আমাদের সমাজে একদল পালোয়ান লোক আছেন, তাঁহারা লড়াই ছাড়া আর কোনো কথা মুখে আনেন না। তাঁহাদের অস্ত্রের মধ্যে একখানি ভোঁতা জিহ্বা ও একটি ইস্টিল পেন। তাঁহারা ম্লেচ্ছ অনার্যদের প্রতি অবিরত শব্দভেদী বাণ বর্ষণ করিতেছেন ও পরমানন্দে মনে করিতেছেন তাহারা যে-যাহার বাসায় গিয়া মরিতেছে। তাঁহাদের মুখগহ্বর হইতে ঘড়িঘড়ি এক-একটা বড়ো বড়ো হাওয়ার গোলা বাহির হইতেছে ও তাঁহাদের কল্পিত শত্রুপক্ষের আসমান-দুর্গের উপর এমনি বেগে গিয়া আঘাত করিতেছে ও তাহা হইতে এমনি মস্ত আওয়াজ বাহির হইতেছে যে, বীরত্বের গর্বে তাঁহাদের অল্প পরিসর একটুখানি বুক ফুলিয়া ফাটিয়া যাইবার উপক্রম হইতেছে। সুতরাং এই-সকল মিলিটেরি ব্যক্তিদিগের নিজের গলার শব্দে নিজের কানে এমনি তালা ধরিয়াছে যে, এখন, কী সৌন্দর্যের মোহন বংশিধ্বনি, কী বিশ্বপ্রেমের উপর আহ্বানস্বর, কী বিকাশমান অনন্ত জীবনের আনন্দ উচ্ছ্বাস, কী পরদুঃখকাতরের করুণ সংগীত, কিছুই তাঁহাদের কানের মধ্যে প্রবেশ করিবার রাস্তা পায় না। যে-কেহ ভাঙা গলায় কামানের আওয়াজের নকল করিতে না চায়, যে-কেহ শিশুদিগের মতো জুজুর অভিনয় করিয়া চতুর্দিকস্থ বয়স্ক-লোকদিগকে নিতান্ত শঙ্কিত করিতেছে কল্পনা করিয়া আনন্দে হাত পা না ছোঁড়ে, তাহারা তাঁহাদিগের নিকট খাতিরেই আসে না। তাঁহারা চান, ভারতবর্ষের যে যেখানে আছে, সকলেই কেবল লড়াইয়ের গান গায়, লড়াইয়ের কবিতা লেখে, মুখের কথায়, যতগুলা রাজা ও যতগুলা উজীর মারা সম্ভব সবগুলাকে মারিয়া ফেলে। যেন বঙ্গসাহিত্যের প্রতি ছত্রে বারুদের গন্ধ থাকে, যাহাতে শুদ্ধমাত্র বঙ্গসাহিত্য পড়িয়া ভবিষ্যতের পুরাতত্ত্ববিদ্গণ একবাক্যে স্বীকার করেন যে, বাঙালিজাতির মতো এত বড়ো পালোয়ান জাতি আজ পর্যন্ত জন্মগ্রহণ করে নাই। ইঁহারা সর্বদা সশঙ্কিত, পাছে বঙ্গসমাজ খারাপ হইয়া যায়; ইঁহারা বঙ্গসমাজের কানে তুলা দিয়া রাখিতে চান পাছে সে গান শুনিয়া ফেলে ও তাহার প্রাণ কোমল হইয়া যায়, পাছে সে উপন্যাস পড়ে ও তাহার চিত্ত দুর্বল হইয়া পড়ে, পাছে সে নাট্যাভিনয় শোনে ও তাহার হৃদয় আর্দ্র হইয়া যায়। দিনরাত্রি কেবল বঙ্গসমাজকে ঘিরিয়া বসিয়া তাহার কানের কাছে তূরী ভেরী জগঝম্প বাজাও, যেখানে যে আছ ঢাকঢোল গলায় বাঁধো, ঢুলিতে দেখিলেই পরস্পর পরস্পরকে খোঁচা মারো এবং “উঠ উঠ’, “জাগো জাগো’ বলিয়া অস্থির করিয়া তোলো।
কিন্তু এই বীরপুরুষেরা বড়ো মনের আনন্দে আছেন। একখানা ছাতা ঘাড়ে করিয়া এই-সকল সরু সরু ব্যক্তিরা কেবলই চার দিকে ছটফট করিয়া বেড়াইতেছেন, বিশেষ একটা উদ্দেশ্য নাই, লক্ষ্য নাই, কেবল একটা গোলমাল চলিতেছে, মনে মনে অত্যন্ত স্ফূর্তি যে ভারি একটা কাজ করিতেছি। আর যত প্রকার কাজ আছে তাহা নিতান্ত অবহেলার চক্ষে দেখেন, যাহারা অন্যান্য কাজে মগ্ন রহিয়াছে তাহাদিগকে কৃপাপাত্র জ্ঞান করেন, ঈষৎ হাস্য করিয়া মনে করেন, আর সকলে কী ছেলেখেলাই করিতেছে! কাজ যা একমাত্র তিনিই করিতেছেন, কেননা তিনি যে কী করিতেছেন নিজেই তাহা পরিষ্কাররূপে জানেন না, কেবল এক প্রকার অস্পষ্ট ধারণা আছে যে, খুব একটা কী কাজ করিয়া বেড়াইতেছি। সত্য বটে, এক প্রকার ব্যস্ত কোমরবাঁধা মুষ্টিবদ্ধ উদগ্রভাব সর্বদাই দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু কেন যে এ ভাব তাহা তিনিও জানেন না, আমিও জানি না। কী যেন একটা ঘোরতর কারখানা বাধিয়াছে, কী যেন একটা সর্বনাশের উদ্যোগ হইতেছে, কেবল তিনি জাগ্রত সতর্ক আছেন বলিয়াই কোনো দুর্ঘটনা ঘটিতেছে না। শ্রাবণের রাত্রে বজ্রবিদ্যুৎ বর্ষণের সময় ব্যাঙের দল নিতান্ত ব্যস্তভাবে সমস্ত রাত্রি জাগিয়া জগতের কানের কাছে অনবরত মক্মক্ করিতে থাকে, তাহারাও বোধ করি মনে করে, ভাগ্যে তাহারা ছিল ও প্রাণপণে সমস্ত রাত্রি চিৎকার করিয়াছে, জগতে তাই আজ প্রলয় হইতে পারিল না। আমাদের বীরপুরুষেরাও মনে করেন, আজি এই দুর্যোগের রাত্রে ভারতবর্ষের ভার বিশেষরূপে তাঁহাদেরই হস্তে সমর্পিত হইয়াছে, এইজন্য উদ্দেশ্যহীনের ন্যায় অবিশ্রান্ত হো হো করিয়া হুটপাট করিয়া বেড়াইতেছেন ও মনে করিতেছেন জগতের অত্যন্ত উপকার হইতেছে। কাজেই ইহাদের বুক ক্রমেই ফুলিতে থাকে ও প্রাণ ক্রমেই সংকীর্ণ হইতে থাকে, বঙ্গসমাজ বা বঙ্গসাহিত্যের সর্বাঙ্গীণ বিকাশকে অত্যন্ত ভয় করেন। ইঁহারা চান বঙ্গসাহিত্য কেবলমাত্র দাঁত ও নখের চর্চা করিতে থাকুক আর কিছু নয়। ক্ষমতাভেদেও ও অবস্থাভেদে যে প্রত্যেকে স্ব স্ব উপযোগী কার্যে প্রবৃত্ত হইবে ও এইরূপে সমাজের অন্তর্নিহিত বিচিত্র শক্তি চারি দিক হইতে বিকশিত হইয়া উঠিবে তাহা তাঁহাদের অভিপ্রেত নহে। আজ কয়েক বৎসর ধরিয়া এই শ্রেণীর কতকগুলি সংকীর্ণদৃষ্টি সমালোচক কবিদিগকে কবিত্ব শিখাইয়া আসিতেছেন ও অবিরত বীররস ফরমাস করিতেছেন এবং অবশিষ্ট আটটি রসের মধ্যে কোনো একটি রসের ছিঁটাফোঁটা দেখিবামাত্র ননীর পুতুলি বঙ্গসমাজের স্বাস্থ্যভঙ্গের ভয়ে শশব্যস্ত হইয়া উঠিতেছেন! তাহার কতকটা ফল ফলিয়াছে, বীররসটা ফ্যাশান হইয়া পড়িয়াছে। গদ্য লেখক ও পদ্য লেখকগণ পালোয়ান সমালোচকদিগের চিৎকার বন্ধ করিয়া দিবার জন্য তাহাদের মুখে বীররসের টুকরা ফেলিয়া দিতেছেন। সকলেই বলিতেছে, উঠ, জাগো; বাংলায় ইংরাজিতে গদ্যে, পদ্যে, মিত্রাক্ষরে, অমিত্রাক্ষরে, হাটে ঘাটে, নাট্যশালায়, সভায়, ছেলে মেয়ে বুড়ো সকলেই বলিতেছে, উঠ, জাগো! সকলেই যে অকপট হৃদয়ে বলিতেছে বা কেহই যে বুঝিয়া বলিতেছে তাহা নহে। সকলেই বলিতেছে, “আজ ঊনবিংশ শতাব্দী’, ঊনবিংশ শতাব্দীটা যেন বঙ্গসমাজের বাবা স্বয়ং রোজগার করিয়া আনিয়াছে! “ঊনবিংশ শতাব্দী’ নামক একটা অনুবাদিত শব্দ বাঙালির মুখে শুনিলে অত্যন্ত হাসি পায়। যে বাঙালি দুই দিন বিলাতে থাকিয়া বিলাতকে বষলন বলেন তিনিও ইহা অপেক্ষা হাস্যজনক কথা বলেন না! ঊনবিংশ শতাব্দী আমাদের কে? আঠারোটি শতাব্দী যাহাদিগকে ক্রমান্বয়ে মানুষ করিয়া আসিয়াছে, নিজের বিদ্যালয়ে পাঠাভ্যাস করাইয়াছে, তাহারাই ঊনবিংশ শতাব্দী লইয়া গর্ব করিতেছে। আর আমরা আজ দুদিন ইংরাজের সহিত আলাপ করিয়া এমনিভাবে কথাবার্তা আরম্ভ করিয়াছি যেন ঊনবিংশ শতাব্দীটা আমাদেরই! যেন ঊনবিংশ শতাব্দীটা অত্যন্ত সস্তা দামে বাংলা দেশে নিলাম হইয়া গিয়াছে, আর বঙ্গীয় বীরপুরুষ নামক জয়েন্ট স্টক্ কোম্পানি তাহা সমস্তটা কিনিয়া লইয়াছেন। ভাববিশেষ যখন সমাজে ফ্যাশান হইয়া যায় তখন এইরূপই ঘটে। তখন তাহার আনুষঙ্গিক কতকগুলা কথা মুখে মুখে চলিত হইয়া যায়, সে কথাগুলার যেন একটা অর্থ আছে এইরূপ ভ্রম হয়, কিন্তু জিজ্ঞাসা করিলে কেহ তাহার অর্থ ভালো করিয়া বুঝাইয়া দিতে পারেন না। কৃত্রিমতা মাত্রেই মন্দ, তথাপি মতের কৃত্রিমতা সহ্য করা যায়, কিন্তু হৃদয়ের অনুভাবের কৃত্রিমতা একেবারে অসহ্য! আজকাল যেখানে যাহার তাহার মুখে “ভারত মাতা’ সম্বন্ধীয় গোটাকতক হৃদয়সম্পর্কশূন্য বাঁধি বোল শুনিতে পাওয়া যায়; তাহারা এমনিভাবে কথাগুলো ব্যবহার করে যেন সব কথার মানে তাহারা জানে, যেন তাহা তাহাদের প্রাণের ভাষা! কিন্তু ইহাতে তাহাদের দোষ নাই, যে-সকল সমালোচক দিবারাত্রি চেষ্টা করিয়া এত বড়ো একটি মহৎ ভাবকে ফ্যাশানের ঘৃণিত হীনত্বে পরিণত করিয়াছেন, হৃদয়জাত ভাবকে সস্তা করিবার জন্য কলে ফেলিয়া গড়িতে পরামর্শ দিয়াছেন, অবশেষে তাহা আবালবৃদ্ধবনিতার হাতে হাতে দোকানের কেনাবেচা দ্রব্যের মতো, রাংতা-মাখানো শব্দ-উৎপাদক চকচকে ভেঁপুর মতো করিয়া তুলিয়াছেন তাঁহারাই ইহার জন্য দায়ী। যে ভাব ও যে কথার অর্থ ভুলিয়া যাই, যাহারা আর হৃদয় হইতে উঠে না, কেবল মুখে মুখে বিরাজ করে, তাহারা মরিয়া যায় ও জীবন অভাবে ক্রমশই পচিয়া উঠিতে থাকে। দেশহিতৈষিতার বুলিগুলিরও সেই দশা ধরিবে। তুমি জিজ্ঞাসা করিতেছ, “বঙ্গসাহিত্যে ও ছাইভস্মগুলা কেন?’ আমি বলিতেছি, “কী করা যায়! একদল মহা বীর আছেন, তাঁহারা বঙ্গসাহিত্যে অগ্নিকাণ্ড করিতে চান। সময় অসময় আবশ্যক অনাবশ্যক কিছু না মানিয়া দিনরাত্রি আগুন জ্বালাইয়া রাখিতে চান, কাজেই বিস্তর ছাই ভস্ম জমিয়াছে।’
এইখানে একটা গল্প বলি। একটা পাড়ায় পাঁচ-সাতজন মাতাল বাস করিত। তাহারা একত্রে মদ্যপান করিয়া অত্যন্ত গোলমাল করিত। পাড়ার লোকেরা একদিন তাহাদিগকে ধরিয়া অত্যন্ত প্রহার দিল। সেই প্রহারের স্মৃতিতে পাঁচ-সাত দিন তাহাদের মদ খাওয়া স্থগিত রহিল, অবশেষে আর থাকিতে না পারিয়া তাহারা প্রতিজ্ঞা করিল আজ মদ খাইয়া আর কোনো প্রকার গোল করিব না। উত্তমরূপে দরজা বন্ধ করিয়া তাহারা নিঃশব্দে মদ্যপান আরম্ভ করিল। সকলেরই যখন মাথায় কিছু কিছু মদ চড়িয়াছে, তখন সহসা একজনের সাবধানের কথা মনে পড়িল ও সে গম্ভীর স্বরে কহিল, “চুপ্!’ অমনি আর-একজন উচ্চতর স্বরে কহিল, “চুপ্!’ তাহা শুনিয়া আবার আর-একজন আরও উচ্চস্বরে কহিল, “চুপ্’, এমনি করিয়া সকলে মিলিয়া চিৎকারস্বরে “চুপ্ চুপ্’ করিতে আরম্ভ করিল– সকলেই সকলকে বলিতে লাগিল “চুপ্’। অবশেষে ঘরের দুয়ার খুলিয়া সকলে বাহির হইয়া আসিল, পাঁচ-সাতজন মাতাল মিলিয়া রাস্তায় “চুপ্ চুপ্’ চিৎকার করিতে করিতে চলিল, “চুপ্ চুপ্’ শব্দে পাড়া প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। আমাদের উঠ জাগো শব্দটিও কি ঠিক এইরূপ হয় নাই? সকলেই সকলকে বলিতেছে, উঠ, সকলেই সকলকে বলিতেছে, জাগো, কে যে উঠে নাই ও কে যে ঘুমাইতেছে সে বিষয়ে আজ পর্যন্ত ভালোরূপ মীমাংসাই হইল না।
ইহাতে একটা হানি এই দেখিতেছি, সকলেই মনে করিতেছে, কাজ করিলাম। গোলমাল করিতেছি, হাততালি দিতেছি, চেঁচাইতেছি, কী যেন একটা হইতেছে! দেশের জন্য প্রাণপণ করিতেছি মনে করিলে নিজের মহত্ত্বে নিজের শরীর লোমাঞ্চিত হইয়া উঠে, অতি নিষ্কণ্টকে সেই অতুল আনন্দ উপভোগ করিতেছি। মাথা-মুণ্ডহীন একটা গোলেমালেই সমস্ত চুকিয়া যাইতেছে, আর কাজ করিবার আবশ্যক হইতেছে না।
একদল লোক আছেন, তাঁহারা কেবল উত্তেজিত ও উদ্দীপ্তই করিতেছেন, তাঁহাদের বক্তৃতায় বা লেখায় কোনো উদ্দেশ্য দেখিতে পাওয়া যায় না। তাঁহারা কেবল বলিতেছেন, “এখনও চৈতন্য হইতেছে না, এখনও ঘুমাইতেছ? এই বেলা আলস্য পরিহার করো, গাত্রোত্থান করো। আমাদের পূর্বপুরুষদের একবার স্মরণ করো– ভীষ্ম দ্রোণ গৌতম বশিষ্ঠ ইত্যাদি।’ কী করিতে হইবে বলেন না, কোন্ পথে যাইতে হইবে বলেন না, পথের পরিণাম কোথায় বলেন না, কেবল উত্তেজিতই করিতেছেন। বন্দুকের বারুদে আগুন দিতেছেন, অথচ কোনো লক্ষ্যই নাই, ইহাতে ভালো ফল যে কী হইতে পারে জানি না, বরঞ্চ আপনা-আপনির মধ্যেই দু-চারজন জখম হওয়া সম্ভব! কোনো একটা কাজে প্রবৃত্ত হইতে পারিতেছি না কেবল তপ্তরক্তের প্রভাবে ইতস্তত ধড়ফড় করিতেছি! কতকগুলা অসম্ভব কল্পনা গড়িয়া তুলিয়া তাহাকে প্রাণ দিবার চেষ্টা করিতেছি, স্বদেশের বুকে যে শেল বিঁধিয়াছে, মনে করিতেছি বুঝি তাহা বলপূর্বক দুই হাতে করিয়া উপড়াইয়া ফেলিলেই দেশের পক্ষে ভালো, কিন্তু জানি না যে তাহা হইলে রক্তস্রোত প্রবাহিত হইয়া সাংঘাতিক পরিণাম উপস্থিত করিবে। বীরত্ব ফলাইবার জন্য সকলেই অস্থির হইয়া উঠিতেছেন, অথচ সামর্থ্য নাই, কাজেই দৈবাৎ যদি সুবিধামতে পথে অসহায় ফিরিঙ্গি-বালক দেখিতে পান অমনি তিন-চার জনে মিলিয়া তাহাকে ছাতিপেটা করিয়া আপনাদিগকে মস্ত বীরপুরুষ মনে করেন, মনে করেন একটা কর্তব্য কাজ সমাধা হইল। যথার্থ কর্তব্য কাজ চুলায় যায়, আর কতকগুলা সহজসাধ্য মিথ্যা-কর্তব্য তাড়াতাড়ি সাধন করিয়া তপ্তরক্ত শীতল করিতে হয়, নহিলে মানুষ বাঁচিবে কী করিয়া? তাই বলিতেছি, কতকগুলা অর্থহীন অনির্দিষ্ট অস্পষ্ট উদ্দীপনাবাক্য বলিয়া মিথ্যা উত্তেজিত করিবার চেষ্টা পাইয়ো না। কারণ, এইরূপ করিলে দুর্বলেরা অভদ্র হইয়া উঠে, অভদ্রতাকে বীরত্ব মনে করে, স্ত্রীর কাছে গর্ব করে ও কার্যকালে কী করিবে ভাবিয়া পায় না। গুরুজনকে মানে না, পূজ্যলোককে অপমান করে ও একপ্রকার খেঁকিবৃত্তি অবলম্বন করে। সম্প্রতি নরিস্ সাহেব ও জুরিস্ডিক্শন বিল প্রভৃতি লইয়া কোনো কোনো বাংলা কাগজ যেরূপ ব্যবহার করিয়াছে তাহা দেখিলেই আমাদের কথা সপ্রমাণ হইবে। তিরস্কার করিবার সময়, এমন-কি, গালাগালি দিবার সময়েও ভদ্রলোক ভদ্রলোকই থাকে, কিন্তু বানরের মতো মুখ-ভেংচাইয়া দাঁত বাহির করিয়া রুচিহীন অভদ্রের মতো অতিবড়ো শত্রুকেও অপমান করিতে চেষ্টা করিলে নিজেকেই অপমান করা হয়, তাহাতে বিপক্ষপক্ষের যত না মানহানি হয় ততোধিক আত্মগৌরবের লাঘব করা হয়। এরূপ ব্যবহারকে যাঁহারা নির্ভীকতা ও বীরত্ব মনে করেন তাঁহারা ভীরু, হীন, কারণ প্রকৃত বীরত্ব আত্মসম্মান রক্ষা করিয়া চলে।
পুনশ্চ বলিতেছি, যাঁহারা বক্তৃতা দেন ও উদ্দীপক গদ্য পদ্য লেখেন তাঁহারা যেন একটা উদ্দেশ্য দেখাইয়া দেন, একটা কর্তব্য নির্দেশ করিয়া দেন। আমাদের সমাজের পদে পদে এতশত প্রকার কর্তব্য রহিয়াছে যে, কতকগুলা অস্পষ্ট বাঁধি বোল বলিয়া সময় ও উদ্যম নষ্ট করা উচিত হয় না। দীপ্তরক্ত যুবকেরা যাহাতে কতকগুলা কুহেলিকাময় পর্বতাকার উদ্দেশ্য লইয়াই নাচিয়া না বেড়ান, ছোটো ছোটো কাজের মধ্যে যে-সকল মহৎ বীরত্বের কারণ প্রচ্ছন্ন আছে সেগুলিকে যেন হেয় জ্ঞান না করেন। গড়ের মাঠে, বা কেল্লার মধ্যেই কেবল বীরত্বের রঙ্গভূমি নাই, হয়তো গৃহের মধ্যে, অন্তঃপুরের ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে তাহা অপেক্ষা বিস্তৃত রণস্থল রহিয়াছে! এত সামাজিক শত্রু চারি দিকে রহিয়াছে তাহাদিগকে কে নাশ করিবে! দুর্ভাগ্যক্রমে ইহাতে তফভঢ়তঢ়ভষশ করিতে হয় না, ইহাতে ঢাকঢোল বাজে না, হট্টগোল হয় না। তফভঢ়তঢ়ভষশ করা অনেকের একটা নেশার মতো হইয়াছে, মদ্যপানের মতো ইহাতে আমোদ পান– সকলেই উদ্দেশ্য বুঝিয়া কর্তব্য বুঝিয়া তফভঢ়তঢ়ন করেন না।
সুযোগ্য বক্তা শ্রীযুক্ত বাবু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন বঙ্গবাসীদিগকে লষধনক্ষতঢ়ভষশ, অর্থাৎ মিতব্যবহার অবলম্বন করিতে অনুরোধ করিয়াছেন শুনিয়া অত্যন্ত সুখী হইলাম। অধিকাংশ বঙ্গযুবক মনে করেন পেট্রিয়ট হইতে হইলে হঠাৎ অত্যন্ত উন্মাদ হইয়া উঠিতে হইবে, হাত-পা ছুঁড়িতে হইবে, হুটোপাটি করিতে হইবে, যাহাকে যাহা না বলিবার তাহা বলিতে হইবে। তাঁহারা মনে করেন, সফরীপুচ্ছের ন্যায় অবিরত ফর্ফরায়মান তাঁহাদের অতি লঘু, অতি ছিব্লা ওই জিহ্বাটার জুরিস্ডিক্শন সর্বত্রই আছে। একটি স্থির উদ্দেশ্য অবলম্বন করিয়া, আত্মসংযমন করিয়া, না ফুলিয়া ফাঁপিয়া ফেনাইয়া, বালকের মতো কতকগুলা নিতান্ত অসার কথা না বলিয়া অপ্রতিহত বেগে বহিয়া যাও, গম্যস্থানে গিয়া পৌঁছিবে, যে-সকল পাষাণ স্তূপ পথে পড়িয়া আছে, অবিশ্রাম স্থির প্রবাহ-বেগে তাহারা ক্রমেই ভাঙিয়া যাইবে। যতদিন পর্যন্ত না আমরা আত্মসংযম করিতে শিখিব, যতদিন পর্যন্ত অপরিণত বুদ্ধির ন্যায় আমাদের ভাবে ভাষায় ব্যবহারে একপ্রকার ছেলেমানুষী আতিশয্য প্রকাশ করিব, ততদিন পর্যন্ত বুঝিতে হইবে যে, আমরা স্বায়ত্তশাসনের উপযুক্ত হইতে পারি নাই। যখন আমরা নিজের স্বত্ব বুঝিব ও ধীর গম্ভীর দৃঢ়স্বরে যুক্তিসহকারে সেই স্বত্ব দাওয়া করিতে পারিব, তখন আমাদের কথা শুনিতেই হইবে। আর, নিতান্ত বালকের মতো না বুঝিয়া না শুনিয়া কেবল অনবরত আবদার করিলে, ঘ্যানঘ্যান করিলে, চিৎকার করিলে, কে আমাদের কথায় কর্ণপাত করিবে? তাই বলিতেছি, আগে দেশের অবস্থা সম্বন্ধে উদাহরণ সংগ্রহ করো, ভাবিতে আরম্ভ করো ও বলিতে শেখো, তাহা হইলে আর সকলে শুনিতে আরম্ভ করিবে। বেশি করিয়া বলিলে কিছুই হয় না, ভালো করিয়া বলিলে কী না হয়! আতিশয্যের দিকে যাইয়ো না, কারণ যেখানেই যুক্তিহীন আতিশয্যপ্রিয় প্রজা, সেইখানেই স্বেচ্ছাচারী প্রভুতন্ত্র শাসন প্রণালী।
ভারতী, শ্রাবণ, ১২৯০