ময়ূরগঞ্জের নৃসিংহ সদন

ময়ূরগঞ্জের নৃসিংহ সদন

০১.

তারাপদরা সবেই ট্রেন থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে, প্ল্যাটফর্মের আলোগুলো হঠাৎ কমে এল। একে তো ছোট স্টেশন, লোকজনও তেমন একটা নামল না গাড়ি থেকে বা উঠল না, তার ওপর আলোগুলো কমে আসতেই কেমন যেন ফাঁকা-ফাঁকা নিঝুম মতন মনে হল জায়গাটা।

এদিকে আবার আকাশে মেঘ ডাকছে। একে পৌষের শীত, সময়টাও সন্ধে হয়-হয়, রীতিমত উত্তুরে বাতাস দিচ্ছে কনকনে, এর ওপর যদি বৃষ্টি শুরু হয়–তবে তো হয়ে গেল।

তারাপদ কিছু বলতে যাচ্ছিল চন্দনকে, এমন সময় কানে এল, “হ্যা-ল-লো!”

কিকিরা। হাত দশেক মাত্র তফাতে। এগিয়ে আসছিলেন তিনি।

তারাপদ আর চন্দন কিকিরাকে দেখতে লাগল। দেখার মতনই বেশভূষা। গরম প্যান্ট, ঢলঢল করছে; গায়ে পুরো-হাতা বেঢপ এক পুলওভার; রং ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, গাঢ় মেরুন রং বোধ হয়, মেরুনের সঙ্গে সাদার নকশা। রোগা-পাতলা, মাথায় লম্বা কিকিরার গায়ে জিনিসটা যা মানিয়েছে–আহা! কিকিরার গলায় বড়সড় মাফলার, মাথায় এক কাশ্মীরি টুপি, হাতে ছড়ি আর টর্চ।

এগিয়ে এসে কিকিরা বললেন, “ট্রেন লেট। প্রায় এক ঘণ্টা।”

তারাপদ বলল, “চার ঘণ্টাও হতে পারত। ট্রেনের ইঞ্জিন বিগড়ে গিয়েছিল। একটা ছোট জংশন স্টেশনে গাড়ি থামল, তারপর ছাড়ল যখন–ট্রেন আর এগোয় না, ইঞ্জিনের চাকা রেল লাইনে স্লিপ করতে লাগল। শুধু চাকা ঘুরে যায় বনবন করে।”

“বলো কী?”

“রেলের লোকগুলো বালতি বালতি বালি ঢালতে লাগল লাইনে, চাকার পাশে। সে এক কাণ্ড। শেষ পর্যন্ত চাকাগুলো গ্রিপ পেল।”

কিকিরা বললেন, “আজকাল ট্রেন মানেই ট্রাবল। হয় এটা, না হয় ওটা। নাও নাও চলো; আর দাঁড়িয়ে থাকা নয়।” বলেই কিকিরা মুটে ডাকতে লাগলেন।

মালপত্র কম। দুটো সুটকেস, দুটো হোল্ডঅল, একটা বেতের ঝুড়ি।

একটা মুটে হলেই চলত; সুটকেসগুলো চন্দনরা হাতে-হাতে নিতে পারত। কিকিরা দু’জন মুটে ঠিক করলেন। বললেন, “নৃসিংহ-সদন খানিকটা দূর হে, মাইলটাক পথ। রাস্তাও তোমাদের কলকাতার মতন নয়, পাথর, গর্ত, এবড়োখেবড়ো, মাঠ-ময়দানের ভেতর দিয়েও যেতে হবে শর্টকাট করে, ওরাই নিক, তোমরা ফ্রি হ্যাঁন্ডে চলো।” বলে একটু হাসলেন।

চন্দন তামাশা করে বলল, “ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতে করতে?”

 মুটেরা মাল উঠিয়ে নিল। নৃসিংহ-সদনের রেট পাঁচ টাকা করে।

কিকিরা বললেন, “আরে পাঁচ কাহে ছ’ করকে মিলি তুহার। হোড়া জলদি জলদি চল্; আগর পানি আ যায়ি তো…”

ওভারব্রিজের আগেই টিকিটবাবুর সঙ্গে দেখা। চন্দন পকেট থেকে তাদের টিকিট বের করে এগিয়ে দিল।

টিকিটবাবু ছোকরা। বাঙালি। চন্দনদের দেখে নিয়ে হেসে কিকিরাকে বলল, “আপনার গেস্ট, দাদু?”

কিকিরা বললেন, “রেসপেক্টেল গেস্টস্! ইনি হলেন ডাক্তার, ধন্বন্তরি; আর উনি সেতার, কলকাতায় ওঁর খুব নাম সেতারে..” বলে হাত দিয়ে আঙুল নেড়ে সেতারবাদ্যটা বুঝিয়ে দিলেন। হেসে বললেন আবার, “চলি, রাহাবাবু। অনেকটা যেতে হবে। বৃষ্টি এসে গেলেই মরব।” পা বাড়িয়ে কী মনে পড়ে যাওয়ায় আচমকা জিজ্ঞেস করলেন, “নতুন আর কোনো খবর আছে?”

টিকিটবাবু মাথা নাড়লেন। “তেমন খবর কিছু নেই?”

“তেমন নেই, তা এমন খবর কী আছে?”

“এমনও বলার মতন নয়। তবে লোকে বলছে, যে-লোকটা মারা গিয়েছে। সেই লোক আর যাকে আগুনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত তারা এক নয়।”

“আচ্ছা! লোকে বলছে..! চলি, রাহাবাবু।”

ওভারব্রিজে উঠেই শীতের দাপটটা আরও বোঝা গেল। পৌষ মাস, ডিসেম্বরের একেবারে শেষ। কনকনে বাতাস আসছে ঝাঁপটা মেরে। আকাশে মেঘ। চারপাশ জুড়ে যে ভীষণভাবে মেঘ ডাকছে তা অবশ্য নয়, কিন্তু গুড়গুড় শব্দটা রয়েছে। দূরের বিদ্যুৎ-চমক চোখে পড়ার মতন নয়। বেশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে এরই মধ্যে। অথচ সবেই সন্ধে এখন। শীতের দিনে এই সময়টাকেই রাত বলে মনে হয়।

ওভারব্রিজের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কিকিরা বললেন, “ট্রেনে এলে কেমন?”

“এলাম। ভিড় মোটামুটি।…এক্সপ্রেস গাড়ি। শুনলাম–গাড়িটা সব সময় লেট রান করে বলে অনেকেই এই ট্রেনে আসতে চায় না, রাত্তিরের মেল নেয়।”

“তোমাদের বরাত ভাল হে! এ ট্রেন চার-পাঁচ ঘণ্টাও লেট করে। এর নাম লেট লতিফ ট্রেন। তোমাদের বেলায় মাত্র এক ঘণ্টা। কিস্ নয়।”

“আপনিই তো এই ট্রেনটায় আসতে বলেছিলেন।”

“ঠিকই বলেছিলাম। রাত্তিরের গাড়িতে এলে তোমাদের কষ্ট হত, আমারও বুড়ো হাড়ে সহ্য হত না।”

তারাপদ ঠাট্টা করে বলল, “আপনি বুড়ো!..এই বুড়ো হাড়েই কত ভেলকি দেখাচ্ছেন! এখন সাফসুফ বলুন তো কিকিরা-স্যার, আপনি হঠাৎ এই ময়ূরগঞ্জ নামক জায়গাটিতে এলেন কেন?”

কিকিরা বললেন, “বেড়াতে। বড়দিনের ছুটি কাটাতে।”

চন্দন বলল, “আপনি তা হলে বড়দিন করেন?”

“করি। আমার বাপ ঠাকুরদাও করেছেন। তোমরা করো না? কলকাতায় তোমাদের বড়দিন হয় না? সাহেব পাড়ায় বড়দিনের কথা বাদ দাও। দিশি পাড়ায় তোমাদের কেক খাবার বহর কম নাকি? কেক খাওয়া, পিকনিক করা, চিড়িয়াখানায় যাওয়া…! দেখো হে স্যান্ডেল উড, খাঁটি সাহেবরা চলে গেছে বটে–কিন্তু তাদের লেজের টুকরো পড়ে পড়ে আছে। ওদের ফুর্তি-ফাতা আমাদেরও করতে হচ্ছে অল্পস্বল্প।” কিকিরা টর্চের আলো দেখাতে লাগলেন। এখানের পথঘাট অন্ধকার।

তারাপদ বলল, “স্যার, আপনি যদি বড়দিনের ছুটি কাটাতে এখানে এসে থাকেন–ভাল কথা। আমরা তা হলে শুধু ছুটি কাটাব, নাথিং মোর।…ওই যে শুনলাম আপনার রাহাবাবু কি সব বললেন, ওর মধ্যে আমরা নেই। কী বলিস, চাঁদু?”

চন্দন কিছু বলল না।

শীত এখানে সত্যিই বেশি। আজ বাদলা বাদলা ভাব হয়েছে বলে আরও শীত পড়েছে, না, মেঘলার দরুন শীত খানিকটা চাপা রয়েছে, আপাতত তা বোঝা মুশকিল; মেঘ কাটলে বোঝা যাবে।

কিকিরা ঠিকই বলেছিলেন। এ তো রাস্তা নয়, যেন পাহাড়তলির হাঁটা পথ। উঁচু-নিচু গর্ত, ছোট-ছোট ঝোপ, পাথরের টুকরো ছড়ানো। গাছপালাও দাঁড়িয়ে আছে সার বেঁধে। বিশাল বিশাল গাছ। অন্ধকারে বোঝা না গেলেও মনে হচ্ছিল, তেঁতুল, কাঁঠাল, অশ্বথ ছাড়া এত বড় বড় গাছ বড় একটা হয় না।

সকাল না হলে বোঝা যাবে না জায়গাটা কেমন। কিকিরা অবশ্য লিখেছেন–খুবই স্বাস্থ্যকর জায়গা, অনেকেই জল-হাওয়া বদলাতে আসে, তবে ভিড়-ভাড়াক্কা বেশি হয় না। থাকার মতন ঘরবাড়ি এখানে কম।

তারাপদ আবার বলল, “কিকিরা-স্যার, আপনি যে কথা বলছেন না?”

কিকিরা বললেন, “তোমরা কি বেড়াল! আঁশের গন্ধ ছাড়া নাকে কিছু ঢেকে।”

তারাপদ বলল, “এই অভ্যেস আপনিই করিয়েছেন।”

“বলো! যা মন চায় বলো!”

“এক-এক করে বলি!”

“যেমনভাবে তোমাদের ইচ্ছে।”

তারাপদ বলল, “তা হলে বলি। এক নম্বর পয়েন্ট হল, আপনি আগেভাগে কিছু না জানিয়ে রাতারাতি এখানে আসা ঠিক করে ফেললেন। আসার আগে আমার কাছে একটা দু লাইনের চিঠি পাঠালেন। ব্যাপার কী? না, আমি বড়দিনের ছুটি কাটাতে অমুক জায়গায় যাচ্ছি। পৌঁছেই তোমাদের চিঠি দেব। ঠিক কি না?”

“ঠিক। কারেক্ট।”

“এখান থেকে আপনি যে চিঠি দিলেন–তাতে লিখলেন, তুরন্ত চলে এসো।.কী খাসা জায়গায় আছি না এলে বুঝবে না! ঘণ্টায়-ঘণ্টায় খিদে পায়, মুরগি ভেরি চিপ, দুধে মাত্র ওয়ান-টেনথ জল থাকে। শাকসবজি টাটকা। বড়দিন কাটাবার পক্ষে আদর্শ জায়গা। লিখেছিলেন তো?”

“কারেক্ট।”

“তারপর কী লিখেছিলেন?”

“কী লিখেছিলাম! মনে পড়ছে না।”

“স্যার, আপনি আমাদের লেজে খেলাচ্ছেন কেন! এতদিন আপনার শাগরেদ করছি। …আপনি লিখেছিলেন–এখানে এলে তোমাদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে না। অলস বিলাসে কাটিবে না বেলা…। লিখেছিলেন না?”

কিকিরা নিরীহ গলায় বললেন, “লিখেছিলাম বুঝি! তা লিখতে পারি। মাঝে-মাঝে আমায় পদ্য ভর করে। ছেলেবেলায় পড়েছিলুম।”

“এবার বলুন। প্লিজ!”

কিকিরা সামান্য চুপ করে থেকে বললেন “ধৈং ধরতি রাঘব..” বলে নিজেই হেসে ফেললেন।

তারাপদরা হেসে ফেলল। বলল, “স্যার, আপনি তো ইংলিশদের নাক ভাঙার ব্রত নিয়েছেন, হঠাৎ স্যাংক্রিট কেন?”

“মাঝে-মাঝে জিভের স্বাদ পালটাতে হয়।…তবে কি জানো, এখানে রাঘব মানে রামচন্দ্র নন, রঘুপতি রাঠোর।”

“রঘুপতি রাঠোর! দারুণ নাম! ছত্রপতি বংশের নাকি?” বলে হাসল তারাপদ।

“জানি না।…আমি যেখানে উঠেছি-নৃসিংহ-সদন, তার মালিক এই রঘুপতি।”

“আচ্ছা।”

“দেখলে বুঝতে পারবে। মানুষটিকে মালুম করতে পারবে খানিকটা। সেইসঙ্গে বাড়িটা দেখলেও চমৎকৃত হবে।”

“চমৎকৃত!

“ওই হল বাবা!..তা এই রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে অত কথা বলা যাবে না। আগে বাড়িতে চলো। একটু জিরিয়ে নিয়ে ডবল ডোজ চা, ডবল ডিমের ওমলেট, পটেটো ফ্রাই, টমাটো সস খাও–পেট জুডোেক–তারপর আস্তে-আস্তে সব শুনবে। এখন রাস্তা দেখে পথ হাঁটো, নয়ত হোঁচট খাবে।” বলে টর্চের আলোটা আরও কাছাকাছি ছড়িয়ে দিলেন।

চন্দন বলল, “জায়গার নাম ময়ূরগঞ্জ, অথচ রাস্তা আর মাঠ দেখে মনে হচ্ছে–এর নাম হওয়া উচিত ছিল পাখরগঞ্জ।”

কিকিরা মজা করে বললেন, “নামের মহিমা আছে হে! পরে শুনো–এখন সাবধানে এগোও আর খানিকটা, তারপর মাঠ ধরব। শর্টকাট। মাঠ পরিষ্কার।”

মুটে দুটো সামনেই ছিল। যেতে-যেতে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল নিচু গলায়। ওদের গায়ে ভুট কম্বলের মতন জামা, গামছায় কান-মাথা জড়ানো। চেনা রাস্তা বলে ওদের যেন কোনো অসুবিধেই হচ্ছিল না, অন্ধকারের মধ্যে দিয়েও চলে যাচ্ছিল দিব্যি।

খানিকটা তফাতে দু-চার ঘর কুঁড়ে। একটা ঝুপড়ি। টিমটিপে বাতি জ্বলছে। মাঠে যেন আরও জোর বাতাস। আকাশের কোনো প্রান্তেই তারা নেই। মেঘ ডাকছিল আগের মতনই।

কিকিরা বললেন, “রাত্তিরে ঠিক বুঝছ না, জায়গাটা কিন্তু সত্যিই ভাল।

 “স্বাস্থ্যকর বলছেন?”

“খুবই স্বাস্থ্যকর। যেসব বাঙালিবাবু পুজোয় আর বড়দিনে জল-হাওয়া বদলাতে বেরিয়ে পড়ে, তারা এখনও এই জায়গায় খবর পায়নি। পেলে আর রক্ষে রাখবে না। মধুপুর-দেওঘর করে তুলবে। জায়গাটা কিন্তু পুরনো। বাঙালিবাবুদের বাড়িও আছে কিছু।”

“কই, চোখে তো পড়ছে না?” চন্দন বলল।

“এ-পাশে চোখে পড়বে না। আমরা শর্টকাট করে যাচ্ছি। বড় রাস্তা ঘুরে গেলে দেখতে পেতে। বাহারি নামও আছে বাড়ির : “সন্ধ্যানীড়’, “রুবিভিলা’, “মিতালি-লজ’, “ব্লু হাউস’, “মুন লাইট। আবার “দীননাথ’, মাতৃস্মৃতি’–তাও আছে।”

“সব বাড়িই কি একদিকে, না…?”

“উঁহু! দু-চারটে স্টেশনের বাঁদিকে, বাকিগুলো এদিকে।”

“আপনার নৃসিংহ-সদন?”

“একেবারে শেষদিকে। লাস্ট।”

“তা আপনার গৃহস্বামী রঘুপতি রাঠোর কোথাকার লোক?”

“সাত পুরুষ আগে কোথা থেকে এসেছিলেন কে জানে! এখন বাঙালি। রাঠোর পদবিটাকে বাড়িয়ে নিয়ে রায় রাঠোর করে নিয়েছেন।”

“তা হলে তো স্যার আপনার জাত–কিঙ্করকিশোর রায়!” তারাপদ হেসে ফেলল।

“গৃহস্বামীর বয়েস?” চন্দন জিজ্ঞেস করল।

“বয়েস, পঞ্চাশের ওপর। বাহান্ন-তিপান্ন। মাতৃভাষা বাংলা। পত্নী বিগত। দুই পুত্রের মধ্যে একজন এখন জাহাজে-জাহাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে সমুদ্রে। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। অন্যজন কলকাতার বাড়িতে। সে বেচারির ছেলেবেলায় পোলিও হয়ে পা দুটো জখম হয়ে গেছে। দাঁড়াতে পারে না ভাল করে। কলকাতায় তাকে দেখাশোনা করার লোক আছে বলে তাকে কলকাতার বাড়িতেই রাখতে হয়। এখানে তাকে রাখার নানান অসুবিধে। খুব কমই এখানে এসেছে। তা ছাড়া রঘুপতিবাবু নিজেও কলকাতাতেই বেশি থাকেন।”

তারাপদ কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় জোরে মেঘ ডেকে আকাশময় ছড়িয়ে পড়ল। বিদ্যুও চমকে গেল কাছেই।

কিকিরা বললেন, “তাড়াতাড়ি পা চালাও। বৃষ্টি এসে পড়লে ভিজে ন্যাতা হয়ে যেতে হবে।”

চন্দনরা জোরে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে-হাঁটতে বলল, “কিকিরা-স্যার—ঘটনাটা কি এই রঘুপতি রাঠোরকে নিয়ে?”।

“হ্যাঁ।..এখন আর কথা নয়, কাজ। মুখ বন্ধ করো, পা চালাও; রানিং লাগাও।

.

বৃষ্টি আসেনি। বৃষ্টি আসার তোড়জোড় অবশ্য বেড়েছে। তারাপদরা নৃসিংহ-সদন-এ পৌঁছে গিয়েছিল।

বাড়ি দেখে তারাপদ বলল, “কিকিরা, এটা কি ভূতের বাড়ি?”

 কিকিরা সেকথার কোনো জবাব না দিয়ে একটি লোককে দেখিয়ে দিলেন। লোকটির হাতে লণ্ঠন। বছর চল্লিশ বয়েস হতে পারে, ঠিক ছোকরা নয়, আবার বয়স্কও নয় তেমন। হাতে লণ্ঠন, গায়ে গরম চাদর, পরনে ধুতি। স্বাস্থ্যবান চেহারা।

লোকটিকে দেখিয়ে কিকিরা বললেন, “চন্দন, এর নাম বিরজু। আদিতে বিরিজলাল। আমি বলি বিরজুবাবা। নামটা হিন্দুস্থানি হলে কী হবে বিরজুবাবা বারো-চোদ্দ বছর বয়েস থেকে এবাড়িতে।” বলে বিরজুর দিকে তাকালে কিকিরা, “এ বাড়িতে তোমার কত বছর চলছে বিরজুবাবা?”

“পঁচিশ বছর।“ পরিষ্কার বাংলায় বলল বিরজু। “বুড়োবাবু আমায় বিরজু বলে ডাকতেন।”

“বুড়োবাবু? মানে রঘুপতিবাবু?”

“না। বাবুর বাবা।”

 তারাপদরা আর কিছু বলল না। বাগানের সরু পায়ে-চলা পথ ধরে এগিয়ে যেতে লাগল। চারপাশে গাছপালা। আগাছার জঙ্গলে বাগান যেন ভরে আছে। গাছগাছালির গন্ধ। বাতাসের ঝাঁপটা আরও বাড়ছিল। অন্ধকারেই বাড়িটা আবছাভাবে অনুমান করা যাচ্ছিল। পুরনো বাড়ি। কত পুরনো তা এই অন্ধকারে বোঝা যায় না।

তারাপদ নিচু গলায় চন্দনকে বলল, “চাঁদু, থিয়েটারের সিনে যেমন ভাঙা দুর্গ আঁকা থাকে–সেইরকম দেখাচ্ছে না বাড়িটা?”

চন্দন বলল, “আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না; কালোকালো দেওয়ালই দেখছি। “

“কিকিরা আমাদের কোথায় নিয়ে এলেন কে জানে!”

কথাটা কানে গিয়েছিল কিকিরার। বললেন, “ ‘দানব দমন’ পালার নাম শুনেছ? কোত্থেকেই বা শুনবে তোমরা! যোগেন পাণ্ডার রয়েল অপেরার পয়লা নম্বর পালা। তাতে ছিল : এ কী মল্লভূমি সেনাপতি, চতুর্দিকে শিবারব, অট্টহাসি হাসে ওই পিশাচের দল, কম্পিত আমার বক্ষ…”

বাধা দিয়ে তারাপদ বলল, “আমাদেরও বক্ষ কম্পিত হচ্ছে কিকিরা। এটা কি বাড়ি, না গোরস্থান?”

 “ধৈর্য বস্তুটা তোমাদের একেবারেই নেই, তারাপদ। তোমরা ভাবো যা হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে হয়ে যাক। আরে বাবা, এটা ওয়ান ডে ক্রিকেট নয়। পাঁচ দিনের খেলা। ধৈর্যং, ধরয়তি বৎস?”

তারাপদরা হেসে ফেলল।

কথা বলতে বলতে বাড়ির ঢাকা বারান্দায় পৌঁছে গিয়েছিল ওরা। স্পষ্ট করে না হলেও বিরজুর লণ্ঠনের আলোয়, আর কিকিরার টর্চের দৌলতে বারান্দার খানিকটা চোখে পড়ল। বারান্দাটা যেন তিন ভাগে ভাগ করা। মাঝের ভাগটা এগিয়ে, পাশেরগুলো পিছিয়ে। গোল চাঁদোয়ার মতন ছাদ বারান্দাগুলোর।

বিরজু হাঁকডাক করার আগেই লণ্ঠন হাতে দুটি ছোকরা এসে গেল। মুটের কাছ থেকে মালপত্র নামিয়ে নেবে, নিয়ে যথাস্থানে রাখবে বোধ হয়।

কিকিরা বললেন, “বাবু কোথায়?”

একজন বলল, “বাবুর শরীর ভাল নয়। শুয়ে আছেন। বলতে বললেন, কাল সকালে দেখা হবে।”

কিকিরা বললেন, “ঠিক আছে। নাও তোমরা মালপত্র তুলে নাও। নিয়ে দোতলায়…! তাই না বিরজুবাবা?”

বিরজু বলল, “হ্যাঁ। সব ঠিক করা আছে।”

.

০২.

বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিল। জোরে নায়, মাঝারিভাবে।

দোতলার একটা ঘরে কিকিরারা বসে ছিলেন। চা-খাওয়া শেষ হয়েছে। খানিকটা আগে। গোল টেবিলের ওপর থেকে কাপ, প্লেট, সসের বোতল, চামচ সব পরিষ্কার করে তুলে নিয়ে গিয়েছে কাজের লোক। ঘরের মধ্যে একটা গোল ধরনের টেবিল বাতি জ্বলছিল। কেরোসিনের বাতি। আলো মোটামুটিভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল ঘরে। তবে লালচে আলোলা।

ঘরের জানলাগুলো বন্ধ। শার্সি, কাঠ দুইই। ঘরের এককোণে ফায়ার প্লেসের মতন জায়গাটায় একটা চৌকোনো উনুন মতন। তাতে কাঠকয়লার আঁচ। ঘরটা গরম রাখার চেষ্টা।

কিকিরা সিগারেট খেতে-খেতে বললেন, “এবার তা হলে শুরু করা যাক।”

 তারাপদও সিগারেট খাচ্ছিল। বলল, “করুন, আর কত ধাঁধায় রাখবেন।”

কিকিরা বললেন, “বিগিনিংটা বলি তবে। দিন দশ-পনেরো আগে আমার কাছে কলকাতার বাড়িতে এক ভদ্রলোক দেখা করতে যান। আমার চেনা লোক। গোপবাবু। এক সময় গোপবাবু আমার প্রতিবেশী ছিলেন। প্রায়ই গল্পগুজব করতে আসতেন। ওই গোপবাবু এখন রঘুপতিবাবুদের কলকাতার অফিসে কাজ করেন।”

“কিসের অফিস?”

“ট্রাভেলিং এজেন্সির অফিস। রঘুপতিবাবুদের অনেকরকম ব্যবসা। বড় ব্যবসা বলতে, জাহাজের ঠাণ্ডি মেশিন সারানোর একটা কারবার, সেটা কলকাতায়। বজবজে এক কারখানা আছে; সেখানে–ওই তোমার কী বলে–ড্যাম্প পুফ পাউডার তৈরি হয়, কেমিক্যাল প্রোডাক্ট। ঘরবাড়ি বানানোর সময় লাগে জিনিসটা। আর ওই ট্রাভেলিং এজেন্সি’। মিশন রোয়ে অফিস।…তা গোপবাবু একদিন এসে বললেন, তাঁর মালিক একটা ঝঞ্ঝাটে পড়েছেন, আমি যদি ব্যাপারটা একটু দেখি বড় ভাল হয়। বিনি পয়সার কাজ নয়, যা লাগে পাওয়া যাবে। “

“আপনি রাজি হয়ে গেলেন?”

“নিমরাজি। ব্যাপারটা না বুঝে কি রাজি হওয়া যায়!…তবে মুশকিল হল কি জানো, আমি যাঁর সঙ্গে কথা বলব সেই রঘুপতিবাবু তো এখানে–ময়ূরগঞ্জে। ঘটনাটাও এখানকার। গোপবাবু ভাল করে কিছু বলতে পারেন না। আমায় ধরেবেঁধে লোক দিয়ে এখানে পাঠিয়ে দিলেন। তোমাদের কোনোরকমে একটা খবর দিয়ে চলে এলাম আমি। এসেই কিন্তু চিঠি দিয়েছি।”

চন্দন মাথা নাড়ল। “তা দিয়েছেন। আমি আবার ভেবেছিলাম দিন কয়েক দিঘা ঘুরে আসব। ছুটি নিয়েছিলাম।”

 “দিঘা! ও তো ঘরের কাছে। পরে যাবে যখন খুশি।” সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে হাত নাড়লেন কিকিরা, যেন দিঘার ব্যাপারটা হাত নেড়ে দূরে হটিয়ে দিলেন। এবার একটু মন দিয়ে শোনো।”

“বলুন।”

“গোড়ার কথা একটু বলি,” কিকিরা বললেন, “রঘুপতিবাবু যদিও কলকাতাতেই থাকেন, তবু বছরে বার দুই করে এখানে–তাঁদের নৃসিংহ সদনে আসেন। এই বাড়িটার ওপর তাঁর খুবই মায়া-মমতা। পৈতৃক বাড়ি। ষাট-সত্তর বছর হতে চলল। তা ছাড়া এখানে রঘুপতিবাবুদের কিছু জমি-জায়গা বিষয়-সম্পত্তি আছে। মাঝে-মাঝে খোঁজ-খবরও নিতে হয়।”

“শীতকালেই আসেন বুঝি?”

“বর্ষার গোড়ায় আসেন একবার। ধানী জমি আছে। চাষবাসের ব্যবস্থা করে দিয়ে যান। আর আসেন শীতের মুখে। কালীপুজো নাগাদ। এই সময়টায় এসে এক-দেড় মাস থেকে যান টানা। আসেন বাড়ির টানে। ওঁর স্ত্রী এখানেই মারা গিয়েছিলেন–সেটাও একটা কারণ। তা ছাড়া বাইরে বাড়িঘর থাকলে লোকে একবার শরীর সারাতে আসে–এটা বনেদি রেওয়াজই বলতে পারো।”

তারাপদ বলল, “রঘুপতিবাবু এবারে কবে এসেছেন?”

কালীপুজোর পর। নভেম্বর মাসের শেষদিকে।

 “তারপর?”

“এসে ভালই ছিলেন। অন্য-অন্যবার আসার পর যেভাবে সময় কাটে সেইভাবেই দিন কাটছিল। সকাল-বিকেল ঘরে বেড়ান অনেকটা, চেনা লোকজনের সঙ্গে গল্পগুজব করেন, বইটই পড়েন–মানে দিনগুলো আরাম আয়াস করেই কাটাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। বরং বলতে পারো, ঘটতে লাগল।”

“কী ঘটনা?”

 কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন। চুপ করে থাকলেন সামান্য সময়। তারপর পাঁচ-দশ পা সরে ফায়ার প্লেসের মতন জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়ালেন। সেখানে চৌকোনা উনুনের মতন পাত্রে কাঠকয়লার আঁচ উঠেছিল। কিকিরা নুয়ে পড়ে সিগারেটের টুকরোটা আগুনে ফেলে দিলেন। দিয়ে হাত সেঁকতে লাগলেন।

তারাপদরা অপেক্ষা করতে লাগল।

শেষ পর্যন্ত কিকিরা সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, “রঘুপতিবাবু একদিন শেষ বিকেলে নিজের ঘরের ব্যালকনিতে বসে ছিলেন, হঠাৎ চোখে পড়ল দূরে এক জায়গায় আগুন জ্বলছে। ঠিক দাউ দাউ করে যে জ্বলছে তা নয়–খানিকটা জায়গা জুড়ে জ্বলছে; শুকনো পাতাটাতায় আগুন ধরিয়ে দিলে যেভাবে জ্বলে, সেইভাবে জ্বলছে।”

তারাপদ চন্দনের দিকে তাকাল। চন্দন কিকিরার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে।

কিকিরা বললেন, “রঘুপতিবাবু প্রথমে ভেবেছিলেন, শীতের সময় বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে বড় বড় গাছের তলায় ঝরে পড়া শুকনো পাতা জড়ো করে যেভাবে আগুন জ্বালানো হয়–সেইরকমই ব্যাপার। তবে শুধু পাহাড়ে-জঙ্গলে নয়–এমনিতেও সাফসুফ রাখার জন্য লোকে এখানে-ওখানে জঞ্জাল জ্বালিয়ে দেয়। সাধারণ দৃশ্য বলে তেমন নজর করতে চাননি। কিন্তু হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল, একটা লোক সেই আগুনের ওপর হাঁটছে। হাঁটতে-হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়ল মাঝখানে, আগুনটাও ধীরে ধীরে নিভে এল।“

চন্দন বলল, “আগুনের ওপর হাঁটছে?”

“হ্যাঁ।”

“মানে–সেই–কী যেন বলে-ফায়ার ওয়ার্কিং না কী যেন!”

“বলে।”

তারাপদ বলল, “আগুনের ওপর হাঁটবে কেন? ব্যপারটা কী?”

কিকিরা বললেন, “লোকটাকে কেমন দেখতে ছিল সেটা শোনো। তার গায়ে টকটকে লাল-গেরুয়া রঙের আলখাল্লা। মাথার চুল বড়বড়কাঁধ পর্যন্ত ছড়ানো। লম্বা দাড়ি।”

“সাধু-সন্ন্যাসী?”

“বেশভূষা সেইরকম।”

“তারপর?”

“আগুন নিভে যাওয়ার পর লোকটিও অদৃশ্য হয়ে গেল।…রঘুপতিবাবু এই ধরনের অদ্ভুত দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তবু তিনি ভয় পাননি। ভেবেছিলেন, চোখের ভুল বা নিজে ঠিক মতন ধরতে পারেননি ব্যাপারটা।”

“তা হতে পারে।“

“আগে সবটা শোনো,” কিকিরা বললেন। বলে তারাপদদের দিকে এগিয়ে এলেন। “এই একই দৃশ্য যদি তুমি বারবার দেখোতখনো কি মনে হবে চোখের ভুল?”

তারাপদ চন্দনের মুখের দিকে তাকাল। চন্দন বলল, “রঘুপতিবাবু এই একই ব্যাপার–আবার দেখেছেন। “

“পর-পর তিনবার। দু-তিনদিন অন্তর।”

“বলেন কী!”

“এর পর যা ঘটল সেটা বড় মারাত্মক ব্যাপার। ভয়ঙ্কর। যে জায়গায় ঘটনাটা দেখা যেত ওরই কাছাকাছি এক জায়গায় একটা লোককে মরে পড়ে থাকতে দেখা গেল।”

তারাপদ আঁতকে ওঠার শব্দ করল। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ে গেল স্টেশনের টিকিটবাবুর কথা। কী যেন বলছিলেন ভদ্রলোক! একই লোক নয়–এইরকম কিছু একটা বলছিলেন কিকিরাকে।

চন্দন বলল, “মারা গেল কীভাবে?”

“ওপর থেকে নিচে পড়ে গিয়ে। মাথায় লেগেছিল। বড় পাথরের ওপর পড়ে গিয়েছিল লোকটা।”

“পুলিশ কী বলল?”

“এ-সব ছোটখাটো জায়গায় থানা বলে একটা আখড়া অবশ্য থাকে। কিন্তু তারা কোনো কর্মের নয়। নামকো বোস্ত থাকা। চুরি ছাঁচড়ামি হলে লাঠি নিয়ে ঘোরে, ডাকাতি হলে টহল মেরে আসে। বিহারের এই ছোট জায়গায় অন্য ক্রাইম আর কী হতে পারে চুরিচামারি ছাড়া! মরে গেছে তো গেছে। পুলিশ কিছুই করল না, করতে পারল না। অ্যাকসিডেন্ট কেস। সাবডিভিশনের থানার ওপরঅলাকে জিজ্ঞেস করে লাশ পুড়িয়ে দিল।”

“লাশ পুড়িয়ে দিল?”

“কী করবে! এখানে কি মর্গ আছে?…লাশ পচতে শুরু করেছে, মাথার ওপর শকুনের ঝাঁক নেমেছে.”

“লোকটা কে?”

“কেউ জানে না। এখানকার লোক নয়।”

“আইডেন্টিফিকেশন হল না?”

“না।”

তারাপদ উঠে গেল হাত সেঁকতে। বৃষ্টি বোধ হয় পড়েই চলেছে। শীত যেন বেড়েই উঠছিল।

কিকিরা বললেন, “একটা ব্যাপার কী জানো? অজানা-অচেনা একটা লোক ওইভাবে মারা যাওয়ার পর আগুন জ্বলার ব্যাপারটাও বন্ধ হয়ে গেল। আর কেউ আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটল না।”

“তার মানে–যে-লোকটা আগুন জ্বালাত, জ্বালিয়ে আগুনের ওপর হাঁটত–সেই লোকটাই মারা গেল।”

“তাই তো দাঁড়াচ্ছে।”

তারাপদ হঠাৎ বলল, “আপনি আসার আগেই এসব ঘটনা ঘটে গিয়েছে?”

মাথা নাড়লেন কিকিরা। “আমি যেদিন এখানে এলাম–তার তিন-চারদিন আগে লোকটা মারা গিয়েছে। আমি এসেছি, একুশে ডিসেম্বর। আঠারোই ডিসেম্বর লোকটা মারা গিয়েছে।”

“আপনি এসে লোকটাকে দেখেননি?”

“না।”

“সে কি সাধু-সন্ন্যাসী ছিল?”

“এরা বলছে, নয়। যে-লোকটা আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটত–তার বড় বড় চুল ছিল ঘাড় পর্যন্ত, দাড়ি ছিল। যে-লোকটা মারা গেল– তার চুল-দাড়ি ওরকম ছিল না।”

“তা হলে তো আলাদা লোক!”

“তা তুমি কেমন করে বলতে পারো? চুল-দাড়ি লাগিয়ে স্টেজে তো লোকে কত কী সাজে! নারদমুনি, আলমগির…!”

চন্দন বুঝতে পারল, কথাটা বলার আগে সে খেয়াল করেনি তেমন করে। ঠিকই তো! চুল-দাড়ি নকলও হতে পারে।

তারাপদ বলল, “একটু বুঝতে দিন স্যার। সব গুলিয়ে যাচ্ছে। তার আগে একটা কথা বলুন। আপনি বললেন, আপনার বন্ধু গোপবাবু আপনাকে এখানে পাঠিয়েছেন। ঠিক কিনা!”।

“বিলকুল ঠিক।”

“তিনি আছেন কলকাতায় রঘুপতিবাবু আছেন এখানে, ময়ূরগঞ্জে। এখানে কি ফোন আছে যে দুজনের মধ্যে কথা হয়ে যাবে রাতারাতি?”

কিকিরা বললেন, “এখানে ফোন নেই। তবে রাতারাতি না হোক-চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে খবরাখবর দেওয়া-নেওয়া হয়ে যায়।”

“কেমন করে?”

“কলকাতা থেকে তোক আসে রঘুপতিবাবুদের। কমপক্ষে হপ্তায় দু’দিন। দরকার পড়লে তিনদিন। অফিসের লোক। মেসেঞ্জার। একবেলার ব্যাপার। চিঠিপত্র নিয়ে আসে, কাগজে সইসাবুদ করাতে আসে; যখন যা দরকার হয় নোক এসে করিয়ে নিয়ে যায়।”

“আচ্ছা?”

কিকিরা আবার চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লেন। বললেন, “অফিস আর বাড়ি–দুইয়ের সঙ্গেই এইভাবে যোগাযোগ রাখেন রঘুপতিবাবু। না রাখলে চলে না। কারবারি লোক। টাকা-পয়সা আছে।”

 “সিস্টেমটা ভাল!” তারাপদ বলল “গোপবাৰু কি লোকমুখে খবর পেয়েছিলেন?”

“চিঠি। রঘুপতিবাবু চিঠি দিয়েছিলেন গোপবাবুকে। লোকের হাতে চিঠি পান গোপবাবু।

“উনি, মানে গোপবাবু তা হলে রঘুপতিবাবুর বিশ্বস্ত লোক?”

“তা তো ঠিকই। গোপ খুবই কাজের লোক। রঘুপতির সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল–তবে তখন গোপ অন্য জায়গায় কাজ করতেন। রঘুপতিবাবুদের কাছে বছর দুই আছেন।”

চন্দন বার কয়েক পায়চারি করল ঘরের মধ্যে। “স্যার কিকিরা, সত্যি করে বলুন তো–এই ব্যাপারটার গন্ধ পেয়ে আপনি নিজেই ছুটে এলেন? নাকি এই কাজটার জন্য আপনাকে ডাকা হয়েছে? ডাকল কে? রঘুপতি রাঠোর? না, গোপবাবু?”

কিকিরা হেসে বললেন, “স্যান্ডেল উড, সহজ কথাটা বুঝলে না! গোপ আমার প্রতিবেশী আর বন্ধুর মতন ছিলেন। কিকিরার ক্যালিবার তিনিই জানেন রঘুপতির জানার কথা নয়। গোপই আমাকে পাঠিয়েছেন।”

“ও!…ভাল কথা। তা আপনি এখানে এসে রঘুপতিজিকে কেমন দেখলেন? মানে, তিনি আপনাকে দেখে কেমন ভাব করলেন? আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন, এইরকম ভাব করলেন কী?

কিকিরা অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “সেটাই বুঝতে পারছি না। উনি খুবই অবাক হয়েছিলেন আমাকে দেখে। বোধ হয় আমাকে আশাও করেননি। তবে মনে যাই থাক-মুখে আমাকে মেনে নিয়েছেন। হাবভাবে মনে হয়, খাতির করেন। আর থাকা-খাওয়ার কোনো অসুবিধে রাখেননি কোথাও! এই যে তোমাদের নেমন্তন্ন করে আনলুম এখানে–উনি জানেন। না করেননি। বরং বললেন–বেশ তো, ওরা আসুক না। ভালই হবে।”

তারাপদ কিছু ভাবছিল। বলল, “যা ঘটার আপনি আসার আগেই ঘটে গিয়েছে। তারপর আর কিছু হয়নি?”

কিকিরা মাথা নাড়লেন, “আগুন আর দেখা যায়নি। গেরুয়াধারীকেও নয়। তবে অন্য দু-চারটে খুচরো ব্যাপার হয়েছে। “

“যেমন?”

 রঘুপতিবাবুর শরীর খারাপ হয়েছে। চুনিয়া নদী–যদিও সেটা নদী নয়–পাহাড়ি জল বয়ে-যাওয়া একটা স্রোত বলতে পারো–সেই চুনিয়া নদীতে একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ পাওয়া গেছে।”

“ক্যাম্বিসের ব্যাগ?”

“ক্যানভাস ব্যাগটার ভেতরে একটা হাতুড়ি। বরদস্ত হাতুড়ি। হাতলটা ধরো হাতখানেক মতন, আর লোহার মুণ্ডুটা বিঘতখানেক।

তারাপদ আর চন্দন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। কিছুই বুঝল না।

শেষে তারাপদ বলল, “কিকিরা, এ যে ডিটেকটিভ নভেল হয়ে যাচ্ছে। রহস্য আর রহস্য। আগুন, আগুনের ওপর হাঁটা, অজ্ঞাত ব্যক্তির মৃত্যু, গৃহস্বামীর অসুস্থতা, তারপর হাতুড়ি..পর-পর-ওরে বাব্বা!” গলায় খানিকটা হালকা ভাব তারাপদর। মনে-মনে অবশ্য অন্যরকম ভাবছিল।

কিকিরা বলেন, “তোমাদের সেই গান আছে না–মেঘের পরে মেঘ জমেছে, এ অনেকটা সেইরকম। মিস্ত্রির পর মিস্ত্রি!”

“রঘুপতিবাবু সব জানেন?”

“জানেন। শুধু একটা জানেন না। হাতুড়ি জানেন না।”

“কী বলছেন উনি?”

“বলছেন, তিনি কিছুই ধরতে পারছেন না। তাঁর বাড়ির কাছে এ-সমস্ত ঘটনা ঘটল কেন?”

“আপনি কিছু বুঝতে পারছেন?”

“বোঝার চেষ্টা করছি।” বলে উঠে দাঁড়ালেন কিকিরা। হাই তুললেন। আগুনের কাছে গেলেন আবার, “ঠাণ্ডাটা বড় বেয়াড়াভাবে পড়েছে হে, তারাপদ! বুড়ো হাড়ে আর সহ্য হয় না। এদিকে যদি এই বৃষ্টি চলতে থাকে তবে একেবারে কফিন!

“কফিন?”

“কবরের বাক্স।”

“আপনি কবরে যাবেন কেন?”

“কবরটা আমার বেশ লাগে। বাক্সর মধ্যে আরামে থাকলুম। থাকতে-থাকতে বেরিয়ে এলুম।”

“বেরিয়ে এলেন? বলেন কী!..আপনি কি ভূত-শক্তি?”

“না, ভূত নয়। তবে পারি। বন্ধ বাক্স থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। ম্যাজিক। হুডিনির ম্যাজিক। কিকিরা দ্য গ্রেট ম্যাজিকটাকে আরও এক কাঠি ইমপ্রুভ করে নিয়েছে। প্রবেশ করব ধুতি-চাদর পরে। বেরিয়ে আসব গেরুয়া আলখাল্লা পরে খঞ্জনি বাজাতে বাজাতে। হাউ বিউটিফুল।” বল কিকিরা হেসে খঞ্জনি বাজাবার ভঙ্গি করলেন।

.

০৩.

সকালে বৃষ্টির চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, দুপুর বা বিকেল নাগাদ বাদলা আবহাওয়াটা কাটলেও কাটতে পারে। ঝিরঝির বৃষ্টি থামছিল, হচ্ছিল আবার থামছিল। আকাশে মেঘ থাকলেও সেটা ঘন নয়, সাদাটে। দু-চারবার মেঘ সরে আলোও উঁকি দিয়ে গেল।

রঘুপতিকে ঘিরে কিকিরারা বসে ছিলেন। দোতলায়। রঘুপতির বসার ঘরে।

বসার ঘরটি বড় নয়, মাঝারি। সেকেলে বাড়ি। কাঠের কড়ি বরগা। জানলা-দরজা বড়। জানলায় শার্সিও রয়েছে। ভেতরের দেওয়াল শক্তপোক্ত, সাধারণ প্লাস্টার। ঘরের দু’দিকে দুই দেওয়াল আলমারি, এমনি আলমারিও একজোড়া, ভারী গোছের সোফা সেটি। দেওয়ালে দু-চারটে ছবি, হরিণের মাথা একটা, দেওয়াল ঘড়ি। মোটামুটি সবই আছে–তবে খুব সাজিয়েগুছিয়ে রাখা নয়।

বসার ঘরের গা-লাগিয়ে ঝুল বারান্দা।

তারাপদরা রঘুপতিকে দেখছিল।

রঘুপতির বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়েছে বোঝা যায়। তবে শরীরের কাঠামো মজবুত। উনি মাথায় তেমন লম্বা নন, মাঝারি হতে পারেন। প্রায়-গোল মুখ। থুতনির দিকটা ফোলা। গালে দু-চারটি দাগ আছে বসন্তের। ফরসা রং গায়ের। মাথার চুল পাতলা। মাঝখানে সিঁথি।

রঘুপতির চোখে চশমা ছিল। কাচের রং ঘোলাটে। স্পষ্ট করে তাঁর চোখ দেখা যাচ্ছিল না।

ভদ্রলোককে দেখলেই অভিজাত, রাশভারী, বৈষয়িক বলে মনে হয়।

 কিকিরা আগেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তারাপদদের, সাধারণ কথাবার্তা হয়েছে রঘুপতিবাবুর সঙ্গে ওদের।

কিকিরা বললেন, “বৃষ্টিটা থেমে যাবে মনে হচ্ছে।”

 রঘুপতি বললেন, “এ-সময় দু-চারদিন বৃষ্টি হয়। শীতের বৃষ্টি।

 “যদি বরষে মাঘের শেষ’। “

“মাঘ এখন দেরি রয়েছে,” রঘুপতি বললেন, “ডিসেম্বরের এন্ডে এরকম হয়। কলকাতাতেও হয়। গত বছর তো জানুয়ারিতে গোড়া থেকেই এখানে বর্ষাকাল ফিরে এসেছিল আবার। সাত-আটদিন তুমুল বৃষ্টি।”

তারাপদ বলল, “আপনি প্রতি বছর এই ডিসেম্বরে এখানে থাকেন?”

“শীতটা থাকি। কখনো দেরি করে এসে একেবারে জানুয়ারি মাসটা কাটিয়ে ফিরে যাই। কখনো নতুন বছর পড়তেই। বিশ-বাইশ বছরের মধ্যে বার-দুই শীতটা এখানে থাকতে পারিনি।”

“জায়গাটা আপনার ভাল লাগে?”

“লাগে।…ঠাকুরদার স্মৃতি। বাবা বেঁচে থাকতে এবাড়িতে পুজোয় আর এই শীতে হইহল্লা হত বেশ। তারপর যা হয়, ধীরে ধীরে আসা-যাওয়া কমতে লাগল। আত্মীয়স্বজন সরে গেল একে-একে। আমি আমার স্ত্রী শীতকালটা বরাবরই এখানে কাটাতাম। আমি এখন একলা। মায়া তো ছাড়তে পারি না।” বলে রঘুপতি একটু যেন ম্লান হাসলেন, “তোমরা কি এসব বুঝতে পারবে! বুড়োদের সেন্টিমেন্ট।”

তারাপদ হেসে বলল, “আপনি আবার বুড়ো কোথায়?”

“ফিফটি সিক্স।”

“ছাপ্পান্ন! বোঝা যায় না।”

“আমার বড় ছেলে মেরিনে আছে। তার বয়সেই ছাব্বিশ-সাতাশ। “

“শুনেছি। কিকিরা বলেছেন।”

“কিকিরা!” রঘুপতি হাসলেন, তারপর কিকিরার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি এরকম একটা নাম বেছে নিলেন কেন? কিঙ্কর নামটাই তো বেশ ছিল মশাই।”

কিকিরা হেসে বললেন, “জাপানি-জাপানি মনে হয় বলে! মিসিকিরা ওকাকুরা কিকিরা।”

রঘুপতি হেসে ফেললেন। তারাপদরাও হাসতে লাগল।

হাসি থামলে কিকিরা বললেন, “এ বাড়িতে কি নতুন কোনও লোক এসেছে?”

“নতুন?” রঘুপতি তাকালেন।

“কাল বিকেলে একটা লোককে দেখেছিলাম। আজ সকালেও দেখলাম।”

“কেমন দেখতে?”

“গাঁট্টাগোট্টা। কালো।”

“ও! আপনি পুজনের কথা বলছেন! ওর নাম পুজন। এবাড়িতেই থাকে।”

“দেখিনি কিনা–তাই বলছিলাম।”

“দেখেননি!” রঘুপতি হাতের চুরুটটা আবার জ্বালাতে লাগলেন। “পুজন ছিল না। ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়েছিল। কালই ফিরেছে।”

“আপনার পোয্য তা হলে কম নয় রঘুপতিবাবু”, কিকিরা হাসতে হাসতে সাদামাটা গলায় বললেন, “মানুষ আপনি একলা, এখানে থাকেনও বছরে দেড়-দু-মাস-লোকজন কিন্তু পুষতে হয় অনেক।”

চুরুট টেনে রঘুপতি বললেন “তা হয়। সকলেই কাজের লোক। ঘরবাড়ি রয়েছে, জমিজায়গার খোঁজ নেওয়া আছে, দেখাশোনারও দরকার করে। ওরাই তো সব করছে। আমি আর কী করি!”।

কিকিরা মাথা নাড়লেন! যেন বললেন, তা তো ঠিকই।

রঘুপতির যেন কী দরকার পড়েছিল, বললেন, “বসুন আপনারা; আমি আসছি–দু-চার মিনিট।”

উনি উঠে গেলেন। ঘরে চুরুটের গন্ধ। বাইরে মিহি বৃষ্টি।

কিকিরা ইশারা করে ঝুল বারান্দাটা দেখালেন। বললেন, “ওই হচ্ছে সেই বারান্দা, যেখান থেকে রঘুপতিবাবু সেই সন্ন্যাসীকে দেখতেন। আগুন নিয়ে যে খেলা দেখাত।” জোরে জোরেই কথাটা বললেন কিকিরা। রঘুপতি যদি কাছাকাছি কোথাও থেকে থাকেন কথাটা শুনলেও শুনতে পারেন।

চন্দন প্রথমে তাকিয়ে থাকল বারান্দার দিকে, তারপর সামান্য ইতস্তত করে উঠে গেল বারান্দার কাছে। তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখল বাইরে। বৃষ্টির ঝাপসার দরুন দুরের কিছু দেখা যাচ্ছিল না।

চন্দন বলল, “জায়গাটা এখান থেকে কতদূর?”

“তা অনেকটা। সরাসরি ছ’ সাতশো গজ হবে। হেঁটে যেতে হলে বেশ খানিকটা।”  

“এখান থেকে কি অত দূরের জিনিস স্পষ্ট করে দেখা যায়?”

“চোখের জ্যোতি থাকলে যায়। তবে খালি চোখে মোটামুটি বোঝ যাবে।…আর যদি দূরবীন চোখে আঁটো-না-দেখার কিছু নেই।”

“রঘুপতিবাবু কি বায়নাকুলার দিয়ে দেখেছেন?”

“হ্যাঁ। উনি বলছেন–প্রথম দিন নয়, পরে তাই দেখেছেন।”

“ওঁর কাছে আছে যন্ত্রটা?”

“চলনসই একটা আছে।”

“উনি একটা বায়নাকুলার রাখতে গেলেন কেন?”

“শখ!..শখ করে মানুষ কত জিনিস তো রাখে; ক্যামেরা, টেপ রেকর্ডার, বায়নাকুলার, বন্দুক…”।

“রঘুপতিবাবুর বন্দুকও আছে?”

“আছে। এতবড় বাড়ি যার, যথেষ্ট বিষয়-সম্পত্তি, আর যে-জায়গায় থাকেন–জঙ্গলে, একেবারে একপ্রান্তে–তাতে একটা বন্দুক রাখতে দোষ কী! বন্দুকের লাইসেন্স আছে।”

তারাপদ বলল, “কিকিরা, ওই জায়গাটা তো আপনি দেখেছেন।”

“দেখেছি।…তোমাদেরও দেখাব। কিন্তু এই বৃষ্টিই সব ভেস্তে দিচ্ছে। “

আরও দু-একটা কথা বলাবলির মধ্যে রঘুপতি ফিরে এলেন। এসে বললেন, “একটা চিঠি পাঠিয়ে এলাম। এখানে আমার এক বন্ধু আছেন। পশুপতিবাবু। স্টেশনের দিকে থাকেন। রমা কুটির’। ভদ্রলোককে আমি চিকিৎসা করি। উনি বাতের রোগী। শীতে বাদলায় বাতটা বাড়ে। ওষুধটা পালটে দিলাম।”

“আপনি চিকিৎসা করেন?” চন্দন অবাক হয়ে বলল।

 “হোমিওপ্যাথি?” রঘুপতি সহজভাবে হাসিমুখে বললেন, “যে-জায়গায় আমরা থাকি, নিজের কখন কী দরকার পড়ে হুট করে, একটু-আধটু হোমিওপ্যাথি জেনে রাখা ভাল। আর আমি তো এই বিদ্যেটা অনেকদিন ধরেই চালাচ্ছি। আমার স্ত্রী অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খেতে চাইতেন না। খেলেই নানারকম কমপ্লেন করতেন। তাঁর ওপর দিয়েই হাত পাকিয়েছিলাম প্রথমে।” বলেই হঠাৎ চুপ করে গেলেন। কী যেন ভাবলেন। তারপর চন্দনকে বললেন, “ডাক্তার, আমার স্ত্রী যখন মারা গেলেন তখন অবশ্য অ্যালোপ্যাথিই চলছিল। গুপ্ত-ডাক্তার চিকিৎসা করছিল। ইট ওয়াজ সো সাডেন! সব শেষ হয়ে গেল। ওঁকে নিয়ে আর কলকাতায় যেতে পারলাম না। গেলে অন্তত ভাল চিকিৎসা করাতে পারতাম। মরা বাঁচা ভগবানের হাত। তবু মানুষ তো চেষ্টা করে। আমার কপাল খারাপ। দুদিনের মধ্যে সব হয়ে গেল। সুস্থ মানুষ, কী যে হল–চোখের পলকে চলে গেল। “ রঘুপতি চুপ করে গেলেন।

চন্দন কোনো কথা বলল না। রঘুপতির হতাশ বিষণ্ণ মুখে যেন কেমন অনুশোচনা। নিজের অক্ষমতার জন্য, না দুর্গের কথা ভেবে, কে জানে!

কিকিরারা উঠে পড়লেন।

.

বৃষ্টি কিন্তু থামল না। সকালে যা মনে হয়েছিল দুপুরে দেখা গেল ঠিক উলটো হয়ে গেল সব। আকাশ আবার কালো হল, জোর হল বৃষ্টি; আর হাড়কাঁপানো বাতাস দিতে লাগল।

বাইরে যাওয়ার আশা-ভরসা ছেড়ে দিতে হল কিকিরাদের।

সারাটা দিন তা হলে করার কী থাকল? কিছুই নয়। তারাপদ আর চন্দন বাড়িটা দেখে নিল ঘুরে-ঘুরে। এবাড়ির ছাঁদছিরি খানিকটা বিহারি জমিদারবাড়ির মতন। বাহুল্য আছে, বাঁধুনিও আছে কিন্তু ছিমছাম ভাব নেই। সামনের দিকটা একরকম, তবে পেছনের দিকটা খাপছাড়া। ঘরদোর বড় কম নয়। অব্যবহারের ফলে পোড়োবাড়ির মতন চেহারা হয়েছে। কোথাও দেওয়াল থেকে পলেস্তরা খসে পড়েছে, কোথাও কড়িকাঠে দরজা-জানলায় ঘুণ ধরেছে। ময়লা জমেছে নানান জায়গায়, রং বিবর্ণ। বন্ধ ঘরের দমচাপা বাতাস।

রঘুপতি যে-ঘরগুলো ব্যবহার করেন–দোতলার মাত্র সেইগুলোই যে বসবাসযোগ্য। বাকিগুলো নয়।

তারাপদ বলল, “এত লোক এ বাড়িতে! তারা করে কী?”

 চন্দন বলল, “ঘুমোয়। এবাড়িতে কীই-বা করবে! লোকজন থাকে না।”

“রঘুপতিবাবু যতদিন আছেন–তারপর তো ধসে পড়বে বাড়ি।

“তাই মনে হয়।”

.

সন্ধের মুখে কিকিরা বললেন, “ওহে, দিনটা তো বৃথা গেল। এসো, একটু হোম ওয়ার্ক করে নিই।”

“বলুন, কী করতে হবে?”

“কেমন লাগল রঘুপতিবাবুকে?”

 তারাপদ বলল, “খারাপ আর কোথায়?”

চন্দন বলল, “আমারও খারাপ লাগেনি।”

 কিকিরা বললেন, “ভাল কথা। বয়স্ক মানুষ। অভিজাত। আচার ব্যবহার ভাল–ওঁকে খারাপ লাগার কথা নয়। কিন্তু..” কিকিরা চুপ করে গেলেন।

“কিসের কিন্তু?”

“কথা হল– যে ঘটনাগুলো ঘটল–সেগুলো রঘুপতিবাবুর বাড়ির কাছেই ঘটল কেন?”

তারাপদ চন্দনের দিকে তাকাল। চন্দন কিছু বলল না।

কিকিরা বললেন, “এমন কী কারণ থাকতে পারে যে, একটা লোক রঘুপতিকে দেখিয়ে-দেখিয়ে আগুনের ওপর হাঁটবে? তার উদ্দেশ্য কী ছিল?”

চন্দন বলল, “আপনি কী বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি না। লোকটা যে রঘুপতিবাবুকে দেখাবার জন্য আগুনের ওপর হেঁটে বেড়াত–একথা কে বলল! রঘুপতিবাবুর নজরে পড়ে গিয়েছিল হঠাৎ। অন্যদের নজরেও পড়তেও পারে। আপনি খোঁজ নিয়েছেন?”

মাথা হেলিয়ে কিকিরা বললেন, “নিয়েছি। রঘুপতি ছাড়া এ-দৃশ্য আর মাত্র একজন দেখেছে–সে হল বিরজুবাবা। বিরজুকে দেখিয়েছেন রঘুপতি, ডেকে দেখিয়েছেন। এ বাড়ির আর কেউ দৃশ্যটা দেখেনি।”

তারাপদ বলল, “বিরজুর সঙ্গে আপনি কথা বলেছেন?”

“বলেছি। সে দেখেছে বটে, তবে একদিনই দেখেছে। বাবু তাকে দেখিয়েছেন।”

“এটা কেমন করে হয় স্যার!” তারাপা বলল, “সাধারণ একটা দৃশ্য হলে লোকের চোখে না পড়তে পারে। একটা পাখি উড়ে গেল, কিংবা একটা লোক গাছতলায় দাঁড়িয়ে কাঠকুটো কুড়োচ্ছ, গোরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে কোথায়–এ-সব দৃশ্য না হয় লোকে চোখ চেয়ে দেখে না। তা বলে এক জায়গায় আগুন জ্বলছে-আর-এক গেরুয়াধারী আগুনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে–এমন জিনিস চোখে পড়বে না–এমন হতেই পারে না। ইপসি।”

কিকিরা মাথা দুলিয়ে-দুলিয়ে বললেন, “ঠিক তাই। একেবারে সহজ সত্য। অস্বাভাবিক কিছু একটা নজরে পড়লে মানুষ তার দিকে না তাকিয়ে পারে না, অবশ্য যদি সে অন্ধ না হয়! এ বাড়িতে অন্ধ কেউ নেই।”

“তা হলে?” তারাপদ বলল।

“তবে একটা কথা আছে। তোমাদের পক্ষে আজ অনেক কিছু দেখা সম্ভব হয়নি। বৃষ্টি মাটি করে দিয়েছে।”

“কী কী দেখা হয়নি?”

“রঘুপতিবাবুর বসার ঘরের দোতলায় ঝুল বারান্দায় গিয়ে তোমরা দাঁড়াওনি। চন্দন একবার উঁকি মেরে এল শুধু। ওখামে না দাঁড়ালে ওই জায়গাটা দেখা যাবে না।”

“মানে?”

“মানে, আগুন যেখানে জ্বলত, গেরুয়াপরা সন্ন্যাসী এসে দাঁড়াত–সেই জায়গাটা দেখা যাবে না।”

“কেন?”

“আড়ালে পড়ে যায়। গাছপালার আড়াল, পাহাড়ি খাঁজের আড়াল।” বলে কিকিরা রুমাল বের করে নাক মুছলেন। সর্দি হয়ে গিয়েছিল তাঁর। বললেন, “কাল নিশ্চয়ই রোদ উঠবে। রোদ উঠলে তোমাদের ওই জায়গাটায় নিয়ে যাব। নিজের চোখেই সব দেখতে পাবে।”

“রঘুপতিবাবুর বসার ঘরের বারান্দাটাও দেখব।”

“দেখবে।”

“ওঁর বসার ঘরের বারান্দা দিয়ে যা দেখা যায়–অন্য কোনো জায়গা থেকে তা দেখা যায় না?”

কিকিরা বললেন, “পারটিকুলার ওই স্পটটা দেখা যায় না। অবশ্য বসার ঘরের পশ্চিমের জানলা দিয়ে দেখা যায় খানিকটা। শোবার ঘর থেকে দেখা যায় না।”

তারাপদ ঘাড় চুলকোতে-চুলকোতে বলল, “স্যার, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, রঘুপতিবাবুকে দেখাবার জন্যই ওই আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থাটা হয়েছিল!”

“কোনো সন্দেহ নেই।”

“কিন্তু কেন?”

“সেটাই তো কথা।”

চন্দন হঠাৎ বলল, “এই দৃশ্য রঘুপতি দেখতেন বলেই কি শেষ পর্যন্ত সেই লোকটাকে খুন করা হল?”

কিকিরা বললেন, “সেই লোক মানে–তুমি গেরুয়াপরা সাধুবাবার কথা বলছ?”

“হ্যাঁ।”

“মুখে খুন বললেই তো খুন হবে না। প্রমাণ কী? পুলিশও খুন বলেনি। বলেছে, ওপর থেকে পা পিছলে পড়ে গিয়ে মাথায় চোখ লেগে মারা গেছে।”

“হতে পারে! ওপর থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় জখম হয়ে মারা যেতে পারে। কিন্তু সন্দেহটা থেকে যাচ্ছে।”

তারাপদ বলল, “জায়গাটা আপনি দেখেছেন নিজে?”

“দেখেছি। তোমরাও কাল দেখবে।…তবে একথা ঠিক, কেউ যদি অতটা উঁচু থেকে পা হড়কে সরাসরি নিচে পড়ে, পাথরে মাথা থেঁতলে মরতেই পারে।” বলে কিকিরা ঘরের মধ্যে বার কয়েক পায়চারি করে নিলেন।

তারাপদ চাপা গলায় বলল, “আপনি কি রঘুপতিবাৰুকৈ সন্দেহ করছেন?”

কিকিরা দাঁড়িয়ে পড়লেন, “সন্দেহ করার আগের প্রশ্ন, কেন করব?”

“কেন করবেন?”

“করার মতন কারণ দেখছি না বলে করতে পারছি না। রঘুপতিবাবু অকারণে একটা লোককে খুন করতে যাবেন কেন? যদি করে থাকেন–তা হলে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। কারণটা কী? কেন একটা লোক রঘুপতিকে বেছে নিয়েছিল তার আগুনে খেলা দেখাবার জন্য! আগুনের ওই খেলা দেখানোর মধ্যে কোন রহস্য আছে?” কিকিরা দু হাত ডানার মতন ছড়িয়ে যেন সাঁতার কাটার ভঙ্গি করতে-করতে বললেন, “আমি বাপু অগাধ জলে। ডিপ ওয়াটারে পড়ে হাত-পা ছুঁড়ছি। একবার ভাবছি রঘুপতি সাফসুফ মানুষ নন, নিশ্চয় কোনো রহস্য আছে ওঁর মধ্যে। আবার ভাবছি, এই মানুষটি যদি দোষীই হবেন, তবে আমাকে এখানে তোয়াজ করে রাখবেন কেন? আবার মনে হচ্ছে, রঘুপতি তো ডেকে পাঠাতে চাননি, গোপবাবু আগ বাড়িয়ে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। রঘুপতিবাবুর এখন ছুঁচো গেলার অবস্থা। আমাকে গিলতেও পারছেন না, উগরোতেও পারছেন না। মুখে একেবারে ‘ওয়েলকাম’-ভাব নিয়ে বসে আছেন।…সত্যি বলছি স্যান্ডেল উড, আমি কোনো দিশে পাচ্ছি না।”

“তা হলে?”

“পেতে হবে। চেষ্টা তো করি। পরে যা হয় হবে। ভাল কথা, চন্দন, ওই হাতুড়িটার কথা কিন্তু ভুলো না। ওটা আমি আমার হেফাজতে রেখেছি। কেউ জানে না। এমন তো হতে পাতে হাতুড়ি দিয়ে লোকটার মাথায় মারা হয়েছিল। তাতেই সে মারা গেছে। তারপর তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছে নিচে। বলে কিকিরা নিজের মাথার পেছনদিকটা দেখালেন।

তারাপদরা কোনো কথা বলল না।

.

০৪.

পরের দিন আর বৃষ্টি নেই। শীতের কুয়াশামাখা রোদ উঠল সকালেই। সামান্য বেলা বাড়তে-না বাড়তেই রোদ ছড়িয়ে গেল সর্বত্র। পৌষের রোদ, তাত ওঠেনি তখনও। কিন্তু বড় আরামের। আর পরিষ্কার।

চায়ের পাট শেষ করেই কিকিরারা বেরিয়ে পড়লেন। শীত যেন আরও প্রখর হয়েছে।

তারাপদরা এসেছিল সন্ধের অন্ধকারে, মেঘ বাদলার মধ্যে, চারদিক লক্ষ করার উপায় ছিল না তখন; গতকাল বৃষ্টির মধ্যে বাড়িতে বসেবসেই সারাদিন কেটেছে বাইরের কিছুই প্রায় দেখতে পায়নি। আজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে তারা আশপাশের দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছিল। ও

একেবারে পাহাড়তলি। সমতল জায়গা কোথাও যেন নেই। কোথাও কোথাও বেশ চড়াই। মাঠের মধ্যে এখানে-ওখানে তাঁবু খাঁটিয়ে রাখলে যেমন দেখায়, অনেকটা সেইভাবে কোথাও মাটি আর পাথরের স্তূপ, কোথাও ঝোপঝাড়। পাথর-নুড়িতে ভরতি হয়েছিল জায়গাটা। শ’গজ বড় জোর–তারপরই গাছপালা, জঙ্গলের মতন। গাছ সম্পর্কে তারাপদদের ধারণা কম, তবু বুঝতে পারছিল বড় বড় তেঁতুলগাছ আর ঘোড়ানিম যেন আড়াল করে রেখেছে ওপাশটা। শালও রয়েছে। কম। কুলগাছের ঝোপ অজস্র। জামগাছও চোখে পড়ছিল। আর বট অশ্বত্থা। বুনো গাছপালাও কত কী!

তারাপদ বুঝতে পারছিল না, জঙ্গলের এত কাছাকাছি ‘নৃহিংহসদন’-এর মতন বাড়ি তৈরির কী দরকার ছিল।

চন্দনই বলল, “কিকিরা, এত জায়গা থাকতে একেবারে জঙ্গল ঘেঁষে বাড়িটা তৈরি হল কেন?”

কিকিরা বললেন, “রঘুপতিবাবুর ঠাকুরদার পছন্দ হয়েছিল জায়গাটা।”

“অদ্ভুত পছন্দ।”

“খানিকটা অদ্ভুত ঠিকই। তবে এবাড়ি তৈরির পেছনে একটু ইতিহাস আছে। বাড়িটা যখন তৈরি হচ্ছিল তখন রঘুপতির কাকা অসুস্থ। তাঁর যক্ষ্মা রোগ হয়েছিল। তখনকার দিনে এই রোগ ছিল যম। চিকিৎসা কিছু ছিল না। ভগবানের নামে ফেলে রাখা। ডাক্তাররা বলতেন, স্বাস্থ্যকর জায়গায়, ফাঁকায়, আলোবাতাসে রোগীকে রাখতে। প্রকৃতি যতদিন টিকিয়ে রাখে।

তারাপদ বলল, “সেইজন্যই এই বাড়ি।”

কিকিরা বললেন, খানিকটা নিশ্চয়ই। ওঁর বাবাই বাড়িটা শেষ করেছিলেন। রঘুপতির কাকা এই বাড়িতেই বছর পনেরো বেঁচেছিলেন। এখানেই তিনি থাকতেন। তাঁর শখ ছিল ছবি আঁকার। ল্যান্ডস্কেপ আঁকতেন, স্টিল লাইফ আঁকতেন। সেসব ছবি নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো একটা ঘরে কিছু ছবি রাখা আছে ভদ্রলোকের আঁকা।”

“আপনি দেখেছেন?”

“না। ইচ্ছে আছে–দেখব।…ঘরটা তালাবন্ধ থাকে।”

তারাপদ ঠাট্টা করে বলল, “কিকিরা, আপনি কি ছবিও বোঝেন?” কিকিরা মজার গলায় জবাব দিলেন, “না বাবু। আমি হলাম ছবিকানা। তবে কলা, শশা, আম আঁকলে বুঝতে পারি। একবার ছেলেবেলায় চায়ের কেটলি এঁকেছিলুম, সবাই বলল–বাঃ, হুঁকোটা বেশ হয়েছে।”

তারাপদরা হোহো করে হেসে উঠল। কিকিরাও হাসছিলেন। এ

হাঁটতে হাঁটতে মনে হল সামনে পাহাড়ের মতন একটা বালিয়াড়ি, গাছপালা, ঝোপঝাড়, পাথরে ভরতি জায়গাটা, তারপর পাহাড়ি টিলা।

কিকিরা বললেন, “ওই উঁচুটার ওপাশে চুনিয়া নদী।“

 “নৃসিংহ-সদন কিন্তু দেখা যাচ্ছে, স্যার।”

“এখন যাবে। এর পর যেখানে যাব–সেখান থেকে দেখা যাবে না।”

চন্দন পাখি দেখছিল। গাছপালার মাথা টপকে কয়েকটা টিয়া উড়ে গেল। চিকির-চিকির ডাক শোনা যাচ্ছে কোনো বুনো পাখির।

তারাপদ বলল, “জায়গাটা পাহাড়ি।”

কিকিরা বললেন, “কাছেই পাহাড়। পরেশনাথের ফ্যামিলি। এই যে দেখছ-এটা পাহাড়ের ঢাল। আধ মাইলটাক দূরে ঘন জঙ্গল।”

চন্দন হঠাৎ বলল, “রঘুপতিবাবুদের বংশে আর কারা আছে কিকিরা?”

“সঠিক জানি না।”

“তবু!”

“কাকা বিয়ে-থা করেননি। তাঁর কোনো বংশ নেই। আরও একজন কাকা ছিলেন। ছোটকাকা। সেই কাকা অনেককাল আগেই আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন।”

“কেন?”

“ওঁদের পরিবারের ব্যাপার। সোজাসুজি কিছু বলেন না। মনে হয়, ঝগড়াঝাটি হয়েছিল।”

চন্দন হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে আকাশের আকাশের দিকে মুখ তুলে কী দেখছিল। তারপর বলল, “প্লেন! শব্দ হচ্ছে…!”

প্লেনের শব্দ ক্রমে জোর হল, দেখাও গেল, কিন্তু অনেক দূর দিয়ে মিলিয়েও গেল একসময়।

ওরা বেশ খানিকটা পথ চলে এসেছিল। চড়াইয়ের প্রায় শেষ। এখানে পাহাড়ের গায়ে জঙ্গল। অনেকটাই ঘন। ঝাউগাছের মতন এক ধরনের গাছপালা যেন পাহাড়ের গা ঢেকে রেখেছে। বুনো লতাপাতা। বাবলা ঝোপের মতন ঝোপ।

নৃসিংহ-সদন আর দেখা যাচ্ছিল না।

তারাপদ বলল, “কিকিরা স্যার, আপনি বোধ হয় রঘুপতিবাবুর সঙ্গে আসর জমিয়ে বসে ওঁদের ফ্যামিলির কথা জেনে নিয়েছেন–তাই না?”

কিকিরা বললেন, “সামথিং সামথিং, নট এভরিথিং। রঘুপতিবাবু, কী বলে তোমার ওই যে, মুখ-আঁটা মানুষ। ঠিক যেটুকু বলার বলেন, বাড়তি বলেন না। উনি একেবারে মেডিসিন বটুল!”

 চন্দন অবাক হয়ে বলল, “সেটা আবার কী কিকিরা? মেডিসিন বল।”

“ওষুধের শিশি। ওষুধের শিশির মুখ এঁটে রাখতে বলে না, তেমন আর কী মাউথ টাইট…”।

চন্দন আর তারাপদ হোহো করে করে হেসে উঠল।

গাছের ছায়ায় রোদ আড়াল পড়ে যাচ্ছিল। কখনো কখনো একেবারেই ঘন ছায়া। শীতও বেশি এখানে।

চড়াই উঠতে এবার কষ্ট হচ্ছিল। খাড়া বেশ। পায়ের তলায় পাথর আর নুড়ি। সামান্য লতাপাতা জড়ানো তৃণ, পাথরের কোথাও-কোথাও শ্যাওলা জমে রয়েছে ঘন হয়ে।

কিকিরা এবার একটু দাঁড়ালেন। দু দণ্ড বিশ্রাম নেবেন বুঝি।

তারাপদরা দাঁড়াল। তাদেরও পা ধরে গিয়েছিল। কলকাতা শহরের মানুষ। এ-ধরনের রাস্তা হাঁটায় অভ্যস্ত নয়।

কিকিরা বললেন, “আমি গোপবাবুর কাছে কিছু কিছু শুনে এসেছিলুম। তবে তিনিও যা জানেন ওপর-ওপর। বাকিটা রঘুপতি রায় রাঠোর মশাইয়ের মুখ থেকে জানার চেষ্টা করছি।

চন্দন বলল, “কিকিরা, রাঠোরটা কী?”

“রাজপুত। তারাপদর ছত্রপতি নয়। অনেক রাজপুত ক্ষত্রিয়–এক সময় বিহারে, বাংলাদেশে চলে এসেছিল। রঘুপতিদের চার-পাঁচ পুরুষ বাংলাদেশে। ওঁরা নিজেদের দেশটেশ জানেনও না। বাঙালিই হয়ে গেছেন। খাঁটি বাঙালি।”

চন্দন বলল, “আমাদের এক মাস্টারমশাইও তাই। তাঁরা সিংহ; অরিজিন্যালি রাজপুতানার লোক। এখন সিন্হা হয়ে গেছেন।”

তারাপদ বলল, “রঘুপতিবাবুর মধ্যে সিংহ ব্যাপারটা নেই; তাই না কিকিরা? থাকলে ব্যাঘ্র ব্যাপারটা থাকতে পারে।”

কিকিরা বললেন, “চলো। আর সামান্যই।”

.

তারাপদরা যেখানে এসে দাঁড়াল সেটা একটা অদ্ভুত জায়গা। বড় বড় কিছু পাথর পড়ে আছে চারপাশে। পাথরগুলো কোনোটাই মসৃণ নয়। ভাঙাচোরা হলে যেমন দেখায় সেইকম। কালচে পাথর। পাথরের গায়ে ফাঁক-ফোকরে অল্প ঘাস, তৃণজাতীয় গুল্ম, শ্যাওলা, দু-চারটি শ্যাওড়া ঝোপের মতন ঝোপ, একটি নিম চারা।

কিকিরা হাত তুলে আঙুল দিয়ে দেখালেন “দেখো”

তারাপদরা দেখল। অবাক কাণ্ড। এখান থেকে সত্যি সত্যিই নৃসিংহসনের সামান্য একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। রঘুপতির বসার ঘরের সেই ঝুলবারান্দা আর ঘরের অল্প একটু দেওয়াল, একটিমাত্র জানলা।

চন্দন বলল, “এখান থেকে বাড়িটা বেশি দুর মনে হচ্ছে না। সরাসরি বলে। “

তারাপদ বলল, “কিকিরা, গাছপালার আড়াল থেকে যেমন একফালি চাঁদ ভেসে উঠতে দেখা যায়–এ যেন অনেকটা সেইরকম তাই নয়?”

কিকিরা বললেন, “তোমরা হাত পনেরো-বিশ ওপাশে সরে যাও, আর কিছু দেখতে পাবে না। আড়াল পড়ে যাবে গাছপালায়। পাহাড়ি গাছ ছাড়াও নৃসিংহ-সদনের গায়েই অজস্র গাছ।”

তারাপদরা সরে গিয়ে দেখে নিল। কিকিরা ঠিকই বলেছেন।

কিকিরা বললেন, “এইবার এ-দিকটায় দেখো।”

তারাপদরা কাছে এল।

কিকিরা আঙুল দিয়ে কতকগুলো জায়গা দেখালেন। পাথরের ওপর পোড়া পোড়া দাগ। বোঝা যায় ওই পাথরের ওপর কিছু পোড়ানো হয়েছিল। দাগ ধরে রয়েছে।

চন্দন বলল, “এই পাথরের ওপর আগুন জ্বালানো হত, স্যার?”

“হ্যাঁ।”

“কিসের আগুন?”

“শুকনো লতাপাতার বা অন্য কিছুর” বলে তিনি পাথরের পাশে ফাঁকে পোড়া কিছু গুল্ম দেখালেন। বললেন, “ভাল করে দেখলে বুঝতে পারবে, পাথর যেখানে খানিকটা প্লেন মতন–সেখানে আগুন জ্বালানো হত। তার আশেপাশে আরও যেসব পাথর ভাঙা-ভাঙা দেখতে, সেগুলা চারদিক দিয়ে যেন গোল হয়ে আছে। ওখানে দাগ পাবে।”

“মানে?”

“মানে মাঝখানে একটা আগুন জ্বালিয়ে–তার চারপাশে ছোট-ছোট আগুনও জ্বালানো হত। “

“চারদিকে আগুন–মাঝখানে সন্ন্যাসী?”

“হ্যাঁ।…আর এইখানটাও দেখো। পাথরে শ্যাওলা জমে ছিল–সেই শ্যাওলার ওপর ঘষটানো দাগ। ওদিকেও ঘাস রগড়ে গিয়েছে।”

তারাপদরা দেখল।

 কিকিরা বললেন, “একটু বসা যাক।”

 বসলেন কিকিরা। সিগারেট চাইলেন।

সিগারেট খেতে-খেতে শেষে বললেন, “ব্যাপারটা তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে বুঝলে?”

তারাপদরা জবাব দেওয়ার আগেই নিজে থেকেই কিকিরা বললেন, “একটা লোক এখানে আসত। এসে আগুন জ্বালাত। কেন জ্বালাত? জ্বালাত একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। উদ্দেশ্যটা কী? না, সে নৃসিংহ-সদনের কাউকে আগুন জ্বালানোর খেলাটা দেখাবে।”

“খেলা?”

“খেলা না বলতে চাও, না বলো। দৃশ্য বলল। দৃশ্যটা সে,দেখাত। আর কাকে দেখাত? রঘুপতিবাবুকে। তার মানে সে রঘুপতি সম্পর্কে সব খবরই জানত।”

“যেমন?”

“যেমন জানত রঘুপতি এখন এখানে আছেন বা এসময় থাকেন সচরাচর। জানত রঘুপতি কোন ঘরে থাকেন, কোনটা তাঁর বসার ঘর। তিনি কোন সময়টায় ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। মাঝে-মাঝে বা বসেবসে এই পাহাড় দেখেন, সূর্যাস্ত দেখেন–এসবও তার জানা ছিল।”

চন্দন আর তারাপদ একইসঙ্গে বলল, “রঘুপতিকে কি ভয় দেখাত লোকটা?”

কিকিরা বললেন, “ভয়! হতে পারে! ভয় দেখাত হয়ত। হয়ত কিছু বোঝাতেও চাইত।”

“কে লোকটা?”

“কেমন করে বলব?”

“যে মারা গেল…”

কিকিরা উঠে পড়লেন। বললেন, “চলো, লোকটা কোথায় মারা গিয়েছিল দেখাই তোমাদের!”

বিশ-পঁচিশ গজ ডাইনে সামান্য ঢাল। বড় বড় পাথর। বুনো ঝোপঝাড়। তার পাশেই খাদ। নিচে চুনিয়া নদী। জল না থাকার মতন। পাথরে ভরা। পাথরের ফাঁক দিয়ে শীর্ণ জলস্রোত বয়ে যাচ্ছে।

চন্দন আর তারাপদ দেখল। এখান থেকে চুনিয়া নদী–অন্তত সত্তর-আশি ফুট নিচে। মানে ছ-সাততলা বাড়ির সমান উঁচু। নীচের দিকে তাকালে ভয়ই হয়, পাথরভরা নদী দেখে।

চন্দন বলল, “নদী কেথায় কিকিরা–শুধুই পাথর।”

“পাহাড়ি ঝরনা থেকে নেমে আসা স্রোত। পাহাড়ি ছোট নদী এইরকম হয়।”

“যে মারা গিয়েছিল সে কোথায় পড়ে ছিল?”

কিকিরা হাত বাড়িয়ে জায়গাটা দেখালেন। বললেন, “ওইরকম একটা জায়গায়। ঠিক স্পট বলতে পারব না।’

“জায়গাটা আপনাকে কে দেখিয়েছিল?”

“বিরজুবাবু।”

“একটা লোক ওখানে মরে পড়ে আছে–একথা লোকে জানল কেমন করে? এদিকে তো লোকজন আসে না?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।

মাথা নাড়লেন কিকিরা। বললেন, “এক্কেবারেই যে আসে না–তা নয়। আসে। ওপাশে গাঁ আছে। নদী পেরিয়ে তোক আসে। বিশেষ করে হাটবাজারের দিন। কিছু লোক কাঠকুটো কুড়োত আসে। দু-চারজন বাচ্চাকাচ্চা জোটে নদীর মাছ ধরতে।”

“মাছ? এ-নদীতে মাছ?”

“পাওয়া যায়। ওই তোমার মৌরলা ধরনের মাছ। পুঁটিও থাকে। পাঁচমেশালি। খেতে খুব স্বাদ। “

চন্দন বলল, “কিকিরা, এত উঁচু কেউ যদি পা হড়কে নিচে পড়ে যায়-পাথরের ওপর, সে কিন্তু বাঁচবে না। বাঁচা মুশকিল। মাথা থেঁতলে যাবে। ঘাড় ভেঙে যেতে পারে। হাত-পা ভাঙবে।…কথা হচ্ছে বডিটা কী অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল?”

কিকিরা বললেন, “মাথা চৌচির, হাত-পা ভাঙা।” বলেই একটু থেমে বললেন, “লোকে তাই বলছে।”

“পুলিশ?”

“পুলিশের কাছে আমি যাইনি। যাওয়া অনর্থক।”

“রঘুপতি কিছু বলছেন না?”

“তিনি ডেড বডি দেখেননি। ওঁর পক্ষে এ-ধরনের দৃশ্য দেখা অসম্ভব। সহ্য করতে পারবেন না। বডি না-দেখেই ভদ্রলোক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। দেখলে হার্ট ফেল করতেন।”

তারাপদ চুনিয়া নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল। আচমকা বলল, “আর, আপনি ক্যাম্বিসের ব্যাগটা কোথায় কুড়িয়ে পেয়েছিলেন?”

কিকিরা হাত বাড়িয়ে আঙুল দিয়ে একটা জায়গা দেখালেন। বললেন, “ডেড বড়ি পড়ে ছিল ওখানে–মানে ডান দিকে। আমাদের ডান দিকে। আর ক্যাম্বিসের ব্যাগটা আমি পেয়েছি বাঁ দিকে। পাথরের ফাঁকে আটকে গিয়েছিল। আমার মনে হয় ক্যাম্বিসের ব্যাগটা কেউ জোরে ছুঁড়ে দিতে গিয়েছিল নদীর জলে। ব্যাগটা অতদূর যায়নি। খানিকটা আগে পড়ে যায়, পাথরের ফাঁকে আটকে থাকে।”

চন্দন বলল, “ব্যাগের মধ্যে ভারী হাতুড়ি!”

“বেশ ভারী।”

“বডি ডান দিকে, আর ব্যাগ বাঁ দিকে! উলটো দিকে কেন?”

কিকিরা হাসলেন, “তাই হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। একে বলে কনসিমেন্ট সাইকোলজি। তোমাকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা।”

তারাপদ বলল, “এটা তা হলে খুনের ঘটনা! আশ্চর্য!”

.

০৫.

বিকেলের দিকে কিকিরা তারাপদদের নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন।

নৃসিংহ-সদন থেকে বেরিয়ে শ’খানেক গজ পশ্চিমে এগোলে লালা রোড। দেখলেই বোঝা যায়, মূল রাস্তা থেকে নৃসিংহ-সদন খানিকটা তফাতে। তফাতে হলেও রাস্তা ভালই। মেঠো নুড়ি ছড়ানো পথ। গাড়ি আসা-যাওয়ার কোনও অসুবিধে নেই। এক সময় রঘুপতিরা গাড়ি নিয়েই আসতেন কলকাতা থেকে। তখন বাড়ি গমগম করত। এখন আর গাড়ি আসে না, আনার দরকার করে না।

লালা রোড় মোটামুটি রাস্তা। পাথর, খোয়া আর নুড়ি ছড়ানো। রাস্তাটা সোজা জোড়া বটতলার পাশ দিয়ে ধানিয়া তলাও-এর গা দিয়ে স্টেশনের কাছাকাছি গিয়ে পড়েছে। রেল লাইনের ওপাশে বাজার, দোকান, ডিপো, চৌকি।

কিকিরা জায়গাটার বিবরণ শোনাচ্ছিলেন হাঁটতে-হাঁটতে। তারাপদরা কিছু শুনছিল, কিছু বা কানে যাচ্ছিল না। অন্যমনস্কভাবে মাঠঘাট গাছপালা দেখছিল। শীতের বিকেল প্রায় ফুরিয়ে আসছে। রোদ নিভে আসার মতন।

কিছু ঘরবাড়ি এখানে চোখে পড়ে। সাজানো-গোছানো বাড়ি দু-চারটে, বাকি মামুলি ধরনের। লোকজন মোটামুটি। সাইকেলের চলনটা বেশি বলে মনে হল। বিশ-পঁচিশ পা অন্তর কোনো-না-কোনো সাইকেলঅলাকে দেখা যাচ্ছিল।

বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর, মেঘ সরে যেতেই পৌষের হাওয়া যেন আরও ধারালো কনকনে হয়ে উঠেছে।

চন্দন বলল, “ওগুলো নিশ্চয় বাঙালিদের বাড়ি?”

কিকিরা বললেন, “হ্যাঁ। বেশিরভাগ। শীতের সময় জল-হাওয়া বদলাতে এসেছেন বাবুরা। স্টেশনের ওপারেও কিছু বাড়ি আছে। সেটাকে বলে জজ মহল্লা।”

“জজ মহল্লা? কেন?”

“ওখানে এক বুড়ো জজবাবুর বাড়ি ছিল। তিনি কিছু জজ-উকিলদের এনে বসিয়েছিলেন।”

“ও!”

“আপনি এখানে আসতে-আসতেই ইতিহাস-ভূগোল জেনে নিয়েছেন?” তারাপদ মজার গলায় বলল, “ভ্রমণকাহিনী লিখবেন নাকি?”

কিকিরা বললেন, “একটু-একটু জানতে হয় হে! ময়ূরগঞ্জের পাস্ট হিষ্ট্রি বলছে–এখানে এক মাউন্টেন অ্যান্ড জাঙ্গল কিং–মানে পার্বত্য রাজা মুসলমান এক সেনাপতির মুণ্ডু কেটে গেণ্ডুয়া খেলেছিল।”

“বলেন কী?”

“যুদ্ধ! জঙ্গুলে যুদ্ধ করার টেকনিক আলাদা। সেনাপতি সেটা জানত না।”

 চন্দন বলল, “ঝোপে লাঠি মারতে হয়।”

“মানে?”

“মানে ঝোপেঝাড়ে লাঠি মেরে যাও, যদি সাপের মাথায় লাগে। এই যেমন আপনি?”

“আমি? আমি কি বাপু ঝোপেঝাড়ে লাঠি মেরে যাচ্ছি?”

“যাচ্ছেন বইকি! আপনার রঘুপতি, ওই আগুনের খেলা, একটা লোক খুন হওয়া–এর কোনোটারই কোনো সুতো আপনি ধরতে পারছেন না–জানেনও না, বৃথাই ঝোপেঝাড়ে লাঠি ঠুকে যাচ্ছেন?”

কিকিরা বললেন, “দেখো স্যান্ডেল উড, গল্পের গোয়েন্দারা বড়বড় লাফ মারতে পারে, তাদের প্র্যাকটিস আছে। আমি গোয়েন্দা নই–ম্যাজিশিয়ান। আমি হাত সাফাই করি। ভেলকি দেখাই।”

“তাই দেখান।”

বলতে বলতে রেল ফটক। রেল ফটক পেরিয়ে এক পানঅলার দোকান।

কিকিরা বললেন, “চলো, একটু খোঁজখবর করি।”

পানঅলার সঙ্গে কিকিরা আগেই পরিচয় সেরে রেখেছিলেন। পানঅলা কিকিরাকে দেখে নমস্তে করল। কিকিরাও খুব আহ্লাদ-মেশানো গলা করে সিগারেট, দেশলাই, পান চাইলেন।

পানঅলা বুড়ো মতন। ছোট্ট দোকান তার। শুধু পানের দোকান দিয়ে চলে না বলে সঙ্গে চায়ের ব্যবস্থাও রেখেছে। ময়লা কেটলি, ততোধিক ময়লা ক’টা ছোট-ছোট কাচের গ্লাস। অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে চিনি, হরলিকসের শিশিতে দুধ।

কিকিরা চোখ টিপে তারাপদদের বললেন, “চা খাবে নাকি?”

আগেই মাথা নাড়ল চন্দন। “না।”

তারাপদও খাবে না।

কিকিরা কিন্তু এক গ্লাস চা বানাতে বললেন।

তারাপদ কিছু বলতে যাচ্ছিল, ইশারায় বাধা দিয়ে কিকিরা বুড়ো চাঅলার সঙ্গে গল্প করতে লাগলেন।

দু-চার কথার পর কিকিরা বললেন, “বাবুলোক, কালকাত্তাসে আয়া। চায়ে নেহি পিয়ে গা। কফি পিনেঅলা বাবু হ্যায়।”

তারাপদরা কিকিরার হিন্দিবুলির রসিকতা শুনতে-শুনতে হাসছিল।

 পানঅলা কিকিরার চা তৈরি করতে লাগল।

কিকিরা অন্য দু-চারটে মজার কথা বলার পর বললেন, “এক খবর তো দেও বুড়া বাবা!”

“জি।”

“রঘুপতিবাবুকো কোঠিমে বহুত ডর লাগতা হ্যায়।” বলে কিকিরা কাঠের বেঞ্চিটায় বসলেন। বললেন, আগে জানলে তিনি ওবাড়িতে এসে উঠতেন না।

“কাহে বাবু?”

কিকিরা বললেন, “যে লোকটা মারা গিয়েছে, তার দাহ কাজ ঠিকভাবে হয়েছে কিনা কে জানে! একটা আত্মা যেন বাড়ির কাছে ঘুরে বেড়ায়।”

বুড়ো বলল, পুলিশের লোক লাশ জ্বালিয়ে দিয়েছে। ব্রাহমন কেউ ছিল না। এরকম অধর্মের কাজ করলে আত্মার কি সদগতি হয়।

কিকিরা বললেন, “লোকটা কে?” বাংলাতেই বললেন।

“নেহি মালুম।”

“তুমি তাকে দেখোনি কোনোদিন?”

“নেহি।”

“লাশ দেখেছ?”

 মাথা নাড়ল পানঅলা। দেখেনি।

 “কোনো নতুন লোককে তুমি দেখোনি?”

পানঅলা কী ভাবল। তারপর বলল, একটা লোককে সে একদিন দেখেছিল। কিন্তু এখন এখানে চেঞ্জারদের ভিড়। কত লোক আসে, যায়। সবাই যে তার সামনে দিয়ে আসে, যায় তাও নয়। কাজেই যাকে দেখেছিল সে যে কে–কেমন করে বলবে!

কিকিরা বললেন, “কবে দেখেছিলে লোকটাকে?”

পানঅলা ভাবল। আনুমানিক সময় বলল।

কিকিরা মোটামুটি হিসেব করে নিলেন। সময়টা মিলে যাচ্ছে।

 “কখন দেখেছিলে? ফজিরে, না সাঁঝে?”

“ফজিরে।” বলে পানঅলা আবার বলল, সে যখন ভোরবেলায় চুলায় আগ লাগাচ্ছিল–তখন একটা লোক তার দোকানের কাছে এসে দাঁড়ায়। বলে, তুরন্থ হলে এক গ্লাস চা খেতে পারে।

“চা খেয়েছিল?”

“জি”

“লোকটা বাঙালি?”

“ওই সেই মালুম।”

“দাড়ি ছিল?”

“না।”

“তোমায় কিছু বলল? কোত্থেকে আসছে?”

“জি না।..কুছ না বলল।”

“সকালে কোন ট্রেন আসে এখানে?”

“বানারসকা গাড়ি আসে। ফজির চার বাজে।”

“আচ্ছা! লোকটার সঙ্গে গাঁঠরি ছিল না?”

“থোড়া বহুত ছিল।”

“কী ছিল?”

“গাঁটরি, বাকাস!”

“বড় বাক্স।”

“জি না। ছোটা।” বলে একটা সুটকেসের চেহারা দেখাল।

 “লোকটা কোথায় যাবে কিছু বলল না?”

“নেহি।”

কিকিরা সিগারেট দেশলাই পান নিয়ে পয়সা দিলেন পানঅলাকে।

 পানঅলা নিজেই বলল, “আপনি মুসাফিরখানায় গিয়ে খোঁজ করুন বাবু, ওখানে খোঁজ করলে কোনো খবর পেতেও পারেন।”

তারাপদদের ডেকে নিয়ে কিকিরা স্টেশনের দিকে পা বাড়ালেন।

হাঁটতে-হাঁটতে কিকিরা বললেন, “পান খাও।”

 তারাপদ একটা পান নিল। বলল, “আপনি তো পান খান না। চাঁদুও খায় না। অকারণ এত পান নিলেন কেন? আর ওই গাঁজা সিগারেট! কে খাবে ওগুলো?

কিকিরা বললেন, “লোকটার সঙ্গে আমি ভাব পাতাবার চেষ্টা করে যাচ্ছি। কেন যাচ্ছি জানো? স্টেশন থেকে কেউ যদি লালা রোড আসতে চায়–ওই পানঅলার দোকানের সামনে দিয়েই আসতে হবে। অবশ্য বে-টাইমে এলে কে দেখছে! টাইমে এলে–সেই আসুক, পানঅলার নজরে পড়তে পারে। যদি এই রাস্তায় না এসে মাঠ ভেঙে এগিয়ে গিয়ে লালা রোড ধরে তবে আলাদা কথা। তোমাদের নিয়ে পরশু যেভাবে আমি নৃসিংহ সদনের রাস্তা ধরেছিলুম।” বলে পানের মোড়কটা হাতে রেখেই সিগারেটের প্যাকেট দুটো তারাপদকে দিলেন, “রেখে দাও, যা শীত–এগুলো কাজে লেগে যাবে।…আরে, শুধু-শুধু তো ভাব পাতানো যায় না, দু-চার টাকা খরচ করতে হয়। নাও, রাখো।”

চন্দন বলল, “আপনি মুসাফিরখানায় খোঁজ করেননি?”

“না। মাথায় আসেনি।”

“টিকিট কালেক্টর? তাঁরা তো জানতে পারেন। “

“টিকিটবাবুরাও জানেন না।…আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করিনি, তবে ওই রাহাবাবু-টিকিটবাবু যাঁকে দেখলে–উনি বলছিলেন–অত লোকজনের মধ্যে নতুন-পুরনো খেয়াল করা যায় না তখন। তা ছাড়া টিকিটবাবুদের তো ডিউটির ঠিক থাকে না। কার কখন ডিউটি, কোন্ গাড়িতে কে নামল, কার তখন ডিউটি ছিল…, নজর করেছেন কি করেননি–বলা মুশকিল।”

তারাপদ বলল, “সব প্যাসেঞ্জারই কি ওভারব্রিজ ধরে বেরিয়ে আষ্ট্রে? মনে হয় না।”

“হ্যাঁ–এদিক-ওদিক দিয়ে চলে যায়। দেহাতীরা বেশিরভাগ।”

তারাপদ আর কিছু বলল না। তিনজনে হাঁটতে লাগল। বিকেল ফুরিয়ে ঝাপসা অন্ধকার নেমে আসছিল।

কিকিরা হঠাৎ বললেন, “পুলিশগুলো কেমন বলো তো? তারা যদি ভাল করে খোঁজ করত–অন্তত কিছু জানতে পারত।”

“চেষ্টা করেছে নিশ্চয়। জানতে পারেনি।”

“আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, পানঅলা যা বলল, তা হলেও হতে পারে। খুব ভোরের ট্রেনে যদি কেউ এসে থাকে, এই প্রচণ্ড শীতে, তাকে নজর করার মতন লোক পাওয়া মুশকিল!”

তারাপদ বলল, “এখন চলুন, মুসাফিরখানায় খোঁজ করে দেখুন–যদি কোনো হদিস পান!”

.

স্টেশনের বাইরে মুসাফিরখানা। একপাশে টিকিট অফিস, অন্যপাশে পার্সেল অফিস। দু-তিনটে ছোট-ছোট দোকান। দুটো মিঠাইঅলার, অন্যটা চায়ের দোকান। মাঝখানে চত্বর। গাঁটরি-গুটরি নিয়ে যাত্রীরা ওখানেই বসে থাকে, শুয়ে থাকে, অপেক্ষা করে গাড়ির।

কিকিরা খোঁজ-খবর নিতে লাগলেন মিঠাইঅলাদের কাছে।

কেউ কিছু বলতে পারে না। বেনারসের গাড়ি আসে একেবারে ভোরবেলায়, এত ভোর যে, শেষরাতও বলা যায়। এই শীতে তখন দোকান খুলে রাখে না কেউ, চাঅলার দোকানই যা একচিলতে খোলা থাকে। তখন যদি কোনও যাত্রী এসে মুসাফিরখানায় অপেক্ষা করে সকাল না হওয়া পর্যন্ত–তবে তাকে কে আর নজর করবে!

চাঅলা অবশ্য বলল, দু-একটা লোকে এসে দেখেছে, কিন্তু ভাল করে লক্ষ করেনি। কত তো যাত্রী আসছে-যাচ্ছে–কে আর খেয়াল করে বাবু! থানা থেকে পুলিশ এসেও তাদের জিজ্ঞেস করেছিল। ওরা কিছু বলতে পারেনি।

মুসাফিরখানা থেকে রেল স্টেশন।

টিকিটবাবু রাহা বললেন, “আর্লি মর্নিংয়েবর ট্রেনটা এত ভোরে আসে মশাই যে, এই শীতে আমরা তখন ঘুমিয়ে কাদা হয়ে থাকি। একে ঘুম চোখ, তায় এই শীত আর কুয়াশাধরে নিন কিছু দেখার অবস্থা থাকে না।…তা ঠিক আছে শর্মার তখন ডিউটি ছিল–জিজ্ঞেস করব।”

কিকিরা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ রাহা বললেন, “যে-লোকটা মারা গিয়েছে তার সম্পর্কে এত খোঁজ করছেন! আপনারা তাকে জানেন নাকি?”

কিকিরা তাড়াতাড়ি বললেন, “না। আমরা কেমন করে জানব! আপনিই তো বলছিলেন..”

“বলছিলুম। এ তো কলকাতা শহর নয় দাদু, রোজই দু-চারটে সেসেসান লেগে আছে। আমাদের কাছে এটাই মস্ত খবর। তার ওপর এই সিজনটাইমে।…তা আপনাদের ইন্টারেস্ট?”

“ইন্টারেস্ট ঠিক নয়, কৌতূহল! যাঁর বাড়িতে গেস্ট হয়ে রয়েছি, তিনি দেখছি খুবই ঘাবড়ে গিয়েছেন।”

“হ্যাঁ, তা ঘাবড়ে যেতে পারেন। কিন্তু তাঁর বাড়ির মধ্যে যখন কিছু হয়নি ঘাবড়ে গিয়ে কী করবেন!…আগুনের ব্যাপারটা কিন্তু দাদু, ভুতুড়ে–তাই নয়। সেই লোকটা কোথায় গেল?”

কিকিরা বললেন, “পালিয়ে গিয়েছে বোধ হয়!” কথাটা হালকাভাবে বলা।

রাহা পান চিবোচ্ছিলেন, স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে লোক বাড়ছে। ট্রেন আসার সময় হয়ে এল।

কিকিরারা চলে আসছিলেন, হঠাৎ রাহাবাবু বললেন “দাদু, আপনি একবার ঘোষদার সঙ্গে দেখা করে যান না! উনি অনেক খবর রাখেন। পুরনো লোক।”

“কে ঘোষদা?”

“ঘোষদাকে চেনেন না? নাম শোনেননি এখনো। লোকে বলে এইচ ঘোষ। হেম ঘোষ। তাঁর সঙ্গে দেখা করে যান। অন্নদা কুটির। ঘোষদা এখানকার পুরনো লোক।”

কিকিরা বললেন, “অন্নদা কুটিরটা কোথায়?”

“আপনার যাওয়ার পথেই পড়বে। বড় রাস্তায় নয়। ভেতরে ঢুকে। একটা খাটাল মতন দেখবেন। সামান্য এগিয়ে। বাঁ দিকে। বিরাট তেঁতুলগাছের পাশে ঢালু মাঠ। সেখানে অন্নদাকুটির।”

কিকিরা ব্যস্ততা দেখালেন না। বললেন, “দেখি। যাব একবার।”

.

ফেরার পথে তারাপদ বলল, “কিকিরা, এই কেসটা ছেড়ে দিন।”

“কেন?”

কোনো আশা দেখছি না। ধরার মতন পাচ্ছেন না কিছুই, অকারণ অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ে কী লাভ!”

কিকিরা বললেন, “পাচ্ছি না ঠিকই; তবে পেয়ে যেতেও পারি।” বলে চন্দনের দিকে তাকালেন। “স্যান্ডেল উড। কাল আমরা ওই জায়গাটা একবার ডিটেল সার্ভে করব। কোন জায়গা বুঝেছ? আজ সকালে যেখানে গিয়েছিলুম। টিলার মাথা, তার আশপাশ। নদীর দিকটা। বুঝলে?”

“আপনি তো সার্ভে করেছেন স্যার!”

“একা মানুষ কতটুকু সার্ভে করব! ওপর-ওপর একটু দেখে এসেছি?”

“পাবেন কিছু?”

“পাওয়া উচিত। …একটা হোক দুটো হোক-কেউ-না-কেউ তো ওখানে যেত। হয়ত থাকত। মানুষের খিদে-তেষ্টা আছে, মাথা গোঁজার জায়গা দরকার–সে তো বাতাস নয়। মানুষ থাকলে তার ফেলে যাওয়া চিহ্ন থাকবে না–এমন হতে পারে না। নিশ্চয় কিছু পাওয়া যাবে।”

চন্দন বলল, “আমার আপত্তি নেই। তবে একটা কথা আমি বলছি–যে-লোকটা মারা গিয়েছে–আমি তার মতন পা হড়কে ওই বিশ্রী জায়গা থেকে নিচে পড়ে মরতে রাজি নই। তারা যদি রাজি থাকে..”

তারাপদ বলল, “বাঃ! আমি কেন মরব।”

 কিকিরা বললেন, “লোকটা যে পা হড়কে পড়ে গিয়েছিল–তা তোমাদের কে বলল! তাকে খুন করাও তো হতে পারে।”

“আপনি এই সন্দেহটা বারবার করছেন স্যার।”

“করছি দুটো কারণে। এক, ওই হাতুড়িরটার জন্য। কোথাও কিছু খুঁজে পাওয়া গেল না, শুধু একটা হাতুড়ি–তাও ক্যাম্বিসের ব্যাগের মধ্যে পাওয়া যাবে কেন? সেটা আবারও এমনভাবে পাওয়া গেল–যেন কেউ ওটা ব্যাগের মধ্যে পুরে নদীতে ফেলে দিতে গিয়েছিল। পারেনি। ঠিক মতন ছুঁড়তে পারেনি।”

“আপনি বলছেন, হাতুড়ি দিয়ে একটা লোককে জখম করা হয়েছিল আগে। “

“হ্যাঁ। মাথার পেছনে মারা হয়েছিল।”

তারাপদ বলল, “আপনার দ্বিতীয় সন্দেহের কারণ?”

“সকালে তোমাদের দেখিয়েছি। হাতুড়ি দিয়ে মারার পর লোকটা যখন পড়ে যায়, অজ্ঞান। তখন তাকে টেনে-হিঁচড়ে টিলার ধারে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তোমাদের সেই দাগও দেখিয়েছি। হেঁচড়ে ঘষটে কাউকে টেনে নিয়ে গেলে যেমন দাগ থাকে–সেইরকম দাগও কিছু ছিল। পাথর বলে দাগ কম। তবে শ্যাওলায় দাগ পড়েছে, ঘাসেও দাগ। ধরেছে।…আমি মনে করছি, এটা খুন!”

তারাপদ চন্দনের দিকে তাকাল। চন্দন কিছু বলল না।

.

০৬.

রোদ যেন আকাশ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল টিলার মাথায়। চারপাশের বন-জঙ্গল, বুনো আগাছার গায়ে তখনও রাতের হিমের ভিজে ভিজে ভাব রয়েছে। ঘাসে শিশিরবিন্দু।

কিকিরা তারাপদদের নিয়ে সকাল-সকালই এসেছেন। বেলা বেড়ে গেলেও ক্ষতি নেই। ভাল করে চারপাশ তিনি আজ দেখতে চান কিছু পাওয়া যায় কিনা! তাঁর ধারণা, নিশ্চয় পাওয়া যাবে।

তারাপদকে একটা চড়াইয়ের দিক দেখিয়ে দিয়ে বলেন, “তুমি ওদিকটা দেখো। ভাল করে দেখবে।”

তারাপদ ঠাট্টা করে বলল, “চোখে ম্যাগনিফাইয়িং গ্লাস গোছর কিছু যদি বেঁধে দিতেন, নয়ত এই বুনো ঝোপের আড়ালে কী পড়ে আছে–কেমন করে দেখব, স্যার।”

কিকিরা পালটা রসিকতা করে বললেন, “ম্যাগনিতে কি হবে–যা চোখ। টেলিফায়িং গ্লাস হলে হত!..যাক, ছুঁতো না করে কাজে লেগে পড়ো। নজর রাখলে ঠিকই দেখতে পাবে।”

তারাপদ পা বাড়াল।

কিকিরা এবার চন্দনকে অন্যদিকটা দেখিয়ে দিলেন, “স্যান্ডেল উড, তুমি ও-পাশটা চষে ফেলবে। আমি সামনে দেখছি।”

চন্দন বলল, “সামনে খুব ঢালু সার; পা হড়কে যাবেন না তো?”

“না।”

“পড়লে কিন্তু খোঁড়া…”

“না বাবা, এ পায়ের অনেক প্লে আছে।…ভুজঙ্গ কাপালিকের বেলায় একটা খেলা দেখিয়েছিলুম মনে আছে! ঘণ্টা নাড়ার খেলা।”

চন্দন হাসল। “আছে। দারুণ খেলা।”

“তবে?”

“আচ্ছা কিকিরা, আপনি কি আগুনের ওপর দিয়েও হাঁটতে পারেন?”

কিকিরা একটু হাসলেন, “কেন?”

“না, আপনি বারবার বলছিলেন–ওই সাধু আগুনের ওপর হাঁটার খেলা দেখাত, তাই জিজ্ঞেস করছি।”

কিকিরা বললেন “ওটা খেলাই। তোমরা কি কখনও চড়কপুজোর মেলা দেখোনি? ঝাঁপান, নাক ফুটো কান ফুটো, আগুন নিয়ে খেলা…! দেখোনি?”

“ছেলেবেলায় একবার দেখেছিলাম। দেখা যায় না।”

“আগুনের ওপর হাঁটাটা খেলাই। সস্তা খেলা।”

“আপনি পারেন?”

“তুমিও পারবে।…তা এ-সব পরে হবে, আগে অন্য কাজ। যাও, এগিয়ে যাও। আমি এ-দিকটায় দেখছি।”

চন্দন চলে গেল।

কিকিরা বললেন, “কিছু দেখলে জায়গা ছেড়ো না; চেঁচিয়ে ডাকবে। টারজানের মতন, বুঝলে?” বলে মুখের সামনে হাত আড়াল করে টারজানের ডাক দেখানোর ভঙ্গিটা দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলেন।

চন্দন বলল, “ডাকব।”

 কিকিরা সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। পাহাড়ি জায়গা, পায়ে চলা পথও নেই। গাছপালার ডাল ধরে পাথর ধরে ধরে ঝোপের পাশ দিয়ে এগুতে হয়। পা পিছলে যাওয়ার ভয় আছে। কিকিরা সাবধান হলেন।

ফুট তিরিশ নেমেছেন কিকিরা, চোখে পড়ল তারাপদ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছে।

কিকিরাও দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারাপদ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছে–কিকিরাকে দেখছে না। কিকিরা তাকে দেখতে পাচ্ছিলেন। তেমন একটা দূরেও নেই তারাপদ।

কিকিরা ডাকলেন তারাপদকে।

ডাক শুনে তারাপদ এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। ঠিক ধরতে পারছিল না, কিকিরা কোথায়?

কিকিরা রুমাল বের করলেন পকেট থেকে। নাড়তে লাগলেন।

 তারাপদ দেখতে পেল। পেয়ে হাত নেড়ে ডাকতে লাগল।

বাধ্য হয়েই কিকিরাকে আবার উঠে আসতে হল। ঘুরপথে তাঁকে তারাপদর কাছে যেতে হবে।

.

কিকিরা তারাপদর কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতেই তারাপদ বলল, “ওই দেখুন!”

শিমগাছের মতন লতানো এক গাছ জড়িয়ে রয়েছে অন্য একটা গাছকে। গাছটির চেহারা করবী গাছের মতন, পাতাগুলো কিন্তু অন্যরকম। ছোট-ছোট হলুদ ফুলে ভরতি তার ডালপালা।

লতানো গাছটার আড়াল থেকে একটা ভাঙাচোরা খাপরা-ছাওয়া ছোট কুঁড়ে দেখা যাচ্ছিল। কুঁড়েটা দু পাশ থেকে এমনভাবে ঢাকা যে, একেবারে কাছে এসে না দাঁড়ালে দেখা যায় না।

কিকিরা বললেন “চলো দেখি।”

ডালপালা, লতানো গাছের ঘন পাতা সরিয়ে কিকিরাকে কুঁড়েটার কাছে এলেন। সামনে আসতেই দেখা গেল, তফাত থেকে যতটা মনে হয়েছিল কুঁডেটা তত ভাঙাচোরা নয়। মাথায় খাপরা ঠিকই, তবে একেবারে নষ্ট হয়ে যায়নি। ছাউনির খাঁচাটা বেরিয়ে এসেছে বারান্দা পর্যন্ত। একটামাত্র কুঠরি, সামনে সরু বারান্দা মতন। দরজাও আছে। আলকাতরা মাখানো রয়েছে পাল্লায়। অবশ্য দরজার কাঠ বেঁকেচুরে গিয়েছে। আলকাতরার গায়ে রং দিয়ে হিন্দিতে কী যেন দু-একটা অক্ষর লেখা। নম্বরও রয়েছে।

 কিকিরা দেখেশুনে বললেন, “মনে হচ্ছে জঙ্গলের বিট চৌকি।”

“মানে?”

“জঙ্গলের পাহারাদারের চৌকি।”

“এই অবস্থা?”

“আগে হয়ত এটা চৌকি ছিল–এখন নেই। হয় উঠিয়ে দিয়েছেনা হয় অন্য কোথাও করেছে।”

কিকিরা বারান্দায় উঠলেন। পাথর, ইট, কাদা, কোথাও বা সামান্য সুরকি দিয়ে গাঁথা একটা কুঁড়ে ধরনের ঘর। জঙ্গলের কাঠ কেটে তার মাথার ছাউনি হয়েছিল, তার ওপর খাপরা।

ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। শেকল তোলা।

তারাপদ বলল, “খুলব?”

“খোলো।”

 কিকিরা বারান্দাটা দেখছিলেন। তারাপদ দরজার পাল্লা হাট করে দিল।

খানিকটা অন্ধকার জমে আছে ঘরের মধ্যে। ছোট একটি জানলা দিয়ে রোদ না ঢুকলেও আলো ঢুকছিল।

ঘরের বাতাস ততটা ভারী নয়, বদ্ধও নয়। জানলা খোলা থাকার দরুনই বোধ হয়। দরজার ফাঁক-ফোকরও যথেষ্ট।

কিকিরা বললেন, “লোক ছিল। ওই দেখো!”

এই কুঠরিতে লোক ছিল বোঝা যায়। একপাশে কিছু খড় বিছানো, টাটকা খড়, একটা শতরঞ্জি, কম্বল। গোটা দুয়েক মাটির হাঁড়ি, একটা ছোট লণ্ঠন।

কিকিরা আর তারাপদ নজর করে সব দেখতে লাগল। জলের পাত্র, লোটা। এমনকি সিগারেটের পুরনো প্যাকেট পর্যন্ত চোখে পড়ল।

কিকিরা বললেন, “গাঁঠরি কই, সুটকেস কই?”

তারাপদ বলল, “আপনি কি সেই লোকটার কথা ভাবছেন–পানঅলা বুড়ো যার কথা বলেছিল?”

মাথা নেড়ে কিকিরা বললেন, “সেই লোক ছাড়া আর কে হবে? বিট চৌকিদার এভাবে থাকবে না! তারা টহল মেরে ফিরে যায় দিনে-দিনে।”

“তা হলে এই পোস্ট, মানে চৌকি?”

“গরম আছে, বর্ষা আছে, আপদ-বিপদ আছে। হয়ত কখনো দরকার পড়লে একটা রাতও কাটিয়ে দিতে হয়…”

“আপনি জানেন?”

“বাঃ! জানি বইকি।”

“তা আপনার সেই লোকই যদি হবে–তার অন্য মালপত্র কোথায় গেল?”

“তাই ভাবছি।”

কিকিরা মাটির হাঁড়ি দুটো তুলে নিতে বললেন তারাপদকে। নিয়ে বারান্দায় আসতে বললেন।

বারান্দায় এসে হাঁড়ির ভেতরটা দেখতে-দেখতে তারাপদ বলল, “স্যার, আটা ময়দা নাকি? নুন?”

কিকিরা হাত ডুবিয়ে গুঁড়ো পদার্থ খানকিটা তুলে নিলেন। তারপর কী হাসি তাঁর। হাসতে-হাসতে যেন নাচতে লাগলেন।

তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “হল কি কিকিরা? এত হাসছেন!”

“ছেলেমানুষ, একেবারে ছেলেমানুষ।”

“কে?”

“তোমরা! এই যে দুটো হাঁড়ি দেখছ–এই দুটো হল আগুনের ভেলকি দেখাবার জিনিস।”

“মানে?”

“আগুনের খেলা দেখাতে হলে এ-দুটো দরকার।…যাগে, হাঁড়ি দুটো তুলে নাও। নিয়ে যাব।”

কিকিরাকে খুব খুশি দেখাচ্ছিল। এতই খুশি যে, নিজের মনে রামপ্রসাদী ঢঙে গান গেয়ে উঠলেন : আর কত মা ঘুরাবি আমায়।

গান গাইতে-গাইতে কিকিরা বারান্দার আনাচকানাচ খুঁজলেন তন্নতন্ন করে। এক টুকরো কাগজ পাওয়া গেল। পকেটে পুরে নিলেন।

“ওটা কী দেখো তো?”

তারাপদ নিচে নামল বারান্দার। আমলকী ঝোপের পাশে খানিকটা সাদা মতন কী পড়ে আছে। তুলে নিল তারাপদ। দেখল। বলল, “কিকিরা, পাকা চুল-সাদা শণের মতন দেখতে…!”

“সাধুবাবার দাড়ি থেকে খসে পড়েছে!”

“দাড়ি?”

“ফল্স দাড়ি বা চুল। থিয়েটার যাত্রায় যা পরা হয়। বোধ হয়, সাধুবাবার গাল চুলকোচ্ছিল। খুব চুলকেছেন। খসে পড়ে গিয়েছে দু-চার গুচ্ছ। ফেলে দিয়েছেন।”

“তা হলে সাধুবাবা নকল?”

“বলতে?”

“আগুনের ওপর হাঁটাও ভাঁওতা।

“পুরোটাই ভাঁওতা।”

“কিন্তু সাধুবাবা কই?”

“সেটাই বলা মুশকিল। হয় মরে গেছে, না হয় ঘাপটি মেরে বসে আছে কোথাও।”

কিকিরা আরও একবার দেখলেন চারপাশ। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। বললেন, “যেখানে যেমনটি আছে থাক। চলো, চন্দনের খোঁজ করি।”

.

চন্দনকে পাওয়া গেল নদীর দিকে। হাঁটতে-হাঁটতে নদী পর্যন্ত চলে এসেছে প্রায়। গাছতলায় বসে বিশ্রাম করছিল।

তারাপদর হাতে একটা মাটির হাঁড়ি, অন্যটা কিকিরার হাতে।

 চন্দন অবাক হয়ে বলল, “হাঁড়ি কিসের?”

 কিকিরা বললেন, “রসগোল্লার। এর ইংরিজি নাম স মিল্ক পটাটোস উইথ সুগার জুস।”

চন্দন হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। বলল, “এ কি কিকিরা-ইংলিশ?”

“না স্যার”, কিকিরা বললেন, “এইটটি ফিফটি ফাইভে কোম্পানির খাস গিয়ারসন সাহেব তাঁর মেমসাহেবকে খাওয়ানোর জন্য মুনসিকে হুকুম করেছিলেন–এই মুনসি, গো অ্যান্ড ব্রিং দোস স মিল্ক পটাটোস উইথ সুগার জুস…।”

তারাপদ আর চন্দন হোহো করে হেসে উঠল।

কিকিরা এবার গাছতলায় বসলেন। বসে সিগারেট চাইলেন। তারপর মাটির হাঁড়ি দুটো দেখিয়ে বললেন, “স্যান্ডেল উড, এই দুটো হাঁড়ির মধ্যে যা আছে–তা দিয়ে আগুনে হাঁটার খেলা দেখানো যায়।”

চন্দন দেখল। বলল, “কিসের গুঁড়ো?”

“একটায় আছে পেলেন অ্যান্ড সিম্পল নুন। সল্ট। নরমাল সল্ট। অন্যটায় রয়েছে অ্যালাম বা ফটকিরি আর নুন। গুঁড়ো করে মেশানো। …দাও সিগারেট দাও।” কিকিরা সিগারেট নিয়ে আরাম করে বসলেন।

চন্দন বলল, “এই গুঁড়ো নিয়ে আগুনের খেলা দেখানো যায়?”

“যায়। ফটকিরি আর নুনের এই গুঁড়ো পায়ে মাখো হাতে মাখো মেখে আগুনের ওপর পা রাখো, বা হাত রাখো। তিন সেকেন্ডের বেশি রাখবে না। বড় জোর চার সেকেন্ড–তোমার কিস্যুটি হবে না। এ হল প্রিমিটিভ ব্যাপার। আজকাল শুনছি অ্যাক্রোলাইট পলিমার সলুশান আঙুলে লাগিয়ে জ্বলন্ত মোমবাতির শিখার ওপর আঙুল আরও বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায়। আমি পরখ করে দেখিনি। তা ছাড়া অ্যাসবেসটাস দিয়ে খড়ম করেও তুমি চাপা আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে দেখতে পারো।”

চন্দন বলল, “দারুণ কিকিরা, খাসা! গ্র্যান্ড!”

কিকিরা বললেন, “আরও একটু আছে স্যান্ডাল উড। আগুনের এই খেলা দেখানোর মধ্যে অন্য কলাকৌশলও আছে। ব্যাপারটাকে এমনভাবে সাজাতে হয়–যাতে যে দূর থেকে দেখে তার দৃষ্টিভ্রম হয়। ভিসানারি ইলিউশন। পাহাড়ের যে জায়গায় দাঁড়িয়ে খেলাটা দেখানো হত–সেটা খেলা দেখাবার পক্ষে খুবই ভাল জায়গা। পারফেক্ট প্লেস। ওই বড় বড় পাথরগুলো সামনে থাকায় কাজটা অনেক সোজা ও নিখুঁত হয়ে উঠেছে। …পরে তোমাদের দেখিয়ে দেব।”

তারাপদও সিগারেট খাচ্ছিল।

বেলা অনেকটা বেড়েছে। রোদের রং গাঢ়। তাত জমছে রোদে। পাহাড়তলি যেন নিঝুম। মাঝে-মাঝে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছিল।

চন্দন বলল, “আপনি তা হলে কাজের কাজ একটা কিছু করেছেন?”

“একটা নয়, তিনটে।”

“তিনটে?”

“হাঁড়ি, দাড়ি বা চুল, আর একটুকরো কাগজ।” বলে কিকিরা তারাপদকে নকল চুলদাড়ির অংশটুকু দেখাতে বললেন।

তারাপদ দেখাল। কিকিরা বললেন, “ফস দাড়ি বা চুল। সাধুবাবার।” বলে নিজের পকেট থেকে কাগজের টুকরোটা বের করলেন। বারান্দার পাশে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন টুকরোটা। বললেন আবার, “এটা একটা কাগজের টুকরো। খইনির প্যাকেটের টুকরো। মুখের দিকটা ছেঁড়া, নিচের দিকটা আছে। এখনো একটু-আধটু গন্ধ পাওয়া যাবে খইনির। প্যাকেটের তলায় লেখা আছে হাজিবাবা খইনি অ্যান্ড বিড়ি মার্চেন্ট, নাগোয়া। বানারস।”

তারাপদ প্রায় লাফিয়ে উঠল। “স্যার, আপনার সেই পানঅলা তা হলে ঠিক লোকই বলেছে। বেনারসের গাড়িতেই এসেছিল লোকটা। কাশীর লোক।

কিকিরা বললেন, “কাশীর লোক কিনা এখনই বলা যায় কেমন করে। তবে হতে পারে।…কিন্তু লোকটা কে?”

চন্দন খুব নিরীহ গলায় বলল, “কমলাপতি…”

কিকিরা কান করলেন না। মস্ত করে ধোঁয়া গিললেন সিগারেটের। নিজের লম্বা লম্বা মাথার চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বললেন, নিজের মনেই, “লোকটা কে? কেন এসেছিল?”

চন্দন আবার বলল, “লোকটার নাম কমলাপতি রাঠোর।”

কিকিরা এবার তাকালেন চন্দনের দিকে।

চন্দন পকেট থেকে একটা লকেটের মতন জিনিস বের করল। গোল চাকতি। কিকিরার দিকে এগিয়ে দিল। বলল, “এই দেখুন। চাবির রিংয়ের চাকতি। এই চাকতিটা খুলে গেছে। এটা মেটালের। এতে ঢালাই অক্ষরে ইংরিজিতে লেখা আছে কমলাপতি রাঠোর অ্যান্ড কোং। গোধুলিয়া। বেনারস। “

কিকিরা কেমন স্তম্ভিত। হাত বাড়িয়ে চাকতিটা নিলেন।

 তারাপদ বলল, “চাঁদু-তুই যে কেল্লা ফতে করে দিলি রে।”

.

০৭.

অন্নদা কুটির খুঁজে পেতে কষ্ট হল না।

বাড়িটা প্রায় রেললাইন ঘেঁষে, বালিয়াড়ির তলায়, এক প্রান্তে। সেখানে আরও দু-তিনটে বাড়িও চোখে পড়ে। এদিককার ঘরবাড়িগুলো সাধারণ, বাহার বিশেষ নেই। তবু গাছপালা বাগান দিয়ে মোটামুটি সাজানো।

রোদ মরে আসছিল। শীতের অপরাহ্ন। আকাশ পরিষ্কার। কয়েকটা চিল পাখিটাখি তখনো ভেসে বেড়াচ্ছিল শূন্যে।

কিকিরা তারাপদদের নিয়ে এমনভাবে অন্নদা কুটিরের কাছে এলেন যেন তাঁরা বেড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। চেঞ্জার বাবুবিবিরা এই সময়টাতেই বেড়িয়ে বেড়ান। সন্ধের আগে-আগেই বাড়ি ফিরে যান তাঁরা, যা শীত–তখন আর ঘুরে বেড়ানো সম্ভব নয়।

অন্নদা কুটিরের সামনে একজোড়া ইউক্যালিপটাস গাছ সিধে খাড়া হয়ে রয়েছে, গাছতলায় কিছু শুকনো পাতা জমেছে।

কিকিরা যেন ইউক্যালিপটাস গাছ দেখছেন এমনভাবে দাঁড়িয়ে তারাপদদের কিছু বলছিলেন, এমন সময় এক ভদ্রলোককে দেখা গেল।

বাড়ির ফটক খুলে বেরিয়ে এসেছিলেন ভদ্রলোক। কিকিরাদের দেখে দাঁড়ালেন।

ভদ্রলোকের বয়েস ষাটের ওপারে। পঁয়ষট্টির কাছাকাছি হবে। বয়েস হলেও শরীরস্বাস্থ্য ভাঙা নয়, বরং কর্মক্ষম বলেই মনে হয়। গায়ে জহর কোট, গরম চাদর, পরনে ধুতি। পায়ে জুতোমোজা। হাতে লাঠি। জহর কোটের পাশ পকেট থেকে চশমার খাপ উঁকি দিচ্ছিল।

কিকিরা বুঝতে পারলেন ইনিই ঘোষদাদা।

অচেনা হলেও চেনা-চেনা মুখ করে কিকিরা একটু হাসলেন। সৌজন্য দেখাতে নমস্কারও করলেন হাত জোড় করে।

ভদ্রলোক দেখলেন কিকিরাদের।

কিকিরা হাসি-হাসি মুখে বললেন, “একটু ঘুরতে বেরিয়েছি।…ইউক্যালিপটাস দেখছিলাম। বেশ বড় হয়ে গেছে। এখানে অনেক বাড়িতেই গাছটা দেখছি। আপনারটাই সবচেয়ে বেশি লম্বা মনে হল।”

“আরও পুরনো গাছ আছে ও-দিকে। গেলে দেখতে পাবেন।”

“এই গাছগুলো কত বছরের?”

“বছর বারো।”

“ষোলো হলেই সাবালক” কিকিরা হাসলেন, “ইউক্যলিপটাস পঁচিশ-তিরিশ ফিট পেরোলেই নাকি সাবালক হয়ে যায়। “

“ও!…তা আপনারা?”

“বেড়াতে এসেছি। বড়দিনের ছুটিতে।”

“চেঞ্জার!…এবছর চেঞ্জার একটু কম। এখনো আসার সময় যানি।”

“আপনিই কি ঘোষসাহেব?”

“সাহেব!” ভদ্রলোক দু-চার পলক দেখলেন কিকিরাদের, তারপর বললেন, “না, বাপের জন্মেও নই। আমি হেমচন্দ্র ঘোষ, আদি বাড়ি মেমারি, বর্ধমান। বাপ-ঠাকুরদা জমিজায়গা চাষবাসের কাজকর্ম নিয়ে পড়ে থাকতেন। আমি রেলে চাকরি করতাম। রিটায়ার্ড স্টেশন মাস্টার। লোকে মাস্টারমশাই বলত। সাহেব তো মশাই কেউ বলত না।”

কিকিরা হাসতে-হাসতে বললেন, “তা ঠিক। সাহেবদের বেশ ভিড় এখানে। মশাইদের পাওয়াই যায় না।…আপনার নাম শুনছিলাম।”

“কোথায়?”

“স্টেশনে। রাহাবাবু বলছিলেন…”

“আচ্ছা! আমাদের জীবন রাহা!..তা আপনারা উঠেছেন কোথায়?”

“নৃসিংহ-সদন।”

“নৃসিংহ-সদন!” ঘোষবাবু যেন দু-মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন। তারপর তারাপদদের দিকে তাকালেন। “এঁরা?”

“আমাদের ইয়াং ফ্রেন্ডস। ও হল চন্দন। ডাক্তার। এম বি বি এস। কলকাতার হাসপাতালে আছে। আর ও আমাদের তারাপদ, চাকরি করে অ্যাকাউন্টসে। চন্দন আর তারাপদ বন্ধু। ছেলেবেলার। আমিই বুড়ো।”

“আপনার নাম?”

“কিঙ্করকিশোর রায়। লোকে বলে কিকিরা।”

“ওই শর্টকাট আর কি! কিঙ্করের কি, কিশোরের কি আর রায়ের রা–কিকিরা।”

ঘোষবাবুর মন্দ লাগল না কথাটা। বললেন, “কলকাতা থেকে আসছেন সব?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“আপনার কী করা হয়?”

“বিশেষ কিছু নয়। মানে বড়সড় কাজকর্ম করি না কিছু। দু-একটা কোম্পানির হয়ে কাজ করি।”

“কী কোম্পানি?”

“নাম করার মতন নয়। আজকাল আয়ুর্বেদের পুনর্জন্ম হচ্ছে–দেখেছেন! রিভাইভেল। লোকে আর অ্যালোপাথি খেতে চাইছে না। চন্দনরা যতই বলুক। সিস্টেম খারাপ করে দেয় অ্যালোপাথিতে। আয়ুর্বেদের পুরনো ওষুধগুলো নেড়েচেড়ে নতুন-নতুন ওষুধ বেরুচ্ছে। হজমের, লিভারের, মাথাধরার, বাতের, সর্দি-শ্লেষ্মর, পা মচকানোর কত কী! তা আমাদের কোম্পানি ভাবছিল–হরতুকির এক্সট্রাক্ট দিয়ে একটা কিছু যদি বের করা যায়। কবিরাজী শাস্ত্রে বলেছে হরীতকীর শত গুণ। গুণ শত না হলেও অনেক। মালটিভিটামিন টাইপের একটা ওষুধ বের করতে পারলে বাজারে চলত ভাল। যেমন ধরুন রসুনের রস আজকাল বাজারে দমদম করে চলছে। “

“দমদম করে…!”

তারাপদরাও হেসে ফেলল।

ঘোষবাবু কৌতুক বোধ করছিলেন। বললেন, “তা এলেন যখন–একটু বসবেন নাকি? এক কাপ করে চা?”

কিকিরা সংকুচিত হবার ভান করে বললেন, “না, না, এখন থাক। আপনি দু-পা হাঁটতে বেরিয়েছেন–এখন আর বাড়ির মধ্যে ঢুকব না। বরং কাল-পরশু আসা যাবে। আমরা তো আছি দু-চার দিন।”

“আমার কোনো অসুবিধে হত না।…আসুনই না। আলাপ যখন হয়েই গেল।”

কিকিরাদের নিয়ে বাড়ির মধ্যেই এলেন ঘোষবাবু। বারান্দায় চেয়ার পাতা ছিল। বসতে বললেন তারাপদদের। তারপর কাকে যেন ডাকলেন।

ভেতর থেকে এক মহিলার গলা শোনা গেল।

“জটা নেই?”

“জল তুলছে। ডাকব?”

“তুমিই এসো একবার।”

এক মহিলা এলেন। বয়স্কা। মাথায় কাপড় ছিল না। বাইরে এসে কিকিরাদের দেখে মাথায় কাপড় দিলেন।

ঘোষবাবু বললেন, “এঁরা বেড়াতে এসেছেন। চেঞ্জার। উনি হকিবাবু, হতুকির ব্যবসা ফাঁদবেন। উনি ডাক্তার। আর উনি চাকরি করেন।..” বলে ঘোষবাবু কিকিরার দিকে তাকালেন, মহিলাকে দেখিয়ে বললেন “আমার গিন্নি। নাতিনাতনিরা ছুটিতে এখানেই থাকে। তাদের আসার কথা। এখনো এসে পৌঁছয়নি। উনি দু বেলা গাড়ির শব্দ পেলেই ঘরে বাইরে করছেন।”

কিকিরারা উঠে দাঁড়িয়ে মহিলাকে নমস্কার করলেন।

 “আপনারা বসুন। একটু চা করে আনি।” মহিলা চলে গেলেন।

ঘোষবাবু দু-চারটে সাংসারিক কথা বললেন। এখানে ওঁরা দুই বৃদ্ধবৃদ্ধাই থাকেন। কাজের লোক আছে। ছেলেমেয়েরা বাইরে। কাজকর্ম করে। ছুটিছাটায় সব আসে। নাতিনাতনিরা তো আসেই।

তারাপদ বলল, “আপনি এখানে কতদিন আছেন?”

“তা অনেকদিন। এই বাড়ি অবশ্য বেশিদিন নয়। তাও ক’বছর হয়ে গেল। আগে আমি এখানকার স্টেশন মাস্টার ছিলাম। জায়গাটার সঙ্গে আমার কিসের নাড়ির যোগ কে জানে! চার-চারবার ট্রান্সফার হয়ে এখানেই এসেছি। ঘুরেফিরে। আগে এ এস এম ছিলাম–পরে স্টেশন মাস্টার। আমার খুব ভাল লাগে জায়গাটা। শেষ জীবনটা কাটাব বলে মাথা গোঁজার জায়গাও করেছি একটা।”

কথায় কথায় আলাপ জমে গেল। চা এসেছিল।

চা খেতে-খেতে কিকিরা বললেন, “একটা কথা জিজ্ঞেস করব। মাস্টারমশাই?”

“কেন করবেন না?”

“না মানে, আমরা তো নতুন লোক, কলকাতা থেকে আসছি। কলকাতায় আমাদের এক বন্ধু নৃসিংহ-সদনে পাঠিয়ে দিয়েছেন ব্যবস্থা করে। বন্ধুটি রঘুপতিবাবুদের ফার্মে কাজ করেন। তাঁর ব্যবস্থা মতন আগে আমি এসেছি, আর এরা এসেছে মাত্র তিনদিন আগে।”

ঘোষবাবু মাথা দোলালেন। শুনছেন সবই।

 কিকিরা বললেন “নৃসিংহ-সদনে আসার পর একটা খবর শুনলুম।”

“একটা লোক মারা যাওয়ার খবর?”

“হ্যাঁ। আরও শুনলাম-কে একজন সাধু নাকি কিছুদিন ধরে আগুনের ওপর হাঁটাচলা করছিল…”।

“আমিও তাই শুনেছি।”

“রঘুপতিবাবু আমাদের হোস্ট। এমনিতে আমাদের কোনো অসুবিধেই হচ্ছে না। কিন্তু ভদ্রলোককে খুবই ডিস্টার্বড় দেখছি, মুষড়ে পড়া চেহারা। শরীরও ওঁর খারাপ হচ্ছে।…আমরা কেমন অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গিয়েছি।”

ঘোষবাবু মাথা নাড়তে-নাড়তে বললেন, “আপনারা আর কী করবেন?”

“করার কিছু নেই ঠিকই, কিন্তু খারাপ লাগছে।”

“আপনার সঙ্গে রঘুপতিবাবুর আলাপ নেই?” তারাপদ বলল হঠাৎ।

 “আলাপ! আলাপ থাকবে না কেন! অনেকদিন ধরেই আলাপ। ওঁরা এখানকার পুরনো লোক, আর আমিও কম পুরনো নই।”

“ওঁর বাবা…?”

“বিলক্ষণ চিনতাম রে ভাই! উমাপতিবাবু!…আমি তখন একেবারে ছোকরা, এখানে পোস্টেড, এ এস এম–তখন তাঁকে দেখেছি। বিশাল চেহারা ছিল। ছ’ ফুটের ওপর লম্বা।”

“তবে তো আপনি রঘুপতিবাবুর কাকাকেও চেনেন?”

“শচীপতিবাবু! ছবিটবি আঁকতেন। চিনতাম।”

“তাঁর যক্ষ্মা হয়েছিল। “

“হ্যাঁ, উনিই এখানে থাকতেন বরাবর।”

“এখানেই মারা যান?”

“তাই গেলেন। তখন ওঁর বয়েস বেশি হয়নি। চল্লিশের কাছাকাছি।” বলে ঘোষবাবু একটু চুপ করে থেকে নিজেই বললেন, “ভাল লোক ছিলেন। ছবিও বড় ভাল আঁকতেন। আমি দেখেছি। ছবি ওঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। অবশ্য এখানকার ক্লাইমেটও একটা ফ্যাক্টর।”

“আর কোনো ভাই ছিল না?” তারাপদ বুদ্ধি করে জিজ্ঞেস করল।

“ছিল।…ব্যাপার কী জানো, ভাই আমি এখানে তিন-চার বছর করে থাকি–তারপর ট্রান্সফার হই। আবার দু-তিন জায়গার জল বদলে এখানেই ফিরে আসি। চারবার এই স্টেশনে পোস্টেড হয়েছি যা তোমাদের বলছিলাম। পুরনো জায়গায় দু-একবার অনেকেই ফিরে আসে। আমি চার-চারবার।”

“উনিও কি পতি ছিলেন?” চন্দন হালকাভাবে বলল, “এঁরা সবাই দেখছি। পতি। উমাপতি, রঘুপতি, শচীপতি..”

“ওটা ওঁদের বংশের নিয়ম বা সংস্কার।”

“তা হলে নৃসিংহ…?”

“নৃসিংহও হয়ত পতি ছিলেন। জানি না।”

 কিকিরা বললেন, “উমাপতির ছোট ভাইয়ের নাম কী ছিল জানেন?”

“বিশ্বপতি!”

“বিশ্বপতি! ঠাকুরদেবতা দেবদেবী বাদ দিয়ে..”

“বিশ্বপতিও নারায়ণের নাম।”

“ও!”

ঘোষবাবু হঠাৎ কিকিরার দিকে তাকালেন। “আপনারা এসব কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন! রঘুপতিবাবুর বাড়িতে তো কিছু ঘটেনি। তা হলে?”

কিকিরা বললেন, “সেইটাই তো কথা মাস্টারমশাই! আমরাও ওই কথাটাই ভাবছি। রঘুপতিবাবুকে আমরা বলেছিও সে কথা। বলেছি, আপনি অস্থির হচ্ছেন কেন! যা ঘটার বাইরে ঘটেছে। আপনার সঙ্গে কিসের সম্পর্ক! উনি আমাদের কথায় কান করছেন না।”

 “কেন?”

কিকিরা চালাকি করে বললেন, “উনি বলছেন, যে-লোকটা টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে আগুনের ওপর হাঁটাচলা করত–সে নাকি ইচ্ছে করেই রঘুপতিবাবুকে সেটা দেখাতে চাইত।”

ঘোষবাবু পকেট থেকে সিগারেটের তামাক আর কাগজ বের করলেন। নিজের মনেই বললেন, “পুলিশকে সেকথা উনি বলেছেন?”

“জানি না। আমাদের বলেন।”

সিগারেট পাকাতে লাগলেন ঘোষবাবু। “আপনাদের বলেন!” বলেই চুপ করে গেলেন।

তারাপদ বলল, “বিশ্বপতিবাবু নাকি আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন?”

মাথা তুললেন ঘোষবাবু। “তাই শুনেছি।”

“কেন?”

“নিজেদের গণ্ডগোল। ফ্যামিলির ব্যাপার।”

“কিসের গণ্ডগোল! সম্পত্তি নিয়ে। সিগারেটটা পাকানো হয়ে গিয়েছিল। ধরিয়ে নিলেন ঘোষবাবু। বললেন, “ভাই, ধনী লোকের সঙ্গে কি আমাদের মেলে! আমরা দু-চার হাজার টাকার জন্য ঝগড়াঝাটি করি, দশ হাত জমি কোনো ভাই ভাগে বেশি পেল–তাই নিয়ে মামলা মোকদ্দমা করি। ওরা করে লাখ-লাখ টাকার জন্য। দু-চার লাখ টাকা ছেড়ে দেওয়া সামান্য কথা নয়। সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়াঝাটি তো হতেই পারে।”

কিকিরা বললেন, “এ ছাড়া কি কিছু নেই মাস্টারমশাই?”

“কেন?”

“জিজ্ঞেস করছি।”

“আপনারা কে?”

 কিকিরা থতমত খেয়ে গেলেন। বললেন, “আমরা আমরাই। আপনি বিশ্বাস করছেন না?”

ঘোষবাবু কথা বললেন না অনেকক্ষণ। তারপর বললেন, “রঘুপতিবাবু তাঁর বংশের কথা কিছু বলেননি?”

“তেমন কিছু বলেননি?”

“রঘুবংশের কথা?”

“রঘুবংশ…?”

“আপনারা জানেন না। পুরাণে আছে, রঘুবংশের শেষ রাজা ছিলেন অগ্নিবর্ণ। মহারাজ সুদর্শন অনেককাল রাজত্ব করার পর ছেলে অগ্নিবর্ণকে রাজ্যপাটে বসিয়ে স্বর্গে চলে যান। অগ্নিবর্ণ ছিলেন অলস, বিলাসী, আহাম্মক। বিলাসব্যসনেই তাঁর দিন কাটত। তাঁর হল যক্ষ্মা। রাজরোগ। তখন অগ্নিবর্ণের মন্ত্রীরা নিজেরা পরামর্শ করে রাজাকে হত্যা করাই ঠিক করে। একদিন বনের মধ্যে নির্জনে এক অগ্নিকুণ্ডের ওপর ফেলে দেওয়া হল রাজাকে। রানীকে বসানো হল সিংহাসনে। রানী সন্তানসম্ভবা।” ঘোষবাবু থামলেন; তাঁর হাতের পাকানো সিগারেটটা আবার ধরিয়ে নিলেন। বললেন “রঘুপতিবাবুরা মনে করেন–মানে তাঁদের আট পুরুষের ধারণা ছিল রানীর যথাসময়ে যে পুত্রসন্তান হল–তারই গোত্রের তাঁরা। অগ্নিজিহু তাঁদের উপাস্য দেবতা। অগ্নির সাতটি শিখা বা জিভ। সাতটি শিখার নামকরালী, ধামিনী, শ্বেতা, লোহিতা নীললোহিতা, পদ্মরাগ, সুবর্ণা। সপ্তজিহ্ অগ্নির এক নতুন মূর্তি করেছিলেন শচীপতি। পাথরের মূর্তি নয়, মাটিরও নয়। সেই আমি দেখেছি। এমন মূর্তি আর দেখিনি। দেখব না। ওই মূর্তিটি শেষ করার কিছুদিন পরে শচীপতিবাবু মারা যান।…শুনেছিলাম ওই মূর্তি নিয়ে পারিবারিক গণ্ডগোল হয়েছিল।…আমি তো ভাই বলতে পারব না, সেই অগ্নিজিহু মূর্তির সঙ্গে এই আগুনের কী সম্পর্ক রয়েছে। তবে থাকতেও পারে।”

তারাপদ চন্দন কিকিরা যেন স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল। অগ্নিজিহু দেবতার সঙ্গে কি এই আগুনের কোনো সম্পর্ক আছে?

ঘোষবাবু বললেন, “আর আমি কিছু জানি না।”

.

০৮.

পরের দিন সকালটা কাছাকাছি ঘুরেফিরে কাটিয়ে দিলেন কিকিরা তারাপদদের নিয়ে। নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলেন।

তারাপদ বলল, “কিকিরা, আমি কিন্তু এখনো অগাধ জলে।”

 চন্দন বলল, “স্যার, আমি একবার ভেবেছিলাম, কমলাপতি রাঠোরের নামটা ঘোষবাবুর কাছে বলি। বললাম না। বললে কি তিনি চিনতে পারতেন?”

তারাপদ বলল, “আমার মনে ছিল। কিন্তু অগ্নিজি-তেই আমার মাথা গোলমাল করে দিল। লাইফে এরকম এক দেবতার কথা শুনিনি। সাতটা জিভ!”

কিকিরা বললেন, “যটাই জিভ হোক, ব্যাপারটা আগুন। আগুনের সঙ্গে রঘুপতিদের একটা সম্পর্ক রয়েছে দেখছি।”

“উপাস্য দেবতা যে!” চন্দন বলল।

“তা ঠিকই। আমাদের দেশের নানা ধরনের মানুষের নানা উপাস্য দেবতা রয়েছে। সূর্য চন্দ্র থেকে সাপ পর্যন্ত। শুনেছি, অগিও বৈদিক দেবতা।”

তারাপদ কতই না অবাক হয়েছে, বলল, “আপনি বেদও জানেন?”

“বিন্দুমাত্র না,” মাথা নাড়লেন কিকিরা। “তোমরা কমলাপতি রাঠোরের কথা বলছিলেন না? আমার মনে হয় ঘোষ-মাস্টারমশাই তাঁকে চেনেন না। চিনলে বলতেন।”

“আমরা জিজ্ঞেসই করলাম না, তিনি বলবেন?”

“বলতে পারতেন। এত কথা যখন বলেছেন–হয়ত নিজের থেকেই বলে ফেলতেন।”

খানিকটা চুপচাপ থাকার পর তারাপদ বলল, “কিকিরা, আমার মনে হচ্ছে, পাহাড়ের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে হেঁটে বেড়ানোর ব্যাপারটার উদ্দেশ্যই ছিল রঘুপতি। রঘুপতিকে ওটা দেখানো হত।”

“কী উদ্দেশ্য?” চন্দন বলল।

 “রঘুপতিকে কিছু মনে করিয়ে দেওয়া।”

“সেটা কী?”

 কিকিরা কী ভাবছিলেন, হঠাৎ বললেন, “স্যালে উড, ওই যে রাজার ছেলেকী নাম–অগ্নিজিহু–যার যক্ষ্মা হয়েছিল, তাকে তার মন্ত্রীরা বনের মধ্যে নির্জনে নিয়ে গিয়ে আগুনের মধ্যে ফেলে দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিল, তাই না বললেন মাস্টারমশাই?”

“হ্যাঁ।”

“ শচীপতিরও যক্ষ্মা হয়েছিল। তাকে ষড়যন্ত্র করে কেউ পুড়িয়ে মারেনি তো?”

“বলেন কী! একজন টিবি পেশেন্টকে পুড়িয়ে মারা! এত বড় নৃশংস কাজ কে করবে!”

কিকিরা কোনো জবাব দিতে পারলেন না। পরে নিচু গলায় বললেন, “সংসারে আগুন তো অনেক রকম আছে। শিখাও। শোক, তাপর, রুগ্নতা, ব্যর্থতাকত কী? তারও হয়ত সাতটি শিখটা।”

অনেকক্ষণ পরে চন্দন বলল, “কিকিরা, সেই মূর্তিটি কোথায়? আমরা যদি দেখতে পেতাম।”

কিকিরা বললেন, “পারো!..দেখি আজ একবার চেষ্টা করব।”

.

দুপুর বেলায় তারাপদ ধরল বিরজুকে। পাঁচটা এলোমেলো কথা, খোশ গল্পের পর তারাপদ বলল, “বিরজু, তোমাদের এখানে যে তসবির ঘরটা আছে–সেটা কোথায়?” বলেই চালাকি করে আবার বলল, “রঘুপতিবাবু তসবির ঘরের গল্প করছিলেন।”

বিরজু বলল, “ওধারে আছে, ডাইনে। দক্ষিণ পাশে। বাবুর ঘরের গা দিয়ে বারান্দা আছে বারান্দার শেষ ঘরে।”

“আমি তসবির দেখতে ভালবাসি। বাবুকে বলব!”

“ঘর বনধ। তালা লাগানো আছে। বাবুকে বলবেন।”

“তুমি ও-ঘরে গিয়েছ?”

“বাবুর সাথ গিয়েছি।”

“বাবু বুঝি প্রায়ই তসবির ঘরে যান?”

“না। কলকাতা থেকে এলে একদিন-দুদিন যান?”

“ঘর সাফ হয় না?”

“চাবি বাবুর কাছে থাকে। দোতলার ইধারকার সব ঘরের চাবি বাবুর কাছে। তিনি কলকাতা থেকে এলে আমরা ঘর সাফা করি।”

তারাপদ আর কিছু বলল না। বুঝতে পারল, রঘুপতি তাঁর দিককার ঘরদোরের চাবি এখানে ফেলে রেখে যান না। ছবি রাখা ঘরের চাবিও থাকে তাঁর কাছে। এতে অবশ্য দোষের কিছু নেই। ভাইয়ের আঁকা ছবি তো তিনি বাগানে ফেলে রাখতে পারেন না। একটা ঘরে রেখে দিয়েছেন। যত্ন করেই হোক বা অযত্নে।

যদিও তারাপদ দেখেনি, তবু তার মনে হল ছবি-ঘরের তালাটা নিশ্চয় মামুলি নয়। রঘুপতি বৈষয়িক লোক, তিনি নিশ্চয় সস্তা বাজে তালা তাঁর নিজের মহলের দরজায় ঝুলিয়ে কলকাতায় গিয়ে বসে থাকেন না।

কিকিরা যদি কোনো ভেলকি দেখিয়ে তালাটা খুলতে পারতেন!

তবে তা সম্ভব নয়। গৃহস্বামীর ঘরের সামনে দিয়ে না গেলে ছবিঘরে যাওয়া যায় না। আর রঘুপতি তো এখন সারাদিন বাড়িতে। হয় তাঁর ঘরে না হয় বসার ঘরে। নিচেও বড় একটা নামেন না।

কিকিরার কাছে ফিরে এসে তারাপদ বলল, “কিকিরা, শচীপতিবাবুর ছবিঘরে একবার যাওয়া দরকার।”

“’হুঁ”

“আপনি কিছু ভেবেছেন?”

“তুমি ভাবলে কিছু?”

তারাপদ বিরজুর কথা বলল। বিরজুর কাছ থেকে সে যা শুনেছে।

কিকিরা সব শুনলেন। তারপর বললেন, “আজ সন্ধেবেলায় রঘুপতিবাবুকে দিয়েই ছবিঘর খুলিয়ে নেব।”

.

০৯.

বছরের শেষ দিনে শীতও পড়েছিল প্রচণ্ড। বইরের উত্তরে বাতাস এই সন্ধেতে মাঝে-মাঝে এমন করে বয়ে ঝড় উঠেছে। রঘুপতির বসার ঘরে কাঠ-চুল্লি জ্বলছিল অনেকক্ষণ ধরেই। ঘরটা মোেটামুটি আরামদায়ক হয়ে উঠেছে।

চা খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল।

চুরুট ধরাতে ধরাতে রঘুপতি বললেন, “ছবি দেখতে চান, দেখতে পারেন। তবে এই সন্ধেবেলায় কি ছবি দেখতে ভাল লাগবে! আলো নেই।”

কিকিরা বললেন, “এমনি আলোতেই দেখি। আপনার যদি কোনো অসুবিধে না থাকে…”

“না না, আমার আর কিসের অসুবিধে,” বলে সোফা থেকে উঠলেন, “দাঁড়ান–বিরজুকে আলো আনতে বলি। চাবিটাও নিয়ে আসি।”

রঘুপতি চলে গেলেন।

সামান্য অপেক্ষা করে কিকিরা নিচু গলায় বললেন, “তারাপদ, বোধ হয় ওঁর সুবিধেই হল।”

“কেন?”

“দিনের বেলার চেয়ে এই সন্ধেবেলায় টিমটিমে আলোয় ছবিঘর দেখালে সব তো আর চোখে পড়বে না। হয়ত এটাই ওঁর পক্ষে ভাল হল।”

চন্দন বলল, “আমরা দিনে দেখলেও পারতাম। রঘুপতিবাবুর কথা শুনে মনে হল, উনি ছবি দেখাতে অরাজি ছিলেন না।”

কিকিরা বললেন, “চলো, দেখা তো যাক কী আছে। একটু চোখ চেয়ে দেখো তোমরা। আমার একার নজরে…”

কথাটা শেষ হল না কিকিরার, রঘুপতির গলা শোনা গেল। কী যেন বলছিলেন তিনি বিরজুকে।

সামান্য পরে ঘরে এলেন রঘুপতি। “আসুন।”

 কিকিরারা উঠলেন।

বসার ঘর, বারান্দা, বারান্দার পাশ দিয়ে ডাইনের গলি। শীতের হাওয়া এসে হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।

রঘুপতির হাতে চৌকো টর্চ। বেশ জোরালো আলো হয় টর্চটার। বিরজুর হাতে বড় বাতি, টেবিলে রাখার বাতি। তারাপদকেও একটা বাতি নিতে হয়েছে।

ছবিঘরের সামনে এসে রঘুপতি বললেন, “কদিন আগেই ঘর পরিষ্কার করিয়েছি, ভেতরের দরজা-জানলা বন্ধ থাকলেও নোংরা লাগবে না।”

কিকিরা নজর করে দেখলেন, তালাটা মামুলি নয়। ভাল তালা। সাধারণ তালা ছাড়াও ডোরলক রয়েছে।

দরজা খুলে রঘুপতি ডাকলেন, “আসুন।”

যে-কোনো বন্ধ ঘরের তালা খুলে ভেতরে ঢুকলেই কেমন লাগে। চাপা একটা গন্ধ যেন নিশ্বাস-প্রশ্বাস ভারী করে তোলে।

কিকিরাররা কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকলেন। বিরজু একপাশ দিয়ে এগিয়ে গেল আলো হাতে। রঘুপতি তাকে বলে দিলেন–আলোটা কোথায় রাখতে হবে। “তুমি যাও।”

 বিরজু চলে গেল।

তারাপদও এক জায়গায় আলো রাখল।

রঘুপতি বললেন, “এই ঘর দুটো আমার কাকার ছিল। শচীপতির। কাকাকে আমরা শচীভাই বলতাম। ছেলেবেলা থেকেই। বাবা শচীভাই বলে ডাকতেন। আমরাও বলতাম। কাকার ছবি-টবি শেষ পর্যন্ত যা ছিল–এখানে রেখে দিয়েছি। দু-একটা এ বাড়িতে টাঙানো আছে। আমার বসার ঘরেও আছে। কলকাতার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছি কয়েকটা।”

কিকিরা ঘরের চারদিক দেখছিলেন। ঘর বেশ বড়। দক্ষিণের দিকটা বোধ হয় আধখানা চাঁদের মতন গোল বাঁকানো। বড়বড় দরজা-জানলা। জানলার খড়খড়ি আর শার্সি বন্ধ। পাশের ঘরে যাওয়ার দরজাও বন্ধ ছিল।

এতবড় ঘরে যত ছবি থাকার কথা ছিল, তা নেই সাজানো-গোছানোও নয় ছবিগুলো। পড়ে আছে এখানে ওখানে। দু চারটে দেওয়ালে ঝোলানো। কোনো কোনো ছবি একটা লম্বা টেবিলের ওপর দাঁড় করানো, দেওয়ালে হেলান দিয়ে।

কিকিরা বললেন, “ওঁর ছবি তো খুব বেশি নেই!”

“নষ্ট হয়ে গিয়েছে, ও নিজেই কত বিলিয়ে দিয়েছে…। আর এসব কে দেখাশোনা করবে, যত্ন করবে। আমি তো বছরে দু-একবার আসি মাত্র।”

তারাপদ আর চন্দন ছবি দেখছিল। দাঁড়াচ্ছিল কোথাও, আবার দু-পা এগিয়ে যাচ্ছিল। ঘরে এখন যা আলো তাতে বাস্তবিকই কোনো ছবি ভাল করে দেখা যায় না। সাজানো-গোছানোও নেই। তবে একটা মস্ত সুবিধে এই যে, শচীপতি বেশিরভাগই নিসর্গচিত্র এঁকেছেন, আর স্টিল লাইফ। নিসর্গচিত্রগুলো বড়বড়। বিরাট অশ্বত্থাগাছের ওপাধের ধুধু মাঠ, একটা হয়ত গোরুর গাড়ি। বেশ লাগে। জঙ্গলের ছবিই বেশি। পাহাড়, গাছপালা, নদী, পুকুর, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত।

তারাপদ ছবি দেখতে-দেখতে বলল, “স্টিল লাইফ বলে ওকে–ওই যে ফুল…!”

“হ্যাঁ।”

“ভালই। ভদ্রলোকের হাত ছিল।”

কিকিরাও ছবি দেখতে-দেখতে কথা বলছিলেন রঘুপতির সঙ্গে।

 হঠাৎ চন্দন কেমন শব্দ করে উঠল।

 কিকিরা ঘুরে দাঁড়ালেন।

 কিছু বলতে গিয়ে চন্দন নিজেকে সামলে নিল।

তারাপদও দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

কিকিরাও ঘুরে এলেন। তাকালেন। তাকিয়ে কেমন অপলক চোখে দাঁড়িয়ে থাকলেন।

কাচের একটা চৌখুপি বা বাক্স। হাত দেড়েক লম্বায়, চওড়ায় হয়ত হাতখানেকের মতন। তার মধ্যে এক অদ্ভুত মূর্তি।

“ওই মুর্তিটা…!”

রঘুপতি তাঁর হাতের টর্চের উজ্জ্বল আলো কাচের ওপর ফেললেন। ভেতরের মূর্তিটা যেন কেঁপে গেল।

কিকিরা অবাক হয়ে মূর্তিটা দেখছিলেন।

 রঘুপতি বললেন, “অগ্নিমূর্তি!”

“অগ্নিমূর্তি?”

“হ্যাঁ। ওই তো দেখছেন। পরনে কৃষ্ণ বস্ত্র। হাতে ধুম্রপতাকা, জ্বলন্ত বর্শা। “

“চারটে হাত?”

“হ্যাঁ। হরিবংশের বর্ণনা মতে অগ্নির ওই রূপ। কৃষ্ণবস্ত্রাবৃত, ধুম্রপতাকা, জ্বলন্ত বর্শা হাতে দেবতা অগ্নি। ওঁর চারপাশে আগুনের সাতটি শিখা।”

“একটা ছাগলের মুণ্ডু রয়েছে নিচে।”

“অগ্নির বাহন ছাগ।”

কিকিরা বুঝতে পারছিলেন না এই মূর্তিটিকে তিনি কী বলবেন! অসামান্য, সুন্দর, না ভীতিপদ। আগুনের সাতটি শিখার রং এক নয়, কোনোটা ঘন লাল, কোনোটা আগুনে লাল, কোনোটা তামাটে, কোনোটা সাদা-মেশানো। অগ্নিমূর্তির বেশ একেবারে কালো। চার হাতের এক হাতে পতাকা! ধোঁয়া উঠছে যেন পতাকার মাথায়, বর্শা লাল, অন্য দুই হাতের একটিতে শাঁখ, অন্যটিতে কমণ্ডলু।

তারাপদ আর চন্দন কোনো কথা বলছি না।

শেষ পর্যন্ত কিকিরাই কথা বললেন, “এই মূর্তি কিসের তৈরি?”

“তা আমি ঠিক বলতে পারব না। শচীভাই নানারকম জিনিস মিশিয়ে করেছিল। তবে গালাই বেশি।”

“গালা?”

“কালো লাল গালা। সবুজ নীল গালাও আছে। কেমন করে এসমস্ত গালা সে জুটিয়েছিল, বা নিজেই রং বানিয়েছিল আমি জানি না।”

“এই মূর্তি কি এখানেই আছে বরাবর?”

“না।”

“কোথায় ছিল?”

রঘুপতি ইতস্তত করে বললেন, “পাশের ঘরের এক চোরা সিন্দুকে।”

“আপনি এখানে নিয়ে এসে রেখেছেন।”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

রঘুপতি হঠাৎ যেন কেমন হয়ে গেলেন। স্তব্ধ, গম্ভীর, বিষণ্ণ। নির্বাক মানুষটি যেন ভীষণ অন্যমনস্ক।

অনেকক্ষণ পরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, “চলুন বাইরে যাই।”

কিকিরা কিছু বলার আগেই রঘুপতি ঘুরে দাঁড়ালেন।

উনি চলে যাচ্ছেন দেখে কিকিরা তারাপদদের ইশারা করলেন বাতি দুটো তুলে নিতে।

বাইরে এসে দাঁড়ালেন কিকিরারা।

 রঘুপতি দরজা বন্ধ করতে লাগলেন সাবধানে।

.

১০.

বসার ঘরে এসে আবার বসলেন চারজনে।

 চুপচাপ। রঘুপতিকে বিমর্ষ, ভারাক্রান্ত দেখাচ্ছিল।

কিকিরাই শেষ পর্যন্ত কথা বললেন, “রঘুপতিবাবু, ওই মূর্তি কি আপনাদের…”।

রঘুপতি বললেন, “আমরা অগ্নি-উপাসক। আমাদের কুলদেবতা অগ্নি। যে-মূর্তি আমরা পুজো করি সেই মূর্তি আমার কলকাতার বাড়িতে আছে। সেই মূর্তি এক ঋষিপুরুষের। তাঁর দুটি হাত। এক হাতে বজ্র, অন্য হাতে ঘৃতপাত্র। পরনে তাঁর সন্ন্যাসীর বেশভূষা। তাঁর পায়ের তলায় আগুনের শিখা।” বলে রঘুপতি চুপ করে থাকলেন সময়। আবার বললেন, “এখানে যে মূর্তিটি দেখলেন–এটা শচীভাই নিজের খেয়ালে গড়েছিল। তার মনের মতন করে। এই মূর্তি ভয়ঙ্কর, অভিশপ্ত। এতে আমাদের অমঙ্গল হয়েছে। শচীভাই মারা গেল, আমার ছোটছেলে হল পঙ্গু। বাবা শেষ বয়সে উন্মাদ হয়ে আত্মহত্যা করলেন।

কিকিরা বললেন, “মূর্তির জন্য কি এমন হয়!”

“জানি না। হয় না হয়ত। আমার মনে হয়, হয়েছে।”

“তারপর?”

“আমার আর-এক কাকা বিশ্বপতি আমাদের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করে বাড়ি ছেড়ে চলে যান।”

“কেন?”

“ওই মূর্তির জন্য।…সে মূর্তিটি নিজের জন্য চেয়েছিল।”

“আপনারা দেননি?”

“না।”

“মৃর্তিটি অমঙ্গলের বলছেন–তা হলে দিলেন না কেন?”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে রঘুপতি বললেন, “ওই মূর্তির মধ্যে আগুনের যে সাতটি শিখা আছে–সেই শিখার তলায় সাতটি রত্ন লুকানো রয়েছে–গালার মধ্যে। এই সাতটি রত্ন আমাদের পূর্বপুরুষদের সঞ্চয়। প্রতিটি শিখার যেমন রং, রত্নগুলিরও রং সেইরকম। এক-একটি রত্নের দাম আজকের দিনে অনেক। …বিশ্বপতি মূর্তিটা গলিয়ে নষ্ট করে রত্নগুলি নিয়ে নিত।’

কিকিরা বললেন, “শচীপতিকে এইসব রত্ন কে দিয়েছিল?”

“বাবা।”

“কেন?”

“আমি জানি না। বেধ হয় লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। কিংবা শচীভাই নিজেই চেয়ে নিয়েছিল। অসুস্থ ভাইকে বাবা কষ্ট দিতে চাননি। শচীভাইয়ের বড় জেদ ছিল। তা ছাড়া সে হয়ত নতুন করে আমাদের উপাস্য কুল-দেবতার মূর্তি তৈরি করতে চেয়েছিল বলেই।”

“আপনি এ-সব জানতেন না?”

“আগে জানতাম না। বাবা যখন পাগল হয়ে যান তখন বলেছিলেন।”

 কিকিরা কী ভেবে বললেন, “ওগুলো কি এখনো আছে?”

রঘুপতি যেন বিষণ্ণ মুখে হাসলেন। “আছে।”

তারাপদ আর চন্দন একসঙ্গে হঠাৎ বলে বসল, “বিশ্বপতি কোথায় আছেন?”

“মারা গিয়েছেন। কাশীর গঙ্গায় ডুবে গিয়েছিলেন।”

“কতদিন আগে?”

“বছর দশেক। “

কিকিরা হঠাৎ বললেন, “কমলাপতি রাঠোর কে?”

“আমার ভাই। বিশ্বপতির ছেলে।”

“যে-সাধু আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটার খেলা দেখাত, সে কি কমলাপতি?”

“হ্যাঁ। আমার তাই মনে হয়। …আমি শুনেছিলাম কমলাপতি অনেক অসাধ্য কাজ করতে শিখেছে। তন্ত্রমন্ত্র জানে। আগুনের মাঝখানে সে দাঁড়িয়ে থাকত-হাঁটত। আমার মনে হয়েছিল, কমলাপতিই আমাকে ভয় দেখিয়ে মূর্তিটি নিতে এসেছে।”

“এরকম মনে হত কেন?”

“হত। দূর থেকে যখন ওকে আগুনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম–তখন ওই মূর্তির কথাই মনে হত।”

কিকিরা এবার হাসলেন। বললেন, “রঘুপতিবাবু, আপনি ভুল করেছেন। আগুনের মাঝখানে দাঁড়ানো, তার ওপর দিয়ে হাঁটা-সাধারণ একটা চালাকির খেলা। তন্ত্রমন্ত্র ওতে নেই।”

“খেলা! কী বলছেন?”

“খেলা–ছেলেমানুষি খেলা। আপনাকে আমি কালই দেখাব কেমন করে এই খেলা খেলতে হয়। …আচ্ছা আজই একটু দেখাই,” বলে কিকিরা উঠে পড়লেন। “আমি আসছি, দু-পাঁচ মিনিট।”

কিকিরা চলে গেলেন।

 তারাপদ বলল, “কমলাপতি আপনাকে কিছু জানায়নি? এখানে আসবে?”

“না।”

“আপনি তার খোঁজখবর করতেন।”

“না। সম্পর্ক ওরা রাখেনি। আমিও নয়। তবে মাস কয়েক আগে কে একজন খবর দিল, কমলাপতিদের ব্যবসা ডুবে গিয়েছে। অজস্র দেনা। পুলিশ নাকি তাকে ধরেও নিয়ে গিয়েছিল বার কয়েক, জাল-জালিয়াতির জন্য।”

 চন্দন বলল, “কমলাপতির টাকার খুব দরকার পড়েছিল মনে হচ্ছে।”

“বোধ হয়।”

কিকিরা ফিরে এলেন। দু’হাতে দুটি হাঁড়ি। পায়ে চটি।

হাঁড়ি দুটো চন্দনকে রাখতে দিলেন। দিয়ে একটা হাঁড়ি থেকে কিছু সাদা গুঁড়ো নিয়ে ডান পায়ের পাতার চেটোয় ছড়িয়ে নিলেন ভাল করে। বললেন, “আমি আগেই প্রিপেয়ার হয়ে এসেছি। তবু পায়ে চটিটা ছিল। আবার একবার লাগিয়ে নিলাম।” বলে কাঠকয়লার চুল্লির কাছে এগিয়ে গেলেন। চুল্লির আগুন নিভে আসার মতন। তাত আছে সামান্য।

কিকিরা চুল্লির ওপর পা রাখলেন, তুললেন। আবার রাখলেন, তুললেন। তারপর আরও একটু রাখলেন।

রঘুপতি অবাক হয়ে বললেন, “আগুন নেই?”

“দেখুন।”

 উঠে গিয়ে দেখলেন রঘুপতি। হাত বাড়িয়ে তাত অনুভব করলেন।

কিকিরা বললেন, “আগুনের আঁচ মরে গিয়েছে। তবু যতটুকু আছে–আপনি হাত চেপে রাখতে পারবেন না। আমি পারব।”।

“কেমন করে?”

কিকিরা হাঁড়ি দুটো দেখালেন। বললেন, “এই দুটো হাঁড়িতে কী আছে জানেন? এটাতে রয়েছে ফটকিরি আর নুনের গুঁড়ো। পাউডার করে মিশিয়ে রাখা আছে। আর এই হাঁড়িটায় আছে নুন। আগুনের খেলা দেখাবার সহজ সস্তা দুটো জিনিস। তবে এ দুটো ছাড়া অন্য একটা জিনিস এখানে ছিল রঘুপতিবাবু–যেটা আপনি ধরতে পারেননি।” বলে কিকিরা ঘরের অন্যপাশে সরে গেলেন।

সামান্য দাঁড়িয়ে থেকে কিকিরা হাত দিয়ে সোফা সেটি দেখালেন তাঁর সামনের। বললেন, “ধরে নিন–এই যে সোফাগুলো–এগুলো এক-একটা বড় পাথরের চাঁই। পাহাড়ে নদীর পাড়ে যেমন দেখেন। এই বড় বড় পাথরগুলো যদি আমার সামনে থাকে, আশেপাশেও থাকে আর আমি তার আড়ালে বা মাঝখানে থাকি-”আপনি আমার পা থেকে হাঁটু পর্যন্ত দেখতে পাবেন না। এখন এই ধরনের পাথরগুলোর ওপর আগুন জ্বালানো হল। পাশাপশি, সামান্য ছাড়াছাড়া ভাবে আগুন জ্বালানে পাথরের মাথায়। আগুন জ্বলতে লাগল। আমি থাকলাম পাথরের আড়ালে। সামনে থেকে সামান্য দূর থেকে অবশ্য কেউ যদি আমাকে দেখে–তার মনে হবে আমি আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি।”

রঘুপতি তাকিয়ে থাকলেন। তাঁর মাথায় যেন কিছুই ঢুকছিল না।

কিকিরা হেসে বললেন, “কলকাতার স্টেজে সীতার অগ্নিপরীক্ষা দেখেননি? এটাও হল অগ্নিলীলা।”

“কিন্তু আমি হাঁটতে দেখেছি।”

“আপনি দেখেননি। ওটা আপনার চোখের ভুল। যদি দেখেও থাকেন–তা হলেও ক্ষতি নেই। ধরুন আপনি রয়েছেন পাথরগুলোর আড়ালে। সামনের পাথরগুলোর মাথায় আগুন জ্বলছে জ্বলুক। আপনি যেখানে আছেন সেখানে কিছু কাঠকুটো পাতা সাজিয়ে নিন। সামনের দিকে উঁচু করে পেছনের দিকে নিচু করে। মাঝখানে কাঠকুটো কম রাখবেন। এবার আগুন জ্বালিয়ে দিন। সামনের দিকের কাঠকুটোয় আগুন জোর জ্বলতে থাকবে-পেছনের দিকের কাঠকুঠো ঘাসপাতা টিমটিম করে জ্বলবে। তফাত ওই টিমটিমে আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটুন, একটু তাড়াতাড়ি–কি হবে না আপনার প্র্যাকটিসের ব্যাপার। আর সেইসঙ্গে নুনের গুঁড়ো ছড়াতে থাকুন আগুনে। দেখবেন আগুন নিস্তেজ হয়ে আসছে। এই খেলাটা খুব সাধারণ।…আপনি যা দেখেছেন সেটা খেলা।”

রঘুপতি বললেন, “কে বলল? আপনারা কি দেখেছেন ওই জায়গাটা?”

 কিকিরা বললেন, “আমরা ওখানে গিয়ে সব দেখেছি। তারাপদ-চন্দনকে জিজ্ঞেস করুন। আমরা যতটা পেরেছি দেখেছি সামনে গিয়ে, খুঁজেছি সমস্ত।” বলে কিকিরা তাঁদের ঘোরাফেরা, খোঁজখবর করার কথা বললেন সবিস্তারে। কী কী পেয়েছেন সেখানে হাঁড়ি, দাড়ি, খইনির ছেঁড়া প্যাকেট, চাবির রিংয়ের চাকতি।

রঘুপতি যেন কোনো গল্পকথা শুনছেন, এমনভাবে তাকিয়ে থাকলেন।

খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকার কিকিরা বললেন, “শুধু দুটো ব্যাপার ধরতে পারছি না।”

“কী?”

“যে-লোকটা মারা গেল সে কে?” বলে কিকিরা রঘুপতির চোখে-চোখে তাকিয়ে থাকলেন সামান্য সময়, যেন জবাবটা অন্য পক্ষই দেবেন, “কমলাপতি?”

রঘুপতি চুপ করে আছেন দেখে তারাপদ বলল, “কমলাপতি বলেই মনে হয়।”

কিকিরা বললেন, “লোকটা যেখানে মারা যায়–চুনিয়া নদীতে, পাথরের ওপর–তার বিশ-পঁচিশ গজ দূরে আমি একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ কুড়িয়ে পেয়েছিলুম। ব্যাগের মধ্যে ভারী এই হাতুড়ি ছিল। এটা কোথা থেকে এল?”

রঘুপতি এবারও কোনো কথা বললেন না।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে কিকিরা রঘুপতিকে বললেন, “আপনি সব জানেন। আমাদের বলছেন না। রঘুপতিবাবু, আমরা পুলিশের লোক নই। গোপবাবু আমাকে ধরে বেঁধে এখানে পাঠিয়েছেন। আপনাকে সাহায্য করতেই আমি এসেছিলুম।”

রঘুপতি যেন খানিকটা চঞ্চল হলেন। তাকালেন। মুখ নিচু করলেন আবার। চুপচাপ। নিজের মনে মাথা নাড়লেন। মুখ তুললেন। বললেন, “যে মারা গিয়েছে সে কমলাপতি।” বলে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ভারী গলায় আবার বললেন, “আমি তাকে দেখিনি। তবু বলছি সে কমলাপতি। আর সে কমলাপতিকে মেরেছে সে তার লোক।”

কিকিরা রঘুপতিকে দেখছিলেন। “আপনি কমলাপতিকে দেখেননি। তবু একথা বলছেন কেমন করে?”

“পুজনকে আপনারা দেখেছেন। আমি তাকে খবর করতে পাঠিয়েছিলাম। সে খোঁজখবর করে এসে আমায় বলেছে।”

“কমলাপতির বন্ধুটি কে?”

“জানি না। বেনারস থেকে নিয়ে এসেছিল। ভাড়াটে গুণ্ডা হয়ত।”

“সে কেন কমলাপতিকে খুন করবে?”

“কেন করতে তার জবাব আমি দিতে পারব না। তবে ওই মূর্তির জন্যই। মনে হয়। কমলাপতি বোধ হয় তাকে বলেছিল–মূর্তিটা খুব দামি। লাখ-লাখ টাকা হাতে আসবে মূর্তিটা পেলে। এলে ভাগাভাগি করা যাবে।”

“কিন্তু মূর্তি তো আপনার কাছে। চুরি না করা পর্যন্ত মূর্তি পাবে কোথায়?”

“চুরি করতে আসবে জেনেই আমি মূর্তিটা ছবির ঘরে এনে রেখেছিলাম।..ওটা তো পাশের ঘরে চোরা সিন্দুকের মধ্যে থাকার কথা।”

“আপনি কি চোর ধরতে চাইছিলেন?”

“না। আমি চাইছিলাম চোর ওটা নিয়ে যাক।”

 কিকিরা অবাক। তারাপদ আর চন্দনও কিছু বুঝতে না পেরে রঘুপতির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।

রঘুপতি নিজেই বললেন, “কমলাপতিকে যেদিন মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়, তার আগের দিন রাত্তিরে চোর এসেছিল এবাড়িতে। আমার কুকুরটাকে বিষ খাইয়ে দিয়েছিল রুটির টুকরোর সঙ্গে। কুকুরটা মারা যায় পরের পরের দিন। বুনো কুকুর বলে লড়েছিল দুদিন, নয়ত আগেই মারা যেত।”

চন্দন বলল, “আপনি কি বলতে চাইছেন কমলাপতিকে খুন করে সেদিন রাত্তিরেই তার বন্ধু এ বাড়িতে মূর্তি চুরি করতে এসেছিল?”

“হ্যাঁ।”

“এর কোনো প্রমাণ আছে?”

 “কুকুর ছাড়াও প্রমাণ আছে। বাড়ির কাজের লোকরা জেগে উঠেছিল…। তারা একটা লোককে পালিয়ে যেতে দেখেছে।”

কিকিরা বললেন, “একটা কথা, রঘুপতিবাবু। যে-মূর্তি চোরাই সিন্দুকের মধ্যে ছিল সেই মূর্তি আপনি ছবিঘরে এনে রাখলেন কেন? তা ছাড়া আপনার ছবিঘরের দরজার তালা ভেঙে ভেতরে মূর্তি চুরি করবে–এ প্রায় দুঃসাধ্য কর্ম।“

রঘুপতি বললেন, “আপনাদের কাছে দুঃসাধ্য কর্ম। এ বাড়ির খোঁজখবর যারা ভাল রাখে তাদের কাছে নয়। ছবিঘরে যাওয়ার একটা অন্য পথও আছে। পেছনদিক থেকে। ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ওঠা যায়। উঠে একটা মামুলি দরজা পাবে। পাকা চোরের পক্ষে সে-দরজা ভাঙা সহজ।…কমলাপতি এ-সব জানত। তার বাবার কাছে শুনেছে। সে এ বাড়ির নাড়িনক্ষত্র জেনে নিয়েছিল।”

“কিন্তু আপনি কি তাকে মূর্তিটা দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন?”

 রঘুপতি কিছু বললেন না প্রথমে। তারপর দ্বিধার সঙ্গে বললেন, “আমি একটা কথা আপনাদের ঠিক বলিনি। আমি বলেছিলাম কমলাপতি আমাকে জানায়নি সে এখানে আসছে। না না।…। সে জানিয়েছিল। আমিও তাকে মূর্তিটা দিতে চেয়েছিলাম।”

“কিন্তু কেন?”

রঘুপতি আর কথা বলেন না। তাঁর গলার কাছটা ফুলে উঠল, মুখের মাংসগুলো কাঁপছিল। নিজেকে যেন প্রাণপণে সংযত করার চেষ্টা করছিলেন। শেষে বললেন, “আমি আপনাদের সব কথা বলিনি, বলতে চাইনি। এখন আর না বলে উপায় নেই।…ওই কমলাপতি আমাকে কলকাতায় চিঠি লিখে লিখে বিরক্ত করছিল। ভয় দেখাচ্ছিল। শেষে ও আমার ছোট ছেলেকে চিঠি লিখল। সে বেচারি পঙ্গু। পোলিও ভিকটিম। কমলাপতি তাকে জীবনের ভয় দেখাল। নিজের রুগ্ন ছেলেটাকে প্রাচে বাঁচাতে আমি শেষ পর্যন্ত তার কথায় রাজি হলাম। আমার লোক তাকে জানিয়ে দিল শীতকালে যখন আমি ময়ূরগঞ্জে আসব–তখন সে যোগাযোগ করতে পারে। তবে লুকিয়ে। সরাসরি আমি তার মুখ দেখতে চাই না, তার হাতে ওই মূর্তিও তুলে দিতে পারব না। সে ক্ষমতা আমার নেই। শচীভাইয়ের তৈরি মূর্তি বাড়ির জিনিস–যতই তা অমঙ্গলের হোক–আমি চোরবদমাশ নচ্ছারের হাতে তুলে দিতে পারব না বাড়ির জিনিস। সে নিজে এসে নিয়ে যেতে পারে নিয়ে যাক। আমি অন্তত বাধা দেব না।”

রঘুপতি নীরব হলেন। তাঁর দুটি চোখ যেন জলে ভরে এসেছে।

 কিকিরা প্রথমে কিছু বললেন না, পরে বললেন, “রঘুপতিবাবু, আমরা একটা লোকের খবর পেয়েছিলুম। দু’নম্বরটা এল কোথা থেকে? মানে কমলাপতির বন্ধু-বা ভাড়া করা লোক।”

“একসঙ্গেই এসেছিল বোধ হয়। তবে ঘোরাফেরা করেনি একসঙ্গে পাছে লোকে সন্দেহ করে, দেখতে পায়। বা মুখ চিনে রাখে।” রঘুপতি মাথা নাড়লেন–নিজের মনেই, “এখানে কোনো হোটেল নেই।পিনুর গেস্ট হাউস বলে একটা বাড়ি আছে। হঠাৎ কেউ এসে পড়লে থাকতে পারে দু-দশ দিন। খাওয়া-দাওয়া বাইরে। আপনি সেখানে খোঁজ নিলে দেখতে পাবেন “খইনি-খাওয়া একটা লোক ওই সময় ওখানে এসে কিছুদিন ছিল। লোকটাকে দেখতে ষণ্ডার মতন। বলত, সে জি আর পি-তে কাজ করে মোগলসরাইয়ে। নাম বলত, কেদার।…এসব খবর আমাকে জোগাড় করতে হয়েছে। পুজনই জোগাড় করেছে।”

“সেই লোক আর নেই?”

“না। কমলাপতি মারা যাওয়ার পরের দিনই সে চলে গেছে। মানে খবরটা জানাজানি হওয়ার পরের দিন।”

কিকিরা কিছুক্ষণ বসে থাকার পর উঠে পড়লেন ধীরে-ধীরে। বললেন, “মূর্তিটা তা হলে আপনার কাছেই থেকে গেল।”

“থাকল। ওটা আবার ঠিক জায়গায় রেখে দেব। বলে রঘুপতিও উঠে দাঁড়ালেন। “আমি জানতাম আপনারা কেন এসেছেন। গোপ আমায় জানিয়েছিল। কী করছেন তাও জানতাম। ছবিঘর যে আপনারা দেখতে চাইবেন–তাও বুঝতে পেরেছিলাম। মূর্তিটা তাই তুলে রাখিনি। এবার রেখে দেব।”

“ওটা বিদায় করা যায় না?”

“কোথায় আর গেল!…আপনারা বিশ্বাস করুন, কমলাপতি আমার ভাই। সম্পর্ক থাক না থাক–সে যতবড় বদমাইশ হোক–এমন করে সে মারা যাবে আমি কল্পনাও করিনি। বংশের আরও একজন গেল। এর পর হয়ত আমার পালা।“

তারাপদরাও উঠে দাঁড়িয়েছিল।

 রঘুপতি বললেন, “অনেক রাত হয়ে গেল।”

কিকিরা বললেন, “রঘুপতিবাবু আপনি সব বলেও একটা কথা বললেন না। মূর্তিটা আপনি বোধ হয় কমলাপতিকে দিতে চাননি। আপনি চেয়েছিলেন সে ওই মূর্তি নিতে আসুক কিন্তু নিয়ে যেতে যেন না পারে।”

রঘুপতি অপলকে চেয়ে থাকলেন।

কিকিরা বললেন, “আপনার রুগ্ন পঙ্গু ছেলেকে যে ভয় দেখায় সে নিশ্চয় অমানুষ পশু। কাকা হয়েও সে এমন কাজ করতে পারে! আমার মনে হয় আপনি ঠিক করেছিলেন কমলাপতি মূর্তিটা নিতে এলে আপনি তাকে গুলি করে মারবেন। আপনার সৌভাগ্য এই কাজটা আপনাকে আর করতে হল না। কমলাপতির সঙ্গী সেই গুণ্ডাটাই করে গেল।”

রঘুপতি নির্বাক। তাঁর সমস্ত মুখ যেন আবেগে থরথর করে কেঁপে উঠছিল। তিনি কিছু বলতে পারছিলেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *