সেদিন টাউনহলে একটা মস্ত তামাশা হইয়া গিয়াছে। দুই-চারিজন ইংরাজে মিলিয়া আশ্বাসের ডুগডুগি বাজাইতেছিলেন ও দেশের কতকগুলি বড়োলোক বড়ো বড়ো পাগড়ি পরিয়া নাচন আরম্ভ করিয়া দিয়াছিলেন।
দেশের লোক অবাক হইয়া গেল। শীতের সময় কলিকাতায় অনেক প্রকার তামাশা আসিয়া থাকে, সার্কস্, অপেরা ইত্যাদি। কিন্তু বড়োলোকের নাচনী সচরাচর দেখা যায় না।
সাহেব বলিল, তাই, তাই, তাই; অমনি বড়ো বড়ো খোকারা হাততালি দিতে লাগিল!
কিন্তু ভালো দেখাইল না। কারণ, নাচন কিছু সকলকেই মানায় না। তোমাদের এ বয়সে, এ শরীরে এত সহজে যদি নাচিয়া ওঠ, সে একটা তামাশা হয় সন্দেহ নাই, রাস্তার লোকেরা হো হো করিয়া হাসিতে থাকে, কিন্তু তাই বলিয়া আপনার লোকেরা তো আর হাসিতে পারে না! তাহাদের নিতান্ত লজ্জা বোধ হয়, দুঃখ হয়, ধিক ধিক করিয়া মুখ ফিরাইয়া, নতশির হইয়া চলিয়া যায়, সুতরাং ইহাকে ঠিক তামাশা বলা যায় না।
কিন্তু যাই বল, সাহেবদিগকে ধন্য বলিতে হয়। যাঁহারা উইল্সনের সার্কস্ দেখিতে গিয়াছেন তাঁহারা সকলেই দেখিয়াছেন ইংরাজ ঘোড়া নাচাইয়াছেন এবং অরণ্যের বড়ো বড়ো প্রাণীদের পোষ মানাইয়াছেন, কিন্তু তাঁহারা যে বাংলার গোটাকতক জমিদার ধরিয়া আনিয়া এত সহজে বশ করিতে পারিবেন এ কে জানিত?
বশ করা কিছু আশ্চর্য নয়, কিন্তু ইহার কিছু পূর্বেই যে লাথি ঝাঁটা বৈ আর কিছু খোরাকি জোটে নাই, সেগুলি যে এত শীঘ্র হজম করিয়া ফেলিয়া দানার লোভে তোমরা উহাদের কাছে ঘেঁসিয়া যাইতেছ এইটেই আশ্চর্য!
ডারুয়িন বলিয়াছেন, প্রাণীর ক্রমোন্নতি সহকারে মানুষের কাছাকাছি আসিয়া তাহার লেজ খসিয়া যায়। যেমন শারীরিক লেজ খসিয়া যায়, তেমনি তাহার আনুষঙ্গিক মানসিক লেজটাও খসিয়া যায়। মান-অপমান তুচ্ছ করিয়া, লাথি ঝাঁটা শিরোধার্য করিয়া কেবল একটুখানি সুবিধার অনুরোধে বাপান্তবাগীশদিগের গা ঘেঁসিয়া গেলে মানসিক লেজের অস্তিত্ব প্রকাশ পায়। সে জিনিসটা যদি থাকে তো চাপিয়া রাখো, অত নাড়িতেছ কেন? ওটা দেখিতে পাইলে পণ্ডিতেরা তোমাদিগকে হীন প্রাণী ও মহৎ প্রাণীদের মধ্যস্থিত missing linkবলিয়া গণ্য করিতেও পারে
তোমাদের একটা কথা আছে যে, “কাহারও সহিত এক বিষয়ে মতভেদ হইলে অন্য বিষয়ে মতের ঐক্য সত্ত্বেও মিশিতে বাধা কী?’ সে তো ঠিক কথা। কিন্তু মতের আবার ইতরবিশেষ আছে। “ক’ কখন কহিল, সূর্য পশ্চিমে ওঠে, তখন “খ’য়ের সহিত এ সম্বন্ধে তাহার সম্পূর্ণ মতভেদ সত্ত্বেও “ক’য়ে “খ’য়ে গলাগলি ভাব থাকার আটক নাই। কিন্তু কখন “ক’য়ের মতে “খ’ এবং তাহার বাপ-পিতামহ সকলেই চোর, মিথ্যাবাদী ও প্রবঞ্চক, তখন এ মতভেদ সত্ত্বেও উভয়ের আর ভালোরূপ বনিবনাও হওয়া সম্ভব নহে।
যাহারা দেশকে অপমান করে দেশের কোনো সুপুত্র তাহাদের সহিত সম্পর্ক রাখিতে পারে না। একটুখানি সুযোগের প্রত্যাশায় যাহারা দাঁতের পাটি সমস্তটা বাহির করিয়া তাহাদের সহিত আত্মীয়তা করিতে যাইতে পারে তাহাদিগকে দেখিলে নিতান্তই ঘৃণা বোধ হয়।
তোমরা বলিবে, এ-সকল কথা বালকেরই মুখে শোভা পায়, ইহা পাকা কাজের লোকের মতো কথা হইল না। কার্য উদ্ধার করিতে হইলে অত বিচার করিয়া চলা পোষায় না। বড়ো বড়ো sentiment-গুলি ঘরের শোভা সম্পাদনের জন্য, সচ্ছল অবস্থায় বড়ো বড়ো ছবির মতো তাহাদিগকে ঘরে টাঙাইয়া রাখিয়াছিলাম; কিন্তু যখন গাঁঠের কড়িতে টান পড়িল, তখন সুবিধামতে তাহাদের একটাকে টাউনহলে নিলামে highest bidder-দের বিক্রি করিয়া আসিলাম, ইহাতে আর দোষ হইয়াছে কী? Political Economy-র মতে ইহাতে দোষ কিছুই হয় নাই, যেমন বাজার দেখিয়াছ তেমনি বিক্রয় করিয়াছ এতবড়ো দোকানদারি বুদ্ধি কয়জনের মাথায় জোগায়। কিন্তু তাই যদি হইল, তোমরাই যদি এমন কাজ করিতে পার ও এমন কথা বলিতে পার, তবে ভারতবর্ষ এতকাল তাহার নিজের ক্ষীরটুকু সরটুকু খাওয়াইয়া তোমাদিগকে পোষণ করিল কেন? যাহারা প্রত্যহ একমুষ্টি উদরান্নের জন্য প্রাণপণ করিয়া মরে, এতবড়ো ভয়ংকর কাজের লোক হওয়া বরঞ্চ তাহাদিগকেই শোভা পায়, বড়ো বড়ো sentiment বরঞ্চ তাহাদিগের নিকটেই মহার্ঘ বলিয়া গণ্য হইতে পারে কিন্তু তোমরা যে জন্মাবধি এতকাল এত অবসর পাইয়া আসিয়াছ একটা মহৎ sentiment চর্চা করিতেও কি পারিলে না? তবে আর কুলীন ধনী পরিবারদিগকে দেশ কেন পোষণ করিতেছে? তাহারা না খাটিবে, না তাহাদের অবকাশের সদ্ব্যবহার করিবে! দেশের সমস্ত স্বাস্থ্য শোষণ করিয়া মস্ত মস্ত জমকালো বিস্ফোটকের মতো শোভা পাওয়াই কি তাহাদের একমাত্র কাজ! আমাদের বিশ্বাস ছিল, কুলক্রমাগত সচ্ছল সম্ভ্রান্ত অবস্থা উদারতা ও মহত্ত্ব সঞ্চয়ের সাহায্য করে– এরূপ কুলীনেরা সামান্য হীন সুবিধার খাতির অগ্রাহ্য করে ও মানের কাছে প্রাণকে তুচ্ছ জ্ঞান করে– দেশের সম্ভ্রম তাহারাই রাখে; আর তাই যদি না হয়, একটু মাত্র কাল্পনিক সুবিধার আশা পাইলেই অমনি তাহারা যদি নীচত্ব করিতে প্রস্তুত হয়, নিজের অপমান ও দেশের অপমানকে গুলি-পাকাইয়া অম্লানবদনে গলাধঃকরণ করিয়া ফেলিতে পারে তবে তাহারা যত শীঘ্র সরিয়া পড়ে ততই দেশের পক্ষে মঙ্গল। দেখিতেছি চোখে ঠুলি পরিয়া তাহারা কেবল টাকার ঘানি টানিয়া দুই-চারি হাত জমির মধ্যে ঘুরিয়া মরিতেছে, কিছুই উন্নতি হয় নাই, এক পা অগ্রসর হইতে পারে নাই! মান-সম্ভ্রম-মহত্ত্ব সমস্তই ঘানিতে ফেলিয়া কেবল তেলই বাহির করিতে হইবে! বোধ করি স্বদেশকে ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে তোমাদের ওই ঘানিতে ফেলিতে পার যদি একটুখানি তেল বাহির হয়! সমস্ত জীবন তোমাদের ওই ঘানি-দেবতাকে প্রদক্ষিণ করিয়া মরো ও উহার ক্যাঁচ্ ক্যাঁচ্ শব্দে জগতের সমস্ত সংগীত ডুবিয়া যাক!
তোমরা হিন্দু, তোমরা জাতিভেদ মানিয়া থাক। আমরণ তোমাদের সন্তানের যদি বিবাহ না হয় তথাপি সহস্র সুবিধা সত্ত্বে একটা ফিরিঙ্গির সন্তানের সহিত তাহার বিবাহ দাও না, কেন? না শাস্ত্রে নিষেধ আছে। কিন্তু আর-একটি অলিখিত শাস্ত্র এবং মহত্ত্বর জাতিভেদ আছে, যদি সে শাস্ত্রজ্ঞান ও সে সহৃদয়তা থাকিত, তবে একটুখানি সুবিধার আশায় গোটাকতক অ্যাংলো-ইন্ডিয়নের সহিত মিলনসূত্রে বদ্ধ হইতে পারিতে না! সকলই প্রজাপতির নির্বন্ধ বলিতে হইবে। নহিলে তোমরা যত শ্যাম তনু, ক্ষীণ, ক্ষুদ্রগণ ঘড়ির চেনটি পরিয়া ললিত হাস্যে মধুর সম্ভাষণে ওই বড়ো বড়ো গোরাদের আদর কাড়িতে গিয়াছ ও কৃতকার্য হইয়াছ ইহা কী করিয়া সম্ভব হইল! এ তো প্রকাশ্যে, এ তবু ভালো! কিন্তু বিশ্বাস হয় না লোকে কানাকানি করিতেছে, কালায় গোরায় গোপনে গোপনে নাকি গান্ধর্ব মিলন চলিতেছে! শুনিতেছি নাকি কানে কানে কথা, হাতে হাতে টেপাটেপি ও পরস্পর সুবিধার মালাবদল হইতেছে!
সুবিধাই বা কতটুকু! তোমরা নিজে কিছু কম লোক নও। রাজ-সরকারে তোমাদের যথেষ্ট মান-মর্যাদা, খ্যাতি-প্রতিপত্তি আছে। তাহা ছাড়া, তোমরা নিতান্ত মুখচোরাও নও যে, তোমাদের হইয়া আর-একজনকে কথা কহিতে হইবে। তোমরা বেশ বলিতে পার লিখিতে পার, তোমাদের কথা গবর্মেন্ট কান পাতিয়া শুনিয়া থাকেন। তোমাদের টাকা আছে, পদ আছে, প্রতিপত্তি আছে, তবে দুঃখটা কিসের! তবে কেন ওই খোদাবন্দ্দিগের হাঁটুর কাছে হামাগুড়ি দিয়া বেড়াইতেছ! যাহারা সকল বিষয়েই অনবরত গবর্মেন্টের অন্ধ-বিদ্রোহিতা করিয়া আসিতেছে তাহাদিগকে কামানস্বরূপ করিয়া বারুদ ঠাসিয়া আগুন লাগাইয়া গবর্মেন্টের বিরুদ্ধে গোলাবর্ষণ করিতে থাকিলে কি সরকার বড়ো খুশি হইবে!
কী আর বলিব! ইহা এক অপূর্ব অথচ শোচনীয় দৃশ্য। আমাদের দেশের বড়ো বড়ো মাথাগুলা যে এত সহজেই সোডা-ওয়াটারের ছিপির মতো চারি দিকে টপাটপ উড়িতে আরম্ভ করিয়াছে ও জলধারা উচ্ছ্বসিত হইয়া বক্ষ ভাসাইয়া প্রবাহিত হইতেছে এ দৃশ্যে মহত্ত্ব কিছুই নাই! ইহাতে বঙ্গদেশের বর্তমানের জন্য লজ্জা বোধ হয় ও ভবিষ্যতের জন্য আশঙ্কা জন্মে।
ভারতী, পৌষ, ১২৯০