হায়দার লেনের তেরো নম্বর বাড়ির কফিন বাক্স

হায়দার লেনের তেরো নম্বর বাড়ির কফিন বাক্স

০১.

“তারাপদ, তোমার ফোন।”

মুখ তুলে তাকাল তারাপদ। জয়দেবদার টেবিলে ফোন। ফোনটা তিনি নামিয়ে রেখেছেন একপাশে।

হাতের কাজ সরিয়ে রেখে তারাপদ উঠল। অফিসে তাকে ফোন করার তেমন কেউ নেই। চাঁদু কদাচিৎ করে। চেনাজানা দু-একজন হয়তো। তবে অফিসের ফোন হতে পারে। বি ডি কোম্পানির বা মুখার্জিদের।

তারাপদ নিজের টেবিল ছেড়ে উঠে জানলার দিকে এগিয়ে গিয়ে জয়দেবদার সামনে দাঁড়াল। ফোন তুলে নিল।

“হ্যালো?”

“আমি ফিরেছি।” কিকিরার গলা।

 “ও আপনি! কবে ফিরলেন?”

“গত পরশু সন্ধেবেলায়। কাল আর তোমায় জানাতে পারিনি। ব্যস্ত ছিলাম।”

“কাজ মিটেছে?”

“তা মিটেছে। ওদিকে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। এখানেও দেখছি শুকনো নেই।”

“না। এই তো একটু আগেই এক পশলা হয়ে গেল এদিকেআবার হতে পারে। বর্ষা এসে গিয়েছে…।

কিকিরা শেষের কথাটা শুনতে শুনতেই বললেন, “কাল একবার আসবে। বিকেলেই এসো। শনিবারে তোমার আধবেলা অফিস।”

“কাল একবার মাঠে যাব ভেবেছিলাম। অনেকদিন খেলা দেখিনি। আমাদের টিম নাকি দারুণ শুরু করেছে।”

“রাখো তোমার টিম। ধ্যাড়ানো টিম, তার আবার খেলা! বিকেলেই চলে আসবে। জরুরি খবর আছে।”

তারাপদ ইতস্তত করে বলল, “জরুরি?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। জরুরি। বুঝলে তারাবাবু- ঘনঘোর রহস্য, সাঙ্ঘাতিক মিস্ত্রি, একটা কালো ট্রাঙ্ক, একটা কফিনের বাক্স, আর নস্যির ডিবে। আমি এখন রেখে দিচ্ছি। পারলে চাঁদুকে একবার খবর দিও।”

কিকিরা ফোন ছেড়ে দিলেন।

 তারাপদ কেমন থ’ মেরে গিয়েছিল। দু’মুহূর্ত। তারপর ফোনটা রেখে দিল।

জয়দেবদা বেয়াড়া এক হিসেবের মধ্যে ডুবে আছেন। প্রায় তেরো হাজার টাকার বাড়তি পেমেন্ট হয়ে গিয়েছে। দুর্গাপুরের এক পার্টি টাকাটা মেরে দিয়ে চুপ করে বসে আছে। মাল সাপ্লাই করেনি পুরো, অথচ তার বিল পাস হল কেমন করে? পাঁজাসাহেব খেপে গিয়েছেন। কী হচ্ছে এসব! চোখ বুজে সবাই ঘুমোয় নাকি? মোহিত দত্তকে পাঠিয়ে দিয়েছেন দুর্গাপুরে, এর পর নিজেই হয়তো উকিলবাড়ি ছুটবেন!

তারাপদ নিজের টেবিলে ফিরে এল। এখন যেরকম তোলপাড় চলছে অফিসে, এটা দু’-একদিনের বেশি চলবে বলে তার মনে হয় না। জয়দেবদা পাকা মাথার মানুষ। কাগজপত্র দেখতে দেখতে ভুলটা ঠিক বার করে ফেলবেন।

তারাপদ যে-ঘরে বসে সেটা ছোট। জনা চারেকের বসার ব্যবস্থা। পাশের ঘরটা বড়। সেখানে সাতজন; পিয়ন বেয়ারা সমেত। গোটা অফিসে সব মিলিয়ে জনা বারো স্টাফ। কোম্পানি বড় নয়, ছোট। কারখানা বেলেঘাটায়।

তারাপদর পাশে জানলা নেই। অনাদির দিকে একফালি লম্বাটে জানলা রয়েছে। অন্যমনস্কভাবে সেই দিকেই তাকাল তারাপদ। বাইরে বৃষ্টি নেই, কিন্তু পড়ন্ত দুপুর বেশ মেঘলা হয়ে আছে। বৃষ্টি আবার আসতে পারে, নাও পারে। সবেই বর্ষা পড়েছে। আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি চলছে বোধ হয়। জুলাই শুরু হল।

কিকিরা যে কী বললেন তারাপদর মাথায় ঢুকছিল না। কালো ট্রাঙ্ক, কফিনের বাক্স, নস্যির ডিবে– মানেটা কী? উনি কি রসিকতা করলেন! করতেও পারেন। আসলে কিকিরা দিন চারেকের জন্যে রানিগঞ্জ গিয়েছিলেন। ওঁর নিজের কেউ নেই কোথাও, তবে দূর সম্পর্কের জ্ঞাতিগোষ্ঠী দু-একজন আছে, পুরনো বন্ধুবান্ধবদের কেউ। এক বন্ধু মারা গিয়েছেন সদ্য। তাঁর শ্রাদ্ধশান্তি ছিল। বন্ধুর ছেলে চিঠি লিখেছিলেন একবার যদি যেতে পারেন কাকাবাবু। কিকিরা মানুষটির মায়ামমতা সামাজিক কর্তব্যবোধ যথেষ্ট। তিনি না গিয়ে কি পারেন! যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলেন তারাপদদের।

কিন্তু ফিরে এসেই কালো বাক্স আর কফিনের গল্প ফাঁদলেন কেন? অযথা, না কি নিছকই তারাপদকে তলব করার ছুতো! কে জানে!

কালই তবে তারাপদকে কিকিরার বাড়ি যেতে হবে? এটা ঠিকই যে, তারাপদ ফুটবল খেলা নিয়ে মাতামাতি করে না। সে ফুটবল-পাগল নয়। তার নিজের কোনও দলও নেই। তবে তারাপদ যে বোর্ডিং হাউস বা হোটেলে থাকে সেখানে কানু বলে একটা ছেলে থাকে, কানাই পাল। কানু চাকরি করে জাদুঘরে। আর ফুটবল খেলে বি ডিভিশন লিগে। তার ক্লাব ইয়াং স্পোর্টিং। কানুর পাল্লায় পড়ে তারাপদকে ইয়াং স্পোর্টিংয়ের মেম্বার হতে হয়েছে। মাঝেসাঝে মাঠেও যেতে হয় কানুর তাগাদায়। কালকের খেলাটা নাকি ইজ্জতের খেলা ছিল কানুদের, মাঠে যাব বলেছিল তারাপদ। কী আর করা যাবে, যাওয়া হবে না। পরে কানুকে কিছু একটা বলে সামাল দিতে হবে। কানু ছেলেটা ভাল। চেহারাও শক্তসমর্থ। রোজ সকালে আধ বাটি ভিজে ছোলা আর ভিজিয়ে রাখা চিনেবাদাম খায়। বোর্ডিংয়ের ছাদে গিয়ে উনবৈঠক মারে সকালে।

যাকগে, কাল বিকেলে তা হলে তাকে কিকিরার বাড়ি যেতেই হচ্ছে। যাবে। তবে চাঁদুকে পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। চাঁদু এখন খানিকটা ঝামেলায় রয়েছে। তার বদলির হুকুম হয়েছে অন্য হাসপাতালে। কোয়ার্টারও পাবে। চাঁদু চেষ্টা করছে আরও অন্তত একটা বছর তার পুরনো হাসপাতালে থাকার। হয়তো তার ধরাধরি কাজে দেবে না। তবু চেষ্টা!

খানিকটা সময় অন্যমনস্ক থাকার পর তারাপদ আবার কাজে মন বসাতে চেষ্টা করল। পারল না। কিকিরা আবার কী নতুন উৎপাত জুটিয়ে নিয়েছেন কে জানে!

.

চন্দনকে পাওয়া গেল।

 “কী রে! বৃষ্টিতে ভিজলি?”

“দু’-চার ফোঁটা!” তারাপদ রুমালে মুখ মাথা মুছতে মুছতে বল। “তোর কী অবস্থা? হবে কিছু?”

“না। আমার বসকে বললাম, সার এখানে থাকলে একটু পড়াশোনা করতে পারতাম। যেখানে ঠেলে দিচ্ছে আর বোধ হয় হবে না।”

“কী বললেন?”

“হাসলেন। বললেন, বাবা ওপরঅলার মরজি, আমি আর কী করব! তবু তো দু’-একজনকে বলেছিলুম। চান্স দেখছি না।”

“তুই বেকার ঘাবড়াচ্ছিস! যেখানেই যাস তোর কাজ তো একই।”

“পুরনো হাসপাতালের একটা মায়া থাকে রে, তারা। তা ছাড়া সবাই চেনা, ফেসিলিটি ছিল অনেক। নতুন জায়গায় বনিবনা কেমন হবে কে জানে।… ছেড়ে দে, যা হওয়ার হবে। চা আনতে বলি।”

“বল।”

চা আনতে বলে চন্দন একবার অকারণে দেওয়ালে টাঙানো আয়নার সামনে দাঁড়াল। নিজের মুখ দেখল। গালে হাত বুলিয়ে নিল। ফিরে এসে বিছানায় বসল আবার। “তোর খবর কী?”

“দুপুরে অফিসে কিকিরার ফোন।”

 চন্দন তাকিয়ে থাকল। “কিকিরা ফিরেছেন?”

“গত পরশু। ফিরেই আজ বললেন, ঘনঘোর না ঘনঘটা রহস্য : কালো বাক্স– ট্রাঙ্ক, কফিনের বাক্স, আর নস্যির ডিবে। ভয়ঙ্কর মিস্ত্রি!”

চন্দন কিছুই বুঝল না। বন্ধুর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। পাতা পড়ল না  চোখের। “মানে?”

“জানি না।”

“কিকিরা তো রানিগঞ্জ গিয়েছিলেন। মিস্ট্রিটা এল কেমন করে?”

“ভগবান জানেন।”

“উনি কি রানিগঞ্জ থেকে মিষ্ট্রি বয়ে এনেছেন?”

“আমি ভাই কিছুই জানি না। যা বললেন বললাম তোকে।”

চন্দন মাথা নাড়ল, বিশ্বাস করল না। “কিকিরার জোক। ঠাট্টা।”

“কে জানে! কাল যেতে বলেছেন, অবশ্য করেই। তোকেও খবরটা দিতে বলেছেন।”

“আমার হবে না। কাল আমি একটা সেমিনারে যাব।”

“কখন?”

“বিকেলে।”

“ফিরবি কখন?”

“তার কি ঠিক আছে! রাত আটটা ন’টা হতে পারে। দু’জন ফিজিশিয়ান আসছেন বাইরে থেকে; চেস্ট স্পেশালিস্ট ফেমাস ডক্টরস। একজন আলিগড় থেকে, আর একজন মাদ্রাজ থেকে।”

তারাপদর খেয়াল হল, বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে গিয়েছে। শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এই বৃষ্টির যা তোড়, কম করেও আধ ঘণ্টা চলবে।

“আমাকে একলাই যেতে হবে, তারাপদ বলল।

 “চলে যা।”

“যাব। কিন্তু কিকিরাকে নিয়ে আর পারা যাচ্ছে না।”

“কেন?”

“ধ্যুত! যে যা পারছে এনে ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে; আর উনিও ঝাটগুলো মাথা পেতে নিয়ে নিচ্ছেন। কী দরকার!”

চন্দন হাসল। বলল, “পরোপকার। আজকাল আবার নেশাও ধরে গিয়েছে।”

“এই নেশাই একদিন ওঁকে বিপদে ফেলবে।”

.

০২.

কিকিরা যে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন, তারাপদ বুঝতে পারল না।

বগলাও কাছে নেই। সদর দরজা খুলে দিয়ে নীচে গিয়েছে কী যেন আনতে। মুহূর্ত কয়েক দাঁড়িয়ে থেকে তারাপদ কিকিরার বসার ঘরে ঢুকল।

“এই যে, এসো!” কিকিরা ডাকলেন। সঙ্গে সঙ্গে হাঁচি। বার পাঁচ-সাত। মাঝের একটা হাঁচি এমন বিকট শোনাল, মনে হল রোগাসোগা মানুষটির নাকচোখের শিরাই না ছিঁড়ে যায়! হাতে রুমাল ছিল কিকিরার। নাক-মুখ মুছলেন।

তারাপদ কিকিরাকে নজর করে দেখল। চোখ লালচে, ছলছল করছে, মুখও সামান্য ফোলা দেখাচ্ছিল। মানে, সদ্য বর্ষায় ভিজে কাঁচা সর্দি ঝামরেছে ওঁর।

অন্য লোকটিকেও নজর করল তারাপদ। মুখ দেখলেই বোঝা যায়, চিনেপাড়ার লোক। পুরোপুরি না হলেও আধাআধি চাইনিজ তো হবেই। মাথার অর্ধেকই যেন টাক, পাতলা চুল, গোল থ্যাবড়ানো মুখ, ছোট ছোট চোখ, ভোঁতা নাক; গায়ের রং খানিকটা হলদেটে। বয়েস কমপক্ষেও বছর পঁয়ত্রিশ চল্লিশও হতে পারে। বোঝা মুশকিল। পরনে প্যান্ট, গায়ে বুশ শার্ট।

কিকিরা বললেন, “এসো তারা, আলাপ করিয়ে দিই। এই জেন্টেলম্যানের গোটা তিনেক নাম। আমরা জ্যাকি বলে ডাকি। জ্যাকি সুঙ।” বলে তারাপদর দিকে আঙুল তুলে দেখালেন জ্যাকিকে, “তারাপদ। মাই পার্টনার।”

জ্যাকি মাথা নুইয়ে সম্ভাষণ জানাল তারাপদকে।

তারাপদ তখনও বোকার মতন দাঁড়িয়ে। বুঝতে পারছে না–জ্যাকি কে? আর কেনই বা তার আবির্ভাব?

কিকিরা রুমালে নাক মুছলেন আবার। হাসি হাসি ভাব করে বললেন, “জ্যাকি নাইনটি ফাইভ পার্সেন্ট বাংলা বোঝে। বলতেও পারে। টেরেটি, বউবাজার, ধর্মতলা করে ওর দিন কেটেছে। কাকার জুতোর দোকান বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে। দু-তিন জেনারেশান এখানে। ওয়েলেসলিতে জ্যাকির দাঁত তোলার চেম্বার। না না, পাশ করা ডেন্টিস্ট নয়, তবে ওটা ওদের ফ্যামিলি প্রফেশান। বাবা ফটাফট দাঁত তুলতেন। হুট করে বাবা মারা গেলে মায়েরও পেশা হল দাঁত তোলা। এখন জ্যাকি।” কিকিরা আবার হাঁচলেন। নাক পরিষ্কার করলেন রুমালে। মজার গলা করেই বললেন, “এদের স্পেশালিটি কী জানেনা, তারাপদ? পেশেন্টকে নিয়ে ঠুক ঠুক করবে না। যদি দাঁত তোলাতে চাও, একটা গুলি আগে, একবার কুলকুচো, তারপরই এক টান। ব্যস। সাফ। রাত্রে আর-একটা গুলি। কী জ্যাকি–আমি রাইট?”

জ্যাকি হাসল। তারাপদ দেখল, জ্যাকির সামনের একটা দাঁতের ডগায় সোনা সামান্য; যেন পিন করে বাঁধানো। বাদামি রং দাঁতের।

তারাপদর মনে হল, ওই সোনা-বাঁধানো দাঁতটা বোধ হয় বিজ্ঞাপন। জ্যাকি নিশ্চয় সোনা দিয়ে দাঁত বাঁধাতে পারে। সে শুনেছে, চিনে ডেন্টিস্টরা এ-ব্যাপারে এক্সপার্ট।

নিজের দাঁতের ওপর আলগা জিব বুলিয়ে নিল তারাপদ অকারণেই। এবার বসল একপাশে।

জ্যাকি এবার উঠবে। বলল, “টাইম হয়ে গেল; আমি চলি অ্যাঙ্কল।” জ্যাকির উচ্চারণে খানিকটা গোলমাল রয়েছে, হয়ে গেল’ ‘হোয়ে’’গ্যালো’ শোনাল।

কিকিরা ঘাড় হেলালেন। “এসো।”

“নেক্সট কবে মিট হবে?” জ্যাকির কথা বলার ধরনই বোধ হয় এরকম।

 “আমি যাব। খবর পাবে। তোমায় ভাবতে হবে না।”

জ্যাকি আবার একবার তার হাতঘড়ি দেখল। সোনালি চেন ব্যান্ড। উঠে পড়ল। তারাপদের দিকে এগিয়ে দু’হাতে তার হাত ধরল একবার। হাসল। তারপর এগিয়ে গিয়ে ঘরের কোণ থেকে তার ওয়াটার প্রুফ আর মাথার হেলমেট উঠিয়ে নিয়ে হাত নাড়ল।

চলে গেল জ্যাকি।

 তারাপদ কয়েক পলক তাকিয়ে থাকল দরজার দিকে। মনে পড়ল, বাড়ির নীচে একটা স্কুটার দেখেছিল সে। ওটা তবে ওই লোকটির। কিকিরার দিকে চোখ ফেরাল তারাপদ। “এটিকে কোত্থেকে জোগাড় করলেন?”

“বাতিটা জ্বেলে দাও। ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে। বাইরে…”

তারাপদ উঠে পড়ল। বাতি জ্বালাল। বাইরের জমা মেঘ বোধ হয় ঘন হয়ে এসেছে। বাদলার গন্ধ। বৃষ্টি আসতে পারে।

“কটা বাজল হে?”

“সাড়ে পাঁচ।”

“চাঁদু?”

“আসতে পারবে না। সেমিনারে গিয়েছে।”

 বগলা ফিরে এসেছে খানিকটা আগেই, তার নড়াচড়া, কাজকর্মের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। বাতি জ্বেলে দিয়ে এসে তারাপদ বসল। বলল, “বললেন না?”

“তুমি জ্যাকির কথা বলছ? জ্যাকি আমার ওল্ড নেফু, আমায় অ্যাঙ্কল বলে। চাচা ভাতিজা আর কী! ওর বাবা আমার দুটো দাঁত তুলেছিল। কী হাত! ম্যাজিক হ্যান্ড। বন্ধুত্ব হয়েছিল। হুট করে মরে গেল বেচারি। একটু সন্দেহ আছে মরা নিয়ে। জ্যাকি তখন দুরন্ত ছোকরা। বাপের ধমকানিতে মাঝে মাঝে বাবার চেম্বারের পাশের ঘরে বসে দাঁত-বাঁধানোর কাজ শেখে। জ্যাকির মা গত যুদ্ধের সময় অনেকের সঙ্গে বর্মা থেকে পালিয়ে আসে। বয়েস কম। এখানেই থাকত, চিনেপাড়ায়। পরে বিয়ে হয়। স্বামীর কাছে হাতেখড়ি দাঁত-তোলার কাজে। তা ছাড়া টেলারিংও করত। এখন বুড়ি। অথর্ব।”

“আপনি সার ধান ভানতে শিবের গীত গাইছেন!”

“না হে! একটু আধটু জানিয়ে রাখছি। তোমরা তো হালের ছোকরা, অনেক কিছুই দেখোনি। আমিও যে সব দেখেছি, তাও নয়, তবু তোমাদের চেয়ে বেশি দেখেছি। কলকাতায় আমার পঁচিশ তিরিশ বছর থাকা হল। চোখে যা দেখেছি তাই বা তোমরা দেখলে কোথায়! শুনেছি আরও বেশি। যেমন ধরো, কলকাতা শহরের এই বউবাজার পাড়া, ধর্মতলা স্ট্রিট, কিড় স্ট্রিট-একসময় চাইনিজ মানে চিনে দাঁতের ডাক্তারদের বিস্তর পসার ছিল। ওটা ওদের বংশগত ব্যাপার। প্রফেশনাল হেরিটেজ বলতে ওদের ওই দাঁত তোলা, বাঁধানো, জুতোর দোকান, রেস্তোরাঁ, কার্পেন্টারি…!” কিকিরা আবার হাঁচলেন। সামান্য বিরক্ত যেন। “বর্ষার মুখে ভেজা খুব খারাপ, বুঝলে তারা। আর বয়েসও তো হচ্ছে। যা বলছিলাম, পাঞ্জাবিদের ছেলেগুলো গোঁফ ওঠার আগেই গাড়ির স্টিয়ারিং ধরতে শিখে যায়, বড়বাজারে গিয়ে দেখবে–ষোলো সতেরোও বয়েস হয়নি, ছেলেগুলো বাপের গদির পাশে ঘুরঘুর করছে। ফ্যামিলি ট্রাডিশন আর কী! চিনেদের দাঁত তোলার ব্যাপারটাও সেইরকম। আগে ভালই ছিল ওদের এই পেশাটা। এখন কমে গিয়েছে। তবে আছে..।”

“জ্যাকি কি আপনার মক্কেল, না, শুধুই ভাইপো?” তারাপদ ঠাট্টা করে বলল।

 “দুই-ই।”

“মানে?”

“জ্যাকি বিপদে পড়েছে হে!…ওর মা এখন বুড়ি। তার ওপর একটা পা আর নাড়তে পারে না। কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত অসাড়।”

“কেন?”

“ওটা ডাক্তারি শাস্ত্র। আমি বলতে পারব না। চাঁদু যদি বলতে পারে। তবে তার দ্বারাও হবে বলে মনে হয় না। অনেক ডাক্তারই তো দেখেছে, যে যার মতন হাতও লাগিয়েছে, কিস্যু হয়নি।”

“ও! মহিলার বয়েস কত?”

“যাটের ওপর নিশ্চয়।…একটা কথা তোমায় বললাম না! জ্যাকির মা যখন বর্মা মুলুক ছেড়ে পালিয়ে আসে তখন সেকেন্ড ওয়ার্লড ওয়ার চলছে। অনেক লোকই পালিয়ে আসছিল, ইন্ডিয়ানরা তো বটেই, অন্যরাও। প্রচণ্ড কষ্ট করে এসেছিল তারা, কত যে হাঁটতে হয়েছে বনজঙ্গল পাহাড় পেরিয়ে। নানান রোগ হয়েছে। পথে, ইনজুরি হয়েছে, বিষাক্ত পোকামাকড়ের কামড়, ঘা, রক্তপাত…। তা সে সময় শিরদাঁড়ার তলার দিকে জোর চোট পেয়েছিল। জ্যাকির মাকে আমি যখন দেখেছি, মহিলা সামান্য খোঁড়াত। এখন বয়েস হয়েছে। পুরনো জখমের জের কিনা বলতে পারব না। দু-একজন সেরকমই বলে।…আমার সঙ্গে জ্যাকির বাবার আলাপ হয় বছর বারো-চোদ্দ আগে। পরে খাতির। ওর মুখেই সব শুনেছি।”

তারাপদ অন্য কথা ভাবছিল। বলল, “যাক গে, অনেক হিস্ট্রি শোনালেন। এবার আসল কথা বলুন তো?”

“আসল, মানে তুমি বলতে চাইছ-”

“হ্যাঁ সার! আমি বলতে চাইছি–কালো বড় ট্রাঙ্ক, খালি কফিনের বাক্স, নস্যির ডিবে…মিস্ট্রিটা কী?”

“ভয়ঙ্কর মিস্ত্রি, অতীব রহস্যময় ঘটনা…” কিকিরা বললেন, চোখ বড় বড় করে। আবার হাঁচি। বার পাঁচেক কম করেও। গলা ধরে এসেছে তাঁর।

বগলা যেন সময় বুঝে চা এনে দিল।

 কিকিরার হাতে চায়ের মগ এগিয়ে দিয়ে বগলা বলল, “আদার রস দেওয়া আছে।”

“বেশি করে দিয়েছ?”

“দিয়েছি।” জবাবটা এমনভাবে দেওয়া, যেন কিকিরার অযথা মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই, যেমন দেওয়ার বগলা দিয়েছে।

তারাপদ চায়ে চুমুক দিল।

 কিকিরা বললেন, “বুঝলে তারাবাবু, আমার টোটকা হল, চায়ের লিকার, উইথ জিনজার রস, স্লাইট নুন, পারলে দুটুকরো বচ ফেলে দাও, সর্দি গন। বচ অবশ্য পায়নি বগলা, লবঙ্গ ফেলে দিয়েছে।” বলে গরম চায়ে চুমুক দিলেন তিনি।

“ভাল টোটকা,” তারাপদ বলল, “বৃষ্টিতে ভিজেছেন নাকি?”

“রানিগঞ্জে ভিজেছিলাম। তার ওপর কাল জ্যাকির পাল্লায় পড়ে ওর কেনা বাড়িটা দেখতে গিয়ে একরাশ ধুলো নোংরা নাকে ঢুকল। সে কী বাড়ি হে, আমার মনে হয়, পাঁচ-দশ বছরেও সেখানে মানুষের পা পড়েনি। হাঁটু ডুবে যায় ধুলোয় ময়লায়, মাকড়সার জাল, ধেড়ে ইঁদুর, ছুঁচো, আরশোলা, পায়রার নোংরা– হোয়াট নট?”

তারাপদ একটা আন্দাজ করল। “জ্যাকির বাড়ি দেখে আসার পর আপনি আমায় ফোন করেছিলেন?”

“রাইট।”

“আপনার অতীব রহস্যময় ঘটনাটা তা হলে জ্যাকির বাড়িতে দেখেছেন?”

“বিলকুল ঠিক। ধরেছ ঠিকই। তবে পদার্থগুলো এখনও চোখে দেখা হয়নি। শুনেছি।”

তারাপদ শব্দ শুনতে পেল। বৃষ্টি নামল। বাইরের দিকে জানলার শার্সি বন্ধ। জলের ছাট আসবে না। চা খেতে খেতে দু’ পলক জানলাটা দেখে নিল সে।

হঠাৎ বলল, “আপনি বলছেন, জ্যাকির কেনা বাড়ি। আবার বলছেন, সে বাড়িতে মানুষের পা পড়েনি অনেককাল। একটু ধরিয়ে দিন, সার; মাথায় ঢুকছে না। তা ছাড়া আপনার মক্কেলের নাম জ্যাকি হল কেন? লি, সিন, ফু… এই রকম একটা কিছু হওয়া উচিত ছিল। নয় কী? চিনে নাম…!”

কিকিরা দু’ চুমুক চা নিয়ে যেন গলায় গরমটা লাগিয়ে নিচ্ছিলেন। ঢোঁক গিললেন। তারপর বললেন, “আরে ওরা দু-তিন পুরুষ কলকাতায়, নাম নিয়ে অত ধরাকাটা করেনি। তোমরা করো? বাঙালি ছেলের ডাকনাম ডন, টিটো, যিশু হয় না? মেয়েদের নাম আইভি, লিলি, রুবি শোনোনি। নামে কী আসে যায়।… তবে জ্যাকিরা চিনে হলেও অ্যাংলো পাড়ার গায়ে মানুষ তো, ওই নামটা নিয়ে নিয়েছে। মাইন্ড দ্যাট ওর মা বার্মিজ, বার্মিজ খ্রিশ্চান।”

তারাপদ চায়ের কাপ নামিয়ে পকেটে হাত ডোবাল, একটা সিগারেট খাবে।

সিগারেট ধরিয়ে চায়ের কাপ আবার উঠিয়ে নিল। “জ্যাকিরা নতুন বাড়ি কিনেছে?”

“ইয়েস। হায়দার লেনে। জায়গাটা তোমার ম্যাপে নেই। কর্পোরেশনের খাতায় কী নাম আছে জানি না। ওটা তোমার ওয়েলেসলি পাড়ার মধ্যে পড়ত একসময়। ওখানে তুমি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, চাইনিজ, দু’-চার ঘর গুজরাটি মুসলিম, মায় সাউথ ইন্ডিয়ানও পেয়ে যেতে পারো–কেরেলিয়ান। পাঁচমেশালি পাড়া হলেও অ্যাংলো ঘরানা, মেইনলি; আর চাইনিজ।”

“এখন কোথায় থাকে জ্যাকিরা?”

“জ্যোতি সিনেমার পেছন দিকে…?”

“নতুন বাড়ি হালে কিনেছে?”

“জাস্ট এ মান্থ! এখনও পুরোপুরি কেনা হয়নি, কাগজপত্র তৈরি হয়নি বিক্রিবাটার, কাজ এগুচ্ছে। এর মধ্যে অনেক টাকা অ্যাডভান্স করেছে জ্যাকি…”

“কত টাকা?”

“লাখখানেক।”

“লা-খ!”

“চমকাবার কিছু নেই তারাবাবু। লাখ দু’ লাখ আজকের বাজারে কিছুই নয়। কলকাতায় লাখ টাকায় ফুটপাথের দু হাত জায়গা পাওয়া যায় না।” কিকিরার আবার হাঁচি হল। জোরেই। সামলে নিতে সময় লাগল সামান্য। চা খেয়ে গলা ভিজিয়ে টাগরায় শব্দ করলেন। বললেন, “জ্যাকি যে বাড়িটা কিনেছে সেটা মান্ধাতা আমলের হলেও, ওই বাড়ির দাম কম করেও এখন আট-দশ হতে পারত। হয়নি, কারণ বাড়িটা নিয়ে টানা মামলা-মোকদ্দমার পরও তার মালিকানা নিয়ে একটা গণ্ডগোল আছে। মর্টগেজ করা প্রপার্টি ছিল। শরিকও। যাই হোক, ঝামেলার সম্পত্তি বলে কম দামে হাতে পেয়ে গিয়েছিল জ্যাকি।”

“ঝামেলার প্রপার্টি কিনল কেন?”

“বললাম যে, কম দামে পাচ্ছে…। তা ছাড়া এসব প্রপার্টি মামলা-দেওয়ানি মামলা ক’ পুরুষ ধরে চলে কেউ বলতে পারেনা। এমন লোক বহু আছে এ শহরে, যারা ডিসপিউটেড প্রপার্টি কেনার জন্যে তক্কে তক্কে থাকে। মানে সস্তায় কিনে রাখে, তারপর দশ বিশ বছর মামলা লড়ে দশগুণ দামে সেটা বেচে দেয়।” কিকিরা তারিয়ে তারিয়ে চা খেতে লাগলেন।

তারাপদ বলল, “জ্যাকি দাঁও মারার জন্যে কিনেছে বাড়িটা?”

“খানিকটা তো বটেই। জলের দরে হাতে পেলে কে ছাড়ে। তবে সস্তা বলে শুধু নয়, জ্যাকি ভাবছিল, বাড়িটা সারিয়েসুরিয়ে নতুন করে নিয়ে ওই বাড়িতে মা আর ভাইকে নিয়ে থাকবে। ভবিষ্যতে চেম্বারও করতে পারে। কাছাকাছি।”

“আপনি তো বাড়িটা দেখেছেন বললেন? কেমন বাড়ি?”

“কাল দেখতে গিয়েছিলাম। অনেক পুরনো বাড়ি। মাথার ছাদ ধসে পড়তে পারে, দেওয়াল হেলে পড়ার অবস্থা, চুন বালি খসে গিয়েছে, কাঠের সিঁড়িতে ধপধপ শব্দ হয়। বাড়ির ধাঁচটা হল সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতন। না দেখলে বুঝতে পারবে না।”

“তো এই বাড়িতে মিস্ট্রিটা কোথায় দেখলেন?”

“দেখার সুযোগ হয়নি; শুনেছি। দোতলা থেকে তেতলার ছাদে যাওয়ার সময় ডান দিকের একটা ঘরে। ঘরটা নাকি বাইরে থেকে বন্ধ ছিল। দরজার কড়ায় তালা তো ঝুলছিলই, তা ছাড়া দুটো কাঠের তক্তা দরজার মাথা থেকে তলা পর্যন্ত ক্রস-এর মতন করে বসিয়ে বাইরে থেকে লম্বা লম্বা পেরেক ঠুকে আটকানো ছিল।”

“বাইরে থেকে ক্রস…?”

“হ্যাঁ। শুনেছি, এককালে বিদেশে যখন প্লেগ এপিডেমিক হয়ে দেখা দিত, লোকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাত, এইভাবে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করা থাকত। দেখলেই ধরে নিতে হত, ওই বাড়িতে প্লেগ হানা দিয়ে দু’-একটাকে সাবাড় করে গিয়েছে।”

তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “ওই ঘরের দরজা আপনি খুলেছিলেন?”

“আমি কেন খুলব! জ্যাকি নিজেই বাড়িতে ঢোকার পর ব্যাপারটা দেখে মিস্ত্রি-মজুর এনে ঘর খুলিয়েছিল। খুলে ওই দৃশ্য দেখে, কালো ট্রাঙ্ক, কফিনের বাক্স, আর একটা নস্যির ডিবে দেখেই মাথায় চক্কর মেরে যায়।”

তারাপদ এবার রীতিমতন কৌতূহল বোধ করল। তার চা শেষ হয়েছে। কাপটা নামিয়ে রাখল। “তারপর?”

“জ্যাকি বিপদে পড়ে গেল। এসব আবার কী! তার মাকে বলল, ভাইকে। মা ভয় পেয়ে বলল, ও বাড়ি ছেড়ে দাও। ওখানে পা দিলে কী অমঙ্গল ঘটবে কে জানে! বুড়ি মানুষ, কম দুঃখশোক পায়নি। ভয় পাওয়া স্বাভাবিক।”

“আর ভাই?”

“ভাইটা ছোকরা। ট্যানারিতে কাজ করে, আর বক্সিং লড়ে বেড়ায়, চক্কর মারে স্কুটার নিয়ে। ভাই বলল, টান মেরে সব বাইরে ফেলে দেবে। কিন্তু জ্যাকির কাকা বুড়ো মানুষ। তার জুতোর দোকান বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে। হুন বলে ডাকে লোকে। সে বলল- ওসব কাজ কোরো না বাছা। শয়তানের সঙ্গে লড়া যায় না।”

মাথা চুলকে তারাপদ বলল, “ইভিল?”

“হ্যাঁ।”

“তা আপনি হঠাৎ জ্যাকিকে পেলেন কোথায়?”

“আরে, আমি আর কোথায় পাব! জ্যাকি নিজেই এল। আমি তখন রানিগঞ্জ যাচ্ছি, মুকুন্দর কাজ। আমি বললাম, এখন তো আমি কলকাতার বাইরে যাচ্ছি। ফিরতে ফিরতে দিন চার-পাঁচ। চার দিন পরে তুমি এসো, ভাল করে শুনব। এখন তুমি যতটা পারো ঘরদোর সাফ করাও।”  

“ও! জ্যাকি আবার এল কবে?”

“কাল সকালেই। বগলা বলল, আগের দিন মানে সকালে এসেও খোঁজ নিয়ে গিয়েছে।”

“কালই আপনি গেলেন জ্যাকির সঙ্গে?”

“গেলাম। বাড়িটা দেখলাম বাইরে বাইরে।”

“কী মনে হল?”

“ঝট করে বলতে পারছি না। তবে ব্যাপারটা মিস্টিরিয়াস, ঘোরতর রহস্য রয়েছে। আমি যেটুকু শুনেছি জ্যাকির মুখে ও-রকম বড় সাইজের হাত তিন-সাড়ে তিনের কালো ট্রাঙ্ক আজকাল বাজারে ঝট করে পাওয়া যায় না। অর্ডার দিতে হয় বোধ হয়। আগে এ ধরনের ট্র্যাভেলিং ট্রাঙ্ক আমি দেখেছি। তবে এমন ট্রাঙ্ক হয় এখনও; স্পেশ্যাল কাজে লাগে। খবর নিয়ে বলতে হবে। জ্যাকি বলল, ট্রাঙ্কের রং বোঝাই মুশকিল। চার পুরু ধুলো জমেছে। কফিনের বাক্সটা মামুলি নয়, মাঝারি, তবে কাঠে ঘুণ ধরেছে। আর নস্যির ডিবে! অদ্ভুত।”

তারাপদ সামান্য চুপ করে থেকে বলল, “জ্যাকি যার কাছ থেকে বাড়ি কিনেছে– সে কী বলে?”

“সে বলে, বন্ধ ঘরের মধ্যে কী ছিল সে জানে না। ঘরটাই সে খোলেনি কোনওদিন।”

তারাপদ চুপ করে গেল।

.

০৩.

দিন দুই পরের কথা। কিকিরার সঙ্গে বাড়িটা দেখতে এসেছিল তারাপদরা। আসার আগেই তারাপদ ঠাট্টা করে চন্দনকে বলেছিল, কিকিরার মাথায় আবার ভূত ভর করেছে রে!

চন্দন আজ সঙ্গেই ছিল। দুপুরে আরাম করে ঘুম দিচ্ছিল নিজের কোয়ার্টারে। আজ সে ছুটি নিয়েছে আগে আগে। তারাপদ এসে ঠেলা মেরে তুলল। বলল, “কিকিরার তলব, তাঁর বাড়িতে যেতে হবে, সেখান থেকে হায়দার লেন, মানে কিকিরার নতুন মক্কেলের বাড়িতে।”

চন্দন আরও খানিকক্ষণ ঘুমোবার তালে ছিল। কিকিরার বাড়িতে সে যেত, তবে তার ইচ্ছে ছিল সন্ধে নাগাদ যাবে।

তারাপদ বলল, বিকেল বিকেল না গেলে বাড়ি দেখা যাবে না। ও বাড়ির ইলেকট্রিক লাইন অকেজো। তার কাটা, কানেকশান নেই। অন্ধকার হয়ে গেলে সিঁড়িতে পা ফেলাও যাবে না, তার ওপর যদি বৃষ্টি এসে যায় সবই বৃথা যাবে।

অগত্যা চন্দনকে উঠতে হল।

 কিকিরার বাড়ি আসার পথে তারাপদ মোটামুটি জ্যাকিকাহিনী শুনিয়ে দিয়েছিল চন্দনকে।

চন্দন বলল, “বোগাস। ফালতু কেস। বাড়ি কেনা নিয়ে কে কাকে ঠকাচ্ছে, কার মাথায় কীসের ফন্দি রয়েছে তা জেনে আমাদের লাভ কী! এসব কোর্টকাছারির ব্যাপার, আমাদের নাচবার মানে হয় না। কিকিরার ব্যাপারটা হল, নেই কাজ তো খই ভাজ। যত্ত বাজে ব্যাপার।”

“কিকিরাকে বলিস।”

বৃষ্টি হল না। আকাশ মেঘলাই। বাদলা বাতাসের দমকাও নেই। মোটামুটি আরামই লাগছিল।

কিকিরা তৈরি ছিলেন।

ঘড়িতে সোয়া চার। চন্দনের সঙ্গে দু-চারটে কথা বলেই বেরিয়ে পড়লেন। কাঁচা সর্দির ভাবটা আজ কম। গলা অবশ্য ভারী। মাঝে মাঝে কাশি আসছিল।

চন্দন বলল, “ওষুধ খেয়েছেন?”

“টোটকা। রাত্রে ফুটবাথও নিয়েছি।”

“আপনার উচিত ছিল হেড বাথ নেওয়া।”

“ঠাট্টা করছ! কেন আমার হেডটা কি ফেলনা।” ‘না, কে বলল! আপনার হেড হাজারে এক।”

“শাস্ত্র পড়েছ! পড়োনি! কোত্থেকে পড়বে। আজকের ছেলেছোকরা, বাপ ঠাকুরদার কথাবার্তাই কানে তুলতে চায় না তো শাস্ত্র! আমাদের শাস্ত্রে মাথাকে বলেছে গুণসমনিত্বম অঙ্গ।”

“আপনার শাস্ত্র থাক, সার। শাস্ত্রই আপনার মাথার বারোটা বাজাবে। নিন যেখানে নিয়ে যাচ্ছেন সেখানেই চলুন।”

.

হায়দার লেনের আগে ট্রাম থেকে নেমে পড়লেন কিকিরা। চন্দনরাও নামল। এইসব অঞ্চলে চন্দন তারাপদর ঘোরাফেরা প্রায় নেই বললেও চলে। মাঝ কলকাতার বাঙালি পাড়ার ছাঁদছিরি চোখে পড়ে না এখানে, তবে পুরনো এলাকা নিশ্চয়ই। বাড়িগুলো বিবর্ণ। বৃষ্টিতে জলে স্যাঁতসেঁতে। কোনওটার চেহারা খাঁচার মতন, কোনওটার বা সামনে গাড়িবারান্দার মতন ছাদ আছে। দোতলায় কাঠের জাফরি-করা সান-শেড, ভেঙেচুরে গিয়েছে। বারান্দায় লোহার শিক আঁটা রেলিং। সেকেলে নকশা করা রেলিংও আছে দু’-একটা বাড়িতে, তবে ভাঙাচোরা। বারান্দায় জানলায় কাপড়-জামা ঝুলছে, শুকোতে দেওয়া, প্যান্ট শার্ট ফ্রক থেকে শুরু করে লুঙ্গি পর্যন্ত। বাড়িগুলো বেশিরভাগই দোতলা বা তেতলা। গায়ে গায়ে ঠেস দেওয়া। চাপাচাপির একটা গন্ধ রয়েছে বাতাসে। পাখির খাঁচাও চোখে পড়ল চন্দনের। রাস্তাও অপরিষ্কার।

তারাপদ বলল, “যা বাব্বা, এখানে বোরখাও ঝুলছে?”

 চন্দন বলল, “শুঁটকি মাছের গন্ধ পাচ্ছিস না?”

তারাপদ নাক টানল। বলল, “এতরকম গন্ধ পাচ্ছি। কোনটা শুঁটকির আর কোনটা পচা ডিমভাজার, বুঝতে পারছি না।”

রাস্তার গায়ে দু-একটা দোকান। মামুলি। খদ্দের চোখে পড়ছে না তেমন।

বড় রাস্তার পাশ দিয়ে একটা গলিতে ঢুকলেন কিকিরা।

সরু গলি। দুটো লোক পাশাপাশি হেঁটে গেলে তৃতীয়জনের জায়গা থাকে না।

গলিতে এখন ছায়া। মেঘলার দরুন আরও ঘন হয়েছে ছায়া।

 “এই আপনার হায়দার লেন?” চন্দন বলল কিকিরাকে।

 “হ্যাঁ। এই গলির এটা পেছনের দিক। ওপাশ দিয়ে ঢুকলে এত সরু মনে হয় না।”

“মানে, এটা বাই লেন?”

“না। কলকাতার অনেক পুরনো গলির মুখ বড়, লেজ ছোট। এটা লেজের দিক।”

“ও! তা আপনার মক্কেল এই লেজের দিকে বাড়ি কিনল কেন?”

“পেয়ে গেল। দাম কম।”

“বাড়ির পজেশান নেয়নি।”

“না, এখনও নয়। পজেশান নেওয়ার আগে লেখাপড়া আছে কাগজে, আইনের ব্যাপার। সেটা শেষ হলে তবে তার আগেই ফ্যাকড়া বেঁধে গেল।”

“কালো ট্রাঙ্ক, কফিনের বাক্স…”

“মার্ডার!” কিকিরা আচমকা বললেন। কিন্তু স্বাভাবিক গলায়।

চন্দন আর তারাপদ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। “মার্ডার?”

“বেশি নয়। মাত্র দুটো…”

 কিকিরার গলার স্বর ঠাণ্ডা, মোটেই উত্তেজিত নয়। তারাপদদের সন্দেহ হল। কিকিরা তামাশা করছেন।

তারাপদ বলল, “মজা করছেন?”

“উঁহু! নো মজা। ফ্যাক্ট।”

“ফ্যাক্ট! কই আগে তো বলেননি!”

“তখন শুনিনি। কাল সকালে একবার টহলে বেরুলাম। জ্যাকির কাকার জুতোর দোকান বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে বলেছিলাম না! কাল রবিবার বলে দোকান বন্ধ ছিল। কাকা হেয়ার স্ট্রিট থানার পেছন দিকে থাকত জানতাম। পুরনো জায়গাতেই। খোঁজ করে করে পেয়ে গেলাম বুড়োকে।”

“চিনতেন কাকাকে?”

“বাঃ, চিনব না। আগে দু-এক জোড়া জুতোও কিনেছি। তা ছাড়া জ্যাকির বাবার সঙ্গেও গিয়েছি হুন-এর কাছে। আজকাল কালেভদ্রে দেখা হয় ওদিকে গেলে দোকানে।”

“কী বলল সে?”

“বলল, ভাইপোর বাড়ি কেনার কথা সে জানে। জ্যাকিই বলেছে। প্রথমে ও অতটা বোঝেনি। খেয়ালও করেনি। পরে কার সঙ্গে হায়দার লেনের বাড়ির কথা বলতেই সে বলল, আরে তেরো নম্বর বাড়ি; সেখানে যে দুটো মার্ডার হয়েছে। ওটাকে লোকে গুম বাড়ি বলে! ওই বাড়ি তো কেউ কেনে না। অনেক চেষ্টা করেও বিক্রি করা যায়নি। জ্যাকি ওই বাড়ি কিনেছে! ও মরবে।”

চন্দন বলল, “কবে হয়েছে মার্ডার।”

“হালে নয়। একটা হয়েছে বছর দুই আগে। আর-একটা আরও আগে।”

“পাড়ার লোক জানে নিশ্চয়।”

“না-জানবে কেন? অন্তত কিছু লোক। দুটো মার্ডারই শ্বাস বন্ধ করে, যাকে বলে গলায় ফাঁস দিয়ে, স্ল্যাংগুলেশান…”

“পুলিশ।”

“পুলিশ রিপোর্টেই বলেছে স্ট্র্যাংগুলেশান।”

“কেউ ধরা পড়েনি?”

“না।”

 চন্দন সন্দেহের গলায় বলে, “তা ইয়ে–এই মার্ডারের ব্যাপারটা আপনার জ্যাকি জানে না? বলেনি আপনাকে?”

“বলেছে একবার। তবে সেভাবে নয়। পাড়ায় দু-একটা খুন জখমের গল্প শোনা যায়–বলেছিল। ব্যাপারটাকে ও তেমন পাত্তা দেয়নি। আমার তো তাই মনে হচ্ছে।”

“পাত্তা দেয়নি কেন?”

“বলতে পারব না। আমার ধারণা, জ্যাকি ভেবেছে, এসব পাড়ার লোকের গল্প। কতটা সত্যি কতটা বানানো বলা মুশকিল। তা ছাড়া দুটো ঘটনাই পুরনো। এখন আর তার গুরুত্ব কী?”

কথা বলতে বলতে একটা বাড়ির কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন কিকিরা। তারপর চোখের ইশারায় যে বাড়িটা দেখালেন তাকে ইটকাঠের স্তূপ বললেও বলা যায়। ভাঙাচোরা বাড়ি, নোনাধরা দেওয়াল, ইট বেরিয়ে আছে, ফাটল, চারাগাছ বেরিয়েছে ফাটল থেকে; বাড়িটার ধাঁচ বোঝার উপায় নেই বাইরে থেকে, তবু আন্দাজ হয় ওটা যেন সত্যিই সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতন দেখতে, কিকিরা যা বলেছিলেন। জমির মাপ বোধ হয় বেশি নয়, তারই মধ্যে সামনের দিক একরকম, পেছনের দিক অন্যরকম। সরু বারান্দা, এখানে-সেখানে বাঁক, দু’-দশ হাত বারান্দার পরই সিঁড়ি, গায়ে গায়ে ঘর, আবার সিঁড়ি, কাঠের ঝুলবারান্দা, দেড়তলা, দোতলা… না, কিছুই ধরা যায় না এখান থেকে।

তারাপদ বলল, “ওই বাড়ি?”

“হ্যাঁ।”

“এ তো সার হরিপালের কাউশেড!”  

“হরিপালটা কে হে?”

“আপনি চিনবেন না। শেওড়াফুলি দিয়ে যেতে হয়…”

কিকিরা ঠাট্টাটা বুঝলেন, বললেন না কিছুই।

চন্দন বলল, “লেবাররা কাজ করছে দেখছি।”

“হ্যাঁ, জঞ্জাল সাফ করছে। মাত্র ক’দিন হল হাত লাগিয়েছে। আমি জ্যাকিকে বলেছি, আগে রাবিশ সরিয়ে ফেলো সমস্ত, হাত যখন দিয়েছ, শেষ করো, তারপর দেখা যাবে।”

মজুরের সংখ্যা বেশি নয়। জনা চারেক। সর্দার টাইপের কাউকে দেখা গেল না। মজুররা ধীরেসুস্থে গা এলিয়ে জঞ্জাল পরিষ্কার করছে। কাজের বেলাও ফুরিয়ে এল। আর আধ ঘণ্টা বড় জোর, তারপর আজকের মতন ছুটি।

.

বাড়ির মুখেই রাবিশ জমানো ঢিবি। কয়েকটা নয়নতারা গাছের ঝোঁপ, ফণিমনসা।

পাড়ার কুকুর শুয়ে আছে ঢিবির পাশে।

অনেক কষ্টে, ভাঙা ইটকাঠ, জমা করা ময়লার স্তূপ সরিয়ে কিকিরা তাঁর শাগরেদদের নিয়ে সেই ঘরটার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

তারাপদ বলল, “বাইরে যে তালা ঝোলানো, সার!”

“হ্যাঁ, জ্যাকি ঝুলিয়েছে।”

চন্দন বলল, “সেই তক্তাগুলো, যা দিয়ে ঘরটা নো-এন্ট্রি করে রেখেছিল?”

“সেসব আগেই খুলে নিয়েছে জ্যাকি। তক্তা উঠিয়ে নিয়েছে, পুরনো তালা ভেঙে ফেলেছে। এটা নতুন তালা।”

তালা যে নতুন আর শক্তপোক্ত, বোঝাই যাচ্ছিল। চন্দন একবার দরজার কাছে গিয়ে ভাল করে পাল্লাগুলো দেখল দরজার, হাত বোলালো দু-চার জায়গায়। বলল, “মনে হচ্ছে মস্ত মস্ত গজাল মারা ছিল তক্তায়। দরজায় ফুটোগুলো দেখেছেন?”

তারাপদও দেখল।

 কিকিরা বললেন, “জ্যাকির আসার কথা, এখনও আসছে না কেন?”

চন্দন দু’পা সরে এসে আশপাশ দেখতে লাগল। এখানে গায়ে গায়ে বাড়ি। দু’ বাড়ির বাইরের দেওয়াল অনেকসময় ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে গিয়েছে। এই বাড়িটার গায়ে লাগানো পুবের বাড়িটাও দোতলা। দু’ বাড়ির মধ্যে একটা পেয়ারা গাছ। ও বাড়ির বারান্দা জাল দিয়ে ঢাকা। কয়েকটা প্যাকিং বাক্স গায়ে গায়ে দাঁড় করানো। বুড়ো এক কুকুর বারান্দায় শুয়ে আছে। দক্ষিণের বাড়িটা আড়াই কি তেতলা। জানলার খড়খড়িতে চিনে মেয়েদের পাজামা, গায়ের কুর্তা শুকোতে দেওয়া আছে। ছাদে টিভি অ্যান্টেনা, পাঁচিলের ওপর দু-তিনটে ফুলের টব। ফুল নেই। গাছ চোখে পড়ছে। ওই বাড়িটায় বোধ হয় নানা পরিবারের বাস। একটা কোলাহল কানে যাচ্ছিল।

চন্দন হঠাৎ বলল, “সার, আপনার হ্যাঁমার আসবে তো?”

“হ্যামার–!”

“হাতুড়ে বদ্যি। মানে ডেন্টিস্ট!”

“চাঁদু, এক সময় হাতুড়েরাই ধন্বন্তরি ছিল।”

“রাখুন ধন্বন্তরি। তখন লোকে বুঝত না দন্ত থেকে জীবনান্তও হতে পারে। এখন লোকে অনেক কসাস হয়েছে।”

“জ্যাকিকে তুমি অতটা তুচ্ছ কোরো না, চাঁদু! তোমার নামকরা ডেন্টিস্টও আমি দেখেছি। বড়ুয়া গিয়েছিল ধর্মতলায় দাঁত তোলাতে। ডাক্তার অনেক টানা হেঁচড়া করে আধখানা দাঁত তুলল। বাকি অর্ধেকটা মাড়ির মধ্যে ডুবে থাকল। বড়ুয়া বলল, ছেড়ে দে বাবা তোর পায়ে পড়ি। ডাক্তার বলল, ঠিক আছে, তবে মশাই অর্ধেকটা যখন তুলেছি, আমার ফিজ-এর হাফ টাকা দিয়ে যান।”

তারাপদ হো হো করে হেসে উঠল।

 চন্দনও হেসে ফেলেছিল।

এমন সময় স্কুটারের শব্দ শোনা গেল গলিতে।

সামান্য পরে জ্যাকি এসে হাজির।

চন্দন নতুন মানুষ, তারাপদকে আগের দিন দেখেছে জ্যাকি। নতুন মানুষটিকে ক’ মুহূর্ত দেখল জ্যাকি; তারপর কিকিরার দিকে তাকাল। “সরি অ্যাঙ্কল, আই অ্যাম লেট!”

কিকিরা মাথা নাড়লেন, “বেশি নয়। ঠিক আছে।” বলে চন্দনকে দেখালেন, পরিচয় করিয়ে দিলেন।

জ্যাকি হাত বাড়াল। “ডক্টর?”।

 চন্দন হাতে হাত মিলিয়ে একটু হাসল। ভদ্রতার হাসি।

কিকিরা বললেন, “জ্যাকি, তোমার লেবাররা বড় স্লো। এখনও ঠিকমতন সাফসুফ করতে পারল না। আর কদিন লাগবে?”

জ্যাকি বলল, “ওয়ান উইক মোর। লেবার কম অ্যাংকল, আমিও জলদি করছি না। হয়ে যাবে।”

“একটু জলদি করো।” বলে দু’পা বাড়ালেন। “ওই ঘরটার চাবি এনেছ?”

 জ্যাকি মাথা নাড়ল। এনেছে।

 “চলো তা হলে!”

এই ঘরটার সামনে আসার আগে তারাপদরা একটা সরু প্যাসেজ পেরিয়ে চার ধাপ সিঁড়ি ভেঙেছিল। ভাঙাচোরা রেলিং। একটা বাঁক। বদখত সিঁড়ির ধাপ উঠতেই বন্ধ ঘর।

আলো অনেক কমে এসেছে, খানিকটা পড়ন্ত বেলা আর বাইরের মেঘলার জন্যে, বাকিটা আশপাশের ইটকাঠের বাধার জন্যে। মজুরগুলো বোধ হয় হাত গুটিয়ে ফেলেছে, তাদের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে অন্য অন্য বাড়ির লোকজনের কথা, চেঁচামেচি, কুকুরের ডাক– সব মিলিয়ে মিশিয়ে একটা শব্দ ভেসে আসছিল।

কিকিরা জ্যাকিকে ঘরের তালা খুলতে বললেন।

জ্যাকি তালা খুলল।

ঘরে পা দিলে, কিছুই চোখে পড়ে না। অন্ধকার। কোথাও কোনও জানলা আছে কিনা বোঝা যায় না। থাকলেও বন্ধ। ধুলো আর পোড়ো ঘরের ঘন বাসি গন্ধ। টিকটিকি ডেকে উঠল কোথাও।

চোখ সইয়ে নিতে সময় লাগল খানিকটা। তারপর আবছাভাবে যখন ঘরটা দেখা যাচ্ছিল, কিকিরা টর্চ জ্বালালেন। তিনি টর্চ এনেছিলেন পকেটে করে। জানতেন, যে কোনও সময়ে অন্ধকার হয়ে যেতে পারে।

টর্চ জ্বেলে কিকিরা ঘরটার চারপাশে ফেললেন। খড়খড়ি-দেওয়া পুরনো আমলের একটা জানলা অবশ্য আছে। মাঝারি মাপের।

জানলাটা খুলে দিতে বললেন কিকিরা। জানলাটার একটা পাল্লা পুরোপুরি খোলা গেল না। পাট ভাঙা, ফ্রেমের সঙ্গে লোহার তার আর পেরেক মেরে আটকানো। অন্য পাল্লাটা খোলা যায়, তবে কবজা আলগা। আশ্চর্যের ব্যাপার জানলায় কোনও শিক নেই, গরাদহীন। মানে, একেবারে খোলামেলা জানলা।

এবার যেটুকু আলো এল আর কিকিরার টর্চের কল্যাণে মোটামুটি দেখা গেল ঘরটাকে। লম্বাটে ঘর। চওড়ায় কম। হাত দশ-বারো লম্বা হতে পারে। কড়িকাঠের ছাদ। ধসে পড়লেও পড়তে পারে। ফরফর করে আরশোলা উড়ে গেল। হয়তো ইঁদুরও আছে।

কিকিরা বললেন, “এই ঘরটাকে আগে সাফ করিয়ে নিতে বলেছিলাম তোমায়?”

জ্যাকি বলল, “অ্যাঙ্কল, লেবারদের এখন এই ঘরে ঢুকতে দিলে ওরা আর কাজ করবে না।”

“কেন?”

“কফিনের বাক্স! বেটারা ভেগে পড়বে।”

“ও! তা খানিকটা তো পরিষ্কার দেখছি।”

“আমরা করেছি নিজের হাতে। আমি আর আমার ভাই।”

“আচ্ছা! তুমি কি আজ সকালেও এসেছিলে এখানে?”

“ইয়েস অ্যাঙ্কল।”

 তারাপদ আর চন্দন তখন অবাক চোখে কফিনের বাক্স, আর কালো বড় ট্রাঙ্ক দেখছিল। ট্রাঙ্কটা সত্যিই বড়। এত বড় বাক্স সচরাচর দেখা যায় না। তার গায়ের রং কালো না খয়েরি, না মরচে রঙের, বোঝা যায় না। কেন যেন বাক্সটা দেখলে অদ্ভুত লাগে। মনের কোথাও খোঁচা লাগে। সন্দেহ, না, ভয়! ওই ট্রাঙ্কের হাত দুই দূরে কফিনের বাক্স। অনেক পুরনো। ভারীও হতে পারে। ডালা কেমন ফোলা, জায়গায় জায়গায় উঁচু হয়ে উঠেছে। রং বোঝা যায় না। কালোই হবে।

তারাপদ চন্দনের দিকে তাকাল। চন্দন অবাক হয়ে জিনিস দুটি দেখছিল। একটি লোহার বাক্স, বা একটা কফিনের বাক্স চোখে দেখা–আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। স্বাভাবিক। দেখা যেতেই পারে। কিন্তু এই ঘরের মধ্যে, সত্য মিথ্যা যেমনই হোক, রহস্যময় কিছু কাহিনী শোনার পর–খানিকটা অন্যরকম লাগছিল বইকী!

কিকিরা জ্যাকিকে বললেন, “বাক্সটা তুমি এইভাবেই দেখেছ? তালা দেওয়া ছিল না! খোলা।”

জ্যাকি মাথা হেলিয়ে বলল, এই ভাবেই দেখেছে, তবে তালা ছিল বাক্সে।

“আর ওটা–কফিনের বাক্সটা?”

“ওইভাবেই।”

“নাড়াচাড়া করোনি?”

“ঘর সাফ করার সময় ট্রাঙ্ক, কফিনের বাক্স–দুইই সরিয়েছি।”

 কিকিরা টর্চের আলো ফেলে ভাল করে দেখলেন আবার।

 “জ্যাকি?”

“অ্যাঙ্কল!”

“আমি তোমার কাকার সঙ্গে কাল দেখা করেছিলাম। হুন বলল, এই বাড়িটা, কিনতে ওরা সবাই তোমায় বারণ করেছিল। করেছিল না?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“মর্টগেজ প্রপার্টি ছিল বাড়ি। লাস্ট ওউনার মর্টগেজ দেয় বাড়ি। কিন্তু তার আগে কে কে মালিক হয়েছিল তার পেপার্স নেই ঠিকঠাক। লাস্ট ওউনার অবশ্য হ্যারিশ।”

“গোলমেলে সম্পত্তি আর কী! তা এখানে যে দুটো মার্ডার হয়েছিল ……”

“নেবাররা বলে। আমি বলিনি অ্যাঙ্কল? আই টোল্ড ইউ।”

“বলেছ হয়তো। তবে পাত্তা দিতে চাওনি বলে আমার মনে হয়েছিল।”

“রাইট অ্যাঙ্কল। মার্ডার হয়েছিল নেবাররা বলে। কেউ দেখেনি। দ্যাট মে বি এ স্টোরি।” বলে জ্যাকি বিড়বিড় করে যা বলল তার অর্থ, প্রত্যেক বাড়িতেই মানুষ মারা যায়, দুর্ঘটনা ঘটে, লোকে আত্মহত্যাও করে কোনও কোনও বাড়িতে–তা বলে সেই বাড়িতে কি মানুষ থাকবে না। আর এসব অঞ্চলে কিছু হল্লা, ছোরাছুরি, পটকাবাজি চলে। জ্যাকি ও নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি। এত কম টাকায় এই জায়গায় একটা বাড়ি পাচ্ছে–সেই লোভে সে হাত বাড়িয়েছিল।

কিন্তু বাড়িটার জন্য লাখখানেক টাকা দাদন দিয়ে পরে যখন একদিন ঘুরেফিরে দেখতে এল, সেদিনও সে জানত না এই বাড়ির ওপরতলার একপাশে ছাদে ওঠার সিঁড়ির মুখে এইরকম একটা ঘর আছে। প্রথমদিন ভাঙাচোরা বাড়ির ভেতর দিকটা দেখার উপায়ও ছিল না। দিন কয়েক পরে ভাঙা ইট-কাঠ মোটামুটি সরিয়ে যখন বাড়ির ভেতরে ঢুকতে পারল তখনই নজরে পড়ল ছাদে ওঠার সিঁড়ির একপাশে একটা ঘরের বাইরের দরজা লম্বা লম্বা কাঠের তক্তা মেরে বন্ধ করা। রয়েছে। দেখে অবাক হল। এভাবে ক্রস করে কাঠের তক্তা মারা কেন? কেনই বা ঘরের দরজায় বিশাল এক পুরনো তালা ঝুলছে?

তারাপদ আর চন্দন ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখার মতন অন্য কিছু দেখতে পেল না। একটা মামুলি দেওয়াল-তাক একপাশে। ছোটই।

কিকিরা জ্যাকির সঙ্গে কথা বলছিলেন। “বাক্সটার তালা খুলতে পারলে?”

“ভাই খুলতে পেরেছে। মেহনত করল। তালা ভেঙে দিল।”

কিকিরা টর্চের আলো ফেললেন বাক্সর তালা লাগানো আঙটার দিকে। বুঝতে পারলেন, তালা খুলতে গিয়ে আঙটা লাগাবার জায়গাটাই ভেঙেচুরে রেখেছে ওরা।

“কী ছিল বাক্সে?”

জ্যাকি বলল, একটা অ্যাপ্রন টাইপের ড্রেস। মোটা শক্ত কাপড়। ব্ল্যাক। ওয়ান গাউন টাইপের ড্রেস। সিল্কের। ব্ল্যাক। … অ্যাঙ্কল, লেট মি ওপেন ইট!”

 কিকিরা কিছু বলার আগেই জ্যাকি বাক্সটার ডালা উঠিয়ে ফেলল।

দু’পা এগিয়ে টর্চের আলো ফেললেন কিকিরা বাক্সর মধ্যে। ফেলে অবাক হয়ে গেলেন। বৃহৎ ট্রাঙ্ক, হাত দুয়েক, কি সোয়া দুই গভীর। বাক্সটার একপাশে দুটি মাত্র পোশাক পড়ে আছে। বাকিটা ফাঁকা নয় পুরোপুরি। কয়েকটা যন্ত্রপাতিও রয়েছে যেন।

তারাপদরাও এগিয়ে এসে ঝুঁকে পড়ল।

কোনও সন্দেহ নেই, বাক্সর মধ্যেটা সামান্য ঝাড়মোছ করা হয়েছে। কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায়, বন্ধ বাক্সর মধ্যেকার পোকামাকড় দুর্গন্ধ এখনও যায়নি। তেমন করে দেখলে হয়তো মরা আরশোলার দাগ টিকটিকির চ্যাপটানো গায়ের ছালও চোখে পড়তে পারে। আরও কী দেখা যাবে কে জানে! দিনের আলো ছাড়া বোঝা মুশকিল।

কিকিরা বললেন, “ওগুলো একবার বার করতে পারো? দেখি!”।

জ্যাকি হাত তুলে সামান্য অপেক্ষা করতে বলল। তারপর ঘরের বাইরে চলে গেল।

চন্দন বলল, “ব্যাপারটা কী, সার?”

“দেখছি।”

তারাপদ বার কয়েক কাশল খুকখুক করে। এই ঘরের অত্যন্ত ময়লা নোনাধরা দেওয়াল, ঘুণধরা কড়িকাঠের ছাদ থেকে কেমন এক দমবন্ধ করা বাতাস চুঁইয়ে পড়ছে। মুখে রুমাল চাপা দিল তারাপদ। কাশি সামলাচ্ছিল।

জ্যাকি ফিরে এল। হাতে এক সরু কাঠের টুকরো। লম্বা।

নিজে বাক্সের মধ্যে হাত দিল না জ্যাকি, যেন ঘেন্নাতেই, কাঠের টুকরো দিয়েই বাক্সর মধ্যেকার জিনিসগুলো তুলল একটা একটা করে। প্রথমে অ্যাপ্রনটা ঝুলিয়ে ধরল কাঠের টুকরোর আগায়।

কিকিরা দেখলেন। তারাপদরাও। পোশাকটা ধুলো ময়লায় ন্যাতার মতন দেখাচ্ছে। কালো।

অ্যাপ্রনের সঙ্গে একটা স্কার্ফও উঠে এসেছিল। কালোই। তবে বেশ বড় স্কার্ফ। সিল্কের। মাঝে মাঝে পোকায়-কাটা, একটা দাগ একপাশে।

মাথা নাড়লেন কিকিরা। “ওটাও বার করো তো দেখি।”

জ্যাকি স্কার্ফ রেখে অন্য জিনিসটা বার করল। একই ভাবে।

কিকিরা টর্চের আলো ফেলে দেখলেন। তারাপদরাও দেখছিল।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিকিরা বললেন, “এটা গাউন নয়, আলখাল্লা। কাঁধ থেকে পা পর্যন্ত ঝুল। দরবেশ, ফকির-টকিরদের পরতে দেখেছি। তা এটারও অবস্থা তো ওই স্কার্ফের মতন …. ঠিক আছে রেখে দাও।”

জ্যাকি আলখাল্লাটা বাক্সর মধ্যে রেখে দিল।

কিকিরা কী ভাবলেন। পরে বললেন, “এখনকার মতন বাক্সটা বন্ধ করেই দাও।” বলে কফিনের বাক্সর দিকে তাকালেন। “ওর মধ্যেটা দেখেছ?”

বাক্সর ডালা বন্ধ করে জ্যাকি বলল, “দেখেছি।”

“কী আছে?”

“একটা স্টিক। ওয়াকিং স্টিক। গুড কোয়ালিটি কেইন। বেত। মাথার দিকটা লোহা দিয়ে বাঁধানো। বাকি যা আছে,” মাথা ফেরাল জ্যাকি। “ইঁদুর, বিছে, করোচ, কাঠের পোকা। একটা বোর্ড ছিল। কাগজের।”

“আর কিছু নয়?”

না।”

“বেতের ছড়ি ওনলি?”

“কফিনের বাক্সটা দেখবেন অ্যাঙ্কল?”

“পরে দেখব।” বলে কিকিরা একবার দেওয়াল-তাকটার দিকে আলো ফেললেন। “নস্যির কৌটোটা নাকি এখানেই ছিল–জ্যাকি বলেছে।” হঠাৎ মত পালটালেন কিকিরা। “আচ্ছা, দেখি তো ছড়িটা!”

কফিনের বাক্সে হাত ডোবাতে যেন সামান্য ইতস্তত করল জ্যাকি। তারপর ডালা খুলে ছড়িটা বার করল।

প্রথমে টর্চের আলোয় ছড়িটা দেখলেন কিকিরা। কী মনে করে হাত বাড়ালেন, “দেখি।” তারাপদরাও দেখছিল।

কিকিরা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলেন ছড়িটা। ছড়ির মাথা লোহা-বাঁধানো। কোনওকালে হয়তো ঝকঝকে লোহার পাত বা জার্মান সিলভারের একটা আবরণ ছিল। এখন সবই কালচে। কিঞ্চিৎ কারিকুরিও ছিল আবরণের গায়ে। আপাতত বোঝা যায় না ময়লার জন্যে। কিকিরা ওজন অনুমান করার চেষ্টা করলেন। বেতের জন্যে নয়, লোহার মুণ্ডুর জন্যে ছড়িটা বেশ ভারী লাগছিল। ছড়িটার মাঝামাঝি গোল দাগ। কালচে। অলঙ্করণ বলেই মনে হয়।

“রেখে দাও–” ছড়ি ফেরত দিলেন কিকিরা। দিয়ে দেওয়াল-তাকের দিকে তাকালেন। “ওটা একবার দেখি।”

কফিনের বাক্সর মধ্যে ছড়ি রেখে ডালা বন্ধ করল জ্যাকি।

 দেওয়াল-তাক থেকে একটা কৌটো তুলে নিয়ে কিকিরার হাতে দেওয়ার সময় জ্যাকি বলল, “অ্যাঙ্কল, এটা স্নাফ বক্স বলে আমার মনে হয়। শেপটা পিকিউলিয়ার। মাঙ্কির মতন দেখতে।”

কিকিরা হাতে নিয়ে দেখলেন। হাড়ের তৈরি। দেড় ইঞ্চি কি দুই ইঞ্চি লম্বা। হ্যাঁ, বাঁদর বা ওই ধরনের জন্তুর মতন ছাঁদ করে কাটা। হাড়ের তৈরি ছোট্ট হাতি, বেড়াল, নৌকো, বুদ্ধমূর্তি–কত কী তো দেখা যায়। এই কৌটোটার ছাঁদ জন্তুর মতন। তবে বাঁদর, না পেঁচা, না অন্য কিছু বোঝা দায়। কৌটোর মাথায় প্যাঁচ আছে; খোলা যায়। ভেতরে কিছুই নেই। সাদাটে কি বাদামি গুঁড়ো।

তারাপদ বলল, “মোষের শিংয়ের তৈরি নাকি?”

 কালোই দেখাচ্ছিল কৌটোটা। কিকিরা কিছু বললেন না। ফেরত দিয়ে দিলেন কৌটোটা। “চলো, ফেরা যাক।”

.

গলিতে এসে বোঝা গেল। বিকেল পড়ে গিয়েছে। মেঘের জন্যে হালকা অন্ধকারও হয়ে এসেছে চারপাশ।

কিকিরা বললেন, “জ্যাকি, তুমি কীসের ভয় পাচ্ছ?”

জ্যাকি বলল, “আমি ভয় পাইনি অ্যাঙ্কল। শুরু মে পাইনি। ওই ঘরটা দেখার পর মামিকে বললাম। মা ভয় পেল। হুন অ্যাঙ্কল নার্ভাস হয়ে গেল। মামি …”

“তোমার মা আমার কাছে পাঠাল তোমাকে?”

জ্যাকি বলল, তার মা যে তাকে কিকিরা অ্যাঙ্কলের সঙ্গে দেখা করতে বলেছে তা ঠিকই। তবে যেদিন ও ওই বাড়ি থেকে ঘুরে এল প্রথম, তখন থেকে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করতে লাগল।

“কী লক্ষ করলে?” কিকিরা বললেন।

“আমি ইভনিংয়ে আমার চেম্বার থেকে বেরুনোর পর কেউ আমায় ফলো করে।”

“তুমি কখন চেম্বার থেকে ফেরো?”

“আট; হাফ পাস্ট এইট।”

“তুমি স্কুটারে ফেরো?”

“হ্যাঁ, স্কুটারেই আমি ঘুরি।”

“যে ফলো করে তাকে তুমি দেখেছ?”

 জ্যাকি বলল, প্রথমটায় সে খেয়াল করেনি। পরে তার চোখে পড়ল কেউ তাকে ফলো করছে।

“তুমি স্কুটারে ফিরছ, লোকটা কেমন করে তোমায় ফলো করবে?”

“সেও স্কুটার নিয়ে ফলো করে।”

“ও। … চিনতে পারো লোকটাকে?”

“না! তফাতে থাকে।” বলে, জ্যাকি মাথা নাড়ল। আবার বলল, “অ্যাঙ্কল, আমি বাড়িটার ভেতর দেখে যেদিন ফিরে এলাম, ওই হরিবল ঘরটা দেখলাম– তার এক দো দিন বাদ থেকে আমার চেম্বারে ঘোস্ট কল আসতে লাগল। কে ফোন করে বুঝতে পারি না। চেম্বার আওয়ার্সের শেষের দিকে কল আসে।”

কিকিরা তাকিয়ে থাকলেন জ্যাকির দিকে। অবাক গলায় বললেন, “কী বলে?”

“বেশি কথা বলে না। রাফ টোন। বলে, বি কেয়ারফুল, বাড়ি কেনার চেষ্টা কোরো না। বিপদ হবে।”

“আশ্চর্য! একই কথা বলে?”

“হ্যাঁ, অ্যাঙ্কল।”

“তোমার কী মনে হয় কথা শুনে? তোমাদের কমিউনিটির কেউ? কী ভাষায় কথা বলে?”

“হিন্দিতে। বাজারি হিন্দি।”

তারাপদ হঠাৎ বলল, “বাড়িটা যে বিক্রি করেছে সে এইসব ঘটনা জানে?”

“বলেছি।”

“লোকটা তোমার চেম্বারে ফোন করে বাড়িতে করে না কেন?”

“বাড়িতে ফোন নেই। ….. চেম্বারের ফোন পুরনো, দরকারে লাগে।”

গলি দিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন কিকিরা। চারপাশ দেখলেন। পাড়াটা এতক্ষণে যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। লোকজন আসা-যাওয়া করছে। সামান্য তফাতে ট্রামলাইন। দেখা যাচ্ছে না। শব্দ পাওয়া যাচ্ছে ট্রামের। দশ বিশ পা এগিয়ে গেলেই বড় রাস্তা। ট্রামলাইন। কতকগুলো বাচ্চা বল নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে।

তারাপদ আর চন্দন যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সিগারেট ধরিয়ে নিল একপাশে দাঁড়িয়ে।

কিকিরা কিছু ভাবছিলেন। পরে জ্যাকিকে বললেন, “তুমি ঠিক কী করতে চাও? মানে বাড়িটা কিনবে, না, কিনবে না–সেটা স্থির করতে চাও? না কি, দেখতে চাও কে বা কারা–তোমায় বাড়িটা কিনতে দিতে চায় না বলে ভয় দেখাচ্ছে?”

জ্যাকি বলল, “অ্যাঙ্কল, বাড়ি আমি কিনতেই চাই। তার আগে চাই মিস্ত্রি সভ করতে। ওই ঘরটা কবে থেকে বন্ধ আছে ওভাবে? কে বন্ধ করেছিল? কেন? রুমের মধ্যে কে অত বড় ট্রাঙ্ক রেখেছিল? কেন? ফাঁকা একটা কফিন বাক্স পড়ে আছে কেন এতদিন? কে রেখেছিল…? আর আমায় থ্রেট করার কারণ কী? আমি সবই জানতে চাই।”

তারাপদ বলল, “ঘরের মধ্যে যে ট্রাঙ্ক আর কফিন বাক্স পড়ে আছে–আপনি পুলিশকে জানিয়েছিলেন?”

জ্যাকি বলল, “ঘরের মধ্যে বাক্স পড়ে থাকলে পুলিশ কী করবে? কফিন বাক্স ডেড বডি নয়।”

কিকিরা মাথা হেলিয়ে বললেন, “না, পুলিশকে ইনফর্ম করার কিছু নেই। পুরনো ভাঙা বাড়িতে কী পড়ে আছে জেনে পুলিশ কী করবে? সোনাদানা, ভ্যালুয়েবল কোনও জিনিস পেলে জানানো যেত। কিছুই তো পাওয়া যায়নি। থানায় গেলে তাড়িয়ে দেবে।”

চন্দন বলল, “থানা পুলিশ এখানে আসে না। আইনের কোনও ব্যাপার নেই। তবে বাড়ি-বিক্রির ব্যাপারটা হয়তো ….” কথা শেষ করল না সে। তার মাথাতেই এল না কী বলবে।

কিকিরা জ্যাকির দিকে তাকালেন। “এই কেসটা বড় গোলমেলে, জ্যাকি। আমরা যে তোমায় ভরসা দেব তাও দিতে পারছি না। তা একটা কথা তুমি কি আগে বলেছ? আমার মনে পড়ছে না। বাড়িটা তুমি কার কাছ থেকে কিনতে যাচ্ছ? সে কে?”

জ্যাকি বলল, “তালুকদার এস্টেট অ্যান্ড প্রপার্টিজ থেকে কিনতে যাচ্ছিলাম।”

“তারা কে?”

“তাদের হাতে এদিককার দু-চারটে বাড়ির মালিকানা আছে। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটেও আছে জানি। তালুকদারের কাছ থেকে কিনে নেব বলে টাকা অ্যাডভান্স করেছি।”

কিকিরা শুনলেন। পরে বললেন, “ঠিক আছে। আমি ভেবে দেখি। ঝামেলা অনেক। নাও এখন চলো।”

.

০৪.

সপ্তাহখানেক পরের কথা।

কিকিরার ঘরে বসে কথাবার্তা হচ্ছিল। চন্দন রাগ করে ছুটি নিয়েছে হাসপাতাল থেকে। বদলি আর আটকানো গেল না বেচারির। এখন মেজাজ ভাল নয়। বলছে চাকরি ছেড়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে নেমে পড়বে। বাড়িতে আপত্তি আছে বাবার। কলকাতা শহরে অত সহজে প্র্যাকটিস জমানো যায় না। আর নিজের দেশবাড়িতে গিয়ে বসলেও চার-পাঁচ বছরের আগে সুবিধে হবে না। সেখানেও ভাল পসারের ডাক্তার আছে জনা কয়েক, বাকিরা চরে খাচ্ছে। বাবা বলেন, কাক যেভাবে ময়লা ঠুকরে বেড়ায়–এরাও সেইভাবে রোগী হাতে পেলে ঠুকরে বেড়াচ্ছে। আপাতত তাই চন্দন চাকরি ছাড়তে পারছে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিরক্ত।

তারাপদ আর কিকিরাই কথাবার্তা বলছিল বেশি, চন্দন শুনছিল।

 শেষে তারাপদ একবার বলল কিকিরাকে, “আপনি নিজের চোখে দেখেছেন–জ্যাকির কেনা ভাঙা বাড়ি সাফসুফ হয়ে গিয়েছে?”

“কালও একবার গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, জঞ্জাল প্রায় পরিষ্কার, ভাঙা মালমশলা তুলে নিয়ে গিয়েছে, কাঠকুটোও বেশি পড়ে নেই ….”

“কে নিয়ে গেল?”

“এসব নেওয়ার লোক আছে। কিনে নিয়ে যায়। পুরনো ভাঙা বাড়ির ইট কাঠ সবই বিক্রি হয়ে যায় হে তারাবাবু! এ হল কলকাতা শহর, এখানের ধুলো মাটিও পড়ে থাকে না। তা ছাড়া, পুরনো আমলের বাড়ির কাঠকুটোও উঁচু ক্লাসের। তার দাম রয়েছে।”

তারাপদ শুনল। পরে বলল, “কাজের কাজ হল কিছু?”

“না, বলার মতন নয়। চেষ্টা করছি।”

চন্দন হঠাৎ বলল, “কিকিরা, একটা কথা আমায় বলুন তো? একজন হাতুড়ে চিনে দাঁতের ডাক্তার। বয়েসও বেশি নয়। সে লাখ টাকা পেল কোথায়? আরও একটা পয়েন্ট আছে, বাড়িটা কিনতে হলে তার আরও কয়েক লাখ টাকা লাগবে? এত টাকা তার আসে কেমন করে?”

কিকিরা বললেন, “তুমি যা ভাবছ তা নয়। জ্যাকির বাবা ভাল রোজগার করত। স্পেশ্যালি দাঁত বাঁধানোয় তার সুনাম ছিল খুব। অনেককে দেখেছি, নিজেরা দাঁত না বাঁধিয়ে ওর কাছে ছাঁচ ফেলে যেত। ও সেট তৈরি করত। আর সোনাদানার কাজ হলে জ্যাকির বাবা ছিল পয়লা নম্বরের। টাকা ওর বাবা ভালই করেছে।”

“কত করতে পারেন?”

“মোটামুটি মন্দ কী! আমার অনুমান। জ্যাকির মা, মাইন্ড দ্যাট, নিষ্কর্মা ছিল না। তারও রোজগার ছিল। আরও একটা কথা জেনে রাখবে। ওদের কমিউনিটির লাইফ স্টাইল আমাদের মতন নয়। পকেট ফাঁকা, কাপ্তেনি করছে–এ তুমি ওদের মধ্যে পাবে না।”

“আপনি জ্যাকিকে টাকার ব্যাপারে বোধ হয় কিছু বলেননি?”

“না। সরাসরি বলিনি। কেননা আমি ওদের অবস্থাটা আন্দাজ করতে পারি।…শোনো চাঁদু, এক বাঙালি ছাড়া, বাকি যারা কলকাতা শহরে টাকা কামায়–তারা সব সময় নিজের ভাই বেরদার বন্ধু–এমনকী আধ-চেনা জাতভাইদের সব সময় দাঁড় করানোর জন্যে হেল্প করে। কাজেই জ্যাকির কাছে টাকা জোগাড়ের ব্যবস্থা করা কঠিন হত না মনে হয়।”

তারাপদ বলল, “জ্যাকির ইনকাম কেমন?”

“এই তো বিপদে ফেললে। আমি কি ইনকাম ট্যাক্স অফিস?”

“তবু?”

“খারাপ নয়। জ্যাকিও দাঁত বাঁধানোর কাজ ভাল করে। বাপের কাছ থেকে শিখেছে।”

“যাক গে, আপনি ওর মায়ের কাছে গিয়েছিলেন?”

“না। যাব একদিন।”

“তা হলে এই ক’দিন…?”

কিকিরা নিজের মাথার চুল ঘাঁটতে ঘাঁটতে বললেন, “একেবারে হাত গুটিয়ে বসে নেই হে! কচ্ছপের স্টাইলে এগুচ্ছি।…রাতারাতি একটা কিছু করে ফেলা এখানে সম্ভব নয়।”

আজ বৃষ্টি নেই। মেঘও নয়। বরং অন্যদিনের তুলনায় গুমোট। সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। কিকিরার কথামতন বগলা শরবত তৈরি করে দিয়ে গেল।

শরবতে চুমুক দিয়ে চন্দন হেসে বলল, “সার, আপনি কচ্ছপের মতন কতটা যাবেন? আমি জ্যাকির ব্যাপারে…”

চন্দনকে থামিয়ে দিয়ে কিকিরা বললেন, “তুমি বিশ্বাস করতে পারছ না জ্যাকিকে। না করতেই পারো। কিন্তু একেবারে অকারণে সে আমার কাছে আসেনি। ওর কাকার কথাই ধরো। বাড়ি কেনার কথা কাকা জানে। এটাও শুনেছে ওই তেরো নম্বর বাড়িটাকে লোকে গুমবাড়ি বলে।”

“জেনেশুনেও জ্যাকি এগিয়ে গিয়েছে।”

“কতটা আগে শুনেছে–কতটা পরে–তা তুমি জানছ কেমন করে! জ্যাকির নিজের কথায় আগেভাগে সব জানত না। যেমন ওই বন্ধ ঘরটার কথা। জানত না, ঘরে কী আছে, কী দেখতে পারে!…হ্যাঁ, বাড়িটাকে গুমবাড়ি বলে সে শুনেছে। তাতে কী! কলকাতার কত পুরনো ধসে পড়া বাড়িকে লোকে ভূতের বাড়ি বলে। তা বলে সেই বাড়িতে কি দু-চারজন মাথা গুঁজে থাকে না? না তোমার ওই বাড়ির বেচাকেনা নিয়ে কথা চলে না?”

তারাপদ বুঝতে পারল, চন্দনের মনোভাব গোড়া থেকেই যে জ্যাকির বিরুদ্ধে–এটা কিকিরা বুঝতে পেরেছেন। তিনি হয়তো খুশিও হচ্ছেন না। হওয়ার কথা নয়। জ্যাকিদের পরিবার ও জ্যাকিকে তিনি যতটা চেনেন, চন্দন তার কতটুকু জানতে পারে! কিছুই নয়।

কথা ঘুরিয়ে নিল তারাপদ। হেসে বলল, “ছাড়ুন ওসব কথা। এবার বলুন তো আপনার কচ্ছপ গতিতে কতটা এগুতে পারলেন?”

কিকিরা শরবত খেতে খেতে বললেন, “তালুকদারদের অফিসে গিয়েছিলাম।”

“অফিস?”

“আছে বাবা, অফিস আছে। রাসমণির বাড়ির খানিকটা আগে। জায়গাটা হাট বললেও চলে, একটা বাড়ির দোতলায় তালুকদারদের অফিস। আগের দিনের নায়েব গোমস্তার কাছারিবাড়ি টাইপের। দেখলে তোমার অভক্তি হবে। তা সেখানে ভাবসাব জমিয়ে দশ-বিশটা বাজে কথার পর তালুকদারদের ঘুঘু ম্যানেজারটিকে পটালাম। রুপোর আংটি সোনার আংটি হল, দশের নোট হল বিশ। হাত সাফাইকা খেল। নজরানা দিলাম। ম্যনেজার আমায় ওদের ছোটবাবুর কাছে নিয়ে গেল।”

চন্দন খানিকটা শান্ত। হাতের গ্লাস নামিয়ে রাখল মাটিতে। মুখ মুছে নিল।

 কিকিরা বললেন, “কথাবার্তায় বুঝলাম তালুকদাররা দু’-তিন পুরুষ ধরে প্রপার্টি বিজনেসে আছে। বাজার বসানো, দোকান ভাড়া, পুরনো বাড়ি সম্পত্তি কেনাবেচা থেকে শুরু করে আরও কিছু ব্যবসা। ওদের একটা সলিসিটার ফার্মও আছে পার্টনারশিপের।”

“মানে ধনী লোক!”

“তা তো বটেই।”

“বাড়িটার কথা কী বলল?”

“বললেন, ছোটবাবুই বললেন, মর্টগেজ প্রপার্টি ছিল বাড়িটা। ছোটবাবুর বাবা টাকা ধার দিয়েছিলেন বাড়ি বন্ধক নিয়ে।”

“কাকে?”

“হ্যারিশ বলে এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ানকে। সে আর টাকা শোধ করতে পারেনি। মূল টাকা আর সুদ মিলে যখন টাকার অঙ্কটা বিরাট হয়ে দাঁড়াল, হ্যারিশ পাগল হয়ে একদিন বেপাত্তা হয়ে গেল। মারাও গেল।”

“মারা গেল কেমন করে বুঝল তালুকদাররা? হ্যারিশ তো বেপাত্তা ছিল।”

“মরার আগে হ্যারিশ রাস্তার ভিখিরির মতন চেহারা আর পেটে আলসার নিয়ে চ্যারিটেবল হাসপাতালে ভর্তি হয়। দিন কয়েক বেঁচে ছিল। মারা যাওয়ার আগে নিজের নাম ঠিকানার সঙ্গে তালুকদারদের ঠিকানা দিয়ে যায়।”

“আইডেন্টিফিকেশান হয়েছিল তবে?”

“হ্যাঁ।”

“সেই বাড়ি জ্যাকি কিনেছে। হ্যারিশের কেউ ছিল না?”

“না। স্ত্রী আগেই মারা গিয়েছিল। ছেলেমেয়ে ছিল না।”

চন্দন বলল, “কতকাল বাড়িটা খালি থাকার পর জ্যাকি ওই প্রপার্টি কিনেছে?”

“বাড়ি তো খালিই পড়ে ছিল অনেক বছর! কম করেও বছর দশেক।”

তারাপদ যেন কিছু ভাবছিল। চন্দনের কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে ধরাল। শেষে বলল, “জ্যাকি খবর পেল কেমন করে যে মর্টগেজে পাওয়া বাড়িটা তালুকদাররা বিক্রি করবে।”

“দালাল। তা ছাড়া তালুকদাররা যে কোনও প্রপার্টি আর রাখবে না–বেচে দেবে–তা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তারা জানিয়েছিল।”

তারাপদ মাথা দোলাল, যেন বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা।

চন্দন বলল, “সার, একটা কথা বলুন। বাড়ি বিক্রির ব্যাপারটা এখানে ক্লিয়ার আইনত। তা হলে জ্যাকি কেন বলছে, লাখ টাকা দাদন দেওয়ার পরও সে শুনছে বাড়ি নিয়ে গোলমাল আছে। মানে মালিকানা নিয়ে।”

 “আছে খানিকটা। তালুকদারদের বড় মেজো ছোট ছেলের মধ্যে শরিকি গোলমাল। ওটা ওদের নিজেদের মধ্যে। আমার মনে হয়, নিজেদের পাওনাগণ্ডার মিটমাট হলে সমস্যাটা থাকবে না।”

“আচ্ছা!…তা কিকিরা জ্যাকিকে যে বাড়ির মধ্যেটা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল– সে কে? তালুকদারদের কোন লোক?”

“ম্যানেজারের লোক। নাম তার উপেন। সেও তালুকদার। তবে মালিকদের কেউ নয়। চাকরি করে ম্যানেজারের অফিসে।”

চন্দন ঝট করে বলল, “বেশ, উপেনই হল। কিন্তু ওই বাড়ির একটা বন্ধ ঘরে যে ওই কফিনের বাক্সটাক্স পড়ে ছিল, আপনার ছোট তালুকদার জানত না? কী বলল ছোটকর্তা।”

কিকিরা মাথা নাড়লেন। বললেন, জানতেন না। বললেন, আমরা কি মশাই, ওসব খবর রাখি! ভেতরে কী আছে জানব কেমন করে। পরে শুনেছি। তবে ও নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। রাবিশগুলোকে ফেলে দিলেই পারে।”

তারাপদ বলল, “টাকা ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না ওরা। বাজে লোক।”

.

০৫.

দুপুরেই বৃষ্টি নেমেছিল।

আকাশভাঙা বৃষ্টি নয়। দু’পশলা মাঝারি চালের বারিবর্ষণ। রাস্তাঘাট ভিজে থাকল, জল দাঁড়াল না। বারিবর্ষণ’ কথাটা কিকিরাই বলেন, মজা করে। মাঝেসাঝে সংস্কৃত শব্দটব্দর ওপর তাঁর ঝোঁক আগেও দেখা যেত, এখন যেন আরও বেশি হয়েছে। ওঁর ইংলিশ যেমন থাকার তেমনই আছে, কম-বেশি হয়নি, ‘ফিশ ক্যাচিং’ থেকে ‘লেগিং কোয়ারল’। এসব বোঝা যায় কিকিরার, কিন্তু হালফিল চাণক্য শ্লোকের মতন কোত্থেকে এক ছেঁড়াখোঁড়া হলুদপাতার রত্নদেব পন্ডিতের শ্লোকের বই উদ্ধার করেছেন তিনি, আর হুটহাট পাঁজির পাতায় ছাপা দেবদেবীর স্তোত্রপাঠের সংস্কৃতের মতন স্যানসক্রিট আওড়ে যাচ্ছেন। অদ্ভুত মানুষ। কিকিরা যে এতে মজা পান, তারাপদরা জানে। মজা অবশ্য তারাও পায়, তবে সব সময়ে নয়।

কিকিরা বদখত এক কাজের ভার চাপিয়ে দিয়েছিলেন তারাপদদের ওপর। বলেছিলেন, “জ্যাকির চেম্বার বন্ধ হয় আট থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে। তোমরা ওই সময়টায় ওর চেম্বারের আশেপাশে হাজির থাকবে। আর দেখবে কে তাকে ফলো করছে। কতদূর পর্যন্ত।”

চন্দন বলেছিল, “জ্যাকি তো নিজেই বলেছে ওকে কেউ ফলো করে। তবে?”

“তবু করবে। নিজের চোখে দেখবে।”

“আমরা কি বুঝতে পারব?”

“খুব পারবে। তোমার আজকাল চোখ পেকে উঠেছে।”

“ফলো করতে গিয়ে যদি ধরা পড়ি! বেপাড়া সার। ধোলাই হয়ে যাব। ওদিকটায় আমাদের শেল্টার নেই।”

 “শোন চাঁদু, আমি জ্যাকির কথা অবিশ্বাস করি না। তবু শিওর হতে চাই। জ্যাকি যা বলে তাতে মনে হয়, একজন কেউ রুটিন করে তাকে ফলো করে না। হয়তো ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে। বা একই লোক হলে আইডেন্টিফাই করার সুবিধে। আমার মনে হয় কাজটা রোটেশানে হয়। দেখতে হবে বইকী!”

“সার, এই বৃষ্টির দিন, রাত আটটায় আমরা কোথায় গিয়ে মাথা গুঁজে থাকব। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাবে। তেড়ে বৃষ্টি নামলে ভিজে একেবারে নেতিয়ে যাব।”

কিকিরা কান করলেন না কথায়। “নো এক্সকিউজ সার। মনসা চিন্তিতং…”।

“প্লিজ……! ঠিক আছে; বৃষ্টি হলে নো গোয়িং, না হলে গোয়িং।”

 কপাল মন্দ চন্দনদের। বৃষ্টি হল, তবে ঝাঁপিয়ে হল না। বিকেলের পর মেঘ সরতে লাগল। আবার জমতে লাগল ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবে। টিপটিপ বৃষ্টিও এল, গেল।

তারাপদ আর চন্দন বুদ্ধি খাঁটিয়ে একটা কাজ করেছিল। চেনা একটি ছেলে আজকাল অটো চালায়, চন্দনের চেষ্টায় তার ভাঙা হাত জোড়া লেগেছিল– পাড়ায় থাকে, চন্দন তাকে বলে রেখেছিল, “এই ভব, আমার একটা কাজ করবি?”

“কী দাদা?”

“একদিন তোর অটো নিয়ে–ধর সাড়ে সাতটা থেকে ঘন্টা দেড়েক আমার হয়ে খাটবি?”

“কী যে বলেন দাদা! এটা কোনও কাজ? কবে চাই অটো?”

“বলব।”

.

ভব–বা ভবানীর অটো নিয়ে চন্দন আর তারাপদ আজ রাত আটটার আগে আগে জ্যাকির চেম্বারের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

চন্দন চারপাশ দেখে নিয়ে একটা গলির পাশে বড় রাস্তায় অটো দাঁড় করাল!

“তারা, এই জায়গাটা ভাল। কাছাকাছি দোকানপত্র প্রায় বন্ধ। ওপাশে একটা মিল্ক বুথ। বন্ধ। এপাশে ময়লা-জমানো ভ্যাট। এখানেই…”

তারাপদ বলল, “এখানেই ওয়েট করা যাক। জ্যাকির চেম্বারও সামনে।”

 চন্দন আগেই নজর করে দেখেছে, একটা পুরনো বাড়ির দোতলায় জ্যাকির চেম্বার। অনুমান করে নিয়েছে। কিকিরার বর্ণনা মতন মিলে যাচ্ছে বাড়িটা। হাতের ঘড়ি দেখে নিল চন্দন। অটোর ছেলেটাকে বলল, “এই ভব, তুই একটু খুটখাট করবি। বাই চান্স কেউ যদি ভাড়ার জন্যে আসে বলবি, দেখছেন না গাড়িতে যে প্যাসেঞ্জার আছে তাদেরই বসিয়ে রেখেছি, গাড়ি গন্ডগোল করছে। অন্য গাড়ি দেখুন।”

ভবানী বলল, “দাদা, আপনারা বসে থাকুন। ভাববেন না। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে…”

 “তুই বুঝবি না। আমরা এক বেটাকে ধরব। ছ’মাস আগে ধাপ্পা মেরে হাজারখানেক টাকা ধার নিয়ে পালিয়ে এসেছে। আর ও-মুখো হচ্ছে না। শুনেছি এদিকেই কোথাও আসে রোজ।”

ভবানী বিশ্বাস করল কিনা কে জানে। তবে অটোটাকে নিয়ে ঝামেলায় পড়েছে, এমন ভাব করে বসে থাকল।

তারাপদ নজর করে জায়গাটা দেখছিল। হাতে সিগারেট। রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা নয়। বৃষ্টির দরুন মানুষজনের চলাচল কম। দোকানপত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অন্ধকার জমেছে মাঝে মাঝে! রাস্তার আলো যেমন থাকে ততটাই রয়েছে। শাটার-টানা দোকানগুলো হরেক রকমের, সাইনবোর্ড নজর করলে মনে হয় এখানে রেডিয়ো স্টোর্স, ফোম গদি, চশমা ঘড়ি থেকে পোশাকআশাক ওষুধপত্র মায় স্টেশনারি সবরকম দোকানই আছে। গাড়িঘোড়া আপাতত কম।

দেখতে দেখতে আটটা বাজল। সোয়া আট…..। দু’ পাশের দোতলা তেতলা পুরনো বাড়িগুলো যেন চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। বোধ হয় এসব বাড়িতে পরিবার নিয়ে লোকজন কমই থাকে, বেশিরভাগই হয় অফিস-খুপরি, না হয় দোকানের মালপত্র রাখার গুদাম।

চন্দন হঠাৎ ঠেলা মারল তারাপদকে। “ওই যে!”

তারাপদ দেখল।

জ্যাকি নীচে নেমে এসেছে। বাড়িটার নীচে ফুটপাথ ঘেঁষে পান সিগারেট ঠাণ্ডি পানির দোকান। জ্যাকির স্কুটার ফুটপাথের ওপর থাকে। পানের দোকানের সামনে। পানঅলার সঙ্গে কথা বলে জ্যাকি কী কিনে পকেটে রাখল। তারপর হেলমেট মাথায় চাপাল।

চন্দন ভবানীকে খোঁচা মারল। “বি রেডি। তৈরি হ’।”

ভবানী তৈরি।

 “একটু দাঁড়া, ওই স্কুটারটা এগিয়ে যাক খানিক, তারপর তোকে বলব…”

জ্যাকি স্কুটারে স্টার্ট দিয়ে পঞ্চাশ গজ মতন এগুতে না এগুতেই কোন গলির অন্ধকার থেকে আরও একটা স্কুটার বেরিয়ে এল। লোকটাকে বোঝা যাচ্ছে না। গায়ে পলিথিন রেনকোট, মাথায় হেলমেট পরেনি, ফেল্ট হ্যাঁটের মতন সস্তা বর্ষাতি টুপি। মুখ মাথা দেখা যায় না। এমন টুপি হরদম দেখা যায় চাঁদনির ফুটপাথে। বর্ষাকালেই বেশি।

লোকটা জ্যাকির পিছু পিছু এগুতে লাগল। সামান্য দূরত্ব রেখে।

চন্দন ভবানীকে বলল, “নে, ওদের পেছন পেছন চল। ফলো করবি। এগিয়ে যাবি না।”

ভবানী প্রথমটায় অবাক হয়েছিল, পরে অটোতে স্টার্ট দিল।

সোজা রাস্তা। একটা মোড় বাঁদিকে। পরে ছোট রাস্তা। বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির করে। মেঘও ডাকল।

“জ্যাকি বুঝতে পেরেছে, তারাপদ বলল, “একবার ঘাড় ঘোরাল। ও জানে ওকে কেউ ফলো করছে।”

“হ্যাঁ। স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছে গাড়ির।”

“লোকটাও বাড়াবে।”

 ভবানী বলল, “দাদা আর একটু কাছাকাছি যাব?”

“না।”

 বলতে না বলতেই জ্যাকি চট করে একটা গলির মধ্যে ঢুকে গেল। অদৃশ্য। লোকটাও চতুর। কয়েক মুহূর্ত থতমত খেয়ে সেও গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল।

চন্দনদের অটো গলির মুখে এসে দাঁড়াল।

হঠাৎ শব্দ। এত আচমকা, অপ্রত্যাশিত যে চন্দনরা চমকে গেল। এ তো গুলির আওয়াজ। কলকাতা শহরে আজকাল কে আর বোমা পটকা গুলির আওয়াজ না শোনে কানে।

তারাপদ ঘাবড়ে গেল।

ভবানীও থতমত খেয়ে গিয়েছে। ভয়ও পেয়েছে।

চন্দন এক মুহূর্ত ভাবল, তারপর ভবানীকে বলল, “গলির মধ্যে ঢুকিস না।”

ভবানী বলল, “দাদা, আর এগুলেই বিপদে পড়ব। এদিকে অন্য কোনও গাড়ি নেই। পুলিশ ঢুকে পড়লে আমাদের ধরবে।”

চন্দন জানে। গলির মধ্যে কে কাকে গুলি করেছে সেটা পরের কথা, কিন্তু কেউ যদি অটোটাকে ঢুকতে দেখে ধরে নেবে অটো থেকেই…..। ব্যস্ত হয়ে চন্দন বলল, “না, যাবি না। ঘুরিয়ে নে মুখ। পালা…..”

ভবানী আগেই অটোর মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।

.

পালিয়ে এসে ভীত গলায় তারাপদ বলল, “কী হল, বল তো?”

“জানি না।”

“গুলি চালিয়ে দিল? জ্যাকিকে মারতে চেয়েছে। জ্যাকির কী হল? আমার ভয় করছে চাঁদু।”

চন্দন বলল, “বুঝতে পারছি না। জ্যাকিই যদি গুলি চালায়।”

“জ্যাকি?”

“ওকে রোজ ফলো করছে দেখে আজ নিজেই ফাঁদ পেতে লোকটাকে যদি গলিখুঁজি ঘুরিয়ে বেজায়গায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে।….আমরা ওদিককার কিছুই জানি না।”

তারাপদ ধাঁধার মধ্যে থাকল; বুঝতে পারছিল না, কী হল, কী হতে পারে।

নিজেদের এলাকায় এসে চন্দন অটোর ছেলেটাকে ছেড়ে দিল। সে বেচারি রীতিমতন ঘাবড়ে গিয়েছিল। চন্দনের কথা মতন সে একটা স্কুটারের পিছু পিছু যাচ্ছিল। লোকটা কে সে জানে না। তা জানুক বা না-জানুক, গুলি চলাচলির সময় গলিটার মধ্যে ঢুকে পড়লে বিপদ হত। পুলিশ এসে ধরবার আগেই যদি পাড়ার লোক এসে পড়ত গলিতে, ভবানীদের আর বেঁচে ফিরতে হত না, পিটিয়ে শেষ করে দিত।

ভবানীকে ছেড়ে দিয়ে চন্দন বলল, “কিছু মনে করিস না, আমি নিজেও জানতাম না এমন হবে! তোকে বিপদে পড়তে হবে জানলে কি ডাকতাম তোকে! যাক, শেষ পর্যন্ত কিছু হয়নি। বাড়ি যা এবার। আজকের কথা কাউকে বলিস না।”

“আপনারা জ্যাকি জ্যাকি বলছিলেন, কে সে?”

 চন্দন একবার তারাপদকে দেখল। নামটা ভবানীর কানে গিয়েছে। কথা লুকিয়ে লাভ নেই। চন্দন বলল, “যে-লোকটার স্কুটার আগে ছিল সে জ্যাকি।”

“পরের লোকটা?”

“জানি না। তাকেই ফলো করছিলাম।..যা তুই বাড়ি চলে যা। আমরা পরে যাব।”

ভবানী চলে গেল।

তারাপদ আর চন্দন ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে বসার মতন জায়গা খুঁজছিল। মামুলি একটা চায়ের দোকান তখনও খোলা। একটু পরেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

দোকানে এসে বসল দু’জনে। “দু’ কাপ চা।”

তারাপদ সিগারেট খুঁজল।

 “তারা?”

“উঁ!”

“কী হল বল তো? কে কাকে গুলি করল? যদি ওই লোকটাই জ্যাকিকে গুলি করে থাকে! হতেও তো পারে।” চন্দন নিচু গলায় বলল, যেন কারও কানে না যায় কথাটা।

তারাপদ সিগারেট ধরিয়েছিল। ধোঁয়া গিলে বলল, “হতেই পারে। হয় এ, না হয় ও!”

“জ্যাকি যদি ইনজিওরড হয়…! বেজায়গায় লাগলে সর্বনাশ…!”

“আমরা কোনও চিৎকার শুনিনি।”

“গলির বাইরে ছিলাম। শুনতে পাইনি হয়তো। পালিয়েও এলাম সঙ্গে সঙ্গে। তবু তুই যা বলছিস ঠিকই। চিৎকার শুনিনি।”

তারাপদ কথা বলল না। চুপচাপ।

চা এল।

চায়ে চুমুক দিয়ে চন্দন বলল, “তুই কাল সকালেই একবার কিকিরার কাছে যা। ব্যাপারটা জানিয়ে আয়।”

“আমার অফিস।”

“সকাল সকাল যাবি। ফিরে এসে চান-খাওয়া করবি। …..ও হয়ে যাবে।”

“তুই?”

“আমি বিকেলে কিকিরার বাড়িতে হাজির থাকব।”

তারপদ মাথা হেলিয়ে জানাল, কাল সকালেই সে কিকিরার বাড়ি যাবে।

“নে, চা শেষ কর তাড়াতাড়ি। আজ রাতে আমার ঘুম গেল! জ্যাকি যদি ফট হয়ে যায়… কী জানি, বুলেট ইনজুরি হল অনেকটা লাক, হাতে পায়ে কাঁধে লাগলে রক্ষে, মাথায় আর বুকে লাগলে…”

“জ্যাকির মাথায় হেলমেট ছিল…”

“মে গড সেভ হিম।”

চা শেষ করে উঠে পড়ল দু’জনে।

.

সাত সকালে তারাপদ কিকিরার বাড়িতে হাজির।

কিকিরা অবাক হয়ে বললেন, “এ কী! তুমি! কী ব্যাপার তারাচাঁদবাবু!”

ঠাট্টার সময় এখন নয়। তারাপদ গম্ভীর হয়ে বলল, “আপনার ভাইপো বেঁচে আছে, না, হাসপাতালে খোঁজ নিন আগে।”

“কেন, কেন?”

তারাপদ গতকালের ঘটনা বলল বিস্তারিত ভাবে।

 কিকিরা হকচকিয়ে গেলেন। “বলো কী! এতদিন তো গুলিবন্দুক আমদানি হয়নি। এবার তাও হল…।”

“আগে আপনি খোঁজ নিন।”

“নিচ্ছি।”

“চাঁদু ও-বেলা আসবে। আমার আসতে আসতে ছ’টা। তার আগে পারব না। অফিসে আজ অনেক কাজ…।” তারাপদ বেশিক্ষণ বসল না। চা খেয়েই চলে গেল।

.

০৬.

কিকিরার ঘরে বসেই আলোচনা হচ্ছিল।

জ্যাকির খোঁজ সকালেই নিয়েছেন কিকিরা। না, জ্যাকির কিছু হয়নি; সে ঠিকই আছে।

তা হলে গুলি?

 গুলির রহস্যটা অদ্ভুতই বলতে হবে। কিকিরা যেমনটি শুনেছেন জ্যাকির কাছে, তারাপদদের বললেন।

আসলে যে-বাড়িতে জ্যাকির চেম্বার, সেই বাড়ির অন্য খুপরিগুলোয় আরও চার-পাঁচজনের ছোট ছোট অফিস আছে। কারও এজেন্সি অফিস, কারও বা এক্সপোর্ট সার্ভিস অফিস। ইনকাম ট্যাক্সের দুই উকিলও একটা ঘরে ভাগাভাগি করে বসে বিকেলবেলায়। এ ছাড়া হালে এক ফিনান্স কর্পোরেশানের কোনও কর্তা একটা ঘর দখল করে বসে আছেন। সেখানে প্রায়ই লোকজন আসে, তারা নাকি ফিল্ড ওয়ার্কার। জ্যাকির এই চেম্বার তার বাবার আমলের। বাড়িটার নীচে যার পানের দোকান সে বেশ চালাক চতুর। নাম রামশঙ্কর, বছর চল্লিশ বয়েস। জ্যাকির সঙ্গে রামশঙ্করের বরাবরই খাতির। দোকানের গায়ে একপাশে ফুটপাথে স্কুটার রাখে জ্যাকি। পানওলা রাম নজরদারি করে স্কুটারের। ইদানীং সে জ্যাকির কথামতন আরও একটা জিনিসের ওপর লক্ষ রাখছে।

তারাপদ বলল, “বুঝেছি। সে ওয়াচ করছে জ্যাকি চেম্বার ছেড়ে বেরনোর পর অন্য কেউ তাকে ফলো করছে কিনা!”

“ধরেছ ঠিক।” কিকিরা বললেন, “পানঅলার পজিশানটা ভাল, এ-পাশ ও পাশ নজর রাখতে পারে। যে-কোনও গলি থেকে ফট করে বেরিয়ে এল দেখতে তার অসুবিধে হয় না।”

“ভাল ব্যবস্থা, সার।”

“কাল যখন জ্যাকি চেম্বার ছেড়ে চলে আসছে, তখন রামশঙ্করকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, রুটিন পালটে গিয়েছে। অন্য দিন একজন কেউ পিছু নেয়, আজ আরও একটা দল আছে।”

“মানে?”

“একটা অটো অনেকক্ষণ থেকে তফাতে- মিল্ক বুথের কাছে দাঁড়িয়ে আছে।”

তারাপদ চন্দন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। থমকে গিয়ে বলল, “বলেন কী? আমাদেরও দেখেছিল!”

কিকিরা বললেন, “জ্যাকি জেনেশুনেই কাল খানিকটা ঘুরপথে এ-গলি ও গলিতে ঢুকে পিছু-নেওয়া লোকগুলোকে মিসলিড করেছিল।”

চন্দন বলল, “যা বাব্বা! আমরাও সাসপেক্ট হয়ে গেলাম।”

“তা ওর দোষ কী! ও কেমন করে জানবে তোমরা অটোয় চেপে বসে আছ?”

তারাপদ বলল, “রাম সে রাম! কেচ্ছা! … কিন্তু গুলি।”

“গুলির শব্দ সেও শুনেছে। শুনে তার ধাঁধা লেগে গিয়েছিল। আগে এরকম হয়নি। ভয় পেয়ে কাছাকাছি গলিতে ঢুকে পড়ে পালিয়ে এসেছে।”

চন্দন হাঁ করে কিকিরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েক পলক। তারপর বলল, “গুলিটা কে করল, সার?”

“সিমপিল ব্যাপার হে। ভেরি ইজি কোশ্চেন। তোমরা গুলি চালাওনি, জানোই না গুলি চালাতে; জ্যাকি নিজের খুলি নিজে ওড়াবে না; তা হলে রইল ওই থার্ড পার্টি– মানে, দ্য আদার ম্যান- যে স্কুটারে চড়ে জ্যাকিকে ফলো করছিল। সহজ বুদ্ধি তো তাই বলে।”

তারাপদ অনেকটা যেন স্বস্তি পেয়েছে; বলল, “আমরা জোর বেঁচে গিয়েছি।”

চন্দন বলল, “লোকটা জ্যাকিকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছিল। এ তো কিলিং, সার। খুনের চেষ্টা।”

মাথা হেলিয়ে কিকিরা বললেন, “তাই মনে হয়। হওয়া স্বাভাবিক। তবে যদি এমন হয়, লোকটা বুঝতে পেরেছিল তোমরা অটো নিয়ে তাকে ফলো করছ বুঝে তোমাদের তাড়াবার জন্যে, ঘাবড়ে দেওয়ার জন্যে ফাঁকা গুলি চালিয়েছিল তা হলে সার কী বলবে। বে-আন্দাজ গুলি।”

চন্দন আর তারাপদ চুপ! কী বলবে! কিকিরা যা বলছেন– তাও হতে পারে। আবার নাও পারে।

“জ্যাকিকে আপনি বলেছেন- অটোতে আমরা ছিলাম।”

“বলেছি।… সে বলল, এভাবে ওদের পাঠাবেন না, অ্যাঙ্কল! আমার লাইফের রিস্ক আমার, ওরা কেন বিপদে পড়বে!”

তারাপদ সঙ্গে সঙ্গে বলল, “কিকিরা, আমরা নবিশ লোক। গুলি গোলার মধ্যে নেই। আর ও-পথ মাড়াচ্ছি না।”

কিকিরা হাসলেন।

আজ বৃষ্টি নেই। সকাল থেকেই খটখটে দিন। চড়া রোদ উঠেছিল ও-বেলায়, স্যাঁতসেঁতে বাড়িঘর খানিকটা শুকিয়ে গেছে এক বেলার রোদে। এখন শুক্লপক্ষ।

সবে শুরু। বাইরে চাঁদের আলো বোঝা যায় না। এরই মধ্যে একটা কিছু ঘটল রাস্তায়। চেঁচামেচি হইরই। নীচে রাস্তায় এমন হট্টগোল প্রায়ই হয় এখানে। চন্দন একবার দেখে নেওয়ার চেষ্টা করল। ট্যাক্সি ভার্সেস প্রাইভেট গাড়ি। ধাক্কাধাক্কির ব্যাপার।

বগলা একবার ঘরে এসেছিল। এঁটো প্লেট কাপ ডিশ তুলে নিয়ে চলে গিয়েছে।

তারাপদই কথা বলল খানিকটা সময় চুপচাপ থাকার পর। বলল, “কিকিরা, আপনার জ্যাকিকে বলুন না এসব ঝুট-ঝামেলা থেকে সরে দাঁড়াতে। যে-টাকা সে দিয়ে ফেলেছে দাদন হিসেবে সেটা বরং ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করুক।”

কিকিরার গলার অবস্থা এখন ভাল। সর্দি কাশি ফ্লয়ের ভাব কবেই কেটে গিয়েছে। নিজের মনে কী ভাবছিলেন। অন্যমনস্কভাবেই নিজস্ব চুরুট ধরালেন একটা, সরু আঙুলের মতন চুরুট। “কী বললে?”

“বললাম, জ্যাকিকে ব্যাক করতে বলুন।”

“নতুন কথা কী বললে তারা! এ-কথা তো প্রথম থেকেই তার মা কাকা বলছে। কিন্তু সে ব্যাক করবে না।”

“কেন?”

“খানিকটা জেদ। কেনই বা করবে! কেউ যদি বলে পোড়োবাড়ি মানেই ভূতের বাড়ি, হানাবাড়ি– তাই শুনে কি সবাই হাত গুটিয়ে নেয়।”

“এটা অন্যরকম কেস! জ্যাকির লাইফ রিস্ক হয়ে যাচ্ছে।”

“তা হচ্ছে।”

“তা হলে?”

কিকিরা কোনও জবাব দেওয়ার আগে চন্দন বলল, “কিকিরা, আপনি আমি আমরা সবাই বুঝতে পারছি, বাড়িটা পোড়োই হোক আর যাই হোক, এমন কেউ বা কারা আছে যারা জ্যাকিকে বাড়িটার মালিক হতে দিতে চায় না। তাদের মোটিভ ক্লিয়ার, ওই বাড়ি তুমি কিনতে পারবে না..! ঠিক কি না!”

কিকিরা বললেন, “কোনও ভুল নেই কথায়। দুয়ে দুয়ে চার, সহজ অঙ্ক।”

“তবে কেন?”

বাধা দিলেন কিকিরা। বললেন, “এটা কি মগের মুলুক। আমি টাকা দিয়ে বাড়ি কিনব, তুমি কিনতে দেবে না! হু আর ইউ? তোমার লিগাল অথারিটি কী আছে মশাই! … আর তোমার নিজেরই যদি কেনার ইচ্ছে থাকত- আগে কেন কিনলে না? বাড়ি তো পড়েই ছিল। তখন কেন নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলে! আর আজ আমি যখন কিনতে যাচ্ছি, তুমি আমায় শাসাতে ভয় দেখাতে শুরু করেছ! …”

কথাটা ঠিকই। তুমি কেন ভয় দেখাবে।

সামান্য উত্তেজিত হয়ে উঠলেন কিকিরা। “না, চাঁদু ব্যাপারটা অত সোজা অঙ্ক সত্যিই নয়। হ্যাঁ, জ্যাকি যেন বাড়িটার মালিকানা না পায় এটা তার বিপক্ষের লোকদের মোটিভ অবশ্যই। কিন্তু কেন? কী আছে ওই বাড়িতে? ভাঙা ইট সুরকি কাঠ কড়ি বরগার জন্যে ঘুম হবে না তাদের তা হতে পারে না। কলকাতায় ভাঙা বাড়ির অভাব নেই, সেখানে গিয়ে ইট কাঠ কিনতেই পারে তারা। এ-বাড়িতে তার অনেক বেশি– অনেক বেশি কিছু থাকতে পারে। সেটা কী?”

চন্দন কিকিরার মুখ দেখছিল। ওঁরও যেন জেদ ধরেছে। তারাপদর দিকে মুখ ফেরাল চন্দন।

তারাপদ বলল, “কী সেটা, আমরা কেমন করে জানব, সার! আপনিই বলুন।”

কিকিরা মাথা নাড়ালেন। “এখন বলতে পারছি না। খোঁজখবর নিচ্ছি। তবে একটা কথা মাথায় রাখবে, তেরো নম্বর বাড়ির ওই ঘরটা কালো বাক্স আর কফিন… ওরই সঙ্গে রহস্যটা জড়িয়ে আছে। তবে কালো বাক্সটা দেখে আমার মনে হল হ্যারিশ ওর মধ্যে কাজের জিনিসপত্র রেখেছিল।

চন্দন রুমাল বার করে মুখ মুছল। চকচকে চোখ। বলল, “আপনি জানতে পারলেন কিছু?”

কিকিরা প্রথমে চুপচাপ থাকলেন। পরে বললেন, “আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি। মুশকিল হল, পাড়াটা আমার অজানা, মানে ওদিকে আমার চেনাজানা লোক কেউ নেই। চেলাও নেই। শেষে খুঁজে খুঁজে একজনকে পেলাম– পাড়ার কাছাকাছি লাগোয়া পাড়ায় থাকে। ছেনু গুণ্ডা…”

“ছেনু গুণ্ডা!”

“ভাল নাম শ্রীদাম বা ছিদাম। ওরফে কালু, ওরফে টিকিয়া, ওরফে হাতকাটা ছে। ছেনুর কেরিয়ার বলো আর বায়োডাটা বলো- খারাপ নয়। তিনবার জেল, মার্ডার কেসের আসামি হয়নি একবারও, তবে দাঙ্গা মারামারি, লুঠ, চোরাই পিস্তল বিক্রি, বোমাবাজি– এসব তার কোয়ালিফিকেশনের মধ্যে আছে..”

তারাপদ হাততালি দিয়ে বলল, “বাঃবাঃ, আপনি তবে ছেনু গুণ্ডার গডফাদার?”

“গ্র্যান্ডফাদারও বলতে পারো, কিকিরা ঠাট্টার গলায় বললেন, “এটা অবশ্য সে গ্র্যান্ড নয়, গ্র্যান্ড হোটেলের গ্র্যান্ডের মতন…”

চন্দন হেসে ফেলল।

 কিকিরা বললেন, “তোমরা ছোটখাটো চোর ছ্যাচড় গুন্ডাদের যতটা ঘেন্নাপিত্তি করো, বিগদের বেলায় তা করো না! বিগদের বেলায় মিস্টার, রেসপেকূটেড সার…! তা সে যাই হোক, ছেনো বা ছেনু এখন জেন্টলম্যান। রেস্তরাঁ লাগিয়ে দিয়েছে। প্লাস এন্টালি বাজারে মাছের একটা স্টল। ছেনুর গোঁফ পেকে সাদা, মাথার চুলও টুয়েলভ আনা হোয়াইট। ধবধবে সাদা জামা পরে বসে থাকে তার রেস্তরাঁয়। পরনে ধুতি। দেখলে তোমাদের মনে হবে ধর্মপুত্তুর। বেচারির বাঁ-হাতের আধখানা কাটা।… ইয়ে মানে এরা হল আগের জেনারেশানের হিরো। এখন লস্ট। ওরা গজরাত বেশি, বর্ষণ তত হত না।”

চন্দন বলল, “জোক রাখুন! কী বলল ছেনু?”

“ছেনু কিছু বলেনি। সে দিন দুয়েক সময় চাইল। তারপর আমাকে এক বুড়োর কাছে নিয়ে গেল। বুড়ো একসময় কলকাতা কর্পোরেশানে কাজ করতেন। নেপালচন্দ্র সাধুখাঁ। নেপালবাবুর বয়েস এখন সত্তরের কাছাকাছি। থিন এরারুট বিস্কুটের মতন গায়ের রং এবং পাতলা চেহারা। উনি ঠিক হায়দার লেনের বাসিন্দ নন; এলাকাটা নাগালের মধ্যে। তার চেয়েও বড় কথা– কর্পোরেশানে অ্যাসেসমেন্ট ডিপার্টমেন্টে কাজ করার সময় ওঁর নজরদারিতে ছিল জায়গাটা…”

“মানে?”

“মানে নেপালবাবুর এক্তিয়ারের মধ্যে ছিল পাড়াটা। তিনি খোঁজখবর রাখতেন ওদিককার। তা ছাড়া ভদ্রলোকের জ্ঞানচর্চায় মতি আছে শুনলাম, একটু ন্যাক।”

চন্দন, তারাপদ প্রায় একই সঙ্গে বলল, “তেরো নম্বর বাড়িটা চিনতেন উনি?”

চুরুট টানতে টানতে কিকিরা বললেন, “চেনারই কথা। অসুবিধে কী জানো হে, ভদ্রলোকের একে বয়েস হয়েছে, তাতে পেটরোগা মানুষ। কে যে তাঁকে এক গুলি আফিং খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল পেটের জন্যে, ফলে বুড়ো সন্ধেবেলায় একটু মৌতাতে থাকেন।”

“তা থাকুন, আসল কথা কী বললেন?”

“বললেন, ওই বাড়িটা নিয়ে একটা গল্প চালু আছে। এমন গল্প কত বাড়ি নিয়েই থাকে। শ’ সোয়া শ’ বছর আগে ওই এলাকা ছিল প্রায় অস্পৃশ্য। লোকজন ঘেঁষত না। পরে দু-চারটে করে ঘরবাড়ি হতে হতে রাজা পঞ্চম জর্জের আমল নাগাদ ফ্যান্সি পাড়া হয়ে উঠল। অ্যাংলো সাহেবদেরই আস্তানা। তারপর বিশ-পঁচিশ বছর পরে জমে উঠল জায়গাটা। আর যুদ্ধের পর তো রথের মেলা। হালের তিরিশ চল্লিশ বছরে ওখানে যত্রতত্র যার যেমন খুশি পায়রার খুপরি করে হরেকরকম লোক থাকে…”

“তেরো নম্বর বাড়ির কী হল?” তারাপদ বলল। কিকিরা বললেন, “নেপালবাবুর কথা যদি মানতে হয় তবে বলতে হবে এক পর্তুগিজ সাহেব একদা ওই বাড়িতে সংসার পেতেছিলেন। স্ত্রী, মেয়ে আর তিনি৷ উনি নাকি আফ্রিকা থেকে এ-দেশের কালিকট পর্যন্ত জাহাজি কাজ করেছেন। পরে এখানে। সাহেব কলকাতা শহরে একটা বেকারি চালু করেন। নিজেই মালিক। সাহেবি বাড়িতে তাঁর বেকারির পাঁউরুটি কেকটেকের বিক্রিবাটা ছিল ভালই।”

চন্দন বলল, “তার মানে বেকারি করে ফেঁপে উঠেছিলেন!”

“হতে পারে দুটো পয়সা হয়েছিল। কিন্তু কপাল মন্দ সাহেবের। কলকাতায় বেরিবেরি ধরনের কী-এক রোগ লাগল। তাতেই মারা গেল স্ত্রী আর মেয়ে।”

“আর সাহেব?”

“ক’ বছরের মধ্যে তিনিও কবরের মধ্যে।… এই দেখো একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। সাহেব রীতিমতন গোঁড়া খ্রিস্টভক্ত ছিলেন।”

“কলকাতায় একটা পর্তুগিজ চার্চ আছে না?”

“তা থাকুক। ওর হিস্ট্রি আমি বাবা জানি নে। কলকাতায় কী না আছে! আর্মেনি গির্জাও আছে। কত সাহেবসুবো এল গেল বাপু! তা পর্তুগিজ সাহেবরা এখানে কী ব্যবসা বাণিজ্য করত, কতই বা নিজেদের লোক ছিল– তাও বলতে পারব না। সহজ কথাটা হল এই যে, ওই সাহেবের কাছে নাকি বিখ্যাত পাদরি পেইজ-এর (Paiz) একটা ক্রশ ছিল। অমূল্য সম্পদ।”

“ক্রশ?”

“নেপালবাবু বললেন, তিনি তাই শুনেছেন। আধ হাতটাক লম্বা। সোনা দিয়ে তৈরি। ক্রসের ওপর হিরে পান্না চুনির কাজ…। রকমারি দামি পাথরের।”

 “সাহেব ওটি পেলেন কেমন করে?”

“কেউ বলে আফ্রিকা থেকে চুরি করেছিলেন। অ্যাবিসিনিয়ার চার্চ থেকে। কেউ বলে লিসবনের কোনও চার্চ থেকে।… তা এ তো সব গল্প হে! সত্যিমিথ্যে কেউ জানে না। জোর করে বলতে পারবে না।”

“গল্পটা আপনি নেপালবাবুর মুখে শুনলেন?”

“তা ছাড়া কার কাছ থেকে শুনব! আমার চৌদ্দপুরুষও জানে না এমনি সাহেব আর পর্তুগিজ সাহেবদের মধ্যে তফাতটা কোথায়! আমাদের চোখে সব সাহেবই সাহেব। ভাগ্যিস ছেলেবেলায় ইতিহাস বইয়ে ভাস্কো দা গামার নাম পড়েছিলাম, নয়তো পর্তুগিজ যে কারা তাও জানতাম না।”

তারাপদ বলল, “সেই ক্রশের কী হল? যদি সত্যিই সেটা থেকে থাকে!”

 কিকিরা এবার রহস্য করে বললেন, “শোনা যায়, মানে নেপালবাবু শুনেছেন– সেটি ওই তেরো নম্বর বাড়ির মাটির তলায় কোথাও পোঁতা আছে।”

তারাপদরা যেন খানিকটা চমকে উঠল। চন্দনের চোখে চোখ রাখল সে। যেন বলতে চাইল, কী বুঝছিস রে! চন্দনও ইতস্তত করছিল।

“সার, এটা কি আফিংখোরের গল্প?” চন্দনই বলল শেষে।

 মাথা নাড়লেন কিকিরা। “পরমেশ্বরই জানেন।”

“আবার পরমেশ্বর কেন! …আপনি আর কী জানেন? মানে নেপাল সমাচার?”

“এই তো তোমাদের দোষ! বিশ্বাসও করবে না, আবার জোক করবে?”

“বাড়িটার কী হল তারপর? পর্তুগিজ সাহেব মারা যাওয়ার পর?”

“হাত বদল আর জাত বদল! সবই ওদের জাতভাইদের মধ্যে। তবে ওরা আর পর্তুগিজ নয়। দু-তিন দফা হাত বদলের পর এল পাগলা হ্যারিশের হাতে।”

“হোয়াই পাগলা হ্যারিশ?”

“লোকে তাই বলত।”

“কী করত পাগলা হ্যারিশ?”

“কফিন মেকার। কফিন তৈরি করত।”

“কী?”

“কফিনের বাক্স তৈরি করত। অর্ডিনারি কফিন বাক্স থেকে দামি কফিন বাক্স পর্যন্ত। ওহে তারাবাবু, আমাদের যেমন তিলকাঞ্চন থেকে বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ পর্যন্ত রয়েছে, গরিব বড়লোক মানুষ যে যেমনটি চায় করে, ওনারাও তেমন বারোয়ারি থেকে মনোহারি- যার যেমনটি ইচ্ছে কফিন বাক্সটি পছন্দ করে নেন।”

“বাঃ! কোন সিনেমায় যেন দেখেছিলাম… রাজকীয় এক বাক্স তৈরি হচ্ছে।”

“দেখতে পারো। আমার বেলায় হিন্দু সৎকার সমিতির ব্যবস্থা করবে! জলের দরে ভাড়া পাবে!”

“আপনার তামাশা রাখুন! আর কোনও কিছু শুনলেন না?”

“শুনলাম,” কিকিরা বললেন, “পাগলা হ্যারিশ নাকি নিজের জন্যে একটা কফিন বাক্স তৈরি করেছিল। অ্যাডভান্স ব্যবস্থা…!”

চন্দন অবাক! কিকিরাকে দেখছিল। বলল, “মানে?… আমরা যে কফিন বাক্সটা দেখেছি ঘরে, সেটা কি তবে পাগলা হ্যারিশের?”

“খুব সম্ভব।”

“কিন্তু সেটা তো ঘরেই পড়ে আছে, কবরখানায় যায়নি।”

“না। যায়নি, কেননা যারা তার কবরের ব্যবস্থা করেছিল তখন তারা হয়তো জানত না যে হ্যারিশের বাড়িতেই তার নিজের হাতে তৈরি করা কফিন বাক্স পড়ে আছে!… তোমরা ভুলে যাচ্ছ পাগলা হ্যারিশ দাঁতব্য হাসপাতালে মারা যাওয়ার পর- যারা তার শেষকৃত্য করেছে তারা ওদেরই একটা ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান। দয়াধর্ম করাই তাদের কাজ। ওদের কি এসব জানার কথা!”

তারাপদ বলল, “আপনি আবার কথা বলছেন, সার! যে-লোক মারা যাওয়ার আগে নিজের নাম ঠিকানা পরিচয় জানিয়ে যেতে পারল, সে তার মনের শেষ ইচ্ছেটা জানিয়ে যাবে না?”

চন্দন মাথা নাড়ল। “ঠিক কথা। তালুকদার আপনাকে এ ব্যাপারে কিছু জানায়নি? সে তো হ্যারিশকে আইডেনটিফাই করতে গিয়েছিল!”

কিকিরা একটা শব্দ করলেন। যেন হতাশ হয়েছেন চন্দনদের কথা শুনে। বললেন, “তোমরা বেলাইনে যাচ্ছ। প্রথম কথা, হ্যারিশ মর্টগেজ মামলায় বাড়িটা খুইয়েছিল। তারপর পালিয়ে যায়, বা খেপাটে হয়ে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। কেউ তার খোঁজ পায়নি। পরে ওদেরই একটা চ্যারিটেবল হাসপাতালে এসে আশ্রয় নেয়। সব কথা বলার মতন অবস্থা ওর হয়তো ছিল না। তা ছাড়া তালুকদাররা নিজেরা হাসপাতালে যাবেন কেন ডেডবডি শনাক্ত করতে, তাঁদের লোক গিয়েছিল।… আর বাপু, মানুষের আয়ুর কথা, হ্যারিশ শেষ সময়ে কতটা বলতে পেরেছে, তার সাধ্য ছিল- কে বলবে! হতে পারে তার ক্ষমতায় কুলোয়নি।”

আপত্তি করা যাক বা না যাক তারাপদরা চুপ করে থাকল।

 নিজেই একসময় বললেন কিকিরা, “তবে এসব তো গল্প! শোনা কথা। পাগলা হ্যারিশ সাহেবকে নিয়ে ওদের মহল্লায় গল্পটা চাউর হয়ে থাকতে পারে। নিজেই হয়তো কাউকে ঠাট্টা করে বলেছিল সাহেব।”

তারাপদ বাধা দিয়ে বলল, “সে যাই হোক, ওই বাড়ির একটা ঘরে সত্যিই তো কফিন বাক্স আছে একটা।”

“হ্যাঁ।”

“এর কী উত্তর হতে পারে?”

“ভাবছি!”

“একটা কালো ট্রাঙ্কও ছিল, আছে এখনও। আপনার কথায় হ্যারিশের কাজের বাক্স।”

“কে অস্বীকার করবে হে! আমরা স্বচক্ষে দেখলাম…”

“আপনার জ্যাকি কি হ্যারিশ সাহেবের সব কথা জানে?”

“কিছু জানে নিশ্চয়ই, তবে ওই যে ফাদার পেইজ, কিংবা সোনার ক্রশ, গায়ে মণিমুক্তো বসানো~ এসব গল্প বোধ হয় জানে না। জানার কথাও নয়। আমি আফিংখোর বুড়ো নেপালবাবুর মুখে শুনেছি। গল্পটা তাঁরও শোনা।”

“আপনি বলছেন নেপালবাবুর বয়েস সত্তরের মতন; তিনি সেই আদ্যিকালের কলকাতার কথা জানবেন কেমন করে? কোনও চালু কাহিনী শুনেছেন বোধ হয়।”

চুরুট ফেলে রেখে মাথার চুল ঘাঁটতে ঘাঁটতে কিকিরা দ্বিধার গলায় বললেন, “সে তো আগেই বলেছি। এই কলকাতা শহরের কত কিছু নিয়েই বানানো গল্প চালু আছে। আবার আসল-ভেজাল মেশানো গল্পও আছে। নেপালবাবুর স্টোরিটাকে তুমি আমি না মানতে পারি। কিন্তু একটা কথা মানতেই হবে ভদ্রলোক যে শুধু কর্পোরেশানের অ্যাসেস ডিপার্টমেন্টে এককালে কাজ করতেন– শুধু তা নয়– ওঁর আবার পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটা বইপত্র পড়ার শখ ছিল। পাদরি পেইজ নামটা বইয়ে পাওয়া যায়। আফ্রিকায় ছিলেন পাদরি সাহেব। আর উনি বললেন, আজ আমরা সোনা সোনা করে কেঁদে মরি, কিন্তু তিন-চারশো বছর আগে ওইসব পর্তুগিজ স্প্যানিয়ার্ড ডাচরা বাইরে বেরিয়েছে জাহাজ নিয়ে নতুন নতুন দেশ খুঁজতে, ব্যবসা বাণিজ্যর ব্যবস্থা দেখতে– আর এরা যেমন মরেছে জলে ডাঙায়, তেমনই আবার কোথাও পা রাখতে পারলে মাটি গেড়ে বসার চেষ্টা করছে, খুনোখুনি রক্তপাত করেছে সেইভাবে তাল তাল সোনা মুঠো মুঠো মণিমুক্তো নিয়ে নিজেদের দেশে পালিয়ে গিয়েছে…”

তারাপদ জোরে হেসে উঠল। ঠাট্টার গলায় বলল, “কিকিরা সার, আপনি কি মাস্টারি করতেন একসময়?”

কিকিরাও হেসে ফেললেন। বললেন, “না বাপু, পৃথিবীতে দুটো জিনিসকে আমি ভীষণ ভয় পাই। নাম্বার ওয়ান, মাস্টারি; নাম্বার টু স্নেক প্লেয়িং–!”

“স্নেক প্লেয়িং–!” চন্দন অবাক; বুঝল না।

কিকিরা ঘাড় দুলিয়ে বললেন, রসিকতার গলায়, “সাপ খেলানো। সাপুড়েদের আমার ভীষণ ভয়। ওরা যেভাবে খেলা দেখায় গা আমার শিউরে ওঠে।”

রাত হচ্ছিল। তারাপদরা উঠি-উঠি ভাব করল।

 “তা হলে শেষ পর্যন্ত– জ্যাকির কেসটা…?”

“কেসটা গিঁট পড়ে যাওয়া। খোলা মুশকিল। জবর গিঁট। তবে একটা ব্যাপারে আমার কোনও সন্দেহ নেই।”

“কী ব্যাপারে?”

“ওই বাড়িতে একটা কিছু লুকনো রহস্য আছে। জ্যাকি কেন, কাউকেই ও বাড়ি ওরা কিনতে দেবে না। …আর আমি বলছি, ওই ঘরটা যেখানে কফিন বাক্স আর ট্রাঙ্ক পড়ে আছে, ওই ঘরই হল রহস্য। মিস্ত্রি।… আর ক’দিন দেখি– তারপর একটা প্যাঁচ কষব। হয় জিতব, না হয় হারব।”

.

০৭.

শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি কলকাতা শহর জলে ডুবে থাকল দিন দুই। ঘটনাটা নতুন নয়; প্রতি বর্ষাতেই বার কয়েক এমন হয়। জলে তলিয়ে থাকে এমন জায়গা কলকাতায় কম নেই। উনিশ বিশের কথা বাদ দিলে ষাট সত্তর আশি বছর আগেও যেখানে যেখানে জলে ভেলা ভাসিয়ে ছেলের দল মজা করত, আজও সেখানে জল থইথই করে বর্ষার মরশুমে। মাঝে মাঝে।

চন্দন ঠাট্টা করে বলে, চিরস্থির এই নীর, বুঝলি তারা! এর আর হেরফের হবে না।

সেই চন্দনই অনেক কষ্ট করে জল সাঁতরে তার নতুন হাসপাতালে গেল চাকরি বজায় রাখতে। একদিন গেল, অন্যদিন পারল না।

চারদিনের মাথায় প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল শহর। মাঝে মাঝে মেঘলা থাকলেও রোদ উঠছিল। কটকটে রোদও নয়। বাতাসও ছিল বাদলার ঠাণ্ডা মেশানো।

নিজের পুরনো কোয়ার্টার এখনও ছাড়েনি চন্দন। দেরি হবে এক-দুমাস।

সেদিন হাসপাতালে বেরুবার সময় ভবানী এসে হাজির। তার অটো নিয়েই।

 “কী রে, তুই! আমি হাসপাতালে বেরুচ্ছি।”

“চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।”

“চল, ভালই হল।”

অটোয় উঠল চন্দন। ভবানী প্রথমটায় কিছু বলল না। সামান্য পরে বলল, “দাদা, একটা কথা।”

“কী?”

সামান্য ইতস্তত করে ভবানী বলল, “বদুয়ার নাম শুনেছেন? শোনেননি!”

“ব-দুয়া! কে বদুয়া?”

“রাজা শের, তার দলের লোক। মস্তান। রাজাকে লোকে ‘শের’ বলে। হেভি গুন্ডা!”

চন্দন অবাক! রাজা শের, বদুয়া এসব নাম জীবনে সে শোনেনি। শোনার কারণও নেই। বলল, “তোর কাছে গুন্ডা?”

“দাদা, আমাদের লাইনে কমসম খোঁজখবর রাখতে হয়। গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বেরোই। বাঁধা রুট ছাড়াও এদিক-ওদিক যেতে হয়। সব জায়গাতেই এক-আধজন চেনা থাকে।”

“কী নাম বললি গুন্ডাটার! তা নাম যাই হোক, তোর কাছে কেন?”

“ওদের ফড়ে আছে। বদুয়া খোঁজ করে করে আমার কাছে এসেছিল। জানতে চাইছিল সেদিন আমি অটোতে দু’জনকে তুলে নিয়ে তাদের এরিয়ায় গিয়েছিলাম কেন? লোক দুটো কে?”

ভবানী বা ভব আজ অটো চালায়। চন্দন জানে, ছেলেটা একসময় স্কুলে পড়ত। নাইন শেষ করেছে কি তার বাবা মারা গেল। আচমকা। ট্রামের ধাক্কা খেয়েছিল। কায়কষ্টে দুটো দিন বাঁচিয়ে রাখা গিয়েছিল লোকটিকে। ভব বাপের জন্যে হাসপাতালে আসত, ছোটাছুটি করত, হাতেপায়ে ধরত ডাক্তারবাবুদের। তখন থেকেই ছেলেটার সঙ্গে চেনা চন্দনের। বাপ মারা যাওয়ার পর ভবানী মা ভাই বোন নিয়ে পথে বসে গেল। পেট চালাবে কেমন করে। মাঝে ছেলেটা বিগড়েও গিয়েছিল। পরে আবার শুধরে নিল। এই অটো তার নয়, শম্ভু বড়াল বলে একজনের। কারবারি লোক। ভবদের পাড়ার বড়ালবাবু। তা সে যাই হোক অটোটা ভবই চালায়। না চালালে পেট চলত না।

চন্দন বলল, “তোর পাত্তা পেল কেমন করে?”

“ওসব ওদের লোক আছে দাদা। নজর রাখতে। অটোর নম্বর তো আছেই, আমাদের গাড়ি নিয়ে ঘুরতেও দেখে। সেন্ট্রালে ঘুরি। সাউথ হলে ধরতে কষ্ট হত।”

চন্দন অনুমান করে নিল কথাটার অর্থ। মাঝ কলকাতার অটো ভবানীর, ঘোরাফেরাও ধর্মতলা, ওয়েলিংটন, মৌলালি থেকে এপাশে হ্যারিসন রোড, কখনও এলাকার বাইরেও যেতে হয়, কাজেই বদুয়াদের চোখে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। সাউথের অটো হলে খোঁজখবর করতে অসুবিধে হত।

ভবানী নিজেই বলল, “দাদা, আমরা হরদম ঘুরি, রাস্তাঘাটে পুলিশ পাবলিক কত হ্যাপা আছে। নিজেদের দু-চারটে ঘাঁটি না রাখলে চলে না। বদুয়া খবর জোগাড় করে নিয়েছে।”

“তুই কী বললি?”

“বললাম, গাড়িতে সেদিন ডাক্তারবাবু ছিলেন। আমার চেনা। আর তাঁর এক বন্ধু। আমি চিনি না।”

“কী বলল তোদের বাবুয়া!”

“বদুয়া।” ভবানী নামটা শুধরে দিল। বলল, “বদুয়া জিজ্ঞেস করল কেন গিয়েছিলি ওদিকে? আমি বললাম, ডাক্তারবাবু নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি জানি না। বলল, গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখেছিলি কেন? বললাম, এঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। দেখছিলাম কোথায় বিগড়ে গেল।”

“তারপর?”

“বদুয়া বিশ্বাস করল না। শাসিয়ে গেল। বলল, আর যাবি না ওদিকে। কেস রাজার। ফালতু ভোগে চলে যাবি। তোর ডাক্তারবাবুকে বলে দিস রাজা শেরকে থানা পুলিশও সমঝে চলে।”

চন্দন সামান্য উত্তেজিত হয়ে পড়ল। “রাজা কি খুনখারাবি করে?”

“টাকা পেলে সব করে।”

“ভাড়াটে গুন্ডা! কিলার?”

ভবানী বলল, “দাদা, আপনি সাবধানে থাকবেন।”

“দেখি!… এখানে আমাকে ছেড়ে দে। হাসপাতাল সামনে।”

ভবানী অটো থামাল।

.

দুপুরবেলা কাজের ফাঁকে চন্দন ক্যান্টিন থেকে চা খেয়ে ফিরছিল, হঠাৎ অবনীশের সঙ্গে দেখা।

“এ কী রে তুই?” চন্দন অবাক! অবনীশ তার বন্ধু। ছেলেবেলায় স্কুলে পড়েছে একসঙ্গে। কতকাল পরে দেখা। অবনীশের পরনে পুলিশের উর্দি।

অবনীশ বলল, “তুই ডাক্তার হয়েছিস শুনেছি। এখানে আছিস–কই জানতাম না তো!”

“বদলি হয়ে এসেছি সবে। তুই গাধা পুলিশের চাকরি করছিস?”

“কপাল ভাই। যার ভাগ্যে যা লেখা থাকে!”

“আমি তো ভাবতাম তুই সিনেমা থিয়েটারে নেমে যাবি!”

অবনীশের চেহারা সত্যিই সুন্দর। মুখের ছাঁদও নরম। পুলিশ হওয়া যেন তাকে একেবারেই মানায় না। সে হেসে বলল, “বড্ড ভিড়। জায়গা পেলাম না। শেষে এই উর্দি।”

“ক’ বছর হল?”

“বছর সাত-আট।”

“বড়বাবু, না, মেজোবাবু?”

“চরকি বাবু!” অবনীশ হো হো করে হাসল। “নে, সিগারেট খা।”

সিগারেট ধরানো হয়ে গেল। দু-একটা পারিবারিক কথা। শেষে চন্দন বলল, “তুই এখন কোন থানায়?”

“লালবাজারে।”

“আঁ বলিস কী! লালবাজারে! ভয় দেখাচ্ছিস?”

“ভয় তো তোরা দেখাস। এই যে, আজকের কেসটা ধর। আমার এক ডিসটান্ট রিলেটিভ পরশু এখানে ভরতি হয়েছে। ডাক্তাররা প্রথমে সন্দেহ করল, হার্ট, এখন বলছে ব্রঙ্কাইটাল অ্যাজমা। সকালে সময় হয়নি। এখন একবার খবর নিতে এসেছিলাম। ভাল আছে।”

চন্দন বলল, “গুড নিউজ। …তুই লালবাজারে কোথায় আছিস?”

অবনীশ এবার হেসে ফেলল। “রাস্তায়।”

“তুই গাধা ট্রাফিক লাইনে নাকি? লাল মোটরবাইক? …ইস, গুন্ডা পেটাবার চাকরি পেলি না?”

“তোর দরকার! বলিস, পিটিয়ে দেব।” হাসতে হাসতে অবনীশ বলল, “একদিন বাড়ি আয়। জমিয়ে গল্প হবে। এভাবে আড্ডা হয়!”

“তুই থাকিস কোথায়?”

“বেকবাগান।” অবনীশ ঠিকানা বলল। “চলে আসিস একদিন। একটু খবর দিয়ে আসবি। ফোন নম্বর…”

চন্দন মাথা নাড়ল। যাবে।

চলে যাচ্ছিল অবনীশ, হঠাৎ কী মনে করে চন্দন বলল, “এই শোন, তোর ট্রাফিক তো জুতসই হল না। ধর, কোনও ব্যাপারে হেল্প দরকার হল। পারবি না?”

“কেমন হেল্প?”

“আরে না না, এমন কিছু নয়; জেনে রাখছি… ভবিষ্যতে যদি কাজে লাগে।”

“ভবিষ্যৎ! …সে তখন দেখা যাবে। চলি।” চলে গেল অবনীশ। খানিকটা তফাতে গাছতলায় তার মোটরবাইক রাখা ছিল।

হাসপাতাল শেষ করে বাড়ি ফিরল চন্দন। বিশ্রাম করল খানিক। বিকেল ফুরিয়ে এল। কেমন একটা অস্বস্তি লাগছে। কী যেন খচখচ করছে মনে। স্নান সেরে পাজামা পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে পড়ল। কিকিরার কাছে যাবে।

.

কিকিরা বাড়িতেই ছিলেন। বসে বসে তাসের খেলা প্র্যাকটিস করছিলেন। আসলে, চন্দনরা দেখেছে, কিকিরার একটা অভ্যেস হল– গভীরভাবে যখন কিছু ভাবেন তখন স্থির থাকতে পারেন না। বাইরে কেমন চঞ্চল হয়ে ওঠেন।

“এসো চাঁদু!”

 চন্দন এগিয়ে গিয়ে বসল। “তারা আসেনি?”

“কদিন ওর মুখ দেখিনি। আজ যদি বাবু আসেন! সামান্য কাজ বলেছি করতে, তাতেই কাবু হয়ে পড়েছেন।”

চন্দন বলল, “সার, আজ একটা ব্যাপার হয়েছে।

 তাকালেন কিকিরা।

 চন্দন সকালের ঘটনার কথা বলল, ভবানীর কাছে যা যা শুনেছে। কোনও কথাই বাদ দিল না।

কিকিরা মন দিয়ে শুনলেন সব। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বললেন, “ওই ছেলেটাকে আর ওদিকে যেতে দিয়ো না। বারণ করো।”

“বলে দেব। তবে ও নিজেই আর ওদিকে ভিড়বে না।”

“তুমি..”

“আমার ব্যাপারটা ভাল লাগেনি।” চন্দন বিরক্ত হয়ে বলল, “একটা গুণ্ডা আমাকে শাসাবে!”

“মুখোমুখি তো শাসাতে আসেনি।”

“না হোক। তবু এটা তার থ্রেট।”

“কলকাতা শহরে আজকাল গুণ্ডা বদমাইশ এত বেড়ে গিয়েছে যে, পুঁটিমাছের সাইজ যারা, মানে তুচ্ছ গুণ্ডা, তারাও শাসায়। কী করবে বলো! ওদের ইউনিয়ন আছে কিনা জানি না, তবে ছোরা ভোজালি সঙ্গেই থাকে। ঝুপ করে একটা চাকু যদি চালিয়েই দেয়…”

 “আপনি আমায় ভয় দেখাচ্ছেন! সার, আমি তারাপদ নই। রাজা না বদু সে বেটা আমার কী করবে?”

কিকিরা হাসলেন। “কী করবে জানি না। তোমার মাথা গরম করারও দরকার নেই। রাস্তার কুকুরও কামড়ায়। যেচে তার লেজ ধরে টানতে যাবে কেন! একটু সাবধান হওয়া ভাল।”

চন্দন মাথা নাড়ল। “সাবধান হওয়া মানে ঘরে লুকিয়ে বসে থাকা! ও কি হয় নাকি!”

“ঘরে বসে থাকবে কেন! যেমন আছ থাকবে।…..তা একটা কথা তোমার ছেলেটি ঠিকই বলেছে। ওরা–মানে জ্যাকিকে যারা বাড়িটা কিনতে দিতে চায় না–তারা কিন্তু তেমন তেমন হলে কেনা গুণ্ডা-বা ভাড়াটে খুনেকে দিয়ে একে খুন পর্যন্ত করতে পারে। করবে। আমিও সেটা জেনেছি।”

“পারচেজর কিলার তবে ওই রাজা…”

“রাজা গজা যেই হোক, নামে যায় আসে না। সোজা কথা ওদের হাতে কেনা খুনে আছে।”

কিকিরার কথা শেষ হওয়ার আগেই তারাপদর গলা শোনা গেল।

ঘরে এসে চন্দনকে দেখল তারাপদ। “আমার মনে হচ্ছিল তুই আসবি।”

“তোর মনের বাহাদুরি আছে।” চন্দন ঠাট্টা করে বলল, “আমি অনেকক্ষণ এসেছি। তুই বরং দেরি করলি!”

তারপদ হাতের ঘড়ি দেখল। বলল না কিছু। ঘরের বাতির দিকে তাকাল। জোর নেই আলোয়। পাখাটাও গোরুর গাড়ির চাকার মতন ঘুরছে। ভোল্টেজ কম নিশ্চয়। ঝপ করে একসময় বেড়ে যাবে।

তারাপদ বলল, “আজ ওয়েদারটা ভাল। ফাইন। ক’দিন একেবারে নেতিয়ে রেখেছিল।”

বগলা জল এনে তারাপদকে দিল। আসবার সময়েই জল চেয়েছিল সে। তেষ্টা পেয়েছিল খুব। শ্যামলালের দোকানের কচুরির এফেক্ট। খাব না খাব না করেও খেয়ে ফেলেছিল অফিস থেকে বেরিয়ে।

কিকিরা বললেন, “ চাঁদুর কথা শুনেছ? শোনো।”

 তাকাল তারাপদ। “কী রে?”

চন্দন ছোট্ট করে ভবানী বৃত্তান্ত বলল।

শুনল তারাপদ। চুপ করে থাকল কমুহূর্ত। শেষে বলল, “আরে রাখ। অত সস্তা নাকি! রাজা মহারাজার মরজিতে বেঁচে আছি! আমাদের কানুকে বললে, অমন গুণ্ডা পাড়াতেই পাওয়া যাবে।”

তারাপদ যেন নিতান্তই বন্ধুকে ভরসা দেওয়ার জন্যে বলল কথাগুলো, যদিও সে জানে চন্দন যথেষ্ট সাহসী, গায়ে খানিকটা ক্ষমতাও রাখে। ভেতরে ভেতরে তার সামান্য অস্বস্তিও হচ্ছিল।

কিকিরা অন্য কথায় চলে গেলেন। যেন রাজা-গজার চিন্তাটা আপাতত করার কোনও কারণ দেখছেন না উনি। তারাপদকে বললেন, “তোমায় যে কাজটা করতে বলেছিলাম করেছ?”

তারাপদ মাথা নাড়ল। “যা বৃষ্টি গেল, বেরুতেই পারলাম না। তবু ফরটি পার্সেন্ট করেছি। আমাদের অফিসের চণ্ডীদা জানবাজারের অনেক খোঁজখবর রাখে। তার মামার বাড়ি ওদিকেই। বলল, তালুকদারদের নাম জানে অনেকে। ওরা বাড়ি জমি কেনাবেচা থেকে সুদে টাকা খাটানো, সব ব্যবসাই করে। মামলা মোকদ্দমার লাইনে ফেমাস। ওরা দোকান বাজারেরও মালিকানা করে। একবার কি দু’বার ফিল্ম লাইনেও টাকা ঢেলে মার খেয়েছিল। তারপর থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে।”

কিকিরা মাথা নাড়তে লাগলেন ধীরে ধীরে। শেষে বললেন, “আমি কাল-পরশু একবার ছোট তালুকদারের সঙ্গে দেখা করব।”

“কেন? আগেও তো একবার করেছেন।”

“সেবার ভদ্রলোক তেমন পাত্তা দিতে চাননি। তাঁদের গদির–মানে দপ্তরের ম্যানেজারের কাছে ঠেলে দিয়েছিলেন।”

চন্দন বলল, “ছোট তালুকদারের বয়েস কত?”

“পঞ্চাশের মধ্যেই।”

“টাকার গরম দেখেছেন? তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে নাকি পাঁচজনকে..”

“না, অতটা নয়। তবে আসুন বসুনও করেন না। মনে হল, অহঙ্কারী ভাব আছে, তবে চাপা। বোধ হয় মূর্খ!”

তারাপদ বলল, “দেখা করে কী করবেন?”

“পাগল হ্যারিশ সম্পর্কে ভাল করে খোঁজখবর করব।”

বগলা চা নিয়ে এল। সামান্য খোঁড়াচ্ছে। গত পরশু পড়ে গিয়েছিল সিঁড়ির মুখে। লেগেছিল হাঁটুতে। মারাত্মক চোট পায়নি।

চা ধরিয়ে দিয়ে বগলা চলে গেল।

তারাপদ বলল, “পাগলা হ্যারিশ তো মারা গিয়েছে। ওর সম্পর্কে নতুন কী খোঁজ নেবেন?”

চায়ে চুমুক দিয়ে কিকিরা বললেন, “পাগলা হ্যারিশের মারা যাওয়া নিয়ে একটা গোলমাল থাকতে পারে। সে কোনও সরকারি হাসপাতালে মারা যায়নি। নেহাতই এক মিশনারি চ্যারিটেবল সিক হোম-এ মারা যায়। এসেও ছিল বেহালার দিকে। কোথায় এক পুওর ওল্ড হোম থেকে। যে লোকটা একদিন নিজে থেকেই বেপাত্তা হয়ে যায়, কোথায় কেউ জানে না, সে মরার আগে কেমন ভাবে সেখানে গিয়ে পড়ল, আর কখনই বা চ্যারিটেবল সিক হোম-এ এল? আর কেনই বা মারা যাওয়ার আগে তালুকদারদের নাম-ঠিকানা দিয়ে গেল, আন্দাজ করতে পারছি না যে।”

“বডি আইডেন্টিফিকেশানের জন্যে।”

“শনাক্তকরণ! হ্যাঁ, তা তো ঠিকই। কিন্তু আরও তো লোক ছিল। তার বাড়ির আশেপাশের লোক, পাড়ার লোক।”

“আপনি তো বলেছিলেন তেমন প্রতিবেশীও এসেছিল।”

“আমাকে তালুকদারের ম্যানেজার যা বলেছিল–তাই বলেছি। কিন্তু কোন প্রতিবেশী? কেমন প্রতিবেশী? তারা যদি জাল সাক্ষীর মতন হয়! তালুকদারদের কথায় এসেছে। তবে–?”

তারাপদ থতমত খেয়ে বলল, “কী বলছেন, সার! আসলের জায়গায় নকলের কবর হয়ে গেল!”

কিকিরা চুপ করে থাকলেন।

.

০৮.

দিন দুইয়ের জায়গায় চারদিন হয়ে গেল। উপায় ছিল না কিকিরার; দরকারি অন্য কাজগুলো না মিটিয়ে তালুকদারের দপ্তরে গিয়ে লাভ হত না।

তারাপদকেই সঙ্গে নিয়েছিলেন কিকিরা। শিখিয়ে পড়িয়ে রেখেছিলেন কখন কী বলতে হবে, চোখ কান খোলা রাখতে হবে কেমন করে!

তালুকদারদের অফিস না গদি দেখে তারাপদ নিচু গলায় বলল, “সার, এটা কি অফিস! এ তো সেরেস্তা টাইপের জমিদারি দপ্তর।”

কিকিরা বললেন, “ওরা তো জমিদারই ছিল একসময়। ধানচালের কারবারও করত শুনেছি আগে। এমন সেরেস্তা তুমি চিৎপুরের দিকে এখনও দু’একটা পাবে। সময়ের হাওয়া গায়ে লাগেনি তেমন, পুরনো ফরাসে বসে আছে।”

কথা না বাড়িয়ে তারাপদ বলল, “বৃহস্পতিবারের বারবেলায় দেখা করতে এলেন, কাজের কাজ হবে তো?”

“চলো না, দেখি।”

যেমন বাড়ি তেমনই সিঁড়ি। বেখাপ্পা চেহারা। চুনের সাদাটে ভাব আর খুঁজে পাওয়া যায় না, হলুদ হয়ে গিয়েছে। খোলা চাতালে শ্যাওলা বসেছে। সিঁড়ির ধাপের ইট নড়বড়ে। একরাশ পায়রা ভেতর দালানের খাঁজে খোঁদলে। একটানা শব্দ করে চলেছে। স্যাঁতানির গন্ধ চারপাশে।

কিকিরা ম্যানেজারের কাছে গিয়ে নমস্কার করে হাসলেন।

 মুখ তুললেন ম্যানেজার। ষাটের কাছাকাছি বয়েস। মুখের গড়নটা গোল। তারাপদর মনে হল, শিকারি বেড়ালের মতনই যেন দেখতে। গোল গোল চোখ। গোঁফের অর্ধেক সাদাটে হয়ে গিয়েছে। মাথার চুলও বারো আনা পাকা।

“কী চাই?” চিনেও না-চেনার ভাব, কিংবা ম্যানেজারি মুদ্রাদোষ।

কিকিরা বিনীত ভঙ্গি করে হাসলেন। “আমায় চিনতে পারলেন না! আগে একদিন এসেছিলাম।”

“ও!” মুখটা দেখলেন ভদ্রলোক কিকিরার। চিনতে পেরেছেন যেন, তবু গম্ভীর। “কী দরকার?”

“ছোটবাবুর সঙ্গে একবার দেখা করব!”

“ছোটবাবু! তিনি এখন ব্যস্ত আছেন।”

“দশ বিশ মিনিটের জন্যে দেখা হয় না?”

“বললাম তো?”

“একবার দেখুন না দয়া করে। কাজের কথা। আপনি চাইলে সবই হয়” বলতে বলতে কিকিরা অদ্ভুত কায়দায় দুটো একশো টাকার নোট ম্যানেজারের হাতে গুঁজে দিলেন।

ম্যানেজার প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। “এ কী?” বলেই তারাপদর দিকে তাকালেন। অন্যের সামনে টাকা নেওয়ার ইতস্তত ভাব।

অবশ্য নিতেও বাধল না।

 ম্যানেজার তাঁর পানের চৌকো ডিবের মধ্যে টাকাটা রেখে দিলেন। পান নিয়ে মুখে দিলেন একটা। বাড়ির সাজা পান। শুকিয়ে গিয়েছে। পানের পর জরদা। গন্ধ পাওয়া গেল। আমাকে বললে হত না?”

“আজ্ঞে, কথাটা ছোটবাবুকে না বলে আপনাকে আগে বলি কেমন করে। আপনিও শুনবেন বইকী! আগে ছোটবাবু-”

“ও! দাঁড়ান দেখি।”

ম্যানেজার উঠে গেলেন। চৌকো ঘর। তফাতে বসে জনা চারেক কর্মচারী। টেবিল চেয়ারের বালাই নেই। তক্তপোশ, চিট চাদর, ডেস্ক, খাতাপত্র, কাগজ। দুটো পুরনো পাখা ঘুরছে মাথার ওপর।

তারাপদ চাপা গলায় বলল, “টাকাটা কেমন করে নিল দেখলেন!”

“তুমিই দেখো। …এসব হল দস্তুর। আগের বারে ম্যাজিক দেখিয়েছি, এবার ভেলকি।”

“ছোটবাবু…?”

“দরজার ছিটকিনি খুলে গিয়েছে হে, দেখা হবে।”

 সামান্য পরেই ম্যানেজার ফিরে এলেন। “যান। বেশি বিরক্ত করবেন না। ওঁর এখন বিশ্রামের সময়। … আচ্ছা মশাই। এর আগে আপনি একদিন হায়দার লেনের তেরো নম্বর বাড়ির খোঁজ করতে এসেছিলেন না?”

“আপনার মনে আছে? ভাবছিলাম”

“এবার আবার কোন দরকারে?”

“ঘুরে এসে বলব।” বলে তারাপদকে উঠতে বললেন ইশারায়।

“তাড়াতাড়ি করবেন। ছোটবাবু আধঘুমে ছিলেন। তাঁকে বিরক্ত করবেন না বেশি।”

“না না–তাই কি করি! কাজের কথা বলেই চলে আসব।”

তারাপদকে নিয়ে কিকিরা ছোটবাবুর ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। ফিসফিস করে বললেন, “যা যা শিখিয়েছি তার বাইরে একটাও কথা বলবে না। ধরা পড়লেই মুশকিল।”

মাথা নাড়ল তারাপদ।

ম্যানেজারমশাইয়ের দফতরখানার বাইরে এসে ঢাকা বারান্দা দিয়ে ডাইনে হাঁটলে কোনাকুনি একটা বাঁক, তার গায়েই ছোটবাবুর ঘর। কিকিরা আগে একবার এসেছেন। ঘরটা চেনেন।

তালুকদারদের ছোটবাবুর ঘরের দরজা খোলাই ছিল। গরমকালে একটা পরদা ঝুলত খসের। এখন সেটা গুটোনো।

কিকিরা তারাপদকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন ছোটবাবুর। ঢুকেই হাত জোড় করে নমস্কার করলেন। তারাপদ খেয়াল করেনি প্রথমে, পরে আধাআধি একটা নমস্কার সেরে ফেলল।

ছোটবাবুর ঘরে ফরাস পাতা। আবার একপাশে লম্বাটে সোফাও। তিন-চারটি চেয়ার টেবিলও আছে একটা। দেওয়ালের সঙ্গে গেঁথে-রাখা ছোট সিন্দুকবা আয়রন চেস্ট। পাখা ঘুরছিল। সস্তা এক ম্যাপ টাঙানো কলকাতা শহরের। দেওয়াল ঘড়ি, ক্যালেন্ডার।

ছোটবাবুর চেহারা দেখে বোঝা যায় ভদ্রলোক একসময় রীতিমতন স্বাস্থ্যবান ছিলেন। এখন স্বাস্থ্য নেই, কাঠামোটা রয়েছে। গায়ের রং কালো। ধারালো ধাঁচ মুখের। চকচকে চোখ। চশমা পরেন। মাথার চুল ছোট ছোট। বয়েস পঞ্চাশের গায়ে গায়ে।

ফরাসের ওপরেই তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় ছিলেন ছোটবাবু। কিকিরাদের দেখলেন।

“আপনি ক’দিন আগে একবার এসেছিলেন না?” ছোটবাবু বললেন।

“আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার মনে আছে”

“তেরো নম্বর বাড়িটার খোঁজখবর করছিলেন?”

“যথার্থ।”

“আজ আবার কেন?”

কিকিরা তারাপদকে দেখালেন। “এটি আমার মক্কেল বলতে পারেন। বাইরের দিকে প্রমোটারি শুরু করেছে, চুঁচড়ো বাঁশবেড়ে..! বেশিদিন হয়নি। বছর দুই তিন। তাতেই দু’পয়সা এসেছে। না, সেরকম কিছু নয়। তবে হালে ও কলকাতায় কাজকর্ম করতে চায় অল্পস্বল্প। ধরুন লাখ আট-দশ..”।

ছোটবাবু তারাপদকে দেখলেন। চেহারা দেখে দু’ লাখের কারবারিও মনে হয় না। তবে আজকাল যা অবস্থা হয়েছে, কার পকেটে কালো তাসের ক’টা টেক্কা সাহেব বিবি, বোঝা যায় না। “তা আমি কী করব?”

“আজ্ঞে, আমি একটা কথা ভাবছিলাম। আপনি একটু বিবেচনা করুন। … বলছিলাম যে ওই তেরো নম্বর বাড়ির জন্যে আপনি লাখখানেক টাকা দাদন নিয়েছেন। কিন্তু বাড়িটা শেষ পর্যন্ত কি বিক্রি হবে?”

“কেন?”

“দাঁতের ওই চিনে ডাক্তার বোধ হয় ও-বাড়ি আর কিনবে না।”

“কে বলল?”

“আমার সেরকমই মনে হচ্ছে। আপনি তো জানেন, আগের বারই বলেছি, ওর সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে খানিকটা। ওর মায়ের সঙ্গেও। বাপের সঙ্গেও ছিল কিন্তু বাপ তো আর নেই। গতবার আমি ওর জন্যেই এসেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি, ডাক্তারের হাতে টাকা নেই তেমন। ধারধোরের চেষ্টা করছে। তা ছাড়া ওই বাড়িতে পা দেওয়ার আগেই ওকে ঝাট ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে মশাই। লোকে ভয় দেখাচ্ছে, শাসাচ্ছে। চিনে ডাক্তারের মা একেবারেই রাজি নয় এখন।”

“সে ওদের ব্যাপার। দাদনের টাকা আমি ফেরত দেব না তা বলে!”

“আমি বলছিলাম, হাত বদল হয়ে যাক না–” কিকিরা তারাপদকে দেখালেন। “ধরুন, এ যদি আপনাকে লাখ চারেক দাদন দেয়–আপনি আগের পার্টিকে তার টাকা ফেরত দিয়ে ওকে কাটিয়ে দিলেন।”

ছোটবাবু সোজা হয়ে বসলেন। সামান্য চুপ করে থেকে সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিয়ে দেশলাই খুঁজতে খুঁজতে বললেন, “আপনি আশ্চর্য লোক মশাই, কদিন আগে একজনের হয়ে দালালি করতে এসেছিলেন, আজ আবার অন্য একজনকে সঙ্গে নিয়েই এসেছেন দালালি করতে! দালালদেরও একটা নীতি থাকে। আপনার সেটাও নেই।”

কিকিরা হাসলেন। মুচকি হাসি। বললেন, “জ্যাকি পারবে না বলে আমি একে এনেছি। নীতির কথা তুলছেন কেন! … তা ছাড়া আপনি তো জ্যাকিকে বাড়িটা বেচে দেননি এখনও। দেব বলেছেন। আপনাদের নিজেদের মধ্যেই গোলমাল। শরিকি বিবাদ। কে কত পাবে …”

“চুপ করুন।” ছোটবাবু ধমকে উঠলেন, “আমাদের গোলমাল আমাদের ব্যাপার। সেটা মিটে যাবে। সেটেল হয়ে যাবে। বাড়ি আমি ওই দাঁতের ডাক্তারকেই দেব–যদি দি।”

কিকিরা তারাপদর দিকে তাকালেন একবার। তারপর কখন যেন পকেট থেকে নাইলনের এক দড়ি বার করে নিলেন। ফাঁস লাগাতে লাগাতে বললেন, “তা হলে তো আপনার চোখের সামনে আমায় গলায় দড়ি দিতে হয়। বাবু আমি যে এর সঙ্গে পঁচিশ হাজার টাকার রফা করেছি। ছি ছি!”

ছোটবাবু সিগারেট ধরিয়ে নিয়েছেন ততক্ষণে।

নাইলনের দড়ির গোল বড় ফাঁসটা কিকিরা নিজের গলায় গলিয়ে তারাপদর হাতে বাকি প্রান্তটা তুলে দিলেন।

“কী করছেন কী?” ছোটবাবু ভয় পেয়ে গেলেন। “আমি চেঁচিয়ে লোক ডাকব।”

“ডাকুন। তারাও সবাই দেখবে।” বলে কিকিরা চোখের ইশারায় তারাপদকে দড়ির প্রান্ত টানতে বললেন। এ বড় অদ্ভুত দৃশ্য। কিকিরার গলায় দড়ির ফাঁস লাগানো গোল করে, আর তারাপদ সেই দড়ির একটা প্রান্ত ধরে টানছে।

ছোটবাবুর মুখ থেকে জ্বলন্ত সিগারেটটা পড়ে গেল কোলের ওপর। লাফিয়ে উঠে তাড়াতাড়ি আগুন নেভালেন।

তারাপদ এমন ভাব করল যেন দড়িটা টানছে। ফাসটাও কিকিরার গলায়। কিন্তু কী অবাক ব্যাপার, দমবন্ধ হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই কিকিরার। ফাস যেন গলা জড়িয়ে আটকেই থাকল, শক্ত হল না, চাপও লাগল না। আর তারাপদর হাতে ধরা দড়ির অংশটা দু-তিনটে টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

ছোটবাবু ঘামতে লাগলেন। তারপর হাত জোড় করে বললেন,”মশাই, প্লিজ এসব বন্ধ করুন।”

কিকিরা তারাপদকে ইশারা করলেন। দড়ি ছেড়ে দিল তারাপদ।

গলার ফাস খুলতে খুলতে কিকিরা বললেন, “এতেই আপনি ঘাবড়ে গেলেন। এটা কিছু নয়। ভ্যাসি বলে এক ম্যাজিশিয়ান ছিল। বত্রিশ রকম নট’ মানে ওই গিট আর রোপ ট্রিকস– সাফাইয়ের খেলা দেখাত। একে বলে ‘জিরো নট’ মানে যে ভাবে গিট বেঁধে দেব, তার চেয়ে এক সুতোও আর আগু-পিছু নড়বে না।”

কপাল চোখমুখের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, “চুলোয় যাক আপনার ভ্যানসি ফ্যাসি। এবার দয়া করুন, আসুন।”

“যাব ঠিকই। কিন্তু কথাটা শেষ হল না যে!”

“আবার কী কথা!”

“বাড়িটার হাত বদল?”

তারাপদ কিকিরাকে বলল, “আমি বেশিদিন বসে থাকতে পারব না।” শেখানো কথা ছাড়া কিছু নয়।

ছোটবাবু বললেন, “এখন আপনারা যান, পরে ভেবে দেখব।”

কিকিরা বললেন, “শুনুন তালুকদারবাবু! আপনি হয়তো ঘাবড়ে যাবেন–তবু বলি, আমরা খোঁজখবর করে জেনেছি, পাগলা হ্যারিশ বলে যাকে আপনার লোক শনাক্ত করে এসেছিল সে একটা জিনিস লুকিয়েছে।”

ছোটবাবু ভয়ে কেমন আঁতকে উঠলেন, “কী বলছেন আপনি!”

“আমি ঠিক বলছি। পাগলা হ্যারিশ বেহালার যে চ্যারিটেবল মিশনারি সিক হোমে ছিল সেখানে আমরা দু’দিন আগে গিয়েছিলাম। হ্যারিশের শরীরের অবস্থা এত খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, তার কোনও প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল না। ওষুধবিষুধ কাজ করছিল না আর। নিউমোনিয়া হয়ে সে মারা যায়।”

তালুকদার অস্বীকার করলেন না।

 “আপনার কাছে বলতে আপত্তি নেই, আমি একা বেহালায় যাইনি, সঙ্গে আমার একজন ডাক্তার ছিল।” কিকিরা আর চন্দনের নাম বললেন না। “ঠিক কীভাবে হ্যারিশ মারা গেল, তা নিয়ে সে কথাবার্তাও বলল।”

“তা আমি কী করব! আমি কি তাকে মেরেছি?”

‘না! আপনি মারেননি। কিন্তু হ্যারিশ মারা যাওয়ার আগে একটা ডাইরি বইয়ের মধ্যে পেনসিলে কয়েকটা কথা লিখে রেখেছিল। লিখে একটা খামে ঢুকিয়ে রেখেছিল। আপনার লোক সেটা নিয়ে আসে।”

তালুকদার যেন আকাশ থেকে পড়ছেন। “কী বলছেন?”

“আমি ঠিক বলছি। সেই ডাইরিটা কোথায়?”

“কী মুশকিল” ছোটবাবু যেন ধৈর্য হারিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, “মশাই একটা পাগলার দু’-চার ছত্র লেখা নিয়ে আমি কী করব! ও যদি আমাদের কথা নিজে না জানিয়ে যেত, আমরা ওর মারা যাওয়ার কথাও জানতাম না। নেহাত একসময়ের চেনা লোক বলে খবর পেয়ে আমার এখান থেকে একজন গিয়েছিল। নয়তো কেউ যেত না। এ দেখছি, রাস্তার আপদ ঘরে টেনে আনা!”

“আপনি সত্যি কথা বলছেন?”

“কেন! কী দুঃখে মিথ্যে বলব!”

“বেশ। কে গিয়েছিল আপনার এখান থেকে?”

“ম্যানেজার জানে! ডাকব তাকে?”

 ডাকাডাকির পর ম্যানেজার হাজির।

 ছোটবাবু তিরিক্ষে মেজাজে বললেন, “নাগমশাই, ওই পাগলা হ্যারিশকে শনাক্ত করতে কে গিয়েছিল এখান থেকে?”

ম্যানেজার ঘরের অবস্থাটা অনুমান করতে পেরেছিলেন। অল্প সময় চুপ করে থেকে বললেন, “ঘটক গিয়েছিল, সুশীল। কেন বাবু?”

“ও কি একটা খাতাটাতা এনে জমা দিয়েছিল আপনার কাছে?”

“না।”

“ঘটক কোথায়?”

“এ আপনি কী বলছেন বাবু? ঘটক তো কবেই চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছে।”

উত্তেজনার মাথায় কথাটা প্রথমে খেয়াল হয়নি। পরে খেয়াল করতে পারলেন। তিনি কী বলতে কী বলে ফেললেন! ঘটক তো কবেই চলে গিয়েছে। নিজেই। বিব্রতভাবে একবার কিকিরা আরেকবার ম্যানেজারের দিকে তাকালেন, “আমারই মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।”

কিকিরা ম্যানেজারকে বললেন, “ঘটকের বাড়ি কোথায়?

“শিবপুর। তবে তাকে কি আর আপনি দেখতে পাবেন?”

“কেন?”

“শুনেছি একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল কালীঘাটে পুজো দিতে যাচ্ছি বলে, আর সে বাড়ি ফেরেনি।”

তারাপদ চুপচাপই ছিল। তার অস্বস্তি হচ্ছে। ঘামছিল। হঠাৎ বলল, “কবে ঘটেছে এটা?”

“ক-বে! হিসেব করে বললে মোটামুটি বছর তিন-চার আগে!”

কিকিরার দিকে তাকালেন ছোটবাবু। “সুশীল ঘটকের এক ভাই আমাদের সলিসিটার অফিসে টাইপিস্টের কাজ করে। জেঠতুতো খুড়তুতো ভাই। সে বলতে পারে ঠিকঠাক।”

কিকিরা আর কিছু বললেন না।

 খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে ম্যানেজার বললেন, “বাবু আমি যাই?”

ছোটবাবু হাত নাড়ার আগেই কিকিরা বললেন, “আসুন আপনি।”

ম্যানেজার চলে যাওয়ার পর কিকিরা কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবলেন কী যেন; শেষে ছোটবাবুকে বললেন, “আপনি এখানে কতদিন বসছেন? কিছু মনে করবেন না!”

“বছর দশেক।”

“দাদারা কোথায় বসেন?”

“বড়দা আমাদের বৈমাত্রভাই। উনি চা বাগানের ব্যবসা দেখতেন। ডুয়ার্সেই ছিলেন। হার্টের অসুখের পর শিলিগুড়ি।”

“মেজোদাদা?”

“আমরা কলকাতাতেই থাকি। তবে আলাদা বাড়িতে। মেজদা অন্য ব্যবসা অফিস দেখে। সে খানিকটা বেআক্কেলে, টাকাপয়সা নয়ছয় করে, বড় মেজাজি…”

কিকিরা আর কথা বাড়ালেন না। বললেন, “তালুকদারমশাই, আপনি মানে আমার মনে হচ্ছে অনেক কিছুর খোঁজ রাখেন না। তা কিছুদিনের মধ্যে হয়তো শুনবেন আপনাদের হায়দার লেনের তেরো নম্বর বাড়ি নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছে। অবাক হবেন না। আজ আমরা চলি। পরে আবার দেখা হতে পারে। ভাল কথা, দাঁতের ডাক্তার জ্যাকিকে ঠকাবেন না। অবশ্য সব যদি ভালয় ভালয় মিটে যায়। চলি।”

.

০৯.

তাড়াহুড়ো করার উপায় ছিল না। দিন কয়েক সময় গেল অন্য ক’টা কাজ সারতে।

পরে সদলবলে কিকিরা তেরো নম্বর বাড়িতে এসে হাজির। দুপুর তখন ফুরিয়ে আসছে। আগের দিন বৃষ্টি হয়েছিল। আজ শুকনো।

জ্যাকি পকেট থেকে চাবি বার করতে করতে বলল, “ অ্যাঙ্কল, আমিও এই ঘরে আর ঢুকিনি।”

কিকিরা মাথা হেলালেন, “তালাটা খোলো।”

বাড়িটার চারপাশে জমানো ইটকাঠের প্লাস্টারের চাঙড়ের আবর্জনা এখন মোটামুটি পরিষ্কার। কুলিমজুর আর কাজ করছে না। বন্ধ করে রেখেছে জ্যাকি এখনকার মতন। বাইরে থেকে বাড়িটাকে ভাঙাচোরা খাঁচার মতন দেখাচ্ছিল প্রায়।

জ্যাকি দরজার তালা খুলল।

ঘরে আলো নেই। জানলাটা খুলে দিল জ্যাকি। সময় লাগল খুলতে।

চন্দন ঘরটা দেখল। তারপর তারাপদকে নিয়ে জানলার কাছে সরে গেল।

প্রথম থেকেই চন্দনের চোখে পড়েছে–জানলাটা খড়খড়ি করা, অথচ না আছে কাঁচ, না লোহার শিক বা গরাদ। মানে একেবারে ফাঁকা জানলা। তার ওপর একটা পাল্লার সঙ্গে জানলার ফ্রেমের ভাঙা মরচে ধরা কবজা থাকলেও অন্য পাল্লার কবজা নেই। মামুলি তার জড়িয়ে যেন আলগা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। জানলার গায়ে পেয়ারা গাছ।

চন্দন গাছটা দেখছিল। বর্ষায় তেজি হয়ে উঠেছে।

 কিকিরা হঠাৎ বললেন, “জ্যাকি, ওটা কী? কাদার ছাপ?”

জ্যাকি ঝুঁকে পড়ে মেঝে দেখল। দু-তিন জায়গায় দাগ। বলল, “ফুট প্রিন্ট! ছাপ অ্যাঙ্কল?”

“এই ঘরে কেউ এসেছে। আসে। আগে কি পায়ের ছাপ দেখছ?”

জ্যাকি ভাবল কিছুক্ষণ। আগে এই ঘর এত ময়লা আবর্জনায় ভরা ছিল যে, দাগ চোখে পড়ার কথা নয়। পরে সে আর তার ভাই মিলে ঘরটা পরিষ্কার করেছে ঠিকই, তবু কালচে মেঝেতে দু-চারটে দাগ তারা খেয়াল করে লক্ষ করেনি।

জ্যাকি বলল, “বলতে পারব না অ্যাঙ্কল!”

“তুমি বলছ, পায়ের দাগ দেখছ এখন?”

“হ্যাঁ।”

 চন্দন জানলার কাছ থেকে বলল, “কিকিরা, আমি একবার নীচে থেকে ঘুরে আসছি।” বলতে বলতে সে পাল্লা-খোলা জানলা দিয়ে গলে গিয়ে পেয়ারা গাছের ডাল ধরল। পুরো ডালটা বেঁকে গেল, শব্দ হল পাতার। তারাপদ আঁতকে উঠল। “পড়বি!”

চন্দন ঝুলতে ঝুলতেই কায়দা করে বড় শক্ত ডাল ধরে ফেলল। তারপর নেমে গেল গাছ বেয়ে।

কিকিরা জানলার কাছে সরে এসেছিলেন তারাপদর আচমকা চিৎকার শুনে। নীচে তাকিয়ে দেখলেন। চন্দন শহুরে ছেলে নয়, গাছে চড়া, সাঁতার কাটা–এসব সে ছেলেবেলা থেকে শিখেছে। কোন গাছের কোন ডালটা বেশি পলকা সে আন্দাজ করতে পারে।

চন্দন মাটিতে নেমে গিয়ে কী দেখতে লাগল।

কিকিরা জ্যাকিকে বললেন, “ঘরটা ভাল করে দেখো, আর কী পাওয়া যায়?”

জ্যাকি প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের চারপাশ দেখতে লাগল।

তারাপদ বলল, “কিকিরা এই ঘরের বাইরে তালা থাকলে কী হবে, জানলা দিয়েই তো আসা-যাওয়া করা যায়।”

কিকিরা বললেন, “যায় দেখছি।” বলেই চন্দনকে কী যেন বললেন জানলা দিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে, তারপর তারাপদর দিকে ঘাড় ঘোরালেন। “ব্যাপারটা বুঝতে পারছ?”

“কী?”

“এই ঘরের বাইরের দিকে দরজায় যে কাঠের তক্তা মারা ছিল সেটা স্রেফ ব্লাফ। মানে, তুমি যেন ওই বেয়াড়া তক্তামারা ক্রশ দেখে ভেতরে আসতে না চাও। ভাবো, ঘরে ঢোকা নিষেধ। কিংবা ভয়ের। বা ধরো কোনও আপদ-বিপদ…”

“সার,” চন্দন নীচে নেমে ডাকল।

 কিকিরা মাথা ঝোঁকালেন, “কী হল?”

“সার, গাছতলার মাটিতে জুতোর বড় বড় দাগ। বৃষ্টিতে কাদাটে হয়ে রয়েছে। জায়গাটা।”

“বুঝেছি। তুমি চলে এসো।”

জ্যাকি সারা ঘর খুঁজে কয়েকটা জিনিস পেল, দেশলাইয়ের কাঠি, সিগারেটের পোড়া টুকরো, একটা তাস। হরতনের গোলাম।

কিকিরাকে জিনিসগুলো দেখাল জ্যাকি।

“বাঃ, বাঃ, এই ঘরে একটা আসর বসে তবে?” ঠাট্টার গলায় বললেন কিকিরা। “মোমবাতি-টাতির টুকরো পেলে না?”

“না।” জ্যাকি মাথা নাড়ল।

তারাপদ বলল, “মোমবাতির কারবার এখন উঠে যাওয়ার মতন। আজকাল অনেকরকম হালকা আলোর ল্যাম্প পাওয়া যায়। ফ্যান্সি ল্যাম্প, ব্যাটারিতে জ্বলে। মিঠে আলো হয়।”

কিকিরা তাসটা দেখতে দেখতে বললেন, “ঠিক বলেছ! মোমবাতির আলো বাইরে থেকে চোখে পড়ে। মানে উলটো দিকের বাড়ি থেকে আলো চোখে পড়তে পারে। হালকা আলোর বেলায় সেটা হয় না। অতটা ছড়াতে পারে না।”

জ্যাকি বলল, “কারা আসে এখানে অ্যাঙ্কল?”

“ধৰ্মপুত্তুররা আসে না। …গুন্ডা বদমাশদের ভাল আখড়া হয়েছে এখানে। নো ডাউট অ্যাবাউট ইট। কিন্তু তারা কোথাকার? এই পাড়ার?”

চন্দন ফিরে এল। জানলা গলেই।

“সার, নীচে জুতোর দাগ দেখলাম। স্পষ্ট।”

“এগুলোও দেখো।”

 চন্দনকে তাস, সিগারেটের টুকরো, দেশলাইকাঠিও দেখানো হল। দেখল চন্দন। বলল, “এ ঘরে যারা লুকিয়ে আসে”

বাধা দিয়ে কিকিরা বললেন, “আমার মনে হয় অনেক আগে থেকেই আসে। এটা তাদের মিটিং প্লেস। ভাঙা পুরনো বাড়ি, একটেরে একটা ঘর ছাদে ওঠার মুখে। এমন সুবিধের জায়গা আর হয় নাকি! জ্যাকি বাড়ি কেনার পর আসা-যাওয়া করছে দেখে হালে হয়তো সাবধান হয়েছে। তারাই বোধ হয় এই ঘরের দরজার বাইরে তক্তা মেরে বন্ধ করে দিয়েছিল, যাতে অন্য কেউ না এসে পড়ে।”

“কেন?”

“কেন! খানিকটা বুঝতে পারছি, পুরোটা পারছি না। এটা গুমঘর। ঘরের মধ্যে তোক বা না হোক- এই বাড়িতে দুটো খুন হয়েছে। এই ঘরে পাগলা হ্যারিশের কফিন বাক্স এখনও পড়ে আছে। লোককে ভয় পাওয়ানোর পক্ষে যথেষ্ট ভাল পাবলিসিটি।

“কালো ট্রাঙ্কটাও।”

“চাঁদু, আমার বিশ্বাস দুষ্কর্মের জায়গা তো বটেই, ঘরটার মধ্যে কিছু খোঁজটোজও চলতে পারে।”

“কী খুঁজবে সার? এতদিনেও খুঁজে পেল না?”

“পায়নি। ভাবছে পাবে। মাঝে মাঝেই বোধ হয় তল্লাসি চালায়। কিন্তু কী পাবে! হ্যারিশ এখানে কোন গুপ্তধন লুকিয়ে রেখে গিয়েছে? কোথায়?”

তারাপদ বলল, “কিকিরা যে-লোক বাড়ি মর্টগেজ দিয়ে আর ছাড়াতে পারেনি, হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে তার ভিটে, পাগলা আর ভিখিরি হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে– মারা গিয়েছে চ্যারিটেবল হাসপাতালে, তার আর কী গুপ্তধন থাকবে! থাকলে এমন অবস্থা তার হয়!”

জ্যাকি বলল, “ইট ইজ টু, অ্যাঙ্কল। টাকা থাকলে কেউ ভিখ মাগে?”

কিকিরা বললেন, “তোমরা হয়তো ঠিকই বলছ। কিন্তু এমন জিনিস যদি হয়– যা বাজারে বিক্রি করা যাবে না। কিংবা বিক্রি করতে রাজি হয়নি হ্যারিশ।”

“তা হলে সেটা সে এ বাড়িতে ফেলে যাবে কেন? সঙ্গে করে নিয়ে যাবে।”

“তাতে বিপদ হত। …আচ্ছা, এ বাড়িতে সে তো তার নিজের কফিন বাক্সও রেখে গিয়েছিল। সে কোথায় মারা যাবে, কবে মারা যাবে নিজে কি জানত সে! তবু কফিন বাক্সটা রেখে গেল কেন? কেন এই ঘরে বসে বসে নিজের কফিন বাক্স বানাল। তার কি মনে হয়নি– হ্যারিশ মারা যাওয়ার পর কার দায় পড়েছে তার কফিন বাক্স খোঁজ করার!”

কোনও জবাব পাওয়া গেল না।

তারাপদ হঠাৎ বলল, “কিকিরা, তা হলে কি হ্যারিশ মারা যাওয়ার আগে কিছু লিখে গিয়েছিল কাগজে?”

“আমার তো তাই মনে হয়। শিবপুরের ঘটক–তালুকদারদের লোক– সেটা হাতে পেয়ে যায়। তার বাবুদের কাছে আর দেয়নি কাগজটা। নিজেই খুঁজে দেখতে গিয়েছিল ব্যাপারটা কী! দেখতে গিয়ে ও মরেছে।”

“মরেছে।”

“আমার আন্দাজ। এ বাড়িতে প্রথম খুন হয় বছর চারেক আগে। তালুকদারদের কথামতন হিসেবটা মিলে যাচ্ছে না, তারাপদ?”

“হ্যাঁ, সেদিক দিয়ে দেখলে মিলছে একরকম।”

“দ্বিতীয় খুন?” চন্দন জিজ্ঞেস করল।

“বলতে পারছি না। তবে ঘটকের মতন কেউ নাও হতে পারে। গ্যাং কেস।”

“কে সে?” তারাপদ বলল, “অযথা–”

কিকিরা যেন কথাটায় কান দিলেন না। ঘরের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে বললেন, আপন মনে, “আমি দুটো ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত। এক, এই বাড়ি বলো ঘর বলো কতকগুলো মিসক্রিয়েন্টের গুন্ডা খুনি ক্লাসের লোকের মিটিং প্লেস। তারা এখানে এমন অনেক কাজ করে, যা চোখের আড়ালে করা সুবিধের। এটা তাদের জমিদারি, কাউকে হাত বাড়াতে দেবে না। সাধারণ মানুষের সাধ্য নয় তেরো নম্বর কিনে তার পজেশান নিতে পারে। জ্যাকির মতন অবস্থা হবে। ঠিক এইজন্যেই খদ্দের জোটে না বাড়িটার।”

তারাপদ ঠাট্টার গলায় বলল, “আমাদের এখানে এটা নতুন কিছু নয়, সার। কত বাড়ি শুনি বেওয়ারিশ সম্পত্তির মতন পাড়ার মাম্যানরা অকোপাই করে নিয়েছে। তাদের পেছনে আবার সাপোর্ট থাকে…।”

চন্দন অনর্থক কথা থামিয়ে দিয়ে কিকিরাকে বলল, “কিকিরা, এই বাড়ি, ঘর– একটা ‘ডেন অব মিসক্রিয়েন্টস’– সেটা ধরেই নিচ্ছি। আপনার আরও একটা কথা আছে বলবার। সেটা কী?”

“সেটা এই যে, এখানে অত্যন্ত মূল্যবান একটা কিছু রয়েছে লুকোনো।”

“কী?”।

“নেপালবাবুর কথা যদি সত্যি হয় তবে বিশ্বাস করতে হয় পর্তুগিজ সাহেব যে ক্রশটি চুরি করেছিলেন পাদরি পেইজ-এর সেই জিনিসটি…”

“অসম্ভব।”

“কেন! কোথাকার পাদরি পেইজ…”

“নেপালবাবু বলেন, আফ্রিকার।… ওটা নাকি গল্প নয়। বিখ্যাত পারি। পর্তুগিজ। নিজের দেশ থেকে আফ্রিকায় গিয়েছিলেন।

“আমি বিশ্বাস করি না। ক’ শো বছর আগেকার এক গল্প…”

“তিন-চারশো বছর আগেকার ধরে নাও। পাদরির ক্রশটা তো তার গলায় তখন ঝুলত না। চার্চে ছিল। হয় অ্যাবেসেনিয়ার, না হয় লিসবনের কোনও চার্চে। কেউ চুরি করেছিল। আমাদের পর্তুগিজ সাহেবের হাতে আসে জিনিসটা। লোকটি আদতে ছিল সেলার। পরে এ দেশে এসে ঠিক কোথায় উঠেছিল, কালিকট না কোচিন বলা মুশকিল। শেষে কবে থেকে গুছিয়ে বসে কলকাতায় এসে…”

জ্যাকিও মাথা নাড়ল। বলল, সে এরকম কোনও কথা আগে শোনেনি, পর্তুগিজ সাহেবের।

তারাপদ বলল, “আপনি এখনও সেই ক্রশের কথা ভাবছেন! যদি সেটা থেকেও থাকে, পাগলা হ্যারিশের হাতে যাবে কেমন করে?”

কিকিরা মাথা নাড়লেন। “যাওয়ার কথা নয়। তবে ঘটনাচক্রে অনেক অঘটনই ঘটে যায়। দু-চারশো বছরের আগেকার জিনিস হামেশাই হাতে এসে যায় আচমকা। …বেশ তো, তোমরা বিশ্বাস কোরো না। তবে আমি একবার চেষ্টা করব। মনে হয় না, জিনিসটা যদি থাকেও, অবিকল সেইভাবে পাব। তবে পর্তুগিজ সাহেব যদি দয়া করে থাকেন একটা আঁচ পেতে পারি।” চন্দন বলল, “ঠিক আছে। এখন চলুন। বিকেল পড়ে আসছে।”

.

১০.

বাইরের ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। সন্ধেও হয়ে এল।

ছেনুর রেস্তরাঁয় ছোট একটা খুপরি আছে পেছন দিকে। ওই খুপরিতে বসে ছেনু মাঝে মাঝে জিরিয়ে নেয়, হিসেবের খাতাপত্র দেখে কখনও। আবার গল্পগুজবও করে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে।

কিকিরাকে সেই খুপরিতে বসিয়ে ছেনু কথা বলছিল। কিকিরার সামনে চায়ের কাপ। দুধে একেবারে সাদা। চিনিরও মাত্রা নেই।

কিকিরার কথা শুনে ছেনু তার গোঁফ একটু চুলকে নিল। তারপর বলল, “মামু, আমি নিজে আর কোথাও হাত লাগাই না আপনি জানেন। দীক্ষাটিক্ষাও নিয়ে নিয়েছি। পুজো আর্চা করি না করি, বাড়িতে মা কালীর মূর্তির পায়ে দুটো জবাফুল না দিলে শান্তি পাই না। ও-কথা যাক, আপনার দরকারে দু-চারটে সোলজার আমি জুটিয়ে দিতে পারব।”

কিকিরা বললেন, “শোনো, খুনোখুনির কাজ এটা নয়। সেরেফ গার্ড। ওই তেরো নম্বর বাড়িটা আমি একদিন ঘেরাও করতে চাই।”

“থানায় বলুন না।”

“না। থানায় বললে কাজ হবে না। …আর থানা যদি নজর রাখত ওই বাড়িতে কি গুন্ডাবদমাশদের আখড়া হত! আমি তোমায় বলছি ওখানে একটা ঘাঁটি আছে। জুয়া নেশাভাঙ…”

“আরে এ তো আজকাল শহরের রীতি হয়ে গেছে, মামু! এরা হল পাতি গুন্ডা। নোংরা কাজ করে পেট ভরায়। আমাদের টাইমে ছুঁচোগিরি ছিল না। হ্যাঁ– হাত পা চালাবার আগে হাঁক মারতাম। তাতেই সব ভড়কে যেত।”

“তুমি তা হলে লোক দিচ্ছ?”

“হয়ে যাবে।”

“আমরাও ক’জন আছি।”

“আমার তরফে ক’জন সোলজার লাগবে?”

“দু-তিনজন।”

“ভাববেন না। …সোলজাররা মেশিন তৈরি রাখবে?”

“মেশিন!”

ছেনু যেন মুখ আলো করে হাসল, তারপর হাত আর আঙুলের ইশারায় পিস্তলের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল।

কিকিরা সভয়ে মাথা নাড়লেন। “না না, ওসব একেবারেই নয়। অন্যরকম কিছু হলে বিপদে পড়ে যাব।”

ছেনু মাথা নাড়ল। “মামু, ভয় দেখাবার জন্যে বলছিলাম। চালাবে না।”

“না। দরকার নেই।” কিকিরা উঠে পড়বার জন্যে তৈরি। “আমি তোমায় কাল পরশুর মধ্যে দিনটা জানিয়ে দেব। ধরে নাও, এই হপ্তার শেষে। তুমি কথা বলে রাখবে।”

ছেনু মাথা হেলিয়ে সায় দিল।

 উঠে পড়ে কিকিরা বললেন, “ছেনু, একটা কথা বলতে পারো? অবশ্য তুমি জানবে কেমন করে? ওই যে ভদ্রলোক নেপালবাবুর কাছে আমায় নিয়ে গিয়েছিলে–উনি কি গল্পগাছা করতেই ওস্তাদ, না, সত্যিই খোঁজখবর রাখেন…?”

ছেনু বলল, “উনি বুড়ো মানুষ। কর্পোরেশনে চরে বেড়িয়েছেন অনেককাল। এমনিতেও শুনেছি পেটে বিদ্যে আছে। এর বেশি কিছু জানি না, মামু!”

কিকিরা ছাতাটা উঠিয়ে নিলেন। ছেনুর ঠিক যা বলা উচিত তার বেশি কিছু বলেনি। সে এর বেশি কী বা জানবে!

“চলি ছেনু। যা বললাম মনে রেখো।”

 কিকিরা রাস্তায় নেমে বুঝলেন, বৃষ্টির জোর সামান্য বেড়েছে।

.

দু’-দশ পা এগিয়ে একটা ট্যাক্সিই ধরেছিলেন কিকিরা। ঘড়ি দেখার দরকার নেই। আন্দাজেই বোঝা যায় আটটা বাজেনি এখনও।

জ্যাকির চেম্বারের বাড়িটার সামনে এসে ট্যাক্সি ছেড়ে দিলেন। একহাতে ছাতা ধরে আছেন, অন্য হাতে রুমাল। মুখের একপাশ রুমালে চাপা।

জ্যাকির রোগী দেখা প্রায় শেষ। কার যেন দাঁত ফিলিং করছিল। চেম্বারের ভেতর থেকে অস্পষ্ট কথা ভেসে আসছিল এক-আধবার।

সামান্য পরেই লোকটা বেরিয়ে এল। চিনে। মাঝ বয়েসি।

 জ্যাকির চেম্বারে একটা ছোকরা থাকে, হিন্দি সিনেমার ফাইটারদের মতন মাথার চুল, ছোট ছোট, এক কানে একটা তামার আঙটা ঝোলানো।

কিকিরা চেম্বারে ঢুকে পড়লেন।

“অ্যাঙ্কল–?”

“চলে এলাম। …আজ তুমি কোনও ফোন পেয়েছ?”

 মাথা নাড়ল জ্যাকি। এখনও পায়নি।

জ্যাকির অফিস-টেবিলটা দেওয়াল ঘেঁষে। জানলার দিকে দাঁত-তোলার হেলানো চেয়ার। হাত কয়েক তফাতে কাঁচের শেলফের মধ্যে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি। একটা র‍্যাকে গোটা কয়েক ছাঁচ পড়ে রয়েছে দাঁতের।

কিকিরা বললেন, “ক’টা বাজল?”

“এইট ফিফটিন।”

“আর দশ-পনেরো মিনিট দেখো। যদি ফোন আসে ভাল কথা–” বলতে বলতে টেবিলের পাশে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসলেন। চুরুট ধরালেন অন্যমনস্কভাবে। বললেন, “যদি আজ ফোন আসে, আমায় একবার গলাটা শুনতে দিয়ে। তবে কথা বলার সময় তোমায় একটা চালাকি করতে হবে। ঘাবড়াবে না, ভয় পাবে না। শুধু বলবে… কী বার যেন আজ, মঙ্গলবার, এগারো তারিখ, …বলবে আসছে রবিবার সাড়ে সন্ধের পর তোমায় তেরো নম্বরে মিট করতে।”

“আমায় মিট করতে বলব?” জ্যাকি কিছুই বুঝল না।

“বলবে। বলবে, তুমি একটা মিটমাট করতে চাও। সেটেলমেন্ট। এভাবে চলতে দিয়ে লাভ নেই। তা ছাড়া, তুমি যদি তার সামনাসামনি বসে কথা বলতে পারো তারও লাভ হবে। তোমার হাতে এমন একটা ইনফরমেশান আছে– যাতে সে হাত লাগালে অনায়াসে কয়েক লাখ টাকা বানাতে পারে। মানে– দু’ জনে ভাগাভাগি হলেও ফিফটি ফিফটি– সে লাখ কয়েক হাতে পেয়ে যেতে পারে।”

জ্যাকি কথা বলতে পারছিল না। মাথায় ঢুকছিল না, কী বলছেন কিকিরা। বোকার মতন তাকিয়ে থাকল। “অ্যাঙ্কল, লাখ টাকা লাখ লাখ টাকা–হোয়ার ফ্রম! আর ইউ ম্যাড?”

কিকিরা বললেন, “কী করব হে বাপু! আর কিছু মাথায় আসছে না। এটা আমার বাজি ধরা। প্লেয়িং লাস্ট কার্ড! লাগলে লাগবে, না লাগলে তোমায় বলব, তেরো নম্বর বাড়ির আশা ছেড়ে দেওয়াই ভাল। দাদনের টাকা তুমি ফেরত পাবে কি পাবে না আমি জানি না। একটা কাঁচা লেখাপড়া কী করেছ তালুকদারদের সঙ্গে, আমি বাপু জানব কেমন করে!”

জ্যাকি বলল, “আজ যদি ফোন না আসে? রোজ তো আসে না।”

“কাল আসবে, পরশু আসবে…! এলেই যেমনটি শিখিয়ে দিলাম বলবে লোকটাকে। তারপর আমায় খবর দিয়ে আসবে। হাতে আমার অন্তত দু’-একটা দিন থাকা দরকার। …মাঝে চারটে দিন রইল। দেখো কী হয়।”

সাড়ে আটটা বেজে গেল।

জ্যাকি বলল, “আর ওয়েট করবেন?”

“না, চলো।”

“আমি সঙ্গে যাই।”

“না। আমি পেশেন্টের মতন এসেছি। পেশেন্টের মতন চলে যাব।”

“অ্যাঙ্কল ওদের ওয়াচ-ম্যান আছে…”

“আমার কিছু হবে না। এখানে ট্যাক্সি পেয়ে যাব।”

“নীচে পানওয়ালা আছে। আপনি ওয়েট করবেন। ট্যাক্সি পেলে তবে–”

“ঠিক আছে।”

কিকিরা ছাতা তুলে নিয়ে চলে যাওয়ার আগে আরও একবার মনে করিয়ে দিলেন জ্যাকিকে কী কী বলতে হবে ফোন পেলে।

জ্যাকি মাথা নাড়ল। বলল, “অ্যাঙ্কল, ফোন যদি না আসে। এই উইকে এল না?”

“পরের হপ্তায় আসবে। জ্যাকি, সোজা ব্যাপারটা ভেবে দেখো। ওরা তোমায় নজরে রেখেছে দিনের পর দিন। রেখেছে কিনা!”

“আমি ওই তেরো নম্বর বাড়িতে যাওয়ার পর থেকেই।”

“মোর দ্যান এ মান্থ!”

“হ্যাঁ।”

“তুমি আজকাল একা তোমার ভাইকে নিয়ে কতবার গিয়েছ আমি জানি না। আমাদের নিয়ে ক’বারই গিয়েছ। ওরা সেটা দেখেছে।”

“আপনি পাঁচবার গিয়েছেন। আপনারা সবাই তিন-চারবার।”

“ফোন তুমি পাবে।”

 জ্যাকি আর কিছু বলল না।

কিকিরাও আর দাঁড়ালেন না চেম্বারে।

নীচে নেমে পানের দোকানের সামনে দাঁড়ালেন কিকিরা। বৃষ্টি থামেনি। জোরেও পড়ছে না। ছাতা মাথায় কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকলেন। রাস্তার আলো বৃষ্টির জলে ঝাপসা হয়ে রয়েছে।

ট্যাক্সি চোখে পড়ছিল না কিকিরার।

হাঁটতে লাগলেন।

আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতন একটা ঢিল তিনি ছুঁড়ে দিয়েছেন, সেটা লাগবে কি লাগবে না তিনি জানেন না। তবে কথায় আছে, ক্রিমিনালদের মনের পাল্লা লোভের দিকেই ঝুঁকে থাকে বেশিটা। দেখা যাক, কথাটা এখানে কতদূর খাটে!

.

১১.

ঘুটঘুটে অন্ধকারে কে যেন হাত রাখল কাঁধে। লোকটি চমকে উঠল। “কে?”

লোকটির গায়ে গায়ে দু’-এক পা পিছনে তার সঙ্গী ছিল। সাবধানে আসছিল সে। চোখ কান সতর্ক। তবু সে বুঝতে পারেনি, অন্য কেউ অন্ধকারে লুকিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে পকেটে হাত দিল সে৷ দিয়েই বুঝতে পারল, তার ঠিক পিঠের কাছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।

“আসুন!”

“কে আপনি? এভাবে গায়ে হাত দিলেন?”

“গলার স্বর থেকেই আপনি বুঝেছেন আমি কে? তা ছাড়া আপনার মতন বুদ্ধিমান মানুষ নিশ্চয় আন্দাজ করেছিলেন আমি এখানে হাজির থাকতে পারি। আসুন আপনারা…!”

সেই ঘর। প্রথমে টর্চ, পরে দুটো বড় মোমবাতি জ্বেলে দিল জ্যাকি।

কিকিরার গায়ে কালো আলখাল্লা গোছের জামা, প্যান্টটাও কালো। মাথায় কালচে রুমালের ফেট্টি। লোকটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন কিকিরা। বললেন, “ম্যানেজারবাবু, আমি আদতে ম্যাজিশিয়ান। আমরা কখন কীভাবে কোন খেলা দেখাব সেইভাবে সাজতে পারি। রাজাগজা থেকে সন্ন্যাসী–সবই। ওগুলো চমক। পার্ট অব দ্য গেম! আমাদের যা মানায় আপনাকে মানাবে কেন, মশাই। আপনি তালুকদারদের গদির-সেরেস্তাই ধরুন, গদির ধুতি পাঞ্জাবিপরা ম্যানেজার। চাঁদনির প্যান্ট শার্ট আপনাদের মানাবে কেন? মাথার চুল এতটা কালো নয় আপনার। ওটাও চালে ভুল…।”

ম্যানেজার চুপ করে থাকলেন। ঘরের মধ্যে কালো বাক্সটা দেখতে পাচ্ছিলেন না। কোথায় গেল? কফিন বাক্সই বা কোথায়? তার বদলে এক লম্বাটে সরু বেঞ্চির ওপর যেন চাদর পাতা মাটি পর্যন্ত ঝুলে রয়েছে! ওটাই কি কফিন বাক্স! কিকিরার ঠাট্টা হজম করছিলেন মুখ বুজে।

কিকিরা ম্যানেজারের সঙ্গীর দিকে তাচ্ছিল্যের চোখে তাকালেন। “আপনার বডিগার্ড? এ পাড়ার? রাজা না কী নাম! শের বলে লোকে!”

রাজা যেন খাঁচায় ধরা পড়েছে। রাগে তার চোখ জ্বলছিল, কিন্তু একেবারে অসহায়। জ্যাকির বক্সিংলড়া ভাই, ট্যানারিতে কাজ করতে করতে যেন নিজের গায়ের চামড়াই পালটে ফেলেছে, রাজার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। চাদর ঢাকা লম্বা বস্তুটার মাথার দিকে তারাপদরা।

কিকিরা ম্যানেজারকে বললেন, “আমি আমার মক্কেল জ্যাকির হয়ে কথা বলছি। আপনি তো সেটা বিলক্ষণ বোঝেন। এটা আদালত নয়। তবু একটা বোঝাঁপড়ার কথা ছিল বলে আপনার সঙ্গে কয়েকটা বাতচিত…আলাপ আর কি করতে হচ্ছে। কী নাম আপনার? আমরা জানি নামটা, তবু একবার নিজের মুখে বলুন?”

ম্যানেজার দু মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “নরেশ মজুমদার।”

“নরেশচন্দ্র মজুমদার,” কিকিরা বললেন মজার গলায়, “মাঝেরটা বাদ দেবেন না, মশাই, মাঝ হল স্যাকরার জোড়। আপনি তো পদ্মপুকুরে থাকেন?”

“হ্যাঁ। তাতে কী?”

“তালুকদারদের কাছে কাজ করেছেন ক’ বছর?”

“ষোলো বছর।”

“ষোলো।… নরেশবাবু, আপনি একটু গোলমাল করছেন। দু’ বছর বড়বাবুর কাছে চা বাগানে ছিলেন। উনি বোধ হয় আপনাকে তাড়িয়ে দেন। তারপর…”

“তাড়িয়ে দেননি। বনিবনা হয়নি।”

“এখন আপনার বয়েস বোধ হয় বাহান্ন-চুয়ান্ন! তা মশাই, আপনি ছোটবাবুর মাথায় কাঁঠাল ভাঙছিলেন–ভালই ছিলেন। হঠাৎ ঘটককে নিয়ে খেলতে গেলেন কেন? আপনি তাকে খুন করিয়েছেন।”

ম্যানেজার নরেশের মুখ ভয়ে আতঙ্কে কেমন যেন হয়ে গেল। চোখ স্থির। পাতা পড়ছিল না।

কিকিরা অপেক্ষা করতে লাগলেন।

নরেশ হঠাৎ চিৎকার করে বলল, “আপনি কে? পুলিশের মতন কথা বলছেন! ঘটককে আমি খুন করিয়েছি? কেন? কে বলেছে এ-কথা? ঘটকের ফ্যামিলি?”

কিকিরা মাথা নাড়লেন। “না, তার ফ্যামিলির লোক আজও জানে না সে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে! থানা পুলিশ ভবানী ভবন কম করেনি। নো ট্রেস! তবে আপনি জানেন ঘটক কেন খুন হয়েছিল।”

“আমি জানি?”

“জানেন। পাগলা হ্যারিশের হাতে লেখা একটা কাগজ আর কিছু লেখার কথা ঘটক দেখেছিল। চুরি করেছিল। আপনি তার কাছে দেখেছিলেন মাত্র; হাতাতে পারেননি। ঠিক সেইজন্যে এই বাড়িতে ঘটককে আপনারা খুন করেন।”

“মিথ্যে কথা। বানানো কথা।”

“মিথ্যে কথা!” কিকিরা রাজার দিকে তাকালেন। “রাজা! এ-বাড়িতে প্রায় চার বছর আগে খুন হয়েছিলেন একজন। তুমি জানো কে খুন করেছিল।”

রাজা বলবে কি বলবে না করে বলল, “আমি করিনি সার, আমাদের গুরু মায়ারাম করেছিল। সে গত বছর ব্যাঙ্ক ডাকাতি করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে।”

“যাক, ল্যাঠা চুকেছে,” কিকিরা বললেন। “তুমি তবে একটা কথা স্বীকার করছ, ঘটকের প্রাণটা তোমার গুরুর হাতেই গিয়েছে! শুধু আর-একটা কথা বলো, এই ম্যানেজারবাবুই টাকা খাইয়ে খুন-খারাবির কাজটা করিয়েছে কি না?”

রাজা একেবারে অসহায়। কথা লুকোবার চেষ্টা করে লাভ নেই। মাথা হেঁট করে স্বীকার করে নিল।

নরেশ মজুমদার কর্কশ গলায় বললেন, “এটা কোনও প্রমাণ নয়। আইন আদালত করে বুড়ো হয়ে গেলাম মশাই। রাম বলল, শ্যামের কথায় যদু খুন। হয়েছে আর আইন তা মেনে নেবে! মামার বাড়ি!”

ম্যানেজারের কথার কোনও জবাব না দিয়ে কিকিরা রাজাকেই বললেন, “তোমরা এ-বাড়িতে আসো! জানলা টপকে। তোমরাই এই ঘরের দরজা বাইরে থেকে কাঠের তক্তা মেরে বন্ধ করে রেখেছিলে, যাতে কেউ ঘরে আসতে না পারে?”

রাজা চুপ। তার গলায় পাতলা সোনার হার। হারের সঙ্গে একটা লকেট। কার লকেট কে জানে!

“এখানে কেন আসতে?” কিকিরা বললেন। “তুমি না বললেও আমরা জানি। এই ঘর থেকে তোমাদের ব্যবসা হত। চোরাই নেশা–গাঁজা চরস কোকেন– ওই যে কীসব বলে এখানে লুকিয়ে রাখতে আমদানি হলে, পরে বাইরে গিয়ে পার্টির কাছে বিক্রি করতে। নস্যির কৌটোয় কী থাকত হে? নেশা? পাউডার। তেরো নম্বরের ভাঙা পুরনো বাড়ি, ছাদের দিকের ঘর–তোমাদের আড্ডা হয়ে উঠেছিল। জায়গাটা পছন্দসই, তাই না!”

রাজা একবার আড়চোখে ম্যানেজারের দিকে তাকাল, “মজুমদারবাবু আমাদের একটা মাসখরচা দিতেন। বলেছিলেন, বাড়িটা নজরে রাখতে। আমরা সার–

কিকিরা কথা শেষ করতে দিলেন না রাজাকে, বললেন, “জানি, মানে পরে বুঝতে পারলাম।” বলে ম্যানেজারের দিকে তাকালেন, “ঘটকের সেই কাগজটা তো আপনার কাছে নেই। নকলটা আছে। আপনি ঘটককে ধোঁকা দিয়ে কাগজটার নকল করিয়ে নিজের কাছে রেখেছেন। তাই না?”

“কী করেছি সেটা আমার ব্যাপার”

“ব্যাপার আপনারই কিনা বলতে পারব না। তবে কাগজটা যদি দেখান–”

ম্যানেজার বুঝতে পারলেন, গায়ের জোর দেখিয়ে লাভ হবে না। তিনি একা। খানিকটা ইতস্তত করে পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে দিলেন। ময়লা চিট হয়ে গিয়েছে কাগজটা। চার ভাঁজে ভাঁজ করা।

কাগজটা নিলেন কিকিরা। মন দিয়ে দেখলেন। দেখালেন জ্যাকিকে। তারাপদ আর চন্দনও দেখল।

অনেকক্ষণ পরে কিকিরা বললেন, “মশাই, এই বাগানের একপাশে একটা জাহাজি কম্পাসের ছবি। অন্য একপাশে একটা হাওয়া-মোরগ বা ওয়েদার কক-এর ছবি। তলায় একটা অঙ্কের মতন কী লেখা আছে। আপনি এরই ভরসায় বসে আছেন কবে লাখ লাখ টাকা কামাবেন!”

“আপনি বেশি পণ্ডিত?”

“না, আমি পণ্ডিত নয়। মুখসুখ মানুষ। তবে একটা কথা আপনাকে বলতে পারি। পর্তুগিজ পাদরি ফাদার পেইজ-এর গলায় পাথরের মালার সঙ্গে যে ক্রশ-লকেটটা ঝুলত, সোনা আর দামি পাথর দিয়ে তৈরি–সেটা চুরি গিয়েছিল ঠিকই–লিসবনের এক গির্জা থেকে। পরে ধরা পড়ে ওটা আসল নয়, নকল।”

“নকল?”

“হ্যারিশও এই ভুল করেছিল।..। অত কথায় দরকার কীসের, এখানকার গঞ্জেলাস কোম্পানিতে গিয়ে খোঁজ করলেই পারেন।”

নরেশ মজুমদার বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

কিকিরা তারাপদদের কী ইশারা করলেন চোখে চোখে।

লম্বাটে টেবিল–মানে কফিন বাক্সটার ওপরে একটা মোটা চাদর পাতা ছিল। ঢাকা দেওয়া ছিল। তারাপদরা চাদরটা সরিয়ে নিল।

কিকিরা যেন কোনও ম্যাজিক দেখাচ্ছেন। বাক্সর মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে জ্যাকিদের বললেন, ওপরের ডালাটা খুলে ফেলতে।

ডালা খোলা হল।

“ম্যানেজারবাবুনা মজুমদারমশাই, কী বলে ডাকব আপনাকে। তা সে যাই হোক, আপনি এবার এই কফিন বাক্সের মধ্যে এসে শুয়ে পড়ুন। আমরা ডালাটা বন্ধ করে দেব। ভাববেন না দরজা জানলা খোলা থাকবে। সব বন্ধ করে দিয়ে চলে যাব আমরা।…আসুন!”

মজুমদার ভয় পেয়ে পালাতে গেল, পারল না।

কিকিরার কাছে তাঁকে ধরে আনল জ্যাকি আর চন্দন।

কফিনের ভেতরের দিকটা দেখালেন কিকিরা। একটা লোক শুয়ে আছে। বাক্সর মাথার দিকের মানে–পাশের কাঠ খুলে ফেলা হয়েছে, যাতে যে শুয়ে আছে তার শ্বাসপ্রশ্বাসের অসুবিধে না হয়।

কিকিরা লোকটিকে উঠতে বললেন। সে উঠে পড়ল।

মজুমদার ঘামছিল।

 কিকিরা বললেন, “আপনি ভাববেন না বেঁচে গেলেন। এতক্ষণ যে শুয়ে ছিল সে আমাদের বন্ধু। কিন্তু পুলিশের লোক। ওর নাম অবনীশ। চন্দনের বন্ধু। পুলিশেই আছে। তবে অন্য লাইনে। তবু পুলিশ পুলিশই। আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে রইল ও। বাকিটা কী হয় দেখা যাক।”

রাজা আচমকা মজুমদারের ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ল।

কিকিরা যেন দেখেও দেখলেন না। চন্দনদের বললেন, “চলো হে! চলো।” বলে অবনীশের দিকে চোখ টিপে হেসে বললেন, “কথায় আছে শিশুরা মাতৃক্রোড়ে সুন্দর! তাই না! কফিন বাক্সের মধ্যে পুলিশের শুয়ে থাকাটাও খারাপ দেখাচ্ছিল না! কী বলো, চাঁদু?”

ওরা হেসে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *