জাদুকরের রহস্যময় মৃত্যু
ট্রাম থেকে নেমেই তারাপদ বলল, “নে, হয়ে গেল!” হয়ে গেল মানে চোখের পলকে সব অন্ধকার; আলো চলে গেল। লোডশেডিং।
ভর সন্ধেবেলায় এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেলে কারই বা ভাল লাগে! চন্দন বলল, “কলকাতায় আর থাকা যায় না, বুঝলি! এর চেয়ে গ্রামে গিয়ে থাকা ভাল।”
হঠাৎ অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় তারাপদ পাশের লোকটিকে খেয়াল করতে পারেনি। হুমড়ি খেয়ে তার গায়ে পড়ছিল। সামলে নিল কোনোরকমে। লোকটি কিছু বলল। তারাপদ ভাল করে শুনতে পায়নি।
চন্দন বলল, “তোকে কী বলল শুনলি?”
“কী?”
“অন্ধ বলল। চীনে ভাষায়।”
“তুই চীনে ভাষা বুঝিস?”
“একটু একটু বুঝতে পারি। আমাদের হাসপাতালে চীনে রোগী দু’দশটা রোজই আসে। আন্দাজ করে নিতে পারি,” বলে চন্দন হেসে উঠল।
তারাপদ বুঝতে পারল, চন্দন ঠাট্টা করছে। ঠাট্টাই করুক আর যাই করুক, এই পাড়াটায় চীনেদের অভাব নেই। তবে পাড়াটা চীনেদের নয়। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানই বেশি। কিছু চীনে। দুদশ ঘর পার্সি বোম্বাইঅলা। বেশ কিছু মুসলমান। পাঁচমেশালি পাড়া। এদের কার কী পেশা বোঝা যায় না। তবে চেহারা দেখলে মনে হয়, গতরে-খাটা মানুষ। ব্যবসাপত্রও করে।
চন্দন বলল, “হ্যাঁ রে তারা, কিকিরা ফিরেছেন তো? না, গিয়ে দেখব, দরজায় তালা ঝুলছে?”
তারাপদ বলল, “ফেরারই কথা। চিঠিতে লিখেছেন, দশ তারিখে ফিরছেন। আজ তেরো তারিখ।“
“চল, দেখি।…আচ্ছা, এত জায়গা থাকতে কিকিরার কাশীতে বেড়াতে যাবার কী দরকার ছিল বলতে পারিস?”
“বেড়াবার আবার দরকার থাকে নাকি! এমনি গিয়েছিলেন।”
ট্রাম রাস্তা থেকে কিকিরার বাড়ি দুর নয়। তবে গলিতে ঢুকতে হয়। বার তিনেক ডাইনে-বাঁয়ে পাক খেয়ে পৌঁছতে হয় কিকিরার বাড়িতে। চন্দনরা গলিতে ঢোকার আগেই আলো দেখতে পাচ্ছিল; নানা ধরনের বাতি জ্বলে উঠছে। কেউ জ্বালিয়েছে লণ্ঠন, কেউ মোমবাতি। কোথাও বা কাবাইডের লক্ষ জ্বলতে শুরু করেছে। ইভাটারের আলোও চোখে পড়ছিল দু’এক জায়গায়।
গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চন্দন বলল, “কিকিরা এই পাড়াটা পালটে নিতে পারেন। এখানে এলেই আমার ভাই গুমঘর লেনের কথা মনে পড়ে।”
“গুমঘর লেন! কোথায় সেটা?”
“চাঁদনির দিকে। অদ্ভুত নাম। তাই না?”
“এরকম নাম হবার কারণ?”
“কে জানে! আমার মনে হয়, পুরনো কলকাতায় ওখানে একটা মর্গ ছিল। লাশকাটা ঘর। বোধহয় সেই থেকে ওরকম নাম হয়েছে। কে জানে!”
তারাপদ মজার গলায় বলল, “কলকাতায় অদ্ভুত অদ্ভুত নামের গলি আছে। কিকিরার নামেও একটা গলি করে দেওয়া যেতে পারে, কী বলিস, চাঁদু?” বলে হেসে উঠল।
সামান্য এগিয়েই কিকিরার বাড়ি। নিচের তলায় মুসলমান কারিগররা দরজিগিরি করছে। লণ্ঠন ঝুলছে এখানে-ওখানে। সেলাইমেশিনের শব্দ। কেউ-কেউ গোছগাছ সেরে নিচ্ছে; বোধহয় দোকান বন্ধ করবে। ডান দিকে চাতাল। চাতালের শেষ প্রান্তে দোতলার সিঁড়ি।
কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তারাপদ বলল, “আলো দেখছি রে, কিকিরা আছেন।”
দরজায় টোকা মারতেই বগলা দরজা খুলে দিল। প্যাসেজে লণ্ঠন জ্বলছে।
চন্দন বলল, “কী বগলাদা? কাশী বেড়ানো হল?”
ও “হল দাদা! এই নিয়ে দু’রার হল। একবার গিয়েছি ছেলেবেলায়, আর এবার গেলাম বুড়োবেলায়।”
“ভাল ছিলে?”
“তা ছিলাম। কোনো কষ্ট হয়নি।”
কিকিরার গলা পাওয়া গেল। ঘর থেকে সাড়া দিচ্ছেন।
তারাপদ ঘরের দিকে পা বাড়াল।
চন্দন বগলাকে বলল, “চা লাগাও, বগলাদা। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।”
কিকিরার ঘরে এসে তারাপদ বলল, “আপনি অন্ধকারে বসে আছেন?”
কিকিরা ঠিক অন্ধকারে বসে ছিলেন না। ঘরের এক কোণে এক খেলনা বাতি জ্বলছিল। দেখতে অনেকটা ফানুসের মতন। বাহারি। ছোট। তার মধ্যে বোধহয় মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন কিকিরা। বাটি-মোমবাতি।
কিকিরা বললেন, “এসো। তোমাদের কথাই ভাবছিলাম।…এসো গো, স্যান্ডেল উড়। তোমার হাসপাতাল কেমন চলছে?”
চন্দন হাসল, “যেমন চলে। আপনি ফিরলেন কবে?”
“বুধবার। দশ তারিখেই। ভদ্দরলোকের এক কথা।”
“শুনলাম, খুব আরামে ছিলেন? বগলাদা বলছিল।”
“তা ছিলাম। এককালের রাজরাজড়ার বাড়ি। এখন ভূতের বাড়ি। একপাশে পড়ে ছিলাম।”
“ভূতের বাড়ি মানে?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।
“আগে বোসো, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করবে নাকি?”
চন্দন আর তারাপদ কাছাকাছি বসল কিকিরার।
ঘরের আলো এতই কম যে, কিকিরাকে ভাল করে দেখা যাচ্ছিল না। পরনে পাজামা, গায়ে কামিজ ধরনের এক জামা। জামার রঙ সাদা না ফিকে বাদামি বোঝা যাচ্ছে না। মাথার চুল উস্কোখুস্কো। কিকিরার রোগা হাড়-হাড় চেহারায় কেমন যেন রুক্ষ ভাব। শরীর খারাপ হয়েছিল নাকি ওঁর।
চন্দন বলল, “কিকিরা-স্যার, আপনাকে কাহিল দেখাচ্ছে কেন? বগলাদা বলছিল, আরামে ছিলেন কাশীতে; তা হলে শুকিয়ে গেলেন কেমন করে?”
কিকিরা কিছু বলার আগে হাত বাড়ালেন। বললেন, “একটা মিঠে সিগারেট দাও! চুরুট খেতে পারছি না। গলায় লাগছে।”
চুরুট সিগারেট কোনোটারই পাকা নেশা নেই কিকিরার। শখ করে খান। চিন্তা-ভাবনার সময় মগজে ধোঁয়া দেন।
চন্দন সিগারেট-দেশলাই এগিয়ে দিল কিকিরাকে।
সিগারেট ধরিয়ে দুচারটে টান দিলেন কিকিরা। তারপর হালকা গলায় বললেন, “চন্দন, আমাকে বোধহয় এবার একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলতে হবে।”
চন্দন কিছু বুঝল না। তারাপদর দিকে তাকাল। তামাশা করছেন কিকিরার, না, অন্য কিছু ঘটেছে? কিকিরাকেই আবার নজর করে দেখতে লাগল চন্দন। লম্বা নাক, উঁচু চোয়াল। চোখ দুটি গর্তে ঢোকানো। দেখলে মনে হয়, টর্চলাইটের বাদ্ধ যেমন কাচের তলায় গর্তে ঢোকানো থাকে, সেই ভাবে ডোবানো আছে কিকিরার চোখ দুটি। অজীর্ণ রোগীর মতন রোগা রুক্ষ চেহারা। এই মানুষকে কি গোয়েন্দা মানায়? গোয়েন্দাদের কাঠামোই আলাদা।
চন্দন হেসে বলল, “আপনি তো হাফ-গোয়েন্দা।”
“না বাপু,” কিকিরা মাথা নেড়ে বললেন, “আমি ম্যাজিশিয়ান। কিকিরা দি গ্রেট,” বলে ছেলেমানুষের মতন হাসলেন। পরে বললেন, “সত্যি কথা বলতে কী, ম্যাজিকটাই বা হল কোথায়? শুরু করেছিলাম, মাঝপথে সেটা গেল। কপাল খারাপ হলে যা হয়। তারপর দেখো, কবে থেকে বসে আছি ম্যাজিকের ওপর বড় বড় দুটো বই লিখব বলে, জোগাড়যন্তর করি, আর কাজ নিয়ে বসলেই আটকে যায়। হবে না যে, আমার দ্বারা হবে না।”
এক সময় তারাপদদের ধারণা ছিল, ম্যাজিক নিয়ে আবার বই লেখা হয় নাকি? হলে সেটা বটতলার বইয়ের মতন হয়। কিকিরার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার পর বুঝেছে, তাদের ধারণা ভুল। বিরাট-বিরাট বই আছে ম্যাজিকের। আর সেসব কি আজকের বই? কত পুরনো-পুরনো বই! কিকিরার মুখে নাম শোনা যায় : রোলো, বাটলার, কিং ফ্রান্সিস, সেলিগম্যান, হুডিনি, আরও কত কে! নামগুলো মনে থাকে না তাদের। তবে কিকিরার ঘর হাতড়ালে দশ-বিশটা বই পাওয়াও যাবে।
তারাপদ বলল, “ব্যাপারটা কী বলুন তো? আপনি যেন কাশী ঘুরে এসে মনমরা হয়ে গিয়েছেন। আপনার হাসিঠাট্টা নেই, মজা নেই, আপনার ইংলিশ নেই।”
কিকিরা একটু চুপ করে থেকে বললেন, “গিয়ে ভুল হয়েছে। আমার এক পুরনো বন্ধু এসেছিল কলকাতায়। তার ভাগ্নের বিয়েতে। সে একদিন খোঁজ করে দেখা করতে এল। পুরনো বন্ধুবান্ধবের ব্যাপার তো বোঝে। এমন করে মন গলিয়ে দেয় যে, তাদের আর না বলা যায় না। ওর পাল্লায় পড়ে কাশী চলে গেলাম। ভাবলাম, যাই, দু’দিন বেড়িয়ে আসি। এক সময় দশাশ্বমেধ ঘাট আমায় খুব টানত। গরমের দিন নৌকো করে গঙ্গায় ঘুরে বেড়াতে বড় আরাম হে। আমার একটা নেশাই ছিল, নৌকো করে ঘোরা। দশাশ্বমেধ, কেদার, ঘঘাড়াঘাট, এস্তার ঘুরে বেড়াতাম।”
“কাশীতে গরম পড়ে গিয়েছে?” চন্দন বলল।
“পড়ছে। কলকাতায় যা দেখছি তার চেয়ে বেশি।”
“এখানেও তো গরম পড়ে এল।…দেখুন না, আলো নেই, পাখী গরম-গরম লাগছে আমার।”
কিকিরা সিগারেটের টুকরোটা ছাইদানে ফেলে দিলেন।
তারাপদ বলল, “কাশী বেড়াতে গিয়েছিলেন, ভোল করেছিলেন। কিন্তু ভুলটা কী করলেন যে আফসোস করছেন?”
কিকিরা সামান্য চুপ করে থাকলেন, তারপর বললেন, “তোমরা কাগজ-টাগজ পড়ো না?”
প্রশ্নটা যেন বুঝতে পারল না তারাপদ। চন্দনের দিকে তাকাল। বলল, “পড়ি বইকি! অনেকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে কাগজ পড়ে। আমি অত পড়ি না,” বলে চন্দনের দিকে তাকাল, “তুই পড়িস?”
“আসলগুলো পড়ে নিই; ভেজাল পড়ি না,” হাসতে হাসতে বলল চন্দন।
কিকিরা বললেন, “তা হলে তোমরা খবরটা পড়োনি?”
“কোন খবর?”
“ডেথ অব এ ম্যাজিশিয়ান, জাদুকর ফুলকুমারের রহস্যময় মৃত্যু?”
চন্দন তারাপদ দু’জনেই অবাক। ফুলকুমার আবার কে? জীবনে এমন নাম তারা শোনেনি। তা ছাড়া ম্যাজিক সম্পর্কে তাদের আগ্রহ তেমন কিছু নেই। নিতান্ত কিকিরার সঙ্গে ওদের একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তাই মাঝে-মাঝে দু’দশটা গল্প শোনে ম্যাজিশিয়ানদের। ফুলকুমারের নাম চন্দনরা শোনেনি।
চন্দন বলল, “কিকিরা-স্যার, ফুলকুমারের নাম আমরা শুনিনি। খবরের কাগজেও কিছু পড়িনি। হেঁয়ালি না করে ব্যাপারটা যদি আমাদের বলেন, খুশি হব।”
কিকিরা মাথার ওপর হাত তুলে আলস্য ভাঙার ভঙ্গিতে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। যেন ফুলকুমারের কথা ভাবছিলেন।
বগলা চা নিয়ে এল। তার কাজকর্ম বেশ গোছানো। ট্রে করে চা এনেছে। বড় প্লেট গোটা দুই। প্লেটে কাশীর প্যাঁড়া, বরফি ধরনের এক মিষ্টি আর মচমচে সেউ গাঁঠিয়া।
চা রেখে বগলা চলে গেল।
চন্দন বরাবরই পেটুক গোছের। হাত বাড়িয়ে গোটা-দুই প্যাঁড়া তুলে নিল, নাকের কাছে এনে কল শব্দ করে; মজার গলায় বলল, “দারুণ, গন্ধতেই জিবে জল আসে।”
“দেওঘরের প্যাঁড়ার চেয়ে খারাপ নয় স্যান্ডেল উড়, বরং বেটার’ বলেই আমার মনে হয়। নাও, খাও। তারাপদ হাত বাড়াও, নয়ত ঠকবে,” বলে কিকিরা নিজের চায়ের কাপ তুলে নিলেন।
তারাপদ বলল, “প্যাঁড়ার চেয়েও জাদুকর ফুলকুমার আমার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে কিকিরা।”
কিকিরা বললেন, “বলছি ফুলকুমারের কথা। তুমি শুরু করে দাও,” বলে বার কয়েক চুমুক দিলেন চায়ে। পরে বললেন, “ফুলকুমাকে আমি বাপু চিনি না। তার দাদা রাজকুমারকে চিনি। রাজকুমারের মুখেই আমি গতকাল সব শুনলাম।”
“আপনি যে বললেন কাগজে বেরিয়েছে?”
“বেরিয়েছে। ছোট করে। রাজকুমারই আমাকে বলেছে। আমি তো তখন কলকাতায় ছিলাম না। আজ সকালে পুরনো কাগজ জোগাড় করে দেখলাম।”
চন্দন বলল, “কবে ঘটেছে ঘটনাটা?”
“সাত তারিখে।” বলে কিকিরা বিষম খাওয়ার মতন করে কাশলেন। সামলে নিলেন। বললেন, “ফুলকুমারের মৃত্যুটা বড় অদ্ভুত। শিয়ালদার কাছে একটা হল-এ ম্যাজিক দেখাবার প্রোগ্রাম ছিল ফুলকুমারের। প্রায় অর্ধেকটা সময় সে তার ম্যাজিক দেখিয়েছে। মাঝে মিনিট পনেরো-বিশের জন্যে খানিকটা হাসি-তামাশার ব্যবস্থা ছিল। ওই প্রোগ্রামের পর ছিল ফুলকুমারের আসল খেলা, ভৌতিক হারমোনিয়াম।”
তারাপদর যেন গলা আটকে গেল, “ভৌতিক হারমোনিয়াম? সেটা আবার কী?”
“এক ধরনের খেলা। ম্যাজিক শো। স্টেজের ওপর একটা হারমোনিয়াম রাখা হবে। কাছাকাছি থাকবে ম্যাজিশিয়ান। চোখ বাঁধা, হাত বাঁধা। অথচ হারমোনিয়ামটা নিজেই বাজবে।”
চন্দন অবাক গলায় বলল, “বলেন কী? নিজে নিজেই হারমোনিয়াম বাজবে! ভুতুড়ে ব্যাপার নাকি?”
“বললাম তো ভৌতিক হারমোনিয়াম,” কিকিরা বললেন, “ফুলকুমারের এইটেই ছিল সেরা খেলা আর নতুন খেলা।”
চন্দন বলল, “দেখুন স্যার কিকিরা, আমরা এত রকম ম্যাজিকের খেলার কথা শুনেছি, নিজেরাও দু চারটে দেখেছি যে, হারমোনিয়াম বাজনায় কোনো থ্রিল পাচ্ছি না। ম্যাজিকে গলাকাটা, পেট কাটা, ভূত-নাচানো, মোটরগাড়ি ওড়ানো, কত কী হয়। এসব যদি হতে পারে, তবে সামান্য হারমোনিয়াম বাজানো হবে না কেন?”
“না-হবার কারণ সত্যি নেই। কিন্তু, তুমি কি এমন কথা শুনেছ চন্দন, খেলা দেখাবার সময় কোনো ম্যাজিশিয়ান স্টেজের মধ্যে খুন হয়?”
“খুন!” চন্দন আর তারাপদ একসঙ্গে যেন আঁতকে উঠল।
কিকিরা বললেন, “হ্যাঁ, খুন। রাজকুমার তাই বলল। বলল, তার ভাইকে স্টেজের মধ্যে কেউ খুন করেছে।”
“খুন করার প্রমাণ?”
“হাসপাতালে নিয়ে যাবার আগেই ফুলকুমার মারা যায়। ওরা সন্দেহ করেছে মাথার পিছন দিকে মারাত্মক চোট।”
“আপনি কী বলছেন, কিকিরা?”
“যা শুনেছি তাই বলছি। ফুলকুমারকে এমন একটা জিনিস দিয়ে মারা হয়েছিল যে, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই যে-কোনো সবল সুস্থ মানুষ মারা যেতে পারে।”
“কী দিয়ে মারা হয়েছিল?”
“তা আমি জানি না। রাজকুমারের মুখে যা শুনেছি তাই বলেছি।”
“ফুলকুমারকে খুন করার কারণ?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।
“আমি কেমন করে বলব! আপাতদৃষ্টিতে কোনো কারণ থাকতে পারে না। ওর দাদা রাজকুমারও বলছিল, ফুলকুমারকে খুন করার মতন কেউ আছে বলে সেও জানে না। তবে তার জানার বাইরে অনেক কিছুই তো ঘটতে পারে।”
চন্দন বলল, “তবু একটা সন্দেহ? কিংবা ধরুন অনুমান…”
“না,” মাথা নাড়লেন কিকিরা, “রাজকুমার কাউকে সন্দেহ করতে পারছে না। তবে একটা ব্যাপার যা ঘটেছে সেটা অদ্ভুত।…স্টেজের মধ্যে ফুলকুমার মারা যাবার পর সেই হারমোনিয়ামটাও বেপাত্তা হয়ে গেছে।”
“বেপাত্তা? মানে হাপিস?”
“হ্যাঁ।”
“কেমন করে?”
“তা তো বলতে পারব না এখন। হারমোনিয়াম নেই; কিন্তু তার বাক্সটা আছে।”
তারাপদ চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল। জানলা দিয়ে হাওয়া এল এক ঝলক। কিকিরার এই ঘরে এত রকম জিনিসপত্র যে ভাল করে বাতাস বইতে পারে না। চন্দনের কাছে একটা সিগারেট চাইল তারাপদ। তারপর কিকিরাকে বলল, “আপনি কি মনে করছেন ওই ভুতুড়ে হারমোনিয়ামটার জন্যে ফুলকুমারকে খুন করা হয়েছে?”
কিকিরা মাথার চুল ঘাঁটলেন সামান্য। বললেন, “কোনো ম্যাজিশিয়ানের খেলা দেখাবার জিনিসের জন্যে তাকে খুন করা হয়েছে বলে আমি শুনিনি। কেনই বা করবে? ফুলকুমারের ম্যাজিক-দেখানো হারমোনিয়ামের জন্যে তাকে খুন করা হবে কেন? আবার এটাও ঠিক, হারমোনিয়ামটা চুরিই বা যাবে কেন?…আমার মাথায় কিছু আসছে না।”
চন্দন আর তারাপদ সিগারেট ধরাল। চন্দন বলল, “আপনি কি ফুলকুমারের মৃত্যু রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা করবেন ঠিক করেছেন?”
“ঠিক করিনি। কিন্তু রাজকুমার আমায় বড় ধরেছে। বলছে, পুলিশ তার কাজ যা করছে করুক। আমি যেন অন্তত চোর এবং চুরি, এই দুটো নিয়ে কিছু করি।”
তারাপদ একমুখ ধোঁয়া গিলে বলল, “কিকিরাস্যার, ব্যাপারটা যখন খুন-জখমের, তখন কি আপনার নাক গলানো উচিত হবে?”
“কেন?”
“ওটা তো পুলিশের হাতে চলে গেছে। আপনি নাক গলাতে গেলে উলটো না হয়ে যায়!”
কিকিরা মাথা দোলালেন। বললেন, “উলটো না হোক, পুলিশ ভাল চোখে দেখবে না। তবে কী জানো তারাপদ, আমি এমন একটা মানুষ, নিরীহ গোবেচারি যে, পুলিশ অন্তত আমায় খুনি ভাববে না। তা ছাড়া আমি বাপু, সাত তারিখে কলকাতায় ছিলাম না, ছিলাম কাশীতে। ঠিক কিনা?” বলে কিকিরা একটু মজা করে হাসলেন। বললেন, “মামলা লড়ার জন্যে তুমি যেমন যে-কোনো উকিলব্যারিস্টার নিতে পারো, রাজকুমার তার ভাইয়ের রহস্যময় মৃত্যুর কারণ জানার জন্যে যে-কোনো লোকের সাহায্য নিতে পারে। আইন তাকে আটকাতে পারে না।”
চন্দন বলল, “তার মানে, আপনি রাজকুমারের কথায় রাজি হয়ে গেছেন?”
“হ্যাঁ।.আরও হয়েছি এই জন্যে যে, ফুলকুমার একজন ম্যাজিশিয়ান ছিল। আমি নিজে ম্যাজিশিয়ান। ফুলকুমারের ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামানো আমার কর্তব্য। ঠিক কিনা, বলো?”
তারাপদ আর চন্দন চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারাপদ বলল, “আপনার কাজ কি শুরু হয়ে গেছে?”
“সবে শুরু করছি। এখন ভাবনা-চিন্তা যা খেলছে সব মাথার মধ্যে। সকালের দিকে একবার ওদিকের থানায় গিয়েছিলাম। রাজকুমার সঙ্গে ছিল। থানার বড়বাবু ছোটবাবুর সঙ্গে আলাপ করে এসেছি। বড়বাবু আমার দেশের লোক হে! গলাধাক্কা দেননি।” বলে কিকিরা হাসলেন। “পনেরো তারিখ থেকে কাজ শুরু করব। যাকে বলে কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়া। তোমরাও আমার সঙ্গে লেগে পড়ো। পরশু থেকে। বুঝলে?”
তারাপদ বলল, “আমরা তো আপনার সঙ্গে লেগেই আছি। বলুন কী করতে হবে?”
“কাল বিকেলে আমার এখানে চলে আসবে। কাল রবিবার। কাল তোমাদের ওই জায়গাটায় নিয়ে যাব–যাকে বলে ঘটনাস্থল। বুঝলে? পরশু থেকে কাজ।”
.
ঘটনাস্থল
কিকিরা যাকে ঘটনাস্থল বলেছিলেন, সেই জায়গাটাকে দেখলে মনে হয় এ যেন ঠিক কলকাতা শহর নয়; পুরনো কোনো রেল কলোনি। কলকাতার ঘরবাড়ি, পাড়ার সঙ্গে এখানকার মিল কম, অমিলই বেশি দুচারটে সেকেলে বাড়ি, লোহার নকশা করা রেলিং, খড়খড়ি-দেওয়া জা-জানলা, ইট বারকরা ঝুলবারান্দা, এ-সব চোখে না পড়বে তা নয়, তবে বেশি করে যেটা চোখে পড়বে সেটা হল এক ছাঁদের, একই ধাঁচের সার-সার বাড়ি। মেটে লাল রং। একতলা। দোতলার সংখ্যা কম। বাড়িগুলো থেকে খানিকটা তফাতে বড় একটা মাঠ, মাঠের ওপারে বুঝি রেললাইন। উঁচু পাঁচিলের জন্যে লাইন চোখে পড়ছিল না।
তারাপদ আর চন্দন এলাকাটা ভাল করে দেখছিল। এদিকে তাদের আসা হয়ে ওঠেনি। রাস্তাঘাট সাধারণ, মাঝে-মাঝে ইট-বাঁধানো সেকেলে গলিখুঁজিও চোখে পড়ে। এক-আধটা ছোট কারখানা। দূরে বোধহয় রেলব্রিজ। খাল।
কিকিরা বললেন, “ওই বটগাছের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা, ওদিকে…।”
চন্দন বলল, “জায়গাটা চুপচাপ বলে মনে হচ্ছে?”
“কলকাতার তুলনায়। নয়ত চুপচাপ আর কোথায়?”
তারাপদরও সেইরকম মনে হল। লোকজনের আসা-যাওয়া, ছেলেছোকরার হইচই, রেডিওর গান, কোনো কিছুই বাদ যায় না, তবে কলকাতা শহরের পাড়াগুলো যেমন গমগম করছে, সে রকম গমগমে নয়। তার একটা কারণ বোধহয়, ঠিক এই জায়গাটা দিয়ে বাস-মিনিবাস যায় না, দোকান-পসার কম। ট্যাক্সি-রিকশার অবশ্য চলাচল রয়েছে।
তারাপদ বলল, “জায়গাটার নাম কী? কী বলে?”
কিকিরা জায়গাটার নাম বললেন। বলে চন্দনকে ইশারায় ঘড়ি দেখতে বললেন।
চন্দন তার হাতঘড়ি দেখল, “সাড়ে পাঁচ বেজে গিয়েছে।”
“এখনও ঘণ্টাখানেক আলো থাকবে, কী বলো? আজকাল বেলা বেড়ে গেছে।”
চন্দন অত খেয়াল করে কথাটা শুনল না, মাথা নাড়ল।
বটতলার পাশ দিয়ে সরু রাস্তা। পিচবাঁধানো। ট্যাক্সি টেম্পো অনায়াসেই চলে যেতে পারে। ডান দিকে এক শহিদ-স্তম্ভ। হাতকয়েক তফাতে খানিকটা জায়গার মাটি কোপানো। কুস্তির আখড়া নাকি? সাইকেল চড়ে দু’তিনটে ছেলে পাশ দিয়ে চলে গেল।
কিকিরা হাত তুলে সামনের দিকটা দেখালেন, “ওই বাড়িটা। সামনে গেট।”
তারাপদ আর চন্দন বাড়িটার দিকে তাকাল। ভাঙা পাঁচিলের ওপারে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। বাড়ি না বলে শেড় বলাই ভাল। ঢেউ-খেলানো ছাদ। সিনেমা-থিয়েটারের হল সাধারণত যেমন দেখতে হয় সেই রকম দেখাচ্ছিল। লোহার শিক্-দেওয়া ফটক। ফটকের গা ঘেঁষে কৃষ্ণচূড়ার গাছ একটা।
কিকিরা বললেন, “আজ যেন ফাঁকা ফাঁকা!”
চন্দন তাকাল। “ফাঁকা মানে?”
“হল ফাঁকা। নো ফাংশান,” কিকিরা হাসলেন, “নাচ-গান-থিয়েটার কিছু নেই।”
তারাপদ বলল, “এই ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে কে ফাংশান করতে আসবে?”
“যার দরকার সে আসবে,” কিকিরা বললেন, “কলকাতা শহরে রোজ কত ফাংশান হয় জানো? পাড়ার ক্লাব, অফিস-ক্লাব, স্কুলের প্রাইজ, কলেজের থিয়েটার এ তো বারো মাস তিনশো পঁয়ষট্টি দিন লেগে আছে। অত হল লোকে পাবে কোথায়? দরকারে পড়লে এখানেও আসে।”
“আপনি জানেন?”
“অল্পস্বল্প জানি বইকি। তা ছাড়া খবর নিয়েছি। রাজকুমার বলেছে।” বলে কিকিরা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে আকাশের দিকে তাকালেন। আলোর অবস্থাটা দেখে নিলেন বোধহয়। তারাপদকে বললেন, “একটা কথা আগে থাকতে শিখিয়ে দিই। তোমরা এমন ভাব করবে যেন এই হল্টা ভাড়া নেবার কথা বলতে এসেছ। পাড়ার ক্লাব থেকে আসছ। আমি তোমাদের সেক্রেটারি।”
চন্দন হেসে ফেলে বলল, “কোন্ ক্লাব? নাম কী?”
“কোন্ ক্লাব? ও একটা বলে দিও যা মুখে আসে। তবে পাড়ার কথা বললে কাছাকাছি একটা জায়গার নাম করবে। কাছাকাছি পাড়া থেকেই এখানে ভাড়া নিতে আসে বেশি। তাদের সুবিধে হয়। পাড়ার লোকেরও সুবিধে। “
তারাপদ চন্দনের দিকে তাকিয়ে রগড়ের গলায় বলল, “চাঁদু, কিকিরা একেবারে ছকে এসেছেন সব।”
কিকিরা বললেন, “তা ছকতে হবে না! এসেছি গোয়েন্দাগিরি করতে, পা বাড়াবার আগে না ভাবলে চলে?”
চন্দন বলল, “কিকিরা-স্যার, কাছাকাছি কোন্ পাড়া আছে আমি জানি না। তবে এদিক দিয়ে বোধহয় বেলেঘাটা যাওয়া যায়। তাই না?”
“বেলেঘাটাই বোলো। মস্ত এলাকা। বুঝতে পারবে না।”
শিকঅলা লোহার ফটক খোলাই ছিল। অবশ্য ফটকটা পুরো বন্ধ হবার কোনো উপায় নেই। একদিকের পাল্লার তলার দিকটা হেলে পড়ে মাটির মধ্যে গেঁথে রয়েছে।
ফটক পেরিয়ে ভেতরে পা দিতেই তারাপদ আর চন্দন খানিকটা অবাক হয়ে গেল। তাদের ডান দিকে ছোট-মতন একটা শেড়। ঢাকা বারান্দার মতন দেখতে লাগে। সেখানে কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে। একটা বেঞ্চি পাতা রয়েছে বাইরে। ছেলেগুলো গাঁট্টাগোট্টা। চেহারা আর পোশাক দেখলেই বোঝা যায়, ওরা এতক্ষণ ব্যায়াম করছিল। এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। প্যারালাল বার, রিং, ওজন–আরও কত কী চোখে পড়ছে শেডের তলায়। দুটো বাতি জ্বলছিল।
তারাপদ বলল নিচু গলায়, “চাঁদু, ফিজিকাল কালচার নাকি রে?”
চন্দন বলল, “তাই মনে হচ্ছে। ব্যায়াম সমিতি।
কিকিরা বললেন, “হাঁ করে দাঁড়িয়ে থেকো না। দাঁড়াও, আমি জেনে আসছি।”
কিকিরা যে কী জানতে গেলেন, চন্দনা বুঝল না। তারা দেখল, উনি ছেলেগুলোর কাছে এগিয়ে গেলেন।
তারাপদ চারদিক দেখছিল। বাইরে থেকে একেবারেই বোঝা যায় না, ভেতরে এসে দাঁড়ালে অন্য রকম লাগে। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা জায়গাটা কম নয়। বাঁ দিকে কয়েকটা খুপরি ঘর, লোকজন থাকে। ঘরের সামনে দড়ির খাটিয়া, গামছা শুকোচ্ছে। দেখে মনে হল, দরোয়ান জমাদার, এদের থাকার জায়গা ওগুলো। ফটকের পাশে দু’চারটে টিনের ছাউনি। চা-পান-বিড়ির দোকান বসে শো থাকলে। মাঝ-মধ্যিখানে হল। সামনের দিকে কোনো দরজা নেই। হলে ঢোকার দরজা বোধহয় দু’পাশে, ডাইনে বাঁয়ে। সামনে শুধু কাঠের এক চৌখুপি। টিকিট বিক্রির ঘর।
চন্দন বলল, “তারা, ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াচ্ছে বল তো?”
“কোন ব্যাপার?”
“এই গোয়েন্দাগিরির। আমার ভাই মাথায় কিছু ঢুকছে না। কিকিরা যে কেন এই ঝামেলা ঘাড় পেতে নিলেন কে জানে! পুলিশের কাজ পুলিশকেই ছেড়ে দেওয়া ভাল।”
তারাপদ কিছু বলল না। কিকিরা আসছিলেন।
কাছে এসে কিকিরা বললেন, “সরখেলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে হবে।”
“সরখেল? সে কে?”
“এই হলের চার্জে আছেন। কেয়ারটেকার। সরখেলবাবুর অফিস পিছন দিকে। স্টেজের দিকটায়। চলো, যাই।”
কিকিরা পা বাড়ালেন।
তারাপদ আর চন্দন এগোতে লাগল। চন্দন বলল, “আপনি ওদের কী বললেন?”
“বললাম, আমরা এই হল্টা বু করতে চাই। কার সঙ্গে কথা বলতে হবে, ভাই! ওরা সরখেলবাবুর কথা বলল। আর কী বলল, জানো!”
“কী?”
“বলল, হল্ ভাড়া দেওয়া এখন বন্ধ। এই হলে ক’দিন আগে একজন খুন হয়েছে। ওদের কথা শুনে আমি এমন ভাব করলাম যেন ফ ফ্রম স্কাই। তারপর বললাম, সে কী, আমরা যে তা হলে মারা পড়ে যাব। তখন ওরা সরখেলবাবুর সঙ্গে দেখা করে যেতে বলল।” কিকিরা হাসলেন একটু, মুখ-টেপা হাসি।
চন্দন বলল, “এতক্ষণে বুঝতে পারছি, কিকিরা। আজ রবিবার; তবু হল ফাঁকা। তার মানে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে না।…আপনি আর তা হলে কষ্ট করে যাচ্ছেন কেন সরখেলবাবুর কাছে?”
“আমি কি ভাড়া নিতে যাচ্ছি?”
“বাঃ! ভাড়ার কথাই বলতে যাচ্ছেন। আপনি তো সেই রকম “শো’ দেবেন?” চন্দন মজা করে বলল।
“তা দেব; দিতে হবে। আসলে, সরখেল কী বলে শুনব, তাকে বাগিয়ে একবার স্টেজ আর হল্টা দেখব।”
“সরখেল যদি আপনাকে হল দেখাতে না চায়?”
“চাইবে না, কেন চাইবে–” কিকিরা মুচকি হাসলেন, তারপর চোখ ছোট করে বললেন, “সরখেল চাইবে না, কিন্তু ওকে দিয়ে কাজটা হাসিল করিয়ে নিতে হবে। সেটাই তো কেরামতি।”
হলের পাশ দিয়ে রাস্তা। দরজাগুলো বন্ধ রয়েছে হলের। একটা মাত্র বাতি জ্বলছে এপাশে। দু’চারটে সাধারণ গাছপালা কম্পাউন্ডওয়ালের দিকে। সাইকেল রাখা কাঠের ভাঙা খাঁচা।
তারাপদ বলল, “কিকিরা, হল্টার পিছন দিকে বোধহয় ঝোপঝাড় আছে।”
“গাছ দেখে বলছ?”
মস্ত একটা নিমগাছের মাথা দেখা যাচ্ছিল পিছন দিকে। অন্ধকার মতন দেখাচ্ছে ওপাশটায়। আলো মরে এসেছে। ছায়া নেমে গিয়েছে গাঢ় হয়ে। তারাপদ বলল, “গন্ধ পাচ্ছেন না? ঝোপজঙ্গলের গন্ধ?”
কিকিরা মাথা নাড়লেন।
দশ-পনেরো হাতের একটা ঘর। বাতি জ্বলছিল। সমস্ত ঘরটা অগোছালো, নোংরা। কয়েকটা পুরনো র্যাক, গোটা-দুই ভাঙা আলমারি আর গোটা কয়েক লোহার চেয়ার ছাড়া অন্য কিছু নেই।
সরখেল টেবিলে বসে কাজ করছিলেন। বিড়ির গন্ধে ঘর ভরা।
কিকিরা দরজার বাইরে থেকে কাশলেন।
“কে?” সরখেল দরজার দিকে তাকালেন।
“আমরা একবার আসব, স্যার?”
“কী দরকার?”
“জরুরি দরকারেই এসেছি, স্যার। আপনি তো সরখেলবাবু?”
“আসুন।”
ভেতরে এলেন কিকিরা। চন্দন আর তারাপদ পিছনে।
“নমস্কার স্যার,” কিকিরা বিনয় করে নমস্কার সারলেন। “আপনার নাম শুনেই এলাম।”
সরখেল বোধহয় কোনো হিসেবপত্র দেখছিলেন। খাতাটা সেই রকম। মানুষটিকে দেখলে মায়া হয়। গায়ে যেন মাংস নেই, শুধু হাড়; মাথার চুল কাঁচা-পাকা, তোবড়ানো গাল, চোখের চশমাটা ডাঁটি-ভাঙা। গায়ে ময়লা পাঞ্জাবি।
কিকিরা বললেন, “আমরা একটু বসি?” বলে চেয়ার সরিয়ে বসে পড়লেন। ইশারায় বসতে বললেন তারাপদদের।
“কী দরকার আপনাদের?” সরখেল জিজ্ঞেস করলেন।
“আমাদের একটা বুকিং দিতে হবে, স্যার,” কিকিরা বললেন।
“বুকিং? কিসের বুকিং?”
“এই হলটা আমাদের একদিন চাই।”
“হল ভাড়া!” সরখেল চশমাটা কপালের ওপর তুলে নিলেন। “হ এখন ভাড়া দেওয়া হচ্ছে না।”
“ভাড়া দেওয়া হচ্ছে না! কেন? এই তো সেদিন হরিপদ চাটুজ্যেরা ভাড়া নিয়ে ওদের থিয়েটার করল। আমি কার্ড দেখেছি ওদের।”
“আগে কী হয়েছে সেকথা বাদ দিন,” সরখেল বললেন, “হল আমরা ভাড়া দিই। ভাড়া দেবার জন্যেই হল। ভাড়ার টাকায় খরচ-খরচা চলে। কিন্তু মশাই, হল এখন বন্ধ। ভাড়া দেওয়া হচ্ছে না।”
“সে কী! কেন?” কিকিরা ইশারায় চন্দনের কাছে সিগারেটের প্যাকেটটা চাইলেন। চন্দন প্যাকেট দিল।
সরখেল বললেন, “থানা থেকে বারণ করে দিয়েছে।”
“থানা?” কিকিরা যেন কতই না অবাক হয়েছেন, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। ততক্ষণে সিগারেটের প্যাকেট তাঁর হাতে। প্যাকেটের মধ্যে কী যেন খুঁজলেন। সরখেলের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। রেখেই দিলেন সামনে। “থানা কেন বারণ করবে? মারদাঙ্গা হয়েছিল, স্যার?”
“না। খুন। “
“খুন?” চোখের পাতা পড়ছিল না কিকিরার, হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন, “এই হলে খুন! বলেন কী?”
সরখেল সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিলেন, “কী বলব, মশাই! এমন ঘটনা এই হলে কোনোদিন ঘটেনি। আজ বিশ বছর আমি এখানকার কেয়ারটেকার। খুনখারাপি হয়নি কখনও। লোকে হল ভাড়া নেয়; নাচে, গায়, থিয়েটার করে; টাকা মিটিয়ে যে-যার বাড়ি চলে যায়।”
সিগারেটের প্যাকেট খুলতেই সরখেল কী যেন দেখলেন। দেখে অবাক হলেন। একবার কিকিরার দিকে তাকালেন। তারপর প্যাকেট থেকে আলগোছে সিগারেট বার করলেন। “কোত্থেকে আসছেন আপনারা?”
“বেলেঘাটা। আমাদের এই ছেলেদের ক্লাবের সিলভার জুবিলির একটা ফাংশান আছে,” বলে তারাপদ আর চন্দনকে দেখালেন। “হল না হলে বিপদে পড়ে যাব, দাদা?”
সরখেল বললেন, “কোন ক্লাব?”
চন্দন বলল, “নব যুবক সংঘ,” নামটা তার চট করে মুখে এসে গিয়েছিল।
কিকিরা বললেন, “বুঝতেই তো পারছেন। পাড়ার লোকের সুবিধে দেখে আমাদের ব্যবস্থা করতে হয়। এই হল্টা কাছে। আসা-যাওয়ার সুবিধে।”
সরখেল সিগারেট ধরিয়ে নিলেন। বললেন, “হল এখন আমার হাতে নেই। খুন হবার পরের দিন থেকেই থানার হুকুমে সব বন্ধ রাখতে হয়েছে। এমনকী, যাদের বুকিং করা ছিল, তাদের ডেট ক্যানসেল করে দিতে হল। কী যে ঝামেলা, মশাই। লোকে এসে গালাগাল দিচ্ছে। আমি থানা দেখিয়ে দিচ্ছি। কী করব!”
“সত্যি সত্যি খুন হয়েছে?” কিকিরা বললেন।
“মানে! আপনি বলছেন কী! আমি কি ফক্কুড়ি করছি?”
“না না, তা করবেন কেন! কবে হয়েছে খুন?”
“ওই তো, সাত তারিখে।”
“হলের মধ্যে?”
“স্টেজে। একেবারে স্টেজের ওপর। তখন কে একজন ম্যাজিক দেখাচ্ছিল।”
“ম্যাজিক! আপনি দেখেছেন খুন হতে?”।
“না,” মাথা নাড়লেন সরখেল, “আমি কি মশাই সারা রাত এখানে বসে পাহারা দেব? সাড়ে সাতটা-আটটা নাগাদ আমি বাড়ি চলে যাই।” বলে সরখেল যেন বিরক্ত হয়েই সামনের খাতাটা বন্ধ করে ফেললেন।
“তা তো ঠিকই। আপনি এই ঘরে কতক্ষণ আর বসে থাকবেন!”
“থাকি না। পার্টির কাছ থেকে বকেয়া টাকা নিয়ে রসিদ দিয়ে এক-আধ ঘণ্টা থাকি, তারপর বাড়ি। দরকার পড়লে আমায় বাড়ি থেকে ডেকে নেয়। বাড়ি কাছেই।”
কিকিরা তারাপদদের দিকে তাকালেন, “তোমরা খুব মুশকিলে পড়ে গেলে। সরখেলবাবু যা বলছেন, তাতে আর আশা দেখছি না,” কিকিরা পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছলেন। রুমালটা তুললেন না। টেবিলের ওপর ফেলে রাখলেন। সরখেলকে দেখলেন কিকিরা, হাসলেন, “বড় নিরাশ হলাম স্যার। বিপদেও পড়ে গেলাম।”
সরখেল কী মনে করে বললেন, “আপনাদের ফাংশান কবে?”
“তা…তা দেরি আছে ক’দিন। এ-মাসের শেষাশেষি…। হ যবে পাব।”
“এ-মাসের শেষাশেষি! তাই বলুন। তা হলে হয়ে যেতে পারে।”
“পারে?”
“পারে। থানা বোধহয় দু’চার দিনের মধ্যেই হুকুম উঠিয়ে নেবে। সে রকম শুনেছি। আমাদের বড় লোকসান হচ্ছে, বুঝলেন না!”
কিকিরা এমন করে নিশ্বাস ফেললেন, যেন নিশ্চিন্ত হয়েছেন এতক্ষণে। বললেন, “তা হলে স্যার, আমাদের একটা দিন দিয়ে দেন যদি…।”
“এখনই! না না, এখন কিছুই হবে না। পরে আসুন। থানা থেকে ছাড় আসুক।”
“বেশ। তবে তাই,” রুমালটা আরও একটু সরিয়ে দিলেন কিকিরা সরখেলের দিকে, “আমরা দিন চার-পাঁচ পরেই আসব।”
“আসুন।”
“একটা অনুরোধ,” কিকিরা রুমালের ওপর চোখ রেখে হাসলেন, “হলটা যদি একবার দেখতে দেন। মানে আমাদের ছেলেরা একটা ঐতিহাসিক নাটক করবে। স্টেজটা দেখে গেলে ভাল হত। নিজেরাই সেটেট তৈরি করছে। বেশ করেছে। কোথায় কেমন মানাবে দেখে নিলে ভাল হত। তা ছাড়া হলটাও দেখে নেওয়া দরকার। পাঁচ-ছ’শো লোক হবে আমাদের। পাড়ার লোকই বেশি। …আপনাদের হলে কত লোক ধরে?”
“শ’পাঁচেক। চারশো বাহাত্তর।
“একটু কম হয়ে গেল,” কিকিরা তারাপদর দিকে তাকালেন, “টেনেটুনে ম্যানেজ করতে হবে, কী বললো!…যাকগে, তোমার স্টেজের ব্যাপার–একবার দেখে নাও,” কিকিরা এমনভাবে বললেন, যেন সরখেল স্টেজ দেখাতে রাজি হয়ে গেছেন।
সরখেল চেয়ার ছেড়ে উঠলেন না।
কিকিরা ইশারা করলেন তারাপদদের। ঘর ছেড়ে চলে যেতে বললেন।
চন্দন আর তারাপদ একে-একে ঘরের বাইরে চলে গেল।
সরখেল প্রথমটায় কোনো কথাই বললেন না। পরে বললেন, “আপনাদের আমি স্টেজ দেখাতে পারি না।”
“কেন! একটিবার শুধু দেখব।”
“আপনাকে আমি বলছি কী? পুলিশ থেকে বারণ!”
“ভাড়া দেওয়া বারণ বলেছেন। ভাড়ার কথা পরে এসে ঠিক করে যাব। এখন শুধু একটি বার স্টেজ আর হল্টা…”
“না। হবে না। আপনি মশাই বেআইনি কাজ করিয়ে নিতে চাইছেন। থানা থেকে লিখিয়ে আনুন, আপনাদের হ দেখিয়ে দেব।”
কিকিরা হাসি-হাসি মুখ করে বললেন, “আমি স্যার থানা-পুলিশ জানি না। আপনাকে জানি। আপনি যদি দেখাতে না চান দেখাবেন না। কিন্তু, আমি বলছিলাম, আপনি যদি দেখাতেন ক্ষতিটা কী হত! আমরা একবার চোখের দেখা দেখে চলে যেতাম। কোনো জিনিসে হাত ছোঁয়াতাম না।..অ-আপনার যখন অসুবিধে, তখন না হয় না-দেখালেন। পরে এসে দেখে যাব।”
কিকিরা নমস্কার জানিয়ে উঠে পড়লেন।
সরখেলের বোধহয় খেয়াল হল। “আপনার রুমাল?”
“ও”
কিকিরা রুমালটা তুলে নিলেন হাত বাড়িয়ে। রুমালের তলায় এমন কিছু ছিল, যা দেখার পর সরখেল খানিকটা ইতস্তত করলেন। হঠাৎ তাঁর মত পালটে গেল। বললেন, “আপনি আমাকে দিয়ে বেআইনি কাজ করিয়ে নিচ্ছেন মশাই। কী আছে, চলুন। তাড়াতাড়ি সেরে নিন।”
সরখেল টেবিলের ড্রয়ার থেকে চাবির গোছা বার করে উঠে দাঁড়ালেন।
.
রাজকুমার
তারাপদ এসে দেখল, কিকিরা চোখ বুজে গান শুনছেন। এমনভাবে শুয়ে আছেন তাঁর গদিঅলা আর্ম চেয়ারে হাত-পা ছড়িয়ে, মাথার তলায় কুশন খুঁজে, যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন।
দুমুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল তারাপদ। পুরনো আমলের গ্রামোফোন, রেকর্ডও পুরনো; গান দূরের কথা, গলাই শোনা যায় না; ঘ্যাসঘেসে একটা শব্দ, না-কথা, না-সুর। এই গান শুনে মানুষ আবার ঘুমিয়ে পড়ে নাকি? কিকিরার সবই অদ্ভুত। যেমন মানুষ, তেমন তাঁর পছন্দ। এই ঘরটা দেখলেই বোঝা যায়, ছোটখাটো একটি মিউজিয়াম আগলে কিকিরা দিব্যি তাঁর দিনগুলো কাটিয়ে যাচ্ছেন।
তারাপদ ডাকতে যাচ্ছিল কিকিরাকে, তার আগেই কিকিরা বললেন, “সোজা আসছ?”
“আপনি জেগে আছেন? আমি ভেবেছিলুম, গান শুনে ঘুমিয়ে পড়েছেন!”
কিকিরা চোখ খুললেন, নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, “এ গান তোমার খগেন দস্তিদারের। রেকর্ডটা হবে ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ সালের। আমার পুরনো রেকর্ডের স্টকের মধ্যে পেয়ে গেলাম।”
“ওটা গান, না, গদাযুদ্ধ?”
হেসে ফেললেন কিকিরা। “সেকালের গানটান তোমাদের পছন্দ নয়। বন্ধ করে দাও। শেষ হয়ে এসেছে।”
গান শেষ হল। তারাপদ রেকর্ডটা তুলে রেখে দিল একপাশে। গ্রামোফোনের ঢাকনা বন্ধ করল।
“তুমি মেসে যাওনি?”
“না। চন্দনের আসতে আসতে সাতটা বেজে যাবে। ওর হাসপাতাল থেকে ছুটিই হবে ছ’টার সময়। “
“তাই বলছিল, নতুন ডিউটি শুরু হয়েছে?”
“কিকিরা-স্যার,” তারাপদ বলল, “কাল রাত্তিরে আমার একটা কথা মাথায় এল।” কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসল সে। ঘরে পাখা চলছে। জানলা খোলা। বিকেল মরে গিয়েছে অনেকক্ষণ, আলো ঝাপসা। ঘরের মধ্যে এখন তেমনভাবে ছায়া নামেনি। সব কিছুই চোখে দেখা যায়।
কিকিরা বললেন, “কী কথা?”
“ফুলকুমার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। তার দাদা রাজকুমার আপনাকে যা বলছে, আপনি সেটাই মেনে নিচ্ছেন।”
“মেনে নিচ্ছি মানে শুনছি। না শুনে উপায় কী! রাজকুমার যদি আমার কাছে এসে তার ভাইয়ের কথা না বলত, কিছুই জানতে পারতাম না।”
“রাজকুমারকে আপনি বিশ্বাস করেন?”
“এ-কথা কেন বলছ?”
“না, ধরুন, এর মধ্যে যদি রাজকুমারের কোনো হাত থাকে?”
“আমার মনে হয় না,” কিকিরা বললেন, “রাজকুমারের হাত থাকলে সে আমার কাছে আসত না। আর সে না এলে আমি ফুলকুমারের কথা কিছুই জানতে পারতাম না।”
তারাপদ সামান্য চুপ করে থাকল। “রাজকুমারকে আপনি অনেকদিন চেনেন?”
“তা চিনি। দশ বারো বছর আগে ওর সঙ্গে আমার দেখাশোনা খুবই হত। আমি তখন বিডন স্কোয়ারের দিকে থাকতাম। রাজকুমার আমাদের পাড়ায় একটা ছোট বাড়ি ভাড়া করে কারখানা খুলেছিল।”
“কিসের কারখানা?”
“বাজনা তৈরির। মিউজিক্যাল ইনমেন্ট-এর। মানে বাদ্যযন্ত্র তৈরির। সেখানে হারমোনিয়াম, বাঁশি, ফুট, তবলা, তারপর কী বলে তোমার তারের যন্ত্র–সেতার, এস্রাজ তৈরি হত।”
তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “ভদ্রলোকের কি বাজনা-তৈরির কারবার?”
“আগে তাই ছিল। একরকম পৈতৃক ব্যবসাই ছিল। চিতপুরে দোকান ছিল ওদের। এখন আর নেই।”
“এখন কিসের ব্যবসা?”
“কাপড়ের। বড়বাজারে কাপড়ের ব্যবসা করে।”
“বাদ্যযন্ত্র থেকে বস্ত্র ব্যবসায়ী?” তারাপদ হাসল।
কিকিরাও মুচকি হাসলেন। বললেন, “রাজকুমার আজ আসবে। সময়ও হয়ে এসেছে। তাকে দেখলে তুমি খানিকটা আঁচ করতে পারবে।”
তারাপদ আর কিছু বলল না। আসুক রাজকুমার, দেখা যাবে ভদ্রলোককে।
কিকিরাও সামান্য সময় চুপচাপ। মাথার চুল ঘাঁটছিলেন অলস ভাবে। শেষে উঠে দাঁড়ালেন। “আমি একটা পিচার এঁকেছি! দেখবে?”
কিকিরার গলার স্বরে মজা। চোখ দুটিও হাসি-হাসি।
তারাপদ বলল, “ছবি? আপনার ওটাও জানা আছে?” বলে জোরে হেসে উঠল।
কিকিরা এগিয়ে গিয়ে র্যাকের মাথা থেকে একটা চওড়া মাপের বই তুলে নিলেন। তার মধ্যে থেকে মোটা ড্রয়িং-পেপারের মতন এক কাগজ বার করলেন। নিজে দেখলেন একবার। কাগজটা এনে তারাপদকে দিলেন।
কাগজটা হাতে নিয়ে তারাপদ অবাক। এ আবার কেমন ছবি? দেখতে দেখতে তারাপদ বলল, “কিকিরা-স্যার, এটা কিসের ছবি?”
“কী মনে হচ্ছে তোমার?”
“স্টেজের মতন লাগছে।”
“ওটা স্টেজ। ঠিকই ধরেছ। যে-স্টেজ আমরা গত পরশু দেখে এলাম।”
“আচ্ছা! এ ছবির মধ্যে এখানে-ওখানে নানা চিহ্ন কেন?”
“ওগুলো সংকেত-চিহ্ন বলতে পারো। খানিকটা আবার নকশা।”
“ছবিটা থেকে আপনি কিছু ধরবার চেষ্টা করছেন মনে হচ্ছে।”
“না, একটা আন্দাজ করছিলাম,” কিকিরা বললেন, “আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় স্টেজটা ঠিকঠাক আছে? কিছু বাদ যায়নি তো?”
তারাপদ খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করল। সরখেল যেভাবে স্টেজ দেখিয়েছেন ওভাবে দেখলে কিছুই বোঝা যায় না। দুটো টিমটিমে বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে বড়জোর মিনিট দশেক দেখিয়েছিলেন স্টেজের ভেতর আর বাইরেটা। তারাপদ মন দিয়ে লক্ষ করতেও পারেনি সব।
তারাপদ বলল, “স্টেজের সামনের দিক আর পিছনের দিক ঠিকই আছে মনে হচ্ছে। একটা জিনিস আমি দেখতে পাচ্ছি না। কাঠের একটা সিঁড়ি দেখেছিলাম স্টেজের বাঁ..না, বাঁ নয়, ডান ধারে। সেই সিঁড়িটা কই?”
কিকিরা কী ভেবে হাসলেন। “নেই? তা হলে বোধহয় ভুলে গিয়েছি। আঁকতে। বাকি সব ঠিক আছে?”
“মনে হচ্ছে আছে, তারাপদ নকশা দেখতে দেখতে বলল।
সাজঘরের জায়গায় দুটো ক্রস দেওয়া আছে, দেখছ। একটা ঘর ছেলেদের, অন্যটা মেয়েদের। তার পাশ দিয়ে একটা প্যাসেজ গেছে। লক্ষ করেছ?”
“ডট-ডট দিয়ে রেখেছেন যেটা?”
“হ্যাঁ। ওই প্যাসেজটা সোজা ব্যাক স্টেজের বাইরে গিয়ে পড়েছে। যেখানে পড়েছে সেখানে একটা গুদোম মতন। কাঠকুটো, ভেঁড়াখোঁড়া সিনসিনারি, লোহালক্কড় ডাঁই হয়ে পড়ে আছে ওখানটায়। তার পাশেই একটা কল। খানিকটা ঝোপ মতন।”
তারাপদ নকশা দেখছিল। নকশায় কয়েকটা গোল চৌকো দাগ দেওয়া রয়েছে। কিকিরার নজরকে তারিফ করতে হয়। কত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি এ-সব নজর করেছেন! তারাপদ বলল, “এই নকশা থেকে আপনি কী প্রমাণ করতে চাইছেন?”
“প্রমাণ করতে চাইছি না কিছু। এখন অন্তত নয়। তবে ভাবছি।”
“কী ভাবছেন?”
“ভাবছি, এই রাস্তাটা দিয়ে একটা লোকের আসা, চলে যাওয়া, চুরি করে কিছু নিয়ে পালিয়ে যাওয়া সহজ। সহজ, কেননা একবার ওই বাতিল জিনিসপত্রের জঞ্জাল আর ঝোপঝাড়ের কাছে পৌঁছতে পারলে তার বাইরে বেরোতে কষ্ট হবে না। ওখানটার পাঁচিল ভাঙা। কম্পাউন্ড-ওয়ালের ওপারেই সরু রাস্তা। রাস্তাটা ঘুরে গিয়ে বড় রাস্তায় পড়েছে।”
তারাপদ কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েক পলক। বলল, “আপনি বলতে চাইছেন, এই রাস্তা ধরে কেউ এসেছিল, ফুলকুমারকে খুন করে পালিয়ে গিয়েছে?”
“হতে পারে। আসতেও পারে, আবার শুধু পালাতেও পারে। ভুতুড়ে হারমোনিয়ামটাও এই রাস্তা দিয়ে পাচার হয়ে যেতে পারে। তুমি কী বলল?”
তারাপদ কিছু বলার আগেই বগলা তাকে ডাকল।
নকশা রেখে দিয়ে তারাপদ বলল, “আমি আসছি। চোখে-মুখে জল দিয়ে আসি। বগলাদা খাবার তৈরি করেছে। বড় খিদে পেয়ে গিয়েছে আমার,” বলে উঠে পড়ল। কিকিরার ঘরবাড়িকে ওরা আর অন্যের বলে মনে করে না।
কিকিরা নকশাটা তুলে নিয়ে দেখতে লাগলেন।
.
ঘরে আলো জ্বালাবার মুখেই রাজকুমার এসে হাজির।
কিকিরা আর তারাপদ কথা বলছে, রাজকুমার এলেন। তারাপদকে দেখে রাজকুমার থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মুখ দেখে মনে হল, খুশি হলেন না।
কিকিরা হেসে বললেন, “ঘাবড়াবেন না। এরা আমার চেলা। আমি এদের “সোলজার’ বলি। এর নাম তারাপদ। আর একজন এখনো এসে পৌঁছয়নি। তার নাম চন্দন। সে ডাক্তার।”
তারাপদ নমস্কার করল।
রাজকুমারও নমস্কার করে ঘরের অন্য পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।
ভদ্রলোককে দেখছিল তারাপদ। লম্বা-চওড়া চেহারা। শক্ত গড়ন। গায়ের রঙ ফরসাই ছিল, বয়েসে খানিকটা যেন তামাটে হয়ে গিয়েছেন। মুখের গড়ন দেখে বোঝা যায় ঠিক বাঙালি নন। তবে সাজে-পোশাকে একেবারে বাঙালি। পরনে ধুতি, গায়ে পাঞ্জাবি। মাথার চুল সিঁথি করে আঁচড়ানো। চোখে চশমা। কপালের একপাশে কাটা দাগ। চোখ দুটিতে দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগের ছাপ রয়েছে। জামাকাপড়গুলোও ধোপদুরস্ত নয়। কেমন বিষণ্ণ লাগে।
রাজকুমারের হাতে একটা বড় মতন খাম ছিল। উনি বসলেন একপাশে।
কিকিরা বললেন, “আমরা পরশুদিন জায়গাটা দেখে এসেছি, কুমারবাবু।”
রাজকুমার খুশি হলেন। “আপনি যাবেন বলেছিলেন।”
তারাপদ লক্ষ করল, রাজকুমারের বাংলা উচ্চারণে দোষ প্রায় নেই। বোঝাই যায় না উনি বাঙালি নন। কলকাতায় থাকতে থাকতে জিভ রপ্ত হয়ে গিয়েছে।
কিকিরা বললেন, “হল্টার যিনি কেয়ারটেকার, সরখেলবাবু, তাঁকে বাগ মানাতে তেমন অসুবিধে হয়নি। তবে হল্ এখন বন্ধ।”
“জায়গাটা কেমন দেখলেন?” রাজকুমার বললেন।
“খুনখারাপি করে গা-ঢাকা দেবার মতন জায়গা। ফাঁকা, চুপচাপ; একদিকে রেললাইনের সাইডিং, অন্যদিকে খাঁখাঁ,” কিকিরা হাসলেন।
রাজকুমার বললেন, “আপনার কথামতন আমি জিনিসগুলো এনেছি।” বলে খামটা দেখালেন।
কিকিরা হাত বাড়ালেন। “ফুলকুমার কবে থেকে ম্যাজিক দেখাচ্ছে রাজকুমারবাবু?”
“পাঁচ-ছ’ সাল। আপনাকে সেদিন বলেছি, রায়বাবু।”
তারাপদ বুঝতে পারল কিকিরাকে রাজকুমার রায়বাবু বলেন। দু’একটা চলতি হিন্দি শব্দ বেরিয়ে আসে।
“বলেছেন। সব কথা খেয়াল রাখতে পারি না,” হাসির মুখ করলেন কিকিরা, “তা ছাড়া বারবার শুনলে ফাঁকগুলো ধরা পড়ে।” কিকিরা তারাপদর দিকে তাকালেন। “কাগজ কলম নেবে নাকি? দু’চারটে নোর্ট থাকা ভাল। পাঁচরকম ভাবতে ভাবতে এটা ওটা মিস করে যায়।”
তারাপদ উঠল। সামনের টেবিলেই সাতসতেরো জিনিস পড়ে আছে; কাগজ, কলম, ডায়েরি, পাঁজি, সেলোটেপ, কাঁচি, হজমিবড়ির শিশি, কিছুই বাদ যায়নি।
কাগজ আর ডটপেন নিয়ে ফিরে এসে নিজের জায়গায় বসল তারাপদ।
কিকিরা রাজকুমারকে বললেন, “আমি কী জিজ্ঞেস করছি তা নিয়ে আপনি মাথা ঘামাবেন না। যা জানেন, যতটা জানেন বলবেন। না জানলে বলবেন না।…আপনি বলছেন, ফুলকুমার ম্যাজিক দেখাচ্ছে মাত্র পাঁচ-ছ বছর?”
রাজকুমার ঘাড় নাড়লেন।
“তারাপদ, তুমি শর্টে নোট্ করে নিয়ো। জাস্ট পয়েন্টগুলো।…কুমারবাবু, আপনার ভাই, ফুলকুমার অন্য কী কাজ করত? শুধুই ম্যাজিক দেখাত, তা তো হতে পারে না।”
রাজকুমার বললেন, “আমার ভাইয়ের মাথা খারাপ ছিল রায়বাৰু? ওকে আমরা কমার্স পড়াতে পারলাম না, ওকাইলতি পড়াব ভেবেছিলাম, ও কিছু পড়ল না। কালেজে যেত, ঘুরত-ফিরত, ইয়ার-দোস্ত নিয়ে মজা করত, সিনেমা দেখত। কালেজ ছেড়ে দিল। ভাইকে বললাম, কারবারে এসে বসতে। দু’চার মাস মরজি মতন এল। আর এল না। কলকাত্তা ছেড়ে চলে গেল বেনারস। আমার বোন থাকে। বোনের কাছে, ফ্যামিলিতে দেড় সাল ছিল, কলকাত্তা ফিরে এল। সেই থেকে ওর নেশা চাপল–ম্যাজিশিয়ান হবে।”
“বয়স কত ছিল ফুলকুমারের?”
“আঠাইশ।“
“দেখতে কেমন ছিল? ফোটো এনেছেন?”
“খামের মধ্যে আছে।”
কিকিরা খাম থেকে ছবি বার করলেন। ফোটো। দেখলেন, “আপনার ভাই দেখতে সুন্দর ছিল কুমারবাবু!” বলে গোটাচারেক ফোটো তারাপদর দিকে এগিয়ে দিলেন।
তারাপদ ফোটো নিল। দেখল। ফুলকুমারের সাধারণ একটা ফোটো ছাড়া, অন্যগুলো জাদুকরের পোশাক-আশাক পরা ছবি। ফুলকুমার দেখতে সুন্দর ছিল যে, বোঝাই যায়।
“আপনি বলছেন ফুলকুমার শুধু ম্যাজিকই দেখাত?” কিকিরা বললেন।
“না, রায়বাবু। দো সাল হল ও একটা দোকান খুলেছিল, “টয় শপ। নিউ মার্কেটে ওর স্টল ছিল। বালবাচ্চার খেলাওনা বিক্রি করত। ম্যাজিক ওর নেশা ছিল।”
“খেলনার দোকানটির মালিক কে? ফুলকুমার একলা?”
“ওর একলারই দোকান ছিল। আমরাও নামে মালিক ছিলাম।”
“মানে, আপনি আর আপনার মেজো ভাই, মোহনভাই?”
“জি।…আপনি মোহনকে দেখেছেন রায়বাবু, ও বেচারির…”
“জানি।” কিকিরা তারাপদর দিকে তাকালেন, “কুমারবাবুর মেজো ভাইকে আমি চিনি। ট্রাম অ্যাকসিডেন্টে একটা হাত নষ্ট হয়ে গেছে। খুব ভাল লোক। মোহন চমৎকার হারমোনিয়াম বাজাত। তবলা। না, কুমারবাবু?”
রাজকুমার ঘাড় নাড়লেন। “আপনি জানেন রায়বাবু, আগে আমাদের যখন মিউজিক্যাল ইনস্ট্রমেন্টসের দোকান ছিল, তখন কারখানাটা মোহন দেখত। ওর হাত চলে যাবার পর কারখানা তুলে দিলাম।”
কিকিরা অন্য কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন, বগলা এল। রাজকুমারের জন্যে চা এনেছে।
বগলা চলে গেলে কিকিরা বললেন, “ফুলকুমারের খেলনার দোকান এখন বন্ধ?”
“জি।”
“আচ্ছা কুমারবাবু, বেনারস থেকে ফিরে আসার পরই কি আপনার ভাইয়ের মাথায় ম্যাজিকের নেশা বা শখ যাই বলুন, সেটা চেপে ধরে
“আমার তাই মালুম।”
“বেনারসে ও কার কাছে খেলা শিখত, আপনি জানেন?”
“না।”
কিকিরা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু ভাবলেন। শেষে বললেন, “আপনারা ফুলকুমারের খেলা দেখেছেন?”
রাজকুমার কেমন বিষণ্ণ মুখে হাসলেন। “দো-একবার দেখেছি। বাতচিত ভাল বলত। খেলা খারাপ ছিল না, রায়বাবু। ঘোড়া হোড়া কাঁচা ছিল। ইমপ্রুভ করছিল। চার-পাঁচ সালে কে আর পাকা ম্যাজিশিয়ান হয়?”
কিকিরা মশলার কৌটোটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। “সেদিন আপনি বা আপনার বাড়ির কেউ খেলা দেখতে যাননি বলছিলেন?”
“না।”
“ফুলকুমারের হারমোনিয়ামের খেলা আপনারা দেখেননি?”
“না। খেলাটা নতুন ছিল। ওই দিন ও সেকেন্ড টাইম খেলাটা দেখাচ্ছিল।”
“খেলাটা কে দেখেছে?”
“বাড়ির কেউ দেখেনি।…আমাদের দোকানের লালাজি দেখেছে। পয়লা বার যখন খেলা দেখায় ফুলকুমার, তখন দেখেছে।”
“আপনি জানেন খেলাটা কেমন ভাবে দেখানো হত?”
রাজকুমার মাথা নাড়লেন। “আমি ঠিক জানি না, রায়বাবু। লালাজি দেখেছে, ও জানে।…আমি শুনেছি, স্টেজের ওপর, মাঝখানে টেবিলে হারমোনিয়াম থাকে। হারমোনিয়াম থেকে দো-তিন হাত দূরে ফুলকুমার। ফুলকুমারের হাতে হ্যান্ড কা থাকে, চোখ বাঁধা থাকে পট্টিতে।”
তারাপদ অবাক হয়ে রাজকুমারের কথা শুনছিল।
কিকিরা এর আগেও রাজকুমারের কাছ থেকে কথাটা শুনে নিয়েছেন। আবার শুনলেন। রাজকুমার ঠিক-ঠিক বলছেন, না, ভুলচুক করছেন, বা কিকিরাই কোনো কথা ভুলে গিয়েছেন কি না, পরখ করে নিচ্ছিলেন।
“স্টেজ অন্ধকার থাকে তখন?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।
“জি, তাই থাকে। স্টেজ বিলকুল ডার্ক। অডিটোরিয়াম ডার্ক।”
“কুমারবাবু, আমি যদি আপনার দোকানে যাই লালাজিকে পাব?”
“কেন পাবেন না?”
“আমি লালাজির সঙ্গে একটু কথা বলব!” বলে কিকিরা খাম থেকে বাকি ছবিগুলো বার করে দেখতে লাগলেন। বেশির ভাগ ছবিই হল ম্যাজিক শো-এর। ফুলকুমারের নানান সাজ, কোনোটায় রাজপুত্র গোছের এপাশাক, কোনোটায় আরব দেশের সাজপোশাক। জাপানি পোশাকও দেখা গেল। কোনো-কোনো ফোটো গ্রুপ ফোটো; ফুলকুমারের সঙ্গে তার দলের ছেলেমেয়েরা রয়েছে।
কিকিরা ছবিগুলো দেখতে দেখতে বললেন, “দুটো ছবি দেখছি, ফুলকুমারের দলের ছবি নয়, তার সঙ্গীর ছবি। আপনি এদের চেনেন?”
“একজনকে চিনি। অন্য ছোকরাকে চিনি না।”
“যাকে চেনেন তার নাম কী? কোথায় থাকে?”
“লম্বা মুখের ছেলেটা, নাক ঘোড়া বেঁকা, ওর নাম হল কমল। কমল ফুলকুমারের পুরানা দোস্ত। স্কুল ফ্রেন্ড। ও এন্টালি বাজারের কাছে থাকে। ভাল ছেলে, রায়বাবু। কমল হোটেলে কাজ করে। ক্লার্ক।”
“আর অন্যটা?”
“আমি চিনি না। নাম জানি না। কমল জানতে পারে।”
“এটাকে তো বডি বিল্ডারের মতন দেখতে।..যাক গে, আপনি একটা কথা খোলাখুলি বলুন তো কুমারবাবু?” কিকিরা বললেন, “ফুলকুমারকে খুন করার কী কারণ থাকতে পারে?”
রাজকুমার কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মনে হল, তাঁর বলার কিছু নেই। মুখে ঘাম জমছিল তাঁর। বললেন, “আমি জানি না, রায়বাবু। ফুলকুমারের কোনো বদ দোষ ছিল না। তার কোনো দুশমন ছিল বলেও জানি না।..ও আমাদের ছোট ভাই। আমরা সেই শয়তানকে চাই, ভাইকে যে মেরেছে।” রাজকুমারের গলা বুজে এল।
কিকিরা কিছু বললেন না।
.
খোঁজ-খবর :কমল আর মোতিয়া
দু তিন দিন চন্দনের কোনো খবর নেই। তারাপদ বুঝতে পারছিল না, কী হয়েছে চন্দনের? বাড়ি গিয়েছে নাকি? কোনোরকম খবর না দিয়ে চন্দন অবশ্য কলকাতা ছেড়ে পালায় না। আগে মাঝে-মাঝে ডুব দিত। এখন হাসপাতালের চাকরি, ডুব দেওয়া সম্ভব হয় না। তবে কখনোকখনো চন্দনের মাথা গরম হয়ে গেলে ও গা ঢাকা দেয়। সে-অভ্যেস তার আছে।
বন্ধুর খোঁজ নিতে তারাপদ গেল চন্দনের মেডিক্যাল মেসে। গিয়ে দেখল, চোখে রঙিন গগলস্ এঁটে চন্দন বসে-বসে তাস খেলছে, পেসেন্স। আর রেডিও খুলে গান শুনছে।
সময়টা বিকেল। খানিকটা আগে ঝোড়ো হাওয়া উঠেছিল। এখনও যেন রাস্তাঘাটের ধুলোটে ভাব কাটেনি।
তারাপদ এসে বলল, “কী রে, তুই চোখে ঠুলি পরে বসে আছিস? কী হয়েছে?”
রেডিও বন্ধ করে দিল চন্দন। বলল, “বলিস না, কী করে একটা ইনফেকশান হয়ে গিয়েছিল। চোখ ফুলে, লাল হয়ে দুদিন যা কষ্ট দিয়েছে। আজ বেটার।”
“আমি ভাবলাম বাড়িটাড়ি চলে গিয়েছিস!”
“না। আসছে মাসে যাব,” বলে চন্দন তাসগুলো গুটিয়ে ফেলল, “আমি ভাবছিলাম আজ তুই আসবি।”
“তোর পাত্তা নেই, ভাবছিলাম কী হল?”
“কিকিরার খবর কী?”
“বলছি।”
চন্দনদের মেডিক্যাল মেসটাকে কোয়ার্টারও বলা যায়। প্রত্যেকের একটা করে ঘর, লাগোয়া ঘোট বাথরুম। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা মেসের মতনই। তবে চা-জলখাবার এটা-ওটা ঘরেই দিয়ে যায়।
তারাপদ গায়ের জামা খুলে ফেলল। ঝড়ের ধুলোয় চোখ-মুখ-মাথা কিরকির করছে। আগে বাথরুমে যাবে।
“আমি একটু ভদ্দরলোক হয়ে নিই। পাঁচ মিনিট। কিকিরা আসতে পারেন।” তারাপদ বাথরুমে চলে গেল।
চন্দন তাস রেখে বিছানাটা একটু ঝেড়ে নিল। জানলার একটা পাট কখন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, খুলে দিল। বাইরে করিডোর। শাঁটুল যাচ্ছিল নাচতে নাচতে। ছেলেটার হাঁটার ধরনই ওই রকম। ডাকল শাঁটুলকে। চা-টোস্ট আনতে বলল তারাপদর জন্যে। বলেই আবার কী মনে হল, “এই, আমাকে মুড়ি বাদাম খাওয়াতে পারবি? আচ্ছাসে তেল দিয়ে মাখবি। ভেজাল তেল। পিয়াজ দিবি, পচা পিঁয়াজ। আর লঙ্কা। পারবি না?”
শাঁটুল মাথা হেলিয়ে হাসল, “ওর সঙ্গে দুটো ফুলুরি?”
চন্দন বুঝল, ফাজলামি করছে শাঁটুল। তাড়া মারল শাঁটুলকে।
চোখের জন্যে গত দু’দিন মাথা ধরে ছিল বেশ। আজ অবশ্য মাথা ধরা নেই। কিন্তু জিভের স্বাদ আসছে না কেন? আসলে মাঝে-মাঝে বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতের রান্না খেয়ে জিভের স্বাদ না পালটে এলে আর ভাল লাগে না।
বাড়ির জন্যে চন্দনের মন-কেমন করে উঠল হঠাৎ।
তারাপদ বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। বলল, “চাঁদু, আমার বোধহয় বাত হয়েছে। মাঝে-মাঝে বাঁ পায়ের হাঁটুটা কনকন করে ওঠে।”
“করুক। বেশি করে হাঁটবি, সেরে যাবে।”
চুল আঁচড়াতে লাগল তারাপদ। বলল, “আর কত হাঁটব রে! হেঁটেই অফিস যাই; ফিরি। কাল কম-সেকম পাঁচ-সাত মাইল হেঁটেছি।”
“কেন? কোথায় গিয়েছিলি?”
“কিকিরার চেলাগিরি করছিলাম। গিয়েছিলাম এন্টালির দিকে। সেখানে গিয়ে শুনলাম, লাইন পেরিয়ে শিবতলায় যেতে হবে সেখানে গিয়ে আবার খোঁজ পেলাম…।”
তারাপদকে কথা শেষ করতে দিল না চন্দন, “এন্টালির দিকে কেন?”
“কমলের খোঁজ করতে।”
“কে কমল?”
“কমল ব্যানার্জি।”
“কে সে?”
“ফুলকুমারের বন্ধু। ফুলকুমারের ম্যাজিকের দলেও ছিল।”
চন্দন টেবিল হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিল, “আমি তো একেবারে ইগনোরান্ট হয়ে আছি রে তারা, মানে কিকিরার ভাষায়..” বলে হো-হো করে হেসে উঠল।
তারাপদ বলল, “তুই সেদিন গেলি না, গেলে জানতে পারতিস। রাজকুমারের সঙ্গে তোর আলাপটাও হয়ে যেত।”
“কপাল খারাপ, চন্দন নিজের কপাল দেখাল, “আমি যে কী রকম হাঁ করে তোদের জন্যে বসে ছিলাম। কোনো খবর পাচ্ছি না। কিকিরাকে একটা টেলিফোন নিতে বল।”
“বল না তুই!”
“যাক গে, আমায় বল তো, ডেভালাপমেন্ট কতদূর?”
তারাপদ গত দু’তিন দিনের ঘটনা শোনাতে লাগল চন্দনকে। রাজকুমারের কথা, কিকিরার নকশা-করা স্টেজের কথা, সেদিনের সমস্ত কথাবার্তা একে একে বলে যেতে লাগল।
শাঁটুল খাবার এনেছিল। চা টোস্ট পুডিং দিল তারাপদকে। চন্দন বসল এক বাটি মুড়ি বাদাম নিয়ে।
চন্দন বলল, “কিকিরা কাল তোর সঙ্গে ছিলেন?”
“না। আমি একলাই কমলের খোঁজ করতে গিয়েছিলাম।”
“দেখা পেলি?”
“পেলাম। তিন জায়গায় ঘুরে দেখা পেলাম। আমায় পাত্তা দিতে চায়নি প্রথমটা। সন্দেহ করছিল। পরে রাজকুমারবাবুর কথা বলতে খানিকটা কান দিল।”
“কী বলল কমল?”
“বলল, ফুলকুমারের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব থাকলেও, সে অনেক দিন হল দল ছেড়ে দিয়েছে। এখন সময় হয় না। হোটেলের চাকরি।”
“হোটেলের চাকরি? কী চাকরি?”
“বিল ক্লার্ক।“
“কোন হোটেল?”
“স্টার হোটেল। মাঝারি হোটেল,” তারাপদ পুডিং খেতে খেতে বলল, “চন্দনদের মেডিক্যাল মেসে পুডিংটা চমৎকার করে।
“কীরকম দেখলি কমলকে?” চন্দন জিজ্ঞেস করল।
“খারাপ লাগল না। ফুলকুমারের দাদা রাজকুমারবাবু সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন কমলকে। আমারও মনে হল, কমল সিল্প টাইপের।”
তারাপদর কথা ফুরোবার মুখেই কিকিরা এসে ঘরে ঢুকলেন। দেখলেন চন্দনকে, তারপর বললেন, “আগে আমায় জল খাওয়াও।” উনি পাচ্ছিলেন।
ঘরের একপাশে ছোট কুঁজোয় জল ছিল। চন্দন উঠে গিয়ে জল গড়িয়ে আনল। “দৌড়চ্ছিলেন নাকি? এমন হাঁপাচ্ছেন?”
কিকিরা কোনো জবাব দিলেন না। আগে জল খেলেন। হাঁফ ছাড়লেন স্বস্তির। বললেন, “কী ফ্যাসাদ! ওই যে বড় রাস্তায় ছানার দোকান আছে, ওখানে একপাল কুকুর খ্যাপার মতন কামড়াকামড়ি করছে। তাড়ানো যাচ্ছে না। রাস্তার লোককেও তেড়ে আসছে। আমি বাপু, কুকুরকে বড় ভয় পাই।”
চন্দন ঠাট্টা করে বলল, “করবেন গোয়েন্দাগিরি, আবার কুকুর দেখলে ভয় পাবেন, আপনি কেমন গোয়েন্দা?”
“কে চায় গোয়েন্দাগিরি করতে!’ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা আমার। যাক গে, তোমার খবর শুনি আগে। হয়েছে কী তোমার?”
চন্দন চশমা-আঁটা চোখ দেখাল। “দেখছেন না, গগলস্ এঁটে বসে আছি। ইনফেকশান হয়েছিল। “
কিকিরা হাত উঠিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করলেন। “তোমাদের একটু কিছু হলেই গালভরা কথা! ইনফেকশান। সোজা কথাটা কী! চোখ উঠেছিল, না আঞ্জনি বড় হয়ে ফেটে গিয়েছিল!”
চন্দন হাসল, “আইরাইটিস্।” এমন ভাবে গালভরা একটা কথা বলল, যেন কিকিরা একটু ঘাবড়ে যান।
“বোগাফাইটিস্– যত্ত সব! রোজ ওয়াটার দাও; না হয় লোটাস হনি,” কিকিরা মজা করে বললেন। তাকালেন তারাপদর দিকে, “তোমার খবর কী? গিয়েছিলে?”
“গিয়েছিলাম,” তারাপদ বলল, “চাঁদুকে সেই কথাই বলছিলাম। কমল এখন এন্টালিতে থাকে না। থাকে তার জ্যাঠতুতো দিদির কাছে, গুলাম আলি লেনে।”
“কেমন দেখলে?”
“আমার তো মনে হল, এই গোলমালের মধ্যে ও নেই। কমল বলল, ফুলকুমার তার স্কুলের বন্ধু। কলেজে পড়ার সময় দুজনে আলাদা কলেজে পড়লেও আগের মতনই ভাবসাব ছিল। ফুলকুমার কাশী চলে যাবার পর দু’জনে ছাড়াছাড়ি হয়। আবার যখন ফুলকুমার ফিরে এল কাশী থেকে, এসে ম্যাজিক নিয়ে পড়ল, তখন কমলের সঙ্গে পুরনো বন্ধুত্ব আগের মতনই গড়ে উঠল। তবে কমল তখন চাকরিবাকরি শুরু করেছে, বন্ধুর সঙ্গে রোজ তার দেখা-সাক্ষাৎ হত না।”
“ফুলকুমারের ম্যাজিকের দলে কমল ছিল,” কিকিরা বললেন।
“আমি জিজ্ঞেস করেছি।” কমল বলল, “গোড়ার দিকে দু-এক বছর সে ফুলকুমারের দলের সঙ্গে ছিল। ছিল মানে, কমল একরকম ম্যানেজারি করত ফুলকুমারের ম্যাজিক-পার্টির। যারা ওর ম্যাজিকের অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল, খেলা দেখানোয় সাহায্য করত, কমল তাদের মধ্যে ছিল না।”
কিকিরা ইশারায় আসতে বললেন তারাপদকে। চোখ বুজে কিছু ভাবলেন। বললেন, “ফুলকুমারদের যে গ্রুপ-ফোটো দেখেছি, তাতে কমল ছিল?”
“আমার মনে পড়ছে না।”
“আচ্ছা! তারপর?”
তারাপদ বলল, “আজ প্রায় দেড় বছর কমল আর ফুলকুমারের ম্যাজিক-পার্টির দেখাশোনা করে না। সে ম্যানেজারি ছেড়ে দিয়েছে। সময় হয় না। তবে ফুলকুমারের সঙ্গে দেখাশোনা, আসা-যাওয়া তার ছিল। মাঝে-মাঝে গল্পগুজব করতে যেত নিউ মার্কেটের দোকানে।”
“ফুলকুমারের খুন সম্পর্কে কিছু বলল?”
“বলল, খবর শুনে সে রাজকুমারবাবুর কাছে ছুটে গিয়েছিল। তার ভীষণ লেগেছে। ছেলেবেলার বন্ধু।“
কিকিরা কিছুক্ষণ তারাপদর মুখের দিকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে থাকলেন। চন্দন মুড়ি শেষ করে চা খাচ্ছিল। উঠে গিয়ে বাতি জ্বালাল ঘরের। বাইরে গেল একবার। হাঁক মারল শাঁটুলকে। চা আনতে বলল আবার। ঘরে ফিরে এল।
তারাপদ বলল, “আমার মনে হল, ফুলকুমারের সঙ্গে হালে বোধহয় কমলের বন্ধুত্ব আগের মতন ছিল না। কোনো কারণে বন্ধুর ওপর বিরক্ত হয়েছিল। “
“কারণটা কী?”
“তা বলল না।…শুধু বলল, ফুলকুমার কতকগুলো বাজে লোকের পাল্লায় পড়েছিল। ববি বলে একটা লোকের কথা বলল কমল।”
“কে ববি?”
“ববি নাকি একজন বক্সার। লাইট ওয়েট, ফেদার ওয়েট–কিসের চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল এককালে। এখন তার বাস-লরির ব্যবসা।”
তারাপদ চা-খাওয়া শেষ করে কাপটা মাটিতে নামিয়ে রাখল।
সন্ধের মুখে চন্দনদের মেডিক্যাল মেস গমগমে হয়ে উঠেছে। করিডোর দিয়ে লোকজন আসছে যাচ্ছে। চেঁচিয়ে কথা বলছে। হাসাহাসি করছে। নিচে রাস্তায় একটা ব্যান্ড-পার্টি যাচ্ছিল। বাজনার আওয়াজ আসছিল।
কিকিরা চুপচাপ। তারাপদর দিকে তাকাচ্ছেন মাঝে-মাঝে, আবার চোখ ফিরিয়ে ঘরের ছাদ দেখছেন, দেওয়াল দেখছেন। উঠে পড়লেন। ঘরের মধ্যে পায়চারি করলেন বারকয়েক। তারপর বললেন, “আমি কাল থেকে চেষ্টা করেও ওই ছোকরার কোনো হদিস করতে পারলাম না।”
“কোন্ ছোকরা?” চন্দন জিজ্ঞেস করল।
“দ্যাট বডি বিল্ডার।…তুমি তার ছবি দেখোনি। আমরা দেখেছি।…ছোকরার চেহারা দেখে বডি বিল্ডার বলে মনে হয়। তাগড়া, বেঁটে, গোল মুখ, মাথার চুল কোঁকড়ানো। ওকে মাসল-ম্যানও বলা যেতে পারে। আমি অনেক চেষ্টাচরিত্র করে নামটা উদ্ধার করেছি। মোতিয়া।”
“মোতিয়া?” তারাপদ অবাক চোখ করে বলল, “কেমন নাম? বাঙালি নাম বলে মনে হচ্ছে না!”
কিকিরা মাথা নাড়লেন, “সেভাবে বাঙালি নয়। ওরা ভাগলপুরের লোক। মোতিয়ার বাবা কলকাতায় এসেছিল চাকরিবাকরির খোঁজে। কাজ করত গ্যাস কোম্পানিতে। বাবা অনেক কাল আগে মারা গেছে। মোতিয়ার মা ছেলেকে মানুষ করেছে। মা কাজ নিয়েছিল মেয়ে হাসপাতালে। আয়ার কাজ। মাও মারা গিয়েছে বছরখানেক আগে। মোতিয়া এখন গণেশ টকির দিকে একটা গলিতে থাকে। যে বাড়িতে থাকে, সে বাড়িতে নানান রকমের লোক, পঞ্চাশ রকম ব্যবসা। দাঁতের মাজন, কলপের শিশি থেকে ফলের দোকানের খেজুরের প্যাকেট-কী না হচ্ছে, চন্দন। খুপরি-খুপরি ঘর, যে-যার মতন ব্যবসাও করছে, আবার তোলা উনুন-হাঁড়ি-কড়া নিয়ে সংসারও ফেঁদে বসেছে। মোতিয়া ওই বাড়িতে একটা ঘর নিয়ে থাকত।”
চন্দন বলল, “একলা?”
মাথা হেলালেন কিকিরা, “একলাই থাকত। খাওয়াদাওয়া করত হোটেলে, দোকানে।”
তারাপদ কিকিরাকে লক্ষ করছিল। বলল, “আপনি মোতিয়ার খবর পেলেন কেমন করে?”
“খবর পাওয়া কঠিন কিসের? আমি তো তোমায় বলেছিলাম, রাজকুমার না চিনুক আমি চিনে নেব। রাজকুমার কমলের কথা বলেছিল। তোমাকে পাঠালাম কমলের খোঁজ করতে। অন্য ফোটোটা কার সে বলতে পারেনি। আমি ফুলকুমারের দলের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা করলাম। তাদের দুএকজনের নাম-ঠিকানা রাজকুমারই বলে দিয়েছিল জোগাড় করে। বাকিগুলো আমি দেখা করে জোগাড় করে নিলাম। ওরাই বলে দিল মোতিয়ার কথা।”
“ফোটো দেখে?”
“ফোটো দেখাবার দরকার করল না। চেহারা বলতেই বলে দিল।”
চা নিয়ে এসেছিল শাঁটুল। কিকিরাকে সে চেনে কখনো-সখনো চন্দনের মেসে কিকিরা আসেন। দেখে-দেখে চিনে ফেলেছে। চন্দনের মুখে শুনেছে, কিকিরা ম্যাজিশিয়ান। শাঁটুলের ভক্তি বেড়ে গিয়েছে কিকিরার ওপর।
চা এগিয়ে দিয়ে দু’একটা কথা বলল শাঁটুল কিকিরার সঙ্গে। এঁটো কাপ-ডিশ উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল।
চা খেতে খেতে কিকিরা বললেন, “মোতিয়াকে আজ তিন-চার দিন আর তার আস্তানায় পাওয়া যাচ্ছে না।”
“মানে?” তারাপদ বলল, “বেপাত্তা হয়ে গেছে?”
“কী হয়েছে, কেমন করে বলব! সাত তারিখে ফুলকুমার খুন হয়েছে। আট-ন’ তারিখ পর্যন্ত সে ছিল। থানা থেকে ফুলকুমারের দলের লোকজনের, সেদিন যারা ছিল, সকলকেই জেরা করা হয়েছিল। মোতিয়াকেও।”
“মোতিয়া সেদিন তা হলে ছিল?” চন্দন বলল, “ফুলকুমারের খুনের দিন?”
মাথা হেলিয়ে কিকিরা বললেন, “ছিল। মোতিয়াও একটা খেলা দেখায়।”
তারাপদ আর চন্দন অবাক হয়ে চোখ চাওয়াচাওয়ি করল, “কী খেলা?”
“চেঞ্জ অব কফিন।”
মুখে যেন কথা আসছিল না তারাপদদের। চন্দন ঢোক গিলে বলল, “স্যার, আপনি আমাদের মাথা গোলমাল করে দিচ্ছেন। চেঞ্জ অব কফিনটা কী?”
কিকিরা বললেন, “কফিনের বাক্স তো দেখেছ? ওই রকম একই মাপের, একই রঙের, একই রকম দুটো বাক্সর একটাতে মোতিয়াকে শুইয়ে দেওয়া হত। সেই বাক্সটা থাকত স্টেজের মাঝখানে। আর-একটা কফিন বাক্স এনে রাখা হত পাশে, সেটা থাকত ফাঁকা। দুটো বাক্স, এরপর একটার ওপর অন্যটা চাপিয়ে দেওয়া হত। কিছুক্ষণ একটা কাপড় ঢেকে দেওয়া থাকত বাক্স দুটোর ওপর। তারপর কাপড় সরিয়ে কফিন খুললে দেখা যেত, মোতিয়া ছিল এক কফিনে, বেরিয়ে এল অন্য কফিন থেকে।”
চন্দন একবার তারাপদর দিকে তাকাল। তারপর গাল চুলকে বলল, “এরকম খেলা হয় নাকি কিকিরা-স্যার?”
“কেন হবে না? অনেক হয়। এক-একজন এক-একভাবে দেখায়। নিজের সুবিধেমতন করে নিয়েছে। কেউ বড় ডাইস বক্সের নকশা করে দেখায়, কেউ আবার বাস্কেট করে দেখায়।”
তারাপদ বলল, “এই খেলা সেদিন মোতিয়া দেখিয়েছে?”
“হ্যাঁ।” কিকিরা বললেন, “ইন্টারভ্যালের আগে এই খেলাটা হয়ে যায়।”
“তা হলে তো মোতিয়া…”
তারাপদকে কথা শেষ করতে না দিয়ে কিকিরা বললেন, “তা হলে মোতিয়া গেল কোথায়? বা মোতিয়া হঠাৎ গা-ঢাকাই বা দেবে কেন?
“থানা থেকে কি ওদের ওপর চোখ রাখছিল না?
“হয়ত রাখছিল, জানি না। এমনও হতে পারে, আমি যেমন মোতিয়াকে খুঁজছি পুলিশও হয়ত নজর রেখে তাকে খুঁজছে।”
চন্দন ঘরের মধ্যে বার-দুই পায়চারি করে নিল। সিগারেট ধরাল। বলল, “আপনি মোতিয়াকে সন্দেহ করছেন?”
কিকিরা ঘাড় নেড়ে বললেন, “মোতিয়াকে সন্দেহ করার কতকগুলো কারণ থেকে যাচ্ছে। প্রথম কারণ, তার চেহারার মধ্যে একটা রা ভাব আছে। দেখলেই মনে হয়, খুন-জখম করতে পারে। দ্বিতীয় কারণ, কাউকে কিছু না বলে তার বেপাত্তা হওয়া। আর তৃতীয় কারণ..” কিকিরা কথা শেষ না করে থেমে গেলেন। তাঁর চোখের তলায় যেন কেমন রহস্য।
“তৃতীয় কারণটা কী?”
“মোতিয়ার কাজ ছিল, ভুতুড়ে হারমোনিয়াম বাজার খেলা শুরু হওয়ার সময় ফুলকুমারের চোখ বাঁধা, হ্যান্ড কাফ পরানো। হ্যান্ড কাফের চাবিটা সে দর্শকদের মধ্যে একজনকে দিয়ে দিত। দিয়ে নিজে আবার স্টেজে উঠে আসত। স্টেজে ফুলকুমার আর মোতিয়া ছাড়া তৃতীয় কারও থাকার কথা নয়।” কিকিরা সিগারেটের জন্যে হাত বাড়ালেন। সিগারেট নিয়ে ধরালেন অন্যমনস্কভাবে। ধোঁয়া গিললেন। তারপর বললেন, “চোখ বাঁধা, হ্যান্ড কাফ লাগানো, চাবি দেওয়া হয়ে যাবার পর মোতিয়ার উইংসের পাশে চলে আসার কথা। স্টেজ তারপর অন্ধকার হয়ে যাবে। …আমি শুনলাম, মোতিয়া উইংসের পাশে এসে দাঁড়াবার পর, আচমকা নিজের জায়গা ছেড়ে কোথাও চলে যায়।”
“কোথায় যায়?”
“সেটা জানতে হবে।…মোতিয়াকে আবার দেখা যায় যখন ফুলকুমারকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।”
“হাসপাতালে গিয়েছিল মোতিয়া?”
“হ্যাঁ।”
“তবে তো সে বলতে পারে, স্টেজের কাছাকাছি ছিল সে।”
“বলতে পারে। বলেছে নিশ্চয়ই পুলিশের কাছে। ফুলকুমারের হ্যান্ড কাফের চাবি তার পকেটে থাকার কথা নয়। মোতিয়াই হ্যান্ড কাফ খুলে দিয়েছিল হাসপাতালে নিয়ে যাবার আগে।”
তারাপদ বলল, “তবু আপনি মোতিয়াকে সন্দেহ করছেন?”
“দেখো হে, একটা জটিল অসুখ হলে চন্দনরা চট করে কি কোনো একটা বিশেষ রোগ হয়েছে বলে ঠিক করে নেয়? না, তারা পাঁচটা লক্ষণ মেলায়, দশ রকম পরীক্ষা করে, অপেক্ষা করে দেখে, শেষে রোগটা ধরতে পারে। এখানেও সেই কথা। সন্দেহ অনেককেই হয়। দশরকম দেখে, প্রমাণ পেয়ে তবে না আসল লোককে ধরতে হবে!” কিকিরা সামান্য সময় চুপ করে থাকলেন। সিগারেট খেলেন নিজের মনে, শেষে বললেন, “মোতিয়া হাসপাতালে বেশিক্ষণ ছিল না।”
“কতক্ষণ ছিল?”
“আধ ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট।”
“অন্যরা ছিল?”
“দলের চার-পাঁচজন ছিল। রাজকুমার যখন খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যায়, তখনো মোতিয়া ছিল না।”
“আপনাকে এসব কথা কে বলেছে?”
“হরিমাধব।…হরিমাধব ফুলকুমারের দলের ম্যানেজার হয়ে কাজ করছিল ইদানীং। সেদিনের শো-এর বায়না ধরেছিল হরিমাধব। সাড়ে তিন হাজার টাকা শোবাবদ, আর অন্যান্য খরচ বাবদ পাঁচশো টাকা পাবার কথা ছিল তাদের। শোয়ের ব্যবস্থা করেছিল একটা জুট মিলের রিক্রিয়েশান ক্লাব।” মাথা চুলকে চন্দন বলল, “আপনি অনেক খবরই নিয়েছেন তা হলে?”
“নিতে হয়েছে। সবেই শুরু। এখনো কত খবর নিতে হবে,” বলে আঙুল দেখালেন তারাপদর দিকে, “তারাপদ আবার এক ববি’র কথা বলল। কে সে? খোঁজ নিতে হবে। তারপর রয়েছে লালাজি!”
চন্দন বলল, “কিকিরা-স্যার, আর-একটা দিন। পরশু থেকে আমি আপনার সার্ভিসে।”
কিকিরা হেসে ফেললেন।
.
ফুলের দোকানের খোঁড়া মানুষটি
দেখতে দেখতে গরম পড়ে গেল। সপ্তাহখানেক আগেও এমন গরম ছিল না। তখন বিকেলের দিকে এলোমেলো বসন্তের হাওয়া দিয়ে যেত। এখন আর তেমন বাতাস বইছে না, বরং গরমের ঝলকানি দিচ্ছে থেকে-থেকে।
দুপুরের দিকে ঘোরাফেরা করতে কষ্ট হয় কিকিরার। বাধ্য না হলে বাড়ির বাইরে বড় বেরোন না।
ঘুম নয়, আবার পুরোপুরি যে জেগে ছিলেন তাও নয়, তার মধ্যে শুয়ে ছিলেন, এমন সময় তারাপদ আর চন্দনের গলা পেলেন। এই সময়টা ওদের আসার সময় নয়। চোখ খুলে কান পেতে থাকলেন। স্বপ্ন নয়, সত্যি-সত্যি ওরা এসেছে। এসে বাইরের ঘরে বসে হাঁকডাক ছাড়ছে।
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন কিকিরা।
বাইরের ঘরে পা দিতেই চোখে পড়ল, তারাপদ-চন্দনদের সঙ্গে রয়েছেন লালাজি।
“কী ব্যাপার? তোমরা এই অসময়ে?”
চন্দন বলল, “তারার আজ শনিবার। আর আমার ডিপার্টমেন্ট বন্ধ।”
“বন্ধ! কেন?”
“আপনি স্যার কলকাতায় থাকেন। কলকাতার হাসপাতাল মাঝে-মাঝে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, জানেন না? অবশ্য আমার হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হয়নি। দিন-দুয়েকের জন্যে ডিপার্টমেন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একটা গোলমাল হচ্ছিল।”
কিকিরা লালাজির দিকে তাকালেন।
লালাজি মানুষটিকে দেখলেই মনে হয়, সাদামাটা নিরীহ বয়স্ক মানুষ। তাঁর কপালে চন্দনের ফোঁটা, গলার কাছে একটি মালা, তুলসীর মালার মতন। চোখের তলায় দাগ ধরেছে। মাথার চুল সবই প্রায় সাদা।
কিকিরা বললেন, “লালাজি, আপনি?”
লালাজি বললেন, “আমি আপনার কাছেই আসছি, রায়বাবু। কুছ খবর আছে।” বলে পকেট থেকে একটা খাম বার করে কিকিরার দিকে এগিয়ে দিলেন। “রাজাজি দিয়েছেন।”
চিঠিটা নিলেন কিকিরা। খামের মুখ বন্ধ। তারাপদদের আসার সঙ্গে লালাজির আসার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে একপক্ষে ভালই হয়েছে। লালাজিকে তারাপদরা দেখেনি। দেখার সুযোগ হয়ে গেল।
চন্দন বোধহয় আগেই জল চেয়েছিল। বগলা জলের জগ আর গ্লাস নিয়ে ঘরে এল।
কিকিরার যেন মনে পড়ে গেল কিছু। তারাপদদের সঙ্গে লালাজির পরিচয় করিয়ে দিলেন। রগড় করে বললেন, “লালাজি, এরা দুজনে পাক্কা জাসুস!” বলে হেসে উঠলেন।
বগলা লালাজিকে জল দিতে যাচ্ছিল। লালাজি হাত নেড়ে বারণ করলেন।
কিকিরা চিঠির মুখ খুলে পড়লেন চিঠিটা। বার-দুই। তাঁর মুখ দেখে বোঝা গেল না কিছুই।
লালাজি খানিক অপেক্ষা করে বললেন, “বাবুজি, আমি যাই?”
“যাবেন?..দোকানে যাবেন?”
“দুসরা একটা কাম আছে। এক-আধ ঘণ্টা বাদ যাব।”
“আসুন তবে।”
লালাজি উঠতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ কী মনে করে কিকিরা বললেন, “একটু বসুন লালাজি! পাঁচ-দশ মিনিট,” বলে কিকিরা তারাপদদের দিকে তাকালেন একবার। চোখ ফিরিয়ে লালাজির দিকেই তাকালেন আবার, “আচ্ছা লালাজি, আপনি ফুলকুমারের হারমোনিয়ামের খেল একবারই দেখেছেন?
“জি” লালাজি মাথা হেলালেন, “আমি আপনাকে বলেছি বাবুজি।”
কিকিরা অস্বীকার করলেন না। রাজকুমারের দোকানে গিয়েছিলেন তিনি। লালাজির সঙ্গে কথাও বলেছেন। ফুলকুমার কেমনভাবে খেলাটা দেখাত, ভাল করে জেনে নিয়েছেন।
“লালাজি, আপনি কি জানেন, হারমোনিয়ামটা কে তৈরি করেছিল?”
“জি, না।”
“আপনি বলেছেন, হারমোনিয়ামটা সরু আর লম্বা ছিল। মামুলি হারমোনিয়ামের মতন দেখতে ছিল না।”
“আমি ঠিক বলেছি বাবুজি!”
“আচ্ছা লালাজি, ফুলকুমার যখন হারমোনিয়ামের খেলা দেখাত, ও কী। ধরনের পোশাক পরত? মানে, ওর সাজ কী হত?”
“আমি বলেছি আপকো।”
“বলেছেন,” কিকিরা একটু হাসলেন, “আর-একবার বলুন।” লালাজি বললেন, “রায়বাবু, আমি বুড়া আদমি। খেলা-ঊলা আমি দেখি না। ছোটবাবু আমায় জবরদস্তি করলেন। আমি যিস্ দিন খেলা দেখি, উস্ দিন, ফুলকুমার ওস্তাদজির কাপড় পরেছিল। “
“পাজামা আর পাঞ্জাবি?”
“জি। “
“কালো রঙের?”
“তফাতসে ওইসে মালুম হয়।”
“মোতিয়া ছিল?”
“নাম আমার মালুম ছিল না, বাবুজি। মগর, আপ যার কথা বলেছিলেন, উও ছোকরা ছিল।”
কিকিরা সামান্য চুপ করে থাকলেন। পরে বললেন, “লালাজি, আপনি ফুলকুমারকে ছেলের মতন ভালবাসতেন শুনেছি। একটা কথা আমায় বলুন। ফুলকুমারের দুশমন কে ছিল? কাকে আপনার সন্দেহ হয়?”
লালাজি কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তাঁর মুখে কষ্ট ও বেদনার ছাপ ফুটে উঠছিল। চোখ নামিয়ে নিয়ে ভাঙা-ভাঙা ভাবে বললেন, “রায়বাবু, আমি রাজাজির সঙ্গে দোকানে থাকি। ফুলবেটা কাদের সাথ দোস্তি করত, আমি জানি না। ত সাচ বাত কী জানেন? আচ্ছা দোস্ত ওর জাদা ছিল না।”
তারাপদ হঠাৎ বলল, “আপনি কমলকে জানেন লালাজি?”
“জি, জানি।”
“কমল কেমন লোক?”
“কমল আচ্ছা ছোকরা। “
“মোতিয়া?”
“আমার মালুম নেহি।”
লালাজি আর বসতে চাইছিলেন না। কাজ আছে তে। উঠে দাঁড়ালেন।
কিকিরা বললেন, “আপনি আসুন। কুমারবাবুকে বলবেন, কাল আমি থাকব। উনি আমাকে বাড়িতে পাবেন।”
লালাজি চলে গেলেন।
কিকিরা সামান্য চুপচাপ থাকলেন। হাই উঠল। বললেন, “বোসো তোমরা, চোখে-মুখে জল দিয়ে আসি। ঘুমিয়ে পড়েছিলুম একটু।”
বাইরে গেলেন কিকিরা।
চন্দন বলল, “তারা, আমি কাল এই ব্যাপারটা নিয়ে রাত্তিরে অনেক ভাবছিলুম। প্রবলেমটা টু-ফোল্ড। মানে, ডবল ব্যাপার। একটা হল, ফুলকুমারকে খুন; আর দু নম্বর হল, হারমোনিয়াম চুরি। একটার সঙ্গে অন্যটার সম্পর্ক আছে বলেই মনে হয়। তবু বলব, মতলব যদি চুরির হত, অনর্থক একটা মানুষকে খুন করতে যাবে কেন? চোর হিসেবে ধরা পড়লে যে শাস্তি, সেটা হল চুরির শাস্তি। বড়জোর ছ’ মাস এক বছরের জেল। খুনি হিসেবে ধরা পড়লে যে ফাঁসির দড়ি, এটা সকলেই জানে। হঠকারিতা করে খুন করে না ফেললে মানুষ সহজে খুন করে না। এমনকী ক্রিমিন্যালরাও ঝট করে খুন পর্যন্ত এগোতে চায় না। তবে যারা পাক্কা খুনি তাদের কথা আলাদা।…আমার এইটেই অবাক লাগছে।”
তারাপদ বলল, “এমন তো হতে পারে, হারমোনিয়াম চুরি করতে হলে ফুলকুমারকে খুন না করে উপায় ছিল না।”
“মনে হয় তাই। কিন্তু একটা ম্যাজিক দেখানো হারমোনিয়াম কি এতই দামি যে তার জন্যে মানুষ খুন করতে হবে?”
“দেখো চাঁদু, আমারও সেটা মনে হয়।…তা ছাড়া আমি বুঝতেই পারি না–হারমোনিয়ামটা বাজত কেমন করে। কিকিরা কিছু বলেন না।”
ঘরে এলেন কিকিরা। চোখ-মুখ ধুয়ে এসেছেন। বললেন, “কী বলছিলে কিকিরাকে নিয়ে?”
“বলছিলাম, আপনি হারমোনিয়াম রহস্যটা আমাদের কাছে ভাঙছেন না…” তারাপদ বলল।
কিকিরা কোনো জবাব দিলেন না। নিজের জায়গাটিতে বসলেন। ঘড়ি দেখলেন দেওয়ালের। বললেন, “চা খাবে তো?”
চন্দন বলল, “সে-চিন্তা বগলাদার। আপনি আমাদের কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন।”
কিকিরা হাসি-হাসি মুখ করলেন। মাথার চুল ঘাঁটলেন অভ্যাসবশে। বললেন, “হারমোনিয়ামটা কেমন করে বাজত, এটা জানা তেমন জরুরি নয়, স্যান্ডাল উড়। ম্যাজিক মানে ভেলকি। বুদ্ধির খেলা, হাতের খেলা, কথার খেলা, আর তোমার প্রেজেন্টেশান, এই সব মিলিয়ে ম্যাজিক হারমোনিয়ামটা কেমন করে বাজত, সেটা তোমাদের সামনে দেখিয়ে দিতে পারলে ভাল হত, বেশ তো, একদিন দেখিয়ে দেব। একটা হারমোনিয়াম জোগাড় করে এনো।”
“আপনি জানেন?” তারাপদ বলল।
“না, আমি জানি না।” মাথা নাড়লেন কিকিরা, “ওরকম খেলা আমি কখনো দেখাইনি।”
“তা হলে?”
“তা হলে কিছু নয়,” কিকিরা মজার চোখে হাসলেন। “প্রসেসটা জানি। ছেলেবেলায় তোমরা তো কত অঙ্ক করেছ, জ্যামিতি করেছ। নিয়মটা জানলে যেমন সেই নিয়মের অন্য অঙ্কগুলো করা যায়, এ হল তাই। জিনিস এক। তবে দেখাবার সময় এক-একজন এক-এক কায়দা করে দেখায়। যে যত চমক দিতে পারবে তার কপালে তত হাততালি জুটবে।” বলে কয়েক মুহূর্ত থামলেন কিকিরা। আবার বললেন, “হারমোনিয়ামটা কেমন করে বাজছিল, সেটা আমার কাছে তত বড় কথা নয়। আমার কাছে বড় কথা, ওই হারমোনিয়ামের মধ্যে কী ছিল? কে ফুলকুমারকে খুন করল?”
চন্দন কিকিরার চোখে-চোখে তাকিয়ে থাকল। বলল, “আমরাও তাই বলাবলি করছিলাম। ম্যাজিক-দেখানো হারমোনিয়াম কি এতই মূল্যবান যে, তার জন্যে মানুষ খুন করতে হবে?”
“ঠিকই,” কিকিরা ঘাড় হেলিয়ে সায় দিলেন। “আমার মনে হয় চন্দন, হারমোনিয়ামটা উপলক্ষ। ওর মধ্যে কিছু ছিল। যাই থাক, সেটা মূল্যবান।”
তারাপদ বলল, “কী থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?”
মাথা নাড়লেন কিকিরা। “বলতে পারছি না। চোরাই হীরে, জহরত, দামি পাথর। সোনার বিস্কুট বার থেকে শুরু করে নেশার জিনিস, কোকেন, হাসিস সবই থাকতে পারে। আবার অন্য কোনো বহুমূল্য জিনিস থাকতে পারে।”
তারাপদ বলল, “ফুলকুমার কি সেটা জানত?”
“বলতে পারি না।”
“ফুলকুমার কি নিজেই হারমোনিয়াম বাজাচ্ছিল?”
“বাইরে থেকে দেখতে গেলে তার বাজাবার কথা নয়। কেন নয়? কারণ তার হাতে ছিল হ্যান্ডকা; হ্যান্ডকাফের চাবি অন্যের কাছে–মানে কোনো দর্শকের কাছে। তার ওপর ফুলকুমারের চোখ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।”
চন্দন বলল, “আপনি বলতে চাইছেন, অন্য কেউ তার হয়ে বাজাচ্ছিল?”
কিকিরা এবার ছোট-ছোট চোখ করে হাসিমুখে বারকয়েক নাক চুলকোলেন। পরে বললেন, “চন্দন, তোমরা এতদিন ম্যাজিশিয়ান কিকিরার চেলাগিরি করেও নাথিং নোয়িং হয়ে রইলে। দু’চারটে ম্যাজিকের বই পড়তে বলি, তাও পড়বে না। পড়লে অনেক কিছু জানতে পারতে! কথায় কথায় এত অবাক হতে হত না। যাক গে, সবুর করো। সবুরে মেওয়া ফলে।”
বগলা চা নিয়ে এল।
হাতে-হাতে চা এগিয়ে দিয়ে বগলা কিছু টাকা চাইল কেনাকাটার জন্য।
কিকিরা নিজে উঠলেন না। শোবার ঘরের টেবিলের ওপর খুচরো টাকা কিছু পড়ে আছে। নিয়ে যেতে বললেন বগলাকে।
টাকা এনে চলে যাচ্ছিল বগলা, কিকিরা বললেন, “আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরবে; আমরা ঠিক পাঁচটায় বেরোব।”
চলে গেল বগলা।
চায়ে চুমুক দিয়েছিল তারাপদ। বলল, “কোথায় বেরোবেন?”
“নিউ মার্কেট,” কিকিরা বললেন।
“নিউ মার্কেটে? সেখানে কী?”
“সেখানে একটি খোঁড়া লোকের সন্ধানে। সেই-যে ফাস্ট বুকে পড়েছ, ওয়ান মর্ন আই মেট এ লেম্ ম্যান, এও হল অনেকটা তাই। একজন লেম্ ম্যানকে খুঁজে বার করতে হবে।”
চন্দন একবার ঘড়ির দিকে তাকাল। চারটে কুড়ি। বলল, “আপনার সঙ্গে কি তার দেখা করার কথা?”
“না। আমি তাকে চিনি না। সেও আমাকে চেনে না।”
“তা হলে আর নাই বা গেলেন? আপনি কিকিরা-স্যার, কলকাতার অনেক খবর রাখেন না। শনিবার নিউ মার্কেট আধবেলা। আপনি গিয়ে দেখবেন সব বন্ধ।”
কিকিরা বললেন, “লোকটাকে আমি পাব,” বলে জামার পকেট থেকে চিঠি বার করলেন। “রাজকুমার যে চিঠিটা পাঠিয়েছে, তাতে কী লিখেছে জানো? লিখেছে ফুলকুমারের খেলনার দোকান বা “টয় শপ’-এর আশেপাশে এই লোকটা আজ কদিন ঘুরঘুর করছে। লোকটার চালচলন সন্দেহজনক। সে। কেন ফুলকুমারের বন্ধ খেলনার দোকানের সামনে ঘুরঘুর করছে এটা জানা দরকার।”
“খবরটা রাজকুমারবাবুকে কেউ দিয়েছে, না তিনি নিজে দেখেছেন?”
“পাওয়া খবর। ফুলকুমারের স্টলের পাশে যাদের দোকান আছে, তাদের কেউ দিয়েছে খবরটা। “
চন্দন বলল, “কিন্তু সেই খোঁড়া লোকটাকে এখন আপনি কেমন করে পাবেন? দোকান বন্ধ। মার্কেট বন্ধ।”
“দেখতে ক্ষতি কিসের,” কিকিরা বললেন, “হিন্দু একটা আছে। যদি পাই! আর না যদি পাই–বিকেলের দিকে একটু বেড়ানো তো হবে। তোমরা এমন অলস কেন? ইয়ং ম্যান!”
চন্দন বলল, “অলস নই, স্যার। আমরা দারুণ অ্যাকটিভ কিন্তু আপনার এই ফুলকুমার রহস্যতে মারদাঙ্গা দেখছি না। একবার চা দিন, তারপর দেখুন কী হয়?” চন্দন হাসতে লাগল।
কিকিরাও হেসে ফেললেন। বললেন, “মুখে তো বলছ, কাজের সময় পারবে মারদাঙ্গা করতে?”
“তারা পারবে না, স্যার। আমি পারব।”
.
নিউ মার্কেটের সামনে ঠিক নয়, নিউ এম্পায়ার সিনেমার কাছে আচমকা একটা গণ্ডগোল বেঁধে গিয়েছিল। ছোটখাটো ভিড়। ছোকরামতন একজনের চোখ-মুখের অবস্থা দেখে মনে হল, ছোকরা বেদম মারধোর খেয়েছে। চোখের তলায় কালশিটে, ঠোঁটের পাশে রক্ত, ধুলো লেগে রয়েছে চুলে, শার্টের একটা হাতা ছেঁড়াখোঁড়া।
চন্দন ভিড়ের মধ্যে মুখ বাড়িয়ে খবরটা জেনে এল। এসে বলল, “মোটর বাইক কাকে ধাক্কা মেরেছিল। পাবলিক বেদম মেরেছে লোকটাকে।”
কিকিরা বললেন, “তবু রক্ষে! ওর গায়ে সইতে হল; গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলে বেচারির অনেকগুলো টাকা যেত।”
ভিড়ের কাছ থেকে সরে এল তারাপদরা।
শনিবারের বিকেল, সিনেমার ভিড় গিজগিজ করছে। উলটো দিকের দোকানগুলো খোেলা। শরবতের দোকানের সামনে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের ভিড়।
কিকিরা বললেন, “এ-পাশে নয়, লিন্ডসে স্ট্রিটের দিকে চলো।”
নিউ মার্কেট বন্ধ হয়ে গেছে কোন্ দুপুরে। ওদিকের রাস্তাটা সামান্য ফাঁকা। কিকিরা হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “গ্লোব সিনেমার উলটো দিকে, মার্কেটের গায়ে একটা ফুলের দোকান আছে। একেবারে শেষের দিকে, মনে হচ্ছে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের দিকে। দোকানটা খুঁজে বার করতে হবে।”
চন্দন বলল, “দোকান না হয় খুঁজে বার করা গেল। কিন্তু লাভ কী? দোকান বন্ধ দেখবেন।”
“চলো দেখি।”
কিকিরা ধীরেসুস্থে হাঁটতে লাগলেন। যেন বেড়াতে এসেছেন। আশেপাশে তাঁর নজর ছিল। সন্ধে হয়ে আসছে প্রায়। জায়গাটা গমগম করছে। গাড়ি রাখার জায়গাগুলো ভরতি। দুটো ছেলে প্ল্যাস্টিকের জল-ভরতি ব্যাগে রঙিন মাছ পুরে নিয়ে খদ্দের ধরার চেষ্টা করছে।
চন্দন আর তারাপদ সিগারেট ধরাল।
চন্দন বলল, “আপনি যে বললেন, খোঁড়া লোকটিকে আপনি চেনেন না। তা হলে ফুলের দোকানে খোঁজ করছেন কেন?”
“রাজকুমার তার চিঠিতে একটা হদিস দিয়েছে। তাই কিকিরা বললেন।
“তাই বলুন।“
নিউ মার্কেটের গা ধরে আরও খানিকটা হেঁটে গেলেন কিকিরা। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় যখন দক্ষিণের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছেন, চোখে পড়ল, একটা নাশরি। নিছক ফুলের দোকান নয়, তবে নাশরি। দোকান অবশ্য বন্ধ। বন্ধ হলেও দোকানের সামনে কয়েকটা টব পড়ে আছে। পাতাবাহারের টব। একটা বেতের বড় ঝুড়ির মধ্যে বাসী ফুল আর পাতার জঞ্জাল। দোকানটার নাম, “কৃষ্ণা নাশারি’।
তারাপদ দাঁড়িয়ে পড়েছিল। বলল, “এই দোকান?”
মাথা হেলালেন কিকিরা। দেখলেন দোকানটা, তারপর এদিক-ওদিক তাকালেন।
চন্দন বলল, “আপনার খোঁড়া লোক কোথায়?”
আশেপাশে কাউকে বিশেষ দেখা যাচ্ছিল না। খানিকটা তফাতে জনা দু-তিন বাজারের মুটে বসে বসে সুখদুঃখের গল্প করছে।
কিকিরা কী যেন ভাবছিলেন। বললেন, “তারাপদ, ওই যে উলটো দিকে একটা দোকান আছে, ওটা কিসের দোকান?”
মার্কেটের উলটো দিকে একটা ছোট দোকান দেখা যাচ্ছিল। বেতের জিনিসপত্র বিক্রি করে বলে মনে হল। বেতের টুকরি, চেয়ার, টেবিল, টুকিটাকি দেখা যাচ্ছিল। তারাপদ বলল, “বেতের জিনিস বিক্রি হয় মনে হচ্ছে। ওটা রাস্তার ওপারে। ভোলা আছে।”
“চলো, একবার খোঁজ করি।”
রাস্তা পেরিয়ে এ-পারে দোকানের কাছে আসতেই লুঙ্গি আর হাফ শার্ট পরা একজনকে দেখা গেল। দোকানে খদ্দের নেই। লোকটা বোধহয় নতুন-আসা কিছু মালপত্র মিলিয়ে নিয়ে দোকান বন্ধ করার অপেক্ষায় ছিল।
কিকিরা কিছু বলার আগেই লোকটা বলল, “এখন আর বিক্রি হবে না।”
কথার ঢঙ থেকে বোঝা গেল, লোকটা দক্ষিণ ভারতীয়।
কিকিরা বললেন, তিনি একজনের খোঁজে এসেছেন। ওই নাশারিতে খোঁড়ামতন একটি লোক থাকে, তার খোঁজে!
ভাঙা-ভাঙা ইংরেজি আর বেখাপ্পা হিন্দি মিশিয়ে লোকটা বলল, “মুফতি? ইউ ওয়ান্ট হিম? উধার যাও,” বলে আঙুল দিয়ে লিন্ডসে স্ট্রিটের দিকে একটা গলি দেখাল। বলল, “টেলারিং শপ! মিন্ জায়গা।”
কিকিরা আর দাঁড়ালেন না। চোখের ইশারায় তারাপদদের পা বাড়াতে বললেন।
দশ-পনেরো পা হেঁটে এসে চন্দন বলল, “লোকটার নাম কি মুফতি?”
“বোধহয়। “
“বাঙালি বলে মনে হচ্ছে না?”
“চলো, দেখা যাক।”
“আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে কিকিরা, ফুলকুমার ম্যাজিকই দেখাক, আর খেলনার দোকান দিক, সে কোনো একটা বাজে দলে ভিড়ে গিয়েছিল। মোতিয়া, ববি, মুফতি…এ যেন এক শয়তানের চক্র!”
কিকিরা ঠোঁট টিপে হাসলেন, বললেন, “এত তাড়াতাড়ি কোনো কিছু ঠিক করে নিও না। তুমি যা বলছ তা হতে পারে। আবার এমনও তো হতে পারে চন্দন, ফুলকুমার স্বভাবে বোকা ছিল। হয়ত সে নিজে কিছু জানত না। চালাকি করে তাকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে।“
কিকিরার কথা শেষ হয়নি, হঠাৎ তারাপদ চেঁচিয়ে উঠল, “কমল, কিকিরা, ওই যে কমল। স্কুটারে করে চলে যাচ্ছে।”
তাকালেন কিকিরা। চন্দনও তাকাল।
তারাপদ হাত তুলে আঙুল দিয়ে দূরের কাকে যেন দেখাতে লাগল। স্কুটারে-চড়া লোক অন্তত জনা-তিনেক। “ওই গলি দিয়েই বেরিয়ে এল কমল। ধরব?”
“ধরো।”
তারাপদ পা চালিয়ে ধরতে যাচ্ছিল কমলকে। কিন্তু ধরতে পারল না। লিন্ডসে স্ট্রিট ধরে কমল সোজা চৌরঙ্গির দিকে চলে গেল।
.
বিজয় মুস্তাফি
দরজির দোকান নয়, দরজির দোকানের পাশে খোঁড়া মানুষটিকে পাওয়া গেল। নাম তার মুফতি নয়–মুস্তাফি। বলল, “ওই নাশারির মালিকের বন্ধু আমি। মুস্তাফি। আমার নাম বিজয় মুস্তাফি। ভুল করে আমায় মুফতি বলেছে। মাথায় আসেনি ওর। বুঝতে ভুল হয়েছে।”
কিকিরা খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। রাজকুমারের চিঠি পড়ে যে-মানুষটিকে খুঁজতে এসেছিলেন, বিজয় মুস্তাফির সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। বিজয়ের বয়েস বছর চল্লিশ কি বিয়াল্লিশ। শক্ত চেহারা। গায়ের রঙ তামাটে। চোখ দেখলে বোঝা যায়, চতুর। বুদ্ধিমান। সাদা লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে বসেছিল বিজয়। খাটের উপর। লুঙ্গি পরে থাকার দরুন কিকিরা পা দেখতে পাচ্ছিলেন বিজয়ের। খোঁড়া বলতে যেমনটি মনে হয়েছিল তেমন নয়। বাঁ পায়ের নিচের অংশ, হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত, সোজা করতে পারে না বিজয়। ভর দিতে পারে না মাটিতে। ক্রাচ নিয়ে হাঁটে।
তারাপদ আর চন্দন বিজয় মুস্তাফির ঘরবাড়ি দেখছিল। দেখার মতন যদিও নয়, তবু এই ঘরের এক অন্যরকম চেহারা রয়েছে। মাঝারি ঘরু, গোটাতিনেক জানলা। জানলাগুলোর তলার অর্ধেক খোলা যায় না, ওপরের অংশ খোলা যায়, খোলাই ছিল। খড়খড়িকরা জানলা। দরজা দুটোও বড়। উঁচু। ঘরের দেওয়াল স্যাঁতসেঁতে ধরনের, খাপচা-খাপচা হলদেটে দাগ ধরেছে অনেক জায়গায়। মাথার ওপর থেকে বাতি আর পুরনো পাখা ঝুলছিল। আসবাবপত্র বলতে একটা শোবার খাট, টেবিল, দু’তিনটে নানা ছাঁদের চেয়ার। ঘরের একপাশে এক বড় মিটশেফ। মিটশেফের মাথার ওপর কৌটোবাটা, চায়ের কেটলি, প্ল্যাস্টিকের বাটি। মিটশেফের পাশে কেরোসিন স্টোভ আর প্রেশার কুকার। বোঝাই যায়, বিজয় মুস্তাফির এই ঘরই তার সংসার।
কিকিরা যেন ভেবে নিচ্ছিলেন কেমন করে কথা শুরু করবেন। শেষে বললেন, “আমরা রাজকুমারবাবুর কাছ থেকে আসছি। চেনেন আপনি রাজকুমারকে?”
বিজয় মুস্তাফি ঘাড় নাড়ল। “নাম জানি। ফুলকুমারবাবুর দাদা।”
“ওঁকে দেখেননি?”
“না। ফুলকুমারের দোকানে ওঁকে আমি দেখিনি। উনি আসতেন না।”
“কখনোই আসতেন না?”
“দু চারবার নিশ্চয়ই এসেছেন। ভাইয়ের দোকান। তবে আমি দেখিনি।”
কিকিরা একবার তারাপদর দিকে তাকালেন। চোখ ফিরিয়ে নিলেন। বিজয়কে দেখতে দেখতে বললেন, “ফুলকুমারকে খুন করা হয়েছে, আপনি জানেন?”
ঘাড় হেলাল বিজয়, “জানি।”
“আপনি ফুলকুমারকে কত দিন ধরে চিনতেন?”
“চার-ছ’ মাস।”
“আপনার এই নার্সারি কত দিনের?”
বিজয় কয়েক পলক কিকিরাকে দেখল। চোখের তলায় যেন হাসি এল। বলল, “দোকান আমার নয় আপনাকে আমি বলেছি। দোকানের মালিক আতাবাবু। আতাবাবু মালিকের ডাকনাম। সবাই তাকে আতাবাবু বলে। মালিক বেহালায় থাকে। তার ভারী এক অসুখ করার পর থেকে রোজ দোকানে আসতে পারে না। ওর লোক আছে দোকান দেখার। আমিও কিছু কিছু দেখি।”
“আপনি দোকানের কর্মচারী নন?”
বিজয় যেন অসন্তুষ্ট হল। বলল, “না। আমি কারও চাকরি করি না। কী নাম আপনার?”
“কিকিরা বলেই ডাকতে পারেন। ওর নাম তারাপদ, আর ওর নাম চন্দন।”
“অদ্ভুত নাম,” বিজয় একটু হাসল। “আপনি কে? কী করেন?”
“আমি রাজকুমারবাবুর বন্ধু। পুরনো বন্ধু।..মাঝে মাঝে চোর গুণ্ডা বদমাশের খোঁজখবর করি,” বলে কিকিরাও মুচকি হাসলেন, “তা বলে পুলিশে কাজ করি না।”
বিজয় কয়েক পলক কিকিরাকে দেখল। তারপর বলল, “ডিটেকটিভ?”
“আধা-ডিটেকটিভ,” কিকিরা হাসলেন, “আমি আপনার কাছে কয়েকটা কথা জানতে এসেছি। যদি আপত্তি না থাকে আমায় বলতে পারেন। না বলতে চাইলে বলবেন না। আমি পুলিশের লোক নই, জোর করে কথা আদায় করতে পারি না। “
চন্দন সিগারেটের প্যাকেট বার করল। বিজয় মুস্তাফি লোকটাকে তার নির্বোধ মনে হচ্ছিল না।
বিজয় বলল, “কী কথা জানতে চান?”
কিকিরা বললেন, “আপনি নাশারির মালিক নন বললেন। আপনি কর্মচারীও নন। তা হলে আপনি কী? মানে…?”
“আমার সঙ্গে আতাবাবুর আসল সম্পর্ক ব্যবসার। আমি দেওঘরের লোক। যশিড়িতে আমার ফল-ফুলের বাগান আছে। আতাবাবুকে আমি ফুলের টুকরি পাঠাতাম রেল-পার্শেলে। মাঝে-মাঝে কলকাতায় আসতাম। ওর অসুখ হবার পর আমাকে কলকাতার দোকানটা দেখতে হয়। ও আমায় দেখতে বলেছে। আমি পনেরো-বিশ দিন কলকাতায় থাকি। আবার যশিড়ি ফিরে যাই। পাঁচ-সাতদিন পর আবার আসি। এটাই আমার ডেরা। “
চন্দন আচমকা জিজ্ঞেস করল, “নিচে গুদোম মতন দেখলাম। ওটা কী?”
“ইউ. পি, গভর্নমেন্টের হ্যান্ডলুমের গোডাউন। তার পাশে বিহার গভর্নমেন্টের কটেজ ইন্ডাসট্রির গোডাউন। এই বাড়িটার নিচে গোডাউন দু তিনটে। একটা ছোট বেকারি আছে।”
চন্দন সিগারেট দিল কিকিরাকে। বিজয়কেও। তারাপদ সিগারেট নিল না।
সিগারেট ধরানো হয়ে গেলে কিকিরা বললেন, “ফুলকুমারের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব ছিল?”
মাথা হেলিয়ে বিজয় বলল, “চেনা-জানা ছিল। ফুলবাবুর দোকানে বসে কথাবার্তা বলতাম, গল্প করতাম।”
“দোকানটা কেমন চলত?”
“সবসময় ভাল চলত না। পরবের আগে ভাল চলত।”
“ফুলকুমারের দোকানে আপনি কাদের আসা-যাওয়া করতে বেশি দেখতেন? কারা এসে আড্ডা মারত? মানে, ওর বন্ধুবান্ধবের কথা বলছি।”
বিজয় মুঠো পাকিয়ে সিগারেট খায়। শব্দ করে টান মারল সিগারেট, বলল, “আসত অনেকে। হরিমাধব, মোতিয়া, কমল, ববি। আর-একজন আসত। তার নাম “টাইগার’। আসল নাম পিন্টু দুবে।”
চন্দন-তারাপদ চোখ চাওয়াচাওয়ি করল।. কিকিরা সিগারেটের ধোঁয়া গিলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। পরে বললেন, “মুস্তাফিবাবু, আপনি একটা কথা আমাদের বলতে পারেন? কিন্তু তার আগে বলুন, ফুলকুমার কেমন ভাবে খুন হয়েছে, কোথায় খুন হয়েছে, আপনি জানেন?”
বিজয় মুস্তাফি ঘাড় হেলিয়ে বলল, “জানি। শুনেছি। স্টল হোল্ডাররা অনেকেই জানে।”
“তা হলে নতুন করে বলার কিছু নেই।…আচ্ছা, বলতে পারেন, পুলিশ এদিকে কোনো খোঁজখবর করেছে কি না?”
“আমি জানি না। শুনেছি, একদিন এক ইনসপেক্টারসাহেব এসেছিল।”
“আপনার কী মনে হয় মুস্তাফিবাবু? ফুলকুমারের কেউ শত্রু ছিল?”
বিজয় ছাদের দিকে চেয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ। পরে মুখ নামিয়ে বলল, “কে কখন শত্রু হয় কেমন করে বলব? আমিও তার শত্রু হতে পারি, বিজয় যেন চাপা হাসি হাসল।
কিকিরা বুঝতে পারছিলেন বিজয় যেন রেখে-ঢেকে কথা বলছে। তেমন করে কান দিলেন না কথায়। বললেন, “আপনি কেন শত্রু হবেন! আমি ওর বন্ধুদের কথা বলছি।”
“বাবু, ফুলকুমারের সঙ্গে আমার ফালতু গল্প হত। আমি কিছু জানি না।”
কিকিরা হঠাৎ কথা ঘুরিয়ে নিলেন, “ববিকে আপনি ফুলকুমারের দোকানে দেখেছেন। কেমন লোক?”
বিজয় একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল কিকিরার চোখে-চোখে। পরে বলল, “আমার ভাল লাগত না।”
“টাইগার?”
“পাক্কা গুণ্ডা। ববি কাজকারবার করে। টাইগার শুধু গুণ্ডা বদমাইশি করে। শয়তান। পুলিশের খাতায় নাম আছে টাইগারের।”
কিকিরা চুপ করে থেকে কিছু ভাবলেন। “ববিকে কোথায় পাওয়া যাবে মুস্তাফিবাবু?”
“ওর বাড়িতে খোঁজ করুন। চাঁদনি বাজারের পিছনে ওর বাড়ি। টেম্পল স্ট্রিট।”
চন্দন হঠাৎ বলল, “আরে, ওই দিকে কোথায় যেন আমি গুমঘর লেন দেখেছি,” বলে তারাপদর দিকে তাকাল। মনে আছে, তোকে সেদিন গুমঘর লেনের কথা বলছিলাম!”
তারাপদ মাথা নাড়ল। তার মনে আছে।
বিজয় জানালার দিকে তাকাল অন্যমনস্ক চোখে।
ববির বাড়ির নম্বরটা জানতে চাইলেন কিকিরা। মুস্তাফি সঠিকভাবে বলতে পারল না।
হঠাৎ বিজয় মুস্তাফির যেন মনে পড়ে গেল কিকিরাদের অন্তত এক কাপ করে চা খাওয়ানো উচিত। বলল, “চা খাবেন?”
সামনের ছোট টেবিলে বাসী চায়ের কাপ পড়ে আছে লক্ষ করেছেন তিনি। মাথা নাড়লেন কিকিরা, “না, থাক।…আচ্ছা, ওই টাইগারটিকে কোথায় পাব?”
বিজয় ভাল করে নজর করল কিকিরাকে। বলল, “এদিকেই পাবেন। ওর বাড়ি কোথায় আমি জানি না। সন্ধেবেলায় ওকে এই এলাকায় দেখা যায়। এলিট সিনেমা, মিনাভা সিনেমা, মার্কেটের এ-পাশে ও-পাশে ঘুরে বেড়ায়। ওর দু’চারজন চেলা থাকে সঙ্গে।” ১১৪
“কেমন দেখতে?” চন্দন জিজ্ঞেস করল।
“লম্বা, কালো। মুখে দাগ। দাঁত উঁচু। দুলে-দুলে হাঁটে।”
“ফুলকুমারের সঙ্গে ওর ভাব কত দিনের?”
“বলতে পারব না।”
“কেন আসত ফুলকুমারের কাছে, জানেন কিছু?”
“না।”
কিকিরার যেন আর কিছু জানার নেই। উঠে পড়ার ভাব করে বললেন, “আজ আমরা চলি। পরে আপনার সঙ্গে দেখা করব, মুস্তাফিবাবু। চলো, চন্দন।” বলে উঠে পড়লেন কিকিরা। “ভাল কথা, একটু জল খাওয়াতে পারেন?”
“জল? দিচ্ছি।” বিজয় মুস্তাফি উঠে দাঁড়াল। ক্রাচ নিল। জল গড়িয়ে দেবার জন্যে জানলার দিকে যাচ্ছিল।
কিকিরা চোখের ইশারায় চন্দনকে কিছু বললেন। চন্দন বুঝতে পারল। বিজয় মুস্তাফির হাঁটা নজর করতে লাগল তীক্ষ্ণ ভাবে।
জল গড়িয়ে নিল বিজয়। কাচের গ্লাস।
এগিয়ে গেলেন কিকিরা। গ্লাস নিলেন। “আপনার এখানে ফুলকুমার আসত না?”
“না।”
“কোনো দিনই আসেনি?”
“না। দোকানে দেখা হত। আসবার দরকার করেনি।”
জল খেতে গিয়েও কিকিরা মুখের সামনে থেকে গ্লাস সরিয়ে নিলেন। “ববি, টাইগার, এরা এখানে এসেছে?”
“ববি এক-আধবার এসেছে। টাইগার আসেনি।”
“কমল?”
“কমল আসত।”
“শেষ কবে এসেছে?”
“শেষ?” বিজয় কিকিরার চোখের দিকে তাকাল। মনে করবার চেষ্টা করছে যেন। বলল, “দিন-তিনেক আগে।”
তারাপদ কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল।
কিকিরা জল খেলেন। পুরো গ্লাস খেলেন না। আধগ্লাস মতন জল খেয়ে নিজেই জানলার পাশে রাখতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তাঁর হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে গেল মাটিতে। শব্দ হল ভাঙার। ভেঙে চুরমার হল, কাঁচ ছড়িয়ে গেল মাটিতে পায়ের কাছে।
“ইশ!” কিকিরা আফসোসের শব্দ করে বিজয়কে ধরে ফেললেন, “হাত ফসকে পড়ে গেল। সাবধান মুস্তাফিবাবু। পায়ে কাঁচ ফুটবে। এ-দিক দিয়ে আসুন। কাচের টুকরো বাঁচিয়ে।”
বিজয় মুস্তাফিকে সাবধানে কাচের টুকরো থেকে সরিয়ে আনছিলেন কিকিরা। মুস্তাফির বগলে ক্রাচ।
এক টুকরো বিশ্রী কাচের ধারালো ফলার দিকে তাকিয়ে কিকিরা বললেন, “দেখবেন, সামলে।” বলতে বলতে কী যে করলেন কিকিরা, বিজয়ের কাছ পিছলে গেল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে-যেতে নিজেকে সামলে নিল বিজয়। কিকিরা পায়ে করে সেই বিশ্রী কাচের টুকরোটা সরিয়ে দিলেন।
“তারাপদ, কাচের টুকরোগুলোকে সরিয়ে একপাশে রেখে দাও তো,” কিকিরা ব্যস্তভাবে বললেন। তারপর বিজয়ের দিকে তাকালেন, “আপনার একটা ক্ষতি করলাম। স্যরি। “
বিজয় কিছু বলল না।
.
বাইরে এসে কিকিরা কিছু বলার আগেই তারাপদ বলল, “মুস্তাফি মিথ্যে কথা বলেছে, কিকিরা। ও বলল, কমল দিন-তিনেক আগে এসেছিল। ডাহা মিথ্যে কথা। কমল আজই এসেছিল। ওই গলির মুখেই আমি কমলকে দেখেছি।”
কিকিরা কিছু ভাবছিলেন। বললেন, “গলির মুখে দেখেছ বলেই কিছু প্রমাণ হয় না। তবে, তুমি যা বলছ, সেটাই ঠিক মনে হয়। মুস্তাফির ঘরে দুটো চায়ের কাপ পড়ে ছিল। আমাদেরই চোখের সামনে। টেবিলের ওপর। কাপ দুটোর তলায় তলানি চা যতটুকু পড়ে ছিল, তা বাসী নয়। টাটকা চেহারা। মনে হয়, কমল আর মুস্তাফি বসে বসে চা খেয়েছে।”
চন্দন বাহবা দেবার মতন করে বলল, “দারুণ, কিকিরা। ওয়ান্ডারফুল।”
কিকিরা বললেন, “দাঁড়াও, দাঁড়াও, আরও আছে। মুস্তাফি লোকটা খোঁড়াও নয়।”
“খোঁড়া নয়?” তারাপদ অবাক হয়ে বলল।
“না,” মাথা নাড়লেন কিকিরা, “ও লুঙ্গি পরে বসে ছিল দেখেছ তো? খোঁড়া পায়ের দিকে নজর পড়তে আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছিল। শরীরের যে-অঙ্গ কাজ করে না, তার বাইরের চেহারা বড় একটা স্বাভাবিক হবার কথা নয়। মুস্তাফির খোঁড়া পায়ের চেহারা দেখে আমার মনে হল, পায়ের চেহারায় গোলমাল তেমন নজরে আসছে না। ব্যাপারটা জানার জন্যে আমি একটা চাল চালোম। উঠে আসার সময় জল খেতে চাইলাম মুস্তাফির কাছে। মুস্তাফি জল দিতে গেল। চন্দনকে বললাম ওর পায়ের দিকে নজর রাখতে। তারপর তো দেখলে কী করলাম? ইচ্ছে করে ওর পায়ের কাছে কাচের গ্লাস ভাঙলাম। খোঁড়া মানুষকে আগলাবার নাম করে ঠেলে দিলাম কাচের ওপর। ভাঙা কাঁচ থেকে পা সামলাতে গিয়ে মুস্তাফি খোঁড়া পা সোজা করে নিজেকে সামলে নিল। অবশ্য মুহূর্তের জন্যে। আমার চোখ কিন্তু এড়ায়নি। কী চন্দন? আমি রাইট?”
চন্দন বলল, “রাইট। আমিও দেখেছি। আপনি কিকিরা, ফ্যান্টাসটিক্।”
কিকিরা বললেন, “আমায় খোঁজ নিতে হবে, লোকটা কে? কেন ও খোঁড়া সেজে রয়েছে?”
“কেমন করে খোঁজ নেবেন?”
“আমার ব্যবস্থা আছে; মুস্তাফি বললে, যশিডিতে ওর বাগান।…তোমরা বোধহয় সেই কাপালিক ভুজঙ্গের কথা ভুলে যাওনি। তখন তোমাদের বলেছিলাম, যশিড়িতে আমার জানাশোনা পুলিশের লোক আছে। তেওয়ারি। আমি খোঁজ করে নেব।”
.
ববির সঙ্গে
কলিংবেলটা বাজে কী বাজে না কিকিরা বুঝতে পারছিলেন না। এই নিয়ে বার-তিনেক বোতাম টিপলেন কলিংবেলের। কেউ দরজা খুলল না। অথচ ভেতরে লোক আছে। গান বাজছিল। রেকর্ড। জোরেই বাজছিল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সেই বাজনা শুনতে পাচ্ছিলেন কিকিরা। কোনো ইংরেজি গানবাজনা চলছে।
তারাপদ বারবার সিঁড়ির দিকে তাকাচ্ছিল। অদ্ভুত বাড়ি, অদ্ভুত সিঁড়ি। কলকাতা শহরে এমন জেলখানার মতন বাড়ি আছে, স্বর্গে চড়ার মতন সিঁড়ি আছে সে জানত না। পাড়াটা যে অনেক পুরনো বোঝা যায়; ঘরবাড়ির বেশির ভাগই বোধহয় শ’খানেক বছরের পুরনো। ছাঁদছিরি থেকে মনে হয়, অনেককাল আগে যেন এখানে সাহেবসুবোদের ব্যবসার মালপত্র রাখার গুদোমখানা ছিল। কে জানে কী ছিল?
কিকিরা মুখ ফিরিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তারাপদকে, দরজা খুলে গেল।
ববি। কিকিরা সঙ্গে-সঙ্গে বুঝতে পারলেন, ও ববি।
ববি বলল, “ইয়েস? কিয়া বাত?”
কিকিরা বুঝতে পারলেন ববি জানতে চাইছে, কে তোমরা? কী দরকার?
কিকিরা বললেন, “ববি?”
ববি মাথা হেলাল, “ইয়েস।”
কিকিরা পকেট হাতড়ে একটা কার্ড বার করে এগিয়ে দিলেন।
কার্ড নিয়ে ঘরের আলোয় লেখাগুলো পড়ল ববি। তারপর খানিকটা অবাক হয়ে দেখল কিকিরাকে, “ম্যাজিশিয়ান?”
“কিকিরা,” মাথা ঘাড় ঝুঁকিয়ে কিকিরা হাসি-হাসি মুখ করলেন।“ইন্ডিয়ান; নট জাপানিজ।”
ববি হেসে ফেলল, “আসুন।” স্পষ্ট বাংলায় বলল ববি।
কিকিরা আর তারাপদ ভেতরে এলেন। দরজা বন্ধ করে দিল ববি।
ঘরের অবস্থা দেখে তারাপদ হকচকিয়ে যাচ্ছিল। দশ-বিশ হাতের ঘর, কিন্তু জিনিসপত্রে ঠাসা। সোফাসেট, টেবিল, আলমারি, স্টিরিও। একপাশে মাঝারি এক কাচের বাক্সে রঙিন মাছ, অ্যাকোয়ারিয়াম। টিমটিমে আলো জ্বলছে বাক্সের মধ্যে। তারই পাশে নিচে গোটা দুই বড় বড় পেস্টবোর্ডের প্যাকিং বাক্স।
ববি এগিয়ে গিয়ে স্টিরিও বন্ধ করে দিল। ঘরের ডান পাশে দরজা। ভেতর দিকের জানলা দিয়ে করিডোর দেখা যাচ্ছিল। রান্নাবান্নার গন্ধ আসছিল ভেতর থেকে। ববি বোধহয় একা থাকে না।
কিকিরা ববিকে দেখছিলেন। মাথায় বেঁটে। নাক আর চোয়াল খানিকটা বসা; বিশেষ করে নাক, নয়ত ববিকে দেখতে খারাপ নয়। চোখ সামান্য কটা। মাথার চুল কোঁকড়ানো, ব্যাকব্রাশ করা। গায়ের রঙ ফরসা। ববির পরনে সাদা শার্ট-প্যান্ট। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি।
কিকিরা বললেন, “আমি দু’দিন এসে ঘুরে গিয়েছি।”
“আপনি এসেছিলেন? দিদি বলছিল, কে একজন এসে..”
“দিদি? আমার সঙ্গে আপনার দিদির দেখা হয়নি। একটা ছোকরা…।”
“আমাদের বাড়িতে কাজ করে। দিদিকে আপনার কথা বলেছে। …বসুন। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
কিকিরা আর তারাপদ বসলেন। তারাপদ দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল। ববি সম্পর্কে যা শুনেছে, কিছুই যে মিলছে না!
“আপনি কলকাতায় ছিলেন না?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।
“না। আমার ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা। মাঝে-মাঝে লরির সঙ্গে বাইরে যাই। বাইরে কাজ থাকে। নিজে না দেখলে ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা চলে না।”
“আপনার শুনেছিলাম বাস-মিনিবাসও…।”
“না। আমাদের দুটো লরি আছে। আমি আর আমার একজন বন্ধু মিলে ব্যবসা করি। “
তারাপদ কী ভেবে আচমকা বলল, “আপনি কলকাতার লোক “
ববি হেসে উঠল, “তিন জেনারেশান। আমার বাবা ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের অফিসার ছিলেন। ঠাকুরদা পোর্টে কাজ করতেন।”
কিকিরা হেসে বললেন, “ববি নাম শুনে অন্যরকম মনে হয়েছিল।”
“নামটা বাবা দিয়েছিলেন। বাবা হকি-প্লেয়ার ছিলেন। বাবা ভেবেছিলেন, আমি ববি বিশ্বাসের মতন ভাল হকি-প্লেয়ার হব। ববি বিশ্বাসের খেলা আমি ছেলেবেলায় দেখেছি। ভাল খেলত। এখন মনে নেই।”
“আপনি বক্সার?”
ববি হাসল। ঝকঝকে হাসি, “ছিলাম।”
কিকিরা ববির ভাবভঙ্গি লক্ষ করছিলেন। ছেলেমানুষি রয়েছে।
ববি নিজেই হঠাৎ বলল, “আমার বাড়িতে ম্যাজিশিয়ান কেন?” বলে হাসল।
কিকিরা একটু চুপ করে থেকে বললেন, “ম্যাজিশিয়ানদের সম্পর্কে আপনার ধারণা ভাল নয়, স্যার?”
ববি টেবিল থেকে প্যাকেট তুলে নিল সিগারেটের, “না না, ভালই লাগে। ফুলকুমার আমার বন্ধু ছিল। নাম শুনেছেন?” বলে বাঁকা চোখেই যেন তাকাল।
কিকিরা বুঝতে পারলেন, ববিকে বোকা বানানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। বললেন, “শুনেছি। আগে শুনিনি। এখন শুনছি।”
“আপনারা বোধহয় সেজন্যে এসেছেন?” ববি সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিল কিকিরার দিকে।
কিকিরা ববিকে লক্ষ করলেন। লুকোচুরি করে লাভ হবে না।
সিগারেট নিতে-নিতে কিকিরা বললেন, “আপনি বুঝলেন কেমন করে?”
ববি লাইটার এগিয়ে দিল। চোখে হাসি। বলল, “বোঝা যায়।”
কিকিরা সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “আমি রাজকুমারবাবু, মানে ফুলকুমারের দাদার পরিচিত। ছোট ভাই খুন হয়ে যাবার পর তাঁর মনের অবস্থা ভাল নয়। রাজকুমারবাবু এই খুনের রহস্যটা জানতে চান। কেন ফুলকুমার খুন হল? কে তাকে খুন করল?”
ববি নিজের সিগারেট ধরাল। ভেতর দিকের জানলার কাছে গিয়ে হাঁক মেরে কিছু বলল। ফিরে এল। “আপনি ম্যাজিশিয়ান, না ডিটেকটিভ?” ঠাট্টা করেই বলল ববি।
কিকিরা জোরে হেসে উঠলেন। “আমি ম্যাজিশিয়ান! এখন আর ম্যাজিক দেখাই না। পারি না। আর মাঝে-মাঝে শখের গোয়েন্দাগিরি করি স্যার। করতে হয়,” বলে কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন। দু-চার পা এগিয়ে অ্যাকোয়ারিয়ামের কাছে গেলেন। রঙিন মাছ দেখতে দেখতে বললেন, “বিউটিফুল! ওই মাছটা সোনার গয়নার মতন দেখতে। কী সুন্দর রঙ! ওই জাতের আর কটা আছে? দুই, তিন…।”
ববি বলল, “দু জোড়া। ওকে বলে গোল্ডেন নাইফস”
“নাইফ? ছুরি?”
“পাতলা ছুরির মতন দেখতে। এ-সমস্ত নাম বাজারের লোকেরা দেয়। আসল নাম কেউ জানে না।”
“তা ঠিক,” কিকিরা মুখ ফেরালেন, “যা বলছিলাম, ফুলকুমারকে আমি দেখিনি। চিনি না। রাজকুমারকে চিনি। পুরনো চেনাজানা লোক। তিনি আমার কাছে এসে কান্নাকাটি করছেন। শুধু সেই জন্যে…!”
কিকিরাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ববি বলল, “আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন? আপনি কি ভাবছেন, এই খুনের মধ্যে আমার হাত আছে?”
মস্ত জিভ বার করে কিকিরা ছি ছি করে উঠলেন। বললেন, “না, না, এ আপনি কী বলছেন, স্যার! আমি আপনার কাছে জানতে এসেছি, সাহায্য নিতে এসেছি।”
“আপনি এসেছেন সাহায্য নিতে!..কই, ফুলকুমারের দাদা তো আসেননি?”
কিকিরা চুপ করে থাকলেন। পরে বললেন, “আসা উচিত ছিল, স্যার। আপনার সঙ্গে আলাপ আছে রাজকুমারবাবুর?”
“না।”
“হয়ত সেজন্যে আসেনি। আপনার কথাও রাজকুমার আমাকে বলেনি।”
“আমার কথা কে বলেছে আপনাদের? কমল? মুস্তাফি?”
তারাপদ একদৃষ্টে ববির দিকে তাকিয়ে ছিল। ববি যেন সবই জানে।
কিকিরা বললেন, “ঠিকই ধরেছেন।”
ববির মুখ রুক্ষ রূঢ় হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে কিছু বলল অস্ফুটভাবে। শোনা গেল না। শেষে ববি বলল, “চোরে-চোরে মাসতুতো ভাই!…যাক গে, আপনি আমার কাছে কী ধরনের সাহায্য চান?”
একটা ছেলে কফি নিয়ে এল ট্রে করে। কিকিরা চিনতে পারলেন। এর আগে এই ছেলেটির কাছ থেকেই ববির খবর নিয়ে গেছেন।
ছেলেটি চলে গেল।
ববি ডাকল কিকিরাকে, “নিন, কফি খান।”
ফিরে এসে নিজের জায়গায় বসলেন কিকিরা। বললেন, “আপনার কী মনে হয়? হঠাৎ ফুলকুমারকে খুন করার দরকার হল কেন? খুন করার কারণ?”
ববি সরাসরি জবাব দিল না। বলল, “আমার কথা পরে। আপনার ধারণা কী?”
“আমি…আমি কিছুই বুঝতে পারছি না,” কিকিরা বললেন, “ফুলকুমারকে খুন করার পেছনে কার স্বার্থ? কী জন্যে তাকে খুন করা হল এখনো কোন হদিস করতে পারিনি। তবে বুঝতে পারছি, ভেবেচিন্তে ছক করে সাজিয়ে তাকে খুন করা হয়েছে। যাকে বলে প্ল্যান করে।”
ববি বেঁকা করে হেসে বলল, “এই প্ল্যানের মধ্যে আমাকে আপনি জড়াতে চান? দেখুন মশাই, আমি যদি খুন করতে চাইতাম, ফুলকুমারকে তুলে নিয়ে যেতাম লরি করে, খুন করে জি. টি. রোডে, জঙ্গল ঝোপঝাড়ে ফেলে দিতাম। প্ল্যান আমার মাথায় আসত না। তার ধার ধারতাম না। আমি লেখাপড়া কম শিখেছি। আমার বুদ্ধিসুদ্ধি কম। আপনাদের প্ল্যান আমার আসে না। তবে আমি খুনখারাপির মধ্যে থাকি না। কখনো ছিলাম না। আমি খুনি হলে আমার দিদিকে দেখতেন গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে। দিদি ছাড়া আমার কেউ নেই। আর দিদি বেঁচে থাকতে কোনো নোংরা কাজ আমি করব না, এটা ফুলকুমারও জানত।”
কিকিরা কফিতে চুমুক দিলেন। দেখছিলেন ববিকে। ছোকরা সাফসুফ কথা বলে। মেজাজি।
“আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, ফুলকুমার আপনার বন্ধু হলেও তার ওপর আপনার রাগ ছিল!”
“যদি সত্যি কথা শুনতে চান, রাগ ছিল।…কেউ যদি বন্ধু হয় তার ওপর রাগ করা যাবে না, এমন কথা আছে?”
“তা ঠিক। তবে রাগের কারণ তো থাকবে! আপনার রাগ ছিল কেন?”
“তাও বলতে হবে?”
“বললে উপকার হয়।”
“ফুলকুমার ম্যাজিক-ট্যাজিক কী করত আমি জানি না। আমি ওর ম্যাজিক দেখিনি। দোকানে বসে কখনো কখনো তাসের খেলা দেখাত। দেখেছি। কিন্তু আমি জানতাম, ফুলকুমার তার খেলনার দোকানে বসে চোরাই স্মাগলড মালপত্র বিক্রি করে।”
তারাপদ এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি, হঠাৎ বলল, “চোরাই সোনা?”
ববি তারাপদর দিকে তাকাল। “শুধু সোনা নয়, আরও অনেক কিছু।”
“তার খরিদ্দার কারা ছিল?”
“খরিদ্দাররা সোজাসুজি বোধহয় আসত না। স্মাগলাররাই তাদের পাঠাত। ফুলকুমার ছিল, কী বলব, সাপ্লায়ার। এজেন্ট। মানে, যারা বেচাকেনা চালাত, তারা ফুলকুমারের হাত দিয়ে কারবার করত। ভাল কমিশন পেত ফুলকুমার।”
কিকিরা কফি খাচ্ছিলেন। খেতে-খেতে বললেন, “আপনি নিজের চোখে এরকম কাউকে দেখেছেন?”
“আমার চোখের সামনে আট-দশ হাজার টাকা রতির চুনি, হীরে বিক্রি হবে এটা কি আপনি আশা করেন? আপনি কি মনে করেন, যারা চোরাই মাল বিক্রি করে, তারা ইঞ্চি-ছয়েক লম্বা ইটালিয়ান রিভলবার আমার নাকের ডগায় বিক্রি করবে?”
তারাপদ যেন চমকে ওঠার মতন শব্দ করল। কিকিরাও চুপ।
ববি বলল, “আপনি ভাববেন না, ফুলকুমার আমার কাছে তার লুকনো কারবারের কথা বলত। আমি জানতাম। একবার ফুলকুমার আমাকে বলেছিল, ছোট এক পেটি চকোলেট ধানবাদে পৌঁছে দিতে। বলেছিল, পার্টি হাজার চারেক টাকাও দেবে। আমি রাজি হইনি। বুঝতেই পারছেন, পেটিটা চকোলেটের নয়।..মাল-মশলার। মানে…” ববি আঙুলের ইশারায় গুলিবন্দুক বোঝাল।
কিকিরা একদৃষ্টে ববির দিকে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক পলক, তারপর বললেন, “আপনি জানলেন কেমন করে?”
ববি এবার মুচকি হাসল। বলল, “আপনি গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছেন, অথচ সহজ নিয়মগুলো জানেন না। কোনো চোরাই কারবার একা-একা করা যায় না। তার জন্যে দল থাকা দরকার। চোরাই কারবারটা হল রিলে রেসের মতন। হাতে-হাতে এগোয়।”
কিকিরা বললেন, “আপনি বলতে চাইছেন, ফুলকুমার আপনাকে দলে ভেড়াতে চেয়েছিল। “
“হ্যাঁ। আমার ট্রান্সপোর্টের কারবার। আমার পক্ষে সোনা-দানা, রিভলবার, গুলি-বারুদ কোনোটাই জায়গামতন পৌঁছে দেওয়া অসম্ভব নয়। ধরুন, আমাকে বলা হল, ট্রাক নিয়ে যাবার সময় অমুক জিনিসটা পানাগড়ে অমুক লোকের হাতে ফেলে দিয়ে যেতে। কাজটা কি কঠিন?”
কিকিরা মাথা নাড়লেন। কফি খেতে লাগলেন চুপচাপ।
তারাপদ বলল, “ফুলকুমার যে একটা বাজে দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল, আমরাও তা সন্দেহ করি। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই দলের কাউকে ধরতে পারছি না।”
ববি ঘাড় কাঁপাল। যেন বলল, সে আপনারা বুঝে নিন।
কিকিরা কফি শেষ করলেন। বললেন, “টাইগারকে চেনেন, স্যার?”
“ভাল করেই চিনি।”
“কেমন লোক?”
“পয়সা পেলে সবই করতে পারে।”
“খুন?”
“ওটা বোধহয় পারে না। চুরি, গুণ্ডামি, সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক, পকেটমার, ছিনতাইয়ে তার হাত আছে। খুনের ব্যাপারে এগোবে বলে মনে হয় না। আর যদিবা এগোয়, বে-পাড়ায় খুন করতে যাবে না। টাইগার সেই ধরনের ক্রিমিন্যাল নয়।”
কিকিরা যেন হতাশ হয়ে বললেন, “না, কিছুই ধরা যাচ্ছে না।…আচ্ছা ববিসাহেব, একটা কথা বলুন, ফুলকুমার নোংরা ব্যাপারে সুত গলিয়েছে দেখেও আপনি ওর বন্ধু থাকলেন কেমন করে?”
ববি মুচকি হাসল, “কেন বলুন তো? আপনি সঙ্গদোষের ভয় পাচ্ছেন!..যাক্, এবার আমায় ছাড়ন। আমি দিদিকে নিয়ে সিনেমায় যাব। তৈরি হতে হবে। দরকার পড়লে পরে আসবেন। আড্ডা মারতে আমার আপত্তি নেই।” বলে ববি হাত তুলে বিদায় জানাল।
কিকিরা যেন বাধ্য হয়ে উঠে পড়লেন।
.
কমলের হোটেল
দুতিনটে দিন কিকিরাকে বাড়িতে পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়ল। তারাপদরা আসে যায়, অপেক্ষা করে, কিকিরাকে ধরাই যায় না। বগলা কিছু বলতে পারে না। শুধু বলে, “আপনাদের বসতে বলে গেছেন।“
তিন দিনের দিন কিকিরাকে ধরা গেল। চন্দন বলল, “আপনার ব্যাপার কী স্যার? আমরা তো ভাবলাম, আপনি নিজেই গায়েব হয়ে গেছেন।”
কিকিরা বললেন, “আমার দোষ নেই। রোজই বলে যাই তোমাদের বসিয়ে রাখতে, ফিরে এসে দেখি, তোমরা নেই। না, না, দোষ তোমাদেরও নয়। আমি সময় মতন ফিরতে পারি না। আটকে যাই।”
“যাক গে, আসল কথা বলুন! প্রগ্রেস্ কতদূর?” তারাপদ বলল।
“মোটামুটি।…আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে, তারাপদ; শেষ রক্ষা করা যাবে না।“
চন্দন ঠাট্টা করে বলল, “তা হলে আর বেগার কেন খেটে মরছেন। ছেড়ে দিন। ফর নাথিং …”
চন্দনকে কথা শেষ করতে দিলেন না কিকিরা। বললেন, “আর একটু দেখি। কাল একটা লাস্ট চান্স নেব!”
“লাস্ট চান্স?”
“কাল আমরা কমলের সঙ্গে দেখা করব। তার হোটেলে। বাড়িতে নয়।”
তারাপদ দু মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল। “হোটেলে?”
“বাড়িতে যাব না। হোটেলেই যাব।…তুমি একটু খোঁজ করে জেনে নাও তার ডিউটি কখন?”
“দুপুরেই হবে।”
বিকেলেও হতে পারে। খোঁজ করে নাও,” বলে কিকিরা পিঠ এলিয়ে বসলেন, “ভাল কথা, যশিডি থেকে চিঠির জবাব পেয়েছি। তেওয়ারি লিখেছে, মুস্তাফি বলে কোনো লোকের বাগান যশিডিতে নেই। বিজয় মুস্তাফি বলে কোনো লোকও থাকে না। তবে মধুপুরের এক মুন্তাফি নাশারির ব্যবসা করে।”
চন্দন কিকিরাকে দেখছিল। বলল, “আপনি অ হলে ঠিকই ধরেছেন, কিকিরা। বিজয় মুস্তাফি একটা ব্লাফ!”.
কিকিরা একটু হেসে বললেন, “লোকটা ভাল অভিনেতা। তা ছাড়া কী জানো, ও যে-ধরনের খোঁড়া তেমন খোঁড়া হওয়া সহজ। আমার মনে হয়, ও যদি পন্ট পরে, ওইরকম এক পেয়ে ল্যাংচা হয়ে থাকে, চট করে ধরাও যাবে না।”
চন্দন বলল, “ওর মতলবটা কী বলুন তো?”
“সেটাই বুঝতে পারছি না। তবে লোকটা নিজেকে ধরিয়ে দিয়েছে। ফুলকুমারের ব্যাপারটার সঙ্গে সে জড়িয়ে আছে, বোঝা যাচ্ছে। কীভাবে আছে সেটা ধরতে হবে।”
চন্দন ঘড়ি দেখল। আটটা বাজে। তার কাজ আছে। বলল, “আমরা আজ উঠি, কিকিরা। রাত আটটা। কাল দেখা হবে। আপনি কখন যাবেন জানলে সুবিধে হত।”
“তারাপদ খোঁজ না করা পর্যন্ত বলতে পারছি না। তা ও তোমায় জানিয়ে দেবে। একটা কথা বলে নিই। কমলের হোটেলে আমি আর তুমি দুজনে যাব। তারাপদকে বাইরে বসিয়ে রাখব।”
“কেন, আপনি কি মনে করছেন.”
“আমি কিছুই মনে করিনি। কমল যে মুস্তাফির কাছ থেকে আমাদের খবর শুনবে, সেটাও আমি ধরে নিচ্ছি। তবু তারাপদকে হোটেলের বাইরে রাখব।”
“যা ভাল বোঝেন। উঠি…”।
তারাপদ আর চন্দন উঠে পড়ল।
.
একপশলা ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল শেষ বিকেলে। বাতাসে তখনও বাদলা ভাব, আকাশে মেঘও রয়েছে। ট্যাক্সি থেকে নেমে বোঝা গেল, আজ গুমোট বা গরম থাকবে না, বরং আরামই লাগবে।
কিকিরা ভাড়া মিটিয়ে দিলেন ট্যাক্সির। সন্ধে হয়ে আসার মতন দেখাচ্ছে। ঘড়িতে মাত্র সোয়া ছয়। কিকিরা বললেন, “তারাপদ, তুমি হোটেলের বাইরে কোথায় থাকবে?”
“আপনি বলুন।”
“রেস্টুরেন্ট?” চার দিকে তাকালেন কিকিরা। রেস্টুরেন্ট দেখতে পেলেন না। সোডা ফাউনটেন গোছের একটা কী আছে দেখা গেল। কিকিরা বললেন, “আপাতত ওখানে থাকবে। একটু নজর রাখবে। অবশ্য নজর রাখবে কার ওপর? তুমি আমি ক’জনকে বা চিনি? তবু নজর রেখো।”
কিকিরা চন্দনকে নিয়ে হোটেলের দিকে পা বাড়ালেন।
হোটেলটা বাইরে থেকে দেখতে বাহারি নয়। ভেতরে ঢুকলে বোঝা যায়। বাহারি না হোক, এই হোটেলের প্রাচীনত্ব রয়েছে, হয়ত সেই জন্যেই খানিকটা আভিজাত্য। রঙচঙে ঝকঝকে ভাবের চেয়ে পরিচ্ছন্নতাই নজরে আসে। ঘোট রিসেপশান। দুজনে বসে কাজকর্ম করছিল। পাশে ফোন।
চন্দন এগিয়ে গিয়ে কমলের খোঁজ করল।
কমল বসে দোতলায়। সিঁড়ির মুখে বাঁ দিকের ঘরে।
কিকিরা আর চন্দন সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় এলেন। একটা ঘর দেখতে পেল চন্দন বাঁ দিকে। “অফিস লেখা রয়েছে। এপাশে দোতলার অন্য ঘরগুলো থাকা-খাওয়ার জন্যে নয় বলে মনে হল। বোধহয় হোটেলের স্টোর, কিচেন, ম্যানেজারের ঘরটর হবে। তিরিশ-পঞ্চাশ পা তফাতে ঢাকা বারান্দা চোখে পড়ছিল। টেবিল-চেয়ার পাতা। হোটেলের রেস্টুরেন্ট হতে পারে।
অফিস-ঘরের দরজা ঠেলতেই খুলে গেল।
কিকিরা কমলকে আন্দাজ করে নিতে পারলেন। ছবি দেখা আছে কমলের।
এগিয়ে গেলেন কিকিরা। কমল বসেবসে সিগারেট খাচ্ছিল। হাতে কাজ নেই। তার টেবিলের পাশে খাতাপত্র, বিল বুক, কলম-পেনসিল পড়ে আছে। এক কাপ চা। একটা ভাঁজ করা খবরের কাগজ।
কিকিরা হাসি-হাসি মুখ করে বললেন, “কমল ব্যানার্জি?”
কমল দেখছিল কিকিরাকে। “আমি। আপনি?”
“কিকিরা। রাজকুমারবাবুর বন্ধু” বলে দু পা পেছনে দাঁড়ানো চন্দনকে দেখাল, “চন্দন।”
কমলের মুখ দেখে মনে হল, ও যেন কিকিরার কথা আগে শোনেনি। বলল, “কী ব্যাপার বলুন?”
“আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে। একটু সময় লাগবে।”
“সময়। কিন্তু এখন…এখন আমার সময় কোথায়?”
“ঘণ্টাখানেক,” কিকিরা বিনয়ের মুখ করে বললেন।
কমলের হাত কয়েক তফাতে অবাঙালি মাঝবয়েসী এক ভদ্রলোক কাজ করছিলেন। বেয়ারা আসা-যাওয়া করছিল।
কমল বলল, “স্যরি। দু’পাঁচ মিনিট কথা বলা যায়, এক ঘণ্টা গল্প করা অসম্ভব?” বলে হাত দিয়ে কাগজপত্র দেখাল, “এত কাজ।”
কিকিরা বললেন, “তা হলে ছুটির পর?”
“ছুটির পর?” কমল অবাক হয়ে বলল, “আমার ছুটি হতে-হতে আট সোয়া-আট বাজবে। ততক্ষণ…”
“আমরা অপেক্ষা করব।”
“অপেক্ষা করবেন?”
“তাতে আর কী! বাইরে রিসেপশানের ওখানে বসে থাকব! এখন কটা বাজে? সাড়ে ছয়। ঘণ্টা দেড়েক বসে থাকা যাবে তুমি কী বলল, চন্দন?”
চন্দন মাথা নাড়ল, “নো প্রবলেম।”
কমল প্রথমটায় যেন বুঝতে পারেনি, বা, খেয়া করেনি। পরে তার খেয়াল হল। বলল, “রিসেপশানে বসে থাকবেন? এতক্ষণ!”
কিকিরা রগুড়ে হাসি হেসে বললেন, “নট মাছ স্যার। ওনলি ওয়ান অ্যান্ড হাফ আওয়ার্স। রেশনে লাইন দিলে দু ঘণ্টা দাঁড়াতে হয়, ঝাঁঝাঁ রোদে। আর এখানে তো আরামেই বসে থাকব, কী বলল চন্দন?”
চন্দন মাথা হেলিয়ে সায় দিল।
কমলকে খুশি মনে হল না, বাধ্য হয়েই বলল, “বেশ, বসুন।”
কিকিরা চলে যাচ্ছিলেন, কমলই আবার বলল, “আমার সঙ্গে আপনাদের এমন কী কথা মশাই, দেড় ঘন্টা বসে থাকবেন?”
“জরুরি কথা। শুনলেই বুঝতে পারবেন।”
“রাজাদা আপনাদের পাঠিয়েছেন?”
“আপনি কাজ সেরে নিন; আমরা আছি। পরে কথা হবে।”
কিকিরা আর দাঁড়ালেন না। চলে এলেন চন্দনকে নিয়ে।
নিচে রিসেপশানের জায়গায় ভিড় প্রায় নেই। সোফাসেট পাতা ছিল। দেওয়ালে দু একটা ছবি ঝুলছে।
কিকিরা একপাশে বসলেন। সামান্য আড়াল থাকে যেন। চন্দনকে বললেন, “একটা ম্যাগাজিন টেনে নাও তো।”
চন্দন গোটা দুয়েক ম্যাগাজিন তুলে আনল।
“ছোকরাকে কি নার্ভাস দেখলে?” কিকিরা বললেন।
“নার্ভাস? না, নার্ভাস নয়, তবে…”
“তবে আমাদের দেড় ঘণ্টা বসে থাকায় ও খুশি হল না।”
“কেন বলুন তো?”
“দেখা যাক্, কেন? একটা সিগারেট দাও। আর শোনো, তুমি একবার বাইরে গিয়ে তারাপদকে বলে এসো, আমরা না বেরোনো পর্যন্ত ও যেন হোটেলের কাছাকাছি থাকে। দরকার হলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে। পালিয়ে না যায়।”
চন্দন সিগারেটের প্যাকেট দেশলাই কিকিরার হাতে তুলে দিয়ে বাইরে চলে গেল।
কিকিরা সিগারেট ধরালেন। ম্যাগাজিন তুলে নিলেন। হোটেলে যারা আসছে-যাচ্ছে তাদের লক্ষ করতে লাগলেন।
চন্দন ফিরছিল না। দেওয়াল-ঘড়িতে পৌনে সাত হল। বোধহয় তারাপদর সঙ্গে কথা বলছে চন্দন। কিকিরা ব্যস্ত হলেন না, অধৈর্য হলেন না।
লোকজন দেখতে দেখতে কিকিরার মনে হল, এখানে যারা আসে, তারা বেশির ভাগই অবাঙালি। হোটেলের খদ্দেররা মাঝারিআনার। ব্যবসাপত্রের কাজে যারা কলকাতায় আসে, সেই ধরনের লোকই বেশি। বেড়াতে এসে হোটেলে উঠেছে বউ বাচ্চা নিয়ে, এমন লোক চোখে পড়ে না বললেই হয়।
চন্দন ফিরে এল। এসে ঠাট্টার গলায় বলল, “তারা একটা পজিশন পেয়ে গৈছে। ইলেকট্রনিকস্ মালপত্র বিক্রির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বলছে, দেড়-দু’ ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হলে পা ধরে যাবে।”
“যাক। পায়চারি করুক। লয়টারিং।”
আরও খানিকটা সময় কাটল। সোয়া সাত।
কিকিরা আর চন্দন কথা বলছেন, নেপালি চেহারার এক বেয়ারা এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে তাঁদের সামনে এসে দাঁড়াল। কিকিরাকে দেখল। বলল, “কমলবাবুসে মোলাকাত করনে কৌন্ আয়া? আপ?”
হ্যাঁ।
“দেরি হোগা সাব! ন’ বাজ যায়গা।”
“ঠিক হ্যায়। আগার দশ ভি হো তো বাত নেহি..”
বেয়ারাটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেন দাঁড়িয়ে থাকল ক মুহূর্ত; তারপর চলে গেল।
চন্দন বলল, “কী ব্যাপার কিকিরা? কমল আমাদের তাড়াতে চাইছে যেন।”
“ঠিক ধরেছ। হঠাতে চাইছে।”
“কেন?”
“কেন? হয় ও আমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি নয়, না-হয় এই হোটেল থেকে বেরিয়ে ও কোথাও যাবে।”
“কিংবা কেউ আসবে। আসার কথা আছে।”
“রাইট স্যার।” কিকিরা সিঁড়ির দিকে তাকালেন, “আমরা বাপু উঠছি না। সে যত রাতই হোক।”
চন্দন বলল, “আমি একটা চেষ্টা করব?”
“কী চেষ্টা করবে?”
“বাইরে গিয়ে ফলস্ ফোন করব। এই হোটেলের দু’একটা বাড়ির পর একটা ড্রাগ স্টোর আছে। ওখান থেকে হোটেলে কমলকে ফোন করতে পারি।”
কিকিরা ভাবলেন। কথাটা তাঁর পছন্দ হচ্ছিল, “কী ফোন করবে?”
“কী ফোন! ধরুন, ধরুন মুস্তাফি হয়ে ফোন করলাম। বললাম, কথা আছে। কিংবা বললাম, কমলের কখন ছুটি হচ্ছে? বা আপনি যদি অন্য কিছু সাজেস্ট করেন।”
কিকিরা চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, “না থাক আর খানিকক্ষণ দেখা যাক। আমার মনে হচ্ছে, কমল নিজেই আসবে। ওর ইচ্ছে নয়, আমরা হোটেলে থাকি। আমাদের হোটেলে থাকায় ও ভয় পাচ্ছে। বসে থাকো, দ্যাখো, কী হয়।”
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, সত্যি-সত্যি সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল কমল। বিরক্ত। কিকিরার সামনে এসে বলল, “আপনাকে আমি যে বলে পাঠালাম, আমার দেরি হবে আজ।”
কিকিরা হাসিমুখেই বললেন, “তোক না দেরি। আমরা থাকব।”
“থাকবেন? বাঃ! আমি বলছি দেরি হবে, তবু বলছেন থাকব।”
“কথা আছে।”
“আপনাদের সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই। ফুলকুমারের ব্যাপার আমি কিছু জানি না।”
“ফুলকুমার! কই, আমরা তো ফুলকুমারের ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে আসিনি!”
কমল থতমত খেয়ে গেল। মনে হল, নিজের বোকামির জন্যে আফসোস করছে। অবাক চোখে কিকিরাদের দেখছিল। কী বলবে যেন বুঝতে পারছিল না। শেষে বলল, “তা হলে কেন এসেছেন? কোন্ কথা বলতে?”
কিকিরা হাসিমুখেই বললেন, “আপনার কাজকর্ম শেষ হোক। তখন বলা যাবে।”
কমল চটে গেল, “আমার কাজকর্ম শেষ হবে না। আপনারা যান। আমি কোনো কথা আপনাদের সঙ্গে বলব না।”
কিকিরা মুখ টিপে হাসলেন। ইশারায় চন্দনকে দেখালেন। বললেন, “আমাকে না বললেন। ওঁকে তো বলতে হবে। উনি কিন্তু বাইরে চন্দন, ভেতরে জ্বালাতন; আসলে লালবাজার…!”
লালবাজার শুনে কমল কেমন চমকে গেল। দেখল চন্দনকে। চন্দনের শরীর স্বাস্থ্য চেহারা দেখে লালবাজারের লোক মনে হওয়া অসম্ভব নয়। সাদা পোশাকের গোয়েন্দা-অফিসার নাকি? কমলের মুখের চেহারা পালটে যাচ্ছিল।
কমলের যেন গলা শুকিয়ে গেল। বারদুয়েক ঢোক গিলল। “লালবাজার! লালবাজারের সঙ্গে আমার…!” কথাটা আর শেষ করতে পারল না।
কিকিরা সাহস দেবার মতন করে বললেন, “না, না, আপনার সঙ্গে কিছু নেই। শুধু কয়েকটা কথা। ওঁর সামনে হলেই ভাল। “
কমল একবার বাইরের দরজার দিকে তাকাল। ভাবছিল। শেষে বলল, “আসুন। “
কিকিরা আর চন্দন উঠে দাঁড়াল।
কমলের সঙ্গে দোতলায় এলেন কিকিরা। চন্দনের সঙ্গে ইশারায় যেন তাঁর কথা হয়ে গিয়েছে। চন্দন গম্ভীর মুখ করে লালবাজার হবার চেষ্টা করছিল।
নিজের ঘরের কাছে এসে কমল বলল, “একটু দাঁড়ান। বলে আসি। অফিসে বসে কথা বলা অসুবিধে। অন্য জায়গায় বসব।”
কিকিরা মাথা হেলালেন।
কমল তার অফিসে ঢুকল। বেরিয়ে এল। তারপর কিকিরাদের নিয়ে দোতলার অন্য পাশে চলে গেল। শেষের দিকের একটা ঘরে এনে বলল, “এটা আমাদের রেস্টরুম। বসুন।”
ছোট ঘর। একটা সোফাকাম-বেড, গোটা-দুয়েক চেয়ার, নিচু এক টেবিল রয়েছে ঘরে। লম্বাটে জানলা। আলোপাখা আছে। কমল নিজেই পাখা চালিয়ে দিল।
কিকিরা বসলেন। চন্দন দু’পা এগিয়ে গিয়ে জানলার পাশে দাঁড়াল। জানলা খোলা। ঝুঁকে পড়ে বাইরেটা দেখল। রাস্তা ঘেঁষে এই ঘর। নিচের সবই দেখা যাচ্ছে।
কমল বলল, “বলুন, কী কথা?”
কিকিরা বললেন, “আপনি বসুন। আমরা কোনো বদ মতলব নিয়ে আসিনি। কয়েকটা কথা আপনার কাছে জানতে এসেছি। আপনার দুশ্চিন্তার কারণ নেই।”
কমল বসল। সে যে রীতিমতন ঘাবড়ে গিয়েছে, বোঝাই যাচ্ছিল। চোখ-মুখ শুকনো, কপালে গলায় ঘাম জমেছে।
চন্দন জানলার কাছে দাঁড়িয়ে কিকিরাদের দিকে তাকিয়ে থাকল।
কিকিরা চন্দনকে বললেন, “আমার কথাগুলো জেনে নিই।”
ঘাড় হেলিয়ে চন্দন বলল, “নিন।”
কিকিরা কমলের দিকে সহজভাবেই তাকিয়ে বললেন, “আপনি স্যার, রাজকুমারবাবুদের ফ্যামিলি-ফ্রেন্ড?”
“না,” কমল মাথা নাড়ল। “রাজাদা’র ছোট ভাই ফুলকুমার আমার ছেলেবেলার বন্ধু। সেই হিসেবে ওবাড়ির সকলকে আমি চিনি। আমাকে সবাই চেনেন।”
“আপনি ফুলকুমারের ম্যাজিকের দলে আগে ছিলেন না?”
“দলে আমি কোনো দিনই ছিলাম না। ফুল যখন ম্যাজিক দেখাবার জন্যে মেতে উঠল, আমাকে তার দলের দেখাশোনা করতে বলেছিল। সেটা অর্ডিনারি ব্যাপার। শৌখিন ম্যাজিক শো। পরে আর আমি ওর সঙ্গে ছিলাম না।”
“ফুলকুমার কীভাবে মারা গিয়েছে, সবই আপনি শুনেছেন?”
“হ্যাঁ। আমি ভাবতেও পারিনি এ-ভাবে ও মারা যাবে!”
“একটা কথা স্যার! ফুলকুমারকে নিয়ে কথা বলতে আসিনি আমরা। আগেই আপনাকে বলেছি। কথাটা উঠল বলে বলছি। আচ্ছা, আপনার কী মনে হয়? কে আপনার বন্ধুকে খুন করতে পারে?”
কমল পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল। “আমি জানি না।”
“ফুলকুমার আপনার বন্ধু ছিল। ও কি কোনো দিন কারও সম্পর্কে কিছু বলেছে?”
কমল কয়েক পলক তাকিয়ে থাকল। মাথা নাড়ল, “না।”
“আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?”
“সন্দেহ! না, মানে সন্দেহ করার মতন কেউ নেই। তবে আজকাল ওর বন্ধুবান্ধবদের ভাল মনে হত না।”
“দু’একটা নাম বলতে পারেন?”
“নাম বলে লাভ কী! ববি বলে ওর এক বন্ধুকে আমার ভাল লাগত না।”
“ববি! আচ্ছা, রাজকুমারবাবু সম্পর্কে আপনার কী মনে হয়?”
কমল কয়েক পলক তাকিয়ে থাকল। “রাজাদা! রাজাদা অত্যন্ত ভালমানুষ। ছোট ভাইকে তিনি খুবই ভালবাসতেন। রাজাদার সঙ্গে আমি দেখাও করেছি। “
“মোহনবাবু? মানে, মোহনকুমার?”
কমলকে যেন কেউ আচমকা ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকল কমল। “মোহনদাদা?”
“হ্যাঁ; মোহনভাই। ফুলকুমারের মেজদা।”
“আপনি কী বলছেন, আমি ভাল বুঝতে পারছি না। মোহনদাদা মাটির মানুষ। নিরীহ। তাঁর একটা হাত..”
“জানি। একটা হাত কাটা,” কিকিরা বললেন, “ভাল লোকও কখনোকখনো মন্দ হয়ে যায়। দশচক্রে ভগবানও ভূত হয়, জানেন তো?”
কমল কোনো কথা বলল না। ঠোঁট কামড়ে বসে থাকল।
কিকিরা বললেন, “ফুলকুমারের খেলনার দোকান সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?”
কমল কিকিরার চোখের দিকে তাকাল। “খেলনার দোকানে খেলনা বিক্রি হত!”
“তা তো হবেই,” কিকিরা ঠাট্টার গলায় বললেন, “পানের দোকানে কি মশাই পোনামাছ বিক্রি হয়? আমি সে কথা বলছি না। আমি বলছি, ওখানে আর কী হত?”
মাথা নাড়ল কমল, “আমি জানি না।” বলে চোখ নামিয়ে নিল।
কিকিরা হঠাৎ রুক্ষ গলায় বললেন, “আপনি জানেন। মিথ্যে কথা বলবেন না, বোকা সাজার চেষ্টা করবেন না, স্যার। আপনি ভাল করেই জানেন দোকানে কী হত? আর যদি না জানেন, আমি আপনাকে বলছি, ফুলকুমারের খেলনার দোকানে চোরাই-সোনা, চোরাই-পাথর, আরও পাঁচরকম জিনিস বিক্রি হত। খেলনার দোকানটা ছিল বাইরের ভে। আসলে ওই দোকান থেকে চোরাই-মালের কারবার হত।”
কমল তার শুকনো ঠোঁট জিভের আগা দিয়ে ভেজাতে লাগল। কথা বলছিল না।
কিকিরা বললেন, “আপনি এখন ধোয়া তুলসীপাতা সাজতে চাইছেন? ওতে লাভ হবে না। ফুলকুমারের দালালি করে, তার বিশ্বস্ত লোক হয়ে আপনি মোটামুটি ভাল পয়সা কামাতেন।”
“বাজে কথা, সমস্ত বাজে কথা,” কমল চিৎকার করে উঠল, “কে আপনাকে এ-সব কথা বলেছে? আপনি নিয়ে আসুন তাকে। টেনে জিভ ছিঁড়ে দেব রাস্কেলের।”
কিকিরা যেন কমলের রাগ দেখছিলেন। কমুহূর্ত পরে বললেন, “যে বলেছে তার কাছ থেকে আপনি দু’দফায় পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছেন। শুধু টাকাই নেননি, তাকে বলেছিলেন, মোতিয়ার সঙ্গে আপনি কথা বলে ব্যবস্থা করবেন। হাজার চার-পাঁচ টাকা মোতিয়াকেও দিতে হবে। না না, মাথা নাড়বেন না। চেঁচাবেন না। আমার কাছে প্রমাণ আছে।” বলে কিকিরা জামার পকেটে হাত ঢোকালেন। মামুলি খাম বার করলেন পকেট থেকে, তার মধ্যে থেকে একটুকরো ভাঁজ করা কাগজ। কাগজটার ভাঁজ খুললেন। বললেন, “এই কাগজটার মাথার ওপর আপনার হোটেলের নাম-ঠিকানা লেখা আছে। মেমো স্লিপ। আপনি কী লিখেছেন, পড়ে শোনাচ্ছি। আপনি লিখেছেন, “কেমন করে কী করতে হবে, আমি জানিয়ে দেব। পালোয়ানকে কিছু দিতে হবে। চার-পাঁচ লাগবে। ঝামেলার কাজ।”
কমল যেন লাফ মেরে এগিয়ে আসত, চন্দনের ভয়ে পারল না।
এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল।
কমল উঠল না। বসে থাকল।
কিকিরা চন্দনকে ইশারা করলেন। চন্দন এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল।
বিজয় মুস্তাফি। ছিমছাম চেহারা। পরনে প্যান্ট শার্ট। দু’পায়ে সমান ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
চন্দন অবাক।
বিজয়কে দেখে কমল দাঁড়িয়ে পড়ল। কিছু বলতে যাচ্ছিল। বিজয় হাত তুলে কমলকে থামতে বলল। “তোমার সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। অনেকক্ষণ এসেছি। ওয়েট করতে পারলাম না আর। সরি।”
কিকিরাও অবাক হয়ে বিজয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
বিজয় যেন ঠোঁট টিপে হাসল। বলল, “অরাক হবার কোনো দরকার নেই। কমলের কাছে আমি আসি মাঝে-মাঝে। চোরে-চোরে মাসতুতো ভাই। তবে কী কিকিরাসাহেব, আমি বিহার পুলিশের লোক। রতন সিংহ। আজ ক’মাস ধরে ফাঁদ পেতে বসে ছিলাম, ফুলকুমার অ্যান্ড পার্টিকে ধরার জন্যে। কমলবাবু আমার ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। জাল প্রায় গুটিয়ে নিচ্ছিলাম, এমন সময় ফুলকুমার খুন হল। আমার ইল মুশকিল। ঘাটের কাছে ভেড়া নৌকো আবার জলে ভাসাতে হল। শেষ পর্যন্ত বাকি কাজটা আপনারাই সারলেন মনে হচ্ছে!”
কিকিরা কোনো কথা বললেন না। বিজয় মুস্তাফিকে দেখছিলেন।
বিজয় মুস্তাফি, মানে রতন সিংহ কিকিরাকে বললেন, “ঘাবড়াবেন না। তেওয়ারিসাহেব আমাকে আপনার চিঠির কথা জানিয়েছেন। নিন, হাত মেলান।”
কিকিরা উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন।
কমল দরজার দিকে তাকাল। চন্দন পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে।
.
হারমোনিয়াম–রহস্য
কিক্রির ঘরে আর যেন জায়গা কুলোচ্ছিল না। রাজকুমার, বিজয় মুস্তাফি মানে রতন সিংহ, ববি, তারাপদ, চন্দন আর কিকিরা। রতন সিংহ আর ববিকে অতিথি হিসেবে ডেকে আনা হয়েছে। সিংহ হয়ত এমনিতেই আসত; তবু কিকিরা তাকে ডেকে এনেছেন। সন্ধে হয়ে গেছে কখন। বড় বাতিটাই জ্বালিয়ে রেখেছেন কিকিরা। বগলা চা-জলখাবার দিয়ে গিয়েছিল। চা খেতে-খেতে সাধারণ কিছু কথাবার্তা হচ্ছিল। রাজকুমার চা খেলেন না, শরবত খেলেন। খাবারে হাত দিলেন না। মানুষটি নিয়ম মেনে চলেন। বাইরে কিছু খান না।
কিকিরাই শেষে সিংহকে বললেন, “সিনাসাহেব, আপনিই আজ শুরু করুন। শুনি।”
বিহার পুলিশের সিনাসাহেব সিগারেট ধরিয়ে বলল, “আমার বলার কথা কম রায়সাহেব। ঘটনাটা ঘটেছিল, ছ’সাত মাস আগে। মধুপুর স্টেশনের ওয়েটিংরুমে এক ভদ্রলোক হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। তাঁর কোনো সঙ্গী ছিল না। জিনিসপত্রও ছিল সামান্য। ওঁর অ্যাড্রেস খুঁজতে গিয়ে আমরা ভদ্রলোকের জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করি। জিনিসপত্রের মধ্যে একটা পুতুল ছিল। আধ-হাত মতন লম্বা, একটা জাপানি ড। ওই পুতুলটা নাড়াচাড়া করার সময় হঠাৎ পায়ের জুতোটা ভেঙে গেল। খুলে গেলও বলতে পারেন। আর অবাক কথা, পুতুলের ভেতর থেকে দু’টুকরো হীরে, তা ধরুন, পাঁচ-সাত রতি করে তো হবেই, আমাদের হাতে পড়ে। ব্যাপারটা অদ্ভুত! আমাদের এক কর্তা জহুরিকে দিয়ে হীরে দুটো পরখ করিয়ে বললেন, ওর দাম কম করেও হাজার পঞ্চাশ-ষাটের মতন। এই হীরে কোথা থেকে এল, কেমন করে এল, কেনই বা পুতুলের মধ্যে করে আনা হচ্ছিল, এ-সব নিয়ে মাথা ঘামাতে বসে আমরা একটাই মাত্র হদিস পেলাম। পুতুলটা কলকাতার নিউমার্কেট থেকে কেনা হয়েছে। না, কোনো রসিদ ছিল না। বাক্স ছিল পেস্টবোর্ডের। তার একপাশে দোকানের স্ট্যাম্প মারা ছিল। ফুলকুমারের দোকানের।”
“ভদ্রলোক মধুপুরের?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।
“না। মধুপুরের নন। ভদ্রলোকের টিকিট ছিল কিউলের। পকেটে শ’ দুয়েক টাকা, একটা হিন্দি ম্যাগাজিন ছাড়া, আমরা আর কিছু পাইনি। জিনিসপত্রের মধ্যেও কোনো ঠিকানা ছিল না। উনি যে কেন মধুপুরে নেমে গিয়েছিলেন তাও বোঝা গেল না। এমন হতে পারে, কেউ ভদ্রলোককে ফলো করছিল। হয়ত হীরের জন্যেই। ভদ্রলোক ভয় পেয়েই হোক, বা লোকটাকে এড়াবার জন্যে হোক, মাঝপথেই নেমে পড়েন। এবং হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।”
রাজকুমার বললেন, “আপনারা তার কোনো পাত্তা পাননি?”
“না। উনি কে, কোথাকার লোক, আমরা জানতে পারিনি। কিউলের টিকিট সঙ্গে ছিল ঠিকই, তবে কিউলের লোক নন। উনি কিউল থেকে অন্য কোথাও চলে যেতেন হয়ত।”
“তারপর?”
“আমাদের বড় কর্তাদের সন্দেহ হয়, চোরাই-সোনা আর হীরে-চুনি-পান্না, নানা রকম স্টোনের কারবার চলছে ওদিকে। এটা তার প্রমাণ। নেশাভাঙের চোরাই-চালান আমাদের হাতে ধরা পড়ত মাঝে-মাঝে। সোনাদানা, হীরে আমরা আগে পাইনি। আমার কতারা ব্যাপারটা তদন্ত করার জন্যে আমাকে বেছে নিলেন। আমার ওপর ভার পড়ল কলকাতায় এসে ইভেস্টিগেট করার। আমি বিজয় মুস্তাফি সেজে এখানে আমার কাজ করছিলাম,” সিংহ হাসল হালকাভাবে, বলল, “আমার কপাল ভাল, কৃষ্ণা নাশারির আতাবাবুর সঙ্গে একটা সম্পর্ক আছে আমার। সুবিধেই হয়েছিল কাজের।”
“এখানে এসে আপনি ফুলকুমারের ওপর নজর রেখে যাচ্ছিলেন?” চন্দন। বলল।
“হ্যাঁ। ফুলকুমারের দোকান আমার কাছে খুবই সন্দেহজনক মনে হয়। একটা কথা বলা দরকার। যে-পুতুলের মধ্যে আমরা হীরে দুটো পাই, সেটা যেবাক্সে রাখা ছিল, তার একপাশে ফুলকুমারের দোকানের রাবার স্ট্যাম্প ছিল, এ কথা আগেই বলেছি আপনাদের। কিন্তু সেই সূত্র ধরে ফুলকুমারকে ধরা বা দোষী বলা যেত না, বা বললেও সেটা বোকামি হত। …আমি ওর দোকানের ওপর নজর রাখতে শুরু করি। ওর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিশে ভেতরের খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করি। কমলকে আমি শেষ পর্যন্ত হাতে আনতে পেরেছিলাম। কমল বুঝতেই পারেনি আমি পুলিশের লোক
ববি বলল, “আপনি আমাকে সন্দেহ করতেন।”
সিংহ হাতজোড় করে বলল, “আমরা নানা চালে চলি। আপনাকে সন্দেহ হয়, এটা না দেখালে কমল আমার হাতে থাকত না। সরি, ববিসাহেব। কিছু মনে করবেন না।”
রাজকুমার বললেন, “আপনি কমলকে ধরলেন না কেন?”
“ধরার সময় হলেই ধরতাম। ফুলকুমারকে হাতেনাতে ধরব বলেই অপেক্ষা করেছি। শুধু ও কেন, ওর সঙ্গে সেইসব রুই কাতলা, যারা এই ব্যবসাটা চালাচ্ছে। তবে, বলতেই হবে ফুলকুমার প্রচণ্ড চালাক ছিল, ভেরি মাচ ক্লেভার। ওকে সরাসরি ধরা সহজ ছিল না। তবে ধরা পড়ত, দুদিন আগে আর পরে। এমন সময় ফুলকুমার খুন হল। আমাকেও থমকে দাঁড়াতে হল। খুনের ঘটনাটা আমার কাছে মিস্টিরিয়াস মনে হচ্ছিল। আমি ভাবছিলাম, কী করা যায়। এমন সময় রায়সাহেব হাজির হলেন,” বলে সিংহসাহেব হাত বাড়িয়ে কিকিরাকে দেখাল, “পরের ব্যাপারটা উনিই জানেন, আমি জানি না।” একটু থেমে সিংহ কী মনে করে হাসল। বলল, “ছোট একটা কথা বলে নিই, রায়সাহেব। আমি যে খোঁড়া নই, এটা আপনি ধরতে পারবেন, আমি মোটামুটি সেটা আন্দাজ করেছিলাম। আপনি বড় আচমকা গিয়ে পড়েছিলেন। আমি তৈরি হতে পারিনি। আমার একটা মোজা ধরনের জিনিস আছে, নাইলনের। গায়ের চামড়ার সঙ্গে এমনভাবে মিশে থাকে যে, ধরা যায় না। তার রঙ খানিকটা মরা চামড়ার মতন। সেটা আমি খোঁড়া পায়ে পরতাম। পরে তার ওপর প্যান্ট চাপাতাম। সেদিন কমল আমার ঘর থেকে চলে যাবার পর, সবে আমি মোজাটা খুলে লুঙ্গি পরেছি, আপনারা গিয়ে হাজির। ধরা পড়ে গেলাম।” সিংহ জোরে হেসে উঠল।
সামান্য সময় সকলেই চুপচাপ। অল্পক্ষণের বিরাম যেন। তারপর রাজকুমার কিকিরাকে বললেন, “রায়বাবু, আপনার মুখে বাকিটা শুনতে চাই।”
কিকিরা ঘাড় দোলালেন। বললেন, “বলব বলেই আপনাদের সকলকে ডেকেছি রাজাবাবু। কিন্তু কোন্টা আগে বলব, কোন্টা পরে, তাই ভাবছি। আমার মনে হয়, যেমন-যেমন ঘটেছে তেমন করে বলাই ভাল। তাই নয়?”।
তারাপদ বলল, “আপনার যেমন করে বললে সুবিধে হয়, তেমন করেই বলুন, স্যার।”
কিকিরা বললেন, “তা হলে ম্যাজিশিয়ান ফুলকুমারের ভুতুড়ে হারমোনিয়াম বাজানো দিয়েই শুরু করা যাক। মুখে সব বলার চেয়ে একটু বরং হাতে কলমে দেখাই। আমার এই ছোট্ট ঠাসা ঘরে আপনাদের সব তো দেখাতে পারব না। আমার কাছে ম্যাজিক দেখানোর জিনিসপত্রও নেই। তবু একটা জিনিস দেখাই। খানিকটা আন্দাজ করতে পারবেন।” বলে কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন। ঘরের চারদিক দেখলেন। বললেন, “আমার বাড়িতে হারমোনিয়াম নেই। থাকার মধ্যে রয়েছে ওই পুরনো আমলের গ্রামোফোন আর রেকর্ড। আপনারা আমার হাত বেঁধে দিন, চোখ বেঁধে দিন। আমি আমার শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে গ্রামোফোনের কাছে যাব। রেকর্ড বার করব। বাজাব। আপনারা আমায় দেখতে পাবেন না। শুধু একটা কাজ করবেন। হাত-পা বাড়াবেন না। আর দেশলাই জ্বালাবেন না। আসুন, কে আমার হাত বাঁধবেন? ববিসাহেব, আপনি আসুন।” বল্লে কিকিরা একপাশ থেকে হাত বাঁধা দড়ি, আর চোখ বাঁধা কালো রুমাল বার করে দিলেন।
ববি উঠে গিয়ে কিকিরার হাত বাঁধল। শোবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কিকিরা বললেন, “এবার আমার চোখ বাঁধুন। ভাল করে বাঁধবেন। আমার চোখ বাঁধা হয়ে গেলে, আপনি নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়বেন। চন্দন, তোমার ঠিক হাতের কাছে আলোর সুইচ আছে। তুমি আলো নিভিয়ে দেবে। তার আগে জানলার পরদাগুলো টেনে দাও। আলো যেন না আসে।”
কিকিরার কথামতন তাঁর চোখ বাঁধা হল। ঘর অন্ধকার করা হল। ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল ঘর। শোবার ঘরের হাত কয়েক তফাতে গ্রামোফোন।
কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। কিকিরা বললেন, “অধৈর্য হবেন না, আমার আজকাল অভ্যেস নেই। একটু দেরি হবে। ততক্ষণ আপনারা ভূতের নাম জপ করুন।”
রাজকুমাররা বসে থাকলেন। চুপচাপ। সময় কাটতে লাগল। পাঁচ-সাত মিনিট কেটে গেল। কোনো সাড়াশব্দ নেই। অন্ধকারে বসে থাকল তারাপদরা। তারপর কখন যেন শব্দ হল। ঘষঘষে শব্দ। শেষে গান বেজে উঠল গ্রামোফোনে। রেকর্ড বাজছিল।
কিকিরার গলা শোনা গেল, “চন্দন, আলোটা জ্বেলে দাও।”
চন্দন আলো জ্বালল।
কিকিরা গ্রামোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে। হাতের বাঁধন খোলা। চোখের বাঁধন আগের মতনই। হাসছেন।
চন্দন হাততালি দিয়ে উঠল, “দারুণ কিকিরা স্যার। ওয়ান্ডারফুল।”
“চোখটা খুলে দাও।”
ববি এগিয়ে গিয়ে চোখের বাঁধন খুলল। খুলতে খুলতে বলল, “আলগা লাগছে কিকিরাসাহেব?” বলে হাসল।
কিকিরা একবার চোখ রগড়ে নিলেন। তাকালেন সকলের দিকে। হাসলেন। বললেন, “আপনারা অবাক হবেন না। এর মধ্যে অদ্ভুত কিছু নেই। একে বলা হয়, ব্ল্যাক আর্ট। মানে কালোর খেলা। কালোয় ঢেকেছে আলো। কালোর মধ্যে কালো দেখা যায় না। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আপনি কালো জামা পরে যদি দাঁড়িয়ে থাকেন, আপনাকে দেখবে কার সাধ্য!এই দেখুন, আমার প্যান্ট কালো, জামা কালো, মায় মাথায় সাদা চুল চোখে পড়ে, সেই ভয়ে একটা কালচে বাঁদুরে টুপি পরেছি। টুপিটা আমার পকেটেই ছিল, হাতের বাঁধন খোলার পর পরে নিয়েছি।”
সিংহ বলল, “জানলার পরদাগুলোও তো কালো।”
“ইচ্ছে করেই টাঙানো হয়েছে সিনাসাহেব। যাতে আলো না আসতে পারে। আর একটা জিনিস দেখুন, গ্রামোফোনটা এমনভাবে রাখা আছে, যাতে আমি খুব সহজে দেওয়াল ধরে সেখানে যেতে পারি। আমার নিজের ঘরবাড়ি, ঘরটাও ছোট, কাজেই আমার আন্দাজ আছে, অভ্যেস আছে।”
ববি বলল, “আপনি হাতের বাঁধন খুললেন কেমন করে?”
কিকিরা হাসলেন। “আমি ম্যাজিশিয়ান। বাঁধন খোলা আমার পক্ষে একটুও কঠিন নয়। হ্যান্ডকা খোলা আরও সোজা। অনেক রকম হ্যান্ডকা হয় ম্যাজিশিয়ানদের। যে যেমন পারে এক-একটা গালভরা নাম দিয়ে নেয়। ওর মধ্যে কলাকৌশল আছে। ট্রিক। খানিকটা আবার হাত-পায়ের অভ্যেস।”
“আপনি কি বলতে চাইছেন, ফুলকুমারের হারমোনিয়াম বাজানোর সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে?”
“হ্যাঁ,” কিকিরা মাথা নাড়লেন, “ফুলকুমার কেমন করে হারমোনিয়াম বাজানোর খেলাটা দেখাত, আমি তার দলের লোকদের জিজ্ঞেস করে করে জেনে নিয়েছি। সে খেলাটা দেখাত, স্টেজ উইদিন দি স্টেজ করে, আমরা আগে একে বলতাম ডাবল স্টেজ। এখন কী বলে জানি না।”
“লালাজি বলেছিলেন..” তারাপদ কিছু বলতে গেল।
“লালাজি ঠিকই বলেছিলেন। তাঁর বলতে একটু ভুল হয়েছিল। তিনি দু’ নম্বর স্টেজটাকেই স্টেজ বলেছিলেন। আর তিনি বলেননি, বা বলতে পারেননি, ছোট স্টেজের পেছন আর দু পাশ ঢাকা ছিল। ইট ওয়াজ অল্ ব্ল্যাক। সামনের দিকটা ছিল খোলা। আর সামনে একটা টেবিলের ওপর হারমোনিয়ামটা রাখা ছিল। ফুলকুমার হাত-দুই তফাতে দাঁড়িয়ে ছিল।”
“আপনি বলতে চাইছেন ফুলকুমার নিজেই হারমোনিয়াম বাজাচ্ছিল?”
“হ্যাঁ।”
“হ্যান্ডকাফ খুলে ফেলে?”
“অবশ্যই। ফুলকুমারের অ্যাসিসট্যান্ট মোতিয়া যে হ্যান্ডকা লাগানোর পর চাবিটা দর্শকদের কাছে দিয়ে আসত, ওটা নেহাতই ধাপ্পা। দশটা চাবি দিয়ে এলেও হ্যান্ডকাফ খোলা কিছু নয়।”
“ওকে কেমন করে মারা হল?”
“ফুলকুমারকে মারা হয়েছে বুদ্ধি করে। প্ল্যান করে। প্রথম দফায় সে একটা গৎ বাজায় হারমোনিয়ামে। বাজনা শেষ হলে, বড় স্টেজের আলো জ্বেলে দেখানো হয়, হ্যান্ডকা বাঁধা অবস্থায় সে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ বাঁধা। তার সামনে হারমোনিয়াম। মানে দর্শকদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়, দেখো হে, ম্যাজিশিয়ান সেই একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে।”
“গুড শো!” ববি বলল।
“দ্বিতীয় দফায় যখন নতুন করে ফুলকুমার হারমোনিয়াম বাজাতে শুরু করে, তখন দু নম্বর স্টেজের পেছনের লুকনো জায়গা থেকে কালো পোশাক পরা কেউ এসে তার মাথার পেছন দিকে মারে। ভারী শক্ত জিনিস দিয়ে মেরেছিল। হাতুড়ি বা কোনো রকম ভারী ওজনের লোহা দিয়ে। ফুলকুমার মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। বাজনা যায় বন্ধ হয়ে। ওই সময় স্টেজ পুরো অন্ধকার। ব্যাপারটা কী হচ্ছে খেয়াল হতে সময় যায় খানিকটা। আর তারপর যখন আলো জ্বালানো হয়, দেখা যায়, ফুলকুমার মাটিতে পড়ে আছে।”
সিংহ বলল, “হারমোনিয়ামও গায়েব?”
“তাই হয়েছিল। তখন ওই অবস্থার মধ্যে কেউ হারমোনিয়ামের কথা খেয়াল করেনি। পরে যখন খেয়াল হল, দেখল, বাক্সটা আছে হারমোনিয়ামের। ভাবল, ঠিক আছে। আরও পরে তাদের খেয়াল হল, বাক্সটা আছে, হারমোনিয়াম নেই।”
চন্দন বলল, “কিন্তু কিকিরা, আমরা প্রথমে শুনেছিলাম, ফুলকুমারের হ্যান্ডকা মোতিয়া খুলে দিয়েছিল।”
কিকিরা বললেন, “আমার মনে হয়, মোতিয়া হ্যান্ডকা খোলার ভড়ং দেখিয়েছিল। পাছে লোকে দেখে ফেলে ফুলকুমারের এক হাতের হ্যান্ডকা খোলা, তাই ঝটপট মাটিতে বসে পড়ে অন্য হাতের হ্যান্ডকা খুলে দেয়। আসলে সে ধোঁকা দিয়েছিল। ওই রকম একটা সাঙ্ঘাতিক সময়ে, সবাই দিশেহারা, কেউ বুঝতে পারছে না, কী হল, কী করবে!”
“হারমোনিয়ামটা তার আগেই পাচার হয়ে গিয়েছিল?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ। সঙ্গে-সঙ্গে।”
“কেউ দেখতে পেল না?”
“পাবার কথা নয়। তোমরা লালাজির কাছেই শুনেছ, ফুলকুমার কালো পোশাক পরে খেলা দেখাত। ঠিকই করত। নয়ত ভূতের খেলা জমে না। যে-লোকটা ফুলকুমারকে জখম করেছিল, সেও কালো পোশাকে ঢুকেছিল। হারমোনিয়াম নিয়ে যাবার সময়ও কালো কাপড়ে চাপা দিয়ে নিয়ে পালিয়েছে।”
“কেমন করে পালাল?” চন্দন জিজ্ঞেস করল।
“পালানোর পথ ছিল। তোমরা স্টেজটা মনে করে দেখো। সাজঘরের পাশ দিয়ে প্যাসেজ ছিল। সেই প্যাসেজ দিয়ে হলের বাইরে এসে পেছন দিকে গিয়ে দাঁড়ালে একটা গুদোমখানার মতন, যত কাঠকুটো, ছেঁড়াফাটা জিনিস জড়ো হয়ে আছে। তার পাশে কল একটা। তার পরই ভাঙা পাঁচিল। একবার পাঁচিল টপকে বেরিয়ে আসতে পারলে আর কে মারে! সামান্য এগিয়ে গেলেই তো গাড়ি চড়ে পালাতে পারবে।”
তারাপদ মনে-মনে জায়গাটার কথা ভেবে নিল। কিকিরা ঠিকই বলছেন। “ওদের গাড়ি দাঁড় করানো ছিল, তাই না কিকিরা?”
“নিশ্চয় ছিল। নয়ত পালাবে কেমন করে?”
চন্দন নিজের মনেই মাথা নাড়ল। ববি সিগারেট ধরাল। সকলকেই উত্তেজিত মনে হচ্ছিল।
রাজকুমার বললেন, “রায়বাবু, ওই লোকটা কে, যে ফুলকুমারকে খুন করল? কেন খুন করল?”
কিকিরা কিছুক্ষণ কোনো কথা বললেন না। পরে নিজের জায়গায় বসতে বসতে বললেন, “রাজাবাবু, আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, মোতিয়া ফুলকুমারকে খুন করেছে। পরে বুঝলাম, মোতিয়া নয়। কমল অতি ধূর্ত। সে একটা ছক সাজিয়েছিল। ছকটা কেমন জানেন? একজনের ওপর ভার পড়েছিল, ফুলকুমারকে জখম করার। ফুলকুমারকে জখম করে সে হারমোনিয়ামটা নিয়ে পালিয়ে আসবে হলের বাইরে। অন্য একজনকে ঠিক করে রেখেছিল কমল, তার ওপর হুকুম ছিল, ভাঙা পাঁচিলের সামনে গা-ঢাকা দিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকবে, হারমোনিয়ামটা হাতে পাবার পর সোজা গাড়িতে গিয়ে উঠবে। যে ফুলকুমারকে জখম করেছিল সে ওরই দলের লোক, ম্যাজিক-পার্টির লোক, একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট। সে সব জানত। জানত কেমন করে, কোন্ সময় ফুলকুমারকে জখম করা যায়। আর এটাও জানত, জখম করে পালিয়ে গেলে পুলিশ তাকে সন্দেহ করবে। কাজেই সে আবার স্টেজে ফিরে এসেছিল। তখন ফুলকুমারকে নিয়ে হইচই হচ্ছে। ওই অবস্থায় তার ওপর নজর পড়ার কথা নয়। এই লোকটা কে হতে পারে?”
চন্দন বলল, “আগে তো মনে হত মোতিয়া। সে কিছুক্ষণ নিজের জায়গায় ছিল না।”
“হ্যাঁ। কিন্তু মোতিয়া নয়। সেই লোকটার নাম হরিমাধব। ফুলকুমারের ম্যাজিক-পার্টির ম্যানেজার। নতুন ম্যানেজারও বলতে পারেন।”
“হরিমাধব?” রাজকুমার অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকলেন। ভাল করে চেনেনও না ছোকরাকে।
কিকিরা বললেন, “মোতিয়া এই ছকের মধ্যে ছিল। জানত সব। কিন্তু সে ফুলকুমারকে জখম করেনি। তার ওপর ভার দেওয়া ছিল, কমলের ছকমতন যেন সব ঠিকঠাক হয়, ম্যাজিক-শো চলার সময়, সেটা লক্ষ রাখতে। মোতিয়া তার কাজ করেছিল। কিন্তু ভাবতে পারেনি, ফুলকুমারকে ওরা মেরে ফেলবে। ভেবেছিল, ফুলকুমার জখম হবে, চোট পাবে, বেহুঁশ হয়ে থাকবে কিছুক্ষণ। ফুলকুমার মারা যেতে সে ভয় পেয়ে গেল। তারপর দু-একদিনের মধ্যে ফেরার হল।”
তারাপদ বলল, “মোতিয়া এখন কোথায়?”
“পুলিশ হাজতে। আজ সকালে সে নিজে থানায় গিয়ে ধরা দিয়েছে। কমলের হোটেলে সে লুকিয়ে ছিল। কমল ধরা পড়ার পর, সে নিজের থেকে গিয়েই ধরা দিল। ভালই করেছে।”
কিকিরার কথা শেষ হল কি হল না, বাতি চলে গেল। অন্ধকার। লোডশেডিং হয়ে গেল।
হঠাৎ কেমন চুপচাপ। কেউ কোনো কথা বলছিল না।
শেষে রাজকুমার বললেন, “রায়বাবু, হারমোনিয়ামের আন্দার কোন্ চিজ ছিল? আগার ফাঁকা থাকত তো…!”
কিকিরা বললেন, “কুমারবাবু, রাজাবাবু! আপনি বহুত কুছ জানেন না।” কিকিরা ইচ্ছে করেই একটু হিন্দি কথা বললেন, “আপনি জানতেন না, আপনার ছোট ভাই খেলনার দোকানের নাম করে চোরাই সোনা, পাথর, রিভলবার, আরও হয়ত কিছু বিক্রি করে। ও ছিল স্মাগলারদের বড় এজেন্ট। আপনি এটাও জানেন না রাজাবাবু, আপনার মেজো ভাই, মোহনবাবুর হঠাৎ মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ফুলকুমারের ব্যবসার কথা মোহনভাই জানতে পারে। টাকার লোভ বড় লোভ। ছোট ভাইকে ভয় দেখিয়ে টাকা-পয়সা নিত মোহনভাই। পরে ফুলকুমার তার দাদাকে বাধ্য হয়ে নিজের কথা মাঝে সাঝে বলত। মোহনভাই আবার কমলের সঙ্গে লুকিয়ে যোগাযোগ করত। ফুলকুমারের হাতে নতুন কী এসেছে, তার দাম কত হতে পারে, জানিয়ে দিত। কমল আবার ফুলকুমারকে নজরে রাখত, চাপ দিত, যেন ওই জিনিসগুলো তার হাত দিয়ে বিক্রি হয়। মানে, তার মক্কেলরা কিনতে পারে।”
“কমল বিক্রির ওপর কমিশন নিত?”
“হ্যাঁ। ফুলকুমারকে নিজের কমিশন থেকে কমলকে ভাগ দিতে হত। সব সময় সেটা পছন্দ করত না ফুলকুমার।”
“সেদিন কী হয়েছিল?”
কিকিরা বললেন, “মোহনভাই কমলকে আগেই খবর দিয়েছিলেন, লাখ চারেক টাকার দামি পাথর, হীরে, চুনি আর নীলা, ফুলকুমার তার হারমোনিয়ামের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে যাবে ঠিক করেছে। ম্যাজিক দেখানোর পর পাথরগুলো সে অন্য একজন দালালকে দিয়ে দিতে পারে কিংবা কোনো জুয়েলারকে। পাথরগুলো একটা কাগজের প্যাকেটে থাকবে। তুলোর মধ্যে জড়ানো। জিনিসটা থাকবে হারমোনিয়ামের মধ্যে লুকনো। মোহনাই চায়, অন্যের হাতে গিয়ে পড়ার আগে যেন কমল সেটা হাতিয়ে নেয়।
সিংহ বলল, “রায়সাহেব, আমার মনে হয়, মোহনবাবুর এখানে একটা চাল ছিল। উনি নিজেই এগুলো ফুলকুমারের কাছ থেকে চুরি করেছিলেন। চোরাইমাল কেমন করে পাচার করবেন, দুজনের মধ্যে আগেই শলাপরামর্শ হয়ে গিয়েছিল। বোধহয় সব দিক থেকে ভেবেচিন্তে ঠিক করা হয়েছিল, ফুলকুমারের ম্যাজিক দেখানোর দিন, হারমোনিয়ামের মধ্যে করে পাচার করাই সবচেয়ে সুবিধের।”
কিকিরা বললেন, “বোধহয়, ঠিকই বলেছেন। মোট কথা কমল সেদিন হারমোনিয়াম চুরি করার ছক সাজিয়ে বাজনাটা চুরি করে। কিন্তু..।”
“কিন্তু! কিসের কিন্তু?”
“হারমোনিয়ামের মধ্যে কিছু ছিল না। কমল স্বীকার করেছে, সে কিছু পায়নি।”
“সে মিথ্যে কথা বলছে না তার প্রমাণ কী?”
“প্রমাণ মোহনভাই!” কিকিরা রাজকুমারের দিকে তাকালেন। বললেন, “রাজাবাবু, আপনি কি একদিন মোহনভাইকে ভাল করে নজর করেননি?”
“করেছি, রায়বাবু! ও দোকানে আসছিল না। বাড়িতে নিজের ঘরে চুপ করে বসে থাকত। কান্নাকাটি করত। ওর স্ত্রী আর আমার স্ত্রী মোহনকে অনেক করে সমঝিয়েছে। আমি ভাবতাম, ফুলকুমারের জন্যে মোহনের এই অবস্থা। ছোট ভাই খুন হয়ে যাওয়ায় নিজেকে ও সামলাতে পারছে না। কেমন করে বুঝব, রায়বাবু, আমার ফ্যামিলিতে…” কথা শেষ করতে পারলেন না রাজকুমার। গলা বুজে গেল।
কিকিরা বললেন, “মোহনভাই আমায় বলেছে, রায়বাবু, উনি জানতেন না ফুলকে ওরা মেরে ফেলবে। ওরা চুরি করবে জানতেন। মেরে ফেলবে। ভাবেননি। হারমোনিয়ামের মধ্যে ফুল কিছু নিতে পারেনি। আমি জানি। মোহনভাই বলেছেন–আমার পাপে আমার ভাই মরল। আমাকে জেলে দিন।”
রাজকুমার হঠাৎ যেন কেঁদে ফেললেন। বগলা বাতি এনে ঘরে রাখল।
কিকিরা বললেন, “পুলিশ মোহনভাইকে ছাড়বে না রাজাবাবু! আপনি থানায় যান কাল সকালে। উকিলের সঙ্গেও কথা বলুন। দেখুন, কার ভাগ্যে কী আছে! হরিমাধব, মোতিয়া, কমল এখন পুলিশের হেফাজতে। মোহনভাইকেও ছেড়ে দেবে না পুলিশ! দেখুন কী হয়!”