নবপর্যায়
[ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধ করা হয়নি]
প্রশস্তি
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্” বদনেতে, চরিতে তোমার, হে মহান, হে নরগৌরব! মরুভূমে মরূদ্যান, ভীমকান্ত দরশন তব,-উৎসারিত আত্মার সৌরভ!
যারা যত দীনহীন, অন্ধ, পঙ্গু, মূক, দিশাহারা, জন্ম তব তাহাদেরি ভিতে; জড়তায় রূঢ় স্পর্শ, অন্ধকারে বজ্ৰদীপ্তি তুমি,-জয় গাহে কবি মৃগ্ধ চিতে!
যে তৌহীদ বিঘোষিলে তন্দ্রাহত জগতের কানে, বীর্যবান সে যে বীর্যবান, সমস্ত অন্তর মাঝে ফুকারিয়া দেয় অগ্নিকণা, কহে, “নাহি আল্লা ভিন্ন আন; “সে-আল্লার ভাতি, সে তো নহে শুধু ধেয়ানীর চিতে, নহে শুধু ভকতের বকে, “জাগ্রত দেখহ তারে সর্বকর্মে সর্ব প্রেমে তব, সর্ব ভয়ে, সর্ব বন্ধ-দুখে।”
হে অমর-’পয়গাম্-বহ, হে মহাতাপস, সঙ্কটবন্ধনেনদ্ভিন্ন হে সৃষ্টির চিরদীপ্ত প্রাণ! মহাকালকণ্ঠশোভী অম্লান রতন, প্রত্যয়বিগ্রহ মূর্ত, কর কর তব ছন্দ দান।
মূঢ়, মূক, নজপৃষ্ঠ, নিরানন্দ, নিবীর্য, শ্রীহীন-সুন্দর এ পৃথ্বীবুকে পুনঃ সেই শরণে তোমার;
বজ্র হানি কহ পুনঃ, “মিথ্যা কথা-অসম্ভব কথা!-আত্মা কভু নহে ক্ষুদ্র, নহে দীন প্রকাশ তাহার।”
মুস্তফা কামাল সম্বন্ধে কয়েকটি কথা
মুসলমান-জগতের, বিশেষ করে ভারতীয় মুসলমানদের, আবেদন-নিবেদন, কান্না অভিমান, হুঙ্কার আর আস্ফালন, যখন এক বিদ্রুপের চেহারা নিয়ে জগতের শক্তিমানদের সভায় মনোরঞ্জনের কার্যে ব্যাপৃত ছিল, তখন একদিন কামালের বহস্তে উদ্যত হলো তাঁর জন্মভূমির এককোণে নিরালায় শাণিত তলোয়ার। সেবারকার মতো শক্তিমানদের আরাম আর কৌতুকের উপর যবনিকা পতন হলো; আর মুসলমানজগত বিস্ময় পুলক, আর তারীফের বন্যায় দিকহীন লক্ষ্যহীন হয়ে’ ভাসতে লাগলো।
আমাদের তরুণ কবির সেদিনকার যে প্রাণময় উচ্ছ্বাস
“কামাল তু নে কামাল কিয়া ভাই”!
७१७
সেদিন ঐ-ই ছিল আমাদের সকলেরই অন্তরের অন্তরতম কথা।
কিন্তু বিধাতা যে নীরব উপহাসে আমাদের সেদিনকার সমস্ত মুগ্ধতা উপভোগ করছিলেন সে কথা কি আর আমরা ভাবতে পেরেছিলাম! তুর্ক-সুলতানের সিংহাসন চ্যুতি, কামালের পত্নীর পর্দাহীনতা, এবং তাঁর এরকম আরো ছোট-খাটো ‘অনৈসলামিকতা’র ভিতর দিয়ে ক্রমে আমাদের ধৈর্য-পরীক্ষা শুরু হলো। যুগধর্ম অর্থশূন্য নয়; আমাদের অশেষ গৌরব-আর আশা-ভরসাস্থল কামালের এই সব অনাচার নীরবে সহ্য করে যাওয়া হয়তো আমাদের পক্ষে অসম্ভব হতো না। কিন্তু অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস! যার হাতে আমাদের নষ্ট গৌরবের পুনরুদ্ধার হবে বলে আমরা সর্বান্তঃকরণে আশা করেছিলাম, তিনিই ভেঙে চুরমার করে দিলেন আমাদের বহু স্বপ্ন বহু অশ্রু দিয়ে গড়া খেলাফত! শুধু তাই নয়; সমাজের শীর্ষস্থানীয়, যুগে যুগে পুঞ্জীভূত শাস্ত্রজ্ঞানের যাঁরা ভাণ্ডারী, সেই আলেমসম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর যে দৃষ্টি তা আদৌ শ্রদ্ধাবিঘ্ন নয়। আর তার যোদ্ধার কঠোর হস্ত নিপতিত হয়েছে মুসলিম নারীর সুপবিত্র, সুবিহিত, যুগযুগান্তরাগত, অবরোধের উপরে!
-তবে রহস্য এইখানে যে, এ আফসোস শুধু একতরফাই নয়। হজরত মোহম্মদ তাঁর পয়গাম্বরীর প্রারম্ভে তাঁর নিজের চরিত্রের সাক্ষ্য দিয়ে কোরেশদের বলেছিলেন,-যাকে তারা এতকাল ধরে’ জানেন বিশ্বাসী, ইমানদার, আল-আমীন বলে তিনিই যখন আল্লাহর একত্ব প্রচার করছেন তখন কোন্ যুক্তিতে তারা তার সে কথা অবিশ্বাস করতে পারেন। হজরতের এই ব্যথিত প্রশ্নে কোরেশরা যে উত্তর দিয়েছিলেন, প্রাচীন পন্থীরা নবীন পন্থীদের চিরকাল সেই উত্তরই দিয়ে আসছেন। আদর্শের জন্য বড় নিষ্করুণ এ ভ্রাতৃবিরোধ। এর আঘাত দেহের উপরে যা লাগে, উভয় পক্ষেরই হৃদয়ের অন্তস্থলে লাগে তার চাইতে অনেক বেশী নির্মমভাবে। কিন্তু উপায় নেই। এই-ই বিশ্ববিধান। নব সত্যের প্রচারের, নব পর্যায়ের জীবনারম্ভে এই নির্মমতার চিত্ৰই ইতিহাসের উপহার।
একই সমাজে একই সময়ে বিভিন্ন পন্থী লোক বাস করে, আর কামাল আধুনিক কালের মুসলমান সমাজের নবীন পন্থীদের একজন বড় নেতা, নিশ্চয়ই এসব কথা সবিস্তারে বলবার প্রয়োজন করে না। অতটুকু যুগধর্ম কি আর আমাদের ভিতরে সঞ্চারিত হয় নি! কিন্তু আমাদের প্রকৃত অবস্থা কি তার প্রমাণ এইখানে যে, সমাজের এই যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, নবীনপ্রাচীনের দ্বন্দ্ব প্রত্যক্ষ করে, আমাদের সমাজের অধিকাংশ ব্যক্তি-অন্তত যাঁদের বলবার মত কণ্ঠশক্তি, আর নিজেদের কথা ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করবার মতো অর্থ-শক্তি আছে তারা-অন্তরে শুধু উদ্বেগ আর পীড়নই অনুভব করছেন; যুগ-ধর্মের এই সব বিচিত্র চেষ্টার উদ্দেশ্য তাঁদের আশীর্বাদের হস্ত আদৌ উত্থিত হচ্ছে না বলে অত্যুক্তি হয় না। উল্টে’ জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে, জগতের মানব-সমাজের এক উল্লেখযোগ্য অংশের পক্ষে একি খুব গৌরবের বিষয়? শিশুসলভ এই পরিচিতের একান্ত মোহ আর কতকাল আমাদের পক্ষে প্রবলতম হয়ে থাকবে? কতকালে আর আমাদের সমাজ-মনে যৌবনের সঞ্চার হবে, যার প্রভাবে
৩৭৪
বুঝতে পারা যাবে, ব্যক্তিগত জীবনের মতো সমাজ-জীবনেরও ধর্ম পরিবর্তন,-উদ্দেশ্য থেকে উদ্দেশ্যে সম্প্রসারণ, আদর্শ থেকে আদর্শে উন্নয়ন?
জানি, প্রতিপক্ষের এখানে একটি শক্ত জবাব আছে। তাঁর উক্তিতে দাঁড়াবে,-”আমাদের যে সামাজিক, রাজনৈতিক, অথবা ব্যক্তিগত জীবনাদর্শ, তার স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে আমাদের ধর্মশাস্ত্রে। তার সে ধর্মশাস্ত্র যে অপৌরুষেয়- revealed. এরই পরিবর্তন হবে না কি?”-সম্মানপুরঃসর প্রতিপক্ষকে নিবেদন করতে চাই,-হাঁ এই কথাটাও ভেবে দেখা দরকার। অন্যান্য দেশে বা সমাজে যারা নব নব প্রয়োজনে জীবনরহস্যকে নব নব ভাবে বুঝতে চেষ্টা করেছেন, শাস্ত্রের অপৌরুষেয়তার কি অর্থ তাদের সামনে দাঁড়িয়েছে সে সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল হতে পারা খুব কষ্টসাধ্য নয়। ইয়োরোপীয় রেনেসাঁস, অথবা আমাদের অতি নিকটের রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, কেশবচন্দ্র ও রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ প্রভৃতির ভিতর দিয়ে ধর্ম ও সমাজ-জীবনে বাঙালি হিন্দুর যে কিছু নব চৈতন্যলাভ, সেইটি প্রণিধান করলেও প্রাচীন শাস্ত্রের সঙ্গে নব
পর্যায়ের জীবনের যে কি সম্পর্ক দাঁড়ায় তা উপলব্ধি করা সহজসাধ্য হবে।
এসব বাদ দিয়ে শুধু মুসলমানের অতীত ইতিহাস থেকেও স্পষ্টভাবে দেখানো। যেতে পারে, মুসলমানের গৌরবের দিনে শাস্ত্রের একই ব্যাখ্যা তার ভিন্ন ভিন্ন যুগে চলে নি। বর্তমান কালে দুর্ভাগ্য বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের যে বিশ্বাসবানরা ধ্রুব নিশ্চয় করে বসে আছেন, মুসলমানের চরম কৃতিত্ব, হজরত তার জামায় কি ধরণের বোতাম ব্যবহার করতেন, আর তার আস্হাবরা কি ধরণের খাদ্য চর্বণ করতেন, সেই সমস্ত তত্ত্বের পুঙ্খানুপুঙ্খ উদ্ধারে, তাঁদের গণনার বাইরে রেখে এ সমস্ত কথা আলোচনা করা ভিন্ন আর উপায় কি আছে। তাঁদের বাইরে আমাদের সমাজের যারা শিক্ষিত, যারা জিজ্ঞাসু, যারা জ্ঞানী, তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, অন্যান্য জাতির বা দেশের ইতিহাসের মতো ইসলামের ইতিহাসও শুধু একই আদর্শের অপ্রতিহত প্রবাহ নয়। বিভিন্ন জাতি ও ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার সংস্পর্শে এসে সে ইতিহাস ভিন্ন ভিন্ন যুগে বিভিন্ন রূপ গ্রহণ না করে পারে নি। তাই হজরতের জীবিতাবস্থায় ও ‘খোলাফায়ে রাশেদীন’ এর প্রথম যুগে মুসলমানের জীবনে দেখতে পাই যে সবল ঋজুতা আর অনাড়ম্বর, তা থেকে দূরে পারশ্য-প্রভাবান্বিত বনি-আব্বাসের যুগে দেখতে পাই, সেই ঋজুতার স্থানে দাঁড়িয়েছে জটিলতা, বহুভঙ্গিমতা, আর আড়ম্বরহীনতার স্থানে ফুটে উঠেছে ঐশ্বর্যের ও বিলাসিতার দীপ্তি। চিন্তা ও সৃষ্টির দিক দিয়ে মোতাজেলাদের যুগ, সুফীদের যুগ, আর ভারতীয় আকবর-শাহজাহানদের যুগ, এমনি বিভিন্ন আদর্শাবলম্বী, বিভিন্নরূপী।
মুসলমান-ইতিহাসের স্তরে স্তরে এইভাবে একলা বৈচিত্র্যহীনতাই যে আমাদের দৃষ্টিপথে পড়ে না, তা মুসলমানের মন্দ ভাগ্যের জন্যও নয়, শক্তিহীনতার জন্যও নয়, এই বৈচিত্র্যবিপুলতাই মানব-প্রকৃতির জন্য সত্য। কথাটাকে অন্য ভাবেও বলা যেতে পারে। হজরত ওমর আর হারুণ-অর-রশীদ উভয়েই ছিলেন খলিফা; কিন্তু একজনের “এফতারী” ছিল চারটি ছোলা, আর-একজনের বাবুর্চিখানার দৈনিক খরচ ছিল দশহাজার দিরহাম। অথচ হারুণ-অর-রশীদকে মুসলমান ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া চলে না, বাদ দিলে মুসলমানের গৌরব-সৌধের এক বিরাট স্তম্ভই ভূমিসাৎ হয়ে যায়।
७१०
–
–
–
—
–
–
–
–
–
–
–
–
–
–
–
–
–
—
তেমনিভাবে ইবনেরোশ আর ইমাম গাজ্জালী দুজনেই মহাপণ্ডিত মুসলমান; কিন্তু একজনের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান চিন্তার স্বাধীনতা, যুক্তি-বিচার, আর একজন শাস্ত্রানুগত্যকে শ্ৰেয়ো-লাভের এক বড় পথ বলেই জানেন। ইত্যাকার বহু দুষ্টান্তই দেওয়া যেতে পারে-যেমন বীরকেশরী ইবনে জুবের আর বীরকেশরী বাবর, বাদশাহ নাসিরুদ্দিন আর বাদশাহ শাহজাহান, কবি সাদী আর কবি হাফিজ-যাদের স্বাতন্ত্রের ভঙ্গিমা দেখে দৃষ্টিমান মাত্রেরই মনে পড়বে, চিররহস্যময় মনুষ্য-জীবন দৃশ্যত একই আদর্শের কিরণসম্পাতে বর্ধিত হয়েও কত রকমারি বৈচিত্র্যেই না অনুরঞ্জিত হয়-নয়নাভিরাম হয়!
বাস্তবিক, যে-কোনো তত্ত্বের চাইতে, যে-কোনো আদর্শের চাইতে মানব-প্রকৃতি গভীরতর, জটিলতা। যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার ধারায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে আত্মপ্রকাশ করাতেই তার সার্থকতা।-এসব জ্ঞানের একেবারে গোড়ার কথা। এসব না বোঝা, আর জ্ঞানের দিকে একেবারে পিঠ ফিরিয়ে জীবন আরম্ভ করা, এক কথা। সমাজের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যকে যদি মানা না যায়, তবে সমাজ যে মানুষের বাস আর পরিবর্ধনের জন্য অযোগ্যই হয়ে দাঁড়ায়, একথা অস্বীকার করবার মতো স্পর্ধা কেবল তিনিই দেখাতে পারেন, স্পর্ধা ভিন্ন অন্য সম্বল লাভ যার পক্ষে জীবনে সম্ভবপর হয় নি।
প্রত্যেক সমাজে যে বৈচিত্র্য-বিলাসী মানুষ বাস করে, শুধু বিশেষ বিশেষ আদর্শের, মতবাদের, ‘ডগৃমা’র, লীলাক্ষেত্রই মানুষের সমাজ নয়; আর সেই মানুষ জম্ভধর্মী, অর্থাৎ জন্তুর মতো ক্ষুৎপিপাসার তাড়নায় অধীর, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অভিলাষী; এ সমস্ত কথা ভুলে থাকা আর কোনোমতেই আমাদের শোভা পায় না। মানুষের যে জাগতিক জীবন, এই জাগতিক জীবন যদি সুন্দর না হয়, সুব্যবস্থিত না হয়, তবে সত্যিকার নৈতিক জীবন, আধ্যাত্মিক জীবন, তার পক্ষে সুদূরপরাহতই হয়ে থাকে। সুপক্ক ফল যেমন বিস্তারিত নৈসর্গিক ক্রিয়ার পারম্পর্যের অপেক্ষা রাখে, ওটি একটা বিপুল চেষ্টার পরিণত অবস্থা, তার খণ্ডতা নয়, তেমনিভাবে ভাব, জ্ঞান, আর অর্থ-সমৃদ্ধ, জাগতিক জীবনেরই অপরিহার্য পরিণতি দাঁড়ায় নৈতিকতায়, আধ্যাত্মিকতায়। শুধু অনুকরণ, শুধু পূর্বানুবর্তিতা সত্যিকার আধ্যাত্মিকতা-লাভের পক্ষে নিতান্তই তুচ্ছ-অর্থহীন। এর জন্য প্রয়োজনীয় একটা বলিষ্ঠ, ঘাতসহ, মানব-প্রকৃতি, সুব্যবস্থিত জাগতিক জীবনের উপরই যার ভিত্তিপত্তন সম্ভবপর।
মুস্তফা কামালের প্রশংসায় আজ আমরা যে প্রবৃত্ত হয়েছি, তার কারণ সমগ্র মুসলমান-জগতের বহুবিস্তৃত জীবতোর মাঝখানে তিনিই পর্যাপ্ত পরিমাণে এই সুন্দর জাগতিক জীবনের তত্ত্ব নূতন করে উপলব্ধি করেছেন-শুধু উপলব্ধি নয়, তার সে উপলব্ধিকে নানা প্রতিষ্ঠানের ভিতর দিয়ে ফুটিয়ে তুলে’ এর অমৃত-রস তার স্বদেশীয়দের অন্তরেও পৌঁছে দিতে পেরেছেন। কি পর্বতপ্রমাণ বাধা অতিক্রম করে’ তিনি নবসৃষ্টির কাজে প্রবৃত্ত হয়েছেন, তা ভাবলে চমৎকৃত না হয়ে থাকা যায় না। প্যান-ইসলাম তত্ত্বকে যে সমগ্র মুসলমানজগত সাদরে বরণ করে নিয়েছে, সে শুধু ধর্মপ্রীতির জন্যই নয়; বর্তমান জগতে মুসলমানের যে স্থান লাভ হয়েছে, স্বীকার করতেই হবে, তা অগৌরবের; এই হীনতাপঙ্কে সে যাতে একেবারে নিমজ্জিত হয়ে না
৩৭৬
যায় এই জন্যও তার এই সঘবদ্ধতার এত উৎসাহ। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এই প্যান ইসলামের তথাকথিত সঙ্ঘবদ্ধতা কি মুসলমানের দুর্বলতাকেই লালন করে চলে নি? ভিন্ন ভিন্ন দেশে তাদের সত্যিকার অবস্থা কি, কি উপায় অবলম্বন করলে পুনরায় তারা শক্তিমান হয়ে সম্মানিত জীবন যাপন করতে পাবে, এ সবের দিকে এই সঙ্ঘবদ্ধতা তাদের দৃষ্টিকে কি অন্ধ করেই রাখে নি? অথচ উদ্ধারের পথও এখানে কম সঙ্কটসঙ্কুল নয়। এই হীনতাপঙ্কে দাঁড়িয়ে দৃশ্যতঃ এই একমাত্র অবলম্বনকেও বিসর্জন দিয়ে, একেবারে গোড়া থেকে নব-সৃষ্টির কাজে লাগা!-বীরের যোগ্য এ কর্ম!-পরম আত্মপ্রতিষ্ঠ দৃষ্টিমানের যোগ্য এ কর্ম! বাস্তবিক আধুনিক মুসলমানের জন্য অতি অপ্রোয়জনীয় এবং রাজনীতির দিক দিয়ে অতি অনিষ্টকর এই খেলাফত-জঞ্জাল সবলে দূর করে দিয়ে মুসলমানের ইতিহাসে তথা মানুষের ইতিহাসে, কি অসাধারণ বীররূপে কামাল যে নিজেকে পরিচিত করেছেন পরবর্তীকালের ঐতিহাসিক তার মহিমা শতমুখে ঘোষণা করেও তৃপ্তি পাবেন না। নানা-সংস্কার-জর্জরিত হীন ক্ষীণ তামসিক জীবনযাত্রার পরিবর্তে এই যে তিনি প্রচলিত করলেন সর্বপ্রকারে-সমৃদ্ধ, সুন্দর, সবল, জাগতিক জীবন, জীবনের উপর প্রাচীন শাস্ত্রের সর্বময় কর্তৃত্ব অস্বীকার করে তার স্থানে এই যে তিনি প্রতিষ্ঠিত করলেন মানববুদ্ধির অধীশ্বরত্ব, মুসলমানসমাজে সত্যিকার আধ্যাত্মিক জীবনের স্থায়িত্ব আর পরিব্যাপ্তি এরই থেকে ভবিষ্যতে সম্ভবপর হবে।
এ সম্বন্ধে কামালের নিজের উক্তি অল্পদিন হলো খবরের কাগজে বেরিয়েছিল, তার সারমর্ম এই:- Pan-Islamism, Pan-Turanianism ইত্যাদি বহু নিষ্ফল স্বপ্ন মুসলমানরা এতদিন দেখে এসেছেন; তাতে মুসলমানজগতের লাভ কিছুই হয়নি, বরং লোকসান হয়েছে অনেক বেশি। এই সমস্ত কথায় ভীত হয়ে মুসলমানের বিপক্ষ দল তাঁদের সকল চেষ্টাকেই আঁতুড়ে গলা টিপে মারতে তৎপর হয়েছেন। তা ছাড়া, এত বৈচিত্র্যপূর্ণ সাম্রাজ্য বা রাষ্ট্রসঙ্ সম্যকরূপে পরিচালনের ক্ষমতা যে আধুনিক মুসলমানের নেই, এই অত্যন্ত সত্য কথা তারা নিজেরা সহজভাবে স্বীকার করতে পরাজুখ হয়েছেন। কিন্তু আর এই সব দুঃস্বপ্ন দেখে কোনো লাভই নেই। এখনকার সত্যিকার প্রয়োজন, মুসলমান যে যেখানে আছেন তাদের প্রকৃত অবস্থা কি, কিসে তাদের দুঃখদৈন্যের অবসান হবে, পুনরায় কেমন করে তারা উন্নত হবেন, এই সমস্ত বিষয়েই পূর্ণভাবে সচেতন হওয়া।-কামাল নিজে তার সাধনার বিষয় করে তুলেছেন তুর্কীজাতির পুনর্গঠন। স্বাধীনতায়, ধনে মানে, জ্ঞানে, সুরুচিতে, মনুষ্যত্বে তুর্কীজাতি যাতে সত্যিকার মনুষ্যজাতি হয়ে গড়ে উঠতে পারে-শক্তিমান মানুষের প্রাণ আর মস্তিষ্ক নিয়ে নিজেদের প্রাচীন ধর্মাদর্শের, ও অন্যান্য জাতি ও সভ্যতার আদর্শের, মাহাত্ম অনুভব করতে পারে, বুঝতে পারা যাচ্ছে, এই হয়ে দাঁড়িয়েছে তার আপ্রাণ চেষ্টার বিষয়। এতদূর থেকে তার অনেক কাজকে মনে হতে পারে শুধু ইয়োরোপের অন্ধ
অনুকরণ। কিন্তু যিনি রাষ্ট্রের সর্বপ্রধান নায়ক হয়েও কৃষক, দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় অনাড়ম্বর, দেশের সর্বত্র নানা সমিতি-অনুষ্ঠান ছড়িয়ে দিয়ে ধীরভাবে পুনর্গঠনের কার্যে
–
—
•
* দ্র: পৃঃ ১৯৫-৬
৩৭৭
ব্যাপৃত, মুসলমান-জগতের যুগসন্ধিক্ষণে দন্ডায়মান সেই অসাধারণ শিল্পীকে শুধু অনুকারক বলতে যাওয়া দুঃসাহস আর নির্বুদ্ধিতা ভিন্ন আর কি বলা যেতে পারে। তা ছাড়া সমাজ-জীবনে যে বৈচিত্র্যের কথা আগে বলা হয়েছে, সে কথা এখানে স্মরণ করা দরকার। যাদের সঙ্গে তুর্কীজাতির দৈনন্দিন কারবার তাদের প্রভাব ও প্রতিযোগিতার ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসার ফলে তুর্কী মুসলমানের জাতীয় জীবন যে-রূপ পরিগ্রহ করবে, ভিন্ন-পরিবেষ্টনে-বর্ধিত ভারতীয় মুসলমানের রুচি-অরুচির সঙ্গে তার কিছু পার্থক্য তো নিশ্চয়ই অপরিহার্য। সামান্য চিন্তাশীলের পক্ষেও সে কথা বুঝতে পারা কষ্টসাধ্য নয়।
অবশ্য কোনো দুর্বলতাই যে কামালের ভিতরে সম্ভবপর নয়, একথা বলবার মতো স্পর্ধা আমাদের নেই-এর প্রয়োজনই কি আছে? তার ভবিষ্যৎ কর্মে তাঁর বহু দুর্বলতা প্রকাশ পেতেও পারে। এমনও হতে পারে, অস্থায়ী জননায়কের আসন ছেড়ে হয়ত শেষে নেপোলিয়ানের মতো রাজাসনের জন্য তাঁর মনে লোভ জন্মাবে। এ আশঙ্কা বেদনাদায়ক বটে; কিন্তু সত্যই খুব আফসোসের নয়। কামাল মুসলমান সমাজের নবজীবনারম্ভের এক চমৎকার পূর্বসূচনা, সভ্যজগতে হতশ্রী মুসলমানের জন্য বিধাতার হাতের এক স্পষ্ট ইঙ্গিত প্রতিফলিত হচ্ছে তাঁর কর্মধারায়,-এই কথাটাই এখন আমাদের গভীর চিন্তার বিষয়ীভূত হোক। নবজাগরণ-কামী তুর্কীজাতির সমাজজীবনে যে-রূপ দান করতে তিনি প্রয়াসী হয়েছেন, নবজাগরণকামী ভারত বা বাংলার মুসলমান তার সমাজ জীবনে হয়তো হুবহু সেই-রূপেই প্রতিষ্ঠা করবেন না, ভিন্ন পরিবেষ্টন এখানে কার্যকর হবে, কিন্তু কামালের কাছ থেকে এই-ই আমাদের প্রধান গ্রহণের বিষয় যে, অতীতের অন্ধ অনুবর্তিতায় নব সৃষ্টি সম্ভবপর নয়। নব জাগরণ যিনি চান, অতীতকে কিছু রূপান্তরিত করে না নিয়ে তার উপায় নেই।
কর্মক্ষেত্রে কামালের যে নব আবিষ্কার-বড় বড় দুঃস্বপ্ন দেখার চাইতে সত্যিকার ছোট কাজ অনেক বেশি মূল্যবান-সেই সত্য আমাদের দুঃস্থ সমাজের স্তরে স্তরে ছড়িয়ে পড়ক। চারদিকে আমাদের হীনতা, নিরক্ষরতা, আর তার চাইতেও শোচনীয়, তথাকথিত সমাজ-নেতৃবৃন্দের বিচারমূঢ়তা, দৃষ্টিহীনতা-যার ফলে দারিদ্র্য আর পশুত্ব আমাদের সমাজে অদ্ভুত প্রভাব বিস্তার করে বসেছে;সেই সত্যিকার ক্ষত-স্থান-সমূহে আমরা এ পর্যন্ত কতটুকু সেবা পৌঁছে দিতে পেরেছি? এমন কি, সেই সমস্ত স্থানেই কর্মরি যে সবচাইতে বড় প্রয়োজন, সেই বোধই যেন আমাদের ভিতরে নিঃসাড় হয়ে আছে। আমাদের যেটুকু সামর্থ্য, যেটুকু সঞ্চয়, পথে-বিপথে খেয়ালী খরচে তা উৎসন্ন হয়ে যাচ্ছে!
কিন্তু সত্যের আঘাত বড় প্রচন্ড। মুসলমানের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে গতানুগতিকতাকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে, নব সৃষ্টির প্রয়োজন ও সম্ভাবনা দেখিয়ে, মুসলমান-সমাজের বুকে কামাল যে সত্যিকার আঘাত দিয়েছেন, আশা করা যায়, এই আঘাতেই আমাদের শতাব্দীর মোহ-নিদ্রার অবসান হবে। ধর্মে, কর্মে, জাতীয়তায়, সাহিত্যে, সমস্ত ব্যাপারেই আমাদের ভিতরে স্থান পেয়েছে যে জড়তা, দৃষ্টিহীনতা, মনে আশা জাগছে, যেমন করেই হোক, এইবার তার অবসান আসন্ন হয়ে এসেছে।
৩৭৮
কামালের প্রদত্ত এই আঘাতের বেদনাতেই হয়তো আমরা উপলব্ধি করতে
-সত্যিকার ধর্ম-জীবন কি, জীবনের সঙ্গে শাস্ত্রের সত্যিকার সম্বন্ধ কি। হয়তো বা উপলব্ধি করতে পারবো, জীবন-সমস্যার চরম সমাধান কোনো কালেই হয়ে যায় a নতন করে সে সমস্ত বিষয়ে সচেতন হওয়া আর তার মীমাংসা করতে চেষ্টা করা-এই-ই জীবন।
আর, এই বেদনাময়, আনন্দময়, উপলব্ধির বহুভঙ্গিমচ্ছটায় অনুরঞ্জিত হবে আমাদের যে আত্মপ্রকাশচেষ্টা, তারই থেকে উৎসারিত হবে আমাদের সত্যিকার সাহিত্য।
১৩৩২ সালের পৌষ মাসে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্যসমিতিতে ও ঢাকা মুসলিম হলে পঠিত।
সাহিত্যে সমস্যা
মস্ত নাম দিয়ে লেখাটির আরম্ভ হলো। কিন্তু শ্রোতৃবর্গ অসহিষ্ণু হবে না, Realism, Idealism, জাতীয়তা, সার্বজনীনতা, সত্য-শিব-সুন্দরের সমন্বয়, ইত্যাদি নামধেয় ভীতিপ্রদ সাহিত্যিক সমস্যার অবতারণা করে আপনাদের অতিষ্ঠ করে তুলবার মতলব আমার নয়।
যে কথাটা বলতে চাই তা বরং কতকটা এর উল্টো। অল্প কথায় বললে তা দাঁড়ায়-সাহিত্যে বাস্তবিকই এ সমস্ত সমস্যা নেই। সাহিত্য যারা সৃষ্টি করেন তাঁদের দিক থেকে দেখলে সমালোচকদের এই সব সমালোচনার কারসাজি কতকটা ডকুইসোটি ব্যাপার বলেই মনে হয়।
এ কোনো নতুন কথা নয়। প্রায় কবিই এই নিয়ে দিাগের বংশধরদের ঠাট্টা করে এসেছেন। তবে পুরোনো কথা হলেও পুনরুক্তিতে এর সত্য যে খুবই ম্লান বোধ হবে তা মনে হয় না।
এমার্সন বলেছেন, মহামানব এমন সমস্ত কথার অবতারণা করেন যে-সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করবার ক্ষমতাও তাঁর যুগের লোকের নেই। যথেষ্ট ভাববার বিষয় আছে তাঁর এই উক্তিতে। এর এক বর্ণও কি মিথ্যা? দূরে যাবার দরকার করে না, বাংলার কাব্যে ও ছন্দে মধুসূদন যে সমাধান করে গেলেন তাঁর যুগের কজন বাঙালি তার সম্ভাব্যতাও কল্পনা করতে পেরেছিলেন?-তেমনি করে বঙ্কিমচন্দ্রের দেশমাতৃকার পূজা, নির্জীব বৈচিত্র্যহীন গতানুগতিক বাঙালির জীবন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অপূর্ব শিল্পচাতুর্য, এ সমস্তের কতটুকু আমরা, তাদের দেশবাসী, আজও বুঝে উঠতে পেরেছি? ফেরদৌসীর
বঙ্গীয় সাহিত্য-সম্মেলনের মুন্সীগঞ্জ অধিবেশনে পঠিত। শরৎচন্দ্র এই সম্মেলনে সাহিত্য-শাখায় সভাপতি হয়েছিলেন।
কৃতিত্ব সম্বন্ধে একজন উর্দুসাহিত্যিক চমৎকার বলেছেন-ফারসী ছিল শিশু, আধো আধো তার বোল, পলকে সেই হয়ে উঠল জওয়ান! আর সে জওয়ানীও যে-সে জওয়ানী নয়-রোস্তমের পাহলোয়ানীর যোগ্য!
এই যে বিশেষ-ক্ষমতা-সমন্বিত প্রতিভা, মূককে যা বাঁচাল করে, পঙ্গুকে গিরিলঙ্ঘন করায়, তা কখন, আর কোন, বিশেষ কোনো জাতি বা সম্প্রদায়ের ভিতরে আবির্ভূত হয়, আজও আমরা বলতে বাধ্য, তার সব কারণ আমরা জানি নে। ইতিহাসে মোটের উপর দেখতে পাই এর কার্য; আর অনেক সময়ে দেখা যায়, যে মূর্তিতে প্রতিভা নরসমাজে আবির্ভূত হলো তা কতকটা অপ্রত্যাশিত অথবা অবাঞ্ছিত। ইহুদীরা প্রতীক্ষা করছিলেন এক প্রতিবিধিৎসু পরিত্রাতার আগমন, এলেন সেখানে প্রেম-মূর্তি যীশু। পৌত্তলিক নৃশংস আরব-সমাজে একেশ্বর-তত্ত্ব যে একেবারে অবিদিত ছিল, তা নয়; কিন্তু যে অমিততেজসম্পন্ন একেশ্বরবাদ আর নৈতিক জীবনের আদর্শ নিয়ে আবির্ভূত হলেন মোহাম্মদ, সাধারণ আরবীর পক্ষে তা এতই অবাঞ্ছিত যে ব্যক্তিগত ভাবে অকথ্য অত্যাচার সারাজীবন তাকে তো সহ্য করতে হয়েছেই, তার মৃত্যুর পরও তার জ্ঞাতি কোরেশকুলের অধিকাংশ ব্যক্তি বহুদিন পর্যন্ত সে-তত্ত্ব বুঝেই উঠতে পারে নি।
এঁদের তুলনায় সাহিত্য-রথীদের শক্তি কিছু হীনপ্রভ মনে হতে পারে; কিন্তু ভেবে দেখলে বুঝতে পারা যায়, সমস্ত রকমের প্রতিভাই এক গোত্রের,–”অঘটনঘটনপটীয়সী” এই তার চিরকালের বিশেষণ।
এহেন শক্তির যিনি অধিকারী সামান্য-মস্তিষ্ক-সমম্বিত পাণ্ডিত্যাভিমানীর তারই গতিপথ নির্দেশ করবার, নিয়ন্ত্রিত করবার, যে দুরাশা তাকে স্পর্ধা ভিন্ন আর কোনো
দ্র নামে অভিহিত করা যায় না। অলঙ্কার আর ব্যাকরণ-সূত্রের জঞ্জাল জমিয়ে সাহিত্য-রথীর গতিপথে বিঘ্ন উৎপাদন যে হাস্যকর, আজকাল একথা প্রায় সর্ববাদিসম্মত। এখন আমাদের মনের প্রধান মোহ-প্রচলিত নীতিরুচির মোহম-সংস্কারের মোহ। বলছি না, আমাদের যে-সমস্ত সংস্কার তা অর্থহীন, কেবলই মিথ্যা। তবে আমাদের সংস্কারের বাইরও যে অনেক কিছু সুন্দর, অনেক কিছু মঙ্গলকর থাকতে পারে সে খেয়াল আমাদের নেই বা থাকলেও তা নির্জীব, অকর্মণ্য। তাই বলছি আমাদের এ মোহাচ্ছন্ন অবস্থা।
এক জগদবিখ্যাত ব্যক্তির এই কথাকে মহামূল্য বলেই মানি-A healthy nature cannot be immoral-স্বাস্থ্যবন্ত প্রকৃতি নীতিবোধহীন হতে পারে না। প্রতিভার ভিতরে এই স্বাস্থ্য পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান; এর মগ্নচৈতন্যে সত্য-শিব-সুন্দরের এক চমৎকার সমম্বয় আপনা থেকে হয় বলেই এর এই স্বাস্থ্য আর শক্তি। তাই প্রতিভার হাতে ধ্বংস খুবই হয়; প্রলয়ও সে ঘটায়; কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দিয়ে আসছে-সেই ধ্বংস আর প্রলয়েরই স্তরে স্তরে বিরাজমান মঙ্গল।-সীতা-সাবিত্রীর বা এ কালের সূর্যমুখীর আসনে আজ যদি উপবিষ্ট দেখি দামিনীকে, রাজলক্ষ্মীকে, তার জন্য অস্বস্তি-আসোসের কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই, কেননা এ সমস্ত এক নব পর্যায়ের মঙ্গলমূর্তি-নব নব পথে
প্রবহমান জীবনের নব নব আবিষ্কার।
৩৮০
কথা হতে পারে, প্রতিভাবান যা দেবেন তা কি কেবলই মুক্ত করে অবনতমস্তকে অতন করতে হবে? মনে যার প্রত্যয় জনো না সে কি আপত্তি জানাবে না? প্রতিবাদ ভরবে না?-নিশ্চয়ই করবে। কোনো বিশেষ প্রতিভাবান যা দিলেন তাই যে সত্যের একমাত্র রূপ এত বড় স্পর্ধার কথা কি কেউ বলতে পারে? প্রতিবাদও অনেক সময়ে এক নব পর্যায়ের সৃষ্টির পূর্বাভাস। এখানে শুধু এই কথাটুকু বলতে চাচ্ছি যে, শক্তিমানের প্রতি শ্রদ্ধা যেন আমরা না হারাই। তাঁর কথায় অর্থ আছে, সৃষ্টিতে নব মঙ্গলের সম্ভাবনা আছে, মানুষের চিরনবীনতার তিনি এক নূতন প্রমাণ-একথা যেন আমরা না ভুলি।
বাস্তবিক প্রতিভার সৃষ্টিতে যে অপূর্ব, তা ভাবলে চমৎকৃত না হয়ে থাকা যায়,-চিরকালই মানুষ এতে চমৎকৃত হয়ে এসেছে। আর তার এমনি প্রভাব যে প্রচলিত নীতিরুচির মায়াকান্না তার সামনে যেন বেত্রাহত হয়েই স্তব্ধ হয়ে গেছে। ভিকটর হগোর ‘জিন ভালজিনের সামনে নায়ক সম্পর্কে “সদ্বংশ ক্ষত্রিয় ধীরোদাত্ত” প্রভৃতির কথার সংকীর্ণ অর্থ চিরদিনের জন্য হেঁটমাথা হয়ে যায়নি কি?
প্রতিভাবানের সৃষ্টির উপকরণও যে কোথা থেকে কি উপায়ে সংগৃহীত হয় সে ব্যাপারটিও কম বিস্ময়কর নয়। পুরোপুরিই তিনি দেশকালের সন্তান; কিন্তু সে-দেশ শুধু তার স্বদেশই নয়, আর সে কাল শুধু তাঁর সমসাময়িক কালই নয়। রামমোহনের দেশ বঙ্গের এক প্রান্ত, আর কাল ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ। অথচ তার দেশবাসী হারির মা পারীর মা বড়াই বুড়ি রামনাথ তর্কপঞ্চাননই নয়; আর তার মননধর্মের বিশিষ্টতার জন্য উনবিংশ শতাব্দীর মত বৈদিক যুগ, উপনিষদ-যুগ আর মোতাজেলাদের যুগও তাঁর পক্ষে জীবন্ত। গুরু-বা মনীষী-পারম্পর্যও প্রতিভাবানের পক্ষে বন্ধন নয়। বঙ্গসাহিত্যের আসরে নবীনচন্দ্রের সহজ তুতানানানা শেষ হতে না হতেই কে আশা করেছিল রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে উঠবে এমন অপরূপ তাল-মান-সমম্বিত গীতঝঙ্কার!
প্রতিভাবান যে infallible নন, অসম্পূর্ণতা ত্রুটি তাতেও আছে, তার ইঙ্গিত আগেই করা হয়েছে। কিন্তু তিনি যে শক্তিমান, সত্যের এক চমৎকার রূপ উপলব্ধি করা যায় তার ভিতরে, এইটিই আসল গণনার বিষয়। সেই পরম কৌতুকীর এ এক চমৎকার কৌতুক যে অক্ষম অথচ দুরাকাক্ষ মানুষকে নিয়ে যুগ যুগ ধরে তিনি বাঁদর নাচের তামাসা দেখছেন। শক্তিমানের নাকেও যে সময় সময় সে দড়ি না ওঠে তা নয়। কিন্তু তা নিয়ে ব্যস্ত হবার কি দরকার আছে? মানুষের অধিনায়কত্বে, বিশেষ করে সাহিত্যে, কোনোদিন অনধিকারীর আসন লাভ ঘটে না, জয়পত্র ললাটে বেঁধে যিনি মানুষের সামনে দেখা দিলেন স্বয়ং বিধাতার দেওয়া সেই জয়পত্র-এ সব আমরা জানি, আর তারই সঙ্গে সঙ্গে এই মোটা কথাটাও জানি যে, সেই জয়পত্রের মেয়াদের কম বেশ আছে।
ফাল্গনীর যৌবনের দল গাচ্ছেন-”চলার বেগে পায়ের তলায় রাস্তা জেগেছে।” জীবনে, সাহিত্যে সত্যিকার সমস্যা যদি কোথাও থাকে তবে সে এই গতির সমস্যা-পর্যাপ্ত জীবনানন্দ আর অপ্রতিহত চলার বেগের সমস্যা। বলা যেতে পারে, এই
:
+ +
=:
–
–
–
–
–
–
–
*
•
• •
..
–
—
৩৮১
গতির অভিমুখেই তো Idealism Realism-এর সমস্যা, জাতীয়তা সার্বজনীনতা সত্যশিবসুন্দরের সমন্বয় ইত্যাদির আলোচনা–কিন্তু এ বৃষ্টির কথা ভলে wি . কুয়োর জল টেনে টেনে সমস্ত দেশকে সজীব রাখবার চেষ্টা, তাই চিরকাল সyes স্রষ্টাদের কাছে হাসিতামাসার ব্যাপার।
বাস্তবিক বুদ্ধি যেখানে বাস্তবিক বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট হয়ে যায়নি, অতীত সংস্কারের জুজুর ভয়ে আত্মশক্তিতে বিশ্বাস যেখানে ক্ষীণ কাহিল হয়ে পড়েনি সাস। কোনো সমস্যাই সেখানে নেই। নানা সমস্যায় আলোচনা সেখানে চলতে পারে ভয় সে-সব খেয়ালের নামান্তর।
সমস্যা যাতে “জীবন”রাজের দরবারে মোসাহেবি করতে পারে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী হবার স্পর্ধা না রাখে, যদি কোনো দিকে দৃষ্টি রাখবার দরকার করে তবে সেই দিকে।
“মানব-মুকুট”
মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী প্রণীত মানব-মুকুট বইখানি বছর দুয়েক হলো ছাপা হয়েছে-লেখা হয়েছে এর বহু আগে। কিন্তু এ সম্বন্ধে কোনো আলোচনা কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। অবশ্য দুই-ছত্রী সমালোচনার কথা বলছি নে; বইখানি চটি হলেও সেই দুই-ছত্রী সমালোচনার যোগ্য নয়।
শুনেছি, হজরত মোহাম্মদের একখানি বড় জীবনী লিখবার সংকল্প চৌধুরী সাহেবের আছে। স্বাস্থ্যহীনতা ও অন্যান্য নানা কারণে তা পেরে উঠছেন না, বা তার প্রকাশে দেরি হচ্ছে। তাই তার ভূমিকা-স্বরূপ লেখা এই প্রবন্ধটি তিনি আগেই ছেপে দিয়েছেন।
কাজেই এটি হজরত মোহম্মদরে পুরোপুরি জীবনী নয়-জীবনী-পাঠ, অর্থাৎ তার ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষার আলোচনা। কিন্তু এই অল্প পরিসরে ষষ্ঠ শতাব্দীর সেই মহাপুরুষ সম্বন্ধে এমন অনেক কথা তার কলমের মুখে বেরিয়েছে যা বাংলার মুসলিম সমাজের কাছে এক অতি বড় সুসংবাদ-অন্ততঃ মুসলমানের নব জাগরণের প্রতীক্ষায় যারা বসে আছেন তাদের চোখে এ এক চমৎকার পূর্ব-সূচনা।
সাহিত্য জীবন্ত মনের প্রকাশ
আমাদের সমাজের মন জীবন্ত তো নয়ই, ঝিমস্ত কি
তাও সন্দেহ। এ অবস্থায় আমাদের সৃষ্ট সাহিত্য যে সাহিত্য নামের অযোগ্য হবে, এ খুবই স্বাভাবিক। হজরত মোহাম্মদের জীবনচরিতও আমাদের সাহিত্যে প্রচলিত আছে। কিন্তু শুষ্ক আর অর্থহীন ঘটনাবিন্যাস ভিন্ন আর কিছু কি তাতে সম্ভবপর? কি আমাদের বর্তমান অবস্থা, কিসে আমাদের মঙ্গল, এ সম্বন্ধে ধারণার অভাব যাদের
৩৮২
ভিতরে এত বেশি, তারা কোথায় পাবে সেই ধ্যানীর দৃষ্টি যাতেই কেবল প্রতিভাত হতে পারে হজরত মোহাম্মদের মতো ইতিহাসের এক বিরাট পুরুষের শক্তি-মাহাত্ম! ইতালীয় দার্শনিক মহামতি ক্রোচে বড় সুন্দর বলেছেন- বর্তমান ইতিহাস ভিন্ন মানুষের আর কোনো ইতিহাস নেই। অতীত ইতিহাস তখনই তার পক্ষে অর্থপূর্ণ ইতিহাস, যখন বর্তমানের জীবন-সমস্যার সমাধানের সহায়রূপে তা এসে দাঁড়ায়। সেই বর্তমানে মূঢ়ের মত শুধু ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে আমরা চেয়ে রয়েছি জগতের পানে। অতীত তাই আমাদের পক্ষে অস্তমিত-শুধু অন্ধকার।
কিন্তু আল্লাহর করুণা অসীম। এই অবজ্ঞাত বাংলার মুসলমানও হয়ত শুধু খেয়ে পরে বংশবৃদ্ধি করে’ ধ্বংস হয়ে যাবে না। বহু আঘাতের পরে তার যে ঈষৎ চৈতন্যের সঞ্চার হয়েছে, তার স্পন্দন আকাশে-বাতাসে অনুভব করা যায়।
একালের মুসলমান সাহিত্যিকদের মধ্যে দুইজন তাপসকে আমরা দেখতে পাচ্ছি-মোহাম্মদ লুত্যর রহমান, আর মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী। কিসে সমাজের মঙ্গল হবে, সে সমস্যা নিয়ে এঁরা কম সাধনা করেন নি; তার প্রমাণ রয়েছে। এঁদের রচনায়। পর্যাপ্ত সৃষ্টি-ক্ষমতা থাকলে হয়তো এঁদের দ্বারাই মুসলমান-সমাজে যুগান্তর সূচিত হতো।
আগেই বলা হয়েছে, এয়াকুব আলী সাহেবের এই চটি বইখানি হজরত মোহাম্মদের পুরো জীবনী নয়-জীবনী-পাঠ। কিন্তু বাস্তবিকই এ একটি পাঠ। অর্থাৎ, একজন জীবন্ত আধুনিক যুগের পুরুষ পাঠ করতে চেষ্টা করেছেন হজরত মোহম্মদের মহাজীবন।
‘জীবন্ত’ আর ‘আধুনিক’ এই দুটি কথার প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। জীবন্ত তাকেই বলি যে সাড়া দেয়, প্রতিদিনের ক্ষয় পূরণ করে বেঁচে থাকতে চায়। কিন্তু মানুষের বাঁচা শুধু খেয়ে-পরে বাঁচাই নয়। মনে বলে তার ভিতরে একটি উপসর্গ আছে, তাকে লালন করবার দায় তাকে পোহাতে হয়। জীবনের উন্নতি, ভাল, মন্দ, জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ ইত্যাদি সব ব্যাপারেই সর্দারি করে এই মন। তাই মন যদি অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করবার ক্ষমতা না রাখে, তাহলে জীবন-যুদ্ধে ফল কি দাঁড়ায়, তা বলবার দরকার করে না। এই সংসার নিত্য নূতন সমস্যা, নিত্য নূতন সম্ভাবনা, মানুষের সামনে খুলে ধরছে। প্রচলিত কথায় আছে বটে, History repeats itself, কিন্তু সে স্থূল কথা। বাস্তবিকপক্ষে ইতিহাসের এক পর্যায়ের সঙ্গে অন্য পর্যায়ের কোনো দিনই হুবহু মিল হয় না। তাই মানুষ হিসেবে জীবন্ত তাকেই বলা যায় যে (ব্যক্তি বা জাতি) পর্যাপ্ত পরিমাণে সজাগ; অর্থাৎ এই চিরপরিবর্তনশীল জগৎকে সে নিজের মন দিয়ে বুঝবার ক্ষমতা রাখে, আর বুঝে তার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারে।
‘জীবন্ত’ কথার অর্থ পরিষ্কার হলে ‘আধুনিক’ কথার অর্থ আপনি পরিস্কার হয়ে আসে, কেননা এদুটি একই জিনিষের এপিঠ আর ওপিঠ। যে জীবন্ত সে আধুনিক বা
৩৮৩
যুগধর্মী হতে বাধ্য। তার প্রমাণ,-হজরত ওমর আর ইমাম গাজ্জালী। দু’জনই সাচ্চা মুসলমান। কিন্তু হজরত ওমর ভুলেও দার্শনিকতার গহনে প্রবেশ করেন নি, কেননা, মাধ্যহ্ন-সূর্যের মতো ভাস্বর হজরত মোহাম্মদের জীবন ছিল তার সামনে; আর দার্শনিকতাকে পরিপাক করেই ইমাম গাজ্জালী প্রকৃত ধর্ম-জীবন লাভ করতে পেরেছিলেন, কেননা, তিনি যে যুগের সন্তান সে-যুগে মুসলমানের বিশাল জাগতিক জীবন জ্ঞানে কর্মে বহুধা বিভক্ত হয়ে সত্য আর সার্থকতার সন্ধান করছিল। এই জন্যই শঙ্করাচার্য-চৈতন্যদেবের ভারতবর্ষে বিংশ শতাব্দীতে দেখছি, মহাত্মা গান্ধী রাজনীতির পুরোহিত; আর কালিদাস-বিদ্যাপতির মতো পরম সৌন্দর্যেপাসক রবীন্দ্রনাথকে দেখছি, বারেবারে ঘুরে-ফিরে দেশের দুর্দশার গান গাচ্ছেন।
আমাদের মানব-মুকুটের গ্রন্থকার একজন জীবন্ত ব্যক্তি বলেই যুগধর্মের প্রভাব তার ভিতরে পরিষ্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে। হজরত মোহাম্মদের আদর্শের মাহাত্ম আর শ্রেষ্ঠত্ব তার প্রতিপাদ্য বিষয়। কিন্তু যে পদ্ধতিতে তিনি তা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন। সাধারণতঃ আমাদের আলেমদের পদ্ধতি তা নয়। খ্রিস্টানের বা ইহুদীর ধর্মগ্রন্থে। হজরত মোহাম্মদের আগমনের ইঙ্গিত আছে বলে যে তিনি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর একথা তিনি বলেন না; অথবা তার আঙুলের ইশারায় চাঁদ দ্বিখণ্ড হয়েছিল, অথবা ইহুদীর বালতি তার হাত থেকে কুয়োয় পড়ে গেলে হাত বাড়িয়েই তিনি তা তুলেছিলেন, হজরত মোহাম্মদ সম্বন্ধে প্রচলিত এই সব অলৌকিক কাহিনীর প্রতি কি তার মনোভাব ভুলেও তার কোনো ইঙ্গিত লেখক আমাদের জানতে দেন না। তার পদ্ধতি ভিন্ন রকমের। “আনা বশারুম মেসলোকুম” আমি তোমাদেরই মতো একজন মানুষ, হজরত মোহাম্মদ সম্পর্কে কোরআনের এই বাণীই তার সমস্ত চিন্তা-ভাবনার কেন্দ্র। সর্বপ্রকারে এই আরবের মহাপুরুষ যে মানুষ,-সব অলৌকিকতা, সব অবতারত্ব, সব অমানুষিক কৃচ্ছসাধনা, এ সমস্তের পরিবর্তে তাঁর সমস্ত ব্যাপার যে সাধারণ মানুষের জীবনের মতনই স্বাভাবিক, কত যত্ন কত দক্ষতার সঙ্গে লেখক এই সমস্ত কথা বার বার তাঁর গ্রন্থের মধ্যে বলেছেন। আরবের এই মহাপুরুষ যে হাড়ে হাড়ে মানুষ,-দুঃখ কষ্ট সহন ব্যাপারে তিনি মানুষ, উন্মাদিনী শক্তির আকস্মিক আবির্ভাবে নয় কিন্তু সাধনার পথে শনৈঃ শনৈঃ অগ্রগতিতে তিনি মানুষ, সিদ্ধিলাভের প্রাক্কালে মানবসুলভ ভয়বিহ্বলতার জন্য তিনি মানুষ, সিদ্ধ পয়গম্বর অবস্থায় পরম করুণ-প্রাণতার জন্য তিনি মানুষ, মানুষের নিকটতম আপনার জন,-এই সমস্ত কথা কত আনন্দে কত আবেগে লেখকের লেখনীমুখে উচ্ছলিত হয়ে উঠেছে।
“আনা বশারুম মেসৃলোকু” প্রাচীন কথা। কিন্তু প্রাচীন বলেই কি সেটি আমাদের গ্রন্থকারের চিত্তের উপর এমন প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে? নিশ্চয়ই নয়। আসল কথা, এ প্রাচীন সত্যের নব আবিষ্কার; আর আধুনিক জীবনের প্রয়োজন রয়েছে এই আবিষ্কারের মূলে।-জীবন-উপবাস নয়, ত্যাগ নয়, মৃত্যু নয়-জীবন-অনন্ত-সম্ভাবনা পুর্ণ, অনন্ত-সুখস্বাদ-বিমণ্ডিত জাগতিক জীবন, অপরূপ হয়ে এ যুগের লোকের চোখের সামনে আবির্ভূত হয়েছে। “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,”
“বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়, এ সব কথা শুধু এ যুগের এক বড় কবিরই কথা নয়, কবির কণ্ঠে এই
৩৮৪
যুগেরই মর্মোক্তি। বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, সাহিত্য সমস্তই আজ নিযুক্ত এই জীবনের অপরূপতা, ব্যাপকতা, জটিলতা ইত্যাদির পরিচিন্তনে ও ব্যাখ্যানে।
এরই সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে মানব-মুকুটের লেখক বলছেন-”গৃহহীন খ্রিস্ট ও বুদ্ধের প্রেম ও ত্যাগ আমাদিগের মনকে এতকাল মুগ্ধ করিয়া রাখিয়াছে, কিন্তু এক্ষণে জিজ্ঞাসা করিবার সময় আসিয়াছে যে, কে সেই মহাপুরুষ যিনি মানবের চিরকালের আবাসভূমি গৃহঙ্গনকে তুচ্ছ না করিয়া পবিত্র ও মধুর করিয়াছেন; মানুষের বিচিত্র সুখ দুঃখ ও আশা আকাক্ষাময় মরজীবনকে জীবনদ্বারা সার্থক ও সুন্দর করিয়া অনন্ত জীবনের সন্ধান দিয়েছেন…।” হজরত মোহম্মদের জীবনের মাহাত্ম-আলোচনা আমাদের লেখকের উদ্দেশ্য সন্দেহ নেই; কিন্তু সেই উদ্দেশ্যের সঙ্গে আর একটি উদ্দেশ্য পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চলেছে;-আধুনিক জগতের যে জীবনসমস্যা, লেখক মানুষকে ডেকে বলতে চান, তার উপযুক্ত সমাধান মিলবে হজরত মোহম্মদের জীবনাদর্শে।
প্রশ্ন হতে পারে–যুগের যা চিন্তা-ভাবনার ধারা লেখক তাই নিয়েই নাড়াচাড়া করছেন, তবে আর এতে এত তারীফের কি আছে?-তারীফের কথা এই যে, পরের মুখে ঝাল খাওয়ার মতো জীবনসমস্যার কথা মানব-মুকুটের গ্রন্থকার বলছেন না। এই জীবনসমস্যা বাস্তবিকই জেগে উঠেছে তার ভিতরে। তাই তাঁর কথাগুলো ফাঁকা ফ্যাকাশে নয়-তাতে ফুটে উঠেছে অন্তরের অনুভূতির গাঢ় লাল রং। কেমন গলা ছেড়ে তিনি বলতে পারছেন-”তাঁহারা (সন্ন্যাসী মহাপুরুষ) পথের ধারে গলিত কুষ্ঠ রোগী পড়িয়া থাকিলে কি করিতে হয়, তৎসম্বন্ধে আমাদিগকে শিক্ষা দিতে পারেন। কিন্তু কি করিয়া সদুপায়ে ক্ষুধার অন্ন সংগ্রহ করা যায়, পত্নীর প্রেমার্ত চিত্ত স্নিগ্ধ করিয়া পাতার প্রীতি লাভ করা যায় তৎসম্বন্ধে কিছুই শিক্ষা দিতে পারেন না।”-কিছু বাড়াবাড়ি এই সমস্ত কথার ভিতরে নিশ্চয়ই আছে; তবু আমাদের চোখে লাগে না কি, কি একটা বেদনাময় মানুষের মন রয়েছে এই সব কথার পিছনে।
এই যে নিজের অন্তরের অনুভূতি, সাহিত্যিকের, চিন্তাশীলের এ প্রথম। প্রয়োজন-প্রধান প্রয়োজনও বটে। পরে পরের যত অগ্রগতি, ভাবুকতার যত উৰ্দ্ধতর গ্রামে আরোহণ, তার সমস্ত পাথেয়ের যোগাড় হতে পারে এই আত্ম-অনুভূতি থেকে। বাস্তবিক অন্তৰ্জীবনের পরিপোষণের জন্য সব চাইতে পুষ্টিকর উপাদান মিলতে পারে
কেবল এই আত্ম-অনুভূতিরই ভিতরে।
কিন্তু শুধু এই জন্যই এয়াকুব আলী সাহেবের এই মানব-মুকুট বইখানিকে বাংলার মুসলিম চিন্তা-জগতে এক অনুপম সূচনা বলা হয়নি। এই আত্ম-অনুভূতির পাথেয়ের সাহায্যে তিনি ঊর্ধ্বতর গ্রামে আরোহণ করতে পেরেছেন। বিরাট পুরুষ মোহাম্মদের মহাপ্রাণতা সামান্য কিছু উপলব্ধি করবার জন্য দ্রষ্টারও চাই যে সমুন্নত দৃষ্টিভুমি, বুঝতে
পারা যাচ্ছে, সেই উচ্চতর গ্রামে লেখক নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার অধিকার লাভ * করেছেন। তাই বলেছি, তিনি তাপস। জহুরী জওহর চিনে, এ চিরকালের সত্য। এই * মানব-মুকুট বইখানির জায়গায় জায়গায় হজরত মোহাম্মদের যে আবেগময় তারীফ
অনর্গলভাবে বেরিয়ে এসেছে, সবারই কাছ থেকে কি তা আশা করা যেতে পারে?
—
* * *
*
–
–
»
৩৮৫
তার এই ক্ষমতা হীরকের মত ঝক্সক্ করে উঠেছে, এর “মানুষের অধিকার” পরিচ্ছেদে,-যেখানে তিনি হজরত মোহম্মদের মনোরাজ্যে প্রথম সত্য-প্রকাশের মহা মুহূর্তের কথা লিখেছেন:
“দৈবদতির প্রথম ছটায় তাহার চিত্ত চমকিত হইল; দৈববাণীর গম্ভীর-নাদে তিনি সম্ভ্রম-শঙ্কায় কম্পিত হইলেন। তিনি কম্পিত কলেবরে গৃহে ফিরিয়া খোদেজা বিবিকে বলিলেন, ‘ঢাক আমায় ঢাক-কাপড় দিয়া আমায় আবৃত কর।’ ঐশী-শক্তির তাড়িত-তেজে রক্ত-মাংসের মানবদেহ সম্ভ্রম সঙ্কোচে কম্পিত হইতেছে, সত্যজ্যোতির প্রথম ঝলক নরনয়ন সহ্য করিতে সমর্থ হইতেছে না।”
অন্যত্র:
“মহাপুরুষের সত্যপূত মহিমালোকে তাঁহার মানব-চিত্ত বারেকের নিমিত্ত কম্পিত হইয়াছিল, সেইক্ষণে রক্ত-মাংসের মানব-মন মহিমা-লাভের আশার আবেগে মহানন্দ নৃত্য করিয়াছে।”…
বিরাট সত্যের সামনে সম্ভ্রম-সঙ্কোচে কম্পিত হওয়া, মহাজীবন লাভের আশার আবেগে মহানন্দে নৃত্য করা-এ সমস্ত কথা যে এমন অপূর্ব আর অব্যর্থ হয়ে ফুটে উঠেছে, এ কি লেখকের অন্তঃকরণের জীবন্ত স্পর্শের জন্যই নয়?-মহাপ্রাণতার সামান্য স্পন্দনও বাঙালি মুসলমানের বুকে জেগেছে, এর চাইতে সুখকর খবর আমাদের পক্ষে আর কি হতে পারে!
এখানেই এ আলোচনার শেষ করতে পারলে মন্দ হতো না। কিন্তু আর একটি কথা বলবার বাকি আছে; সেটি না বললে আমার এই তারীফের পুরো চেহারা বুঝতে পারা যাবে না। পূর্বেই বলেছি, এই বইখানিতে লেখকের প্রতিপাদ্য বিষয় দুইটি-হজরত মোহাম্মদের মাহাত্ম-কীর্তন, আর তার আদর্শই যে জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ তাই প্রমাণিত করা। আমরাই এই দুটিকে পৃথক করে দেখেছি। কিন্তু লেখকের মনে এ দুটি অভিন্ন হয়ে ফুটে উঠেছে। হজরত মোহাম্মদের আদর্শ-একাধারে সাংসারিক আর আধ্যাত্মিক জীবন-এর চমৎকারিত্ব তার চোখে এতই বেশি যে, এ যে সুন্দর এ কথা বলে তাঁর তৃপ্তি হয় না, গলা ছেড়ে আপনা থেকে তাঁর বলা আসে-এই-ই সুন্দরতম, এই-ই মহত্তম।
একজন সাধারণ প্রচারকও নিজের ধর্ম বা সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু তার সঙ্গে আমাদের লেখকের যে পার্থক্য, সেটি লক্ষ্য না করলে তার প্রতি খুব অন্যায় করা হবে। একজন সাধারণ প্রচারকের ভিতরেও প্রকৃত স্বধর্ম-প্রেম বা স্বজাতি-প্রেম থাকতে পারে। কিন্তু সাধারণত তার বড়ম্বরের উদ্দেশ্য, মানুষ বাগানো, দল ভারী করা। কিন্তু মানব-মুকুটের’ গ্রন্থকার যখন জোশের
৩৮৬
আতিশয্যে বলতে একটুও দ্বিধা বোধ করেন না-”মুহূর্তের মৃত্যু দ্বারা নহে, পরস্তু বহুবর্ষব্যাপী জীবন দ্বারা মানুষের জন্য আত্মত্যাগের যে আদর্শ তিনি (হজরত মোহাম্মদ) দেখাইয়াছেন, তাহার নিকটে বৃদ্ধের সুখত্যাগ ও খ্রিস্টের প্রাণত্যাগ নিপ্রভ হইয়া গিয়াছে”-তখনো সমদর্শী মনীষী তাঁকে স্নেহের চক্ষে দেখতে পারেন এইজন্য যে, মহামানব বুদ্ধ আর খ্রিস্টকে হীন সাব্যস্ত করা লেখকের উদ্দেশ্য নয়, বরং এমন এক বিরাট শক্তির ঔজ্জ্বল্যে তিনি মোহিত হয়েছেন যে, সেদিক ভিন্ন আর কোনো দিকে চোখ ফেরাবার অবসর তার নেই।
তাঁর এই পক্ষপাতিত্বকে আর এক ভাবেও দেখা যেতে পারে। বাংলা বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা হলেও এত কালের বাংলাসাহিত্যে তার বিশেষ কোন দাবি দাওয়া নেই, বরং তার যত প্রকৃত আর কল্পিত জঘন্যতা, মূঢ়তা, তারই ছবি প্রতিবিম্বিত হয়ে আছে এই সাহিত্যে। তাই জাগরণের এই প্রথম মুহূর্তে বিরুদ্ধবাদীর অনেক কিছুই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সে যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইবে, এ খুবই স্বাভাবিক।
তবু চৌধুরী সাহেবকে বলতে চাই, তার স্বজন-প্রেম স্বধর্ম-প্রেম যত সুন্দরই হোক
কেন, এ কথার স্থানও যেন তার মনে থাকে যে, বিষয়টিকে তিনি যে দৃষ্টিতে দেখছেন ও দেখাতে চাচ্ছেন, তারই মত বিদ্বান বুদ্ধিমান দৃষ্টিমান ব্যক্তি ঠিক তার উল্টোভাবেও দেখতে পারেন। যেসব কথা স্বীকার করে তিনি তর্কে নেমেছেন তার কেন্দ্রগত কথা এই:- জগতে যত মহাপুরুষ ভিন্ন ভিন্ন যুগে আবির্ভূত হয়ে মানুষকে পাপ তাপ থেকে উদ্ধার করেছেন, তাঁরাই মানুষের আদর্শ; তাঁদেরই ভিতরে যার আদর্শ ব্যাপকতম গভীরতম তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ,-মহাপুরুষের গৌরব-মুকুট তারই প্রাপ্য। বলা বাহুল্য, এক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব আমাদের লেখকের উপরে খুবই কার্যকর হয়েছে।
যে সমস্ত যুক্তি-বলে বঙ্কিমচন্দ্র শ্রীকৃষ্ণকে জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শরূপে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছেন, তিনিও প্রায় সেই সমস্ত যুক্তির বলেই হজরত মোহম্মদকে জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শরূপে প্রতিপন্ন করতে যত্নবান! কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের সেই সমস্ত যুক্তি-তর্কও নির্বিচারে গৃহীত হবার যোগ্য নয়। আদর্শবাদ জিনিসটিকেই অনেক মনীষী সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবে দেখতে প্রয়াস পেরেছেন। যেমন এমার্সন বলেছেন-” No facts are to be sacred; none are profane; I simply experiment, an endless seeker with no Past at my back”“
বাস্তবিক, গুরুবাদীর, আদর্শবাদীর, যেমন অভাব নেই, তেমনি এমন কথাও অনেক মনীষী বলেছেন,-অতি বড় যে ব্যক্তি তার জীবন যেমন কালের শাসনের বাইরে নয়, তার চিন্তা-ভাবনা মত-বিশ্বাসও তেমনি কালের শাসনের বাইরে নয়। অতি বড় যে কবি, তাঁর সৃষ্টির চমৎকারিত্ব কালে স্লান হয়ে আসে; অতি বড় যে সত্যদ্রষ্টা, তার দৃষ্টিও আংশিক দৃষ্টি বলে’ কাল রায় দেয়।
* একথাটি অনুমান করে লেখা হয়েছিল। পরে জানা যায় প্রকৃতই কৃষ্ণচরিত্রের প্রভাব মানব-মুকুটের
লেখকের উপরে পড়েছিল। ১ কোনো ব্যাপারই আমার কাছে প্রত্যাদেশ’ পর্যায়ের নয়, কিছুই নয় ‘পার্থিব মাত্র; আমি চলেছি
পরীক্ষা করে-অন্তহীন অম্বেষ্টা আমি, পিঠে বহন করি না কোনো অতীতের ভার।
৩৮৭
তাই যে সব যুক্তি-বলে বঙ্কিমচন্দ্র বা আমাদের লেখক প্রমাণ করতে না শ্রীকৃষ্ণ বা হজরত মোহাম্মদ জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ, একটুখানি ঘরিয়ে চোখে পড়বে, তা দুর্বল যুক্তি-তর্ক। ভক্তের কাছে তার প্রিয় আদর্শ নিশ্চয়ই অs ) কিন্তু এমন কোনো যুক্তি-তর্ক আছে কি না, যার সাহায্যে কোনো মহাপক জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শরূপে প্রতিপন্ন করা যায়, তা যথেষ্ট সন্দেহের বিষয়।
এখন বোধ হয় বুঝতে পারা যাচ্ছে, মানব-মুকুট গ্রন্থখানিকে আমি যে, চোখে দেখি, তা কি ধরণের। যুক্তি-তর্কের দিক দিয়ে এর অসম্পূর্ণতা খুবই চোখে পড়ে; কিন্তু তার চাইতেও অনেক বেশি করে চোখে পড়ে এর লেখকের বলীয়ান হৃদয়- নব-সাধনায় যা তাজা আর রঙীন হয়ে উঠেছে! এই তাজা রঙীন হৃদয়েতে আমাদের প্রধান প্রয়োজন। তাই সমস্ত অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও এক নবজাগরণের পর লক্ষণ ফুরিত হচ্ছে এর পাতায় পাতায়। মহাপ্রাণতা যে কোনো বিশেষ যুগের সম্পদ নয়, প্রত্যেক যুগেরই পরম বিভব-তার অস্তিত্বের প্রমাণ, এই শুভতম সংবাদ এ বহন করে এনেছে বাঙালি মুসলমানের জীর্ণ দ্বারে।
চৈত্র, ১৩৩১
পণ্ডিত সাহেব
বন্ধুরা বললেন-”এত কাছে এবার সাহিত্য-সম্মেলন হচ্ছে, চলো দেখে আসা যাক।” আমি বললাম-”কি সেখানে হবে তার কল্পনা করা তোমাদের পক্ষে এতই কি শক্ত?” তারা বললেন-”রাখো তোমার কুড়েমি, এবার যেতেই হবে; তৈরি হও।”
নির্দিষ্ট দিনে মুন্সীগঞ্জ অভিমুখে রওনা হওয়া গেল। যাচ্ছিলাম আমরা বঙ্গীয় সাহিত্য-সম্মেলনে বটে, কিন্তু সেদিন আমাদের সত্যিকার ব্যাপার ছিল নিরুদ্দেশ ভ্রমণ; তাই পথে মহাজন-সন্দর্শন, পুরাতন আলাপীর সঙ্গে দুনঃ-সাক্ষাৎকার, এ সমস্তের ছটা সেদিন আমাদের অবসরের লালিমা-সমুদ্রে তেমন বিশেষ কোনো বর্ণসমৃদ্ধ তরঙ্গভঙ্গের সৃষ্টি করেনি।
গন্তব্য স্থানে পৌঁছা গেল। আমাদের বাস নির্দিষ্ট হলো শহরের কিছু বাইরে মাঠের মাঝখানে এক দালানে। চারদিকেই খোলামাঠ; পূবদিকে কিছুদূরে প্রবাহিত হচ্ছে পদ্মা অভিসারী এক খাল; দূরে কৃষক-পল্লী,-শুধু সবুজ গাছের ভিড়; চষা, পরিপাটি মাঠে শোভা পাচ্ছে চারা ধান গাছ। মনে মনে খুশি হয়ে ভাবলাম, আমাদের এবারকার নিরুদ্দেশ ভ্রমণের উপর বিধাতার সুন্দর হস্তের আশীর্বাদ বর্ষিত হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি।
* শরৎচন্দ্র ছিলেন এই সম্মেলনে সাহিত্য-শাখার সভাপতি।
৩৮৮
( যথাসময়ে সম্মেলনে উপস্থিত হওয়া গেল। যথাবিহিত অভিনন্দন-আপ্যায়ন সনিস্পন্ন হলো। সাহিত্যমহারথিবৃন্দ একে একে তাঁদের অভিভাষণ পাঠ করে চললেন। যখন যেখানে করতালির প্রয়োজন গল্প আর ধূমপান ক্ষণকালের জন্য বন্ধ করে তা সমাধা করে শ্রোতৃমন্ডলী নিজেদের সমঝদারির পরিচয় দিলেন। বাংলা সাহিত্যের উৎপত্তি, তার বর্তমান অবস্থা, তার ভবিষ্যৎ, তার চমৎকারিত্ব, তার ত্রুটি, বাঙালির জাতীয় জীবনের দুর্বলতা, তার ভবিষ্যৎ কর্তব্য ইত্যাদি বিষয়ে বহু মন্তব্য শ্রবণ করবার সৌভাগ্য আমাদের হলো। তা রাত্রে ফিরে এসে গ্রাম্য বাবুর্চির বিশুদ্ধ ঘৃতের পোলাও, টাটকা মুরগীর কোরমা, আর রামপালী কলা উদরস্থ করে ভলান্টিয়ারদের ভূয়সী প্রশংসা করলাম, আর মনে মনে ভাবলাম-যাক, আমাদের এবারকার নিরুদ্দেশ ভ্রমণের রস কিছুতেই গেঁজে যাবে না এমন আশা করতে পারি।
জ্যোৎস্না-আলোকিত মাঠের মাঝখানে এই ঘরটিতে বহু রাত পর্যন্ত দরজা জানালা খুলে রেখে শেষে ঘুমিয়ে পড়া গেল। গানের শব্দে সকালে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি, পাশের বিছানায় বসে এক বন্ধু ভৈরবী-ললিত-মিশানো একটি গান গাচ্ছেন। আমার পানে চেয়ে তিনি হাসলেন, আমিও হাসলাম। পাশে চাইতেই দেখলাম-একজন গ্রাম্য ‘মুসল্লি’-গোছের লোক ওধারের চেয়ারে বসে আমারই দিকে চেয়ে আছেন। তিনি আদাব করলেন; আমিও আদাব করলাম। কালো স্বাস্থ্য-সমম্বিত জওয়ান চেহারা তাঁর, মুখে অনন্য ঝাঁকড়া দাড়ি, কালো পুরু ওষ্ঠের উপর শক্ত গোঁফ খাটো করে ছাঁটা; চোখ দুটি ছোট, তাতে যে দৃষ্টি তাতে যথেষ্ট ঔজ্জ্বল্য।
তহবন-পরা লম্বা নীল কোর্তা গায়ে এই বলিষ্ঠ ব্যক্তি বিনীতভাবে আমার বিছানার এক পাশে এসে বসলেন। তাঁর বাঁ-হাতে কয়েকখানি খাতা। একখানি খুলে আমার সামনে রেখে বললেন, “এক নূতন পদ্ধতিতে আমি এই বইখানি লিখেছি, মেহেরবানি করে একটু পড়ে দেখুন। কিছু সন্দিগ্ধচিত্তে খাতাখানি হাতে তুলে পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে এখানে ওখানে দেখতে লাগলাম। দুই এক জায়গায় লেখার যে বাঁধুনি চোখে পড়লো তাতে কিছু বিস্ময় বোধ হলো। তাকে বললাম, “আপনি পড়ন আমি শুনি।” তিনি পড়তে লাগলেন। প্রথম শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েদের কি করে মুখে মুখে বানান শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে, সেই সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। এর যে ভূমিকা তিনি পড়লেন তার কয়েকটি কথা এই,-”যে পথ দুর্গম চেষ্টা করে সে পথকে সুগম করা যায়। যা জটিল তাও চেষ্টা করে আয়ত্ত করা যায়, আর তা আয়ত্ত করবার সহজ পথ নির্দেশ করা যায়; তবে কেন সরলমতি শিশুদের মনে ভীতি অথবা অরুচি উৎপাদন না করে তাদের মাতৃভাষার বর্ণবিন্যাস স্বাভাবিকভাবে শিক্ষা দেওয়া যাবে না?”-আমার আন্তরিক প্রশংসার অবধি ছিল না। মাঝে মাঝে অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করছিলাম-সত্যান্বেষীর পক্ষে অবশ্যলভ্য যে বিজ্ঞানদৃষ্টি এই অল্পশিক্ষিত গ্রাম্য লোকটির পক্ষেও তা কি অদ্ভুতভাবে সম্ভবপর হয়েছে।
পড়া শেষ হলে তাঁকে সাধুবাদ প্রদানে কার্পণ্য করতে পারলাম না। তিনি বললেন, এটি প্রকাশ করতে তিনি ইচ্ছুক, কিন্তু তার মতো নগণ্য ব্যক্তির বইয়ের আদর কি স্কুল
৩৮৯
কর্তৃপক্ষেরা করবেন। আমি বললাম, এ ব্যাপারে আমারও ক্ষমতা তারই মতো, তবে অন্য কোনো উপায়ে যদি আমার দ্বারা কোনো কাজ হয় তা তো নিশ্চয়ই করবো।
লোকটির সঙ্গে আলাপের গাঢ়ত্ব সহজেই সম্ভবপর হলো। অতি অল্পক্ষণ কথাবার্তার পরই তার দৈনন্দিন জীবনের নানা ছোট খাটো কথা জিজ্ঞাসা করতে পারলাম। সহজভাবে তিনিও সে সমস্তের উত্তর দিলেন। তিনি গ্রামের পাঠশালার শিক্ষক; বহুকাল পর্যন্ত গ্রামের ‘খতিব’ও ছিলেন; কোনো রকমে দিনগুজরান হয় অর্থাৎ বাংলার মুসলমানদের হাজারকরা নয়শত নিরানব্বই জনের যে রকমে হয়। আমাদের আলাপ এগিয়ে চললো। শেষে এমন একটা জীবনের ছাপ আমার চিত্তপটে মুদ্রিত হলো যা গ্রাম্য পণ্ডিতের নয়, কবিযশঃপ্রার্থীরও নয়,-যার প্রত্যাশা এবারকার নিরুদ্দেশ-যাত্রার প্রারম্ভে স্বপ্নেও মনে স্থান দিতে পারিনি।
পণ্ডিত সাহেব একে একে তার পনেরো বৎসরের শিক্ষকতার কথা আমাকে বললেন। গ্রামের লোকেরা তার প্রতি সদয় নয়। তার স্কুলের ছাত্রেরা প্রায়ই বৃত্তি পায়; স্কুল-পরিদর্শকরা তাঁর খুবই প্রশংসা করেন; এ সমস্ত আর গ্রামের লোকদের চোখে সহ্য হয় না। আমি বললাম,-”তা শিক্ষকতা তো আর সকলে করে না যে প্রশংসা পাবে।” তিনি বললেন,-”সে চেষ্টা কি আর তারা করেনি। কিন্তু স্কুল খুলে ক’দিন চালাবার ক্ষমতা তাদের আছে। দুইবার খুব তোড়জোড়ের দুই স্কুল খুলেছিল। তাদের স্কুল আর ক’দিন চলতে পারে। ছাত্রদের পড়ানো হয় না, তারা পাশ করতে পারে না, তারা পালিয়ে শেষে আবার আমার স্কুলে এসে ভর্তি হলো।” হেসে বললেন,-”পেটে বিদ্যে বুদ্ধি কিছু থাকলে তো স্কুল চালাতে পারবে।”
দিলখোলা এ হাসি, তবে এর পর্দায় পর্দায় বিদ্রুপের বিষ আর ব্যর্থতার প্রতিঘাত।
গ্রামবাসীদের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্যের প্রকৃত কারণ কিছু অনুমান করতে পারলাম। তবু বললাম, “এ তো আড়াআড়ির কথা। কি নিয়ে এঁদের সঙ্গে আপনার মনোমালিন্যের সূত্রপাত যাতে তারা ভিন্ন স্কুল খুলেছিলেন?” তিনি বললেন, “তারা গ্রামের মাতব্বর। তাদের দলাদলিতে আমি সায় দিইনে। আমাকে প্রকারান্তরে মিথ্যা সাক্ষী দিতে বলে; তা আমি দেব কেন। এই সব নিয়েই আমার সঙ্গে বিরোধ। সে বহু কথা। একবার এক মাতব্বরের ছেলে “ইদ্দত” পার না হতেই এক বিধবাকে নিকে করতে পাগল হয়ে উঠলো। মোড়ল আমাকে নিকে পড়িয়ে দিতে বললে। আমি বললাম,-”শরা’র বিরুদ্ধ কাজ আমি পারবো না। এই নিয়ে মোড়ল আমার উপরে মহা খাপ্পা। অন্য এক মুন্সীকে দিয়ে নিকে পড়িয়ে নিলে হয়ত কিছু ঘুষের ব্যবস্থা হয়েছিল। আমার উপর খুব গালাগালি করলে, বললে, “জানেন না এক হরফ ঝাক মারেন বড় মৌলবীর মতো।” আমি বললাম, “বড় হই আর ছোট হই তোমরা তো এসবের কিছু জানো যে, তোমাদের সঙ্গে তর্ক-বিচার হবে। কোনো নাম-করা ‘আলেম’কে মধ্যস্থ মানো, তখন যদি আমার কথা ভুল সাব্যস্ত হয়, আমি ঘাট মান্ব।”
মনে মনে বলছিলাম, “তোমার সঙ্গে যদি এদের বনিবনাও হয় তবে আর অবনিবনাও হবে কার সঙ্গে।” এই সবলমেরুদণ্ডসম্পন্ন আত্মভিমানী গ্রাম্য পণ্ডিতের
৩৯০
প্রতি এক আন্তরিক স্নেহ আর সহানুভূতিতে আমার হৃদয় ভরে উঠছিল। একধার থেকে তিনি গ্রামবাসীদের শ্রাদ্ধ করে চলেছিলেন। “এরা লোক দেখিয়ে নামাজ পড়ে; পরের অনিষ্ট আর নিজের স্বার্থ সিদ্ধির দিকেই এদের মন; এরা নামে মাত্র মুসলমান, কাজে একদম পশু”; ইত্যাকার বচনে তাদের সবিস্তৃত পরিচয় দিচ্ছিলেন। হাসিমুখে তার সমস্ত কথাই শুনছিলাম, আর ভাবছিলাম-”মুকুলিত আমগাছ তার উগ্রগন্ধে কেন দশদিক আন্দোলিত করে তোলে, আর তার পাশে শেওড়া গাছ কেন শ্রীহীন চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, এ তত্ত্বের তাৎপর্য গ্রহণ তোমার জন্য নয়।”-শেষে পণ্ডিত বললেন, “এরা যে কি শক্ত ‘জাহেল তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। কতকগুলো মেয়েও আমার কাছে কোরাণ শরীফ পড়ে। তারই ভিতরে একটি মেয়ে কি ‘নেক-খাসলত’ আর পড়াশুনায় দক্ষ হয়েছিল। কোরাণ শরীফ খতম করেছিল। উর্দু ‘মেফতাহুলজ্জান্নাত’ শেষ করেছিল। বাংলা নিম প্রাইমারি পর্যন্ত পড়েছিল; কিন্তু সাহিত্যে উচ্চ প্রাইমারি ক্লাসের ছাত্রেরাও তার কাছে কিছু নয়। আর কি তার হাতের লেখা! স্কুল সাব-ইনসপেক্টর বলেছিলেন-এ পর্যন্ত নিম প্রাইমারির কোনো ছাত্র-ছাত্রীর লেখাই তিনি অত সুন্দর দেখেন নি। এই জাহেলরা আমাকে জব্দ করবার জন্য তাকেই বিয়ে দিলে এক আকাট মূখের সঙ্গে।”-তার কণ্ঠ ভারী হয়ে এল, মুখ ফিরিয়ে জামার
আস্তিনে তিনি চোখ মুছলেন।
আমি স্তব্ধ হয়ে ক্ষণকাল তার মুখের পানে চেয়ে রইলাম। শেষে ধীরে ধীরে বললাম, “তা মেয়েটির বাপ-মা….” তিনি বললেন, “বেশি টাকা তারা পেলে-আর তারা কি দেখবে।”
অদূরে-বসা আমার এক ইতিহাসজ্ঞ বন্ধু আমাদের কথাবার্তা শুনছিলেন। তিনি বললেন, “যারা অগ্রবর্তী চিরকালই তাদের কষ্ট ভোগ করতে হয়। পেটালোসি যখন তাঁর নব-উদ্ভাবিত পদ্ধতি অনুসারে শিশুর শিক্ষা বিধানে অগ্রসর হলেন, অভিভাবকরা তার কাছে সন্তান পাঠাতে পর্যন্ত রাজি হলেন না। রাস্তার বেওয়ারিশ ছেলেদের নিয়ে প্রথমে তার নূতন ধরণের শিক্ষা চললো।”
কিন্তু হায়, এর কি কোনো সান্ত্বনা আছে! নীরবে বসে তার বলিষ্ঠ বেদনামাখা চিত্তের উত্তাপ আর জ্বালা অনুভব করতে চেষ্টা করছিলাম। ইচ্ছা হচ্ছিল বলি, “আপনার যে দুঃখ, তা বহনের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত বলেই তো বাংলার মুসলমান আজ হতভাগ্য।” তা আর সাহস হলো না। কথাটা তার কাছে হেঁয়ালির মতো শোনাবার সম্ভাবনাই বেশি।
সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তাকে জয়ী হতে হবে, শেষে এই সব বলে তাকে বিদায় দিলাম। সম্মেলনের বৈঠক দুই দিনের জায়গায় তিন দিন হলো। সুখাদ্য, সু-আলাপ, গান, জ্যোৎস্না-উদ্ভাসিত মাঠে বাসের রোমাঞ্চ, তেমনি চললো। কিন্তু সেদিনের সমস্ত সুখস্মৃতির পুষ্পদলের মাঝখানে কাঁচা নবীন ফলের মতো জেগে রয়েছে এই গ্রাম্য শিক্ষকের স্মৃতি। সেখানে আলাপের দিনের অবসানে রাত্রে সেই মাঠের ভিতরকার দালানে পায়চারি করতে করতে দূরে গ্রামের পানে চেয়ে ভাবছিলাম তার কথা। মূঢ়, গতানুগতিক, সর্বপ্রকারে দরিদ্র, গ্রামবাসীদের মাঝখানে মাথা উঁচু
৩৯১
করে দাঁড়িয়েছে, কিছু উগ্র, আত্মাভিমানী, ন্যায়নিষ্ঠ, উন্নত জীবনের আগ্নেয় আকর্ষণে আকৃষ্ট, এই অর্ধশিক্ষিত পুরুষ। সেবারকার সাহিত্য-সম্মেলনে এই ছিল আমার সব চাইতে বড় তথ্যের আবিষ্কার।
আজ পুনরায় যখন সেই স্মৃতি মনে ভেসে উঠছে তখন দেখছি, সত্যই এ এক আবিষ্কার। সর্বপ্রকারে অধঃপতিত বাংলার বিশাল মুসলমান-সমাজের পুঞ্জীভূত প্রাণহীনতার মাঝে হেথায় হোথায় কৃচিৎ কখনো সত্যিকার প্রাণস্পন্দনও যে অনুভব করা যায়, এ তারই আবিষ্কার। কিন্তু সেদিন ভেবে কিছু দুঃখিতই হয়েছিলাম,-এই সামান্য প্রাণ-শক্তির চারপাশ ঘিরে কি বিকট মৃত্যু! তার গ্রাস এ কতক্ষণ এড়িয়ে থাকতে পারবে!
আজ যখন ভাবছি, দূরে গণ্ডগ্রামে সেই পণ্ডিত নিত্য তার পারিপার্শ্বিক হীনতার সঙ্গে বুঝছে, হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তার জন্য সহানুভূতি হলেও দুঃখবোধ নেই। এ সত্যিকার প্রাণবহ্নি-নির্বাপিত হওয়ার আগে পর্যন্ত তার পরিবেষ্টকে দহন করে চলবে।-এ দহনের বড় প্রয়োজন।
অগ্রহায়ণ, ১৩৩২
কাজি ইমদাদুল হক স্মরণে
ছেলেবেলা থেকে কাজি ইমদাদুল হক সাহেবের কথা শুনে আসছি;-শিক্ষিত মুসলমান সমাজে তিনি নামজাদা ব্যক্তি ছিলেন, তাছাড়া আমার মুরুব্বিগণের তিনি সহাধ্যায়ী বন্ধু ছিলেন। কিন্তু তার সঙ্গে পরিচয়ের সৌভাগ্য ঘটে বহু দেরীতে,-১৯২০ সালে। ১৯২৮ সালে তার প্রথম অস্ত্রোপচার হয়; তার পর থেকে তিনি ভগ্নস্বাস্থ্যে রোগভোগই করেছেন বেশি। কিন্তু তিনি ছিলেন সেই দুর্লভ মানুষদের একজন, নিজের মন’ বলে একটি অনুপম বস্তুত যারা অধিকারী। আর তাঁর সেই মনটি ছিল আনন্দোজ্জ্বল, আর, মোটের উপর, অজটিল। তাই এই ক্রমাগত ক্ষয়কর অসুস্থতার ফাঁকে ফাঁকেও দেখেছি-তার প্রাণপুরুষের এক সুন্দর পরিচয় অনেক সময় আপনা থেকে উৎসারিত হয়েছে। এক অক্ষয় আনন্দকণা রূপে তার সেই পরিচয় আমার চিত্তভাণ্ডারে সঞ্চিত রয়েছে-তার সকল বন্ধুর অন্তরেই হয়ত তা সঞ্চিত থাকবে।
তাঁর মৃত্যুর কয়েকদিন পরে তার এক পুরাতন বন্ধু কথা-প্রসঙ্গে বলছিলেন-”জীবনে কতজনের সঙ্গেই তো আলাপ পরিচয় হয়; কিন্তু তাদের ক’জনার কথা মনে থাকে। কাজি ইমাদুল হক সাহেবকে কিন্তু ভুলতে পারবো না।”-বাস্তবিক তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভাবে মিশবার সুযোগ যাদের হয়েছে তারা তাকে ভুলতে পারবেন
; কেননা, দুর্লভ আনন্দধন তার কাছে তারা পেতেন। লোকের প্রয়োজনের চরিতার্থতা তার হাতে কম হয়নি। কিন্তু সেই প্রয়োজনের দাবি এক স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে
৩৯২
চকিয়ে দিয়ে কত সহজ ভাবে আনন্দ আর ভব্যতার প্রাচুর্য নিয়ে তিনি সবার সঙ্গে কতেন! কত দুর্লভ এই স্বাভাবিক ভব্যতা আর আনন্দ আমাদের এই তাত্ত্বিক আর
তাকারের দেশে! আরো কত দুর্লভ আমাদের এই নিরানন্দ মুসলমান সমাজে! বলি মুসলমানের চিত্ত বিকাশের ধারায় আবদুল্লাহ্, প্রবন্ধমালা, নবিকাহিনী, বোগদাদি = পভতির লেখকের কি স্থান, তার নির্দেশ পরবর্তী কালের ঐতিহাসিক করবেন; কিন্তু র সহজ আনন্দের উৎসরূপে তিনি তাঁর বন্ধুবর্গের সামনে প্রতিভাত হয়েছিলেন তা তাঁদের মনোজগতে চিরন্তন হয়ে থাকবার দাবিই বেশি করে করে।
১৯২০ সালের এপ্রিল কি মে মাসে তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। তখন তাঁর কলকাতা থেকে ঢাকায় বদলি হয়ে আসবার প্রাক্কালে। সন্ধ্যার পর আমরা ক’বন্ধু একদিন তার বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। তার বইয়ের-আলমারি-দিয়ে-সাজানো বসবার ঘরে তার সঙ্গে দেখা হলো। উজ্জ্বল-চম্পক-বর্ণ, উজ্জ্বল-চক্ষু, বেশে আসবাবপত্রে মার্জিতরুচি,-একটি সহজ আনন্দচ্ছটা যেন তার চোখে মুখে সদাই খেলছে! অল্প কিছুদিন আগে কঠিন অস্ত্রোপচার ভোগ করে তিনি যে উঠেছেন সে কথা তাঁকে দেখে বিশ্বাস করা শক্ত।
আর একদিনের কথা মনে আছে। বোধ হয় গত বৎসরের আগের বৎসর, পদ্মায় কিছুদিন ঘুরে বায়ু পরিবর্তন করে এলে হঠাৎ তার সঙ্গে একদিন দেখা। তাঁর পরিধানে ছিল চায়না সিল্কের ইয়োরোপীয় পোষাক,-সেই পোশাকের রঙের সঙ্গে তাঁর মুখের রঙের ও চোখের স্ফুর্তির চমৎকার সঙ্গত হচ্ছিল। দেখেই খুশি হয়ে বললাম-”বাঃ! আপনি যে একদম সেরে উঠেছেন!” তিনি হেসে বললেন-”আমাকে দেখলে তাই মনে হয়; এমনকি, লোককে অনেক সময় বিশ্বাস করানো শক্ত হয় যে আমার শরীর অসুস্থ। কিন্তু বাস্তবিকই শরীরে আর কিছু নেই।”-জীবনানন্দ তার ভিতরে এমন সহজ ভঙ্গিতে সর্বদা উৎসারিত হতো যে, তার পরিমাণ যে কত বেশি ছিল, সে কথা সাধারণত কারো মনেই পড়ত না।
এই ভগ্ন স্বাস্থ্যেও তাঁর সঙ্গে দেখা হলে নানা কথার অবতারণা তিনি করতেন। তার অধিকাংশই বাঙালি-মুসলমান-সমাজের অদ্ভুত রীতি-নীতি বুদ্ধি-বিবেচনা সম্পর্কে। কিন্তু ঠিক সংস্কারকের মনোভাব তার ছিল না। ছেলে-পিলের লালনপালনে আদবের অর্থশূন্য কড়াকড়ি, অবরোধের বিড়ম্বনা, মুসলমান সমাজপতিদের বুদ্ধির স্থূলতা-এই সমস্ত নিয়েই তিনি মৃদু ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতেন। মুসলমান সমাজের বজ্রকঠোর গোঁড়ামিকে তিনি সামনা-সামনি আঘাত করতে যাননি, অথবা চাননি; তার পাশ কাটিয়ে নিজের পরিজন ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে একটা সুন্দর অথচ ঘাতসহ জীবনের আয়োজন করে যেন সমাজকে বলতে চেয়েছেন-আমি জীবন উপভোগ করছি, তোমরা যদি না পার সে তোমাদের দুর্ভাগ্য।
তাঁর জীবনের একটি বিশেষ ব্যাপার ছিল তাঁর উদ্ভাবনী ক্ষমতা। তাঁর লিখিত শিশুপাঠ্য পুস্তকাবলিতে, তার নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রে, এর প্রচুর পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু এখানেও তার বিশিষ্টতা ছিল এই যে, তার উদ্ভাবিত কোনো বস্তু বা কোনো শিক্ষা-প্রদানের নিয়ম খুব সুন্দর হলেও তা নিয়ে বিশেষ হৈচৈ তিনি কখনো করেন নি।
তার নানা শ্রেণীর বন্ধুবান্ধবের মধ্যে যারা এই সমস্ত বিষয়ে কৌতূহল অনুভব করতেন, তাঁদের নিয়ে এ সমস্তের আলোচনা কিছু করতেন; তারা দেখে সস্তুষ্ট হতেন, বিস্মিত হতেন, তিনিও খুশি হতেন, আর সময় সময় তার ছেলে-পিলের শিক্ষাদীক্ষায় সে সব ব্যবহার করতেন,-ব্যস, এই পর্যন্ত! এই আনন্দময় উদ্ভাবনা তার নিত্যসহচর ছিল।
এমনি এক সরল, চটুল, অথচ অনাড়ম্বর, ভঙ্গিতে দীর্ঘতর জীবন তিনি অতিবাহিত করতে পারতেন। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা তা ছিল না। এই সুকুমার জীবনে তিনি সন্ধান করেছিলেন কঠিন ব্যাধিশর। তবে, এই কঠিন আঘাত সহ্য করেও, তার দত্ত আনন্দকে বহুলপরিমাণে অম্লান রাখবার ক্ষমতা তিনি তার এই বান্দাকে দিয়েছিলেন।
সেদিন কথা-প্রসঙ্গে অধ্যাপক মৌলবী আনোয়ারুল কাদীর বলছিলেন,-কাজি ইমাদুল হক সাহেবের মৃত্যুর পর থেকে বাংলার মুসলমান-সমাজে হয়ত একটা নূতন যুগের সূত্রপাত হবে। জীবনকে তিনি কিছু স্বাধীনতায় ও সৌন্দর্যে মণ্ডিত করে উপভোগ করেছিলেন; অনেক বিষয়েই কিছু কিছু নূতনত্ব তার ভিতরে ছিল, সেই সমস্তের খবর মুসলমান সমাজ যদি নেয়, আর সে-সব আত্মস্থ করে তারা যদি দাঁড়াতে পারে, তাহলে উন্নতির পথে কয়েক পা তার এগোবে।-তার একথা মিথ্যা নয়। সুন্দর অথচ স্বল্পজীবী কাজি ইমদাদুল হক নানা দিক দিয়েই বাঙালি মুসলমানের চিত্তোৎকর্ষের সৌধের জন্য মূল্যবান উপকরণরূপে নিজেকে উপস্থাপিত করেছেন। জড়তায় ক্লিষ্ট, তামসিকতায় সমাচ্ছন্ন, বাঙালি মুসলমান সমাজের কোলে প্রথম যৌবন থেকে এই তেতাল্লিশ বৎসর পর্যন্ত একটি নিঃসঙ্গ দীপশিখার মতো তিনি স্বাধীন-চিত্ততা নিয়ে জ্বলেছেন; নিজের পারিবারিক জীবন ঘিরে সরসতার ব্রততী লতিয়ে তুলে মুসলমানের ঊষর চিত্তক্ষেত্র পল্লবিত করবার অব্যর্থ ইঙ্গিত তিনি দিয়েছেন।
কিন্তু আজ সে-সব বিচার বিতর্ক নয়। আজ আমরা, তাঁর অনুরক্ত বন্ধুবৰ্গ, শুধু এই কথাটাই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তার জান্নাতবাসী আত্মার উদ্দেশ্যে বার বার নিবেদন করি যে, তাঁর সাহচর্যে একদিন আমরা আনন্দলাভ করেছি;-তাঁর স্মৃতি আমাদের চিরপ্রিয়। এক অল্পপরিসরে নিরলসতা, ভব্যতা, উদ্ভাবনা, আর আনন্দ নিয়ে তাঁর সমগ্র জীবন এক সুন্দর সৃষ্টির ছন্দে আত্মপ্রকাশ করেছিল; তাই বিদেহ হলেও বিস্মৃত তিনি হতে পারেন না;-No perfect thing is too small for eternal recollection-পূর্ণাঙ্গ যা, তা যত ছোটই হোক, চিরস্মরণের অযোগ্য তা নয়।
ঢাকা মুসলিম সাহিত্য-সমাজের শোক-অধিবেশনে পঠিত।১০ই এপ্রিল, ১৯২৬।
সৃষ্টির কথা
কলকাতা জনসমুদ্র আর কর্মসমুদ্রের এককোণে কবি আর তার বন্ধু আরামে দিন গুজরান করছিলেন। কবি কবিই, অর্থাৎ, জীবিকার্জনের জন্য চেষ্টা তাঁর অবসরের সুরসঙ্গতিতে কোনো বেসুর-সংযোগ ঘটায়নি। কলেজ থেকে বের হয়ে ওয়ালেদ
৩৯৪
সাহেবের তাড়াহুড়ায় মাত্র কয়েক দিনের জন্য তার শান্তিতে কিছু ব্যাঘাত ঘটেছিল, তিনি বলেছিলেন, “ভাল চাকরির চেষ্টা যখন করলে না তখন তোমাকে উকিল হতে তবে,” তা কবি আপন মনে হেসে ভেবেছিরেন-ওঃ, বাপগুলো কি নিদারুণ বুড়ো!
ছোট একখানি বাড়ি আর সামান্য কিছু আয়ের সংস্থান রেখে বৃদ্ধ পরলোকগমন করলেন। কবি এতটাও আশা করেননি। “A loaf of bread and cup in hand’-এর ভবিষ্যৎ “loaf” তার বিবেচনায় ছিল সহজলভা মাস্টারি। এইবার তার বন্ধু এসে যখন বললেন, “একটা দরখাস্ত-টরখাস্ত কোথাও পাঠাও;” কবি বললেন, “ক্ষেপেছ নাকি?”
কবির সহযোগী বন্ধুটি কিন্তু ‘লজ্জতে শুরব’ সম্বন্ধে কিছু ওয়াকিফহাল থাকলেও কলেজ থেকে বেরুবার পরই সওদাগরি হৌসে যে একটি কাজ নিয়েছিলেন সেখানে দৈনন্দিন উপস্থিতিতে কোনো দিনই তাঁর ত্রুটি লক্ষিত হয়নি। কবি প্রথম প্রথম এতে অবজ্ঞা তো প্রকাশ করতেনই (তার বন্ধু অপেক্ষাকৃত সঙ্গতিসম্পন্ন লোক), কিছু অসম্ভষ্টও তিনি হয়েছিলেন। কিন্তু শেষে বললেন,-”নাহে তুমি খাসা রসিক আর বুদ্ধিমান। ফুল ফুটে থাকে, মলয়ের ঝলক দীর্ঘ অবসরের ফাঁকে ফাঁকে এসে তার সঙ্গে মোলাকাত করে’ যায়।”-সকালে সন্ধ্যায় তাঁদের মিলন সূর্যোদয়ের মতো অবশ্যম্ভাবী। কি আলাপ তাদের হয়, কি তার উদ্দেশ্য, অর্থ, তার সন্ধান দেবে কার সাধ্য।
কবিকে তাঁর বন্ধু ঠাট্টা আর আদর করে বলেন, evergreen. Evergreen এর মতনই তিনি চিরশ্যাম আর ফলহীন,অর্থাৎ, মসী আর মেসিনের কলঙ্কছাপ-বিবর্জিত কবি। কবি উত্তর দেন, “সেকি অগৌরবের হে বন্ধু! কাব্য সংসারে ক’জন বোঝে। তুমি বোঝো, তোমার কাছে তো আমি কবিই।”
কবির কথা শুনে তার অন্তর্যামী সেদিন হেসেছিলেন।
—
–
—
—–
–
–
কালধর্মেই বল, আর লীলামাহাত্মেই বল, মহাত্মার অসহযোগের মতো শক্তিপ্লাবন ভারতের শত শত বৎসরের ঊষর স্থবির চিত্তে সম্ভবপর হলো। সকলেরই মতো কবিও সেদিন এর সূচনাকে অসাধারণ-কিছু ভাবেননি। তাঁর বন্ধুকে তিনি বলেছিলেন,-”পাগড়ি-মাথায় এই মেড়ো-চেহারা গান্ধী লোকটি কি যে বলছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না হে, তবে আওয়াজটা কেমন মোটা আর জোরালো।”
তারপর অঘটন ঘটলো। কাগজে কাগজে উচ্চ প্রশংসা আর তীব্র নিন্দা, সভাসমিতিতে ধুম বক্তৃতার নির্ভীকতা, আর এই সমস্তের ভিতরে চরকা আর খদ্দরের অমার্জিত শ্রী, নীরব কর্মশক্তি,-কবি আর তার বন্ধুর সকাল সন্ধ্যায় বিশ্রম্ভ-আলাপ কোন অতলে তলিয়ে গেল। “এ এক নূতন ব্যাপার! নূতন কর্মশক্তি! বাংলার মেরুদণ্ডহীন ভাবুকতা কি হতশ্রী এর সামনে!” এই কবির মুখের সব সময়কার বাণী হয়ে দাঁড়াল।
* খাদ্য কিছু পেয়ালা হাতে”-কাঃ চঃ ঘঘাষের অনুবাদ। ১ পানের আনন্দ-কবি হাফিজের কথা।
৩৯৫
তার সমঝদার বন্ধুর চিত্তও মহা-আন্দোলিত। তবু মাঝে মাঝে তার কবিকে বলতে খুবই লোভ হচ্ছিল-”কিন্তু অবসর যে অবসর গ্রহণ করলে কবি।” তা কবির বিষম আস্ফালনের সামনে সে কথা বলতে তার সাহস হয় নি।
সেদিন বাতি জ্বালিয়ে কামরায় বসে কবি কিছু লিখছিলেন। তাঁর অবস্থা দেখে খবরের কাগজ হাতে তার বন্ধু নীরবে হাসিমুখে তার পাশে গিয়ে বসলেন। কবি আরো খানিকক্ষণ লিখে বন্ধুর। মুখপানে চেয়ে হাসতে হাসতে সে লেখাটি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বললেন, “আজকার খবর কি পড়ো।” বন্ধু বললেন, “আজকার খবর খবরেরই মতো, শোনো।”
মহাত্মার কৌপীন ধারণের খবর।……খদ্দর এখনো দেশে প্রচুর নয়; কিন্তু আমাদের জাতীয় অপমানের প্রতিমূর্তি বিদেশী বস্ত্রের পরিবর্তে নিজেদের হাতের তৈরি খদ্দরই চাই……..তার উপর ভারতের কোটি কোটি নরনারী লজ্জা আর শীতাতাপ নিবারণের জন্য অতি সামান্য বস্ত্রের সংস্থানই করতে পারে।……।
বন্ধু শান্ত কণ্ঠে সেই সভার বিবরণ আর মহাত্মার বক্তৃতা পড়লেন। উত্তাপবিবর্জিত চির-উজ্জ্বল কথা, প্রেম আর কর্মশক্তি যার ভিতরে অমর রস-বিগ্রহ লাভ করেছে!
সেদিন তাদের আর কোনো কথাবার্তাই হলো না। একটু মুখ ফিরিয়ে কবি বসেছিলেন, বন্ধু তার মুখের অর্ধেক মাত্র দেখতে পাচ্ছিলেন। শেষে আস্তে আস্তে উঠে দরজা ভিড়িয়ে তিনি আজকার মতো কবিকে নীরব বিদায়-সম্ভাষণ জানালেন।
পশ্চিমে এলাহাবাদের এক ছোট নির্জন বাড়িতে কবির বর্তমান বাস। খেয়াল আর চিন্তা তাকে পাগল করে তুলেছে বললে অত্যুক্তি হয় না। কোনোদিন সমস্ত দিন চরকা কাটেন, কোনোদিন রোজা রাখেন। কোনোদিন ওক্তের পর ওক্তো নামাজ পড়ে’ চলেন; সেজদায় যেভাবে পড়ে থাকেন মনে হয় যেন আর উঠবেন না। কোনোদিন অটলভাবে উপবিষ্ট হয়ে বার বার মনে মনে আবৃত্তি করতে থাকেন তার প্রিয় “সুরা ফাতেহা।” তার আদরের সমস্ত কবি ও কাব্য আজ তাঁর কাছে স্বাদহীন-পানসে। ক্কচিৎ কখনো টেনে নন এমার্সন, কোরআন কিংবা গীতা; সামান্য কিছু পড়েন; সহসা দুই একটা কথা তাঁর মনের তারে এমন কঠিন ঝঙ্কার দেয় যে বই ফেলে উঠে উদ্ভ্রান্তের মতো তিনি ইতস্তত পদচারণা করতে থাকেন।
কয়েকমাস অতীত হলো। শেষে এই নিভৃত নিলয় দারুণ অবজ্ঞাভরে উপেক্ষা করে কবি লোকারণ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন। কয়েক দিন সভা-সমিতির তাড়নায় ঝালাপালা হয়ে’ শেষে গ্রামে প্রচারের কাজে বেরিয়ে পড়লেন।
কবির অন্তর্যামী সেদিনও হাসছিলেন।-চরকা যে কি অপূর্ব আবিষ্কার, কি বিরাট তপস্যার ফল, মহাত্মার অসহযোগ ভারতের ভাগ্য-বিধাতার যে কি প্রাণভরা আশীর্বাদ, এর চেয়ে দশগুণ জোরালো কণ্ঠ হলেও সে-সব সেদিন বলে’ কবির তৃপ্তি হতো না।
৩৯৬
কিন্তু কয়দিন। গ্রামবাসীদের জড়তার পরিমাণ তিনি কিছু উপলব্ধি করতে পারছিলেন। তার জন্য তাঁর হৃদয়ে কিঞ্চিৎ করুণার উদ্রেক হচ্ছিল। তবু শেষে অধীর হয়ে তিনি দেখলেন, শুধু তার খাতিরে কেউ কেউ চরকায় দুটো একটা পাক দেয়; হেসে বলে, “এ মেয়েলোকের কাজ কিনা।”
কংগ্রেস থেকে নাম কাটানোর দরখাস্ত পাঠিয়ে ছিন্নসূত্র ঘুড়ির মতো ফুঁকতে ধুতে কবি মান্দ্রাজ-প্রদেশের এক সমুদ্রতীরে বাসস্থান ঠিক করলেন। সমুদ্রের বিস্তারে তাঁর চিত্তবিক্ষেপ লুটিয়ে পড়ে কেমন সহনক্ষম ছন্দে আত্মপ্রকাশ করলে।
আপনা আপনি শান্ত হয়ে কবি ধ্যানাসনে বসলেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেটে যেতে লাগলো। শেষে বৎসর কেটে যাবার উপক্রম করলে। ধ্যানের নিস্তরঙ্গ সমুদ্রতলে কবি নিমজ্জিত।
প্রভাতের নীলিমাপ্রান্ত রঞ্জিত করে’ অরুণোদয়ের যে রোমাঞ্চ একদিন তেমনি রোমাঞ্চে কবির ভিতর বাহির সচকিত হলো। কবি পুলকিত হয়ে দর্পণে আপনার প্রতিবিম্ব নিরীক্ষণ করলেন!
তারপরের যে প্রতীক্ষা, সন্দেহে আনন্দে নৈরাশ্যে তা বিচিত্র!-কবির ভাগ্যবিধাতার আশীর্বাদের দৃষ্টি তার উপর নিপতিত হলো। সন্তানবতী নারীর ন্যায় কবি অনুভব করলেন, তার অন্তরে এক আবির্ভাব ঘটেছে।
তারপর সে-আবির্ভাবের জগতের নেত্রে সুপ্রকট হবার পর্যায়। কবি বুঝতে পাবলেন, বৃক্ষের ফল-প্রসবের মতো, নারীর সন্তানবতী হবার মতো, জগতের করে তাপসের তপস্যা-উপহার কি নিদারুণ পারম্পর্য-শৃঙ্খলে দৃঢ়- বদ্ধ! সে-বন্ধন কি আয়াসের! কি প্রাণারামের!-কবি আবার ধ্যানরাজ্যে প্রবিষ্ট হলেন।
তারপর মুখে আনন্দদীপ্তি চোখে আবেশ নিয়ে তিনি লিখতে বসলেন। দিন রাত কি ব্ৰস্ত গতিতে কালসমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে যেতে লাগলো, কে সেদিকে তাকায়। কবি লিখছেনই। লিখতে লিখতে তার চোখের আবেশ কেটে গেল। সেই আবেশের স্থানে জাগলো পরিচ্ছন্ন দৃষ্টি; আনন্দবিহ্বলতা পর্যবসিত হলো স্থির প্রসন্নতায়।কবির মানসনয়নে আবির্ভূত হলো এক দিব্য মূর্তি।
এর নবীনতায়, জ্যোতির্ময়তায়, বীর্যবত্তায়, কবি আনন্দিত হলেন। বুঝতে পারলেন, তাঁর সমস্ত মানসবিপর্যয়ের পর্যায়ে পর্যায়ে এরই আবির্ভাব কি অপূর্ব ভঙ্গিতে
স্পন্দিত হয়েছে!
পরম বেদনা ও আনন্দের দৃষ্টিতে এর সর্বাঙ্গ তিনি অভিনন্দিত করলেন।
অগ্রহায়ণ, ১৩৩২
–
—–
—
—
—
৩৯৭
সম্মোহিত মুসলমান
হজরত মোহাম্মদ যে একজন মহাপুরুষ, অর্থাৎ, সত্য তিনি শুধু কথায় প্রচার করেননি তা তাঁর সমগ্র জীবনের ভিতরে এক আশ্চর্য-দৃঢ় রূপ লাভ করেছিল, সে-সম্বন্ধে তর্ক বিচার করবার কাল বোধ হয় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এখনো যারা তাঁর মহাত্মের পানে সন্দিগ্ধ চিত্তে তাকান, কেননা, তিনি যুদ্ধ করেছিলেন, অথবা শেষ বয়সে বহু বিবাহ করেছিলেন, বলা যেতে পারে, কিছু সরল প্রকৃতি নিয়ে তারা তাঁর জীবনের জটিলতাবর্তে ঘুরপাক খেয়ে মরছেন। হয়তো তাদের সংস্কার আছে, মহাপুরুষের যে জীবন, শিশুর মতো সারল্যই তাতে প্রতিভাত হওয়া স্বাভাবিক ও শোভন। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারা যাবে, তাদের এ সংস্কার শুধু এক মধুর খেয়াল-সত্যে এর প্রতিষ্ঠা নয়। মহাপুরুষের জীবনে কেমন এক ঋজুতা আমরা প্রত্যক্ষ করি সত্য, আসলে কিন্তু সেটি ঋজুতা নয়, ঋজুতার ভঙ্গিমা মাত্র। বহুভঙ্গিমতা বা মানব-মনের জটিলতা মহাপুরুষের জীবনে নিরাকৃত হয়ে যায় না; সে-সমস্ত শুধু এক পরমাশ্চর্য অধিকারে একমুখিত্ব লাভ করে।
কিন্তু মহাপুরুষ মোহাম্মদের অভক্ত যে তাঁর জীবনের এই জটিলতায় বিড়ম্বিত হয়েছেন, সে আর কতটুকু দুঃখের বিষয়। তার চাইতে অনেক বেশি শোচনীয় ব্যাপার তার অনুবর্তী ভক্তদের ভিতরেই ঘটেছে,-তারাও তার এই বিচিত্র অথচ ভগবমুখী জীবনে বিড়ম্বিত হয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মহাসাধনাকে বিড়ম্বিত করেছেন। তাঁরা তাঁর পানে যে-দৃষ্টিতে চেয়েছেন ও যে-দৃষ্টিতে চাইবার জন্য অপরকে আহ্বান করেছেন, তাতে এই সহজ অথচ অতি বড় সত্য আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে যে, জগতের অনন্তকোটি মানুষের মতো হজরত মোহাম্মদও একজন মানুষ;-মানুষের ইতিহাসের এক বিশেষ স্তরে শক্তিমাহাত্মে তিনি সুপ্রকট, কিন্তু তার শক্তিমাহাত্ম-লাভই সে-ইতিহাসের চরম কথা নয়, তার চেয়ে গভীরতর কথা এই,-জগৎসংসারের যিনি চির-জাগ্রত নিয়ামক অনন্তকাল ধরে তিনি এমনিভাবে শক্তিমান আর সাধারণ এই দুই শ্রেণীর চক্রের সমবায়ে সংসার-রথকে চিরচলন্ত রেখেছেন। বাস্তবিক, মহাপুরুষ যে সর্বজ্ঞ নন, মানুষের সর্বময় প্রভু নন, মানুষের জীবন-সংগ্রামে তিনি একজন বড় বন্ধু মাত্র অবশ্য যেমন বন্ধু সমুদ্রচারী পোতের জন্য আলোকস্তম্ভ; তার কথা ও চিন্তার ধারা চিরকালের জন্য মানুষের পথকে নিয়ন্ত্রিত করে দিয়েছে একথা বিশ্বাস করলে মানুষরূপে তাঁর সাধনাকে যে চরম অপমানে অপমানিত করা হয়, কেননা, সমস্ত সাধনার যা লক্ষ্য সেই আল্লাহর উপলব্ধি মানুষের দৃষ্টিপথ থেকে রুদ্ধ হয়ে যায়-যে আল্লাহ্ চিরজাগ্রত, চিরবিচিত্র, বিশ্বজগতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দেশে দেশে, যুগে যুগে মানুষের অন্তহীন শুভ চেষ্টায় যার মহিমা প্রকটিত; হজরত মোহাম্মদের অনুবতীরা সেই প্রাণপ্রদ সদাস্মর্তব্য কথা
৩৯৮
অদ্ভুতভাবেই মন থেকে দূর করে দিয়েছেন;-হয়ত তারই ফলে অন্যান্য ছোটখাটো প্রতিমার সামনে নতজানু হওয়ার দায় থেকে কিছু নিষ্কৃতি পেলেও “প্রেরিতত্ব”রূপ এক প্রকাণ্ড প্রতিমার সামনে নতদৃষ্টি হয়ে তারা যে জীবন পাত করছেন, আধ্যাত্মিকতা নৈতিকতা সাংসারিকতা সবদিক থেকেই তা শোচনীয়রূপে দুঃস্থ ও বিভ্রান্ত।
অথচ হজরত মোহাম্মদের সাধনার এই বিড়ম্বনা ভোগ কত বিস্ময়কর ব্যাপার! মানুষের সাষ্টাঙ্গ প্রণামকে পর্যন্ত এই মহাপুরুষ গ্রহণ করেননি! আর তার আবিষ্কৃত যে বজসার তৌহীদ (একেশ্বরতত্ত্ব), তার অবলম্বিত যে আশ্চর্য অনাড়ম্বর সাংসারিক জীবন, আগ্নেয় সাম্যবাদ, আল্লাহ্র পানে সে সমস্তের যে প্রচণ্ড আকর্ষণ, কিসের সঙ্গে তার তুলনা করা চলে!-কিন্তু তার মাহাত্ম যত বড়ই হোক, একথা অস্বীকার করবার কিছুমাত্র উপায় নেই যে, সেই আল্লাহর উপলব্ধি, অন্য কথায়, সমস্ত জগতের সঙ্গে প্রেম ও কল্যাণের যোগের উপলব্ধি, আজ তাঁর অনুবর্তীদের দৃষ্টির সামনে নেই। জীবনের অর্থই যেন আধুনিক মুসলমান বোঝেনা। বুদ্ধি, বিচার, আত্মা, আনন্দ, এ সমস্তের গভীরতার যে আস্বাদ তা থেকে তাকে বঞ্চিত ভিন্ন আর কিছু বলা যায় না। জগতের পানে সে তাকায় শুধু সন্দিগ্ধ আর অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে,-এর কোলে যেন সে সুপ্রতিষ্ঠিত নয়, একে যেন সে চেনে না। কেমন এক অস্বস্তিকর অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে সারা জীবন সে ভীত ত্রস্ত হয়ে চলেছে!
মুসলমানের, বিশেষ করে আধুনিক মুসলমানের, এই অবস্থা লক্ষ্য করেই বলতে চাই-সে সম্মোহিত। সে শুধু পৌত্তলিক নয়; সে এখন যে অবস্থায় উপনীত তাকে পৌত্তলিকতারও চরম দশা বলা যেতে পারে,-তার মানবসুলভ সমস্ত বিচার-বুদ্ধি, সমস্ত মানস উৎকর্ষ, আশ্চর্যভাবে স্তম্ভিত! বর্তমান তার জন্য কুয়াসাচ্ছন্ন, দিগদেশবিহীন, অতীত ভবিষ্যৎ তার নেই। সময় সময় দেখা যায় বটে সে তার অতীতকালের বীরদের, রাজাদের, ত্যাগীদের মনীষীদের কথা বলছে। কিন্তু এ শেখানো বুলি আওড়ানোর চেয়ে এক তিলও বেশী-কিছু নয়। জীবনকে সত্যভাবে উপলব্ধি করবার দুর্নিবার প্রয়াসের মুখেই যে উদ্ভূিত হয় যুগে যুগে মানুষের বীরত্ব, ত্যাগ, শাস্ত্রজ্ঞান, মনীষা, তার প্রাচীন ইতিহাসে এর যোগ্য প্রমাণের অভাব নেই। হজরত ওমর ও ইবনে জুবেরের মতো বীর-কর্মীদের, সাদী-ওমর খইয়ামের মতো মনীষীদের, গাজ্জালি-রমির মতো সাধকদের, জীবনের অন্তস্থলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে এ কথা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। কিন্তু জীবনরহস্যের সেই গহনে উঁকি দেবে, এই সন্মোহিতের কাছ থেকে তা আশা করা কত দুরাশা! এ সমস্তই যে তার কাছে শুধু নাম-পঠন-অযোগ্য অক্ষরের মতো কালের পটে কতকগুলো আঁচড়। তার জন্য একমাত্র সত্য শাস্ত্রবচন। অথবা তাও ঠিক নয়; শাস্ত্রবচনের পিছনে যে সত্যও শ্রেয়ঃ-অম্বেষী মানবচিত্তের স্পন্দনের অপূর্ব রয়েছে শাস্ত্রবচনের মাহাত্ম-উপলব্ধির সেই দ্বার তার জন্য যে রুদ্ধ। প্রকৃত সন্মোহিতের মতো তার জন্য একমাত্র সত্য প্রভুর হুকুম-স্থূলবুদ্ধি শাস্ত্রব্যবসায়ী প্রভুর হুকুম। সেই প্রভুর হুকুমে কখনো কখনো ভবিষ্যতের অসংলগ্ন স্বপ্ন সে দেখে-কখনো ‘প্যান ইসলাম’-এর স্বপ্ন, কখনো এই তের শত বৎসরের সমস্ত ইতিহাস, সমস্ত বর্তমান পরিবেষ্টন, যেন যাদুমন্ত্রে উড়িয়ে দিয়ে সেই তের শত বৎসরের আগকার
৩৯৯
আগেরকার) শরীয়ত’-এর হুবহু প্রবর্তনার স্বপ্ন। কত নিদারুণ তার জীবনের পক্ষে এই প্রভুর হুকুম তার প্রমাণ এইখানে যে, এর সামনে তার সমস্ত বুদ্ধি বিচার স্নেহ প্রেম। শুভইচ্ছা, সমস্ত স্বাভাবিক মনুষ্যত্ব, আশ্চর্যভাবে অন্তর্হিত হয়ে যায়, সে যে চিরদাস। চিরঅসহায়, অত্যন্ত অপূর্ণাঙ্গ মানুষ, এই পরম বেদনাদায়ক সত্য ভিন্ন আর কিছুই তার ভিতরে দেখবার থাকে না।
কিন্তু এই সম্মোহন আজ যত প্রবল চেহারা নিয়েই দাঁড়াক, অনুসন্ধান করলে বুঝতে পারা যাবে, এ নূতনই নয়, পুরাতনও বটে। মনে হয়, এ সম্মোহনের এক বড়। কারণ হজরত মোহাম্মদের মহাজীবনই। সে জীবন তপস্যায়, প্রেমে, কর্মে, বিচিত্র ও বিরাট; নানা দুঃখ-দহনের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসার ফলে প্রখর তার ঔজ্জ্বল্য: তার। উপর তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ জানবার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য মানুষের হয়েছে। সাধারণ মানুষ তো চিরকালই পৌত্তলিক; কিন্তু হজরত মোহাম্মদের ব্যক্তিত্বের এই প্রাখর্যের
জন্যই হয়ত মুসলমান-ইতিহাসের অনেক শক্তিধর পুরুষও তার সম্মোহনের নাগপাশ এড়িয়ে যেতে পারেননি।-হজরত ওমর ও ইমাম গাজ্জালির কথা বলতে চাই। হজরত ওমরের ভিতরে দেখা যায়, তিনি তাঁর প্রকাণ্ড পৌরুষকে যেন আর সব দিকে লৌহ আবেষ্টনে বদ্ধ করে শুধু হজরত মোহাম্মদের অনুবর্তিতার পানে উনুখ রেখেছিলেন; সত্য আর হজরত মোহাম্মদের সাধনা এক ও অভিন্ন এই-ই যেন তার মনোভাব। তার নিজের জীবন-সাধনার জন্য এই একান্ত অনুবর্তিতার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি ছিল কিনা সে জিজ্ঞাসা অনাবশ্যক, কেননা, মুসলমান-জগতের সামনে মাত্র একজন বিশিষ্ট সাধক তিনি নন, তার চেয়ে সাধারণত তার সমাদর এইজন্য যে, সর্বসাধারণ মুসলমানের জন্য তিনি এক অতি বড় আদর্শ। ইমাম গাজ্জালিকেও তেমনিভাবে দেখা যায় দর্শনচর্চার বিরুদ্ধে এই অদ্ভুত যুক্তির অবতারণা করেছেন:- সাপুড়ে তার অল্পবয়স্ক পুত্রের সামনে সাপ খেলায় না, তার ভয় এই, সে তার বাপের অনুকরণ করতে গিয়ে বিপদ ঘটাবে; সর্বসাধারণের জন্য দর্শনচর্চাও এমনি ভাবে বিপজ্জনক।*-সর্বসাধারণের জন্য শাস্ত্রানুগত্যেও যে বিপদ কিছুমাত্র কম নয়, তাতে তাদের সত্যানুসন্ধিৎসায় গ্লানি পৌঁছবার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি, নিজে দার্শনিক আর সাধক হয়েও সে দিকে যে তিনি দৃষ্টি রাখেননি তার স্বপক্ষে এই সামান্য কথা বলা যেতে পারে যে, তাঁর যুগে এ প্রতিবাদের হয়ত প্রয়োজন হয়েছিল,-বৃথাতর্কের প্রবণতা ঘুচিয়ে দিয়ে সত্যান্বেষীকে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন হজরত মোহাম্মদের মহাদৃষ্টান্তের। তবু গোটা দর্শনচর্চার বিরুদ্ধে তাঁর যে প্রতিবাদ তাকে অত্যন্ত দোষাবহ বলা ভিন্ন উপায় নেই। যুক্তি বিচার যতই অপূর্ণাঙ্গ হোক, জীবনপথে বাস্তবিকই এ যে মানুষের এক অতি বড় সহায়। এর সাহায্যের অভাব ঘটলে পূর্বানুবর্তিতা পাষাণভারের মতনই মানুষের জীবনের উপরে চেপে বসে, দেখতে দেখতে তার সমস্ত চিন্তা-ও কর্ম-প্রবাহ শুষ্ক ও শীর্ণ হয়ে আসে।-কর্মে আত্মপ্রকাশ মানুষের প্রকৃতি চায়,-এই-ই তার জন্য কল্যাণকর; আর এই কর্মচেষ্টার জীবনে পূর্বানুবর্তিতা যে মানুষের পরম কাঙ্ক্ষিত কে না তা জানে। তবু
tr- ৯
–
—
—
–
* Confessions of AlGhazzali নামক পুস্তক দ্র:।
•–
–. •
৪০০
র প্রকতির বৈচিত্র্য ও বহুধা সার্থকতার কথা মন থেকে দূর করে দিয়ে কর্মের গাজন যেখানে মানুষ করে সেখানে সে যে মরণের আয়োজনই করে চিন্তাশীলেরা একথা আজ বিশ্বাস করেন।
‘ ইসলামের ইতিহাস বহুল পরিমাণে এক ব্যর্থতার ইতিহাস। হজরত মোহাম্মদের
সমের সাধনা তার মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পরই আরবের আদিম উচ্ছলতার ও পারস্যের বিলাস-মত্ততার আবর্তে পড়ে বিপর্যয় ভোগ করেছিল। সে-বিপর্যয় সালে নিয়ে সুস্থ ও স্বাভাবিক ভাবে বিকাশ লাভ করবার অবসর খুব কমই তার ঘটেছে। হয়ত সেই জন্যও কিছু বাড়াবাড়ির ছবি মুসলমান-ইতিহাসের প্রায় সব পর্যায়েই আমাদের চোখে পড়ে- কখনো চরম উচ্ছলতার বাড়াবাড়ি, কখনো অন্ধ অনুবর্তিতার বাড়াবাড়ি। তবু, হজরত মোহাম্মদের সাধনার পথে উদার বিচার-বুদ্ধি নিয়ে সহজ ছন্দে বেড়ে উঠলে মানুষের জীবনে যে কি অলৌকিক মহিমা প্রকাশ পায়, সৌভাগ্যবশত তার দৃষ্টান্তও মুসলমান-ইতিহাসে খুব বিরল নয়। মুসলমান সমাজ নূতন করে তাদের মাহাত্মের কাহিনী পাঠ করবে যেন তারই অপেক্ষায় বিশ্বজগতে সৌরভ ছড়িয়ে অথচ নিজেদের ঘরে কতকটা অবহেলিত হয়ে নীরব মহিমায় তারা বিরাজ করছেন। বিশ্ববরণ্যে শেখ সাদী এই পুণ্যশ্লোক মুসলমানদের অন্যতম। তাঁর যে সমস্ত অনাড়ম্বর অথচ প্রাণ-ও বিশ্বাস-সঞ্চারী বাণী হজরত মোহাম্মদের তৌহীদ ও বিশ্ব-কল্যাণের সাধনাই সে সমস্তের অন্তরে অন্তরে। কিন্তু হজরত মোহাম্মদের সেই সাধনাকে তিনি গ্রহণ করেছেন ভব-বিহ্বল হয়ে নয়, অন্ধ অনুবর্তিতার পথেও নয়,-সবল মনুষ্য-প্রকৃতি ও উদার বিচার-বুদ্ধির পথে। মনীষী তিনি, সত্যদ্রষ্টা তিনি, মানুষকে তিনি দেখেছেন জাতি-ধর্মের, আচার-আড়ম্বরের সমস্ত আবরণ ভেদ করে, সেই মুক্ত অবিচলিত দৃষ্টিতেই তিনি চেয়েছেন হজরত মোহাম্মদের পানে; দেখেছেন, মানুষের বিচিত্র আশা আকাক্ষার, বেদনা-সম্ভাবনার, কি আশ্চর্য স্ফুর্তি ও সামঞ্জস্য-সাধন সে-জীবনে ঘটেছে, সেই জন্য তা কি সুন্দর, কি উজ্জ্বল, কি ব্ৰজ্যরোধী দৃঢ়তা তার অঙ্গে অঙ্গে-সুখে দুঃখে, সম্পদে বিপদে তা মানুষের কত অবলম্বন যোগ্য। আবার যদি জ্ঞানে ও মনুষ্যত্বে বিকশিত হয়ে জগতের কাজে লাগবার আকাঙ্ক্ষা মুসলমানের অন্তরে জাগে তখন এই মহামনীষী সাদী হবেন তাদের একজন শ্রেষ্ঠ উপদেষ্টা। বুদ্ধি বিচার প্রভৃতি মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্বল বিসর্জন দিয়ে নতজানু হয়ে মহাপুরুষের পায়ে গড় হওয়া যে তারও প্রতি সত্যিকার শ্রদ্ধা নিবেদন নয়, তাঁর প্রতি সত্যিকার শ্রদ্ধা নিবেদন হচ্ছে, প্রকাণ্ড এই জগতের উপর দাঁড়িয়ে তাঁর প্রতি সত্যিকার শ্রদ্ধা নিবেদন হচ্ছে, প্রকাণ্ড এই জগতের উপর দাঁড়িয়ে তাঁর সাধনাকে সমস্ত প্রাণ ও মস্তিষ্ক দিয়ে গ্রহণ করায়, এবং সেই অধিকারের, প্রয়োজন হলে, তাকে অতিক্রম করায়, সেই তত্ত্বের সন্ধান যাদের কাছ থেকে নব মুসলিমের লাভ হবে এই শ্রেষ্ঠ মুসলমান সাদী হবেন তাদের অন্যতম।
–
–
–
–
—
* সাদীর একটি অতি প্রসিদ্ধ বাণী এই:- তরিকত বজুজ খেদমতে খল নিসৃত বতবিহ্ ও সাজ্জাদাও
দক্ নিত।” সৃষ্টির সেবা ভিন্ন ধর্ম আর কিছু নয়। তসবিহ, জায়নামাজ ও আলখাল্লায় ধর্ম
৪০১
জগতের জন্য ইসলামের প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়নি। বরং ইসলামের যে একান্ত ঈশ্বরপরায়ণতা, সাম্য ও মৈত্রীর বীর্যবন্ত সাধনা, জগতের জন্য আজো সেই সমস্তেরই দারুণতম প্রয়োজন। কিন্তু এই কল্যাণময় ইসলামকে বহন করে’ জগতের আর্ত ক্লিষ্ট নরনারীর সেবায় পৌঁছে দেবে কে? নিশ্চয়ই সেটি সেই কৃপার পাত্রের দ্বারা সম্ভবপর নয় যে, “আলেম” বলে নিজের পরিচয় দেয়, কিন্তু হৃদয়ের দ্বার যার সাংঘাতিক ভাবে বদ্ধ! শত শত বৎসরের পুরাতন বিধিনিষেধের তুচ্ছ তালিকা থেকে চোখ উঠিয়ে আল্লাহর এই জীবন্ত সৃষ্টির অন্তহীন সুখ দুঃখ ব্যথার পানে এতটুকু প্রীতি ও সমবেদনার দৃষ্টিতে চাইতে যে অপারগ!-কোনো সাধনার উত্তরাধিকার বংশসূত্রে নির্ণীত হয় না, গতানুগতিক শিষ্যত্ব-সূত্রেও নির্ণীত হয় না, হয় সাধনা-সূত্রেই। সাধক যে, নিজের রসনা দিয়ে সত্যের অমৃতস্বাদ গ্রহণ করবার আকাঙ্ক্ষা যার চিত্তে জাগে, তারই চোখে কেবল পূর্ববর্তীর সাধনার দ্বার উঘাটিত হয়, আর যে বেদনায়ও শ্রদ্ধায় সেই সাধনাকে বহন করে নব নব ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ করে তাকে সার্থকতা দান করতে হয়, সেই পরম সৌভাগ্যে অধিকারও তার জন্মে। সেই সাধনার দ্বারা শক্তি ও যোগ্যতা অর্জনের কথা বিস্মৃত হয়ে মুসলমান হজরত মোহাম্মদের বিরাট তপস্যাকে বহন করতে গিয়েছিল শুধু অন্ধ অনুবর্তিতার লাঠিতে ভর দিয়ে! সে যে পিষ্ট পর্যদস্ত হবে, তার মস্তি স্ক অবসাদগ্রস্ত হবে, এ তার অপরিহার্য পরিণাম। সেই তপস্যাহীন, সুতরাং অর্ধবিকশিত মানুষ, মুসলমানই জগতের দুঃখ-ব্যাধিতে ইসলামের সেবা পৌঁছে দিতে হাত বাড়াতে পারবে, এ মোহ যে আজো আমাদের চিন্তা ও কর্মের নেতাদের অন্তরে প্রবল, একটা গৌরবময়-অতীতের-অধিকারী সম্প্রদায়ের পক্ষে এর বড়ো লজ্জা ও পরিতাপের বিষয় আর কি হতে পারে? আল্লাহর এ জগৎ বিরাট, অনাদ্যন্ত হর্ষে ক্ষোভে, ব্যাথায় আনন্দে, এ বিচিত্র, এই বিরাট বাস্তবতার সঙ্গে যে যোগযুক্ত নয় জীবনে শ্রেয়োলাভের আসল দরজা তাঁর জন্য বন্ধ,-নূতন করে এই সত্য আমাদের চিত্তে প্রেরণা সঞ্চার করুক; আমাদের দেহকোষাণুসমূহ অক্সিজেন-সংস্পর্শে প্রতি মুহূর্তে দগ্ধ ও পুনর্গঠিত হয়, এমনি করেই দেহ সবল ও কার্যক্ষম থাকে, আমাদের চিত্তকেও তেমনিভাবে নব নব জ্ঞান ও প্রেরণার দহনে নিরন্তর দগ্ধ ও সঞ্জীবিত করতে হয়, নইলে জড়তার আক্রমণ প্রতিরোধে অসমর্থ হয়ে তা সম্পূর্ণ অকর্মণ্য ও জীবনের পক্ষে অভিশাপের মতো হয়ে দাঁড়ায়,-নূতন করে এ জ্ঞানের দহনে আমাদের সমস্ত জড়তা ভস্মীভূত হয়ে যাক; আর আমাদের চিত্তে বল সঞ্চার করুক এই নব বিশ্বাস যে, মানুষের চলার জন্য ব্যস্তবিকই কোনো বাঁধানো রাজপথ নেই,-জগৎ যেমন এক স্থানে বসে নেই মানুষও তেমনি তার পরিবর্তনশীল পরিবেষ্টনকে নিয়ে একস্থানে স্থির হয়ে নেই-আর এই পরিবর্তনশীল পরিবেষ্টনের ভিতর দিয়ে পথ করে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন অন্ধ অনুবর্তিতার নয়, সদাজাগ্রতচিত্ততার।-হয়ত তাহলে আমাদের চোখের সম্মোহন ঘুচে যাবে। তখন জগতের সঙ্গে আমাদের অপরিচয়ের পর্যায়ের অবসান
নাই।-বোধ হয় এই বাণীটি রাজা রামমোহন রায়ের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। নগেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কৃত রামমোহনের জীবনী ৫২৪ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
৪০২
হবে। তখন হয়ত সহজ দৃষ্টিতেই আমরা দেখতে পাব, বিপুলা এ পৃথিবীর কত বিচিত্র প্রয়োজনে কত ধর্ম, কত নীতি, কত সভ্যতা কোন্ অনাদি কাল থেকে তার কোলে জন্মলাভ করে আসছে,আর এই অনন্ত জন্মপ্রবাহে ইসলামের অর্থ কি, তার নব নব সম্ভাবনা ও সার্থকতা কোন্ পথে। তখন প্রীতিতে আর শ্রদ্ধায়ই আমরা অবলোকন করতে পারব, আমাদের প্রিয় হজরত মোহাম্মদের সাধনার সঙ্গে যে সমস্ত মহাপুরুষের সাধনার হুবহু মিল নেই তারাও কেমন করে’ জগতের সেবা করে চলেছেন। আর, নিন্দা ও বড়ম্বরের স্থূলতা ভেদ করে সত্যের চির-অমল চির-আনন্দপ্রদ জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠার যে গৌরব ও অমোঘ কার্যকারিতা, তখন জগৎ ও ইসলামের জন্য সেই শ্রেষ্ঠ সার্থকতার সন্ধানে আমাদের চিত্ত উন্মুখ হবে।
মুক্ত বিচার-বুদ্ধির সঙ্গে ইসলামের কিছুমাত্র বিরোধ নেই। বরং ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, ইসলামের যে প্রাণভূত তৌহীদের সাধনা, মুক্ত বিচার-বুদ্ধির সঙ্গে তার অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ,-বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর আল্লাহকে যে জানতে চায়, তার চিত্তে ভিন্ন বিচার, কাণ্ডজ্ঞান, অপরের প্রতি স্নেহ ও শ্রদ্ধা প্রভৃতি মুক্তির লক্ষণ আর কোথায় যোগ্যভাবে বিকশিত হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া, ইসলামের তৌহীদের সাধনা জগতে কল্যাণ ও মুক্তির সহায়তা করে এসেছে, ইতিহাসে তার প্রমাণ আছে। তৌহীদে-বিশ্বাসী দার্শনিক ইবনে রোশদের (Averroes) লেখা থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে ইয়োরোপীয় চিত্তে শাস্ত্রের অভ্রান্ততায় সন্দেহ জন্মেছিল, প্রাচীন শাস্ত্রের বন্ধন থেকে বুদ্ধির এই মুক্তির স্থান ইয়োরোপীয় রেনেসাঁসে অনেকখানি; মধ্যযুগের ঘোর তামসিকতার ভিতরে নানক, কবীর প্রভৃতি ভক্ত সত্যিকার আধ্যাত্মিকতার দীপ ভারতে পুনঃ প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন, তাদের সামনেও শিখারূপে জ্বলেছিল ইসলামের তৌহীদ ও সাম্যবাদ; আর বাঙালি মুসলমানের জন্য সব চাইতে বড় সুসংবাদ এই যে, ভারতের নবজাগরণের যিনি আদি নেতা সেই মহাত্মা রাজা রামমোহনের উপরে ইসলাম আশ্চর্যভাবে প্রভাবশীল হয়েছিল। বাংলার চণ্ডীমণ্ডপের অবরুদ্ধতা ও নিরুদ্বেগের ভিতরে তিনি যে প্রবাহিত করতে পেরেছিলেন সবল কাণ্ডজ্ঞান, চিন্তা ও কর্মের বিশ্বধারা, সে-সমস্তের যোগ্য প্রেরণা চিত্তবিকাশের মহামুহূর্তে তার লাভ হয়েছিল, হজরত মোহাম্মদের সাধনা থেকে,-তাঁর প্রচারিত তৌহিদ, সাম্য, নর-নারী নির্বিশেষে সবারই জীবনের মর্যাদাবোধ, আধুনিক যুগের এই মহাপুরুষের কল্যাণ ও মুক্তির পথে অমূল্য পাথেয়েরই কার্য করেছিল।
কিন্তু, চেরাগকে নিচে আন্ধেরা!’-সেই ইসলামের অনুবর্তী বলে’ আজ যারা নিজেদের পরিচয় দেয়, সমস্ত রকমের মুক্তির সঙ্গে তারা অপরিচিত!-কেন এমন হয়েছে, সে সম্বন্ধে আমাদের নতুন কোনো কথা বলবার নেই। সত্য ও সত্যসাধকের মহৈশ্বর্যময় প্রকাশের সামনে মুসলমান চকিত সম্মোহিত হয়েছে, জগতের সমস্ত সাধনাকে জীবনগঠনের উপাদনরূপে ব্যবহার করা যে মানুষের চিরন্তন অধিকার, সে কথা সে শোচনীয়রূপে বিস্মৃত হয়েছে বার বার এই কথাটাই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে;-একটা বড় সম্প্রদায় হিসেবে এই-ই মুসলমানের চরম দুর্ভাগ্য যে, তার যে সমস্ত পরমাত্মীয় পূর্ণাঙ্গ মনুষ্য-প্রকৃতি নিয়ে গভীর শ্রদ্ধা ও গভীর আত্মবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ইসলাম ও হজরত মোহাম্মদের পানে চেয়েছেন, তাদের শান্তোজ্জ্বল দৃষ্টান্তের
৪০৩
চেয়ে, যারা ইসলাম ও হজরত মোহাম্মদের দীপ্তিতে অন্ধ হয়ে সম্মোহিত হয়ে আস্ফালন করেছেন তাদের প্রচণ্ডতা, তাকে আকৃষ্ট করেছে বেশি,-আর আজ পর্যন্ত সেই। আকর্ষণই তার পক্ষে প্রবলতম।
–তবে, শুধু নৈরাশ্যে একান্ত ম্রিয়মাণ না হলেও আধুনিক মুসলিম সাধকদের চলে। একটা বড় সত্যসাধনার পূর্ণ পরিস্ফুরণের জন্য তের শত বৎসর খুব দীর্ঘকাল নয়। বিপুল ভবিষ্যৎ তাদের সামনে। সেই ভবিষ্যতে ভীত সম্মোহিত মুসলমানের পরিবর্তে মুক্তদৃষ্টি ভূমার প্রেমিক মুসলমানকে জগৎ পাবে, তাতে করে বিশ্বমানবের আত্মপ্রকাশের চিরসংগ্রামে এক দৃঢ়-মেরুদণ্ড-সমম্বিত অকুতোভয় সৈনিক জগতের লাভ হবে, ইসলামও এক অপূর্ব সার্থকতার শ্রীতে মণ্ডিত হবে-এই আশায় ও বিশ্বাসে তারা তাঁদের অতীত ও বর্তমানের সমস্ত ব্যর্থতা ও লজ্জা বহন করতে পারেন।
জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৩
নবপর্যায়ের পরিশিষ্ট
বাদ-প্রতিবাদ
কিছুদিন পূর্বে “মোহাম্মাদী”-তে একটি লেখা বের হয়। তাতে অধ্যাপক আবুল হুসেনকে ও তরুণ কবি আব্দুল কাদিরকে কোরআন ও হজরত মোহাম্মদ সম্বন্ধে কয়েকটি অসঙ্গত কথার জন্য জবাবদিহি করা হয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের বার করে দেবার পরামর্শ দেওয়া হয়। অধ্যাপক আবুল হুসেন প্রতিবাদে বলেন, তিনি সে রকম কোনো অসঙ্গত কথা কখনো বলেন নি, বলতে পারেন না। আবদুল কাদির সাহেবও সেই কথা বলেন। তাতে ‘মোহাম্মদী’ সন্তুষ্টই হন। কিন্তু সেই সম্পর্কে (১৯২৭ সালের) ১৬ই নভেম্বরের ‘ছোলতানে’ “ঢাকার তরুণ দল” শীর্ষক লেখায় এই ধরণের কয়েকটি কথা বলা হয়:
“আমরা (ছোলতান) চিন্তার স্বাধীনতার বিপক্ষে নই, বরং তার ঘোর পক্ষপাতী; কিন্তু ঢাকার তরুণ-দল ইসলাম ও আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান উভয়েরই পল্লবগ্রাহী মাত্র। ইসলামের ইতিহাসে মোতাজেলা-সম্প্রদায়, ইমাম গাজ্জালী-প্রমুখ পণ্ডিতবর্গ, চিন্তার স্বাধীনতা-প্রীতি দেখিয়েছেন; ইয়োরোপের ও আমেরিকার Free-thinker-দের কথা ভাবলে চমৎকৃত হতে হয়, কিন্তু এঁদের সে রকম কিছুমাত্র যোগ্যতা নেই, শুধুই তাঁরা অনধিকার-চর্চা করছেন। তারা নিজেদের ভুল শিগগিরই দেখতে পাবেন। আপাততঃ ঢাকার তরুণ দল ও “শিখা”-সম্প্রদায়ের বন্ধুদের কাছে আমাদের এই অনুরোধ, তারা যদি ইসলামের ভিতরে এমন কিছু পান, যা যুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিপন্থী, তবে সে
৪০৪
সব তারা আমাদের জানালে, আমরা ইন্শাআল্লাহ্ সে সমস্তের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারব। যতদিন তারা না বোঝেন, ততদিন বোঝাতে চেষ্টা করব; আর এ কথাও বলে বাখছি যে শাস্ত্রবচন উদ্ধার করে চাপ দেবার বা কাফেরী ফতোয়া দেবার লোক আমরা নই।”
জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমাদের একশ্রেণীর লেখকদের এই আস্ফালন অত্যন্ত মারাত্মক এই ভেবে আমি সেই লেখাটির উত্তর স্বরূপ দুটি প্রশ্ন করে একখানি চিঠি ‘ছোলতানে পাঠাই। সম্পাদকের টিপ্পনী-সমেত সেই চিঠিখানি ৩০শে নভেম্বরের ‘ছোলতানে প্রকাশিত হয়। আমার সেই মূল চিঠিখানি এই :
“জনাব ছোলতান-সম্পাদক সাহেব, ঢাকার তরুণ দলকে ও “শিখা”-সম্প্রদায়কে বন্ধুভাবে গ্রহণ করে তাদের সন্দেহভঞ্জনের জন্য আগুয়ান হয়েছেন, এর জন্য শত সহস্র ধন্যবাদ। কিন্তু এ হয়ত আপনাদের সদা-সক্রিয় “চিন্তার স্বাধীনতা”-প্রীতিরই পরিচায়ক, কেননা, এমন শক্তিশালী দল ঢাকায় আছে ঢাকায় অবস্থান করেও তা আমাদের তেমন জানা নেই। তবে ভবিষ্যতে ঢাকায় বা অন্যত্র মুসলমানসমাজে এমন শক্তিশালী দলের আবির্ভাব হয়ত সম্ভবপর হবে। আশা করি, আপনাদের উদারতা ও “চিন্তার স্বাধীনতা-প্রীতি সেদিনেও এমনিভাবে কার্যকরী থাকবে।
আমি নিজে ঠিক তরুণ নই; হতে চাইলেও আপনারা হয়ত বাদী হবেন, কেননা আমার বয়স ত্রিশের উপর; তবে ‘শিখার আমি একজন লেখক, আর “ঢাকার তরুণদল” বলে যাদের অভিহিত করেছেন, সেই বিকাশোনুখ কিশোরদের একজন বন্ধু। তাই তাদের হয়ে দু’একটি কথা বলা প্রয়োজনীয় মনে করি। অথবা শুধু তাদের হয়েই কেন, নিজের তরফ থেকেও সমাজের প্রচলিত চিন্তা-ধারার বিরুদ্ধাচরণ কর্তব্য বলে মনে করি। তাই প্রশ্ন শুনিবার জন্য যখন আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তখন দুটি প্রশ্ন পাঠাচ্ছি; আশা করি বন্ধুর মতো উন্মুক্ত চিত্ত নিয়েই এ সমস্তের আলোচনা করবেন-অর্থাৎ হার অথবা জিৎ কারো একচেটে নয় বিচারকালে এ কথাটি বিস্মৃত হবেন না।
ঢাকার দলকে ধর্মবিচারে অনধিকারী সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই যে, ধর্ম বলতে তারা কি বোঝেন, অর্থাৎ, এ বিষয়ে আপনাদের ধারণার সঙ্গে তাঁদের ধারণার কোনো বড় অমিল রয়েছে কিনা, সে সব কিছুই জানবার চেষ্টা না করে এক তরফা ডিগ্রি দিয়েছেন। “শিখা”র লেখাগুলো এবং আমার “নবপর্যায়” খানা একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লে এমন বেপরোয়াভাবে রায় দেবার আগে হয়ত সেখানকার তর্ক খণ্ডন করে তবে অগ্রসর হতেন। সেখানে মানুষের সঙ্গে আত্মীয়তা, বুদ্ধির মুক্তি (Emancipation of the Intellect), বর্তমানে মুসলমানের শিক্ষার দোষ, ইসলামকে সম্পূর্ণ নূতন করে বুঝবার প্রয়োজনীয়তা, ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে যে, মুসলমান, বিশেষ করে আধুনিক মুসলমান, সম্মোহিত ও পৌত্তলিক। নিশ্চয়ই আলেমদের বাদ দিয়ে এসব কথা বলা হয় নি।
৪০৫
বাস্তবিক যত গোলমাল তো এইখানেই। আপনারা ঠিক করে বসে আছেন যে, ইসলাম (আপনাদের মতে ধর্মের চরম) কোরআন-হাদিসের দুর্ভেদ্য দুর্গে সুরক্ষিত আছে, সেখান থেকে বচনের গোলাগুলি আহরণ করে আনতে না পারলে ধর্মযুদ্ধে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কারোই নেই। কিন্তু আফসোস, মুসলমান-সমাজও যে মানুষের সমাজ। আর সেই মানুষের সন্ধানী চিত্ত একালে শাস্ত্রবচন-রূপ গোলাগুলির range পেরিয়ে গেছে! তাই একালে ধর্মযুদ্ধে জয়ী হতে চাইলে শাস্ত্রের যা থেকে উদ্ভব সেই মানব-বুদ্ধি ও মানবকল্যাণের কারখানায় নূতন নূতন অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করা ভিন্ন গত্যন্তর দেখি না। তবু জয়ী হবেন কিনা তা আগে থাকতেই কি করে বলা যায়। তবে জয়ীই হন আর পরাজিতই হন মানব-বুদ্ধি ও মানব-কল্যাণ যদি আশ্রয় করেন, তবে মানুষের শ্রদ্ধাভাজন হবেন নিশ্চয়।
ইয়োরোপ ও আমেরিকার Free-thinker দের পাণ্ডিত্যের কথা বলেছেন। অতদূরে যাবার দরকার ছিল না, আমাদের এই দেশে রাজা রামমোহন রায় ও স্যার সৈয়দ আহমদ খাঁ কম শাস্ত্রজ্ঞানের পরিচয় দেন নি। কিন্তু তাদের সেই শাস্ত্রবচনতীরে ক’টি প্রাণী ঘায়েল হয়েছিল, বলুন তো? ঘায়েল যে হয় নি তার সবচেয়ে বড় কারণ-সাধারণত মানুষ শাস্ত্র মানে না অথবা মানতে পারে না, তবে নিজেদের দুর্বলতার জন্যে শাস্ত্রের সেবাইতদের চোখ-রাঙানিতে সময়সময় চতুর্দিক অন্ধকার দেখে।
সাধারণ মানুষে ও মহামানুষে প্রভেদ শাস্ত্রজ্ঞানে নয়, প্রভেদ জীবনের আস্বাদ ও অর্থের গভীরতার উপলব্ধিতে। তাই মহামানুষের শাস্ত্রবচন উদ্ধার ব্যর্থ হলেও চরিত্র ও কর্মের দ্বারা জীবনের নব সম্ভাব্যতার ছবি যে তারা দেখিয়েছেন তা ব্যর্থ হয় নি। জীবনের এই নব আস্বাদ ও অর্থের উপলব্ধির জন্য প্রাচীন শাস্ত্র ও চিন্তাধারার সঙ্গে নিবিড় পরিচয়ের প্রয়োজন কিছুমাত্র কম নয়; কিন্তু সেই পরিচয়ের অর্থ “সংগ্রহ” নয়, সেই পরিচয়ের অর্থ “পরিপাক”। এই ‘পরিপাকে’র ক্ষমতা কেন সময় সময় কারো ভিতরে প্রবল হয়, আর সেই জন্য তাঁর কর্মচেষ্টা তার পারিপার্শ্বিক মানুষের জীবনে বিশেষভাবে কার্যকরী হয়, তার সব কারণ আজো আমরা জানি না, তবে সমসাময়িক মানুষের দুঃখ-ভাবনা নিয়ে ধ্বস্তাধ্বস্তি করবার ক্ষমতা যে এই “পরিপাক”-ক্রিয়ার নিত্য-সহচর তা এক রকম সর্বদিসম্মত। Free-thinkers, মোতাজেলা, ইমাম গাজ্জালী, এঁদের জীবনকথা ভাবলে সেখানেও দেখবেন এই যুগধর্মের তাড়না, সমসাময়িক মানুষের দুঃখ-বিপত্তি নিয়ে লড়বার আকাঙ্ক্ষা। তাই মুসলমানী শাস্ত্রের সঙ্গে আপনাদের (আলেমদের) কিছু পরিচয় থাকলেও সেই শাস্ত্রের নির্দেশ বাস্তবিকই আপনাদের জীবনে পরিপাক” লাভ করেছে কিনা সে সম্বন্ধে আমাদের সন্দেহ কম নয় কেননা, সমসাময়িক মানুষের জীবনের সমস্যা কি, তাদের দুঃখ-আনন্দের কী চেহারা, ‘পরিপাকে’র এই সমস্ত লক্ষণ আজো আপনাদের কথায় ও কাজে ফুটে ওঠে নি।
অপরপক্ষে আমাদের-আপনাদের রায়-অনুসারে অল্পবিদ্যাসম্পন্ন অনধিকারীদের-চোখে মুসলমান-সমাজের কি চেহারা ফুটেছে? সেখানে দেখছি, অনুসন্ধিৎসা বন্ধ, মনুষ্যত্ব অর্জনের দিকে কিছুমাত্র দৃষ্টি নেই, আর ধর্ম হচ্ছে দরুদ
৪০৬
কারআন-চুম্বন, আর শাস্ত্র নিয়ে আস্ফালন। এরই মধ্যে দুইএকজন আলেম
তাদের সাগরে ইসলামের আদর্শ “ইসলামের সার্বজনীনতা” ইত্যাদি দুইএকটি ভগীর বচন আওড়াচ্ছেন; কিন্তু মনুষ্যত্বের, অর্থাৎ সুন্দর ও সাধু জীবনের, মবেদনা থেকে এ-সমস্তের উদ্ভব নয়; এ সমস্তের মূলে রয়েছে “সম্মোহন আর রকরণ-আধুনিক প্রতিক্রিয়াধর্মী হিন্দু যে প্রাচীন শাস্ত্রের মাহাত্ম অনেকখানি গলার সাবে ঘোষণা করতে চাচ্ছেন তারই অনুকরণ। মাজহাব’-পন্থী আর ‘পীর-পরস্তের = কিছুদিন আগে পর্যন্ত মুসলমান-সমাজে সর্বত্র প্রবল ছিলেন; এখন তারা সমাজের সদর আঙিনায় আসর আর তেমন জমাতে পারছেন না, যদিও ভিতরে ভিতরে তাঁদের প্রভাব এখনো অত্যন্ত প্রবল। সমাজের সেই সদর আঙিনায় আজকাল আসর জমিয়েছেন আপনারা, অর্থাৎ “যুক্তিবাদী শরিয়ৎপন্থী”। বর্তমান জগতে বাস করে আধুনিক মুসলমান যুক্তি কথাটাকে যে অশ্রদ্ধা করবেন না, এ খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু যুক্তির পুরো চেহারার সঙ্গে তাঁদের আজো পরিচয় হয় নি, তাই আপনাদের তথাকথিত যুক্তিবাদ আজ সমাজে আদৃত হচ্ছে বলে বোধ হচ্ছে। কিন্তু আপনাদের যুক্তিবাদ যে কত অসম্পূর্ণ ও নিরর্থক তার এক বড় প্রমাণ মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সাহেবের বিরাটকায় ‘মোস্তফা-চরিত’। সেখানে সহি হাদিস নির্ণয়ের চেষ্টা বেশ আছে, পাদ্রীদের থোকা-ভঞ্জনের চেষ্টা তার চেয়েও বেশি আছে, কিন্তু নেই মানুষ, মোহাম্মদের চরিত্র; কেমন করে তার চিত্ত-কোরক দিনে দিনে বিকশিত হয়েছে, কেমন করে তিনি পরিজনকে ভালবেসেছেন, মানুষকে ভালবেসেছেন, জীবনকে ভালবেসেছেন, কেমন করে সময় সময় ভুলও করেছেন, কেমন করে তাঁর আদর্শ বুকে ধরে সর্বস্ব পণে অগ্রসর হয়েছেন, অনন্ত অত্যাচার-অবিচার প্রেম ও ক্ষমার অতলে নিমজ্জিত করেছেন,-অর্থাৎ, মানুষের মনুষ্যত্ব যখন জাগে তখন তা কেমন করে এমনি ভাবে সমস্ত অন্যায়-অত্যাচারের শীর্ষে জীবনের অপরূপত্ব ফুটিয়ে তোলে-নেই সেই সমস্ত কথা। কেমন করেই বা থাকবে? পূর্ণ বৈজ্ঞানিক যুক্তিকে যদি আপনারা সমস্ত প্রাণ দিয়ে গ্রহণ করতেন তা হলে আপনাদের হাতে মহাপুরুষ মোহাম্মদকে না পাওয়া গেলেও মানুষ-মোহাম্মদকে ও সেই ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীর আরবকে হয়ত অনেকখানি পাওয়া যেত। কিন্তু মাফ করবেন, আপনাদের যুক্তিবাদের ধারা হচ্ছে
খাতেমুন্নবীঈন যিনি হবেন তাঁর সর্বগুণালঙ্কৃত ও নির্দোষ হওয়া চাই, হজরত মোহাম্মদ খাতেমুন্নবীঈন, অতএব হজরত মোহাম্মদের সর্বগুণালঙ্কৃত ও নির্দোষ হওয়া চাই,
এই ধরণের; তাই সত্য ও কল্যাণ-অভিসারী যুক্তি, মহাপুরুষের জীবনের অপরূপত্বের উপলব্ধি, সবই তাতে দুর্লভ হয়েছে, দুর্লভ হয়েছে শুধু রসহীন সৌষ্ঠবহীন
বাগ্বিস্তার।
সমাজের এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে মুসলমানের মুক্তির ও জগতে তাদের সার্থক হবার এক ছবির দিকে আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল, অথবা হতে চাচ্ছিল। কতকটা নির্জনে
৪০৭
নীরবে আমাদের সেই সাধনা চলেছিল, ও প্রধানত সাহিত্যকে অবলম্বন করেই আমাদের চিন্তাভাবনা বিচার-বিতণ্ডা অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু আপনারা আমাদের টেনে হাটের ভিতরে নিয়ে এলেন। এনে ভাল করলেন কি মন্দ করলেন তার বিচার কালের দরবারে হবে; আপাতত এই প্রাচীন কথাটা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, মানুষ যখন নিজেকে নিরাপদ মনে করে তখনই সে সবচেয়ে বড় ভুল করে।
যাক, যে দুটি প্রশ্ন তুলতে চেয়েছি তাই তোলা যাক। এ-সব হাটের ভিতরে আলোচনার যোগ্য নয়। কিন্তু না করেই বা উপায় কি আছে। প্রশ্ন-দুটি হচ্ছে এই:
১। কোরআন আল্লাহর বাণী কি অর্থে?
২। খাতেমুন্নবীঈন (শেষ বাণী-বাহক) কথাটাকে মুসলমান সমাজে যে-ভাবে মানতে বলা হয় তাতে আল্লাহর সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধকে বিকৃত করে দেখা হয় কিনা ও পৌত্তলিকতা করা হয় কি না।
এ সমস্ত প্রশ্নের কি উত্তর দেবেন তা আপনারাই জানেন ভাল। তবে প্রচলিত যুক্তিতর্কের প্রায় সবগুলোর সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে, আর সে-সব সন্তোষজনক নয়, এ-কথাটা বলে রাখা দরকার, নইলে অকারণে কথা বেড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। সে-সমস্ত যুক্তিতর্ক এই জন্যই সন্তোষজনক নয় যে, চিন্তার স্বাধীনতা-পূর্ণ অবাধ চিন্তার স্বাধীনতা-মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে ও সমাজ-জীবনে কত প্রয়োজনীয় সেই সমস্ত তর্কে যথেষ্ট পরিমাণে এই কথাটার সম্মুখীন হওয়া হয় নি। ইতি-”।
আমার এই চিঠিখানির উপর সেই সংখ্যার ছোলতানে-ই যে টিপ্পনী করা হয় তার মর্ম এই:
“লেখকের প্রশ্নের উত্তর আপাততঃ দেওয়া দেখি অনর্থক কেননা তাঁর ও তাঁর স্বমতাবলম্বীদের এই ধারণা যে, কোনো যুক্তিই বুঝবার প্রয়োজনীয়তা তাদের নেই, কেননা জগতে যিনি যে তর্ক উপস্থিত করবেন সবই তাদের জানা আছে তা তারা শুনুন আর নাই শুনুন, বুঝুন আর নাই বুঝুন, সংবাদপত্রে ঘোষণা করে আমরা যখন প্রশ্নের কারণ হয়েছি তখন অপর দশজনের সন্দেহ ভঞ্জনার্থ আমরা এ সমস্ত কথার আলোচনা করব। কিন্তু তার আগে আমাদের প্রশ্নকর্তার মনোভাব জানা দরকার। তাঁর কাছে। আমাদের জিজ্ঞাসা: ১। তিনি কোনো অর্থে কোরাণকে আল্লাহর বাণী বলে মানেন কিনা, ২। তিনি হজরত মোহাম্মদকে নবী ও খাতেমুন্নবীঈন বলে মানেন কিনা। ডাক্তার যেমন প্রশ্ন করে করে রোগীর অবস্থা বোঝেন ও তারপর ব্যবস্থা দেন এই সমস্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসায় আমাদেরও সেই উদ্দেশ্য।”
এই টিপ্পনীর উত্তরে আমি ছোলতানে লিখেছিলাম:
“জনাব ‘ছোলতান’-সম্পাদক সাহেব, আপনার ৩০শে নভেম্বরের ‘ছোলতানে আমার চিঠিখানি ও তার উপর আপনার টিপ্পনী দেখলাম। কিন্তু কেমন করে যে এই টিপ্পনী করতে পারলেন তা ভেবে পাচ্ছিনে। আপনার ১৬ই নবেম্বরের ‘ছোলাতা’নে
৪০৮
নাবাই জানতে চেয়েছিলেন “প্রচলিত ইসলামের ভিতরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিপন্থী কোনো কিছু আছে কিনা, ও তা জানালে আপনারা তার সন্তোষজনক উত্তর দেবেন বলেছিলেন। আপনারাই যুক্তিতর্কের দিক দিয়ে সব আলোচনা করবেন স্বীকার করেছেন, এরপর প্রশ্নকর্তা কোরাণকে আল্লাহর বাণী বলে মানেন কিনা, হজরত মোহাম্মদকে নবী ও খাতেমুন্নবীঈ বলে মানেন কিনা, ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করা শুধু অপ্রাসঙ্গিক নয়, অন্যায়। ঢাকার দলকে আপনারা একশ্রেণীর Free-thinker সাউরেছেন; সেই Free-thinker–দের সঙ্গে যে ভাবে মোকাবেলা করতে হয়, সেই ধারা অবলম্বন করবেন এত আগে থাকতে জানা কথা। মেহেরবানি করে আমার চিঠিখানি আর একবার ভাল করে পড়ে নেবেন, তা হলেই বুঝবেন, কোথায় আমাদের বেধেছে।
আমরা যে শুধুই প্রশ্ন করেছি, আপনাদের কোনো কথা শুনবার জন্য প্রস্তুত নই তা পুরোপুরি ঠিক নয়। তবে সত্য লুকিয়ে লাভ নেই, আমাদের সাধারণ ধারণা এই যে, এ-সব প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দেবার ক্ষমতা আপনাদের নেই, শুধুই অকারণে বড় কথা বলেছেন; কেননা, আধুনিক যুগের এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেবার শক্তি যদি আপনাদের থাকত তা হলে আপনাদের হাতে মুসলমান-সমাজের চেহারা এতদিনে ফিরে যেত। কিন্তু আমাদের এই ধারণা থাকা সত্ত্বেও যদি সত্যিকার জ্ঞানের খোরাক আপনাদের কাছে আমরা পাই, তবে আমাদের সব বিতৃষ্ণা অভিমান সরিয়ে দিয়ে আপনাদের প্রদত্ত সেই জ্ঞানের ফলারে যে বসে যাব তা নিশ্চিত।
আমার লেখাটির ভিতরে কিছু ঔদ্ধত্য আছে; ইচ্ছা করেই সেটি বিনয়ে রূপান্তরিত করা হয় নি। আপনারা এতকাল মুসলমান-সমাজের লোকদের সমস্ত মানসিক উৎকণ্ঠা শুধু ধমক দিয়েই চেপে দিয়ে এসেছেন, এবারও কতকটা তারই আয়োজন করেছেন। এই ঔদ্ধত্যের ভেতর দিয়ে শুধু এই কথাটির বলার প্রয়াস পাওয়া হয়েছে যে, ধমকে কাবু হওয়ার দিন আর নেই।
এই ঔদ্ধত্যের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার সময় আসে নি। যদি আপনাদের কথায় আমাদের জীবনের পথে নব আলোকপাত হয়, অথবা নিজেদের বাড়াবাড়ির জন্য আপনারা লজ্জিত হন তখন এর জন্য বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করব।-ইতি”
এই চিঠিখানি ৩রা কি ৪ঠা ডিসেম্বরে ‘ছোলতানে’ পাঠাই, কিন্তু তা ছোলতানে প্রকাশ করা হয় নি, অথচ আমার সম্বন্ধে রুচি-ও চিন্তাশূন্য কটুক্তি এর পরে ‘ছোলতানে’ই স্থান পেয়েছে।
‘ছোলতানে’ প্রকাশিত আমরা সেই চিঠিখানি লক্ষ্য করেই ৯ই ডিসেম্বরের ‘মোহাম্মদী’তে ‘ধৃষ্টতার পরাকাষ্ঠা প্রবন্ধ বার হয়েছে। মোহাম্মদীতে তার প্রতিবাদ স্বরূপ ১৩ই ডিসেম্বর তারিখে একখানি পত্র পাঠিয়েছি, কিন্তু এপর্যন্ত বহু চেষ্টা করেও জানতে পারিনি আমার সেই চিঠিখানি তারা ছাপবেন কি না। চিঠিখানি এই:
..—
.
–
–
–
–
–
—
–
—
“জনাব মোহাম্মদী-সম্পাদক সাহেব, আপনার ২৩শে অগ্রহায়ণের ‘মোহাম্মদী’তে ধৃষ্টতার পরাকাষ্ঠা’ শীর্ষক লেখাটি পড়েছি। আমার কয়েকটি কথা বিকৃত করে
৪০৯
পাঠকদের সামনে ধরা হয়েছে ও কয়েকটি ভুল কথা বলা হয়েছে, সে সমস্তের উল্লেখ করা দরকার।
১। (ক) আমি বলেছি-”সাধারণতঃ মানুষ শাস্ত্র মানে না অথবা মানতে পারে না,” আপনারা বলেছেন, কেউ কোরাণ-হাদিসের ধার ধারে না এই আমার মত। (খ) আমি বলেছি-মুসলমান, বিশেষ করে আধুনিক মুসলমান সম্মোহিত ও পৌত্তলিক; আমার “সম্মোহিত” মুসলমান প্রবন্ধে এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা আছে তারও ইঙ্গিত দিয়েছি। কিন্তু আপনারা বলেছেন, সাহাবীদের কাল থেকে এ পর্যন্ত সমস্ত মুসলমান সম্মোহিত ও পৌত্তলিক এই আমার মত।-ইসলামের ইতিহাসে অনেক বড় মুসলমানের জীবনের উপরও যে হজরত মোহাম্মদের ব্যক্তিত্বের ও বাণীর সম্মোহন প্রবল একথা আমি বলেছি, এখনো বলি; তবে প্রাচীন মুসলমানদের সম্বন্ধে শুধু এই কথাই আমি বলি নি, আরো দুইচারটি কথা বলেছি; আমার মত বলে কোনোকিছুর উপর টিপ্পনী করতে চাইলে সে-সমস্তেরও উল্লেখ করা দরকার।
২। বলা হয়েছে আমি নাস্তিক-যার ছদ্মবেশ এতদিনে খুলে গেছে। যে কোনো সাহিত্যিকের কাছে আমার লেখা ফেলে দিলে তিনি বলবেন, আমার লেখার ভিতরে লুকিয়ে ছাপিয়ে কিছুই বলা হয় নি। তবে আমার ভাষা সাহিত্যের ভাষা, কিছু আলঙ্কারিক। কিন্তু সেটি হয়ত আমার অপরাধই নয়। আমার লেখা যদি কেউ না বোঝেন তার জন্য আমি দুঃখিত; কিন্তু যিনি বলেন তিনি বোঝেন না তার নিজেরও লজ্জিত হবার কারণ থাকতে পারে। আর নাস্তিক আমি নই, নাস্তিকতা বলতে কি বোঝায় সে-কথাটি হয়ত আপনারা ভাল করে ভেবে দেখেন নি।
৩। হজরত মোহাম্মদের ভুলের উল্লেখ করেছি তার মাহাত্ম সম্বন্ধে কখনো কিছু বলি নি, আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়েছে। এটি পুরোপুরি সত্য নয়। ‘মোস্তফা-চরিত’ বইখানির প্রশংসা করতে পারি নি এই জন্য যে, হজরত মোহাম্মদ মানুষটি কেমন ছিলেন, আধুনিক মুসলমানদের জন্য তাঁর জীবনের কি ইঙ্গিত, এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর তাতে নেই। যুগধর্ম বাদ দিয়ে চিরন্তন ধর্ম হয় না, তাতে করে কতকগুলো কথা বলা হয় মাত্র।
৪। আমাকে অমুসলমান বলেছেন। আমি কি তা পুরোপুরি তিনিই জানেন যিনি আমার স্রষ্টা। অবশ্য আমি মুসলমান কি না একথা প্রমাণ করবার জন্য খুব ব্যস্ত আমি নই, কেননা মুসলমান হিন্দু এ সব হচ্ছে মানুষের সামাজিক বা শ্রেণীগত পরিচয়, আর আমি যখন একটি সমাজে বাস করি তখন সেই সমাজের পদবীটি আমার প্রাপ্য একথা প্রমাণ করবার জন্য ব্যগ্রতা অনাবশ্যক। তবে হজরত মোহাম্মদ মুসলমান বলতে এক বিশেষ-গুণ-সমম্বিত মানুষ বুঝতেন; কিন্তু সে-মুসলমান যে মুখে কলেমা পড়ে ও কাজে জ্ঞানহীনতা ও মিথ্যাচারের পরিচয় দিয়ে হওয়া যায় না সেকথা হয়ত আপনারাও কম বোঝেন না।
আমরা গায়ে পড়ে দৈনিকে সাপ্তাহিকে এসব আলোচনা শুরু করি নি, ছোলতান সম্পাদককে ও মওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেই তা জানতে পারবেন। আর আমরা যে কথা বলেছি বা বলছি তা-ইসলাম-সম্মত হোল্ক বা
৪১০
অনৈসলামিক হোক জ্ঞানের কথা, সত্য-ও কল্যাণ-জিজ্ঞাসু মানুষের অন্তরের কথা; তাই তার সঙ্গে মোকাবেলা করা দরকার জ্ঞান দিয়ে, হৃদয় দিয়ে, গালাগালি দিয়ে নয়। আমরা শুধু জিবার জন্যই প্রস্তুত নই, হারবার জন্যও প্রস্তুত, কেননা আমাদের লক্ষ্য সত্য এবং সমাজের ও দেশের ১jiণ। যদি যোগ্যতা থাকে তবে জ্ঞান দিয়ে আমাদের কথার উত্তর দেবেন। আর যদি সে-যোগ্যতা আপনাদের না থাকে, তবে চুপ করে যাবেন কি গালাগালি করবেন সে-সম্বন্ধে আমাদের কিছুই বলবার নেই। আরজ ইতি…
…এই অপ্রীতিকর বাদ-প্রতিবাদের স্বরূপ সমাজের সামনে অনাবৃত করে ধরতে এখানে যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম। এতে কার দোষ কতখানি সে-বিচারের কর্তা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সমাজ।*
জানুয়ারী, ১৯২৮
গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ
গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ উভয়েই জীবিত পুরুষ; শুধু দেহধারণের জন্য নয়, অন্তৰ্জীবনেও এঁরা জীবিত। এঁদের দেখা শেষ হয় নি, বোঝা শেষ হয় নি, বলাও শেষ হয় নি। কাজেই মাঝখান থেকে তাঁদের কোনো কথা চেপে ধরে বিচার করতে যাওয়ায় অবিচারও হতে পারে। এসব জেনে-শুনেও যে আমরা তাঁদের সম্বন্ধে আলোচনায় প্রবৃত্ত হচ্ছি, সে কেবল এই সত্যের জোরে যে, তারা আমাদেরই বুকে তাদের চিন্তা-ভাবনা উৎসাহ-আবেগের তরঙ্গ জাগিয়ে সামনে চলেছেন। সে-সব ঘাত-প্রতিঘাত আমাদের বুকে কেমন করে এসে লাগছে কি কথা কি আভাস-ইঙ্গিত রণিয়ে উঠছে আমাদের শিরায় শিরায়, এ পর্যন্ত যতটা আত্মপ্রকাশ তারা আমাদের সামনে করেছেন, তাতে কাকে আমাদের কেমন বলে মনে হচ্ছে-এ সমস্তের নিশ্চয়ই একটা সত্যিকার মূল্য আছে।,
গান্ধীর Indian Home Rule বইখানি পড়ে প্রথম মনে হয়েছিল-এযুগের কবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার বেশ বড় অমিল রয়েছে। আর Indian Home Rule বইখানির কথাগুলো অনেক জায়গায় কেমন বেখাপপা-ই লেগেছিল; যিনি কথাগুলো বলছিলেন তার বলবার অধিকার আছে বোঝা যাচ্ছিল, কিন্তু তার কথাগুলো যে কি ভাবে গ্রহণ করতে হবে, তিনি কি ফের অতীতের দিকে মুখে ফেরাতে বলছেন, না বর্তমানেই আরো খানিকটা এগিয়ে গেলে আমরা তার কথার সত্যতা বুঝতে পারব, তা তেমন পরিষ্কার বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
* ‘প্রদীপ’-এর ১৩৪১ সালের ভাদ্রের সংখ্যায় প্রকাশিত।
৪১১
তারপর গ্রন্থকার হলেন কর্মী, অর্থাৎ তাঁরই সেই কথাগুলো দেশের চিত্তে জীবন্ত করে তুলবার কার্যে তিনি ব্রতী হলেন। তার সে কর্মের ধারাও প্রথমে খুব পরিষ্কার বলে আমাদের চোখে লাগে নি, কেননা তিনি যে আদর্শ থেকে তাঁর কথা বলছিলেন আমাদের চিন্তা-ভাবনার গতি ঠিক সে-পথের কাছ দিয়েও চলবার মত ছিল না। আরো মুশকিল এই যে, তিনি এক এক সময়ে, তার কর্মের প্রয়োজন মত, তার কথা বলছিলেন; তার যে গোড়ার কথা কি তা আদৌ ধরতে পারা যাচ্ছিল না।
যাক-অল্পদিনের মধ্যেই তার কর্মও যথেষ্ট এগিয়ে গেল, কথাও বেড়ে গেল, আর তার থেকে তার তত্ত্বের চেহারাও জ্বলজ্বল করে উঠল।
কি সে তত্ত্ব?
সে-তত্ত্ব অসহযোব্রতে কিছু আছে, ভারতে ভারতবাসীর স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় কিছু আছে, কিন্তু আসলে সেটি হচ্ছে স্বাধীনতার তত্ত্ব-যার জন্য আজকালকার দুনিয়ার সবজায়গার লোকের মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে, যার আগমনী অনেকদিন ধরে রবীন্দ্রবীণার তাতে তারে রণিয়ে রণিয়ে ফিরছে, যার অবতারণের পাদপীঠ হবে বলে
অদ্বিতীয় শক্তিধর রোমা রোলাঁ তার বিশাল বক্ষ বিস্তৃত করে দাঁড়িয়েছেন।
অথচ রোমা বোলা আর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গান্ধীর বেশ মোটা অমিল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। একটা বড় কথাকে রবীন্দ্রনাথ বেশ একটু ফলিয়ে বলেন
“…মানুষের অন্তঃকরণ সন্ধান করছে; যা তার চারিদিকে আছে তাতেই সে আসক্ত হয়ে নেই-যা তারা হাতের কাছে নেই তাকে হাতের তলায় আনচে। পাথর আছে তার সামনে, তাতে সে সন্তুষ্ট নয়; লোহা আছে মাটির নীচে, সেখানে গিয়ে সে ধাক্কা দেয়; পাথরকে ঘসে মেজে তার থেকে হাতিয়ার তৈরি করা সহজ; কিন্তু তাতেও তার মন উঠল না, লোহাকে আগুনে গলিয়ে হাতুড়িতে পিটিয়ে ছাঁচে ঢালাই করে যা সব চেয়ে বাধা দেয় তাকেই আপনার সব চেয়ে অনুগত করে তুললে। মানুষের অন্তঃকরণের ধর্মই হচ্ছে এই, আপনাকে খাঁটিয়ে কেবল যে তার সফলতা তা নয়, তার আনন্দ; সে কেবলি উপরিতল থেকে গভীর তলে পৌঁছতে চায়, প্রত্যক্ষ থেকে অপ্রত্যক্ষে, সহজ থেকে কঠিনে, পরাসক্তি থেকে আত্ম-কর্তৃত্বে, প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বিচারের ব্যবস্থায়। এমনি করে সে জয়ী হোয়েছে।”
এরই উত্তরে গান্ধী বললেন,
“I doubt if the steel age is an advance upon the flint age. I am indifferent.”
এই সমস্ত কথায় যে বিরোধের ঝঙ্কার পাওয়া যাচ্ছে সেটি যে শুধু গান্ধীতে আর রবীন্দ্রনাথে বিরোধ তাতো নয়, এখানে আধুনিক শিক্ষিত জগতের সঙ্গে গান্ধীর মত বিরোধ বুঝতে পারা যাচ্ছে। কেননা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের জ্ঞান, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের আবিষ্কার, জড়জগতের উপর মানুষের প্রভুত্ব-এ সমস্তের ভিতর দিয়ে মানুষের শক্তির প্রকাশ বুঝতে পারা যায়, আর বিষয়ের জ্ঞানের এই সম্প্রসারণ মানুষের পূর্ণতার জন্য যে চাইই-চাই, এই বিশ্বাসই কি আমাদের শিক্ষিত-জগতের চিন্তা-ভাবনার ভিত্তি নয়?
৪১২
সু শিক্ষিত-জগতের সামনে দাঁড়িয়ে গান্ধী একা বলছেন-”মানুষের হাতিয়ার বের কোঠা থেকে লোহার কোঠায় এসে পৌঁছলে তার প্রকৃত উন্নতি হয় কিনা সে অল্প সন্দেহ আছে।” অথচ সমস্ত শিক্ষিত জগতের মত তিনি Evolution of the .ই চান! তিনি সন্ন্যাসী সন্দেহ নেই, কিন্তু ইহ-বিমুখ তো নন। তা হলে আর ডশের লোকের পরাধীনতা, তাদের অপমান, তাকে এখন আকুল করে তুলবে কেন?
এই ধরণের অনেক প্রশ্নই মনে খেলে, অনেক কথাই মনে জাগে। কেবলি মনে তোলপাড় হতে থাকে-কোন্ সত্যের উপর ভর দিয়ে তিনি দাঁড়িয়েছেন যার জন্যে আধনিক চিন্তাবীরদের আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার সন্ধানী হয়েও তিনি তাদের অনেক গোড়ার কথা অস্বীকার করে চলেছেন?
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,-”সহজের ডাক মানুষের নয়, সহজের ডাক মৌমাছির। মানুষের কাছে তার চূড়ান্ত শক্তির দাবি করলে তবেই সে আত্মপ্রকাশের ঐশ্বর্য উদ্বাটিত করতে পারে।অর্থাৎ গান্ধী সবাইকে চরকা কাটতে কাপড় বুনতে বলেছেন, তাতে রবীন্দ্রনাথ বলতে চান, শুধু এই চরকার একঘেয়ে ঘর্ঘরে স্বরাজের আরতি হবে না, তার জন্যে দেশের সব শক্তির জাগরণ চাই। সেই শক্তির জাগরণে জ্ঞানের সম্প্রসারণে স্বরাজ লাভের যোগ্যতা আমাদের ঘটবে। রবীন্দ্রনাথের একথা অতি মূল্যবান। ইংরেজের হাত থেকে আমাদের হাতে ভারতের শাসনভার এলেই যে আমরা প্রকৃত স্বরাজ পাব না, সে জ্ঞান আমাদের অনেকের নেই। আমাদের অন্তঃকরণের জড়ত্ব মোহ ইত্যাদি অনেক কিছু দূর করে দিলে তবে আমরা প্রকৃত স্বরাজ্যের সন্ধান পাব, যে স্বরাজ্য বাইরের প্রভুত্বে নয়, আত্মকর্তৃত্বে।
এখানে গান্ধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কোনো প্রকৃত মতভেদ নেই বললেই চলে। তবু রবীন্দ্রনাথ বললেন, এই স্বরাজ্য শুধু চরকা কেটে পাওয়া যাবে না, তাঁর বিবেচনায় চরকা কাটা আর দশটা ছোট খাটো কাজেরই এক কাজ, সময় সুবিধা বুঝে করতে হবে; আর গান্ধী চরকা কাটাকেই স্বরাজ-লাভের প্রধান উপায় জ্ঞান করে কবি রবীন্দ্রনাথকেও চরকা কাটতে আহ্বান করছেন! কেন? তিনি কি জানেন না যে সমাজে সবাই এক কাজ করে না বা করলে তাতে সমাজ বাঁচে না? কবির বীণা চিরকালই সমাজে বাজবে, অবশ্য নানা মূৰ্ছনায় নানা সুরে। বাস্তবিকই যদি সে-সুর থেমে যায় তবে সমাজ-দেহের রক্তের ছুটাছুটিই যে থেমে যাবে! সে যে মৃত্যুরই পূর্ব-লক্ষণ!
এ সম্বন্ধে গান্ধী তাঁর নিজের একথা একটু খুলে বলেছেন,
…………. A plea for the spinning wheel is a plea for the dignity of labour……… There are certain things which all must do in all climes. There are certain things which all must do in certain climes. The spinning wheel is the thing which all must turn in the Indian clime for the transition stage at any rate and the vast majority for all time……..God created man to work for
৪১৩
his bread and said that those who ate without work were thieves…… Why should I, who have no need to work for food, spin?” may be the question asked. Because I am living on the spoliation of my countrymen. Trace the course of every pice that finds its way into your pocket and you will realise the truth of what I write.”
গান্ধীর লেখা থেকে এই কথাগুলো আমরা স্তরে স্তরে সাজালাম। আমাদের উদ্দেশ্য কি তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। বাস্তবিক Dignity of labour সম্বন্ধে তিনি যে আমাদের নতুন করে হুশিয়ার হতে বলেছেন, মনে হয়, এইখানেই তার তত্ত্বের গোড়া পাওয়া যাবে।
বর্তমান জগতে বুদ্ধির পথে আমরা অনেকটা এগিয়েছি সন্দেহ নেই। কিন্তু কুসংস্কার। বলতে যা বোঝায়, গান্ধীর কথা থেকে বিশেষ করে মনে হচ্ছে, সে-সব একেবারে লোপ
পেয়ে নাম ভঁড়িয়ে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। আধুনিক সমাজে কর্মবিভাগ, বিশেষ করে ইয়োরোপের অনুকরণে আধুনিক ভারতে কর্মবিভাগ, যেভাবে চলেছে তার। সবটাই ডাহা গোঁজামিল। শুধু তাই নয়; মানুষ সম্বন্ধে যেসব বড় বড় সত্যের কথা আমরা অহরহ শুনি বা লিখি তারও অধিকাংশ অর্থশূন্য, কেননা সেসমস্ত আমাদের ধার করা কথা, নিজেদের অন্তরে তার জন্মলাভ হয় নি। বাংলাদেশের যে কোনো লেখকের লেখার উপর চোখ বুলিয়ে যাও, দেখতে পাবে, সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা সত্যবোধ বিশ্ব মানব বিশ্বভাব ইত্যাদির ছড়াছড়ি হয়েছে; অথচ একটু তলিয়ে বুঝতে চেষ্টা কর, দেখবে, পৌনে ষোল আনা লেখকের বেলায় এ-সব আস্ত ফাঁকি, তারা নিজেরাই এসবের মাথা মুণ্ড কিছু বোঝে নি। কথায় কথায় আমরা যেমন আল্লা হরি ভগবান রাধাকৃষ্ণ ইত্যাদি নাম উচ্চারণ করি অথচ এসবের সঙ্গে আমাদের কার যে কি সম্বন্ধ তার বিন্দুবিসর্গও বুঝি না, প্রাতঃস্মরণীয় মহাত্মাদের দোহাইও তেমনি আহাম্মকের মত দিই, এই সব বড় কথাও আমরা সেই ভাবেই ব্যবহার করে থাকি। এও এক ফ্যাশান,
অথবা সত্য কথা বলতে গেলে-কুসংস্কার।
আমাদের বুদ্ধির এই মোহ শুধু এইখানেই থেমে যায় নি। আজকালকার জগতের বিজ্ঞানের বিশ্লেষণের দিনেও অনেক বড় বড় ব্যাপারে এই মোহ দেখতে পাওয়া যাবে। আধুনিক রাজনীতি অর্থনীতি সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি সমাজসম্বন্ধনীয় শাস্ত্র যারা আলোচনা করেছেন, তারা একটু মনোযোগ দিলেই দেখতে পাবেন কি ভাবে এ সবে বৈজ্ঞানিক আলোচনার ভড়ং থাকলেও আসলে এ-সব দুনিয়ার সব জায়গার মানুষ সম্বন্ধে পূর্ণ সত্য নয়; এমন কি ইয়োরোপের মানুষ সম্বন্ধেও পুরো সত্য নয়, শুধু বিশেষ বিশেষ যুগের গোটাকয়েক সুসংবদ্ধ কথা। অবশ্য এ-সবের নিন্দা করা আমার উদ্দেশ্য নয়, অথবা
অবুঝের মত একথাও বলতে চাই না যে এসব কিছুই নয়। এরও যথেষ্ট মূল্য আছে।
৪১৪
সত্য, কিন্তু যত বেশি মূল্য আছে বলে এদের দাবি তা এ সমস্তে নেই। এই সব অবিজ্ঞানের জুলুম যাতে তেমন জবরদস্ত হতে না পারে সেজন্য পশ্চিমেও চেষ্টা চলেছে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যের জন্য আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত-সমপ্রদায়ের অনেকেই পশ্চিমের সেই অর্ধ-সত্যকেই বৈজ্ঞানিক সত্য বলে মেনে নিয়েছে। এর একটা ছোটখাট দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে কিছু দিন আগে Englishman-এ যে Indian ভদ্রলোক দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার আলোচনা করছিলেন তাঁর লেখায়। ভদ্রলোকের পড়াশুনো বেশ আছে, বুদ্ধিও ভোতা নয়, কিন্তু এমন কতকগুলো বাধি গৎ তাকে পেয়ে বসেছে যে, যতই কেন বিদ্যা ফলানো হোক না সে বাধা ঘের থেকে তিনি আর বাইরে বেরিয়ে সত্যকে সামনা-সামনি দেখতে পারছেন না। বাস্তবিক যেখানে মানুষকে দেখে তার তত্ত্বের সন্ধান করতে না গিয়ে, তত্ত্বের পরিমাপে মানুষকে বিচার করা হয়, সেখানে সত্যের সাক্ষাৎ যে কিছুতেই মিলতে পারে না, সে-জ্ঞান এই বিজ্ঞানের বিশ্লেষণের দিনেও আমাদের অনেকেরই নেই। আর তাতেই এই পাণ্ডিত্যের দিনেও আমরা অনেকে এমন পণ্ডিত-মূর্খ।
আমাদের এই অবস্থায় গান্ধীর আশ্চর্য অন্তর্দৃষ্টি আমাদের কতকগুলো সাধের সংস্কারের গোড়ায় যে কি গলদ রয়েছে তাই দেখিয়ে দিয়েছে। কর্মবিভাগ সমাজে আছে, থাকাও উচিত; কিন্তু সে-বিভাগ কতদূর পর্যন্ত হলে আমাদের মঙ্গল হতে পারে, আর কতদূর হলে আমাদের অমঙ্গল হতে পারে, সে চিন্তা আমরা তেমন করি কি? আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কথা যখন পড়ি তখন তার মূলতত্ত্ব যে সব দেশে সব জিনিষ ভাল হয় না তাই বিভিন্ন দেশের জিনিষ বিভিন্ন দেশে আমদানি রপ্তানি হয়, আর এই-ই ভাল, সেটা আপাততঃ ভাল বলে মনে হলেও পরক্ষণেই চিন্তা হয়-কোন্ দেশে কি হতে পারে তার সব চেষ্টা হয়েছে কি? ইতিহাস তো শেষ হয়ে যায় নি; আজ পর্যন্ত যা হয়েছে শুধু তাই-ই যে আমাদের মাপকাঠি হবে তাই কি সত্য? মানুষের প্রয়োজনে তার চেষ্টায় অনেক কিছুই তো অনেক জায়গায় হচ্ছে, যা আগে খুব জোরালো কল্পনায়ও ঠাওরনো যেত না।
তাই মনে হয় মানব-সভ্যতার বর্তমান অবস্থায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই মোহাচ্ছন্নতার দিনে প্রকৃত কল্যাণকে পেতে হলে কথার মোহ ছেড়ে মানুষ যাতে জ্ঞান-বিজ্ঞানকে ধারণ করবার উপযুক্ত আধার হতে পারে, তারই চেষ্টা করতে হবে। শুধু সেই ধরণের চেষ্টায় মানুষের ভিতরের শক্তি ভাল করে জাগাতে পারলে, তাকে নিরেট সাচ্চা মানুষ হওয়ার পথে অন্ততঃ খানিকটা এগিয়ে নিতে পারলে, তবেই প্রকৃত স্বাধীনতার দ্যুতি তার বুকে জ্বলে ওঠা সহজ হবে।
বর্তমানে কর্ম-বিভাগ খুব বেড়ে গেছে, আর বড় বড় যন্ত্রের আবিষ্কারের ফলে লোকের সুখ-সুবিধাও অনেক বেড়ে গেছে বলে আমরা বিশ্বাস করে থাকি; কেননা চোখের সামনেই তো দেখছি, আগে যে সব জিনিষ শুধু বড় লোকের ঘরেরই শোভা বৃদ্ধি করত
৪১৫
আজকাল তা প্রায় যেখানে-সেখানে পথে-ঘাটে গড়াগড়ি যাচ্ছে। কিন্তু শুধু এই দেখাটুকুতেই চলবে না। আরো একটু বেশি করে চেয়ে দেখে আমাদের মীমাংসা করতে হবে, এতে করে বাস্তবিকই কি মানুষের সুখ-সুবিধা বেড়ে গেছে, না এ সব শুধু চোখের ধাঁধা-দেখতে যেমন কাজে তা আদৌ নয়।
এর জন্য বেশিদূর যেতে হবে না। আমাদের দেশের পাটের ব্যবসায়ের কথা। ভাবলেই ব্যাপারটা কিছু বোঝা যাবে। পাটের জন্য যত টাকা আমাদের দেশে এসেছে, কৃষক অবশ্য তার অতি সামান্য অংশই পেয়েছে; তবু যা সে পেয়েছে টাকার হিসেবে তা নেহাৎ কম নয়। কিন্তু কি হয়েছে সেই টাকায়? যেখানে যেখানে বেশি পাট হতে সেই সব জায়গায় শুধু সাদা সাদা টিনের ঘর কৃষকের এক সময়ের স্বচ্ছল অবস্থার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাত্র; অনেক জায়গায় তাও আছে শুধু ক্রেতার অভাবে। তবে কেউ হয়ত বলতে পারেন যে, পাটের ব্যবসায়ে নানা গোলমাল এসে পড়েছে বলে কৃষকের এই দুর্দশা, পাট যদি চলত তা হলে তার অবস্থা এমন ধারা হত না। কিন্তু এ সত্য কথা নয়। গ্রামের সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে তারাই জানেন পাটের দরুণ যথেষ্ট টাকা পাওয়া সত্ত্বেও যে বৎসরের পাটের টাকা সেই বৎসরেই খরচ হয়ে যেত; উপরন্তু সময় সময় কৃষকের বেশি কর্জ হয়ে দাঁড়াত; কেননা ধান চাল তাকে কিছু চড়া দামে কিনে খেতে হত; এর উপর কাপড় ইত্যাদি কেনাও আছে; হাতে হঠাৎ দুটো নগদ টাকা হওয়ার ফলে তার মামলা-মোকদ্দমার বহরও বেড়ে যেত, গাঁয়ের পঞ্চায়েতের বিচারে আর কুলোতো না; এর উপর টিনের ঘর তোলায় ছেলেমেয়ে অথবা নিজের বিয়ে-নিকে ইত্যাদিতে বাজে খরচের ধাক্কা তার সব পুঁজিপাটা উজাড় করে তাকে ঋণগ্রস্ত করাত। ব্যারাম ইত্যাদির কথা আর ধরলাম না কেননা, সেটা কতকটা পাটেরই বিশেষত্ব। কিন্তু পাট সম্বন্ধে মোটামুটি এই সব কথা বলবার উদ্দেশ্য এই যে পাট কেন, জীবন-রক্ষার জন্য খাওয়া আর নগ্নতা বা শীত-বাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পরা নিশ্বাসবায়ুর মত এই দুই অপরিহার্য বস্তুর উৎপাদন উপেক্ষা করে, অথবা লোকবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ সবের উৎপাদন যাতে বাড়তে পারে বা এসব যাতে জলবায়ুর মতনই প্রায় বিনামূল্যে অথবা অল্পায়াসে পাওয়া যেতে পারে, তার কোনো ব্যবস্থা না করে আর যে কোন বস্তুর উৎপাদনের দিকেই বেশি মনোযোগ দেওয়া যাক না কেন তাতে অনিশ্চয়তা, পরমুখাপেক্ষিতা, এক কথায় প্রকৃত স্বাধীনতা লাভের অযোগ্যতা বেড়ে যাবেই, কোনো গোঁজামিল কোনো জোড়া-তাড়া তা রোধ করতে পারবে না। স্বদেশী যদি ভারত মিশর প্রভৃতি দেশে পুরাদমে চলে অথবা অনায়াসে যতটা চলতে পারে তাই-ই যদি চলে তবে শুধু বড় বড় কলকারখানার আগার ইংলন্ডের দশা কি হবে সে-বিষয়ে একটু চিন্তা করলেই এসব কথা দিনের আলোর মত পরিষ্কার বোধ হবে।
অবশ্য আমাদের এই সব কথা থেকে কেউ যেন মনে না করেন যে, আমরা কর্মবিভাগের পক্ষপাতী নই। সেটা অসম্ভব। কর্মবিভাগ চিরকালই আছে চিরকালই থাকবে। প্রত্যেক লোককে যদি তার দরকারী সব জিনিস শুধু নিজের চেষ্টায়ই তৈরি করে নিতে হয় তবে শুধু খেয়ে পরে বেঁচে থাকাই তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে।
৪১৬
দাঁড়াবে। কিন্তু কর্মের অবিভাগ যেমন মারাত্মক, তেমনি আজকালকার জগতের কর্মের চুলচেরা বিভাগও মানুষের পক্ষে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক একজন লোক বা এক একটা কল শুধু বিশেষ এক বস্তুর উৎপাদন নিয়েই ব্যস্ত রয়েছে বলে বড় বড় কলের জিনিস দেখতে সুন্দর হচ্ছে সস্তা বলেও বোধ হচ্ছে। কিন্তু যা আমার দেহের রক্তের মতো বা নিশ্বাসবায়ুর মতো সব সময়ে দরকারী তা যদি রেল জাহাজ ইত্যাদি করে সাত সমুদ্র তের নদীর পার থেকে আসে, শুধু তাই নয়, এর উপর ছোট বড় নানা শ্রেণীর দালালের হাত ঘুরে গুদামওয়ালার গুদামের ভিতর দিয়ে পাইকারি ও খুচরা দোকানদারদের হিসাব-নিকাশের খাতায় শুকনো পাতার নানা শোষণ সয়ে তবে আমার কাছে এসে পৌঁছায় তবে অনেক সময়েই যে তা পাওয়ার আশায় থাকতে থাকতে আমার দম আটকে মরবার দশা উপস্থিত হবে, কখনো বা একেবারে সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, তাতে আর আশ্চর্য হবার কি আছে। বাস্তবিক এ সব ব্যাপারে আমরা সেই আসল কথা ভুলে গেছি-মানুষের জন্যই সব বস্তু, সেই মানুষই যদি খেয়ে পরে বহাল তবিয়তে দিন গুজরান করতে না পারলো, অথবা শেয়াল-কুকুরের মত অপরের উচ্ছিষ্ট চেটে কখনো বা তাও না পেয়ে আধপেটা খেয়ে কখনো বা না খেয়ে দিন কাটালো, তবে বৃথাই এত জাহাজভরা গুদামভরা সুন্দর সুন্দর বস্তু, আর বৃথাই এত কলকারখানার কড় কড় ঘড় ঘড় যা আকাশ-আলোর শান্তিকে দিনরাত বিষিয়ে তুলছে। তবে তর্ক হতে পারে যে খাওয়া-পরার জিনিসও বড় বড় যন্ত্রের সাহায্যে বেশি করে তৈরি করা যেতে পারে। আজকাল মহাজনের টাকায় কল চলে বলে লাভের মোটা অংশটা যায় তার ঘরে, আর কিসে তার বেশি লাভ হবে সেই বিচার থেকেই সে বস্তুর উৎপাদন কখনো বাড়ায় কখনো কমায় বলে কলে সব লোকের উপকার হচ্ছে না; কিন্তু যন্ত্র যদি মহাজন বা মহাজনবর্গের টাকায় না চলে কোনো গাঁয়ের বা কোনো শ্রেণীর লোকের চাদা-করে-উঠানো টাকায় চলে, আর তাতে সে-গাঁয়ের বা সেই শ্রেণীর লোকের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদনের দিকেই বেশি ঝোঁক দেওয়া হয় তবে তাতে লোকের বর্তমান দুঃখ-কষ্টের অনেক লাঘব হবে বলে আশা করা যায়। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদনে ‘সমবায়’-এর পদ্ধতি অবলম্বন করলে, আজকালকার বড় বড় একচেটে কারবারের অত্যাচার থেকে মানুষ অনেকটা মুক্তি লাভ করতে পারবে। এই যুক্তির ভিতরে সত্য যথেষ্ট আছে। আর এতে করে যে এই কথা প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা চলেছে যে, যন্ত্রের নিজের কোনো দোষ নেই যত দোষ তার ব্যবহারপদ্ধতির, সে কথাও সত্য। আর বাস্তবিক বড় বড় যন্ত্রের যখন নিন্দা করা হয় তখন যন্ত্রকেই গালি দেওয়া হয় না, কেন না, সেটা আহাম্মকি-চরকা লাঙ্গল এসবও যন্ত্র-তবে মন্দ বলা হয় বড় বড় যন্ত্র যে অনর্থ সৃষ্টি করছে তাকে। সমবায়ের পদ্ধতি অবলম্বন করলে বস্তুর উৎপাদন চলতে পারে কিনা সেটিও বিচার্য। সমূহতান্ত্রিক (Socialistic) রাষ্ট্রের বস্তুর উৎপাদনে কোনো ব্যক্তির স্বার্থ নেই বলে পরিচালনায় যে বিঘ্ন আশঙ্কা করা হয়, সমবায়ের উৎপাদনেও কতকটা সেই গোলমাল এসে দাঁড়ায়। তবে এ দুয়ের প্রভেদ যা তাও লক্ষ্য করবার জিনিস, যাদের সঙ্গে আমাদের সব সময়ের পরিচয় তাদের জন্য কোনো কাজ করতে সব সময় আমরা টাকাপয়সার জন্য লালায়িত হইনে। তাই
-২৭
৪১৭
সমবায়ের উৎপাদন প্রচলিত হলে অনেক দিক দিয়ে সুফল পাওয়া যাবে এমন আশা করতে পারা যায়।
কিন্তু সেটি ভবিষ্যতের কথা। বর্তমানে যন্ত্রের যে অবস্থা আর লোকের যে দশা, বিশেষ করে আমাদের দেশে এ দুয়ের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে সমবায়ের পদ্ধতিতে উৎপাদন এখন অসম্ভব! আমাদের দেশে এসব যন্ত্র তো নেই, বিদেশ থেকে যন্ত্র তৈরি করবার কৌশল শিখে আসাতেও যে কত বিঘ্ন তা যে কোনো উদ্যোগী পুরুষকে জিজ্ঞাসা করলে জানা যাবে। এ অবস্থায় স্বাধীনতার সত্যকে অবলম্বন করে চলতে হলে সখ সবিধা সস্তা ইত্যাদির মুখোস পরে যে সব আবর্জনা আমাদের জীবনের গতিকে হাল্কা হতে দিচ্ছে না, সহজ ছন্দে তাকে চলতে দিচ্ছে না, সেসব বিসর্জন দিয়ে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও স্বাবলম্বনের মূর্তস্বরূপ চরকা অবলম্বন না করে আমাদের আর উপায় কি আছে? ইসলামে এক অসাধারণ ব্যবস্থা আছে- তোমার সব কাপড় যখন অপবিত্র, পরার জন্য আর কিছুও তোমার নেই তখন উলঙ্গ হয়ে নির্জনে নামাজ পড়বে তবু সময় মতো নামাজ তুমি ছাড়তে পার না। স্বাধীনতাই মানুষের প্রকৃতি, তার আত্মার ধর্ম: তাকেও অব্যাহত রাখবার জন্যে এখন আমাদেরও তেমনি করে বড় বড় যন্ত্রের মোহ বিসর্জন দিয়ে চরকাই গ্রহণ করতে হবে, কেন না আর কোনো ছোট যন্ত্র আমাদের আয়ত্তের মধ্যে নেই যা ব্যক্তির স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে আর কিছু খোরাকের যোগাড়রও করে দিতে পারে। আর একটি কথাও এখানে বলে রাখা দরকার; অল্প দিনের ভিতরে চরকার যে উন্নতি হয়েছে তাতেই কতকটা বুঝতে পারা যাবে কোনো বিষয়ে একবার মানুষের সত্যদৃষ্টি খুলে দিতে পারলে সে নিজেই কেমন করে অসাধ্য সাধন করবার পথে অগ্রসর হয়, কি করে তার সামনে সব রুদ্ধ দ্বার একে একে খুলে যেতে থাকে।
বাস্তবিক যন্ত্রের অসাধারণ কড় কড় ঘড় ঘড় আর তার আশ্চর্য উৎপাদিকা-শক্তি মানুষের দৃষ্টির সামনে এমন মোহ রচনা করেছে যে, সে-মোহ থেকে নিজে মুক্ত হওয়া আর তার সঙ্গে সঙ্গে আর দশজনকে মুক্ত করা যে-সে, শক্তির সাধ্য নয়। তীক্ষ্মবুদ্ধি মানুষকে এই মোহ সম্বন্ধে কিছু ইঙ্গিত দিতে পারে মাত্র। কিন্তু কোনো ইঙ্গিত পাওয়া আর কার্যকরী শক্তি লাভ করা এক কথা নয়। তাই বর্তমান সভ্যতার যে ঢের দোষ আছে তা অনেকে। বুঝে আর অনেকে না বুঝে বললেও কোন্ পথে চললে যে সে দোষের হাত এড়িয়ে চলা যাবে, সে-সম্বন্ধে তেমন কোনো স্পষ্ট নির্দেশ কেউ বড় একটা দিতে পারেন নি। কিন্তু বর্তমান জগতের এই অসাধারণ পুরুষ, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী স্বাধীনতাকে শুধু বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে যান নি বা বর্তমান সভ্যতার দোষ কীর্তন করে একটা নতুন কিছু বলে বাহবা নিতেও যান নি। প্রেমের পথে তিনি জগতের লোকের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন
* দ্র: পৃ. ১৮
৪১৮
করেছেন; ব্যক্তির স্বাধীনতাকে ব্যক্তির মর্যাদাকে তিনি ধর্ম-সাধনার মতনই কায়-মনঃ বাক্যে সাধনা করেছেন। সেই অসাধারণ সাধনায় যে সিদ্ধিলাভ ঘটেছে তাই আজ ব্রহ্মাস্ত্রের মত বর্তমান জগতের বুদ্ধির মোহকে ভস্মীভূত করবার শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাই তিনি যে বলেছেন- The message of…………Swadeshi is a message to the world” একথা বর্ণে বর্ণে সত্য। উন্নতির পথে এগিয়ে চল, স্বাধীনতার দ্যুতি তোমার সারা দেহ-মনে জ্বলে উঠুক, জুড়ে আজ এই চীৎকার শোনা যাচ্ছে। অথচ এই গোড়ার কথাটার দিকে মানুষের দৃষ্টি তেমন করে পড়ে নি যে, মাটি শক্ত না হলে গাছ শিকড় গেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারবে না, তার ফলে ফুলে বিকশিত হওয়া তো দূরের কথা; মানুষেরও তেমনি উন্নত হতে হলে, তার সব শক্তি-সম্ভাবনার বিকাশ সাধন করতে হলে, স্বাধীনতার দীপ্তিতে তারা সারা দেহমনকে উজ্জ্বল করে তুলতে হলে, তার পায়ের তলায় সোজা হয়ে দাঁড়াবার যোগ্য শক্ত ঠাই চাই। এই গোড়ার কথাটা উপেক্ষা করে বর্তমান উৎপাদন-রীতির চোরাবালির উপর মানুষের উন্নতির গগনস্পর্শী সৌধ নির্মাণ করতে যাওয়া এক বিরাট তামাসা নয় কি?
বাস্তবিক চরকা কাটার নামে যে অসাধারণ সত্যের দিকে গান্ধী আমাদের চোখ ফেরাতে বলেছেন, কত গড়াপেটার মূল তথ্য যে তার ভিতরে রয়ে গেছে, এখন সেইটিই আমাদের ধ্যান-ধারণার বিষয় হওয়া উচিত। সূর্যের আলো জগতের সব সৃষ্টির মূলে রস যোগায়, তাই সূর্যের আলোই হচ্ছে জগতের অনন্ত সৃষ্টির প্রাণ; চরকা কাটার নামে গান্ধী যে স্বাধীনতাকামী ব্যক্তিকে তার দেহের রক্তের মতনই তার নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তুর উপর যথাসম্ভব স্বামিত্ব লাভ করতে বলেছেন, এরও অন্তরে মানুষের সব সৃষ্টিশক্তির মূলে রস যোগাবার অসাধারণ ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস হচ্ছে।
আর দশজন পণ্ডিত গান্ধীর অসহযোগে, চরকা কাটায়, শুধু ধ্বংসের চেহারাই দেখতে পারেন; কিন্তু কবি রবীন্দ্রনাথ, আজীবন স্বাধীনতাপিয়াসী রবীন্দ্রনাথ, সত্যের অনন্ত রূপের পূজারি রবীন্দ্রনাথ যে কেন চরকার এই অসাধারণত্ব লক্ষ্য করলেন না, তাড়াতাড়ি ভেবে নিলেন যে, ওটা আর দশটা ছোটখাটো কাজেরই এক কাজ, এ ব্যাপারটা আমাদের কাছে এক বিষম হেঁয়ালির মতই রয়ে গেল। তিনি বলেছেন “একদিন ভারতের পোবন আমাদের দীক্ষাগুরু তার সত্যজ্ঞানের অধিকারে দেশের সমস্ত ব্রহ্মচারীদের ডেকে বলেছিলেন, জলসকল যেমন নিমদেশে গমন করে, মাসসকল যেমন সংবৎসরের দিকে ধাবিত হয়, তেমনি সকলদিক থেকে ব্রহ্মচারিগণ আমার নিকটে আসুন, স্বাহা। সেদিনকার সেই সত্য-দীক্ষার ফল আজও জগতে অমর হয়ে আছে এবং তার আহ্বান এখনো বিশ্বের কানে বাজে। আজ আমাদের কর্মগুরু তেমনি করেই দেশের সমস্ত কর্মশক্তিকে কেন আহ্বান করবেন না, কেন বলবেন না, আয়ম্ভ সর্বতঃ স্বাহা-তারা সকল দিক থেকে আসুক। দেশের সকল শক্তির জাগরণেই দেশের জাগরণ,-এবং সেই সর্বতোভাবে জাগরণেই মুক্তি। মহাত্মাজির কণ্ঠে বিধাতা ডাকবার শক্তি দিয়েছেন, কেন না তাঁর মধ্যে সত্য আছে, অতএব এই তো ছিল আমাদের শুভ অবসর। কিন্তু তিনি ডাক দিলেন একটি মাত্র সংকীর্ণ ক্ষেত্রে। তিনি বললেন-কেবল মাত্র সকলে মিলে সুতো-কাটো কাপড় বোনো। এই কি সেই ‘আয়ন্তু সর্বতঃ স্বাহা’! এই
৪১৯
ডাক কি নবযুগের মহাসৃষ্টির ডাক?”-সম্মানপুরঃসর আমরা নিবেদন করছি-আমাদের বিশ্বাস হচ্ছে এই-ই নবযুগের মহাসৃষ্টির যথার্থ ডাক, যে নবযুগের লক্ষ্য স্বাধীনতা, অন্ত রে বাহিরে জ্ঞানে কর্মে শক্তিমান নির্ভীক সত্যানুসন্ধিৎসু মানুষের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা, আর সেই স্বাধীনতার ছন্দেই তার আত্মপ্রকাশ।
একথা মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, মানুষকে চরকা কাটতে বলাতে তাকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদিকে উপেক্ষা করে অতীতের সারল্যের দিকেই চোখ। ফেরাতে বলা হচ্ছে; কিন্তু এর চেয়ে বড় ভুল, আর হতে পারে না। প্রকৃত জ্ঞান বিজ্ঞানের স্বাদ যতটুকু মানুষ পেয়েছে তা কি করে সে ভুলে যেতে পারে? সেটি যে তার গোটা জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে গেছে। কিন্তু জ্ঞানের নামে যে অজ্ঞানতা, বিজ্ঞানের নামে যে মোহ তার জীবন-স্রোতের সামনে মরুভূমির মতো ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে সব দূর করে দিলেই কি মানুষের চিরকল্যাণের পথ মুক্ত করা হবে না? তার সৃষ্টির শক্তিকে সার্থকতা লাভের সবচেয়ে বড় সুযোগ দেওয়া হবে না? চরকা যে সারল্যের সন্ধানে ফিরছে তা অজ্ঞানতার সারল্য নয়; সত্যকে গভীর করে উপলব্ধি করলে যে সরলতা আমাদের সব কাজে সব চেষ্টায় এক সহজ ছন্দে ফুটে ওঠে এ সেই সারল্য। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই এই সত্যে দীক্ষা গ্রহণ করে আজ তারই কথার আলোচনায় আমাদের এসব বলতে হচ্ছে! জানি না বাংলা সাহিত্যের উপর এ কোন অভিসম্পাতের ফল।
আজ কার্লাইলের একটি কথা বারবারই মনে পড়ে যাচ্ছে
He that must toil outwardly for the lowest of man’s wants is also toiling inwardly for the highest. Sublimer in this world know I nothing than a Peasant Saint, could such a one any-where be met with? Such a one will take three back to Nazareth itself; thou shall see the splendour of Heaven spring forth from the humblest depths of Earth, like a light shining in great darkness.
মানুষের জন্যই বস্তু বস্তুর জন্য মানুষ নয়, স্বাধীনতাই মানুষের প্রকৃতি-পূর্ণাঙ্গ বিপুল আকাশ-আলোর মত স্বাধীনতা, জড়ত্ব কুসংস্কার এই সবই মানুষের সর্বস্বাপহারক, সে আচার-প্রথার কুসংস্কারই হোক অথবা অর্ধ-সত্যের কুসংস্কারই হোক-এই সত্য যিনি আজ সূর্যের আলোর মতন দীপ্যমান করে তুলেছেন তাঁর কার্যে তার চেষ্টায় খোদার আশিস্ বৃষ্টি হোক।
চৈত্র, ১৩২৮
৪২০
ডি)-রবীন্দ্রকাব্যের দিকে যখন আমরা দৃষ্টিপাত করি, তখন দেখতে পাই মানস সতের বিচিত্র অনুভূতি কি অদ্ভুতভাবেই তার লেখনী-মুখে আত্মপ্রকাশ করেছে। অনেক জায়গাতেই তিনি যেন জাগ্রতভাবে কথা বলছেন না, কথা আপনি যেন তাঁর ভতরে থেকে বেরিয়ে আসছে এবং নূতন নূতন অর্থে প্রকাশ পাচ্ছে।
প্রথম বয়স থেকে ‘চৈতালি’ পর্যন্ত কাব্য লিখে যদি রবীন্দ্রনাথের লেখনী স্তব্ধ হয়ে যত তবে বলা যেত, তিনি কবি, কিন্তু খুব বড় স্রষ্টা নন-যেমন বড় স্রষ্টা ব্যাস হোমার বা কলিদাস তার পরে তার ভিতরে যে পরিবর্তন এসেছে, তার জীবন যে নূতন খাতে প্রবাহিত হয়েছে, তা থেকে তাঁর কাব্য-কীর্তির অন্য অর্থ দাঁড়িয়েছে।
পরে-পরের সৃষ্টি সম্বন্ধেও বলা যেতে পারে, খুব বড় শিল্পী তিনি নন, অনবদ্য রূপ ফলানোর চেষ্টা তার ভিতরে বেশি নয়। কিন্তু তাঁর প্রতিভা শুধু কবি-প্রতিভা নয়, এ বিশেষভাবে একটি আধ্যাত্মিক প্রতিভা। অথবা তার প্রতিভা কবি-প্রতিভাই বটে, তবে সে-প্রতিভার প্রকাশ রূপের চেয়ে মানস-গতিতেই বেশি। এই জন্যই রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কাব্য পাঠ না করলে তার প্রকৃত মাহাত্ম উপলব্ধি করা যায় না। সব কবি সম্বন্ধে কিন্তু এ-কথা খাটে না।
রবীন্দ্র-প্রতিভা সেই যে প্রথম যৌবনে জাগ্রত হয়েছে তারপর আজ পর্যন্ত অর্ধ শতাব্দীর দীর্ঘ দিনও দীর্ঘ রাত্রির ভিতরে এ যেন তন্দ্রাচ্ছন্নও হয় নি। জগতের অথবা জীবনের অনির্বাণ রহস্য তাঁর অনির্বাণ সন্ধানী চিত্তে নব নব প্রেরণার সৃষ্টি করে চলেছে। এই যে সদা-জাগ্রত ভাব, শুধু জ্ঞানে নয় অনুভূতিতেও, এই সদা-জাগ্রতোর জন্যই তাঁর সমগ্র রচনা একখানি গ্রন্থ হিসেবে পাঠ করা দরকার, এবং সেই ভাবে পাঠ করলেই এই প্রতিভার ভিতরে রয়েছে কি বল কি স্বাস্থ্য তা উপলব্ধি করা যাবে; এবং তারই ফলে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে একে আত্মসাৎ অথবা প্রয়োজন মতো অতিক্রম করে নবতর সৃষ্টি সম্ভবপর হবে। বড় সৃষ্টির ভিতরে যে পূর্ণ তপস্যার এবং সেবায় আত্ম সমর্পণের ভাব রয়েছে সমগ্রতার দিক দিয়ে দেখলে রবীন্দ্র-কাব্যে সেটি পাওয়া যাবে। এভাবে দেখলে রবীন্দ্র-কাব্য এক প্রকাণ্ড গ্রন্থ বটে, তবে তা সুখপাঠ্য এই জন্য ভীতিকর নয়।
–
—
–
–
–
–
–
–
মাঘ, ১৩৩২
রবীন্দ্রকাব্যপাঠ
=
=
=
=
=
(মনোবিকাশের ধারার অনুসরণ)
অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেয়, তার বক্ষে বেদনা অপার, তার নিত্য জাগরণ…….
৪২৩
দুর্যোধনকে চিত্ররথ গন্ধর্বের হাত থেকে উদ্ধার করবার জন্য যুধিষ্ঠিরের অর্জুনকে উপদেশ দান, ভক্ত ভীষ্মের তার ভক্তি-ভাজন শ্রীকৃষ্ণকে অস্ত্রধারণে বাধ্য করা, তার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা, আর শেষে এই ধ্বস্তাধ্বস্তিলব্ধ রাজ্য পরিত্যাগ করে বিজয়ী পাণ্ডবদের মহা-প্রস্থান; অথবা, তপোবনে দুষ্যন্ত ও শকুন্তলার পরস্পরকে প্রথম সন্দর্শন, পতিগৃহগামিনী শকুন্তলার সহকার-তরুকে আলিঙ্গন দান, মৃগশিশুকে সান্ত্বনা দান; অথবা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে লেডি ম্যাকবেথের চলা ও বলা
Hell is murky! ……….all the perfumes of Arabia will not sweeten this little hand……..*
এসব যেন যমুনাতীরের সেই চিরশুভ্র, একবিন্দু অশ্রুর মতো উজ্জ্বল তাজমহল! কত কবি, কত প্রেমিক, কত ভাবুক তার কত বর্ণনাই না দিলে, কিন্তু আজো রহস্যের
পূর্ণ-উদ্ঘাটন সম্ভবপর হলো না………..
স্রষ্টার নিজেকে আড়ালে রেখে এই যে সৃষ্টি-ভঙ্গিমা, মানস-জগতে এই-ই একমাত্র সৃষ্টি নয়। আর এক সৃষ্টিপদ্ধতি আছে, বিশেষভাবে সে নিজেকে সৃষ্টি করা,-মহাপুরুষ যেমন স্বীয় চরিত্রের ভিতর দিয়ে নিজেকে সৃষ্টি করেন, গীতি-কবি যেমন তার অপরূপ সুখ-বেদনার ভিতর দিয়ে নিজেকে বিকশিত করে তোলেন। রবীন্দ্র-প্রতিভার সৃষ্টি এই শেষোক্ত ধরণের সষ্টি। সে-প্রতিভা “আমি”র অনন্ত সুখ-দুঃখ, অনন্ত রূপ পর্যায়ে। পর্যায়ে প্রকাশ করে এসেছে। সে-প্রকাশ যে সব সময়ে অনবদ্য হয়েছে, তা নয়। কিন্তু এ-প্রতিভা ক্রমাগত অগ্রসর হয়ে এসেছে এবং কি আশ্চর্য এর ক্ষমতা, বজ্ৰসূচির মতো এ ভাবের সমস্ত মণি বিদ্ধ করে গলায় পরে চলেছে। তাই এই প্রতিভার বিশেষ লক্ষণ সম্বন্ধে বলেছি-তীব্র অনুভূতি আর সন্ধানপরতা। রূপসৃষ্টি এর প্রকৃতিগত, এর অনুভূতি আপনা থেকে কেমন-এক রূপে হিল্লোলিত হয়ে ওঠে, কিন্তু তারও ভিতরে তীব্র অনুভূতি আর সন্ধানপরতাই প্রধান বলে প্রতিভাত হয়। রবীন্দ্র-প্রতিভাকে শ্রদ্ধেয় শশাঙ্কমোহন সেন বলেছেন, “দার্শনিক প্রতিভা”। কিন্তু দার্শনিক প্রতিভা” এ নয় এই জন্য যে যুক্তি বা বুদ্ধি এর ভিতরে প্রধান নয়, যদিও খুব প্রবল। অনুভূতি তারও চেয়ে এর বড় সম্বল।
‘রবীন্দ্রনাথের এই তীব্র অনুভূতির ক্রমাগত পরিবর্তন আর সঙ্গে সঙ্গে রূপে হিল্লোলিত হয়ে ওঠা, এই দিক দিয়ে তাকে কবিগুরু বলা যেতে পারে। ইয়োরোপে এমনি প্রতিভা গ্যেটে। এই দুই মহা-প্রতিভাই প্রচলিত মত-বিশ্বাস অনুসারে বড় স্রষ্টা নন, যেমন বড় স্রষ্টা ব্যাস, হোমার বা শেকস্পীয়র। কিন্তু মানস-সৃষ্টির অন্য অর্থে এঁরা মহা-স্রষ্টা; এঁরা রূপ দিয়েছেন নিজেদের অন্তরের গূঢ় অনুভূতিতে বিশ্বজনের অন্তরের অনুভূতি। মানুষের যে অনুভূতি একটু ভাবলে বুঝতে পারা যায় তা কত সূক্ষ্ম, কত রকমারি। (পারশ্য-সাহিত্যে আক্তার, হাফিজ, রুমী, প্রভৃতির ভিতরে এমন আত্ম সৃষ্টির বেদনা উপলব্ধি করা যায়। তাই হাফিজের দুই একটি চরণ জায়গায় জায়গায়
*
নরক কালো!
আরবের সমস্ত সুরভি দিয়েও এই ক্ষুদ্ৰ হাতখানি সুবাসিত করা যাবে না।
৪২২
‘রবীন্দ্রকাব্যপাঠে’র ভূমিকা
প্রচলিত কথায় যাকে সমালোচনা বলা হয়, রবীন্দ্রকাব্যপাঠ তা নয়-পড়লেই তা বুঝতে পারা যাবে। এ রবীন্দ্র-প্রতিভার একটুখানি তারীফ। তার চিন্তার ও সৃষ্টির সমালোচনা করবার, অন্যান্য চিন্তা ও সৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করে তার যথার্থ মূল্য নির্ধারণ করবার, সময় উপস্থিত হয় নি। তার একটি কারণ, রবীন্দ্র-প্রতিভা এখনো সৃষ্টিশীল। কিন্তু তার চেয়েও বড় কারণ এই যে, এই প্রতিভাকে আমাদের আজো প্রাণ ভরে’ অনুভব করা হয় নি। কি বিপুল অনুভূতি ও মনীষা এর ভিতরে রয়েছে তা অনুভব করে কিছু আপনার করে না নিতে পারলে অন্যান্য সাহিত্য-মহারথদের তুলনায় বা অন্যান্য সৃষ্টির গঠন বা সৌষ্ঠবের সঙ্গে তুলনায় এর যথার্থ নিরূপণ করতে যাওয়া কতকটা অর্থহীন। সত্যকে, সৌন্দর্যকে, নিজে উপলব্ধি করে’ পুনঃসৃষ্টির চেষ্টা না করে শুধু অতীতের সৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করে তার প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করতে চেষ্টা করা “পরের মুখে ঝাল খাওয়ার চাইতে বড় কাজ নয়। সাধনার মর্মের মতো সাধনার দেহও যুগে যুগে বিভিন্ন মূর্তি পরিগ্রহ করে রবীন্দ্র-সাধনার মর্ম বাঙালীর মর্মকে কিঞ্চিৎ পরিমাণে স্পর্শ করেছে, সেই স্পর্শনের ফলে বাঙালির সমসাময়িক কাব্যে শুধু আকুলি-বিকুলিই জেগেছে। প্রথম অনুভূতির অস্বচ্ছন্দতা গভীর অনুভূতিতে রূপান্তরিত হলে যে সত্যিকার সৃষ্টি হবে তারই সঙ্গে তুলনায় এই প্রতিভার সত্যিকার মূল্য নির্ধারণ হবে- যেমন প্রাচীন কবিদের সৃষ্টির মূল্য-নির্ধারণ পরে-পরের সৃষ্টির সঙ্গে তুলিত হয়ে রয়েছে। বর্তমানের ভিতর দিয়ে ভবিষ্যতেও তা চলবে। বাস্তবিক কোনো বড় সাধনার যথার্থ মূল্যের নির্ধারণ ভবিষ্যতের নব নব সৃষ্টির ভিতর দিয়েই কিছু কিছু হয়। বড় সাধনা জড় জগতের গ্রহ-নক্ষত্রের মতো এক পরমরহস্যময় বিরাট সত্য, ভাবের জগতে এমনি করেই তা বিদ্যমান থেকে নব নব কার্য-কারণের উৎস হয়।
কবি-প্রতিভা বললে বিশেষ এক শ্রেণীর শিল্প-প্রতিভাই সাধারণত বোঝায়। কবি এক আশ্চর্য ক্ষমতায় কতকগুলো মানস-মূর্তি ফুটিয়ে তোলেন; তাঁর নিজের জীবনের সমস্ত দুঃখ চাঞ্চল্য বিক্ষোভ সাধারণত অন্তরালে রেখে এমন এক অনবদ্য সৃষ্টি মানুষের সামনে দাঁড় করান যার রহস্যময় সৌন্দর্য চিরদিন মানুষের সামনে যেন অপূর্বই থেকে যায়। বলা যেতে পারে, এ এক ধরণের সেবা, সেবক আত্মগোপন করে তার রূপ রসের সেবা মানুষের দরবারে হাজির করে দেন। এর দৃষ্টান্ত ব্যাসের মহাভারত, হোমারের ইলিয়াড়, কালিদাসের শকুন্তলা, শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথ ইত্যাদি। যাঁরা এ সমস্তের স্রষ্টা তাঁদের কথা বিস্মৃত হয়ে এই সমস্ত সৌন্দর্যের কক্ষে কক্ষে শৃঙ্গে শৃঙ্গে বিচরণ করতে পারা যায়। যেমন-মহাভারতের ভীষ্ম-পরশুরামের গুরু-শিষ্যের যুদ্ধ, উত্তর-গোগৃহ-রনের প্রারম্ভে বাণ দিয়ে অর্জুনের গুরুপদ-বন্দনা, দাম্ভিক চিরশত্রু
৪২১
রবীন্দ্রনাথ তার ছেলেবেলার কথা স্মরণ করে ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখছেন:
“এক একদিন মধ্যাহ্নে ছাদে আসিয়া উপস্থিত হইতাম….দূরে দেখা যাইত তরুচূড়ার সঙ্গে মিশিয়া কলিকাতা শহরের নানা উচ্চনীচ ছাদের শ্ৰেণী মধ্যাহ্ন-রৌদ্রে প্রখর শুভ্রতা বিচ্ছুরিত করিয়া পূর্বদিগন্তের পাণ্ডুবর্ণ নীলিমা মধ্যে উধাও হইয়া গিয়াছে। সেই সকল অতিদূর বাড়ির ছাদে একটি চিলা কোঠা উঁচু হইয়া থাকিত, মনে হইত তাহারা যেন নিশ্চল তর্জনী তুলিয়া চোখ। টিপিয়া আপনার ভিতরকার রহস্য আমার কাছে সঙ্কেত করিবার চেষ্টা করিতেছে। ভিক্ষুক যেমন প্রাসাদের বাহিরে দাঁড়াইয়া রাজভাণ্ডারের রুদ্ধ সিন্ধুকগুলার মধ্যে অসম্ভব রত্ন মাণিক কল্পনা করে, আমিও তেমনি ঐ অজানা বাড়িগুলিকে কত খেলা কত স্বাধীনতায় আগাগোড়া বোঝাই মনে করিতাম তাহা বলিতে পারি না। মাথার উপরে আকাশব্যাপী খরদীপ্তি, তাহারই দূরতম প্রান্ত হইতে চিলের সূক্ষ্ম তীক্ষ্ম ডাক আমার কানে আসিয়া পৌঁছিত এবং সিঙ্গির বাগানের পাশের গলিতে দিবাসুপ্ত নিস্তব্ধ বাড়ীগুলোর সম্মুখ দিয়া পসারী সুর করিয়া চাই চুড়ি চাই, খেলনা চাই’ হাঁকিয়া যাইত-তাহাতে আমার সমস্ত মনটা উদাস করিয়া দিত।”
স্বর্গীয় অজিতকুমার চক্রবর্তী তাঁর “রবীন্দ্রনাথে” যে একটি চিঠি তুলেছেন তার কতক অংশ এই
“আমার নিজের খুব ছেলেবেলাকার কথা একটু একটু মনে পড়ে, কিন্তু সে এত অপরিস্ফুট যে ভাল করে ধরতে পারিনে। কিন্তু বেশ মনে আছে, এক একদিন সকাল বেলায় অকারণে অকস্মাৎ খুব একটা জীবনানন্দ মনে জেগে উঠত। তখন পৃথিবীর চারিদিক রহস্যে আচ্ছন্ন ছিল। গোলাবাড়িতে একটা বাখারি দিয়ে রোজ রোজ মাটি খুঁড়তাম, মনে করতাম কি একটা রহস্য আবিষ্কৃত হবে।”
প্রকৃতির সৌন্দর্যে আর বৈচিত্র্যে কিছু-না-কিছু আনন্দ উপভোগ করা বালক কেন সকল মানুষেরই সাধারণ ধর্ম। তবু বলতে হবে, বালক রবীন্দ্রনাথ সেই “সকল মানুষের শ্রেণীতে বেমালুম খাপ খেয়ে যান না। বালক বয়সেই অসীমের রহস্যকে এমন সারা প্রকৃতি দিয়ে অনুভব করা এক অসাধারণ ব্যাপার সন্দেহ নেই। বালক নচিকেতা নাকি মৃত্যুর গুহায় তলিয়ে গিয়ে অমৃতের উদ্ধার করে এনেছিলেন, তাঁর প্রশ্নে দেখতে পাই আশ্চর্য সমাহিতচিত্ততা। কবি রবীন্দ্রনাথও তাঁর কবিকীর্তিতে যে বৈচিত্র্য, বিপুলতা আর অমর সৃষ্টি-মাহাত্ম লাভ করেছেন, সেটি এই আশ্চর্য রহস্যের অনুভবকর্তা বালক রবীন্দ্রনাথের যোগ্য পরিণতি।
রবীন্দ্র-প্রতিভার এই বিশেষত্বকে অল্প দুটি কথায় নির্দেশ করা যেতে পারে-অতি তীক্ষ্ম অনুভূতি আর সন্ধানপরতা। অনুভূতি তার ভিতরে এর চেয়ে কিছু কম থাকলে এই অপ্রতিহত সন্ধানপরতার মুখে তিনি হয়ত হতেন একজন বড় দার্শনিক অথবা বড় যোগী। কিন্তু প্রকৃত কবির মত অনুভূতিই তার ভিতরে সব চেয়ে প্রবল। এই অনুভূতিরই সঙ্গে-সঙ্গে প্রচ্ছন্নভাবে চলেছে সন্ধান। “ফাল্গনী”র অন্ধ বাউলের মতন সত্যের অরুণ আলো প্রথমে তার ভুরুর মাঝখানে খেয়া নৌকাটির মতো এসে ঠেকে, আর তিনি গান গেয়ে ওঠেন।
৪২৪
প্রথম পর্যায়
বরীন্দ্রনাথ অতি অল্প বয়সেই কবিতা লিখতে আরম্ভ করেন। আশৈশব তিনি সাহিত্যের আবহাওয়ায় মানুষ; তাই বুদ্ধিমান বালকের পক্ষে এটি খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু গানে ছন্দে ঝঙ্কত হয়ে উঠবার ক্ষমতাও যে তাঁর মজ্জাগত তার পরিচয় সেই অল্প বয়সের কবিতায়ও প্রচুর।
উন্মাদ পবনে যমুনা তর্জিত,
ঘন ঘন গর্জিত মেহ। দমকত বিদ্যুত পথতরু লুণ্ঠত,
থর থর কম্পত দেহ। ঘন ঘন রিম ঝিম রিম ঝিম রিম ঝিম,
বরখত নীরদ পুঞ্জ। ঘোর গহন ঘন তাল তমালে
নিবিড় তিমিরময় কুঞ্জ। বোল ত সজনী এ দুরু যোগে
কুঞ্জে নিরদয় কান দারুণ বাশী কাহ বজায়ত
সকরুণ রাধা নাম।
হোক এ অনুসরণ, হোক এ “আজকালকার সস্তা আর্গিনের বিলাতি টুংটাং মাত্র”, তবু এ বেশ একটু স্নেহ আর আনন্দের দৃষ্টিতে দেখবার যোগ্য নয় কি? কেমন-একটু রসবিলাসী মনের সাক্ষাৎ পাওয়া যাচ্ছে এর ভিতরে!
সন্ধ্যাসঙ্গীতে কবি নিজের বিশেষত্ব প্রথম উপলব্ধি করেন। আর পরলোকগত শ্রদ্ধেয় অজিতবাবুর বিশ্বাস “প্রভাত সঙ্গীতে কবির সমস্ত জীবনের ভাবটির ভূমিকা নিহিত রয়েছে।” মিথ্যা নয়। এর “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” কবিতায় কেমন এক বিপুল কবিপ্রাণ উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে।
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
(ওরে) উথলি উঠেছে বারি; (ওরে) প্রাণের বাসনা
প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি….;
৪২৫
তার রুদ্ধ প্রতিভা-নিঝরিণী প্রকাশের মহাসাগরের ডাক শুনতে পেয়েছে
ডাকে যেন-ডাকে যেন-সিন্ধু মোরে ডাকে যেন। আজি চারিদিকে মোর কেন কারাগার হেন….;
“প্রভাত-উৎসব” কবিতায় জগতের আনন্দ আর সৌন্দর্যের মূর্তি কবির চোখের সামনে কেমন সুন্দর ভাবে খুলে গেছে
হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি। জগত আসি সেথা করিছে কোলাকুলি।
*
এসেছে সখাসখী বসিয়া চোখখাচোখি, দাঁড়ায় মুখোমুখি হাসিছে শিশুগুলি। এসেছে ভাই বোন পুলকে ভরা মন, ডাকিছে ভাই ভাই আঁখিতে আঁখি তুলি;
আর “অনন্ত জীবন”
“অনন্ত মরণ”
“মহাস্বপ্ন”
“সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়” প্রভৃতি কবিতায় কবির প্রতিভা কি এক বিরাট সৃষ্টিতেই না আত্মপ্রকাশ করতে চাচ্ছে।
“চাচ্ছে” কথাটি আমরা ইচ্ছা করেই ব্যবহার করেছি; আমাদের বলবার মতলব-প্রকৃত স্রষ্টার সাক্ষাৎ এখনো আমরা পাইনি। সৃষ্টির জন্য কবির মনে আবেগ জেগে উঠেছে-বিপুল গভীর সে-আবেগ; কবির দৃষ্টিও কিছু পরিস্কার; কিন্তু নিশ্চয়ই এত পরিচ্ছন্ন নয় যাতে তার সামনে সৃষ্টি পূর্ণচ্ছন্দে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। “প্রভাত উৎসবের পরে “ছবিও গানে”ও প্রকৃত স্রষ্টাকে আমরা দেখতে পাইনে। কবির দৃষ্টি এখানে আরো কিছু পরিষ্কার; কিন্তু সামগ্রের ধারণায় ত্রুটি রয়েছে বলে মনে হয়। পাঠক এর “একাকিনী” কবিতাটির সঙ্গে Wordsworth এর The Reaper কবিতাটি মিলিয়ে পড়লে হয়ত আমাদের সঙ্গে একমত হতে পারবেন।
রবীন্দ্রনাথকে সর্বপ্রথম প্রকৃত স্রষ্টারূপে দেখতে পাই তার “কড়ি ও কোমলে”, বিশেষ করে, এর সনেটগুলোতে। তিনি নিজেও বলেছেন
আমার কাব্যলোকে যখন বর্ষার দিন ছিল তখন কেবল ভাবাবেগের বায়ু এবং বর্ষণ; কিন্তু শরৎকালের “কড়ি ও কোমলে” কেবল আকাশে মেঘের রং নহে সেখানে মাটিতে ফসল দেখা দিতেছে। এবার বাস্তব সংসারের সঙ্গে কারবারে ছন্দ ও ভাষা নানাপ্রকার রূপ ধরিয়া উঠিবার চেষ্টা করিতেছে।
৪২৬
কড়ি ও কোমল
কড়ি ও কোমলের প্রথম কবিতায় কবির সাধটি যে ভঙ্গিমায় প্রকাশ পেয়েছে সবাইকে বলতে হবে তা সুন্দর। “বলাকার একটি কবিতার কয়েকটি চরণ এই
কত লক্ষ বরষের তপস্যার ফলে
ধরণীর তলে। ফুটিয়াছে আজি এ মাধবী……
কবিপ্রাণও তেমনিভাবে সংশয়, ব্যথা, আবেগ, উচ্ছ্বাস, সমস্তের ভিতর দিয়ে এক শুভ মুহূর্তে ফুলের মতো পূর্ণতা নিয়ে ফুটে উঠেছে।
মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই। এই সূর্যকরে এই পুস্পিত কাননে জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই।
কড়ি ও কোমলে কবির এই প্রথম সৃষ্টিক্ষমতা নানা ভাবে সার্থকতা খুঁজছে, দেখতে পাচ্ছি। শিশু-কবিতায় রবীন্দ্রনাথের যে অসাধারণ কৃতিত্ব তারও পরিচয় এতে রয়েছে। (“সাত ভাই চম্পা”, “পুরানো বট”, “হাসিরাশি”
“আশীর্বাদ” ইত্যাদি। আর কবির দেশাত্মবোধও এর আহ্বান-গীতে ঝঙ্কৃত হচ্ছে
পৃথিবী জুড়িয়া বেজেছে বিষাণ,
শুনিতে পেয়েছি ওই সবাই এসেছে লইয়া নিশান,
কইরে বাঙালী কই।
কিন্তু এর সনেটগুলোই যে সবচাইতে বেশি প্রশংসার জিনিস সে-সম্বন্ধে বোধ হয় সব কাব্যরসিকই একমত; প্রায় প্রত্যেকটি সনেটই দামী মুক্তার মতো নিটোল-প্রকাশে, রসে, জমাট।
এইসব সনেটের কতকগুলোর ভিতর যে ভোগের সুর বাজছে তার জন্যে রবীন্দ্রনাথকে যথেষ্ট নিন্দা সহ্য করতে হয়েছে। মনে হয়, নানা অর্ধসত্যের অত্যাচারে
৪২৭
আমাদের জাতীয় জীবন বড় ক্লিষ্ট বলেই একটুখানি সংস্কার-বিমুক্ত হয়ে কাব্যের সৌন্দর্য উপভোগ করবার ক্ষমতা আমাদের ভিতরে এমন ব্যাহত। কাব্য আত্মারই এক প্রকাশ; কাজেই এর সৌন্দর্যও “ন বলহীনেন লভ্যঃ।”।
এই ভোগের “কুসুমের কারাগার থেকে উদ্ধার পাবার জন্য পরে কবির অন্তরে আকাঙ্ক্ষা জেগেছে বলেই যে কবি আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র, তা সত্য নয়। অনেক বড় কবির ভিতরে এ বিদ্রোহ জাগেনি। তাই বলে তাদের কাব্য আমাদের কম প্রিয় নয়। কালিদাস, বিদ্যাপতি, হাফিজ, Burns (
বাস), Byron (বায়রন) প্রভৃতি কবির কথা স্মরণ করে আমরা এ কথা বছি। আসলে, জীবনে ভোগ অসত্য নয়। আর এই সনেটগুলোর ভিতরে সুপ্রকাশের সৌন্দর্যে স্নাত হয়ে সেই ভোগের সত্য যথাযথভাবেই ফুটে উঠেছে।
তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদেরও বিশেষত্ব আছে। নৈতিক বোধ তার ভিতরে দুর্বল ছিল, পরে সবল হয়েছে বলে যে তার মনে এই প্রতিবাদ জেগেছে তা সত্য নয়। “কুসুমের কারাগারে বদ্ধ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাঁর পক্ষে যেমন স্বাভাবিক, এর থেকে মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছাও তার ভিতরে তেমনি বলবতী, কেননা, এই দুই-ই একই মূল থেকে উৎসারিত হচ্ছে-তার ভিতরকার সেই চিরজাগ্রত রহস্যের সন্ধানপরতা থেকে। নারীসৌন্দর্য তো সাধারণত আমরা তুচ্ছ ভেবেই উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করি; যাকে আমরা মহত্তর ভাব বলি, পরে পরের কাব্যে দেখব, সেই জাতীয়তা, স্বাদেশিকতা ইত্যাদির বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষাও কবির ভিতরে এমনই প্রবল।
রবীন্দ্র-প্রতিভার বিশেষত্ব তাঁর ভোগের কবিতার ভিতরেও যথেষ্ট পরিস্ফুট কালিদাসের দুষ্মন্ত শকুন্তলার কথা স্মরণ করে বলছেন
অনাঘ্রাতং পুষ্পং কিশলয়মলুনং কররুহৈঃ অনাবিদ্ধং রত্নং মধু অনাস্বাদিতরসম্।
হাফিজ তাঁর “মাশুকের কথা স্মরণ করে বলছেন
রুয়িয়ে মা বাআদ লালে শঙ্কর আফশানে শুমা;
আর Burns তাঁর Highland Mary-র কথা স্মরণ করে বলছেন
How sweetly bloom’d the gay, green birk. How rich the hawthorn’s blossoms, As underneath their fragrant shade. I clasp’d her to my bosom!
* “লাল শীরীন ঠোঁট প্রিয়ার রোজ পাই ভরাই লাখ লাখ চুম্বনে।” কবি নজরুল ইসলামের অনুবাদ।
৪২৮
The golden Hours on angel wings, Flew o’er me and my Dearie; For dear to me, as light and life Was my sweet Highland Mary.
এসব কবিতার ভিতরে ভোগ কেমন আত্মসম্পূর্ণ, যথেষ্ট তৃপ্তি স্বস্তি এ সমস্তে রয়েছে। তবে কালিদাসের ভোগ কেমন গোলাপগন্ধি; আর হাফিজে, Burns এ মত্ততা আর আবেগ কিছু বেশি। এসবের সঙ্গে মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভোগের স্বরূপ যখন উপলব্ধি করতে যাই তখন দেখি, কালিদাসের মতন সৌন্দর্যের উপাসক তিনি; মাঝে মাঝে বুঝতে পারা যায়, এ ভোগে তিনি তৃপ্ত; কিন্তু মোটের উপর এই ভোগের ভিতরে আকণ্ঠ নিমজ্জনের স্বস্তি যেন তিনি পাচ্ছেন না। সেইজন্য কেমন-একটা ব্যথা তার “বাহু”
“দেহের মিলন” প্রভৃতি কবিতায় বর্তমান। আর সব ভোগ সব অনুভূতির ভিতরে পরমরহস্যমণ্ডিত সত্যের সন্ধানই যে তার মজ্জাগত মানসীর “হৃদয়ের ধন” কবিতায় তা পরিষ্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে:
নাই নাই কিছু নাই শুধু অন্বেষণ। নীলিমা লইতে চাই আকাশ ছাঁকিয়া কাছে গেলে রূপ কোথা করে পলায়ন, দেহ শুধু হাতে আসে শ্রান্ত করে হিয়া। প্রভাতে মলিন মুখে ফিরে যাই গেহে, হৃদয়ের ধন কভু ধরা যায় দেহে!
মানসী
“কড়ি ও কোমলের পরে মানসীতে দেখতে পাই, কবির প্রকাশ-সামর্থ্য আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। হৃদয়ের ভাবতরঙ্গ আরো বিক্ষুব্ধ, জীবন হর্ষে আর ব্যথায় জটিল হয়ে দেখা দিয়েছে। কিন্তু এই জটিলতায় তার দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছে না। উপরে “হৃদয়ের ধন” কবিতার কয়েক চরণ যে উদ্ধৃত হয়েছে তাতে কবি তার সমস্ত কথা নিখুঁত আর অব্যর্থভাবে পাঠকের সামনে ধরূতে পেরেছেন।
“মানসীকে” মোটামুটি দুইভাগে ভাগ করে পড়া যেতে পারে। প্রথম ভাগের বিশেষত্ব এর প্রেমের কবিতা। মানসী’র চরণাঘাতে কবিহৃদয়ে সৌন্দর্য যেন সহস্রধারে উদ্ভূিত হয়ে উঠেছে। মানসী’কে কবি কখনো বলছেন
কে আমারে যেন এনেছে ডাকিয়া,
এসেছি ভুলে।
৪২৯
তবু একবার চাও মুখপানে
নয়ন তুলে।
দেখি ও নয়নে নিমিষের তরে। সেদিনের ছায়া পড়ে কি না পড়ে, সজল আবেগে আঁখিপাতাদুটি
পড়ে কি চুলে। ক্ষণেকের তরে ভুল ভাঙায়োনা,
এসেছি ভুলে।
কখনো ভুল ভেঙে যাওয়ায় কবি বলছেন
বাঁশি বেজেছিল, ধরা দিনু সেই
থামিল বাঁশি। এখন কেবল
চরণে শিকল কঠিন ফাঁসি!
কখনো বলছেন, বিরহেই তিনি ছিলেন ভালো
তবু সে ছিনু আধো আলো আঁধারে, গহন শত-ফের বিষাদের মাঝারে।
কখনো শূন্যহৃদয়ে তিনি বসে আছেন, মনে তার আকাঙ্ক্ষা জাগছে, কবে
পাগল করে
দিবে সে মোরে চাহিয়া, হৃদয়ে এসে,
মধুর হেসে প্রাণের গান গাহিয়া।
কখনো সংশয়ের আবেগে কবি স্থির থাকতে পারছেন না
ভালো বাসো, কি না বাসো বুঝিতে পারিনে,
তাই কাছে থাকি। তাই তব মুখপানে রাখিয়াছি মেলি
সর্বগ্রাসী আঁখি।
কেন এ সংশয়-ডোরে বাঁধিয়া রেখেচ মোরে,
বহে যায় বেলা।
৪৩০
জীবনের কাজ আছে, প্রেম নহে ফাঁকি,
প্রাণ নহে খেলা।
কখনো এক অপুর্ব বিচ্ছেদের ছবি আঁকছেন
সেই ভালো, তবে তুমি যাও! তবে আর কেন মিছে করুণ নয়নে আমার মুখের পানে চাও!
আবার কখনো সমস্ত আশা বিসর্জন দিয়ে কবি বলছেন
তবু মনে রেখো…. তবু মনে রেখো যদি মনে পড়ে আর আখি–প্রান্তে দেখা নাহি দেয় অশ্রুধার।
এইসব কবিতায় অতি সূক্ষ্ম অনুভূতিও অনুপম সৌন্দর্য-ভঙ্গিমা নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। এগুলো যে অ-”বাস্তব” নয় তার ভালো একটি প্রমাণ আমরা জানি। আমাদের এক সুবিখ্যাত কবি-বন্ধু তাঁর মানসী”-খানিতে এই সব কবিতার বহু চরণের পাশে-পাশে তারিখ দিয়ে রেখেছেন।
‘মানসী’তে কবি দক্ষ স্রষ্টা হয়ে উঠেছেন। ভাব, ছন্দ, প্রকাশ-ভঙ্গিমা সমস্তেরই উপর পর্যাপ্ত অধিকারের জন্যে এই মানসীর সময় থেকে যত কবিতা তিনি লিখেছেন তা’র প্রায় প্রত্যেকটিতেই কিছু-না-কিছু প্রশংসাযোগ্য আছে। জগতের অতি অল্প কবি সম্বন্ধে এত বড় কথা বলা যেতে পারে। আমাদের কথা যেন কেউ ভুল না বোঝেন। বলছি না, রবীন্দ্রনাথ যত কবিতা লিখেছেন তার প্রায় সবই শ্রেষ্ঠ কবিতা, অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। কাব্যে যা শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি কোনো কবির ভিতরেই তা পরিমাণে বা সংখ্যায় বেশি নয়, এমন-কি অল্পই। এখানে আমরা শুধু এই কথা বলতে চাচ্ছি যে, তার স্বভাবসিদ্ধ তীক্ষ্ম অনুভূতি, সন্ধানপরতা আর প্রকাশ-ভঙ্গিমার গুণে সাধারণ লেখকের স্তরে তিনি প্রায় কখনো নেমে পড়েননি; এটি যেন তাঁর প্রতিভার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
যে-সমস্ত কবিতার উল্লেখ করা হয়েছে, তা ভিন্ন মানসী’র প্রথম ভাগে “ক্ষণিক মিলন”, “একাল ও সেকাল”, “আকাঙ্ক্ষা”, “নিষ্ফল প্রয়াস”, “নারীর উক্তি”, “পুরুষের উক্তি” প্রভৃতি আরো সুন্দর কবিতা রয়েছে। কিন্তু এসমস্তের মুকুটমণি হচ্ছে “নিষ্ফল কামনা”:
বৃথা এ ক্রন্দন! বৃথা এ অনল-ভরা দুরন্ত বাসনা!
রবি অস্ত যায়।
৪৩১
অরণ্যেতে অন্ধকার আকাশেতে আলো।
সন্ধ্যা নত-আঁখি ধীরে আসে দিবার পশ্চাতে।
বহে কি না বহে। বিদায়-বিষাদ-প্রশ্রান্ত সন্ধ্যার বাতাস। দুটি হাতে হাত দিয়ে ক্ষুধার্ত নয়নে চেয়ে আছি দুটি আঁখি-মাঝে। খুঁজিতেছি, কোথা তুমি,
কোথা তুমি!
এর ছন্দ, যতি, ভাবাবেগের বিপুলতা, চিন্তার অতলস্পর্শতা প্রকাশ-ভঙ্গিমার অভ্যর্থতা, সমস্তের মিলনে সৃষ্টি যে অপরূপ মহিমায় আত্মপ্রকাশ করেছে কি কথায় তার যোগ্য প্রশংসা হতে পারে! ৭৯ লাইনের কবিতা এটি, অথচ কোথাও এতটুকু ত্রুটি, এতটুকু দীনতা, প্রকাশ পায়নি-এই কবিতাটিকে আমরা কত উঁচুতে স্থান দিই তা শুধু এই কথাতেই বোঝা যাবে যে, সমগ্র রবীন্দ্র-কাব্য-সাহিত্যে এরকম আর দুটি কবিতার সাক্ষাৎ আমরা পাই-চিত্রার “উর্বশী” আর বলাকার “বলাকা” কবিতাটি। এগুলো কাব্যে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি একথা বললে অতি সামান্যই বলা হয়। শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি রবীন্দ্রকাব্যে আরো আছে। অনুভূতির আগ্নেয়োচ্ছুসমুখে কি গগনস্পর্শী সৃষ্টির অধিকার বিধাতা মানুষকে দিয়েছেন এসব তারই প্রমাণ।
মানসীর দ্বিতীয় ভাগের অর্থাৎ শেষের দিকের অনেক কবিতায় দেখছি, কেমন বেদনামাখা কবি-হৃদয়-বিশ্ববিধানে জড়প্রকৃতির নির্মমতার জন্য এই বেদনা (“নিষ্ঠুর সৃষ্টি”, “সিন্দু-তরঙ্গ” প্রভৃতি), নিজেকে ক্ষুদ্র জীবনের কারাগারে বন্দী দেখে এই বেদনা। তার বিরাট আত্মা সংসারে পরিব্যাপ্ত হবার জন্যে ভিতরে-ভিতরে কামনা করছে। এতদিনের যে এলা-মনে রস-সম্ভোগের জীবন, তার মায়া কাটাতে তাঁর বাধে, অথচ কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্য আকাক্ষাও তার মনে যথেষ্ট প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে।
কবির এই অবস্থার সুন্দর চিত্র বিস্তৃত হয়ে আছে এর ভৈরবী গান’ কবিতাটিতে। তাঁর এই সময়কার এমন সৌন্দর্যসৃষ্টি-ক্ষমতা, এত সৌন্দর্য-উপভোগ, সব যেন ফেটে চৌচির হয়ে ভিতরকার বেদনাময় কবিহৃদয় খু’লে ধরেছে।
যদি কাজ নিতে হয় কত কাজ আছে,
একা কি পারিব করিতে? কাঁদে শিশির-বিন্দু জগতের তৃষা
হরিতে। কেন অকূল সাগরে জীবন সঁপিব
৪৩২
একেলা জীর্ণ তরীতে। শেষে দেখিব, পড়িব সুখ-যৌবন
ফুলের মতন খসিয়া, হায় বসন্ত-বায়ু মিছে চলে গেল
শ্বসিয়া, সেই যেখানে জগৎ ছিল এককালে সেইখানে আছে বসিয়া।
তবু সামনে না চলে তিনি পারছেন না; তার ভিতরকার দুর্জয় শক্তি-স্রোত আপনা থেকে এগিয়ে চলেছে।
ওগো, থাম, যারে তুমি বিদায় দিয়েছ
তারে আর ফিরে চেয়ো না।
অশ্রুসজল ভৈরবী আর
গেয়ো না। আজি প্রথম প্রভাতে চলিবার পথ
নয়ন-বাস্পে ছেয়ো না!
সেই আপনার গানে আপনি গলিয়া
আপনারে তারা ভুলাবে, স্নেহ আপনার দেহে সকরুণ কর
বুলাবে। সুখে কোমল শয়নে রাখিয়া জীবন
ঘুমের দোলায় দুলাবে। ওগো এর চেয়ে ভালো প্রখর দহন,
নিঠুর আঘাত চরণে। যাবো আজীবন কাল পাষাণ-কঠিন
সরণে। যদি। মৃত্যুর মাঝে নিয়ে যায় পথ,
সুখ আছে সেই মরণে।
–২৮
৪৩৩
আস্তে-আস্তে চলার আনন্দই তার ভিতরে কেমন জমাট হয়ে উঠেছে, মানসীর ‘পরিত্যক্ত কবিতায় তার পরিচয় রয়েছে। বন্ধুদের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়েও তিনি আর। দমছেন না, প্রতিভার এই স্বাতন্ত্র্য বড় রহস্যপূর্ণ।
বন্ধু এ তব বিফল চেষ্টা,
আর কি ফিরিতে পারি? শিখর-গুহায় আর ফিরে যায়
নদীর প্রবল বারি? জীবনের স্বাদ পেয়েছ যখন,
চলেছি যখন কাজে, কেমনে আবার করিব প্রবেশ
মৃত বরষের মাঝে?
“মানসী”র “বঙ্গবীর”, “ধর্মপ্রচার” প্রভৃতি ব্যঙ্গ কবিতার ভিতরেও যে-বেদনার সঞ্চার হয়েছে দেখতে পাওয়া যায়, তা এক বড় জীবনেরই গর্ভর্বাস থেকে মুক্ত হওয়ার বেদনা। বাঙালির বোতাম-আঁটা পোষমানা প্রাণের তলে বাস্তবিকই দুরন্ত কামনা সর্পসম কবির মনে ফুঁসছে
ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন।
গুরু গোবিন্দের পরই নিষ্ফল উপহার কবিতাটি বেশ বিশিষ্টতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। “সুরদাসের প্রার্থনা”
“গুরু গোবিন্দ” প্রভৃতি ভালো কবিতা, কিন্তু সৃষ্টি-হিসেবে হয়ত নিখুঁত নয়। এসমস্ত কবিতায় এমন-একটা গতি ছন্দের ভিতর দিয়ে ধেয়ে চলেছে যে তারই জন্য সৃষ্টি-কমল যেন পূর্ণভাবে দল মেলতে পারেনি। নিষ্ফল উপহারে দেখছি, কবি তাঁর সেই গতির রাশ খুব জোরে টেনে ধরেছেন এবং রাশ টেনে ধরে তিনি যে এক চমৎকার ভঙ্গিতে রথ চালনা করতে পারেন, তার পরিচয় দিয়েছেন। এর সর্বত্র কি দৃঢ় সংযম! এক-একটি স্তবক এক-একটি ভাব প্রায় পুরোপুরি প্রকাশ করছে বলে তাদের সমবায়ে সমগ্র কবিতাটিতে যে ভাবধ্বনি উঠছে তা গম্ভীর আর উদাত্ত।
মানসীর শেষের দিকে আরো কতকগুলি সুন্দর কবিতা আছে। ধ্যান, অনন্ত প্রেম, উচ্ছল প্রভৃতি। ধ্যান প্রতিভার প্রাণ। কবি নিজের সেই ধ্যানী রূপ যেন উপলব্ধি করতে পেরেছেন
তুমি যেন ওই আকাশ উদার, আমি যেন ওই অসীম পাথার, আকুল করেছে মাঝখানে তার
আনন্দ পূর্ণিমা।
৪৩৪
উচ্ছল কবিতাটি এক সুন্দর সৃষ্টি। কবির মনোজগৎ এখন যথেষ্ট বিস্তৃত। সেই বিস্তত মনোজগতের বুকে উজ্জ্বলকে তিনি দাঁড় করিয়ছেন:
প্রতিদিন বহে মৃদু সমীরণ প্রতিদিন ফুটে ফুল। ঝড় শুধু আসে ক্ষণেকের তরে
সৃজনের এক ভুল। দুরন্ত সাধ কাতর বেদনা
ফুকারিয়া উভলায়। আঁধার হইতে আঁধারে ছুটিয়া যায়।
এ আবেগ নিয়ে কার কাছে যাবো,
নিতে কে পারিবে মোরে!
কে আমারে পারে আঁকড়ি রাখিতে দুখানি বাহুর ডোরে।
নবীন কবি নজরুল ইসলামের সুবিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’র আবেগ এর চেয়ে অনেক বেশি; কিন্তু সে-আবেগ এমন সত্যসৃষ্টি স্রষ্টার হাতে নিয়ন্ত্রিত নয়। তাই তার অনেকখানি কাব্যহিসেবে অকিঞ্চিৎকর। অতি বিপুল আবেগ সৃষ্টিক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত হলে কি অপরূপ কাব্য হতে পারে, বায়রনের (Byron) চাইল্ড হারল্ডের (Child
Harold) শেষের দিকের সমুদ্র-বন্দন তার এক বড় প্রমাণ।
সোনার তরী
“মানসী”র যুগের পর রবীন্দ্রনাথের জীবনে এক বড় পরিবর্তন এসেছিল। এতদিন শুধু এক্কা-মনে কবির জীবন তিনি যাপন কছিলেন। “সোনার তরী” যে যুগের লেখা তখন তিনি জমিদারি-কাজের ব্যাপদেশে বৃহৎ বাস্তব জগতের সঙ্গে মিবার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর গভীর সবল প্রকৃতি এই বিপুল বাহিরকে হজম করে যে কি অলৌকিক পরিপুষ্টি লাভ করেছে, ‘সোনার তরী”
“গল্পগুচ্ছ”
“চিত্রা” প্রভৃতি তার দৃষ্টান্ত। এই যুগ রবন্দ্রি-সাহিত্যে “সাধনার যুগ” নামে খ্যাত; এবং অনেকের বিশ্বাস, এই যুগই কবি রবীন্দ্রনাথের জীবনের শ্রেষ্ঠ যুগ। এ সম্বন্ধে কিছু আলোচনা আমরা পরে করব।
* সমস্ত অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও সত্যিকার প্রতিভার স্পন্দনও যে এর ভিতরে বুঝতে পারা যায় সে বিষয়ে
সন্দেহ নেই।
৪৩৫
মানসীর সুরের সঙ্গে সোনার তরী, চিত্রা, ইত্যাদির সুরের বেশ পার্থক্য রয়েছে। সোনার তরী প্রভৃতির কবিহৃদয় নিশ্চয়ই পূর্ণতর, পরিপুষ্টতর। রবীন্দ্রনাথের যে তীক্ষ্ণ অনুভূতি আর সন্ধানপরতা তা যেন এখানে এক পরম সৌন্দর্যময় প্রকাশে নিজের সার্থকতা উপলব্ধি করেছে। তাই সোনার তরী, চিত্রা, গল্পগুচ্ছ, প্রভৃতির ভাব শক্তিমান আনন্দময় দ্রষ্টার ভাব-ক্ষুদ্র বৃহৎ সমস্তের অন্তরের সৌন্দর্য আর সত্য কবি নিবিড়ভাবে অনুভব করছেন, আর এক অপূর্ব ছন্দে সে-সব শরীরী হয়ে উঠছে।
কিন্তু মানসীর সুর সাধারণত সঙ্গীতের সুর। যে অনুভূতি কবির মনে জাগছে তা তীক্ষ্ণ; সৌন্দর্য ও তাঁর চোখে ফুটে উঠেছে নানা রেখা ও বর্ণ-বৈচিত্র্য নিয়ে; কিন্তু এসব মূর্তির মতো গড়ে তোলার দিকে কবির তত চেষ্টা নয়, যত এর সৌন্দর্যে আবেগ নিজে মেতে ওঠা-নৃত্য করা। এই আনন্দময়, আবেগময়, বেদনাময়, চির-আন্দোলিত, কবিহৃদয়ের স্পর্শ যাদের কাছে অপূর্ব “মানসী” তাদের প্রিয় কাব্য।
রবীন্দ্র-প্রতিভার প্রকাশ-ভঙ্গির এই দুই রূপ-রহস্যময় বংশীবাদকের রূপ আর সমাহিতচিত্ত দ্রষ্টার রূপ-শুধু তার যৌবনের রচনায় নয় পরে পরের রচনাও প্রকাশ পেয়েছে। এদিকে মানসী, কল্পনা, ক্ষণিকা, খেয়া, গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য, গীতালি, অন্যদিকে সোনার তরী, চিত্রা, চিত্রাঙ্গদা, চৈতালি, কথা, কাহিনী, নৈবেদ্য, বলাকা, প্রভৃতি দাঁড় করিয়ে আমরা এ কথা বলছি।
শুধু নিজের মনে বদ্ধ না থেকে বৃহৎ জগতে ছড়িয়ে পড়বার জন্যে কবির মনে যে আকাক্ষা জাগছিল, সোনার তরীতে তা কতকটা সার্থক হয়েছে। কতকটা বলছি এই জন্যে যে, যে-জগতে এখন ঘুরে-ফিরে তিনি তৃপ্তি পাচ্ছেন গ্যেটের মেফিসূটোফিলিস্ এর ভাষায়, তা ক্ষুদ্র জগৎ (Little World).(রবীন্দ্র-প্রতিভার জন্যও যে তা Little World.তা পরে দেখব।) সংসারের নানা সুর তাঁর চিত্তে এখন কিছু প্রবেশাধিকার পেয়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা এই যে সংসারের প্রাত্যহিক জীবনের যে একটি আনন্দময় রূপ আছে সেটি কবির চোখে পড়েছে।
আমাদের বৈরাগ্য-প্রপীড়িত তামসিক জীবন-যাত্রার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের যে তীব্র প্রতিবাদ সোনার তরী কাব্যেই তার সূচনা নয়। কিন্তু যে সত্যের উপর দাঁড়িয়ে কবি এই প্রতিবাদ করেছেন তার প্রথম পর্যাপ্ত উপলব্ধি দেখতে পাই এই সোনার তরীতে ও সোনার তরীর যুগের গল্পগুচ্ছে। আকাশের চাঁদ’ কবিতাটিতে দেখছি, এক অদ্ভুত সাধক আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার খেয়ালে আর সব দিকে উদাসীন হয়ে শুধু নিজের খেয়াল মতোই চলেছিল; শেষে তার চোখ পড়ল প্রাত্যহিক জীবনের সমস্ত ক্ষুদ্রতা তুচ্ছতার উপরে, সে দেখলে, এই সমস্ত ক্ষুদ্রতা তুচ্ছতার বুকে কি অমৃত লুকানো রয়েছে। অর্থাৎ, দেশেরই জড়তাগ্রস্ত খেয়ালী-চিত্তকে প্রাত্যহিক জীবনের ভিতরকার অমৃতের সন্ধান কবি দিচ্ছেন।
এমন সময়ে সহসা কি ভাবি
চাহিল সে মুখ ফিরে, দেখিল ধরণী শ্যামল মধুর
৪৩৬
সুনীল সিন্ধুতীরে। সোনার ক্ষেত্রে কৃষাণ বসিয়া
কাটিতেছে পাকা ধান, ছোটো-ছোটো তরী পাল তুলে যায়
মাঝি বসে গায় গান। *
* * দেখিল চাহিয়া জীবনপূর্ণ
সুন্দর লোকালয়, প্রতিদিবসের হরষে-বিষাদে
চির-কল্লালময়। স্নেহ-সুধা লয়ে গৃহের লক্ষ্মী
ফিরিছে গৃহের মাঝে, প্রতিদিবসের করিছে মধুর
প্রতিদিবসের কাজে। *
* ছোটো-ছোটো ফুল ছোটো ছোটো হাসি,
ছোটো কথা, ছোটো সুখ, প্রতিনিমিষের ভালোবাসাগুলি,
ছোটো-ছোটো হাসিমুখ। আপনা-আপনি উঠিছে ফুটিয়া
মানবজীবন ঘিরি বিজন শিখরে বসিয়া সে তাই
দেখিতেছে ফিরি-ফিরি’।
জাগতিক জীবন, প্রাত্যহিক জীবন-যাত্রা, যে অমৃতময় রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কাব্য-সাধনায় এ এক বড় সত্যের উদ্ঘাটন। এ মন্ত্রের দর্শন কবি পেয়েছেন বহু পরে “নৈবেদ্য” কাব্যে
বৈরাগ্য-সাধনে মুক্তি সে আমার নয়। অসংখ্য বন্ধন-মাঝে মহানন্দময় লভিব মুক্তির স্বাদ ………
কিন্তু কতরূপে কত ভাবে যে কবি বারবার এই সত্যের সম্মুখীন হয়েছেন, কাব্যরসিক ও সত্যজিজ্ঞাসু-দুয়েরই তা অনুধাবনের বিষয়।
সোনার তরীতে রবীন্দ্র-প্রতিভায় যেন বান ডাতে চাচ্ছে। এখানে এক মহা ঐশ্বর্যপূর্ণ কবিহৃদয় আমাদের সামনে উদ্ঘাটিত-ভাব, ছন্দ, সামর্ঘ্যের ধারণা, সমস্তই
৪৩৭
ঐশ্বর্যপূর্ণ। আর তাঁর বিপুল সৌন্দর্যানুভূতি সমুদ্র-ফেনার মতনই এক দিগন্তবিস্তৃত স্বল্পমাধুরী রচনা করেছে। কিন্তু সৃষ্টি হিসেবে সোনার তরীর খুব বেশি কবিতা হয়ত অনবদ্য নয়,-কবির চোখে লেগে রয়েছে সৌন্দর্যের কেমন এক স্বপ্নবেশ। সোনার তরীর মানস-সুন্দরী কবিতাটিতে কি অদ্ভুত সৌন্দর্য-পূজা! কিন্তু এই পূজায়ও লেগে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের সেই প্রকৃতিগত রহস্যের সন্ধানপরতা।
কিন্তু সম্পূর্ণ পরিচ্ছন্ন দৃষ্টির সৃষ্টি না হলেও, বলা যেতে পারে, সৌন্দর্যানুভূতির গভীর তন্ময়তার সৃষ্টি এই সোনার তরী; তাই রবীন্দ্র-প্রতিভার এও এক বড় দান। প্রকৃতির সৌন্দর্যের ভিতরে, নরনারীর প্রেম-প্রীতির ভিতরে, এই যে তন্ময়তা এরই থেকে উদ্ভূত হয়েছে উচ্চতর আত্মপ্রকাশ ও পূর্ণতর সৃষ্টি।
সোনার তরীর ‘বৈষ্ণব কবিতায় কবি তার কথাটি কত স্পষ্ট করে বলেছেন! আগে আকাশের চাঁদ কবিতাটি যে আমরা আংশিক উদ্ধৃত করেছি, তার চেয়ে এর প্রকাশ ভঙ্গিমা অনেক উৎকর্ষ লাভ করেছে। অন্তরের সরসতার সত্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের প্রচলিত মতবিশ্বাসের মোহ কবি কতটা এড়িয়ে উঠেছেন তারও স্পষ্ট পরিচয় এতে রয়েছে।
শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান? পূর্বরাগ, অনুরাগ, মান-অভিমান, অভিসার, প্রেমলীলা, বিরহ, মিলন, বৃন্দাবন-গাথা……. ……….একি শুধু দেবতার? ……….আমাদেরিই কুটির-কাননে ফুটে পুষ্প, কেহ দেয় দেবতা-চরণে, কেহ রাখে প্রিয়জন তরে-তাহে তার নাহি অসন্তোষ। এই প্রেমগীতিহার গাঁথা হয় নরনারী-মিলন মেলায়, কেহ দেয় তারে, কেহ বঁধুর গলায়। দেবতারে যাহা দিতে পারি দিই তাই প্রিয়জনে-প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই তাই দিই দেবতারে; আর পাবো কোথা? দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়েরে দেবতা!
সোনার তরীর “যেতে নাহি দিব” কবিতাটি বাস্তবিকই এক অপরূপ সৃষ্টি-হয়ত সমস্ত “সোনার তরী” কাব্যখানির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এটি। “মানসী”তে দেখেছি কবি নিষ্ঠুর সৃষ্টির সম্মুখীন হয়েছেন। কিন্ত জগতের কাঁচা কোমল প্রাণের সঙ্গে তার যে চিরসংগ্রাম তার ফলাফল কি, সে-কথাটি তার দৃষ্টিতে তেমন ফুটে ওঠেনি। এই “যেতে নাহি দিব” কবিতায় সেটি অপরূপ বেদনায় বিকশিত হয়ে উঠেছে।
৪৩৮
*
এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত্য ছেয়ে সবচেয়ে পুরাতন কথা সবচেয়ে গভীর ক্রন্দন যেতে নাহি দিব।” হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়!
*
*
………..তবু প্রেম বলে, “সত্যভঙ্গ হবে না বিধির। আমি তার পেয়েছি স্বাক্ষর-দেওয়া মহা অঙ্গীকার চির-অধিকার লিপি।” তাই স্ফীতবুকে সর্বশক্তি মরণের মুখের সম্মুখে। দাঁড়াইয়া সুকুমার ক্ষীণ তনুলতা বলে, “মৃত্যু তুমি নাই।”-হেন গর্বকথা। মৃত্যু হাসে বসি। মরণ-পীড়িত সেই চিরজীবী প্রেম আচ্ছন্ন করেছে এই
অনন্ত সংসার, বিষণ্ণ নয়ন’পরে অশ্রুবাষ্পসম, ব্যাকুল আশঙ্কাভরে চিরকম্পমান। * মেঠো সুরে কাঁদে যেন অনন্তের বাঁশি বিশ্বের প্রান্তর-মাঝে; শুনিয়া উদাসী বসুন্ধরা বসিয়া আছেন এলোচুলে দূরব্যাপী শস্যক্ষেত্রে জাহ্নবীর কূলে একখানি রৌদ্রপীত হিরণ্য-অঞ্চল বক্ষে টানি দিয়া; স্থির নয়নযুগল দূর নীলাম্বরে মগ্ন; মুখে নাহি বাণী। দেখিলাম তার সেই ম্লান মুখখানি সেই দ্বারপ্রান্তে লীন, স্তব্ধ মর্মাহত মোর চারি বৎসরের কন্যাটির মতো!
ভাষায় শাণিত দীপ্তিতে, সবল ছন্দোগতিতে, দৃষ্টির পরিচ্ছন্নতায় ও অব্যর্থতায়, ভাবের দৃঢ়-সম্বন্ধতায় এটি রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির অন্যতম রূপে গণ্য হবারই যোগ্য।
৪৩৯
সোনার তরীর পুরস্কার” কবিতাটির অনেক জায়গায় কবি নিজের কথা এমন চমৎকার ভঙ্গিতে প্রকাশ করেছেন, ছোটোখাটো সত্য এমন রসময় মূর্তি নিয়ে ফুটে উঠেছে যে, তারই জন্য এ কবিতাটি চিরকাল পাঠকের হৃদয়রঞ্জন করবে। এর বাণী বন্দনাটি কত সুন্দর! কবি-প্রতিভার ভিতরে যে একটি নির্লিপ্ততা বা আত্মসম্পূর্ণতা আছে, যার গুণে কবি স্রষ্টা, তা’র কত মনোরম বর্ণনা কবি দিয়েছেন
কে আছে কোথায়, কে আসে কে যায় নিমেষে প্রকাশে নিমেষে মিলায়, বালুকার পরে কালের বেলায়
ছায়া-আলোকের খেলা! জগতের যত রাজা-মহারাজ কাল ছিল যারা কোথা তারা আজ, সকালে ফুটিছে সুখদুখ লাজ
টুটিছে সন্ধ্যাবেলা। তা’র মাঝে শুধু ধ্বনিতেছে সুর, বিপুল বৃহৎ গভীর মধুর, চিরদিন তাহে আছে ভবপুর
মগন গগনতল। যে জন শুনেছে সে অনাদি ধ্বনি ভাসায় দিয়েছে হৃদয়-তরণী, জানে না আপনা, জানে না ধরণী,
সংসার-কোলাহল।
বাজুক সে বীণা, মজুক ধরণী, বারেকের তরে ভুলাও জননী, কে বড় কে ছোটো কে দীন কে ধনী
কেবা আগে কেবা পিছে,
তুমি মানসের মাঝখানে আসি’ দাঁড়াও মধুর মুরতি বিকাশি, কুন্দবরণ সুন্দর হাসি
বীণাহাতে বীণাপাণি। ভাসিয়া চলিবে রবি শশী তারা
৪৪০
সারি-সারি যত মানবের ধারা অনাদি কালের পান্থ যাহারা
তব সঙ্গীতস্রোতে! দেখিতে পাইব ব্যোমে মহাকাল ছন্দে ছন্দে বাজাইছে তাল, দশ দিধূ খুলি’ কেশজাল
নাচে দশদিক্ হ’তে।
জগতের কি কাজে লাগতে কবির সাধ যায় সে-সম্বন্ধে কবি বাণীর কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছেন
লক্ষযুগের সঙ্গীতে মাথা
সুন্দর ধরাতল। এ-ধরার মাঝে তুলিয়া নিনাদ চাহিনা করিতে বাদ-প্রতিবাদ,
*
শুধু রাশিখানি হাতে দাও তুলি’ বাজাই বসিয়া প্রাণ-মন খুলি পুষ্পের মতো সঙ্গীতগুলি
ফুটাই আকাশ-ভালে। অন্তর হতে আহরি’ বচন আনন্দলোক করি বিরচন, গীত-রসধারা করি সিঞ্চন
সংসার-ধূলিজালে
ধরণীর তলে, গগনের গায়, সাগরের জলে, অরণ্য-ছায় আরেকটুখানি নবীন আভায়
রঙিন করিয়া দিব। সংসার-মাঝে দুয়েকটি সুর রেখে দিয়ে যাবো করিয়া মধুর দুয়েকটি কাঁটা করি দিব দূর
৪৪১
তা’র পর ছুটি নিব। সুখহাসি আরো হবে উজ্জ্বল, সুন্দর হবে নয়নের জল, স্নেহ-সুধামাখা বাসগৃহতল
আরো আপনার হবে। প্রেয়সী নারীর নয়নে-অধরে, আরেকটু মধু দিয়ে যাবো ভ’রে, আরেকটু স্নেহ শিশু-মুখপরে
শিশিরের মতো র’বে।
রবীন্দ্রনাথের নিছক সৌন্দর্য-পূজার এ এক অসাধারণ সার্থকতা। তাঁর নিছক সৌন্দর্য-দৃষ্টির সামনেই মূর্তি ধরে উঠেছে কেমন আড়ম্বরহীন অথচ গভীর সত্য-অমৃতমাখা সত্য কাব্যের যা উপজীব্য। কবি এখানে মানুষের ছোটোখাটো কাজে লাগতে চেয়েছেন। এক হিসেবে কাব্য মানুষের জীবনের এমন ছোটোখাটো কাজেই লাগে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হয় সামান্য কাজ, মানুষের জীবনের জন্য তা যে সত্যই অসামান্য।
সোনার তরীর বসুন্ধরা’ কবিতাটি সুবিখ্যাত,-কাব্যরসিকের চির-আদরের সামগ্রী। চিরশ্যাম ধরণীর নিগূঢ় প্রাণরস কবির চিত্তকে একেবারে বিভোর করে তুলেছে।
ওগো মা মৃন্ময়ি, তোমার মৃত্তিকা-মাঝে ব্যাপ্ত হয়ে রই; দিগবিদিকে আপনারে দিই বিস্তারিয়া বসন্তের আনন্দের মতো……
……হিল্লোলিয়া, মর্মরিয়া, কম্পিয়া, খলিয়া, বিকিরিয়া, বিচ্ছুরিয়া, শিহরিয়া, সচকিয়া, আলোকে-পুলকে প্রবাহিয়া চলে যাই সমস্ত ভূলোকে প্রান্ত হতে প্রান্তভাগে;……..
এ কবিতাটিতে বিশেষ লক্ষ্যযোগ্য “বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে কবির পরম নিবিড় যোগ। মানুষের বিচিত্র জীবনযাত্রার সঙ্গে তাঁর যেটুকু সহানুভূতি জন্মেছে তা “আঘাত সংঘাত”-পূর্ণ মানুষের জীবনের সঙ্গে তেমন নয়, বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানুষ যতখানি অবিচ্ছেদে যুক্ত তারই সঙ্গে। সেই আঘাত-সংঘাতপূর্ণ বিশ্বমানবের ক্ষেত্রে তাঁকে দণ্ডায়মান দেখতে পাই এর পরে চিত্রা’ কাব্যে।
৪৪২
নার তরীর শেষের কবিতায় দিগন্ত বিস্তৃত সৌন্দর্য সাগরের বুকে কবির যে নিরুদ্দেশ যাত্রা অদ্ভুত তার সৌন্দর্য
বলো দেখি মোরে শুধাই তোমায়,
অপরিচিতা, ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কূলে
দিনের চিতা, ঝলিতেছে জল তরল অনল, গলিয়া পড়িছে অম্বরতল, দিধূ যেন ছলছল-আঁখি
অশ্রুজলে, হোথায় কি আছে আলয় তোমার, ঊর্মিমুখর সাগরের পার, মেঘচুম্বিত অস্তগিরির
চরণতলে? তুমি হাসো শুধু মুখপানে চেয়ে
কথা না বলে।
এই নিরুদ্দেশ যাত্রাকে নিছক নিরুদ্দেশ যাত্রা কল্পনা করে কাব্য-রসিক আনন্দ পেতে পারেন; আবার কারো-কারো মনে হতে পারে, এই অপরিচিতার নয়নে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতার দ্যুতি।
মোটের উপর সোনার তরীর ভাব আনন্দময় রসতন্ময় দ্রষ্টার ভাব, কিছু বেশি সৌন্দর্যপ্রিয়তাও তাতে আছে। কিন্তু শুধু এই-ই নয়। এই দৃষ্টির আনন্দ আর পরম সৌন্দর্যতন্ময়তার মধ্যেও জায়গায় জায়গায় দেখছি, কি এক গভীরতার জন্য কবির আকাক্ষা জেগেছে। “সমুদ্রের প্রতি কবিতায় কবি অনুভব করছেন
……….মানব-হৃদয়সিন্ধুতলে যেন নব মহাদেশ সৃজন হতেছে পলে-পলে আপনি সে নাহি জানে, শুধু অর্ধ অনুভব তারি ব্যাকুল করেছে তারে,……….. জননী যেমন জানে জঠরের গোপন শিশুরে প্রাণে যবে স্নেহ জাগে, স্তনে যবে দুগ্ধ উঠে পুরে। প্রাণভরা ভাষাহারা দিশাহারা সেই আশা নিয়ে চেয়ে আছি তোমাপানে; তুমি সিন্ধু প্রকাণ্ড হাসিয়ে টানিয়া নিতেছ যেন মহাবেগে কি নাড়ীর টানে আমার এ-মর্মখানি তোমার তরঙ্গ-মাঝখানে কোলের শিশুর মতো………….।
৪৪৩
‘ঝুলন’ কবিতাটিতে কবির চিত্ত যে বিষম দোল খাচ্ছে, সে শুধু খেয়ালের দোল
নয়
দে দোল দোল।
দে দোল দোল। এ মহা সাগরে তুফান তোল। বধূরে আমার পেয়েছি আবার
ভরেছে কোল। প্রিয়ারে আমার তুলেছে জাগায়ে
প্রলয়-রোল বক্ষ-শোণিতে উঠেছে আবার
কি হিল্লোল। ভিতরে-বাহিরে জেগেছে আমার
কি কল্লোল……..;
কবি নিজের হৃদয়-যমুনায় এমন এক অতলস্পর্শ গভীরতা অনুভব করছেন যার অন্য নাম তিনি দিয়েছেন মরণ
যদি মরণ লভিতে চাও, এস তবে ঝাঁপ দাও
সলিল-মাঝে! স্নিগ্ধ, শান্ত, সুগভীর, নাহি তল, নাহি তীর,
মৃত্যুসম নীল নীর স্থির বিরাজে………;
আর কবি নিজে তাঁর ‘আমার ধর্ম’ প্রবন্ধে বলেছেন- “বড়-আমিকে চওয়ার আবেগ ক্রমে আমার কবিতার মধ্যে যখন ফুটতে লাগল, অর্থাৎ অঙ্কুররূপে বীজ যখন মাটি কুঁড়ে বাহিরের আকাশে দেখা দিলে, তারই উপক্রম দেখি, সোনার তরীর বিশ্বনৃত্যে।”
বিপুল গভীর মধুর মন্দ্রে
কে বাজাবে সেই বাজনা উঠিবে চিত্ত করিয়া নৃত্য
বিস্মৃত হবে আপনা। টুটিবে বন্ধ, মহা আনন্দ, নব সঙ্গীতে নূতন ছন্দ, হৃদয়-সাগরে পূর্ণচন্দ্র
জাগাবে নবীন বাসনা।
“
–
–
‘
‘““
“““
“
“
“
–
–
–
৪৪৪
–
*
– *
**
চিত্রা
এর পর চিত্রাতে দেখি, “দৃষ্টির আনন্দ’ আর ‘বাঁশির ব্যথা যুগপৎ কবির সৃষ্টিতে চলেছে। “সুখ কবিতায় তিনি বলছেন
আজি বহিতেছে। প্রাণে মোর শান্তিধারা; মনে হইতেছে সুখ অতি সহজ সরল, কাননের প্রস্ফুট ফুলের মতো, শিশু আননের হাসির মতন..
কিন্তু সন্ধ্যায় কবি ব’সে ব’সে ভাবছেন,
ক্রমে ঘনতর হয়ে নামে অন্ধকার, গাঢ়তর নীরবতা,-বিশ্ব-পরিবার সুপ্ত নিশ্চেতন। নিঃসঙ্গিনী ধরণীর বিশাল অন্তর হ’তে উঠে সুগম্ভীর। একটি ব্যথিত প্রশ্ন-ক্লিষ্ট ক্লান্ত সুর শূন্য-পানে-”আরো কোথা?”
“আরো কতদূরে?”
একদিকে কবির মোহন তুলিকাস্পর্শে উর্বশী জেগে উঠেছে।
যুগ-যুগান্তর হ’তে তুমি শুধু বিশ্বের প্রেয়সী
হে অপূর্ব শোভনা উর্বশি! মুনিগণ ধ্যান ভাঙি, দেয় পদে তপস্যার ফল, তোমারি কটাক্ষঘাতে ত্রিভুবন যৌবনচঞ্চল, তোমার মদির গন্ধ অন্ধ বায়ু বহে চারিভিতে, মধুমত্ত ভৃঙ্গসম মুগ্ধ কবি ফিরে লুব্ধ চিতে,
উদ্দাম সঙ্গীতে। নূপুর গুঞ্জরি’ যাও আকুল-অঞ্চলা
বিদ্যুৎ-চঞ্চলা……….
আর-একদিকে এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় যার চেহারা কবির সামনে আসছে তার সৌন্দর্য উর্বশীর সৌন্দর্য নয়
৪৪৫
মৃত্যুর করি না শঙ্কা! দুর্দিনের অশ্রুজল-ধারা মস্তকে পড়িবে ঝরি’-তারি মাবো যাবো অভিসারে তার কাছে,-জীবনসর্বস্বধন অর্পিয়াছি যারে জন্ম-জন্ম ধরি’! কে সে? জানি না কে! চিনি নাই তারে শুধু এইটুকু জানি-তারি লাগি’ রাত্রি অন্ধকারে চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর-পানে ……..শুধু জানি-যে শুনেছে কানে তাহার আহ্বানগীত-ছুটেছে সে নির্ভীক পরাণে ……………..দহিয়াছে অগ্নি তারে বিদ্ধ করিয়াছে শূল, ছিন্ন তা’রে করেছে কুঠারে, সর্বপ্রিয় বস্তু তার অকাতরে করিয়া ইন্ধন চিরজন্ম তারি লাগি’ জ্বেলেছে সে হোম হুতাশন;
অজিতবাবু যে বলেছেন,-সোনার তরী চিত্রা ও চৈতালির মাধুর্য-সম্পন্ন জীবনের সঙ্গে কথা কল্পনা ক্ষণিকা প্রভৃতি পরবর্তী কাব্যের জীবনের যে বিচ্ছেদ সেটি এমন গুরুতর যে, এ-দুটি দু’জন স্বতন্ত্র লেখকের জীবন বললেও অত্যুক্তি হয় না, একথা পুরোপুরি মেনে নেওয়া যায় না। আমরা বরং দেখতে পাচ্ছি, কল্পনার আগে একই সঙ্গে আনন্দ আর ব্যথার উচ্ছ্বাসে ‘চিত্রা’ বিচিত্র হয়ে দেখা দিয়েছে। সোনার তরীর নিবিড় রসানুভূতির মধ্যেও যে এর আভাস বিদ্যমান, তাও আমরা দেখেছি।
আর রবীন্দ্র-প্রতিভার পক্ষে এটি খুবই স্বাভাবিক। অনুভূতি যার ভিতরে এত তীক্ষ্ম, আর স্বভাবতই সন্ধান যার ভিতরে এমন অপ্রতিহত, নানা পরস্পরবিরোধী ভাবও তার ভিতরে ওতপ্রোত হয়ে থাকতে বাধ্য।
সোনার তরীতে দেখেছি, রবীন্দ্র-প্রতিভায় বান ডাকবার উপক্রম হয়েছে। চিত্রাতে দেখছি, সত্যই সে-বান ডেকেছে। তাঁর প্রতিভার ঐশ্বর্য যেন সহস্র ছটায় বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সুরসভাতলে উর্বশীর নৃত্যের মতনই কি যে তার সৌন্দর্য তার পুরোপুরি বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব।
চিত্রায় নানা ধরণের কবিতা স্থান পেয়েছে। নিছক সৌন্দর্য-পূজা হিসেবে “চিত্রা”
“সুখ” অতি সুন্দর কবিতা। ‘সুখ’ কবিতায় সহজ সরল সুখ কবির ছন্দে কি সহজ সরল অথচ সবল ভাবে ফুটে উঠেছে। “জ্যোৎস্না রাত্রে” কবিতায় কবি কেমন এক তৃষ্ণায় কাতর-নিদ্রাহীন। সৌন্দর্যের এক দিব্য-মূর্তি চাক্ষুষভাবে দেখবার জন্যে কবির মনে যে আকুলতা জেগেছে, তা কেমন বিচিত্র হয়ে ফুটে উঠেছে। কবির এই রহস্য-অভিসারী না।
।
•
• •
• না।
*
সোনার তরীর মাঝামাঝি থেকে “চিত্রা”র মাঝামাঝি পর্যন্ত এ জোয়ারের স্থিতিকাল বললে বোধ হয়
অনেকখানি বেশি নির্ভুল হয়।
৪৪৬
মনোভাবের সঙ্গে খুব বেশি পাঠকের সহানুভূতি না হতে পারে; কিন্তু তার জন্যে এর শিল্পগৌরব ম্লান হয় না। কবি অধিকারী হয়ে কাব্য লেখেন, পাঠকের বেলায়ও সেই
অধিকারের কথা একেবারে ভুলে গেলে চলবে কেন।
এর সন্ধ্যা’ কবিতাটি এক চমৎকার সৃষ্টি। কিন্তু সন্ধ্যার সৃষ্টি তত নয় যত কবির প্রতিভার এক সন্ধিক্ষণের সৃষ্টি।-এখানে বিশ্বপ্রকৃতির ক্ষেত্রের মাধুর্য থেকে চোখ একটু উঠিয়ে কবি দূরে বিশ্বমানবের ক্ষেত্রের “কত যুদ্ধ কত মৃত্যু”র ছবির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন।
এর পরই “এবার ফিরাও মোরে” কবিতাটি। রবীন্দ্র-প্রতিভা-নির্ঝরের এ আর এক স্বপ্নভঙ্গ। এর কয়েক লাইন উপরে উদ্ধৃত হয়েছে। এ কবিতাটি সম্বন্ধে বেশি কিছু বলা নিপ্রয়োজন। আমাদের জাতীয় জীবনের বর্তমান অবস্থায় এটি যে আমাদের প্রাণের বস্তু হবে, এ খুব স্বাভাবিক। কিন্তু কাব্য হিসেবেও এ অমূল্য। মহাজীবনের জন্য মানুষের আত্মায় মাঝে মাঝে যে ক্রন্দন জাগে, তার কি অসাধারণ প্রকাশ এতে বর্তমান।
এর কাছাকাছি দাঁড় করানো যেতে পারে পরলোকগত সত্যেন্দ্রনাথের ‘মহাত্মা গান্ধী’ কবিতা।
রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য-পূজার চরম সার্থকতা ‘উর্বশী’। কারো কারো মতে এটি-ই রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি। আমাদের ধারণা কি তা আগেই বলেছি। কিছু ভিন্ন ধরণের হলেও বায়রনের (Byron) সমুদ্রবন্দনের সঙ্গে এই উর্বশী কবিতাটির কিছু সাদৃশ্য আছে। দু’য়ের ভিতরেই সমুদ্রের কল্লোল আর তরঙ্গবিক্ষেপ কানে বাজে।
চিত্রার বিজয়িনী, ‘পর্ণিমা, ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’ প্রভতিও সুন্দর কবিতা। কিন্তু ব্রাহ্মণ’, ‘পুরাতন ভৃত্য’ প্রভৃতি কবিতায় দেখছি, কবি বাস্তবিকই তার সৌন্দর্য-পূজার ‘অখিল মানসস্বর্গ’ ছেড়ে মাটির ধরণীর মহিমার পানে নির্নিমেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন।
“ব্রাহ্মণ” কবিতার বর্ণনাভঙ্গি আর ছন্দোগতি খুব লক্ষ্যযোগ্য। কবির দৃষ্টি সূর্যের আলোর মতন পরিষ্কার অথচ অনাড়ম্বর। ছন্দোগতিতে সত্যিকার ব্রাহ্মণেরই সংযমের শুচিতা।
পুরাতন ভৃত্যের মতন চমৎকার সৃষ্টি রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্পগুচ্ছে আরো করেছেন। এ কবিতাটিতে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, এর অতি অনাড়ম্বর অথচ অতি অব্যর্থ শব্দপ্রয়োগ
দূর কমে
শুনে মহা রেগে ছুটে যাই বেগে
আনি তার টিকি ধরে বলি তারে, “পাজি, বেরো তুই আজি,
দূর করে দিনু তোরে।” ধীরে চলে যায়, ভাবি, গেল দায়
পরদিন উঠে দেখি। হুঁকাটি বাড়ায়ে রয়েছে দাঁড়ায়ে
ব্যাটা বুদ্ধির চেঁকি।
৪৪৭
প্রসন্ন মুখ, নাহি কোনো দুখ,
অতি অকাতর চিত্ত। ছাড়ালে না ছাড়ে, কি করিব তারে,
মোর পুরাতন ভৃত্য।
“ব্যাটা বুদ্ধির টেকি” কথাটার গায়ে কি অমৃত মাখিয়ে দেওয়া হয়েছে!
অজিতবাবু যে বলেছেন, চিত্রাতে আর চৈতালিতে রবীন্দ্রনাথের কাব্য-জীবনে খুব বড় একটা সম্পূর্ণতা লাভ হয়েছে, সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই। চৈতালির সনেটগুলো বেশি প্রশংসাযোগ্য এইজন্যে যে, এর অনেকগুলোতে গভীর জ্ঞান অতি অল্প কথায় সুন্দর রূপ নিয়ে ফুটে উঠেছে। কবির মানস-প্রকৃতি যে এখন কত সবল তার পর্যাপ্ত পরিচয় রয়েছে এই চৈতালির সনেটগুলোর ভিতরে।
এইবার চিত্রার “অন্তর্যামী,’ ‘জীবনে-দেবতা’ প্রভৃতি সুবিখ্যাত কবিতা সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করবার সময় এসেছে। রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন-দেবতা’কে নিয়ে তার সমালোচকরা যথেষ্ট গোলমালে পড়ে গেছেন। আমাদের কাছে কিন্তু ব্যাপারটি অত গোলমেলে বলে মনে হয় না। আমরা সোজা কথায় বলতে চাই, রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতার অর্থ রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা। অবশ্য প্রতিভা বললেই যে কথাটি খুবই পরিষ্কার করে বলা হল, তা নয়। তবে, এ-কথাটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত; আর আমাদের সবারই অল্পবিস্তর জানা আছে যে, ‘অপূর্ব; ‘অপরূপ, নবনবোন্মেষশালিনী,’ এই সমস্ত হচ্ছে এর বিশেষণ।
ইতিহাসে দেখা যায়, প্রতিভাবানেরা প্রায়ই নিজেদের অন্তর্নিহিত শক্তি সম্বন্ধে সজাগ। সর্বসাধারণের ভিড়ে তারা যে বেমালুম খাপ খেয়ে যেতে পারেন না, এ-কথাটি নিজের মনে তারা ভালো রকমই জানেন, আর নিজেদের অন্তর্নিহিত এই সত্যকে তাঁরা পরম যত্নেই লালন করেন। মানসী’তে তার কিছু পরিচয় আমরা পেয়েছি। (নিন্দুকের প্রতি, পরিত্যক্ত ইত্যাদি)। তাই আমাদের মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্তরে-শায়িত এই অসাধারণত্বকে পরম যত্নে আর পরম বেদনায় বহন করে আনতে আনতে শেষে পূর্ণ। যৌবনে অনেকটা পুরোপুরি দেখতে পেয়েছেন, কি তার স্বরূপ
একি কৌতুক নিত্য-নূতন।
ওগো কৌতুকময়ী! আমি যাহা-কিছু চাহি বলিবারে
বলিতে দিতেছ কই?
* *
নূতন ছন্দ অন্ধের প্রায় ভরা আনন্দে ছুটে চলে যায়, নূতন বেদনা বেজে উঠে তায়
৪৪৮
নূতন রাগিণীভরে। যে-কথা ভাবিনি বলি সেই কথা, যে-ব্যথা বুঝি না জাগে সেই ব্যথা, জানি না এসেছি কাহার বারতা
কারে শুনাবার তরে।
মানুষের ধর্ম, সভ্যতা, বিজ্ঞান, ইতিহাস সব-কিছুই এক অদ্ভুত অনুসন্ধান,-অন্ধের মতন মানুষ হাড়িয়ে হাড়িয়ে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে চলেছে এক পথ থেকে অন্য পথে, লক্ষ্য থেকে লক্ষ্যান্তরে। বিশ্বমানবের সেই পরমরহস্যপূর্ণ বিরাট অনুসন্ধিৎসা এমন অল্প পরিসরে এই এশিয়ার এক কোণের কবির অন্তরে কেমন করে সজীবতা লাভ করতে পারল, সেই তত্ত্বকে উদঘাটিত করতে পারি এমন ক্ষমতা আমাদের নেই। রবীন্দ্রনাথকে যে বিশ্বকবি অর্থাৎ বিশ্বভাবের কবি আখ্যা দেওয়া হয়েছে, বাস্তবিকই তা অতিরঞ্জন নয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে
সোনার তরী, চিত্রা ও চৈতালিতে কবি-প্রতিভার এক পূর্ণ, সৌন্দর্য-তন্ময়, আত্মপ্রকাশের পর “কল্পনা”তে দেখি-কবির নূতন চেহারা। এমন এক অবস্থার দ্বারদেশে কবি এসে দাঁড়িয়েছেন, যার পুরো পরিচয় তিনি অবগত নন, কিন্তু পিছনে ফেলে-আসা ঐশ্বর্যের পানে চেয়ে আর তিনি তৃপ্তি পাচ্ছেন না।
তার এই অবস্থার ছবিটি কত সুন্দরভাবে ফুটে রয়েছে কল্পনার প্রথম কবিতাটিতে
যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দমস্থরে, সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া, যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে, যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া, মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে, দিক্দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা,
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ বন্ধ কোরো না পাখা।
* বিশ্বকবির অন্য অর্থও আছে; অর্থাৎ তিনিই বিশ্বকবি যিনি বিশেষ কোনো জাতি বা দেশের দুঃখ ব্যথার
কবি নন। এ কথাটি কতকটা অর্থহীন। “বিশেষ”কে নিয়েই কাব্য-তার উপর বিশ্বের দ্যুতি আপনা থেকে প্রতিফলিত হয়। এক হিসেবে সত্যিকার কবি-মাত্রকেই বলা যেতে পারে বিশ্বকবি
অর্থাৎ বিশ্বের কবি।
৪৪৯
এই “কল্পনা”-কাব্যখানিও যে কল্পনার সৌন্দর্যের দিক দিয়ে পাঠ করা না যায় তা নয়; তবে সমগ্র রবীন্দ্র-কাব্য-সাহিত্যের সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে তারা এর ভিতরকার সাধক-হৃদয়টির খবর একটু বেশী না নিয়ে পারেন না। তাছাড়া সাধক-রবীন্দ্রনাথের গৌরব কবি-রবীন্দ্রনাথের গৌরবের চাইতে একটুও কম নয়। তাই এই দ্বিতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের কাব্যালোচনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনার ক্রম একটু বুঝতে আমরা চেষ্টা করব।
প্রথম কবিতাটি আংশিক উদ্ধৃত হয়েছে। এর “ভ্রষ্ট লগ্ন” কবিতাটি অতি বিখ্যাত। যে বিফল প্রতীক্ষার ছবি কবি এঁকেছেন কি-এক শান্ত অথচ নিবিড় বেদনা তার অন্তরে!
ফাগুন যামিনী, প্রদীপ জ্বলিছে ঘরে, দখিন বাতাস মরিছে বুকের পরে। সোনার খাঁচায় ঘুমায় মুখরা শারী, দুয়ার-সমুখে ঘুমায়ে পড়েছে দ্বারী। ধূপের ধোঁয়ায় ধূসর বাসর-দেহ। অগুরু-গন্ধে আকুল সকল দেহ। ময়ূরকণ্ঠী পরেছি কাঁচলখানি, দূর্বাশ্যামল আঁচল বক্ষে টানি। রয়েছি বিজন রাজপথপানে চাহি, বাতায়ন-তলে রয়েছি, ধূলায় নামি ত্রিযামা যামিনী একা বসে গান গাহি,
“হতাশ, পথিক, সে যে আমি, সেই আমি।”
এর “ভিখারী,”
“বিদায়” প্রভৃতি কবিতায়ও এমনি বেদনার সুর বাজছে। কবির জীবন-যন্ত্রে যে নতুন সুর বাঁধা হচ্ছে, এ তারই বেদনা।
কিন্তু বেদনা-বোধই এ-কাব্যের শেষ কথা নয়। “অশেষ” কবিতায় সব বেদনা সরিয়ে রেখে কবি এক সুস্পষ্ট আহ্বান কানে শুনছেন
মাঠের পশ্চিম শেষে অপরাহ্ন ম্লান হেসে
হল অবসান, পরপারে উত্তরিতে
তা দিয়েছি তরণীতে আবার আহ্বান?
তাঁর সমস্ত অবসাদ চূর্ণ করে তাঁর জীবন-দেবতা বড় নির্মমভাবে তাঁকে সামনে টানছেন
ওরে রক্ত-লোভাতুরা
রে মোহিনী, রে নিষ্ঠরা,
৪৫০
কঠোর স্বামিনী, দিন মোর দিনু তোরে। শেষে নিতে চাস হরে
আমার যামিনী?
এ-সব কথার সামনে শুধু কাব্যের সৌন্দর্য উপভোগের আকাঙ্ক্ষা আপনা থেকে সঙ্কুচিত হয়ে যায়। যে কবি-কীর্তি নিয়ে সাধারণত কোনো বড় কবি নিজেকে অগৌরবান্বিত মনে করবেন না, তারই শীর্ষে দাঁড়িয়ে ইনি বলছেন-”শেষে নিতে চাস হরে আমার যামিনী?”-বারবার এমন নির্মম আঘাত লাভ করবার সৌভাগ্য কত অল্প লোকের জীবনে ঘটে।
কিন্তু সবচাইতে লক্ষ্যযোগ্য এর “বর্ষশেষ” কবিতাটি। ঝড়ের বর্ণনা হিসেবেও এ-কবিতাটি সুন্দর। ঝড়ের আয়োজন, তার ভ্রুকুটি, তার ক্রন্দন, তার উল্লাস আর শেষে তার বিরতি অদ্ভুত ছন্দোবন্ধে আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু কবির আত্মার যে আগুন এর ভিতরে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে, কি ছার ঝড়ের সৌন্দর্য তার কাছে! “এবার ফিরাও মোরে” প্রভৃতি কবিতায় দেখেছি, কবির অন্তরে শায়িত “মহাজীবন” সচেতন হয়ে উঠেছে। এই “বর্ষশেষ” কবিতায় দেখছি, তার যে দ্বিধা-সঙ্কোচ ও অবসাদটুকু এখনো বাকি আছে, তা যেন ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। যার দর্শনে তাঁর এতদিনের প্রতীক্ষা অসাধারণভাবে সার্থক হয়েছে আশ্চর্য তার রূপ! কবি তাঁকে প্রণাম নিবেদন করছেন এই ভাবে :
হে দুর্দম, হে নিশ্চিত, হে নূতন নিষ্ঠুর নূতন,
সহজ প্রবল। জীর্ণ পুষ্পদল যথা ধ্বংস ভ্রংশ করি চতুর্দিকে
বাহিরায় ফল পুরাতন পর্ণপুট দীর্ণ করি বিকীর্ণ করিয়া
অপূর্ব আকারে তেমনি সবলে তুমি পরিপূর্ণ হয়েছে প্রকাশ
প্রণমি তোমারে।
প্রত্যেকটি বিশেষণ, প্রায় প্রত্যেকটি শব্দ, এখানে যে নতুন নতুন অর্থ প্রকাশ করেছে, অভিধানে তার কতটুকু পাওয়া যায়! ‘অনুভব” যে না করতে চায় সেই বা তার কতটুকু গ্রহণ করতে পারে!
কিন্তু আশ্চর্য এর শক্তি! একেবারে বদ্ধ-হৃদয় ভিন্ন হয়ত কথাগুলো আর কারো কাছ থেকেই ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবে না।
শেলির Ode to The West Wind-এর সঙ্গে এই কবিতাটি মিলিয়ে পড়া যেতে পারে। দুই কবিতায়ই ঝড় প্রবল আকারে দেখা দিয়েছে। কিন্তু শেলি ঝড়কে বলছেন
৪৫১
Be through my lips to unawkened earth The trumpet of a prophecy!
আর রবীন্দ্রনাথ বলছেন
লাভ-ক্ষতি টানাটানি, অতি সূক্ষ্ম ভগ্ন অংশ ভাগ,
কলহ সংশয়, সহে না সহে না আর জীবনের খণ্ড খণ্ড করি’
দণ্ডে দণ্ডে ক্ষয়
শোনসম অকস্মাৎ ছিন্ন করে ঊর্ধ্বে ল’য়ে যাও
পঙ্ক-কুণ্ড হতে মহান্ মৃত্যুর সাথে মুখামুখি করে দাও মোরে
বজ্রের আলোতে।
“বর্ষশেষ”, “বৈশাখ” প্রভৃতি কবিতায় “মহাজীবনে”র (কবির ভাষায় “বড় আমি”র) তপঃক্লিষ্ট’ সুষমা চোখ ভ’রে দেখে নেবার পর কবির ভবিষ্যৎ তার চোখে কি চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়েছে “রাত্রি” কবিতাটিতে তার ইঙ্গিত রয়েছে
তোমার তিমির তলে যে বিপুল নিঃশব্দ উদ্যোগ
ভ্রমিতেছে জগতে জগতে আমারে তুলিয়া লও সেই তার ধ্বজচক্রহীন
নীরব-ঘর্ঘর মহারথে।
বড় মহিমামণ্ডিত ধ্যান-গম্ভীর মূর্তি কবির মনে জেগে উঠেছে।
স্তম্ভিত তমিস্রপুজ কম্পিত করিয়া অকস্মাৎ
অর্ধরাত্রে উঠেছে উচ্ছ্বাস সদ্যস্ফুট ব্ৰহ্মমন্ত্র আনন্দিত ঋষিকণ্ঠ হতে
আন্দোলিয়া ঘন তন্দ্রারাশি। পীড়িত ভুবন লাগি’ মহাযোগী করুণাকাতর
চকিতে বিদ্যুৎ-রেখাবৎ তোমার নিখিল-লুপ্ত অন্ধকারে দাঁড়ায়ে একাকী
দেখেছে বিশ্বের মুক্তি-পথ।
৪৫২
তার কল্পনাও কত মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে! এই রাত্রিকেই তিনি বলছেন
নক্ষত্র-রতন-দীপ্ত নীলকান্ত সুপ্তি-সিংহাসনে
তোমার মহা জাগরণ।
বাস্তবিক রবীন্দ্র-প্রতিভার এই এক আশ্চর্য ক্ষমতা আমরা উপলব্ধি করি যে, তিনি নিজের চেতনা দিয়ে সর্বমানবের পরম সূক্ষ্ম চেতনার সঙ্গেও আত্মীয়তা করবার, আর তার ললিত কণ্ঠে সে-সব প্রকাশ করবার, এক অসাধারণ ক্ষমতা রাখেন। অবশ্য কবি প্রতিভার অর্থই কতকটা তাই বিশেষ করে গীতি-কবি-প্রতিভার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথে সেই গীতি-কবি-প্রতিভারও এক পরম অসাধারণ বিকাশই দেখতে পাই। নবীন প্রেমিক-প্রেমিকার আশা-সুখ-ব্যথা নিবিড় হয়েই যার বাঁশীতে এক কালে বেজেছিল, তিনিই এখন বাজাচ্ছেন মহাযোগীর পরমনিগূঢ় বেদনার সুর!-আর এই-ই তার বাশীর শেষ সুর নয়!
রবীন্দ্রনাথ যে কবি-শেখরের মুখে নিজের রচনা সম্বন্ধে বলেছেন, “আমার এসব জিনিস বাশীর মতে-বুঝবার জন্যে নয়, বাজবার জন্যে”, তাঁর কাব্য সম্বন্ধে এর চেয়ে সুন্দর বর্ণনা আর দেওয়া যায় না। বুঝবার কথা নিশ্চয়ই তাঁর কাব্যে ঢের আছে; কিন্তু সব বোঝা, সব জ্ঞান, আনন্দ, বিষাদ, প্রেম, নৈরাশ্য, সাধনা,-এ সমস্তের অতি ক্ষুদ্রতম কথাও, তাঁর কাব্যে কেমন বাঁশীর সুরের নিবিড়তা আর অব্যর্থতা নিয়েই বাজে! “ক্ষণিকা”র সময় থেকে তাঁর এ ক্ষমতায় যে অপূর্ব জেগেছে-গীতঝঙ্কারের অপূর্ব জেগেছে-এক হাফিজ ছাড়া আর কোনো গীতি-কবির ভিতরে সেটি প্রত্যক্ষ করবার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি।
কথা “কল্পনায় যে সহজ প্রবল সত্যের রূপ কবির চোখ বেঁধে দিয়ে গেল, “কথা” কাব্যে দেখছি-তারই সঙ্গে কবির বার বার মুখোমুখি হচ্ছে। ভারতের পুরাণে ইতিহাসে যাঁরা জীবনের রহসোদ্ঘাটনের তপস্যা করেছেন, ক্ষুদ্র স্বার্থের কারাগারে বদ্ধ হয়ে পলে পলে যে নিদারুণ আত্মহত্যা, তার হাত থেকে উদ্ধার করে ক্ষতির, ত্যাগের, সময় সময় মৃত্যুর রাজটীকা পরিয়ে জীবনকে যারা সুন্দর করেছেন, তাঁদের দৃষ্টান্ত এক নূতন মহিমা নিয়ে কবির সামনে দাঁড়িয়েছে। অতীত তাঁর কাছে আর অতীত নয়। অতীত ইতিহাসে দীপ্যমান দেখছেন যে “মহাজীবন” তারই স্পন্দন কবি নিজের ভিতরে অনুভব করতে পারছেন বলেই এর অল্প কিছুকাল পরের একটি কবিতায় অতীতকে বলতে পেরেছেন
কথা কও কথা কও। স্তব্ধ অতীত হে গোপনচারী,
অচেতন তুমি নও।
৪৫৩
“কথা” কাব্যখানির প্রায় সব কবিতাই সুন্দর। “প্রতিপাদ্যে”রই মহিমা আছে. ক উপর লেখক অসাধারণ কুশলী; কাজেই “প্রবন্ধ”
“মহত্তর” তো হবেই। রবীন্দ্রনাথের এই কাব্যখানি বোধ হয় সব চেয়ে বেশি জনপ্রিয়।
গাথা (Ballad) হিসেবে এর শেষের দিকের কবিতাগুলোই (অপমান বর, স্বামী লাভ, বন্দী বীর, নকল গড়, হোরি খেলা, বিবাহ ইত্যাদি) উৎকৃষ্ট। আর এ সমন্তের মধ্যে “হোরিখেলা” কবিতাটি অতি উঁচু দরের Ballad. Ballad-এর বিশেষত্ব তার সরল সরলতায়। এই জিনিসটিই এই কবিতায় পুরোপুরি দেখতে পাওয়া যায়। আর এর ছন্দ বড় সুন্দর-যোদ্ধার হোরি-খেলার ছন্দই বটে।
পত্র দিল পাঠান কেসর খারে
কেতুন হ’তে ভুনাগ রাজার রাণী, লড়াই করি আশ মিটেছে মিঞা? বসন্ত যায় চোখের উপর দিয়া, এস তোমার পাঠান সৈন্য নিয়া
হোরি খেব আমরা রাজপুতানী। যুদ্ধে হারি’ কোটা-সহর ছাড়ি’
কেতুন হতে পত্র দিল রাণী।
কিন্তু “কথা”র পরিশোধ কবিতাটিই হয়ত এর সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা-রবীন্দ্রনাথের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতাসমূহের অন্যতম। এই কবিতা সংস্পর্শে নীতির কথা কেউ তুললে আশ্চর্য হবে না; এর বিশেষতও সেইখানেই। কবি-দষ্টি যে কি অসাধারণ, প্রায় সর্বভেদী, প্রচলিত নীতি-রুচি, মত-বিশ্বাস ইত্যাদির স্থূলতা সে দৃষ্টির সামনে যে কেমন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, সত্য আপনার উলঙ্গ মহিমায় সুপ্রকট হয়, এ কবিতাটিতে তার আশ্চর্য পরিচয় রয়েছে। এর যে জায়গায় শ্যামা বলছে
……..বালক কিশোর উত্তীয় তাহার নাম, ব্যর্থ প্রেমে মোর উন্মত্ত অধীর। সে আমার অনুনয়ে তব চুরি-অপবাদ নিজ স্কন্ধে লয়ে দিয়েছে আপন প্রাণ। এ জীবনে মম সর্বাধিক পাপ মোর, ওগো সর্বোত্তম, করেছি তোমার লাগি এ মোর গৌরব।
সেখানে বসেন যদি
কি কহিলি পাপিয়সী.. ……….চাহি না আর তোরে
৪৫৪
বলে’ নাটকীয় ভঙ্গিতে পদাঘাত করে চলে যেত আর সেখানেই যবনিকা-পতন হ’ত, তাহলে এক শ্রেণীর সমঝদারদের কাছ থেকে হয়ত হাততালির আর অন্ত থাত না। কিন্তু কবির প্রাণপুরুষ লজ্জার দুরূহ ভারে পিষ্ট হয়ে যেত।-স্থূলদৃষ্টি যে সেই কেবল জানে, পাপ আর পুণ্য দুই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বস্তু। দৃষ্টিমাণ প্রত্যক্ষ করে, ভালো মন্দ পাপ-পুণ্য সমস্তের ভিতর দিয়ে চলেছে মানুষেরই জয়যাত্রা। সে-যাত্রা-পথে, মোহদুর্বলতার সহস্র কুশাঙ্কুরে নিত্য-বিদ্ধ মানুষের চরণতল; মানুষের সে-বেদনা পরম দরদী কবি যদি না বুঝবেন তবে আর বুঝবে কে?
ক্ষণিকা
“কল্পনায় কবি-হৃদয়ের যে-বেদনা উপলব্ধি করেছি, ‘কথা’র মহাজনদের অমৃতস্পর্শ লাভ করেও কবির অন্তরের সে বেদনা প্রশমিত হয়ে যায় নি। কিন্তু এই ক্ষণিকা কাব্যে সে-বেদনা রয়েছে নিচে। সেই ব্যথার মৃণালের উপর তার প্রতিভাপদ্ম যে-ভাবে পাপড়ি খুলে দাঁড়িয়েছে, অপূর্ব তার সৌন্দর্য আর সৌরভ। ব্যথা, বিবেচনা, সমস্যা, সন্ধান-সব সরিয়ে দিয়ে ক্ষণ-প্রকাশের বুকে মুহূর্তে মুহূর্তে যে-অমৃত ফুটে উঠছে, কবি তাই চোখ ভরে দেখছেন, আর প্রাণ ভরে উপভোগ করছেন
ওরে থাক্ থাক্ কাঁদনি! দুই হাত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দেরে
নিজ হাতে বাধা বাঁধনি! যে সহজ তোর রয়েছে সমুখে আদরে তাহারে ডেকে নেরে বুকে, আজিকার মতো যা যা চুকে
যত অসাধ্য সাধনি!
ক্ষণিক সুখের উৎসব আজি,
ওরে থাক্ থাক্ কাঁদনি!
প্রকাশ-ভঙ্গিমা কত শাণিত!-এপর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ যত কাব্য লিখেছেন, তার মধ্যে নিছক গীতিকবিতা হিসেবে এই ক্ষণিকার কবিতাগুলি আমাদের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়। সরল চটুল ভঙ্গিতে কবি কথা বলছেন, অথচ তারই ফাঁকে-ফাঁকে কবি হৃদয়ের অন্তস্থলে চেয়ে দেখবার সুযোগ আমাদের যখন ঘটছে, তখন দেখতে পাওয়া
Dante-এর Divine Comedyর Francesca ও Paolo র অতি করুণ কাহিনী এই সম্পর্কে স্মরণীয়।
৪৫৫
যাচ্ছে, কি গভীরতা থেকে তার কথা উৎসারিত, আর অনেক সময়েই কেমন বেদনাভরা সেই গভীরতা।
ওমর খৈয়ামের সঙ্গে এখানে রবীন্দ্রনাথের তুলনা চলে। তবে ওমরের মতো জীবনের অতি গুরুতর সমস্যাগুলোর কোনো মীমাংসা করতে না পেরে “ভাগ্য-দেবীর ক্রর পরিহাস পেয়ালা ভরে ভুলবার চেষ্টাই এখানে কবির সবখানি কথা নয়। এখানে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গিমার বেশি মিল বরং হাফিজের সঙ্গে।
ক্ষণিকার বহু পরে শিশুভোলানাথ প্রভৃতি কাব্যে কবির “সহজে”র সাধনা পুরোপুরিই আমরা দেখতে পাই। এই ক্ষণিকায় তারই পূর্বসূচনা সত্যকে সব বাহুল্যের আবর্জনা থেকে মুক্ত করে, এমন সহজরূপে প্রকাশ করবার ক্ষমতা এর আগে রবীন্দ্রনাথে দেখা যায় নি। কণিকায় এর সামান্য আভাস আছে; কিন্তু ক্ষণিকায় সহজ সুন্দরের লীলা যে ভাবে দলের পর দলে খুলে যেতে চাচ্ছে, বাস্তবিকই তা অপূর্ব। প্রকৃতির সৌন্দর্য-বর্ণনায়ও কবির এই সহজ ভঙ্গি
আমি ভালোবাসি আমার
নদীর বালুচর, শরৎকালে যে নির্জনে
চখাচখির ঘর। যেথায় ফুটে কাশ তটের চারি পাশ শীতের দিনে বিদেশী সব হাঁসের বসবাস। কচ্ছপেরা ধীরে রৌদ্র পোহায় তীরে দু’একখানি জেলের ডিঙি সন্ধ্যেবেলায় ভিড়ে।
ক্ষণিকার ‘মাতাল’ কবিতাটি বিখ্যাত। জীবনের সব জটিলতা দুর্ভাবনা, সরিয়ে দিয়ে হৃদয়াবেগের সহজ পথে চলার যে সত্য কবির চোখে ফুটে উঠতে চাচ্ছে, তাই-ই ঝঙ্কার দিয়ে উঠেছে এই কবিতায়
পাড়ার যত জ্ঞানীগুণীর সাথে
নষ্ট হ’ল দিনের পর দিন, অনেক শিখে পক্ হল মাথা,
অনেক দেখে দৃষ্টি হল ক্ষীণ, কত কালের কত মন্দ ভালো
বসে বসে কেবল জমা করি,
৪৫৬
ফেলা-ছড়া ভাঙা-ঘেঁড়ার বোঝা
বুকের মাঝে উঠছে ভরি ভরি, গুঁড়িয়ে সে-সব উড়িয়ে ফেলে দিক
দিক্-বিদিকে তোদের ঝোড়ো হাওয়া!
বুঝেছি ভাই সুখের মধ্যে সুখ। মাতাল হয়ে পাতাল পানে ধাওয়া!
যুগল কবিতাটিতে সত্যের সন্ধান কি অব্যর্থ! জায়গায় জায়গায় Browning-এর The Last Ride Together মনে করিয়ে দেয়
স্বয়ং যদি আসেন আজি দ্বারে মান্ব নাক রাজার দারোগারে, কেল্লা হ’তে ফৌজ সারে সারে
দাঁড়ায় যদি ওঁচায় ছোরাছুরি, বলব, রে ভাই, বেজার কোরো নাকো, গোল হতেছে একটু থেমে থাকো, কৃপাণ-খোলা শিশুর খেলা রাখো
ক্ষ্যাপার মতো কামান-ছোঁড়াছুঁড়ি! একটুখানি সরে গিয়ে করো সঙের মতো সঙীন, ঝমঝমর, আজকে শুধু একবেলারই তরে
আমরা দেহে অমর দোঁহে অমর!
হৃদয়ের আবেগ যে অসত্য নয়, সৌন্দর্যের উপলব্ধির যে কোন সত্যের কাছেই মাথা হেঁট করবার প্রয়োজন করে না, ‘অতিবাদ’ কবিতাটিতে কত স্বচ্ছন্দচিত্তে কবি সে কথা বলতে পারছেন
আজ বসন্তে বিশ্বখাতায় হিসেব নেইক পুষ্পে পাতায়, জগৎ যেন ঝোঁকের মাথায়
সকল কথাই বাড়িয়ে বলে,
*
*
মা দর পিয়ালে আকসে রোখে ইয়ার দিদায়েম। আয় বেখবর জেলজ্জতে শুরবে মুদামে মা ॥ হাফিজ। আমাদের নিরন্তর-পান-সুখে ওরে বঞ্চিত, শোন্, আমরা আমাদের পেয়ালার ভিতরে। প্রিয়তমের মুখ প্রতিবিম্বিত দেখেছি।
৪৫৭
প্রিয়ার পুণ্যে হলেম রে আজ একটা রাতের রাজ্যাধিরাজ, ভাণ্ডারে আজ করছে বিরাজ
সকল প্রকার অজস্রত্ব! কেন রাখব কথার ওজন? কৃপণতায় কোন প্রয়োজন? ছুটুক বাণী যোজন যোজন
উড়িয়ে দিয়ে ষত্ব ণত্ব!
হাফিজের ‘দিউয়ান’ যাদের প্রিয় তারা ক্ষণিকা’র এইরকম বহু কবিতায় তার ঝঙ্কার অনুভব করবেন। কিন্তু দুয়ের পার্থক্যও লক্ষ্য করবার যোগ্য। মিলনের যে সৌন্দর্য, আবেগ, আনন্দ, তাই দিউয়ানের স্থায়ীভাব। ক্ষণিকায়ও মাঝে মাঝে এসব চিকমিক করে ওঠে। কিন্তু একে অপূর্ব করেছে, এর সব সৌন্দর্য-বোধ, আবেগ, আর স্কৃর্তির তলদেশে লুকায়িত যে বেদনা। কতকগুলো কবিতায় দেখা যাচ্ছে, কবি সে বেদনা আর লুকিয়ে রাখতে পারছেন না।
গভীর সুরে গভীর কথা
শুনিয়ে দিতে তোরে
সাহস নাহি পাই। মনে মনে হাসবি কি না।
বুঝ কেমন করে? আপনি হেসে তাই।
শুনিয়ে দিয়ে যাই; ঠাট্টা করে ওড়াই সখি
নিজের কথাটাই। হাল্কা তুমি করো পাছে
হাল্কা করি ভাই আপন ব্যথাটাই।
আর পরামর্শ কবিতায় কবির অশ্রু যেন আর রোধ মানতে চাচ্ছে না।
অনেক বার তো হাল ভেঙেছে,
পাল গিয়েছে ছিঁড়ে,
ওরে দুঃসাহসী! সিন্ধু পানে গেছিস্ ভেসে
অকূল কালো নীরে
৪৫৮
ছিন্ন রশারশি। এখন কি আর আছে সে বল?
বুকের তলা তোর
ভরে উঠছে জলে। অশ্রু সেঁচে চবি কত
আপন ভারে ভোর
তলিয়ে যাবি তলে।
কবি নিজেকে সমঝাচ্ছেন, এখন না হয় তরী ঘাটেই বাঁধা থাকুক, আর কাজ কি দুঃসাহসে ভর করে নতুন যাত্রা করা?
এবার তবে ক্ষান্ত হ’রে
ওরে শ্রান্ত তরী।
রাখরে আনাগোনা। বর্ষ-শেষের বাঁশি বাজে
সন্ধ্যা-গগন ভরি’
ঐ যেতেছে শোনা।
কিন্তু মিছে প্রবোধ দেওয়া
হায়রে মিছে প্রবোধ দেওয়া,
অবোধ তরী মম
আবার যাবে ভেসে। কর্ণ ধ’রে বসেছে তার
যমদূতের সম
স্বভাব সর্বনেশে। ঝড়ের নেশা ঢেউয়ের নেশা ছাড়বে নাকো আর,
হায় রে মরণ-লুভী। ঘাটে সে কি রৈবে বাধা,
অদৃষ্টে যাহার আছে নৌকাডুবি।
::
–:
–
–
. .
এর সঙ্গে এবার ফিরাও মোরে” কবিতা মিলিয়ে পড়লে এর বিশিষ্টতা সহজেই অনুভব করা যায়। এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় রয়েছে দূর থেকে কবি যে মৃত্যুভীষণ মহাজীবনের কল্লোল শুনতে পেয়েছেন তারই ছন্দ। তাই বলেছি, এ তার
৪৫৯
প্রতিভা-নির্ঝরের আর-এক স্বপ্নভঙ্গ। কিন্তু সে-জীবন-পথে বহু দূর এগিয়ে করি যে বিষম “আকর্ষণ অনুভব করছেন, সেই সর্বনাশা আকর্ষণের টানে সামনে চলতে যে। অদ্ভুত আশঙ্কা ও বেদনা কবির চিত্তে জাগছে, তারই অপরূপ ছবি ফুটে উঠেছে এই কবিতায়! হাফিজও বলেছেন,
..ইশক আসান নমুদ আউয়ল
ওালে উক্তদা মোশূকে হা।
অথবা
শবে তারীখ ও বীমে মওজ
ও গিবৃন্দ আবে চুনিন হায়েল। কুজা দানন্দ হালে মা।
সুরক্সারানে সাহিলহা। কবির প্রেম-সাধনার এখন কি অবস্থা তার নির্দেশ রয়েছে এর শেষের দিকের “অন্তরতম” কবিতায়
আমি যে তোমায় জানি, সে তো কেউ
জানে না। তুমি মোর পানে চাও, সে তো কেউ
মানে না। মোর মুখে পেয়ে তোমার আভাস কত জনে কত করে পরিহাস,
পাছে সে না পরি সহিতে নানা ছলে তাই ডাকি যে তোমায়,
কেহ কিছু নারে কহিতে।
তোমার পথ যে তুমি চিনায়েছ
সে-কথা বলিনে কাহারে। সবাই ঘুমালে জনহীন রাতে
একা আসি তব দুয়ারে। স্তব্ধ তোমার উদার আলয়,
প্রথমে প্রেম বড় আরামের মনে হয়েছিল, কিন্তু শেষে দেখছি মুশকিল এসে পৌঁছেছে।
অন্ধকার রাত, ঊর্মিসংঘাত, ঘূর্ণাবর্ত ও তুমুল গর্জে,
বেলায় বাস বার বুঝবে ছাই তার পথের ক্লেশ মোর সমুন্দর যে।
– কবি নজরুল ইসলামের অনুবাদ।
৪৬০
বাণীটি বাজাতে মনে করি ভয়,
চেয়ে থাকি শুধু নীরবে। চকিতে তোমার ছায়া দেখি যদি
ফিরে আসি তবে গরবে। প্রভাত না হতে কখন আবার
গৃহ-কোণ মাঝে আসিয়া, বাতায়নে বসে বিহ্বল বীণা
বিজনে বাজাই হাসিয়া। পথ দিয়া যেবা আসে যেবা যায় সহসা থমকি চমকিয়া চায়,
মনে করে তারে ডেকেছি। জানে না তো কেহ কত নাম দিয়ে
এক নামখানি ঢেকেছি।
বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছে, পূর্বরাগের পালা শেষ, কবির চিত্ত এখন অনুরাগের রাঙা রাখীতে বাঁধা পড়ে গেছে।
এ ভিন্ন অন্য ধরণের কবিতাও ক্ষণিকায় আছে, আর কবির অভিনব বর্ণন-ভঙ্গিতে তারও অধিকাংশই সুন্দর কবিতা। এর বর্ষার কবিতাগুলি খুবই চমৎকার। বর্ষার অনেক সুন্দর কবিতা রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। তার মধ্যেও মানসী, সোনার তরী, আর ক্ষণিকার, বর্ষার কবিতা লক্ষ্যযোগ্য। বাস্তবিকই যেন কাজল মেঘের ছায়া পড়েছে এইসব কবিতার উপর। আর তাই তাদের চেহারায় কেমন তৃণপল্লবেরই নবীনতা।
ওগো আজ তোরা যাসনে গো তোরা
যানে ঘরের বাহিরে আকাশ আঁধার বেলা বেশী আর নাহিরে।
ঝরঝর ধারে ভিজিবে নিচোল, ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল,
ওই বেণুবন দুলে ঘনঘন
পথ পানে দেখ চাহিরে। ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে
ক্ষণিকার “নববর্ষা” কবিতাটি খুবই বিখ্যাত। এর সে খ্যাতি কোনোদিন যে ম্লান হবে তা মনে হয় না। Nightingale-এর গান শুনে যে আনন্দ Keats বলেছিলেন, My heart aches সেই অবশ-করা আনন্দের অনুভূতি রয়েছে এর ভিতরে; আর সেই আনন্দের গুরু ভারে ছন্দ বোঝাই নৌকার মতো কেমন ধিমিয়ে ধিমিয়ে চলেছে
৪৬১
হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে
ময়ূরের মত নাচে রে
হৃদয় নাচেরে। শত বরণের ভাব-উচ্ছ্বাস কলাপের মতো করেছে বিকাশ; আকুল পরাণ আকাশে চাহিয়া
উল্লাসে কারে যাচে রে।
হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে
ময়ুরের মতো নাচেরে। গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি
গরজে গগনে গগনে
গরজে গগনে। ধেয়ে চলে আসে বাদলের ধারা, নবীন ধান্য দুলে দুলে সারা, কুলায়ে কাঁপিছে কাতর কপোত,
দাদুরি ডাকিছে সঘনে। গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি’
গরজে গগনে গগনে।*
এর ক্ষতিপূরণ, প্রতিক্ষা, পথে, কবি, সোজাসুজি, একগায়ে প্রভৃতি খুবই লক্ষ্যযোগ্য কবিতা। কবির সহজের সাধনার কথা আগেই বলা হয়েছে; কত গভীর আর জটিল কথাও সহজ আর চটুল ভঙ্গিতে কবি প্রকাশ করতে পারেন এসবে তারই প্রচুর পরিচয় রয়েছে। বেশ হাল্কা ভাবেও এগুলো পড়া যেতে পারে; কিন্তু কবির দিকে একটুখানি স্থির দৃষ্টিতে চাইলেই বুঝতে পারা যায়, ফুর্তিবাজ তাকে যতই মনে হোক, আসলে, সোজা পাত্র তিনি নন
আমি নরের মহাকাব্য
সংরচনে ছিল মনে, ঠেল কখন তোমার কাঁকন
কিঙ্কিণীতে
কবি নিজে এই কবিতাটি যে ভাবে আবৃত্তি করেছেন তাতে আনন্দের ‘গুরুভার’ নয় ‘উচ্ছলতাই প্রকাশ পেয়েছে বেশি।
৪৬২
কল্পনাটি গেল ফাটি’
হাজার গীতে। মহাকাব্য সেই অভাব্য।
দুর্ঘটনায় পায়ের কাছে ছড়িয়ে আছে
কাণায়-কাণায়।
বাস্তবিক কবির দৃষ্টি এখন কত তীক্ষ্ণ, আর কত প্রসারিত তার হৃদয়, তার সুন্দর পরিচয় আমরা পাই এর “কবির বয়স” কবিতাটিতে
কেশে আমার পাক ধরেছে বটে,
তাহার পানে নজর এত কেন? পাড়ার যত ছেলে এবং বুড়ো
সবার আমি একবয়সী জেনো।
ওষ্ঠে কারো সরল সাদা হাসি,
কারো হাসি আঁখির কোণে-কোণে, কারো অশ্রু উছলে পড়ে যায়,
কারো অশ্রু শুকায় মনে-মনে, কেউবা থাকে ঘরের কোণে দোঁহে,
জগৎ-মাঝে কেউবা হাঁকায় রথ, কেউবা মরে একলা ঘরের শোকে,
জনারণ্যে কেউবা হারায় পথ। সবাই মোরে করেন ডাকাডাকি,
কখন শুনি পরকালের ডাক? সবার আমি সমান-বয়সী যে।
চুলে আমার যত ধরুক পাক।
নৈবেদ্য
কল্পনায় ও ক্ষণিকায় কবির ভিতরে যে নবজন্ম-সঞ্চারের বেদনা উপলব্ধি করেছি, নৈবেদ্য দেখা যাচ্ছে, সে-বেদনা কেমন একটু সার্থক হয়ে দেখা দিয়েছে স্পষ্টতর দৃষ্টিতে। কবি উপলব্ধি করছেন, সারাজীবন তিনি যেভাবে কাটিয়ে এসেছেন, যে-সব
৪৬৩
অনুভূতির ভিতর দিয়ে এসেছেন, তার কিছুই বৃথা নয়, মিথ্যা নয়। সেই সমস্তেরই সঙ্গে-সঙ্গে অপরূপও তাঁর ঘরে বহু বার প্রবেশ করেছেন
নির্জন শয়ন-মাঝে কালি রাত্রিবেলা
ভাবিতেছিলাম আমি বসিয়া একেলা গত জীবনের কত কথা। হেন ক্ষণে শুনিলাম, তুমি কহিতেছ মোর মনে; ওরে মত্ত, ওরে মুগ্ধ, ওরে আত্ম-ভোলা, রেখেছিলি আপনার সব দ্বার খোেলা, চঞ্চল এ সংসারের যত ছায়ালোক, যত ভুল, যত ধূলি, যত দুঃখ শোক, যত ভালো মন্দ, যত গীতগন্ধ লয়ে বিশ্ব পশেছিল তোর অবাধ আলয়ে। সেই সাথে তোর মুক্ত বাতায়নে আমি অজ্ঞাতে অসংখ্যবার এসেছিনু নামি। দ্বার রুধি’ জপিতি যদি মোর নাম কোন পথ দিয়ে তোর চিত্তে পশিতাম।
নৈবেদ্যের প্রথমে কতকগুলি প্রার্থনা-সঙ্গীত রয়েছে। পূর্ণাঙ্গ প্রার্থনার জন্য প্রয়োজন যে স্থির চিত্তের আর স্থির লক্ষ্যের রবীন্দ্র-প্রতিভায় এখন সেটি সম্ভবপর হয়েছে। এই প্রার্থনার ভিতর দিয়ে এগিয়ে যেতে-যেতে কবি অনুভব করেছেন, জাগ্রত আত্মার ভার বহন করা কত আয়াসসাধ্য! অথচ এ ভার বহনের প্রতি তাঁর পরম লোভ!
তোমার পতাকা যারে দাও, তারে
বহিবারে দাও শকতি। তোমার সেবার মহৎ প্রয়াস
সহিবারে দাও ভকতি। আমি তাই চাই ভরিয়া পরাণ দুঃখেরি সাথে দুঃখেরি ত্রাণ, তোমার হাতের বেদনার দান
এড়ায়ে চাহি না মুকতি! দুখ হবে মোর মাথার মাণিক
সাথে যদিও দাও ভকতি।
কিন্তু এ ভার-রোধ শেষে আর থাকছে না। আত্মার অপরূপ জ্যোতিই তাকে চমৎকৃত করছে
৪৬৪
দেহে আর মনে-প্রাণে হ’য়ে একাকার এ কি অপরূপ লীলা এ অঙ্গে আমার! এ কি জ্যোতি! এ কি ব্যোম্ দীপ্ত দীপ-জ্বালা দিবা আর রজনীর চির নাট্যশালা! এ কি শ্যাম বসুন্ধরা সমুদ্রে চঞ্চল, পর্বতে কঠিন, তরুপল্লবে কোমল, অরণ্যে আঁধার! এ কি বিচিত্র বিশাল অবিশ্রাম রচিতেছে সৃজনের জাল আমার ইন্দ্রিয়-যন্ত্রে ইন্দ্রজালবৎ! প্রত্যেক প্রাণীর মাঝে প্রকাণ্ড জগৎ। তোমারি মিলনশয্যা, হে মোর রাজন, ক্ষুদ্র এ আমার মাঝে অনন্ত আসন অসীম বিচিত্র কান্ত! ওগো বিশ্বভূপ দেহ মনে প্রাণে আমি এ কি অপরূপ?
এই নৈবেদ্য কাব্যখানিতে বেশি করে চোখে পড়ে কবির যোগীর ভাব-পরমমঙ্গলময়ের প্রতি তাঁর চিত্ত সব সময়ে উন্মুখ হয়ে আছে। তার এ যোগ যেন কিছুতেই ভাঙে না
কালি হাস্যে পরিহাসে গানে আলোচনে অর্ধরাত্রি কেটে গেল বন্ধুজন-সনে; আনন্দের নিদ্রাহারা শ্রান্তি ব’হে লয়ে ফিরি’ আসিলাম যবে নিভৃত আলয়ে দাঁড়াইনু আঁধার অঙ্গনে। শীতবায় বুলাল স্নেহের হস্ত তপ্ত ক্লান্ত গায় মুহূর্তে চঞ্চল রক্তে শান্তি আনি দিয়া।
মুহূর্তেই মৌন হ’ল স্তব্ধ হ’ল হিয়া নির্বাণপ্রদীপ রিক্ত নাট্যশালা সম। চাহিয়া দেখিনু ঊর্ধ্বপানে; চিত্ত মম মুহূর্তেই পার হয়ে অসীম রজনী।
দাঁড়াল নক্ষত্রলোকে। হেরিনু তখনি খেলিতেছিলাম মোরা অকুণ্ঠিত মনে তব স্তব্ধ প্রাসাদের অনন্ত প্রাঙ্গণে।
এই পরম সমাহিতচিত্ততার অবস্থায় এমন অনেক কথা তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে। ঋষিদৃষ্ট মন্ত্রের মতনই যা পূর্ণ আর অগ্নিগর্ভ। নৈবেদ্যের
৩০
৪৬৫
বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়’
-এমনই এক বাণী-বিশ্বমানবের কানে (বিশেষ করে তার অস্বাভাবিকতা-পীড়িত স্বদেশীয়দের কানে) এক বড় মন্ত্র।
এই মন্ত্রটি তাঁর সাধনার ধারার মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাঁর সমগ্র জীবনকে দু’ভাগ করে দেখাচ্ছে। একদিকে অসংখ্য-বন্ধন-মাঝে যে মুক্তির আনন্দ প্রচ্ছন্ন রয়েছে রবীন্দ্রনাথকে বারেবারে ঘুরে-ফিরে নানা পাকে বদ্ধ হতে দেখে আর সে-সব বন্ধন এড়িয়ে যেতে দেখে সে-কথার যোগ্য প্রমাণ আমরা পাই। অন্যদিকে গীতালিতে এই সত্যটি আরো গভীর করে উপলব্ধি করবার পর বলকা পলাতকা প্রভৃতি কাব্যে দেখতে পাই, দৃষ্টির অব্যর্থতা নিয়ে আনন্দময় কবি যেন স্বর্গ-মর্ত্য পরিভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন।
ভারত সম্বন্ধে সে-সমস্ত কবিতা এতে আছে, সে-সমস্তও এম্নি পূর্ণ আর বীর্যবান দষ্টির আলোকে ভাস্বর। ভারতের অতীত মহিমা, বর্তমান হীনতা দীনতা, আর ভবিষ্যতের লক্ষ্য, সমস্তই তাঁর যোগ-দৃষ্টিতে তিনি যেন মধ্যদিনের-আলোকে-দেখা চিত্রের মতো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন।
তাহারা দেখিয়াছেন-বিশ্বচরাচর ঝরিছে আনন্দ হ’তে আনন্দ নিঝর; অগ্নির প্রত্যেক শিখা ভয়ে তব কাঁপে, বায়ুর প্রত্যেক শ্বাস তোমারই প্রতাপে; তোমারি আদেশ বহি’ মৃত্যু দিবারাত চরাচর মর্মরিয়া করে যাতায়াত;
*
*
*
এ দুর্ভাগ্য দেশ হতে হে মঙ্গলময় দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছ ভয়, লোকভয়, রাজভয়, মৃত্যুভয় আর। দীন প্রাণ দুর্বলের এ পাষাণ-ভার, এই চির পেষণ-যন্ত্রণা, ধূলিতলে এই নিত্য অবনতি, দণ্ডে পলে-পলে এই আত্ম-অবমান, অন্তরে বাহিরে এই দাসত্বের রজ্ঞ, ত্রস্ত নতশিরে সহস্রের পদপ্রান্ততলে বারম্বার মনুষ্যমর্যাদাগর্ব চিরপরিহার এ বৃহৎ লজ্জারাশি চরণ-আঘাতে
৪৬৬
চূর্ণ করি’ দূর করো!
*
* *
* *
*
সে পরম পরিপূর্ণ প্রভাতের লাগি হে ভারত সর্বদুঃখে রহ তুমি জাগি সরলনির্মলচিত্ত; সকল বন্ধনে আত্মারে স্বাধীন রাখি’ পুষ্প ও চন্দনে আপনার অন্তরের মাহাত্ম-মন্দির সজ্জিত সুগন্ধি করি’, দুঃখশির তাঁর পদতলে নিত্য রাখিয়া নীরবে! তাহতে বঞ্চিত করে তোমায় এ-ভবে এমন কেহই নাই-সেই গর্বভরে সর্বভয়ে থাকো তুমি নির্ভয় অন্তরে তার হস্ত হতে লয়ে অক্ষয় সম্মান। ধরায় হোক না তব যত নিম স্থান। তাঁর পাদপীঠ করো সে আসন তব যার পাদরেণুকণা এ নিখিল ভব।
আরো লক্ষ্যে বিষয় এই যে, কবি এখানে মঙ্গলময় ঈশ্বরকে অন্তরে-অন্তরে অনুভব করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না। তাকেই তার চিত্তমন্দিরে পূর্ণ গৌরব প্রতিষ্ঠিত করে তারই সৈনিকরূপে সংসার-বক্ষে দৃঢ়পদক্ষেপে বিচরণ করতে চাচ্ছেন
ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা, হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হ’তে পারি তথা তোমার আদেশে! যেন রসনায় মম সত্য বাক্য ঝলি উঠে খর খড়গ সম তোমার ইঙ্গিতে! যেন রাখি তব মান তোমার বিচারাসনে লয়ে নিজ স্থান! অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।
বাস্তবিক ক্লৈব্যবিবর্জিত এক অসাধারণ বলীয়ান আত্মার সাক্ষাৎই আমরা এই নৈবেদ্য কাব্যের প্রায় সব জায়গায় পাই। আর এই জন্যই রবীন্দ্রনাথের এই কাব্যকে
৪৬৭
আমরা তার সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্যসমূহের অন্যতম বলে’ জ্ঞান করি। কাব্যের উৎকর্ষ সৃষ্টিতে: আমরা দেখতে পাচ্ছি, এক ওজস্বল জাগ্রত আত্মা সেই সৃষ্টিমহিমা লাভ করেছে এই কাব্যে।
নৈবেদ্য কাব্যখানি মুসলমান-পাঠকের কাছে বিশেষভাবে অর্থপূর্ণ; মঙ্গলের অভিমুখে এমন ক্লৈব্যবিবর্জিত অগ্রগতিই কোআনের ইসলামের প্রিয়।
ভাববিলাসী বাঙালির নিত্যপাঠ্য হওয়া উচিত এই কাব্য
যে ভক্তি তোমারে লয়ে ধৈর্য নাহি মানে, মুহূর্তে বিহ্বল হয় নৃত্যগীতগানে ভাবোদ মত্ততায়, সেই জ্ঞানহারা উদ্ভ্রান্ত উচ্ছল-ফেন ভক্তিমদ-ধারা নাহি চাহি নাথ!
দাও ভক্তি শান্তিরস, স্নিগ্ধ সুধা পূর্ণ করি’ মঙ্গল কলস
সংসার-ভবন-দ্বারে। যে ভক্তি-অমৃত সমস্ত জীবনে মোর হইবে বিস্তৃত নিগূঢ় গভীর,-সর্ব কর্মে দিবে বল, ব্যর্থ শুভ চেষ্টারেও করিবে সফল আনন্দে কল্যাণে। সর্বপ্রেমে দিবে তৃপ্তি, সর্ব দুঃখে দিবে ক্ষেম, সর্ব সুখে দীপ্তি দাহহীন।
সম্বরিয়া ভাব-অশ্রুনীর। চিত্ত রবে পরিপূর্ণ অমত্ত গম্ভীর।
কিন্তু এর শেষের দিকের দুটি প্রার্থনায় (৮৬,৮৭) দেখতে পাচ্ছি, আর এক সুর বাজছে কবির চিত্তবীণায়। ধ্যান তার হৃদয়ে চমৎকার উজ্জ্বলতা এনে দিয়েছে; তবু অন্তরের শুষ্কতা তার ঘুচছে না। সে উজ্জ্বলতা সময়ে যেন তাঁর পক্ষে “নিঃশব্দ দাহ”। তাই কবি প্রার্থনা করছেন
আমার এ মানসের কানন কাঙাল শীর্ণ শুষ্ক বাহু মেলি’ বহু দীর্ঘকাল আছে ক্রুদ্ধ ঊর্ধ্বপানে চাহি’! ওহে নাথ, এর রুদ্র মধ্যাহ্ন মাঝে কবে অকস্মাৎ
৪৬৮
পথিক পবন কোন দূর হ’তে এসে ব্যগ্র শাখাপ্রশাখায় চক্ষের নিমেষে কানে কানে রটাইবে আনন্দমর্মর, প্রতীক্ষায় পুলকিয়া বন বনান্তর!
এত ধ্যান-জ্ঞানের অন্তরে অন্তরে এই প্রতীক্ষার ব্যথা!-তপস্যার রুদ্র দহন প্রেমের বর্ষণই চায়।-বিধাতার অসাধারণ কৃপা এই কবির উপর।
আমাদের মনে হয়, নানা সংস্কার-জর্জরিত হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে রাজা রামমোহনের যে প্রতিবাদ আর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথে প্রতিফলিত বাঙালি-জীবনের যে নব ঈশপ্রাণতা, বাংলা সাহিত্যে তার এক বড় সার্থকতা লাভ হয়েছে এই নৈবেদ্য কাব্যে।
নৈবেদ্য প্রকাশিত হয় ১৯০১ সালে। এই ঘটনাও হয়ত নিরর্থক নয়
শতাব্দীর সূর্য আজি রক্তমেঘমাঝে
অস্ত গেল,-হিংসার উৎসবে আজি বাজে অস্ত্রে অস্ত্রে মরণের উন্মাদ রাগিণী ভয়ঙ্করী! দয়াহীনা সভ্যতা-নাগিনী তুলিছে কুটিল ফণা চক্ষের নিমিষে, গুপ্ত বিষদন্ত তা’র ভরি তীব্র বিষে।
আর বিংশ শতাব্দীর এই প্রারম্ভকে সামনে করে ভারতের এক প্রান্তে এক জাগ্রত আত্মা কবি প্রার্থনা করছেন
বীর্য দেহ, ক্ষুদ্র জনে করিতে হীন জ্ঞান,-বলের চরণে না লুটিতে; বীর্য দেহ, চিত্তের একাকী প্রত্যহের তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে দিতে রাখি। বীর্য দেহ তোমার চরণে পাতি শির। অহর্নিশি আপনারে রাখিবার স্থির।
* *
*
–
–
–
–
–
—
—–
—
–
–
–
–
–
শিশু
–
—
নৈবেদ্যর কিছুদিন পরে শিশু-কাব্য প্রকাশিত হয়। এই শিশুকাব্যের জন্মবৃত্তান্ত-সম্বন্ধে অজিত বাবু বলেন, পীড়িতা কন্যা, মাতৃহীন শিশু-পুত্র সমী কবির কাছে পিতার এবং
৪৬৯
মাতার উভয়েরই স্নেহ লাভ করত। সেই গভীর স্নেহ থেকে উৎসারিত এই কাব্যটি বাৎসল্য রসে পূর্ণ হয়ে উঠেছে।
শিশুকাব্য রবীন্দ্র-প্রতিভার এক অসাধারণ নিদর্শন সন্দেহ নেই। অজিতবাবু যে বলেছেন, এ সেই বৈষ্ণব মাধুর্যতত্ত্ব, ভগাবনকে যারা বাৎসল্য-রসের ভিতর দিয়ে দেখে তাদের সেই মাধুর্যের স্রোতটি এর মধ্যে আগাগোড়া প্রবাহিত, সে-কথাটি অনেক পরিমাণে সত্য। অনেক পরিমাণে বলছি এই শিশুকাব্যের বিশেষত্বের দিকে দৃষ্টি রেখে। বৈষ্ণব-সম্বন্ধে সাধারণ ধারণা এই যে তিনি ভগবানকে লাভ করে শিশুতে তার প্রকাশের আনন্দ উপলব্ধি করেন; অথবা গুরুর কাছ থেকে এ তত্ত্বের সন্ধান পেয়ে নিজের জীবনে তা প্রতিফলিত দেখতে প্রয়াস পান। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বেলায় দেখা যাচ্ছে, ভগবৎ-সাধানায়ও নিজের অন্তরের অনুভূতি আর সন্ধানের প্রদীপ তাকে পথ দেখাচ্ছে। তাই এ কাব্যে মাধুর্য-রসের সঙ্গে-সঙ্গে মিশে রয়েছে এক রহস্য-রস। কিন্তু তাতে কাব্য-হিসেবে এর গৌরব বেড়েছে বৈ কমেনি; কেননা আধুনিকের সামনে প্রসারিত যে জগৎক্ষেত্রে তা বহুল পরিমাণে বিরাটতর, আর সেই অসীমবৈচিত্র্যপূর্ণ বিরাট জগৎ-ক্ষেত্রের উপরে ক্ষুদ্র শিশু পরম রহস্যপূর্ণই বটে।
জগৎ-পারাবারের তীরে
ছেলেরা করে মেলা। অন্তহীন গগনতল। মাথার পরে অচঞ্চল, ফেনিল ওই সুনীল জল
নাচিছে সারা বেলা। উঠিছে তটে কি কালাহল
ছেলেরা করে মেলা।
এই কাব্যে কবি যেন তাঁর ভগবৎ-উপলব্ধির দ্বারদেশে দাঁড়িয়ে শিশুতে তার কেমন-এক ছটা প্রত্যক্ষ করছেন-যেন প্রভাত-সূর্যের কিরণ গাছের পাতা-ফেঁড়ির ফাঁকে-ফাঁকে তীক্ষ্ণ হয়ে এসে চোখে পড়ছে।
আগেকার ক্ষণিকার মধ্যে যে সহজ প্রকাশ-ভঙ্গিমা তার সঙ্গেও এর তফাৎ রয়েছে। ক্ষণিকার মধ্যে যে সহজ প্রকাশের লীলা সে জীবননান্দেরই এক বিচিত্র ভঙ্গিমা-ভগবৎ-অম্বেষণ তার তলে তলে লুকিয়ে রয়েছে বলে এই বিচিত্রতা। কিন্তু ‘শিশু’র ভিতরে ভগবৎ-দীপ্তি যেন কতকটা সোজাসুজি কবির চোখে-মুখে এসে পড়তে চাচ্ছে। তাই কবির কথাগুলো খুব সোজা আর মধুর, কিন্তু তারই সঙ্গে-সঙ্গে বাজছে কেমন এক অপরূপ সন্ধানের সুর
রঙিন খেলেনা দিলেও রাঙা হাতে তখন বুঝি রে, বাছা, কেন যে প্রাতে
৪৭০
এত রং খেলে মেঘে জলে রং ওঠে জেগে, কেন এত রং লেগে ফুলের পাতে রাঙা খেলা দেখি যবে ও রাঙা হাতে।
*
*
যখন নবীন দিই লোলুপ করে, হাতে মুখে মেখেচুকে বেড়াও ঘরে,
তখন বুঝিতে পারি স্বাদু কেন নদীবারি, ফল মধুরসে ভারী কিসের তরে, যখন নবনী দিই লোলুপ করে!
তবে,
‘সমব্যথী’ কবিতায় বালকের সহজ খেয়ালের অন্তরে কবির মনের কি এক তীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসা!
যদি খোকা না হয়ে আমি হতেম কুকুরছানা
পাছে তোমার পাতে আমি মুখ দিতে চাই ভাতে তুমি। করতে আমায় মানা?
সত্যি করে বল আমায় করিস নে মা ছল,
বতে আমায় ‘দূর দূর দূর!
কোথা থেকে এল এই কুকুর’?
যা’ মা তবে যা’ মা, আমায় কোলের থেকে নামা! আমি খাবো না তোর হাতে, আমি খাবো না তোর পাতে।
যদি থোকা না হয়ে আমি হতেম তোমার টিয়ে, তবে পাছে যাই মা উড়ে আমায় রাখতে শিকল দিয়ে?
সত্যি করে বল্ আমায় করিস্ নে মা ছল বলতে আমায় ‘হতভাগা পাখি, শিকল কেটে দিতে চায়রে ফাঁকি!
৪৭১
*
*
–
–
—
এর কতকগুলো কবিতায় বাৎসল্যরস জমাট হয়ে দেখা দিয়েছে
তোমার কটিতটের ধটি
কে দিল রাঙিয়া? কোমল গায়ে দিল পরায়ে রঙিন আঙিয়া!
বিহান বেলা আঙিনা-তলে
এসেছে তুমি কি খেলা-ছলে চরণ-দুটি চলিতে ছুটি
পড়িছে ভাঙিয়া।
তোমার কটিতটের ধটি কে দিল রাঙিয়া?
*
**
বাছারে তোর সবাই ধরে দোষ!
আমি দেখি সকল তাতে
এদের অসন্তোষ। খেতে গিয়ে কাপড়খানা
ছিড়েখুঁড়ে এলে, তাই কি বলে লক্ষ্মীছাড়া ছেলে?
ছি ছি কেমন ধারা! ভেঁড়া মেঘে প্রভাত হাসে
সে কি লক্ষ্মীছাড়া?
—
—
–
আর এর কতকগুলি কবিতা অতি সুন্দর ছড়া-ছছাটো-বড়, বীরপুরুষ, বলবান্, ইত্যাদি। সমস্ত শিশুকাব্যখানির ভিতরে একটি তাজা, চিরনবীন, রহস্যের সংস্পর্শে চিরচঞ্চল, প্রাণ ঝলমল করছে।
রবীন্দ্রকাব্যের বৈচিত্র্যের কথা ভাবলে বাস্তবিকই চমৎকৃত হতে হয়-চিরদিনই হয়ত সাহিত্যানুরাগীরা এই কথাটি ভেবে চমৎকৃত হবেন।
—– •••
খেয়া
এর কিছুদিন পরে স্বদেশী আন্দোলনের দিনে রবীন্দ্রনাথকে একজন অগ্রণীরূপে দেখতে পাওয়া যায়। নৈবদ্যে তিনি কর্মক্ষেত্রে যোগ্যভাবে অবতীর্ণ হবার জন্যে প্রার্থনা করেছেন,
8१२
কর মোরে সম্মানিত নব বীরবেশে, দুরূহ কর্তব্য-ভারে, দুঃসহ কঠোর বেদনায়। পরাইয়া দাও অঙ্গে মোর ক্ষতচিহ্ন অলঙ্কার। ধন্য করো দাসে সফল চেষ্টায় আর নিষ্ফল প্রয়াসে। ভাবের ললিত ক্রোড়ে না রাখি’ নিলীন কর্মক্ষেত্রে করে দাও সক্ষম স্বাধীন….,
স্বদেশী আন্দোলনের দিনে তিনি যে কর্মব্রত নিয়েছিলেন তার উদ্যাপনে তাঁর ভিতরে এতটুকু দ্বিধা দেখা যায়নি। সঙ্গীত, বক্তৃতা, আদর্শপ্রচার, ইত্যাদির দ্বারা সে
আন্দোলনকে তিনি আরো বহুগুণে আন্দোলিত করে তুলেছিলেন।
কিন্তু শেষে দেখা গেল, এ-আন্দোলন থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিলেন। এর জন্য তার অনেক ভক্তও তার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সেই কাজ উচিত হয়েছিল কি অনুচিত হয়েছিল, সে-আলোচনা অনেকটা নিরর্থক। ইতিহাস যে-ভাবে গড়ে উঠছে, সেই-ভাবেই তাতে গ্রহণ করা ভিন্ন আর উপায় কি আছে। কিন্তু এই যুগের রবীন্দ্রসাহিত্য একটু ভালো করে পড়ে দেখলে বুঝতে পারা যায়, যে স্ব-ধর্মের সন্ধান কবি আজীবন করে আসছিলেন, নিজেকে শেষে স্বদেশী আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করে সেই স্ব-ধর্ম-পালনই তিনি করেছিলেন। প্রথমত, তিনি যে-আদর্শ থেকে স্বদেশ-মঙ্গলের কথা বলছিলেন, স্বাদেশিকতা তার শেষ পর্যায়ে তা থেকে ভিন্ন চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল; দ্বিতীয়ত, এক গভীর আধ্যাত্মিক বোধের জন্য সমস্ত কর্ম কোলাহলের মধ্যে তিনি বড় পীড়ন অনুভব কছিলেন। সাধকের যে শান্ত সমাধি, ভক্তের যে সঙ্গোপনের পূজা, এই সমস্তেরই তার বড় প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। একেই লক্ষ্য করে কবি বলেছেন
বিদায় দেহ ক্ষম আমায় ভাই। কাজের পথে আমি তো আর নাই।
এগিয়ে সবে যাও না দলে দলে, জয়মাল্য লও না তুলি’ গলে, আমি এখন বনচ্ছায়াতলে
অলক্ষিতে পিছিয়ে যেতে চাই,
তোমরা মোরে ডাক দিয়ো না ভাই। অনেক দূরে এলেম সাথে-সাথে, চলেছিলেম সবাই হাতে-হাতে,
এইখানেতে দুটি পথের মোড়ে
*
অজিতবাবুর “রবীন্দ্রনাথ” দ্রষ্টব্য।
8१७
হিয়া আমার উঠল কেমন করে
জানিনে কোন্ ফুলের গন্ধ ঘোরে
সৃষ্টিছাড়া ব্যাকুল বেদনাতে। আর তো চলা হয় না সাথে-সাথে।
ক্ষণিকায় দেখেছি, কবির চিত্তে পরম-সুন্দরের প্রতি অনুরাগ জেগে উঠেছে। নৈবেদ্যে দেখেছি, তিনি যে তাঁরই এ প্রত্যয় কবির ভিতরে দৃঢ় হয়ে দেখা দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ভক্তভাবে রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখি খেয়াতে অনুরাগ আর বিশ্বাসেই তিনি সন্তুষ্ট থাকতে পারছেন না-”প্রতীক্ষা” তার ভিতরে নিবিড় হয়ে উঠেছে! সেই প্রতীক্ষার ব্যথায় কবি এক নূতন ভঙ্গিতে কথা বল্ছেন।
আমার যে এই নূতন গড়া
নূতন-বাঁধা তার নূতন সুরে করতে সে যায়
সৃষ্টি আপনার। মেশে না তাই চারিদিকের
সহজ সমীরণে, মেলে না তাই আকাশ-ডোবা
স্তব্ধ আলোর সনে। জীবন আমার কাঁদে যে তাই
দণ্ডে পলে পলে, যত চেষ্টা করি কেবল
চেষ্টা বেড়ে চলে। ঘটিয়ে তুলি কত কি যে
বুঝি না এক তিল, তোমার সঙ্গে অনায়াসে
হয় না সুরের মিল।
–
–
–
–
—
—
—
–
–
বেশির ভাগ কথা কবি রূপক দিয়ে বলছেন। এর এক কবিতায় বালিকা-বধূর এক সুন্দর ছবি আঁকা হয়েছে। কিন্তু সেটি হয়ত শুধু বালিকা-বধূর ছবিই নয়। কবি অনুভব করছেন, সেই বিরাটের পাশে তার নিজের চিত্তও এমনি বালিকা বধূর মতনই দাঁড়িয়ে। তিনি যে কত বড়, কি যে তাঁর মহিমা, অবোধ বালিকারই মতন কবি-হৃদয় সেই তত্ত্বের রস-বিলাসের সন্ধান পুরোপুরি পায়নি; তবু তার সঙ্গে কবির যে কেমন-একটি নিবিড় যোগ স্থাপিত হয়েছে এ-কথাটি বাঁশির সুরের অনির্বচনীয়তা নিয়েই বেজে উঠেছে!
ওগো বর, ওগো বধূ, এই যে নবীনা বুদ্ধিবিহীনা
এ তব বালিকা বধূ।
৪৭৪
তোমায় উদার প্রাসাদে একেলা কত খেলা নিয়ে কাটায় যে বেলা, তুমি কাছে এলে ভাবে তুমি তার
খেলিবার ধন শুধু;
ওগো বর, ওগো বধূ।
শুধু দুর্দিনে ঝড়ে–দশ দিক ত্রাসে আঁধারিয়া আসে
ধরাতলে অম্বরে তখন নয়নে ঘুম নাই আর, খেলাধূলা কোথা পড়ে থাকে তার তোমারে সবলে রহে আঁকড়িয়া, হিয়া কাপে থরথরে দুঃখ-দিনের ঝড়ে।
যে প্রতীক্ষা নিয়ে কবি জেগে আছেন তার চমৎকার রূপটি ফুটে রয়েছে এর জাগরণ কবিতায়
কৃষ্ণপক্ষে আধখানা চাঁদ
উঠল অনেক রাতে, খানিক কালো খানিক আলো
পড়ল আঙিনাতে। ওরে আমার নয়ন আমার
নয়ন নিদ্রাহারা, আকাশ-পানে চেয়ে-চেয়ে
কত গুনবি তারা? সাড়া কারো নাইরে সবাই
ঘুমায় অকাতরে। প্রদীপগুলি নিবে গেল
দুয়ার-দেওয়া ঘরে। তুই কেন আজ বেড়াস্ ফিরি’
আলোয় অন্ধকারে? তুই কেন আজ দেখিস্ চেয়ে
বনপথের পারে?
৪৭৫
বৈষ্ণব কবির রাধার প্রতীক্ষার চেয়ে একহিসেবে নিবিড়তর এই খেয়ার প্রতীক্ষা। বৈষ্ণব কবির অনুভূতি নিশ্চয়ই অতি গভীর, কিন্তু জীবনের জটিলতা তার সামনে কম; কেমন সহজ প্রতীক্ষার ভিতর দিয়ে তিনি কেমন সহজ অথচ গভীর মিলনে পৌঁছুতে পারছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের-আধুনিকেরও বটে-প্রতীক্ষা বড় আশ্চর্য। দেবতার যৌবন নিয়ে একসময়ে যিনি উর্বশীর নৃত্য উপভোগ করেছেন, বিজয়িনীর বিজয় চেয়ে
দেখছেন; গভীর জ্ঞানকে আত্মসাৎ করে গম্ভীর উদাত্ত কণ্ঠে যিনি ঘোষণা করেছেন
“বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়,
অথবা
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালিরাশি বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি’, পৌরুষেরে করেনি শতধা; নিত্য যেথা তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা, নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি’ পিত
ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত…….
সেই বলীয়ান-হৃদয় কবি আজ বিরাটের প্রেমের আকর্ষণে নব-অনুরাগিণী কিশোরীর মতন কাঁপছেন! ভাষার যত দীপ্তি, উচ্ছ্বাস, কল্পনার যত উদ্দমতা, সে-সব
আজ কোথায়? একেবারে শাদা কথায় হৃদয়টি অনাবৃত করবার জন্য কবি ব্যাকুল!”
গীতাঞ্জলি
গীতাঞ্জলিতে দেখা যাচ্ছে, খেয়ার এই প্রতীক্ষা কান্নায় ফেটে পড়তে চাচ্ছে
কোথায় আলো কোথায়, ওরে আলো! বিরহানলে জ্বালোরে তারে জ্বালো।
রয়েছে দীপ না আছে শিখা
এই কি ভালে ছিল রে লিখা, ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো। বিরহানলে প্রদীপখানি জ্বালো।
সকশ মশো কেচু শাম আজ গায়রাতৎ বসুজ। দিব কে দর কফে উ মোমাস্ত সংগে খারা ॥
হাফিজ ॥
উন্নত-শির হয়ো না, হলে মোমবাতির মতো জ্বলবে। চিত্তহারী এমন যে তার হাতে পড়ে শিলা মোম হয়।
8१७
গীতাঞ্জলির প্রায় সব জায়গায়ই দেখতে পাওয়া যায়, কবি বিরহের ব্যথা বড় গভীর করে অনুভব করছেন। সেই বিরহের ভিতরেই কখনো-কখনো প্রিয়তমের কেমন একটুখানি সান্নিধ্য লাভ করতে পারছেন।
বাঞ্ছিত সম্বন্ধে নানা কথাই কবির মনে জাগছে, বড় মাধুর্য-মাখা সেই সব কথা। কখনো বলছেন
অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না। এবার হৃদয়-মাঝে লুকিয়ে বোসো
কেউ জানবে না কেউ বলবে না। (২৪)*
তিনি জানেন, তাঁর হৃদয় এখনো তাঁর চরণস্পর্শে ধন্য হবার মতো হয়নি,
জানি আমার কঠিন হৃদয়। চরণ রাখার যোগ্য সে নয়,
কিন্তু এ কথা বলার অধিকার কবি পেয়েছেন
সখা তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায়
তবু কি প্রাণ গলবে না?
আর এ যে-সে অধিকার নয়।
মাঝে মাঝে কবি অদ্ভুত আবদারে কথা বলছেন
মুখ ফিরিয়ে রবো তোমার পানে এই ইচ্ছাটি সফল করা প্রাণে। (৯৯)
কখনো অজানিতভাবে তার ক্ষণিক স্পর্শ লাভ করে সচেতন হয়ে কবি নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছেন
সে যে পাশে এসে বসেছিল
তবু জাগিনি! (৬২)
* রবীন্দ্র-রচনাবলী একাদশ খণ্ডের পরিশিষ্ট দেখুন।
৪৭৭
ধরে যেতে পারে বিরহের বেদনাই গীতাঞ্জলির মূল সুর, আর রীতিমত তীব্র সে বেদনা।
কবি প্রায় সব অবস্থায়ই এই বিরহের বেদনা অনুভব করছেন। প্রভাতে জেগে উঠে বলছেন,
সুন্দর তুমি এসেছিলে আজ প্রাতে অরুণবরণ পারিজাত ল’য়ে হাতে। (৬৮)
মেঘলা দিনে বলছেন,
মেঘের পরে মেঘ জমেছে,
আঁধার করে আসে, আমায় কেন বসিয়ে রাখো
একা দ্বারের পাশে। (১৭)
বৃষ্টির মাতামাতি দেখে তিনি বলছেন,
ওরে বৃষ্টিতে মোর ছুটেছে মন,
লুটেছে ঐ ঝড়ে, বুক ছাপিয়ে তরঙ্গ মোর
কাহার পায়ে পড়ে। (২৮)
স্নান বৈকালে তার মনে পড়ছে,
এখন বিজন পথে করে না কেউ
আসা যাওয়া ওরে প্রেম-নদীতে উঠেছে ঢেউ
উতল হাওয়া। জানি না আর ফিরব কিনা
কার সাথে আজ হবে চিনা, ঘাটে সেই অজানা বাজায় বীণা তরণীতে। (১৭)
ঝড়ের রাতে তিনি আকুল হয়ে ভাবছেন,
আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার,
পরাণসখা বন্ধু হে আমার। (২১)
৪৭৮
আর সব অবস্থাতেই তার মনে জাগছে,
প্রভু তোমা লাগি আঁখি জাগে;
দেখা নাই পাই।
পথ চাই, সেও মনে ভালো লাগে। (২৯)
গীতাঞ্জলিতে কবির দুই ভাবের সাধনা আমরা লক্ষ্য করি। একবার তিনি বলছেন
নিভৃত প্রাণের দেবতা
যেখানে জাগেন একা, ভক্ত সেথায় খোল দ্বার,
আজ লববা তার দেখা। (৫১)
আর-বার বলছেন,
ভজনপূজন সাধন আরাধনা
সমস্ত থাক পড়ে। রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে
কেন আছিস্ ওরে? (১২০)
অথবা,
বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো।
নয়কো বনে নয় বিজনে,
নয়কো আমার আন মনে, সবার যেথায় আপন তুমি, হে প্রিয়,
সেথায় আপন আমারো। (৯৫)
এর ভিন্ন-ভিন্ন পরিণতি আমরা গীতিমাল্যে, আর গীতালি-বলাকা-পলাতকায় দেখতে পাই।
গীতাঞ্জলির এই বিরহ বৈষ্ণব বা সুফীর বিরহের সঙ্গে মিলিয়ে পড়া যেতে পারে। প্রকৃত বৈষ্ণব চমৎকার প্রেমিক, তাই প্রেমের ব্যথা রবীন্দ্রনাথ যখন অনুভব করেছেন তখন বৈষ্ণবের ভাবটি মাঝে-মাঝে তার ভিতরে যে ফুটে উঠবে এটি স্বাভাবিক। রাধিকার ভাবটি গীতাঞ্জলির অনেক জায়গায়ই বেশ ফুটে উঠেছে। এমন-কি-কেউ যদি
৪৭৯
বলেন, বৈষ্ণবের প্রেমের ভাবটিই গীতাঞ্জলিতে বেশি প্রস্ফুট, তা হলে তাঁর সঙ্গে তর্ক না কলেও চলে। তবু একথা বলতেই হবে, মোটের উপর বৈষ্ণবের প্রেমের ধাত রবীন্দ্রনাথের নয়। বৈষ্ণব মূর্তিবাদী, রাধাকৃষ্ণ এক সুন্দর রসঘন বিগ্রহ ব’লেই বৈষ্ণব তা অবলম্বন করে আনন্দ পান। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ রহস্যময়ের পূজারি। সে রহস্যময় তার কাছে “জলে স্থলে”
“নানা আকারে ধরা দেন। কবি নিজের গাঢ় অনুভূতিতে কখনো তার চরণ ছুঁতে পারছেন। কখনো মৃত্যুর বেশে তিনি কবির মনোনেত্রে আবির্ভূত হচ্ছেন।
এই জন্যই সুফীর আধ্যাত্মিক সাধনার সঙ্গেও তার কিছু অমিল রয়েছে; সুফীও পীর মানেন, শাস্ত্রের সত্যকে জীবনে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেন। বাস্তবিক রবীন্দ্রনাথের সাধনার নূতনত্বই বেশি করে চোখে পড়ে।
ইয়োরোপ তাঁকে বলেছে ‘মিটিক Mystic. কিন্তু মিটিক বলে তাঁর বিশেষত্ব নির্দেশ পুরোপুরি হয় না, কেননা এ-কথাটি খুবই ব্যাপক। ওয়ার্ডসওয়ার্থও (Wordsworth) Mystic, qalya’s (Emerson) Mystic- viata C500 (Blake) Mystic. শ্ৰীযুক্ত নলিনীকান্ত গুপ্ত Mystic-এর এক সংজ্ঞা দিয়েছেন-”তার কাছে মধ্যাহ্নের তপন বড় রূঢ় রুক্ষ, সে ভালোবাসে ছায়া-আলোর মিশ্রণ।” এক শ্রেণীর Mystic-সম্বন্ধে একথা প্রযোজ্য বটে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে এ-কথাটি খাটে না। তাঁর সন্ধানের তীব্রতা অনুভূতির গাঢ়তা আর প্রকাশের পর্যাপ্ত প্রায় সব জায়গায় চোখে পড়ে।
রবীন্দ্রনাথ Mystic এই হিসেবে যে সত্যের চিররহস্যময় দ্বারে তিনি উঁকি মেরেছেন। সেই হিসেবে হয়ত শক্তিমানমাত্রেরই জীবনের অন্তস্থলে দেখতে পাওয়া যায় Mysticism.
বৈষ্ণবের সহজ ভক্তি’র সুর রবীন্দ্রনাথে পান না বলে অনেককে দুঃখ করতে দেখেছি। তারা ভুলে যান, মানুষের জীবন বিচিত্র, জীবনের সার্থকতাও বিচিত্র। তা ছাড়া, অপরের পরিচয় যখন আমরা পেতে যাই তখন আমাদের উচিত, নিজেদের খেয়াল রুচি ইত্যাদি একটুখানি চেপে রাখা। এই জ্ঞানী মানী সুসভ্য কবি যখন বলছেন
জড়িয়ে গেছে সরু-মোটা
দুটো তারে জীবনবীণা ঠিক সুরে তাই
বাজেনারে। (১২৯)
তখন, কি দুঃখে তার হৃদয়ে এই দারুণ অস্বস্তি বাজছে, কি সত্য রয়েছে এর ভিতরে,-সেই সমস্তের অনুসরণই কি সত্য-অনুসরণ নয়? যাঁরা “সহজ অধিকারে ডুব দিয়ে অতলে তলিয়ে যেতে পেরেছেন তারা নিশ্চয়ই ভাগ্যবান। (অবশ্য “সহজ অধিকার” বলে কোনো কিছু আদৌ আছে কিনা তাও বিচারের বিষয়।) কিন্তু যিনি তেমনি করে নিজেকে তলিয়ে দিতে পারছেন না, অথচ অতলের জন্য প্রাণ তার আকুল
৪৮০
হয়ে উঠেছে, তার সেই আকুলতায়ও তো বিশ্ব-বিধাতার এক চমৎকার লীলা। মানুষের পক্ষে তা একতিলও অসত্য নয়। তার উপর খেয়া গীতাঞ্জলি গীতিমাল্য শুধু বিরহীর কান্নাই নয়, এসমস্তে ফুটে উঠেছে এক নব বিরহ-মূর্তি। এই সমস্ত কাব্যের অনেক কবিতা যে ইয়োরোপের আধুনিক ভাবুক মনীষীদের হৃদয় স্পর্শ করেছে সেও এই জন্যেই।
গীতিমাল্য
গীতাঞ্জলির যে কান্না, গীতিমাল্যে তা থেমে যায়নি। কিন্তু সে-অশ্রুর এখন এক নতুন বেশ। এ তীব্র বেদনার অশ্রু নয়, এ অঞর ভিতর দিয়ে কবি-হৃদয়ের কেমন-এক স্নিগ্ধ শান্তি চোখে পড়ে,-যেন বৃষ্টিতে-ভেজা টগর। গীতাঞ্জলিতে ঝড়ের রাত্রে কবি বলেছেন
আজ ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরাণসখা বন্ধু হে আমার….
আর গীতিমাল্য বলেছেন,
যে রাতে মোর দুয়ারগুলি
ভাঙল ঝড়ে। জানি নাই তো তুমি এলে
আমার ঘরে। সব যে হয়ে গেল কালো নিবে গেল দীপের আলো
আকাশ পানে হাত বাড়ালেম
কাহার তরে ॥ অন্ধকারে রইনু পড়ে
স্বপন মানি। ঝড় যে তোমার জয়ধ্বজা
তাই কি জানি? সকাল বেলায় চেয়ে দেখি দাঁড়িয়ে আছ তুমি একি,
গীতিমাল্যের “কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না” শীর্ষক কবিতার আলোচনা দ্রষ্টব্য।
৪৮১
ঘরভরা মোর শূন্যতারি
বুকের পরে ॥ (৬৭)
কবির অন্তরের ব্যথা ঘুচে যায়নি, কিন্তু অন্তর তলে কেমন একটু তৃপ্তি গীতিমাল্যের অনেকগুলি কবিতাকে সরস করে রেখেছে।
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ। (৭) কোলাহল তত বারণ হল
এবার কথা কানে-কানে। (৮)।
কে গো অন্তরতর সে? আমার চেতনা আমার বেদনা তারি সুগভীর পরশে। (২২)।
ভোরের বেলায় কখন এসে। পরশ করে গেছ হেসে। (৩৫)
ইত্যাদি।
ভক্তের যে সঙ্গোপনের পূজা সেইটিই গীতিমাল্যের মূল সুর। কবির যত কথা, যত দুঃখ, যত সার্থকতা, যত আনন্দ একান্ত করে তাকেই তিনি বলছেন
লুকিয়ে আসো আঁধার রাতে
তুমি আমার বন্ধু। লও যে টেনে কঠিন হাতে
তুমি আমার আনন্দ ॥ (৪৭)
গীতিমাল্যে কবি বড় খাদের পর্দায় সুর বেঁধেছেন; তাই তা পুরোপুরি উপভোগ করবার জন্য খুব দরদীর কান চাই। সেই কান থাকলে গীতিমাল্যে খুবই একটা গভীর তৃপ্তি অনুভব করা যায়। এই খাদের পর্দাতে সময় সময় কবির মনের কথা কি মর্মস্পর্শী হয়ে বেজে উঠেছে!
“এই যে তুমি” এই কথাটি
বলব আমি বলে কত দিকেই চোখ ফেরালেম
কত পথেই চলে। ভরিয়ে জগৎ লক্ষ ধারায়
৪৮২
• “আছ আছ”র স্রোত বহে যায় “কই তুমি কই” এই কাঁদনের।
নয়ন-জলে গলে ॥ (১৪)
যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা
তোমায় জানাতাম। কে যে আমায় কাঁদায়, আমি
কি জানি তার নাম।
এই বেদনার ধন সে কোথায়
ভাবি জনম ধরে। ভুবন ভরে আছে যেন
পাইনে জীবন ভরে। সুখ যারে কয় সকল জনে। বাজাই তা’রে ক্ষণে-ক্ষণে,
গভীর সুরে “চাইনে, চাইনে,”
বাজে অবিশ্রাম ॥ (৫৭)
তখন মনে হয় এমন খাদের পর্দায় সুর না ধরলে এমন অপূর্ব গান শুনবার সৌভাগ্য আমাদের হত না।
রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক সাধনার চেহারা গীতিমাল্য অনেকখানি পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। কোনো গুরু বা শাস্ত্র তাঁর পথ-প্রদর্শক নন। উপনিষৎ তার প্রিয়, বৈষ্ণব কবিতার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ পরিচয়, দেশবিদেশের সাহিত্যমহারথীদের প্রতি তার প্রচুর শ্রদ্ধা, তার পিতার জীবনব্যাপী আধ্যাত্মিক বেদনা তার অনুপ্রাণনার এক বড় উৎস; কিন্তু প্রকৃত গুরুর পদে বরণ তিনি কাউকেই করেন নি। তাঁর অন্তরের অনুভূতিই বিশ্বজগতের বুকের উপর দিয়ে তার পথ দেখিয়ে চলেছে।
মিথ্যা আমি কি সন্ধানে
যাবো কাহার দ্বার? পথ আমারে পথ দেখাবে
৪৮৩
এই জেনেছি সার। শুধাতে যাই যারি কাছে কথার কি তার অন্ত আছে? যতই শুনি চক্ষে ততই
লাগায় অন্ধকার। (৬২)
নিজের অন্তরের সত্যিকার বেদনা যে কেমন করে মানুষকে পথ দেখায়-চিরকাল মানুষকে পথ দেখিয়ে এসেছে-সে কথাটি অন্য এক কবিতায় বড় সুন্দর করে বলা হয়েছে। মনে হয়, সমস্ত রবীন্দ্র-কাব্যে এ একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা
আমার ব্যথা যখন আনে আমায়
তোমার দ্বারে। তখন আপনি এসে দ্বার খুলে দাও।
ডাকো তারে।
আমার ব্যথা যখন বাজায় আমায়
বাজি সুরে, সেই গানের টানে পারো না আর
রইতে দূরে। লুটিয়ে পড়ে সে-গান মম ঝড়ের রাতের পাখী-সম, বাহির হয়ে এস তুমি।
অন্ধকারে; আপনি এসে দ্বার খুলে দাও
ডাকো তারে।* (৬৪)
কবীরও বলেছেন বাসুরি জব মোহে ডগরা ধরাঈ। রয়না আনৃহেরী রহি কারী বাদরন-সে
ডগরা মোহে কৌন দিখাঈ ॥ ঠারী কোঈ দেখত আপন অঙন-সে
জিনহে কভি বাসুরি বুলাই। ডগরা মোহে কৌন দিখাই ॥ ডর নাহি কুচ্ছৌ ডগরা না পুচ্ছৌ বাসুরি সুনত কবীরা বঢ় জাঈ।
৪৮৪
এর “ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো” শীর্ষক কবিতাটি বড় অদ্ভুত
ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো আমার মুখের আঁচলখানি। ঢাকা থাকে না হায় গো
তা’রে রাখতে নারি টানি। (১৯)।
কোন্ চুম্বকের আকর্ষণে কবি-চিত্ত এমন অস্থির হয়ে উঠেছে আমাদের পক্ষে তা বোঝা সহজ নয়। হাফিজও এক জায়গায় বলেছেন
দিল্ মিরও জে দস্তম্।
সাহিবদিলা খোদারা।
সহজের সাধনায় কবি যে অনেকখানি এগিয়েছেন গীতিমাল্যের অনেকগুলি কবিতায় তার পরিচয় রয়েছে
বাজাও আমারে বাজাও। বাজালে যে সুরে প্রভাত আলোরে
সেই সুরে মোরে বাজাও। যে সুর ভরিলে ভাষা-ভোলা গীতে শিশুর নবীন জীবন-বাঁশিতে জননীর মুখ তাকানো হাসিতে
সেই সুরে মোরে বাজাও। (৩৯)
আকাশে দুই হাতে প্রেম বিলায় ও কে? সে-সুধা গড়িয়ে গেল লোকে-লোকে।
পীতম বুলাওত আনহেরী-কি পার-সে। কৌন বেশরম আজ তোর সাথে জাঈ ॥ বাসুরি-বাঁশি; জব-যখন; মোহে-আমাকে; ডগরা-পথ; ধরাঈ-ধরিয়েছিল; রয়না-রাত্রি; আনুহেরী-অন্ধকার; কারী বাদরন সে-কালো বাদলের দ্বারা; ঠারী-দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে; কোঈ-কোনো কোনো পূর্ব সাধক; সুনত-শুনতে শুনতে; বঢ় জাঈ-এগিয়ে যাও; পীতম-প্রিয়তম।
শ্ৰীযুক্ত ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের সংগ্রহ থেকে গৃহীত। ১ হাত হতে মোর হৃদয় যায় দোহাই বাঁচাও হৃদয়বান্!-কবি নজরুল ইসলামের অনুবাদ।
৪৮৫
গাছেরা ভরে নিল সবুজ পাতায়, ধরণী ধরে নিল আপন মাথায়। ফুলেরা সকল গায়ে নিল মেখে। পাখীরা পাখায় তারে নিল এঁকে। (১০৮)
গীতিমাল্যের শেষের দিকে কতকগুলি কবিতায় দেখা যাচ্ছে, কবির বেদনা প্রায় অন্তর্হিত হয়েছে, আর আনন্দ বেশ সজীব হয়ে উঠেছে
শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে পড়ুক ঝরে, তোমারি সুরটি আমার মুখের পরে বুকের পরে। পুরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে দুই নয়নে নিশীথের অন্ধকারে গভীর ধারে পড়ক প্রাণে। নিশিদিন এই জীবনের সুখের পরে দুখের পরে শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে পড়ুক ঝরে ॥ (৬৮)
তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে
সে আগুন ছড়িয়ে গেল।
সবখানে। যতসব মরা গাছের ডালে ডালে
নাচে আগুন তালে তালে আকাশে হাত তোলে সে
কার পানে ॥ (৮৯) বৈষ্ণবের সেই
এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা
কেমনে আইলা বাটে আঙ্গিনার পরে তিতিছে বঁধুয়া
দেখে যে পরাণ ফাটে
কবিতার সঙ্গে গীতিমাল্যের “কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না” শীর্ষক কবিতাটি মিলিয়ে পড়া যেতে পারে। বৈষ্ণবের সরল হৃদয়, বাইরের বন্ধনই তাঁকে আকুল করেছে। তিনি কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছেন। কত মর্মস্পর্শী এই কান্না তা কে না বুঝতে পারে?-কিন্তু গীতিমাল্যের কবির দুঃখ দেখছি একটু ভিন্ন রকমের
৪৮৬
তুমি পার হয়ে এসেছ মরু
নাই যে সেথায় ছায়াতরু, পথের দুঃখ দিলেম তোমায়,
এমন ভাগ্যহত! (৯১) বাইরের তেমন-কোনো প্রতিবন্ধকতা তাঁকে দুঃখ দিচ্ছে না। তার প্রিয়তমের আসবার পথ রুদ্ধ হয়েছে তাঁর, নিজের অন্তরের শুষ্কতার মরুতে-শিথিল-প্রত্নতার মরুতে। আধুনিক কবির এই দুঃখ বিশেষ করে আধুনিক জগতের লোকেরই দুঃখ, কেননা মানুষের এই ভিতরকার বন্ধনই আজ বেশি প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে।
এক যুগের কাব্যের ভিতরকার কথার সঙ্গে অন্য যুগের কাব্যের ভিতরকার কথার নিশ্চয়ই খুব বেশি মিল। তবু এক যুগের ভাবের অবলম্বন আর প্রকাশভঙ্গিমা অন্য যুগের ভাবের অবলম্বন আর প্রকাশভঙ্গিমা হ’তে বিভিন্ন হতে বাধ্য, নইলে ভিন্ন ভিন্ন যুগ বলে কোনো কথাই থাকত না। অতীতের যারা অন্ধ ভক্ত এ কথাটি তাঁদের স্মরণ রাখা দরকার।
গীতিমাল্যের শেষের কবিতায় কবি যে প্রণাম নিবেদন করেছেন কেমন এক সার্থকতার আনন্দ রয়েছে তাতে
মোর সন্ধ্যায় তুমি সুন্দর বেশে এসেছ
তোমায় করি গো নমস্কার। মোর অন্ধকারের অন্তরে তুমি হেসেছ
তোমায় করি গো নমস্কার। (১১১)
গীতালি
কবির এত দিনের সব কান্না ব্যথা কেমন এক সার্থকতার শ্রীতে মণ্ডিত হয়ে দেখা দিয়েছে গীতালিতে
=
=
=
=
দুঃখের বরষায়
চক্ষের জল যেই
নামল বক্ষের দরজায়
বন্ধুর রথ সেই
থামল।
* অন্ততঃ, বন্ধন যে চিরদিনই ভিতরকার, আধুনিক কবির ভাষায় সেটি বেশী পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।
৪৮৭
*
*
*
এত দিনে জানলেম
যে কাদন কাদলেম
সে কাহার জন্য। ধন্য এ ক্রন্দন,
ধন্য এ জাগরণ,
ধন্য রে ধন্য। (১)
গীতালির প্রায় সব কবিতায়ই এই সুর-এই সার্থকতার স্বস্তির সুর।
ভক্ত কবি তার চিরবাঞ্ছিতের সামনে বসে যে সব আবদারের কথা বলছেন কত নিবিড় তা’র রসটি!
বক্ষ আমার এমন করে’
বিদীর্ণ যে করো উৎস যদি না বাহিরায়।
হবে কেমনতরো? (৩২)
অথবা
গর্ব আমার নাই রহিল প্রভু, চোখের জল তো কাড়বে না কেউ কভু। (৬৪)
তার হৃদয়-গৃহে-শয়ান প্রিয়তমকে জাগাবার জন্য কবি যে ডাকছেন, কোনো ব্যথা কোনো আশঙ্কা নেই সেই স্বরে। পূর্ণ বিশ্বাসে প্রাণ ভরে’ তিনি বলছেন
মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে একেলা রয়েছ নীরব শয়ন-পরে
প্রিয়তম হে জাগো জাগো জাগো। রুদ্ধ দ্বারের বাহিরে দাঁড়ায়ে আমি
আর কত কাল এমনে কাটিবে স্বামী
প্রিয়তম হে জাগো জাগো জাগো।
মিলাবো নয়ন তব নয়নের সাথে মিলাবো এ-হাত তব দক্ষিণ হাতে
৪৮৮
প্রিয়তম হে জাগো জাগো জাগো। হৃদয়পাত্র সুধায় পূর্ণ হবে, তিমির কাঁপিবে গভীর আলোর রবে
প্রিয়তম হে জাগো জাগো জাগো।
এখন সার্থকতার অঞ্জনে কবির দৃষ্টি আরো পরিষ্কার; আর প্রেমামৃত পানে তার কণ্ঠ আরো সবল। তাই তার এতদিনের আধ্যাত্মিক সাধনার যে বেদনা আর এখনকার যে আশা সে-সম্বন্ধে কবি বেশ দারাজ ঝঙ্কারে কথা বলছেন
যখন তুমি বাঁধছিলে তার।
সে যে বিষম ব্যথা। আজ বাজাও বীণা, ভুলাও ভুলাও
সকল দুখের কথা। (১৭)
গীতালিতে কতকগুলো উঁচুদরের কবিতা স্থান পেয়েছে-রূপ আর রসের দিকে দিয়েই উঁচুদরের
আগুনের
পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে এজীবন।
পুণ্য করো–দহন দানে (১৮)
যে থাকে থাক্ না দ্বারে যে যাবি যা না পারে।
কুঁড়ি চায় আঁধার রাতে শিশিরের রসে মাতে।
ফোঁটা ফুল চায় না নিশা প্রাণে তার আলোর তৃষা
-কাঁদে সে অন্ধকারে। (২৩)
অগ্নিবীণা বাজাও তুমি
কেমন করে? আকাশ কাপে তারার আলোর
গানের ঘোরে। (৫৩)
৪৮৯
পুষ্প দিয়ে মারা যারে
সে মরণকে। বাণ খেয়ে যে পড়ে, সে যে
ধরে তোমার চলনকে। (৭৩) ইত্যাদি।
এর দু’টি কবিতা গীতিমাল্যের সেই “ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো” শীর্ষক কবিতার মতনই আমাদের মতো সাধারণ পাঠকের কাছে দুৰ্জ্জেয়। গুহ্য সাধনা যারা করেন তাঁরা হয়ত এ সমস্তের রস ভালো করে উপভোগ করতে পারেন
কোন্ সাহসে একেবারে শিকল খুলে দিলি দ্বারে, জোড় হাতে তুই ডাকিস কারে?
প্রলয় যে তোর ঘরে ঢোকে। (১০)
*
*
আমি যে আর সইতে পারিনে।
সুর বাজে মনের মাঝে গো
কথা দিয়ে কইতে পারিনে। (১১)।
–
–
–
*
–
যার প্রেমের আকর্ষণে আকৃষ্ট হ’য়ে কবি এতকাল কেঁদেছেন তাঁর সেই প্রেমকে কবি বলেছেন সর্বনাশা। হাফিজও বলেছেন
কস্ বদৌরে নার্গিস তরফিনবস্ত আজ আফিয়াত।
সত্যের যে সন্ধানী তাঁর আরাম-আয়েসে আগুনের স্পর্শই লাগে। আচার্য জগদীশচন্দ্রের বক্তৃতা যারা শুনেছেন তারা তার কাছেও এই কথাটিরই আভাস বেশি করে পেয়েছেন।
গীতালির “আবার যদি ইচ্ছা করো” শীর্ষক কবিতাটিও খুবই লক্ষ্যযোগ্য। কত অল্প কথায় কত বিস্তৃত আর রসময় ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে! কবির এই ক্ষমতার আরো বেশি পরিচয় পাওয়া যায় এর পরে রচিত পলাতকায় আর বিশেষ করে লিপিকায়। –তার আধ্যাত্মিক সাধনার উচ্চভূমিতে দাঁড়িয়ে চিরপরিচিত অতি বড় ধরণীর পানে চেয়ে কবি বলেছেন
* তোমার নার্গিস-চোখের সামনে কারো সাধ্য নেই যে আরামে বসে থাকে।
৪৯০
আবার যদি ইচ্ছা করো।
আবার আসি ফিরে দুঃখসুখের ঢেউ-খেলানো
এই সাগরের তীরে। আবার জলে ভাসাই ভেলা, ধূলার পরে করি খেলা। হাসির মায়া-মৃগীর পিছে
ভাসি নয়ন-নীরে। কাটার পথে আঁধার রাতে
আবার যাত্রা করি; আঘাত খেয়ে বাঁচি, কিম্বা
আঘাত খেয়ে মরি। আবার তুমি ছদ্মবেশে আমার সাথে খেলাও হেসে। নূতন প্রেমে ভালোবাসি
আবার ধরণীরে।
রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক সাধনার স্বরূপ গীতালিতে বেশ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন
সেই তো আমি চাই! সাধনা যে শেষ হবে মোর
সে ভাবনা তো নাই।
এমনি করে মোর জীবনে
অসীম ব্যাকুলতা, নিত্যনূতন সাধনাতে
নূতন ব্যথা।
“নিত্যনূতন সাধনাতে নিত্যনূতন ব্যথা সহ্য করার ভিতরে মুক্তির স্বাদ আছে। কবির জীবন এতেই ভোর হবে, না এমন দিন আসবে যেদিন তাঁর প্রতিভা-নিঝরিণীর সব কলকল ভাষা সাগরসঙ্গমে নীরব হয়ে যাবে, কে তা বল্তে পারে? কিন্তু এই কবিতার অন্য জায়গায় তিনি যে বলছেন
ফলের তরে নয়ত খোঁজা, কে বইবে সে বিষম বোঝা,
৪৯১
যেই ফলে ফল ধূলায় ফেলে
আবার ফুল ফুটাই….,
এটি অনেকখানি তাঁর ব্যক্তিগত সাধনার কথা হলেও এর ভিতরে একটি বড় সত্যের সাক্ষাৎ পাওয়া যাচ্ছে।
আধ্যাত্মিক সাধনায় যাদের উপলব্ধি তত্ত্ব-আকারে, অনুশাসনআকারে ফলের মতন দেখা দিয়েছে, তাঁদের মহাত্ম ইতিহাসে কীর্তিতে হয়েছে। অবতার-পয়গম্বররূপে, শাস্ত্রকাররূপে, পথপ্রদর্শক গুরুরূপে তারা মানুষের পূজা পেয়েছেন। তাঁদের মাহাত্ম যে অসাধারণ একথা কে অস্বীকার করবে? কিন্তু একদিকে যেমন রয়েছে তাদের প্রতিভার উজ্জ্বলতা, তেমনি অন্যদিকে দেখা যায় দুর্বল লোকের জীবনে তাদের প্রভাবের বিকারের অন্ধকার। তাঁদের আবিষ্কৃত যে-সব তত্ত্ব যে-সব উপদেশ তারা মানুষকে দিয়েছেন, সে-সব কালে-কালে মানুষের উপর অকথ্য অত্যাচারই করেছে। জগতের সব ধর্মের ইতিহাসই বহুল পরিমাণে এই ফলের বিষম বোঝার দৌরাত্মের ইতিহাস নয় কি? অনন্ত তত্ত্ব, অনন্ত সৌন্দর্যের নিলয়, যে ভগবান তাঁকে বাদ দিয়ে তাঁর বিশেষ আনন্দ বিশেষ উদ্দেশ্য প্রকাশিত যে অবতারে পয়গম্বরে, মানুষ তাদেরই জীবনের সব অবস্থার অবলম্বনরূপে বেশি করে চেপে ধরে নেই কি? মানুষের সব ব্যাপারেই এই গুরুর অত্যাচার আদর্শের অত্যাচার-সাধনার ফলের ‘বিষম বোঝা’র অত্যাচার।
এখন অবশ্য এই গুরুগিরির অত্যাচার আস্তে-আস্তে হালকা হবার পথে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা রাজনীতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে গুরু এখন বন্ধু হয়ে উঠেছেন-অন্ততঃ সে-সত্য স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন যে ধর্ম-ভগবৎ-উপলব্ধি-সেখানেও যে গুরু শুধু বন্ধু, অবতার পয়গম্বর প্রাচীন আদর্শ সবাই বন্ধু, একটুখানি সহায়, তার বেশি নয়, তার বেশি হলে তারা যে মানুষের উপর দৌরাত্ম করেন, তাদের জীবনে সত্যিকার ফুল ফোঁটাবার সুযোগ নষ্ট করে দেন-দেখা যাচ্ছে, এই আশ্চর্য্য সন্ধানী মানুষের বড় কামনার ধন সেই সত্যকে নিজের জীবনে উপলব্ধি করে মানুষকে উপহার দিয়েছেন। তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনাকে তত্ত্ব-আকারে অনুশাসন-আকারে জমিয়ে তুলতে
তার কত সঙ্কোচ!
ফলের তরে নয়ত খোঁজা, কে বইবে বিষম বোঝা!
এক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কবি-জীবনই বিশ্ব-মানবের কাছে এই সংস্কার মুক্তির উপহার,-ইতিহাসের ধারায় সহস্র-সংস্কারে-বদ্ধ মানুষের ভিতরেও অনুভব করা যায় যে অবন্ধনের চমৎকারিত্ব, তারই মূর্ত মহিমা।
* চতুরঙ্গের শচীশ বলছেন-আমার অন্তর্যামী কেবল আমার পথ দিয়েই আনাগোনা করেন।
৪৯২
তৃতীয় পর্যায়
গীতালিতে রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক সাধনার বেশ একটা সার্থকতা লাভ হয়েছে, আমরা দেখেছি। এই সার্থকতার রসে কবি নিজেকে একেবারে ডুরিয়ে দিতে পারতেন-অর্থাৎ অনেক ভক্ত তা পেরেছেন। তা হলে তাঁর গানে হয়ত অনুভব করতে পারা যেত হাফিজ বা কবীরের জমাট মিলনানন্দ। কিন্তু তা না পেয়ে আমরা দুঃখিত নই, কেননা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, স্বয়ং কবি এর জন্য দুঃখিত নন। তিনি আর কিছুর সন্ধান পেয়েছেন আর এক অপূর্ব মমতার সঙ্গে সে-পথ অনুসরণ করে চলেছেন।
গীতালির এই সার্থকতার সবলতায় কবি অনুভব করছেন গতির আনন্দ। তাঁর সমগ্র জীবনের ভিতরেই গতি যথেষ্ট তৃর্ণ-হিল্লোলিত তো বটেই। এখনকার এই দৃষ্টির আর চিত্তের সবলতায় কবি প্রত্যক্ষ করছেন তার সেই আজীবন পথিক-রূপ
আমি পথিক আমারই সাথী।
* *
* বাহির হলেম কবে সে নাই মনে। যাত্রা আমার চলার পাকে এই পথেরই বাঁকে বাঁকে
নৃতন হ’ল প্রতি ক্ষণে ক্ষণে। কবি তাই ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছেন
পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে,
পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া। যাত্রাপথের আনন্দগান যে গাহে
তারি কণ্ঠে তোমারি গান গাওয়া।
তার এই পরিব্রাজক-রূপ বলাকায় পরম ঐশ্বর্যমণ্ডিতভাবেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। জীবনেও তিনি এখন থেকে পুরোপুরি পরিব্রাজক। কিন্তু এই বলাকা কাব্যের ভিতরে তার যে পরিব্রাজক-রূপ তা দেশ-কালের গণ্ডী অতিক্রম করে এক অপূর্ব সৃষ্টি মাহাত্মই লাভ করেছে।
রবীন্দ্রনাথের কাব্যের প্রায় সর্বত্রই আমরা যে একটি গতিবেগ দেখতে পাই, তত্ত্ব হিসেবেও তা তার সমসাময়িকদের কাছে খুব প্রিয়; কেননা আমাদের জাতীয় জীবনের বর্তমান অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় প্রতিক্রিয়ারূপে গতিবেগের দিকে আমাদের দৃষ্টি পড়া
৪৯৩
স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথ যদি শুধু এই গতির তত্ত্বই তার দেশবাসীকে দিতেন, তা হ’লেও বাংলার সামাজিক ইতিহাসে তার একটি বড় স্থান লাভ হত। কিন্তু তিনি সত্যিকার কবি, তাই গতির যে চিরকালের সত্য তাই-ই রূপ ধরে উঠেছে তার সামনে।
বলাকার অনেক কবিতাই সুন্দর। তত্ত্ব এ সমস্তের ভিতরে কম নেই; কিন্তু সে তত্ত্বকে রাঙিয়ে দিয়েছে আর জীবন্ত করেছে তার কল্পনা। কি বিরাট রূপ নিয়ে দেখা দিয়েছে তার কল্পনা তা ভাবলে স্তম্ভিত হতে হয়। বলাকার কতকগুলো কবিতার ছন্দও অসাধারণ গ্রহ-নক্ষত্রের ঘূর্ণনের মহাচ্ছন্দে যেন ছন্দিত হয়ে উঠেছে কবির ভাবোস
হে বিরাট নদী, অদৃশ্য নিঃশব্দ তব জল
অবিচ্ছিন্ন অবিরল চলে নিরবধি।
স্পন্দনে শিহরে শূন্য তব রুদ্র কায়াহীন বেগে;
বস্তুহীন প্রবাহের প্রচণ্ড আঘাত লেগে
পূঞ্জ পুঞ্জ বস্তু-ফেনা উঠে জেগে; আলোকের তীব্রচ্ছটা বিচ্ছুরিয়া উঠে বর্ণ-স্রোতে
ধাবমান অন্ধকার হতে; ঘূর্ণাচক্রে ঘুরে ঘুরে মরে
স্তরে স্তরে সূর্য চন্দ্র তারা যত বুদ্বুদের মত।
মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে সমাজে ইতিহাসে সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে চলার যে লীলা, তা’র অপরূপতা প্রত্যক্ষ করে কবি যেন আনন্দে নৃত্য করছেন।
আমরা চলি সমুখ পানে
কে আমাদের বাঁধবে? রৈল যারা পিছুর টানে
কাঁদবে তারা কাঁদবে।
ছবি শুধু ছবি, চিরচঞ্চলের মাঝে শান্ত, এ-কথায় তার আর মন ওঠে না, তিনি বলেন
কি প্রলাপ কহে কবি?
তুমি ছবি?
৪৯৪
নহে, নহে, নও শুধু ছবি!
কে বলে রয়েচ স্থির রেখার বন্ধনে
নিস্তব্ধ ক্রন্দনে?
* * * বিস্মৃতির মর্মে বসি রক্তে মোর দিয়েছ যে দোলা।
নয়ন সম্মুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাই;
আজি তাই। শ্যামলে শ্যামল তুমি নীলিমায় নীল।
সোনার তরী ও চিত্রা কাব্যের ভিতরে দেখা গেছে রবীন্দ্র-প্রতিভার এক পূর্ণ উচ্ছ্বসিত রূপ; তেমনি আর এক বন্যাবেগ পরিলক্ষিত হয় এই বলাকা কাব্যে।
বলাকার ‘তাজমহল’ কবিতাটি খুবই বিখ্যাত। তার বর্ণনা জায়গায়-জায়গায় দ্বিতীয় তাজমহলের মতনই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে
হে সম্রাট কবি, এই তব হৃদয়ের ছবি,
এই তব নব মেঘদূত, অপূর্ব অদ্ভুত
ছন্দে গানে উঠিয়াছে অলক্ষ্যের পানে
যেথা তব বিরহিনী প্রিয়া
রয়েছে মিশিয়া। প্রভাতের অরুণ-আভাসে, ক্লান্ত-সন্ধ্যা দিগন্তের করুণ নিশ্বাসে,
পূর্ণিমায় দেহহীন চামেলির লাবণ্য-বিলাসে,
ভাষার অতীত তীরে কাঙাল নয়ন যেথা দ্বার হ’তে আসে ফিরে ফিরে।
বলাকা কাব্যখানি যে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কাব্যসমূহের অন্যতম অনেকেই হয়ত সে বিষয়ে আমাদের সঙ্গে একমত হবেন। বড় ভাব কি বড় রূপ এতে লাভ করেছে এর প্রায় সব কবিতাই পাঠককে সেই কথা মনে করিয়ে দেয়। সামান্য ভাবও এতে কি পূর্ণ আর পরিচ্ছন্ন রূপ লাভ করেছে এর “মোর গান এরা সব শৈবালের দল” শীর্ষক কবিতাটি তার প্রমাণ
৪৯৫
মোর গান এরা সব শৈবালের দল, যেথায় জনোছে সেথা আপনারে করেনি অচল।
মূল নাই, ফুল আছে, শুধু পাতা আছে, আলোর আনন্দ নিয়ে জলের তরঙ্গে এর নাচে।
বাধা নাই, নাইক সঞ্চয়, আজানা অতিথি এরা কবে আসে নাইক নিশ্চয়।
যেদিন শ্রাবণ নামে দুর্নিবার মেঘে,
দুই কূল ডোবে স্রোতোবেগে, আমার শৈবালদল।
উদ্দাম চঞ্চল, বন্যার ধারায়।
দেশে দেশে দিকে দিকে যায় ভেসে ভেসে।
কিন্তু এর “তাজমহল” কবিতাটি সম্বন্ধে আমাদের আরো কিছু বলার আছে। কবির গতি-তত্ত্ব জীবন-তত্ত্ব এসব শিরোধার্য করে নিয়েও যখন কবিকে বলতে শুনি “মিথ্যা কথা,-কে বলে রে ভোললা নাই?-তখন আমাদের অন্তরপুরুষ কেমন-একটু পীড়ন অনুভব করে। কবি যা বলছেন তা মিথ্যা নয়, তবু মনে বলে, “আর যে বলে বলুক, কিন্তু কবির মুখ থেকে এ-কথাটা এই ভঙ্গিতে শুনতে রাজি হওয়া যায় কি?”
এই অসম্পূর্ণতা হয়ত কবির মনেও লেগেছিল, তাই তাজমহল সম্বন্ধে অন্য একটি কবিতায় তিনি বলছেন
আজ সর্বমানবের অনন্ত বেদনা।
এ পাষাণ-সুন্দরীরে
আলিঙ্গনে ঘিরে রাত্রিদিন করিছে সাধনা।
-অতীত অস্তমিত বটে, কিন্তু তার সবটুকু চির-অস্তমিত নয়। কবি নিজে একথাটা খুব ভালো করেই বোঝেন; তাই বলাকার একটি কবিতায় কবিকে বলতে শুছি
এমন একান্ত কুরে চাওয়া
এও সত্য যত এমন একান্ত ছেড়ে যাওয়া
সেও সেই মত। এ দুয়ের মাঝে তবু কোনোখানে আছে কোনো মিল;
৪৯৬
নহিলে লিখিল এত বড় নিদারুণ প্রবঞ্চনা হাসিমুখে এতকাল কিছুতে বহিতে পারিত না।
সব তার আলো কীটে-কাটা পুষ্পসম এতদিনে হয়ে যেত কালো।
বলাকা যে-যুগের লেখা রবীন্দ্র-সাহিত্যে সে একটি বড় যুগ-সবুজ পত্রের যুগ। আগেকার সাধনার যুগের মতো এ-যুগও কাব্যে গল্পে উপন্যাসে নাটকে এবং প্রবন্ধে সমৃদ্ধ। সাধনার যুগ আর সবুজ পত্রের যুগ এ দুয়ের কোন্টি সমৃদ্ধতর-শিল্প-সম্ভারে সমৃদ্ধতর, সে-সম্বন্ধে আলোচনা হতে পারে। দুই যুগ সম্বন্ধেই ঢের কথা বলবার আছে। সবুজ পত্রের যুগের বলাকা পলাতকা লিপিকা কয়েকটি ছোটো গল্প, আর সাধনার যুগের সোনার তরী চিত্রা পঞ্চভূত গল্পগুচ্ছ পাশাপাশি দাঁড় করালে, সাধারণত সবুজপত্রের যুগের দিকেই পক্ষপাত করতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু যখন মনে করা যায় পঞ্চ ভূতের নবীন মনীষা-নবীন প্রতিভাচ্ছটা, প্রথম-লেখা ছোটো গল্পের নিবিড় রসানুভূতি, আর সোনার তরী ও চিত্রার তত্ত্ব-নিরক্ষেপ প্রায়-নিরঙ্কুশ কবি-কল্পনা-বর্ণবৈচিত্র্যে পরম আঢ্য কবি-কল্পনা,-তখন পক্ষপাতিত্ব ব্যাপারটি যথেষ্ট কঠিন হয়ে ওঠে। সবুজ পত্রের যুগের কবির অত্যাশ্চার্য সৃষ্টি-ক্ষমতায় আমরা মুগ্ধ-”বলাকা’ ‘পলাতকা’ ‘কালো মেয়ে ‘হৈমন্তী’ ‘শেষের রাত্রি’ ‘বশি প্রভৃতি কবিতা আর ছোটো গল্প পড়লে কে না মুগ্ধ হয়-বাস্তবিক, দার্শনিকতা আর কল্পনার অদ্ভুত মিলনে সবুজপত্রের যুগ খুবই লক্ষ্যযোগ্য; তবু সাধনার যুগ থেকে এ-যুগ মোটের উপর শিল্প-গৌরবে শ্রেষ্ঠতর কি না সে-সম্বন্ধে আমরা কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারিনি।
আগেই বলা হয়েছে, বলাকার অনেক কবিতাই সুন্দর কবিতা। এর “স্বর্গ কোথায় জানিস্ কি তা ভাই” শীর্ষক কবিতার নৃত্যদোদুল’ ছন্দটি বড় মর্মস্পর্শী। “অশ্রুজলে চিরশ্যাম ধরণীর স্বর্গখণ্ডগুলির প্রতি চিরকালই কবির অপরিসীম মমতা। এখানে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, চির-আরামের কল্পিত স্বর্গের পানে কবি আর চাইতেই চান না। সে-স্বর্গ স্বৰ্গই নয়। অনন্ত সুখে আর অনন্ত দুঃখে বিচিত্র যে মাটির ধরার জীবন, তার চমৎকারিত্ব আর সত্যতা কবির চোখে এত বেশি যে, সে-কথা ভেবে আনন্দে তিনি যেন নৃত্য করূছেন!
স্বর্গ কোথায় জানিস্ কি তা, ভাই?
“সাধনা”, বঙ্গদর্শন”
“সবুজপত্র” এর কোন্ যুগ রবীন্দ্র-প্রতিভার শ্রেষ্ঠ যুগ এ অনুসন্ধানে কোনো সন্তোষজনক ফললাভ বোধ হয় সম্ভবপর নয়। তার চেয়ে সমগ্র রবীন্দ্রকাব্যসাহিত্য এক মহাকাব্য (জীবন-বেদ) আর বিভিন্ন কাব্য তারই বিভিন্ন পরিচ্ছেদ বা সর্গ, এইভাবে দেখলে বোধ হয় রবীন্দ্র-প্রতিভার স্বরূপ উপলব্ধি কিছু সহজসাধ্য হবে।
৪৯৭
শাশ্বত বঙ্গ ৩২
তা’র ঠিক ঠিকানা নাই! তার আরম্ভ নাই, নাইরে তাহার শেষ,
ওরে নাইরে তাহার দেশ,
ওরে, নাইরে তাহার দিশা, ওরে নাই রে দিবস, নাই রে তাহার নিশা।
ফিরেছি সেই স্বর্গে শূন্যে শূন্যে
ফাঁকির ফাঁকা মানুষ। কত যে যুগ-যুগান্তরের পুণ্যে জন্মেছি আজ মাটির পরে ধূলামাটির মানুষ।
স্বর্গ আজি কৃতার্থ তাই আমার দেহে, আমার প্রেমে, আমার স্নেহে,
আমার ব্যাকুল বুকে, আমার লজ্জা, আমার সজ্জা, আমার দুঃখে সুখে।
আমার জন্ম-মৃত্যুরি তরঙ্গে নিত্য নবীন রঙের ছটায় খেলায় সে যে রঙ্গে।
রসের এমন অনুপম উপলব্ধির জন্যই রবীন্দ্রনাথ এত তাত্ত্বিকতা সত্ত্বেও চমৎকার কবি-যেমন চমৎকার কবি কালিদাস, যেমন চমৎকার কবি হাফিজ।
বলাকা’ কবিতাটির কথা আগেই বলা হয়েছে। বলাকারত্নহারের এ মধ্যমণি। গতির যে জগদ্ব্যাপী কালব্যাপী তত্ত্ব, রবীন্দ্রনাথের অলৌকিক প্রতিভায় তা যে-ভাবে বিগ্রহান্বিত হয়েছে, তার সামনে আনন্দে বিস্ময়ে শ্রদ্ধায় শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে
হয়!
হে হংস-বলাকা, আজ রাত্রে মোর কাছে খুলে দিলে স্তব্ধতার ঢাকা।
শুনিতেছি আমি এই নিঃশব্দের তলে
শূন্যে জলে স্থলে অমনি পাখার শব্দ উদ্দাম চঞ্চল।
তৃণদল মাটির আকাশ পরে ঝাঁপটিছে ডানা; মাটির আঁধার নীচে কে জানে ঠিকানা
মেলিতেছে অঙ্কুরের পাখা
লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকা। দেখিতেছি আমি আজি
এই গিরিরাজি,
৪৯৮
এই বন, চলিয়াছে উন্মুক্ত ডানায় দ্বীপ হ’তে দ্বীপান্তরে, অজানা হইতে অজানায়।
নক্ষত্রের পাখার স্পন্দনে চমকিছে অন্ধকার আলোর ক্রন্দনে।
শুনিলাম মানবের কত বাণী দলে দলে
অলক্ষিত পথে উড়ে চলে অস্পষ্ট অতীত হ’তে অস্ফুট সুদূর যুগান্তরে।
শুনিলাম আপন অন্তরে অসংখ্য পাখীর সাথে
দিনে রাতে এই বাসা-ছাড়া পাখী ধায় আলো-অন্ধকারে কোন পার হতে কোন পারে! ধ্বনিয়া উঠিছে শূন্য নিখিলের পাখার এ গানে “হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোন্ খানে!”
গ্যেটের ফাউন্টু-এর প্রারম্ভে দেবদূতদের যে স্তুতি আছে, তারই বিরাট ভাবধারণা এর সঙ্গে তুলিত হতে পারে।
পলাতকা
বলাকায় রবীন্দ্র-প্রতিভায় যে জোয়ার এসেছে পলাতকায় তাতে ভাটা পড়েনি, শুধু তার দিগদিগন্তব্যাপী ফেনোচ্ছল তরঙ্গভঙ্গের পালা চুকে গেছে; মানুষের অত্যন্ত আপনার জনের মতন সে জোয়ার এখন তার দ্বারের সামনে দিয়ে বইছে-বিস্তৃত প্রশান্ত আনন্দরশিদীপ্ত তার রূপ।
এর এমন মনোরম ভঙ্গিমা আর অব্যর্থ কবিদৃষ্টি সূর্যালোকের মতন যার উপর পড়েছে তারই সমগ্র রূপ উন্মুক্ত হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রথম কবিতা পলাতকা আংশিক উদ্ধৃত করছি
কুকুরছানা বারে বারে এসে
কাছে ঘেঁসে ঘেঁসে কেঁদে কেঁদে চোখের চাওয়ায় শুধায় জনেজনে, “কোথায় গেল, কোথায় গেল, কেন তারে না দেখি অঙ্গনে?”
আহার ত্যেজে বেড়ায় সে যে, এল না তার সাথী।
৪৯৯
আঁধার হ’ল, জ্বলল ঘরে বাতি;
উঠল তারা; মাঠে মাঠে নামূল নীরব রাতি। আতুর চোখের প্রশ্ন নিয়ে ফেরে কুকুর বাইরে ঘরে,
“নাই সে কেন, যায় কেন সে কাহার তরে?” কেন যে তা সেই কি জানে? গেছে সে যার ডাকে
কোনো কালে দেখে নাই যে তাকে। আকাশ হ’তে, আলোক হ’তে, নতুন পাতার কাঁচা সবুজ হতে
দিশাহারা দখিন হাওয়ার স্রোতে রক্তে তাহার কেমন এলোমেলো
কিসের খবর এলো! বুকে যে তার বাজল বাঁশি বহুযুগের ফাগুন-দিনের সুরে
কোথায় অনেক দূরে রয়েছে তার আপন চেয়ে আরো আপন জন।
তারেই অন্বেষণ জন্ম হ’তে আছে যেন মর্মে তারি লেগে,
আছে যেন ছুটে চলার বেগে, আছে যেন চল-চপল চোখের কোণে জেগে।
কোনো কালে চেনে নাই সে যারে সেই তো তাহার চেনাশুনার খেলাধূলা ঘোচায় একেবারে।
আঁধার তা’রে ডাক দিয়েছে কেঁদে,
আলোক তা’রে রাখল না আর বেঁধে। পলাতকার আর-একটি কবিতা আংশিক উদ্ধৃত করে আমরা এ আলোচনা শেষ করব। দ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ আর বংশীধর রবীন্দ্রনাথ কি গাঢ় আলিঙ্গনে এক হয়ে গেছেন, পলাতকার এইসব কবিতার ভিতরে তাই উপলব্ধির বস্তু
ঘুরে ঘুরে উমেদারির ব্যর্থ আশে। শুকিয়ে মরি বরাদুরে আর উপবাসে।
প্রাণটা হাঁপায়, মাথা ঘোরে, তক্তপোষে শুয়ে পড়ি ধপাস্ করে। হাত-পাখাটার বাতাস খেতে খেতে হঠাৎ আমার চোখ পড়ে যায় উপরেতে,
মচে-পড়া গরাদে ঐ, ভাঙা জালাখানি, ব’সে আছে পাশের বাড়ীর কালো মেয়ে নন্দরাণী।
ঐ যে ওদের কালো মেয়ে নন্দরাণী যেমনতর ওর ভাঙা ঐ জালাখানি, যেখানে ওর কালো চোখের তারা।
৫০০
কালো আকাশতলে দিশাহারা; যেখানে ওর এলোচুলের স্তরে স্তরে বাতাস এসে কত খেলা আলসভরে; যেখানে ওর গভীর মনের নীরব কথাখানি আপন দোসর খুঁজে পেত আলোর নীরব বাণী;
তেমনি আমার বাঁশের বাঁশি আপন-ভোলা চারদিকে মোর চাপা দেয়াল, ঐ বাঁশিটি আমার জানলা খোলা।
ঐ খানেতেই গুটিকয়েক তান। ঐ মেয়েটির সঙ্গে আমার ঘুচিয়ে দিত অসীম ব্যবধান।
এ সংসারে অচেনাদের ছায়ার মতন আনাগোনা, কেবল বাঁশির সুরের দেশে দুই অজানার রইল জানাশোনা।
এই এক অসাধারণ প্রতিভার সঙ্গলাভ আমরা এতক্ষণ করলাম, বলা যেতে পারে,-নিত্যজাগরণ যার ধর্ম। বাঙালির ভবিষ্যৎ হয়ত মন্দ নয়; এক শত বৎসরের ভিতরে বাঙালির ঘরে জন্মেছেন রামমোহন, মধুসূদন, রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ। এদের
একজনকে এক শত বৎসরে পেলে একটি সমাজ নিজেকে ধন্য মনে করতে পারে।
আধুনিক বঙ্গসাহিত্য রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে যে প্রভাবান্বিত সে কথা বলবার দরুকার করে না। কিন্তু আজ পর্যন্ত রবীন্দ্র-প্রতিভার চাকচিক্যেই যে আমরা মুগ্ধ হয়ে রয়েছি, তা’র প্রতি স্থির দৃষ্টিতে চাইবার আকাঙ্ক্ষা আমাদের অন্তরে তেমন প্রবল হয় নি-এ কথা ভাববার সময় এসেছে।
রবীন্দ্রনাথ আজ বিশ্ববিখ্যাত পুরুষ। তাঁর খ্যাতিতে বাঙালি গৌরবান্বিত। কিন্তু তার এ খ্যাতিকে সত্যিকার খ্যাতিতে রূপান্তরিত করবার, অর্থাৎ, তাঁর প্রতিভাকে একটা জাতির জীবনের বস্তু করে তাকে সার্থকতা দান করবার, শ্রেষ্ঠ অধিকার যে বাঙালিরই আছে, এ কথা ভুললে চলবে না। বাঙালির অত্যন্ত অসম্পূর্ণ জাতীয়জীবন ও সাহিত্যের জন্য এর প্রয়োজন বড় বেশি।
রবীন্দ্রনাথের বহু সুন্দর সৃষ্টির সামান্য সামান্য পরিচয় আমরা এতক্ষণ পেয়েছি। কিন্তু তাঁর সমগ্র কাব্যশতদল আশ্রয় করে ফুটে রয়েছে যে এক মহিমান্বিত প্রতিভা, বিধাতার হাতের সেই অপূর্ব সৃষ্টির মাহাত্ম উপলব্ধির অধিকারী-শ্রদ্ধাবান্ মার্জিতবুদ্ধি
শ্রম-অকাতর পাঠক।
আষাঢ়, ১৩৩১
৫০১