করেছিলেন, তার কিছুই আমাদের হাতে এসে পৌঁছোয় নি। তুহফাতুল-মুওহহিদীন গ্রন্থে অবশ্য কোরআনের কয়েকটি বচন ও হাদিস সম্বন্ধে কিছু মন্তব্য আছে; কিন্তু সে আলোচনা তিনি করেছেন শাস্ত্র বিসর্জন দিয়ে, শাস্ত্র স্বীকার করে নয়। তবু এই তুহফাতুল-মুওহিদীন গ্রন্থ ও তাঁর রচনার নানাস্থানে ইসলাম ও মুসলমান সম্বন্ধে বিক্ষিপ্ত উক্তি, আভাস, ইঙ্গিত ইত্যাদি থেকে মুসলিম সাধনা সম্বন্ধে তার মনোভাব, অথবা তাঁর চিত্তের উপরে মুসলিম সাধনার প্রভাবের স্বরূপ অনেকখানি বুঝতে পারা যায়।

অনেকেই বলেছেন, তাঁর স্বসম্প্রদায়ের প্রতীক-উপাসনার প্রতি তাঁর যে বিতৃষ্ণা, তার মূলে রয়েছে কোরআনের শিক্ষা।–শুধু এইই নয়। খ্রিস্টান-সমাজের ত্রিত্ববাদ, যিশুর রক্তে পাপীর পরিত্রাণ, এ সমস্তের প্রতি তাঁর যে বিরূপতা, অথচ যিশুখ্রিস্টের প্রতি তাঁর যে গভীর শ্রদ্ধা, এ-সমস্তেরও মূলে রয়েছে কোরআনের শিক্ষা। যথা:

তারা বলে, আল্লাহ্ পুত্র গ্রহণ করেছেন। তারই প্রশংসা! তিনি পরম সমৃদ্ধ। আকাশে ও মাটিতে যা কিছু আছে সব তার। এর সমর্থক কিছু তোমাদের নেই। এমন কথা কি বলছ তোমরা আল্লাহ্র সম্বন্ধে যা তোমরা জান না? (১০ : ৬৮)। আর আমরা মেরি-তনয় যিশুকে পরিচ্ছন্ন নির্দেশ দান করেছিলাম ও তাকে “রুহুল কুদুস (Holy Spirit) দ্বারা বলীয়ান করেছিলাম (২: ৮৭)। যিশুর প্রার্থনা নামে কোরআনে একটি আয়াত আছে, তার অর্থ এই: “তুমি যদি তাদের শাস্তি বিধান কর (তবে)-তারা তোমারই দাসানুদাস; আর যদি তুমি তাদের ক্ষমা কর (তবে-তুমি মহান ও জানময় (৫: ১১৮)।”

প্রসিদ্ধি আছে যিশুখ্রিস্টের এই কোরআনোক্ত পরম নির্ভরতার প্রার্থনাটি একদা হজরত মোহাম্মদ সমস্ত রাত্রি আবৃত্তি করেছিলেন।

শুধু এই-ই নয়। কোরআনের আরো বহু বাণী রামমোহনের মর্ম স্পর্শ করেছিল। কোরআনের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে তারা জানেন, প্রকৃতির দিকে, মানুষের ইতিহাসের দিকে, কোরআন বারবার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। পরমকবিত্বপূর্ণ ভাষায় বলা হয়েছে-সূর্য চন্দ্র মেঘ বৃষ্টি বসন্ত-বায়ু কেমন করে আল্লাহর মহিমাকীর্তন করছে, মানুষের সেবায় এ সবের নিয়োগ হয়েছে, ফলে জলে শস্যে মানুষের কেমন পরিতোষ-সাধন হচ্ছে, এবং এই সব বিশ্বপাতার অস্তিত্বের প্রকৃষ্ট প্রমাণ। রামমোহন তাঁর তুহফাতুল-মুওহিদীন গ্রন্থে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে এই সব যুক্তি যথেষ্ট অনুরাগের সঙ্গে ব্যবহার করেছেন।

বিধর্মীদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে সে-সম্বন্ধেও কোরআনে কয়েক জায়গায় সুন্দর উপদেশ আছে, যথা:

আল্লাহ্ ভিন্ন তারা অন্যান্য যাদের উপাসনা করে তাদের গালি দিও না, পাছে তারা অজ্ঞানতাবশতঃ সীমা অতিক্রম করে আল্লাহকে গালি দেয়…. (৬ : ১০৯)। যারা….ভালোর দ্বারা মন্দ বিদূরিত করে, তারা সুখকর আশ্রয় লাভ করবে (১৩ : ২২)। আমার ভৃত্যদের বল যা উত্তম তাই তারা বলুক (১৭ : ৫৩)। তারাই পরমকারুণিকের দাস যারা বিস্ত্র হয়ে ধরণীবক্ষে বিচরণ করে, আর অজ্ঞরা যখন তাদের সম্বোধন করে তখন তারা বলে, “সালাম’ (শান্তি) (২৫ : ৬৩)। নারীজাতির পক্ষ রামমোহন আজীবন সমর্থন করেছেন। নারীর প্রতি সুবিচার ও। সদয় ব্যবহার করবার উপদেশ কোরআনে বিস্ততভাবে আছে। যথা:

হে বিশ্বাসিগণ, এটি তোমাদের জন্য বৈধ নয় যে, নারীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমরা তাদের উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করবে, আর তোমরা তাদের যা দিয়েছ তার কিছু অংশ ফিরে পাবার জন্য তাদের বিপন্ন করো না, অবশ্য যদি তারা জ্বলজ্যান্তভাবে অন্যায়াচরণ না করে, আর তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার কর; এর পর যদি তোমরা তাদের ঘৃণা কর তাহলে, হতে পারে, তোমার এমন একটি জিনিষ অবজ্ঞা করলে যার ভিতরে আল্লাহ পর্যাপ্ত কল্যাণ নিহিত রেখেছেন (৪ : ১৯)।

নারীজাতির প্রতি শ্রদ্ধান্বিত ব্যবহার হযরত মোহাম্মদের নিজের চরিত্রেও লক্ষণীয়। যখন তিনি মদিনার রাজা তখন তার ধাত্রী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। তাঁকে দেখেই তিনি গাত্রোত্থান করলেন ও নিজের উত্তরীয় বিছিয়ে দিলেন তার বসবার জন্য।

কিন্তু কোরআন থেকে সবচেয়ে বড় জিনিস যেটি রামমোহনের লাভ হয়েছিল, সেটি। মনে হয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বরের মহিমা সম্বন্ধে তার ধারণা। তার ব্রহ্মাসঙ্গীতের অল্প কয়েকটিতে ঈশ্বরের মহিমা অতি সুন্দর রূপ লাভ করেছে, সে-সবের পাশে পাশে কোরআনের কয়েকটি বচন উদ্ধৃত করা যাচ্ছে:

মন যারে নাহি পায় নয়নে কেমনে পাবে।
সে অতীত গুণত্রয়
ইন্দ্রিয় বিষয় নয়;
রূপের প্রসঙ্গ তার কেমনে সম্ভবে।
ইচ্ছামাত্র করিল যে বিশ্বের প্রকাশ, ইচ্ছামতে রাখে
ইচ্ছামতে করে নাশ, সেই সত্য এই মাত্র নিতান্ত জানিবে।

কোরআন: …তার তুলনা ব্যক্ত করবার মতনও কোনো কিছু নেই (৪২: ১১)।

আকাশ ও পৃথিবীর অপূর্ব স্রষ্টা,-আর যখন তিনি কোনো-কিছু সংকল্প করেন তিনি শুধু সেটিকে বলেন, হোক আর প্রকাশ পায় (২: ১১৭)।

ভাব সেই এক জলে স্থলে শূন্যে যে সমভাবে থাকে।

যে রচিল এ সংসার
আদি অন্ত নাহি যার
যে জানে সকল, কেহ নাহি জানে তাকে।

কোরআন:

তিনি জানেন তাদের অগ্রে কি আছে ও তাদের পশ্চাতে কি আছে, তার যেটুকু অনুগ্রহ সেটুকু ভিন্ন তাঁর জ্ঞানের কিছুই তারা ধারণা করতে পারে না; তার সিংহাসন আকাশ ও পৃথিবীর উপরে বিস্তৃত, আর এই উভয়ের রক্ষণাবেক্ষণে তিনি ক্লান্ত হন না…(২: ২৫৫)।

কে বুঝিবে তার মর্ম
ইন্দ্রিয়ের নহে কর্ম
গুণাতীত পরব্রহ্ম সকল কারণ।

কোরআন:

দৃষ্টি তাকে দর্শন করতে পারে না, কিন্তু তিনি (সব) দৃষ্টি দর্শন করেন। তিনি সম্মেলন পরিজ্ঞাতা-সদাজাগ্রত (৬: ১০৪)।

ঈশ্বর, আত্মা বা প্রত্যাদেশ, ইত্যাদির স্বরূপ-চিন্তায় মানুষ বিব্রত হবে এ কোরআনের অভিপ্রেত নয়, যথা:

“তারা তোমাকে প্রেরণা (প্রত্যাদেশ, আত্মা) সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করছে; বল, আমার প্রভুর হুকুমে প্রেরণা আসে, আর জ্ঞানের অতি অল্প অংশই তোমাদের দান করা হয়েছে” (১৭ : ৮৫)।

ব্ৰহ্ম স্বরূপতাঃ দুয়ে, তটস্থ লক্ষণের দ্বারা তাকে বুঝতে হয়, এ কথা রামমোহন বারবার বলেছেন।

অনেকের ধারণা-কোরআনের আল্লাহ্ এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ অধীশ্বর, তাঁর ভয়ে সমস্ত প্রাণী ভীত, দণ্ড বা পুরস্কার যা খুশিী তাই তিনি তাঁর সৃষ্ট জীবকে প্রদান করেন। এসব ভাব যে কোরআনে নেই তা বলবো না। কিন্তু কোরআন একটু বিশেষ মনোযোগ দিয়ে পড়লে বুঝতে পারা যায়-কোরআনের আল্লাহ অনন্তমহিমান্বিত সদাজাগ্রত আর প্রেমপ্রবণ। এই আল্লাহর বশ্যতা স্বীকার করবার জন্য কোরআনে বারবার বলা হয়েছে-”আমানু ও আমালুস সালেহাত”-বিশ্বাস কর ও সৎকর্মশীল হও। এই সৎকর্ম বলতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সৎকর্মের কথাই ভাবা হয়েছে, যদিও অনেক মুসলমান-ধর্মাচার্য সৎকর্মের এই সাধারণ ও স্বাভাবিক ব্যাখ্যার উপরে বেশি জোর দেন না। সৎকর্ম (লোকশ্রেয়ঃ) বলতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সৎকর্মের কথাই যে রামমোহন বুঝতেন সে কথা সর্বদিসম্মত।

মুসলমানের চিন্তায় কোরআনের স্থান সর্বোচ্চে। কিন্তু এই কোরআন কি ভাবে বুঝতে হবে সে-সম্বন্ধে সব মুসলমান নিশ্চয়ই একমত নন। মানুষের অন্তর্নিহিত বিচারবুদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যে-সব মুসলমান কোরআন বুঝতে চেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে মধ্যে মোতাজেলা-দল সুবিখ্যাত। মানুষের অন্তরের অনুভূতি বিশেষভাবে তার সত্যোপলব্ধির সহায়ক, এই মত যে-সমস্ত মুসলমান পোষণ করতেন, তাঁদের মধ্যে সুফী-সম্প্রদায়ের কোনো কোনো শাখা সুবিখ্যাত। রামমোহনের চোখে যে ইসলাম মহিমা বিস্তার করেছিল, সে-ইসলাম সর্বসাধারণ মুসলমানের ইসলাম তেমন নয়। ইসলামের সেই পরিচিত রূপে তিনি যে তৃপ্ত হতে পারেন নি, তা বুঝতে পারা যায় তার Second Appeal to the Christian Public-এর এই উক্তি থেকে।

Disgusted with the puerile and unsociable system of Hindoo idolatry, and dissatisfied at the cruelty allowed by Mussalmanism against Non Mussalmans, I, on my searching after the truth of Christianity, felt for a length of time very much perplexed with the difference of sentiments found among the followers of Christ (I mean Trinitarians and Unitarians, the grand division of them) until I met with the explanation of the unity given by the divine Teacher himself as a guide to peace and happiness. (Panini office Edition, 1906. page 580).*

[* হিন্দুর অসামজিক ও বালকোচিত পৌত্তলিকতায় বিরক্ত হয়ে আর অমুসলমানদের প্রতি মুসলমান ধর্মের নির্মমতায় দুঃখিত হয়ে আমি খ্রিস্টধর্মের সত্য সম্বন্ধে জিজ্ঞাসু হই; কিন্তু খ্রিস্ট-অনুবতীদের মধ্যে অর্থাৎ ত্রিত্ববাদী ও একত্ববাদী এই দুই বড় দলের মধ্যে, যে-মতভেদ তা দেখে বহুদিন আমার দ্বিধাসন্দেহে কাটে। অবশেষে শান্তি ও আনন্দের নির্দেশ স্বরূপ সেই স্বর্গীয় আচার্যের প্রদত্ত একত্বের ব্যাখ্যার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে।]

তিনি যে-ইসলাম থেকে প্রেরণা লাভ করেছিলেন, সে-ইসলাম মোতাজেলাদের ও শ্রেষ্ঠ সুফীদের ইলাম।

সাদী হাফিজ প্রমুখ সুফী-সাহিত্যিকদের রচনা তাঁর চিত্তের সন্তোষ-সাধন করেছিল। তার কয়েকটি অতি প্রিয় বচনের মধ্যে একটি হচ্ছে হাফিজের একটি গজলের এই দুই চরণ:

ইহকাল ও পরকালের আরাম এই এক কথায়–

বন্ধুদের নিয়ে উৎসব কর, শত্রুদের সঙ্গে আপোস কর ॥

তার তুহফাতুল মুওহহিদীন-এ হাফিজের আরো দুইটি বাণী উদ্ধৃত হয়েছে:

বায়াত্তর দলের ঝগড়া নিরর্থক,
সত্য না বুঝে তারা খেয়াল ও মূঢ়তার পথে চলেছে ॥
কারো অনিষ্টাচারী হয়ো না, আর যা খুশি কর,
আমাদের পন্থায় এ ভিন্ন আর কোনো পাপ নেই ॥

আর সাদীর এই বাণীটি তার অত্যন্ত প্রিয় ছিল;

জীবের সেবা ভিন্ন ধর্ম আর কিছু নয়।
তসবিহ্ জায়নামাজ (আসন) ও আলখাল্লায় ধর্ম নাই ॥

তিনি নাকি মাঝে মাঝে ইচ্ছাপ্রকাশ করতেন, এই বচনটি যেন তাঁর সমাধি-গাত্রে উৎকীর্ণ হয়। আর ভারতীয় কৃষকদের নিদারুণ দুঃখের কাহিনী বর্ণনা করে তাদের দুঃখ দূর করবার জন্য East India Company-র কর্মকর্তাদের তিনি অনুরোধ জানিয়েছিলেন সাদীর এই বাণীটি উপহার দিয়ে–

প্রজাদের সঙ্গে প্রীতিবদ্ধ হও ও (এই ভাবে) তোমার
শত্রুদের যুদ্ধ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হও।
কেননা ন্যায়পরায়ণ নরপতির সৈন্য হচ্ছে তার প্রজা ॥

সুফীদের যে-সব বাণী তিনি উদ্ধৃত করেছেন, সে-সবের ভিতর দিয়ে তার চিত্ত সুস্পষ্টভাবেই আত্মপ্রকাশ করেছে। সবাই জানেন, ঈশ্বরের স্বরূপ নির্দেশ সম্পর্কে সুফী-সাহিত্যে অনেক তত্ত্বপূর্ণ কথা আছে। মৌলানা জালালুদ্দিন রুমির কবিতায় অদ্বৈত-তত্ত্ব আশ্চর্য সাহিত্যিক সার্থকতা লাভ করেছে। সে-সবে রামমোহন কতখানি আনন্দিত হতেন, তা তেমন জানতে পারা যাচ্ছে না। কিন্তু শ্রেষ্ঠ সুফীদের সুগভীর মানব-প্রেম বা জীব-প্রেম যে তার পরম আনন্দের বিষয় ছিল, সেটি অতি সুন্দরভাবে বুঝতে পারা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞেরা আজ এ বিষয়ে একমত যে বিশ্বামানবের একতের ধারণা রামমোহন সুস্পষ্টভাবে করেছিলেন। সেই বিশ্বমানবের একাত্ব সম্বন্ধে সাদীর এই বাণীটি সুবিখ্যাত–

আদম-সন্তানরা একে অন্যের অঙ্গস্বরূপ
কেননা তাদের উৎপত্তি একই মূল থেকে।
যদি এক অঙ্গে বেদনা বাজে
তাহলে অন্য অঙ্গও শান্তিতে থাকে না।
মানুষের দুঃখ যদি তুমি না বোঝে
তাহলে মানুষ নাম নেওয়া তোমার অন্যায় হয়েছে।

সুফী-সাহিত্য রামমোহনের অন্তরকে আনন্দিত করেছিল, কিন্তু তার অন্তর ও বাহির উভয়কে বীর্যবন্ত করেছিল মোতাজেলাবাদ। তার যুক্তিবাদের কয়েকটি প্রধান সায়ক গৃহীত হয়েছিল মোতাজেলাতৃণ থেকে, যথা:

(১) ঈশ্বর সর্বশক্তিমান কিন্তু তিনি নিজেকে ধ্বংস করতে পারেন না, তাঁর সমকক্ষ আর একজন ঈশ্বর সৃষ্টি করতে পারেন না।

(২) ঈশ্বরের গুণ তাঁর সত্তা থেকে পৃথক নয়, গুণের স্বতন্ত্র সত্তা স্বীকার করলে ঈশ্বরের একত্ব নষ্ট হয়। প্রধানত এই যুক্তির দ্বারা রামমোহন বিভিন্ন দেবদেবীর ঈশ্বরত্বের দাবি খণ্ডন করেছেন।

(৩) রামমোহন বলেছেন বেদ নশ্বর। মোতাজেলারা বলতেন, কোরআন সৃষ্টবস্তু, স্রষ্টার মতো চিরন্তন নয়। প্রধানত এই মতের জন্য মোতাজেলারা সর্বসাধারণ মুসলমানের বিরাগভাজন হন।

তবে মোতাজেলাদের সঙ্গে রামমোহনের বড় পার্থক্য হয়ত এই-মোতাজেলারা সাধারণত বিচারপন্থী পণ্ডিত, রামমোহনের পাণ্ডিত্য অনন্য-সাধারণ, কিন্তু বিচারপন্থী পণ্ডিত তিনি যতখানি তার চেয়ে বেশি তিনি বিচারপন্থী কর্মী-স্বদেশ-প্রেমিক ও মানব প্রেমিক।

মুসলমান নৈয়ায়িকদের কাছে রামমোহন যে বিশেষভাবে ঋণী, সে কথা সবাই স্বীকার করেছেন। তাদের আবিষ্কৃত তর্ক-বিজ্ঞানের ‘যথেষ্ট হেতু’-বাদ “তরজি বেলা মুরাজ্জেহ্” (Principle of sufficient reason) আধুনিক বিজ্ঞানের এক শ্রেষ্ঠ অবলম্বন।

রামমোহন মুসলিম সাধনাকে যে-দৃষ্টিতে দেখেছিলেন, সেই দৃষ্টি তাঁর সমকালে কোনো মুসলমানের ভিতরে ছিল কি না, তার পরিচয় পাওয়া যায় না।* শুধু তার জীবন-চরিতে পাওয়া যাচ্ছে, মুসলমানরা তার কোনো কোনো মন্তব্যের জন্য এক সময়ে বিরক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর কলিকাতা-বাসকালে মুসলমানদের সঙ্গে তার যথেষ্ট হৃদ্যতা জন্মেছিল। এমন কি মুসলমানদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুব বেশি ছিল বলেই তার স্বসম্প্রদায়ের লোক তার উপর বিশেষভাবে অসস্তুষ্ট ছিলেন, তারা সন্দেহ করতেন, হয়ত মুসলমানদের সঙ্গে তাঁর পানভোজনও চলে। তৎকালের উচ্চশ্রেণীর মুসলমান রাজ-কর্মচারীরা যে কৃতবিদ্য ও দক্ষ দিলেন, বিদ্যায় বুদ্ধিতে চরিত্রবলে শারীরিক বীর্যে, পোষাকে-পরিচ্ছদে তৎকালের মুসলমান যে তৎকালের হিন্দুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন, বিলাতে সাক্ষ্যদান-কালে স্পষ্টভাবেই তিনি সে কথা বলেছিলেন।

[* সিয়ারুল মোতা আখেরীন-এর লেখক সৈয়দ গোলাম হোসেন রামমোহনের অব্যহতির পরের লোক। তাঁর স্বদেশপ্রেম ও কাণ্ডজ্ঞান প্রশংসাৰ্য, কিন্তু ধর্মে তিনি রামমোহনের ___ নন।]

কিন্তু তবু মনে হয়, মুসলমানদের সঙ্গে তাঁর এই যে সম্প্রীতি, সম-মতের সম্প্রীতি এ নয় সম-বৈদগ্ধ্যের এ সম্প্রীতি। মুসলিম সাধনা ও তৎকালের মুসলিম প্রকর্ষ তাঁর প্রিয় ছিল, কিন্তু এসবের প্রতি তাঁর মোহ ছিল না। তাই পার্শীর পরিবর্তে ইংরেজিকে রাজভাষা করবার পরামর্শ তিনি শাসকদের দিয়েছিলেন; উদ্দেশ্য এর ফলে দেশের জনসাধারণ বিচারালয়ে কিছু সুবিচার পাবে, আর দেশবাসীর পক্ষে ইয়োরোপীয় বিদ্যালাভের পথ সুগম হবে।

রামমোহন ও হিন্দু-সাধনা

পাটনা থেকে গৃহে প্রত্যাবর্তনের পরে পিতার সঙ্গে রামমোহনের মতান্তর ঘটে। তার ফলে তিনি পিতৃগৃহ পরিত্যাগ করেন ও তিব্বতে গমন করেন। তিব্বতে গমনের বাসনা হয়ত পাটনবাসকালেই তাঁর হয়েছিল, তাতে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয়ের সম্ভাবনা ছিল, পার্বত্য জাতিদের বিচিত্র পূজা-পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয়-লাভও তাঁর অবাঞ্ছিত ছিল না। এই ভাবে নরপূজা, পিশাচ-পূজা ইত্যাদি বিচিত্র অজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত হয়েই, নিরাকার একেশ্বরবাদের দিকে তাঁর অত প্রবণতা জন্মেছিল মনে হয়।

তিব্বত প্রভৃতি ভ্রমণের পরে তাঁর জীবনের বড় ঘটনা হচ্ছে কিছুকাল কাশীবাস ও হিন্দুশাস্ত্রের চর্চা। এই চর্চা তিনি যে গভীরভাবে করেছিলেন, পণ্ডিতেরা সে-কথা স্বীকার করেন। আর রামমোহন যত শাস্ত্রের চর্চা করেছিলেন, তার মধ্যে হিন্দু-শাস্ত্রের চর্চাই এ পর্যন্ত বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে। হিন্দু-সমাজও তাকে আশানুরূপভাবে গ্রহণ করেন নি, তবু তারাই যে তাকে বেশি গ্রহণ করেছেন এ সত্য।

নগেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-কৃত রামমোহন-চরিতকথায় তার হিন্দুশাস্ত্রের চর্চা বিশদভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। বেদান্তের শঙ্করাভাষ্য অবলম্বন করলেও রামমোহন জোর দিয়েছেন, ব্রহ্মনিষ্ঠ গার্হস্থ্যজীবনের উপরে, আর শঙ্করাচার্য জোর দিয়েছেন সন্ন্যাসের উপরে, এসব কথা বলা হয়েছে। আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল রামমোহনের ব্রহ্মজিজ্ঞাসাকে পূর্ণ অদ্বৈতবাদ না বলে, বিশিষ্টদ্বৈতবাদ অথবা দ্বৈতবাদ বলতে চান। কিন্তু পণ্ডিতপ্রবর রাধাকৃষ্ণন শঙ্করদর্শনের যে-ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে মনে হয়, হিন্দু-মনীষার এই শ্রেষ্ঠ উপার্জন অদ্বৈতবাদ রামমোহন, যে-ভাবে বুঝেছিলেন সেই ভাবেই তা বোঝ হয়ত সঙ্গত। যথা-

Sankara does not assert an identity between God and the world but denies the independence of the world……..If we raise question as to how the finite rises from out of the bosom of the infinite, Sankara says that it is an incomprehensible mystery, maya. We know there is the absolute reality, we know that there is the empirical world, we know that the empirical world rests on the absolute; but the how of it is beyound our knowledge…… The greatest thinkers are those who admit the mystery (of the relation of God to the world) and comfort themselves by the idea that the human mind is not omniscient Sankara in the East and Bradley in the West adopt this wise attitude of agnosticism. (Hindu View of Life, pp. 66-68).

[শঙ্করের মত এ নয় যে ব্ৰহ্ম ও জগৎ অভেদ, তিনি শুধু জগতের স্বাতন্ত্র অস্বীকার করেন।…অসীম থেকে সসীমের উৎপত্তি কেমন করে হয়, এ প্রশ্নের উত্তরে শঙ্কর বলেন-এ এক দুর্জ্ঞেয় রহস্য, মায়া। আমরা জানি, শুদ্ধ সত্তা আছেন আর ব্যবহারিক জগৎ আছে, আর এই শুদ্ধ সত্তার উপরে ব্যবহারিক জগৎ নির্ভরশীল; কিন্তু কেমন করে সেটি আমাদের জ্ঞানের বাইরে। … শ্রেষ্ঠ চিন্তাশীলেরা ব্রহ্ম ও জগতের এই রহস্যময় সম্বন্ধের কথা স্বীকার করেন। তাঁরা জানেন যে, মানবমন সর্বজ্ঞ নয়। প্রচারে শঙ্কর ও পশ্চিমের ব্র্যাডলি জ্ঞানিজনসূলভ এই অজ্ঞেয়তাবাদের সমর্থক।]

অন্যত্র

No theory has ever asserted that life is a dream and all experienced events are illusions. One or two late followers of Sankara lend countenance to this hypothesis, but it cannot be regarded as representing the main tendency of Hindu thought (p. 69)

[এমন কোনো মত নেই যাতে বলা হয়েছে যে জীবন স্বপ্ন, আমাদের সমস্ত অভিজ্ঞতা অলীক শঙ্করের বহুপরের দুই একজন শিষ্যের ভিতরে এই মতের কিছু সমর্থন পাওয়া যায়, কিন্ত এ দিকেই যে হিন্দু-চিন্তার বিশেষ প্রবণতা তা বলা যায় না।]

রামমোহনের হিন্দু-শাস্ত্রের বিচার তার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসুদের চির-বিস্ময়ের সামগ্রী। হিন্দুর অতলস্পর্শ অতীতের অন্তহীন শাস্ত্র-সিন্ধু মন্থন করে তিনি যে-ভাবে, একমেবাদ্বিতীয়ম ও লোকশ্রেয়ঃ-তত্ত্ব তাদের উপহার দিয়েছেন, সেটি যে কত বড় দান সে-সম্বন্ধে তার স্বসম্প্রদায়ের সর্বসাধারণ এ পর্যন্ত তেমন অবহিতচিত্ত হন নি এইজন্য যে, তার সিদ্ধান্তকে তারা হিন্দু-সাধনা সম্বন্ধে বাস্তবিকই একটি শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত বলে ভাবতে পারেন নি। যে কারণেই হোক, প্রতীক-উপাসনার সঙ্গে হিন্দু-সাধনা বহুকাল ধরে ওতপ্রোতভাবে বিজড়িত রয়েছে। এই প্রতীক-উপাসনাকে কোনো কোনো হিন্দু সাধক অপকৃষ্ট সাধনা জ্ঞান করেছেন; কিন্তু এটি যে আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য (অথবা জীবনের জন্য) হানিকর, এমন নির্মম কথা রামমোহনের মতো এতখানি জোর দিয়ে আর কোনো হিন্দু-সাধক বলেছেন মনে হয় না। শ্রীযুক্ত ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের “ভারতীয় মধ্যযুগে সাধনার ধারা” গ্রন্থে দেখা যাচ্ছে, রামমোহনের আবির্ভাবের কিছু পূর্বে শিবনারায়ণী সম্প্রদায় বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদী ছিলেন; কিন্তু এ রকম প্রতীক উপাসনার বিরোধী একেশ্বরবাদী দল হিন্দু-সমাজে এত কম যে, এঁদের গণনার ভিতরে না আনলেও চলে। প্রতীক-উপাসনার প্রতি এরূপ বিরূপতার জন্যই যে, রামমোহন তার সমকালে তার স্বসম্প্রদায়ের দ্বারা তিরস্কৃত ও লাঞ্ছিত হয়েছিলেন এবং বর্তমান কালেও অনেকখানি অবহেলিত হচ্ছেন এ সত্য। এর সঙ্গে তাঁর অপ্রিয় হবার আর একটি বড় কারণ হচ্ছে-তার বেশভূষা হিন্দুর চিরপরিচিত চিরশ্রদ্ধেয় সন্ন্যাসীর বেশভূষা নয়। রামমোহন তাঁর বেশভূষা ও আহারাদি প্রবলভাবেই সমর্থন করেছেন, তিনি তাঁদের বোঝাতে চেয়েছেন-সুরুচিপূর্ণ বেশ মানুষের জন্য বাঞ্ছনীয়, আর মাংস-আহারাদির দ্বারা। তাদের নষ্ট বীর্যের পুনরুদ্ধার হতে পারবে।

রামমোহনের হিন্দু-সাধনা সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত হিন্দু-সম্প্রদায়ের শিক্ষিতদেরও তেমন শ্রদ্ধার বস্তু হয় নি, হিন্দু-সাধনা সম্বন্ধে পরমহংস রামকৃষ্ণের সিদ্ধান্তের ফলে। তার সুবিখ্যাত বাণী “যত মত তত পথ” দেশের লোকদের অনেক বেশি স্বস্তি দিয়েছে রামমোহনের “লোকশ্রেয় ও বিচারবুদ্ধির দ্বারা পরিশোধিত শাস্ত্র” এই মন্ত্র থেকে। আর “যত মত তত পথ” বাণীতে দেশের লোক শুধু স্বস্তিলাভই করে নি, একালের কোনো কোনো শ্রেষ্ঠ চিন্তাশীল, যেমন- ফরাসী ভাবুক রোমা রোলা ও ভারতের স্বনামধন্য মহাত্মা গান্ধী, এই বাণীকে বর্তমান যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাণী বলে মত প্রকাশ করেছেন। এ সম্বন্ধে রোমা রোলার যুক্তি এই:

I have never seen anything fresher or more potent in the religious spirit of all ages than this enfolding of all the Gods existing in humanity, of all the faces of truth, of the entire body of human Dreams, in the heart and the brain, in the Parmahangsa’s great love and Vivekananda’s strong ams…………….But you must not suppose that this immense diversity spells anarchy and confusion……Each note has its own part in the harmony. No series of notes must be suppressed, and polyphony reduced to unison with the excuse that your own part is most beautiful! Play your own part perfectly and in time, but follow with your ear the concert of the or instruments united to your own…….And this teaching condemns all spirits propaganda, whether clerical or lay, that wishes to mould other brains on own model (the model of its own God or of its own Non-god who is merel. God in disguise).

[পরমহংসের মহান্ প্রেমে ও বিবেকানন্দের বীর্যে যেমন মিলন ঘটেছে বিশ্বমানবের সমস্ত উপাস্য দেবতার, সত্যের সর্ববিধ প্রকাশের মানুষের হৃদয় ও মস্তিষ্কের সমস্ত কল্প-রূপের, যুগযুগান্তের ধর্মভাবের ইতিহাসে এর চাইতে সজীবতর ও সতেজতর কোনো কিছু আমার চোখে পড়ে নি।……..কিন্তু একথা মনে করবার হেতু নেই যে, এই বিরাট বৈচিত্র্য একটি বিরাট অব্যবস্থা ও বিশৃঙ্খলা মাত্র।……….এই সুর-সামঞ্জস্যে প্রত্যেক সুরেরই বিশিষ্ট স্থান আছে। কোনো সুর সমষ্টিকেই এই বলে নীরব করে দেওয়া চলবে না (তাতে বহুসুর পরিণত হবে একসুরে) যে, কোনো একজনের বাজানো সুর সব চেয়ে ভাল। যার যা বাজাবার তা চমৎকার করে বাজাক, কিন্তু তার সেই সুরের সঙ্গে অন্যান্য যে-সব সুরের সঙ্গত হচ্ছে, তা সে কান পেতে শুনুক।…..এই মতে সর্বপ্রকার প্রচারব্ৰত-তা ধর্ম-বিষয়ক হোক বা কোনো জাগতিক বিষয়ক হোক-নিন্দনীয়; কেননা এদের উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যের বুদ্ধি-বিচার নিজেদের ছাঁচে গড়া। এক্ষেত্রে সেশ্বরবাদী ও নিরীশ্বরবাদী দুইই তুল্যমূল্য-নিরীশ্বরবাদ ছন্দবেশী সেশ্বরবাদ মাত্র।]

এ সঙ্গে তিনি মহাত্মা গান্ধীর অভিমত উদ্ধৃত করেছেন:

“My veneration for other faiths is the same as for my own faith Consequently the thought of conversion is impossible………..Our prayer for others ought never to be : “God, give them the light thou hast given to me!” –but “God, give them all the light and truth they need for their highest development.”

[স্ব-ধর্মের প্রতি আমার যে-শ্রদ্ধা পর-ধর্মের প্রতি আমার সেই শ্রদ্ধা। সেইজন্য ধর্মান্তর-গ্রহণ আমার চিন্তায় অসম্ভব। আমরা যেন অন্যের জন্য এই প্রার্থনা না করি-ভগবান্ আমাকে যে-আলোক তুমি দান করেছ, সে-আশোক তুমি তাদের দাও; এর পরিবর্তে আমাদের প্রর্থনা যেন এই হয়-ভগবান শ্রেষ্ঠ পরিণতির জন্য যার যে-আলোক ও যে-সত্যের প্রয়োজন, তুমি সেই সব তাকে দাও।]

মানুষে মানুষে মৈত্রীকামী রোলাঁ ও গান্ধী যে গভীর বেদনা থেকে এসব কথা বলেছেন, তা বুঝতে পারা কষ্টসাধ্য নয়। রোলাঁ স্পষ্টই বলেছেন–

At this stage of human evolution wherein both blind and conscious forces are driving all natures to draw together for “co-operation or death”, it is absolutely essential that the human consciousness should be impregnated with it until this indispensable principle becomes an axioum: that every faith has an equal right to live, and that there is an equal duty incumbent upon every man to respect that which his neighbour respects. (Life and Gospel of Vivekananda, pp. 353-55). [মানব-সমাজের ক্রম-অভিব্যক্তির এই অবস্থায় অন্ধ ও সচেতন শক্তি দুইই সমস্ত প্রকৃতির মানুষকে একত্র করেছে “সহযোগিতার জন্য অথবা ধ্বংসের জন্য”, এ সময়ে শ্রেষ্ঠতম প্রয়োজন হচ্ছে মানবের অন্তর্লোকে এই বিশ্বাসের আবির্ভাব ঘটা-প্রত্যেক ধর্মেরই বেঁচে থাকবার তুল্য অধিকার আছে, আর প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য হচ্ছে তার প্রতিবেশীর ধর্ম-বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করে চলা। এটিকে স্বতঃসিদ্ধান্তরূপে পরিণত করা চাই।]

কিন্তু উদ্দেশ্য সাধু হলেই সব সময়ে যে কার্যসিদ্ধি হয় তা নয়। মানুষে মানুষে যে মৈত্রীর কামনা করে এই সব মনীষী এই ব্যবস্থা সমীচীন মনে করেছেন, এর প্রবর্তনের ফলে সেই মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে কি না, অথবা মানুষের জন্য এই ব্যবস্থার সত্যিকার প্রয়োজন আছে কি না, সে-সবও বিচার্য।

ধর্ম যদি ললিতকলার মতো মুখ্যতঃ মানস ব্যাপার হতো তাহলে, জগতের সমস্ত ধর্মকে এমন পরম আদরে সঞ্জীবিত রাখবার চেষ্টা হতো, মানুষের সভ্যতার এক প্রকৃষ্ট নিদর্শন। কিন্তু সাধারণতঃ জীবনে ও ললিতকলায় যে প্রভেদ, ধর্মে ও ললিতকলায়ও সেই প্রভেদ। ধর্ম ও জীবনের অভেদত্বের কারণ, ধর্ম একইসঙ্গে জীবনের নিয়ামক ও জীবনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত; কিন্তু ললিতকলাকে তেমনিভাবে জীবনের নিয়ামক বলা যায় না। জীবন অস্থির অপূর্ণাঙ্গ ক্রমাগত পরিবর্তনশীল; ললিতকলা অচঞ্চল, পূর্ণাঙ্গ, সৌন্দর্য-লোকে অবিনশ্বর; জীবন সত্য, ললিতকলা স্বপ্ন। ধর্ম কখনো কখনো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের অথবা ব্যক্তিবিশেষের এমন মানস ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু সেটি স্বাভাবিক বা সাধারণ ব্যাপার নয়। স্বভাবত ধর্ম মানুষের মানস ব্যাপার যতখানি তার চেয়ে বেশি সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যাপার। তাই সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যাপারে যেমন পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য অসম্ভব ও অসত্য ধর্মের ব্যাপারেও তেমনি নিরঙ্কুশ স্বাতন্ত্র্য অবাঞ্ছিত, তাতে ধর্মের যে শ্রেষ্ঠ লক্ষ্য-মানুষের বৃহত্তর সমাজ-জীবনে কল্যাণের আয়োজন-তাইই ব্যাহত হয়। মানুষের বয়স কম হয় নি, অভিজ্ঞতাও কম হয় নি। সেই অভিজ্ঞতার ফলে আজ এ কথা সে বুঝেছে যে, জ্ঞান ও সত্যের অভিমানের মতো বিড়ম্বনা আর নেই। কিন্তু এই নূতন জ্ঞান লাভ করে সে যদি ধর্মে ধর্মে Laissez-faire* নীতি অবলম্বন করে, তাহলেও কম ভুল সে করবে না। জ্ঞাতসারে ও অজ্ঞাতসারে নানা অনুকূল ও প্রতিকূল ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষের চিত্ত বিকশিত হয়। তার কর্মজীবনও বিকশিত হয়। এই ঘাত-প্রতিঘাতের ভিতর দিয়েই বিরাট জগতের সাহচর্য যে তার লাভ হয়, সেটি তার জন্য অমূল্য। রোলাঁ ও গান্ধীর এই নূতন ব্যবস্থার যে শান্তি ও স্বস্তি, লোক-সমাজে সতেজ ও সন্ধান-তৎপর মানসিকতা সৃষ্টির সহায়ক না হবার সম্ভবানাই তার বেশি।

[* Laissez-faire (Let alone)–যে যার পথে চলুক। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে ও অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই নীতির প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই নীতির সমর্থিত ব্যক্তিত-বাদ অচিরেই সমষ্টি-বাদের দ্বারা পরাভূত হয়।]

হয়ত বলা হবে, অন্ততঃ বিভিন্ন জাতীয় বা সংস্কৃতিগত বৈশিষ্ট্য রক্ষা করা তো চাইই, নইলে মানুষ পরস্পরকে চিনবে ও বুঝবে কেমন করে? এই চিন্তা-ধারার মলের রয়েছে একটি বড় ভুল-অতীত ও কতকাংশে বর্তমানকে এ ক্ষেত্রে মনে করা হলে চিরকালের পরিচায়ক বলে’। অতীতের বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন দুর্লঙ্ ভৌগলিক ক্ষেত্রে লালিত হয়েছিল। কতকটা সেই ব্যবধানের প্রভাবে তাদের স্বাতন্ত্র হতে পেরেছিল সুস্পষ্ট। কিন্তু আজ সে-ব্যবধান চূর্ণ হবার পথে দাঁড়িয়েছে, মানুষের কৌতূহলও বর্ধিত হয়ে চলেছে, জাতিতে জাতিতে আন্তর ও বাহ্য স্বাতন্ত্র্য তাই পরস্পরের অজ্ঞাতসারেও নিশ্চিহ্ন হবার পথে চলেছে। মানব-সভ্যতার এই এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও যদি বিভিন্ন জাতি বা সম্প্রদায়ের চিরস্থায়ী বৈশিষ্ট্য বা type-এর কথাই ভাবা হয়, তাহলে ভাবনার পরিচয় যা দেওয়া হয়, তার চেয়ে বেশি পরিচয় দেওয়া হয় অতীত-প্রীতির। কোনো কোনো চিন্তাশীল ভবিষ্যৎ মানবসমাজের একাকারত্বের কথা ভেবে আনন্দ পান না, এই ধারণা থেকে যে তেমন একাকারত্ব হবে বর্ণ ও বৈচিত্র্যহীন, সুতরাং অসুন্দর। কিন্তু কত অনাবশ্যক ও অর্থহীন বৈশিষ্ট্যের শৃঙ্খলে এখনো মানুষ বন্দী, এখনো কত অবিকশিত তার সৃষ্টিশক্তি, এ চিন্তা মনে স্থান দিতে পারলে সেই বর্ণ ও বৈচিত্র্যের প্রাচুর্যের কথা ভেবেই তারা আহ্লাদিত হবেন।

ধর্ম জ্ঞানেরই প্রকারভেদ, এই কথাটি তেমন স্পষ্টভাবে মনে না রাখার ফলেই ধর্ম-সমস্যা মানুষের জন্য এমন অশোভন ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যুগে যুগে ভূয়োদর্শন ও অভিজ্ঞতার ফলে মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের, অন্য কথায়, প্রত্যয়ীভূত জ্ঞানেরও উৎকর্ষলাভ হয়েছে। একালে ধর্মের উপরে বৈজ্ঞানিক চিন্তাপদ্ধতির প্রভাবও সেই একই সত্যের পানে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। জীবনের অন্যান্য ব্যাপারে যেমন অপ্রতিহত সন্ধানপরতা ও কল্যাণের আয়োজন ভিন্ন আর কোনো দিকে লক্ষ্য রাখলে শেষ পর্যন্ত বিড়ম্বিতই হতে হয়, ধর্মের ব্যাপারেও তেমনি সত্য ও কল্যাণ-জিজ্ঞাসাকে কিছুমাত্র শিথিল করবার প্রয়োজন আছে তা মনে হয় না। রামকৃষ্ণ ও গান্ধীর কর্মজীবনের দিকে চাইলে দেখা যায়, তারাও যথাসম্ভব অভিমান বিবর্জিত হয়ে তাদের আবিষ্কৃত সত্যপথ অনুসরণ করে চলেছেন, তাতে অন্যের অন্তরে কতখানি বেদনা বাজলো সেটি তাদের চিন্তার মুখ্য বিষয় নয়।

তাই মনে হয় মানব-সভ্যতার নব সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে পেরে রামমোহন যে তাঁর দেশবাসীকে অতীত বা বর্তমান-প্রীতির পরিবর্তে লোকশ্রেয়ঃ ও বিচারবুদ্ধির মন্ত্র দান করেছিলেন, সে-মন্ত্রের যথাযোগ্য সমাদর হয় নি সেই মন্ত্রের অন্তর্নিহিত কোনো ত্রুটির জন্য নয়-তার দেশবাসীর সত্যপ্রীতির ও বৃহত্তর দেশের কল্যাণ-কামনার অভাবের জন্যই।

রামমোহনের হিন্দুশাস্ত্র-বিচারে এত চমৎকারিত্ব রয়েছে, পাণ্ডিত্য ও বিচার-বুদ্ধির এমন স্ফুরণ সেখানে হয়েছে যে, সে-সম্বন্ধে আধুনিক শিক্ষিত বাঙালির তেমন কৌতূহল না থাকা তার মনন-শক্তির উৎকর্ষের পরিচায়ক হয়ত নয়। এই সব বিচারে তার কোনো কোনো শাস্ত্র-ব্যাখ্যা খুবই নূতন, যেমন গীতার এই সুবিখ্যাত শ্লোকের ব্যাখ্যা–

ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাম।
যোজয়েৎ সর্বকর্মানি বিদ্বান, যুক্তঃ সমাচরন্‌ ৷৷

গীতার গান্ধীভাষ্যে এর অর্থ লেখা হয়েছে এই:- “কর্মে আসক্ত অজ্ঞানী ব্যক্তির বদ্ধিকে জ্ঞানী যেন ওলট পালট না করে, বরঞ্চ সমত্ব রক্ষাপূর্বক ভাল রকমে কর্ম করিয়া তাহাকে যেন সর্বকর্মে প্রেরণা দেয়।”-এইটি এর প্রচলিত ব্যাখ্যা, আর এই ব্যাখ্যার দ্বারা প্রচলিত আচারপদ্ধতি (প্রতিমাপূজা ইত্যাদি) মান্য করতে বলা হয়। কিন্তু রামমোহন এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই:

“জ্ঞানবান ব্যক্তি আপনি কর্ম করিয়া অজ্ঞানী কর্মসঙ্গিকে কর্মে প্রবর্তক হইবেন, যেহেতু জানির নিষ্কাম কর্ম দেখিয়া অজ্ঞানীও সেই প্রকার কর্ম করিবেক। সুতরাং জ্ঞানির কদাপি কাম্য কর্মে অধিকার নাই তাহার নিষ্কাম কর্ম দেখিয়া অজ্ঞানীও চিত্তশুদ্ধির নিমিত্ত নিষ্কাম কর্ম করিবেক। কর্ম-সঙ্গিদের কি প্রকার কর্ম কর্তব্য তাহা ভূরি স্থানে ঐ গীতাতে লিখিয়াছেন। কর্মণ্যোবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।….যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোহন্যত্র লোকোহয়ং কর্মবন্ধনঃ ॥ পরমেশ্বরের উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে অর্থাৎ ফল কামনা করিয়া কর্ম করিলে সে কর্ম দ্বারা লোক বন্ধন প্রাপ্ত হয়। এবং স্মার্তধৃত ষষ্ঠস্কন্ধ বচন ॥ “স্বয়ং নিঃশ্রেয়সং বিদ্বান্ ন বক্তব্যজ্ঞায় কর্মহি। ন রাতি রোগিণে পথ্যম বাঞ্ছতেপি ভিষতমঃ ॥ আপনি জ্ঞানবান ব্যক্তি অজ্ঞানকে সকাম কর্ম করিতে উপদেশ করেন না, যেমন রোগী মনুষ্য কুপথ্য প্রার্থনা করিলেও উত্তম বৈদ্য কুপথ্য দেন না।” (গ্রন্থাবলী-পৃষ্ঠা ২১৫)।

রামমোহন ও খ্রিস্টধর্ম

6 ota Precepts of Jesus, a guide to peace and happiness-43 বলেছেন, খ্রিস্টের এই যে উপদেশ, অন্যের প্রতি তেমন আচরণ কর যেমন আচরণ তুমি প্রত্যাশা কর, মানুষের নৈতিক জীবন গঠনের সহায়ক এমন পূর্ণাঙ্গ উপদেশ তিনি আর কোনো ধর্মগ্রন্থে পান নি। ধর্মশাস্ত্র হিসেবে বাইবেলের স্থান তাই অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রের চেয়ে উচ্চে তিনি নির্দেশ করেছেন। কিন্তু তার সেই বাইবেল ত্রিত্ববাদ, খৃষ্টের রক্তে পাপীর পরিত্রাণ, ইত্যাদি দুৰ্জ্জেয়-তত্ত্ব-বিবর্জিত বাইবেল। বলা বাহুল্য বাইবেলের এই ধরণের ভক্তের প্রতি বাইবেলের ভক্ত-সাধারণের সম্ভষ্ট হওয়া অসম্ভব। খ্রিস্টানসমাজের এই অসন্তোষের ফলেই বাইবেলের প্রকৃত শিক্ষা নির্ণয়ে তিনি দীর্ঘ তিন বৎসর কাল সুকঠোর পরিশ্রম করেন। তিনখানি সুবিস্তৃত গ্রীক-ও-হিব্রুবচন-কন্টকিত Appeal to Christian Public তাঁর এই কঠোর পরিশ্রমের ফল। তার এই পাণ্ডিত্য দর্শনে তৎকালীন খ্রিস্টান-জগত চমকিত হয়েছিলেন।

আধুনিক খ্রিস্টান-জগত তাঁর এই খ্রিস্টানশাস্ত্র-বিচারের কি মূল্য দেন দুর্ভাগ্যক্রমে সে-বিষয়ে কিছু জানি না। কিন্তু তাঁর দেশবাসীর কাছে এর মূল্য কম হওয়া উচিত নয়। তাঁর এই খ্রিস্টানশাস্ত্র-বিচারের ভিতর দিয়ে এই কথাটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে স পরস্পরের প্রতি প্রেমপূর্ণ জীবনকেই তিনি কাম্যজীবন জ্ঞান করতেন।

রামমোহনের সাধনা

রামমোহনের খ্রিস্টান-শাস্ত্রের বিচারে দেখা যায়, তিনি নিজেকে খ্রিস্ট-অনুবর্তী বলে প্রচার করেছেন। তাঁর তুহফাতুল মুওহহিদীন গ্রন্থে কিন্তু দেখা যায়, তিনি “ঈশ্বর প্রেরিত পুরুষ” “প্রত্যাদিষ্ট গ্রন্থ” এসবের কিছুই মানেন নি। এজন্য তার সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞেরা প্রায় একমত যে, প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন একান্ত যুক্তিবাদী, কিন্তু পরে তার সেই শাস্ত্রনিরপেক্ষ স্বাধীন যুক্তিবাদ ধর্মাশ্রিত যুক্তিবাদে পরিণত হয়েছিল; আর মানুষের জন্য এই ধর্মাশ্রিত যুক্তিবাদই তিনি কাম্য জ্ঞান করতেন।

কিন্তু রামমোহন সম্বন্ধে এই সিদ্ধান্ত অভ্রান্ত কিনা সে-সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করবার অবসর আছে। তার হিন্দুশাস্ত্রের বিচারেও দেখা যায়, তিনি নিজেকে শাস্ত্রানুগামী হিন্দু বলে প্রচার করেছেন ও সেই ভাবে হিন্দুর শ্রেষ্ঠগ্রন্থ বেদান্ত আশ্রয় করে হিন্দুর জন্য প্রকৃত শাস্ত্রজ্ঞান আহরণের চেষ্টা করেছেন। অথচ তাঁর দেশবাসীর জন্য ইয়োরোপীয় জ্ঞানলাভের পথ সুগম করবার অনুরোধ জানিয়ে লর্ড আমহার্স্টকে তিনি যে পত্র লেখেন, তাতে সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞানলাভের দুরূহতার কথা বলেছেন, আর বেদান্ত, মীমাংসা, ন্যায় প্রভৃতির শিক্ষাকে বেশ উপহাস করেছেন। বলা যেতে পারে, বেদান্ত মীমাংসা ও ন্যায়কে নয়; তা’হলেও একথা স্বীকার করতে হবে যে দেশের প্রচীন ও প্রচলিত মধ্যযুগীয় জ্ঞানচর্চার চেয়ে ইয়োরোপীয় বিজ্ঞান-দর্শন-চর্চাকে তিনি বেশি মর্যাদা দিয়েছেন। বাইবেলের প্রতি তার কিছু বেশি শ্রদ্ধা থাকলেও এর আলোচনা-কালেও তাঁর যুক্তিবাদ বাস্তবিকই যে শিথিল হয় নি, তার প্রমাণস্বরূপ এই কয়েকটি কথার উল্লেখ করা যেতে পারে:- প্রথমত-Precepts of Jesus a guide to peace and happiness গ্রন্থখানি তিনি বাইবেল থেকে সংগ্রহ করেছিলন এই উদ্দেশ্যে যে, এই দুৰ্জ্জেয়-তত্ত্ব বিবর্জিত সহজ সরল উপদেশ-মালায় বিশ্ব-বিধাতা সম্বন্ধে মানুষের ধারণা উন্নততর হবে ও তাদের একের অন্যের প্রতি ও সমাজের প্রতি ব্যবহার সু-নিয়ন্ত্রিত হবে; তার তুহফাতুল মুওহিদীন গ্রন্থে বিচার-বুদ্ধির কার্যকারিতা সম্বন্ধেও তিনি এই ধরণের কথা বলেছেন, যথা- সব ধর্ম আত্মা ও পরকালে বিশ্বাসের উপরে প্রতিষ্ঠিত; যদিও এই দুয়ের স্বরূপ দুয়ে তবু এতে বিশ্বাস তেমন দোষাৰ্থ নয়, কেননা মানুষ দুষ্কর্ম থেকে নিরস্ত থাকে পরলোকের ভয়ে ও রাজভয়ে। কিন্তু এই দুই প্রয়োজনীয় বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে পান-আহার পবিত্রতা-অপবিত্রতা শুভ-অশুভ ইত্যাদি বিষয়ে কত শত অকল্যাণকর ও বুদ্ধিনাশকর বিশ্বাস সম্মিলিত হয়েছে, ও তাতে মানুষের দুঃখ বেড়ে গেছে। তবু মানুষের অন্তরে এই শক্তি নিহিত আছে যে, এই সব বিশ্বাস সত্ত্বেও সে যদি নিরপেক্ষভাবে বিভিন্ন জাতির ধর্ম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসু হয়, তাহলে কি সত্য আর কিইবা অসত্য, তা সে নিরূপণ করতে পারবে আশা করা যায়; ও এইভাবে অর্থহীন ধর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে এক অদ্বিতীয় মঙ্গলবিধাতার প্রতি ও সমাজকল্যাণের প্রতি মনোযোগী হতে পারবে। দ্বিতীয়ত-রামমোহনের প্রতিপক্ষ এই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, খ্রিস্টধর্মের দুৰ্জেয় তত্ত্বসমূহে বিশ্বাসী না হলে প্রকৃত ধর্মবিশ্বাসী হওয়া যায় না; রামমোহন দেখিয়েছিলেন, খ্রিস্টের ভিতরে যা কিছু অলৌকিক বা অসাধারণ সব ঈশ্বর প্রসাদে তার একান্ত নির্ভর ঈশ্বরের উপরে, আর বাইবেল থেকেই প্রমাণ করা যায় যে, ঈশ্বরের সমস্ত আদেশের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের পরস্পরের প্রতি কি কর্তব্য তাই শিক্ষা দেওয়া।

তাই আমাদের বলতে ইচ্ছা হয়, তুহফাতুল মুওহিদীন গ্রন্থে রামমোহন যে অলৌকিকতানিরপেক্ষ একেশ্বরতত্ত্বেও ও লোকশ্রেয়বাদে উপনীত হয়েছিলেন পরে এই মতের কোনো বিশেষ পরিবর্তন তার ভিতরে ঘটে নি। যাঁরা এই পরিবর্তন দেখবার জন্য উৎকণ্ঠিত তারা বোধ হয় এই অদ্ভুত ব্যাপারটি লক্ষ্য করেন নি, যে তুহফাতুল মুওহিদীন গ্রন্থেও রামমোহন একদিকে যেমন প্রখরযুক্তিবাদী অন্যদিকে তেমনি সহজভাবে ঈশ্বরানুরাগী ও মানব-কল্যাণকামী।

বিলাতগমনের পূর্বে রামমোহন Unitarian (ঈশ্বরের একত্ববাদী) খ্রিস্টানদের বিশেষ বন্ধু ছিলেন ও ত্রিত্ববাদী খ্রিস্টানদের প্রতি বিরূপ ছিলেন। কিন্তু ইংলন্ডে গমনের পরে উভয় শ্রেণীর খ্রিস্টানদের সঙ্গে তিনি আলাপ-আলোচনা করেন ও উভয় দলেই তার অন্তরঙ্গ বন্ধু লাভ হয়। তাঁর মৃত্যুর পরে কোনো কোনো ধর্মযাজক মত প্রকাশ করেছিলেন যে, তিনি ত্রিত্ববাদের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হচ্ছিলেন এবং আরো কিছুকাল বেঁচে থাকলে ত্রিত্ববাদ পূর্ণভাবেই গ্রহণ করতেন। মিস্ কলেট-লিখিত জীবনীর সম্পাদক এসব কথা গণ্য করেন নি। তবে তিনি এই মত প্রকাশ করেছেন যে, রামমোহনের ভিতরে ধর্ম-ব্যাকুলতা চিরদিনই অত্যন্ত প্রবল ছিল; সেই ব্যাকুলতার বশে প্রথম জীবনে তিনি স্বাধীন যুক্তিবাদ গ্রহণ করেন ও পরবর্তী জীবনে যুক্তিবাদের অসম্পূর্ণতা উপলব্ধি করে’ “ধর্মবিশ্বাসের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এই মতের স্বপক্ষে তিনি এই প্রমাণটি দিয়েছেন:- রামমোহন তাঁর সর্বশেষ রচনায় উচ্চশ্রেণীর ইয়োরাপীয়দের ভারতে বসতিস্থাপন সমর্থন করেন। এই বসতিস্থাপনের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে বহু তর্ক তিনি উত্থাপন করেন, সে-সবের একটি এই-উচ্চশ্রেণীর ইয়োরোপীয়দের ভারতে বসতিস্থাপনের ফলে ও তাদের সঙ্গে পরিচয়ের ফলে ভারতবাসীদের যথেষ্ট উন্নতির সম্ভাবনা; এই উন্নত ভারতবাসীরা ও ইয়োরোপীয়েরা সম্মিলিত হয়ে ব্রিটিশের সহিত সম্বন্ধ ছেদন করতেও পারেন; তাহলেও তাদের ভিতরে বাণিজ্য-সম্পর্ক থাকবে ও এই নব-আলোকপ্রাপ্ত ভারতবর্ষ এশিয়ার শিক্ষাগুরু হবে। রামমোহনের মূল বক্তব্য এই:

Americans were driven to rebellion by misgovernment ……… The mixed community of India. so long as they are treated librally and governed in an enlightened manner, will feel no inclination to cut off its connection with England……yet if events should occur to effect a separation, still a friendly and highly advantageous commercial connection may be kept up between two free and Christian countries, united as they will then be by resemblance of language, religion and manners. [আমেরিকা-বাসীরা বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়েছিল কুশাসনের ফলে।…ভারতের এই মিশ্রিত জাতি যতদিন সদয় ব্যবহার ও উদার শাসন লাভ করবে, ততদিন তারা ইংলন্ডের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদন করবার কোনো প্রয়োজন অনুভব করবে না।…..ঘটনাক্রমে সম্পর্ক যদি ছিন্নই হয় তবু এই দুই স্বাধীন ও খ্রিস্টান দেশের মধ্যে বন্ধুভাব ও পরস্পরের কল্যাণ-সাপেক্ষ বাণিজ্যসম্পর্ক থাকবে-ভাষা ধর্ম ও আচার-ব্যবহারের সাদৃশ্য তখন এই দুই দেশের ভিতরে যোগ রক্ষা করবে।]

এখানে সম্পাদক মহাশয় এই যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, রামমোহন তাঁর দেশবাসীদের খ্রিস্টান-ধর্মে দীক্ষিত হবার কথা ভেবেছেন, এটি সুসিদ্ধান্ত বলে গ্রহণ করা যায় না কয়েকটি কারণে। প্রথমত:- যে-সমস্ত গণ্যমান্য ইয়োরোপীয় ভারতবর্ষে বসতিস্থাপন করবেন, তাঁরা খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ভারতের শ্রেষ্ঠ অধিবাসী হবেন, তাঁদের অধ্যুষিত ভারতবর্ষকে রামমোহন খ্রিস্টান-ভারতবর্ষ বলতে পারেন। দ্বিতীয়ত:- তার প্রিয় খ্রিস্টান-নীতির (Do unto others as you like to be done by) (দ্বারা প্রভাবান্বিত ভারতবর্ষকে তিনি খ্রিস্টান-ভারত বলতে পারেন। তৃতীয়ত:- তার দেশবাসীরা সোজাসুজি যিশুর উন্নততর ধর্মে দীক্ষিত হবে, এ চিন্তা রামমোহনের জন্য একান্ত অপ্রীতিকর হয়ত ছিল না, কেননা কোনো রকমে তাঁর দেশবাসীর ভাললার দিকে একটু পরিবর্তন হোক, এ কামনা তিনি করতেন, তবু এই চিন্তা যে তার খুব প্রীতিকরও ছিল না, তা বুঝতে পারা যায় আমেরিকার Bishop Ware কে লিখিত তার এই পত্রাংশ থেকে

I am led to believe from reason, what is set forth in the scripture, that “in every nation he that feareth God and worketh righteousness is accepted with him,” in whatever form of worship he may have been taught to golrify God. [(খ্রিস্টান) শাস্ত্রে এ-কথা আছে, আর বুদ্ধির সাহায্যেও আমি এই বিশ্বাসে উপনীত হয়েছি, যে, প্রত্যেক জাতির ভিতরে যারা ঈশ্বরের ভয় রাখে ও ধর্ম আচরণ করে তারা তার (যীশুর) করুণা লাভ করে, তা যে-ভাবেই তারা ঈশ্বরের মহিমা কীর্তন করতে শিখুক।]

Bishop Ware-কে লিখিত এই পত্রে আরো একটি লক্ষ্য করবার কথা আছে। রামমোহনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ভারতে খ্রিস্টধর্মের প্রসারের সম্ভাবনা কিরূপ; তাতে তিনি শেষ পর্যন্ত এই উত্তর দেন:- বিজ্ঞান ইংরেজি সাহিত্য ও ধর্মনিরপেক্ষ সুনীতি শিক্ষার আয়োজন যদি এদেশবাসীর জন্য তাঁরা করতে পারেন, তবে সেই ভাবেই তারা এদেশবাসীর মনকে খ্রিস্ট-ধর্ম গ্রহণের উপযুক্ত করতে পারেন।

এই থেকে রামমোহনের সংস্কার-চেষ্টার অথবা সমগ্র সাধনার স্বরূপ জিজ্ঞাসায় প্রবৃত্ত হবার প্রয়োজন হয়। এই সম্পর্কে তাঁর সাধনার দুইজন শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকারী, রবীন্দ্রনাথ ও আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ, যে মত প্রকাশ করেছেন তার মর্যাদা নিরূপণ প্রথমেই কর্তব্য।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বিশ্বমানবের একত্ববোধ তাঁর সমকালে জগতে আর কারো ভিতরে এমন পূর্ণভাবে দেখা যায় না। বর্তমান জগৎ সহযোগিতার জগৎ, স্বদেশের প্রাচীন অবিনশ্বর যা-কিছু তা আয়ত্ত করে অন্যান্য সাধনার দিকে তিনি সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের এই সকল কথার প্রমাণ রামমোহনের বিরাট সাধনার ভিতরে নিশ্চয়ই আছে-যদিও রামমোহনের সমকালে শুধু তাকেই বিশ্বমানবের একত্ববোধের পূর্ণ অধিকারী বলে ভাবতে আমাদের কিছু আপত্তি, কেননা রামমোহনের সমকালে, অথবা কিছু পূর্বে, মহামনীষী গ্যেটের আবির্ভাব; নবযৌবনেই তিনি নিজেকে বলেছিলেন Welt-Kind (বিশ্বসন্তান); আর পরিণত বয়সে তার বিশ্ব-মানবতার পরিপূর্ণ বোধ সুবিদিত। তবু যিনি দূর স্পেনের জনসাধারণের রাজনৈতিক অধিকার-লাভে উল্লসিত হয়ে নিজ-ব্যয়ে এক বড় উৎসবের আয়োজন করেছিলেন, ও Naples-এর পরাধীনতা-দুঃখের অবসান হয়নি জানতে পেরে জগতের অত্যাচারীদের উদ্দেশ্যে এই অভিসম্পাত উচ্চারণ করেছিলেন–

I consider the cause of the Neapolitans as my own and their enemies as ours. Enemies to liberty and friends of despotism have never been, and never will be, ultimately successful. [নেপলস-বাসীদের দুঃখ আমারও দুঃখ বলে আমি জ্ঞান করি-তাদের শত্রু আমাদেরও শক্র। যারা স্বাধীনতার শত্রু ও স্বেচ্ছাতন্ত্রের সমর্থক তারা কখনো সফলকাম হয়নি আর শেষ পর্যন্ত কখনো সফলকাম হবে না।-এইটি একটি পত্রাংশ। পত্রখানি বাকিংহাম্ সাহেবকে লেখা, তারিখ-১১ই আগস্ট, ১৮২১।]

মানুষের সঙ্গে তাঁর এই সহজ যোগ জাতিতে জাতিতে সহযোগিতার যোগের চেয়ে নিবিড়তর বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

রামমোহনের সাধনার স্বরূপ-নির্দেশ সম্পর্কে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথের মন্তব্য পরম হৃদয়গ্রাহী, কল্পনার সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ। তিনি রামমোহনকে দাঁড় করিয়েছেন জগতের বিভিন্ন ধর্ম ও সভ্যতার শ্রেষ্ঠ মর্মোদ্ঘাটক রূপে। তাঁর মতে বিভিন্ন ধর্ম ও সভ্যতা হচ্ছে বিশ্বজনীনতার এক একটি রূপ, এর কোনোটি মিথ্যা নয়, কিন্তু প্রত্যেকটির লক্ষ্য হওয়া উচিত তার সর্বোচ্চ পরিণতির দিকে। বিভিন্ন ধর্ম-শাস্ত্রের আলোচনা করে রামমোহন তাদের সেই সর্বোচ্চ পরিণতির পথ সুগম করতে চেষ্টা করেছেন। কিছু ভিন্ন বেশে এই চিন্তাধারার সঙ্গে আমাদের আগেই পরিচয় হয়েছে। এই চিন্তাধারা দার্শনিক-প্রবর রাধাকৃষ্ণনের লেখনীতে রূপ পেয়েছে এই ভাবে

…If we believe that every type means something final, incarnating a unique possibility, to destroy a type will be to create a void in the scheme of the world. (Hindu View of Life). [যদি আমরা বিশ্বাস করি যে, প্রত্যেক সভ্যতা হচ্ছে এক একটি চরম পরিণতি, এক অতুলনীয়। সম্ভাবনা রূপ পরিগ্রহ করেছে তার ভিতরে, তবে এর একটি ধ্বংস হলে জগদ-বিধানে অভাব দেখা হবে।]

এই চিন্তাধারা সম্পর্কে আমাদের বক্তব্যও নিবেদন করতে চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্মের যে-রূপ সহজভাবে প্রতিদিন আমাদের সামনে উন্মুক্ত হচ্ছে, সেই পরিচিত রূপের পানে এঁরা তাকান নি, এঁদের আলোচিত ধর্ম ভাবলোকের ব্যাপার-সেখানে কোনো type-কে পূর্ণাঙ্গ ও অবিনশ্বর ভাবুলে আপত্তির কারণ তেমন ঘটে না।

এই সম্পর্কে আরো কয়েকটি কথা ভাববার আছে। আচার্য রাধাকৃষ্ণন প্রমুখ। “স্বাতন্ত্র”-বাদী চিন্তাশীলেরা ভারতের জাতিভেদে দেখেছেন, প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বা জাতির স্বাতন্ত্র্যরক্ষার একটি প্রয়াস। হয়ত তাদের এই অভিমতের মলে। সত্য আছে; কিন্তু এর ফল কি হয়েছে সেটিও বিচার্য। প্রাচীন ভারতীয় সমাজের বিচ্ছিন্নতা, ভারতের পতনের এক বড় কারণ অনেক মনীষী এই মত ব্যক্ত করেছেন; তারপর এই বিচ্ছিন্ন বা স্বতন্ত্র-মণ্ডিত অংশসমূহ যে কালে অসুন্দর বৈ সুন্দর হয় নি, তার পরিচয় পাওয়া যায় রামমোহনের সমসাময়িক ব্রাহ্মণ-সমাজের জীবনে। তারা পূর্বপুরুষের সাধনা বিস্মৃত হয়ে রামমোহনের উদ্ধৃত উপনিষৎ-রচনাবলী ভেবেছিলেন রামমোহনের নিজের রচিত শ্লোক বলে-আর হিন্দু-সমাজের এই বিচ্ছিন্ন খণ্ডসমূহে শক্তি-তরঙ্গ খেলেছে তখন, যখন দয়ানন্দ বা বিবেকানন্দের মতো স্বাতন্ত্র-ধ্বংসকারীর আবির্ভাব সেখানে ঘটেছে।

স্বাতন্ত্র-বাদের বড় অপরাধ হয়ত এই যে, এর প্রভাবে মানুষের মানুষে অপরিচয়ের, সুতরাং অপ্রেমের, সৃষ্টি হয়-সৃষ্টিধর্মী কৌতূহলবৃত্তিরও খবৰ্ত সাধন হয়। সৃষ্টির ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্রলোপভীতির কোনো সার্থকতা হয়ত নেই;-পারশ্য সর্বপ্রকারে আরবের বশ্যতা স্বীকার করেছিল, কিন্তু জগতে পারশ্যের বিলোপ-সাধন হয় নি; ব্যক্তিগত জীবনেও দেখা যায়, আমাদের মধুসূদন সর্বপ্রকারের স্বাতন্ত্র বিসর্জন দিয়েছিলেন, কিন্তু তার বাঙালিত্ব ও মানবত্ব কিছুই পরিস্লান হয় নি-হয়ত বা উজ্জ্বলতর হয়েছে। রামমোহনকে বলা হয় প্রাচীন সত্যদ্রষ্টা ঋষির যোগ্য বংশধর, কিন্তু স্বাতন্ত্র রক্ষার প্রয়াস তিনি যা করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি করেছেন স্বাতন্ত্র-ধ্বংসের ও সর্ব-অভিমানমূন্য সত্যোপলব্ধির প্রয়াস।

বাস্তবিক, হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান ইত্যাদি প্রাচীন নামে রামমোহনকে পরিচিত করতে যাওয়া অসার্থক বলেই মনে হয়। তিনি ছিলেন সহজ ভাবে সত্যজিজ্ঞাসু,-আর জগতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা হয়ত এই সহজ পরিচয়েই পরিচিত।

কিন্তু এই সহজ সত্য-জিজ্ঞাসার প্রেরণায়ও মানুষ ধর্ম-সংস্কারক, সমাজ-সংস্কারক দার্শনিক বৈজ্ঞানিক ইত্যাদি বহুকিছু হতে পারেন, রামমোহন এর কোন শ্রেণীর অন্তর্গত? বলা বাহুল্য জীবন এক অখণ্ড ব্যাপার, তাই কোনো শক্তিমান একই সঙ্গে ধর্ম সংস্কারক, সমাজ-সংস্কারক, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক হতে পারেন। তবু বিশেষ বিশেষ দিকে শক্তিমানদের প্রবণতা দেখা যায়-রামমোহনের প্রবণতা কোন দিকে?

ইতিহাসে রামমোহনের পরিচয় এক ধর্ম-সম্প্রদায়ের স্থাপয়িতা রূপে, যদিও তিনি নিজে বার বার বলেছেন, কোনো নূতন ধর্মমতের প্রবর্তক তিনি নন। কিন্তু চিন্তাশীল মাত্রেই নূতন কিছুর প্রবর্তক, কেননা জগৎ চিরনূতন, কাজেই তার আপত্তি সত্ত্বেও তাঁকে এক নূতন মতের প্রতিষ্ঠাতা বলা যেতে পারে। একালের অনেক শিক্ষিত বাঙালির অভিমত, রামমোহনকে ধার্মিক পুরুষরূপে না দেখে পাণ্ডিত্য ও প্রতিভাশালী সমাজ সংস্কারক রূপে দেখাই সঙ্গত; কেননা, তাঁদের মতে, ধর্মভাবের যে মূল কথা বিশ্বতীত কোনো শক্তিতে একান্ত আত্মসমর্পণ, সেই অহমিকাপরিশূন্য আত্মসমর্পণ তাঁর বিচিত্র বাদ-প্রতিবাদের ভিতরে দুর্লভ। কিন্তু এই অভিমত তেমন মূল্যবান নয় বলেই মনে হয়, কেননা রামমোহনের সমস্ত বাদপ্রতিবাদের উৎস-স্বরূপ যে অবিচলিত মানবকল্যাণ বোধ তার প্রতি এর দৃষ্টি নেই। রামমোহনের নিজের এই মন্তব্যটিও এই সম্পর্কে স্মরণীয়-”ধর্ম যদি ঈশ্বরের, রাজনীতি তবে কি শয়তানের?”

যে-সম্প্রদায়ের তিনি নেতা, তাকে বর্তমানে একটি ভক্ত-সম্প্রদায় বলা চলে; কিন্তু ধর্মজীবন সম্বন্ধে রামমোহনের নিজের ধারণা অনেক ব্যাপক, অভিনবত্বও তাতে কম নয়। প্রথমতঃ-একটি বিশেষ ধর্মতত্ত্ব বা ঈশ্বরতত্ত্ব উদ্ভাবনের দিকে তাঁর দৃষ্টি বেশ কম। সত্য বটে, তিনি এক নিরাকার ঈশ্বরের আরাধনার কথা বলেছিলেন ও নাস্তিকতার বিরোধী ছিলেন, কিন্তু এ সব বিষয়ে যে অনাবশ্যকভাবে ব্যস্ত তিনি ছিলেন না, তার প্রমাণ পাওয়া যায় এই দুইটি ব্যাপার থেকে :-হিন্দুসমাজের পৌত্তলিকতার তিনি বিরোধী হয়েছিলেন কেননা তার বিশ্বাস হয়েছিল।

Hindu Idolatry, more than any other pagan worship, destroys the texture of Society (Introduction to the Vedanta); [অন্যান্য পদ্ধতির প্রতীক-উপাসনার চেয়ে হিন্দু-পৌত্তলিকতা সমাজ-বিধানের সমধিক ক্ষতিকর।]

কিন্তু যখন তাঁর বিরুদ্ধবাদীরা বলেছিলেন, তারা প্রকৃতই মূর্তিপূজা করেন না, মূর্তির ব্যাপদেশে ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণের পূজা করেন, রামমোহন তাঁদের এই উক্তি যথার্থ বলে স্বীকার করেন নি, তবু বলেছিলেন, হিন্দু-সমাজের লোকেরা মূর্তিপূজার যে এমন রূপক ব্যাখ্যা দিতে আরম্ভ করেছেন, এ শুভ লক্ষণ। আর বিলেতে গমন করে’ ত্রিত্ববাদী খ্রিস্টানদের সঙ্গে তিনি অন্তরঙ্গ ভাবে মিশেছিলেন, তার কারণ মনে হয় এরূপ ধর্মবিশ্বাস সত্ত্বেও তাঁদের সমগ্র জীবনের উৎকর্ষ। দ্বিতীয়ত, সুফীমত, যোগ প্রভৃতি বিভিন্ন প্রাচীন ধর্মসাধন-প্রণালী তিনি ব্যবহার করেছিলেন, দেহ ও মনের উৎকর্ষ বিধানের উপাদান রূপে। কিন্তু সেই উৎকর্ষ-সমম্বিত দেহমনের ব্যবহার করেছিলেন জ্ঞানান্বেষণে ও মানবসেবায়, অর্থাৎ তার চারপাশের লোকদের দৈনন্দিন জীবনের উন্নতি বিধানে। দেশের প্রাচীন অকল্যাণকর প্রথা-সমূহের বিলোপ-সাধন, উন্নততর শিক্ষাপদ্ধতির প্রচলন, মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা, অত্যাচারিত কৃষকদের আর্থিক স্বাচ্ছল্য বিধান, দেশের সর্বসাধারণের জন্য উন্নততর বিচার-ব্যবস্থার প্রচলন, ইত্যাদি বিষয়ে রামমোহনের অশেষ প্রয়াসের কথা সুবিদিত। শুধু দুঃখ এই, এই প্রাণপ্রদ চিরন্তন ধর্ম-ভাগ্যবান জাতির লোকেরা যার মর্যাদা উপলব্ধি করতে প্রায়ই ভুল করেন না, আমাদের দেশের ভাবুক ও কর্মীদের যথাযযাগ্য অনুধাবনের বিষয় হয়েছে এ কদাচিৎ।

গ্যেটে সম্বন্ধে ক্রোচে বলেছেন, অল্প বয়সেই তাঁর চিত্তের আশ্চর্য বিকাশ-সাধন হয়েছিল, আর আমৃত্যু তা অক্ষুণ্ণ ছিল। রামমোহন সম্বন্ধেও এই কথা খাটে। তার যৌবনের তুহফাতুল মুওহিদীন গ্রন্থেই তার মস্তিষ্কের পূর্ণ বিকাশ দেখতে পাওয়া যায়। তার বিভিন্ন ধর্মের আলোচনাকে গণ্য করা যেতে পারে, মানুষের বিচারবুদ্ধিকে সমস্ত বক্রতা থেকে উদ্ধার করে ঋজু করবার প্রয়াস রূপে। “তুহফাতুল মুওহিদীন”-এর মস্তিষ্ক ও বিভিন্ন জনহিত-প্রচেষ্টার মানব-প্রেম ও কর্মশক্তি-রামমোহনের প্রতিভার মর্যাদা এ-সব ক্ষেত্রে অন্বেষণ না করলে তার প্রতি অবিচার করার সম্ভাবনাই বেশি।

রামমোহন শতবার্ষিকী-ঢাকা

পথ ও পাথেয়

কিছুদিন পূর্বে স্বনামধন্য উর্দু কবি ইকবালের কাব্যের আলোচনায় কয়েকদিন কাটাবার সুযোগ আমার হয়েছিল। তার পাশীতে লেখা আসরার-ই-খুদি-র ইংরেজি অনুবাদ বহু পূর্বেই পড়েছিলাম। এবার তাঁর উর্দু রচনার সঙ্গে আরো একটু পরিচয়ের ফলে, বোঝা গেল ইকবালের প্রতিভা মুসলিম ভারতে, হয়ত বা মুসলিম জগতে, এক বিশেষ অর্থপূর্ণ প্রতিভা। ভারতীয় মুসলমানদের কথাই প্রধানত আমাদের আলোচনার বিষয়। কিছুদিন থেকে এই ভারতীয় মুসলিম নবপ্রতিষ্ঠালাভের পথ ও পাথেয়ের সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে ফিরছে-সেই ব্যাকুল সন্ধানীদের সামনে ইকবাল দাঁড়িয়েছেন নেতৃত্বের দাবি নিয়ে। তার সেই দাবি উপেক্ষিত হবার সম্ভাবনা নেই বল্লেই চলে। শিক্ষিত ভারতীয় মুসলমানদের ভিতরে যারা প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন তারা বড়-জোর ভাবুকতার দিনমজুরি করছেন;-তাই তাঁদের চাইতে সূক্ষ্মতরদৃষ্টিসম্পন্ন, সুপণ্ডিত, সর্বোপরি অনুপমবাকশক্তিশালী ইকবাল যে, অচিরে তাদের সবারই অন্তরে সম্ভ্রমের আসন লাভ করবেন তা স্বাভাবিক।

কিন্তু ইকবাল সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে, একথা ভুললে তাঁর প্রতিভার অবমাননা করা হবে যে, তিনি কবি। তাঁর চিন্তা-ভাবনার মূল্য যাই থাকুক, তার মর্যাদা তার কবিত্বের জন্য। উর্দ-কবিগণ স্বভাবত রচনানিপুণ ও সৌন্দর্যরসিক। ইকবালের প্রতিভায় সেই সঙ্গে মিশেছে দার্শনিকতা ও এক অদ্ভুত জ্বালা-বোধ।

কিন্তু কবি-ইকবাল আজ আমাদের আলোচনার বিষয় নন, আজ আমাদের আলোচনার বিষয় মুসলিম-নেতা ইকবাল।* এ ব্যাপারে বিশেষ সাহায্য পাওয়া যাবে তাঁর এই ক’খানি কাব্য থেকে-আর-ই-খুদি, শেকোয়া ও জওয়াব-ই-শেকোয়া। আ র-ই-খুদি বা ‘আত্মতত্ত্ব’-এ (Secrets of the Self) পাওয়া যাবে তার চিন্তার দার্শনিক ভিত্তি, শেকোয়া বা অনুযোগ’-এ পাওয়া যাবে তার অঙ্কিত মুসলমানের পতনের ছবি ও তার জন্য তাঁর নিদারুণ ক্ষোভ, আর জাওয়াব-ই-শেকোয়া বা ‘অনুযোগের প্রত্যুত্তর-’এ পাওয়া যাবে মুসলিমজাগরণ সম্পর্কে তাঁর পথ-নির্দেশ।

[* দ্র: ইকবাল। ১ শেকোয়ার সূচনার দুটি লাইন এই:
আয় খোদা! শেকোয়া-ই-আবাবে-ওফা ভি সুনলে।
 খুগারে-হামদ-সে ঘোড়াসা গেলা ভি সুলে।।
হে খোদা, একান্ত নতশিরদের অনুযোগও কিছু শোনো।
প্রশংসায় চির-অভ্যস্ত মুখ থেকে নিন্দাও কিঞ্চিৎ শোনো।।]

আসরার-ই-খুদি-র ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকায় Dr. Nicholson বলেছেন, দার্শনিক নিটশের প্রভাব ইকবালের উপরে পড়েছে। তা নিশের প্রভাবের ফলেই হোক অথবা অন্য কারণেই হোক ইকবাল শক্তিমত্তায় একান্ত বিশ্বাসী। তিনি বারবার বলেছেন শক্তিমান হওয়াই জীবনের ধর্ম, যে শক্তিমান হ’তে পারল না সে জীবন নষ্ট করল। তার এই শক্তিবাদ সম্পর্কে তিনি অন্যত্র বলেছেন-দার্শনিক বর্গসঁর মতে ws প্রবাহে মানুষ ভেসে চলেছে; কিন্তু তার ধারণা, এই পরিবর্তন-প্রবাহ নিয়মিত ক্ষমতাও মানুষের আছে। কোরআনে ও মুসলিম সাধকদের জীবনে এর এক অe পরিচয় তিনি পেয়েছেন। তাই তার মতে মহাসাধনা ইসলাম নিয়তির দাস মস তার প্রভু।

একজন সাধারণ মুসলমানও বিশ্বাস করেন-ইসলাম আল্লাহর মনোনীত ২ ব্যবস্থা, আল্লাহর বাণী কোরআনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত; তাই ইসলাম ও কোমল। অবিনশ্বর, অপরিবর্তনীয়, চিরশক্তিমন্ত। এর সঙ্গে ইকবালের পার্থক্য এইটক যে ৯ বিশ্বাসই তার পক্ষেও, সবচাইতে বড় কথা কি না সে-সম্বন্ধে কিছু না বলে তিনি ইস্লামের মহিমা প্রচারে ব্রতী হয়েছেন দার্শনিক যুক্তিতর্কের ও এক নিবিড় উপলব্ধির সাহায্যে।

এই জন্যই তার কথার প্রভাব অনেক বেশি। আমাদের বাংলাদেশের জনৈক খ্যাতনামা ‘আলেম মুসলিম তরুণদের কারো কারো সঙ্গীত ও চিত্রবিদ্যার দিকে প্রবণতা দেখে ও ‘আলেমদের এসবের প্রতি নিদারুণ অবজ্ঞা লক্ষ্য করে এই প্রমাণ করতে প্রয়াস পেয়েছেন যে, ইসলাম সঙ্গীত ও চিত্রবিদ্যার বিরোধী নয়। এই ধরণের ব্যাখ্যার দ্বারা ইসলামের আধুনিকতা প্রতিপাদনের অন্য মূল্য যাই থাকুক, এর খুব বড় ত্রুটি এইখানে যে, এ-ব্যাখ্যায় সঙ্গীত ও চিত্রবিদ্যার মাহাত্ম বাড়ে না, অপর পক্ষে জীবনের এক নিয়ামক আদর্শ হিসেবে ইসলামের মূল্য ক্ষুণ্ণ হয়। এতে ইস্লামের অবস্থা হয় শক্তিহীন বৃদ্ধ পিতার মতো, শক্তিমান যুবক পুত্রের আচরণ সমর্থন না করে যার উপায় নেই। অপর পক্ষে ইকবালের যে কথা-ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষ তার জীবনের সত্যিকার স্বাদ পেতে পারে, সারা জগৎ সন্ধান করে এ তিনি বুঝেছেন, এতে ইসলামকে দাঁড় করানো হয় এক সুমহৎ বিশ্ব-আদর্শ হিসেবেই, তার বর্তমান দুর্বলতা বা কার্যকারিতাই তার শ্রেষ্ঠ পরিচয়স্থল হয় না।

কিন্তু যুক্তির সাহায্য যে ইকবাল বিশেষভাবে গ্রহণ করেছেন, অথবা করতে চেয়েছেন, এতেই বহু শ্রেণীর যুক্তিবাদীর আঘাতের স্থল তাকে হতে হয়েছে, আর এই যুদ্ধে কোনো প্রতিপক্ষের কাছে পরাজিত হলে পরম বিনয়ে হার স্বীকার না করে তার উপায় নেই। অন্যভাবে কথাটি বললে দাঁড়ায়-যুক্তির সাহায্যে ইসলামের মাহাত্ম প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে প্রকারান্তরে তিনি যুক্তিরই মাহাত্ম প্রতিষ্ঠিত করেছেন, অর্থাৎ যুক্তির আশ্রয় তিনি যখন নিয়েছেন, তখন তাঁকে স্বীকার করতে হবে যে, যুক্তিতে যা

2 In solidity consists the glory of life. Weakness is worthlessness and immaturity Secrets of the Self.

২৪০

শেষ্ঠ প্রতিপন্ন হয় তাই-ই শ্রেষ্ঠ। এ সম্বন্ধে Dr. Nicholson তার অনূদিত Secrets of the Self-এর ভূমিকায় বলেছেন

Iqbal’s philosophy is religious, but he does not treat philosophy as the handmaid of religion. Holding that the full development of the individual presupposes a society, he finds the ideal society in what he considers to be the Prophet’s conception of Islamn.*

ইকবালের মতবাদ এইবার একটু বুঝতে চেষ্টা করা যাক।

বলা হয়েছে তিনি শক্তিমত্তায় বিশ্বাসী-নিজের শক্তিতে যে বিকশিত হয়ে উঠতে পারল না, তাঁর মতে, সে কৃপার পাত্র। এই শক্তির বাণী প্রচার করে একদিকে যেমন পতিত মুসলমানের কানে জড়তা বিসর্জনের মন্ত্র দেওয়া হলো, অন্যদিকে তেমনি তার কল্পনা উদ্দীপ্ত করা হলো, তার অবসন্ন শিরায় শিরায় এক নূতন বিদ্যুৎ-তরঙ্গ খেলে গেল,-মুহূর্তের জন্য জীবনের এক মহাসার্থকতার দ্বার তার জন্য উন্মুক্ত হলো।

এমনিতর অনুভূতির পরক্ষণে এ-প্রশ্নের উদয় হওয়া স্বাভাবিক-এই সার্থকতা লাভ হবে কোন্ পথে?

মানুষের মুখে এ বড় নিষ্ঠুর প্রশ্ন। কিন্তু নেতারা এ প্রশ্নের উত্তর দেন-ইক্কালও দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন-মুসলমানের পতনের কারণ, সে ইসলাম ছেড়ে দিয়েছে; তার পূর্বপুরুষগণ বিশ্ববরণ্যে হয়েছিলেন ইসলাম অবলম্বন করে। এই কথাটি একটি ইংরেজি বক্তৃতায় খুব জোরালো করে তিনি বলেছেন এই ভাবে

In times of crises in their History it is not Muslims that saved Islam, on the contrary, it is Islam that saved Muslims.

এর উত্তরে বুঝতে পারা যাচ্ছে ইস্লাম বলতে অনেকখানি সুস্পষ্ট এক আদর্শ তাঁর মনে আছে, তার মাহাত্ম তার কাছে অপরিসীম। কিন্তু তার এই উক্তির ক্রটি এই যে, তিনি এখানে প্রচলিত শব্দ ব্যবহার করেছেন নূতন অর্থে। ইসলাম ব’লতে তিনি বোঝেন শক্তিমত্তা, কিন্তু বহু প্রাচীন মুসলিম মনীষী ইসলাম ব’লতে বুঝেছেন আত্মসমর্পণ। কেউ কেউ বলতে পারেন, এ দু’য়ে আসল পার্থক্য হয়ত নেই। কিন্তু তা

ইকবালের দর্শন ধর্মমূলক; কিন্তু দর্শনকে তিনি ধর্মের পরিচারক জ্ঞান করেন না। ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সমাজ-জীবন-সাপেক্ষ, তিনি মনে করেন সেই আদর্শ সমাজ-জীবনের সন্ধান তিনি পেয়েছেন হজরত মোহম্মদের পরিকল্পিত ইসলামে। মুসলিম ইতিহাসের সঙ্কটকালে মুসলমান ইসলামকে রক্ষা করেনি, বরং ইসলাম মুসলমানকে রক্ষা করেছে।

-১৬

২৪১

সত্য নয় এই জন্য যে, শক্তিবাদী ইকবাল বিশেষভাবে চাচ্ছেন মুসলমানের জন্য। রাজনৈতিক গৌরব, কিন্তু, সমর্পণ-ধর্মী অনেক মুসলিম মনীষী ঠিক তাই-ই চাননি।

তারপর ঐতিহাসিক ঘটনারও তিনি যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সে-সম্বন্ধে মতভেদ থাকা স্বাভাবিক। তিনি বলেছেন, সঙ্কটকালে ইসলাম মুসলমানকে উদ্ধার করেছে। একটি সুপরিচিত সঙ্কটকালের কথা ভাবা যাক-মোতাজেলা-সমপ্রদায়ের সঙ্গে সর্বসাধারণ। মুসলমানের সংঘর্ষ-কাল। ইসলামের সেই সুপরিচিত সঙ্কটকালে ইমাম গাজ্জালি জয়ী হয়েছিলেন ও মোতাজেলা-নেতা ইবনে রোশদ (Averoes) পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু এ-জয় ইসলাম ও মুসলমানের জন্য সত্যিকার জয় হয়েছিল কিনা সে-সম্বন্ধে মুসলিম চিন্তাশীলদের ভিতরেই প্রবল মতভেদ বিদ্যমান। এই সম্পর্কে এ ব্যাপারটির উল্লেখ হয়ত অসঙ্গত হবে না যে, পরাজিত ইবনে রোদের চিন্তার প্রভাব যাদের উপরে। পড়েছিল তাঁদের সন্ততি বর্তমান ইয়োরোপে, আর বিজেতা ইমাম গাজ্জালির চিন্তার প্রভাব যাদের উপরে পড়েছিল, তাদের সন্ততি বর্তমান মুসলিম-জগৎ। বলা যেতে পারে-ইতিহাস শেষ হয়ে যায় নি। তা সে-শেষ বিজেতা বিজিত কারো জন্যই হয় নি।

উর্দু-কাব্যরসিকরা এ বিষয়ে বোধ হয় একমত যে, মুসলমানের পতনের জন্য বেদনা যাতে ব্যক্ত হয়েছে সেই শেকোয়া-র চাইতে তার প্রতিকারের কথা যাতে বলা হয়েছে, সেই জওয়াব-ই-শেকোয়া কাব্যহিসেবে নিকৃষ্টতর। এর থেকে দৃষ্টিমানরা সহজেই বুঝতে পারেন প্রতিকার সম্বন্ধে সুনিশ্চিত অকুণ্ঠিত বাণী উচ্চারণ করতে ইকবাল পারেন নি, যদিও তার সন্ধানে তিনি ফিরছেন। কিন্তু তা না পারলেও তার এই সব কথার প্রভাব কম না হওয়াই সম্ভবপর। তিনি যা বলছেন মুসলমান-সমাজে তাই-ই প্রচলিত মত, তার উপর এর সঙ্গে তার সংস্রব একে নূতন শক্তি দিয়েছে।

ইকবালের রচনায় দার্শনিকতা থাকলেও আসলে তিনি কবি-ইস্লাম বলতে এক নূতন সৌন্দর্যচ্ছবি তাঁর মনোনেত্রে আবির্ভূত হয়েছে, তার মাহাত্মে তিনি একান্ত বিশ্বাসবান।

এই একান্ত বিশ্বাস অশ্রদ্ধার যোগ্য নয় বরং শ্রদ্ধেয়, নূতন বিশ্বাসে মানুষ তার অন্তরে অন্তরে এক নিবিড় পুলক অনুভব করবে ও অপরকে সেই আনন্দ উপহার দেবে, এর চাইতে ভাল কাজ সে আর কি করতে পারে। কিন্তু বিশ্বাসের প্রভাব মানুষের উপরে এ না হয়ে হয় অন্য রকমের-এর প্রভাবে মানুষ হয়ে ওঠে নিদারুণ অত্যাচারী। জগতের বিভিন্ন ধর্মের ইতিহাস এই কলঙ্কে কলঙ্কিত হয়েছে-একালের জাতীয়ত্ববাদীরা নূতন করে এই অভিশাপগ্রস্ত হয়েছেন। ইকবাল বলেছেন, ইসলাম মানুষের জন্য “আবে হায়াত” মৃতসঞ্জীবনী, ডা. মুঞ্জে বা শ্রীঅরবিন্দ বলেছেন, হিন্দুত্ব মানুষের জন্য অমোঘ বিধান;-এসব কথা মানুষ কখনো ধীরে-সুস্থে বুঝে দেখতে চেষ্টা করবে কিনা

সৈয়দ আমির আলির Spirit of Islam দ্রষ্টব্য। কবিদের উদ্দেশ্যে গ্যেটে এই একটি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেনঃ-যখন হৃদয় মন উধাও হয়ে ওঠে তখন, হে তরুণ, মনে রেখো কল্পনাদেবী (Muse) সঙ্গিনী হতে পারেন কিন্তু অভ্রান্ত পথনির্দেশ তার নয়- Goethe by B. Croce, p. 4.

২৪২

জানিনা, কিন্তু এর প্রভাবে ভারতবাসীর জীবন যে হয়ে উঠল দুর্বহ। মনীষী সাদী বলেছেন-সাধু উদ্দেশ্যের মিথ্যা অসাধু উদ্দেশ্যের সত্যের চাইতে ভাল; ইকবালের বা আধুনিক হিন্দু মনীষীদের ব্যাখ্যাত ইসলাম-আদর্শ বা হিন্দুত্ব-আদর্শ যদি যুক্তিতর্কের দিক দিয়ে অভ্রান্তও হতো, তবু সে-সবের এমন ভয়াবহ পরিণতি দেখে মানুষের জন্য

সে-সবের উপযোগিতায় সন্দেহ প্রকাশ করা অসঙ্গত হতো না।

ইকবালের ইস্লাম-ব্যাখ্যার দুর্বলতা কোথায় তা কিছু বুঝতে চেষ্টা করা হয়েছে। এর উৎপত্তি-সূত্র খুঁজলেও বুঝতে পারা যাবে এর দুর্বলতা-আধুনিক জগতে মুসলমান এক পতিত সম্প্রদায় অথচ এ জ্ঞান তাঁদের আছে যে, তাদের পূর্বপুরুষ জগজ্জয়ী হয়েছিলেন,-রুগণের পক্ষে উত্তেজনা অকল্যাণকর।

কিন্তু যুক্তিতর্কের দিক দিয়ে কোনো মতবাদ দুর্বল হলেও মানুষের জীবনের উপর তার প্রভাব প্রবল হতে বাধূতে না-ও পারে, বিশেষতঃ ইকবালের বাণীতে যখন রয়েছে। প্রত্যয়ের তেজ ও এক অনুপম সৌন্দর্যচ্ছট।

ইকবালকে পথপ্রদর্শকরূপে গ্রহণ না করে ভারতীয় মুসলমান হয়ত পারবেন না, যদি অন্য কোনো সবলতর বা সুন্দরতর চিন্তাধারা তাদের সামনে উন্মুক্ত না হয়।

ইকবালের চিন্তার চাইতে অন্য কোনো সবলতর বা সুন্দরতর চিন্তাধারা ভারতীয় মুসলমানদের সামনে আছে কি না বলা শক্ত। তবে এ কথা সত্য যে, অন্য একটি চিন্তাধারাও কিছুদিন থেকে তাঁদের সামনে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ধারা প্রবর্তিত করেছেন মুস্তফা কামাল।

মুস্তাফা কামালের সত্যিকার অনুরাগী ভারতীয় মুসলমানদের ভিতরে তেমন বেশী হয়ত নেই-অন্তত ‘আলেম-সম্প্রদায়ের ও নেতা ও সম্পাদক-সম্প্রদায়ের কথাবার্তা শুনে তাই-ই মনে হয়। তবে তরুণ মুসলিম কামালের কর্মচেষ্টার অর্থ পুরোপুরি না বুঝেও মোটের উপর হয়ত শ্রদ্ধার দৃষ্টিতেই তাঁর পানে চেয়ে আছেন। বাংলাদেশে এই দল নিজেদের আদর্শের নাম দিয়েছেন-বুদ্ধির মুক্তি।

ইকবালের ইসলাম-আনুগত্যের আদর্শ আর মুসলিম তরুণদের এই বুদ্ধির মুক্তির আদর্শ পরস্পর-বিরোধী মনে হতে পারে। এ দুয়ে খুব বড় পার্থক্যও আছে, একের দৃষ্টি শাস্ত্রের পানে খুব বেশী, অপরের দৃষ্টিতে শাস্ত্র জীবনের বহু উপকরণের এক উপকরণ, একের ভিতরে রয়েছে একটি বিশেষ আদর্শের জন্য আকুলতা, অপরের ভিতরে আছে আত্মপ্রকাশের আনন্দ ও সহজ জগৎ-প্রীতি,-তবু এই দুয়ের ভিতরে এই বড় মিল রয়েছে যে, দুই-ই যুক্তিপন্থী, দুয়েরই চরম লক্ষ্য সত্য ও জগতের কল্যাণ।

বাংলার মুসলিম-সমাজে এই বুদ্ধির মুক্তিবাদীদের উদ্ভবের মূলে তিনটি বড় কারণ দেখতে পাওয়া যাবে:- প্রথমতঃ, ইসলামের সত্যিকার সামাজিক রূপ বাংলার মুসলিম জীবনে নগণ্য অথচ এরও উপর ধর্মের হুকুম প্রবল করতে চেষ্টা করা হয়েছে; দ্বিতীয়তঃ, বাংলা আত্মনিষ্ঠ ধর্মসাধনার দেশ, আউল-বাউলের দেশ, ধর্মসংহিতাদির

* দ্র: ৭৭ পৃ.:

২৪৩

প্রভাব এ-দেশের লোকদের জীবনে অল্প। শতাধিক বৎসর আগে চট্টগ্রামের জনৈক মুসলমান দরবেশ তার জ্ঞান-সাগর’ গ্রন্থে হজরত মোহাম্মদের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন

মোর পরে পয়গম্বর না জন্মিব আর ॥ মোর পরে হইবেক কবি ঋষিগণ। প্রভুর গোপন রত্নে বান্ধিবেক মন ॥ শাস্ত্র সব ত্যাগ করি ভাবে ডুষ দিতা। প্রভুপ্রেমে প্রেম করি রহিবে জড়িআ ॥

বাংলার মুসলমান-বাউলদের রচনায় চিন্তার স্বাধীনতা খুবই লক্ষ্যযোগ্য; তৃতীয়তঃ, বাংলাদেশের শিক্ষিত হিন্দুসমাজে শতাধিক বৎসর যাবৎ চিন্তায় ও কর্মে বিশ্বধারার ঢেউ খেলে যাচ্ছে; তাতে বাংলার জাতীয় জীবনে আশানুরূপ ফল ফলেছে কি না সে-প্রশ্নের উত্তর না দিয়েও বলা যায়, এ ঢেউ আজো যে প্রবল তার আধুনিকতম প্রমাণ শরৎচন্দ্রের ‘শেষ প্রশ্ন। এ-ঢেউ যে বাংলার মুসলিম সমাজের বুদ্ধির মুক্তি’-বাদীদেরও লাগবে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

কিন্তু এরও চাইতে বড় কারণ এই অভিনব মুসলিম জাগরণের মন্ত্রের মূলে হয়ত আছে। আধুনিক তুর্ক যে ইয়োরোপের ইতিহাস থেকে নিজেদের কর্মচেষ্টার নজির সংগ্রহ করছেন এ কথা অনেকেই বলেছেন, তার সঙ্গে একথাও কেউ কেউ বলেছেন যে, এই ধরণের কর্মপ্রেরণার উৎস ইসলামের নিজের ভিতরেই আছে। ইসলাম দেবদেবীর মূর্তি চূর্ণ করেছে, পৌরহিত্য রহিত করেছে, নরনারীনির্বিশেষে ব্যক্তির স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে; কাণ্ডজ্ঞানের এই জয়যাত্রা শাস্ত্রের দুয়ে মাহাত্মের সামনে যুগের পর যুগ প্রতিহত হবে এ আশা করা সঙ্গত না-ও হতে পারে। ইকবাল নিজেই তার নবপ্রকাশিত Six Lectures on the Reconstruction of Religious Thought in Islam গ্রন্থে এক জায়গায় বলেছেন

The birth of Islam is……..the birth of inductive intellect. In Islam prophecy reaches its perfection in discovering the need of its own abolition.*

এই বুদ্ধির মুক্তির জন্মবেদনা বারবার মুসলিম-জগতে অনুভূত হয়েছে। পশ্চিমের আবু হানিফা ও মোতাজেলা-সম্প্রদায় ও পূর্বের আকবর ও আবুল ফজল এর কিছু কিছু প্রমাণ।

তা উৎপত্তি-সূত্র যাই-ই হোক তার চাইতে বড় কথা এর অনুবর্তীদের অন্তরে এর জন্য অনুরাগ ও সমসাময়িক জীবনের জন্য এর প্রয়োজন। এর অনুবর্তীদের অন্তরে এ

* ইসলামের অভ্যুদয়ের অর্থ (মানবের) ভুয়োদর্শনজাত বৃদ্ধির অভ্যুদয়। ইসলামে বার্তাবহন

চরমোৎকর্ষ লাভ করেছে সঙ্গে সঙ্গে তার (বার্তাবহনের) পরিসমাপ্তিও ঘটেছে।

২৪৪

এক অভিনব স্বাচ্ছন্দ্য ও মুক্তির আনন্দ এনে দিয়েছে বুঝতে পারা যাচ্ছে, আর এর প্রয়োজন সুগভীর বলেই মনে হয়। আমরা গৃহে বাস করি সত্য কিন্তু সে-গৃহ নির্মিত হয় আকাশের নিচে। বিভিন্ন জাতীয়ত্ব বা সাম্প্রদায়িকতাও তেমনি মানুষের জন্য অসত্য নয়, কিন্তু সকলে মিলে মানুষ এক বিশ্ব-পরিবার, সেখানে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের অপরিহার্য কর্তব্য রয়েছে, এই বৃহত্তর জীবনের কথা মানুষ যখন বিস্মৃত হয় তখনই আরম্ভ হয় তার দুর্দিন। মুসলিমত্বের অভিমান বা হিন্দুত্বের অভিমানের চাইতে বুদ্ধির মুক্তির আদর্শ যে জাতিধর্মনির্বিশেষে ভারতবাসীর জন্য পরম কল্যাণকর আদর্শ, একথা হয়ত নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে।

মুসলিম জাগরণ সম্পর্কে ইকবালের যে-সব কথার আলোচনা আমরা করেছি সে সব তার আগেকার লেখা কাব্য থেকে নেওয়া। মনে হয় কিছু মত-পরিবর্তন সম্প্রতি তার হয়েছে। তার পূর্বোল্লিখিত Six Lectures on the Reconstruction of Religious Thought in Islm গ্রন্থে তুর্কীর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বহু সতর্কবাণী উচ্চারণ করেও তিনি তা’র সংস্কার-চেষ্টা মোটের উপর শ্রদ্ধা ও আনন্দের দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করেছেন। এ সম্পর্কে তার কয়েকটি কথা প্রাণিধানযোগ্য

If the Renaissance of Islam is a fact, and I believe it is a fact, we too one day, like the Turks, will have to revaluate our intellectual inheritance…… The truth is that among the Muslim nations of to-day Turkey alone has shaken off its dogmatic slumber, and attained to self consciousness. She alone has claimed her right of intellectual freedom; she alone has passed from the ideal to the real-a transition, which entails keen intellectual and moral struggle. To her the growing complexities of a mobile and broadening life are sure to bring new situations suggesting new points of view, and necessitating fresh interpretation of principles, which are only of an academic interest to a people who have never experienced the joy of spiritual expansion. It is, I think, the English thinker Hobbes who makes this acute observation that to have a succession of identical thoughts and feelings is to have no thoughts and feelings at all. Such is the lot of most Muslim countries to day. They are mechanically repeating old values, whereas the Turk is on the way to creating new values.

ইসলামের জাগরণের যদি সূচনা হয়ে থাকে-এর যে সূচনা হয়েছে তাতে আমার নিজের সন্দেহ নেই-তবে তুর্কীদের মতো আমাদেরও একদিন আমাদের উত্তরাধিকারীর প্রাপ্ত প্রাচীন জ্ঞানের মূল্য নিরূপণ করতে হবে।……..প্রকৃত কথা এই যে ইসলাম-অবলীলা জাতিদের মধ্যে কেবল তুকীই বিশ্বাসপরায়ণতার সুখনিদ্রা পরিত্যাগ করে জাগ্রতচিত্ত হয়েছে। কেবল সেইই তার বিচারবুদ্ধির

২৪৫

কিন্তু ইকবাল নিজে বদলালেও তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যের প্রভাব মুসলিম জনসাধাদা উপরে অন্য রকমের হওয়া বিচিত্র নয়। মনীষী বার্ণার্ড শ’ বলেছেন-পরাধীনতায় ৮ ভুগছে তার অবস্থা ক্যান্সার’গ্রস্ত রোগীর মতো, যে-কেউ চেঁচিয়ে বলে সে ওষুধ জাল তারই শরণাপন্ন সে হয়। মুসলমান বড় অবনত পতিত’ এই inferiority cam, এর জন্য তার উপর ইকবালের বাণীর প্রভাব অবাঞ্ছিত রকমের হওয়া আশ্চর্য নয়।

মুসলিম জনগণের সামনে এই যে দুই পথ, তার বিচিত্র পাথেয় নিয়ে উন্মুক্ত হয়ে এর কোন্‌টি শেষ পর্যন্ত তাদের অবলম্বন হবে, সে-উত্তর আজ দেওয়া সম্ভবপর নয়। বুদ্ধির মুক্তি’র আদর্শ নিশ্চয়ই খুব সহজসাধ্য আদর্শ নয়; তবে মানুষের সাধনা দিন দিন কঠিনতর হচ্ছে, আর এতেই তার আনন্দ, তাই ভয় পাবারও কিছু নেই। আজ হয়ত মুসলমানের পক্ষে প্রয়োজন একান্ত করে ভাবা কোন্‌টির কি ফল। তারই সঙ্গে সঙ্গে inferiority complex-এর স্থানে জীবনে আনন্দ ও শ্রদ্ধা এবং মানুষের অসীম সম্ভাবনায় বিশ্বাস তার পক্ষে যদি সত্য হয়-তবে সেটি হবে তার পক্ষে ও জগৎ বা বৃহত্তর দেশের পক্ষে যেন এক দৈব অনুকম্পা।

তাহলে আজকের এই পতিত ভারতীয় বা বাঙালী মুসলমানই হবে অন্তত তার নিজের দেশের জন্য কল্যাণের সিংহদ্বার।

অগ্রহায়ণ, ১৩৩৮

আমাদের কথা

[আবুল হুসেন সাহেব “তরুণের সাধনা” নাম দিয়ে একটি প্রবন্ধ “সাওগাতে” প্রকাশ করেন। তাতে তিনি রামমোহনের মুক্তবুদ্ধি ও স্বদেশপ্রেমের সাধনার দিকে তরুণদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাকে বিদ্রূপ করে মিঃ এস, ওয়াজেদ আলি মাসিক মোহাম্মদী”তে এক দীর্ঘ প্রবন্ধের অবতারণা করেন। উক্ত পত্রেই তার প্রতিবাদ করেন অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন। তার প্রতিবাদে “বাঙ্গালী মুসলমানের সাহিত্য সাধনা” লেখাটি মোহাম্মদীতে প্রকাশিত হয়।

স্বাধীনতার দাবি জানিয়েছে; মাত্র সেইই ভাব-জগৎ থেকে বাস্তব জগতে পদার্পণ করেছে যার অর্থ মানস ও নৈতিকক্ষেত্রে এক তীব্র সংগ্রাম। চলিষ্ণু ও সম্প্রসারণশীল জীবনের বিচিত্রতা এখন তার জন্য এনে দেবে নব নব পরিস্থিতি, তার ফলে উন্মোষিত হবে তার নব নব দৃষ্টি, প্রয়োজন হবে প্রাচীন মতের অভিনব ব্যাখ্যা-যারা আত্মিক জীবনের বিকাশের আনন্দ অনুভব করেন নি, তাদের জন্য সেই সব মতবাদ বিদ্বৎসমাজের নিপুণ বিচারবিশ্লেষণে বিষয় মাত্র। বোধ হয় ইংরেজ মনীষী হস্ এই সূক্ষ্ম মন্তব্যটি করছেন-একই রকমের চিন্তা ও অনুভূতির অনুবৃত্তির অর্থ চিন্তা ও অনুভূতি-বিহীনতা। বর্তমানে অধিকাংশ মুসলিম দেশের এই দশা। যান্ত্রিকভাবে তারা প্রাচীন সম্পদের অনুবর্তন করছেন কিন্তু তুর্কী রত হয়েছে নূতন সম্পদ সৃষ্টিতে। Inferiority Complex-মনস্তাত্ত্বিক পরিভাষা, নিজে ছোট এই মনোভাব। এই মনোভাবের ফলে সাধারণতঃ মানুষ অসহিষ্ণু কলহপ্রিয় ও অন্যান্য নানা ভাবে অসামাজিক হয়।

২৪৬

জনাব সম্পাদক সাহেব, আপনার আযাঢ়ের “মাসিক মোহাম্মদী”তে “বাঙ্গালী মুসলমানের সাহিত্য সাধনা” নামে যে লেখাটি বেরিয়েছে তার উৎপত্তি এক বাদানুবাদসূত্রে; সে-বাদানুবাদে লিপ্ত হ’বার আগ্রহ আমার নেই। আমি শুধু আপনার লেখকের কয়েকটি প্রধান যুক্তিতর্কের দুর্বলতার উল্লেখ করতে চাই। আপনার লেখকের সেই সব যুক্তিতর্ক হয়ত “মোহাম্মদী”-ভাবুক-সঙ্রেই যুক্তিতর্ক।

১। অতীতকে বর্তমান দিয়ে বুঝতে হবে,-একথা আপনার লেখক ভ্রমপূর্ণ বলেছেন। বর্তমান অর্থ বর্তমান কার্যকারিতা-এই সোজা কথাটা কেন তার কাছে দুর্বোধ্য হ’ল বোঝা শক্ত। যাঁর লেখার প্রতিবাদে এই “বাঙ্গালী মুসলমানের সাহিত্য সাধনা” লেখাটির উৎপত্তি তাঁর ও তাঁর দলস্থ সাহিত্যিকদের লেখায় একথা ব্যক্ত হয়েছে। আপনাদের অপ্রিয় একদল সাহিত্যিক’ যে প্রচলিত ইসলামে সম্ভষ্ট হতে পারছেন না তার কারণ, এর বর্তমান কার্যকারিতা তারা দেখছেন না, এর জ্ঞানকাণ্ডের প্রচলিত ব্যাখ্যায় তাদের মন ওঠে না। কোনোকিছুর ভবিষ্যৎ কার্যকারিতা আছে এ একটি আশার বা নিরাশার কথামাত্র। ভবিষ্যৎ কার্যকারিতা সত্যই যাদের লক্ষ্য, তাঁরা কাজের সূচনা করেন বর্তমানে।

২। আপনার লেখক ইঙ্গিত করেছেন-প্রকৃতির মতো ইসলাম চিরন্তন, চিরশক্তিমন্ত। কিন্তু সে কোন্ অর্থে? কোরআনে যে বলা হয়েছে জগতের সমস্ত পয়গম্বরের ধর্ম ইসলাম, মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম ইসলাম, সেটি এই অর্থে যে চিরকালই মানুষ এক জগৎ-কারণের সন্ধান করে এসেছে, তার বশ্যতা স্বীকার ও সঞ্জীবন যাপন এ-সমস্ত কথা বলেছে। বলা যেতে পারে এ হচ্ছে সমস্ত ধর্মের ঐক্যস্থল। কিন্তু ধর্মে ধর্মে ঐক্যই তো শুধু নেই, বিরোধও তো প্রবলভাবে আছে, আর সেই বিরোধ বা বৈশিষ্ট্যই তো ভাবনা-চিন্তার বড় বিষয়। তাই ইসলাম বলতে শুধু “আমানু ও আমালুস সালেহাত” (বিশ্বাস করো ও সৎকর্মশীল হও) এই তত্ত্বই বোঝায় না, কোরআন, হাদিস, ফেকাহ, ফেকাহর টীকা, মায় একালের আলেমদের ভালমন্দ ফতোয়া, সবই বোঝায়। Abstract (তত্ত্বগত) ইসলাম ও Applied (ব্যবহারিক) ইসলামের এই পার্থক্য লক্ষ্য না করে এবং একের জায়গায় আরকে টেনে এনে আপনার লেখক পাঠক-সাধারণের সময় ও মনের উপর জুলুম ভিন্ন আর কিছুই করেন নি।

৩। আপনার লেখকের মত-ইসলাম এখনো জীবন্ত ও বীর্যবন্ত কেননা কোআন হাদিস আগেকার মতো এখনো বর্তমান। এই ধরণের চিন্তা যে অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ একথা

আমাদের তরফ থেকে বলা হয়েছে। আর একবার বলতে চেষ্টা করা যাক।

কোরআন-হাদিসে কি আছে তা জানবার জন্য আরবী শিখতে হয়, অথবা যারা আরবী জানেন তাদের কত অনুবাদ পাঠ করতে হয়। শুধু তাই নয়, কোরআন ও হাদিসের বিশেষ ভাষা, বিশেষ প্রকাশভঙ্গি এ সমস্তের সঙ্গে পরিচিত হতে হয়। এও পর্যাপ্ত নয়, কোআন হাদিসের যুগের বিস্তৃত ইতিহাস, কোরআনের পূর্ববর্তী ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মশাস্ত্র, কোরআনের পরবর্তী মুসলিম সভ্যতার বিকাশ প্রভাব ও পতন ইত্যাদির খবরদারি করতে হয়,-আর, এ সমস্তের চাইতে বড় কথা, অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তির নিজের ভিতরে চাই কিছু স্বভাবদত্ত সুবুদ্ধি। কোআন হাদিসের সত্যিকার সার্থকতা

২৪৭

যখন নির্ভর করে কমবেশি এতগুলো ঘটনার উপরে, তখন অত্যন্ত সোজা করে যদি বলা হয় যে, ইসলাম পূর্ববৎ জীবন্ত ও বীর্যবন্ত কেননা, কোরআন হাদিস বর্তমান তবে সোজা কথাই বলা হয় মাত্র, কিন্তু সত্য কথা নয়।-বীজ থেকে বৃক্ষ হয় এ খুবই একটি প্রচলিত কথা। তবু একটু ভাবতে গেলেই বোঝা যায়, এ আংশিক সত্য। বীজ থেকে বৃক্ষ পর্যন্ত রয়েছে নানা অনুকূল ঘটনার পারম্পর্য। বীজ থেকে বৃক্ষ হয় এ যতখানি সত্য, কোরআন থেকে ইসলামের (ধর্মজীবনের) উদ্ভব হয় এ ততখানি সত্যও নয়, কেননা বৃক্ষ ও বীজের নিত্যযোগ, কিন্তু কোরআনের সঙ্গে সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তির অন্তরেও ইস্লামের (ধর্মজীবনের) আবির্ভাব হতে পারে। (হজরত এবরাহিমের আল্লাহর ধারণায় উপনীত হ’বার কাহিনী স্মরণীয়)।

হয়তো আপনার লেখক এই কথাটি বলতে চেয়েছেন যে, অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের চাইতে মুসলমান-ধর্মগ্রন্থ সুরক্ষিততর হয়ে এসেছে, তাই এর প্রবর্তকের মনে কি সংকল্প ছিল তা বুঝতে পারা অপেক্ষাকৃত সহজ। এ যুক্তি অনেক ধর্মতত্ত্বজ্ঞ মুসলমানই উপস্থিত করে থাকেন। শুধু ধর্মগ্রন্থ যে ধর্ম-জীবনের জন্য যথেষ্ট নয়, সে-সম্বন্ধে আগেই কিছু বলা হয়েছে। তা ছাড়া কোনো ধর্মগ্রন্থ অবিকৃত অবস্থায় আছে এ ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের জন্য খুব বড় সংবাদ, ধর্মজীবনের জন্যও আনন্দসংবাদ নিশ্চয়ই,-একটা ধর্মজীবনের অবিকৃত ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় হবে এর দাম বাস্তবিকই খুব বেশী-কিন্তু তবু ধর্মজীবন হচ্ছে মুখ্যত মানবচিত্তের এক নব উন্মেষ, অন্য কথায়, সে-ই ধার্মিক যে আল্লাহ্ সম্বন্ধে সজাগ হয়েছে অথবা বিশ্বজগতের সঙ্গে প্রেম ও কল্যাণের যোগে যুক্ত হয়েছে; আর মানব-চিত্তের এই নব-উন্মেষে বিকৃত বা অবিকৃত সমস্ত ধর্মগ্রন্থ, মনীষীর মনীষা, বিশ্বপ্রকৃতি, সবই কিছু কিছু সাহায্য মাত্র। অন্যান্য চিন্ত শীলের মতো ধার্মিকও electic, তার পছন্দ বা প্রয়োজন মতো জীবন-পথের পাথেয় বা প্রেরণা তিনি আহরণ করেন গ্রন্থ, মানব-প্রকৃতি, বিশ্বপ্রকৃতি, সব-কিছু থেকে। মানুষের নিজের ভিতরকার এই যে সৃষ্টিধর্ম, creativeness,ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রের এই মূলীভূত কারণ, মনে হয় আপনার লেখক এই এক গোড়ার কথা বিস্মৃত হয়ে ধর্মতত্ত্বের আলোচনায় মনোনিবেশ করেছেন।

৪। মি. এস, ওয়াজেদ আলীর অনুবর্তিতায় আপনার লেখক বলেছেন, ইসলাম Rationalistic (যুক্তিবাদী) ধর্ম। ইসলাম জগতের বড় ধর্মগুলোর সর্ব কনিষ্ঠ, তাই যুক্তি-বিচারের আদর তাতে বেশী হওয়া স্বাভাবিক। আর বাস্তবিকই কোরআনে বিচার কাণ্ডজ্ঞান এ-সবের উপরে যথেষ্ট জোর দেওয়া হয়েছে, মোজেজা (অলৌকিকতা) দেখাবার আগ্রহ হজরতের নেই বললেই চলে। তবু এ সত্য যে কোরআনে বহু মো’জেজার কথা আছে, হাদিসে দজ্জাল, কেয়ামত, বেহেশত, দোজখ, ইত্যাদি সম্বন্ধে এমন সব কথা আছে, যাকে হয় সেকালের লোকের ধারণা বলতে হবে-নইলে সে সমস্তের রূপক ব্যাখ্যা দিতে হবে। কোরআনের একালের তফসির-কার মৌলবী মোহাম্মদ আলী কতকটা অনিচ্ছাসত্ত্বে ব্যক্ত করেছেন, পূর্ববর্তী তফসির-কারদের অনেকে অলৌকিকতার দিকে যথেষ্ট প্রবণতা দেখিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ইবনে সা’দ, ইবনুল আসির, ইবনে খালদুন প্রমুখ মুসলিম ঐতিহাসিক থেকে সামান্য উপকরণ সংগ্রহ

২৪৮

করতে গিয়েও দেখছি, হজরত সম্বন্ধে অলৌকিক কাহিনী লিপিবদ্ধ করতে তারা আদৌ অনিচ্ছুক ছিলেন না, হয়ত আগ্রহান্বিত ছিলেন। বোধ হয় ইবনে খালদুনে এই কথাটি আছে-বিবাহের পূর্বে হজরত যখন বিবি খোদেজার উট নিয়ে বাণিজ্য থেকে ফিরছেন তখন তার (বিবি খোদেজার) বাদী দেখলে, হজরতের মাথার উপরে দুই ফেরেশতা ছায়া দিতে দিতে আসছে।

ইসলাম, অথবা যে-কোনো ধর্ম Rationalistic এ কথা যারা বলেন তারা Rationalism ও ধর্ম দুইয়েরই সম্বন্ধে অত্যন্ত ভাসাভাসা কথা বলেন মাত্র। ধর্ম সম্বন্ধে জনৈক ভাবুক বলেছেন

Religion is life before God and in God.”

অন্যত্র

The soul penetrated with the sense of the infinite is in the religious

state

কোরআনের বহু জায়গায় এই মর্মের কথা আছে:

তার প্রভুর যখন তাকে বল্লেন” সমর্পিতচিত্ত হও; তিনি (হজরত এবরাহিম) বলেন : আমি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বরের শরণ নিলাম (২: ১৩১);

স্বর্গে ও মর্ত্যে যে-কেউ আছে প্রত্যেকে তার; আর সবাই তার অনুবর্তী (৩০ : ২৬);

সপ্ত স্বর্গ তার মহিমা ঘোষণা করে, আর ধরিত্রীও; আর এদের মধ্যে যাদের অবস্থিতি এমন কিছুই নেই যা তাঁর স্তবগান না করে, কিন্তু সে-স্তবগান তোমরা বোঝো না; নিঃসন্দেহ তিনি ধৈর্যবান ও ক্ষমাবা (১৭ : ৪৪);

যে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ্র শরণ নিয়েছে, আর সে সৎকর্মশীল, সে নিঃসন্দেহ অবলম্বন করেছে যা অবলম্বন করা যায় সে-সবের মধ্যে সবচাইতে নির্ভরযোগ্য বস্তু; আর সব ব্যাপারের পরিণাম আল্লাহর (৩১ : ২২); ইত্যাদি।

_Rationalism (বিচার-বাদ) থেকে এর জন্য কিছু সাহায্য পাওয়া যেতে পারে মাত্র:

…. Religion differs from philosophy as the simple and spontaneous self differs from the reflecting self, as synthetic intuition differs from intellectual analysis. We are initiated into the religious state by a sense of voluntary dependence on, and joyful submission to, the Principle of order and of goodness. Religious emotion makes man conscious of himself; he

* ঈশ্বরগোচর ও ঈশ্বরে-স্থিত জীবনের নাম ধর্ম। ১ অন্তর্লোক যখন অনন্তের বোধের দ্বারা নিষিক্ত তখন তা ধর্ম-ভাবে অবস্থিত বলা যায়।

২৪৯

finds his own place within the infinite unity, and it is this perception which is sacred. (Amiel’s Journal, p. 153).*

৫। আপনার লেখক এবং আপনি নিজে বহুবার বলেছেন, আমরা ইসলাম মানি না অথচ সে-কথা সোজাসুজি বলবার সাহসও আমাদের নেই। কোন্ লাভের আশায় আমরা এমন “মোনাফেক্‌” (ভণ্ড) সেজেছি তা ভেবে পাওয়া বাস্তবিকই দুষ্কর! যদি এইই আপনাদের ধারণা হয়ে থাকে যে, সমাজের প্রবল বিরূদ্ধতার সামনে আমাদের মনোভাব ব্যক্ত করতে আমরা সাহস করি না, তাই আস্তে আস্তে স্বরূপ প্রকাশের চেষ্টায় আছি, তা হলে সমাজের কল্যাণকামী হিসেবে আপনাদের উচিত, আমাদের সেই দুর্বলতার দিকে চোখ না দিয়ে কোন্ দুঃখের আমরা এ পথ অবলম্বন করেছি, সেই সম্বন্ধে অবহিত হওয়া।

আসল কথা, আমরা (বড় হই বা ছোট হই) সাহিত্যিক; আমাদের চারপাশের দুঃখ-বেদনা বাণী খুঁজে ফিরছে আমাদের মনে। সাহিত্য দরদীর কথা। সাহিত্যের সমজদারেরও হওয়া চাই স্বাভাবিক দরদী মানুষ, সাম্প্রদায়িকতার পাণ্ডা নয়। আপনার লেখক তার লেখাটির প্রথম অনুচ্ছেদেই সাহিত্য ও ‘কালচারের লক্ষ্য ও কার্যকারিতা সম্বন্ধে যা বলেছেন, তাতেই বোঝা গেছে বেহালার তাঁত দিয়ে ফাঁসির রজ্জু তৈরির সাধনা তাঁর। খোদা জানেন, এ বিড়ম্বনা ভোগ আমাদের এই দুর্ভাগা দেশের ভাগ্যে আরো কতকাল আছে; কিন্তু এর পেছনে পেছনে “আমীন” বলি, বাস্তবিকই এ ক্ষমতা আমাদের নেই।

সাহিত্যিক ধর্মহীন নন। তবে এ সত্য যে তাঁর ধর্মের ধারণা ও সাম্প্রদায়িকের ধারণা এক পর্যায়ের নয়। মৌলবী মোহাম্মদ আলী কোরআনের একটি আয়াতের

অনুবাদ দিয়েছেন এই

Those who listen to the word and then follow the best of it, those are they whom Allah has guided and those it is who are the men of

understanding. (39:18).

প্রচলিত কথায় যাকে ‘মুসলমানি’ বলা হয়, যাদের ভিতরে তার অভাব দেখে আপনারা আজ নিন্দার ধিক্কারে পঞ্চমুখ হয়েছেন, হতে পারে, সেই অপকীর্তিতদেরই ভাগ্য হয়েছে কোরআনের এই best-এর (শ্রেষ্ঠ অংশের) সাধনায় রত হওয়া।

শ্রাবণ, ১৩৩৭

ধর্মের সঙ্গে দর্শনের সেই পার্থক্য সহজ সরল “আমি”র সঙ্গে চিন্তাপরায়ণ “আমি”র যে পার্থক্য, সংশ্লেষণী সহজ-জ্ঞানের বিচাররত বিশ্লেষণ-বুদ্ধির যে পার্থক্য। বিশ্বজগতের সামঞ্জস্য ও কল্যাণ-বোধে আমাদের স্বতঃপ্রণোদিত নির্ভরতা ও আনন্দময় আত্মসমর্পণের ফলে আমাদের ধর্মভাবে অনুপ্রেবেশ ঘটে। ধর্মভাব মানুষকে তার নিজের সম্বন্ধে চেতনা দান করে, অনন্ত একত্বের ভিতরে সে খুঁজে পায় তার নিজের স্থান, আর এই চেতনাই পরম সম্পদ। * যারা আল্লাহর বাণী শ্রবণ করে, তার পর অনুসরণ করে তার শ্রেষ্ঠ অংশের, আল্লাহর পথ-প্রদর্শন লাভ

করেছে তারাই, আর তারাই হচ্ছে জ্ঞানপ্রাপ্ত।

২৫০

বাংলা সাহিত্যে জাতীয়তার আদর্শ

কিছুদিন পূর্বে কোনো মাসিকপত্রে একটি লেখা পড়েছিলাম-কবি-কঙ্কণ চণ্ডীতে সেকালের বাংলার জাতীয় জীবন কেমন প্রতিফলিত হয়েছে এই সম্পর্কে। লেখক কড়া লোক, অমন সুপ্রাচীন কবি কঙ্কণকেও তিনি খাতির করেন নি মোটেই, বরং তার ভাঁড় দত্ত, কালকেতু প্রভৃতি যে মোটের উপর হীন শ্রেণীর জীব, কোনো জাতির শ্লাঘার বস্তু নয়, এসব কথা এতটুকু আবরু রেখে বলবার প্রয়োজনও তিনি অনুভব করেন নি। আমার আজকার এই লেখাটিও সেকালের বাংলার জাতীয় জীবনের কাহিনী দিয়ে আরম্ভ করা যেতে পারতো, কিন্তু জাতীয়তা’ বলতে সে সজ্ঞান প্রচেষ্টা বোঝায় সেটি যখন বিশেষভাবে একালের তখন প্রাচীন মহাজনদের শান্তিতে বিঘ্ন না ঘটানোই হয়ত শোভন।

একালের বাংলার জাতীয় জীবনের সূচনা রামমোহন থেকে-এ সম্বন্ধে কিছু আলোচনা আমরা অন্যত্র করেছি-কিন্তু একালের বাংলা সাহিত্যে জাতীয় জীবনের সমস্যার আলোচনার সূচনা বোধ হয় ভূদেব মুখোপাধ্যায় থেকেই। তাঁর সতীর্থ রাজনারায়ণ বসু সুবিখ্যাত “হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠতা বিষয়ক প্রস্তাব” লিখেছিলেন, টেকচাঁদ ঠাকুরের হিন্দুত্বের, বিশেষত হিন্দুনারী-জীবনের, আদর্শ বঙ্কিমচন্দ্রের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে পাদ্রীদের মসীযুদ্ধও প্রণিধানযোগ্য, কিন্তু তবু “সামাজিক প্রবন্ধ” ও “পারিবারিক প্রবন্ধের রচয়িতা ভূদেবের স্থান বাংলার জাতীয়তা সমস্যার আলোচনার ইতিহাসে খুব উচ্চে এই জন্য যে, এইসব বইতেই হিন্দুত্বকে বিস্তারিতভাবে যুক্তি-তর্কের দিক দিয়ে দেখতে চেষ্টা করা হয়েছে, প্রতিপক্ষের মত খণ্ডন করবার চেষ্টাও হয়েছে যুক্তি-তর্কের সাহায্যেই- বিশেষত সুপরিচিত হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধানের অভিনব চেষ্টাও

এই সব গ্রন্থে আছে।

একালে ভূদেবের আগে পর্যন্ত হিন্দু-সমাজের উপর দিয়ে বেশ এক ঝড় বয়ে যায়; পারিদের নিন্দা, ব্রাহ্মদের সংস্কার-চেষ্টা, হিন্দু-কলেজের আঘাত, এই ত্রিবিধ আক্রমণে হিন্দুসমাজ নিজেকে বিপন্ন বোধ করে। এ-সবের মধ্যে হিন্দু-কলেজের নব্য হিন্দুর আক্রমণই হয়ত হিন্দু-সমাজকে ব্যতিব্যস্ত করেছিল কিছু বেশী, কেননা They were enemies within the citadel (ঘর-শত্রু); আর এই আঘাতের নিষ্করুণতার জন্যই প্রতিঘাত হিন্দু-সমাজের পক্ষে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে পড়ে। প্রতিঘাতের পদ্ধতি কিছু দিন থেকে সুনির্দিষ্ট হয়ে আসছিল;-ব্রাহ্মদের উপনিষেদের আশ্রয় নেওয়া, বাইবেল থেকে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে যত্নবান হওয়া, রাজনারায়ণ বসুর “হিন্দুধর্মের। শ্ৰেষ্ঠতা বিষয়ক প্রস্তাব,” প্রভৃতিতে এই প্রতিঘাতের অস্ত্রের যোগান চলছিল; এর সঙ্গে শশধর তর্কচূড়ামণির প্রচলিত হিন্দুধর্মের চমকপ্রদ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও সুপণ্ডিত

২৫১

চরিত্রবান ভূদেবের স্বজন-বাৎসল্যের যোগ হলো। মানুষ স্বভাবত রক্ষণশীল; ভূদেব। পর্যন্ত হিন্দু-মনীষার এই যে অভিনব আবিষ্কার দাঁড়ালো যে, হিন্দুধর্ম জগতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম, হিন্দু-সমাজ চূড়ান্ত বৈজ্ঞানিকতার উপরে প্রতিষ্ঠিত, এ-কে পূর্ণ সত্যের মর্যাদা দিতে হিন্দুসমাজের দেরি হলো না আরো বিশেষ করে এই জন্য যে, সত্বরই বঙ্কিম, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের প্রতিভার প্রসন্ন আলোক এই চিন্তাধারার উপরে পতিত হলো।

ভূদেবকে আজো অনেকে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকেন। দুই-একজনকে ঠাট্টা করতেও শুনেছি এই বলে যে, তার ভিতরে নিজের বংশের শ্রেষ্ঠ-ব্রাহ্মণত্বের গৌরব বোধ প্রবল ছিল। কিন্তু এ সত্য যে ভূদেব বাস্তবিকই একালের বাংলার চিন্তাক্ষেত্রে এক প্রবল ব্যক্তি-তাকে সেই চিন্তার ক্ষেত্রে অতিক্রম করে যেতে পারেন এমন হিন্দু (অথবা মুসলমান-মুসলমানেরা স্বভাবত ভূদেব প্রমুখ চিন্তানায়কদের কাছ থেকে তাঁদের স্বধর্মগৌরবের শিক্ষা গ্রহণ করেছেন ও করছেন) দেখি নি বলে অত্যুক্তি হয় না। ভূদেবের এই হিন্দু-ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বিষয়ক চিন্তাই বাংলার একালের মনীষীদের সাধারণ লক্ষণ, বলা যেতে পারে; তাঁদের কেউ কেউ বা জোর দিয়েছেন উপনিষদের উপরে, কেউ কেউ পৌরাণিক হিন্দুধর্মের উপরে, কেউ বা হিন্দু-ইতিহাসের সব-কিছুরই উপরে। অবশ্য আলবেরুনী থেকে আরম্ভ করে একালের রোম রোলা পর্যন্ত অনেক প্রথিতযশাঃ অহিন্দুও হিন্দুসাধনার উচ্চ প্রশংসা করেছেন, আর হিন্দর মতো একটা সুপ্রাচীন সভ্যজাতির ইতিহাসে গৌরব-জনক অনেক-কিছু যে থাকবে, এ যেমন স্বাভাবিক তেমনি সঙ্গত, তবু একালের বাংলা সাহিত্যে হিন্দু-চিন্তানায়কদের আত্মপ্রশংসা যে-রূপ নিয়ে ফুটে উঠেছে ও যে-ফল ফলিয়েছে, তা বুঝতে চেষ্টা করা এ কালের বাংলার জিজ্ঞাসুদের জন্য নানা কারণেই অবশ্য কর্তব্য; পরিবর্তনশীলতা মানুষের ইতিহাসের এক নিত্য লক্ষণ, সেই পরিবর্তন হয়ত কিছু পরিমাণে সুনিয়ন্ত্রিত হতে পারবে এই-সব অনুসন্ধানের সাহায্যে।

আত্মপ্রশংসা-মাত্রই দোষাৰ্হ নয়; অনেক সময়ে আত্মপ্রশংসা আত্ম-বিকাশেরই এক রূপ। গ্রীক, মুসলমান, ইংরেজ, জার্মান, ফরাসী, এদের সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের যে অল্প পরিচয়টুকু ঘটে তারও ভিতর দিয়ে বুঝতে পারা যায়, আত্মগৌরববোধ এঁদের কারো ভিতরে কম নয়। কিন্তু এদের আত্মপ্রশংসার সঙ্গে একালের বাঙালীর আত্ম প্রশংসা মিলিয়ে দেখলে পার্থক্য যেটি সেটি সহজেই চোখে পড়ে। জগতের বুকে দৃঢ়পদে দাঁড়াবার ও বিচরণ করবার ক্ষমতা থেকে উৎসারিত হয় যে একটি সহজ আত্মগৌরববোধ, সেই স্বাভাবিকতার প্রভামণ্ডিত আত্মপ্রশংসা একালের বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ; একালের বাংলা সাহিত্যিকদের আত্মপ্রশংসার মূলে রয়েছে বরং তার্কিকতা-প্রবল প্রতিপক্ষের সামনে নিজেদের বজায় রাখবার একটা চেষ্টা।

তার উপর এই সব হিন্দু সমাজ-তাত্ত্বিকদের সমস্ত চিন্তার মূলে রয়েছে এক শোচনীয় দায়িত্বহীনতা। ভূদেব তো তাঁর কালের ব্রিটিশভারতকেই প্রায় চিরন্তন ভারত

* হিন্দুমুসলমানের বিরোধ, দ্বিতীয় বক্তৃতা, দ্রষ্টব্য

২৫২

ধরে নিয়েছেন। দেশ-রক্ষা ও দেশ-শাসনের বৃহৎ দায়িত্ব রয়েছে সবল শাসকদের স্কন্ধে, সে-দায়িত্ব যে কত বিচিত্র বাস্তবতায় সুকঠোর সে-সম্বন্ধে দেশের চিত্ত সচেতন করবার প্রয়োজনও তেমন অনুভূত হয় নি, এই শান্তির ও স্বস্তির আওতায় কেমন করে একটি সম্মানিত ভব্য ধর্ম-জীবন যাপন সম্ভবপর ভূদেবের অনেকখানি সমস্যাই এই সমস্যা। তাই বাংলার বা ভারতের ভবিষ্যৎ ওজস্বল জাতীয় জীবন ভূদেবের মতো একজন সুপণ্ডিত সচ্চরিত্র সুপ্রসিদ্ধ কিন্তু হ্রস্বদৃষ্টি চিন্তা-নায়কের ঋণ অতি সামান্যই স্বীকার করবে মনে হয়।

ভুদেবের পরে বঙ্কিমচন্দ্র কালানুসারে; কিন্তু বাংলার সর্বসাধারণের উপরে প্রভাব বিস্তারে অগ্রবর্তী বঙ্কিমচন্দ্ৰই-বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভার প্রসন্ন আলোক ভূদেবের চিন্তাধারার উপরে পড়েছিল বলেই তার ঐতিহাসিক মর্যাদা এত বেশী। নব-বাঙ্গালীত্বের স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র এ-সম্বন্ধে দ্বিমত নেই-স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও তার কালের একজন কর্মী বলে নিজেকে পরিচিত করতে অগৌরব বোধ করেন নি। বঙ্কিম প্রতিভাবান, তাই স্বভাবতই তিনি অনেকখানি সত্যাশ্রয়ী। তিনি তাঁর স্বদেশবাসী মুসলমানদের সম্বন্ধে এক জায়গায় বলেছেন-এদেশের যে সব মুসলমান গরু খায় তারা নরাধম; তবু এই অসহিষ্ণু বঙ্কিমচন্দ্রই বঙ্গদেশের কৃষকে’র দুর্দশার কাহিনী লিখেছেন, পুরুষের সঙ্গে নারীর সমান অধিকারের কথা বলেছেন, আর প্রবল ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে যুগযুগাগত জড়তা কাটিয়ে উঠতে নানা ভাবে নির্দেশ করেছেন। বাংলাদেশের সর্বসাধারণের উপরে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব যাই-ই হোক, তাকে বাস্তবিকই যারা বুঝতে চেষ্টা করেন তাদের বুঝতে দেরি হয় না যে, মানব-প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর পরিচয় কত গভীর। কিন্তু তবু কেন সঙ্কীর্ণ হিন্দুত্বের অভিমান তাঁর পরিচয় কত ভিতরে এত প্রবল, তা বহু রকমে ভেবেও আমি নিজে তেমন সুমীমাংসায় পৌঁছুতে পারিনি। হতে পারে স্বভাবদত্ত প্রতিভার তীক্ষ্ণ চঞ্চল আলোকে ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনের অনেক কিছুই তার চোখে প্রতিভাত হয়েছিল, কিন্তু সমগ্রভাবে দেশের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে একটি মহান্ বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত হবার সামর্থ্য তাঁর ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভা সৃষ্টিধর্মী ঠিক নয় যদিও প্রদীপ্ত- একথাটি আপাতত অনেকের কানে রূঢ় শোনাতে পারে, কিন্তু সেদিন হয়ত দূরে নয় যেদিন তার শ্রেষ্ঠ ভক্তরাও বলবেন-জাতীয় জীবনে বঙ্কিমচন্দ্রের নেতৃত্ব অস্বীকার না করলে কাল ও পরিবেষ্টনের সঙ্গে দ্বন্দ্বই হবে বাঙালীর ভাগ্য। বাঙালী বলতে আমরা জাতিধর্মনির্বিশেষে বাংলাদেশের সব লোকই বুঝছি। মুসলমানদের অনেকে বলতে চান বটে তাঁরা বঙ্কিমচন্দ্রের বিরোধী, কিন্তু যে-ভাবে তারা তার বিরোধিতা করতে প্রয়াস পান তা প্রকৃতই তাঁর অনুকরণ। সঙ্কীর্ণ ও উগ্র জাতীয়ত্বই বঙ্কিমচন্দ্রের মন্ত্র, সে-মন্ত্রের মোহ কাটিয়ে উঠবার মতো মানসিকতা আজো দেশের কোনো সম্প্রদায়েরই হয় নি।

বঙ্কিমচন্দ্রের সহপাঠী, কিন্তু অপরিচিত, কেশবচন্দ্র বাংলার জাতীয় জীবনের আর এক দিকের উৎকর্ষ বিধানে ব্রতী হয়েছিলেন-ধর্মের ক্ষেত্রে। কেশবচন্দ্রের প্রতিভা ছিল আশ্চর্য ধরণের। সাধারণত তাঁর রচনায় সাহিত্যিক সৌষ্ঠব খুব বেশী নয়, কিন্তু তার

* দ্র: পঞ্চাশোর্ধ্ব

‘জীবন-বেদ’ বাংলা সাহিত্যে এক পরমোৎকৃষ্ট কাব্য এই হিসেবে যে ধর্মজীবনের আকুলি-বিকুলির এক চমৎকার রূপ ফুটেছে এতে। এ ভিন্ন তাঁরই নির্দেশক্রমে তার প্রচারকবর্গ বিভিন্ন ধর্ম-সাহিত্য মন্থন করে বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারে নব নব সাহিত্য রত্ব দান করেছেন। এই সব প্রচেষ্টার ফলে বাংলার জাতীয় জীবন বৃহত্তর ও গভীরতর হবে এ আশা করা স্বাভাবিক। কিন্তু বিজ্ঞান-প্রভাবান্বিত ঊনবিংশ শতাব্দীতেও কেশবচন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত বেশী mystic (মরমিয়া); তাই তার প্রভাবে বাংলার জাতীয় জীবন ধর্মময় তত হতে পারে নি, যত হয়েছে ধর্মোন্মত্ত; অন্য কথায়, কর্মহীন ও গতিহীন। কেশবচন্দ্রের প্রতিভা কেন এমন একটা অবাঞ্ছিত পরিণতি লাভ করলে এ সম্বন্ধে অনেক কথাই ভাবা যেতে পারে। এর জন্য দোষ কেশবচন্দ্রকে না দিয়ে তার দেশবাসীদেরও দেওয়া যেতে পারে-তারা শুধু তাঁর ভাবোন্মত্ততা না নিয়ে তার জ্ঞান ও কর্মময় জীবন থেকে প্রেরণা বেশী করে গ্রহণ করতে পারতেন। কিন্তু এর জন্য শেষ পর্যন্ত কেশবচন্দ্রকেই দায়ী করা ভিন্ন হয়ত গত্যন্তর নেই। এক বৃহৎ মানব-পরিবারের ধর্মজীবন বলতে যে একটি বিপুল বীর্যবন্ত অভিনব জীবনযাপন বোঝায়, সে-সম্বন্ধে সচেতনতা কেশবচন্দ্রের ভিতরে ছিল না এ সত্য নয়, কিন্তু তবু কেমন করে যেন তিনি সেই অভিনব বিরাট জীবন সর্বান্তঃকরণে চাইতে পারেন নি। সত্য ও কল্যাণের আকর্ষণে কেশবচন্দ্র আকৃষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু সমসাময়িক কালের সুপরিচিত জীবন ধারার জন্য তার মমতা হয়ত তারও চাইতে বলবত্তর ছিল।

কেশবচন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের কথা এসে পড়ে, যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গে হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রমেশচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল প্রভৃতির কথা এসে পড়ে-শুধু পার্থক্য এই যে হেম-নবীন প্রমুখ বঙ্কিমচন্দ্রের অনুবতীরা অনেকখানি শক্তিহীন অনুবর্তী, কিন্তু রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ কেশব চন্দ্রের চাইতে অনেক বেশী আধিপত্য বাংলার জাতীয় জীবনের উপরে বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছেন।

কিন্তু আমাদের আলোচনাস্থল বিবেকানন্দই, রামকৃষ্ণ তেমন নন, কেননা তিনি একালের বাংলার নূতন নর-দেবতা-তার মর্যাদা তাঁর দেবত্বেরই জন্য, নরত্বের জন্য তেমন নয়। তাঁকে এক বড় সমন্বয়াচার্যরূপে দাঁড় করাবার চেষ্টা কেউ কেউ করেছেন, কিন্তু যাঁর মনোজীবন গভীর ও চমৎকার হলেও অল্প-পরিসর তাঁকে নিয়ে এক্ষেত্রে বাদানুবাদ না করাই শোভন।

বিবেকানন্দ সম্বন্ধে মহানুভব রোলা এক জায়গায় বলেছেন-তাঁর প্রতিভার বিরাটত্ব এইখানে যে, জীবনের পর্বত-প্রমাণ দুঃখের সামনে তিনি ভীত হন নি-যে-ভয় হয়ত বুদ্ধদেবেও লক্ষ্যযোগ্য। বিবেকানন্দ নির্ভীক ছিলেন সন্দেহ নেই, মানুষের সঙ্গে একটি সহজ প্রীতির যোগও তাঁর ছিল, তবু মানুষের দুঃখ বুঝবার ধৈর্য তার ভিতরে ছিল তা মনে হয় না। আমাদের মনে হয় বিবেকানন্দ জীবনে একটি সুসামঞ্জস্য লাভ করবার পূর্বেই ইহলোক ত্যাগ করেন। তার ভিতরকার সাহস শেষ পর্যন্ত রয়ে গেছে একটি ব্যক্তিগত সাহস। যাকে বলা হয় বহু জনের জন্য সত্যের আবিষ্কার ও প্রয়োগের সাহস, সে-গৌরব তাকে দিতে পারলে আজ আমরা জাতীয় জীবনে অনেক বিড়ম্বনার হাত থেকে অব্যাহতি পেতে পারতাম।

২৫৪

বিবেকানন্দ সুপণ্ডিত ও সুলেখক; কিন্তু তার প্রধান কীর্তি দেশের বুকে সেবাশ্রমের বিস্তার। এর পেছনে যে আত্মসম্মানবোধ ও স্বদেশবাৎসল্য রয়েছে সেটি আমাদের পরম আনন্দ ও শ্রদ্ধার সামগ্রী। তবু এ-কথা আমাদের ভাবতেই হবে যে, সন্ন্যাস ও ভিক্ষার সাহায্যে দেশের দুঃখ দূর করতে চেষ্টা করা ছেঁড়া কাপড় তালি দেওয়ার চাইতে বড় কাজ নয়। সন্ন্যাস জীবনের বহু অলঙ্কারের এক অলঙ্কার, ভিক্ষার সাহায্যে অর্থনৈতিক অসাম্যের রূঢ়তা ঈষৎ শ্রীমণ্ডিত হতেও পারে; কিন্তু মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সমৃদ্ধিই, ভিক্ষা বা দীনতা নয়। বিবেকানন্দও জাতির জন্য দীনতা চান নি-তাঁর নিজের বেশও দীনবেশ ছিল না। জাতির পরিবেশ ও চিত্ত উভয়েরই সমৃদ্ধির জন্য তিনি যে তেমন বিশেষ আয়োজন করতে পারেন নি, তার কারণ মনে হয় তার অস্থিরতা-স্বসম্প্রদায়ের আশু উন্নতির জন্য অস্থিরতা। এ অস্থিরতা শ্রদ্ধেয় নিশ্চয়ই, কিন্তু এ কথাও ভুললে চলবে না যে, অস্থিরতা সব সময়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধির অনুকূল হয়

, অনেক সময়েই হয় প্রতিকূল।

হিন্দু-মুসলমান-সমস্যা সম্পর্কে বিবেকানন্দের একটি কথা সুবিখ্যাত, তিনি বলেছেন-ভারতীয় জাতীয়ত্বের রূপ হবে ইসলাম-দেহ ও বেদান্তমস্তিষ্ক। কিন্তু কথাটি কিছু সুচিন্তার উদ্রেক করলেও এর ভিতরকার দুর্বলতা অল্পেই চোখে পড়ে। ইসলাম ও বেদান্ত দুয়েরই বর্তমান অনুবতীরা জগৎ-সভায় সম্মানের আসনে আসীন নন-আর সত্যের মর্যাদা সত্যের সেবক থেকেই। তাছাড়া ইসলাম ও বেদান্তের যে-সমন্বয় ভারতীয় জীবনকে জগতে গণনার বস্তু ক’রে তুলবে, সে সময়ের চেষ্টা তিনি বা তার শিষ্যেরা কেউই তেমন করেন নি, করলেও এমন জিনিস হয়ত দাঁড়াতে যা দেখে বেদান্ত-বাদী, ইসলাম-বাদী কেউই খুশি হতে পারতেন না। হয়ত বেদান্তের ভিতরে ইসলাম আছে ও ইসলামের ভিতরে বেদান্ত আছে, তাই জাতির সর্বসাধারণের জন্য প্রয়োজন নানা-বিরূদ্ধতা-খণ্ডিত পুরাতন মতবাদের জোড়াতালি তেমন নয়, যেমন সমসাময়িক জাগতিক জীবনের কল্যাণ-অকল্যাণ, উন্নতি-অবনতি সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা ও অক্লান্ত সাধনা। কর্মী বিবেকানন্দও বাস্তবিকই কর্মী তেমন নন, অনেকখানি খেয়ালী।

উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার প্রায় সমস্ত কর্ম ও চিন্তা-নেতাই জাতীয় জীবনে পরিবর্তনের প্রয়োজন অনুভব করেছেন, বলা যেতে পারে। কিন্তু সে-পরিবর্তন জাতীয় জীবনে প্রকৃতই কার্যকর হবার জন্য যে খুব বড় রকমের হওয়া চাই-হয়ত আমূল-সে বোধ জেগেছে দুই জনের ভিতরে-রামমোহন ও রবীন্দ্রনাথ। এই সম্পর্কে মধুসূদনের নাম করা যায় না শুধু এই জন্য যে, তার ভিতরে জাতীয় জীবন নিয়ন্ত্রণের সজ্ঞান প্রচেষ্টা অতি কম। কেউ কেউ বলতে পারেন-রামমোহন ও রবীন্দ্রনাথের ভিতরেও Scholasticism যথেষ্ট-তারা প্রাচীন শাস্ত্রের নূতন ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন, তাও ব্যবহারিক জীবনে তেমন নয়, চিন্তাক্ষেত্রেই-ফলে প্রাচীন-পস্থিত্ব আমাদের ঘোচে নি। এই ধরণের চিন্তার প্রতি আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা যথেষ্ট, শুধু বলতে চাই-রামমোহনকে এই অভিযোগে অভিযুক্ত করা দুঃসাধ্য, কেননা তার কর্মের আয়োজন সুবিপুল, আর তার দৃষ্টি যে পিছনে নিবদ্ধ নয় সামনে বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত, তা বুঝতে এতটুকুও বেগ পেতে হয় না; আর রবীন্দ্রনাথকে কিছু পরিমাণে অভিযুক্ত করা সম্ভবপর হলেও

২৫৫

তার প্রবণতা কোন দিকে তা বুঝতে না পারা তার দেশবাসীর পক্ষে অশোভন। তার ‘অচলায়তনে’র আচার্য, ‘গোরা’র ‘পরেশ’, চতুরঙ্গের শচীশ, এরা কেউই কূলের শান্তি চান নি, স্রোত ও আবর্তের উপরে নিজেদের সঁপে দিয়েছেন।

কিন্তু তবু এ সত্য যে জাতীয় জীবনের উৎকর্ষ সাধনে রবীন্দ্র-প্রতিভা আশানুরূপ কার্যকরী হয়নি। ভূদেবের স্বস্তি, বঙ্কিমচন্দ্রের উগ্রতা, কেশবচন্দ্রের ভাবোন্মত্ততা, বিবেকানন্দের খেয়ালিত্ব, জাতীয় জীবনের জন্য এ-সমস্তেরই অপকারিতা সম্বন্ধে তিনি যথেষ্ট সচেতন; কিন্তু তিনি যে কবি, মানুষের ও প্রকৃতির সভায় চির-আনন্দময় গায়ক, এই বোধ কর্মীর যোচূবেশ গ্রহণে বারবার তার ভিতরে কুণ্ঠা এনে দিয়েছে। এতে তাঁর সাহিত্যের গৌরব ক্ষুণ্ণ হয় নি, বরং এক হিসেবে বৃদ্ধি পেয়েছে-আত্মপ্রকাশে-ব্যস্ত মানুষের সমাজে এ-কুণ্ঠা কত দুর্লভ-কিন্তু কবির সমসাময়িক বাঙালী জীবন কিছু পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বৈ কি। রবীন্দ্র-সাহিত্যের সার্থকতা তুলিত হতে পারে সুফী সাহিত্যের সার্থকতার সঙ্গে। সুফী-সাহিত্য বহু দেশের বহু ব্যক্তির মনোজীবনে আশ্চর্য সুফল ফলিয়েছে, তবু বৃহত্তর সমাজজীবনে সে-সাহিত্যের প্রভাব আশানুরূপ সুন্দর নয়।

সমাজ-জীবনে রবীন্দ্রনাথের নির্দেশ কিছু সুস্পষ্ট করতে প্রয়াস পেয়েছেন তাঁর প্রতিভাবান শিষ্য শরৎচন্দ্র; আর এ-কার্যে কিছু সাফল্যও তিনি অর্জন করেছেন। তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রন্থ “শেষ প্রশ্ন” উপন্যাস না হতে পারে, একদেশদর্শিতাও তাতে যথেষ্ট, তবু একালের সর্বকল্যাণরোধী হিন্দুত্ব-অভিমান ও তারই পেছনে-পেছনে-আসা মুসলিম-অভিমান তাঁর হাতে যে আঘাত খেয়েছে তাতে দেশের মোহমুক্তির কিছু। সহায়তা হবে আশা করা যেতে পারে।

শরৎচন্দ্রের ধরণের পরিচ্ছন্ন চিন্তা তাঁর সমকালবর্তী দুইজন মুসলমান সাহিত্যিকের ভিতরেও ফুটেছে-একজন কাজি ইমদাদুল হক অপরজন লুৎফর রহমান্ শুধু এঁদের ত্রুটি এই-দেশের আম-দরবারে আসন গ্রহণ করে কথা বলতে এঁরা পারেন নি, অথবা সাহস করেন নি।

যাকে বলা যেতে পারে সুব্যবস্থিত বীর্যবন্ত জাতীয় জীবন তার আয়োজন একালের বাংলার সাহিত্যে ও জীবনে কম হয়েছে আমরা দেখেছি। কিন্তু কিভাবেই বা এ-ক্রটির ক্ষালন সম্ভবপর?

এ-সম্বন্ধে কাগজে-পত্রে সভা-সমিতিতে শুধু জল্পনা-কল্পনাই চলতে পারে, সত্যিকার কর্মারম্ভ অপেক্ষা করছে নবভাববাদ্দীপ্ত কর্মীর। সেই ধরণের একটি জল্পনা কল্পনার অবতারণা করা যেতে পারে।

সত্যিকার জাতীয় জীবনের উদ্দেশ্যে দুটি কর্ম ও চিন্তাধারার কথা সহজেই মনে পড়ে-প্রথমটি, হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান-চেষ্টা, দ্বিতীয়টি, জাতীয় জীবন সুনিশ্চিত অর্থনৈতিক ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত করা। শিক্ষা ও স্বরাজ-সাধনা অর্থনৈতিক সমস্যার অন্তর্গত করে ভাবাই সঙ্গত, আর সেভাবে না ভাবলে শিক্ষা ও স্বরাজ-সাধনা হয়ত শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে ভাববিলাসের ব্যাপারই রয়ে যাবে। আমি নিজে এই শেষোক্ত অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানচেষ্টাই আপাতত বেশী প্রয়োজনীয় মনে করি। জাতিভেদ ও হিন্দু-মুসলমান সমস্যার মীমাংসার ভার আমাদের ভিতরকার ক্রমবর্ধমান

বৈজ্ঞানিকতার উপরে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে-অর্থনৈতিক সুমীমাংসাও এ-সবের সাহায্য করবে।

কিন্তু অর্থনৈতিক সমস্যার সুমীমাংসা তো সহজসাধ্য নয়। সহজসাধ্য নিশ্চয়ই নয়, তবে এর একটি যোগ্য ভিত্তির পত্তন হতে পারে, শাসক ও শাসিত সকলেরই ভিতরে এই চিন্তা যদি প্রবল হয় যে, দেশে অভুক্ত ও কর্মহীন কেউ থাকবে না। উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার সমাজকল্যাণ-চিন্তায় এক একটি মারাত্মক দৈন্য ছিল যে, সমাজ ও রাষ্ট্রকে দুই বিভিন্ন, এমন কি পরস্পর-বিরোধী, শক্তিরূপে কল্পনা করা হয়েছিল; তারই ফলে সেবাশ্রমের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সে-যুগের শ্রেষ্ঠ কর্ম। দেশের রাজনৈতিক অবস্থিতি সম্বন্ধে সূক্ষ্মদৃষ্টি রবীন্দ্রনাথও দেশের রাজশক্তিকে কতকটা বিরুদ্ধশক্তিই ভেবেছেন। কিন্তু রাজশক্তিকে যেমন করেই হোক দেশের সম্পদবৃদ্ধির কাজে লাগাতে না পারলে, দেশের ও সঙ্গে সঙ্গে দেশের লোকের উন্নতি বাস্তবিকই অসম্ভব। আর দেশের এই সম্পদ-বৃদ্ধির কাজে রাজশক্তিরও ব্রতী হওয়া স্বাভাবিক, কেননা সম্পদের প্রয়োজন তার অত্যন্ত বেশী। দক্ষ মাঝি প্রতিকূল হাওয়াকেও বহু পরিমাণে তার কাজে লাগাতে পারে। দক্ষ জাতীয় কর্মীও তেমনিভাবে রাজশক্তির অপ্রসন্নতা সত্ত্বেও তার সাহায্যে জাতীয় জীবনের উৎকর্ষ বিধানে অগ্রসর হতে পারে। এ কল্পনা নয়, ভাগ্যবান দেশের ইতিহাসে জনসাধারণের সঙ্গে রাষ্ট্রের এই দৃঢ় যোগ খুবই লক্ষ্যযোগ্য।

অবশ্য এই অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধিই যে জাতীয় জীবনের উৎকর্ষের জন্য যথেষ্ট তা নয়; আর্থিক স্বাচ্ছল্য জীবনের খুব বড় একটি কাম্য কিন্তু একমাত্র কাম্য নয়। মনে হয় বাংলাদেশে অন্যান্য সৃষ্টির সূচনা কিছু কিছু হয়েছে, এখন সবারই গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থার জন্য সমস্ত দেশ দায়ী, এই চিন্তার ভিতরে আপামরসাধারণের প্রতি যে একটা শ্রদ্ধা ও কর্তব্য-বোধ আছে, তাইই হয়ত বিশেষভাবে সাহায্য করবে আমাদের সমস্ত চেষ্টার সত্যাশ্রয়ী হতে। আর প্রাচীনত্বের অভিমান নয় সত্যাশ্রয়ের প্রয়োজনই আমাদের জন্য অত্যন্ত বেশী-আমাদের সাহিত্য, বীর্যবন্ত জাতীয় জীবন, সব ক্ষেত্রেই।

জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৮

বঙ্কিমচন্দ্র

বঙ্কিমচন্দ্র তার আনন্দমঠে দুই জন মহাপুরুষকে আমাদের সামনে দাঁড় করিয়েছেন-একজন সত্যানন্দ অপরজন চিকিৎসক। এই দুই জনেরই চরিত্রের বৈশিষ্ট্য আনন্দমঠের একটি জায়গায় অল্প কয়েকটি কথায় তিনি সুস্পষ্ট করে তুলেছেন–যেখানে সন্তানদের আত্মদানের ব্যর্থতা লক্ষ্য করে সত্যানন্দ কেঁদে আকুল হয়ে বলছেন, “হায়। মা! তোমারে উদ্ধার করিতে পারিলাম না”….আর চিকিৎসক তাঁর হাত ধরে সুগম্ভীর কণ্ঠে বলছেন, “…চল, জ্ঞান লাভ করিবে চল, হিমালয়ের শিখরে মাতৃমন্দির আছে,

-১৭

২৫৭

সেখান হইতে মাতৃমূর্তি দেখাইব।”-এখানে সত্যানন্দের সুগভীর বেদনা ও চিকিৎসকের সুগভীর স্থৈর্য দুইই আঁকা হয়েছে পরম মনোহারী করে। সত্যানন্দের হৃদয়ের জ্বালা বুঝতে আমাদের এতটুকু দেরি হয় না; আর চিকিৎসকের জ্ঞান ও স্থৈর্যের, সামনে সহজেই আমরা সম্ভ্রমশীল হই।

মনে হয়, বঙ্কিমচন্দ্র ব্যক্তিটি একাধারে এই সত্যানন্দ ও চিকিৎসক। সত্যানন্দের ভিতরে তিনি দেখেছেন কর্ম আর চিকিৎসকের ভিতরে দেখেছেন ধর্ম, আমরা

বলি-সত্যানন্দ অসহিষ্ণু আর চিকিৎসক দৃষ্টিমান।

এই অসহিষ্ণুতা ও সত্যদৃষ্টি–একই সঙ্গে এই দুই প্রায়-পরস্পর-বিরোধী ভাব বঙ্কিমচন্দ্রের ভিতরে কেন প্রবল হলো বলা শক্ত। তবে হয়েছে এ হয়ত মিথ্যা নয়। রবীন্দ্রনাথ কৃষ্ণচরিত্রের সমালোচনায় প্রতিভাবান, বঙ্কিমচন্দ্রের এই অসহিষ্ণুতা (তার ভাষায়-কলহপ্রিয়তা) লক্ষ্য করে দুঃখিত হয়েছেন। যে কেউ কোনো কারণে তার কিঞ্চিৎ বিরাগভাজন হয়েছেন, তাঁকেই তার এই অসহিষ্ণুতার নির্মমতা সহ্য করতে হয়েছে।

শক্তিশালী বঙ্কিমচন্দ্রের এই অসহিষ্ণুতা সম্পর্কে আমাদের একটি বিশেষ কথা মনে পড়ছে। ভারতবাসী যে বারবার পরপদদলিত হয়েছে এতে যন্ত্রণাবোধ তারা কম করে। নি নিশ্চয়ই, কিন্তু কেমন করে যেন সে-যন্ত্রণা তাদের নিজেদের মধ্যেই পরিপাক হয়েছে বেশী। পরিপাক হয়েছে’ কথাটা ব্যবহার করা হয়ত সঙ্গত হলো না, কেমন করে তারা সয়ে গেছে’ আপাতত এই কথাটা ব্যবহার করা যাক। এই ধরণের সয়ে যাওয়া সম্পর্কে মনীষী আলবেরুনী এই মন্তব্যটি করেছেন-”মাহমুদের আঘাতে এদেশের শ্রীসম্পদ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে…হিন্দুরা দিগ্বিদিকে ধূলিকণার মতো বিক্ষিপ্ত হয়েছে…এই সব চূর্ণবিচূর্ণ কণার অন্তরে মুসলিম-বিদ্বেষ নিদারুণ।”-কিন্তু সেই নিদারুণ বিদ্বেষ বিদ্বেষপোষণকারীর অন্তরকেই তো জ্বালিয়েছে বেশী; এ ভিন্ন অন্য ধরণের সার্থকতা কতটুকুই বা তার লাভ হয়েছে।

উপদ্রুত মানুষের চিরন্তন রূপ শেক্সপীয়রের ‘শাইল’-বাইরে কেমন সহনশীলতা, ভিতরে প্রতিহিংসার আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে। অত্যাচারিত হওয়াও বাস্তবিক মানুষের জন্য এক অতি বড় অভিশাপ। কবি মিথ্যা বলেন নি।

…অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে। বঙ্কিম-সাহিত্যে যে সব মুসলিম ইতিহাসের উল্লেখ আছে তার দুই-একখানির সঙ্গে কিছু পরিচয়ের ফলে আমরা বুঝেছি-আজ বঙ্কিমের কশাঘাতে বাংলার প্রতিষ্ঠাহীন মুসলিম যেমন ক্ষুব্ধ ও মিয়মাণ হয়েছেন, বিজেতা মুসলিমের দৃষ্টির সামনে বিজিত হিন্দুও নিজেকে একদিন তেমনি বিপন্ন বোধ করেছিলেন। একটা বড় গাছ অত্যন্ত সহজভাবে পাশের একটা ছোট গাছের জীবন-লীলার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। বিজেতা মুসলিমের সামনে বিজিত হিন্দু যে সেদিন অনেকখানি অস্বস্তি, এমন কি অসম্মান অনুভব করেছিলেন, এ স্বাভাবিক।

২৫৮

পর্যদস্ত ভারতবাসীর যুগযুগসঞ্চিত ব্যথা যদি শক্তিমান বঙ্কিমচন্দ্রের নেতৃত্বে। অভিযান ঘোষণা করে থাকে, তবে এক-হিসেবে তা খুব স্বাভাবিক কাজই হয়েছে। তবে বঙ্কিমচন্দ্রকে আমরা অসহিষ্ণু বলি এজন্য যে, অন্যায়ের তাড়নায় তিনি যা করেছেন তাও অন্যায়, এই অন্যায়ের জের টেনে চলে’ বাস্তবিক কোনো সত্যিকার লাভের আশা নেই, অন্যায় করা ও অন্যায় সওয়া এই দ্বিবিধ পাপের কবল থেকে মুক্তি পাওয়াই মানুষের জন্য কাম্য-এ-চেতনা তার ভিতরে দেখা দিয়েছে ক্ষীণভাবে।

কিন্তু ক্ষীণভাবে হলেও দেখা যে দিয়েছে, এই আমাদের পরম লাভ। তাঁর পরম বেদনার ধন সত্যানন্দকেও তিনি নির্মম হয়ে শুনিয়ে দিতে পেরেছেন-”তুমি বুদ্ধির ভ্রমক্রমে দস্যুবৃত্তির দ্বারা ধন সংগ্রহ করিয়া রণজয় করিয়াছ। পাপের কখন পবিত্র ফল হয় না”-এতেই আমরা তাকে বলতে পারি দষ্টিমান।

মানুষ সর্বস্ব-পণে একেবারে পাগল হয়ে যুদ্ধ করে; কিন্তু সেই যুদ্ধ-কথা উত্তরকালে হয় শিশুর কৌতূহলোদ্দীপক-বয়স্ক মানুষ আর তাতে তেমন আনন্দ পায় না। ভারতের হিন্দু-মুসলমানের কয়েক শতাব্দীব্যাপী রেষারেষি দ্বেষাদ্বেষিও কালে হয়ত অর্থশূন্য কিন্তু অতি-অদ্ভুত ঘটনা বলে মানুষের মনে হবে। তখন জ্ঞানী ও শক্তিমান বঙ্কিমচন্দ্রকে মানুষ ভালবাসতে পারবে সন্দেহ নেই, কিন্তু তার অসহিষ্ণুতা হবে তাদের জন্য পরম কৌতুকাবহ।

ফাল্গুন, ১৩৩৮

শিক্ষা-সঙ্কট

বর্তমান জগতে মানুষের জীবন বড় জটিল ও অস্বস্তিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কি তার জন্য কাম্য, কি নয়, এই নিয়ে পণ্ডিতে পণ্ডিতে মতভেদের আর অন্ত নেই। ধ্রুব বলে কোথাও কিছু আছে কি না এই সংশয় জনসাধারণে পর্যন্ত সংক্রামিত হচ্ছে।

তবু যে-সব দেশ ভাগ্যবান সে-সব দেশে এই বিপদ কাটিয়ে উঠবার চেষ্টাও কম হচ্ছে না। মানুষের এতদিনের জ্ঞান ও বিশ্বাসের সব-কিছুই যদি ঝালিয়ে নিতে হয়, তবে তা নিতে হবে এ-সঙ্কল্প যাঁদের অন্তরে প্রবল তাঁদের জন্য বেশীর ভাগ বিপদ কেটে গেছে বলা যেতে পারে।

কেউ কেউ বলতে পারেন, নানা-অভাবে-জর্জরিত আমাদের এদেশও এই ধরণের এক ভাগ্যবস্ত দেশ। তাঁদের মতে, ভারতবাসী আজ নিষ্ক্রিয় নয়, তাদের সামনে সকল লক্ষ্যের বড় লক্ষ্য রাষ্ট্রনৈতিক লক্ষ্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এসব কথার বিরুদ্ধে কিছু বলতে যাওয়া হয়ত অশোভন। কিন্তু সন্দেহ-কীট যাদের অন্তরে প্রবেশ করেছে তাদের পক্ষে মৌনের মাধুর্য উপভোগ করাও সম্ভবপর নয়। আমাদের দেশের আধুনিক চিত্ত যে

২৫৯

কত বিশৃঙ্খলা-পূর্ণ, তার কিছু পরিচয় পাওয়া যাবে দেশের শিক্ষার অবস্থা একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলে।

যে-ভাষা আমাদের মাতৃভাষা নয় তার সাহায্যে শিক্ষালাভ করলে তাতে অনেক ত্রুটি যে অনিবার্য হয়ে পড়ে এ-বিষয়ে আমাদের দেশের চিন্তাশীলেরা বোধ হয় একমত। এই সমস্যার মীমাংসার চেষ্টাও এতদিনে হয়ত আরম্ভ হতো যদি নানা অনিবার্য রাজনৈতিক কারণে শিক্ষা-সমস্যা আমাদের দেশের লোকদের চোখে নগণ্য হয়ে না পড়ত। কিন্তু শিক্ষার বাহনের সুমীমাংসা হলেও শিক্ষার অবস্থা যে আশানুরূপ সুন্দর হবার পথে দাঁড়াবে, সে-আশায় আশান্বিত হওয়া শক্ত এই একটি কারণে যে, শিক্ষা দান বা গ্রহণ করবে যেমন, তার অবস্থায় যদি কিছু অস্বাভাবিকত্ব থাকে তবে শুধু শিক্ষাদানের ভাষার পরিবর্তনে বাঞ্ছিত ফললাভ না হওয়াই সম্ভবপর। এই সুব্যবস্থিত মনের অভাব নানা কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুপ্রকট হয়ে উঠেছে, এই অভিযোগ আজকাল শিক্ষার্থীদের গুরুজনদের অনেকেরই মুখে শোনা যায়। কিন্তু সমস্যা যদি এই-ই হতো তবে ব্যাপার মোটেই কঠিন হতো না, কেননা জ্ঞানের ক্ষেত্রে যারা প্রবেশার্থী তাদের ক্রটি নগণ্য। এই মনের গন্ডগোল আমাদের দেশে এর চাইতেও জটিল-এ-ব্যাধিতে হয়ত বেশী করে ভুগছেন শিক্ষার্থীদের গুরুস্থানীয়েরাই।

এই ব্যাধি দেশের গুরুস্থানীয়দের আক্রমণ করেছে এই সব দিক থেকেঃ-প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জীবন-যাপন প্রণালীর সংঘর্ষ, একালের প্রাচ্য জীবনে যে-সব চিন্তাধারা ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করছে দেশের বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে সে-সবের কি যোগ সে-সব

অনুধাবনে অনিচ্ছা; দারিদ্র।

অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিকে বলতে শুনেছি, পাশ্চাত্য প্রভাবে আমরা জীবনে আদর্শহীন হয়ে পড়েছি বড় বেশী। কিন্তু পাশ্চাত্য লোকেরা বাস্তবিকই তো আদর্শহীন নন, আর পাশ্চাত্য আদর্শের পরিবর্তে অন্য আদর্শ (তা হোকনা দেশের প্রাচীন আদর্শ) তারা সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করেন না কেন, এ সম্পর্কে কোনো সন্তোষজনক উত্তর তাঁদের মুখে শুনি নি। দারিদ্র্য তাঁদের এ-অবনতির কারণ বলা চলে না, কেননা, যে-সব শিক্ষক দরিদ্র নন আদর্শ নিষ্ঠার অভাব তাদের ভিতরেও কম লক্ষ্যযোগ্য নয়।

কিন্তু পাশ্চাত্য প্রভাব ও দারিদ্র্য আমাদের জীবনে যে-বিশৃঙ্খলা এনে দিয়েছে, তার চাইতে অনেক বেশী বিশৃঙ্খলা এনে দিয়েছে একালে আমাদের দেশে যেসব চিন্তাশীলের জন্ম হয়েছে তাদের প্রভাব। প্রতিভাবান শক্তিমান নিশ্চয়ই কিন্তু তার সাহচর্য বা অনুবর্তিতা করতে হয় সজাগ ভাবে, কেননা শক্তিমান বলেই ব্যক্তিত্বের বিশেষত্ব-বর্জিত তিনি নন, আর সে-বিশেষত্ব যুগ-ধর্মের প্রভাবে গঠিত; তাই এক যুগের মহাপুরুষের অনুবর্তিতা, অন্য যুগের লোকদের করতে হয় যথেষ্ট সচেতন হয়ে, নইলে তাদের জন্য যেটি সবচাইতে বাঞ্ছিত-তাদের যুগে তাদের সমসাময়িক জগতে তাঁদের জীবনকে সার্থক করা-তা থেকেই তারা বঞ্চিত হন। দৃষ্টান্ত থেকে কথাটা বুঝতে চেষ্টা করা যাক। এই বাংলাদেশে রামমোহন থেকে শরৎচন্দ্র পর্যন্ত যেসব শক্তিশালী লোক জন্মেছেন, নানা কারণে তাঁদের একের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য যথেষ্ট, এমন কি, কোথাও কোথাও বিরোধিতা সুস্পষ্ট। এঁদের প্রায় সবারই জীবন থেকে

২৬০

বঝবার ও গ্রহণ করবার অনেক কিছু আছে, কিন্তু সে-কাজটি বাস্তবিক খুব সহজ-সাধ্য নয়। এই সব বিরোধিতা একটি সামঞ্জস্যে রূপান্তরিত করবার চেষ্টা আমাদের দেশের শিক্ষিতেরা যে করেননি তা নয়, যেমন হিন্দুত্বের এক নূতন মহিমা তাঁরা এ-সবে দেখেছেন। কিন্তু এ-দেখা যে সত্য দেখা হয় নি তার প্রমাণ পাওয়া গেল তখন, যখন হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষে হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্ব উভয়েরই এক ঘৃণিত রূপ জগতের সামনে ফটে উঠল।-আর বাস্তবিক জীবন এমনি করেই চলে। একদিনের খাওয়ায় যেমন অন্যদিনের চলতে চায় না, এক যুগের চিন্তায়ও তেমনি অন্য যুগের চলে না।

এই হিন্দু-মুসলমান-সমস্যাও বাংলাদেশে শিক্ষার এক বিশেষ অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একালের বাংলা সাহিত্যে হিন্দুত্বের এক বিভ্রমময়ী ছটা ফুটেছে। সেইখানেই হয়ত এ-কালের বাংলা সাহিত্যের দুর্বলতা। কিন্তু শিক্ষিত মুসলমানের সখ-তারও জন্য বাংলাদেশে ও বাংলা সাহিত্যে এমনি গৌরব-কীর্তন চাই। সে-চাওয়া। কতদিনে সফল হবে, অথবা আদৌ হবে কি না, জানিনা; কিন্তু এর এই এক ফল ফলেছে যে, পাঠ্য-পুস্তকে সব শ্রেণীর লোকের প্রিয় ব্যক্তিদের কাহিনী লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে কথাগুলো হয়ে যাচ্ছে অনেকখানি অর্থহীন; শিক্ষকরাও ভাসা-ভাসা ধরণে সবাইকে ভাল বলে কর্তব্য শেষ করছেন। সার্থক জীবন-যাত্রার জন্য বিচারপরায়ণতা আমাদের চাই-ই, তা যত ভুল-ত্রুটির ভিতর দিয়েই সে-বিচার চলুক-সেই বড় প্রয়োজন শিক্ষকরা এমনি গণ্ডগোলে সমাধা করতে পারছেন না, বা করছেন না।

শিক্ষকরা এই মানসিক বিশৃঙ্খলার জন্য যথেষ্ট অস্বস্তি অনুভব করছেন না কেন তার দুটি কারণ নির্দেশ করা যেতে পারে,-একটি, দেশের রাজনৈতিক গণ্ডগোল, সেই গণ্ডগোলে আত্ম-অম্বেষণ প্রায় অসম্ভব; অপরটি, জনসাধারণের অজ্ঞতা ও ঔদাসীন্য। পুত্রকন্যার শিক্ষাদানে যে-অর্থ ব্যয় তাদের হচ্ছে তার বিনিময়ে তারা কি পাচ্ছেন, এ প্রশ্ন তারা নিজেদের ভাল করে’ করতে পারছেন না এজন্য যে, কিছুদিন আগেও বিশ্ব বিদ্যালয়ের সনদ যোগাড় করতে পারলেই অন্নের ব্যবস্থা একরকম হতে পারত, সেই মোহ আজো পুরোপুরি কাটে নি। শিক্ষার উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন নিশ্চয়ই, কিন্তু সদুপায়ে অর্থার্জনও ঘৃণার সামগ্রী আদৌ নয়। শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি হয় মানুষের ভিতরকার সুপ্ত সৃষ্টিশক্তিরকে সচেতন করা, তবে যে-শিক্ষা মানুষের প্রয়োজনীয় জীবিকা আহরণের জন্য সাহায্য করে না, সে-শিক্ষা কেন আদৌ শিক্ষা নামে খ্যাত হবে, এ-প্রশ্ন জনসাধারণের মনে জাগলে শিক্ষকদের হুঁশিয়ার হয়ে উঠতে হবে অনেকখানি। কিন্তু দায়িত্বও মানুষ গ্রহণ করতে পারে ইচ্ছুক হয়ে বা অনিচ্ছুক হয়ে। দেশের জনসাধারণ যখন দেশের শিক্ষকদের প্রদত্ত শিক্ষার মূল্য যাচাই করতে চাইবেন, তখন সে-পরীক্ষা যদি তারা শ্রদ্ধার ভাবে গ্রহণ করতে পারেন, তবে সেইটিই হবে দেশের জন্য কল্যাণকর।

সমুদ্রগামী জাহাজের জন্য যেমন নাবিক, সমাজ বা দেশের পক্ষেও তেমনি শিক্ষক। আরোহীরা কত বিচিত্র খেয়াল ও খুশীর ভিতর দিয়ে দিন কাটাতে থাকেন, নাবিকরা সে-সব দেখেন, সময় সময় তাদের বুকও আন্দোলিত হয়, তবু জাহাজ চালনা তাদের বড় লক্ষ্য এ-ব্যাপারে ভুল হওয়া মারাত্মক। সমাজ বা দেশের বিচিত্র

২৬১

জীবনযাত্রাও তেমনি শিক্ষকের বুকে স্পন্দন জাগাতে পারে, কিন্তু সর্বাগ্রে তিনি শিক্ষক-মানুষের মনের লালন, শৃঙ্খলা-বিধান, তার বড় কাজ এবং সেই জন্য তিনি স্বদেশপ্রেমিক বা বিশেষ-ধর্ম-প্রেমিক ইত্যাদি যাই হোন, তারও উপরে তিনি বৈজ্ঞানিক, man of science, বিচার-বুদ্ধি তাঁর শ্রেষ্ঠ অবলম্বন-একথা বিস্মৃত হলে মানুষের সেবাও আর তার দ্বারা হয় না।

আমাদের দেশের শিক্ষক-সমাজ আজ মনোজীবী নন, বড়-জোর ভাব-প্রবণ-মনে হয়, শিক্ষা-ব্যাপারে এ এক বিষম সঙ্কট।

মুসলিম সাহিত্য-সমাজের ষষ্ঠবার্ষিক অধিবেশনে পঠিত। চৈত্র ১৩৩৮

মোহাম্মদ আলী।

মওলানা মোহাম্মদ আলীর কথা ভাবতে গেলেই সর্ব প্রথমে চোখে পড়ে তাঁর তেজ। জীবনে দুঃখ ও লাঞ্ছনা তিনি কম ভোগ করেন নি। কিন্তু সমস্ত দুঃখ-ভোগের গ্লানি ছাপিয়ে উঠেছে তার তেজ, আর রসিকতার দীপ্তি ও প্রসন্নতা। বাস্তবিক মোহাম্মদ আলী এমন একজন লোক, শত্রু মিত্র সবাই যার সম্বন্ধে বলতে পারেন- “With all thy faults I love thee still”

মোহাম্মদ আলীকে হারিয়ে মুসলমান-সমাজ বান্ধব-হারা হয়েছে। তিনি মুসলমান সমাজকে যে-ভাবে চালিত করতে চেয়েছিলেন, তাতে তার কতখানি কল্যাণ-সাধন। হয়েছে, অথবা আদৌ হয় নি, সে-সব ভাববার কথা; কিন্তু তিনি যে এ-সমাজের সুন্দর অসুন্দর সমস্ত মানুষকে ভালবেসেছিলেন, তাদের জন্য ধন-মান জীবন-যৌবন পণ। করেছিলেন, শুধু এরই দাম তো কম নয়। ব্যক্তিগত জীবনেই হোক অথবা সামাজিক জীবনেই হোক আত্মভোলা প্রেম তো নিজেই অশেষ-কল্যাণবাহী। আর এই প্রেম সংসারে বাস্তবিকই কত দুর্লভ।

মোহাম্মদ আলী যে শুধু মুসলমানকে ভালবাসতেন তা নয়; জাতিধর্ম নির্বিশেষে তাঁর সমস্ত দেশবাসীকেও তিনি কম ভালবাসতেন না। কিন্তু সেই বৃহত্তর প্রেম বিকশিত করে তুলবার অবসর তিনি হয়ত পান নি। তার নিকটবর্তী মুসলমানের দুর্দশা হয়ত তাঁকে সারা জীবন আকুল করে রেখেছিল বেশী। জানি না, কোন অভিসম্পাতের জন্য জামালউদ্দীন, স্যার সৈয়দ আহমদ, আমীর আলী, মোহাম্মদ আলীর মত প্রতিভাবান ব্যক্তিদের স্বাভাবিক সৌন্দর্য “হায় মুসলিম! হায় ইসলাম!”-এর অশ্রুপাতে জগতের সামনে শ্রেষ্ঠ প্রকাশের সার্থকতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

মোহাম্মদ আলী বহুবার বলেছেন, “প্রথমে আমি মুসলমান, তার পর ভারতবাসী।” জাতীয়তাবাদী হয়েও এ-কথা বলার জন্য ভারতের অন্যান্য

২৬২

জাতীয়তাবাদী হয়ত এখনো তাকে ক্ষমা করতে পারেন নি। কিন্তু এ-কথা বলে বাস্ত বিকই তো কোনো অন্যায় তিনি করেন নি; বরং তার অন্তরাত্মাকে তিনি জগতের সামনে পরিব্যক্ত করেছেন। ইস্লাম বলতে তিনি বুঝতেন মনুষ্যত্বের এক আদর্শ। হজরত মোহাম্মদ সাম্যের ও সমস্ত মানুষের জীবনের মর্যাদার যে-বাণী প্রচার করে গেছেন, তা যে মানুষের জন্য পরম কল্যাণকর এ-বিশ্বাস তার ভিতরে ছিল সুনিবিড়ি। কর্মী তার জ্ঞান-বিশ্বাস অনুসারেই কর্মের আয়োজন করেন। এই-ই স্বাভাবিক ও সঙ্গত। মোহাম্মদ আলী যদি তার অন্তর-প্রদীপের আলোকে নিজে চলতে ও তাঁর স্বদেশবাসীকে চালাতে চেয়ে থাকেন, তবে তিনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কাজই করতে চেয়েছিলেন।

তবে তার সম্প্রদায়ের অনেকের পক্ষে তার এই কথার কদৰ্থ সম্ভবপর। কিন্তু সে কদর্থ তো অনেক কিছুরই সম্ভবপর। সেই জাতির লোকেরাই ভাগ্যবান, যাঁরা তাঁদের প্রতিভাবানদের প্রতিভার আলোকে পথ চলতে চেষ্টা করেন, সেই আলোর স্তবগান করে বা প্রদক্ষিণ করে সময় কাটানো অমূল্য জ্ঞান করেন না।

মোহাম্মদ আলী জাতীয়তাবাদী ছিলেন সন্দেহ নেই। কিন্তু তার চেয়েও হয়ত বেশী ছিলেন (অথবা তাকে হতে হয়েছিল) Pan-Islam-বাদী। জগতে Pan-Islam বাদের অভ্যুত্থান খুবই এক স্বাভাবিক ঘটনা। দেখতে দেখতে সমস্ত মুসলমানরাজ্য অমুসলমানদের করতলগত হচ্ছে-এরই বিরুদ্ধে মুসলমানদের সঙ্বদ্ধ হয়ে বাঁচবার চেষ্টার এক নাম Pan-Islamism.ভারত তাত্ত্বিকের দেশ, Pan-Islam-তত্ত্বেরও ভক্ত যথেষ্ট সংখ্যায় এখানে জুটবে এতে বিস্মিত হবার কারণ নেই। কিন্তু Pan-Islam বাদ দেখতে প্রকাণ্ড হলেও সেই প্রকাণ্ডতার জন্যই এ কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্বল। মুস্তাফা কামাল রেজাশাহ প্রমুখ রাজনৈতিক ধুরন্ধরেরা মুসলিম-জগতকে সে-কথা বোঝাতে প্রয়াস পেয়েছেন। বলা বাহুল্য মোহাম্মদ আলী সে-কথা বুঝতে চান নি অথবা বুঝবার সময় পান নি।

মোহাম্মদ আলী তার স্বপ্রদায় ও দেশকে যেখানে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছেন। সেখান থেকে কোন দিকে এখন তাদের নূতন যাত্রা শুরু হবে তাঁর সত্যিকার ভক্তদের উদ্ৰিত, সেই কথাটি বিশেষভাবে ভাবা। তিনি Pan-Islam বাদী ছিলেন এটি যত শীগগির অতীত ইতিহাসের বিষয় হয়, আর তিনি ধার্মিক অর্থাৎ কল্যাণ-অম্বেষী ও স্বদেশপ্রেমিক ছিলেন এটি যত শীগগির বর্তমানের উপজীব্য হয়, মনে হয়, ততই মোহাম্মদ আলীর প্রতিভা তার যোগ্য সার্থকতা লাভ করতে থাকবে। অতীতের অনেক অতিকায় জীব ধারাপৃষ্ঠে আর বর্তমান নেই। তেমনি অতীতের সাম্রাজ্যবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদেরই দোসর প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ধর্ম-সঙ্ঘ-বাদ, Pan-Islamism তারই একটি) এ-সবেরও হয়ত জগতে আর প্রয়োজন নেই। একালের একজন মনীষী বলছেন;

“Let us live rationally and nationally.”*

* বিচারবুদ্ধি ও জাতীয়তার পথে আমাদের জীবন-নির্বাহ হোক-বার্ণার্ড শ।

২৬৩

মোহাম্মদ আলীর সুবৃহৎ চিত্তে rationalism ও nationalisin-এর যে বীজ লুক্কায়িত ছিল, তাকেই মহীরুহে বৰ্দ্ধিত করে তোলা তাকে যারা ভালবাসেন তাদের আজ হয়ত সবচাইতে বড় কাজ।

১৩৩৮

রামমোহনের বিরুদ্ধ-পক্ষের বক্তব্য

জনৈক খ্যাতনামা সাহিত্যিক সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের Sanskrit Bengali Association-এ “রামমোহন রায়” নাম দিয়ে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেছেন। তাতে তার প্রতিপাদ্য বিষয় এই:- রামমোহন রায়কে বাংলার নব-যুগ ও নবজীবনের গুরু ও

পথনির্দেশক বলা হয়; এই কথাটাই এবারকার শতবার্ষিক অনুষ্ঠানসমূহে অতি উচ্চকণ্ঠে। ঘোষণা করার চেষ্টা হয়েছে; কিন্তু এ-সম্মান তার প্রাপ্য নয়। তার কারণ, প্রথমতঃ, তার চরিত্র এমন নয় যে, জাতির অন্তরের সিংহাসনে তাঁর আসন লাভ হতে পারে, দ্বিতীয়ত, তাঁর যে পৌত্তলিকতা-বিরোধী ধর্ম-মীমাংসা, তা হিন্দু-সাধনার সম্পূর্ণ প্রকৃতি বিরুদ্ধ। এই জন্যই দেখা যায়, পরের হিন্দু-মনীষী (যেমন রামকৃষ্ণপরমহংস, বঙ্কিমচন্দ্র ও বিবেকানন্দ) প্রকারান্তরে তার ঘোর প্রতিবাদই করেছেন। রামমোহন সম্বন্ধে শুধু এই কথা বলা যায় যে, তিনি একজন তীক্ষ্ণবুদ্ধি তার্কিক-তখনকার দিনের জাতীয় সুষুপ্তির ভিতরে কিছু চেতনাবান্ পুরুষ।

যে ভাবে যুক্তিতর্কের সাহায্যে এই গুরু বিষয়ের মীমাংসার পথে অগ্রসর হওয়া উচিত ছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে, তিনি তা করেননি। তার প্রবন্ধে বিচার-পরায়ণতার চাইতে বিশ্বাসপরায়ণতার স্থান লাভ হয়েছে অনেক বেশী। তবে আশা আছে, শেষ পর্যন্ত যুক্তিবিচারের আশ্রয়ই তাঁকে নিতে হবে। তাই বিচারের দিক থেকেই তাঁর ত্রুটি-নির্দেশ কর্তব্য।

১। রামমোহনের চরিত্র সম্বন্ধে যে-সব কথা তিনি বলেছেন, তার প্রমাণ রয়েছে শ্ৰীযুক্ত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের রামমোহন সম্বন্ধে ঐতিহাসিক প্রবন্ধসমূহের মধ্যে। ব্রজেন্দ্র-বাবুর ঐতিহাসিক তথ্যের আবিষ্কার মূল্যবান, কিন্তু তার সিদ্ধান্ত এখনো

অকিঞ্চিৎকর বলেই মনে হয়। তার কারণ, প্রথমতঃ, তা যথেষ্ট তথ্যমূলক নয়, দ্বিতীয়তঃ, রামমোহনের চরিত্র অর্থাৎ মানসজীবন তাঁর রচনায় ও অন্যান্য কার্যকলাপে যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তার সঙ্গে এই-সব নব-আবিষ্কৃত তথ্যের কি সত্যিকার সম্পর্ক তা নিরূপণ করতে চেষ্টা করা হয়নি। ব্রজেন্দ্র-বাবু রামমোহনকে ১৪ বৎসর

শ্ৰীযুক্ত মোহিতলাল মজুমদার। বাংলার জাতীয় জীবন সম্বন্ধে তাঁর চিন্তাধারা পরে তার বাংলার নবযুগ’ গ্রন্থে বিবৃত হয়েছে।

২৬৪

বয়সে স্বগ্রামে ও ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে পিতার জমিদরিতে দেখতে চান। কিন্তু এই সব তথ্যের সঙ্গে রামমোহনের বাল্যজীবনে পাটনায় ও কাশীতে বিদ্যাভ্যাস ও তিব্বত ভ্রমণের সত্যিকার বিরোধ নেই। পিতার টাকা সুদে খাঁটিয়ে তিনি যে অর্থশালী হয়েছিলেন ও পরে এই দান অস্বীকার করেছিলেন এই সিদ্ধান্তেরও প্রমাণাভাব। রামমোহন যৌবনে কিছুদিন কলকাতায় কোম্পানীর কাগজের কেনা-বেচা করে’ অর্থোপার্জন করেছিলেন, দেখা যাচ্ছে। এই ধরণের জীবিকা-অর্জনের চেষ্টা তিনি একাধিকবার অনায়াসেই করতে পারেন। নব-যৌবনে সে-শক্তি ও অবসরের অভাব তার নেই। তার শৈব-বিবাহের প্রতি ইঙ্গিত করে যারা তাঁর চরিত্রের কলুষ প্রতিপন্ন করতে যত্নবান, আশ্চর্যের বিষয়, তারা একথাও স্বীকার করেন যে, তিনি তাঁর এই পত্নী ও তার গর্ভজাত সন্তানদের সম্মানিত জীবন-যাপনের পথ চিরদিন সুপ্রশস্ত রেখেছিলেন। মানুষের চরিত্রের বিচার এত হাল্কাভাবে করতে যাওয়া হাস্যকর, বিশেষ করে, প্রতিভাবানের চরিত্রের বিচার। আর রামমোহনের রচিত অমর সাহিত্য বিদ্যমান থাকতে একজন সাহিত্যিক তার সাহায্যে তার চরিত্রের মর্মোদ্ঘাটনের চেষ্টা না করে

সে-চেষ্টা করছেন শুধু ক্ষণভঙ্গুর ঐতিহাসিক তথ্যের সাহায্যে, এ-দৃশ্য শোচনীয়। রামমোহনের সমসাময়িক জীবন-ধারার প্রভাব যদি তাঁর জীবনে পরিলক্ষিত হয় তবে তার মাহাত্ম ক্ষুণ্ণ হয় না, বরং এক হিসেবে বাড়ে, কেননা, সেই পরিবেশ অতিক্রম করে’ অনেক উঁচুতে তিনি উঠতে পেরেছিলেন।

২। তিনি রামমোহনকে হিন্দু-সাধক বলে স্বীকার করতে রাজি নন। এ-মত সানন্দে তিনি পোষণ করতে পারেন। মহাত্মা গান্ধীর মতো হিন্দুকেও কোনো কোনো পণ্ডিত বলছেন অহিন্দু। বোধ হয় সব সম্প্রদায়ের বিচক্ষণেরাই চিরদিন তাদের শ্রেষ্ঠ বন্ধুদের এই ভাবে অপমান করে এসেছেন। কিন্তু চিন্তাশীল হিসেবে একথা তার মনে স্থান দেওয়া উচিত যে, এ-মত সর্বজনগ্রাহ্য নাও হতে পারে। হিন্দুসাধনায় monotheism নেই monism আছে এই এক কথায় হিন্দু-সাধনার মতো একটি বিরাট ও জটিল ব্যাপার যদি তিনি বুঝে ফেলতে চান, তবে তাঁর সে-চেষ্টাকে প্রশংসাৰ্হ বলতে আপত্তি না থাকতে পারে, কিন্তু তাঁকে সত্যদ্রষ্টার মর্যাদা দেওয়া সহজ হয় না। Monotheism আর monism (একেশ্বরবাদ ও একত্ববাদ) যে পরস্পর-বিরোধী নয়, বরং সাধনার ক্ষেত্রে এ হয়ত একই ঘরের এক কামরা থেকে অন্য কামরায় যাবার মতো ব্যাপার, সে-তত্ত্বের কিছু সন্ধান পাওয়া যায় ইসলামের ইতিহাসে। ইসলাম monotheistic একথা সবাই জানেন, সেই ইসলাম-বৃক্ষের এক অমৃত-ফল monism বাদী মৌলানা জালালুদ্দিন রুমি-সর্বসাধারণ মুসলমান ও আধুনিক বিশেষজ্ঞদের এই মত। তা ছাড়া স্যার রাধাকৃষ্ণন-প্রমুখ দার্শনিকদের লেখায় হিন্দু-সাধনার যে-রূপ ফুটেছে তা দেখে মনে হয়, গভীর জ্ঞান ও গভীর অজ্ঞানতাপূর্ণ যুগযুগান্তরের হিন্দু সাধনার (মুসলমান খ্রিস্টান প্রভৃতি সব প্রাচীন সাধনা সম্বন্ধেই একথা তুল্যরূপে প্রযোজ্য) যা শ্রেষ্ঠ সম্পদ আধুনিক কালে তার পর্যাপ্ত পরিচয় রামমোহন-সাহিত্যেই আছে। ভূদেব, বঙ্কিমচন্দ্র, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ ও গান্ধী হিন্দুসাধনা সম্বন্ধে যে সব কথা বলেছেন, মানুষের জন্য তা কম মূল্যবান্ নয়; কিন্তু জীবনের বহুভঙ্গিমতা ও ক্রমোৎকর্ষের দিকে দৃষ্টি রেখে এঁদের কথার মর্যাদা নিরূপণ করতে গেলে মনে হয়,

২৬৫

হিন্দু-সাধনা সম্বন্ধে রামমোহনের পথনির্দেশই বেশী মূল্যবান, কেননা এঁদের চাইতে রামমোহনের মনীষা শ্রেষ্ঠতর, আর শুধু হিন্দুর নয় অন্যান্য সম্প্রদায় ও জাতির মানুষেরও তিনি বেশী আত্মীয়। সৃষ্টিতে একক নিঃসম্পর্ক বা অপরিবর্তনীয় কিছুই নেই। সেক্ষেত্রে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান প্রভৃতি নামে মানুষ যে কোনো এক কালে পরিচিত হয়েছিল, এইই তার চিরকালের পরিচয় এ-চিন্তার পরিসর এত ক্ষুদ্র যে, একে অসত্য বলা যেতে পারে। যা আছে শুধু তাইই সত্য নয়, যা হওয়া উচিত মানুষের জন্য তাইই বিশেষভাবে সত্য-তা সে-সত্যের উপলব্ধিতে মানুষের যত দীর্ঘকালই ব্যয়িত হোক। বাংলার বুকে হিন্দু আর মুসলমান এই দুই প্রতিবেশী আজ প্রেমহীন নিঃসম্পর্কতায় বিরাজমান, এ সত্য। কিন্তু এ-সত্য যদি চিরন্তন হয় তবে মানুষের।

জীবনের মতো এমন একটি শোচনীয় ব্যাপার জগতে আর নেই।

৩। তিনি বলেছেন, রামমোহনকে ধার্মিক বলা যায় না; অন্য কথায়, তাঁর প্রতিভা ধর্ম-প্রতিভা নয়। ধার্মিক কাকে বলা যায় এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয়, কেননা ধার্মিকদের মধ্যে আস্তিক, নাস্তিক, সংশয়-বাদী, সাকার-বাদী, নিরাকার-বাদী সবাই আছেন। তবে হয়ত এদের সবারই সাধারণ লক্ষণ-কোনো-এক সত্যে সমর্পিতচিত্ততার ভাব। এই সমর্পণ কি রামমোহনে নেই? বরং সংকীর্ণচিত্ত ও অপূর্ণাঙ্গ-মস্তিষ্ক সাধু সন্ন্যাসীর চাইতে দেহ-ও-মনের অপূর্ব-স্বাস্থ্য-সমন্বিত রামমোহনে সত্য ও মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে সমর্পিত-চিত্ততা পরম মনোজ্ঞ হয়েই তো প্রকাশ পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে রোমা রোলা পর্যন্ত যাঁরা রামমোহনের প্রতিভার মাহাত্ম উপলব্ধির চেষ্টা করেছেন, তাঁরাই তার ভিতরকার এই শক্তি ও শান্তি দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। রামমোহন তাঁর রচনায় বারবার এক ঈশ্বরের কথা বলেছেন, এতেই যে তিনি ধার্মিক পুরুষ তা নয়। কিন্তু এই ঈশ্বর তাঁর কাছে একটি শব্দ বা সংস্কার মাত্র নয়। এই ঈশ্বরের উপলব্ধি-চেষ্টাই তাঁর কাছে সমস্ত রকমের মানসিক জড়তা পরিহারের উপায় স্বরূপ। রামমোহনের ঈশ্বর একদিকে অবাঙ্মানসগোচর নিশ্চয়ই, কিন্তু তিনিই আবার তাঁর নিজের ও বিশ্ব-মানবের “সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা”-সদাজাগ্রত। সত্য ও কল্যাণের প্রেরণায় এমন চির-অনুপ্রাণিত প্রতিভাকে ধর্ম-প্রতিভা না বলা, ধর্মবোধ সম্বন্ধে সংকীর্ণ ধারণার পরিচয় দেওয়া মাত্র।

৪। রামমোহনের রাজনৈতিক চিন্তার বিশেষ মূল নেই, এও তাঁর মত, কেননা তার মতে সে-চিন্তা আহৃত চিন্তা, মৌলিকন্তু তাতে নেই। তার জানা উচিত যে, আমাদের। দেশের কোনো কোনো শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে, ঐতিহাসিক-সত্য নিরূপণ, রাষ্ট্রশাসনপদ্ধতি, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর উৎপত্তি ও পুষ্টি, ইত্যাদি বিষয়ে মৌলিক চিন্তা রামমোহনের রচনায় বিদ্যমান রয়েছে। আর ত চিন্তা মাত্রই যে অকিঞ্চিৎকর তা নয়। অনেক সময়ে আহৃত চিন্তাও নৃতন চিন্তা, কেননা, নূতন পরিবেশের প্রয়োজনে তার জন্ম। তা ছাড়া রামমোহন সম্বন্ধে এই বড় কথাটি বিস্মৃত হওয়া উচিত নয় যে, তিনি পন্ডিত যত বড়ই হোন সে-পাণ্ডিত্য তিনি ব্যবহার করেছেন তার চারপাশের লোকদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যার মীমাংসায়। এই যে শুধু পন্ডিত

হয়ে কাজের লোক হবার দিকে তাঁর বেশী ঝোঁক এরই ফলে তাঁর পরবর্তী রাজনৈতিক স্বাপ্নিকদের সঙ্গে তার পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেই দিনে তিনি

২৬৬

বলেছিলেন, জমিদারের সঙ্গে যেমন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হয়েছে প্রজার সঙ্গেও তাই করা হোক- বর্ধিত কর-ভারের চাপে প্রজার প্রাণ যে ওষ্ঠাগতপ্রায়। আজো আমাদের দেশের ক’জন রাজনীতিজ্ঞ দেশের এই ধরণের সমস্যা, এমন সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারেন তাই ভাববার বিষয়। এবারকার শতবার্ষিক অনুষ্ঠানসমূহে রামমোহনের ভাববিলাসবর্জিত স্বদেশপ্রেমের গভীরতা যে অনেকের আলোচনার বিষয় হয়েছিল, এতেই বুঝতে পারা যায়, রামমোহনের প্রতিভার মাহাত্ম উপলব্ধির পথেই তার দেশ অগ্রসর হচ্ছে-যদিও আস্তে আস্তে।

৫। তিনি আর একটি বড় প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন-রামমোহন বাংলা গদ্যের প্রবর্তক কি না। তার বক্তব্য, রামমোহনের গদ্য-রীতির প্রভাব বাংলা গদ্য-রীতির ইতিহাসে আদৌ লক্ষ্যযোগ্য নয়, কাজেই বাংলা গদ্যের প্রবর্তক তাঁকে বলা যায় না। তার একথা অনেকখানি যথার্থ বলে স্বীকার করা যেতে পারে। কিন্তু এ-কথা বলতে গিয়ে রামমোহনকে যে তিনি অসাহিত্যিক প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন, এখানেই খুব বড় একটি ভুল করেছেন। সাহিত্যিক কাকে বলবো?-যিনি তার মনের ভাব সুন্দর ভাষায় ব্যক্ত করতে পারেন। সুন্দর ভাষা কি? যাতে ভাবের প্রকাশ পূর্ণাঙ্গ বা পর্যাপ্ত হয়েছে। রামমোহনের ইংরেজি, ফার্সি এমন কি আরবী রচনায়ও যে উৎকৃষ্ট সাহিত্যিক সৌষ্ঠব যথেষ্ট, এ কথার প্রমাণ দেবার দরকার করে না। তার বাংলা রচনাই অনেক বাঙালীর পক্ষে দুরধিগম্য-মনে হয় আড়ষ্টতায় ভরা। কিন্তু তাঁর ভাষা-সঙ্কেতের ভিতরে প্রবেশ করলে বুঝতে পারা যায়, তাঁর নিজের ভাষায় তাঁর বক্তব্য সুস্পষ্ট তো বটেই, চিন্তার ঋজুতা ও সূক্ষ্মতা ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের তীক্ষ্মতা ও মার্জিতত্ত্বের জন্য স্থানে স্থানে উপভোগ্যও। আমার তো মনে হয়, রামমোহনের অলোকসামান্য মানসজীবনের শ্রেষ্ঠ পরিচয় তাঁর সাহিত্যের ভিতরেই সঞ্চিত রয়েছে-যেমন অন্যান্য সাহিত্যিকের বেলায় ঘটে। ও-সাহিত্য বাস্তবিকই একটি জগৎ। প্রচলিত বাগাড়ম্বরপূর্ণ বাংলা গদ্যের পাশে সংযত-বাক্, সারবান, ক্ষিপ্রগতি কিন্তু অদ্ভুত, রামমোহনী গদ্য মস্তিষ্কবান্ সাহিত্যিকদের। আদরের সামগ্রী। সামান্য পরিবর্তনেই রামমোহনের বাংলা গদ্যের অদ্ভুতত্ব কেটে গিয়ে, তা আধুনিক স্বচ্ছন্দগতি গদ্য হয়ে উঠতে পারে এটিও লক্ষ্য করবার বিষয়। আর একটি কথা, রামমোহনের বাংলা গদ্য যে নিতান্ত নিঃসম্পর্ক তাও হয়ত নয়। রবীন্দ্রনাথের গদ্যের সঙ্গে রামমোহনের গদ্যের কিছু কিছু মিল আছে মনে হয়েছে। সমস্ত বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের একটি বৈশিষ্ট্য আছে। ব্যঙ্গের সেই তীক্ষ্ণতায় ও মার্জিতত্বে হয়ত রামমোহন রবীন্দ্রনাথের পূর্ববর্তী।

প্রতিভা ও সত্য এক কথা নয়। প্রতিভা সত্যের বাহন। তাই কোনো প্রতিভাকে বুঝতে যথেষ্ট চেষ্টা না করা, আর সত্যের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানো প্রায় তুল্যরূপের অপরাধ। এ-অপরাধ আরো গুরুতর হয়ে ওঠে তখন, যখন সেই প্রতিভার সঙ্গে দেশ ও জাতির প্রগতির যোগ গৌণ না হয়ে হয় মুখ্য।

চৈত্র, ১৩৪০

* দ্র: শতবর্ষ’ পরে রামমোহন

২৬৭

জ্ঞান ও প্রেম

…………আপনি ভারতের জন্য চান জাতীয়তাবোধ ও বিচার-পরায়ণতা, Nationalism ও Rationalism.আমাদেরও দেশের জন্য যা কামনা, তার হয়ত খুব বড় কথাটাই এই। তবু আমি হচ্ছি মোটের উপর একজন সাহিত্যিক-সংস্কারক ঠিক নই। সংস্কারের বীজ হয়ত আমার বা আমাদের লেখার ভিতরে আছে, কিন্তু আসলে, জীবনের এক নূতন অনুভূতির প্রকাশ, এই-ই হয়ত আমাদের সমস্ত চেষ্টার মূল কথা। একালের ভারতবাসী আমরা, মুসলমানসমাজে জন্মেছি, সেই নানা বন্ধনে বদ্ধ মানুষ কেমন করে স্বাভাবিক মানুষের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে, মনে হয়, তাই হয়ত একটুখানি ফুটেছে বা ফুটতে চাচ্ছে আমাদের লেখায়। কিন্তু আপনি হচ্ছেন রাষ্ট্রের সাহায্যে সংস্কারের খুব পক্ষপাতী, আপনি বিশ্বাস করেন যে, সেই ভাবেই ভারতের জাতীয় জীবন অর্থপূর্ণ ও উন্নত করা যাবে, এক কথায়, জাতীয়তাবাদী ভারত গড়ে উঠে’ আধুনিক ইয়োরোপের মতো বলবীর্য ও সৌন্দর্য-সম্পন্ন হবে। আপনার বা আপনাদের এই আশার বাদ সাধা আমাদের উদ্দেশ্য তো নয়-ই, বরং এ-ব্রতে সত্যই যদি আপনারা ব্রতী হন তবে আমাদের সম্পূর্ণ সহানুভূতিই পাবেন; কিন্তু তারই সঙ্গে শুধু এই কথাটুকু বলতে চাই, “আমাদের ইয়োরোপের মতো হতে হবে” এই ধরণের চিন্তার ভিতরেই একটি বড় ত্রুটি রয়েছে, তার নাম দেওয়া যেতে পারে ব্যস্ততা, অর্থাৎ কিছু অন্ধতা। ইয়োরোপের মতো হতে চান, বেশ, কিন্তু কেমন করে হবেন? তার যে কতকগুলো সামাজিক ও সংস্কৃতিগত বিধি-বিধান, সে-সবের হুবহু প্রবর্তনা করলেই কি সব হবে? তাই যদি হতো তাহলে ইয়োরোপের সকল দেশের ও আমেরিকার। চিত্তোকর্ষ এক হতো। কিন্তু বাস্তবিকই সে-সব এক নয়, এক রকম দেখালেও ভিতরে ভিতরে যথেষ্ট পার্থক্য। আমি এ-সব দেশের মাত্র সাহিত্যের সঙ্গে কিছু পরিচিত, কিন্তু দেখেছি, সেই সাহিত্যে বিভিন্ন জাতীয় বৈশিষ্ট্য যথেষ্ট প্রস্ফুট, অনেক সময়ে পড়লেই বুঝতে পারা যায় কোন্ দেশের সাহিত্য পড়ছি। আপনি বলেছেন, প্রাচ্যের অতীত মরে’ ভূত হয়ে গেছে, পাশ্চাত্যের অভিজ্ঞতার উপরে আমাদের নির্ভর করতে হবে; কথাটি বেশ সাহস করে বলা, আর অনেকখানি সত্যও এই জন্য যে, কি প্রাচ্য কি পাশ্চাত্য সব দেশের ইতিহাসই মানুষের ইতিহাস, তাই পাশ্চাত্যের ইতিহাসকে যদি নিজের ইতিহাস বলে মনে করেন, তবে অসঙ্গত বা অন্যায় কিছুই করা হবে না। কিন্তু আপনার কথার ত্রুটি এইখানে যে, বাস্তবিকই প্রাচ্য মৃত নয়, মৃত হলে হিন্দু-মুসলমান-বিরোধ অমন জত না। একে মৃত বলে যদি স্বীকার করে চলতে চান তবে পদে পদে যে প্রতিবন্ধকতা পাবেন তাই আপনাকে জানিয়ে দেবে, যে যাকে মনে করেছেন মৃত সে

১ সাংবাদিক আবুলকালাম শামসুদ্দিন-কে লিখিত।

২৬৮

মত নয়। আসল কথা, আমাদের দেশের যে বর্তমান অবস্থা ইয়োরোপকেও এক সময়ে সে-অবস্থার ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে, এমন কি এখনো সেখানে যে ভারতের মতো অজ্ঞতা বা কুসংস্কার নেই তা নয়। তবে জ্ঞানের একটা প্রবল স্রোত সেখানে বইছে, তাই কোথায় কি আবর্জনা আছে তার উপরে তেমন চোখ পড়ে না। আপনি বলবেন, প্রবল রাষ্ট্র-জীবনই হচ্ছে সেই প্রবল স্রোত, যা দেশকে সজীব ও সতেজ রাখে। আপনার কথার প্রতিবাদ করতে চাই না, শুধু এই কথাটুকু বলতে চাই, ইয়োরোপে আজ রাষ্ট্রের যে ক্ষমতা দেখছেন, আগেও কি এই-ই ছিল? ইয়োরোপে যখন ধর্মদ্রোহিতার জন্য মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, তখন রাজশক্তি অথবা জনসাধারণ কি তার পৃষ্ঠপোষকতা করে নি? আমাদের এই ভারতেও আজ যদি রাজশক্তি দেশের লোকের হাতে আসে তাহলে গোরক্ষণ, মন্দির ও মসজিদ রক্ষণ ইত্যাদি সংক্রান্ত আইন পাশ করাবার দিকেই রাজনৈতিক নেতাদের খেয়াল বেশী জাগবেনা কি?

যাকে বলা হয় Initiative (প্রবর্তনা) তা রাজশক্তির দ্বারা না হয় তা নয়; কিন্তু তবু এ সত্য যে, বহুদিন ধরে দেশের লোকের মন তৈরি হওয়া চাই, তার পর চলতে পারে রাজশক্তির কাজ। অর্থাৎ কোনো নতুন বিষয়ে সত্যিকার প্রবর্তনা আসে ব্যক্তির কাছ থেকে; বহুদিন সে হয়ত নির্যাতন প্রতিবন্ধকতা এ-সবই ভোগ করে, তারপর দশজনের কাছে সে-কাজের কদর হয়। আজকাল শিক্ষা সার্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করা দেশে দেশে রাজশক্তির এক বড় কাজ হয়েছে, কিন্তু এর পেছনে রয়েছে কত শতাব্দীব্যাপী কত মহাপুরুষের অশেষ লাঞ্ছনা-ভোগ।

অবশ্য আপনি মনে করবেন না, আজি রাজশক্তির সাহায্যে সংস্কারচেষ্টা অসম্ভব মনে করি। নিশ্চয়ই তা অসম্ভব নয়। কিন্তু যত দ্রুত ফললাভ আশা করেন, বলতে চাই, তা সম্ভবপর নয়। রাজশক্তি খুব বড় শক্তি হলেও মানুষের সমাজ-জীবনের একটি শক্তি, তার অন্যান্য শক্তি সক্রিয় না হলে রাজশক্তি কার্যকরী হতে পারে না।

তাছাড়া আমাদের দেশে সেই রাজশক্তিকে কার্যকরী করাই তো এক বিরাট সমস্যা। ভিতরের ও বাহিরের কত প্রতিবন্ধকতা তাতে। সেই সব প্রতিবন্ধকতার শক্তি হ্রাস করবার কিছু ক্ষমতা সাহিত্যের আছে, কিন্তু সে Propagandist-সাহিত্যের নয় সত্যিকার সাহিত্যের। Propagandist-(বিশেষ-উদ্দেশ্যমূলক) সাহিত্য হচ্ছে এক শ্রেণীর চেঁচামেচি শুনে কখনো কখনো ভ্রম হতে পারে হয়ত ভয়ানক আয়োজন চলেছে, কিন্তু আসলে ফাঁকি। সত্যিকার সাহিত্য কি? যা ব্যক্তিবিশেষের সত্যকার দুঃখ

আনন্দের প্রকাশের ফল

কত প্রাণপণ দগ্ধ হৃদয় বিন্দ্ৰি বিভাবরী জানো কি বন্ধু উঠেছিল গীত কত ব্যথা ভেদ করি!

এ ফরমাসে গড়া যায় না। এর জন্য অপেক্ষা করতে হয়, আর পেলে তার যত্ন করতে হয়। পুষ্টিকর খাদ্য যেমন মানুষের সমস্ত দেহ সক্ষম ও সুন্দর করে তোলে তেমনিভাবে সত্যিকার সাহিত্যের প্রভাবে অনেকটা অজ্ঞাতসারে মানুষের মানস-লোক সুন্দরভাবে গড়ে ওঠে। যে-জাতির ভিতরে সেই মানসলোক গড়ে নি, তার রাজশক্তির

২৬৯

সাহায্যে কতকগুলো বিধি-বিধান পাশ করিয়ে নিয়ে জগৎ-সভায় সুদর্শন হবার চেষ্টা অসার্থক বা অবাঞ্ছিত বলব না, তবে আমার জন্য এ-সাধনা নয়। আপনি হয়ত বলবেন, রাষ্ট্র না হলে সেই বড় সাহিত্য গড়বার ভূমিকা পাওয়া যাবে কোথা থেকে? এ যদি বলেন তবে আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করব, তবু বলব, সত্যিকার সাহিত্যিকের দেশ সব সময়ে তার চারপাশের দেশই নয়।

যারা বলেন, আমাদের দেশকে সত্যিকার মানুষের দেশ করবার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে, দেশের রাজশক্তিকে বিশেষভাবে কার্যকরী করা তারা আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু; আগে ধর্মের যে স্থান ছিল বর্তমানে রাষ্ট্র তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে বা হতে যাচ্ছে এবং এইই সঙ্গত এও আমি সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করি, কোনো রকমের অভিজাত-তন্ত্র আমি চাই

, জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষের কল্যাণ হোক এই আমার কাম্য, তাই সমস্ত ত্রুটি সত্ত্বেও গণতন্ত্র আমার শ্রদ্ধার সামগ্রী, তবু আমি রাজনীতি-বিশারদদের দলের নই, মুক্তিপথের যারা পথিক তাঁদেরই এজন নগণ্য অনুচর। মানুষের জন্য দারিদ্র আমি চাই

, যাকে বলা হয় সমৃদ্ধি তাই-ই আমি চাই-তবু জানি, মানুষের সকল সমৃদ্ধির উপরে জ্ঞান ও প্রেম। মনে হয় এখানেই আপনার সঙ্গে আমার পার্থক্য। তা থাকনা পার্থক্য। আপনার যে-প্রোগ্রাম তাই-অনুসরণ করে চলুন। দেশের ভবিষ্যৎ কি তা কে জানে? যা সত্য বলে জানি, কল্যাণকর মনে করি, তাই-ই আমার করণীয়। God does his business do yours (তার কাজ তিনি করছেন তোমার কাজ তুমি কর), এর বেশী ভার আমার জন্য নয়।

আপনার যে-প্রোগ্রাম (কর্ম-ধারা) তার মূল উদ্দেশ্যটির প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে বুঝতেই পারছেন, কিন্তু এর ভিতরে এমন কতকগুলো কথা আপনি ব্যবহার করেছেন যাতে বোঝা যায়, কতকগুলো ঐতিহাসিক ব্যাপারের যথাযথ মূল্য নির্ধারণের জন্য চেষ্টা আপনি করেন নি। যেমন- রামমোহন ও মির্জা গোলাম আহমদকে এক পর্যায়ে ফেলেছেন, যদিও তাঁদের একজন revealed bookএ (প্রত্যাদিষ্ট গ্রন্থে) বিশ্বাস করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মনে করতেন, অপরজন করতেন না। তা ছাড়া তাদের চেষ্টায় কোনো সত্যিকার ফল লাভ হয় নি, এ বলা অত্যন্ত হাল্কা কথা বলা। আপনি বিচার বুদ্ধির পক্ষপাতী, কিন্তু সেই বিচার-বুদ্ধি কি বলে না যে, মানুষের অবলম্বন শুধু বিচার বুদ্ধি নয়, বরং তার বিচার-বুদ্ধি অনেককিছুর অপেক্ষা রাখে? আপনার কর্মধারার ত্রুটি এই যে, বিরুদ্ধ-শক্তি যে কত বড় শক্তি তা আপনি খুব কমই ভেবেছেন। এ কিন্তু কর্মীর লক্ষণ নয়। যে যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতিত্ব করতে চায়, তার খুব বড় কাজ হচ্ছে বিপক্ষের শক্তি রীতি-নীতি ইত্যাদি সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল থাকা। অবশ্য enthusiasm (উৎসাহের প্রাচুর্য) খুব বড় কথা, কিন্তু শুধু প্রচুর উৎসাহের সাহায্যে কাজ করতে চেষ্টা করা মন্ত্রশক্তির উপরে নির্ভর করারই মতো।

প্রাচীন ভারত বা প্রাচীন ইসলামের চাইতে আমিও বর্তমান ইয়োরোপকে বেশী শ্রদ্ধা করি, তবু, আমাদের ইয়োরোপকে অনুকরণ করতে হবে, একথা বলতে রাজি নই এই জন্য যে, তাতে আমাদের অন্তর্নিহিত সৃষ্টিশক্তি (creativeness) হয়ত কিছু বাধা পাবে। ইয়োরোপ আজ বরেণ্য হয়েছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, নানা দুঃখ-বিপত্তি, বিপুল

২৭০

জ্ঞান-সাধনা, ইত্যাদির ভিতর দিয়ে সে এসেছে বলে। আমাদের জন্যও তাইই পথ। আমাদের যত রকমের মানসিক দৈন্য সব দূর করতে চেষ্টা করতে হবে, মানুষের সর্বাঙ্গীন স্ফুর্তির জন্য প্রাণপণ সাধনা করতে হবে-সেই হচ্ছে আমাদের জন্য সত্যিকার উন্নতির পথ। শুধু এই ভাবে চলেই ইয়োরোপের অনুবর্তিতাও আমরা বিচার-পরায়ণ হয়ে করব। অর্থাৎ ইয়োরোপের কোনো আচার-পদ্ধতি গ্রহণ করব ইয়োরোপের জিনিষ বলে’ নয়, আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় বলে’। মানুষ বিচার-বুদ্ধির পথে চললে কত বড় হতে পারে বর্তমান ইয়োরোপে তারই সূচনা হয়েছে; ইয়োরোপের এই সাধনা সমস্ত মানুষেরই সাধনা, নানা ভাবে এ-কে পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত করে চলা এই-ই বিভিন্ন দেশের সাধকদের কাজ। কিন্তু ইয়োরোপের অনুকরণ করতে হবে এ-কথা বলে মানুষের সেই অনন্তের অভিসারী সৃষ্টিশক্তির প্রতি অবমাননা দেখানো হয়।

এই অনুকরণ করার কথা বলায় অসুবিধাও ঢের। মানুষকে অনুকরণ করতে বলে মোটেই তাকে বেশী উৎসাহিত করে তুলতে পারা যায় না, আর অনুকরণের পথ সোজা মনে হলেও বাস্তবিকই সোজা নয়। ইয়োরোপের কি নেবেন, কার্যক্ষেত্রে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হলে পরিবেশ ইত্যাদির কথা ভাবতে হবে।

আপনি ধর্মের উপর খুব চটা, বুঝতে পারা যাচ্ছে। ধর্মালুতা’ ‘অটল বিশ্বাস এসব সিংহাসনচ্যুত করতে মোটেই আমার আপত্তি নেই। তবু একটি কথা ভাববার আছে। ধর্মের আনুষ্ঠানিক অংশ বাদ দিলেও যাকে বলা হয় ‘ধর্ম-ভাব তাকে বাদ দেওয়া যায় না, কেননা সেই ধর্মভাবের অর্থ হচ্ছে জীবনকে গভীরভাবে নেওয়া, মানুষের বা জগতের প্রতি প্রেম-পরায়ণ হওয়া, এ না হলে কর্মশক্তিই তো জাগে না। এ দিক দিয়ে দেখলে অনেক নাস্তিকও ধার্মিক। টলস্টয় ধর্মবোধের খুব সুন্দর এক সংজ্ঞা দিয়েছেন

Religious perception is nothing else than the first indication of that which is coming into existence, namely, a new relation of man to the world around him-What is art?”

‘প্রাচ্যের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি আপনি চান না। বেশ। যারা বৈশিষ্ট্য রক্ষার জন্য ব্যস্ত তাদের চাইতে আপনার সঙ্গে এ ব্যাপারে আমার যোগ বেশী। তবু বলি, বৈশিষ্ট্য চাইবার বা না চাইবার জিনিষ নয়, ও আপনিই হয়, যেমন এক পিতামাতার সন্তানও এক চেহারার হয় না। চাষীর কাজ জমি ভাল করে চষা ও ভাল বীজ ছড়ানো, তারপর সোনার ফসল ফলে। আমাদেরও কাজ, সমস্ত মোহ (প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সব মোহ) থেকে যথাসম্ভব মুক্ত হয়ে সত্য ও কল্যাণের বীজ দেশে ছড়ানো। তারপর ইয়োরোপের সঙ্গে ভারতের পার্থক্য হবে কি না, সেটি নিয়ে মাথা ঘামাতে অন্ততঃ আমি নারাজ। হয় হবে, না হয় না হবে।

চিত্র-হওয়াই সম্ভব।

আপনি ‘মোল্লা-পুরোহিতের নিশ্চিহ্ন ধ্বংস চেয়েছেন। কিন্তু চাইলেই কি ধ্বংস হয়? আমি বলি, দেশে জ্ঞানের দীপ জ্বলুক, সে-আলোর সামনে মোল্লা-পুরোহিত যদি তিষ্ঠোতে না পারে, ভাল পারে, তাতেও আপত্তি নেই। আপনি যাকে বলেছেন মোল্লা

* চারপাশের জগতের সঙ্গে মানুষের নৃতন নূতন সম্পর্ক সম্বন্ধে প্রথম চেতনার নামই ধর্ম-বোধ।

২৭১

পুরোহিত সেটি আসলে আমাদের দেশের বহু-বিস্তৃত অজ্ঞতার পরিচয়-চিহ্ন। কতকগুলো মোল্লা-পুরোহিত না হয় কোতলই করলেন, কিন্তু যে-অজ্ঞতার জলাভূমিতে মোল্লা-পুরোহিত গজায় তার ধ্বংস যদি না করতে পারেন, তবে মোল্লা-পুরোহিতের উপরে খাপ্পা হয়ে লাভ? কিন্তু মানুষের সেই অজ্ঞতা দূর করা সোজা কাজ নয়, এক দিনের কাজ তো নয়ই।

তবু আপনাদের মোল্লাদের বিরুদ্ধে প্রচার আমি অশ্রদ্ধার চক্ষে দেখি না। বেশ, করুন। শুধু এই বলতে চাই, ওতে বেশী কাজ হবে না, অথবা ও-কাজ করবার সামর্থ্য বা প্রবৃত্তি আমার নেই। মোল্লাদের বিরুদ্ধে প্রচারের চাইতে দেশের শিক্ষা-ব্যবস্থার উৎকর্ষ বিধান করতে আপনারা যদি আগুয়ান হন, তবে আমার বেশী সহানুভূতি পাবেন।

আমার বিরুদ্ধে আপনি হয়ত এই বড় অভিযোগটি আনতে পারেন যে, আমি মানুষের ভুল-ভ্রান্তিপূর্ণ কাজের ধারার প্রতি অশ্রদ্ধা জানিয়ে প্রকারান্তরে নিষ্ক্রিয়তাই সমর্থন করছি। কিন্তু এ আমার বিরুদ্ধে সত্য অভিযোগ হবে না এই জন্য যে, আমিও জানি-কাজ মাত্রই ভুলভ্রান্তিপূর্ণ, তবু সেই ভুলভ্রান্তিপূর্ণ কাজের ভিতর দিয়েই মানুষের সত্যিকার কলাণের পথ। আপনাদের কাজের ধারা পুরোপুরি আমার মনঃপূত নয় এইজন্য যে, আপনারা ভুলভ্রান্তি এড়িয়ে চলবার জন্য যথেষ্ট অনুরাগ দেখাচ্ছেন না। মানুষ ভুল খুবই করে সেই জন্যই সে নিন্দনীয় নয়, কিন্তু নিন্দনীয় তখন, যখন সত্যকে

জানবার জন্য বরণ করবার জন্য আগ্রহ তার কম।

ত্রুটি সকলেরই আছে, তবু যদি কারো ভিতরে আমরা দেখি কিছু পরিমাণ সাধনা, কল্যাণের পথে চলবার আগ্রহ, তাতেই আমাদের আনন্দিত হবার কারণ ঘটে।

শুধু আমার প্রার্থনা-আপনার বা আমাদের এই চলবার সঙ্কল্প প্রবল হোক, সক্রিয় হোক। মতামত মানুষের খুব বড় জিনিষ নয়, বড় জিনিষ হচ্ছে সেই মতামত সার্থক করবার জন্য তার আয়োজন, কেননা, সেই আয়োজনেই ফুটতে পারে তার ব্যক্তিত্ব-আর এই ব্যক্তিত্ব থেকেই রূপ পায় সব মতামত; নইলে, মতামত কথামাত্র।

১৩৩৭

দিদারুল আলম-স্মৃতিবার্ষিকী

….এবারকার স্মৃতি-সভায় যোগদান করা বাস্তবিকই আমার পক্ষে সম্ভবপর হলো না। সেজন্য দুঃখ করে লাভ নেই; বাইরের ঘটনার উপরে আমাদের কতটুকুই বা হাত। কিন্তু আমাদের পরমপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয় দিদারুল আলমের স্মৃতি-উৎসবের প্রত্যেক অনুষ্ঠানে

আমি আপনাদের একজন, এ-কথাটি বিস্মৃত হবেন না।

* সাহিত্যিক মাহবুব উল-আলমকে লিখিত।

২৭২

উৎসব কথাটি ইচ্ছা করেই ব্যবহার করেছি। মৃতের স্মরণে শোকের নব উদ্রেক-সে তো স্বাভাবিক; সেই শোকে মাতা-ভগিনীর যে বেদনা-কাতর মুখচ্ছবি মানব-জীবনে সে হয়ত ‘রহমত; কিন্তু নব যৌবনে মৃত্যুর কারণে আমাদের বন্ধুর লাভ হ’য়েছে চির-যৌবন, ব্যধি দুঃখ আজ সে-যৌবনে নিশ্চিহ্ন, সে-যৌবন শুধু আশা ও সাহসের এক অফুরন্ত উৎস। যতক্ষণ আমাদের দেহে-মনে যৌবন প্রজ্বলিত, সৌন্দর্যে আনন্দ দুঃখে অভয়, ক্ষতিতে সাহস যতক্ষণ আমাদের জন্য সত্য, ততক্ষণ মৃত্যু লাঞ্ছিত দিদারুল আমাদের জন্য শোকাবহ নন প্রাণবহ-জরা ও জীর্ণতাভরা পরিবেষ্টনে আশা এ অভয়ের মূর্তি।-এরই নাম তো উৎসব।

চট্টগ্রাম দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, আর সে-দেশ আমার ভালো লেগেছে। আরো ভালো লেগেছে তার বুকের মানুষগুলো। জীবন তাদের জন্য এখনো যেন অনেকখানি সরস ও স্বাভাবিক, তত্ত্বের ঢাকায় রূপহীন বর্ণহীন হয়ে পড়ে নি। দিদারুল আলম সেই পার্বতী চট্টলার এক অকতোভয় সন্তান। চট্টগ্রামে আরো কয়েকজন প্রাণবন্ত ব্যক্তির পরিচয় পেয়ে আনন্দিত হয়েছি। মনে হয়, জীবনের আস্বাদ চট্টগ্রাম যেন বাংলাকে কিছু কিছু শেখাতে পারবে।

আজকার দিনে যারা দিদারুলকে বিশেষভাবে স্মরণ করতে চান তাঁদের প্রত্যেকেরই জন্য সত্য হোক তার জীবনের মর্মকথা। তিনি ধর্ম বলতে বুঝতেন সমস্ত মানুষের কল্যাণ, আর কর্ম বলতে বুঝতেন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত দেশবাসীর মঙ্গল-সাধন। আজ আমাদের এই অন্ধ ও ভীরুর দেশে সত্য হোক আমাদের এই লোকান্তরবাসী বীরের অকুণ্ঠিত কল্যাণ-জিজ্ঞাসা; যে-কল্যাণজিজ্ঞাসায় তিনি পণ করেছিলেন তাঁর জীবন ও যৌবন। দেশের যে-সমাজে তিনি জন্মেছিলেন সে-সমাজ আজো দিশাহারা-হয়ত বৃহত্তর দেশও দিশাহারা। কিন্তু সেটি বাস্তবিকই তেমন ভাবনার কথা নয়। বৈজ্ঞানিক তার ক্ষুদ্র কক্ষে বসে যদি তার অনুসন্ধানে সফলকাম হতে পারেন তবে তিনি জানেন, সমস্ত জগতের ভ্ৰমান্ধকারের পাশে তিনি স্থাপন করতে পেরেছেন। জ্ঞানালোকের কণিকা; সামাজিক কর্মীও তেমনিভাবে যদি নিঃসন্দেহ হতে পারেন, তার অন্তরের প্রেম ও কল্যাণ-চিন্তা সম্বন্ধে তা হলে জগতের বিপুল দুঃখ-ব্যর্থতার সমুদ্রে এতটুকু অবলম্বন মানুষের জোটে। A good man is a great man” (সদাশয় যিনি তিনি মহান) কথাটি সত্য।

আজকার স্মৃতি-বাসরে আমাদের সবারই চিত্ত সত্যের প্রতি ও মানুষের প্রতি প্রেমে উদ্বুদ্ধ হোক, অন্যায় ও অসুন্দরের বিরুদ্ধে চিরসংগ্রামে নূতন তেজ লাভ করুক, এই প্রার্থনা করি।

২৮ ডিসেম্বর ১৯৩০

১ দিদারুল আলম রেঙ্গুন থেকে দু’খানি কাগজ চালাতেন। বাংলা গদ্য ও পদ্য দুয়েতেই তার হাত

ছিল। অসংকীর্ণ মতবাদের জন্য তাকে নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছিল। ১৮

২৭৩

বিপ্লব

..হঠাৎ দেরাজের ভিতর থেকে তোমার একখানি পেন্সিলে-লেখা বড় চিঠি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তার তারিখ ১৬-৮-৩১। তার কি উত্তর তখন দিয়েছিলাম, মনে পড়ছে না। কিন্তু চিঠিখানিতে এমন দুটি বড় সমস্যার প্রতি তুমি ইঙ্গিত করেছ, যার আলোচনা বারবার করাও সঙ্গত বৈ অসঙ্গত নয়।

আমার যে মত, বিপ্লব মানুষের সমাজের এক ব্যাধি সুতরাং মানুষের জন্য কাম্য নয়, তোমারও ধারণা হয়ত এইই; তবু Wordsworth-এর মতো লোকও তাঁর Prelude কাব্যে Residence in France নামের পরিচ্ছেদগুলোয় বিপ্লবের স্তুতি অনেকখানি গেয়েছেন এতে তোমার একটু খটকাও লেগেছে।

কোনো মতামতই হয়ত খুব জোর করে দেওয়া যায় না-তাতে শুধু জোর প্রকাশের সম্ভাবনাই বেশী। মানুষের মতামত তার ব্যক্তিগত নীতিরুচি শিক্ষাদীক্ষা ও অভিজ্ঞতা ইত্যাদির সঙ্গে এমন নিবিড়ভাবে জড়িত যে, তাকে এক সনাতন সত্য বলে প্রচার করা বাস্তবিকই বিপজ্জনক। কিন্তু ব্যক্তিই তো হচ্ছে সমাজের আত্মপ্রকাশের এক একটি উৎস-মুখ, তাই যে-সব মতামত ব্যক্তির অন্তরতম কথা, সে-সবের যথাযোগ্য রূপ দিতে চেষ্টা না করাও সমাজেরই প্রতি ব্যক্তির এক মহা অপরাধ।

বিপ্লব কাকে বলবে? ধোঁয়াতে ধোঁয়াতে হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল-এ তো জগতের নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু যে-বিপ্লব বিপ্লবীদের কামনার ধন, এ তা নয়। বিপ্লবীরা মোটের উপর চান বিশৃঙ্খলা। চারদিকের এই বিরাট ভাঙার ভিতরে তাঁদের মাথা ঠিক থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে, কিন্তু সেইটি বিপ্লবের বড় কথা নয়; বড় কথা হচ্ছে সর্বত্র একটি বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি, আর তারা বিশ্বাস করেন, সেই বিশৃঙ্খলার ভিতর দিয়ে এক সুন্দরতর ভবিষ্যতের জন্মলাভ হবে। বিপ্লবীরা এক ধরণের mystic-realistic (সত্যাশ্রয়ী), তাঁরা যত তার চাইতে mystic (দুয়েতাবাদী) অনেক বেশী।–এইখানে বিপ্লবীর পথে আর আমার পথে এক দুস্তর ব্যবধান। এক সর্বব্যাপী বুদ্ধিনাশের চর্চার ভিতর দিয়ে মানুষের সমাজের কোনো শ্ৰেয়লাভ হতে পারে এ-তত্ত্ব আমার জন্য বাস্তবিকই দুরধিগম্য।

আশা করি তুমি বলবে না আমি বিপ্লবের অপব্যাখ্যা করছি।

বিপবের মদষ্টা আর বিপ্লবের আয়োজন-কর্তা এ দুয়ের পার্থক্য কিন্তু যথেষ্ট। বিপুবের মন্ত্রদ্রষ্টা মোটের উপর একজন স্বাভাবিক চিন্তাশীল মানুষ; মানুষ হাড়িয়ে হাৎড়িয়ে জীবনের জটিল পথে পথ খুঁজে চলে, তার ভিতরেও সেই চলারই ভঙ্গিমা। বিপ্লব-কর্তাকেও যে ইতিহাসের ধারায় তেমনি এক পথচারী রূপে না দেখা যায় তা নয়;

*

কবি আবদুল কাদিরকে লিখিত।

২৭৪

তবে ভালো-মন্দের বিচার আমাদের না করে তো উপায় নেই, তাই বিপ্লবের মন্ত্রদ্রষ্টা ও বিপ্লবের কর্তা-সমাজের উপর এ দু’য়ের প্রভাবে যে-পার্থক্য তা আমাদের ভালো করেই লক্ষ্য করতে হয়। আমার সমস্ত অভিযোগ এই বিপ্লব-কর্তাদের বিরুদ্ধে; ঠিক ঠিক বলতে গেলে, এঁদের কর্মপদ্ধতির বিরুদ্ধে।

অবশ্য অহিংসা ও হিংসা এ-দু’য়ের এক যোগ্য সামঞ্জস্যসাধন খুবই কঠিন। ব্যাপার। তবু মনে হয়, মানুষের এতদিনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও সাধনার পরও হিংসাকেই মানব-সমাজে কার্যোদ্ধারের শ্রেষ্ঠ অবলম্বন রূপে গণ্য করলে মানুষকে পশু ভিন্ন আর কিছু তেমন মনে করা হয় না। আর মানুষ যদি পশুই হয় তবে বিপ্লবের

অন্তর্নিহিত সত্যের সন্ধানে কিইবা প্রয়োজন।

আর একটা কথা বলতে হবে; Wordsworth যে তার Prelude এ বিপ্লবের স্তুতি গেয়েছেন এ হয়ত ঠিক নয়। Liberty’-র (স্বাধীনতার জন্য তাঁর প্রেম অপরিসীম, এই কথাই Prelude-এ বলা হয়েছে মনে হয়। বড়জোর তিনি বিপ্লবের মন্ত্রদ্রষ্টাদের দলের। কিন্তু তিনি যে বিপ্লবের আয়োজন-কর্তাদের কেউ নন্ একথা তিনি খুব বেশী স্পষ্ট করে

বলেছেন।

তোমার অপর কথাটিও বেশ ভাববার মতো কথা-”If you would succeed you must not be too good” যদি সফলকাম হতে চাও, তবে অতিরিক্ত ভাল হয়ো না। কিন্তু সফলকাম হবে কি ভাবে? Napoleon-এর সাফল্য আর Wordsworth বা গ্যেটে বা Shelley-র সাফল্য তো এক পর্যায়ের নয়। আমার তো মনে হয়, কতগুলো সফলতা আছে যা লাভের জন্য অতিরিক্ত ভাল হওয়া চাই কি না বলতে পারি না, তবে ভাল হওয়া চাইই। তার উপর, যারা বাস্তবিকই সফলকাম হন তারা সফলতার আরাধনা করেন না। হয়ত একটু-আধটু তার কথা ভাবতে পারেন, কিন্তু সেটি নগণ্য ব্যাপার। তাঁদের আসল কাজ হচ্ছে আত্ম-নিবেদন, অসীম প্রয়াস- taking infinite pains’-আর তাতেই তাদের এক নিগূঢ় আনন্দ ……..

সেপ্টেম্বর, ১৯৩১

বাংলা সাহিত্যের মুসলিম ধারা

আমাদের কোনো সাহিত্যিক এবার বাঙালী মুসলমানের সাহিত্যসাধনার ইতিহাস সম্বন্ধে কোনো রচনা পাঠ করবেন কি না জানি না। কিন্তু বাস্তবিকই এ একটি বিষয় এবং এ বিষয়ে বিশেষভাবে ভেবে দেখবার সময় উপস্থিত হয়েছে। সেকালের বাংলা সাহিত্যে মুসলমান সাহিত্যিকের দান নগণ্য নয়, বরং এক হিসেবে গৌরবের, অথচ একালের মুসলমানসমাজ যেন বহুদিন পর্যন্ত ভাবতেই ভরসা পান নি যে, তাদের কোনো সাহিত্যিক এমন কিছু রচনা করতে পারেন, যা দেশের সর্বত্র এতটুকু সমাদর লাভ করতে পারে; আর কতকটা এই দুঃখে তাঁদের কেউ কেউ ব্যবস্থা দিয়েছেন-বাংলা বাদ

২৭৫

দিয়ে উর্দুকেই বাঙালী মুসলমানের মাতৃভাষারূপে ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু এবিষয়ে আপনাদের সন্তোষ সাধন করবার সঙ্গতি এখনো আমার লাভ হয় নি। দুই একটি কথা বলে আপনাদের কৌতূহল উদ্ৰিক্ত করতে চেষ্টা করব মাত্র।

বাঙালী মুসলমানের সেকালের সাহিত্য-চৰ্চা প্রধানতঃ তিন ভাগে ভাগ করে দেখা যেতে পারে-অনুবাদ-সাহিত্য, গাথা-সাহিত্য ও মারফতী সাহিত্য।

‘পুঁথি সাহিত্য’ নামে যে বিরাট ‘মুসলমানী’ সাহিত্য আছে তা অনুবাদ সাহিত্যের অন্তর্গত করে আমরা দেখতে চাচ্ছি। বলা বাহুল্য এই পুঁথি সাহিত্যের খুব কম গ্রন্থই অনুবাদ, অধিকাংশই পূর্ববর্তী গ্রন্থের অনুসরণ মাত্র, কতকগুলো তাও নয়, প্রাচীন কাহিনী, কিংবদন্তী, প্রভৃতির সংগ্রহ। এই পুঁথি সাহিত্য সম্বন্ধে বিশেষ আলোচনা আজও হয় নি। আমাদের জনৈক তরুণ সাহিত্যিক পুঁথি সাহিত্যের নায়িকার রূপ-বর্ণনায় যে যথেষ্ট চটুলতা আছে, তা দেখাতে চেষ্টা করেছেন। আমি নিজে এই সাহিত্যের সঙ্গে তেমন পরিচিত নই। তবে যেটুকু পরিচয় লাভ করেছি, তাতে খুশি হতে পারিনি আদৌ। চিন্তা, কল্পনা, রচনা, সমস্তেরই বড় বেশী দৈন্য তাতে চোখে পড়েছে। সুপ্রসিদ্ধ পুঁথি ‘কাছাছল আম্বিয়া’তেও এমন কিছু পাইনি যাকে বলা যেতে পারে চিত্তাকর্ষক। অথচ বাইবেলের ওল্ড-টেষ্টামেন্ট-এর কাহিনী চমৎকারিত্বে পরিপূর্ণ, আর কোরআনের নবী-কাহিনী গভীরভাবে আল্লাহতে সমর্পিতচিত্তদের কাহিনী, স্থানে স্থানে কবিত্বময়ও বটে। কিন্তু মনে হয় “কাছাছল আম্বিয়া”র লেখক বা লেখকগণ দৈববলের অদ্ভুতত্বে বিশ্বাসী ভিন্ন আর কিছুই নন। জীবনের মাহাত্ম মর্যাদা ইত্যাদি সম্বন্ধে কিছুমাত্র ধারণা

যে তাদের ছিল তা বিশ্বাস করতে ভরসা হয় না।-তবে একথা বাংলার প্রাচীন সাহিত্যের অনেকখানি সম্বন্ধেই বলা যেতে পারে।

অনুবাদ-সাহিত্যে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান কবি আলাওলের। অন্তত এই-ই অনেকের মত। তিনি প্রকৃতই পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। এতখানি পাণ্ডিত্য নিয়ে আর কোনো মুসলমান বোধ হয় বাংলা সাহিত্যে লেখনী ধারণ করেন নি। সৌন্দর্যবোধও তাঁর ছিল। তাঁর ‘পদ্মাবতী’ পড়তে গিয়ে অনেক সময়েই মনে হয় বিদ্যাপতি ও ভারতচন্দ্রের কথা। কিন্তু সত্যিকার কবি হিসেবে আলাওলের স্থান এঁদের নিচে।

মোটের উপর অনুবাদ-সাহিত্য সত্যিকার সাহিত্য হিসেবে তেমন কিছু নয় বলেই মনে হয় যদিও এ-সাহিত্যের বহুল প্রচলন মুসলমান সমাজে ছিল। এই অনুবাদ সাহিত্যের চাইতে গাথা-সাহিত্যে প্রাচীন মুসলমানের দান অনেক উঁচু দরের।

মুসলমানের রচিত গাথা-সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ বোধ হয় ‘মৈমনসিংহ গীতিকার ‘দেওয়ানা মদিনা। গ্রাম্য ভাষায় এই গাথা রচিত; কিন্তু রচয়িতা সত্যিকার কবি বলে তার সৃষ্টি তাতে স্নান হয় নি। স্বামী কর্তৃক অকারণে পরিত্যক্ত প্রেমময়ী কৃষককন্যা মদিনার শোকের এক মর্মস্পর্শী চিত্র আঁকা হয়েছে এতে; আর মদিনার মৃত্যুতে তার এই অপরাধী স্বামীর যে বুক-ফাটা ক্রন্দনের ছবি কবি এঁকেছেন সাহিত্যরসিকদের চোখে তা অমূল্য-সীতার বিরহে কৃত্তিবাসের রামের চাইতে চাষী-কবি মনসুর বয়াতির

অঙ্কিত এই শোক গভীরতর, সুন্দরতর।

২৭৬

মারফতী সাহিত্য এক সুবিস্তীর্ণ সাহিত্য। মুর্শীদী গান, দেহতত্ত্ব গান, বাউল গান, এর অন্তর্গত। এই মারফতী সাহিত্যের অনেকখানিই তাত্ত্বিকতাপূর্ণ। কিন্তু এর অন্তর্গত কবিত্বময় বাউল গানের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ রচয়িতা-যেমন হাসন রাজা, মদন, লালন শাহ, শেখ ভানু-মুসলমান সমাজ-উদ্ভূত।

এই মুসলমান-বাউলদের সম্বন্ধে অনেক কথাই আমাদের সাহিত্যিকদের ভাবতে হবে। এই বাউলরা কোন্ সাধনার উত্তরাধিকারী, সুফী সাধনা ও বৈষ্ণব সাধনা অথবা সুফী কবিতা ও বৈষ্ণব কবিতা এর কোনটির প্রভাব এঁদের উপরে বেশী, এঁদের নিজস্বতাই বা কি, ইত্যাদি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে তাঁরা হিন্দু-মুসলমানের দীর্ঘ দিনের পরিচয়ের অনেক গোপন তথ্য উদ্ধার করতে পারবেন। এঁদের রচনা পড়ে আমার কিন্তু মনে হয়েছে, এদের ভাষায় বাংলার বৈষ্ণব কবিতার কোমলতা ও মৃদুতার চাইতে বায়েজিদ বোস্তামি, হাফিজ প্রমুখ সুফীদের বাণীর বিদ্যুভঙ্গি ও দাহই বেশী ফুটেছে। তবে কেন যে এমন হয়েছে তা বলা নিশ্চয়ই সহজ নয়। সুফী-সাধনা ভারতে এসে এখানকার নানা ভাব-সাধনার সঙ্গে সংমিশ্রিত হয়েছিল, চট্টগ্রামের দরবেশ আলী রাজা ওরফে কানু ফকিরের “জানসাগর” গ্রন্থে তার কিছু কিছু পরিচয় পাওয়া যায়।

এ পর্যন্ত যে সমস্ত বাউল-কবি আবিষ্কৃত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে মদন বাউল এক ক্ষণজন্মা কবি। “নিঠুর গরজি, তুই মানুষ-মুকুল ভাজবি আগুনে” ও “হৃদয় কমল চলতেছে ফুটে কত যুগ ধরি”* শীর্ষক তার দুইটি গান ভারতীয় দার্শনিক সম্মিলনীর। প্রথম অধিবেশনের সভাপতিরূপে রবীন্দ্রনাথ তার অভিভাষণে উদ্ধৃত করেছিলেন। সমস্ত বাংলা সাহিত্যে মদনের এই গান পরমাশ্চর্য সামগ্রী। যতদূর জানি, এর জন্য বাংলার রসিকসমাজ মরমী সাহিত্যের ভাণ্ডারী শ্ৰীযুক্ত ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের কাছে ঋণী।

এই যে কয়েক শ্রেণীর সাহিত্যের উল্লেখ করা হলো, এ ভিন্ন নানা রকমের পল্লীগান মুসলমান চাষীর কণ্ঠে গীত হয়ে থাকে। সেই সব গানের রচয়িতার নাম প্রায়ই পাওয়া যায় না। তা না যাক, কবিতা বা গান যে রচনা করে শুধু তারই নয়, যে মনঃপ্রাণ দিয়ে পাঠ করে বা গায় তারও বটে। এই ভাবে কয়েক শতাব্দী ধরে বাংলার মুসলমান ভাব-চর্চার আস্বাদ লাভ করে আসছে তার মাতৃভাষার সাহায্যেই।

কিন্তু এই সহজ ধারা একালে এমন বিকৃত হলো কেন? বিকৃত যে হয়েছে কেউই তা অস্বীকার করেন না। সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত মুসলমান তো নানা ভাবেই দ্বিধান্বিত, এমন কি পল্লীর মুসলমান চাষীর সেই গানের সাধনার ধারাও অনেকখানি বদলে গেছে।

এ ব্যাপারটি বাস্তবিকই বড় জটিল। আমি যেটুকু বুঝতে পেরেছি তা নিবেদন করতে চেষ্টা করব।

বাংলার মুসলিম জীবনের এই বিপর্যয়ের প্রথম কারণ-রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন বাংলার মুসলমানের সাহিত্যিক জীবনে বিপর্যয় আনল তার সমাজ গঠন ও চিত্তোৎকর্ষের দুর্বলতার জন্যই। এই পরিবর্তনে উত্তর ভারতের মুসলমানের জীবন এমন প্রকর্ষ-ধারা-বিচ্যুত হয় নি। বৌদ্ধ, হিন্দু, পাঠান, আরব প্রভৃতি বিচিত্র

* পরে জানা গেছে ‘হৃদয় কমল চলতেছে ফুটে’ শীর্ষক গানটি বিশা ভুইমালীর।

২৭৭

উপকরণে বাংলার মুসলমান-সমাজ গঠিত। এই বৈ{ty: 1 {(৩ খতের রূপান্তরিত হবার সময় ও সুযোগ পায় নি; মোগল.. ভারতে আf a! ৩-বোধের লালিত হবার অবকাশ কম ছিল না। প্রায় দেড় শত বৎসর পূর্বে প্রকাশিত সিয়ারুল মোতা আখেরীন-এর ইংরেজি অনুবাদক তাঁর গ্রন্থে স্থানে স্থানে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে নিঃসন্দেহে বুঝতে পারা যায়, বাংলাদেশে সাধারণ মুসলমান ও ভদ্র মুসলমানের ভিতরে (একালের মুসলমানের ভাষায় ‘আশরাফ’ ও ‘আতরাফে’র ভিতরে) একটি সুবিস্তীর্ণ ব্যবধান ছিল। এই ভদ্র মুসলমানদের চিৎ-প্রকর্ষের ভাষা যে ফারসী ও উর্দু ছিল এ সম্বন্ধে হাকিম হাবিবুর রহমান ঢাকার মুসলিম সাহিত্য-সমাজের পঞ্চম বার্ষিক অধিবেশনে তার অভিভাষণে অনেক যুক্তিপূর্ণ কথার অবতারণা করেছেন। তার প্রধান বক্তব্য এই যে, উর্দু সাহিত্যে বাংলার বিভিন্ন স্থানের মুসলমানের মূল্যবান দান আছে; সেটি নিশ্চয়ই দীর্ঘ সাধনার ফল। আর এরূপ ঘটনা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। বাংলার ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা বহুকাল পর্যন্ত সংস্কৃতকে ব্যবহার করে আসছিলেন, তাঁদের চিৎ প্রকর্ষের ভাষারূপে। রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনে রাজাশ্রয়হীন এই দ্র মুসলমান-দল অচিরেই শক্তিহীন হয়ে পড়লেন, আর দেশের বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে সম্পর্কশূন্য তাদের প্রকর্ষ ধ্বংস হয়ে গেল। মুসলমান-সমাজের এক অংশে বিপর্যয় ঘটবার পরে অন্যান্য অংশ যে স্বাভাবিক অবস্থায় থাকবে এ সম্ভবপর নয়।

এর উপর সমস্ত দেশের ভিতরে একটি বড় ব্যাপার ঘটল। বাংলাদেশই নূতন সভ্যতার নিকেতন হয়ে উঠল। বাংলার হিন্দু-সমাজে এমন মনীষীর জন্ম হলো যারা এই নূতন বিদ্যা ও প্রকর্ষ মনেপ্রাণে গ্রহণ করবার পথ আবিষ্কার করলেন। এই নব ঐশ্বর্য-লব্ধ হিন্দুর সঙ্গে তুলনায় মুসলমান হয়ে চললো দিন দিন অধিকতর শ্রীহীন।

দ্বিতীয় কারণ-ওহাবী প্রভাব। ওহাবী প্রচারকেরা বাংলায় এসেছিলেন অনেকখানি শান্ত মূর্তি ধরে-ইসলামের শরীয়ত নূতন করে প্রচার করবার উদ্দেশ্যে। তাঁদের মতে, বাংলার অধিকাংশ মুসলমান ছিল অদ্ভুত কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীব, তাঁরাই তাদের মুসলমানী আচার ব্যবহার নূতন করে শিক্ষা দিয়েছেন। তাদের দাবি মিথ্যা নয়। এক আচারের পরিবর্তে অন্য আচার তারা বাংলার মুসলমানকে শেখাতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। কিন্তু যেভাবে শিক্ষা দিলে কোরআনের ইসলামের মর্যাদা রক্ষা হতো সেইভাবে দেওয়া হয়েছে কি না সেটিও বিচার্য। আমি কেবল একটি বিষয়ের দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। ওহাবী অথবা ওহাবী-প্রভাবান্বিত প্রচারকদের প্রচারের ফলে বাংলার মুসলমানের অনেকে নামাজ পড়তে শিখেছেন, কিন্তু কিছুই না বুঝে। অথচ নামাজে যে-সব কথা ব্যবহার করা হয় তার অর্থ সম্বন্ধে অমনোযোগীর প্রতি কোরআনে কঠোর ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে, আর বলা হয়েছে নিশ্চয়ই আল্লাহ্র চক্ষে অধমতম জীব হচ্ছে বধির ও বোবা-যারা বোঝে না (৮ : ২২)।

মোটের উপর ওহাবী-আন্দোলন ধ্বংসশীল মুসলিম জগতের, বিশেষ করে’ মুসলিম ভারতের, এক সশস্ত্র প্রতিবাদ। কিন্তু সে-সংঘর্ষে তার ভাগ্যে জয়লাভ ঘটে

* দ্র: বাংলার মুসলমানের কথা

২৭৮

নি। তাই তার পক্ষভুক্তদের ভাগ্যেও লাভ হয়েছে পরাজিত পক্ষের যত নৈতিক ও আত্মিক দুর্গতি।

তৃতীয় কারণ-মনীষীর অভাব। মনীষীর জন্য কেন কোনো কোনো সমাজের ভিতরে কখনো কখনো হয় তা বলা শক্ত। তবে তাদের আবির্ভাব না হলে কোনো

জাতির বা দেশের জীবনে নূতন উদ্যম যেন অসম্ভব হয়েই থাকে। সমাজ যখন অপেক্ষাকৃত নিমতর অবস্থায় থাকে অথবা অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় উপনীত হয়, তখন তার জন্য মনীষীর প্রয়োজন হয় সব চাইতে বেশী। কিন্তু বাংলার মুসলমানের প্রয়োজন যত বড়ই হোক তার সমাজে কোনো মনীষীর আবির্ভাব ঘটে নি। উত্তর ভারতে স্যার সৈয়দ আহমদের আবির্ভাব সেখানকার মুসলমানদের জন্য কল্যাণপ্রসূ হয়েছিল। তাকে মনীষী বলা যায় কি না এ নিয়ে মতভেদ হতে পারে, কেননা মনীষী সাধারণত তাঁকেই বলা হয়, যার কাছ থেকে তার চারপাশের লোক জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে একটি নূতন অথচ চিরসত্য দৃষ্টি লাভ করে। তবে সবল-কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন এক শক্তিশালী কর্মী তিনি। ছিলেন নিশ্চয়ই, তাই সিপাহি-বিদ্রোহের ফলে পশ্চিমী মুসলমানের সঙ্কটাপন্ন অবস্থার আশু প্রতিকারের চেষ্টা তিনি নিপুণভাবেই করেছিলেন। বাংলার হিন্দু-সমাজে যে কয়েকজন মনীষীর জন্ম হয়েছে, তাঁদের প্রভাব মুসলমানের উপর তেমন কিছুই হয় নি, তার কারণ তাঁদের বিশেষ কর্মক্ষেত্র ছিল হিন্দুসমাজ, আর নানা প্রভাবের তাড়না ভোগের ফলে মুসলমানের এমন মনোভাবও ছিল না যে, এই সব মনীষীর বাণীর ও কর্মের পূর্ণ অর্থ তাদের হৃদয়ঙ্গম হবে।

একটি কথা হয়ত বলা যেতে পারে। বাউল গানকে আমি সেকালের সাহিত্য বলেছি, অথচ যে সব মুসলমান বাউলের নামোল্লেখ করা হয়েছে তারা সবাই ঊনবিংশ শতাব্দীর লোক, হয়ত ওহাবীপ্রভাবের সমবয়সী অথবা পরবর্তী। এর উত্তরে বলব, মুসলমান বাউলসাহিত্য একালে জন্মেছে বটে কিন্তু তার নাড়ীর যোগ রয়েছে সেকালের অর্থাৎ মধ্যযুগের মরমী সাধনার সঙ্গেই, একালের বহির্মুখী জ্ঞানবিজ্ঞানের জন্য তার কিছুমাত্র দরদ আছে তা বোঝা যায় না। মুসলমান-সমাজের লৌকিক ধর্মের প্রতিবাদ এ-সাহিত্যে আছে বটে, কিন্তু সেই প্রতিবাদ এর ভিতরকার প্রধান কথা নয়, প্রধান কথা হলে বাউলসাহিত্য একালের সাহিত্যই হোতো, এর প্রধান কথা হচ্ছে অন্তর্লোকের এক অপরূপ পরিচয় লাভ করা-যে-পরিচয় লাভের ফলে অনুভাবকের জীবন হয়ে ওঠে মধুময়, জগৎ হয় আনন্দ-নিকেতন।

বাংলার মুসলিম জীবনে ওহাবীপ্রভাব ও মনীষীর অভাব সম্বন্ধে বহু-কথা বলবার আছে। কিন্তু আপাতত শুধু এই কথাটি বলতে চাই যে, বাংলার মুসলমান এক সম্পূর্ণ নূতন পরিবেষ্টনে এখন উপস্থিত, সেই পরিবেষ্টনে আত্মরক্ষা ও আত্মবিকাশের জন্য নূতন আয়োজন তার চাই-ই, কিন্তু সেই আয়োজনের উপকরণ সে যে তার চারিদিকে সন্দিগ্ধ ও অপ্রসন্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পাবে না পাবে শান্ত ও সকৌতুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই, এই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কথাটিও সে বুঝছে না এই ওহাবী-প্রভাব ও নব সৃষ্টিধর্মী মনীষীর অভাবের জন্যই।

২৭৯

কিন্তু বাঙালী মুসলমানের একালের জীবনে এই সব বিপত্তির জন্য যে সে ক্রমাগত অধঃপাতের দিকেই যাচ্ছে, তা সত্য নয়। তার সংস্কৃতিধারার বিপর্যয়, আর্থিক অসচ্ছলতা, রাজনৈতিক দৃষ্টির অভাব, এসব বিড়ম্বনায় তার জীবন বিড়ম্বিত হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু এত বিড়ম্বনাভোগের ভিতরে তার প্রাণপুরুষ যে মুহ্যমানই হয় নি তার পরিচয় ফুটতে চেয়েছে তার একালের সাহিত্যে। মীর মোশাররফ হোসেনের এ কায়কোবাদের সাহিত্য অলোকসামান্য কিছু নয় বটে কিন্তু নৈরাশ্য ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ওহাবী পরিবেষ্টনে তাঁরা যে সহজভাবে জীবনে গ্রহণ করতে পেরেছিলেন, এর হর্ষ বেদনা ও প্রেমের মাধুর্য উপভোগ করতে পেরেছিলেন, জগতের অনাত্মীয় কখনো তারা হয় নি এরও মাহাত্ম তো কম নয়। সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ও শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হকের প্রথম-যৌবনের রচনাও এমনিভাবে হৃদয়গ্রাহী। আর এই সময়ের চিন্তাশীল লেখক হচ্ছেন পণ্ডিত রেয়াজউদ্দিন, উনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুসলিম জামালুদ্দিন-আ-আফগানীর জীবন কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে, তাঁর স্বসম্প্রদায়ের নব- জীবনারম্ভের কথাও তিনি ভেবেছিলেন। আমাদের একালের সাংবাদিকদের উপরে তার ‘প্যান ইসলাম’-বাদের ছায়া পড়েছে মনে হয়, কিন্তু তার জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রীতির উত্তরাধিকারী হবার প্রয়োজন তারা তেমন অনুভব করেন নি।

কিন্তু এযুগের মুসলমান সাহিত্যিকদের মধ্যে চিন্তার ক্ষেত্রে বিশেষ গৌরবের আসন এই তিন জনের-মিসেস আর এস হোসেন, কাজি ইমদাদুল হক, ও লুৎফর রহমান। একালের মুসলমানকে কঠিন কটু কিন্তু জীবনপ্রদ অনেক কথা তারা শুনিয়েছেন। সেসব কথা তাদের কানে তেমন যে প্রবেশ করেছে, তা মনে হয় না। তবে ব্যর্থ যে হয়েছে তাও নয়। আর সাহিত্যের প্রভাব হয়ত এমনিভাবেই হয়।

মিসেস আর এস্ হোসেনের প্রতিভা একালের ভগ্নহৃদয় মুসলমানের জন্য যেন এক দৈব আশ্বাস। নিবাত নিষ্কম্প মুসলমান-অন্তঃপুরে যদি এহেন বুদ্ধির দীপ্তি, মার্জিত রুচি, আত্মনির্ভরতা, ও লিপিকুশলতার জন্ম হয়, তবে আজো ভয় কেন বাংলার মুসলমানের ঘোচে না। তবে আজো কেন নিজেকে পরিবেষ্টনের সন্তান ও জগতের অধিবাসী বলে পরিচিত করবার সাহস তার হয় না! আর লুৎত্যর রহমান সম্পর্কে এই একটি কথা না বলে অন্যায় হবে যে একালের বাংলার মুসলমানসমাজে ধর্ম নিয়ে বাগবিতণ্ডা ও মাতামাতি কম হয় নি, কিন্তু সেই বিপুল আড়ম্বরের ফাঁকি একদিন যখন নিঃশেষে ধরা পড়বে তখন এ-যুগ ধর্মহীনতার, অর্থাৎ মনুষ্যত্বের জন্য বেদনা-হীনতার, অভিযোগ থেকে অব্যাহতি লাভ করবে যাঁদের অতন্দ্রিতচিত্ততার দৃষ্টান্তে, এই কিছু অব্যবস্থিত প্রতিভা লুত্যর রহমান তাঁদের মধ্যে এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি।

একালের বাঙালী মুসলমানের সৃষ্ট এই সাহিত্য দেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের দৃষ্টি তেমন আকর্ষণ করতে পারে নি, তার কারণ মনে হয় এর অপ্রাচুর্য ও অনবদ্যতার অভাব। কিন্তু যাদের জন্য এই সাহিত্য বিশেষভাবে রচিত হয়েছিল, তারা যে এর পূর্ণ মর্যাদা দিতে পারেন নি এইটি-ই এর গৌরবহীনতার প্রধান কারণ বলে মনে হয়।

তবে এঁদের চাইতে ভাগ্যবান সাহিত্যিকও এযুগে মুসলমান-সমাজে জন্মেছেন-বৃহত্তর দেশে তারা সমাদর লাভ করতে পেরেছেন। আমি নজরুল ইসলাম ও

২৮০

জসীমউদ্দিনের কথা বলছি। মুসলমান-সমাজের এই দুই তরুণ শিল্পীর সম্বন্ধে মত প্রকাশ করবার সময় এখনো বহু দূরে থাকুক, কিন্তু এঁরা ধন্য হয়েছেন এই জন্য যে, একালের মুসলমান সমাজের অন্তরে তার সাহিত্যিক সার্থকতা সম্বন্ধে এক নব আশার। সঞ্চার এঁরাই করতে পেরেছেন।

কিন্তু তবু বলতে হবে, বাংলার মুসলমান-সমাজে সাহিত্য-চর্চার যে অবস্থা, অর্থাৎ লেখক ও পাঠকের যে সম্বন্ধ, তা শুধু অসন্তোষজনক নয়, অনেকখানি আপত্তিকর। পাঠক-সমাজের বিচার-শক্তি এখনো অত্যন্ত দুর্বল, সেই দুর্বলতার সুযোগ পুরোপুরি নেবার উদ্দেশ্যে আমাদের অনেক লেখককে অনেক সময়ে দেখতে পাওয়া যায়, অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর রচনায় হাত দিতে। পাঠক-সমাজের অজ্ঞতা এইভাবে দাঁড়াচ্ছে লেখক সমাজের উৎকর্ষলাভের পরিপন্থী হয়ে। এর আর এক ফলও ফলেছে। সেইটি বেশী মারাত্মক। এমন পাঠককে অবহেলা করবার প্রবৃত্তি একটুখানি তীক্ষ্ণবুদ্ধি সাহিত্যিকের মনে সহজেই আসে। ফলে সম্পূর্ণ দায়িত্বহীন চরমপন্থী চিন্তাশীল ও পরিবর্তনভীত পাঠক-সমাজ এই দুয়ের প্রাদুর্ভাব এই সমাজে হচ্ছে। এই বিরোধের পরিণতি কোথায় জানি না, কিন্তু মুসলিম-সভ্যতার এক গৌরব-যুগে এমনি ধরণের বিরোধ সমাজে জেগেছিল, আর তার ফল সমগ্র মুসলমান-সভ্যতার জন্য অবাঞ্ছিতই হয়েছিল, এ কথাটি সহজেই মনে পড়ে।

তবে এ বিরোধ দীর্ঘকালস্থায়ী নাও হতে পারে। কিন্তু সেজন্য চেষ্টাও যেন কম না হয়। দেশের সর্বত্র শিক্ষাবিস্তারের প্রেরণাদান, উচ্চাঙ্গের সংবাদপত্র পরিচালনা, এসব সাহিত্যিকদের দ্বারা সম্ভবপর হতে পারে, কিন্তু তারও চাইতে বড় কথা এই যে উদ্দেশ্য আদর্শের যে-বিরোধ একালে মুসলমান-সমাজে প্রবল হতে চাচ্ছে, তার একটা যোগ্য মীমাংসার চেষ্টায় যদি সমাজের সব শ্রেণীর চিন্তাশীল অগ্রসর হন, তবে কোনো মীমাংসায় উপনীত হতে না পারলেও সমস্ত সামজের মানস-উৎকর্ষের এক অভিনব ভিত্তিপত্তন তারা করতে পারবেন। অবশ্য তার জন্য প্রথম প্রয়োজন এই যে, সব শ্রেণীর চিন্তাশীলই হবেন সত্য ও কল্যাণকামী।

মনে হয় এমন এক মানস-উৎকর্ষের পথে বাংলার মুসলমান-সমাজ আস্তে আস্তে পা বাড়াতে শুরু করেছে। এ সমাজে যারা নিজেদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মনে করেন সমাজের উপরে তাদের প্রভাব এখনো নগণ্য, কিন্তু এই দলের ভিতর থেকেই বুদ্ধির মুক্তি’-বাদীদের উদ্ভব হয়েছে, আর তাদের জিজ্ঞাসা যে সমাজে কিছু সাড়া জাগাতে পেরেছে তা অস্বীকার করা যায় না। আর আলেম-সম্প্রদায়ের ভিতরেও এমন চিন্তাশীলের আবির্ভাব হচ্ছে, যারা অলৌকিকতা দুজেঁয়তা ইত্যাদি থেকে ধর্মকে মুক্ত করে তাকে করতে চাচ্ছেন প্রধানত সহজ বুদ্ধির বিষয়। এই সম্পর্কে বাঙালী আলেম মওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী ও মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর নাম উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এই শ্রেণীর চিন্তাশীল আলেমদের মুকুট-মণি হচ্ছেন উর্দুভাষী বাঙালী আলেম মওলানা আবুল কালাম আজাদ। তাঁর সম্প্রতি-প্রকাশিত “তরজুমান ই-কোরআন”-এর ভূমিকায় তিনি ইসলামের যে উদার ও সঞ্জীবনী ব্যাখ্যা দিতে পেরেছেন, তাতে দেশের আলোকপন্থীদের শ্রদ্ধাভাজন তিনি হয়েছেন। তার ব্যাখ্যায়

২৮১

মুসলমানসমাজ ওহাবী প্রভাবের কাণ্ডজ্ঞান-বিমুখতা ও অপ্রেম থেকে মুক্তি পাবে আশা করা যায়।

বাংলার মুসলমানের দীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনের সঙ্গে যে-পরিচয়টুকু আমাদের হলো তা থেকে এ কথাটি পরিষ্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, সেকালের বাঙালী মুসলমান সহজভাবেই মাতৃভাষায় সাহিত্যের চর্চা করেছিলেন, আর একালে সে সহজ ধারা কিছুদিনের জন্য বিপর্যস্ত হলেও আবার তাতে প্রতিষ্ঠিত হবার পথেই তারা চলেছেন। শুধু তাই নয়, পরিবেষ্টনের সঙ্গে প্রেমের যোগ ও অকুণ্ঠিত সত্যানুসন্ধান এ না হলে যে জীবনে শ্ৰেয়লাভ হয় না, এ-সত্যের প্রমাণও রয়েছে মুসলমানের সেকালের ও একালের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের সাধনায়। তবে সাদৃশ্য এমনি ধরণের থাকলেও দুয়ের ভিতরে পার্থক্যও আছে। মধ্যযুগের অন্যান্য চিন্তাশীলের মতো সেকালের মুসলমানও প্রধানত ছিলেন গুরুবাদী ও জীবনের অনিত্যতাবাদী, কিন্তু একালের মুসলমান মুগ্ধ হতে চাচ্ছেন বৈজ্ঞানিকতায় ও দৈনন্দিন জীবন-ধারার উৎকর্ষে।

আরো একটি ব্যাপার চোখে পড়ছে-বঙ্গ-সাহিত্যে হিন্দু ও মুসলমান এই দুই ধারা সম্মিলিত হয়েই রয়েছে, কিন্তু গঙ্গা-যমুনাধারার মতো। ভবিষ্যতেও দু’য়ের এই অদ্ভুত স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকবে কি না, সেটি হয়ত নির্ভর করবে তাদের পরস্পরের ভবিষ্যৎ সামাজিক সম্বন্ধের উপরে। তবে একালের বাংলা সাহিত্যে এমন একটি চিন্তাধারা রূপ লাভ করতে চাচ্ছে, যার পরিপূর্ণ বিকাশে মুসলমান সমাজ উদ্ভুত সাহিত্যিক বিশেষ সাহায্য করতে পারবেন বলে মনে হয়।

কথাটি একটু পরিষ্কার করে বলতে চেষ্টা করা যাক। হিন্দুসাধনার শ্রেষ্ঠ কথা হয়ত নির্গুণ ব্রহ্মের সাধনা। জিজ্ঞাসার এক সুগভীর তৃপ্তি সেই চিন্তাধারায় আছে; কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন ভাল কোনো কিছুতেই নেই, তাই নির্গুণ ব্রহ্মের সাধনার সঙ্গে যুক্ত দেখতে পাওয়া যায় উৎকট ব্যক্তিত্ববাদ ও কর্মে অবিশ্বাস। বাংলার একালের সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ অংশে রূপ ধরে উঠতে চাচ্ছে বীর্যবন্ত জাগতিক জীবনের আদর্শ-বিশ্ব-জ্ঞান ও বিশ্ব সৌন্দর্যের দিকে যার গতি। কিন্তু যে-সমাজের ভিতরে এর উদ্ভব হয়েছে, তার সেই নির্গুণ ব্রহ্মবাদ ও জাতি-অভিমান এর সার্থকতা লাভের অন্তরায় সহজেই হতে পারে। এই অবস্থায় মুসলমান-সমাজের সাহিত্যিকদের দ্বারা এই ভাবধারার বিশেষ সার্থকতা সাধনের কথা মনে হয় এই জন্য যে, মুসলমানের এতদিনের ধর্মাদর্শে যে আল্লাহর পরিকল্পনা আছে তিনি নানা সদ্‌গুণের আধার, সেই সদ্গুণময় আল্লাহকে স্মরণ করে’ দৈনন্দিন জীবন সুন্দরভাবে যাপন করবার এই যে মুসলমানের প্রাচীন শিক্ষা, তার একালের জীবনের বিশেষ প্রয়োজনে সেই শিক্ষার সাহায্য তার লাভ হবে এ আশা করা যেতে পারে। তবে এসব হচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা। সেই ভবিষ্যৎকে কতকটা সুনিশ্চিত করা যেতে যে না পারে তা নয়। কিন্তু সে-ক্ষমতা শুধু তাদেরই আছে, যাদের বর্তমান কর্মধারা সুনিশ্চিত।

বাংলার মুসলিম সাহিত্যের বিশেষ পরিবেষ্টন সম্বন্ধেই এতক্ষণ কয়েকটি কথা বলতে চেষ্টা করেছি। এইবার সাধারণভাবে সাহিত্যের আকৃতি-প্রকৃতি উদ্দেশ্য-আদর্শ সম্বন্ধে কিছু আলোচনা শুরু করে আপনাদের ধৈর্য পরীক্ষা করব না নিশ্চয়ই। তবে

২৮২

সাহিত্যিকদের সভায় এই-সব বিষয় সম্পর্কে দুই একটি কথা না বললে বক্তব্য নিতান্ত অসম্পূর্ণ থেকে যাবে মনে হয়। আমি সাহিত্যে রস ও সমস্যা সম্বন্ধে দুই একটি কথা বলেই আমার বক্তব্য শেষ করব।

সাহিত্যের উদ্দেশ্য রস-সৃষ্টি একথাটির সঙ্গে আমরা সবাই অত্যন্ত পরিচিত। কিন্তু এর প্রতিবাদ বা সমর্থন কিছুই না করে আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি। অন্য একটি কথার দিকে-সাহিত্যের উদ্দেশ্য জীবনের সমস্যার সমাধানের প্রয়াস। এই প্রয়াস জ্ঞাতসারেও হতে পারে, অজ্ঞাতসারেও হতে পারে। কিন্তু সমস্যার সোনার কাঠির স্পর্শ না পেলে সাহিত্যিক-চিত্তের নিদ্রাভঙ্গ হয় না, সাহিত্য সক্রিয় হয় না, এ এত সত্য কথা যে, এর প্রমাণ দেবার দরকার করে না। রস অনেক সময়ে এই সমস্যার আনুষঙ্গিক, যেমন ফুলের রং ও পাপড়ির বিন্যাস তার বীজকোষের আনুষঙ্গিক। এই সমস্যার দিকে দৃষ্টি রেখে সাহিত্য সৃষ্টি করলে, সাহিত্য সাংবাদিকতায়ও পর্যবসিত হতে পারে, তবু তা হবে অর্থপূর্ণ-সুপাঠ্য, কিন্তু শুধু রস বা সৌন্দর্যসৃষ্টির দিকে দৃষ্টি রেখে সাহিত্য সৃষ্টি করলে, তা যে কি বিষম পাগলামির ব্যাপার হয়, বিশেষ করে এই স্বল্প-অবসরের যুগে, বাংলার দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর রস স্রষ্টাদের রচনায় রয়েছে তার দৃষ্টান্ত। যীশুখ্রিস্ট বলেছেন, Take not the name of God in vain, ঈশ্বরের নাম বৃথা উচ্চারণ করো না, সাহিত্যে রস ও সৌন্দর্য সম্বন্ধেও সেই কথা খাটে,-ও এমনি দুর্লভ ব্যাপার যে, ও-সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে নিপুণভাবে জীবনের সমস্যার আলোচনা ভিন্ন কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি আর কিছু যে করতে পারেন তা মনে হয় না।

এই সমস্যা-সাহিত্যের কথা আপনাদের কাছে উত্থাপন করছি কতকগুলো কথা ভেবে। বাংলার মুসলমান এক নূতন জীবনের স্পন্দন অনুভব করতে শুরু করেছে। সেই নূতন জীবনের সূচনায় নানা সমস্যা সহজেই তাকে আঘাত দিচ্ছে। সেই সব সমস্যা যদি গানে, কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, রূপকে, কিম্বা নিবন্ধে, সে রূপ দিতে চেষ্টা করে, তবে বাংলা সাহিত্যে এক অভিনব সম্পদ সে দান করতে পারবে আশা করা যায়। অনেক সময়ে দেখা যায়, বড় বড় উত্তেজনার মুখে উৎক্ষিপ্ত হয় বড় বড় সাহিত্য।

আমাদের দীর্ঘদিনের অজ্ঞানতার ও অপ্রেমের বেদনা সাহিত্যে সার্থকতা লাভ করুক, এই প্রার্থনা করি।

বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সম্মিলন, পঞ্চম অধিবেশন,-সাহিত্যশাখা-২৬ ডিসেম্বর, ১৯৩২

গ্যেটে

সুবিখ্যাত দার্শনিক ক্রোচে গ্যেটে সম্বন্ধে যে বইটি লিখেছেন, তাতে গ্যেটের মনীষা ও কাব্য সম্বন্ধে নানা বিচার বিশ্লেষণের পর বলেছেন-সাহিত্যের ইতিহাসের ক্রমবর্ধনের

২৮৩

ধারায় গ্যেটের স্থান কি তা নির্দেশ করতে তিনি অক্ষম। বলা বাহুল্য, এ অক্ষমতার অন্য নাম আপত্তি, কারণ, তাঁর মতে-প্রত্যেক কবি হচ্ছেন এক একজন স্বতন্ত্র স্রষ্টা, আর তার সৃষ্টির বিষয় হচ্ছে তার নিজের ব্যক্তিত্ব, তাঁর জীবনের সঙ্গে যার অবসান; পরে যারা আসেন তারা যদি সত্যিকার কবি হন তবে নূতন-কিছু সৃষ্টি করেন, আর তা

হলে অনুকরণ করেন, কিন্তু অনুকারীর স্থান কাব্যের ইতিহাসে সত্যই নেই।-তবু তিনি স্বীকার করেছেন

…….in Goethe’s poetry, in his rich, varied, impressionable and highly intelligent mind were mirrored for the first time in conspicuous fashion many sides of the modern spirit.” s*

অনেক সাহিত্যিকই গ্যেটের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু তার সম্বন্ধে সব চাইতে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা বোধ হয় কার্লাইলের। তিনি তাঁর Hero and Hero worship গ্রন্থে Hero as man of letters অধ্যায় গ্যেটের কথা দিয়ে শুরু করেছেন, এবং গ্যেটের প্রতিভা যে জগতে এক নূতন বিস্ময়ের সামগ্রী, যে হজরত মোহাম্মদের তিনি অত্যন্ত প্রশংসা করেছেন, তাঁর প্রতিভার চাইতেও যে গ্যেটের প্রতিভা উচ্চতর গ্রামের ইত্যাদি কথা বলবার পর বলেছেন-গ্যেটের কথা থাকুক, কেউ আপাতত তাঁকে বুঝবে না। এই বলে তিনি রুসসা বার্ণস প্রমুখ সাহিত্যিকদের মাহাত্ম কীর্তনে মনোনিবেশ করেছেন। কিন্তু ক্রোচে যে গ্যেটের প্রতিভাকে modern spirit- এর (আধুনিকতার) এক বড় প্রতীক বলেছেন, সেইটি ভাল করে বুঝতে পারলে গ্যেটের সঙ্গে আমাদের সত্যিকার পরিচয় হয়ত খানিকটা হবে।

গ্যেটের ভিতরে এই যে সুবৃহৎ নূতন মন, বলা যেতে পারে, Renaissance (নবজাগরণ)-সূচিত মানসিকতার তা এক বড় পরিণতি। শিক্ষিত ব্যক্তিরা জানেন, ইয়োরোপের Renaissance কয়েক শতাব্দীব্যাপী ব্যাপার, বহু লক্ষণের দ্বারা জটিল, আর তা শুধু সৌন্দর্য ও আনন্দের কাহিনীই নয়, সেই সৌন্দর্য ও আনন্দের সঙ্গে মিশে রয়েছে অনেকখানি কদর্যতাও-টলষ্টয় তাঁর শেষ বয়সের কতকগুলো রচনায় যার দিকে তার বলিষ্ঠ তর্জনী নির্দেশ করেছেন। তবু এ সত্য যে Renaissance–কাহিনী মোটের উপর মানুষের উষর চিত্তক্ষেত্র পল্লবিত করবার কাহিনী, মানুষের জাগতিক জীবনের সুখ-সম্ভোগের এক করুণ মধুর কাহিনী। কিন্তু এই Renaissance পুস্পের সৌরভে ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশ আমোদিত হলেও তুহিনাবৃত জার্মানী বহু দিন পর্যন্ত তা থেকে বঞ্চিত ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে সেখানে দেখা দিল ধর্মান্দোলন Reformation, আপাতদৃষ্টিতে যা বহুদিক দিয়ে Renaissance-এর বিপরীত-ধর্মী। অষ্টাদশ শতাব্দীর জার্মানীর যে Classicism-প্রাচীন গ্রীক শিল্প ও সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় লাভের চেষ্টা-তার সঙ্গেই বরং Renaissance এর আত্মীয়তা বেশী। কিন্তু জার্মানীর Classicism তার পূর্ববর্তী Reformation,-এর বিপরীতধর্মী বোধ হলেও বাস্ত

*

গ্যেটের কাব্যে, তার সারবান বৈচিত্র্য-বিলাসী রূপগ্রাহী ও প্রখরবুদ্ধি মনে, প্রথম স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় আধুনিকতার বহু দিক।

২৮৪

বিকপক্ষে এটি Renaissance ও Reformation-এর বেশ এক সমন্বয়। এই acticism-এর প্রবর্তকদের সৌন্দর্যানুরাগ Renaissance-এর, কিন্তু তাদের সত্য ও আদেশানুরাগ, অন্য কথায়, কল্যাণানুরাগ Reformation-এর। এক শ্রেষ্ঠ নায়ক

assing-এর একটি উক্তি খুব প্রণিধানযোগ্য। সৌন্দর্যতত্ত্ব বোঝাবার জন্য তিনি লিখেছিলেন Laokoon,-এক জগবিখ্যাত বই, যদিও আকারে ক্ষুদ্র; তিনিই বলেছেন-ঈশ্বর যদি এক হাতে পূর্ণজ্ঞান অপর হাতে প্রয়াসের অনন্ত দুঃখ এই দুটি নিয়ে বলেন, কোন্‌টি নেবে বলো, তা হলে বলব, পিতঃ, প্রমাদহীন পূর্ণজ্ঞান তোমাতেই সাজে, আমাকে দান কর অনন্ত প্রয়াস।

জার্মানীর এই অষ্টাবিংশ শতাব্দীর Classicism-এর শ্রেষ্ঠ প্রতীক গ্যেটে। সত্য বটে তিনি নিজেকে খ্রিস্টান বলে পরিচিত করবার জন্য ব্যগ্রতা দেখেন নি, বরং বলেছেন “আমি পেগ্যান” (Pagan), প্রকৃতির পূজারি, (মুসলমানী ভাষায় “কাফের”), সেই পরমসৌন্দর্যপ্রেমিক গ্যেটের ভিতরেও সত্যান্বেষণের বীরব্রত কতখানি ছিল, তা তার এই উক্তি থেকেই বোঝা যাবে

“In religious scientific and political matters, I generally brought trubles upon myself because I was no Hypocrite and had the courage to express what I felt.”

একটা জাতির জাগরণে প্রতিবিম্বিত যেন বসন্ত ও বর্ষার নৈসর্গিক প্রাচুর্য। বসন্তের আগমনে দেখা দেয় গাছে গাছে নূতন পাতা, ডালে ডালে লাখো পাখীর আনন্দ-গান; বর্ষায় দেখতে দেখতে নদী নালা ভরে ওঠে উপরের নিরন্তর বর্ষণে;-একটা জাতির জাগরণ-সময়ে তেমনি একই সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু কর্মীর আবির্ভাব ঘটে। অষ্টাদশ শতাব্দীর জার্মান-জাগরণে দেখতে পাই-চিত্রের ক্ষেত্রে Oeser, Winckelmann; সাহিত্যে Klopstock, Herder, Wieland, Goethe, Schiller; দর্শনে Kant, Schelling, Hegel, Schopenhauer; সমালোচনায় Schlegel; সঙ্গীতে Mozart, Beethoven…ইত্যাদি-এ যেন দেখতে দেখতে গগন বিদীর্ণ করে দাঁড়ালো বিচিত্ৰশীর্ষ এক বিরাট পর্বত। বিশেষজ্ঞেরা বলেন- এই শৃঙ্গমালার উচ্চতম মহত্তমটির নাম গ্যেটে।

গ্যেটের চরিতাখ্যায়ক Lewes বলেছেন

“If God were to hold in his right hand all truth, and in his left hand the single everactive impulse to seek after Truth, even though with the condition that I must eternally remain in error, and say to me, “Choose”, I would with humility fall before his left hand and say, “Father, Give! For pure thoughts belong to thee alone.” ধর্ম বিজ্ঞান ও রাজনীতি-সম্পর্কিত ব্যাপারে বহু সময়ে আমি নিজের উপর বিপদ ডেকে এনেছি, তার কারণ ভণ্ডামি আমার পোষাত না, আর যা মনে প্রাণে বুঝতাম তা প্রকাশ করে বলবার সাহস আমার ছিল।

২৮৫

……….of all the failings usually attributed to literary men Goethe had the least of what could be called jealousy; of all the qualities which sit gracefully on greatness he had the most of magnanimity.”

এ. আদৌ অতিরঞ্জন নয়। এই অসাধারণ প্রতিভা তাঁর প্রতিভার ভারে আদৌ টলটলায়মান হন নি। কত সহজভাবে তিনি বলেছেন

Even the greatest genius won’t go far if he tried to owe everything to his own internal self. But many very good men do not comprehend that and they grope in darkness for half a life with their dream of originality…….I by no means owe my work to my wisdom alone, but a thousand things and persons around me who provided me with material. There were fools and sages, minds enlightened and narrow, childhood, youth and mature age-all told me what they felt, what they thought, how they lived and worked and what experience they had gained; and I had nothing further than to put out my hand and reap what others had sown for me

অন্যত্র তাঁর পূর্ববর্তী Winckelmann, Lessing, Herder প্রভৃতির নিকট তার ঋণ তিনি বার বার স্বীকার করেছেন। কিন্তু তবু এ সত্য যে গ্যেটে যদি অপরিসীম কীর্তিমণ্ডিত গ্যেটে না হতেন, তাহলে তাঁর পূর্ববর্তীদের মাহাত্ম অমন পরিকীর্তিত হবার সম্ভাবনা কমই ঘটত-যেমন, কোনো পরিবারকে লোকচক্ষুতে গৌরবমণ্ডিত করেন তার বহু স্বল্পকীর্তি সন্তান নন, তার একজন অতুলকীর্তি সন্তান। তাই গ্যেটে নিজে তাঁর মাহাত্মবিশ্লেষণে উদাসীন হলেও তাঁকে যারা বুঝতে চান, তাঁদের পক্ষে সে-ঔদাসীন্য

অসার্থক।

১৭৪৯ খ্রি. অব্দে Frankfort নগরে এক বর্ধিষ্ণু পরিবারে গ্যেটের জন্ম হয়। তাঁর আত্মচরিতে তিনি তাঁর বাল্যজীবনের ছবি নিপুণ হস্তে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার সেই বাল্য-কাহিনীতে বেশী করে চোখে পড়ে দুইটি ব্যাপার-তার স্বভাবদত্ত প্রতিভা আর তাঁর পিতার শিক্ষাব্যবস্থা। তিনি যখন সাত আট বৎসরের বালক তখন এক প্রচণ্ড ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। তিনি তাঁর আত্মচরিতে লিখেছেন, এই ঘটনা তার বালক

সাহিত্যিকজনসুলভ দুর্বলতার মধ্যে ঈর্ষা তাতে ছিল না বললেই চলে; মহত্ত্বের শোভাবর্ধক গুণাবলীর মধ্যে মহানুভবতা তাতে ছিল অপর্যাপ্ত। শুধু অন্তর-সত্তার উপরে নির্ভর করে শ্রেষ্ঠতম প্রতিভাও বেশি দূর অগ্রসর হতে পারবেন না। কিন্তু অনেক সাধুসঙ্কল্প ব্যক্তি একথা বুঝে উঠতে পারেন না, আর তার ফলে তাদের মৌলিকতার স্বপ্ন নিয়ে অর্ধেক জীবন তারা অন্ধকারে হাড়ে কাটান।…আমি যা করতে পেরেছি তা শুধু আমার নিজের জ্ঞানের ফলে কখনো নয়, আমার চারপাশের শত সহস্র বস্তু ও ব্যক্তি আমাকে যে-সব উপকরণ যুগিয়েছে তারও ফলে। মূর্খ ও পণ্ডিত, উদারমনা ও সংকীর্ণমনা, বালক যুবক ও প্রবীণ-সবাই আমার কাছে ব্যক্ত করেছে কি তারা অনুভব করেছে চিন্তা করেছে, কেমন করে তারা জীবন নির্বাহ করেছে কাজ করেছে, ও কি অভিজ্ঞতা তারা অর্জন করেছে; আমার কাজ হয়েছিল এরা যা আবাদ করেছে হাত বাড়িয়ে তাই সংগ্রহ করা।

২৮৬

মনের উপরে গভীর রেখাপাত করে। সবারই মুখে যিনি দয়াল প্রেমময় ইত্যাদি নামে পরিকীর্তিত, তারই সামনে এমন ধ্বংস কি করে সম্ভবপর, সেই চিন্তায় তার চিত্ত কিছুদিন ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে। কিন্তু তার স্বভাবত-সৌন্দর্যানুরাগী মনে এ দুশ্চিন্তার ভার স্থায়ী হয় নি। তার উপর ধর্মসম্বন্ধে বহু বাদানুবাদ তিনি অনেক সময়েই শুনতেন। এই সব থেকে ইহুদি-পুরাণের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ক্রোধপরায়ণ ঈশ্বরে অপ্রত্যয় ও প্রকৃতির অধীশ্বর শান্ত সুন্দর ঈশ্বরে প্রত্যয় তার বালক-মনে প্রবল হতে থাকে। কিন্তু এই ঈশ্বরকে তিনি কেমন করে তার অন্তরের পূজা নিবেদন করবেন? তার পিতা বহু খনিজ দ্রব্য সংগ্রহ করেছিলেন, তিনি ঠিক করলেন সেই সব খনিজদ্রব্য প্রকৃতির বৈচিত্র্যের প্রতীকরূপে একখানি সুদর্শন কাষ্ঠখণ্ডের উপরে সাজাবেন। কিন্তু কেমন করে মানুষের মনের স্তব পরিব্যক্ত হবে? শেষে ঠিক হলো তার ছবি আঁকার Pastel পেন্সিল সেই সব ধাতুদ্রব্যের উপরে দাঁড় করিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেবেন, তা থেকে যে ধূম কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠবে সেই হবে মানুষের মনের স্তবের প্রতিচ্ছবি।-এক প্রভাতে তিনি এইভাবে ঈশ্বরের প্রতি স্তুতি নিবেদন করলেন–Pastel পেন্সিলে আগুন ধরালেন উদীয়মান সূর্যের দিকে আতস-কাঁচ ধরে’। কিন্তু এই স্তব নিবেদনের এক মন্দ ফল ফলেছিল-Pastel পেন্সিল পুড়ে গিয়ে সেই সুদর্শন কাষ্ঠখণ্ডে আগুন ধরেছিল, আর তাতে তার সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এর উপরে গ্যেটে একটি সুগভীর মন্তব্য করেছেন

The accident might almost be considered a hint and warning of the danger there always is in wishing to approach the Deity in such a way.*

তাঁর বাল্য-জীবনের অপর একটি লক্ষ্যযোগ্য ঘটনা এই:-একদিন এক স্কুলে তাঁর সহপাঠীরা এই বলে তাকে জব্দ করতে চেষ্টা করে যে, তাঁর পিতা তাঁর পিতামহের ছেলে নন, অন্য কোনো বড় লোকের ছেলে (তাঁর পিতামহ দর্জি-ব্যবসায়ী ছিলেন)। সঙ্গীদের এই নির্মম কথার উত্তরে বালক গ্যেটে শান্ত-কণ্ঠে বলেছিলেন-এ যদি সত্য হয় তাতেই বা এমন কি ক্ষতি; জীবন এমন এক মহা দান যে, এর জন্য কার কাছে কে ঋণী সে কথা না ভেবেও পারা যায়, কেননা এতটুকু তো সত্য যে, ঈশ্বরের কাছে থেকেই তা এসেছে, আর তার সামনে সবাই সমান।

তাঁর পিতা উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি ছিলেন; কিন্তু নিজে জীবন বেশী কিছু করতে পারেন নি। তাঁর ব্যর্থ জীবন তাঁর পুত্রের ভিতর দিয়ে সার্থকতা লাভ করুক এই ছিল তাঁর সাধনা। পুত্রকে প্রায় সর্ববিদ্যাবিশারদ করবার আয়োজন তিনি করেছিলেন। কলেজে প্রবেশের পূর্বে চৌদ্দ পনের বৎসর বয়সে গ্যেটে মাতৃভাষা ভিন্ন লাতিন, ইতালীয়, হিব্রু, গ্রীক, ফরাসী, ও ইংরেজি শিখেছিলেন, এর উপর চিত্রাঙ্কন, নৃত্যগীত, অসিচালনা, উদ্যানরচনা ইত্যাদিতেও অভ্যস্ত হয়েছিলেন। তাঁর পিতার ইচ্ছা ছিল, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়ন করেন। কিন্তু প্রথমে Leipsig এ গিয়ে তিনি তা করেন

এইভাবে ঈশ্বরের উপলব্ধি-চেষ্টায় যে বিপদ এই দুর্ঘটনাকে গণ্য করা যেতে পারে সেই সম্বন্ধে সঙ্কেত ও সাবধান-বাণীর তুল্য।

২৮৭

নি। পরে Strasburg-এ তিনি আইন অধ্যয়ন করেছিলেন। কিন্তু তার প্রাণের সামগ্রী বরাবরই ছিল কাব্যচর্চা ও চিত্রাঙ্কন।

গ্যেটের সাহিত্যিক গুরুদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এঁদের সাহায্যে তার জ্ঞান দিন দিন গভীরতর হচ্ছিল। কিন্তু তাঁর কাব্যের সত্যিকার উৎস তার এই গুরুদের প্রেরণা তত নয়, যত তাঁর নিজের প্রণয়-ব্যাপার। সেই প্রেমের দহন তিনি সারাজীবন ভোগ করেছেন। বাস্তবিক, গ্যেটের ভিতরে একই সঙ্গে দুই অদ্ভুত ধারা যথেষ্ট লক্ষ্যযোগ্য-একটি জ্ঞানান্বেষণ, অপরটি প্রেমবিধুরতা।

গ্যেটের প্রণয়-কাহিনী তাঁর জীবন ও কাব্যের ইতিহাসে খুব বড় জায়গা দখল করে আছে। কিন্তু এখানে তাকে ভুল বোঝা এতই স্বাভাবিক যে, তার স্বদেশবাসীরাও বহুকাল পর্যন্ত তাঁকে এ ব্যাপারে নিকৃষ্ট রঙে রঞ্জিত করে এসেছেন। আমাদের জন্য ব্যাপারটি আরো কঠিন এইজন্য যে, আমাদের সংস্কার অনেক বিভিন্ন, তা যতই কেন আমরা ইয়োরোপের প্রতি প্রীতি-সম্পন্ন না হই।

দৃষ্টান্তস্বরূপ ধরা যেতে পারে Frau Von Stein-এর সঙ্গে তাঁর দীর্ঘকালব্যাপী সম্বন্ধ। তাঁর চরিতাখ্যায়কদের কেউ কেউ বলেছেন, গ্যেটে ও Von Stein-পত্নীর সম্বন্ধ মোটের উপর একটি প্রগাঢ় বন্ধুত্বের সম্বন্ধ, তার বেশী কিছু নয়; অপরে এ মত আদৌ গ্রাহ্য করেন নি। তেমনিভাবে জটিল বৃদ্ধবয়সে যুবতী বন্ধুপত্নী Marianne Von Willemer-সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ-যা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল হাফিজের অনুসরণে তার সুবিখ্যাত West-Eastern Divan, কিন্তু এর জন্য যারা তাকে ইন্দ্রিয়পরতন্ত্র বলতে চান, তাদের মত গ্রহণ করতে আমাদের বাধে এইজন্য যে, কবির অন্তরাত্মা প্রতিবিম্বিত হয় যাতে সেই কাব্যে গ্যেটে যে প্রেমের ছবি অঙ্কিত করেছেন, তাতে ফুটে রয়েছে এক আশ্চর্য পবিত্রতা। তার Sorrows of Werther-এ ভের্টের Albert-এর বিবাহিতা Charlotte-এর প্রেমে আত্মহারা; সে এক জার্মান “মজনু”; কিন্তু সেই Werther-ই এক জায়গায় বলছেন

“….. Is not my love for her the purest most holy…has my soul ever been sullied by a single sensual desire?”

তার “Elective affinities” গ্রন্থে নায়ক Eduard তাঁর স্ত্রীকে বিস্মৃত হয়ে Otile র প্রেমে পাগল হয়েছেন; কিম্ভ Otile তার কাছে দেববিগ্রহের মতে পবিত্র, Otile-এর একটু ইঙ্গিতে কঠোরতম সংযমে তিনি নিজেকে বাঁধছেন।-ক্রোচে বলেছেন, Faust প্রথম খণ্ডে Margaret-এর সঙ্গে Faust-এর সম্বন্ধে ইন্দ্রিয়পরতন্ত্রতা বেশী প্রকাশ পেয়েছে, Faust তাঁর সমস্ত জ্ঞানান্বেষণ বিস্মৃত হয়ে বৃদ্ধা দূতীর সাহায্যে Margaret কে আয়ত্ত করছেন। দূতীর মধ্যবর্তিতাই যদি ক্রোচের কাছে প্রধান আপত্তিকর ব্যাপার হয় তবে সেই কালের দোহাই দিয়ে সহজেই তাকে অনেকখানি নিরুত্তর করা যেতে

তার প্রতি আমার প্রেম পরম শুদ্ধ পরম পবিত্র নয় কি?…আমার অন্তরাত্মা কি কখনো একটি ভোগাকাক্ষার দ্বারাও কলুষিত হয়েছে?

২৮৮

পারে। তা ছাড়া, প্রথম কয়েক দৃশ্যের সেই বিশ্বজ্ঞনের পিপাসু সুন্দর ও সবল-চিত্ত

aust যে পরে বলে কামুক হয়ে গেছে। তা সত্য নয়। Margaret-র প্রেমে বাস্তবিকই তিনি আত্মহারা; Margaret-এর কক্ষে গোপনে প্রবেশ করে তিনি তার নিজের ভিতরে এক রহস্যময় পরিবর্তন অনুভব করছেন:

“……… And I? What drew me here with power? How deeply am I moved, this hour! What seek I? Why so full my heart and sore? Miscrabele Faust! I know thee now no more. Is there a magic vapour here? I came with lust of instant pleasure, And lie dissolved in dream of love’ sweet leisure…

তার Tasso, Iphigenie, প্রভৃতি গ্রন্থ থেকেও এই ধরণের প্রমাণ দেওয়া যেতে পারে।

কিন্তু এমনি করে তার পক্ষ সমর্থন করলেও আমাদের দেশের সর্বসাধারণের কথা ছেড়ে দিয়ে শিক্ষিত-সাধারণকে নিয়েও নরনারীর এমন সম্বন্ধ কল্পনা করা খুব সহজ কি? এই সুন্দর স্বেচ্ছাচার আমাদের দেশের হিন্দু-দেবদেবীর লীলায় বেশ আছে, মুসলমানের বেহেশতের প্রচলিত ধারণায় খানিকটা আছে, কিন্তু এরই ভিতর দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে শ্রেয়ে পৌঁছনো-এ আজো আমাদের সহজ ধারণার বহির্ভূত।-কেউ কেউ বলেছেন, গ্যেটের ভিতরে ‘পাপ বোধ’, অন্যায় বোধ এসব ছিল

, মানুষের জন্য বিশেষ কোনো দরদ তিনি অনুভব করতেন না, যেমন Amief বলেছেন

“He is a Greek of the great time, to whom the inward crises of the religious consciousness are unknown……..he takes no more interest than Nature herself in the disinherited the feeble, and the oppressed……….

আর আমি? কিসের সবল আকর্ষণ আমাকে এখানে এনেছে? কি প্রবল ভাবেই না আন্দোলিত হচ্ছে আমার অন্তর। কি আমি চাই? কেন এখন হৃদয় আমার এমন উদ্বেলিত ও ব্যথিত? হায় ফাউস্ট! তোমাকে আর চেনা যায় না।

এখানে কি কোনো যাদু-বাপ আছে? আপাততৃপ্তির কামনা নিয়ে আমি এসেছিলাম; কিন্তু প্রেমের স্বপ্নরসে আমি এখন নিমজ্জিত।

তবে ব্যাপারটি অন্য দিক দিয়েও ভাবা যেতে পারে। নারীর ব্যক্তিত্ব আমরা স্বীকার করি না; সেই ব্যক্তিত্ব স্বীকার করলে গ্যেটের জীবন ও প্রয়াস হয়ত মানুষের স্বাভাবিক জীবনের ব্যাপার বলেই আমরা ধারণা করতে পারব। তিনি হচ্ছেন গৌরব-যুগের একজন গ্রীক ‘ধর্মবোধের অন্তর-বেদনা যার কাছে অজ্ঞাত।….জগতের বঞ্চিত দুর্বল ও অত্যাচারিতদের প্রতি প্রকৃতির মতোই তিনি উদাসীন।

২৮৯

…..কিন্তু এ মত যে সত্য নয় তা Amiel নিজেই সেই দিনের ডায়রীর শেষের দিকে ব্যক্ত করেছেন

“One must never be too hasty in judging these complex natures. »34

প্রকৃতির সমস্ত ভাঙচুর ছাপিয়ে জাগে প্রাণের সবুজ উৎসব,-আমাদের মনে হয় গ্যেটের প্রতিভা ছিল প্রকৃতিরই মতো অপরিসীম বীর্যবন্ত, তাই তার ভিতরকার সমস্ত দুঃখ-বিপত্তি বেদনা বিক্ষোভ আত্মগোপন করেছিল এক পরম রমণীয় প্রফুল্লতার অন্তরালে। এই সম্পর্কে গ্যেটে নিজেও বলেছেন

Only he who has been the most sensitive can become the hardest and coldest of men, for he has to encase himself in triple steel…….and often his coat of mail oppresses him.

গ্যেটের ভিতরে একই সঙ্গে প্রেমবিধুরতা ও জ্ঞানান্বেষণ বিদ্যমান এর ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ সম্বন্ধে বহু কথা বলবার আছে-গ্যেটে সম্বন্ধে জিজ্ঞাসুদের এটি বিশেষ অনুধাবনের বিষয়। প্রেমে তিনি যেন একেবারে আত্মহারা হয়ে পড়েন আর তার আর একটি চেতনা যেন বসে বসে তাঁর মত্ততার কাহিনী সংগ্রহ করতে থাকে। এই আশ্চর্য বাস্তবপ্রীতি, এই যেন গ্যেটে-প্রতিভার সবখানি কথা। তাঁর গুরু ও বন্ধু Merk তার সম্বন্ধে বলেছিলেন-বাস্তব (সত্য) যা তুমি তাকে দাও কাব্য-রূপ You give poetic froin to the real.তাঁর কাব্যের এর চাইতে সুন্দরতর পরিচয় হয়ত আর দেওয়া যায় না। অথচ তার এই বাস্তব-প্রীতি কেন তথাকথিত realism-এ (বস্তুতন্ত্রতায়) পরিণত হলো না সে সম্বন্ধে তিনি নিজেই বলেছেন:

প্রকৃতির সঙ্গে শিল্পীর সম্বন্ধ দ্বিবিধ; তিনি একই সঙ্গে তার প্রভু ও দাস। দাস এই কারণে যে পার্থিব সামগ্রীর সাহায্যে তাঁকে কাজ করতে হয় নিজেকে বোঝাবার জন্য; আর প্রভু এই কারণে যে, এইসব পার্থিব সামগ্রী তিনি উপায়স্বরূপ ব্যবহার করেন তার উচ্চতর উদ্দেশ্য ফুটিয়ে তুলতে।-সমগ্রতার সাহায্যে শিল্পী তার মনোভাব ব্যক্ত করেন। এই সমগ্ৰতা কিন্তু প্রকৃতিতে নেই; এটি তার নিজের চিত্তের ফল, অথবা বলা যায়, ফল-সঞ্চারী ঐশ্বরিক প্রেরণা।

*C

এই জটিল প্রকৃতির লোকদের সম্বন্ধে তাড়াতাড়ি কোনো মত প্রকাশ করা অসঙ্গত। Amiel’s Journal-p. 187 যিনি সব চাইতে অনুভূতিপ্রবণ কেবল তিনিই হতে পারেন, সব চাইতে কঠিন ও নির্বিকার; কেননা তার পক্ষে প্রয়োজন হয় নিজেকে বহুস্তর বর্মে আবৃত করা………আর অনেক সময় এই বর্ম হয় তার জন্য পীড়াদায়ক। The artist has a twofold relation to nature; he is at once her master and her slave. He is her slave in as much as he must work with earthly things in order to be understood, but he is her master, in as mach as he subjects these earthly means to his higher intentions and renders them subscrvient.

২৯০ না।

“ “

“ **

**

গ্যেটের এই ধরণের মতামত অনুসরণ করে Dr. Rudolf Steiner একটি বই লিখেছেন, তার নাম তিনি দিয়েছেন Goethe as the founder of a new Science of A Esthetics. তার মূল কথা কতকটা এই-প্রকৃতির ভিতরে বুঝতে পারা যায় এক উদ্দেশ্যের ইঙ্গিত, মানুষের জীবনে রয়েছে তারও চাইতে বৃহত্তর উদ্দেশ্যের ইঙ্গিত,-শিল্পীর রচনায় তারই প্রকাশ; যেমন গ্যেটে বলেছেন…

In that Man is placed on Nature’s pinnacle, he regards himself as another whole Nature, whose task is to bring forth inwardly yet another pinnacle. For this purpose he heightens his powers imbuing himself with all perfections and virtues, calling on choice, order, harmony, and meaning, and finally rising to the production of the work of art, which takes a prominent place by the side of his other actions and works. Once it is brought forth, once it stands before the world in its ideal reality, it produces a permanent effect-it produces the highest effect-for as it develops itself spiritually out of a unison of forces, it gathers into itself all that is glorious and worthy of devotion and love, and thus breathing life into the human form uplifts man above himself, completes the cycle of his life and activity, deifies him for the present in which the past and future are included……….”

এ সম্বন্ধে গ্যেটের আরো কয়েকটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য

The artist would speak to the world through an entirely; however, he does not find this entirely in nature; but it is the fruit of his own mind, or if you like it, of the aspiration of a fructifying divine breath. প্রকৃতির চূড়ার অধিষ্ঠিত মানুষ নিজেকে জ্ঞান করে আর-এক পূর্ণাঙ্গ প্রকৃতি বলে, তার কাজ হচ্ছে। অন্তর্লোক আর-এক চূড়ার সৃষ্টি করা। এই উদ্দেশ্য সে তার ক্ষমতার উৎকর্ষ সাধন করে-সমস্ত সৌষ্ঠব ও গুণপণায় সে নিজেকে করে ভূষিত, নির্বাচন শৃঙ্খলা সামঞ্জস্য অর্থবোধ, এ-সবের হয় তার বিশেষ প্রযোজন, অবশেষে লাভ হয় তার শিল্প-সৃষ্টির যোগ্যতা যা তার অন্যান্য কর্ম ও কীর্তির পাশে লাভ করে বিশেষ মর্যাদার স্থান। একবার যদি এর সৃষ্টি হয়, একবার যদি এই শিল্পসৃষ্টি জগতের সামনে দাঁড়ায় মানস-সত্য রূপে, তা হলে এর লাভ হয় এক স্থায়ী প্রভাব-শ্রেষ্ঠতম প্রভাব; কেননা বহু শক্তির সম্মিলন-ক্ষেত্রে আত্মিক শক্তিরূপে এ যে নিজেকে বিকশিত করে তোলে এই জন্য জীবনে যা-কিছু শ্রেয় প্রেয় ও গৌরবের সে-সবই নিজের ভিতরে সঞ্চিত করে, আর এই ভাবে মনুষ্যমূর্তিতে (নূতন ভাবে) প্রাণসঞ্চার করে মানুষকে করে মহত্তর, তার জীবন ও কর্মের পরিধিকে করে পূর্ণাঙ্গ, আর অতীত ও ভবিষ্যৎ-সমম্বিত বর্তমানে তাকে দান করে দেবত্ব। Dr. R. Steiner তাঁর বইখানিতে শেষ মন্তব্য করেছেন এই:- Beauty is not the divine in a cloak of physical reality; no, it is physical reality in a cloak that is

divine.

-সৌন্দর্য পার্থিব আবরণে এক দিব্য বস্তু নয় বরং দিব্য আবরণে পার্থিব সত্য। (তিনি এখানে দার্শনিক Schelling-এর সৌন্দর্য-তত্ত্বের প্রতিবাদ করেছেন)।

২৯১

………….Occasional poems (are) the first and most genuine of all kinds of poetry….

……….. The first and last thing demanded of genius is love of truth……..

……….I seek in everything a point from which much may be developed……

Theodore Watts-Dunton Encyclopaedia Britannica-য় Poetry শীর্ষক লেখায় কবি-দৃষ্টিকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন- Absolute Vision শুদ্ধদৃষ্টি ও Relative Vision আপেক্ষিক দৃষ্টি। সেই Absolute Vision এর দৃষ্টান্ত তিনি দেখেছেন Shakespeare এ ও Homer-এ। Absolute Vision বলতে তিনি বুঝেছেন বস্তুর নিজস্বতার বিবৃতি: কবি নিজের রাগ-দ্বেষ একেবারে ভুলে গিয়ে কোনো বস্তুর বা কোনো

ব্যক্তির মর্মে প্রবেশ করে তাকে বিশ্লেষণ করছেন, রূপময় করছেন। এই ভাবে সম্পূর্ণভাবে আত্মবিস্মৃত হয়ে Absolute Vision-লাভ করা মানুষের পক্ষে সম্ভবপর কি

, অর্থাৎ শেক্সপীয়র ও হোমার তাদের Absolute Vision-এর মুহূর্তেও শেক্সপীয়রত্ব ও হোেমারত্ব বিবর্জিত হয়েছিলেন কি না, সে বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতে পারে। তবে এই আত্মবিলোপ কবির পক্ষে মানুষ হিসেবে যতখানি সম্ভবপর সেদিক দিয়ে দেখলে হয়ত বোঝা যাবে, সত্যিকার Absolute Vision-অর্থাৎ মানুষের মনের বহু স্তরের বহু গ্রামের অবস্থা সম্বন্ধে Vision-গ্যেটের চাইতে শেকস্পীয়রে ও হোমারে বেশী নয়। কিন্তু সাহিত্যের প্রচলিত শাস্ত্র অনুসারে এ হয়ত blasphemy-”কাফেরী কালাম”-তাই বেশী কিছু না বলাই শোভন।

অল্প বয়সেই গ্যেটে বলেছিলেন-আমি প্রকৃতির মতো অকৃত্রিম হব, ভাল হব, মন্দ হব, তোমাদের কোনো আদর্শ আমাকে বাধা দিতে পারবে না (All your ideals shall not prevent me from being genuine, and good and bad-like Nature).

এই যাঁরা সাধনা প্রচলিত কথায় যাকে বলা হয় কবিত্ব কাব্য-সৌন্দর্য, তাতেই যে তিনি সন্তুষ্ট থাকবেন তা সম্ভবপর নয়। ঘটেছেও তাই; গ্যেটে শুধু কবি নন, তিনি বিজ্ঞানবিৎ (বিজ্ঞানে তাঁর দান স্বীকৃত হয়েছে), চিত্র-সমঝদার, শেষ বয়সে সঙ্গীত সমঝদার, ধর্ম-তত্ত্বজ্ঞ, এমন-কি মরমী-সাধনার সঙ্গেও সুপরিচিত। তাঁর চিত্তের এই বিরাটত্বের জন্যই জনৈক লেখক তাঁকে আধুনিক জগতের সমস্ত চিন্তাশীলের গুরু বলেছেন:

……..We are all disciples of Goethe whether we know it or not, and any liberal mind has but to be brought into contact with the master to realise that

সাময়িক কবিতাই আদি ও অকৃত্রিমতম কবিতা। প্রতিভার সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ কর্তব্য-সত্যপ্রীতি। প্রত্যেক বিষয়ে আমি এমন একটি স্থান খুঁজি যা থেকে প্রভূত বিকাশ সম্ভবপর।

২৯২

inevitable discipleship………..” John Macy-The Story of the World’s

Literature.’

গ্যেটে নিজেও বলেছেন যিনি প্রকৃতই আমার রচনা ও চরিত্রের মর্মাগ্রাহী হয়েছেন তাকে স্বীকার করতে হবে যে তার ফলে তিনি একপ্রকার চিত্তের অবন্ধন লাভ করেছেন।

প্রচলিত ধর্মে আস্থাবান না হয়েও ঈশ্বর সম্বন্ধে যে সব কথা তিনি বলেছেন, তা বাস্তবিকই বিস্ময়করভাবুকের জন্য আনন্দের অফুরন্ত প্রস্রবণ। তাঁর Faust এর সেই who dare express Him…..”“ ইত্যাদি সুবিখ্যাত, এভিন্ন অন্যান্য সুন্দর উক্তিও আছে, যেমন–

* আমরা সবাই গ্যেটের শিষ্য তা আমরা জানি আর নাই জানি; যে-কোনো উদারচিত্ত ব্যক্তি এই

গুরুর সংস্পর্শে এলেই সেই অবশ্যম্ভাবী শিষ্যত্বের কথা বুঝবেন। “……..And any one who has really learnt to understand my works and my character is bound to acknowledge that he has thereby attained to a certain freedom of the spirit.” মার্গারেটের মনে সন্দেহ জেগেছে হয়ত ফাউসট ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন; তার প্রশ্নের উত্তরে ফাউস্ট বলেছেন: Who dare express Him? And who profess Him? Saying: I believe in Him! Who, feeling, seeing, Deny His being, Saying: I believe Him not! The All-upholding, The All-sustaining, Folds and upholds He not Thee, me, Himself? Arches there not the sky above us? Lies not beneath us firm the earth? And rise not, on us shining, Friendly, the everlasting stars? Look I not, eye to eye, on thee, And feel’st not, thronging To head and heart, the force, Still weaving its eternal secret Invisible, visible, round thy life? Vast as it is, fill with what force thy heart, And when thou in the feeling wholly blessed art, Call it then, what thou wilt, Call it Bliss! Heart! Love! God! I have no name to give it!

২৯৩

“…. what know we of the idea of the Divinity? and what can our narrow ideas tell of the Highest Being? Should I, like a Turk, name it with a hundred names, I should still fall short and in comparison with the infinite attributes, have said nothing.”

অথবা

Let men continue to worship Him who gives the ox his pasture and to man food and drink, according to his need. But I worship Him Who has filled the world with such a productive energy, that is only the millionth part became embodied in living existences the globe world so swarm with them

Feeling is all in all:

The Name is sound and smoke, Obscuring heaven’s clear glow.

স্পর্ধা কার তাকে ব্যক্ত করবে? বলবে কে-তাকে জানি, তাতে বিশ্বাস রাখি!

অনুভূতি ও দৃষ্টি অব্যাহত রেখে অস্বীকার করবে কে তাকে! বলবে কে বিশ্বাসী তাকে নই! সর্বধর সর্বাশ্রয় ধারণ কি করছেন না তিনি তোমাকে, আমাকে নিজেকে? মাথার উপরে নেই কি আকাশের খিলান? পায়ের নিচে শান্ত ধরণী? সামনে জ্বলজ্বল-করা বন্ধুর-মতো-চেয়ে-থাকা চিরদিনের তারা? চোখ কি আমার দেখছে না তোমাকে? অনুভব কি করছ না তুমি, মনে প্রাণে, তোমার জীবন ঘিরে চলেছে কি রহস্যময় শক্তির শীলা?–কখনো দৃশ্য কখনো অদৃশ্য!

বিরাটের দ্বারা তোমার হৃদয় পূর্ণ কর নিঃশেষে! আর যখন তুমি ভাগ্যবতী এই অনুভূতি-ধনে তখন নাম দিয়ে এর পরমা শান্তি, হৃদয়, প্রেম, ঈশ্বর-যা খুশি! আমি অক্ষম এর নাম দিতে। অনুভূতিই আমার সব। নাম শুধু কোলাহল ও কুহেলী আকাশের প্রোজ্জ্বলতা তাতে হয় আচ্ছন্ন। ঈশ্বরের ধারণা সম্বন্ধে আমাদের কিইবা জ্ঞান আছে। আমাদের সংকীর্ণপরিসর ভাবনা সেই পরমপুরুষের সম্বন্ধে কতটুকুই বা ব্যক্ত করতে পারে। যদি মুসলমানের মতো শতনামে আমি তাকে ডাকি তবু অকথিত থাকবে বহু, আর তার মহিমার কথা ভাবলে বুঝব-কিছুই বলা হয় নি।

২৯৪

bot War. Pestilence, Flood, and Fire would be powerless to diminish them.

That is my God.”

তার আর একটি উক্তিও প্রণিধানযোগ্য-যারা ধর্মপ্রাণ সৃষ্টি শুধু তাদের দ্বারাই সম্ভবপর- only religious men can be creative.

গ্যেটের ভিতরে স্বজাতিপ্রেমের তীব্রতা ছিল না। এজন্য তাঁকে কম নিন্দা ভোগ করতে হয় নি। কিন্তু দার্শনিক ক্রোচে এতে মহা আনন্দিত হয়েছেন

“…I consider it singularly fortunate that among all the sublime poets, perennial sources of deep consolation, there should yet be one who, possessing a knowledge of human nature in all its aspects. such as no other poets ever possessed, nevertheless keeps his mind above and beyond political sympathies and the inevitable quarrels of nations.”

এ সম্বন্ধে গ্যেটে নিজে বহু কথা বলেছেন,

“National literature is now rather an unmeaning term; the epoch of world literature is at hand, and each one must try to hasten its approach.”

অন্যত্র

Altogether national hatred is something peculiar. You will always find it strongest and most violent where there is the lowest degree of culture. But there a degree where it vanishes altogether, and where one stands to a certain extent above nations and feels the weal or woe of a neighbouring people as if it had happened to one’s own. This degree of culture was conformable to my nature, and I had become strengthened in it long before I had reached my sixtieth year.’

১ অন্যেরা পূজা করুন তাঁকে যিনি ষাঁড়কে দিয়েছেন চরবার মাঠ আর মানুষকে দিয়েছেন তার

প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানীয়। কিন্তু আমি পূজারী তাঁর যিনি জগৎকে পূর্ণ করেছেন এমন প্রাণশক্তিতে যে, যদি তার অযুততম অংশও সক্রিয় হয় তবে জগত তার দ্বারা এমনভাবে পূর্ণ হবে যে, যুদ্ধ মড়ক বন্যা প্রভৃতির সাধ্য হবে না তার শক্তি হ্রাস করতে। এই আমার ঈশ্বর। মহাকবিরা হচ্ছেন আশা ও আনন্দের অফুরন্ত প্রস্রবণ সেই মহাকবিদের মধ্যে এমন একজনও যে আছেন যিনি মানব-প্রকৃতির সর্ব ক্ষেত্রের জ্ঞানে সর্বাগ্রগণ্য হয়েও রাজনৈতিক পক্ষপাত ও জাতিতে জাতিতে অবশ্যম্ভাবী দ্বন্দ্বের বহু উর্ধ্বে নিজের চিত্ত স্থাপন করতে পেরেছেন, এ এক মহা সৌভাগ্য বলে আমি জ্ঞান করি। জাতীয় সাহিত্য এখন বরং এক অর্থহীন কথা। বিশ্বসাহিত্যের যুগ আসন্ন হয়েছে আর প্রত্যেকেরই উচিত একে এগিয়ে আনা। মোটের উপর বিজাতিবিদ্বেষ এক অদ্ভুত ব্যাপার। যেখানে চিত্তোৎকর্ষের যত অল্পতা সেখানে এর তীব্রতা তত বেশি। কিন্তু চিত্তোৎকর্ষের এমন স্তর আছে যেখানে এর সম্পূর্ণ বিলোপ ঘটে, ফলে এর অনুভাবকের স্থান লাভ হয় জাতীয়তার উর্ধ্বে। পর-জাতির দুঃখবিপত্তি তখন তার মনে হয়

গ্যেটে সম্বন্ধে যে ক’জন আলোচকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, তাদের কেউই কয়েক শত পৃষ্ঠার কমে তাঁদের বক্তব্য শেষ করতে পারেন নি। তবু তাদের লেখা ফেনানো লেখা নয়। তাঁর সুদীর্ঘ জীবন-কাহিনী, তার কাব্যের কিছু কিছু পরিচয়। আপাততঃ অকথিতই রইল।

গ্যেটে-সমুদ্রের হাওয়া মানস-স্বাস্থ্যের জন্য অমূল্য, এই একটি কথাই বলতে চেষ্টা করেছি হয়ত।

মুসলিম সাহিত্য-সমাজের চতুর্থ বার্ষিক অধিবেশনে পঠিত। চৈত্র, ১৩৩৬

রবীন্দ্রনাথের গান

প্ৰিবাহিণী, গীত-মালিকা, কেতকী, শেফালী ও বসন্ত অবলম্বনে লিখিত]

রবীন্দ্রনাথের সুর-সৃষ্টিতে মৌলিকতা অনেকখানি। কিন্তু সেই সুর বাদ দিয়ে কবিতা হিসেবেও তাঁর গানগুলো পড়া যেতে পারে, আর পড়ে যে-আনন্দ পাওয়া যায় তার স্বাদ বেশ নতুন রকমের। এগুলো যে রবীন্দ্রনাথেরই রচনা এ-সম্বন্ধে ভুল হবার সম্ভাবনা অবশ্য নেই, তবু রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য কবিতার সঙ্গে, এমন কি গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য ও গীতালির কবিতার সঙ্গে তুলনায়ও এ-সবের পার্থক্য চোখে পড়তে দেরি হয় না।

গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য প্রভৃতির কবি তাঁর গভীর আত্মিক অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গে বিচার-পরায়ণও বটেন। কোনো বিশেষ মতবাদে পৌঁছা অবশ্য কখনো তার কাম্য হয়ে ওঠে নি, তবু নিজে যখন জীবনের পথে সত্যিকার চলা চলতে চাচ্ছেন, তখন তার চারপাশের লোকের চিন্তাভাবনার সঙ্গে তার পার্থক্যটি সহজেই যে তার ভাবনার বিষয় হবে এ স্বাভাবিক। এই গানগুলোর ভিতরে সেই বিচার-বিশ্লেষণের ভাব নেই বলেই চলে। তাঁর নিজের বিশেষ একটি ভাব-মুহূর্তে, প্রকৃতির বিশেষ একটি রূপ, এই সবই আশ্চর্য হাল্কা হাতে এঁকে এঁকে তিনি চলেছেন। বাংলা ভাষা এক অদ্ভুত-সৌন্দর্য-মাখা সঙ্কেত-প্রাণ ভাষা হয়ে উঠেছে তার হাতে।

তার এই সব গানের সম্পর্কে বাংলার বাউল সঙ্গীতের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। কিন্তু অবন্ধন-প্রিয় বাউলের কেমন-একটি বিশেষ ঝোঁক এক সুস্পষ্ট তত্ত্বের পানে। এই সব গানের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ কিন্তু নিতান্তই অ-রূপের রূপের শিল্পী।

তার নিজের জাতির দুঃখ-বিপত্তির মতো। চিত্তোকর্ষের এই স্তরের সঙ্গে আমার প্রকৃতির সহজ যোগ ছিল, আর ষাট বৎসর বয়সের বহু পূর্বেই এতে আমার স্থিতিলাভ হয়েছিল। কবিগুরু গ্যেটে প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড দ্র:।

২৯৬

পরাণ আমার বাঁধন হারায়

নিশীথ রাতের তারায় তারায় আকাশ আমায় কয় কী যে কয় কেইবা জানে।

অথবা

নিদ্রাহারা রাতের এ গান বাধব আমি কেমন সুরে? কোন রজনীগন্ধা হতে আনব সে তান কণ্ঠে পুরে ॥

সুরের কাঙাল আমার ব্যথা

ছায়ার কাঙাল রৌদ্র যথা, সঁঝ সকালের বনের পথে উদাস হয়ে বেড়ায় ঘুরে ॥ এই সব গানের রচয়িতা যে ভক্ত বা সত্যান্বেষী নন তা নয়, কিন্তু বিশেষভাবে তিনি শিল্পী; তাঁর ভক্তের অতলস্পর্শ ও রঙীন হৃদয়, তীক্ষ্ণ সত্যদৃষ্টি, এ সব তাঁকে সাহায্য করেছে এই অদ্ভুত শিল্প-চাতুর্য লাভে।

এই সব গানের সব চাইতে বড় সংগ্রহ প্ৰবাহিণীতে গানগুলোকে ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে-গীতগান, প্রত্যাশা, পূজা, অবসান, বিবিধ ও ঋতুচক্র। কিন্তু এই ধরণের বিভাগের চাইতে রচনার ক্রম-অনুসারে সাজালেই হয়ত পাঠকদের বেশী উপকার হতো। সূক্ষ্ম, অতি সূক্ষ্ম, ভাবের খেলা, ঘাত-প্রতিঘাত, এ সব গানে এত বেশী যে তারই জন্য কোনো ধরণের শ্রেণীবিভাগ ব্যর্থ হওয়াই স্বাভাবিক।

‘প্রত্যাশা বিভাগ থেকে একটি গান নেওয়া যাক

আমি জ্বালব না মোর বাতায়নে প্রদীপ আনি। আমি শুনব বসে আঁধার-ভরা গভীর বাণী ॥

আমার এ-দেহ মন মিলায়ে যাক নিশীথ রাতে,

আমার লুকিয়ে ফোঁটা এই হৃদয়ের পুষ্পপাতে

থানা ঢাকা মোর বেদনার গন্ধখানি ॥ আমার সকল হৃদয় উধাও হবে তারার মাঝে যেখানে ওই আঁধার বীণায় আলো বাজে।

আমার সকল দিনের পথখোঁজা এই হল সারা এখন দিগবিদিকের শেষে এসে, দিশাহারা

কিসের আশায় বসে আছি অভয় মানি ॥

এতে শেষের চরণে প্রত্যাশার কথা আছে বটে; কিন্তু এই কবিতার রস হয়ত প্রত্যাশারই রস নয়। কবির এই-যে সব কথা

আমার এ দেহ মন মিলায়ে যাক নিশীথ রাতে

২৯৭

আমার লুকিয়ে ফোঁটা এই হৃদয়ের পুষ্পপাতে

থাকনা ঢাকা মোর বেদনার গন্ধখানি অথবা

আমার সকল হৃদয় উধাও হবে তারার মাঝে

যেখানে ওই আঁধার বীণায় আলো বাজে

এ-সবে প্রত্যাশার চাইতে কেমন-এক অ-প্রত্যাশার সৌন্দর্য উপভোগই আমাদের বেশী করে চোখে পড়ে। প্রত্যাশা বিভাগের জন্য একটি কবিতা থেকে এ কথাটি আরো ভালো বোঝা যাবে।

কেন-যে মন ভোলে আমার মন জানে না। তারে মানা করে কে আমার মন মানে না।

কেউ বোঝে না তারে।

সে-যে বোঝে না আপনারে, সবাই লজ্জা দিয়ে যায়, সে তো কানে আনে না।

তার খেয়া গেল পারে।

সে-যে রইল নদীর ধারে। কাজ করে সব সারা ওই এগিয়ে গেল কারা আমনা-মন সে-দিক-পানে দৃষ্টি হানে না ॥

‘অ-প্রত্যাশা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এর প্রতি-শব্দরূপে অন্য একটি শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে-নিঃসঙ্গতা। কিন্তু এই দুয়েরই জন্য একটুখানি ভূমিকার হয়ত প্রয়োজন।

আমাদের প্রত্যেকেরই মনের হয়ত এই দুইটি দিক আছে : একদিকে আমরা দশের সঙ্গে যুক্ত-সেখানে ভাল-মন্দের লড়াই, সঞ্চয় ক্ষয়, তৃপ্তি অতৃপ্তি এ সবের আর অন্ত নেই, আর একদিকে আমরা নিতান্ত নিঃসঙ্গ-সেখানে শুধু নিঃসীম আকাশ আমাদের বন্ধু, আর কেউই নয়। সাধারণ মানুষ এই নিঃসঙ্গতা বা নিঃসীমতা কেমন এক ভীতির চক্ষে দেখেন, কিন্তু প্রতিভাবান এতে ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে কেমন-এক গোপন পুলকও অনুভব করেন।

এই নিঃসঙ্গতা বা নিঃসীমতার রস রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য কবিতায়ও কিছু কিছু আছে। কিন্তু তা যেন এক সহজ মহিমা লাভ করেছে এই সব গানে। এমন কি নিঃসঙ্গতাই এই সব গানের প্রধান সুর বা রস বলা যেতে পারে।

২৯৮

রবীন্দ্রনাথের এক-সময়ের পরমপ্রিয় ফরাসী-ভাবুক এমিয়েলও (Amiel) নিঃসঙ্গতা-রসিক। তিনি সময় সময় হয়েছেন নিঃসঙ্গতার রসে একেবারে বুদ। তার গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকায় Mrs. Humphry Ward তার এই মানসিক লক্ষণের নাম দিয়েছেন intoxication of the infiniteঅসীমের মাদকতা। রবীন্দ্রনাথ নিঃসঙ্গতার প্রেমিক; কিন্তু এর ভিতরে কুঁদ হয়ে যাওয়া, এটি তাতে হয় নি। বুঁদ হয়ে যাবার জন্য কেমন-এক আগ্রহ সময় সময় তার ভিতরে জেগেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর ব্যক্তিত্বের রস তার জন্য মধুর রয়ে গেছে। অনন্ত-সমুদ্রের কূলে হাওয়া খাওয়া তার খুব হয়েছে, সময় সময় তাতে ঝাঁপিয়ে পড়বার দুঃসাহসও তাতে জেগেছে, কিন্তু একটুখানি সাঁতার দিয়ে আবার কূলে উঠে সে-সমুদ্রের পানে তিনি চেয়ে দেখেছেন।

‘অনন্ত’-সরোবরে ‘আমিত্ব-কমলের এমনি এক পরম নিগূঢ় রূপ আর একজন কবির ভিতরে দেখবার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে তিনি ইয়োরোপের কবিকুলগুরু’ গ্যেটে।

বলেছি, নিঃসঙ্গতা রবীন্দ্রনাথের এইসব গানের প্রধান সুর। এ কথাটি অন্যভাবেও বলা যেতে পারে। একটি গান নেওয়া যাক

তোমার সুরের ধারা ঝরে যেথায় তারি পারে

দেবে কিগো বাসা আমায় একটি ধারে ॥

আমি ভরব ধ্বনি কানে,

আমি ভরব ধ্বনি প্রাণে, সেই ধ্বনিতে চিত্তবীনায় তার বাঁধিব বারে বারে ॥ আমার নীরব বেলা সেই তোমারি সুরে সুরে ফুলের ভিতর মধুর মতো উঠবে পুরে।

আমার দিন ফুরাবে যবে।

যখন রাত্রি আঁধার হবে হৃদয়ে মমার গানের তারা উঠবে ফুটে সারে সারে ॥

এখানে কবি আর তার প্রেমাস্পদের কথা আছে বটে, কিন্তু এই কবিতার শেষের ক’টি চরণের যে আবেদন

(আমার নীরব বেলা সেই তোমারি সুরে সুরে

ফুলের ভিতর মধুর মতো উঠবে পুরে।

আমার দিন ফুরাবে যবে

যখন রাত্রি আঁধার হবে হৃদয়ে মোর গানের তারা উঠবে ফুটে সারে সারে)

২৯৯

-আর এই ক’টি চরণেই হয়ত এই কবিতার বিশেষ সৌন্দর্য ফুটেছে- সেটি হয়ত নিঃসঙ্গতারই আবেদন। মিলন, মিলনের আশা, এ-সব যে কবির অবাঞ্ছিত তা বলব না, কিন্তু শুধু নিঃসঙ্গতারই মাধুর্য তার জন্য কম নয়।

এই ধরণের আরো কয়েকটি গানের উল্লেখ করা যেতে পারে

কূল থেকে মোর গানের তরী দিলেম খুলে, সাগর-মাঝে ভাসিয়ে দিলেম পালটি তুলে ॥ যেখানে ওই কোকিল ডাকে ছায়াতলে

সেখানে নয়, যেখানে ওই গ্রামের বধূ আসে জলে

সেখানে নয়, যেখানে নীল মরণ-লীলা উঠছে দুলে সেখানে মোর গানের তরী দিলেম খুলে ॥ এবার বীণা তোমায় আমায় আমরা একা। অন্ধকারে নাইবা কারে গেল দেখা! কুঞ্জবনের শাখা হতে যে-ফুল তোলে

সে-ফুল এ নয়, বাতায়নের পাতা হতে যে-ফুল দোলে

সে-ফুল এ নয়, দিশাহারা আকাশ-ভরা সুরের ফুলে

সেইদিকে মোর গানের তরী দিলেম খুলে ॥

পাখি আমার নীড়ের পাখি অধীর হলো কেন জানি।

সে কি শোনে আকাশ কোণে ভোরের আলোর কানাকানি ॥

ডাক উঠেছে মেঘে মেঘে

অলস পাখা উঠল জেগে লাগল তারে উদাসী ঐ নীল গগনের পরশখানি ॥

আমার নীড়ের পাখি এবার উধাও হলো আকাশ মাঝে।

যায়নি কারো সন্ধানে সে, যায়নি যে সে কোনো কাজে।

গানের ভরা উঠল ভরে

চায় দিতে তাই উজাড় করে নীরব গানের সাগর মাঝে আপন প্রাণের সকল বাণী ॥

মেঘের কোলে কোলে যায়রে চলে বকের পতি। ওরা ঘরছাড়া মোর মনের কথা যায় বুঝি ঐ গাঁথি গাঁথি ॥

৩০০

সুদূরের বীণার স্বরে কে ওদের হৃদয় হরে,

দুরাশার দুঃসাহসে উদাস করে সে কোন্ উধাও হাওয়ার পাগলামিতে পাখা ওদের ওঠে মাতি ॥ ওদের ঘুম ছুটেছে ভয় টুটেছে একেবারে অলক্ষ্যেতে লক্ষ্য ওদের-পিছন পানে তাকায় নারে।

যে বাসা ছিল জানা

সে ওদের দিল হানা,

-জানার পথে ওদের নাইরে মানা; ওরা দিনের শেষে দেখেছে কোন্ মনোহরণ আঁধার রাতি ॥

গহনরাতে শ্রাবণধারা পড়িছে ঝরে,

কেন গো মিছে জাগাবে ওরে? এখনো দুটি আঁখির কোণে যায় যে দেখা

জলের রেখা,–বলা বাণী রয়েছে যেন অধর ভরে ॥

হয় যেয়ো গুঞ্জরিয়া বীণার তারে

মনের কথা শয়ন-দ্বারে ॥ না হয় রেখো মালতী-কলি শিথিল কেশে

নীরব এসে, হয় রাখী পরায়ে যেয়ো ফুলের ডোরে।

কেন গো মিছে জাগাবে ওরে ॥

এ সব কবিতা সম্পর্কে কেউ যদি বলেন, এ-সবে বিরহের প্রকাশ বড় মধুর হয়েছে তাহলে সে-কথার প্রতিবাদ না করে শুধু এই কথাটি বলব-এ সব কবিতায় অনুভাবকের নিজের ব্যক্তিত্বেরই যে এক গূঢ় মধুর আস্বাদ আছে তার পানে চোখ না রাখলে কবিতাগুলোর প্রতি অবিচার করা হবে। অন্যের জন্য কবি আকুল যতখানি তার চাইতে ‘নিজের’ই মনোহারিত্বে মুগ্ধ তিনি বেশী।

কিন্তু কাব্যের রস-আস্বাদনে কোনো সূত্রের সাহায্য একান্তভাবে গ্রহণ করা বিড়ম্বনা বৈ আর কি। অতএব নিঃসঙ্গতা’ ‘বিরহ’ ইত্যাদি কথা থাকুক।

অন্যান্য বহুভাবের কবিতাও প্রবাহিণী গীতমালিকা প্রভৃতি গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। যেমন-প্রেমের কবিতা

৩০১

অলকে কুসুম না দিয়ো শুধু শিথিল কবরী বাধিয়ো।

কাজলবিহীন সজল নয়নে

হৃদয়-দুয়ারে ঘা দিয়ো৷ আকুল আঁচলে পথিক-চরণে

মরণের ফাঁদ ফাদিয়ো। করিয়া বাদ মনে যাহা সাধ নিদয়া নীরবে সাধিয়ো ॥ এস এস বিনা ভূষণেই

দোষ নেই তাহে দোষ নেই। যে আসে আসুক ঐ তব রূপ

অযতন-ঘঁদে দিয়ো শুধু হাসিখানি আঁখি-কোণো হানি।

উতলা হৃদয় ধাধিয়ো ॥

অথবা

নিশি না পোহাতে জীবন-প্রদীপ জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া

তোমার অনল দিয়া ॥ কবে যাবে তুমি সমুখের পথে দীপ্ত শিখাঁটি বাহি,

আছি তাই পথ চাহি ॥ পুড়িবে বলিয়া রয়েছে আশায় আমার নীরব হিয়া

আপন আঁধার নিয়া ॥ নিশি না পোহাতে জীবন-প্রদীপ জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া ॥

কিন্তু এই সব গানের প্রিয়া আর সুফী-কবিদের ‘মা’শুক’ (beloved) হয়ত একই দেশের মোহিনী।

প্ৰবাহিণীর একটি কবিতায় প্রকাশ-ভঙ্গির সৌন্দর্য অত্যদ্ভূত। চিন্তা-ধারা সুপরিচিত, কিন্তু নূতন প্রকাশ-ভঙ্গিমার জন্য এ কত নূতন!

মাটির বুকের মাঝে বন্দী যে-জল মিলিয়ে থাকে

মাটি পায়না তাকে ॥ কবে কাটিয়ে বাঁধন পালিয়ে যখন যায় সে দূরে,

আকাশপুরে, তখন কাজল মেঘের সজল ছায়া শূন্যে আঁকে।

মাটি পায়না তাকে।

৩০২

শেষে বজ্র তারে বাজায় ব্যথা-বহ্নি-জ্বালায়,

ঝঞ্ঝা তারে দিগবিদিকে কাঁদিয়ে চালায়। তখন কাছের ধন যে দূরের থেকে কাছে আসে

বুকের পাশে। তখন চোখের জলে নামে সে যে চোখের জলের ডাকে,

মাটি পায় রে তাকে ॥

এই গানগুলোতে কিন্তু একটি খুব চোখে পড়বার মতো ব্যাপার এই যে যে-মাটির প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ এত বেশী একান্তভাবে সেই মাটির মহিমা-সম্বন্ধে গান তাঁর খুব কম। “এইত ভাল লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়’ অথবা “যেদিন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে” প্রভৃতি মাটির মহিমাজ্ঞাপক কয়েকটি সুন্দর কবিতা এই সব সংগ্রহে আছে, কিন্তু তার সংখ্যা খুব কম। কেউ কেউ বলতে পারেন, ঋতু-সম্বন্ধে তার যে অজস্র গান সে-সব তো মাটিরই মহিমার গান। কিন্তু বাস্তবিক হয়ত তা নয়। ঋতুর যত সমারোহ সে মাটিরই সমারোহ একথা কবি ভাল করেই জানেন, তিনি নিজেও বসে আছেন মাটিরই উপরে, কিন্তু এই সমারোহ তার চোখে সার্থক হয়েছে কোন্ সুদূর থেকে আসা আলোর ধারায়, আর সেই সুদূরের প্রতি তাঁর দৃষ্টি প্রায়। নির্নিমেষ।

প্ৰবাহিণীর “পূজা’ বিভাগের কবিতাগুলোর চাইতে গীতিমাল্যের অনেক কবিতা আমাদের ভাল লাগে বেশী, পূজার ভাবটি সেখানে যেন আরো নিবিড়, তবু এ বিভাগেও কয়েকটি ভারি সুন্দর কবিতা আছে।

তোমায় কিছু দেবো বলে চায় যে আমার মন

নাইবা তোমার থাকল প্রয়োজন ॥ যখন তোমার পেলাম দেখা অন্ধকারে একা একা

ফিরিতেছিলে বিজন গভীর বন ইচ্ছা ছিল একটি বাতি জ্বালাই তোমার পথে

নাইবা তোমার থাকল প্রয়োজন। দেখেছিলেম হাটের লোকে তোমারে দেয় গালি,

গায়ে তোমার ছড়ায় ধূলাবালি। অপমানের পথের মাঝে। তোমার বীণা নিত্য বাজে

আপন সুরে আপনি নিগমন। ইচ্ছা ছিল বরণমালা পরাই তোমার গলে

নাইবা তোমার থাল প্রয়োজন ॥ দলে দলে আসে লোকে রচে তোমার স্তব

নানা ভাষায় নানান কলরব।

৩০৩

ভিক্ষা লাগি তোমার দ্বারে আঘাত করে বারে বারে

কত যে শাপ কত যে ক্রন্দন। ইচ্ছা ছিল বিনাপণে আপনাকে দিই পায়ে

নাই বা তোমার থাকল প্রয়োজন ॥ তোমার দ্বারে কেন আসি

ভুলেই যে যাই

কতই কি চাই দিনের শেষে ঘরে এসে লজ্জা যে পাই।

সে সব চাওয়া সুখে দুখে।

ভেসে বেড়ায় কেবল মুখে,

গভীর বুকে যে চাওয়াটি গোপন তাহার কথা যে নাই।

বাসনা সব বাঁধন যেন কুঁড়ির গায়ে

ফেটে যাবে ঝরে যাবে দখিন বায়ে। একটি চাওয়া ভিতর হতে

ফুটবে তোমার ভোর আলোতে

প্রাণের স্রোতে অন্তরে সেই গভীর আশা বয়ে বেড়াই। এই সব গানের অল্প কয়েকটিতে তত্ত্ব-চিন্তা সুস্পষ্ট, কিন্তু সেগুলোর আলোচনা এই সম্পর্কে না হওয়াই ভাল। মোটের উপর এই সব গান নিতান্তই ক্ষণিকার গান-এক একটি আদি-অন্ত-বিবর্জিত মুহূর্ত রূপে রসে পরমক্ষণের মতো চিকমিক করে উঠে কোন্ অতলে গিয়ে জমছে। কবির সেই সব বিচিত্র ভাব-মুহূর্তের বিস্তারিত আলোচনা এক অসম্ভব ব্যাপার। হয়ত তা অপ্রয়োজনীয়ও, কেননা সে-সবের একান্ত প্রতীক্ষা রসিক পাঠকের অতন্দ্রিত রসবোধের। মাত্র দুটি কবিতা উদ্ধৃত হচ্ছে, যথাক্রমে তার নাম দেওয়া যেতে পারে ‘অবসান’ ও ‘সন্ধ্যাদীপ’

কোথা হতে শুনতে যেন পাই আকাশে আকাশে বলে যাই। পাতায় পাতায় ঘাসে ঘাসে জেগে ওঠে দীর্ঘশ্বাসে

হায়, তারা নাই তারা নাই। কত দিনের কত ব্যথা হাওয়ায় ছড়ায় ব্যাকুলতা। চলে যাওয়ার পথ যেদিকে

৩০৪

সেদিক পানে অনিমিখে।

আজ ফিরে চাই ফিরে চাই ॥

আমি সন্ধ্যাদীপের শিখা অন্ধকারের ললাটমাঝে পরানু রাজটিকা।

তার স্বপনে মোর আলোর পরশ

জাগিয়ে দিল গোপন হরষ, অন্তরে তার রইল আমার

প্রথম প্রেমের লিখা।

আমার নির্জন উৎসবে অম্বরতল হয়নি উতল পাখির কলরবে।

যখন তরুণ রবির চরণ লেগে নিখিল ভুবন উঠবে জেগে তখন আমি মিলিয়ে যাব

ক্ষণিক মরীচিকা ॥

ঋতু বর্ণনায় এই ভাব-বৈচিত্র্য খুব স্পষ্ট।

রবীন্দ্রনাথ বর্ষার কবিরূপে প্রসিদ্ধ। কিন্তু গ্রীষ্ম, শরৎ ও বসন্ত-বর্ণনায়ও তাঁর কৃতিত্ব অসাধারণ।

এই গানগুলোতে ঋতু-বৰ্ণনার যে বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে লক্ষ্য করবার বস্তু সেটি হচ্ছে কবির নূতন দৃষ্টিভঙ্গি ও বর্ণন-ভঙ্গি। ঋতুর সহজ সরল বর্ণনা এসব আদৌ নয়। তার এই নূতন মনের উপরে ঋতুর বিভিন্ন রূপের ছায়াপাত, প্রভাব, কেমন হয়েছে এসব তারই বর্ণনা মুখ্যত, অথচ ঋতুর বিভিন্ন ভাবও ফুটেছে সুন্দর। নিদাঘ সম্পর্কে দুটি কবিতা নেওয়া যাক

হে তাপস, তব শুষ্ক কঠোর রূপের গভীর রসে মন আজি মোর উদাস বিভোর কোন্ সে ভাবের বশে

তব পিঙ্গল জটা।

হানিছে দীপ্ত ছটা, তব দৃষ্টির বহ্নিবৃষ্টি অন্তরে গিয়ে পশে ॥

বুঝি না কিছু না জানি। মর্মে আমার মৌন তোমার কি বলে রুদ্র বাণী।

২০

৩০৫

দিগদিগন্ত দহি

দুঃসহ তাপ বহি তব নিশ্বাস আমার বক্ষে রহি রহি নিশ্বাসে ॥

সারা হয়ে এল দিন সন্ধ্যামেঘের মায়ার মহিমা নিঃশেষে হবে লীন।

দীপ্তি তোমার তবে

শান্ত হইয়া রবে। তারায় তারায় নীরব মন্ত্রে ভরি দিবে শূন্য সে ॥

নাই রস নাই, দারুণ দাহনবেলা। খেল খেল তব নীরব ভৈরব খেলা।

যদি ঝরে পড়ে পড়ক পাতা,

ম্লান হয়ে যাক মালা গাথা, থাক জনহীন পথে পথে মরীচিকা-জাল ফেলা ॥

শুষ্ক ধূলায় খসে-পড়া ফুলদলে ঘূর্ণী-আঁচল উড়াও আকাশ তলে।

প্রাণ যদি কর মরুসম

তবে তাই হো হে নির্মম, তুমি একা আর আমি একা, কঠোর মিলন মেলা ॥

নিদাঘের “দারুণ দাহনবেলা” দুটিতেই ফুটেছে, কিন্তু নূতন বর্ণন-ভঙ্গির জন্য শেষোক্ত কবিতাটি আমাদের মর্ম স্পর্শ করে যেন বেশী।

ঋতু-সম্পর্কিত এই সব গানে ছন্দোগতি খুবই লক্ষ্যযোগ্য। এই ছন্দোগতিই বিশেষভাবে সাহায্য করেছে ঋতুর ভাব-বৈচিত্র্য প্রকাশে।

নিদাঘের দাহনে ধরণীর অসহায়তার ছবি আমরা দেখেছি, কালবৈশাখীর হঠাৎ প্রচুর বর্ষণে তার যে ছবি তা ফুটেছে অন্য একটি গানে

পুব-সাগরের পার হতে কোন্ এল পরবাসী

শূন্যে বাজায় ঘন ঘন

হাওয়ায় হাওয়ায় সন সন

সাপ খেলাবার বাঁশি ॥ সহসা তাই কোথা হতে

কুলু কুলু কলস্রোতে দিকে দিকে জলের ধারা ছুটেছে উল্লাসি ॥

আজ দিগন্তে ঘন ঘন গভীর গুরু গুরু

৩০৬

ডমুর-রব হয়েছে ঐ শুরু। তাই শুনে আজ গগনতলে

পলে পলে দলে দলে অগ্নিবরন নাগনাগিনী ছুটেছে উদাসী ॥

এর পরই বর্ষার বিপুল ও বিচিত্র আয়োজন।

বর্ষা আরম্ভ হয় নি, শুধু রসপুষ্ট গাছপালার মাথার উপর দিয়ে বাতাসের বেগে মেঘ ভেসে যাচ্ছে, তার ছবিটি এই

আকাশ তলে দলে দলে মেঘ-যে ডেকে যায়,

আয় আয় আয়। জামের বনে আমের বনে রব উঠেছে তাই

যাই, যাই, যাই। উড়ে যাওয়ার সাধ জাগে তার পুলক-ভরা ডালে

পাতায় পাতায়

নদীর ধারে বারে বারে মেঘ-যে ডেকে যায়।

আয় আয় আয়। কাশের বনে ক্ষণে ক্ষণে রস উঠেছে তাই

যাই, যাই, যাই। মেঘের গানে তরীগুলি তান মিলিয়ে চলে

পাল-তোলা পাখায় ॥

বর্ষার সূচনা হয়েছে। বর্ষণোন্মুখ অত্যন্ত কালো মেঘ, তার কোলে কোলে বিদ্যুতের চমক-এর এই মোহন মূর্তি কবি এঁকেছেন

কাঁপিছে দেহলতা থরথর। চোখের জলে আঁখি ভরভর ॥

দোদুল তমালেরি বনছায়া তোমারি নীলবাসে নিল কায়া,

বাদল নিশীথেরি ঝরঝর

তোমার আঁখি পরে ভরভর ॥ যে কথা ছিল তব মনে মনে চমকে অধরের কোণে কোণে।

নীরব হিয়া তব দিল ভরি কী মায়া স্বপনে যে মরি মরি,

আঁধার কাননের মরমর।

৩০৭

বাদল নিশীথের ঝরঝর ॥

এই দুটি কবিতায় সারাদিন ঝরঝর বৃষ্টির ছবি আঁকা হয়েছে অথচ দুটিতে পার্থক্য। যথেষ্ট

আজ আকাশের মনের কথা ঝরঝর বাজে সারা প্রহর আমার বুকের মাঝে

দিঘির কালো জলের পরে

মেঘের ছায়া ঘনিয়ে ধরে, বাতাস বহে যুগান্তরের প্রাচীন বেদনা যে সারা প্রহর আমার বুকের মাঝে।

আঁধার বাতায়নে। একলা আমার কানাকানি ঐ আকাশের সনে।

ম্লান স্মৃতির বাণী যত

পল্লব-মর্মরের মত সজল সুরে ওঠে জেগে ঝিল্লিমুখর সাঁঝে ॥

সারা প্রহর আমার বুকের মাঝে ॥

বাদল-বাউল বাজায়রে একতারা সারা বেলা ধরে ঝর ঝর ঝর ধারা

জামের বনে ধানের ক্ষেতে আপন তানে আপনি মেতে

নেচে নেচে হল সারা ॥ ঘন জটার ঘটা ঘনায় আঁধার আকাশ মাঝে, পাতায় পাতায় টুপুর টুপুর নূপুর মধুর বাজে।

ঘর-ছাড়ানো আকুল সুরে উদাস হয়ে বেড়ায় ঘুরে

পূবে হাওয়া গৃহহারা ॥

‘কেতকী’র কয়েকটি গানে বর্ষার প্রবল রূপ প্রকাশ পেয়েছে যেমন

আবার শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে, মেঘ-আঁচলে নিলে ঘিরে।

রায়, হারায় তারা, আধারে পথ হয়-যে হারা,

৩০৮

ঢেউ দিয়েছে নদীর নীরে। সকল আকাশ, সকল ধরা বর্ষণেরি বাণী-ভরা।

ঝরঝর ধারায় মাতি বাজে আমার আঁধার রাতি,

বাজে আমার শিরে শিরে।

অথবা

আজ নাহি নাহি নিদ্রা আঁখি পাতে। তোমার ভবনতলে, হেরি প্রদীপ জলে, দূরে বাহিরে তিমিরে আমি জাগি জোড়হাতে।

ক্রন্দন ধ্বনিছে পথহারা পবনে রজনী মূৰ্ছাগত বিদ্যুত-ঘাতে।

দ্বার খোলো হে দ্বার খোলো! প্রভু করো দয়া দেহ দেখা দুখরাতে।

কিন্তু সাধারণত তাঁর এই সব গানের আবেদনে কোনো প্রবলতা নেই। সেই প্রবলতার অতবই এ-সবের এক বিশেষ সৌন্দর্য-যেন নিস্তরঙ্গ জলে একরাশি কুমুদ।

অপর একটি কবিতায় বর্ষার দুর্যোগ দুর্দিন এ-সবের ছবি আঁকা হয়েছে সুন্দর, কিন্তু তার আবেদনে কোনো প্রবলতা নেই বলেই চলে।

ঝর ঝর বরিষে বারিধারা হায় পথবাসী, হায় গতিহীন, হায় গৃহহারা ॥ ফিরে বায়ু হাহাস্বরে, ডাকে কারে

জনহীন অসীম প্রান্তরে,

রজনী আঁধারা ॥

অধীরা যমুনা তরঙ্গ-আকুলা রে, তিমির-দুকূলা রে। নিবিড় নীরদ গগনে গরগর গরজে সঘনে, চঞ্চলা চপলা চমকে, নাহি শশিতারা ॥

দীর্ঘ বর্ষাযাপনের পরে শরৎ-বধূর প্রসন্ন নয়ন-উন্মীলনের ছবিটি বড় মনোরম

এবার অবগুণ্ঠন খোলো খোলো। গহন মেঘমায়ায় বিজন বনছায়ায়

৩০৯

তোমার আলসে অবলুণ্ঠন সারা হল!

শিউলি-সুরভি রাতে বিকশিত জ্যোৎস্নাতে

মৃদু মর্মর গানে তব মর্মের বাণী বোলো। বিষাদ-অশ্রুজলে মিলুক শরমহাসি। মালতীবিতানতলে

বাজুক বঁধুর বাঁশি। শিশিরসিক্ত বায়ে বিজড়িত আলোছায়ে বিরহ-মিলনে-গাঁথা

নব প্রণয়-দোলায় দোলো ॥

প্রথম শরতের কালো মেঘ ও উজ্জ্বল রৌদ্রের গানটিতে কবি জীবন-সম্বন্ধেও একটি বড় ও ভাল কথা বলেছেন; কিন্তু সেসব মনে না এনেও এর রচনামাধুর্যে কত মুগ্ধ হওয়া যায়

শ্যামল শোভন শ্রাবণ, তুমি নাইবা গেলে

সজল বিলোল আচল মেলে ॥ পূব হাওয়া কয়, “ওর যে সময় গেলো চলে,” শরৎ বলে, “ভয় কি সময় গেলো বলে,”

বিনা কাজে আকাশ মাঝে কাটবে বেলা

অসময়ের খেলা খেলে।” কালো মেঘের আর কি আছে দিন

ও যে হলো সাথিহীন। পূব হাওয়া কয়, “কালোর এবার যাওয়াই ভালো,” শরৎ বলে, “মিলবে যুগল কালোয় আলো,

সাজবে বাদল সোনার সাজে আকাশ-মাঝে

কালিমা ওর ঘুচিয়ে ফেলে।”

শরতের শিশির ও রৌদ্রের ঐশ্বর্য শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি’ শীর্ষক সুপরিচিত গানটিতে এক চমৎকার রূপ লাভ করেছে; প্রবাহিণীর গানগুলোতে কিন্তু শরতের আকাশ-বাতাসের চাঞ্চল্য উদাস ভাব, এসবই বেশী পরিস্ফুট-সে-উদাসভাবে যেন কি-এক জাদু আছে

৩১০

তোমরা যা বল তাই বল, আমার লাগে না মনে। আমার যায় বেলা যায় বয়ে কেমন বিনা কারণে ॥

এই পাগল হাওয়া

কী গান-গাওয়া। ছড়িয়ে দিয়ে গেল আজি সুনীল গগনে। সে-গান আমার লাগল-যে গো লাগল মনে, আমি কিসের মধু খুঁজে বেড়াই ভ্রমরগুঞ্জনে।

ঐ আকাশ-ছাওয়া

কাহার চাওয়া এমন করে লাগে আজি আমার নয়নে ॥

হেমন্ত ও শীতের বর্ণনা এই সব গানে তেমন নেই। তার বড় কারণ হয়ত এই যে বাংলাদেশে এ দুয়ের যা’ রূপ তা হচ্ছে সঞ্চয়ের রূপ

“আয়রে মোরা ফসল কাটি,

কিন্তু কবির এই সব গানের যা রূপ তাকে বলা যায় অপচয়ের রূপ-চঞ্চল সৌন্দর্যের সঙ্গে মুহূর্তের জন্য চোখখাচোখি।

বসন্তের রূপ-বৈচিত্র্য এই সব গানে ফুটেছে বেশী। পৌষের পাতা-ঝরা শীর্ণ শাখায় বসন্তের যে আগমনী বাজছে কবির কানে তা প্রতিধ্বনিত হয়েছে এই ভাবে

সব দিবি কে সব দিবি পায়!

আয়, আয়, আয়! ডাক পড়েছে ঐ শোনা যায়

আয় আয় আয়! আসবে-যে সে স্বর্ণরথে জাগবি কারা রিক্তপথে

পৌষ রজনী তাহার আশায়

আয় আয় আয়! ক্ষণেক কেবল তাহার খেলা;

হায় হায় হায়! তার পরে তার যাবার বেলা

হায় হায় হায়! চলে গেলে জাগবি যবে

৩১১

ধন-রতন বোঝা হবে,

বহন করা হবে-যে দায়!

হায় হায় হায়!

বসন্তের ঝরা পাতার গানটি বড় মর্মস্পর্শী

ফাগুনের শুরু হতেই শুকনো পাতা ঝরল যত

তারা আজ কেঁদে শুধায়

“সেই ডালে ফুল ফুটুল কিগো?

ওগো কও ফুটল কত ॥”

তারা হয়, হঠাৎ হাওয়ায় এল ভাসি

মধুরের সুদূর হাসি-হায়, ক্ষ্যাপা হাওয়ায় আকুল হয়ে ঝরে গেলেম শত শত ॥”

তারা কয়, “আজ কি তবে এসেছে সে।

নবীন বেশে? আজ কি তবে এতক্ষণে জাগল বনে

যে গান ছিল মনে মনে? সেই বারতা কানে নিয়ে যাই চলে এই বারের মত ॥”

ঝরে-পড়ার আনন্দ নয় কেমন এক বেদনা-কাত

য়েছে এই সব পাতার মুখে।

বসন্তের বহু রূপ কবি এঁকেছেন। যেমন, ফাল্গুনের ডালপালা ও রঙীন ফুলের উৎসবের গান

সহসা ডালপালা তোর উতলা যে!

ও চাপা, ও করবী। কারে তুই দেখতে পেলি

আকাশ মাঝে

জানি না-যে জানি না-যে কোন সুরের মাতন হাওয়ায় এসে

বেড়ায় ভেসে,

ও চাঁপা, ও করবী। কার নাচনের নূপুর বাজে

জানি না-যে জানি না-যে ॥ তোরে ক্ষণে ক্ষণে চমক লাগে।

৩১২

কোন্ অজানার ধেয়ান তোমার

মনে জাগে। কোন রঙের মাতন উঠল দুলে

ফুলে ফুলে কে সাজালে রঙিন সাজে।

জানি না-যে জানি না-যে।

ফাল্গুন-পূর্ণিমার গান

ভাঙল হাসির বাঁধ অধীর হয়ে মাতল কেন

পূর্ণিমার ঐ চাঁদ। উতল হাওয়া ক্ষণে-ক্ষণে মুকুলছাওয়া বকুল বনে দোল দিয়ে যায়, পাতায় পাতায়

ঘটায় পরমাদ ॥ ঘুমের আঁচল আকুল হ’ল

কী উল্লাসের ভরে! স্বপন যত ছড়িয়ে প’ল

দিকে দিগন্তরে!

আজ রাতের এই পাগলামিরে বাঁধবে বলে কে ঐ ফিরে, শালবীথিকায় ছায়া গেঁথে

তাই পেতেছে ফাঁদ ॥

বসন্তের এই সমারোহের ভিতরে মেঠো ফুলটির কথা কবি ভোলেননি

আজ দখিনবাতাসে

নাম-না-জানা কোন্ বনফুল

ফুটুল বনের ঘাসে। ও মোর পথের সাথি পথে পথে

গোপনে যায় আসে৷ কৃষ্ণচূড়া, চূড়ায় সাজে, বকুল তোমার মালার মাঝে, শিরীষ তোমার ভরবে সাজি

ফুটেছে সেই আশে। এ মোর পথের বাঁশির সুরে সুরে

লুকিয়ে কাঁদে হাসে। ওরে দেখ বা নাই দেখ, ওরে

যাও বা না যাও ভুলে। ওরে নাইবা দিলে দোলা, ওরে

নাইবা নিলে তুলে।

সভায় তোমার ও কেহ নয়, ওর সাথে নেই ঘরের প্রণয়, যাওয়া-আসার আভাস নিয়ে

রয়েছে এক পাশে

ওগো ওর সাথে মোর প্রাণের কথা

নিশ্বাসে নিশ্বাসে।

ক্ষণস্থায়ী বসন্তের বিদায়ের রূপটি কবি এঁকেছেন এইভাবে

না যেয়োনা যেয়ো নাকো। মিলনপিয়াসী মোরা

কথা রাখো কথা রাখো। আজো বকুল আপনহারা, হায়রে ফুল ফোঁটানো হয়নি সারা,

সাজি ভরেনি, পথিক ওগো, থাকো থাকো ॥

চাঁদের চোখে জাগে নেশা তার আলো গানে গন্ধে মেশা।

দেখ চেয়ে কোন্ বেদনায়, হায়রে মল্লিকা ওই যায় চলে যায়

অভিমানিনী! পথিক, তারে ডাকো ডাকো ॥

এমনি কত মুহূর্ত অপরূপ হয়ে আছে এই সব গানের ভিতরে! রবীন্দ্রনাথের প্রথম যৌবনের দান দেশের কাব্যরসিকরা শ্রদ্ধায় ও আনন্দে গ্রহণ করেছেন। তাঁর বার্ধক্যের ‘নিরাসক্ত যৌবনের’র এই দানও কালে কাব্য-হিসেবে পরম আদরে গৃহীত হবে সন্দেহ

৩১৪

নেই। এই সব গানের পদগুলো যেন সৌন্দর্য ও আনন্দের অফুরন্ত উৎস। রূপের ভাঙ্গতা এখানেই যেন লাভ হয়েছে বিশেষভাবে। * আর একটি গান উদ্ধৃত করব। যে নিঃসঙ্গতা-প্রীতি এই সব গানের প্রধান সুর বলেছি, তা হয়ত তেমন ই এই গানটিতে। তা না থাকুক। কবি স্থির হয়ে এক অপরূপ সৌন্দর্য দেখছেন, আমাদের সকলেরই জন্য এ-দেখা সার্থক হোক

আমার মন চেয়ে রয় মনে মনে হেরে মাধুরী

নয়ন আমার কাঙাল হয়ে মরেনা ঘুরি। চেয়ে চেয়ে বুকের মাঝে গুঞ্জরিল একতারা যে, মনোরথের পথে পথে বাজল বাঁশুরি। রূপের কোলে ঐ যে দোলে অরূপ মাধুরী ॥

কূলহারা কোন্ রসের সরোবরে

মূলহারা ফুল ভাসে জলের পরে। হাতের ধরা ধরতে গেলে, ঢেউ দিয়ে তায় দিই যে ঠেলে,

আপন মনে স্থির হয়ে রই, করিনে চুরি। ধরা দেওয়ার ধন সে ত নয়, অরূপ মাধুরী ॥

অগ্রহায়ণ, ১৩৩৮

শরৎ-সাহিত্য

শরৎ-সাহিত্য দুই বড় ভাগে ভাগ করে দেখা যেতে পারে। প্রথম ভাগের নাম দেওয়া যেতে পারে প্রাক্-শ্রীকান্ত ও দ্বিতীয় ভাগের নাম দেওয়া যেতে পারে শ্রীকান্ত পরবর্তী।

মোটামুটি ভাবে এই বিভাগ রচনার ক্রম অনুসারেই। কিন্তু এই ক্রমবিকাশ এক বিশেষ অর্থেই বুঝতে হবে। প্রথম ভাগের বড়দিদি বিন্দুর ছেলে’ ‘বিরাজ বৌ প্রভৃতির সঙ্গে দ্বিতীয় ভাগের চরিত্রহীন’ ‘গৃহদাহ’ ‘শেষপ্রশ্ন’ প্রভৃতির তুলনা করলে সহজেই বোঝা যায়, প্রথম ভাগের রচনাকে অপরিপক্ক রচনা বলা চলে না। বড়দিদির সুরেন্দ্রনাথ’ও নিপুণ শিল্পীর রচনা। বাস্তবিক শরৎ-প্রতিভা বাঙালীর যে এতটা বিস্ময়ের সামগ্রী হয়েছে, বড় কারণ তার মনে হয় এই যে, পাঠকরা তাঁর রচনার অপরিপক্কতার সুযোগ পেয়ে তাকে তামাসা বা কৃপা করবার অবসর কখনো পাননি। এই বিভাগ আমরা করতে চাচ্ছি প্রধানত শরৎচন্দ্রের প্রতিপাদ্যের দিকে দৃষ্টি রেখে।

এই প্রতিপাদ্য কি? অল্পকথায় বলে দাঁড়ায়, প্রথম ভাগে, অর্থাৎ ‘বড়দিদি’ ‘বিরাজ বৌ এমন কি ‘পল্লী-সমাজ’ প্রভৃতি গ্রন্থে শরৎচন্দ্র নিপুণ শিল্পী বটেন কিন্তু নূতন ভাবুক

নন; কিন্তু দ্বিতীয় ভাগে, অর্থাৎ ‘চরিত্রহীন’ ‘গৃহদাহ’ ‘শেষ-প্রশ্ন’ প্রভৃতি গ্রন্থে, তিনি নিপুণ শিল্পীও বটেন, নূতন ভাবুকও বটেন।

‘নূতন ভাবুক’ কথাটা হয়ত একটু বুঝিয়ে বলা দরকার। একালের বাংলা সাহিত্যের সূচনা মধুসূদন থেকে, কিন্তু এ-কালের বাঙালী সমাজ ও বাংলা সাহিত্যের স্বাভাবিক যোগের সূচনা বঙ্কিমচন্দ্র থেকেই। ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র তার কল্পনার ইন্দ্রজালে তাঁর দেশবাসীকে অভিভূতই করেননি, দেশের যে জীবন-ধারা তার ভিতরকার মনোহারিত্বেরও অনেকখানি সন্ধান তিনি তাঁদের দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাবে “আমরা আমাদের ঘরের মেয়েকে সূর্যমুখী কমলমণি রূপে দেখিলাম…আমাদের প্রতিদিনের ক্ষুদ্র জীবনের উপরে একটি মহিম-রশি নিপতিত হইল।” রবীন্দ্রনাথ নিজেও বঙ্কিমচন্দ্রের সৃষ্ট এই নব-বাঙালীত্বের সৌষ্ঠববিধানে ব্রতী হলেন। যৌবনে তিনি চেয়েছিলেন

সুখ-হাসি আরো হবে উজ্জ্বল সুন্দর হবে নয়নের জল স্নেহসুধামাখা বাসগৃহতল

আরো আপনার হবে প্রেয়সী নারীর নয়নে অধরে আরেকটু মধু দিয়ে যাব ভরে আরেকটু স্নেহ শিশুমুখ পরে

শিশিরের মত রবে……

তার সে-কামনা বিফলে যায় নি। তাঁর গল্পগুচ্ছের সংখ্যাতীত নায়ক-নায়িকা আর উপন্যাসের আশা-বিনোদিনী-মহেন্দ্র কমলা-রমেশ, ললিতা-সূচরিতা-বিনয়-আনন্দময়ী প্রভৃতির ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সুখ-দুঃখের উজ্জ্বল আলেখ্যে একালের বাঙালীর গৃহ ও জীবন সুন্দর ও মধুময় হয়েছে। শরৎচন্দ্র তাঁর সাহিত্যিক জীবনের প্রথম অংশে এই ধারারই অনুসরণ করেছেন। সে-অনুসরণে তাঁর কৃতিত্ব কম নয়। বাঙালী জীবনের মাধুর্য আরো কাছে থেকে দেখে, আরো চমকপ্রদ করে তিনি অঙ্কিত করেছেন। কিন্তু তবু এ অনুসরণই। তাঁর সুপ্রসিদ্ধ ‘পল্লী-সমাজ’ও এই শ্রেণীর অন্তর্গত করে আমরা ভাবতে পারছি এই জন্য যে, এতে পল্লীসমাজের যত নিন্দাই থাকুক, তবু তা খুব বেশী নিন্দা নয়, কেননা এখানে তাঁর লক্ষ্য যে-দিকে সে হচ্ছে এই পল্লীসমাজকেই একটু-খানি মেজে-ঘষে নেওয়া, তার বেশী নয়; সমাজ ও পারিবারিক গঠন ইত্যাদি বিষয়ে দেশের যে প্রচলিত আদর্শ, বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের ভিতরে যে সাধারণ সম্পর্ক, সে-সব কোনো নূতন দৃষ্টি দিয়ে দেবার কথা তিনি ভাবেন নি। দ্বিতীয় অংশে শরৎচন্দ্রের মনোভাব কিন্তু এইই নয়। দেশের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন সম্বন্ধে নূতন সমস্যা সম্প্রতি তিনি বিশেষভাবে ভাবতে শুরু করেছেন, কিন্তু শ্রীকান্তের পর থেকে, অথবা

‘শ্রীকান্তের সময় থেকে (কেননা ‘শ্রীকান্তে’ ঘরের মায়া নয়, বাহিরের তাগিদই শরৎচন্দ্রকে বেশী করে লেগেছে) যে কয়েকখানি বড় উপন্যাস তিনি লিখেছেন, তার প্রায় প্রত্যেকটিতে যে-জীবনের ছবি এঁকেছেন, সে-জীবন আমাদের একান্ত পরিচিতই নয়। রাজলক্ষ্মী, অভয়া, কিরণময়ী, সুরেশ অচলা যে পরমদুঃখময় সুবিপুল জীবন নিয়ে আমাদের হৃদয় ও মনের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে দাঁড়ায়, তা একালের বাংলা সাহিত্যে সম্পূর্ণ নৃতন নয় বটে কিন্তু অনেকখানি নৃতন।

এই দ্বিতীয় অংশের পরিণতিস্বরূপ ধরা যেতে পারে ‘শেষ-প্রশ্ন’কে। এই ‘শেষ প্রশ্ন’ নানা বাদানুবাদের কারণ হয়েছে। তার মধ্যে সব চাইতে কড়া অভিযোগ শরৎচন্দ্রের বিরুদ্ধে হয়ত এই যে, ওটি নিতান্তই প্রশ্ন, তাও খুব একালের নয়-কিছুদিন আগেকার Rationalism. বলা বাহুল্য, এ অন্যায় অভিযোগ। Rationalism কিছুদিন আগে ইয়োরোপের চিত্ত আন্দোলিত করেছিল বলেই, আজ তা পুরাতন অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে, এ যদি সত্য হয়, তবে অত্যন্ত পুরাতন Mysticism ও Atheism নূতন করে এ-কালের মানুষের মনে প্রেরণা যোগাতে পারত না। গ্যেটে বলেছেন-যাতে জীবনের মর্যাদা বাড়ে, তাইই সত্য। এই দৃষ্টিভূমি থেকে দেখলে বোঝা যাবে Rationalism-এর আশ্রয় আজ যদি শরশ্চন্দ্র নিয়ে থাকেন, তবে তার চারপাশের জীবনের প্রয়োজনেই নিয়েছেন। তাছাড়া ‘শেষপ্রশ্নে’র কমলের চরিত্র বেশ একটু সৃষ্টিও বটে। আমার তো মনে হয়, রোমা রোলার The Soul Enchanted উপন্যাসধারার মতো ‘শেষপ্রশ্নও এক উপন্যাসধারার সূচনা, কেননা কমলের চরিত্রের পূর্ণবিকাশের জন্য আরো বহু অবস্থায় তাকে দেখানো দরকার। আর কমলকে শরৎচন্দ্র একটি চরিত্র হিসেবে দাঁড় করাতে চান বলে মনে হয় যেমন রোলাঁ Annette-কে দাঁড় করিয়েছেন।

কিন্তু শরৎ-সাহিত্য যে-ভাবে ভাগ করে আমরা দেখতে চাচ্ছি, তাতে দেখবার মতো অনেক কিছু পেলেও শরৎপ্রতিভার শ্রেষ্ঠ কীর্তির সন্ধান যে এর সাহায্যে আমাদের লাভ হবে না তা নিঃসন্দেহ, কেননা চিন্তানায়ক-শরৎচন্দ্রের মর্যাদা যতই থাকুক তার চাইতে অনেক বেশী মর্যাদা শিল্পী-শরৎচন্দ্রের। তবে শিল্পী-শরৎচন্দ্রের মাহাত্ম নিরূপণের পথে বিঘ্নও কম নয়।

প্রথম, হুবহু ছবি আঁকবার দিকে প্রবণতা তার যথেষ্ট। তাতে বিস্ময়কর অনেক কিছুর সমাবেশ সহজেই ঘটতে পারে, কিন্তু চিত্র শেষ পর্যন্ত তেমন অর্থপূর্ণ হয় না। দ্বিতীয়ত, বাঙালী জীবনে গ্রাম্যতা এখনও কম নয়, হুবহু ছবি আঁকার প্রবৃত্তির ফলে গ্রাম্যতাও অনেক সময়ে এতখানি আঁকা হয়ে যায় যে, তাতে পাঠকের সৌন্দর্যবোধ যথেষ্ট পীড়িত হয়। কিন্তু গোলাপ যেমন কাঁটাগাছে জন্মে তেমনি এত অসম্পূর্ণতার ভিতরেও শরৎপ্রতিভা জীবনের পরমাশ্চর্য শিল্প-রূপ দান করতে সক্ষম হয়েছে।

শরৎচন্দ্রের এই শিল্প-প্রতিভার একটি বিশেষ লক্ষণও আছে। পূর্ণাঙ্গ চরিত্র-সৃষ্টি বলতে যা বোঝায়, শরৎ-প্রতিভার প্রবণতা সেদিকে তেমন নয়; এর প্রবণতা জীবনের এক একটি মুহূর্ত, এক একটি ঘটনা-সংস্থান-এই সবের অপরূপত্বের দিকেই। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একই সঙ্গে তাঁর মিল ও অমিল দেখতে পাওয়া যাবে। রবীন্দ্রনাথও এমনিভাবে অপরূপ মুহূর্তের শিল্পী কিন্তু সে-মুহূর্ত বিশেষভাবে তার নিজের

৩১৭

ভাব-মুহূর্ত। শরৎচন্দ্রের লেখনী-স্পর্শে যে-মুহূর্তে রূপায়িত হয়ে ওঠে, সেটি তাঁর নিজের ভাব-মুহূর্ত যেন তেমন নয়, সেটি তার সামনে উদ্ঘাটিত মানুষের জীবনের মুহূর্ত। সেই মুহূর্তের জন্য শরৎন্দ্রের নিজের ব্যক্তিত্ব যেন একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়-শুধু জলজ্যান্ত হয়ে ওঠে সেই মুহূর্তের ঘটনাসংস্থানের সত্য ও পাঠকের অনুভব শক্তি। এর দৃষ্টান্ত শরৎচন্দ্রের প্রায় সব বয়সের গ্রন্থেই বিদ্যমান, কিন্তু এর শ্রেষ্ঠতম বিকাশ লাভ হয়েছে মনে হয় ‘গৃহদাহে’।

আমরা বলেছি, চরিত্র-সৃষ্টি তেমন নয় বরং মানুষের জীবনের এক একটি মুহূর্তের ঘটনা-সংস্থানের অপরূপত্ব অঙ্কিত করবার দিকেই শরৎ-প্রতিভার প্রবণতা। তাঁর সাহিত্যিক creed (বিশ্বাস) থেকে এ-কথার সমর্থন পাওয়া যাবে। তার শ্রীকান্ত নিজেকে বলছেন–”মানুষের অন্তর জিনিষটা যে অনন্ত…তোমার কোটি জন্মের অসংখ্য অদ্ভুত ব্যাপার যে এই অনন্তে মগ্ন থাকিতে পারে এবং হঠাৎ জাগ্রত হইয়া তোমার ভূয়োদর্শন তোমার লেখাপড়া তোমার মানুষ বাছাই করিবার জ্ঞানভাণ্ডারটুকু এক মুহূর্তে ঔড়া করিয়া দিতে পারে, একথাটি কি একটিবারও মনে পড়ে না?” তাঁর এই মতবাদ তার সৃষ্টির উপরে সময় সময় জবরদস্তি যে না করেছে তা নয়, কেননা চরিত্রসৃষ্টি সাহিত্যের একটি নিত্যপ্রয়োজন। সাহিত্যিকের ভাব যেখানে কোনো ব্যক্তিত্বে রূপ ধরে ওঠে নি, সেখানে তা যেন সত্যিকার জীবনে সঞ্জীবিত হয় নি। শ্রেষ্ঠ গীতি-কবিদের সম্বন্ধেও এ-কথা খাটে, কেননা তারা নিজেদেরই রূপায়িত করে তোলেন। কিন্তু নায়কনায়িকার ব্যক্তিত্ব-বিকাশের চেষ্টা সোজাসুজি না করলেও, এমন কি তার বিরোধিতা করলেও, ব্যক্তিত্বের সত্যিকার বিকাশ শরৎ-সাহিত্যে দুর্লভ হয় নি এই কারণে যে, এই creed-এর চাইতে তার ভিতরে প্রবলতর হচ্ছে তাঁর শিল্প-প্রতিভা, আর সেই প্রতিভার সাহায্যে মূহুর্তের ঘটনা-সংস্থানের যে অপূর্ব রূপ তিনি অঙ্কিত করেছেন সেই সমস্তের প্রভায় তার কয়েকটি নায়ক-নায়িকা-বিশেষত নায়িকা-সুমহৎ ব্যক্তিত্ব গৌরব লাভ করেছে। গৃহদাহে’র কথা বলেছি। সেই গ্রন্থখানির বিস্তৃত আলোচনা করলে দেখা যাবে, শরৎচন্দ্রের creed সেখানে নিষ্ক্রিয় নয়; কিন্তু তার চাইতে অনেক বড় ব্যাপার হয়ে উঠেছে নিপুণভাবে জীবনের ছবি আঁকা, আর তারই ফলে অচলা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক আশ্চর্য tragic (ভাগ্য-লাঞ্ছিত) চরিত্র। অদৃষ্টের কত পরিহাস, নারী চিত্তের কত বেদনা তাতে প্রমূর্ত! টলষ্টয়ের Anna Karenina র সঙ্গে এর তুলনা চলে, তবে টলস্টয়ের রেখাপাত স্পষ্টতর, পট-ভূমিকা বৃহত্তর।

বাংলার এই পরমজনপ্রিয় ঔপন্যাসিকের বিরুদ্ধে অভিযোগও কম নেই-নানা পতিত ও পতিতার জীবনালেখ্য অঙ্কিত করে দেশে দুর্নীতির প্রশ্রয় তিনি দিয়েছেন, অনেক তরুণ-তরুণীর বুদ্ধি বিকৃত করেছেন, ইত্যাদি। এই অভিযোগের সম্পূর্ণ বিপরীতটিই যে আসলে সত্য, সে-কথা বুঝতে হয়ত খুব বেশীদিন আমাদের লাগবে না। বাস্তবিক এই ঔপন্যাসিক জীবনের কথা বড় গভীর করে ভাবেন। Art for art’s sake-বাদী অতি আধুনিকরা তাঁকে গুরুস্থানীয়ও ভাবতে পারেন, কিন্তু Art for art’s sake দলের সাহিত্যিকও তিনি নন। মানুষের জীবনের প্রতি এক অপরিসীম মর্যাদা বোধ, হয়ত ভগবানের প্রতি ভক্তের যে মর্যাদা-বোধ, তেমনি মর্যাদা-বোধ রয়েছে এই

৩১৮

শিল্পীর শিল্প-প্রেরণার মূলে। শরৎ-প্রতিভা বিংশ শতাব্দীতে বিকশিত হয়েছে সত্য, কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর ধর্মান্দোলনবিক্ষুব্ধ বাংলারই তিনি সন্তান হয়ত সর্বকনিষ্ঠ সন্তান।

১৩৩৯

বঙ্কিম-প্রতিভা

বঙ্কিমচন্দ্রের আলোচকদের তিনটি বড় দলে ভাগ করে দেখা যেতে পারে। প্রথম দল বঙ্কিমচন্দ্রের ভিতরে দেখেছেন ভারতীয় অথবা এশিয়ার আধ্যাত্মিক আদর্শের এক সুন্দর পরিণতি; দ্বিতীয় হল তার ভিতরে দেখেছেন সত্যিকার সাহিত্যিক প্রতিভা, অর্থাৎ ভাষার পর্যাপ্ত প্রকাশ-সামর্থ্য ও মানবজীবনের সত্যোদঘাটনের দুর্লভ শক্তি; আর তৃতীয় দল তাকে ভাবেন খেয়ালী, কিছু রোমাঞ্চকর, আখ্যায়িকা-স্রষ্টা। তৃতীয় দল তাদের মতামত তেমন পূর্ণাঙ্গ করে ব্যক্ত করার তাগিদ এখনো অনুভব করেন নি, তাই প্রথম দুই দলের মতই বিচার্য।

বঙ্কিমচন্দ্রের ভিতরে যারা ভারতীয় অথবা এশিয়ার অধ্যাত্মিক আদর্শের সুপ্রকাশ দেখেছেন, তাঁদের মধ্যে স্বর্গীয় শশাঙ্কমোহন সেন অগ্রগণ্য, কেননা তিনি এই আধ্যাত্মিকতা বলতে মানুষের অন্তরাতার এক বিশেষ বিকাশ বুঝেছেন; সাধারণত আমাদের দেশের আধ্যাত্মিকতা-বাদীরা যেমন প্রচ্ছন্ন অথবা অপ্রচ্ছন্ন দাম্ভিক সেই সাহিত্যিকজন অশোভন রূঢ়তার দ্বারা তিনি কখনো আক্রান্ত হন নি।

কিন্তু মনে হয় যথেষ্ট জ্ঞানসম্পন্ন ও দৃষ্টিসম্পন্ন হলেও কতকটা সমসাময়িক কালের প্রভাবের বশীভূত হয়েই তিনি বঙ্কিম-সাহিত্য সম্পর্কে এই ধরণের অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র তার কালে এমন দোর্দন্ডপ্রতাপ ছিলেন, হিন্দু-সমাজের জাগরণ নামে যে-ব্যাপারটির জন্য দেশের অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি অপরিসীম আনন্দ প্রকাশ করে’ থাকেন, তার সঙ্গে তাঁর সংস্রব এত বেশী যে তাঁর সম্বন্ধে এরকম ভুল হওয়া খুবই স্বাভাবিক। আধ্যাত্মিকতা বা ধর্ম-জীবন বলতে কি বোঝায় সে-সম্বন্ধে একাধিক সংজ্ঞা বা বর্ণনা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু মনে হয়, বঙ্কিমচন্দ্রের-এই সংজ্ঞাটিও সুন্দর; তিনি বলেছেন, সমুদয় বৃত্তির ঈশ্বরমুখী হওয়ার নাম ধর্ম। কিন্তু ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রের ভিতরে-অথবা কৃষ্ণচরিত্র ও সাম্য-প্রণেতা বঙ্কিমচন্দ্রের ভিতরেও-এই সমুদয় বৃত্তির ঈশ্বরমুখী হওয়ার শান্তি বাস্তবিকই কি আমরা অনুভব করি? তার চাইতে দুঃখবোধ, নৈরাশ্য ও অশান্তি-প্রকৃতির নির্মমতার জন্য দুঃখ মানুষের অক্ষমতার জন্য নৈরাশ্য ও তাঁর নিজের প্রকৃতির ভিতরকার কি-এক অশান্তিবোধ-এই সবই কি তার উপন্যাসগুলোতে আমরা বেশী করে’-অনুভব করি না? অনেক সাধুসন্ন্যাসীর কথা,

* দ্র: শরৎ-প্রতিভা

৩১৯

তাদের পরোপকার-ব্রতের কথা বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে আছে বটে-মনে হয়, বঙ্কিমচন্দ্র এসব কথা শ্রদ্ধার সঙ্গেই ভাবতেন-কিন্তু সাহিত্যিকের যে-চেতনা তাঁর সৃষ্টিতে ব্যক্ত হয়, সেই চেতনায় এই আধ্যাত্মিকতার শান্তি তো পৌঁছায় নি।

তাই দ্বিতীয় দলের কথাই বেশী ভাববার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনায় সাহিত্যিক বৈভবও কম নয়, সাহিত্যামোদীদের দৃষ্টিও তাই এঁদের মতামতের দিকেই সহজে আকৃষ্ট হয়।

কিন্তু মনে হয় এঁরাও কিছু বিভ্রান্ত হয়েছেন সমসাময়িক কালের প্রভাবে। বিদ্যাভ্যাসের সময়ে ইংরেজি সাহিত্যের চর্চা আমরা করি, ইংরেজি সাহিত্যের সমালোচকদের নানা তত্ত্ব আমাদের রাগ-দ্বেষের বিষয় নয়। বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যিক কৃতিত্ব বিচার করতে গিয়ে এই দ্বিতীয় দল ইংরেজি বা ইয়োরোপীয় সাহিত্য-প্রীতির পরিচয়ই দিয়েছেন বেশী, বঙ্কিমচন্দ্রের দিকে যে বাস্তবিকই জিজ্ঞাসুর দৃষ্টিতে চেয়েছেন, তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না। বঙ্কিমচন্দ্রকে এঁরা বলেছেন দুর্লভ রূপাঙ্কন ক্ষমতার অধিকারী-ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Objective art-এর শিল্পী। বঙ্কিমচন্দ্রের সৃষ্ট চরিত্র সহজেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তাই রূপাঙ্কনের ক্ষমতা যে তার আছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সাহিত্যিক রূপাঙ্কন বলতে আরো কিছু বোঝায়। সুবিখ্যাত শিল্পী চসারকেও কোনো কোনো সাহিত্য-সমঝদার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক রূপস্রষ্টা বলেন নি এই ভাবনা থেকে যে, (তাঁদের ধারণায় মানবের অন্তৰ্জীবনে চসারের দৃষ্টি যথেষ্ট গভীর নয়। অপর পক্ষে টলস্টয়ের রচনায় প্রচলিত সাহিত্যিক সৌষ্ঠব লক্ষ্যযোগ্য না হলেও তাকে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য-প্রতিভার অধিকারী বলা হয় এই জন্য যে, মানবজীবনের সঙ্গে তার পরিচয় গভীর ও ব্যাপক। এই জিজ্ঞাসার দৃষ্টি নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের দিকে চাইলে খুশি হবার অনেক কিছু তার ভিতরে আমরা পাই সন্দেহ নেই, কিন্তু তাতে তো পরিতোষ লাভ হয় না। ধরা যাক তার বিষবৃক্ষ। তাতে যে সব চরিত্র তিনি সৃষ্টি করেছেন সহজেই সে-সব মনোজ্ঞ। কিন্তু তারা বড় বেশী প্রাদেশিক। অবশ্য প্রাদেশিকতা মাত্রই সাহিত্যে নিন্দনীয় নয়,বরং অনেক স্থলে প্রশংসনীয়, কেননা পরিবেষ্টনের ভূমিকায়ই রূপসৃষ্টি সম্ভবপর। কিন্তু শ্রেষ্ঠ সাহিত্য একই সঙ্গে প্রাদেশিক ও সার্বভৌমিক। টলস্টয়ের নায়ক নায়িকাও কম প্রাদেশিক নয়, কিন্তু সেই প্রাদেশিকতার বেশে যে তারা সার্বভৌমিক একথা বুঝতে এতটুকু বেগ পেতে হয় না। মনে হয় বিষবৃক্ষের ক্ষুদ্র-বৃহৎ উজ্জ্বল-মহৎ সমস্ত চরিত্রই নিতান্ত অল্প পরিসরে উজ্জ্বল বা মহৎ, একটু বিস্তীর্ণ পরিবেশে তাদের দাঁড় করালেই তারা যেন হয়ে পড়ে অনেকখানি গৌরবহীন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ ধরা যাক ‘কমলমণি’ চরিত্র। বাঙালী মাত্রেরই অন্তরের অভিনন্দন তার উদ্দেশ্যে, কিন্তু অন্তর্নিহিত যে রুচি ও বুদ্ধিবৃত্তির ফলে নায়ক-নায়িকার শ্রেষ্ঠত্ব লাভ হয় বাস্তবিকই তার সেটি লাভ হয় নি।

তেমনি ভাবে বঙ্কিমচন্দ্রের চন্দ্রশেখরের ‘প্রতাপ’। প্রতাপ আমাদের পরম প্রিয়, পরম শ্রদ্ধেয়। তাকে যে মহৎ সম্ভাবনাপূর্ণ করে’ কবি এঁকেছেন তা বুঝতে দেরি হয় না। কিন্তু লুণ্ঠন যুদ্ধ প্রভৃতি ব্যাপারের সঙ্গে তাকে সংশ্লিষ্ট করে তার ব্যক্তিত্বকে যে ভাবে বিকশিত করতে পারলে এই সব চেষ্টা অর্থপূর্ণ হতো সেটি বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে

সভবপর হয় নি। অর্থাৎ, প্রতাপ কবির খানিকটা সৌন্দর্যময় উপলব্ধি কিন্তু সত্যিকার চরিত্র-সৃষ্টি বা জীবন-সৃষ্টি নয়।

সত্যিকার রূপসৃষ্টি তেমন নয়, বরং কিছু কিছু সৌন্দর্য-উপলব্ধির ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে মনে হয়। রূপ-সৃষ্টিও তাঁর সাহিত্যে আছে, যেমন- নবকুমার, মতিবিবি, জেবুন্নিসা, সীতারাম ইত্যাদি। কিন্তু একটুখানি ভেবে দেখলেই বোঝা যায়, এসব ক্ষেত্রে সত্যিকার রূপসৃষ্টির চাইতে Idea র (চিন্তার) সৌন্দৰ্য্যময় উপলব্ধিই বেশী প্রকাশ পেয়েছে। সেই Idea ও তিনি অনেক জায়গায় পর্ণাঙ্গ হতে দেন নি দেশের ও সমাজের কল্যাণ সম্বন্ধে তার অদ্ভুত ধারণার ফলে।

অদ্ভুত কথাটা ইচ্ছা করেই ব্যবহার করেছি। বৃহত্তর দেশ (সুতরাং পূর্ণ সত্য) তাঁর চিন্তা-ভাবনার বিষয় তেমন হতে পারে নি, হিন্দুসমাজের উন্নতির জন্য আগ্রহের অস্বস্তিই তার ভিতরে হয়েছে বেশী লক্ষ্যযোগ্য। বলা বাহুল্য তাতে হিন্দু-সমাজের প্রকৃত উন্নতিও সম্ভবপর নয়, কেননা হিন্দু-সমাজ একক-কিছু নয়, অনেক কিছুর সঙ্গে নানা ভাবে সম্পর্কিত।

প্রতিভা ফরমাসে গড়া যায় না, ও প্রকৃতির দানকৃতাঞ্জলিপুটে গ্রহণ করতে হয়। তাই বঙ্কিমচন্দ্রের ভিতরে সেই প্রতিভার স্ফুরণ যতটুকু হয়েছে, সেইটুকু নিয়েই আমাদের আনন্দ। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের ঐতিহাসিক মর্যাদা বিস্মৃত না হওয়া পর্যন্ত তার পরিমাণ উপলব্ধি করা সম্ভবপর নয়, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের মূল্য ও মর্যাদা নিরূপণও সেই কারণে কতকটা অসম্ভব।

মুসলিম সাহিত্য-সমাজের সপ্তম বার্ষিক অধিবেশনে পঠিত। চৈত্র, ১৩৩৯

“আবদুল্লাহ্”

১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে কঠিন অস্ত্রোপচার-ভোগের পরে কাজি ইমদাদুল হক সাহেবকে দীর্ঘ হাসপাতাল-বাস স্বীকার করতে হয়। তাঁর “আবদুল্লাহ্” সেই হাসপাতাল-বাসকালে রচিত। এর দুই বৎসর পরে “মোসলেম ভারতে” ধারাবাহিকভাবে এটি প্রকাশিত হতে থাকে। প্রায় দেড় বৎসর কাল স্থায়ী মোসলেম ভারতে”

“আবদুল্লাহ যতখানি প্রকাশ করা হয়েছিল বোধ হয় ততখানি লিখেই ইমদাদুল হক সাহেব পাণ্ডুলিপি ‘মোসলেম ভারত”-সম্পাদকের হস্তে অর্পণ করেছিলেন। এর পরে তার স্বাস্থ্য ক্রমাগত ভেঙে পড়তে থাকে, তাই এই বইখানি তিনি লিখে শেষ করে যেতে পারেননি। এর ৪১ পরিচ্ছেদের ৩০ পরিচ্ছেদ তাঁর নিজের রচনা। বাকি অংশটুকুর খসড়া তিনি রেখে

* রোহিণী-হত্যার অপরাধে “কৃষ্ণকান্তের উইলের সাহিত্যিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। গোবিন্দলাল

চরিত্র হয়ে পড়েছে অনেকখানি প্রাদেশিক।

৩২১

গিয়েছিলেন, তার মৃত্যুর পরে সেটুকুকে গল্পের আকৃতি দেবার ভার পড়ে আনোয়ারুল কাদীর সাহেবের উপরে। ৩১ পরিচ্ছেদ থেকে ৪১ পরিচ্ছেদ পর্যন্ত আবদুল্লাহর ভাষা আনোয়ারুল কাদীর সাহেবের বলেই মনে হয়। তবে শুনেছি আরো দুই একম মুসলমান সাহিত্যিককে নাকি পাণ্ডুলিপিখানি দেখানো হয়েছিল।

রচনার প্রায় পনের বৎসর পরে আবদুল্লাহ্ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। এ৯ দীর্ঘকালে আমাদের ভিতরে কোনো পরিবর্তন যে হয় নি তা নয়। আশরাফ-আতরায় সমস্যা, পর্দা-সমস্যা এখনো মুসলমান সমাজে আছে; কিন্তু এ সবের উৎকটতার,হাস হয়েছে। হিন্দু-মুসলমান সমস্যা, মহাজন-খাতক সমস্যা এসবও নূতন রূপ নেবার পথে দাঁড়িয়েছে। তবু বাংলাদেশের এক যুগের সমাজের এই চিত্রের সত্যিকার মর্যাদা এতটুকু যে হ্রাস হয়েছে তা নয়। এমন কি এই ‘আবদুল্লাহ’ যে দিন বাঙালীর চোখে। বিশেষ করে মুসলমান বাঙালীর চোখে, অতীত ইতিহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে সেই দিনই হয়ত বোঝা যাবে, তার জীবনের উপরে অজ্ঞানতা যে দুর্যোগ-রাত্রির নিবিড়তা নিয়ে জমেছিল তার অবসান হয়েছে।

বলা হয়েছে এ একখানি সমাজ-চিত্র। কিন্তু চিত্রকরের ক্ষমতা যে কত, নানা দিক দিয়ে তা বিচার করে দেখা যেতে পারে। আমরা সেই সম্পর্কে দুই একটি কথা বলতে

চেষ্টা করব।

প্রথমেই চোখে পড়ে বইখানিতে সমস্ত রকমের আতিশয্যের অভাব। আশরাফ আতরাফ সমস্যা, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা, প্রভৃতি সম্বন্ধে যে সব চিত্র এতে অঙ্কিত হয়েছে সহজেই সে-সব ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু উৎকটতার প্রলোভন এড়িয়ে চলবার আশ্চর্য ক্ষমতা এই কাণ্ডজ্ঞান-প্রেমিকের ও কৌতূহল-রসিকের। আমি একটি মাত্র দৃষ্টান্ত দেব। ২৯ পরিচ্ছেদে আবদুল্লাহ্ হে মাস্টার হয়ে রসুলপুর স্কুলে যাচ্ছেন-গরুর গাড়িতে। পল্লীগ্রামের পথ বর্ষার অত্যাচারে ভীষণাকার হয়েছে। এক জায়গায় গাড়ি অচল হয়ে দাঁড়াল। পাশের এক ব্রাহ্মণের বাড়ির পাশ দিয়ে পায়ে হেঁটে যাবার পথ ছিল। কিন্তু সে চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যাপার কি দাঁড়াল ‘আবদুল্লাহ্’-কারের ভাষায় তার পরিচয় এই:

…গাড়োয়ান কহিল “হুজুর, আছে এট্টা পথ; কিন্তু সে এক ঠাহুরির বাড়ীর পর দ্যে যাতি হয়। আপনি গে তানারে এট্ট কয়ে বুলে দ্যাহেন যদি যাতি দেন।”

..আবদুল্লাহ্ গিয়া বৈঠকখানার বারান্দার উপর উঠিল। গৃহমধ্য হইতে শব্দ আসিল-কে? আবদুল্লাহ্ কহিল,-”মশায় আমি বিদেশী, একটু মুস্কিলে পড়ে আপনার কাছে” বলিতে বলিতে ঘরে উঠিবার জন্য পা বাড়াইল।

টুপি চাপকান পরিহিত অদ্ভুত মূর্তিখানি সটান ঘরের মধ্যে উঠিতে উদ্যত হইয়াছে দেখিয়া গৃহমধ্যস্থিত লোকটি সত্রাসে “হ্যাঁ, হাঁ, করেন কি, করেন কি, বাইরে দাঁড়ান, বাইরে দাঁড়ান” বলিতে বলিতে তক্তপোষ হইতে নামিয়া পড়িলেন। আবদুল্লাহ অপ্রস্তুত হইয়া তাড়াতাড়ি পা টানিয়া লইয়া বারান্দায় সরিয়া আসিয়া দাঁড়াইল।

৩২২

“কি চান মশায়?” সেই লোকটি দরজার গবরাটের উপর দাঁড়াইয়া দুই হাতে চৌকাটের বাজু দুটী ধরিয়া, একটু রুষ্ট স্বরে এই প্রশ্ন করিলেন।

আবদুল্লাহ্ যথাশক্তি বিনয়ের ভাব দেখাইয়া কহিলেন,-”মশায় আমি গরুর গাড়ী করে যাচ্ছিলাম, গ্রামের মধ্যে এসে দেখি রাস্তা এক জায়গায় ভাঙ্গা, গাড়ী চলা অসম্ভব। শুনলাম মশায়ের বাড়ীর পাশ দিয়ে একটি পথ আছে যদি দয়া করে……

লোকটি রুখিয়া উঠিয়া কহিলেন-”হ্যাঃ, তোমার গাড়ী চলে না চলে তা আমার কি? আমার বাড়ীর উপর দিয়ে ত আর সদর রাস্তা নয় যে, যে আসবে তাকে পথ ছেড়ে দিতে হবে…….।

আবদুল্লাহ্ একটু দৃঢ়স্বরে কহিল,-”মশায় বিপদে পড়ে একটা অনুরোধ করতে এসেছিলাম, তাতে আপনি চটছেন কেন? পথ চেয়েছি বলে ত আর কেড়ে নিতে আসিনি! সোজা বলেই হয়, না, দেব না!”

“ওঃ ভারিত লবাব দেখি! কে হে তুমি, বাড়ী বয়ে এসে লম্বা লম্বা কথা কইতে লেগেছ?” ইত্যাদি।

গাড়োয়ানের সঙ্গে নিজে কাদায় নেমে গাড়ী চালিয়ে নেবার চেষ্টা করে বিফল হয়ে অবশেষে অন্য গ্রাম থেকে লোক ডেকে এনে এই সঙ্কট থেকে আবদুল্লাহ্ পরিত্রাণ পেলেন। এমন ঘটনায় সাম্প্রদায়িকতার বিষ যে কি বিষম ফেনিয়ে উঠতে পারে, আজকালকার পাঠকদের সে কথা বলবার প্রয়োজন করে না। কিন্তু এমনি ভাবে বিপদ কাটিয়ে কাজি ইমদাদুল হকের আবদুল্লাহ্ সেই অদ্ভুত লোকটির প্রতি তাকিয়ে দেখলেন এই ভাবে:

ব্রাহ্মণটি উঠিয়া গিয়াছিলেন; কিছুক্ষণ পরে পান চিবাইতে চিবাইতে ডাবা হাতে আবার বাহিরে আসিয়া বসিলেন।…. যাইবার পূর্বে আবদুল্লাহ সেই ডাবা-প্রেমিক ব্রাহ্মণটির দিকে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল ঠাকুর মশায় তাহাদের দিকেই তাকাইয়া আছেন এবং সুস্থচিত্তে ধূমপান করিতেছেন।

এমন বহু চিত্র এই ‘আবদুল্লাহ্’ গ্রন্থে আছে যেখানে মুসলমানসমাজের ক্লেদ, হিন্দু মুসলমান-সম্পর্কের ক্লেদ অশেষ দক্ষতার সঙ্গে এই চিত্রকর অনাবৃত করে ধরেছেন। কিন্তু এই সমস্ত মূঢ়তা, বর্বরতা ও বীভৎসতার উপরে ফুটে রয়েছে তাঁর হাস্যচটুল কিন্তু

প্রীতিময় দুটি চোখ।

চিত্রাঙ্কনে আবদুল্লাহ্-কারের কৃতিত্ব কতখানি প্রকাশ পেয়েছে, সে-সম্বন্ধে মতভেদ হতে পারে। কেউ কেউ বলতে পারেন, ব্যক্তির চাইতে সমাজের দিকেই তাঁর দৃষ্টি বেশী, তাই তিনি যাদের আমাদের সামনে দাঁড় করিয়েছেন, তাঁরা ব্যক্তি তেমন নন যেমন সমাজের বিচিত্র গতিভঙ্গির পরিচয়-চিহ্ন। এই মতের যথার্থতা অনেকখানি স্বীকার করা যেতে পারে, কিন্তু পুরোপুরি নয়। আবদুল্লাহর পাত্রপাত্রীরা আমাদের চারপাশের অতিপরিচিত প্রতিবেশী-প্রতিবেশিনীর দল সন্দেহ নেই; কিন্তু এই চিত্রকরের চোখ দুটি বড় সজাগ, তাই অতি-পরিচিতদেরও তিনি মাঝে মাঝে এমন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখেছেন যে, তাতেই এঁদের অনেকের ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছে পাঠকদের কৌতূহলের সামগ্রী। অপেক্ষাকৃত অপ্রধান চরিত্রগুলির ভিতরে পূর্বাঞ্চল নিবাসী’ মৌলবী সাহেব, বরিহাটি গভর্ণমেন্ট স্কুলের হেডমাষ্টার, তারুণ্যের প্রতিমূর্তি আবদুল

৩২৩

কাদের, এম্‌নি ধরণের সৃষ্টি। অতিপরিচিত বলে এঁদের প্রতি অমনোযোগী হওয়া সম্ভবপর নয়।

‘আবদুল্লাহ’র প্রধান চরিত্র এই ক’জন-আবদুল্লাহ্, সৈয়দ সাহেব, মীর সাহেব। আর ডাক্তার দেবনাথ সরকার। যে বিবেচনায় আমরা আবদুল কাদেরকে অপ্রধান চরিত্র। বলেছি, সেই বিবেচনা থেকে ডাক্তার দেবনাথ সরকারকেও কেউ যদি অপ্রধান চরিত্র ভাবেন, তবে আপত্তি না করলেও চলে। কিন্তু এই ডাক্তারের ভিতরে এমন একটি সহজ সুন্দর নব্য-বাঙালীত্ব ও মনুষ্যত্ব ফুটে উঠেছে যে, সেইজন্যই মনে হয়, হয়ত ডাক্তারের ভিতরে রূপ ধরতে চেয়েছে কাজি ইমদাদুল হকের এক সুগভীর আকাঙ্ক্ষা।

আবদুল্লাহ্, সৈয়দ সাহেব, মীর সাহেব এই তিন প্রধান চরিত্রের ভিতরে প্রধানতম কে, এ নিয়ে তর্ক চলতে পারে। আবদুল্লাহকে সহজেই গ্রন্থের প্রধান ব্যক্তি ভাবা যেতে পারে, কেননা গ্রন্থের সর্বত্র আমরা তার সাক্ষাৎ পাই, আর বহু বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তিনি জয়ী হতে পেরেছেন। তার চরিত্রে তেজের চাইতে বুদ্ধি ও ভব্যতার অংশই বেশী, তবু যে-সাফল্য তিনি অর্জন করেছেন তাকে বীর্যবন্তের সাফল্যই বলা যায়। কিন্তু যখন ভাবা যায়, রক্ষণশীল সৈয়দ সাহেবের প্রকাণ্ড ব্যক্তিত্ব, তার চারপাশের জগতের উপরে তার প্রভাব, আর সমাজে অপ্রিয় কিন্তু তীক্ষ্ণদৃষ্টি ও বিচক্ষণ মীর সাহেবের অনাড়ম্বর কিন্তু সুনিশ্চিত সংস্কার-প্রয়াস ও তাতে অনেকখানি সাফল্য তখন মনে হয় এই দুই ব্যক্তি অথবা দুই শক্তি হচ্ছে আবদুল্লাহ্-কারের তুলিকার প্রধান বিষয়,-আবদুল্লাহ্, আবদুল কাদের, আবদুল খালেক, রাবিয়া, হালিমা, প্রমুখ মুসলিম নবীন নবীনা হচ্ছেন বাংলার মুসলিমসমাজের এই দুই বিরুদ্ধশক্তির অবশ্যম্ভাবী সংঘর্ষ জাত স্ফুলিঙ্গ। এই স্ফুলিঙ্গই অবশ্য ভবিষ্যতের অচঞ্চল আলোকের পূর্বাভাস।

পুরুষ-চরিত্রের মতো নারী-চরিত্র তেমন প্রস্ফুট করে আবদুল্লাহ্ কার আমাদের সামনে ধরেন নি, অথবা ধরতে পারেন নি। এর প্রধান কারণ মনে হয় বর্তমান মুসলমান-সমাজে নারীর ব্যক্তিত্ব-বিকাশের ক্ষেত্রের সঙ্কীর্ণতা। তবু আবদুল্লাহর মাতা, হালিমা ও রাবেয়ার অন্তরের যে মাধুর্যটুকুর সঙ্গে তিনি আমাদের পরিচিত করিয়েছেন তা মনোরম। এই মুসলিম অন্তঃপূরিকাদের দিকে চাইলেই ভাল করে বোঝা যায়, বাংলার হিন্দু ও মুসলমান বাহ্যত যতই বিভিন্ন হোক, বাস্তবিকপক্ষে তাদের বিভিন্নতা কত নগণ্য-নেই বলে হয়ত অত্যুক্তি হয় না।

আবদুল্লাহর মতো একখানি সমাজ-চিত্রে বহুপ্রাচীন হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সম্বন্ধে লেখকের কি মনোভাব প্রকাশ পেয়ে তা জানতে স্বভাবতঃই কৌতূহল হয়। কিন্তু এই লেখকের যে প্রধান কর্ম, অথবা ধর্ম, চিত্রাঙ্কন এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম তাতে ঘটে নি। হিন্দু ও মুসলমানের কার অপরাধ কতখানি এ চুলচেরা ভাগে তার রুচি নেই, তাদের ভবিষ্যৎ কেমন সে-সম্বন্ধেও বিশেষ কোনো দুশ্চিন্তা তার নেই। এক্ষেত্রেও তিনি কাণ্ডজ্ঞানপ্রেমিক ও হৃদয়বান ব্যক্তি। হেডমাস্টার হয়ে যাবার প্রাক্কালে তাঁর আবদুল্লাহ্ সমাগত ছাত্রদের এই আশীর্বাদ করে যাচ্ছেন-”আশীর্বাদ করি তোমরা মানুষ হও, প্ৰকত মানুষ হও-যে মানুষ হলে পরস্পর পরস্পরকে ঘণা করতে ভুলে যায়, হিন্দু মুসলমানকে, মুসলমান হিন্দুকে আপনার জন বলে মনে কর্তে পারে….।”

৩২৪

আবদুল্লাহর ভাষা সম্বন্ধে দুই একটি কথা বলা আবশ্যক। মুসলিম বাঙালীরা সদাসর্বদা যে-সব শব্দ ব্যবহার করেন অথচ হিন্দু বাঙালীরা করেন না বাঙালা সাহিত্যে সে-সবের প্রয়োগ কি ধরণের হবে, এ-নিয়ে বেশ এক ছোটখাটো সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এমন একটি সমস্যা যে উঠেছে, এ আধুনিক শিক্ষিত হিন্দু-মুসলমানের দরদষ্টি ও কাণ্ডজ্ঞানের কিঞ্চিৎ অভাবেরই পরিচায়ক। কোনো ভাষা মাতৃভাষারূপে লাভ করা মানুষের জন্মগত অধিকার, কিন্তু সেই ভাষায় সাহিত্য রচনা করা সাধনা-সাপেক্ষ। সেই সাধনার দ্বারা সাহিত্যিক নিজেই ভাল বুঝতে পারেন, তার শব্দ-সম্পদ কি ধরণের হওয়া উচিত-চিত্রের কোন্ রূপ ফোঁটাবার জন্য কোন্ কোন্ রেখা ও রঙের তার প্রয়োজন। এই ক্ষমতার যেখানে অভাব সেখানে ভাষা বা সাহিত্য সম্বন্ধে কোনো সমস্যাই ওঠে না। চিত্তের স্বাস্থ্য ও স্বাভাবিকত্বে ইমদাদুল হকের ত্রুটি ছিল না। সর্বোপরি তিনি বাংলার সন্তান; তাই তার রচনা সহজেই হয়ে উঠেছে সাহিত্য ও খাঁটি বাংলা ভাষা-যে জীবনের চিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন, তার জন্য প্রয়োজনীয় অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহার সত্ত্বেও তা অকৃত্রিম বাংলার ভাষা ভিন্ন কিছু নয়। বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের বিকাশের অবকাশ এখনো প্রচুর, তাই কোন্ কোন্ অপরিচিত পথে পদচারণা করে’ সাহিত্যিকরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সম্পদ বৃদ্ধি করবেন, সে-সবের আবিষ্কার সম্ভবপর কেবল তাদেরই ঐকান্তিক সাধনার দ্বারা।

আনোয়ারুল কাদীর সাহেব আবদুল্লাহর শেষ কয়েক পরিচ্ছেদ লিখেছেন বলা হয়েছে। সে-সম্বন্ধে দুই একটি কথা বলে আমার এই আলোচনা শেষ করছি। কাজি ইমদাদুল হক প্রধানত চিত্রকর, আর আনোয়ারুল কাদীর প্রধানত মনস্তাত্ত্বিক। তাই দুজনের রচনারীতির পার্থক্য সহজেই প্রস্ফুট হয়েছে। তবে দুটি পরিচ্ছেদ আনোয়ারুল কাদীর সাহেবের কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে বেশ। সেই দুটি পরিচ্ছেদের একটি ‘সালেহা’র মৃত্যু-বৰ্ণনা, অপরটি মীর সাহেবের অন্তিমকালের বর্ণনা। ইমদাদুল হক সাহেবের আঁকা সালেহা যেন প্রাণলেশবর্জিত, দোর্দণ্ডপ্রতাপ পিতার বিচারহীন মতবাদের প্রতিমূর্তি। কিন্তু এই আচার-অনুষ্ঠানের স্তবকের ভিতরেও আনোয়ারুল কাদীর সাহেব একটি ক্ষীণ হৃৎস্পন্দন অনুভব করেছেন, তারই সঙ্গে সঙ্গে আবদুল্লাহর কর্মবহুল পরিশ্রান্ত জীবন ঈষৎ প্রেমসুধাস্পর্শে ক্ষণকালের জন্য একটু নূতন রকমের করে তুলেছেন। সমাজের নিদারুণ বিরুদ্ধতায় সবল ও বিচক্ষণ মীরসাহেবও শেষে কেমন ভেঙে পড়েছেন, সে-চিত্রটিও তিনি মর্মস্পর্শী করে আঁকতে পেরেছেন। কিন্তু সৈয়দ সাহেবের নিষ্ঠা ও আড়ম্বরপ্রিয়তার প্রতি একটু সদয় বা সশ্রদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, তিনি যে সফল-প্রযত্ন হতে পেরেছেন তা মনে হয় না। যতদূর বুঝেছি তাতে মনে হয় সৈয়দ সাহেবের চরিত্রে নিষ্ঠা থাকলেও, সে-নিষ্ঠাকে ইমদাদুল হক সাহেব শ্রদ্ধার চক্ষে দেখেন নি, এই নিষ্ঠার সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিশেছে বিষম আত্মপরায়ণতা। ভবিষ্যদৃষ্টির একান্ত অভাব, ও যা আছে বা ছিল তার জন্য প্রচণ্ড মোহ, অন্যকথায় আত্মম্ভরিতা, মনে হয়, এরই উপরে সৈয়দ সাহেবের চরিত্রের ভিত্তি। তার নিষ্ঠা ও আড়ম্বরপ্রিয়তা এরই আনুষঙ্গিক; তাঁর স্বভাবদত্ত তীক্ষ্মবুদ্ধিও এই আত্মম্ভরিতার কুহক থেকে তাকে রক্ষা করতে পারে নি। এই সৈয়দ-সাহেবেরা মুসলমান সমাজে বিরল নন আদৌ। এমন

৩২৫

উৎকট আতারিতা মুসলমান-চরিত্রে কেন দেখা দিল, তার কারণ-নির্ণয়-চেষ্টার অবকাশ এখানে নেই; কিন্তু সমাজের এই দারুণ ক্ষতস্থান কাজি ইমদাদুল হকের দড়ি এড়িয়ে যাবে এ সম্ভবপর নয়।

“মসলিম কালচার” নামে যে সুন্দর কিন্তু সাড়ম্বর ‘মোগল কালচারের ধ্বংসাবশেষের প্রতি আজও বাংলার শিক্ষিত মুসলমানের অনুরাগের অন্ত নেই, তার প্রতি আবদুল্লাহ্-কারের মনোভাব বেশ বুঝে দেখবার মতো। অতীত বা ভলি, কোনো শ্রেণীর মোহই যেন তার জন্য প্রবল নয়। তিনি কাম্য জ্ঞান করেছেন বছি, সুরুচি-নিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা-এইই মনে হয়।

হয়ত আবদুল্লাহ্ সম্পর্কে আনোয়ারুল কাদীর সাহেবেরও যথেষ্ট বক্তব্য আছে আর সেসব জানতে পারলে আমরা লাভবানই হব। তবু বইখানির ভবিষ্যৎ সংস্করণে ইমদাদুল হক সাহেবের মূল খসড়াটি, পরিশিষ্ট আকারে যুক্ত থাকা সমীচীন মনে করি। পরে এ বইখানি আরো বহু আলোচকের আলোচনার বিষয় হবে সন্দেহ নেই, তাঁদের জন্য এমন একটি পরিশিষ্টের বিশেষ প্রয়োজন অনুভূত হওয়াই স্বাভাবিক।

জ্যৈষ্ঠ, ১৩৪১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *