আজকাল সকলেই সকল বিষয়েই চেঁচিয়ে কথা কয়। আস্তে বলা একেবারে উঠিয়া গিয়াছে। চেঁচিয়ে দান করে, চেঁচিয়ে সমাজ সংস্কার করে, চেঁচিয়ে খবরের কাগজ চালায়, এমন-কি, গোল থামাইতে গোল করে। সেকরা গাড়ি যত না চলে, ততোধিক শব্দ করে; তাহার চাকা ঝন ঝন করে, তাহার জানলা ঝর ঝর করে, তাহার গাড়োয়ান গাল পাড়িতে থাকে, তাহার চাবুকের শব্দে অস্থির হইতে হয়। বঙ্গসমাজও আজকাল সেই চালে চলিতেছে, তাহার প্রত্যেক ইঞ্চি হইতে শব্দ বাহির হইতেছে। সমাজটা যে চলিতেছে ইহা কাহারও অস্বীকার করিবার জো নাই; মাইল মাপিলে ইহার গতিবেগ যে অধিক মনে হইবে তাহা নহে, কিন্তু ঝাঁকানি মাপিলে ইহার গতি-প্রভাবের বিষয়ে কাহারো সন্দেহ থাকিবে না। ঝাঁকানির চোটে আরোহীদের মাথায় মাথায় অনবরত ঠোকাঠুকি লাগিয়াছে, আর শব্দ এত অধিক যে, একটা কথা কাহারও কর্ণ-গোচর করিতে গেলে গলার শির ছিঁড়িয়া যায়।
কাজেই বঙ্গসমাজে চেঁচানোটাই চলিত হইয়াছে। পক্ষীজাতির মধ্যে কাকের সমাজ, পশুজাতির মধ্যে শৃগালের সমাজ, আর মনুষ্য জাতির মধ্যে বাঙালির সমাজ যে এ বিষয়ে শ্রেষ্ঠতা লাভ করিয়াছে, ইহা শত্রুপক্ষকেও স্বীকার করিতে হইবে।
শুনা গেছে, পূর্বে লোকে গরীবকে লাখ টাকা দান করিয়াছে, অথচ টাকার শব্দ হয় নাই, কিন্তু এখন চার গণ্ডা পয়সা দান করিলে তাহার ঝম্ঝমানিতে কানে তালা লাগে। এই তো গেল দানের কথা। আবার, দান না করিয়া এত কোলাহল করা পূর্বে প্রচলিত ছিল না। ভিক্ষুক আসিল, দয়ার উদ্রেক হইল না, তাহাকে এক কথায় হাঁকাইয়া দিলাম, এই প্রাচীন প্রথা। কিন্তু এখন লোকে ভিক্ষুক তাড়াইতে গেলে, পোলিটিকল ইকনমির বড়ো বড়ো কথা আওড়াইতে থাকে, বলে, দান না করাই যথার্থ দয়া, দান করাই নিষ্ঠুরতা, ইহাতে সমাজের অপকার করা হয়, আলস্যকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, ভিক্ষাবৃত্তিকে জিয়াইয়া রাখা হয়– ইত্যাদি ইত্যাদি। সমস্তই মানি। কিন্তু তোমার মুখে এ-সব কথা কেন? তুমি এক পয়সা উপার্জন কর না, ঘরের পয়সা ঘরে জমাইয়া রাখ, বাণিজ্য ব্যবসায়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নাই, কেবল অকেজো কতকগুলা বিলাস দ্রব্য কিনিয়া পয়সা ধ্বংস কর, ভিক্ষা দিবার সময়েই তোমার মুখে পোলিটিকল ইকনমি কেন? পোলিটিকল ইকনমিটাকে কেবল ঢাকের কাজেই ব্যবহার করা হয়, আর কোনো কাজে লাগে না।
দেশহিতৈষিতা, আলো জ্বালিবার গ্যাসের মতো যতক্ষণ গুপ্তভাবে চোঙের মধ্য দিয়া সঞ্চারিত হইতে থাকে, ততক্ষণ তাহা বিস্তর কাজে লাগে– কিন্তু যখন চোঙ্ ফুটা হইয়া ছাড়া পায় ও বাহির হইতে থাকে, তখন দেশ-ছাড়া হইতে হয়। আজকাল রাস্তায় ঘাটে দেশহিতৈষিতা-গ্যাসের গন্ধে ভূত পালাইতেছে, অথচ আবশ্যকের সময় অন্ধকার। গ্যাসটা কেবল নাকের মধ্য দিয়াই খরচ হইয়া যায়, বাকি কিছু থাকে না। আত্ম-পরিবারের মধ্যে যে ব্যক্তি শূল বেদনার মতো বিরাজমান, যে ব্যক্তি মাকে ভাত দেয় না, ভাইয়ের সঙ্গে লাঠালাঠি করে, পাড়া-প্রতিবেশীদের নাম পর্যন্তও জানে না– আজকাল সে ব্যক্তিও ভারতবর্ষকে মা বলে, বিশ কোটি লোককে ভাই বলে– শ্রোতারা আনন্দে হাততালি দিতে থাকে। পূর্বে আর-এক রূপ ছিল– তখনকার ভালো লোকেরা বাপ-পিতামহদের ভক্তি করিত– আত্ম-পরিবারের সহিত দৃঢ়রূপে সংলগ্ন ছিল, পাড়া-প্রতিবেশীর উৎসবে আমোদে কায়মনোবাক্যে যোগ দিত, বিপদে-আপদে প্রাণপণে সাহায্য করিত। কিন্তু বাপকে ভক্তি করিলে, ভাইকে ভালোবাসিলে, বন্ধু-বান্ধবদিগকে সাহায্য করিলে, তেমন একটা হট্টগোল উপস্থিত হয় না– পৃথিবীর বিস্তর উপকার হয়, কিন্তু সমস্ত চুপেচাপে সম্পন্ন হয়। কাজেই এখন “ভ্রাতাগণ’, “ভগ্নীগণ’, “ভারতমাতা’ নামক কতকগুলা শব্দ সৃষ্ট হইয়াছে, তাহারা অনবরত হাওয়া খাইয়া খাইয়া ফুলিয়া উঠিতেছে– ও তারাবাজির মতো উত্তরোত্তর আসমানের দিকেই উড়িতেছে, অনেক দূর আকাশে উঠিয়া হঠাৎ আলো নিবিয়া যায় ও ধপ করিয়া মাটিতে পড়িয়া যায়। আমার মতে আকাশে এরূপ দুশো তারাবাজি উড়িলেও বিশেষ কোনো সুবিধা হয় না আর ঘরের কোণে মিটমিট করিয়া একটি মাটির প্রদীপ জ্বালিলেও অনেক কাজে দেখে।
আমি বেশ দেখিতেছি, আমার কথা অনেকে ভুল বুঝিবেন। আমি এমন বলি না যে, হৃদয়কে একটি ক্ষুদ্র পরিবারের মধ্যে অথবা একটি ক্ষুদ্র পল্লীর মধ্যে বদ্ধ করিয়া রাখাই ভালো। যদি সমস্ত ভারতবর্ষকে ভালোবাসিতে পারি, বিশ কোটি লোককে ভাই বলিতে পারি, তাহা অপেক্ষা আর কী ভালো হইতে পারে। কিন্তু তাহা হইল কই? যাহা আমাদের খাঁটি ছিল, তাহা যে গেল; তাহার স্থানে রহিল কী? বীজের গাছগুলা উপড়াইয়া ফেলিলাম, তাহার পরিবর্তে গোটাকতক গোড়াকাটা বৃক্ষ পুঁতিয়া আগায় জল ঢালিতেছি। বিদেশী বন্দুকে ফাঁকা আওয়াজ করার চেয়ে যে আমাদের দিশি ধনুকে তীর ছোঁড়াও ভালো। কিন্তু আমাদের শব্দপ্রিয়তা এমন বাড়িয়া উঠিয়াছে যে, লক্ষ্যের প্রতি দৃষ্টি নাই, শব্দের প্রতিই মনোযোগ।
কানটাই আমাদের এখন একমাত্র লক্ষ্য হইয়াছে। দেখো-না, বাংলা খবরের কাগজগুলি কেবল শব্দের প্রভাবেই পাঠকদের কান দখল করিয়া বসিয়া আছে। কী যে বলিতেছে তাহা বড়ো একটা ভাবিয়া দেখে না, কেবল গলা খাটো না হইলেই হইল। একটা কথা উঠিলে হয়, অমনি বাংলা খবরের কাগজে মহা চেঁচামেচি পড়িয়া যায়। কথাটা হয়তো বোঝাই হয় নাই, ভালো করিয়া শোনাই হয় নাই, হয়তো সে বিষয়ে কিছু জানাই নাই– কিন্তু আবশ্যক কী? বিষয়টা যত কম বোঝা যায়, বোধ করি, ততই হো হো করিয়া চেঁচাইবার সুবিধা হয়। জ্ঞানের অপেক্ষা বোধ করি অজ্ঞতার আওয়াজটা অধিক। ইহা তো সচরাচর দেখা যায়, আমাদের বাংলা সংবাদপত্র দেশের অবস্থা কিছুই জানে না, এমন-কি, দেশের নামগুলা উচ্চারণ পর্যন্ত করিতে পারে না, অথচ গবর্নমেন্টকে বিজ্ঞভাবে উপদেশ দেয়; আইন জানে না, উভয় পক্ষ দেখে না অথচ বিচারককে বিচার করিতে শিখায়; অনেক অনুসন্ধান করিয়া, বিস্তর বিবেচনা করিয়া যোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা যাহা অনেক দিনে স্থির হইয়াছে, তাহা অবহেলা করিয়া, অথচ নিজে কিছুমাত্র অনুসন্ধান না করিয়া যাহা মুখে আসে তাহাই বলিয়া বসে। গলা ভারী করিয়া কথা কয়, অথচ কথাগুলা ছেলেমানুষের মতো, বলিবার ভঙ্গি এবং বলিবার বিষয়ের মধ্যে এমন অসামঞ্জস্য যে, শুনিলে হাসি পায়। কথায় কথায় ইংরাজ গবর্নমেন্টের নিকট হইতে কৈফিয়ত তলব করা হয়। কেহ বা লিখিলেন, “অমুক গাঁয়ের নিকট পদ্মায় সহসা এক ঝড় উঠিয়া তিনখানা নৌকা ডুবিয়া গিয়াছে, অমুক সালে আর-একবার এইরূপ সহসা ঝড় উঠিয়া অমুক স্থানে আর-দুইখানা নৌকা ডুবিয়া যায়, আশ্চর্য তথাপি আমাদের গবর্নমেন্টের চৈতন্য হইল না।’ কেহ বা বলিলেন– “অমুক গাঁয়ে রাত্রি তিন ঘটিকার সময় এক ভয়ানক ভূমিকম্প উপস্থিত হয় ও জমিদারবাবুদের এক আস্তাবল পড়িয়া যায়, গবর্নমেন্টের পূর্ব হইতে সাবধান হওয়া উচিত ছিল।’ কেহ বা লিখিলেন– “বাঙালিরা দুইবেলা ডাল ভাত খাইয়া অতিশয় দুর্বল হইয়া যাইতেছে, অথচ আমাদের শাসনকর্তারা এ বিষয়ে কিছুমাত্র মনোযোগ দিতেছেন না!’ হয়তো ইহা হইতে প্রমাণ করিলেন যে, ইংরাজদের স্বার্থই এই যে, আমাদের ডাল ভাত খাওয়াইয়া রোগা করিয়া রাখা। এই বিষয় অবলম্বন করিয়া এক উদ্দীপনাপূর্ণ প্রবন্ধ লিখিত হইল– বলা হইল যে, যে দেশে এককালে শাক্যসিংহ ও শঙ্করাচার্য জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, সেই দেশের লোকেরা যে ডাল ভাত খাইয়া রোগা হইয়া যাইতেছেন ইহা কেবল বিদেশীয় শাসনের ফল! পাঠ করিয়া উক্ত জগৎবিখ্যাত কাগজের ১৩৭ জন অনারারি পাঠকের সর্ব শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। মাঝে একবার সহসা দেখা গেল, কোনো কোনো বাংলা কাগজ তারস্বরে ইংরাজি জঢ়তঢ়নড়লতশ পত্রকে গাল দিতে আরম্ভ করিয়াছেন– রুচি-বিরুদ্ধ কঠোর ও অভদ্রভাবে উক্ত পত্রের বিরুদ্ধে বড়ো বড়ো প্রবন্ধ লিখিতে আরম্ভ করিয়াছেন। স্টেটস্ম্যানের অপরাধের মধ্যে তিনি বলিয়াছেন যে, স্বায়ত্ত-শাসনপ্রণালী যখন প্রবর্তিত হইল, তখন কোথায় তাহার পদ-স্খলন হইতে পারে তাহাই দেখাইয়া দেওয়া যথার্থ কাজ। অমনি বাংলা খবরের কাগজের ঢাকে কাঠি পড়িল। এরূপ আচরণ অতিশয় হাস্যজনক। যে ব্যক্তি অপ্রিয় সত্য শুনিতে পারে না, সে ব্যক্তি মানুষের মধ্যেই নহে, সে ব্যক্তি বালক, দুর্বল, লঘুচিত্ত! তুমি কি চাও, আদুরে ছেলেটির মতো কেবল তোমার স্তুতিগান করিয়া তোমাকে বুকে তুলিয়া নাচাইয়া বেড়ানোই Statesman পত্রের কাজ? তোমার একটা দোষ দেখাইয়া দিলেই অমনি তুমি হাত-পা ছুঁড়িয়া চিৎকার করিয়া আকাশ ফাটাইয়া দিবে? যাহার হিতৈষিতার সহস্র প্রমাণ পাইয়াছ, সে যদিই বা হিত কামনা করিয়া একটা কঠোর কথা বলে অমনি তাহা বরদাস্ত করিতে পারে না, এমনি তুমি নন্দদুলাল হইয়াছ?– পূর্বকৃত সমস্ত উপকার বিস্মৃত হইয়া তার কুটিল অর্থ বাহির করিতে থাক, এমনি তুমি অকৃতজ্ঞ? এইরূপ প্রত্যেক সামান্য ঘটনায় চিৎকার করিবার ভাব প্রতিনিয়ত বাংলা সংবাদপত্রে দেখা যাইতেছে। ইহাতে ফল এই হইতেছে, সাধারণের মধ্যে ছেলেমানুষের মতো এক প্রকার খুঁৎখুঁতে কাঁদুনে ভাবের প্রাদুর্ভাব দেখা যাইতেছে। অনবরত আত্ম-প্রশংসা করিয়া নিজের দোষের জন্যে পরকে তিরস্কার করিয়া নিজের কর্তব্যভার পরের স্কন্ধে চাপাইয়া কেবল গলার আওয়াজেরই উন্নতি করিতেছি ও চক্ষু বুজিয়া মনে করিতেছি যে, আমাদের দুর্ভাগ্যের নিমিত্ত আমরা ব্যতীত আর বিশ্বসুদ্ধ সকলেই দায়ী।
গোটাকতক ইংরাজি শব্দ আসিয়া আমাদের অতিশয় অনিষ্ট করিতেছে। Independent Spirit নামক একটা শব্দ আমাদের সমাজে বিস্তর অপকার করিতেছে– বাঙালির ছেলেপিলে খবরের কাগজপত্র সকলে মিলিয়া এই Independent Spirit-এর চর্চায় ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে। এই শব্দটার প্রভাবে প্রতিমুহূর্তে বাংলাদেশ হইতে সহজ ভদ্রভাব চলিয়া যাইতেছে ও এক প্রকার অভদ্র উদগ্র পরুষ ভাবের প্রাদুর্ভাব হইতেছে। খবরের কাগজের লেখাগুলার মধ্যে আগাগোড়া এক প্রকার অভদ্র ভঙ্গি দেখা যায়। ভালো মুখে মোলায়েম করিয়া কথা কহিলে যেন Spirit-এর অভাব দেখানো হয়– সেইজন্য সর্বদাই কেমন তেরিয়াভাবে কথা কহিবার ফেসিয়ান উঠিয়াছে– অনর্থক অনাবশ্যক গায়ে পড়িয়া অভদ্রতা করা খবরের কাগজে চলিত হইয়াছে। যেখানে উপদেশ দেওয়া উচিত সেখানে গালাগালি দেওয়া হয়– যেখানে কোনো প্রকার খুঁত ধরা রুচি-বিরুদ্ধ, সেখানে জোর করিয়া খুঁত ধরা হয়। এইরূপ সংবাদপত্রগুলি পাঠকদের পক্ষে যে কীরূপ কুশিক্ষার স্থল হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহা ভাবিয়া দেখিলে অন্ধকার দেখিতে হয়! আজকালকার ছেলেদের সর্বাঙ্গ দিয়া এমনি Independent Spirit ফুটিয়া বাহির হইতেছে যে, তাহাদের ছুঁইতে ভয় করে। তাহারা সর্বদাই যেন মারিতে উদ্যত। চব্বিশ ঘণ্টা যেন তাহারা হাতের আস্তিন গুটাইয়া কোমর বাঁধিয়াই আছে। কিসে যে সহসা তাহাদের অপমান বোধ হয়, ভাবিয়া পাওয়া যায় না। এক-এক জন ইংরাজ যেমন দিশি-জুতা দেখিলে অপমান বোধ করে– তেমনি দিশি লৌকিক আচরণ ইহাদের পিঠে দিশি জুতার ন্যায় বাজিয়া থাকে। যদি দৈবাৎ কোনো অনভিজ্ঞ প্রাচীন ইহাদিগকে জিজ্ঞাসা করে, “মহাশয়ের ঠাকুরের নাম কী?’ অমনি ইহারা ফোঁস করিয়া উঠে। ইহাদের ভাব দেখিয়া মনে হয় যেন, জগৎ সংসার ইহাদিগকে অপমান করিবার জন্য অবিরত উদ্যোগী রহিয়াছে, তাই জন্যে ইহারা আগে হইতে পদে পদে জগৎকে অপমান করিবার জন্য ধাবমান হয়। শুঁয়াপোকার ন্যায় দিনরাত্রি কণ্টকিত হইয়া থাকাকেই ইহারা Independent Spirit কহে। গল্পে শুনা যায়, এমন এক-এক জন অতি-বুদ্ধিমান আছেন, যাঁহারা নাকে-কানে তুলা দিয়া মশারির মধ্যে বসিয়া থাকেন, পাছে তাঁহাদের বুদ্ধি কোনো সুযোগে বাহির হইয়া যায়; ইঁহারাও তেমনি সজারুর মতো সর্বদাই চারি দিকে কাঁটা উঁচাইয়া সমাজে সঞ্চরণ করিতে থাকেন, পাছে ইঁহাদের কেহ অপমান করে। এদিকে আবার ইঁহারা ভীরুর অগ্রগণ্য; দুর্বলের কাছে, ভৃত্যের কাছে, স্ত্রীর কাছে ইঁহারা Independent Spirit নামক বৃহৎ লাঙ্গুলটা এমনি আস্ফালন করিতে থাকেন যে, কাছাকাছির মধ্যে লোক তিষ্ঠিতে পারে না, আর, একটা শ্বেত মূর্তি দেখিলেই সে লাঙ্গুলটা গুটাইয়া কোথায় যে অদৃশ্য হইয়া যায় তাহার ঠিকানা পাওয়া যায় না। যাহার যথার্থ বল আছে সে সর্বদাই ভদ্র– সে তাহার বলটাকে গণ্ডারের শিঙের মতো অহোরাত্র নাকের উপর খাড়া করিয়া রাখে না। আর যে দুর্বল, হয় সে লাঙ্গুল গুটাইয়া কুঁকড়ি মারিয়া থাকে, নয় সে খেঁকি কুকুরের মতো ভদ্রলোক দেখিলেই দূর হইতে অবিরত ঘেউ ঘেউ করিতে থাকে। আমরাও কেবল দূর হইতে অভদ্রভাবে ঘেউ ঘেউ করিতেছি। শব্দে কান ফাটিয়া যাইতেছে।
প্রাণের সঙ্গে যখন কোনো কথা বলি, তখন যাহা বলি তাহারই একটা বল থাকে– যখন প্রাণে বাজে নাই অথচ মুখে বলিতে হইবে, তখন চেঁচাইয়া বলিতে হয়, বিস্তর বলিতে হয়। বঙ্গসমাজে যে আজকাল বিশেষ চেঁচামেচি পড়িয়া গিয়াছে ইহাও তাহার একটি কারণ। বক্তা যখন বক্তৃতা দিতে উঠেন, তখন সে এক অতি কষ্টকর দৃশ্য উপস্থিত হয়। গ্রহণী রোগীর ন্যায় তাঁহার হাতে পায়ে আক্ষেপ ধরিতে থাকে, গলার শির ফুলিয়া ওঠে, চোখ দুটা বাহির হইয়া আসিতে চায়। যিনি বাংলা দেশের কিছুই জানেন না, তিনি কথায় কথায় বলেন, “কুমারিকা হইতে হিমালয় ও সিন্ধুনদী হইতে ব্রহ্মপুত্র;’ ফুঁ দিয়া দিয়া কথাগুলাকে যত বড়ো করা সম্ভব তাহা করা হয়; যেখানে বাংলা দেশ বলিলেই যথেষ্ট হয় সেখানে তিনি এশিয়া না বলিয়া থাকিতে পারেন না; যেখানে সামান্য জমা-খরচের কথা হইতেছে, সেখানে ভাস্করাচার্য ও লীলাবতীর উল্লেখ না করিলে তাহার মনঃপূত হয় না; একজন ফিরিঙ্গি বালকের সহিত দেশীয় বালককে ঝগড়া করিতে দেখিলে তাঁহার ভীষ্ম দ্রোণ ভীমার্জুনকে পর্যন্ত মনে পড়ে। যথার্থ প্রাণের সঙ্গে বলিলে কথাগুলা খাটো খাটো হয় ও কিছুই অতিরিক্ত হইতে পারে না।
আজকালকার সাহিত্য দেখো-না কেন, এইরূপ চিৎকারে প্রতিধ্বনিত। পরিপূর্ণতার মধ্য হইতে যে একটা গম্ভীর আওয়াজ বাহির হয়, সে আওয়াজ ইহাতে পাওয়া যায় না। যাহা-কিছু বলিতে হইবে তাহাই অধিক করিয়া বলা, যে-কোনো অনুভাব ব্যক্ত করিতে হইবে, তাহাকেই একেবারে নিংড়াইয়া তিক্ত করিয়া তোলা। যদি আহ্লাদ ব্যক্ত করিতে হইল, অমনি আরম্ভ হইল, বাজ বাঁশি, বাজ কাঁশি, বাজ ঢাক, বাজ ঢোল, বাজ ঢেঁকি, বাজ কুলো– ইহাকে তো আনন্দ বলে না, ইহা এক প্রকার প্রাণপণ মত্ততার ভান, এক প্রকার বিকার রোগ; যদি দুঃখ ব্যক্ত করিতে হইল, অমনি ছুরি ছোরা, দড়ি কলসী, বিষ আগুন, হাঁসফাঁস, ধড়ফড়, ছটফট– সে এক বিপর্যয় ব্যাপার উপস্থিত হয়। এখনকার কবিরা যেন হৃদয়ের অন্তঃপুরবাসী অনুভাবগুলিকে বিকৃতাকার করিয়া তুলিয়া হাটের মধ্যে দিগবাজি খেলাইতে ভালোবাসেন। কোনো কোনো কবিসমাজের নাসিকাকে উপেক্ষা করিয়া হৃদয়ের ক্ষতগ্রস্ত ভাবকে হয়তো কোনো কুলবধূর নামের সহিত মিশ্রিত করিয়া নিতান্ত বেআব্রু কবিতা লিখিয়া থাকেন। ইহাকেই চেঁচাইয়া কবিতা লেখা বলে। আমাদের প্রাচ্য-হৃদয়ে একটি আব্রুর ভাব আছে। আমরা কেবল দর্শকদের নেত্রসুখের জন্য হৃদয়কে উলঙ্গ করিয়া হাটেঘাটে প্রদর্শনের জন্য রাখিতে পারি না। আমরা যদি কৃত্রিম উপায়ে আমাদের প্রাচ্য ভাবকে গলা টিপিয়া না মারিয়া ফেলিতাম, তবে উপরোক্ত শ্রেণীর কবিতা পড়িয়া ঘৃণায় আমাদের গা শিহরিয়া উঠিত। সহজ সুস্থ অকপট হৃদয় হইতে এক প্রকার পরিষ্কার অনর্গল অনতিমাত্র ভাব ও ভাষা বাহির হয়, তাহাতে অতিরিক্ত ও বিকৃত কিছু থাকে না– টানা-হেঁচড়া করিতে গেলেই আমাদের ভাব ও ভাষা স্থিতিস্থাপক পদার্থের মতো অতিশয় দীর্ঘ হইতে থাকে ও বিকৃতাকার ধারণ করে।
যখন বাংলা দেশে নূতন ইংরাজি শিক্ষার আরম্ভ হইল, তখন নূতন শিক্ষিত যুবারা জোর করিয়া মদ খাইতেন, গোমাংস খাইতেন। চেঁচাইয়া সমাজ-বিরুদ্ধ কাজ করিতে বিশেষ আনন্দ বোধ করিতেন। এখনও সেই শ্রেণীর একদল লোক আছেন। তাঁহাদের অনেকে সমাজ-সংস্কারক বলিয়া গণ্য। কিন্তু ইহা জানা আবশ্যক যে, তাঁহারা যে হৃদয়ের বিশ্বাসের বেগে চিরন্তন প্রথার বিরুদ্ধে গমন করেন তাহা নহে, তাঁহারা অন্ধভাবে চেঁচাইয়া কাজ করেন। ভারতবর্ষীয় স্ত্রীলোকদের দুর্দশায় তাঁহাদের যে কষ্টবোধ হয় তাহা নহে, তাঁহারা যে হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিয়া কোনো কাজ করেন তাহা নহে, তাঁহারা কেবল চেঁচাইয়া বলিতে চান আমরা স্ত্রী-স্বাধীনতার পক্ষপাতী। ইঁহাদের দ্বারা হানি এই হয় যে, ইঁহারা নিজ কার্যের সীমা-পরিসীমা কিছুই দেখিতে পান না– কোথা গিয়া পড়েন ঠিকানা থাকে না। কিন্তু যাঁহাদের হৃদয়ের মধ্যে একটি বিশ্বাস একটি সংস্কার ধ্রুবতারার মতো জ্বলিতে থাকে, তাঁহারা সেই ধ্রুবতারার দিকে লক্ষ্য রাখিয়া চলিতে থাকেন; তাঁহারা জানেন কোন্খানে তাঁহাদের গম্যস্থান, কোন্ দিকে গেলে তাঁহারা কিনারা পাইবেন। কেবল দৈবাৎ কখনো স্রোতের বেগে ভাসিয়া বিপথে যান।
আমাদের সমাজে আজকাল যে এইরূপ অস্বাভাবিক চিৎকার-প্রথা প্রচলিত হইতেছে, তাহার কারণ আর কিছু নহে, আমরা হঠাৎ সভ্য হইয়াছি। আমরা বিদেশ হইতে কতকগুলা অচেনা ভাব পাইয়াছি, তাহাদের ভালো করিয়া আয়ত্ত করিতে পারি নাই, অথচ কর্তব্যবোধে তাহাদের অনুগমন করিতে গিয়া এক প্রকার বলপূর্বক চেঁচাইয়া কাজ করিতে হয়। আমরা নিজেই এখন ভালো করিয়া বুঝিতে পারিতেছি না, কোন্ কাজগুলা আমরা বিশ্বাসের প্রভাবে করিতেছি, আর কোন্গুলা কেবলমাত্র অন্ধভাবে করিতেছি। কোন্খানে আমরা নিজে দাঁড় টানিয়া যাইতেছি, আর কোন্খানে আমাদের ভাসাইয়া লইয়া যাইতেছে। বড়ো বড়ো বিদেশী কথার মুখোশ পরিয়া আমরা তো আপনাকে ও পরকে প্রবঞ্চনা করিতেছি না? আমাদের যেরূপ দেখাইতেছে আমরা সত্যই কি তাহাই হইয়াছি? যদি হইতাম তাহা হইলে কি এত চেঁচাইতে হইত? আর যদি না হইতেই পারিলাম, তবে কি মাংসখণ্ডের ছায়া দেখিয়া মুখের মাংসখণ্ডটি ফেলিয়া ভালো কাজ করিতেছি? শেষকালে কি অধ্রুবও যাইবে ধ্রুবও যাইবে?
ভারতী, ফাল্গুন, ১২৮৯