সাকার্স থেকে পালিয়ে

সাকার্স থেকে পালিয়ে

০১.

শীত তখনো ফুরিয়ে যায়নি। মাঘের শেষ। এক-একদিন মনে হয়, এই বুঝি শীত গেল, বসন্ত এল। আবার কোনো কোনো দিন শীতের ছোঁয়া থাকে বাতাসে।

সেদিন সামান্য শীত শীত ভাব ছিল। কিকিরা নিজের ঘরে বসে কী যেন করছিলেন। ড্রয়িং পেপার, পেনসিল, স্কেল, কম্পাস, রঙিন সিসকলম সামনে সাজানো রয়েছে। বাতি জ্বলছিল। ডেস্কের মতন এক কাঠের হেলানো তক্তা তাঁর হাতের কাছে।

এমন সময় সদরে ডোর-বেলের শব্দ। তারপরই তারাপদর গলা। বগলার সঙ্গে কথা বলছে তারাপদ।

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই তারাপদ আর চন্দন ঘরে এল।

কিকিরা হাতের কাজে সারতে-সারতে আড়চোখে যেন দুজনকে দেখে নিলেন। মুখে বললেন, “হ্যালো?”

তারাপদ দু’ পা এগিয়ে এসে একটু ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখল। বলল, “স্যার, আপনি যেন খুব ব্যস্ত?”

কিকিরা বললেন, “খুব নয়, অল্প-স্বল্প। বোসো। তারপর কী খবর তোমাদের?”

দিন দশেক এদিকে আর আসা হয়নি তারাপদদের। হপ্তায় অন্তত একবার এ বাড়িতে না এলে কিকিরা বেশ অখুশি হন। অভিমানু হয় তাঁর। চাঁদু ডাক্তার, সে তার হাসপাতালের দোহাই দিয়ে পার পেয়ে যায়। তারাপদ নিছক কেরানি। তার কোনো কৈফিয়ত কিকিরা কানে তোলেন না।

তারাপদ আর চন্দন বসল।

তারাপদ বলল, “খবর অনেক, স্যার। প্রথম খবর, আমি সর্দি-জ্বরে দিন চারেক কাবু হয়ে পড়ে ছিলাম। দ্বিতীয় খবর, চাঁদু একটা ঝাট বয়ে এনেছে। আপনি তো আপাতত বেকার…।”

চন্দন বলল, “আমাদের কথা পরে বলছি। আপনার খবর কী? ওটা আপনি কী করছেন?”

“ড্রয়িং।” কিকিরা গম্ভীর গলায় বললেন

। “ড্রয়িং! হঠাৎ ড্রয়িং কেন? কিসের ড্রয়িং?”

“খাঁচা। “

“খাঁচা?…বলেন কী! সন্ধেবেলা বসে বসে খাঁচা আঁকছেন?”

তারাপদ তামাশার গলায় বলল, “খাঁচা আঁকতে অত সাজ-সরঞ্জাম লাগে নাকি, কিকিরা? এ কোন খাঁচা? বাঘের খাঁচা নিশ্চয় নয়।”

কিকিরা বললেন, “খাঁচার তুমি কী বোঝ? খাঁচার কত ভ্যারাইটি আছে জান? বর্মি-খাঁচা দেখেছ? তিব্বতি-খাঁচা? ইউ নো নাথিং।”

তারাপদ হাত জোড় করে বলল, “ভেরি সরি সার। আমি কিছু জানি না। এখন দয়া করে বলুন, এই বয়েসে হঠাৎ রং পেনসিল নিয়ে খাঁচা আঁকবার শখ হল কেন? আমরা তো ওয়ান-টু ক্লাসে পড়ার সময় এইসব এঁকেছি চায়ের কেটলি, কলা, কমলালেবু, কাপ-ডিশ, গেলাস, খাঁচা…!”

কিকিরা এবার মুখ তুললেন। বললেন, “এ তোমার ওয়ান-টু ক্লাসের খাঁচা নয়। এ হল ম্যাজিক-খাঁচা। ম্যাজিশিয়ানস কেজ।”

“মানে?”

“মানে, ম্যাজিক দেখাবার খাঁচা, ম্যাজিশিয়ানদের খেলা দেখাবার খাঁচা।”

“ও!..তা এতে কী খেলা দেখানো হবে, সার?”

“হবে।” মাথা নাড়তে নাড়তে কিকিরা বললেন, “প্রথমে এই খাঁচায় একটা পাখি থাকবে। ছোট্ট পাখি। পাখি সমেত খাঁচাটা তোমাকে দেখানো হবে। তারপর একটা কালো কাপড় ঢাকা দেব খাঁচার ওপর। দু-চারটে বোলচাল দিয়ে যেই না কাপড়টা তুলব, দেখবে খাঁচা আছে–পাখি নেই। নো বার্ড অনলি খাঁচা। “

তারাপদ বলল, “বাঃ! পাখি ফুড়ত?”

“নো স্যার। আবার কালো কাপড়টা ঢাকা দেব। দু-পাঁচটা বাত-চিত হবে। কাপড়টা তুলে নেব খাঁচার ওপর থেকে; দ্য বার্ড ইজ দেয়ার..”

তারাপদ মজার গলায় বলল, “দারুণ! খাঁচার পাখি ছিল খাঁচায়–তারপর ভ্যানিশ। আবার দেখতে-দেখতে খাঁচায়। তা স্যার আপনি কি আবার খেলা দেখাবেন ভাবছেন নাকি?”

“না-না, আমি কেন দেখাব! হরেন দেখাবে। আমি সব তৈরি করে দিচ্ছি। এ হল ধোঁকাবাজির ব্যাপার। কল-কৌশলের খেলা। চালাকি আর বোকা বানানোর খেলা। খাঁচাটাই আসল। কায়দা করে তৈরি করাতে হয়। আমি ড্রয়িং করে দিচ্ছি, শিয়ালদার সুরি লেনের গঙ্গাপদ খাঁচাটা তৈরি করে দেবে। গঙ্গা হল কলকাতার এক নম্বর মিস্ত্রি, ম্যাজিকঅলাদের মিস্ত্রি।”

চন্দন বলল, “হরেন আবার কে?”

“ছোকরা ম্যাজিশিয়ান। অ্যামেচার। ব্যাঙ্কে কাজ করে। মাঝে-মাঝে ম্যাজিক দেখায় ছোটখাট জায়গায়। আমার কাছে আসে মাঝেসাঝে। “

এমন সময় চা এল। বগলা চা নিয়ে এসেছে।

চা নিতে নিতে তারাপদ দলল, “কিকিরা-সার, চাঁদু আপনার জন্যে একটা কেস নিয়ে এসেছে। ভেরি ইন্টারেস্টিং…।”

কিকিরা চা নিলেন। সরিয়ে রাখলেন ডেস্ক। বগলাই সরিয়ে রাখল।

বগলা চলে যাওয়ার পর কিকিরা চন্দনের মুখের দিকে তাকালেন। যেন বোঝবার চেষ্টা করছিলেন–কথাটা ঠিক, না বেঠিক।

চন্দন মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ, স্যার।”

চায়ে চুমুক দিলেন কিকিরা। মুখ তুলে আবার তাকালেন। চোখে কৌতূহল। “কী কেস?”

চন্দন বলল, “সার্কাসের এক ছোকরার কেস স্যার।”

“সার্কাস?”

“গোল্ডেন সার্কাস। এখন মাকাস স্কোয়ারে খেলা দেখাচ্ছে।”

“গোল্ডেন সার্কাস!..ও! কাগজে যেন বিজ্ঞাপন দেখেছি। নতুন বলে মনে হচ্ছে।

“একেবারে নতুন নয়। বছর পাঁচ-সাতের সার্কাস। বাঙালি মালিক, সার। সার্কাস খুব বড় নয়, আবার একেবারে ছোটও নয়। আসলে পুরনো অনেক সার্কাস তো ভেঙে গিয়েছে। তারই কিছু কিছু খেলোয়াড় নিয়ে এই সার্কাস। এরা কলকাতায় বড় আসে না। পাত্তা পাবে না বলে। মফস্বল শহরেই বেশি ঘুরে বেড়ায়। কলকাতায় এক-আধবার আগে এসেছে। সুবিধে করতে পারেনি। এবারে এসে মাকাস স্কোয়ারে তাঁবু ফেলেছে।…সেই সার্কাসের এক ছোকরা…”

কিকিরা বললেন, “কী করে ছোকরা সার্কাসে?”

“খেলা দেখায়। খেলোয়াড়।”

“কিসের খেলা দেখায়?”

 চন্দন বলল, “মোটর সাইকেলের। নাম অনিল। পুরো নাম অনিল ভৌমিক। সার্কাসে অনেকে ওকে ঠাট্টা করে “অলিভার বলে ডাকে। আসলে ওরা বাঙালি ক্রিশ্চান। অনিলের বয়েস বছর পঁচিশ-ছাব্বিশ। দেখতে ছিপছিপে। গায়ের রং কালো। মাথার চুল কোঁকড়ানো।”

কিকিরা বাধা দিয়ে বললেন, “ডেসক্রিপশন পরে; আগে কী হয়েছে শুনি।”

চন্দন একবার তারাপদর দিকে তাকাল। যেন তারাপদই বলবে ঘটনাটা। শেষে নিজেই বলল, “সার্কাস থেকে অনিল পালিয়ে এসেছে। ওকে বেশ কিছুদিন ধরে একটা লোক খুন করার চেষ্টা করছিল। মানে, হুমকি দিচ্ছিল। বারবার থ্রেট করায় ও ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছে।”

কিকিরা বললেন, “কে হুমকি দিচ্ছিল?”

“সার্কাসেরই অন্য একটা লোক। সেও খেলোয়াড়। পুরনো খেলোয়াড়। সেই লোকটাও মোটর সাইকেল নিয়ে খেলা দেখায়। তার নাম কৃষ্ণমূর্তি। সার্কাসে তাকে সবাই মাস্টার বলে ডাকে। লোকটার দারুণ দাপট সার্কাসে।”

কিকিরা চা খেতে-খেতে তাঁর সেই সরু ধরনের চুরুট ধরালেন। বললেন, “আরও একটু খুলে বলল। ঠিক ধরতে পারছি না।”

 চন্দন ঘটনাটা যা বলল তা মোটামুটি এইরকম :

অনিল আজ বছর দুই হল সার্কাসে গিয়েছে। কৃষ্ণমূর্তি পুরনো লোক। গোল্ডেন সার্কাসের গোড়া থেকেই সে ওই দলে আছে। কৃষ্ণমূর্তি আর অনিল দু’জনেই মোটর সাইকেল নিয়ে খেলা দেখাত সার্কাসে। কৃষ্ণমূতির দেখাত পুরনো খেলা : একটা মস্ত বড় গোল খাঁচা বা গ্লোবের মধ্যে মোটর বাইক নিয়ে বন বন করে ঘুরত। নিচে, ওপরে, পাশে পাক খেত। খুবই চমকপ্রদ খেলা। ভয়ের খেলা। আর অনিল যে-খেলা দেখাত মোটর বাইক নিগে, সেটা অন্যরকম। অনিল খেলা দেখাত ফাঁকায়, সার্কাস রিঙের মধ্যে। একটার পর একটা বাধা টপকানোর খেলা, যেমন প্রথমে টপকাত সার দিয়ে সাজিয়ে রাখা চারটে ড্রাম, তারপর টপকাত আগুন, তারপর জোড়া কাচের দরজা। জোড়া। কাচের দরজা মানে দুটো বিশাল কাঁচ দুদিকে “A’ অক্ষরের মতন সাজানো থাকত, তার তলা দিয়ে গলে যেত হাই স্পিডে। শেষপর্যন্ত ছিল, স্পট জাম্প।…অনিলের এই খেলাগুলো নতুন ধরনের। সচরাচর কোনো সার্কাসে দেখা যায় না। গ্লোবের মধ্যে মোটর সাইকেল নিয়ে পাক মারার খেলাটা যতই কেননা চমকপ্রদ হোক, খেলাটা এখন পুরনো হয়ে গিয়েছে। প্রায় সব সার্কাসেই এটা দেখা যায় আজকাল। বোধ হয় তার ফলে, অনিলের খেলা নতুন ধরনের বলে, দর্শকদের ভাল লাগত বেশি, হাততালির ঝড় উঠত। সার্কাসে অনিলের কদর বেড়ে যাচ্ছিল। কৃষ্ণমূর্তি মাস্টারের এটা পছন্দ হয়নি। প্রথমে সে অনিলকে হিংসে করতে শুরু করে। ঘৃণা করত শেষে তার পেছনে লাগে। এমনকী দু-একবার তাকে জখম করার চেষ্টাও করেছিল। আর হালে তো অনিলকে ক্রমাগত শাসাচ্ছিল। বলছিল, ছোকরাটাকে সে খতম করে। দেবে। অনিলের আর সাহস হয়নি। সে ভয় পেয়ে সার্কাস ছেড়ে পালিয়ে এসেছে।

কিকিরা মন দিয়ে সব শুনছিলেন। মাঝে-মাঝে মাথাও নাড়ছিলেন।

তারাপদ বলল, “আমি চাঁদুকে বলেছিলাম, অনিলকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে। সে থাকলে, আপনি ভাল করে সব শুনতে পেতেন।”

কিকিরা চন্দনকে বললেন, “তুমি ওই অনিল ছোকরাকে চেনো?”

 চন্দন মাথা নাড়ল। “আগে চিনতাম না। আজ ক’দিন হল চিনেছি।”

“কেমন করে?”

“আমাদের হাসপাতালে এক সিনিয়র সিস্টার আছেন। নাম মায়া। আমরা তাঁকে মায়াদি বলি। অনিল মায়াদির ভাই।”

“এই সিস্টার তোমাকে তাঁর ভাইয়ের কথা বলেছেন?”

“হ্যাঁ। আসলে গত সোমবার আমি হাসপাতালে ছিলাম। নিজের ওয়ার্ড ছেড়ে একটু অন্য দরকারে ইমার্জেন্সিতে গিওগছিলাম। ফেরার সময় মায়াদির সঙ্গে দেখা। ছোকরা মতন একজনের সঙ্গে মায়াদি কথা বলছিলেন। তার ডান হাতে ব্যান্ডেজ। আমাকে দেখে ছোকরা তাড়াতাড়ি চলে গেল। মায়াদিকে বললাম, কী ব্যাপার? মায়াদি তখন আমাকে কথায় কথায় বললেন ব্যাপারটা।”

“ব্যান্ডেজ কেন?”

“চোট পেয়েছিল।”

“তারপর?”

“তারপর পরের দিন মায়াদি আমাকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে গেলেন। সেখানে অনিলকে দেখলাম।”

“কোথায় ধরে নিয়ে গেলেন?”

“তালতলা। মায়াদির বাড়িতে সে থাকছে না ভয়ে। তালতলায় অন্য একটা বাড়িতে অনিল লুকিয়ে রয়েছে। বাড়িটায় নানা ধরনের লোক। অনিল এক বুড়ির কাছে শেল্টার নিয়েছে। ওদের চেনাজানা।”

কিকিরা কী যেন ভাবছিলেন। পরে বললেন, “আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না চাঁদু। অনিলকে তাদের সার্কাস পার্টির একটা লোক ভয় দেখাচ্ছে, মেরে ফেলব বলছে। মেরে ফেলব, খুন করব বললেই তো মেরে ফেলা যায় না। তা অনিল কেন কথাটা সার্কাসের মালিক বা ম্যানেজারকে বলল না। সে পালিয়ে এল কেন?

চন্দন বলল, “না পালিয়ে এলে তার হয়ত বড় বিপদ হত। কৃষ্ণমূর্তি শুধু পুরনো লোকই নয়, সার্কাসে তার ভীষণ ক্ষমতা। তা ছাড়া লোকটা নাকি নটোরিয়াস।”

“ভাল কথা। তা অনিল সরাসরি সার্কাস ছেড়ে চলে এলে পারত। চাকরি ছেড়ে। পালিয়ে এল কেন?”

“অনিল আপনাকে ভাল বলতে পারবে। আমায় যা বলল, তাতে মনে হল, সার্কাস দলের সঙ্গে ওর যা কনট্রাক্ট তাতে ও জখম, অসুস্থ বা বড় কোনো কারণ না ঘটলে খেলা দেখাতে বাধ্য। খেলা না দেখালে খেসারত দিতে হবে। টাকাটাও কম নয়।”

তারাপদ বলল, “কিকিরা আমার মনে হয়, অনিল যেরকম আপসেট হয়ে পড়েছিল–তাতে ওভাবে খেলা দেখানো যায় না। এসব খেলায় লাইফ রিস্ক। সেন্ট পার্সেন্ট কনসেনট্রেশান দরকার। মন ঠিক না থাকলে, যে-কোনো সময়ে একটা বিশ্রী রকম গণ্ডগোল হয়ে যেতে পারে। অনিল হয়ত সত্যিই বড় রকম জখম হত, মারা পড়ত।”

কিকিরা কিছু বললেন না।

সামান্য অপেক্ষা করে চন্দন বলল, “স্যার, আমি কি অনিলকে নিয়ে আসব এখানে? বা অন্য কোথাও যদি বলেন–তাকে ধরে আনতে পারি।”

কিকিরা ভাবলেন সামান্য। বললেন, “তুমি কি তাকে কিছু বলেছ?”

“না,” মাথা নাড়ল চন্দন, “স্পষ্ট কিছু বলিনি তাকে। তবে মায়াদিকে বলেছি। আপনার কথা বলেছি। মায়াদি আমার কথায় ভরসা করে বসে আছেন।”

তারাপদ বলল, “কেসটা নিয়ে নিন কিকিরা। এর আগে আপনি একজন জাদুকরের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। যদিও সে-বেচারি আগেই খুন হয়েছিল। এটা অবশ্য সার্কাস-খেলোয়াড়দের কে। এ এখনো বেঁচে আছে, হয়ত পরে আর বেঁচে থাকবে না।”

কিকিরা যেন একটু অসন্তুষ্ট হলেন। “কেন বেঁচে থাকবে না? সার্কাস ছেড়ে একজন পালিয়ে এসেছে বলে সে বেঁচে থাকবে না? এটা কি একটা কথা হল? অনিল নিশ্চয় ভয় পাচ্ছে। কিন্তু তার ভয় পাওয়ার পেছনে কতটা মনগড়া ব্যাপার আছে–আমরা তো জানি না। তা ছাড়া সে এভাবে লুকিয়ে থাকবে কেন? সার্কাসের লোক কি এই কলকাতা শহরে তাকে তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছে! আমার তো তা মনে হয় না। এত বড় কলকাতা শহরে লাখ লাখ লোকের ভিড়ে অনিলকে কেউ খুঁজে বেড়াবে। …পালিয়ে আসার যেকারণটা বলছে সেটা ছুতোও হতে পারে। অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। তবু আমি ধরে নিচ্ছি-অনিল যা বলছে তা সত্যি। কিন্তু একটা লোকের শাসানির ভয়ে খেলা দেখানো ছেড়ে পালিয়ে আসবে?”

চন্দন বলল, “আপনি ঠিকই বলেছেন। ঠিক এই কথাই আমি মায়াদি আর অনিলকে বলেছি। কিন্তু অনিলের ধারণা, কৃষ্ণমূর্তি সাঙ্ঘাতিক লোক। তার নানা ঘাঁটি আছে, চেনাজানা আছে কলকাতা শহরে সে নিশ্চয় অনিলের খোঁজ চালাচ্ছে।”

কিকিরা কী ভাবলেন। তারপর বললেন, “দেখা চাঁদু, সার্কাস পার্টি এক জায়গায় বেশিদিন থাকে না। দিন কতক পরে তারা এখান থেকে চলে যাবে। তখন আর কে অনিলের খোঁজ করতে আসছে! অনিল যেমন গা-ঢাকা দিয়ে আছে–সেইভাবেই না-হয় থেকে যাক দশ-পনেরোটা দিন। তারপর আর তার ভয়ের কিছু থাকবে না।”

চন্দন বলল, “হ্যাঁ, তা ঠিক। তবু আমার মনে হচ্ছে, সার্কাস, সার্কাস পার্টি, কৃষ্ণমূর্তি, অনিল–এদের মধ্যে অন্য কিছু ব্যাপার আছে। লুকনো ব্যাপার। সেটা আমাদের খোঁজ করে দেখলে ভাল হয়।”

কিকিরা ভাবলেন কিছু সময়। বললেন, “বেশ, অনিলকে তবে নিয়ে আসতে পারো। এখানেই নিয়ে এসে তাকে। কাল-পরশু, যেদিন সুবিধে হয়। “

.

০২.

পরের দিন, তার পরের দিন তারাপদরা অনিলকে নিয়ে হাজির। কিকিরা বাড়িতেই ছিলেন। আজ আর খাঁচার ছবি আঁকছিলেন না, বসে বসে গান শুনছিলেন। তাঁর সেই চোঙঅলা পুরনো গ্রামোফোনে কোন আদ্যিকালের এক রেকর্ড চাপিয়ে গান শুনছিলেন। যেমন গ্রামোফোন, তেমনই রেকর্ড। রেকর্ড থেকে খসখসে, অস্পষ্ট এক আওয়াজ বেরোচ্ছিল, গানের সুর বা কথা কিছুই। বোঝা যাচ্ছিল না।

তারাপদ বলল, “ওটা কার গান শুনছেন, স্যার?”

কিকিরা বললেন, “গান নয়, বেয়ালা।”

“বেয়ালা?”

“ওই যাকে তোমরা বলো বেহালা। আগেকার বুড়োরা বলত, বেয়ালা। প্রোফেসর মদন শীলের বেয়ালা শুনছি। মদন শীল ছিলেন জেনাফোন রেকর্ড কোম্পানির মিউজিক টিচার।”

তারাপদ বিনয় করে বলল, “গলা না বেয়ালা বোঝা যাচ্ছে না সার, ভেরি সরি। মদনকে এখন বন্ধ করে দি’? কী বলেন! অনিলকে এনেছি।” বলে চোখের ইশারায় অনিলকে দেখাল।

কিকিরা নিজেই উঠলেন। গ্রামোফোন বন্ধ করলেন। পুরনো রেকর্ডটা জায়গা মতন রাখতে রাখতে বললেন, “তোমরা পুরনো জিনিসের কদর জানো না! যত্তসব আজকালকার সিনেমার গান নিয়ে নেচে বেড়াও। এই করে দেশটা গেল।” বলতে বলতে তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন। হাত বাড়িয়ে চন্দনদের বসতে বললেন।

চন্দন অনিলকে বসতে বলল।

কিকিরা বললেন, “কাল না এসে ভালই করেছ। আমি একবার বেরিয়েছিলাম। ফিরতে-ফিরতে সাতটা বেজে গেল। অবশ্য তোমরা বসে থাকলে দেখাত। বগলাকে বলে গিয়েছিলাম।”

চন্দন বলল, “কাল আর হল না। স্যার, এই হল অনিল।” কিকিরা অনিলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক মুহূর্ত, দেখছিলেন যেন ছেলেটিকে। হাতের কব্জির কাছে একটা ব্যান্ডেজ। ক্রেপ ব্যান্ডেজ। কী মনে করে মুচকি হাসলেন। “অলিভার দ্য জাম্পার!”

অনিল কেমন যেন একটু চমকে উঠল। কিকিরাকে দেখছিল।

কিকিরা বললেন, “তোমাদের সার্কাসের বাইরে বড়বড় দুটো ছবি দেখলাম। কাপড়ের ওপর রংচং করে আঁকা। ট্রাপিজ, বাঘ, সিংহ, এক চাকা সাইকেল, ক্লাউন, তোমাদের খেলা দেখাবার ছবিও।…হ্যান্ডবিলও পেয়েছি হে।“

অনিল বুঝতে পারল। সার্কাস থিয়েটার-সিনেমা নয়। সেখানে কারও নাম থাকে না। খুব বিখ্যাত হলে অন্য কথা। অবশ্য হ্যান্ডবিলে সত্যিই তার নাম থাকে অলিভার দ্য জাম্পার বলে। কিন্তু অনিল তো খেলা দেখাচ্ছে না কদিন। পুরনো হ্যান্ডবিল পেয়েছেন বোধ হয় ভদ্রলোক। কিংবা ওরা ইচ্ছে। করেই নামটা কাটেনি।

তারাপদ বলল, “আপনি এর মধ্যে সার্কাসেও ঘুরে এসেছেন?”

হাসি-হাসি মুখে কিকিরা বললেন, “একবার ভিজিট করে এলাম। দেদার হোর্ডিং পোস্টার এঁটেছে বাইরে। রাস্তাতেও দু-চারটে হোর্ডিং দেখলাম। সার্কাসটা জমিয়ে ফেলেছে মনে হল।”

“আপনি কি সার্কাস দেখলেন?” চন্দন বলল।“

“না। এখনো দেখিনি। একদিন যাব দেখতে তোমাদের নিয়ে।”

“তা হলে আপনি কেন গিয়েছিলেন?”

কিকিরা নিজের জায়গায় বসতে বসতে বললেন, “খোঁজ-খবর করতে। একবার দেখে আসা ভাল। …তুমি কখনো ফিশিং, মানে মাছ ধরতে গিয়েছ, চাঁদু?”

“না।” মাথা নাড়ল চন্দন।

 “যারা মাছধরার নেশায় মেতেছে তারা কোথাও মাছ ধরতে গেলে আগে পুকুর, দিঘি, খাল বা নদীর খোঁজখবর করে আসে, দেখে আসে। যেখানে-সেখানে ছিপ ফেললেই তো ফিশিং হয় না হে! আগেভাগে খোঁজখবর করে দেখে আসতে হয়।”

তারাপদ বলল, “আপনি কী দেখে এলেন?”

 কিকিরা ধীরেসুস্থে, যেন গল্প শোনাচ্ছেন, হালকা ভাবে বললেন, “আমি কাল বিকেল-বিকেল মাকাস স্কোয়ারে গেলাম। কাল দুটো শো ছিল। প্রথম শো চলছে তখন। বাইরে তেমন একটা ভিড়ও নেই। সেকেন্ড শো ছ’টায়। আমি গিয়েছিলাম পাঁচটা নাগাদ। দেখলাম, তাঁবুর এখানে-ওখানে কটা রঙিন পতাকা উড়ছে, টিকিট কাউন্টারের কাছে কয়েকটা লোক, আশেপাশে কিছু ছেলে-ছোকরা, এক দঙ্গল বাচ্চা, সার্কাসের একটা ছোট তাঁবুবোধ হয় বাইরের অফিস। একজোড়া কাঠের রংকা রেলিং সামনে। একটা লোক ফোল্ডিং চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে ছিল। আশেপাশে পান-বিড়ি, ভাঁড়ের চা, গেলাবাদামের ফেরিঅলা।”

কিকিরা ছোট করে গোল্ডেন সার্কাসের আশপাশের বিবরণ দেওয়া শেষ করেছেন সবে, তারাপদ বলল, “আপনি শুধু এইসব দেখলেন?”

“না-না, দু-পাঁচটা খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করলাম।”

“কী খোঁজ পেলেন?”

“গোল্ডেন সার্কাসে যে ভদ্রলোক ম্যাজিক দেখান, তাঁর নাম আদিনাথ মজুমদার।

“বাঃ, স্যার, এখানেও ম্যাজিক?”

“এখানেও মানে! তুমি কি জীবনে সার্কাস-টাকাস দেখোনি। প্রত্যেক সার্কাসে একজন করে ম্যাজিশিয়ান থাকে। তারা খেলা দেখায়। হাত সাফাইয়ের খেলা। কেউ টুপির মধ্যে থেকে পায়রা বের করে, কেউ আধ বালতি জল খেয়ে আবার সেটা বের করে, কেউ জ্যান্ত মাছ মুখের মধ্যে পুরে দেয়, আবার বের করে নেয়..”

চন্দন বলল, “আমি দেখেছি স্যার।”

কিকিরা বললেন, “ভাল-ভাল সার্কাসে বড় দরের ম্যাজিশিয়ান রাখে। শুধু ম্যাজিশিয়ান কেন, অনেক রকম খেলোয়াড় রাখতে হয়। কেউ সাইকেলের খেলা দেখায়, কেউ দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটে, কেউ জিমনাস্টিক খেলা দেখায়।”

তারাপদ জানে সবই। বলল, “তা আদিনাথ কি আপনার চেনা নাকি?”

“না। ও-নাম আমি শুনিনি।”

“তা হলে?”

“জাতভাইয়ের খোঁজটা নিয়ে এলাম তারাবাবু। কাকে কখন কাজে লেগে যায়।”

“আর কী করলেন?”

“অলিভার দ্য জাম্পারের খেলাটার খবরও নিলাম। শুনলাম জাম্পারের অসুখ বলে খেলাটা এখন দেখানো হচ্ছে না। তার বদলে অন্য খেলা দেখাবার ব্যবস্থা হয়েছে।” বলে কিকিরা অনিলের দিকে তাকালেন।

অনিল কোনো কথাই বলছিল না। কিকিরাকে দেখছিল। তার কিছুতেই মাথায় ঢুকছিল না, এই রোগা লম্বা মামুলি একটা লোক তার কোন উপকার করতে পারে? ভদ্রলোককে দেখলে হয়ত মজাদার মানুষ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এই লোকটির ক্ষমতা কতটুকু? অনিলের মোটেই ইচ্ছে ছিল না এখানে আসে; দিদির জন্য আসতে হল। দিদি জোর করলেন। ডাক্তারবাবুর কথায় দিদি কেন বিশ্বাস করলেন কে জানে!

কিকিরা অনিলকে দেখতে-দেখতে বললেন, “কী হে জাম্পারসাহেব। আমি ঠিক বলেছি কি না! আদিনাথ মজুমদার তোমাদের সার্কাসে ম্যাজিক দেখান না?”

অনিল মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ।”

“কোথাকার লোক! কলকাতার?”

“ডুয়ার্সের লোক। কলকাতাতেও থাকতেন। আগে রয়েল সার্কাসে ছিলেন।”

“কৃষ্ণমূর্তিও তো সাউথ ইন্ডিয়ান?”

“হ্যাঁ। তবে কৃষ্ণমূর্তি অনেক জায়গায় ছিলেন। কলকাতাতেও অনেক বছর। বাংলা, হিন্দি–দুই ভাল জানেন।”

“কৃষ্ণমূর্তি আর আদিনাথ–মানে মজুমদারমশাইয়ের মধ্যে ভাবসাব কেমন?”।

“বনে না। কৃষ্ণমূর্তিকে অনেকেই পছন্দ করে না।”

“কেন?”

অনিল একটু চুপ করে থেকে বলল, “কৃষ্ণমূর্তি সকলের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। গালমন্দ করেন। লোকটার বড় দেমাক। এমনিতেও নোংরা, রাফ গোছের।”

“তবু তিনি সার্কাসে টিকে আছেন কেমন করে?”

“মালিকের বন্ধু। গোল্ডেন সার্কাসটা গড়ে তোলার সময় মাস্টার–ওই। কৃষ্ণমূর্তি–অনেক করেছিলেন।”

“আচ্ছা! কৃষ্ণমূর্তি কি সার্কাসের পার্টনার?”

“জানি না। তবে ওঁর জন্যে আলাদা ব্যবস্থা থাকে। থাকেন আলাদা; ভাল-ভাল খাবার খেতে পান। টাকাও বেশি পান।”

“তোমাদের সার্কাসে একটা খোঁড়া মতন লোক আছেন?”

অনিল অবাক হয়ে বলল, “আপনি কেমন করে জানলেন?”

“আলাপ হল।”

“হরিশবাবু। হরিশবাবু আগে জিমনাস্টিকের ট্রেনার ছিলেন। নিজে জালারি দেখাতেন। একবার সার্কাসের বাইরের তাঁবুতে আগুন লাগে। হরিশবাবু আগুন নেভাতে গিয়ে জখম হন। এখন আর উনি খেলা দেখান না। মাঝেমাঝে ক্লাউন সাজেন। বেশিরভাগ সময় হরিশবাবু টিকিট ঘরে বসে থাকেন, না হলে বাইরে ঘোরাফেরা করেন।”

কিকিরা বললেন, “হরিশবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। বাইরে ছোট তাঁবুর পাশে টিনের চেয়ার টেনে বসে ছিলেন। বিড়ি টানছিলেন।”

“নিজেই আলাপ করলেন আপনি?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ। লোকটি তো ভালই মনে হল। খানিকটা মনমরা গোছের। ভাঁড়ের চা খাচ্ছেন, বিড়ি টানছেন। আমি একটা বুদ্ধি খাঁটিয়ে আলাপটা সেরে ফেললাম।”

“কীরকম বুদ্ধি?” চন্দন বলল।

 কিকিরা বললেন, “এজেন্ট সেজে গেলাম, বুঝলে। মানে দালাল। কলকাতার যাত্রা দলগুলোর দালাল থাকে বাইরে, দেখেছ না? মফস্বল শহরের দালাল, কোলিয়ারির দালাল, চা-বাগানের দালাল। আমি খানিকটা অন্যরকম দালাল হয়ে গেলাম। বললাম, আমি হলাম টিসি ইমপ্রেসারিও কোম্পানির এজেন্ট। আমরা বাইরে মফস্বল টাউনে নাচ, গান, থিয়েটার, সার্কাস–এইসব দেখাবার ব্যবস্থা করি। “

কিকিরার কথা শেষ হল না, তারাপদ যেন থ মেরে গিয়ে কোনোরকমে বলল, “আপনি এজেন্ট হয়ে গেলেন? ইমপ্রেসারিও কোম্পানির? বলেন কী সার?”

“হলাম। না হলে ভাব জমাব কেমন করে। কাজ বাগাবার জন্যে কত কী হতে হয় হে, তারাবাবু।”

“ও। টিসি কোম্পানি বলে আছে নাকি কোনো কোম্পানি?”

“তোমরাই আছ। তারা-চন্দন কোম্পানি। “

“আমরা?” তারাপদ চন্দনের দিকে তাকাল। তারপর হেসে ফেলল। “সত্যি স্যার, আপনি মাথা খাটাতে পারেন বটে।”

কিকিরা হাসতে-হাসতে বললেন, “মাথা থাকলেই খাটাতে হয়। না খাটালে মাথা আর মাথা থাকে না, ঘট হয়ে যায়। বুঝলে?”

চন্দন বলল, “আলাপ করে লাভ হল?”

“হল সামান্য। যেমন, সার্কাসে কী কী খেলা দেখানো হয়। ভাল খেলা কী আছে? কারা খেলা দেখায়–এইসব জেনে নিলুম। হরিশবাবুর মুখেই শুনলুম অলিভার দ্য জাম্পারের খেলাটা এখন বন্ধ আছে। ছোকরার অসুখ করেছে।” বলে একটু থেমে মুচকি হাসলেন। বললেন আবার, “ম্যাজিশিয়ান আদিনাথের নামটা হরিশবাবুর কাছ থেকেই জেনে নিলুম।”

তারাপদ বলল, “তাতে কোনো লাভ হবে?”

“আগে থেকে বলতে পারছি না। তবে একই জাতের পাখি তো, চান্স পেলে ভাই-ভাই হয়ে যেতে পারি। …তা, হরিশবাবু একদিন নেমন্তন্ন করলেন তাঁদের সার্কাস দেখতে যাওয়ার জন্যে। বললেন, আপনি আসুন একদিন আমাদের খেলা দেখুন, তারপর মালিকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দের কথা বলবেন।”

বগলা ট্রে করে চা নিয়ে ঘরে এল। চা আর সামান্য খাবার কুচো নিমকি, সেউ ডালমুট, শোনপাপড়ি।

চা আর খাবার নামিয়ে দিয়ে চলে গেল বগলা।

“নাও, হাত লাগাও-” কিকিরা অনিলকে বললেন। বলে তারাপদদের দিকে তাকলেন। “কাল-পরশু একদিন সার্কাস দেখতে যেতে হয়, কী বলে?”

“যান আপনি!” তারাপদ বলল “আপনাকে নেমন্তন্ন করেছে।”

“আমি একা কেন যাব, তোমরাও যাবে–তুমি আর চাঁদু। আমি তো এজেন্ট, মালিক হলে তোমরা। তোমরা পছন্দ করলে তবেই না সার্কাস কোম্পানির সঙ্গে কথাবার্তা হবে।”

চন্দন বলল, “কি যে বলেন আপনি! আমরা মালিক। ইমপ্রেসারিওর “ই’ জানি না, কথা বলব! ধরা পড়ে যাব, স্যার।”

“কথা বলতে হবে না; কথা আমি বলব। তোমরা শুধু হ্যাঁ করে যাবে, মাথা নাড়বে, কপাল কোঁচকাবে। এমন ভাবে করবে যেন, তোমাদের ঠিক পছন্দ নয় সার্কাসটা, বিজনেসের দিক থেকে। আমি শুধু তোমাদের তেলিয়ে যাব। এজেন্ট তো!”

“তারপর?”

“তারপর কিছু না। আসলে, তোমরা যাবে আমার সঙ্গে চারদিক নজর করতে। ওয়াচ করবে। আমার একার পক্ষে চারদিকে নজর করা সম্ভব নয়।”

চন্দন আর তারাপদ কিছুই বলল না। ওরা রাজি।

চা খেতে-খেতে কিকিরা এবার অনিলের দিকে তাকালেন। দেখছিলেন ছোকরাকে। কিকিরার মনে কোথায় যেন একটু খুঁতখুঁত করছিল। ছেলেটিকে দেখলে মনে হয় না ওর মধ্যে বাড়তি সাহস, বেপরোয়া ভাব তেমন একটা আছে। সার্কাসের কয়েকটি খেলা, যেমন ট্রাপিজ, জিপগাড়ি নিয়ে লাফানো, মোটর সাইকেল নিয়ে খাঁচার মধ্যে পাক খাওয়া–এসব খেলা দেখাতে হলে বেজায় সাহস, সঙ্কল্প, খানিকটা বেপরোয়া ভাব দরকার হয়। কিকিরার মনে হল, ছেলেটির চেহারা যেমন আছে–তাতে লাফ মারার খেলা দেখানোয় কোনও অসুবিধে নেই। তবে চেহারাই তো সব নয়, মনও দরকার।

কিকিরা অনিলকে বললেন, “তোমার বয়েস কত?”

অনিল চা খাচ্ছিল। মুখ তুলে বলল, “পঁচিশ হয়ে গেছে।”

“তুমি কতদিন খেলা দেখাচ্ছ?”

“দু বছর।”

“আগে কোনো সার্কাসে ছিলে?”

“না।”

“তা হলে? কে তোমায় খেলা শেখাল? তোমার ট্রেনার কে?”

অনিল কী মনে করে তার গলায় ঝোলানো চেনের লকেটটায় একবার হাত বুলিয়ে নিল। রুপোর চেন, লকেটটা সোনার। ক্ৰশ। বলল, “আমায় খেলা শেখাতেন সিসিল সরকার।”

“সিসিল।”

“ওই নাম। আমাদের লোক। সিসিল নামমকরা বাইক রাইডার। মোটর সাইকেল রেসিং-এ অনেক প্রাইজ পেয়েছেন। ভাল হকিও খেলতেন।”

“সিসিল কি সার্কাসে ছিলেন?”

“না। সিসিলদের টেলারিং শপ ছিল। নিউ মার্কেটের কাছে। লিন্ডসে স্ট্রিটে বড় দোকান। নামী দোকান। সিসিল দোকান দেখতেন।”

“সেই দোকান এখন..”

“হাত বদল হয়ে গেছে। সিসিল নেই। মাঝে শুনেছিলাম, ওঁর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে; বেঁচে নেই। পরে শুনলাম, সিসিল দার্জিলিঙে চলে গেছেন।”

“তোমার সঙ্গে আর দেখা হয়নি?”

“না স্যার।”

কিকিরা হাত বাড়িয়ে সিগারেট চাইলেন তারাপদর কাছে। চুরুটে যেন অভিরুচি ছিল না। তারাপদ সিগারেট দিল।

সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া গিলে কিকিরা অনিলকে বললেন, “তুমি বলছ, আগে তুমি কোনো সার্কাস পার্টিতে ছিলে না। তা হঠাৎ গোল্ডেন সার্কাসে ঢুকলে কেমন করে?…আমি যতটুকু বুঝি বাবা, সার্কাসে ঢোকা, চাকরি পাওয়া–আর কোনো অফিসে কেরানির চাকরি পাওয়া এককথা নয়। তোমার মতন আনকোরা আনাড়িকে কোন সার্কাস চাকরি দেবে?”

অনিল মাথা নেড়ে বলল, “আপনি ঠিকই বলেছেন। কেউ দেয় না। আমিও চাকরি খুঁজতে সার্কাসে যাইনি। তালেগোলে ওটা হয়ে গেছে।” বলে অনিল তার সার্কাসে ঢোকার ঘটনার কথা বলল।

সেবার, বছর দুই আগের কথা, শীতের সময় অনিল গিয়েছিল আসানসোলে তার এক বন্ধুর কাছে বেড়াতে। বন্ধুর বাড়ির সিকি মাইলটাক দূরে তখন গোল্ডেন সার্কাসের তাঁবু পড়েছে। খেলা চলছিল। একদিন অনিল তার বন্ধুর কোয়ার্টারের সামনে বন্ধুরই মোটর বাইক নিয়ে খেলা দেখাচ্ছিল মজা করে। সামনের রাস্তা দিয়ে তখন একটা জিপগাড়ি করে যাচ্ছিলেন গোল্ডেন সার্কাসের মালিক। সঙ্গে সার্কাসের অন্য দুজন। মালিকের কেমন করে নজর পড়ে গেল অনিলের ওপর। গাড়ি থামিয়ে কিছুক্ষণ খেলা দেখলেন। তারপর নিজেই এসে দাঁড়ালেন অনিলের সামনে।

কিকিরা বললেন, “মালিকই তোমায় নিজে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন সার্কাসে?”

“হা স্যার। নিজে। আমি সার্কাসে ঢুকব ভাবিনি কোনোদিন। ঢুকে গেলাম। দিদি বারণ করেছিলেন, রাগ করেছিলেন। তবু লোভে পড়ে ঢুকে গেলাম।”

“কিসের লোভ?”

ইতস্তত করে অনিল বলল, “স্যার, গ্ল্যামারের লোভ। সার্কাসের টেস্ট, গ্যালারি, আলো, রং-চং খেলা–সব কেমন যেন। থ্রিলিং। তবে স্যার, প্রথমে আমি আজকের মতন এত খেলা দেখাতাম না। জানতাম না। দু-তিনটে খেলাই দেখাতাম। তারপর ধীরে ধীরে নিজে খেলা বের করেছি। প্র্যাকটিস করেছি দিনের পর দিন। আমার কোনো ট্রেনার সার্কাসে ছিল না। নিজের চেষ্টায় যা পেরেছি করেছি।”

তারাপদ আর চন্দন কোনো কথা বলছিল না। অনিলের কথা শুনছিল। মনে-মনে বাহবা দিচ্ছিল অনিলকে।

কিকিরা সিগারেট নিভিয়ে রেখে দিলেন। বললেন, “তুমি সার্কাসে ঢোকার পর থেকেই কি কৃষ্ণমূর্তি তোমার পেছনে লাগেন?”

মাথা নাড়ল অনিল। “না। আগে ভাল ব্যবহার করতেন। “

“কখন থেকে তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করলেন?”

“এবারকার সিজিনে।”

“কেন?”

“জানি না।”

“তিনি তোমায় জখম করার চেষ্টা করেছেন শুনলাম। কেমন ভাবে?”

অনিল বলল, “কৃষ্ণমূর্তি সাহেব আমাকে, আমার খেলা নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করতে শুরু করলেন গোড়ায়-গোড়ায়। তারপর আমাকে বললেন, তাঁর সঙ্গে ওই লোহার পাতের গ্লোবটার মধ্যে ঢুকে খেলা শিখতে। মানে আমরা দুজনেই একটা গোল খাঁচার মধ্যে পাক খাব। উনি ক্লক ওয়াইজ, আমি অ্যান্টি ক্লক ওয়াইজ। আমার স্যার এই খেলাটা শিখতে বা দেখাতে ইচ্ছে ছিল না। কৃষ্ণমূর্তির জোর-জবরদস্তিতে মাঝে-মাঝে ঢুকতাম। তখন উনি খেলা শেখাবার নাম করে আমাকে জখম করার চেষ্টা করতেন।”

কিকিরা শুনলেন মন দিয়ে। ভাবছিলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, “ওই লোকটা তোমাকে আর কীভাবে শাসাত?”

“আমার টেন্টের মধ্যে জামার পকেটে, সুটকেসের ওপর ভাঁজ করা কাগজ রেখে দিয়ে যান লুকিয়ে। তাতে গালমন্দ থাকে, শাসানি থাকে। “

“কী লেখেন?”

“বেশি কিছু লেখেন না। দু-একটা কথা। বড় বড় হরফে। ভয় দেখান, মেরে ফেলার ভয় দেখান।”

“লেখাটা যে কৃষ্ণমূর্তির, তার প্রমাণ কী? তুমি কি ওঁর হাতের লেখা চেনো?”

“নিজের হাতে লেখেন না। কাগজ থেকে টাইপ কেটে-কেটে আঠা দিয়ে জুড়ে ওঁর যা লেখার লেখেন।”

কিকিরা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। শেষে বললেন, “ঠিক আছে। আজ থাক। পরশু আবার কথা হবে। তুমি এখানেই এসো। সন্ধেবেলায়।”

.

০৩.

সার্কাস থেকে বেরিয়ে এসে কিকিরা বললেন, “কী চাঁদু, কেমন হল?”

চন্দন কোনো কথা বলল না। কীইবা বলবে!

তারাপদ চুপ করে থাকতে পারল না। বলল, “স্যার, আপনার সবই অদ্ভুত। কখন যে কী করেন, বুঝতে পারি না।”

কথাটা তারাপদ মিথ্যে বলেনি। কিকিরা প্রথমে বলেছিলেন, তারাপদ আর চন্দনকে টিসি ইমপ্রেসারিও কোম্পানির পার্টনার আর মালিক সাজিয়ে গোন্ডেন সার্কাসে নিয়ে যাবেন। ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “তোমরা কোনো কথা বলবে না। নেহাত যেটুকু না বললে নয়, সেইটুকুই বলবে। আর তোমরা এমন ভাব করবে, যেন কোম্পানির মালিক হলেও দুজনেই অকর্মা, বাপের কিছু পয়সা আছে বলে নামকেওয়াস্তে এই কোম্পানি খুলে রেখেছে, নিজেরা তেমন কিছু দেখাশোনা করো না, সবই আমার হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে আছ! আমি যা করি–তোমরা না বলো না। আমি হলাম তোমাদের বাপ-জেঠার আমলের লোক। আমাকে খাতির করো তোমরা। ব্যস, বাকি যা সব আমার হাতে ছেড়ে দাও।”

তারাপদ বা চন্দন কোনো আপত্তি করেনি। ইমপ্রেসারিও, কোম্পানি–এর কোনো কিছুই যখন তারা জানে না, তখন কিকিরার হাতে ব্যাপারটা ছেড়ে দিলেই ভাল।

সার্কাসে ঢোকার আগে কিকিরা হঠাৎ বললেন, “তোমরা এক কাজ করো। দুটো টিকিট কেটে ভেতরে চলে যাবে। একেবারে সামনের দিকে।”

“কেন, আপনার সঙ্গে যাব না?”।

“না। আমি হরিশবাবুর সঙ্গে দেখা করে–তাঁর সঙ্গে ভেতরে যাব। তিনি যখন তোমাদের–মানে মালিকদের কথা জিজ্ঞেস করবেন, বলব, ওরা নিজেরাই আসবে। ফ্রিতে আসতে চায় না। বলে, তাতে প্রেস্টিজ থাকে না কোম্পানির। খাতির করে নিয়ে গিয়ে ভাল জায়গায় বসাবে, চা-সিগারেট-পান খাওয়াবে–তারপর আমাদের বাগিয়ে ব্যবসা করার চেষ্টা করবে। চক্ষুলজ্জা বলে কথা আছে। আমরা নিজেরাই যাব। সার্কাস ভাল লাগে আপনার সঙ্গে আলোচনা করব। তারপর অন্য কথা…।”

তারাপদ বলল, “বাঃ।

“ কিকিরা বললেন, “বাঃ নয়! গোড়ায়-গোড়ায় তোমাদের একটু তফাতে রাখতে চাই। বেফাঁস কথাবার্তা বলে ফেললে ধরা পড়ে যেতে পারি। তা ছাড়া আমি চাই তোমরা চোখ কান খোলা রেখে সব দেখোশোনো।”

তারাপদরা আর আপত্তি করেনি।

আড়াই ঘণ্টা সময় তারা সার্কাসে বসেবসে কাটিয়েছে।

সার্কাস ভাঙার পর কিকিরা এসে ধরলেন দুজনকে। সঙ্গে হরিশবাবু। তারাপদদের টেনে নিয়ে যেতে চাইলেন মালিকের কাছে।

কিকিরা হরিশবাবুকে বোঝালেন। তাড়াহুড়োর কোনো দরকার নেই। এরা কিছু না জানিয়েই নিজেরা এসেছে। ওরা একটু ভেবে নিক। দু-চার দিনের মধ্যে আমিই আবার ওদের নিয়ে আসব। তখন বিজনেসের কথা বলা যাবে।

.

সার্কাস থেকে বেরিয়ে তিনজনে খানিকটা হেঁটে আসার পর কিকিরা বললেন, “কেমন দেখলে সার্কাস?”

চন্দন বলল, “কেমন আর! এ-সব সার্কাস এইরকমই হয়। খুব ভাল নয়, আবার একেবারে রদ্দি নয়।”

“তারাবাবু, তুমি?

“নতুন খেলা কিছু দেখলাম না। তবে, ওই খেলাটা ভাল দেখাল। ড্যাগার থ্রো। আগেও আমি দেখেছি। কিন্তু শেষে যখন লোকটার চোখ বেঁধে দিল, আর মেয়েটাকে দাঁড় করিয়ে ও ড্যাগার ছুড়ছিল–তখন আমার বেশ ভয় করছিল, স্যার।”

চন্দন বলল, “ট্রাপিজ খেলাটাকে বড় ম্যাড়মেড়ে করে দেখাল। আরও ব্রাইট করা উচিত ছিল, কিকিরা। ট্রাপিজই তো সার্কাসের আসল খেলা। আর বাঘ-সিংহর খেলা যা দেখাল, টোটালি হোপলেস। ঝিমোনো দু-চারটে বুড়ো বাঘ-সিংহ নিয়ে চলে না। “

কিকিরা হাসলেন। বললেন, “পাকা মালিকের মতন কথা বলছ চাঁদ!..যাক গে, আর কিছু নজর করলে?”

“কী?”

“সে কি! তোমাদের তবে আনলাম কেন?”

তারাপদ কিকিরার দিকে তাকাল। বুঝতে পারল কথাটা। বলল, “আপনি কৃষ্ণমূর্তির কথা বলছেন?”

“বলছি তো আরও কিছু। কেমন দেখলে কৃষ্ণমূর্তির মোটর বাইকের খেলা?”

তারাপদ বলল, “ভাল। দারুণ রিস্কি খেলা। লোকটা ভাল দেখাল, স্যার। বিশেষ করে ওর ওপর থেকে নিচে নামার খেলাটা। সারকেলগুলো ডেঞ্জারাস?”

কিকিরা মাথা নাড়লেন। “শুনলাম, কৃষ্ণমূর্তি প্রায় গত দশ বছর এই খেলাই দেখাচ্ছেন! খেলোয়াড় হিসেবে পাকা।” বলে একটু থেমে খানিকটা অন্যমনস্কের মতন জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন দেখলে লোকটাকে?”

চন্দন হাঁটতে-হাঁটতে মুখ তুলল। বলল, “লোকটাকে আর দেখলাম কোথায়! গায়ে ওই রেসিং সুট। পুরো শরীর ঢাকা। মাথায় হেলমেট, মিলিটারি মাকা, হাতে গ্লাভস, পায়ে ব্রিচেস মাকা বুট জুতো। সবই তো ঢাকা স্যার। …তবে উনি যখন খেলার শেষে হেলমেট খুলে দাঁড়িয়ে হাততালি কুড়োচ্ছিলেন–তখন কৃষ্ণমূর্তির মুখটা দেখলাম। দু-চার মিনিটের জন্যে। থুতনির কাছে দাড়ি। জাহাজের সেলারদের মতন দেখাচ্ছিল। চোখ গোল-গোল। নাক বসা।”

তারাপদ বলল, “চেহারার মধ্যে একটা রোবাস্ট ভব আছে।”

কিকিরা বললেন, “লোকে কী বলছিল? মানে, আরো একটা মোটর বাইকের খেলা যে বন্ধ রয়েছে, লোকে কীভাবে নিচ্ছিল!”

তারাপদ বলল, “দু-চারজন বলছিল বটে, তবে ও নিয়ে খুব যে কথাবার্তা হচ্ছিল–তা নয়।”

ততক্ষণে বড় রাস্তায় এসে একটা ফাঁকা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। কিকিরা হাত বাড়িয়ে ডাকলেন ট্যাক্সিটাকে।

তারাপদরা ট্যাক্সিতে উঠল।

সামান্য সময় চুপচাপ থাকার পর কিকিরা বললেন, “আমি হরিশবাবুর সঙ্গে ছিলাম। মালিক ছাড়াও দু-তিনজন খেলোয়াড়কে দেখলাম। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কথাও বললাম হে। আমার মনে হল, অনিলের খেলাটা বন্ধ রয়েছে বলে ওরা যে মুশকিলে পড়েছে–তাও নয়। অবশ্য মালিক আর হরিবাবু দুজনেই বলছিলেন, অন্য খেলাটারও একটা মেজর অ্যাট্রাকশান ছিল। লোকে নিয়েছিল খেলাটা। তবে সার্কাসের ব্যবসায় দু-একটা খেলা বাদ গেলে মহাভারত অশুদ্ধ হয় না। লোকে ও নিয়ে মাথা ঘামায় না।”

“তবে?”

“আমিও তাই ভাবছি।”

“অনিলের কথা আপনি জিজ্ঞেস করলেন নাকি?”

“মাথা খারাপ হয়েছে নাকি। আমি অনিল বলে কাউকে হালে চিনেছি বা দেখেছি–একথা কি বলা যায়! খেলাটার কথা জিজ্ঞেস করেছি, খেলোয়াড়ের কথা নয়। আমি বাবা ইমপ্রেসারিও। খেলার ভাল-মন্দ খোঁজ নিতে পারি, কেননা সেগুলো নিয়ে ব্যবসা করব। খেলোয়াড়ের কথা আমি তুলব কেন?”

চন্দন বলল, “অনিল পালিয়ে আসায় ওদের তবে ক্ষতি হচ্ছে না?”

“হয়ত একটু হচ্ছে, ওরা কিন্তু ভাঙল না। …বিজনেস সিক্রেট হতে পারে।”

“তা হলে?”

 কিকিরা এবার পকেট হাতড়ে চুরুট বের করলেন। চুপচাপ থাকলেন কিছুক্ষণ। চুরুট ধরিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, “চাঁদু, অনিল যা বলছে, আর সত্যি কী ঘটেছে–মানে অনিল ছেলেটির কথা কতটা সত্যি আমি বুঝতে পারছি না।”

তারাপদ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। এখানে রাস্তায় বাতি নেই। অন্ধকার। হয়ত লোড শেডিং হয়ে গিয়েছে। দোকান-পশারও বন্ধ। রাত হয়ে গিয়েছে। আলো বড় একটা দেখাই যাচ্ছে না। ট্যাক্সির হেড লাইটের আলোও তেমন জোরালো নয়। অবশ্য উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ির আলো মাঝে-মাঝে তারাপদদের গায়ে-মুখে পড়ছিল।

তারাপদ বলল, “অনিল কি মিথ্যে কথা বলছে?”

 কিকিরা বললেন, “বলতে পারে।”

চন্দন আপত্তি জানাল যেন। “ও মিথ্যে কথা বলবে কেন? কী লাভ? ও যে ভয় পেয়েছে, পালিয়ে এসে লুকিয়ে রয়েছে, এটা তো ঠিকই।”

“হ্যাঁ”, কিকিরা কী ভাবতে-ভাবতে ধীরেসুস্থে বললেন, “সার্কাস ছেড়ে অনিল পালিয়ে এসেছে–এটা সত্যি। ভয় পেয়েছে–তাও হতে পারে। কিন্তু ভয় পাওয়ার কারণ ও যা বলছে তা আমি মেনে নিতে পারছি না। সব খেলাতেই কম্পিটিশান থাকে। খেলাতেই বা শুধু কেন–সব জায়গাতেই। গাইয়েদের মধ্যে থাকে, থিয়েটারে থাকে, যাত্রায় থাকে”

“আপনাদের ম্যাজিকেও থাকে।”

“হ্যাঁ, থাকে। আছেও। …আমার কথা হল, অনিলের খেলা বেশি পপুলার হয়ে যাচ্ছে বলে কৃষ্ণমূর্তি তাকে শাসাচ্ছেন, জখম করার চেষ্টা করছেন, মেরে ফেলতেও পারেন–এইসব কথা কি ঠিক? শুধু প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যে খুন-খারাপি পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব কি না বলতে পারছি না। অন্য ব্যাপার হলে হতে পারে। এখানে নিতান্ত একটা সার্কাসের খেলা। আমার মাথায় আসছে না চাঁদু!”

চন্দন একটু চুপ করে থেকে বলল, “কিকিরা, অনিলকে আমি চিনি না। সে কেমন ছেলে তাও জানি না। কিন্তু মায়াদিকে আমি চিনি। সিস্টার হিসেবে মায়াদি কত ভাল আমি জানি। তার চেয়েও বেশি জানি, মায়াদিকে। মায়াদি কখনো মিথ্যে কথা বলবেন না। আর অনিলই মায়াদির একমাত্র ভাই।

তারাপদ বলল, “অনিলের সঙ্গে আপনি আরও কথা বলুন।”

“বলব বলেই তো ডেকে পাঠিয়েছি।”

“কাল ও আসবে আপনার কাছে।”

 কিকিরা কথাটা শুনলেন কি শুনলেন না বোঝা গেল না। চুরুটটা দাঁতে চেপেই থাকলেন। ট্যাক্সি অনেকটা এগিয়ে এল।

শেষ পর্যন্ত চুরুটটা আবার জ্বালাবার চেষ্টা করতে করতে কিকিরা বললেন, “সার্কাসের মধ্যে আমায় ঢুকতে হবে।”

তারাপদ হালকাভাবেই বলল, “খেলা দেখাবেন?”

“মন্দ নয়; দেখাতেও পারি।”

“কী খেলা?” তারাপদ মজা করেই বলল, “ম্যাজিক?”

“ঠাট্টা করছ! শোনো হে তারাবাবু, কিকিরা দ্য ম্যাজিশিয়ান এখনো ইচ্ছে করলে দু-চারটে থ্রোট চোকিং খেলা দেখাতে পারে।”

“থ্রোট চোকিং?”

“ইয়েস স্যার, গলা চোক হয়ে যাবে–মানে ভয়ে তোমার গলা একেবারে শুকিয়ে কাঠ।”।

“কী খেলা স্যার?”

“কাটা মুণ্ডু গড়াগড়ি। টেবিলের এ-পাশ থেকে ও-পাশ, ওপাশ থেকে এ-পাশ। মুণ্ডুর ওপর আলোর লাল ফোকাস। সেইসঙ্গে অট্টহাসি।”

তারাপদ জোরে হেসে ফেলল। চন্দনও না হেসে পারল না। তারাপদ বলল, “অট্টহাসিটা কে হাসবে? আপনি?”

“নো। রেকর্ড বাজবে। আজকাল তো আবার স্টিরিও সিস্টেম।”

আর-এক দফা হাসি হল।

 শেষে চন্দন বলল, “কিকিরা, এখন তা হলে আপনি কী করতে চান?”

কিকিরা বললেন, “আমি সবার আগে আর-একবার অনিলের সঙ্গে কথা বলতে চাই। তোমরা থাকলে ভাল হয়। তারপর আমি সার্কাসের ভেতরের খোঁজ-খবর করবার চেষ্টা করব। তোমরা কাছাকাছি থাকবে।”

“সত্যি আপনি সার্কাসের অন্দরমহলে ঢুকবেন?”

“ঢুকতে হবে। না ঢুকলে আসল ব্যাপারটা জানব কেমন করে! তোমরা যতটা সহজ ভাবছ ততটা সহজ ঘটনা এটা নয় চাঁদু। আমার তাই আন্দাজ হচ্ছে।”

.

০৪.

সাতটা বাজল দেখতে-দেখতে।

তারাপদ এসেছে ছ’টারও আগে। চন্দন এল সাড়ে ছ’টা নাগাদ 1 অনিলের কিন্তু দেখা নেই।

কিকিরা বললেন, “কই গো, তোমাদের জাম্পার অলিভারের যে এখনো দেখা নেই। কী হল তার?”

তারাপদ খানিকটা বিরক্ত হয়ে উঠেছিল অপেক্ষা করতে করতে। বলল, “কী জানি, বাড়ি ভুল করল নাকি?”

কিকিরা বললেন, “তোমরা ভাল করে চিনিয়ে দাওনি রাস্তাটা?”

“দিয়েছি।”

কিকিরা অন্য কথা পাড়লেন। নিজে অল্প বয়েসে কত ভাল-ভাল সার্কাস দেখেছেন তার গল্প শোনাতে লাগলেন। তখনকার সার্কাসে পশুর খেলা ছিল দেখবার মতন। বাঘ-সিংহ ছাড়াও ঘোড়ার খেলা থাকত, থাকত হাতির খেলা। এক-একজন রিং মাস্টার যেভাবে সাজপোশাক পরে বেত হাতে এসে দাঁড়াত, মনে হত যেন রাজপুত্র এসে দাঁড়িয়েছে। আর ট্রাপিজ? আরে সে-ট্রাপিজ এখন দেখবে কোথায়? সাহেব-মেম ট্রাপিজের খেলা দেখাত পুরনো “কুইন সার্কাসে’।

.

কিকিরার গল্পের মধ্যে অনিল এল।

অনিলকে কেমন যেন দেখাচ্ছিল। খানিকটা জড়োসড়ো–মুখে দুশ্চিন্তার একটা ছাপ। গায়ের শার্টটা কুঁচকে রয়েছে অনিলের। বোধ হয় ভিড়ের মধ্যে ধস্তাধস্তি করতে হয়েছে বাসে।

কিকিরা বললেন, “এসো। এত দেরি?”

অনিল কিকিরাকে আগেই দেখেছিল। তারাপদদের দিকে তাকাল। দেখল ওদের। বলল, “দেরি হয়ে গেল।”

চন্দন বলল, “ঠিকানা গোলমাল হয়ে গিয়েছিল?”

অনিল মাথা নাড়ল। বলল, “না, রাস্তা গোলমাল হয়নি।” বলে একটু থেমে কিকিরার দিকে তাকাল। “সাড়ে পাঁচটা নাগাদই আমি বেরোতে যাচ্ছিলাম। বাড়ির গলির কাছে একটা লোককে দেখে বেরোতে সাহস হল না। “

“লোক? কোন লোক?” চন্দনই বলল অবাক হয়ে।

অনিল বলল, “লোকটাকে চিনি না। আগে কোনোদিন দেখিনি গলিতে। তবে মুখটা কোথাও দেখেছি বলে মনে হল। আজই গলিতে দেখলাম। আমাদের বাড়ির কাছে একটা ইলেকট্রিক মিস্ত্রির দোকান আছে। মোটর গাড়ির ইলেকট্রিকের কাজ করে। সেলফ ডায়নোমো। ব্যাটারিও তৈরি করে। সেই দোকানের সামনে কাঠের টুল নিয়ে ঠায় বসে ছিল লোকটা।”

কিকিরা বললেন, “এ আবার কেমন কথা হে! দোকানের সামনে একটা লোক বসে থাকতেই পারে। হয়ত কোনো কাজ কাচ্ছিল। তুমি তাকে চেনোও না। তা হলে ভয় কিসের?”

প্রায় তোতলানোর মতন করে অনিল বলল, “লোকটাকে গুণ্ডার মতন দেখতে। দেখলে মালম্যান বলে মনে হয়। মাথার চুল ছোট-ছোট করে ছাঁটা। হাতে লোহার বালা। লোকটা বসেবসে গলিতে যারা আসছে-যাচ্ছে। তাদের দেখছিল। আমার মনে হল, সে ওয়াচ করছে।”

“তোমাকে দেখেছে সে?”।

“না। আমি তাকে দেখেছি। ও আমাকে দেখতে পেত। কিন্তু একটা রিকশার আড়াল পড়ে যাওয়ায় সে আমাকে দেখতে পায়নি। ওকে দেখেই আবার আমি বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লাম।”

“তা হলে তুমি কেমন করে বুঝলে লোকটা অনেকক্ষণ ধরে দোকানের সামনে বসে ছিল।”

অনিল থতমত খেয়ে বলল, “আগেও আমি তাকে দেখেছি। বাড়ির খোলা জানালা দিয়ে। তখন কিছু মনে হয়নি। বেরোবার সময় আবার দেখতে পেয়ে–সন্দেহ হল।”

চন্দন বলল, “তোমাদের নিজের বাড়িতে তুমি থাকো না। লুকিয়ে অন্য জায়গায় গিয়ে থাকছু। তোমার আস্তানা সে জানবে কেমন করে?”

অনিল সেকথার কোনো জবাব দিল না। এমন ভাব করল, যেন সেও জানে না কেমন করে লোকটা এই গলিতে ঢুকে পড়ল।

কিকিরা বললেন, “তুমি তো দেখছি সব ব্যাপারে ভয় পাচ্ছ। একটা লোককে দেখতে ষণ্ডাগুণ্ডার মতন হতেই পারে। সে আর বিচিত্র কী। কলকাতার অলিতে-গলিতে আজকাল গুণ্ডা মাকা লোক দেখা যায়। এরকম কাউকে দেখা গেলেই তোমার মনে হবে লোকটা তোমাকে ওয়াচ করছে-এ আবার কেমন কথা!”

অনিল বলল, “লোকটাকে দেখে আমার ভাল লাগেনি।”

 তারাপদ বলল, দোকানে জিজ্ঞেস করেছ, লোকটা কে?”

“না।”

“কেন! তাতেও ভয়!” তারাপদ ঠাট্টা করে বলল।

অনিল অস্বস্তি বোধ করছিল। কিকিরা কথা ঘুরিয়ে নিলেন। নিয়ে সার্কাসের চাকরি কাজকর্ম নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন অনিলের সঙ্গে। তারাপদরা বসে বসে শুনছিল।

কিকিরা গোড়ার দিকে এমন সব কথা বলছিলেন যা খানিকটা মামুলি। সার্কাসের খেলা, খেলোয়াড়, থাকা-খাওয়া, মোটামুটি আয়, বছরে ক মাস সাকার্স চলে, ক’ মাস বসে থাকতে হয়, ইত্যাদি।

কথাগুলো যেন গল্পগাছার মতন বলতে বলতে একসময় হঠাৎ কিকিরা অন্য কথায় এসে গেলেন। অনিলকে বললেন, “কৃষ্ণমূর্তি তোমাকে শাসিয়ে যে কাগজগুলো রেখে যেতেন, তার দু-একটা তোমার কাছে আছে?

মাথা নাড়ল অনিল। না।

“একটাও রাখোনি?”

“না।”

“কথাটা অন্য কাউকে বলেছিলে? দেখিয়েছিলে কাগজ?”

“না।”

“কেন?”

“আমার ভয় করত।”

কিকিরা অনিলকে দেখতে-দেখতে বললেন, “তুমি সার্কাসের খেলোয়াড়। খেলা যা দেখাও তাতেও ভীষণ সাহস দরকার হয়। আর সামান্য ব্যাপারে তোমার সাহস হল না? কী করত তোমার কৃষ্ণমূর্তি, সার্কাসের মধ্যে খুন করতেন?”

অনিল সামান্য চুপ করে থেকে বলল, “আমার সাহস হয়নি। কৃষ্ণমূর্তি বড় ডেঞ্জারাস লোক। আপনারা জানেন না। তিনি সবই পারেন।

“কী পারেন?” কিকিরা বললেন। “তুমি দু বছর সার্কাসে খেলা দেখাচ্ছ বলছ। এই দু বছরে তিনি এমন কোন কাজ কি করেছেন যা দেখে তোমার ভয় হগেছে? তিনি কি কাউকে খুন করেছেন?”

“খু-ন! না।”

“তবে?”

অনিল ইতস্তত করে বলল, “খুন না করুন, মারধোর করতে গিয়েছেন, খারাপ ব্যবহার করেছেন। অপমানও করেছেন। দু-একজনকে তাড়িয়েও দিয়েছেন। ওঁর অনেক ক্ষমতা। মালিকের ডান হাত।”

কিকিরা মাথার চুল ঘাঁটতে-ঘাঁটতে তারাপদদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর আবার অনিলের দিকে তাকালেন। বললেন, “তুমি কি মনে করো প্রফেশন্যাল জেলাসির জন্যে কৃষ্ণমূর্তি তোমার শত্রু হয়ে উঠেছিলেন।”

অনিল কোনো জবাব দিল না কথার।

অপেক্ষা করে কিকিরা বললেন, “তুমি সার্কাসে যে-টাকা পাও মাইনে হিসেবে কৃষ্ণমূর্তি নিশ্চয় তার বেশি পান?”

“অনেক বেশি।”

“কৃষ্ণমূর্তির খেলা আমরা দেখেছি। খেলাটা বেশ ভাল দেখান। লোকে পছন্দও করে। দেদার হাততালি শায়। তবু তিনি কেন তোমার খেলাটাকে নিয়ে অত মাথা ঘামাতে যাবেন?”

অনিল চুপ করে থাকল।

চন্দন বলল, “বোধ হয় নতুন খেলা বলে।”

কিকিরা কান দিলেন না কথাটায়। অনিলকেই বললেন, “তুমি কি মনে কর, খেলা ছাড়াও অন্য কোনো কারণ আছে শত্রুতার। মানে, এমন কোনো কারণ আছে যাতে কৃষ্ণমূর্তি তোমার শত্রুতা করবেন?”

অনিল খানিকটা থতমত খেয়ে গেল। পরে বলল, “জানি না। আর কী কারণ থাকবে?”

“ভাল করে ভেবে দেখেছ অন্য কোনো কারণ নেই।”

মুখ নিচু করে মাথা নাড়ল অনিল।

 কিকিরা নিজের জামার পকেট হাতড়াতে-হাতড়াতে হঠাৎ বললেন, “তোমাদের সার্কাসের দলে তোমার কোনো বন্ধু নেই?”

“আছে।”

“কে-কে? নাম বলো।”

অনিল বলল, “হরিশবাবু ভালমানুষ। নাইডু বলে একজন আছে–সাইকেলের খেলা দেখায় তার সঙ্গেও আমার ভাব। ট্রাপিজের রমাকান্ত, সেও ভাল। আরও দু-একজন আছে।”

“কারও কাছে তুমি কৃষ্ণমূর্তির কথা বলোনি?”

“স্পষ্ট করে বলিনি।”

“কী বলেছ তবে?”

“ওই–ওই ওঁর মেজাজের কথা, খারাপ ব্যবহারের কথা। আমায় পছন্দ করেন না–এ-সমস্ত কথা বলেছি।”

“তা তারা কী বলেছে?”

“কী বলবে! ওঁকে তো সবাই চেনে। বলেছে–ওঁকে এড়িয়ে থাকতে।”

“তুমি তাই থাকতে বোধ হয়।”

“আর কী করব।”

“সার্কাসে কৃষ্ণমূর্তির দলের লোক আছে? মানে ওঁর সঙ্গে ঘোরে-ফেরে?”

“আছে। রামু, সদাশিব, কাপুর, আরও দু-একজন। এর মধ্যে রামু হল কৃষ্ণমূর্তির ডান হাত। রামু জিমনাস্টিকের খেলা দেখায়, লিলি বলে একটা মেয়ের সঙ্গে ভল্ট-এর খেলাও দেখায়। সদাশিব ট্রাপিজের দলে আছে। কাপুর হল সার্কাসের সবচেয়ে ভাল জোকার। খেলাও জানে।”

কিকিরা চুরুটটা ধরিয়ে নিলেন আবার। চোখ বুজে চুরুট টানতে টানতে হঠাৎ বললেন, “তুমি না বলেছিলে কৃষ্ণমূর্তি তোমাকে তাঁর নিজের খেলা শেখাবার চেষ্টা করেছিলেন।”

অনিল মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ। খেলা শেখানোর নাম করে তিনি আমাকে জখম করতে চেয়েছিলেন। বার কয়েক দেখার পর আমি আর খেলাটা শিখতে রাজি হইনি।”

“এ ছাড়া আর কোনোভাবে..”

“হ্যাঁ। আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, গাড়ি নিয়ে যারা খেলা দেখায় তারা যেন যার গাড়ির ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে হয়। নিজেরাই দেখভাল করে গাড়ির। নয়ত বিপদ হতে পারে। নিজের খেলা দেখাবার গাড়ি হবে নিজের পোষা কুকুরের মতন। কুকুর তবু পশু। গাড়ি যন্ত্র। কোথাও একটু গড়বড় থাকলেই খেলোয়াড় শেষ। ভুল আমরা করি না। ছোট একটা ভুল মানেই লাইফ রিস্ক। …আমার খেলা দেখাবার মোটর সাইকেল আমি কাউকে ছুঁতে দিতাম না। নিজেই চেক করতাম রোজ। কৃষ্ণমূর্তিও তাঁর মোটর বাইক ভাল করে দেখে নেন রোজ। কিন্তু আজকাল আমি মাঝে-মাঝে দেখতাম, আমার বাইকে কেউ লুকিয়ে হাত লাগিয়েছে। এমন একটা গোলমাল করে রেখেছে ভেতরে, যাতে ওই অবস্থায় খেলা দেখাতে গেলে আমি মরব।”

তারাপদ খানিকটা অবাক হয়ে চন্দনকে বলল, “মূর্তি তো পাকা শয়তান। বাইক খারাপ করে রেখে দিতেন।”

অনিল বলল, “এ-সব খেলা অঙ্কের মতন। সব মাপা, হিসেব করা। হাত-পায়ের রিফ্লেক্স, চোখ, মন–সব একই সঙ্গে কাজ করবে। যে-কোনো ছোটখাট ভুল মানেই বিপদ।”

কিকিরা বগলাকে ডেকে চা দিতে বললেন। তারপর অনিলের দিকে তাকালেন। বললেন, “তোমার কখনও অ্যাসিডেন্ট হয়েছে?”

“দু’বার। তবে ছোট অ্যাসিডেন্ট।… এবার একটা বড় অ্যাসিডেন্ট হত। এই কদিন আগেই খেলা দেখাতে যাওয়ার আগে বাইক চেক করতে গিয়ে দেখি, কে যেন আমার বাইকের ব্রেক হালকা করে দিয়েছে! মানে, ঢিলে করে দিয়েছে। সামনের চাকার বাতাস কম। ওই বাইক নিয়ে খেলা দেখাতে যাওয়া মানে মৃত্যু।”

“এটা কবে ঘটেছিল?”

“সার্কাস ছেড়ে পালিয়ে আসার আগের দিন।”

 চন্দন আর তারাপদ একই সঙ্গে আঁতকে ওঠার শব্দ করল।

কিকিরা বললেন, “লোকটা দেখছি ভয়ঙ্কর। কিন্তু একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না অনিল, কৃষ্ণমূর্তি এরকম শত্রুতা তোমার সঙ্গে কেন করছিলেন। ওঁর উদ্দেশ্য কী? তোমায় জখম করে, মেরে ফেলে ওঁর কী লাভ? কে কত বড় খেলোয়াড় তা নিয়ে রেষারেষি থাকতে পারে। তা বলে। সেই রেষারেষি এত দূর গড়াতে পারে বলে আমি ভাবতে পারি না।”

অনিল কোনো কথা বলল না। তারাপদ আর চন্দন নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কী যেন বলাবলি করল।

কিকিরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অনিলকে বললেন, “অন্য কোন কারণ আছে বলে তোমার মনে হয় না?”

“আমি জানি না।”

“ভাল করে ভেবে বলছ?”

“হ্যাঁ।”

“কৃষ্ণমূর্তি কি পাগল?”

“পাগল বলবেন না, বলুন ক্রিমিন্যাল..” তারাপদ বলল।

অনিল বলল, “একটা কথা স্যার। আমি শুনেছিবছর চারেক আগে জনি নামের এক ট্রাপিজ খেলোয়াড়কে উনি শেষ করে দিগেছিলেন।”

চমক খেলেন যেন কিকিরা। “কেমন করে?”

“শেষ খেলার সময় জনি যখন দুলতে-দুলতে ভল্ট খেয়ে পার্টনারের হাত ধরতে গেছে–পার্টনার তার হাত ছেড়ে দিল। আর জনি পড়ল তো পড়ল–একেবারে জালের ধার ঘেঁষে। জাল থেকে লাফিয়ে নিজেকে সামলাতে পারল না। জালের বাইরে মাটিতে পড়ে গেল।”

চন্দন বলল, “মারা গেল?”

“না, মারা যায়নি। হাত-পা জখম হল। খোঁড়া পা আর ভাঙা হাত নিয়ে ট্রাপিজের খেলা দেখানো যায় না।”

তারাপদ বলল, “লোকটাকে তো পুলিশে দেওয়া উচিত ছিল।”

“কোনো প্রমাণ ছিল না। পুলিশে কেমন করে দেবে!”

কিকিরা বললেন, “এটা তা হলে সার্কাসের লোকের সন্দেহ। …সত্যি কি অন্য খেলোয়াড়টির জনির হাত ধরেনি, বা ছেড়ে দিয়েছিল? ওটা অ্যাসিডেন্টও হতে পারে। ট্রাপিজ খেলায় এরকম হয় বলে শুনেছি। সেইজন্যেই তো নিচে জাল থাকে। … যে-লোকটা হাত ছেড়ে দিয়েছিল সে কি কৃষ্ণমূর্তির শাগরেদ, মানে তাঁর লোক?”

অনিল বলল, “ওরা তো তাই বলে। আমি যা শুনেছি তাই বললাম।”

“দু’জনের মধ্যে শত্রুতা ছিল?”

“জনি কৃষ্ণমূর্তিকে কেয়ার করত না। মাঝে-মাঝে দু’জনের ঝগড়াও হত।”

“জনি এখন কোথায়?”

“সার্কাসে আর সে আসেনি। বছরখানেক বিছানায় পড়ে থাকার পর জনি কী করছে কেউ জানে না। বোধ হয় তার দেশবাড়ির কাছেই আছে কোথাও।”

“কোথাকার লোক সে?”

“ডালটনগঞ্জের।”

 কিকিরা অন্যমনস্কভাবে মাথার চুল ঘাঁটতে-ঘাঁটতে কী যেন ভাবছিলেন।

 বগলা চা এনে অনিলকে দিল।

তারাপদ আর চন্দন সিগারেট ধরাল। নিচু গলায় কথা বলল।

অনেকক্ষণ পরে কিকিরা বললেন, “আমার কাছে ব্যাপারটা বড় জটিল মনে হচ্ছে, চাঁদুবাবু! কৃষ্ণমূর্তির উদ্দেশ্য কী? কেন তিনি অনিলের সঙ্গে শত্রুতা করবেন? কী লাভ তাঁর! এক যদি তিনি পাগল হন, গোঁয়ার মুখ তবেই বোকার মতন এ-সব কাজ করতে পারেন। এরা দুজনেই সার্কাসে খেলা দেখায়। দুজনেই অবশ্য মোটর বাইক নিয়ে। কিন্তু আলাদা ধরনের খেলা। প্রোফেশন্যাল জেলাসি থাকার কথা কী! কী জানি!.ঠিক আছে, কাল থেকে আমি সার্কাসে ঘুরব। দেখি ব্যাপারটা। তারাবাবু তুমি আমার সঙ্গে যাবে। চাঁদুর এখন যাওয়ার দরকার নেই।”

.

০৫.

সার্কাসের মালিককে দেখলে বাঙালি বলে মনে হয় না। কিন্তু ভদ্রলোক বাঙালি। নাম, কানাইচাঁদ মল্লিক। মল্লিকবাবুর চেহারায় বেনারসি ছাপ আছে। কাশীর পাণ্ডার মতন দেখতে। নধর চেহারা, গোলগাল, মাথায় মাঝারি, চুল কম–টাক বেশি। গায়ের রং অবশ্য অতটা ফরসা নয়। ভদ্রলোক অনবরত কালো কফি খান, আর যখন কফি খান না তখন পান-জরদা। ওঁর একটা মুদ্রাদোষ আছে। দু-চারটে করে কথা বলেন আর মুখের অদ্ভুত এক ভঙ্গি করেন। হাস্যকর ভঙ্গি। গলার স্বর ভাঙা-ভাঙা।

কিকিরা আর তারাপদ যখন মল্লিকবাবুর তাঁবুতে এলেন, ভদ্রলোক কিসের হিসেব নিয়ে চেঁচামেচি করছিলেন। ওঁর পরনে ঢোলা পাজামা, গায়ে গরম শার্ট। শার্টের হাত গুটিয়ে নিয়েছেন।

কিকিরাদের দেখে মল্লিকবাবু চেঁচামেচি থামিয়ে সামনের লোকটিকে চলে যেতে বললেন।

কিকিরাদের সঙ্গে হরিশবাবুও ছিলেন।

মল্লিকবাবু খাতির করেই ডাকলেন কিকিরাদের। “আসুন!” বলে সামনের দুটো চেয়ার দেখালেন। একটা কাঠের, অন্যটা ফোল্ডিং। হরিশবাবুকে বললেন, “হরিশ, দো কুরশি আনাও।” মল্লিকবাবু এইভাবেই কথা বলেন, বাংলার সঙ্গে হিন্দি-উর্দু মেশানো থাকে। সার্কাসে নানান জায়গার লোক। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা, মেলামেশা করতে করতে শব্দগুলো নিজের থেকেই মুখে এসে গেছে। তা ছাড়া মল্লিকবাবু নিজে পূর্ণিয়ায় মানুষ হয়েছেন।

হরিশবাবু গেলেন চেয়ারের কথা বলতে।

কিকিরা কাঠের চেয়ারটায় বসতে গিয়ে সামলে নিলেন। তারাপদকে বললেন বসতে। হাজার হোক তারাপদ হল কোম্পানির মালিক, কিকিরা তো কর্মচারী। যদিও কোম্পানির ব্যাপারে তিনি ওদের অভিভাবক। তুমি-টুমি করেই কথা বলেন।

তারাপদ বসল না। লজ্জা করছিল।

 মল্লিকবাবু বললেন, “বসুন। …লোকগুলো আমার দেমাক খারাপ করে দেয়। চোর-চোট্টার দল। “

কিকিরা হেসে বললেন, “হিসেব নিচ্ছিলেন। ম্যানেজার কোথায়?”

“ম্যানিজার বোখার করে পড়ে আছে। …ঝামেলা আমার।”

“তা তো বটেই। আপনি আর কতদিক সামলাবেন!”

“রায়বাবু, সার্কাসের মালিক হল গাধা…।” কানাইবাবু গাধা বলেন না, বলেন গাধা। দ’-এর ওপর ঝোঁক থাকে বেশি। গাধা বলাটাও তাঁর মুদ্রাদোষ।

কিকিরা হাসলেন। “কী বলেন?”

“সাচ বলি। সার্কাসের যেতনা ঝামেলা সব মালিকের ঘাড়ে।”

হরিশবাবু ফিরে এলেন। একটা ছোকরা গোটা দুয়েক ফোল্ডিং চেয়ার এনে রাখল। কানাই চা আনার হুকুম করলেন। রায়বাবুরা আগের দিন কফি না খেয়ে চা খেয়েছিলেন। মনে আছে তাঁর।

তারাপদরা বসল। বাইরে শেষ শীতের রোদ। ভেতরেও সামান্য রোদ এসেছে তাঁবুর দরজা দিয়ে।

দু-পাঁচটা সাদামাঠা কথার পর কিকিরা বললেন, “আপনার সঙ্গে এবার ব্যবসার কথা বলি মল্লিকবাবু। আমাদের কোম্পানি–তার আগে বলি আমার মালিকের একজন এসেছে…” বলে তারাপদকে দেখালেন। “অন্যজন আসতে পারেনি। কাজে আটকে গিয়েছে। তাতে কোনও ক্ষতি নেই। আমরাই কথা বলব।”

“বলুন।”

“আমরা চারটে জায়গা সিলেক্ট করেছি।” বলে তারাপদকে বললেন, “কাগজটা দেখাও।”

আগে থেকেই সব তৈরি ছিল। তারাপদ পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে কিকিরাকে এগিয়ে দিল।

“নিন দেখুন…” কিকিরা আবার কাগজটা মল্লিকবাবুকে দিলেন।

কানাইবাবু কাগজ দেখতে-দেখতে বললেন, “টিটাগড়, ব্যারাকপুর, চন্দননগর, তমলুক…”

কিকিরা বললেন, “এই জায়গাগুলোয় আমাদের লোকজন আছে। এখানে কাজ করেছি। আপনি দেখুন।”

কানাইবাবু পান চিবোতে চিবোতে হরিশবাবুর দিকে তাকালেন। বললেন, “টিটাগড় আচ্ছা?”

হরিশ বললেন, “মিল এরিয়া। লোক পাওয়া যাবে।”

 কিকিরা বললেন, “বিজনেস ভাল হবে।”

পান চিবোতে চিবোতে গাল-গলা চুলকোতে-চুলকোতে কানাইবাবু কী যেন ভাবলেন। বললেন, “টিটাগড় ঠিক আছে। ব্যারাকপুর.” বলে মাথা নাড়তে লাগলেন। মানে ব্যারাকপুর তাঁর পছন্দ নয়। কেন নয়, তাও বললেন, গত বছরের আগের বছর গিয়েছিলেন সেখানে।

কিকিরা বললেন, “চন্দননগর?”

“হরিশবাবু?” মানে হরিশের মতামত জানতে চাইলেন মালিক।

হরিশ বললেন, “বড় জায়গা। মাঠ পাওয়া যাবে।”

“লাভ হবে।”

“হওয়ার কথা।”

কানাই মল্লিক পরের নামটা দেখতে-দেখতে বললেন, “তমলুক!”

 কিকিরা তমলুক শহরের গুণগান শুরু করলেন।

তারাপদ অবাক হয়ে কিকিরার কথা শুনছিল। এমন করে কথা বলছিলেন তিনি, যেন কিকিরা তমলুক শহরের লোক।

মল্লিকবাবুর ঠিক পছন্দ হল না তমলুক। না হওয়ার কারণও বললেন। এখন শীত শেষ হয়ে এল। এখানকার পাট চুকিয়ে টিটাগড়ে গিয়ে সার্কাস নামাতে ক’দিন সময় যাবে। টিটাগড় থেকে চন্দননগর। কম করেও তিনটে হপ্তার মতন বসতে না পারলে সার্কাস পার্টির লোকসান হয়। সময় কোথায় তা হলে! আর গরম পড়ে গেলে সার্কাস চলে না। গরম ছাড়াও ঝড় বৃষ্টির ভয় আছে গরম থেকে তাই সার্কাস বন্ধ। তবে হাতে সময় থাকলে চন্দননগর থেকে কাছাকাছি কোনও জায়গায় যাওয়া যেতে পারে।

কিকিরা মেনে নিলেন কথাটা। অন্য কিছু ব্যবসার কথা হল। কিকিরা যদিও ইমপ্রেসারিও ব্যবসার কিছুই জানেন না, তবু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কথা বলে সামলে নিলেন তখনকার মতন।

ততক্ষণে চা খাওয়া হয়ে গিয়েছে।

কিকিরা এবার অন্য কথা পাড়লেন। বললেন, “আমাদের তো জোর পাবলিসিটি করতে হবে, কাগজে বিজ্ঞাপনও দেব। আপনার সার্কাসের নতুননতুন খেলার কথা বললে লোক টানবে। লোকে নতুন চায় মল্লিকবাবু!”

মল্লিকবাবু কয়েকটা খেলার কথা বললেন।

 কিকিরা হঠাৎ বললেন, “আপনাদের হ্যান্ডবিলে, বাইরে ছবিতে একটা খেলার নাম দেখেছি। মোটর সাইকেল জাম্প। ওটা কি বন্ধ করে দিলেন! সেদিন তো শুনছিলাম-খেলোয়াড়ের অসুখ বলে।”

মল্লিকবাবু হঠাৎ বেজায় বিরক্ত হয়ে বললেন, “আরে, ওই গাধা আমায় একদম বুদু বানিয়ে দিল। এখানে চার-ছ’দিন শো করল, তারপর পালিয়ে গেল। কাউকে কুছ বলল না রায়বাবু, রাস্কেল ভেগে গেল।”

কিকিরা ভীষণ অবাক হওয়ার ভান করে বললেন, “পালিয়ে গেল! হরিশবাবু বলছিলেন, শরীর খারাপ…। আপনিও..”।

“না-না; বাহারে কী বলব, রায়বাবু! উ বাত ঠিক নয়। অলিভার ভেগে পড়েছে।”

“ভেগে পড়েছে। কেন?”

“কেন? মালুম নেই। গাধা আছে, ইডিয়ট। বদমাশ।”

“আশ্চর্য! খেলা দেখাচ্ছিল, পালিয়ে গেল! আপনারা থানায় জানিয়েছেন?”

“জানিয়েছি। সার্কাস বহুত ঝামেলার কাম কাজ রায়বাবু। না জানালে আমাদের দোষ চাপত।”

“কোথাকার লোক ও?”

“এই কলকাত্তার। ওর অ্যাড্রেসে লোক পাঠিয়েছি। নো ট্রেস।”

 কিকিরা বললেন, “কোনও অ্যাকসিডেন্ট?”

“না। হাসপাতালের রেকর্ড নেই।”

“তাজ্জব ব্যাপার।”

মল্লিকবাবু দুঃখ করে বললেন, ছোকরাকে তিনিই ধরে এনেছিলেন সার্কাসে। “নতুন খেলোয়াড়। বহুত রিস্ক ছিল। ছোকরা দু’ বছর আছে সার্কাসে। ভাল খেলা শিখেছিল। আমার সঙ্গে ট্রেজারি করল রায়বাবু। ফের যদি কোনোদিন ফিরে আসে, আমি ওকে দেখে নেব।”

কিকিরা আর কথা বাড়লেন না। বুঝতে পারলেন, অনিলের ওপর ভদ্রলোকের আস্থা ছিল, স্নেহও ছিল।

উঠে পড়লেন কিকিরা। বললেন, এখন উনি যাচ্ছেন, কাল-পরশু আবার আসবেন কথা বলতে।

তারাপদ আর হরিশবাবুকে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। সার্কাসের ছোট-ছোট তাঁবু এ-পাশে ও-পাশে। সার্কাসের মেয়েরা যে যার মতন কাজ করছে নিজেদের। বোয়াধুয়ি, কাঁচাকাচির কাজ। ধোপারা যেভাবে কাপড় শুকোয়, দড়ি টাঙিয়ে সেভাবে কিছু শাড়ি-জামা-সালোয়ার শুকোচ্ছে রোদে। কেউ বা গল্পগুজব করছে। দু-তিনজন জমাদার গোছের লোক বড়বড় ঝাঁটা নিয়ে আশপাশ সাফসুফ করছে। ও-পাশে, তফাতে কয়েকটা বাঘ-সিংহর খাঁচা, পশুগুলোকে দেখা যায় না, ঘুমিয়ে আছে বা শুয়ে-শুয়ে হাই তুলছে হয়ত। পুরুষদের তাঁবুগুলোতেও হইহল্লা নেই। যে যার মতন ঘোরাফেরা, গল্পগুজব করছে। দুটো ছোকরা নিজেদের মধ্যে বক্সিং প্র্যাকটিস করছিল মজা করে। একদিকে জনা কয়েক তাস নিয়ে বসে পড়েছে।

কিকিরা দেখছিলেন সবই, কিন্তু কাকে যেন খুঁজছিলেন।

হঠাৎ আদিনাথকে দেখতে পেয়ে গেলেন। আদিনাথের পরনে লুঙ্গি, গায়ে গরম চাদর, এক হাতে একটা কলাই করা মগ। চা খাচ্ছিলেন।

কিকিরা বললেন, “হরিশবাবু, চলুন আপনাদের ম্যাজিকবাবুর সঙ্গে আলাপ করে যাই। সেদিন ওঁর খেলা দেখলাম খানিকটা বেশ লাগল। তারাপদ, তোমার কেমন লেগেছে?”

“ভাল।”

“মফস্বলের লোক ম্যাজিক দেখতে পেলে বর্তে যায়। কেন জানেন, হরিশবাবু? কলকাতা শহরে বছরে দু-তিনবার করে বড় বড় ম্যাজিশিয়ানের খেলা দেখানোর প্রোগ্রাম থাকে। মশাই কী বলব, টিকিট নিয়ে মারামারি লেগে যায়। মফস্বলে এসব কোথায়…তারাপদ, তোমার মনে আছে, আমরা একবার সেই চিনে ম্যাজিশিয়ান ফুং লুং-কে জোর করে বর্ধমানে টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম, ও তো যাবেই না, বলে–আমি হংকং উইজার্ড-আমাকে তোমরা ছোট টাউনে নিয়ে যেতে চাইছ? আমার মর্যাদা থাকে না। …তা বুঝলেন হরিশবাবু, চিনে-সাহেবকে অনেক বুঝিয়ে বর্ধমানে নিয়ে গেলাম। কী বলব মশাই, তিন দিনে আমরাই এজেন্সি কমিশন হিসেবে হাজার পঁচিশ টাকা পকেটে ভরেছিলাম। ফুং লুং তারপর ঢাকায় চলে গেল। সেখানে খেলা দেখিয়ে হংকং ফিরে যাবে।”

তারাপদ জীবনে কোনোদিন ফুং লুং-এর নাম শোনেনি। বর্ধমানে যাওয়া তো দূরের কথা। কিকিরা যা পারছেন বলে যাচ্ছেন। মুখে কিছুই আটকাচ্ছে না। হঠাৎ তারাপদর মাথায় এল, কিকিরাকে একটু জব্দ করা যাক। মজা করেই। গম্ভীরভাবে তারাপদ বলল, “আপনি ফুং লুং বলছেন কেন! ওর নাম ছিল, চুং কিং চ্যান। আর আমরা ঠিক পঁচিশ হাজার পাইনি। হাজার কুড়ি হতে পারে।”

কিকিরা একটু হেসে তারাপদর দিকে তাকালেন। “চুং টুং ওর আসল নাম, বাজারে নাম হল ফুং লুং; ম্যাজিশিয়ানদের একটা করে মার্কেট-নেম থাকে। ফুং লুং নামেই লোকে তাকে জানে। আর কুড়ি-পঁচিশ হাজারের হিসেবটা তুমি ভুল করলে। আমরা হাজার পাঁচেক টাকা এক্সট্রা পাবলিসিটিতে আগেই খরচ করে ফেলেছিলাম–সেটা দিতে হল।”

তারাপদ জব্দ হয়ে হেসে ফেলতে যাচ্ছিল, কোনোরকমে সামলে নিল নিজেকে। কিকিরাকে কথায় জব্দ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

ততক্ষণে তারাপদরা আদিনাথের কাছে পৌঁছে গিয়েছে।

হরিশবাবু আলাপ করিয়ে দিলেন।

কিকিরা জোড় হাতে প্রায় স্তুতি করার মতন আদিনাথ ম্যাজিশিয়ানের প্রশংসা করে বললেন, “আপনি মশাই উঁচু দরের ম্যাজিশিয়ান। সার্কাসে বড় একটা ফার্স্ট রেট ম্যাজিশিয়ান পাওয়া যায় না। কাজচলা গোছের লোক দিয়ে ওরা চালিয়ে দেয়। আপনি সে-জাতের নন। ব্যাপারটা কী জানেন, একটা লোক কনসার্টে বেহালা বাজায়, আর একটা লোক একা গানের মজুলিশে বেহালা বাজায়। দুটোয় অনেক তফাত। প্রথমটা হল, গোলে হরিবোল। বুঝলেন না! দ্বিতীয়টা একেবারে নিজের। তা আপনাকে দেখে জাত চেনা যায়।”

আদিনাথ খুবই খুশি। এভাবে কেউ কথা বলে না। “আপনার ভাল লেগেছে।”

“ভাল কি মশাই, চমৎকার। এই তারাপদও বলছিলকী বলছিলে যেন তুমি তারাপদ?”

হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে তারাপদ বলল, “প্রায় হুং লুং-এর ক্লাস।”

“তা ঠিকই। বড় বড় ম্যাজিশিয়ানের বড় বড় লেজ। পাবলিসিটি। ছোটদের তো তা নয়। গেঁয়ো যোগীর অবস্থা…”

হরিশবাবু বললেন, “আদিনাথ মাঝে-মাঝে বলে সার্কাস ছেড়ে চলে যাবে। আমি তাকে আটকে রাখি। বলি, যাবে কোথায়? এখানে তবু ধরাবাঁধা মাইনে আছে। তোমার পরিশ্রমও কম। বাইরে গিয়ে এক-একা কতটা পারবে।”

“তা ঠিক। ঠিকই বলেন আপনি।”

কথা বলতে বলতে কিকিরা হঠাৎ মাটিতে নুয়ে পড়ে মাঠ থেকে কী যেন কুড়িয়ে নিলেন। “আপনার গলার চেইন।”

আদিনাথ অন্যমনস্কভাবে একবার গলায় হাত দিলেন। আমি চেইন পরি না।”

চেইনটা সোনার বলেই মনে হয়। চকচক করছে। সোনালি রং।

“তা হলে কার! আমি ভাবলাম আপনার…!”

“আমার নয়।”

“হরিশবাবু, আপনি তবে এটা রেখে দিন। খোঁজ করে দেখবেন কার চেইন হারিয়েছে। তাকে দিয়ে দেবেন।”

হরিশবাবু হাত বাড়ালেন। কিকিরা তাঁর হাতের মুঠোয় চেইনটা দিলেন যেন। তারপর আচমকা হাসতে লাগলেন।

হরিশবাবুর হাতে চেইন নেই, কিকিরার হাতেও নয়, মাটিতে পড়ে যায়নি। একেবারে হাওয়া যেন।

আদিনাথ বুঝতে পেরেছিলেন। অবাক হয়ে বললেন, “সে কী! আপনি এ-সব শিখলেন কোত্থেকে?”

কিকিরা হাসতে-হাসতে বললেন, “কম বয়েসে শখ হয়েছিল। শিখেছিলাম একজনের কাছে। শখ মিটে গেল। …তা শখ মিটলেও আমি মশাই ম্যাজিকের ভক্ত। এই যে তারাপদ–আমার মালিক–এরাও জানে।”

আদিনাথ বললেন, “পাকা হাত আপনার।” কিকিরা হাসতে হাসতে বললেন, “আরে না, এ তো ছেলেমানুষি খেলা। বাচ্চারাও জানে। …দু-একটা ভাল খেলা শিখেছিলাম একসময় অভ্যেস নেই, ভুলে গিয়েছি। যদি আপনি অভ্যেস করতে চান, শিখিয়ে দিতে পারি।” বলে তারাপদকে ইশারায় এগোতে বললেন, “চলি স্যার, আবার দেখা হবে।”

ডান দিক দিয়ে ঘুরে খানিকটা এগোতেই একটা তাঁবুর পাশে কৃষ্ণমূর্তিকে দেখা গেল। কৃষ্ণমূর্তির পাশে একজন মিস্ত্রি মতন লোক। দু-পাঁচটা যন্ত্রপাতি পড়ে আছে পাশে। কৃষ্ণমূর্তি তাঁর খেলা-দেখানো মোটর বাইকের কাজকর্ম দেখছিলেন।

তারাপদকে চোখের ইশারায় আসতে বলে কিকিরা কৃষ্ণমূর্তির দিকে এগিয়ে চললেন।

হরিশবাবু বললেন, “যাবেন ওদিকে?”

“চলুন। একটু আলাপ সেরে যাই।”

তারাপদ সার্কাস দেখতে এসে কৃষ্ণমূর্তিকে দেখেছে। কিন্তু তখন যেন মানুষটাকে দেখা যেত না, যেত সাজপোশাক, হেলমেট, ব্রিচেস-এর মতন জুতো। এখন কৃষ্ণমূর্তিকে স্বাভাবিক চেহারায় দেখা যাচ্ছিল।

মাথায় মাঝারি। গায়ের রং কালো। চৌকো ধাঁচের মুখ। মোটা নাক। থুতনির তলায় ফ্রেঞ্চকাট ধরনের দাড়ি। চোখ বড়বড়। চেহারাটা দেখলেই বোঝা যায়-গড়াপেটা স্বাস্থ্য। মাদ্রাজি লুঙ্গি আর লাল রঙের সোয়েটার পরে নিজের মোটর বাইরে কাজ দেখাশোনা কছিলেন কৃষ্ণমূর্তি। ভদ্রলোকের বয়েস বোধ হয় বছর চল্লিশ। দু-এক বছর বেশি হতেও পারে।

কিকিরা তারাপদদের নিয়ে কাছে আসতেই কৃষ্ণমূর্তি মুখ তুলে তাঁদের দেখলেন।

হরিশবাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন কিকিরাদের।

কিকিরা কিছু বলার আগেই কৃষ্ণমূর্তি হাত বাড়িয়ে দিলেন।

 হাত-মেলানো হয়ে গেলে কিকিরা বললেন, “আপনার খেলা আমি আর আমার মালিকরা দেখেছেন, মূর্তিসাহেব। বহুত আচ্ছা! স্পেলেডি, ওয়ান্ডারফুল। “

কৃষ্ণমূর্তি হাসলেন। নিতান্ত ভদ্রতার হাসি।

 কিকিরা বললেন, “আমি রয়েল সার্কাসে অনেকদিন আগে এরকম খেলা দেখেছিলাম। ভাল জমাতে পারেনি। আপনি সাহেব আমাদের চার্মিনার করেছেন।”

তারাপদ খেয়াল করেনি প্রথমে। পরে কানে লাগল। চার্মিনার! সে আবার কী! কিকিরার ইংরিজির সঙ্গে তারাপদর কম পরিচয় নয়। কিন্তু চার্মিনার। কিকিরা কি বেমালুম ভুল বলে গেলেন। চামড় বলতে চার্মিনার। অবাক কাণ্ড!

কৃষ্ণমূর্তি নিজেও অবাক!

কিকিরা কিন্তু হাসছেন। হাসতে-হাসতে বললেন, “সাহেব, আমাদের পাড়ার ছেলে-ছোকরাদের মুখে আজকাল এইরকম শুনি।ফ্যান্টা, ফ্যান্টাকোলা, চার্মিনার, লা পাত্তা…। মাফ করবেন।”

কৃষ্ণমূর্তি এবার হেসে ফেললেন।

কিকিরা বললেন, “এই সার্কাসের আপনি এক নম্বর। সিনেমার হল হিরো। সার্কাসের হল বেস্ট প্লেয়ার। সেদিন আপনার খেলা দেখে যখন বাইরে গেলাম–পাবলিক আপনার খেলার কথা বলছিল। তাই না তারাপদ?”

তারাপদ অনেক কিছুই এখন রপ্ত করে ফেলেছে কিকিরার। মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।

কৃষ্ণমূর্তি খুশি হলেন। বললেন, “রিস্কি খেলা।”

আরও দু-চারটে খোশামাদের কথা বলে কিকিরা বললেন, “আমাদের কথা আপনি হরিশবাবুর মুখে শুনলেন। …সাহেব, এবারের সিজনটা আমাদের ভাল যাচ্ছে না। আপনাদের সার্কাসটা নিয়ে সামথিং করতে চাই। মল্লিকসাহেবের সঙ্গে কথা বলছি। আপনি কী মনে করেন?”

“গুড প্রোপোজাল। মালিক কী বলল?”

“ফাইনাল কথা দেননি। ভাবছেন। ..আপনার সঙ্গে হয়ত কথা বলবেন।”

কৃষ্ণমূর্তির হাতে সিগারেটের প্যাকেট ছিল। লাইটার। চার্মিনারের প্যাকেট। সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিতে দিতে কৃষ্ণমূর্তি বললেন, “আমি মালিক নয়, বাবু!”

কিকিরা সিগারেট নিলেন। তারাপদরাও নিল। সিগারেট ধরাতে লাগল ওরা।

কৃষ্ণমূর্তি মোটর বাইকের মেকানিককে কী যেন বললেন। তারপর দু-চার পা সরে এসে দাঁড়ালেন।

কিকিরা বললেন, “আপনি বললে মালিক না বলবে না, সাহেব। আমি সব খবর রাখি। আপনি এই সার্কাসের গোড়ার লোক। সিনিয়ারমোস্ট…।”

কৃষ্ণমূর্তি হরিশবাবুর দিকে তাকালেন। মানে বোঝাতে চাইলেন, হরিশবাবু তুমিই এসব কথা বলেছ?

হরিশ সিগারেট টানতে লাগলেন।

কৃষ্ণমূর্তি বললেন, “আমি পুরানা লোক বাবু। সার্কাস শুরু হওয়ার সময় থেকেই আছি। মালিককে হেল্প করেছি। হরিবাবু জানেন। মালিক মরজি করেন তো সব হয়ে যাবে।”

কৃষ্ণমূর্তির বাংলায় দোষ বিশেষ নেই। উচ্চারণগুলোও মোটামুটি ভাল। মনে হয় না লোকটা দক্ষিণের।

“আপনি আমাদের হয়ে যদি একটু দেখেন…।” কিকিরা বললেন।

কৃষ্ণমূর্তি মাথা নাড়লেন সামান্য।

আরও দু-একটা কথা বলার পর কিকিরা বলল, “সাহেব, আপনি এমন ভাল বাংলা বলেন কেমন করে? বাংলাদেশে ছিলেন?” 

কৃষ্ণমূর্তি হাসলেন। বললেন, “আমি কলকাতায় পঁচিশ বছর ছিলাম। আমার মা বাঙালি। বাবা সাউথ ইন্ডিয়ান। বাবা ব্রিটিশ আমলে রয়েল নেভিতে ছিলেন। মা এখানে একটা মিশনারি স্কুলে লোয়ার ক্লাসে পড়াতেন।”

কিকিরা অবাক হলেন। তারাপদও।

কৃষ্ণমূর্তি নিজেই বললেন, “বাবু, আমি এখানে লেখাপড়া শিখেছি। ফুটবলার ছিলাম। …আমার বহুত ফ্রেন্ডস আছে এই শহরে।”

কিকিরার মনে পড়ল, অনিলের কথা। অনিল ঠিকই বলেছিল, কৃষ্ণমূর্তির অনেক বন্ধু আছে কলকাতা শহরে।

কিকিরা ঠিক বুঝতে পারলেন না, আর কীভাবে কথা চালানো যায়। আপাতত আজকের মতন এখানেই শেষ করা ভাল।

হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠে কিকিরা বললেন, “আরে, দশটা বেজে গিয়েছে। চলো তারাপদ।” বলে কৃষ্ণমূর্তির দিকে তাকালেন। “আজ চলি মূর্তিসাহেব। আমাদের কথা একটু মনে রাখবেন স্যার। কাল-পরশু আমরা আসছি আবার।”

কিকিরা আর দাঁড়ালেন না।

সার্কাসের বাইরে আসতে-আসতে হঠাৎ যেন কী মনে পড়ে গেল। পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের একটা টাটকা প্যাকেট বের করলেন। বড় প্যাকেট, কুড়িটা সিগারেটের। প্যাকেটটা হরিশবাবুর দিকে এগিয়ে দিলেন। “এটা আপনার জন্যে এনেছিলাম। ভুলেই যাচ্ছিলাম। নিন…।”

হরিশবাবু ইতস্তত করলেন।

“আরে নিন মশাই, আপনি না থাকলে মালিকের সঙ্গে দেখা করা কঠিন হয়ে পড়ত। নিন।“

প্যাকেটটা নিলেন হরিশবাবু। সার্কাসে তিনি পুরনো লোক। কিন্তু যখন থেকে তাঁর অঙ্গ গিয়েছে তখন থেকেই তিনি খেলোয়াড়ের মর্যাদা হারিয়েছেন। মাইনেপত্রও কম পান। দয়া করে যে তাঁকে রেখে দিয়েছে মালিক–এই না যথেষ্ট। খুবই দুঃখ হয় হরিশের। মনমরা হয়ে থাকেন। কালনার দিকে বাড়ি। বাড়িতে স্ত্রী, ছেলেমেয়ে আছে। বেঁচেবর্তে আছে কোনো রকমে। মাসকাবারি ক’টা টাকা পাঠানো ছাড়া হরিশ আর কিছু করতে পারেন না সংসারের। নিজের জন্যও পারেন না। বিড়ি টানাই তাঁর অভ্যাস। সিগারেট খাবার পয়সা কোথায়! কেউ দিলে অবশ্য হাত পেতে নেন।

তাঁবুর বাইরে আসতে-আসতে কিকিরা হরিশবাবুকে বললেন, “কৃষ্ণমূর্তিসাহেব আপনাদের সার্কাসের বড় অ্যাট্রাকশান। তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“ভদ্রলোকের অনেক ক্ষমতা এই সার্কাসে?”

 “ক্ষমতা আছে। মল্লিকবাবুর সঙ্গে ভাল সম্পর্ক।”

“উনি কি পার্টনার?”

“না। কে বলল?”

“এমনি জিজ্ঞেস করলাম।”

“মল্লিকবাবু একাই মালিক। তবে শুনেছি মালিকের এক বন্ধু আছেন। ধনিলাল। তাঁর টাকাও আছে সার্কাসে।”

“আচ্ছা! ধনিলাল কোথায় থাকেন?”

“পূর্ণিয়ায়।”

“সার্কাসে আসেন না?”

“দু-একবার আসতে দেখেছি।”

কিকিরা তারাপদকে ডাকলেন। রাস্তার কাছাকাছি এসে গেছেন। হঠাৎ বললেন, “হরিশবাবু, মূর্তিসাহেবকে তো ধরে এলাম। জানি না, উনি কী পরামর্শ দেবেন মল্লিকবাবুকে। …তা মূর্তিসাহেব মানুষটি কেমন?”

হরিশ যেন সামান্য অবাক হলেন। বললেন, “খারাপ কেন হবে। ভাল লোক। তবে কিনা একটু মাথা গরম। বড় কড়া কড়া কথা বলেন। আবার সার্কাসের কারও কিছু হলে দেখেনও। খারাপ লোক নন কৃষ্ণমূর্তি।”

কিকিরা তারাপদকে ইশারায় কিছু যেন বোঝাবার চেষ্টা করলেন।

“চলি হরিশবাবু। আবার আসব।”

.

রাস্তায় এসে কিকিরা কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেন। তারপর বললেন, “তারাপদ, কৃষ্ণমূর্তিকে কেমন দেখলে?”

তারাপদ কী বলবে! বলল, “কিছু বুঝতে পারলাম না। এমনিতে তো ভালই লাগল।”

কিকিরা বললেন, “আমারও খারাপ লাগেনি।” বলে এদিক-ওদিক তাকালেন। “একটা ট্যাক্সি ধরো তো!”

ট্যাক্স পাওয়া গেল।

গাড়িতে উঠে কিকিরা বললেন, “তারাপদ, আমি একেবারে ধাঁধায় পড়ে গিয়েছি।”

ট্যাক্সি চলতে শুরু করেছিল।

 তারাপদ বলল, “কেন?”

“না, না। ব্যাপারটা কেমন লাগছে হে! অনিল যা বলেছে তার সঙ্গে দেখছি সব মিলছে না। অনিল কী মিথ্যে কথা বলছে?”

“কেন? মিথ্যে বলবে কেন?”

“সেটাই তো ধরতে পারছি না।”

.

০৬.

বাড়িটা যে কত পুরনো বোঝা মুশকিল। গলির মধ্যে আলোও জোরালো নয়। আসলে এটা গলির গলি। তবে কানাগলি বা বাই লেন নয়। সন্ধের মুখে লোকজনও অত নেই।

কিকিরা তারাপদকে ইশারায় মুখের একটা দোকান দেখালেন। দোকানটা অবশ্য বন্ধ। আজ রবিবার। দোকানের মাথায় হাত দুয়েকের এক সাইনবোর্ড। একেবারে আনাড়ি লোককে দিয়ে লেখানো সাইনবোর্ড। কাঁচা লেখা। বিটি অটো ইলেকট্রিক হয়ত নাম ছিল। সাইনবোর্ডের অর্ধেকটাই মোছা।

তারাপদ বুঝতে পারল কিকিরা কী বোঝাতে চাইছেন। অনিল সেদিন এই দোকানটার কথা বলেছিল। এখানেই সে ষণ্ডামার্কা একটা লোককে দেখে ভয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরোতে পারছিল না।

কিকিরা গলি এবং পাড়াটা ভাল করে দেখতে লাগলেন। কলকাতা শহরের এইসব এলাকায় এমন গলি আছে যা দেখে বেশ বোঝা যায়, পাঁচমেশালি লোকের বসবাস এখানে। বাঙালি পাড়া বলতে যা বোঝায় তা নয় মোটেই, তবে বাঙালিও আছে। বেশির ভাগই অবাঙালি। হিন্দুস্থানী, দু-পাঁচটা বোধ হয় কেরলের লোক, মামুলি কিছু অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, এমনকী নেপালিও চোখে পড়ে।

পাড়াটার চেহারা দেখে বোঝা যাগ–বেশ পুরনো। ঘরবাড়িগুলোও সে-আমলের। বেশির ভাগ বাড়িই ইট-বেরোনো, জানলার পাল্লা নড়বড়ে, রংচং নেই। এরই মধ্যে আবার এক জায়গায় বস্তি ধরনের দু-তিনটে ঘর পাশাপাশি।

বাড়ি খুঁজতে কষ্ট হল না কিকিরাদের। চন্দনের কাছ থেকে ভাল করে জেনে এসেছে তারাপদ। চন্দনের আর আসা হল না আজ। রবিবার হলেও অন্য কাজে আটকে গেছে।

কিকিরা তারাপদকে বললেন, “এই বাড়িটা মনে হচ্ছে! তাই না?”

তারাপদ বলল, “হ্যাঁ। চাঁদু বলেছিল বাড়ির উলটো দিকে একটা ভাঙা টিউবওয়েল আছে। “

“চলো তবে।”

সদর বলে বিশেষ কিছু নেই বাড়িটার। হাট করে ভোলাই ছিল। নিচে এপাশে-ওপাশে ভাড়াটে। যে যার নিজের মতন ব্যস্ত। ওরই মধে কোনও ঘরে টেলিভিশন খোলা রয়েছে মনে হল। জোর শব্দ আসছিল।

দোতলার সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় কিকিরা বললেন, “পেন্সে হয়?”

তারাপদ বলল, “দেখা যাক। থাকতেও পারে।”

দোতলার সিঁড়ির শেষ মাথায় এক বুড়োর সঙ্গে দেখা। হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ। যাচ্ছিল কোথাও।

কিকিরা তাকে অনিলের কথা জিজ্ঞেস করলেন। বর্ণনা দিলেন অনিলের চেহারার।

বুড়ো ডান দিকটা দেখিয়ে দিল। বাড়িটার দোতলায় সামান্য ফাঁকা জায়গা। খোলা ছাদ।

দোতলাতেও ভাড়াটেদের হই-হল্লা। কোথাও যেন কিছু একটা হয়েছে। পোড়া গন্ধ আসছিল।

আচমকা অনিলকে দেখা গেল।

অনিল যেন কোথাও বেরাচ্ছিল, হঠাৎ কিকিরাদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বেশ অবাক। “আপনারা?”

“তোমার কাছেই এলাম।”

অনিল ইতস্তত করছিল।

 “কোথাও বেরোচ্ছ?”

“না, কাছেই। হোটেলে যাচ্ছিলাম।”

“হোটেলে?”

“কাছেই একটা হোটেল-রেস্টুরেন্ট আছে। ওখান থেকেই রাতের খাবার নিয়ে আসি।”

এই ভর সন্ধেবেলায় রাতের খাবার! কিকিরা অবাকই হলেন। বললেন না সেকথা। “ও!…তা খানিকটা দেরি হয়ে গেলে খাবার–”

“পাব। আসুন।”

অনিল ডাকল কিকিরাদের।

দু-চারটে খুপরি মতন ঘর পেরিয়ে একেবারে শেষের একটা ঘরের কাছে এসে দাঁড়ায় অনিল। ঘরের দরজা বন্ধ। তালা ঝুলছিল।

অনিল তালা খুলতে লাগল।

তারাপদ বলল, “কী হয়েছে? হল্লা শুনছিলাম।”

“স্টোভের আগুন ধরে গিয়েছিল। নিভে গিয়েছে। কিছু হয়নি।”

ঘরের দরজা খুলে বাতি জ্বালল অনিল।

ঘরটা খুবই ছোট। চিলে কুঠরি বললেও বলা যায়। একটি মাত্র ছোট জানলা। ঘরের মধ্যে একটা ক্যাম্প খাট। বিছানা পাতা রয়েছে। এলোমেলো। ঘরের একপাশে দড়ি ঝুলছে। দড়ির ওপর অনিলের জামাপ্যান্ট ঝোলানো। একটা তোয়ালেও। ঘরের এককোণে বড় কিট ব্যাগ, সুটকেস একটা। আশেপাশে সিগারেটের দোমড়ানো প্যাকেট, টুকরো-টাকরা সিগারেট ছড়ানো। এক প্যাকেট তাস পড়ে রয়েছে বিছানার ওপর প্যাকিং বাক্সর মতন একটা কাগজের বড় বাক্স। তার ওপর দু পাঁচটা খুচরো জিনিস রেখেছে অনিল। ব্রাশ, টুথপেস্ট, আয়না। পুরনো খবরের কাগজ দিন কয়েকের।

কিকিরা বললেন, “হাতে সময় ছিল; চলে এলাম। … কেমন আছ? নতুন কোনো ঝঞ্জাট হয়নি তো?”

মাথা নাড়ল অনিল। “না।”

“কাউকে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছ?”

“আমি বেশির ভাগ সময় বাড়িতেই থাকি।”

“তোমার কাছে কেউ এসেছিল?”

“না। দিদি এসেছিল পরশু। আর কেউ নয়।”

তারাপদ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘরটা দেখছিল। কিকিরা তাকে বলে দিয়েছেন। বলেছেন, তিনি অনিলের সঙ্গে কথা বলবেন যতক্ষণ পারেন, সেই সময় তারাপদর কাজ হবে সমস্ত কিছু খুঁটিয়ে দেখা।

কিকিরা ক্যাম্প খাটের ওপরই বসলেন। বসে তাসের প্যাকেটটা উঠিয়ে নিলেন। “তাস খেল নাকি?”

“হ্যাঁ।”

“একা-একা।”

“পেশেন্স খেলি। কী করব সারাদিন–”।

“তা ঠিক।” তাসগুলো একপাশে রেখে দিলেন কিকিরা। তারপর কী যেন ভাবতে-ভাবতে বললেন, “আচ্ছা, ধরো তুমি সার্কাসে ফিরে গেলে!”

অনিল সঙ্গে-সঙ্গে মাথা নাড়ল। “না। কী বলছেন আপনি?”

“ফিরে গেলে তোমার কোন ক্ষতি হবে?”

অনিল চুপ করে থাকল। মাথা নাড়তে লাগল।

কিকিরা অনিলকে লক্ষ করছিলেন। বললেন, “আজ ও-বেলায় আমি সার্কাসে গিয়েছিলাম তারাপদকে সঙ্গে নিয়ে। মল্লিকবাবুর সঙ্গে কথাও হল। আমি তোমার কথা কিছু বলিনি বটে, তবে তোমায় নিয়ে কথা উঠেছিল। ভদ্রলোক তোমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন মনে হল। তুমি এভাবে পালিয়ে আসায় ভীষণ চটে রয়েছেন।” বলে একটু থেমে অনিলকে বোঝাবার মতন করে বললেন, “আমার কিন্তু মনে হয় তুমি যদি ফিরে যাও তিনি খুশি হবেন। হয়ত গোড়ায় খানিকটা চেঁচামেচি করবেন, তারপর ঠাণ্ডা হয়ে যাবেন।”

অনিল চুপ করে থেকে কী যেন ভাবল। বলল, “আমি যেতে পারি না।”

“কেন পারো না, আমি বুঝতে পারছি না অনিল। তুমি নিশ্চয় জানোসার্কাসের লোক তোমার দিদির ঠিকানায় তোমার খোঁজ করতে গিয়েছিল?”

“জানি। দিদি বলেছে।”

“ওরা থানায় গিয়েছিল তা জানো?”

“আন্দাজ করছিলাম।”

“কৃষ্ণমূর্তির ভয়ে তুমি তোমার পেশা ছেড়ে দেবে। কী করবেন কৃষ্ণমূর্তি তোমার?”

বলব কি বলব না করে শেষে অনিল বলল, “আমায় খুন করতে পারেন। “

“কেন? তোমার কী এমন দোষ, কোন্ ক্ষতি তুমি তার করেছ যে তোমায় তিনি খুন করতে যাবেন। খুন করা কি চাট্টিখানি কথা! চাইলেই করা যায়।”

অনিল কোনো জবাব দিল না। কিকিরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন, “তুমি বলেছিলে কৃষ্ণমূর্তি মল্লিকবাবুর পার্টনার। আমরা খোঁজ করে জানলাম, কথাটা ঠিক নয়। মল্লিকবাবুর পার্টনার অন্য লোক। নাম ধনিলাল বা ধনিয়ালাল।”

অনিল বলল, “আমি শুনেছি, কৃষ্ণমূর্তিও পার্টনার। বাইরে কাউকে বলেন না।”

“ও!…একটু জল খাওয়াতে পারো?”

“জল!..দাঁড়ান এনে দিচ্ছি।”

ঘরে একটা জলের বোতল ছিল প্লাস্টিকের। বোতলে জল ছিল না। অনিল বোতলটা নিয়ে বাইরে চলে গেল।

কিকিরা ইশারা করলেন। তারাপদ সরে গেল দরজার কাছে। অনিলকে নজর করতে লাগল।

কিকিরা তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে অনিলের কিট ব্যাগটা দেখলেন। বন্ধ। চেন টানা। তালা লাগানো। সুটকেসও তালা বন্ধ। কিট ব্যাগ আর সুটকেসের পাশে একটা ছোট সরু কৌটো পড়ে ছিল। কৌটোটা তুলে নিলেন কিকিরা। দেখলেন। নস্যির ডিবে মনে হল। মুখটা খুললেন। গন্ধ পাওয়া গেল। নস্যি। কালো রঙের ডিবেটা বোধ হয় হাড়ের। ডিবের পাশে খোদাই করা ইংরিজি “N” অক্ষর লেখা। তার তলায় বাঁকাভাবে আরও দুটো খুদে ইংরিজি অক্ষর-জি সি। দেখে মনে হয়, কেউ কাঁচা হাতে নরুন বা ওইরকম কিছু দিয়ে ডিবের গায়ে অক্ষর গুলো লিখেছে।

“অনিল কি নস্যি নয়, তারাপদ? দেখেছ নিতে?” কিকিরা হঠাৎ বললেন।

“কই না!”

কিকিরা পকেটে পুরে নিলেন কৌটোটা। পোরার আগে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন আবার। একটু ঘাটাঘাটি করলেন জায়গাটা। জুতোর বাক্স আর পুরনো কাগজের আড়ালে পেস্ট বোর্ডের ছোট একটা বাক্স। খুবই ছোট। ওপরে লেখা আছে “ভেনাস চক’। কোম্পানির ছাপ। মানে কি আছে বাক্সটায়। কিকিরা আড়চোখে দরজার দিকে একবার সাবধানে তাকালেন। তারাপদ বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে, দেখছে অনিল আসছে কিনা।

বাক্সটার ওপর দিকের ঢাকা আলগা ছিল। কিকিরার লড়াতাড়ি ভেতরটা দেখে নিলেন। দেখে অবাক হয়ে গেলেন। চক বা খড়ি রাখার বাক্সর মধ্যে কয়েকটা ছোট-ছোট টিউব। একটা টিউব তুলে নিলেন কিকিরা। দেখলেন। গায়ে লেখা আছে সোয়ান কালার। মানে রং। ছবি আঁকার রং। গায়ে ছোট-ছোট হরফে আরও কিছু চোখের সামনে না ভাল করে ধরলে পড়া যাবে না।

কিকিরা বুঝতে পারলেন না, এত–প্রায় ছ-আটটা রঙের টিউব রাখার মানেটা কী? অনিল কি ছবি আঁকে? কই, তা তো জানা ছিল না। আশ্চর্য। ছবি আঁকার অন্য কোনো চিহ্ন তো কোথাও চোখে পড়ছে না।

তারাপদ শব্দ করল।

কিকিরা বুঝতে পারলেন অনিল আসছে। সঙ্গে সঙ্গে নিজের অজান্তেই যেন একটা টিউব পকেটে ভরে ফেললেন।

অনিল যখন ঘরে লে–কিকিরা জানলার কাছে সরে গিয়েছেন।

“আপনার জল।” অনিল জলের বোতল রেখে একটা গ্লাস নিয়ে এল। কাচের গ্লাস। ঘরেই ছিল। গ্লাস ধুয়ে জল ঢেলে এগিয়ে দিল।

কিকিরা জলের গ্লাস নিতে নিতে বললেন, “জানলাটা খুলে দেখছিলাম। কোন দিক ওটা?”

“পশ্চিম হবে। খেয়াল করিনি।”

জল খেলেন কিকিরা। আরামের নিশ্বাস ফেললেন। “আজ খানিকটা গরম-গরম লাগছে তাই না।”

অনিল কোনো কথা বলল না।

কিকিরা আরও দু-একটা সাধারণ কথা বললেন।

তারাপদ বুঝতে পারছিল এখানে আর অপেক্ষা করার মানে হয় না। কিকিরার পক্ষে এখন সরে যাওয়াই ভাল। বলল, “চলুন সার, আমাকে একবার ভবানীপুর যেতে হবে। আপনাকে বাসে তুলে দিয়ে আমি মিনি ধরব।”

কিকিরা বললেন, “, চলো।” বলে অনিলের দিকে তাকালেন। “তুমি তো বেরোচ্ছিলে, যাবে নাকি?”

অনিল বলল, “একটু পরে যাচ্ছি।”

পা বাড়িয়ে কী মনে করে কিকিরার বললেন, “অনিল, তুমি একবার সার্কাসে ফিরে গিয়ে দেখো না কী হয়! এত ভয় পাচ্ছ কেন?”

অনিল মাথা নাড়ল। না, সার্কাসে সে আর যাবে না।

“তোমার ইচ্ছে। …তা আমার ওখানে আসবে কবে?”

 “যাব।”

“পরশু এসো। আমি থাকব।”

.

বড় রাস্তায় এসে কিকিরা বললেন, “তারা, ব্যাপারটা আরও প্যাঁচালো হয়ে উঠল মনে হচ্ছে।

তারাপদ মাথা চুলকে বলল, “দেখছেন কিছু?”

অন্যমনস্কভাবে কিকিরা বললেন, “অনিলের কাছে কেউ আসে না–কথাটা ঠিক নয়। ওর দিদি ছাড়াও নিশ্চয় কেউ আসে। অন্তত এসেছিল।”

“কেমন করে বুঝলেন?”

“এই নস্যির ডিবে।” নিজের পকেট দেখালেন কিকিরা। “নেশা হল সর্বনাশা। যে-লোক পান, সিগারেট, বিড়ি, নস্যির নেশা করেছে তার পক্ষে নেশা সামলানো মুশকিল। আমার মনে হয়, নস্যিখোর কেউ অনিলের কাছে আসে, বা এসেছিল। নইলে তার ডিবে ও-ঘরে পড়ে থাকত না। তা ছাড়া ডিবের ওপর নাম খোদাই আছে। “N’। N’-টা কে? আর জি. সি। জিসি তো গোল্ডেন সার্কাস!”

তারাপদ চমকে ওঠার মতন করে বলল, “কেউ কি ফেলে গেছে।”

“না না, ইচ্ছে করে ফেলে যায়নি। পকেট থেকে পড়ে গিয়েছে।”

“তা না হয় বুঝলাম–কিন্তু নস্যি নেওয়া কোন লোক অনিলের কাছে আসে জানব কেমন করে? আসার সার্কাসের লোক বলছেন আপনি! জি-সি তো অন্য কিছু হতে পারে।”

“দেখি। অনিলকেই হয়তো বলতে হবে। … আচ্ছা তারাপদ, সার্কাসে আমরা যাদের সঙ্গে দেখা করলাম তারা তো কেউ নস্যি নেয় বলে মনে হল না। নেয়?”

তারাপদ বলল, “কই, আমি তো দেখলাম না। … কিন্তু স্যার, বিড়ি, সিগারেট, নস্যি সাধারণ নেশা। এমন নেশা সার্কাসের লোকরা নিশ্চয় করে। তাতে আর কী হল?”

“না, কী আ হবে।…আচ্ছা আর-একটা কথা বলো তো। অনিল হল সার্কাসের খেলোয়াড়–সে রঙের টিউব নি কী করবে?”

“রঙের টিউব?”

“হ্যাঁ, ব্যাপারটা অদ্ভুত। সাধারণ একটা চকের বাক্সর মধ্যে বেশ কয়েকটা ছোট-ছোট রঙের টিউব।”

“আমি দেখিনি স্যার।”

“তোমার দেখার কথা নয়, তুমি বাইরে তাকিয়ে অনিলকে ওয়াচ করছিলে। আমি একটা টিউব উঠিয়ে নিয়েছি। পকেটেই আছে আমার।”

তারাপদ যেন মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝছিল না। নস্যির ডিবে, রঙের টিউব। একটার সঙ্গে অন্যটার সম্পর্ক কী?

অনেকটা হেঁটে এসে কিকিরা বললেন, “রঙের টিউবগুলো ভাল করে আমি দেখিনি। দেশি কোম্পানির, বুঝতে পারলাম। টিউবের ওপর ছাপা কাগজ জড়ানো।”

তারাপদ বলল, “আপনার সন্দেহ হচ্ছে?”

“সন্দেহ .. তা হচ্ছে বইকি! জিনিসগুলো তো মনে হল কাগজের আড়ালে লুকিয়ে রাখা।”

“কেন?”

“বলতে পারছি না।”

“হয়ত এমনি রেখে দিয়েছে।”

“একেবারে অকারণে। অকারণে একটা পেস্টবোর্ডের বাক্সর মধ্যে কয়েকটা রঙের টিউব রেখে দেবে।… আমি তো বাবা বুঝছি না।”

তারাপদ ঠাট্টার গলায় বলল, “স্যার, এটা কি আপনার কোনও ক্লু?”

 কিকিরা কিছুই বললেন না। সিগারেট চাইলেন তারাপদর কাছে।

 এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে ছিল দুজনে।

সিগারেট ধরানোনা হয়ে গেলে কিকিরা বললেন, “কাল তো তোমার অফিস। আমি সারাদিন বাড়িতেই থাকব। বিকেলে বেরোব। সার্কাসেই যাব। তুমি সোজা সার্কাসে চলে যাবে। পারলে চাঁদুকে নিয়ে যেয়ো।”

তারাপদ বলল, “যেতে-যেতে সন্ধে হবে।”

“তা হোক।”

.

০৭.

সার্কাসের তাঁবুর বাইরে হরিশবাবুকে নিয়ে অনেকক্ষণ ঘোঘারাঘুরি করে শেষে এক জায়গায় বসলেন কিকিরা। গতকাল রবিবার বলে যত ভিড় জমেছিল আজ অতটা ভিড় নেই। কিছু লোকজন তো থাকবেই।

হরিশকে নানা কথায় ভোলাতে-ভোলাতে শেষপর্যন্ত কিকিরা তাঁকে বশ করে ফেলেছিলেন। আবার এক দফা চা, সিগারেট খাওয়ানোর পর কিকিরা বললেন, “আচ্ছা, ওই খেলোয়াড়টির আর কোনও খবর পেলেন না?”

“কার? অনিলের?”

“হ্যাঁ।”

“না। কোনো খবর নেই।”

কিকিরা বললেন, “ছেলেটির খেলা দেখার বড় শখ ছিল আমার। ও থাকলে–বোধ হয় ব্যবসাটা জামানো যেত। কী বলেন? আমি নিজের ইন্টারেস্টে বলছি মশাই।”

হরিশ মাথান নাড়লেন। “খেলাটা ভালই হত। লোকে নিয়েছিল।”

কিকিরা হঠাৎ বললেন, “আচ্ছা হরিশবাবু, ছেলেটি কেন পালাল বলতে পারেন?”

হরিশ বললেন, “কী জানি। কী যে হল–?”

কিকিরা চারপাশ দেখে নিলেন। এখানে কেউ নেই। একটু আড়ালে এবং আচ্ছাদনের তলায় তাঁরা বসে আছেন দুজনে। কিকিরা সাবধানে বললেন, “আপনি কিছু জানেন না?”

“আমি?”

“তা হলে মশাই আপনাকে বলি। একটা গুজব আমার কানে এসেছে। বলব আপনাকে?”

কিকিরা সতর্ক হয়ে বললেন, “আপনারা যতই বাইরে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করুন হরিশবাবু, গুজবটা কিন্তু শোন যাচ্ছে। সার্কাসে এত লোক। কে কখন বাইরে যাচ্ছে কার সঙ্গে কথা বলছে তা তো আপনাদের জানার উপায় নেই। তা ছাড়া আজ দশ-বারো দিন ধরে খেলাটা বন্ধ। গুজব তো রটবেই।”

“কিসের গুজব? কী বলছে বাইরে?”

“বলব?”

“বলুন।”

“সেই ছোকরাকে নাকি কেউ প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল সার্কাসের মধ্যে। “

হরিশবাবু থতমত খেয়ে গেলেন। কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক পলক। তারপর তোতলানোর মতন করে বললেন, “ককই।” আমি কিছু জানি না। এরকম গুজব কে রটাল!”

কিকিরা বুঝতে পারলেন হরিশবাবু ধাঁধায় পড়ে গেছেন। তাঁর চোখমুখ বলে দিচ্ছিল, তিনি যেন কিছু লুকোবারও চেষ্টা করছেন। কিকিরা বললেন, “আপনি বলছেন, গুজছ মিথ্যে? কিন্তু মশাই, গুজবটা যে মিথ্যে নয় তা আমি জানি।”

“কেমন করে জানলেন?”

“আমায় একজন বলেছেন।… হরিশবাবু, আপনি আমায় বিশ্বাস করতে পারছেন না! না পারলে আর কী করব!”

হরিশবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শেষে বললেন, “আমাদের ভেতরের কথা বাইরে বলতে নেই, রায়বাবু! আমি আবার এদের দয়ায় আছি। বুঝতেই তো পারছেন! আমার মুখ থেকে কোনোও কথা…”

“আরে না, আপনার-আমার মধ্যেকার কথা অন্য লোকে জানবে কেন?” বলতে বলতে কিকিরা আবার একটা সিগারেট দিলেন হরিশকে।

হরিশ বললেন, “কী গুজব আপনি শুনেছেন?”

কিকিরা বললেন, “শুনেছি, কৃষ্ণমূর্তির সঙ্গে অনিল ছোকরার রেষারেষি ছিল। সেটা শেষপর্যন্ত এত বেড়ে যায় যে–”।

কিকিরাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে হরিশ বললেন, “কৃষ্ণমূর্তি গুকে খুন করার চেষ্টা করেছেন! বলেন কী! একথা যে বলেছেন সে মিথ্যে, বাজে কথা বলেছেন। বানানো কথা।”

কিকিরা অবাক হলেন না। বললেন, “আপনি জানেন?”

“জানাজানির কিছু নেই রায়বাবু। কৃষ্ণমূর্তিকে আমি এত বছর ধরে দেখছি। তিনি খানিকটা দেমাক নিয়ে থাকেন, রগচটা, মুখে যা আসে বলে ফেলেন। তবে কাউকে খুন করার মানুষ তিনি নম। আমি আপনাকে বলছি।”

“কৃষ্ণমূর্তিকে আমারও সেদিন ভাল লেগেছে। কিন্তু হরিশবাবু, বাইরে এ-গুজব রটল কেমন করে?”

“কেউ রটিয়েছে।”

“কেন?”

“কেমন করে বলব! হয়ত ইচ্ছে করেই।”

“এমন কে আছে?”

“বলতে পারব না। থাকতেও পারে।”

“আপনার কাকে মনে হয়? মানে, মূর্তির সঙ্গে একেবারেই বনে না কাদের?”

হরিশ সিগারেটের টুকরোটা প্রায় শেষ করে ফেলেছিলেন। বাকিটুকু শেষ করে বললেন, “আমি কাকে সন্দেহ করব। দু একজন থাকতে পারে।”

“কে-কে?”

“লম্বু। মতিলাল।”

“লম্বু কে? মতিলালই বা কে?”

“লস্তু হল নাইডু। সাইকেলের খেলা দেখায়। তার সবচেয়ে ভাল খেলা–এক চাকার লম্বা সাইকেল নিয়ে। আর মতিলাল হল জোকার-ক্লাউন।”

“কৃষ্ণমূর্তির সঙ্গে এদের ঝগড়া নাকি?”

“মেলামেশা নেই। কেউ কাউকে দেখতে পারে না।”

“অনিলের সঙ্গে এদের বোধ হয় ভাবসার আছে।”

“লম্বুর সঙ্গে বেশি।”

“আচ্ছা, একটা কথা হরিশবাবু। লম্বু কি নস্যি নেয়?”

হরিশ কেমন অবাক হয়ে গেলেন। হঠাৎ নস্যির কথা কেন। বললেন, “নস্যির কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন! হ্যাঁ, নেয়।”

কিকিরা যেন শেষমেশে একটা আলোর ঝিলিক দেখতে পেলেন। বললেন, “নাইডুর পুরো নামটা কী?

“আমরা তো বুড্ডি বলে জানি।”

কিকিরা এবার নিশ্চিন্ত। এই নাইডু বা লম্বুর সঙ্গে অনিলের নিশ্চয় যোগাযোগ আছে। নাইডু অনিলের কাছে যায়। লুকিয়ে। কিন্তু কেন? তার নস্যির কৌটো অনিলের ঘরে পড়ে থাকার আর অন্য কী মানে হয়।

 কিকিরা বললেন, “আপনাদের লম্বু বা নাইডু কেমন লোক?”

“সুবিধের মানুষ নয়।”

“আর মতিলাল?”

“মতিকে আপনি মালিকের মোসাহেব বলতে পারেন। সব সময় মালিকের কাছে থাকে। মালিক যা বলেন মতিও তাই বলে, জল উঁচু তো জল উঁচু জল নিচু তো জল নিচু।”

কিকিরা মনে হল, আপাতত আর হরিশবাবুকে ঘাঁটিয়ে লাভ নেই। বেশি কচলালে লেবু তেতো হয়ে যায়, হরিশকে বেশি ঘাঁটালে সে অন্যরকম সন্দেহ করতে পারে।

.

তারাপদ আর চন্দন এসেছিল সময় মতন। কিকিরা খানিকটা সময় কাটিয়ে শেষে একসময় ধীরে ধীরে কৃষ্ণমূর্তির তাঁবুতে গিয়ে হাজির।

কৃষ্ণমূর্তি সবেই তাঁর খেলা দেখালো শেষ করে তাঁবুতে ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এই খেলাটা দেখাবার আগে কৃষ্ণমূর্তি কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলে না। বোধ হয় মনকে সংযত, স্থির রাখার চেষ্টা করেন। খেলা দেখানো হয়ে গেলে তিনি সোজা নিজের তাঁবুতে ফিরে আসেন। প্রচণ্ড মানসিক চাপের পর যেন ক্লান্তি লাগে বড়। দুর্বল মনে হয় নিজেকে। কিছুক্ষণ পরে নিজেকে সামলে নেওয়ার পর জল খান, চা খান। পোশাক-টোশাক খুলে ফেলেন। তারপর বিশ্রাম করেন।

কিকিরা আগেভাগেই সেটা জেনে নিয়েছিলেন। কৃষ্ণমূর্তি যখন বিশ্রাম করছেন–কিকিরা তামর দুই শাগরেদ নিয়ে তার তাঁবুতে ঢুকলেন।

তাঁবুতে ঢুকেই দুহাতে তাল বাজাবার মতন করে বললেন, কিকিরা, “অদ্ভুত স্যার। ওয়ান্ডারফুল। আজ আপনি টেক্কা দিয়ে দিলেন। কী খেলাই দেখালেন সাহেব। আমরা একেবারে দমবন্ধ হয়ে দেখলাম।”

কৃষ্ণমূর্তি এ-সময় কিকিরাকে এখানে দেখবেন ভাবেননি। বললেন, “আপনি! আপনারা?”

“আপনাকে সেলাম জানাতে এলাম সাহেব!”

“সেলাম!”

“আজকের খেলা বেস্ট।”

“রোজই দেখাই রায়বাবু!”

“তা তো দেখান। আমরাও দেখেছি। তবু সাহেবগুড, বেটার, বেস্ট আছে। আজ আরও ভাল লাগল। বেস্ট। নাকি হে তারাপদ?”

তারাপদরা যথারীতি ঘাড় নাড়ল।

কিকিরা বললেন, দেখুন মৃর্তিসাহেব। আমার এক চেনা ওস্তাদজি আছেন। রহিম খাঁ। তিনি বলেন, বেটা গানা তো রোজই গা, মাগর এক-কেদিন সুর আপনাই খেলা করে। …খুব দামি কথা। খেলা আপনি রোজই দেখান। এক-একদিন সেই খেলা আপনাকে ভর করে।”

কৃষ্ণমূর্তি হাসলেন। খুশি হলেন।

কিকিরা নিজেই এক প্যাকেট সিগারেট এগিয়ে দিলেন কৃষ্ণমূর্তিকে। কিনে আনিয়েছেন আগেই। দামি সিগারেট। “আপনার জন্যে এনেছি। রাখুন।”

কৃষ্ণমূর্তি হাসলেন। কিকিরার উদ্দেশ্য যেন বুঝতে পারছিলেন। বললেন, “ঠিক আছে, দিন। আপনারাও নিন।”

“আপনি নিন আগে। আমরা তো আছি।”

“চা খাবেন?”

“না না, চা নয়। অনেকবার খেয়ে ফেলেছি। আমার আবার ব্যাড লিভার। আর এরাও এইমাত্র চা খেয়েছে। ম্যাজিশিয়ান আদিনাথ খাইয়েছেন।”

কৃষ্ণমূর্তি নিজেই কথাটা তুললেন। বললেন, “রায়বাবু, আমি মালিকের সঙ্গে কথা বলেছি। মালিক বলছেন, দু’জায়গায় যেতে পারেন। টিটাগড় আর…”।

“চন্দননগর। “

“আর হবে না। শীত চলে গেলে সার্কাস সিজন খতম হয়ে যায়।”

“শীতের পর কোথায় যান আপনারা?”

“নর্থ বিহারে দু-এক জায়গায় ঘুরি। তারপর আমরা বেকার।”

“এত জিনিসপত্র,বাঘ, সিংহ, তাঁবু…”

“মালিকের দেশে চলে যায়। আবার দেওয়ালির পর… “

“ও! আপনি কি কলকাতাতেই থাকেন তখন?”

“না। আমি মধুপুরে থাকি। আমার বোনের ফ্যামিলি থাকে মধুপুরে।”

তারাপদ আর চন্দন কোনো কথা বলছিল না। শুনছিল। কৃষ্ণমূর্তিকে ওপর-ওপর বেশ ভদ্র মনে হয়।

নতুন প্যাকেটের সিগারেট বিলি করে কৃষ্ণমূর্তি বললেন, “রায়বাবু, আপনি কাল মালিকের সঙ্গে কথা বলে নিন।”

কিকিরা মাথা নাড়লেন। বলবেন। তারপর হঠাৎ বললেন, “মূর্তিসাহেব, একটা কথা বলি। আমরা ব্যবসাদার লোক। বেড়াল যেমন মাছের গন্ধ শুঁকতে চায়, আমরাও দু পয়সা বেশি রোজগারের কথা ভাবি। শুনেছি, আপনি আগে বড় সার্কাসে ছিলেন। গোল্ডেন সার্কাস বড় নয়। বাইরেও এরা বেশি খেলা দেখায় না। ব্যবস্থা করতে পারে না। তা যেখানেই দেখাক, খেলা নিয়ে কথা। খেলা যত ভাল থাকবে তত লোক আসবে দেখতে। দু-চারটে ভাল খেলা নিয়ে মিয়ে ব্যবসা করা যায় না। যায়?”

“না,” মাথা নাড়লেন কৃষ্ণমূর্তি।

 “আপনাদের সার্কাসে আপনি টপ। ট্রাপিজ চলনসই। জন্তু জানোয়ারের খেলা মামুলি। শুনলাম আপনারা।”

বাধা দিয়ে কৃষ্ণমূর্তি বললেন, “এবছর একটা নতুন খেলা চালাবার চেষ্টা করেছিলাম। আটকে গেলাম। কামানের মুখ থেকে একটা মেয়েকে ছুঁড়ে দেওয়া? খেলা দেখেছেন?”

তারাপদ আর চন্দন মুখ চাওয়াচাওনি করল। কিকিরা বললেন, “দেখিনি। তবে এরকম খেলার কথা শুনেছি। কিবা কাগজে পড়েছি।”

“আমরা অ্যারেঞ্জ করতে পারলাম না। আটকে গেলাম।”

“আচ্ছা, আপনাদের তো আরও একটা মোটরবাইকের খেলা ছিল। দেখানো হচ্ছে না। মল্লিকসাব বলছিলেন, খেলোয়াড় ছোকরা পালিয়ে গেছে।”

কৃষ্ণমূর্তি চুপ। কয়েক পলক দেখলেন কিকিরাকে।

“সত্যি পালিয়ে গেছে? বাইরে আমরা খোঁজ নিচ্ছিলাম। খেলাটা নাকি মন্দ হত না।”

আপনারা দেখেছেন?”

“না, না সাহেব। আমরা আসার আগেই খেলাটা বাদ হয়ে গেছে।”

“ও।”

“ছোকরা কি সত্যি পালিয়ে গেছে, স্যার?”

মাথা নাড়লেন কৃষ্ণমূর্তি।

 “হঠাৎ পালাল?”

“হ্যাঁ।”

“অদ্ভুত ব্যাপার! হয়েছিল কী?”

 “সমালিক কী বলল?”

“উনি কিছু বলতে পারলেন না। বললেন, কী হয়েছিল জানেন না। তবে বাড়িতে খোঁজ করেছিলেন। হাসপাতালেও খোঁজ নিয়েছেন। থানায়”

কৃষ্ণমূর্তি ক্রমশ যেন বিরক্ত, ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছিলেন। বললেন, “নেমকহারাম, বদমাশ। শয়তান।”

কিকিরারা কৃষ্ণমূর্তিকে লক্ষ করছিলেন। মূর্তিসাহেব বেশ উত্তেজিত, মুখ কঠিন হয়ে উঠেছে। চোখের দৃষ্টি রুক্ষ।

“কার কথা বলছেন? ছোকরা বদমাশ?” কিকিরা বোকার মতন ভান করে বললেন।

“বহুত নেমকহারাম। চোর।… আমি ওর পাত্তা লাগাচ্ছি বাবু। দু-একমাস ওই চোট্টা লুকিয়ে থাকবে। বরাবর পারবে না। আমি ওকে হাতে পাঁব।”

চন্দন আর তারাপদ চোখে-চোখে কী যেন কথা বলল। কিকিরা তারাপদদের দিকে তাকালেন না। কৃষ্ণমূর্তিকেই লক্ষ করছিলেন। শেষে বললেন, খানিকটা সহজ গলায়, “আপনি তো এখানে থাকছেন না। সার্কাসের সঙ্গে চলে যাবেন। তারপর মধুপুরে গিয়ে থেকে যাবেন বাড়িতে।”

কৃষ্ণমূর্তি বললেন, “আমি থাকি না থাকি আমার লোক থাকবে কলকাতায়। ওকে আমি ছেড়ে দেব না রায়বাবু।”

কিকিরা যেন মুখ ফসকে বলছেন, এমনভাবে বললেন, “ছোকরা কি আপনার ভয়ে পালিয়ে গেছে?”

কৃষ্ণমূর্তি সরাসরি সেকথার জবাব দিলেন না। বললেন, “চোর, চোট্টা, নেমকহারামরা কাকে ভয় পায়!”

“কী চুরি করেছে, স্যার?” বলেই কিকিরা নিজের অসাবধানতার জন্য যেন জিভ কাটলেন। “যাক গে। আপনাদের কথায় আমার মতন থার্ড পার্সনের থাকা কেন? মুখ ফসকে বলে ফেলেছি সাহেব। মাফ করবেন।”

কৃষ্ণমূর্তি বললেন, “মালিক আপনাকে কী বলেছেন?”

“উনি তো বললেন, উনি কিছুই জানেন না, ছোকরা কেন পালিয়েছে।”

“জানেন না? …না বলেননি?”

“তা হবে।”

“আচ্ছা! এবার।”

“হ্যাঁ স্যার, এবার আমরা যাই।… আপনাকে একটু বিরক্ত করলাম।”

 কৃষ্ণমূর্তি ঘাড় নাড়লেন। ঠিক আছে।”

কিকিরা উঠে পড়লেন। উঠতে বললেন তারাপদদের।

তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসার সময় কিকিরার কী খেয়াল হল, এগিয়ে গিয়ে কৃষ্ণমূর্তিকে বললেন, নিচু গলায়, “একদিন আসুন না আমাদের ওখানে।”

কৃষ্ণমূর্তি যেন বুঝতে পারলেন না। তাকিয়ে থাকলেন। কিকিরা বললেন, “আপনার তো রাত্তিরের দিকে খেলা। দুপুর দুপুর একদিন চলে আসুন।”

“আপনাদের অফিসে? কোথায় অফিস?”।

“অফিসে কী যায়-আসে সাহেব! আপনি যাব বললে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা আমরাই করব। আসুন একদিন। না হয় একটু খেয়েদেয়েই আসবেন। নেমন্তন্ন জানিয়ে যাচ্ছি।”

“দেখি।”

“আপনি আসুন। হয়ত আপনাকে একটু-আধটু সাহায্য করতে পারব স্যার।”

কৃষ্ণমূর্তি তাকিয়ে থাকলেন সামান্যক্ষণ। তারপর বললেন, “আপনি কে?”

কিকিরা হাসলেন। জবাব দিলেন না।

.

০৮.

পরের দিন আর সার্কাসে যাননি কিকিরা। যাওয়ার কথাও ছিল না।

তারাপদ আর চন্দন এল সন্ধের মুখে। তার আগেই শেষ শীতের এক পশলা খামখেয়ালি বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিতে রাস্তাঘাটও হয়ত ভেজেনি।

তারাপদরা এসে দেখল কিকিরা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছেন। ভদ্রলোককে আগে কখনও দেখেনি তারাপদরা। তবে কিকিরার সঙ্গে এত লোকের চেনাজানা যে, সকলকে দেখা বা চেনার উপায় নেই।

তারাপদরা আসার পর-পরই ভদ্রলোক চলে গেলেন।

তারাপদ বলল, “কে স্যার? আগে তো দেখিনি।”

“ কিকিরা বললেন, “আমার এক পুরনো বন্ধু। ওল্ড ফ্রেন্ড।”

“আগে কখনো দেখিনি।”

“এদিকে আসে কই যে দেখবে। আমি একটা কাজে ওর কাছে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম কাজটা সেরে একবার আসতে দয়া করে। তাই এসেছিল। ওরা হল কাজের লোক বুঝলে তারাবাব, সময় কোথায় আসার। আমার মতন বেকার আর ক’টা পাবে। আমার হল হাউস ইটিং অ্যান্ড ফরেস্ট ব্যাফেলো ড্রাইভিং।”

চন্দন আর তারাপদ হাঁ হয়ে গেল। “কী বললেন স্যার!”

চন্দরা হো হো করে হেসে উঠল। মেজাজ খুশি থাকলে কিকিরা চমৎকার-চমৎকার ইংলিশ বলেন।

হাসি সামলাতে সময় গেল খানিকটা। তারপর চন্দন বলল, “অনেকদিন পরে আপনার মেজাজ শরিফ দেখছি।”

কিকিরা বললেন, “না। শরিফ একেবারেই নয়। তবে হ্যাঁ, একটু ভাল।”

“কিছু হয়েছে?”

 “আশার আলোনা কী বলে যেন–তাই দেখছে পাচ্ছি।”

তারাপদরা জায়গামতন বসে পড়েছিল।

তারাপদ বলল, “আশার আলোটা কেমন একটু শুনি?”

 মাথা হেলিয়ে কিকিরা বললেন, “শুনবে বাবা, তোমাদের শোনাব না তো কাকে শোনাব! তার আগে বলো তো, কৃষ্ণমূর্তি কোথায় এনে বসাই। “

“মানে?”

“বাঃ! কাল তে তাঁকে নেমন্তন্ন করে এলাম।”

চন্দন বলল, “আপনি বলছিলেন বটে। কিন্তু কাজটা কি ভাল করলেন?”

কিকিরা মাথার চুল ঘাঁটতে ঘাঁটতে বললেন, “খানিকটা ঝুঁকি নিয়েই কাজটা করলাম। না করে উপায় ছিল না।”

“আমরা তো এবার ধরা পড়ে যাব, স্যার। সত্যি যদি একটা অফিস ঘর থাকত, তা হলে না হয় কৃষ্ণমূর্তিকে অফিসে বসিয়ে তারপর কোনো হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়ানো যেত। আপনি ওঁকে বসাবেন কোথায়? আমাদের মতলব, পেশা সবই তো তিনি জেনে যাবেন। হয়ত ওঁর মনে সন্দেহও হয়েছে।”

তারাপদ বলল, “কৃষণমূর্তি না আপনাকে জিজ্ঞেস করেছেন সেদিন–আপনি কে? আমরা অবশ্য আপনার শেষের কথা কিছু শুনিনি তখন–তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম। আপনি ওঁর সঙ্গে কথা বলে পরে বাইরে এলেন। তারপর নিজেই সব বললেন।”

কিকিরা চুরুশ হাতড়াতে লাগলেন। বললেন, “চাঁদু, আমি একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি। কৃষ্ণমূর্তি বা অনিল এরা যদি না নিজের থেকে সব কথা বলে–আমরা আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারব না। জানতেও পারব না। ওদের দু জনের একজনকে দিয়ে কথাটা বলাতে হবে। অনিলকে আর আমি বিশ্বাস করি না।”

“কেন?”

“ও আগাগোড়া মিথ্যে কথা বলছে। তারাপদকেই জিজ্ঞেস করো–”

চন্দন আজ আর অসন্তুষ্ট বা বিরক্ত হল না। সে সবই শুনেছে কিকিরা আর তারাপদর মুখে। শুনে তার খারাপ লেগেছে।

কিকিরা বললেন, “কয়েকটা জিনিস তুমি খেয়াল করে দেখো। প্রথম হল, অনিল যেভাবে কৃষ্ণমূর্তিকে ভিলেন সাজাতে চেয়েছে আমাদের কাছে–মূর্তিসাহেব তেমন লোক নন। সার্কাসের হরিশবাবু তার সাক্ষী। এমনকী আমি আদিনাথকেও ঠারেঠোরে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, মূর্তিকে কেউ শয়তান, খুনে, বদমাশ ভাবে না। তিনি অহঙ্কারী, মাঝে-মাঝে চেঁচামেচি করেন, রাফ হয়ে ওঠেন–এই একমাত্র তাঁর দোষ। আবার লোকটা বেশ ভাল বলেও শুনলাম। কাজেই অনিল আগাগোড়া কৃষ্ণমূর্তিকে যেভাবে দেখাতে চেয়েছে সেটা ঠিক নয়। নিজের কোনো উদ্দেশ্য মেটাবার জন্যে মূর্তির নামে অত কথা বলেছে।”

চন্দন বলল, “মূর্তিরও কিন্তু প্রচণ্ড রাগ দেখলাম অনিলের ওপর।”

“হ্যাঁ। সৈকথায় পরে আসছি।” কিকিরা এতক্ষণ পরে চুরুটটা ধরিয়ে নিলেন। চুরুট ধরিয়ে বললেন, “অনিল যে মিথ্যে কথা বলে যাচ্ছে তার আর একটা প্রমাণ, অনিল সার্কাসের লোকের সঙ্গে লুকিয়ে যোগাযোগ রেখেছে। যার সঙ্গে রেখেছে তার নাম নাইডু বা লঘু। সাইকেলের খেলা দেখায়। নস্যিখোর। তার নস্যির ডিবে অনিলের ঘরে পাওয়া গেছে। অথচ অনিল আমাদের কাছেও বলেছে, দিদি ছাড়া তারক কাছে কেউ আসে না। অথচ তার কাছে সার্কাসের লম্বু আসে। কেন আসে?”

বগলাচরণ চা নিয়ে এল।

 কিকিরা তাঁর চা নিয়ে একটু সোজা হয়ে বসলেন। বগলা চলে গেল।

সামান্য থেমে কিকিরা বললেন, “তোমাদের কি মনে আছে, দ্বিতীয় দিন ও যখন একলা-একলা আসে তখন বলেছিল, ইলেকট্রিকের দোকানে একটা ঘণ্ডাগুণ্ডা লোক বসে থাকায় ও ভয় পেয়ে বাড়ি থেকে বেরোতে পারছিল না। লোকটাকে নাকি ও দোকানে বসে থাকতে দেখেছিল সারাবেলা, তার ঘরের জানলা দিয়ে। পরে বিকেলে যখন রাস্তায় নামল-তখনো লোকটাকে দেখে সে আর এগোতে ভরসা পায়নি। মনে আছে কথাটা?”

তারাপদ আর চন্দন ঘাড় নাড়ল।

কিকিরা বললেন, “এটাও মিথে কথা। আমি সেদিন অনিলের ঘরের জানলা খুলে বাইরে দেখছিলাম। ওটা পশ্চিম দিকের জানলা। ওখান থেকে গলির মুখের ইলেকট্রিকের দোকান দেখা যায় না।”

চন্দন বলল, “ছেলেটা পর-পর এত মিথ্যে কথা বলল কেন?”

কিকিরা বললেন, “সেদিন না হয় দেরি করে আসার জন্যে একটা অজুহাত খাড়া করেছিল। আমি ওটা বাদ দিচ্ছি। হয়ত ওর ঘরে কেউ এসেছিল–তাই দেরি হচ্ছিল।… কিংবা ও বোঝাতে চাইছিল, ওর ওপর নজর রাখা হচ্ছে।”

তারাপদ বলল, “ও ছেলে খুব সেয়ানা, স্যার। তাই তো মনে হচ্ছে।”

কিকিরা বললেন, “আরও একটা জিনিস তোমরা জানো না। তারাপদ খানিকটা জানে। অনিলের ঘরে আমি একটা মামুলি ছোট বাক্স পাই। চক পেনসিল রাখার বাক্স। সেই বাক্সর মধ্যে চকের বদলে কয়েকটা টিউব ছিল। রঙের টিউব। ছোট সাইজের একটা টিউব আমি পকেটে পুরি নিয়ে চলে এসেছিলাম। সেই টিউবটা দেখবে?”

তারাপদ আর চন্দন কৌতূহলের চোখে চেয়ে থাকল।

কিকিরা উঠলেন। চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখলেন একপাশে।

ঘরের এককোণে ঝোলানো একটা সেলফ থেকে কাগজে মোড়া কী যেন নামিয়ে নিলেন। নিয়ে এগিয়ে এসে চন্দনের হাতে দিলেন। “নাও, খুলে দেখো।”

চন্দন কাগজ খুলল। দেখল, রঙের টিউব। টিউবের গায়ে যে ছাপা কাগজ জড়ানো ছিল সেটা কেউ খুলে ফেলেছে। টিউবের একটা পাশ পুরোপুরি কাটা। সরু করে। গা দিয়ে লাল রং বেরিয়ে প্রায় জমে রয়েছে।

চন্দন কিছুই বুঝল না। তারাপদও দেখল।

কিকিরা বললেন, “অনিল সার্কাসের খেলোয়াড়। ছবি সে আঁকে না। অন্তত তার কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি। তা হলে চকের বাক্সর মধ্যে রঙের টিউব লুকিয়ে রাখার মানে?”

তারাপদ বলল, “কী মানে?”

“মানেটা বলছি।” কিক্রি নিজের জায়গায় ফিরে এসে বসলেন। পকেটে হাত ঢোকালেন। কাগজে মোড়া কী যেন বার করে কাগজটা খুলতে-খুলতে বললেন, “ওই রঙের টিউবের মধ্যে এই প্ল্যাটিনাম নির্মানে ছুঁচটা ছিল।” ছুঁচটা দেখালেন কিকিরা।

চন্দন উঠে গিয়ে ছুঁচটা হাতে নিল। দেখল। ইঞ্চি চারেক লম্বা ছুঁচ। অনেকটা ক্রুশ কাঁটার মতন সরু। ফিরে এসে তারাপদকে দিল উঁচটা।

কিকিরা বললেন, “জিনিসটা আমিই রঙের টিউব থেকে বার করেছি। কিন্তু ওটা যে কী, বুঝতে পারিনি। যে ভদ্রলোককে তোমরা একটু আগে দেখলে তিনি পাকা লোক। ওঁর দোকান আছে পার্ক স্ট্রিটে। পুরনো জিনিস বেচাকেনা করেন। কিউরিয়ো শপের মতন দোকানটা। দত্তরায় আমার পুরনো বন্ধু। তাঁকে দিয়ে এসেছিলাম দেখতে। আজ সে ফেরত দিয়ে গেল। বলল, এ একেবারে খাঁটি প্ল্যাটিনাম। সেলাইয়ের দুচের মতন সরু না হলেও সরু। পেনসিলের সিসের মতন মোটা বড় জোর। তাই না?”

হ্যাঁ, তারাপদ বলল।

“ নিডল-শেপ। কিন্তু একটা জিনিস ভাল করে নজর করলে দখতে পাবে। ওই নিড়ল এর একটু মুখে কয়েকটা দানা আছে। চারটে দানা। বালির মতন।”

তারাপদরা দেখল।

কিকিরা বললেন, “এই প্ল্যাটিনাম নিডল রঙের টিউবের মধ্যে লুকিয়ে রাখার মানেটা কী? কে রেখেছে? কেন রেখেছে?”

চন্দন বলল, “স্যার, প্ল্যাটিনাম তো ভীষণ দামি জিনিস। সোনাকেও ছাড়িয়ে যায়।”

“সে পরের কথা। এই জিনিস এখানে কেন? এভাবে কেন? আর অনিলের কাছেই বা কেন?”

এত কেন’র একটারও উত্তর তারাপদদের জানা ছিল না। তারা চুপ করে থাকল।

চন্দনের ভাল লাগছিল না। মায়াদির কথায় সে আগ বাড়িয়ে অনিলকে ধরে এনেছিল কিকিরার কাছে। মায়াদি তো তাকে কিকিরার কথা বলেননি। তিনি জানেনই না কিকিরাকে। চন্দন নিজেই গরজ দেখাল। ভাবল, মায়াদির একটা উপকার করা যাক। অনিলও প্রথমে গা করেনি কিকিরার কাছে আসতে। মায়াদি জোর করলেন, কান্নাকাটি করলেন। ভাইয়ের জীবন নিয়ে তিনি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। …যা হওয়ার তা তো হয়ে গিয়েছে–এখন কী করা যায়! অনিল ছোকরাকে আর পছন্দ হচ্ছিল না চন্দনের।

কিকিরা বললেন, “তারা, সেদিন তো অনিলকে বলে এলুম একবার আসতে। সে কিন্তু এল না।”

“কেন বলুন তো?”

“তাই ভাবছি। আমি ভেবেছিলাম সে আসবে।… কেন ভেবেছিলাম জানো? অনিল যখন চকের বাক্স খুলে দখেছে–ওর মধ্যে থেকে একটা টিউব গায়েব হয়ে গিয়েছে–ও আমাকে সন্দেহ করবে। করতে পারে। আর সন্দেহ করলে আসা উচিত। তাই না?”

“হয়ত সন্দেহ করেনি বা চকের বাক্সটা খুলে দেখেনি।”

“হতে পারে। আবার এমনও তো হবে পারে–এখন সে বুঝতে পেরেছে। আমরা নিতান্তই ভদ্রতা রক্ষা করতে সেদিন তার কাছে যাইনি। কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে গিয়েছিলাম। আর রঙের একটা টিউবও নিয়ে এসেছি চুরি করে। এখন তার সন্দেহ হয়েছে। ভয়ে সে আসতে পারছে না। ভাবছে, যদি ফেঁসে যায়!”

তারাপদ মাথা নাড়ল।

চন্দন বড় করে নিশ্বাস ফেলে বলল, “কিকিরা, আমি কি অনিলের কাছে যাব?”

 “এখন নয়। তার আগে কৃষ্ণমূর্তিকে নিয়ে কী করি বলো তো? ওঁকে বেশি দরকার। মূর্তির কাছ থেকে কথা বার করতে না পারলে–আমি ধরতেই পারছি না কিছু।”

“আপনি ওঁকে নিয়ে বসুন তা হলে কোথাও।”

“বসার জায়গা বলতে আমার এই বাড়ি। তাতে আমরা ধরা পড়ে যাব ঠিকই। কিন্তু কৃষ্ণমূর্তি হয়ত সত্যি কথাটা বলতে পারেন। জানি, এটা ঝুঁকি নেওয়া হবে। এ ছাড়া উপায় নেই।”

তারাপদ আর চন্দন নিজেদের মধ্যে কথা বলল। শেষে তারাপদ বলল, “স্যার, তাই করুন। কৃষ্ণমূর্তিকে এখানেই আনুন। তারপর যা হওয়ার হবে। আমাদের আর কী হবে! ফাঁসি তো হবে না।”

.

০৯.

তারাপদই নিয়ে এল কৃষ্ণমূর্তিকে।

 চন্দন আসবে দুপুরের পর। হাসপাতাল ফেরত।

কৃষ্ণমূর্তিকে সদর খুলে দিলেন কিকিরা; হাত বাড়িয়ে সাদর অভ্যর্থনা করলেন। “আসুন মূর্তিসাহেব। গরিবের বাড়িতে আপনার পায়ের ধুলো পড়ল। আসুন।”

কৃষ্ণমূর্তিকে নিয়ে নিজের ঘরে আসতেই মূর্তি পা যেন আটকে গেল। ভীষণ অবাক হয়ে তিনি ঘরটা দেখছিলেন। কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। এরকম বিচিত্র ঘর তিনি জীবনে দেখেননি। এখানে কী আছে আর কী নেই। মুখে কথা আসছিল না মূর্তির। চোখের পলকও যেন পড়ছিল না।

কিকিরা হাসি-হাসি মুখে বললেন, “বসুন।… ওই জায়গাটায় বসুন। আরাম পাবেন। তারাপদ, চায়ের কথা বলো, আগে একটু চা হয়ে যাক। এখন তো মাত্র বেলা এগারোটা।”

কৃষ্ণমূর্তির মুখে কথা ফুটল। “এই ঘর আপনার?”

“ঘর বলতে পারেন, জাদুঘরও বলতে পারেন, কিকিরা তামাশা করে বললেন।

তারাপদ মজার গলায় বলল, “ওল? কিউরিয়োসিটি শপও বলতে পারেন। চোরাবাজারের হরেক জিনিস এখানে পাবেন, মায় বাগবাজারের টপ্পা গাইয়ে, অমুকের গাঁজার কলকে, থিয়েটারের ফুলুট…।” বলে হাসতে হাসতে সে চায়ের কথা বলতে গেল।

কৃষ্ণমূর্তি বসলেন। তাকিয়ে-তাকিয়ে তখনও এই অদ্ভুত ঘরটি দেখছিলেন। শেষে বললেন, “রায়বাবু, আপনি কে?”।

কিকিরা হাসিমুখেই বললেন, “আমি কিকিরা। কিঙ্করকিশোর রায়। ছোট করে কিকিরা।”

কৃষ্ণমূর্তি বললেন, “আর?…আমি সেদিনও আপনাকে কথাটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। আপনি জবাব দেননি।”

কিকিরা বললেন, “আমি সামান্য লোক। নিন একটা সিগারেট খান ততক্ষণে।” কিকিরা পকেট থেকে ভাল সিগারেট বার করে এগিয়ে দিলেন।

“আগে একটু জল খাওয়ান।” এমনভাবে বললেন কৃষ্ণমূর্তি যেন কিকিরার কাছে এসে তাঁর গলা শুকিয়ে গেছে।

“বলছি।” কিকিরা দরজার কাছে গিয়ে বগলাকে জল আনতে বললেন।

কৃষ্ণমূর্তি বললেন, “আপনি আমায় অবাক করেছেন। তবে একটা কথা–আপনারা যে কোনো ইম্প্রেসারিও কোম্পানির লোক নন–সেটা আমি আন্দাজ করেছিলাম।”

“কেমন করে?”

 কৃষ্ণমূর্তি এবার একটু হাসলেন। বললেন, “রায়বাবু, আমি সার্কাসে অনেককাল আছি। এ লাইনের কথা জানি। মানুষও কম দেখিনি। খেলার তাঁবু কেমন করে পড়ে আমি জানি। আপনি ওখানে একটু গলতি করেছিলেন। পরে ভাবলাম কী জানি হয়ত আপনারা কোম্পানি খুলে সার্কাস পার্টিও বসাচ্ছেন।”

বগলাচরণ জল নিয়ে এল।

কৃষ্ণমূর্তি জলের গ্লাস নিলেন। জল খেয়ে ধীরেসুস্থে সিগারেট ধরালেন।

কিকিরা বললেন, “স্যার, তবে সত্যি কথাটা বলি। আমি হলাম ম্যাজিশিয়ান। কিকিরা দি ওয়ান্ডার। এখন অবশ্য আর খেলা দেখাই না।”

“মাঝে-মাঝে দেখান। “

“মানেটা বুঝলাম না সাহেব।”

“আদিনাথকে দেখিয়েছেন। আমি শুনেছি। হরিশবাবুও সেই ম্যাজিক দেখেছেন।”

“ও ম্যাজিক নয়, হাত সাফাই।”

“তা হল। এখন বলুন আমাকে আপনি কোন সাফাই দেখাতে চান? এত খাতির করে নেতন্তন্ন খেতে ডেকেছেন যখন-তখন বিনি মতলবে ডাকেননি। আমিও সেটা বুঝে এসেছি।”

তারাপদ ঘরে এল।

কিকিরা বললেন, “মূর্তিসাহেব, আমার কোনো বদ মতলব নেই। কীইবা থাকবে! গরিব মানুষ। নিজের মনে থাকি আর ডুগডুগি বাজাই।”

“বলুন, কেন এনেছেন এখানে?”

“বলব স্যার। কিকিরা ভদ্দরলোক। আপনি আসতে না আসতে বিরক্ত করতে সে চায় না। চা-টা খান। একটু জিরিয়ে নিন। সব কথাই বলব আপনাকে।”

“আপনি এখনও বলতে পারেন।”

“চা-টা অন্তত খেয়ে নিন। ..মূর্তিসাহেব আমি ম্যাজিশিয়ান হলেও কুকিং এক্সপার্ট। আপনার জন্যে নিজের হাতে দু-তিনটে খাবারও করেছি। দেখুন, মুখে কেমন লাগে।”

বগলা চা নিয়ে এল।

.

চা খাওয়া শেষ হল।

 কিকিরা তাঁর কথা বলতে লাগলেন। কিছুই লুকোলেন না। যা ঘটেছে। অর্থাৎ চন্দন, হাসপাতালের সিস্টার মায়া, অনিল, অনিলের পালিয়ে আসা, লুকিয়ে থাকা, কৃষ্ণমূর্তির বিরুদ্ধে তার অভিযোগ, ভয় দেখান, শাসানো, মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া ইত্যাদি সবই বললেন একেএক।

কৃষ্ণমূর্তি একমনে শুনছিলেন সেসব কথা। মুখের ভাবভঙ্গি পালটে যাচ্ছিল মাঝে-মাঝে। কখনও রাগে মুখ কেমন শক্ত হয়ে উঠছিল, নাকমুখ কুঁচকে যাচ্ছিল ঘৃণায়, কখনও বিড়বিড় করে কিছু বলছিলেন, গালমন্দ করছিলেন অনিলকে।

কিকিরার কথা শেষ হওয়ার পর সকলেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। কৃষ্ণমূর্তি এমন ভাবে বসেছিলেন যেন রাগে, বিরক্তিতে, ঘৃণায় তাঁর সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে।

খানিকক্ষণ পরে কিকিরা বললেন, “প্রথমেই আমার কেমন খকটা লেগেছিল, মূর্তিসাহেব। আমি নাক গলাতে চাইনি। চাঁদু–মানে চন্দনই বেশি গা। দেখাল। অবশ্য তার দোষ নেই। অনিলের দিদি ময়ার কথা শুনেই সে ভেবেছিল ছোকরার সত্যিই কোনো বিপদ হতে পারে।”

কৃষ্ণমূর্তি বললেন, “বুঝতে পারছি। ওই ছেলেটি …চন্দন–ডাক্তার বললেন না?”

“হ্যাঁ। এখন হাসপাতালে ডাক্তার হয়ে আছে। চাঁদুই প্রথম অনিলকে দেখে।”

“সেই চোর, বদমাশ, স্কাউড্রেলটা এখন কোথায়?”

“কলকাতাতেই লুকিয়ে আছে।..বলব আপনাকে। তার আগে আপনার তরফ থেকে কিছু শুনতে চাই। আপনি স্যার আমাদের বিশ্বাস করতে পারেন। আর এটাও নিশ্চয় বিশ্বাস করবেন আপনার সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র খারাপ ধারণা থাকলে–এত কথা বলতাম না। আপনাকে নিজের বাড়িতে ডেকেও আনতাম না। শুধু আপনার মুখ থেকে আসল ব্যাপারটা জানার জন্যে আপনাকে এখানে এনেছি। সার্কাসের তাঁবুতে সব কথা হয় না মূর্তিসাহেব। সময়ও হয় না।”

কৃষ্ণমূর্তি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। ভাবলেন। তারপর বললেন, “অনিল কোথায় আপনি জানেন?”

“জানি। তারাপদও জানে।” বলে তারাপদকে দেখালেন।

“আমায় সেখানে নিয়ে যাবেন?”

“যাব। যাব বলেই আপনাকে ডেকেছি। কিন্তু তার আগে আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই সত্যি কী ঘটেছে?”।

কৃষ্ণমূর্তি বললেন, “বেশ, আপনাদের আমি বলছি। যা-যা ঘটেছেবলব। তবে ছোট করে।”

“তাই বলুন।”

 কৃষ্ণমূর্তি তাঁর কথা শুরু করলেন। “অনিল কীভাবে সার্কাসে এসে পড়েছিল সেকথা আপনাদের বলেছে। মিথ্যে বলেনি। মল্লিক তাকে এনেছিল। আমি প্রথমটায় তাকে নজর করতে চাইনি। সার্কাসে এরকম মামুলি খেলোয়াড় দু-চারটে আসে। চলেও যায়। ভেবেছিলাম, মল্লিকের শখ হয়েছে। এনেছে, ছোঁক দু-চার মাস পরে নিজেই চলে যাবে সাকার্স ছেড়ে।…দেখলাম, সে গেল না। বরং তার মন পড়ে গেল সার্কাসে। যত্ন। করে খেলা শিখতে লাগল। হরদম প্র্যাকটিস করত। তখন আমিও তার দিকে ঝুঁকে পড়লাম। ওকে নানা ব্যাপারে সাহায্য করতে লাগলাম। খেলার ব্যাপারেও। ছোকরাকে আমি পছন্দই করেছিলাম রায়বাবু। ভাল লাগত। ভালবাসতাম।”

কিকিরা বললেন, “অনিল নিজেও তা বলেছে। গোড়ায়, আপনি তাকে পছন্দ করলেও পরে–”

“মিথ্যে বলেছে। পরেও আমি তাকে ভালবাসতাম। আমি কোনোদিনই নিজে তাকে আমার খেলা শেখাতে চাইনি। সেই বরং আমায় বলত খেলাটা তাকে রপ্ত করিয়ে দিতে। অনিল যদি বলে থাকে আমি তাকে খেলা শেখাবার নাম করে জখম করার চেষ্টা করতাম–তবে সে আগাগোড়া বানিয়ে বলেছে, মিথ্যে বলেছে।”

“আপনি কি তার খেলা দেখানোর বাইকটায় গণ্ডগোল করে রেখে দিতেন?”

“না। আমি জানি তাতে কী বিপদ হতে পারে।”

“ওকে শাসানোর জন্যে আপনি কাগজ গুঁজে রেখে দিয়ে যেতেন ওর তাঁবুতে।”

“না। কখনও নয়।”

“কাগজ থেকে অক্ষর কেটে-কেটে শাসানোর কথাগুলো লেখা থাকত বলে ও বলেছে।”

“বানানো কথা–।”

“আমারও তাই মনে হয়েছিল। কাগজের অক্ষর কেটে-কেটে কেউ চিঠি লেখে না। মানে নর্মাল প্রসেস নয়। টাইপ করে লিখতে পারে হাতের লেখায় যেন ধরা পড়ে না যায়।”

“সে আপনারা জানেন। আমি তাকে চিঠি লিখে কখনও শাসাইনি।”

“শেষের দিকে আপনার সঙ্গে নাকি সম্পর্ক ভাল ছিল না?”

“ভাল ছিল নাকেন? আমি ওকে কী করেছিলাম? ও যদি নিজে আমাকে এড়িয়ে চলে, আমি কী করব!”

এমন চন্দন এসে হাজির হল।

কিকিরা বললেন, “সেকি! তোমার তো দুপুরে আসার কথা।”

 চন্দন আগেই কৃষ্ণমূর্তিকে দেখে নিয়েছে। হেসেছে সামান্য। চন্দন বলল, “কাজ শেষ না করেই চলে এসেছি বলবেন না। আজ একটু তাড়াতাড়ি হয়ে গেল।”

“ভালই হয়েছে। বসো। “

চন্দন বসল।

কিকিরা কৃষ্ণমূর্তির দিকে তাকালেন। বললেন, “যা বলছিলেন, স্যার। অনিল নিজেই আপনাকে এড়িয়ে যাচ্ছিল। কারণটা কী?”

কৃষ্ণমূর্তি বললেন, “কারণটা আপনারা জানেন না। আমিও বুঝতে পারিনি। বুঝলাম সেদিন, যেদিন দেখলাম, আমার ট্রাঙ্ক থেকে একটা দামি জিনিস চুরি গিয়েছে। আর অনিলও পালিয়েছে সার্কাস ছেড়ে।”

“কিকিরা বললেন, “কী জিনিস?”

“বাটারফ্লাই ট্রে।”

কিকিরা, তারাপদ চন্ন–তিনজনেই অবাক। বাটারফ্লাই ট্রে? মানে, একটা ট্রে! না অন্য কিছু?

কিকিরা অবাক হয়ে বললেন, “সেটা কী জিনিস মূর্তিসাহেব?”

কৃষ্ণমূর্তি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “একটু বুঝিয়ে না বললে বুঝতে পারবেন না। মুখে বললেও বুঝবেন না। যদি চোখে দেখতেন বুঝতে পারতেন–সে-জিনিস কী! ওরকম জিনিস দেখেননি। জীবনে দেখবেন বলেও মনে হয় না। ..রায়বাবু, আপনার হয়ত মনে আছে, আমি বলেছিলাম আমার বাবা লাস্ট ওয়ারের সময় নেভিতে ছিলেন। রয়েল। ইন্ডিয়ান নেভিতে। তিনি ছিলেন ওয়ারশিপে–মানে যুদ্ধ জাহাজের রেডিয়ো অপারেটর। লাস্ট ওয়ারে আমার বাবাকে জাহাজে করে নানা জায়গায় ঘুরতে হয়েছে। বিশেষ করে মেডিটারেনিয়ানে। আমরা বলি ভূমধ্যসাগর। বাবার জাহাজটা পাহারাদারির কাজ করত। আপনারা নিশ্চয় জানেন না, যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়–হিটলারের নাজি জার্মানরা নানা জিনিস স্মাগল করে আনত নানা জায়গা থেকে। যেমন, রেডিয়াম, ডায়মন্ড, প্লাটিনাম, আরও অনেক কিছু। প্লাটিনাম দরকার লাগত এরোপ্লেনের কলকজার কাজে, অন্য আরও পাঁচটা কাজেও লাগত। নিজেদের চাহিদা মিটাবার জন্যে চোরাই চালানের ওপর ভরসা না করে জার্মানদের উপায় ছিল না। একদিকে বেপরোয়া স্মাগলিং অন্যদিকে তাদের গুপ্তচরদের কাজকর্ম। গুপ্তচর ছড়িয়ে দিয়েছিল সর্বত্র। দক্ষিণ আমেরিকা পর্যন্ত।” বলতে বলতে একটু থামলেন কৃষ্ণমূর্তি। যেন দম নিলেন। তারপর বললেন, “এই যে বাটারফ্লাই ট্রে-এর কথা বললাম, এগুলো তৈরি হত ব্রাজিলে। আসত রিও ডি জেনিরো থেকেই বেশিরভাগটা।”

তারাপদ বলল, “ট্রেগুলো কি সোনার ছিল? হিরেটিরে থাকত?”

“না। কাচের ট্রে। ব্রাজিলিয়ান গ্লাস। কিন্তু কাচের তলায় যে রঙিন প্রজাপতির চেহারা থাকত–তার কোনো তুলনা নেই। অপূর্ব ডিজাইন। কত রং, কত কারুকাজ, কী সুন্দর! এমন বাহার, রং, সূক্ষ্ম কাজ আপনারা দেখেননি। কল্পনাও করতে পারবেন না।”

কিকিরা কিছু বলার আগেই চন্দন বলল, “প্রজাপতি আঁকা কাচের ট্রে! কী হত এগুলো?”

“কী হত–সেটাই রহস্য। জার্মানরা শয়ে শয়ে এগুলো আনাত চোরাই পথে। তাদের এমব্যাসিতে থাকত, যুদ্ধের বড় বড় কর্তাদের ঘরে থাকত।”

“কেন?”

“তা বলতে পারব না। ব্রিটিশরা একসময় এই চোরা চালান ধরতে পারল। তাদের গুপ্তচররা চোরাই পথে আসা ট্রেগুলোর হদিস পেয়ে বেশ কিছু ট্রে পাকড়াও করে নিয়ে যেতে লাগল নিজেদের দপ্তরে। নানাভাবে পরীক্ষা করল। ভাঙল টুকরো-টুকরো করে–তবু কিছু ধরতে পারল না। আজ পর্যন্ত ধরা যায়নি ওগুলো কেন আসত, কী কাজে লাগত জার্মানদের। তবে শেষপর্যন্ত মনে হয়েছিল, ওই প্রজাপতিগুলো দখেতে যতই সুন্দর হোক, শখ করে ওগুলো কেনা হত না, চোরাই পথে আনানো হত না। ওগুলো ছিল সিক্রেট মেসেজ পাঠাবার অদ্ভুত এক ব্যবস্থা। কিন্তু কী গোপন খবর আসত, কীভাবে সেই প্রজাপতির রং আর ডানার নকশা থেকে খবরটা জার্মানরা ধরত তা ব্রিটিশ গুপ্তচররা বুঝতে পারেনি। ওটা রহস্য থেকে গেছে।”

কিকিরা বললেন, “আপনার বাবার কাছে এইরকম একটা ট্রে ছিল?”

“হ্যাঁ। যুদ্ধের শেষে বাবা এইরকম একটা ট্রে হাতে পেয়েছিলেন। সেটা তিনি নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। বাবার মুখেই আমি বাটারফ্লাই ট্রে-এর কথা শুনেছি।”

“আপনার বাবা মারা যাওয়ার পর—”

“বাবা বেশিদিন বাঁচেননি। পঞ্চাশ পেরোবার আগেই মারা যান। আমাও মাও বছর কয়েক পরে মারা যান।”

কিকিরা বললেন, “এই ট্রে আপনার কাছে ছিল?”

“হ্যাঁ।”

“নিজের কাছেই রাখতেন সব সময়?”

“না। আমি সার্কাসের সঙ্গে ঘুরে বেড়াই। ও-জিনিস নিজের কাছে রাখব কেমন করে!”

“তা হলে?”

“এবার আমার কাছে ছিল। মধুপুরে বোনের কাছেই বরাবর থাকত ওটা। এই মাসখানেক আমার কাছে ছিল। মধুপুর থেকে নিয়ে এসেছিলাম।”

“কেন?”

“কেন!.. গত ডিসেম্বরে আমি খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখি। ইংরিজি কাগজে। পারসোন্যাল কলমে। কলকাতার এক ভদ্রলোক জানিয়েছিলেন, তিনি ব্রাজিলিয়ান বাটারফ্লাই ট্রে খোঁজ করছেন। তিরিশ হাজার টাকা কিংবা তার কিছু বেশি তিনি দিতে পারেন ট্রে-এর জন্যে।”

“ও! আপনি ওটা বিক্রি করতে চাইছিলেন।”

“হ্যাঁ। টাকার আমার খুব দরকার রায়বাবু। অন্তত হাজার চল্লিশ।”

“এত টাকা দরকার?”

 কৃষ্ণমূর্তি চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। অন্যমনস্কভাবে সিগারেট ধরালেন আরও একটা। তারপর বিষণ্ণ গলায় বললেন, “আপনাদের কাছে কোনো কথাই যখন লুকোলাম না, তখন আর-একটা কথাও লুকোব না। … বছর চারেক আগে আমি মল্লিকের কাছ থেকে তিরিশ হাজার টাকা ধার করেছিলাম। আমার বোনের জন্যে। তারা বড় অসুবিধেয় পড়েছিল। আমার ভগ্নীপতির পা চলে যায়। তার চিকিৎসা ছাড়াও মধুপুরের বাড়িটা ছেড়ে দিতে হত টাকাটা না পেলে। মল্লিকের কাছ থেকে টাকাটা নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম শোধ করে দেব ধীরে-ধীরে। পারিনি। বরং সেই টাকার সুদ গুনতে হয়েছে আমাকে। এখন বোধ হয় হাজার পঁয়ত্রিশ মল্লিককে দিতে হবে। হালে সে বড় তাগাদা দিচ্ছিল। টাকাটা নাকি সে তার বন্ধু আর পার্টনার ধনিলালের কাছ থেকে নিয়ে আমায় দিয়েছিল।”

কিকিরা বুঝতে পারলেন।

“আমি মল্লিককে বলেছিলাম-”এবার টাকাটা আমি দিয়ে দেব। ব্যবস্থা করছি। মল্লিককে আমি ট্রে-টা দেখিয়েছিলাম। কাগজের লেখাটাও।”

কিকিরা যেন এবার অনেকটা পরিষ্কারভাবে ঘটনাটা বুঝতে পারছিলেন। বললেন, “মল্লিকবাবুকে আগে কখনো ট্রে দেখাননি?”

“না। তবে ও আমার কাছে শুনেছিল।”

“ট্রে দেখে মল্লিকবাবুর অবস্থা কেমন হল?”

“অবাক হয়ে গেল। সে সভাবতেই পারেনি এমন জিনিস হতে পারে!”

তারাপদ বলল, “সেই ভদ্রলোক যিনি এই ট্রে কিনতে চেয়েছিলেন–আপনি তার কাছে যাননি। দেখা করেননি?”

“গিয়েছিলাম। ভদ্রলোক ছিলেন না। হপ্তা দুয়েকের জন্যে দিল্লি গিয়েছেন। কিন্তু আমার মনে হল, ওই ভদ্রলোক মিল ম্যান হয়ে কাজ করছেন। কোনো জামান ভদ্রলোক হালে এখানে এসেছেন। ঘোরাফেরা করছেন। চলে যাবেন আবার জার্মানিতে। তাঁর হয়ে এই ভদ্রলোক কাগজে বিজ্ঞাপনটা দিয়েছিলেন।”

কিকিরা বললেন, “কথাটা আপনি মল্লিকবাবুকে বলেছিলেন?”

“হ্যাঁ।”

“তারপরই আপনার বাক্স থেকে ট্রে-টা চুরি যায়।”

“দিন দুই পর।”

“চুরির কথাটা আপনি মল্লিকবাবুকে বলেননি?”

“বলেছিলাম।”

“কী বললেন উনি?”

“খানিকটা চেঁচামেচি করল। লাফাল।”

“তখন থেকেই অনিল বেপাত্তা।”

“হ্যাঁ।”

“অনিলকে আপনি ট্রের কথা বলেননি? দেখাননি তাকে?”

“কথাটা আগে বলেছিলাম। ট্রে দেখানো হয়নি।”

“চুরির কথাটা সার্কাসের কে-কে জানে? সকলেই শুনছে নাকি?”

“আমি কাউকে বলিনি। মল্লিক যদি বলে থাকে।”

কিকিরা মনে-মনে ভাবলেন কী যেন। তারপর বললেন, “মুর্তিসাহেব, আমি আপনাকে একটা জিনিস দেখাব। আপনি কি বলতে পারবেন ওটা কী?”

কিকিরা উঠলেন। ঘরের এককোণ থেকে সেই রঙের টিউব আর প্লাটিনামের নিল নিয়ে এসে কৃষ্ণমূর্তির হাতে দিলেন।

কৃষ্ণমূর্তি চমকে উঠলেন। অবাক হয়ে তিনি একবার কিকিরা দিকে তাকাচ্ছিলেন, আর একবার সেই সরু উঁচটা দেখছিলেন। কথা বলতে পারছিলেন না। ভীষণ চঞ্চল যেন। বিহ্বল।

“এ আপনি কোথায় পেলেন রায়বাবু?”

“কোথায় সে?”

“জিনিসটা কী মুর্তিসাহেব?” 

কৃষ্ণমূর্তি নিজের কপালে চড় মারলেন। মাথা ঝাঁকাতে লাগলেন জোরে-জোরে। তারপর বললেন, “এ-জিনিস আপনি পেলেন! কেমন করে ফেলেন! পাওয়ার কথা নয় রায়বাবু। এরকম তিনটে সরু জিনিস বাটারফ্লাইয়ের মাঝখানটায় ছিল পিঠের দিকে। শিরদাঁড়ার মতন জায়গাটায়। আর তার পাশ থেকে আরও সরু-সরু এই একই জিনিস প্রজাপতির পাখনায় ছড়িয়ে গিয়েছিল। ওর আর নিচের পাখনায়।”

“সবসমেত ক’টা ছিল?”

“পিঠে তিন। পাখনার দুপাশে দুটো করে, মোট চারটে।”

“মানে সাতটা।”

“হ্যাঁ।“

“এগুলো তা হলে প্রজাপতির মধ্যেই ছিল?”

“কাচের তলায় রায়বাবু! ভেতরে। ছাঁচের মধ্যে।”

“এগুলো কি রঙিন ছিল?”

“আলবাত ছিল। আলাদা-আলাদা রং। তবে রংটা তলার দিকে ছিল না।…আমি বুঝতে পারছি না, এগুলো কে বার করল। কাচের ট্রে না ভেঙে ওই ট্রের একটা জিনিসও বার করা সম্ভব নয়। মাই গড, অনিল কি ট্রে ভেঙে ফেলেছে? হায় হায়! রায়বাবু আমি–আমি, আমার সব চলে গেল। আমি এখন কী করব?” কৃষ্ণমূর্তি পাগলের মত ছটফট করছিলেন। গলা বন্ধ হয়ে এল তাঁর। কেঁদে ফেললেন যেন।

তারাপদ চন্দন মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিল। কিকিরাও কেমন হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন।

হঠাৎ কৃষ্ণমীর্তি বললেন, “সে কোথায়? জোচ্চর, বদমাশ, শয়তান–সেই নেমকহারামটা কোথায়? আমি তাকে খুন করব। আমার এত বড় সর্বনাশ সে করল। কোথায় সে?”

কিকিরা নরম গলায় বললেন, “আপনি শান্ত হোন। আমরা আপনাকে অনিলের কাছে নিয়ে যাব। মূর্তিসাহেব, একটু ধৈর্য ধরুন। এখন তার কাছে যাওয়ার সময় নয়।…নিন, চলুন–এবার হাতমুখ ধুয়ে দুটো খেয়ে নিন।.আমাকে বিশ্বাস করুন, আজই আমরা (অনিলের কাছে যাব। রাত্তিরে।”

“রাত্তিরে?”

“তখন যাওয়াই ভাল। সে থাকবে। এখন গেলে যদি তাকে না পাই! তা ছাড়া আপনি এখন কোনো কথাই কাউকে বলবেন না। আভাস দেবেন না। রাত্তিরে আপনার খেলা শেষ হলে–আমরা সার্কাস থেকেই অনিলের কাছে চলে যাব।”

খাওয়াদাওয়া শেষ হতে-হতে দুপুর গড়াল।

কিকিরারর বসার ঘরে চারজনে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল।

পান চিবোতে-চিবোতে কিকিরা বলেলেন, “একটা কথা আপনাকে তখন বলা হয়নি, স্যর।..সার্কাসের লম্বু মানে নাইডুর সঙ্গে অনিলের যোগাযোগ আছে বলে আমার মনে হয়। N’ লেখা একটা নস্যির ডিবে আমি অনিলের ঘরে পেয়েছি। শুধু “N’ নয়, তলায় আবার ছোট করে “G.C.’ লেখা ছিল। বোধ হয় ওটা গোল্ডেন সার্কাস।…আমার ধারণা, অনিল সার্কাস ছেড়ে পালিয়ে পাওয়ার পর–আপনাদের সার্কাসে কী হচ্ছে না হচ্ছে–তার খবরাখবর সে অনিলকে দিয়ে আসে।”

কৃষ্ণমূর্তি বললেন, “নাইডুকে আজকাল খুব মল্লিকের কাছে যেতে-আসতে বসে থাকতে দেখছি। “

“এখন তো আমার মনে হচ্ছে, মল্লিকবাবুই আসল লোক। ভদ্রলোক অনিলকে দিয়ে আপনার জিনিস চুরি করিয়েছেন। কিন্তু কেন? উনি কি ঠিক করেছিলেন নিজেই সেই বিজ্ঞাপনের ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে টাকাটা নিয়ে আসবেন?”

কৃষ্ণমূর্তি মাথা নাড়লেন। বললেন, “না। মল্লিকের ধারণা প্রজাপতির ওই বাহার আর রঙের তলায় হীরে-চুরি গোছের পাথর-টাথর লুকননা আছে। বিক্রি করলে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার কেন, লাখ দেড়-দুই টাকা সে কামাতে পারে। মূর্খ, ইডিয়েট। ওর মধ্যে হীরেটিরে নেই। এমন অসামান্য জিনিস আপনারা জীবনে দেখেননি।”

তারাপদ বলল, “জিনিসটা নিশ্চয় খুবই সুন্দর। কিন্তু একটা কথা মূর্তিসাহেব। আপনি বলছেন, এক জার্মান ভদ্রলোক কলকাতায় বেড়াতে বা কোনো কাজে এসে ওইরকম একটা ট্রে কিনতে চেয়েছেন। দাম দিয়েছেন তিরিশ হাজারেরও বেশি। এটা একটু বাড়াবাড়ি হল না কী?”।

কৃষ্ণমূর্তি বললেন, “মনে হয় বাড়াবাড়ি। তবে বাড়াবাড়ি নয়।”

“কেন?”

“হিটলারের আমলের নাজি জার্মানির হোমরাচোমরাদের কাছে এই বাটারফ্লাই ট্রে-র অন্য মানে ছিল, কদর ছিল, আর দাম ছিল। দাম মানে টাকার দাম নয়। অন্য কোনো দাম। কী দাম আমি জানি না। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের অমন মাথাওয়ালারাও সেটা ধরতে পারেনি। আমি তো কোন ছার!”

“আপনি কি বলতে চাইছেন–পুরনো কোনো নাজি”

“জানি না। এখনও কোন-কোনো নাজি নাকি এদেশে-ওদেশে লুকিয়ে নাম ভাঁড়িয়ে বেঁচে আছে। তারা মাঝেমধ্যে ধরাও পড়েছে। কাগজেই পড়ি। সেরকম বুড়ো কোনো নাজি-র এরকম জিনিস দরকার হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে সিক্রেট কোনো নাজি অগানিজেশান এ-সব খুঁজে বেড়াচ্ছে। হয়ত তাদের দরকার। যেন দরকার আমি বলতে পারব না।”

চন্দন বলল, “এমনও তো হতে পারে, জিনিসটার ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে।”

“হতে পারে। হাজারবার হতে পারে।…তবে আমার অত জেনে কী লাভ! আমি ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা পেলে মল্লিকের দেনা শোধ করে দিতাম। মল্লিক আমায় কম কথা শোনায় না। অপমান, অপদস্ত করে। অথচ ওর জন্যে আমি কম কিছু করিনি।”

কিকিরা বললেন, “মল্লিকবাবু তো আপনার বন্ধু।”

কৃষ্ণমুর্তি করুণ মুখে হাসলেন যেন। বললেন, “ওর অসময়ে বন্ধু ছিলাম। এখন নয়। আর বনারাই তো সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক হয়ে ওঠে। মল্লিককে অনেক বেশি লোভে পেয়েছিল।”

কিকিরা মাথা নাড়লেন। কথাটা যেন মেনে নিলেন।

.

রাত হয়েছিল খানিকটা।

অনিল ঘরেই ছিল। আচমকা কিকিরাদের দেখতে পেয়ে চমকে উঠল। ভয় পেল। “আপনারা?”

কিকিরার পেছনে তারাপদ আর চন্দন। কৃষ্ণমূর্তি নেই।

 কিকিরা বললেন, “তোমার কাছেই এলাম।”

অনিল তাকিয়ে থাকল।

 কিকিরা ভাল করে অনিলকে দেখতে দেখতে বললেন, “অনিল, তুমি আজ আর আমাদরে ঠকাবার চেষ্টা করবে না। মিথ্যে কথাও বলবে না। আমরা সব জানি। প্রমাণ পেয়েছি। তুমি মূর্তিসাহেবের বাটারফ্লাই ট্রের কী করেছ? কোথায় সেটা?”

অনিল বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। ভয় পেয়েছিল প্রচণ্ড। তবু বলল, “কী বলছেন আপনারা?”

কিকিরা বললেন, “তুমি জানো কী বলছি! ট্রে কোথায়! চন্দন, তুমি ওই ব্যাগ আর সুটকেসটা দেখো তো?”

চন্দন এগিয়ে যাচ্ছিল, অনিল এসে সামনে দাঁড়াল। “আমার ঘরে এসে আপনারা আমার জিনিসে হাত দেবেন! কী ভেবেছেন আপনারা?”

কিকিরা বললেন, “দরকার পড়লে দেব। তুমি কি ঝামেলা বাধাতে চাও। যদি চাও, আমরা চলে যাচ্ছি, তবে নিচে দুজন পুলিস আছে। গিয়ে তাদের পাঠিয়ে দিচ্ছি।” পুলিসের কথাটা ভয় দেখানোর জন্য বললেন।

পুলিসের নামে অনিল থতমত খেয়ে গেল।

 “পুলিস কেন?”

“তোমার কাছে ট্রে আছে কিনা দেখবে!”

“আছে।”

“দেখি।”

অনিল মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।

“কী হল?”

“ট্রেটা আমি ভেঙে ফেলেছি। শুধু কাচের টুকরো ছাড়া আর কিছু নেই।”

“কোথায় সেটা?”

“আমর কিট ব্যাগে।”

“তা হলে তুমিই ট্রে চুরি করেছিলে?”

অনিল মাথা আরও নিচু করল।

 “কে তোমায় চুরি করতে বলেছিল?”

“মালিক।”

“তোমায় কি টাকা দেবে বলেছিল?”

“হ্যাঁ। টাকা ছাড়াও বিক্রির ভাগ দেবেন বলেছিলেন।”

“তুমি বলছ, ট্রেটা তুমি ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলেছ!”

“হ্যাঁ। আপনারা দেখতে পারেন। কাঁচ ছাড়া আর কিছু পাবেন না।”

 “মল্লিককে জানিয়েছ কথাটা?”

“জানিয়েছি।”

“লম্বুকে দিয়ে?”

“হ্যাঁ। “

“শুনে তোমার মালিক কী বলেছে?”

“বলেছেন, তিনি কিছু জানেন না। আমার ব্যবস্থা যেন আমি নিজেই করি। আর সার্কাসে ফিরে না যাই।”

কিকিরা নিজের মনে মাথা নাড়তে লাগলেন।

অনেকক্ষণ পর কিকিরা বললেন, “অনিল, তোমায় একটা খারাপ খবর দি। খুবই খারাপ খবর। কৃষ্ণমূর্তিসাহেব আজ খেলা দেখাবার সময় গোলাল করে ফেলেছিলেন। বিশ্রী অ্যাকসিডেন্ট করে ফেলেছেন। অবস্থা খুব খারাপ। হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে তাঁকে। কোনো হুঁশ নেই। নাকমুখ দিয়ে অনর্গল রক্ত পড়ছে। উনি বাঁচবেন কিনা জানি না।..আজ তাঁর মন বড় চঞ্চল ছিল। ডিস্টার্বড ছিলেন। ভুল করে ফেলেছিলেন কোথাও।…কৃষ্ণমূর্তি যদি মারা যান, এর দায় কিন্তু তোমার আর তোমার মালিকের।”

অনিল যেন কথাটা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। পাথরের মতন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

কিকিরা বললেন, “একটা ভাল মানুষকে তোমরা আজ শেষ করলে। এর শাস্তি তুমি পাবে। তুমি না ক্রিশ্চান!”

অনিলের হঠাৎ কী হল, কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *