বিবিধ প্রবন্ধ

বিবিধ প্রবন্ধ

কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথ

কালিদাসপ্রীতি রবীন্দ্রনাথ লাভ করেছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ‘আত্মচরিতে’ কালিদাসের ভাষা মাঝে মাঝে উঁকি দিয়েছে, বিশেষ করে যেখানে তিনি হিমালয়ের শোভা-সৌন্দর্যের বর্ণনার চেষ্টা করেছেন।

মহর্ষির কালিদাসপ্রীতি তাঁর বিখ্যাত পুত্রদের প্রায় প্রত্যেকেই সংক্রামিত হয়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের শকুন্তলার অনুবাদ কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর শকুন্তলা’ প্রবন্ধে উদ্ধৃত করেছেন, আর নবমেঘোদয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথের সানুরাগ ‘মেঘদূত’-আবৃত্তি কিশোর-রবীন্দ্রনাথের চিত্ত যে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল ‘জীবনস্মৃতি’র পাঠকরা তা জানেন।

কিন্তু প্রতিভার স্বধর্ম স্বীকরণ-অনুকরণ নয়। রবীন্দ্রনাথের গভীর কালিদাসপ্রীতিতে তাঁর সেই স্বীকরণ-বৃত্তি কার্যকরী হয়েছে। কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের বিচার এক উপাদেয় সাহিত্যিক বিষয়, কিন্তু সহজসাধ্য নয় আদৌ, কেননা কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথ দুই কালের দুই মহাভাবুক ও মহাশিল্পী। এ-বিষয়ে মাত্র কিছু কিছু ইঙ্গিত দিতে আমরা চেষ্টা করবো।

প্রথমেই চোখে পড়ে কালীদাসের সৌন্দর্য-বোধে ও রস-বোধে আর রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য-বোধে ও রস-বোধে পার্থক্য। এ বিষয়ে মিলও তাঁদের মধ্যে যথেষ্ট। এই দুই কবিই পৃথিবীর শোভা-সৌন্দর্যের একান্ত অনুরাগী: কালিদাস ইন্দ্র সারথি মাতলির মুখে বলেছেন–অহহ উদাররমণীয়া পৃথিবী; তার সঙ্গে আত্মিক যোগ রয়েছে রবীন্দ্রনাথের এই ধরনের অগণিত উক্তির :

শ্যামলা বিপুলা এ ধরার পানে,
চেয়ে দেখি আমি মুগ্ধ নয়ানে…………(কবির পুরস্কার)
মাটির সুরে আমার সাধন–
আমার মনকে বেঁধেছে রে
এই ধরণীর মাটির বাঁধন। (গান)

বিশেষ লক্ষ্য করার বিষয় এই যে দুই কবির চোখেই পৃথিবীর মহিমা যেন অন্যনিরপেক্ষ–পৃথিবীর যিনি স্রষ্টা ও নিয়ন্তা তাঁর কথা অনেকখানি বিস্মৃত হয়ে এরা উপভোগ করেছেন পৃথিবীর শোভা-সৌন্দর্য। এক্ষেত্রে জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকৃতপ্রেমিক ওয়ার্ডসোয়ার্থের সঙ্গে এঁদের পার্থক্য সুস্পষ্ট, কেননা, ওয়ার্ডসোয়ার্থ

প্রকৃতির অপরূপতার সঙ্গে অভিন্নভাবে দেখেছেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্তার মহিমা। মায়াবাদী হিন্দুর কুলে এই দুই কবির জন্ম যেন অদ্ভুত। কিন্তু হিন্দুর মায়াবাদকে হিন্দু অহিন্দু উভয়েই অসঙ্গত-রকমে বড় করে দেখেছেন। প্রাচীন হিন্দু যে শুধু–এমনকি মুখ্যত–মায়াবাদী ছিলেন না তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ বাৎস্যায়ন, চাণক্য আর বিশেষভাবে ব্যাস– তাঁর মহাভারতের সংখ্যাহীন নায়ক-নায়িকা দোষে গুণে এমন প্রাণবন্ত যে তেমন বিচিত্র প্রাণবন্ত নরনারী– সৃষ্টি জগতের খুব কম সাহিত্যেই সম্ভবপর হয়েছে। কিন্তু কালিদাসের ও রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য-বোধে ও রস-বোধে এতখানি মিল সত্ত্বেও খুব বড় পার্থক্য ফুটে উঠেছে এইখানে যে কালিদাস যথেষ্ট ভোগবাদী– অবশ্য সবল সেই ভোগ তাই অসুন্দর নয় কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আনন্দবাদী; কালিদাসের সৌন্দর্য-বোধ ও রস-বোধের চাইতে সূক্ষ্মতর রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য-বোধ ও রস-বোধে। এ সম্পর্কে কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করছিঃ

বালেন্দুবক্ৰাণ্যবিকাশভাবাদভুঃ পলাশান্যতিলোহিনি।
সদ্যো বসন্তেন সমাগতানাং নক্ষতানীব বনস্থলীনামা।। [১]

আসোদ মিথিলাং স বেষ্টয়ন পীড়িতোপবন- পাদপাং বলৈঃ।
প্রতিরোধমসহিষ্ট সা পুরী স্ত্রীব কান্তপরিভোগমায়তমা।। [২]

জলপ্রান্তে ক্ষুদ্ধ ক্ষুব্ধ কম্পন রাখিয়া,
সজল চরণচিহ্ন আঁকিয়া আঁকিয়া
সোপানে সোপানে, তীরে উঠিলা রূপসী;
স্রস্ত কেশভার পৃষ্ঠে পড়ি গেল খসি।
অঙ্গে অঙ্গে যৌবনের তরঙ্গ উচ্ছল
লাবণ্যের মায়ামন্ত্রে স্থির অচঞ্চল
বন্দী হয়ে আছে–তারি শিখরে শিখরে
পড়িল মধ্যাহ্ন রৌদ্র………..
ঘিরি তার চারিপাশ
নিখিল বাতাস আর অনন্ত আকাশ
যেন এক ঠাই এসে আগ্রহে সন্নত
সর্বাঙ্গ চুম্বিল তার; সেবকের মতো
সিক্ত তনু মুছি নিল আতপ্ত অঞ্চলে
সযতনে, ছায়াখানি রক্ত পদতলে
চ্যুত বসনের মতো রহিল পড়িয়া।
অরণ্য রহিল স্তব্দ, বিস্ময়ে মরিয়া।
ত্যজিয়া বকুলমুল মৃদুমন্দ হাসি
উঠিল অনঙ্গদেব
সম্মুখেতে আসি
থমকিয়া দাঁড়াল সহসা। মুখপানে
চাহিল নিমেষহীন নিশ্চল নয়ানে
ক্ষণকাল তরে। পরক্ষণে ভূমি ’পরে
জানুপাতি বসি, নির্বাক বিস্ময়ভরে
নতশিরে পুষ্পধনু, পুষ্পশরভার
সমর্পিল পদপ্রান্তে পূজা-উপাচার
তৃণ শূন্য করি। নিরস্ত্র মদন পানে
চাহিলা সুন্দরী শান্ত প্রসন্ন বয়ানো (বিজয়িনী)

কালিদাসের ভোগবাদ রবীন্দ্রনাথ যেন সজাগ ভাবেই ‘শোধিত’ করে’ নিয়েছেন। ‘কুমারসম্ভবে’র শেষের অনেকগুলো সর্গ কালিদাসের রচনা নয় এই প্রচলিত মত তিনি অতি মনোজ্ঞ ভাবে সমর্থন করেছেন এই সনেটে–

যখন শুনালে কবি দেবদম্পতিরে
কুমারসম্ভবগান,–চারি দিকে ঘিরে
দাঁড়াল প্রথমগণ,–শিখরের ’পর
নামিল মন্থর শান্ত সন্ধ্যামেঘস্তর,–
স্থগিত বিদ্যলীলা, গর্জন বিরত,
কুমারের শিখী করি পুচ্ছ অবনত,
স্থির হয়ে দাঁড়াইল পার্বতীর পাশে
বাঁকায়ে উন্নত গ্রীবা! কভু স্মিত হাসে
কাঁপিল দেবীর ওষ্ঠ,–কভু দীর্ঘশ্বাস
অলক্ষ্যে বহিল,–কভু অশ্রুজলোচ্ছ্বাস
দেখা দিল আঁখি প্রান্তে–যবে অবশেষে
ব্যাকুল শরমখানি নয়ন নিমেষে
নামিল নীরবে,–কবি, চাহি দেবী পানে
সহসা থামিলে তুমি অসমাপ্ত গানে। (চৈতালি)

“সহসা অসমাপ্ত গানে” থামবার ধরন যে সাধারণত কালিদাসের নয় তার পর্যাপ্ত প্রমাণ তাঁর রচনায় রয়েছে। তবে তিনি প্রকৃতই সৌন্দর্যরসিক, তাই এমন সুকুমার রুচি এক্ষেত্রে তাতে আরোপ করা সঙ্গত ও শোভন দুইই হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ‘ঋতুসংহার’ সনেটটিও এমন শোভন ‘শোধনে’র দৃষ্টান্ত, কেননা মূল ‘ঋতুসংহার প্রকৃতির আবেগপ্রাবল্যের স্তোত্রও বটে আনন্দস্তোত্রও বটে।

কিন্তু কালিদাসের ভোগবাদের এই উল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে সত্যের অনুরোধে না উল্লেখ করে’ উপায় নেই যে অন্যান্য বড় প্রতিভার মতো কালিদাসকেও দুই একটি লক্ষণের দ্বারা বুঝে ফেলার চেষ্টা করা বিড়ম্বনা। এই ভোগবাদী কবি আশ্চর্যভাবে ত্যাগবাদীও। মহারাজ অজের রাজ্যভোগ আর দিগবিজয়ী রঘুর সন্ন্যাসের কৃচ্ছ সাধনা এই দুয়ের যে ছবি তিনি পাশাপাশি দাঁড় করিয়েছেন তা মনোরম। আমরা কয়েকটি শ্লোকের বাংলা অনুবাদ উদ্ধৃত করছি :

যুবা নৃপতি প্রজাদের পর্যবেক্ষণের জন্য আরোহণ করলেন ধর্মাসন। বর্ষীয়ান নৃপতি চিত্তের একাগ্রতা বিধানের জন্য নির্জনে পরিগ্রহ করলেন কুশাসন। একজন চারপাশের রাজাদের বশীভূত করলেন প্রভু-শক্তির দ্বারা। অপরজন সমাধিযোগের অভ্যাসের দ্বারা বশীভূত করলেন দেহস্থ পঞ্চ মরুৎ। তরুণ নৃপতি ভস্মসাৎ করলেন জগতের শত্রুদের সব আয়োজন। বর্ষীয়ান নৃপতি ভস্মসাৎ করতে প্রবৃত্ত হলেন স্বকর্মসমূহকে জ্ঞানময় বহ্নির দ্বারা।

প্রকৃত মহত্ত্বের ছবি আঁকতেও কালিদাসের অশেষ আগ্রহ; ভারত রাজ্যলোভী না হয়ে রামের অনুপস্থিতিকালে দীর্ঘকাল রাজ্য পরিচালনা করেন, এজন্য কবি তাকে বলেছেন, “অসিধারব্রত’ অভ্যাসকারী–শিয়ং ‘যুবাপ্যঙ্কগতামভোক্তা’ অঙ্কগতা স্ত্রীকে যুবক হয়েও তিনি ভোগ করেননি।’ [৩]

একই সঙ্গে ভোগ ও ত্যাগ রবীন্দ্রনাথেও বিদ্যমান, কিন্তু কালিদাসের সঙ্গে এক্ষেত্রে তাঁর পার্থক্য সূক্ষ্ম এবং গভীর। তরুণ নৃপতির রাজ্যশাসন আর প্রবীণ নৃপতির আত্মশাসনের যে ছবি কালিদাস এঁকেছেন তা থেকে এবং তার আরো বহু উক্তি থেকে এ সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে কালিদাসের চোখে সংসার ও সন্ন্যাস যেন দুই স্বতন্ত্র জগৎ, একটিকে সম্পূর্ণ বর্জন করে তবেই যেন অন্যটিতে প্রবেশ পথ পাওয়া যায়। যেন কালিদাস বলতে চান : যতদিন মানুষ সংসারে আছে ততদিন সে মুখ্যত ভোগধর্মী; অবশ্য মহৎদের জন্য এই ভোগ স্কুল চর্বচোষ্যাদি ভোগের সঙ্গে সঙ্গে–কখনো সে-সব অতিক্রম করে–কীর্তি-ভোগ বা যশ ভোগও বটে: ‘নন্দিনী’কে রক্ষার জন্য রাজা দিলীপ সিংহকে বলেছেন :

আমাকে যদি মনে কর তোমার অবধ্য তবে আমার যশ-শরীরের প্রতি দয়ালু হও, একান্তবিধ্বংসী পাঞ্চভৌতিক এই পিন্ডে আমার মতো লোকের একান্ত অনাস্থা। লোকোপবাদে সীতাকে বর্জন কালে রামের হয়ে কবি বলেছেন :

লোকোপবাদ নিবৃত্তির অন্য উপায় নেই দেখে রাম পত্নীত্যাগে বদ্ধপরিকর হলেন। যশ যাদের ধন তাঁরা নিজেদের দেহ থেকে যশকে অধিকতর মূল্যবান জ্ঞান করেন, ভোগসুখের সামগ্রীর (স্রক্‌চন্দনবনিতার) তো কথাই নেই।

কিন্তু এইসব কীর্তিমানদের জীবনেও কালে কালে এমন সময় উপস্থিত হয় যখন ভোগ যশ সবের কথা একেবারে বিসর্জন দিয়ে এরা রত হন যোগে-আত্মায় পরমাত্মা দর্শনের ব্রতে। এ আত্মায় পরমাত্মাদর্শনের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্তরূপে কালিদাস এঁকেছেন কৈলাসে ধ্যানরত মহাদেবের মূর্তি :

মনো নবদ্বারনিষিদ্ধবৃত্তি হৃদি ব্যবস্থাপ্য সমাধিবশ্যম্।
যমক্ষরং ক্ষেত্রবিদো বিদুস্তমাত্মানমাত্মন্যবলোকয়ন্তম।।[৪]

আত্মায় পরমাত্মা দর্শনের বা উপলব্ধির মাহাত্ম্য সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথও সচেতন, এ সম্পর্কে তাঁর নৈবেদ্যের এই কবিতা স্মরণ করা যেতে পারে :

হে রাজেন্দ্র তোমা-কাছে নত হতে গেলে
যে ঊর্ধ্বে উঠিতে হয়,সেথা বাহু মেলে
লহো ডাকি সুদুর্গম বন্ধুর কঠিন
শৈলপথে; অগ্রসর করো প্রতিদিন
যে মহান পথে তব বরপুত্রগণ
য়াছেন পদে পদে করিয়া অর্জন
মরণ-অধিক দুঃখ। ওগো অন্তরযামী,
অন্তরে যে রহিয়াছে অনির্বাণ আমি
দুঃখে তার লব আর দিব পরিচয়।
তারে যেন ম্লান নাহি করে কোনো ভয়,
তারে যেন কোনো লোভ না করে চঞ্চল।
সে যেন জ্ঞানের পথে রহে সমুজ্জ্বল,
জীবনের কর্মে যেন করে জ্যোতি দান,
মৃত্যুর বিশ্রাম যেন করে মহীয়ান।

কিন্তু তবু কালিদাসের আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতার বড় পার্থক্য এই যে রবীন্দ্রনাথ মুখ্যত গুহ্যসাধনাবাদী মরমী নন, ‘বিকাশধর্মী মানবতা’-পন্থী ভগবানে বা পরমাত্মায় তাঁর যতখানি আনন্দ তার চাইতে হয়ত তাঁর বেশি আনন্দ মানুষের জাগতিক জীবনের সর্বাঙ্গীন উল্কর্ষ সাধনায়। এ সম্বন্ধে তাঁর বহু উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে, কয়েকটি উদ্ধৃত করছি :

সেই তো আমি চাই।
সাধনা যে শেষ হবে মোর
সে ভাবনা তো নাই।
ফলের তরে নয়তো খোঁজা
কে বইবে সে বিষম বোঝা
যেই ফলে ফল ধুলায় ফেলে
আবার ফুল ফোঁটাই। (গীতালি)

পান্থ তুমি পান্থ জনের সখা হে
পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া
যাত্রাপথের আনন্দগান যে গাহে
তারি কণ্ঠে তোমারি গান গাওয়া। (গীতালি)

পতন-অত্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী,–
হে চির-সারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিন রাত্রী।

এই বিকাশধর্মী মানুষের পরিণামে নির্বাণলাভ বা ব্ৰহ্মপদ লাভ রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে অশ্রদ্ধেয় হয়ত নয় কিন্তু বেশি আনন্দ তার এই কথা ভাবায় যে মানুষ স্বীয় সৃষ্টিধর্মগুণে এই সংসার-ক্ষেত্রে ঈশ্বরের সাহায্যকারী :

তুমি তো গড়েছ শুধু এ মাটির ধরণী তোমার
মিলাইয়া আলোকে আঁধার।
শূন্য হাতে সেথা মোরে রেখে
হাসিছ আপনি সেই শূন্যের আড়ালে গুপ্ত থেকে।
দিয়েছ আমার পরে তার
তোমার স্বর্গটি রচিবার। (বলাকা)

‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থে সুপ্রাচীন সোহহম তত্ত্বের যে ব্যাখ্যা রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন তাও এই সম্পর্কে স্মরণীয়, তার মতে সোহহমের এ অর্থ নয় যে মানুষ ঈশ্বর, বরং এই অর্থ যে মানুষকে হতে হবে ঈশ্বরের মত সুন্দর ও শক্তিমান অর্থাৎ সৃষ্টিধর্মী। তাঁর এই বিখ্যাত বাণীও এই সম্পর্কে স্মরণীয় : যা শাস্ত্র তাই বিশ্বাস্য নয়, যা বিশ্বাস্য তাই শাস্ত্র। [৫]

কালিদাসের কালে, অথবা তার কিছু পূর্বে, ভারতবর্ষে প্রবল হয়েছিল বেদপন্থী ও বেদবিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ। কালিদাস বেদপন্থী-বর্ণাশ্রমধর্মের শক্তিমান সমর্থক, তার আদর্শ নৃপতিরা বর্ণাশ্রমধর্মের সজাগ প্রহরী। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের যুগে ভারতবর্ষ যে সংঘর্ষ প্রত্যক্ষ করেছিল তা আরো ব্যাপক ও গভীর, তা হচ্ছে প্রাচ্য আর প্রতীচ্যের সংঘর্ষ। এই বিরাট সংঘর্ষ সমস্ত চেতনা দিয়ে অনুভব করবার শক্তি নিয়ে জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর চিন্তাধারার ও আদর্শের অপূর্ব মর্যাদা তাই থেকে।

রবীন্দ্রনাথ যেন সেকাল ও একালের মধ্যবর্তী সেতু। তার আদর্শ যে কালিদাসের আদর্শের চাইতে ব্যাপকতর, একালের মানুষের জন্য বেশি সত্য ও সার্থক, তা সহজেই বোঝা যায়, কেননা একালের মানুষের চিন্তায় বড় ব্যাপার কোনো ধরনের মরমী সাধনায় তেমন নয় যেমন বিকাশধমী মানবতা। কিন্তু জীবনাদর্শে রবীন্দ্রনাথ কালিদাসের চাইতে সমৃদ্ধতর বলেই তাকে যে কালিদাসের চাইতে স্বভাবত শ্রেষ্ঠতর কবি জ্ঞান করা হবে তা সত্য নয় কেননা কবির সত্যকার কৃতিত্ব অঙ্কনকুশলতায়। অবশ্য শ্রেষ্ঠ অঙ্কনকুশলতার সঙ্গে শ্রেষ্ঠ চিন্তাভাবনাও স্বভাবতই যুক্ত থাকে, কিন্তু কবির চিন্তাভাবনার মর্যাদা তার অঙ্কনকুশলতার মর্যাদা থেকেই। এর সুপরিচিত দৃষ্টান্ত দান্তে। ধর্মাদর্শে তিনি রোমান ক্যাথলিক, কিন্তু বিশিষ্ট আদর্শবাদী হয়েও মহত্ত্বঙ্খলিত জীবনের ছবি আঁকার কাজে তিনি এমন কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন যে সেজন্য জগতের কাব্যরসিকদের চিরশ্রদ্ধেয় হতে পেরেছেন। কালিদাসও জীবনের অর্থপূর্ণ আলেখ্য অঙ্কনে আশ্চর্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন বিশেষ করে তাঁর শকুন্তলায়– তাই তিনিও জগতের রসিকদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। কবি হিসাবে এমন শ্রদ্ধার্য যে রবীন্দ্রনাথও হয়েছেন সে বিষয়ে আমরা, তার একালের স্বভাষীরা, নিঃসন্দেহ। কিন্তু এই দাবির যথার্থতার বিচারক আমরা নই– কাল। কালিদাসের মতো সেই কালজয়ী কবি প্রতিষ্ঠা যে যে কারণে রবীন্দ্রনাথের লাভ হবে বলে আমাদের ধারণা তা সংক্ষেপে বিবৃত করা যায় এইভাবে :

কালিদাসের রচনায় রয়েছে অপূর্ব লালিত্য ও গাম্ভীর্য; রবীন্দ্রনাথের রচনাও তুল্যরূপে ললিত ও গম্ভীর। হয়তো এক্ষেত্রে কালিদাসই রবীন্দ্রনাথের বিশিষ্ট পথপ্রদর্শক। কিন্তু বিদ্যা এক্ষেত্রে যোগ্য শিষ্যে ন্যস্ত হয়েছিল।

কালিদাস আবির্ভূত হয়েছিলেন স্বাধীন ভারতবর্ষে, সেই স্বাধীন ভারতবর্ষে ছিলো মহাবিক্রম নৃপতিকুল। কালিদাসের শ্রেষ্ঠ নায়করা তাই শক্তিমান সৈনিক–অমিতপরাক্রম। রবীন্দ্রনাথের জন্ম পরাধীন ভারতবর্ষে। কিন্তু সেই হীন দশায়ও ভারতবর্ষের অন্তরে জেগেছিল নবশক্তির উল্লাস– বিরাট জগতে শ্রদ্ধেয় হবার স্বপ্ন। রবীন্দ্রনাথ সেই জাগরণের কবি, তাই তাঁর নায়করা ব্যবসায়ে বীর-সৈনিক না হলেও প্রকৃতপক্ষে বীরত্ব-ধর্মী, পরাজয় স্বীকার করা তাদের স্বভাব নয়, জীবনে নব নব মহিমার সম্ভাবনায় উদ্বোধিত হওয়া তাদের জন্মগত অধিকার।

কালিদাস সৃষ্টি করেছেন শকুন্তলাকে; অপূর্ব সেই নারী-মূর্তি–বোধ হয় শিল্পে নারীসৃষ্টির চরম– একাধারে সে উর্বশী আর লক্ষ্মী, মত আর স্বর্গ, বসন্ত আর হেমন্ত। রবীন্দ্রনাথও সৃষ্টি করেছেন এক চিরবন্দনীয় মাতৃমূতি– আনন্দময়ীকে–জগতের সাহিত্যে হয়ত অদ্বিতীয় মাতৃমূর্তি; কিন্তু শকুন্তলার মতো একই সঙ্গে মহিমা ও মোহনতা সেই মূর্তিতে নেই, তাই শিল্পসৃষ্টি হিসাবে শকুন্তলার গৌরব বেশি। কিন্তু এক পরমমোহন শিল্প-সৃষ্টি রবীন্দ্রনাথও করেছেন, সেটি হচ্ছে তাঁর নিজের অন্তরাত্মা-প্রকৃতির অযুত লীলায় অপরূপভাবে চঞ্চল, অথচ এত যে লীলাচাঞ্চল্য, সৌন্দর্যের পরমসূক্ষ্ম অনুভূতি, সব অজানার উদ্দেশ্য স্তবনিবেদন :

আমর সব চেতনা সব বেদনা
রচিল এ যে কী আরাধনা…[৬]

 গম্ভীর ও অকুল স্তবনিবেদন জগতে ঢের হয়েছে, কিন্তু এমন মোহন স্তবনিবেদন হয়ত আর কোনো দ্বিতীয় কবির দ্বারা সম্ভবপর হয়নি।

———

১. বালচন্দ্রের মত বক্র অবিকশিত অতিলোহিত পলাশরাজি সদ্যঃ-বসন্তসমাগতা বনস্থলীরূপা নায়িকাদের অঙ্গে নক্ষত্রসমূহের মত শোভা পাইতে লাগিল। কুমারসম্ভব, তৃতীয় সর্গ।

২. তিনি (দশরথ) মিথিলায় উপনীত হইয়া সৈন্যদলসহ মিথিলা বেষ্টন করিয়া উহার উপবন ও পাদপরাজি পীড়িত করিতে লাগিলেন; মিথিলা তাহার প্রীতির অত্যাচার সহ্য করিল যুবতী যেমন সহ্য করে প্রগাঢ় প্রিয়-সম্ভোগ। রঘুবংশ, একাদশ সর্গ।

৩. রঘুবংশ, ত্রয়োদশ সর্গ

৪. (সংযমী মহাদেব) দেহের নবদ্বার হইতে নিবৃত্ত সমাধিনিয়ন্ত্রিত মন হৃদয়-অধিষ্ঠানে স্থাপিত করিয়া ক্ষেত্রজ্ঞ পুরুষগণ যাহাকে অবিনাশী বলিয়া জানেন সেই আত্মাকে স্বীয় আত্মার মধ্যে অবলোকন করিতেছেন। কুমারসম্ভব, তৃতীয় সর্গ

৫. সমাজ–অযোগ্য ভক্তি ৬. নটীর পূজা

রস ও ব্যক্তিত্ব

ব্যাপক অর্থে মানুষের সমস্ত লিপিবদ্ধ চিন্তাভাবনাকে সাহিত্য বলা যায়। কিন্তু সাধারণত আমরা বিজ্ঞানকে সাহিত্যের অন্তর্গত করে দেখি না। দর্শন ও ইতিহাসকে যদিও সাহিত্য থেকে পৃথক করা খুব কঠিন তবু এসবও সাধারণত আমরা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত জ্ঞান করি না।

বাংলায় এই সংকীর্ণ অর্থে সাহিত্যের প্রচলিত নাম রস-সাহিত্য। নামটি একহিসেবে বেশ ভাল কেননা এই সংকীর্ণ অর্থে সত্যিকার সাহিত্য তাই যা রসোত্তীর্ণ। এর অর্থ অবশ্য এ নয় যে বৈজ্ঞানিক অথবা দার্শনিক অনুসন্ধান ও বিচার অথবা ঐতিহাসিক তথ্য সাহিত্যে অবাঞ্ছিত অথবা অপ্রয়োজনীয়; তবে, প্রকৃত সাহিত্যে এসব অতিক্রম করে থাকা চাই রস অর্থাৎ মানুষের মনের বিশেষ ও গভীর অনুভূতির পরিচয়।

আমাদের দেশের প্রাচীন সাহিত্যে এই রস বা অনুভূতিকে মোটামুটিভাবে কয়েক ভাগে ভাগ করে দেখা হয়েছে, যথা হাস্য রৌদ্র বীভৎস করুণ ইত্যাদি। আমাদের প্রাচীন আলঙ্কারিকদের সেই রসের নয় বিভাগ যে একালে আমাদের খুশী করতে অক্ষম তা বলাই বাহুল্য, কেননা মানুষের মন যে অত্যন্ত জটিল, সুতরাং তার অনুভূতিও বহুবিচিত্র, এ বিষয়ে এযুগে আমরা অতিশয় সচেতন। তবে রস, অর্থাৎ অনুভূতির বিশেষ পরিচয়, যে সাহিত্যের এক অতি বড় ব্যাপার সে-সম্বন্ধে প্রাচীনদের নির্দেশ শিরোধার্য। বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম’ চাঁদের দেওয়া সাহিত্যের এই সংজ্ঞা বাস্তবিকই মূল্যবান নির্দেশ।

কিন্তু একালে আমাদের সাহিত্যিক চিন্তাভাবনায় যেমন মূল্যবান রস তেনি মূল্যবান অন্য একটি ব্যাপার-তার নাম সাহিত্যিকের ব্যক্তিত্ব। নানা দেশেরে নানা, কালের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমরা বুঝেছি সাহিত্যে সাহিত্যস্রষ্টার এই ব্যক্তিত্বের মর্যাদা। বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম, আর সাহিত্য ব্যক্তিত্বের বাণীরূপ-সাহিত্যের এই দুই সংজ্ঞাই আজ আমাদের জন্য মহামূল্য।

কিন্তু এ-দুটিকে স্বতন্ত্রভাবে বোঝ আমাদের পক্ষে যত সহজ এ-দুয়ের পরস্পরের যোগাযোগের তত্ত্বটি বোঝা সেই পরিমাণে দুরূহ, কত দুরূহ তা বোঝা যাবে এই থেকে যে এ-দুয়ের পূর্ণ উপলব্ধির সন্ধান আমরা পাই জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের মধ্যেই, কিন্তু মানুষের দীর্ঘ ইতিহাসে তাঁদের সংখ্যা অতিশয় পরিমিত। সাধারণত কবি সাহিত্যিক নামে যারা পরিচিত তাঁরা মোটের উপর সাহিত্যে রসের অর্থাৎ মাধুর্যের ও কলাকৌশলের কথা কিছু কিছু বোঝেন, কিন্তু ব্যক্তিত্বের কথা খুব কমই বোঝেন। এর দৃষ্টান্ত রয়েছে সংস্কৃত সাহিত্যে। মনোরম পদ ও শ্লোকের রচয়িতা সে-সাহিত্যে প্রচুর সংখ্যায় মেলে, প্রকাশের মার্জিতত্বের গুণে অশ্লীল কবিতাও তাতে সাধারণত সুপাঠ্য, কিন্তু সাহিত্যের বাণীতে যেমন চাই মনোহারিতা তেমনি চাই মহাপ্রাণতা, কিন্তু সেটি সম্ভব হয় রচয়িতা নিজে যখন মহাপ্রাণ-রচয়িতার নিজের সেই মহাপ্রাণতা ভিন্ন পাণ্ডিত্য কলাকৌশল কিছুই তাঁর বাণীতে সেই মহাপ্রাণতার সঞ্চার করতে পারে না-এ-বিষয়ে প্রাচীন আলঙ্কারিকরা যেন উদাসীন। এই ব্যাপারে গ্যেটের মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে-মন্তব্যটি তিনি করেছিলেন বিখ্যাত সমালোচক শ্লেগেল সম্পর্কে :

স্বীকার করতে হবে যে, শ্লেগেলের জানাশোনা ঢের, তার অসাধারণ গুণপনা ও পড়াশুনা দেখে ভীত হতে হয়। কিন্তু তা-ই যথেষ্ট নয়। জগৎজোড়া পাণ্ডিত্য থাকলেও বিচারক্ষমতা না থাকতে পারে। শেগেলের সমালোচনা সম্পূর্ণ একদেশদর্শী, তার কারণ, নাটকে তিনি দেখেন শুধু প্লট ও সাজাবার কৌশল আর পরবর্তীদের সঙ্গে (আলোচ্য) লেখকের ছোটখাটো মিল। সেই লেখক জীবনের মাধুর্য ও মহৎ চিত্তের প্রভাব কতখানি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন সেদিকে তার দৃষ্টি নেই। কিন্তু প্রতিভার সমস্ত কলানৈপুণ্যের কি মূল্য যদি নাটকে আমরা না পাই লেখকের মধুর অথবা মহৎ ব্যক্তিত্ব? জনসাধারণের চিত্তের উৎকর্ষ ঘটে এরই গুণে। শ্লেগেলের ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্ব মহৎদের প্রকৃতি বুঝবার ও সমাদর করবার অযোগ্য। [কবিগুরু গ্যেটে, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৯১]

মহৎ ব্যক্তিত্ব দুর্লভ ব্যাপার বলেই সব দেশের সাহিত্যেই, বিশেষ করে চলতি সাহিত্যে, কলাকৌশলের বিন্যাস কবি ও সাহিত্যিকদের এক বড় কাজ। এমন চেষ্টার একটা ব্যবহারিক মূল্য অবশ্য আছে, কেননা, অনেকের জন্য সাহিত্য কালহরণের বহু উপায়ের মধ্যে একটি উপায়; শিল্পেরও এমনি প্রয়োজনীয় অপব্যবহারের দৃষ্টান্ত বিজ্ঞাপনে শিল্পের ব্যবহার। এমন নিকৃষ্ট কলা-কৌশলময় সাহিত্য ও শিল্প যে বহুজনের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে পারে, তাদের চিত্তবিনোদনও কিছু-পরিমাণে করতে পারে, এতেই প্রমাণিত হয় যে শিল্পে ও সাহিত্যে কলাকৌশল খুব বড় ব্যাপার-শিল্পের ও সাহিত্যের বিশেষত্ব এই থেকে। কিন্তু যারা দৃষ্টিমান তাঁদের বুঝতে দেরী হয় না যে এই কলাকৌশলেরপ্রয়োগও তাদের দ্বারা বেশি সার্থক হয় যারা শুধু কলাকুশলী নন, সেই সঙ্গে সহজভাবে মহৎ।

শিল্পী ও সাহিত্যিকদের এই মহত্ত্বের কথা কিন্তু একটু বিশেষভাবে বুঝবার আছে। সাধারণত দেখা যায় যাকে মহত্ত্বে সুপ্রতিষ্ঠিত বলা যায় তেমন চরিত্র শিল্পী। সাহিত্যিকদের নয়। তাদের শ্রেষ্ঠদেরও প্রতিনিধিস্থানীয় বরং ভর্তৃহরি যিনি বহুবার বৈরাগ্য অবলম্বন করেছিলেন আর বহুবার কামনার জীবনে ফিরে এসেছিলেন-খেয়ালের বশে নয়, অন্তরপ্রকৃতির সত্যকার তাগিদে। শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে সবলতা ও দুর্বলতা যে এমন একই সঙ্গে থাকে বোধ হয় এই জন্য ভাল আর মন্দ দুয়েরই আকর্ষণের মনোহারিতা তারা নিজেরা এমন গভীর করে উপলব্ধি করেন আর সুন্দর করে তা ব্যক্ত করতে পারেন। চিত্তের এমন সহজ প্রসার, বিচিত্র অনুভূতির এমন তীক্ষ্মতা, যখন শিল্পী-সাহিত্যিকের জন্য দুর্লভ হয় কোনো বিশেষ idea বা ধারণার চাপে তখন ঘটে তাঁর পতন। তখনো দক্ষতাগুণে লোভনীয় অথবা রোমাঞ্চকর চিত্র তিনি অঙ্কিত করতে পারেন কিন্তু যাতে মানুষের চিত্ত গভীরভাবে আশ্নিষ্ট হতে পারে তার রচনা আর তেমন রচনা থাকে না। এমন ত্রুটিপূর্ণ শিল্প সম্পর্কে ম্যাক্সিম গোর্কির টলস্টয়-চরিতের এই বিচার স্মরণীয়-বিচার করেছেন রবীন্দ্রনাথ :

ম্যাক্সিম গোর্কি টলস্টয়ের একটি জীবনচরিত লিখেছেন। বর্তমান কালের প্রখরবুদ্ধি পাঠকেরা বাহবা দিয়ে বলছেন, এ-লেখাটা আর্টিষ্টের যোগ্য লেখা বটে। অর্থাৎ, টলস্টয় দোষে গুণে ঠিক যেমনটি সেই ছবিতে তীক্ষ্ম রেখায় তেমনিটি আঁকা হয়েছে; এর মধ্যে দয়ামায়া ভক্তিশ্রদ্ধার কোনো কুয়াশা নেই। পড়লে মনে হয়, টলস্টয় যে সর্বসাধারণের চেয়ে বিশেষ কিছু বড় তা নয়, এমন কি, অনেক বিষয়ে হেয়।…টলসটয়ের কিছুই মন্দ ছিলনা এ কথা বলাই চলে না; খুঁটিনাটি বিচার করলে তিনি যে নানা বিষয়ে সাধারণ মানুষের মতোই এবং অনেক বিষয়ে তাদের চেয়েও দুর্বল, এ কথা স্বীকার করা যেতে পারে। কিন্তু যে সত্যের গুণে টলস্টয় বহু লোকের এবং বহুকালের, তাঁর ক্ষণিকমূর্তি যদি সেই সত্যকে আমাদের কাছ থেকে আচ্ছন্ন করে থাকে তাহলে এই আর্টিস্টের আশ্চর্য ছবি নিয়ে আমার লাভ হবে কী। প্রথম যখন আমি দার্জিলিং দেখতে গিয়েছিলুম দিনের পর দিন কেবলই দেখেছিলুম মেঘ আর কুয়াশা। কিন্তু জানা ছিল, এগুলো সাময়িক এবং যদিও হিমালয়কে আচ্ছন্ন করবার এদের শক্তি আছে তবুও এরা কালো বাষ্পমাত্র, কাঞ্চনজঙ্ঘার ধ্রুব শুভ্র মহত্ত্বকে এরা অতিক্রম করতে পারে না। আর যাই হোক, হিমালয়কে এই কুয়াশার দ্বারা চিরকালের স্বরূপকে আচ্ছন্ন করে দেখাই আর্টিষ্টের দেখা, একথা মানতে পারি নে। তা ছাড়া গোর্কির আর্টিস্ট-চিত্ত তো বৈজ্ঞানিক হিসেবে নির্বিকার নয়। তাঁর চিত্তে টলস্টয়ের যে-ছায়া পড়েছে সেটা একটা ছবি হতে পারে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক হিসেবেও সেটা-যে সত্য তা কেমন করে’ বলব। গোর্কির টলস্টয়ই কি টলস্টয়। বহুকালের ও বহুলোকের চিত্তকে যদি গোর্কি নিজের চিত্তের মধ্যে সংহত করতে পারতেন তাহলেই তার দ্বারা বহুকালের বহুলোকের টলস্টয়ের ছবি আঁকা সম্ভবপর হত। তার মধ্যে অনেক ভোলবার সামগ্রী ভুলে যাওয়া হত, আর তবেই যা না-ভোলবার তা বড় হয়ে, সম্পূর্ণ হয়ে, দেখা দিত। [রবীন্দ্র-রচনাবলী, ১৯শ খণ্ড, পৃঃ ৩৮২]

রবীন্দ্রনাথের সমালোচনার শেষ ক’টি ছত্রে যে বলা হয়েছে: শিল্পীর কাজ শুধু অঙ্কনকুশল হওয়া নয়, শিল্পীর কাজ তার বর্ণনার বিষয় সম্পর্কে প্রধান ও অপ্রধানের বিচার করা, সাহিত্য ও শিল্প সম্পর্কে এ এক বড় ব্যাপার। বলাবাহুল্য এরও যোগ কবির ব্যক্তিত্বের সঙ্গেই, নিজে এক মহৎ ব্যক্তিত্বের অধিকারী না হলে জীবনের ব্যাপারে এমন প্রধান অপ্রধানের বিচার সম্ভবপর নয়; কিন্তু জীবনে প্রধান অপ্রধানের ভাল-মন্দের এই ভেদ সাহিত্যিক ও শিল্পী যে করেন সেটি কিন্তু ঠিক নীতিবিদের ভঙ্গিতে নয়। নীতিবিদ্‌ কোনো বিশেষ আদর্শকে তাঁর অথবা তার ও জগতের জন্য শ্রেয় জ্ঞান করেছেন, আর যথাশক্তি অনুসরণ করে চলেছেন সেই আদর্শই, অন্যদিকে দৃষ্টি তার প্রায় নেই, কিন্তু শিল্পী-অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ শিল্পী-জীবনের এক বিশেষ আদর্শ সম্বন্ধে যেমন সচেতন তেমনি সচেতন মানবচিত্তের বিচিত্র প্রবণতা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে, তবে এই বিচিত্র প্রভাবে ও আকর্ষণে শ্রেষ্ঠ শিল্পী আকুল ও দিশহারা নন, চমকিত ও আন্দোলিত কিন্তু স্থিরলক্ষ্যও-যেমন স্থিরলক্ষ্য বর্ষার দুরন্ত পদ্মায় যারা পাড়ি জমায় সেই মহাবিচক্ষণ ও মহালাঞ্ছিত মাঝিরা। শিল্পে ও সাহিত্যে এমন বিচক্ষণতা অবশ্য উচ্চাঙ্গের প্রতিভার পক্ষেও দীর্ঘদিনে লভ্য, কাজেই আলোচনার বিষয় তেমন নয়। শিল্পে ও সাহিত্যে এই ধরণের ব্যাপার লক্ষ্য করেই বলা হয়েছে-শিল্পের অতি অল্প অংশই শেখানো যায় কিন্তু শিল্পীকে জানতে হয় সবটা।

সাহিত্যের সংজ্ঞা সম্পর্কে এই যে দুটি কথার অবতারণা আমরা করেছি-রস আর ব্যক্তিত্ব-অর্থাৎ রচনাকে রসময় করা আর তাতে ব্যক্তিত্বের স্পর্শ দান করা, যাতে রচনাটি হয়ে ওঠে শুধু মধুর নয়, বিশিষ্ট, এই দুটি ব্যাপারই কি সমান মর্যাদার? অথবা এ-দুয়ের মধ্যে এমন সম্পর্ক আছে যার গুণে এর বিশেষ একটির সাধনাই অন্যটি লাভেরও প্রশস্ত উপায় বলে গণ্য হতে পারে? ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা বুঝি, রসই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের প্রধান নির্ভরের ব্যাপার হয়েছে; তাতে প্রাচীন সাহিত্য সহজেই হয়েছে সুখপাঠ্য আর অনেকের আকর্ষণস্থল। কিন্তু রস যত মনোহর হোক একালে আমাদের মন বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছে সাহিত্যে ও শিল্পে ব্যক্তিত্বের দ্বারা, এমন কি, সাহিত্য ও শিল্পের সমস্ত মাধুর্যে সমস্ত কলা কৌশলে ব্যক্তিত্বের স্পর্শটুকু আবিষ্কার করতে না পারলে আমাদের শিল্প ও সাহিত্য উপভোগ আজ আর পূর্ণাঙ্গ হয় না। কিন্তু এই ব্যক্তিত্ব বাস্তবিকই অতি গভীর ব্যাপার। গজে গজে যেমন মৌক্তিক হয় না তেমনি এই ব্যক্তিত্বও সাহিত্যে দুর্লভ রয়ে যাবে হয়ত চিরকাল-তা পাণ্ডিত্য ও কলাকৌশলের পথে যতই আমরা অগ্রসর হই। এটি সজাগ সাধনারও ব্যাপার তেমন মনে হয় না, বরং কতকটা জনাগত সহজ অধিকারের ব্যাপার অথচ অশ্রান্ত বিকাশেরও ব্যাপার। তবে, একালে সাহিত্যে ও শিল্পে এই ব্যক্তিত্বের মর্যাদা সম্বন্ধে অবহিত হয়ে একালের সমালোচনা-সাহিত্য এক নূতন মর্যাদা লাভ করেছে। [অল ইন্ডিয়া রেডিওর সৌজন্যে]

জুন, ১৯৪৬

সাহিত্য-জগৎ

সাহিত্য-জগৎ বলে একটা স্বতন্ত্র স্বয়ং-পূর্ণ জগৎ আছে কি? যারা Art for art’s sake বাদী তাঁরা সোৎসাহে বলে উঠবেন: নিশ্চয়ই। তাদের দলে কৃতী সাহিত্যিকের অভাব নেই, তবু তাঁদের দলে ভিড়তে স্বতঃই সঙ্কোচ জাগে, বিশেষ করে এই Socialism-এর দিনে। কিন্তু Socialism সাম্যবাদ ও তার আনুসঙ্গিক যত মানব-কল্যাণ জীব-কল্যাণ তত্ত্ব সব শিরোধার্য করেও সাহিত্য-প্রচেষ্টার সামনে দাঁড়িয়ে না বলে যেন উপায় থাকে না যে সাহিত্য-জগৎ একটা স্বতন্ত্র জগৎ।

কথাটা মনে পড়ছে কয়েকজন তরুণ বন্ধুর সাহিত্য-প্রচেষ্টা দেখে। বোঝা যাচ্ছে, আন্তরিকতায় তাদের ত্রুটি নেই, বাস্তবিকই তারা কিছু একটা করতে চাচ্ছেন বা হতে চাচ্ছেন, আর তাদের দৃষ্টিও সাহিত্যের জগতের দিকে। তবু মনে হচ্ছে, যে-পথে তারা অগ্রসর হচ্ছেন তা ঠিক সাহিত্যের পথ নয়।

সমসাময়িক রাজনৈতিক সমস্যা, নর-নারীর সমস্যা, সব-বিষয়ে তাদের কৌতূহল যথেষ্ট তীব্র, কিন্তু মনে হচ্ছে সেই তীব্রতা এতখানি যে, সেই জন্যেই সাহিত্যের সুর তাতে ঠিক লাগছে না। সাহিত্য সমস্ত সমস্যারই আলোচনার ক্ষেত্র হতে পারে, হয়েও এসেছে চিরকাল, এমন কি যখন হয়নি তখনই সাহিত্য স্বাদহীন পানসে হয়ে উঠেছে। কিন্তু সেই আলোচনার একটা বিশিষ্ট ধরণ আছে-যেমন নাচের একটা বিশিষ্ট ধরণ আছে, তার বাইরে গেলেই তা মাত্র লাফালাফি।

সাহিত্যের সেই ধর্মের একটি নাম মাত্রা-বোধ। সাহিত্য অনুভূতির প্রকাশ-ক্ষেত্র মাত্র নয়, অনুভূতির সুপ্রকাশ-ক্ষেত্র। সেই সুপ্রকাশের সঙ্গে কৌতূহল এবং স্থৈর্য গাম্ভীর্য এবং ব্যঙ্গ আশ্চর্য ভাবে মিশ্রিত। এই সব পরস্পর-বিরোধিতার যেখানে মিলন ঘটেছে, সেখানেই সাহিত্যিক-শ্ৰী দেখা দিয়েছে। শুধু ঔৎসুক্য, শুধু গাম্ভীর্য মূল্যহীন নয় কখনো, কিন্তু যত মূল্যবানই হোক সাহিত্যিক-শ্রী থেকে বঞ্চিত।

মনে হতে পারে তাহলে তো সাহিত্যে Art for art’s sake-বাদীদের মতই সত্য। এক-হিসেবে এ-কথা মিথ্যা নয়, কিন্তুArt for art’s sake-বাদে এমন একটা স্বস্তিবোধ রয়েছে, যাকে স্বাভাবিক ভাবা কঠিন। গাছে যে ফুল হয় তা গাছের কাণ্ড, ডালপালা ও পাতা থেকে স্বতন্ত্র নিশ্চয়ই। কিন্তু স্বতন্ত্র হয়েও তা গাছের অংশ ভিন্ন আর কিছু নয়। সাহিত্যও তেমনি, হাসি-কান্না-সুখ-দুঃখ-বিকার-ব্যর্থতাময় যে জীবন তারই একটি প্রকাশ। সেই বিরাট জীবনের সঙ্গে তার অঙ্গাঙ্গী যোগ নষ্ট হলে, তা হয়ে পড়ে অদ্ভুত এবং অসার। যেমন সত্যিকার ফুলের সঙ্গে তুলনায় কাগজের ফুল অদ্ভুত ও অসার।

সাহিত্য জীবনের সঙ্গে নিবিড় ভাবে যুক্ত। আবার তার থেকে এক হিসেবে স্বতন্ত্র। এ কথাটা পরস্পর-বিরোধী মনে হতে পারে।

ব্যাপারটি বাস্তবিকই বড় জটিল। তবে কিছু বোঝা যায় যদি এই কথা মনে রাখা যায়: জীবন থেকে সাহিত্যের জন্ম হলেও তার সঙ্গে সাহিত্যের পার্থক্য এই যে, তা জীবনের মতো অস্থির, অপূর্ণাঙ্গ ও সতত-পরিবর্তনশীল নয়। বরং, এই সতত পরিবর্তনশীল জীবনের বুকে সে যেন এক অচঞ্চল স্বপ্ন, তা যত অল্পক্ষণের জন্যেই হোক।

যে পূর্ণাঙ্গতা আমাদের জীবনে নেই, তারই সাধনা করি বা স্বপ্ন দেখি সাহিত্যে। এই পূর্ণাঙ্গতার জন্যেই অবশ্য স্বপ্নের পূর্ণাঙ্গতা, সাহিত্য-জগৎ বাস্তবিকই একটু স্বতন্ত্র জগৎ।

১৩৪৮

কাব্য-পাঠ

আমার সামনে খোলা রবীন্দ্রনাথের চৈতালি। ছোট ছোট কবিতা, বইও ছোট-অনেকগুলোরই উপরে বার বার চোখ বুলোনো কঠিন নয়।

ভূমিকায় কবি জানিয়েছেন :

পতিসরের নাগর নদী নিতান্তই গ্রাম্য। স্বল্প তার পরিসর, মন্থর তার স্রোত। তার এক তীরে দরিদ্র লোকালয় গোয়ালঘর, ধানের মরাই, বিচালির স্তূপ, অন্য তীরে বিস্তীর্ণ ফসল-কাটা শস্যখেতে ধূ ধূ করছে। কোনো এক গ্রীষ্মকালে এইখানে আমি বোট বেঁধে কাটিয়েছি। দুঃসহ গরম। মন দিয়ে বই পড়ার মতো অবস্থা নয়। বোটের জানালা বন্ধ করে খড়খড়ি খুলে সেই ফাঁক দিয়ে দেখছি বাইরের দিকে চেয়ে। মনটা আছে ক্যামেরার চোখ নিয়ে, ছোট ছোট ছবির ছায়া ছাপ দিচ্ছে অন্তরে। অল্প পরিধির মধ্যে দেখছি বলেই এত স্পষ্ট করে দেখছি।

স্পষ্ট করে দেখাটা যে বিশেষভাবে সার্থক হয়েছে এই ছোট ছোট কবিতার মধ্যে তা মিথ্যা নয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় সৌভাগ্য এদের লাভ হয়েছে। শঙ্খের মধ্যে যেমন শোনা যায় তার জন্মস্থান সমুদ্রের তরঙ্গধ্বনি, তেমনি এই ছোট কবিতাগুলোর মধ্যে বিম্বিত হয়েছে অনন্তপ্রসারিত আকাশ, শান্ত লোকালয়, আর প্রসন্নসলিলা কলকণ্ঠা নদী-যে পরিবেষ্টনে এদের জন্ম হয়েছিল সেই সব।

এই উন্মুক্ত আকাশ, এই শান্ত লোকালয়, আর এই কলস্বনা নদী কবিকে একেবারে। আপনার করে নিয়েছে। এই পরিবেষ্টনে কবি যেন পুনর্জন্ম লাভ করেছেন। এতে নিশ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে, বর্ধিত হয়ে, তিনি যে ব্যক্তিত্ব লাভ করেছেন তা যেমন অনাড়ম্বর, তেমনি প্রসন্ন, তেমনি বীর্যশালী। বনকে কবি বলেছেন:

তুমি দাও ছায়াখানি, দাও ফুল ফল,
দাও বস্ত্র দাও শয্যা দাও স্বাধীনতা….

কিন্তু এই সমস্ত দানের মধ্যে বিশেষ গৌরবের যেটি হয়েছে সেটি স্বাধীনতা, অর্থাৎ স্বাধীনতা-পরবশতার অসদ্ভাব ও অন্তরাত্মার স্বাতন্ত্রে আনন্দ। যে উজ্জ্বল আকাশের নিচে আর শান্ত ধরণীর বুকে কবি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এই স্বাধীনতা সেই আকাশ ও ধরণীর সন্ততি।

এই স্ব-অধীনতা কবিকে পৃথিবীর জড়-জীব, দৃশ্য-অদৃশ্য ছোট-বড়, সকলের সঙ্গে মিলিত করেছে, সকলের পরমাত্মীয় করেছে। প্রকৃতির ভীষণতা, অকরুণের আঘাত, তাকে যে দুঃখ না দেয় তা নয়, কিন্তু এই উদার বিশ্ব-প্রকৃতির সাহচর্যে এই যে স্ব অধীনতা কবির লাভ হয়েছে, এতে তাঁর এক গোপন শক্তি লাভ হয়েছে, এসব অতিক্রম করবার এ-সবে বিহ্বল না হবার। এই শক্তি কবির কাছে নাম পেয়েছে “শান্তি-মন্ত্র। কিন্তু কী গভীর, কী বিপুল ঐশ্বর্যময় এই শান্তি!

কবির প্রশংসায় লোকে শতমুখ হয়, তাকে নিয়ে তারা গর্ব করে। কিন্তু কবির কাব্য প্রশংসার জন্য নয়, গর্বের জন্য তো নয়ই-কবির কাব্য উপভোগের জন্য। সেই উপভোগে মানুষের অন্তরাত্মা তৃপ্ত হয়, শান্ত হয়, বলিষ্ঠ হয়।

১৩৪৮

সুভাষচন্দ্র

জানতাম এক সুভাষচন্দ্র বসুকে।
-এক সঙ্গে পড়তাম কলেজে,
চোখে তার চশমা,
রং ফর্সা, পানশে শাদা,
প্রায়-রোগা গড়ন,
মুখে কঠিন সংকল্পের ছাপ–,
কিন্তু প্রিয়দর্শন।

আশ্রান্ত ছিল তার বন্ধুদের দেশের পথে আহ্বান…
একদিন কাঁধে হাত রেখে বলেছিল সে অনুচ্চকণ্ঠে
ত্যাগ করতে হবে ভোগবিলাসের পথ, হতে হবে ফকির,
ফকির হয়ে করতে হবে দেশের সেবা, দশের সেবা,
–তাতেই জীবনের সার্থকতা।
জানতাম তার কৌমার্যের কঠিন সংকল্প,
জানতাম জ্বলছে তার অন্তরে স্বদেশপ্রেমের তুষানল।
শ্রদ্ধা করতাম এই সহপাঠীকে-গভীর শ্রদ্ধা করতাম।
সে ছিল বিপ্লবীদের যুগ।
তরুণ-নির্বোধ নয়–কে ছিল বাংলা দেশে
যার মনে সেদিন ছোঁয়া লাগেনি
এই সর্বত্যাগী বরি-দলের!
কিন্তু শ্রদ্ধা করতাম স্বদেশপ্রেমিককেই–
সাড়া জাগাতো না অন্তরে তার সন্ন্যাসের আহ্বান।
জেনেছি তখন তরুণীর মাধুর্য ও শুচিতা–
বাধতো ভাবতে নারী পথের বাধা।

তারপর সেই সহপাঠী হলো দেশ-গৌরব-বিচিত্র পথে।
দেখতাম দূরে থেকে সেই তপস্বীর জয়যাত্রা;
ভীত হতাম তার গতির তীব্রতা-ভয়াবহতা-দেখে…
-বন্ধু-বিচ্ছেদ, গুরুর অসন্তোষ,
সব অতিক্রম করে চললো ভারতীয় যোগীর
অভারতীয় কর্মমার্গে বিচরণ!

শেষে একদিন ছিন্ন করলে এই তরুণ সিংহ
–অপূর্ব দক্ষতায়–
যত জালের রশি ঘিরেছিল তাকে চারদিক থেকে;
উপস্থিত হলো বিশ্বাস হিটলারের দেশে;
তার পর সমুদ্র সাঁতরে হাজির হলো পূর্ব-এশিয়ায়;
–গড়লে অপরূপ বাহিনী মন্ত্রবলে–
ঝাঁপিয়ে পড়লো জন্মভূমির শত্রুর উপরে।
সাথীদের বললে সে: দাও আমাকে তোমাদের শোণিত,
দেব আমি তোমাদের স্বাধীনতা।
এক সুরে বলে উঠলো সবাই: নাও আমাদের সব।
সেই দুঃসাহসী নিজেরও শোণিত দিলে নিঃশেষে,–
বললে বিধাতাকে দিয়েছি আমাদের বুকের রক্ত–
দাও স্বাধীনতা হে করুণাময়!
বাঞ্ছাকল্পতরু পূর্ণ করে সবার বাঞ্ছা…
দেখলে জগৎ সেই দুঃসাহসীর বাঞ্ছ হলো পূর্ণ-অচিরে!

কি কথায় স্তব-নিবেদন হবে এই দুঃসাহসীর প্রতি–
কবিগুরু করেছে যাকে পূজা-নিবেদন।
মহান-আত্মা বললে যার উদ্দেশে-কোনো ত্রুটি
স্পর্শ করে না বীরকে!
আর কৃপাণধারী বীর মাত্র সে নয়–
বীর সে চিত্তক্ষেত্রে,
বীর সে বিচার-ক্ষেত্রে।

এই বীরকে নিবেদন করছে দেশ অশ্রু আর আকুতি!
হায় দুর্ভাগ্য!!!
ওরে মূঢ়–
বীরের পূজা হয় বীরত্বে–
–ধর্মে বীরত্বে, কর্মে বীরত্বে।

১৯৪৯

ব্যক্তির স্বাধীনতা

সেদিন একজন মনস্বিনী ইয়োরোপীয় মহিলার [ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অধ্যক্ষা মিস্ এ. জি. স্টক] সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। তিনি একটি ভাল মন্তব্য করেছিলেন : ব্যক্তি আজ একান্ত অসহায়, তার বিদ্যা সাধুতা দক্ষতা সবই অর্থশূন্য যতক্ষণ না সে কোনো শক্তিশালী সঙ্ঘে যোগ দিচ্ছে।

কথাটা আজ খুবই সত্য, আর সেজন্য কিছু চমকপ্রদও। সামগ্রিকতা আজ আকাশে বাতাসে। গঠন ও ধ্বংস দুয়েরই বিপুল আয়োজন আজ মানুষের সামনে। সেইসব বিরাট আয়োজনের সামনে ব্যক্তি তার নগণ্য দেহ আর পরিমিত ক্ষমতা নিয়ে বাস্তবিকই অসহায়।

কিন্তু এ-সমস্যা কি বিশেষভাবে আজকার? অসভ্য যুগ, অর্ধসভ্য যুগ, ধর্মতান্ত্রিকযুগ, সামন্ততান্ত্রিক যুগ, কোন্ যুগে ব্যক্তি নগণ্য ছিল না? অবশ্য বহু অতিমানব এসব যুগে জন্মেছিলেন। বিস্ময়কর হয়েছিল তাঁদের প্রভাব। কিন্তু সে প্রভাবও প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তির প্রভাব নয়, বিশেষ বিশেষ ভাবের বা ভাবধারার প্রভাব-অতিমানবে তা হয়েছিল মূর্ত। অতিমানবদের সাধারণত মানুষই ভাবা হয়নি। তাদের মানুষ ভাবা হয়েছে তখন, যখন তাদের বহু ত্রুটি অনেকের বুদ্ধিতে ও বিচারে ধরা পড়েছে। তখন অতিমানবের পদ তারা হারিয়েছেন অন্তত এই সব বিচারক ও তাঁদের অনুবর্তীদের চোখে।

অতিমানবরা যে যুগে অতিমানবত্ব হারালেন সেই অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীই এক হিসেবে ব্যক্তি-স্বাধীনতার যুগ। কিন্তু সেই ব্যক্তি-স্বাধীনতাও অচিরে কলুষিত হলো কাঞ্চনকৌলীন্যে ও স্বেচ্ছাচারে। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির বা শ্রেণীর সেই কাঞ্চন-কৌলীন্য আর স্বেচ্ছাচারের প্রতিক্রিয়ায়ই তো জন্ম হয়েছে একালের নির্ধনদের সামগ্রিকতার আর জাতীয় সামগ্রিকতার।

সেকালের সামগ্রিকতা আর একালের সামগ্রিকতার মধ্যে খুব বড় পার্থক্য এই যে, সেকালে ধর্ম, কর্মফল, বিধাতা ইত্যাদি অদৃশ্য শক্তির ভয় মানুষের বেশ ছিল, একালে এসব ভয় আর মানুষের নেই। মানুষের সমাজ রাষ্ট্রনীতি সবই যে মানুষী ব্যাপার, কোনো রকমের অদৃশ্য শক্তির প্রভুত্ব এসবের উপরে আছে তা মানবার প্রয়োজন করে না, এ বোধ একালের নেতাদের অন্তরে প্রবল। এতে মানুষের লাভ মন্দ হয় নি। ব্যাপক খাদ্যেৎপাদন, জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা ইত্যাদি দুঃসাধ্য ব্যাপার একালে আর দুঃসাধ্য ভাবা হয় না; প্রকৃতির ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করবার সাহস মানুষের বেড়েই চলেছে। এক কথায়, মানুষ আজ ভাবতে সাহসী হচ্ছে যে, প্রকৃতির অধিস্বামিত্ব একদিন তার পুরোপুরি লাভ হতেও পারে। কিন্তু এই ঐশ্বর্যের মধ্যে এক বড় অভাবও মানুষের জীবনে দেখা দিয়েছে; সে আজ আনন্দ, সখ্য, প্রেম প্রভৃতি মনের সুকুমার সম্পদ থেকে অনেকখানি বঞ্চিত-এসব না হলেও মানুষের চলতে পারে এমন ভাবনাও দানা বাঁধতে চাচ্ছে তার মনে। যীশু বলেছিলেন : মানুষ শুধু খাদ্যের দ্বারা বাঁচবে না; একালের মানুষ যেন বলতে চাচ্ছে : খাদ্যই মানুষের প্রধান প্রয়োজন, সেই খাদ্যের সংস্থান করতে গিয়ে যদি আনন্দ, সখ্য ও প্রেমের মতো মনের সম্পদের মায়া মানুষকে ছাড়তেও হয় তবে তাতে সঙ্কুচিত হলে চলবে না। সঙ্রে শক্তি খাদ্য-আহরণের আর শত্রুর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার যে অভাবনীয় ক্ষমতা মানুষকে জুগিয়েছে, সেজন্য সঙ্ঘের আনুগত্য স্বীকার একালের মানুষের জন্য প্রায় অনিবার্য হয়েছে।

সেকালেও ব্যক্তির স্বাধীনতা তেমন ছিল না, একালেও যদি না থাকে তবে খুব আফসোস মানুষ আর কেমন করে’ করবে। তবে মাঝখানে সামান্য ক’দিন যে তারা গণতন্ত্র ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা ভোগ করেছিল তাতে এমন একটি স্বাদ ছিল যে, তার কথা তারা ভুলতে পারছে না। কিন্তু গণতন্ত্র ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্বহীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতাও যে অনেকখানি ছিল, তা ভুললেও চলবে না। তার উপর গণতন্ত্র ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা সামগ্রিক শাসন-পদ্ধতির সঙ্গে তুলনায় যথেষ্ট দুর্বল, তাই একালে গণতন্ত্রও সামগ্রিকশাসনধর্মী হচ্ছে নিছক আত্মরক্ষার প্রয়োজনে।

অর্থাৎ যেদিক দিয়েই যাওয়া যায় সামগ্রিকতার হাত এড়াবার উপায় এ-যুগের মানুষের নেই বলেই মনে হয়। বহুকালের অর্ধাশনক্লিষ্ট মানুষ সামগ্রিকতার কাছ থেকে খাদ্যের ও অন্যান্য প্রাচুর্যের যে আশ্বাস পেয়েছে, সেজন্যে সামগ্রিকতার দিকে পুরোপুরি ঝুঁকে কি আর সে করবে।

কিন্তু “শুধু খাদ্যের দ্বারা মানুষ বাঁচবে না”, একথাও যে মানুষের জন্য অতি বড় সত্য। এর উপলব্ধির আয়োজন যদি মানুষের সমাজে না হয়, তবে মানুষ যত সঙ্গতি সম্পন্নই হোক সে রয়ে যাবে বর্বর। বহু শক্তিশালী বর্বর ব্যক্তি ও জাতি জগতে তাদের শক্তি দেখিয়ে গেছে, কিন্তু ইতিহাসে তারা ক্ষণজীবী হয়েছে। খাদ্যের আয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যাতিরিক্তের আয়োজনের যোগ কেমন করে’ ঘটানো যায় সেটি এযুগের বড় সমস্যা।

মনে হয় মহাত্মা গান্ধী যে ভাবে এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তা খুব কাজের। ব্যক্তিকে তার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আর নিজের ভরণ-পোষণের জন্য তিনি চরকা কাটতে বলেছেন: কৃষি-কাজ, গো-পালন প্রভৃতি অজটিল সহজ-সাধ্য জীবিকা চরকার অন্তর্ভুক্ত-আর ব্যক্তির চিত্তের স্বাধীনতা বজায় রাখবার জন্য তিনি ব্যবস্থা দিয়েছেন সত্যাগ্রহের। এক সময় ছিল যখন কলকারখানার প্রয়োজন তিনি অস্বীকার করতেন, এখন কলকারখানার প্রতি তাঁর ততখানি বিরূপতা নেই মনে হয়। তাহলে তাঁর মতে ব্যক্তিস্বাধীনতা সম্পর্কে অবস্থা দাঁড়াচ্ছে এই ব্যক্তি তার নিজের ভরণ-পোষণের জন্য। অজটিল জীবিকার উপরে অনেকখানি নির্ভর করবে, আর বিশেষ ভাবে নির্ভর করবে সত্যাগ্রহের উপরে ব্যক্তি-স্বাধীনতা হারাবার সঙ্কটে। এই সত্যাগ্রহ অবশ্য হবে পূর্ণ ভাবে অহিংস, আর নিয়মানুবর্তিতাও এর জন্য প্রতি পদক্ষেপে প্রয়োজনীয়।

বলা বাহুল্য, এই সত্যাগ্রহ সহজসাধ্য নয়। কিন্তু সহজসাধ্য না হলেও এই প্রবল সামগ্রিকতার যুগে সত্যাগ্রহ ভিন্ন দ্বিতীয় আর কোনো পথও নেই, যার দ্বারা ব্যক্তি স্বাধীনতা যোগ্য ভাবে রক্ষা হতে পারে। এক ধরণের সামগ্রিকতা দিয়ে অন্য ধরণের সামগ্রিকতা জয় করতে পারা যায়, কিন্তু তাতে ব্যক্তিস্বাধীনতার সমস্যার সমাধান হয় না। সামগ্রিকতা এযুগে চাইই, নইলে লোকরক্ষণ ও লোকপালন দক্ষতার সঙ্গে হবে না–মানুষের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে সামগ্রিকতা একটি বড় আবিষ্কার-এই সামগ্রিকতার সঙ্গে সুসঙ্গত হওয়া চাই ব্যক্তি-স্বাধীনতা। এমন ব্যক্তি-স্বাধীনতা অবশ্য সবাই দাবি করতে পারবে না, যাদের শক্তি আছে, অর্থাৎ সত্য আগ্রহ আছে, তারা এটি ভোগ করবে অহিংস আত্মোৎসর্গের মতো মহৎ মূল্য-দানের সঙ্কল্পে। কেননা, তারা জানে দেহের নাশে মানুষের অনেক কিছুই নষ্ট হয় না। এ-বিশ্বাস যাদের নেই তাদের জন্য ব্যক্তি-স্বাধীনতা এযুগে সমস্যা নয়-সৌখীনতা।

সেই মনস্বিনীকে এযুগে এই সত্যাগ্রহের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলাম। তিনি জোর দিতে চাচ্ছিলেন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের উপরে। কিন্তু বিকেন্দ্রীকৃত শিল্পায়োজনও তো এ্যাটম বোম প্রভৃতির আঘাতে বিধ্বস্ত হতে পারে। তখন মানুষ দাঁড়াবে কিসের উপরে?

ধ্বংসের আয়োজন মানুষ যেমন বিরাট ভাবে এযুগে করেছে তাতে মানব-সভ্যতার বাঁচা কঠিন; বাঁচার এক বড় উপায় মনে হয় অহিংস সত্যাগ্রহই-অর্থাৎ পূর্ণ অভয়। হয়ত সত্যাগ্রহই একমাত্র উপায়, কেননা যে ভীত নয় সে মরেও বাঁচে-যেমন বেঁচে আছেন বিষপায়ী সক্রেটিস, তাঁর অনুরাগী ও বিরোধী সবার জন্য-সর্বকালের জন্য।

সক্রেটিসদের বাদ দিয়ে মানুষের সভ্যতা অনেকখানি অর্থশূন্য একথা সক্রেটিসরা তো জানেনই, আর-দশ-জনেরও মনে রাখা মানসিক স্বাস্থ্যের অনুকূল, কেননা, সার্থক সভ্যতা তাই যা বস্তুতে সমৃদ্ধ আর মানস চেতনায় বিশেষভাবে সমৃদ্ধ।

১৯৪৮

জয়তু মহাত্মা

মহাত্মাজীর তিরোধানে সমস্ত জগৎ আলোড়িত হয়েছে। এমন আত্মিক আলোড়ন সমস্ত জগতে খুব কমই অনুভূত হয়েছে। মনে হয় জগৎ যেন নিঃসন্দেহ যে, এমন একটি মানুষ সহজে তো মিলবার নয়ই, মানুষের দীর্ঘ ইতিহাসেও এমন মানুষের আবির্ভাব অতি বিরল ঘটনা, মাত্র কয়েকজনে পর্যবসিত।

কিন্তু মহাত্মাজীকে জগতের বুদ্ধ-খ্রিস্টদের শ্রেণীভুক্ত করে দেখলেই কি তার প্রতি সত্যিকার শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়? অবশ্য গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় সন্দেহ নেই, কেননা, বুদ্ধ-খ্রিস্টরা আজো জগতের প্রিয়তম। কিন্তু কোন্ অর্থে? এই অর্থে যে তারা আজো মানুষের মধুরতম স্বপ্ন।

মধুরতম স্বপ্ন-হাঁ, বুদ্ধ-খ্রিস্টরা জগতের মধুরতম স্বপ্ন। মানুষ যেন বুঝে নিয়েছে বিশেষ করে এ যুগে-যে, মানুষ তাদের মহিমময় মূর্তির পানে শুধু সতৃষ্ণ নয়নে চাইবে, কেউ কেউ কখনো মর্মভেদী দীর্ঘনিঃশ্বাসও মোচন করবে এই বলে : হায় মানুষ, তোমার বাগানে এমন ফুল ফুটলো, কিন্তু সে-ফুল চোখ ভরে দেখবার আর প্রাণ ভরে তার সৌরভ উপভোগ করবার অবসর তোমার হলো না! কিন্তু এমন বিলাপীরাও যেন নিঃসন্দেহ, যে, এইই বিশ্ববিধান। মহাত্মাজী যদি সেই মধুরতম স্বপ্নের স্মারক মাত্র হন তবে সেটিও তার জন্য কম গৌরবের নয়, কিন্তু নূতন করে সেই স্বপ্নের স্মারক-রূপে কাউকে না পেলে মানুষের এমন কি ক্ষতি হতো?

বাস্তবিক এইটিই প্রশ্ন : বিংশ শতাব্দীর মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী দূর অতীতের দেবদূর্লভ মানবিকতার অপেক্ষাকৃত নিষ্ফল স্মারক মাত্র, না, মানুষের নব সম্ভাবনার অগ্রদূত।

ভারতবর্ষের একটি গণ্যমান্য দল যে মহাত্মাজীর শিক্ষার বিরোধী তার রূঢ়তম পরিচয় তারা দিয়েছে। অবশ্য তার ফলে তারও চেয়ে বড় দলের প্রবল প্রতিবাদ উত্থিত হয়েছে। বোঝা গেল, ভারতের চিত্তে মহাত্মাজীর আসন আজো অটল। কিন্তু সে আসনে মহাত্মার কোন্ মূর্তি স্থাপিত? দেবদুর্লভ মানবিকতার অস্পষ্ট স্বপ্নমূর্তি, না, মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সার্থকতার অর্থপূর্ণ মূর্তি? জনগণের অন্তরে মহাত্মার যে মূর্তি তা যে সেই স্বপ্ন-মূর্তি তাতে সন্দেহ নেই। আর শিক্ষিতদের অন্তরে? তারা অবলম্বন করতে চাচ্ছে মহাত্মার মৈত্রী-মূর্তি-দেশের হিন্দু-মুসলমানদের সন্ধি ও মক স্থাপনের আদর্শ।

কিন্তু সত্যের বা সত্যসাধকের সমসাময়িক প্রকাশ পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ নয় কখনো। মহাত্মাজী কোন্ হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে মৈত্রী স্থাপন করতে চেয়েছিলেন যে হিন্দ বলে সে জগতে প্রাচীনতম আর সর্বোত্তম অথবা যে মুসলমান বলে, নবতম ও সত্যতম প্রত্যাদেশের সে ধারক-তাদের মধ্যে কি? কখনো নয়। তিনি হিন্দু ও মুসলমানকে শ্রদ্ধা করতে বলেছিলেন তাদের অতীত সাধনাবলীর ধারাকে, কিন্তু সর্বপ্রযত্নে অনুবর্তী হতে বলেছিলেন সত্যাগ্রহের-সেই সত্যাগ্রহের আলোকেই যাচাই করে নিতে বলেছিলেন অতীত সাধনাবলীর মূল্য ও মর্যাদা। সত্যাগ্রহী হিন্দু ও মুসলমান আর আত্মাভিমানী হিন্দু ও মুসলমান স্বতন্ত্র জগতের জীব। সত্যাগ্রহী হিন্দু ও মুসলমানের মিলন শুধু কাম্য নয়, অবশ্যাম্ভাবী-কেননা উভয়ের লক্ষ্য জীবনের সার্থকতা; কিন্তু আত্মাভিমানীদের মধ্যে মিলন ঘটাবে কে? তারা যে অনুভূতিহীন বর্বর-ধ্বংসধর্মী!

সত্যাগ্রহ! এই একটি কথা বাদ দিয়ে মহাত্মার জীবন ও শিক্ষা হৃদয়ঙ্গম করতে, চেষ্টা করা, সূর্যকে বাদ দিয়ে সৌরজগতের কথা ভাবার মতোই অদ্ভুত। তেমন অদ্ভুতত্ব দেশের গান্ধী-ভক্তদের মধ্যে কম আছে কি? আশ্চর্য নয় যে তারা আজ তার জন্য অঝোরে অশ্রু বিসর্জন করছে। কিন্তু মহাত্মাজী তো কাঁদেননি কখনো! তাঁর ছিল জীবন। নিয়ে পরীক্ষা করার কাজ, সেই পরীক্ষার কাজে অশ্রুঝরানোর অবকাশ ঠিক নেই। সেই পরীক্ষার কাজের নিত্যসঙ্গী সজাগ বুদ্ধি আর সজাগ অনুভূতি-মহাত্মার ভাষায়, সত্যাগ্রহ আর অহিংসা।

সত্যাগ্রহ আর অহিংসা-গান্ধী জীবন-বৃক্ষের এ মূল আর কাণ্ড। এক হিসেবে ভগবদভক্তি তাঁর জীবনের মূল কথা, কিন্তু সেই ভগবদ্ভক্তিও আসলে তার জন্য সত্যবোধ, অথবা সত্যবোধই ভগবদ্ভক্তি। তাই প্রকৃতই সত্যাগ্রহ আর অহিংসা গান্ধী জীবন-পিরামিডের ভিত্তি। যে কোনো মহান আত্মার মতো মরমী তিনি নিঃসন্দেহ, কিন্তু তার আচরণ নিয়ন্ত্রিত সাধারণ বুদ্ধি-বিচারের দ্বারাই। একই সঙ্গে তাঁর সাধারণ আর অসাধারণ মানসিকতা তাঁর জীবন ও দর্শনকে করেছে এ কালে এত অর্থপূর্ণ-এ কালের জগৎজোড়া বিদ্বেষ ও সংঘর্ষের মধ্যে তিনি এক নূতন শক্তিমন্ত প্রতিবাদ।

এক নূতন শক্তিমন্ত প্রতিবাদ নিঃসন্দেহ; কিন্তু সত্যই কি সার্থক? সেই উত্তরই দেবার আছে অগণিত গান্ধীভক্তের। কিন্তু অসম্বল হয়ে সে-উত্তর কেউ দিতে পারবে না। সে-উত্তর দেওয়া সম্ভব তার পক্ষে, যে শান্ত হয়ে বুঝতে চেষ্টা করবে: একালের এই যে জগৎজোড়া বিদ্বেষ আর সংঘর্ষ-এইই কি মানুষের নিয়তি, অথবা এর চেয়ে সুন্দরতর মহত্তর কিছুও আছে।

জগৎজোড়া বিদ্বেষ ও সংঘর্ষ-এর সামনে মানুষ আজ সত্যই অসহায়। মানুষ আজ হয়েছে ধ্বংসের দূত-সংঘবদ্ধতা তাদের প্রধান অথবা একমাত্র পরিচয় আর সেই সংঘবদ্ধতা ছড়িয়ে চলেছে মারীবিষ। সংঘবদ্ধতা স্বভাবত মানুষের এক শ্রেষ্ঠ পরিচয়, কিন্তু মানুষের বিকৃত বুদ্ধি সংঘবদ্ধতাকে করে তুলেছে এমন অভিশাপ।

এই বিরাট অভিশাপ থেকে মুক্তিলাভের উপায়-উৎকৃষ্ট উপায়-মহাত্মার উদ্ভাবিত। সত্যাগ্রহ আর অহিংসা। সত্যাগ্রহের মূল্য বোঝা কঠিন নয়, কিন্তু অহিংসার মূল্য বোঝা ‘ বেশ কঠিন। হিংসার বিরাটত্বের সামনে অহিংসাকে মনে হয় নিতান্ত অকর্মণ্য, অর্থহীন-হিংসার দাপটে অসহায়ভাবে পিষ্ট হওয়াই তার ভাগ্য। তা পিষ্ট অহিংসা হোক, কিন্তু পিষ্ট হয়েও অহিংসা যে অভিসম্পাত করে না-এজন্য অত্যাচারীর বর্বরতা অন্তরে অন্তরে লজ্জিত হয়। সত্যাগ্রহ ও অহিংসা সত্যই শত্রুজিৎ; তাদের দ্বারা নির্জিত হয় মানুষের চিরশত্রু-অনুভূতিহীন বর্বরতা। মহাত্মাজীর কর্মক্ষেত্র ভারতবর্ষ অহিংসার খুব উৎকৃষ্ট পরিচয় যে অনেক সময়ে দিতে পারে নি, এ কথা যথার্থ; তবু মহাত্মার প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ যেভাবে ভারত ত্যাগ করল-জগতের ইতিহাসে তাও অভিনব নয় কি?

কিন্তু সত্যাগ্রহ আর অহিংসা মানুষের জন্য যত মূল্যবান হোক, মুষ্টিমেয় হয়ত সে কথা বুঝবে, ‘বহু’ তা বুঝবে কি? ‘মুষ্টিমেয়’ যদি বোঝে তাতেই কাজ হবে, ‘বহু’ তা হলে বোঝার পথে এগোবে। ভারতে সেই ‘মুষ্টিমেয়’কেও আজ পর্যন্ত তেমন পাওয়া যায় নি। কিন্তু মহাত্মার মৃত্যুতে-এমন মহান মৃত্যু জগৎ কমই প্রত্যক্ষ করেছে-তার অবলম্বিত সত্যাগ্রহ ও অহিংসা এমন রূপ পেয়েছে যা অমোঘ হতে বাধ্য যে কোনো সত্য- ও কল্যাণ-অম্বেষীর জন্যে। সক্রিয় হোক আমাদের সেই অম্বেষণ-সত্যে ও কল্যাণে দীক্ষা গ্রহণ। “হিংসা জীবধর্ম হতে পারে কিন্তু অহিংসা বিশেষভাবে মানব ধর্ম”–বর্তমান জগতের ভাব-সঙ্কটে এই-ই শ্রেয়ের ক্ষুরধার পথ।

কিন্তু মহাত্মাজী সত্যার্থী-সত্যের তত্ত্ব ও প্রয়োগ দুই ক্ষেত্রেই। সেই প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাঁর শ্রেষ্ঠ নির্দেশ চরকা, অর্থাৎ, ব্যক্তির স্বাধীন সত্তার লালনের উপভোগী অজটিল সহজলভ্য জীবিকা। ‘বহু’-এর জন্য বাস্তবিকই এটি অমূল্য। এ যুগের বিভীষণ সংঘবদ্ধতার মারাত্মকতা প্রশমনের এক বিশিষ্ট উপায় নিহিত রয়েছে এই চরকার, অর্থাৎ কুটীর-শিল্পের, মধ্যে।

হে মহামরণ! হে মহাজীবন! জয়ী হও।

১৯৪৮

শতবর্ষ পরে রামমোহন

রামমোহনের তিরোধানের পরে ১১৬ বৎসর গত হলো। এই কালে তার জন্মভূমি বাংলায় বহু শক্তিমানের জন্ম হয়েছে; ধর্ম সাহিত্য স্বদেশসেবা প্রভৃতি ক্ষেত্রে তারা অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে গেছেন। তাঁদের কয়েকজন শুধু বাংলায় বা ভারতে নয়, জগতে বরেণ্য হয়েছেন। যে কোনো দেশ বা জাতির জন্য এমন একটা যুগ গৌরবের যুগ।

এই মহাগৌরবময় যুগের প্রবর্তয়িতা রামমোহন। সে-সম্মান তাঁকে সবাই অকুণ্ঠিতচিত্তে নিবেদন করে থাকেন। আজকার এই স্মরণ-বাসরে যদি শুধ এই ব্যাপারটাই আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি, তবে তাতেও তাঁর মহিমা-কীর্তন কম হবে না। কাল তো চিরপরিবর্তনশীল। বহুকাল পূর্বে গ্রীক দার্শনিক বলেছিলেন, আমরা একই নদীতে দুইবার স্নান করি না। জীবনের সব ক্ষেত্রেই এ স্বীকত সত্য। তাই রামমোহন যদি বাংলার ও ভারতের এই গৌরবযুগের প্রবর্তয়িতা মাত্র হন, অন্য কথায় তার দেশ যদি কর্মে ও চিন্তায় কালে কালে এতখানি ব্যাপকতা ও গভীরতা লাভ করে’ থাকে যে তার সেই শতবর্ষ পূর্বের নির্দেশ তার জন্য আর সার্থক নির্দেশ বলে গণ্য করা সম্ভবপর না হয়, তবে তাও তার জন্য শোচনীয় নয়, বরং শ্লাঘনীয়-পুত্র ও শিষ্যের কাছে পরাজিত হওয়া তো মানুষের সৌভাগ্যের কথা।

কিছুদিন থেকে আমাদের কোনো কোনো খ্যাতনামা লেখক রামমোহনের সাধনার এই ধরণের মূল্য নিরুপণে ব্যাপৃত আছেন। তাদের চেষ্টার ফলে যদি জাতির সাধনা ও সম্ভাবনার ছবি স্পষ্টতর হয়, নব নব সার্থকতার পথে তার প্রেরণা লাভ হয়, তবে তারা জাতির ধন্যবাদাহ হবেন নিঃসন্দেহ। তাদের প্রধান বক্তব্য দাঁড়িয়েছে এই: রামমোহন শক্তিমান নিঃসন্দেহ; খ্যাতিমানও যথেষ্ট; কিন্তু জাতির হৃদয়-সিংহাসনে তাঁর আসন লাভ ঘটেনি। সেই আসন বাংলাদেশে বিশেষভাবে লাভ হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের ও রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের, আর বিশাল ভারতে মহাত্মা গান্ধীর। জাতির মন-প্রাণ-আত্মার সত্যিকার নেতৃত্ব এঁদেরই লাভ হয়েছে, যদিও দেশের একালের জাগরণ সূচিত হয়েছিল রামমোহনের দ্বারা।

এঁদের বিচার উপেক্ষণীয় নয়। যে সমস্ত নেতার জনপ্রিয়তার কথা এঁরা বলেন তাঁরা যে দেশের আপামর সাধারণের সমাদর রামমোহনের চেয়ে অনেক বেশি লাভ করেছেন তা অনস্বীকার্য। তা ছাড়া এঁরা অপেক্ষাকত আধুনিক কালের, অসাধারণ শক্তিমানও বটেন। এঁদের মধ্যে তিন জন তো বিশ্ববরণ্য। কাজেই এঁদের মতো পূজনীয় ব্যক্তি যদি জাতির সত্যিকার সমাদর লাভ করে থাকেন তবে রামমোহনের বিদেহ আত্মার প্রসন্নতার কারণই তো সেটি হয়েছে, কেননা, তা হলে জাতি উন্নতির পথে নিশ্চিতরূপেই অগ্রসর হচ্ছে।

কিন্তু এইখানেই যে সমস্যা। বৃক্ষ: ফলেন পরিচয়তে-সেই ফলের পরিচয় এই নতন মল্য-নিরূপয়িতাদের অনুকূলে নয়। কিছুদিন পূর্বে দেশে মন্বন্তর দেখা দিয়েছিল; সেদিনে দেশের অনেকে-শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে-কালোবাজারী মুনাফায় দেহ মন উৎসর্গ করেছিল; এই সব মহাপুরুষের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা সেই দুর্গতি থেকে তাদের রক্ষা করতে পারে নি। তারপর এসেছে দেশের স্বাধীনতা। সে স্বাধীনতা আজো যে দেশের সর্বসাধারণের জন্য সার্থক হয়ে উঠলো না তার মূলে অবশ্য এমন কতকগুলো কারণ আছে যার উপরে দেশের লোকের হাত নেই। কিন্তু এমন অনেকগুলো কারণ ও আছে যার প্রতিকার দেশের লোকের করায়ত্ত। সেই কল্যাণ-চেষ্টা, জনগণের প্রতি দায়িত্ব, সর্বসাধারণের কথা থাকুক দেশের শিক্ষিতদের মনেও কি সক্রিয় হয়েছে!-যে শিক্ষিত-সমাজ ইংরেজের সঙ্গে লড়াই কম করেনি, আর বঙ্কিমচন্দ্র রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ ও মহাত্মা গান্ধীর প্রতি যাদের অনুরাগের অকৃত্রিমতায় সন্দেহ করবার কোনো হেতু নেই! কেন এমন হয়েছে তার কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে বুঝতে দেরি হয় না, এই সব বরেণ্যের এমন জনপ্রিয়তা লাভের মূলে তাদের ধর্মবোধ মনীষা বা মহাপ্রাণতা নয়, এর মূলে বরং তাঁদের কোনো কোনো কথায় ও আচরণের দেশের শিক্ষিত-সমাজের এবং কখনো কখনো অশিক্ষিত-সমাজের আত্ম-অভিমান যে লালিত হবার সুযোগ পেয়েছে সেই ব্যাপারটি। এ ব্যাখ্যা ভিন্ন পরীক্ষার দিনে তাদের অনুরাগীদের এমন শোচনীয় পরিচয়ের আর কোনো হেতু খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য। বায়ুমণ্ডলের কার্যক্ষমতার উপরে নির্ভর করে সূর্যোত্তাপের সাফল্য; প্রতিভার সার্থকতাও তেমনি বহুল পরিমাণে নির্ভর করে তার চারপাশের শিক্ষিত-সমাজের গুণগ্রাহিতার উপরে। আমাদের দেশের শিক্ষিত-সমাজ আমাদের একালের বরেণ্য নেতাদের তপস্যা কি ভাবে ব্যর্থ করেছে সে সম্বন্ধে কয়েকটি কথা কিঞ্চিৎ বিস্তৃত করে বললে হয়ত অসঙ্গত হবে না।

রামমোহনের কথা ধরা যাক। কি নির্দেশ তিনি রেখে গেলেন দেশের লোকদের সামনে? সৌভাগ্যক্রমে তার রচনা দুপ্রাপ্য নয়; তাই কোনো ব্যাখ্যাকার উপরে নির্ভর করে যে কেউ ইচ্ছা করলে তার মতামতের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। সংক্ষেপে বলতে গেলে তার নির্দেশ এই: (ক) পৌরাণিক দেবদেবীর আরাধনার পরিবর্তে উপনিষদের নিরাকার ব্রহোর উপাসনা ও যুক্তি-যুক্ত কল্যাণ-কর্মের অনুষ্ঠান; (খ) প্রাচীন শাস্ত্র অশ্রদ্ধেয় নয় কিন্তু তার ব্যাখ্যা করতে হবে বিচারবুদ্ধি ও লোকশ্রেয়ের আলোকে-অনিষ্টকর আচার প্রাচীন হলেও বর্জনীয়। কিন্তু তাঁর নির্দেশের প্রতিক্রিয়া দেশের শিক্ষিতদের উপরে কি হলো? তাদের মধ্যে যারা তার বিরোধী হলো-তারাই সংখ্যায় অনেক বেশি-তারা সোজা বললে: চিরাচরিত আচার বিসর্জন সম্ভবপর নয় বিসর্জন দিলে সমাজশৃঙ্খলায় ব্যাঘাত হবার সম্ভাবনা। আর যারা তাঁর অনুরাগী হলো তাদের উপরে প্রতিক্রিয়া এই হলো যে তারা প্রতীক-চর্চার প্রতি বিমুখ হলো সোৎসাহে, কিন্তু উন্মুখ হলো লোকাশ্রয়ের দিকে তত নয় যত ভগবদ্ভক্তির আতিশয্যের দিকে। রামমোহনের ঈশ্বরানুরাগের অথবা ব্রহ্মানুরাগের সঙ্গে লোকাশ্রয় নিত্যযুক্ত, সেই চিরন্তন উদার পথ তাঁর অনুরাগীর জগতে এই ভাবে বেঁকে গেল।

রামমোহনের পরে মহাসাধক রামকৃষ্ণ। রামমোহন পৌরাণিক ধর্ম পরিত্যাগ করবার নির্দেশ দিয়েছিলেন; রামকৃষ্ণ নিজের অপূর্ব সাধনায় নিঃসন্দেহ। হলেন-পৌরাণিক ধর্ম পরিত্যাগের কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই। কিন্তু রামকৃষ্ণের সাধনা কি সত্যই প্রচলিত পৌরাণিক ধর্মের সাধনা? যে দেবতার আরাধনা তিনি করলেন তাঁর কাছে কি বর তিনি চাইলেন? ভক্ত তার দেবতার কাছে সাধারণত যে সব বর চায়, সেই ধন জন মান স্বর্গ এমন কি মুক্তিও তিনি চাইলেন না, তিনি চাইলেন অচলা ভক্তি। দেশের লোক চমৎকৃত হলো তার এমন তপস্যা দেখে। কিন্তু চমৎকৃত হয়ে এই মহাতাপসের কাছ থেকে কোন্ দীক্ষা তারা গ্রহণ করল? তারই মতো অচলা ভক্তির দীক্ষা কি? না, তা নয়। তারা চলচ্চিত্ত হয়েছিল সংস্কারকদের সমালোচনায়-এঁকে। দেখে নতুন করে তারা প্রতিষ্ঠিত হলো সনাতন ধারায়, নিঃসন্দেহ হলো সংস্কারকদের চেষ্টার অপ্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে। আর বিবেকানন্দের অপূর্ব আবিষ্কার ‘দরিদ্র নারায়ণ’-তার অগণিত দেশবাসীর জন্য এটি হলো একটি সুন্দর কথা মাত্র; সে-প্রমাণ তারা নিঃশেষে দিল গত পঞ্চাশের মস্বস্তরে। তার যে সব কথা সত্যই তাদের মর্ম স্পর্শ করল তার একটি এই:- ভারতকে ইয়োরোপের আচার্য হতে হবে। এঁদের পরে বাংলার শ্রেষ্ঠ চিন্তা-নেতা বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ। বঙ্কিমচন্দ্রকে তাঁর অনুরাগীরা দেখলে হিন্দুত্বের নবসংস্থাপকরূপে-তার হিন্দুত্বের অন্তরে যে ছিল সুনিবিড় মানবিকতা

সুগভীর ধর্মবোধ, সেসব তাদের চোখে কমই পড়লো। আর রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমখিতাকে তাঁর অনুরাগীরা বুঝলে ইয়োরোপমুখিতা বলে তার বিশ্বমুখিতার অর্থ সে সত্যমখিতা। প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে নিবিড় মৈত্রী-বন্ধন, মানুষের জন্য সুগভীর কল্যাণ-কামনা সে সব অর্থপূর্ণ হলো না তাদের চিন্তায়। পরিশেষে মহাত্মা গান্ধীর জনশ্রদ্ধালাভের কথা ভাবা যাক। তাঁর সাধনার প্রধানত দুটি স্তর। প্রথম স্তরে তিনি সব ধর্মকে জানতেন স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে’। দ্বিতীয় স্তরে তিনি ভগবান বলতে বুঝলেন সহ্য: প্রত্যেক কর্মকেই জানলেন কিছু কিছু ত্রুটিপূর্ণ আর সেজন্য প্রত্যেক ধর্মের মহত্তর বিকাশ প্রয়োজনীয় জ্ঞান করলেন; ধর্ম বলতে তিনি বুঝলেন নিরবচ্ছিন্ন ও নিষ্কলুষ সত্য-প্রীতি ও জগৎ হিত-সাধনা, কোনো সাম্প্রদায়িক বা আচারপরায়ণ জীবন নয়। কিন্তু অগণিত জনচিত্তে তিনি লাভ করলেন কী রূপ? তার অপূর্ব সত্যপ্রীতি, মানবপ্রীতি, জীবপ্রীতি তাঁর অনুরাগীদের অনুধাবনের বিষয় হলো না। তাদের জন্য সত্য হলো তার মূর্তির ও স্মৃতির সাড়ম্বর পূজা-প্রদক্ষিণ,-তার জগৎজোড়া খ্যাতির অংশীদার এই ভাবেই তারা হলো।

কিন্তু কেন এমন হলো? বলা কঠিন। দেখা যাচ্ছে কয়েক শত বৎসর পূর্বে কবীর দুঃখ করে বলছেনঃ দেশের হিন্দু ও মুসলমানের সম্মতি হোক এজন্য বহু চেষ্টাই তিনি করলেন, কিন্তু

হিন্দু পূজে দেবতা
তুর্ক কাহু না হোঙ্গ

হিন্দু কেবল দেবতারই পূজো করে, আর মুসলমানের কারো জন্য মায়া মমতা নেই। অথবা সমস্যাটা এর চেয়ে গুরুতর। বর্তমানকালে বৃহত্তর জগতে দেখা যাচ্ছে মানুষের এত কালের জ্ঞান বিজ্ঞান ও মনুষ্যত্বের সাধনার পরে মানুষের ভিতরকার আদিম বর্বরই প্রবল হয়ে উঠেছে-ভোগ ও প্রাধান্য-স্পৃহা, চক্রান্ত, জিঘাংসা আজ অত্যন্ত ব্যাপকভাবে মানুষের কাম্য হয়ে উঠেছে।

তা বৃহত্তর জগতের কথা থাকুক। যারা কাজ করতে চায় তাদের সংহত হতে হয় বিভিন্ন কেন্দ্রে। যারা বিশ্বাস করে দেহই মানুষের বড় ব্যাপার, তার প্রয়োজন মিটিয়ে যদি সময় পাওয়া যায় তবে ‘আত্মা ‘সত্য এ সব কথা ভেবে দেখা যেতে পারে, তাদের পথ তারা অনুসরণ করে চলেছে। কিন্তু আমরা যারা বিশ্বাস করি আত্মা, অর্থাৎ মনোজীবন, যদি সক্রিয় না হয়, সত্য যদি সম্পূজিত না হয়, তবে কোনো প্রাচুর্যেই মানুষের কল্যাণ নেই, তাদের কি কর্তব্য? তারা কোন্ কেন্দ্রে সংহত হবে?  

অতন্দ্ৰিত জ্ঞান ও লোকশ্রেয়ের পথের মহাপথিক রামমোহনের স্মরণ-দিনে আমরা, তাঁর অনুরাগীরা, যদি এই প্রশ্নটি যথাযথভাবে নিজেদের অন্তরাত্মার সামনে উপস্থাপিত করতে পারি তবে তাতে করেই সেই অমরবীর্য সাধকের প্রতি আমাদের সত্যিকার শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে; আমরা নিজেরাও সার্থকতার পথে সুনিশ্চিত পা বাড়াবো। কেননা, বড় কথা দলে ভারী হওয়া নয়, বড় কথা অন্তরাত্মাকে সক্রিয় করে তোলা সত্যদৃষ্টি ও দৃঢ় সংকল্পের দ্বারা। রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ ও মহাত্মা গান্ধীর মতো মহাজন দেশে বিপুলভাবে আদৃত হয়েও ব্যর্থ হচ্ছেন এই বড় কারণে যে তাঁদের তপস্যা সক্রিয় হতে পারে নি তাদের অনুরাগীদের অন্তরাত্মায়, তারা বরং ব্যবহৃত হয়েছেন তাদের অভিমান, মুখ্যত স্বধর্মের অভিমান, চরিতার্থতার কাজে। কিন্তু অভিমান তাদের জীবনে অনর্থ না ঘটিয়ে কি আর করবে? অভিমান কেন, স্বদেশ-প্রীতির মতো মূল্যবান ভাবও মানুষকে সত্যিকার কল্যাণ-পথে ও বেশি দূর এগিয়ে নিতে পারে না, যদি সেই স্বদেশ প্রীতি গূঢ়ভাবে যুক্ত না থাকে সত্য-প্রীতি ও সর্বমানব-প্রীতির সঙ্গে। রামমোহনের নিরাকার পরমব্রহ্ম ও লোকশ্রেয়ের সাধনা স্বরূপত অতন্দ্রিত সত্য ও কল্যাণ-সাধনা, কোনো মোহকেই তা প্রশ্রয় দেয় নানা সাম্প্রদায়িক মোহকে, না অতীতের মোহকে, না অতিপ্রাকৃত মোহকে, জড়বাদ ও ভোগবাদের অন্ধতাকে ত নয়ই-তাই বহুপুরাতন ও বহুজটিল ভারতীয় জীবনের সার্থক নেতৃত্বের অধিকার তাঁরই, তা যত বিলম্বে ও যত বিড়ম্বনার ভিতর দিয়েই দেশ সেকথা বুঝুক। কিন্তু আমাদের বিড়ম্বনা ভোগ যথেষ্ট হয়েছে ভাবা যেতে পারে; আশা করা যায় এবার দেশ তার পরমনির্ভরযোগ্য জ্ঞান সাধক ও কল্যাণ-সাধকের মর্যাদা যথাযোগ্যভাবে বুঝবে; তার ফলে একালের অন্যান্য সব সাধকই যোগ্য সার্থকতা লাভ করবেন, যোগ্য মর্যাদায় ভূষিত হবেন।

সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে কথিত, ১৯৪৯

গ্যেটের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী

সুদীর্ঘ আয়ু গ্যেটের লাভ হয়েছিল। তাঁর সাহিত্যিক জীবনও হয়েছিল যেমন দীর্ঘ তেমনি সমৃদ্ধ। কিন্তু এই দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ সাহিত্যিক জীবনে জাতির নিরবচ্ছিন্ন সমাদর তার লাভ হয় নি। তাঁর তিরোধানের পরে বহু বৎসর পর্যন্ত জাতির অন্তরের পূজা লাভ হয় তার নয়, তার বন্ধু শিলারের। তাঁর একালের ইংরেজ চরিতকার রবার্টসন বলেন: ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ফ্রাঙ্কো-প্রুসীয় যুদ্ধের পরে তাঁর জাতি তার প্রতিভার মূল্য সম্বন্ধে সচেতন হয়, তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য তাঁর স্বদেশে বিপুলভাবে আলোচিত হতে থাকে। কিন্তু তা হলেও এ ব্যাপারটি দিনের আলোর মত পরিষ্কার যে, তার চিন্তা ও সাধনা আর তার জাতির চিন্তা ও সাধনা প্রায় পরস্পর-বিরোধী হয়েছে। উগ্র জাতীয়তা সম্বন্ধে সুবিখ্যাত তাঁর এই উক্তি:

মোটের উপর বিজাতি-বিদ্বেষ এক অদ্ভুত ব্যাপার। যেখানে চিত্তোকর্ষের যত অল্পতা সেখানে এর তীব্রতা তত বেশি। কিন্তু চিত্তাকর্ষের এমন স্তর আছে যেখানে এর সম্পর্ক বিলোপ ঘটে, ফলে অনুভাবকের স্থান লাভ হয় অনেকটা জাতীয়তার উর্বে, প্রতিবেশী জাতির দুঃখবিপত্তি তখন তার মনে হয় স্বজাতির দুঃখবিপত্তির মতো।

কিন্তু উগ্র জাতীয়তা বহুগুণসম্পন্ন জার্মান জাতির অবলম্বন হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতেই, আর বিংশ শতাব্দীতে তার পরিণতি যা হয়েছে তা সর্বজনবিদিত। কিন্তু শুধ জার্মানী কেন, উগ্র জাতীয়তা, অন্য কথায় রক্তপিপাসু সংগ্রামমুখিতা, একালে মানুষের সমাজে ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়েছে-রাষ্ট্র, বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক দল। সবারই সাধারণ পরিচয়-চিহ্ন হয়েছে এমন ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাব-একথা বলা যেতে পারে। অবশ্য এ পথের ভয়াবহতা স্মরণ করিয়ে দেবার মতো মনীষী একালের খুব কম জন্মগ্রহণ করেন নি। ইয়োরোপের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ চিন্তাশীল জাতির এবং মানুষের প্রতি এই কর্তব্য সম্পাদন করতে গিয়ে লাঞ্ছিতও হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ আধুনিক জগতের প্রায় প্রতি জ্ঞান-কেন্দ্রে বর্তমান সভ্যতার এই সঙ্কট সম্বন্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে গেছেন। আর মহাত্মা গান্ধী অহিংসা ও মৈত্রীর যে সম্ভাবনার ছবি জীবনব্যাপী সাধনার দ্বারা মূর্ত করে গেছেন, মানুষের ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরেই লেখা থাকবে। কিন্তু তবু একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, আজ মানুষের সাধারণ গতি অপ্রেম আর সংঘর্ষের দিকেই।

এই পরিবেশে উন্মাদনায় নিরানন্দ, ক্ষুদ্র-মহৎ পাপী-পুণ্যাত্মা নির্বিশেষে মানুষের প্রতি সশ্রদ্ধদৃষ্টি বিপ্লবে নয় অতন্দ্রিত প্রয়াসে ও বিকাশে আস্থাবান্ গ্যেটের প্রতি এ যুগের মানুষ, অর্থাৎ এ যুগের শিক্ষিত মানুষ, কোন্ দৃষ্টিতে তাকাবে? বহুবার বহু শক্তিধর তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছেন এই বলে যে, তিনি প্রতিভাবান হলেও বুর্জোয়া-সুখী দলের। আজকার প্রধানদেরও কি তার সম্বন্ধে তাই-ই বক্তব্য হবে? মনে হয়, তেমন নিঃশঙ্ক সিদ্ধান্তের পথে একালে এই বাধা উপস্থিত হয়েছে যে, ‘উন্মাদনা’, ‘বিপ্লব’ এ-সবের দ্বারা ভাল যা সম্ভবপর তার সীমা আজ যেন মানুষ দেখতে পেয়েছে দেখতে পেয়েছে উন্মদনা আর বিপ্লব থেকে সংঘবদ্ধ হবার ক্ষমতা মানুষের মন্দ লাভ হয় না, বহুর গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা যা সম্ভবপর হয় তাও প্রশংসনীয়, কিন্তু এই সব ভালর সঙ্গে মন্দ এই ঘটে যে ব্যক্তির স্বাধীনতা পায় লোপ, সাহিত্য ইতিহাস হয়ে ওঠে শেখানো বুলি-বলা বাহুল্য এমন মন্দ ভয়াবহ মন্দ।

একালের ব্যাপক হানাহানি ও বিশৃঙ্খলার ভিতর দিয়ে এই একটি বড় সত্য অবশ্য মূর্ত হয়ে উঠেছে যে, জীবনের সুখস্বাচ্ছন্দ্যে ও মহৎ সম্ভাবনায় সব মানুষের অধিকার, জগতে নিরন্ন ও কর্মহীন কেউ থাকতে পারে না। মূলত এ অতি প্রাচীন সত্য, প্রাচীন কালের শ্রেষ্ঠ ধর্মনেতারা ও মনীষীরা এ সত্যের দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ত্রুটি করেন নি, নিজেদের জীবনে এর যোগ্য দৃষ্টান্ত তারা রেখে গেছেন। কিন্তু প্রাচীন সত্য হলেও এর যথাযোগ্য স্বীকৃতির দিকে মানুষের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকর্ষণ করবার গৌরব একালেরই। অষ্টাদশ শতাব্দীর নব-মানবিকতা প্রচারের সময় থেকে এই একালের আরম্ভ বলা যেতে পারে।

গ্যেটের ঐতিহাসিক মর্যাদা সাধারণত এই অষ্টাদশ শতাব্দীর মানবিকতার এক ব্যাপক দৃষ্টান্ত হিসেবে। কিন্তু তার সেই মানবিকতায় এমন সম্পদ আছে যার দিকে মানুষের দৃষ্টি তেমন আকৃষ্ট হয়েছে মনে হয় না, হলে তারা হয়ত এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হ’ত যে, একালে মানবিকতার যে পর্যাপ্ত স্বীকৃতি লাভ হয়েছে গ্যেটেতে আর প্রাথমিক পরিচয় মাত্র নয় এবং এক পরম সার্থক বিকাশ-আজো যা অশেষ অর্থপূর্ণ। ভুলভ্রান্তি ও অক্ষমতা-পূর্ণ মানুষের দিকে গ্যেটের দৃষ্টি শুধু ক্ষমাশীল ও সহানুভূতিশীল নয়, গভীর ভাবে শ্রদ্ধাশীল-মানুষ দেবতার অংশ এমন কোনো ধারণার বশবর্তী হয়ে নয়, কোনো মানুষই সম্ভাবনাহীন নয়-এই চেতনা থেকে। এরই গুণে তরুণ বয়সে মানব-চরিত্রের কদর্যতার সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত হলেও মানব-দ্বেষ অথবা সংস্কারকের অসহিষ্ণুতা তাতে দেখা দেয় নি; এরই গুণে বহুল-পরিমাণে জাতির অনাদর পেয়েও অতি সাধারণ মানুষ সম্বন্ধে এমন ধারণা পোষণ করতে তাঁর বাধে নি যে, এই উপেক্ষিত সাধারণ “সংযম, সন্তোষ, ঋজুতা, বিশ্বাস, সামান্য সাফল্যলাভে উক্তৃতা, সরলতা, অনন্ত কষ্টসহিষ্ণুতা” প্রভৃতি গুণের জন্য “ভগবানের সৃষ্টিতে যেন সর্বশ্রেষ্ঠ”।

সাধারণের প্রতি কারুণ্য নয় শ্রদ্ধা, আর উন্মাদনায় ও হিংস্রতায় অনাস্থা-গ্যেটের মানবিকতার এই দুই শ্রেষ্ঠ নির্দেশ একালের সভ্যতার সঙ্কটে মানুষের পরম আশ্রয় হবারই যোগ্য।

২৮শে আগস্ট, ১৯৪৯।

মহৎ সংবাদ

আজ বেতার ঘোষণা করছিল: পূর্ববঙ্গের অনেক স্থানে তরুণ মুসলিম দেশরক্ষী-দল। তাঁদের অঞ্চলের হিন্দুদের দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনে রক্ষী রূপে কাজ করেছেন। তাঁদের সুব্যবস্থায় প্রতিমা-বিসর্জন সুশৃঙ্খলভাবে নিস্পন্ন হয়েছে।

এমন মহৎ সংবাদ জীবনে খুব কমই শুনেছি; আমার সম্প্রদায় সম্পর্কে এই-ই প্রথম শুনলাম। সমস্ত অন্তর থেকে তাই এই তরুণদের উদ্দেশ্যে শুভ কামনা উৎসারিত হচ্ছে: জয় হোক তোমাদের হে বিবেচক তরুণ দল!

আমি সাহিত্যিক। জনতায় বাস বাধা আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়। থাকি জনতা থেকে দূরে। কিন্তু তাই বলে সম্পর্কশূন্য নই জনতার সঙ্গে। তাকিয়ে আছি জনতার দিকে কেননা মানুষকে ভালবাসা আমার ধর্ম। কিন্তু তাকিয়েই আছি। জনতা উচ্ছল। তারা ছুটোছুটি করছে, কিন্তু কি যে চায়, কোন্ বিশেষ দিকে তাদের গতি, তা তারা জানেনা। দেখছি, আজ সেই জনতা পথের কিছুটা দিশা পেয়েছে-বুঝেছে তারা: তাদের চারপাশে যারা আছে তাদের সবার প্রতিদিনের জীবন সুশৃঙ্খল হওয়া চাই, নির্বিঘ্ন হওয়া চাই, দেশের এই এক সঙ্কটকালে এই শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার বিশেষ দায়িত্ব তরুণদের-যারা অকুতোভয় অদীন অপাপবিদ্ধ। হাঁ, চমৎকার সূচনা হয়েছে। এইবার জনতা পথ পাবে। কোন্ দূরে তাদের লক্ষ্য, কি পাথেয় তাদের চাই সেখানে পৌঁছোবার জন্যে, সবই তারা বুঝবে। শীগগিরই বুঝবে আশা করি, কেননা জীবন-শিখরে উঠবার প্রথম ধাপ দায়িত্ব-বোধ, সেই দায়িত্ববোধের উপরে তাদের চোখ পড়েছে।

হে আমার তরুণ বন্ধু-দল, ভুলোনা কখনো যে বিদ্যা বুদ্ধি ধন-সম্পদ সবের চেয়ে বেশি মল্য চরিত্রের, আর চরিত্রের ভিত্তি ন্যায়-বিচার-ইনসাফ। সেই ইনসাফ তোমাদের আকর্ষণ করেছে-এ তোমাদের সৌভাগ্য, সমস্ত দেশের সৌভাগ্য। এই আকর্ষণ প্রবলতর হোক তোমাদের জীবনে। ইনসাফের বশবর্তী হয়ে দেশের সবার সুব্যবস্থিত জীবনের দায়িত্ব তোমরা গ্রহণ কর-ঔদ্ধত্যে নয়, পরম বিনয়ে। আমি জানি তোমরা সুন্দর মুসলমান হতে চাও। ইনসাফের বশবর্তী হয়ে সেই পথেই তোমরা পা বাড়িয়েছ-এ কথা বিশ্বাস কর। ইনসাফই ইসলাম। উদ্ধত হয়ো না কখনো, অলস হয়ো না কখনো-তাহলে ইনসাফের প্রভাবে তোমরা সুন্দর মুসলমান হবে, যে-মুসলমান মানুষের নির্ভরযোগ্য বন্ধু। কিন্তু মুসলমান হওয়ার পথে বিপদও আছে। সস্তা মুসলমানীর প্রলোভন চারদিকে। সাবধান। মুসলমানীর অর্থ সুবিকশিত মনুষ্যত্ব। যে কর্মঠ, বিবেচক, জ্ঞানপিপাসু, দশের সঙ্গে যুক্ত, সে-ই মুসলমান-আর কেউ নয়। অথবা সে মুসলমান হিন্দু খ্রিস্টান বৌদ্ধ সবই। সস্তা ধর্ম-মত ও পথকে সন্দেহ করবে-সে সন্দেহ যেন কখনো শিথিল না হয়।

আজকার এই শুভদিনে গ্রহণ কর কোরআন হাদিস ও উপনিষদের কিঞ্চিৎ উপহার:

পাল্লা পাথর ঠিক রাখ, ওজন ঠিক দাও…যখন কথা বল, হক কথা বল-আত্মীয়ের বিরুদ্ধে হলেও।

সে মুসলমান নয়, সে মুসলমান নয়, সে মুসলমান নয় যার আঘাত থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়।

বিশ্ব-জগৎ আল্লাহর পরিবার; সে-ই আলাহর কাছে ভাল যে তার পরিবারের প্রতি ভাল!

কারো ধনে লোভ করো না।

কি করবো আমি তা দিয়ে যা আমাকে অমৃতত্ব না দেবে।

হে স্বাধীন দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃবৃন্দ, ক্ষুদ্রতা ও তুচ্ছতা তোমাদের কখনো স্পর্শ না করুক। তোমরা স্বাধীনতার ধারক ও বাহক, এই বৃহৎ দায়িত্ব সম্বন্ধে সর্বদা থাক সচেতন-তৎপর। সুখ চেয়ো না কখনো, দারিদ্র্যও নয়-চাও আত্মবিকাশ।

কবিশেখর হাফিজ একদিন বাংলার সুলতানের সমাদরে খুশি হয়ে বাংলাকে আশীর্বাদ করেছিলেন এই বলে:

ইরানের মিছরির টুকরো যাচ্ছে বাংলায়, এ থেকে মধুগর্ভ হবে ভারতের সব শুক– সারী।

তাঁর সে-আশীর্বাদ সফল হয়েছে বিশেষ করে তাঁর অনুরাগী মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সন্তান রবীন্দ্রনাথে। ইদানীং আর এক মহাপুরুষ নিজের অমূল্য জীবন পণে কলকাতায় শান্তি মৈত্রী ও মানবতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন হিন্দু মুসলমান উভয় শ্রেণীর বাঙালি নরনারীর সাগ্রহ সহায়তায়। এ সৌভাগ্য শুধু কলকাতার নয়-সমস্ত বাংলার, সমস্ত বাঙালির। বাংলার খ্যাতি আছে সে আগে চলে; বাংলার এই আগে চলার নব-সৌভাগ্য পতাকা তোমরা সগৌরবে বহন করে চল। নূতন নূতন মহৎ জয় তোমাদের লাভ হোক।

২৯শে অক্টোবর, ১৯৪৭

ইসলামে রাষ্ট্রের ভিত্তি

দেশ বিভক্ত হলো। এর ফলে ভারতবর্ষের পূর্বে ও পশ্চিমে মুসলমানদের স্বতন্ত্র স্বাধীন ভূখন্ড লাভ হলো। এই স্বাধীন ভূখন্ড মুসলমানরা কি ভাবে শাসন করবে, কি ভাবে তার শ্রীবৃদ্ধি সাধন করবে, আজ সে-কথা বিশেষভাবে ভাবা তাদের পক্ষে স্বাভাবিক।

সংবাদপত্রে দেখা যাচ্ছে, পূর্ব পশ্চিম দুই অঞ্চলেই কথা উঠেছে মুসলমানদের এই নূতন রাষ্ট্র শরীয়ত’ অর্থাৎ কোরাআন-হাদিসের বিধিবিধান অনুসারে শাসিত হওয়া চাই। এই মত প্রবল হয়ে উঠবে মনে হয় কেননা, মুসলমানরা নূতন রাষ্ট্র লাভ করেছে স্বতন্ত্র জাতীয়তার দাবিতে।

কিন্তু এযুগে প্রাচীন শরীয়তের পুনঃপ্রবর্তনার পথে বাধাও কম নেই। সেই-সব বাধা দুই প্রধান ভাগে ভাগ করে দেখা যেতে পারে: প্রথমত, শরীয়তের ও একালের বিধিবিধানের মধ্যে পার্থক্য; দ্বিতীয়ত, নৃতন মুসলিম-রাষ্ট্রে অ-মুসলমানেরা সংখ্যাশক্তিতে নগণ্য নয়, তারা শরীয়তের বিধান অনুসারে শাসিত হতে রাজী হবে কি না।

প্রথম শ্রেণীর কথাই আগে ভাবা যাক। কোনো কোনো অপরাধের জন্য অপরাধীর হাত পা কেটে ফেলা কিম্বা তাকে পাথর মেরে মেরে ফেলার বিধান শরীয়তে আছে। মুসলমানদের নূতন রাষ্ট্রে সে-সবের পুনঃ প্রবর্তন হবে? অপরাধের প্রতি একালের মানুষের মনোভাবে বড়-রকমের পরিবর্তন ঘটেছে-অপরাধকে একালে দেখা হয় প্রধানত সামাজিক ব্যাধি হিসেবে; তাই অপরাধী ব্যক্তিকে কঠোর শাস্তি দেবার কথা তেমন না ভেবে একালে ভাবা হয় শিক্ষা-দীক্ষার সাহায্যে তাকে একজন স্বাভাবিক সাধারণ মানুষ করে গড়ে তোলার কথা। শরীয়তপন্থীরা কি এই নূতন সম্ভাবনাপূর্ণ সমাজদর্শন অস্বীকার করবেন? একে ইসলামের প্রতিকূল জ্ঞান করবেন? (পাথর মারার মতো শাস্তি হজরত মোহাম্মদ যথেষ্ট অনিচ্ছুক হয়ে বিধান করেছেন হাদিস গ্রন্থে এমন প্রমাণ বিরল নয়)।

দ্বিতীয় শ্রেণীর বাধাও কম প্রবল নয়, বরং এক-হিসেবে প্রথম শ্রেণীর চেয়েও গুরুতর; কেননা, সংখ্যালঘিষ্ঠদের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠদের আচরণের উপরেই নির্ভর করবে ভারতবর্ষের মুসলমান ও হিন্দু উভয় রাষ্ট্রেরই শান্তি-শৃঙ্খলা-হয়ত বা তাদের অস্তিত্ব। তবে অন্য দিক থেকে এ সমস্যাটা একটু হাল্কা করে ভাবা যায়। মুসলমানরা যদি এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হয় যে, শরীয়তের পুনঃপ্রবর্তনই তাদের রাষ্ট্রের জন্য প্রধান কাম্য, আর মুসলিম রাষ্ট্রের অ-মুসলমানরা যদি শরীয়তের শাসন স্বীকার করতে অসম্মত হয়, তবে অতি দুরূহ লোক-বিনিময়ের দ্বারা মুসলমানেরা এ সংকট থেকে উদ্ধার পেতেও পারে।

প্রথম শ্রেণীর বাধা কিন্তু তেমন কঠিন মনে না হলেও আসলে খুব কঠিন; কেননা, এক্ষেত্রে বিরোধ বাইরের কারো সঙ্গে নয়, বিরোধ নিজেদের মনের সঙ্গে। ধর্মের বিধান কেন মানুষ মানবে? এই জন্য যে ধর্মের বিধান মানলে মানুষের যে শুধু পরকালে কল্যাণ হবে তাই নয়, ইহকালেও কল্যাণ হবে। সেই জন্য মুসলমান তার প্রার্থনায় বলে: প্রভু দুনিয়ার ভালো দাও, পরকালের ভালো দাও। কিন্তু তার বিচার-বুদ্ধি যদি তাকে বলে: অপরাধ মানুষ করে শুধু তার কুপ্রবৃত্তির তাড়নায়ই নয়, বরং অভাবের তাড়নায়; আর সব মানুষের অভাব-অভিযোগ দূর করা এযুগের সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রধান কাজ-তবে হাত পা কাটা ও পাথর মেরে মেরে ফেলার মতো কঠোর শাস্তি মেনে নেওয়া তার পক্ষে সহজ হবে না–কেবলই তার মনে হবে: সত্যই কি মানুষের উপকার হচ্ছে এমনসব বিধানের দ্বারা? তাই শরীয়তের পুনঃপ্রবর্তন যারা চান তাঁদের একথা বললেই চলবে না যে শরীয়ত কোরআন-হাদিসের বিধান, অতএব মান্য; তাঁদের বরং প্রমাণ করতে হবে যে, শরীয়ত বলতে যে সব বিধিবিধান মুসলমানরা পুনরায় প্রবর্তিত করতে চায় সে-সব একালেও মানুষের সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রকৃত উন্নতির জন্য বাস্তবিকই কাম্য। কোরআনও কিন্তু এই কথাই বলে: কোরআন আল্লাহর বাণী, অতএব মানুষকে মানতে হবে, এইই কোরআনের প্রধান বক্তব্য নয়, বরং কোরআনের প্রধান বক্তব্য এই যে কোরআন আল্লাহর বাণী, মানুষ তার বুদ্ধিকে সক্রিয় করে প্রকৃতির দিকে আর ইতিহাসের ঘটনাবলীর দিকে তাকিয়ে কোরআনের নির্দেশের সত্যতা উপলব্ধি করুক; আর সেই নির্দেশ অনুসারে জীবন যাপন করে ইহকালে ও পরকালে লাভবান হোক। কোরআন ও হাদিসের মধ্যে একটি লক্ষণীয় পার্থক্য এই যে, ‘রূপে’র চেয়ে ভাবে’র উপরে জোর কোরআনে কিছু বেশি।

বাস্তবিক মুসলমানের ধর্মগত সমস্যা সাধারণত যত সহজ ভাবা হয় আসলে তত সহজ নয়। মুসলমানের প্রধান ধর্মগ্রন্থ কোরআন। কোরাআনের নিচে বিশ্বস্ত হাদিসের (হজরত মোহাম্মদের বাণী ও চরিত্র-চিত্রের) স্থান। কোরআন আকারে বড় নয়। বিশ্বস্ত হাদিসও সংখ্যায় খুব বেশি নয়। কাজেই কোরআন-হাদিসের প্রকৃত বিধিবিধান কি সে সম্বন্ধে কাজ চালাবার যোগ্য একটা ধারণা করা কঠিন নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায়: ইসলামের নির্ভর অলিখিত অনির্দিষ্ট শাস্ত্রের উপরে নয়, বরং সুলিখিত সুনির্দিষ্ট শাস্ত্রের উপরে। মুসলমানের দৈনন্দিন জীবনও এই সব সুস্পষ্ট নির্দেশের দ্বারাই চালিত। যে কোনো শাস্ত্রজ্ঞ আলেম’কে যদি জিজ্ঞাসা করা যায়: একজন ধার্মিক মুসলমানের কি কর্তব্য? তিনি অকুণ্ঠিতচিত্তে উত্তর দেবেন: তাকে আল্লাহ-তে ও রসুলে বিশ্বাস করতে হবে, নামাজ রোজা হজ জাকাত নিয়মিত ভাবে নিস্পন্ন করতে হবে। কিন্তু সেই ‘আলেম’কে যদি জিজ্ঞাসা করা যায়: এসব শাস্ত্রীয় বিধিবিধান-পালনকারীর সংখ্যা মুসলমান-সমাজে নগণ্য নয়, কিন্তু কোরআনে যে বলা হয়েছে, “নামাজ পড়-নামাজ কদর্যতা ও অকল্যাণ থেকে রক্ষা করে”, এমন কল্যাণপথের প্রকৃত পথিক মসলমান-সমাজের বিধিবিধান-পালনকারীদের মধ্যে তেমন লক্ষণীয় নয় কেন, তবে। তার উত্তর দেওয়া তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সমাজের এই দিকটা তাঁর চিন্তা-ভাবনার বিষয় হয়নি বললেই চলে, কেননা, তাঁর মনোযোগ আকৃষ্ট রয়েছে লিখিত বিধিবিধানের রকমারিত্বের দিকে, সমাজ-মনের উপরে সে-সবের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া কি হয়েছে সেই অপেক্ষাকৃত অস্পষ্ট ব্যাপারের দিকে নয়। ভিটামিন (খাদ্যপ্রাণ) আবিষ্কারের পর খাদ্য-বিজ্ঞানীরা বুঝেছেন, খাদ্যে সূক্ষ্ম ভিটামিনের অভাব যদি হয় তবে স্কুল অন্যান্য যত উপকরণই তাতে থাকুক সেসবের দ্বারা মানবদেহের প্রকৃত পুষ্টিসাধন হয় না; তেমনি ধর্মের বিচিত্র বিধিবিধানের মূল যে সূক্ষ্ম মনুষ্যত্ব-সাধন, অর্থাৎ জ্ঞান ও চরিত্র-লাভ ও অশ্রান্ত শুভ-সাধনা, সেই অতিপ্রয়োজনীয় ব্যাপারটা ভুলে গেলে ধর্মের বিধিবিধান পালনের দ্বারাও কোনো সত্যিকার লাভ সম্ভবপর নয়-তা সে-সব বিধিবিধান যত বিচিত্র, যত কষ্টসাধ্য হোক। কোরআন বলেন:

তিনি জ্ঞান দেন যাকে ইচ্ছা করেন, আর যে জ্ঞান পায় সে মহাসম্পদ পায়, জ্ঞানী ভিন্ন আর কেউ বিচার করে দেখে না (২ : ২৬৯)।
আল্লাহ্ একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন: একজন ক্রীতদাসের কথা ভাব, কোনো কিছুর উপরে তার কর্তৃত্ব নেই, আর ভাব অন্য একজনের কথা যাকে আমার তরফ থেকে দেওয়া হয়েছে উৎকৃষ্ট জীবিকা, তা থেকে সে খরচ করে চলে প্রকাশ্যে এবং গোপনে-এই দুই জন কি তুল্য মর্যাদার?…(১৬৭৫)।

ধর্মের এই যে মূল কথা মনুষ্যত্ব-সাধন, ব্যাপক ও গভীর মনুষ্যত্ব-সাধন; এই ব্যাপারটি না বুঝে ধর্মের ব্যাখ্যা বা প্রয়োগ করতে গেলে যে নিতান্ত কাঁচা বনিয়াদের উপরে ইমারত তোলার চেষ্টা করা হয়, মুসলমান-সমাজের একালের শরীয়তপন্থীদের সে-বিষয়ে হুশিয়ার হবার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। এ যুগ আত্মনিয়ন্ত্রণের বা জাতীয় বৈশিষ্ট্যসাধনের যুগ বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে নিবিড় বিশ্বসংযোগের যুগও বটে। আত্মনিয়ন্ত্রণ-তত্ত্ব থেকে যে এ যুগের মুসলমানের নূতন করে লাভ হয়েছে শরীয়তের পুনঃপ্রবর্তনার স্বপ্ন তা বোঝা কঠিন নয়। কিন্তু যদি শুধু আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বপ্নে সে বিভোর থাকে আর বিশ্বের সঙ্গে তার যোগ যদি শিথিল হয়, তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় ওহাবীদের চেয়ে তার ভাগ্য প্রসন্নতর হবার কথা নয়, কেননা ওহাবীদের মনোবল ছিল অপরিসীম আর বাইরের সঙ্গে সংযোগ দূরে থাকুক তাদের শত্রুপক্ষের। বলবিক্রম সম্বন্ধে ধারণাও ছিল অদ্ভুত। [বাংলার মুসলমানের কথা] একালের শরীয়তপন্থীরা ওহাবীদের অনুবর্তী না হয়ে বরং অনুবর্তী হোক মহাপ্রাণ স্যার সৈয়দের, ইসলাম সম্বন্ধে যিনি বলতে পেরেছিলেন: যা সত্যি নয় তা ইসলাম নয়। যে কোন ধর্ম বা আদর্শ সম্বন্ধে এ সার কথা। যা সত্য অর্থাৎ সার্থক নয় তা ধর্ম বা আদর্শ হবার যোগ্য নয়। কোরআনের একটি বাণীর মর্ম এই: আল্লাহ্ যদি চেয়েন তবে সবাইকে একজাতীয় লোক করতেন, কিন্তু তিনি মানুষের (বিচার-বুদ্ধির) পরীক্ষা করতে চান, তাই কল্যাণের পথে মানুষ। পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করুক (৫:৪৮)। কল্যাণের পথে প্রতিযোগিতা-মানুষের দৈনন্দিন জীবনে-এর উপরে জোর দিতে ইসলাম যে কসুর করেনি দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের আলেমরা সে-কথা ব্যক্ত করতে পারেন নি। সেজন্য মুসলমান-সমাজের। একালের চিন্তানেতাদের দায়িত্ব আরো বেড়ে গেছে। সব সময়ে তাদের হুশিয়ার থাকতে হবে পূর্বের ভুল যেন আবার না করা হয়। তারা গভীরভাবে অধ্যয়ন করুন। কোরআন ও হাদিস, হজরতের জীবনকথা, মুসলিম ইতিহাসের বিভিন্ন যুগের শ্রেষ্ঠদের কথা, ভিন্ন দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠদেরও কথা; এসবের চেয়েও কঠিনতর প্রয়াস তাঁরা করুন চরিত্রে ও চেতনায় নিজেরা মহৎ হতে, কেননা যার নিজের চোখ নেই, সূর্যের ঔজ্জ্বল্যও তার জন্য ব্যর্থ; আর বিচিত্র শুভ-সাধনায় তাঁরা সংসারে গড়ে তুলুন স্বর্গ প্রত্যেক স্মরণীয় জাতি এমন সংসারে স্বর্গ গড়ার চেষ্টা করেছেন। এমন বিচিত্র ও বিপুল ঐহিক পাথেয়ের সাহায্যেই তারা আশা করতে পারেন তের শত বৎসরের ব্যবধান অতিক্রম করে শরীয়তের মর্ম উপলব্ধি করতে। শরীয়তের পুনঃপ্রবর্তন অবশ্য অসম্ভব, কেননা অতীত অস্তমিত-মৃত-তার যে অংশ সজীব সে তুমি ও আমি; অতীত পুনজীর্বিত হবে না, তবে তুমি ও আমি বিপুল সাধনায় নব মহিমা লাভ করতে পারবো-সংসারে এক নতুন চাঁদের হাট বসাতে পারবো।* আর যেহেতু আমরা ইসলামের উত্তরাধিকারী সেজন্য আমাদের মহিমা-লাভ হবে ইসলামের নতুন মহিমা লাভ।

[* তোমরা এখন এমন যুগে যখন যে-সব আদেশ-নির্দেশ তোমাদের দেওয়া হয়েছে তার দশ ভাগের এক ভাগ ত্যাগ করলে তোমরা ধ্বংস হবে; কিন্তু এমন যুগ আসবে, যখন এই-সব আদেশ নির্দেশের দশ ভাগের এক ভাগ পালন করলে তোমরা মুক্তি পাবে।-হাদিস]

নতুন মুসলিম রাষ্ট্রে অ-মুসলমানদের সমস্যার ইঙ্গিত মাত্র করা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি বাস্তবিকই খুব জটিল। মুসলমানের ইতিহাসে দেখা যায়, এটি বিভিন্ন যুগে বিভিন্নভাবে মীমাংসা করতে চেষ্টা করা হয়েছে। মদিনায় ও হোদায়বিয়ায় হজরত বিশেষ চেষ্টা করেছিলেন মুসলমান ও অ-মুসলমানদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করতে, পরস্পরের মধ্যেকার বিরোধিতা দূর করতে, সেজন্য নিজের প্রাধান্য অনেকখানি খর্ব করতেও তিনি প্রস্তুত। কিন্তু বিজয়ী ইসলাম স্বভাবতই বিজিতদের সঙ্গে সন্ধি করেছে তাদের আনুগত্য-স্বীকারের শর্তে। সেই আনুগত্য-স্বীকারের ধারাও এক থাকেনি। প্রথম যুগে অ-মুসলমানরা আনুগত্য স্বীকার করে জিজিয়া দিয়ে তাদের ধর্মাদি আচরণের অবাধ অধিকার পেতো, সিন্ধুর হিন্দুরা বিকাসিমের কাছ থেকে এমন অধিকার পেয়েছিল। কিন্তু পরে এ অধিকার কিছু ক্ষুণ্ণ হয়েছিল-মুসলিম রাষ্ট্রে নতুন করে দেবমন্দির নির্মাণের অধিকার স্বীকৃত হয়নি। প্রধানত এই ব্যাখ্যারই ফলে আওরঙ্গজেব বহু হিন্দুমন্দির ভেঙেছিলেন। অ-মুসলমানদের প্রতি প্রাচীন মুসলিম রাষ্ট্রের এই নীতিবৈচিত্র্য একালের মুসলমানরা যথেষ্ট কাজে লাগাতে পারে। এক্ষেত্রেও স্যার সৈয়দের অপূর্ব ইসলাম-নীতি যা সত্য নয়, অর্থাৎ সার্থক নয়, তা ইসলাম নয়-তারা প্রয়োগ করতে পারে; কায়েদে-আজমের যে সংখ্যালঘিষ্ঠদের প্রতি অভয় দান তা সম্পূর্ণ ইসলাম-অনুমোদিত জ্ঞান করতে পারে।

ইসলামে রাষ্ট্রের ভিত্তি কী-আইনজ্ঞেরা তার উত্তর দিতে চেষ্টা করবেন কোরআন হাদিস আর মুসলিম ইতিহাস মন্থন করে। কিন্তু যিনি জানেন মুসলমান হওয়ার অর্থ আল্লাহ্র, অর্থাৎ সত্য ও কল্যাণের, অনুগত হওয়া, আর সেইজন্য জগতের বন্ধু হওয়া,* তিনি নিঃসংশয়ে বুঝবেন- ইসলামে রাষ্ট্রের ভিত্তি কাণ্ডজ্ঞান ও মানব-হিত।

[* জগৎ আল্লাহর পরিবার। সে-ই আল্লাহর কাছে ভাল যে তার পরিবারের প্রতি ভাল হাদিস। সে আল্লাহতে বিশ্বাসী নয়, সে আল্লাহতে বিশ্বাসী নয়, সে আল্লাহতে বিশ্বাসী নয় যার আঘাত থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়। হাদিস।]

কোরআনের আল্লাহ্

বিষয়টি বিরাট। বিজ্ঞেরা জানেন এটি কোরআন-তত্ত্বের গোড়ার কথা; উৎকট অদৃষ্ট বাদ, মোতাজেলা যুক্তি-বাদ, সুফীর অন্তর্জোতি-বাদ, ইত্যাদি মুসলিম দার্শনিক মতামতের উৎপত্তি-কেন্দ্রও প্রায় এইটি। কিন্তু এসব জটিল ব্যাপার ত্যাগ করে আমরা বরং দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে চাচ্ছি মানুষের প্রতিদিনের জীবন-যাত্রার দিকে। মানুষের সেই প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে কোরআন-বর্ণিত আল্লাহর কি যোগ?

কোরআনের পাঠকদের সহজেই চোখে পড়ে আল্লাহর স্বরূপ-নির্দেশ সম্পর্কে বাগবিস্তারে কোরআনের আপত্তি। কোরআনের এই ধরণের যে সব উক্তি-মানুষকে জ্ঞান সামান্যই দেওয়া হয়েছে (১৭ : ৮৫), আল্লাহ মানুষকে যেটুকু জানান তার বেশি তার সম্বন্ধে ধারণা করবার শক্তি মানুষের নেই (২ : ২৫৫)-এ সব থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, আল্লাহর স্বরূপ-জিজ্ঞাসা কোরআনের অনভিপ্রেত। অথচ কোরআনে যদি কোনো একটি ব্যাপার অত্যুগ্র হয়ে থাকে সেটি হচ্ছে আল্লাহর কথা-আল্লাহর মহিমার অন্ত নেই, করুণার অন্ত নেই, চিরজাগ্রত তিনি, অন্যায়ের কঠোর শাস্তিদাতা তিনি-এসব কথা বারংবার কোরআনে উচ্চারিত হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ্ যে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ভালমন্দের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত, এ বিষয়ে কোরআন নিঃসন্দেহ-যেমন নিঃসন্দেহ, তিনি দুয়ে, সে-সম্বন্ধে।

আর শুধু কোরআন নয়, জগতের অন্যান্য বিখ্যাত ধর্মগ্রন্থ ও জগতের অনেক মনীষীও ‘আল্লাহ্’ সম্বন্ধে এই মনোভাবেরই পরিচয় দিয়েছেন-আল্লাহ্ যে স্বরূপতঃ দুয়ে অথচ এই দুয়ে আল্লাহর সঙ্গেই মানুষের প্রতিদিনের জীবন নিবিড়ভাবে যুক্ত, এ সব তাদেরও অন্তরতম কথা।

কিস্তু শক্ত প্রশ্ন এই দাঁড়ায়: যাঁকে জানা যায় না অথবা অতি সামান্যই জানা যায়: তিনি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অবলম্বন হবেন কেমন করে? এই কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েই যোগী সুফী প্রভৃতি রহস্যবাদীরা অবলম্বন করেছেন কৃচ্ছসাধনা, কল্পনাকুশলীরা প্রশ্রয় দিয়েছেন প্রতীক-চর্চা, আর সমাজ-শৃঙ্খলাবাদীরা জোর দিয়েছেন বিধি-নিষেধ পালনের উপরে।

এর কোন্‌টির কি মূল্য সেসব তর্কও আপাতত আমাদের পরিত্যাজ্য; আমরা তাকাতে চাচ্ছি কোরআনের একটি বিশেষ উক্তির দিকে : সব চেয়ে ভাল ভাল নাম আল্লাহর (৭ ও ১৮০)। অন্য কথায়, কোরআনের মতে, সব-চেয়ে শ্রেষ্ঠ গুণসমূহে আল্লাহ্ বিভূষিত; আর কোরআন নির্দেশ দিচ্ছেন এই সব শ্রেষ্ঠ নামে তাঁকে ডাকতে, অর্থাৎ তার শ্রেষ্ঠ গুণসমূহ স্মরণে রাখতে। বলা বাহুল্য এই থেকেই ধর্মভীরু মুসলমানের তসবীহ-পাঠ। কিন্তু আল্লাহ্ এই সব শ্রেষ্ঠ গুণ স্মরণ করার প্রকৃত অর্থ কী? তার নির্দেশ রয়েছে হজরতের এই বিখ্যাত বাণীতে: আল্লাহর গুণাবলীতে ভূষিত হও, অর্থাৎ আল্লাহ বলতে যেসব শ্রেষ্ঠ গুণ তোমার চিন্তায় আসে সেসব নিজের ভিতরে সৃষ্টি কর। কোরআনে মানুষকে বলা হয়েছে জগতে আল্লাহর প্রতিনিধি, সূর্য চন্দ্র দিবস রজনী এসব প্রাকৃত ব্যাপারও মানুষের অধীন (১৪ ৩৩)-নিশ্চয় সেখানে সেই মানুষের কথা বলা হয়েছে, যে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত অর্থাৎ যে বহু-সদ্‌গুণসমম্বিত শক্তিমান ব্যক্তি।

ধর্মভীরু মুসলমানেরা প্রতিদিন আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নাম বা গুণসমূহ স্মরণ করেন। তারা তাঁকে ৯৯ নামে ডাকেন, যেমন– তিনি করুণাময়, মহিমাময়, সুন্দর, কঠোর শাস্তি দাতা ইত্যাদি। বলাবাহুল্য তাঁর শ্রেষ্ঠ নামের শেষ নেই (৫৯ : ২৩)। কিন্তু এই স্মরণ করার অর্থ যে শুধু মুখে উচ্চারণ করা নয়, মন দিয়ে উপলব্ধি করা ও চরিত্রে এসবের প্রভাব ফুটিয়ে তোলা, সেই বড় কাজটাই চাপা পড়ে গেছে। ফলে আল্লাহর এই শ্রেষ্ঠ নামসমূহ স্মরণও শুষ্ক আদেশ-পালনের পর্যায়ভুক্ত হয়ে পড়েছে।

কিন্তু চিন্তা করলে বোঝা যাবে কোরআনের এই যে বাণী ও হজরতের এই যে নির্দেশ-এর এমন একটি ইঙ্গিত নিহিত রয়েছে যা উপলব্ধি করতে পারলে দুয়ে আল্লাহর সঙ্গে আমাদের এমন একটি যোগ স্থাপিত হয়, যাতে আমাদের প্রতিদিনের জীবনে শক্তি-সঞ্চার হয়; আমাদের জানার আকাঙ্ক্ষা খানিকটা তৃপ্ত হয়, আমাদের অনুভূতিকেও খানিকটা সজীব করে তোলা হয়।

দৃষ্টান্ত থেকে বুঝতে চেষ্টা করা যাক। ধরুন-আল্লাহকে বলা হয়েছে সুন্দর সেই ব্যাপারটি। আল্লাহ স্বরূপত কি, তা কে বলবে? কিন্তু তিনি সুন্দরের চরম–এই কথা ভাবতে তাঁর ভাবনা একটা অবলম্বনযোগ্য আদর্শের মতো আমার মনের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেল। সেই আদর্শ মনোগত, বস্তুগত নয়; কাজেই সেটির উৎকর্ষ হচ্ছে আমার বুদ্ধি বিবেচনার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে। আর সব চেয়ে বড় কথা এই যে এটি আমার সৌখীন কল্পনা নয়, এটিকে আমি অবলম্বন করেছি আমার জীবনের লক্ষ্য হিসেবে-আল্লাহ পরম সুন্দর এই ভাবনা আমার ভিতরে দিন দিন এনে দিচ্ছে আমার নিজের সমস্ত কাজে ও চিন্তায় সুন্দর হবার তাগিদ। তেমনি ধরুন-তাঁর করুণাময় নাম। তাঁকে করুণার শ্রেষ্ঠ আদর্শরূপে বুঝে আমি চেষ্টা করছি সেই করুণার ভাব আমার মধ্যে সঞ্জীবিত করে’ তুলতে। এমনি ভাবে বোঝা যেতে পারে তার অন্যান্য শ্রেষ্ঠ নাম ও আমাদের জীবনের বিকাশের উপরে সেসবের শক্তি। আল্লাহ সম্বন্ধে এই সব ধারণায় আমাদের জ্ঞান ও অনুভূতি কিছু তৃপ্ত হচ্ছে এই জন্য যে, আল্লাহ্ দুয়ে এই কথা বলে আমরা হৃদয় ও মনের সমস্ত দাবিকে স্তব্ধ করে দিতে চেষ্টা করছি না, বরং আমরা আবিষ্কার করেছি এই দুয়ের চরিতার্থতার একটি পথ-আল্লাহ্ বলতে আমরা বুঝছি জীবনের এক অন্তহীন অগ্রগতির তাগিদ, সেই তাগিদে ও চলার পথের বিচিত্র সৌন্দর্যে আমাদের মস্তিষ্ক ও হৃদয় দুইই সচেতন ও আনন্দিত।

আল্লাহকে যদি এইভাবে শ্রেষ্ঠ গুণের সমষ্টি বোঝা যায়, তবে আল্লাহ্ বাস্তবিকই আমাদের আকর্ষণ-স্থল হয়ে দাঁড়ান-আমাদের বহুব্যর্থতাময় দৈনন্দিন জীবনে তিনি হয়ে ওঠেন গভীরভাবে অর্থপূর্ণ। তখন মুসলমানের এই যে প্রতিদিনের বহু বারের প্রার্থনা-আমাদের সোজা পথে চালাও-সেটি প্রার্থনাকারীর হৃদয়-মনকে সত্যিকারভাবে উদ্ববাধিত করে; কেননা সোজা পথ বলতে কি বোঝা হচ্ছে, গতি হয়েছে আমাদের কোন্ দিকে, সে-বিষয়ে অনেক কথা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। জীবনের অর্থ এইভাবে অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে উঠলে ধর্মের বিধি-বিধানের তাৎপর্যও স্পষ্ট হয়ে ওঠে; তখন বুঝতে দেরী হয় না যে, ধর্মের বিধি-নিষেধ কোনো নিষ্ঠুর প্রভুর কষ্টদায়ক হুকুম নয়, বরং সেসব হচ্ছে জীবনকে উন্নতির দিকে পরিচালনার নিয়মশৃঙ্খলা-নদীর ধারাকে পরিচালনা করার জন্য যেমন তার দুই তীর। তখন আরো বোঝা যায়, তাই ধর্ম যা জীবনের বিকাশের সহায়ক আর তাই অধর্ম যা তেমন সাহায্য করে না, যেমন তাই খাদ্য যা বল দেয়, তা খাদ্য নয় যা বল দেয় না। সুবিজ্ঞ বিচারক যেমন বিচিত্র ও জটিল আইনের মধ্যে দেখেন জীবনের প্রয়োজন ও সেই দৃষ্টি দিয়ে দেখে তার সুব্যাখ্যার চেষ্টা করেন, কখনো কখনো করেন নূতন ক্ষেত্রে তার নূতন প্রয়োগ, আল্লাহ্র অভিমুখে যাত্রীও ধর্মের মর্মের সন্ধান পান ও জীবনের প্রয়োজনে নূতন নূতন ক্ষেত্রে তার নূতন নূতন প্রয়োগ ও পরীক্ষা করে চলেন।

পরম দুয়ে আল্লাহকে কোরআন যে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এমন ব্যবহারযোগ্য করেছেন এ মানুষের এক বড় লাভ।

১৩৪৯

সৈয়দ জামালুদ্দীন আল্-আফগানী

ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুসলিম সৈয়দ জামালুদ্দীন আল আগানীর সঙ্গে বাংলার ও বাঙালির পরিচয় নূতন নয়। বহুদিন পূর্বে পণ্ডিত রেয়াজউদ্দীন “সমাজ ও সংস্কারক” নাম দিয়ে তাঁর একখানি সুলিখিত জীবনী প্রকাশ করেন, সে গ্রন্থখানি এখন বাজেয়াপ্ত; আর জামালুদ্দীন উত্তর জীবনে ফরাসী দেশ থেকে যে পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, শোনা যায়, তারও ব্যয়ভার বিশেষভাবে বহন করতেন বাংলার কোনো কোনো মুসলমান। তার প্রতি বাংলার মুসলমানের এক দলের এই শ্রদ্ধার সঙ্গে সঙ্গে অন্য দলের বিরোধিতাও স্মরণীয়। তিনি যখন কলকাতায় উপস্থিত হন তখন নবাব আবদুল লতীফ প্রমুখ বাংলার তদানীন্তন শ্রেষ্ঠ মুসলিম-নেতৃবৃন্দ কলিকাতা মাদ্রাসায় তার বক্তৃতাদানে বাধা দেন; কয়েকজন বিশিষ্ট হিন্দু বাঙালির চেষ্টায় অন্যত্র-বোধ হয় এলবার্ট হলে-তার বক্তৃতার আয়োজন হয়।

নবাব আবদুল লতীফ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ কেন জামালুদ্দীনের বিরোধী হয়েছিলেন আজ তা বোঝা কঠিন নয়। জামালুদ্দীন, স্যার সৈয়দ, নবাব আবদুল লতীফ, এরা সমসাময়িক। এঁদেরই কালে ভারতীয় মুসলমানের এক বিশেষ ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে। তার সূচনা বহু পূর্বেই হয়েছিল, তবে সে বিপর্যয় উৎকট আকার ধারণ করে এঁদের সময়ে সিপাহী বিদ্রোহ ও ওহাবী বিদ্রোহের সঙ্গে সঙ্গে-ভারতীয় মুসলমান সাধারণভাবে রাজরোষের পাত্র হয়।* নবাব আবদুল লতীফের ও স্যার সৈয়দের বিশেষ চেষ্টা হয়েছিল এই রাজরোষ প্রশমন।

[* বাংলার মুসলমানের কথা]

কিন্তু জামালুদ্দীনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল শুধু ভারতীয় মুসলমানের সমস্যা নয়, বিশ্ব-মুসলিম সমস্যা। তাঁর বিরুদ্ধ পক্ষের কানে ও চোখে তাঁর জাগরণ-বাণী ও নির্ভীকতা হয়ত ওহাবীত্বের মতোই ভয়ঙ্কর বোধ হয়েছিল। অকপট অভীত ওহাবীদের প্রতি আজন্ম-যোদ্ধা জামালুদ্দীনের শ্রদ্ধাহীন না হবারই কথা। কিন্তু তার মত ও পদ্ধতির স্বাতন্ত্র সহজেই অনুমেয়। বিশ্ব-মুসলিম সমস্যার প্রতি ওহাবীদের চেয়ে অবিচলিততর তার দৃষ্টি, আর তার সমাধানও যে শ্রেষ্ঠতর সমাধান মুসলিম জগতের পরবর্তী ইতিহাস তার প্রমাণ-ওহাবীদের অতীতমুখিতা নয়, তার প্রচারিত জন-জাগরণ ও বিজ্ঞানমুখিতাই একালের মিসর-তুরস্কে সূচিত মুসলিম জাগরণের শ্রেষ্ঠ লক্ষণ।

ভারতীয় মুসলমানের চিন্তাভাবনার ধারা এখনো জামালুদ্দীনের নির্দেশিত পন্থা থেকে দূরে। ওহাবীদের অতীতমুখিতা, অথবা তাদের একশ্রেণীর হিন্দু স্বদেশবাসীদের মতো প্রাচীন-গৌরবের স্বপ্ন এখনো তাদের উপজীব্য। সম্প্রদায় হিসেবে ভারতীয় মুসলমানের দুর্বলতা অথবা দুর্বলতা-বোধ তাদের এমন স্বপ্ন-বিলাসের মূলে রস জুগিয়ে চলেছে। এই দিক থেকে দেখলে বোঝা যায় সমস্যাটি কত জটিল। কিন্তু নিবিড় দুর্যোগেরও অবসান হয়-জামালুদ্দীনের প্রতি ভারতীয় মুসলমানের একালের স্বত উৎসারিত শ্রদ্ধা তার শুভাদৃষ্টের পরিচায়ক মনে করা যেতে পারে।

১৩৪৫

ইকবাল

ইকবালের যে প্রধান মতবাদ-আত্মতত্ত্ব বা আমিত্বতত্ত্ব তার বিবৃতি পাওয়া যাবে তাঁর আ র-ই-খুদী নামক ফার্সী গ্রন্থে। ডক্টর নিকলসন Secrets of the Self নাম দিয়ে এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেছেন। বাংলাতেও এর গদ্যানুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

ইকবালের জন্ম ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ইয়োরোপে গমনের পূর্বেই তিনি উর্দু কবিসমাজে একজন শক্তিমান নবীন কবিরূপে আদৃত হন। কেম্ব্রিজে তিনি দর্শন অধ্যয়ন করেন ও কৃতী ছাত্ররূপে পরিগণিত হন, আর জার্মানীর মুনিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর উপাধি লাভ করেন তাঁর The Development of Metaphysics in Persia সন্দর্ভের দ্বারা। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্বদেশে প্রত্যাগমন করেন প্যান-ইসলামবাদে দীক্ষিত হয়ে, আর কবিতা রচনায় বীতস্পৃহ হয়ে। বন্ধুদের আগ্রহে তিনি পুনরায় কবিতা রচনায় মন দেন। তাঁর আর-ই-খুদী প্রকাশিত হয় ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে।

আ র-ই-খুদী সম্পর্কে তার কেম্বিজের গুরু ও বন্ধু দার্শনিক MacTaggart-এর এই চিঠিখানি অর্থপূর্ণ :

তোমার কবিতাগুলো (Secrets of the Self) পড়ে বড় খুশি হচ্ছি, সেকথা জানাবার জন্য এই চিঠি লিখছি। তোমার চিন্তাধারা আগেকার তুলনায় অনেক বদলে যায়নি কি? সেদিনে আমরা দুজনে যখন একত্রে দর্শন আলোচনা করতাম তখন তুমি অনেক বেশি মরমিয়া ও সর্বব্ৰহ্মাবাদী (Pantheist) ছিলে। আমি নিজে বলবৎ আছি আমার পূর্বের প্রত্যয়ে যে ব্যক্তিসত্তা-সমূহ (Selves) হচ্ছে চরম সত্তা (ultimate reality), তাদের প্রকৃত অর্থ ও সার্থকতা বোঝা যাবে অনন্ত কালে (পূর্বেও আমার এই ধারণা ছিল), কালক্রমে নয়, এবং কর্মে তত নয় যত প্রেমে। হয়ত আমাদের এই পার্থক্য বেশির ভাগ মাত্রাগত-আমাদের বিভিন্ন দেশের কি কি প্রয়োজন সেইটি হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের প্রধান ভাবনার বিষয়। তুমি ঠিকই বলেছ যে, ভারতবর্ষ বড় বেশি ধ্যানী। কিন্তু ইংল্যান্ড ও ইয়োরোপ-যে যথেষ্ট ধ্যানী নয় সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। এই শিক্ষা তোমাদের কাছ থেকে আমাদের নেবার আছে, আমাদের কাছ থেকেও যে তোমাদের কিছু শিখিবার আছে তাতে ভুল নেই। [The Poet of the East : Abdullah Beg]

মরমীবাদ ও সন্ত্রহ্মবাদ থেকে ব্যক্তিত্ববাদে, অর্থাৎ চরম সত্তায় বা ভগবানে বা আল্লাহ্র ব্যক্তিত্ববিসর্জন-তত্ত্ব থেকে সেই চরম সত্তার সাহায্যে ব্যক্তিত্বের বিকাশ-তত্ত্বে, কেমন করে ইকবালের পরিবর্তন ঘটলো তাঁর কাব্যের ভিতরে তার কিছু কিছু পরিচয় থাকলেও বিস্তারিত পরিচয় নেই, তাঁর কাব্যে বিস্তারিত পরিচয় আছে তার ব্যক্তিত্ববাদেরই। তবে বাইরের কোন্ কোন্ ঘটনার প্রভাবে (Mac Taggart এর ভাষায় তাঁর দেশের কি প্রয়োজনে) তার মধ্যে এমন পরিবর্তন ঘটে তা বোঝা কঠিন নয়।

নবীন কবি ইকবালের অন্তরে স্বদেশানুরাগ যথেষ্ট প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছিল-তার ‘হিমালয়’ বুদ্ধ’ ‘নানক’ নূতন শিবালয়’ প্রভৃতি কবিতায় রয়েছে তার সেই অনুরাগের পরিচয়। কিন্তু স্বদেশের দুঃখমূর্তি তাঁর চোখে প্রকট হলো বেশি। এ সম্বন্ধে তাঁর তসবীর-ই-দর্দ (ব্যথার ছবি) নামক দীর্ঘ কবিতা (১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে রচিত) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার কয়েকটি চরণ এই:

আমার কাহিনীর এ প্রার্থনা নয় যে ধৈর্য ধরে তোমরা শুনবে।
স্তব্ধতাই আমার বাণী ভাষাহীনতাই আমার ভাষা ॥

হায় হিন্দুস্থান, তোমাকে দেখে কেবল উদ্গত হয় আমার অশ্রু।
সব কাহিনীর মধ্যে তোমার কাহিনী স্মরণ করায় অপরাধ ॥

আকাশের আস্তিনে লুকানো রয়েছে বজ্র।
এই বাগানের বুলবুলিরা তাদের কুলায়ে নিশ্চিন্ত না থাকুক ॥

তাঁর স্বদেশবাসীদের তিনি বলেন ‘ছিন্ন জপমালা’-সেই ছিন্ন জপমালা তিনি আবার দেখতে চান গ্রথিত; অদূরদর্শী ভারতবাসীকে তিনি বলেন সমস্ত অভিমান বিসর্জন দিতে-একতার পথে অগ্রসর হতে।

ইয়োরোপে গিয়ে মুসলমান-দেশসমূহের দুর্দশা ও বিপদ সম্বন্ধে তিনি বেশি সচেতন হন ও স্যার আবদুল্লাহ্ সুহরাওয়ার্দি প্রভৃতির সঙ্গে Pan Islam Society গঠন করেন।

দেখা যাচ্ছে ভারতের দুর্দশা, আর বিশেষ করে মুসলমান দেশসমূহের বিপদ, তাকে পরিচালিত করেছে তার আমিত্ব তত্ত্বের পানে। একালের মুসলমান চিন্তাশীলদের মধ্যে সৈয়দ জামালুদ্দিন আফগানীর কাছে তিনি বিশেষভাবে ঋণী। আঙ্গনী উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের লোক। ধ্বংসশীল মুসলিম জগতের কানে তিনি দেন বিজ্ঞান অনুশীলনের ও রাষ্ট্রশক্তি লাভের মন্ত্র। তার মন্ত্র মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশসমূহে ফলপ্রসূ হয়েছে। কিন্তু এই মনীষী প্রধানত গ্রহণ করেছিলেন রাজনৈতিক প্রচারকের ব্রত। ইকবাল আরো গভীর করে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেন মুসলমানের পতনের কারণ। তিনি বুঝলেন, তাদের পতনের মূলে সুফীমতের আত্মবিসর্জন ও বৈরাগ্যবাদ সেই আত্মবিসর্জন ও বৈরাগ্যবাদ পরিহার করে তাদের হতে হবে আত্মবিকাশশীল ও সংসারে বরেণ্য।

এই ধরণের আত্মতত্ত্বের সন্ধান তিনি যে পান জার্মান দার্শনিক নীটশের কাছে থেকে একথা ডক্টর নিকলসন বলেছেন। তাঁর কথা মিথ্যা নয়। তবে নীটশের শক্তিবাদে ও ইকবালের শক্তিবাদে বড় রকমের পার্থক্যও রয়েছে। নীটশের ঈশ্বরে অবিশ্বাসী এবং নারী ও জনসাধারণের মূল্য ও মর্যাদায়ও অবিশ্বাসী; ইকবাল ঈশ্বরে বিশ্বাসী আর পুরোপুরি গণতন্ত্রবাদী না হলেও জনসাধারণের মহত্তর সম্ভাবনায় আস্থাবান্; নারীকে তিনি নরের সমকক্ষ জ্ঞান করেন না, তবে নারী-প্রকৃতির মাধুর্য ও সৌন্দর্য তাঁর শ্রদ্ধার সামগ্রী, নারীকে তিনি দেখতে চান সুগৃহিণী ও জননী রূপে।

আমাদের মনে হয়েছে ইকবালের শক্তিবাদ নীটশের দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও এর লালনে বিশেষ সাহায্য করেছে গ্যেটের ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাধারা। গ্যেটের প্রতি ইকবাল যথেষ্ট শ্রদ্ধাবান্; তাঁর “প্রতীচ্য-প্রাচ্য-দিউয়ানের স্মরণে ইকবাল লিখেছেন, পায়াম-ই মশরেক (প্রাচ্যের বার্তা), তাঁর বিখ্যাত Six Lectures-এ তিনি উদ্ধৃত করেছেন গ্যেটের কবিতা। মানুষের আমিত্ব যে লালনের ও বিকাশের সামগ্রী, বিসর্জন দেবার জন্য নয়, এই মত যেমন ব্যক্ত হয়েছে গ্যেটের বহু লেখায়, তেমনি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর ব্যক্তিত্বে। এ সম্পর্কে কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করা হচ্ছে:

(১) গ্যেটে তার ছেলেবেলায় এক অভিনব পদ্ধতিতে ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তাঁর পিতা অনেক খনিজ দ্রব্য সংগ্রহ করেছিলেন। একদিন চুপে চুপে সে সব তিনি একখানি সুদর্শন কাষ্ঠখণ্ডের উপরে সাজালেন। এসব হলো প্রকৃতির বৈচিত্র্যের প্রতীক; আর সেই খনিজ দ্রব্যের স্তূপের উপরে ‘প্যাসটেল’ পেন্সিল রেখে তাতে আগুন ধরালেন উদীয়মান সূর্যের দিকে আতস-কাঁচ ধরে-উদ্দেশ্য এইভাবে প্যাসটেলে আগুন ধরে যে ধূম কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠবে, তা হবে প্রকৃতির বৈচিত্র্যের উপরে মানুষের মনের স্তবের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু প্যাসটেলে পেন্সিল পুড়ে গিয়ে নীচের কাষ্ঠখণ্ডে আগুন ধরে ও তা নষ্ট হয়ে যায়। এই ঘটনার উপরে গ্যেটে এই মন্তব্য করেছেন:

এই ধরণের ঈশ্বর লাভের বাসনায় সর্বদা যে বিপদ বিদ্যমান এই দুর্ঘটনাকে গণ্য করা যেতে পারে সে-সম্বন্ধে এক সঙ্কেত ও সাবধানবাণীর তুল্য। (ইকবাল বলেছেন, ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরে বিসর্জন দেবার জন্য নয় বরং পরম-ব্যক্তি ঈশ্বরের গুণ আত্মস্থ করে বিকশিত হবার জন্য।

(২) গ্যেটে তাঁর বিখ্যাত নরদেবতা’ (Divine) কবিতায় বলেছেন: সমস্ত প্রকৃতি অন্ধ নিয়মের দ্বারা শাসিত, কেবল মানুষের মধ্যেই আছে বিবেক, এর দ্বারা সে ভালমন্দের বিচার করে, যা মহৎ তাকে লালন করে, দেবতা বলতে যে মহিমার ধ্যান তারা করে, সেই মহিমার প্রতিমূর্তি তারা হোক।

(৩) গ্যেটে নিরঙ্কুশ যুক্তিবাদের বিরোধী ছিলেন; তিনি বলেছেন: যাতে ভাবের মুক্তি আনে কিন্তু সেই অনুপাতে আত্মজয় এনে দেয় না তা অনিষ্টকর। তার ফাউস্ট’ নাটকে শয়তানকে বলা হয়েছে, অস্বীকৃতিপরায়ণ আত্ম-The spirit that denics-অর্থাৎ মানুষের বা জগতের মহৎ সম্ভাবনায় সে অবিশ্বাসী, সে শুধু পরিচ্ছন্ন বুদ্ধির অধিকারী। ইিকবাল আমিত্বের সাধনায় প্রেমের স্থান দিয়েছেন বুদ্ধির উপরে।

(৪) গ্যেটে দেখতেও ছিলেন অসাধারণ। যৌবনে তাকে বলা হতো Apollo আর বার্ধক্যে বলা হতো Jupiter. নেপোলিয়ন তাকে দেখে বলেছিলেন- Voila un homme! (একটা মানুষ বটে!)।

(৫) ধর্মজীবন সম্বন্ধে গ্যেটে বলেছেন নিজেকে শ্রদ্ধা করাই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম, অবশ্য এই শ্রদ্ধা অহমিকা ও দুরাকাতক্ষা বর্জিত।

(৬) গ্যেটের একটি বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি চরণ এই;

কেউ পড়তে পারেনা নাস্তি’তে;
অব্যয় বাস করে সবার মধ্যে।
ধন্য হও তাই সত্তায়।
সত্তা চিরন্তন, নির্ধারিত নিয়মে
রক্ষা পায় তার চিরজীবন্ত সম্পদ;
তাতেই বিশ্বের মহিমাময় রূপায়ণ।

নীটশে ছিলেন জরাথুস্ত্র, সীজার, হজরত মোহাম্মদ, গ্যেটে, মিরাবো প্রভৃতি ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। হজরত মোহাম্মদের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে তাঁর এক সঙ্গী বলেছেন যে, তাঁর মুখের পানে তারা চেয়ে সাহস করতেন না। আমাদের মনে হয়েছে হজরত মোহাম্মদের যে বিখ্যাত বাণী “আল্লাহর গুণে বিভূষিত হও,” আর মনসুর হাল্লাজের যে বিখ্যাত উক্তি “আনাল হক” (সোহহম), এসবের দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইকবালের নীটশে-গ্যেটে অনুপ্রাণিত ও লালিত শক্তিবাদ, আর শেষে তার অবলম্বন হয়েছেন হজরত মোহাম্মদ, তাকে তিনি বলেছেন “ইনসান-ই কামেল-পূর্ণমানুষ-Superman.

প্রাচ্যে আমিত্বকে সাধারণত ভাগ করা হয়েছে দুইভাগে-রামকৃষ্ণ পরমহংসের ভাষায়-”পাকা-আমি” আর “কাঁচা-আমি”। কাঁচা-আমি অজ্ঞান-তাড়িত দুর্বল উদৃব্যস্ত ‘আমি’, আর পাকা-আমি ঈশ্বরে বা সত্যে সমর্পিতচিত্ত প্রশান্ত ‘আমি’। সেই ‘আমি’ সম্পর্কে

বুদ্ধদেব বলেছেন :

তোমরা নিজেরা নিজেদের প্রদীপ হও; নিজেরা নিজেদের আশ্রয়স্থল হও;

গীতা বলেছেন :

নিমিত্ত মাত্র হও-ভগবানের হাতের যন্ত্র হও;

বাইবেল বলেছেন :

জগতের অধিস্বামী হবে সহিষ্ণুরা:

কোরআন বলেছেন :

আল্লাহতে বিশ্বাস করো ও ভাল কাজ করো………আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে চলো;

সুফীরা বলেছেন :

মরার আগে মরে যাও।

এসবের মধ্যে যে কোনো পার্থক্য নেই ঠিক তা নয়, এসব কথা মানুষের ইতিহাসকে যেভাবে প্রভাবিত করেছে সেদিকে তাকালে বরং যথেষ্ট পার্থক্যই চোখে পড়ে। তবে এসবের মধ্যে খুব বড় মিল এইখানে যে সর্বত্রই মানুষকে বলা হয়েছে বিক্ষুব্ধ প্রাত্যহিক জীবনের ঊর্ধ্বে উঠতে, আর প্রশান্তিকে জ্ঞান করা হয়েছে বিশেষ কাম্য।

ইকবালের যে ‘আমি’ সেটি কি প্রাচ্যের এই পরিচিত পাকা-আমি? শোনা যাক ইকবাল কি বলেন :

আমিত্বের স্বরূপ হচ্ছে নিজেকে প্রকাশ করা,
প্রতি কাণায় ঘুমিয়ে আছে আমিত্বের বীর্য।

জীবন লুকিয়ে আছে অন্বেষণে,
এর মূল নিহিত রয়েছে চাই-মন্ত্রের মধ্যে।

জ্ঞান হচ্ছে জীবন রক্ষার একটি উপায়,
জানের কাজ আমিত্বকে শক্তিমান করা।

আমি-রূপ যে আলো-কণিকা
তা এই মাটির তলায় লুকানো স্ফুলিঙ্গ।
প্রেমের দ্বারা বর্ধিত হয় এর বায়ু–
আরো তাজা হয়, আলো জ্বলে, আরো ঝলমল করে।

ইকবালের যে ‘আমি’, বোঝা যাচ্ছে, তা বিকাশের তাড়নায় চঞ্চল—’প্রশান্ত’ ঠিক নয়। কিন্তু এই ‘আমি’ সম্পর্কে তিনি আরো বলেছেন :

এক মুঠা ধূলি দিয়ে করো সোনা তৈরি,
পূর্ণ মানুষের দ্বারের ধূলি কর চুম্বন।

ওরে বেহুশ, অনুগত হতে শেখ,
আনুগত্য থেকে জন্ম হয় কর্তৃত্বের।

যার নিজের উপরে কর্তৃত্ব নেই
তার উপরে কর্তৃত্ব করবে অন্য জন।

আল্লাহর জন্য ভিন্ন যে তলোয়ার খোলে,
সেই তলোয়ারের খাপ হয় তার বুক।

সংসারে সর্বশক্তিমানের প্রতিনিধি হওয়া আনন্দের,
প্রকৃতির উপরে স্বামিত্ব লাভ করা আনন্দের।

এসব থেকে, বিশেষ করে শেষ চারিটি ছত্র থেকে বোঝা যাচ্ছে, প্রাচ্যের পরিচিত প্রশান্তি আর ইকবালের আমিত্বের মধ্যে যে পার্থক্য, তা ঠিক শ্রেণীগত নয়-মাত্রাগত। প্রশান্তি, ব্রাহ্মীস্থিতি, এসব যে কর্মহীন নয় তার প্রমাণ বুদ্ধ-শিষ্যের প্রচার-ব্ৰত গ্রহণ, অর্জুনের আত্মীয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ, সুফীর সৃষ্টির সেবা (খেদমতে খলক)। তবে প্রাচ্যের এই সুপরিচিত প্রশান্তির প্রবণতা সাধারণত দাঁড়িয়েছে কর্মহীনতার দিকে, সেই দিক দিয়ে ইকবালের সদাসক্রিয় আনন্ত্য-লোলুপ আমিত্বের সাধনা এ যুগের প্রাচ্যে-শুধু মুসলমান জগতে নয়-বিশেষভাবে অর্থপূর্ণ, এবং সেই দিক দিয়ে তিনি এযুগের প্রাচ্যের এক শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। এশিয়া-আফ্রিকার সব চেয়ে বড় প্রয়োজন যেটি সেটি হচ্ছে, তার জড়তা-বিসর্জন আর প্রাত্যহিক জীবনকে সুন্দরতর মহত্তর করবার আগ্রহ। এ আগ্রহ ব্যক্ত হয়েছে এ-কালের প্রাচ্যের বহু কর্মী ও ভাবুকের বাণীতে। সেই আগ্রহ ইকবালের কাব্যে ধারণ করেছে এক প্রবল, অগ্নিশিখার মতো মোহন রূপ। তাই তিনি যে এ যুগের তরুণ-সমাজের- আপাতত মুসলিম তরুণের-প্রাণের মানুষ হয়েছেন, এ অনেকটা অপরিহার্য।

কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে এই পর্যন্তই আমি ইকবালের সাহচর্য উপভোগ করতে পারি। এর পরে সেই আমিত্বের সাধনার যে সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারার নির্দেশ তিনি দিয়েছেন, সেখানে ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাখ্যা, ঐতিহ্যের মূল্য নিরূপণ, ইত্যাদি গুরু ও জটিল বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আমার যে পার্থক্য তা হয়ত মূলগতঃ মনে হয় তিনি বিশ্বাস করেন প্রাচীন ধর্ম ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন সম্ভবপর ও কাম্য, আমার ধারণায় তা এক অসম্ভব ব্যাপার—“যে কাল যা সৃষ্টি করে তাতে মেটে সেই কালেরই প্রয়োজন”*–অতীত থেকে পাওয়া যেতে পারে কিছু প্রেরণা যদি সংকল্প সাধু হয়। সেজন্য কবি ইকবালের সঙ্গে তুলনায় চিন্তানেতা-ইকবাল আমার কাছে কিছু স্বল্পমূল্য** এবং আমার এমন আশঙ্কাও আছে যে চিন্তানেতা নীটশে যেমন পরোক্ষভাবে ইয়োরোপের বর্তমান ধ্বংসলীলার কারণ হয়েছেন তেম্‌নি ইকবালের চিন্তাধারারও এমন অপব্যাখ্যা সম্ভবপর-এমন অপব্যাখ্যা বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তাধারার হয়েছে-যার ফলে তাঁর মনুষ্যত্ব ও প্রতিভা তার স্বদেশীয়দের আনন্দের কারণ না হয়ে দুঃখের কারণ হতে পারে দীর্ঘদিনের জন্য। শক্তিবাদ ও শান্তিবাদ দুই থেকেই সময় সময় যে কুফল ফলে সে সম্বন্ধে Religion of Man গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের এই দুটি উক্তি স্মরণীয়:

শক্তিবাদ সম্পর্কে–

সংগ্রামশীল ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে স্বভাবতযুক্ত দৈহিক বলবিক্রম-সেই ইচ্ছাশক্তি যখন তার পূর্ণ দায়িত্ব ও সার্থকতা থেকে বঞ্চিত হয়, তখন থেকে জন্মলাভ করে দুর্দমনীয় লোভ, সূচনা হয় অন্তরে বস্তুর দাসত্ব, আর শেষে বিচিত্র স্বার্থবুদ্ধির ঘাত-প্রতিঘাতে দুরাকাঙ্ক্ষার সৌধচূড়া ধূলি-ধূসরিত হয়।

শান্তিবাদ সম্পর্কে–

প্রবল প্রাণশক্তির কর্মধারা যেমন পরিণত হতে পারে অর্থহীনতায় যার ফলে আত্মা নিপীড়িত হয় বস্তুসমারোহে, তেম্‌নি ইচ্ছালোপের যে শান্তি তা পরিণত হতে পারে মৃত্যুর শান্তিতে, আমাদের অন্তর্লোক তখন হয়ে ওঠে অসংলগ্ন স্বপ্নের রাজ্য।

[* গ্যেটে-ফাউস্ট-প্রথম দৃশ্য

** ইকবালের ইংরেজী জীবনী “The Poet of the East’- এর ভূমিকায় ডক্টর নিকলসন বলেছেন : The affinities with Neitzsche and Bergson need not be emphasised. It is less clear, however, why Iqbal identifies his ideal society with Mohammed’s conception of Islam, or why membership of that socity should be a privilege reserved for Moslems. Here the religious enthusiast seems to have knocked out the philosopher-a result which is logically wrong but poetically right.]

ইকবালের অর্থপূর্ণ প্রভাবকে এই অবাঞ্ছিত পরিণতি থেকে রক্ষা করা প্রত্যেক চিন্তাশীল কর্মীর কর্তব্য; তাঁর ভক্তদের উপরে তো এই দায়িত্ব বিশেষ ভাবেই ন্যস্ত। এই উদ্দেশ্যে ইকবালের বাণীর সঙ্গে সঙ্গে তার উদযাপিত জীবন স্মরণে রাখার যোগ্য। আকাক্ষার (আজুর) মহিমা কীর্তন তিনি একান্তভাবে করেছেন, কিন্তু নিজেকে বারবার বলেছেন ফকীর-নিঃস্ব-আর তার এই নিঃস্বতা নির্লোভ, পদস্থ ও বিত্তশালীর দ্বারস্থ তিনি হননি কোনোদিন, অযাচিত সাহায্যও তিনি করেছেন প্রত্যাখ্যান। বারবার তিনি বলেছেন-আমিত্বের বিকাশ ব্যহত হয় যাচ্ঞার দ্বারা আর সমৃদ্ধ হয় আকাক্ষার দ্বারা। অন্য কথায়, তাঁর এই ‘আকাক্ষা’র অর্থ হচ্ছে মহত্ত্বের পথে অতন্দ্রিত প্রয়াস, গ্যেটে যেমন বলেছেন :

জীবন আর স্বাধীনতা তারই লভ্য ও ভোগ্য
যে প্রত্যহ নতুন করে জয় করে এদুটি।

আর সেই সঙ্গে দরকার এই তিনটি বড় বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখাঃ-প্রথমত, তিনি মুসলমানের উন্নতি প্রাণভরে’ চেয়েছেন–

প্রভু, মুসলমানের অন্তরে, এক জাগ্রত আকাক্ষা দাও,

কিন্তু বুঝতে হবে, সমস্ত মানুষের, সমস্ত জগতের, উন্নতি উপেক্ষা করে তিনি মুসলমানের উন্নতি চেয়ে পারেন না, চাইলে তার সত্যপ্রীতি ও আল্লাহ-প্ৰীতি হয় অর্থহীন। তিনি কবি, তাই বিশিষ্ট, concrete, তাঁর প্রিয়, মানুষের কথা তত না ভেবে ‘মুসলমানের কথা বেশি ভাবা সেজন্য তাঁর পক্ষে কতকটা অপরিহার্য; বিশেষ করে তার চারপাশের মুসলমানের এমন পতিত দশায়। দ্বিতীয়ত, আমিত্বের যে-বিকাশ তিনি চেয়েছেন তা রাতারাতি হবার মতো ব্যাপার নয়। তাই সাধনাহীন হয়ে তাড়াতাড়ি ফল চেয়ে গেলে এ-ক্ষেত্রে অনর্থ ভিন্ন আর কিছুই সম্ভবপর নয়। এ সম্বন্ধে বাউল-কবির সতর্কবাণী চির-শ্রদ্ধেয় :

নিঠুর গরজী, তুই মানুষ-মুকুল ভাজবি আগুনে!
তুই ফুট ফুটাবি বাস ছুটাবি সবুর বিহুনে!
চেয়ে দ্যাখ মোর পরম গুরু সাঁই,
তিনি যুগ যুগান্তে ফুটান কমল তার তাড়াহুড়া নাই।

তৃতীয়ত, বর্তমান ইয়োরোপীয় সভ্যতা থেকে তিনি যে মুখ ফিরিয়েছেন তাকে ধ্বংসোনুখ জ্ঞান করে’-তার শেষ বয়সের একটি লেখায় ইয়োরোপ সম্পর্কে তিনি বলেছেন “এই সওদাগরের মৃগনাভিও কুকুরের নাভি ভিন্ন আর কিছু নয়’*-আর বরণীয় জ্ঞান করেছেন প্রাচ্যের আধ্যাত্মিকতা, সেক্ষেত্রে দৃষ্টির পরিচয় না দিয়ে দৃষ্টি-বিভ্রমেরই পরিচয় তিনি দিয়েছেন বেশি, কেননা, সমস্ত ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও, ইয়োরোপীয় সংস্কৃতির বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি ও অকুণ্ঠিত মানব-কল্যাণ জিজ্ঞাসা আজো মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠ আত্মিক সম্পদ, প্রাচ্যের আমিত্ব-সাধনের বা প্রশান্তি-সাধনের হওয়া চাই তার পরিপূরক, প্রতিদ্বন্দ্বী নয়।

[* মুষকে ইন্সওদাগর নাফে সগসত]

ইকবালের মহৎ বেদনা মহৎ সার্থকতা লাভ করুক।

১৩৪৯-ইকবাল স্মৃতিবার্ষিকী-রাজশাহী কলেজ

গৃহযুদ্ধের প্রাক্কালে

বন্ধুবর এস্ ওয়াজেদ আলি প্রতিষ্ঠিত গুলিস্তা-সাহিত্য চক্রের পঞ্চম বার্ষিক অধিবেশনে অন্যান্য সাহিত্যিকের মতো আমিও সানন্দে যোগদান করেছি, বোধ হয় প্রধানত এই কারণে যে, আমরা কবি-সাহিত্যিকরা কবিশেখর হাফিজের এই বাণী অমূল্য বলেই জানি।

বা-দোসতাঁ তালাত্তুফ বা-দুশমনাঁ মদারা।
বন্ধুদের নিয়ে আনন্দ কর আর শত্রুদের সঙ্গে আপোষ কর।

সংসারে যারা জবরদস্ত তাদের সঙ্গে তুলনায় কি সংখ্যাশক্তিতে কি প্রতিপত্তিতে আমরা তো নগণ্য ভিন্ন আর কিছু নই, কিন্তু প্রতিদিনের সংসারে নগণ্য হয়েও মহা অহঙ্কারী আমরা, নিজেদের আমরা জানি জবরদস্তদের চেয়ে অনেক বড়, এমনকি জবরদস্তদের জানি মোটের উপর কৃপার পাত্র বলে-আমাদের সেই মূল্য ও মর্যাদা বাঁচিয়ে চলার এক উপায় হচ্ছে এই ধরণের পলায়ন ও গণ্ডীবদ্ধতা। বলা বাহুল্য এ পন্থা খুব নিরাপদ নয়। পলায়ন অবশ্য অনেক সময়ে প্রশস্ত পথ- নইলে অনুভূতির তীক্ষ্মতা বাঁচিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব-কিন্তু গণ্ডীবদ্ধতার প্রায়-অপরিহার্য গতি আত্মকেন্দ্রিকতার দিকে যা উৎকট হলে ঘটায় ভাবরসিক চিত্তের মহামূল্য সচেতনতার অপঘাত। আমাদের আজকার সম্মেলন তাই হোক মহা-অহঙ্কারী কিন্তু মহা-প্রেমিকদের আনন্দ সম্মেলন। অহঙ্কার আমাদের দেবদত্ত বর্ম, কিন্তু সংসারপথে আমাদের অবলম্বন অপরিমেয় প্রেম, সেই প্রেম আমাদের শক্তি দিয়েছে সব রকমের ক্ষুদ্রতা নীচতা ও নির্বুদ্ধিদের প্রতি নয়, কেননা তারা আমাদের সহতীর্থযাত্রী। আজকার সম্মেলনে আমাদের সেই প্রেম ও ঘৃণা উজ্জ্বল শিখায় জ্বলুক।

বন্ধুগণ, আজকার দুনিয়ায় স্বভাবত মুক্তপক্ষ কবি-সাহিত্যিকরা যথেষ্ট নিপীড়িত হয়ে চলেছে। জগতে এখন চলেছে এক কালান্তর-বড় রকমের ভাঙাগড়া; বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে দেশে দেশে দূরত্ব গেছে ঘুচে, পৃথিবী হয়ে পড়েছে অনেক ছোট; মানুষের বিভিন্ন স্বাভাবিক অধিকারের কথা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর প্রতি কোণে; তাই অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে মানুষের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনের সম্পূর্ণ নূতন গঠন। সেই গঠনের সূচনাও হয়েছে সাম্যবাদের বিশ্বব্যাপী প্রসারের দ্বারা। কিন্তু সাম্যবাদ। যেমন সূচিত করেছে মানুষের ব্যাপক দায়িত্ববোধ ও অভূতপূর্ব কর্মোদ্যম, তেমনি এনে দিয়েছে মানুষের চিন্তার স্বাধীনতার কঠোর নিয়ন্ত্রণ এই যুক্তির বলে যে, চিন্তার স্বাধীনতার অন্য নাম কর্মে ব্যাপক নিষ্ফলতা। এই যুক্তি অবশ্য অভ্রান্ত নয়, কিন্তু খুব দুর্বলও যে নয় তা আমরা জানি এই অভিজ্ঞতার ফলে যে, স্বাধীন-আত্মা কবি সাহিত্যিকদের দলে অনেক সময়ে ভিড় জমে স্বেচ্ছাচারীদের ও ভাববিলাসীদের। মানুষের এই প্রতিশ্রুতিপূর্ণ অভিনব কল্যাণায়োজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে কবি সাহিত্যিকদের তাই সহ্য করে যেতে হবে এই পীড়ন, যদিও অন্তরে তারা রইবে চির অধৃষ্য বিষপায়ী সক্রেটিসের মতো।

বৃহত্তর জগতে যে বিষম ভাঙাগড়া চলেছে আমাদের দেশে তা রূপ নিয়েছে হিন্দু মুসলমানের বিরোধের তীব্রতায়। আজ অমুসলমান-দলের প্রায় সবাই চাচ্ছে ভারতের অবিলম্বিত স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা, মুসলমানদের খুব বড় দল চাচ্ছে বিভক্ত ভারত-মুসলমানের অবাধ বিকাশের অনুকূল স্বাধীন বাসভূমি। মুসলমানের কাঙ্ক্ষিত এই স্বাধীন’ বাসভূমির অবস্থিতি ও আয়তন-সমস্যা আপোষ-নিস্পত্তির যোগ্য নয় বলেই মনে হয়, কেননা যথেষ্ট বিস্কৃত-আয়তনের না হলে তাতে মুসলমানের স্বাধীন বিকাশ হবে অর্থহীন, আর মুসলমানের জন্য ভারতের পশ্চিমে ও পূর্বে তেমন বাসভূমির ব্যবস্থা করতে হলে হিন্দুর নিজের বিকাশ যতটা ব্যাহত হবে, তা আপোষে স্বীকার করে’ নেওয়া তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তাই গৃহযুদ্ধ ভারতে আসন্ন এ আশঙ্কা অমূলক নয়, অবশ্য মুসলমান যদি তার পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার দাবির ইতর-বিশেষ না করে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের, অর্থাৎ উন্মাদনায় উৎসাহহীনদের, কি কর্তব্য? এই প্রশ্নের উত্তরে এক বন্ধু সেদিন অম্লানমুখে উত্তর দিয়েছিলেন : কিছুই না-ঝড়-ঝঞ্ঝার দুর্যোগে সূর্য-চন্দ্র মুখ ঢাকে, মানুষের উন্মত্ততার মৌসুমও তেমনি আলোকপিয়াসী কবি সাহিত্যিকদের অজ্ঞাতবাসের কাল। কথাটিতে বিজ্ঞতা যথেষ্ট। শ্রোতার যখন শুনবার মতো অথবা শুনে বুঝবার মতো মনের অবস্থা নয়, তখন তাকে বুঝবার কথা বলা শুধু নিরর্থক নয়, আপত্তিকরও। তবে দেশের লোকদের অবস্থা বাস্তবিকই যে এমন সাংঘাতিক হয়ে উঠেছে তা মনে হয় না, অন্তত গৃহযুদ্ধ এখনো আরম্ভ হয় নি। তাই কবি-সাহিত্যিকদের পক্ষপাতহীন সত্যভাষণ একটু কড়া লাগলেও একান্ত অবাঞ্ছিত নাও মনে হতে পারে। তাছাড়া কবি-সাহিত্যিকদের নিজেদের এতে প্রয়োজন আছে তাদের প্রেম ও অতন্দ্রিতোর পথে।

এদেশের হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের দিকে হিন্দু সচেতন-দল আর মুসলমান সচেতন-দল যেভাবে তাকায় তা বেশ অদ্ভুত। হিন্দু-দলের সিদ্ধান্ত এই যে, এটি একালের ইংরেজ শাসকদের ভেদ-নীতির অপরিহার্য ফল-পূর্বে এর অস্তিত্ব ছিল না। মুসলমান-দলের সিদ্ধান্ত এই যে, ব্রিটিশ আমলে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা লাভ হয়েছে হিন্দুরা, হিন্দু তার সদ্ব্যবহার করেছে পুরোপুরি, তার সেই সুযোগ-সুবিধার এতটুকু কমতি সে সইতে নারাজ, দেশের স্বাধীনতার নামে সে চায় তার চোখে চির-ঘৃণিত মুসলমানের উপরে সর্বময় কর্তৃত্ব, অস্পৃশ্যতাধর্মী হিন্দু স্বভাবত এত অনুদার যে, তার কাছ থেকে সুবিচারের আশা মুসলমান কোনো দিন করতে পারে না।

এইসব ধারণাকে আমরা অদ্ভুত বলেছি এসবে সত্যান্বেষণের অভাব অতিশয় স্পষ্ট বলে’। প্রাক্-ব্রিটিশ যুগেও বাজনা আর গো-হত্যা নিয়ে হিন্দু-মুসলমানে তুমুল দাঙ্গার বিবরণ ইতিহাসে রয়েছে;* কাজেই হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ ব্রিটিশোত্তর নয়, অবশ্য একথা যথার্থ যে সুপ্রাচীন হিন্দু-মুসলমান বিরোধের সুযোগ নিতে নতুন শাসকরা কসুর করে নি। কিন্তু তাদের তেমন তৎপরতা দেখা গেছে ভারতবাসীদের স্বাধীনতা-স্পৃহা দমনের কাজেও। তাতে যদি তারা বিফল হয়ে থাকে আর হিন্দুমুসলমানের বিরোধ বৃদ্ধির কাজে সফল হয়ে থাকে, তবে তাতেও প্রমাণিত হয় এই ব্যাধির প্রাচীনতাই।

[* ‘সিয়ারুল্-মোতাআখেরীন’ অথবা হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ’-প্রথম বক্তৃতা]

আর মুসলমানের সিদ্ধান্ত তো খুবই অদ্ভুত। অদ্ভুত ভাবে তারা ভুলে গেছে : এদেশে মুসলমানের আগমন প্রধানত বিজয়ী ও বিজয়ীদের অনুচর ও পার্শ্বচর রূপে-বিজেতা আর বিজিতদের মধ্যে সম্বন্ধ কোনো দিন মধুর হতে পারে না। এর উপর মুসলমানের চিত্ত হিন্দুর প্রতি বিশেষ ভাবে বিমুখ ছিল এই ধারণার প্রভাবে যে হিন্দুর কাফের অর্থাৎ মানুষের পূর্ণ অধিকার ভোগের অযোগ্য; মুসলমানদের মধ্যে এমন মনীষী ও সহৃদয় ব্যক্তির অভ্যুদয় হয়েছিল, যারা হিন্দুর প্রতি মুসলমানের চিত্তের এই অনুদারতা দূর করতে চেষ্টা করেছিলেন; মহামনীষী আলবেরুনী সেই প্রাথমিক যুগেই মুসলমানদের বলেছিলেন, ভারতের হিন্দু আরবের কাফেরের সমপর্যায়ভুক্ত নয়; কিন্তু আজ পর্যন্ত ভারতীয় মুসলমানের শ্রদ্ধার পাত্র আলবেরুনী ও আকবর তেমন নন যেমন সুলতান মাহমুদ ও আওরঙ্গজেব। এহেন অনাত্মীয় মুসলমানের প্রতি হিন্দুও যদি অনাত্মীয়ের মতো ব্যবহার করে থাকে তবে উদার তাকে বলা যায় না নিশ্চয়ই কিন্তু অস্বাভাবিক কেমন করে তাকে বলা যায়? এর উত্তরে এযুগের সচেতন মুসলমান হয়ত বলবে: যে কারণেই হোক হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি নেই, নতুন-করে যে তাদের মধ্যে প্রণয় হবে তারও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না-অতএব ভারত-ব্যবচ্ছেদ ও হিন্দু মুসলমানের পৃথক পৃথক বাসভূমিতে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বসবাস প্রশস্ত নয় কি?

এই গুরু সমস্যা সম্পর্কে আমাদের নিবেদন এই :

মুসলমান যদি সত্যই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে থাকে যে, যে কারণেই হোক হিন্দুর সঙ্গে তার মিল কোনো দিন হয়নি, কোনো দিন হবেও না; তবে তার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াই তাদের দুই পক্ষের জন্যই ভাল। কিন্তু বিচ্ছিন্ন তাকে হতে হবে ন্যায়ানুমোদিত ও সার্থক পথে, অর্থাৎ দেশকে বিভক্ত করতে হবে এমনভাবে যাতে কোনো পক্ষেরই বেশি ক্ষতি না হয়, আর দুই পক্ষেরই ভবিষ্যৎ যথাসম্ভব নিরাপদ হয়। বর্তমানে যে ব্যবচ্ছেদ মুসলমান চাচ্ছে তা যেমন অসঙ্গত তেনি বিপদসঙ্কুল, তার কারণ যে হিন্দুকে মুসলমান বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না, তারা প্রায় সমসংখ্যক রয়ে যাচ্ছে মুসলিম রাজ্যে। এর পরিবর্তে মুসলমানদের এমন বাসভূমির দাবি করা উচিত, যেখানে অমুসলমান প্রায় কেউ থাকবে না, যারা থাকবে তারা থাকবে বিদেশি হিসেবেই। সেজন্য মুসলমানদের চলে যাওয়া উচিত ভারতবর্ষের এক প্রান্তে-ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তই এজন্য প্রশস্ত মনে হয়, যারা পাকিস্তানের আদি উদ্ভাবয়িতা তারাও এই ক্ষেত্রের কথাই ভেবেছিলেন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের যত মুসলমান এই নূতন বাসভূমির বাসিন্দা হতে চাইবে, তাদের সবাইকেই সে সুযোগ দিতে হবে। মুসলমানের এমন সংকল্প যদি হিন্দু ও জগৎ জানতে পারে তবে এর প্রতি তারা শ্রদ্ধান্বিত হবে, মুসলমানের ঐকান্তিকতা ন্যায়পরাধ ও ত্যাগস্বীকার দেখে। এর জন্য যদি মুসলমানকে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে হয়, তবে সেটিও জগতের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করবে। বলা বাহুল্য কেবল এমন একটা চরম ব্যবস্থার দ্বারাই হিন্দু আর মুসলমানের দীর্ঘকালের বিবাদের একটা সন্তোষজনক অবসান সম্ভবপর। অন্য ব্যবস্থায় বিচ্ছেদ পূর্ণাঙ্গ হবে না, তাই সামান্য কারণে বিবাদের সম্ভাবনা যথেষ্ট রয়ে যাবে।

কিন্তু এমন চরম ব্যবস্থা কি ব্যাপকভাবে ভারতের মুসলমান কাম্য জ্ঞান করতে পারবে? মুসলিম নেতারা হিন্দু-মুসলমান বিরোধের যে ছবি দেশের সামনে ও জগতের সামনে তুলে ধরেছেন তা যদি সত্য হয়, তবে মুসলমানদের পারা উচিত কেননা অন্য কোনো প্রশস্ত পথ নেই। যদি সবাই না পারে তবে যারা পারে তারা গিয়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে স্বাধীন রাজ্য গড়ক। কিন্তু যারা পারবে না তাদের এর পরে আর হিন্দু মুসলমানের বিরোধের কথা মুখে আনা চলবে না, কেননা হিন্দু ও মুসলমানের অতীত যাইই হোক, বোঝা গেল মিলেমিশে না থেকে তাদের উপায় নেই। তাই এই মিলমিশের চর্চাই সম্মিলিত ভারতে করতে হবে একান্ত আন্তরিকতার সঙ্গে। হিন্দুর মুসলিম-বিদ্বেষ আর মুসলমানের হিন্দু-বিদ্বেষ, সেখানে শুধু নিন্দনীয় নয় দণ্ডনীয় বিবেচিত হবে। আর নতুন সম্মিলিত ভারত গঠিত হবে সাম্যবাদের ভিত্তির উপরে: ধর্ম হবে ব্যক্তিগত ব্যাপার, ভারতবর্ষের নব-নাগরিকদের জাতিধর্ম-নির্বিশেষে বুঝতে হবে। যে, তাদের প্রাচীন ধর্মের একালের অর্থ ব্যাপক মনুষ্যত্ব-সাধন, তাই ধার্মিক হবার জন্যে তারা ফিরে যেতে চেষ্টা করবে না কোনো অতীত ব্যবস্থার দিকে, তাদের গতি হবে নব নব জ্ঞান ও কল্যাণ আহরণের অভিমুখে-সমস্ত জগৎকে সব মানুষের জন্য স্বর্গে পরিণত করার কাজে: অতীতের কোনো ধর্ম-ব্যাখ্যা যদি এর পরিপন্থী হয়, বুঝতে হবে তা ভুল ব্যাখ্যা।

ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের কথা তেমন জানিনা, কিন্তু আমাদের এই বাংলা দেশের হিন্দু আর মুসলমান ভাবুকরা যে এই কাঙ্ক্ষিত পথেরই পথিক তার পর্যাপ্ত পরিচয় তারা দিয়ে গেছেন; অনেক মুসলমান যাঁকে গোঁড়া হিন্দু বলে জানে সেই বঙ্কিমচন্দ্রও সাম্যবাদী-হাশিম শেখ আর রামা কৈবর্তের দুঃখের সমঝদার। বাংলার মুসলমানেরা সেকালে ও একালে যতটুকু সার্থক সাহিত্য সৃষ্টি করতে পেরেছেন তারও অন্তরাত্মা আশ্চর্যভাবে উদার-প্রায় দেড় শত বৎসর পূর্বে আলি রাজা ওরফে কানু ফকির হজরত মোহাম্মদের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন :

মোর পরে পয়গম্বর না জন্মিব আর–
মোর পরে হইবেক কবি ঋষিগণ,
প্রভুর গোপন রত্নে বান্ধিবেক মন।
শাস্ত্র সব ত্যাগ করি ভাবে ডুষ দিয়া,
প্রভু প্রেমে প্রেম করি রহিবে জড়িয়া। (জ্ঞানসাগর)

আর মদন বাউলের এই গান তো বিখ্যাত :

ডুইবা যাতে অঙ্গ জুড়ায়
তাতেই যদি জগৎ পুড়ায়
তবে অভেদ সাধন মরল ভেদে।
প্রেম-দুয়ারে নানান তালা
কোরাণ পুরাণ তসবি মালা
হায় গুরু এ বিষম জ্বালা
কাইন্দা মদন মরে খেদে ।।

বাংলার মুসলমানের সৃষ্ট সাহিত্য সাধারণত আমাদের রাজনীতিকরা মূল্যহীন জ্ঞান করেন। বলা বাহুল্য তাদের এমন ধারণার মূলে তাঁদেরই অজ্ঞতা। বাংলার মুসলমান বাংলা সাহিত্যে যতটুকু সার্থক দান করতে পেরেছেন-মুসলমানের দানের পরিমাণ যে কম তা অনস্বীকার্য-তা বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ অংশের সঙ্গে তুলনায় কিঞ্চিৎ স্বল্পমূল্য বিবেচিত হতেও পারে, কিন্তু যে সাহিত্য নিয়ে আমাদের রাজনীতিকদের গর্ব, সেই উর্দু-সাহিত্যের সঙ্গে তুলনায় তা স্বল্পমূল্য নয়-বিশেষ করে গদ্যে। কাজী ইমদাদুল হকের ‘আবদুল্লাহ’ মাহবুব-উল আলমের ‘মো’মেনের জবানবন্দী’ এমন কি আবদুর রউফের ‘পথের ডাকে’-র মতো সমাজ-চিত্র ও জীবনালেখ্যর গৌরব উর্দু-সাহিত্য আজো করতে পারে কিনা সে সন্ধান আমাদের রাজনীতিকদের নেওয়া উচিত।

বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য সৃষ্টি সম্পর্কে আমাদের নবনেতারা হয়ত বলবেনঃ বাংলার মুসলমানেরা যে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, তার অন্য মূল্য যাই থাকুক ইসলামের আদর্শ তাতে তেমন প্রতিফলিত হয়নি, সেইজন্য সে সাহিত্যের কথা বিস্তৃত হয়ে বাংলার মুসলমানকে আত্মনিয়োগ করতে হবে ইসলাম-প্রভাবান্বিত সাহিত্য সৃষ্টি করতে। এর উত্তরে আমাদের বক্তব্য : সাহিত্য ফরমাসে গড়া যায় না, ফরমাসে যা গড়া যায় তা বড়জোর সাংবাদিকতা। ইসলাম ও মুসলমানের প্রভাবে অতীতে বিভিন্ন দেশে যেসব সাহিত্য গড়ে উঠেছিল, সেসবের কথাও এই নেতাদের একটু ভাবা। দরকার। ইরানের মুসলমানেরা যে সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন জগৎ তার মূল্য দিয়েছে, কিন্তু আমাদের নবনেতারা যাকে ইসলামী আদর্শ বলতে চান-তাদের ধারণা অবশ্য বিচারসাপেক্ষতার সাক্ষাৎকার সেখানে পুরোপুরি মিলবে না। উর্দু-সাহিত্যে গালেব অমর কাব্য সৃষ্টি করে গেছেন, তাও যে যথেষ্ট ইসলামী’ নয় তা জানা কথা। আমাদের নবনেতারা হয়ত খুশি একমাত্র ইকবালের উপরে। কিন্তু সত্যই কি তারা তার অভিনিবিষ্ট পাঠক? তার যে এইসব বাণী :

কাফেরে বেদার-দিল্ পেশে সনম্
বেহ্ যে দীদারে কে খু আন্দর হরম্
প্রতিমার সামনে জাগ্রতচিত্ত কাফের
উৎকৃষ্টতর সেই নিষ্ঠাবান মুসলমানের চেয়ে যে ঘুমিয়ে কাবার মধ্যে

তার ইঙ্গিত সত্যই কি তারা বোঝেন? সন্দেহ হয়। বুঝলে তাদের মুখে এত হিন্দু নিন্দার খৈ ফুটতো না। তা ইকবালের মূল্য ও মর্যাদা নিরূপণ এত শীগগির সম্ভবপর নয়। হতে পারে এই অসাধারণ মুসলমান পণ্ডিত ও কবির পাশে আমাদের বন্য নজরুল কালের দরবারে হীনপ্রভ হবেন না।

‘ইসলাম ও মুসলমানের প্রভাবে বিভিন্ন পরিবেশে যখন বিভিন্ন ধরণের ভাবধারার ও সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে, তখন স্বভাবতই বাঙালি মুসলমানের সার্থক সৃষ্টি বিশেষ শ্রদ্ধারই যোগ্য। যারা ফরমাস দিয়ে সাহিত্য গড়তে চান, তারা সে চেষ্টা করে দেখুন। ব্যর্থ তারা হবেনই তা না বললেও চলে, কেননা সাহিত্য সমষ্টির সামগ্রী হলেও বিশেষভাবে তা ব্যক্তির যে ব্যক্তি সমষ্টির সঙ্গে একান্ত যুক্ত হয়েও অনুভব করতে পেরেছে তার অন্তরাত্মার বীর্যবন্ত স্বাধীনতা। সাহিত্যিক বিশেষ আদর্শের প্রেমিক হতে পারেন, কিন্তু কোনো আদর্শেরই দাস হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভবপর নয়।

বাঙালি মুসলমানের চিত্ত বাংলা সাহিত্যে যে বিশেষ রূপ পেয়েছে, তার সুপরিচিত নাম বিকাশধর্মী মানবতা। বলা বাহুল্য বাংলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক সৃষ্টিরও এই রূপ। আর সেই জন্যই বাংলার হিন্দু-মুসলমানকে বিচ্ছিন্ন করার কথা যথেষ্ট ধীরতার সঙ্গে ভাবা দরকার। আমার বলবার মতলব এ নয় যে, বাংলার মুসলমানের অথবা হিন্দুর আর কোনো সার্থক রূপ সম্ভবপর নয়। কিন্তু যারা একবার উদার মানবতার স্বাদ পেয়েছে তাদের কোনো গণ্ডীতে সার্থকভাবে বন্ধ করা যে কঠিন তা যথার্থ। আমাদের নব নেতাদের গভীর ভাবেই ভাবা উচিত বাংলার মুসলমানের সঙ্গে পাঞ্জাবের মুসলমানের অঙ্গাঙ্গী যোগ ঘটাতে গিয়ে, দুয়েরই বিকাশ ব্যাহত করার মতো মহা অনর্থ তারা ঘটাবেন কি না। এর উপর রয়েছে বাংলার বিশেষ ভৌগলিক অবস্থিতি-বাংলার অতিগুরু নদনদী-সমস্যা, যার দিকে মহাপ্রাণ আবুল হুসেন বিশ বৎসর পূর্বে দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, বাংলার বৈজ্ঞানিকেরাও যার দিকে দেশের শাসক ও জনসাধারণ সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ত্রুটি করছেন না। এই একটি সমস্যাই হয়ত দেশের সর্বসাধারণকে দেখিয়ে দেবে, হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের মতো তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে যারা এতটা সময় ব্যয় করতে পারে তারা কত বড় কৃপার পাত্র।

নাৎসীবাদ ও বলশেভিকবাদের সামগ্রিকতা একালে ব্যাপকভাবে মানুষের চিত্ত আকৃষ্ট করেছে। আমাদের দেশের নবনেতারাও যে এসবের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন তা বোঝা কঠিন নয়। ইসলামের নব রাষ্ট্রিক রূপের কথা যারা ভাবছেন, তাদের কেউ কেউ যে বিশেষ প্রেরণা পেয়েছেন নাৎসীবাদ থেকে F. K. Khan-কৃত নবপ্রকাশিত “A Plan of Muslim Educational Reform গ্রন্থে রয়েছে তার এক সুস্পষ্ট পরিচয়। আমাদের চোখে এটি দোষের নয় কেননা আমাদের ধারণা, মানুষ কোনো অতীত আদর্শের দিকে ফিরে যেতে পারে না, সে চেষ্টা করতে গিয়ে সে বরং বেশি করে অগ্রসর হয় কোনো সমসাময়িক আদর্শের দিকেই-যেমন বঙ্কিমচন্দ্র প্রাচীন হিন্দুত্বের মহিমা কীর্তন করতে গিয়ে প্রকৃত প্রস্তাবে জয় ঘোষণা করেছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর স্পেনসার কৎ ও সাম্যবাদীদের চিন্তাধারারই। একালের বিদ্বান্ ও বুদ্ধিমান মুসলমানও যে প্রাচীন ইসলামের জয় ঘোষণা করতে গিয়ে প্রকৃত প্রস্তাবে জয়ঘোষণা করবেন, সমসাময়িক প্রবল নাৎসীবাদের অথবা বলশেভিকবাদের তাও কতকটা অপরিহার্য। কিন্তু ইয়োরোপের এইসব মতবাদ বা ব্যবস্থা আমাদের দেশে পত্তন করতে গিয়ে নেতাদের ভাবা উচিত সাফল্যের সম্ভাবনা তাঁদের কতখানি। জার্মানীর সুদীর্ঘ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনার কথা, তার সঙ্ঘবদ্ধতার কথা, সুবিদিত। সেই বিরাট সাধনা-সমম্বিত জাতিকে হিটলার ও তাঁর সহকর্মীরা নিয়োজিত করেছিলেন, পৃথিবীর উপরে প্রাধান্য লাভের কাজে-যেমন প্রাধান্য লাভ হয়েছে, অথবা হয়েছিল, ইংরেজের। নাৎসীদের বিরাট কর্মশক্তির দিকে চেয়ে বিস্ময়বিমুগ্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভাবা দরকার জার্মান জাতির সেই অতীত সাধনার ব্যাপার। কিন্তু আমরা নাৎসীদের অনুকরণে নিয়োজিত করেছি কাদের? যারা জীবনের সর্বক্ষেত্রে সাধনাহীন। তাই সিদ্ধি যদি আমাদের তিতুমিরের বাঁশের কেল্লার মতনই হয়, তবে আশ্চর্য হবার কিছুই থাকবে না। নাৎসী আদর্শের চেয়ে বলশেভিক আদর্শের বরং আমাদের দেশে বেশি কার্যকর হবার সম্ভাবনা, কেননা মানবতার দাবি বলশেভিক আদর্শে বেশি স্বীকৃত হয়েছে, জগতের বঞ্চিতদের পক্ষ সমর্থন তাতে বেশি আছে বলে তা জগতের মানুষের হৃদয়ের উপরে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও আমাদের ভাবা দরকার যে রুশজাতি এই মতবাদ সার্থক করে তোলার ভার নিয়েছে তাদের দুর্ধর্ষতার কথা, তাদের অপূর্ব সাহিত্য সম্পদের কথা। আমাদের জবরদস্ত বন্ধুদের কাছে তাই আমাদের পরম বিনীত নিবেদন: ধীরে বন্ধু ধীরে। নগরকে আলোক-মালায় উজ্জ্বল করা আর তাতে অগ্নিকাণ্ড ঘটানো এক কথা নয় কোনদিন। অগ্নিকাণ্ড অল্পকালেই ঘটানো যায় সন্দেহ নেই, কিন্তু আলোক-মালায় সজ্জিত করার জন্য তাই পর্যাপ্ত আয়োজন।

সূচনায় যে বন্ধু আমাদের জন্য বিধান করেছিলেন অজ্ঞাতবাস আর আমাদের বাণীর জন্য তুহিন-শয্যাবরণ আমাদের সাগ্রহ বাগ্‌বিস্তার দেখে হাসি চাপা তার পক্ষে কঠিন হচ্ছে। তাই তাঁর নির্দেশ এইবার শিরোধার্য করা যাক। তা নির্বোধ তিনি আমাদের যত ভাবুন থামবার আগে তাকে না শুনিয়ে পারবো না প্রেমপন্থীদের গুরু হাফিজের এই বাণী :

হরগিয ন মীরদ আঁ কে দিলশ যিন্দা ব-ইশক।
সবতাসত বর যরিদায়ে আলম দায়ামে মা ॥
প্রেমে যাদের চিত্ত সঞ্জীবিত তারা কখনো মরবে না।
আমাদের চিরন্তন হয়ে থাকবার দাবি জগতের পটে লেখা হয়ে গেছে ॥

৪ঠা মে, ১৯৪৬

কবিগুরু স্মরণে

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ আর ইহ জগতে নন।

যাকে বলা হয় ইন্দ্রপতন রবীন্দ্রনাথের তিরোধান তেমুনি একটি ঘটনা-শুধু বাংলার জন্য নয়, শুধু ভারতের জন্য নয়, সমগ্র জগতের জন্য। প্রতিভাবান হিসেবে সুনিবিড় শ্রদ্ধা আর মানব-বন্ধু হিসেবে অকৃত্রিম প্রীতি আজ তাঁর জন্য সমস্ত জগতের অন্তরে স্বতঃ-উৎসারিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা-অভ্রংলিহ আর বিচিত্ৰশীর্ষ, সমসাময়িক জগতে এর তুলনা নেই। নিকট অতীতের দিকে তাকালে এমন আর দুটি বিস্ময় চোখে পড়ে-পঞ্চদশ মোড়শ শতাব্দীর লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, আর অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর গ্যেটে। শুধু অতুলনীয় প্রতিভা নিয়ে নয়, অতুলনীয় দৈহিক সৌন্দর্য নিয়েও এরা আবির্ভূত হয়েছিলেন; যার গুণে এদের ব্যক্তিত্ব হতে পেরেছিল দেবদুর্লভ।

কুৎসিত সাপের মাথায় কখনো কখনো শোভা পায় অতুল্য মণি। দুর্দৈবও দুর্বুদ্ধি লাঞ্ছিত একালের বাংলায় পরমসুন্দর রবীন্দ্রনাথকেও মনে হতে পারে অদ্ভুত। বাস্তবিক রবীন্দ্রনাথের যে অনুভূতি, বুদ্ধি ও রুচি বাংলার জীবন-ধারায় তা অদ্ভুত ও আকস্মিক,

সুসঙ্গত ও শোভন, সেই উত্তর বাংলার নরনারীর নিজেদের কাছে ও জগতের কাছে দেবার আছে। এ এক কঠিন দায়িত্ব সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথকে ঘরের ছেলে রূপে পাবার সৌভাগ্য যাদের লাভ হয়েছিল, এই কঠিন দায়িত্ব সহজ ভাবে বহন করবার মহত্তর সৌভাগ্যও তাদের লাভ হবে এ আশায় আশান্বিত হওয়া যাক।

বাংলার এক মহৎ ভাব-সাধনার ধারায় রবীন্দ্রনাথের জন্ম একালের দুর্দশাগ্রস্ত বাঙালির সেকথা স্মরণ করবার আছে। রামমোহন থেকে সুরেন্দ্রনাথ-চিত্তরঞ্জন পর্যন্ত সেই ধারা বিচিত্র ভঙ্গিতে নিজেকে প্রকাশ করেছে। আজ বাঙালির জীবনে সেই ধারা ক্ষীণশক্তি ও হতশ্রী। জোয়ার ভাটা জগতের নিয়ম। বাঙালির জীবনে আবার জোয়ার চাই। নইলে যত আবর্জনা তার জীবনে স্থূপীকৃত হয়েছে, কেমন করে সেসব নিশ্চিহ্ন হবে? কেমন করে আবার বাঙালির জীবনে সৌন্দর্য জাগবে?

প্রতিভা, স্বাস্থ্য, সঙ্গতি ও আয়ু, ভাগ্য এর কিছু থেকেই তাঁকে বঞ্চিত করে নি, এই সুযোগের সদ্ব্যবহারও তিনি পূর্ণভাবে করে গেছেন। বিরাট সাহিত্য ও শিল্প আর বিপুল সদনুষ্ঠান তিনি জাতিকে উপহার দিয়ে গেছেন। সেই উপহারের মর্যাদা উপলব্ধির সংকল্প জাতির জীবনে নূতন জোয়ারের সূচনা করবে। কিন্তু আমাদের ভাবুক ও কর্মী কারো এ বিষয়ে আজ ভুল না হোক যে, শুধু তপস্যার দ্বারাই তপস্যার দান গ্রহণ করা যায়।

রবীন্দ্রনাথ বার বার বলেছেন তিনি কবি। তাঁর ভক্তরা পরম যত্নে বার বার তার জন্য গুরুর আসন রচনা করেছেন। সে আসন তিনি যে কখনো গ্রহণ করেন নি তা নয়। তবু বার বার তিনি বলেছেন তিনি কবি-কবি ভিন্ন আর কিছু নন। তার এই গভীর উক্তির তাৎপর্য তাঁর অনুরাগীদের বুঝতে হবে, বিশেষ করে দেশের ভাবুক ও কবি সাহিত্যিকদের। কবি কে? যিনি কথার সঙ্গে কথা গাঁথার দক্ষতা অর্জন করেছেন? কখনো নয়। কবি তিনি যিনি সচেতন-মনে এবং দেহে। এই কবিত্বের পরম পূর্ণ বিকাশ যেন রবীন্দ্রনাথে-পায়ের নখ থেকে মাথার চুলের আগা পর্যন্ত তিনি সচেতন। পরিণত যৌবনে প্রতিভার লক্ষণ সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন–

অলৌকিক আনন্দের ভার
বিধাতা যাহারে দেয় তার বক্ষে বেদনা অপার–
তার নিত্য জাগরণ; অগ্নিসম দেবতার দান
ঊর্ধ্বশিখা জ্বালি চিত্তে অহোরাত্র দগ্ধ করে প্রাণ…

এই জাগরণের শিখা দীপ্তি পেয়েছিল তাঁর সমগ্র জীবনে। এর দীপ্তিতে তার কাছে প্রকাশিত হয়েছিল জীবনের রহস্য আর মর্যাদা, আর যে জাতির কোলে তাঁর জন্ম। হয়েছিল তার ঘৃণিত দুর্গতি। শুধু নিমতলার শ্মশানে নয় সারা জীবন এই জাগরণের শিখায় তিনি দগ্ধ হয়েছিলেন।

এই নিত্য-জাগরণ মন্ত্রে, এই পরম কবিত্বে, দীক্ষিত হয়ে তবেই বাঙালি রবীন্দ্রনাথের ভাব ও কর্মের উত্তরাধিকার গ্রহণ করুক। তাহলে সে ধন্য হবে-তার ঘরে রবীন্দ্রনাথের জন্ম একটি অর্থপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা হবে।

তোমার পতাকা যারে দাও
তারে বহিবারে দাও শকতি।

১৩৪৮

কাব্যের সঙ্গে জীবনের কি সম্পর্ক?

মোটামুটিভাবে এর দুটি উত্তর দেওয়া হয়েছে। প্রথম উত্তরটি এই ধরণের : জীবন। দুঃখময়, সেই দুঃখের মরুভূমিতে কাব্য একটুখানি মরূদ্যান। অল্পক্ষণের জন্য হলেও জীবন-পথিক এই মরূদ্যানে যে আরামটুকু পায় বাস্তবিকই তা দুর্লভ :

‘এক লহমা সময় আছে সর্বনাশের মধ্যে তোর
ভোগ-সায়রে ডুব দিয়ে কর শেষ নিমেষটা নেশায় ভোর।’

আর দ্বিতীয় উত্তরটি হচ্ছে এই: জীবনে দুঃখ ঢের তাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই। তবু জীবন দুঃখময় একথা বলতে মানুষের অন্তরাত্মায় বাজে।

যারা আসে যায় হাসে আর চায়
পশ্চাতে যারা ফিরে না তাকায়
নেচে ছুটে ধায় কথা না সুধায়,
ফুটে আর টুটে পলকে–
তাহাদেরি গান গা’রে আজি প্রাণ
ক্ষণিক দিনের আলোকে….

এ শুধু কবির কথা নয়, মরণশীল ও দুঃখাহত মানুষেরই মনের একটি গোপন কথা। দুঃখের চেয়ে আনন্দ মানুষ যদি জীবনে বেশি অনুভব না করতো, তবে সংসার এতদিনে শ্মশান হয়ে যেত। এই যে জীবনে বিশ্বাস, মানুষের অন্তরতম আশাবাদিতা, এরই পরমমনোহর প্রকাশ কাব্যে। কবির কাজ, দুঃখ, বিপর্যয়, মৃত্যু, এই সমস্তের মাঝে দাঁড়িয়ে বারবার এই কথা ঘোষণা করা–

হবে হবে হবে জয় হে দেবী করিনে ভয়, হবো আমি জয়ী।

আমাদের দেশের প্রাচীন কাব্যের যে ধারা, অর্থাৎ সংস্কৃত কাব্যের যে ধারা, তাতে প্রথম মতবাদটির প্রভাব কিছু বেশি; অন্তত সংস্কৃত-রসশাস্ত্রের উপরে যে এই জীবন দর্শন প্রভাবশীল হয়েছে এ কথা সত্য।

অপর পক্ষে ইয়োরোপীয় কাব্যে, বিশেষত ইয়োরোপীয় রেনেসাঁসের পরের কাব্যে, দ্বিতীয় মতবাদটি যে প্রভাবশীল হয়েছে তা সহজেই চোখে পড়ে। তাই অল্পকালের ব্যবধানে সাহিত্যের আকৃতি ও প্রকৃতির যত পরিবর্তন সেখানে ঘটেছে তা বিস্ময়কর।

রবীন্দ্রনাথ পরম সৌন্দর্যেপাসক কবি। একটি দুর্দশাগ্রস্ত জাতির কোলে জন্মলাভ করেও সৌন্দর্যের যে অপূর্ব ধ্যানে তার জীবন কেটেছে, সৌন্দর্যের যত বিচিত্র রূপ তাঁর সুরে ও ছন্দে ধরা পড়েছে,তা’ ভাবলে সহজেই মনে হতে পারে, দুঃখ ও ব্যর্থতাময় জীবন এড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ এক শান্তিস্বর্গ রচনা করতেই চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রকাব্যে যারা এইরূপ সৌন্দর্য ও শান্তি অম্বেষণ করেন, আমাদের সাহিত্যরসিকদের মধ্যে তাদের সংখ্যা কম নয়। তবু একথা বুঝবার আছে যে, রবীন্দ্রনাথ এই শ্রেণীর শান্তি ও সৌন্দর্যকামী কবি মুখ্যত নন, যারা জীবনের জয়গানের কবি তাঁদেরই দলে তাঁর আসন।

রবীন্দ্রনাথের সেই জয়গান হচ্ছে একালের ভারতীয় জীবনের জয়গান। তাই তার সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, তিনি একালের ভারতীয় রেনেসাঁসের (নব জন্মের) কবি, তা অতি যথার্থ কথা। এ কালের ভারতীয় জীবনের যত দুঃখ, যত সঙ্কট সে-সবের কিছুই তার দৃষ্টি ও অনুভূতির প্রহরা এড়ায়নি; এ সম্পর্কে কোনো সত্যকেই-যত অপ্রিয়ই হোক, তিনি উপেক্ষা করেন নি। তাঁর চিত্তের যে অপূর্ব সন্ধানপরতা, তার নিগূঢ় যোগ যে একালের এই ভারতীয় জীবনের সঙ্গে, তাঁর সুবিখ্যাত ‘বর্ষশেষ’ কবিতায় রয়েছে। তার এক প্রকৃষ্ট প্রমাণ। যে নবপ্রেরণার ফলে কবির অতীত জীবন “ধূলিসম তৃণসম”

“নিষ্ফল” হয়ে যাচ্ছে, সেই প্রেরণায় কবি চাচ্ছেন দেশের ‘পঙ্ক-কুণ্ড হতে’ ‘শুধু দিন যাপনের, শুধু প্রাণধারণের গ্লানি হতে’ উদ্ধার পেতে। দেশের জন্য তাঁর এই অসীম বেদনা, তার নৈবেদ্যের বহু কবিতায়ও অপূর্ব ভঙ্গিতে ব্যক্ত হয়েছে:

“আছ তুমি অন্তর্যামী এ লজ্জিত দেশে”…
“আদেশ তোমার পড়ে থাকে আবেশে দিবস কাটে তার”

এই সমস্ত কথার অন্তরে দেশের দুর্দশার জন্য এই পরমসৌন্দর্যেপাসক কবির যে কি মর্মান্তিক দুঃখ লুক্কায়িত রয়েছে তা অনুভব করা কঠিন নয়।

বহু পূর্বে কবি গ্যেটে বলেছিলেন, “যা প্রকৃতিতে মহৎ’তা’ ঘটে প্রকৃতির নিয়মেই, আকস্মিকভাবে নয়। মানুষেরও যা শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য-সৃষ্টি, সেসবও ঘটে স্বভাবের নিয়মে, অদ্ভুত বা আকস্মিকভাবে কখনো নয়। যা অদ্ভুত ও আকস্মিক তা নিতান্তই স্বল্পায়ু। জগত শাসিত হচ্ছে প্রয়োজনের দ্বারা, বিধাতুবিধানের দ্বারা।” অপরূপ রবীন্দ্রপ্রতিভাও একালের ভারতীয় জীবনের জন্য সেই প্রয়োজন, সেই ‘বিধাতৃবিধান’। এই দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রপ্রতিভার দিকে তাকালে, তার এত বড় প্রাণবত্তা চোখে পড়ে যে, আমাদের সমস্ত ব্যর্থতাবোধ যেন মুহূর্তে অন্তর্হিত হয়ে যায়। তখন মনে হয়, ভারতের যুগ যুগান্তরের আবর্জনাস্তূপে যখন এত বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, তখন নিরুৎসাহ হবার কিছুই তো নেই। শুধু দেখবার আছে-কোনো অনবধানতায় এই দিব্য অগ্নিশিখা জাতির অন্তরে যেন স্তিমিত হয়ে না আসে।

ফুলের যত শোভাসৌগন্ধ তা’ বৃন্তের উপরে বিন্যস্ত হয়ে; শিল্পের অসাধারণ সৌন্দর্যও শিল্পীর অসাধারণ বীর্যবত্তারই অন্য নাম। দুর্ভাগ্যক্রমে শিল্পরসিকদের এ বিষয়ে বারবার ভুল হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য-বোধ ও বীর্যবত্তা উভয়েরই এমন পর্যাপ্ত প্রকাশ তাঁর সৃষ্টিতে ঘটেছে যে তাঁর অনুরাগীদের এবিষয়ে ভুল হওয়া বাস্তবিকই একটি অপরাধ। রবীন্দ্রনাথের যে সৌন্দর্যসাধনা, অপরূপ নিঃসঙ্গতা-প্রীতি,* মনে হয়, তার মর্যাদা উপলব্ধির সময় তার নির্বীর্য দেশবাসীদের জন্য এখনো বহু দূরে। জীবনের যে শ্রেয়ঃ-পস্থার নির্দেশ তিনি দিয়ে গেছেন, ‘আবেশে’র জড়তা পরিহার করে ‘আদেশ পালনে উন্মুখ হতে বলেছেন, শ্রদ্ধান্বিত অন্তরে সেই পথের পথিক হয়ে তবেই তাঁর দেশবাসী তাঁর অপরূপ ও অতুল্য সৃষ্টির উত্তরাধিকার গ্রহণ করার যোগ্য হবে।

১৩৪৮

[* দ্র: রবীন্দ্রনাথের গান]

রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান-সমাজ

আজকার দিন বাংলাদেশের পক্ষে যে এক দুর্দিন, সে-কথা অনেকেই বলে থাকেন। হয়ত মিথ্যা বলেন না। এমন একটা সাম্প্রদায়িক মনোমালিন্য অবিশ্বাস, এমনকি শত্রুতা, আজ বাংলার আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে যে, এই পরিমণ্ডলে বাস করা ভদ্ৰব্যক্তিদের পক্ষে রীতিমত কষ্টকর হয়ে উঠেছে। তবে আর একদিক দিয়ে দেখতে গেলে বর্তমানের এই অস্বস্তিকর অবস্থা মনে হয় ভালই। ফোঁড়া যখন পেকে ওঠে তখনকার যন্ত্রণা অসহ্য, কিন্তু সেই সঙ্গে সান্ত্বনাও পাওয়া যায় যে, বেদনার অবসান হতে দেরী হবে না।

এই দিনে কোনো কোনো শিক্ষিত মুসলমান বাঙালির মুখেও শুনতে পাওয়া গেছে। এই প্রশ্ন ও রবীন্দ্রনাথ একজন অতি বড় কবি, মহামানব, বিশ্ব-প্রেমিক, কিন্তু তাঁর বাড়ির কাছের মুসলমানদের জন্য তিনি কি করেছেন?

এরূপ প্রশ্ন বহুবার আমাকে শুনতে হয়েছে। কিন্তু একবার একজন শ্রদ্ধেয় মুসলিম সাহিত্যিক এ প্রশ্নের উত্তরে যা বলেছিলেন, তা মনে রাখবার মতো; তিনি বলেছিলেন? আকাশের সূর্য মুসলমানদের জন্য বিশেষ কি করেছে? [‘আমাদের দুঃখ’-প্রণেতা আনোয়ারুল কাদীর]

রবীন্দ্রনাথের এই ধরণের সমালোচকদের উক্তির এইই হয়ত শ্রেষ্ঠ প্রত্যুত্তর। কবি আকাশের সূর্যের মতোই একজন সহজ মানববন্ধু। অবশ্য যেহেতু কবি একজন মানুষ, এক বিশেষ পরিবেষ্টনের সৃষ্টি, সেজন্যে অত্যন্ত কাছে থেকে তাঁকে দেখতে গেলে তাঁর সত্যিকার পরিচয় না পাওয়াই স্বাভাবিক। অত্যন্ত খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে আলোকের উৎস সূর্যেও ধরা পড়ে কালো দাগ। যে গোলাপ সৌষ্ঠবে আর গন্ধে অতুলনীয় তার স্পর্শলোভাতুর লাভ করে হাতে কাটার আঘাত। কিন্তু কালো দাগ সত্ত্বেও সূর্য সূর্যই। কাঁটা সত্ত্বেও গোলাপ গোলাপই। এক বিশেষ পরিবেষ্টনে জন্ম সত্ত্বেও কবি চিরন্তন মানব-তাঁর পরিবেষ্টনের সমস্ত সীমারেখা অবলীলাক্রমে অতিক্রম করে তাতে উৎসারিত হয় মানুষের চিরন্তন সুখ, চিরন্তন দুঃখ, চিরন্তন প্রেম, চিরন্তন অভয়। যেহেতু রবীন্দ্রনাথ কবি এবং যেহেতু মুসলমান মানুষ, সেজন্যে মুসলমান তার আজকার বিশেষ ঐতিহাসিক বিবর্তনের প্রভাবে বুঝুক আর নাই বুঝুক, রবীন্দ্রনাথ বাস্তবিকই তার পরম বন্ধু ব্যতীত আর কিছু নন।

কিন্তু চিরন্তন যদি সত্য হয়, যা স্থানিক ও কালিক তাও তো মিথ্যা নয়। আজকার এই বিশেষ যুগে যদি কবি রবীন্দ্রনাথের মুসলিম দেশ-ভ্রাতাদের মনে এই অকরুণ প্রশ্ন জেগে থাকে যে তিনি তাদের কোন্ কাজে লেগেছেন, তবে সত্য-জিজ্ঞাসুকে সে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়।

এই প্রশ্ন রবীন্দ্রনাথের মুসলমান প্রতিবেশীর মনে জেগেছে প্রধানত দু’টি কারণে, প্রথমত, রবীন্দ্রনাথ শুধু বিশ্বকবি নন, বিশেষভাবে একজন ভারতীয় কবিও বটে। সেই ভারতীয়তার রূপ দান করতে গিয়ে প্রাচীন হিন্দু-সভ্যতা ও সংস্কৃতির বহু মনোরম চিত্রও তিনি অঙ্কিত করেছেন; তাঁর সেই সব সৃষ্টি হিন্দুকে শুধু আনন্দিতই করেনি, গর্বিতও করেছে।

দ্বিতীয়ত, মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিগত বিরূপতা না থাকলেও এমন কি অম্লাধিক অনুরাগ সত্ত্বেও, সেই সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে তিনি প্রায় মৌনই রয়েছেন তাঁর সুদীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে।

খুব সহজভাবে এই ব্যাপারের এই ব্যাখ্যা দেওয়া যায় যে, শিল্পীর তুলিকার অবলম্বন হয় যে সমস্তের সঙ্গে তাঁর বিশেষ পরিচয় হয় সেইসব। হয়ত তাঁর প্রতিদিনের পরিচিত মুখ তার তুলিকায় ধরা পড়ে না, কিন্তু ক্ষণিকের দেখা এক আধ-পরিচিত মুখ তার অন্তরে চাঞ্চল্য জাগায় দীর্ঘ দিন ও দীর্ঘ রাত্রি। শিল্পীর এই পক্ষপাতের তত্ত্ব দুরভিগম্য। কিন্তু হয়ত প্রশ্ন হবে, রবীন্দ্রনাথ তো শুধু শিল্পী নন, তিনি একজন শ্রেষ্ঠ জীবন-সমালোচক। সেক্ষেত্রে তাঁর দেশবাসী মুসলমান সম্পর্কে তার প্রায়-তুষ্টীভাব অদ্ভুত নয় কি?

এ প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথের একদল অনুরাগী এই কৈফিয়ৎ দিয়ে থাকেন, যে মুসলমান সাধারণত সমালোচনা-অসহিষ্ণু। এরূপক্ষেত্রে আলোচনা বা সমালোচনার পক্ষে যে অবাঞ্ছিত কলহ অপরিহার্য, রবীন্দ্রনাথের রুচি তাঁকে সেপথ থেকে প্রতিনিবৃত্ত করেছে। কিন্তু এই কৈফিয়ত বড় দুর্বল। রবীন্দ্রনাথ হিন্দুর সমালোচনাও কম করেননি, এবং সে-ক্ষেত্রে অপ্রীতিকর কলহ তিনি যে এড়িয়ে যেতে পেরেছেন ঠিক তা নয়। হয়ত তিনি এড়িয়ে যেতে চানও নি, চাইলে এই বাণী তাঁর জন্য অসত্য হত

যেন রসনায় মম
সত্য বাক্য বলি’ উঠে খর খড়গ সম…

বস্তুত তার দেশবাসী মুসলমান সম্পর্কে তিনি যে কম আলোচনা করেছেন তা নয়। অন্তত, তিনি যে আলোচনা করেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমান ধর্মের প্রতি অথবা পরধর্মের প্রতি তার যে-শ্রদ্ধা ব্যক্ত হয়েছে তার সতী’ নাটিকায় তুলনাহীন। ভারতের মুসলমান শাসনের দোষ ও গুণ দুই-ই তাঁর আলোচনার বিষয় হয়েছে। [দ্র: আত্মশক্তি ও আধুনিক সাহিত্য।] বিশেষত ভারতীয় মুসলমানের সঙ্গে ভারতবর্ষের বাইরের মুসলমানের পার্থক্য কোথায় এবং ভারতীয় মুসলিম জীবনের সত্যিকার পরিণতি কোন পথে সে-সম্বন্ধেও স্পষ্ট ভাষায় তিনি তাঁর মতামত প্রকাশ করেছেন। [দ্র: আত্মপরিচয় ও পরিচয়।] তাঁর এই সব মত স্বীকার্য কি অস্বীকার্য তার চেয়েও বড় কথা এই যে সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েই তিনি এসব মতামত ব্যক্ত করেছেন।

অবশ্য মুসলমানের ধর্ম বা ধর্ম-প্রবর্তক সম্বন্ধে কোনো বিস্তৃত আলোচনা তিনি করেন নি। কিন্তু বিস্তৃত আলোচনা কোনো ধর্ম সম্পর্কেই তিনি করেন নি। তিনি যে কবি-জগতের প্রাত্যহিক জীবনের সাহচর্য আর আত্ম-অনুভূতি এই-ই যে তার জীবনের রাজপথে বোধের সঞ্চার তাতে হয়েছিল তার প্রথম যৌবনে, আর এই স্বধর্ম থেকে তিনি বিচ্যুত হন নি কখনো। একজন ব্রাহ্মনেতার সন্তান হয়ে তিনি জন্মলাভ করেছিলেন, কিন্তু তার সেই পিতৃধর্মও তার জন্য হয়েছিল এক প্রেরণার স্থল, পরিক্রমণের স্থল নয়। এসম্বন্ধে তার এই উক্তি স্মরণীয় :

…ধর্মসম্প্রদায় ব্যাপারটাকে আমরা কী চোখে দেখিব? তাহাকে এই বলিয়াই জানিতে হইবে যে, তাহা তৃষ্ণা মিটাইবার জল নহে, তাহা জল খাইবার পাত্র। সত্যিকার তৃষ্ণা যাহার আছে, সে জলের জন্যই ব্যাকুল হইয়া ফিরে, সে উপযুক্ত সুযোগ পাইলে গঙুষে করিয়াই পিপাসা নিবৃত্তি করে। কিন্তু যাহার পিপাসা নাই সে পাত্রটাকেই সবচেয়ে দামি বলিয়া জানে। সেই জন্যই জল কোথায় পডিয়া থাকে, তাহার ঠিক নাই, পাত্র লইয়া বিষম মারামারি বাধিয়া যায়। তখন যে-ধর্ম বিষয়বুদ্ধির ফাস আলগা করিবে বলিয়া আসিয়াছিল, তাহা জগতে একটা নূতনতর বৈষয়িকতার সূক্ষ্মতর জাল সৃষ্টি করিয়া বসে, সে-জাল কাটানো শক্ত। [দ্র: চারিত্রপূজা]

রবীন্দ্রনাথের নিজের ভিতরে সত্যের জন্য এই যে সহজাত তৃষ্ণা ছিল, এই জন্যই হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান সব সমাজেরই সত্যিকার ধর্ম-জিজ্ঞাসুদের তিনি পরম বন্ধু, তা তিনি সেই সমস্ত ধর্মের বিশেষ আলোচনা ও অনুশীলন করুন আর নাই করুন। যে সমস্ত মুসলমান সমালোচক এই প্রশ্নের অবতারণা করেন-রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের জন্য কি করেছেন, তাঁদের নিজেদের প্রথমে এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া উচিত-মুসলমান কে, এবং কি সে চায়। যদি মুসলমানীর অর্থ এই হয় যে, তা বিশেষ কতকগুলি অনড় মতবাদের সমষ্টি, তবে সে-মুসলমানীর জন্য রবীন্দ্রনাথ কিছুই করেন নি। এই মুসলমানীর সমর্থন কোরআন, হজরত মোহাম্মদ, এবং যুগযুগান্তের মুসলিম-শ্রেষ্ঠরাও করেন নি, বরং তার প্রতিবাদ করেছেন, যেমন মহামনীষী সাদী বলেছেন

তরিকত ব-জুজ খেদমতে খালক নিসত
ব-তসবিহ্ ও সাজ্জাদ ও দল্‌ক নিস্‌ত।

সৃষ্টির সেবা ভিন্ন ধর্ম আর কিছু নয়, তসবিহ জায়নামাজ ও আলখাল্লায় ধর্ম নেই। অথবা যেমন কোরআনে বলা হয়েছে-আল্লাহ্ সম্বন্ধে ভুল ধারণার জন্য মানুষ আল্লাহর রোষে পতিত হয় না, পতিত হয় দুষ্কৃতির জন্য (১১ : ১১৭)।

কিন্তু মুসলমানীর অর্থ যদি হয় সত্যপ্রীতি, কাণ্ডজ্ঞান-প্রীতি, মানব-প্রীতি,, জগৎ প্রীতি, ন্যায়ের সমর্থন ও অন্যায়ের প্রতিবোধ, তবে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় মুসলমান এ যুগে আর কেউ জন্মেছেন কি না, সে-কথা এই সব সমালোচকদের গভীর বিচার বিশ্লেষণের বিষয় হওয়া উচিত।

দুর্ভাগ্যক্রমে ভারতীয় মুসলমান আজও ভুগছে একটি মানসিক বিকৃতি থেকে, ইংরেজিতে তাকে বলা হয় Inferiority complex. তারা সংখ্যায় অল্প, প্রভাবে খর্ব, এই চেতনা তাদের অন্তরে সঞ্চারিত করেছে একটি মানসিক অস্বস্তি। সেই মানসিক অস্বস্তির চশমার সাহায্যে জগৎকে যথাযথভাবে দেখা ভারতীয় মুসলমানের পক্ষে সম্ভব নয়। এই মানসিক অস্বস্তি যেদিন তার কেটে যাবে, তার পরিবর্তে তার অন্তরে সঞ্চারিত হবে অভয় ও আশা, সেদিন সহজেই সে বুঝবে, দেশ-দেশান্তরে মুসলমানদের মধ্যে অমুসলমানদের মধ্যে কোথায় তার পরম মিত্রেরা বাস করছেন। সেদিনে আজকার একশ্রেণীর দুঃখী মুসলমানের এই যে প্রশ্ন-কবি ও বিশ্বপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ তাদের জন্য কি করেছেন, এটি তার অট্টহাসির সামগ্রী হবে।

১৩৪৮

সংস্কৃতির কথা

মনে হয় মানুষ স্বভাবত পৌত্তলিক : কোনো বিশেষ প্রতিমা বিশেষ তত্ত্ব বিশেষ আচার বা বিশেষ ধরণ-ধারণ-এ না হলে যেন তারা চলতে চায় না। আর এরই সঙ্গে সঙ্গে সে পরিবর্তন প্রিয়-তার প্রতিমা তত্ত্ব আচার বা ধরণ-ধারণ ক্রমাগত বদলায়।

সংস্কৃতি কথাটা ইয়োরোপে প্রবল হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইয়োরোপে নানা ধরণের বিপ্লব দেখা দেয়; ভাব-বিপ্লব, অর্থনৈতিক বিপুব, রাষ্ট্রিক বিপ্লব, সবই। সেই বিপ্লবের পরে ঊনবিংশ শতাব্দীতে আসে নূতন সংগঠনের কাল। সেই দিনে অতীতের ধর্মের স্থান দখল করে সংস্কৃতি।

সংস্কৃতি বলতে বোঝা হয় এক বিশেষ সমম্বয়-খ্রিস্টান অখ্রিস্টান সমস্ত রকমের জ্ঞান ও উৎকর্ষ এর অন্তর্ভুক্ত হয়। এর সংজ্ঞা দেওয়া হয়, অতীতের শ্রেষ্ঠ ভাব সম্পদের সমাহার। প্রথমে এর প্রবণতা হয় ব্যক্তিতান্ত্রিকতার দিকে-ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষই হয় এর প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু ইয়োরোপে সজ্জবদ্ধ জীবন অনেক বেশি সক্রিয়, তাই অচিরেই এই ব্যক্তিতান্ত্রিকতার মোড় ফেরে সামাজিকতার দিকে।

ভারতবর্ষ চিন্তার দিক দিয়ে ইয়োরোপের অন্তত পঞ্চাশ বৎসর পেছনে পড়ে রয়েছে; ইয়োরোপের ঊনবিংশ শতাব্দীর ঢেউ ভারতবর্ষে যে এসে লাগবে বিংশ শতাব্দীতে, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। সংস্কৃতির ব্যক্তিতান্ত্রিক প্রবণতা আমাদের দেশে দুই চার বৎসর আগেও অত্যন্ত প্রবল ছিল। ভদ্রলোক হওয়া বা একটি দ্ৰপরিবার গড়ে তোলা, এইই ছিল আমাদের দেশের শিক্ষিতদের লক্ষ্য। সম্প্রতি দেশে যে গণতান্ত্রিক শাসন-নীতি প্রবর্তিত হয়েছে আর সাম্প্রদায়িক বিরোধ তীব্র হয়ে উঠেছে তার; ফলে আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনায় সমাজ-বোধ একটা বড় জায়গা দখল করতে চাচ্ছে।

ভারতবর্ষের একালের সাংস্কৃতিক চিন্তার ইতিহাসে দুই জনের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য-একজন বাংলার বঙ্কিমচন্দ্র অপরজন পাঞ্জাবের ইকবাল। এদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর চিন্তাশীলের জন্ম একালের ভারতবর্ষে হয়েছে, কিন্তু চিন্তা-নায়ক হিসেবে এঁদের মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে আর কেউ পারেন নি। এঁরা দুজনেই চেয়েছেন প্রাচীন ধর্মের নূতন ব্যাখ্যা দিতে, সঙ্গে সঙ্গে শক্তিশালী রাষ্ট্রজীবন গঠন বলতে যা বোঝায়, তারও স্পষ্ট ইঙ্গিত এঁদের বাণীতে রয়েছে। মানুষ একই সঙ্গে স্থিতিশীল ও গতিশীল, আমাদের দেশের লোক স্থিতিশীল কিছু বেশি-জীবনে নূতন নূতন পরীক্ষা করবার সুযোগ তাদের জন্য সংকীর্ণ, বোধ হয় মুখ্যত এই কারণে। বঙ্কিমচন্দ্র ও ইকবালের চিন্তায় সনাতন স্থিতিশীলতার সঙ্গে কিছু গতিশীলতা যে মিশেছে, এরই মধ্যে নিহিত রয়েছে তাদের জনপ্রিয়তার রহস্য। স্থিতিশীলতার আর গতিশীলতার এই যে অদ্ভুত মিশ্রণ আমাদের দেশের চিন্তায় ঘটেছে, আমাদের একালের সংস্কৃতিগত চিন্তায় এই একটি গোড়ার কথা। কিন্তু সুচিন্তার কাজ হচ্ছে, চিন্তার গ্রন্থির জটিলতা ঘুচিয়ে তাকে ঋজু করা-জীবনে কার্যকরী করা।

আমাদের জীবনে নূতন নূতন পরীক্ষার সুযোগ সংকীর্ণ-বিচিত্র ও দূরপ্রসারী এই ব্যাপারটির প্রভাব। এর ফলে যেমন কঠিন আমাদের পক্ষে মাত্ৰাজ্ঞানসম্পন্ন হওয়া, তেমনি দুর্নিবার আমাদের জন্য চরমপন্থিত্বের আকর্ষণ: যে-চিন্তার লক্ষ্য দীর্ঘাভিসারী কর্মপন্থা আমাদের কৌতূহল সহজেই তা থেকে হয় প্রতিনিবৃত্ত, আর যে-চিন্তা আমাদের জন্য এনে দেয় ভাবোন্মত্ততা, সহজেই আমাদের মন হয় তার দ্বারা বন্দী। এই প্রতিকূল পরিবেশ আর অব্যবস্থিত চিত্ত-বেশ বড় রকমের দুর্ঘটনা এসব আমাদের জীবনে।

সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ব্যক্তিতান্ত্রিকতা যে দুর্বল চিন্তা তা বোঝা কঠিন নয়। মানুষ বিশেষ ভাবে সামাজিক জীব। কাজেই যে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক উৎকর্ষের সামাজিক মূল্য কম, তা যত সুদর্শনই হোক শেষ পর্যন্ত অদ্ভুত ভিন্ন আর কিছু নয়। অবশ্য একথা সত্য যে, এক যুগে যার সামাজিক মূল্য কম অন্য যুগে তার সামাজিক মূল্য বেশি হতে পারে। কিন্তু এমন কতকগুলো ব্যাপার আছে, স্বভাবতই যার সামাজিক মূল্য কম। মানুষের ইতিহাস বিচিত্র-বিচিত্র ভাবের মধ্যে দিয়ে তার অভিব্যক্তি হয়েছে ও হচ্ছে। তাই যে-সব চিন্তা প্রকৃতপক্ষে জনহিতকর নয়, বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর বা দলের চেতন বা অবচেতন স্বার্থবোধের অনুকূল মাত্র, অথবা ক্ষণিক খেয়াল, সে-সবের দিকেও মাঝে মাঝে নেতৃস্থানীয়দের প্রবণতা জন্মেছে।

সেকালের ধর্মের মতো একালের সংস্কৃতিরও মূল কথা হওয়া চাই সামাজিক উৎকর্ষ লাভ। আর যেহেতু সমাজের অর্থ একদিকে বিশ্বমানব সমাজ অন্যদিকে বিশেষ বিশেষ দেশগত বা রাষ্ট্রগত সমাজ, সেজন্যে সংস্কৃতিও মূলত বিশ্বসামাজিক ও রাষ্ট্রিক। অন্য কথায়, যে চিন্তা জগতের অনেকের মনে অনুরণন জাগায় না এবং যার রাষ্ট্রিক সার্থকতা কম, তা বাস্তবিকই স্বল্পমূল্য বা মূল্যহীন-হোক না তা অন্যভাবে যত অসাধারণ।

এই দিক দিয়ে দেখলে হিন্দু-সংস্কৃতি, মুসলিম-সংস্কৃতি, আর্য-সংস্কৃতি, সেমীয়সংস্কৃতি ইত্যাদি কথা যে দেশে উঠেছে, সে-সবের মূলে সুচিন্তা যে তেমন কার্যকরী হচ্ছে না, তা সহজেই বোঝা যায়। যদি হিন্দু ও মুসলমানের রাষ্ট্রিক জীবন সম্মিলিত হয়, তবে তাদের সাংস্কৃতিক জীবন বিভিন্ন হতে পারে না, অন্তত সে বিভিন্নতা অগ্রগণ্য হতে পারে নাহলে সংস্কৃতির যে একটি প্রধান লক্ষ্য সামাজিক অর্থাৎ রাষ্ট্রিক উৎকর্ষ লাভ তাই হয় ব্যাহত। হিন্দু-সংস্কৃতি, মুসলিম-সংস্কৃতি এসব চিন্তা কিছু পরিমাণে কার্যকরী হতেও পারে যদি হিন্দু ও মুসলমানের রাষ্ট্রিক জীবন স্বতন্ত্র হয়। কিন্তু যারা হিন্দু-সংস্কৃতি, মুসলিম-সংস্কৃতি ইত্যাদি কথা বলছেন, তাঁরা ভারতবর্ষের অথবা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের হিন্দু ও মুসলমানের পৃথক পৃথক রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা তেমন ভাবছেন তা মনে হয় না।

সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশ্বজনীনতার কথা তোলা হয়েছে। চিন্তা চিরদিনই বিশ্বজনীন। আর একালে চিন্তার বিশ্বজনীনতা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, বিভিন্ন দেশের মানুষ পরস্পরের অত্যন্ত কাছাকাছি এসেছে বলে। এই চিন্তার ক্ষেত্রে নূতন নূতন সম্ভাবনার কথা আজ মানুষ জ্ঞাতসারে মনে স্থান দিচ্ছে, ফলে প্রাচীন চিন্তাধারা তার চিত্তকে আর বন্দী করে রাখতে পারছে না-যেসব দেশে প্রাচীন ধর্মের প্রভাব অত্যন্ত বেশি সে-সব দেশেও নয়। কাজেই সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রাচীন চিন্তার দোহাই একালে বাস্তবিকই অচল। সংস্কৃতি মানুষের সৌখিন পোষাক-পরিচ্ছদ নয়, তা তার জীবন যুদ্ধের অস্ত্র, আর অস্ত্রের প্রাচীনতাই তার গৌরবের বিষয় নয়।

আমাদের দেশের একশ্রেণীর চিন্তাশীল ব্যক্তিরা এই ব্যাপারের দিকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকান। আমাদের বর্তমান শক্তিহীনতার কথা তারা বোঝেন, আর বুঝে তাঁরা এই ভাবেন যে, এ অবস্থায় আক্রমণের চেয়ে প্রতিরোধের মনোভাব বরণ করাই আমাদের জন্য প্রশস্ত। এই প্রতিরোধ মুখ্যত তাঁদের জন্য কূর্ম-বৃত্তি অবলম্বন। কূর্ম যেমন বিপদ-কালে নিজেকে গুটিয়ে নেয় তার আবরণের মধ্যে, এঁরাও তেমনি আত্মরক্ষার প্রয়াসী হন দেশের বা সমাজের সনাতন ভাবধারার আশ্রয়ে। কিন্তু এই চিন্তাধারা খুব দুর্বল। কূর্ম-বৃত্তি অবলম্বন করে বিশেষ বিশেষ প্রাচীন সম্প্রদায় জগতের নানা স্থানে আজো টিকে আছে, কিন্তু তারা নাম পেয়েছে পিছিয়ে-পড়া-সম্প্রদায় অথবা বর্বর সম্প্রদায়। জগতে বাস্তবিকই তারা পিছিয়ে পড়েছে। সাবধানতা সাধারণত একটি সদ্গুণ, কিন্তু তা যদি হয় পরাজয়-স্বীকৃতির অন্য নাম, তবে তার চেয়ে দোষাই আর কিছু নেই।

“বাংলার মুসলমানের সংস্কৃতি” সম্পর্কে দুই একটি কথা বলতে গিয়ে আমাদের এই ভূমিকার অবতারণা করতে হলো। বাংলার মুসলমানের উৎপত্তির কথা আমরা অন্যত্র আলোচনা করেছি। [দ্র: ‘বাংলার মুসলমানের কথা’।] তাতে দেখেছি, বৌদ্ধ হিন্দু পাঠান আরব ইত্যাদি বিচিত্র উপাদানে এই সমাজ গঠিত। কিছুদিন পূর্বেও এই সমাজে দুইটি শ্রেণী ছিল: একটি সম্ভ্রান্ত “আশরাফ”, অপরটি সাধারণ “আতরাফ”, এবং এই দুই শ্রেণীর মধ্যে সামাজিক আদান-প্রদান প্রায় ছিল না বললেই চলে-কতকটা হিন্দুর জাতিভেদের মতো। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, এমনি বিচিত্র সমাজ ও মত ভারতবর্ষের প্রশস্ত বুকে স্থান লাভ করেছে। ক্ষুদ্র সংহতি-জীবনই মুখ্যত তাদের উপজীব্য হয়েছে, বৃহত্তর দেশ সম্বন্ধে চেতনা কদাচিৎ অনুভূত হয়েছে। এই যে একধরণের “যত মত, তত পথ” অথবা “যত পথ, তত মত তত্ত্বের সূত্রে ভারতবর্ষের লোকদের জীবন গ্রথিত হয়েছিল, তাতে কিছু শান্তি হয়ত ভারতীয় সমাজ-জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; কিন্তু যার অভাব ঘটেছিল তার নাম সচেতনতা। হাজার বৎসর পূর্বে আলবেরুনী এটি লক্ষ্য করেছিলেন, আর আজো এটি কম লক্ষ্যযোগ্য নয়। ভারতবর্ষের প্রাচীন সাধনা সম্বন্ধে আমাদের একালের অনেক চিন্তাশীলের এই যে এক সিদ্ধান্ত, যে অনন্ত বৈচিত্র্যের ভিতরে একত্বের সন্ধান করতে হবে, এটি আংশিক ভাবেই গ্রহণযোগ্য। সত্য শুধু মানস ব্যাপার নয়, বিশেষ ভাবে সামাজিক ব্যাপার; বৈচিত্র্য কম হোক আর বেশি হোক তার ভিতরকার একত্ব হওয়া চাই সুদৃঢ়-সামাজিক অর্থে; আর ততখানি বৈচিত্র্যই স্বীকার্য যা এই সুদৃঢ় একত্বের অনুকূল। ফলের প্রাচুর্যে ডাল যদি ভেঙে পড়ে, তবে তা ফল ও ডাল দুইয়েরই জন্য হয় অসার্থক।

বাংলায় মুসলমানের আবির্ভাব হয়েছে অন্তত সাত শতাব্দী পূর্বে। কিন্তু তার এই দীর্ঘ জীবনের ইতিহাস অতি সামান্যই আমরা জানি। যেটুকু জানি তাতে বলা যায়, তার “সম্ভ্রান্ত” ও “সাধারণ” শ্ৰেণীর মধ্যে দুই বিভিন্ন রকমের মনোভাব ছিল। যারা “সম্ভ্রান্ত” তারা প্রধানত অনুবর্তী ছিলেন ইসলামী সংস্কৃতি বলতে যা বোঝা যায় তার, আর যারা “সাধারণ” তাঁদের জীবন সাধারণত চলতো তাদের পূর্বপুরুষদের ধারায়।[দ্র: হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ: প্রথম বক্তৃতা।] অবশ্য দেশের সমস্ত সমাজের উপরেই তখন প্রভাবশীল ছিল লীলা-বাদ এবং তার ফলে প্রত্যেক সমাজই মোটের উপর সন্তুষ্ট ছিল তাদের ভাগ্য নিয়ে। এমনি ভাবে দীর্ঘকাল কাটবার পরে ভারতবর্ষের, বিশেষ করে বাংলার, লাভ হলো ইয়োরোপের স্পর্শ। এই স্পর্শে প্রথমে দেশের যা ফল লাভ হলো, এক হিসেবে তা বহুমূল্য, কেননা হিন্দু মুসলমান দেশের সব সমাজেই আত্ম-অম্বেষণ সক্রিয় হলো এবং দেশের বিভিন্ন কেন্দ্রে অনেক মহিমময় ব্যক্তির আবির্ভাব হলো।

কিন্তু অচিরেই দেশের মনোভাবে পরিবর্তন ঘটলো। দেশ মুগ্ধ হয়েছিল ইয়োরোপের ভাবুক-রূপের দ্বারা। কিন্তু ইয়োরোপের প্রভু-রূপের সঙ্গে পরিচিত হতে তার দেরী হলো না এবং তার ফলে তার ইয়োরোপ-পূজা রূপান্তরিত হলো ইয়োরোপ বিদ্বেষে বা ইয়োরোপ-ভীতিতে। এই ইয়োরোপ-বিদ্বেষ বা ভীতির সঙ্গে দেশের একালের রাজনৈতিক চেতনা সম্বন্ধ। সুতরাং আমাদের একালের সাংস্কৃতিক চিন্তারও গভীর যোগ এই বিদ্বেষ বা ভীতির সঙ্গে।

আত্মরক্ষার জন্য কূর্ম-বৃত্তি অবলম্বনের উল্লেখ আমরা করেছি। আমাদের দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সাংস্কৃতিক চেতনা বলতে মোটের উপর ববাঝেন এই কৃর্ম-বৃত্তি অবলম্বন বিপন্ন কূর্মের মতো অক্ষম আক্রোশ হয়ত তাদেরও এই চেষ্টার আনুষঙ্গিক। কিন্তু যারা প্রধানত বিদ্বেষপরায়ণ বা ভীত, তাদের স্বাভাবিক মনুষ্যত্বে গ্লানি পৌঁছেছে- সুচিন্তা, অর্থাৎ কল্যাণপ্রসূ চিন্তা, সেই অবস্থায় আর তাঁদের পক্ষে সম্ভবপর নয়। তাদের সঙ্গে সংস্কৃতির মতো গুরু বিষয়ের আলাপ আলোচনা না করাই হয়ত শোভন। কিন্তু তাদের আত্মীয়স্থানীয় অপর একটি দল আছেন, তাঁরা সময় সময় চিন্তাশীল বলে’ আদৃত হন। তারা বলতে চান: চিন্তা উচ্চাঙ্গের অথবা সারগর্ভ হলেই জনসাধারণের গ্রহণযোগ্য হয় না, গ্রহণযোগ্য হয় তাদের অভ্যস্ত ভাবধারার অনুকূল হলে; এত কাল এদেশের লোকে বিভিন্ন সমাজে ও ধর্মে বিভক্ত হয়ে জীবন অতিবাহিত করে এসেছে, আজ যদি তাদের-তা যে প্রয়োজনেই হোক-বলা হয় যে তাদের সেই ভাবধারা তাদের জন্য আর কল্যাণপ্রসূ নয়, তবে তাদের বিহ্বল ও বিভ্রান্ত ই করা হবে বেশি, তাদের পথের নির্দেশ দেওয়া হবে মনে হয় না। এই শ্রেণীর ভাবুকদের বড় ক্রটি এইখানে যে, যে-চিন্তাকে তারা জনসাধারণের পক্ষে দুর্বোধ্য জ্ঞান করেন, সেটি-অথবা অন্য কোনো চিন্তাধারা-তাঁদের নিজেদের সহজবোধ্য হয়েছে কিনা সে-জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হন তাঁরা কদাচিৎ। অথচ কে না জানে যে, সার্থক প্রচার আমাদের দ্বারা তখনই সম্ভবপর, যখন কোনো মত বা পথ আমরা সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ। করেছি। মানুষের নব নব ইতিহাস নিয়তই রচিত হচ্ছে, আর রচিত হচ্ছে তাদের দ্বারা নয় যারা বুদ্ধিমা কিন্তু দ্বিধান্বিত, পরম্ভ তাঁদের দ্বারা সত্য ও কল্যাণকে বুঝবার চেষ্টায় যাঁদের ত্রুটি নেই সঙ্গে সঙ্গে যা তাঁরা সত্য ও কল্যাণকর বলে বুঝেছেন তাতে আত্মসমর্পণ করেছেন। সংস্কৃতির একটি সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে-সুন্দরের সাধনা। যাদের ব্যক্তিতান্ত্রিক প্রবণতা বেশি, তাঁদেরও এই সংজ্ঞা হয়ত মনঃপূত হবে। কিন্তু সুন্দর তো শুধু মোহকর নয়, সুন্দর বিশেষ বিশেষভাবে সত্যাশ্রয়ী-জগৎ ও জীবনের সঙ্গে তার যোগ যেমন দৃঢ়, তেমনি তার গতি সার্থকতা লাভের দিকে। সত্যাশ্রয়িতা,অর্থাৎ সত্য উপলব্ধির চেষ্টা আর সার্থক হবার আকাঙ্ক্ষা, যাদের অন্তরের ধর্ম নয় তারা জ্ঞানীও নন কর্মীও নন।

এই সত্যাশ্রয়িতার দৃষ্টিভূমি থেকে যদি আমরা বাংলার মুসলমানের সংস্কৃতির দিকে তাকাই তাহলে কি দেখব? দেখব-নানা দৈন্যে বাংলার মুসলমান জর্জরিত, আর্থিক দৈন্য তার যত তার চেয়ে অনেক বড় তার ভাবের দৈন্য, সঙ্কল্পের দৈন্য। মুসলমান হিসেবে প্রতিমা পূজায় আপত্তি জানিয়ে সে প্রাকৃত জীবন অনেকখানি অস্বীকার করেছে; কিন্তু জীবনে বড় কথা অস্বীকার করা নয় বরং বড় কথা হচ্ছে ‘স্বীকার করা’-মুসলমানের স্বীকার করা উচিত ছিল সজাগ-মানব-জীবন অর্থাৎ জ্ঞান ও প্রেমের জীবন-ইসলামের অর্থ কেবল তাই হতে পারে। কিন্তু তেমন করে স্বীকার সে কিছুই করতে পারে নি-যা স্বীকার করেছে অথবা করতে চেয়েছে তা তুচ্ছ আচার-পূজা ভিন্ন। আর কিছু নয়।

তা অতীত যা-ই হোক তার চেয়ে বড় কথা বর্তমানের প্রয়োজন। সেই বর্তমানে তার অজ্ঞান ও অভাবাত্মক মনোভাব দূর হোক, সে স্বীকার করুক ভাবাত্মক মনোভাব-জাগ্রত আদর্শ। যে-জ্ঞান ও প্রেমের জীবন তার স্বীকার করা উচিত ছিল সৌভাগ্যক্রমে তা শুধু আজ তারই স্বীকার্য নয়, জগতের সবারই স্বীকার্য, জগতের বিভিন্ন দেশের বা বিভিন্ন সমাজের মানুষের পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে বলে’ সংস্কৃতিতে সংস্কৃতিতে বৈশিষ্ট্য ও বিরোধ আজ প্রধানত অতীতের কথা। আজ বড় কথা সে-সবের প্রাণশক্তির সন্ধান যা থেকে সম্ভবপর হবে জাতিতে জাতিতে অথবা সমাজে সমাজে গাঢ়তর সহযোগিতা ও মঙ্গলতর ভবিষ্যৎ। মানুষের বিচিত্র সংস্কৃতির সেই প্রাণশক্তি আজ চিন্তার ক্ষেত্রে নাম পেয়েছে বৈজ্ঞানিকতা ও মানব-হিত আর কর্মের ক্ষেত্রে নাম পেয়েছে সুব্যবস্থিত রাষ্ট্র-জীবন। একালে বাংলার মুসলমানের সাংস্কৃতিক জীবনও প্রতিষ্ঠিত হবে, সেই বৈজ্ঞানিকতা মানব-হিত ও সুব্যবস্থিত রাষ্ট্রের ভিত্তির উপরেই।

দেশের হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের কথা এ ক্ষেত্রে সহজেই ওঠে। এই সমস্যার সম্মুখীন হয়ে যাঁরা বলছেন, হিন্দু-মুসলমানের পৃথক রাষ্ট্র-জীবন ভিন্ন এর সমাধান নেই। তাদের কথা বোঝা যাচ্ছে না এই কারণে যে, রাষ্ট্র-জীবনের অর্থ হচ্ছে আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রভূত ক্ষমতাসমন্বিত সংহতি-জীবন, কিন্তু ভারতবর্ষের মতো ভৌগলিক অবস্থানের দেশে সেই ক্ষমতা সমস্ত দেশের পক্ষে লাভ হওয়াই সম্ভবপর মনে হয়, প্রদেশ বিশেষের বা অংশবিশেষের জন্য তা একান্তই দুঃসাধ্য। আমরা যতটা ভাবতে পেরেছি তাতে মনে হয়েছে, ভারতবর্ষের অথবা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের লোকেরা যদি নিজেদের কোনো রকমের সত্যিকার উন্নতি চায়, তবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পরস্পরের সঙ্গে সম্মিলিত হওয়া ভিন্ন গত্যন্তর নেই, এবং এই জন্যই তাদের অতীত ও বর্তমানের সমস্ত চিন্তা-ভাবনা সুসঙ্গত হওয়া চাই, তাদের জীবনের এই এক শ্রেষ্ঠ প্রয়োজনের সঙ্গে। বলা বাহুল্য এই সম্মিলন বৈচিত্র্যহীন হতেই পারে না-কিন্তু বৈচিত্র্য যেন কদাচ বিপন্ন না করে একত্বকে। আজকার বিবৰ্দ্ধিত বিরোধের দিনে এই চিন্তাধারা কারো কারো মনে হতে পারে অবাস্তব। এই বাস্তববাদীদের দৃষ্টি এই কঠিন বাস্তবতার দিকে আকৃষ্ট হওয়া উচিত যে, আজ পর্যন্ত এদেশের হিন্দু-মুসলমান যত মারামারি করেছে। তাতে শক্তিতে শক্তিতে যোঝযুঝির পরিচয় নেই আদৌ, আছে দুর্দৈব ও দুর্বুদ্ধির পরিচয় মাত্র। অবশ্য রোগভোেগ দীর্ঘ দিন ধরে চললে তাকেই সময় সময় ভ্রম হয় স্বাভাবিক অবস্থা বলে। কিন্তু রোগ রোগই-তা কদাচ স্বাস্থ্য নয়।

হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত জীবন ভিন্ন আর কিছু যদি এদেশে সম্ভবপর না হয়, তবে হিন্দু-সংস্কৃতি, মুসলমান-সংস্কৃতি, আর্য-সংস্কৃতি, সেমীয়-সংস্কৃতি এসব কথা হয়ে পড়ে দায়িত্বহীন এবং এসবের প্রচলন আমাদের ভাষায় ও সাহিত্যে যত কম হয়, ততই মঙ্গল-ততই চিন্তার সৌখিনতা আমাদের ঘুচবে আর আমরা সত্যাশ্রয়ী হব। সার্থক সমাজ-সত্তার দিক দিয়ে বাংলার মুসলমান অথবা হিন্দু বাংলার অথবা বিশাল ভারতবর্ষের অংশ ভিন্ন যখন আর কিছু নয়, তখন তার সাংস্কৃতিক জীবনের সার্থকতা লাভের পথ এই বিশাল সত্তার সঙ্গে তার গূঢ় যোগ উপলব্ধির ভিতর দিয়েই। ঝরণার সার্থকতা যেমন নদীর পুষ্টিসাধন করে’-এ সত্য যত অকপট ভাবে স্বীকার করা যাবে, ততই শক্তি ও শ্রী লাভের পথে আমরা অগ্রসর হব।

আজকার অসার্থক সংস্কৃতি-চিন্তার স্তর থেকে সার্থক সংস্কৃতি-চিন্তার স্তরে উপনীত হতে হলে যে সব ধাপ আমাদের অতিক্রম করতে হবে, তার কিছু নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে এই ভাবে:

(১) দেশে অভুক্ত ও কর্মহীন কেউ থাকবে না।

(২) একান্ত বীভৎস না হলে কোনো সমাজেরই ধর্মাচার অশ্রদ্ধের বিবেচিত হবে না, সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে হবে যে-যা প্রাচীন তা প্রাচীন বলেই বরণীয় নয়, বরণীয় তার বর্তমান কার্যকারিতার জন্যে।

(৩) হিন্দু-মুসলমানের পোষাক ও নামের ব্যবধান থাকবে না অথবা অস্বীকার করা হবে।

(৪) সামাজিক আদান-প্রদান, বিবাহ-সাদি সমেত-সর্বত্র সহজ হবে।

(৫) আইন সমস্ত দেশের জন্য এক হবে।

১৩৪৮

আধুনিক বাংলা সাহিত্য

[P.E. N. এর দ্বারা জয়পুরে আহুত অল্-ইন্ডিয়া রাইটার্স কনফারেন্সে পঠিত]

আমার উপরে ভার পড়েছে বাংলার একালের সাহিত্য সম্বন্ধে কিছু বলতে, বিশেষ করে তার গত পঞ্চাশ বৎসরের সাহিত্য সম্বন্ধে। অন্যান্য সাহিত্যের প্রতিনিধিরাও তাঁদের সাহিত্য সম্পর্কে তুল্যরূপে অনুরুদ্ধ হয়েছেন। বুঝতে পারা যাচ্ছে উদ্যোক্তারা জানতে ও জানাতে চান ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে চিন্তা-ভাবনা ও সৃষ্টির ধারা কোন্ পথে বইছে বা বইতে চাচ্ছে। আমি যা বলতে চেষ্টা করবো তা বাংলার একালেরই কথা, তবে তার সেই একাল পঞ্চাশ বৎসরের চেয়ে দীর্ঘতর। বাংলার এই ঈষৎ দীর্ঘতর একালের সংবাদ না রাখলে তার সমসাময়িক জীবন, বিশেষ করে সাহিত্য, দুর্বোধ্য হবে এই আমাদের ধারণা।

বাংলার প্রাচীন সাহিত্য অর্বাচীন নয়, দীনও নয়, আপনারা তা জানেন। শ্রীযুক্ত অন্নদাশঙ্কর রায় ও শ্রীমতী লীলা রায়ের যে বইখানি P. E. N. প্রকাশ করেছেন, তাতে বাংলার প্রাচীন সাহিত্যের পরিচয় সুন্দরভাবেই দেওয়া হয়েছে। তবু বাংলার ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে-নবীন সাহিত্যের জন্ম হলো, নানা দিক দিয়েই তা মর্যাদাবান। সেকালের বাঙালি অনুভব করেছিলেন প্রেমের গভীরতা, একালের বাঙালি অনুভব করেছেন বিশ্বচিত্তপরিক্রমার আনন্দ।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে ইয়োরোপের ‘রেনেসাঁসে’র মতো একটি ব্যাপার যে ঘটেছিল, বাংলার বাইরের লোকেরাও তা কিছু কিছু জানেন। কিন্তু নিশ্চয়ই তার সঙ্গে বিস্তারিত পরিচয় তাঁদের নেই, কেননা অনেক বাঙালিই সে-সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নন। কিন্তু বাস্তবিকই একটি “রেনেসাঁস’-এর নব জন্ম-বাংলার ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঘটেছিল, বাংলার একালের সাহিত্য তারই বিশেষ পরিচয় বহন করে গৌরবান্বিত। ইয়োরোপের ‘রেনেসাসে’র মূলে কাজ করেছিল বহু প্রভাব; বাংলার রেনেসাঁসের মূলেও তেমনি কাজ করেছে বিচিত্র প্রভাবহিন্দু ও মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির দীর্ঘদিনের সংঘর্ষ ও আদানপ্রদান, ফরাসী বিপ্লব, খ্রিস্টান ধর্ম, ইংরেজি সাহিত্য, ইত্যাদি। তবে সেই বিচিত্র প্রভাবের মধ্যে দু’টিকে দাঁড় করানো যেতে পারে বড় করে একটি, বাঙালির নূতনত্বের পূজারি প্রকৃতি, অপরটিউনবিংশ শতাব্দীর প্রথমপাদের ইয়োরোপের নবমানবতাবাদ। বাংলাদেশ পলিমাটির দেশ। বাঙালি প্রকৃতির মধ্যেই যেন রয়েছে পলিমাটির ধর্ম। বৌদ্ধ যুগে বাঙালি বিশেষভাবে বৌদ্ধ হয়েছিল, কয়েকজন শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ প্রচারকের জন্ম হয়েছিল বাংলার মাটিতে, এ ইতিহাসের কথা। তেমনি নবাগত ইসলামকেও বাঙালি বরণ করেছিল কতকটা উৎসাহে, বৌদ্ধ-হিন্দুসংঘর্ষের প্রতিক্রিয়ায় এরও কিছু কিছু প্রমাণ বাংলার প্রাচীন সাহিত্যে রয়েছে। বাঙালির এহেন প্রকৃতির কাছে নবমানবতাবাদী ইয়োরোপের বিপুল আকর্ষণ যে ব্যর্থ হবে না এইই স্বাভাবিক।

এই নব্য বাংলার গুরু রামমোহন রায়। শুধু নব্য বাংলার নয় নব্য ভারতেরও তিনি গুরু। ফরাসী ভাবুক রোসা বোলা তাঁকে জ্ঞান করেছেন জগতের আধুনিক যুগের অন্যতম স্রষ্টারূপে। যে দিক দিয়েই দেখা যায় এই লোকটি এক মহা বিস্ময়। হিন্দুচিত্তের গভীরতা, ইসলামের সবল কাণ্ডজ্ঞান খ্রিস্টানের সহৃদয়তা অপূর্বভাবে সম্মিলিত হয়েছিল তার মধ্যে। এ এক পরম সৌভাগ্য যে, নব্য বাঙালি ও নব্য ভারতবাসী তাকে লাভ করেছেন তাঁদের একালের জীবনের কাণ্ডারীরূপে। অবশ্য লাভ করেছেন ঐতিহাসিক ক্ষেত্রেই, পূর্ণরূপে চিত্তক্ষেত্রে আজো নয়; তার নির্দেশের গৌরব পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে ভারতের একালের অনেক জটিল সমস্যা বহু পূর্বে সুমীমাংসিত হতো। [রামমোহন রায় দ্র:।]

বাংলায় যে নবজাগরণ দেখা দিল মুখ্যত তার তিনটি ধারা। প্রথমটিকে বলা যায় রামমোহনী ধারা, ব্রাহ্ম-আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যা অভিব্যক্ত হলো; দ্বিতীয়টি হিন্দু কলেজীয় ধারা-যুক্তিবাদী ও ভারতপ্রেমিক হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও এর প্রবর্তয়িতা; আর তৃতীয়টি নব-হিন্দুত্বের ধারা-এর প্রতিনিধি-স্থানীয় বঙ্কিমচন্দ্র ও রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ। এই তিন ধারাতেই বহু সংখ্যক অকৃত্রিম কর্মীর আবির্ভাব ঘটেছিল। তাদের কথা বিস্তৃতভাবে বলবার সুযোগ আমার নেই, মাত্র এই মন্তব্যটুকু করবার আছে যে, এই বিভিন্ন ধারার কর্মীরা জাতীয় জীবনে তাদের বিশিষ্ট কর্মধারার অর্থ ও সম্ভাবনা সম্বন্ধে সচেতন থাকতে পারেন নি অনেক সময়ে। তাতে বাংলার জাতীয় জীবনে লাভ লোকসান দুইই হয়েছে। লাভ এই হয়েছে যে বাঙালির প্রকৃতি ক্ষেত্রবিশেষে আরো সূক্ষ্ম আরো গম্ভীর হয়েছে, লোকসান এই হয়েছে যে দুচ্ছেদ্য জটিলতা বাঙালির মানস জীবনে দেখা দিয়েছে। এই জটিল বন্ধ মোচন করে’ সহজ ও প্রশস্ত পথ আবিষ্কার করা একালের বাঙালির এক বড় কাজ। সৌভাগ্যক্রমে সেকাজ আরম্ভ হয়েছে।

বাংলার এই নবজাগরণ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় প্রারম্ভে সূচিত হলেও, বাংলা সাহিত্যে এর যোগ্য প্রকাশ ঘটে সেই সূচনার প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে। রামমোহনের তিরোধানের কয়েক বৎসর পরে তার ব্রাহ্ম-আন্দোলনের কোনো কোনো ধুরন্ধর উৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন, আজো তার গৌরব ক্ষুণ্ণ হয় নি। কিন্তু যে সাহিত্য বিশেষভাবে আধুনিক-লক্ষণাক্রান্ত হলো-রূপ ও রস দুই দিক দিয়েই-তার উদ্ভব হলো ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়য়ার্ধের সূচনায়, হিন্দু-কলেজীয় ধারায়। এই নব সাহিত্যের স্রষ্টা বাংলার পরমপ্রিয় আর একান্তভাগ্যতাড়িত মাইকেল মধুসূদন দত্ত। দীর্ঘদিন তিনি এই স্বপ্নে বিভোর ছিলেন যে ইংরেজি কাব্য রচনা করে’ যশস্বী হবেন, এই স্বপ্নের প্রেরণায়ই তিনি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন মনে হয়। তাঁর এই ধর্মান্তর গ্রহণে তার স্বজাতীয়দের অনেকে গভীর দীর্ঘশ্বাস মোচন করেছেন। কিন্তু তার এই ধর্মান্তর গ্রহণ তার নিজের জন্য যতবড় দুঃখের কারণ হোক, তাঁর জাতির জন্য প্রকৃতই হয়েছে এক মহালাভের ব্যাপার। এই ধর্মান্তর গ্রহণের ফলেই খ্রিস্টান পাদরীদের সাহায্যে গ্রিক লাতিন ইতালীয় প্রভৃতি ভাষায় ও সাহিত্যে তাঁর অনুপ্রবেশ ঘটে-তার নব-সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভবপর হয়েছিল এই সব সাহিত্যের সঙ্গে তার নিবিড় পরিচয়ের গুণে। মধুসূদন তাঁর সমসাময়িক কালেই দেশের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিলেন। কিন্তু তার মর্যাদা যে কত বড় তা বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছে একালে। তার স্বজাত্যবোধ সুগভীর, সেই সঙ্গে সর্বমানবের সঙ্গে তাঁর যোগও সুনিবিড়; দেবতা বা ভাগ্যের ভ্রুকুটির ঊর্ধ্বে তিনি তুলে ধরেছেন মানুষের পৌরুষের মহিমা; শব্দপ্রয়োগের নিপুণতায় বিশ্ব-শিল্পীদের সভায় তিনি একজন প্রথম শ্রেণীর শিল্পী; আর হৃদয়-ধর্মে তিনি রাজাধিরাজ। এই অপেক্ষাকৃত স্বল্পজীবী কবি যে প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন তার তুলনায় তাঁর সৃষ্টি পর্যাপ্ত নয়; কিন্তু সেই জন্যই তিনি হয়ে রয়েছেন সহৃদয় পাঠকের চিরবিস্ময়। রামমোহনের কাছ থেকে জাতি পেলো বলিষ্ঠ বুদ্ধি ও বলিষ্ঠ মনুষ্যত্বের নির্দেশ, আর মধুসূদনের কাছ থেকে পেলো বিশ্বব্যাপক হৃদয়-ধর্মের স্বাদ।

মধুসূদনের পরেই বাংলা-সাহিত্যে কয়েকজন শক্তিশালী কবির আবির্ভাব ঘটে, তাদের কারো কারো সমসাময়িক যশ মধুসূদনেরও গৌরব-স্পর্ধী হয়েছিল। কিন্তু একালে তাদের অপেক্ষাকৃত অখ্যাতরাই হয়েছেন খ্যাতিমান, আর খ্যাতিমানরা স্থান লাভ করেছেন নিম্নতর শ্রেণীতে। মধুসূদনের অব্যবহিত পরে যাঁরা বাস্তবিকই শ্রেষ্ঠ কবি তাঁরা মধুসূদনের ‘মর্যাদাবান’ রীতি ত্যাগ করে’ অবলম্বন করেছিলেন সহজ-সরল সুপরিচিত বাঙালি রীতি। তাতে তাঁরা পথ পরিষ্কার করে গেছেন রবীন্দ্রনাথের, কেননা রবীন্দ্রনাথ রীতিতে অকৃত্রিম বাঙালি কবি আর চিত্তের কৌলীন্যে মহাকবি।

মধুসূদনের পরে বাংলা সাহিত্যে একচ্ছত্র সম্রাট হন বঙ্কিমচন্দ্র। অনন্য-সাধারণ সাহিত্য-প্রতিভার অধিকারী তিনি যে ছিলেন তা অবিসংবাদিত। কিন্তু তার বিস্ময়কর প্রতিপত্তির মূলে তাঁর সাহিত্য-প্রতিভা যত, তার চেয়ে বেশি তার চিন্তাধারা, নব হিন্দুত্বের মহাব্যাখ্যাতারূপে তিনি পূজা লাভ করে আসছেন। একালে বঙ্কিমচন্দ্রের মূল্য নির্ধারণের নূতন চেষ্টা হচ্ছে। বঙ্কিমচন্দ্রের বিরুদ্ধে মুসলিম বিদ্বেষের অভিযোগ এই সব বিচারকের দৃষ্টিতে অযৌক্তিক, কেননা কয়েকটি উৎকৃষ্ট মুসলিম চরিত্র তাঁর হাতে রূপ লাভ করেছে, আর সাম্যবাদীরূপে দুঃস্থদের পক্ষ তিনি অবলম্বন করেছিলেন সম্পন্নদের বিরুদ্ধে জাতিধর্মনির্বিশেষে। তবে তাঁরা বঙ্কিমচন্দ্রে দেখেছেন দ্বিধাভিন্ন ব্যক্তিত্ব। [দ্র: বঙ্কিমচন্দ্র।] একদিকে যেমন প্রবল তার সত্যানুসন্ধিৎসা ও সহজ মানবপ্রীতি, অন্যদিকে তেমনি প্রবল তার লাঞ্ছিত ও বিপর্যস্ত সম্প্রদায়ের জন্য উৎকণ্ঠা-এই মাত্রাতিরিক্ত উৎকণ্ঠার জন্য তার স্থান সুনির্দিষ্ট হতে পারেনি একালের ভারতের শ্রেষ্ঠ নেতাদের মণ্ডলে। কিন্তু তার সাহিত্যিক মর্যাদা বাস্তবিকই অসাধারণ। সমস্ত ক্রটি সত্ত্বেও-যেমন অসাধারণ তার অঙ্কনকুশলতা, তেমনি গভীর মানব-চিত্তের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। মানব-মনের, অন্তর্দ্বন্দ্বের শেক্সপীয়রের ভঙ্গির রূপদান তাঁর রচনায় মাঝে মাঝে সম্ভবপর হয়েছে। তাঁর আশ্চর্য মিল পশ্চিম-ভারতের কবি ইকবালের সঙ্গে। দুজনেরই বাণীর দীপ্তি অসাধারণ আর চিন্তা অপরিচ্ছন্ন; আর দুজনেরই সমসাময়িক খ্যাতি-প্রতিপত্তি প্রধানত চিন্তানেতা হিসেবে।

বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যিক শক্তির মর্যাদা তাঁর সমসাময়িক শিষ্যেরা তেমন উপলব্ধি করতে পারেন নি। বোধ হয় সেজন্যই তাঁদের মধ্যে সত্যিকার সাহিত্যিক শক্তির অধিকারীর সংখ্যা নগণ্য। গুরুর সুরে সুর মিলিয়ে তারা হিন্দুত্বের জয়ধ্বনিতে বাংলার সেদিনের আকাশ বাতাস কম্পিত করেছিলেন-বিশেষ করে রঙ্গমঞ্চে, কিন্তু সাহিত্যক্ষেত্রে বাস্তবিকই তাঁরা নিষ্ফল হয়েছেন। সাহিত্য বিকাশের আনন্দের বা বেদনার সৃষ্টি, আড়ম্বর চিরদিনই তার প্রাণঘাতী।

বঙ্কিমচন্দ্র স্বীয় সাহিত্যিক প্রতিভার গুণেই নিঃসন্দেহ হতে পেরেছিলেন তরুণ রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্বন্ধে, অকপট অভিনন্দন সেইদিনেই তিনি তাঁকে জ্ঞাপন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জন্ম এক মহত্ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হিন্দুধর্মের সংস্কারকের পুত্ররূপে। পিতার ব্যক্তিত্ব চিরদিন তাঁর অন্তরে জাগিয়েছে সম্ভ্রম আর প্রেরণা। তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত চিঠিপত্র থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে, যৌবনেই তাতে দেখা দিয়েছিল জীবন সম্বন্ধে গভীর চেতনা-তাঁর পিতার প্রভাব যে এক্ষেত্রে সব চেয়ে বেশি কার্যকর হয়েছিল তাতে সন্দেহ পোষণ করবার হেতু নেই। এই প্রভাবের জন্যই প্রাচীন হিন্দুত্বের নব-প্রচারক বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি প্রথম থেকেই সন্দিগ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করা তার পক্ষে স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথের স্বাভাবিক নিসর্গপ্রীতি আর বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবর্তিত চিন্ত ধারার প্রতি আহৃত বিরূপতা হয়ত নিরূপিত করেছিল তাঁর প্রতিভার গতিপথ। পরবর্তীকালে অবশ্য এমন সময় রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় এসেছিল যখন প্রায় বঙ্কিমচন্দ্রের ধরণের হিন্দুজাতীয়তাবাদী তিনি হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বদেশ ও স্বজাতি-প্রেম যত প্রবলই হোক বঙ্কিমচন্দ্রের খাতে তা কখনো প্রবাহিত হয়নি। তাদের দুজনের পরিণত প্রতিভার এই দুইটি বাণী থেকে বোঝা যাবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য :

বঙ্কিমচন্দ্র :

সকল ধর্মের উপরে স্বদেশ-প্রীতি, ইহা বিস্মৃত হইও না।

রবীন্দ্রনাথ :

স্বজাতির সিংহাসন উচ্চ করি গড়ো,
সেই সঙ্গে মনে রেখো সত্য আরো বড়ো।
স্বদেশের চাহ যদি তারো ঊর্ধ্বে ওঠো,
করোনা দেশের কাছে মানুষের ছোটো।

বাংলার ঊনবিংশ শতাব্দীর যে নবজাগরণের কথার উল্লেখ করেছি, তার প্রায় সমস্ত ঝঙ্কার রবীন্দ্রনাথের চিত্তবীণায় অনুরণিত হয়েছে, কখনো উদাত্ত রাগিণীতে বেজে উঠেছে। এই দিক দিয়ে দেখলে বোঝা যায় জগতের প্রায় প্রত্যেক মহাকবির মতো, রবীন্দ্রনাথও মৌলিক তত নন, যত সংগ্রাহক-বাংলার ঊনবিংশ শতাব্দীর অথবা ভারতের ঊনবিংশ শতাব্দীর বিরাট নবজাগরণের তিনি ঘনীভূত রূপ-গ্যেটেকে যেমন বলা হয় ইয়োরোপের বিরাট রেনেসাঁসের সংহত ব্যক্তিরূপ।

বাংলা সাহিত্যে বিংশ শতাব্দীর আরম্ভ হলো রবীন্দ্রনাথের ‘নৈবেদ্য’ দিয়ে। তখন তাঁর বয়স চল্লিশ পূর্ণ হয়েছে। এর পূর্বেই যে বিপুল সাহিত্য তার দ্বারা সৃষ্ট হয়েছিল অনেক বাঙালি সাহিত্য-রসিকের দৃষ্টিতে তাইই কবি-রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ দান। এই মতের পরিপোষক আমরা নই। আমাদের বরং ধারণা সুবিপুল রবীন্দ্র-সাহিত্য তাঁর বিরাট ও বিচিত্র ব্যক্তিত্বের অভিব্যক্তির ইতিহাস-অল্প বয়সেই সেই বিকাশের সূচনা হয়েছিল, আর আমৃত্যু তা অম্লান ছিল। আরো সৌভাগ্যের কথা এই যে, কোনো প্রয়োজনের তাগিদে এই বিকাশ তার ভিতরে বিকৃত বা বিপর্যস্ত হয় নি, এবং সেইজন্য বিরাট রবীন্দ্র-সাহিত্য হয়ে রয়েছে সুস্থ মানবতার এক মহান ছবি-যুগ যুগ ধরে যা থেকে জীবন-জিজ্ঞাসুরা অভয় আনন্দ ও উদ্দীপনা লাভ করবে। নৈবেদ্য দিয়ে যে বাংলার বিংশ শতাব্দীর আরম্ভ হলো এটি এক হিসেবে খুব অর্থপূর্ণ। নৈবেদ্য রবীন্দ্রনাথের এক শ্রেষ্ঠ কাব্য। এতে যেমন রূপ লাভ করেছে এক বীর্যবন্ত ঈশ্বরবোধ, অন্য কথায় সত্য ও কল্যাণবোধ, তেমনি রূপ লাভ করেছে স্বদেশ সম্বন্ধে তাঁর গভীর বেদনা আর বিপুল চেতনা। ইয়োরোপের দম্ভ ও লোভ সম্বন্ধে তিনি নিঃসন্দেহ, বিংশ শতাব্দীর প্রলয়ঙ্কর যুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণী সেইদিনে তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল এই ভাবে:

ছুটিয়াছে জাতিপ্রেম মৃত্যুর সন্ধানে
বাহি স্বার্থতরী গুপ্ত পর্বতের পানে।

আর তাঁর ভগবানের কাছে তার দেশবাসীদের হয়ে তিনি এই প্রার্থনা করেছিলেনঃ

বীর্যদেহ ক্ষুদ্র জনে
না করিতে হীন জ্ঞান, বলের চরণে
না লুটিতে।

দেখবার আছে এই চিন্তাধারার সঙ্গে একালের ভারতের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতার যোগ কত নিবিড়।

‘নৈবদ্যে’ রবীন্দ্রনাথের যে গভীর স্বদেশ-চেতনা প্রকাশ পায়, তা যে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে তাঁকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করবে কার্যক্ষেত্রে তা অপ্রত্যাশিত নয়। রবীন্দ্রনাথের সেইদিনের রূপ অনেক বাঙালির অন্তরে চিরদিনের জন্য মুদ্রিত হয়ে গেছে। কত কর্মী ও সাহিত্যিক যে সেইদিনে তার দ্বারা অজ্ঞাতসারে জীবনের ব্রতে দীক্ষিত হয়েছিলেন, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু স্বদেশী-আন্দোলনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত যোগ রক্ষা করতে পারলেন না মুখ্যত দুটি কারণেঃ প্রথমত, সেই আন্দোলনের এক বিশিষ্ট কর্মীদল সন্ত্রাসবাদে দীক্ষা গ্রহণ করলে; দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগত জীবনে মরমী-সাধনা তার ভিতরে প্রবল হলো। এই একান্ত মরমী সাধনার যুগে রচিত হয় ‘গীতাঞ্জলি’ ও সেই জাতীয় অন্যান্য কাব্য যার ইংরেজি অনুবাদ রবীন্দ্রনাথের জন্য আহরণ করে আনলো ইয়োরোপের জয়মাল্য, তথা সমগ্র ভারতের ও সমগ্র জগতের সমাদর। গীতাঞ্জলি’ যে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কাব্য নয় বাঙালি কাব্যরসিকদের অনেকের এই মত। তাদের কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথের এই মরমী-যুগের কাব্যগুলোকে বলতে চান তাঁর প্রতিভার গৌণ সৃষ্টি। বলা বাহুল্য এই শেষোক্ত মত বিশেষভাবে ভ্রান্ত–রবীন্দ্রপ্রতিভার বিশিষ্ট ক্রমবিকাশের দিকে এর দৃষ্টি নেই। গীতাঞ্জলি’র শ্রেণীর কাব্য তাঁর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ দান হিসেবেই গৃহীত হবার যোগ্য, কেননা সেসবে তাঁর ব্যক্তিত্বের এক অর্থপূর্ণ রূপ ফুটেছে। বিংশ শতাব্দীর রক্তলোলুপতাকে যে তিনি সেই শতাব্দীর সূচনায় গভীর ধিক্কার দিতে পেরেছিলেন, তার মূলে ছিল তাঁর নিবিড় ঈশ্বর-বোধ ‘গীতাঞ্জলি’ প্রভৃতি কাব্যের যা প্রধান বিষয়। (ঈশ্বর কখনো কখনো রবীন্দ্রনাথের কাব্যে হয়ে উঠেছেন এক মরমী ব্যাপার, কিন্তু মোটের উপর তার এই ঈশ্বরবোধের অন্য নাম সত্য ও কল্যাণের নিবিড় অনুভূতি একথা বলা যেতে পারে। সমগ্র রবীন্দ্রকাব্য এক অখণ্ড কাব্য, তার বিভিন্ন কাব্য সেই অখণ্ড কাব্যের বিভিন্ন সর্গ, এভাবে এই কবিকে পাঠ করতে চেষ্টা না করলে তার সত্যিকার মূল্য ও মর্যাদা উপলব্ধি সম্ভবপর নয়। তার বিভিন্ন কাব্যে তিনি একজন উৎকৃষ্ট গীতিকবি মাত্র, তাঁর কাব্যের সমগ্রতায়ই তিনি মহাকবি, মানব-চিত্তের প্রায় সমস্ত আকুলি-বিকুলি এই অপূর্ব চিত্তে রণিত হয়েছে আর মনোহর বাণী-রূপ লাভ করেছে।

রবীন্দ্রনাথ তেমন ব্যাপকভাবে বাংলার সমাদর লাভ করেন নি নোবেল-প্রাইজ লাভের পূর্বে একথা অনেকখানি সত্য, সেই সঙ্গে এও সত্য যে তাঁর একটি প্রকৃত অনুরাগী দল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকেই দেখা দিয়েছিলেন, আর অচিরে তারা বাংলা সাহিত্যের আসরে সম্মানিত আসন অধিকার করেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এইসব শিষ্য প্রধানত মুগ্ধ হয়েছিলেন তাঁর শিল্পচাতুর্যের দ্বারা। এঁরা অনেক উপভোগ্য কবিতা রচনা করেছেন, কিন্তু এদের মধ্যে হয়ত কালজয়ী হবেন একমাত্র সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার শিল্পচাতুর্যের জন্যই নয়, বরং তাঁর বিশ্বব্যাপক সহানুভূতির জন্যে। যেখানে যা কিছু সুন্দর ও মহৎ তার প্রতি এমন এক অকৃত্রিম অনুরাগ ও শ্রদ্ধা এই কবির কাব্যে ব্যক্ত হয়েছে যে সেজন্য তাঁকে সমাদর না করা সহৃদয় পাঠকদের পক্ষে অসম্ভব।

রবীন্দ্রনাথ যেদিনে মরমী সাধনায় নিমগ্ন, সেই দিনে বাংলার সাহিত্য-ক্ষেত্রে আবির্ভূত হন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আর অচিরে প্রবল ভাবে আকর্ষণ করেন দেশের মনোযোগ। শরৎচন্দ্রকে আমাদের কোনো কোনো সমালোচক বলেছেন, বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। শরৎচন্দ্রের অঙ্কন-কুশলতা পরমাশ্চর্য সন্দেহ নেই, তবু তার মহিমা কালে কিছু ম্লান হবে বলেই কারো কারো ধারণা, কেননা কবি-কল্পনা তাতে কিছু। কম আর তার চিন্তাভাবনার পরিধি অপেক্ষাকৃত স্বল্পপরিসর-এই শেষোক্ত ক্রটি এযুগের সাহিত্যে বড় ত্রুটি। কিন্তু সমস্ত ত্রুটি সত্ত্বেও শরৎচন্দ্র চিরদিন তাঁর পাঠকদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করবেন, দুঃস্থ পতিত ও নির্যাতিতদের জন্য তাঁর অপরিসীম সমবেদনার গুণে। তার এই সমবেদনার মূলে তার এই গোপন বিশ্বাস যে, মানুষ স্বভাবত সুন্দর ও মহৎ, তার যত ভুল ত্রুটি পাপ সব যেন বাইরে থেকে লাগা ধূলা কাদা, একমুহূর্তে তা ঝেড়ে ফেলে মানুষ আপন মাহাত্মে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এই গোপন বিশ্বাসের জন্য শরৎচন্দ্রের তথাকথিত ‘রিয়ালিজম সত্ত্বেও আমরা তাকে জ্ঞান করি বাংলার নবজাগরণেরই সন্ততি হয়ত সর্বকনিষ্ঠ সন্ততি, কেননা সেই নবজাগরণ প্রধানত লালিত হয়েছে একটি নব বীর্যন্ত বিশ্বাসের দ্বারা।[দ্র: শরৎ-প্রতিভা।] রামমোহন, ডিরোজিও কেশবচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, এঁরা সবাই যে এক নববিশ্বাসের দ্বারা অনুপ্রাণিত সে-কথা সবিস্তারে বলবার দরকার করেনা, এমন কি মধুসূদন-যিনি মুখ্যত শিল্পী, তাঁকেও বলা যায় ধার্মিক প্রাচীন গ্রিক অর্থে-তিনি নব প্রমেথেউস, দেবতার সমস্ত দ্রুকুটি উপেক্ষা করে মানুষের জন্য আহরণ করেছেন আত্ম-সম্মান।

শরৎচন্দ্রের আবির্ভাবের কয়েক বৎসর পরেই বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনিও শরৎচন্দ্রের মতো বাঙালির চিত্ত জয় করে নেন স্বল্পকালে। তিনি যখন বাংলার সাহিত্যিক-সমাজে পরিচিত হন ১৯১৯-২০ খ্রিস্টাব্দে-তখন তার বয়স বোধ হয় বিশ বৎসর। কাজেই বাংলার স্বদেশী আন্দোলনের প্রবলতার দিনে তিনি নিতান্ত বালক ছিলেন। কিন্তু যেমন করেই হোক স্বদেশী আন্দোলনের সমস্ত বীর্য নিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হলেন। তাঁর অপূর্ব তারুণ্য আর অপূর্ব স্বাধীনতাপ্রীতি দেখতে দেখতে তাকে প্রিয় করে তুললো বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতারা। এর সঙ্গে মিলিত হলো তাঁর স্বসম্প্রদায়ের নব তেজোবীর্য লাভের জন্য তার আকাঙ্ক্ষা আর ১৯১৪-১৮ সনের যুদ্ধোত্তর বিপন্ন ইসলামের জন্য তাঁর বেদনা। নজরুল ইসলাম একালের বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম সাহিত্যিক যিনি বাংলার মুসলমান ও হিন্দু উভয়ের চিত্ত আন্দোলিত করতে সক্ষম হলেন। তার পূর্বে একালেও শক্তিশালী মুসলিম সাহিত্যিক যে বাংলায় না জন্মেছেন তা নয়। মীর মোশারফ হোসেন, কায়কোবাদ, এয়াকুব আলি চৌধুরী, লুৎফর রহমান, বেগম রোকেয়া, কাজী ইমদাদুল হক প্রভৃতির নাম একালের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু নজরুল ইসলামই হচ্ছেন এযুগের প্রথম বাঙালি মুসলমান যিনি সমস্ত দেশের সম্ভ্রম ও সমাদর লাভ করলেন। শুধু বাংলায় নয় ভারতেও তাঁর যশ আজ ছড়িয়ে পড়েছে। তার পরে সমস্ত দেশের সমাদর লাভ করেছেন মুসলমান পল্লীকবি জসীমউদ্দিন।

নজরুলের সমসাময়িক মর্যাদা যত বড়ই হোক, তার সত্যিকার সাহিত্যিক মর্যাদা কি এই নিয়ে বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে তর্ক হয়েছে। সেক্ষেত্রে তাঁকে নিতান্ত স্বল্পজীবী বলতেও কেউ কেউ কুণ্ঠিত হন নি। কিন্তু বর্তমানে সে-মতের পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলার সাহিত্যিকসমাজ আজ প্রায় নিঃসন্দেহ যে, নজরুল বিংশ শতাব্দীর বাংলার-শুধু বাংলার নয় ভারতের-একজন স্মরণীয় কবি। তাঁর দোষ ত্রুটি যতই থাকুক সমস্ত অতিক্রম করে বিচ্ছুরিত হয়েছে তার প্রাণাবেগ, আর বাংলার সাহিত্যিকদের মধ্যে একমাত্র তিনিই গণচিত্ত বিশেষভাবে স্পর্শ করতে সমর্থ হয়েছেন। একালে দেশের যে গণশক্তির উত্থান তার মূলে নজরুল-প্রতিভা বিশেষভাবে কার্যকরী হয়েছে। এই দিক দিয়ে তার ঐতিহাসিক মর্যাদা অসাধারণ।

নজরুলের প্রসঙ্গে সহজেই এসে পড়ে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের সাহিত্যিক দানের কথা। সেকালের মুসলমান যে বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অংশ গ্রহণ করেছিলেন, একথা স্বীকৃত হয়েছে। লোকসাহিত্যে মুসলমানের দান হিন্দুর মতোই শ্রদ্ধেয়। ভারতীয় দার্শনিক সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অভিভাষণে কতিপয় মুসলিম বাউলের গান শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু একালের শিক্ষিত মুসলমান যে একালের বাংলা সাহিত্যে তেমন উল্লেখযোগ্য অংশ গ্রহণ করতে পারেন নি এ অনস্বীকার্য। এর প্রধান কারণ অষ্টাদশ শতাব্দীর রাজনৈতিক পরিবর্তন, আর ঊনবিংশ শতাব্দীর ওহাবী আন্দোলন। রাজনৈতিক পরিবর্তনে সহজেই পূর্বের প্রাধান্যগর্বিত মুসলমান অপ্রধান হয়ে পড়লো। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মুসলমান প্রধানত ইংরেজের সঙ্গে করলো বিরোধিতা, হিন্দু করলো মিতালি। দ্বিতীয়ার্ধের সূচনায় ঘটলো সিপাহী বিদ্রোহ, যার ফলে মুসলমান ব্যাপকভাবে রাজরোষের পাত্র হলো। এর সঙ্গে ওহাবী আন্দোলন তাদের করলো অতীতমুখী। স্যার সৈয়দ আহমদের আলিগড় আন্দোলনের ফলে পশ্চিমী মুসলমানের মানসিক ও সাংসারিক অবস্থার কিছু উন্নতি হলো, কিন্তু বাংলায় সে-ঢেউ তেমন পৌঁছলো না। স্যার সৈয়দের শিষ্য সৈয়দ আমির আলি বাংলার ইংরেজি-শিক্ষিত মুসলমানদের অন্তরে নবীন-পন্থিত্বের এক ক্ষীণ রশ্মি প্রবেশ করাতে পারলেন, কিন্তু সে-রশ্মি এত ক্ষীণ যে, কার্যক্ষেত্রে তা নিষ্ফল হলো। বিংশ শতাব্দীর সূচনায় বাংলার শিক্ষিত মুসলমানের অন্ত রে শ্রদ্ধার আসন লাভ করলে, বাংলার শিক্ষিত হিন্দু বিশেষ করে স্বদেশী আন্দোলনে তার সাফল্যের ফলে। নজরুল ইসলাম সাহিত্যে প্রবেশ করেন এই পরিবেশে। হিন্দু পুরাণের সঙ্গে তাঁর গভীর পরিচয়ের কিছু ব্যাখ্যা মিলবে এই থেকে।

নজরুল যখন গণ-সংযোগে একান্ত রত সেই দিনে ১৯২৬-২৭ খ্রিস্টাব্দে-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমণ্ডলে একটি ক্ষুদ্র মুসলিম-চিন্তাশীল দলের উদ্ভব হলো। এই দলের মন্ত্র হলো ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আর নিজেদের তারা ঘোষণা করলেন কামাল-পন্থী বলে’। সেই দিনে মুসলিম তরুণ-সমাজে এই দল একটি বিশিষ্ট চিন্তাধারা প্রবর্তিত করতে সক্ষম হয়েছিল। এর সঙ্গে নজরুলের সংস্রব এর প্রভাব কিছু বাড়িয়েছিল। কিন্তু অচিরে ব্যাপকভাবে মুসলমানসমাজ থেকে এর প্রতি বিরোধিতা এমন প্রবল হলো যে যোগ্যভাবে কাজ করবার সুযোগ এর লাভ হলো মাত্র চার পাঁচ বৎসরের জন্য। [দ্র: নব-পর্যায়-পরিশিষ্ট।] এই সমাজ অবশ্য সক্রিয় ছিল আরো দীর্ঘ দিন। এর দুই এক জন সাহিত্যিক আজো এক রত রয়েছেন সাহিত্য-সেবায়। কিন্তু ব্যাপকভাবে বাংলার শিক্ষিত মুসলমান সমান এঁদের প্রভাব আজ কম। এঁদের বুদ্ধির মুক্তি’র মন্ত্রের পরিবর্তে বাংলার মসলমান সমাজ আজ ব্যাপকভাবে নিতে চাচ্ছেন ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের মন্ত্র। চাচ্ছেন মাত্র এই কথাটাই আপাতত এঁদের সম্বন্ধে প্রযোজ্য, কেননা নেতৃত্ব ও অনুবর্তিতা কিছুই আজো ব্যাপকভাবে বাংলার মুসলমানসমাজে তেমন সত্য হয়ে ওঠে নি। বাংলার মুসলমানদের মধ্যে যারা অগ্রগণ্য সাহিত্যিক (শ্রীযুক্ত অন্নদাশঙ্কর ও শ্রীমতী লীলা রায়ের গ্রন্থে তাদের অনেকের নাম উল্লিখিত হয়েছে। তারা অবশ্য আজো প্রধানত বুদ্ধির মুক্তিবাদী। তবে মোটের উপর তারা নিঃসঙ্গ সাহিত্যিক। আত্মনিয়ন্ত্রণী দলের সাহিত্যিক ও সাহিত্যোৎসাহীদের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য হয়েছেন ফররুখ আহমদ। তিনি ইকবালের অনুবর্তী হতে চেষ্টা করছেন, যদিও ইকবালের দার্শনিক মেজাজ তার নয়। তিনি তরুণ, কোনো বিচার-বিশ্লেষণ নয় সুপরিণতিই তার জন্য আজ কাম্য।

ঢাকায় যেসময়ে চলেছিল মুসলিম ‘বুদ্ধির মুক্তি’বাদীদের কাজ সেইকালে বাংলার ব্যাপক সাহিত্যের আসরে আগমন ঘটলো একদল তরুণ সাহিত্যিকের–এঁরা নিজেদের বললেন, অথবা নাম পেলেন, অতি-আধুনিক। গোকুল নাগ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত প্রভৃতি হলেন এর ধুরন্ধর। এঁদের মন্ত্র রূপ পেল প্রেমেন্দ্রমিত্রের এই উক্তিতে:

আমি কবি যত কামারের আর কাঁসারির আর ছুতোরের মুটে মজুরের,
আমি কবি যত ইতরের।

এঁদের মধ্যে বুদ্ধদেব ও অচিন্ত্যকুমার বিশেষভাবে হলেন ফ্রয়েড-পন্থী, দেশের অভিশম্পাত বিপুলভাবে বর্ষিত হয়ে চললো তাদের শিরে। কিন্তু গাল খেয়ে এই দল আরো ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগলো। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এঁদের জন্য চিন্তিত হলেন, এঁদের সঙ্গে তাঁর অপ্রিয় বাণী-বিনিময়ও চলো-যেমন চলেছিল উনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় জার্মাণীতে গ্যেটে শিলারের সঙ্গে রোমান্টিসস্‌টদলের যোঝযুঝি।

কিন্তু অতি-আধুনিকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিরোধ দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। রবীন্দ্রনাথ চিরতারুণ্যের কবি, তার উপর তিনি অচিরেই নিঃসন্দেহ হলেন এঁদের অনেকের সাহিত্যিক সম্ভাবনা সম্পর্কে। তরুণদের দাবি এই যে অল্পদিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের উপরে পড়েছিল তাঁদের প্রভাব–রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের রচনায় রয়েছে তার পরিচয়। অতি-আধুনিকদের এই দাবি যে অপ্রবল নয়, তার প্রমাণস্বরূপ কেউ কেউ উল্লেখ করেন তার শেষ বয়সের বিখ্যাত উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’, তারা বলতে চান এতে নায়ক-নায়িকার প্রেমের যে-পরিণতি রবীন্দ্রনাথ দেখালেন এর পূর্বে সে-পরিণতি দেখাতে তিনি হয়ত সমীহ করতেন। কিন্তু অতি-আধুনিকদের দাবি অপ্রবল না হলেও সত্য নয় এই বড় কারণে যে, তরুণরা মুখ্যত আত্মকেন্দ্রীক ও ভোগবাদী। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আত্মকেন্দ্রীক ও ভোগবাদী যতখানি তার চেয়ে গতিবাদী ও বৃহত্তর মানবসমাজের স্পর্শকামী বেশি। এর উপরে রয়েছে রুচির পার্থক্য রবীন্দ্রনাথের রুচির সৌকুমার্য থেকে অতি-আধুনিকরা সেদিনে যথেষ্ট দূরে ছিলেন। শেষের কবিতা’কে বরং জ্ঞান করা যেতে পারে অতি-আধুনিকদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের এক সস্নেহে ইঙ্গিত-তাদেরই পথে প্রকৃত সাহিত্যিক সার্থকতার দিকে।

আস্তে আস্তে অতি-আধুনিকরা নিজেদের অনেক ত্রুটি কাটিয়ে উঠতে পারলেন। তাঁদের অনেক রচনা-পদ্য গদ্য দুইই-আজ শুধু পাঠ্য নয় আনন্দপ্রদও। চিন্তা ভাবনায়ও তারা অনেক পরিচ্ছন্নদৃষ্টি-নব-হিন্দুত্বের কুয়াসা তাঁরা অনেকে কাটিয়ে উঠেছেন, আর সহজভাবেই তাকিয়ে দেখছেন মানুষকে আর তার পরিবেশকে। কিন্তু এদের বড় দুর্ভাগ্য হয়ত এই যে, এরা জন্মেছেন রবীন্দ্রনাথের অব্যবহিত পরে। রবীন্দ্রনাথকে এঁরা অতিক্রম করতে পারছেন না, পাশ কাটিয়ে যেতেও পারছেন না, যদিও সে-চেষ্টায় তাদের ক্রটি নেই (সেইটেই অবশ্য এঁদের বড় দুর্বলতা) আর সে জন্যই পরবর্তীকালে অনেকখানি হীনপ্রভ হতে এঁরা বাধ্য যদি আরো বড় হতে না পারেন। কেননা সাহিত্যে পুনরাবৃত্তির তেমন মর্যাদার স্থান নয়, সাহিত্যে মর্যাদার স্থান। তুঙ্গশীর্ষ অ-সাধারণদের। তবে তরুণ কবিদের মধ্যে বিষ্ণু দে এমন একটি বিশিষ্ট ভঙ্গি অর্জন করেছেন, যার উপরে সৌন্দর্যের স্বাক্ষর পড়েছে মনে হয়।

গদ্য-লিখিয়েদের মধ্যে ইতিমধ্যেই বিশেষ খ্যাতিমান হয়েছেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর রায়, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বনফুল’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁদের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছেন তারাশঙ্কর, হয়ত যোগ্যভাবেই। অতি-আধুনিকদের মারাত্মক আত্মকেন্দ্রিকতা তিনি পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলতে পেরেছেন মনে হয়। বাংলার গ্রামদেশের সঙ্গে তার পরিচয় অতি নিবিড়, অঙ্কন-ক্ষমতাও পর্যাপ্ত। তার সঙ্গে মিলেছে তার দূরপ্রসারী দৃষ্টি, বাঙালির ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত সংসার তিনি দেখেছেন, সেই সঙ্গে তাকাতে চাচ্ছেন তার নতুন-ক’রে গড়ে-তোলা আবাসভূমির পানে।

রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যে আজ জেগেছে নব সম্ভাবনার আশা যদিও আজকার বাংলাদেশ রাজনীতি ও অর্থনীতির দিক দিয়ে এক অরাজক ক্ষেত্র।

১৯৪৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *