উভয় পক্ষের কথা তো শুনা গেল। এখন বিচার করিয়া স্থির করিবার সময় আসিয়াছে। হাজার প্রয়োজনীয় বিষয় হউক তবু এক কথা বার বার শুনিতে ভালো লাগে না, তাহার পরে আবার, শ্রীমতীতে শ্রীমতীতে বোঝাপড়া চলিতেছিল মাঝে হইতে কোথাকার এক শ্রীযুক্ত আসিয়া যোগ দিলে পাঠকরা বিরক্ত হইতে পারেন। কিন্তু দুই পক্ষে তর্ক-বিতর্ক আরম্ভ হইলে শীঘ্র মিটিবে না ও পাঠকদের বিরক্তিজনক হইবে বিবেচনা করিয়া আমি শ্রী তৃতীয় পক্ষ আসিয়া যথাসাধ্য সংক্ষেপে সারিবার চেষ্টা করিলাম। প্রথমত, গোড়ায় কী কী কথা উঠিয়াছিল ও তাহার কীরূপ উত্তর দেওয়া হইয়াছে, তাহা সংক্ষেপে উত্তর-প্রত্যুত্তরচ্ছলে সাজাইয়া দিই, তাহা হইলে বোধ করি আমাকে আর বেশি কথা বলিতে হইবে না।
প্রথম পক্ষ। আমাদের নব্য সম্প্রদায় উন্নতিপথের কণ্টকস্বরূপ কুসংস্কারগুলিকে একেবারে উন্মূলিত করিতে চান, ইহা অপেক্ষা দেশের সৌভাগ্য আর কিছুই নাই। কিন্তু কোন্টা কুসংস্কার সেইটে বিশেষ মনোযোগ করিয়া আগে স্থির করা দরকার। মন্দ মনে করিয়া ভালোকে দূর করিয়া দিলে দেশের বিশেষ উপকার হয় না, কারণ, কেবলমাত্র মহৎ-উদ্দেশ্য লইয়া ঘরকন্না চলে না। তাহা ছাড়া, দেশী কুসংস্কারের জায়গায় হয়তো বিলাতি কুসংস্কার রোপণ করা হইল, তাহার ফল হইল এই যে, গোরা ডাকিয়া সিপাই তাড়াইলে, এখন গোরার উৎপাতে দেশছাড়া হইতে হয়! যাহা হউক, ইহা বোধ করি কেহ অস্বীকার করিবেন না যে, যদি সেই কুসংস্কারই পুষিতে হইল তবে আমাদের দেশের আয়ত্তাধীন রোগা ভেতো কুসংস্কারই ভালো, বিলাতের গোখাদক জোয়ান কুসংস্কার অতি ভয়ানক!
দ্বিতীয় পক্ষ। উত্তর নাই।
প্রথম পক্ষ। এমন কতকগুলি লোক আছেন, তাঁহারা বিলাতি আচার-ব্যবহারের সহিত যাহার মিল আছে তাহাকেই সুসংস্কার মনে করেন ও যাহার বিলাতি প্রতিরূপ নাই তাহাকেই কুসংস্কার বলিয়া ত্যাগ করেন। এ বিষয়ে বিবেচনাশক্তি খাটানো বাহুল্য জ্ঞান করেন। যাঁহারা এই শ্রেণীর লোক, যাঁহারা বিলাতি অনাবশ্যক আচার-ব্যবহারও সগর্বে গ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে কি হৃদয়ের দোহাই দিয়া জিজ্ঞাসা করা যায় না যে, তোমরা আমাদের দেশের অনাবশ্যক, এমন-কি, বিশেষ আবশ্যক, অনুষ্ঠানগুলি সগর্বে ত্যাগ করিলে কেন? তোমরা নব্য বালিকারা, আত্মীয় ও সখীদিগের জন্মতিথির দিনে ছবি-আঁকা কার্ড পাঠাইয়া ইংরাজি ধরনে উৎসব কর, ইংরাজি বৎসরের আরম্ভের দিন ইংরাজি প্রথানুসারে পরস্পরকে কুশল-লিপি প্রেরণ করিয়া থাক, এপ্রিলের ১লা তারিখে ইংরাজদের অনুকরণে পরস্পরকে নানাপ্রকার ঠকাইতে চেষ্টা কর, এ কাজগুলি কিছু মহাপাতক নয়, ইহাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো বক্তব্যও নাই। কিন্তু একটা কথা আমার জিজ্ঞাসা করিবার আছে, তোমরা ভাইদ্বিতীয়ার অনুষ্ঠান ত্যাগ করিলে কেন? তোমরা বড়ো হইলে জামাইষষ্ঠী পালন কর না কেন? এমনও দেখিয়াছি সামান্য ইংরাজি অনুষ্ঠানের ব্যত্যয় হইলে তোমরা লজ্জায় মরিয়া যাও, আর ভালো ভালো দিশি অনুষ্ঠান পালন না করিলে কিছুই মনে হয় না। ইহা হইতে এইটেই দেখা যাইতেছে যে, তোমরা সুসংস্কার কুসংস্কার বাছিয়া কাজ কর না, দিশি বিলাতি বাছিয়া কাজ কর।
দ্বিতীয় পক্ষ। দেশীয় ভাবের অনাদরে লেখিকার প্রাণে বাজিয়াছে বলিয়া তিনি প্রকৃতিস্থ হইয়া কথা কহিতে পারেন নাই! লেখিকা দেশীয় ও বিদেশীয় ভাবের একজন নিরপেক্ষ বিচারক নহেন, তিনি দেশীয় ভাবের পক্ষপাতী। এরূপ পক্ষপাতে হৃদয় প্রকাশ পায় বটে কিন্তু যুক্তির অভাব অনুমান হয়। অনেক নব্যদের কাছে সেকেলে ভাবের আদর দেখা যায় না বটে, কিন্তু সাহেবিয়ানাই তাহার কারণ নয়। সমাজ সংস্কারের আবশ্যক হইয়াছে, নব্য সম্প্রদায় তাহা বুঝিয়াছেন ও কাজে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। উৎসাহের চোটে অনেক সময় হিতে বিপরীত করেন বটে, কিন্তু সেটা কি সাহেবিয়ানা? তাঁহারা সাহেবদের ভালো লইতে গিয়া ধাঁধা লাগিয়া মন্দও লন, কিন্তু দেশকে সাহেবি করিবার জন্য তাহা করেন না, দেশের ভালো করিবার জন্যই এরূপ করিয়া থাকেন। কারণ, সাহেবি করিবার ইচ্ছা করিলে অনায়াসে তাঁহারা হ্যাটকোট্ পরিয়া অবিকল ইংরাজ সাজিতে পারিতেন, কিছুমাত্র দিশি অবশিষ্ট রাখিবার দরকার কী ছিল? যাহা হউক, আমার কথাটার মর্ম এই, নব্য সম্প্রদায় যাহা-কিছু গলদ করেন তাহা অতিশয় উৎসাহের প্রভাবেই করিয়া থাকেন, সাহেবিয়ানা হইতে করেন না।
তৃতীয় পক্ষ। লোকের কাজ দেখিয়া মনের ভাব জানিতে হয়, আমি (এবং লেখিকাদ্বয়) কিছু অন্তর্যামী নহি। প্রথম পক্ষ দৃষ্টান্ত দ্বারা দেখাইতেছেন যে, একদল লোক আছেন তাঁহারা ইংরাজি অনাবশ্যক এবং অর্থহীন প্রথাগুলিকেও সমাদরে গ্রহণ করেন, অথচ, দিশি অনাবশ্যক, এমন-কি, আবশ্যক প্রথাগুলিকে অকাতরে পরিত্যাগ করেন। ইহা দেখিলেই কী মনে হয়? মনে হয় যে, ইঁহারা আবশ্যক অনাবশ্যক দেখিয়া যে কিছু গ্রহণ করিতেছেন তাহা নয়, ইঁহারা বিলাতিকে আবশ্যক জ্ঞান করেন, দিশিকে অনাবশ্যক জ্ঞান করেন। সাহেব দেখিয়া তাঁহাদের ধাঁধা লাগিতে পারে বটে, কারণ আমাদের বরাবর কালো দেখা অভ্যাস, সুতরাং সহসা সাদা দেখিলে ধাঁধা লাগিয়া যায়– কিন্তু ধাঁধা লাগিয়া নাহয় সাহেবদের দুটো মন্দই গ্রহণ করিলাম, কিন্তু ধাঁধা লাগিয়া আমাদের স্পষ্ট ভালো জিনিসগুলিকে পরিত্যাগ করি কেন? শ্রীমতী– গোড়াতেই একটা ভুল করিতেছেন। এইরূপ ধাঁধা লাগাকেই যে বলে সাহেবিয়ানা! সাহেব দেখিয়া ধাঁধা লাগিয়া যখন একজন দিশি লোক সাহেবের অনাবশ্যক প্রথাকে আবশ্যক জ্ঞান করেন ও আমাদের আবশ্যক প্রথাকেও অনাবশ্যক জ্ঞান করেন ও সেই অনুসারে কাজ করেন তখনই বলা যায় তিনি সাহেবিয়ানা করিতেছেন। কারণ, এই সামান্য ঘটনা হইতে দেখা যায় যে, একজন সাহেব দেখিয়াই আমাদের দেশের প্রতি তাঁহার সদ্ভাব এমনি বিপর্যস্ত হইয়া গিয়াছে যে, দেশের ভালোও তাঁহার চক্ষে অনাবশ্যক বা মন্দ বলিয়া বোধ হইতেছে। তাঁহার উদ্দেশ্য খুবই ভালো হইতে পারে, তিনি হয়তো সত্য সত্যই মনের সহিত সাহেবিকে শ্রদ্ধেয় ও দিশিকে ঘৃণ্য জ্ঞান করেন, সুতরাং দেশে সাহেবি প্রচলিত করা ও দিশি নষ্ট করাই তিনি তাঁহার কর্তব্য বিবেচনা করেন, কিন্তু বিনা কারণে কেবলমাত্র ধাঁধা লাগিয়া এইরূপ মনে করাকেই বলে সাহেবিয়ানা অর্থাৎ সাহেবি-প্রিয়তা। অতএব যখন দেবী জ্ঞানদানন্দিনী অকারণে বিলাতি প্রথা অনুষ্ঠান ও অকারণে দেশী প্রথা পরিত্যাগের উল্লেখ করিয়া তাহাকে সাহেবিয়ানা বলিয়াছেন, তখন তাঁহাকে দোষ দেওয়া যায় না। আর যাহাই হউক, তিনি যে “প্রকৃতিস্থ’ ছিলেন তাহা সহজেই মনে হয়।
শ্রীমতী– বলেন, সাহেবিয়ানাই যদি তাঁহাদের উদ্দেশ্য হয়, তবে তাঁহারা পূরা সাহেবিয়ানা করেন না কেন? তাহা আমি কী জানি? কিন্তু তাঁহারা যতটা করিতেছেন ততটা যে সাহেবিয়ানা তাহা আমরা স্পষ্ট দেখিয়াছি, সে বিষয়ে প্রথম পক্ষ দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছেন– তাঁহারা কী যে করেন না, তাহা তিনি বলেন নাই, সুতরাং তাহার জবাবদিহি তিনি করিতে পারেন না। হইতে পারে, সমাজের শাসন একেবারে লঙ্ঘন করিতে তাঁহারা সাহস করেন না, আস্তে আস্তে অল্পে অল্পে যতটা সয় ততটা অবলম্বন করিতেছেন; হইতে পারে, পাড়া-প্রতিবেশীদের উপহাস বিদ্রূপ সহ্য করিতে পারেন না; হইতে পারে, তাঁহারা যে অবস্থায় থাকেন সে অবস্থা পূরা সাহেবিয়ানার অনকূল নহে। এমন আরও দুইশো কারণ থাকিতে পারে। এমনও হইতে পারে, সাহেবিয়ানাই তাঁহাদের আদর্শ বটে, অথচ সমাজ-সংস্কার করিতেছি মনে করিয়া আত্ম-প্রবঞ্চনা করেন, আগাগোড়া সাহেবি করিলে সংস্কার করিতেছি মনে করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করা যায় না, সুতরাং কিছু কিছু দিশি রাখিয়া মাঝে মাঝে বিলাতি চাকচিক্য অবলম্বন করিয়া সংস্কার করিবার গর্ব অনুভব করা যায়, কেবল তাহাই নয়, সেই আত্মপ্রসাদের প্রভাবে moral courage-এর ধুয়া ধরিয়া দেশীয় সমাজকে উপেক্ষা করিবার বল সঞ্চয় করা যায়। এই পর্যন্ত থাক্। পুনশ্চ পূর্বপক্ষের কথা শোনা যাউক।
প্রথম পক্ষ। এতক্ষণ ছোটো ছোটো প্রথার কথা বলিলাম। কিন্তু এখন একটা বড়ো বিষয়ে হাত দিতেছি। কোনো কোনো সমাজ-সংস্কারক সম্প্রদান প্রথা পরিত্যাগ করিয়াছেন। তাঁহারা বলেন, “মেয়ে কি একটা ঘটিবাটি যে, একজনের হাত হইতে আর-একজনের হাতে পড়িবে?’ এ কী হৃদয়হীন কথা? জগতে ঘটিবাটির অধিকার ছাড়া আর কোনো প্রকারের অধিকার নাই কি? স্নেহ প্রেমের কোনো অধিকার নাই কি? মনুষ্য-সমাজে অরাজকতা উচ্ছৃঙ্খলতা কেন নাই? যার যা খুশি সে তা করে না কেন? তাহার কারণ মানুষের উপর মানুষের অধিকার আছে। পরস্পরের জন্য পরস্পরকে অনেকটা সহিয়া থাকিতে হয়, অনেকটা আত্মসংযম করিতে হয়। এই পরস্পরের প্রতি যে দৃষ্টি রাখা, এ কি কেবল সুবিধার শাসনেই হয়? তাহা নয়, সভ্য সমাজে হৃদয়ের শাসনই বলবান হইতে থাকে। আমি একটি জন্তুকে যত সহজে বধ করিতে পারি, একটি মানুষকে তত সহজে বধ করিতে পারি না, সমাজের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি দৃষ্টিপাত করাই কি তাহার কারণ? তাহা নয়। তাহার কারণ এই যে, একজন মানুষের হৃদয়ের উপর, দয়ার উপর আর একজন মানুষের অধিকার আছে, সেই অধিকার লঙ্ঘন করা অসভ্যতা, পাপ! এক জাতি বলিয়া মানুষের উপর মানুষের যেরূপ অধিকার আছে, তেমনি এক পরিবার বলিয়া পরিবারস্থ ব্যক্তিদিগের পরস্পরের প্রতি বেশি অধিকার আছে, সে অধিকার লঙ্ঘন করিলে সমাজে ঘোর উচ্ছৃঙ্খলতা ও পাপের সৃষ্টি হয়, আবার পরিবারস্থ বিশেষ ঘনিষ্ঠ-সম্পর্ক ব্যক্তির বিশেষ ঘনিষ্ঠ অধিকার আছে, এই-সকল অধিকারের সহিত ঘটিবাটির অধিকার কি তুলনীয়? অতএব মেয়ের উপরে বাপের অধিকার নাই এ কথা কী করিয়া বলা যায়? ইত্যাদি ইত্যাদি।
দ্বিতীয় পক্ষ। তাহা যেন বুঝিলাম, মানিলাম সম্প্রদান প্রথা অন্যায় নহে। কিন্তু ইহা হইতে এই প্রমাণ হইতেছে যে, সংস্কারকদিগের বুঝিবার ভুল হইয়াছিল। কিন্তু ইহাকে তো আর সাহেবিয়ানা বলা যায় না। কারণ সাহেবদের মধ্যে সম্প্রদান প্রথা আছে।
তৃতীয় পক্ষ। সাহেবদের মধ্যে কীরূপ প্রথা প্রচলিত তাহা আমি জানি না, সুতরাং সে বিষয়ে কিছু বলিতে পারি না। সকলেই স্বাধীন, সকলেরই স্বতন্ত্র অধিকার আছে, ইত্যাদি ভাব আমরা ইংরাজের কাছ হইতে পাইয়াছি, সেই-সকল সাহেবি মতের ধুলায় অন্ধ হইয়া দেশীয় ভাবকে তাড়াতাড়ি উপেক্ষা করিতে যাওয়া কতকটা সাহেবি-প্রিয়তার ফল। ইংরাজেরা যদি ঠিক ইহার উল্টা কথাটা বলিতেন, আমরা হয়তো ঠিক ইহার উল্টা আচরণ করিতাম। যাহাই হউক, ইহা দেখা যাইতেছে, নব্যদিগের হৃদয়ে এমন একটি ভাব প্রবেশ করিয়াছে, যাহার প্রভাবে কথায় কথায় অকাতরে তাঁহারা দেশীয় প্রথা ত্যাগ করিতে পারেন, তাহার প্রতি একটু দরদ থাকিলে যতটা সাবধানে যতটা বিবেচনা করিয়া কাজ করা যাইত, ততটা করা হয় না। একটা লম্বাচৌড়া মত শুনিবামাত্রই অমনি তড়িঘড়ি এক-একটা দিশি প্রথাকে নির্বাসন করিতে যাওয়ার ভাবটাই ভালো নহে।
প্রথম পক্ষ। আচ্ছা, যদি পূর্বোক্ত সংস্কারকগণ কন্যার উপরে পিতার বা স্ত্রীর উপর স্বামীর অধিকার বাস্তবিকই স্বীকার না করেন, তবে কেন তাঁহারা, কন্যা যতদিন অবিবাহিত থাকে ততদিন তাহাকে তাহার পিতার পদবী দেন ও বিবাহিত হইলে কেন তাহাকে তাহার স্বামীর পদবীতে ডাকেন? যথা, অবিবাহিত কন্যার নাম কমলমণি ঘোষ, বিবাহিত কন্যার নাম কমলমণি নন্দী। তাহার নিজের নামের স্থায়িত্ব নাই কেন? সে কি একটা জড় পদার্থ, তাহার কি এতটুকু স্বাতন্ত্র্য নাই যে যখন যাহাদের ঘরে যাইবে তখনই তাহাদের নাম গ্রহণ করিবে?
দ্বিতীয় পক্ষ। লেখিকা কী অর্থে “স্বাতন্ত্র্য’ শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন তাহা ঠিক বুঝা গেল না। স্ত্রীলোক বংশের পদবী গ্রহণ করিতে স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যের যে কী খর্বতা হয় তাহাও বুঝিতে পারি না। পুরুষরা তো বংশের উপাধি গ্রহণ করেন, সেইজন্য কি তাঁহাদের স্বাতন্ত্র্য বিন্দুমাত্র কমিয়াছে?
তৃতীয় পক্ষ। এ কেমনতরো খাপছাড়া উত্তর হইল কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। পদবী গ্রহণে তো স্বাতন্ত্র্যের খর্বতা হয় না, কিন্তু পদবী পরিবর্তনে হয়। যত দিন স্ত্রী ঘোষ-পিতার অধীনে আছে ততদিন সে ঘোষ, আর, যখন সে বোস-স্বামীর বাড়িতে গেল তখনই সে বোস হইল, ইহাকে “প্রকৃতিস্থ’ লোকে স্বাতন্ত্র্যের অভাব বলে না তো কী বলে? বিবাহের পর স্ত্রীর অনুসারে স্বামীর নামেরও পরিবর্তন হয় না কেন? স্বামীরা কর্তা বলিয়া। যাহা হউক, স্ত্রী স্বাতন্ত্র্য ভালো কি মন্দ সে কথা হইতেছে না, কথাটা এই যে যাঁহারা স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যের পাছে একটুখানি খর্বতা হয় বলিয়া সম্প্রদান প্রথা উঠাইয়া দিতে চান তাঁহারা কোন্ মুখে স্ত্রীলোকের পদবী পরিবর্তন প্রথা গ্রহণ করিতে পারেন?
প্রথম পক্ষ। তবে, যদি বল পরিচয়ের সুবিধার জন্য স্ত্রীলোকদের নামের সহিত পদবী গ্রহণ ও বিবাহ হইলে তাহার পরিবর্তন সমাজের বর্তমান অবস্থায় আবশ্যক করে, তবে তাহার বিরুদ্ধে বক্তব্য এই যে, ঘোষ বা বোস বলিলে আমাদের দেশে পরিচয়ের বিশেষ কী এমন সুবিধা হইল? আমাদের দেশের ঘোষ বোস প্রভৃতি উপাধি পরিবার-বিশেষের নাম নহে, বিস্তৃত শ্রেণীবিশেষের উপাধি, সুতরাং ইহাতে ব্যক্তিবিশেষগত পরিচয়ের কোনো সুবিধা হইল না।
দ্বিতীয় পক্ষ। পরিচয়ের সুবিধার জন্যই যে এই প্রথা প্রচলিত হইয়াছে সে কথা লেখিকা কোথা হইতে সংগ্রহ করিলেন? আমি তো মনে করি, দেবী ও দাসীর প্রভেদ উঠাইয়া দিবার জন্যই এই প্রথা অবলম্বন করিতে হইয়াছে। এককালে শূদ্রেরা দাসত্ব করিত, তাই বলিয়া যখন দাসত্ব করে না তখনও যে নামের সহিত সেই দাসত্বের স্মৃতি যত্নপূর্বক পুষিয়া রাখিতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। দ্বিতীয়ত, এখন জাতিভেদ উঠিয়া গিয়া অসবর্ণ বিবাহ হইতেছে; একজন ব্রাহ্মণকন্যা শূদ্রপত্নী হইলে তিনি আপনাকে দেবী বলিবেন, না দাসী বলিবেন? এরূপ অবস্থায় তিনি কী করিবেন?
তৃতীয় পক্ষ। স্ত্রীলোকের নামের সম্বন্ধে শ্রীমতী অনামিকা একটি ভুল বুঝিয়াছেন দেখিতেছি। দেবী জ্ঞানদানন্দিনী স্ত্রীলোকদিগের নামের শেষে দেবী দাসী যোগ করা লইয়া কিছুই বলেন নাই, সে বিষয়ে তাঁহার কী মত তাহা জানিও না। তিনি কেবল বলিয়াছেন স্ত্রীলোকদের নামের সহিত বংশের পদবী যোগ করা, কানেও খারাপ শুনায় বটে আবার তাহাতে পরিচয়েরও কোনো সুবিধা হয় না। সুতরাং,এ প্রথাটি ভালো নয়। শ্রীমতী– যে বলিতেছেন নামের সঙ্গে দেবী দাসীর প্রভেদ থাকা ভালো নয়, সে বিষয়ে আমারও তাঁহার সহিত কোনো বিবাদ নাই, কিন্তু স্ত্রীলোকের নামের সহিত বংশের পদবী যোগ করা যে ভালো এ কথার সহিত পূর্বোক্ত কথাটার বিশেষ যোগ কোথায়। একটা ভালো নয় বটে, কিন্তু আর-একটা যে তাই বলিয়া ভালো তাহা কী করিয়া বলিব! আর শ্রীমতী– যে পরিচয়ের সুবিধার কথাটা একেবারে উড়াইয়া দিয়াছেন, সেটা ভালো করেন নাই। জিজ্ঞাসা করি, নামের সৃষ্টি কিসের জন্য? কেবলমাত্র পরিচয়ের জন্য, উহার আর কোনোই উদ্দেশ্য নাই। যদি সে উদ্দেশ্য উপেক্ষা কর তবে নাম রাখিবার কোনো দরকার নাই। জাতিভেদের উপর আমাদের সমাজ-ব্যবহার অনেকটা নির্ভর করে, সুতরাং সামাজিকতার অনুরোধে দাসী ও দেবীর ভিন্ন পরিচয় পাওয়া আমাদের দেশে নিতান্ত আবশ্যক। যাঁহাদের সে অনুরোধ নাই, যাঁহারা জাতিভেদ মানেন না, তাঁহাদের আর দেবী দাসী বলিয়া পরিচয় দিবার দরকার নাই বটে, কিন্তু তাঁহারা বসু বা বাঁড়ুয্যে বলিয়াই বা পরিচয় দেন কীরূপে? কারণ “বসু’ ব্যক্তিবিশেষগত পরিচয় নয়, পরিবারবিশেষগত পরিচয় নয়, উহা জাতিবিশেষগত পরিচয়। যাঁহারা বলেন “আমি বসু’ তাঁহারা বলেন, “আমি কায়স্থজাতির শ্রেণীবিশেষভুক্ত ব্যক্তি।’ বসু বলিতে আর কিছুই বুঝায় না। সুতরাং সেই তো তাঁহারা জাতিভেদের পরিচয় দিলেন। সেই তো তাঁহারা ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ জাতির প্রভেদ স্বীকার করিলেন। আমাদের দেশের জাতিভেদ শাস্ত্র অনুসারে নির্দিষ্ট অতএব তুমি যদি একবার জাতিভেদ স্বীকার কর, তবে শাস্ত্র অনুসারে ইহাও স্বীকার করিতে হইবে যে, ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ জাতি ও শূদ্র অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট জাতি, এতটা পর্যন্তই যদি হইল তবে আর দেবী দাসী হইতে বেশি দূরে রহিল কই? তোমাদের কাজে ও কথায় মিল করিতে হইলে দেবী দাসীও ছাড়িতে হয়, ঘোষ বোসও ছাড়িতে হয়। হয়, কেবলমাত্র নামের পূর্বার্ধ রাখিয়া দাও, নয় রমণীপরিচয়সূচক এমন একটি নূতন সাধারণ শব্দ প্রচলিত করিয়া নামের শেষে যোগ করো যাহাতে জাতিভেদের অথবা শ্রেষ্ঠ-নিকৃষ্টত্বের কোনো উল্লেখ না থাকে। বোধ করি, মহারাষ্ট্রীয়দিগের “বাই’ শব্দ কতকটা এইরূপ। প্রতিবাদে যতগুলি কথা বলা হইয়াছিল, আমরা তাহার সকলগুলিই আলোচনা করিয়া দেখিলাম, কোনোটিই বোধ করি ছাড়িয়া দিই নাই।
যাহা হউক, যতদূর দেখা গেল, তাহাতে দেবী জ্ঞানদানন্দিনীর অপ্রকৃতিস্থতার কোনো লক্ষণ পাওয়া গেল না, তাঁহার লেখায় হৃদয় প্রকাশ পাইয়াছে, যুক্তিরও অভাব দেখিলাম না, এবং তাঁহার কথার প্রকৃত প্রতিবাদও দেখিলাম না, সুতরাং এখনও তাঁহারই মত প্রবল রহিল।
ভারতী, আশ্বিন, ১২৯০