নীল বানরের হাড়

নীল বানরের হাড়

০১.

মুখোমুখি দেখা।

“আরে, রায়বাবু যে!”

কিকিরা হাসলেন। পরিচিতজনকে দেখলে কিকিরা ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে অন্যজনের হাত ধরে ফেলেন। এটা তাঁর অভ্যেস। বরাবরের। “নন্দবাবু! অনেকদিন পরে দেখা। কেমন আছেন?” নবাবুর হাত আলগাভাবে চেপে ধরে কিকিরা বললেন।

“টিকে আছি। আপনি কেমন আছেন? সেই কবে কানাই দত্তর মেয়ের বিয়েতে আপনাকে দেখেছিলাম। বছর চার-পাঁচ হয়ে গেল। তারপর আর দেখাসাক্ষাৎ নেই। এদিকে আসেন না?”

কিকিরা হালকা গলায় বললেন, “কমই আসা হয়। এক-আধবার ভেবেছি আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই। হয়ে ওঠেনি।”

“আজ তা হলে ছাড়ছি না। আসুন। দোকানে বসে একটু চা খাবেন; গল্পগুজব হবে।”

সামান্য তফাতেই নন্দবাবুর দোকান। এখান থেকেই সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে : ‘দাশ অ্যান্ড কোং’। তলায় ছোট হরফে লেখা, ডিলার্স ইন ওল্ড ফার্নিচারস। তার তলায়, ইএসটিডি; নাইনটিন টুয়েন্টি এইট। মানে, উনিশশো আঠাশ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল দোকানটির।

কিকিরা নন্দবাবুর দোকান সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানেন। এককালে চেনাজানা, বন্ধুত্ব ছিল। দোকানে বসে আড্ডাও মেরেছেন। দোকান দিয়েছিলেন নন্দবাবুর বাবা। ভদ্রলোক সেকালের বিখ্যাত এক সাহেব-কোম্পানির আসবাবপত্রের দোকানে কাজ করতেন, হরেকরকম নকশা বুঝতেন, কাজ জানতেন, কাঠ চিনতেন। সেই কোম্পানি অন্য হাতে চলে যাওয়ার পর নন্দবাবুর বাবা নিজেই দাশ কোম্পানির দোকান খোলেন। অবশ্য, সাবেকি আসবাবপত্র কেনা, নিলাম থেকে তুলে আনা, ছোটখাটো মেরামতির কাজ, নতুন করে রং পালিশ–এর বাইরে অন্য কিছুতে হাত দেননি। পুরনো আসবাবপত্র নিয়েই ছিল তাঁর ব্যবসা। ভালই চলত। তখনকার দিনে সাবেকি আর সাহেববাড়ির টেবিল চেয়ার আলমারি দেরাজ সাজ আয়নার ওপর মানুষের ঝোঁক ছিল। পছন্দও করত। শখের জিনিস সস্তাও পড়ত তুলনায়।

নন্দবাবুর বাবা মারা যান প্রৌঢ় বয়েসেই। বাবা বেঁচে থাকতেই উনি দোকানে গিয়ে বসতেন। বছর পঁচিশ বয়েস থেকে মোটামুটি দশ-বারো বছর বাবার সঙ্গে দোকানে কাটানোর পর নন্দবাবু একা হয়ে গেলেন। তখন তাঁর বয়েস পঞ্চাশের এপারে। পঞ্চান্নর মতন।

দোকানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে কিকিরা নন্দবাবুকে বললেন, “দোকান ছেড়ে এই শেষ দুপুরে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন, মশাই?”

নন্দবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। “থানায়।”

“থানায়?” কিকিরা অবাক।

নন্দবাবু বললেন, “রাগের মাথায় থানা পর্যন্ত গেলাম। থানার একজনকে চিনি। ধীরেন মজুমদার। … তা থানার সামনে গিয়েও কেমন মনে হল, ঝট করে একটা কিছু করে ফেলা কি ভাল হবে! থানা-পুলিশের ঝাটও অনেক। পরে ঠেলা সামলাতে প্রাণ বেরিয়ে যাবে হয়তো।”

কিকিরা কিছুই বুঝলেন না। নন্দবাবুকে দেখছিলেন।

নন্দবাবুর পুরো নাম, নন্দদুলাল দাশ। বছর পঞ্চান্ন বয়েস হলেও বয়েসের তুলনায় আরও সামান্য বেশি মনে হয়। সেটা তাঁর চেহারার জন্যে। মাঝারি মাপের গড়ন হলেও মাথায় প্রায় চুল নেই। যা আছে তারও অর্ধেক সাদা। চৌকোনো মুখ। গালের হাড় স্পষ্ট। তামাটে রং গায়ের চোখে আপাতত খানিকটা বিরক্তি। নন্দবাবুকে রুক্ষ না হোক শুকনো দেখাচ্ছিল। গায়ে শার্ট। পরনে ধুতি। উনি বেশিরভাগ সময়ে সাদা শার্টই পরেন। পরনের ধুতি মিলের।

দোকানের সিঁড়িতে পা দিয়ে নন্দবাবু বললেন, “আসুন।”

 কিকিরা মাথা নাড়লেন, “চলুন।”

ফুটপাথ-ঘেঁষে দোকান। বিশাল নয়, আবার ছোটও নয়। এই দোকানের কোনও বাহার নেই। লম্বাটে দোকান-ঘর। চারপাশে পুরনো আসবাবপত্র। টেবিল, দেরাজ, ড্রেসিংটেবিল, আর্মচেয়ার, কাঠের দোলনা-ঘোড়া, আলমারি, খাট, বুককেস–এইসব। অনেক জিনিস আলগা করে খুলে রাখা, যেমন খাটের মাথা আর পায়ের দিক, পাশের লম্বা কাঠ, ড্রেসিং টেবিলের আয়না, টেবিলের মাথা বা টপ। খুলে না রাখলে জায়গা হওয়ার উপায় নেই। প্রায় গুদোম মতন এই দোকানেরই একপাশে বসে জনা দুই কারিগর কাজ করছে। ছোটোখাটো সারাই, পালিশের কাজ। কম বয়েসের একটা ছোকরা ফরমাশ খাটছিল। দোকানের মধ্যে রং পালিশ টারপিন তেলের গন্ধ। ঠাসাঠাসি কাঠকুটোর চাপা গন্ধ তো আছেই।

ওরই মধ্যে দোকানের সামনের দিকে নন্দবাবুর বসার চেয়ার টেবিল। টেবিলে বিশেষ কিছু নেই। খাতাপত্র দু-চারটে, স্কেল, মেজারমেন্ট টেপ, একটা ডেস্ক ক্যালেন্ডার, টেলিফোন, পেপারওয়েট। মাথার ওপর দেয়াল কুলুঙ্গিতে তামার গণেশ, লক্ষ্মীর পটও ঝুলছে একপাশে। শুকনো ফুল, ধূপের কাঠি–সবই নজরে পড়ে।

নন্দবাবু বললেন, “বসুন রায়বাবু। পাখাটা চালিয়ে দিই।” বলে টেবিলের মাথার ওপর ঝুলন্ত পাখাটা চালিয়ে দিলেন। “বেশ গরম পড়ে গেল কী বলুন।”

নন্দবাবুর টেবিলের উলটো দিকে দুটিমাত্র কাঠের চেয়ার। কিকিরা চেয়ার টেনে বসলেন। বললেন, “ফাল্গুন মাস শেষ হয়ে গেল; গরম তো পড়বেই।”

“চা আনতে বলি। তার আগে একটু ঠাণ্ডা কিছু খাবেন?”

“না না। চা হলেই চলবে!”

“শুধু চা! কতদিন পরে দোকানে এলেন, একটু কিছু তো মুখে দেবেন। দুটো সন্দেশ অন্তত।” বলে নন্দবাবু আর অপেক্ষা করলেন না জবাবের, ছোকরা গোছের লোকটিকে ডাকলেন। “গণেশ, ভাল করে দু’কাপ চা, স্পেশ্যাল; আর এঁর জন্যে শ্যামের দোকান থেকে ভাল সন্দেশ আনবে। টাকা নিয়ে যাও।”

গণেশ চলে গেল।

কিকিরা দোকানের চারপাশে তাকাতে তাকাতে বললেন, “কেমন চলছে। ব্যবসাপত্র নন্দবাবু?” মুখে বললেন, কিন্তু মনে মনে তাঁর ধারণা হল, আগে যতটা সাফসুফ তকতকে দেখেছেন দোকানটা এখন আর ততটা নয়। এককালের মোটামুটি চলতি দোকান পড়তির অবস্থা হলে যেমন দেখায়–সেইরকমই দেখাচ্ছে।

নন্দবাবু বললেন, “ওই যে বললাম, টিকে আছি, তাই। কোনওভাবে বেঁচে আছি। সেসব আগের দিনের কাস্টমার কোথায়! কে আর পুরনো জিনিসের কদর বুঝবে! চোখেও দেখেনি, ভালমন্দ বোঝার ক্ষমতাও নেই। কাঠ তো চেনেই না, খানদানি জিনিসের মর্যাদাও বোঝে না। আজকাল যতসব ফিনফিনে ওপর চকমকির দিন।” গলায় ক্ষোভ ও হতাশা লুকোবার চেষ্টা করলেন না নন্দবাবু। একটু থেমে আবার বললেন, “ফার্নিচারের দোকান তো কম নেই কলকাতায়। শয়ে শয়ে। সবই মডার্ন। মানে, সস্তায় কিস্তিমাত করে খদ্দেরের গলা কাটা। আমার মশাই, ওদিকে হাতেখড়ি হল না। বাবা যেখানে বসিয়ে গেলেন সেখানেই থেকে গেলাম।” বলতে বলতে নন্দবাবু পকেট থেকে সস্তা সিগারেটের প্যাকেট আর মামুলি লাইটার বার করে এগিয়ে দিলেন কিকিরাকে।

কিকিরা সিগারেট নিলেন। ধরালেন। অন্যমনস্ক ভাবে রাস্তার দিকে তাকালেন। ফুটপাথের এপাশে ছায়া পড়েছে। ওপারে এখনও ফাল্গুন শেষের রোদ। তেজ হয়তো সামান্য কমে এসেছে। বিকেল প্রায় চারটে। গরম পড়ে আসছে। হাওয়ায় দক্ষিণের ছোঁয়া আছে সামান্য। এলোমেলো। এপার থেকে ওপারে তাকালে– অন্যদিকের ফুটপাথ-ঘেঁষা দোকানগুলো দেখা যায় : একটা দোকান জুয়েলারির, পাশে চশমার দোকান, তার গায়ে গায়ে হোসিয়ারি স্টোর্স, একচিলতে পান সিগারেটের খুপরি। কোল্ড ড্রিংকসও সাজানো আছে। দুই ফুটপাথের মাঝখানে ট্রামলাইন।

কলকাতা শহরের উত্তর-ঘেঁষে এই দোকানটাকে যেন একটেরে দেখায়। অবশ্য কিকিরা জানেন, নন্দবাবুদের পৈতৃক বাড়ি এই পাড়াতেই। ওঁর বাবা যখন দোকান করেন, নিজের সুবিধে অসুবিধে বুঝেই করেছিলেন; আর তখন–বছর সত্তর আগে–এসব অঞ্চল ছিল অন্যরকম। ভিড়ভাড়াক্কা নেই। অনেক নিরিবিলি।

নন্দবাবু কী যেন বললেন।

অন্যমনস্ক থাকায় কিকিরা খেয়াল করেননি। তাঁর চোখ ছিল ফুটপাথের অন্যদিকে একটা আধমরা হেলেপড়া গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ছিল, শুকনো পাতা। ট্রাম চলে যাচ্ছিল।

“কিছু বললেন?” কিকিরা বললেন।

 “আপনি এখন আছেন কোথায়?”

 কিকিরা নিজের আস্তানা জানালেন। হেসে বললেন, “এবার ভাবছি ঠিকানা পালটাব। ওখানে ক’বছর কেটে গেল। বদল দরকার।”

নন্দবাবু হেসে বললেন, “আপনি তো বরাবরই ঠাঁই পালটান। তা এখন করছেন কী? আগেই তো ম্যাজিক ছেড়েছিলেন!”

“বেকারই বসে আছি বলতে পারেন। হাতে টুকটাক কাজ পেলে করি। আমারও চলে যাচ্ছে কোনওরকমে, আপনার চেয়ে খারাপ ছাড়া ভাল নয়।”

নন্দবাবুও সিগারেট ধরিয়েছিলেন। একমুখ ধোঁয়া গিলে বললেন, “এই দোকান আমি যে ক’দিন আছি, তারপর উঠে যাবে। আমার ছেলের মতিগতি আলাদা। সে-বেটা চাকরি-বাকরির দিকে ঝুঁকছে। পরীক্ষা দেয়, আর হাঁ করে বসে থাকে কবে গাছের ফল তার মুখে এসে পড়বে-এই আশায়। এমনিতে নিরীহ গোবেচারি গোছের। ব্যবসা তার লাইন নয়। পারবেও না।”

“যা পারে সেটা করাই ভাল। … তা আপনি হঠাৎ থানায় যাচ্ছিলেন কেন–তা তো বললেন না!”

গণেশ মিষ্টি নিয়ে এল। এনে একটা কাঁচের প্লেট ধুয়েমুছে সন্দেশ আর জল এনে টেবিলের সামনে রাখল।

কিকিরা বললেন, “আপনি?”

“না না, আমার টিফিন হয়ে গিয়েছে। মিষ্টি আমার বারণ। ব্লাড সুগার ধরব ধরব করছে। মার্জিন লাইন। সামলে থাকতে হয়। বাড়ি থেকে টিফিন আনি, ময়দার দুটো রুটি, সবজি, শশার কুচি। নিন আপনি।” বলে কয়েক মুহূর্ত থামলেন; তারপর বললেন, “দোকান সামলাতে এমনিতেই মেজাজ ভাল থাকে না, তার ওপর একটা ছোকরা-জানি না চিনি না–আমার দোকানে ঢুকে হম্বিতম্বি করে গেল। কী চোটপাট রাস্কেলের।”

কিকিরা অবাক হয়ে বললেন, “সে কী! হঠাৎ দোকানে ঢুকে–?”

“জানি না মশাই,” নন্দবাবু বিরক্তির সঙ্গে বললেন; রেগে উঠছিলেন ভদ্রলোক। “আমি করি ব্যবসা; চুরিও নয়, ডাকাতিও নয়। কোন সেকেলে বনেদি বাড়ির অবস্থা একেবারে পড়ে গিয়েছে, শরিকি ঝগড়ায় ভাগ বাঁটোয়ারায় ছিটকে ছটকে টুকরো-টুকরো; কে কোথায় তার দু’তিন পুরুষের আগলানো জিনিসপত্র বেচে দিচ্ছে একটা একটা করে–এসব খোঁজপত্তর আমায় রাখতে হয়। আমার অবশ্য ফার্নিচারের ব্যাপার; খাট আলমারি দেরাজ ড্রেসিংটেবিল–এসব নিয়ে কারবার। তেমন কিছু পেলে কিনে নিই। দু’-তিনটে কোম্পানি আছে, হপ্তায় হপ্তায় নিলাম ডাকে, তার বেশিরভাগই সাহেববাড়ির ফার্নিচার। তাও কেনার চেষ্টা করি। তারপর দোকানে এনে মেরামত রং পালিশ করে এখান থেকে বেচবার চেষ্টা করি। এই তো আমার ব্যবসা …”।

কিকিরা জানেন সবই। একটুকরো সন্দেশ মুখে দিয়ে বললেন, “ছোকরা এসেছিল কেন?”

“কেন এসেছিল! এসেছিল তার ছোটদাদুর বাড়ি থেকে আমি যে আলমারিটা কিনে এনেছি সেটা ফেরত নিতে।”

“কেন? আপনি তো কিনে এনেছিলেন।”

“আলবাত। নগদ আড়াই হাজার টাকা দিয়ে রসিদ লিখিয়ে কিনে এনেছি।”

“কবে?”

“এই তো হালে। দিন আষ্টেক আগে।”

“ছোকরা জানে না?”

“বলছে তো আগে জানত না। সবে জেনেছে।”

“তার মানে? আগে জানত না, এখন জেনেছে-ব্যাপারটা কী?”

“বলল, সে তখন বাড়িতে–মানে কলকাতায় ছিল না। থাকলে আলমারি বেচতে দিত না দাদুকে।”

“কোথায় ছিল?”

“দিঘা।”

“বেড়াতে গিয়েছিল বুঝি!”

“কে জানে!” তিরিক্ষে মেজাজে নন্দবাবু বললেন। “বারফট্টাই অনেক। বলল, দিঘায় একটা হোটেলের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, কলকাতায় থাকতে পারছে না। ও যদি বাড়িতে থাকত আমি নাকি ধাপ্পা মেরে ভুলিয়ে ভালিয়ে বুড়োমানুষের কাছ থেকে ওই আলমারি কিনতে পারতাম না।”

চায়ের দোকান থেকে চা দিয়ে গেল। ধোয়ামোছা পরিষ্কার কাপ, প্লেটও দিয়েছে। বোঝাই যায়, নন্দবাবুর কথামতন স্পেশ্যাল করে বানানো। ওঁর চা আলাদা করে সামনে রাখল। মানে ভদ্রলোকের বোধ হয় চিনির বরাদ্দ নেই, বা নামমাত্র।

কিকিরা চায়ের কাপ টেনে নিলেন। তাঁর নাক গলাবার কথা নয়, তবু কেমন কৌতূহল বোধ করছিলেন। চুরিচামারি ঠগজোচ্চুরি নয়, দাম মিটিয়ে একটা জিনিস কিনে এনেছেন নন্দবাবু, তা হলে দোকানে এসে অন্যায়ভাবে তাঁকে শাসানোর মানে কী? কেন শাসাবে?

“ছোকরা ঠিক কী বলল আপনাকে?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।

“বলল, সাতদিনের মধ্যে আলমারি ফেরত দিয়ে আসতে। নয়তো এই দোকান ছাই হয়ে যাবে!”

“বাঃ, মগের মুলুক নাকি!”

“মশাই, আমিও তো তাই বললাম। রাস্কেল কী বলল জানেন, বলল, হ্যাঁ মগের মুলুকই। দোকানই শুধু জ্বালিয়ে দেব না, আপনার অন্য ক্ষতিও হতে পারে।”

“তার মানে মারধোর–?”

“হবে।” বলে ভেতরদিকটা দেখালেন, “ওই তো আমার কর্মচারীরাও ছোকরার হল্লা শুনেছে।”

কিকিরা বুঝতে পারলেন, ব্যাপারটা একেবারে তুচ্ছ হলে নন্দবাবু রাগের মাথায় থানার দিকে পা বাড়াতে যেতেন না। রাগই হোক, অথবা ভয়, কিংবা উত্তেজনা তাঁকে বিচলিত করেছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তিনি থানায় যাননি।

চায়ের কাপে বার দুই চুমুক দিলেন কিকিরা। ট্রাম রাস্তার দিকে দেখলেন কয়েক মুহূর্ত। পরে মুখ ফিরিয়ে নন্দবাবুর দিকে তাকালেন। “আর আপনার টাকা, আড়াই হাজার?”

“ফেরত দিয়ে দেবে।”

“আচ্ছা! … আলমারিটা আপনি কাদের বাড়ি থেকে কিনেছিলেন?”

“হাতিবাগানের বিশ্বাসবাড়ি থেকে। বনেদি বাড়ি। দু’-পুরুষ হেসেখেলে কাটিয়েছে। ইংরেজ আমলে বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল খুব। পাঁচরকম কারবারে কামিয়েছিল অনেক। যাতেই হাত দেয় তাতেই সোনা উঠে আসে। তিনপুরুষে এসে ভাঙন। শরিকি ঝগড়া, কোর্টকাছারি, ঘরবাড়ি ভাগাভাগি, দেখতে দেখতে ওই বাড়ির এমন দৈন্যদশা হল যে, আর চেনা যায় না।”

কিকিরা অনুমান করতে পারছিলেন, এমন বাড়ি তিনিও দু’-দশটা দেখেছেন বইকি এই কলকাতা শহরে। ভাঙাচোরা, পলেস্তরা-খসা, চুনবালি ঝরে পড়া, বিবর্ণ, আধো অন্ধকার বাড়ি। ধুলোয় ময়লায় ভরা। দরজা জানলা হয় হেলে পড়ছে, না হয় তার আর অস্তিত্ব নেই। কেউ যদি মনে করে এগুলো ইটকাঠের ভগ্নস্তূপ, তবে তাকে তেমন দোষ দেওয়া যায় না।

চা খেতে খেতে কিকিরা বললেন, “আলমারিটার খবর পেলেন কেমন করে?”

“খবর! খবর আমাদের রাখতে হয়। কানে আসে। সব ব্যবসারই নিজের একটা ধরন থাকে রায়বাবু, বিজনেস করব ওল্ড ফার্নিচারের আর খোঁজখবর রাখব না কোথায় কী বেচাকেনা চলছে, কোথায় কী পাব–তাই কি হয়!”

মাথা হেলালেন কিকিরা, ঠিক কথা। বললেন, “বিশ্বাসবাড়ির কোন তরফ মানে শরিকের বাড়ি থেকে পেলেন ওটা?”

“ছোট। সুবর্ণকান্তি বিশ্বাস।”

“সুবর্ণকান্তি! নামটি তো বেশ,” কিকিরা হাসলেন।

“ওদের সবই কান্তি …, সজলকান্তি শুভ্রকান্তি সুবর্ণকান্তি … নামের সঙ্গে কান্তি টা যোগ করে নেয়। ট্রাডিশান।”

“বয়েস কত ভদ্রলোকের?”

“মোটামুটি সত্তর। সোনা না হোক এখনও যা রং গায়ের–পাকা আমের মতন। একসময় যে খুবই সুপুরুষ ছিলেন, বোঝা যায়।”

“তা এখন বোধ হয় কিছু করেন না। চলে কেমন করে?”

“এই বয়েসে আর কী করবেন! আগে একটা দোকান ছিল যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনুয়েতে। গ্রামোফোন রেকর্ড রেডিও বিক্রি হত। সাজানো গোছানো দোকান। বিক্রিবাটা মন্দ ছিল না। তবে সে দোকান কবেই উঠে গিয়েছে। পড়তি অবস্থায় মানুষের যেমন করে চলছে- সেইভাবেই চলছে, কুড়িয়ে বাড়িয়ে, এটা ওটা বেচে দিয়ে। উনি আর বাইরে বড় একটা যান না। আর্থারাইটিসে একেবারে কাবু। তার ওপর চোখ নিয়ে ভুগতে ভুগতে এখন প্রায় অন্ধ হয়ে পড়েছেন। মেয়েই ভরসা।”

চা শেষ করলেন কিকিরা? “যে ছোকরা আপনার দোকানে এসেছিল সে কেমন নাতি? মানে ছেলের তরফে, না, মেয়ের …”

“ওঁর ছেলে নেই। দুটি মেয়ে শুনেছি। .. এটি কোন মেয়ের ছেলে আমি জিজ্ঞেস করিনি। কথায়বার্তায় মনে হল, বড় মেয়ের ছেলে। মেয়ে বাবার কাছেই থাকে। বিধবা।”

কিকিরা মনে মনে যেন ব্যাপারটা গুছিয়ে নিলেন। “তা হলে ছোটদাদু কেন? শুধু দাদু বললেই তো হত।”

“ও ওদের ব্যাপার। বড়দাদু এখনও বেঁচে, সেজো মারা গিয়েছেন। হয়তো ছোট বলে, ছোটদাদু বলে।”

কিকিরা দোকানের ভেতরটা দেখলেন একবার। কর্মচারীরা কাজ করছিল। কথাও বলছিল নিজেদের মধ্যে।

“নন্দবাবু, আড়াই হাজার টাকা দিয়ে আপনি যে আলমারিটা কিনেছেন, সেটা আপনি মোটামুটি কী দামে বেচতে পারবেন বলে মনে করেন?”

নন্দবাবু একটু ভাবলেন। বললেন, “মেরামতির কাজ আছে সামান্য। তার ওপর রং-পালিশ। তা তেমন খদ্দের পেলে সাত-আট হাজার। আসলে কী জানেন রায়বাবু, এসব জিনিসের খদ্দের আজকাল টপ করে পাওয়া যায় না। ছ’মাস এক বছর হয়তো পড়েই থাকল দোকানে। গাঁট থেকে যে টাকাটা আগাম গেল, মেরামতির খরচ–সব মিলিয়ে যা দাঁড়ায়–তার ওপর হাজার দুই তিন না রাখলে আমার চলে কেমন করে! আপনাকে মিথ্যে বলব না, আগের দিন হলে যখন শখ শৌখিনতা ভালমন্দ লোকে বুঝত, তখনকার বাজার হলে আমি দশ বারো হাজার কামিয়ে নিতে পারতাম।”

কিকিরা বোধ হয় সামান্য অবাক হলেন। “দশ হাজার!”

“অবাক হওয়ার কী আছে মশাই, কাঠ তো স্টিল নয়, কারখানায় তৈরি হয় না। ভাল কাঠের দাম সোনার মতন। দশ হাজার কেন, বারো-চোদ্দও হতে পারত। কিন্তু আজকাল আর তেমন খদ্দের পাব কোথায়?”

“দামি আসবাব বলুন!”

“বলতে! ও কি এখনকার জিনিস! ল্যাজেরাস কোম্পানির নাম শুনেছেন? ফার্নিচারের কারবারে পয়লা নম্বর ছিল তখন। তারপরেই লিসা কোম্পানি। ওদের ঘরের জিনিস। কাঠ বাইরের, টিক; ডিজাইন বিলেতি। আলমারির একটা পাল্লায় ফুল সাইজ আয়না। ওই আয়না এখন পাওয়া যাবে! ইটালিয়ান গ্লাস, বেলজিয়ান নয়। আয়নার চারপাশে ফ্রেমিং লতাপাতার কাজ করা। যেমন সুন্দর তেমনই সূক্ষ্ম! জিনিসটা বড় ভাল রায়বাবু!”

“আছে এখানে? দেখতে পাব?”

“নেবেন নাকি?” নন্দবাবু হালকাভাবে বললেন।

 “কী যে বলেন! আমার কি দশ হাজারের পুঁজি আছে? এই একটু চোখের দেখা দেখতাম।”

“আরে, ঠাট্টা করছিলাম।” বলে হাত তুলে দোকানের ভেতর দিকের একটা জায়গা দেখালেন আঙুল দিয়ে, “ওই যে, পলিথিন দিয়ে ঢাকা দেওয়া আছে। চলুন, দেখবেন।” উঠে পড়লেন চেয়ার সরিয়ে।

নন্দবাবু কিকিরাকে নিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেলেন। “শ্রীকুমার, পলিথিনটা নামিয়ে দাও তো!”

শ্রীকুমার পালিশের কাজ করছিল। উঠে এসে পলিথিনের ‘শিট’-টা সরিয়ে দিল।

কিকিরা দেখলেন আলমারিটা। দেখার মতনই। পুরনো বলে বাইরের ঝকঝকে ভাবটা নেই, কাঠেও ময়লা ধরে, তবে একনজরেই বোঝা যায়–মামুলি আসবাব এটা নয়। সত্যিই সুন্দর। হিসেব করে গড়ন, নকশা, হাতের কাজ দেখে বোঝা যায়, পাকা মিস্ত্রিদের হাতে তৈরি আসবাব। বনেদিয়ানার একটা চেহারা রয়েছে আলমারিটার গায়ে। কিকিরার মনে হল, মাথার দিকে ওটা ছ’ ফুটের মতন, চওড়ায় তিনের কাছাকাছি, ভেতরের দিকটা–যাকে ডেথ বলে, মন্দ হবে না। আপাতত মরা-মরা রং দেখেও অনুমান করা যায়, ওটা মেহগনি রঙেরই ছিল।

আলমারির আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখতে দেখতে কিকিরা বললেন, “খাঁটি জিনিসই বটে নন্দবাবু, কিন্তু আয়নার তলার দিকে কাচটা ফেটে গিয়েছে না?”

 “হ্যাঁ। ওই কাচ তো আর পালটানো যাবে না, দেখি কীভাবে ম্যানেজ করতে পারি।”

“ভেতরটা একবার দেখা যায় না?”

“কেন যাবে না!” বলে নন্দবাবু গণেশকে ডাকলেন, “গণেশ, আমার টেবিলের তলার ড্রয়ার থেকে চাবিটা এনে দাও। অন্য চাবি নয়, দেখবে টোয়াইন সুতোয় বাঁধা গোটা চারেক বড়-ছোট চাবি রয়েছে। সুতোয় একটু লাল রং লাগানো।”

গণেশ ড্রয়ার হাতড়ে চাবি এনে দিল।

নন্দবাবু আলমারির পাল্লা খুলতে খুলতে বললেন, “এর আবার ডবল লক সিস্টেম। একটায় খুলবে না। প্রথমে একটা, ওপরের দিকের গর্তে, পরে নীচের দিকে। আলাদা আলাদা চাবি। আগেকার দিনে এরকম অনেক আলমারিতেই থাকত।”

পাল্লা খুলতে সামান্য সময় লাগল নন্দবাবুর। চাবির গোলমাল হচ্ছিল। “দেখুন!”নন্দবাবু বললেন, “ভেতরটা দেখুন, মশাই! কত স্পেস। এক-একটা তাকে বিশ-পঁচিশটা শাড়ি জামা ঢুকে যায় অনায়াসে। ওপরের তাকটা দেখছেন?”

কিকিরা একদৃষ্টে দেখছিলেন। চারটে তাক। যথেষ্ট জায়গা। ওপরের তাকে তিনটি ভাগ। পাশের দুটোয় ড্রয়ার, মাঝখানেরটা ফাঁকা। ওর মধ্যে ছোট বড় লম্বাটে চৌকোনো কয়েকটা খুপরি, মানে ‘পকেট। ড্রয়ার দুটোর গায়ে হালকা হাতল, পেতলের। চাবির গর্তও রয়েছে।

কিকিরা মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “বাঃ! দেখার মতন। আপনার নজর আছে নন্দবাবু! আড়াই হাজারে এ-জিনিস পেয়ে গিয়েছেন, বরাত ভাল আপনার।”

নন্দবাবু হাসলেন সামান্য। “আরও একটা জিনিস আছে তলার দিকে। আপনি বুঝতে পারবেন না। বোর্ড ড্রয়ার। মানে কাঠের তক্তা ড্রয়ার। হালকা, পাতলা।”

কথা বলতে বলতে নন্দবাবু আলমারির পাল্লা বন্ধ করে দিলেন।

টেবিলে ফোন বাজছিল।

 নিজেই এগিয়ে গিয়ে ফোন ধরলেন নন্দবাবু। কথা বললেন। কেউ বোধ হয় ফার্নিচার ভাড়া নেওয়ার কথা বলছিল। ভুল জায়গায় ফোন করেছে হয়তো। নন্দবাবু বললেন, না–এখানে ফার্নিচার ভাড়া দেওয়া হয় না। পার্ক সার্কাসের দিকে দেখুন।

কিকিরা এবার উঠবেন। বললেন, “আমি তা হলে আজ চলি, নন্দবাবু।”

“যাবেন! … আচ্ছা কী করি বলুন তো! ছোকরাকে আমার একদম পছন্দ হয়নি।”

কিকিরা ভাবলেন কয়েক মুহূর্ত। বললেন, “আমার মনে হয়–আপনি একবার হাতিবাগানে যান। যাঁর কাছ থেকে আলমারি কিনেছেন–তাঁকেই বলুন। তাঁরই তো নাতি। যা ঘটেছে বলবেন ভদ্রলোককে। দেখুন না উনি কী বলেন।”

নন্দবাবু মন দিয়ে শুনলেন। “আমিও তাই ভাবছি।”

“আজ না হয় কাল–একবার চলে যান। ঘাবড়াবেন না। আমি আজ চলি। দিন কয়েক পরে আমাকে এদিকে আসতে হবে একটা কাজে, তখন বরং খোঁজ নিয়ে। যাব।”

“আসুন তবে। দাঁড়ান, আপনার ঠিকানাটা লিখে রাখি, মশাই। আপনি তো আবার চোর-জোচ্চোর ধরতে জানেন। কখন কী দরকার পড়ে।” বলে নন্দবাবু একটা খাতায় কিকিরার ঠিকানা লিখে নিতে লাগলেন।

.

০২.

কোনও একটা কথায় হাসির হল্লা উঠেছিল। চন্দন তারাপদ কিকিরা–সকলেই হাসছে।

শেষে হাসি থামিয়ে কিকিরা বললেন, “পুরনো কথা শুনলে তোমরা এত হাসো কেন বলো তো? আমি কি বানিয়ে বলছি, না, বাজে কথা বলছি?”

চন্দন বলল, হাসতে হাসতেই, “তা বলে আপনি বিশ্বাস করতে বলেন, আগেকার দিনে এই কলকাতা শহরে থিয়েটার হলের সামনে হুঁকোর দোকান থাকত? তামাক কলকে ফিট করা। বাবুরা মাঝে মাঝে হল থেকে বেরিয়ে এসে হুঁকো টেনে যেতেন?”

“আমি বলছি না চাঁদুবাবু, বইয়ে বলছে। আমি তখন কোথায়, আমার পিতৃপুরুষও জন্মাননি মনে হয়। সে কি এখনকার কথা! শ’খানেক বছর পিছিয়ে যাও। তারও বেশি। ভুবন মুখুজ্যের বইয়ে পড়েছি। তখন থিয়েটার পাড়ায় প্ল্যাকার্ডকে বলত পেলাকাঠ’, অবশ্য যারা মুখুসুখ মানুষ, থিয়েটারে সাধারণ কাজকর্ম করত–তারা। পানের দোকানের ছোঁড়ারা থালায় বরফজলের গ্লাস সাজিয়ে হেঁকে হেঁকে বিক্রি করত, বিলিতি জল–ওয়ান পেয়ালা ওয়ান পাইস, খেয়ে নিন বাবুরা বুক ঠাণ্ডা প্রাণ ঠাণ্ডা …।”

তারাপদ মুখ মুছতে মুছতে বলল, “তখন সিগারেট বিড়ি সোডা লেমোনেড ছিল না?”

 “সিগারেট তো সেদিনের বাচ্চা! ছিলিম-সাজা হুঁকোর দোকানেও জাত গোত্র ছিল, বামুন হুঁকো, কায়েত হুঁকো–যার যেটি দরকার টেনে নিত। সিগারেট ক’জন চোখে দেখেছে! আর লেমোনেড জন্মেছে …” বলতে বলতে থেমে গেলেন কিকিরা; কে যেন এসেছে, বগলা দরজা খুলে কথা বলছিল।

কিকিরা ঘরের দরজার দিকে তাকালেন।

বগলা এল। “একজন দেখা করতে এসেছে।”

“কে? নিয়ে এসো।”

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে যে-লোকটি এল কিকিরা তাকে দেখে অবাক। ভাবতেই পারেননি এমন কাউকে দেখবেন! “তুমি নন্দবাবুর দোকানের লোক না! কী নাম যেন, শ্রীকুমার?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি শ্রীকুমার।”

“তা হঠাৎ এখানে?”

“বাবু পাঠিয়েছেন।”

“নন্দবাবু! কী ব্যাপার?”

শ্রীকুমার খানিকটা আড়ষ্ট, চোখেমুখে উদ্বেগও রয়েছে। বলল, “আমাদের বাবু ভীষণ জখম হয়ে পড়ে আছেন।”

“সে কী!” কিকিরা যেন চমকে উঠে সোজা হয়ে বসলেন চেয়ারে। “জখম! নন্দবাবু জখম হয়ে পড়ে আছেন? কোথায়? হাসপাতালে?”

“না, বাড়িতেই আছেন। হাসপাতালে পাঠাবার অবস্থাই হয়েছিল। ভাগ্য ভাল হাসপাতালে পাঠাতে হয়নি, বাড়িতেই বিছানায় পড়ে আছেন।”

কিকিরা একবার তারাপদদের মুখের দিকে তাকালেন। তারপর চোখ সরিয়ে শ্রীকুমারকে দেখতে দেখতে বললেন, “তুমি বোসো। ওই টুলটা টেনে নাও। কী হয়েছে বলো তো?”

শ্রীকুমার বসল না। মাথায় লম্বা, রোগাটে গড়ন তার। নাক লম্বা, চোখ গর্তে ঢোকা। গালে অল্প দাড়ি। পরনে ধুতি, গায়ে খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি। মাথার চুল পাতলা। বয়েস চল্লিশের ওপর।

শ্রীকুমার বলল, “আপনি আমাদের দোকানে গিয়েছিলেন–আট-দশ দিন আগে–!”

হিসেব করে কিকিরা বললেন, “হ্যাঁ, এই তো কাল শুক্রবারের আগের শুক্রবার, আজ শনিবার। ন’-দশদিনই হল।”

“আপনি যেদিন গেলেন, তার পরের দিন বাবু হাতিবাগানে ওই বিশ্বাসবাবুদের বাড়িতে বুড়োকর্তার সঙ্গে দেখা করতে যান। তাঁকে সব জানাতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে বললেন, বুড়োকর্তা তেমনভাবে কানই দিলেন না কথাটায়। বললেন, তাঁর আলমারি তিনি বেচে দিয়েছেন নিজের মরজিতে; কারও কিছু বলার থাকতে পারে না। … আমাদের বাবু তবু বললেন, কিন্তু আপনার নাতি যে আমায় শাসিয়ে এসেছে। বিশ্বাসবাড়ির বুড়োকর্তা বাবুকে বললেন, এখন তো ও নেই, দিঘা থেকে ফিরে আসুক–আমি বলব। ছেলেটা যে জেদি আমি জানি; তবে গুণ্ডা বদমাশ ধরনের নয়। কেন যে ও আপনার দোকানে গিয়ে শাসিয়ে এল–তাও বুঝতে পারছি না। আসুক ও, জিজ্ঞেস করব।” বলে শ্রীকুমার চুপ করে গেল।

কিকিরা একটু ভাবলেন। “নন্দবাবুর ঠিক হয়েছে কী? কবে? কোথায়?”

“আজ্ঞে পরশুদিন। সন্ধেবেলায়, সাড়ে সাতটা নাগাদ বাবু একটা কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন। পাড়ার কাছাকাছি, মল্লিক লেনের মুখে একটা লোক আচমকা পাশের গলি থেকে মোটরবাইক নিয়ে বেরিয়ে এসে বাবুকে পাশ থেকে ধাক্কা মারে। মেরেই পালিয়ে যায়।”

“ধাক্কা মারে! ইচ্ছে করে, না, অ্যাক্সিডেন্ট?”

“বাবু বলছেন, ইচ্ছে করে, মতলব নিয়ে।”

“লোকটাকে দেখেছেন নন্দবাবু?”

“ওখানে রাস্তার বাতি ছিল না কাছাকাছি। দু’-এক পলক যা দেখেছেন তাতে সেই ছেলেটার মুখ বলেই তাঁর মনে হল। উনি তখন রাস্তায় ছিটকে পড়েছেন। কোমরে লেগেছে, হাতে-মাথায় চোট, মুখ থুবড়ে পড়ায় গালে নাকে লেগেছে, রক্ত পড়ছিল। …আপনি নিজে গেলেই সব দেখতে পাবেন– শুনবেন। আমি আর কী বলব!”

‘নন্দবাবু আমায় তবে যেতে বলেছেন।”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, সেজন্যেই আমায় আপনার ঠিকানা দিয়ে পাঠিয়েছেন। অনেক করে বলেছেন–আপনি যেন একবার যান। তাঁর বাড়িতে। তিনি তো আর দোকানে আসতে পারছেন না।”

কিকিরা চোখ বুজে মাথা নাড়লেন। তারপর তাকালেন। “বাড়িটা কোথায় যেন। অনেক আগে এক-দু’বার গিয়েছি, ঠিক মনে নেই। ঠিকানাটা বলে যাও, আর একটু বুঝিয়ে দাও আমাকে।”

শ্রীকুমার ঠিকানা বলল, নন্দবাবুর বাড়িটা কোথায় হবে বুঝিয়েও দিল।

কিকিরা বার কয়েক ঠিকানাটা আওড়ালেন। বললেন, “ঠিক আছে। আমি কাল বিকেলে যাব, নন্দবাবুকে বোলো। এমনিতেই কথা ছিল, পরে একদিন তাঁর কাছে যাব। তুমি বরং এখন এসো। সাবধানে থাকতে বলবে নন্দবাবুকে। এই বয়েসে চোট-জখম বড় ভোগায়।”

শ্রীকুমার চলে গেল।

অল্পসময় চুপচাপ। কিকিরা অন্যমনস্ক; তারাপদ আর চন্দনও কথা বলল না। ঘরে বাতি জ্বলছে, পাখাও চলছিল। লাফ মেরে মেরে গরম যেন এগিয়ে এসেছে। চৈত্রমাস একেবারে দোরগোড়ায়।

শেষপর্যন্ত কিকিরাই কথা বললেন। অনেকটা অবিশ্বাসের গলায়, “আমি এতটা ভাবিনি।”

তারাপদ বলল, “কী ভাবেননি?”

“ভাবিনি সত্যি সত্যি নন্দবাবুর ওপর হামলা হতে পারে এভাবে। এত তাড়াতাড়ি।”

চন্দন বলল, “এটা সার, অ্যাকসিডেন্ট কেস হতে পারে। কোনও আনাড়ি হয়তো ধাক্কা মেরে পালিয়েছে।”

“অসম্ভব নয়। কিন্তু নন্দবাবু যে বলছেন, ওই ছোকরাটাকেই উনি দেখেছেন।”

“সত্যিই কি দেখেছেন, না, চোখের ভুল? উনি হয়তো উদ্বেগ আতঙ্ক নিয়ে রয়েছেন বলে ভুল দেখেছেন। কিংবা ভাবছেন।”

 “এখন কিছু বুঝতে পারছি না। দেখি, কাল ওঁর বাড়ি যাই–কথা বলি–?”

তারাপদ দেশলাইয়ের বাক্স বার করে একটা কাঠি নিল। তারপর কান চুলকোতে চুলকোতে বলল, “আপনার কাছে আলমারির গল্প আমরা শুনেছি। হতে পারে ওটা মূল্যবান আসবাব। কিন্তু একটা কাঠের পুরনো আলমারির জন্যে এত কাণ্ড হয় কেমন করে। একজন বিক্রি করবে, পরে নাতি এসে শাসাবে। তারপরও ধরুন, যিনি কিনলেন তিনি আবার ওই বুড়ো ভদ্রলোককে গিয়ে জানিয়েও এলেন শাসানোর কথাটা। বুড়ো কোনও কানই করলেন না। এর পর আবার হামলা! কীসের এমন মহামূল্যবান আলমারি, সার! আপনি যাই বলুন, ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। আমি কোনও মানে খুঁজে পাচ্ছি না।”

চন্দন বলল, “আসলে নন্দবাবু বোধ হয় কোনও কারণে প্যানিক হয়ে রয়েছেন।”

কিকিরা বললেন, “তারও তো একটা কারণ থাকবে, চাঁদু। নন্দবাবু কচি ছেলে নন। প্রবীণ মানুষ। ব্যবসাও করছেন কতকাল। পুরনো ফার্নিচার কেনা আর বেচা তাঁর কাছে নতুন জিনিস নয়। এতকাল কোনও ঝামেলা হয়েছে বলে শুনিনি। বলেনওনি সেদিন। হঠাৎ এই বিশ্বাসবাড়ির আলমারি নিয়ে কেন তিনি ঝামেলায় পড়বেন! ভয় পাবেন! তোমরা ভুলে যেও না, নন্দবাবুর দোকান যথেষ্ট পুরনো। ওই এলাকাটা তাঁর নিজের এলাকা। ওখানে সবাই তাঁর চেনা, হাঁকডাক করলে দশজন বেরিয়ে পড়বে। তবু একটা ছোকরা কোন সাহসে গিয়ে তাঁকে শাসিয়ে আসতে পারে।” বলে কিকিরা থামলেন কয়েক মুহূর্ত। আবার বললেন, “নন্দবাবুর পাড়ার কাছাকাছি গিয়ে তাঁকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ধক তার হল কেমন করে?”

“আপনি নন্দবাবুর ধারণার কথা ভাবছেন। ওটা সিম্পল অ্যাক্সিডেন্ট কেস হতে পারে। অন্য কেউ ধাক্কা মেরেছে হয়তো।”

“দেখি। কাল একবার নন্দবাবুর কাছে যাই। দেখে আসি ভদ্রলোককে। তখন জানতে পারব।”

তারাপদ বলল, “আপনি যান, দয়া করে আমাদের লেজুড় করবেন না, সার। আপনার বন্ধু, আপনি…”

তারাপদকে থামিয়ে দিয়ে কিকিরা বললেন, “লেজুড় কাকে বলে তুমি তাই জানো না। আমার লেজের সঙ্গে তোমায় জুড়ব কেন! তোমরা হলে আমার শাগরেদ। অ্যান্ড পার্টনার।…আরে বাবা, বিকেলে একটু যাবে তাতে আপত্তি কীসের।…শোনো, তারাবাবু–এই সংসার বড় বিচিত্র জায়গা, মিস্টিরিয়াস প্লেস; লোকজনের সঙ্গে যত মিশবে, চোখ খুলে দেখবে, ততই তোমার জ্ঞানচক্ষু…”

“থাক সার, আর লেকচার শোনাবেন না আপনার।”তারাপদ বলল কিকিরাকে বাধা দিয়ে, “আপনার পাল্লায় পড়ে এরই মধ্যে আমাদের জ্ঞানচক্ষু যথেষ্ট ফুটেছে। আরও বেশি ফুটলে জ্ঞানী বুদ্ধ হয়ে যাব।”

কিকিরা হাসলেন। “বুদ্ধ তো একটাই হয় হে, তবে বুন্ধু হয় হাজারে হাজারে। শোনো বাবা, আমার সার কথা হল–নন্দবাবুই হোক, বিশ্বাসবাড়ির ছোটকর্তা সুবর্ণকান্তি হোক কিংবা তাঁর নাতি সেই ছোকরাই হোক–কে যে কাকে বুদ্ধ বানাতে চাইছে–একবার দেখতে চাই। বুঝলে?”

চন্দন ঠাট্টার গলায় বলল, “এবার তা হলে আপনার কেসটা হবে আলমারি রহস্য।”

“কোন রহস্য বলতে পারছি না। আলমারিটা অবশ্যই রহস্যের লিস্টিতে পয়লা নম্বরে জায়গা পাবে।”

“পাবে বলছেন–কিন্তু কেন পাবে, সার? পুরনো একটা কাঠের ফার্নিচার, তার মধ্যে এমন কী রহস্য থাকতে পারে!”

কিকিরা মাথার চুল ঘাঁটতে ঘাঁটতে বললেন, “কথাটা ঠিকই। তবে একবার ভেবে দেখো, এক ভদ্রলোক স্বেচ্ছায়, টাকা নিয়ে, তাঁদের বাড়ির একটা আলমারি বেচে দিয়েছেন। সেটা কিনেছেন নন্দবাবু–যাঁর ব্যবসাই হল পুরনো আসবাব কেনা। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। নো প্রবলেম, নো রহস্য! অথচ তারপরই এক রাফ-টাইপের ছোকরা, যিনি আলমারি বেচেছেন তাঁর নাতি এসে নন্দবাবুকে শাসিয়ে গেল, আলমারিটা ফেরত দিয়ে আসতে। না দিলে নন্দবাবু বিপদে পড়বেন। কেন? তার এমন ব্যবহার করার কারণটা কী?”

তারাপদ বলল, “সার, নাতির হয়তো মনে হয়েছে, নিজেদের ঘরের জিনিস ওইভাবে বেচে দেওয়াটা উচিত হয়নি। ওদের আভিজাত্যে লাগে। সেন্টিমেন্ট…।”

“বেশ তো। সেন্টিমেন্টে লাগতেই পারে। তা বলে সে নন্দবাবুর দোকানে এসে বয়স্ক এক ভদ্রলোককে শাসিয়ে যাবে? কী বলছ তুমি? বলার আর ধরন ছিল না! ভদ্রজনের মতন বুঝিয়ে বললেই পারত।”

তারাপদ চুপ। জবাব দিতে পারল না।

কিকিরা বললেন, “তা সে যাই হোক, নন্দবাবু আবার যখন বিশ্বাসবাড়ির ছোটকর্তার কাছে সবকিছু জানাতে গেলেন, তখন ছোটকর্তা কানেই তুললেন না কথাটা। শ্রীকুমার কী বলে গেল, নিজেরাই শুনলে। উনি নাকি বলেছেন, নিজের জিনিস আপন মরজিতে বেচেছেন, কারও কিছু বলার থাকতে পারে না।…এবার বলো নন্দবাবুর দোষটা কোথায়?”

চন্দন মাথা নাড়ল। না, নন্দবাবুর দোষ নেই কোথাও।

“তা হলে সেই ছোকরা আবার কেন নন্দবাবুকে ওভাবে জখম করার চেষ্টা করবে?”

“হ্যাঁ, যদি অবশ্য ওই ছোকরাই ধাক্কা মেরে থাকে?” চন্দন বলল।

 “সেটা কাল বুঝতে পারব; নন্দবাবুর সঙ্গে দেখা হলে।”

তারাপদ মুখ মুছে নিল। পাখা চলছে ঠিকই, তবে গুমোট লাগছে। ঘাম হচ্ছিল। জলতেষ্টা পাচ্ছিল তার। উঠে পড়ল। ভেতরে গিয়ে সে খেয়ে আসবে। ২৪৪

যেতে যেতে বলল, “আলমারিটা আপনি দেখেছেন কিকিরা। দেখে কি মনে হয়, ওর মধ্যে কোনও রহস্য থাকতে পারে?”

“বাইরে থেকে দেখেছি। খুবই সুন্দর। ভেতরে–মানে আলমারির ভেতরে, কিংবা জিনিসটাকে জড়িয়ে কী রহস্য আছে–কেমন করে বলব!”

তারাপদ ভেতরে চলে গেল।

চন্দন বোধ হয়, ব্যাপারটার জটিলতা বুঝতে পারছিল খানিক। বলল, “ছোকরার নাম কী? কী করে?”

 “নামটাম জানি না। কী করে বলতে পারব না। নন্দবাবু যা বলেছেন তার থেকে মনে হল, ছোকরা দিঘায় কারও সঙ্গে মিলেমিশে বা একলা একটা হোটেল খোলার চেষ্টায় আছে। আজকাল প্রায়ই দিঘায় গিয়ে থাকে, কাজকর্ম দেখে।”

“বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক কেমন?”

“জানি না। দাদুকে চিনি না, নাতিকেও নয়। কেমন করে বলব সম্পর্ক কেমন!” চন্দন একবার নিজের হাতঘড়ি দেখল। আটটা বাজে প্রায়। এবার উঠে পড়তে হবে। “আপনি তা হলে কাল নন্দবাবুর বাড়ি যাচ্ছেন?”

“যাই। নিজের চোখে দেখে আসি একবার। ঠিক কী ঘটেছে উনি ছাড়া আর কে বলতে পারবে। তার মানে আমি কী বলতে চাইছি বুঝতে পারছ? আমি বলতে চাইছি, নন্দবাবু বিশ্বাসবাড়ির ছোটকর্তার সঙ্গে দেখা করার পর কী কথাবার্তা হয়েছে, তারপর কী ঘটেছে, কেনই বা তাঁকে মোটর সাইকেলের ধাক্কা খেতে হল, সত্যি সত্যি সেই ছোকরা তাঁকে ধাক্কা মেরেছে কি না জানা দরকার।”

তারাপদ ফিরে এল। বলল, “সার, আপনি একটা ফ্রিজ কিনতে পারেন না?”

“কেন?”

“কেন আবার কি! ঠাণ্ডা জল খেতে পারতাম।”

“আমার আদ্যিকালের আইস বক্সে রাখা জলের বোতল ঠাণ্ডা হয় না?”

“হয়, তবে ফ্রিজ বলে কথা…”

“তোমাদের দেখছি পুরনো জিনিসে মন ওঠে না। আরে ফ্রিজ তো হালের জিনিস, আগে সাহেবসুবো থেকে শুরু করে বড়লোকের বাড়িতেও ওই আইস বক্সই থাকত। বুঝলে! এখনও তুমি চাঁদনিতে গেলে আইস বক্স কিনতে পাবে। আমার বাপু ওই বরফ বাক্সেই চলে যায়। ফ্রিজ নিয়ে আমি কী করব? দিব্যি আমার চলে যাচ্ছে।”

“চলুক তা হলে! আমরা আজ উঠি।”

“এসো। কাল তা হলে তুমি যাচ্ছ আমার সঙ্গে?”

তারাপদ তেমন উৎসাহ দেখাল না। “আপনি বললে যেতেই হয়। তবে আলমারির ব্যাপারটায় আমি ইন্টারেস্ট পাচ্ছি না।”

“দেখাই যাক না নন্দবাবু কী বলেন!”

 চন্দনরা উঠে পড়ল।

.

০৩.

নন্দবাবু বিছানায় শুয়ে ছিলেন। গায়ে ফতুয়া, সামনের দিকটা শার্ট-পাঞ্জাবি মতন বোতাম লাগানো। পরনে ধুতি, দু’-পাট করে লুঙ্গির মতন জড়ানো রয়েছে কোমরে। বাঁ হাতে প্লাস্টার, টাটকা। পায়ের দিকেও মোটা ব্যান্ডেজ, কপালে একপাশে কালশিটে পড়েছে, তার ওপর কোনও ওষুধ লাগানো। গালেও কালচে দাগ। ভদ্রলোককে বেশ কাতর দেখাচ্ছিল। যন্ত্রণায় চোখমুখ শুকনো।

কিকিরাকে দেখে যেন আশ্বস্ত হলেন। “আসুন রায়বাবু।” বলে তারাপদর দিকে তাকালেন। “এঁকে তো চিনি না।”

কিকিরা পরিচয় করিয়ে দিলেন। “তারাপদ। আমার শাগরেদ, চেলাও বলতে পারেন।”

“বসুন আপনারা।”

 বিছানার কাছাকাছি চেয়ার ছিল। টেনে নিয়ে বসলেন কিকিরা, ইশারায় বসতে বললেন তারাপদকে।

“এই অবস্থা হল কবে?” কিকিরা বললেন।

“পরশুর আগের দিন। সন্ধেবেলায়। একটা দিন ডাক্তার বদ্যি করে কাটল। কাল সকালে এক্সরে করেছি। বিকেলে প্লাস্টার। হাতের হাড় দু’-টুকরো হয়ে গিয়েছে। এই রিস্টের ওপরে। পায়ের হাড় ভাঙেনি, তবে মচকে গিয়েছে। মাথায় বেশ লেগেছে মশাই, রক্ষে যে মারাত্মক কিছু হয়নি। সারা পিঠ কোমরে যা ব্যথা…।”

“তা তো হবেই। বয়েস হচ্ছে এখন, অল্প লাগলেও তার জের সহজে ছাড়তে চায় না।”

নন্দবাবু কাকে যেন ডাকলেন। ঘরের ব্যবস্থা দেখে বোঝা যায়, কিকিরা আসবেন জেনে আগেভাগেই সব গোছগাছ করে রাখা হয়েছিল।

বাড়ির কোনও কাজের লোক মুখ বাড়াল। নন্দবাবু চা জল দিতে বললেন।

কিকিরা বললেন, “ব্যাপারটা আগে সব শুনে নিই।…আপনি যা যা ঘটেছে আমায় বলুন।”

নন্দবাবু বালিশে হেলান দিয়ে যতটা পারেন গুছিয়ে বসলেন।

তারাপদ ঘরটা দেখছিল। পুরনো বাড়ির ঘর যেমন হয়, মাঝারি মাপের, মাথার ছাদে কড়িবরগা, দেয়ালের রং সাদা, জানলায় কাঠের পাল্লা, লোহার গরাদ। ঘরের মধ্যে আসবাবপত্র সবই পুরনো ধাঁচের, কিন্তু দামি এবং সুন্দর। দেখে মনে হল, এই ঘরেই নন্দবাবু থাকেন।

নন্দবাবু বললেন কিকিরার দিকে তাকিয়ে, “আপনার কথামতন আমি পরের দিনই সুবর্ণবাবুর কাছে গেলাম। বললাম তাঁকে সব কথা শুনে উনি ভীষণ অবাক হলেন। বললেন, আমি তো কিছু জানি না। রাজা আমায় একটা কথাও বলেনি।”

“রাজা কে?”

“ওঁর নাতি। ডাকনাম রাজা। ভাল নাম রাজীব। রাজীব নন্দী।”

“ও! সুবর্ণবাবুরা না বিশ্বাস?”

“মেয়ের ছেলে। গোত্র বদল হয়েছে।”

“হ্যাঁ, তা তো হবেই। আর কী বললেন উনি?”

“বললেন, আলমারি ফেরত দিতে হবে না। ও-বাড়িতে যা জিনিসপত্র আছে সবেরই মালিকানা তাঁর। তিনি নিজেই বেচে দিয়েছেন আলমারি। অন্যের তা নিয়ে কথা বলার অধিকার নেই। আগেও তিনি এটা-ওটা বেচে দিয়েছেন। কই তা নিয়ে তো কোনও ঝাট হয়নি। হঠাৎ এটা নিয়ে কেন হবে–তিনি বুঝতে পারছেন না।”

কিকিরা কী ভেবে বললেন, “উনি কি বললেন, নাতির সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবেন।”

“হ্যাঁ, বললেন–রাজা এখন দিঘায়, চার-পাঁচদিন পরে ফিরবে, তখন কথা বলবেন।”

“তার মানে নাতি ফিরে এলে তিনি নিশ্চয় বলেছেন কথাটা।”

“বলার কথা।”

“রাজা দিঘায় কী করে–শুনেছেন।”

“শুনেছি। এক বন্ধুর সঙ্গে হোটেলের ব্যবসা করবে বলে আদাজল খেয়ে লেগেছে। এখনও হোটেল চালু হয়নি। কাজকর্ম চলছে। মাস দুই আরও হয়তো লাগবে।”

তারাপদ চুপচাপ শুনছিল। দেখছিল নন্দবাবুকে। ভদ্রলোককে একেবারে সাদামাটা নিরীহ বলেই মনে হয়। তবে ব্যবসাদার মানুষ, চোখেমুখে এক ধরনের বুদ্ধির ছাপ তো থাকবেই।

কিকিরা বললেন, “তারপর এই ঘটনা…! আপনি বাইকের ধাক্কা খেলেন?”

“হ্যাঁ। আমি দোকান বন্ধর পর একটা কাজে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধে। একটু আগে হালকা একটা ঝড় উঠেছিল। কালবৈশাখী নয়, ধুলোর ঝড়। থেমেও গেল। আমি বাড়ি ফিরছি। আমাদের পাড়ার কর্পোরেশনের প্রাইমারি স্কুলটার আগে একটা আধমরা পাকুড়গাছ আছে। পাশেই মিল্কবুথ। জায়গাটা নিরিবিলি, আলোও কম। হঠাৎ একটা মোটরসাইকেল এসে আমায় পাশ থেকে ধাক্কা মারল। আমি টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলাম রাস্তায়।”

“যে আপনাকে ধাক্কা মারল তাকে আপনি দেখেছেন?”

“ওই দু’পলকের জন্যে।”

“লোকটা যে রাজীব আপনি চিনলেন কেমন করে?”

“আমি তার মুখ দেখেছি।”

 তারাপদ বলল, “মাথায় হেলমেট ছিল না?”

“ছিল।”

“হেলমেট দু’ধরনের হয়। কোনও কোনও হেলমেটের মুখের সামনে আড়াল থাকে–ফাইবার গ্লাসের। আলো যেখানে কম, সেখানে আপনি কেমন করে মুখ দেখবেন ড্রাইভারের?”

 “মুখের সামনে আড়াল ছিল না। আমি স্পষ্ট দেখেছি–সেই ছোকরা। ধাক্কা মারার পর আমার দিকে তাকাল, কী একটা বলল–তারপর চলে গেল।”

“কাছাকাছি তখন কেউ ছিল না গলিতে, ধরতে পারল না?”

“না। ফাঁকা ছিল। একটু পরে সত্যবাবুকে দেখলাম। তিনি আমায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন। আমি যতবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিলাম, পারছিলাম না। মনে হল, পায়ে জোরই পাচ্ছি না। সত্যবাবুই তখন লোকজন ডেকে ধরাধরি করে আমায় বাড়ি পৌঁছে দিলেন।”

কিকিরা মন দিয়ে নন্দবাবুর কথা শুনছিলেন। সামান্য সময় চুপচাপ থাকার পর বললেন, “আপনার চোখের ভুল হয়নি তো?”

“মনে তো হয় না। ওই ছোকরার মুখ ভুল হওয়ার কথা নয়।”

“কেমন দেখতে?”

“ধবধবে ফরসা। মুখের আদল লম্বাটে। খাড়া নাক। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। থুতনির কাছে দাড়ি গোঁফও রেখেছে। গাল পরিষ্কার। স্টাইলের দাড়ি, মশাই।”

কিকিরা কী বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই ভেতর থেকে চা মিষ্টি এল।

 “এত কেন? শুধু চা হলেই হত,” কিকিরা বললেন।

“বাড়িতে এসেছেন শুধু চা খাবেন! তা ছাড়া এই ব্যবস্থা আমার গিন্নির।”

“ছেলে কোথায়?”

“কী একটা পড়তে গিয়েছে। আমি ওসব বুঝি না। পরীক্ষা দেবে চাকরির

“ও!… তা নন্দবাবু, বিশ্বাসবাড়িতে গিয়ে সুবর্ণকান্তিবাবুর সঙ্গে যখন কথাবার্তা বলছিলেন তখন আপনার কী মনে হল? মানে নাতি সম্পর্কে দাদুর মনোভাব কেমন দেখলেন? বৃদ্ধ ভদ্রলোক কি নাতির ওপর বিরক্ত? পছন্দ করেন না তাকে? না কি মনে হল, নাতিকে প্রশ্রয় দেন?”

নন্দবাবু বালিশটা কোনওক্রমে টেনে নিলেন ভর দেওয়ার জন্যে। বললেন, “দেখুন, আমি ঠিক বুঝলাম না। বিরক্ত হয়েছেন যে তাও বোঝা গেল না। তবে ওর ওইভাবে দোকানে এসে শাসানো তার পছন্দ হয়নি। বললেন, ও ফিরে এলে কথা বলবেন।”

“দিঘার হোটেল তৈরি কতদিন ধরে চলছে?”

“আমি সেভাবে জানতে চাইনি। কথায় কথায় মনে হল, দু-তিন মাস তো হবেই।”

“হোটেলের নাম ঠিক হয়েছে?”

“জানি না।”

চা মিষ্টি খেতে খেতে তারাপদ বলল, “আপনার দোকান এখন দেখছে কে?”

“আমার কর্মচারীরা। ছেলে মাঝে একদিন গিয়েছিল।”

“দোকানে আর ওই ছোকরা যায়নি।”

“না।”

কিকিরা হঠাৎ বললেন, “নন্দবাবু, আপনার কী মনে হয়? রাজা ওই আলমারি ফেরত পাওয়ার জন্যে এত ব্যস্ত কেন? কী আছে ওর মধ্যে?”

“আমিও তো তাই ভাবি! কী আছে? পুরনো কাঠের আলমারি, দেখতে সুন্দর– সবই ঠিক। তা এভাবে কত পুরনো বনেদি জিনিস একসময় বাজারে বিক্রি হয়ে যায়। দু’-এক পুরুষের জিনিস তার বংশধররা বিক্রি করে দেয়। বেশিরভাগই টাকার অভাবে বেচে দেয়। কাঠ তো সামান্য জিনিস মশাই, কত মণিমুক্তো, রুপোর বাসন, বিদেশি কাঁচের বাহারি জিনিস, মায় মার্বেলের মূর্তি বিক্রির কি শেষ আছে! আমি একবার একটা লাল পাথরের পাচা কিনেছিলাম। রেয়ার জিনিস।”

“লাল প্যাঁচা?” তারাপদ অবাক হয়ে বলল।

“লাল কেন, সাদা, কালো, মেটে রঙের প্যাচাও পাওয়া যায়। এক এক দেশের কারিগরের তৈরি। শখের ব্যাপার হয়তো, তবে শুনেছি কোনও কোনও দেশে পাচা নাকি বড় পয়মন্ত জিনিস। আমাদের দেশেই তো আমরা পাচাকে লক্ষ্মীর বাহন মনে করি।”

কিকিরা বললেন, “পাচা বিক্রি করে দিয়েছেন?”

“কবে! সে কি আজকের কথা! এক সাহেব তিন হাজার টাকায় কিনে নিয়েছিলেন।”

কিকিরা কী যেন ভাবলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে অন্যমনস্কভাবে ঘরের চারদিকে তাকালেন একবার। জানলার দিকে দেয়ালে শ্রীচৈতন্যের পট, অন্যপাশে দেয়াল ঘড়ি। নন্দবাবুর মা-বাবার ফোটোও রয়েছে, বাঁধানো।

“আলমারিটা কেনার পর আপনি ভেতরটা ভাল করে দেখেছিলেন?” কিকিরা বললেন হঠাৎ।

নন্দবাবু সামান্য অবাক হলেন। “কী দেখব! আমি মশাই যখন আলমারিটা কিনি, তখন তো ওটা ফাঁকা! দোকানে নিয়ে আসার পর আলাদাভাবে কিছু দেখিনি। ওই একবার ওপরের ড্রয়ার দুটো টেনে দেখেছিলাম। ফাঁকা। ড্রয়ার দুটোর মাঝখানে যে ছোট ছোট খোপগুলো আপনি সেদিন দেখলেন, সেগুলোও ফঁকা। ধুলো আর দু-চারটে নেপথলিনের শুকনো গুলি ছাড়া কিছুই দেখিনি। তা ছাড়া দোকানে এনে রাখার পর তো ও নিয়ে মাথা ঘামাইনি। দোকানের কর্মচারীরা অন্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আলমারিটা পড়েই ছিল। মাত্র ক’দিন আগে কেনা। পরে যখন সময় পাওয়া যাবে তখন ওতে হাত পড়বে। আগেভাগে আর কত খুঁটিয়ে দেখব, বলুন?”

কিকিরা মাথা নাড়লেন। কথাটা ঠিকই। একটা পুরনো আসবাব দোকানে তুলে এনে কে আর সঙ্গে সঙ্গে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে বসে! এমন তো নয় যে, আজ যা এনেছি–কাল পরশুই তা বিক্রি হয়ে যাবে বলে তাড়া থাকবে সারাইসুরাই রং-পালিশের। একটা খদ্দের জুটতে কত মাস লাগবে কে জানে, কাজেই হুড়োহুড়ি করার দরকার কোথায়?

“আলমারিটা এখনও দোকানেই আছে?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।

“হ্যাঁ। এই বাড়ির নীচের তলায় আমার একটা গোডাউন আছে। জায়গা যে বেশি তা নয়, সেখানে ভাঙাচোরা জিনিস পড়ে আছে ক’টা। ভাবছিলাম আলমারিটা সরিয়ে আনব কি না!”

“আনতে পারেন। তবে তাতে কি লাভ হবে?”

“না, লাভ আর কী হবে! বরং বাইরের বিপদ ঘরে টেনে আনা হতে পারে।”

“আপনার কাঠকুটো ফার্নিচারের দোকান! হঠাৎ যদি কোনওভাবে আগুন লেগে যায়, দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে। ইনসিওর করানো নেই?”

আচমকা এই প্রশ্নে নন্দবাবু যেন থতমত খেয়ে গেলেন। পরে বললেন, “আছে। আজকাল কে আর ইনসিওর না করায়! তবে কী জানেন, যা যায় তা তো আর ফিরে আসে না। ব্যবসা দোকান- তাও দু’পুরুষের, পুড়ে ছাই হয়ে গেল, বদলে কিছু টাকা পেলাম, তাতে কি আর মনে শান্তি আসে!”

কিকিরা প্রায় মুখ ফসকে বলতে যাচ্ছিলেন, ‘ইনসিওর থেকে কী রকম টাকা পাওয়া যাবে!’ বললেন না কথাটা।

ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে কিকিরা বললেন, “আজ তো উঠতে হয়, নন্দবাবু। পরে আবার খোঁজ করে যাব।”

“রায়মশাই একটা কথা।”

“বলুন।”

“আপনাকে আমি একবার দেখা করতে অনুরোধ করেছিলাম দু একটা কারণে।”

“সঙ্কোচের কী আছে, বলুন!”

“আপনি আমায় পরামর্শ দিন কী করব। সেদিন আপনার সঙ্গে ওই ভাবে আচমকা দেখা না হলে আমি কি আপনাকে খুঁজে পেতাম? না, আমার মাথায় আসত! ভাগ্য ভাল সেদিন আপনাকে পেয়ে গিয়েছিলাম। … আমি এখন কী করব বলুন তো?”

“কী করতে চান?”

“আমার উকিলকে বলে ছেলেকে সঙ্গে দিয়ে থানায় পাঠাব? একটা ডায়েরি করে আসবে?”

 “না করাই ভাল আপাতত। সেদিন আপনি থানা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসেছিলেন। আবার এখন আপনি সন্দেহ করছেন সেই একই ছোকরা আপনাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে মারবার চেষ্টা করেছে। সন্দেহ তো প্রমাণ নয়। অযথা খুঁচিয়ে ঘা করবেন কেন! আরও একটু দেখুন।”

“তা হলে আপনি দয়া করে যদি আমার তরফে একটু খোঁজখবর করেন–!”

কিকিরা হাসলেন। “আচ্ছা দেখি। আমার বিদ্যে আর কতটুকু! তবু দেখব, আপনি যখন বলছেন।” বলে উঠে দাঁড়ালেন। তারাপদও উঠে পড়ল।

.

০৪.

চন্দনের ইচ্ছে ছিল না, গরজও নয়; তবে কিকিরার পাল্লায় পড়ে তাকে আসতে হল। তারাপদর অবশ্য অতটা অনিচ্ছে ছিল না। দিঘায় তারা আগেও এসেছে, সে আর চন্দন, সঙ্গে চন্দনের এক বন্ধু পবিত্র। কিকিরা সঙ্গে ছিলেন না তখন। আগেরবার তারা এসেছিল শীতকালে। বড়দিনের ছুটির পর। দিঘায় তখন ভিড় নেই, অনেকটাই ফাঁকা। নয়তো আজকাল ছুটিছাটার সময় দিঘা মানেই রথের মেলা।

এবার গরমের সময়, চৈত্র মাসে দিঘায় এসে তারাপদরা দেখল, লোকজন কম। কারণ কাছাকাছি কোনও ছুটি নেই। তার ওপর মাত্র দিন দুই আগে প্রচণ্ড এক কালবৈশাখীতে ইলেকট্রিক লাইনের ক্ষতি হয়েছে খুব। আলো-পাখা, মায় হোটেলে জলের ব্যবস্থা ঠিকমতন করা যাচ্ছে না। যারা বেড়াতে আসে হুটহাট তারা হয়তো এসব খবর রাখে। ফলে আপাতত লোক কম। ঝড় জল থেমে যাওয়ার পর দিঘা এখন শান্ত। ইলেকট্রিক লাইনের মেরামতিও প্রায় শেষ।

কিকিরারা এসেছিলেন সরকারি বাসে। সকালের বাস। দিঘা পৌঁছতে বেলা গড়িয়ে প্রায় দুপুর। রোদে তাপে, গরম দমকা হাওয়ায় কষ্ট হওয়ারই কথা। তবে বিকেলের পর আরামই লাগছিল।

চন্দন দিঘার সমুদ্রকে কোনওদিনই পাত্তা দেয় না। বলে, ‘ধ্যুত এই কি সমুদ্র! পুরী অনেক ভাল। জলের চেহারাই আলাদা। দিঘার সমুদ্রের জল দেখলে খালের জল মনে হয়।

চন্দন যাই বলুক, খানিকটা পড়ন্ত বিকেলে কিকিরারা তিনজনে টহল দিতে বেরোলেন। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে বালির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিকিরা হঠাৎ বললেন, “চাঁদু ডাক্তার, তুমি কপালকুণ্ডলা পড়েছ?”

চন্দন অবাক হয়ে বলল, “মানে! আপনি আমাকে গবেট মনে করেন নাকি? আশ্চর্য!”

 “আরে না, তুমি যদি গবেট হবে তবে ডাক্তারি বিদ্যেটা শিখলে কেমন করে! এমনি বললাম। বঙ্কিম এদিকে থাকার সময় কপালকুণ্ডলা লিখেছিলেন বলে শুনেছি। কাপালিককে মনে আছে?”

“আছে। আপনি কি কাপালিক খুঁজতে এসেছেন?”

“নো সার, আমরা এসেছি শ্রীমান রাজা–ওরফে রাজীবচন্দ্রকে খুঁজতে।”

“ও কি এখানে আছে?” তারাপদ বলল।

 “নন্দবাবু খোঁজখবর নিয়ে বলেছেন, কলকাতায় ছোকরা নেই, দিঘায় চলে এসেছে।”

“পাত্তা করতে পারবেন?”

“তোমাদের তো আগেই বলেছি, এদিকে কোথায় হোটেল তৈরি হচ্ছে খোঁজ করো, আর নন্দবাবুর বর্ণনা মতন একটি ছেলের চেহারা খুঁজে পেলে কাজটা অসাধ্য নয়।”

চন্দন বলল, “তা হলে সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন! হোটেল ঘরবাড়ি যেদিকে, সেদিকে হেঁটে বেড়ালেই হত।”

কিকিরা হেসে বললেন, “একটু হাওয়া খেয়ে নিচ্ছি। বিশুদ্ধ বাতাস। তাতে মগজ সাফ হবে। তা ছাড়া উদ্যম বাড়বে।”

“উদ্যম!” চন্দন ঠাট্টা করে বলল।

কিকিরা একই ভাবে হেসে বললেন, “মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ বারবার পাণ্ডবদের বলেছেন, উদ্যম আর ধৈর্য না থাকলে শত্রুকে জয় করা যায় না। আরে বাবা, আমাদের সাদা বাংলায় কী বলে? উদ্যম বিনে কার পুরে মনোরথ।”

চন্দন বিরক্ত হয়ে বলল, “মহাভারত রাখুন।”

“কেন! মহাভারতে কতরকম কৌশল-শিক্ষা আছে জানো? বড় বড় বীর মহাবীরকে কেমন ছলচাতুরি করে ফিনিশ করছে দ্যাখোনি!” বলেই কিকিরা গম্ভীর গলায় বললেন, “বলং বলো, কৌশলঃ মহাবলং …!”

তারাপদ জোরে হেসে উঠল। “দারুণ স্যাংস্কৃট, সার।”

“মাই স্যাংস্কৃট, সার। আমি পরোয়া করে স্যাংস্কৃট বলি না, আমাদের সময়ে স্কুলে সংস্কৃত পড়ানো হত। পরীক্ষায় আমি কোনওবার পনেরো কুড়ির বেশি নম্বর পাইনি। পণ্ডিতমশাই আমার নাম রেখেছিলেন ব্যাকরণ কৌতুকী’, মানে ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’-র ধরনে আর কী!”

তারাপদ হো হো করে হেসে উঠল। চন্দনও হেসে ফেলল।

সমুদ্রের ধার ঘেঁষে এখনও কিছু লোক হাঁটাচলা করছে। বালির ওপর হাত-পা ছড়িয়ে অলসভাবে বসে আছে কেউ কেউ। দু-তিনটি মহিলা গল্প করতে করতে হাঁটছিলেন। একটি ছেলে তার মেয়ে আর বউকে নিয়ে ফিরে আসছিল। সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে; আকাশ লাল হয়ে আছে পশ্চিম প্রান্তে। সমুদ্রের গর্জন অনেক শান্ত। ঝাউবনের দিকে ছায়া ঘন হয়ে এল।

তারাপদ বলল, “আর কতটা যাবেন, সার?”

“বেশি নয়। এবার ফিরব। ফিরে ওই কাফেটারিয়া, চায়ের দোকান, কাছের হোটেলগুলোয় একবার উঁকি দেব। বাসস্ট্যান্ড, বাজার ঘুরে আমাদের হোটেলে।”  

“রাজার খোঁজটা তা হলে …?”

“ঘোরাঘুরির মধ্যেই করতে হবে। হয়তো আশেপাশেই তাকে পেয়ে যাব।”

“কেমন করে?”

“আরে একটা ইয়াং ম্যান কি এই সন্ধে হওয়ার সময় তার ঘরে বসে থাকবে! এদিকেই কোথাও ঘুরছে ফিরছে। এখন কি আর তার হোটেলের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময়! ঘোরাফেরা করবে না। আর করলে এইদিকেই করবে। দিঘায় লোকজনের মুখ দেখতে হলে অন্য কোথাও গিয়ে লাভ!”

চন্দন বলল, “আর যদি দেখতে না পাই? তা ছাড়া তাকে তো আমরা চিনি না।”

“না চিনলেও আন্দাজ করতে পারব। নন্দবাবু ছেলেটির যে বর্ণনা দিয়েছেন চেহারার গায়ের রং, মুখের ছাঁদ, থুতনির তলায় দাড়ি, মাথার কোঁকড়ানো চুল …!”

তারাপদ বলল, “সার, অমন দাড়ি আজকাল অনেকেই রাখে।”

“রাখতেই পারে। তবু, শুধু দাড়ি নয়, গায়ের রং, মাথার চুল, চোখ। শোনো হে তারাবাবু, চোখে দেখা এক জিনিস আর ঠিকমতন লক্ষ করা অন্য জিনিস। শার্লক হোমস তাঁর শাগরেদকে বলেছিলেন, ওহে বন্ধু তুমি দেখো সবই কিন্তু মন দিয়ে লক্ষ করো না।”

“আপনি সার শার্লক হোমস হবেন নাকি?” ঠাট্টা করে তারাপদ বলল।

“কী যে বলো, উনি হলেন মহারাজ আর আমরা হলাম কলাগাছ!”

চন্দন হেসে ফেলল। “বললেন ভাল। … তা ধরুন আমরা ওই ছেলেটিকে দেখতে পেলাম না।”

“না পেলাম। তখন এখানে ওখানে, হোটেলে বাজারে, ইতিউতি খোঁজ করব, কাছাকাছি কোথায় নতুন হোটেল তৈরির কাজ হচ্ছে। দিঘায় তো একসঙ্গে গণ্ডায় গণ্ডায় হোটেল বাড়ি তৈরি হচ্ছে না। একটু হাতড়ালেই পেয়ে যাব ছোকরাকে।”

“দেখুন যদি পান। আমি কিন্তু সার, পরশু রবিবার দিনই পালাব। হাসপাতাল ফেলে এভাবে থাকতে পারব না এখানে।”

“কাল তো আছ! তার মধ্যেই রাজামশাইকে ধরে ফেলব।”

“ভাল কথা।”

 কিকিরারা এবার ফিরতে শুরু করলেন। সূর্য অস্ত গিয়েছে। ছায়া ঘন হয়ে অন্ধকার নেমে এসেছিল। সমুদ্র যেন মনোরম এক বাতাস বয়ে আনছিল, সামান্য এলোমেলো কিন্তু স্নিগ্ধ।

ভালই লাগছিল তারাপদর। কলকাতা শহর থেকে দু-একদিনের জন্যে বাইরে এলে চমৎকার লাগে যে, তাতে সন্দেহ নেই।

“সার?”

“বলো।”

“ওই রাজা ছেলেটির সঙ্গে যদি আপনার দেখা হয়ে যায়, কী বলবেন তাকে? আপনি ওকে চেনেন না, জানেন না।”

কিকিরা আকাশের দিকে তাকালেন। তারা ফুটে উঠছে। আসন্ন সন্ধ্যায় কয়েকটি বক উড়ে যাচ্ছিল ঝাউবনের দিকে। কিকিরা বললেন, “আলাপ করব। আলাপ না জমলে সুর ধরা যায় না,” বলে হাসলেন।

.

০৫.

কিকিরা ঠিকই বলেছিলেন। বাসস্ট্যান্ডের কাছে দোকানে বাজারে খোঁজ করতেই রাজাবা রাজীবদের খবর পাওয়া গেল। নিজেদের হোটেলেও খবর নিলেন, শুনলেন, হ্যাঁ–একটা নতুন হোটেল খুলেছে, জায়গাটা কাছেই। দিঘায় এখন হোটেল ব্যবসার রমরমা, সে যেমনই হোক। আরে দাদা, এক-একটা বড় ছুটি থাকলে এখানে মেলার মতন ভিড় জমে যায়, তখন মাথা গোঁজার জায়গা পায় না মানুষ। কলকাতার এত কাছে, বাসে মাত্র পাঁচ-ছ’ ঘণ্টার জার্নি। লোকে আসবে না কেন! ক’ বছরেই দিঘা কত পালটে গেল, ছড়িয়ে গেল। আরও যাবে।

 পরের দিন সকালবেলায় চায়ের পাট মিটিয়ে কিকিরারা বেরিয়ে পড়লেন।

বিশ পঁচিশ মিনিটও হাঁটতে হল না, জায়গাটা পাওয়া গেল। কিছু গাছপালা, সরু রাস্তা, তারপরই টিলার মতন উঁচু একটা স্তূপ–অনেকটা বালিয়াড়ির মতন দেখতে রাজীবদের হোটেলবাড়ি দেখতে পেলেন কিকিরা।

তারাপদ বলল, “সার, ওইটে বলে মনে হচ্ছে।”

কিকিরা মাথা নাড়লেন।

 সামান্য এগিয়ে আরও স্পষ্ট হল দৃশ্যটা।

 চন্দন বলল, “বাড়ি তো নতুন নয়।”

“সেরকমই মনে হচ্ছে। চলো দেখি।”

কাছাকাছি আসতেই বোঝা গেল, কোনও পুরনো বাড়ি যেন হাত বদলে রাজীবদের দখলে এসেছে। একতলা বাড়ি। বড়জোর মাঝারি মাপের। আশেপাশে বাগান। এক প্রান্তে ছোট আউট হাউস।

বাড়িটায় কাজকর্ম হচ্ছে বোঝা যায়। ইট, বাঁশের খুঁটি, বালি, লোহার ছড় মালমশলা চোখে পড়ে।

কিকিরা হালকাভাবে বললেন, “তারা, আমরা বেড়াতে বেরিয়েছি বুঝলে! কলকাতা পার্টি …। এই একটু ঘুরেফিরে দেখছি। আন্ডারস্ট্যান্ড। নো একোয়ারি, নাথিং।”

“বুঝলাম।”

সামান্য চড়াই। বেড়ানোর ভঙ্গিতে তিনজনে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়ে অবাক। উঁচু এই জায়গাটা যেন সত্যিই বালিয়াড়ি, বিশ পঁচিশ গজ তফাতেই উতরাই, তারপর বালি, গোটা দুয়েক ঝাউগাছ, মাটি তেমন চোখে পড়ে না। আর সামনেই সমুদ্র। যেন এখান থেকে হাত বাড়িয়েই সমুদ্র ছোঁয়া যায়। অবশ্য ওটা চোখের ভ্রম। সমুদ্রতট অন্তত শ’খানেক গজ তফাতে। জায়গাটা সত্যিই সুন্দর। তারিফ করতে হয়।

আড়াল থেকে কে যেন বেরিয়ে এল। বাড়িটার বারান্দার দিকে তাকালেন কিকিরা।

রাজা, মানে রাজীব নন্দী।

চিনতে অসুবিধে হল না। টকটকে ফরসা গায়ের রং। ছিপছিপে গড়ন। কাটা কাটা মুখ। থুতনির তলায় দাড়ি। ঘন জুলফি। কুচকুচে কালো মাথার চুল। কোঁকড়ানো। চোখের মণি ধূসর রঙের।

রাজীবের পরনে জিক্স-এর প্যান্ট, গায়ে ঢিলে ঢলঢলে রঙিন গেঞ্জি, সুতোর, পায়ে চটি। হাতে সিগারেট।

নিজেই এগিয়ে এল রাজীব। দেখল কিকিরাদের। “আপনারা?”

“বেড়াতে বেড়াতে এদিকে চলে এসেছিলাম,” কিকিরা বললেন, “দেখতে বড় ভাল লাগছিল। তাই উঠে এলাম ওপরে।” নরম করে হাসলেন কিকিরা।

“বেড়াতে এসেছেন? দিঘায় প্রথম নাকি?”

“অনেক আগে একবার…”

“কোথায় থাকেন?”

“কলকাতা।”

“ও!”

“এটা আপনার বাড়ি। বাঃ, বড় সুন্দর। কতটা উঁচুতে বাড়ি–সামনে সমুদ্র। অসাধারণ।”

“আমার বাড়ি নয়। একটা হোটেল তৈরির কাজ হচ্ছে।”

“তাই বলুন। আমরা ভাবছিলাম, বাড়িটার মেরামতির কাজ চলছে। হোটেল মানে তো বড় ব্যাপার। অনেক ঘরটর, খাওয়া-বসা, অফিস-?”।

মাথা নাড়ল রাজীব। “না, এখনই অত বড় করার ইচ্ছে নেই। এখানে এখন বড় মাঝারি, ভাল মন্দ অনেক হোটেল। আমরা এটাকে গেস্ট হাউস মতন করব। চার-পাঁচটা ঘর, অ্যাটাচড বাথ, বারান্দার দিকে বসার লাউঞ্জ। যে আসবে, থাকবে দু-চারদিন। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করছি না। সকালে ব্রেকফাস্ট দেওয়া হবে শুধু। বাকি খাওয়া বাইরে।”

“আচ্ছা! তাতে লোকের অসুবিধে হবে না?”

“হওয়ার কথা নয়। এখানে যারা বেড়াতে আসে তারা সকলেই একই হোটেলে খায় না। যার যেমন মরজি, মুখ বদল, মিল চার্ট বুঝে খেয়ে বেড়ায়। তবে কে বললে, আমরা বাইরে থেকে মিল আনিয়ে দেব।”

কিকিরা কথা বলতে বলতে রাজীব সম্পর্কে একটা ধারণা গড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ছেলেটিকে উদ্ধত, রাগী, রুক্ষ বলে তো মনে হচ্ছে না। নন্দবাবুর কথার সঙ্গে যেন মিলছে না ঠিক।

রাজীবই বলল, “আপনারা একটু ওপাশে সরে দাঁড়ান। রোদ লাগছে মাথায়। এরই মধ্যে রোদ চড়ে উঠেছে। … আপনারা ছাতাটাতা নিয়ে বেরুলেই পারতেন।”

কিকিরা মৃদু হাসলেন। “আবার ছাতা! সামান্য ঘোরাফেরা করে আমরা হোটেলে ফিরে যাব। বিকেলে আরও ঘোরা যাবে, যতটা পারা যায়।” বলেই কী যেন মনে পড়ল। তাড়াতাড়ি বললেন, “ভাই, আপনার নামটি জানা হল না। পরে কখনও এলে এখানে যদি উঠি!”

“আমার নাম রাজীব নন্দী।”

“আমি কিঙ্করকিশোর রায়, লোকে ছোট করে বলে কিকিরা। এরা আমার ইয়ং ফ্রেন্ডস, চন্দন আর তারাপদ।” কিকিরা পরিচয় করিয়ে দিলেন, বিস্তারিত বললেন না।

মিস্ত্রিমজুররা আসতে শুরু করেছিল। তাদের গলা পাওয়া যাচ্ছে, সঙ্গে ধুতি শার্ট পরা মাঝবয়েসি এক সর্দার, হাতে মাপজোকের ফিতে, একটা চটি মতন খাতা।

রাজীব চেঁচিয়ে কী যেন বলল লোকটিকে।

কিকিরা বুঝলেন, এবার তাদের ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু এভাবে কেমন করে ফিরে যাওয়া যায়! আরও খানিকটা দেখা দরকার। মাথায় একটা বুদ্ধি এল। বললেন, “এক গ্লাস জল পাওয়া যেতে পারে, ভাই? বড় তেষ্টা পেয়েছে।”

“জল খাবেন! আসুন,” বলে রাজীব ডানদিকে পা বাড়াল।

মেঠো জমি, বাগান, করবী ঝোঁপ, গন্ধরাজ ফুলের গাছ। দশ-বিশ পা ডাইনে বাড়িটার পিছন দিকে আসতেই আউট হাউসটা স্পষ্ট নজরে পড়ল। কোনাকুনি একটেরে গোটা দুই ঘর, তারই গা লাগিয়ে কোনাকুনি অন্য এক খুপরি। অ্যাসবেসটাসের ছাদ দেওয়া। আউট হাউসের ঘর দুটি কিন্তু পাকা, সামনে বারান্দা। বেতের চেয়ার পাতা ছিল এক জোড়া।

বারান্দার নীচে কলকেফুলের গাছের ছায়ায় একটা মোটরবাইক।

কিকিরা চন্দনের দিকে আড়চোখে তাকালেন।

চন্দনরা এখন পর্যন্ত একটাও কথা বলেনি। তারাপদ শুধু একবার তুচ্ছ একটা কথা বলেছিল।

হাঁটতে হাঁটতে কিকিরা বললেন, “এই গেস্ট হাউসের নাম কী হবে?”

“নাম এখনও ভাবিনি।”

“আমাদের চেনাশোনা বন্ধুবান্ধব এলে রেফার করতে পারতাম।”

“নাম একটা দেওয়া যাবে।”

“সাগরসঙ্গম। নামটা মুখে এসে গেল।” কিকিরা হাসলেন।

 রাজীবও হাসল। মন্দ নয়।”

আউট হাউসে পৌঁছে বারান্দায় উঠলেন কিকিরারা। রাজীব কাকে যেন ডাকল, “ভোলা, জল দিয়ে যাও।” কিকিরাদের দিকে তাকাল, “বসুন আপনারা। ওই কাঠের চেয়ারটাও টেনে নিন।”

পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ গলা মুছলেন কিকিরা। এখানেই কি আপনি থাকেন?”

“হ্যাঁ, আমরা এখন আউট হাউসেই থাকি। ও-বাড়ির কাজ চলছে, থাকার উপায় নেই।”

ভোলা জল নিয়ে এল। কলাইকরা জলের জগ। কাঁচের গ্লাস। ও বোধ হয় নজর করেছিল, দু-তিনজন বারান্দায় এসে উঠেছেন।

জল খাওয়া হয়ে গেলে কিকিরা বললেন, “আমরা তবে আসি?”

“আসবেন! দাঁড়ান, ভোলা বোধ হয় চা খাওয়াবার ব্যবস্থা করছে। ভোলা কি চা হবে?”

“আনছি।”

ভোলা চলে গেল।

চন্দন হঠাৎ বলল, রাজীবের দিকে তাকিয়ে। “আপনার বাঁ হাত কি ভাঙা?”

 রাজীব নিজের বাঁ হাত দেখল। হাসল। “ছেলেবেলার দুরন্তপনার চিহ্ন। ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে ছাদ থেকে পড়েছিলাম। মাটিতে পড়লে আর বেঁচে থাকতে হত না। গাড়িবারান্দার ছাদে পড়েছিলাম।…আপনার তো নজর আছে।”

“ভাল সেট হয়নি, চোখে পড়ে…।”

“ও ডাক্তার,” কিকিরা বললেন।

“আচ্ছা! তাই বলুন।” বলে কী মনে করে মজার মতন মুখ করে হাসল রাজীব। “আমার বাবা ডাক্তার ছিলেন। শুনেছি তাঁর সাধ ছিল আমায় ডাক্তারি পড়াবেন। সাধ মেটেনি। আমার বছর দশেক বয়েসে বাবা মারা যান। অদ্ভুত ভাবে। ওঁর শখ ছিল বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবার। শিকার করারও নেশা ছিল। জঙ্গলে বেড়াতে গিয়েই মারা যান।”

“ইস–স্যাড” কিকিরা বললেন, “জন্তু-জানোয়ার অ্যাটাক করেছিল?”

“না। একটা পাথরের চাঁই ওপর থেকে খসে গড়িয়ে পড়ে মাথার পেছন দিকে এসে লেগেছিল।”

কিকিরা আফসোসের শব্দ করলেন। “দুর্ভাগ্য! মানুষ যে কীভাবে মারা যায়!…তা ভাই, আপনি সেই ছেলেবেলা থেকে–”

“আমার দাদুর কাছে মানুষ।”

“কলকাতায় কোথায় বাড়ি?”

“হাতিবাগান।” রাজীব বাড়ির একটা বর্ণনা দিল, নাম বলল রাস্তার, “ওটা আমার দাদু-মানে মায়ের বাপের বাড়ি। ওই বাড়িতেই আমি মানুষ, বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে। আমাদের নিজেদের বাড়ি সুরি লেন, বাবার ভাই জ্ঞাতিগোষ্ঠীরা সেখানে থাকে। আমরা থাকি না।”

কিকিরারা চুপ করে থাকলেন। রোদ ঝলসে উঠছে, দমকা বাতাসও এল। মিস্ত্রিমজুরের গলা। এখান থেকে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে না, আড়াল পড়ে গিয়েছে, শব্দ শোনা যাচ্ছিল, ঢেউ যেন এখন অনেক শান্ত।

তারাপদ হঠাৎ বলল, “এই বাড়িটা আপনারা কিনেছেন?”

“হ্যাঁ,” রাজীব মাথা নাড়ল। “পনেরো-বিশ বছরের পুরনো বাড়ি। কাঁথির এক ভদ্রলোকের বাড়ি। উনি মারা যাওয়ার পর ওঁর স্ত্রী ভাগলপুরে চলে যান। ছেলেমেয়ে ছিল না। এই বাড়িটা ফাঁকাই পড়ে থাকত। তখন দিঘায় লোকজনও বেশি আসত না। আমার পার্টনার যোগাযোগ করে বাড়িটা কিনে নেয়।”

“তাঁকে তো দেখছি না?”

“না, এখন আমি আছি বলে সে অন্য কাজে ব্যস্ত, খঙ্গপুরে তার বাড়িতে গিয়েছে। আমরা দুজনে একসঙ্গে এখানে কমই থাকি। ও যখন থাকে, কাজকর্ম দেখাশোনা করে এদিককার, আমি কলকাতায় চলে যাই। আবার আমি ফিরে এলে ও চলে যায়।”

“অল্টারনেট ব্যবস্থা।”

 রাজীব হাসল।

ততক্ষণে চা এসে গিয়েছে। হাতে হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিল ভোলা। বেতের গোল একটা টেবিলও পড়ে ছিল সামনে।

চায়ে চুমুক দিয়ে কিকিরা তারিফ করলেন চায়ের। পরে বললেন, “আপনাদের এই সাগরসঙ্গম চালু হবে কবে?” বলে হাসলেন।

রাজীব বলল, “আশা করছি জুনের আগেই। আর মাস দুই লাগবে বড়জোর।”

“বর্ষার আগেই তবে তা ভাল। শুভস্য শীঘ্রম।” হাসলেন কিকিরা। “আমরাও চলে আসতে পারি।…আজ তা হলে চলি, ভাই। আপনার সঙ্গে আলাপ করে বড় ভাল লাগল।”

চা শেষ করে তিনজনে উঠে পড়লেন।

বারান্দা দিয়ে নামার সময় চন্দনের আবার নজর পড়ল মোটরবাইকের দিকে। কিকিরাদের কাছে সে নন্দবাবুর কথা শুনেছে, বাইকের ধাক্কা খেয়েছেন ভদ্রলোক। তাঁর ধারণা ওটা দুর্ঘটনা নয়, তাঁকে জখম করার চেষ্টা।

চন্দন চোখের ইশারায় বাইকটা দেখাল রাজীবকে। “আপনি কি মোটরসাইকেল নিয়ে কলকাতা যান? এতটা রাস্তা!”

“না। আমার যাওয়ার ঠিক নেই। কখনও বাসে যাই, কখনও খঙ্গপুর পর্যন্ত গিয়ে লোকাল ধরি, আবার চেনাশোনা কন্ট্রাক্টারদের জিপ-টিপ যাচ্ছে দেখলে তাতেও চলে যাই। কেন বলুন তো?”

“এমনি বললাম,” চন্দন বলল, “এই রাস্তাটায় মাঝে মাঝেই শুনি অ্যাক্সিডেন্ট হয়। এই তো কদিন আগেই কাগজে দেখছিলাম এক ভদ্রলোকের স্ত্রী মেয়ে সবাই হেড অন কলিশনে মারা গিয়েছেন। ভদ্রলোক নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছিলেন।”

রাজীব বলল, “পড়েছি কাগজে, শুনেছি। বেশিরভাগ অ্যাক্সিডেন্টই হয় কেয়ারলেস ড্রাইভিংয়ের জন্যে। ভদ্রলোক শুনলাম নতুন গাড়ি কিনে বেশি বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। ব্যাড লাক।”

কিকিরারা আর দাঁড়ালেন না। মাথার ওপর সূর্য গনগনে হয়ে উঠেছে, বালি তেতে যাচ্ছে ভীষণ।

.

রাস্তায় এসে তারাপদ বলল, “কী সার? কেমন মনে হল?”

কিকিরা বললেন, “মনে হওয়ার মতন এখন কিছু হয়নি। ছেলেটি হয় সরল সাদামাটা ভদ্র; না হয় অত্যন্ত চতুর ধূর্ত। ওপর থেকে কিছু বোঝা যায় না।”

চন্দন বলল, “রাজীবকে আমার কিন্তু খারাপ লাগেনি। ওকে ক্রিমিন্যাল ভাবা যায় না।”

“বোধ হয়। তবু দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়,” কিকিরা বললেন।

.

০৬.

কলকাতায় ফিরে কিকিরা নন্দবাবুর সঙ্গে দেখা করলেন না। করার কোনও প্রয়োজনও আপাতত আছে বলে তাঁর মনে হয়নি। নন্দবাবু জানেনও না, কিকিরা এর মধ্যে রাজীবের খোঁজে দিঘা গিয়েছিলেন।

কিকিরা চাইছিলেন, একবার হাতিবাগানের বিশ্বাসবাড়ির ছোটকর্তাবৃদ্ধ সুবর্ণকান্তির সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু সেটা কেমন করে সম্ভব? কিকিরার পরিচিত এমন কেউ নেই যাকে সঙ্গে নিয়ে, বা যার সুপারিশে ছোটবাবুর সঙ্গে দেখা করতে পারেন।

তারাপদ আর চন্দনকেও তিনি বলে রেখেছিলেন, একটু খোঁজে থাকো, যদি কাউকে পেয়ে যাও–ও পাড়ার লোক, বিশ্বাস ফ্যামিলিকে চেনে, আমাদের একবার ও-বাড়ির সদরে ঢুকিয়ে দেবে।

তারাপদরাও এরকম কোনও বন্ধুবান্ধব, চেনাজানা লোক পাচ্ছিল না। দিন চারেক এইভাবেই কেটে গেল, কাজের কাজ কিছুই হল না।

সেদিন কিকিরার বাড়িতে বসে কথা বলতে বলতে তারাপদ বলল, “সার, নন্দবাবুর মামলা নিয়ে আর মাথা ঘামাবেন না। ছেড়ে দিন। তুচ্ছ ব্যাপার ওটা; আপনার মতন বুদ্ধিমান লোকের ওখানে নাক গলানো পোষাচ্ছে না।”

কিকিরা একটা পুরনো ডায়েরি-বুকের পাতা ওলটাচ্ছিলেন। মুখ না তুলেই বললেন, “না হয় দিলাম; কিন্তু কেন বলবে তো?”

“সত্যি কথা বলতে কি সার, আমি আর চাঁদু মনে করি না-রাজা বা রাজীব গুণ্ডা মস্তান গোছের ছেলে। তাকে দেখলে কেউ একথা বলবে না। নন্দবাবু কেন যে তার সম্পর্কে অত বাজে কথা বলছেন–আমরা বুঝতে পারছি না।”

চন্দন বলল, “নন্দবাবুর সঙ্গে রাজীবের তো সরাসরি কোনও শত্রুতা নেই। তবে কেন সে ভদ্রলোককে শাসাতে যাবে, আর কেনই বা মোটরবাইক চাপা দিয়ে জখম করতে যাবে?”

কিকিরা অল্পক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বললেন, “মুখ দেখে মানুষ চিনতে অনেক সময় ভুল হয় হে! …তা এত তাড়াতাড়ি রাজীবকে জামিন দেওয়ার কারণ নেই। আর একটু দেখা যাক। …আচ্ছা শোনো, আমার এই পুরনো ডায়েরিতে হরেনবাবু বলে একজনের নাম দেখেছি। গ্রে স্ট্রিটের দিকে থাকতেন, রাধাকান্ত দেব লেন– বা ওইরকম একটা কিছু হবে। খোঁজ নিতে পারো?”

তারাপদ বলল, “অবাক কথা বলছেন তো আপনি! আপনার ডায়েরিতে নাম; আর খোঁজ নেব আমরা!”

“হরেনবাবু ভদ্রলোকটি কে?” চন্দন জিজ্ঞেস করল।

“মিউজিক হ্যান্ড। বাঁশি বাজাতেন; তবলা হারমোনিয়ামেও দখল ছিল। থিয়েটারে, রেকর্ড কোম্পানিতে কাজকর্ম করতেন। আমার সঙ্গে আলাপও হয়েছিল তাঁর। লোকটি খেপাটে, মুখে সবসময় পান, না হলে আড়বাঁশি। তবে হ্যাঁ-বাঁশিতে পয়লা নম্বর।”

“যা বাবা, বাঁশিঅলা আপনার কী করবে?”

“কী করবে বলতে পারি না, নট নাউ! বিশ্বাসবাড়ির ছোটকর্তা সুবর্ণকান্তির একসময় দোকান ছিল গ্রামোফোন রেকর্ড বিক্রি করার। সেখানে গাইয়ে বাজিয়ের আড্ডা বসত প্রায়ই। নন্দবাবুই বলেছেন। হরেনবাবু ছোটকর্তাকে চিনতে পারেন।”

তারাপদ বিরক্ত হয়ে বলল, “আপনি যে কী বলছেন আমি মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছি না। সুবর্ণবাবুর দোকান ছিল তাঁর যৌবনকালে, এখন তিনি বুড়ো, হরেন তাঁকে কেমন করে চিনবেন!”

কিকিরা ডায়েরি বন্ধ করে মুখ তুললেন। মানে ভাল করে দেখলেন তারাপদদের। পরে বললেন, “তোমাদের ব্রেন দিন দিন কমজোরি হয়ে যাচ্ছে। ঘিলু শুকিয়ে গেলে গোবর-গণেশ হয়ে যাবে।” বলে কিকিরা হাসলেন। তারপর দাঁড়িয়ে পড়ে হাত মাথার ওপর তুললেন। আলস্য ভাঙলেন। ঘরের মধ্যে জায়গা কম। দু’পা হাঁটলেন। শেষে বললেন, “সুবর্ণবাবু যৌবন বয়েসে দোকান সাজিয়ে বসেছিলেন–মানেটা কী! যৌবন বলতে তুমি কি তাঁর বিশ-পঁচিশ বছর বয়েস বোঝো? সেটা তিরিশ-চল্লিশ হতে আপত্তি কোথায়? পঁয়তাল্লিশও হবে না কেন? ওভাবে হিসেব হয় না। আমি ধরে নিচ্ছি সুবর্ণবাবুর বয়েস এখন যদি সত্তর হয়– তবে বছর কুড়ি-বাইশ আগেও তাঁর গ্রামোফোনের দোকানটা ছিল। তখন তাঁকে হরেনবাবুরা দেখলেও দেখতে পারেন। আলাপও থাকতে পারে।”

“হরেনবাবুর বয়েস কত হতে পারে?” চন্দন জিজ্ঞেস করল।

 “ক-ত! সঠিক বলতে পারব না। যাটের গায়ে গায়ে হবে।”

“তিনি এখনও পুরনো ঠিকানায় আছেন?”

“ঠিকানা জানি না। গলির নাম লেখা আছে ডায়েরিতে। ওখানে গিয়ে খোঁজ করলে ভদ্রলোককে পাওয়া যেতে পারে। অবশ্য অনুমানে বলছি!”

তারাপদ বলল, “কিন্তু সার, উনি যে এখনও বাঁশি বাজান আপনি জানেন?”

“না। সেটা খোঁজ করলেই জানা যাবে। তবে আমি জানি হরেনবাবু ওই পাড়ার একটা রেকর্ড কোম্পানির রিহার্সাল অফিসে নিয়মিত যেতেন। হয় বাঁশি না হয় তবলা বাজাতেন। হারমোনিয়ামেও হাত লাগাতেন।”

“তা হলে তো সেই রেকর্ড কোম্পানির অফিসে গিয়ে খোঁজ করলেই হয়।”

“তাও হয়। ..মুশকিল হল, সেই অফিস এখনও আছে কিনা জানি না।”

 বগলা চা দিয়ে গেল। গরমে সর্দিজ্বরে ভুগেছে সবে। মুখ শুকনো কাহিল কাহিল লাগছিল।

চন্দনের ডাক্তারিতে বগলা আপাতত নিজেকে সামলে নিলেও গায়ে-গতরে খানিকটা নির্জীব হয়ে রয়েছে।

চা খেতে খেতে তারাপদ বলল, “আপনি তবে লেগে পড়ুন সার। দেখুন হরেনবাবুকে খুঁজে পান কিনা!”

“আমি রেকর্ডিং কোম্পানির অফিসে খোঁজখবরটা নেব। তোমরা বাড়ির খবরটা জোগাড় করার চেষ্টা করো। মনে হয় পেয়ে যাব।”

“ঠিক আছে, বলছেন যখন খোঁজ করব”, তারাপদ বলল। তার গলায় তেমন উৎসাহ নেই, যেন নিতান্তই কিকিরার কথা রাখতে সে খোঁজ করবে, আশা-ভরসা তার নেই।

কিকিরা বললেন, “কালকেই যাও একবার। আমিও কাল বেরোব।” চন্দন বলল, “একটা কথা বলব, সার?”

“বলো।”

“ধরে নিলাম কোনওভাবে আপনি বিশ্বাসবাড়ির চৌকাঠ ডিঙোলেন, বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সঙ্গে আপনার দেখাও হল। কিন্তু যদি দেখেন রাজীব সেখানে হাজির, কিংবা আপনার আসা-যাওয়ার পথে তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তখন কী করবেন? ধরা পড়ে যাবেন না?”

কিকিরা অস্বীকার করলেন না কথাটা। বললেন, “আমি একটা হিসেব করেছি। ধরে নিচ্ছি, রাজীব আজ কাল পরশুর মধ্যে দিঘা থেকে ফিরবে না। তার পার্টনার দিঘায় না-যাওয়া পর্যন্ত সে কাজকর্ম ফেলে কলকাতায় আসছে না। সম্ভবত নয়।”

 “আপনি একটা চান্স নিতে চান?”

“হ্যাঁ। …তবু অন্যভাবে একবার জেনে নেওয়ার চেষ্টা করব, রাজীব কলকাতায় ফিরেছে কি না?”

“অন্যভাবে মানে?”

“নন্দবাবুর দোকানের শ্রীকুমারকে বলব, খোঁজ করে জেনে আসতে।”

“নন্দবাবুর সঙ্গে আপনি তো আর দেখাই করছেন না!”

“না। ইচ্ছে করেই। অযথা মুখ দেখিয়ে লাভ কী! তা ছাড়া সুবর্ণবাবুর সঙ্গে একবার দেখা না করে আমি নন্দবাবুর বাড়ি যেতে চাই না।”

চন্দন কিকিরাকে নজর করে দেখল। ওঁর গলার স্বর খানিকটা অন্য রকম। কানে লাগল। দ্বিধা হল চন্দনের, তবু বলল, “আপনার মনে যেন কোথাও খোঁচা লেগেছে?”

কিকিরা কথাটার জবাব দিলেন না। না দিয়ে হাত বাড়ালেন, “কই, একটা সিগারেট দাও দেখি। গরমে নেতিয়ে যাচ্ছি। পিক আপ দরকার।”

.

০৭.

পরনে চেককাটা লুঙ্গি, গায়ে ঢিলেঢালা ফতুয়া। মাথার কাঁচাপাকা চুল ফুলেফেঁপে ঝুঁটির মতন দেখায়। মনে হয় না ভদ্রলোক সেলুন বা নাপিতের পরোয়া করেন। মুখে অবশ্য দাড়ি নেই, পাতলা গোঁফ আছে, পাকা।

পুরনো কলকাতার গলি। মোটামুটি চওড়াই বলতে হবে, টেম্পো, ছোট ট্রাক ঢুকে পড়তে পারে অনায়াসেই। গায়ে গায়ে বাড়ি, খানিকটা স্যাঁতসেঁতে চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে। এবাড়ি ও-বাড়ির সামনে রোয়াক। এক জায়গায় জনাকয়েক ছেলে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। কিকিরা আর তারাপদ সদর পেরোতেই হরেনবাবুর গলা পেলেন।

বাঁদিকের ঘরের দরজা খুলেই বসে ছিলেন হরেনবাবু। “এই যে যদুমাস্টার আসুন। আমি ঘড়ি ধরে বসে আছি।”

কিকিরা ভেতরে এলেন; পেছনে তারাপদ।

মজার গলায় কিকিরা বললেন, “আমার নামটা এখনও ভোলেননি দেখছি।” বলে তারাপদর দিকে তাকালেন, বললেন, “হরেনদা আমার জাদুকর পেশাটাকে যদুমাস্টারে পালটে দিয়েছিলেন। এখনও ওঁর সেটা মনে আছে ভাবিনি।”

হরেনবাবু হাসছিলেন। “বসুন বসুন। আগে বসা হোক, তারপর কথা।”

ঘরের মধ্যে একটা চওড়া তক্তপোশের ওপর ফরাস পাতা। চাদরটা ময়লা হয়ে গিয়েছে। জানলার দিকে একটামাত্র কাঠের চেয়ার। দেয়াল জুড়ে নানান ছবি। বাঁধানো ফোটোগ্রাফ, কোনওটা গ্রুপ ফোটো, কোনওটা একলা হরেনবাবু। একপাশে সরস্বতীর পট, দেয়াল-তাকে এটা-ওটা সাজানো, ফরাসের এককোণে একটা হারমোনিয়াম, পাশে ডুগি তবলা।

ঘরের মধ্যে গান চলছিল। আলো জ্বালানোর সময় হয়ে এসেছে দেখে আলোও জ্বালিয়ে দিলেন হরেনবাবু।

কিকিরারা ফরাসের ওপর বসলেন, “কেমন আছেন দাদা?”

“আছি। পুরনো হলে বাঁশেও ঘুন ধরে। আমারও ধরেছে।”

“অসুখবিসুখ?”

“তা ঠাকুরের দয়ায় হাঁপানিটা বারো মাসে তেরো পার্বণের মতন লেগেই আছে। ব্লাড প্রেশারটাও চড়া। কী আর করা যাবে ভাই! গিন্নি সটকান দিল। আমি বলতাম, ওগো তেজ দেখিয়ো না, ড্যাংড্যাঙিয়ে চলে যাব আগে আমি, তুমি থাকবে পড়ে। তো সেই আগে চলে গেল। এখন আমি পড়ে আছি। সংসার বলতে ছেলে, বউমা আর এক নাতি। দিন কেটে যাচ্ছে।”

কিকিরার কষ্টই হল। হরেনদা বরাবরই রসিক মানুষ ছিলেন। মুখে হাসি লেগেই থাকত। সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “বাজনাটাজনা ছেড়ে দিয়েছেন নাকি?”

“চোদ্দ আনা। বাঁশি আর ছুঁই না, দম কোথায় কলজেতে, হাঁপানি রোগী। তবে একেবারে বসে থাকি কেমন করে! দু’-পাঁচটা ছাত্র আছে–তারা হপ্তায় দু’ তিনদিন আসে। এখানে বসে বাজায়টাজায়। শুধরে দিই।”

কিকিরা ফরাসের ওপর পড়ে থাকা হারমোনিয়াম ডুগিতবলার ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন।

“আমার কথা হল, আপনার কথাটা বলুন তো যদুমাস্টার। ওই ছেলেটি পরশুদিন আমার বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে হাজির,” বলে তারাপদকে দেখালেন হরেনবাবু। “আপনার কথা বলল। প্রথমটায় থমকে গিয়েছিলাম। ধরতে পারলাম ঠিকই যখন বলল, আপনি ম্যাজিশিয়ান ছিলেন একসময়। তবে অবাক হলাম এই ভেবে যে, এতকাল পরে আপনি আমার খোঁজ করে দেখা করতে চান।”

কিকিরা বললেন, “আমি আপনাদের সেই রেকর্ড কোম্পানির অফিসের খোঁজেও গিয়েছিলাম। শুনলাম, উঠে গিয়েছে।”

“সে তো কবেই।”

“আমার পুরনো ডায়েরি খাতায় আপনার নাম পেলাম। গলির নাম। ঠিকানা মানে বাড়ির নম্বরটা লেখা ছিল না। তারাপদকে খোঁজ করতে পাঠিয়েছিলাম।”

“আমরা আর কোথায় যাব, ভাই! দু’পুরুষের বাড়ি। ইটকাঠের চেহারা দেখেই বুঝতে পারছেন। …যাক গে, এবার আসল কথাটা শুনি। আমায় হঠাৎ মনে পড়ল কেন? …দাঁড়ান, আগে একটু চায়ের কথা বলে নিই।” বলে হরেনবাবু ভেতর-দরজার ওপারে গিয়ে হাঁক পাড়লেন, “বউমা, নীচে লোক এসেছেন, দু-তিনজনের চা পাঠাও।”

ফিরে এসে বসলেন আবার। পানের ডিবে থেকে পান বার করে মুখে দিলেন। “বলুন?”

কিকিরা সরাসরি বললেন, “আপনি হাতিবাগানের বিশ্বাসবাড়ির ছোটকর্তা সুবর্ণকান্তিকে চেনেন?”

“কে? সোনাবাবু! চিনব না কেন? বিলক্ষণ চিনি। ওঁকে আমরা সোনাবাবু বলতাম।”

“ভদ্রলোকের দোকান ছিল একসময়; গ্রামোফোন রেকর্ড বিক্রি হত…।”

“আরে হ্যাঁ, ওই তো–যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউতে, বিশ্বাস মিউজিক্যাল হাউস। বাহারি দোকান ভায়া, অন্য পাঁচটা দোকানের মতন একেবারেই নয়। দিব্যি বড় ঘর, কাঠের ঠেলা-দরজা, দোকানের একপাশে রেকর্ড, গ্রামোফোন মেশিনটেশিন বিক্রি হত; অন্য পাশে পার্টিশানের এপাশে সোফাসেটি চেয়ার গালচে। সেখানে জমাট আড্ডা বসত গাইয়ে বাজিয়ের, চা পান চুরুট চলত। মাঝে মাঝে খাবারদাবার আসত। হইচই হাসি তামাশা…”

“আড্ডার দোকান?”

“হু, তা বলতে পারেন। সোনাবাবুর যে একটা রেকর্ড কোম্পানি ছিল। বেঙ্গল মিউজিক্যাল রেকর্ডস। বেশি না হলেও কিছু রেকর্ড বার করেছিলেন। গাইয়ে-বাজিয়েদের আসা-যাওয়া তো থাকবেই।”

“দোকান উঠে গেল কেন?”

 হরেনবাবু হাসলেন, “ব্যবসা চালাবার মানুষ সোনাবাবু ছিলেন না। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি, খরচার খাতা ভারী হতে হতে গণেশ উলটে গেল।”

“তারপর আর উনি কিছু করেননি?”

“আমার জানা নেই, ভায়া। করেছেন বললে বলতে হয়, শরিকি মামলা মোকদ্দমা আইন আদালত। আগেও করেছেন পরেও করেছেন। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা উকিল ব্যারিস্টারের পকেটে ঢেলে এসেছেন। আর বোঝেনই তো, বড় বড় বাড়ির দেওয়ানি মামলা এক যুগেও শেষ হয় না। সোনাবাবুর জীবনটা এইভাবেই কেটে গেল। খেয়ালি মানুষ, আগুপিছু না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়েন, শেষে মাঝপুকুরে গিয়ে গলা ডুবে যায়, হাঁসফাঁস করেন। … কিন্তু যদুমাস্টার আপনি হঠাৎ সোনাবাবুর খোঁজ নিচ্ছেন কেন?”

ওপর থেকে ততক্ষণে একটি কমবয়েসি মেয়ে এসে চা, মিষ্টি, কাটা ফল দিয়ে গিয়েছে। হরেনবাবু হাত বাড়িয়ে তুলে নিতে বললেন কিকিরাদের।

“খোঁজ নেওয়ার দরকার পড়েছে, দাদা। বলব আপনাকে,” কিকিরা বললেন, “তার আগে আরও দু-একটা কথা জেনে নিই। …আপনি ওঁকে শেষ কবে দেখেছেন?”

“শেষ! শেষ দেখেছি বছর দুই আগে। আমি নিজেই আজকাল তেমন একটা বেরোই না বাইরে। উনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন, গিয়েছিলাম।”

“ডেকে পাঠিয়েছিলেন কেন?”

“এই তো মুশকিলে ফেললেন, যদুমাস্টার। সব কথা কি বলা যায়? উচিতও নয়।”

“সিক্রেট! তা হলে বলবেন না।”

“বলেই ফেলি। অনেকদিন হয়ে গেল, ক্ষতি কিছু হবে না। আমার এক ভায়রাভাইয়ের জুয়েলারির ব্যবসা আছে। সোনাবাবুর জানা ছিল। ওঁর তখন টাকার দরকার। ভীষণ জরুরি। পেনেটির বাগান ক্রোক হয়ে যাচ্ছে। আদালতের খাঁড়া মাথার ওপর। সোনাবাবু একটা নেকলেস বিক্রি করবেন। জড়োয়ার নেকলেস, হিরে আছে এক জোড়া, মুক্তো, পান্না। বাজারে গিয়ে নেকলেস ফেলে দেবেন সোনাবাবু, তাই কি হয়! তার ওপর দাঁও মারার লোকের অভাব নেই। কেউ ঠেকায় পড়লে তাকে ঠকাবার লোকের অভাব হয় না। সোনাবাবু অতটা ঠকতে রাজি নন, আবার লোকের চোখের আড়ালে বেচতে হবে। আমায় তাই ডেকে পাঠিয়েছিলেন।”

কিকিরা একবার তারাপদর দিকে তাকালেন। তারাপদ ফলের টুকরো তুলে মুখে দিয়েছে ততক্ষণে।

“অবস্থা তা হলে খুবই খারাপ বলুন” কিকিরা বললেন।

“অবস্থা–!..কী বলব ভাই যদুমাস্টার, বাড়িতে ঢুকলে মনে হয় না, এই সেই বিশ্বাসবাড়ি যেখানে দেড়শো বছর ধরে দোল দুর্গোৎসব হয়েছে রমরম করে। বাড়ির তিনটে ভাগ তিন শরিকের; সব শরিকেরই একই অবস্থা, উনিশ-বিশ তফাত। সোনাবাবুর বাড়িতে আগেও গিয়েছি, অমন দৈন্যদশা চোখে পড়েনি। ঘরদোর মেঝে ছাদ দরজা জানলা–সবদিকে তাকাও, ভূতের বাড়ির মতন পোড়ো আর ময়লায় ভরতি। দেখলে কষ্ট হয়।”

কিকিরা বললেন, “শুনলাম, ওঁর নাকি এখন এমন অবস্থা যে–বাড়ির যেখানে যা আছে বিক্রি করে দিয়ে সংসার চালান।”

“আমারও কানে গিয়েছে কথাটা। সোনাবাবু আজকাল চোখেও প্রায় অন্ধ হয়ে এসেছেন শুনেছি। মাথারও ঠিক থাকে না।”

কিকিরা চা খাচ্ছিলেন।

“আপনার দরকারটা তো বললেন না?” হরেনবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন।

 “বলব বইকি, দাদা। আমাকে আর একটা কথা বলুন।”

“কী?”

“সুবর্ণবাবুর একটি নাতি আছে। রাজীব…”

“রাজু! হ্যাঁ, আছে। কেন?”

“চেনেন তাকে?”

“চিনি বইকি! ছোটবেলা থেকে দেখছি।”

“তার খবর রাখেন নাকি?”

“খবর? না? চিনি; দেখেছি। কথাবার্তাও বলেছি দেখা হলো কেন, সে কী করেছে?”

“ছেলেটি কেমন? মানে আপনার ধারণা?”

হরেনবাবু কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন কিকিরার দিকে। পরে বললেন, “বাপ-মরা ছেলে, দাদুর কাছেই মানুষ ও। কম বয়েস থেকেই ওকে দেখেছি মাঝে মাঝে। সোনাবাবুর মুখে নাতির কথা যা শুনেছি কখনও-সখনও, তাতে তো মনে হয়নি রাজু ওঁকে জ্বালিয়ে মারে। বিরক্ত হয়েছেন বলেও জানি না। এখন সে বড় হয়েছে, দাদুর সঙ্গে কেমন সম্পর্ক বলব কেমন করে! আমি জানি না। …আপনি এসব কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?”

কিকিরা শেষ কথাটা যেন শোনেননি। বললেন, “রাজীব যে দিঘায় একজনের সঙ্গে পার্টনারশিপে হোটেল খুলছে, জানেন?”

“না”

“হালে তাকে দেখেননি?”

“না। কেন?”

“দাদুর হাতে টাকা নেই, নাতি হোটেলের ব্যবসায় নামছে, টাকা পাচ্ছে কেমন করে?”

হরেনবাবু এবার বিরক্ত হয়েই বললেন, “আরে ভায়া, এসব সাংসারিক কথা কি আমার জানার কথা! আপনারই তাতে কী! তবে রাজুর বাবার তরফে কানাকড়িও ছিল না–আপনি জানলেন কেমন করে? ওর মায়ের গয়নাগাটিও তো থাকতে পারে।…আপনি ঠিক কী জানতে চাইছেন বলুন তো?”

কিকিরা নিজেকে শুধরে নিয়ে মোলায়েম গলায় বললেন, “দাদা, আমি একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছি বলেই কথাগুলো জানতে চাইছিলাম। আপনি কিছু মনে করবেন না।…আচ্ছা, আপনি আমাকে একবার সুবর্ণবাবুর কাছে নিয়ে যেতে পারেন?”

মাথা নাড়লেন হরেনবাবু, “না, ভাই। যাঁর সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয় না, খোঁজ রাখি না, তাঁর দুর্দিনে আমি আপনাকে কোন দরকারে নিয়ে যাব! না, আমি পারব না। আপনার দরকার থাকলে নিজে যান। কিছু কিনতে চান নাকি?”

কিকিরা বুঝলেন, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।

 কথা ঘুরিয়ে অন্য প্রসঙ্গ তুলে খানিক গল্প করলেন কিকিরা। তারপর উঠে পড়লেন তারাপদকে নিয়ে।

.

০৮.

ছ’-সাতটা দিন তারাপদদের সঙ্গে কিকিরার দেখা-সাক্ষাৎই হল না। না হওয়ার কারণ মাঝে দু দিন পর পর কলকাতায় সন্ধের গোড়ায় ঝড়বৃষ্টি হয়ে গেল। চৈত্রমাসের কালবৈশাখী। যেভাবে লাফে লাফে গরম পড়ছিল, এক-আধ পশলা বৃষ্টির জল না পেলে শহরটার আগুনে রুক্ষ চড়া-ভাব আর কমত না। বৃষ্টি হয়ে বাঁচিয়ে দিল মানুষগুলোকে।

তবু তারাপদরা একদিন এসেছিল কিকিরার কাছে। দেখা পায়নি। তিনি যে কোথায় গিয়েছেন বগলাও বলতে পারল না।

সাতদিনের মাথায় দেখা পাওয়া গেল কিকিরার।

চন্দন বলল, “আপনি কি উধাও হয়ে গিয়েছিলেন? আমরা এসে ফিরে গিয়েছি। বগলাদা বলেনি?”

কিকিরা মাথা নাড়লেন। “বলেছে। ঝড়বৃষ্টির দু’দিন বেরোতে পারিনি। তোমরা তার পরে এসেছ?”

“গিয়েছিলেন কোথায়?”

“নন্দবাবুর বাড়ি।”

“ও! কেমন আছেন ভদ্রলোক?”

“পায়ের ব্যথা কমেছে। হাঁটতে পারছেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। হাতের প্লাস্টার কাটতে দেরি আছে।”

“কতদিন হল? ছ’ সপ্তাহের আগে”

“নন্দবাবু বললেন, আলমারিটা তিনি ফেরত পাঠিয়ে দেবেন।”

“সে কী! কেন?”

“বলছিলেন, তাঁর বাড়ির লোক ভয় পেয়ে গিয়েছে। স্ত্রী তো বটেই, ছেলেও বলছে ফেরত দিয়ে দিতে।”

তারাপদ সন্দেহের গলায় বলল, “আবার কিছু হয়েছে নাকি?”

“হ্যাঁ। বাড়িতে ফোন আসতে শুরু করেছে। দু’দিন ফোন এসেছিল। সেই একই গলা। শাসাচ্ছে নন্দবাবুকে।”

তারাপদ চন্দনের দিকে তাকাল একবার। বোধ হয় পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিকিরার দিকে মুখ ফেরাল আবার। “ঝামেলাটা তবে মিটে যাচ্ছে?”

কিকিরা মাথার চুল ঘাঁটতে ঘাঁটতে বললেন, “নন্দবাবু মেটাতে চাইছেন, আমি বললাম, এত সহজে মিটিয়ে দেবেন? আর-একটু দেখুন না!”

“মানে?”

“মানে, আলমারি ফেরত দেওয়া, আড়াই হাজার টাকা ফেরত আসা বড় কথা নয়। ধরে নিলাম, আপনি ব্যবসাদার মানুষ, একটা ডিল মনের মতন হল না, লাভও নয়, লোকসানও নয়–ছেড়েই দিলেন। কিন্তু আপনার কি মনে হয় না, কী আছে ওই আলমারির মধ্যে যার জন্যে আপনার কেনা জিনিস জোর করে ভয় দেখিয়ে আপনার কাছ থেকে ফেরত নেবে ওরা?”

চন্দন বলল, ইতস্তত করে, “কী বললেন নন্দবাবু?”

“বললেন, না মশাই–আর আমার সাহস হয় না। ছেলে তো একেবারে বেঁকে বসেছে। বলছে, জেদ করে বিপদ ডেকে আনার দরকার কী এই বয়েসে! নিজের প্রাণ বড়, না জেদ!”

“ছেলে ভয় পেয়েছে, সার।”

“হ্যাঁ। নিরীহ ছেলে, তা ছাড়া বাপের ব্যবসা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। তা আমি নন্দবাবুকে বললাম, আলমারিটা ফেরত দেওয়ার আগে আপনি একটু চালাকি করুন।”

“চালাকি?”

“আবার যখন ফোন আসবে আপনি বলবেন, ওটা আপনি আমাকে বেচে দেবেন বলে আগাম টাকা নিয়েছেন। কথা ছিল, মাসখানেক পরে আলমারির খুচখচ মেরামতি সেরে, রং পালিশ করে আমায় ডেলিভারি দেবেন। এখন কথার খেলাপ করে কেমন করে আলমারিটা ফেরত পাঠান। অন্তত আমার সঙ্গে কথা না বলে তা করা সম্ভব নয়।”

তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “আপনি সার ওই আলমারিটা কিনছেন?”

“কিনছি না; কেনার ভান করছি।”

“ফলস দিচ্ছেন!”

“তাই দিচ্ছি,” কিকিরা নির্বিকার গলায় বললেন, “আমি নন্দবাবুকে বলেছি, আপনার হাতে প্লাস্টার, পা নাড়াতে এখন আর অসুবিধে হয় না। কাল পরশু আপনি রিকশা চেপে দোকানে আসুন। আমিও থাকব। দোকানে গিয়ে আপনি কর্মচারীদের বলবেন, আলমারিটার কাজে হাত লাগাতে। অন্তত সাফসুফ করুক। মেরামতির কোথায় কী আছে খুঁজে বার করুক। আমিও দোকানে গিয়ে হাজির হব।”

“কাস্টমার হিসেবে?” চন্দন বলল।

“আগে গিয়েছি পুরনো বন্ধু হিসেবে। মাইন্ড দ্যাট, আমি সেদিনও আলমারি দেখেছি। কর্মচারীরা নিজের চোখে দেখেছে, আমি নন্দবাবুর সঙ্গে কথাও বলছি, আবার আলমারিও দেখছিলাম। এমন তো হতেই পারে, ওটা আমার পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। পরে আমি কেনার কথা ভেবেছি।”

চন্দন বলল, “আপনি নন্দবাবুর বাড়িতেও গিয়েছেন, দোকানের কর্মচারী শ্রীকুমার এসে আপনাকে খবর দিয়ে গিয়েছে ও-বাড়ি যাওয়ার জন্যে।”

“তাতে ব্যাপারটা পোক্তই হয়েছে, চাঁদু। নন্দবাবু হাত-পা জখম করে বাড়িতে পড়ে আছেন, আমি তাঁকে দেখতে গিয়েছি–তার মানে এই নয় যে আমাদের মধ্যে কেনাকাটার কথা আগে হয়নি বা পরে হবে না। বরং উটকো অ্যাক্সিডেন্টে পড়ে তিনি হয়তো বলতে পারেন, আলমারিটা ডেলিভারি দিতে আরও কিছু সময় লাগবে।”

তারাপদ ধোঁকা খেয়ে প্রায় বোবা হয়ে ছিল এতক্ষণ। এবার বলল, “সার, আপনাদের দুজনের মধ্যে আলমারিটা বেচাকেনার কথা হয়েছে অন্য কেউ জানবে না? দোকানের কর্মচারীরা নয়?”

“না জানতেও পারে। নন্দবাবু আর আমার মধ্যে আড়ালে কোন কথা হচ্ছে কর্মচারীদের জানাবার দরকার কোথায়?”

তারাপদ চন্দনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল, যেন বলতে চাইছিল, ‘তুই কিছু বুঝছিস?”

চন্দন কী যেন ভাবছিল। অন্যমনস্ক। সিগারেট ধরাল। কিকিরার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার উদ্দেশ্য কী? আপনি কি মনে করছেন, এইভাবে রাজীবকে আপনি সামনাসামনি দাঁড় করাতে পারবেন?”

 “এ ছাড়া অন্য কোনও চাল আমার মাথায় এল না,” কিকিরা বললেন, “রাজীবকে আমরা দেখেছি। কিন্তু সে অন্যভাবে। তার খোঁজখবর করতে গিয়েছিলাম। নন্দবাবু বললেন, আর আমি মেনে নেব তাঁর কথা–তাই কি হয়! ওঁরও তো কোনও মতলব থাকতে পারে। রাজীব ব্যাপারটা যদি মনগড়া হয়, যদি দু’জনের মধ্যে এমন একটা চুক্তি হয়–রাজীব একদিন দোকানে ঢুকে যাত্রা-থিয়েটার করবে–তারপর হুট করে দোকানে আগুন লাগিয়ে দিলাম নিজেরাই, আর আগুনে পুড়ে দোকান ছাই হয়ে ইনসিওরেন্সের লাখ দুই তিন টাকা হাতে আসবে…

“বলেন কী, সার?”

“এসব আকছার হয়। ম্যানেজ করতে পারলে তুমি ধরা পড়বে না, তারাবাবু। লাখ দুই আড়াই টাকা এল ইনসিওর থেকে, তারপর ধরো তুমি আর দোকান নিয়ে মাথা ঘামালে না। না ঘামিয়ে জায়গাটা অন্য পার্টিকে বেচে দিলে। ওসব জায়গায় দোকানঘর পেতে হলে এখন হাজার পঞ্চাশ গুঁজে দিতে হয় হাতে। ব্ল্যাক মানি। নন্দবাবু যে এমন দাঁও মারতে চাইছেন না বুঝব কেমন করে! দোকানের অবস্থা তো টিমটিমে। ছেলের কোনও আগ্রহ নেই দোকানে। এই অবস্থায়–

কথা শেষ করতে পারলেন না কিকিরা, চন্দন অবাক গলায় বলল, “আপনি বলছেন কী! আপনার মাথায় এতরকম প্যাঁচ ঘোরে! অবাক করলেন, সার। ভেতরে ভেতরে আপনি অনেক এগিয়েছেন তো!”

কিকিরা হাসলেন। “প্যাঁচ নয়, প্যাঁচালো গিটের মুখ খোলার চেষ্টা। সবই যদি, যদি লেগে যায়!”

তারাপদ বলল, “আচ্ছা, একটা কথা ভেবেছেন?”

“কী?”

“নন্দবাবু চালাকি করে আপনাকে মাঝখানে খাড়া করে দিলেন, আপনারই কথামতন। কিন্তু এমন কী গ্যারান্টি আছে যে, রাজীব তা বিশ্বাস করবে? আর যদি বা করে সে বলতে পারে, নন্দবাবু কার কাছ থেকে অ্যাডভান্স টাকা নিয়েছেন তা দেখার দরকার তার নেই; সে শুধু চায় আলমারিটা তাদের বাড়িতে ফেরত দিয়ে আসা হোক।”

কিকিরা মাথা হেলিয়ে বললেন, “বলতেই পারে। তবে নন্দবাবু একটু শক্ত হয়ে থাকলে রাজীব সুবিধে করতে পারবে না। যে-জিনিস আমায় বিক্রি করব বলে তুমি আগাম টাকা নিয়েছ, আমায় না জানিয়ে কথা না বলে সে-জিনিস তুমি অন্য কাউকে দিয়ে দিতে পারো না। আইনে আটকাবে। উকিল দিয়ে মামলা ঠুকে দেব। কার সাধ্য তুমি জিনিস সরাবে!”

চন্দন চমৎকৃত হয়ে তারিফ করার গলায় বলল, “দারুণ। চালটা ভালই চেলেছেন বলে মনে হচ্ছে। তবে সত্যি তো আপনি টাকা দিয়ে ওটা বুক করেননি।”

“আরে, টাকা দিয়েছি কি দিইনি সেটা আমি আর নন্দবাবু বুঝব। হাতেনাতে না দিলাম, মুখে দিয়েছি।”

সামান্য অপেক্ষা করে তারাপদ বলল, “সার, আপনি ভাবছেন, এর পর রাজীব আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইবে?”

“আশা করছি। অন্তত যোগাযোগ করতে পারে।”

“বেশ, যোগাযোগ করল। করলেই তো আপনাকে চিনে ফেলবে।”

“আমার উদ্দেশ্য তো সেইরকম। রাজীবকে নন্দবাবু আমার ঠিকানা দিয়ে দেবেন। তবে পুরো নাম দেবেন না-শর্ট করে বলবেন, কে কে রায়। ঠিকানা সঠিক দেবেন। রাজীব নাম-ঠিকানা পেয়ে সটান আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারে। যদি চায়, নন্দবাবু শ্রীকুমারকে সঙ্গে দিয়ে রাজীবকে আমার কাছে পাঠাতে পারেন।”

তারাপদ উঠে পড়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। গরমের তাত খানিকটা কমলেও গুমোট কাটছিল না। রুমালে মুখ ঘাড় মুছে নিল তারাপদ। সন্ধে পেরিয়ে রাত হয়ে এল।

তারাপদই হঠাৎ বলল, “শেষমেশ তা হলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, আপনি এখন রাজীবের সঙ্গে দেখা হওয়ার ভরসায় রয়েছেন?

কিকিরা গলা তুলে বগলাকে ডাকলেন। জল দিয়ে যেতে বললেন তাকে। হঠাৎ হাই তুললেন। ক্লান্তির জন্যেই সম্ভবত। ঘাড়ের আড়ষ্ট ভাবটা কাটাবার জন্যে নাড়াচাড়া করলেন মাথা-ঘাড়।

বগলা জল এনে দিল।

জল খেয়ে আরাম পেলেন। চুরুট ধরালেন। তারপর বললেন, “আমার যা যা মনে হয়, বলছি। মন দিয়ে শোনো। বিশ্বাসবাড়ির ছোটকর্তা সুবর্ণবাবুর সঙ্গে আমি দেখা করতে পারিনি। হরেনবাবু আমায় ও-বাড়িতে নিয়ে যেতে রাজি হননি। আমি তাঁর কোনও দোষ ধরছি না। সত্যি সত্যি এভাবে হুট করে কাউকে সেখানে নিয়ে যাওয়া যায় না। উচিতও নয়। বুড়ো মানুষটির দুর্দিনে তাঁর কাছে নিয়ে গেলে সেটা হয়তো খারাপ দেখাত। তবে তাতে আমার লোকসান হয়নি। হরেনবাবুর কাছ থেকে সুবর্ণবাবুর সম্পর্কে যা জানার আমি জেনেছি।”

“কী জেনেছেন?”

“ভদ্রলোকের এখন চরম দুরবস্থা। স্থাবর অস্থাবর যেখানে যা আছে বেচেবুচে দিন কাটাতে হচ্ছে। ওঁর এমন অবস্থা নেই যে, নাতিকে টাকা দেবেন হোটেল খোলার জন্যে। রাজীব হোটেলের ব্যবসায় নেমেছে দিঘায় গিয়ে–এটা তিনি জানেন কিদ্র তাকে আর্থিকভাবে সাহায্য তিনি করতে পারেননি। করা সম্ভবই নয়।”

রাজীবের হাতে টাকা এল কেমন করে?

“হরেনবাবুর ধারণাই বোধ হয় ঠিক। রাজীব নিশ্চয় তার বাবার গচ্ছিত কিছু পেয়েছে, মায়ের গয়নাগাটিও বেচে দিতে পারে টাকার জন্যে। না হয় কোথাও থেকে ধারকর্য করেছে। এ ছাড়া আর কী বলব! না হলে বলতে হয়, রাজীব টাকাপয়সা ঢালেনি, ওয়ার্কিং পার্টনার হিসেবে কাজ করছে।…তা সে যাই হোক ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আমাদের লাভ নেই।”

“বেশ! তা হলে–”

“আলমারিটাই আসল তারাবাবু। দাদু বেচে দিল, নাতি সেটা বেচতে দেবে না। কেন? আগে কত কীই না দাদু বেচে দিয়েছেন, আসবাবপত্রও, রাজীব ফেরত পাওয়ার জন্যে হন্যে হয়ে উঠেছে! না, কিছুতেই নয়। যদি হত সুবর্ণবাবু বিনা দ্বিধায় আলমারি বেচতেন না।”

“এ তো এক পাজল, সার। একটা কাঠের আলমারি, যত পুরনোই হোক, তার সঙ্গে এমন কী মিস্ত্রি জড়িয়ে থাকতে পারে যে, তা নিয়ে এত কাণ্ড হবে?”

কিকিরা চুরুটটা রেখে দিলেন। আগুন নিভে গিয়েছে। গলা পরিষ্কার করলেন, বললেন, “আমি নন্দবাবুকে বলেছি, আপনি আলমারির কাজে হাত লাগান। ভেতর-বাইরে দেখুন ভাল করে–যদি কিছু নজরে আসে…”

“কী আসবে?”

“কেমন করে বলব! ওই আলমারিটায়–আমি ওপর থেকে যা দেখেছি, একটা তাকে ড্রয়ার, খোপখাপ আছে। এখন যেমন আলমারিতে লকারের ব্যবস্থা থাকে। তা থাকবে বইকি, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু!”

কিকিরা থেমে গেলেন। চুরুটটা আবার ধরাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলেন। রদ্দি চুরুট।

“কিন্তু কী–?” চন্দন বলল অধৈর্য হয়ে।

“ওর মধ্যে কোনও সিক্রেট পকেট বা খোপের ব্যবস্থা আছে–যা বাইরে থেকে হাজার খুঁজলেও ধরা মুশকিল। পুরনো কালের আলমারিতে এসব থাকত, নন্দবাবু জানেন। এখনও থাকে, তবে রেয়ার। ব্যাঙ্ক লকার হয়ে যাওয়ার পর বিশেষ বিশেষ দামি জিনিস, কাগজপত্র রাখার সুবিধে হয়ে গিয়েছে। ধরো হিরের নেকলেস, নীলার আংটি, চুনির গয়না থেকে কোনও অত্যন্ত জরুরি দলিল দস্তাবেজের কাগজ তো আলগোছে সকলের চোখের সামনে ফেলে রাখা যায় না, লুকিয়েই রাখতে হয়।”

 “আপনি বলতে চাইছেন সেরকম কিছু লুকিয়ে রাখা আছে ওই আলমারির লুকননা কোনও ‘পকেটে–মানে খাপখোপরে?”

“আমার তাই ধারণা। আর সেটা রাজীবই শুধু জানে, সুবর্ণবাবু জানতেন না– জানেন না। রাজীবের কাছে আলমারিটার দাম নেই, ওই লুকনো জিনিসটাই আসল। সেটা তার চাই। কিন্তু যতক্ষণ না আলমারিটা ফেরত পাচ্ছে সে নিশ্চিন্ত হবে কেমন করে?”

চন্দন আর তারাপদ চুপ। পরস্পরকে দেখল বারকয়েক। তারা কিছু ভাবতেই পারছিল না।

.

০৯.

নন্দবাবু দোকানে আসছিলেন। নিয়মিত নয়। একদিন আসেন তো পরের দিন বাদ যায়। রিকশা করেই আসেন। প্লাস্টার করা ভাঙা হাত বুকের কাছে ঝোলানো থাকে। আসেন, বসেন। কর্মচারীরা আলমারি পরিষ্কারের কাজ শুরু করল। নন্দবাবু চোখ রাখেন। আবার মাঝে মাঝে অন্যমনস্কভাবে বাইরের দিকে তাকান। রাস্তার লোক দোকানের কাছাকাছি চলে এলেই তাঁর উদ্বেগ বেড়ে যায়।

কিকিরাও আসেন দোকানে। নন্দবাবুর সঙ্গে কথাবার্তা বলেন নিচু গলায়। কখনও কখনও আলমারির সামনে গিয়ে নজর করেন ভেতরের দিকটা। কিছুই বুঝতে পারেন না।

সাত-আটটা দিন এইভাবেই কেটে গেল।

 “কী হল রায়বাবু? রাজীবের তো সাড়া পাচ্ছি না।”

“বাড়িতে ফোনও আসছে না?”

“না। হঠাৎ কী হল?”

“দেখুন আর ক’দিন।”

“আমি যে কী ধন্দে পড়ে গেলাম। বাড়িতে ওদের আর তর সইছে না; বলছে, ফেরত দিয়ে দাও। বিদেয় করো আপদ। ক’টা টাকা যদি গচ্চা যায় যাক; প্রাণ আগে…”

কিকিরা বললেন, “দেবেন বইকি! নিশ্চয় দেবেন। তবে সবুর করুন না আট-দশটা দিন। কথায় বলে, সবুরে মেওয়া ফলে।”

“ফলার নামগন্ধও দেখছি না। তবু দেখি।”

.

মেওয়া ফলতে ফলতে আরও তিন-চারদিন কাটল! তারপর যা ঘটল সেটা নাটকীয় বললেও হয়।

কিকিরার বাড়িতে বসে গল্পগুজব হচ্ছিল। কিকিরা আর তারাপদ কথা বলছিলেন। সন্ধে হয়ে এসেছে। বাতি জ্বালা হল এইমাত্র। চন্দনের আসার কথা, এসে পৌঁছয়নি এখনও। তারাপদ তাদের হোটেলের মজুমদার সাহেবের ঘরে বসে সেদিন একটা চমৎকার প্রোগ্রাম দেখেছে টিভিতে। তাও পুরো দেখা হয়নি, কারণ সে যখন মজুমদার সাহেবের ঘরে যায়–তখন প্রোগ্রামের অর্ধেকটা হয়ে গিয়েছে। বিবিসি থেকে দেখাচ্ছিল প্রোগ্রামটা। হিস্ট্রি অব ম্যাজিক। পার্ট টু।

“বুঝলেন কিকিরা, দারুণ একটা জিনিস দেখলাম,” তারাপদ বলল। “স্টেজের ওপর একদিকে ম্যাজিশিয়ান। অদ্ভুত তার ড্রেস। মাথায় হেলমেট, কান গলা পর্যন্ত ঢাকা। চোখে গগল্স। পরনে কুস্তিগির টাইপের পোশাক। ম্যাজিশিয়ান দাঁড়িয়ে আছে, দু’ হাত বুকের কাছে। স্টেজের অন্য সাইড থেকে একজন পিস্তল ধরনের ফায়ার আর্মস থেকে নিশানা করে ম্যাজিশিয়ানের মুখে গুলি ছুড়ল। তারপর দেখি, গুলিটা ম্যাজিশিয়ানের মুখে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরা রয়েছে। কী থ্রিলিং। ভয় লাগে। এই খেলা অনেকেই দেখাত। সামান্য হেরফের করে। শেষে একজন চাইনিজ ম্যাজিশিয়ান-”

“জানি। খেলা দেখাতে গিয়ে মারা যায়। অনেকে বলে, ওটা সুইসাইড। খেলাটা তারপর থেকে আইন করে বন্ধ করে দেওয়ার কথা হয়েছিল। এখনও দেখানো হয় বলে শুনিনি।”

তারাপদ বলল, “যাই বলুন, খেলাটা দেখতে বেশ ভয় করে। তবু তো সামনাসামনি দেখছি না।”

এমন সময় বগলা এল। দেখা করতে এসেছেন একজন।

 “নিয়ে এসো।”

মুহূর্ত কয়েক পরে যে এল তাকে দেখে কিকিরা অবাক! রাজীব। তারাপদ তাকিয়ে থাকল।

রাজীব কিছু বলার আগেই কিকিরা নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। খাতিরের গলা করা বললেন, “আরে বসুন! আপনি!”

রাজীব কোনও জবাব দিল না। প্রথমে কিকিরাকে দেখল লক্ষ করে, পরে তারাপদকে। শেষে ঘরটাও নজর করে দেখে নিল।

কিকিরা আবার বললেন, “দাঁড়িয়ে কেন! বসুন না!”

রাজীব বসল। তারাপদর পাশের চেয়ারে।

“আমার ঠিকানা খুঁজে পেতে অসুবিধে হয়নি তো? না, শ্রীকুমার পৌঁছে দিয়ে গেল?” কিকিরা বললেন স্বাভাবিক গলায়, যদিও চাপা মজার ভাব ছিল তাঁর কথায়।

রাজীব বলল, “শ্রীকুমার নয়, সুশীল।”

“সুশীল! মানে দোকানের সুশীল? সে..”

 রাজীব ভণিতা করল না। “আমার লোক।”

“নন্দবাবুর দোকানে তোমার” বলেই নিজেকে শুধরে নিলেন কিকিরা, “আপনার লোক!”

“আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন, আপত্তি নেই; বয়েসে আপনি বড়। বলছিলাম, নন্দবাবুর দোকানে আমার নোক থাকার মধ্যে অবাক হওয়ার কী আছে? দু’-একশো টাকা বাড়তি হাতে দিলে খবরাখবর দেওয়ার মতন লোক পাওয়া যায়।”

কিকিরা থমকে গেলেন। বুঝতে পারলেন, ছোকরা চতুর, বুদ্ধিমান। সহজে ওকে কবজা করা যাবে না। নিজেকে সঙ্গে সঙ্গে পালটে নিলেন কিকিরা। যেন সত্যিই তিনি অবাক হননি, সরল গলায় বললেন, “তা তো ঠিকই।…ইয়ে, আমার এখানে একটু শরবত, বা চা হতে আপত্তি নেই তো?”

“শরবত! না, চা খেতে পারি, যদি অসুবিধে না হয়!”

“তারাপদ, চা বলে দাও।”

 তারাপদ উঠে গেল বগলাদাকে চায়ের কথা বলতে।

 কিকিরাকে কথা বলার সময় দিল না রাজীব। নিজেই বলল, “আপনি কে, আপনারা কে কী করেন আমি জানি। শুনেছি। দিঘায় আপনারা তিনজনে কেন গিয়েছিলেন আন্দাজ করতে আমার কষ্ট হয়নি।”

“দিঘায় যাওয়ার আগে নন্দবাবুকে আমি কিছু জানাইনি।”

“না জানালেও আপনি তারাপদবাবুকে নিয়ে ভদ্রলোকের বাড়িতে গিয়েছিলেন। কথাবার্তা হয়েছিল। এসব কি চাপা থাকে? খবর আমি সময়মতন পেয়েছিলাম।”

“ও! তা হলে তখনই তুমি-আপনি বুঝে ফেলেছিলেন…”

“আমাকে তুমি বলুন। আমি কিছু মনে করব না।”

তারাপদ ফিরে এল। বসল নিজের জায়গায়।

কিকিরাও বসে পড়েছিলেন ততক্ষণে।

রাজীব হঠাৎ বলল, কিকিরাকেই, “আপনি কি সত্যিই আলমারিটা কেনার জন্যে টাকা আগাম দিয়েছেন? না, দেননি। মিথ্যে কথা। আমাকে আপনার সামনে হাজির করতে চাইছিলেন। তাই না?…এখন আমি আপনার বাড়িতে আপনার সামনে হাজির। বলুন, কী জানতে চান?”

চন্দনের গলা পাওয়া গেল ভেতরে। বগলার সঙ্গে কথা বলছে। তারপরই ঘরে এল। রাজীবকে দেখে যেন বিশ্বাস হল না প্রথমে। চোখের পলক পড়ল না কয়েক মুহূর্ত।

কিকিরা বললেন, “এসো চাঁদু! বসো। রাজীব শেষপর্যন্ত এসেছে–এসেছেন। না, এসেছে।”

চন্দন তারাপদর দিকে তাকাল। ইতস্তত করে সামান্য তফাতে গিয়ে বসল শেষে।

কিকিরা রাজীবকে বললেন, “তুমি বলছ, আমি কী জানতে চাই–তোমায় বলতে। বরং তুমিই বলো তোমার যা বলার। ধরো, নন্দবাবু যে তোমাদের বাড়ি থেকে আলমারিটা কিনেছেন সেটা তো ঠিকই। তুমি অস্বীকার করতে পারবে না।”

“হ্যাঁ, উনি ছোটদাদুর কাছ থেকে আলমারিটা কিনেছেন নগদ টাকা দিয়ে।”

“তা হলে তুমি কেন ওঁর দোকানে গিয়ে ভদ্রলোককে শাসিয়ে এসেছ?”

“আপনার বন্ধু আপনাকে পুরো সত্যি কথা বলেনি, অর্ধেক বলেছে।”

“মানে?”

“আমি ওঁর দোকানে গিয়েছিলাম। প্রথমে হইচই, রাগারাগি করিনি। বরং ওঁকে অনুরোধ করে বলেছিলাম, দাদু বিপাকে পড়ে বাড়ির ওই আলমারিটা বিক্রি করে দিয়েছেন। একে ওঁর আজকাল অর্ধেক কথা মনে থাকে না, তার ওপর চোখেও ভাল দেখেন না। আপনি দয়া করে ওটা ফেরত পাঠিয়ে দিন। আপনার টাকা আমি দিয়ে দেব। যদি বলেন, কালই টাকা ফেরত পাবেন। … তা উনি তো রাজি হলেনই না, উলটে আমার সঙ্গে চড়া গলায় তর্ক করতে লাগলেন। নন্দবাবু ব্যবসাদার মানুষ। উনি বলতেই পারেন, কেনা জিনিস উনি কেন ফেরত দেবেন! কিন্তু আমি তো অনুরোধ করেছিলাম। নন্দবাবু ওভাবে রাগারাগি শুরু করায় আমি চটে উঠেছিলাম। তখন দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি, ঝগড়াঝাটি হয়।”

“তারপর তুমি নন্দবাবুকে শাসাও?”

“হ্যাঁ।

 “তুমি ওঁকে একদিন মোটরসাইকেল চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলে?”

“না।”

“ধাক্কা দেওয়ার মতলব ছিল?”

“কী যে বলেন!”

“নন্দবাবু তোমায় দেখেছেন।”

“ওঁর মনগড়া কথা। ভুল দেখেছেন। আমি আমার বাইক দিঘায় রেখে এসেছি। আপনারা দেখেছেন।”

“তুমি তোমার কোনও বন্ধুর বাইক চেয়ে নিয়ে যে যাওনি তার প্রমাণ কী?”

“প্রমাণ দেওয়ার দরকার নেই। আমি যা করিনি তা নিয়ে আমায় দোষ দেবেন না। বিশ্বাস করা না-করা আপনাদের ব্যাপার।”

বগলা চা এনেছিল। হাতে হাতে এগিয়ে দিল।

 কিকিরা বললেন, “তুমি নন্দবাবুর বাড়িতে ফোন করে ওঁকে শাসাও?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“আলমারিটা আমাদের বাড়িতে ফেরত আসা দরকার।”

“কেন?”

“সে অনেক কথা। আপনি বুঝবেন না।”

 চায়ে চুমুক দিয়ে কিকিরা সামান্য সময় চুপ করে থাকলেন। দেখলেন রাজীবকে। শেষে বললেন, “কী আছে আলমারির মধ্যে? সোনাদানা হিরে মুক্তো কত আর লুকিয়ে রাখতে পারো ওর চোরা-ফোকরে?”

রাজীব এবার কেমন করে যেন হাসল। শব্দ করে নয়; ঠোঁট কামড়াল। বলল, “একরত্তি সোনাও নেই। হিরে মুক্তোও নয়। … অন্য কিছু।”

তারাপদ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “কিছু মনে করবেন না। একটা কথা জানতে ইচ্ছে করে। আপনি দিঘায় গিয়ে হোটেল খুলছেন। অবশ্য আপনার পার্টনার আছে। তবু ওই বাড়িটা কেনা, সেটাকে সারিয়েসুরিয়ে অদলবদল করতে তো যথেষ্ট টাকা খরচ হয়েছে, হচ্ছে। আপনি নিশ্চয় আপনার দাদুর কাছ থেকে টাকা পাননি। এত টাকা আপনি কোথা থেকে পেলেন?”

রাজীব তারাপদর দিকে তাকাল। জবাব দিল না।

অপেক্ষা করে কিকিরা বললেন, “বাবা কোথাও কিছু রেখে গিয়েছিলেন? মায়ের গয়নাগাটি …?”

রাজীব ছোট করে বলল, “জোগাড় করতে হয়েছে।”

“ধারকর্জ!”

 রাজীব এমনভাবে মাথা নাড়ল, যা থেকে বোঝা মুশকিল সে ঠিক কী বলতে চাইল।

অল্প সময় চুপচাপ থাকার পর রাজীব নিজেই কিকিরাকে বলল, “আপনি নন্দবাবুকে বলুন, আলমারিটা ফেরত দিয়ে দিতে। তাতে ওঁর কোনও ক্ষতি হবে না। একথাও বলতে পারেন, আপাতত না হয় দিয়ে এলেন ফেরত, তার বদলে উনি অন্য কোনও আসবাব নিয়ে আসতে পারেন। বাড়ি একেবারে শূন্য হয়নি।”

কিকিরা শুনলেন মন দিয়ে। ভাবলেন। চন্দন আর তারাপদকে দেখলেন একবার। রাজীবের দিকে তাকালেন, “আমি বলতে পারি। … কিন্তু ব্যাপার কী জানো? আলমারিটা এখন মিস্ত্রিদের হাতে, কাজকর্ম করছে। তারা যদি তোমার লুকনো জিনিসটা খুঁজে পায় আচমকা! কাজ করতে করতে সিক্রেট পকেটটা পেয়ে গেল! তখন–?”

রাজীব মাথা নাড়ল। “পাবে না। নন্দবাবুর ওই মামুলি মিস্ত্রিদের সে-ক্ষমতা আছে বলে আমার মনে হয় না। তা ছাড়া চোরা পকেট খোলার চাবি পাবে কোথায়? সেটা আমার কাছে। নন্দবাবু যে চাবিগুলো পেয়েছেন তার মধ্যে ওই চাবিটা নেই। ছোড়দাদু, মা- কেউই জানে না আমি কোন লুকনো খোপে ওটা লুকিয়ে রেখেছিলাম। চাবির কথাও জানে না।” চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল রাজীব। অর্ধেকটা খেয়েছে মাত্র। নিজেই বলল, “তবে হ্যাঁ, কেউ যদি আলমারির সব কেটেকুটে ভেঙেচুরে তছনছ করে দেয় তবে অন্য কথা। নন্দবাবু নিশ্চয় তা করবেন না।”

কিকিরা হতাশ হয়ে পড়ছিলেন। ছেলেটির মধ্যে লুকোচুরি নেই। যা বলছে, স্পষ্ট। ওকে বশে আনা কঠিন।

কিকিরা বললেন, “তোমার সঙ্গে নন্দবাবুর দেখা কিংবা কথা হয়েছে?”

“দু-চারদিনের মধ্যে হয়নি। আগে হয়েছে; ফোনে।”

“উনি আমার কথা বলেছেন তখন?”

“হ্যা!”

“তুমি কি এখন কলকাতায় থাকবে?”

“এই হপ্তাটা থাকব।”

“শোনো ব্রাদার। আমি নন্দবাবুকে তোমার কথা বলব। চেষ্টা করব, আলমারিটা যেন তোমাদের বাড়িতে ফেরত যায়। নন্দবাবুর নিজেরই আর ওটা রাখার ইচ্ছে নেই। বাড়ির লোকও আপত্তি করছে।”

রাজীব এবার উঠে দাঁড়াল। “আমি তা হলে আসি।” বলেই কী মনে হল, আবার বলল, “আমি আপনাকে বিশ্বাস করি। আপনিও বিশ্বাস করতে পারেন, আমি গুণ্ডা বদমাশ নই। নন্দবাবু যা বলেছেন তার বারো আনাই সত্যি নয়।”

কিকিরাও উঠে দাঁড়ালেন। “তুমি আমায় বিশ্বাস করো, অথচ বললে না আলমারির মধ্যে কী আছে!”

রাজীব কী ভেবে বলল, “বলব। দু-একটা দিন অপেক্ষা করুন। আলমারিটা ফেরত পাই।”

.

১০.

পরিবেশ অন্যরকম। এই ঘরের চারদিকে তাকালে কালচে ছায়া, বিবর্ণ ময়লা দেয়াল, খসেপড়া পলেস্তরাই চোখে পড়ে। একটিমাত্র বাতি– তাও অনুজ্জ্বল। এতবড় ঘরে ওই আলোটুকু অন্ধকারকেই যেন আরও ছড়িয়ে দিচ্ছিল। ওপরের কড়িকাঠ চোখে পড়ে না। জানলাগুলো বড়, কিন্তু ভাঙাচোরা শার্সি, খড়খড়ি। কোনওরকমে একটি জানলা খুলে রাখা সম্ভব হয়েছে। বাইরে অন্ধকার। কোথাও থেকে জল ছুঁয়ে পড়ছে। মৃদু শব্দ। দালানের ফঁক-ফোকরে বুঝি দু-পাঁচটা পায়রা বাসা বেঁধে থাকে; আচমকা তাদের পাখা ঝাঁপটানির আওয়াজও কানে আসছিল।

কিকিরা স্বপ্নেও ভাবেননি, বিশ্বাসবাড়ির ছোট তরফের ঘরবাড়ির এমন জীর্ণ দীন চেহারা হতে পারে। অবশ্য এই ঘরটা বারবাড়ির ঠাকুরদালানের কাছাকাছি কোনও ঘর হবে।

রাজীব তাদের এখানেই এনে বসিয়েছে। বসার ব্যবস্থা যৎসামান্য। একটি গোল টেবিল, কয়েকটি সাধারণ চেয়ার।

কিকিরারা তিনজনেই এসেছেন, কিকিরা তারাপদ চন্দন। আর এসেছেন নন্দবাবু। নন্দবাবুকে আনার দায়িত্ব ছিল কিকিরার ওপর। রাজীব জানিয়েছিল, আপনারা আসার সময় নন্দবাবুকেও দয়া করে নিয়ে আসবেন।

ওঁরা চারজন পাশাপাশি বসে, গোল টেবিল ঘিরে। রাজীবও বসল একপাশে।

কিকিরা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই রাজীব বলল, “আমি কথা দিয়েছিলাম নন্দবাবুর টাকাটা আমি ফেরত দিয়ে দেব, আপনাদের সামনেই সেটা দিচ্ছি,” বলে একটা খাম বার করে নন্দবাবুর দিকে এগিয়ে দিল। “পৌঁছে দেওয়ার খরচার টাকাও ওর মধ্যে আছে। নন্দবাবুকে ধন্যবাদ, পরশু আমি আলমারিটা ফেরত পেয়েছি। তারপর কিকিরার দিকে তাকাল। “আপনাকেও ধন্যবাদ রায়বাবু।”

কিকিরা বললেন, “এবার তা হলে তুমি তোমার কথা রাখো। বলেছিলে আলমারি ফেরত পাওয়ার পর তুমি যা বলার বলবে, কোনও কথাই গোপন রাখবে না!”

রাজীব মাথা নাড়ল। বলল, “বলব বলেই আপনাদের একটু কষ্ট করে এ বাড়িতে আসতে বলেছিলাম। আপনারা এসেছেন, সত্যিই আমি কৃতজ্ঞ।”

চন্দন বলল, “আমরা আসতুম। আপনি আপনার কথা বলুন।”

 রাজীব সামান্য চুপ করে থেকে বলল, “দিঘায় যখন আপনাদের সঙ্গে আমার আলাপ হয়- তখন কথায় কথায় আমি বলেছিলাম, আমার বাবা ছিলেন ডাক্তার। মনে আছে সে-কথা?”

কিকিরা বললেন, “আছে। পেশা ছিল ডাক্তারি আর নেশা ছিল জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো। শিকারের শখ ছিল।”

“শিকারের শখ ছিল একসময়। পরে আর শিকার করতেন না। সেটা বন্ধ হয়ে যায়। সরকারি নিষেধ ছিল। তবে কোথাও কোনও খেপা জন্তু বেরোলে লোকে এসে তাকে ধরত। যেতেনও মাঝে মাঝে। … একটা কথা আপনাদের সেদিন বলিনি। দরকার মনে করিনি। আমার বাবা ঠিক পুরোপুরি রোগী-দেখা ডাক্তার ছিলেন না। তার মাথায় অন্য একটা চিন্তাও থাকত। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবার সময় বাবা লক্ষ করতেন একেবারে জংলি দেহাতি গরিব মানুষরা অসুখবিসুখ হলে গাছগাছালি এটা-ওটা নিয়ে কীভাবে নিজেদের চিকিৎসা করে। তিনি দেখতে পান, অনেক গাছপালা যা আমরা উপেক্ষা করি, কিংবা আমরা যার কথা জানি না– সেগুলো দিয়ে নানা ধরনের ব্যাধি দূর করা যায়।”

“তোমার বাবা কি ওইসব গাছপালা, পাতা নিয়ে নিজে পরীক্ষা করতেন?” কিকিরা বললেন।

“করতেন খানিকটা। বাবার নিজের বাড়িতে ছোট একটা ল্যাবরেটরি ছিল। বাবার বন্ধু কুমুদকাকা ছিলেন ফারমোকোলজির লোক। কেমিস্ট। তাকে দিয়ে বাবা দু-চারটে খুচরো ওযুধও তৈরি করিয়েছিলেন তার মধ্যে একটা তখন ভালই চলত বাজারে। জন্তু জানোয়ার, বিষাক্ত পোকামাকড়ের কামড়ে বিযিয়ে যাওয়া ঘায়ের ওযুধ। … দু’পয়সা রোজগারের জন্যে বাবা এসব করতেন না ঠিক। কৌতূহল ছিল। ঝোঁকও বলতে পারেন। … তা একবার বাবা মধ্যপ্রদেশের এক জঙ্গলে যান। সঙ্গে কুমুদকাক। কুমুদকাকাও মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গী হতেন।”

“মধ্যপ্রদেশের কোথায়?” তারাপদ বলল।

“পাঁচমারির কাছে। জায়গাটার নাম আমার মনে পড়ছে না। জাড়িয়া ফরেস্ট হবে হয়তো। সেখানে এমনি লোকবসতি নেই। আদিবাসী পাঁচ-সাতটা গ্রাম। সভ্য সমাজের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই। সেখানে তখন এক ধরনের অসুখ দেখা দিয়েছে। অনেকটা ইয়ালো ফিভারের মতন। মারাত্মক ব্যাধি। আমাদের দেশে সচরাচর চোখে পড়ে না। বাবা লক্ষ করে দেখলেন, ডুমুরগাছের মতন একজাতের গাছের ফল জলে ফুটিয়ে সেটা রোগীদের খাওয়ানো হচ্ছে। বেঁচেও যাচ্ছে অনেকে। ফেরার সময় বাবা আর কুমুদকাকা সেই গাছের পাতা, ছাল আর ফল নিয়ে চলে আসেন কলকাতায়।”

“আচ্ছা! এখানে এসে নিজেরা রিসার্চ করতে শুরু করেন?” কিকিরা বললেন।

রাজীব মাথা নাড়ল। “মাস ছয়েক চেষ্টার পর একটা রেজাল্ট পাওয়া গেল। ইয়ালো ফিভার ঠিক নয়, তবে ওই ধরনের অসুখের পক্ষে কাজে লাগতে পারে। বাবা তার নোটবইয়ে রিসার্চের কথাগুলো লিখে রাখেন। যাকে বলে ফারমোকোলজিকাল প্রোফাইল। তার ইচ্ছে ছিল, নানা অসুবিধে ও অর্থাভাবের জন্যে নিজেদের পক্ষে এই গবেষণা নিয়ে আর যখন এগুনো সম্ভব নয়– তখন কোনও বড় ওষুধ কোম্পানিকে সেটা বেচে দেবেন। তারা আরও নিখুঁতভাবে রিসার্চ করে ওষুধটা তৈরি করতে পারবে।”

কিকিরা সন্দেহ করে বললেন, “সেই কাগজপত্র– মানে নোটস আর পাওয়া যায়নি!”

“পরে পাওয়া গিয়েছে। আমি পেয়েছি,” রাজীব বলল। যখন আমি পেয়েছি তখন আমার বয়েস কুড়ির মতন। বাবা মারা গিয়েছেন আমার দশ বছর বয়েসে।

“ওটা কি চুরি গিয়েছিল?”

“না। বাবা লুকিয়ে রেখেছিলেন। আমি হঠাৎ পেয়ে যাই।”

“তোমার বাবা মারা যাওয়ার পর তোমরা তো দাদুর কাছে চলে আসো। তোমাদের নিজের বাড়ি ছেড়ে এ-বাড়িতে আসার পর কাগজগুলো পেলে? দশ বছর পরে। এতদিন এই কাগজগুলো কোথায় ছিল? ও-বাড়ি, না, এ-বাড়িতে?”

“ও-বাড়িতেই ছিল। মায়ের আলমারির একটা লুকনো খোপে। মা জানতেন না। মা যখন বাপের বাড়িতে চলে আসেন তখন ও-বাড়ি থেকে সামান্য কয়েকটা নিজের জিনিস নিয়ে এসেছিলেন, আলমারিটাও।”

তারাপদ বলল, “তা হলে আলমারিটা আপনার মায়ের। দাদু সেটাই বেচে দিয়েছিলেন?”

মাথা নাড়ল রাজীব। “না, না। মায়ের আলমারি থেকে সরিয়ে আমিই দাদুর একটা আলমারিতে রেখে দিয়েছিলাম। দাদু সংসারের খোঁজখবর এখন আর রাখেন না, চোখেও দেখেন কম। অন্ধ হয়ে এসেছেন প্রায়।”

কিকিরা বললেন, “আলমারির কোথায় ওটা ছিল?”

“বাঁদিকের ড্রয়ারের পেছনে। অবশ্য আপনি ড্রয়ার টেনে বার করে নিলেও কিছু দেখতে পেতেন না। ড্রয়ার টেনে বার করে নিলে পেছনে দেখতেন আলমারির কাঠ। কিন্তু বুঝতে পারতেন না পেছন দিকে একটা চোরা খোপ আছে। ধরা যায় না। সেই খোপের চাবি নীচের দিকে। ছোট্ট চাবি। ওটা আমার কাছে থাকে। কেউ জানে না।”

নন্দবাবু কিকিরার দিকে তাকালেন। যেন বোঝাতে চাইলেন, দেখেছেন– আমিও সেই চাবি পাইনি। জানিই না ওরকম কোনও চোরা খোপ আছে।

কিকিরা বললেন, “কিন্তু ডান আর বাঁ দুটো ড্রয়ার পাশাপাশি রাখলে তো বোঝা যেত, মাপের হেরফের আছে; বাঁ দিকের ড্রয়ারের মাপ লম্বায় ছোট হত।”

রাজীব হাসল যেন। “না, তাও বোঝা যেত না। ডান দিকের ড্রয়ারের লম্বার মাপ একই রকম ছিল, যদিও তার পেছনে কোনও চোরা খোপ রাখা হয়নি। লোক ঠকাবার কারিকুরি তখনকার মিস্ত্রিদের ভালই জানা ছিল।”

বাইরে হাওয়া উঠেছে। জল পড়ার সেই একই রকম শব্দ। ঘরের আলো কমে আসছে মাঝে-মাঝে। দেয়ালগুলো আরও কালচে দেখাচ্ছিল।

.

রাজীব জামার পকেট থেকে একটা কী বার করল। রাখল টেবিলে। কিকিরারা অনুমান করলেন ওটা চামড়ার ব্যাগ। তবে চওড়ায় সরু। চশমার খাপের মতন অনেকটা। লম্বায় ইঞ্চি ছয়েক। বেশিও হতে পারে সামান্য।

কেউ কিছু বলল না।

রাজীব নিজেই ব্যাগ খুলে একটা পকেট নোটবই বার করে টেবিলের ওপর রাখল। তফাত থেকেও বোঝা যাচ্ছিল নোটবইটা অনেক পুরনো।

চন্দন বলল, “এটা কি আপনার বাবার সেই পুরনো নোটবই?”

“হ্যাঁ।”

“দেখতে পারি?”

“আপনি ডাক্তার মানুষ। দেখলেই নিশ্চয় আন্দাজ করতে পারবেন। তবে অকারণ দেখা। আমায় বিশ্বাস করতে পারেন।” বলে একটু থেমে চন্দনকেই বলল, “আপনি বোধ হয় জানেন, কাগজেও দু-চারবার একটা খবর বেরিয়েছে– হালে একধরনের ভাইরাল অসুখ-ইস্ট এশিয়া থেকে এসে এদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। অসুখটা মারাত্মক। তার লক্ষণটাও ইয়ালো ফিভারের মতন।”

চন্দন বলল, “কানে গিয়েছে, তবে আমি নিজে বেশি জানি না।”

“আমারও জানার কথা নয়। বেশি জানি না। তবে কুমুদকাকা আমায় জানিয়েছেন। তিনি এখন গুজরাটে থাকেন। বড় একটা ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ ল্যাবরেটরির মাথায় বসে আছেন। অ্যাডভাইসার। তাঁর বয়েস হয়েছে। মানুষটিও একলা। তিনি আমায় চিঠিতে জানিয়েছিলেন, বাবার সেই কাগজপত্রগুলো যদি উদ্ধার করা যায়-তবে এ-সময় কাজে লাগতে পারে।”

“মানে, তুমি সেই কাগজপত্র ওঁদের কোম্পানিকে বেচে দিতে পারো?” কিকিরা বললেন।

রাজীব বলল, “হ্যাঁ। এতে দোষ কোথায়? আমি বাবার নোটবইটা রেখেছি স্মৃতি হিসেবে। আমি তো আর রিসার্চ করব না, আমার ল্যাবরেটরি বা ওষুধ কোম্পানিও নেই। ওটা যদি কুমুদকাকাদের কাজে লাগে, মানুষের উপকার হবে। তাই না?”

“তুমি তা হলে ওটা বেচে দিতে চাও?”

 রাজীব মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, বেচে দিতে চায়।

“বোধ হয় ভালই টাকা পাবে?”

“কত পাব জানি না। কুমুদকাকাই ব্যবস্থা করবেন।”

তারাপদ হালকাভাবে বলল, “একেই বলে ভাগ্য!”

 রাজীব কোনও জবাব দিল না। ব্যাগের মধ্যে আঙুল ডুবিয়ে আরও একটা কী বার করে টেবিলের ওপর রাখল। পাতলা কাপড়ে মোড়া, কাপড়টা খুলে নিল।

কিকিরা দেখছিলেন। কিছু বুঝলেন না। সরু একটা কাঠি যেন। লম্বা। রং বোঝা যায় না। কালচে দেখাচ্ছিল।

“কী ওটা?” তারাপদ বলল।

 “হাড়ের টুকরো?”

 কিকিরারা অবাক! “কার হাড়? কীসের?”

“বাবাকে একজন দিয়েছিল। বুড়ো এক জিপসি৷ সার্কাসে খেলা দেখাত। জাগলারি। আগুনের খেলাও দেখাত। মুখে আগুন নিয়ে সাইকেলের কসরত। সে হঠাৎ মারা যায়। বাবা তাকে দেখেছিল। বাঁচাতে পারেনি।”

“হাড় দেওয়ার কারণ?”

“শুনেছি হাড়টা বানরের। নীল বানরের…”

“নীল বানরের?” কিকিরা অবাক!

 “তাই বলেছিল। নীল বানর দেখাই যায় না। এদেশে কেউ দেখেছে বলে শুনিনি।”

“কী হবে এই হাড়ে?”

“ভাগ্য! বাবার পরিবারকে চরম দুঃখ দুর্ভাগ্য থেকে বাঁচাবে।”

“বাঁচিয়েছে? এ তো কবচ-মাদুলি পাথর-টাথর পরার মতন ব্যাপার।”

“জানি না। আমার জন্যে আমি ভাবি না। মা আর দাদুর জন্যে ভাবি। দাদু হয়তো আর দু-চার বছরও নয়; কিন্তু মা! মা না থাকলে আমার আর কী থাকতে পারে!” রাজীব বড় করে নিশ্বাস ফেলল। কয়েক মুহূর্ত থেমে বলল, “বাবা হঠাৎ চলে যাওয়ার পর আমরা খুবই বিপদে পড়েছিলাম, দাদু না থাকলে কী হত জানি না। সেটাও তো ভাগ্য! এই হাড়ের কোন গুণ আছে না আছে জেনে আমার লাভ নেই; মায়ের কথা ভেবে ওটা আমি কাছছাড়া করি না। ওটা নাকি জীবনে মাত্র একবার একটি প্রার্থনাই পূর্ণ করতে পারে।”

কিকিরা কিছু বললেন না। যত অলৌকিক অবিশ্বাস্যই শুনতে হোক মায়ের ওপর ছেলের এই দুর্বলতা স্বাভাবিক। বিশেষ করে যে ছেলে কম বয়েসে বাবাকে হারিয়েছে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর চন্দন বলল, “আমরা এবার উঠতে পারি!”

কিকিরা মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ, ওঠা যেতে পারে।

নন্দবাবুই উঠে পড়লেন প্রথমে। মনে হল, তিনি যেন চলে যাওয়ার জন্যে বেশি ব্যস্ত।

.

বাড়ির বাইরে এসে নন্দবাবু একটা রিকশা নিলেন। তাঁর বাড়ি তেমন দূরে নয়, গলি দিয়ে চলে যাওয়া যায়।

কিকিরারা একটা ট্যাক্সির জন্য বড় রাস্তার দিকে হাঁটছিলেন। সঙ্গে রাজীব।

রাজীব হঠাৎ বলল, “নন্দবাবুর অনেক ক্ষতি হল!”

কিকিরা হাসলেন।

 “হাসছেন?”

“আমি জানি। খোঁজ করে দেখেছি। দোকানটায় আগুন লাগলে ওঁর লাভ হত।”

“আমি কিন্তু আগুন লাগাতাম না।”

“তুমি লাগাতে না।… তবে সেদিন দোকানে গিয়ে তুমি ঝগড়াঝাটি করে আসার পর ওঁর মাথায় এই দুর্বুদ্ধি দেখা দেয়। দেওয়ার কারণও আছে। দোকানটা এখন টিমটিম করে চলে। কর্মচারীদের ঠিকমতন মাইনে দিতেও পারেন না। পৈতৃক বাড়ি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ছেলের কোনও উৎসাহ নেই দোকান সম্পর্কে। কী হবে ওই দোকান রেখে! তবে হ্যাঁ, দোকান ছাই হয়ে গেলে নন্দবাবুর নিশ্চয় প্রাণে লাগত। সেটা সহ্য করা কঠিন হত ওঁর পক্ষে। হয়তো ভেবেছিলেন লাখ তিন সাড়ে তিন টাকা যদি হাতে আসে এখন–দুঃখটা সামলে নিতে পারবেন।… মানুষ এইরকমই হয় রাজীব। পাকেচক্রে হতাশায় সে কখন যে অন্যায়ের সঙ্গে রফা করে বসে, কে জানে!… তা বলে তুমি ভেবো না নন্দবাবু মানুষটি সত্যিই অত খারাপ! ভাল কথা, তুমি সব জানতে নাকি?”

রাজীব হেসে বলল, “আমি তো আগেই বলেছি, আমার তরফেও একজনকে লাগিয়ে রেখেছিলাম দোকানে! সুশীল।”

তারাপদ আর চন্দন প্রায় একই সঙ্গে হেসে উঠে বলল, “আপনি মশাই আগুন লাগাতে পারলেন না, অথচ ধোঁয়া ছড়িয়েই খেলাটা শেষ করে দিলেন। কী যে করলেন!”

ততক্ষণে ট্যাক্সি দেখতে পেয়ে গিয়েছিলেন কিকিরা। হাত তুলে থামালেন গাড়িটাকে। ডাকলেন তারাপদদের, “এসো।… চলি রাজীব। তোমার দিঘার হোটেলের নামটা কিন্তু ‘সাগরসঙ্গম’ই দিও।”

রাজীব হাসল। “আপনারা কিন্তু আসবেন।”

ট্যাক্সি চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *