হিন্দুবিবাহ

সায়ান্স্‌ অ্যাসোসিয়েশন হলে পঠিত

অধ্যাপক সীলি তাঁহার Natural Religion নামক গ্রন্থের একস্থলে লিখিয়াছেন :

Among the crowd of Voltairian abbes we can fancy some in whom the conflict between inherited and imbibed ways of thinking may have destroyed belief and energy alike. Those who live in the decay of Churches and systems of life are exposed to such a paralysis. They have been made all that they are by the system; their mode of thought and feeling, their very morality has grown out of it. But at a given moment the system is struck with decay. It falls out of the current of life and thought. Then the faith which had long been genuine, even if mistaken, which had actually inspired vigorous action and eloquent speech, begins to ebb. The vigour begins to be spasmodic, the eloquence to ring hollow, the loyalty to have an air of hopeless self-sacrifice. Faith gradually passes into conventionalism. A later stage comes when the depression, the uneasiness, the misgiving have augmented tenfold. It is then that in an individual here and there the moral paralysis sets in. In the ardour of conflict they have pushed in to the foreground all the weakest parts of their creed, and have learnt the habit of asserting most vehemently just what they doubt most, because it is what is most denied. As their own belief ebbs away from them they are precluded from learning a new one, because they are too deeply pledged, have promised too much, asseverated too much, and involved too many others with themselves. Happy those in such a situation who either are not too clear-sighted or cling to a system not entirely corrupt! There is an extreme case when what is upheld as divine has really become a source of moral evil, while the champion is one who cannot help seeing clearly. As he becomes reluctantly enlightened as his advocacy grows first a little forced, then by degrees consciously hypocritical, until in the end he secretly confesses himself to be on the wrong side, what a moral dissolution !

ইহার মর্মার্থ :

যাঁহারা কোনো পুরাতন ধর্মপ্রণালী অথবা সমাজতন্ত্রের জীর্ণদশায় জন্মগ্রহণ করেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই প্রাচীন সংস্কারের সহিত নূতন শিক্ষার বিরোধবশত বিশ্বাস ও বল হারাইয়া নৈতিক পঙ্গু-অবস্থা প্রাপ্ত হন। তাঁহারা সেই সমাজতন্ত্রের মধ্যেই গঠিত হইয়াছেন, তাঁহাদের মনোবৃত্তি ও চিন্তাপ্রণালী, এমন-কি, ধর্মনীতি সেই সমাজ হইতেই উদ্ভূত হইয়াছে। কিন্তু কখন এক সময়ে সেই সমাজে জরা প্রবেশ করিয়াছে; সে-সমাজ মানবের বুদ্ধি ও জীবনস্রোতের বাহিরে গিয়া পড়িয়াছে। যে অকপট বিশ্বাস পূর্বে সকলকে উদ্যমশীল কার্যে ও আবেগপূর্ণ বক্তৃতায় প্রবৃত্ত করিয়াছে এখন সে-বিশ্বাস ক্ষীণ হইয়া আসিতে থাকে। তাহার জীবন্ত উদ্যম ক্বচিৎ ক্ষণস্থায়ী চকিত চেষ্টায় পর্যবসিত হয়; তাহার বক্তৃতাবেগ শূন্যগর্ভ বলিয়া বোধ হয় এবং তাহার নিষ্ঠা অত্যন্ত আশাহীন আত্মবলিদানের ন্যায় প্রতিভাত হইতে থাকে। আন্তরিক বিশ্বাস ক্রমে বাহ্য প্রথায় পরিণত হয়। ক্রমে অবসাদ অশান্তি ও সংশয় বাড়িতে থাকে। এই মতবিরোধের সময় কতকগুলি লোক উঠেন, তাঁহারা বিবাদে উত্তেজিত হইয়া তাঁহাদের মতের জীর্ণতম অংশগুলিই সম্মুখে সাজাইয়া আস্ফালন করিতে থাকেন; যেগুলি মনে মনে সর্বাপেক্ষা অধিক সন্দেহ করেন সেইগুলিই তাঁহারা সর্বাপেক্ষা অধিক উৎসাহের সহিত ঘোষণা করেন, কারণ বিরোধী পক্ষ সেইগুলিকেই অধিকতর অবিশ্বাস করিয়া থাকে। ক্রমে এতদূর পর্যন্ত হইতে পারে যে, যাহা নৈতিক দুর্দশার কারণ তাহাকেই তাঁহারা স্বর্গীয় বলিয়া প্রচার করেন, অথচ ইহার অসংগতি নিজেই মনে মনে না বুঝিয়া থাকিতে পারেন না। প্রথমে অল্পে অল্পে চোখ ফুটিতে থাকে এবং জোর করিয়া নিজমত সমর্থন করেন, পরে ক্রমে আপন মত অন্যায় জানিয়াও স্পষ্ট কাপট্য অবলম্বন করেন।

অধ্যাপক সীলির এই বর্ণনার সহিত আমাদের সমাজের বর্তমান অবস্থার কী আশ্চর্য ঐক্য। নূতন শিক্ষাপ্রাপ্ত বঙ্গভূমির নূতন চিন্তাস্রোত ও জীবনস্রোতের সহিত প্রাচীন সমাজতন্ত্র মিশিতে পারিতেছে না। সুতরাং প্রাচীন সমাজের প্রচলিত বিশ্বাসবলে যে-সকল বৃহৎকার্য যেরূপ প্রবল বেগে সম্পন্ন হইতে পারিত, এখন আর সেরূপ হইবার সম্ভাবনা নাই। তখনকার জীবন্ত বিশ্বাস এখন জীবনহীন প্রথায় পরিণত হইয়াছে। অবসাদ অশান্তি ও সংশয়ে আমাদের সমাজ ভারাক্রান্ত, এবং আমাদের মধ্যে একদল লোক উঠিয়াছেন, তাঁহারা পরমসূক্ষ্ম কূটযুক্তি দ্বারা প্রাচীন মতের পক্ষ সমর্থন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন; এবং বোধ করি একদল রূঢ়স্বভাব সংবাদপত্রব্যবসায়ীর মধ্যে এ সম্বন্ধে কাপট্যের লক্ষণও দেখা দিয়াছে।

সম্প্রতি আমাদের দেশে একদলের মধ্যে এই-যে প্রাচীনতার একান্ত পক্ষপাত দেখা যায়, তাহার কতকগুলি কারণ ঘটিয়াছে। প্রথমত, নূতন শিক্ষার প্রভাবে আমরা অনেকগুলি নূতন কর্তব্য প্রাপ্ত হইয়াছি; কিন্তু আমাদের অনভ্যাস, পূর্বরাগ, স্বাভাবিক জড়ত্ব ও ভীরুতাবশত আমরা তাহা সমস্ত পালন করিয়া উঠিতে পারি না। আলস্যের দায়ে ও সমাজের ভয়ে অনেক সময়ে তাহার বিপরীতাচরণ করিয়া থাকি। কিন্তু অসম্পন্ন কর্তব্যের লাঞ্ছনা মানুষ চিরদিন সহিয়া থাকিতে পারে না। কেন বিশ্বাস করিতেছি একরূপ এবং কাজ করিতেছি অন্যরূপ, তাহার সন্তোষজনক কৈফিয়ত দিতে ইচ্ছা করে। সুতরাং কিছুদিন পরে নূতন বিশ্বাসের খুঁত ধরিতে আরম্ভ করা যায়। নূতন শিক্ষালব্ধ কর্তব্য যে অকর্তব্য, এবং আমরা যাহা করিয়া আসিতেছি ঠিক তাহাই করা যে উচিত, প্রাণপণ সূক্ষ্মযুক্তি দ্বারা ইহাই প্রমাণ করিতে প্রবৃত্ত হওয়া যায়। কিন্তু এরূপ স্থলে সাধারণত যুক্তিগুলি কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত সূক্ষ্ম হইয়া পড়ে; এত সূক্ষ্ম হয় যে সেই যুক্তিভেদ করিয়া যুক্তিকর্তার হৃদয়ের প্রচ্ছন্ন অবিশ্বাস কখনো কখনো কিছু কিছু দৃষ্টিগোচর হইতে থাকে।

দ্বিতীয়ত, পুরাতনের উপর যখন একবার আমাদের বিশ্বাস শিথিল হইয়া যায়,তখন আমরা অনেক সময় অবিচারে নূতনকে হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশাধিকার দিই। নূতনের উপর প্রকৃত বিশ্বাসবশতই যে তাহাকে সকল সময়ে আমরা হৃদয়ে স্থান দিই তাহা নহে, অনেক সময়ে পুরাতনের প্রতি আড়ি করিয়া তাহাকে অভ্যর্থনা করিয়া আনি। আমরা গৃহশত্রুর প্রতি আড়ি করিয়া কখনো কখনো বহিঃশত্রুকে গৃহে আহ্বান করিয়া থাকি। অবশেষে উপদ্রব সহ্য করিয়া যখন চৈতন্য হয় তখন আগাগোড়া নূতনের উপরে বিরাগ জন্মে। যখন এ দেশে নূতন কালেজ হয় তখন শিক্ষিত যুবকেরা যে অনেকগুলি উৎপাত আপন গৃহচালের উপরে ডাকিয়া আনিয়াছিলেন, সে কেবল পুরাতনের উপরে আড়ি করিয়া বৈ তো নয়। এখনকার একদল লোক সেই-সকল উৎপাতমিশ্রিত নূতন মতকে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য বলিয়া প্রমাণ করিবার জন্য কৃতসঙ্কল্প হইয়াছেন।

তৃতীয়ত, আমরা পরাধীন জাতি। আমরা পরের কাছে অপমানিত, সুতরাং ঘরে সম্মানের প্রত্যাশী। এইজন্য আমরা ইংরেজকে বলিতে চাহি– ইংরেজ, তোমাদের শস্ত্র বড়ো, কিন্তু আমাদের শাস্ত্র বড়ো; তোমার রাজা, আমরা আর্য। এককালে আমাদের যাহা ছিল এখনো যেন তাহাই আছে, এইরূপ ভান করিয়া অপমানদুঃখ ভুলিয়া থাকিতে চাই। দেহে বল ও হৃদয়ের সাহস নাই যে অপমান হইতে আপনাকে রক্ষা করিতে পারি, সুতরাং পুরাণ ও সংহিতা, চটুল রসনা ও কূটযুক্তির দ্বারা আবৃত হইয়া আপনাকে বড়ো বলিয়া মনে করিতে ইচ্ছা হয়। যে-সকল আচারের অস্তিত্ব হয়তো আমাদের অপমানের অন্যতম কারণ সেগুলি দূর করিতে সাহস হয় না, এইজন্য তাহাদের প্রতি আর্য আধ্যাত্মিক পবিত্র প্রভৃতি বিশেষণ প্রয়োগ করিয়া আপনাদিগকে পরমসম্মানিত জ্ঞান করি। এইরূপে অনেক সময়ে অপমানজ্বালা বিস্মৃত হইবার অভিপ্রায়েই আমরা অপমানের কারণ স্বহস্তে স্বদেশে বদ্ধমূল করিয়া দিই।

চতুর্থত, ভাবেগতিকে বোধ হয়, কেহ কেহ মনে করেন প্রাচীনতাকে অবলম্বন করা আমাদের political উন্নতির পক্ষে আবশ্যক। তাহাকে বিশ্বাস করি বা না করি, তাহা সত্যই হউক আর মিথ্যাই হউক, তাহাকে সম্পূর্ণ সত্য বলিয়া মনে করিলে আমাদের কতকগুলি বিষয়ে কতকগুলি লাভ আছে। কিন্তু সত্যমিথ্যার প্রতি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হইয়া এরূপ লাভক্ষতি গণনা করিয়া যে দেশের কোনো স্থায়ী ও বৃহৎ কাজ করা যায় এরূপ আমার বিশ্বাস নহে।

আমাদের দেশে কিছুকাল হইল হিন্দুবিবাহ লইয়া আলোচনা পড়িয়াছে। যাঁহারা এই আলোচনা তুলিয়াছেন তাঁহারা অনেকেই সাধারণের শ্রদ্ধার পাত্র এবং আমাদের বঙ্গসাহিত্যের শীর্ষস্থানীয় বলিয়া গণ্য। কিন্তু তাঁহারা কেহই হিন্দুবিবাহের শাস্ত্রসম্মত ঐতিহাসিকতা বা বিজ্ঞানসম্মত উপযোগিতার বিষয় বড়ো-একটা-কিছু বলেন নাই, কেবল সূক্ষ্মযুক্তি ও কবিত্বময় ভাষা প্রয়োগ করিয়া হিন্দুবিবাহের পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিকতা সপ্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। হিন্দুসভ্যতার ইতিহাসে ক্রমে ক্রমে হিন্দুবিবাহের বিস্তর রূপান্তর ঘটিয়াছে–ইহার মধ্যে কোন্‌ সময়ের বিবাহকে যে তাঁহারা হিন্দুবিবাহ বলেন, তাহা ভালোরূপ নির্দেশ করেন নাই। যদি বঙ্গদেশের উচ্চবর্ণের মধ্যে প্রচলিত বর্তমান বিবাহকে হিন্দুবিবাহ বলেন, তবে প্রাচীন শাস্ত্র হইতে তাহার পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিকতা প্রমাণ করিবার চেষ্টা কেন। প্রাচীনকালে স্ত্রীপুরুষের মধ্যে যেরূপ সম্বন্ধ ছিল, এখন সেরূপ আছে কি না সে বিষয়ে কিছুই বলা হয় না। অতএব সেকালের শাস্ত্রোক্তি এখন প্রয়োগ করিলে অনেক সময়ে চোখে ধুলা দেওয়া হয়। হিন্দুবিবাহের পবিত্রতা সম্বন্ধে যদি কেহ বৈদিক বচন উদ্‌ধৃত করেন তাঁহার জানা উচিত যে, বৈদিক কালে স্ত্রীপুরুষের সামাজিক ও গার্হস্থ্য অবস্থা আমাদের বর্তমান কালের ন্যায় ছিল না। যিনি হিন্দুবিবাহের পক্ষে পুরাণ ইতিহাস উদ্‌ধৃত করেন, তিনি এক মহাভারত সমস্ত পড়িয়া দেখিলে অকূল সমুদ্রে পড়িবেন। মহাভারতের নানা কাহিনীতে বিবাহ সম্বন্ধীয় নানা বিশৃঙ্খলা বর্ণিত হইয়াছে; ঐতিহাসিক পদ্ধতি-অনুসারে তাহার ভালোরূপ সমালোচনা ও কালাকাল নির্ণয় না করিয়া কোনো কথা বলা উচিত হয় না। যিনি মনুসংহিতার দোহাই দেন তাঁহার প্রতি আমার গুটিকতক বক্তব্য আছে। প্রথমত, মনুসংহিতা যে-সমাজের সংহিতা সে-সমাজের সহিত আমাদের বর্তমান সমাজের মূলগত প্রভেদ। শিক্ষার ঐক্য নাই অথচ সমাজের ঐক্য আছে, ইহা প্রমাণ করিতে বসা বিড়ম্বনা। মনুসংহিতায় ব্রাহ্মণের শিক্ষাপ্রণালী যেরূপ নির্দিষ্ট আছে তাহা যে বঙ্গদেশে কোন্‌কালে প্রচলিত ছিল নির্ণয় করা কঠিন। তিন দিনের মধ্যে নিতান্ত জো-সো করিয়া ব্রহ্মচর্যব্রতের অভিনয় সমাপনপূর্বক আমাদের দেশে ব্রাহ্মণ বহুকাল হইতে দ্বিজত্ব প্রাপ্ত হইয়া আসিতেছেন। কোথায় বা গুরুগৃহে বাস, কোথায় বা বেদাধ্যয়ন, কোথায় বা কঠিন ব্রতাচরণ। অতএব প্রথমেই দেখা যাইতেছে, মনুসংহিতার মতে যে-মানুষ গঠিত হইত, এখনকার মতে সে-মানুষ গঠিত হয় না। দ্বিতীয়ত, মনু পুরুষের পক্ষে বিবাহের যে-বয়স নির্দেশ করিয়া দিয়াছেন, তাহাই বা কোথায় পালিত হইয়া থাকে। তৃতীয়ত, বিবাহের পরে মনু স্ত্রীপুরুষের পরস্পর সংসর্গের যে-সকল নিয়ম স্থির করিয়াছেন, তাহাই বা কয়জন লোক জানে ও পালন করে। তবে, আপন সুবিধামত মনু হইতে দুই-একটা শ্লোক নির্বাচন করিয়া বর্তমান দেশাচার-প্রচলিত বিবাহপ্রথার পক্ষে প্রয়োগ করা সকল সময়ে সংগত বোধ হয় না। তবে যদি কেহ বলেন, আমাদের বর্তমান প্রথাসকল হিন্দুশাস্ত্রসম্মত বিশুদ্ধতা হারাইয়াছে, অতএব আমরা মনুকে আদর্শ করিয়াই আমাদের বিবাহাদিপ্রথার সংস্কার করিব, কারণ সেকালের বিবাহাদি পবিত্র ও আধ্যাত্মিক ছিল, তবে আমার জিজ্ঞাস্য এই–বিবাহাদি সম্বন্ধে মনুর সমস্ত নিয়ম নির্বিচারে গ্রহণ করিবে, না আপনাপন মতানুসারে স্থানে স্থানে বর্জন করিয়া সংহিতাকে আপন সুবিধা ও নূতন শিক্ষার অনুবর্তী করিয়া লইবে। মনুসংহিতা স্ত্রীপুরুষের যে সম্বন্ধ নির্ণয় করিয়া দিয়াছেন তাহার সমস্তটাই পবিত্র ও আধ্যাত্মিক, না তুমি তাহার মধ্য হইতে যেটুকু বাদসাদ দিয়া লইয়াছ সেইটুকু পবিত্র ও আধ্যাত্মিক?

আমরা যে শাস্ত্র হইতে বাদসাদ দিয়া কিয়দংশ উদ্‌ধৃত করিয়া দেশানুরাগে কথঞ্চিৎ অন্ধ হইয়া আপন ঘরগড়া মতকে প্রাচীন বলিয়া প্রতিপন্ন করি, এখানে তাহার দুই একটি উদাহরণ দিতে চাই।

শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত চন্দ্রনাথ বসু পরম ভাবুক জ্ঞানবান ও সহৃদয়। তাঁহার শকুন্তলা সমালোচন তাঁহার আশ্চর্য প্রতিভার পরিচয় দিয়াছে। আমি যতদূর জানি বাংলায় এরূপ গ্রন্থ আর নাই। বাংলার পাঠকসাধারণে চন্দ্রনাথবাবুকে বিশেষ শ্রদ্ধা করিয়া থাকে। এইজন্য কিছুকাল হইল তিনি “হিন্দুপত্নী’ এবং “হিন্দুবিবাহের বয়স ও উদ্দেশ্য’ নামে যে-দুই প্রবন্ধ প্রচার করেন তাহা সাধারণ্যে অতিশয় আদৃত হইয়াছে। উক্ত প্রবন্ধে তিনি হিন্দুবিবাহের আধ্যাত্মিকতা ও হিন্দুদম্পতির একীকরণতা সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, তাহা আজকাল গুটিকতক কাগজে অবিশ্রান্ত প্রতিধ্বনিত হইতেছে। ইনি উক্ত প্রবন্ধদ্বয়ে হিন্দুবিবাহ এবং তাহার আনুষঙ্গিকস্বরূপে বাল্যবিবাহ সম্বন্ধে যতটা বলিয়াছেন, তাঁহার পরবর্তী আর কেহ ততটা বলেন নাই। খ্যাতনামা গুণী ও গুণজ্ঞ লেখক শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার সরকার মহাশয় চন্দ্রনাথবাবুর বিবাহ প্রবন্ধের উল্লেখ করিয়া বলেন, “হিন্দুবিবাহের ওরূপ পরিষ্কার ব্যাখ্যা আর কোথাও নাই।” অতএব উক্ত সর্বজনমান্য প্রবন্ধদ্বয়কে মুখ্যত অবলম্বন করিয়া আমি বর্তমান প্রবন্ধ রচনা করিয়াছি, এবং এই উপলক্ষে আমার মতামত যথাসাধ্য ব্যক্ত করিয়াছি।

চন্দ্রনাথবাবু তাঁহার “হিন্দুপত্নী’ প্রবন্ধে বলিয়াছেন :

খ্রীষ্টধর্মের আবির্ভাবের বহুপূর্বে ভারতে হিন্দুজাতি স্ত্রীজাতিকে অতি উৎকৃষ্ট ও মাননীয় বলিয়া বুঝিয়াছিল এবং অপর দেশে খ্রীষ্টধর্ম স্ত্রীজাতিকে যত উচ্চ করিয়া তুলিয়াছিল ভারতের হিন্দু ভারতের স্ত্রীকে তদপেক্ষা অনেক উচ্চ আসনে বসাইয়াছিল। খ্রীষ্টধর্ম স্ত্রীকে পুরুষের সমান করিয়াছিল; হিন্দুধর্ম স্ত্রীকে পুরুষের সমান করে নাই, পুরুষের দেবতা করিয়াছিল। “যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।’ যেখানে নারী পূজিতা হন সেখানে দেবতা সন্তুষ্ট হন।

প্রাচীন কালে স্ত্রীলোকের অবস্থা কিরূপ ছিল তাহা আমি বলিতে পারি না, কারণ আমি সংস্কৃতভাষায় ব্যুৎপন্ন নহি এবং আমার শাস্ত্রজ্ঞান যথেষ্ট পরিমাণে নাই। কিন্তু আজকাল মুখে ও লেখায় ও অনুবাদে শাস্ত্রচর্চা দেশে এতটুকু ব্যাপ্ত হইয়াছে যে, শাস্ত্রসম্বন্ধে কথঞ্চিৎ আলোচনা করিবার অধিকার অনেকেরই জন্মিয়াছে। চন্দ্রনাথবাবুর মত সত্য কি মিথ্যা তাহা সাহস করিয়া বলিতে পারি না, কিন্তু এটুকু বলিতে পারি যে, চন্দ্রনাথবাবু তাঁহার মত ভালোরূপ প্রমাণ করিতে পারেন নাই। তিনি যেমন দুই-একটি শ্লোক আপন মতের স্বাপক্ষ্যে উদ্‌ধৃত করিয়াছেন, আমিও তেমনই অনেকগুলি শ্লোক তাঁহার মতের বিপক্ষে উদ্‌ধৃত করিতে পারি। কিন্তু মনুসংহিতায় স্ত্রীনিন্দাবাচক যে-সকল শ্লোক আছে তাহা উদ্‌ধৃত করিতে লজ্জা ও কষ্ট বোধ হয়। যাঁহারা জানিতে চাহেন তাঁহারা মনুসংহিতার নবম অধ্যায়ে চতুর্দশ পঞ্চদশ ও ষোড়শ শ্লোক পাঠ করিবেন, আমি কেবল সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শ্লোক এইখানে পাঠ করি।

শয্যাসনমলংকারং কামং ক্রোধমনার্জবং
দ্রোহভাবং কুচর্যাঞ্চ স্ত্রীভ্যো মনুরকল্পয়ৎ।

শয্যা, আসন, অলংকার, কাম, ক্রোধ, কুটিলতা, পরহিংসা ও কুৎসিত আচার স্ত্রীলোক হইতে হয় ইহা মনু কল্পনা করিয়াছেন।

নাস্তি স্ত্রীণাং ক্রিয়া মন্ত্রৈরিতি ধর্মোব্যবস্থিতঃ
নিরিন্দ্রিয়াহ্যমন্ত্রাশ্চ স্ত্রিয়োহনৃতমিতি স্থিতিঃ।

যেহেতুক স্ত্রীলোকের মন্ত্রদ্বারা কোনো ক্রিয়া নাই ধর্মের এইরূপ ব্যবস্থা, অতএব ধর্মজ্ঞানহীন মন্ত্রহীন স্ত্রীগণ অনৃত, মিথ্যা পদার্থ।

এ-সকল শ্লোকের দ্বারা স্ত্রীলোকের সম্মান কিছুমাত্র প্রকাশ পায় না। চন্দ্রনাথবাবু তাঁহার প্রবন্ধের একস্থলে হিন্দুবিবাহের সহিত কোম্‌তের মতের তুলনা করিয়াছেন। হিন্দুশাস্ত্র সম্বন্ধে আমার জ্ঞান যতদূর কোম্‌ৎশাস্ত্র সম্বন্ধে তাহা অপেক্ষাও অনেক অল্প, কিন্তু চন্দ্রনাথবাবুই এককথায় স্ত্রীজাতি সম্বন্ধে কোম্‌তের মত ব্যক্ত করিয়াছেন। সেই স্থানটি উদ্‌ধৃত করি:

বিবাহের উদ্দেশ্য ও আবশ্যকতা সম্বন্ধে হিন্দুশাস্ত্রকারদিগের মত যে কতদূর পাকা তাহা এতদিনের পর য়ুরোপে কেবল কোম্‌তের শিষ্যেরা কিয়ৎপরিমাণে বুঝিতে সক্ষম হইয়াছেন। কোম্‌ৎ মুক্তকণ্ঠে বলিয়াছেন যে, ধর্মপ্রবৃত্তি এবং হৃদয়ের গুণ সম্বন্ধে স্ত্রী পুরুষ অপেক্ষা অনেক গুণে শ্রেষ্ঠ এবং সেইজন্য স্ত্রীর সাহায্য ব্যতিরেকে পুরুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবন পূর্ণতা লাভ করিতে পারে না।

বলা বাহুল্য কোম্‌ৎ মুক্তকণ্ঠে যাহা বলিয়াছেন মনু মুক্তকণ্ঠে ঠিক তাহা বলেন নাই। মহাভারতে ভীষ্ম ও যুধিষ্ঠিরও মুক্তকণ্ঠে কোম্‌তের মত সমর্থন করেন নাই। অনুশাসনপর্বে অষ্টত্রিংশত্তম অধ্যায়ে স্ত্রীচরিত্র সম্বন্ধে ভীষ্ম ও যুধিষ্ঠিরে যে-কথোপকথন হইয়াছে, বর্তমান সমাজে তাহার সমগ্র ব্যক্ত করিবার যোগ্য নহে। অতএব তাহার স্থানে স্থানে পাঠ করি। কালীসিংহ কর্তৃক অনুবাদিত মহাভারত আমার অবলম্বন।

কামিণীগণ সৎকুলসম্ভূত রূপসম্পন্ন ও সধবা হইলেও স্বধর্ম পরিত্যাগ করে। উহাদের অপেক্ষা পাপপরায়ণ আর কেহই নাই। উহারা সকল দোষের আকর।

উহাদের অন্তঃকরণে কিছুমাত্র ধর্মভয় নাই।

তুলাদণ্ডের একদিকে যম, বায়ু, মৃত্যু, পাতাল, বাড়বানল, ক্ষুরধার, বিষ, সর্প ও বহ্নি এবং অপর দিকে স্ত্রীজাতিরে সংস্থাপন করিলে স্ত্রীজাতি কখনোই ভয়ানকত্বে উহাদের অপেক্ষা ন্যূন হইবে না। বিধাতা যে-সময় সৃষ্টিকার্যে প্রবৃত্ত হইয়া মহাভূতসমুদয় ও স্ত্রীপুরুষের সৃষ্টি করেন, সেই সময়েই স্ত্রীদিগের দোষের সৃষ্টি করিয়াছেন।

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বলিতেছেন :

পুরুষে রোদন করিলে উহারা কপটে রোদন এবং হাস্য করিলে উহারা কপটে হাস্য করিয়া থাকে।

কামিনীরা সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যারে সত্য বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে পারে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

স্ত্রীলোকের চরিত্র সম্বন্ধে যাহাদের এরূপ বিশ্বাস তাহারা স্ত্রীলোককে যথার্থ সম্মান করিতে অক্ষম, বিশেষত স্ত্রীলোক সম্বন্ধে কোম্‌ৎ-শিষ্যগণের মতের সহিত তাহাদের মতের ঐক্য হইবার সম্ভাবনা নাই।

বিবাহ সম্বন্ধে আলোচনা করিতে হইলে প্রথমত স্ত্রীলোকের ও পুরুষের অবস্থা সম্বন্ধে আলোচনা করিতে হয়। চন্দ্রনাথবাবু শাস্ত্র উদ্‌ধৃত করিয়া বলিতেছেন–প্রাচীন সমাজে স্ত্রীলোকের সবিশেষ সম্মান ছিল, কিন্তু আমি দেখিতেছি, শাস্ত্রে স্ত্রীলোকের অসম্মানেরও প্রমাণ আছে। অতএব এ বিষয়ে এখনো নিঃসংশয়ে কিছু বলিবার সময় হয় নাই।

দ্বিতীয় দ্রষ্টব্য বিষয় এই যে, বিবাহিতা স্ত্রীলোকের অবস্থা সেকালে কিরূপ ছিল। চন্দ্রনাথবাবু রঘুনন্দনের এক বচন উদ্‌ধৃত করিয়া এবং তাহার অত্যন্ত সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা করিয়া প্রমাণ করিয়াছেন যে–

হিন্দুভার্যা পুণ্য বল,পবিত্রতা বল, অলৌকিকতা বল, দেবতা বল, মুক্তি বল, সবই।

সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিবেন আমাদের দেশে সর্বসাধারণের সংস্কার এই যে, স্বামীই স্ত্রীর দেবতা, কিন্তু স্ত্রী যে স্বামীর দেবতা ইহা ইতিপূর্বে শুনা যায় নাই। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ধর্মপত্নী দ্রৌপদীকে দ্যূতক্রীড়ায় পণ স্বরূপে দান করিয়াছেন। কেহ কেহ বলিবেন, তৎপূর্বে তিনি আপনাকে দান করিয়াছিলেন। তাহার উত্তর এই যে, আপনাকে সম্মান করিতে কেহ বাধ্য নহে, কিন্তু মান্য ব্যক্তিকে সম্মান করিতে সকলে বাধ্য। দ্রৌপদী যদি সত্যই যুধিষ্ঠিরের মান্যা হইতেন, দেবতা হইতেন, তবে যুধিষ্ঠির কখনোই তাঁহাকে দ্যূতের পণ্যস্বরূপ দান করিতে পারিতেন না। প্রকাশ্য সভায় যখন দ্রৌপদী যৎপরোনাস্তি অপমানিত হইয়াছিলেন তখন ভীষ্ম-দ্রোণ ধৃতরাষ্ট্রপ্রমুখ সভাস্থগণ কে স্ত্রীসম্মান রক্ষা করিতে অগ্রসর হইয়াছিলেন। ঐ দ্রৌপদীই যখন প্রকাশ্যভাবে বিরাটসভায় কীচকের পদাঘাত সহ্য করেন তখন সমস্ত সভাস্থলে কেহই স্ত্রীসম্মান রক্ষা করে নাই। মনুসংহিতার দণ্ডবিধির মধ্যে এক স্থলে আছে :

ভার্যা পুত্রশ্চ দাসশ্চ শিষ্যোভ্রাতা চ সোদরঃ
প্রাপ্তাপরাধাস্তাড্যাঃ সূরজ্জ্বা-বেণুদলেন বা।

স্ত্রী, পুত্র, দাস, শিষ্য ও সোদর কনিষ্ঠভ্রাতা যদি অপরাধ করে সূক্ষ্ম রজ্জু অথবা বেণুদল দ্বারা শাসনার্থ তাড়ন করিবে।

দেবতার প্রতি এরূপ রজ্জু ও বেণুদলের তাড়নব্যবস্থা হইতে পারে না। স্বামীও স্ত্রীর দেবতা, কিন্তু স্বামীদেবতা স্ত্রীর হস্ত হইতে এরূপ অর্ঘ্য শাস্ত্রবিধি অনুসারে কখনো গ্রহণ করেন নাই; তবে শাস্ত্রের অনভিমতে’ সম্মার্জনীপ্রয়োগ প্রভৃতির উল্লেখ এখানে আমি করিতে চাহি না। যাহা হউক, আমার এবং বোধ করি সাধারণের বিশ্বাস এই যে, হিন্দু স্ত্রী কোনোকালে হিন্দু স্বামীর দেবতা ছিলেন না। অতএব এ স্থলে হিন্দুশাস্ত্রের সহিত কিঞ্চিৎ বলপূর্বক কোম্‌ৎশাস্ত্রের অসবর্ণ মিলন সংঘটন করা হইয়াছে।

বিবাহবিশেষ আলোচনায় তৃতীয় দ্রষ্টব্য এই যে, স্বামীস্ত্রীর দাম্পত্যবন্ধন কিরূপ ঘনিষ্ঠ। চন্দ্রনাথবাবু বলেন, হিন্দুবিবাহে যেরূপ একীকরণ দেখা যায় এরূপ অন্য কোনো জাতির বিবাহে দেখা যায় না। এ সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ বক্তব্য আছে। এক স্বামী ও এক স্ত্রীর একীকরণ বিবাহের উচ্চতম আদর্শ। সে আদর্শ আমাদের দেশে যদি জাজ্বল্যমান থাকিত তবে এ দেশে বহুবিবাহ কিরূপে সম্ভব হইত। মহাভারত পাঠে জানা যায় শ্রীকৃষ্ণের ষোড়শসহস্র মহিষী ছিল। তখনকার অন্যান্য রাজপরিবারেও বহুবিবাহদৃষ্টান্তের অসদ্ভাব ছিল না। ব্রাহ্মণ ঋষিদিগেরও একাধিক পত্নী দেখা যাইত। অন্য ঋষির কথা দূরে যাউক, বশিষ্ঠের দৃষ্টান্ত দেখো। অরুন্ধতীই যে তাঁহার একমাত্র স্ত্রী তাহা নহে, অক্ষমালা নামে এক অধম জাতীয়া নারী তাঁহার অপর স্ত্রী ছিলেন। এরূপ ব্যবস্থাকে ন্যায্যমতে একীকরণ বলা উচিত হয় না; ইহাকে পঞ্চীকরণ, ষড়ীকরণ, সহস্রীকরণ বলিলেও দোষ নাই। কেহ কেহ বলিবেন, স্ত্রী যতগুলিই থাক্‌-না-কেন, সকলগুলিই স্বামীর সহিত মিশিয়া একেবারে এক হইয়া যাইবে, ইহাই হিন্দুবিবাহের গৌরব। স্ত্রী যত অধিক হয় বিবাহের গৌরবও বোধ করি তত অধিক, কারণ একীকরণ ততই গুরুতর। কিন্তু একীকরণ বলিতে বোধ করি এই বুঝায় যে, প্রেমবিনিময়বশত স্বামীস্ত্রীর হৃদয়মনের সর্বাঙ্গীন ঐক্য; এবং এরূপ ঐক্য যে দাম্পত্যবন্ধনের পবিত্র আদর্শ তাহা কেহই অস্বীকার করিতে পারে না। কিন্তু প্রেমপ্রভাবে হৃদয়ের ঐক্য যেখানে মুখ্য আদর্শ সেখানে বহুদারপরিগ্রহ সম্ভব হইতে পারে না। স্ত্রী ও পুরুষের পরিপূর্ণ মিলন যদি হিন্দুবিবাহের যথার্থ প্রাণ হইত তবে এ দেশে কৌলীন্য বিবাহ কোনোমতে স্থান পাইত না। বিবাহের যত কিছু আদর্শের উচ্চতা সে কেবলমাত্র পত্নীর বেলায়, পতিকে সে-আদর্শ স্পর্শ করিতেছে না। কিন্তু ইহা কে অস্বীকার করিতে পারেন যে, বিবাহ পতি পত্নী উভয়ে মিলিয়া হয়। এ সম্বন্ধে শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার আশ্চর্য উত্তর দিয়াছেন। হিন্দু বিধবার ন্যায় বিপত্নীক পুরুষও যে কেন নিষ্কাম ধর্ম অবলম্বন করেন না, তৎসম্বন্ধে তিনি বলেন :

হিন্দু সাম্যবাদ মানেন না; হিন্দু মানেন অনুপাতবাদ। ক খ যখন সমান নহে তখন তাহারা সমান আসন পাইবেও না; ক যেমন তেমনই ক পাইবে, খ যেমন তেমনই খ পাইবে। ক খ মধ্যে যেরূপ সম্বন্ধ, ক-র ও খ-র স্বত্বাধিকার মধ্যে সেইরূপ অনুপাত হইবে। হিন্দু এই অনুপাতবাদী। হিন্দু স্ত্রীপুরুষের সাম্য স্বীকার করে না; কাজেই হিন্দু স্ত্রীপুরুষ মধ্যে অবস্থার সাম্য ব্যবস্থা করে না।

এ কথা যদি বল তবে কোথায় গিয়া দাঁড়াইতে হয় বলা যায় না। তুমি বলিতেছ নিষ্কামধর্মের পবিত্র মহত্ত্ব আছে; অতএব স্বামীর মৃত্যুর পর কামনা বিসর্জন দিয়া সংসারধর্ম পালন করিবার যে-অবসর পাওয়া যায়, তাহা অতি পবিত্র অবসর, সে-অবসর অবহেলা করা উচিত নহে। এখন তোমার সাম্য বৈষম্যের দোহাই দিয়া জিজ্ঞাসা করি, নিষ্কামধর্মও কি হিন্দুদের ন্যায় অনুপাতবাদ মানিয়া চলেন। পুরুষের পক্ষেও নিষ্কামধর্ম কি পবিত্র নহে, অতএব কষ্টসাধ্য হইলেও হিন্দুবিবাহের পরম একীকরণ এবং আধ্যাত্মিক মিলনের দ্বারা অনিবার্যবেগে চালিত হইয়া স্ত্রীবিয়োগে পুরুষেরও নিষ্কামধর্মব্রত গ্রহণ করা কেন অবশ্যকর্তব্য বলিয়া স্থির হয় নাই। তাহার বেলায় ক খ ও অনুপাতবাদের হেঁয়ালিধূম বিস্তার করিবার তাৎপর্য কী। পবিত্র একনিষ্ঠ অচল দাম্পত্যপ্রেম পুরুষেরও মহত্ত্বের লক্ষণ ও হৃদয়ের উন্নতির অন্যতম কারণ, তাহা কোন্‌ অনুপাতবাদী অস্বীকার করিতে পারেন।

তবে এমন যদি বল যে, আধ্যাত্মিকতা ও পবিত্রতার কথা ছাড়িয়া দাও, হিন্দুবিবাহ সাংসারিক সুবিধার জন্য, তবে সে এক স্বতন্ত্র কথা। তাহা হইলে অনুপাতবাদের হিসাব কাজে লাগিতে পারে। অক্ষয়বাবু বলেন :

অপত্যোৎপাদনের জন্যই বিবাহের প্রয়োজন, এ সিদ্ধান্ত বিবাহের অতি নিকৃষ্ট ভাগ, অতি সামান্য ভাগ দেখিয়াই হইয়াছে। হিন্দুবিবাহের অতি উচ্চতর, অতি প্রশস্ততর, অতি পবিত্র, সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য আছে; সকল ব্যাপারেই হিন্দুর আধ্যাত্মিক দিকে দৃষ্টি প্রখরা। হিন্দুর বিবাহব্যাপারেও আধ্যাত্মিক ভাবটা উজ্জ্বলরূপে প্রতিভাত।

অপত্যোৎপাদনের জন্যই বিবাহের প্রয়োজনীয়তা যে বিবাহের অতি নিকৃষ্টভাগ, অতি সামান্যভাগ এরূপ আমার বিশ্বাস নহে। এবং প্রাচীন হিন্দুরা যে ইহাকে নিকৃষ্ট ও সামান্য জ্ঞান করিতেন, আমার তাহা বোধ হয় না। শ্রদ্ধাস্পদ পণ্ডিত শ্রীযুক্ত কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য “ভারতবর্ষের ধর্মপ্রণালী’ নামক প্রবন্ধে বলিয়াছেন :

মনু প্রভৃতি ধর্মশাস্ত্রকারেরা যাহা কিছু উপদেশ করিয়াছেন, সমাজই সে সকলের কেন্দ্রস্থান, সমাজের কল্যাণ লক্ষ্য করিয়াই সেই সকল ব্যবস্থার সৃষ্টি করা হইয়াছে।

অতএব সমাজের কল্যাণের প্রতি যদি দৃষ্টিপাত করা যায় তবে অপত্যোৎপাদন বিবাহের নিতান্ত সামান্য ও নিকৃষ্ট উদ্দেশ্য কেহই বলিবেন না। সুস্থকায় সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ প্রফুল্লচিত্ত সুচরিত্র সন্তান উৎপাদন অপেক্ষা সমাজের মঙ্গল আর কিসে সাধিত হইতে পারে। পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্ষা, এ কথা আমাদের সাধারণের মধ্যে প্রচলিত। মনু কহিতেছেন :

প্রজনার্থং মহাভাগাঃ পূজার্হাগৃহদীপ্তয়ঃ।

সন্তান উৎপাদনের জন্য স্ত্রীগণ বহুকল্যাণভাগিনী পূজনীয়া ও গৃহের শোভাজনক হয়েন।

উৎপাদনমপত্যস্য জাতস্য পরিপালনং
প্রত্যহং লোকযাত্রীয়াঃ প্রত্যক্ষং স্ত্রীনিবন্ধনং।

স্ত্রীগণ অপত্যের উৎপাদন, অপত্যের পালন ও প্রত্যহ-লোকযাত্রার প্রত্যক্ষ নিদান হয়েন।

যেখানে মনু বলিয়াছেন :

যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।

সেইখানেই বলিয়াছেন :

যদিহি স্ত্রী ন রোচেত পুমাংসং ন প্রমোদয়েৎ।
অপ্রমোদাৎ পুনঃ পুংসঃ প্রজনং ন প্রবর্ততে।

নারী যদি দীপ্তি প্রাপ্ত না হন তাহা হইলে তিনি স্বামীর হর্ষোৎপাদন করিতে পারেন না। স্বামীর হর্ষোৎপাদন করিতে না পীরিলে সন্তানোৎপাদন সম্পন্ন হয় না।

এই সমস্ত দেখিয়া মনে হইতেছে সংসারযাত্রানির্বাহই হিন্দুবিবাহের মুখ্য উদ্দেশ্য। এবং কেবল সেই উদ্দেশ্যেই যতটা একীকরণ সাংসারিক হিসাবে আবশ্যক তাহার প্রতি হিন্দুধর্মের বিশেষ মনোযোগ। অনেক সময়ে সংসারযাত্রানির্বাহের সহায়তা-জন্যই পুরুষ দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করিতে বাধ্য। কারণ, অপত্য উৎপাদন যখন বিবাহের প্রধান উদ্দেশ্য তখন বন্ধ্যা স্ত্রী সত্ত্বে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ শাস্ত্রমতে অন্যায় হইতে পারে না। এমন-কি, প্রাচীনকালে অশক্ত স্বামীর নিয়োগানুসারে অথবা নিরপত্য স্বামীর মৃত্যুতে দেবরের দ্বারা সন্তানোৎপাদন স্ত্রীলোকের পক্ষে ধর্মহানিজনক ছিল না। মহাভারতে ইহার অনেক উদাহরণ আছে।

অতএব সন্তান-উৎপাদন, সন্তানপালন ও লোকযাত্রানির্বাহ যদি হিন্দুবিবাহের মুখ্য উদ্দেশ্য হয় তবে দেখা যাইতেছে, উক্ত কর্তব্যসাধনের পক্ষে স্ত্রীলোকের একপতিনিষ্ঠ হওয়ার যত আবশ্যক পুরুষের পক্ষে একপত্নীনিষ্ঠ হইবার তেমন আবশ্যক নাই। কারণ, বহুপতি থাকিলে সন্তানপালন ও লোকযাত্রার বিশেষ ব্যাঘাত ঘটে, কিন্তু বহুপত্নীতে সে-ব্যাঘাত না ঘটিতেও পারে। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে দ্বিতীয়বার বিবাহ সংসারযাত্রার সুবিধাজনক হইতে পারে, কিন্তু বিধবার দ্বিতীয়বার বিবাহ অধিকাংশস্থলে সংসারে বিশৃঙ্খলা আনয়ন করে। কারণ, বিধবার যদি সন্তানাদি থাকে তবে সেই সন্তানদিগকে হয় এক কুল হইতে কুলান্তরে লইয়া যাইতে হয়, নচেৎ তাহাদিগকে মাতৃহীন হইয়া থাকিতে হয়। সন্তানাদি না থাকিলেও বিধবা রমণীকে পুরাতন ভর্তৃকুলে লইয়া যাওয়া নানা কারণে সমাজের অসুখ ও অসুবিধাজনক; অতএব যখন সাংসারিক অসুবিধার কথা হইতেছে, কোনোপ্রকার আধ্যাত্মিকতার কথা হইতেছে না, তখন এ স্থলে অনুপাতবাদ গ্রাহ্য। এইজন্য মনু পুরুষের দ্বিতীয়বার বিবাহের স্পষ্ট বিধান দিয়াছেন :

ভার্যায়ৈ পূর্বমারিণ্যৈ দত্ত্বাগ্নীনন্ত্যকর্মণি
পুনর্দারক্রিয়াং কুর্যাৎ পুনরাধানমেবচ।

পূর্বমৃতা ভার্যার দাহকর্ম সমাধা করিয়া পুরুষ পুনর্বার স্ত্রী ও শ্রৌত অগ্নি গ্রহণ করিবেন।

এখানে সংসারধর্মের প্রতিই মনুর লক্ষ্য দেখা যাইতেছে। আধ্যাত্মিক মিলনের প্রতি অনুরাগ ততটা প্রকাশ পাইতেছে না। বিবাহের আধ্যাত্মিকতা কাহাকে বলে। সমস্ত বিরহবিচ্ছেদ-অবস্থান্তর, সমস্ত অভাবদুঃখক্লেশ, এমন-কি, কদর্যতা ও অবমাননা অতিক্রম করিয়াও ব্যক্তিবিশেষ বা ভাববিশেষের প্রতি ঐকান্তিক নিষ্ঠার যে একটি পবিত্র উজ্জ্বল সৌন্দর্য আছে, তাহাকেই যদি আধ্যাত্মিকতা বল এবং যদি বল সেই আধ্যাত্মিকতাই হিন্দুবিবাহের মুখ্য অবলম্বন এবং সন্তানোৎপাদন প্রভৃতি সামাজিক কর্তব্য তাহার গৌণ উদ্দেশ্য, তাহার সামান্য ও নিকৃষ্ট অংশ তবে কোনো যুক্তি অনুসারেই বহুবিবাহ ও স্ত্রীবিয়োগান্তে দ্বিতীয় বিবাহ আমাদের সমাজে স্থান পাইতে পারিত না। কারণ পূর্বেই বলিয়াছি বিবাহ বলিতে স্ত্রী এবং পুরুষ উভয়েরই পরস্পরের সম্মিলন বুঝায়–বিবাহ লইয়া সম্প্রতি এত আন্দোলন পড়িয়াছে এবং বুদ্ধির প্রভাবে অনেকে অনেক নূতন কথাও বলিয়াছেন, কিন্তু এ পর্যন্ত এ সম্বন্ধে কাহারো মতভেদ শুনা যায় নাই।

অনেকে হিন্দুবিবাহের পবিত্র একীকরণপ্রসঙ্গে ইংরেজি ডিভোর্স প্রথার উল্লেখ করিয়া থাকেন। ডিভোর্স প্রথার ভালোমন্দ বিচার করিতে চাহি না, কিন্তু সত্যের অনুরোধে ইহা স্বীকার করিতে হইবে যে, আমাদের দেশে ডিভোর্স প্রথা নাই বলিয়া যে আমাদের বিবাহের একীকরণতা বিশেষ সপ্রমাণ হইতেছে তাহা বলিতে পারি না। যে দেশে শাস্ত্র ও রাজনিয়মে একাধিক বিবাহ হইতেই পারে না সেখানে ডিভোর্স প্রথা দূষণীয় বলা যায় না। স্ত্রী অসতী হইলে আমরা ইচ্ছামত তাহাকে ত্যাগ করিয়া যত ইচ্ছা বিবাহ করিতে পারি। স্বামী ব্যভিচারপরায়ণ হইলেও স্বামীকে ত্যাগ করা স্ত্রীর পক্ষে নিষিদ্ধ। স্বামী যখন প্রকাশ্যভাবে অন্যস্ত্রী অথবা বারস্ত্রীতে আসক্ত হইয়া পবিত্র একীকরণের মস্তকের উপর পঙ্কিল পাদুকাসমেত দুই চরণ উত্থাপন করেন তখন অরণ্যে রোদন ছাড়া স্ত্রীর আর কোনো অধিকার দেওয়া হয় নাই। যদি জানা যাইত অন্যদেশের তুলনায় আমাদের দেশে বিবাহিত পুরুষের অধিকাংশই বারস্ত্রীসক্ত নহে তবে হিন্দুবিবাহের পবিত্র প্রভাব সম্বন্ধে সন্দেহমোচন হইত। কিন্তু যখন পুরুষ যথেচ্ছ বিবাহ ও ব্যভিচার করিতে পারে এবং স্ত্রীলোকের স্বামীত্যাগের পথ কঠিন নিয়মের দ্বারা রুদ্ধ তখন এ প্রসঙ্গে কোনো তুলনাই উঠিতে পারে না।

আমাদের দেশে বিবাহিত পুরুষের মধ্যে দাম্পত্যনীতি সম্বন্ধে যথেচ্ছাচার যে যথেষ্ট প্রচলিত আছে তাহা বোধ করি কাহাকেও বলিতে হইবে না। বৃদ্ধ লোকেরা অবগত আছেন, কিছুকাল পূর্বে অন্যান্য নানা আয়োজনের মধ্যে বেশ্যা রাখাও বড়োমানুষির এক অঙ্গ ছিল। এখনো দেখা যায় দেশের অনেক খ্যাতনামা লোক প্রকাশ্যে রাজপথে গাড়ি করিয়া বেশ্যা লইয়া যাইতে এবং ধুমধাম করিয়া বেশ্যা প্রতিপালন করিতে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করেন না এবং সমাজও সে বিষয়ে তাঁহাদিগকে লাঞ্ছনা করে না। সমাজের অনেক তুচ্ছ নিয়মটুকু লঙ্ঘন করিলে যে-দায়ে পড়িতে হয় ইহাতে ততটুকু দায়ও নাই। অতএব ডিভোর্স প্রথা আমাদের মধ্যে প্রচলিত নাই বলিয়াই ইহা বলা যায় না যে, আমাদের দেশে বিবাহের পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিক একীকরণতা রক্ষার প্রতি সমাজের বিশেষ মনোযোগ আছে।

যাহা হউক আমার বক্তব্য এই যে, হিন্দুবিবাহের যথার্থ যাহা মর্ম ইতিহাস হইতে তাহা প্রমাণ না করিয়া যদি ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে আপন মনের মতো এক নূতন আদর্শ গড়িয়া তাহাকে পুরাতন বলিয়া প্রচার করিতে চেষ্টা করি, তবে সত্যপথ হইতে ভ্রষ্ট হইতে হয়। আমরা ইংরেজি শিক্ষা হইতে অনেক sentiment প্রাপ্ত হইয়াছি (sentiment শব্দের বাংলা আমার মনে আসিতেছে না), অনেক দেশানুরাগী ব্যক্তি সেইগুলিকে দেশীয় ও প্রাচীন বলিয়া প্রমাণ করিবার জন্য বিশেষ উৎসুক হইয়াছেন, এবং তাঁহারা বিরোধী পক্ষকে বিজাতীয় শিক্ষায় বিকৃতমস্তিষ্ক বলিয়া উপহাস করেন। কেবল sentiment নহে, অনেক Evolution, Natural Selection, Magnetism প্রভৃতি নব্য বিজ্ঞানতন্ত্রসকলও প্রাচীন ঋষিদের জটাজালের মধ্য হইতে সূক্ষ্মদৃষ্টিতে বাছিয়া বাহির করিতেছেন। কিন্তু সাপুড়ে অনেক সময়ে নিরীহ দর্শকের ক্ষুদ্র নাসাবিবর হইতে একটা বৃহৎ সাপ বাহির করে বলিয়াই যে উক্ত নাসাবিবর যথার্থ সেই সাপের আশ্রয়স্থল বলিয়া বিশ্বাস করিতে হইবে এমন নহে। সাপ তাহার বৃহৎ ঝুলিটার মধ্যেই ছিল। sentiment সকলও আমাদের ঝুলিটার মধ্যেই আছে, আমরা নানা কৌশলে ও অনেক বাঁশি বাজাইয়া সেগুলি পুঁথির মধ্য হইতেই যেন বাহির করিলাম এইরূপ অন্যকে এবং আপনাকে বুঝাইতেছি। হিন্দুবিবাহের মধ্যে আমরা যতটা sentiment পুরিয়াছি তাহার কতটা Comte-l, কতটা ইংরেজি কাব্যসাহিত্যের, কতটা খৃস্টধর্মের “স্বর্গীয় পবিত্রতা’ নামক শব্দ ও ভাব বিশেষের এবং কতটা প্রাচীন হিন্দুর এবং কতটা আধুনিক আচারের, তাহা বলা দুঃসাধ্য। সাংসারিকতাকে প্রাচীন হিন্দুরা হেয়জ্ঞান করিতেন না, কিন্তু খৃস্টানেরা করেন। অতএব, পুত্রার্তে ক্রিয়তে ভার্যা–এ কথা স্বীকার করা হিন্দুর পক্ষে লজ্জার কারণ নহে, খৃস্টানের পক্ষে বটে। হিন্দু স্ত্রীকে যে পতিপ্রাণা হইতে হইবে সেও সাংসারিক সুবিধার জন্য। পুত্রার্থেই বিবাহ কর বা যে কারণেই কর-না কেন, স্ত্রী যদি পতিপ্রাণা না হয় তবে অশেষ সাংসারিক অসুখের কারণ হয়, এবং অনেক সময়ে বিবাহের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হইয়া যায়, অতএব সাংসারিক শৃঙ্খলার জন্যই স্ত্রীর পতিপ্রাণা হওয়া আবশ্যক। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে স্বামীর পত্নীগতপ্রাণ হইবার এত আবশ্যক নাই যে তাহার জন্য ধরাবাঁধা করিতে হয়। এইজন্যই শাস্ত্রে বলে, সা ভার্যা যা পতিপ্রাণা, সা ভার্যা যা প্রজাবতী–সেই ভার্যা যে পতিপ্রাণা। কিন্তু ইহা বলিয়াই শেষ হয় নাই–তাহার উপরে বলা হইয়াছে, সেই ভার্যা যে সন্তানবতী। আধ্যাত্মিক পবিত্রতা যতই থাক্‌, সন্তান না হইলেই হিন্দুবিবাহ ব্যর্থ।

এইখানে আমার মনে একটি আশঙ্কা জন্মিতেছে। যে-শব্দের পরিষ্কার অর্থ নাই অথবা নির্দিষ্ট হয় নাই তাহা ইচ্ছামত নানা স্থানে নানা অর্থে প্রয়োগ করা যাইতে পারে। ইহাতে সে-শব্দের উপযোগিতা বাড়ে কি কমে তাহা বিচারের যোগ্য। সকলেই জানেন আমাদের বাংলাভাষায় “ইয়ে’ নামক সর্বভুক্‌ সর্বনাম শব্দ আছে; শব্দ বা ভাবের অভাব হইলেই তৎক্ষণাৎ “ইয়ে’ আসিয়া ভাষার শূন্যতা পূর্ণ করিয়া দেয়। এই সুবিধা থাকাতে আমাদের মানসিক আলস্য ও ভাবপ্রকাশের অক্ষমতা সাহায্যপ্রাপ্ত হইতেছে। Magnetism-এর স্বরূপ সম্পূর্ণ অবগত না থাকাতে উক্ত শব্দকে আশ্রয় করিয়া অনেক বৈজ্ঞানিক উপকথা সমাজে প্রচলিত হয়। Magnetism-এর কুহেলিকাময় ছদ্মবেশে আবৃত হইয়া আমাদের আর্যশাস্ত্রের অনেক প্রমাণহীন উক্তি ও অর্থহীন আচার বিজ্ঞানের সহিত এক পঙ্‌ক্তিতে আসন পাইবার মন্ত্রণা করে। সম্প্রতি Psychic Force নামক আর-একটি অজ্ঞাতকুলশীল শব্দ Magnetism-এর পদ অধিকার করিবার চেষ্টা করিতেছে। যতদিন-না স্বরূপ নির্দিষ্ট হইয়া তাহার মুক্তিলাভ হয় ততদিন সে প্রদোষের অন্ধকারে জীর্ণমতের ভগ্নভিত্তির মধ্যে ও দেবতাহীন প্রাচীন দেবমন্দিরের ভগ্নাবশেষে প্রেতের ন্যায় সঞ্চরণ করিয়া বেড়াইবে। অতএব মুক্তির উদ্দেশেই কথার অর্থ নির্দেশ করিয়া দেওয়া আবশ্যক। বিবাহ “আধ্যাত্মিক’ বলিতে কী বুঝায়। যদি কেহ বলেন যে, সাংসারিক কার্য সুশৃঙ্খলে নির্বাহ করিবার অভিপ্রায়ে বিবাহ করার নামই আধ্যাত্মিক বিবাহ, কেবলমাত্র নিজের সুখ নহে সংসারের সুখের প্রতি লক্ষ করিয়া বিবাহ করাই আধ্যাত্মিকতা, তবে বোধ হয় আধ্যাত্মিক শব্দের প্রতি অত্যাচার করা হয়। পার্ল্যামেণ্ট-সভায় সমস্ত ইংলণ্ড এবং তাহার অধীনস্থ দেশের সুখ সম্পদ সৌভাগ্য নির্ধারিত হয়, কিন্তু পার্ল্যামেণ্ট-সভা কি আধ্যাত্মিকতার আদর্শস্বরূপ গণ্য হইতে পারে। যদি বল পার্ল্যামেণ্ট-সভার সহিত ধর্মের কোনো যোগ নাই তাহা ঠিক নহে। দেশের Church যাহাতে যথানিয়মে অব্যাহতরূপে বজায় থাকে পার্ল্যামেণ্টকে তাহার প্রতি দৃষ্টি রাখিতে হয়। উক্ত সভার প্রত্যেক সভ্যকে ঈশ্বরে বিশ্বাস স্বীকার করিতে হয় এবং ঈশ্বরের নামে শপথ গ্রহণ করিতে হয়। যদি বল, পার্ল্যামেণ্টের কার্যকে ইংরেজরা ধর্মকার্য বলিয়া মনে করেন না, কিন্তু বিবাহকে আমরা ধর্মকার্য বলিয়া মনে করি, অতএব আমাদের বিবাহ আধ্যাত্মিক- তবে তৎসম্বন্ধে বক্তব্য এই যে, আমাদের কোন্‌ কাজটা ধর্মের সহিত জড়িত নহে। সম্মুখযুদ্ধে নিহত হওয়া ক্ষত্রিয়ের ধর্ম ও পুণ্যের কারণ বলিয়া উক্ত হইয়াছে, এমন-কি, ক্রূরকর্মা দুর্যোধনকে যুধিষ্ঠির স্বর্গস্থ দেখিয়া যখন বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করিলেন তখন দেবগণ তাঁহাকে এই বলিয়া সান্ত্বনা করেন যে, ক্ষত্রিয় সম্মুখ যুদ্ধে নিহত হইয়া যে-ধর্ম উপার্জন করেন তাহারই প্রভাবে স্বর্গ প্রাপ্ত হন। এক্ষণে জিজ্ঞাস্য এই, ক্ষত্রিয় দুর্যোধন যে-যুদ্ধ অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন তাহাকে আধ্যাত্মিক যুদ্ধ বলিবে কি না। শরীর রক্ষার্থে আহারব্যবহার সম্বন্ধে ধর্মের নামে শাস্ত্রে সহস্র অনুশাসন প্রচলিত আছে; তাহার সকলগুলিকে আধ্যাত্মিক বলা যায় কি না। শূদ্রকে শাস্ত্রজ্ঞান দেওয়া আমাদের ধর্মে নিষিদ্ধ, কিন্তু যদি অন্য-একজন ব্রাহ্মণ মাঝখানে থাকেন ও তাঁহাকে উপলক্ষ রাখিয়া শূদ্র শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করে তাহাতে অধর্ম নাই। এক্ষণে জিজ্ঞাস্য এই শূদ্র শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করিলে তাহার আধ্যাত্মিকতার ব্যাঘাত হয় কি না এবং ব্রাহ্মণ মধ্যবর্তী থাকিলেই সে ব্যাঘাত দূর হয় কি না। ধর্মের অঙ্গস্বরূপ নির্দিষ্ট হইলেও এ-সকল লৌকিক নিয়ম না আধ্যাত্মিক নিয়ম? যখন আমাদের সকল কার্যই ধর্মকার্য তখন ধর্মানুষ্ঠানমাত্রকে যদি আধ্যাত্মিকতা বল, তবে আধ্যাত্মিক বিবাহের বিশেষ উল্লেখ করিবার আবশ্যকতা নাই, তবে আমরা যাহাই করি-না কেন আধ্যাত্মিকতার হাত এড়াইবার জো নাই।

যদি বল হিন্দু স্বামীস্ত্রীর সম্বন্ধ অনন্ত সম্বন্ধ, দেহের অবসানে স্বামীস্ত্রীর বিচ্ছেদ নাই এইজন্য তাহা আধ্যাত্মিক, তবে সে কথাও বিচার্য। কারণ হিন্দুশাস্ত্রে কর্মফলানুসারে জন্মান্তরপরিগ্রহ কল্পিত হইয়াছে। স্ত্রীপুরুষের মধ্যে জন্মজন্মান্তরসঞ্চিত কর্মফলের প্রভেদ আছেই, অতএব পরজন্মে পুনরায় উভয়ের দাম্পত্যবন্ধন দৈবক্রমে হইতেও পারে কিন্তু তাহা অবশ্যম্ভাবী নহে। আমাদের শাস্ত্রে জন্মান্তরের ন্যায় স্বর্গনরক কল্পনাও আছে, কিন্তু সকল সময়ে স্ত্রী পুরুষ উভয়েরই যে একত্রে স্বর্গ বা নরকে গতি হইবে তাহা নহে। যদি পুণ্যবলে উভয়েই স্বর্গে যায় তবে পুণ্যের তারতম্য অনুসারে লোকভেদ আছে, এবং পাপভেদে নরকেও সেইরূপ ব্যবস্থা। আমাদের শাস্ত্রে পাপপুণ্যের নিরতিশয় সূক্ষ্ম বিচারের কল্পনা আছে, এ স্থলে বিবাহের অনন্তকালস্থায়িত্ব সম্ভব হয় কিরূপে। অতএব হিন্দুশাস্ত্রমতে সাধারণত ইহজীবনেই দাম্পত্যবন্ধনের সীমা, অতএব তাহাকে ইহলৌকিক অর্থাৎ সাংসারিক বলিতে আপত্তি কিসের। দাম্পত্য বন্ধনের ঐহিক সীমাসম্বন্ধে সাধারণের বিশ্বাস বদ্ধমূল। কুমারী যখম স্বামী প্রার্থনা করে তখন সে বলে, যেন রামের মতো বা মহাদেবের মতো স্বামী পাই। পূর্বজন্মের স্বামী এ জন্মেও আধ্যাত্মিক মিলনে বদ্ধ হইয়া তাহার অনুসরণ করিবে এ বিশ্বাস যদি কুমারীর থাকিত, তবে এ প্রার্থনা সে করিত না। বাল্মীকির রামায়ণে কী আছে স্মরণ নাই, কিন্তু সাধারণে প্রচলিত গান এবং উপাখ্যানে শুনা যায় সীতা রামকে বলিতেছেন, পরজন্মে যেন তোমার মতো স্বামী পাই– কিন্তু তোমাকেই পাই এ কথা কেন বলা হয় নাই।

অনেকে বলেন, অন্য দেশের বিবাহ চুক্তিমূলক, আমাদের দেশে ধর্মমূলক, অতএব তাহা আধ্যাত্মিক। কিন্তু তাঁহাদের এ কথাটাই অমূলক। য়ুরোপের ক্যাথলিক ধর্মশাস্ত্র বলে :

Our divine Redeemer sanctified this holy state of matrimony and from a natural and civil contract raised it to the dignity of a Sacrament. And St. Paul declared it to be a representative of that sacred union which Jesus Christ had formed with his spouse the Church.

ইহার ধর্ম এই :

বিবাহ পূর্বে প্রাকৃতিক ও সামাজিক চুক্তিমাত্র ছিল কিন্তু যিশুখৃষ্ট ইহাকে উদ্ধার করিয়া মন্ত্রপূত পবিত্র সংস্কারমধ্যে গণ্য করিয়াছেন। ধর্মমণ্ডলীর সহিত দেবতার যে পুণ্য মিলন সংঘটিত হইয়াছে বিবাহ সেই পুণ্য মিলনের সামাজিক প্রতীকস্বরূপ।

বিবাহসময়ে ক্যাথলিক স্ত্রী ঈশ্বরের নিকট যে-প্রার্থনা করেন তাহাও পাঠ করিলে য়ুরোপীয় দাম্পত্যের একীকরণতা সম্বন্ধে সন্দেহ দূর হইবে। অতএব অন্যদেশের বিবাহের তুলনায় হিন্দুবিবাহকে বিশেষরূপে আধ্যাত্মিক আখ্যা দেওয়া হয় কেন। আধ্যাত্মিক শব্দের শাস্ত্রসংগত ঠিক অর্থটি কী তাহা আমি নিঃসংশয়ে বলিতে পারি না; শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতমণ্ডলীর নিকট তাহার মীমাংসা প্রার্থনা করি। কিন্তু আধ্যাত্মিক শব্দের আভিধানিক অর্থ “আত্মা সম্বন্ধীয়’। কোনো খণ্ডকালে বা খণ্ডদেশে যাহার অবসান নাই এমন যে এক অজর অমর সূক্ষ্ম সত্তা আমাদের অস্তিত্বের কেন্দ্রস্থলে বর্তমান, তাহা সহজবোধ্যই হউক বা দুর্বোধ্যই হউক, তৎসম্বন্ধীয় যে-ভাব তাহাকে আধ্যাত্মিক ভাব বলে। এ আত্মা সমাজ নহে, এবং এ সমাজে, এ সংসারে ও এ দেহে আত্মার নিত্য অবস্থিতি নহে–অতএব বিবাহ যদি শ্বশুরশ্বশ্রূ পরিবার প্রতিবেশী অতিথিব্রাহ্মণ প্রভৃতির সমষ্টিভূত সমাজ রক্ষার জন্য হয় অথবা ক্ষণিক আত্মসুখের জন্য হয় তাহাকে কোন্‌ অর্থ অনুসারে আধ্যাত্মিক আখ্যা দেওয়া যায়। যে-উদ্দেশ্য জন্মমৃত্যুসংসারকে অতিক্রম করিয়া নিত্য বিরাজ করে তাহাকেই আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য কহে। কিন্তু হিন্দুমতে বিবাহ নিত্য নহে, আত্মার নিত্য আশ্রয় নহে। হিন্দুদের বানপ্রস্থকে আধ্যাত্মিক বলা যাইতে পারে। কারণ, তাহা প্রকৃতপক্ষে আত্মার মুক্তিসাধন উপলক্ষেই গ্রহণ করা হইয়া থাকে। তাহা সংসারের হিতসাধনের জন্য নহে।

যাহা হউক, আমি যতদূর আলোচনা করিয়াছি তাহাতে দেখিতেছি আমাদের বিবাহ সামাজিক বলিয়াই সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হইয়াছে। এমন-কি, এখন মনুর নিয়মও সমস্ত রক্ষিত হয় না। অতএব বর্তমান সমাজের সুবিধা ও আবশ্যক-অনুসারে হিন্দুবিবাহ সমালোচন করিবার অধিকার আছে। যদি দেখা যায় হিন্দুবিবাহে আমাদের বর্তমান সমাজে রোগ শোক দারিদ্র্য বাড়িতেছে, তবে বলা যাইতে পারে, মনু সমাজের কল্যাণ লক্ষ্য করিয়া বিবাহের নিয়ম নির্দেশ করিয়াছেন; অতএব সেই সমাজের কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া বিবাহের নিয়মপরিবর্তন করা অন্যায় নহে। ইহাতে মনুর অবমাননা করা হয় না, প্রত্যুত তাঁহার সম্মাননা করাই হয়। কিন্তু প্রথমেই বলিয়া রাখা আবশ্যক যে, রাজবিধির সহায়তা লইয়া সমাজসংস্কার আমার মত নহে। জীবনের সকল কাজই যে লাল-পাগড়ির ভয়ে করিতে হইবে, আমাদের জন্য সর্বদাই যে একটা বড়ো দেখিয়া বিজাতীয় জুজু পুষিয়া রাখিতে হইবে, আপন মঙ্গল অমঙ্গল কোনোকালেই আপনারা বুঝিয়া স্থির করিতে পারিব না, ইহা হইতেই পারে না; জুজুর হস্তে সমাজ সমর্পণ করিলে সমাজের আর উদ্ধার হইবে কবে।

বিবাহের বয়সনির্ণয় লইয়া কিছুদিন হইতে ঘোরতর আন্দোলন উপস্থিত হইয়াছে। যদি এমন বিবেচনা করা যায় যে, সন্তানোৎপাদন বিবাহের মুখ্য উদ্দেশ্য এবং সুস্থ সবল সন্তান উৎপাদন সমাজের কল্যাণের প্রধান হেতু, তবে সুস্থ সন্তানোৎপাদনপক্ষে স্ত্রীপুরুষের কোন্‌ বয়স উপযোগী বিজ্ঞানের সাহায্যেই তাহা স্থির করা আবশ্যক। কিন্তু কিছুদিন হইতে আমাদের শিক্ষিত সমাজ এ সম্বন্ধে বিজ্ঞানের কোনো কথাই শুনিবেন না বলিয়া দৃঢ়সংকল্প হইয়াছেন। এ সম্বন্ধে তাঁহারা শরীরতত্ত্ববিৎ কোনো পণ্ডিতেরই মত শুনিতে চাহেন না, আপনারা মত দিতেছেন। তাঁহারা বলেন, বাল্যবিবাহে সন্তান দুর্বল হয় এ কথা শ্রবণযোগ্য নহে। তাঁহাদের মতে আমাদের দেশের মনুষ্যেরাই যে কেবল দুর্বল তাহা নহে পশুরাও দুর্বল, অথচ পশুরা বাল্যবিবাহ সম্বন্ধে মনুর বিধান মানিয়া চলে না; অতএব বাল্যবিবাহের দোষ দেওয়া যায় না, দেশের জলবায়ুরই দোষ। এ বিষয়ে গুটিদুয়েক বক্তব্য আছে। সত্যই যে আমাদের দেশের সকল জন্তুই অন্যদেশের তজ্জাতীয় জন্তুদের অপেক্ষা দুর্বল তাহা রীতিমত কোনো বক্তা বা লেখক প্রমাণ করেন নাই। আমাদের বঙ্গদেশের ব্যাঘ্র ভুবনবিখ্যাত জন্তু। বাংলার হাতি বড়ো কম নহে, অন্যদেশের হাতির সহিত ভালোরূপ তুলনা না করিয়া তাহার বিরুদ্ধে কোনো মত ব্যক্ত করা অন্যায়। আমাদের দেশের বন্যপশুদের সহিত অন্যদেশের বন্যপশুর তুলনা কেহই করেন নাই। গৃহপালিত পশু অনেক সময়ে পালকের অজ্ঞতাবশত হীনদশা প্রাপ্ত হয়, অতএব তাহাদের বিষয়েও ভালোরূপ না জানিয়া কেবল চোখে দেখিয়া কিছুই বলা যায় না। দ্বিতীয় কথা এই যে, মনুষ্যের উপরে যে জলবায়ুর প্রভাব আছে এ কথা কেহই অস্বীকার করে না। কিন্তু তাই বলিয়া বাল্যবিবাহের কথা চাপা দেওয়া যায় না। শ্যালককে মন্দ বলিলেই যে ভগ্নীপতিকে ভালো বলা হয়, ন্যায়শাস্ত্রে এরূপ কোনো পদ্ধতি নাই। দেশের জলবায়ুর অনেক দোষ থাকিতে পারে, কিন্তু বাল্যবিবাহের দোষ তাহাতে কাটে না, বরং বাড়ে। বাল্যবিবাহে দুর্বল সন্তান জন্মিয়া থাকে, এ কথা শুনিলেই অমনি আমাদের দেশের অনেক লোক বলিয়া উঠেন এবং লিখিয়াও থাকেন যে, “ম্যালেরিয়াতে দেশ উচ্ছন্ন গেল, তাহার বিষয় কিছুই বলিতেছ না, কেবল বাল্যবিবাহের কথাই চলিতেছে।’ যখন একটা কথা বলিতেছি তখন কেন যে সে-কথাটা ছাড়িয়া দিয়া আর-একটা কথা বলিব তাহার কারণ খুঁজিয়া পাই না। যাহারা কোনো কর্তব্য সমাধা করিতে চাহে না তাহারা এক কর্তব্যের কথা উঠিলেই দ্বিতীয় কর্তব্যের কথা তুলিয়া মুখচাপা দিতে চায়। আমরা অত্যন্ত বিচক্ষণতা এবং অতিশয় দূরদৃষ্টি ও সম্পূর্ণ সাবধানতাসহকারে দেশের সমস্ত অভাব এবং বিঘ্ন সূক্ষ্মানুসূক্ষ্মরূপে সমালোচনা করিয়া এমন একটা প্রচণ্ড পাকা চাল চালিতে চাহি, যাহাতে একই সময়ে সকল দিকে সকলপ্রকার সুবিধা করিতে পারি এবং সজোরে “কিস্তিমাত’ উচ্চারণ করিয়া তাহার পর হইতে যাবজ্জীবন নির্বিঘ্নে তামাক এবং তাকিয়া সেবন করিবার অখণ্ড অবসর প্রাপ্ত হই। কিন্তু আমরা বুদ্ধিমান বাঙালি হইলেও ঠিক এমন সুযোগটি সংঘটন করিতে পারিব না। এমন-কি, আমাদিগকেও ধীরে ধীরে একটি একটি করিয়া কর্তব্য সাধন করিতে হইবে। অতএব দেশে ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য দুর্বলতার কারণ থাকা সত্ত্বেও আমাদিগকে বাল্যবিবাহের কুফল সমালোচন ও তৎপ্রতি মনোযোগ করিতে হইবে। একেবারে অনেক অধিক ভাবিতে পারিব না, কারণ অত্যন্ত অধিক চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করিতে গেলে অনেক সময়ে চিন্তনীয় বিষয় সম্পূর্ণ অতিক্রম করিয়া চিন্তার অতীত স্থানে গিয়া পৌঁছিতে হয়। মহাবীর হনুমান যদি অতিরিক্তমাত্রায় লম্ফনশক্তি প্রয়োগ করিতেন তবে তিনি সমুদ্র ডিঙাইয়া লঙ্কায় না পড়িয়া লঙ্কা ডিঙাইয়া সমুদ্রে পড়িতেও পারিতেন। ইহা হইতে এই প্রমাণ হইতেছে, অন্যান্য সকল শক্তির ন্যায় চিন্তাশক্তিরও সংযম আবশ্যক।

বৈজ্ঞানিক বিষয়ে বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতদের কথায় যদি কর্ণপাত না করি তবে সত্য সম্বন্ধে কিছু কিনারা করা দুর্ঘট। আমরা নিজে সকল বিষয়েই সকলের চেয়ে ভালো জানিতে পারিব না অতএব অগত্যা বিনীত ভাবে পারদর্শীদের মত লইতেই হয়। কিছুদিন হইল আমাদের মান্য সভাপতি এবং অন্যান্য ডাক্তারেরা বিবাহের বয়স সম্বন্ধে যে বিধান দিয়াছেন তাহা কালক্রমে পুরাতন হইয়া গিয়াছে কিন্তু তাই বলিয়া মিথ্যা হইয়া যায় নাই। কিন্তু সে-সকল কথা পাড়িতে সাহস হয় না–সকলেই পরম অশ্রদ্ধার সহিত বলিয়া উঠিবেন, “সেই এক পুরাতন কথা!’ কিন্তু আমরা পুরাতন কথা যতই ছাড়িতে চাই সে আমাদিগকে কিছুতেই ছাড়িতে চায় না। পুরাতন কথা বারবার তুলিতেই হইবে–নাচার।

ডাক্তার কার্পেণ্টারকে সকলেই মান্য করিয়া থাকেন, শরীরতত্ত্ব সম্বন্ধে তিনি যে মস্ত পণ্ডিত এ কথা কেহই অস্বীকার করিবেন না; অতএব এ সম্বন্ধে তিনি যাহা বলেন তাহা শুনিতে সকলেই বাধ্য। তিনি বলেন, ১৩ হইতে ১৬ বৎসরের মধ্যে স্ত্রীলোকদের যৌবনলক্ষণ প্রকাশ হইতে আরম্ভ করে। অনেকে বলেন উষ্ণদেশে স্ত্রীলোকদের যৌবনারম্ভের বয়স শীতদেশ হইতে অপেক্ষাকৃত অল্প। কিন্তু কার্পেণ্টার তাহা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যৌবনলক্ষণ প্রকাশ শারীরিক উত্তাপের উপর নির্ভর করে, বাহ্য উত্তাপের উপরে নহে। বাহ্য উত্তাপ সামান্য পরিমাণে শারীরিক উত্তাপ বৃদ্ধি করে মাত্র। অতএব যৌনবিকাশ সম্বন্ধে বাহ্য উত্তাপের প্রভাব অতি সামান্য। আমাদের মান্য সভাপতি মহাশয়ের মতের সহিতও এই মতের সম্পূর্ণ ঐক্য দেখা যায়। তবে আমাদের দেশে ১০। ১১ বৎসর বয়সেও যে অনেক স্ত্রীলোকের যৌবনসঞ্চার হইবার উপক্রম দেখা যায় তাহা বাল্যবিবাহের অস্বাভাবিক ফল বলিতে হইবে। বাল্যকালে স্বামীসহবাস অথবা বিবাহিত রমণী, প্রগল্‌ভা দাসী ও পরিহাসকুশলা বৃদ্ধাদের সংসর্গে বালিকারা যথাসময়ের পূর্বেই যৌবনদশায় উপনীত হয়, ইহা সহজেই মনে করা যায়। যৌবনলক্ষণ প্রকাশ হইবামাত্রই যে স্ত্রীপুরুষ সন্তানোৎপাদনের যোগ্য হয় তাহাও নহে। কার্পেণ্টার বলেন :

যৌবনারম্ভে স্ত্রীপুরুষের জননেন্দ্রিয়সকলের বিকাশ লক্ষণ দেখা দিবামাত্র যে বুঝিতে হইবে যে, উক্তইন্দ্রিয় সকল সম্পূর্ণ ব্যবহারযোগ্য হইয়াছে তাহা নহে, তাহা কেবল পূর্ববর্তী আয়োজন মাত্র। নরনারী যখন সর্বাঙ্গীণ পরিস্ফুটতা লাভ করে হিসাবমতে তখনই তাহারা জাতিরক্ষার জন্য জননশক্তি প্রয়োগ করিবার অধিকারী হয়।

আমাদের সভাপতি মহাশয় বলিয়াছেন–যেমন দাঁত উঠিলেই অমনি ছেলেদের খুব শক্ত জিনিস খাইতে দেওয়া উচিত হয় না, তেমনই যৌবন সঞ্চার হইবামাত্র স্ত্রীপুরুষ সন্তান-উৎপাদনের যোগ্য হয় না। এ বিষয়ে বড়ো বড়ো ডাক্তারদের মত এতবার সাধারণের সমক্ষে স্থাপিত হইয়াছে যে, এ স্থলে অন্য পণ্ডিতের মত উদ্‌ধৃত করা অনাবশ্যক। সুশ্রুতসংহিতার সহিত এ বিষয়ে পাশ্চাত্য শাস্ত্রের সম্পূর্ণ ঐক্য আছে, তাহাও সকলে অবগত আছেন–অতএব শাস্ত্র-আস্ফালন করিয়া প্রবন্ধবাহুল্যের প্রয়োজন দেখিতেছি না।

যাহা হউক, কাহারো কাহারো মতের সহিত না মিলিলেও ইহা স্বীকার করিতেই হইবে যে, অভিজ্ঞ বৈজ্ঞানিক মান্য ব্যক্তিগণ বৈজ্ঞানিক কারণ দর্শাইয়া বলিয়া থাকেন যে, যৌবনারম্ভ হইবামাত্রই অপত্যোৎপাদন স্ত্রী পুরুষ এবং সন্তানের শরীরের পক্ষে ক্ষতিজনক। অতএব বিজ্ঞানের পরামর্শ লইতে গেলে বাল্যবিবাহ টেকে না।

শিক্ষিত সমাজের মধ্যে যাঁহার বাল্যবিবাহের পক্ষে তাঁহাদের মধ্যে দুই দল আছেন। একদল মনুর ব্যবস্থানুসারে পুরুষের ২৪ হইতে ৩০-এর মধ্যে এবং স্ত্রীলোকের ৮ হইতে ১২-র মধ্যে বিবাহ দিতে চান, আর-এক দল, স্ত্রী পুরুষ উভয়েরই বাল্যাবস্থায় বিবাহে কোনো দোষ দেখেন না। “পারিবারিক প্রবন্ধ’ নামক একখানি পরমোৎকৃষ্ট গ্রন্থে মান্যবর লেখক “বাল্যবিবাহ’ নামক প্রবন্ধে প্রথমে মনুর নিয়মের প্রশংসা করিয়া তাহার পরেই লিখিতেছেন :

ছেলেবেলা হইতে মা বাপ যে দুটিকে মিলাইয়া দেন, তাহারা একত্র থাকিতে থাকিতে ক্রমে ক্রমে দুইটি নবীন লতিকার ন্যায় পরম্পর গায়ে গায়ে জড়াইয়া এক হইয়া উঠে। তাহাদিগের মধ্যে যে-প্রকার চিরস্থায়ী প্রণয় জন্মিবার সম্ভাবনা, বয়োধিকদিগের বিবাহে সেরূপ চিরস্থায়ী প্রণয় কিরূপে জন্মিবে।

অতএব পুরুষের অধিক বয়সে বিবাহ লেখকের অভিমত কি না তাহা স্পষ্ট বুঝা গেল না। কিন্তু শ্রদ্ধাস্পদ চন্দ্রনাথ বসু বলেন, যখন স্ত্রীকে স্বামীর সহিত সম্পূর্ণ মিশিয়া যাইতে হইবে, তখন স্বামীর পরিণতবয়স্ক হওয়া আবশ্যক। কারণ :

যাহাকে এই কঠিন এবং গুরুতর মিশ্রণকার্য সম্পন্ন করিতে হইবে তাহার জ্ঞানবান বিদ্যাবান এবং পরিণতবয়স্কা হওয়া চাই, এবং যাহাকে এই রকম হাড়ে হাড়ে মিশিতে হইবে তাহার শিশু হওয়া একান্ত আবশ্যক। তাই হিন্দুশাস্ত্রকারদিগের মতে পুরুষের বিবাহের বয়স বেশি, স্ত্রীর বিবাহের বয়স কম।

চব্বিশে এবং আটে বিবাহ হইলে হাড়ে হাড়ে কঠিন এবং গুরুতর মিশ্রণ হইতেও পারে কিন্তু সে-মিশ্রণ সত্বর বিশ্লিষ্ট হইতে আটক নাই। দম্পতির বয়সের এত ব্যবধান থাকিলে আমাদের দেশে বিধবাসংখ্যা অত্যন্ত বাড়িবে সন্দেহ নাই। যদিও বৈধব্যব্রতের মহত্ত্ব সম্বন্ধে চন্দ্রনাথবাবুর সন্দেহ নাই, কিন্তু পুরুষ ও রমণী উভয়েরই কল্যাণ কামনায় ইহা তাঁহাকে স্বীকার করিতেই হইবে যে, তাই বলিয়া বিবাহিতা রমণীর বৈধব্য প্রার্থনীয় নহে। শ্রদ্ধাস্পদ অক্ষয়বাবু এই মনে করিয়াই “হিন্দুবিবাহ’ প্রবন্ধে “কিশোর বালকেরসহিত অপোগণ্ড বালিকার বিবাহ’ অন্যায় বলিয়াছিলেন। বাল্যবিবাহই বৈধব্যের মূল কারণ ইহাই স্থির করিয়া তিনি বলিয়াছেন :

আসুন না, সকলে মিলিয়া আমরা বালকবিবাহের কার্যত প্রতিবাদ করি। করিলে বালবৈধব্যের প্রতিরোধ করা হইবে। যাহার বিবাহ হয় নাই সে বিধবা হইয়াছে এ বিড়ম্বনা আর দেখিতে হইবে না।

যদি ২৪ বৎসর এবং তদূর্ধ্ব বয়সে পুরুষের বিবাহ স্থির হয়, তবে তিনি যেরূপ শাস্ত্র ব্যাখ্যা করুন কন্যার বয়সও বাড়াইতেই হইবে।

এইখানে চন্দ্রনাথবাবুর কথা ভালো করিয়া সমালোচনা করা যাক। কেন কন্যার বয়স অল্প হওয়া আবশ্যক তাহার কারণ দেখাইয়া চন্দ্রনাথবাবু বলেন :

ইংরেজ আত্মপ্রিয় বলিয়া তাহার বিবাহের প্রকৃতপক্ষে মহৎ উদ্দেশ্য নাই। মহৎ উদ্দেশ্য নাই বলিয়াই তাহার বিবাহ বিবাহই নয়। মহৎ উদ্দেশ্য থাকিলেই মানুষের সহিত প্রকৃত বিবাহ হয়। যেমন হারমোদিয়াসের সহিত এরিষ্টজিটনের বিবাহ; যিশুখৃষ্টের সহিত সেণ্ট পলের বিবাহ; চৈতন্যের সহিত নিত্যানন্দের বিবাহ; রামের সহিত লক্ষ্ণণের বিবাহ।

এ কথা বলিবার তাৎপর্য এই যে, হিন্দুবিবাহ মহৎ উদ্দেশ্যমূলক বলিয়া হিন্দুদম্পতির সম্পূর্ণ এক হইয়া যাওয়া আবশ্যক, নতুবা উদ্দেশ্য সিদ্ধির ব্যাঘাত হয়। এবং এক হইতে গেলে স্ত্রীর বয়স নিতান্ত অল্প হওয়া চাই। মহৎ উদ্দেশ্য বলিতে এখানে স্ত্রীর পক্ষে এই বুঝাইতেছে যে, শ্বশুর শ্বশ্রূ ননন্দা দেবর প্রভৃতির সহিত মিলিয়া গৃহকার্যের সহায়তা, অতিথির জন্য রন্ধন ও সেবা, পরিবারে যে-সকল ধর্মানুষ্ঠান হয় তাহার আয়োজনে সহায়তা করা এবং স্বামীর সেবা করা। স্বামীর পক্ষে মহৎ উদ্দেশ্য এই যে, সাংসারিক নিত্যকার্যে স্ত্রীর সাহায্য গ্রহণ করা। সাংসারিক নিত্য-অনুষ্ঠেয় কার্যে স্ত্রীর সাহায্য-গ্রহণ-করা-রূপ মহৎ উদ্দেশ্য সকল দেশের সকল স্বামীরই আছে, এইরূপ শুনিতে পাওয়া যায়। তবে প্রভেদ এই, সকল দেশে গার্হস্থ্য অনুষ্ঠান সমান নহে। দেশভেদে এরূপ অনুষ্ঠানের প্রভেদ হওয়া কিছুই আশ্চর্য নহে, কিন্তু উদ্দেশ্যভেদ দেখিতেছি না। মুসলমান সংসারে নিত্য অনুষ্ঠান কী কী তাহা জানি না, কিন্তু ইহা জানি মুসলমান পত্নী সে-সকল অনুষ্ঠানের প্রধান সহায়। ইংরেজ পরিবারে নিত্যকার্য কী তাহা জানি না, কিন্তু ইহা জানি ইংরেজ পত্নীর সহায়তায় তাহা সম্পন্ন হয়। কেবল তাহাই নহে, শুনিয়াছি সাংসারিক কার্য ছাড়া অন্যান্য মহৎ বা ক্ষুদ্র কার্যেও ইংরেজ স্ত্রী স্বামীর সহায়তা করিয়া থাকেন। লেখকের স্ত্রী স্বামীর কেরানীগিরি করেন, প্রুফ-সংশোধন করেন, এবং অনেক সময় তদপেক্ষা গুরুতর সাহায্য করিয়া থাকেন। পাদ্রির স্ত্রী পল্লীর দরিদ্র রুগ্‌ণ শোকাতুর ও দুষ্কর্মকারীদের সাহায্য সেবা সান্ত্বনা ও উপদেশ দান করিয়া স্বামীর পৌরোহিত্য কার্যের অনেক সাহায্য করিয়া থাকেন। যিনি দরিদ্রের দুঃখমোচন বা অসুস্থের স্বাস্থ্যবিধান প্রভৃতি কোনো লোকহিতকর ব্রত গ্রহণ করিয়াছেন তাঁহার স্ত্রীও তাঁহাকে কায়মনে সাহায্য করে। চন্দ্রনাথবাবু জিজ্ঞাসা করিবেন, যদি না করে? আমার উত্তর, হিন্দু স্ত্রী যদি সমস্ত গার্হস্থ্য ধর্ম না পালন করে? সে যদি দুষ্টস্বভাব বা আলস্যবশত শাশুড়ির সহিত ঝগড়া করে ও সঘনে হাতনাড়া দিয়া কঠিন পণ করিয়া বসে, আমি অমুক গৃহকাজটা করিতে পারিব না, তবে কী হয়। তবে হয় তাহাকে বলপূর্বক সে-কাজে প্রবৃত্ত করানো হয়, নয় বধূর এই বিদ্রোহ পরিবারকে নীরবে সহ্য করিতে হয়। ইংলণ্ডেও সম্ভবত তাহাই ঘটে। যদি ইংরেজ স্ত্রী তাহার অসহায় স্বামীকে বলিয়া বসে তোমার নিমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য পাকাদির ব্যবস্থা আমি করিতে পারিব না, তবে হয় স্বামী বলপ্রকাশ বা ভয়প্রদর্শন করে, নয় ভালোমানুষটির মতো আর-কোনো বন্দোবস্ত করে। চন্দ্রবাবু বলিবেন, হিন্দু স্ত্রী এমনভাবে শিক্ষিত ও পালিত হয় যে বিদ্রোহী হইবার সম্ভাবনা তাহার পক্ষে অল্প; অপর পক্ষে তেমনই বলা যায়, ইংরেজ স্ত্রী যেরূপ শিক্ষা ও স্বাধীনতায় পালিত, তাহাতে সাংসারিক কার্য ছাড়া মহৎ স্বামীর অন্য কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে সহায়তা করিতে সে অধিকতর সক্ষম। কতকগুলি কাজ যন্ত্রের দ্বারা সাধিত হয়, এবং কতকগুলি কাজ স্বাধীন ইচ্ছার বল ব্যতীত সাধিত হইতে পারে না। রন্ধন ও শুশ্রূষাদি শাশুড়ি-ননদের নিত্য সেবা এবং গৃহ-কর্মের অনুষ্ঠানে সাহায্য করা, আশৈশব অভ্যাসে প্রায় সকলেরই দ্বারা সুচারুরূপে সাধিত হইতে পারে। কিন্তু জন স্টুয়ার্ট মিল যেরূপ স্ত্রীর সাহচর্য লাভ করিয়াছিলেন সেরূপ স্ত্রী জাঁতায় পিষিয়া প্রস্তুত হইতে পারে না। হার্মোদিয়াস এবং এরিস্টজিটন, যিশুখৃস্ট এবং সেণ্ট পল, চৈতন্য এবং নিত্যানন্দ, রাম এবং লক্ষ্ণণের যে মহৎ উদ্দেশ্যজাত বিবাহ তাহা জাঁতায়-পেষা বিবাহ নহে, তাহা স্বতঃসিদ্ধ বিবাহ। কেহ না মনে করেন আমি জাঁতায়-পেষা বিবাহের নিন্দা করিতেছি, অনেকের পক্ষে তাহার আবশ্যক আছে; তাই বলিয়া যিনি একমাত্র সেই বিবাহের মহিমা কীর্তন করিয়া অন্য সমস্ত বিবাহের নিন্দা করেন তাঁহার সহিত আমি একমত হইতে পারি না। সর্বত্রই পুরুষ বলিষ্ঠ, অনেক কারণেই স্বামী স্ত্রীলোকের প্রভু; এইজন্য সাধারণত প্রায় সর্বত্রই সংসারে স্ত্রী স্বামীর অধীন হইয়া কাজ করে। ইংরেজের অপেক্ষা আমাদের পরিবার বৃহৎ; এইজন্য পরিবারভারে অভিভূত হইয়া আমাদের দেশের স্ত্রীলোকের অধীন-অবস্থা অপেক্ষাকৃত গুরুতর হইয়া উঠে। ইংরেজ স্ত্রী স্বামীর অধীন বটে কিন্তু বৃহৎ সংসারভারে এত ভারাক্রান্ত নহে যে, কেবল পারিবারিক কর্তব্য ছাড়া আর-কোনো কর্তব্য সাধন করিতে সে অক্ষম হইয়া পড়ে। এইজন্য পরিবারের অবশ্যকর্তব্যকার্য তাহাকে সাধন করিতেই হয়, এবং তাহা ছাড়া জগতের স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত কর্তব্যগুলি পালন করিতেও তাহার অবসর হয়। যদি বল অনেক ইংরেজ স্ত্রী সে অবসর বৃথা নষ্ট করেন তবে এ পক্ষে বলা যায় যে, অনেক হিন্দু স্ত্রী জগতের অনেক স্থায়ী উপকার করিবার স্বাভাবিক ক্ষমতা কুটনা কুটিয়া, বাটনা বাঁটিয়া নিঃশেষ করিয়া ফেলিয়াছেন।

অতএব দাম্পত্যবলে বলীয়ান হইয়া কোনো মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করিবার জন্য বিবাহ করিতে হইলেই যে শিশুস্ত্রীকে বিবাহ করাই আবশ্যক তাহা আমার বিশ্বাস নহে। শিক্ষা পাইলেই যে লোকে মহৎ উদ্দেশ্য গ্রহণ করে তাহা নহে, স্বাভাবিক বুদ্ধি প্রবৃত্তি ও ক্ষমতার উপরে অনেকটা নির্ভর করে। অতএব শিশুস্ত্রী বড়ো হইয়া মহৎ উদ্দেশ্যবিশেষ সাধনে স্বামীর সহযোগিনী হইতে পারিবে কি না কিছুই বলা যায় না। কতকগুলি নিত্যঅভ্যস্ত কার্য নির্বিচারে ও নিপুণতাসহকারে সম্পন্ন করা এক, আর শিক্ষামার্জিত স্বাভাবিক ধর্মপ্রবৃত্তি ও বিবেচনা-সহকারে জগতের উন্নতিসাধনকার্যে স্বামীর সহযোগিতা করা আর-এক। ইহার জন্য নির্বাচন এবং দুই হৃদয়ের এক মহৎ উদ্দেশ্যগত স্বাভাবিক আকর্ষণ আবশ্যক। তবে নির্বাচন করিতে গেলে বিবাহের মহৎ উদ্দেশ্য ভুলিয়া পাছে রূপ যৌবন দেখিয়া লোকে মুগ্ধ হয় এই ভয়। কিন্তু যদি গোড়াতেই পুরুষকে পরিণতবয়স্ক বিদ্যাবান ধর্মবুদ্ধিবিশিষ্ট ও মহৎ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বলিয়া স্বীকার করিয়া লওয়া যায় তবে ইহা কেন মনে করা হয়, উক্ত পুরুষ কেবলমাত্র কন্যার রূপ দেখিয়াই কন্যা নির্বাচন করিবেন। চন্দ্রনাথবাবু গোড়ায় তাহাই স্বীকার করিয়া লইয়াছেন; তিনি বলেন মহৎ-উদ্দেশ্যবিশেষের জন্য স্ত্রীকে প্রস্তুত করিয়া লইবার ভার স্বামীর উপরে, অতএব হিন্দুবিবাহে স্বামীর পূর্বোক্ত লক্ষণাক্রান্ত হওয়া আবশ্যক। এমন স্বামী যদি অধিক থাকে, সমাজের এত উন্নতির অবস্থা যদি ধরিয়া লওয়া হয়, তবে অনেক গোলযোগ গোড়ায় মিটিয়া যায়। তবে সে-সমাজে মহৎ পিতামাতার মহৎ আদর্শ ও মহৎ শিক্ষায় কন্যারাও সহজে মহত্ত্ব লাভ করে এবং মহৎ পুরুষের পক্ষে মহৎ উদ্দেশ্যসম্পন্ন স্ত্রী লাভ করাও দুরূহ হয় না। কিন্তু সর্বদাই ভালো মন্দ দু-ই আছে, এবং মহৎ উদ্দেশ্য সকলের দেখা যায় না। শ্বশুর শাশুড়ি ননদ দেবর প্রভৃতির যথাবিহিত সেবা, এবং পুরপ্রচলিত দেবকার্যের যথাবিধি সহায়তা করিয়া স্ত্রী মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করিলেই যে সকল স্বামীর সম্পূর্ণ পরিতৃপ্তি ঘটে তাহা নহে। স্বামী চায় মনের মতো স্ত্রী। তাহারই বিশেষ প্রীতিকর রূপগুণসম্পন্ন স্ত্রী নইলে কেবল অভ্যস্ত-গৃহকার্যনিষ্ঠা স্ত্রী লইয়া তাহার সম্পূর্ণ বাসনা তৃপ্ত হয় না। মনুষ্যের যে কেবল একমাত্র গার্হস্থ্য শৃঙ্খলার প্রতিই দৃষ্টি আছে তাহা নহে। তাহার সৌন্দর্যের প্রতি স্পৃহা, কলাবিদ্যার প্রতি অনুরাগ, এবং লোকবিশেষে কতকগুলি বিশেষ মানসিক ও নৈতিকগুণের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ আছে। এইজন্য রুচি-অনুসারে স্বভাবতই মানুষ সৌন্দর্য সংগীত প্রভৃতি কলাবিদ্যা এবং আপন মনের গতি-অনুযায়ী বিশেষ কতকগুলি মানসিক ও নৈতিক গুণ স্ত্রীর নিকট হইতে অনুসন্ধান করিয়া থাকে। স্ত্রীতে তাহার অভাব দেখিলে হৃদয় অপরিতৃপ্ত থাকিয়া যায়। সেরূপ স্থলে অনেক পুরুষ হতাশ হইয়া বারাঙ্গনাসক্ত হয় এবং অনেক পুরুষ দাম্পত্যসুখে বঞ্চিত হইয়া মনের অসুখে স্ত্রীর প্রতি ঠিক ন্যায্য ব্যবহার করিতে পারে না। ইহা তো অনেক স্থলেই দেখা যায় স্ত্রী অভ্যাসমত গৃহকোণে আপনমনে নিত্যগৃহকার্য ম্লানমুখে সম্পন্ন করিতেছে, স্বামীর তাহার প্রতি লক্ষই নাই, আদর নাই, যত্ন নাই।

কেহ কেহ বলিবেন আধুনিক শিক্ষিতসমাজের মধ্যেই এরূপ ঘটিতেছে, পূর্বে এতটা ছিল না। এ কথা অসংগত নহে। পূর্বে আমাদের মনে সকল বিষয়েই যে একটি সন্তোষ ছিল, ইংরেজিশিক্ষায় তাহা দূর করিয়া দিয়াছে। ইংরেজের দৃষ্টান্তে ও শিক্ষায় বাঙালির মনে কিয়ৎপরিমাণে উদ্যমের সঞ্চার হইয়াছে। এখন আমরা সকল বিষয়েই অদৃষ্টের হাত দেখিয়া আপন হাত গুটাইয়া লইতে পারি না। এইজন্য কোনো অভাব বোধ করিলে সকল সময়ে অদৃষ্টকে ধিক্‌কার না দিয়া আপনাকেই ধিক্‌কার দিই; ইহাই অসন্তোষ। আমাদের আকাঙক্ষাবেগ পূর্বাপেক্ষা বাড়িয়াছে, এবং আগে অনেক কিছু যাহা অনুভব করিতাম না এখন তাহা অনুভব করিয়া থাকি। অতএব আকাঙক্ষাও বাড়িয়াছে, এবং আকাঙক্ষাতৃপ্তিসাধনের উদ্দেশ্যে উদ্যমও বাড়িয়াছে। অতএব এ কথা যদি সত্য হয় যে, আধুনিক কালে অনেক পুরুষ তাঁহার বাল্যবিবাহিতা পত্নীর প্রতি অনুরাগবিহীন হইয়া থাকেন, তবে তাহাতে স্বভাববিরুদ্ধ কিছু ঘটিয়াছে এমন বলিতে পারি না। অনেকে বলিবেন, এরূপ যাহাতে না হয়, প্রাচীন সন্তোষ যাহাতে ফিরিয়া আসে, এমন শিক্ষা দেওয়া উচিত। কিন্তু ব্রহ্মচর্যাদি আশ্রম গ্রহণ করিয়া প্রাচীন কালে পুরুষের প্রতি যে শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল, এখন সে-শিক্ষাপ্রণালী আর ফিরিয়া আসিতে পারে না। আমরা যে শিক্ষার দায়ে পড়িয়াছি তাহা লইয়াই বিব্রত, কারণ তাহার সহিত পেটের দায় জড়িত। চারি দিকের অবস্থা আলোচনা করিয়া মনে করিয়া লইতে হইবে এ শিক্ষা এখন অনেক কাল চলিবেই। অতএব এ শিক্ষার প্রত্যক্ষ এবং অলক্ষ্য প্রভাব উত্তরোত্তর বাড়িবে বৈ কমিবে না। সুতরাং সামাজিক কোনো অনুষ্ঠান সমালোচন করিবার সময় এ শিক্ষাকে একেবারেই আমল না দিলে চলিবে কেন। সমাজে যে-শিক্ষা প্রচলিত নাই তাহারই ফলাফল বিচার করিয়া, এবং যে-শিক্ষা প্রচলিত আছে তাহাকে দূরে রাখিয়া কোনো সমাজনিয়ম স্থাপন করা যায় না।

বিবাহ সম্বন্ধে ইংরেজিশিক্ষার কী প্রভাব তাহা আলোচনা আবশ্যক। পুরুষ শাস্ত্রচর্চাবান এবং স্ত্রী শাস্ত্রচর্চাহীন মন্ত্রহীন হয়, ইংরেজি মতে ইহা প্রার্থনীয় নহে। বিবাহে স্ত্রীপুরুষের একীকরণ ইংরেজি বিবাহের উচ্চ আদর্শ। কিন্তু সে-একীকরণ সর্বাঙ্গীন একীকরণ–কেবল সাংসারিক একীকরণ নহে, মানসিক একীকরণ। স্বামী যদি বিদ্বান হয় এবং স্ত্রী যদি মূর্খ হয় তবে উভয়ের মধ্যে মানসিক একীকরণ সম্ভবে না, পরস্পরের মধ্যে সম্যক্‌ ভাবগ্রহ চলিতে পারে না। একটি প্রধান বিষয়ে স্ত্রী পুরুষ পরস্পরের মধ্যে অলঙ্ঘ্য ব্যবধান থাকে।

জীবনের সমুদয় কর্তব্যসাধনে স্ত্রীর সহযোগিতা, ইহাও ইংরেজি বিবাহের আদর্শ। এ সম্বন্ধে পূর্বেই বলিয়াছি; এবং ইহাও বলিয়াছি এরূপ মহৎ উদ্দেশ্যে মিলন ঘরে প্রস্তুত করিয়া লওয়া যায় না। চৈতন্যের সহিত নিত্যানন্দের, যিশুখৃস্টের সহিত সেণ্ট পলের, রামের সহিত লক্ষ্ণণের যেরূপ অনিবার্য স্বাভাবিক মিলন ঘটিয়াছিল, ইহাতেও সেইরূপ হওয়া আবশ্যক। ইংরেজি সকল বিবাহে যে এরূপ ঘটিয়া থাকে তাহা নহে, কিন্তু এইরূপ বিবাহই তাহাদের আদর্শ।

যাঁহারা বলেন হিন্দুবিবাহের এইরূপ আদর্শ, তাঁহাদের কথা প্রমাণাভাবে এখনো মানিতে পারি না। হিন্দুবিবাহে মনে মনে, প্রাণে প্রাণে, আত্মায় আত্মায় মিলন ঘটিয়া থাকে কি না বিচার্য। আমরা স্ত্রীকে সহধর্মিণী নাম দিয়া থাকি বটে, কিন্তু মনু স্পষ্টই বলিয়াছেন, স্ত্রীদের মন্ত্র নাই, ব্রত নাই, উপবাস নাই; কেবল স্বামীকে শুশ্রূষা করিয়া তাঁহারা স্বর্গে মহিমান্বিতা হন। ইহাকে উচিতমতে স্বামীর সহিত সহধর্ম বলা যায় না। ইহাকে যদি সহধর্ম বলে তবে প্রাচীন কালের শূদ্রদিগকেও ব্রাহ্মণের সহধর্মী বলা যাইতে পারে। স্ত্রীপুরুষে শিক্ষার ঐক্য নাই, ধর্মব্রতপালনের ঐক্য নাই, কেবলমাত্র জাতিকুলের ঐক্য আছে।

অনেক শিক্ষিত লোকে ইংরেজিশিক্ষার গুণে এই ইংরেজি একীকরণের পক্ষপাতী হইয়াছেন। হৃদয়|মনের স্বাভাবিক নিগূঢ় ঐক্য থাকা প্রযুক্ত দুই স্বাধীন ব্যক্তির স্বেচ্ছাপূর্বক এক হইয়া যাওয়াই ইংরেজি একীকরণ; আঠা দিয়া এবং চাপ দিয়া জোড়া, সে অন্য প্রকার একীকরণ। উক্ত ইংরেজি আদর্শের প্রতি যদি কোনো কোনো শিক্ষিত লোকের পক্ষপাত দেখা যায়, তবে তাঁহাদের দোষ দেওয়া যায় না। উহা অবশ্যম্ভাবী। ইংরেজি শিখিয়া যে কেবলমাত্র অন্নটুকু উপার্জন করিব তাহা হইতেই পারে না, ইংরেজি ভাব উপার্জন না করিয়া থাকিবার জো নাই। জলে প্রবেশ করিয়া মাছ ধরিতে গেলে ভিজিতেও হইবে।

অতএব আধুনিক শিক্ষিত দলের মধ্যে অনেকেই যখন স্ত্রী গ্রহণ করেন তখন সে-স্ত্রী যে কেবলমাত্র গৃহকার্য নিপুণরূপে সম্পন্ন করিবে, ও তাঁহাকেই দেবতা জ্ঞান করিবে, ইহাই মনে করিয়া সন্তুষ্ট থাকেন না। সে-স্ত্রীর স্বাভাবিক গুণ ও শিক্ষা তাঁহারা দেখিতে চান, এবং যাঁহারা ভাবী সন্তানের স্বাস্থ্যের কথা ভাবেন, তাঁহারা স্ত্রীর কোনো স্থায়ী রোগপ্রবণতা বা অঙ্গহীনতা না থাকে তাহার প্রতিও দৃষ্টি রাখিতে চান। কিন্তু সকলেই যে এইরূপ বিচার করিয়া বিবাহ করিবেন তাহা বলি না। অনেকেই ধন রূপ বা যৌবন মোহে মুগ্ধ হইয়া বিবাহ করিবেন। বর্তমান হিন্দুবিবাহেও সেরূপ হইয়া থাকে। অক্ষয়বাবু তাঁহার বক্তৃতায় কায়স্থবিবাহে দরদামের প্রাবল্য এবং কুলশীলের প্রতি উপেক্ষা সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, তাহা কাহারো অগোচর নাই। প্রচলিত বিবাহে কন্যার রূপে মুগ্ধ হইয়াও যে কন্যা নির্বাচন হয় না, তাহাও ঠিক বলিতে পারি না। ইহার যা ফল তাহা এখনো হয় পরেও হইবে। পিতার ধনমদে মত্ত বধূ ঔদ্ধত্য প্রকাশ করিয়া অনেক সময়ে দরিদ্র পতিকুলের অশান্তির কারণ হইয়া থাকে; এবং অক্ষমতাবশত দরিদ্র পিতা কন্যার বিবাহের পণ সম্বন্ধে কোনো ত্রুটি করিলে অভাগিনী কন্যাকে তজ্জন্য বিস্তর লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হয়। অতএব কেবলমাত্র ধনযৌবনের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া কন্যানির্বাচন করিলে তাহার যা ফল তাহা ভোগ করিতে হইবে। কিন্তু যাঁহারা গুণ দেখিয়া কন্যা বিবাহ করিতে চান, বাল্যবিবাহে তাঁহাদের সম্পূর্ণ অসুবিধা। চরিত্রবিকাশ না হইলে কন্যার গুণাগুণ বিষয়ে কিছুই জানা যায় না। কন্যা বড়ো হইয়াই যে সত্যনিষ্ঠ সদ্বিবেচক প্রিয়বাদিনী ও হিতানুষ্ঠাননিরতা হইবে তাহা বলা যায় না। অনেক শিশুস্ত্রী বড়ো হইয়া নানাবিধ বৃথা অভিমানে ও উত্তরোত্তর-বিকাশমান হীন স্বভাব-বশত ঝগড়া-বিবাদ ও ঘরভাঙাভাঙি করিয়া থাকে। এবং অনেকে অগত্যা বধূদশা নিরুপদ্রবে যাপন করিয়া যথাসময়ে প্রচণ্ড শাশুড়িমূর্তি ধারণ করিয়া অকারণে নিজ বধূর প্রতি যৎপরোনাস্তি নিপীড়ন, অধীনাগণকে তাড়ন ও গৃহের শান্তিভঙ্গ করিয়া থাকেন। তর্কস্থলে কী করিবেন জানি না, কিন্তু আমাদের সমাজে এরূপ শাশুড়ির বহুল অস্তিত্ব কেহ অস্বীকার করেন না। অতএব বাল্যবিবাহেই যে সুগৃহিণী উৎপন্ন হই থাকে, যৌবনবিবাহে হয় না, তাহা কেমন করিয়া বলিব।

উপহাস রসিক শ্রীযুক্ত ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলেন, যদি এমন করিয়া বাছিয়াই বিবাহ প্রচলিত হয় তবে সমাজে অন্ধ খঞ্জ কুৎসিত অঙ্গহীনদের দশা কী হইবে। মনুর আমলে অঙ্গহীনতা প্রভৃতি দোষ জন্য যে-সকল কন্যার বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল, তাহাদের দশা কী হইত। পিতামাতার উপরে নির্বাচনের ভার রহিয়াছে বলিয়াই যদি সমাজে অন্ধ খঞ্জ অঙ্গহীনরা পার হইয়া যায়, তবে এমন হৃদয়হীন বিবেচনাশূন্য নির্বাচন-প্রণালী অতি ভয়ানক বলিতে হইবে ছেলেমেয়ের বিবাহ দিবার সময় পিতামাতা তাহাদের মঙ্গল আগে খুঁজিবেন, না সমাজের যত অন্ধখঞ্জদের সুখ আগে দেখিবেন?

কিন্তু পছন্দ করিয়া বিবাহ করিলেই সকল সময়ে মনের মতো হইবে এমন কী কথা আছে– ইহাও অনেকে বলিয়া থাকেন। কিন্তু মনের মতো বিবাহ করাই যদি মত হয় তবে পছন্দ করিয়া লইতেই হইবে। আসল কথা, মনের মতো পাওয়া শক্ত, অতএব ঠকিবার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তাই বলিয়া এমন একজন লোক বলিতে পারেন, তবে আমি মনের মতো চাই না–মনের অ-মতো হইলেও ক্ষতি নাই। যদি আমার সম্পূর্ণতা লাভের জন্য, আমার সমগ্র মানবপ্রকৃতির চারিতার্থতা-সাধনের জন্য আমি স্ত্রী চাই, তবে তাঁহাকে সন্ধান করিতে হইবে। সন্ধান করিলেই যে সকল সময়েই সম্পূর্ণ কৃতকার্য হওয়া যাইবে, এমন কোনো কথাই নাই। কিন্তু সন্ধানপূর্বক বিবেচনাপূর্বক সংযতচিত্তে স্ত্রী নির্বাচন করিয়া লওয়া ছাড়া ইহার অন্য পন্থা নাই। Catholic শাস্ত্র দাম্পত্যনির্বাচন সম্বন্ধে কী বলেন এইখানে উদ্‌ধৃত করিব :

They ought to implore the divine assistance by fervent and devout prayer, to guide them in their choice of a proper person ; for on the prudent choice which they make will very much depend their happiness both in this life and in the next. They should be guided by the good character and virtuous dispositions of person of their choice rather than by riches, beauty or any other worldly considerations, which ought to be but secondary motives.

এখনকার অনেক ছেলে যথাসম্ভব স্ত্রী নির্বাচন করিয়া লয়। এখন অনেক স্থলে শুভদৃষ্টিই যে প্রথম দৃষ্টি তাহা নয়। অতএব দেখিতেছি নির্বাচনপ্রথা অল্পে অল্পে শুরু হইয়াছে। পিতামাতারাও ইহাতে ক্ষুব্ধ নহেন।

তবে একান্নবর্তী পরিবারের কী দশা হইবে। বাল্যবিবাহের স্বপক্ষে এই এক প্রধান যুক্তি। স্ত্রীকে যে অনেকের সহিত এক হইতে হইবে। স্বামীর সহিত সম্পূর্ণ একীকরণ সকল সময় হউক বা না হউক, বৃহৎ পরিবারের সহিত বধূর একীকরণসাধন করিতে হইবে। এ সম্বন্ধে চন্দ্রনাথবাবু যাহা বলেন তাহা যথার্থ :

ইংরেজপত্নীর যেমন একটিমাত্র সম্বন্ধ, হিন্দুপত্নীর তেমন নয়। হিন্দুপত্নীর বহুবিধ সম্বন্ধ। দেখা গেল যে, হিন্দুশাস্ত্রকার হিন্দুপত্নীকে সেই বহুবিধ সম্বন্ধের উপযোগী করিতে উৎসুক। অতএব একরকম নিশ্চয় করিয়া বলা যাইতে পারে যে, পতিকুলের জটিল এবং বহুবিধ সম্বন্ধ ভাবিয়া হিন্দুশাস্ত্রকার হিন্দুস্ত্রীর শৈশববিবাহের ব্যবস্থা করিয়াছেন; যদি তাহাই হয় তবে কেমন করিয়া শৈশববিবাহের নিন্দা করি।

শৈশববিবাহের যে নিন্দাই করিতে হইবে, এমন তো কোনো কথা নাই। অবস্থাবিশেষে তাহার উপযোগিতা কেহই অস্বীকার করিতে পারিবে না। যদি স্ত্রীশিক্ষা না থাকে এবং একান্নবর্তী পরিবার থাকে, তবে শিশুস্ত্রীবিবাহ সমাজরক্ষার জন্য আবশ্যক। কিন্তু তাহার জন্য আরো গুটিকতক আবশ্যক আছে; তাহার প্রতি কেহ মনোযোগ করেন না। পুরাকালে যেরূপ শিক্ষা প্রচলিত ছিল সেইরূপ শিক্ষা আবশ্যক এবং তখন সাংসারিক অবস্থা যেরূপ ছিল সেইরূপ অবস্থা আবশ্যক। কারণ কেবলমাত্র শিশুস্ত্রীবিবাহের উপর একান্নবর্তী পরিবারের স্থায়িত্ব নির্ভর করিতেছে না।

পূর্বকালে সমাজের যে-অবস্থা ছিল ও যে-শিক্ষা প্রচলিত ছিল, সেই-সমস্ত অবস্থা ও শিক্ষা একত্র মিলিয়া একান্নবর্তী-পরিবার-প্রথার স্থায়িত্ব বিধান করিত। ইহার মধ্যে কোনো একটিকে বাছিয়া লইলে চলিবে না। সন্তোষ একান্নবর্তী-প্রথার মূলভিত্তি। বর্তমান সমাজে সন্তোষ কোথায়। আমাদের কত কী চাই তাহার ঠিক নাই। প্রথমত, ছাতা জুতা টুপি অশন বসন ভূষণ এবং ভদ্রসমাজের বাহ্য উপকরণ বিস্তর বাড়িয়াছে, এবং তাহাদের দামও বাড়িয়াছে। দ্বিতীয়ত, বিদেশীয় শিক্ষার আবশ্যকতা ও মহার্ঘতা বাড়িয়াছে। কিছুকাল পূর্বে আমাদের দেশে লেখাপড়া অল্প ছিল এবং তাহার খরচ অল্প ছিল। সংস্কৃত সকলে শিখিতেন না, যাঁহার শিখিতেন তাঁহাদের জন্য টোল ছিল। রাজভাষা ফার্সি কেহ কেহ শিখিতেন, কিন্তু তাহা আমাদের বর্তমান রাজভাষাশিক্ষার ন্যায় এমন গুরুতর ব্যাপার ছিল না। শুভংকর ও বাংলা বর্ণমালা শিখিতে অধিক সময়ও চাই না, অর্থও চাই না। কিন্তু এখন ছেলেকে ইংরেজি শিখাইতে হইবে, পিতামাতার মনে এ আকাঙক্ষা সর্বদাই জাগ্রত থাকে। কেহ কেহ বা ছেলেকে বিলাতে পাঠাইবেন, এমন বাসনা মনে মনে পোষণ করিয়া থাকেন। ইংরেজিবিদ্যাকে যে সকলে শুদ্ধমাত্র অর্থকরী বিদ্যা বলিয়া জ্ঞান করেন তাহা নহে; অনেকেই মনে করেন, ইংরেজি শিক্ষা না হইলে মানসিক, এমন-কি, নৈতিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। এইজন্য ছেলেকে ইংরেজি শিক্ষা দেওয়া তাঁহারা পরম কর্তব্য জ্ঞান করেন।

অতএব সন্তানের স্থায়ী উন্নতিসাধন পিতামাতার সর্বপ্রধান ধর্ম, ইহা স্থির করিয়া তাঁহারা পুত্রের সামান্য শিক্ষায় সন্তুষ্ট থাকিতে পারেন না। সবসুদ্ধ ধরিয়া অভাব আকাঙক্ষা এবং তদনুসারে খরচপত্র বিস্তর বাড়িয়া গিয়াছে, ইহা সকলেই স্বীকার করেন। কিন্তু পূর্বেই বলিয়াছি, সমাজের সচ্ছল ও সন্তোষের অবস্থাতেই একান্নবর্তী পরিবার সম্ভব। যখন সকলেরই অভাব অল্প এবং সামান্য পরিশ্রমেই সে-অভাব মোচন হইতে পারে, তখন অনেকে একত্র থাকিয়া পরস্পরের অভাবমোচনচেষ্টা স্বাভাবিক, এবং তাহা দুরূহ নহে। বললাভের জন্য বৃহৎ জ্ঞাতিবন্ধন বা গোত্রবন্ধন (ইংরেজিতে যাহাকে clan system বলে) সাধারণের অল্প অভাব এবং এক উদ্দেশ্য থাকিলে সহজেই ঘটিয়া থাকে। কিন্তু প্রত্যেকেরই যদি বিপুল অভাব ও উদ্দেশ্যের পার্থক্য জন্মে তবে ঐক্যবন্ধন বলবৎ থাকিতে পারে না। অভাব আমাদের বাড়িয়াছে এবং বাড়িতেছে, একান্নবর্তী পরিবারও টলমল করিতেছে–অনেক পরিবার ভাঙিয়াছে এবং অনেক পরিবার ভাঙিতেছে।

ইংরেজি শাস্ত্রে স্বাধীন চিন্তা শিক্ষা দেয়। স্বাধীন চিন্তা যেখানে আছে সেখানে বুদ্ধির ভিন্নতা-অনুসারে উদ্দেশ্যের ভিন্নতা জন্মিয়াই থাকে। এখন কর্তব্য সম্বন্ধে ভিন্ন লোকের ভিন্ন মত। ভিন্ন মত না থাকিলে বর্তমান প্রবন্ধ লইয়া আজ আমাকে সভাস্থলে উপস্থিত হইতে হইত না। যখন শাস্ত্রের প্রবল অনুশাসনে সকলে গুটিকতক কর্তব্য শিরোধার্য করিয়া লইত তখন ভিন্ন লোকের মধ্যে জীবনযাত্রার ঐক্য ছিল, এবং এক শাস্ত্রের অধীনে অনেকে মিলিয়া বাস করা দুঃসাধ্য ছিল না। কিন্তু এখন যখন এমন অবস্থা হইয়াছে যে, শাস্ত্র বলিতেছে বলিয়াই কিছু মানি না, এমন-কি, যাঁহারা শাস্ত্রকে সম্মান করেন তাঁহারা অনেকে আপন মতানুসারে শাস্ত্রের নানারূপ ব্যাখ্যা করেন, অথবা নিজের বুদ্ধি অনুসরণ করিয়া শাস্ত্রের কোনো কোনো অংশ বর্জন করিয়া কোনো কোনো অংশ নির্বাচন করিয়া লন, তখন নির্বিরোধে একত্র অবস্থান কিরূপে সম্ভব হয়। অতএব একত্র থাকিতে গেলে সকলের অভাব অল্প থাকা চাই, এবং যুক্তিবিচারনিরপেক্ষ কতকগুলি সরল কর্তব্য থাকা চাই, এবং তাহার কর্তব্যতার প্রতি সকলের সমান বিশ্বাস থাকা চাই।

ইহা ছাড়া পরিবারের একটি কর্তা থাকা চাই। কিন্তু এখন পূর্বের মতো কর্তার কর্তৃত্ব তেমন নাই বলিলেও হয়। বঙ্গদেশে পিতা ইচ্ছা করিলে সন্তানকে বিষয় হইতে বঞ্চিত করিতে পারেন, এইজন্য সচরাচর গুরুতর পিতৃদ্রোহ ততটা দেখা যায় না; কিন্তু বড়ো ভায়ের প্রতি ছোটো ভায়ের অসম্মান এবং ভায়ে ভায়ে বিরোধ, ইহা অনেক দেখা যায়। বড়ো ভাই যাহা বলিলেন তাহাই বেদবাক্য, এবং যাহা করিবেন তাহাই সহিয়া থাকিতে হইবে, ইহা এখন সকলে মানে না। যে-কারণে শাস্ত্রের অনুশাসন শিথিল হইয়া আসিতেছে, জ্যেষ্ঠের প্রতি কনিষ্ঠের নির্বিচার ভক্তিবন্ধন সেই কারণেই শিথিল হইয়া আসিতেছে।

এ স্থলে আর-একটি বিষয় বিচার্য। তাহা শিক্ষার বৈষম্য। যে ভালোরূপ ইংরেজি শিখিয়াছে এবং যে শেখে নাই, তাহাদের মধ্যে গুরুতর ব্যবধান পড়িয়াছে। তাহাদের চিন্তা প্রণালী সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হইয়া গিয়াছে। পূর্বে বিদ্বান-মূর্খের মধ্যে এরূপ প্রভেদ ছিল না। তখন একজন বেশি জানিত আর-একজন কম জানিত, এইমাত্র প্রভেদ ছিল। এখন একজন একরূপ জানে, আর-একজন অন্যরূপ জানে। এইজন্য অনেক সময়ে দেখা যায়, উভয়ে উভয়কে জানে না। সামান্য বিষয়ে পরস্পর পরস্পরকে ভুল বুঝে, এইজন্য উভয়ের তেমন ঘনিষ্ঠভাবে একত্র থাকা প্রায় অসম্ভব।

অতএব দেখা যাইতেছে, এক সময়ে একান্নবর্তী প্রথা থাকাতে অনেক সুবিধা ছিল এবং তাহাতে মানবপ্রকৃতির অনেক উন্নতি সাধন করিত। কিন্তু এখন অবস্থাভেদে তাহার সুবিধাগুলি চলিয়া যাইতেছে এবং তাহার মধ্যে যে উন্নতির কারণ ছিল তাহাও নষ্ট হইতেছে। পূর্বে জটিলতাবিহীন সমাজে যে-সকল সুখ সম্পদ ও শিক্ষা লভ্য ছিল, তাহা একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে থাকিয়াই সকলে পাইত। এখন একান্নবর্তী পরিবারে থাকে বলিয়াই অনেকে সে-সকল হইতে বঞ্চিত হইতেছে। আমি প্রাণপণে উপার্জন করিয়া যে-অর্থ সঞ্চয় করিতেছি, তাহাতে কোনো মতে আমার পুত্রের শিক্ষা দিয়া তাহার যাবজ্জীবন উন্নতির মূলপত্তন করিয়া দিতে পারি; কিন্তু আমি আমার পুত্রের অহিতসাধন করিয়া আমার শ্যালকপুত্রের কথঞ্চিৎ উদরপূর্তি করিব, ইহাকে সকলের মহৎ উদ্দেশ্য মনে না হইতেও পারে। যদি ইচ্ছা কর তো সন্তানোৎপাদন বন্ধ করিয়া অপরের সন্তানের উন্নতিসাধনে প্রাণপণ করিতে পার, তাহাতে তোমার মহত্ত্ব প্রকাশ পাইবে; কিন্তু যদি তোমার নিজের সন্তান জন্মে তবে সর্বাপেক্ষা প্রবল স্নেহ ও কর্তব্যসূত্রে তোমার সহিত বদ্ধ যে-আত্মজ, তাহার সম্যক্‌ উন্নতিবিধানের জন্য তুমি প্রধানত দায়ী। পূর্বে শ্যালকপুত্রের সহিত নিজ পুত্রের প্রভেদ করিবার কোনো আবশ্যকতা ছিল না, কারণ তখন আমাদের অন্নপূর্ণা বঙ্গভূমি তাঁহার সকল সন্তানকে একত্রে কোলে লইয়া সকলের মুখে অন্ন তুলিয়া দিতে পারিতেন, তাঁহার ভাণ্ডার এমন পরিপূর্ণ ছিল; এখন চারি দিকে অন্ন নাই অন্ন নাই রব উঠিয়াছে, এখন পিতা স্বয়ং আপন ক্ষুধিত সন্তানের মুখ না চাহিলে উপায় কি। দ্বিতীয় কথা, পূর্বকালে একান্নবর্তী পরিবারে প্রীতিভাবের অত্যন্ত চর্চা হইত। এজন্য তাহা দেশের একটি মহৎ আশ্রম বলিয়া গণ্য হইত। কিন্তু এখন সাধারণের অবস্থাভেদে শিক্ষাভেদে শাস্ত্রভেদে মতভেদে ও রুচিভেদে নিতান্ত একত্র অবস্থানে সর্বত্র সেরূপ সদ্ভাবের সম্ভাবনা নাই, বরঞ্চ বিরোধ বিদ্বেষ ঈর্ষা ও নিন্দাগ্লানির সম্ভাবনা; এবং ইহাতে মনুষ্যপ্রকৃতির উন্নতি না হইয়া অবনতি হইবারই কথা। তৃতীয় কথা, যখন পরিবারের মধ্যে শাসন শিথিল হইয়া আসিয়াছে ইহা সকলেই প্রত্যক্ষ করিতেছেন তখন পরিবারের মধ্যে যথেচ্ছারের প্রাদুর্ভাব অবশ্যম্ভাবী, ইহাও স্বীকার করিতে হইবে। বহুবিস্তৃত পরিবারে এরূপ যথেচ্ছাচরের অপেক্ষা ক্ষতিজনক আর কী আছে। একজন এক ঘরে মদ্যপান করিতেছেন, আর-একজন অন্য ঘরে বন্ধুবান্ধবসমেত অট্টহাস্য ও ঊর্ধ্বকণ্ঠে কুৎসিত আলাপে নিরত, এ স্থলে আমার ছেলেপুলের শিক্ষা কীরূপ হয়। আমি আমার সন্তানকে এক ভাবে শিক্ষা দিতে চাই, আমার গুরুজন তাহাকে অন্য ভাবে শিক্ষা দেন, সে স্থলে ছেলেটার উপায় কী। পিতার শিক্ষাগুণে ভ্রাতুষ্পুত্রগণ বিগড়িয়া গেছে, তাহাদের সহিত আমি আমার ছেলেকে একত্র রাখি কী করিয়া। তাহা ছাড়া বৃহৎ পরিবারে সকলের প্রেমের বন্ধন সমান হইতেই পারে না; সুতরাং পরস্পরের প্রতি কুৎসা দ্বেষ মিথ্যাচরণ অনেক সময় দূষিত রক্তস্রোতের ন্যায় পরিবারের মধ্যে সঞ্চরণ করিতে থাকে। অতএব দেখিতেছি, কালক্রমে একান্নবর্তী প্রথার সদ্‌গুণসকল বিনষ্ট এবং তাহার প্রতিষ্ঠাভূমি জীর্ণ হইয়া আসিতেছে। কেবলমাত্র কন্যার বাল্যবিবাহ-প্রবর্তন-রূপ ক্ষীণ দণ্ড আশ্রয় করিয়াই যে এই ঐতিহাসিক প্রকাণ্ড পতনোন্মুখ মন্দিরকে ধরিয়া রাখিতে পারিব তাহা মনে হয় না। প্রথমে শিখিতে হইবে শাস্ত্র অভ্রান্ত, গুরুবাক্য অলঙ্ঘনীয়, তার পর দেখিতে হইবে জীবনের অভাব-সকল উত্তরোত্তর স্বল্প ও সরল হইয়া আসিতেছে; তবে জানিব একান্নবর্তী প্রথা টিঁকিবে। কিন্তু দেখিতেছি বর্তমান সমাজে দুটার মধ্যে কোনোটাই ঘটিতেছে না; এবং ভবিষ্যতে যতটা দেখা যায়, শীঘ্র এ অবস্থার পরিবর্তন দেখি না, বরঞ্চ উত্তরোত্তর বৃদ্ধিরই সম্ভাবনা।

এই-সকল ভাবিয়া যাঁহারা বলেন বর্তমান সমাজে একান্নবর্তী প্রথার অনেক দোষ ঘটিয়াছে, অতএব উহা উঠিয়া গেলে কোনো হানি নাই, বরং উঠিয়া যাওয়াই উচিত, কিন্তু তাই বলিয়া বাল্যবিবাহ উঠাইবার কোনো প্রয়োজন দেখি না–তাঁহাদের প্রতি বক্তব্য এই যে, একান্নবর্তী প্রথা না রাখিলে বাল্যবিবাহ থাকিতে পারে না। যেখানে স্বতন্ত্র গৃহ করিতে হইবে সেখানে স্বামীস্ত্রীর বয়স অল্প হইলে চলিবে না। তখন শিশুস্ত্রী যদি অনেক দিন পর্যন্ত স্বামীর নিরুদ্যম ভারস্বরূপ হইয়া থাকে তবে স্বামীর পক্ষে সংকট। একক স্বামীগৃহে কেই-বা তাহাকে গৃহকার্য শিক্ষা দিবে। অতএব এরূপ অবস্থায় পিতৃভবন হইতে গৃহকার্য শিক্ষা করিয়া স্বামীগৃহে আসা আবশ্যক। অথবা পরিণত বয়সে বিবাহ হওয়াতে স্বল্প পরিবারের ভার গ্রহণে বিশেষ অসুবিধা হয় না।

অতএব একান্নবর্তী প্রথা ভালো সুতরাং তাহা রক্ষার জন্যই বাল্যবিবাহ ভালো, এ কথা বলিলে তাহার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কথা উঠে; সংক্ষেপে তাহার আলোচনা করা গেল। এখন আর-একটি কথা দেখিতে হইবে। যে-অসচ্ছল অবস্থার পীড়নে একান্নবর্তী প্রথা প্রতিদিন অল্পে অল্পে ভাঙিয়া পড়িতেছে, সেই অবস্থার দায়েই বাল্যবিবাহ প্রথাও দুর্বল হইয়া পড়িতেছে। দায়ে পড়িয়া শাস্ত্রবিধি লঙ্ঘনপূর্বক কন্যাকে অনেক বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত রাখা হইয়াছে, ইতিপূর্বে হিন্দুসমাজে এরূপ দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। সমাজে সর্বাপেক্ষা অধিক মান্য কুলীনসম্প্রদায়ের মধ্যেই ইহা প্রচলিত ছিল এবং অনেক স্থলে এখনো আছে। অতএব তেমন দায়ে পড়িলে অল্পে অল্পে কুমারী কন্যার বয়োবৃদ্ধি এখনো অসম্ভব নহে। সমাজ দায়েও পড়িয়াছে এবং অল্পে অল্পে বয়োবৃদ্ধিও আরম্ভ হইয়াছে। যাঁহারা আচার মানিয়া চলেন তাঁহাদের মধ্যেও ১৩ বৎসর বয়সে কন্যাদান অনেক স্থলে দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু কিছুকাল পূর্বে আট-দশ বৎসর পার হইলেই কন্যাকে পিতৃগৃহে দেখা যাইত না। পূর্বে কন্যার ৩। ৪। ৫ বৎসর বয়সে যত বিবাহ দেখা যাইত এখন তত দেখা যায় না। পুরুষের বিবাহবয়স পূর্বাপেক্ষা অনেক বাড়িয়াছে ইহা প্রত্যক্ষ দেখা যাইতেছে। শিক্ষিত হিন্দুসমাজে পুরুষের শিশুবিবাহ নাই বলিলেও হয়। এইরূপ অলক্ষিতভাবে বিবাহের বয়োবৃদ্ধি যে ইংরেজিশিক্ষার অব্যবহিত ফল, আমার তাহা বিশ্বাস নহে। অবস্থার অসচ্ছলতাই ইহার প্রধান কারণ। আমার বোধ হয় বড়োমানুষের ঘরে বাল্যবিবাহ যতটা আছে মধ্যবিত্ত গৃহস্থের ঘরে ততটা নাই। অর্থক্লেশের সময় ছেলেমেয়েদের বিবাহ দেওয়া বিষম ব্যাপার। সুবিধা করিয়া বিবাহ দিতে অনেক সময় যায়। বিবাহের ব্যয়ভার বহন করিবার জন্য সাংসারিক খরচ বাদে অল্প অল্প করিয়া অর্থ সঞ্চয় করিতে হয়। গৃহস্থ লোকের পক্ষে তাহাতে অনেক সময় চাই। সমাজের সচ্ছল অবস্থায় কন্যাদায়গ্রস্তকে লোকে সাহায্য করিত। কিন্তু একপক্ষে খরচ বাড়িয়াছে, অপরপক্ষে সাহায্য কমিয়াছে।

এ ছাড়া, ইংরেজিশিক্ষার প্রভাবে অনেক অবিবাহিত যুবক নানা বিবেচনায় চটপট বিবাহকার্য সারিয়া ফেলিতে চান না। ইঁহাদের মধ্যে অল্পসংখ্যক যুবক আছেন যাঁহারা যৌবনের স্বাভাবিক উৎসাহে সংকল্প করে যে, বিবাহ না করিয়া জীবন দেশের কোনো মহৎ কার্যে উৎসর্গ করিব; অবশেষে বয়োবৃদ্ধি-সহকারে মহৎ কার্যের প্রতি ঔদাসীন্য জন্মিলে হয়তো বিবাহের প্রতি মনোযোগ করেন। অনেকে বিদ্যাশিক্ষার ব্যাঘাত হইবে বলিয়া পঠদ্দশায় বিবাহ করিতে অসম্মত। এবং অনেকে বিবেচনা করিয়া দেখিয়াছেন, অল্পবয়সে বিবাহ করিয়া তাড়াতাড়ি পরিবারবৃদ্ধি করিলে ইহজীবন দারিদ্র্যের হাত এড়ানো দুষ্কর হইবে। তাঁহারা জানেন যে, অল্পবয়সে স্ত্রীপুত্রের ভারে অভিভূত হইয়া তেজ বল সাহস সমস্তই হারাইতে হয়। সহস্র অপমান নীরবে সহ্য করিয়া যাইতে হয়, তাহার সমুচিত প্রতিশোধ দিতে ভরসা হয় না। যখন বিদেশীয় প্রভুর নিকট হইতে নিতান্ত হীনজনের ন্যায় অন্যায় লাঞ্ছনা সহ্য করা যায় তখন গৃহের ক্ষুধিত রুগ্‌ণ সন্তানের ম্লান মুখই মনে পড়ে এবং নীরবে নতশিরে ধৈর্য অবলম্বন করিতে হয়। কাগজে পত্রে শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে অনেক লেখনী-আস্ফালন করি, কিন্তু গৃহে ক্রন্দনধ্বনি শুনিলে আর থাকা যায় না; সেই শ্বেতপুরুষের দ্বারস্থ হইয়া জোড়হস্তে ছলছলনয়নে দুই বেলা উমেদারি করিয়া মরিতে হয়। সংসার-ভার বহন করিয়া বাঙালিদের স্বাভাবিক সাবধানতাবৃত্তি চতুগুZ বাড়িয়া উঠে এবং সকল দিক বিবেচনা করিয়া কোনো কাজে অগ্রসর হইতে পা উঠে না। এইরূপ ভারাক্রান্ত ভীত এবং ব্যাকুল ভাব জাতির উন্নতির প্রতিকূল তাহার আর সন্দেহ নাই। এ কথা স্মরণ করিয়া অনেক দেশানুরাগী অপমান-অসহিষ্ণু উন্নতস্বভাব যুবক অসমর্থ অবস্থায় বিবাহ করিতে বিরত হইবেন। ইহা নিশ্চয়ই যে, দারিদ্র্যের প্রভাব যতই অনুভব করা যাইবে লোকে বিবাহবন্ধনে ধরা দিতে ততই সংকুচিত হইবে। যখন চারিদিকে দেখা যাইবে উদ্বাহবন্ধন উদ্বন্ধনের ন্যায় বিবাহিতের কণ্ঠদেশ আক্রমণ করিয়াছে, তখন মনু অথবা অন্য কোনো ঋষির বিধান সত্ত্বেও যুবক যখন-তখন উক্ত ফাঁসের মধ্যে গলা গলাইয়া দিতে সম্মত হইবে না। স্ত্রীর সহিত পবিত্র একত্ব সাধন করিতে গিয়া যদি পঞ্চত্ব নিকটবর্তী হয় তবে অনেক বিবেচক লোক উক্ত মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করিতে বিরত হইবেন সন্দেহ নাই। বাপ মায়ে ঠেকিয়া শিখিয়াছেন, তাহারাও যে তাড়াতাড়ি অবিবেচক বালকের গলদেশে বিষম গুরুভার বধূ বাঁধিয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইবেন, ইহা সম্ভব নহে। ছেলে যখন আপনি উপাজর্ন করিবে তখন বিবাহ করিবে, আজকাল অনেক পিতার মুখে এ কথা শুনা যায়। এমন-কি হিন্দুগৃহে প্রাচীন নিয়মে পালিতা সেকেলে একটি প্রাচীনার মুখে এইমত শুনিয়া আশ্চর্য হইয়াছি। অথবা আশ্চর্যের কারণ কিছুই নাই; জীব দিয়াছেন যিনি, আহার দিবেন তিনি–সমাজের অবস্থাগতিকে এ বিশ্বাস আর টিঁকে না।

অতএব ইংরেজিশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে অভাবের জটিলতা যতই বাড়িতে থাকিবে ততই পুরুষেরা শীঘ্র বিবাহ করিতে চাহিবে না, ইহা চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রেই স্বীকার করিবেন। আগে অনেক ছেলে “বিয়েপাগলা’ ছিল, এখন অনেকে বিয়েকে ডরায়। ক্রমে এ ভাব আরো অনেকের মধ্যে সংক্রামিত হইতে থাকিবে। পুরুষ যদি উপার্জনক্ষম হইয়া বড়ো বয়সে বিবাহ করে তবে মেয়ের বয়স বাড়াইতে হইবে সন্দেহ নাই। মস্ত পুরুষের সঙ্গে কচি মেয়ের বিবাহ নিতান্ত অসংগত। দেখা যায় বরকন্যার মধ্যে বয়সের নিতান্ত বৈসাদৃশ্য দেখিলে কন্যাপক্ষীয় মেয়েরা অত্যন্ত কাতর হন। বোধ করি মনের অমিল ও বৈধব্যের সম্ভাবনাই তাঁহাদের চিন্তার বিষয়। অতএব স্বাভাবিক নিয়মানুসারে বিবাহযোগ্য পুরুষের সঙ্গে বিবাহযোগ্য মেয়ের বয়সও বাড়িতে থাকিবে।

অতএব যিনি যতই বক্তৃতা দিন, দেশের যেরূপ অবস্থা হইয়াছে এবং আমরা যেরূপ শিক্ষা পাইতেছি তাহাতে অবিবাহিত ছেলেমেয়ের বয়সের সীমা বাড়িবেই, কেহ নিবারণ করিতে পারিবে না। কিছুদিন প্রাচীন নিয়ম ও নূতন অবস্থার বিরোধে সমাজে অনেক অসুখ অশান্তি বিশৃঙ্খলা ঘটিবে, এবং ক্রমশ এই মথিত সমাজের আলোড়নে নূতন জীবন নূতন নিয়ম জাগ্রত হইয়া উঠিবে। তাহার সমস্ত ফলাফল আমরা আগে হইতে সম্পূর্ণ বিচার করিয়া স্থির করিতে পারি না। এখন আমাদের সমাজে অনেক মন্দ আছে, কিন্তু অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছে বলিয়া সেগুলিকে তত গুরুতর মন্দ বলিয়া মনে হয় না; তখনো হয়তো কতকগুলি অনিবার্য মন্দ উঠিবে যাহা আমরা আগে হইতে কল্পনা করিয়া যত ভীত হইতেছি তখনকার লোকের পক্ষে তত ভীতিজনক হইবে না। দূর হইতে ইংরেজরা আমাদের কতকগুলি সামাজিক অনুষ্ঠানের নামমাত্র শুনিয়া ভয়ে বিস্ময়ে যতখানি চমক খাইয়া উঠেন, ভিতরে প্রবেশ করিলে ততখানি চমক খাইবার কিছুই নাই, সমাজের মধ্যে সন্ধান করিলে দেখা যায়, অনেক অনুষ্ঠানের ভালোমন্দ ভাগ লইয়া একপ্রকার সামঞ্জস্যবিধান হইয়াছে। তেমনি আমরাও দূর হইতে ইংরেজসমাজের অনেক আচারের নাম শুনিয়া যতটা ভয় পাই, ভিতরে গিয়া দেখিলে হয়তো জানিতে পারি ততটা আশঙ্কার কারণ নাই। তাহা ছাড়া অভ্যাসে অনেক ভালোমন্দ সৃজিত হয়। এখন যে-মেয়ে ঘোমটা দিয়া সূক্ষ্ম বসন পরে তাহাকে আমরা বেহায়া বলি না, কিছুকাল পরে যাহারা ঘোমটা না দিয়া মোটা কাপড় পরিবে তাহাদিগকে বেহায়া বলিব না। মনে করো, শ্যালীর সহিত ভগ্নিপতির অনেক স্থলে যেরূপ উপহাস চলে তাহাতে একজন বিদেশের লোক কত কী অনুমান করিয়া লইতে পারে, এবং অনুমান করিলেও তাহাকে দোষ দেওয়া যায় না, কিন্তু সত্য সত্যই ততটা ঘটে না। সমাজের এক নিয়ম অপর নিয়মের দোষসম্ভাবনা কথঞ্চিৎ সংশোধন করে। অতএব কোনো সমাজের একটিমাত্র নিয়ম স্বতন্ত্র তুলিয়া লইয়া তাহার ভালো মন্দ বিচার করিলে প্রতারিত হইতে হয়। এইজন্য আমাদের সমাজের পরিবর্তনে যে-সকল নূতন নিয়ম অল্পে অল্পে স্বভাবতই উদ্ভাবিত হইবে, আগে হইতে তাহার সম্পূর্ণ সূক্ষ্ম বিচার অসম্ভব। তাহারা অকাট্য নিয়মে পরস্পর পরস্পরকে জন্ম দিবে ও রক্ষা করিবে। সমাজে আগে-ভাগে বুদ্ধি খাটাইয়া গায়ে পড়িয়া একটা নিয়মস্থাপন করিতে যাওয়া অনেক সময় মূঢ়তা। সে-নিয়ম নিজে ভালো হইতে পারে, কিন্তু অন্য নিয়মের সংসর্গে সে হয়তো মন্দ। অতএব বাল্যবিবাহ উঠিয়া গেলে আজ তাহার ফল যতটা ভয়ানক বলিয়া মনে হইবে, তাহা হইতে যত বিপদ ও অমঙ্গল আশঙ্কা করিব, তাহার অনেকটা আমাদের কাল্পনিক। কেবল, কতকটা দেখিতেছি এবং অনেকটা দেখিতেছি না বলিয়া এত ভয়।

বলা-বাহুল্য, আমি সমাজের পরিবর্তন সম্বন্ধে যত কথা বলিয়াছি তাহা প্রধানত শিক্ষিত-সমাজের পক্ষে খাটে। অতএব শীঘ্র বাল্যবিবাহ দূর হওয়া শিক্ষিত সমাজেই সম্ভব। কিন্তু তাহা আপনি সহজ নিয়মে হইবে। যাঁহারা আইন করিয়া জবরদস্তি করিয়া এ প্রথা উঠাইতে চান তাঁহারা এ প্রথাকে নিতান্ত স্বতন্ত্র করিয়া লইয়া ইহার দুই-একটি ফলাফলমাত্র বিচার করিয়াছেন, হিন্দুসমাজের বাল্যবিবাহের আনুষঙ্গিক অন্যান্য প্রথা তাঁহারা দেখেন নাই। সামাজিক অন্যান্য সহকারী নিয়মের মধ্য হইতে বাল্যবিবাহকে বলপূর্বক উৎপাটন করিলে সমাজে সমূহ দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলার প্রাদুর্ভাব হইবে। অল্পে অল্পে নূতন অবস্থার প্রভাবে সমাজের সমস্ত নিয়ম নূতন আকার ধারণ করিয়া সমাজের বর্তমান অবস্থার সহিত আপন উপযোগিতাসূত্র বন্ধন করিতেছে। অতএব যাঁহারা বাল্যবিবাহের বিরোধী তাঁহাদিগকে অকারণ ব্যস্ত হইতে হইবে না।

তেমনই, যাঁহারা একান্নবর্তী-পরিবার হইতে বিচ্যুত হইয়া নূতন অবস্থা ও নূতন শিক্ষার আবর্তে পড়িয়া আচার ও উপদেশ হইতে বাল্যবিবাহ দূর করিয়া দিয়াছেন, তাঁহারা ব্রাহ্মসমাজভুক্ত ব্রাহ্ম অথবা বিদেশগমন দ্বারা জাতিচ্যুত হইলেও বিবেচক হিন্দুমণ্ডলী তাঁহাদিগকে দুর্নীতির প্রশ্রয়দাতা মহাপাতকী জ্ঞান না করেন। তাঁহারা কিছুই অন্যায় করেন নাই। তাঁহারা বর্তমান শিক্ষা ও বর্তমান অবস্থার অনুগত হইয়া আপন কর্তব্যবুদ্ধির প্ররোচনায় যুক্তিসংগত কাজই করিয়াছেন। কারণ আমি পূর্বেই বলিয়াছি, অবস্থাবিশেষে বাল্যবিবাহ উপযোগী হইলেও অবস্থাবিপর্যয়ে তাহা অনিষ্টজনক।

এই দীর্ঘ প্রবন্ধে কী কী বলিয়াছি, এইখানে তাহার একটি সংক্ষেপ পুনরাবৃত্তি আবশ্যক।

প্রথম। হিন্দুবিবাহসম্বন্ধে অনেকে অনেক কথাই বলিয়া থাকেন, কিন্তু ঐতিহাসিক পদ্ধতি-অনুসারে হিন্দুবিবাহ সমালোচন না করাতে তাঁহাদের কথার সত্যমিথ্যা কিছুই স্থির করিয়া বলা যায় না। শাস্ত্রের ইতস্তত হইতে শ্লোকখণ্ড উদ্‌ধৃত করিয়া একই বিষয়ের পক্ষে এবং বিপক্ষে মত দেওয়া যাইতে পারে।

দ্বিতীয়। যাঁহারা বলেন, হিন্দুবিবাহের প্রধান লক্ষ্য দম্পতির একীকরণতার প্রতি, তাঁহাদিগকে এই উত্তর দেওয়া হইয়াছে যে, তাহা হইলে পুরুষের বহুবিবাহ এ দেশে কোনোক্রমে প্রচলিত হইতে পারিত না।

তৃতীয়। আজকাল অনেকেই বলেন হিন্দুবিবাহ আধ্যাত্মিক। তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছে, আধ্যাত্মিক শব্দের অর্থ কী। উক্ত শব্দের প্রচলিত অর্থ হিন্দুবিবাহে নানা কারণে প্রয়োগ করা যাইতে পারে না; উক্ত কারণ-সকল একে একে দেখানো হইয়াছে।

চতুর্থ। তাহাই যদি হয় তবে দেখা যাইতেছে, হিন্দুবিবাহ সামাজিক মঙ্গল ও সাংসারিক সুবিধার জন্য। সংহিতা সম্বন্ধে পণ্ডিত কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের উক্তি এবং মনুর কতকগুলি বিধান উক্ত মতের পক্ষ সমর্থন করিতেছে।

পঞ্চম। সমাজের মঙ্গল যদি বিবাহের প্রধান উদ্দেশ্য হয়, পারত্রিক বা আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য যদি তাহার না থাকে বা গৌণভাবে থাকে, তবে বিবাহ সমালোচনা করিবার সময় সমাজের মঙ্গলের প্রতিই বিশেষ দৃষ্টি রাখিতে হইবে। এবং যেহেতু সমাজের পরিবর্তন হইতেছে এবং নানা বিষয়ে জ্ঞানের বৃদ্ধি হইতেছে, অতএব সমাজের মঙ্গলসাধক উপায়েরও তদনুসারে পরিবর্তন আবশ্যক হইতেছে। পুরাতন সমাজের নিয়ম সকল সময় নূতন সমাজের মঙ্গলজনক হয় না। অতএব আমাদের বর্তমান সমাজের বিবাহের সকল প্রাচীন নিয়ম হিতজনক হয় কি না তাহা সমালোচ্য।

ষষ্ঠ। তাহা হইলে দেখিতে হইবে বাল্যবিবাহের ফল কী। প্রথম বাল্যবিবাহে সুস্থকায় সন্তান উৎপাদনের ব্যাঘাত হয় কি না। বিজ্ঞানের মতে ব্যাঘাত হয়।

সপ্তম। কেহ কেহ বলেন, পুরুষের অধিক বয়সে বিবাহ দিলেই আর কোনো ক্ষতি হইবে না। কিন্তু পুরুষের বিবাহবয়স বাড়াইলে স্বাভাবিক নিয়মেই হয় মেয়েদের বয়সও বাড়াইতে হইবে নয় পুরুষের বয়স আপনি অল্পে অল্পে কমিয়া আসিবে, যেমন মনুর সময় হইতে কমিয়া আসিয়াছে।

অষ্টম। কিন্তু কেহ কেহ বলেন, সুস্থ সন্তান উৎপাদনই সমাজের একমাত্র মঙ্গলের কারণ নহে, অতএব একমাত্র তৎপ্রতিই বিবাহের লক্ষ থাকিতে পারে না। মহৎ উদ্দেশ্যসাধনেই বিবাহের মহত্ত্ব। অতএব মহৎ উদ্দেশ্যসাধনের অভিপ্রায়ে বাল্যকাল হইতে স্ত্রীকে শিক্ষিত করিয়া লওয়া স্বামীর কর্তব্য। এইজন্য স্ত্রীর অল্প বয়স হওয়া চাই। আমি প্রথমে দেখাইয়াছি, যথার্থ মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের পক্ষে অধিক বয়সে বিবাহ উপযোগী। তাহার পরে দেখাইয়াছি, মহৎ উদ্দেশ্য সকল স্বামীরই থাকিতে পারে না; কিন্তু অধিকাংশ লোকেরই স্বভাবভেদে বিশেষ বিশেষ গুণের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ আছে, উক্ত গুণ-সকল তাহারা স্ত্রীর নিকট হইতে প্রত্যাশা করে; নিরাশ হইলে অনেক সময়ে সমাজে অশান্তি ও অমঙ্গল সৃষ্ট হয়। অতএব গুণ দেখিয়া স্ত্রী নির্বাচন করিতে হইলে বড়ো বয়সে বিবাহ আবশ্যক।

নবম। কিন্তু পরিণতবয়স্কা স্ত্রী বিবাহ করিলে একান্নবর্তী পরিবারে অসুখ ঘটিতে পারে। আমি দেখাইয়াছি, কালক্রমে নানা কারণে একান্নবর্তী প্রথা শিথিল হইয়া আসিয়াছে এবং সমাজের অনিষ্টজনক হইয়া উঠিয়াছে; অতএব একমাত্র বাল্যবিবাহদ্বারা উহাকে রক্ষা করা যাইবে না এবং রক্ষা উচিত কিনা তদ্বিষয়েও সন্দেহ।

দশম। সমাজে এ-সকল ছাড়া দারিদ্র্য প্রভৃতি এমন কতকগুলি কারণ ঘটিয়াছে যাহাতে স্বতই বাল্যবিবাহ অধিক কাল টিঁকিতে পারে না। সমাজে অল্পে অল্পে তাহার লক্ষণ প্রকাশ পাইতেছে।

অতএব যাঁহারা বাল্যবিবাহ দূষণীয় জ্ঞান করেন অথবা সুবিধার অনুরোধে ত্যাগ করেন, তাঁহাদিগকে দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু তাই বলিয়া বলপূর্বক বাল্যবিবাহ উঠানো যায় না। কারণ, ভালোরূপ শিক্ষা ব্যতিরেকে বাল্যবিবাহ উঠিয়া গেলে সমাজের সমূহ অনিষ্ট হইবে। যেখানে শিক্ষার প্রভাব হইতেছে সেখানে বাল্যবিবাহ আপনিই উঠিতেছে, যেখানে হয় নাই সেখানে এখনো বাল্যবিবাহ উপযোগী। আমাদের অন্তঃপুরের, আমাদের সমাজের, অনেক অনুষ্ঠান ও অভ্যাসে এবং আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের ভিতরকার শিক্ষায় বাল্যবিবাহ নিতান্ত আবশ্যক হইয়া পড়ে; অতএব অগ্রে শিক্ষার প্রভাবে সে-সকলের পরিবর্তন না হইলে কেবল আইনের জোরে ও বক্তৃতার তোড়ে সর্বত্রই বাল্যবিবাহ দূর করা যাইতে পারে না।

১২৯৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *