ভুলের ফাঁদে নবকুমার
০১.
কিকিরা ফোনে কথা বলছিলেন। এই যন্ত্রটি আগে তাঁর বাড়িতে ছিল না। রাখার চেষ্টাও করেননি। ফোনের কথা উঠলে তারাপদদের ঠাট্টা করে বলতেন, “তোমাদের ওই ‘টেলি ফোঁ’ কানে তুললেই আমার ব্রেন ড্যামেজ হয়ে যায়। ওঃ, কী বিদঘুঁটে সব শব্দ, হয় পটকা ফাটছে কানের পরদায়, না হয় সোঁ-সোঁ হাওয়া বইছে। এই জ্যান্ত, এই মৃত।…না, বাপু; এই বেশ আছি। নো ঝামেলা।”
কিকিরা টেলিফোনকে ‘টেলি ফোঁ’ বলেন। অনেক আগে নাকি ‘ফোঁ’ বলারই রেওয়াজ ছিল কারও কারও। কেন ছিল তিনি জানেন না। পুরনো বাংলা বইয়েই দেখেছেন কথাটা।
হালে, কিকিরারই এক চেলা, ম্যাজিশিয়ান চেলা, একটা ম্যাজিক বক্সের নকশা করিয়ে নেওয়ার পর, গুরুদক্ষিণা হিসেবে যন্ত্রটি বসাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তার মামা বা কাকার দৌলতে।
কিকিরা যখন ফোনে কথা বলেন, মনে হয় অ্যাক্টিং করছেন। গলার পরদা উঠছে, নামছে, ঢেউ খেলছে, হয় হাসছেন না হয় হায় হায় করছেন–সে এক অপূর্ব শ্রুতিনাট্য।
কিকিরা কথা বলছিলেন ফোনে, আর তারাপদরা নিজেদের জায়গায় বসে কখনও কথা বলছিল, কখনও বা কিকিরার কথা শুনছিল।
এমন সময় এক কমবয়েসি ভদ্রলোক এসে হাজির।
ফোন নামিয়ে রাখলেন কিকিরা।
“আরে লাটু?”
তারাপদরা ভদ্রলোককে দেখছিল। আগে দেখেনি। দেখার মতন অপূর্ব চেহারা অবশ্য নয়, কিন্তু সুদর্শন। লম্বাটে গড়ন, রং বেশ ফরসা। সাধারণ কাটা-কাটা চোখমুখ। পরনে ধুতি, গায়ে ঘি-রঙের সিল্কের হাফশার্ট। চোখে চশমা। কিকিরার চেয়ে বয়েসে ছোট। অনেকটাই।
“কী ব্যাপার লাটু? তুমি হঠাৎ?”
লাটু কিকিরাকে দেখছিল। তারপর তারাপদদের নজর করে নিল।
“এলাম। আপনাকে অনেকদিন দেখতে পাই না, রায়দা! পথ ভুলে গিয়েছেন।”
“না রে ভাই, যাব যাব করি, যাওয়া হয় না। বোসো, দাঁড়িয়ে রইলে যে!”
লাটু বসল। তার ইতস্তত ভাব তখনও যায়নি। তারাপদদের দেখছিল বারবার।
“কেমন আছ?” কিকিরা বললেন।
“চলে যাচ্ছে! বড়বাবুর শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। ব্লাড সুগারে কাহিল হয়ে পড়েছে। মেজদা ঠিক আছে।”
“তুমি?”
“দেখতেই পাচ্ছেন!” বলে একবার আড়চোখে তারাপদদের দেখল! সামান্য দ্বিধা নিয়ে বলল, “আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল। প্রাইভেট৷”
কিকিরা লাটুকে দেখলেন ভাল করে। “কেমন প্রাইভেট? একেবারে বেশি প্রাইভেট হলে পাশের ঘরে চলো। আর যদি অন্যরকম কিছু হয় তুমি এদের সামনেই বলতে পারো। ওরা–মানে ওই তারাপদ আর চন্দন আমার রাইট লেফট, মানে ডান হাত বাঁ হাত।”
লাটু যেন কী ভাবছিল। কিকিরার ডান-বাঁয়ের সঙ্গে তার চাক্ষুষ পরিচয় না থাকলেও এদের কথা সে শুনেছে।
কিকিরার খেয়াল হল, লাটুর সঙ্গে তারাপদদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “লাটুকে তোমরা আগে দেখোনি না? লাটুর ভাল নাম, লোকেন। আমরা সবাই ওকে লাটু বলেই ডাকি। লাটু দত্ত। ডাকনামটাই ওর চলে গিয়েছে।” বলে একটু হাসলেন, “লোকেন বললে বাড়ির লোকও ধোঁকা খেয়ে যাবে, বুঝতে পারবে না। লাটুরা হল জুয়েলার্স; তিনপুরুষের বিজনেস।”
লাটু অন্যমনস্ক। তারাপদদের দেখছে একবার, আবার চোখ ফিরিয়ে কিকিরাকে লক্ষ করছে। খানিকটা বিব্রত ভাব। দ্বিধা।
কিকিরা বুঝতে পারলেন। সহজ হতে পারছে না লাটু। বললেন, “বাইরে থেকে এলে, জল খাবে? গরম পড়তে শুরু করেছে। ঘেমে গিয়েছ যেন। জল খাও আগে, চা খাও।” বলে ইশারায় তারাপদকে একবার ভেতরে যেতে বললেন। বগলাকে জল চায়ের কথা বলে আসতে।
তারাপদ উঠে গেল।
“বড়বাবু দোকানে আসছেন না?” কিকিরা বললেন। ঘরোয়া কথা বলে লাটুর অস্বস্তি কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
“বিকেলে আসে।”
“ওষুধটষুধ খাচ্ছেন তো! যা জেদি মানুষ।”
“খাচ্ছে। তবে মেজাজ…
“বুঝেছি। স্বভাব কি পালটায় হে সহজে!…ভেবো না; আজকাল বাজারে কত ওষুধ বেরিয়েছে, সুগার কবজা হয়ে যাবে!” বলে চন্দনের দিকে তাকালেন। “কী বলো ডাক্তার?” বলেই আবার লাটুর দিকে তাকালেন, দেখলেন চন্দনকে, “চাঁদু একজন উঠতি ডাক্তার। ভেরি গুড। বয়েসকালে ধন্বন্তরি হয়ে যাবে।” হাসতে লাগলেন কিকিরা।
তারাপদ ফিরে এল। পেছনে পেছনে বগলা। জল এনেছে।
লাটু জলের গ্লাস তুলে নিল। খেল। সত্যিই তার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। গরম পড়ার মুখেই যেন এবার কলকাতা শুকোতে শুরু করেছে। সবে ফাল্গুনের মাঝামাঝি, এখনই রোদের কী তেজ! এভাবে চললে চৈত্র-বৈশাখে শহরে হলকা উঠবে দিনে-রাতে।
জল খেয়ে পকেট থেকে রুমাল বার করে লাটু মুখ মুছে নিল।
“বলো কী ব্যাপার? ফ্যামিলির কোনও ব্যাপার নয় তো?” কিকিরা বললেন।
“না।…আমার ব্যাপার?”
“তোমার ব্যাপার?”
“মানে, আমার এক বন্ধুর ব্যাপার!”
“কী হয়েছে?”
“তাকে খুনের আসামি করার ফন্দি আঁটা হচ্ছে।”
“খুনের আসামি?” কিকিরা অবাক! কেমন যেন থতমত খেয়ে গিয়েছেন।
তারাপদরাও অবাক চোখে লাটুকে দেখছিল।
কিকিরা বললেন, “কী বলছ তুমি! খুনের আসামি। তুমি ঠিক বলছ, না, আন্দাজে! ভয় পেয়ে বলছ?”
মাথা নেড়ে লাটু বলল, “ঠিক বলছি।”
“তোমার বন্ধু-খুনের আসামি–”, কিকিরা তখনও বিশ্বাস করছিলেন না। “কী করে বন্ধু? নাম কী?”
লাটু বলল, “ওর নাম নবকুমার। নবকুমার চৌধুরী। আমরা ওকে কুমার বলেই ডাকি। ওর একটা ব্যবসা আছে। ছোট কারখানার মতন। সেখানে পুরনো ফ্রিজ সারাই, এয়ারকুলার রিপেয়ারিং, রং করা–এই সব হয়।”
“কারখানা কোথায়?”
“সুরেশ ব্যানার্জি রোডে।”
“তা খুনের আসামি কেন? বয়েস কত তার?”
“প্রায় আমারই বয়েসি। বছর তিনেকের ছোট।…ব্যাপারটা আপনাকে গুছিয়ে না বললে বুঝবেন না!”
“কেমন করে বুঝব! খুলেই বলো।”
তারাপদরাও কৌতূহল বোধ করছিল। লাটুর দিকে তাকিয়ে থাকল।
লাটু বলল, “রায়দা, আপনি বর্ধমান জেলার নুরপুরের নাম শুনেছেন?”
মাথা নাড়লেন কিকিরা। “না। সেটা কোথায়?”
“বর্ধমান থেকে কাটোয়ার দিকে যেতে পড়ে। আমি কোনওদিন যাইনি, কুমারের মুখে শুনেছি। নুরপুরের নাকি অনেক খ্যাতি। প্রাচীনকাল থেকেই। এখন অবশ্য অত খ্যাতি-প্রতিপত্তি নেই। তবে নুরপুরের রাজবাড়ি, ওরা যাকে বলে ‘রাজবাটি’ তা টিকে আছে। আগে বলত নুরপুরের রাজা, পরে হল জমিদার, আর এখন জমিদারি সেভাবে না থাকলেও বেনামা জমিজায়গা থেকে শুরু করে, চালকল তেলকল কোল্ড স্টোরেজ নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে। দেদার সম্পত্তি ওদের।”
“মানে নুরপুরের এক্স-জমিদারদের।”
“হ্যাঁ।…কুমার সেই বাড়ির ছেলে। ছোট তরফ-মানে ছোট ভাইয়ের। আইনত পুরো সম্পত্তির অর্ধেক মালিকানা তার। কিন্তু তার ভাগ্য মন্দ। কম বয়েসেই অনাথ। বাবা-মা মারা যান। ওকে পোষ্য নেওয়া হয়। ওর অন্য কোনও নিজের ভাইবোনও ছিল না। ছেলেবেলা থেকে তার জেঠা ওদের ওপর কর্তৃত্ব করেছেন। জেঠা মানে–কুমারকে যিনি পালন করেছেন তাঁর দাদা। মা যতদিন বেঁচে ছিল তবু সামান্য রয়েসয়ে ছিলেন। মা মারা যাওয়ার পর গ্রাহ্যও করতে চান না।”
“দাঁড়াও, দাঁড়াও–একটু ক্লিয়ার হয়ে নিই। তুমি বলছ, নুরপুরের রাজবাড়ির ছোট ভাই অনাথ একটি ছেলেকে পোষ্য নেন! …তাহলে বড় ভাই দাঁড়াচ্ছে ছেলেটির একরকম জেঠা।…তা ভাইপোর দোষ?”
লাটু বলল, “দোষ বলতে কী বলব! ভাগ্যের দোষ। কুমারের কথায়, সে পালিত পুত্র। মানে, সে ছেলেবেলাতেই অনাথ হয়ে যায়। তার নিজের বাবা মারা যান বছর দুই বয়েসে। নিজের মাকেও সে হারায় পাঁচ বছরে। একেবারেই অনাথ।”
“ভেরি স্যাড!”
“রজনীকান্ত আবার সম্পর্কে কুমারের মেসোমশাই। তিনিই তাকে পালন করেন। পোয্য নেন। মাসিমা-মেসোমশাই-ই তার মা-বাবা।”
“রজনীকান্ত তাহলে ছোট ভাই?”
“হ্যাঁ। বড়র নাম কৃষ্ণকান্ত। দু’ভাই কৃষ্ণকান্ত আর রজনীকান্ত। রাজবাড়ি, জমিদারি, স্থাবর সব সম্পত্তির মালিক আইনত দুই ভাইয়ের সমান সমান। কিন্তু ছোট ভাই রজনীকান্ত হঠাৎ মারা যাওয়ার পর, বড় ভাই নিজেই সব অধিকার করে নেওয়ার মতলব আঁটতে শুরু করেন।”
তারাপদ বলল হঠাৎ, “পারিবারিক ঝামেলা। এসব তো ওল্ড কেস। বড় ভাই ছোট ভাইকে পথে বসাবার ধান্দা করতে শুরু করে দেয়!”
লাটু মাথা হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ।
কিকিরা বললেন, “কৃষ্ণকান্ত মানুষটি তবে সুবিধের নয় বলছ? সম্পত্তি হাতাবার এইসব কাণ্ডকারখানা পুরনো আমল থেকে চলছে, এখনও চলে। মানুষের লোভ সহজে মেটে না। তার ওপর এখানে দেখছি ছোট ভাই নেই, ভাইয়ের স্ত্রী নেই। রয়েছে তাদের পোষ্যপুত্র। …তা কৃষ্ণকান্ত থাকেন কোথায়? বয়েস কত?”
“কুমারের কথায়, তার জেঠার বয়েস পঁয়ষট্টির মতন। থাকেন দেশে। নুরপুরে। নিজেদের ভিটেয়, রাজবাড়িতে।”
“ভাল। তোমার বন্ধু থাকে কলকাতায়, তার জেঠা নুরপুরে। একজন এখানে, অন্যজন দূরে। খুনের আসামি করা হচ্ছে কেমন করে? কে করছে?”
“জেঠা।”
“জেঠা? কীভাবে?”
লাটু আবার রুমাল বার করে মুখ মুছে নিল। ঘরে পাখা চলছিল। সামান্য শব্দ হচ্ছিল।
বগলা চা নিয়ে এল। চায়ের সঙ্গে বাড়িতে ভাজা পকৌড়া।
কোনও কাজে তেমন খুঁত রাখে না বগলা। কাঠের ট্রে থেকে পকৌড়ার প্লেট, চায়ের কাপ তুলে একে একে এগিয়ে দিল সকলকে।
কিকিরা ঘরের বাতি জ্বেলে দিতে বললেন।
বাতি জ্বেলে দিয়ে বগলা চলে গেল।
কিকিরা সহজভাবে লাটুকে বললেন, “নাও, চা খাও। অত ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন? ব্যাপারটা শুনি আগে সব। তোমার বন্ধু কি পুলিশের খপ্পরে পড়েছে?”
লাটু মাথা নাড়ল। “না। এখনও পড়েনি।”
“তবে বলছ খুনের আসামি?”
“অ্যাটেম্পট টু মার্ডার কেসে ফাঁসাবার চেষ্টা হচ্ছে।”
“ও! অ্যাটেম্পট টু মার্ডার! সেটাও জব্বর কেস। জামিন পাওয়া বেশ কঠিন শুনেছি।” বলতে বলতে চায়ে চুমুক দিলেন কিকিরা।
চন্দন ধাঁধায় পড়ে বলল, “কেউ খুন হয়নি তো?”
“না।”
যেন নিশ্চিন্ত হয়ে নিশ্বাস ফেলল চন্দন।
কিকিরা লাটুকে বললেন, “একটু গুছিয়ে বলো তো ঘটনাটা। এলোমেলো কথা থেকে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ধরতে পারছি না ব্যাপারটা।”
লাটু কয়েক ঢোক চা খেয়ে নিল। তারপর বলল, “ঘটনাটা দিন আট-দশ আগেকার। কৃষ্ণকান্ত নুরপুর থেকে কলকাতায় এসেছেন। নুরপুর রাজবাড়ির একটা ভাড়া করা আস্তানা আছে কলকাতায়। অনেকদিন ধরেই। ব্যবসাপত্রের কাজকর্মের জন্যে কর্মচারীদের থাকতে হয়। কৃষ্ণকান্তও আসেন। দু-একজন কাজকর্মের লোক বরাবরই থাকে।”
“বাড়িটা কোথায়?”
“বি. কে. পাল অ্যাভিনিউতে।”
“আচ্ছা! তারপর? কী ঘটেছিল ব্যাপারটা?”
“কৃষ্ণকান্ত কিছুদিন আগে কলকাতায় এসেছেন। বছরে এক-আধবার তিনি আসেন। কাজকর্ম থাকে। এবার আসার পর তিনি লোক মারফত খবর পাঠান কুমারকে। দেখা করতে বলেন।”
“কেন?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।
চন্দনরা চা-পকৌড়া খেতে খেতে মন দিয়ে লাটুর কথা শুনছিল।
লাটু বলল, “জেঠার সঙ্গে কুমারের যোগাযোগ একেবারে নেই তা নয়। তবে সেটা চিঠিপত্রে। তবে সবই দু’তরফের ঝগড়াঝাটি নিয়ে। মানে সম্পত্তির দাবি পাওনাগণ্ডা নিয়ে।” একটু থামল লাটু। আবার দু’ ঢোক চা খেল। বলল, “অনেকদিন ধরে গণ্ডগোলটা চলছে, মেটবার আশা নেই, আইন-আদালত করেও কিছু করা যাবে না দেখে, মানে কুমারের পক্ষে তার জেঠার সঙ্গে যুঝে ওঠা সম্ভব নয় ভেবে শেষ পর্যন্ত কুমার একটা মামুলি মিটমাট চাইছিল।”
“কীরকম মিটমাট?” কিকিরা বললেন।
“কুমার কিছু টাকা চেয়েছিল। নগদ।”
“কত টাকা?”
“প্রথমে লাখ বিশেক টাকা চেয়েছিল। কৃষ্ণকান্ত সটান না করে দিয়েছিলেন।…বিশ লাখ থেকে নেমে নেমে দশে দাঁড়াল। তাতেও কৃষ্ণকান্ত অরাজি। শেষে পাঁচ।”
“পাঁচ লাখ টাকা দাবি ছিল?”
“হ্যাঁ।” লাটু মাথা হেলিয়ে বলল, “কৃষ্ণকান্ত নিমরাজি হন। চিঠিতে জানান, ভেবে দেখছেন।”
“তারপর?”
“তারপর কলকাতা আসার আগে কৃষ্ণকান্ত একটা চিঠি লিখে জানান, তিনি শিগগির বিশেষ কাজে কলকাতা যাচ্ছেন। কলকাতায় এসে তিনি কুমারকে খবর পাঠাবেন। দেখা হলে সামনাসামনি কথা হবে। তবে লাখ দুই-আড়াই টাকা তিনি আপাতত দিতে পারেন। কয়েকটা কাগজপত্রের কাজ শেষ হলে পরে সে বাকি টাকা পাবে।”
“কী ধরনের কাগজপত্র?”
“জানি না। কুমারও জানে না। সে সুযোগ তার হয়নি।”
“কেন?”
খানিকটা উৎকণ্ঠার গলায় লাটু বলল, “কুমার তার জেঠার কথা মতন নির্দিষ্ট দিনে কৃষ্ণকান্তর সঙ্গে দেখা করতে যায়। ওখানকার লোক চেনে কুমারকে। কৃষ্ণকান্ত বলেও রেখেছিলেন তাঁর কর্মচারীদের। কুমার যাওয়ামাত্র তারা ভেতরের ঘরে তাকে পাঠিয়ে দেয়।”
“মানে কৃষ্ণকান্ত যেখানে ছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
“কী হল তারপর?”
“কুমার ঘরে গিয়ে দেখে, জানলার কাছে একটা সেকেলে বিশাল আর্ম চেয়ারে কৃষ্ণকান্ত শুয়ে রয়েছেন। তাঁর সামনে একটা গোল টেবিল। পাথরের টপ। টেবিলের ওপর একটা ব্রিফকেস। পাশেই জলের গ্লাস, পানের ডিবে, জরদার কৌটো।”
“কৃষ্ণকান্ত পান খেতেন?”
“ওই নেশাটা ভালমতনই ছিল তাঁর। কুমার তাই বলে।”
“ভাইপোর সঙ্গে দেখা হল তাহলে?”
“হল। তবে একেবারে অন্যভাবে। কৃষ্ণকান্তর ঘাড় মাথা ঝুলে রয়েছে একপাশে আর্মচেয়ারে। যেন ঘাড় গুঁজে পড়ে আছেন। গলায় একটা গেরুয়া রঙের উড়নি জড়ানো। ফাঁস দেওয়ার মতন প্যাঁচানো। চোখ বন্ধ। হাত ছড়ানো। কোনও সাড়াশব্দ নেই।…কুমার বারকয়েক ডাকল। সাড়া পেল না। হঠাৎ তার ভীষণ ভয় হল। মনে হল, জেঠা মারা গিয়েছেন। গলায় উড়নির ফাঁস লাগিয়ে কেউ তাকে শ্বাস বন্ধ করে মেরে ফেলেছে। সমস্ত ব্যাপারটা এমন অদ্ভুত যে, কুমার ভয় পেয়ে পালিয়ে এল।”
কিকিরা কৌতূহল বোধ করে সোজা হয়ে বসলেন। তারাপদরা হতবাক! লাটুর দিকে তাকিয়ে থাকল।
কিকিরা অবাক গলায় বললেন, “কুমার পালিয়ে এল?”
লাটু মাথা নাড়ল। “ভয়ে।”
“অ্যাটাচিতে কি টাকা ছিল? সেটা!”
“কী ছিল কে জানে! কুমার অ্যাটাচি ছোঁয়নি। সে পালিয়ে এসেছে। অ্যাটাচি কেসটা নাকি পাওয়া যায়নি।”
“আর কৃষ্ণকান্ত? মারা গিয়েছিলেন গলায় ফাঁস লেগে?”
“না, মারা যাননি। সেটাও বিচিত্র ব্যাপার। তবে কুমার পালিয়ে আসার সময় মাত্র একজন রাজমিস্ত্রিকে দেখেছিল। তাও সে বাইরে নালা মেরামতির কাজ করছিল। দ্বিতীয় কাউকে চোখে পড়েনি।”
কিকিরা প্রথমে লাটু, পরে তারাপদদের দেখলেন। তিনিও কম বিস্মিত হননি। বললেন, “কৃষ্ণকান্ত তাহলে মারা যাননি! মানে গলায় ফাঁস লেগে শ্বাস বন্ধ হয়ে মরেননি।”
“না।”
“তাহলে নট এ কেস অব মার্ডার?”
“সেভাবে খুন বা হত্যা নয়…”
“তবে?”
“অ্যাটেম্পট টু মার্ডার?”
“প্রমাণ কোথায়? কে বলেছে কুমার তার জেঠাকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে মারতে গিয়েছিল? থানায় ডায়েরি করেছেন কৃষ্ণকান্ত বা তাঁর তরফের কেউ? পুলিশকে জানানো হয়েছে?”
মাথা নেড়ে লাটু বলল, “এখন পর্যন্ত নয় বলে জানি।”
“তাহলে?”
“কুমারের কানে গিয়েছে, কৃষ্ণকান্ত এবার তাকে জালে জড়াবেন। সে টাকার লোভে সেদিন তার জেঠাকে খুন করার চেষ্টা করছিল। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গিয়েছেন।”
কিকিরা গম্ভীরভাবে কী যেন ভাবছিলেন। চন্দনরা চাপা গলায় কথা বলছিল নিজেদের মধ্যে।
অনেকক্ষণ পরে কিকিরা লাটুকে বললেন, “তোমার বন্ধু কুমারের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই। সে কোথায়? পালিয়ে বেড়াচ্ছে?”
লাটু বলল, দেখা হওয়ার ব্যবস্থা সে করবে, কাল বা পরশু।
.
০২.
নবকুমার ছেলেটিকে দেখলে মনে হয় সে ঠিক পুরোপুরি শহুরে ছোকরা নয়। কোথায় যেন খানিকটা মফস্বলি বা গ্রাম্য ভাব রয়েছে। স্বাস্থ্য ভাল, শক্ত গড়ন। হাত পায়ের হাড় বেশ খটখটে। মাথা ভরতি চুল। কোঁকড়ানো। সামান্য দাড়ি গালে। কপাল ছোট। মুখের আদল প্রায় গোল, বড় বড় চোখ, ঘন ভুরু, বসা নাক। দাঁত ঝকঝক করছে। গায়ের রং শ্যামলা। আর বয়েস বেশি হলেও পঁচিশ ছাব্বিশ বড়জোর। তারাপদদের চেয়ে দু-তিন বছরের ছোটই হবে। লাটুর বন্ধু হলেও বয়েসে ছোট। লাটুকে সে লাটুদা’ বলে ডাকে।
লাটু কিকিরাদের যে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল সেটা বেলগাছিয়ার খালের দিকে। আশেপাশে কাঠগোলা, ইট সুরকির আড়ত, পুরনো লোহা-লক্কড়ের গুদোম। মায় একটা কাঠ-চেরাই কল।
মাঠকোঠা ধরনের বাড়ির দোতলায় নবকুমারকে পাওয়া গেল। পেছনে খালের পাড়। মাটি, জংলা গাছগাছালির স্তূপ। খালের গন্ধ আসে হাওয়ায়।
নবকুমার একটা বারমুডা গোছের প্যান্ট আর গেঞ্জি গায়ে বসে ছিল।
লাটুর বোধহয় আগেই বলা ছিল, কিকিরাদের দেখে নবকুমার অবাক হল না। বরং এমনভাবে তাকিয়ে থাকল কিকিরার দিকে যেন তার বিশ্বাস হচ্ছিল না, এরা কিছু করতে পারে তার জন্যে। ক্রিমিন্যাল কেস নিয়ে যারা কোর্টকাছারি মাতিয়ে দেয়–তেমন কোনও পাকা উকিলকে সামনে দেখলে হয়তো নবকুমার সামান্য আশ্বস্ত হত। কিন্তু লাটুদা তাকে বলে গিয়েছিল, আমি ঠিক লোক আনব তুই ভাবিস না।
কিকিরাও নবকুমারকে ভাল করে দেখছিলেন।
শেষে বললেন, “চলো বসা যাক ভেতরে।”
কাঠের সরু বারান্দা ঘেঁষে শেষপ্রান্তের একটা ঘরে গিয়ে বসল সবাই। ঘরে আসবাব বলতে একটা তক্তপোশ আর মাত্র একটা চেয়ার।
তক্তপোশে বিছানা পাতা ছিল। এলোমেলো হয়ে আছে চাদর বালিশ। ঘরের একপাশে মাটির কুঁজো, গ্লাস।
কিকিরা ঘরের চারপাশ দেখছিলেন। মাঠকোঠা ঘর যেমন হয়, পাকাঁপোক্ত দেওয়াল নেই, মাথার ওপর টিনের শেড। মামুলি ইলেকট্রিক লাইন। ঘর দেখতে দেখতে হঠাৎ নবকুমারকে বললেন, “তোমার জানাশোনা, বন্ধু গোছের আর কে কে আছে কলকাতায়?”।
প্রশ্নটা আচমকা। নবকুমার কেমন থতমত খেয়ে গেল। প্রথমটায় বুঝতে পারল না, কী ধরনের জবাব চাইছেন কিকিরা। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আছে; জানাশোনা তো অনেকের সঙ্গে আছে। তবে বন্ধু কম।”
“বিশ্বাসী বন্ধু?”
“বিশ্বাসী বন্ধু।…কেন! লাটুদাই তো আমার বিশ্বাসী বন্ধু।”
“আর কেউ নেই?”
নবকুমার লাটুর দিকেই তাকাল, যেন সে জানতে চাইছে কী বলবে!
“কেন?”
“পরে বলছি। তুমি লাটু ছাড়া আর কার ওপর ভরসা করতে পারো? বিশ্বাস করো পুরোপুরি?”
“বাঁশরি, বাঁশরিলাল। আমাদের দেশের লোক। আমার বন্ধু। আর ওই পালিত, রাধানাথ পালিত, দোকানের লোক আমার। পালিতদা বলি। বয়েসে বড়। খুব বিশ্বাসী।… পালিতদার কাছে এসেই ওদের লোক শাসিয়ে গিয়েছে।”
কিকিরা চেয়ারে বসলেন। তারাপদরা তক্তপোশের ওপর বসে পড়েছে আগেই, নবকুমার আর লাটু দাঁড়িয়ে।
কিকিরা বললেন, “বাঁশরিলাল কোথায় থাকে?”
“নাগেরবাজার। সরকারি চাকরি। ফুড ডিপার্টমেন্ট।”
“তার সঙ্গে এর মধ্যে তোমার দেখা হয়েছে? সে এই ঘটনার কথা জানে?”
“না,”মাথা নাড়ল নবকুমার। “কেমন করে জানবে! আমি তো তারপর থেকেই লুকিয়ে আছি। এমনিতেও বাঁশরির সঙ্গে আমার রোজ দেখা হত না। মাঝে মাঝে হত। সে আসত আমার দোকানে–মানে কারখানায়। কিংবা আগে থেকে বলা থাকলে আমি তার কাছে যেতাম।”
কিকিরা বললেন, “তুমি গোড়া থেকেই কিছু ভুল করে ফেলেছ। প্রথমত, ভয় পেয়ে সেদিন সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে আসা উচিত হয়নি। আমি জানি, ভয়ে মানুষ কাণ্ডজ্ঞান হারায়। তুমি যে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলে, ভয় পেয়েছিলে, বুঝতে পারছি। কিন্তু তোমার উচিত ছিল–যদি ঘরে ঢুকে কৃষ্ণকান্তকে দেখেই মনে হয়ে থাকে তিনি মারা গিয়েছেন–তাহলে ঘরের বাইরে এসে চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করা। বাড়িতে লোক ছিল, তুমি নিজেই বলেছ। কর্মচারীদের দু’-একজনকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে আবার ঘরে ঢোকা।”
“কেন?”
কিকিরা তারাপদর দিকে তাকালেন। “তুমিই বলে দাও তো কেন?”
তারাপদ বলল, “ওরা সাক্ষী থাকত।” বলে নবকুমারের দিকে তাকাল। “তুমি চোরের মতন ঘরে ঢোকোনি–” তারাপদ খেয়াল না করেই নবকুমারকে ‘তুমি’ বলে ডেকে ফেলল। নবকুমার বয়েসে ছোট বলেই বোধহয়। বলল, “ঘরে ঢোকার আগে একজন কর্মচারী তোমায় দেখেছে। কথা বলেছে। এমনকী একথাও বলেছে যে-কৃষ্ণকান্ত ভেতরের ঘরে তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছেন।”
নবকুমার বলল, “বলেছে বইকী!”
“আর তুমি ঘরে ঢুকে দেখলে কৃষ্ণকান্ত মারা গিয়েছেন। মারা গিয়েছেন বুঝলে কেমন করে? শুধু চোখে দেখেই বুঝে নিলে! আর তুমি ঘরে ঢুকলে আর ভদ্রলোককে খুন করলে! অত তাড়াতাড়ি চোখের পলকে কাউকে গলায় কাপড় জড়িয়ে মারা যায়? এটা কি বিশ্বাস করার মতন? পাকা খুনিরাও পারবে বলে মনে হয় না। অ্যাকশান সিনেমায় এসব দেখা যায়, বাস্তবে নয়। তোমার যদি মিলিটারি কমান্ডো ট্রেনিং থাকত–তবু না হয় বলা যেত, তোমার সেই ক্ষমতা কায়দা জানা আছে। তবে তা তোমার জানা নেই।”
লাটু কিকিরার দিকে তাকাল। যেন বুঝতে চাইল, তারাপদ যা বলছে তা কি ঠিক!
কিকিরা আগেই তারাপদদের সঙ্গে ঘটনাটা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি জানেন তারাপদ যা বলেছে ঠিকই বলেছে।
“ওটাও বলো,” কিকিরা তারাপদকে বললেন।
তারাপদ বলল, নবকুমারকেও, “আর ওই যে ব্রিফকেস, সেটা যে তুমি নাওনি, মানে উঠিয়ে নিয়ে পালিয়ে আসেনি, তার প্রমাণও থাকত। অবশ্য তুমি যদি লোক জড়ো করে আবার ঘরে ঢুকতে। যারা তোমার সঙ্গে ঘরে ঢুকত, তারা দেখত– কৃষ্ণকান্তর সামনে টেবিলে ব্রিফকেসটা রাখা রয়েছে।”
লাটু বলল, “ব্রিফকেস ও ছোঁয়নি।… ওর জেঠাকেও নয়।”
“সে তো আমরা বলছি।… ওরা যদি অন্য কথা বলে।”
“কী বলবে?”
“টাকা নিতেই নবকুমার ও বাড়ি গিয়েছিল। তাকে বলা হয়েছিল যেতে। ওরা যদি বলে ঘরে ঢুকে জেঠাকে দমবন্ধ করে মেরে টাকা ভরতি ব্রিফকেস উঠিয়ে নিয়ে ও চলে এসেছে– তাহলে কীভাবে প্রমাণ হবে যে, না সে টাকা নেয়নি। না নেওয়ার সাক্ষী কোথায়?… জেঠা হয়তো বরাতজোরে বেঁচে গিয়েছেন। কিন্তু টাকা!
এবার কিকিরা কথা বললেন। “বুঝলে লাটু, কাজটা বেশ কাঁচা হয়ে গিয়েছে। কৃষ্ণকান্ত ছক কষে কুমারকে ফাঁসাবার চেষ্টা করেছেন বলে সন্দেহ করা যেতে পারে। কুমার টাকা নিতে ও বাড়ি গিয়েছিল। যাওয়ার কথা ছিল। টাকা নিতে গিয়ে কৃষ্ণকান্তর সঙ্গে তার বচসা হয়, রাগে ক্ষোভে বা মাথা গরম করে সে তার জেঠাকে খুন করতে যায়। তারপর টাকা নিয়ে পালিয়ে আসে।… কৃষ্ণকান্তর যদি এটা সাজানো ছক হয়, তবে আমার সন্দেহ-ব্রিফকেসে না পাওয়াই স্বাভাবিক। নিজেরাই সরিয়েছে।”
নবকুমার দু’হাতে মুখ ঢেকে যেন ফুঁপিয়ে উঠল। মাথা নাড়তে লাগল জোরে জোরে। “আমি টাকা নিইনি। ঝগড়াও করিনি। কার সঙ্গে ঝগড়া করব! জেঠা মারা গিয়েছে ভেবে ভীষণ ভয় পেয়ে আমি পালিয়ে এসেছি।”
কিকিরা কথা বললেন না।
সকলেই চুপচাপ।
নবকুমার নিজেকে সামলে নিল খানিকটা।
লাটু বলল, “রায়দা, এখন কী হবে?”
কিকিরা বললেন, “দেখা যাক কী হয়! তবে ওকে এখানে রেখো না। আমি তো বলব, কুমারের লুকিয়ে থাকাও উচিত হয়নি। সে টাকা নেয়নি, তার জেঠাকেও খুন করার চেষ্টা করেনি। তার উচিত ছিল নিজের আস্তানায় বসে থাকা, দোকানে যাওয়া, আর কোনও ঘুঘু উকিল-যারা ক্রিমিন্যাল কেসের প্র্যাকটিস করে, তার কাছে গিয়ে গোটা ব্যাপারটা খুলে বলা। কাউকে ক্রিমিন্যাল বললেই সে ক্রিমিন্যাল হয় না, অ্যাটেম্পট টু মার্ডার চার্জ আনলেই সেটা সত্যি হয়ে যায়? মামার বাড়ি!” বলে কিকিরা নিজের মাথার ওপরটা দেখালেন ডান হাতে। বললেন, “আমি একদিন মলাঙ্গা লেনের সরু গলি দিয়ে যাচ্ছিলাম মাঝদুপুরে। হঠাৎ একটা দোতলা বাড়ির ছাদের কোণ থেকে একটা ইট এসে পড়ল। একেবারে পায়ের কাছে। মাত্র ফুটখানেক তফাতে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে মাথা তুলে ওপরে তাকালাম। কাউকে দেখতে পেলাম না। ইটটা আমার মাথায় পড়লে রক্ষে ছিল। কথা হচ্ছে, আমি যদি এটাকে অ্যাটেম্পট টু মার্ডার বলে কেস ঠুকতাম, আইন কি মেনে নিত?”
লাটু মাথা নাড়ল। “না। তা কেমন করে মানবে! ওটা নিতান্তই অ্যাকসিডেন্ট। কাকতালীয়।”
“পাক্কা কথা বলেছ। আদালত দেখত, ইটটা কেমন করে পড়ল, কে ফেলেছে? নিজের থেকেই আলসের আলগা ইট পড়ে গেছে কি না! যে বাড়ি থেকে ইটটা পড়ল সে বাড়িতে এমন কে আছে যে আমার শত্রু! আমাকে জখম করতে চায়! তার মোটিভ কী!… কিন্তু সেরকম কোনও ব্যাপারই নেই। কাজেই–”
কথাটা আর শেষ করলেন না কিকিরা।
তারাপদ বলল, “আপনার বেলায় না থাক, নবকুমারের বেলায় ছিল।”
“ছিল বলেই তো বলছি, নবকুমার ভুল করেছে পালিয়ে এসে। দু’ নম্বর ভুল হল, সে নিজের দোকান আর বাড়ি ছেড়েই বা পালিয়ে আসবে কেন? তাতে তার ওপর সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। এটা উচিত হয়নি।”
লাটু বলল, “ও ছেলেমানুষ, রায়দা! এতটা বোঝেনি।”
“তুমি যে ওকে এখানে এনে লুকিয়ে রেখেছ, তুমি কি ভাবছ ওর জেঠা বুঝতে পারবে না?”
“কেমন করে বুঝবে! এই মাঠকোঠার মালিক আমার চেনা লোক। বিশ্বাসী।”
“হতে পারে। কিন্তু, এটাও নিশ্চয় যে, ওর জেঠা খোঁজখবর রাখে, তুমি নবকুমারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কাজেই বিপদের সময় তুমিই তার প্রধান সহায় হবে। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান তেমনই বলে।”
চন্দন একেবারে চুপচাপ ছিল। আগের দিনও সে কথা বলেছে কি বলেনি, আজও নীরব। এবার সে কথা বলল, “তা কিকিরা, ভুল শোধরাবার উপায় কী? ও কি নিজের ডেরায় ফিরে যাবে?”
মাথা নাড়লেন কিকিরা। “না। আর ফিরে গিয়ে লাভ নেই। আপাতত নয়। বরং এখানেই থাকুক। তবে চোখ খোলা রেখে!” কথা বলতে বলতে মাথার ওপর তাকালেন। বেশ গরম লাগছিল। ছোট একটা পাখা লোহার রডের সঙ্গে আংটায় ঝোলানো রয়েছে। ছোট পাখা। ইশারায় পাখাটা চালিয়ে দিতে বললেন।
লাটুই পাখাটা চালিয়ে দিল।
কিকিরা নবকুমারকে বললেন, “তোমার জেঠা যে তোমাকে অ্যাটেম্পট টু মার্ডার কেসে ফাসাবার চেষ্টা করছেন এ কথা তুমি জানলে কেমন করে?”
“বললাম যে, পালিতদা বলেছে। আমার দোকানের লোক। জেঠার কর্মচারী আমার দোকানে এসেছিল খোঁজ করতে আমাকে। সে বলে গিয়েছে।”
“খোঁজ করতে, না, ভয় দেখাতে।”
“জানি না।”
“তোমার জেঠা কৃষ্ণকান্তর নিশ্চয় অনেক বুদ্ধি। ধুরন্ধর মানুষ ভদ্রলোক। তা একটা কথা বলো তো বাপু, তোমাকে সম্পত্তি থেকে একেবারে বঞ্চিত করার অজুহাতটা কী ভদ্রলোকের?”
নবকুমার সামান্য চুপ করে থাকল। পরে ক্ষুব্ধ হতাশ গলায় বলল, “জেঠার কথা, আমি তাঁর ছোট ভাইয়ের পালিত পুত্র মাত্র। আমাকে আইনত দত্তক নেওয়া হয়নি। কাজেই আমি চৌধুরী বংশের ছোট তরফের উত্তরাধিকারী হতে পারি না।”
চন্দন অবাক হয়ে বলল, “এমন কোনও আইন আছে নাকি?”
“বর্ধমান কোর্টে আমি মামলা করেছিলাম। কিছু হয়নি।”
কিকিরা বললেন, “এটা তো আমিও জানি না। দত্তক আর পোয্য বা পালিত পুত্রকন্যাদের মধ্যে তফাতটা কী? তবে আইন বড় অদ্ভুত। কোনটা যে হ্যাঁ হয়ে যায়, কোনটা না, বলা মুশকিল।”
লাটু বলল, “আমি একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন, আইন বড় জটিল। যে কোনও লোক যাকে খুশি পালন করতে পারে। পালিত হলেই সে যে পালকের সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবে এমন কোনও কথা নেই। এই ধরনের মামলা অনেক হয়। ব্রিটিশ আমল থেকেই হয়ে আসছে। কোর্ট হাইকোর্টে বছরের পর বছর মামলা চলে।”
কিকিরা আর মামলার কথায় গেলেন না। গিয়ে লাভ নেই। দেওয়ানি আর সম্পত্তির ওয়ারিশন নিয়ে যে এক একটা মামলা বিশ পঁচিশ বছর ধরে পড়ে থাকে আদালতে, তা তিনিও শুনেছেন। আপাতত ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। তবু কয়েকটা কথা জানা দরকার।
কিকিরা বললেন, নবকুমারকেই, “লাটুর মুখে আমরা শুনেছি খানিকটা, তবু তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।”
“বলুন।”
“তোমার বাবা-মানে নিজের বাবার নাম কী? তিনি কোথায় থাকতেন, কী করতেন?”
নবকুমার বলল, “আমার নিজের বাবার নাম ভবনাথ রায়। বাবার মুখও আমার মনে নেই। একেবারে ছেলেবেলায়, আমার দেড় দু’বছর বয়েসে বাবা মারা যান, কেমন করে মনে থাকবে বাবাকে।… বাবা হরিপুর কোলিয়ারিতে কাজ করতেন। কম্পাসবাবু। আমার মায়ের নাম সরমা। মা আমাকে নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়ে যান। কী করবেন, কেমন করে মানুষ করবেন ভেবে পেতেন না। মাসি–মানে মায়ের বড় বোন ছাড়া আমাদের অন্য কোনও আত্মীয় ছিল না। মাকে মাসির ওপরই নির্ভর করতে হত। শেষে মা বেচারিও অসুখে পড়লেন। কী অসুখ আমি বলতে পারব না। রক্তবমি হত মাঝে মাঝেই। বাঁচার আশা ছিল না।… তখন মাসি আর মেসোমশাই এসে আমাদের নুরপুরে তাদের কাছে নিয়ে যান।”
“তোমার মা নুরপুরেই মারা যান?”
“হ্যাঁ। বাবা মারা যাওয়ার বছর তিনেক পরে।”
“মাসি আর মেসোমশাই তোমাকে পালন করেন?”
“হ্যাঁ। ওঁরাই আমার মা বাবা হয়ে ওঠেন।”
“ওঁদের সন্তান–?”
“ছিল না। আমাকেই ছেলে হিসেবে পালন করেছেন।… আমি ভাল করে জ্ঞান হওয়ার পর ওঁদেরই মা বাবা হিসেবে পেয়েছি। আমরা তো রায় ছিলাম। পরে স্কুলে পড়ার সময় মশাইবাবা আমার পদবির সঙ্গে চৌধুরীও জুড়ে দেন।”
“মশাইবাবা? মানে”
“মেসোমশাইকে আমি ছোট্টবেলা থেকেই মশাইবাবা বলে ডাকতাম। মাসিকে মা-মাসি।”
“বুঝেছি। তোমার মশাইবাবার নাম যেন কী–?”
“রজনীকান্ত।”
“কৃষ্ণকান্ত আর রজনীকান্ত দুই সহোদর ভাই।”
“হ্যাঁ।”
“কৃষ্ণকান্তর সন্তান?”
“দিদি আর দাদা। দিদির কবেই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। জামাইবাবু ব্যবসা করে। দুর্গাপুর আসানসোল। কন্ট্রাক্টারি, দোকান, হোটেল…। দাদা কিছু করে না। ওর তেমন বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। বোকা গোছের। চোখ দুটো বড় বড়, টেরা, কথা বলার সময় তোতলায়।”
কিকিরা কী যেন ভাবছিলেন। পকেট থেকে চুরুট বার করে ধরালেন। নবকুমারকেই বললেন, “রজনীকান্ত মানুষটি নিশ্চয় খুব ভাল ছিলেন?”
নবকুমার বলল, “ভাল মানে, মশাইবাবার মতন মানুষ হয় না। তার দয়ামায়ার কথা সকলে জানে। রাজবাড়ির ছোট কর্তা হয়েও একেবারে সাদাসিধে ভাবে থাকতেন। সেরেস্তার কাজকর্ম দেখতেন খানিকটা, বাকি সময়টায় বইটই পড়তেন, বন্ধুদের সঙ্গে তাস খেলতেন। তাস খেলা ছাড়া তার অন্য নেশা ছিল মাছধরা। কত যে ছিপ ছিল মশাইবাবার!”
“উনি কীভাবে মারা যান?”
নবকুমারের মুখ কেমন আরও মলিন বিষণ্ণ হয়ে গেল। বলল, “সে বড় অদ্ভুত ভাবে। আমি তখন বাইরে থাকি। স্কুল বোর্ডিংয়ে। হায়ার ক্লাসে পড়ি। হঠাৎ খবর এল, মশাইবাবা মারা গেছেন। সাপে কামড়েছিল। বিষাক্ত সাপ।”
“সাপ?”
“খবর পেয়ে ছুটলাম।… তখন শ্রাবণ মাস। ভরা বর্ষা। শুনলাম, সেদিন সকাল থেকেই টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিল। মশাইবাবার ঝোঁক চাপল ওই বৃষ্টির মধ্যে পাশের গ্রামের ঘোষপুকুরে মাছ ধরতে যাবেন। ওই ঝিঁঝিপে বর্ষায় মাছধরায় আলাদা আনন্দ।… দুপুরের পর বিকেল যখন গড়িয়ে আসছে, বৃষ্টি নামল তোড়ে। চারদিক ঝাপসা। ঘোলাটে হয়ে এল গাছপালা। মশাইবাবা ফিরেই আসছিলেন, লতাপাতার ঝোপ থেকে কী করে যেন সাপের ছোবল খেলেন।… ওঁকে আর বাঁচানো গেল না।”
তারাপদ আর চন্দন নিশ্বাস ফেলল বড় করে। দুঃখই হচ্ছিল তাদের।
অল্পক্ষণ চুপ করে থাকার পর কিকিরা বললেন, “তুমি লেখাপড়া শেষ করার আগেই-”
“আমি স্কুল শেষ করে বর্ধমানে কলেজে পড়েছি। তারপর এসেছি কলকাতায়। অন্য কোনও জায়গায় পড়ার সুযোগ হল না। টেকনিক্যাল–মানে ওই পলিটেকনিকে পড়েছি। পরে আমার এক গুরু জোটে। তার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে হোটেলে দোকানে ফ্রিজ সারিয়ে বেড়াতাম। হাতে-কলমে শিখেছি। গুরু শেষে শিলিগুড়ি চলে যায়। আমি একটা দোকান দিই।”
“তোমার মা-মাসি তখন বেঁচে ছিলেন?”
“হ্যাঁ। মা-মাসি আমায় টাকাপয়সা দিয়েছেন। দোকান করার সময় নিজের কিছু গয়না। আমি নিতে চাইনি। মা-মাসি জোর করে দিয়েছেন। বলেছেন, আমি বেঁচে থাকতে এগুলো নিয়ে যা, নয়তো পরে কিছু পাবি না। আমি নিয়েছি। তখনই আমার লাটুদার সঙ্গে পরিচয়।–মাসির সোনাদানা যা পেয়েছিলাম লাটুদাই সেসব বিক্রির ব্যবস্থা করে দেয়।
লাটু কিকিরার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। কথাটা ঠিকই।
আবার খানিকটা চুপচাপ থাকার পর কিকিরা বললেন, “তোমার জেঠার কোনও ফোটো আছে?”
“এখানে নেই। আমার বাড়িতে আছে।”
“তোমার বাড়ি মানে—সেই…”
“না। আমি যেখানে আছি। সুরি লেনে।”
“সেখান থেকে ফোটো আনা–”
“পারা যাবে না। কে আনবে!” বলে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে কী ভেবে যেন নবকুমার বলল, “আমি একটু আধটু ছবি আঁকতে জানি। ছেলেবেলা থেকেই। স্কেচ করতে পারি। জেঠার মুখ আমি কাগজ পেন্সিলে এঁকে দিতে পারি। খুব বেশি অমিল হবে না।”
কিকিরা তারাপদদের দিকে তাকালেন।
তারাপদ বলল, “ভালই তো! তাই দিক।”
কিকিরা বললেন, “বেশ। এঁকেই দাও।…এখন আমরা আর বসব না, অন্য কাজ আছে। তুমি ওটা এঁকে রাখো। কাল লাটু এসে নিয়ে যাবে।”
তারাপদ উঠে দাঁড়াল।
কিকিরা লাটুকে বললেন, “লাটু, এখান থেকে ওকে দু’-একদিনের মধ্যে অন্য কোথাও সরিয়ে দাও। আমার মনে হচ্ছে, এখানে থাকলে ওর ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় আছে। এখানে নয়, ওর গ্রামের সেই বন্ধুর বাড়িতেও নয়; অন্য কোথাও থাকুক আপাতত।”
“কোথায় সরাই, রায়দা? ভেবে দেখি।”
হঠাৎ তারাপদ বলল, “কিকিরা, ও না হয় আমার কাছেই থাকতে পারে ক’দিন!”
কিকিরা ভাবলেন দু’ মুহূর্ত। “নট এ ব্যাড আইডিয়া।” বলেই নবকুমারের দিকে তাকালেন। “তুমি সাবধানে থাকবে, এখন বাইরে যাবে না। কেউ এলে দেখাও করবে না। আর শোনো, ভয় পেয়ো না। তোমার জেঠা হুট করে কিছু করতে পারবে না। তোমার যেমন ভুল হয়েছে দু’-একটা ব্যাপারে, তোমার জেঠারও হয়েছে। এত সহজে তোমায় ফঁসাতে পারবে না।… যাই হোক, আমরা এখন চলি।… ভাল কথা, বি. কে. পাল অ্যাভিনিউতে যেখানে জেঠা আছে, তার ঠিকানাটা বলো।”
নবকুমার ঠিকানা বলল।
.
০৩.
মাঝের একটা দিন কিকিরাকে সকাল বিকেল বাড়িতে পাওয়া গেল না।
তারাপদ অফিস থেকে ফোন করেছিল বিকেলে, পায়নি। অবশ্য দুপুরে করলে পেতে পারত। বিকেলে উনি ছিলেন না বাড়িতে।
পরের দিন চন্দন এল বিকেলের পর। বড় গুমোট দিন। আকাশও ঘোলাটে। হয়তো ধুলোর ঝড় উঠতে পারে। এ সময়ে এমন হয়। ঠিক যে কালবৈশাখী তা বলা যাবে না। তবে ঝড় তো নিশ্চয়ই।
চন্দন এসে দেখল, কিকিরা নিজের জায়গাটিতে বসে কী একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছেন। পুরনো বই বলে মনে হল, কাপড় দিয়ে বাঁধানো মলাট।
“কী সার? কী পড়ছেন?” চন্দন বলল।
“চাঁদু! বোসো৷… কী আর পড়ব!” বলে বইটা সরিয়ে রাখলেন।
“কাল আমার আসা হল না। অন্য কাজে জড়িয়ে পড়েছিলাম।”
“আমিও ছিলাম না বিকেলে। সন্ধের অনেক পরে ফিরেছি। এলে আমায় পেতে না। বাড়ি ফিরে শুনলাম তারা ফোন করেছিল।”
“আমার সঙ্গে দেখা হয়নি ওর। আজ নিশ্চয় আসবে।… তা নতুন খবর বলুন। কিছু পাওয়া গেল?”।
কিকিরা বললেন, “তোমায় একটা জিনিস দেখাই।” বলে পাশের ছোট টেবিল হাতড়ে একটা কাগজ বার করলেন। “এটা দেখো।”
চন্দন উঠে গিয়ে কাগজটা নিল। সাদা কাগজে পেনসিল দিয়ে একটা মুখ আঁকা রয়েছে। দেখল চন্দন। “নবকুমারের জেঠার মুখের স্কেচ?”
“হ্যাঁ। কৃষ্ণকান্ত চৌধুরীর মুখ। কাল পেয়েছি। লাটু দিয়ে গিয়েছে। আমি তখন বাড়ি ছিলাম না। রাত্রে লাটু ফোন করেছিল। বললাম, পেয়েছি। অন্য কথাও হল।”
চন্দন কাগজটা হাতে করে নিজের জায়গায় ফিরে এসে বসল। দেখতে লাগল মুখটা। খুঁটিয়ে।
কিকিরা একবার উঠে ভেতরের ঘরে গেলেন। ফিরে এলেন সামান্য পরে।
“দেখে তো মনে হচ্ছে কড়া ধাতের লোক। ধূর্ত, প্যাঁচোয়া।”
“চোখ দেখে তাই মনে হয়।… নবকুমার যদি বাড়াবাড়ি না করে থাকে তবে আমার মনে হয়, ভদ্রলোককে চতুর, ধূর্ত মনে হলেও পাক্কা ক্রিমিন্যালের মতন দেখায় না। খুনখারাপি করার লোক নয়।”
চন্দন আবার ছবির মুখটা দেখতে লাগল।
কিকিরা হঠাৎ তামাশার গলায় বললেন, “চাঁদু, ধরো আমি ফলস দাড়ি গোঁফ লাগালাম, চোখে কপালে খানিকটা কালিঝুলির মেকআপ নিলাম। মাথায় একটা উইগ চাপালাম। আমায় কেমন দেখাবে?”
চন্দন প্রথমটায় বুঝতে পারেনি। কয়েক মুহূর্ত সময় নিল বুঝতে। তারপর হেসে ফেলল। “কেমন লাগবে!… তা খারাপ লাগবে না। যাত্রাদলের নারদ মনে হতে পারে।”
কিকিরা রেগে যাওয়ার ভান করে বললেন, “হোয়াট! আমাকে যাত্রার নারদ বলছ?… তুমি না দেখেছ যাত্রা, না দেখেছ নারদমুনি। নারদ মাথায় ঝুটি বাঁধে, দাড়ি গোঁফ থাকে না।”
চন্দন হো হো করে হেসে উঠল। “আপনাকে কেন বলব, আপনার সাজকে বলছি।”
“তুমি কি জানো না।… যাকগে, আসল কথা হল, আমার এই চোখ দুটো একেবারে ডাল’–মানে ফ্যাকাশে, জন্ডিস রোগীর মতন হলদেটে, একেবারেই ঝকঝক করে না।… বাইবেলে বলেছে, মানুষের চোখই আসল, তাকে চিনিয়ে দেয়।”
“আবার বাইবেল!” চন্দন হাসছিল। “আপনার চোখ ‘আই অব এ নিডল’।”
“সংস্কৃতে বলেছে, সজ্জনং পরিচীয়তে নয়নাৎ… মানে চক্ষু হইতে সজ্জন ও শয়তানকে পৃথক রূপে চেনা যায়।”
“দারুণ সাংস্কিট, ব্যাকরণ কৌমুদী হার মেনে যায়।… তা সার সংস্কৃত থাক। আপনি কী বলতে চাইছেন?” চন্দন হাসছিল।
“বুঝতে পারছ না?”
“না।”
“আমি বলছি, কৃষ্ণকান্তর মুখের গড়ন দেখে মনে হয় মানুষটির ব্যক্তিত্ব আছে। জমিদারদের রক্ত তো! দাপুটে মানুষ। তবে ওই চোখ থেকে বোঝা যায় কৃষ্ণকান্ত অত্যন্ত চতুর, হয়তো নিষ্ঠুর। তবে খুনে নয়।”
“সে তো নবকুমারের কথা থেকেই বোঝা গিয়েছে। নতুন আপনি কী বলছেন!”
“নতুন নয়, কিন্তু আমরা যা শুনেছি এ পর্যন্ত–তা একতরফা। নবকুমার যা বলেছে। এই ছবিও তার আঁকা। সাধারণ বুদ্ধি থেকে তুমি জানো, আমরা যাকে পছন্দ করি না, ঘৃণা করি, মনে করি শত্রু, তাকে যত পারি কালি মাখাই, তার দুর্নাম করি। কৃষ্ণকান্ত যে অত্যন্ত দুর্জন মানুষ, সেটা জানছি নবকুমারের মুখ থেকে। তাকে বিশ্বাস করছি। আমিও করছি বারো আনা। তবে আমার মনে হয়– কৃষ্ণকান্ত সত্যিই কেমন তা আমরা এখন পর্যন্ত ঠিকঠাক জানি না।”
“মানে? আপনি”
“আমি কী বলছি বাদ দাও। অন্য পাঁচজন যদি বলে, নবকুমার টাকা নিয়েছে। যদি বলে সে সেদিন তার জেঠার ঘরে গিয়ে দেখে কৃষ্ণকান্ত বেহুঁশ অবস্থায় আর্মচেয়ারে পড়ে আছেন, সাড়াশব্দ নেই, আশেপাশেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না, টেবিলের ওপর অ্যাটাচি রাখা রয়েছে, নবকুমার সুযোগ বুঝে সেটা উঠিয়ে নিয়ে পালিয়ে এসেছে, তুমি কেমন করে প্রমাণ করবে সে টাকা নেয়নি?”
এমন সময় তারাপদ এসে ঘরে ঢুকল।
চন্দন তারাপদকে দেখল। “আয়-!” বলেই কিকিরার দিকে তাকাল। “আপনি কি বলতে চাইছেন, নবকুমার মিথ্যে কথা বলছে?”
“যদি বলে–?”
“তা কেমন করে হয় কিকিরা! লাটুবাবু ছেলেটিকে ভাল করে চেনে। নবকুমার যদি ওই ধরনের ছেলে হয়, লাটুবাবু নিশ্চয় ওর হয়ে আপনার কাছে আসতেন না।”
তারাপদ এতক্ষণে বসে পড়েছে। বলল, “কী ব্যাপার?”
চন্দন বলল, “কিকিরা কী সব বলছেন, উনি নবকুমারকে সন্দেহ করছেন।”
“কেন?”
কিকিরা বললেন, “আমি সন্দেহ করেছি বলিনি। বলছি যদির কথা–! আমি প্রথমেই বলেছি নবকুমার দু-তিনটে মারাত্মক ভুল করেছে। এক, ঘরে ঢুকে যখন তার জেঠাকে ওই অবস্থায় দেখল, তখন সে কেমন করে বুঝল, জেঠা মারা গিয়েছেন, সে তো জেঠার অঙ্গও স্পর্শ করেনি বলছে। সে কতবড় ডাক্তার যে, চোখে দেখেই বুঝে নিল জেঠা মারা গিয়েছেন। এক্ষেত্রে লোকে কী করে? নবকুমারের উচিত ছিল, তার জেঠাকে নাড়াচাড়া করে দেখা। যদি ভয়ে সেটা না পেরে থাকে তবে ঘরের বাইরে এসে লোকজন ডাকা। সে তাও ডাকেনি। পালিয়ে এসেছে। কেন? অ্যাটাচিটার কী হল। কুমার বলছে, আনেনি। ও বাড়ির লোক যদি বলে, নিয়ে পালিয়ে এসেছে কুমার! তাহলে?”
তারাপদ আর চন্দন পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। ধাঁধা লেগে গিয়েছে যেন!
শেষে তারাপদ বলল, “ভুল তো নবকুমার করেছে। কিন্তু আপনি হঠাৎ অ্যাবাউট টার্ন করছেন কেন?”
“না, করিনি। কোনটা সম্ভব তাই ভাবছি।… চাঁদু ডাক্তার তুমি, ওই আঁকা ছবিটা ভাল করে দেখেছ?”
“হ্যাঁ। কেন?”
“তারাপদকে দেখতে দাও।”
তারাপদ পেন্সিলে আঁকা স্কেচটা নিল। দেখছিল।
কিকিরা চন্দনকে বললেন, “আচ্ছা ডাক্তার, কৃষ্ণকান্তর দাড়ি আছে দেখেছ তো!”
“হ্যাঁ।”
“ওকে চলতি কথায় বলে চাপ-দাড়ি, মানে গালের সঙ্গে যেন চেপে লেগে আছে। ঝুলো দাড়ি নয়, ঝুলে পড়ছে না গলায়।”
“তাতে কী!”
“এবার বলো, একটা লোককে যদি কেউ গলায় ফাঁস লাগিয়ে মারার চেষ্টা করে, তার চোখমুখের চেহারা কেমন হতে পারে? আমি যতদূর বুঝি, আচমকা গলায় ফাঁস লাগলে মানুষ শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে, মরিয়া হয়ে ওঠে, হাত পা ছোড়ে, ফাস আলগা করার চেষ্টা করে। যদি নাও পারে, তার চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসে, মুখ হাঁ হয়ে যায়, জিভ বেরিয়ে আসে।… কৃষ্ণকান্তর বেলায় তা হয়েছিল বলে নবকুমার বলেনি। আমি মেনে নিচ্ছি, কৃষ্ণকান্তর মুখে চাপ-দাড়ি ছিল বলে ভাল করে মুখ দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু চোখ? হাত পা? ফাঁস লেগে মরছে তবু ওভাবে নেতিয়ে কেউ পড়ে থাকে?”
চন্দন অস্বীকার করতে পারল না।
“তা ছাড়া টাকা লেনদেনের সঙ্গে একটা শর্ত ছিল। কৃষ্ণকান্ত তখনই টাকা দেবেন যখন নবকুমার কিছু কাগজপত্রে সই করবে! কোথায় সেই কাগজপত্র? কী লেখা ছিল তাতে? নবকুমার জানে না।”
তারাপদ বলল, “বোধহয় তাতে লেখা ছিল রাজবাড়ির কোনও সম্পত্তির ওপর নবকুমার আর কোনওদিন কোনও দাবি-দাওয়া করবে না।”
“আমারও তাই মনে হয়।… তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে করতে হবে, কৃষ্ণকান্ত দয়ার অবতার সেজে ভাইপোর সঙ্গে একটা মিটমাট করতে চাননি। এমন কোনও কারণ ছিল যাতে তিনি আশঙ্কা করতেও ভবিষ্যতে একটা গণ্ডগোল হলেও হতে পারে,” কিকিরা বললেন। “লাটুকে আমি কালও রাত্রে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নবকুমার কি কখনও তাকে বলেছে রজনীকান্ত কোনও উইলটুইল করেছিলেন কিনা? …লাটু বলল, সে শোনেনি; নবকুমার তাকে বলেনি।”
বগলা লস্যির মতন শরবত তৈরি করেছিল। দিয়ে গেল তারাপদদের। কিকিরাকেও।
এই সময় শরবত খেতে ভালই লাগার কথা। চন্দন আরামের শব্দ করল।
“কাল আপনি সারাদিন কী করছিলেন?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।
“খোঁজখবরের চেষ্টা করছিলাম। সবই বৃথা! শেষে বি.কে. পাল অ্যাভিনিউতে উঁকি দিলাম। মানে, গেলাম ওখানে।”
“কৃষ্ণকান্তর গদিবাড়িতে?”
“আরে না; হুট করে সে বাড়িতে যাওয়া যায়!… চেনা লোকটোক খুঁজলাম, পেলাম না। ও-পাড়ার কাউকে চিনি না। শেষে কী করলাম জানো?”
“কী?”
“একটা মামুলি চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছি–আসলে ভাবছি কী করব, হঠাৎ উলটো দিকের একটা বাড়ির নীচের তলায় ফুটপাথ ঘেঁষে দেখি এক কবিরাজের নাম আর ছোট সাইনবোর্ড লটকানো।”
“কবিরাজ?” চন্দন অবাক হয়ে বলল।
“হ্যাঁ সার, কবিরাজ।…বৈদ্যরাজ চন্দ্রকান্ত সেনশর্মা, আয়ুর্বেদ ধন্বন্তরি। চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করলাম, কবিরাজমশাই কেমন, মানে হাতযশ। তারা বলল, রোগী পায় না। নিজেই হাঁপানি রোগী।”
তারাপদরা জোরে হেসে উঠল।
কিকিরা বললেন, “আমি দেখলাম, একবার টোকা মেরে দেখি কী হয়! কেননা, কৃষ্ণকান্তর বাড়ির চার পাঁচটা বাড়ির পরই কবিরাজমশাইয়ের বাড়ি বা ডাক্তারখানা বা চেম্বার।”
“চলে গেলেন?”
“একেবারে সটান। তখন বেলা হয়ে যাচ্ছে। ধন্বন্তরির দেখা পাব কি পাব না জানি না। জয় মা দুর্গা বলে সটান চলে গেলাম। দেখাও পেলাম। একটা তক্তপোশের ওপর ময়লা ফরাস। কবিরাজমশাই বসে বসে খবরের কাগজের বাসি খবর পড়ছেন। রোগা খিটখিটে চেহারা, গালে দাড়ির কুচি, চোখে চশমা, পরনে আধময়লা ধুতি, গায়ে ফতুয়া।”
“দারুণ। ধন্বন্তরির এই অবস্থা?”
“খুব বিনয় করে নমস্কার সেরে বললুম, আমার এক পরিচিত ভদ্রলোকের মুখে ওঁর গুণপনার কথা শুনে আসছি। বলে একটা উটকো নাম বললুম। তারপর নিজের নাম বলতে হল। ভবানীপ্রসাদ সাঁই। একটা ঠিকানাও দিলাম। দুটোই ঝাড়া ফলস, যা মুখে এল বলে দিলাম।”
তারাপদ আর চন্দন হো হো করে হেসে উঠল।
“তারপর শোনো” কিকিরা বললেন, “কবিরাজমশাই আমায় বসতে বললেন। একটা চেয়ার ও একটা টুল সামনে। বসলাম। সেনশর্মা বললেন, ব্যাধি কী?…বললাম, অনিদ্রা, মাথাঘোরা, অগ্নিমান্দ্য, পেট ফাঁপা, অসম্ভব দুর্বলতা, ইত্যাদি ইত্যাদি। এলাপ্যাথি, হোমোপ্যাথি অনেক করেছি। কোনও উপকার হয়নি। শেষে তাঁর শরণাপন্ন হয়েছি।”
চন্দন হাসতে হাসতে বলল, “ফাইলেরিয়া ম্যালেরিয়া বাকি রাখলেন কেন? লাগিয়ে দিলে পারতেন।”
কিকিরা মুচকি হেসে বললেন, “গাছের সব ফল একসঙ্গে পাড়তে নেই। হাতে রাখতে হয়।…তারপর কী হল শোনো–! কবিরাজমশাই নাড়ি টিপে বায়ু পিত্ত কফ আন্দাজ করে নিয়ে মাথায় মাখার তেল, হজমের গুলি, তেঁতুল চটকানো চ্যবনপ্রাশ, কীসের এক আরিস্ট দিলেন। আমার পঁচাশি টাকা খসে গেল।”
“সারের টাকা হাতের ময়লা,” তারাপদ ঠাট্টা করে বলল।
“আরে বাপু, আমার তো অন্য মতলব। কথায় কথায় কবিরাজকে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁর প্রতিবেশী কৃষ্ণকান্তবাবুকে চেনেন কিনা? বানিয়ে বানিয়ে দিব্যি বললাম, আমি ওঁর দেশের লোক। তবে এক গ্রামের নয়। জমিদারবাড়ির দুটো গ্রাম তফাতে আমার দেশ।”
চন্দন বলল, “বাঃ, বানিয়েছেন ভাল।”
“কী বললেন কবিরাজ?”
“বললেন, চেনেন। আলাপ অবশ্য তেমন নেই। তবে কৃষ্ণকান্তের যে ধর্মেকর্মে মতি আছে, শুনেছেন। নিত্য পুজোআচা করেন। কালীভক্ত। কলকাতায় এলেই একবার কালীঘাট আর দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে যান দর্শন করতে।”
“কালীভক্ত?”
“দেশের বাড়িতে দু’ পুরুষের প্রতিষ্ঠিত কালীমূর্তি আছে, মন্দির আছে। এখানেও বাড়িতে কালী আছেন, ব্রাহ্মণ এসে পুজো করে যান।”
“যাঃ বাব্বা! মা কালীর সন্তান! তা ইয়ে এত কথা…”
“ও বাড়ির এক কর্মচারী, বিপিন সাধু, এখানেই থাকে, মাঝে মাঝে কবিরাজমশাইয়ের কাছে আসে। গল্পগুজব করে, দাবা খেলে, পদ্মমধু দিয়ে গোলমরিচ আর সন্ধব লবণের চূর্ণ খায়।”
“তাতে কী হয়?”
“জানি না।”
“আর কী শুনলেন?”
“কবিরাজ বললেন, মশাই কৃষ্ণকান্তবাবু বেশ মেজাজি মানুষ। এ-পাড়ার দুর্গা কালীপুজোয় তাঁর গদি থেকে পাঁচ সাতশো টাকা চাঁদা বরাদ্দ করা আছে।”
“পাড়ার ছোকরাদের হাতে রেখেছেন আর কি!”
কিকিরা শরবতের গ্লাস নামিয়ে রেখেছিলেন। আয়েসের ভঙ্গিতে মাথা হেলিয়ে একটা চুরুট ধরালেন। বললেন পরে, “তাঁর পান খাওয়ার গল্পও শুনলাম। রাজকীয় ব্যাপার হে। কৃষ্ণকান্তর মুখে বাজারি পান রোচে না। তাঁর পানের রুচি অন্যরকম।”
“কেমন?”
“আফিং দেওয়া জলে পানপাতা ভিজিয়ে রাখতে হবে কমপক্ষে একবেলা। তাতে গোলাপজলের ছিটে থাকবে। খয়ের আসে বেনারস থেকে, কাল্মি খয়ের, গুলতে হয়। গন্ধ মেশানো থাকে। সুপুরি দু’-এক কুচি। জরদা কাশীর। দেড়শো দুশো টাকা ভরি। পানের ডিবে এক বিঘতমানে ধরো ছ-সাত ইঞ্চি লম্বা। জার্মান সিলভারের ডিবে। জরদার কৌটো রুপোর। দিনে তিরিশ চল্লিশটা পান খান।”
চন্দনরা রীতিমতন অবাক হয়ে গিয়েছিল। একজন মানুষ সম্পর্কে জানার কত কী থাকতে পারে! কৃষ্ণকান্ত কালীভক্ত, পুজোআচা করেন, আবার আফিংয়ের জলে ভেজানো পানপাতায় সাজা পান ছাড়া অন্য কিছু মুখে তোলেন না, এ বড় আশ্চর্য জিনিস তো!
কিকিরা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “দেখো চাঁদু, নবকুমারকে আমি অবিশ্বাস করতে চাইছি না, কিন্তু তার সেদিনের ব্যবহারটা অবশ্যই অদ্ভুত। আদালতের সামনে দাঁড়ালে তাকে বিস্তর নাজেহাল হতে হবে।…তা সে যাই হোক, আপাতত তাকে কেউ ফাঁসায়নি। পরের কথা জানি না।”
“লাটুবাবু কী বলেন?”
“লাটু এখনও সব কথা জানে না। কাল দেখা হবে। ফোনে কথা কমই হয়েছে। দেখা হলে বলব!”
“আপনি অন্য কিছু ভাবছেন নাকি?” তারাপদ বলল।
“হ্যাঁ। ভাবছি, কৃষ্ণকান্ত আর নবকুমারের মধ্যিখানে অন্য কেউ ছিল কিনা? থার্ড পারসন।”
“থার্ড পারসন? তৃতীয় কেউ?”
কিকিরা কোনও জবাব দিলেন না।
.
০৪.
সাতসকালে লাটু দত্তর ফোন।
কিকিরা চা জলখাবার খাচ্ছিলেন। হাতে তৈরি একটিমাত্র রুটি, সামান্য সবজি সেদ্ধ, একটা কলা। মগের মতন এক বড় কাপে চা, সকালের চায়ে দুধ থাকে না। সাধারণভাবে এটাই তাঁর জলখাবার। মাঝেসাঝে মুখের রুচি পালটান। তবে মুখে যতই বলুন কিকিরা, আহারের ব্যাপারে বরাবরই সংযমী।
ফোন তুললেন কিকিরা। ভেবেছিলেন, সুশীল কিংবা ছকু হবে। সুশীল ভাল মেকআপম্যান, তার হাতে পড়লে মামুলি ফেরিঅলা যে কেমন করে ছানাপট্টির দুলাল হয়ে যায় কে জানে! সুশীল আবার হাল আমলের কায়দায় মুখোশ তৈরি করতে পারে। সুশীলকে একটা খবর দেওয়া ছিল। হয়তো সে ফোন করেছে। আর ছকু হল চোর-ছ্যাঁচড়দের গুরুর মতন। তার নামযশ হাতযশ যথেষ্ট। ছকু কিকিরার বাধ্য চেলা। তাকেও একটা চিরকুট পাঠিয়েছিলেন কিকিরা। যেটা আজকাল বাগবাজারে আস্তানা গেড়েছে। দোকান দিয়েছে লন্ড্রির। বান্ধব লন্ড্রি। নিজেও খবরটা জানিয়ে রেখেছিল কিকিরাকে।
ফোন তুলে কিকিরা সাড়া দিতেই লাটু দত্তর গলা পেলেন।
লাটুর গলায় উত্তেজনা, উদ্বেগ।
“কী হল? সাতসকালে…”
“রায়দা, সর্বনাশ হয়েছে। কুমার পালিয়ে গিয়েছে।”
“সে কী!” কিকিরা চমকে উঠলেন।
“একটু আগে আমি খবর পেলাম। ওকে যেখানে যার হেফাজতে রেখে এসেছিলাম–সেই প্রফুল্ল হাজরা আমায় ফোন করে জানাল, আজ সকাল থেকে তাকে দেখা যাচ্ছে না। ঘরের দরজা ভেজানো ছিল। ভেতরে কেউ নেই।”
কিকিরা বললেন, “তুমি কি বাড়ি থেকে ফোন করছ?”
“হ্যাঁ।”
“হাজরা তোমায় কোত্থেকে ফোন করল? ওই মাঠকোঠা বাড়িতে কি ফোন আছে?”
‘না। হাজরা তার কাঠগোলা থেকে ফোন করেছে। আমি তাকে বলে রেখেছিলাম কুমারের ওপর নজর রাখতে। সে গোলায় এসে সকাল বিকেল কুমারের সঙ্গে দেখা করে যেত। আজ সকালে এসে মাঠকোঠায় গিয়ে দেখে কুমার নেই। দরজা ভেজানো।…ভেতরে গিয়ে দেখল, কুমার নেই।”
কিকিরা বললেন, “আশেপাশে কোথাও যায়নি তো?”
“কোথায় যাবে! তাকে বারণ করা আছে বাইরে ঘোরাঘুরি করতে। তা ছাড়া এখন বেলাও হয়েছে। আটটা বেজে গেল।”
কিকিরা ভাবছিলেন। তারাপদকে বলা ছিল তার বোর্ডিংয়ে একটা ব্যবস্থা করে কুমারকে নিয়ে গিয়ে রাখতে। তারাপদ ব্যবস্থাও করে ফেলেছিল। আজ কিংবা কাল তাকে নিয়ে যেত। এরই মধ্যে নবকুমার উধাও!
“ওর ঘরে,” কিকিরা বললেন, “জিনিসপত্র? মানে ওর জামাপ্যান্ট এটা ওটা–যা ও ব্যবহার করত–সেসব আছে?”
“অত কিছু প্রফুল্ল দেখেনি। শুধু বলল, একটা বড় কিট ব্যাগ ছিল ঘরে, আগে সে দেখেছে। আজ ব্যাগটা দেখতে পেল না।”
কিকিরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “লাটু, আমার মনে হচ্ছে নবকুমার নিজেই পালিয়েছে। তাকে কেউ ধরে নিয়ে গেলে কিট ব্যাগ ঘরেই পড়ে থাকত। তা যখন নেই, ধরে নেওয়া যেতে পারে সে নিজেই পালিয়ে গিয়েছে। ব্যাগে নিশ্চয় ওর জামাপ্যান্ট টুকিটাকি ছিল।”
লাটু বলল, “কোথায় যাবে? কেনই বা হঠাৎ…!”
“হয় ভয় পেয়েছে, না হয় ওখানে থাকতে আর ভরসা হয়নি।”
লাটু চুপ করে থাকল। ফোনের মধ্যেই ওর বিহ্বলতা ধরা পড়ছিল। বলল, “এখন কী করি বলুন তো?”
“কী করবে!…তোমার করার কিছু দেখছি না। দুটো কাজ করতে পারো! ওর সেই দেশগ্রামের বন্ধু–যে নাগেরবাজারে থাকে, সেখানে একবার খোঁজ করতে পারো! আর ওর দোকানে একবার দেখতে পারো–যদি কোনও খোঁজ পাও!”
অল্প সময় চুপ করে থেকে লাটু বলল, “নাগেরবাজারের বাড়ি আমি চিনি না। দোকানে বরং একবার খোঁজ নিতে পারি।”
কিকিরা ভাবছিলেন। বললেন, “শোনো, আজ বিকেলে–মানে ছ’টা নাগাদ তুমি তৈরি থেকো। খালপাড়ের কাঠগোলায় যাব আমরা। খোঁজখবর করে দেখি কী জানা যায়!”
“আমি আপনাকে তুলে নেব?”
“না। তুমি দোকানেই থেকো। আমি যাব। মেজোবাবুর সঙ্গে ওই ফাঁকে দেখাও হয়ে যাবে।”
“রায়দা, প্লিজ…, মেজদাকে কিছু বলবেন না। আমি বাইরের উটকো ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছি শুনলে খেপে যাবে।”
কিকিরা হাসলেন। “আরে না, বলব না।…তোমার গাড়ি রেডি রেখো। দরকার হবে।”
“দোকানের কাছেই থাকবে।”
“ঠিক আছে।” কিকিরা ফোন ছেড়ে দিলেন।
চা খেতে খেতে ঠিক করে নিলেন, তারাপদকে অফিসে ফোন করবেন। আসতে বলবেন তাকে। চন্দনকে পাওয়া যাবে না। নবকুমার সত্যিই সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। বারবার সে পালিয়ে যাচ্ছে কেন? গোড়ায় সে না হয় ভয় পেয়ে ভুল করেছে। কিন্তু এবার তার কী হল? কেন পালিয়ে গেল? লাটুকেই বা একটা খবর দিল না কেন? আশ্চর্য!
.
লাটু দত্তরা বনেদি বংশ ধনী পরিবার বললে ভুল বলা হয় না। তাদের বাড়ি ওর ঠাকুরদার আমলে। পুরনো ধাঁচের। পরে রদবদল হয়েছে খানিক, প্রয়োজনে, তবু চেহারাটা সাবেকি ধরনের।
লাটুর নিজের একটা গাড়িও আছে। দাদারা আর পরিবারের অন্যরা বড় গাড়িটাই ব্যবহার করেন। লাটুর গাড়ি ছোট, পুরনো মডেলের, তবে তার শখের গাড়ি বলে কলকজাগুলো অতিরিক্ত নজর পায়। লাটুবাবু নিজেই গাড়ি চালায়, মামুলি খুঁতও সে রাখে না গাড়ির। তবু ওটা যন্ত্র তো! মাঝেসাঝে লাটুকে যে ভোগাবে তা বলাই বাহুল্য।
আলো না থাকার মতন। সন্ধে হয়ে আসছে প্রায়। কিকিরারা খালধারের মাঠকোঠায় এসে হাজির। তারাপদও এসেছে সঙ্গে।
মাঠকোঠার নীচের তলায় তিন চারজন মিস্ত্রি থাকে। তাদের দু’জন প্রফুল্লর কাঠগোলায় কাঠ চেরাইয়ের কাজ করে। অন্য দুই মিস্ত্রি সামান্য তফাতে কাঠের দোকানে জানলা দরজার ফ্রেম পাল্লা তৈরির কাজ করে। অবশ্য বাইরের মজুরও আসে দোকানে। মিস্ত্রিদের খাওয়াদাওয়া রান্না নীচেই। নিজেরাই করে।
প্রফুল্ল এ সময় কাঠগোলার গদিতে থাকে না। তার অন্য কাজও থাকে বাইরে। বিশেষ করে আজ মাস দুই বুড়ো বাবা আর ডাক্তার বদ্যি নিয়ে বড় ব্যস্ত।
কিকিরারা মিস্ত্রিদেরই ধরলেন।
তারা বলল, গতকাল সকালে এখানে পুলিশের গাড়ি ঘোরাঘুরি করেছে অনেকক্ষণ। থানার বড়বাবু মেজোবাবুরা সর্বত্র ঢুঁ মেরেছেন।
কেন?
কাল মাঝ বা শেষরাত্রে খালধারে একটা ডেডবডি’ পাওয়া গিয়েছে। জোয়ান বয়েস। গুলি খেয়ে মরেছে। হাতে কাঁধে চপারের ক্ষত।
লোকটা কে, কেউ জানে না। ঠিক এই এলাকারও নয়, নয়তো মুখ চেনা হত। মনে হয় অন্য কোথাও তাকে মেরে এখানে ধড়টা ফেলে গিয়েছে।
কিকিরারা অন্য দু-একটা জায়গাতে খোঁজ করলেন। একই কথা সকলের।
“লাটু, তোমার বন্ধু প্রফুল্ল তো খবরটা বলেনি তোমায়?” কিকিরা বললেন।
লাটু বলল, “কী জানি! ও যখন ফোন করেছে তখন হয়তো খবরটা চাউর হয়নি।”
“নবকুমার কি পুলিশের গাড়ি আর থানার বাবুদের ঘোরাফেরা দেখে ভয়ে পালাল?”
মাঠকোঠা থেকে শ’খানেক গজের তফাতে একটা চায়ের দোকান। মেঠো দোকান, মাথায় টিনের চালা, রাস্তার গা ঘেঁষে বেঞ্চি। তোলা উনুন জ্বলে, জল ফোটে হাঁড়িতে। মাটির খুরি কিংবা ছোট ছোট কাঁচের গ্লাসে চা। কাঁচের বয়ামে দিশি বিস্কুট। চাঅলা বিহারি।
অন্যদের চেয়ে তার দেওয়া খবরটাই বিস্তারিত। সে বলল, সকালে সবেই যখন উনুন ধরিয়েছে চাঅলা, মাঠকোঠার বাবু তার দোকানে চা খেতে এসেছিল। ক’দিনই আসছে। এমন সময় হঠাৎ একটা পুলিশ জিপ খালপাড়ের রাস্তায় ঢুকে পড়ে। তখন অন্য কোনও দোকান খোলেনি এধারের। আটটা ন’টার আগে খোলেও না। টায়ার সারাইয়ের দোকানটাও নয়।…পুলিশের জিপ একবার চর দিয়ে চলে গেল। কখনও কখনও পুলিশের জিপ আসে এপাশে। নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা অন্যরকম, তখন কেউ বোঝেনি, জানতও না! বেলা বাড়ার পর দেখা গেল পুলিশের বড় গাড়ি, পুলিশ একদল। তারপরই শোনা গেল লাশ পড়ে থাকার কথা।
লাটু বলল, “তুমি বাবুকে যেতে দেখছ?”
দোকানি বলল, “জরুর। বাবু গোড়া বাদ ইধার সে কাঁহা…”
“বাবুর সঙ্গে ছিল কিছু?”
“ব্যাগ…।”
কিকিরা লাটুকে বললেন, “চলো। বুঝতে পেরেছি। পুলিশের জিপ দেখেই ও ভয়ে পালিয়েছে। এখানে কী ঘটেছে সে জানে না।”
গাড়ির কাছে ফিরে এসে লাটু বলল, “এখন কী করা যায় রায়দা?”
“কী করবে আর! ওয়েট করো। আমার মনে হয়, নবকুমার যেখানেই যাক– তোমায় একটা খবর দেবে। আজই হোক বা কাল…”
লাটু আকাশের দিকে তাকাল। সন্ধে হয়ে গিয়েছে। তারা ফুটেছে আকাশে। খালের দিক থেকে হাওয়া আসছিল। ঝোপঝাড় আর পাঁক ময়লার গন্ধ-মেশানো হাওয়া।
“এখন তাহলে ফিরতে হয়!” তারাপদ বলল।
কিকিরা তারাপদর দিকে তাকালেন না। লাটুকে বললেন, “চলো তো একবার বি. কে. পাল ঘুরে আসি।”
“বি. কে. পাল অ্যাভিনিউ? মানে
“কৃষ্ণকান্তর বাড়ির দিকটায় চলো একবার। আমি পাড়াটা দেখে গিয়েছি। চলো।”
ওরা গাড়িতে উঠল।
তারাপদ বলল, “আপনি কৃষ্ণকান্তর বাড়ি যাবেন নাকি?” হালকাভাবেই বলল। সে জানে কৃষ্ণকান্তর বাড়ি যাওয়ার কথাই ওঠে না এখন।
কিকিরা বললেন, “যাব। যেতেই হবে। তবে আজ নয়। দু-তিন দিন পরে। আজ ও-পাড়ায় একটু ঘুরব। তোমরা গাড়িতে থাকবে। একটু আড়ালে গাড়ি রেখো। নজর করবে কৃষ্ণকান্তর বাড়িতে কেউ যাচ্ছে, না, বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে?”
“তাতে লাভ?”
“লাভ-লোকসান পরে দেখা যাবে।”
গাড়ি চলতে শুরু করেছিল।
লাটু বলল, “রায়দা, আমি ধোঁকা খেয়ে যাচ্ছি। এর পর কী হবে কে জানে!” কিকিরা বললেন, “আমার মাথাতেও আসছে না, নবকুমার বার বার কেন পালিয়ে যাচ্ছে? ছেলেটার এত ভয় কেন?”
“কী জানি! তবে খুনখারাপির ব্যাপার, ওর বয়েস কম, বোধহয় ঘাবড়ে যাচ্ছে।”
“হতে পারে। তবে অকারণ ভয় ছোকরার ভাল করছে না। এভাবে চললে ও নিজেই না একটা কাণ্ড বাঁধিয়ে বসে৷” বলে সামান্য চুপচাপ থাকলেন কিকিরা। পরে বললেন, “লাটু, তুমি কি জানো, ওকে যিনি পালন করেছিলেন বা পোষ্য নিয়েছিলেন, সেই ভদ্রলোক রজনীকান্ত কোনও উইলটুইল করে রেখে গিয়েছিলেন কিনা?”
মাথা নাড়ল লাটু। গাড়িটা দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ট্রাফিক পুলিশ অন্য পথের গাড়ি পার করাচ্ছিল।
ট্রাফিক পুলিশের হাত নামল। লাটু এগিয়ে গেল সোজা পথেই।
কিকিরা নিজের মনেই যেন বললেন, “এদিকে আমার ঘোরাফেরা কম। ভাল করে রাস্তাঘাটও চিনি না। দু-একজন আলাপী লোক থাকলে সুবিধে হত।”
“কেন। ধন্বন্তরি কবিরাজ মশাইয়ের সঙ্গে আপনার আলাপ…”
“আরও একটু জমাতে পারলে ভাল হত। দেখি।”
.
কৃষ্ণকান্তর বাড়ির উলটো দিকের ফুটপাথে গাড়ি দাঁড় করাল লাটু। কিকিরাই চিনিয়ে দিলেন বাড়ি। “তোমরা বোসো, আমি আসছি”–গাড়ি থেকে নেমে গেলেন তিনি। “বাড়ির দিকে নজর রেখো।”
গাড়িটা ভাল জায়গাতেই দাঁড়িয়েছে। একফালি তেকোনা ছোট পার্ক। বাচ্চারা খেলা করে বোধহয়, পার্কে দোলনা, স্লিপ, ছোট সিঁড়ি। ধুলোয় ভরা মাঠ। ফুটপাথের কোল ঘেঁষে একটা আধ শুকনো কৃষ্ণচূড়া। শীতে পাতা ঝরে যাওয়ার পর সবে নতুন পাতা আসছে ডালে।
তারাপদরা সিগারেট ধরাল।
লাটু বলল, “কী হবে বলুন তো! কুমার আমায় এমন একটা অবস্থায় ফেলবে, ভাবিনি। একেবারে গাধা।”
তারাপদ হেসে বলল, “আমার মনে হয়, বয়েস কম বলে শুধু নয়, ও বোধহয় খানিকটা বেশি অস্থির।”
“আমি অনেকবার বলেছি, তুই তোর জেঠার সঙ্গে ঝগড়াঝাটি ছেড়ে দে। তোর হাতে কী আছে যা নিয়ে ফাইট করবি! কোর্টে একবার হেরেছিস। আর কেন! তার চেয়ে নিজের দোকান নিয়ে থাক। তোর তো দিব্যি চলে যাচ্ছে। …আমার কথা শুনবে না। জেদ। জেঠা তাকে ফাঁকি দিচ্ছে।”
“দেখুন লাটুবাবু, আইন আমি জানি না। কিকিরাও তেমন জানেন না। তবে উনি খোঁজখবর করে যা শুনেছেন তাতে মনে হয়, আইনসঙ্গত ভাবে দত্তক না নিলে আজকাল তার কোনও দাবি থাকে না। সম্পত্তির কথা বলছি। আগে অনেক সময় সামাজিক আচরণ করে কাউকে দত্তক নিলে আদালত তবু সেটা বিবেচনা করত। এখন করতে চায় না। …তার ওপর কোন পক্ষ কীভাবে মামলা লড়ছে, কার কত জোর, জজসাহেবের মরজি”।
“মুশকিল তো সেখানেই,” লাটু বলল, “ছেলেবেলার কথা কুমারের মনে নেই। তার মা, মানে রজনীকান্তর স্ত্রী, যাকে কুমার মা-মাসি বলত, তিনিও বেঁচে নেই যে, পুরনো ব্যাপারটা জানা যাবে। তবে এখানেও একটা ফাঁক আছে। কুমার পুরোপুরি পালিত ছেলে হলে তার মা-মাসি তো বলেই দিতেন, তুমি আমাদের সম্পত্তির কিছুই পাবে না। তোমার কোনও অধিকার নেই।”
“বলেননি বোধহয়?”
“শুনিনি। কুমার বলেনি।”
ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। নজরও রাখছিল কৃষ্ণকান্তর বাড়ির দিকে। দু’-একজন ঢুকে যাচ্ছে বাড়িতে, কেউ বা বেরিয়ে আসছে। হঠাৎ একটা ট্যাক্সি এসে থামল। ভাড়া মিটিয়ে কে একজন ঢুকে গেল ভেতরে। ছোকরা বয়েস, পরনে প্যান্ট শার্ট, হাতে ব্যাগ। গটগটিয়ে ঢুকে গেল ছোকরা। আধঘণ্টার মতন হবে, কিকিরা ঘোরাফেরা সেরে ফিরে এলেন।
“চলো।”
“গিয়েছিলেন কোথায়?”
“বাড়িটার পেছনের দিকে। একটা সরু গলি আছে। পাঁচমেশালি গলি। গলির শেষে ছোট বাড়ি। বাড়িটার পেছন দিকের কম্পাউন্ড ওয়ালের পাঁচিল বেশি উঁচু নয়। গাছপালা রয়েছে দু-একটা। পাঁচিল-লাগোয়া একপাশে একটা টিনের চালা। গলির ওপর ঝুঁকে পড়েছে।”
“গলির লোকজন?”
“বাড়ি রয়েছে রামশ্যামের, মুদিখানার ছোট দোকান, তামাক পাতার আড়ত, কামারের দোকান…”
“কথাবার্তা বললেন কারও সঙ্গে?”
“ না। শুধু দেখে এলাম।”
“তাহলে?”
“এখন কিছু বলতে পারছি না।” বলে হঠাৎ হাত বাড়িয়ে সিগারেট চাইলেন তারাপদর কাছে। “ছকু বেটা যে কী করছে কে জানে!”
“ছকু কে?” লাটু বলল।
“ছকু একজন পাক্কা আর্টিস্ট। নর্থ ক্যালকাটার পিক পকেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট!” কিকিরা গম্ভীরভাবে বললেন।
লাটু অবাক হয়ে বলল, “পকেটমার।”
“আগে মারত। তা বলে ছিঁচকে ছিল না। ওর বাজারে নাম ছিল ছা! মারলে ওভার বাউন্ডারি। ছকু এখন গুরু। ভেরি গিফটেড পারসন। হাত সাফাইয়ের কতরকম কায়দা বার করেছে।”
“বাঃ! শেষ পর্যন্ত পকেটমার!” তারাপদ বলল, “কলকাতা শহরের আর কত দাগি আসামিকে আপনি চেনেন, সার!”
“তা ওরকম চেনাচিনি আমাকে রাখতে হয়, তারাবাবু। ওরা আমার গুমটি। দরকারে কাজে লাগে। …তবে ছকু বেশি জেলেটেলে যায়নি। জেলটা ওর পছন্দ নয়। তাই হাতে-কলমে নিজে কিছু করে না, এখন তো ট্রেনিংয়ের লাইনে আছে। ট্রেনার। বা অ্যাডভাইসার।”
লাটু হেসে ফেলল। ভাবল, রায়দা তামাশা করছেন।
তারাপদ বলল, “ছকু আপনার কোন কাজে আসবে, সার?”
“দেখি কী কাজে আসে!…ছকুর আর একটা কোয়ালিফিকেশন কী জানো?”
“কী?”
“চালাক বেড়ালের মতন সে সব জায়গায় ঢুকে পড়তে পারে। তাকে আটকানো মুশকিল।”
“ও! আপনি তাহলে ছকুকে কৃষ্ণকান্তর বাড়িতে ঢুকিয়ে দিতে চান?”
“পারলে ভাল।” বলে কিকিরা লাটুর দিকে মুখ বাড়ালেন। “শোনো লাটু, আমার ধারণা নবকুমার তোমাকে নিশ্চয় কোনও খবর দেবে। দিলে, তুমি তাকে বলবে, ও যেন পালিয়ে গিয়ে বসে না থাকে। তাতে লাভ হবে না, উলটে ক্ষতি হবে। ওকে ফিরে আসতে বলবে। আরও বলবে, কাঠগোলার মাঠকোঠার বাড়িতে থাকতে না চায় না থাকুক। তারাপদর বোর্ডিংয়ে থাকবে। ব্যবস্থা হয়েছে। ভয়ের কারণ নেই।”
“বলব। আগে খবর পাই।”
“পাবে। …একটা ব্যাপার কী জানো? কৃষ্ণকান্তর সামনাসামনি আমাদের হতেই হবে। ভদ্রলোকের তরফ থেকেও চালে বড় ভুল হয়েছে। না হলে এতদিন থানা পুলিশ ডায়েরি না করে বসে থাকতেন না।”
.
০৫.
পরের দিন সকালে আবার ফোন এল। লাটুর ফোন।
“রায়দা, কাল বাড়ি ফিরে এসে কুমারের ফোন পেলাম। ও বার দুয়েক চেষ্টা করেছিল সন্ধেবেলায়। আমায় পায়নি। আমি তো তখন আপনাদের সঙ্গে…।”
“কোথায় আছে ও?”
“রামরাজাতলায়। এক চেনা লোকের বাড়ি।”
“পালিয়ে গিয়েছিল কেন?”
“আপনি যা ভাবছিলেন ঠিক তাই। সকালে পুলিশের জিপ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল।”
“তুমি ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দিয়েছ তো?”
“হ্যাঁ।…বলেছি, তুই আজই চলে আয়। তোকে মাঠকোঠায় থাকতে হবে না। তারাপদবাবুর সঙ্গে বোর্ডিংয়ে থাকবি। ব্যবস্থা হয়েছে। চলে আসবি আজ। ভয়ের কিছু নেই। …আপনার ফোন নাম্বার দিয়ে দিয়েছি। দরকারে ফোন করবে।”
“বেশ করেছ। এখনকার মতন ছাড়ছি। পরে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব।” কিকিরা ফোন রেখে দিলেন।
আজ কেমন একটা চাপা গুমোট সকাল থেকেই। রোদ দেখলে মনে হয় লাল লাল চোখ করে সব দেখছে। অনবরত গা মুখ ঘামে ভিজে যাচ্ছিল।
কিকিরা আর পারলেন না। স্নানটা সেরে নিলেন।
আরাম লাগছিল। বেলা প্রায় দশটা।
এমন সময় ছকু এসে হাজির।
“আরে ছকুবাবু যে, এসো, এসো। তুমি একেবারে ডুমুরের ফুল হয়ে উঠলে যে!” তামাশা করে বললেন কিকিরা।
ছকু পিঠ নুইয়ে অতি বিনয়ের সঙ্গে দু’হাত বাড়িয়ে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল কিকিরাকে। “আজ্ঞে, খবর পেতে দেরি হল।”
“বোসো।”
ছকু চেয়ারে সোফায় বসবে না। কিকিরার সামনে সে উঁচু আসনে বসে না। অনেক বলেছেন কিকিরা, ছকু মাথা নাড়ে, কান ধরে, “আরে ছি ছি, তাই কি হয়, গুরুজির সামনে চেয়ারে বসা!”
ছকুকে দেখতে রোগা। গায়ের রং তামাটে ফরসা। নিরীহ মুখ। চোখ দুটি সামান্য ধূসর। একটু টেরা। মুখে দু-চারটি বসন্তের দাগ। মাথার চুল ছোট ছোট। বাঁ পাশে টেরি কাটে। ওর পরনে পাজামা। গায়ে হাফহাতা শার্ট।
ছকুর পুরো নাম ছবিলাল। ওটা কেউ জানে না। দেওঘর থেকে বাপের সঙ্গে চলে এসেছিল কলকাতায়। মা ছিল না। অনেক ঘাটের জল খেয়েছে। নিজে তো বিশ বাইশ বছর পর্যন্ত বাস কন্ডাক্টরের কাজ করেছিল। তারপর মালিক আর ড্রাইভারদের সঙ্গে টাকাপয়সার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে গোলমাল, ঝগড়া। খেপে গিয়ে সে পকেটমারের দলে ভিড়ে গেল। তবে পেশাটা তার ইজ্জতে লাগছিল। ফলে নিজে আর লাইনে থাকল না সরাসরি, অন্যদের হাত সাফাই, চালাকি এইসব শেখাতে লাগল। এখন তার বয়েস অন্তত চল্লিশ। লন্ড্রির দোকান দিয়েছে একটা বাগবাজারের দিকে। মন্দ চলে না। সেইসঙ্গে পকেটমারদের মাস্টারি করে। মাস্টারি মানে নিজেদের গল্প শোনায়।
ছকু অত্যন্ত চালাক। বুদ্ধি প্রখর। ওর হাতসাফাইয়ের আশ্চর্য কায়দাকানুন দেখে কিকিরা ওকে দু-চারজন জুনিয়ার ম্যাজিশিয়ান ছেলের (যারা বারো আনা অ্যামেচার) তাদের দলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। অ্যাসিস্ট করত। ছকু শেষ পর্যন্ত আর তাদের সঙ্গে থাকেনি। ছকুর কোনও বদ নেশা নেই। তবে পান বিড়ি খায়।
কিকিরার সামনে মাটিতে বসে পড়ল ছকু।
কিকিরা বললেন, “তোমাকে নিয়ে আর পারলাম না। না হয় ভেতর থেকে একটা টুল বা মোড়া নিয়ে এসে বোসো।”
“এই ঠিক আছে।”
“তাহলে আর কী বলব! …যাক, কেমন আছ?”
“আছি! আমার দুখ নেই, গুরুজি। বালবাচ্চা ভাল আছে।” ছকু কিকিরাকে গুরুজি বলে। খুব দুঃখের দিনে গুরুজি একবার তাকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন।
কিকিরা এবার কাজের কথা পাড়লেন।
খুঁটিনাটি সব কথা বলার দরকার ছিল না, সংক্ষেপে যা জানানোর ছিল– জানিয়ে কিকিরা বললেন, কৃষ্ণকান্তর কলকাতার আস্তানা বি. কে. পাল অ্যাভিনিউয়ের অত নম্বর বাড়ি। সেই বাড়িতে ঢুকতে হবে।
ছকু বলল, “এ আর এমন কী শক্ত কাজ গুরুজি! সদরের কোলাপসিবল গেট, দরজার তালা, গ্রিল, কী ভাঙতে হবে বলুন! ভেঙে দিচ্ছি।”
ছকুর হাতযশ জানা আছে কিকিরার। বললেন, “না; তালা ভেঙে ঢোকার দরকার নেই। তাতে লাভ হবে না। সরাসরি ঢুকতে চাই।”
মাথা চুলকে ছকু বলল, “সিধে যাবেন! কীভাবে!”
“তুমি বলো?”
খানিকক্ষণ ভাবল ছকু। বলল, “গুরুজি, আমি বাড়িটা আগে নজর করে নিই। যদি বলেন, টাইমে হল্লা লাগিয়ে দেব। আপনি ঢুকে যাবেন।”
কিকিরা হাসলেন। “না, হল্লা লাগিয়ে কাজ হাসিল হবে না!”
“তো ক্যায়সা হবে?”
কিকিরা বললেন, “আমি একটা মতলব ভাবছি। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। কৃষ্ণকান্তবাবুর সঙ্গে আমি যখন কথা বলব, তুমি সরে গিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবে। দেখবে কোথায় কোন ঘর, কে কে আছে, বাড়ির পেছন দিক দিয়ে কীভাবে ঢোকা যায়। ও-বাড়িতে দু-তিনজন কর্মচারী আছে বাবুর। তাদের তুমি সামলাবে। দরকার হলে তোমার হাতসাফাই দেখাবে।”
“ওসব ঠিক আছে; মাগর আপনি যাবেন কেমন করে?”
“মহারাজ হয়ে। শ্যামদাস মহারাজ।”
ছকু অবাক! “সাধুজি মহারাজ হয়ে?”
কিকিরা হাসলেন। “কৃষ্ণকান্ত ধর্মকর্ম করেন। কালীভক্ত। সাধুসন্তকে তাড়িয়ে দেবেন না মনে হয়।”
ছকুর বিশ্বাস হচ্ছিল না। পছন্দও করছিল না ব্যাপারটা।
কিকিরা তাকে বোঝাতে লাগলেন তাঁর মতলবটা।
অনেক ভেবে কিকিরা ঠিক করেছেন, বেশি ঝঞ্ঝাট ঝামেলায় না গিয়ে সহজভাবে এই কাজটা করা যেতে পারে। তিনি সাজবেন নকল মহারাজ, সঙ্গে থাকবে চেলা ছকু। ছকুকে জটা দাড়ি গোঁফ কিছুই লাগাতে হবে না। যেমন আছে তেমন থাকলেই চলবে, শুধু একটা গেরুয়া জামা গায়ে চাপালেই যথেষ্ট। কিকিরাকে অবশ্য সামান্য ভোল পালটাতে হবে। মাথায় জটার দরকার নেই, তবে বাবরি ধাঁচের পরচুলা পরতে হবে। সাধুসন্ন্যাসীর কানঢাকা টুপির বদলে তাঁকে গেরুয়া পাগড়িও বাঁধতে হবে না। মাথার নকল চুল সামলাবার জন্যে একটা গেরুয়া পট্টি টুপিই যথেষ্ট। গালে মুখে সামান্য দাড়ি গোঁফ লাগানো দরকার। চোখে চশমা। গোল চশমা হলেই ভাল। পরনে বাসন্তী-গেরুয়া আলখাল্লা। কাছাকোঁচাহীন বস্ত্র। জব্বর এক রুদ্রাক্ষের মালা ঝোলাবেন গলায়।
মহারাজ যাবেন কালীভক্ত কৃষ্ণকান্তর সঙ্গে দেখা করতে।
কেন? সহজ কারণ। কিছু আর্থিক সাহায্য ভিক্ষা করতে। মাতৃমন্দিরের জন্যে।
কদমকানন মাতৃমন্দিরটির পরিবেশ চমৎকার। নির্জন। কোথাও উপদ্রব নেই। ভক্তজন যায়-আসে। তবে আর্থিক অনটন থাকায় অনেক কাজকর্ম করা যাচ্ছে না। আশ্রমের আর মন্দিরের সাধুজিরা তাই মাঝে মাঝে অর্থসংগ্রহে বেরিয়ে পড়েন।
ছকু বলল, “গুরুজি, চাঁদার রসিদ বই হাতে হরেক রকম বাবাজিদের বাড়ি বাড়ি ঘুরতে দেখেছি। এটা কি সেইরকম?”
কিকিরা বললেন, “চাঁদার রসিদ বই কে নিচ্ছে হে! ওসব মঠঅলাদের মানায়। আমি যাব ভদ্রলোককে দেখতে আর বাজাতে। দেখি না কী বলেন?”
“তা মন্দির আখড়ার জায়গাটা কোথায় গুরুজি?”
কিকিরা মুচকি হাসলেন, বললেন, “তুমি বুঝবে না। ক্যানিং লাইনে। …আরে, ওই মন্দির কি আজকের? কোনকালের পুরনো। ভাঙা পাথরের টিবি হয়ে পড়ে ছিল জায়গাটা। পরে কে যেন দেখল, পাথরের আড়ালে এক-দু হাতের ভাঙাচোরা কালীমূর্তি পড়ে আছে। তখন আবার”।
ছকু বুদ্ধিমান। হেসে বলল, “ক্যানিং নয়, বনগাঁ লাইনে করে দিন। লাইনের নামে বাবু যেতে চাইবেন না।”
জোরে হেসে উঠলেন কিকিরা। বাহবা জানালেন ছকুকে।
বগলা চা দিয়ে গেল।
চা খেতে খেতে কিকিরা ছকুকে সব বুঝিয়ে দিলেন। অর্থাৎ তিনি কৃষ্ণকান্তকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন যখন, কথার বহর ছোটাবেন, ভদ্রলোককে দু-চারটে ভেলকিবাজি দেখাতেও পারেন,তখন ছকুর কাজ হবে ঘরের বাইরে চলে যাওয়া। তার নজর থাকবে ভেতর মহলে। দোতলায় সে উঠতে পারবে না, কিন্তু নীচের তলার ঘরদোর জানলা, আসা-যাওয়ার পথ, কে কোথায় ঘোরাফেরা করছে ভাল করে লক্ষ করা। পারলে এক-আধজনের সঙ্গে গল্প জমানো।
ছকু বলল, “বুঝে গেলাম। কব যাবেন?”
কিকিরা বললেন, “পরশু। দেরি করলে কৃষ্ণকান্তবাবু যদি দেশে ফিরে যান– ধরতে পারব না। তবে মনে হয় না যাবেন।”
ছকু উঠে পড়ল।
কিকিরা বললেন, “তুমি কাল আমাকে একটা ফোন করে জেনে নিয়ো। …ভাল কথা, আমরা কিন্তু সকাল দুপুরে যাব না। শেষ বিকেলে যাব। সন্ধে হব-হব সময়ে। বেশি আলো ভাল নয়, ছকু। ধরা পড়তে রাজি নই।”
ছকু চলে গেল।
কাজটা সহজ হবে কিনা তিনি জানেন না। কৃষ্ণকান্তকে ধোঁকা দেওয়া কঠিন। ঠিকমতন চাল না চাললে ধরা পড়ে যেতে পারেন। আর ধরা পড়লে বিসদৃশ ব্যাপার হবে। তখন হয় পালাতে হবে, না হয়!
চন্দন বলছিল, “সার, আপনি বড় বেশি রিস্ক নিচ্ছেন। আমার মনে হয় ব্যাপারটা অন্যভাবে সেটেল হলে ভাল হত। কলকাতায় আজকাল প্রাইভেট এজেন্সি, বুরো হয়েছে। তারা প্রফেশনাল। ইনভেস্টিগেশন করাই কাজ তাদের। নবকুমার ওদের সাহায্য নিলে পারত।”
কিকিরা বলেছেন, “তুমি পাগল। যে-ছেলে ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সে যাবে ওইসব জায়গায়! বরং দেখাই যাক আমরা কী করতে পারি। না পারলে হাত গুটিয়ে নেব। তখন অন্য ভাবনা ভাবা যাবে। নট নাউ।”
.
০৬.
কৃষ্ণকান্ত তখনও আসেননি।
কিকিরা কাঠের চেয়ারে বসে ঘরটি দেখছিলেন। ছকু একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। বসেনি।
নীচের তলায় ভেতর দিকের এই ঘরটি কৃষ্ণকান্তর বসার ঘর। মাঝারি মাপের ঘরের চেয়ে সামান্য বড়। দুটি দরজা, বাইরে থেকে আসার একটি, আর অন্যটি ভেতর দিকে যাওয়ার। প্রথমটি উত্তর দিকে। দ্বিতীয়টি ঘরের বাঁদিকে, পুবে। জানলা তিনটি। দক্ষিণের দিকে দুটি, পেছনে–পুব দিকে একটি। আসবাবপত্র বেশি নেই। জানলা ঘেঁষে পুরনো আমলের এক বিরাট আর্মচেয়ার, সামনে পাথর বসানো গোল টেবিল। ঘরের অন্য পাশে তিন-চারটি কাঠের চেয়ার। এক কোণে দেরাজ একটিমাত্র। দেওয়ালে তিন-চারটি বাঁধানো ছবি। কালীর পট, দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুরবাড়ির রঙিন ফোটো, হাতে আঁকা কোনও পাহাড়ি এলাকার পথ আর অদ্ভুত এক অবধূত সন্ন্যাসীর ছবি–তেলরঙে আঁকার মতন দেখায়। উত্তরের দেওয়ালে বড় দেওয়াল ঘড়ি।
সন্ধে হয়ে আসছিল। ঘরে একটা বাতি জ্বলছে। টিউব লাইট নয়, শেড পরানো দেওয়াল-বাতি।
কিকিরা নিজেকে সামান্য গুছিয়ে নিলেন যেন। শ্যামাদাস মহারাজের ছদ্মবেশটি মন্দ হয়নি। বাড়াবাড়ি সাজসজ্জা নেই। মাথার বাবরিচুলও বড় নয়, তবে খানিকটা এলোমেলো। টুপিটা প্রায় গোল। মাথার সঙ্গে চমৎকার এঁটে গিয়েছে। মুখের দাড়ি গোঁফও ছিমছাম, অল্প। চোখের চশমাটি নিকেল ফ্রেমের। গায়ের আলখাল্লা কটকটে গেরুয়া রঙের নয়, বাসন্তী-গেরুয়া। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা।
ছকুর বেশবাস সাধারণ। তবে সে ধুতি পরেছে, গায়ে গেরুয়া খদ্দরের পাঞ্জাবি। মাথায় কিছু নেই।
কৃষ্ণকান্তর পায়ের শব্দ।
ভদ্রলোক ঘরে ঢুকতেই কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন।
“কী ব্যাপার? আপনারা?”
কিকিরা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে নমস্কার জানালেন কৃষ্ণকান্তকে। ছকুও নমস্কার করল।
নিজের পরিচয় দিলেন কিকিরা। শ্যামাদাস মহারাজ। আসলে তিনি সেবক। লোকে বলে মহারাজ। বলে ছকুকে দেখালেন, “আমার সঙ্গী। আশ্রমের দেখাশোনা করে অন্য দু-একজনের সঙ্গে।”
“কীসের আশ্রম?” কৃষ্ণকান্ত নিজের জায়গায় বসতে বসতে বললেন।
মাতৃমন্দিরের বর্ণনা দিতে দিতে কৃষ্ণকান্তকে দেখে নিচ্ছিলেন কিকিরা। ভদ্রলোক বৃদ্ধ নন, তবে প্রৌঢ়। স্বাস্থ্য মোটামুটি স্বাভাবিক। বয়েসের তুলনায় সক্ষম বলে মনে হয়। চোখ দুটি তীক্ষ্ণ। গলার স্বর ভারী, গম্ভীর। জমিদারি দাপট রয়েছে যেন।
কৃষ্ণকান্ত পাথরের টেবিলের ওপর পানের বড় ডিবে আর জরদার কৌটো রেখে কিকিরার কথা শুনছিলেন। কতটা খেয়াল করছিলেন বলা মুশকিল। পান মুখে দিলেন। পরে জরদা।
হঠাৎ যেন, খেয়াল হল তাঁর। কিকিরাকে হাতের ইশারায় বসতে বললেন।
বসলেন কিকিরা। মাতৃমন্দিরের বিবরণ শোনাচ্ছেন নম্র গলায়। অতীত, বর্তমান; আশ্রমের কথাও।
কৃষ্ণকান্ত বললেন, “তা আমার কাছে কেন?”
কিকিরা বললেন, “ভিক্ষার আশায়। অনেকের কাছেই যাই। কেউ সাহায্য করেন; কেউ বা করেন না। আমাদের অন্য কী উপায় আছে বলুন! যাঁরা সহৃদয় হয়ে সাহায্য করেন তাঁদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। যাঁরা বিমুখ করেন, বুঝি তাঁরা এইসব সাধারণ সৎ কাজে দানধ্যান করতে চান না। সংসারে সবরকমেরই মানুষ আছে, কেউ দয়াদাক্ষিণ্য করেন, কেউ করেন না।”
কৃষ্ণকান্ত বললেন, “আপনারা কেমন করে বুঝলেন আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ নই?”
কৃষ্ণকান্ত আরও একটু জরদা মুখে দিলেন।
কিকিরা বিনীত হাসি হেসে বললেন, “ভিক্ষাপাত্র যে বাড়ায় সে কি আগে থেকে অনুমান করতে পারে কে ভিক্ষা দেবে, কে দেবে না। …আপনি তো ভক্ত মানুষ।”
“ভক্ত! কে বলল মহারাজ, আমি ভক্ত! আর ভক্ত হলেই কি দান করতে হয়। আপনি আমাকে চিনলেন কেমন করে, আপনাকে তো আমি চিনি না।”
কিকিরা এমন মুখভঙ্গি করলেন, সলজ্জভাবে যে, মনে হল, তিনি বলতে চাইছেন–এ আপনি কী কথা বললেন, মশাই। মুখে বললেন, “আজ্ঞে, সাধক রামদাস বলেছেন, আরে তুই তো ভেরা গাছ, তোর কাছে কোন বোকা আশ্রয় নিতে আসবে, লোকে দু’দণ্ড ছায়ায় জিরোবার জন্যে বট, অশ্বত্থ, নিমগাছের তলায় গিয়ে বসে।… আমি সেইরকম নগণ্য ভেরান্ডা; আর আপনি বট, অশ্বত্থ। আপনাকে চিনতে পারব না।”
কৃষ্ণকান্ত হাসলেন। “বা, কথাবার্তা তো ভালই বলতে শিখেছেন। তবে আমি বট, অশ্বত্থ নই।”
“আপনি কে আমি জানি।” কিকিরা বললেন, “আপনি নুরপুরের বিখ্যাত জমিদার বাড়ির কর্তা। আগে আপনাকে আমি দেখিনি। নামধাম অনেক শুনেছি। ছেলেবেলায় আপনাদের দেশবাড়ি জমিদারির পাঁচ-সাত ক্রোশ দূরে আমার মামার বাড়ি ছিল। তখনই নুরপুরের কত গল্প শুনেছি।”
“ও! আপনি বর্ধমান জেলার লোক?”
“বাঁকুড়া জেলার…পুরনো কথা আমাদের বলতে নেই। যৌবনে কেমন করে কী কারণে ঘরছাড়া হই, কী খোঁজে বেরিয়েছিলাম তাও জানি না। আজ্ঞে–সেই যে বলে, ঘুরি পথে পথে হইয়া সাধুর শিষ্য-তাই। নানা জায়গায় ঘুরে আমার আসল গুরু লাভ হয়। স্বামী মহেশ্বরানন্দ। তাঁর কাছে ছিলাম অনেকদিন। গুরুজি দেহ রাখার আগে আমায় আদেশ করেছিলেন, নিজের দেশে ফিরে যেতে। দেশে অবশ্য ফেরা হয়নি, তবে তিনি আমায় কদমকাননে টেনে আনেন।”
“কদমকানন?”
“আজ্ঞে, জায়গাটার নাম বড়জালি। তারই একপাশে একটি জঙ্গল ছিল। কদমগাছ হয়তো ছিল অনেক। সেই থেকে কদমকানন। সেখানে প্রাচীন একটি কালীমূর্তি পাওয়া যায়। ভাঙা মন্দির। মূর্তিরও একটি হাত ভাঙা। মায়ের পায়ের তলায় শিব নেই। কিংবদন্তি বলে, এখানে সতীমায়ের বাঁ পায়ের একটি আঙুলের নখকণা ছিটকে এসে পড়েছিল। …তা সে যাই হোক, ওখানে কেউ একজন কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাচীন মূর্তি। ওটি প্রায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। আমরা চেষ্টাচরিত্র করে মন্দিরটি গড়ে তুলেছি। আশ্রম আছে। পুজোপাঠ ছাড়াও সেবাধর্মের উদ্দেশ্য নিয়ে কাজও কিছু হয়।”
কৃষ্ণকান্ত বললেন, “সবই বুঝলাম। কিন্তু এতকাল পরে হঠাৎ আমায় মনে পড়ল কেন? কার কাছে খবর পেলেন আমি এখন কলকাতায় রয়েছি? ঠিকানা জোগাড় করলেন কেমন ভাবে?”
কিকিরা কোলের ওপর রাখা গেরুয়া রঙের কাঁধ-ঝোলা তুলে নিয়ে কী যেন খুঁজলেন ভেতরে। বইয়ের মাপের একটি ডায়েরি বই বার করে পাতা ওলটাতে ওলটাতে বললেন, “এটি আমার নামধাম এটা-ওটা লিখে রাখার খাতা। যাঁদের কাছে যাই তাঁদের নাম-ঠিকানা আছে। আবার কেউ যদি নতুন কারও কথা বললেন, তাঁর নামধামও টুকে রাখি। আমাদের কাজই হল ছোট-বড় সকলের কাছে যাওয়া। যে যেমন পারেন সাহায্য করেন।…এই যে আপনার নাম-ঠিকানা। এটি পেয়েছি হরিবাবুর কাছে। আপনাদের দেশের লোক।”
কৃষ্ণকান্ত বুঝলেন না, হরিবাবু কোনজন! তবে নামটা এতই প্রচলিত যে, দেশগ্রামে হরিবাবু দু’-একজন থাকতেই পারে।
কৃষ্ণকান্তর দ্বিধা দেখে কিকিরা তাড়াতাড়ি বললেন, “একটা কথা কী জানেন! ঠাকুর বলতেন, রামকৃষ্ণদেব, ওরে বনের মধ্যে ফুল ফুটলেও ভ্রমর তা খুঁজে নেয়। সে যে গন্ধ পায় বাতাসে।… আপনি কাকে জানলেন না জানলেন কিছুই যায়-আসে না। লোকে যে আপনাদের জানে চৌধুরীমশাই।”
কৃষ্ণকান্ত চুপ।
ঘড়ির কাঁটার দিকে আড়চোখে চেয়ে নিলেন কিকিরা। ছকুকে বললেন, “তুমি ঘরের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করো। আমরা দুটো কথা সেরে নিই।”
ছকু চলে গেল। সে জানে তাকে কী করতে হবে। বাড়ির বাইরেও কিকিরা লোক রেখেছেন। তারাপদ, চন্দন, লাটু দত্ত। বলা তো যায় না কোথাকার জল কোথায় গড়াবে! ঝাট ঝামেলা হলে বাঁচতে হবে নিজেদের।
কৃষ্ণকান্ত বললেন, “আমি ভেবে দেখব।” গলার স্বরে ক্লান্তি। কিকিরা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “অবশ্যই ভাববেন। আমি শুধু আপনার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিলাম। আরজি জানিয়ে যাচ্ছি। আজই আপনাকে কিছু দিতে হবে না। পরে আসব।”
“তাই আসুন। আমি সপ্তাহখানেক আছি এখানে।”
ডায়েরি খাতাটা ঝোলার মধ্যে ঢুকিয়ে কিকিরা মুখ নামিয়ে কী যেন হাতড়ালেন। তারপর একটা কাগজের ঠোঙা বার করে বললেন, “মায়ের পায়ে দেওয়া ফুল আর সামান্য প্রসাদী আপনাকে দিয়ে যাই।”
চেয়ার থেকে উঠে কয়েক পা এগিয়ে কৃষ্ণকান্তর দিকে যাবেন, হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল, ভদ্রলোক আর্মচেয়ারে ঘাড় হেলিয়ে দিয়েছেন। মাথামুখ বুকের কাছে ঝুঁকে পড়েছে।
কিকিরা অবাক!
কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করে এগিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়ালেন তিনি কৃষ্ণকান্তর। ভদ্রলোকের চোখের পাতা বোজা। ঠোঁট ঈষৎ ফাঁক হয়ে রয়েছে। মনে হল, ওঁর কোনও হুঁশ নেই। অচৈতন্য।
বিস্মিত বিমূঢ় কিকিরা কী করবেন বুঝতে না পেরে তাড়াতাড়ি কাগজের ঠোঙাটা টেবিলের ওপর রেখে কৃষ্ণকান্তর নাকের কাছে ডান হাতের একটি আঙুল ধরে রাখলেন। নিশ্বাস-প্রশ্বাস আছে, তবে দুর্বল বলে মনে হল। বুক ওঠানামা করছে এত ধীরে যে, সতর্ক হয়ে নজর করতে হয়।
কিকিরা স্বাভাবিক বোধবুদ্ধির বশে তাড়াতাড়ি কৃষ্ণকান্তের গলায় জড়ানো উড়নি বা পাতলা চাদরটা আলগা করে খুলে দিলেন। শ্বাসকষ্ট কমা উচিত। আর তখনই তাঁর নজরে পড়ল, কৃষ্ণকান্তর গলার মাঝামাঝি সামান্য বাঁদিক ঘেঁষে একটি টিউমার। গলগণ্ডর মতন দেখায়। বিসদৃশ অবশ্যই। তবে কি এইজন্যেই কৃষ্ণকান্ত গলার কাছটা চাপা দিয়ে রাখেন?
একবার মনে হল কিকিরা চিৎকার করে কাউকে ডাকেন! জানলার দিকে তাকালেন। বাড়ির ভেতর দিকে জানলা। মেঝে থেকে সামান্যই উঁচু, আড়াই কি পৌনে তিন ফুট। জানলায় গরাদ নেই। ওপাশে বোধ হয় প্যাসেজ। সহজেই টপকে যাওয়া যায়।
কৃষ্ণকান্তকে সামান্য নাড়া দিলেন কিকিরা। “কৃষ্ণকান্তবাবু! শুনছেন! কৃষ্ণকান্তবাবু!”
জলের জন্যে তাকালেন চারপাশ। জল নেই। পানের ডিবে খুললেন। ভিজে ন্যাকড়া চাপা দেওয়া ছিল। সেটা তুলে নিয়ে কৃষ্ণকান্তর কপালে, চোখে বোলাতে লাগলেন।
সামান্য পরে নড়ে উঠলেন কৃষ্ণকান্ত। মনে হল, ঘুমের ঘোর কাটিয়ে জেগে উঠছেন। আলস্য, আবেশ, দুর্বলতা–সব যেন কেমন মেশানো রয়েছে দৃষ্টিতে। শ্বাস নিলেন। শূন্য চোখে তাকালেন। “কে?”
“আমি শ্যামাদাস।”
“শ্যামা-দাস! ও!”
“আপনার কী হয়েছিল? হঠাৎ…?”
কৃষ্ণকান্ত উড়নি দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, “কিছু না। এরকম আমার হয়। আগে কম হত। এখন প্রায়ই হয়। কাজ করতে করতে, কথা বলতে বলতে হঠাৎ কখন ঘুমিয়ে পড়ি। নিজেই বুঝতে পারি না।”
“ডাক্তার দেখাচ্ছেন না?”
“দেখাই। এবারও দেখাচ্ছি।… যাক, আপনি এখন আসুন। আমার ভাল লাগছে না।”
কিকিরা নমস্কার জানিয়ে চলে আসার আগে টেবিলে রাখা কাগজের ঠোঙাটা দেখালেন। “মায়ের প্রসাদী ফুল রেখে গেলাম। আসি।”
.
বাইরে এসে রিকশা ডাকল ছকু। কথাই ছিল কৃষ্ণকান্তর বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিকশায় উঠবেন কিকিরা। সঙ্গে ছকু থাকবে। বেশ খানিকটা এগিয়ে এসে রিকশা ছেড়ে দেবেন ওঁরা।
লাটু গাড়ি নিয়ে পিছু পিছু আসবে। গাড়িতে তারাপদ আর চন্দনও আছে।
শেষে রিকশা ছেড়ে কিকিরা গাড়িতে উঠবেন। ছকু চলে যাবে নিজের জায়গায়।
রিকশায় বসে কিকিরা বললেন, “ছকু, আমি এমন দেখিনি। সমস্ত গোলমাল হয়ে যাচ্ছে আমার।”
ছকু বলল, “কী হল গুরুজি?”
“পরে বলব। তুমি কাল সন্ধের পর একবার বাড়িতে এসো।…তোমার নিজের কাজ কতটা হল।”
ছকু জানাল, “আমার কাজ হয়েছে থোড়া বহুত। আপনি ভাববেন না।”
.
০৭.
তারাপদই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল নবকুমারকে।
নবকুমার এখন কয়েকদিন তারাপদর বোর্ডিংয়েই রয়েছে। তারই হেফাজতে আবার যেন ও পালিয়ে না যায় তার জন্যে তারাপদ বোর্ডিংয়ের ম্যানেজারবাবুকে বলে রেখেছে ছোকরার ওপর নজর রাখতে বলেছে, একটু খেয়াল রাখবেন তো চারুবাবু; ছেলেটার মাথায় ছিট আছে, খেয়ালি, যখন-তখন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। দু-চারদিন থাকুক এখন, ওর গার্জেন এলে হাতে তুলে দেব।
কিকিরার ঘরে চন্দন বসে ছিল। কথা বলছিল।
তারাপদরা আসতেই কিকিরা বসতে বললেন তাদের। দেখলেন নবকুমারকে। একই রকম। উদ্বিগ্ন, শঙ্কিত মুখ। খানিকটা হতাশ।
কিকিরা দু-চারটে মামুলি কথা বলে নবকুমারকে সহজ করার চেষ্টা করলেন। হাসি তামাশাও করলেন। শেষে বললেন, “তোমার জেঠামশাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে এসেছি, শুনেছ তো?”
শুনেছে নবকুমার। তারাপদই বলেছে।
“এবার তোমায় কটা কথা জিজ্ঞেস করি। ঠিক ঠিক উত্তর দেবে। লুকোবে না কোনও কথা।”
“বলুন?”
“কৃষ্ণকান্তবাবু, মানে তোমার জ্যাঠামশাইয়ের যে একটা অদ্ভুত রোগ আছে, উনি যখন-তখন হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েন, তুনি জানো?”
নবকুমার তাকিয়ে থাকল সামান্য সময়। পরে বলল, “শুনেছি। আগে শুনতাম মৃগী। কখনও-সখনও হত। আমি নিজে দেখিনি।”
“দ্যাখোনি?”
“না।..আজ পাঁচ-ছ’ বছরের মধ্যে আমি মাত্র তিন-চারবার নুরপুরের বাড়িতে গিয়েছি। তাও হয়তো দু-একদিনের জন্যে। ওখানে কেউ আমায় আদর আপ্যায়ন করে না। মা-মাসি থাকলে নিশ্চয় করত। অন্য যারা আছে তারা দুটো খেতে দেয়, ঘরের দরজা জানলাগুলো খুলে দেয়, এই পর্যন্ত। এক-আধটা কথা যা বলে তা নেহাতই দয়া করে।”
“ও বাড়িতে তোমায় পছন্দ করে এমন কেউ নেই?”
“না, এখন নেই। জলধরদা ছিল। মারা গিয়েছে।”
“তুমি তা হলে ঠিকমতন জানো না, কৃষ্ণকান্তবাবুর অসুখটা কেমন? কতদিনের?”
“না। শুনেছি এই মাত্র। তাও কেউ বলতে পারত না কেমন অসুখ। মা-মাসির মুখেও শুনেছি। বলত, মৃগী রোগীর মতন অনেকটা। আবার কেউ বলত, এপিলেপসি ধরনের।”
“তুমি নিজে কোনওদিন দ্যাখোনি?”
“না। তা ছাড়া তখন হয়তো বাড়াবাড়ি ছিল না।”
“এখন কি বাড়াবাড়ি হয়েছে?”
“আমি কেমন করে জানব! আপনি যেদিন গিয়েছিলেন আপনার চোখের সামনে হয়েছে–এ কথা তো আমি তারাপদবাবুর মুখে শুনলাম।”
কিকিরা মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ। আমার সামনেই হয়েছে। উনি এখানে এসেছেন, আছেন–তার একটা বড় কারণ শুনলাম ডাক্তার দেখানো।”
“তা আমি জানি না। রোগটা কী? মৃগী–!”
চন্দনের দিকে তাকালেন কিকিরা। চন্দন বলল, “না মৃগী নয়, এপিলেপসি নয়। এর নাম আমি জানি না। সিনিয়ারদের জিজ্ঞেস করেছি। বইপত্র ঘেঁটে বলবেন বলছেন। তবে রোগটা কমন বা নর্মাল নয়। ভেরি রেয়ার। লাখে একটা পাওয়া যায় কিনা তাও সন্দেহ।… আর আশ্চর্যের কথা, এরা নিজেরাও বুঝতে পারে না, কখন আচমকা ঘুমিয়ে পড়বে। ব্যাপারটা নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছেয় হয় না।”
“অদ্ভুত!”
“মানুষের শরীরের স্বাভাবিক একটা গঠন আছে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গেরও মিল আছে। তবু কখনও কখনও অস্বাভাবিক পার্থক্য থেকে যায়। কেন যায় বলা মুশকিল। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা। কিন্তু দেখা গিয়েছে, এই ধরনের অ্যাবনর্মালিটি যাদের থাকে তাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গণ্ডগোলটা জন্মকাল থেকেই থেকে যায়। প্রথম বয়েসে, মাঝবয়েসে বা প্রায় প্রৌঢ় বয়েসে–কখন ধরা পড়বে তাও বলা যায় না।”
তারাপদ বলল, “আরে সেই যে বিখ্যাত গল্প…. একটা লোকের হার্ট বাঁদিকে না থেকে ডানদিকে ছিল…।”
“গল্প নয়, এরকম হয়, হতেই পারে। তবে রেয়ার। আবার সৃষ্টির এমনই মহিমা যে–যদি কারও হার্ট ডানদিকে থাকে তবে এমনও দেখা গিয়েছে, তার ক্ষেত্রে অন্য অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গগুলো–যা বাঁদিকে থাকার কথা, সব ডানদিকে জায়গা করে নিয়েছে।…এসব অবশ্য কদাচিৎ দেখা যায়। সৃষ্টি রহস্য! এর কোনও ব্যাখ্যা নেই।”
“আমাদের অফিসে ডেসপ্যাঁচ সেকশনের কড়িদার বাঁ হাতে ছ’টা আঙুল,” তারাপদ বলল, “এটাও তো স্বাভাবিক নয়।”
কিকিরা বললেন, “যাক গে, আসল কথা হল কৃষ্ণকান্তর একটা অস্বাভাবিক রোগ আছে। আমার পরের প্রশ্ন–” বলে নবকুমারের দিকে তাকালেন, “তুমি একেবারেই খেয়াল করে দ্যাখোনি কৃষ্ণকান্ত সত্যিই বেঁচে আছেন কিনা! তুমি তাঁকে হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখোনি।”
“না।”
“ওঁর গলায় যে গলগণ্ড কিংবা টিউমারের মতন ফোলা মাংসপিণ্ড আছে, তুমি নিশ্চয় জানতে।”
“দেখেছি।”
“লোকের চোখ এড়াতে কৃষ্ণকান্ত গলায় একটা চাদর চাপিয়ে রাখতেন, তুমি জানো না?”
“বাইরের লোকের সামনে বেরুতে হলে গলা চাপা দিতেন, অন্য সময় নয়। বাড়ির মধ্যে দেখিনি।”
“তুমি বলেছিলে, সেদিন তুমি দেখেছ, কৃষ্ণকান্তর গলায় বাসন্তী-গেরুয়া রঙের চাদর ছিল।”
“হ্যাঁ। জেঠামশাই রঙিন চাদরও পছন্দ করেন।”
“আমি তো দেখলুম, ওঁর গলায় সাদা উড়নি। উড়নির পাড়ে অবশ্য রং ছিল বাসন্তী ধরনের।”
নবকুমার কিছু বলল না।
“সেদিন তুমি ঘরে ঢুকে তোমার জেঠামশাইয়ের সামনে টেবিলের ওপর একটা অ্যাটাচি কেস দেখেছিলে তো?”
“হ্যাঁ দেখেছি।”
“তুমি ওটা ছুঁয়েও দেখোনি?”
“না”
“ঠিক বলছ?”
নবকুমার বিরক্ত হল। “আমি বার বার বলেছি, অ্যাটাচি কেসটায় হাত দিইনি আমি।”
“কী রঙের অ্যাটাচি? মনে আছে?”
“অ্যাশ কালার, ছাই রঙের।”
কিকিরা অল্প সময় চুপ করে থাকলেন। ভাবলেন কী যেন, শেষে বললেন, “তবু ওরা রটিয়ে বেড়াচ্ছে, তুমি নাকি তোমার জেঠামশাইয়ের গলায় ফাঁস লাগিয়ে তাঁকে মারবার চেষ্টা করেছ, টাকা ভরতি অ্যাটাচিকেসটা নিয়ে পালিয়ে এসেছ!”
“আমি তাই শুনেছি। ওদের লোক এসে আমার দোকানে বলে গিয়েছে।”
“ওরা বেশি চালাক। তবে চালাকিটা ধোপে টিকবে না জানে। আর সেজন্যে থানাপুলিশ করেনি।… যাক গে, আমি ভেবে দেখলাম, ওটা এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, আড়ালে আড়ালে লড়ে লাভ হবে না। মুখোমুখি হওয়া দরকার। সামনাসামনি না দাঁড়ালে সত্যি কথাটা জানা যাবে না। কাজেই স্ট্রেট ফাইট।”
তারাপদ বলল, “আপনি ফাইট করবেন?”
কিকিরা মাথা নাড়লেন, হেসে যাত্রার ভঙ্গি করে বললেন, “সম্মুখ সমর বিনা গতি নাহি আর। কৃষ্ণকান্ত পর্বটা শেষ করে ফেলতে হবে। না করলে ভদ্রলোককে আর কলকাতায় পাব না। দেশে ফিরে যাবেন উনি।”
তারাপদ হালকাভাবে বলল, “সার, অপারেশন কৃষ্ণকান্তটা কবে হচ্ছে?
“যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। দেরি করলে ভদ্রলোককে কলকাতায় পাচ্ছ কোথায়? উনি তো বললেন, হপ্তাখানেক থাকবেন আর।”
“এই সপ্তাহে তবে লাগিয়ে দিন।…তা আমাদের করণীয় কী?”
“তোমরা থাকবে। তবে বাড়ির বাইরে গেরিলা কায়দায় পজিশন নেবে। ভুলে যেও না ওটা কৃষ্ণকান্তর পাড়া। তাঁর নিজের কর্মচারী ছাড়াও ওঁর হাতে লোক আছে। পাড়ার ছেলে। গণ্ডগোল বাঁধলে তোমাদেরও ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।”
“শুধু হাতে?” তারাপদ ঠাট্টা করে বলল। “নো বোমা, নো পাইপগান, নো হ্যান্ডমেড পিস্তল? ভীষণ রিস্কি হবে, সার?”
কিকিরা গম্ভীরভাবে বললেন, “মুরগিহাটা থেকে কিছু পটকা কিনে নিয়ে যেও। চিনেবাজারেও পেতে পারো।”
তারাপদরা হেসে উঠল। “মুরগিহাটায় পটকা–! সে তো চিকেন কোয়ালিটি হবে।”
চন্দন উঠে পড়ল। তার অন্য একটা কাজ আছে। “আমি চলি।”
“তুই যাবি?” তারাপদ হাতঘড়ি দেখল। “আটটা বাজতে চলল। আমরাও তাহলে যাই। চল, একসঙ্গেই যাব।”… বলে কিকিরার দিকে তাকাল। “আমরা আসি সার। পরে খবর নেব…!”
“এসো।”
চন্দনরা চলে গেল।
কিকিরা একই ভাবে বসে থাকলেন।
.
সামান্য পরেই ছকু এল।
“এসো। আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম।”
ছকু বলল, “দোকানের কাজকর্ম মিটিয়ে এলাম। চেনা একটা স্কুটার ভ্যান আসছিল। বললাম, একটু নামিয়ে দিয়ে যা ভাই।”
“বোসো।”
ছকু বসল। একেবারে কিকিরার পায়ের কাছে। কিকিরা অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করেন এভাবে ছকু মাটিতে বসলে। কিন্তু সে কিছুতেই শোনে না, কী করা যাবে।
“খবর বলো?” কিকিরা বললেন।
ছকু আগের দিনের বিবরণ দিতে শুরু করল। বলল, কৃষ্ণকান্ত যে বাড়িটায় থাকেন, সেটা বেশ পুরনো। ভাড়া-নেওয়া বাড়ি। নীচের তলায় সদর ঘেঁষে একপাশে দফতর, ব্যবসাদারদের গদির মতন। সেখানে জনাদুই বসে। কী করে কে জানে! অন্যপাশে মুনশির কামরা। মুনশিবাবু মানে ম্যানেজারবাবু। ভেতরে একটা হলঘর। পেছন দিয়ে দোতলার সিঁড়ি উঠে গিয়েছে। কৃষ্ণকান্তর বসার ঘর হলঘরের শেষদিকটায়, সিঁড়ির গায়ে গায়ে। গোটা দুই সরু প্যাসেজ এপাশে ওপাশে। বাড়ির পেছনদিকে একফালি জমি। একটা ছোট নিমগাছ, জলের রিজারভার, পাঁচিল।
কর্মচারীদের দু’জন আছে ওই বাড়িতে। রিজারভারের কাছে সাধারণ একটা ঘরে তাদের আস্তানা। ঠাকুর চাকর থাকে নীচে, উত্তর দিকে। উঠোন রয়েছে। সামনে।
দোতলায় ছকু যায়নি।
একতলায় ঘুরঘুর করার সময় মুনশিজির সঙ্গে তার আলাপ হয়ে যায়। কথায় কথায় জানতে পারল, মুনশিবাবু বললেন–তাঁর মালিক কৃষ্ণকান্তর শরীর ভাল যাচ্ছে না। কলকাতায় এসেছেন–ডাক্তার দেখাতে। কাজেকর্মে যখনই আসেন এখানে, একবার ডাক্তার দেখিয়ে যান। এবারে অবশ্য মূল উদ্দেশ্য ডাক্তার দেখানো! বড় ডাক্তার। দু-তিনজনকে দেখানো হয়ে গিয়েছে। পরীক্ষাও হয়েছে। নানারকম।
ছকু নিজের থেকে জানতে চায়নি, মুনশিবাবু নিজেই বললেন, “কর্তামশাইয়ের ডাক্তারবদ্যি দেখানোর ভারটা এবার নিয়েছেন বাসুদেববাবু। তাঁর ব্যবস্থা মতনই আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে কর্তাকে।
“বাসুদেববাবু? সে আবার কে?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।
“কৃষ্ণকান্তবাবুর জামাইয়ের ভাই।”
“কোথায় থাকে?”
“এখানেই, কলকাতায়।”
“কী করে?”
“তা জানি না।”
কিকিরা কৌতূহল বোধ করলেন। “ওই বাড়িতেই থাকে?”
“মুনশিবাবু থাকার কথা বললেন না তো!”
নিজের মাথায় দুটো টোকা মারলেন কিকিরা। “ইস, তুমি একটু আগে এলে জানা যেত হয়তো। নবকুমাররা ছিল।…আচ্ছা, দাঁড়াও দেখি।”
সামান্য ঝুঁকে টেলিফোন তুলে নিলেন কিকিরা। লাটু দওকে ফোন করলেন বাড়িতে।
পাওয়া গেল লাটুকে; সবেই বাড়ি ফিরেছে।
“লাটু?”
“রায়দা! বলুন।”
“বাসুদেব বলে কারুর নাম শুনেছ নবকুমারের মুখে?”
“বা-সু-দেব!..বাসুদেব! কই না, মনে পড়ছে না।”
“কৃষ্ণকান্তবাবুর জামাইয়ের ছোট ভাই। কলকাতায় থাকে। চৌধুরীমশাইয়ের ডাক্তারবদ্যি দেখানোর দায়িত্ব এবার তার ঘাড়ে বর্তেছে।”
লাটু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “না, রায়দা, আমি জানি না। কুমারকে জিজ্ঞেস করতে হবে। তবে সে কি জানবে? জেঠার বাড়ির সঙ্গে তার যা সম্পর্ক!”
“আরে, খানিকটা আগেই তো ওরা আমার কাছে ছিল। ওরাও চলে গেল, ছকু এল। ছকুর মুখে শুনলাম এইমাত্র।”
“কাল খোঁজ করব?”
“আমি করে নেব।… শোনো, পরশু একবার এসো। আমি আর সময় নষ্ট করতে চাই না। হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চৌধুরীবাবুকে আর পাব না। উনি দেশে ফিরে যাবেন।”
“আপনি কি ভেবেছেন কিছু?”
“হ্যাঁ। পরশু এসো, বলব। এবারে সম্মুখ সমর। কৃষ্ণ ভার্সেস কিকিরা। ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসব..” কিকিরা হেসে ফেললেন।
.
০৮.
অফিস যাওয়ার তোড়জোড় করছিল তারাপদ। পৌনে ন’টা বেজে গেল। দাড়ি কামানো শেষ করেছে সবে, স্নানে যাবে, হঠাৎ দেখল কিকিরা তার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন।
“এ কী! আপনি?”
ঘরে ঢুকলেন কিকিরা। “তুমি কি মাথায় ফুলেল তেল মাখো?”
“ফুলেল তেল?”
“এত গন্ধ ছুটছে…!”
“না সার,” তারাপদ হাসল, “আমার মাথার চুল চাপড়া ঘাসের মতন, সিমপিল কোকোনাট মাখি। হ্রাস বৃদ্ধি একই রকম।”
“মোবিল অয়েল চেষ্টা করে দেখতে পারো।”
তারাপদ হেসে উঠল। কিকিরাও।
“আপনি হঠাৎ আমার কাছে, এখন?”
“তোমার কাছে নয়, নবকুমারের কাছে। কোথায় সে? একবার ডাকো।”
তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “কী ব্যাপার! কাল সন্ধেবেলায় আপনার বাড়ি থেকে ঘুরে এলাম; আর আজ সকালেই? সামথিং হ্যাঁপেন্ড?”
“ওকে ডাকো। কোথায় ও?”
“এই তো কাছেই এগারো নম্বর ঘরে ডেকে আনছি।”
এগারো নম্বর ঘরটা ফাঁকা আছে ক’দিন। চুনিবাবু মালদায় গিয়েছেন অফিসের কাজে। দিন পনেরোর আগে ফিরবেন না। নতুন বোর্ডার নেওয়ার কথা ওঠে না। তারাপদর কথায় নবকুমারকে থাকতে দিয়েছেন ম্যানেজারবাবু।
কিকিরা বসলেন। বিছানার ওপরেই।
তারাপদ গেল আর ফিরে এল। সঙ্গে নবকুমার।
কিকিরা একবার দেখলেন নবকুমারকে। তারপর ভণিতা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, “বাসুদেবকে চেনো?”
নবকুমার কেমন ঘাবড়ে গেল। “বাসুদেব–?”
“চেনো না?”
“চিনি। জামাইবাবুর ছোট ভাই।…কেন?”
“বাসুদেব কলকাতায় থাকে? কী করে?”
স্নানে যাওয়ার তাড়া ভুলে তারাপদও দাঁড়িয়ে থাকল।
নবকুমার বলল, “বাসুদাকে আমি চিনি। কুটুম মানুষ। তবে তার সঙ্গে আমার এমনিতে কোনও যোগাযোগ নেই। ন’মাসে ছ’মাসে ট্রামে বাসে পথেঘাটে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। এমনি কথা হয় দু-চারটে।… আমি তো জানি বাসুদা বেলেঘাটা না ওদিকে কোথাও থাকে।”
“কী করে?”
“ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করত শুনেছি। আর তো কিছু জানি না।”
কিকিরা তারাপদর দিকে তাকালেন। “তুমি চান করতে যাও। পারলে এক কাপ চায়ের কথা বলে যেও। আমি নবকুমারের সঙ্গে দুটো কথা বলে নিই।”
“তা বলুন। তবে ওই বাসুদেবকে কোথায় পেলেন আপনি?”
“ছকু।…তোমরা চলে আসার পর ছকু এসেছিল। তার কাছে শুনলাম। কৃষ্ণকান্তবাবুর দেখাশোনার দায়িত্ব এখন তার হাতে। মানে, চৌধুরীমশাইকে সে বড় বড় ডাক্তারবদ্যির কাছে নিয়ে যাচ্ছে।”
“ও! কনট্যাক্ট ম্যান…!” তারাপদ আর দাঁড়াল না। স্নানে চলে গেল।
কিকিরা নবকুমারকে বসতে বললেন।
বসল নবকুমার।
“বাসুদেবের বয়েস কত?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।
“ক-ত! আমার চেয়ে বড়। ত্রিশ-বত্রিশ বছর হবে।”
“কেমন মানুষ? দাদার সঙ্গে সম্পর্ক কেমন?”
নবকুমার বিপদে পড়ে গেল যেন। সে নিজেই কত দিন-বছর হল নুরপুরে যায় না। দিদিরা অন্য জায়গায় থাকে, তবু বাড়িতে গেলে হয়তো দিদির কথা শুনতে পেত। দিদির সঙ্গেও দেখা নেই। ওদের সংসারের খোঁজখবরও রাখে না। তবে দুই ভাইয়ের মধ্যে মাখামাখি বেশি নেই, সেটা জানে।
কিকিরা অপেক্ষা করছেন দেখে নবকুমার আরও অস্বস্তি বোধ করছিল। বলল, “আমি ঠিক জানি না। তবে বাসুদা শুনেছি বেশিদিন কোথাও কাজ করতে পারে না। ঘন ঘন কোম্পানি পালটায়।”
“ফ্যামিলি নিয়ে থাকে?”
“না। বিয়ে-থা করেছে বলে জানি না।”
“তোমার সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয়েছে?” নবকুমার মনে করার চেষ্টা করল। দু’-চার মাসের মধ্যে তো নয়ই। প্রায় আচমকা মনে পড়ল, আরে–এই তো সেদিন–শীতের শেষাশেষি ম্যাডান স্ট্রিটের একটা ইলেকট্রিকের দোকানের সামনে দেখা। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কাকে খুঁজছিল। নবকুমারকে দেখতে পেয়ে ডাকল। দু-একটা কথার পরই বলল, তোর কাছে শ’ দুই তিন টাকা আছে? দে তো! একজনের আসার কথা, আসছে না এখনও, দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার। দু দিন পরে ফেরত দিয়ে আসব তোকে!
নবকুমারের কাছে তখন বাড়তি টাকা শ’খানেক ছিল। বলল, “দু-তিনশো টাকা নেই।”
বাসুদা কেমন বিরক্তির মুখ করল। “পকেটে দু-তিনশো টাকাও থাকে না? ফাঁকা! তোর দোকান চলে কেমন করে! রাবিশ।”
নবকুমারের গায়ে লাগেনি কথাটা। বাসুদাকে সে যতটা দেখেছে তাতে জানে, চালিয়াতি করার, অন্যকে উপেক্ষা করার, ছোট করার অভ্যেস তার আছে। বোধহয় মিথ্যেবাদীও।
“মনে পড়ছে না?” কিকিরা বললেন।
নবকুমার ঘটনাটা সংক্ষেপে বলল। অবশ্য এমনভাবে বলল, যেন, বাসুদেবের কথায় সে বিশেষ কিছু মনে করেনি।
“তোমার দোকান, বাড়ি ও চেনে?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।
“দোকানটা দেখেছে।”
বোর্ডিংয়ের একটা ছেলে এসে চা দিয়ে গেল কিকিরাকে।
চায়ে চুমুক দিয়ে কিকিরা বললেন, “বাসুদেবকে এর মধ্যে তুমি আর দেখোনি?”
“না।”
“আচ্ছা–এত লোক থাকতে তোমার জেঠামশাই এবার হঠাৎ বাসুদেব মানে জামাইয়ের ভাইয়ের ওপর ভরসা করলেন কেন?”
“আমি জানি না। বাসুদার ওপর ভরসা করেছিলেন তাও বা জানব কেমন করে। আপনি বলছেন বলে শুনছি।”
কিকিরা মাথা নাড়লেন।
তারাপদ ফিরে এল। স্নান শেষ! মাথা মুছছে তখনও।
“চা খেয়েছেন? তা এত বেলায় আরও কোথাও যাবেন নাকি?”
“না।“
“কেসটা ভাল বুঝলাম না।”
“বোঝার মতন হয়নি এখনও। সময়ে বুঝবে। আমি চলি। তুমি আজ আমায় সন্ধেবেলায় বাড়িতে পাবে না। কাল পাবে।” কিকিরা উঠে পড়লেন।
“চাঁদুকে কিছু বলার আছে?”
“না। কাল তোমরা দেখা কোরো।”
“অপারেশন কৃষ্ণটা কবে হবে সার?”
“পরশু বা তরশু।”
“পাঁজিতে ভাল দিন আছে?” তারাপদ ঠাট্টার গলায় বলল।
“দেখে নিও। আমি চলি৷”
কিকিরা চলে গেলেন।
নবকুমার বোকার মতন বসে থাকল। দেওয়ালে টাঙানো আয়নায় মুখ মাথা দেখতে দেখতে চুল আঁচড়াচ্ছিল তারাপদ।
“তারাপদদা?”
“বলো?”
“বাসুদার কথা উনি তুললেন কেন আমি বুঝতে পারছি না।”
তারাপদ বলল, “তোমায় বুঝতে হবে না। কিকিরা বরাবরই মিস্টিরিয়াস। অপেক্ষা করো, বুঝতে পারবে।”
কবিরাজমশাইকে পাওয়া গেল।
কাছাকাছি কোথাও ঘুরতে গিয়েছিলেন। বিকেলের পর খানিকটা হাঁটাচলা না। করলে এই বয়েসে শরীর টেকে না।
বাড়ির সামনে আসতেই কিকিরাকে দেখতে পেলেন।
আজ বাতাস রয়েছে বিকেল থেকেই। এলোমেলো। মাঝে মাঝে ধুলো উড়ছে। ঝড় উঠবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। উঠলেও কালবৈশাখীর আশা নেই, দু-একবার দমকা ঘূর্ণি উঠেই থেমে যাবে হয়তো।
“আপনি?” কবিরাজ চিনতে পারলেন কিকিরাকে। “সাঁইবাবু না?”
কিকিরা হাসলেন। “বালাই বড় দায়।”
“কেন, কী হল?”
“আমার সেই বুক জ্বালার ওষুধটা আরও দিনতিনেকের মতন ছিল, কিন্তু নিজের দোষে হাত থেকে পড়ে একেবারে ময়লার মধ্যে। এদিকে আজ কষ্টটা বড় বেড়েছে।… এদিকেই একটা কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম যদি একবার আপনার দেখা পাই!”
“কেমন জ্বালা? গলার কাছে, না অন্ত্রে?” চন্দ্রকান্ত কবিরাজ বললেন।
“পেটে।”
“আসুন, দেখি।”
কবিরাজমশাইয়ের বাড়ির সদর বন্ধ ছিল। কড়া নাড়ার পর একটি ছোট মেয়ে এসে খুলে দিল।
নিজের ঘরটিতে ঢুকে আলো জ্বাললেন কবিরাজ।
“বসুন।”
কিকিরা বসলেন। “কোথাও গিয়েছিলেন?”
“না, বিকেলে একটু পায়চারি করার অভ্যেস। আর মশাই পথে বেরুলে চেনাশোনা লোক, পাড়াপড়শির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। দুটো গল্পগাছা..।” বলতে বলতে ঘরের পেছন দিকে রাখা পুরনো আলমারির পাল্লা খুললেন।
আলমারির গোটাদুয়েক কাচ ফাটা। ভাঙা কাঁচে কাগজের তাপ্লি। ভেতরে পাঁচ-সাতটা ওষুধের শিশি বোতল। কাঁচের বয়াম।
কবিরাজমশাই ওষুধ খুঁজতে খুঁজতে বললেন, “আমাদের অসুবিধে কী তা জানেন! এ তো এলাপ্যাথি হোমিওটোমিও নয়, চাইলেই দু’-এক শিশি বার করে দেব! বড়িও নয়। কারখানার জিনিস নয়, মশাই। আমাদের হল গাছগাছড়া খুঁজেপেতে নিজের হাতে তৈরি। সময় লাগে। দেখি কী পাই।”
কিকিরা বসে থাকলেন। লাটুকে তুলে নিয়ে এসেছেন দোকান থেকে। তাঁর উদ্দেশ্য ওষুধ নয়।
“আপনার তেলটা আমার বড় উপকারে লেগেছে।”
“সুনিদ্রা হচ্ছে।”
“ভালই হচ্ছে।”
“আর ওই ক্ষুধাবৃদ্ধির চূর্ণটা?”
“বোধহয় ধাতে লেগেছে…”
কবিরাজমশাই হাতড়া-হাতড়ি করে পেলেন কিছু।
বসলেন।
“আপাতত এটা দিচ্ছি। জ্বালার উপশম হবে। দুটি করে বটিকা দিনে তিনবার, সামান্য দুধ দিয়ে খাবেন। চামচ পরিমাণ। মধু দিয়ে খাবেন না। দুধের বদলে জল হতে পারে।…ভাল কথা, অল্প কিছু খাবেন না। দধিও নয়।”
ওষুধের বড়ি নিয়ে কিকিরা পঞ্চাশ টাকার একটি নোট সামনে এগিয়ে দিলেন।
কবিরাজমশাই টাকাটা নিয়ে নিলেন।
“আপনার কথা আমি অন্য দু-একজনকে বলেছি। তারাও হয়তো আসবে।”
কবিরাজ বললেন, “কথায় বলে গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। আমরা তো এখন বাতিল। দু’-একটা অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদ খসড়া করে রাখলেই কি চলে মশাই? চলে না। অথচ দেখুন বাজারে হঠাৎ ভেষজ ভেষজ রব উঠেছে কেমন। কত কোম্পানি। লাখ লাখ টাকা ঢালছে! কোটির হিসেবে ব্যবসা। আমরা আর কী করতে পারলাম।”
কিকিরা কথা পালটালেন। “একটা কথা মনে পড়ল।”
“কী?”
“তেমন জরুরি ব্যপার নয়।…আচ্ছা, আপনার প্রতিবেশী কৃষ্ণকান্তবাবুর এক আত্মীয়কে আমি চিনতাম। সেদিন আপনার কাছ থেকে ফেরার সময় তাকে দেখলাম ওই বাড়ির সামনে। আমায় চিনতে পারল না।”
“কে বলুন তো?”
“নামটা মনে হচ্ছে বাসুদেব।”
“বাসুদেব। বাসুদেব পাঁজা!”
“চেনেন?”
“মুখে চিনি। তবে আমার সঙ্গীটি, ওই যে বিপিন সাধু, যে দাবা খেলতে আসে চৌধুরীমশাইয়ের বাড়ি থেকে, কর্মচারী ওই বাড়ির, তার মুখে ওর কথা শুনেছি। ওকে আপনি চিনলেন কেমন করে! শুনেছি, ছোকরার স্বভাব মন্দ, ধাপ্পাবাজ, বড় বড় কথা বলে। দু’ নম্বর তিন নম্বরি কারবার… ও বাড়ির লোকই নিন্দে করে ছোকরার।”
“মানে, লেজ গজিয়েছে এখানে থাকতে থাকতে, তাই আমাদের আর চিনতে পারল না।”
“দুর্জন না চিনলেই ভাল।”
“ও কি ওই বাড়িতেই থাকে!”
“না। ওবাড়িতে থাকে না। বেলেঘাটায় থাকে।” বলে একটু ভেবে একটা পাড়ার নাম বললেন। “তবে এবাড়িতেও আড্ডা গাড়ে মাঝে মাঝে।”
কিকিরা আর বসলেন না। তাঁর যা জানার ছিল জানা হয়ে গিয়েছে।
হয়তো এতটা জানতে পারবেন, আশা করেননি।
“আজ আমি চলি কবিরাজমশাই, আবার আসব।”
চলে এলেন কিকিরা।
.
লাটুর কাছে এসে শুনলেন, একটা ছোকরা এইমাত্র ট্যাক্সি করে এসে কৃষ্ণকান্তবাবুদের বাড়ি ঢুকল। আগের দিনও দেখেছে একে।
.
০৯.
কৃষ্ণকান্ত দরজার দিকে ঘাড় ঘোরালেন। পায়ের শব্দ পেয়েছিলেন তিনি।
“ও, আপনি?”
কিকিরা নমস্কার করলেন। আগের দিনের মতনই সন্ন্যাসীর বেশ। মাথায় গেরুয়া টুপি। চোখে চশমা। গলায় ছোট চাদর, রুদ্রাক্ষের মালা।
“আপনাদের যে তর সইছে না, মশাই।” কৃষ্ণকান্ত শ্লেষের গলায় হয়তো নয়, কিন্তু বিরক্তির সঙ্গে বললেন। বসতেও ইশারা করলেন না।
কিকিরা বিনীতভাবে বললেন, “আপনি কয়েকদিন পরই আসতে বলেছিলেন। কলকাতায় থাকবেন না, দেশে ফিরে যাবেন জানিয়েছিলেন।”
“ঠিক আছে।…আমি মুনশিবাবুকে বলে যাব। পরে এসে শ’ পাঁচেক টাকা নিয়ে যাবেন। পাকা রসিদ দেবেন।”
“পাঁচ শো!”
“কেন! কম হল!” কৃষ্ণকান্ত এবার বিদ্রূপ করেই বললেন, “চাইছেন ভিক্ষে, তাও আবার মন উঠছে না।”
কিকিরা হাসির মুখ করলেন। “আজ্ঞে, মানুষের স্বভাবই এই রকম। যা পায় তাতে মন ওঠে না। আদ্যিকালের কথাই ধরুন। মহাভারত তো পড়েছেন। দুর্যোধনের কি কম ছিল? কুরুবংশ…”
কৃষ্ণকান্ত ধমকের গলায় চুপ করিয়ে দিলেন কিকিরাকে। “জ্ঞান দিতে এসেছেন আমাকে? কোথাকার সাধু, এসেছেন ভিক্ষে চাইতে, বড় বড় কথা বলছেন?”
“বড় কথা কেন হবে চৌধুরীমশাই, মানুষের স্বভাবের কথা। এই সংসারে সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি–! আপনি নিজেও কি তার বাইরে?”
কৃষ্ণকান্ত থমকে গেলেন। দেখলেন কিকিরাকে। “মানে?”
কিকিরা হাসি হাসি মুখেই বললেন, “মানেটা আপনি যথেষ্ট বোঝেন। নুরপুরের রাজত্ব একাই আপনি ভোগ করে যাচ্ছেন কেন? কোন অধিকারে? রজনীকান্তবাবুর?…”
কৃষ্ণকান্ত চমকে উঠলেন। সোজা হয়ে বসলেন আর্মচেয়ারে। তীক্ষ্ণ চোখে দেখলেন কিকিরাকে। “আপনি কে?”
“আমি কে জানার আগে আপনি নিজেই বলুন আপনার অধিকার কতটা সঙ্গত?” বলতে বলতে কিকিরা হঠাৎ শূন্যে হাত বাড়িয়ে একটা ছোট্ট ঘন্টি বার করলেন। ঠাকুরপুজোর সময় বাড়িতে যেমন ঘন্টি বাজায়। ঘন্টিটা বাজালেন। অদ্ভুত শোনাল টুংটুং শব্দটা।
কৃষ্ণকান্ত চমকে উঠলেন। অত্যন্ত অপ্রসন্ন ও উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। তবু কী মনে করে হাত নেড়ে কাছে ডাকলেন কিকিরাকে। সন্দেহের গলায় বললেন, “আপনি সেই চোর নচ্ছার ছেলেটার টাকা-খাওয়া লোক নাকি!..ঘন্টি বাজিয়ে আমায় ভয় দেখাচ্ছেন!”
“যা ভাবেন।”
“তাহলে শুনুন, আমার ছোট ভাই রজনীকান্ত–একটা ছেলেকে নিজের কাছে রেখে লালন করেছিল মাত্র। গোরু-ভেড়া বামুন চাকর-যাকে ইচ্ছে পালন করা যায়। অনাথ অবোধকে এভাবে অনেকেই পালন করে। তাকে আইনত দত্তক নেয়নি। অন্তত সে রকম কোনও প্রমাণ নেই। আপনার মক্কেল কোর্ট কাছারি করেছিল। হেরে গিয়েছে। আপনি কি বলতে চান একটা রাস্তার ছেলেকে আমি চৌধুরীবংশের অন্দরমহলে ঢুকিয়ে নেব, তাকে উত্তরাধিকার দেব, মেনে নেব? না। আমি বেঁচে থাকতে তা হবে না।”
কিকিরা বললেন, “তাহলে আপনি তাকে কয়েক লাখ টাকা দিতে চেয়েছিলেন কেন? দয়া করে?”
“হ্যাঁ। দয়া করে।..বছরের পর বছর সে আমায় চিঠি লিখে লিখে উত্যক্ত করত। তার চিঠির বয়ান ছিল ইতরের মতন। আমার স্ত্রী, জামাই, মেয়ে, সকলেই সেটা জানে।…আপনি নিজেই জানেন আমি অসুস্থ। বয়েস হয়েছে। এই অসুখ সারার নয়। কবে কী হয়ে যায় ভেবে আমি ওকে কিছু টাকা দিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিতে চেয়েছিলাম–যাতে ভবিষ্যতে আর না গণ্ডগোল করে।”
“মানে, আপনি ওকে টাকা দিয়ে বরাবরের মতন মিটমাটের একটা চুক্তি সই করে নিতে চেয়েছিলেন।”
“হ্যাঁ।”
“প্রথম কিস্তির টাকাটা তো ও পায়নি।”
“পেয়েছে। টাকা নিয়ে ও পালিয়েছে।”
“কেমন করে আপনি জানলেন? ও যখন এই ঘরে আসে–আপনি আর্মচেয়ারে শুয়ে, মাথা ঘাড় হেলিয়ে মরা মানুষের মতন অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আপনার গলায় চাদর জড়ানো। ও ভয় পেয়ে বোকার মতন পালিয়ে যায়।”
কৃষ্ণকান্ত প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। “মিথ্যে কথা। আমাকে ওই অবস্থায় দেখে টাকা নিয়েই ও পালিয়েছে..” বলে গলা তুলে ডাকলেন, “কে আছে রে বাইরে, মুনশিকে ডেকে দে।”
কিকিরা ইতস্তত করলেন। মুনশি কি দেখেছে নবকুমারকে। কিন্তু তা কেমন করে হবে?
হঠাৎ কী মনে করে কিকিরা বললেন, “চৌধুরীমশাই, একটা কথা আপনাকে বলি। আজ এই বাড়ির বাইরে আমাদের লোকজন আছে। নজর রাখছে। নবকুমারও আছে। যদি বলেন তাকেও ডাকাতে পারি।”
কৃষ্ণকান্ত খেপাটে গলায় বললেন, “চুপ করুন। আমাকে ভয় দেখাবেন না। চোরের হয়ে আমায় শাসাতে এসেছেন!” বলতে বলতে গলা কর্কশ হয়ে এল। অভ্যাসবশে পানের ডিবে খুলে একটা পান নিলেন। পানের ওপরে ভিজে কাপড়ের টুকরো! জরদার কৌটো সামনেই।
মুনশি এল।
বছর পঞ্চাশ বয়েস। দোহারা গড়ন। পরনে ধুতি আর বড় ফতুয়া। চোখের চশমা হাতে।
কাছে এসে মুনশি আড়ষ্ট গলায় বলল, “বাবু!”
“মুনশি! সেদিন, ওই ছোঁড়াটাকে টাকা দেব বলে আগেরদিন আমার দোতলার ঘরে, তুমি আমার চোখের সামনে গুনে আড়াই লাখ নগদ টাকা অ্যাটাচিতে রাখলে না?”
“হ্যাঁ, বাবু। রেখেছি।”
“টাকার অ্যাটাচিটা চেস্টে রাখা হল। পরের দিন বিকেলে আমি যখন এ ঘরে এলাম, চেস্ট খুলে টাকার ব্যাগটা তুমি আমার হাতে দিলে।”
“দিয়েছি বাবু।”
“শুনুন মশাই-” “কিকিরাকে বললেন কৃষ্ণকান্ত, “আপনি নিজের হাতে ওই টাকা এনে এখানে রেখেছি। এই টেবিলে। আমাদের কুলদেবতা চণ্ডীর নামে শপথ!…আর কিছু বলতে চান?”
কিকিরা কথাটা অস্বীকার করলেন না। নবকুমার টেবিলের ওপর রাখা অ্যাটাচি দেখেছে। “টাকাটা–ওই অ্যাটাচি গেল কোথায়?”
“কোথায় গেল! আপনার মক্কেল জানে না? চুরি করেছে।”
“তাহলে তো আপনার থানা-পুলিশ করা উচিত ছিল। কেন করেননি?..না করে লোক পাঠিয়ে নবকুমারকে ভয় দেখিয়েছেন! অ্যাটেম্পট টু মার্ডার, আর চুরি।”
কৃষ্ণকান্ত মুখ মুছে নিলেন চাদরে। পাখাটা জোরেই চলছিল। ঘরের আলো অতটা উজ্জ্বল নয়। কৃষ্ণকান্তর যেন দম ফুরিয়ে আসছিল। গলা ভেঙে আসছে। বললেন, “পারতাম। কেন করিনি জানেন?”
“কেন?”
“কুমারকে ঘরে ঢুকতে বা বেরিয়ে যেতে আমি দেখিনি। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম অঘোরে। যেমন হয় আমার হঠাৎ হঠাৎ.. প্রমাণ ছিল না যে!..তা ছাড়া দ্বিতীয় কারণ, আপনি বুঝতে পারবেন না ঠিক। চৌধুরীবংশে, কোর্ট কাছারি, মামলা মোকদ্দমা অনেক হয়েছে। তাতে আমাদের লজ্জা নেই। ওটা আভিজাত্যের লক্ষণ। তা বলে ঘরের কেচ্ছার জন্যে থানা-পুলিশ আমরা করি না।”
কিকিরা অবাক হয়ে গেলেন। অদ্ভুত তো!
“কিন্তু টাকা সে নেয়নি,” কিকিরা বললেন। বলে দরজার কাছে গিয়ে ডাকলেন–”ছকু।” আসলে ঘন্টি বাজার সঙ্গে সঙ্গে ছকু তৈরি ছিল।
কোথায় কোন আড়ালে লুকিয়ে ছিল ছকু চোরের মতন, হাজির হয়ে গেল।
কিকিরা বললেন, “নবকুমারকে ডাকো। ওদেরও আসতে বলতে পারো।”
কৃষ্ণকান্ত মুনশিকে জল আনাতে বললেন। তাঁর গলা শুকিয়ে গিয়েছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। মুনশি চলে গেল।
কিকিরা বললেন, “টাকাটা আর কে নিতে পারে বলে আপনি সন্দেহ করেন?”
“জানি না।”
“আপনার কর্মচারীদের কেউ?”
“না।”
“বাসুদেব?”
“বাসুদেব! সে তখন কোথায়?”
“এ বাড়িতে ছিল না?”
“না।”
“আপনি তার ওপর ভরসা করে এখানে ডাক্তার দেখাতে এসেছিলেন কেন?”
“আমি যখনই কলকাতায় আসি, কাউকে না কাউকে দেখাই। লাভ কিছুই হয় না। এবারে ও নিজেই…”
মুনশি জল নিয়ে এল।
কৃষ্ণকান্ত জল খেলেন। স্বস্তি পেলেন যেন।
এমন সময় ছকু ঘরে এল, সঙ্গে নবকুমার।
কৃষ্ণকান্ত দেখলেন নবকুমারকে। “তুমি এইসব দলটল জোগাড় করেছ! আমায় অপদস্থ করতে চাও?”
“আমি টাকা নিইনি।” নবকুমার বলল।
কৃষ্ণকান্ত হঠাৎ উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সকলকে চমকে দিয়ে প্রাণপণে এক চড় মারলেন নবকুমারের গালে। “স্কাউন্ড্রেল। লায়ার। চোর।” কাঁপতে কাঁপতে আবার তিনি বসে পড়লেন আর্মচেয়ারে। হাঁফাচ্ছিলেন। ঘামছেন দরদর করে।
হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কিকিরা। অন্যরাও বিমূঢ়। নবকুমার মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে।
মুনশি হঠাৎ বলল, “বাবু, বাসুবাবুকে ডাকব?”
“কোথায় সে?”
“ওপরে। সামান্য আগে এসেছেন।”
“ডাকো।”
মুনশি বাসুদেবকে ডাকতে গেল।
কিকিরা কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন কৃষ্ণকান্তকে। বললেন না। ভদ্রলোকের মানসিক উত্তেজনা তাঁকে যেন ক্ষিপ্ত করেছে।
স্তব্ধ ঘরে যে যার মতন দাঁড়িয়ে। কৃষ্ণকান্ত চোখের পাতা বুজে ফেলেছেন। ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?
না।
বাসুদেব ঘরে এল৷ সঙ্গে মুনশি। এমনভাবে এল বাসুদেব যেন সে জানতে এসেছে, ঘরে এরা কারা, বেপরোয়া রূঢ় গলায় বলল, “কে? আপনারা কারা? এখানে কেন?”
কৃষ্ণকান্ত চোখ খুললেন। কিকিরা যে কখন আলখাল্লার পকেট থেকে একটা ভয়ংকর বস্তু বার করেছেন, কেউ দেখতে পায়নি। এগিয়ে গিয়ে ছকুর হাতে গুঁজে দিলেন, নজরে পড়ল না কারুর।
বাসুদেব হাত তুলে ঘরের দরজা দেখাল। “বেরিয়ে যান। ভদ্রলোকের বাড়িতে ঢুকে গুণ্ডামি?”
ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই ছকু অদ্ভুত কায়দায় বাসুদেবের গলা চেপে ধরল। একটা হাত তার গলায় পেঁচিয়ে আছে, অন্য হাতে সরু পাতলা অস্ত্র। সাইকেলের চাকার স্পোকের মতন সরু। কিন্তু অতি তীক্ষ্ণ, ধারালো।
বাসুদের নড়তে পারল না। অস্ত্রের সূক্ষ্ম মুখটা তার গলায় লাগছে। সামান্য নড়লেই গেঁথে যাবে।
কিকিরা দু পা এগিয়ে গেলেন। “টাকাটা কোথায়?”
“টাকা!”
“আড়াই লাখ টাকা! কোথায় টাকা?”
“আমি কী জানি! কী যা-তা বলছেন?”
“ছকু!”
ছকু হাতের অস্ত্রটা প্রায় গলায় চামড়ার সঙ্গে ছুঁইয়ে ঈষৎ চাপ দিল।
“আমি জানি না।”
কিকিরা বললেন, “আমাদের সঙ্গে পুলিশ আছে। স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ। ডাকব?” বাসুদেবকে ভয় দেখাবার জন্যে ধাপ্পা দিলেন কিকিরা। ঠাট্টার গলায় বললেন, “উর্দিপরা নয়, প্লেন ড্রেস! ডাকব?”।
ছকু এবার হাতের অস্ত্রটা বাসুদেবের থুতনির তলায় এমনভাবে চেপে ধরল যে, সামান্য নড়াচড়া করলেই গলায় বিধে যাবে ধারালো মুখটা।
কিকিরা মনে মনে ঠিক করে নিয়েছেন, চন্দনকেই পুলিশের অফিসার বলে চালাবেন। প্লেন ড্রেস অফিসার তো! মানিয়ে যাবে। চন্দনের চেহারা ভাল, ডাক্তারি করতে করতে দিব্যি গাম্ভীর্যও রপ্ত করে ফেলেছে।
ছকু যেন সাঁড়াশির মতন আঁকড়ে ধরেছে গলাটা। বাসুদেবের নিশ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।
বাসুদেব কোনওরকমে বলল, “বলছি। আমার গলা ছেড়ে দিন। জিভ বেরিয়ে আসছে।” ঘামে ভয়ে তার মুখ অস্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। চোখ লালচে হয়ে উঠেছে।
কিকিরার ইশারায় গলার কাছ থেকে হাত সামান্য সরিয়ে নিল ছকু।
বাসুদেব শ্বাস নিল। তারপর বাইরের দিকে হাত দেখাল। “বাইরে জলের রিজার্ভারের মধ্যে মোটা পলিথিন শিট জড়িয়ে অ্যাটাচিটা ফেলে রেখেছি।”
“নিয়ে যাওনি?”
“না। পারিনি। এখন ওই টাকা নিয়ে গোলমাল চলছে এবাড়িতে। পরে নিয়ে যেতাম।” বলে কৃষ্ণকান্তকে দেখাল। “উনি এখান থেকে চলে যাওয়ার পর।”
“টাকা তুমি নিয়েছ?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু তুমি তো শুনলাম এ-বাড়িতে ছিলে না তখন?”
মুনশি হঠাৎ বলল, নিজের থেকেই, “কর্তাবাবু জানেন না। বাসুবাবু আগের দিন ছিলেন। রাত পর্যন্ত। পরের দিনও দুপুরে এসেছিলেন লুকিয়ে। আমি জানি।”।
“বাসুদেববাবু কেমন করে জানবে টাকা দেওয়ার কথা? কে বলেছে যে, কুমারকে টাকা দেওয়া হবে?”
মুনশি বলল, “আজ্ঞে, এসব কথা বাসুবাবুর না জানার কথা নয়। কর্তামশাই নিজেই বলেছেন। তবে টাকা দেওয়ার কথাই। কবে কখন তা কি বলেছেন!”
কৃষ্ণকান্ত এতক্ষণ কোনও কথা বলেননি। কাণ্ডকারখানা দেখছিলেন কিকিরাদের। কথা শুনছিলেন। এবার বিরক্তির গলায় বললেন, “হ্যাঁ, বলেছি। বলব না কেন? দোষটা কোথায়! টাকাপয়সা জড়ো করা হচ্ছে নগদ, ও জানতে পারবে। একথাও বলেছি, আমি বুড়ো হয়ে গিয়েছি। অসুখটাও এখন পাকাপাকি জড়িয়ে ধরেছে। ডাক্তারদের ওপর আর ভরসা করা যাচ্ছে না। কবে কী হয় কে জানে! তা আমি চাই না, আমাদের বাড়ির এই ঝামেলা টিকে থাকুক। আমি মারা যাওয়ার পর কুমার আমার স্ত্রীকে জ্বালিয়ে মারবে! তার চেয়ে ওকে কিছু দিয়ে-থুয়ে বরাবরের মতন ঝঞ্জাটটা চুকিয়ে দেওয়া ভাল।”
কিকিরা বললেন, “তাহলে তো সবই জানিয়ে দিয়েছিলেন আপনি।”
“না”, মাথা নাড়লেন কৃষ্ণকান্ত। “কত টাকা দেব এখন তা হয়তো বলেছি কথায় কথায়। তবে কোনদিন কখন, তা বলিনি। টাকার ব্যবস্থা করে যেদিন মুনশি আর আমি গোনাগুনি করছিলাম, সেদিন বাসুদেবকে দেখিনি। আমাদের কাজকর্ম হচ্ছিল ঘরের দরজা বন্ধ করে রাত্তিরবেলায়। ও তখন কোথায়?”
মুনশি ঘাড় নাড়ল। আবার বলল, “কতামশাই জানেন না। আগে যা বলেছি। আমি–সেটাই ঠিক। বাসুবাবু সেদিন এ বাড়িতে অনেকটা রাত পর্যন্ত ছিলেন। হয়তো আঁচ করতে পেরেছিলেন আমরা কী নিয়ে ব্যস্ত থাকব।”
“কিন্তু সে ছিল কোথায়, মুনশি?” কৃষ্ণকান্ত বললেন।
“এ বাড়িতে লুকিয়ে থাকার জায়গার অভাব কোথায় কর্তাবাবু!” মুনশি বলল। “আমিও তো আগে ওঁকে দেখিনি। পরে দেখলাম। দোতলায় ঠাকুরঘরের পাশে কোঠাটায় ছিলেন। পরে চলে গেলেন।”
“আমি তো জানি না।” কৃষ্ণকান্ত বললেন।
কিকিরা সামান্য হেসে বললেন, “আপনার চোখ কতটা আর দেখতে পারে! বাসুদেব অনেক চালাক। বাহাদুরিও আছে। ও সবই নজরে রেখেছিল।…কী বলো বাসুদেব?”
কেমন হতাশ ভেঙে পড়া গলায় বাসুদেব বলল, “আমি কিন্তু একটা কথা জানতাম না। ভাবতেও পারিনি।”
“কী কথা?”
“টাকা নিতে এসে কুমার দেখবে, উনি–মানে চৌধুরীমশাই ঘুমিয়ে পড়েছেন। আর ও চলে যাবে। ভয়ে কুমার পালিয়ে গেল–আমি দেখেছি। ওই জানলার ওপাশে আমি সব দেখছিলাম লুকিয়ে।”
“ও।”
“অ্যাটাচি সরাবার সুযোগটা হঠাৎ এসে গেল আমার।”
“না এলে কী করতে?”
“না এলেই বরং ভাল হত। ও যদি টাকার অ্যাটাচি নিয়ে বাড়ির বাইরে চলে যেত-বেশিদূর যেতে পারত না। আমার লোক ছিল বাইরে, মোটরবাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। টাকা ছিনতাই হয়ে যেত।”
সামান্য চুপ করে থেকে কিকিরা বললেন, “তোমার এত টাকার দরকার হবে কেন? তুমি কি চোর, ডাকাত, গুণ্ডা?”
বাসুদেব মাথা নিচু করে বলল, “যা ভাবেন আপনারা। তবে একটা কথা বলি দুটো কোম্পানি। যেখানে আমি কাজ করেছি আগে, কোথাও মাসআষ্টেক, কোথাও বছরখানেক–আমার নামে কোর্টে মামলা করেছে। হিসেবের গোলমাল, টাকা চুরি, ফোরজারি। আমায় তাড়িয়ে দিয়েছে ওরা। প্রায় আশি-পঁচাশি হাজার টাকা দিতে পারলে নিস্তার পাব। টাকার আমার দরকার ছিল।”
কৃষ্ণকান্ত সোজা হয়ে বসতে যাচ্ছিলেন, পারলেন না। হঠাৎ পেছনদিকে পিঠ হেলিয়ে শুয়ে পড়লেন। চোখের পাতা বুজে গেল। হাত এলিয়ে পড়ল দু পাশে।
তারাপদরা সবাই ততক্ষণে ঘরের মধ্যে এসে পড়েছে।
কয়েক মুহূর্ত সব কেমন নিঃশব্দ। থমথম করে উঠল ঘরের আবহাওয়া। তারপরই হঠাৎ নবকুমার ছুটে গিয়ে কৃষ্ণকান্তর মুখের সামনে ঝুঁকে পড়ল। “জেঠামশাই?”
কৃষ্ণকান্ত সাড়া দিলেন না। তাঁর চোখের পাতা কেমন বিষণ্ণ, মলিন, সামান্য আর্দ্র দেখাচ্ছিল।