সোনালি সাপের ছোবল
বেশ সুর করে টেনে টেনে– ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’ বলতে বলতে তারাপদ ঘরে ঢুকল। সাহেবি কায়দায় ‘ইউ’-টাকে বলল, ‘য়্যু’। হাতে ফুলের তোড়া।
কিকিরা কাগজ পেন্সিল নিয়ে বসে বসে কীসের এক আঁকজোক করছিলেন। তাকালেন মুখ তুলে।
ফুলের তোড়া এগিয়ে দিয়ে তারাপদ বলল, “ধরুন সার, আপনাকে একটা প্রণাম করি।”
কিকিরা ফুলের তোড়া নিলেন। তারাপদ প্রণাম করল।
“আজ আমার বার্থ ডে তোমায় কে বলল?” কিকিরা বললেন।
তারাপদ হাসল। “আপনিই একদিন বলেছিলেন। দোলপূর্ণিমার আগের দিন। ঠিক কি না?”
কিকিরা বললেন, “সে-বছর তাই ছিল শুনেছি। তা বলে প্রতি বছর কি একই তারিখে দোলপূর্ণিমা হয় হে, তারাবাবু! দিন পালটে যায়।”
“আরে তাতে কী? আমাদের কাছে পাঁজি থাকে না, সার; অতশত বুঝি না। হিসেবটা ওই দোলপূর্ণিমা নিয়ে। ইজি হিসেব। অ্যাডভান্স হলে ক্ষতি নেই। আবার লেট হলেই বা কী! আসলে তো আপনাকে ‘উইশ’ করা।”
“বুঝেছি। আমার পিসিমার হিসেব।”
“সেটা আবার কী?”
“আমার পিসিমা হিসেব করত, যখন আমাদের বুধন গোয়ালা টাকায় চার সের দুধ দিত তখন পাঁচকড়ি জন্মেছে, আবার যখন টাকায় দু’ সের দুধ হল–তখন এল সাতকড়ি।”
তারাপদ প্রথমটায় বোঝেনি। পরে বুঝল, বুঝেই জোরে হেসে উঠল।
কিকিরাও হাসলেন। তারপর ফুলের তোড়াটা এগিয়ে দিয়ে চোখের ইশারায় ঘরের একপাশে রেখে দিতে বললেন।
তারাপদ ফুলের তোড়া নিয়ে রেখে দিল।
“চাঁদুর খবর কী?” কিকিরা বললেন।
“আসছে। ও আপনার জন্যে একটু মুখরোচক কিনে চলে আসবে।”
“বাঃ! ব্যবস্থাটি ভাল।”
তারাপদ বসল। বসেই চেঁচিয়ে জল চাইল বগলার কাছে। কলকাতায় গরম পড়ে আসছে। ফাল্গুন মাসের একেবারে শেষ। বেলা বেড়ে গিয়েছে অনেকটা। সকালের সূর্যই কেমন ঝাঁঝিয়ে উঠছে। বাতাস শুকনো। মাঝে মাঝে হলকা ওঠে দুপুরে, যেন কাছাকাছি কোথাও আগুন ধরে গিয়ে তার তাত আসছে বাতাসে।
“তোমাদের বাঁকড়ো বিষ্টুপুর কেমন হল?” কিকিরা বললেন।
“ভালই। হইচই হল খুব।”
তারাপদরা দু-তিনদিন কলকাতায় ছিল না। চন্দনের এক ডাক্তার বন্ধুর বোনের বিয়ে ছিল বাঁকুড়ায়। বন্ধু চন্দনের–সেই সূত্রে তারাপদরও। সেই বন্ধুই ধরে নিয়ে গিয়েছিল ওদের। গতকালই ফিরেছে তারাপদরা।
আজ সোমবার। আগামীকাল দোল। অফিস ছুটি। আজ অফিস ফেরতই এসেছে তারাপদ। চন্দনও আসবে। একটু দেরি হতে পারে।
ফাল্গুনের শেষ বেলার আলো এবার মরে আসছে। একটু পরেই ঝাপসা অন্ধকার হয়ে আসবে। ঘরে এখনও বাতি জ্বালানো হয়নি।
বগলা জল নিয়ে এল।
জল নিল তারাপদ। গলা যেন কাঠ হয়ে ছিল তারাপদর, এক চুমুকেই জলের গ্লাস শেষ।
বগলা চলে গেল।
“আপনার খবর কী?” তারাপদ বলল।
কিকিরা কাগজ পেন্সিল সরিয়ে রেখে বললেন, “একটা চাকরি নিচ্ছি।”
“চা-করি! আপনি?” তারাপদ যেন আকাশ থেকে পড়ল–ভাবটা এই রকমই।
কিকিরা সহজভাবেই বললেন, “সেদিন ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম। শুনলাম আমার ব্যালেন্স তলানিতে। মানে, এর পর অনাহার। নো ফুড। তা মনটা বিগড়ে গেল। ব্যাঙ্ক থেকে ফিরে আসছি, হঠাৎ পানুবাবুর সঙ্গে দেখা। পানু মল্লিক। ক্রিমিন্যাল কেসের ওকালতি করেন। আমায় দেখে খপ করে ধরে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে চাকরি। ম্যানেজার-কাম-কেয়ারটেকার। থাকা খাওয়া ফ্রি।”
তারাপদ তখনও বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিকিরা তামাশা করছেন নিশ্চয়। চাকরি করার মানুষ তিনি নন। তা ছাড়া, উনি ধনী না হন, গচ্ছিত যথেষ্ট না থাকুক, একেবারে খাওয়া-পরার ব্যবস্থা থাকবে না–এমন হতেই পারে না। অপব্যয়ী, বিলাসী–কোনওটাই নন কিকিরা। যা আছে তাতে দুটি মানুষের (তিনি ও বগলা) দিব্যি চলে যায়। আর মাঝেমধ্যে আয়ও হয় বইকী! উঠতি ম্যাজিশিয়ানদের খেলার নকশা করে দেন, সাজসরঞ্জাম কারিগরের ব্যবস্থা করেন-তাতে কিছু হাতে আসে। দু-চার হাজার টাকা ওঁর ক্লায়েন্টরাও দেয়। অবশ্য এখানে তিনি জোর-জবরদস্তি করেন না। যে যা দেয়–জোর করেই কিকিরার পকেটে গুঁজে দেয়।
তারাপদ বিশ্বাস করল না চাকরির কথা। হালকা ভাবেই বলল, “কোন কোম্পানির চাকরি, সার?”
“কোম্পানি নয়; এক ভদ্রলোকের …”
“ভদ্রলোকের! প্রাইভেট পার্টি! কে সে?”
“হরিচন্দনবাবু। হরিচন্দন মুখোপাধ্যায়।”
“কী নাম বললেন? হরি”
“হরিচন্দন।”
“এমন নাম জীবনে শুনিনি। হরিহর, হরিমাধব, হরিধন … এসব অনেক শুনেছি। এ একেবারে হরিচন্দন–! দারুণ।”
“নামে শুধু নয় হে, অন্যদিক থেকেও দারুণ। ফ্যামিলি হেরিটেজ প্রায় সেই ফোর্ট উইলিয়ামের আমল থেকে। বিস্তর ধনী ছিলেন পূর্বপুরুষ। গাছের ডাল ভাঙতে ভাঙতে এখন তিনি যে-ডালের ডগায় বসে আছেন, সেই ডালে একজন বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার, একজন কাউন্সিলার, একজন রায়বাহাদুর ছিলেন। আপাতত সেই বংশে হরিচন্দন নিজে, তাঁর ছেলে ধরণী, আর হরিবাবুর স্ত্রী। ছেলে কলকাতায় থাকে না। বম্বেতে রয়েছে। ব্যবসা করে। পুতুল আর খেলনার ব্যবসা। এক্সপোর্ট বিজনেসই বেশি।”
তারাপদ যেন সব গুলিয়ে ফেলছিল। বলল, “দাঁড়ান, একটু বুঝে নিই। … আগে বলুন, পানুবাবুটি কে? তাঁর সঙ্গে আপনার দেখা হল হঠাৎ আর আকাশ থেকে চাকরি খসে পড়ল! আরব্য রজনী নাকি?”
কিকিরা মুচকি হেসে মাথা নাড়লেন। পকেট হাতড়ে তাঁর সেই পাতলা চুরুট বার করলেন একটা। ধরালেন ধীরে সুস্থে। তারপর বললেন, “পানুবাবু আমার ওল্ড ফ্রেন্ড। বউবাজার পাড়ায় থাকার সময় আমাদের একটা ক্লাব ছিল। তাস, দাবা খেলা হত, আর বছরে একবার করে থিয়েটার লাগানো হত–”চন্দ্রগুপ্ত’, ‘কণার্জুন, ষোড়শী’–এইসব। পানুদা ভাল অ্যাক্টার ছিলেন না। তবে গলায় জোর ছিল। হাজার হোক ক্রিমিন্যাল প্র্যাকটিস করেন তো?”
“আপনার এমন মাই ডিয়ার বন্ধু কত জন, সার?”
“অনেক। বন্ধুর ভ্যারাইটিও কম নয়। কলকাতার সেরা পকেটমার লালুচাঁদও আমার বন্ধু ছিল।”
“বাঃ! তা পানুবাবু আপনাকে চাকরি দিলেন?”
“দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন,” কিকিরা চুরুটের মুখের দিকে ছাই সরিয়ে আগুন, ঠিক করে নিতে নিতে বললেন।
“একটু ঝেড়ে কাশুন তো! বড্ড মিস্ত্রি হয়ে যাচ্ছে।”
“সবটা শুনতে চাও! তা হলে তো অনেক বলতে হবে। আসল কথাটাই বলি : পানুবাবু একটা কাজে শিয়ালদা কোর্টে এসেছিলেন। কাজ শেষ করে নিজের গাড়িতে ফিরছিলেন, যাবেন সেই পুলিশ কোর্ট। রাস্তায় আমায় দেখতে পেয়ে গাড়ি থামিয়ে চেঁচাতে লাগলেন। কাছে যেতেই হাত ধরে টেনে তুললেন তাঁর গাড়িতে। দুপুরবেলায় অত্যাচার। ছাড়াতে পারি না। আমায় প্রায় বগলদাবা করে নিয়ে গিয়ে তাঁর চৌখুপিতে আটকে রেখে ডাবের জল, চা, পান, সিগারেট দিয়ে আপ্যায়ন। নিজের টুকটাক কাজ সেরে শেষে কাজের কথা পাড়লেন। বললেন, ব্রাদার কিঙ্কর, তুমি একেবারে ঠিক সময়ে দেখা দিয়েছ। ভগবানের মনে ছিল, ভাই; পেয়ে গিয়েছি। তোমায় একটা কাজ করতে হবে। আমার খুব চেনাজানা এক ভদ্রলোক হরিচন্দনদা বেজায় ঝামেলায় পড়েছেন। তুমি একটিবার হাত লাগাও।”
“আচ্ছা! … তা পানুবাবু কি আপনার এখনকার খোঁজখবর রাখেন?” তারাপদ বলল।
“রাখেন খানিকটা। দু-চার মাস অন্তর পুরনো ক্লাবেও যাই গল্পগুজব করতে।”
“তারপর?”
“ঝামেলার ব্যাপারটা বললেন উনি।”
“কী?”
“হরিচন্দনবাবুর একটা বাড়ি আছে কদমপুরে। কলকাতার কাছেই। বাড়িটা শখ করে করা। কান্ট্রি হাউস। ছোট বাড়ি, দেদার গাছপালা, মায় একটা কুকুর। একসময় শখ করে করলেও এখন আর যাওয়া-আসা নেই। বাড়িটাকে তিনি একরকম ওল্ড হোম করে ফেলেছিলেন। মানে, খানিকটা বয়স্ক লোকের–যাদের বড়সড় কোনও রোগব্যাধি নেই, অথচ সংসারে ঠিকমতন যত্ন পায় না, অবহেলা করে ছেলে, ভাইপো-তেমন কয়েকজনকে সেখানে তিনি ঠাঁই দিয়েছিলেন।”
তারাপদ অবাক হয়ে শুনছিল। বলল, “ক’জন মানে?”
“ছ’জন ছিল।”
“বেশ। তা …”
“তার মধ্যে দুজন আর নেই। একজন আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছে, আর-একজন গত মাসে অদ্ভুতভাবে আত্মহত্যা করেছে।”
তারাপদ কৌতূহল বোধ করল। বলল, “আগুনে পোড়া আর আত্মহত্যা করায় অবাক হওয়ার কী আছে! এমন তো হয়ই। হরিচন্দনবাবু এই দুটো ব্যাপারকে অস্বাভাবিক মনে করছেন নাকি?”
“হ্যাঁ,” কিকিরা মাথা হেলিয়ে বললেন, “তিন-চার মাসের মধ্যে পর পর ঘটনা দুটো ঘটায় তিনি অস্থির হয়ে পড়েছেন; বিমূঢ় বলতে যা বোঝায়–তারও বেশি, ভীষণ উদ্বিগ্ন। ভয় পেয়ে গিয়েছেন।”
“কেন?”
“সেটাই তো কথা হে? কেন?”
“রহস্য আছে নাকি?”
“আছে বলেই তিনি মনে করেন।”
তারাপদ সামান্য সময় চুপ করে থাকল। উঠে গিয়ে বাতিটা জ্বেলে দিল ঘরের। ফিরে এসে বসল আবার। তারপর বলল, “চাকরির ব্যাপারটা ঠিক হল কেমন করে? তখন তখনই?”
“না। পানুবাবু বিকেলে হরিচন্দনবাবুর বাড়ি গিয়ে কথা বললেন। পরের দিন সকালে তাঁর লোক এল আমার কাছে চিঠি নিয়ে। পানুবাবু লিখেছেন, ব্রাদার কিঙ্কর–আমার সঙ্গে হরিচন্দনদার কথাবার্তা হয়ে গিয়েছে। অলমোস্ট ফাইন্যাল। তুমি পরশু দিন–দোলের পরের দিন বিকেলে তাঁর বাড়ি গিয়ে নিজে দেখা করবে। কথা বলবে। আমি আলাদা একটা চিঠি তোমায় লিখে দিলাম। হরিচন্দনদাকে দেখাবে। ভাই, আমাকে উদ্ধার করো। অন্তত একবার চেষ্টা করে দেখলে তোমার তো কোনও ক্ষতি হবে না। কাজটা হাতে নিলে তোমার কিছু প্রাপ্য হবে। কথা বলে রেখেছি।”
তারাপদ জিভে একটা শব্দ করল। বলল, “কাজটা আপনি হাতে নিচ্ছেন তা হলে?”
“ইচ্ছে আছে। এখন পরশু দিন হরিচন্দনবাবুর সঙ্গে দেখা করি। কী বলেন তিনি শুনি। তারপর …! তা তুমিও আমার সঙ্গে যাচ্ছ?”
“আমি?”
“তিনে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ!” কিকিরা রগড় করে বললেন। “পানুবাবুকে আমার বলা আছে হে, আমরা হলাম তিন টেক্কা, এক টেক্কা হাতে নিয়ে খেলায় নামি না।”
এমন সময় চন্দনের গলা পাওয়া গেল। এসে পড়েছে সে। বগলাকে কী বলল, তারপর ঘরে এসে হাসিমুখে কিকিরার দিকে এগিয়ে গেল। “আপনার জন্মদিনে আমার প্রণাম ও শুভেচ্ছা, সার। দিন একটু পদধূলি দিন।”
“তোমরা আমার জন্মদিনটাকে একেবারে গুবলে দিলে!” কিকিরা বললেন মজা করে।
“গুবলে দিলে! মানে?”
“গুবলেট! যাক গে, তুমি নাকি কী সব খানা নিয়ে আসছ!”
“বেশি কিছু আনিনি। যা গরম পড়ে যাচ্ছে! এই একটু নান, চিকেন পাকৌড়া, স্যালাড আর সামান্য মিষ্টি।”
“বাঃ, খাসা! … তা তোমরা আজ আসবে জানলে আমি দু-একটা কুকিং করতে পারতাম। পরে হবে।”
চন্দন সরে গিয়ে তারাপদর কাছাকাছি বসবার আগেই তারাপদ বলল, “চাঁদু, কিকিরা একটা চাকরি নিয়েছেন।”
“কী?”
“চাকরি।“
“কীসের চাকরি?” চন্দন বুঝতে পারল না।
“ম্যানেজার-কাম-কেয়ারটেকার …! বলুন না সার আপনার চাকরির ব্যাপারটা। “
“তুমিই বলো।”
বগলা চা নিয়ে এসেছিল। তারাপদদের হাতে হাতে চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। কিকিরা এখন লিকার খাবেন। দুধ চিনি দুই-ই বাদ। ক’দিন সন্ধের চায়ে দুটোই বাদ দিয়েছেন, খেয়াল। দুধে নাকি অ্যাসিড হচ্ছে!
চা খেতে খেতে তারাপদ কিকিরার চাকরি নেওয়ার বৃত্তান্ত শোনাল চন্দনকে।
মন দিয়ে শুনছিল চন্দন। মাঝে মাঝে জিগ্যেস করছিল দু-একটা কথা।
তারাপদর কথা শেষ হলে চন্দন কিকিরাকে দেখল সামান্য সময়। পরে বলল, “আপনি দুটো দিন চুপ করে বসে থাকতে পারেন না? দিন দিন কী হয়ে যাচ্ছেন! ছেলেমানুষ।”
“চুপ করেই তো বসে থাকি! বসে থাকতে থাকতে কী দশা হয়েছে জানো? পেটে টান পড়েছে।”
“আপনার কতটুকু পেট!”
“তাই বা ভরে কেমন করে!”
“বুঝতে পারছি। তা হলে হরিচন্দনবাবুর কাজটা আপনি নিচ্ছেন?”
“দেখি, কথাবার্তা বলি। ধরে নাও, যদি কথায় বনে, কাজটা নেব।” চন্দন আর কিছু বলল না।
.
০২.
বাই লেন না লেন–ধোঁকা লেগে যায় গলির মুখে এসে দাঁড়ালে। একটা ট্যাক্সি গলতে পারে মাত্র এইটুকু চওড়া। পঁচিশ ত্রিশ গজ এগিয়ে গেলেই যেন হঠাৎ সব পালটে যায়। গলি খানিকটা চওড়া হয়ে গিয়েছে ঠিকই তবে তার চেয়েও বেশি চমক লাগে পাঁচিলঘেরা বাড়িটাকে দেখলে। এই গলিতে এমন বাড়ি যেন সম্ভব নয়। তারাপদ অবাক হয়ে গিয়েছিল।
উঁচু পাচিল, প্রায় পাঁচ ফুট লম্বা। অবশ্য রংচং আর নেই, ছাই ছাই কালচে দেখায়; কোথাও বা শ্যাওলা ধরার দাগ, চুন সুরকির বদলে ইট বেরিয়ে রয়েছে। মাঝে মাঝে ফাটল, গাছের চারা গজিয়েছে ফাটলের মুখে।
লোহার ফটক ছিল ডানদিকে। ফটকটা আধ-খোলা। ফটকের গায়ে আধমরা লতানো গাছ।
কিকিরার পাশাপাশি পা বাড়িয়ে ভেতরে এল তারাপদ। সামনে মাঠ। একসময় বাগান ছিল, এখন বারো আনাই নেড়া। বাকি চার আনায় দু-চারটে সাধারণ গাছ আর আগাছার ঝোঁপ। ওরই মধ্যে চোখে পড়ে একটা কাঠচাঁপার গাছ, শিউলি ঝোঁপ, মামুলি কয়েকটা রঙ্গন গাছ।
সামনের বাড়িটা দোতলা। একেবারে পুরনো ছাঁদের। মোটা মোটা থাম, চওড়া বারান্দা, দোতলার বারান্দায় লোহার নকশাকরা রেলিং। নীচের তলার একপাশে এক ছোট কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক, অন্যপাশে কোনও ওষুধ কোম্পানির গুদাম।
তারাপদ বলল, হালকা ভাবেই, “সার, এ যে একেবারে চিচিংফাঁক হয়ে গেল। কী দেখছি বুঝতে পারছি না, চোখে ঠিক দেখছি তো!”
কিকিরা বললেন, “কলকাতার পুরনো পাড়ায় এমন বাড়ি অনেক আছে এখনও।”
“এটা কোন পাড়া যেন?”
“পাথুরেঘাটা।”
নীচে লোকজন চোখে পড়ল না তেমন। ওষুধ কোম্পানির দরোয়ান, জনা দুয়েক কম বয়েসি ছোকরা, ছোট ডেলিভারি ভ্যান, বোধ হয় খারাপ হয়ে গিয়েছে, কথাবার্তা বলছিল তিনজনে।
কিকিরা দোতলার সিঁড়ি খুঁজে নিলেন। “এসো।”
সিঁড়ির ধাপগুলো মাঝারি উঁচু, কিন্তু চওড়া যথেষ্ট, আর লম্বাও।
তারাপদ বলল, “কতকালের বাড়ি হবে, কিকিরা? শ’খানেক বছরের পুরনো তো হবেই।”
“শ’ তো সেদিনের কথা, আরও পুরনো।”
সিঁড়ির একটা বাঁক শেষ হল, পরের বাঁক ডান-হাতি। কিকিরা ইশারা করলেন। বাঁকের মুখে দেওয়ালে একটা হরিণের শিং আটকানো। মাথা নেই হরিণের, শুধু একটা কালো কাঠের ওপর আশ্চর্য কায়দায় শিং দুটো লাগানো। জায়গাটায় আলো নেই, ছায়া। তবু আন্দাজে মনে হয়, ধুলো আর ময়লা জড়িয়ে আছে শিংয়ের চারপাশে। কাঠে।
দোতলায় এসে দাঁড়ালেন কিকিরারা।
চওড়া বারান্দা। লম্বাও কম নয়। এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক পায়চারি করছিলেন বারান্দায়। দেখতে পেয়ে গেলেন কিকিরাদের।
কিকিরা হাত তুলে নমস্কার করলেন। “পানুবাবু আমায় পাঠিয়েছেন। আপনি হরিচন্দনবাবু!”
মাথা নেড়ে উনি বললেন, “হ্যাঁ। আমি হরিচন্দন। … আসুন, আপনারই অপেক্ষা করছিলাম।“ কথা বলতে বলতে তারাপদর দিকে তাকালেন একবার।
কিকিরা জামার পকেট থেকে পানুবাবুর চিঠিটা বার করে এগিয়ে দিলেন।
চিঠি নিতে নিতে হরিচন্দন বললেন, “পানু আজ সকালেও ফোন করেছিল। নামটা আপনার কী যেন, কিঙ্কর ..”।
“কিঙ্করকিশোর রায়। ছোট করে কিকিরা।”
চিঠি দেখতে দেখতে হরিচন্দন বললেন, “পানুর সঙ্গে আমার আগেও কথা হয়েছে। শুনেছি সবই। … আসুন, বসুন।”
বারান্দার মাঝমধ্যিখানে একটা ভারী সেকেলে আর্মচেয়ার। বেতের বুনুনি আগাগোড়া, তার ওপর হালকা গদি। চেয়ারের পাশে গোলমতন শ্বেতপাথরের টেবিল। বড় নয় তেমন। টেবিলের ওপর চায়ের কাপ, পট, চশমার খাপ, একটা গোলমতন প্লাস্টিকের জার। তার মধ্যে দু’-তিনটে চুরুট। লাইটারও পড়ে আছে পাশে।
হরিচন্দনবাবু আবার বসতে বললেন। কাছেই বারান্দার গায়ে গায়ে সাজিয়ে রাখা গোটা তিনেক কাঠের চেয়ার। হাতলঅলা। একই রকম দেখতে চেয়ার তিনটে। মজবুত, ভারী চেয়ার।
নিজের চেয়ারে বসলেন হরিচন্দনবাবু। হাত তুলে ইশারায় বললেন, “এগিয়ে নিন চেয়ারগুলো। আমি আবার কানে খানিকটা কালা। দূরে বসলে কথাবার্তা শুনতে পাব না ঠিকমতন।”
তারাপদ চেয়ার টেনে এনে কাছাকাছি রাখল।
কিকিরা হরিচন্দনবাবুকে দেখছিলেন। বয়েস হয়েছে ভদ্রলোকের। পঁয়ষট্টির কম বলে মনে হয় না। মাথায় লম্বা, গড়ন দোহারা। অভিজাত মুখশ্রী। শক্ত থুতনি, লম্বা নাক। মাথার পাতলা চুল সবই পেকে গিয়েছে। ওঁর পরনে ধুতি, গায়ে ফতুয়া পাঞ্জাবি, আদ্দির। পায়ে রবারের চটি। সাদা।
হরিচন্দনবাবু ডাকলেন কাউকে।
কিকিরা আর তারাপদ এতক্ষণে বসে পড়েছেন।
ভেতরের ঘর থেকে একজন বেরিয়ে এল। এ বাড়ির কাজের লোক। মাঝবয়েসি।
হরিচন্দনবাবু বললেন, “কে রে, সাধন! চা-টা দে এখানে। একটু পরে বাতি জ্বেলে দিয়ে যাবি।”
দিনের আলো মরে আসছে। বারান্দায় ছায়া নেমে কালচে ঝাপসা হয়ে এল। এটা বোধ হয় দক্ষিণ-পশ্চিম দিক।
হরিচন্দন বললেন, “রায়মশাই, পানুর মুখে আমি আপনার কথা শুনেছি। পানুকে আমি খুব বিশ্বাস করি। ওর বড়দা আমার বন্ধু ছিল। নামকরা ডাক্তার ছিল সে। রোগী দেখার সময় হাসিঠাট্টা করত, বুঝতে দিত না সে একজন রাশভারী ডাক্তার। তা সে নিজেই একদিন চলে গেল হঠাৎ।”
“আমি জানি পানুবাবুর দাদা বড় ডাক্তার ছিলেন।” কিকিরা বললেন।
“জানেন তবে! … যাক, কাজের কথা তোক। পানুর মুখে আমি শুনেছি। ঠিকই তবে সেটা পরের মুখে ঝাল খাওয়া। আপনার মুখ থেকে শোনাই ভাল। কী করেন আপনি?”
“এমনিতে কিছু করি না। বেকার!” কিকিরা হাসলেন মুচকি।
“পানু বলেছিল, আপনি প্রাইভেটলি ইনভেস্টিগেশান করেন। ডিটেকটিভ!”
“আজ্ঞে না। আমি ডিটেকটিভ নই। কোনও কালেই ছিলাম না। আসলে আমি ম্যাজিশিয়ান ছিলাম এককালে। খেলা দেখাতাম। কপাল দোষে আমার সেই পেশাটি চলে গেল। এখন ..”
“আপনি ম্যাজিশিয়ান! পানু একবার বলেছিল বটে। তা সেই খেলা দেখানো ছেড়ে নতুন করে এখন–”
“আজ্ঞে, আমি একটু শখ করে চোর ছ্যাঁচড় পাজি নচ্ছার ধরার চেষ্টা করি। পানুদার হল ওকালতি, ক্রিমিন্যাল কেস, আমাকে ক্রিমিন্যাল ক্যাচার বলতে পারেন।” কিকিরা হাসি হাসি মুখে বললেন, “আমাদের দেশে ঘটি বাটি চালা, চালপোড়া খাওয়ানো, এসব কতরকমই হয়। আমাকেও তার মধ্যে ফেলতে পারেন। হাতুড়ে বিদ্যে, মাঝে মাঝে লেগে যায়, আবার”
হরিচন্দন হালকাভাবে হাসলেন। “ঠিক আছে। আমি পানুর সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, আপনাকে দিয়ে হতে পারে। ডিটেকটিভের দরকার আমারও ছিল না। দরকার ছিল এমন লোক যে আমার মৃণালকুঞ্জে নজর রাখতে পারবে। কাজটা আপনি নিয়ে নিন।”
কিকিরা বললেন, “কাজটা কী?”
“বলছি।” বলে হরিচন্দন তারাপদর দিকে তাকালেন, “এই ছেলেটি?”
“তারাপদ। আমার চেলা। আরও একজন আছে, চন্দন। তাকে পরে একদিন দেখবেন। আমরা তিনজনে মিলে কাজ করি। কেন, পানুবাবু আপনাকে বলেননি?”
মাথা হেলালেন হরিচন্দন। “বলেছিল। নামটাম বলেনি; বলেছিল–আপনার শাগরেদ আছে।” বলতে বলতে বার কয়েক শুকনো কাশি তোলার মতন শব্দ করলেন গলায়। বোধ হয় গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। এই সময়টা বড় খারাপ। গরম পড়ছে, অথচ সকাল সন্ধেতে সামান্য ঠাণ্ডা ভাব এসে যায়। তা ছাড়া ধুলো উড়ছে ক’দিনই। বাতাসে বুঝি আবিরের গুঁড়ো ওড়ে এখনও। দোল গিয়েছে কাল। আজও তার জের রয়েছে কোথাও কোথাও।
কিকিরা বললেন, “আপনার কাজটা যে কী, আমি ঠিক জানি না। ভাসা ভাসা শুনেছি পানুবাবুর মুখে। আপনি ‘মৃণালকুঞ্জ’-র কথা বললেন, সেটা কী?”
“বাড়ির নাম। কদমপুরে যে বাড়িটা আছে আমার, তার নাম। আমার মায়ের নাম ছিল মৃণালিনী। মায়ের নামে বাড়ি।”
“বাড়ি আপনি করেছিলেন?”
“না,” মাথা নাড়লেন হরিচন্দন। “বাবা করেছিলেন। একতলা একটা ছোট বাড়ি। আমাদের কিছু জমিজায়গা বাগান ছিল ওখানে। সেগুলোর বেশিরভাগটাই বাবা বেচে দেন। সামান্য রেখেছিলেন। আমার মায়ের এক অসুখ করল। অদ্ভুত অসুখ। বছরের অর্ধেক দিন গায়ে জ্বর, সঙ্গে কাশি আর শ্বাসকষ্ট। কলকাতা শহরের কত বড় বড় ডাক্তার দেখল, কেউ ধরতে পারল না। কেউ বলে যক্ষ্মা, কেউ বলে হাঁপানি, আবার কারও ধারণা, হার্টের গোলমাল। ডাক্তাররা বললে, মাকে নিয়ে গিয়ে ফাঁকায় আলো-বাতাসে রাখলে মা খানিকটা ভাল থাকবে। তখন বাবা ওই বাড়িটা করেন। বর্ষা আর শীত বাদে বেশিরভাগ সময় মা ওখানে থাকত। শেষে একদিন মা চলে গেল।” হরিচন্দন থামলেন, নিশ্বাস ফেললেন বড় করে।
কিকিরার দুঃখই হল। ভালও লাগল হরিচন্দনকে। কোনওরকম লুকোচুরি নেই। যা ঘটে গিয়েছে–সাদাসিধেভাবে বলছেন।
.
“বাড়িটা একতলা?” তারাপদ বলল হঠাৎ। এতক্ষণ সে একটাও কথা বলেনি। মুখ বুজে বসে ছিল। দেখছিল হরিচন্দনবাবুকে।
হরিচন্দন বললেন, “একতলাই ছিল প্রথমে। পরে, বারো চোদ্দো বছর পরে– বাবাও তখন নেই, আমি ওটাকে দোতলা করি। অবশ্য দোতলার মাথায় টাইলস বসিয়েছিলাম।”
“দোতলা করতে গেলেন কেন?”
“এমনি; শখ করে। ভাবলাম একটা গ্রামের বাড়ি থাকুক না, মাঝে মাঝে এসে থাকা যাবে। কলকাতায় আমরা যেখানে থাকি– তার অবস্থাটা দেখছ তো?” তারাপদকেও বললেন কথাগুলো। একটু থামলেন। আবার বললেন, সামান্য হেসে, “তখন আমার নিজের ফার্মও ভাল চলছে। হাতে টাকা। পৈতৃক বিষয় তো আছেই। শখ করেই করেছিলাম। কখনও ফ্যামিলি নিয়ে আট-দশদিন কাটিয়ে আসতাম। শনি-রবিবার একবার করে তদারকিও করে আসতে হত। বাগানের টাটকা শাকসবজিও নিয়ে আসতাম।”
“শেষমেশ আর যেতেন না?” কিকিরা বললেন।
“ঠিকই ধরেছেন,” হরিচন্দন বললেন, “বয়েস বাড়ল। কোমরের দিকে কী হল যে– শয্যাশায়ী হয়ে থাকলাম মাস তিনেক। নিজের ব্যবসা মানে ফার্মটা অন্যকে গছিয়ে দিলাম। আর ভাল লাগত না। ছেলেটাও বোম্বাই চলে গেল।… তা মৃণালকুঞ্জ পড়েই থাকল ফাঁকা। … তারপর একদিন আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথায় কথায় বাড়িটার একটা গতি করার ব্যবস্থা করলাম। বিক্রি করব না। টাকায় আমার দরকার নেই। ভাল যদি কিছু করা যায়…”
“স্বাস্থ্য নিবাস?”
“আরে না, স্বাস্থ্য নিবাস নয়। আমার এক বন্ধু রামকমলের অবস্থা দেখে মনে হল, বুড়ো বয়েসে যার দেখার কেউ থাকে না তার বড় কষ্ট। দেখার লোক যদিবা থাকে, কেউ আর তেমন করে দেখে না। নিজের ছেলে ভাইপোও অবহেলা করে, মনে মনে ভাবে, বুড়োটা আপদ। … এই রকম পাঁচ কথা ভাবতে ভাবতে বাড়িটাকে আমি কী বলব-বৃদ্ধ নিবাস বানিয়ে ফেললাম।”
“এটা কবে করলেন?”
“বছর পাঁচেক আগে।” বলে হরিচন্দন টেবিলের দিকে হাত বাড়ালেন। গোল কৌটোটা টেনে নিলেন। কাঁচের মতন স্বচ্ছ প্লাস্টিকের জার। তার মধ্যে কয়েকটা মাত্র চুরুট। ঢাকনা খুলে একটা চুরুট উঠিয়ে নিলেন। বললেন, “দিনে দুটো। একটা ও-বেলায়, একটা এ-বেলায়।” বলে হাসলেন একটু। “যা বলছিলাম। আমার মৃণালকুঞ্জে সেইসব আধ-বুড়ো, বুড়োদের থাকতে দেওয়া হয় যাদের কোনও বড় আধিব্যাধি নেই। কারণ বড় অসুখবিসুখ করলে দেখবে কে? কেই বা সেবা করবে?”
তারাপদ বলল, “কাছে কোনও ডাক্তার নেই?”
“না। মাইলটাক দূরে এক হাতুড়ে আছে; আর কলোনিতে এক হোমিও বদ্যি। আমাদের রজনীবাবুও শুনেছি দু’-চার শিশি নাক্স, পালসেটিলা, অ্যাকোনাইট রাখে। গৃহ চিকিৎসা। বেয়াড়া রোগী পুষে ঝামেলা বাড়াতে চাইনি আমি।”
“কিন্তু মানুষের শরীর যখন, অসুখ তো করতেই পারে।”
“হ্যাঁ, সাধারণ জ্বরজ্বালা, পেটের গোলমাল কার না হয়! হলে সেই রজনীবাবু, না হয় হাতুড়ে। বড় জোর হোমিওপ্যাথ ডাক্তারকে ধরতে হয়। বাড়াবাড়ি দেখলে হেলথ সেন্টার। তিন মাইল…।”
সাধন চা নিয়ে এল। বাহারি ট্রে। মনে হল, বেতের তৈরি। চা আর মিষ্টি, একটা প্লেটে নোন বিস্কিট।
চা আর খাবার রাখল সাধন। যাওয়ার সময় বাতি জ্বেলে দিয়ে গেল বারান্দার।
“নাও, একটু চা খাও,” বলে কিকিরার দিকে তাকালেন। পরের মুহূর্তে কী খেয়াল হল, লজ্জার মুখ করে হাসলেন, বললেন, “ভুল হয়ে গেল, আজকাল মুখের ঠিক থাকে না, পানুর বন্ধু আপনি, তুমি করে বলে ফেললাম। নিন, চা খান।”
কিকিরা বললেন হাসিমুখেই। “তুমি’ বলে ঠিকই বলেছেন। পানুবাবুকে আমি দাদা বলি, মুখোমুখি কথার সময় পানুদা। আপনি পানুদার দাদার বন্ধু। আমাকে তুমি বলার হক আপনার আছে। বয়েসে আপনি বড়।”
“আমার সিক্সটি সেভেন। তোমার?”
“পঞ্চাশ ধরেছি এবার।”
“অনেকটাই ছোট বয়েসে।”
কিকিরারা চা নিলেন।
চুরুট ধরানো হয়ে গিয়েছিল হরিচন্দনের। ধোঁয়া টানলেন। “তা হলে তুমি রাজি হচ্ছ? চোখে একবার বাড়িটা দেখলে–
“দেখব,” কিকিরা বললেন, “আমি নিজেই দেখার কথাটা তুলতাম। কী ভাবে দেখতে যাব বলুন?”
“আমি তোমাদের নিয়ে যাব। কবে যাবে?”
“যেদিন আপনি বলবেন।”
“কালকেই চলো। আমি গাড়ি নিয়ে যাব। তোমরা এখানে এলে, এখান থেকেই যাওয়া যাবে। না হয় তোমাদের তুলে নিতে পারি। কোথা থেকে তুলব বলো! তবে বিকেলের দিকেই যাওয়া ভাল। ধরো, চারটে নাগাদ। এখন বেলা বড় হয়েছে। হাতে সময় থাকবে বাড়িটা দেখার। “
কিকিরা তারাপদর দিকে তাকালেন।
তারাপদ বলল, “আমার অসুবিধে হবে না। খানিকটা আগে আগে ছুটি নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ব। তবে চাঁদু-”
“কে চাঁদু?”
“আমার আরেক শাগরেদ। আগেই বলেছি আপনাকে। চাঁদু– মানে চন্দন ডাক্তার।“
“ও! … তা তোমরাই আগে চলো। দেখে নেবে জায়গাটা, আমার বাড়ি মৃণালকুঞ্জ; তারপর ওই ডাক্তারকে নিয়ে যেয়ো।”
কিকিরা চা খেতে খেতে বললেন, “আপনার কাছ থেকে জানার কথা অনেক আছে। তবে তার আগে বাড়ি আর জায়গাটা একবার দেখে নিতে চাই। কলকাতা থেকে কতটা দূর হতে পারে?”
“মাইলের হিসেবে বারো চোদ্দো। যশোর রোড দিয়ে যেতে হয়।”
“এখন ওখানে ক’জন আছেন?”
“চারজন। ছিল ছয়। দু’জন চলে গেল। ওই চারজন বাদ দিলে রাঁধুনি, কাজের লোক আর মালী একজন। মালীই আমার বাড়ির দরোয়ান।”
“যাঁরা আছেন তাঁরা নিজেরা খরচাপাতি করেই…”
“না না,” মাথা নাড়লেন হরিচন্দন, “খরচাপাতি বলতে বাঁধাধরা কিছু নেই। যার যেটুকু সামর্থ্য দেন; কেউ দু-চারশো, কেউ বা পাঁচ-ছয় বাকিটা আমার। দু’বেলা খাওয়া আর সাদামাঠা জলখাবার টাকাপয়সা আমাকেই দিতে হয়।”
কিকিরা কয়েক মুহূর্ত দেখলেন হরিচন্দনকে। “আপনার তা হলে দায় অনেক। টাকাও যায় মাসে মাসে কম নয়।”
“যায়, তবে রাজার হালে তো ওরা থাকে না। সাদাসিধে খাওয়া-দাওয়া। কাজের লোকদের সব খরচটাই আমার। তবে কি জানো ভায়া, আমার গায়ে লাগে না। একটা ভাল কাজ করব বলেই তো হাত দিয়েছিলাম। টাকার কথাও মাথায় ছিল। দেখলাম, আমার যা আছে তার থেকে খানিকটা গেলেও আমরা মরে যাব না। অন্য কোনও দায় আমার নেই। ছেলে বাইরে। তার ব্যবসাও ভাল চলে। এবাড়িতে আমরা মাত্র দুটি প্রাণী আর কাজের লোক। নীচে ভাড়া বসিয়েছি। ভাড়ার টাকায় যা হাতে আসে তার সঙ্গে আরও দু-পাঁচ হাজার যায় আমার মাসে-মাসে। ভাবি, যা করছি আমার মায়ের নামেই করছি। টাকা জমিয়ে যক্ষ সেজে বসে থেকে আমি কী করব!”
কিকিরা কেমন মুগ্ধ হয়ে শুনলেন কথাগুলো।
.
০৩.
পুরনো দিনের মানুষ, কাজেকর্মে এলানো নয়, ঘড়ির কাঁটা ধরেই যেন চলেন হরিচন্দন। কিকিরাদের মিনিট দশেক দেরি হয়েছিল আসতে। কারণ চন্দন। সেও হাসপাতালের বাকি কাজ অন্য একজনকে দেখতে দিয়ে কিকিরাদের সঙ্গী হয়েছিল।
হরিচন্দনবাবু তৈরি। তাঁর গাড়ি নীচে দাঁড়িয়ে। ড্রাইভার পেছনের ডালা উঠিয়ে কী যেন দেখে নিচ্ছিল।
চন্দন নিচু গলায় তারাপদকে বলল, “অস্টিন অফ ইংল্যান্ড। ম্যাচ করে গিয়েছে বৃদ্ধের সঙ্গে। এসব জাঁদরেল গাড়ি কলকাতায় এখন রেয়ার দেখা যায়।”
তারাপদ গাড়ির কিছু বোঝে না; বলল, “কেন, রাস্তায় বিগড়ে যাবে নাকি?”
“মনে হয় না; দেখে মনে হচ্ছে যত্ন করে রাখা, ওয়েল মেনটেইন্ড।“
কিকিরা চন্দনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন হরিচন্দনের, তারপর সামান্য কুণ্ঠার সঙ্গে বললেন, “আমাদের একটু দেরি হয়ে গেল বোধ হয়।”
“ও কিছু নয়। আসুন।”
হরিচন্দনবাবু পেছনের সিটেই বসলেন। পাশে কিকিরা। জানলার অন্য ধারে তারাপদ। চন্দন সামনে বসল।
ড্রাইভারের নাম বনমালী। মাঝবয়েসি। হরিচন্দনবাবু বললেন, “বনমালী, এক কাজ করো, বাগবাজার ধরে টালা হয়ে দত্তবাগান। যশোর রোড় ধরে নেবে। “
গাড়িতে স্টার্ট দিল বনমালী।
কিছুক্ষণ কোনও কথা নেই। হরিচন্দনের পাশে কিকিরা, কিকিরার পাশে তারাপদ। কথাবার্তা বলার জন্যেই বোধ হয় কিকিরাকে পাশে বসিয়েছিলেন হরিচন্দনবাবু।
খানিকটা এগিয়ে এসে হরিচন্দন বললেন, “রায়মশাই আপনাকে আগেই একটা কথা বলে নিই।”
কিকিরা আলগাভাবে হেসে বললেন, “আবার আপনি কেন, দাদা। তুমিই ঠিক হয়েছিল কাল।”
“ও, হ্যাঁ। একেবারে নতুন তো! মনে থাকে না। …যাক গে, আমি যা বলছিলাম। তোমাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি যেখানে, সেখানের লোকজন যারা আছে–তারা হয়তো জানতে চাইবে, তুমি কে? মুখে না বললেও মনে মনে ভাববে নিশ্চয়, এই লোকটা আবার কে?”
“তা ভাবতেই পারে।”
“আমি কিন্তু বলব, তুমিই এখন থেকে মৃণালকুঞ্জর নতুন ম্যানেজার কাম-কেয়ারটেকার। কী, আপত্তি নেই তো?”
“আজ্ঞে না; কাজটা আমি হাতে নিয়েছি যখন, তখন আপত্তি কীসের!”
“ভাল কথা। …তুমি কবে থেকে আসতে পারবে?”
“যখন থেকে আপনি বলবেন। কাল পরশু–যে কোনও দিন থেকে।”
“তবে পরশুই চলে আসবে। বনমালী তোমায় পৌঁছে দিয়ে যাবে।”
কিকিরা একবার ঘাড় বেঁকিয়ে তারাপদকে দেখলেন। তারাপদ শুনতে পাচ্ছে কথাগুলো। চন্দন সামনে বসে। তার কানে গেল কিনা কে জানে!
“আপনার আগের ম্যানেজারের কী হল?” কিকিরা বললেন। জানেন তিনি, শুনেছেন, তবু বললেন।
“দীননাথ। সে পালিয়েছে। “
“ঠিক কবে পালাল?”
“মুরলীবাবু আত্মহত্যা করার পর। ব্যাপারটা এমন আচমকা ঘটে গেল যে, দীননাথের মাথা বিগড়ে গেল। ভয়ও পেয়ে গিয়েছিল। তার ওপর থানা পুলিশের হাঙ্গামা। পোস্টমর্টেমও হয়েছিল বডির। দীননাথ আমায় এসে বলল, সে আর চাকরি করবে না। একটা দিনও আর থাকবে না মৃণালকুঞ্জে। …তো আমি বললাম, বেশ, না থাকবে থেকো না। দীননাথ চাকরি ছেড়ে দিল। “
তারাপদ ঘাড় বেঁকিয়ে কথা শুনছিল হরিচন্দনের। বলল, “উনি এত ভয়। পেলেন কেন? আগেও তো..”
“হাঁ, মাস দুই-আড়াই আগে বেচারি শ্রীকান্তবাবু আগুনে পুড়ে মারা গেলেন। সেও অদ্ভুত! তখন থেকেই দীননাথ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তবু চলে যেতে চায়নি।”
“ভয়ের কারণটা কী? অবশ্য এটা ঠিক যে, পরপর দুটো বড় দুর্ঘটনা ঘটলে নার্ভ শক্ত রাখা কঠিন,” কিকিরা বললেন। “দীননাথ কি দুর্বল মনের মানুষ ছিলেন? মানে খানিকটা ভিতু ধরনের?”
“কেমন করে বলব! ও প্রায় দু বছর মৃণালকুঞ্জর দেখাশোনা করেছে। আগে কখনও অমন ছটফট, কান্নাকাটি করেনি। এবার একেবারে হাতেপায়ে ধরে ফেলল একরকম। সে কিছুতেই আর চাকরি করবে না। আমিই বা তাকে জোর করে ধরে রাখি কেমন করে! ছেড়ে দিলাম।”
কিকিরা বুড়ো আঙুলের ডগা দিয়ে কপালের ওপর দিকটা চুলকে নিতে নিতে কী ভেবে বললেন, “দীননাথের বয়েস কত হয়েছিল? আপনার চেনা?”
“বয়েস পঞ্চাশের ওপর। আমার মুখচেনা ছিল। আগে ও আমাদের এদিকেই থাকত। কাজ করত একটা হোসিয়ারি কোম্পানিতে। কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর যখন যা জুটত তাই করত। শেষে ওই যে–আজকাল যেটা খুব চলে– ফিনান্সিয়াল ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি–কী যেন নাম–তার এজেন্ট…”
কথা শেষ করতে পারলেন না হরিচন্দন, দমকা কাশি এসে গিয়েছিল। সামলাতে লাগলেন।
কিকিরা বললেন, “একজন বয়স্ক মানুষের হঠাৎ এমন ভয় পাওয়ার আশ্চর্য!”
“আরে কী বলব?” হরিচন্দন বললেন, “ওর মাথায় কোত্থেকে এক উদ্ভট ভাবনা জুটে গেল কে জানে! আমায় বলল, মৃণালকুঞ্জে কোনও অশুভ আত্মা প্রেতাত্মার নজর পড়েছে।”
“কী?” কিকিরা অবাক! তারাপদও ঘাড় ঘুরিয়ে হরিচন্দনকে দেখতে লাগল। চন্দন সামনের সিটে বসে, মাথা-ঘাড় পেছন দিকে হেলিয়ে দিল। কিকিরা বললেন, “অশুভ আত্মা প্রেতাত্মা! তার মানে?”
হরিচন্দন বললেন, “মানে আমি জানি না, ভায়া। আমিও বুঝিনি। দীননাথ যা বলেছিল তার মর্ম হল : কোনও অশুভ আত্মা মৃণালকুঞ্জের ওপর নজর দিয়েছে।”
“কেমন করে বুঝল দীননাথ!”
“ও বলল, যে দু’দিন দুটো দুর্ঘটনা ঘটল, সেই দু’দিনই একটা জিনিস লক্ষ করেছে ও। সন্ধে থেকে মৃণালকুঞ্জে কেমন একটা বিচ্ছিরি বাজে ধূপের গন্ধ পাওয়া যায়, রাত্রে মনে হয় আশেপাশে কোথাও একটা সাপুড়িয়া তার বাঁশি বাজাচ্ছে, শব্দটা অস্পষ্ট কিন্তু বাজতেই থাকে, আর মাঝরাতে এমনভাবে কুকুর কাঁদে যে, ভীষণ অস্বস্তি হয়। তার ওপর গাছপালার আওয়াজ তো আছেই।”
তারাপদ বলল, “ভৌতিক ব্যাপার! অশরীরী। …তা উনি–দীননাথবাবু কখন থেকে এটা বুঝলেন? প্রথমবারের পর?”
“প্রথমবার ও অতটা ঠাওর করতে পারেনি। গোড়ায়। পরে সন্দেহ হচ্ছিল। দ্বিতীয়বারের পর দীননাথ মন থেকে আর ধারণাটা তাড়াতে পারল না। ঘাবড়ে গিয়েছিল। ভয় পেয়েছিল ভীষণ। “
বনমালী ভাল গাড়ি চালায়। না জোরে না ধীরে, একই ভাবে চালিয়ে যায়। অকারণ হর্ন দেওয়া নেই, হুটহাট ব্রেক মারা নেই। ততক্ষণে যশোর রোড ধরে ফেলেছে বনমালী।
রাস্তাঘাট ফাঁকা নয়, আবার শেষ বিকেল থেকে যেমন ভিড় বাড়ে তেমন ভিড়ও নেই। পাতিপুকুরের ব্রিজের কাছে অল্প জ্যাম ছিল, গাড়ি দাঁড়াল সামান্যক্ষণ; আবার চলতে লাগল।
চন্দন একই ভাবে বসে। মাঝেসাঝে বনমালীকে দু’-একটা কথা বলছিল।
হরিচন্দনবাবুর কী যেন মনে পড়ে গেল হঠাৎ, কিকিরাকে বললেন, “ও, হাঁ; একটা কথা খেয়াল হল। দীননাথ বলছিল, দু দিনই–ঘটনা দুটো ঘটে যাওয়ার পর সে আমাদের মৃণালকুঞ্জর সামনের দিকের ফটকের বাইরে পিলারের পাশে একটা জিনিস দেখেছে। মাটির বড় ধুনুচি, ছুঁটে পোড়া, এক মুঠো হলুদ রং মেশানো চাল, মাটির ছোট্ট ধেবড়া পুতুল–এক-দেড় আঙুল লম্বা বড় জোর। সাপের খোলস আর সিঁদুর মাখানো আমপাতা, একটা জবাফুল…।”
তারাপদ বলল অবাক গলায়, “তুক?”
“হতে পারে,” হরিচন্দন বললেন, “দীননাথের কথায়, তুক।”
কিকিরা বললেন, “ভৌতিক কাণ্ডকারখানা, তার সঙ্গে তুকতাক। এ তো বেশ জমে গিয়েছে, দাদা।” বলে হাসলেন মুচকি।
“তোমারও কি ভূতে বিশ্বাস আছে, রায়?”
“খাঁটি ভূতে ভয় পেতে পারি, কিকিরা বললেন, “নকল ভূতে ভয় পাই না।”
“আমি” হরিচন্দন ঠাট্টার গলায় বললেন, “একসময় ভূতচচা করেছি। আমার দুই জেঠতুতো খুড়তুতো ভাইয়ের সঙ্গে বাড়ির চিলেকোঠায় বসে প্ল্যানচেট করতাম; সার্কেলেও বসেছি।”
“পেয়েছেন ভূতদের?”
“দু’বার পেয়েছি। একবার এক ফরাসি ভূত এল চন্দননগর থেকে, আর-একবার আগ্রা থেকে এক পালোয়ান ভূত। দুজনেই যে কী বলতে চাইল বুঝলাম না! ব্যাপারটা নিয়ে রগড় মন্দ হয়নি। তা রায়ভায়া, মৃণালকুঞ্জে ভূত আসার কোনও কারণ দেখছি না। আমার পিতামশাই মাতাঠাকরুন সজ্ঞানে গঙ্গালাভ করেছেন। আমি এখনও মরিনি। গিন্নিও বেঁচে। ছেলে খাসা ব্যবসা করছে। বউমা ঘরসংসার করে আর ফাঁকেফোকরে পুতুলের ডিজাইন করে। নাতি বাচ্চা। পড়াশোনা করে স্কুলে। তা হলে ভূতটা আসবে কোথা থেকে?”
বনমালী আচমকা ব্রেক করল। একটা গোরু এসে পড়েছিল রাস্তার মাঝখানে, অন্য একটা মোষের তাড়া খেয়ে।
হরিচন্দন দেখলেন। বললেন, “বনমালী, সামলে চলো।”
নাগেরবাজারের কাছে হালকা ভিড়। তারপর রাস্তা বেশ ফাঁকা। বিকেল পড়ে এলেও আলোয় ঘোলাটে ভাব ধরেনি।
.
মৃণালকুঞ্জ বড় রাস্তার গায়ে নয়। বাসরাস্তা থেকে একটা আধাআধি পাকা রাস্তা, পাথরের টুকরো আর খোওয়া ছড়ানো, খানিকটা এবড়োখেবড়ো, চলে গিয়েছে ডাইনে। পশ্চিম দিকে। ছোট গ্রাম, মাঠঘাট, খেত, গাছপালা চোখের সামনে শান্ত একটা ছবি ভেসে ওঠে। রোদ মরে আসছে, আলো রয়েছে। বাতাস রয়েছে ফাল্গুন-চৈত্র মাসের। ফাল্গুন শেষ হয়েছে সবে গতকাল।
ইলেকট্রিক তারের খুঁটি দেখতে পেল চন্দন। কী যেন বলল।
বড়জোর সিকি মাইল, হয়তো তারও কম। মাঝপথে একপাশে একটা টিনের শেড, খানিকটা জায়গা পাঁচিল ঘেরা। ছোট কারখানার মতন দেখায়। হয়তো তাই। তবে বন্ধ।
“কারখানা! এখানে?” চন্দন বলল পেছন দিকে ঘাড় হেলিয়ে।
হরিচন্দন একটা কানে কম শোনেন। কিন্তু চন্দনের কথা মোটামুটি কানে গিয়েছিল। বললেন, “বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জেলি, সস, পপকর্ন, চিপস–এইসব ফুড প্রোডাক্টসের কারখানা করেছিল একটা কোম্পানি। দুই বন্ধু। বছরখানেকের মধ্যে গণেশ উলটে গেল। ওসব কি এখানে চলে? তবে আমার খানিকটা সুবিধে হল। ওরা জারুল মোড় থেকে ইলেকট্রিকের তার টেনে এনেছিল––পয়সা খরচ করে। আমার মৃণালকুঞ্জ পর্যন্ত–বাকিটা আমি ব্যবস্থা করে নিলাম। কম খরচে হল।”
আবার মাঠ! সবজি খেত। চমৎকার শশা, কুমড়ো ফলিয়েছে খেতের মালিক। বাঁশঝাড়। নিমগাছ।
মৃণালকুঞ্জ এসে গেল। কিকিরারা গাড়ি থেকে নামলেন। বাইরে থেকে দেখলেও তারিফ করতে হয়! হাত কয়েক উঁচু পাঁচিল, তার ওপর কোনো লোহার পোস্ট, কাঁটাতার। ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই প্রথমে নজরে পড়ে কাঁটাঝোঁপের বেড়া, রাংচিতে। সামনের মাঠে বাগান। সাধারণ ফুলের গাছ। যত্ন বিশেষ নেওয়া না হলেও একেবারে অযত্নে জঙ্গল হয়ে যায়নি। বড় গাছের মধ্যে আম, পেয়ারা, এমনকী একটা বেলগাছও চোখে পড়ে।
মৃণালকুঞ্জর বাড়িটার ধরন বা ছাঁদ অনেকটা ইংরেজি ‘এল (L) অক্ষরের মতন। নীচের তলায় পাকা গাঁথুনি ছাদ, দোতলার মাথায় টালির ছাদ। বাড়িটার গায়ে গায়ে করবী, টগর, কাঠচাঁপা আর লতাপাতা চোখে পড়ে।
মালী এসে দাঁড়াল সামনে।
হরিচন্দন কিকিরাকে বললেন, “এখানকার মালী, চৈতন্য। ও-ই আবার দরোয়ান।” বলে চৈতন্যর দিকে তাকালেন, “বাবুরা কোথায়?”
বাবুদের মধ্যে একজনকে কাছাকাছি দেখা যাচ্ছিল। বাগানের একপাশে বসে যেন কিছুর পরিচর্যা করছিলেন।
চৈতন্য বলল, “ডাকব বড়বাবু?”
“হ্যাঁ।” মাথা নাড়লেন হরিচন্দন।
কয়েক ধাপ সিঁড়ির গায়েই লম্বা বারান্দা। সিমেন্ট ফেটেফুটে গিয়েছে। মাঝেমাঝেই মেরামতির দাগ। একটা কাঠের চেয়ার, ভাঙা মোড়া, একটা বেঞ্চি আর কাঠের টেবিল পড়ে ছিল।
তারাপদ আর চন্দন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। দেখছিল। নিজেদের মধ্যে কথাও বলছিল নিচু গলায়।
হরিচন্দন বললেন, “ভাগের মা গঙ্গা পায় না বলে একটা কথা আছে, রায়। জানো তো? অনেক বলেকয়েও বাড়িটা আমি সাফসুফ রাখতে পারলাম না। দীননাথ চলে যাওয়ার পর আরও বেহাল হয়ে আছে।”
“এখন কে দেখাশোনা করে?”
“কেউ না। ঠাকুর, বামুনে যা পারে রাঁধে আর নকুল বেটা একবার হয়তো ঝাড় মারে ঘরদোরে। চৈতন্যই এখন মুরুব্বি।”
“যাঁরা আছেন তাঁরাই তো খানিকটা দেখাশোনা করতে পারেন।”
“একটু আধটু করে হয়তো। আগ বাড়িয়ে কেউ দায় নিতে চায় না।”
আরও দু-পাঁচটা কথার মাঝখানে চৈতন্য মৃণালকুঞ্জর বাসিন্দাদের ডেকে আনল।
হরিচন্দনবাবুকে নমস্কার করলেন সকলেই। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন কিকিরাদের।
কোনও ভূমিকা না করেই হরিচন্দনবাবু কিকিরার সঙ্গে প্রৌঢ় ভদ্রলোকদের আলাপ করিয়ে দিতে লাগলেন।
“ইনি বলাইবাবু। বলাইচাঁদ দত্ত।… উনি রজনীবাবু–রজনীকান্ত চাটুজ্যে। আর উনি সলিল দাশগুপ্ত। …কই, জলধরবাবু–সামনে আসুন; জলধর হালদার।… আপনাদের দেখাশোনার জন্যে এঁকে আনলাম, নতুন মানুষ। এঁর নাম কিঙ্করকিশোর রায়। আমার চেনাজানা। এখন থেকে ইনিই মৃণালকুঞ্জর হেড। আপনাদের দেখাশোনা ইনিই করবেন। নতুন কেয়ারটেকার।”
কিকিরার মুখে অমায়িক হাসি। বিনীত ভঙ্গি। স্বাভাবিক সৌজন্য দেখিয়ে নমস্কার করলেন ভদ্রলোকদের।
ভদ্রলোকরা বোধ হয় সামান্য অবাকই হয়েছিলেন। বেখাপ্পাভাবে হাত তুলে প্রতিনমস্কার জানালেন।
হরিচন্দন বললেন, “দীননাথ চলে যাওয়ার পর আপনারা সবাই ভয়ে ভয়ে আছেন। আগেরবার এসে আমি দেখলাম ঘাবড়ে গিয়েছেন আপনারা। না, না, ঘাবড়াবার কিছু নেই। সংসারে এমন ঘটনা ঘটে, দুর্যোগ আসে। ভয়টয় পাবেন না কেউ। এবার যাঁকে বসিয়ে যাচ্ছি–তিনি শক্ত ধাতের মানুষ! ..কী জলধরবাবু? জোর পাচ্ছেন তো মনে! জোর করুন। দীননাথ একটা ভিতু, মুখ। ওর কথাবার্তা ভুলে যান। যা প্রাণে চায় বলেছে। গল্প ফেঁদেছে। নিন, আপনারা এবার আগের মতন থাকুন। আমি তো বলছি, কোনও ভয় নেই। “
তারাপদরা সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে দেখছিল মৃণালকুঞ্জর বাসিন্দাদের।
চারজন মানুষই বৃদ্ধ নয়, মানে কাউকেই সত্তরবাহাত্তর বলে মনে হয় না। অথর্ব অক্ষমও নন। এঁদের অবশ্যই প্রৌঢ় বলা যায়, কিংবা আধবুড়ো। বলাইবাবুর চেহারা দেখলে বাষট্টির কম মনে হয় না। মাথায় বেঁটে, গোল ধাঁচের গড়ন, মাথায় টাক, হাত-পা শক্ত হলেও মাপে খাটো। মুখ গোল, চোখও গোল, বড় বড়; নাক মোটা। গায়ের চামড়া যেন কুঁচকে গিয়েছে। মুখেরও। ভদ্রলোক একটা ঢলঢলে প্যান্ট পরে গায়ে সুতির স্পোর্টস গেঞ্জি গলিয়ে হাতে বেতের মোটা মতন লাঠি নিয়ে যেন কোথাও ঘুরতে বেরুচ্ছিলেন। হয়তো বিকেলে হাঁটাচলা করার অভ্যেস রয়েছে। পায়ে ক্যানভাসের বুটজুতো। খাকি রঙের।
চন্দন নিচু গলায় তারাপদকে বলল, “চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ব্লাডসুগারের পেশেন্ট।”
রজনীকান্ত ঢেঙা, রোগা, শীর্ণ। মাথায় সামান্য সাদা চুল। মুখের ধাঁচ লম্বা, সোজা নাক, কপাল কুঁচকোনো, গাল তুবড়ে গিয়েছে। হাতে-কাঁচা ধুতি আর আধ-ময়লা পাঞ্জাবি পরনে। পায়ে চটি। রজনীকান্তই বাগানে বসে গাছের পরিচর্যা করছিলেন সামান্য আগে। ডাক পেয়ে বাগান ছেড়ে উঠে এসেছেন। হাতে একটা লোহার শিক। ভদ্রলোকের বয়েস সাতষট্টি কি আটষট্টি হবে! না, সামান্য কমই! চোখের তলায় চামড়া ঝুলে পড়েছে।
সলিলবাবু আর গৌরবাবু মোটামুটি মাঝারি মাথার মানুষ, না-লম্বা—না বেঁটে। সলিলবাবুর হয়তো বাষট্টি-চৌষট্টির আশেপাশে বয়েস। গায়ের রং ময়লা। চৌকোনো মুখ। মাথার মাঝখানে টেরি। চুল সামান্য। কাঁচাপাকা। দোহারা গড়ন। চোখে চশমা। পরনে গেরুয়া রঙে ছাপানো লুঙ্গি, গায়ে একটা পাতলা বুশ শার্ট, দু-একটি মাত্র বোতাম লাগানো আছে, বাকিগুলো খোলা। চোখের দৃষ্টি সতর্ক।
জলধরবাবুকে দেখলেই মনে হয় ভদ্রলোক যেন সবেই ষাট ছাড়িয়েছেন। মাথার চুল পাকেনি বললেই চলে, মোটা গোঁফ, গোঁফের চুলে সাদা দাগ ধরেছে। গায়ের রং কালো। চোখের দৃষ্টিতে কেমন এক বিরক্তি মেশানেনা। সামান্য লালচে চোখ। হাতের আঙুল মোটা মোটা। ডান হাতে একটি পলার আংটি। ভদ্রলোকের পরনে ছিল ধুতি আর গায়ে ফতুয়া।
হরিচন্দন আর দেরি করলেন না। কিকিরাকে বললেন, “এসো, বাড়িটা তোমায় দেখিয়ে দি।” বলেই কী খেয়াল হল, তারাপদদের ডাকলেন হাত নেড়ে। তারপর মুখ ফিরিয়ে বলাইবাবুদের দিকে তাকালেন। “এরা দুজন রায়ের লোক। ওরা সঙ্গে এসেছে।” বেশি কিছু বললেন না।
কিকিরাদের নিয়ে হরিচন্দন বাড়ি দেখাতে চললেন।
নীচের তলায় ঘুরতে ঘুরতে কিকিরা বললেন, “হরিচন্দনদা, এখানে প্রথম ঘটনা তা হলে ওই আগুনে পোড়া?”
“হ। শ্রীকান্তবাবু আগুনে পুড়ে মারা গেলেন।”
“তার আগে কিছু হয়নি?”
“না। মৃণালকুঞ্জে কিছু হয়নি। তবে মৃণালকুঞ্জ ছেড়ে দু-চারজন চলেও তো গিয়েছে। তাদের মধ্যে সতীনাথবাবু মারা গিয়েছেন শুনেছি।”
“ছেড়ে চলে গিয়েছেন যাঁরা তাঁরা কি এমনিই গিয়েছেন, না?”
“কারও হয়তো পোষায়নি। কেউ বা শেষপর্যন্ত কিছু ভেবে আত্মীয়দের কাছেই ফিরে গিয়েছেন। কিংবা ওরাই ফেরত নিয়ে গিয়েছে। একজন তো বরাবরের মতন হরিদ্বারে চলে গেলেন। ধর্মটর্ম করে বাকি জীবনটা কাটাবেন।”
“এখানে তা হলে বরাবর কেউ থাকে না?”
“আছে। রজনীবাবু আছেন। বলাইবাবুর বছর দুই হতে চলল। …শোনো রায়, আমার এখানে ছ’জনের বেশি লোকের থাকার ব্যবস্থা নেই। কেউ যদি চলে যায়, অসুবিধে হচ্ছে ভেবে আমি তাকে আটকাবার কে? যাবে যাক। তার জায়গায় আবার কেউ এসে পড়ে।”
“প্রথম ঘটনাটা কবে যেন ঘটেছিল, দাদা?”
“পাকাপাকি হিসেবে–এই তোমার কার্তিক মাসের শেষে।”
“দ্বিতীয়টা–মানে আত্মহত্যার ঘটনাটা?”
“গত মাসে, মাঘ মাসে।”
হরিচন্দন এবার সিঁড়ি ধরে দোতলায় উঠতে লাগলেন।
.
০৪.
পরের দিন কিকিরার ঘরে মিটিং বসেছিল : চন্দন, তারাপদ আর কিকিরা।
চন্দন বলল, “কাল তা হলে আপনি মৃণালকুঞ্জে চললেন? বাক্স বিছানা বাঁধা হয়ে গিয়েছে?” ঠাট্টার গলাতেই বলল সে।
কিকিরা বললেন, “ওয়ান সুটকেস অলি। বিছানার দরকার নেই। ম্যানেজারের ঘরে খাট বিছানা আছে। একটা চাদর নিয়েছি। আর টুকটাক।”
কথাটা ঠিকই। মৃণালকুঞ্জের ম্যানেজার কাম-কেয়ারটেকারের ঘরটি ছোট হলেও ব্যবস্থা আছে শোওয়াবসার। খোলামেলা ঘরই বলা যায়। তিনটে মাঝারি মাপের জানলা। দুটি জানলা পুব ঘেঁষেবাকিটা দক্ষিণে। ঘরে পাখাও আছে। অন্য কোনও ঘরে পাখা নেই। খাওয়ার সরু লম্বাটে ঘরে অবশ্য আরও একটা ছোট পাখা লাগানো আছে মাছি তাড়াবার জন্যে।
কিকিরা সবই খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছেন কাল। জলের ব্যবস্থা বলতে বাঁধানো কুয়ো। তার ওপর হাত-টিউবওয়েল, ঝাঁকি মেরে জল তুলতে হয়; ওরই পাশে একটা ছোট মাপের পাম্পসেট। নল ডোবানো আছে কুয়োর ভেতর। দরকারে দোতলাতেও জল তোলা যায়। ওটা জরুরি নয় হয়তো।
চন্দন বলল, “আপনি তো ম্যানেজার হয়ে মৃণালকুঞ্জে চললেন। এখানকার কী হবে?”
“কেন, বগলা রয়েছে। আমি কলকাতায় না থাকলে বগলাই বাড়ি দেখাশোনা করে। তা ছাড়া কদমপুর গায়ের পাশেই; মাত্র মাইল দশবারো। ওখান থেকে বাসে আসতে ঘণ্টা-সোয়া ঘণ্টা। আমিও ভিজিট দেব হে।”
চন্দন সিগারেট ধরাল। তারাপদর গলা খুসখুস করছে, সিগারেট খাবে না। ধোঁয়া গিলে নিল চন্দন। বলল, “আপনি ম্যানেজারি করবেন। করুন। আমরা কী করব?”
কিকিরা বললেন, “আমায় কি নিরেট কাঁঠাল পেয়েছ! যা ভাববার আমি ভেবে রেখেছি।”
“যেমন?”
“যেমন ধরো, তারাপদকে আমি মৃণালকুঞ্জর সাপ্লায়ার করব!”
“সাপ্লায়ার!” তারাপদ অবাক! “কী বলছেন, সার? কীসের সাপ্লায়ার?”
“চাল, ডাল, তেল, নুন…”।
“বাঃ বাঃ! মুদিখানার জিনিস!”
“তাতে কী! কলকাতা থেকে তুমি হপ্তার মুদিখানার জিনিস পৌঁছে দেবে। হরিচন্দনবাবুর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। উনি বলেছেন, তোমার যেভাবে ইচ্ছে তোমার শাগরেদদের কাজে লাগাও, আমার কোনও আপত্তি নেই।”
তারাপদ বিরস মুখ করে বলল, “তা বলে গ্রসারি সাপ্লায়ার?”
“কাজই বড় কথা, কী করছ বড় কথা নয়!” কিকিরা জ্ঞান দেওয়ার মুখ করে বললেন, “গীতায় বলেছে…”
“প্লিজ, আপনার গীতা থাক।… কিন্তু আগে কি এইভাবে জিনিস সাপ্লাই হত মৃণালকুঞ্জে? না, লোকাল মার্কেট থেকে নেওয়া হত!”
“আগে কী হত বাদ দাও। মাঝেসাঝে হত। এখন থেকে রেগুলার হবে। আমার ম্যানেজমেন্টে যা ভাল বুঝবকরব। নতুন ম্যানেজার-কেয়ারটেকারের মরজি।”
“মরজি!”
“শোনো হে তারাবাবু, চাঁদু-তুমিও শোনো,” কিকিরা মেজাজি গলায় বললেন, “আমি সিস্টেম পালটে দেব মৃণালকুঞ্জর। সাদামাঠাই খাওয়াব মেম্বারদেরবা বলতে পারো যাঁরা আছেন তাঁদের–তবে যত্ন করে; যা জুটল হাতের কাছে, চালিয়ে দেব না। ওঁদের দিকে নজর দেব। মেলামেশা করব, গল্পগুজব চালাব, আড্ডা জমাব। মানে বলাইবাবু, রজনীবাবুদের ফ্রেন্ড হয়ে যাব। ওঁদের মন পেতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে বোঝাতে হবে, আরও একটু ডিসেন্টভাবে তাঁরা থাকতে পারেন। একটুকরো সাবান, সামান্য মাথার তেল–এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তাঁদের মাথা ঘামাবার দরকার নেই। আমি আছি।”
“তারপর?”
“তারপর একে একে ওঁদের পেট থেকে কথা বার করতে হবে। সাবধানে। আমায় পছন্দ না হলে, বিশ্বাস না করলে মনের কথা বলবেন কেন?”
“আপনিও তবে মনে করেন, মৃণালকুঞ্জে কোনও মিস্ত্রি আছে?”
“হরিচন্দনবাবুর সন্দেহ বিশ্বাস করলে তোমায় তো মানতেই হবে–দুটি মৃত্যুর পেছনে রহস্য আছে।”
চন্দন মাথা নাড়ল। মানতে বাধ্য হল যেন কথাটা। বলল, “তারা না হয় চালডালের সাপ্লায়ার হল”।
কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে কিকিরা হেসে বললেন, “ঘাবড়াবার কিছু নেই হে তারাবাবু! তোমায় মোট মাথায় করে যেতে হবে না। ওই যে স্কুটার ভ্যান জিনিস ডেলিভারি দেয়, তাতে করেই জিনিস নিয়ে যাবে। হরিচন্দনা ব্যবস্থা করে দেবেন। তোমার শুরুটা এইভাবে হবে!”
“আর আমার?” চন্দন বলল।
“তুমি! তোমাকে আমি আমার বন্ধুর ভাই-টাই বানিয়ে ফেলব। মানে, বন্ধুর ভাই; আর পুরনো প্রতিবেশীও।” বলতে বলতে কিকিরা নিজের মাথার চুল ঘাঁটলেন। হাসলেন আলগাভাবে। “ধরো, ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়াবে যে-”আমি যেন নিজের খেয়ালে বাড়ি ছেড়ে মৃণালকুঞ্জে চলে এসেছি, তোমাদের আপত্তি সত্ত্বেও, ফলে দাদার হুকুমে তুমি আমার খোঁজখবর নিতে আসো। …কী, পছন্দ হয়?”
“না।”
“না কেন?”
“আপনি কি নাবালক যে, আপনার খোঁজ নিতে আসব রোজ?”
“রোজ কেন আসবে। দু-চারদিন অন্তর আসবে। তুমি স্কুটার চালাতে জানো। স্কুটার হাঁকিয়ে চলে আসবে। যেন বেড়াতেই এসেছ! মাঠঘাট, বিশুদ্ধ বায়ু–নো পলিউশান..”
চন্দন মাথা নাড়ল। “গোঁজামিল হয়ে যাচ্ছে, সার। মৃণালকুঞ্জের বাসিন্দাদের কনভিন্স করাতে পারবেন না। …আপনি যা বলছেন–আপনার খোঁজ নিতে আসা–সেটা এক-দুবার হতে পারে, বারবার হয় না।”
“হয় না?” কিকিরা মাথা দোলাতে লাগলেন। ভাবছিলেন, না কি ভাববার ভান করছিলেন! শেষে বললেন, “হয়। …ধরো তুমি না হয় নিছক হাওয়া খেতে এলে না, তোমার মাথায় একটা মতলবও এসেছে হঠাৎ।”
“মতলব! কীসের মতলব?”
“ওই বন্ধ কারখানাটা কেনার মতলব। “
“ওটা তো বন্ধ। আমি বিজনেসম্যানও নই। কারখানা কিনে কী করব!”
“ওই তো মজা। কিনবে কেন? কেনা-কেনা ভাব করবে। হরিসংকীর্তন পার্টিতে সবাই তো দু হাত তুলে নাচে না, অনেকে বসে বসে মাথা দোলায়। সেই রকম। একটা চাল মারবে, যেন তুমি কারখানাটা সম্পর্কে ইন্টারেস্টেড। আরে, আজকাল কত লোক ফাঁকা জায়গায় ঘরবাড়ি বানাবার বিজনেসে নেমে গিয়েছে। প্রমোটার হয়ে যাচ্ছে রাতারাতি। জলের দরে জমি কিনে দোতলা, তেতলা ফ্ল্যাটবাড়ি করছে দু নম্বরি, তিন নম্বরি ইট সিমেন্ট দিয়ে। জুতসই একটা নাম দিয়ে দিচ্ছে বাড়িগুলোর, গ্রিন পার্ক, সানি গার্ডেন…। তুমি না হয় প্রমোটার নাই বা হলে–তা বলে একটা বন্ধ কারখানার দিকে তোমার নজর পড়তে পারে না?”
“ওটা সার একেবারেই বন্ধ। ক্লোজড। ফটকও খোলে না।”
“ভুল বললে। মিস্টেক। তোমাদের চোখ নেই। কারখানার ফটক বন্ধ হলেও একজন চৌকিদার আছে। ফটকের গায়েই তার আস্তানা। আমি দেখেছি। হরিচন্দনবাবুও বলেছেন কথায় কথায়।”
তারাপদ এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার বলল, “কিকিরা, আপনার মোদ্দা কথাটা কী? আপনি নিজে থাকবেন ওই মৃণালকুঞ্জে, আর আমরা থাকব বাইরে? এই তো?”
হাসলেন কিকিরা। “ধরেছ ঠিক। তোমরা বাইরে থেকে আমাকে মদত দেবে। তোমাদের খেলা বাইরে থেকে। আমার ভেতর থেকে। একজন পাক্কা ম্যাজিশিয়ানের অ্যাসিস্টেন্ট হ্যান্ডরা খেলাটাকে পারফেক্ট করে। তারা ডুবোলে ম্যাজিকমাস্টারও ডুবে যায়।”
চন্দন বিশেষ খুশি হল না। বলল, “এভাবে আপনি একলা ও বাড়িতে থাকলে যদি একটা বিপদ হয়?”
“বিপদ! আমার! হবে না হে! আমি নিজেকে বাঁচিয়ে নিতে জানি। গোলমাল বুঝলে তোমরা আছ, ডেকে নেব।”
“যা ভাল বোঝেন করুন সার,” চন্দন বলল, যেন হতাশ হয়েই।
কিকিরা পকেট হাতড়ে সরু চুরুট বার করলেন। দেশলাই চাইলেন চন্দনের কাছে। বললেন, “ঘাবড়াও মাত। চাণক্য পণ্ডিত বলেছেন, বুদ্ধি থাকলে বিপদ বুঝলেই একশো পা পিছিয়ে আসবে।”
“রাখুন আপনার চাণক্য পণ্ডিত। আপনি যাদের সঙ্গে থাকতে যাচ্ছেন তাঁদের আপনি চেনেন না জানেন না। এদের মধ্যে কে শত্রু কে মিত্র হতে পারে–তাও জানার কথা নয় আপনার। তা ছাড়া মৃণালকুঞ্জে যা ঘটেছে তার সঙ্গে ওখানকার বাসিন্দাদের সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। হয়তো নেই। দুটো ঘটনাই নিতান্তই দুর্ঘটনা হতে পারে। আপনি তখন
“তুমি যা বলছ তা কারেক্ট হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে, হরিচন্দনবাবুর সন্দেহ বৃথা নয়। …তা সে পরে দেখা যাবে। আপাতত আমি কাজটা নিয়ে ফেলেছি। মাসখানেক অন্তত দেখি। যদি বুঝি ঘটনা দুটোর পেছনে কোনও রহস্য নেই, ফিরে আসব। আমায় কেউ জোর করে আটকে রাখছে না।“
তারাপদ হঠাৎ বলল, “ওখানে যাঁরা আছেন, যাঁরা ছিলেন তাঁদের সম্পর্কে কম-বেশি ইনফরমেশান?”
“একটা খাতা আছে মৃণালকুঞ্জে। হরিচন্দনদা বলেছেন, রেজিস্টার। তাতে মোটামুটি খবরাখবর লেখা আছে। বাকিটা আমি আদায় করে নেব।”
তারাপদ আর কিছু বলল না, চন্দনের দিকে তাকাল। রাত হয়ে এসেছে। এবার তারা উঠবে।
.
০৫.
দিন তিনেক পরের কথা। কিকিরা মৃণালকুঞ্জে আস্তানা গেড়েছেন সবে।
সেদিন বেশ গরম পড়েছে। সারাটা দিন কেমন রুক্ষ হয়েই কাটল। কালে ঝাঁঝালো রোদ, দুপুরে হাওয়া নেই তেমন। মাঠঘাট গাছপালার জন্যে খানিকটা সয়ে যাচ্ছিল গরম। বিকেলের আলো মরতে প্রায় সন্ধে। তারপর বোঝা গেল, শুক্লপক্ষ চলছে। জ্যোৎস্না ফুটে উঠতে লাগল চারপাশে। আরও পরে এলোমেলো হাওয়া উঠল চৈত্রমাসের।
কিকিরা নিজের ঘরটিতে বসে পাখা চালিয়ে একটা খাতার পাতা ওলটাচ্ছিলেন। এই খাতাটাকে সঠিকভাবে মৃণালকুঞ্জর রেজিস্টার বলা যাবে না, তবে অনেকটা ওই ধরনের।
মৃণালকুঞ্জে যাঁরা এসেছেন, থেকেছেন, চলেও গিয়েছেন–তাঁদের নামধাম, সামান্য পরিচয়, চলে গিয়ে থাকলে কবে গিয়েছেন–তার একটা বৃত্তান্ত লেখা আছে। কিকিরা পাতা ওলটাতে ওলটাতে কল্পনায় মানুষগুলির মুখ দেখছিলেন। কারও কারও কথা পড়ে দুঃখও হচ্ছিল। কিন্তু কী আর করা যাবে!
পুরনো পাতা শেষ করে কিকিরা পরের দিকের পাতাগুলোয় মন দিলেন।
রজনীকান্ত আপাতত এখানের সবচেয়ে পুরনো বাসিন্দে। খাতায় তাঁর পরিচয় লেখা রয়েছে, রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়; পিতা স্বর্গত নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। আদি নিবাস মথুরগঞ্জ, বর্ধমান জেলা। বয়েস পঁয়ষট্টি। পারিবারিক ভাবে তিনি আত্মীয়হীন। স্ত্রী বিগত। সন্তানাদি নেই। একমাত্র একটি বোন ছিল ছোট। বিবাহিতা। দুর্গাপুরে থাকতেন। তিনিও আর নেই। ভাগনে ভাগনি ছিল–কিন্তু তারা কোনও সম্পর্ক রাখেনি মামার সঙ্গে দীর্ঘকাল। কেন রাখেনি–তার কথা কোথাও লেখা নেই।
কিকিরা রজনীকান্তকে যেটুকু দেখেছেন–তাতে ভদ্রলোককে দুঃখী নিঃসঙ্গ মনে হয়। কম কথা বলেন। বোধ হয় হাঁপানি রোগ আছে, অল্পতেই শ্বাসকষ্ট হয়।
রজনীকান্ত একসময় রানিগঞ্জের দিকে কোলিয়ারিতে চাকরি করতেন। দপ্তরের চাকরি।
কিকিরা শব্দ পেলেন পায়ের। মুখ তুলে তাকালেন। বলাইবাবু।
“কী করছেন? আসব নাকি?” বলাইবাবু দরজা থেকেই বললেন।
“আসুন।” কিকিরা খাতা বন্ধ করে পাশে সরিয়ে রাখলেন।
বলাইবাবু ভেতরে এলেন।
“কিছু করছিলেন নাকি?” বলাইবাবু বললেন। পরনে লুঙ্গি। মেটে রঙের। গায়ে হাতকাটা গেঞ্জি।
“খাতাপত্র দেখছিলাম একটু,” কিকিরা আসল কথাটা চাপা দিয়ে বললেন, “হিসেব তোলা নেই অনেকদিনের; পাকা হিসেব। বসুন।”
কিকিরা বিছানায় বসেই খাতা দেখছিলেন। পাশে জানলা। বাইরের বাতাসও আসছিল মাঝে মাঝে, দমকা বাতাস। পাখাও চলছে।
বলাইবাবু চেয়ারটা টেনে বসলেন। একটাই চেয়ার। বসেই বললেন, “কীসের হিসেব দেখবেন মশাই! ওসব কি আর আসল হিসেব, দীনু ম্যানেজারের জাল হিসেব। “
কিকিরা স্বাভাবিক গলায় বললেন, “যা আছে–তাই দেখছি।”
“দেখুন। দেখে লাভ হবে না।”
“তবু দেখি। হরিবাবু জানাতে বলেছেন।” কিকিরা মিথ্যেই বললেন, এরকম কোনও কথা হরিচন্দনবাবু বলেননি। কথাটা শেষ করেই হঠাৎ কিকিরা বললেন, “দীনুবাবু এখানে দেড়-দু’ বছর ছিলেন শুনেছি। মানুষটি কেমন?”
“ও আবার মানুষ নাকি! ধত মশাই। চোর জোচ্চোর ধান্দাবাজ লোকটাকে মানুষ বললে বাড়াবাড়ি হয়! দীনু একটা জন্তু ছিল। শুধু নিজের ধান্দা। ও আমাদের যেভাবে রেখেছিল, মনে হত আমরা গোরু ছাগল। ওর দয়ায় বেঁচে আছি। দুটো নোংরা ভাত, জলের মতন ডাল, একটা ঘাট, পোড়াধোড়া রুটি… ওকে আমরা গালমন্দ করলেও কানে তুলত না। লজ্জা ছিল না। দু’কানকাটা।”
“তা আপনারা হরিবাবুকে বলতেন না?”
“হরিচন্দনবাবু এখানে আসতেন মাসে এক-আধদিন। তাঁর কাছে নালিশ করতে লজ্জা করত। তবু বলেছি।”
“লাভ হয়নি।”
“উনি আড়ালে দীনু ম্যানেজারকে হয়তো বলতেন কিছু। দু-চারদিন ইতরবিশেষ হত–আবার যে-কে-সেই। পুরনো ম্যানেজারের অভ্যেসই খারাপ ছিল। যেখান থেকে পারো দু পয়সা কামাও। চোর। ডিসঅনেস্ট।”
কিকিরা ভাবছিলেন একী বলবেন! নজরে পড়ল, বলাইবাবু লুঙ্গির কোমরের কাছে ভাঁজ থেকে বিড়ির বান্ডিল আর দেশলাই বার করলেন। বান্ডিলটা আলগা, কয়েকটা মাত্র আছে।
“আপনার বিড়ি চলবে? আপনি তো চুরুট খান।”
“দিন একটা।“
বিড়ি ধরানো হল। ধোঁয়া ছেড়ে কিকিরা বললেন, “আপনি এখানে কতদিন আছেন বলাইবাবু?”
“ওয়ান অ্যান্ড হাফ ইয়ার্স। পাকা হিসেবে এক বছর সাত মাস। “
“বাড়ি কোথায় আপনার? আপনি এখানে এসে জুটলেন কেমন করে?”
বলাইবাবু সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন না। গোল গোল চোখ অন্যমনস্ক হয়ে গেল হঠাৎ। ছাদের দিকে তাকালেন। পাখাটা দেখলেন যেন। হাতের বিড়িটা মুখে তুলতে গিয়েও তুললেন না। ঘাড় নামালেন। ইতস্তত করে বললেন, “বাড়িঘর আমার নেই, মশাই। আদি বাড়ি ছিল যশোরে। আমি দেখিনি, আমার বাপজেঠাও দেখেননি। ওঁরা–ওঁদের আমলেই আমরা দেশছাড়া। বাবা মার্চেন্ট শিপ-জাহাজে কাজ করতেন। জেঠা সাত ঘাটের জল খেয়ে গিরিডিতে বসেছিলেন পাকাপাকি ভাবে। তখন মাইকার ব্যবসার বাজার ছিল। ব্যবসা চালাতে চালাতে ঝট করে মারা গেলেন। বাবা গিয়েছেন তারও আগে জাহাজেই। স্পেসিস। মা আগেই গত। জেঠাই আমাকে মানুষ করেন। জেঠাইমা তাঁর দ্বিতীয় পক্ষ। জেঠতুতো ভাই ছিল একরকম। জেঠাইমাও। জেঠা চলে যাওয়ার পরদিনদিন আমি পর হয়ে পড়লাম।”
কিকিরা বিড়ির টুকরোটা ফেলে দিলেন। মন দিয়ে কথা শুনছিলেন বলাইবাবুর।
“আমি ছোকরা বয়েসে রেলের পরীক্ষা দিয়ে গার্ডের চাকরিতে ঢুকেছিলাম। মালগাড়ির গার্ড। আমার শেষ ডেরা ছিল ধানবাদ। তারপর…”
“ঘরসংসার করেননি?”
“না। জেঠতুতো ভাই যে ব্যবহারই করুক তার ছেলেটাকেই একরকম মানুষ করেছিলাম ছেলের মতন। তার বিয়ে-থাও দিলাম। ওরা আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করল। কত না অপমান, অসম্মান করেছে। আমি বুঝতে পারলাম, পর কখনও আপন হয় না। সংসারটা বড় স্বার্থপর। শেষমেশ একদিন রাগ করে ওদের কাঁচকলা দেখিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এখান ওখান ঘুরে এই ঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছি। আমার কোনও পরোয়া নেই। টাকা যেটুকু থাকার আছে। আমি এখানে সাতশো টাকা দিই মাসে মাসে। কিন্তু যা দিই তার বদলে যা পাই–সেটা কিস্যু না। তবু আছি। আই লাইক দিস প্লেস।”
কিকিরা মাথা দোলাচ্ছিলেন কথাগুলো শুনতে শুনতে। শেষে বললেন, “মন্দ কী দেন! আজকের দিনে সাতশো অবশ্য বেশি নয়, তবু আপনি মোটামুটি ভালই দেন।”।
“আমি হায়েস্ট,” বলাইবাবু বললেন, “অন্যরা কী দেয় খোঁজ করুন। রজনীদা চার-পাঁচশো, সলিলবাবুও শ’পাঁচ-ছয়। জলধর আমার সমান সমান। তা ছাড়া ওই দীনু-বেটা আমাদের কাছ থেকে এটা-সেটার নাম করে তিরিশ-পঞ্চাশ আদায় করত।”
কিকিরা হিসেবের মধ্যে গেলেন না। মাত্র চারজনের হিসেব ধরলে যে টাকা হয়–হাজার দুই-আড়াই–তাতে আজকের দিনে কোথাও মাথাগোঁজা, দুবেলা ডালভাত জোটানো মুশকিল। বাড়িটা আছে, হরিচন্দনবাবুর ভাতা আছে, সবজি বাগানের লাউ কুমড়ো শাক রয়েছে তাই এদের চলে যায়।
কথা ঘুরিয়ে নিলেন কিকিরা। “আচ্ছা বলাইবাবু, শ্রীকান্তবাবুর ওই আগুনে পোড়ার ঘটনাটা কী? আমায় বলতে পারেন!”
“আপনি শোনেননি?”
“শুনেছি। হরিবাবু বলেছেন। তবে তিনি তো এখানে থাকেন না, শোনা কথা বলেছেন। দীনুবাবুর মুখে শোনা; আপনাদের মুখেও শুনেছেন। ব্যাপারটা ঠিক কী ঘটেছিল জানেন আপনি!”
বলাইবাবু তাঁর মাথার টাকে হাত বুলিয়ে নিলেন; মুখের ভাবে আফসোস। শব্দ করলেন জিভে। “আর বলবেন না! সেই দৃশ্য ভাবলে সারা গা এখনও শিউরে ওঠে। আমি যখন তাঁকে দেখলাম–তখন ওঁর চেহারাটা কী বলব–বেগুন পোড়ার মতন হয়ে গিয়েছে। হরি। চোখে দেখা যায় না। বেচারি শ্রীকান্তবাবু! ইস..”।
“আপনারা কিছু করতে পারলেন না? আপনি কি…”
“আরে, আমি তো ছিলামই না!”
কিকিরা সতর্ক হলেন। “ছিলেন না?”
“না, মশাই। আমি আর থাকলাম কোথায়! থাকলে চেষ্টা করতাম। যে চাকরি করেছি তাতে কতরকম আপদ বিপদ যে গিয়েছে, গাড়ি বেলাইন হওয়া, ওয়াগন ভেঙে লুটের চেষ্টা, বনেজঙ্গলে আটকে পড়া, আগুন লেগে যাওয়া… কত ঝাট ঝামেলা মাথায় করে দিন কাটিয়েছি। এমনকী দু-একবার ডাকাতদের গুলিও ছুটে এসেছে গার্ডের দিকে।”
“কোথায় ছিলেন সেদিন?” কিকিরা মামুলিভাবে বললেন, বেশি কৌতূহল প্রকাশ করলেন না।
“যাত্রা শুনতে গিয়েছিলাম।”
“যাত্রা! এখানে?”
“আমি বরাবরই যাত্ৰা ভালবাসি। থিয়েটারও ভাল লাগে। তবে যাত্রার মতন আমায় টানে না। আমি যাত্রাপাগলা!”
“এখানে?”
“এখানে মানে! এখানে গাঁ-গ্রাম নেই নাকি! এই তো গায়েই রয়েছে বেলেমাটি, তারপর শীতলপুর। শীতলপুরটা বড় গ্রাম। জগদ্ধাত্রী পুজো হয় গ্রামে। বড় রাস্তার সঙ্গে লিঙ্ক আছে। সেখানে যাত্রা হচ্ছিল। কার্তিক মাস। যাত্রার মরশুম। কলকাতার একটা ছোট দল পালা গাইছিল। বন্দিনী পদ্মাবতী’।“
“তাই নাকি! এখানকার গ্রামে।
“আপনি নতুন এসেছেন, জানেন না। এদিককার প্রায় সব গাঁয়ে পুজোপার্বণ হয়, যাত্রার আসর বসে। লোকাল যাত্রাপার্টিও আছে। একটু ঘুরেফিরে দেখলেই দেখতে পাবেন, কত কী আছে গাঁয়ে : মুদিখানা থেকে চায়ের দোকান, দরমার বেড়া-দেওয়া সেলুন, মুড়ি তেলেভাজা, মেঠাই…।”
কিকিরা কথার মাঝখানে বললেন, “অত রাত্রে যাত্রা দেখে ফিরছিলেন! একলা!”
“রাত্রে ফিরব কেন! পালা ভাঙতেই দুটো-আড়াইটে বেজে গেল। বাকি রাতটুকু আসরে কাটিয়ে ভোর ভোর ফিরছিলাম। এখানে পৌঁছতেই দেখি ছুটোছুটি, হইচই লেগে গিয়েছে। প্রথমে বুঝিনি। ভেতরে পা দিতেই দেখি! উঃ! সে কী দৃশ্য দেখলাম রে বাবা! হায় ভগবান!”
“ঘটনাটা সকালে ঘটেছিল?” কিকিরা বললেন। তিনি অবশ্য আগেই জেনে নিয়েছেন হরিচন্দনের কাছে।
“সকাল! তা সকাল বলতে পারেন। ভোর হয়ে আলো ফুটেছে।”
“আগুনটা লাগল কেমন করে?”
“কেমন করে লাগল জানি না। শ্রীকান্তবাবুর অভ্যেস ছিল সাত ভোরে ত্রিফলার জল খাওয়া। রাত্রে ভিজিয়ে রাখতেন। ওই বদ জিনিসটা খেয়ে নিজেই কেরোসিন স্টোভ জ্বালিয়ে গরম জল করতেন। চায়ের লিকার খেতেন পায়চারি করতে করতে। আগুন লেগেছিল স্টোভ থেকে।”
“কেউ কিছু করতে পারল না?”
“ওই তো কথা ম্যানেজারবাবু! আগুন বড় ভয়ংকর জিনিস! লাগতে এক পলক, সর্বনাশ করতে পাঁচ-দশ মিনিটও লাগে না। যার লাগে সে এমন ঘাবড়ে যায় যে, তখন সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কী করবে ঠাওর করতে পারে না। ছোটাছুটি শুরু করে, চেঁচায়। শ্রীকান্তবাবু একেবারে ঘরের বাইরে বেরিয়ে বাগানে ছোটাছুটি করছিলেন। তারপর পাগলের মতন পেছনে ওই পুকুরের দিকে ছুটে যান। জলে ঝাঁপ মারতে যাচ্ছিলেন। ততক্ষণে পাঁচজনে জেগে উঠে তাঁর পিছু পিছু দৌড়চ্ছে। যার যা মনে আসছে বলছে চেঁচিয়ে… কিন্তু সবাই তো বুড়োকে আর এগিয়ে তাঁকে ধরবে! শেষে উনি ঝলসে গিয়ে ডোবাই বলুন আর পুকুর বলুন–তার সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। “
“ইস!”
“ওঁকে একটা দড়ির খাঁটিয়ায় চাপিয়ে তিন মাইল দূরে হেল্থ সেন্টারে নিয়ে যেতে যেতে বেলা ন’টা-দশটা। ডাক্তাররা বলল, আশা নেই। বিকেলের পর মারা গেলেন শ্রীকান্তবাবু। বেচারি!”
“উনি নীচের তলায় থাকতেন না?”
“হ্যাঁ। ওঁর ঘরে মুরলীদা থাকতেন। তিনি ভাল করে ব্যাপারটা বোঝার আগেই শ্রীকান্তবাবু মাঠে। …তা কাণ্ড দেখে মুরলীদাও চলে গেলেন সেদিন।”
কিকিরা মাথা হেলালেন অন্যমনস্ক ভাবে।
.
০৬.
তারাপদ এল রবিবার, একটু বেলা করেই। যেমন ভাবে আসার কথা তেমন ভাবেই। আধ-পুরনো এক স্কুটার ডেলিভারি ভ্যান, পেছন দিক ঢাকা। সামনে বসেই এসেছে তারাপদ, ড্রাইভারের পাশে বসে।
কিকিরা বাইরেই দাঁড়িয়ে দিলেন। ভ্যানটা এসে একেবারে বাড়ির বারান্দা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাঁকডাক করলেন কিকিরা ঠাকুরকে, কাজের লোকজন ডেকে জিনিসপত্র নামিয়ে নিতে বললেন। চাল ডাল আটার বস্তা তেল মশলাপাতি নামানো হতে লাগল।
তারাপদ জল খেল। ড্রাইভার ডোকরাও।
চায়ের পাট চুকল কিকিরার ঘরে বসেই। তারপর উনি বললেন, “চলো, একটু ফাঁকায় যাই।”
বাড়ির পেছন দিকে কুয়োতলা, টিউবওয়েল। কাছাকাছি সবজিবাগান। কাঠা তিন-চার জমিতে সবজি ফলানো হয়। একপাশে দু-তিনটি পেঁপেগাছ। শীর্ণ। ওদিকে কলাঝোঁপ। তারপর পুকুর। ছোট পুকুর, ডোবাও বলা যায়। পুকুরের গায়ে গায়ে একটা ছোট নিমগাছ, বাবলা! অল্প ঝোঁপ।
ছায়া ছিল এদিকটায়। চৈত্রের রোদ রীতিমতন প্রখর হয়ে উঠেছে। বাতাসও ছিল।
তারাপদকে নিয়ে কিকিরা ছায়ায় বসলেন।
মুখ গলা ঘাড় মুছতে মুছতে তারাপদ বলল, “কেমন কাটছে, সার?”
“চমৎকার। কলকাতার বাইরে এখনও খানিকটা নেচার আছে। আলো বাতাস ফাঁকা মাঠঘাট..”
“আপনি নেচার নিয়ে মজে আছেন, না কাজকর্ম এগুচ্ছে?” তারাপদ ঠাট্টা করে বলল। বলে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট দেশলাই বার করল। “নিন, খান একটা।”
দু’জনের সিগারেট ধরানো হয়ে গেলে কিকিরা বললেন, “এখন পর্যন্ত যা খোঁজখবর করলাম তাতে জোর করে কিছু বলতে পারছি না। তবে একটা গোলমাল থাকতে পারে।”
“আঁচ করছেন?”
“করছি। … আমি একে একে এঁদের পরিচয়গুলো দেখছিলাম। খাতায় লেখা আছে যেটুকু থাকার। বাকিটা আলাপ জমিয়ে জানবার চেষ্টা করছি। একটা কথা কী জানো? এঁরা যে যেমন পরিচয় জানিয়েছেন সেটাই মেনে নিতে হচ্ছে। তবে ওটা পুরোপুরি ঠিক কিনা বলতে পারব না। ঘরসংসার ছেড়ে বুড়ো বয়েসে এখানে এসে ঠাঁই নিয়েছেন এঁরা, তা নিন; কিন্তু সবাই তো নিরাশ্রয় ছিলেন না। বা একেবারেই আত্মীয়স্বজনহীন নন।”
“সার, আমি বুড়ো নই। তবে দু-একটা ঘটনা নিজের চোখেই দেখলাম। আমাদের অফিসের প্রভাতদা মাত্র গতবছর রিটায়ার করেছেন। মাঝেসাঝে তিনি অফিসে আসেন পুরনো লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে। প্রভাতদাকে চেনা যায় না। এক বছরেই যেন পাঁচ বছর বয়েস বেড়ে গিয়েছে। এসেই নিজের দুঃখকষ্টের পাঁচালি গাইতে শুরু করেন। ছেলেদের ব্যবহার, বউমাদের তাচ্ছিল্য, স্ত্রীর অসুখবিসুখ কত কথাই বলে যান। বুঝতে পারি, উনি ক্ষুব্ধ, বিরক্ত। আসলে বুড়োমানুষের গায়ে হয়তো সহজে ফোঁসকা পড়ে।”
“তা খানিকটা পড়ে। অভিমান…”।
“শিবনাথদা আবার অন্য ধাতের। বলেন, বেটারা আমার টাকার দিকে নজর রেখে বসে আছে। বাপ গেলে খামচাখামচি করবে। আমি একটা পয়সাও কাউকে দিয়ে যাব না। লিখে যাব, আমার অবর্তমানে তোমাদের বউদি সে চলে গেলে সব টাকা যেন আশ্রমে দেওয়া হয়…।”
“মেজাজি মানুষ। .. তা শোনো, এই যে যাঁরা এখানে আছেন তাঁদের মুখের কথা ভেরিফাই করার তো উপায় নেই। তোমায় বিশ্বাস করে নিতে হবে। তবে সবসময় বিশ্বাস হয় না। যেমন ধরো সলিলবাবুর কথা। তাঁর মেয়ে থাকে ঢাকুরিয়ায়। জামাইয়ের ব্যবসা। টিভি রেডিয়ো ক্যাসেট প্লেয়ারের দোকান রয়েছে। ভালই চলে দোকান। গাড়ি নেই, তবে মোটরবাইক আছে। মেয়ে তো বাবাকে নিজের কাছে রাখতে চায়। সলিলবাবু একসময় মেয়ের কাছে ছিলেনও। তারপর তাদের ছেড়ে চলে আসেন।”
“মেয়ে-জামাইয়ের কাছে থাকতে চাননি।”
“তা হতেই পারে। অনেকেই থাকতে চায় না। কিন্তু উনি মাঝে মাঝে মেয়েকে দেখতে কলকাতায় যান। নাতির ওপর টান ভীষণ। জামাই সম্পর্কে চুপচাপ।”
“কী করতেন ভদ্রলোক?”
“চা-বাগানে কাজ করতেন। ডুয়ার্সে। দু-তিনটে বাগান বদলেছেন। শেষে আসামে চলে যান। আসামে বছরখানেক ছিলেন। বড়বাবু। রিটায়ার করে শিলিগুড়িতে এসে একটা ঘরবাড়িও করেন। তারপর সব বেচেবুচে কলকাতায়। মেয়ের কাছে থাকতেন। তাও পোষাল না। এখন এই মৃণালকুঞ্জে।”
তারাপদ ভাবছিল। “স্ত্রী নেই?”
“না। শিলিগুড়িতেই মারা গিয়েছেন।”
“মানুষ কেমন?”
“বাইরে থেকে ভেতর বোঝা মুশকিল। তোমায় একটা কাজ করতে হবে। “
“বলুন।”
“আমি তোমায় ঠিকানা দিয়ে দেব সলিলবাবুর মেয়ের বাড়ির। জামাইয়ের দোকানেরও জায়গাটা বলে দেব। একটু খোঁজ নেবে।”
“কী কেস?”
“আপাতত কিছু নয়। পরে বোঝা যাবে। উনি কেন মেয়ের কাছে থাকেন? মাঝে মাঝে যান কলকাতায়, বড়জোর রাত কাটিয়ে চলে আসেন। জামাই সম্পর্কে চুপচাপ।”
“সন্দেহ?”
“এই মুহূর্তে নয়। তবে শ্রীকান্তবাবু আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার দিন বলাইবাবু মৃণালকুঞ্জে ছিলেন না রাত্রে। যাত্রা শুনতে পাশের গ্রামে গিয়েছিলেন। আর মুরলীবাবু আত্মহত্যা করার দিন সলিলবাবু এখানে অ্যাবসেন্ট ছিলেন। বলেন মেয়ের বাড়িতে গিয়ে আটকে পড়েছিলেন।”
তারাপদ বলল, “তবে তো এই দুই ভদ্রলোকই বাদ যান।”
কিকিরা মুচকি হাসলেন। বললেন, “দেখা যাক। অ্যালিবাই ইজ নো প্রফ। বুদ্ধিমানরা চারদিক নজর রেখে কাজ করে।” উঠে পড়লেন কিকিরা। “ওঠো, আজ আর বেশি নয়। পরের বার যখন আসবে এখানেই দুটো ডালভাত খেয়ে যাবে।”
উঠে পড়েছিল তারাপদ। আরও রোদ চড়েছে। বেশ গরম। বাগানের পাশ দিয়ে আসতে আসতে তারাপদ বলল, “শ্রীকান্তবাবুর আগুন লেগে পুড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা তো বললেন, শুনলাম। মুরলীবাবুর আত্মহত্যার ব্যাপারটা শুনলাম না।”
কিকিরা বাড়িটার দিকে তাকালেন। জলধরবাবু স্নান করতে এসেছেন কুয়োতলায়। দোতলার সরু বারান্দায় বলাইবাবু খালি গায়ে দাঁড়িয়ে। এদিকেই তাকিয়ে আছেন।
হাঁটতে হাঁটতে কিকিরা ইশারায় বাড়ির দোতলার দিকটা দেখালেন। বললেন, “ওই দোতলার পশ্চিম দিকে একটা থাম আছে। ইটের। বারান্দার রেলিং নিচু, পলকা। এক ইটের গাঁথনি। ওই থামের কাছ থেকে রেলিং ভেঙে নীচে পড়েছিলেন। কিংবা ঝাঁপ দিয়েছিলেন। নীচে একরাশ ভাঙা ইট, রাবিশ জড়ো করা রয়েছে। পড়ার পর মাথায় লেগেছিল। ঘাড়ও ভেঙেছিল। হাত-পা জখম। ভদ্রলোকের আর জ্ঞান ফেরেনি। মৃত অবস্থাতেই তাঁকে হেলথ সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয় বলতে পারো।”
তারাপদ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। “সে কী! অদ্ভুত তো?”
“আরও অদ্ভুত হল, শ্রীকান্তবাবু আর মুরলীবাবু নীচের তলায় একই ঘরে থাকতেন। একই ঘরের দুজনে চলে গেলেন। ঘরটা এখন বন্ধই পড়ে আছে।”
“স্ট্রেঞ্জ!… দোতলায় কারা থাকে।”
“বাকি চারজন। দুটো ঘরে। কোনার ছোট ঘরটা তালাবন্ধ পড়ে আছে। হরিবাবুর জিনিসপত্র পড়ে থাকে। গুদোম ঘর। … যাক, পরে কথা হবে। চাঁদু কবে আসবে?”
“আজ বিকেলেই আসতে পারে।”
.
০৭.
বিকেলেই এল চন্দন। হালকা মেজাজেই। মৃণালকুঞ্জর ভদ্রলোকরা তখন আশেপাশে পায়চারি করছেন। বলাইবাবু নিত্যদিনের মতন হাঁটাচলা করতে বাইরে গিয়েছেন।
কিকিরাও বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, “এসো।”
“ঠাণ্ডা জল খাওয়ান আগে। যা গরম, সার।”
কিকিরা জল আনতে বললেন কাজের লোকটিকে। নাম তার গঙ্গাধর। “আমার ঘর থেকে আনবে। “
“আছেন কেমন?” চন্দন জিগ্যেস করল।
“ভাল। তারা এসেছিল ওবেলা।”
“জানি। আসবে বলেছিল। …আপনার কাজকর্ম এগুচ্ছে?”
“সবেই শুরু। গাছে না উঠতেই এক কাঁদি হয় নাকি?”
হাসল চন্দন। “গাছে কতটা ক্লাইমবিং করলেন?”
“মাত্র হাত পাঁচেক,” কিকিরাও ঠাট্টা করে বললেন, “হনুমান বাঁদররা তড়াক তড়াক লাফ মারে হে! আমি মনুষ্য। শনৈঃ শনৈঃ আরোহণ করছি।”
চন্দন হাসতে লাগল। “শনৈঃ শনৈঃ আরোহণ! আপনি দারুণ!”
অন্য দু-একটা হালকা কথার মধ্যে জল এল।
জল খেল চন্দন। “বাঃ, বেশ ঠাণ্ডা তো!”
“আমার ঘরের কুঁজোর জল। “
“ফ্রিজ হার মানে।”
“চা খাবে?”
“এখন নয়।”
“চলো তবে–এক পাক ঘুরে আসি।” বলে হাঁটতে শুরু করলেন। চন্দনও এগিয়ে চলল পাশাপাশি। তার স্কুটার পড়ে থাকল সিঁড়ির কাছে, করবী ঝোঁপের পাশে।
কয়েক পা এগিয়ে আসতেই জলধরবাবুর মুখোমুখি হতে হল কিকিরাকে। বিন্দুমাত্র ইতস্তত করলেন না কিকিরা। হাসি হাসি মুখ, আলাপি গলা; বললেন, “হাঁটুর ব্যথা কমল খানিক! রজনীবাবুর আর্নিকা তবে কাজে দিয়েছে। দেখবেন, আবার হোঁচট খাবেন না। এই বয়েসে হাড়গোড় দিলে হয়ে যায়, হালদারমশাই। মেশিন পুরনো হলে নাটবল্ট ঢিলে হবে–এ তো আপনিও বোঝেন।” বলেই চন্দনকে দেখালেন, “আমার এই ব্রাদারের সঙ্গে সামনে থেকে একটু ঘুরে আসি। ব্রাদারের জায়গাটি বেশ পছন্দ হয়ে গিয়েছে। প্রথমে আমায় ভাগিয়ে নিয়ে যাবে ভেবেছিল। এটা নাকি অজ পাড়াগাঁ। আমি থাকতে পারব না। ওর দাদা-আমার বুজুম ফ্রেন্ড-সে একেবারেই আমাকে এখানে ঘাঁটি গাড়তে দিতে রাজি নয়। বলে, ম্যালেরিয়া না হয় সাপের কামড়ে মারা যাব। ব্রাদার আমাকে দেখতে এসেছে। বেঁচে আছি,, মরে গিয়েছি। “
“এঁকে তো আগের দিনও দেখেছি; আপনাদের সঙ্গে এসেছিলেন,” জলধর বললেন।
“দেখেছেন। দাদার হুকুমে হালচাল দেখতে এসেছিল।” বলেই কিকিরা হাত দিয়ে আশপাশ দেখালেন। “ব্রাদারের এখন মত পালটে গিয়েছে। বলছে, জায়গাটা তো বেশ। এখানে জমিজায়গার দর কেমন? একটা কিছু করলে হয়। আসলে ব্যবসাদার লোক তো। বয়েস কম হলে কী হবে, বিজনেস ব্রেইন!”
জলধর কিছু বললেন না। দেখতে লাগলেন চন্দনকে।
“যাই, একটু ঘুরে আসি। বেলা রয়েছে এখনও। এসো চাঁদু।”
কিকিরা চন্দনকে নিয়ে এগিয়ে চললেন।
মৃণালকুঞ্জর বাইরে এসে চন্দন হাসতে লাগল। “ভালই দিয়েছেন। আপনি সার দিনকে রাত করতে পারেন।”
কিকিরা হাসলেন। “না হে, অতটা পারি না। তবে দরকারে দু’-দশটা মিথ্যে বোলচাল দিতেই হয়। ম্যাজিক দেখাবার সময় রুমালে লাগানো এক ফোঁটা আতরকে অ্যারেবিয়ান পারফিউম বলে চালাতাম।”
“বুঝতেই পারি। আপনার সঙ্গে কম দিন তো হল না।”
“তা হল। …এদিককার খবর শুনেছ কিছু?”
“না। তারার সঙ্গে কাল দেখা হবে। আপনিই বলুন।”
“আমি তোমায় একটা সামারি দিচ্ছি। তারার কাছে বিস্তারিত শুনবে।”
“বিস্তারিত।” চন্দন হাসছিল।
কিকিরা কথাটা কানে তুললেন না। হাঁটতে হাঁটতে মৃণালকুঞ্জের কথাগুলো বলতে লাগলেন অল্প কথায়। দুটো দুর্ঘটনার কথা, এখানে যাঁরা আছেন–তাঁদের কথা।
কথা বলতে বলতে প্রায় বন্ধ কারখানার কাছাকাছি চলে এসেছিলেন কিকিরা। তারপর দাঁড়িয়ে পড়লেন।
চন্দন মন দিয়ে শুনছিল সব। বলল, “প্লে জমে গিয়েছে বলুন!”
“না, জমেনি এখনও। জমব জমব করছে। …ভাল কথা, কারখানাটা দেখেছ?”
“কারখানা বন্ধ হলেও ফটকের পাশে দরোয়ানের গুমটি। তার গায়ে টিনের চালা লাগিয়ে দরোয়ানজি বোধ হয় চা বিড়ি খইনি পাতার দোকান চালায়। একটা ভাঙা বেঞ্চি আর দু-একটা পাথরের চাঁই পড়ে আছে বসার জন্যে।”
“আমি দেখেছি। দরোয়ানকে দেখলে?”
“না। এখন তার দোকান বন্ধ। আমার মনে হল, দরোয়ানের কাছে লোকজন আসে যায়। তা ছাড়া এই রাস্তা ধরে যারা তাদের গাঁয়ে যায়–হয়তো দু দণ্ড বসে চা লেড়ো বিস্কুট খায়। বিড়ি কেনে। খইনি নেয়; “
“কারখানাটা কাদের ছিল জানো?”
“কেমন করে জানব!”
“দুই পার্টনারের। একজন বাঙালি, পাল; আর অন্যজন অ-বাঙালি, খাটোয়া। টাইটেল খাটোয়া। খোঁজখবর নিয়েছি আমি। ব্যবসার শুরু থেকেই মার খাচ্ছিল। তবু বছর খানেকের বেশি চালাবার চেষ্টা হয় কারখানা। শেষে বন্ধ। এখন থাকার মধ্যে ওই পাহারাদার দরোয়ান। শুনলাম পাল কদাচিৎ আসে অবস্থাটা দেখে যেতে। বেচে দেওয়ার মতলব রয়েছে ওদের। জমিজায়গা এটা-সেটার দাম পেলে ছেড়ে দেবে। কিন্তু কেনার লোক জুটছে না।”
“এসব খবর কে দিল আপনাকে?”
“কেন! মৃণালকুঞ্জের বাবুরা। মালী চৈতন্য। রাধু বামুনঠাকুরও।”
“কারখানাটা বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে, থাকতেই পারে। তার সঙ্গে মৃণালকুঞ্জের দুটো ঘটনার সম্পর্ক কী? ওদের কেউ তো আর শ্রীকান্তবাবু মুরলীবাবুর মৃত্যুর জন্যে দায়ী নয়।”
কিকিরা জবাব দিলেন না প্রথমে। চন্দনের কাছে সিগারেট চাইলেন। ধরানো হয়ে গেল সিগারেট। বললেন, “দায়ী নয়। কিন্তু আমার একটা খটকা আছে। “
“কীরকম?”
“শ্রীকান্তবাবু আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার দিন বলাইবাবু মৃণালকুঞ্জে ছিলেন না বলছেন। যাত্রা শুনতে পাশের গ্রামে গিয়েছিলেন। কথাটা পুরোপুরি সত্যি কিনা যাচাই করতে হবে।”
“মানে?”
“এমন তো হতে পারে, উনি যাত্রার পালা শেষ হওয়ার আগেই, কিংবা শেষ হওয়ার পর পরই চলে এসে কারখানায় কোথাও লুকিয়ে ছিলেন। দরোয়ানের ঘরেও হতে পারে। তারপর একেবারে ভোররাতে…”
চন্দন একটু ভাবল। মাথা চুলকোতে লাগল। পরে বলল, “মৃণালকুঞ্জের ফটক খোলা পেল কেমন করে? মালী কি ফটক খুলে রাখে?”
কিকিরা ডান চোখটার পাতা প্রায় আধবোজা করে ধূর্তের মতন বললেন, “না, ফটক খোলা থাকে না। তবে ভেতর থেকে চাবি দেওয়াও থাকত না। আমি খোঁজ নিয়েছি। অবশ্য ভেতর থেকে তালাচাবি দেওয়ারই কথা। মালী চৈতন্য তা দিত না। ভাবত, বেকার চাবি দেওয়া। কে আর আসবে চুরিচামারি করতে! কীই বা চুরি করবে! এদিকে চোর ছ্যাচড়ই বা কোথায়!”
“ফাঁকি মারত!”
“অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। আমি আসার পর কড়া হুকুম করেছি, তালাচাবি লাগাতে।” সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিলেন কিকিরা। বললেন, “তা ছাড়াও কথা আছে। শ্রীকান্তবাবু যখন জামাকাপড়ে আগুন লাগিয়ে বাইরে ছোটাছুটি করছেন, অন্যরা জেগে উঠে তাঁর আশেপাশে জড়ো হয়ে চেঁচাচ্ছে-তখন কে আর নজর করতে যাবে–ফটক খোলা না বন্ধ! কে বা এল তখন বাইরে থেকে!”
চন্দন মেনে নিল যুক্তিটা। বলল, “আপনি বলাইবাবু সম্পর্কে পরিষ্কার নন?”
“এখনও নয়। তুমি পাশের গাঁয়ে, শীতলপুরে খোঁজ নিয়ে দেখবে, সেদিন যাত্রা কখন শুরু হয়েছিল, শেষ হয়েছিল কখন! ওই দিনই জগদ্ধাত্রী পুজো ছিল গাঁয়ে। বলাইবাবুর মতন কোনও ভদ্রলোককে কেউ আগাগোড়া দেখেছে কিনা আসরে? যাত্রায় কোন পালা চলছিল? নামই বা কী?”
“সময় লাগবে।”
“লাগুক। ..যদি দেখি বলাইবাবু মিথ্যে কথা বলছেন, বুঝতেই পারব-কোনও কারণ আছে মিথ্যে বলার। কী কারণ?”
“আপনি নিজে বাইরে গিয়ে খোঁজখবর করেন না?”
“না। আমি ফটকের বাইরে দশ হাতও যাই না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এঁদের চোখে চোখে রাখি। আমার মনে হয়–এঁরাও আমাকে নজরে রাখেন!”
“আপনাকে বিশ্বাস করেন না ভদ্রলোকরা।”
“বাইরে থেকে ওঁদের বোঝা যায় না। ভেতরে কে কী করেন বলতে পারব না।”
“আপাতত তা হলে আপনার সাসপেক্ট নম্বর এক হল বলাইবাবু! আর দুই হল সলিলবাবু?
“হ্যাঁ, এই দুই ভদ্রলোকের মধ্যে একজন প্রথম দুর্ঘটনার দিন হাজির ছিলেন না মৃণালকুঞ্জে। দ্বিতীয়জন ছিলেন না পরের ঘটনার দিন।”
“এটা তো হতেই পারে। ব্যাপারটা অ্যাকসিডেন্টাল। বা ধরুন কাকতালীয়।”
“হলে ভাল। না হলে সন্দেহের কারণ থাকে! দুই বুড়ো কেন অকারণ মিথ্যে কথা বলবে! …আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার কী জানো? দুটো ঘটনাই ঘটেছে ভোররাতে বা শেষরাতে। প্রথমটা তো ভোররাতেই। দ্বিতীয়টা, শেষরাতে হতে পারে। কেউ ঠিক করে বলতে পারছে না। বলছে, তখন তো ঘুমিয়ে ছিলাম।”
“একটা লোক পড়ে গেল, কেউ কোনও শব্দও পেল না।”
“না। শীতকাল। মাঘ মাস। জানলা-দরজা বন্ধ করে, লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে সবাই। কেমন করে জানবে! ওঁদের মুখে এই কথাটাই শুনি। সকালে উঠে যে প্রথম দেখেছে মুরলীবাবুকে সে হল রাধু বামুনঠাকুর। তারই চেঁচামেচিতে অন্যরা উঠে আসে।”
চন্দন নিজের মনে ভাবতে লাগল। যুক্তি হিসেবে কথাটা মেনে নিতে হয়।
সামান্য পরে কিকিরা বললেন, “চলো ফিরি, আমি আর এগুব না।”
কিকিরারা ফিরতে লাগলেন।
চন্দন বলল, “সার, আমি হাসপাতালে কাজ করি। কত তুচ্ছ সাধারণ ঘটনা থেকে আগুন লেগে যায় তার কথা জানি। আর আগুন লাগলে শতকরা নব্বই জন মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়। বোধবুদ্ধি কাজ করে না। কাজেই শ্রীকান্তবাবুর আগুন লাগা সম্পর্কে আমি চট করে একটা ধারণা করতে পারি না। ওটা অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে। …মুরলীবাবুর ব্যাপারটা বলতে পারছি না। তবে বেকায়দায় পড়ে গিয়ে ঘাড়ে মাথায় তেমন চোট পেলে-সে না। বাঁচতেও পারে। ঘাড় ভাঙলে মানে ফাস্ট ভারটিব্রা আর সেকেন্ড ভারটিব্রার মধ্যে তেমন জখম হলে ভয়ংকর ব্যাপার। মাথার জখমও ডেঞ্জারাস। “
“সব মানছি। তবু শেষ পর্যন্ত দেখতে চাই। হরিচন্দনবাবুর মনেও সন্দেহ। রয়েছে।
“আমি আপনাকে চলে আসতে বলছি না। দুটো দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়াটা কোয়েনসিডেন্স হতে পারে। এমন হয়। “
“তারাও বলছিল কথাটা। দেখা যাক না কী হয়!”
কথা বলতে বলতে ফটকের কাছাকাছি এসে গেল চন্দনরা। চন্দন হঠাৎ বলল, “ভাল কথা, ফটকের বাইরে সেই ধুনুচির তুক–ঘুঁটে পোড়া, হলুদ চাল, সাপের খোলস, মাটির পুতুলতার কী হল? এখানকার কেউ দেখেছেন?”
“প্রথমবার নজরে পড়েনি। দ্বিতীয়বার পড়েছে। চৈতন্য দেখেছে, কাজের লোক দেখেছে, এখানকার বাবুরাও।”
“সাপুড়ের বাঁশি শুনেছেন?”
“না।”
“এখানকার বাসিন্দারা কি ভয়ে ভয়ে আছেন?”
“ভয় পেয়েছেন কিনা বলতে পারব না, তবে সকলের মনেই খুঁতখুঁতুনি আছে। “
“দেখুন কী হয়! …আমি পরে আসব আবার। আপনি যে কাজগুলো করতে বললেন, সেগুলো সারতে সময় লাগবে। অন্তত হপ্তাখানেক।”
.
০৮.
জলধরবাবুর অভ্যেস হল, সন্ধেবেলায় দোতলার বারান্দায় পায়চারি করতে করতে দু হাতে তালি বাজিয়ে দেবদেবীর গান গাওয়া। পরনে ছালিবস্ত্র, গায়ে ফতুয়া, কখনও বা খালি গায়েই, ‘হে গোবিন্দ রাখো শরণ’, কখনও ‘শিবশঙ্কর নমো হে নারায়ণ’, কখনও বা সাদামাঠা ভক্তিসংগীত, ভজ গোবিন্দ কহ গোবিন্দ।
সেদিন জলধর রামপ্রসাদি ঢঙে একটি গান গাইছিলেন, এমন সময় কিকিরা দোতলায় উঠে এলেন।
জলধর গান থামিয়ে তাকালেন। “কী খবর ম্যানেজারবাবু?”
“কিছু না। এমনি এলাম। আপনার গলা শুনে। গানবাজনার চর্চা হচ্ছিল নাকি?”
“একটু আধটু। বাঁশিতে ফুঁ দিতে পারতাম। …তা হঠাৎ গানবাজনার কথা কেন?”
“গান শুনে মনে হল। রোজই তো শুনতে পাই। “
“শেষ বয়েসে ভগবানের নাম নিই একটু। জীবনটা তো কেটে গেল..” কিকিরা হাসলেন, “এত তাড়াতাড়ি। কত আর বয়েস আপনার! ষাট হয়তো ছাড়িয়েছেন। এখনও অনেক পড়ে আছে।”
“কেমন করে বুঝলেন?”
“বুঝব না কেন! স্বাস্থ্য ভাল আপনার। বড় আধিব্যাধি নেই। চরক বলেছেন, পিত্ত ও কফ যাদের নাশ হয়–তারা দীর্ঘজীবী হয়।” বলে কিকিরা হাসলেন।
“আপনি চরক বোঝেন?”
“বুঝি না। তবে আমার মাতামহ বদ্যি ছিলেন তো…! আর আপনিও তো দেখেছি, রোজ সকালে তুলসীপাতা খান।”
“ও।”
“আপনার রুমমেট কোথায়?”
“পাশের ঘরে দাবা খেলছেন।”
“চলুন আপনার ঘরে গিয়ে বসে দুটো গল্প করি।”
“গপ্প! আসুন!”
কাছেই জলধরের ঘর। জলধরবাবু আর বলাই দত্ত একই ঘরে থাকেন দোতলায়। পাশের ঘরে সলিলবাবু আর রজনীকান্ত।
জলধর ঘরে এসে বসলেন।
কিকিরাও বসলেন বলাইবাবুর বিছানায়। দু হাত জোড় করে মাঝের আঙুলে ঘষতে ঘষতে ছেলেমানুষের মতন বললেন, “পরশু আপনাদের একটা ফিস্ট দেব।”
“ফিস্ট?”
“ওই সামান্য মুখ-বদলের খাওয়া। একটা বড় মাছ পেলে ভাল হয়। দেখি কী করা যায়। তা জলধরবাবু, আমি নতুন, আগে যা পাতে পড়ত আপনাদের, তার চেয়ে ভাল কিছু হয়েছে?”
জলধর ঘাড় কাত করলেন। “হয়েছে। একটা স্বাদ পাচ্ছি আজকাল। দীনুবাবুর আমলে কী যে মুখে তুলতে হত…!”
“শুনেছি। হরিবাবুকে আমি বলেই এই চাকরিতে এসেছি যে, হতচ্ছেদা করে আমি কিছু করতে পারব না। বয়স্ক ভদ্রজনরা আছেন যেখানে, সেখানে দু মুঠো ভাত ছড়িয়ে দিলেই হয় না। আপনি চ্যারিটি করছেন না। ভাল একটা কাজ করতে চান। ভাল কাজ করতে হলে মন থেকে, ওই যে কী বলে, দয়াদাক্ষিণ্য করার মেন্টালিটি পালটাতে হবে। অবশ্য উনি, হরিবাবু মানুষটি ভাল, ওঁর নিজের মধ্যে ইগো নেই। তাচ্ছিল্যও করতে চান না কাউকে।“
“ভাল বলেই মনে হয় ওঁকে।”
“আপনার এখানে ক’ বছর হল?”
“ক’ বছর! বছরখানেকের বেশি। আমি এসেছি বলাইবাবুর পর।”
কিকিরা সব জানেন। নামের খাতামানে রেজিস্টারে দেখেছেন। কিন্তু সেটা তিনি বুঝতে দিতে চান না। কাউকেই আঁচ করতে দেননি যে, তিনি প্রত্যেকের নাড়িনক্ষত্রের খবর নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
গল্প করার ঢঙেই কিকিরা বললেন, “আপনিই কি সবচেয়ে কম আছেন এখানে? অন্যরা শুনলাম, দুই আড়াই তিন বছর ধরে আছেন।”
“একরকম তাই।”
“দেশ বাড়ি কোথায় ছিল? মানে আমি বলতে চাইছি, এই বয়েসে লোকে নিজের ভিটেমাটিতে…”।
“আমার দেশের বাড়ি পুববাংলায়। সেখানে যাওয়া হয়নি। আমার মা সেই কোন কালে নবদ্বীপে এসে স্কুলের চাকরি নিয়েছিলেন। বাবাকে আমি দেখিনি।” একটু চুপ করে থেকে আনমনা হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেন। নিশ্বাস ফেললেন বড় করে। “ছেলেবেলাটা আমার একরকম কেটে গিয়েছিল। মা আমাকে সদানন্দবাবার আশ্রমের স্কুলে রেখে দিয়েছিল, কালনার কাছে। ছুটিছাটায় মায়ের কাছে। …পুরনো কথা আর কী বলব! মা চলে যাওয়ার সময় আমি ছোকরা। একটা চাকরিও জুটিয়ে নিয়েছিলাম। সরকারি চাকরি। কলকাতাতেই। তারপর চলে গেলাম আন্দামান। তখন ওদিকে যাওয়া সুবিধের ছিল। সরকারি কাজ করতাম। বছর পাঁচেক কাটিয়ে ফিরে এলাম। ভাল লাগত না। একা একা লাগত। অবশ্য ওখানে বাঙালিও ছিল। মেলামেশা করে মন ভরত না। ফিরে ওয়েন অ্যান্ড বিলওয়েটে চাকরি করেছি। শিপমেন্ট কোম্পানি। ঘরসংসারও করেছিলাম। একটু বয়েসেই। কপালে দুঃখ ছিল মশাই, না হলে স্ত্রী ওইভাবে মারা যায়!”
“কীভাবে?”
“মাঝদুপুরে ফ্ল্যাটে ডাকাতি। এমনভাবে জখম করল ওকে যে, তিনটে দিনও বাঁচল না।”
কিকিরা সহানুভূতির শব্দ করলেন। খাতায় অবশ্য এটা লেখা নেই। জলধর বিপত্নীক–এইমাত্র লেখা আছে।
আত্মীয়তার সুর এনে ভারী গলায় বললেন কিকিরা, “জীবন বড় গোলমেলে হালদারমশাই। মাথার ওপর বসে কে যে খুঁটি চালছেন–কেউ কি জানে! তবে আপনি পোড়খাওয়া মানুষ। ভেঙে পড়বেন বলে মনে হয় না। …আমি ভাবছিলাম, আপনার মতন মানুষ এখানে না এসে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে থাকলে হয়তো মনের দিক থেকে শান্তি পেতেন।”
জলধর অদ্ভুত এক মুখভঙ্গি করলেন। “আত্মীয়! খুব কম গাছের ডাল সোজা হয়, বেঁকাই বেশি। আমার আত্মীয় বলতে একটি ছেলে। সে হল সেলফিশ, ইররেসপনসিবল, ইডিয়েট, গাধা। নচ্ছার। তার ফ্যামিলি নিয়ে দিল্লি চলে গিয়েছে। সেখানে জুতোর ব্যবসা করে। ফ্যাক্টরি করেছে জুতোর। জু-তো! ছ্যাঃ!”
কিকিরা কথা পালটালেন। “একালের ব্যাপারই আলাদা। ছেলেছোকরাদের মতিগতি বোঝা যায় না। কী আর করবেন। যার যেমন মন চায়”।
“চাক। আমার কাঁচকলা। আমি পরোয়া করি না। একা এসেছি, একলা যেতে হবে।”
“তা ঠিক। একলা চলো রে!”
“খাঁটি কথা। …কে কাকে দেখে? কে কাকে বাঁচায়! যার কপালে যেমন আছে তাই হবে।”
কিকিরা সঙ্গে সঙ্গে কথাটা ধরে নিলেন। বললেন, “কপাল। যা বলেছেন সত্যিই তাই। শ্রীকান্তবাবু মুরলীবাবুর কথাই ভাবুন।”
“স্যাড। আহা রে, দুই বুড়োমানুষ কীভাবে চলে গেলেন। “
“বিচ্ছিরি ভাবে। আচ্ছা হালদারমশাই, এই যে দুজন মানুষ মাস কয়েকের মধ্যে এইভাবে চলে গেলেন, আপনার ভয়টয় করে না?”
“ভয়! …না ভয় নয়, তবে অস্বস্তি হয়।”
“মৃণালকুঞ্জে কি কোনও অশুভ শক্তির নজর”
“অশুভ! বলতে পারেন অশুভ। তবে এমনটা হয়। খারাপ যখন হয়–তখন পর পর হয়ে যায়। কেন হয় কে জানে!”
কিকিরা যেন কৌতূহলবশেই বললেন, “আমি যা শুনেছি শুনেই বলছি– মুরলীবাবু নাকি ঝাঁপ দিয়েছিলেন। কথাটা কি ঠিক?”
“আমিও তাই শুনি।”
“উনি ঝাঁপ দেবেন কেন? থাকতেন একতলায়; দোতলায় এসে ঝাঁপ দিলেন!”
“তাই তো দিলেন।”
“কেন? ওঁর কি মাথাখারাপ হয়ে গিয়েছিল!”
“না, তা কেমন করে বলব! তবে শ্রীকান্তবাবুর ওইভাবে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার পর উনি যেন কেমন হয়ে গিয়েছিলেন। মনমরা, বিচলিত। একই ঘরে থাকতেন দু জনে, হুট করে একজন চলে গেল! কিছুই করতে পারলেন না।”
“অনুতাপ। “
“হবে হয়তো।”
“আপনারা কিছুই জানতে পারলেন না।”
“না। কেমন করে জানব! শীতের দিন। দরজা জানলা বন্ধ। মাঝরাত বা শেষরাতে কেউ যদি ওপরে উঠে এসে থাকে–জানা সম্ভব নয়।
“যে জায়গায় গিয়ে উনি ঝাঁপ দিয়েছিলেন সেখানকার মানে বারান্দার রেলিং কি আগেই ভাঙা ছিল?”
“ও আবার রেলিং কোথায়, এক ইটের এক গাঁথনি, তাও ফোকর করা। হ্যাঁ, নড়বড়ে ছিল। ফাটল ধরেছিল। সারাবার কথাও শুনতাম। দীনুবাবু মুখে বলতেন– এবার সারাব মিস্ত্রিমজুর ডেকে, কিন্তু কই গা করতেন কোথায়!”
“ভদ্রলোক ওইভাবে ওখানে গিয়ে
জলধর কথা শেষ করতে দিলেন না কিকিরাকে, মাঝখানে বললেন, “তবে একটা কথা। এখানে ওই সময়টায় ভীষণ কুয়াশা নামত। পাঁচ হাত দূরের জিনিসও নজর করা যেত না। মুরলীবাবু ভুল করে”
কিকিরা মাথা নাড়লেন। “না সার, কুয়াশা নামুক আর নাই নামুক ভদ্রলোক একতলা ছেড়ে দোতলায় আসবেন কেন অমন সময়! বাথরুম নীচেও আছে। দোতলায় রাত্রে কাজ চালাবার মতন একটা বাথরুমও আছে। জানি। তবু ওই জন্যে দোতলায় নিশ্চয় আসেননি। তাই না, বলুন?”
জলধর আর কী বলবেন! মাথা নাড়লেন।
উঠে পড়লেন কিকিরা। “চলি, অনেকক্ষণ গল্পগুজব হল।” ..পা বাড়িয়ে হঠাৎ আবার বললেন, “আচ্ছা, এখানে কোনও ভৌতিক ব্যাপার ঘটছে? শোনা যায় কিছু?”
জলধর বললেন, “আমি কোনও শব্দ শুনিনি। দীনুবাবু অবশ্য বলতেন।” বলতে বলতে থেমে গেলেন তিনি।
.
০৯.
সপ্তাহ কেটে গেল।
কিকিরা মোটামুটি আলাপ জমিয়ে নিয়েছেন চার প্রৌঢ়ের সঙ্গেই। মালী চৈতন্য, বামুনঠাকুর রাধু আর কাজের লোক নকুলের সঙ্গেও তিনি সরলভাবে হাসি তামাশা করে কথা বলেন। এদের অবজ্ঞা অগ্রাহ্য করা উচিত নয়। বরং ওদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করলে লাভ আছে। রাধুদের পেটেও কথা আছে। সুযোগ বুঝে ধরতে পারলে অনেক কথাই হয়তো বেরিয়ে আসতে পারে।
এখন পর্যন্ত অবশ্য কিকিরা মৃণালকুঞ্জের রহস্যের ব্যাপারে সুবিধে করতে পারেননি তেমন। শুধু অনুমান, ধারণা, সন্দেহ কোনও প্রমাণ নয়। চার প্রৌঢ়ের মধ্যে রজনীকান্তই যেন অন্য রকম মানুষ। কথা কম বলেন। কোনও অভিযোগ জানান না। দুঃখী বিষণ্ণ মনে হয় তাঁকে সবসময়। ভদ্রলোকের একমাত্র কাজ হল সকাল বিকেল বাগানে ঘুরে ঘুরে গাছপালা দেখা, খুরপি বা একটা লোহার শিক হাতে গাছের গোড়া খুঁচনো, অবশ্য ফুলগাছের; নিজের হাতে জলও দেন। বেলফুলের ক’টি মাত্র গাছ, তারও কী যত্ন। হেনা ঝোঁপের শুকনো পাতা পরিষ্কার করেন নিজের হাতে। টগরের মরা শুকনো ডাল ছেটে দেন।
কিকিরা লক্ষ করেন সব। কিছু বলেন না। রাত্রে ভদ্রলোক বেশিরভাগ সময় শুয়ে থাকেন, বড়জোর পুরনো কাগজ পড়েন।
মাঝে একদিন ঝড়ও হয়ে গেল সন্ধেবেলায়। বৃষ্টি হল নামমাত্র।
কিকিরা অধৈর্য হলেন না। অপেক্ষা করে থাকলেন তারাপদদের জন্যে।
.
তারাপদ এল পরের সপ্তাহে। হাতে একটা নাইলনের ব্যাগ। বাসেই এসেছে।
এল বিকেলে। ব্যাগ থেকে চা-পাতার বড় প্যাকেট, গুঁড়ো দুধের কৌটো, খুচরা আরও কিছু নামিয়ে রাখল। হেসে বলল, “সাপ্লায়ার কি শুধু হাতে আসতে পারে?”
কিকিরা হাসলেন। “তোমার মস্তিষ্ক আছে।”
“আপনার দয়ায়।”
“তা হলে একটু চা খাও। এখানকার চা। তুলসীপাতার ফ্লেভার পাবে।”
“হয়ে যাক। তবে আমার চা ভাল দোকান থেকে আনা।”
“ওটা থাক এখন।” বলে রাধুকে ডাকলেন।
রাধু এল। চা দিতে বললেন কিকিরা। তারপর ইশারায় তারাপদর আনা জিনিসগুলো নিয়ে যেতে বললেন।
রাধু চলে গেলে কিকিরা দরজার দিকে তাকালেন। কেউ নেই। নিচুগলায় বললেন “কোনও খবর?”
“হ্যাঁ। অনেক ঝামেলা করে জোগাড় করেছি। অচেনা মানুষ কারুর বাড়িতে গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলা যায় না। সলিলবাবুর জামাইয়ের দোকানেই গিয়েছিলাম। কাস্টমার সেজে। ক্যাসেট কিনব। আলাপ কি জমতে চায়! ধানাই-পানাই। যাকে হিন্দি সিনেমায় বলে, আগারা বাগারা। সেরেফ গল্প বানালুম। এক বন্ধুর সঙ্গে একটা জায়গায় গিয়েছিলাম সেদিন। সেখানে বুড়োদের এক ধর্মশালা টাইপ আস্তানা দেখলাম। আলাপও হল দু-একজনের সঙ্গে। সলিলবাবু বলে একজন ছিলেন। বললেন তাঁর জামাইয়ের টিভির দোকান আছে ঢাকুরিয়ায়। এই সেই দোকান। আশ্চর্য। অ্যায়সা মিথ্যে চালালাম, সার। দুটো সিগারেট গেল। শেষে কথায় কথায় আবার সলিলবাবুর নাম…”
“বললে?”
“বললাম। সে যে কত কায়দা করে, সার! শ্বশুরমশাইয়ের নাম শোনামাত্র জামাই যেন বুলডগের মতন গর্জে উঠল।…. জামাইয়ের চেহারাটাও বুলডগের মতন। মুখটা যা ফেরোশাস দেখতে।”
“গর্জে উঠল কেন?”
“ঈশ্বর জানেন। বুঝলাম সম্পর্ক ভাল নয়।”
“আচ্ছা! সেদিনের কথা তোলোনি?”
“তুলেছি। কায়দা করেই। জামাই বললে, দোকান বন্ধ করে ফিরে গিয়ে বাড়িতে শ্বশুরমশাইকে দেখেনি। তিনি এসেছিলেন শুনেছে। আবার চলেও গিয়েছেন।”
কিকিরা কৌতূহল চাপতে পারলেন না। “গিয়েছিলেন আবার চলেও এসেছেন। মানে মেয়ের বাড়িতে রাত্রে ছিলেন না?”
“না”, মাথা নাড়ল তারাপদ।
“তা হলে রাত্রে তিনি ছিলেন কোথায়? এখানে ফিরে আসেননি। নিজের মুখেই বলেছেন, সেদিন কলকাতায় মেয়ের বাড়ি গিয়ে আর ফেরা হয়নি।”
“মিথ্যে কথা।”
“অফকোর্স! সলিলবাবু মিথ্যে কথা বললেন কেন? হোয়াই! মুরলীবাবুর দোতলা থেকে ঝাঁপ মারার কথা পরের দিন সকালে এখানে এসে শুনেছেন তিনি। তখন মুরলীবাবু অজ্ঞান অচেতন। হয়তো মারাই যাচ্ছেন। গিয়েছেনও বলা যায়।”
তারাপদ বলল, “সাসপেক্ট!”
“হ্যাঁ। সন্দেহ করতেই হবে।”
“কিন্তু সলিলবাবুর উদ্দেশ্য কী? মোটিভ? মানে আমি বলছি মুরলীবাবুর ঝাঁপ দেওয়ার পেছনে সলিলবাবুর হাত আছে বললে– একটা কারণ তো বার করতেই হবে। কী মোটিভ থাকতে পারে সলিলবাবুর!”
কিকিরা নিজের মাথার লম্বা লম্বা চুলে আঙুল জড়িয়ে টানতে লাগলেন। ভাবছিলেন। অন্যমনস্ক। চিন্তিত। শেষে বললেন, “বলতে পারছি না। খোঁজ করতে হবে। কেন উনি মিথ্যে কথা বলবেন? কী এমন আছে যা লুকোতে চান? আশ্চর্য!”
রাধু চা নিয়ে এল। চায়ের আগে জল। রাধুই ঘরে রাখা কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে দিল।
চলে গিয়েছিল রাধু। তারাপদ চা খেতে খেতে বলল, “আপনি কেন হাবুডুবু খাচ্ছেন?”
কিকিরা মাথা নাড়লেন। “না, ঠিক তা নয়; তবে ধাঁধায় রয়েছি।”
“সলিলবাবুকে চেপে ধরুন!”
“ধরব বইকী! তবে এখন নয়। দেখি বলাইচাঁদের ব্যাপারটা কী হয়! চাঁদু কি লেগে পড়েছে, জানো?”
“হ্যাঁ। পরশু ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে।”
“তারা, আমার মন বলছে, মাত্র তিন-চার মাসের মধ্যে দুটো দুর্ঘটনা একই বাড়িতে বিনা কারণে হয়নি। আমি স্বীকার করছি, কখনও কখনও যুক্তিতর্কের বাইরে এমন অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। একই পরিবারের দু’জন চলে যায়। নিয়তির টান। কিন্তু এখানে তা নয়। একই ঘরের পাশাপাশি তক্তপোশে শুয়ে থাকা দুই বুড়ো চলে গেল পর পর, একজন আগুনে পুড়ে, অন্যজন ছাদ থেকে লাফ মেরে। শ্রীকান্তবাবুর না হয় কাপড়েচোপড়ে আগুন ধরে গিয়েছিল আচমকা- অল রাইট, কিন্তু মুরলীবাবু কেন একতলা থেকে দোতলায় এসে ঝাঁপ মারবেন?”
“একতলা থেকে ঝাঁপ দেওয়া যায় না, সার।”
“ঠিক। কিন্তু আত্মহত্যা করার পাগলামি মাথায় এলে, উনি গলায় দড়ি দিতে পারতেন। না হয় বিষ খেতেন। বা অন্যভাবে….। না, আমি কনফিউজড। কেন উনি দোতলায় এলেন? আর কেনই বা এমন জায়গা থেকে ঝাঁপ দিলেন যেখানের রেলিং আলগা নড়বড়ে, নীচে পাহাড়প্রমাণ রাবিশ!”
তারাপদ অবাক আর আতঙ্কের গলায় বলল, “কেউ কি ওঁকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল?”
কিকিরা চুপ। একটা চুরুট ধরালেন। “চলো, বাইরে যাই। “
চা শেষ করে তারাপদ উঠে দাঁড়াল।
বাইরে এসে কিকিরা বললেন, “শোনো, আমি একবার হরিচন্দনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে যাব।”
“কবে?”
“ক-বে! পরশু দিন। বিকেলে। তুমি চাঁদুকে বলবে ওখানে হাজির থাকতে। তুমিও চলে আসবে। হরিবাবুর সঙ্গে আমার কথা আছে।”
“যেমন বলবেন। “
“তুমি এবার এগোও। বাসে যেতে হবে। পরশুদিন বাকি কথা…।”
তারাপদকে সঙ্গে করে ফটক পর্যন্ত গেলেন কিকিরা। এগিয়ে দিয়ে বললেন, “সাবধানে যাবে।”
.
১০.
হরিচন্দনবাবুর মুখোমুখি বসে ছিলেন কিকিরা। পাশে তারাপদ আর চন্দন।
কিকিরা প্রথমে মৃণালকুঞ্জের বৃত্তান্ত শোনালেন। তিনি যাওয়ার পর যা যা দেখেছেন, শুনেছেন। কার সঙ্গে কথাবার্তা কী হয়েছে–তাও বললেন।
হরিচন্দনবাবু মন দিয়ে শুনছিলেন। মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছিলেন। তিনি যে ক্রমশই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু উত্তেজিত হচ্ছিলেন না। তাঁর কথাবার্তা শুনে ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, ভাল কিছু করতে গিয়ে মন্দ হলে মানুষ যেমন হতাশ বিরক্ত হয়, অনেকটা সেইভাবে হতাশ হয়ে পড়েছেন।
কিকিরা বললেন, “সলিলবাবু মিথ্যে কথা বলছেন- আগেই আপনাকে বললাম। বলাইবাবুও ততটা সত্যবাদী নন। তিনিও হয়তো মিথ্যে বলছেন। চন্দনের কাছে শুনুন।”
হরিচন্দন চন্দনের দিকে তাকালেন।
চন্দন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “আমি খোঁজখবর করে যা জেনেছি–তাতে বুঝলাম, বলাইবাবু যাত্রা দেখতে গিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু পালা শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি ছিলেন কিনা কেউ বলতে পারছে না।”
“বলাইবাবুকে কি গাঁয়ের লোক চেনে?” হরিচন্দনবাবু বললেন।
“কেউ কেউ মুখে চেনে। উনি সকাল বিকেল হাঁটাহাঁটি করেন। ভদ্রলোককে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে আশেপাশে। তা ছাড়া বলাইবাবু তো গাঁয়ের মানুষ নন। সেজেগুজেই গিয়েছিলেন। কার্তিকের শেষ বলে ঠাণ্ডার ভয়ে গায়ে গরম কোট লম্বা, মাথায় টুপি, হাতে ছড়ি আর টর্চ। সহজেই তাঁকে নজরে পড়ছিল। “
“ও”
“আরও একটা ব্যাপারে গোলমাল হচ্ছে। সেদিন সময়মতন যাত্রার দল পৌঁছতে পারেনি বলে পালা শুরু হতে দেরি হয়েছিল। ওদের এক ইম্পর্টেন্ট অভিনেতা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল হঠাৎ। তাকে আনতে পারেনি। কাজেই বায়না-দেওয়া তাদের সঙ্গে যাত্রাপার্টির বচসা হয়। পরে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পালা নামাতে হয়েছিল।”
কিকিরা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “বলাইবাবু আমায় এসব কথা বলেননি।”
হরিচন্দন যেন বিভ্রান্ত। বললেন, “বলাইবাবু তা হলে কি যাত্রাও পুরো দেখেননি।”
“আমায় তা অন্য কথা বলেছেন।” কিকিরা বললেন, “যাত্রার আসরে বসে বাকি রাত কাটিয়েছেন।”
তারাপদ বলল, “মিথ্যে কথা! ফাঁকা আসরে বসে থাকলে কারও নজরে আসত। “
হরিচন্দন অসহায়ের মতন কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললেন, “আমি কী করব, রায়! মৃণালকুঞ্জ থেকে সব কটাকে তাড়িয়ে দেব! বন্ধ করে দেব বাড়িটা?”
কিকিরা বললেন, “এত তাড়াতাড়ি নয়। আর ক’দিন দেখি। তবে একদিন আপনাকে কদমপুরে যেতে হবে। গিয়ে বলতে হবে, মানে শাসাতে হবে যে, মৃণালকুঞ্জ বন্ধ করে দিচ্ছেন আপনি। সাতদিন সময় দিচ্ছি, যে যার মতন ব্যবস্থা করে নিন। পাততাড়ি গুটোন। এখন অবশ্য আপনাকে যেতে হবে না। আমি জানাব যখন, তখন যাবেন।”
হরিচন্দন চুপ করে থাকলেন। মুখের ভাবে বিরক্তি, দুঃখ।
কিকিরা হঠাৎ বললেন, “একটা ব্যাপার আমি লক্ষ করছি। আপনার মৃণালকুঞ্জে যা ঘটেছে সবই এই ক’ মাসের মধ্যে। মাস চারেক বড়জোর। তার আগে কোনও ঘটনা ঘটেনি?”
“না। নয় নয় করেও এই ক’ বছরে দশ-বারোজন এসেছেন। কেউ কেউ চলেও গিয়েছেন নিজের মরজিতে। কিন্তু আগুনে পোড়া, আত্মহত্যা- এসব ঘটেনি কোনওদিন।”
“আমি ভেবেচিন্তে দেখেছি, জলধরবাবু ছাড়া অন্যরা বেশিদিন আছেন মৃণালকুঞ্জে। জলধরই শুধু বছরখানেক। উনি আসার আগে কোনও খারাপ ঘটনাই ঘটেনি বাড়িটাতে”, কিকিরা বললেন। “যা যা ঘটল সবই জলধরবাবু আসার পর।”
হরিচন্দন কিকিরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন সামান্য সময়। তারপর মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁ। তুমি ঠিকই বলেছ! জলধর এসেছেন বছরখানেক। আর দুটো ঘটনাই ঘটেছে গত কয়েক মাসের মধ্যে। তোমার কি মনে হয় এর মধ্যে জলধরের হাত আছে?”
“এখন বলতে পারছি না। মানুষটি যতই কেননা হাতে তালি বাজিয়ে সন্ধেবেলায় ঠাকুরদেবতার গান করুন, আমার মনে হয় উনি অতটা দেবদ্বিজের ভক্ত নন। ভক্তি আর ভাব এক জিনিস নয়, দাদা। ভদ্রলোক বেশ চতুর। ওঁর মুখের কথা আর মনের মতলব আলাদা হতেই পারে। তা ছাড়া জলধরবাবু যা যা বলেছেন ওঁর সম্পর্কে, তা সত্যি না বানানো কে বলবে!”
“ভেরিফাই করা যায় না?” তারাপদ বলল।
“করা মুশকিল। অন্তত আন্দামানের ব্যাপারটা। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। অত হাঙ্গামা করতে গেলে সময় নষ্ট হবে।”
“তা হলে?” হরিচন্দন বললেন।
“আমি অন্য কোনও উপায় খুঁজছি। অসুবিধে কী জানেন, যাঁরা মারা গিয়েছেন তাঁদের তো আর ফিরে পাব না যে, দু’-এক কথা শুনে কাউকে সন্দেহ করব! মরা মানুষ সাক্ষী হয় না, দাদা!… তা সে অন্য কথা। আপাতত আমরা বলাইবাবু আর সলিলবাবুকে বাজিয়ে দেখি। তাঁরা দু জনেই কী লুকোতে চাইছেন!”
হরিচন্দন বললেন, “দেখো।…আমাকে না শেষ পর্যন্ত মৃণালকুঞ্জ তুলেই দিতে হয়! দু’জন তো গিয়েছেন, আবার কোন দিন কেউ চলে যান যদি…”
“না না, অত ভাববেন না। আজ উঠি।” কিকিরা উঠে পড়ার উদ্যোগ করলেন।
“তুমি ফিরবে কেমন করে? বনমালীকে বলি পৌঁছে দিয়ে আসুক।”
“না। আজ আমি ফিরব না। বলে এসেছি, কলকাতায় আমার কাজ আছে আপনার সঙ্গে, অন্য দরকারও আছে। কাল বেলার দিকে আমি ফিরব। বাসে। আপনি ব্যস্ত হবেন না। আসি দাদা। চলো তারাপদ।”
.
রাস্তায় এসে চন্দন বলল, “আপনি বাড়ি যাবেন?”
“হ্যাঁ। রাতটা কাটিয়ে কাল ফিরব।”
“চলুন তবে।”
“তোমরাও যাবে! দরকার নেই। আমি একটু ঘুরেফিরে যাব। আমার কয়েকটা জিনিস জোগাড় করতে হবে। আমার চেলাদের কাছে পেয়ে যাব।”
“আপনার শিষ্য? লাইনের লোক?”
কিকিরা হাসলেন। “কারেক্ট।”
“ম্যাজিকঅলা…”
“একটা বাঁশি চাই, সাপুড়েরা যে বাঁশি বাজায়।”
“সাপুড়ের বাঁশি?” তারাপদ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
“আকাশ থেকে পড়ছ নাকি? ফলিং ফ্রম স্কাই! ম্যাজিশিয়ানদের খেলা দেখাবার ছলাকলা সাজপোশাক বাদ দাও। রাস্তায় মাদারির খেলা দ্যাখোনি কখনও! তারাও কেমন সাপুড়ের বাঁশি বাজায়, আর বড় একটা ঝুড়ির মধ্যে একটা বাচ্চাকে ঢুকিয়ে দিয়ে ঝুড়ির মাথা বন্ধ করে দেয়। তারপর বাঁশি বাজাতে বাজাতে ঝুড়ির মধ্যে এক হাত লম্বা ছোরা চালায় চার-পাঁচটা। পরে যখন ছেলেটা বেরিয়ে আসে, একেবারে যেমন কে তেমন!… তোমরা কলকাতার ছেলে–এসব রাস্তাঘাটের মামুলি খেলা দেখবে কেমন করে?”
“সাপুড়ের বাঁশি আপনি কী করবেন?”
“জলধর বলেছেন তিনি আগে একটু বাঁশিতে ফুঁ দিতে পারতেন। আমি অবশ্য পারি না। কলজেতে সে-দম নেই। তবে পিপলুকে পাব। পিপলু সাপুড়ে সেজে বাঁশি বাজিয়ে ঝুড়ির মধ্যে থেকে প্যাঁচানো দড়ি বার করে। রোপ ট্রিক। ওকে ধরে নিয়ে গিয়ে কোথাও থেকে একটা টেপ রেকর্ড করিয়ে নিতে পারব।”
চন্দন আর তারাপদ মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
শেষে চন্দনই বলল, “আপনিও তা হলে বুজরুকি বিশ্বাস করলেন! সাপুড়ের বাঁশি ছাড়াও ধুনুচি, হলুদ চাল, সিঁদুরমাখা আমপাতা, জবাফুল, সাপের খোলস…”।
“কী যে বলো তুমি! প্লাস্টিকের সাপ, গিরগিটি কোনটা না পাওয়া যায় বাজারে! ছেলেমানুষের খেলনা, যাত্রা থিয়েটারের নকল সাপ। আর এ তো শুধু একটু খোলস! বাকি যা তা..”
“বুঝেছি।” তারাপদ মাথা হেলিয়ে বলল, “আর গন্ধ!”
“হয়ে যাবে। অখাদ্য ধূপ অনেক পাওয়া যায় বাজারে। না হলে কেমিক্যাল দোকানে খোঁজ করব।”
“জলধর তা হলে আপনার টার্গেট!”
মাথা নাড়তে নাড়তে কিকিরা বললেন, “জলধর একা নয়, ওঁদের দু’জনও আমার নজরে আছেন- বলাইবাবু আর সলিলবাবু!”
অল্পসময় চুপচাপ।
তারাপদ বলল, “আমরা তা হলে কী করব?”
“তুমি পরশুর পরের দিন তরশু যাবে। দু-একটা জিনিসপত্র নিয়ে যেয়ো হাতে করে। চাল আটা লাগবে না। আছে। বরং পিপলুকে বলে যাব তোমার হোটেলে গিয়ে যা যা দেওয়ার দিয়ে আসবে। একটা ব্যাগে করে নিয়ে যাবে। ডেলিভারির তে-চাকা নিয়ে এসো না।… আর চাঁদু, তুমি এবার ওই বন্ধ কারখানার দরোয়ানকে ক্যাচ করো। যেমন করে হোক পটিয়ে কারখানার ভেতরে ঢোকো একবার। দেখো যদি কিছু প্রমাণ পাও।”
চন্দন মাথা নাড়ল। “ও-কে সার! আমি ম্যানেজ করার চেষ্টায় থাকব। মুশকিল কী জানেন, আপনাদের মৃণালকুঞ্জ আর কারখানা এত কাছাকাছি ভয় হয় আপনাদের ওখানে কারও নজরে পড়ে যাই!”
“যাও তো যাবে। তুমি বিজনেসম্যান! বন্ধ কারখানার ব্যাপারটা দেখতে যেতেই পারো।”
“বেশ! যা বলবেন!”
“তা হলে তোমরা এবার এসো। আমি নিজের কাজে যাই। “
“আসুন। সার, আপনি কিন্তু সাবধানে থাকবেন।”
“আমায় নিয়ে ভেবো না। আমি তিনটে চোখ নিয়ে থাকি ওখানে। আমায় কাবু করা সহজ হবে না।”
“না হলেই ভাল।”
“আমি আসি। সন্ধে হয়ে যাচ্ছে। আর দেরি করলে আমার কাজ হবে না।” কিকিরা একটা ট্যাক্সি ধরে নিলেন বড় রাস্তা থেকে।
.
১১.
বাড়ির সামনে বাগানে সলিলবাবু পায়চারি করছিলেন। আজ বিকেল থেকেই গুমোট বাড়ছে। আকাশের চেহারা থমথমে। বাতাস নেই। সলিলবাবু ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন। মাঝে মাঝেই ধুতির কোঁচার একটা প্রান্ত আলগা করে তুলে নিয়ে মুখের, গলার ঘাম মুছছিলেন।
হঠাৎ কিকিরার গলা পেলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। কিকিরাকে তিনি আগেই দেখেছেন বাগানে। ওপাশে ছিলেন। রজনীবাবুও বাগানে, ফটকের কাছে। আজ হাতে খুরপি বা শিক নেই। চৈতন্য মালীর সঙ্গে কী কথা বলছিলেন। বোধ হয় ফটকের গায়ে মাধবীলতার ডালগুলো যেভাবে ঝুলে পড়েছে, শুকনো পাতা জমেছে গোড়ায়–তা নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে।
সলিলবাবু বুঝতে পারেননি কিকিরা কখন ওপাশ থেকে এপাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, একেবারে তাঁর পাশে। গলা শুনে কিকিরার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন।
কিকিরা আবার বললেন, “আকাশ দেখেছেন?”
সলিলবাবু মুখ তুলে আকাশ দেখলেন। আগেও দেখেছেন।
“কী মনে হচ্ছে, ঝড়বৃষ্টি হবে এক পশলা?” কিকিরা বললেন।
“মেঘ হচ্ছে…”
“এখন কালবৈশাখীর সময়। চৈত্র মাস। “
“হলে ভালই। বড় গুমোট।”
“ঝড় হবে। আমার তাই মনে হচ্ছে। আকাশ কিন্তু কালো হয়ে আসছে ওদিকটায়।”
সলিলবাবু হাঁটতে লাগলেন। পাশে কিকিরা।
দু’-পাঁচটা এলোমেলো সাধারণ কথা। কিকিরা কলকাতা থেকে ফিরেছেন বেলা এগারোটা নাগাদ। রোদের তাতে সব যেন পুড়ে যাচ্ছে তখন। কলকাতায় আজ কী ভয়ংকর এক অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে বাসে বাসে ধাক্কা লেগে শ্যামবাজারের মোড়ে, তার কথা বলতে বলতে দশ-বিশ পা এগিয়ে এলেন কিকিরা, সলিলবাবুকে নিয়ে।
“না। ঝড় হবেই,” কিকিরা বললেন শেষে। ঝড়ের প্রথম ধুলো উড়ে এল।
আকাশ সত্যিই কালো হয়ে আসছে দেখতে দেখতে।
সলিলবাবুও মাথা হেলালেন।
“চলুন ভেতরে যাই। হঠাৎ ঝড় উঠলে ধুলোর ঝাঁপটা খেতে হবে।”
“ভেতরে আরও গুমোট।“
“আমার ঘরে বসবেন। পাখা আছে।”
সলিলবাবু আকাশের দিকে তাকালেন আবার। সামান্য আগেও মেঘগুলো এত কালো মনে হয়নি। সত্যিই ঝড় আসছে। মেঘের দল ছুটে আসছিল হু-হুঁ করে। রজনীবাবুও পা চালিয়ে ফিরে আসছেন।
পা বাড়ালেন সলিলবাবু, “চলুন।”
বারান্দায় উঠে এসে সলিলবাবু বললেন, “ঘরের দরজা জানলা খোলা আছে। বন্ধ করে দিয়ে আসি।”
“আসুন। রজনীবাবুও ফিরে আসছেন। তিনিই বন্ধ করে দিতে পারেন।”
“তা হোক। আমি যাই।”
কিকিরা বললেন, “আসুন তবে। আসবেন কিন্তু। আপনার সঙ্গে আমার ক’টা জরুরি কথা আছে।”
সলিলবাবু দেখলেন কিকিরাকে কয়েক পলক, তারপর চলে গেলেন।
দেখতে দেখতে ঝড় এসে গেল। কালবৈশাখীর ঝড়। মাঠঘাট থেকে ধুলো শুকনো পাতা খড়কুটো উড়িয়ে এনে চারপাশ অন্ধকার করে ফেলল। মেঘও ডাকছিল। সোঁদা গন্ধ ভেসে আসার পর পরই বৃষ্টি।
.
সলিলবাবু এলেন। কিকিরার ঘরে আলো জ্বলছে। পাখাও চলছিল। একটিমাত্র জানলা খোলা। ঝড় নেই; বৃষ্টি রয়েছে তখনও।
“বসুন,” কিকিরা বললেন।
বসলেন সলিলবাবু। কিকিরা নিজের খাটের ওপর বসে।
“আজকের রাতটা তা হলে স্বস্তি, কী বলুন,” বললেন কিকিরা। “রাতে ভালই ঘুম হবে।”
সলিলবাবু জবাব দিলেন না। ক’দিনের ভ্যাপসা গরমের পর আজকের ঝড়বৃষ্টি যে স্বস্তিদায়ক, তা তো জানা কথা।
কিকিরা অনর্থক বেশি ভূমিকায় গেলেন না। সরাসরি বললেন, “আপনাকে ক’টা কথা জিজ্ঞেস করি। আমি এখানে আসা পর্যন্ত নানান কথা শুনি। ভয়ও হয় একটু আধটু। রোগাপটকা মানুষ, বুঝতেই তো পারছেন। সাহস কম। …আচ্ছা সলিলবাবু, ওই ব্যাপারটায় আপনার কী ধারণা? প্রথম দুর্ঘটনাটার কথা বলছি। শ্রীকান্তবাবু যে আগুনে পুড়ে মারা গেলেন, এটা কি ওঁরই দোষে! মানে অসাবধানতার জন্যে?” বাকি কথাটা শেষ করলেন না কিকিরা।
সলিলবাবু তাকিয়ে থাকলেন। “কেন?”
“না, এমনি জিজ্ঞেস করছি। আপনাদের পুরনো ম্যানেজার দীনুবাবু হরিবাবুকে বলেছেন, এই বাড়িতে নাকি একটা অশুভ আত্মা প্রেতাত্মা ভর করেছে।”
সলিলবাবু বললেন, “দীনুবাবুর সেরকম ধারণা হয়েছিল আমরাও শুনতাম। কার কী ধারণা হয়, কেন হয়–কেমন করে বলব!”
“দ্বিতীয় ঘটনাটাও..”
“মুরলীবাবুর আত্মহত্যা সম্পর্কেও আমি কিছু জানি না। সেদিন আমি ছিলাম না। আগেই বলেছি আপনাকে।”
“মেয়ের বাড়ি গিয়েছিলেন কলকাতায়। ঢাকুরিয়ায়। ফিরতে পারেননি।”
“না।”
কিকিরা এবার চোখে চোখে তাকালেন সলিলবাবুর। তারপর হঠাৎ বললেন, “আপনি কি মেয়ের বাড়িতে ছিলেন সেদিন?”
সলিলবাবু যেন থতমত খেয়ে গেলেন। মুখটা কেমন কুঁচকে গেল। “ও কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?”
কিকিরা এবার সরাসরি বললেন, সামান্য শক্ত গলায়। “শুনলাম মেয়ের বাড়িতে আপনি দেখা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু ছিলেন না।”
“কে বলল?” সলিলবাবু চমকে উঠলেন। গলা উঠল না।
“আপনার জামাই।”
সলিলবাবুর মুখচোখের চেহারা পালটে গেল। ভয় পেয়েছেন। বিভ্রান্ত। মুখ নামিয়ে নিলেন।
কিকিরা বললেন, “কথাটা ঠিক?”
সলিলবাবু চুপ। মুখ তুলছিলেন না।
অল্প সময় চুপ করে থেকে কিকিরা চমৎকার এক গল্প বানালেন। বললেন, “কাল আমি যখন হরিবাবুর বাড়িতে কয়েকটা কাজের কথা বলতে যাই, তখন দেখি সেখানে হরিবাবুর এক দূর সম্পর্কের ভাইপো বসে ছিলেন। ভদ্রলোক পুলিশ অফিসার। বড় অফিসারই। তাঁর সঙ্গে উনি কথাবার্তা বলছিলেন। এই বাড়ির কথাই। উনি দু-দুটো দুর্ঘটনার কথা শোনাচ্ছিলেন। অফিসার ভদ্রলোক প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়তে লাগলেন। আমার মনে হল, উনি বিশ্বাস করলেন না। “
সলিলবাবু কেমন যেন সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন, “আমার কথা উঠেছিল?”
“আপনাদের দু’জনের কথাই উঠল। বলাইবাবু, আপনি”
“আমি সত্যিই সেদিন এখানে ছিলাম না। …কিন্তু আমার জামাইয়ের কথা কে বলল!”
“যেই বলুক আপনি নিজে কী বলেন! হরিবাবুই হয়তো তলায় তলায় খোঁজখবর করছেন।”
সলিলবাবু জবাব দিচ্ছিলেন না কথার। বৃষ্টি কমে আসছিল। ঠাণ্ডা বাতাস আসছে, ভিজে মাটি গাছপালার গন্ধ।
কিকিরা সলিলবাবুকে আরও ঘাবড়ে দিতে চাইছিলেন। বিশ্বাস করাতে চান পুলিশের ব্যাপারটা ফেলনা নয়। বললেন, “আপনি জানলেও জানতে পারেন, হরিবাবু এই দুটো দুর্ঘটনাকে মেনে নিতে পারছেন না। তাঁর সন্দেহ রয়েছে। তলায় তলায় তিনি খোঁজখবর নিচ্ছেন।”
সলিলবাবু হঠাৎ বললেন, “আপনি কে? পুলিশের কেউ?”
কিকিরা হেসে ফেললেন, “মশাই, আমার এই হ্যাংলা চেহারা। রোগাপটকা মানুষ আমি। বয়েসটাও বিবেচনা করুন। আমি কি পুলিশের লোক! আপনার কি মাথাখারাপ হয়েছে।”
খানিকটা ধাঁধায় থাকলেন সলিলবাবু। কী মনে করে পরে বললেন, “আপনাকে যদি সত্যি কথাটাই বলি–তাতে কী লাভ হবে আমার!”
“বেশ তো, আমায় না বলেন, হরিবাবুকেই বলবেন। “ কিকিরার গলা শুনে মনে হল তিনি জোরজবরদস্তি করছেন না। “হরিবাবু শীঘ্রি একদিন আসছেন এখানে। তাঁকেই বলবেন। তবে কথা কী জানেন সলিলবাবু, আমায় বললে আপনার কোনও ক্ষতি নেই। হরিবাবুকে আমি বোঝাতে পারব। আর আপনি আমায় না বললেও হরিবাবুর কাছ থেকে আমি জানতে পারব।”
সলিলবাবু ভাবছিলেন। নস্যি নেওয়ার অভ্যেস আছে তাঁর। পকেট থেকে নস্যির ডিবে আর ময়লা রুমাল বার করে নস্যি নিলেন। “আপনাকেই বলি। বিশ্বাস করবেন আমার কথা?”
“কেন করব না। আমাকে দিয়ে আপনার ক্ষতি হবে ভাবছেন কেন! সত্যি কথা বললে লাভও হতে পারে।”
সলিলবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “তা হলে বলি, সেদিন মেয়ের বাড়িতে আমি ঘণ্টা দুয়েকও ছিলাম না। মেয়ে-জামাইয়ের ওপর আমার টান কম। নাতিটার টানেই যাই। মেয়ের কাছে যাব কী বলুন! গেলেই শুধু টাকার কথা। আজ পাঁচ হাজার চায়, কাল সাত হাজার, পরশু দশ হাজার। টাকা চায় জামাইয়ের ব্যবসার নাম করে। এটার জন্যে দরকার, ওটার জন্যে দরকার। জামাইয়ের উসকানি আছে, জানি। জামাইয়ের দোকান তো খারাপ চলে না। তবু কেন যে এত চাই চাই! জামাইটি আমার ভাল নয়। বিয়ের সময় থেকেই কম দিইনি। আমার সারা জীবনের যা উপার্জন সঞ্চয়, তার অর্ধেকটাই ওদের জন্যে খরচ হয়ে গিয়েছে। …আর ভাল লাগে না। সেদিন মেয়ে হাজার দশেক টাকা চেয়ে বসল জামাইয়ের নাম করে। আমার মাথা গরম হয়ে গেল। ঘেন্নাও হল। মেয়েকে বললাম, ‘পারব না।’ বলেই ও বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।”
চুপ করলেন সলিলবাবু, যেন দম নিচ্ছিলেন। কিকিরা শুনছেন মন দিয়ে। বৃষ্টি বুঝি থেমে এল। শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
সলিলবাবু বললেন আবার। “আপনাকে একটা কথা বলি। মেয়েটি আমার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর। সে চলে যাবার পর আবার বিবাহ করতে হয়। আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর হাতেই মেয়ে আমার মানুষ। স্নেহ ভালবাসা কম পায়নি। তা আমার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীরও একটি সন্তান হয়। ছেলে। বিকলাঙ্গ বলতে পারেন। হাবাগোবা। বছর চোদ্দো-পনেরো বয়েস থেকেই তার মাথার গোলমালও দেখা দেয়। এখন সে পাগল। বাঁশদ্রোণীর দিকে একটা সাধারণ উন্মাদ আশ্রমে সে থাকে। আমি তাকে দেখতেও যাই। খরচাপাতিও দিতে হয়। সেদিন মেয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছেলেকে দেখতে গেলাম। তার অবস্থা দেখলাম গুরুতর। ওখানেই সন্ধে হয়ে গেল। মনও খারাপ। আমি আর এখানে ফিরে আসার চেষ্টা করিনি। চেতলায় আমার এক বন্ধু আছে। সেখানেই রাত কাটিয়ে পরের দিন এখানে ফিরলাম। ফিরে দেখি ভয়ংকর অবস্থা। মুরলীবাবুকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হেথ সেন্টারে। তাঁর বাঁচার আশা নেই।”
কিকিরা প্রতিটি কথা মন দিয়ে শুনেছেন। নিশ্বাস ফেললেন। দুঃখও হচ্ছিল সলিলবাবুর জন্যে।
“আপনি যদি খোঁজ নিতে চান–আমি সেই উন্মাদ আশ্রম আর বন্ধুর বাড়ির ঠিকানা দিচ্ছি, নিজে গিয়েও খবর করতে পারেন।”
কিকিরা মাথা নাড়লেন। “আপনার কথা আমি এখন অন্তত অবিশ্বাস করছি। না।”
“আমি একবর্ণও মিথ্যে বলিনি। হরিবাবুকে আপনি আমার কথা জানাতে পারেন।”
“জানাব। …আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো?”
“কী বলব?”
“আপনি যে সেদিন ফিরতে পারবেন না এ-কথা কি এখানকার কাউকে বলেছিলেন?”
“দেখুন, আমরা সবাই বুড়ো মানুষ। এ তো বাচ্চাদের হোস্টেল বোর্ডিং নয় যে, কোথাও যেতে হলে আগে বলতে হবে, পারমিশন নিতে হবে! আর ফিরতে পারব না সেটা জানিয়ে যেতে হবে! দীনুবাবু জানতেন আমি কলকাতায় যাচ্ছি।”
“ফিরতে পারবেন না–তাও জানতেন।”
“না; কেমন করে জানবেন। আমার তো ফেরারই কথা।”
“ও! তা হলে এখানকার কেউই জানতেন না যে আপনি ফিরবেন না?”
“হ্যাঁ। …তবে আমি হয়তো রজনীবাবুকে বলেছিলাম, শীতের দিন, রাত হয়ে গেলে ঠাণ্ডা লাগিয়ে ফিরব না।”
“বলেছিলেন কিনা মনে করতে পারছেন না ঠিক?”
“না। রজনীবাবু আর আমি একই ঘরে আছি কতদিন ধরে। বললে ওঁকেই বলতে পারি; আর কাউকে নয়। তবে আমি ফিরতে পারব না, নিজেও কি জানতাম!”
কিকিরা বসার ভঙ্গি পালটে নিলেন। “রজনীবাবু মানুষটি বড় চুপচাপ। নিরীহ। নিজের মনে থাকেন। কেমন লাগে আপনার রুমমেটকে?”
“ভালই লাগে। উনি বরাবরই ওইরকম। শান্ত, সাতপাঁচে থাকেন না। ওঁরও অনেক দুঃখ আছে। ভাগ্যও বড় মন্দ। একবার মা, স্ত্রী আর একটিমাত্র ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন হরিদ্বার টরিদ্বার বেড়াতে। ঘোরাঘুরি করার সময় বাস উলটে অনেকেই মারা যায়। ওঁর মা, স্ত্রী, ছেলেকাউকেই আর তিনি ফিরিয়ে আনতে পারেননি। এই শোক কি সামলে ওঠা সম্ভব! উনিও পারেননি। চাকরি করতেন সাধারণ। সেখানেও মন বসাতে পারলেন না। রিটায়ার করলেন আগে আগে। হাতে টাকাপয়সাও জমল না। তারপর থেকে কোনও রকমে দুটো খেয়েপরে দিন কাটাচ্ছেন। ওঁর অভাবও রয়েছে। বুঝতে দেন না।”
কিকিরা এতটা জানতেন না। কষ্টই হল।
দু’জনেই নীরব। শেষে কিকিরা বললেন, “আর একটা কথা আপনাকে জিগ্যেস করি। দীনুবাবু যেসব কথা হরিবাবুকে বলতেন–তার মধ্যে সাপুড়ের বাঁশি, বিচ্ছিরি গন্ধ, ফটকের কাছে তুকতাক করার কথাও বলেছেন। আপনি..”
“আমিও শুনেছি।”
“শ্রীকান্তবাবু মারা যাওয়ার দিন, মুরলীবাবুর চলে যাওয়ার দিনও
“মুরলীবাবু চলে যাওয়ার দিন আমি এখানে ছিলাম না। বাঁশি শুনব কেমন করে? পরের দিন যখন ফিরে এলাম এখানে তখন কী অবস্থা যাচ্ছে বুঝতেই পারছেন! ফটকের কাছে কী আছে না আছে কে আর নজর করবে?”
“প্রথমবার, মানে শ্রীকান্তবাবুর ওই ঘটনার দিন–?”
“মনে করতে পারছি না।”
“এখানে আর কোনও দিন সাপুড়ের বাঁশি শুনেছেন?”
“তা শুনেছি। ..ম্যানেজারবাবু, এটা একরকম গ্রাম। মাঠঘাট খেত ঝোঁপঝাড় চার পাশেই। সাপ এখানে থাকবেই। এই বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে গরম বর্ষায় সাপ দেখা যায়। আমরা সাবধানে থাকি। …তা ছাড়া, এই আপনার শীত আসার সময় থেকে দেখেছি– মাঝে মাঝে বেদেরা মাঠেঘাটে সাপ ধরতে আসে। বাঁশিও বাজায়। তবে কীভাবে সাপ ধরে জানি না। শুনেছি ওটা ওদের জন্মগত শিক্ষা। গর্ত দেখলেই বুঝতে পারে। সাপ ধরে বিক্রিও করে বলে শুনি। বিষ থেকে নাকি ওষুধ হয়।”
কিকিরা আর কথা বাড়ালেন না। সলিলবাবুও উঠে পড়লেন।
.
১২.
তারাপদ এসেছিল ঠিক দিনে। হাতে একটা মাঝারি কিট ব্যাগ।
কিকিরা ব্যাগ খুলে দেখে নিলেন যা যা চেয়েছিলেন সব আছে কি না!
“এভরিথিং ও-কে, সার?”
মাথা হেলিয়ে সায় দিলেন কিকিরা।
“কতটা এগুলেন?”
“খানিকটা। সলিলবাবু বাদ গেলেন।”
“মানে, সাসপেক্ট নন।”
“না। অন্তত পনেরো আনা নয়।”
“বলাইবাবু?”
“এখনও চেপে ধরিনি। আজ ধরব।”
“চাঁদু কাল এসে কারখানার দরোয়ানজিকে ম্যানেজ করে গিয়েছে, জানেন?”
“না। এখানে আসেনি। ভালই করেছে। … সরাসরি নজরের বাইরে থাকতেই বলেছিলাম। রেজাল্ট কী? কারখানার ভেতরে ঢুকেছিল?”
“এক নজর দেখেছে। তবে কারখানার ফটকের ও-পাশে দরোয়ানজির ঘর। ফটকের গা ঘেঁষে। সেই ঘরের গায়ে গায়ে আরও একটা ছোট ঘর আছে। চাঁদু বলল, কারখানা থেকে জিনিস বেরুবার সময় ওই ঘরে বসে, কেউ চেকিং করে নিত। মোদ্দা কথা, ডেলিভারি জিনিসের হিসেব রাখত।”
“ঘরে কিছু পেয়েছে?”
“তেমন কিছু নয়। ঘরে একটা দড়ির খাঁটিয়া, একটা ধুলোভরা ভুটকম্বল, আর এক পাটি জুতোর ছেঁড়া ফিতের টুকরো।”
কিকিরা কৌতূহল বোধ করলেন। “ফিতের রং।”
“খাকি। তাই তো বলল।”
কিকিরা কী যেন ভাবছিলেন। পরে বললেন, “চলো, একটু বাইরে যাই।”
বাইরে বিকেল নেমেছে আগেই। চৈত্রমাস বলে আলো রয়েছে যথেষ্ট। রোদও ফুরোয়নি। গাছের মাথার দিকে উঠে যাচ্ছে রোদ। গরম যেন সামান্য কম। গত পরশুর কালবৈশাখী আর বৃষ্টির পর তাপ কমেছে অল্প।
তারাপদকে নিয়ে বাইরে এসে ঘুরতে ঘুরতে সবজি বাগান আর পুকুরের কাছে এলেন কিকিরা।
“বসবে? থাক, মাটি এখনও তলার দিকে ভিজে। কাদা লাগতে পারে। একটা সিগারেট দাও।”
তারাপদ সিগারেট দিল।
সিগারেট ধরিয়ে চারপাশে তাকাতে তাকাতে কিকিরা হঠাৎ বললেন, “ওদিকটায় দেখো,” বলে হাত তুলে আঙুল দিয়ে কী যেন দেখালেন।
তারাপদ বলল, “কী দেখব?”
“ওই যে দেখছ জায়গাটা, যত রাজ্যের ভাঙা ইট, পাথর, রাবিশ জড়ো হয়ে ঢিবি হয়ে আছে ঠিক ওইখানে পড়ে গিয়েছিলেন মুরলীবাবু। ঝাঁপ দিয়েছিলেন বলেন এঁরা।”
“ওটা পরিষ্কার করাননি?”
“না। এখনও করাইনি। লাভও বা কী হবে! … একটা জিনিস লক্ষ করছ? মৃণালকুঞ্জর বাড়ির ওটা পেছন দিক। দোতলার বারান্দা দেখা যাচ্ছে। বারান্দার গায়ে রজনীবাবু, বলাইবাবুদের ঘর। পাশাপাশি।”
তারাপদ দেখল। “ওটা কী সাদা মতন?”
“কোনটা?”
“ওই যে ঢিবির প্রায় পাশেই। “
“ওটা তুলসীমঞ্চ।” বলেই একেবারে আচমকা কিকিরার কী মনে হল, বললেন, “জলধরবাবু রোজ সকালে মঞ্চের কাছে এসে হাত জোড় করে প্রণামট্রনাম করেন। কয়েকটা তুলসীপাতা ছিঁড়ে মুখে দেন। বলেন, তুলসীপাতা হল ভীষণ উপকারী, সব বয়েসের মানুষের পক্ষে। তুলসীপাতার রস দিয়ে ওষুধও হয়।”
তারাপদ হেসে বলল, “মধু আর তুলসীপাতা … সর্দিকাশিতে বাচ্চা বেলায় খেয়েছি।”
“চলো।”
“কোথায়?”
“ওই তুলসীমঞ্চটা একবার দেখি। অত সাদা দেখাচ্ছে। হালে চুনকাম করেছে নাকি কেউ?”
তারাপদ এগিয়ে চলল কিকিরার সঙ্গে।
মঞ্চের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন কিকিরা। ইট দিয়ে বাঁধানো তুলসীমঞ্চ। ফুট তিনেক উঁচু। তুলসীগাছের পাতাগুলি সব সবুজ নয়, রোদের তেজে কিছু পাতা শুকিয়ে এসেছে।
কিকিরা মন দিয়ে মঞ্চ আর গাছটি দেখছিলেন। চোখে পড়ল, রজনীবাবু দশ-পনেরো হাত তফাতে নিজের মনে কী যেন দেখছেন।
কিকিরা ডাকলেন রজনীবাবুকে।
রজনীবাবু এগিয়ে এলেন ধীরে ধীরে। হাতে খুরপি।
“রজনীবাবু? আপনাদের এখানে আর তুলসীঝোপ নেই?”
“কেন থাকবে না; আছে।”
“এটি মঞ্চ। বাঁধিয়ে করা।”
“জলধরবাবু করেছেন। উনি বলেন, এটি বৃন্দাবনী তুলসী। নিজেই তুলসীচারা আনিয়ে মঞ্চ করেছেন। বৃন্দাবনের মাটি … পুণ্যস্থান …”
“ও! নিজের হাতেই করেছেন নাকি?”
“না। বাইরে থেকে রাজমিস্ত্রি ধরে এনেছিলেন। যা করেছেন নিজেই দাঁড়িয়ে থেকে। “
“ধর্মেকর্মে ভদ্রলোকের খুব মতি। সকালে মুখে তুলসীপাতা না দিলে ওঁর মুখ শুদ্ধ হয় না। সন্ধেবেলায় দু হাতে তালি বাজিয়ে নমঃ গোবিন্দ জয় গোবিন্দ করেন।” কিকিরা যেন মুচকি হাসলেন। “এই মঞ্চটি কবে তৈরি হয়েছে?”
“কবে! গত গরমে। বর্ষার আগে আগেই। বর্ষার জলে গাছটা বেড়ে উঠল। এখন একটু শুকোবে। আবার বাড়বে বর্ষায়।”
কিকিরা আর কিছু বললেন না।
রজনীবাবুও সরে গেলেন অন্য পাশে।
আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কিকিরা তুলসীমঞ্চটা দেখলেন। “তারা, তুলসীগাছের এত যত্ন কারা করে? হিন্দুবাড়িতে বিধবারা করে, বুড়িরা করে। মেয়ে বউরাও সন্ধেবেলায় প্রদীপ দে,। এখানে তেমন কেউ নেই। তবে হ্যাঁ, জলধরবাবু আছেন। বোধ হয় উনি পরম বৈষ্ণব। … নাও, চলো।”
কিকিরার পাশে পাশে হাঁটতে লাগল তারাপদ।
বাড়ির সামনের দিকে এসে তারাপদ বলল, “আপনি সামান্য একটা তুলসীমঞ্চ দেখে এত গম্ভীর হয়ে গেলেন কেন?”
“গম্ভীর হলাম কোথায়! ভাবি। আগেও নজরে এসেছে মঞ্চটা, কিন্তু মাথা ঘামাইনি।”
“কী ভাবছেন?”
“জলধরবাবুর কথা ভাবছি। … আচ্ছা, ওই মঞ্চটার গায়ে যে চুনকাম করা দেখলে, তা নতুন নতুন মনে হল না! মানে, আগেও চুনকাম ছিল, আবার কলি ফেরানো হয়েছে। তাই না!”
“বোধ হয়। আমি কি অত খেয়াল করেছি?”
“যাক গে, তুমি যাবে কখন?”
“এবার যাব। বাস ধরতে হবে।”
“চলো, একটু চা খেয়ে যাও। এখনও আলো আছে। তুমি ঠিক সময়ে গিয়ে বাস ধরতে পারবে।”
ঘরে আসার আগেই কিকিরা রাধুঠাকুরকে ডেকে এক কাপ চা করে দিতে বললেন।
চা খেয়ে তারাপদ যখন চলে যাচ্ছিল, কিকিরা তাকে এগিয়ে দিতে গিয়ে হঠাৎ বললেন, “আগামী শনিবার তোমরা এখানে থাকবে রাত্রে। আমার গেস্ট। চাঁদুকে বোলো। রবিবার তার ছুটির দিন।”
.
১৩.
পরের দিন খানিকটা বেলায় বলাইবাবু সকালের ঘোরাফেরা শেষ করে ফিরে আসতেই দেখলেন, কিকিরা বাইরের বারান্দায় বসে আছেন।
কিকিরা দেখছিলেন বলাইবাবুকে। ভদ্রলোক রোদের তাতে ভ্যাপসা গরমে যেন ভিজে জল হয়ে গিয়েছেন। মুখে গলায় ঘাম, গায়ের জামাও ভিজে রয়েছে অনেক জায়গায়।
“কী মশাই, চান করে এলেন যে!” কিকিরা বললেন।
রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বলাইবাবু বললেন, “বেলা হয়ে গেল! যা চড়া রোদ।”
“কোথায় গিয়েছিলেন?”
“ওই দুগা ভাণ্ডারে। বকুলপুরের তেমাথায়।”
“মর্নিং ওয়াক করতে?”
“আরে না মশাই, দু-একটা জিনিস কেনার ছিল। দাড়ি কামানোর সাবান ফুরিয়েছে, ব্লেডও নেই। আমার আবার বড় ঘামাচি হয় গরমে। বরিক পাউডারের সঙ্গে মামুলি কিছু মিশিয়ে নিই। তাও এত বেলা হত না। তেমাথায় গেলাম যখন তখন একবার পোস্ট অফিসটাও ঘুরে এলাম। ছোট পোস্ট অফিস। চিঠিপত্তর ..”
“ও! আপনাদের এখানে চিঠিপত্র বিলি করার লোক আসে না?”
“না। কে আসবে এতদূর! তবু যখন কারখানাটা ছিল একটা পিওন আসত সাইকেলে চেপে। আসত কারখানার জন্যে। মাসোহারা ছিল। তখন তবু তার টিকি দেখতাম এখানে। কারখানা পর্যন্ত আসত বলে আরও একটু এগিয়ে আমাদের কৃপা করে যেত। হালফিল আর আসে না। পুজোর সময় এক-আধদিন হয়তো আসে। বকশিশ তো নিতে হবে।”
“বসুন না! দাঁড়িয়ে কেন?”
“বড় ঘামছি।”
“আমার ঘরে যাবেন! পাখার তলায় বসবেন খানিক।”
“চলুন।” বলে পা বাড়িয়ে নকুলকে ডাকলেন। বার কয়েক।
নকুল কাজে ব্যস্ত ছিল। সময় লাগল আসতে।
দুটো পোস্টকার্ড আর একটা ইনল্যান্ড এগিয়ে দিলেন বলাইবাবু। বলে দিলেন কাকে কাকে দিতে হবে।
কিকিরা বললেন, “মাত্র তিনটে চিঠির জন্যে আপনি”।
“ভাল কথা বললেন আপনি! চিঠি–! আমাদের কে চিঠি দেবে! মাসান্তে কারও যদি একটা আসে! আসেও না। ন’মাসে ছ’মাসে বড়জোর একটা পোস্টকার্ড। আমরা আছি এই পর্যন্ত। দু-একটা চিঠি যা আসে, পড়ে থাকে পোস্ট অফিসে। কেউ যখন যায় ওদিকে, নিয়ে আসে হাতে হাতে।”
কিকিরারা ঘরে এলেন। পাখা চালিয়ে দিলেন তিনি। নিজের হাতে জল গড়িয়ে দিলেন বলাইবাবুকে।
বলাইবাবু জল খেলেন। তেষ্টা পেয়েছিল খুব। জল খেয়ে আরামের শব্দ করলেন।
“একটা বিড়ি দিন, খাই। আছে নাকি পকেটে?”
“আছে। নিন। … এই তো তিন বাণ্ডিল কিনে আনলাম।”
বিড়ি ধরানো হয়ে গেল দু’জনেরই।
কিকিরা দু-পাঁচটা সাধারণ কথার পর বললেন, “বলাইবাবু, আজ সন্ধেবেলায় দাবায় বসবেন নাকি? না হলে একবার আসতেন এখানে!”
“কেন? রোজ তো দাবায় বসি না। সময় কাটাবার জন্যে বসি মাঝে মাঝে। সলিলবাবু কাঁচা খেলোয়াড়। আমিও পাকা নই। রজনীবাবু দাবা বোঝেন না। এ ব্যাপারে মাস্টার ছিলেন মুরলীবাবু। তা তিনি তো আর নেই। … আপনি জানেন নাকি দাবা?”
মাথা নাড়লেন কিকিরা। “আমি একেবারেই অচল। গজ নৌকো কাকে বলে তাও জানি না।”
বলাইবাবু বিড়ির ধোঁয়া টানলেন। “সন্ধেবেলায় আসতে বলছেন কেন?”
“আমার একটু দরকার আছে। “
“দরকার! আমার সঙ্গে!”
“কথা আছে।”
“এখনই বলুন না!”
“এখন হবে না। সন্ধেবেলায়–! কেন, আপনি …”
“না না, আমার আর কী কাজ! আসব!”
কিকিরা বিড়ি টানতে টানতে বললেন, “কড়া নাকি?”
“মিঠেকড়া।”
হাসলেন কিকিরা।
.
সন্ধেবেলায় বলাইবাবু হাজির। কিকিরা বসতে বললেন। মৃণালকুঞ্জর ব্যবস্থা নিয়ে দু’-দশটা মামুলি কথা।
শেষে কিকিরা বললেন, “আপনার কাছে কয়েকটা কথা আমি জানতে চাই। হরিবাবুও আপনার কথা বলেছেন।” শেষের কথাটা বানানো।
বলাইবাবুর চোখে যেন চাপা হাসি। বললেন, “আপনি কী জানতে চান আমি জানি।”
কিকিরা অবাক! “জানেন?”
মাথা হেলিয়ে বলাইবাবু বললেন, “যাত্রা দেখার কথা! সেদিন আমি কেন পুরো পালা না দেখেই চলে এসেছিলাম?”
কিকিরা অবাক হলেন। বললেন, “আপনি আমায় আগে অন্য কথা বলেছেন। বলেছিলেন পালা শেষ হওয়ার পর আসরে বসে বাকি রাতটুকু কাটিয়ে আপনি এখানে ফিরেছেন।”
“তাই বলেছিলাম। … ওটা ঠিক কথা নয়। যাত্রা শুরু হতে দেরি হয়েছিল। আমি ঘণ্টা দুয়েক ছিলাম। তারপর ফিরে আসি। একলা
আসিনি। অত রাতে মাঠঘাট ভেঙে ঠাণ্ডায় কুয়াশায় একা আসা যায়! আমার সঙ্গে শিবপ্রসাদ ছিল। কারখানার দরোয়ান। তাকে আমি নিয়ে গিয়েছিলাম। ওকে সঙ্গে নিয়েই ফিরেছি।”
“ফিরেছেন মানে কারখানায় ফিরেছেন। দরোয়ানের ঘরের পাশের কুঠরিতে শুয়ে রাত কাটিয়েছেন।”
“হ্যাঁ। … দেখুন ম্যানেজারমশাই, আমি গর্দভ নই। দরোয়ান শিবপ্রসাদ আমার চেনাজানা। ওর গুমটি ঘরের পাশে চারপাইয়ায় বসে আমি কতদিন চা বিড়ি খেয়েছি, সুখদুঃখের গল্প করেছি। আপনাদের লোক যে শিবপ্রসাদের কাছে গিয়েছিল, খোঁজখবর করেছিল আমার, আমি জানি। শিবু আমায় বলেছে।”
কিকিরা রীতিমতন অপদস্থ বোধ করলেন। চাঁদুর কথা তা হলে সবই শুনেছেন বলাইবাবু। হেরে গিয়ে ঘাবড়ে যাওয়ার মানুষ অবশ্য নন তিনি। বললেন, “কথাটা আপনি শুনলেও ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়াচ্ছে বলাইবাবু। এই মৃণালকুঞ্জর সকলেই জানে, আপনি নিজেও বলেছেন যে, যাত্রা দেখে ফিরে এসে দেখলেন, শ্রীকান্তবাবু আগুনে পুড়ে ঝলসে গিয়েছেন। এখানের কাউকে কি বলেছেন আপনি, আসলে আপনি কোথায় ছিলেন মাঝরাতের পর থেকে? দরোয়ান শিবপ্রসাদ আপনার হয়ে সাক্ষী দিলেও এখানকার বাকিরা তো অন্য কথা বলবেন! তাই না?”
বলাইবাবু চুপ। টাক মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।
কিকিরা বললেন, “আপনার কি মনে হয় না, ওয়ান ভার্সেস ফাইভ হলে ব্যাপারটা কোন দিকে ঝুঁকে পড়বে? কেন আপনি সেদিন ছিলেন না তার না হয় কারণ দেখালেন! কিন্তু মিথ্যে কথাটা বলতে গেলেন কেন? আইন কী বলবে আপনি বুঝতে পারছেন!”
বলাইবাবু এবার যেন বিচলিত হলেন। বিড়িও ধরিয়ে নিলেন অভ্যাশবশে।
“আপনি কথা লুকোচ্ছেন! কেন?”
বলাইবাবু কী বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। বিড়ির টুকরোটা ফেলে দিলেন জানলা দিয়ে। শেষে বললেন, গলার স্বর একেবারে পালটে গিয়েছে। বললেন, “ম্যানেজারবাবু, মানুষ ভাবে এক, হয় আর-এক। আমি শ্রীকান্তবাবুকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম, পারলাম না।”
কিকিরা তাকিয়ে থাকলেন। অপলক।
“সেদিন আমি যদি ঘুমিয়ে না পড়তাম শিবপ্রসাদের ওখানে, তা হলে হয়তো ওই ঘটনা ঘটত না। ঘুমই আমার কাল হল! বুড়ো মানুষ, অতটা হাঁটাহাঁটি, ঠাণ্ডা–শরীরে অত ধকল সয়নি। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
“আপনি তা হলে জানতেন শ্রীকান্তবাবু..”
“আন্দাজ করেছিলাম। তবে ওঁর বিপদ হতে পারে জানতাম। আগুন ধরে যাবে জানতাম না।“
“কেমন করে জানলেন?”
“তবে আগের কথাটা বলি। শ্রীকান্তবাবু মানুষ খারাপ ছিলেন না। শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে খুঁতখুঁতুনি ছিল। তা সেটা থাকতে পারে। ওঁর যেটা বদ অভ্যেস ছিল–উনি ভীষণ সন্দিগ্ধ স্বভাবের ছিলেন। লুকিয়ে অন্যের কথা শুনতেন, অন্যের চিঠিপত্র এলে লুকিয়ে পড়তেন। মুখ বন্ধ খাম হলে দেখতেন সেটা খোলা যায় কিনা। না গেলে অবশ্য খুলতেন না। … তা একদিন একটা ব্যাপার হল। চৈতন্য গিয়েছিল বাজারে, সকালের দিকে তেমাথার মোড়ে। ফেরার সময় দুটো চিঠি নিয়ে এল। একটা মুরলীদার। অন্যটা জলধরবাবুর। জলধরের চিঠিটা ছিল খামে। তবে ভাল করে আঁটা ছিল না। আজকালকার খামের মুখে আঠার যা হাল! শ্রীকান্তবাবুর যা অভ্যেস, চিঠি খুলে পড়া। উনি সেই কাজটিই করলেন।”
কিকিরা বললেন, “কী ছিল চিঠিতে?”
“কী ছিল! যা ছিল তা তো বিশ্বাস করা যায় না। জলধরকে একজন শাসানো চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে লিখেছে, অনেক ঘুরে আট-আটটি বছর অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত সে খুঁজে পেয়েছে প্রতারক জোচ্চোর জলধরকে। “
“প্রতারক!”
“ওই চিঠিতেই ছিল–আগামী আটই নভেম্বর–সে আসবে। পুজোর কথা অবশ্য ছিল না। তবে জগদ্ধাত্রী পুজোর পরের দিনই আট তারিখ। ভোররাত্রেই সে আসবে। হিসেবনিকেশ শেষ করবে সেদিনই। তার আসার সংকেত হবে বাঁশি। সাপুড়ের বাঁশি।”
কিকিরা আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন। মনে মনে যেন ভাবছিলেন কিছু।
বলাইবাবু বললেন, “অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল, চিঠির একপাশে আঁকা একটা সাপের ছবি।”
“সাপের ছবি। ছাপা?”
“না; হাতে আঁকা। কালো কালিতে। কলমে।”
“চিঠি যে লিখেছে তার নাম?”
“নাম দেয়নি পুরো। শুধু ইংরিজিতে ছোট করে লেখা বি.এস।”
“চিঠিটায় সেন্ডারের ঠিকানা ছিল না?”
“না।”
“পোস্ট অফিসের ছাপ, সিল…”
“পড়া যায় না।”
কিকিরা কী যেন ভেবে বললেন, “তা এই চিঠির কথা আপনি জানলেন কেমন করে?”
“শ্রীকান্তবাবু আমাকে দেখিয়েছিলেন। তা ছাড়া চিঠিটা আমিই জলধরবাবুকে দিই।”
“খামের মুখ খোলা অবস্থায়?”
“একেবারে খোলা অবস্থায় নয়। একটু মুখ এঁটে।”
“চিঠির কথা আর কেউ জানেন না?”
“মুরলীবাবু আর শ্রীকান্তবাবু একই ঘরে থাকতেন। মুরলীবাবু জানলেও জানতে পারেন। শ্রীকান্তদা অন্য কাউকে বলেছিলেন কিনা বলতে পারব না।”
কিকিরা এবার নিজের সরু চুরুট ধরালেন। মাথার চুল ঘাঁটলেন। ভাবছিলেন।
বলাইবাবু বললেন, “একটা উড়ো চিঠি পেয়ে চট করে সব বিশ্বাস করা যায় না, ম্যানেজারবাবু! তা ছাড়া ওই চিঠিটা তো হেঁয়ালির মতন। স্পষ্ট করে লেখা নেই কিছু। প্রতারক বললেই কি প্রতারক হয়! কীসের প্রতারণা? কবে কখন করা হয়েছে? কাজেই আমরা চুপচাপ ছিলাম। তবে হ্যাঁ, শ্রীকান্তবাবুকে দেখতাম জলধরকে দেখলেই কেমন একটা মুখ করতেন।”
“আর আপনি?”
“আমি কিছু বুঝতে দিইনি জলধরবাবুকে। তবে সাবধানে থাকতাম। … আসলে কী জানেন, সেদিন–মানে জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন জলধর যখন বললেন, নিজেই, আমার সঙ্গে যাত্রা দেখতে যাবেন, তারপর যাওয়ার সময় হঠাৎ মত পালটে নিলেন, তখনই আমার মনে মনে কেমন যেন লাগল। ভেতরে একটা কু গাইল। মানুষের মন তো! … আমি পালার মাঝখানে উঠে এলাম। ভেবেছিলাম, শেষরাতে এখানে ফিরে আসব। যদি কিছু হয়! কিন্তু ঘুমই আমার সর্বনাশ করল। সময় মতন আসতে পারলে হয়তো অগ্নিকাণ্ড আটকাতে পারতাম। পারিনি। বড় কষ্ট হয় নিজের বোকামির জন্যে।”
.
১৪.
কৃষ্ণপক্ষ। তিথি বোধ হয় ত্রয়োদশী। ঘন অন্ধকার। আকাশের তারার আলোও এই নিবিড় অন্ধকারকে বিন্দুমাত্র হালকা করতে পারছে না। হয়তো মৃণালকুঞ্জের বড় বড় গাছগুলির মাথা থেকেও আঁধার ছড়িয়ে পড়েছে বলে চারপাশে কোনও কিছুই চোখে পড়ে না।
রাত শেষ হওয়ার মুখে। হেনা ঝোঁপের আড়াল থেকে যে বদ গন্ধটা ছড়ানো হয়েছিল সন্ধেবেলায়, সেটাও নেই। ফটকের সামনে ধুনুচি।
কিকিরা জানেন, একেবারে রাত ফুরোবার সময় অতি অস্পষ্ট একটু আলো ফুটতে পারে অল্পের জন্যে। সে কিছুই নয়। এখনও খানিকটা দেরি আছে তার। চৈত্রের এই শেষরাতে বাতাস দিচ্ছিল। এলোমেলো। তবু ঠাণ্ডা। গাছপালার পাতার শব্দ শোনাই যায় না।
মৃণালকুঞ্জের বাইরে মাঠঘাট অসাড়। যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
কিকিরা আর অপেক্ষা করলেন না।
প্রথমে ধরা যায় না, বোঝাও যায় না। সামান্য পরে বোঝা যায় এই শব্দবাঁশির। সাপুড়িয়ার বাঁশির সুর। জোর নয়, আবার ধীরেও নয়।
কিকিরাকেও চেনা যায় না। দেখাও অসম্ভব। ঘন কালো আলখাল্লায় গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা। পায়ের সরু পাজামাটাও কালো। মাথায় কালো রুমালের ফেট্টি। এ যেন কোনও ভৌতিক চেহারা। চোখমুখ অবশ্য স্বাভাবিক রেখেছিলেন কিকিরা।
মৃণালকুঞ্জের পেছনের দিকেই গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন কিকিরা। তাঁর বুকের কাছে ঝোলানো বিদেশি ক্যাসেট প্লেয়ারে সাপুড়িয়া বাঁশির রেকর্ড করা টেপটা বাজছিল। এই প্লেয়ারটার সুবিধে হল, দেখতে ছোট-আওয়াজ অত্যন্ত স্পষ্ট, শব্দ বাড়ানো কমানো তো মামুলি ব্যাপার, তার চেয়েও বড় কথা, টেপের অটোমেটিক রিওয়াইন্ডিং সিস্টেম আছে। ফলে হাতে করে পালটাতে হয় না। টেপ শেষ হয়ে নিজের থেকেই আবার গোড়া থেকে বাজতে শুরু করে। একটানা যতক্ষণ খুশি বাজাও। তবে অসুবিধে এই যে, কিকিরাকে ব্যাটারিতে বাজাতে হচ্ছিল। যদিও এই জাতের ব্যাটারি হালে বাজারে এসেছে, আয়ু বেশি–তবু তার ইতি আছে একসময়।
আপাতত কিকিরা সে-কথা ভাবছিলেন না। ভাববার কারণও ছিল না।
কিকিরা ঠিক এক জায়গায় না দাঁড়িয়ে থেকে মাঝে মাঝে আড়াল রেখে সরে যাচ্ছিলেন। ফলে বাঁশির আওয়াজও নির্দিষ্ট একই জায়গা থেকে আসছিল না। সরে যাচ্ছিল।
পাঁচ দশ পনেরো কুড়ি মিনিটকতটা সময় কেটে যাচ্ছে তার হিসেব কিকিরা করছিলেন না।
শুকতারা জ্বলজ্বল করছে। চৈত্রের এই ভোররাতের বাতাসে গা সিরসির করে উঠল সামান্য।
এমন সময়, যা আশা করেছিলেন কিকিরা, তার আভাস পেলেন।
দেখা যায় না। তবু ছায়ার মতন কে যেন বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। পেছনের দিকেই হেঁটে আসছিল।
কিকিরা জানেন, তারাপদ আর চন্দন–যে যার মতন জায়গায় লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একজন বারান্দার থামের আড়ালে, অন্যজন কুয়োতলার বাঁধানো পাড়ের আড়ালে।
বিপদ হতে পারে কিকিরার, নাও হতে পারে। ঝুঁকি নেওয়ার দরকার কী! তা ছাড়া সাহায্যের প্রয়োজন কখন কী হয়!
এবার একটু আলোর মতন দেখা দিল। মাত্র মুহূর্ত কয়েক। কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীর চাঁদের রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।
লোকটা, যা ভেবেছিলেন কিকিরা, পায়ে পায়ে সাবধানে দু’-দশ পা এগিয়ে টর্চ জ্বালল। ছোট টর্চ। বোধ হয় কাঁচের ওপর হাত চাপা দিয়ে রেখেছে–যাতে আলো না ছড়িয়ে পড়ে।
এপাশ ওপাশ দেখতে দেখতে লোকটা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কী ভাবল। ওর এক হাতে টর্চ থাকলেও অন্য হাত ফাঁকা নয়। তবে সেই হাতে কী আছে কিকিরা দেখতে বা অনুমান করতে পারছিলেন না।
ছোরা, ভোজালি, চপার? না কি অন্য কোনও অস্ত্র?
লোকটি এবার ধীরে ধীরে সাবধানে এগিয়ে তুলসীমঞ্চ পর্যন্ত গেল। দাঁড়াল। দেখল। বসল। নীচেটাও দেখল। এবার টর্চের কাঁচে হাত নেই।
কিকিরা টেপ বন্ধ করে দিলেন।
আর সঙ্গে সঙ্গে একবার টর্চের আলো ফেলে চারপাশ দেখে–লোকটি বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। টর্চ নিভিয়ে।
কিকিরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।
তাঁর কাজ হয়ে গিয়েছে।
তবু সামান্য অপেক্ষা করে বাড়ির দিকেই পা বাড়ালেন কিকিরা।
হালকা শিস।
তারাপদ আড়াল থেকে বেরিয়ে এল।
বারান্দায় চন্দন।
কিকিরা নিচু গলায় চন্দনকে বললেন, “কাল সকালেই তুমি হরিবাবুর কাছে চলে যাবে। বলবে, দেরি না করে গাড়ি নিয়ে চলে আসতে।”
.
১৫.
হরিচন্দনবাবু বললেন, “রায়, তুমি ওই তুলসীমঞ্চটা ভেঙে ফেলতে বলছ?”
“হ্যাঁ। একেবারে পুরোপুরি। মাটি পর্যন্ত খুঁড়ে ফেলতে হবে।”
মৃণালকুঞ্জর সকলেই হরিচন্দনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন।
হরিচন্দন সামান্য ইতস্তত করে বললেন, “এই চৈত্রমাসে তুলসীমঞ্চটা ভেঙে ফেলবে!”
“উপায় নেই, দাদা!”
জলধর হঠাৎ বললেন, “ওটা আমি বৃন্দাবন থেকে আনিয়েছি। পবিত্র বৃন্দাবন থেকে আনানো তুলসী চারাটাকে কষ্ট করে বাঁচিয়ে রেখেছি, ওটা আপনাদের কী দোষ করল?”
কিকিরা কোনও জবাব দিলেন না জলধরের কথার, হরিচন্দনকে এগিয়ে যেতে বললেন।
“বেশ। ওদের ডাকো।”
মালী চৈতন্য, কাজের লোক নকুল, এমন কী রাধুঠাকুরকেও ডেকে নিলেন কিকিরা। ড্রাইভার বনমালীকেও দেখা গেল।
ব্যাপারটা যে কী হচ্ছে, মৃণালকুঞ্জর বাসিন্দরা বুঝতে পারছিলেন না।
হরিচন্দনের পেছনে পেছনে সকলেই তুলসীমঞ্চর দিকে এগিয়ে গেলেন। রোদ চড়ছে। নকুল একটা ছাতা এনে দিল হরিবাবুকে। ততক্ষণে বনমালী ড্রাইভারও এসে দাঁড়িয়েছে। মালী চৈতন্য কোদাল আর শাবলও নিয়ে এল।
শুরু হল মঞ্চ ভাঙা।
রজনীবাবুরা হাত কয়েক তফাতে গাছের ছায়া খুঁজছিলেন। কথাও বলছিলেন নিজেদের মধ্যে নিচু গলায়।
কিকিরা চন্দনরা রোদের মধ্যেই দাঁড়িয়ে। জলধর একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। মঞ্চের ইটগুলো খসে পড়ছিল একটা একটা করে। ইট, প্লাস্টার।
.
মঞ্চ ভাঙা হল। ইট ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। মঞ্চের মাটি।
এবার মাটি।
কিন্তু এ কী?
মাটির তলায় একটা পাথরের স্ল্যাব।
কিকিরা চন্দনদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।
পাথরের মোটা স্ল্যাবটা ওঠাতে বললেন কিকিরা। শাবলের ডগায় মাটি আলগা করে নিল চৈতন্য মালী। তারপর ওরা দু’ তিনজনে মিলে পাথরটা তুলে নিল। ভারী পাথর।
তারপরই চমক। কিকিরা ঝুঁকে পড়ে দেখলেন।
চারকোনা গর্ত। হাত সোয়া হাত গভীর। গর্তের পাশগুলো লালচে রঙের গার্ডেন টাইন্স দিয়ে ঘেরা, যাতে পাশের মাটি বা জল ভেতরে না ঢুকতে পারে। গর্তের মধ্যে একটা কী যেন রাখা আছে। মোটা পলিথিনে মোড়া। পলিথিনের গায়ে রং ধরেছে মাটি আর লাল টালির।
কিকিরা তুলে নিতে বললেন জিনিসটা।
জলধর রুক্ষভাবে বললেন, “তুলবেন না। ওর মধ্যে আমার গুরুদেবের অস্থি রয়েছে। আপনারা অন্যায় কাজ করছেন।”
চৈতন্য মালী হাত নামিয়ে তুলব কি তুলব না করছিল।
হরিচন্দন হঠাৎ বললেন, “আপনার গুরুদেবের অস্থিই যদি রেখে থাকেন জলধরবাবু, ভাববেন না। আমি নিজে নতুন করে আরও সুন্দর করে আপনার তুলসীমঞ্চ তৈরি করিয়ে দেব। … নে রে চৈতন্য, তোল।”
জিনিসটা তোলা হল।
পলিথিনের মোড়কটা খুলে ফেলল চৈতন্য। অ্যালমুনিয়ামের চারকোনা পাত্র। মোটা চাদরের অ্যালমুনিয়াম। ওপরে ঢাকনা।
ততক্ষণে অন্যরাও ছায়া থেকে সরে সামনে এসে ঝুঁকে পড়েছে।
হরিচন্দন নিজেই বললেন, “ভেতরে চলো। এই রোদে আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। ভেতরে গিয়ে দেখব, কী আছে ওর মধ্যে।”
ভেতরে বারান্দায় পাখা নেই। দুটি মাত্র পাখা মৃণালকুঞ্জের। একটি খাওয়ার ঘরে, অন্যটি ম্যানেজারবাবুর ঘরে।
খাওয়ার ঘরেই এলেন সকলে। পাখা চালিয়ে দেওয়া হল। হাত চারেকের এক লম্বা টেবিল রয়েছে খাওয়ার ঘরে, আর ভাঙা আধ-ভাঙা কটা চেয়ার। একটা বেঞ্চি।
কিকিরা নিজের হাতে অ্যালমুনিয়াম পাত্রটির মুখের ঢাকা খুলতে গিয়েও পারলেন না। ভীষণ আঁট।
চন্দন এগিয়ে এসে পাত্রটির ঢাকনা খুলল।
পাত্রের মধ্যে চামড়ার বাক্স। চৌকোনো।
সেটাও খুলে ফেলা হল।
তারপর সকলেই যেন একসঙ্গে চমকে উঠে কেমন এক শব্দ করলেন।
হরিচন্দনবাবুর গলা যেন আটকে গেল বিস্ময়ে। কিকিরাও ভাবতে পারেননি। অন্যরাও নিশ্চল।
সাপ। তবে সোনার। একটা সোনার সাপ পাকানো লেজের ওপর ভর দিয়ে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। চওড়া ফণা। ফণার কারুকার্যের চেয়েও চোখে পড়ে তার দুটি চোখ। লাল টুকটুকে দুটি চুনি বসানো চোখে। সাপের মাথার ওপর এক সোনার প্রদীপ। চতুর্মুখী। পঞ্চমুখী নয়। প্রদীপের মুখে একটি করে হীরের টুকরো।
এমন একটি অত্যাশ্চর্য জিনিস দেখা যাবে কে ভেবেছিল!
সকলেই প্রথমে চুপ। তারপর দু-একটি অস্ফুট শব্দ।
হরিচন্দনবাবু ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন জলধরকে। নিজেকে সংযত রাখা মুশকিল। তবু বললেন, “এই আপনার গুরুদেবের অস্থি?”
জলধর কথা বললেন না। তাঁর মুখের চেহারা অদ্ভুতভাবে বিকৃত হয়ে গিয়েছে।
কিকিরা বললেন, “এটি উনি কোথাও থেকে চুরি করেছিলেন। এমন জিনিসের দাম কয়েক লাখ টাকা তো হবেই, তা ছাড়া এর অ্যান্টিক ভ্যালু? কবেকার জিনিস, কোথায় ছিল–আমরা তো বলতে পারব না, এ-ব্যাপারে যাঁরা অন্তত আন্দাজ দিতে পারেন–তাঁদের কাছে নিয়ে যেতে হবে। … জলধরবাবু, জিনিসটি আপনি পেলেন কোথায়, কবে? সত্যি কথাই বলুন। আপনার চিঠির কথা আমরা জানি। বলাইবাবু রয়েছেন এখানে।”
জলধর কাউকেই দেখলেন না। বললেন, “আন্দামানে। ভবানীশঙ্কর বলে একজনের সঙ্গে আমার ভাব ছিল। সে চুরি করেছিল। ওটা কোথাকার, আমি জানি না। ওর ইতিহাস বলতে পারব না। তবে এইটুকু জানি, ওটা সুমাত্রা বা জাভা থেকে পাওয়া। বিদেশি টুরিস্টের একটা ছোট দল একবার আন্দামানে আসে। তার মধ্যে এক সাহেব, হয়তো কোটিপতি, আবার কিওরো, ওটি এনেছিলেন। ভবানীশঙ্কর পোর্টে চাকরি করত। সে চুরি করে আমায় রাখতে দিয়েছিল।”
“মানে, পরে কোনও সময়ে ওটা বেচে দিতে পারলে টাকাটা দুজনে ভাগাভাগি করে নেবেন। তাই না?” কিকিরা বললেন।
জলধর সে-কথার জবাব দিলেন না। বললেন, “ভবানীশঙ্কর একবার অসুস্থ হয়ে পড়ল। ভাল রকম। বেঘোর জ্বর। আমি আন্দামান থেকে পালিয়ে এলাম।”
“সোনার সাপ চুরি করে?”
“হ্যাঁ। আমার মনে হয়েছিল, মেনিনজাইটিস রোগের মতন যে ব্যাধি হয়েছে। ভবানীশঙ্করের, তাতে হয়তো সে বাঁচবে না।”
“বাঃ! আপনি তবে ভাল বন্ধু।”
“বন্ধুত্বের কথা বাদ দিন। কে কার বন্ধু! ধরে নিন, আমি লোভে পড়ে এই কাজ করেছি। তারপরও নিশ্চিন্ত ছিলাম না কলকাতায় এসে। গা-ঢাকা দিয়ে থেকেছি অনেকদিন। শেষে আমি আর ভবানীশঙ্করের কোনও খোঁজ পাইনি।”
হরিচন্দনবাবু বললেন, “আপনি মশাই চাকরিবাকরিও তো করতেন। ঘরসংসারও করেছেন শুনেছি।”
“কোনওটাই মিথ্যে নয়। মিথ্যে বলতে আমার টাইটেলটা পালটে নিয়েছিলাম। এফিডেভিট করে। বিশ্বাসের জায়গায় হালদার।”
কিকিরা বললেন, “এসব কথা পরে। আগে বলুন, আপনি শ্রীকান্তবাবুকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন?”
“চেয়েছিলাম। ভদ্রলোক আমাকে সন্দেহ করতেন। খারাপভাবে দেখতেন। তিনি যে আমার চিঠিটা খুলে পড়েছেন তাও স্পষ্ট বুঝেছিলাম আমি। এটা ওঁর বদ অভ্যেস ছিল। উনি নিজের হাতে সেজে পান খেতেন। ছোট ছোট পান। জিভ লাল হয়ে থাকত। চিঠি পড়ে খামের মুখ আঁটার সময় জিভের লালা লাগিয়ে ছিলেন। তার দাগ ছিল।”
কিকিরা বলাইবাবুর দিকে তাকালেন। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলাইবাবু বললেন, “হ্যাঁ, পান খেতেন; বলতেন অজীর্ণ অম্বলের জন্যে পান খান।”
হরিচন্দনবাবু বললেন, “আপনি ওঁর ঘরে ঢুকে গায়ে আগুন ধরিয়ে দিলেন?”
“শ্রীকান্তবাবু ত্রিফলা খাওয়ার পর কেরোসিন স্টোভ জ্বেলে চায়ের লিকার তৈরি করে খেতেন। সকলেই জানে। সেদিনও তাই করছিলেন। কেরোসিন স্টোভ জ্বললে ঘরে গন্ধ হয়–ধোঁয়াও হয় খানিকটা। কার্তিক মাস। ওঁদের ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল না। সামান্য ফাঁক করা ছিল। উনি স্টোভের সামনে বসে জল গরম করছিলেন। আগুন তো জ্বলছিল। আমি নিঃসাড়ে ঢুকে ওঁর ঘাড় গলা স্টোভের ওপর …” জলধর বাকিটা বললেন না। বলার দরকার করে না, অনুমান করা যায়।
সকলেই নিঃশব্দ। শিউরে উঠেছিলেন সকলেই। বুকের মধ্যে কাঁপছিলেন।
কিকিরা বললেন, “মুরলীবাবু?”
“উনি বোধ হয় এক ঝলক দেখতে পেয়ে গিয়েছিলেন আমাকে। শ্রীকান্তবাবু চিৎকার করে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ওঁর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আমি অবশ্য মুড়ি দিয়ে ঘরে ঢুকেছিলাম। তবু–তবু ঘুমজড়ানো চোখে আমাকে দেখে থাকতেও পারেন মুরলীবাবু …। কারণ পরে উনি আমাকে কেমন চোখে যেন দেখতেন। দেখে থাকলে উনিই একমাত্র সাক্ষী।”
“কিন্তু ওঁকে আপনি”।
“উপায় ছিল না। মুরলীবাবুকে আমিই ধোঁকা দিয়ে দোতলায় ডেকে এনেছিলাম ঘুম ভাঙিয়ে। বলেছিলাম, ‘শিগগির আসুন বলাইবাবু কেমন যেন করছেন। উনি গায়ে চাদর জড়িয়ে চলে এলেন।”
“কেন?”
“ওঁকে ডেকে আনার সময় বাঁশিটা বাজছিল। সাপুড়ের বাঁশি। ওই বাঁশি হয়তো উনিও শুনেছিলেন।” একটু থামলেন জলধর। “নিয়তি।”
“আপনি ওঁকে দোতলার বারান্দা থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন?”
“দিয়েছিলাম। ভাঙা বারান্দা। পলকা। ফেলে দেওয়ার আগে মাথার পেছনে জখমও করেছিলাম।”
নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সকলে। রজনীবাবু বসে পড়েছেন। ঘামছিলেন। পাখার বাতাস তাঁর গায়ে লাগছে না। সলিলবাবুর মুখ ফ্যাকাশে।
হরিচন্দনবাবুও অসুস্থ বোধ করছিলেন।
সকলেই যখন স্তব্ধ, বিচলিত, শ্বাস প্রায় রুদ্ধ হয়ে এসেছে, তখন জলধর একবার দরজার দিকে তাকালেন। চন্দন দাঁড়িয়ে আছে। পাশে তারাপদ।
সোনার সাপটির দিকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন জলধর। মনে হল, তিনি যেন বুঝতে পেরেছেন, সোনার সাপও ছোবল দেয়। বড় করে নিশ্বাস ফেলে জলধর বললেন, “পুলিশ ডাকবেন না?”
কিকিরা বললেন, “ডাকব।” বলে হরিচন্দনের দিকে তাকালেন।
জলধর বললেন, “একটা কথা। দয়া করে আমার ছেলেকে জানাবেন না। আমার নিজেরও ভুল হয়েছে। কলকাতায় থাকার সময় ওটা ব্যাঙ্কের লকারে ছিল। এখানে আসার পর সাতপাঁচ ভেবে নিজের চোখে চোখে রাখব বলে নিয়ে এসেছিলাম। না আনলে কী হত জানি না!”
কেউ কোনও কথা বললেন না।