হলুদ পালক বাঁধা তীর

হলুদ পালক বাঁধা তীর

০১.

সিঁড়িতেই দেখা। তারাপদরা নেমে যাচ্ছিল, কিকিরা উঠে আসছিলেন। সিঁড়িতে যেটুকু আলো তার চেয়েও বেশি অন্ধকার। দু-চারটে ইঁদুরও এই ভাঙাচোরা অন্ধকার সিঁড়িতে দিব্যি ছুটোছুটি করে বেড়ায় রাত্রের দিকে।

মুখোমুখি হতেই তারাপদ বিরক্তির গলায় বলল, “বাঃ, বেশ তো আপনি। আমরা দু’দিন হল আসছি আর ফিরে যাচ্ছি। কোথায় যান আপনি, কিকিরা?”

কিকিরা বললেন, “কে তোমাদের ফিরে যেতে বলেছে? আগের দিন আমার রাত হয়েছিল ফিরতে। কাল আমি ফিরে এসে শুনলাম, তোমরা একটু আগেই চলে গিয়েছ। কেন, বগলা তোমাদের বলেনি–আজ আমি না-ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে?”

“বলেছিল। কিন্তু কত আর অপেক্ষা করব! চাঁদু কাল সকালের গাড়িতেই বাড়ি যাচ্ছে, ছুটি ম্যানেজ করেছে দিন সাতেকের। ওর কিছু কাজ আছে, তাড়াতাড়ি কোয়ার্টারে ফিরতে হবে।.. আমরা আরও আগে চলে যেতাম; নেহাত ঝড় উঠল বলে খানিকটা বসে গেলাম।”

কিকিরা বললেন, “আমারও তাই। ট্রাম থেকে নেমেই ঝড়ে আটকে গেলাম। একটা দোকানে মাথা বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম এতক্ষণ। নাও ওপরে চলো। চলো চাঁদু।”

সময়টা আষাঢ়। কালবৈশাখীর ঝড় ওঠার কথা নয় এখন, বৃষ্টি নেমে যাওয়া উচিত ছিল; কিন্তু দু-একদিন ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হলেও বর্ষা নামেনি আজও, উলটে আজ সন্ধের মুখে জোর ঝড় উঠল হঠাৎ, ঠিক যেন কালবৈশাখী। ঝড় উঠলেও বৃষ্টি হল না এদিকে। তবে হতে পারে আকাশে মেঘ ডাকছে, দু-এক ঝলক বাদলা বাতাসও দিচ্ছিল। দূরে কোথাও হয়ত বৃষ্টি নেমেছে।

ঘরে এসে কিকিরা চা করতে বললেন বগলাকে। তারপর জোব্বা জামার পকেট থেকে দু-একটা ছোট মতন খেলনা আর লুডো খেলার বোর্ডের মতন একটা বোর্ড বার করে রেখে দিলেন। বোর্ডের সঙ্গে কৌটোও ছিল। প্লাস্টিকের চৌকোনা কৌটো। গুটি আর ছক্কা ছিল কৌটোর মধ্যে।

“চাঁদু, তুমি বাড়ি থেকে ফিরবে কবে?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।

“পঁচিশ, ছাব্বিশ। পঁচিশ শনিবার পড়েছে। রবিবার বিকেলে ফিরলেই হবে।” চন্দন বলল।

“বাড়িতে মা বাবা…!”

“মা বাবা ভালই আছেন। আমার মাসি-মেসোমশাই এসেছেন লন্ডন থেকে। খানিক হইচই হবে বাড়িতে, তাই আর কী!”

“কী করেন মেসোমশাই?”

“মেসোমশাই কেমিক্যালের লোক। রিসার্চের কাজকর্ম করেন। মাসি চাকরি করেন ব্যাঙ্কে। মাসতুতো ভাই ইঞ্জিনিয়ার…।”

“বাঃ, বেশ! তা তুমি দিন সাতেকের মধ্যেই ফিরছ!”

“না ফিরে উপায় আছে! হাসপাতাল–!”

তারাপদ ততক্ষণে কিকিরার নামিয়ে রাখা খেলনাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করেছে। বলল, “এগুলো কী, স্যার? আপনি কি বাচ্চা হয়ে যাচ্ছেন নাকি? খেলনা কিসের?”

কিকিরা মজার মুখ করে হাসলেন। বললেন, “সেই গানটা শুনেছ?”

“কোন গান?”

“পুরনো গান। এককালে ঘরে-ঘরে গাইত। খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে…’। শোনোনি? কোথা থেকেই বা শুনবে! তোমরা তখন জন্মাওনি।”

“আপনি নিশ্চয় জন্মেছিলেন–?” তারাপদ মজা করে বলল।

“শিশু। চাইল্ড!” বলে কিকিরা ডান হাত মাটির দিকে নামিয়ে তখনকার বয়েসটা বোঝাবার চেষ্টা করলেন।

“ও! তা এখন কি খেলা করতে ইচ্ছে হল?”

“হল মানে, ধরে নিয়ে গেল খেলার জন্যে। বলল, পনেরো হাজার পর্যন্ত দিতে পারে। রাহা খরচ আলাদা। ফিজ দশ হাজার আপাতত। অবশ্য যদি কাজের কাজ হয়। নয়ত এই কাজটা হাতে নেওয়ার জন্যে মাত্র পাঁচ হাজার। তিন হাজার টাকা আগাম দিয়েছে।”

তারাপদরা কিছুই বুঝল না। তবে কিকিরার স্বভাবই এই রকম। গোড়ায় কিছু ভাঙেন না, রহস্য করেন। একটু একটু করে কৌতূহল বাড়ান। তারপর ধীরে ধীরে আসল কথাটা বলেন।

তারাপদ আর চন্দন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। যেন বলতে চাইল, ব্যাপারটা কী?

কিকিরা গায়ের জামাটা খুলে ফেলেছেন। কাছাকাছি জায়গা থেকে একটা ছোট মতন তোয়ালে উঠিয়ে নিয়ে মাথা-মুখ পরিষ্কার করে নিচ্ছিলেন। ধুলোবালি উড়েছিল ঝড়ে, মুখে-মাথায় কিরকির করছে। ওই অবস্থায় একটু গানও গেয়ে নিলেন বেসুরো গলায়, “খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে।

তারাপদ বলল, “বাঃ, ফাইন। বিরাট নয়, অবোধ শিশু! তা স্যার এবার একটু খোলসা করে বলুন তো ব্যাপারটা?”

কিকিরার কোনো তাড়া নেই। নিজের জায়গায় বসতে-বসতে হাই তুললেন ছোট করে, আলস্য ভাঙলেন হাত তুলে। বসতে বললেন তারাপদকে।

খেলনাগুলো রেখে দিয়ে তারাপদ লুডোর বোর্ডের মতন খেলার জিনিসটা খুলে দেখছিল। একটু অবাক হল, হাসিও পেল যেন, “স্যার, এ তো নতুন দেখছি! আগে দেখিনি।”

“আগে কী দেখেছ?”

“লুডো, সাপসিঁড়ি, ঘোড়দৌড়।”

“ওটা হল ক্যাট অ্যান্ড দি মাউস। বেড়াল-ইঁদুর খেলা। ইঁদুরগুলো ভয়ে মরে বেড়াল ছানা পাচ্ছে ধরে।” কিকিরা রসিকতা করে বললেন।

তারাপদ এমন খেলা আগে দেখেনি। তবে বোর্ডের ছবি দেখে অনুমান করেছিল, লুডো, সাপসিঁড়ি, ঘোড়দৌড়ের মতনই কিছু। দান ফেলে এগুতে হবে। মাঝে-মাঝে ইঁদুর। ইঁদুরের গর্ত। … তা সে পরে দেখা যাবে, আপাতত বোঝা যাচ্ছে না কিকিরার এই বয়েসে বেড়াল-ইঁদুর খেলার শখ হল কেন?

চা নিয়ে এল বগলা।

কিকিরা চা নিলেন। চন্দনও।

 তারাপদ এসে বসল একপাশে।

বগলা চলে গেল।

কিকিরা কয়েক চুমুক চা খেলেন। আরামের শব্দ করলেন। বললেন, “হাতে কাজকর্ম ছিল না অনেক দিন। মাস ছয়েক বেকার। নো মানি, নো ফান্ড। ডাল-ভাত জুটবে কোথ থেকে হে তারাবাবু। বাজারের যা হাল। একটা গন্ধ লেবুর দাম এখন দেড় টাকা, তা জানো?”

তারাপদ হেসে বলল, “আপনি জানেন?”

“জানি না! আমি তো তোমার মতন হোটেল বাবু নই, হ্যান্ড বার্নিং করে বেঁধে খেতে হয় স্যার!”

চন্দন জোরে হেসে উঠল। “আপনি হ্যান্ডকানিং করেন, না, বগলাদা করে?”

“বগলা ফিফটি আমি ফিফটি। সেদিন একটা নতুন আইটেম করেছিলাম, পারসি পকৌড়া। দুধ, ডিম, রুটির সাদা টুকরো, টম্যাটো সস, গাজর দিয়ে করতে হয়। তোমরা থাকলে খেতে পারতে।”

“কপালে ছিল না স্যার।”

“আর-একদিন করে খাওয়াব।”

“তা কেসটা এবার বলুন, তারাপদ বলল, “অনেকক্ষণ ধরে ঝোলাচ্ছেন?”

কিকিরা চা খেতে-খেতে বললেন, “লালাবাবুকে দেখেছ? আমার বন্ধু?”।

“না।” বলেই তারাপদ ভুল শুধরে নিল তাড়াতাড়ি, “সেই মণি লাল! তাঁকে দেখেছি। আলাপ হয়নি।”

চন্দন অবশ্য দেখেনি।

“লালাবাবু গত হপ্তায় এসেছিলেন। এসে বললেন, একটা ঘটনা ঘটেছে তাঁর আত্মীয়দের বাড়িতে। মিস্টিরিয়াস ব্যাপার। আমি যদি একবার দেখি…।”

“কেমন মিস্টিরিয়াস? খুন-জখম? চুরি? ভৌতিক কাণ্ডকারখানা? ব্ল্যাকমেইল?”

কিকিরা হাত বাড়ালেন। তাঁর সেই কড়ে আঙুল সাইজের কড়া চুরুট তিনি এখন খাবেন না, একটা সিগারেট চাইলেন।

চন্দন প্যাকেট এগিয়ে দিল সিগারেটের। দেশলাইবাক্সটাও।

 কিকিরা সিগারেট ধরালেন।

“আগে থেকে বলা যাবে না খুন-জখম, না, অন্য কিছু!, এখন পর্যন্ত কেউ মারা যায়নি। তবে মর-মর অবস্থা।“

“তার মানে?”

“মানে এক ভদ্রলোককে হয়ত খুন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তিনি এখনো মারা যাননি। মারা না গেলেও অবস্থাটা খুবই খারাপ। ভদ্রলোক পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছেন। কথা বলতে পারেন না, মানুষ চিনতে পারেন না, মাঝে-মাঝে হাত-পা একটু কাঁপে বটে কিন্তু নিজের থেকে হাত-পা নাড়াবার ক্ষমতাও তাঁর নেই। ডাক্তাররা বলছেন, জোর সেরিব্রাল স্ট্রোক। স্ট্রোক হলে যেমন হয় সচরাচর সেইরকমই অবস্থা। তাঁরা সেইরকমই ভাবছেন। কিন্তু লালাবাবু আর নটুমহারাজ অন্যরকম ভাবছেন।”

চন্দন বলল, “ডাক্তাররা যা বলছেন–সেটা না-মানার কারণ কী?”

তারাপদ বলল, “ভদ্রলোক লালাবাবুর কেমন আত্মীয়?”

কিকিরা এবার সবিস্তারে ঘটনাটা বলতে লাগলেন।

“ভদ্রলোক লালাবাবুর মামাতো ভাই। মানে দাদর। আবার বন্ধুর মতন। নাম রত্নেশ্বর, লোকে রতনবাবু বলে ডাকে। রত্নেশ্বরবাবুর বয়েস পঞ্চাশের ওপর। স্বাস্থ্য খুবই মজবুত ছিল। উনি বরাবর ব্যবসাপত্র করেছেন। পয়সাঅলা লোক। হালে ভদ্রলোক একটা বাস কিনে দিঘা কলকাতায় চালাচ্ছিলেন। ট্যুরিস্ট সার্ভিস। মাস কয়েক আগে তাঁর খেয়াল হয় ঘাটশিলায় একটা হোটেল খুলবেন। জমি আগেই কেনা ছিল।… তা হোটেল বাড়ি তৈরি করার কাজে সবেই যখন হাত দিয়েছেন– তখনই ঘটনাটা ঘটল।”

“রত্নেশ্বরবাবুর স্ট্রোক হল? বা তাঁকে খুন করার চেষ্টা হল?” তারাপদ বলল।

“হ্যাঁ।”

“কোথায়?”

“ঘাটশিলায়।”

তারাপদ তাকিয়ে থাকল। রত্নেশ্বর থাকতেন কোথায়? কলকাতায়, না, ঘাটশিলায়? ভদ্রলোক সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কতটুকু আর জানা হয়েছে? সামান্য দু-চারটে কথা থেকে কীই বা বোঝা যায়?

তারাপদ বলল, “ওঁর বাড়ি কোথায়? ব্যবসাপত্রর জায়গা?”

 কিকিরা বললেন, “বাড়ি হরিশ মুখার্জিতে। পুরনো বাড়ি। পৈতৃক। ব্যবসাও কলকাতাতে। হরেক রকম ব্যবসা। সাইকেলের সিট, ঘণ্টি, আলো এসব তৈরি করার ছোট কারখানা আছে বেহালায়। কার্বন পেপার, স্ট্যাম্প কালি, স্ট্যাম্প প্যাড তৈরি হয় বেলেঘাটায়। চীনেবাজারে একটা দোকান আছে স্টেশনারির। হালে মস্ত বাস কিনে দীঘা কলকাতায় চালাচ্ছিলেন। খুচরো আরও কিছু থাকতে পারে ছোটখাট। এজেন্সি গোছের।”

চন্দন বলল, “এতরকম ব্যবসা! জাত ব্যবসাদার নাকি?”

“ধরেছ ঠিক। ওঁরা জাত ব্যবসাদার। বাপ-ঠাকুদাও ব্যবসা করে গিয়েছেন।”

“এত ব্যবসা একলা সামলাতেন ভদ্রলোক?”

মাথা নাড়লেন কিকিরা। “খোঁজখবর রাখতেন সব ব্যবসারই, তবে নিজে দেখাশোনা করা সম্ভব ছিল না। বেহালার কারখানাটা নিজে দেখতেন। বেলেঘাটার কারবার দেখত নিমাই বলে একটা লোক। সম্পর্কে খুড়তুতো ভাই। রত্নেশ্বরদের আশ্রিত। চীনে বাজারের দোকানে বসত ওঁর নিজের ছোট ভাই যজ্ঞেশ্বর।”

“বাসের ব্যবসা কে দেখত?”

“নিজেই দেখতেন রত্নেশ্বর। তবে একজন ছোকরা ম্যানেজার ছিল। নাম আনন্দ।”

তারাপদ বলল, “দাঁড়ান, একটু গুছিয়ে নিই, তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। বেহালা রত্নেশ্বর, বেলেঘাটা নিমাই, চীনেবাজার যজ্ঞেশ্বর, বাস আনন্দ। মানে এই চারজনই ছিল রত্নেশ্বরের ব্যবসার দেখাশোনার লোক। অবশ্য রত্নেশ্বরকে বাদ দিলে তিনজন।”

“হ্যাঁ।”

“গোলমাল ছিল কারও সঙ্গে?”

“বাইরে অন্তত নয়।”

“আপনি এদের দেখেছেন?”

“দেখেছি। লালাবাবু পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।”

“দেখে কি কাউকে সন্দেহ হল?”

“দু-দশ মিনিট দেখেই কি সন্দেহ হয়? আমার কি পুলিশের চোখ?”

 চন্দন বলল, “সন্দেহের কথা পরে। আগে জানতে হবে হয়েছিল কী যে আপনার বন্ধু লালাবাবু সন্দেহ করছেন রত্নেশ্বরকে খুন করার চেষ্টা হয়েছে?”

কিকিরা মাথা নাড়লেন। বললেন, “আসল কথাটা হল তাই। তারাবাবু আসল কথাটা ছেড়ে বাকিগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে বসল। একে কী বলে জানো? বলে, ফেদার গ্যাদারিং।”

চন্দন আর তারাপদ হাঁ করে তাকিয়ে থাকল।

 “বুঝলে না?” কিকিরা হেসে-হেসে রঙ্গ করে বললেন, “হাতের মুরগিটা যদি পালিয়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল আর তোমার হাতে থাকল পালক। তা হলে হলটা কী? ফেদার গ্যাদারিং হল না?”

চন্দন আর তারাপদ হেসে উঠল হো-হো করে।

মুখ টিপে হাসলেন কিকিরাও। চণ্ডী বাঁড়জ্যের বইয়ে এসব লেখা ছিল।”

“সে কে?”

“ছিল একজন। তোমরা চিনবে না। মজার প্লে লিখত–তোমরা যাকে বলো নাটক। ফার্স-মাস্টার চণ্ডী।”

“ও!… তা এবার আসল কথাটা বলুন, শুনি।”

কিকিরা ঘাড় নেড়ে বললেন, “আপাতত ছোট করে শুনে নাও। বড় করে বলা যাবে না। কেননা, আমি নিজেই জানি না। কাজে হাত না লাগানো পর্যন্ত জানা যাবে না কী কী হয়েছিল!”

“ছোট করেই বলুন।”

“ঘটনাটা ঘটেছে ঘাটশিলায়। সপ্তাহ তিনেক আগে। মে মাসে।”

ঘাটশিলাতেই এখন আছেন রত্নেশ্বরবাবু?”

“না। এখন কলকাতায়। ঘাটশিলা থেকে কলকাতায় এনে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। দিন পনেরো ছিলেন হাসপাতালে। কলকাতার হাসপাতাল এক্সকিউজ মি চাঁদুবাবু ভরসা করার মতন জায়গা আর নেই। তা ছাড়া ডাক্তাররাও বললেন, হাসপাতালে পড়ে থাকার চেয়ে বাড়ি নিয়ে যান। আমরা আর কোনো উন্নতি দেখতে পাচ্ছি না। এইভাবে কতদিন পড়ে থাকবেন তাও বলতে পারব না। বাড়িতে অন্তত দেখাশোনা, যত্ন আরও ভাল হবে। পরে যদি অসুবিধে হয়–আবার নিয়ে আসবেন হাসপাতালে।… তা রত্নেশ্বরের বাড়ির ডাক্তার সিনিয়ারের সঙ্গে পরামর্শ করে বাড়িতেই এনে রেখেছেন।”

“বাড়িতে কতদিন?”

“এই তো, দিন কয়েক মাত্র।”

“তারপর বলুন। ঘটনাটা যেখানে ঘটে- মানে, ঘাটশিলায় কী হয়েছিল?”

কিকিরা সিগারেটের টুকরোটা ছাইদানে ফেলে দিয়েছিলেন আগেই। দু হাতে মাথার বড়বড় চুলগুলো গুছিয়ে নিতে নিতে বললেন, “একটু গুছিয়ে বলি, না হলে বুঝবে না। প্রথম কথা, রত্নেশ্বরবাবুর জমি থাকলেও ঘাটশিলায় তাঁর নিজের কোনো বাড়ি ছিল না। তিনি টুমহারাজের বাড়িটা ভাড়া করে নিয়েছিলেন। মাঝে-মাঝে যেতেন, দশ পনেরো দিন থাকতেন। ঘাটশিলা ওঁর খুব পছন্দসই জায়গা ছিল।”

“তবু নিজে বাড়ি করেননি?”

“না। করবকরব ভাবতেন। করেননি। জমি তো কেনাই ছিল, সময় মতন করে ফেলব ভাবতেন। পরে মনে হয়, বাড়ি পরে হবে– আগে একটা ছোট হোটেল করা যাক। ব্যবসা ভাল হবে। বিজনেসম্যান তো?”

তারাপদ বলল, “তা এবারে তিনি টুমহারাজের বাড়িতেই ছিলেন…”

“হ্যাঁ, সেই বাড়িতেই ছিলেন। হোটেল বাড়ির গোড়ার কাজকর্ম শুরু হয়েছিল। ভিত খোঁড়া সবে শেষ। এমন সময়–”

“ঘটনাটা ঘটল।”

“ইয়েস। ঘটনা ঘটল।”

“বলুন একটু ঘটনাটা।”

“একদিন সন্ধের মুখে রত্নেশ্বর বসার ঘরে বসে বসে বাড়ির নকশাটকশা দেখছিলেন। এমন সময় কে যেন এসেছিল দেখা করতে। কথাবার্তা বলে সে চলে গেল। তার সামান্য পরে নটুমহারাজ ঘরে এসে দেখেন, রত্নেশ্বর চেয়ারসমেত উলটে মেঝেতে পড়ে আছেন। ওই বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি নেই। বড় একটা টেবিল বাতি, কেরোসিনের, জ্বলছিল। অন্ধকারই বেশি ঘরে। আলো আর কতটুকু … নটুমহারাজ প্রথমটায় ধরতে পারেননি। পরে দেখলেন, রত্নেশ্বর অজ্ঞান। সাড়াশব্দ নেই। অবশ্য বেঁচে আছেন।”

“ডাক্তার?” চন্দন বলল।

 “ডাক্তার সেই বাজারের কাছে। লোক পাঠিয়ে আনানো হল।”

“কাছাকাছি কেউ ছিলেন না?”

“চাঁদু, তোমরা ভাবো সব জায়গাই কলকাতা। অলিতে গলিতে ডাক্তার। ঘাটশিলার মতন জায়গায় তুমি ক’জন ডাক্তার পারে যে হাঁক মারলেই ছুটে আসবে।”

তারাপদ বলল, “তারপর?”

 কিকিরা বললেন, “রাতটা কোনোরকমে কাটিয়ে পরের দিন অনেক মেহনত করে একটা অ্যাম্বুলেন্স ভ্যান আনানো হল জামশেদপুর থেকে। সেই অ্যাম্বুলেন্সে করে সোজা কলকাতা। সঙ্গে ডাক্তারবাবু ছিলেন। রাস্তার মধ্যে বিপদ ঘটলেও ঘটতে পারত। ঘটেনি। কলকাতায় এনে সোজা হাসপাতালে।”

চন্দন বলল, “কাজটা খুব রিস্কি হয়েছে।”

“উপায় ছিল না। তা ছাড়া ওঁরা কলকাতার মানুষ। কলকাতা ছাড়া ভরসা পান না।”

তারাপদ বলল, “কে দেখা করতে এসেছিল সেদিন ঘাটশিলায়?”

“সেটাই কেউ জানে না,” কিকিরা বললেন।

“সে কী! কেউ জানে না মানে? কেউ দেখেনি?”

“একজন মাত্র দেখেছিল,” কিকিরা বললেন, “একটা বাচ্চা মেয়ে। ডাকনাম, ফুটফুটি। রত্নেশ্বরবাবুর ভাইঝি। যজ্ঞেশ্বরের ছোট মেয়ে। সে তখন বড় বারান্দার একপাশে এসে লুকিয়ে বসে ছিল।”

“কেন?”

“তার মা তাকে জোর করে এক গ্লাস দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করছিল বলে পালিয়ে এসেছিল।”

“মেয়েটির বয়েস কত?”

“বছর ছয়-সাত!”

“সে বলতে পারছে না কাকে দেখেছে?”

“লোকটা যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল সেই সময় সে দেখেছে। তাও আবছা অন্ধকারে। ওই সময় কৃষ্ণপক্ষ চলছিল। বারান্দায় মাত্র হেরিকেন ছিল একটা।”

“কেমন দেখতে ছিল লোকটা?”

“ভূতের মতন। ফুটফুটি বলছে, ভূত!.. আর কিছু বলতে পারছে না। আমি তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে জানবার চেষ্টা করছি রোজই। পারছি না।”

তারাপদ খেলনাগুলোর দিকে তাকাল। “এগুলো কি ফুটফুটির জন্যে?”

 কিকিরা হাসলেন।

চন্দন আর বসতে পারছিল না। উঠে পড়ল। তারাপদও।

.

০২.

পরের দিন খানিকটা বিকেল-বিকেলই এল তারাপদ। শনিবার। তার অফিস ছুটি হয় দুটো নাগাদ। অফিস থেকে সরাসরি আসেনি, হোটেলে নিজের আস্তানায় গিয়েছিল, খানিকটা জিরিয়ে স্নান সেরে জামাপ্যান্ট বদলে যখন বেরুচ্ছে- বৃষ্টি এসে গেল। সকাল থেকেই মেঘলা ছিল, বাতাসে গন্ধ ছিল সোঁদা-সোঁদা, তবু বৃষ্টি আসেনি। এল বিকেলের দিকে।

জোর বৃষ্টি নয়। খানিকক্ষণ ঝিরঝিরে বৃষ্টি হল; তারপরই বন্ধ। এবারে কবে যে ঠিক-ঠিক বর্ষা নামবে কে জানে!

কিকিরার বাড়ি আসতে-আসতে প্রায় ছটা। গরমের দিন, আকাশ মেঘলা– তবু আলো মরে যায়নি।

আগের দিন আর বসে থাকার উপায় ছিল না তারাপদদের। চন্দনের কাজ ছিল কয়েকটা, রাত্রের আগেই সেরে রাখতে হবে–সকালেই তার ট্রেন। কাল আসছি, বাকি সব শুনব বলে উঠে পড়েছিল তারাপদ।

চন্দন যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল, কিকিরা আমি তো থাকছি না। সাতদিন ধরে আমার পেট ফুলবে। তবু একটা ওয়ার্নিং দিয়ে যাই। ভাল করে না বুঝে হাত বাড়াবেন না। হাসপাতালের কেস নিয়ে অনেক সময় গণ্ডগোল হয়।

কিকিরা মাথা নেড়েছিলেন।

তারাপদ এসে দেখল, কিকিরা বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বসে আছেন।

“বেরুচ্ছেন নাকি?”

“তোমার জন্যে বসে আছি। চাঁদু চলে গিয়েছে?”

“সকালেই যাওয়ার কথা।”

“চলুন। যাবেন কোথায়?”

“রত্নেশ্বরের বাড়িতে।”

“সেটা কোথায়?”

“এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাও? হরিশ মুখার্জি..”

“ও! খেয়াল ছিল না। চলুন।”

“ছাতা কোথায়?”।

তারাপদ হাসল। “নেব ভেবেছিলাম। তারপর দেখলাম বৃষ্টি থেমে গেল।”

কিকিরা হেসে-হেসে বললেন, “কী দেখলে সেটা বড় কথা নয়, কী হতে পারে সেটাও দেখবে। এখন বর্ষাকাল। এক পশলা হয়ে গেছে বলে আর যে হবে না– তুমি জানলে কেমন করে? ভগবান নাকি।”

“আপনারটা থাকবে, তাতেই হয়ে যাবে” হাসল তারাপদ।

 কিকিরা বললেন, “এক ছাতায় দুটো মাথা…! বেশ, চল।

 নিচে এসে তারাপদ এগিয়ে যাচ্ছিল, কিকিরা বললেন, “দাঁড়াও! ওই দেখো- একটা ট্যাক্সি। ওই যে! গাছের তলায়। ওটাকে ধরো। যাবে মনে হচ্ছে।”

তারাপদ ট্যাক্সি ধরতে এগিয়ে গেল।

 ট্যাক্সিতে উঠে তারাপদ বলল, “খেলনাগুলো নিয়েছেন দেখছি।”

প্লাস্টিকের পাতলা ব্যাগের মধ্যে খেলনাগুলো নিয়েছিলেন কিকিরা। দেখাই যাচ্ছিল। কিকিরা মাথা নাড়লেন। নিয়েছেন।

সামান্য পরে তারাপদ বলল, “স্যার, কাল রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম ঘটনাটা। ধাঁধা লাগছিল। অনেক কথা শোনাও হয়নি, কাজেই বুঝতে পারছিলাম না।”

“তা ঠিকই। কাল আর সব কথা বলা হল কোথায়?”

তারাপদ বলল, “কী নাম বলছিলেন যেন! নটুমহারাজ। তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“তিনিই প্রথম, যিনি রত্নেশ্বরবাবুকে চেয়ার উলটে পড়ে থাকতে দেখেছেন?”

“হ্যাঁ।”

“নটুমহারাজ লোকটি কে? সাধুসন্ন্যাসী?”

“আমি তো তাঁকে দেখিনি। খবরাখবর করেছি। তাতে জেনেছি, নটুমহারাজ গেরুয়াপরা সন্ন্যাসী নন। তাঁর কোনো আখড়া, আশ্রম নেই। নিজের সংসার বলতেও নেই কিছু। ঘাটশিলায় অনেকদিন আছেন। লোকাল লোকও বলা যায়। একা থাকেন। একটি কাজের লোক আছে।”

“নটুমহারাজের বাড়ি আছে না ঘাটশিলায়? আপনি কাল বলছিলেন, রত্নেশ্বর সেই বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন ওখানে!”

 “হ্যাঁ, নটুমহারাজের বাড়ি আছে। বাড়ির সামনের দিকটা তিনি রত্নেশ্বরকে ভাড়া দিয়েছিলেন। বরাবর তাই দিতেন। চেনাশোনা হয়ে গিয়েছিল অনেকদিন থেকে। বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।”

“নিচে তিনি কোথায় থাকতেন? বাড়ির সামনের দিক ভাড়া দিতেন বলছেন তার মানে বাড়ির পেছন দিক ছিল?”

“পেছন দিকে একটা আউট হাউস মতন আছে। সেখানেই বরাবর থাকেন নটুমহারাজ।”

“আসল বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আউট হাউসে থাকেন কেন?”

“একা মানুষ। অল্পতেই হয়ে যায়। আসলে বাড়িটা ভাড়া খাটান। সেইরকমই শুনলাম। নিজেরা গিয়ে কথা বললে বুঝতে পারব।”

“ও! তা হলে সামনের দিকটা, বড় বাড়িটা, নটুমহারাজ ভাড়া খাটানোর জন্যে রেখে দিয়েছেন। অন্য ভাড়াটেরাও ভাড়া নিতে পারত তা হলে?”

“পারত। তবে রত্নেশ্বরই বেশি নিতেন। বছরে দু-তিনবার। পুজোয় আর শীতে তো বাঁধা। মাঝে-মাঝে বর্ষায়। অন্য সময় কে আর ঘাটশিলায় ঘর ভাড়া নিয়ে বেড়াতে যাবে।… তুমি কখনো ঘাটশিলায় গিয়েছ?”

“না।”

“আমি একবার গিয়েছিলাম। দশ বারো বছর আগে। তার বেশিও হতে পারে। আমার এক শিষ্য গিয়েছিল শো দেখাতে। ধরে নিয়ে গিয়েছিল। একটা রাতই ছিলাম। নো আইডিয়া স্যার। তবে জায়গাটা ভাল শুনি।”

“আমিও শুনেছি।”  

“এবার চলো, ভাল করে দেখা যাবে।”

তাকাল তারাপদ। “আপনি ঘাটশিলায় যাচ্ছেন?”

“যাচ্ছি বইকি! না গেলে হয়! ঘটনা যেখানে ঘটল সেখানে না গিয়ে, না দেখে, খোঁজখবর না করে জানব কেমন করে কী হয়েছিল।…আসছে শুক্রবারেই যাব ঠিক করেছি। কদিন ছুটি নিয়ে নাও অফিস থেকে। সেভেন ডেজ…!”

তারাপদ কোনো কথা বলল না।

 ট্যাক্সিঅলার হাত ভাল নয়। ছোকা ট্যাক্সিঅলা বাঙালি। বড় এলোমেলো গাড়ি চালাচ্ছিল। সামনের রাস্তা যেন শুধু তার। বেপরোয়াভাবে অন্য গাড়িকে কাটাচ্ছিল, মানুষজন মানছিল না। একবার ট্রাফিক সিগন্যালও না মেনে এগুতে গিয়ে ট্রাফিক পুলিশের ধমকানি খেল।

কিকিরা সবই নজর করছিলেন। তারাপদকে ইশারায় বললেন, লাইসেন্স নেই বোধ হয়।

তারাপদ মুচকি হাসল।

পকেট থেকে চুরুট বার করে কিকিরা ড্রাইভারকে বললেন, “ও ভাই, তুমি ট্যাক্সিও চালাও?”

ড্রাইভার ছেলেটি বুঝল না।

কিকিরা তার পিঠে কাঁধের ওপরে হাত রেখে চাপ দিলেন। “তুমি ট্যাক্সিও চালাও?”

ড্রাইভার ছোরা একবার ঘাড় ঘোরাল, “কেন দাদু?”

“তোমাকে মিনিবাসেও দেখেছি।”

“মিনিবাসে?”

“দেখিনি?”

“মিনিবাস আমি চালাই না।”

“তা হলে ভুল হয়ে গেল! তোমার হাত একেবারে মিনিবাসে পাকা হাত।”

ছোকরা ড্রাইভার কিছুই বুঝতে পারছিল না। খানিকটা দোনামোনা অবস্থায় স্পিড কমিয়ে ফেলল। “আপনার কি মিনিবাসের কারবার দাদু?”

চুরুট ধরাবার চেষ্টা করছিলেন কিকিরা। বললেন, “না, আমার নিজের কোনো মিনি কারবার নেই। তিনি নিয়ে থাকি। তা আমার এক বন্ধুর মিনি আছে। বেলতলার লাইসেন্স ডিপার্টমেন্টের ঘটকবাবু। তিনি একজন ভাল ড্রাইভার খুঁজছিলেন।”

বেলতলার নামেই হোক কি লাইসেন্স ডিপার্টমেন্টের ভয়েই হোক ছোকরা চট করে নিজেকে সামলে নিল।

কিকিরা চুরুট ধরিয়ে নিয়েছেন ততক্ষণে।

“দাদু। আমার এক ভাই আছে। যমজ ভাই। সে মিনিবাস চালাতে পারে। মাঝে-মাঝে কন্ডাক্টারি করত। করতে করতে হাত বানিয়ে ফেলেছে। লাইসেন্স নেই। আপনি তাকে লাগিয়ে দিন না। লাইসেন্সও হয়ে যাবে।”

কিকিরা তারাপদর দিকে তাকালেন।

তারাপদ চোখে-চোখে বলল, নিন, এবার বুঝুন! চালাকি করছিলেন পড়ে গেলেন।

কিকিরা কথা ঘোরাবার চেষ্টা করলেন। “তোমরা যমজ?”

“আমি আট ঘণ্টার বড়। কাশী ছোট। দাদু, কাশী বিকম পড়ে। ফুটবল খেলে।”

কিকিরা কেমন যেন লজ্জা পেলেন। ঠাট্টা করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়ে গিয়েছেন। “তুমি–মানে তোমার নাম তা হলে কী! ছোট হল কাশী, তুমি তবে কী নিশি না শশি?”

“কুশি।”

“কুশি! মানে কী হে!”

“মানে জানি না। বলে, ছোট-ছোট আম। কচি আম!”

“বাঃ!… তুমি লেখাপড়া করেনি?”

“স্কুল ফাইনাল। চারবার। মাথা মোটা দাদু। কাশী খুব বুদ্ধিমান। বেরেন আছে।”

কিকিরা আপাতত আর কথা বাড়ালেন না। বললেন, “শোনো হে কুশিবাবা! আজ আমি যেখান থেকে উঠলাম তোমার ট্যাক্সিতে, তার কাছেই আমার বাড়ি। একদিন সকালবেলায় চলে এসো, গল্প করব। এখন আমাদের নামিয়ে দাও, এসে গিয়েছি।”

সামান্য এগিয়ে ট্যাক্সি দাঁড়াল।

ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়লেন কিকিরা।

 দশ-বিশ পা এগিয়ে কিকিরা বললেন, “তারাপদ, তুমি অবাক হচ্ছ?

চুপ করে থাকল তারাপদ।

 কিকিরা বললেন, “এরকম অনেক পাবে। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। যাক গে, আজ একটা ভাল ছেলের সঙ্গে আলাপ হল।

বড় রাস্তা থেকে একটু গলির মধ্যে রত্নেশ্বরের বাড়ি। কিকিরা গলিতে ঢুকলেন।

তারাপদ বলল, “আপনি একটা কথা আমায় বলেননি। ঘাটশিলার বাড়িতে তখন কারা ছিলেন রত্নেশ্বরের সঙ্গে? তাঁর ফ্যামিলি!”

কিকিরা বললেন, “রত্নেশ্বরের একটি মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে। সে দুরে থাকে, কানপুরে। বাবাকে দেখতে এসেছিল। ফিরে গেছে আবার। রত্নেশ্বরের স্ত্রী মারা গিয়েছেন। ভদ্রলোককে দেখাশোনা করে ছোট ভাই যজ্ঞেশ্বরের স্ত্রী। যজ্ঞেশ্বরের বড় মেয়ে থাকে আসানসোলে। স্কুলে পড়ায়। ছেলে কলেজে পড়ে। ছোট মেয়ে ফুটফুটি হল রত্নেশ্বরের প্রাণ। উনি যখনই ঘাটশিলায় যান, ভাইয়ের স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে সঙ্গে যায়। এবারে ছেলে যায়নি। ফুটফুটি আর তার মা সঙ্গে ছিল।”

“অন্য কেউ?”

“কাজের লোকজন। কলকাতার বাড়ি থেকে দু’জন সঙ্গে গিয়েছিল। একজন রান্নার লোক, মেয়ে। আর অন্যজন ফাই-ফরমায়েশ খাটার। কমলা আর গুরুচরণ।”

“আর কেউ না?”

“না। তবে কলকাতা থেকে একজন যেত মাঝে-মাঝে। কর্মচারী ধীরুবাবু। ঘটনার দিন ধীরুবাবু ছিলেন না।

কথা শেষ হওয়ার আগেই রত্নেশ্বরের বাড়িতে পৌঁছে গেল তারাপদরা।

বাড়িটা পুরনো। অন্তত শ’… বছরের তো হবেই। সেকালের ছাঁদছিরি থেকেই বোঝা যায় সেটা। পাঁচিল-ঘেরা বাড়ি। সামনে সদর। সদর পেরুলেই ফাঁকা জমি খানিকটা। গাছপালা কয়েকটা। সামনে বারান্দা। বারান্দায় বড় বড় তিন-চারটে ফুলের টব। দুটো টবে পাতাবাহার, ঝাঁকড়া হয়ে রয়েছে। সামনে বারান্দা। ডান পাশেও বারান্দা। বারান্দার গায়ে-গায়ে ঘর। সামনের বারান্দার বড় ঘরের দরজা খোলাই ছিল। বাড়িটা দোতলা।

বারান্দায় মাত্র একটা বাতিই জ্বলছিল।

সামনের ঘরটা বসার ঘর। কিকিরাদের পায়ের শব্দে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। “আসুন রায়বাবু?” বলে তারাপদর দিকে তাকালেন।

কিকিরা বললেন, “একটু দেরি হয়ে গেল। চলুন!”

বসার ঘরের আলো উজ্জ্বল নয়। টিউব লাইট ছিল কিন্তু জ্বালানো হয়নি।

কিকিরা তারাপদর দিকে তাকালেন। “তারাপদ, ইনি লালাবাবু আমার পুরনো বন্ধু। দেখেছ হয়ত।… আর লালাবাবু, এ হল তারাপদ। আমার ডান হাত। আরও একজন আছে, চন্দন। ডাক্তার। সে অবশ্য আসতে পারল না। আজ বাড়ি চলে গিয়েছে। দিন সাতেক পরে ফিরবে।”

লালাবাবু বসতে বললেন কিকিরাদের।

তারাপদ লালাবাবুকে দেখছিল। ভদ্রলোকের সঙ্গে তার কি কোনোদিন আলাপ হয়েছে কিকিরার বাড়িতে? মনে পড়ল না। তবে এমন হতে পারে, একদিন সে যখন কিকিরার বাড়ি যাচ্ছিল, ভদ্রলোককে সিঁড়িতে দেখেছে। হয়ত উনি কিকিরার সঙ্গে গল্পগুজব সেরে ফিরে যাচ্ছিলেন। তারাপদ কৌতূহল বোধ করেনি তখন।

কিকিরা বললেন, “কেমন আছেন রত্নেশ্বরবাবু?”

“সেই একই রকম। রতনদাকে খাওয়ানোই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দু চামচ করে গলানো খাবার আর লিকুইড খাইয়ে কতদিন আর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।”

“ডাক্তাররা কী বলছেন?”

“সেই একই কথা। ভগবানের ওপর ছেড়ে দিন। এইভাবেই পড়ে থাকতে-থাকতে যদি নিজের থেকেই সারভাইভ করতে পারেন খানিকটা, হয়ত পরে কোনো সময়ে দেখবেন, হাত-পাও নাড়তে পারছেন একটু-আধটু। কিছুই বলা যায় না।”

“বুঝেছি।”

“বড় কষ্ট রায়বাবু। একটা ছটফটে মানুষ ওইভাবে বিছানায় পড়ে আছে দিনের পর দিন, এ আর সহ্য হয় না।”

কিকিরা ঘাড় নাড়লেন। তিনি বুঝতে পারেন সবই। বললেন, “তা লালাবাবু, আমরা যে সামনের শুক্রবার ঘাটশিলায় যাব ভাবছি।”

“বেশ তো। আপনি তো আগেই বলছিলেন।”

“আপনি সঙ্গে যাবেন?”

“দরকার হলে নিশ্চয় যাব। কিন্তু আমি গেলে এখানে দেখাশোনা করবে কে?”

“যজ্ঞেশ্বর। আরও লোক তো আছে।”

“তা আছে। তবে কী জানেন রায়মশাই, অন্য সময়ে এখানকার ঘরবাড়ি, সংসার সামলানোয় কোনো ঝামেলা ছিল না। আগে কতবার কেউ না কেউ সামলেছে। এবারে বেশ ঝামেলা হবে। রতনদাকে সবসময় নজরে রাখা, ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ…। আমাকেই এসব করতে হয়। যজ্ঞেশ্বরটা ভিতু। নার্ভাস।”

কিকিরা বললেন, “সবই বুঝি। তবে অসুবিধে হচ্ছে, আপনি সঙ্গে না গেলে–আমরা কাজে হাত দেব কেমন করে! কাউকে চিনি না। অন্য পাঁচটা দরকার হতে পারে। আপনার যাওয়া জরুরি। …আপনি চলুন। আমাদের সব দেখিয়ে-শুনিয়ে, বুঝিয়ে না হয় ফিরে আসবেন। কলকাতা থেকে ঘাটশিলা বেশি দূর নয়, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার। আপনি দরকার মতন আসা-যাওয়াও করতে পারেন।”

লালাবাবু আপত্তি করলেন না।

তারাপদ লালাবাবুকে দেখছিল। চেহারায় আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। গোলগাল গড়ন, গায়ের রং ফরসা, মাথায় চুল কম, টাকই বেশি। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। নাক মোটা। চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার।

কিকিরা বললেন, “ফুটফুটি কোথায়?”

“ডাকব?”

“জেগে আছে, না, ঘুমিয়ে পড়েছে?”

“না না, এত তাড়াতাড়ি ঘুমোবে কী! ওকে বিছানায় ফেলতে ফেলতে নটা বেজে যায়। ভীষণ চঞ্চল, দুষ্টু। খানিকটা আগে ওর মায়ের সঙ্গে ফুটি খাওয়া নিয়ে চেল্লাচিল্লি করছিল।”

“তা হলে ডাকুন একবার।”

লালাবাবু চলে গেলেন।

তারাপদ অনেকক্ষণ থেকেই ঘরটা নজর করছিল। ঘর বড়। দরজা-জানলাও পোক্ত। সেকেলে বাড়ির মতনই সব। ঘরের আসবাবপত্র পুরনো ধরনের। ভারী সোফা সেটি, আর্ম চেয়ার একপাশে, কোণের দিকে অ্যাকুইরিয়াম, মাছ, জল কিছুই নেই, ফাঁকা পড়ে আছে, দরজার গা-ঘেঁষে পাতাবাহারের একটা টব। দেওয়ালে দু-তিনটি ছবি, মায় একটা বড়সড় ক্যালেন্ডার।

তারাপদ হঠাৎ বলল, “স্যার, আপনি অন্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন?”

“বলেছি। যজ্ঞেশ্বরের স্ত্রীর কাছে আলাদা খবর পেলাম না কিছুই। মহিলা যেন মরে আছেন। কথা বলবেন কী, কাঁদেন শুধু।”

“যজ্ঞেশ্বর?”

“সে কেমন হতভম্ব হয়ে রয়েছে। ভিতুই হয়ত। তবে সে মনে করে না– দাদাকে কেউ খুন করতে গিয়েছিল।”

“আর সেই খুড়তুতো ভাই?”

“নিমাই। বেলেঘাটার কারখানা দেখত। এই বাড়িতেই থাকত এতদিন, এখন বেলেঘাটাতেই থাকে।”

“ও না এ-বাড়ির আশ্রিত ছিল?”

“আশ্রিত তো বটেই। তবে হালে অন্য জায়গায় থাকছে। কাজকর্ম দেখার সুবিধে হবে বলে।”

“সে কী বলে?”

“খুন করার চেষ্টা বলে সে সন্দেহ করে না।”

“কেমন লোক?”

“দেখতে নিরীহ। তবে বোকা নয়।”

“বাসের কারবার যে দেখত।”

“আনন্দ। সেটা একেবারে বকেশ্বর। টকিং মুখ। অনবরত কথা বলে আর কান চুলকোয়। চেহারাটা ষণ্ডামার্কা। মুখ হলেও গোবেচারা নয়।… তা সেও খুনটুনের ব্যাপার বলে মনে করে না।”

“তা হলে?”

“তা হলে আর কী! আমি জনে-জনে জিজ্ঞেস করেছি। ধীরুবাবুকে, গুরুচরণকে, কমলাকে। তারা কেউ বলেনি, বাড়ির কর্তাকে কেউ খুন করার চেষ্টা করেছিল।”

“শুধু লালাবাবু সন্দেহ করেছেন?”

“লালাবাবু আর নটুমহারাজ। এঁরা দুজনই অন্য সন্দেহ করছেন। তবে লালাবাবুর প্রথমটায় সন্দেহ হয়নি, নটুমহারাজই মাথায় ঢুকিয়েছেন। নটুমহারাজকে আমি দেখিনি। কথাবার্তাই বা বলব কেমন করে? ঘাটশিলায় না-যাওয়া পর্যন্ত ব্যাপারটা বোঝা যাবে না। চোখে দেখি, কানে শুনি–তারপর..”

এমন সময় লালাবাবু এলেন। সঙ্গে ফুটফুটি।

ফুটফুটিই বটে? দেখতে বড় সুন্দর। তবে রোগা। গায়ের রং, গড়ন, চোখমুখে যেন খুঁত নেই। গায়ে পাতলা ফ্রক। মাথার চুল বব করা। বয়েস যে সাতটাত হবে– তা বোঝা যায়।

কিকিরার সঙ্গে ফুটফুটির বেশ আলাপ। এসেই ফুটফুটি বলল, “কী এনেছ? আমার ফটাফট আননি?”

কিকিরা পকেট থেকে খেলনাগুলো বার করে কাছে ডাকলেন। “এই যাঃ! ফটাফট তো ভুলে গিয়েছি পিসিমণি!”

“পিসিমণি বলবে না।”

“মাসিমণি?”

“না।”

“তা হলে মণি।”

“ফুটফুটি বলবে।” বলতে বলতে এগিয়ে এসে খেলনাগুলো নিল।

ফুটফুটি যখন খেলনা দেখছে, ভেতর থেকে চা এল।

কিকিরা এবার একটা চকোলেটের প্যাকেট বার করে ফুটফুটিকে দিলেন। বললেন, “ম্যাজিক দেখবে?”

“দেখব!”

কিকিরা বললেন, “আমি ওপরের দিকে হাত তুলব–আর একটা করে টফি চলে আসবে।”

“কই দেখি?”

কিকিরা হাত তোলেন মাথার ওপর, আর একটা করে টফি বার করেন মুঠো থেকে।

ফুটফুটি খেলনা ভুলে ম্যাজিক দেখছে। যত অবাক, তত খুশি।

কিকিরা হাতের চার-পাঁচটা টফি ওর ছোট্ট-ছোট্ট হাতে গুঁজে দিলেন।

“কে তোমায় টফি দিল?” ফুটফুটি জিজ্ঞেস করল।

 “ভূত!”

“যাঃ!” ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল ফুটফুটি।

 “কেন?”

“ভূত আবার টফি দেয় নাকি?”

“চাইলেই দেয়। সেদিন তুমি যে-ভূতটাকে দেখেছিলে তার কাছেও টফি ছিল।”

“মিথ্যে কথা।”

“কেন! ভূতটার কাছে তুমি কি টফি চেয়েছিলে?”

“বাব্বা! আমার বুঝি ভয় করে না। সে দৌড়ে চলে গেল।”

“বড় ভূত নাকি?”

“অ্যাত্ত বড়।” বলে ফুটফুটি ওপর দিকে হাত তুলে বোঝাবার চেষ্টা করল ভূতটা কত লম্বা ছিল।

কিকিরা বললেন, “ভূতের মুখটা কেমন দেখতে ছিল?”

“বিচ্ছিরি।”

কিকিরা তারাপদর দিকে আড়চোখে তাকালেন একবার। তারপর ফুটফুটিকে বললেন, “কী পরে ছিল মনে আছে? ভূতরা ধুতি পরলে একরকম, প্যান্ট পরলে আর-একরকম।”

ফুটফুটি যেন মনে করবার চেষ্টা করল। তারপর বলল, “প্যান্ট।”

“ঠিক বলছ?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি একলাই দেখলে? আর কেউ ছিল না কাছে?”

“না।”

কিকিরা বললেন, “আচ্ছা, তুমি যাও!”

 ফুটফুটি চলে গেল।

চায়ের কাপ তুলে নিতে-নিতে কিকিরা এবার বললেন, “লালাবাবু, ঘাটশিলায় না যাওয়া পর্যন্ত কিছুই আন্দাজ করতে পারছি না। আর দেরি করা উচিত নয় আমাদের। শুক্রবারই চলুন।”

.

০৩.

ঘাটশিলায় নটুমহারাজের বাড়িটি দেখতে-দেখতে কিকিরা বললেন, “কেমন দেখছ তারাবাবু?”

তারাপদর ভালই লাগছিল। আগের দিন রাত্রের দিকে তারা এসেছে। একেবারে নতুন জায়গা বলে তারাপদ ঠিক ধারণাও করতে পারেনি স্টেশন থেকে কত দূর, বা এটা স্টেশনের কোন দিকে পড়েছে।

নটুমহারাজের বাড়িতেই তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সেই বাড়ি–যেখানে রত্নেশ্বর অসুস্থ হয়ে পড়েন হঠাৎ, কিংবা তাঁকে খুন করার চেষ্টা হয়। তা এই বাড়িতে সব ব্যবস্থাই আছে। রত্নেশ্বর ঘাটশিলায় এসে বরাবর এই বাড়িতে উঠতেন বলে বাড়িটাকে মোটামুটি গুছিয়ে রেখেছিলেন। শোওয়াবসা-খাওয়া–কোনো কিছুরই ভাবনা-চিন্তা করতে হত না। সবই ছিল, গোছানো থাকত। আর এবার, যেহেতু রত্নেশ্বর অনেকদিন থাকবেন, একটানা না পারলেও প্রায়ই থাকবেন, হোটেল তৈরির কাজকর্ম দেখবেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে, নটুমহারাজের বাড়িটা আপাতত বছরখানেকের জন্য ভাড়া নেওয়া ছিল। সেই ভাড়া এখনো নেওয়া রয়েছে।

একেবারে ভোর-ভোর উঠে পড়েছিল তারাপদ। উঠে দেখল, কিকিরা আরও আগে-আগে উঠে পড়ে বাইরে ঘোরাঘুরি করছেন।

চোখমুখ ধুয়ে নিয়ে তারাপদ বাইরে গেল। কিকিরার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল।

কিকিরা বললেন, “কেমন ঘুম হল হে?”

“নতুন জায়গা, মাঝরাত পর্যন্ত ঘুমোতে পারিনি। পরে কখন..”

“হয় ওরকম। তা কেমন দেখছ তারাবাবু?”।

খারাপ লাগার কথা নয়, ভালই লাগছিল তারাপদর। একেবারে ভোরের দিক। সবে সূর্য উঠেছে। আকাশময় রোদ ছড়িয়ে পড়েনি, আলো হয়ে রয়েছে অবশ্য, মাটিতেও রোদ নেই সর্বত্র, ভোরের ভাবটুকু মাখানো আছে ছোট-ছোট গাছপালায়, বাগানে, মাঠে। এখন যদিও আষাঢ়, তবু কোথাও মেঘ দেখা যাচ্ছিল না আকাশে। গরমকালের সকাল। দেখতে-দেখতে রোদ অবশ্য চড়ে যাবে। তবে আপাতত বাতাস ঠাণ্ডা, চারপাশ বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছিল।

তারাপদ বলল, “জায়গাটা বেশ তো! পাহাড়ি ধরনের।”

“সামনেই নদী, সুবর্ণরেখা।”

“কই?”

“ফটকের বাইরে গিয়ে খানিকটা এগুলেই দেখতে পাবে।”

“আপনি দেখেছেন?”

“আমার তো একটা সারকেল হয়ে গেল। আলো ফোঁটার আগেই উঠে পড়েছি।”

“উঠে সারকেল দিচ্ছিলেন?” তারাপদ হেসে বলল।

 কিকিরা মাথা নাড়লেন।

“স্টেশন থেকে কতটা দূর, কিকিরা?”

“খুব বেশি নয়। বাজার-স্টেশন তো গায়ে-গায়ে। এই বাড়িটা ধরো হাঁটাপথে বিশ-পঁচিশ মিনিট। সামান্য বেশিও হতে পারে।”

“বাড়িটা বেশ নিরিবিলি জায়গায়। কাছাকাছি আর বাড়িও দেখছি না।”

“আছে। ওই তোমার ওদিকে দুটো বাড়ি আছে। ছোট। একটা শুরু হওয়ার পর আর শেষ করা হয়নি, সিকি-ফিনিশড। আর-একটা আছে, কটেজ ধরনের। খুবই ছোট।”

“তা হলেও ফাঁকা। নিরিবিলি।”

“তা তো হবেই। ঘাটশিলায় কে আর এদিকে ঘিঞ্জির মধ্যে বাড়ি করতে চাইবে?”

কিকিরা আর তারাপদ হাঁটতে লাগলেন। পায়চারি করার মতন ধীরে-ধীরে।

তারাপদ বলল, “এই বাড়িটা আপনি দেখেছেন ভাল করে?”

“না। তবে আইডিয়া পেয়েছি। হাফ বাংলো টাইপের বাড়ি। সামনে টানা বারান্দা, ডান পাশে বসার ঘর। বাঁ পাশে একটা ভেতর-ঘর। অন্দরমহল পেছন দিকে। গোটা দুই ঘর থাকতে পারে। রান্না, খাওয়ার ঘর পেছন দিকে। পেছনের বারান্দা ঘেরা রয়েছে জাফরি দিয়ে।”

“আবার কী! ভালই। গাছপালাও তো যথেষ্ট।”

“যথেষ্ট মানে? এ একেবারে জঙ্গল। বড় বড় গাছই চার পাঁচটা, ঝোপঝাড়, জঙ্গলা বাগান।… নো ক্লিনিং, নো গার্ডেনিং, বুঝলে।” কিকিরা হেসে-হেসে বললেন।

তারাপদ অস্বীকার করতে পারল না। বাড়ির সামনে পাশে গাছপালা যেন বড় বেশি। বাগান নিয়েও কেউ মাথা ঘামাত না। জঙ্গল হয়ে আছে।

“লালাবাবু এখনও ঘুমোচ্ছেন নাকি?” তারাপদ বলল।

 “বোধ হয়।”

“স্যার, ওই যে বসার ঘর। এখানেই তো ঘটনাটা ঘটেছে।”

মাথা নাড়লেন কিকিরা। “হ্যাঁ।”

“ঘরটা আমরা কখন দেখব?”

“সকালেই দেখব।”

তারাপদর কী মনে হল, বলল, “স্যার, এতদিন পরে ঘরটা দেখে কি কিছু আন্দাজ করা যাবে?”

কিকিরা মাথা দোলালেন। হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “কথাটা ঠিকই তারাপদ! ওঁরা তো বলছেন, ঘটনাটা ঘটার পর প্রথম দু-একদিন সকলের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল–তখন কেউ আর ওই ঘরটা নিয়ে মাথা ঘামাতে বসেননি। পরে নটুমহারাজ ঘরের জানালা বন্ধ করে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেন। লালাবাবুকেই শুধু একবার ঘরটা দেখিয়েছিলেন তালা খুলে।”

তারাপদ পাকা গোয়েন্দার মতন বলল, “সার, ধরুন যদি এটা কিলিং-ই হয়, দু’দিনে কেন, দু’ঘণ্টার মধ্যেও প্রমাণ লোপাট হয়ে যাওয়ার কথা।”

“বিলকুল সহি বাত বিলকুল–!” কিকিরা মজা করে বললেন, হিন্দিতে। তারপর একটু থেমে বললেন, “তবে একটা কথা। বেড়ালেরা সব সময় ইঁদুর চোখে দেখে না, কিন্তু গন্ধ পায়। আমাদেরও নাকের পাওয়ার বাড়াতে হবে। স্মেলিং করতে হবে হে তারাবাবু! লাইক এ ক্যাট।”

“আমার নাক কিন্তু ভোঁতা,” তারাপদ বলল মজার গলায়।

“আমার নাক খাড়া ছিল। যৌবনকালে। তারপর হক্সনসাহেবের সঙ্গে পাঁচ রাউন্ড বক্সিং লড়লাম। বেটা এমন পাঁচ সাতটা পাঞ্চ দিল নাকে–যে অমন খাড়া নাকের হাড় ভেঙে সামান্য বসে গেল। নয়ত দেখতে স্মেলিং কাকে বলে!”

তারাপদ হেসে উঠল। “হক্সনসাহেবটি কে?”

“সান অব অ্যান্ডারসন, ব্রাদার অব জনসন। হক্সন আমার বন্ধু ছিল। এমনিতে বরফকলের মালিক, সোড়া-লেমনেডের কারখানাও ছিল। টেরিফিক হকি প্লেয়ার, আবার শখের ম্যাজিশিয়ান। জাপানি খেলা দেখাত। ভেরি গুড ফ্রেন্ড। “

“তবু আপনার নাকে ঘুষি মারল…তারাপদ হাসছিল।

 “সে তো বেটিং লড়তে গেলে অমন হয়। না পারলে মার খাবে। মার খেলেও হাত-পা ছড়িয়ে নো চিত…!”

 “নো চিতম! মানে?” তারাপদ অবাক।

“মানে, হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে পড়ে থাকবে না। আবার উঠে পড়বে হে!”

তারাপদ হো-হো করে হেসে উঠল।

কিকিরা বললেন, “ধরো এই যে কেসটা আমরা হাতে নিতে যাচ্ছি–এটাতে তো হারতেই পারি, একেবারে চিত হয়ে পড়ে গেলাম। তা বলে কি বুক চাপড়ে হায় হায় করব! নো। নেভার।” বলতে বলতে কিকিরা চোখের ইশারায় কী যেন দেখালেন।

তারাপদ তাকাল। নটুমহারাজ দাঁড়িয়ে আছেন, সামান্য তফাতে। তাঁর বাড়ির কাছে, কুয়াতলার পাশেই।

এই বাড়িটার খানিকটা পেছনে লম্বা টানা ছোট মতন এক বাড়ি। কোনো বাহারি ভাব নেই, একেবারে সাদাসিধে। তবে পাকা দালান-১’সামনে বারান্দা। পেছনে দুটো ছোট-ছোট ঘর। একপাশে সরু গলি মন। বোধ হয় পেছনে এক-আধটা ঘর আছে। এইটেই এবাড়ির আউট হাউস। নটুমহারাজের আস্তানা।

কাল রাত্রেই, এখানে আসার পর ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। লালাবাবুই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য নিছক পরিচয়ই। কথাবার্তা বলার সুযোগ বা সময় তখন ছিল না।

নটুমহারাজ মানুষটিকে দেখলে মহারাজ বলে মনে হয় না। গেরুয়ার কোনো চিহ্ন নেই বেশবাসে। সাদা ধুতি, গায়ে ফতুয়া, একটা পাতলা চাদর–এই হল তাঁর বেশ। পায়ে মামুলি চটি। মাথার চুল বড় বড়, মেয়েদের মতন; চুলগুলো ঝুঁটি করে মাথার ওপর বেঁধে রাখেন। গোঁফ-দাড়ির জন্য মুখটা ভাল করে দেখা যায় না। নাক, চোখ, কপালই যা চোখে পড়ে।

মহারাজের চেহারাটি রোগা। তবে পোক্ত। মাথায় বেশ লম্বা। গায়ের রং তামাটে।

কিকিরা তারাপদকে ইশারায় এগুতে বলে কুয়াতলার দিকে পা বাড়ালেন।

নটুমহারাজও এগিয়ে এলেন।

 কিকিরা দু’হাত তুলে নমস্কার করলেন মহারাজকে। “নমস্কার মহারাজ!”

এগিয়ে এসে নটুমহারাজও নমস্কার জানালেন দুজনকেই।

“এর মধ্যেই উঠে পড়েছেন?” নটুমহারাজ বললেন।

“অনেকক্ষণ। আমি আগেই উঠেছি, তারাপদ একটু আগে উঠল!… ভোরে-ভোরে পায়চারি করছিলাম খানিকটা। বড় ভাল লাগছিল। ফ্রেশ বাতাস, ফাঁকা জায়গা, পায়ের তলায় ঘাস–এসব আর আমাদের কলকাতায় কোথায় পাব বলুন? আপনি বোধ হয় ভোরে ভোরেই ওঠেন?”

“অভ্যেস বরাবরের। স্নান করে নিচ্ছিলাম।”

“এত তাড়াতাড়ি?”

নটুমহারাজ মাথা নোয়ালেন। “সকালেই কুয়াতলায় দাঁড়িয়ে স্নান সেরে ফেলি। এখন গরমকাল। আরাম পাই। শরীর ঠাণ্ডা থাকে। বিকেলেও একবার সারতে হয়। এখানে দুপুরটায় গরম পড়ে। সন্ধের পর আর অতটা গরম থাকে না।”

“বৃষ্টি কেমন হচ্ছে মহারাজ?”

“গত হপ্তায় দিন দুই ভালই হয়েছিল। সবেই বর্ষা পড়ল।”

“কলকাতায় এখনো বর্ষা নামল না। কবে নামবে কে জানে।”

“লালাবাবু ওঠেননি!”

“দেখতে তো পেলাম না।”

“চা খেয়েছেন?”

“না।”

“আমি দেখছি! গুরুচরণ..”

“আরে না না, আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।”

কিকিরাদের সঙ্গে কলকাতা থেকে গুরুচরণও এসেছে। রান্নাবান্না, চা, জলখাবার তারই করার কথা। গতকাল রাত্রে এখানে এসে পৌঁছবার পর অবশ্য কলকাতার বাড়ি থেকে আনা খাবারদাবার খেতে হয়েছে। না আনলেও চলত, এখানে স্টেশনের কাছে আশেপাশে খাবারের দোকান কম নেই।

নটুমহারাজ বললেন, “তা এক কাজ করুন না। আমার ডেরায় গিয়ে বসবেন চলুন। দশ-পনেরো মিনিট। সেখানেই না হয় এক পেয়ালা চা খাবেন…”

কিকিরা বললেন, “আপনি এখন স্নান করবেন। তারপর জপতপ…”

নটুমহারাজ মাথা নাড়লেন। “স্নান করতে মিনিট দশ পনেরো। জপতপ আমার নেই রায়মশাই। সন্ধেবেলায় নিজের মনে একটু গানটান গাই, দু-চার পাতা পড়ি। চলুন আপনারা, বসবেন সামান্য। সংকোচ করবেন না।”

কিকিরা তারাপদর দিকে তাকালেন। “চলো তারাপদ।”

অল্প একটু এগিয়ে টুমহারাজের ডেরা। বারান্দায় কাঠের চেয়ার, একটা চৌকিও পড়ে ছিল। একপাশে ভাঙা দড়ির খাটিয়াও পড়ে আছে একটা।

নটুমহারাজ বললেন, “বসুন। আমি স্নানটা সেরে আসি। দেরি হবে না। চা আমি নিজেই করব।”

“আপনার লোক?”

“জটা। সে এখনো আসেনি। এসে পড়বে। কাছেই থাকে।”

“আপনার এখানে থাকে না?”

“থাকে। ওর দিদির অসুখ। কদিন বাড়ি চলে যাচ্ছে সন্ধের পর। …বসুন আপনারা।” নটুমহারাজ আবার কুয়াতলার দিকে চলে গেলেন।

.

০৪.

দেখতে-দেখতে বোদ ছড়িয়ে গিয়েছিল সর্বত্র। সকালের সেই হালকা স্নিগ্ধভাব আর যেন নেই, উজ্জ্বল ঝকমকে হয়ে উঠছিল রোদ।

চা খেতে-খেতে কিকিরা বললেন, “মহারাজ, …আপনাকে বলছি বলে কিছু মনে করছেন না তো!”

 “না না, বলুন।”

“বলছিলাম, রত্বেশ্বরবাবু যে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েননি, তাঁর যে সেরিব্রাল স্ট্রোক মতন হয়নি, তাঁকে কেউ খুন করার চেষ্টা করেছিল–এমন সন্দেহ আপনি কেন করছেন? কী দেখেছেন আপনি যাতে।”

কিকিরাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে নটুমহারাজ বললেন, “হাঁ, আমি সন্দেহ করছি। কেন করছি লালাবাবু আপনাকে বলেননি?”

“বলেছেন। তবে আমার মনে হয়, তিনি গুছিয়ে বলতে পারেননি। তিনি তো এখানে হাজির ছিলেন না। আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই।”

তারাপদ কোনো কথা বলছিল না। নটুমহারাজকে দেখছিল আর প্রত্যেকটি কথা মন দিয়ে শুনছিল।

নটুমহারাজ একটু চুপ করে থেকে বললেন, “রত্নেশ্বরবাবুকে আমি বেশ কয়েক বছর ধরেই চিনি। তিনি আমার বন্ধুর মতনই হয়ে উঠেছিলেন। নানান। গল্প করতেন, নিজের কথা বলতেন, পারিবারিক কথাও। আমি যতদূর তাঁকে জানি, তাঁকে দেখছি–তাতে বলতে পারি, তাঁর কোনো ভারী অসুখবিসুখ ছিল না। স্বাস্থ্য ভাল ছিল, পরিশ্রম করতে পারতেন, খাওয়াদাওয়া করতেন মুখের রুচি মতন, ধরাবাঁধা মানতেন না। আপনি নিশ্চয় তাঁকে দেখেননি। দেখলে বুঝতে পারতেন, শরীর যেমন বিশাল ছিল, স্বাস্থ্যও ছিল মজবুত। দোষের মধ্যে মাথা গরম মানুষ ছিলেন, চেঁচামেচি করতেন সামান্যতেই। ঠিক রগচটা মানুষ বলব না ওঁকে, বলব বলব–মাথা গরম স্বভাব। কথা বলার অভ্যেসটাই ছিল চড়া ধরনের। অন্য দোষ বলতে কিছু দেখিনি। পান-জরদা খেতেন। সিগারেট কদাচিৎ। …ওঁর কোনো অসুখ ছিল না। এমনকী হালেও হয়নি। কেননা রত্নেশ্বরবাবু আমায় বলেছিলেন, কিছুদিন আগে একবার চেক আপ করিয়েছিলেন কলকাতায়। ডাক্তাররা কোনো খুঁত পায়নি। প্রেশার হয়ত অল্পস্বল্প চড়ত কখনো।

“বয়েস কত হয়েছিল?” তারাপদ বলল।

 “চুয়ান্ন। চুয়ান্ন বছর দু-এক মাস হতে পারে।”

“আপনার সন্দেহের কারণটা বলুন!” কিকিরা বললেন।

নটুমহারাজ বললেন, “কারণ তো একটা নয়, রায়মশাই; কয়েকটা। এক-এক করে বলি তবে?”

কিকিরা মাথা হেলালেন। লালাবাবুর মুখ থেকে যা শুনেছেন তিনি, তার মধ্যে ছাড়-ছোড় থাকতে পারে। আসল লোকের কাছ থেকে শোনাই ভাল।

“আমার প্রথম সন্দেহ, সেই উটকো লোকটা। সে কে? সে কেন এসেছিল, কেনইবা পালিয়ে গেল লুকিয়ে?”।

তারাপদ বলল, “পালিয়ে গিয়েছিল তা কি আপনি চোখে দেখেছেন?”

“না, না। আমি যদি দেখতাম তবে তো চিনতেই পারতাম। আমি না দেখলেও তাকে একজন দেখেছে। সে বাচ্চা মেয়ে। রত্নেশ্বরবাবুর ভাইঝি। ও মিথ্যে কথা, বাজে কথা বলবে না। বাচ্চারা এসব ক্ষেত্রে বলে না। ও যা বলে–তাতে তো বোঝাই যায়–লোকটা পালিয়েই গিয়েছিল।”

“মেয়েটি তো বলে লোকটা ভূতের মতন দেখতে। আমাদের কি তাই বিশ্বাস করতে হবে?তারাপদই বলল।

“না। তবে আমাদের ভাবতে হবে, বেয়াড়া চেহারার কেউ যদি অন্ধকার জায়গা দিয়ে ছুটে পালিয়ে যায়–তাকে ভূত বলেই মনে কতে পারে বাচ্চারা। …চোর-ছ্যাঁচড়ও ভাবতে পারে। তবে এখানে ওই ঋকি বলছে ভূতের মতন দেখতে।”

কিকিরা স্বীকার করলেন কথাটা। তাঁরও ওইরকম ধারণা। বললেন, “উটকো লোকটা কে হতে পারে নটুবাবু? আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন?”

মাথা নাড়লেন টুমহারাজ। “আমার মাথায় আসছে না, উটকো লোকটা কে হতে পারে?”

“একটা উটকো লোক হঠাৎ এল আর পালিয়ে গেল কেন, এইটেই আপনার সন্দেহের প্রথম কারণ?”

“হ্যাঁ। তারপর আমি যখন ওই ঘরে গেলাম, দেখলাম রত্নেশ্বরবাবু চেয়ার সমেত উলটে মাটিতে পড়ে আছেন। জ্ঞান নেই।”

“ঘরে বাতি ছিল?”

“টেবিলের বাতিটা জ্বলছিল। কেরোসিন ল্যাম্প।”

“টেবিলের জিনিসপত্র অগোছালো খানিকটা।”

“ও! তারপর?”

“আরও একটা জিনিস চোখে পড়ল। অবশ্য পরে পড়েছে।”

“কী?”

“তীরের হলুদ পালক।”

“তীর?”

“তীর-ধনুকের তীর। অ্যারো। …দেওয়ালে ঝোলানো একটা বোর্ডের ওপর রাখা থাকত।”

কিকিরা আর তারাপদ অবাক হয়ে নটুমহারাজের কথা শুনছিল। লালাবাবুর মুখে তীরের কথা শোনেননি কিকিরা। তা না শুনুন, রত্নেশ্বরের অসুস্থতার সঙ্গে তীরের সম্পর্ক কোথায়? আর যদি রত্নেশ্বরকে কেউ খুন করার চেষ্টা করে থাকে, তার সঙ্গেও বা কী সম্পর্ক তীরের? কেউ কি আর তীর ছুঁড়ে তাঁকে মেরেছে? অসম্ভব।

কিকিরা বললেন, “বুঝতে পারছি না, মহারাজ? দেওয়ালে তীরই বা থাকবে কেন?”

নটুমহারাজ সামান্য চুপ করে থেমে বললেন, “রায়মশাই, বসার ঘরে একটা ছোট দেওয়াল-আলমারি থাকা, দু-চারটে ছবি টাঙানো থাকা নতুন তো নয়। বসার ঘরে, শোওয়ার ঘরে থাকে অনেকেরই। আলমারি না হোক, দেওয়াল থাক। …ওই ঘরটা তো একসময় আমারই বসার ঘর ছিল। সাজানোও ছিল সেভাবে। ওখান থেকে আমি আসবাবপত্র তেমন কিছু সরাইনি। পড়ে আছে, থাক। কোথায় সরাব! আমি এখন যে-ঘরে থাকি সেখানে ওগুলো রাখার জায়গা কই! …তা দেওয়াল-থাকায় পাল্লা দেওয়া ছিল, পাল্লার নিচের দিকটা কাঠ, ওপরে কাঁচ। ওর মধ্যে হাবিজাবি অনেক কিছু পড়ে ছিল। পুরনো। যেমন থাকে। আর দেওয়ালে একটা বোর্ড ঝোলানো ছিল একপাশে ছবিটবি যেমন থাকে। ওই বোর্ডে তিনটে তীরও রাখা ছিল পাশাপাশি। …আমি আলমারি থেকে নিজের হাতে দু একটা জিনিস বার করে নিলেও বাকি যেমন ছিল সব পড়েই থাকত। কেউ হাত দিত না। হাত দেওয়ার দরকার হত না।”

“তীরের ব্যাপারটা বলুন?”

“বলছি। তার আগে বলি, এবারে রত্নেশ্বরবাবু যখন হোটেল বাড়ি করবার মতলব নিয়ে এখানে এসে চেপে বসলেন, উনি ওই বসার ঘরটাকে একই সঙ্গে বসা আর অফিসঘর মতন করে ফেললেন। আমি তখন তাঁকে বলেছিলাম, ঘরটা সাফ করে দিই–আপনার সুবিধে হবে। উনি বারণ করলেন। বললেন, এখন থাক, পরে দরকার পড়লে দেখা যাবে। কাজেই জিনিসগুলো পড়েই ছিল। …আর আপনি যে তীরগুলোর কথা জিজ্ঞেস করছেন, ওগুলো আমার।

আমি এককালে ভাল তীরন্দাজ ছিলাম। ওগুলো আমার প্রাইজ। কালা, লালা, পিলা…!”

“মানে? আপনি তীরন্দাজ ছিলেন?” তারাপদর চোখের পাতা পড়ছিল।

“হ্যাঁ। সে অনেক পুরনো কথা। পরে সে গল্প শুনবেন। এখন যা বলছিলাম–ওই কালা, লালা, পিলা মানে কালো, লাল, হলুদ পালক দেওয়া তীর। এগুলো হল র্যাংকিং, ওয়ান টু থ্রির মতন। আমি পেয়েছিলাম একসময়, একই বছরে নয়, পরপর তিন বছর।”

“কে, মানে কারা দিত প্রাইজ?”

নটুমহারাজ একটু হেসে বললেন, “এসব দেহাতি কম্পিটিশান। রাঁচির দিকে একটা মেলায় আদিবাসীরা তখন তীর খেলার কায়দা দেখাত। কম্পিটিশান হত। আমি নেমে যেতাম। এই আর কী!”

কিকিরা কিছুক্ষণ নটুমহারাজের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে শেষে বললেন, “তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু মহারাজ, আপনি হঠাৎ তীরের কথা তুলছেন। কেন?”

নটুমহারাজ বললেন, “আমার সন্দেহ হচ্ছে। আপনাকে তবে বলি, রত্নেশ্বরবাবুকে ওই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে আমি ভেবেছিলাম, হয়ত তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে পড়ে গিয়েছেন, মাথা ঘুরে গিয়েছে, ফেইন্ট হয়ে গিয়েছেন। টেবিলে বরফজলের কুঁজো ছিল। কাচের কুঁজো। জল নিয়ে মুখেচোখে দিতে লাগলাম। লোক ডাকাডাকি করলাম। তখন আমার কিছুই খেয়াল হয়নি। লক্ষও করিনি। ..পরের দিন ঘরটা ভাল করে নজর করতে এসে চোখে পড়ল, ক’টা ছেঁড়া হলুদ পালক মাটিতে পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে কেমন সন্দেহ হল। ঘরের দেওয়ালের দিকে তাকালাম। দেখি, বোর্ডের মধ্যে রাখা হলুদ পালক গোঁজা তীরটা নেই।

কিকিরা আর তারাপদ কেমন যেন হতবাক!

নটুমহারাজ সামান্য সময় বসে থেকে বললেন, “আমার সন্দেহের আর-একটা জিনিস দেখাই। একটু বসুন।” বলতে বলতে উঠে গেলেন তিনি।

“কিকিরা?” তারাপদ অবাক গলায় বলল।

কিকিরা বললেন, “মিস্টিরিয়াস হে তারাবাবু! হলুদ পালকের তীর। মানে, তীরের পেছনে হলুদ পালক! বুঝতে পারছি না।”

সামান্য পরেই ফিরে এলেন নটুমহারাজ। তাঁর গায়ে সাদা চাদর, উড়নি ধরনের। চাদরের আড়াল থেকে হাত বার করে কী একটা এগিয়ে দিলেন। “দেখুন! এটা আমি তিন-চারদিন পরে বাড়ির বাইরে ঘুরতে-ঘুরতে আকন্দঝোপের তলায় পেয়েছি।”

কিকিরা জিনিসটা নিলেন। অবাক হয়ে বললেন, “গ্লাভস্। তবে একটা। এ তো সার্জিক্যাল গ্লাভস নয়। কমার্শিয়াল। কলকাতার চাঁদনি বাজারে পাওয়া যায়। মোটা রাবারের দস্তানা। একটা আঙুল আবার নেই। অনামিকা কাটা। কেটে আঙুলটা ফেলে দিয়ে-মুখটা আবার জোড়া হয়েছে। এ তো বাঁ হাতের। “

নটুমহারাজ বললেন, “এবার আপনি ভেবে দেখুন। আমি আমার সন্দেহের তিনটে কারণ বললাম : উটকো লোক, হলুদ পালক লাগানো তীর গায়েব, চার-আঙুলের দস্তানা।”

কিকিরা দস্তানা হাতে বসে থাকলেন।

খানিকটা বেলা হয়ে গিয়েছিল। কিকিরারা সবাই সেই বসার ঘরে জড়ো হয়েছেন। এই ঘরেই রত্নেশ্বরকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল।

ঘরটা নজর করে করে দেখছিলেন কিকিরা।

তারাপদ সামান্য সরে গিয়ে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে চারপাশ নজর করছিল। ঘরে লালাবাবু রয়েছেন, রয়েছেন টুমহারাজ।

ঘটনা ঘটেছে অনেকদিন আগে। মাসখানেক হতে চলল। এই ঘরে, সন্ধেবেলায় বসে কাগজপত্র দেখতে দেখতেই রত্নেশ্বর চেয়ার সমেত মাটিতে পড়ে যান। তখন-তখনই জ্ঞান হারান। পরে একসময় চেতনা ফিরে এলেও সেই ঘটনার পর থেকেই তাঁর আর স্বাভাবিক জীবনের কোনো লক্ষণই আর নেই। হ্যাঁ, বেঁচে আছেন এখনও। কিন্তু অক্ষম, পঙ্গু, অথর্ব। মানুষটা কোনো রকমে শরীরে টিকে আছেন, অন্যথায় মৃত বললেও বলা চলে। বড় কষ্টের এই বেঁচে থাকা।

একমাস আগে একদিন কী ঘটেছিল সে অন্য প্রশ্ন। আপাতত কিকিরা ওই ঘরটাই দেখছেন যেখানে রত্নেশ্বর শেষবার টেবিল চেয়ারে বসে কাগজপত্র ঘেঁটেছেন।

তারাপদ বা কিকিরা কেউই বিশ্বাস করেন না, একমাস আগে যখন ঘটনাটা ঘটে তখন ঘরের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি ঠিক যেভাবে রাখা ছিল–আজও তা থাকতে পারে। সেটা সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ, নটুমহারাজ যতদূর সম্ভব ঘরটার জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে দেননি। তালা বন্ধ করে রেখে দিয়েছেন ঘরটা।

কিকিরা ঘর দেখছিলেন। তারাপদও।

বসার ঘর হিসেবে ভালই। মাঝারি ঘর মোটামুটি। জানলা চারটি। একটা ভারী টেবিল। গোটা তিনেক চেয়ার। একপাশে পিঠঅলা বেঞ্চি। দেওয়ালে কয়েকটা পুরনো ছবি। হরিণের মাথা, ক্যালেন্ডার একটা। সেই তীর রাখা কাঠের বোর্ড।

কিকিরা বললেন, “ঘরের জিনিসপত্র নাড়াচাড়া হয়েছে নিশ্চয়।”

নটুমহারাজ বললেন, “খানিকটা তো হয়েছে। তখন কে বুঝেছিল…।”

“ওই টেবিলের সামনে রত্নেশ্বর বসে ছিলেন?”

“হ্যাঁ।”

“ওই চেয়ারে?”

“হ্যাঁ।”

তারাপদ বলল, “কিকিরা, চেয়ার-টেবিল যেভাবে আছে তাতে চেয়ারে বসে সামনের দিকে মুখ তুললেই ঘরে ঢোকার দরজা চোখে পড়ে।”

লালাবাবু বললেন, “দরজার দিকটা পুব। রতনদার বসার চেয়ার-টেবিল ছিল পশ্চিমের দেওয়াল ঘেঁষে।”

“ওটা তবে দক্ষিণ? দু পাশে দুটো জানলা।“

“হ্যাঁ।”

“বারান্দার দিকে–মানে উত্তরেও একটা জানলা রয়েছে। আর পশ্চিমের দিকেও একটা।”

“হ্যাঁ।”

 কিকিরা নটুমহারাজকে বললেন, “টেবিলে কী কী ছিল নটুবাবু?”

“কাগজপত্র। হোটেলের প্ল্যানের ড্রয়িং কাগজটা। হিসেবপত্রের একটা খাতা। টুকিটাকি রসিদের কাগজ। সব কি আর মনে আছে?”

“আর কী ছিল?”

“শরবতের গ্লাস, বরফজলের কুঁজো কাচের ছোট কুঁজো। পান আর জরদার কৌটো।”

“রত্নেশ্বরের হাতের কাছেই সব ছিল?”

“সেইরকমই থাকত।”

“টেবিলের বাতিটা কোথায় ছিল? কেরাসিনের বাতি তো!”

 “বাতিটা একটু তফাতে সরানো ছিল। এ বাড়িতে ইলেকট্রিক নেই।”

“টেবিলের জিনিসগুলো তো আপনারা তুলে নিয়েছিলেন?”

 “তা তো নিয়েইছি। তখন আর অন্য ভাবনা মাথায় আসেনি।”

“রত্নেশ্বরবাবুর মুখোমুখি টেবিলের এপাশে কি দুটো চেয়ারই ছিল? মনে আছে আপনার?”

“একজোড়া চেয়ারই বরাবর থাকত, লোকজন এলে বসার জন্যে।”

তারাপদ ঘরের মধ্যে নড়াচড়া করছিল। দেখছিল। পুবের জানলার পাশে, বাইরে করবী আর কলকে ফুলের ঝোপ। অন্য গাছও আছে। পশ্চিমের জানলার পেছনে মস্ত বাতাবি লেবুর গাছ। বাগানের পাঁচিলটা চোখে পড়ে না, ঝোপে আড়াল পড়েছে।

কিকিরা কিছু বলার আগেই লালাবাবু বললেন, “রায়বাবু, ঠিক এইখানটায় রতনদা পড়ে ছিল।” বলে টেবিলের পেছন দিকে ডানহাতি মেঝেটা দেখালেন।

কিকিরা নটুমহারাজের দিকে তাকালেন। লালাবাবু ঘটনার সময় এখানে ছিলেন না। তিনি পরে শুনেছেন। টুমহারাজ জানেন ঠিকঠাক। তা ছাড়া তিনিই প্রথম এ-ঘরে ঢুকে রত্নেশ্বরকে পড়ে থাকতে দেখেন।

নটুমহারাজ মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ, লালাবাবুর দেখানো জায়গাটাতেই রত্নেশ্বরকে পড়ে থাকতে দেখেছিলেন তিনি।

কিকিরা কয়েক পা সরে গিয়ে তীর রাখা বোর্ডটার দিকে তাকালেন। দেখলেন। দেওয়াল-আলমারির পাল্লা খুললেন। দেখলেন ভেতরটা। পুরনো আবর্জনা জমানো আছে বললেও ভুল হয় না। নিচের দিকে ছেঁড়া বই, পাঁজি, রঙের ফাঁকা কৌটো, ব্রাশ, আরও কিছু কিছু। বললেন, “অন্য তীরগুলো ঠিক-ঠিক আছে?”

“আমি দেখেছি।” নটুমহারাজ বললেন। “প্রথমে ওদিকে তাকাবার কথা মনে হয়নি আমার। তখন কী অবস্থা বুঝতেই পারছেন। রত্নেশ্বরবাবু চেয়ার উলটে মাটিতে পড়ে আছেন। অজ্ঞান। ওঁকে নিয়েই আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি। পরে যখন দেখি, চোখে পড়ল, হলুদ পালক লাগানো তীরের কটা ছেঁড়া পালকের টুকরো মাটিতে পড়ে আছে। তখনই আমার নজর গেল দেওয়ালের দিকে।”

কিকিরা মাথা নাড়লেন। বুঝতে পারছেন।

 লালাবাবু কী বলতে যাচ্ছিলেন, কিকিরাই হঠাৎ বললেন, “মহারাজজি, এবার বলুন তো রত্নেশ্বরবাবু যে পড়ে গিয়েছিলেন, শরীরের কোথায়-কোথায় লেগেছিল? রক্তপাত?”

নটুমহারাজ বললেন, “ওঁর ভারী শরীর। ওইভাবে পড়েছেন আচমকা। কয়েক জায়গাতেই লেগেছিল। মাথায় লেগে একটা জায়গা ফুলে গিয়েছিল। নাকেও লেগেছিল। রক্ত পড়েছিল নাক থেকে। ঘাড়ের কাছে কালসিটে। কপাল কেটে গিয়েছিল অল্প।”

কিকিরা মন দিয়ে শুনলেন সব। তারপর বললেন, “ডাক্তার এসে সবই দেখেছিলেন?”।

“আজ্ঞে, হ্যাঁ।”

“কিছু বলেননি?”

“না, মানে উনি স্ট্রোক বলেই ধরে নিয়েছিলেন।”

কিকিরা চুপ করে থাকলেন সামান্য। পরে বললেন, “নটুবাবু, আপনি কি ডাক্তারবাবুকে আপনার সন্দেহের কথা বলেছিলেন?”

“না,” মাথা নাড়লেন নটুমহারাজ, “কী বলব বলুন! গোড়ায় তো আমার সন্দেহ হয়নি। পরে হয়েছে।”

“থানায় জানিয়েছেন কিছু?”

“আজ্ঞে না। থানায় কী জানাব বলুন! এ তো আমার সন্দেহ। প্রমাণ আমি কোথায় পাব?”

কিকিরা মাথা নাড়লেন। কথাটা ঠিকই। প্রমাণ কিছু নেই। একমাত্র বলা যায়, একটা অজানা, অচেনা লোক রত্নেশ্বরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল সন্ধেবেলায়, ঘটনার আগে। সে চলে যাওয়ার পরই রত্নেশ্বরকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়।

থানায় যদি জিজ্ঞেস করে, লোক এসেছিল তার প্রমাণ কী, মশাই? তাকে কেউ দেখেনি। দেখেছে একটা বাচ্চা মেয়ে। দেখেছে সে চলে যাওয়ার সময়। চেহারাও বলতে পারছে না, বলছে, ভূতের মতন দেখতে! বাচ্চা মেয়ের কথায় বিশ্বাস কী! সে তো ভুলও বলতে পারে, বা মিছে ভয় পেয়েও বলতে পারে।

কিকিরা বললেন, “লালাবাবুকেই যা বলার বলেছেন তা হলে?”

লালাবাবু বললেন, “আমাকেই বলেছেন। খুঁচিয়েও যাচ্ছেন নটুমহারাজ। আমি রায়বাবু, এতসব বুঝি না। তবে নটুমহারাজ আমার পুরনো বন্ধু। আমিও তো কম বার রতনদার সঙ্গে এখানে আসিনি। রতনদা আমার দাদা হলেও বন্ধুর মতন ছিল। তাকে যদি কেউ সত্যি-সত্যি খুন করার চেষ্টা করে থাকে তবে আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না।”

তারাপদ বলল, “অন্যরাও তো এতদিনে জেনে গিয়েছে যে, আপনি, আপনারা, এখন আর আগের মতন সেরিব্রাল স্ট্রোকের কথাই ভাবছেন না।”

লালাবাবু বললেন, “তা জেনেছে।”

“সকলেই?”

“হ্যাঁ। যজ্ঞেশ্বর, নিমাই, আনন্দ সবাই জেনেছে।”

“কী বলছে?”

“বিশ্বাস করছে না। বলছে, এমন হতেই পারে না।”

“আপনি নিজে এখন কী মনে করছেন?”

লালাবাবু কিকিরার দিকে তাকালেন। বললেন, “দেখুন, আগে আমার মনে হচ্ছিল নটুমহারাজ পাগলামি করছেন। এখন মনে হয়, ব্যাপারটা সত্যি হলেও হতে পারে। কেননা, যে-লোকটা সেদিন এসেছিল সে তো আর পরে এল না। রতনদা অসুস্থ হওয়ার পর ওই অবস্থায় এখানে দু দিন ছিল। কত লোক এসেছে খোঁজখবর নিতে। কিন্তু সেই লোকটা তো আর আসেনি।”

তারাপদ বলল, “আপনি কেমন করে জানলেন?”

 লালাবাবু একটু যেন হাসলেন। বললেন, “সেই লোকটা যদি আসত-নিশ্চয় বলত, সেদিন সন্ধেবেলায় সে এসেছিল আর রতনদাকে সুস্থ অবস্থাতেই দেখেছে। সেটাই স্বাভাবিক হত। নয় কি?”

নটুমহারাজ বললেন, “অন্যরকমও যদি হত, তার চোখের সামনে রত্নেশ্বরবাবু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে চেয়ার থেকে পড়ে যেতেন, সে নিশ্চয় চেঁচিয়ে লোকজন জড়ো করত। কিন্তু সে কিছুই করেনি। পালিয়ে গেছে লুকিয়ে।”

তারাপদ বলল, “তা আপনি কেমন করে বুঝলেন। লোকটা চলে যাওয়ার পরও তো রত্নেশ্বরবাবু অসুস্থ হতে পারেন।”

“আমি প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে এসেছি।”

“অথচ লোকটিকে আপনি দেখতে পাননি?”

“না। আমি এসেছি বাড়ির পেছন দিক থেকে, আর সে সরাসরি এই ঘর থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে ফটক খুলে চলে গিয়েছে।”

লালাবাবু বললেন, “যতই যা বলুন, যে এসেছিল সে যদি ভাল লোকই হবে, তা হলে পরের দিন খবরটা যখন রটে গেল ঘাটশিলায়, নিশ্চয় একবার আসত এবাড়িতে। বলতে আসত যে, রতনদাকে সে একটু আগেই সুস্থ অবস্থায় দেখে গিয়েছিল।”

কিকিরা অস্বীকার করতে পারছিলেন না যুক্তিটা।

সামান্য পরে কিকিরা বললেন, “এই ঘাটশিলায় কেউ কি শত্রু আছে। রত্নেশ্বরবাবুর?”

“শত্রু?”

“হোটেল করা নিয়ে কারও সঙ্গে ঝগড়া বা রেষারেষি হয়েছে?”

“না; জানি না।”

“হোটেলটা কোথায় হচ্ছে?”

“এখান থেকে বেশি দূর নয়। নদীর কাছাকাছি।”

“জায়গাটা কতদিন আগে কেনা?”

“বছর তিন।“

“কোনো নতুন লোক, অচেনা কেউ কি আসত এখানে, হালে?”

নটুমহারাজ বললেন, “কন্ট্রাক্টর, মুনশি, অন্য দু-একজন যারা আসত–তাদের আমি চিনি। তারা পরেও এসেছে।”

“নতুন কাউকে দেখেননি?”

“না। মাত্র একজনকে একবার দেখেছি। “

“সে কে?”

“জানি না। তবে সে কলকাতা থেকে এসেছিল।…বেলায় এল একদিন, দেখা করল। চলে গেল। আর তাকে দেখিনি।”

“আপনি কেমন করে জানলেন কলকাতা থেকে এসেছিল?”

“রত্নেশ্বরবাবুই বলেছিলেন। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।”

“তার নামধাম?”

“কিছুই বলেননি।”

কিকিরা লালাবাবুর দিকে তাকালেন। উনি মাথা নাড়লেন। তিনি জানেন না।

কী ভেবে কিকিরা নটুমহারাজকে বললেন, “মহারাজ, আপনি লালাবাবুকে কি আপনার সন্দেহের সব কথা বলেছেন?”

নটুমহারাজ মাথা নাড়লেন। বললেন, “কেমন করে বলব! আচমকা খবরটা ওঁকে লোক পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। টেলিগ্রামের বিশ্বাস কী! তা ছাড়া এখান থেকে কলকাতা যাওয়া মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার। লালাবাবু এলেন। আমরা ডাক্তারবদ্যি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তারপর উনি রত্নেশ্বরবাবুকে নিয়ে কলকাতায় চলে গেলেন। বউমারা গেল যজ্ঞেশ্বরের সঙ্গে ট্রেনে। তারপর কলকাতায় রত্নেশ্বরবাবুকে নিয়ে লালাবাবু ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। উনি তো আর এখানে আসেননি। আসা সম্ভব ছিল না।…আমি চিঠি লিখে-লিখে লালাবাবুকে আমার সন্দেহের কথা জানিয়েছি।”

“চিঠিতে তীর হারানো, দস্তানা পাওয়ার কথা লেখেননি?”

“না। চিঠিতে অত কথা লেখা যায় না। লিখলেও উনি বুঝতেন না। তবু আভাস দিয়েছি। লালাবাবুর আসার কথা ছিল এখানে। সাক্ষাতে সব বলতাম।”

মাথা নাড়লেন লালাবাবু। কিকিরাকে বললেন, “রায়বাবু, আমি প্রথম থেকেই আপনাকে বলেছি, এ-সব ব্যাপার আমার মাথায় ঢোকে না। একটা মানুষ মরতে চলেছে-তাকে নিয়ে আমি ব্যস্ত। নটুমহারাজ কী লিখতেন–তাও আমি ভাল করে পড়তে পারতাম না। বুঝতাম না।…তবে কাল রাত্তিরে ওঁতে-আমাতে যখন কথা হচ্ছিল–ওঁর কথা শুনেছি। “

তারাপদ ঘরের মধ্যেই পায়চারি করছিল যেন। হঠাৎ বলল, “কিকিরা, সেই লোকটা, যে কলকাতা থেকে এসেছিল, দেখা করে আবার চলে গেল, সেই লোকটার খোঁজ নেওয়া যায় কেমন করে?” বলে লালাবাবুর দিকে তাকাল। বলল, “আপনি কি এমন কাউকে চেনেন, যার বাঁ হাতে চারটে আঙুল?”

লালাবাবু মাথা নাড়লেন। “মনে করতে পারছি না”।

.

০৫.

তারাপদকে সঙ্গে নিয়ে দুটো দিন ঘোরাঘুরি করলেন কিকিরা। লালাবাবু বা নটুমহারাজকে সঙ্গে নিলেন না। ঘাটশিলা জায়গাটা বিরাট কোনো শহর নয়, হাজারটা গলিখুঁজি, রাস্তাও নেই; বাড়ি নেই শয়ে-শয়ে কাজেই এই ছোট শহরটায় ঘুরে বেড়াতে কোনো অসুবিধে হচ্ছিল না। আর বাড়ি ঘরদোর কম-এমনকি কলকাতার ছোটখাট পাড়াতেও যত দোকানপসার থাকে–এখানে তাও চোখে পড়ে না। স্টেশনের দিকটাই যা জমজমাট।

কিকিরা তো ঘাটশিলায় বেড়াতে আসেননি, কাজেই হেলেদুলে গা এলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর অবসর তাঁর ছিল না। উদ্দেশ্য নিয়েই ঘুরতেন। যদিও বুঝতে পারতেন না, এভাবে ঘুরে বেড়িয়ে কাজের কাজ কিছু হবে কী না!

রত্নেশ্বর যেখানে হোটেল করবেন বলে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করেছিলেন, কিকিরা সেই জায়গাটাতেও গিয়েছিলেন। অবশ্য লালাবাবুকে সঙ্গে করেই।

জায়গা এবং খোঁড়াখুঁড়ি দেখে কিকিরাদের মনে হয়েছিল, রত্নেশ্বর বড়সড় কোনো হোটেল তৈরির কাজে হাত দেননি। ছোট হোটেল। দোতলার ভিত করেছেন। ঘর ঠিক কতগুলো করতেন, নকশা না দেখলে বলা মুশকিল। হয়ত সাত-আটটা। দোতলার একপাশে নিজেদের থাকার ব্যবস্থা করারও ইচ্ছে ছিল।

লালাবাবুর কথা শুনলে মনে হত, রত্নেশ্বর হোটেলটাকে আপাতত বরাবরের মতন চালাবার কথা ভাবেননি। পুজো থেকে শীতের শেষ–মাত্র চার-পাঁচ মাস–চালাবেন ভেবেছিলেন। ওই সময়টায় লোকজন আসে এখানে বেড়াতে। গরমে, বর্ষায় কে আর আসবে!

কাজটা শুরু করেছিলেন ভদ্রলোক, হয়ত একটু তাড়াহুড়ো ছিল–কিন্তু কী কপাল, শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই এমন ঘটনা ঘটল যে, উনি আর কোনোদিন এটা শেষ করতে পারবেন না। প্রাণে বেঁচে থাকলেও হয়ত নয়। তা ছাড়া ওভাবে কতদিনই বা আর বাঁচবেন!

.

সেদিন শেষ বিকেলে তারাপদকে নিয়ে কিকিরা আবার হোটেলের জায়গাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।

জায়গাটা ভাল। উঁচু জমির ওপর। খানিকটা তফাতে ঢল নেমেছে। তারপর এবড়ো-খেবড়ো জমি। জমি ঘুরলো কি পাথর ছোট, বড়। শেষে সুবর্ণরেখা নদী।

হোটেলটা যদি শেষ হত, চালু হয়ে যেত বছরখানেক কি দুয়েকের মধ্যে কিকিরার ধারণা, রত্নেশ্বর বোধ হয় ব্যবসাটা জমিয়ে তুলতে পারতেন। ছুটি কাটাবার মতনই জায়গা আর পরিবেশ।

কিকিরা হঠাৎ বললেন, “তারাবাবু, সেই যে কথায় বলে, ম্যান প্রপোজেস গড ডিসপোজেস–এ হল তাই।” বলতে বলতে নিশ্বাস ফেললেন বড় করে।

তারাপদ বলল, “তা ঠিক।…তবে কি কিকিরা, আমার মনে হচ্ছে, গড় নয়–অন্য কেউ…”

তারাপদকে কথা শেষ করতে না দিয়ে কিকিরা হাত বাড়িয়ে কী যেন দেখালেন। “ওই দেখো?”

“কী?”

“ভাল করে দেখো।”

হোটেলের ভিত খোঁড়ার পর তার গাঁথনির কাজও শেষ হয়েছিল মোটামুটি। পাশে একটা স্টোর, মানে মালপত্র রাখার গুদোম, যেমন হয় সচরাচর। এ-পাশে ও-পাশে ইটের পাঁজা, পাথরকুচি আর সাদা নুড়ির ভূপ, কিছু লোহালক্কড়, সুরকি। কাজকর্ম বন্ধ বলে দরোয়ান গোছের জনা দুয়েক আছে গুদোমের কাছেই চালার নিচে।

সাইকেলে করে একজন এগিয়ে আসছিল।

হোটেল তৈরির কাজকর্ম যাদের হাতে ছিল, কন্ট্রাক্টার সিংহি, মুনশি তেজনারায়ণ–এদের সঙ্গে আগেই আলাপ করেছেন কিকিরা। লালাবাবু আলাপ করিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের কোনো কথাই ভাঙা হয়নি। নিষেধ করেছিলেন কিকিরা। রত্নেশ্বর সাংঘাতিকভাবে অসুস্থ-মরাবাঁচার ঠিক নেই–এইটুকুই শুধু জানে তারা। অন্য কিছু নয়।

সাইকেল চালিয়ে যে আসছিল সে একেবারে কাছে এসে নেমে পড়ল। রোদে-পোড়া চেহারা, বয়েস বছর চল্লিশ হবে, পরনে মালকোঁচা-মারা ধুতি, গায়ে হাফশার্ট।

কিকিরারা দাঁড়িয়ে থাকলেন।

লোকটা সাইকেল থেকে নেমে দেখল কিকিরাদের। তারপর হাত তুলে নমস্কার জানাল।

“বাবুরা ঘোরাফেরা করতে এসেছেন?”

 কিকিরা লোকটাকে দেখছিলেন। মাথায় মাঝারি। গায়ে মেদ নেই, হাড়-হাড় চেহারা, লম্বা-লম্বা হাত, চেটালো হাড়। মুখ চৌকোনো, চোয়ালের হাড় ঠেলে উঠেছে। চোখ দুটো ঘোলাটে মতন। গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। গোঁফটি একেবারে কাঁচাপাকা।

কিকিরা বললেন, “হ্যাঁ, ঘুরতে-ফিরতে।”

“আমার নাম লখিন্দর দাস।”

কিকিরা মাথা নাড়লেন। এমনভাবে নাড়লেন যে নামটি তাঁর পছন্দ হয়েছে। বললেন, “এখানকার লোক?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। দেশবাড়ি তমলুক। এখানেই থাকি।”

“কী করা হয়?”

“আজ্ঞে, একটা ছোট দোকান আছে। স্টেশনের কাছেই। মনিহারি। আর জমি কেনাবেচা দেখি অল্পস্বল্প।”

কিকিরা বুঝতে পারলেন, লখিন্দর টুকটাক জমির দালালিও করে।

লখিন্দর নিজেই বলল, “এদিক পানে একটা কাজে এসেছিলাম। ওই পশ্চিম দিকে একটা জমি আছে। বেচার কথা চলছে।…তা এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় আপনাদের দেখলাম। আপনার কী জমি…?” কথাটা শেষ করল না সে।

কিকিরা সরাসরি না বললেন না। মাথা নাড়লেন না। তাঁর মনে হল, লোকটার সঙ্গে খানিকটা আলাপ জমানো যেতে পারে। স্থানীয় লোক। যদি কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায়।

আলাপ জমাবার মতন করে কথা বলতে শুরু করলেন কিকিরা। না, ঠিক জমি কেনার মতলব নিয়ে এখানে ঘুরছেন না, এমনিই বেড়াতে বেড়িয়েছেন; তবে জায়গাটা যেমন ভাল লাগছে, ছিটেফোঁটা জমি হয়ত কিনতেও পারেন পরে। কেমন দামটাম এখানে? লোকে কিনছে? বাঙালি, না বিহারিরাই বেশি কিনছে?

তারাপদ চুপ করে কথাবার্তা শুনছিল কিকিরাদের।

লখিন্দর বলল, “জমিটমি এখনো এদিকে সস্তা বাবু। ওপারে অবশ্য বেশি। এধারে কম। আগে আর কে জমি কিনতে আসত এখানে? এখন কেনে। ঘরবাড়ি কত বেড়ে গেছে আগের তুলনায়।”

কিকিরা এবার আচমকা কথা ঘোরালেন। “এখানে–এই জায়গায় একটা হোটল হচ্ছিল জানো নাকি?”

“জানি।”

“বাবুকে চিনতে? হোটেল বাড়ি যিনি তৈরি করাচ্ছিলেন?”

 মাথা হেলিয়ে লখিন্দর বলল, “চিনতাম। কলকাতার রতনবাবু।”

“জানাশোনা ছিল? নাকি এমনি চিনতে?”

“না না, ভালই চিনতাম। বাবুর কাছে গিয়েছি। এই কাজ যখন শুরু হল–এদিক পানে এলেবাবু যদি থাকতেন, কাছে এসে দাঁড়িয়েছি, কথা হয়েছে।”

“বাবুর কোনো খবর রাখ?”

“আজ্ঞে, শুনেছি বাবু হাসপাতালে আছেন। কলকাতায়।”

কিকিরা কী যেন ভেবে বললেন, “হাসপাতালে নয়, বাড়িতে ভাল নেই।”

লখিন্দর কৌতূহল বোধ করল। “আপনারা?”

 কিকিরা বললেন, “আমরা বাবুর চেনাজানা। ওঁর কলকাতার বাড়িতেও আসা যাওয়া রয়েছে। এখানে একটা দরকারি কাজে এসেছি। একবার জায়গাটা দেখতে এলাম। মানুষের কী কপাল বলল। কত সাধ করে এই হোটেল তিনি করতে এলেন, আর কী হল! সবই ভাগ্য।”

লখিন্দর মাথা নাড়ল। আফসোসের মতন করে বলল, “বাতে না থাকলে জমি বাড়ি সয় না। এ একেবারে সত্যি কথা, বাবু!…আপনারা উঠেছেন কোথায়?”

“ওই বাড়িতেই।”

“ওই বাড়িতে।”

“কেন?”

“না না, এমনি বললাম।…তা আপনারা কি শুনেছেন, এই জমিটমি, ভিত-সমেত নাকি বিক্রি করে দেবেন রতনবাবুর বাড়ির লোক?”

“কই, না।”

“তবে গুজব। শুনছিলাম, তাই বললাম।”

“গুজব তো রটেই লখিন্দর। তবে এখন যে বিক্রিবাটার কথা হয়েছে এমন শুনিনি। ভবিষ্যতে হতে পারে, জানি না। “

লখিন্দর এবার যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হল। “আমি যাই বাবু!”

“চলো, আমরাও যাই।”

 কিকিরা ডাকলেন তারাপদকে।“চলো, ফেরা যাক।”

 তিনজনে ফিরতে লাগলেন।

একথা সেকথার পর কিকিরা হঠাৎ বললেন, “লখিন্দর, এই জমি রতনবাবু যখন কেনেন তখন তুমি কোথায় থাকতে?”

“আজ্ঞে, এখানেই ছিলাম।”

“জমি কেনার কথা শুনেছিলে?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। ..উনি নিজেই একদিন বলেছিলেন। তবে হোটেলের কথা বলেননি। বলেছিলেন, বাড়ি করবেন পরে। বড় করে।”

কিকিরা এবার একটা চুরুট ধরালেন। লখিন্দরকে দিতে গেলেন। নিল না সে। বলল, “সিগারেট, বিড়ি আমি খাই না বাবু। পান-জরদা খাই। দিনে তিন-চারটি।”

তারাপদ বুঝতে পারছিল, কিকিরার মতলব অন্যরকম। তিনি ফাঁকফোঁকর গুজছেন কোনো কথাবার্তা যদি জানতে পারেন।

হাঁটতে-হাঁটতে একসময় তারাপদই বলল, “হোটেল করার মতলবটা যে কেন এল রত্নেশ্বরবাবুর, কে জানে! ঠিক কি না কিকিরা! এখানে একটা বেড়াবার বাড়ি করলেই তো পারতেন। ওঁর তো পয়সার অভাব নেই। ব্যবসাদার মানুষ!”

কিকিরা একবার তারাপদকে দেখে নিলেন। বললেন, “সে ওঁর খেয়াল। তা বাড়িই করুন আর হোটেলই করুন, ভাগ্যে যা লেখা ছিল তা তো হতই। কী বলো লখিন্দর!”

লখিন্দর মাথা হেলিয়ে দিল। ঠিক কথা।

আরও একটু এগিয়ে এসে কিকিরা বললেন, “লখিন্দর, নটুমহারাজকে নিশ্চয় চেনো তুমি।”

লখিন্দর অবাক হয়ে বলল, “চিনব না? উনি এখানকার লোক।”

“এই জমিটা কি উনিই কিনিয়ে দিয়েছিলেন?”

“আমি জানি না, বাবু।”

“মহারাজজি মানুষটি বেশ। তাই না! রত্নেশ্বরবাবুর বন্ধু।”

লখিন্দর হঠাৎ বলল, “মানুষ ভাল। তবে ওঁর এক ভাই আছে। এখানে থাকে না। সে বড় খারাপ লোক। ভাইয়ে ভাইয়ে বনিবনা নেই অনেককাল। আগে এখানে থাকত। পরে মহারাজ তাকে তাড়িয়ে দেন। একবার পুজোর সময় ডাকাতি করেছিল। ধরা পড়েও কেমন করে ছাড়া পেয়ে যায়। তারপর থেকে আর আসে না এখানে।”

কিকিরা আর তারাপদ মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।

 কিকিরা বললেন, “কতদিন আগে সেটা?”

“তা… তা বাবু, সাত-আট বছর আগে। “

“কোথায় থাকে সে?”

“আমি সঠিক জানি না, বাবু।…কেউ বলে জামশেদপুরে থাকে, কেউ বলে ঝাড়গ্রাম। স্বভাব কি আর পালটেছে! শোনা তো যায় না। তবে কে যেন একবার বলছিল, সাপখোপের ধন্বন্তরি হয়েছে। শুনেছি, এখন পয়সাও কামায়।”

তারাপদ হঠাৎ বলল, “এখানে আসে না?”

“না। অনেককাল আগে একবার দেখেছিলাম। আর হালে একদিন দেখেছি।”

কিকিরা কৌতূহল বোধ করলেন। বললেন, “হালে মানে কতদিন আগে?”

লখিন্দর যেন মনে-মনে একটা হিসেব করছিল। বলল, “তা ধরুন মাস হতে চলল।”

কিকিরাও একটা হিসেব করে নিলেন। রত্নেশ্বরের অসুস্থতাও ওইরকম সময়ের ঘটনা। দু-পাঁচদিন আগে-পিছে হতে পারে। পরে ভাল করে মিলিয়ে নেবেন হিসেবটা। অবশ্য মহারাজের ভাইয়ের ঘাটশিলায় আসার ব্যাপারটা নিশ্চিত করে জানতে হবে। সময়টাও সঠিকভাবে না জানলে দুটো ঘটনাকে মেলানো যাবে না।

“তুমি কি মহারাজের ভাইকে তখন দেখেছ? মানে হালে যখন এসেছিল?”

“দেখেছি।…আজ্ঞে, আমি বললাম না–স্টেশনের কাছে আমার একটা ছোট মনিহারি দোকান আছে। আমি দোকানে বসে বিক্রিবাটার হিসেব করছিলাম, এক সময় চোখ তুলতেই নজর গেল, রাস্তায় একটা লোক রিকশা থেকে নামছে। প্রথমে খেয়াল করিনি, পরে আন্দাজ হল সহদেববাবু।”

“নটুমহারাজের ভাইয়ের নাম সহদেব?”

“আজ্ঞে।”

“কী করল সহদেব?”

“রেল স্টেশনের দিকে চলে গেল।”

“আর দেখনি?”

“না।” বলেই লখিন্দরের কেমন কৌতূহল হল। বলল, “আপনি এত কথা জানতে চাইছেন কেন, বাবু?”

কিকিরা বুঝলেন, আপাতত আর কৌতূহল জানানো উচিত নয়। একটু সময় নিয়ে এগুনোই ভাল। বললেন, “না, তোমার মুখে শুনলাম কি না, তাই। গল্প-গল্প লাগছিল।…তা লখিন্দর, তুমি কি এখন দোকানে যাচ্ছ?”

“সন্ধেকালে দোকানেই থাকি আমি।”

“বাঃ, ভালই হল। কাল যদি তোমার দোকানে যাই, দেখা পাব।”

“পাবেন। আমার নাম বললেই দোকান দেখিয়ে দেবে। দুগা ভাণ্ডার।” কিকিরা আর কিছু বললেন না।

.

০৬.

নিজেদের ঘরে বসে কথাবার্তা হচ্ছিল। রাত হয়েছে খানিকটা। সামান্য আগে বৃষ্টি এসেছে, বাইরে বৃষ্টির শব্দ, গাছপাতাও বাতাসে দুলছে, শব্দ হচ্ছিল। এই বৃষ্টি বেশ আরামের। ঘরের জানলার দুটো খোলা, একটা বন্ধ। খোলা জানলা দিয়ে জলের ছাট আসছিল না।

কিকিরা বললেন, “আপনি তা হলে জানেন না?”

লালাবাবু বললেন, “না।” বলে মাথা নাড়লেন। “আমি কথায় কথায় একবার শুনেছিলাম, নটুমহারাজের এক ভাই ছিল। তিনিই বলেছিলেন। সেই ভাই কোথায় থাকে, কী করে তা বলেননি। আমার তো মনে পড়ছে না।

ঘরে নটুমহারাজ ছিলেন না। ওঁরা তিনজনই শুধু আছেন, কিকিরা, তারাপদ আর লালাবাবু।

কিকিরা লালাবাবুর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। অপেক্ষা করে বললেন, “ভাল করে মনে করুন। ভাই সম্পর্কে কখনও কিছু বলেননি নটুমহারাজ?”

লালাবাবু মাথা নাড়লেন। “না। আমার খেয়াল হচ্ছে না। তবে যানটুমহারাজ এটুকু বলেছিলেন যে, ভাইয়ের কোনো খোঁজখবরই তিনি রাখেন না।”

তারাপদ বলল, “লালাবাবু, আপনার সঙ্গে টুমহারাজের জানাশোনা কতদিনের?”

“বছর তিন-চার। একবার রতনদার সঙ্গে এসে দিন পনেরো ছিলাম। এখনই পরিচয়।… আমি পরে আরও দু-তিনবার এখানে এসেছি রতনদার সঙ্গে; কিন্তু বেশিদিন থাকিনি। নটুমহারাজের সঙ্গে ওইভাবেই আলাপ-পরিচয়, বন্ধুত্ব। মানুষটিকে আমার ভাল লাগত।”

কিকিরা বললেন, “রত্নেশ্বরবাবুর সঙ্গে সহদেবের–মানে মহারাজের ভাইয়ের পরিচয় ছিল?”

“না। কেমন করে থাকবে! থাকলে কি রতনদা আমায় বলত না?”

তারাপদ কিকিরাকে বলল, “স্যার, রত্নেশ্বর এখানে আসছেন পাঁচ-ছ বছর। যদি তাই হয়, আর লখিন্দর যা বলল তা ঠিক হয়–তবে রত্নেশ্বর যখন থেকে আসছেন তার আগে থেকেই সহদেব এখান থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে। দু’জনের দেখাসাক্ষাৎ পরিচয় হওয়ার কথা নয়।”

কিকিরা কিছুই বললেন না।

লালাবাবু বললেন, “রায়বাবু, এ নিয়ে এত মাথা ঘামাবার কী আছে! নটুমহারাজকে জিজ্ঞেস করলেই হয়।”

কিকিরা বললেন, “তা করতে হবে শেষপর্যন্ত। এখন কিছু বলবেন না। কিন্তু একটু দেখেনি।…আচ্ছা, লালাবাবু, লখিন্দর বলল–সহদেব এখন সাপের ধন্বন্তরি হয়ে গিয়েছে। পয়সাও কামাচ্ছে। তার মানে কী? ও কি ওঝাগিরি করছে?”

লালাবাবু বললেন, “কেমন করে বলব! তবে ওঝাটঝার দিন চলে গিয়েছে বলে আমার মনে হয়। এখন কে আর ওঝাগিরিতে বিশ্বাস করে!… একেবারে গাঁ-গ্রামে, যেখানে ডাক্তারবদ্যি নেই, সেখানে হয়ত ওঝার ডাক পড়ে এখনো। নয়ত কে আর সাপ কামড়ালে ওঝা ডাকে আজকাল। বিশেষ করে সহদেব যদি জামশেদপুর কি ঝাড়গ্রাম শহরের মতন জায়গায় থাকে! হাসপাতাল পড়ে থাকতে ওঝা! আমার বিশ্বাস হয় না।”

তারাপদ বলল, “আমাদের ইন্টেরিয়ার গাঁ গ্রামে, জঙলি জায়গায় এখনো অনেক অদ্ভুত কাণ্ড হয়। কাগজে একবার পড়েছিলাম, কোথায় যেন ডাইনি ধরা হয়েছিল। এ সমস্ত জায়গায় ওঝাও থাকে হয়ত।“

কিকিরা অন্য কথা ভাবছিলেন। অন্যমনস্কভাবে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকলেন অল্পক্ষণ। তারপর বললেন, লালাবাবু, সহদেবের খোঁজটা কেমন করে পাওয়া যায় বলুন তো?”

“তাই তো ভাবছি! নটুমহারাজ ছাড়া…। তবে, তিনিও যদি না জানেন! আগে মশাই, এত জানতাম না, ভাবিওনি। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, ভাইয়ে ভাইয়ে মুখ দেখাদেখি যখন নেই, উনিও কি কোনো খোঁজ রাখেন। সহদেবের! মনে তো হয় না।”

 কিকিরা কিছু বললেন না।

 খানিকক্ষণ কেউ আর কোনো কথা বলল না।

 লালাবাবু উঠে পড়লেন। “বসুন আপনারা, আমি একবার গুরুচরণের খোঁজ করে আসি। দেখি, রান্নাবান্নার কতদূর এগুলো!”

উঠে গেলেন লালাবাবু।

 কিকিরা সিগারেট চাইলেন তারাপদর কাছে।

সিগারেট ধরানো হয়ে গেলে হঠাৎ একটু হেসে কিকিরা বললেন, “তারাবাবু, ধাঁধাটা কেমন লাগছে? কোনো দিশে পাচ্ছ?”

“না।”

“ তা হলে তো ব্যাক ওয়াকিং করতে হয়।”

“মানে?”

“পশ্চাৎগমন। পৃষ্ঠ প্রদর্শনও বলতে পারো।”

“সে আপনার ইচ্ছে। তবে স্যারকে এতদিন ধরে দেখছি তো, আপনি কি ইজিলি ব্যাক শো করবেন?” ঠাট্টা করেই বলল তারাপদ।

সিগারেট ফুঁকতে-ফুঁকতে হালকা ভাবেই কিকিরা বললেন, “দেখো হে, আমি একটা ম্যাজিশিয়ান। স্টেজে ভূত নাচাতেও পারি। কিন্তু এই রক্তমাংসের ভূতকে কেমন করে ধরব! আমিও বোকা হয়ে আছি। … বেচু দত্ত বলত, ছিপ ফেলার আগে পুকুরটা দেখে নেবে। ঠিক কথাই বলত, তারাবাবু! এ পুকুরের কোথায় যে মাছ তলিয়ে আছে বুঝতে পারছি না।”

“আপনি কি ছিপ উঠিয়ে নিতে চান?”

“ওঠাবার কথা উঠছে কোথায়? এখনো কি ছিপ ফেলেছি।”

“তা হলে এসেছেন কেন?”

“ফিফটিন থাউজেন্ডের লোভে। লোভে পড়ে হে! মানুষ মাত্রেই লোভের দাস। যাবৎ লোভং তাবৎ জীবনং…”

তারাপদ হেসে উঠল হো-হো করে। “এই স্যাংসক্রিটটা কি গীতায় আছে?”

কিকিরা গম্ভীর হয়ে বললেন, “রামায়ণে আছে। মহাভারতেও…।” বলতে বলতে থেমে গেলেন। কান পেতে যেন কোনো শব্দ শোনার চেষ্টা করলেন। বারান্দার দিকে কেউ কি এসেছে? ইশারা করলেন তারাপদকে।

তারাপদ উঠে গেল। দরজার কাছে গিয়ে দেখল বারান্দাটা। অন্ধকার বারান্দা। একটা কুকুর কখন এসে উঠেছে বারান্দায়।

ফিরে এল তারাপদ। “একটা কুকুর। বৃষ্টিতে গা বাঁচাচ্ছে।

 “যা বলছিলাম, লোভ! লোভে পড়ে রাবণবেটা গেল, গেল দুযুধন!”

“দুযুধন!”

“আরে বাবা, সব কথাতেই খুঁত ধরো কেন? ছেলেবেলায় বাণী অপেরার যাত্রা দেখেছি। একজন ফেমাস অ্যাক্টার ছিল অপেরায়, ফটিক কয়াল। মেয়ের পার্ট করত! মা-ঠাকুমার। তো সেই ফটিক কয়াল কখনও দুর্যোধন বলত না, বলত দুযুধন। নিজ পাপে মজিলি রে বাছা দুযুধন…।”

তারাপদ হাসির দমক সামলাতে না পেরে বিছানায় বসে পড়ল।

হাসি-তামাশার মধ্যেই কিকিরা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। উঠে পড়ে খোলা জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, ফেলে দিলেন সিগারেটের টুকরো, বাইরের অন্ধকার আর বৃষ্টি দেখলেন যেন, তারপর ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন, “সহদেব আমাকে ভাবাচ্ছে, তারাপদ। রত্নেশ্বরবাবুর কাছে সে-ই কি সেদিন এসেছিল? যদি এসে থাকে, কেন এসেছিল? ঘাটশিলায় সে এল কবে? সেই দিন? না, আগেই এসেছিল? যদি আগেই এসে থাকে, ছিল কোথায়? কবে সে ঘাটশিলা ছেড়ে পালাল? কে-কে তাকে দেখেছে? প্রশ্ন অনেক।”

তারাপদ বলল, “আগে আসার দরকার কী? যদি জামশেদপুর বা ঝাড়গ্রাম থেকে এসে থাকে–তবে সেইদিনই এসেছে। চলেও গেছে সেইদিন। আসা-যাওয়ার গাড়ি পেতে তো তার অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।”

“হতে পারে। যাই হোক সেটা কাল স্টেশনে গিয়ে লখিন্দরকে নিয়ে খোঁজখবর করলেই জানা যাবে।”

“আপনি টুমহারাজকে বলবেন না কিছু?”

“এখন নয়। একেবারে নয়। আগে দেখি।”

“নটুমহারাজ তাঁর ভাইয়ের কথা একবারও তোলেননি, কিকিরা।”

“দরকার হয়নি হয়ত। তা ছাড়া তিনি নিজের কথা খুব একটা বলেননি আমাদের।”

তারাপদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। সামান্য পরে বলল, “কিকিরা, আমি কিন্তু এখনও ধাঁধায় আছি। সহদেবকেই যদি সন্দেহ করতে হয়–তবে বলব, সে কেন এখানে আসবে, কেনই বা রত্নেশ্বরবাবুকে খুন করার চেষ্টা করবে? তার কিসের স্বার্থ? তা ছাড়া রত্নেশ্বরবাবুকে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল, একথা ডাক্তার-পুলিশ কেউ তো বলবে না। থানায় কোনো ডায়েরি নেই। ডাক্তারবাবুর মাথাতেও সে-চিন্তা আসেনি। শুধু নটুমহারাজের সন্দেহ থেকে…!”

কিকিরা বাধা দিলেন। বললেন, “দাঁড়াও, আরও দু-একটা দিন যাক। খোঁজখবর করি আগে।… আমি ভাবছি, সহদেব সাপের ধন্বন্তরি হয়েছে–এই কথাটা রটলো কেমন করে? কে রটাল? মানেই বা কী কথাটার?”

বারান্দায় পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।

লালাবাবু ঘরে এলেন। বললেন, “চলুন রায়বাবু খাওয়াদাওয়াটা সেরে নেওয়া যাক। আজকের বৃষ্টিটা ভালই হচ্ছে। সারারাত চলতে পারে।”

কিকিরা বললেন, “চলুন। এখানকার জলটা ভাল। দু-চার ঘণ্টা অন্তর খিদে পাচ্ছে। চলুন।”

.

পরের দিন ঠিক সময়ে কিকিরারা লখিন্দরের দোকানে হাজির। সবে সন্ধে হয়েছে। লখিন্দর দোকানেই ছিল।

ওর দোকান ছোট। মনিহারি জিনিসপত্র বিক্রি হয়।

দোকানের মধ্যে জায়গা কম। একটা ছোট বেঞ্চি দোকানের বাইরে এনে রাখল লখিন্দর। বসতে বলল। চা আনতে দিল।

সাধারণ কথাবার্তা সারতে-সারতে চা এসে গেল।

চা খেতে-খেতে কিকিরা সাবধানে কথা তুললেন সহদেবের। বললেন, “লখিন্দর, একটা উপকার করো না আমাদের।”

“কী বাবু?”

“সহদেবের একটু খোঁজখবর করে দাও না।”

লখিন্দর অবাক হল! “সহদেববাবুর খোঁজখবর! কেন?”

“সে তোমায় পরে বলব।… তুমি সেদিন তাকে দেখেছিলে–এটা ঠিক তো?”

“নিশ্চয়।”

“সহদেব তোমায় দেখেছিল?”

“না, উনি ব্যস্ত ছিলেন। রিকশা থেকে নেমেই স্টেশনের দিকে চলে গেলেন।”

“কোন রিকশা, তোমার মনে আছে?”

“হ্যাঁ। মানিকের রিকশা।”

“সহদেবকে তা হলে রিকশাঅলা ছাড়াও বাজারের আরও কেউ-কেউ দেখেছে। তাই নয়? রেল স্টেশনের কেউ না কেউ দেখে থাকবে।”

“কেন দেখবে না? মানুষ কি বাতাস বাবু যে মিলিয়ে যাবে!”

“ঠিক, একেবারে ঠিক কথা।”

তারাপদ বলল, “তখন কি কোনো ট্রেন ছিল?”

লখিন্দর বলল, “ছিল মশাই।”

“কলকাতার দিকের?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

কিকিরা আর তারাপদ একবার নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।

লখিন্দর বলল, “আপনারা অ্যাত্ত খোঁজ করছেন কেন?”

 “না, মানে একটা কথা জানতে চাইছিলাম। টুমহারাজ তো জানেনই না যে তাঁর ভাই এসেছিল।… আচ্ছা, লখিন্দর তুমি…মানে তুমি তো সহদেবকে ভালই চেনো! আগেও দেখেছ! ও কেমন দেখতে?

লখিন্দর বলল, “ডাকাতের মতন চেহারা বাবু! মাথায় আমার চেয়েও লম্বা। হাত-পা ইয়া-ইয়া-লোহার মতন। মুখটা একেবারে নেকড়ে বাঘের মতন। দেখলে ভয় হয়। গায়ের রং কুচকুচে কালো, ধরেন আমার রং।”

“হাত-পায়ে কোনো খুঁত আছে?”

“না।”

 কিকিরা যেন খানিকটা হতাশ হয়ে তারাপদর দিকে তাকালেন। বাঁ হাতে তবে চারটে আঙুল নয়! গ্লাভস-এর কথাটা মাথায় ঘুরতে লাগল।

তারাপদ বলল, “এখানে কোনো আস্তানা আছে সহদেবের?”

“জানি না বাবু। অত খোঁজ রাখি না। সহদেববাবু তো এখানে আসেন না– আস্তানা থাকবে কেন?”

কিকিরা এবার ওঠার জন্য ব্যস্ত হলেন। লখিন্দরকে বললেন, “তোমায় তবে সত্যি কথাটা বলি লখিন্দর। কাউকে বলো না। আমরা দু’জন কলকাতা পুলিশে চাকরি করি। একটা বড়রকম ডাকাতি খুন রাহাজানির জন্যে একজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। শুনেছিলাম, সে ঘাটশিলায় পালিয়ে এসেছে গা-ঢাকা দিয়ে। তার খোঁজেই এখানে আসা। তুমি একটু সাহায্য করো। আমাদের একবার নিয়ে চলো সেই রিকশাঅলার কাছে। তারপর একবার স্টেশনে খোঁজ করব, বাজারেও। তুমি সঙ্গে থাকবে। সহদেবকে কে যে সেদিন দেখেছে, কখন কখন দেখেছে, কোথায় দেখেছে–জানতে হবে।” বলতে বলতে কিকিরা পকেট থেকে দুটো একশো টাকার নোট বার করে লখিন্দরের হাতে গুঁজে দিলেন।

লখিন্দর টাকা নেবে না। কলকাতার পুলিশের নাম শুনেই সে ভয় পেয়ে গিয়েছে। পুলিশ যেখানকারই হোক, তার ছোঁয়া বাঘের ছোঁয়ার চেয়ে দুগুণ। কী সর্বনাশ! এঁরা পুলিশের লোক। লখিন্দর যে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।

টাকা ফেরত দেবার জন্য হাত-পা ধরে ফেলল কিকিরার।

 কিকিরা বললেন, “তোমার ভয় নেই। কাজের জন্যে আমাদের কিছু খরচা করতেই হয়। তুমি টাকাটা রাখো। আর আমাদের একবার নিয়ে চলো রিকশাঅলার কাছে। স্টেশনে।”

লখিন্দর বাধ্য হয়ে বলল, “চলুন”।

.

০৭.

আজ আর বৃষ্টি ছিল না। আকাশে রোদ ছিল, মেঘও ভাসছিল টুকরো-টুকরো। মেঘলা হয়ে আসছিল মাঝে-মাঝে।

বাড়ির বাইরে একটা বড় নিমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন কিকিরা। পাশে লালাবাবু। তারাপদ পায়চারি করছিল কাছাকাছি। বেলা হয়েছে। দশটা বাজতে চলল।

লালাবাবু বললেন, “আমায় তো একবার কলকাতা যেতে হয়। নিজের কাজকর্মের কথা বাদ দিন, রতনদাকে ওদের হাতে ফেলে এসেছি, সবসময়েই দুশ্চিন্তা হয়।”

কিকিরা মাথা নাড়লেন। বললেন, “। আপনি ফিরবেন, আমরাও ফিরব। চলুন, কাল সকালের গাড়িতেই ফেরা যাক।”

“আপনারাও ফিরবেন?” 

“এখানে আপাতত আর কোনো কাজ দেখতে পাচ্ছি না। কলকাতাতেই আমাদের কাজ।… আচ্ছা, লালাবাবুনটুমহারাজের এই ব্যাপারটার সম্পর্কে কী মনে হয় আপনার?”

“কোন ব্যাপার? ভাইয়ের কথা বলছেন?”

“হ্যাঁ। মহারাজের ভাই সহদেব সেদিন এখানে এসেছিল। আমরা কাল নানা জায়গায় খোঁজ নিয়েছি। অন্তত চার-পাঁচজন তাকে দেখেছে। লখিন্দর, রিকশাঅলা মানিক, স্টেশনের এক টিকিট-চেকার আর একটা মুটে। তারা বলেছে, সহদেবকে তারা দেখেছে একদিন। সেই একদিনটা কিন্তু সেইদিনই–যেদিন টুমহারাজের বাড়িতে ঘটনাটা ঘটে। সহদেব সেদিন কেন এসেছিল এখানে? কেনই বা রাত্রের মধ্যেই পালিয়ে গেল?”

লালাবাবু খানিকটা আগে কিকিরাদের মুখে সব কথা শুনেছেন। শুনে তিনি কিছু বলেননি। শুধু অবাক হয়ে এলোমেলো কয়েকটা প্রশ্ন করেছেন। তাঁর কিছুই মাথায় ঢুকছিল না তো বলবেন কী!

কিকিরা বললেন, “সহদেব কেন এসেছিল? কার কাছে এসেছিল? নটুমহারাজ কি কিছু জানেন না? যদি না জানেন, তবে অন্য কথা। আর যদি জানেন, তবে কেন তিনি কথাটা লুকোবার চেষ্টা করছেন?”

লালাবাবু মাথা নাড়লেন। “আমিও বুঝতে পারছি না। তবে রায়মশাই, এই ঘটনার সঙ্গে যদি ভাইয়ের সম্পর্ক না থাকে, তিনি বলবেন কেন? অবশ্য আগে দেখতে হবে, ভাইয়ের আসার কথা সত্যিই তিনি জানেন কি না। তা আপনি নটুমহারাজকে জিজ্ঞেস করুন না সরাসরি।”

 “ভাবছি। ভাবছি এখনই করব, না, কলকাতায় ফিরে গিয়ে আগে সহদেবের খোঁজ করে তারপর কথাটা তুলব কি না।”

তারাপদ কাছে এসে দাঁড়াল। কাল রাত্রে বাদলা পোকার কামড় খেয়ে তার গালের একটা জায়গা লাল হয়ে আছে।

লালাবাবু বললেন, “কলকাতায় সহদেবকে কি পাওয়া যাবে।”

“যেতে পারে। ওই যে ওই লোকটা কী নাম যেন তারাপদযার কাছে আমরা গেলাম, ওই তোমার বাজার ছাড়িয়ে একেবারে শেষে-পুরনো রাজবাড়ি…”।

“গোকুল। বাজারের লাস্ট পয়েন্টে থাকে-ওপাশটায়। রুপোর গয়নাটয়না বেচাকেনা করে। সুদে টাকা খাটায়।”

“হ্যাঁ। একমাত্র ও-ই সহদেবের ঠিকানা বলতে পারল। সে অবশ্য বলল, সহদেবের সঙ্গে এর মধ্যে তার দেখা হয়নি।”

“সহদেবের ঠিকানা সে জানল কেমন করে?”

“একবার কলকাতায় গিয়ে হঠাৎ দেখা হয়েছিল রাস্তায়। যোগাযোগ তখন থেকেই। গোকুল কলকাতায় গেলে সহদেবের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করে আসে।”

“এগারো নম্বর শেতল সরকার লেন।” তারাপদ বলল।

কিকিরা বললেন, “দোকান আর বাসা। একই বাড়িতে। দোকানটা কিসের জানেন, লালাবাবু?”

“না।”

“বিষ বিক্রি হয়। সাপের।”

লালাবাবুর আর চোখের পাতা পড়ছিল না। বিশ্বাস করতেও পারছিলেন না। বললেন, “বলেন কি, সাপের বিষ বিক্রির দোকান আছে? আমি তো জন্মেও শুনিনি মশাই।”

কিকিরা বললেন, “ওষুধবিষুধের কাজে সাপের বিষ লাগে শুনেছি। এমনও শুনেছি, অনেকে সাপ পোষে বিষ বিক্রি করার জন্যে। আবার সাপ নিয়ে যেখানে গবেষণা হয়, তার ল্যাবরেটারিও আছে। আমি নিজে এ-সব দেখিনি। জানি না। একজনকেই শুধু জানি, কুণ্ডুজগৎ কুণ্ডু, সে কার্নিভালে সাপের খেলা দেখাত। মুখের মধ্যেও সাপের মুণ্ডু ঢুকিয়ে দিত দেখেছি। গা সিরসির করত আমার। কুণ্ডুর বাড়িতে নাকি সাপের খাঁচা ছিল।”

তারাপদ বলল, “সহদেবের নামে এখানে যা রটেছে, সাপের ধন্বন্তরি সে–সেটা গুজব। রটনা। একজন শুনেছে এক, বলেছে অন্য। সে আবার আরেক জনকে হয়ত বলেছে। এইভাবেই রটে গিয়েছে। তবে বোঝা যাচ্ছে, সহদেব সাপখোপ নিয়ে কোনো কারবার করে। সেটা কী–আমরা জানি না। জানতে হবে।”

লালাবাবু বললেন, “রায়বাবু, আমি ছাপোষা মানুষ, ঘরসংসার করে আর নিজের ছোট ব্যবসা নিয়ে পড়ে থাকি। জগতের বারো আনাই জানি না।

আমি তো বুঝতে পারছি না, কোথাকার জল কোথায় গড়াচ্ছে?”

কিকিরা বললেন, “আমিও বুঝছি না। দেখুন শেষপর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়!… একটা কথা, লালাবাবু?”

“বলুন?”

“রত্নেশ্বরবাবু কতদিন আগে এই জমি কিনেছিলেন?

বছর তিনেক। সঠিকভাবে জানতে চাইলে কলকাতায় ফিরে বলতে পারব। দলিলপত্র দেখে।”

“কার জমি?”

“তা বলতে পারব না।”

“যখন কেনেন, তখন তো উনি বাড়ি করার কথাই ভেবেছিলেন।”

“তাই বলত, রতনদা। বলত, কিনে তো রেখে দিই। পরে দেখা যাবে।”

“তিনি আর কিছু বলতেন?”

“আমি শুনিনি।”

“জমি নিয়ে কোনো মামলা-মোকদ্দমা হয়েছিল কখনো?”

“না। জানি না।”

“আর-একটা কথা। ওঁর কোনো ব্যবসায়িক শত্রু ছিল না তো!”

লালাবাবু মাথা নাড়লেন। “ব্যবসায় কম্পিটিশন থাকে রায়বাবু। সব ব্যবসাতেই থাকে। কম্পিটিশন থাকা মানে শত্রু থাকা নয়। রতনদার কোনো শত্রু ছিল বলে আমি জানি না।”

ইতস্তত করে কিকিরা বললেন, “ভাইয়ের সঙ্গে তো ভালই সম্পর্ক ছিল?”

“কী বলছেন আপনি! ভাই ছাড়া আর ছিল কে? ছোট ভাইয়ের স্ত্রী আর তার ছেলেমেয়েরাই ছিল প্রাণ।”

“তা ঠিক। ওই নিমাই ছেলেটি কেমন?”

লালাবাবু বললেন, “নিমাই আজ বারো-চোদ্দ বছর রতনদাদের বাড়িতে আছে। শান্তশিষ্ট স্বভাব। বিশ্বাসী। ওর ওপর বিশ্বাস আছে বলেই রতনদা হালে ওকে বেলেঘাটার কারবারটা একাই দেখতে দিয়েছিল। আর এখন নিমাই বেলেঘাটাতেই থাকে।”

কিকিরা কী মনে করে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। “চলুন, ঘরে যাওয়া যাক। গরম লাগছে।”

হাঁটতে হাঁটতে লালাবাবু বললেন, “কাল তা হলে আমরা কলকাতায় ফিরছি?”

“হ্যাঁ। একসঙ্গেই ফিরব।”

“এখানে কি গুরুচরণকে রেখে যাব? আবার যদি আসেন আপনারা?”

“না। আমি অন্তত আর আসব না–এটাই যেন মহারাজ জানেন।”

তারাপদ বলল, “কিন্তু স্যার, যদি দরকার হয়?” মাথা নাড়লেন কিকিরা। বললেন, “তারা, বনে পথ হারিয়ে গেলে বারবার ঘুরতে নেই। তাতে আরও নাজেহাল হতে হয়। তখন যে- কোনো একটা পথ বেছে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া ভাল। মনে রেখো, কোনো না কোনো সময় তুমি ঠিকই বনের বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে। কেননা বনের শেষ আছে।.. আমি আর এখানে পড়ে থাকার কারণ দেখছি না। কলকাতায় বরং বেশি দরকার আমাদের। এক নম্বর দরকার সহদেবকে, আর দুনম্বর দরকার চাঁদুকে।”

 “চাঁদুকে?”

“হ্যাঁ; চাঁদুকে। চাঁদুকে দিয়ে একবার দেখাতে হবে রত্নেশ্বরবাবুকে। ভাল করে। সে নতুন ডাক্তার। তার যদি দরকার হয় চেনা কোনো বড় ডাক্তার নিয়ে আসবে। তিনি এসে দেখবেন রত্নেশ্বরবাবুকে।”

লালাবাবু বললেন, “রায়মশাই, রতনদাকে তো বাড়ির ডাক্তারবাবুই দেখেন। তিনিও বড় ডাক্তার এনেছিলেন।”

“সবই ঠিক লালাবাবু। কিন্তু আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে। এখান থেকে যখন আপনারা রত্নেশ্বরবাবুকে নিয়ে যান–তখন ভেবেছিলেন তাঁর স্ট্রোক হয়েছে। ডাক্তারবাবুও তাই ভেবেছিলেন। কিন্তু কেউ কি অন্য সন্দেহ করে ওঁর শরীর ভাল করে পরীক্ষা করেছিলেন? করেননি। কলকাতার হাসপাতালেও যখন ভরতি করেছেন রোগীকে–স্ট্রোকের রোগী বলেই করেছেন। হাসপাতালও কি আর অন্য কিছু ভেবেছে, না, সন্দেহ করেছে।… সে যাই হোক, চাঁদুকে আমার দরকার।”

.

দুপুরে গুমোট লাগছিল।

কিকিরারা যে-ঘরে আছেন তার জানলাগুলো মাঝারি। দক্ষিণের জানলাগুলো খোলাই ছিল। ওপাশে, জানলা ঘেঁষে গাছপালা, করবীঝোপ, কাঁঠালচাঁপা। ছায়া রয়েছে জানলার গায়ে। অন্যদিকের জানলা বন্ধ। রোদ আসছে তখনো।

এই গুমোটে ঘুম আসার কথা নয়। ইলেকট্রিক পাখা তো নেই যে বনবন। করে মাথার ওপর ঘুরবে। মাঝে-মাঝে হাতপাখা নেড়েই গায়ের ঘাম শুকোবার চেষ্টা করছিলেন কিকিরা। তারাপদ ওরই মধ্যে দু-একবার তার ঘরে নাক ডেকে ফেলছিল।

শেষপর্যন্ত কিকিরা উঠে বসলেন বিছানায়। “ওহে, নোজ কলিং জেন্টুস।”

 সাড়া নেই তারাপদর।

আবার ডাকলেন কিকিরা।

তন্দ্রা ভেঙে গেল তারাপদর।

 “ইয়ং ম্যান তোমরা, এত ঘুমোও কেমন করে। এই গরমে।”

“ঘুমোইনি, চোখ লেগে গিয়েছিল।”

“ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে নোজ কলিং করছ, আবার বলছ ঘুমোওনি। নাও, উঠে পড়ো।”

হাই তুলতে-তুলতে উঠে বসল তারাপদ। বলল, “এই দুপুরে শুয়ে থাকলে কোনো ক্ষতি ছিল স্যার?”

“চলো, ওই ঘরটা একবার দেখব।”

“কোন ঘর?”

“বসার ঘর। চাবি তো তোমার কাছে।”

চাবিটা চেয়ে নিয়ে রেখে দিয়েছিলেন কিকিরা। বিছানা ছেড়ে উঠে তারাপদ জল খেল। মাটির কুঁজোয় রাখা জল ঠাণ্ডা। জল খেয়ে বলল তারাপদ, “চলুন।”

নিজেদের ঘর থেকে বাইরে এসে তারাপদ দেখল, দুপুর শেষ হয়ে এলেও রোদ যেন গনগন করছে তখনও। তাকানো যায় না বেশিক্ষণ। বাতাস গরম। সকালের সেই টুকরো মেঘগুলোর কোনো চিহ্ন নেই। গরম বাতাসের ঝাঁপটায় গাছের পাতা ঝরছে মাঝে-মাঝে, শুকনো পাতা।

বারান্দা পেরিয়ে বসার ঘর।

তারাপদ তালা খুলল। আজ কদিনই কিকিরার কথা মতন ঘরটার তালা-চাবি তারাপদই রাখছে।

কিকিরা ঘরের জানলাগুলো খুলতে-খুলতে বললেন, “তারা, এই ঘরটার ছবি তোমার মনে থাকবে? মানে যেমনটি যা আছে–

বাধা দিয়ে তারাপদ বলল, “এতবার দেখলাম, মনে থাকবে না!”

“থাকলেই ভাল।”

“আপনি এখন হঠাৎ কী মনে করে ঘরটা দেখতে এলেন আবার?”

“ঘর দেখতে আসিনি। এসেছি তীরগুলো দেখতে।”

“তীর!…আগেও দেখেছেন, স্যার।”

“দেখেছি। আবার দেখব। ভাল করে।”

“কেন?”

“এই তীরগুলো একেবারে মামুলি ব্যাপার নয় মনে হচ্ছে। তা ছাড়া, নটুমহারাজ বলছেন, রত্নেশ্বর যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন মাটিতে, সেখানে হলুদ পালক লাগানো তীরের দু-একটা হলুদ পালকের ছেঁড়া টুকরো পাওয়া গিয়েছিল। মনে পড়ছে?”

“হ্যাঁ। তীরটাও আর পাওয়া যায়নি। গায়েব হয়ে গিয়েছিল।”

“ইয়েস!… এখন বাপু বলো তো, হলুদ পালকের তীরের ওই পালকের টুকরো কেন রত্নেশ্বরবাবুর গায়ের কাছে পড়ে থাকবে। আর কেনই বা তীরটা হাপিশ হয়ে যাবে?”

“নটুমহারাজও তো সেই কথাই বলেছেন।”

“বলেছেন বইকি! বলেছেন বলেছেন–”বলতে বলতে কিকিরা দেওয়াল থেকে তীর-রাখা ঝোলানো বোর্ডটা নামিয়ে নিলেন। পাতলা কাঠের বোর্ড, মাঝখানে সামান্য গর্ত, লম্বা করে গর্ত করা, এক-একটা তীর সেই গর্তের মধ্যে বসানো ছিল। দুটো তীর এখনো আছে, তৃতীয়টা নেই–হলুদ পালক লাগানো তীরটা।

কিকিরা টেবিলের ওপর বোর্ডটা রাখলেন। বার করে নিলেন দুটো তীর।

তীর-ধনুকের তীর সচরাচর যতটা লম্বা হওয়ার কথা–এই তীরগুলো তত লম্বা নয়। হাতখানেক লম্বা বড়জোর। এর গা বাঁশ কঞ্চির নয়, কাঠ জাতীয় জিনিসেরও নয়, কোনোরকম পাকা বেতেরও নয়। লোহার। এমন লোহা, যাতে মরচে ধরে না। স্টিল ধরনের জিনিস, হয়ত মিশেল আছে ধাতুর। মুখের ফলা স্টিলের। বেশ ধারালো। তীক্ষ্ণ। আর পালকগুলো পাখিরই। কালো পালকঅলা তীরের পালকগুলোয় ধুলো জমেছে। যা স্বাভাবিক। লাল পালক দেওয়া তীরের পালকগুলো মোরগের বলে মনে হল। কালোগুলো হয়ত কাকের। বাকি যেটা ছিল, হলুদ আর সবুজ পালক দেওয়া সেই তীরটা নেই।

তীরগুলো দেখতে-দেখতে কিকিরা বললেন, “তারাপদ, তোমার কী মনে হয়?”

“কিসের?”

“এই তীরগুলো দেখে।”

“ছোট। আসল তীর নয়।”

“আসল তীর হবে কেন! এগুলো তো প্রাইজ পাওয়া তীর। প্রাইজে যে মেডেল দেয় সেটি আসল না, নকল! প্রাইজটাই তো আসল-তাই না!”

তারাপদ মাথা নাড়ল। হেসে বলল, “আমি স্যার কোনোদিন মেডেল পাইনি। চোখে দেখেছি। আপনিই ভাল জানবেন। অনেক মেডেল পেয়েছেন!”

 “থার্টি সিক্স! ছত্রিশ! কিকিরা দি গ্রেট ম্যাজিশিয়ানের টার্গেট ছিল একশো। অর্ধেকও হল না। হাতটাই বেজুত হয়ে গেল। আর হাত গেলে ম্যাজিশিয়ানের থাকল কী! আমাদের সময় হাতই ছিল আসল, এখন হয়েছে শুধুই চালাকি, বুদ্ধি। যার মগজে যত চালাকি বিদ্যে, সে তত বড় ম্যাজিশিয়ান।” বলতে বলতে কিকিরা কালো-পালক দেওয়া তীরের মুখটা খুলে ফেললেন। খুলে অবাক হয়ে বললেন, “ওহে তারা, দেখো, দেখো। এই ধারালো মুখটা প্যাঁচ-সিস্টেমে তীরের আগায় আটকানো। বাঃ! ফাইন। মুখটা আটকে তার ওপর শক্ত চামড়ার সরু ফিতে দিয়ে জড়ানো। ভেরি বিউটিফুল।”

তারাপদ বলল, “কী বিউটিফুল?”

“কায়দাটা।… আরও একটা জিনিস দেখো, ফলার মাঝখানের ডগাটা–মানে যেটা গিয়ে গিথবে সেটার মুখ কত সরু। মুখ একেবারে ইঞ্জেকশনের ছুঁচ যেন। তাই না!”

তারাপদ কিছু বলল না।

কিকিরা তীর দেখা শেষ করে বললেন, “তোমার কী মনে হয়?”

“কিসের?”

“নটুমহারাজ বলেছেন, তিনি ভাল তীরন্দাজ ছিলেন। ভাল কথা। ভেরি গুড। তিনটে তীর তিনি প্রাইজ পেয়েছেন। তিন বারে। ভেরি গুড। কিন্তু তারাবাবু, এ-সব তো পুরনো কথা। অনেক আগেই হয়েছে। এখনো তীরগুলো এত তকতকে থাকে কেমন করে! হাউ? আর এগুলো যদি এ-ঘরে এইভাবে খোলা পড়ে থাকবে দিনের পর দিন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর–তা হলে কত ময়লা জমা উচিত ছিল বলো! তেমন তো মনে হচ্ছে না।”

তারাপদ সন্দিগ্ধ হয়ে বলল, “আপনি কী বলতে চান?”

“সেটাই তো বলতে পারছি না। নটুমহারাজ কি আমাদের ধোঁকা দিচ্ছেন?”

“তিনি ধোঁকা দেবেন কেন? কাকে দেবেন? কেনই বা দেবেন? তিনি নিজে যদি জোর না করতেন লালাবাবু এইসব খুনখারাপির কথা ভাবতেন না।”

“আমিও তাই বলি। মহারাজ নিজেই সন্দেহটা জাগিয়েছেন। কিন্তু কেন? তাঁর কিসের স্বার্থ?”

“আমি তো…। স্যার, সহদেবের কথা শোনার পর থেকে আপনার মনে একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছে।”

“সন্দেহ? না, ধোঁকা?… সহদেব সম্পর্কে একটা কথাও তিনি বলেননি। কেন বলেননি? ভাইয়ের সঙ্গে বনিবনা নেই বলে? সম্পর্ক নেই বলে? সেদিন সহদেব এখানে এল আর গেল– তিনি কিছুই জানলেন না? সহদেব কোথায় এসেছিল! কার কাছে? রিকশাঅলা মানিকের কথা যদি সত্যি হয় তবে বলতে হবে- এই বাড়ির দিকেই কোথাও এসেছিল সহদেব। মানিক যেখান থেকে সহদেবকে রিকশায় তোলে, সেটা এদিকেরই কোনো জায়গা থেকে।

তারাপদ কিছুই বলল না।

তীর রাখা বোর্ডটা দেওয়ালে জায়গামতন ঝুলিয়ে রাখলেন কিকিরা। রাখার সময় দেওয়ালে হুক-পেরেকগুলো দেখলেন নজর করে। একটু যেন হাসলেন। বোর্ড রেখে ঘরের চারপাশে ঘুরে বেড়ালেন অন্যমনস্কভাবে।

“তারা, এই টেবিলে রত্নেশ্বর বসেছিলেন। তাই না!”

“হ্যাঁ।”

“তাঁর পিঠের দিকের জানলা খোলা ছিল নিশ্চয়। গরমের দিন। জানলা বন্ধ করে কেউ কি বসে?”

“না। মনে হয় না।”

“জানলার ওপাশে বাতাবিলেবুর গাছ। কত বড়। তাই না?

“হ্যাঁ।”

 কিকিরা হঠাৎ বললেন, “নটুমহারাজকে কি কলকাতায় নিয়ে যাওয়া যাবে? গেলে ভাল হত।”

তারাপদ বলল, “বলে দেখুন। “

.

০৮.

কলকাতায় ফিরে এসে চন্দনকে পাওয়া গেল। দিন দুই হল ফিরে এসেছে ও।

চন্দনের মেডিকাল মেসে এসে তারাপদ বলল, “ফিরে এসেছিস! বাঁচা গেল। তোর জন্যে ছুটতে ছুটতে এলাম।”

“তোরা কবে ফিরেছিস?”

“কাল।… আজ বিকেলে তোর ডাক পড়েছে। কিকিরা ওয়েট করছেন। … শোন, আমি এখন অফিসে যাচ্ছি। ক’দিন কামাই হয়ে গেল। বিকেলে আমি কিকিরার কাছে চলে যাব স্ট্রেট। তুই ওখানে চলে যাস।”

চন্দনের তাড়া ছিল। হাসপাতালে যেতে হবে। দেরি হয়ে গিয়েছে। খানিকটা। বলল, “আমি ফিরে এসেই খোঁজ করেছি। বগলাদা বলল, তোরা ফিরিসনি। এমনিতেই আজ আর-একবার খোঁজ করতে যেতাম। তা ব্যাপার কেমন দেখলি?”

“গোলমেলে। অনেক কথা। এখন আর সময় নেই। আমি চলি। তুই কিকিরার কাছে গেলেই শুনতে পাবি। চলি।”

তারাপদ আর দাঁড়াল না।

.

বিকেলে চন্দন যথারীতি কিকিরার কাছে হাজির। কলকাতাতেও বর্ষা নেমে গিয়েছে পাকাপাকিভাবে। রোজই দু-চার পশলা বৃষ্টি হচ্ছে।

বৃষ্টির মধ্যেই চন্দন এল। অল্পসল্প ভিজেছে। হাতের ছাতায় বৃষ্টির ছাট আটকায়নি।

কিকিরা একটা শুকনো তোয়ালে এগিয়ে দিলেন। “এসো, চাঁদু। নাও মুখ-হাত মুছে নাও। আমি তোমার অপেক্ষাতেই বসে আছি।”

হাত মুখ মুছে বসল চন্দন। বলল, “কেমন কাটল ঘাটশিলায়ক” বলে হাসল একটু।“মানে কী দেখলেন।”

“বসো আগে। চা খাও। বলছি।”

“তারা বলছিল, গোলমেলে ব্যাপার।”

“গোলমেলে তো হবেই। জগৎ সংসারে কোন্টা সোজা, বাবা? এই যে আমাদের চোখ, নাক, কান এগুলোই কি কম গোলমেলে! বাইরেটা সোজা, ভেতরটা জটিল। তুমি ডাক্তার, কত গোলমেলে অসুখ নিয়ে মাথা খারাপ হয়ে যায় তোমাদের। তাই না?”

চন্দন হেসে বলল, “আপনাদের কথা বলুন। বাড়ি গিয়েও আমার শান্তি হচ্ছিল না।”

“কেমন করে হবে বলো! আমরা হলাম তিন চাকার গাড়ি। দু’চাকায় চলতে গেলে টলে যাই।”

চন্দন জোরে হেসে উঠল।

কিকিরা মজা করে বললেন, “থ্রি হুইলার টেম্পু!”

ঘাটশিলার কথা শুরু করলেন কিকিরা। বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল। শব্দটা জোর নয়। জলো বাতাস আসছিল ঘরে। মন দিয়ে কিকিরার কথা শুনছিল চন্দন। মাঝে-মাঝে প্রশ্ন করছিল।

এরই মধ্যে চা এল।

 চা খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পরও খানিকক্ষণ কিকিরা চন্দনকে ঘাটশিলার ব্যাপারটা বোঝালেন। শেষে বললেন, “আজ তোমায় নিয়ে হরিশ মুখার্জিতে যাব। তারা আসুক। এলেই বেরিয়ে পড়ব।”

“আমি সেখানে গিয়ে—”

“রত্নেশ্বরবাবুকে ভাল করে দেখবে একবার। তাঁর অসুখের রিপোর্টগুলোও পড়বে।”

“স্যার, এটা কি ভাল হবে? ওঁকে অন্য ডাক্তাররা দেখেছেন, হাসপাতালেও ছিলেন উনি। সিনিয়ার ডাক্তাররাও নিশ্চয় দেখেছেন। আমি জুনিয়ার ডাক্তার। তা ছাড়া এইসব কেস আমি দেখিনি। আমার ঠিক এক্সপিরিয়ান্স নেই।”

“তবু একবার দেখবে।”

“আপনি যখন বলছেন, নিশ্চয় দেখব।”

“আমার যেটা জানার দরকার তোমায় বলি। তুমি ভাল করে দেখবে– ওঁর শরীরে কোনো ইনজুরি আছে কি না?”

চন্দন অবাক হল। বলল, “একটা লোক যদি আচমকা মাথা ঘুরে পড়ে যায়–তার ইনজুরি থাকতেই পারে। কম বা বেশি। তার ওপর আজ মাসখানেক পরে সেই ছোটখাট ইনজুরির কী পাব?”

“পাও না-পাও দেখবে।”

মাথা নাড়ল চন্দন। দেখব।

 কিকিরা বললেন, “আরও একটা খবর জোগাড় করতে হবে। আজ সকালেই আমি বেরুচ্ছিলাম, বকা দত্ত এসে আমার কাজ পণ্ড করে দিল।”

“বকা দত্ত আবার কে?”

“শিপ মার্চেন্ট।”

“শি-প মার্চেন্ট! আরে বাব্বা, সে তো তবে কোটি কোটিপতি…?”

“আরে না না, এ শিপ জলে ভাসে না। জাহাজি ব্যাপার নয়। বকা দত্ত হল গুঁড়ো মশলার কারবারি। ওদের মশলার ট্রেড মার্ক, জাহাজ। একসময় নাকি জাহাজে করে মশলাপাতি আমদানি রপ্তানি হত এদেশে–তাই ওরা জাহাজকে ট্রেড মার্ক করেছে। আমি বকার নাম দিয়েছি শিপ মার্চেন্ট।”

চন্দন বেজায় জোরে হেসে উঠল।

কিকিরা বললেন, “বড্ড বকে। বক্কেশ্বর। তা সে এল। কিছুতেই ওঠাতে পারি না। যখন উঠল ততক্ষণে বেলা হয়ে গিয়েছে। আর তেড়ে বৃষ্টি এসে গেল। আটকে গেলাম। জরুরি কাজটা হল না।”

“কী কাজ?”

“তুমি বলতে পারবে। এই কলকাতা শহরে সাপখোপের বিষ নিয়ে কোথায় ব্যবসা হয় জানো?”

চন্দন ভীষণ অবাক! তার মাথায় ঢুকছিল না। বলল, “না। কেন?”

“শেতল সরকার লেন বলে একটা গলি আছে। শুনলাম গলিটা নাকি নিমতলার দিকে। সেখানে সহদেব থাকে। ওর কথা তো তোমায় বলেছি।”

চন্দন একটু আগেই শুনেছে সহদেবের কথা।

কিকিরা বললেন, “আমি এ ব্যাপারে কিস্যু জানি না, চাঁদু! তবে কোথায় যেন পড়েছি, বিষাক্ত পোকামাকড়, সাপ, বিছে-টিছে সাপ্লাই করার ব্যবসাও কেউ-কেউ করে। এগুলো নিয়ে নাকি গবেষণার কাজ হয়, ল্যাবরেটারির কাজে লাগে।

চন্দন বলল, “তা হতে পারে। আমি খোঁজ করতে পারি। জুলজির লোকরা জানবে। ফিজিওলজির লোকরাও জানতে পারে।”

এমন সময় তারাপদ এল।

এসে বলল, “ভাল বৃষ্টি হচ্ছে, তবে এখনো রাস্তায় জল দাঁড়ায়নি। গাড়িঘোড়া চলছে। বৃষ্টিটা শুনলাম নর্থেই বেশি হয়েছে।”

কিকিরা বললেন, “তোমরা বসো, আমি তৈরি হয়ে নিই।”

তারাপদ বলল, “স্যার, আপনার সেই নাতি কুশি আসছে। মিনিবাসের কাশীর ভাই কুশি।”

“ওকে টাইম দেওয়া আছে। আসারই কথা।” কিকিরা বললেন।

.

হরিশ মুখার্জির বাড়ির বাইরের ঘরে বসে কিকিরা, তারাপদ আর যজ্ঞেশ্বর কথা বলছিলেন। যজ্ঞেশ্বরকে দেখলেই বোঝা যায়, নিরীহ ভিতু মানুষ। ব্যবসাদার বলে মনে হয় না, চোখেমুখে চালাকির চিহ্ন নেই, চটপটে স্বভাবেরও নয়। কথায়, বার্তায় বিনয়ী।

কোনোরকমে সময় কাটানোর মতন করে কথা হচ্ছিল। বৃষ্টি এখন নেই। তবে বাদলার ভাবটা এই প্রথম রাতেই বেশ ঘন হয়ে গিয়েছে।

আরও খানিকটা পরে চন্দন আর লালাবাবু ঘরে এলেন।

 কিকিরা তাকালেন।

চন্দন সামান্য গম্ভীর।

“কেমন দেখলে?” কিকিরা বললেন।

“একই রকম।… একটা ব্যাপার মনে হল, রত্নেশ্বরবাবুর চোখ যেন একেবারে ভ্যাকান্ট নয়। উনি কী বলব, বোধ হয় বুঝতে পারছেন মানুষজন।”

লালাবাবু বললেন, “পায়ের আঙুলগুলো আরও বেশি নাড়াচ্ছে।”

কিকিরা বললেন চন্দনকে। “তোমায় যা বলেছিলাম…!”

“দেখেছি। গায়ে পুরু করে পাউডার মাখানো রয়েছে। তবু আমার মনে হল, হাত, পিঠ, বুকে আঁচড়ানোর দাগ আছে।”

লালাবাবু বললেন, “প্রথমে আরও বেশি ছিল। রতনদা এমনিতেই একটু গা, বুক, হাত চুলকোত, মানে আঁচড়াত। তার ওপর ঘাটশিলার গরমে গায়ে ঘামাচি হয়েছিল, গলা, বুক, পিঠ ভরে গিয়েছিল। আমরা যখন প্রথমে নিয়ে এলাম সারা গা আঁচড়ে আঁচড়ে দগদগে করে ফেলেছে। এখন তো আর হাত নাড়তে পারে না, অনবরত পাউডার দেওয়া হচ্ছে, পাখা চলছে।”

কিকিরা চন্দনকে বললেন, “কোথাও কোনো ক্ষত?”

চন্দন মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ। আমার মনে হচ্ছে, ওঁর বাঁ দিকের হাতের ওপর কিছু ফুটেছিল, বা কেটে গিয়েছিল। জায়গাটা এখনো লালচে হয়ে আছে। সামান্য। ইরাপসান রয়েছে। কাটা জায়গায় চামড়া পড়েছে বটে নতুন, তবে চারপাশে হামের মতন ইরাপসান।”

কিকিরা শুনলেন। ভাবলেন কিছু। তারাপদকে বললেন, “তারাপদ, ঘাটশিলার বসার ঘরের পেছনের জানলাটা কোন দিকে ছিল? মানে, যে-চেয়ারে বসেছিলেন রত্নেশ্বরবাবু, তার কোন দিকে?”

“বাঁ দিকে।”

কিকিরা তখন আর কিছু বললেন না, ইশারা করলেন উঠে পড়ার।

বাইরে এসে কিকিরা বললেন, “একটা ট্যাক্সি ধরতে পারবে?”

“বাড়ি ফিরবেন তো?”

“হ্যাঁ, বাড়ি। তোমাদের নামিয়ে দিয়ে যাব।”

“চলুন বড় রাস্তায়, দেখি…।”

এখন আর বৃষ্টি নেই। সারা বিকেলের বৃষ্টিতে আবহাওয়া ভিজে, স্যাঁতসেঁতে। বাতাস কেমন ভারী হয়ে আছে, আর্দ্র।

চন্দন বলল, “কী ভাবছেন কিকিরা?”

“ভাবছি, নটুমহারাজের কথাই হয়ত সত্যি।… তবে যতক্ষণ না সহদেবকে দেখছি বলতে পারছি না জোর করে।”

“আপনি বলছেন, এটা খুনের ঘটনা?”

“খুনের চেষ্টা। অ্যাটেমপ্ট।”

“কে করেছে?”

“সেটাই রহস্য! কে করেছে? কেন? কী তার স্বার্থ?”

“মানে মোটিভ?”

“হ্যাঁ। রত্নেশ্বরকে কে খুন করার চেষ্টা করবে? কেনই বা করবে!… শোনো চাঁদু, কাল আমি যেমন করে তোক সহদেবকে খুঁজে বার করব। তোমাদের পাব কখন?”

 “বিকেলে।”

“একটু তাড়াতাড়ি করবে। নিমতলার দিকে গলিঘুজি খুঁজে বার করা। কষ্টের। তার ওপর যদি বৃষ্টিবাদলা হয়..।”

তারাপদ বলল, “অফিসে ওদিককার লোক আছে। শেতল সরকার লেনের খোঁজটা নিয়ে নেব আমি।”

“ভালই হবে। কাল চারটে সওয়া চারটে নাগাদ..”

“স্যার, আমার অফিস!”

“ছুটি নিয়ে নিয়ে ঘণ্টাখানেক আগে। বোলো, কিকিরাকে নিমতলায় নিয়ে যেতে হবে।”

চন্দন হেসে ফেলল।

তারাপদ পালটা ঠাট্টা করে বলল, “নিয়ে যাচ্ছি বলতে পারব না, স্যার; বলব– যেতে হবে আমাদের।”

.

০৯.

একপাশে, ঘুপচি মতন একটা জায়গায় বসে সহদেব কী যেন করছিল। পায়ের শব্দে মুখ তুলল।

কিকিরা সহদেবকে দেখছিলেন। লখিন্দরের কাছে যেমন বর্ণনা শুনেছিলেন, চেহারায় তার সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। লখিন্দর খানিকটা বাড়িয়ে বলেছে, বা তার চোখ ভুল করেছে। সহদেব মাথায় অবশ্য খুবই লম্বা। কিন্তু তার চেহারা বিশাল নয়। গড়াপেটা, শক্ত। চেটালো হাড় হাতের। গায়ের রং কালো। মুখ ভোঁতা ধরনের। বড় বড় চোখ। মাথার চুল রুক্ষ।

“কী চাই?” সহদেব বলল।

কিকিরা চারপাশে তাকালেন। দোকানের মতনই সাজানো ঘর। একপাশে বড় অ্যাকুইরিয়ামে মাছ। আর একটা কাচের বাক্সে কিছু বিছে-পোকামাকড়। অন্যদিকে তারের জাল দেওয়া চৌকো খাঁচায় তিন-চারটে সাপ। বেজি গোছের একটা জন্তু কাঠের তাকের ওপর, যদিও মরা।

“কী চাই?”

“আপনিই সহদেববাবু!”

“হ্যাঁ।”

“এই যে দোকানটা বাইরে লেখা আছে “রেপটাইল এম্পোরিয়াম’–এটা আপনারই দোকান তো?”

“হ্যাঁ। তবে এটা মুদি-মশলার দোকান নয়, শাড়ির এম্পোরিয়াম নয়। এখানে অন্য ব্যাপার..”

হাসলেন কিকিরা। “জানি। আমি একটা জরুরি দরকারে এসেছি।”

“কী দরকার?”

“আমার একটু বিষ দরকার। ধরুন দশ মিলিগ্রাম বা এক চামচ।”

“বিষ।” সহদেব থতমত খেয়ে গেল। অবাক হয়ে দেখছিল কিকিরাকে। লোকটা বলে কী?

“এই ধরুন পাঁচশো টাকা পর্যন্ত দিতে পারি।”

সহদেব এগিয়ে এল। তিরিক্ষে গলায় বলল, “আপনি কে মশাই? কে আপনি? কী বলছেন? আমি বিষ বিক্রি করি। এটা বিষ বেচার দোকান? কে বলেছে আপনাকে–?”

কিকিরা মুখ টিপে হাসলেন। “গোকুল। ঘাটশিলার গোকুল…।”

সহদেব চমকে উঠল। বিশ্বাস হল না। মাথা নেড়ে বলল, “গোকুল। গোকুল বলল! সে কেমন করে বলল! আমি তো বিষের কারবার করি না। কে আপনি?”

“আপনি বিষ বেচেন না?”

“না। আমি নিজে বেচি না।”

“আমি শুনলাম…”

“ভুল শুনেছেন। এখানে দু-একটা ওষুধের কোম্পানি আছে। তাদের যখন বিষধর সাপের দরকার হয়, বিষটিষের জন্যে–আমায় জানালে আমি আমার চেনাজানা সাপুড়েদের খবর দি। …বিষ বেচার লোকও আছে। অন্য। তারা বেআইনি কারবার করে না।”

“তা হলে এগুলো?”

“এগুলো মামুলি সাপ। …কলেজের কাজে ব্যাঙ, ইঁদুর, গিনিপিগ, পোকামাকড় দরকার হলে আমি অডার নিয়ে সাপ্লাই করি।”

“ও! তা হলে আপনি আপনার দাদাকে বিষ সাপ্লাই করেননি?”

 “দাদা! কে দাদা?”

“নটুমহারাজ।”

সহদেব যেন কেমন হতভম্ব হয়ে গেল। সে বোধ হয় ভাবতেও পারেনি–নটুমহারাজের নাম তাকে শুনতে হবে! অবাক, বিহ্বল, নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকল সহদেব।

কিকিরাও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। শেষে বললেন, “তা হলে আপনাকে সত্যি কথাটা বলি সহদেববাবু। আমি হলাম “কেটিসি গোয়েন্দা এজেন্সির লোক। আমাদের কোম্পানির আরও দু’জন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা একটা মামলা হাতে নিয়েছি। তদন্ত করছি। ঘাটশিলায় রত্নেশ্বরবাবু বলে এক ভদ্রলোককে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল। নটুমহারাজের বাড়িতে। আপনি খুনের দিন সেখানে হাজির ছিলেন। সন্ধেবেলায়। আপনাকে অনেকেই দেখেছে।”

সহদেব কেমন যেন হয়ে গেল। “আমি খুন করেছি? কী বলছেন আপনি?”

“করেননি?”

“না, না। ধর্মত বলছি, না। বিশ্বাস করুন।”

“নটুমহাজকে বিষ জুগিয়ে দিয়েছিল কে?”

“আমি জানি না। “

“সহদেববাবু, আপনার বাঁ হাতটা আমি দেখতে পাচ্ছি। চারটে আঙুল।”

সহদেব নিজের বাঁ হাত তুলল। দেখল। দেখাল কিকিরাকে। বলল, “একটা আঙুল বাদ দিতে হয়েছে অপারেশন করে। বিষাক্ত একটা বিছে কামড়েছিল।”

“রত্নেশ্বরবাবুর ঘটনাটা ঘটার পর ওই বাড়ির বাইরে একটা কমাশিয়াল গ্লাভস পাওয়া যায়। বাঁ হাতের। চারটে মাত্র আঙুল।’

সহদেব এবার বসে পড়ল চেয়ারে। মাথা তুলতেও পারছিল না।

কিকিরা দু মুহূর্তের জন্য বেরিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন আবার। চন্দন আর তারাপদ ভেতরে এসে দাঁড়াল।

শেষপর্যন্ত মুখ তুলল সহদেব। তাকিয়ে থাকল। দেখল তারাপদদের। তারপর বলল, “আমি খুন করিনি। বিশ্বাস করুন। দাদাকেও আমি বিষ জুগিয়ে দিইনি।”

“কিন্তু আপনি সেদিন ও-বাড়িতে গিয়েছিলেন।”

“হ্যাঁ।

“কেন?”

“সে অনেক কথা।”

“কী কথা?”

“এভাবে বলা যায় না। আপনারা বুঝবেন না।”

“আপনি কতকাল আগে ঘাটশিলা ছেড়ে চলে এসেছেন?”

“অনেকদিন।”

“কেন?”

“আমায় থাকতে দেয়নি।”

“আপনি ডাকাতির মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন?”

“না। ডাকাতির মামলায় আমাকে জড়ানো হয়েছিল।”

“কে জড়িয়েছিল?”

“দাদা।”

“কেন?”

“বলেছি তো, অনেক কথা। …ওই ভদ্রলোক কেমন আছেন?”

“আপনি জানেন না?”

“খোঁজ নিয়েছিলাম। শুনেছিলাম, ওঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছে।”

“উনি বেঁচে না-থাকার মতনই।”

“ইস! …কার মরার কথা, আর কে মরে?”

কিকিরা চন্দনের দিকে তাকালেন, তারপর সহদেবকে বললেন, “আপনি কি আমাদের সব কথা বলবেন?”

“বলব! এখন পারছি না। আমার মাথা ঝিমঝিম করছে।”

“জল খান। বসুন খানিকক্ষণ।”

সহদেব উঠে গিয়ে জল গড়িয়ে খেল। কিকিরার ইশারায় চন্দন পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে এগিয়ে দিল সহদেবকে।

সিগারেট ধরাল সহদেব। কিকিরাও একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলেন।

কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না।

হঠাৎ সহদেব বলল, “কার পাপ কে বয়! পাপ করল আমার দাদা, আর তার দায় পড়ল আমার ঘাড়ে। জগতে এমনই হয়।”

কিকিরা বললেন, “সহদেববাবু, আপনি আমাদের সঙ্গে যাবেন?”

“কোথায়? থানায়?”

“না, না, থানায় নয়। এই কাছেই। হরিশ মুখার্জি স্ট্রিটে। যেখানে রত্নেশ্বরবাবু আছেন। তাঁকে দেখবেন একবার। আমার মনে হয় ওঁকে দেখলে হয়ত আপনি নিজের থেকেই সব কথা বলতে চাইবেন।”

কী যেন ভাবল সহদেব। বলল, “যেতে পারি। কিন্তু আপনারা যদি আমায় থানায় নিয়ে যান।”

“না, যাব না। বিশ্বাস করতে পারেন।”

“নিয়ে গেলে আমি কিছু বলব না। আপনারা একটা কথাও আমার মুখ থেকে জানতে পারবেন না।”

তারাপদ কিছু বলল কিকিরাকে। কিকিরা মাথা নাড়লেন। সহদেবকে বললেন, “আপনি চলুন। থানা থেকে আমার আসিনি। আপনাকে নিয়েও যাব না থানায়। আমাদের যা জানার, সেটা জানলেই খুশি হব।”

“বেশ, তবে চলুন। এখন ক’টা বেজেছে?”

“ছ’টা, সোয়া ছ’টা।”

“দু-তিন ঘণ্টার মধ্যে ফিরতে পারব?”

“পারবেন না কেন?”

“তা হলে চলুন।”

.

১০.

ঘরে সকলেই ছিলেন : লালাবাবু, কিকিরা, যজ্ঞেশ্বর। ছিল তারাপদ আর চন্দন।

সামান্য আগে সহদেব গিয়েছিল রত্নেশ্বরের ঘরে। সঙ্গে ছিলেন লালাবাবু আর চন্দন।

রত্নেশ্বর ঘুমিয়ে পড়েননি। যেমন থাকেন–অর্ধচেতনার মধ্যে– হুঁশ আছে কিন্তু সাড়া নেই- সেইভাবেই শুয়ে ছিলেন।

সহদেবকে তিনি চিনতে পারুন না-পারুন, তাকিয়ে থাকলেন। চোখ সামান্য যেন চঞ্চল হল, চোখের পাতা পড়ল বার কয়েক পায়ের আঙুলগুলো কাঁপতে লাগল। হাতের আঙুল বেঁকাবার চেষ্টাও যেন করলেন, পারলেন না।

চন্দন বলল, “আর না, চলুন।”

 বাইরের ঘরে এসে চন্দন বলল, “উনি বোধ হয় এই অবস্থাতেও আপনাকে আন্দাজ করতে পারছিলেন সহদেববাবু, উত্তেজিত হয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন…।”

সহদেব কিছুই বলল না। তাকে বড় হতাশ, বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।

হরিশ মুখার্জির বাড়ির বসার ঘরে সকলেই রয়েছে তখন। আলো জ্বলছে। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর সহদেব বলল, “দেখুন, আমার যা বলার, বলব। আপনারা বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। মিথ্যে কথা বলে আমার লাভ নেই। আমি খুন করিনি।”

একটু থেমে আবার বলল সহদেব, “গোড়া থেকেই সব বলি আপনাদের। তবে আগাগোড়া সব কথা কি বলা যাবে। আপনারা বুঝে নেবেন।

“আমার আর আমার দাদার সম্পর্ক রক্তের নয়। আমার দাদা পালিত পুত্র। আমি মা বাবার একমাত্র সন্তান। মা-বাবার কোনো সন্তান ছিল না বলে একসময় দাদাকে ওঁরা পালিত পুত্র হিসেবে নিয়েছিলেন। আট বছর পরে আমার জন্ম। আমি আসার পরও মা বাবা দাদাকে অনাদর, অবহেলা করেননি। বাড়ির বড় ছেলের মতনই সে থাকত।

“বাবা মারা যাওয়ার সময় দাদার বয়েস ছিল বাইকে আমার চোদ্দ। দাদা তখন থেকেই বেয়াড়া। মাঝে-মাঝেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেত। কোথায়-কোথায় ঘুরত, কী করত, কেউ জানে না। তবে দাদার টাকা-পয়সার ওপর টান ছিল, লোভ ছিল। মায়ের গয়নাগাটি সে চুরিচামারি করেছে। ধরাও পড়েছে। গ্রাহ্য করেনি।

“মা মারা গেলেন দাদার বয়েস যখন তিরিশ। আমি বাইশ বছরের। মা মারা যাওয়ার পর আমাদের মাথার ওপর আর কেউ থাকল না। দাদা হল মুরুব্বি। আমাদের বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে গোলমাল শুরু করে দিল দাদা। তার চেয়েও বড় কথা, ওই যে মহারাজ’ কথাটা, ওটা কথার কথা নয়। মুসলমান বাদশাদের আমলে মহারাজ মান সিংকে–আমাদের পূর্বপুরুষ সাহায্য করেছিলেন রসদ আর লোকজন দিয়ে। মান সিংয়ের দয়ায় আমরা বিস্তর জমিজায়গার জমিদারি পাই, সেইসঙ্গে পাই ওই উপাধি “রাখাওয়া রাজা’। রাখাওয়া শব্দটা পরে বাদ দিয়ে মহারাজই বলা হত। ওটা আমাদের বংশগত উপাধি। বংশের জ্যেষ্ঠ সন্তানই উপাধিটা ব্যবহার করতে পারবে–অন্য কেউ নয়। উপাধি যার, সে-ই বিষয়-সম্পত্তির বড় ভাগিদার, তার কথাই প্রজারা মানবে। তার অধিকার আর সুবিধে অনেক বেশি।

 “দাদার সঙ্গে আমার গোলমাল শুরু হয়ে যায় তখন থেকেই। দাদা এত নীচ, ইতর যে, আমাকে পড়াশোনা শেষ করতে দেয়নি। নয়ত আমি পাটনা থেকে ল’ পাশ করতাম কবে!

“আইনসম্মতভাবে আমিই তো সব পাওয়ার যোগ্য। দাদা তো পালিত পুত্র। কিন্তু দাদা বছরের পর বছর আমাকে ধোঁকা দিয়েছে, আমাকে ঠকিয়েছে, আমাকে অন্যদের শত্রু করে তুলেছে। দুর্নাম রটিয়েছে আমার। এমনকি খুন করার চেষ্টাও করেছে। পারেনি।”

“শেষপর্যন্ত দাদা চালাকি করে আমাকে ডাকাতি আর রাহাজানি মামলায় ফাঁসাবার চেষ্টা করেছিল। হাত ফসকে আমি বেরিয়ে আসি।

“তখন থেকে আমি রুজি-রোজগারের চেষ্টায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। শেষপর্যন্ত কলকাতায় আমার ওই দোকান নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। আমার যে কী কষ্টে দিন কেটেছে, আপনারা জানেন না। এখনো আমি গরিব। আর আমার দাদা, যার ভিখিরি হওয়ার কথা, সে মহারাজ। আমার কী ভাগ্য!”

সহদেব চুপ করল। করে অন্যমনস্কভাবে পকেট থেকে সস্তা সিগারেট বার করে ধরাল।

অল্পক্ষণ চুপচাপ থাকার পর সহদেব কী বলতে যাচ্ছিল, কিকিরা বাধা দিয়ে বললেন, “নটুমহারাজের সঙ্গে আপনার সম্পত্তি আর টাকা পয়সা নিয়ে বিরোধ চলছিল?”

“চলছিল। তবে আমি হাল ছেড়ে দিয়েছিলাস শেষে যখন শুনলাম–দাদা আমার মায়ের চিতার জমিও এক হোটেলঅলাকে বিক্রি করে দিয়েছে, তখন”।

“মায়ের চিতার জমি?”

“ওই জমিটাতে আমার মায়ের সৎকার করা হয়েছিল। ওটা আমাদের জমি।”

লালাবাবু বললেন, “কে বলল! ও জমি তো অন্য লোকের। আমি দলিল দেখেছি হালে। “

“আপনি জানেন না। দাদা বেনামি করে রেখেছে অনেক জমি। ওই জমি এক বিহারি বাবুর নামে বেনামি করা ছিল। মাঘ সিং।”

লালাবাবু অবাক হয়ে বললেন, “হ্যাঁ। ঠিক।”

 কিকিরা বললেন, “আপনি কি ওই জমি…?”

সহদেব বলল, “দাদাকে আমি লিখলাম, তুমি একা সর্বস্ব লুট করে খাচ্ছ। আমি ভিখিরির মতন একপাশে পড়ে আছি। যদি তুমি আমাকে আমার প্রাপ্যর কিছু অন্তত না দাও, তবে এবার আমি তোমাকে ছাড়ব না। তোমাকে আমি সাবধান করে দিলাম।”

“তারপর?”

“দাদা দরাদরি করতে নামল।”

“চিঠি লিখে?”

“না, লোক মারফত।”

“কোন লোক?”

“গোকুল।”

“আমি সাড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত নামলাম।”

“নটুমহারাজ রাজি হলেন?”

“হ্যাঁ। রাজি হবে না কেন? আমি তো আট-দশ লাখও চাইতে পারতাম। পারিবারিক গয়নাগাটিই কি কিছু কম আছে! তার ওপর জমি-জায়গা।”

কিকিরা বললেন, “আপনি কি সেদিন টাকা আনতে…?”

“টাকা আনতেই গিয়েছিলাম। এবার আর গোকুলের মুখের কথায় যাইনি। দাদাকে চিরকুট লিখে দিতে হয়েছিল। সেই চিরকুট আমার কাছে আছে।”

কিকিরা তারাপদর দিকে তাকালেন।

তারাপদ বলল, “আপনাকে সেদিন টাকা আনতে যেতে বলেছিলেন নটুমহারাজ?”

“হ্যাঁ। লিখেছিল–ওই সময়ে দাদা একা বসার ঘরে থাকবে; অপেক্ষা করবে আমার।”

“কিন্তু ওই বাড়ি যে রত্নেশ্বরবাবুদের ভাড়া দেওয়া ছিল?”,০

“সে-খবরও পেয়েছিলাম। তবে বসার ঘরে দাদা থাকবে ধরে নিয়েছিলাম। এমন তো হয়, একটা ঘর দাদা নিজের জন্যে রেখে দিয়েছিল?”

“তা হয়।”

“কিংবা দাদা সেদিন ওই ঘরেই বসে থাকবে আমার জন্যে এমন একটা ব্যবস্থা করেছিল।”

কিকিরা বললেন, “ঘরে ঢুকে আপনি নটুমহারাজকে দেখতে পেলেন না?”

“না। অন্য এক ভদ্রলোককে দেখলাম। আমি চিনি না। খালি গায়ে বসে নকশা কাগজপত্র দেখছিলেন। আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। আমি কে, কেন এসেছি জিজ্ঞেস করলেন। পালিয়ে আসতে পারছিলাম না। কাজেই মিথ্যে পরিচয় দিয়ে এ-কথা সেকথা বলছিলাম।”

“কী পরিচয় দিলেন?”

“যা মুখে এল তখন।… ততক্ষণে আমি বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম ইনিই সেই হোটেলওয়ালা, এখানে ভাড়া রয়েছেন। কাজেই কথা ঘোরাতে দেরি হল না।”

“এর পর কী হল আমি বলব?” তারাপদ বলল।

 “বলুন।”

“আপনি যখন উঠে পড়েছেন চেয়ার ছেড়ে ফিরে আসার জন্যে”

“উনিও উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, সহদেব বলল, “এমন সময় একটা কী হয়ে গেল। একটা তীর এসে তাঁর হাতের কাছে লাগল। উনি যন্ত্রণায় শব্দ করে– জায়গাটা হাত দিয়ে চেপে ধরলেন। চেপে ধরে ঘষতে লাগলেন। তারপরই দেখি ভদ্রলোক টলছেন। আমি ভয় পেয়ে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। পালিয়ে গেলাম। পালিয়ে যাওয়ার সময় মনে হল উনি টলতে টলতে মাটিতে পড়ে গেলেন।”

লালাবাবু বললেন, “কী সর্বনাশ! কে তীর মারল?”

কিকিরা বললেন, “নটুমহারাজ। নটুমহারাজ তীরন্দাজ লোক। অবশ্য উনি যাকে মারতে গিয়েছিলেন সে-মানুষ রত্নেশ্বর নয়, সহদেব। পেছনের জানলা দিয়ে তীর ছোঁড়ার সময়, রত্নেশ্বর হঠাৎ উঠে পড়ায়, লক্ষ্য ভুল হয়ে যায়, রত্নেশ্বরের হাতে লাগে।”

“আমি তখন কিছুই আর দেখিনি, পালিয়ে এসেছি,” সহদেব বলল।

লালাবাবু বললেন, “তীরে বিষ ছিল?”

“অবশ্যই”, চন্দন বলল, “তীরের মুখে ভাল মতন বিষ ছিল, মারাত্নক বিষ, নয়ত এমন হয় না।”

“কী বিষ?” কিকিরা বললেন।

সহদেব নিজের থেকেই বলল, “আমি কমবিস্তর বিষের কথা জানি। কেননা, যারা বিষ খোঁজে, ল্যাবরেটারিতে কলেজের রিসার্চের কাজে, আমি বিষ-অলাদের কাছে নিয়ে যাই বা পাঠিয়ে দিই। একটা বিষ আছে সাধারণত বালির দেশে পাওয়া যায়। রাজপুতানায় পাওয়া যায় এটা আসলে সাপের বিষ নয়, বিছে ধরনের সাপের বিষ। Echis Carinatus গোত্রের এক ভাইপারের বিষের মতন। ভয়ঙ্কর বিষ। ভয়ঙ্কর। সিংভূমের নদী-পাহাড়েও এই বিছে সাপ পাওয়া যায়। বিষটা দু-চার মাসেও নষ্ট হয় না। রাখার নিয়ম আছে। এই বিষ শরীরের রক্তের পক্ষে ভীষণ খারাপ।”

 চন্দন অবাক হয়ে সহদেবের দিকে তাকিয়ে থাকল।

 একেবারে চুপচাপ সবাই। কেউ আর কথা বলতে পারছে না।

শেষে কিকিরা বললেন, “সহদেববাবু, নটুমহারাজের তো কেউ নেই। তবু উনি এমন লোভী হবেন কেন? অর্থ, অলঙ্কার, সম্পত্তি…?”

সহদেব বলল, “একসময় দাদার সব ছিল, এখন নেই। আর লোভ মশাই আগুনের মতন, জ্বলতে শুরু করলে নিভতে চায় না। পুরাণে কী দেখেছেন? মহাভারতের কথাই ধরুন, দুর্যোধনের লোভ কি শেষদিন পর্যন্ত মিটেছিল! আপনাদের নটুমহারাজ যক্ষ হয়ে বেঁচে আছে। যক্ষ হয়েই মরবে।”

তারাপদ বলল, “মানুষ বড় অদ্ভূত হয়।”

 কিকিরা বললেন, “তারাপদ, নটুমহারাজ চালাকি করে সহদেবকে খুনের আসামি করতে চেয়েছিলেন। উটকো লোক, চার আঙুলঅলা একটা গ্লাভস, হলুদ পালক দেওয়া তীর। কোনোটাই ধোপে টিকল না। উটকো লোক সহদেব আমাদের চোখের সামনে; চার আঙুলের দস্তানাটাও ধোঁকাবাজি। সহদেবের যে আঙুল নেই, দস্তানায় তার ভুল হয়েছে। সহদেবের নেই মধ্যমা, দস্তাদায় অনামিকার আঙুলটা ছিল না। নটু চালে ভুল করেছেন। আর তীরগুলো বসার ঘরে থাকার কোনো কারণই ছিল না। উনি পরে সেগুলো সাজিয়ে রেখেছেন।”

“কেমন করে জানলেন?”

“আমি দেওয়ালের পেরেক দেখেছি। ওগুলো, হুক-পেরেকগুলো বরাবর ছিল না। নতুন করে গাঁথা হয়েছিল। পেরেকগুলোর রং চকচক করছিল।”

লালাবাবু কিছু বলার আগেই যজ্ঞেশ্বর লাফিয়ে উঠে বলল, “নটুকে পুলিশে দেব। এতবড় শয়তান, ভণ্ড লোক! মাডারার।”

কিকিরা বললেন, “লালাবাবু, আমরা সবাই সহদেবকে নিয়ে ঘাটশিলায় যাব। এই শনিবারেই।” বলে সহদেবের দিকে তাকালেন। “নটুমহারাজের চিঠিটা আপনি সঙ্গে রাখবেন সহদেববাবু।”

তারাপদ বলল, “স্যার, রবিবার করুন। শনিবারেও আমার অফিস রয়েছে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *