সোনার ঘড়ির খোঁজে

সোনার ঘড়ির খোঁজে

০১.

কিকিরা বাড়ি ফিরে দেখলেন, তারাপদরা বসে আছে।

 “কতক্ষণ?”

“পনেরো-বিশ মিনিট। আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?”

“কাছেই।…কীরকম গরম পড়েছে দেখেছ?”

“হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলেন?”

“কোথায় হাওয়া! গাছের পাতা পর্যন্ত নড়ছে না। …বসো তোমরা, চোখে-মুখে একটু জলের ঝাপটা দিয়ে আসি।” কিকিরা চলে গেলেন।

এখন গরমকাল। মাঝ-বৈশাখ। কলকাতা শহর তেতেপুড়ে মরছে। সেই কবে চৈত্রমাসের শেষাশেষি একদিন কালবৈশাখী দেখা দিয়েছিল, তারপর থেকে টানা হপ্তা তিনেক না একটু মেঘ, না মেঘলা; মাঝরাতেও যেন বাতাস তেমন ঠাণ্ডা হয় না। কাগজঅলারা বলছে, এখনো কয়েকটা দিন এইরকম গরম চলবে।

কিকিরা ফিরে এলেন। মনে হল, ভাল করে মুখ মোছেননি, ভিজে ভিজে ভাব রয়েছে।

“আচ্ছা তারাবাবু, ফক্স, অক্স আর বক্স-এর মধ্যে মিলটা কোথায়?” কিকিরা বললেন।

আচমকা এরকম একটা বেয়াড়া প্রশ্ন শুনে তারাপদরা অবাক হয়ে গেল। চন্দন তারাপদর দিকে তাকাল, তারাপদ চন্দনের দিকে। দুজনেই যেন বোকার মতন চুপ করে থাকল।

কিকিরা এবার নিজের জায়গাটিতে বসলেন।

বগলা জল এনে দিল কিকিরাকে। জল খেয়ে কিকিরা চায়ের কথা বলে দিলেন বগলাকে। বগলা চলে গেল।

তারাপদ ঠাট্টার গলায় বলল, “হঠাৎ আপনার মাথায় ফক্স, অক্স, বক্স এল কোথ থেকে?”

“না, ভাবছিলাম!”

“ভাববার আর জিনিস পেলেন না?”

চন্দন মজা করে বলল, “স্যার, ফক্স আর অক্সের একটা মিল আছে। দুটোরই চারটে করে পা; একটা করে লেজ…!”

কিকিরা আড়চোখে চন্দনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “দুটো লেজওলা প্রাণী তুমি দেখেছ নাকি?”

প্রথমটায় খেয়াল না হলেও পর মুহূর্তে কথাটা বুঝতে পেরে তারাপদ জোরে হেসে উঠল। সত্যিই তো, দুটো লেজওলা প্রাণী কে আর কবে দেখেছে! অন্তত তারাপদরা আজ পর্যন্ত দেখেনি। তবে জগতে এত অজস্র হাজারে-হাজারে জীবজন্তু রয়েছে যে, যদি কারও দুটো লেজ থেকে থাকে, অবাক হওয়ার কিছু নেই।

তারাপদ হাসতে-হাসতেই বলল, “ঠিক আছে স্যার, লেজের “একটি’কে খসিয়ে দেওয়া গেল। এখন বলুন তো হঠাৎ ফক্স, অক্স, বক্স নিয়ে আপনার মাথা ঘামানো কেন?”

চন্দন বলল, “ক্রস ওয়ার্ড ধরনের কিছু করছেন নাকি?”

“না, আমি ওই জিনিসটা করি না। দু-একবার চেষ্টা করেছিলাম আগে, মাথা গুলিয়ে যায়।” বলে, নিজের মাথা দেখালেন। কিকিরার মাথার উসকো-খুসকো চুল যেন আরও পেকে গিয়েছে আজকাল।

“তা হলে?”

“একটা সমস্যায় পড়া গিয়েছে। এক ভদ্রলোক কাল আমার কাছে। এসেছিলেন; আজও আসবেন। ফক্স, অক্স, বক্স তিনিই আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।”

তারাপদ কিকিরাকে দেখল কয়েক পলক। তারপর চন্দনের দিকে তাকাল। কেমন যেন একটা রহস্যের আঁচ পাওয়া যাচ্ছে।

“কে ভদ্রলোক?” তারাপদ বলল।

 “কৃষ্ণকান্ত দত্তরায়। …কটা বাজল এখন?”

চন্দন ঘড়ি দেখল। “ছ’টা বাজতে চলল।”

“তবে তো ভদ্রলোকের আসার সময় হয়ে গেল। ছুটা সোয়া ছ’টা টাইম দিয়েছি।”

চন্দনই আবার বলল, “আপনার চেনাজানা কেউ?”

“না। আমার পুরনো বন্ধু অশ্বিনীবাবুর কাছ থেকে এসেছেন।”

“প্রয়োজন?”

“সে এক লম্বা কাহিনী। ভদ্রলোককে আসতে দাও, শুনবে।”

তারাপদ বলল, “আপনার নতুন মক্কেল?”

“এখনো নয়। আমি বলেছি, দাঁড়ান আগে ভেবে দেখি, তারপর কথা বলব। নো ফাইন্যাল টক-বুঝলে তারা, কাল শুধু হিয়ারিং দিয়েছি। আসতে বলেছি আজ। তোমাদের সঙ্গে কথা না বলে মক্কেল নেওয়া কি উচিত? তোমরা আমার পার্টনার।” কিকিরা চোখ মটকে হাসলেন।

“বাঃ, আমরা যদি আজ না আসতাম!”

“সে আবার কী কথা গো! আজ শনিবার, তোমাদের আসার কথা। তা ছাড়া বগলার তৈরি গুজরাতি দুহিবড়া খাবার নেমন্তন্ন আজ তোমাদের! আসবে না মানে? খাবার ব্যাপারে তোমরা ভুল করবে এমন তো দেখিনি।” কিকিরা হাসতে-হাসতে মজার গলায় বললেন।

দহিবড়ার নেমন্তন্ন না থাকলেও যে তারাপদরা আজ আসত, তা ঠিকই। নেহাত আটকে না পড়লে শনিবার তারা কিকিরার কাছে অবশ্যই আসে। যদিবা চন্দন কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে- হয়ত সে আসে না, তারাপদ ঠিকই আসে।

চন্দন বলল, “কৃষ্ণকান্ত দত্তরায় লোকটি সম্পর্কে না হয় আগেভাগে একটু বলে রাখলেন কিকিরা! কে তিনি, কোথায় থাকেন, কী করেন?”

কিকিরা বললেন, “কৃষ্ণকান্ত ব্যবসায়ী মানুষ। বিল্ডিং কনট্রাকটার। হালে নিজেই দু-একটা ঘরবাড়ি তৈরি করে বিক্রিও করেছেন। তবে সেগুলো বাইরের দিকে। শহরে নয়। পয়সাঅলা মানুষ ঠিকই, কিন্তু বাইরের চালচলন সাদাসিধে।”

“বয়েস কত?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।

“পঞ্চাশ বাহান্ন। স্বাস্থ্য মজবুত বলা যায়। দুঃখের কথা হল, ওঁর বাঁ হাতটি স্বাভাবিক নয়। মানে, হাত আছে, হাতের রিস্ট থেকে তলার দিকটা–আঙুল পর্যন্ত কী বলব-একটা মাংসের পিণ্ডর মতন। ভোঁতা, মোটা। আঙুলগুলো যেন জড়ানো। মনে হয়, হাত মুঠো করে আছেন। এটা তাঁর জন্মকাল থেকেই নয়। দুর্ঘটনায় পড়ে ওই অবস্থা হয়েছে। কিছু করার নেই। উনি বাঁ হাতে একটা সুতির সাদা দস্তানা পরে থাকেন।”

চন্দন মাথা নাড়ল। সে যেন বুঝতে পেরেছে। অ্যাক্সিডেন্টাল কেস।

তারাপদ বলল, “ভাগ্যের মার।”

“তা বলতে পারো। ওই খুঁতটুকু বাদ দিলে কৃষ্ণকান্তকে সুপুরুষ বলা যায়। লম্বা চেহারা, ধারালো নাক-মুখ, গায়ের রং শ্যামলা মাথার চুল দু-চারটে পেকেছে। বেশ ভদ্র মানুষ। ধীরে ধীরে কথা বলেন। আর এমনিতেও কাজের লোক। ব্যবসার কাজকর্ম দেখার জন্যে লোক আছে ঠিক, তবু নিজে সব দিকে নজর রাখেন।”

বগলা চা নিয়ে ঘরে এল।

চা নিতে-নিতে তারাপদ হেসে বলল, “বগলাদা, আমাদের দুহিবড়া কি রাত্তিরে খাওয়া হবে?”

“একেবারে খাওয়া-দাওয়া সেরে যাবে।”

“বাঃ! ফাইন!”

বগলা চলে গেল।

চন্দন বলল, “কৃষ্ণকান্তবাবুর প্রবলেমটা কী?”

 চায়ে চুমুক দিয়ে কিকিরা বললেন, “ওঁর ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না।”

“সে কী? কত বড় ছেলে? কতদিন ধরে পাওয়া যাচ্ছে না?”

“ছেলে সাবালক। বছর একুশ-বাইশ বয়েস। দিন পাঁচেক হল নিরুদ্দেশ।”

তারাপদ বলল, “আশ্চর্য! অতবড় ছেলে, হঠাৎ নিরুদ্দেশ। বাড়িতে কিছু হয়েছিল নাকি? রাগারাগি? মা বাবার ওপর অভিমান?”

“না। কৃষ্ণকান্ত বলছেন, বাড়িতে কোনো গণ্ডগোলই হয়নি। আর ছেলেও তেমন নয় যে পালিয়ে গিয়ে বাড়ির লোককে জব্দ করবে! ছেলে ভাল। বাড়ির আদুরে ছেলে। শরীর চর্চার দিকে ঝোঁক। খেলাধুলো করে। রোজ সকালে, বারোমাসই, মাইল দুই দৌড়য়। ওটা ওর অভ্যেস। দিন পাঁচেক আগে সে রোজকার মতন ভোরের দিকে দৌড়তে বেরিয়েছিল। আর বাড়ি ফিরে আসেনি।”

তারাপদ আর চন্দন যেন কিছু ভাবছিল। অজানা অচেনা একটি ছেলের কথাই। একটি অস্পষ্ট ছবি ভেসে উঠছিল। ছেলেটি ভোরের আলোয় নিজের মনে দৌড়চ্ছে। কোনোদিকে হুঁশ নেই।

“কোথায় দৌড়চ্ছিল?”

“লেকের পাশে।”

“ঢাকুরিয়া লেক! বাড়ি কোথায় কৃষ্ণকান্তদের?”

“পুরনো বাড়ি টালিগঞ্জ চারু অ্যাভিনিউ। নতুন বাড়ি লেক গার্ডেন্স। কৃষ্ণকান্তরা এখন লেক গার্ডেন্সেই থাকেন। গত আট দশ বছর। টালিগঞ্জের বাড়ি পৈতৃক। সেখানে বড় ভাই তাঁর পরিবার নিয়ে থাকেন।”

চন্দন বলল, “কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়নি তো?”

 “খোঁজখবর করে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। হাসপাতালে খোঁজ করা হয়েছে, এমনকি কাছাকাছি নার্সিংহোমেও। নো ট্রেস…ায়ের কাপ নামিয়ে রেখে কিকিরা পকেট থেকে তাঁর সরু চুরুট বার করে রাতে যাচ্ছেন এমন সময় বাইরের দরজায় টোকা পড়ল।

কিকিরা বললেন, “বোধ হয় কৃষ্ণকান্ত।” বলতে বলতে তিনি উঠলেন। “বস, আসছি।”

সামান্য পরেই কিকিরা এক ভদ্রলোককে নিয়ে ফিরে এলেন।

কৃষ্ণকান্তই। কিকিরার দেওয়া বর্ণনায় কোনো ভুল নেই। তারাপদরা চিনে নিতে পারল। ভদ্রলোকের চোখে চশমা। রঙিন কাঁচ। খানিকটা ঘন রঙের। চোখ দেখা যায় না। কিকিরা চশমার কথাটি বলেননি। হয়ত ভুলে গিয়েছেন। বা এমনও হতে পারে, সব সময় চোখে চশমা রাখেন না কৃষ্ণকান্ত।

তারাপদদের দেখে কৃষ্ণকান্ত যেন অস্বস্তি বোধ করলেন। বিরক্ত হয়েছেন কিনা বোঝা গেল না।

কিকিরা হাসি-হাসি মুখেই কৃষ্ণকান্তকে বললেন, “আমরা আপনার কথাই আলোচনা করছিলাম। এরা আমার দুই শাগরেদ, তারাপদ আর চন্দন। চন্দন পেশায় ডাক্তার। ব্রাইট বয়।” বলে তিনি তারাপদদের দিকে তাকালেন, “তারা, ইনিই কৃষ্ণকান্তবাবু। “

তারাপদরা হাত তুলে নমস্কার জানাল।

কৃষ্ণকান্ত শুধু ডান হাত তুলে প্রতিনমস্কার জানালেন। বাঁ হাত উড়নির তলায় আড়াল করা। এই গরমেও কৃষ্ণকান্ত একটা পাতলা উড়নি গলায় কাঁধে ঝুলিয়ে রাখেন। উড়নিটা দেখতে ভাল। পাড়অলা।

তারাপদদের মনে হল, বাঁ হাতটা আড়াল করতেই কৃষ্ণকান্ত উড়নিটা ব্যবহার করেন। অন্তত বাইরের লোকজনের সামনে। ভদ্রলোকের পোশাকআশাক একেবারে সাদাসিধে। ধুতি পাঞ্জাবি পরা বাঙালি। অবশ্য ভাল ধুতি, আদ্দির পাঞ্জাবি। ডান হাতে দুটি আংটি।

“বসুন,” কিকিরা বললেন কৃষ্ণকান্তকে।

 কৃষ্ণকান্ত বসলেন।

কিকিরা বললেন, “একটা কথা আপনাকে গোড়ায় বলে নিই। আমি মশাই গোয়েন্দা নই। অশ্বিনীবাবু নিশ্চয় আপনাকে বলেছেন, যাদের সঙ্গে ফাইট করার এলেম আমার নেই। মানে, যাকে বলে ষণ্ডার ঘাড়ে গুণ্ডা–আমরা তা নই। রিভলবার বলুন আর বন্দুক বলুন–কোনোটাই আমি চালাতে পারি না। আমি নিতান্তই এক ম্যাজিশিয়ান। তাও সেকেলে ওল্ড ম্যাজিশিয়ান। এখন সে-পাটও গিয়েছে। আমার ভরসায় থাকলে আপনাকে পস্তাতে হতে পারে। তবে হ্যাঁ, যদি আমি বলি, আপনার হয়ে কাজ করব, তবে যথাসাধ্য নিশ্চয় করব। আমার এই দুই চেলাকে সঙ্গে নিয়েই করব। আপনি কি তাতে রাজি হবেন?”

কৃষ্ণকান্ত ভাবলেন একটু। মাথা হেলালেন।

“বেশ। তবে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। কী তারাপদ, চাঁদু কী বলো তোমরা?” কিকিরা বললেন।

তারাপদ আর কী বলবে!

কৃষ্ণকান্ত নিজেই বললেন এবার, “আজও কোনো খবর নেই। আমাদের যত জানাশোনা জায়গা ছিল, আত্মীয়স্বজন, সব জায়গাতেই খোঁজ করা হয়েছে। কলকাতার বাইরেও কেউ-কেউ থাকে দূর সম্পর্কের, সেখানেও লোক পাঠিয়েছি। না, মাথা নাড়লেন কৃষ্ণকান্ত, “কোথাও বাবলুর কোন খবর নেই। সে কোথাও যায়নি।” কৃষ্ণকান্তকে বড় বিমর্ষ, হতাশ দেখাচ্ছিল। উদ্বিগ্ন, ভীত।

কিকিরা বললেন, “আপনি বড় ভেঙে পড়েছেন। ভাঙবারই কথা। কিন্তু অত হতাশ হলে তো চলবে না কৃষ্ণকান্তবাবু; মনে একটু জোর আনুন।”

“কেমন করে জোর আনব বলুন! আমাদের ওই একটিমাত্র ছেলে, আর একটি মেয়ে। সে তো এখনো ছেলেমানুষ, মোলো সতেরো বছর বয়েস। মেয়েটা আজ কদিন ধরে শুধু কাঁদছে। বাবলুর মায়ের অবস্থা পাগলের মতন। আমি আর পারছি না রায়মশাই। কোথায় গেল আমার ছেলে? কী হল তার?”

কিকিরা শান্তভাবে বললেন, “পুলিশ কী বলছে?”

“পুলিশের কথা আর বলবেন না। আজ সকালেই অনেক ধরে করে এক বড় অফিসারের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। সব শুনে অফিসার বললেন, আজকাল মিসিং লোকজনের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে। খোঁজখবর করতে সময় লাগে। তাও অর্ধেককে খুঁজে পাই না। কে যে কোথায় ছিটকে পড়ে, ধরতেই পারি না। তার ওপর কেউ যদি নিজে লুকিয়ে থাকতে চায়–তাকে খুঁজে বার করা একরকম অসম্ভব!”

কিকিরা হঠাৎ বললেন, “আপনার ছেলে বাবলু তো সেরকম নয়। মানে, সে নিজে থেকেই লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করবে না।”

“না, একেবারেই নয়, কৃষ্ণকান্ত মাথা নাড়লেন, “বাবলুর পক্ষে অমন কাজ অসম্ভব!”

কিকিরা একটু চুপ করে থেকে বললেন, “নতুন আর কিছু জানতে পেরেছেন? মানে, আমি বলছি বাবলুর টেবিলে ওই যে কাগজটা পেয়েছিলেন–পাজল-এর মতন, যাতে ফক্স, অক্স আর বক্স লেখা ছিল ইংরিজি হরফে–তার পর আর কিছু নতুন জানতে পেরেছেন?”

কৃষ্ণকান্ত বললেন, “পেরেছি। আপনাকে সেকথাই বলতে যাচ্ছিলাম কাল কথায় কথায় ভুলে গিয়েছিলাম।

কিকিরা কৌতূহল বোধ করলেন, “কী জানতে পেরেছেন?

“আমাদের বাড়িতে পুরনো একটা ঘড়ি ছিল।সেকেলে পকেট ঘড়ি। আমার বাবার কাছে দেখতাম। বাবা বড় একটা ব্যবহার করতেন না। আলমারিতে ভোলা থাকত। ঘড়িটা সুইস মেড। সেকালের বিখ্যাত কোনো কোম্পানির। দেখতে অতি চমৎকার। তার চেয়েও বড় কথা হল, ঘড়িটা সোনার, একেবারে পাকা সোনা হয়ত নয়, কাঁটা দুটোও সোনার। এক-দুই নম্বরের বদলে রোমান সাইন ছিল, এক দাঁড়ি দুই দাঁড়ি…। আর সবচেয়ে মজা ছিল ঘড়িটা আলোয় আনলে ডায়ালের ভেতরে একরকম রং হত, ছায়ায় একরকম, আবার অন্ধকারে জ্বলজ্বল করত। ঘড়ির নিচে আর-এক ছোট্ট গোলের মধ্যে কম্পাসের কাঁটাও ছিল। ঘড়িটা নিশ্চয় দামি। তার চেয়েও বেশি হল, দেখতে খুব সুন্দর। ঘড়ির ডালাটাও ছিল দেখার মতন। ডালার ওপর সুন্দর নকশা ছিল। এনগ্রেভিং। রাজারানীর মুখ। লতাপাতা।”

তারাপদরা মন দিয়ে শুনছিল কৃষ্ণকান্তর কথা। হঠাৎ বলল, “ঘড়িটা চলত?”

“না। বাবার আমলেই বোধ হয় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ও ঘড়ি সারাবার মিস্ত্রি কোথায়?” কম্পাসের কাঁটাটা কিন্তু ঠিক ছিল।”

“ঘড়িটা খোয়া গিয়েছে?”

“হ্যাঁ। আলমারি, লকার, ওয়ার্ডরোব, দেরাজ সব জায়গাতেই খোঁজা হয়েছে–ঘড়ি পাওয়া যায়নি।”

কিকিরা বললেন, “আপনাদের বাড়ি নিশ্চয় ছোটখাটো নয়; ঘর আসবাবপত্রও যথেষ্ট বলে মনে হয়। একটা পকেট ঘড়ি কোথাও না কোথাও পড়ে থাকতে তো পারে!”

“বললাম তো, সব জায়গাতেই খোঁজা হয়েছে তন্নতন্ন করে।…তা ছাড়া ঘড়িটা আমাদের ঘরে পুরনো আলমারির মধ্যে থাকত।”

“বাবলু বাড়ি থেকে উধাও, ঘড়িও উধাও–আপনি কি তাই বলতে চাইছেন?”

কৃষ্ণকান্ত অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। মাথা নাড়লেন। “তাই তো দেখছি!”

চন্দন চুপচাপ বসে কথাবার্তা শুনছিল কৃষ্ণকান্ত আর কিকিরার। তার কাছে ব্যাপারটা এখনো অস্পষ্ট। একটা কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে সকালে লেকের ধারে দৌড়তে গিয়ে হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছে। সাতসকালে এভাবে উধাও হওয়া অসম্ভব–যদি না সেই ছেলে নিজেই কোথাও পালিয়ে যায়! লেকের আশেপাশে অজস্র লোক ভোরবেলায় বেড়ায়, শরীর চর্চা করে, দৌড়য়। অত লোকজনের চোখের সামনে থেকে, সদ্য ভোরে–কেউ তো বাবলু নামের জোয়ান ছেলেকে গুম করে নিয়ে যেতে পারে না। অসম্ভব! তার ওপর আবার ভদ্রলোক কোথ থেকে এক পুরনো সোনার ঘড়ির কথা টেনে আনলেন। কী সম্পর্ক এই দুইয়ের?

চন্দনের কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল, বলল না।

চন্দন না বলুক, কিকিরাই বললেন কৃষ্ণকান্তকে, “বাবলুর সঙ্গে ঘড়ির সম্পর্ক কী কৃষ্ণকান্তবাবু? আপনার ছেলে ভাল, চোর ছাঁচোড় নয়, বাজে বন্ধুবান্ধবও নেই। আপনি আমায় বলেছেন আগে।”

“বলেছি। এখনো বলছি। লেখাপড়ায় সে অ্যাভারেজ হয়ত, কিন্তু তার স্বভাবে কোনো দোষ নেই। খেলাধুলো করে হইহল্লা করে, একটা নাটকের দল আছে ওদের–তাতে খাটাখাটুনি ছাড়াও, একটু-আধটু অভিনয় করে। বাবা হিসেবে ছেলের বেশি প্রশংসা করা মানায় না রায়মশাই। ছেলে সম্পর্কে আমার অন্য কোনো অভিযোগ নেই, শুধু একটাই ভাবনা ছিল; এখন যেমন আছে–আছে, চলে যাচ্ছে। পাঁচ-সাত বছর পরে আমার ব্যবসার হাল ধরতে পারবে তো?”

“কেন, ওর বুঝি মন নেই আপনার ব্যবসাপত্রে?”

“একেবারেই নয়। ছেলেটার সব ভাল, শুধু একটা জিনিস ভাল নয়, বড় খামখেয়ালি, জেদি। বেপরোয়া।”

তারাপদ বলল, “আপনি কি মনে করেন, আপনার ছেলে ঘড়িটা নিয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

“কেন? ঘড়ি তো আপনাদের ঘরে আলমারির মধ্যে থাকত!”

“তাতে কী! বাবলুর মার এমনিতেই ভুলো মন, তা ছাড়া মশাই, বাক্স আলমারি দেরাজের চাবি আগলে রাখার অভ্যেস বাড়ির মধ্যে আমাদের নেই। আমাদের একটি ছেলে একটি মেয়ে, কার জন্যে চাবির গোছা আগলাব?”

“কাজকর্মের লোকজন?”

“তারা আমাদের বাড়িতেই থাকে। পুরনো, বিশ্বস্ত লোক। ঠিকে কাজের লোক একজনই। বাসন-টাসন মাজে।

কিকিরা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, বগলা চা নিয়ে এল কৃষ্ণকান্তর জন্য।

চা দিয়ে চলে গেল বগলা।

 “নিন, একটু চা খান” কিকিরা বললেন। “বাবলু যে ঘড়িটা নিয়েছিল এর কোনো প্রমাণ আছে?”

“খুকু–আমার মেয়ে, দেখেছে।”

“নিতে দেখেছে?”

“না, আগের দিন বাবলুর কাছে দেখেছে। দুই ভাইবোনে এ নিয়ে ঝগড়াও করেছে মজা করে।”

“আপনি বলছেন, বাবলু পরের দিন সকালে যখন লেকে দৌড়তে যায় তখন ওর কাছে ঘড়িটা ছিল?

“তাই তো মনে হয়, কৃষ্ণকান্ত অন্যমনস্কভাবে বললেন

“অচল ঘড়ি, তাও পুরনো পকেট ঘড়ি নিয়ে দৌড়তে যাওয়া?” চন্দন বলল হঠাৎ। এই প্রথম সে কথা বলল। তার বোধ হয় বিশ্বাস হচ্ছিল না কথাটা। সন্দেহ হচ্ছিল।

কৃষ্ণকান্ত দেখলেন চন্দনকে, কোনো জবাব দিলেন না।

 কিকিরা বললেন, “একটা কথা আমায় বলুন। মেনে নিলাম আপনার মেয়ে তার দাদার কাছে ঘড়িটা দেখেছে। কিন্তু বাবলু যে ঘড়িটা পকেটে পুরে দৌড়তে বেরিয়েছিল, তার প্রমাণ কী? কেউ কি তাকে ঘড়ি পকেটে পুরতে দেখেছে?”

কৃষ্ণকান্ত কেমন বিভ্রমের চোখে তাকিয়ে থাকলেন। মাথা নাড়লেন। “না, কেউ দেখেনি।”

“তবে?”

“বাবলুর ঘরে তার পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে ঘড়ি রাখা বাক্সটা পাওয়া গেছে। ওটা অবশ্য ঘড়ির আসল বাক্স নয়। সে বাক্স কবে কোনকালেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমরা একটা গয়নার গোল মতন বাক্সে ঘড়িটাকে রেখে দিয়েছিলাম। বাবার স্মৃতি। দেখতেও তো ভাল।”

“তার ওপর সোনার?

“না, না, ওইটুকু সোনার লোভে ঘড়িটাকে যত্ন করে রেখে দেওয়ার দরকার আমাদের ছিল না। বাবার স্মৃতি হিসেবেই ছিল।”

তারাপদ বলল, “ড্রয়ারের মধ্যে ঘড়ির বাক্সটা রয়েছে, এটা আপনারা পরে খেয়াল করলেন?”

“হ্যাঁ। প্রথমদিকে বাবলুর খোঁজখবর করতে বাইরেই ছোটাছুটি করেছি। ঘরের কথা খেয়ালই হয়নি। পরে ওর ঘরের এটা-সেটা হাতড়েছি। ভেবেছি, কী জানিবাড়ি ছাড়ার আগে ও যদি কিছু লিখে গিয়ে থাকে। এরকম করার কথা নয়। তবু কোথাও কিছু হদিস পাচ্ছি না বলেই ওর ঘর, টেবিল, জিনিসপত্র হাতড়ানো।”

“কী পেলেন?”

“কী আর পেলাম! টেবিলের ওপর একটা কাগজ পেলাম, তাতে লেখা ফক্স, অক্স আর বক্স!…আর কালই ওই ঘড়ির বাক্সটা চোখে পড়ল। কাগজপত্রের তলায় চাপা ছিল।”

“কী ধরনের কাগজ?”

“এমনি কাগজ! একটা স্পোর্টস ম্যাগাজিন, একটা ইংরিজি চটি কমিকসের বই। দু-চারটে এলোমেলো কাগজ!” কৃষ্ণকান্ত চুপ করে গেলেন।

অল্পক্ষণ সবাই চুপচাপ। চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলেন কৃষ্ণকান্ত। অন্যমনস্কভাবেই সিগারেটের প্যাকেট বার করলেন। লাইটার এগিয়ে দিলেন কিকিরাদের।

চন্দন লক্ষ করল, সিগারেট বার করতে, লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে নিতে কোনো অসুবিধে হল না কৃষ্ণকান্তর। অভ্যাস হয়ে গিয়েছে সবই। এইরকমই হয়। মানুষ তার অনেক শারীরিক খুঁত নিজের থেকেই মানিয়ে নেয়।

চন্দন কৌতূহল বোধ করে বলল, “আপনার ছেলে যে রোজকার মতন দৌড়তে বেরিয়েছিল–তাতে আপনাদের কোনো সন্দেহ নেই?”

“না। ও অনেক ভোরে দৌড়তে বেরোয়। আমি তখন বিছানা ছেড়ে উঠি না। বেলায় উঠি। বাবলুর মা মাঝে-মাঝে উঠে পড়ে। আমাদের বাড়ির কাজের লোক সিধু–সিদ্ধেশ্বর ভোরে সদরটর খুলে দেয়। সিধু বাবলুকে সদর খুলে দিয়েছিল।”

“কিছু বলেছিল আপনার ছেলে সিধুকে?”

“না। ট্রাকসুট জুতোটুতো পরে–যেমন রোজ দৌড়তে বেরোয়, বেরিয়ে গিয়েছিল বাবলু।”

কিকিরা বললেন, “আপনি তো আমায় কাল বলছিলেন, পাড়ার চেনাজানা লোক ওকে দৌড়তে দেখেছে লেকে।”

“হ্যাঁ। সকালের দিকে অনেকেই ঘোরাফেরা করে ওদিকে। আমাদের পাড়ার কয়েকজনও করে। তারা বাবলুকে দেখেছে।”

“ভুল দেখেনি তো?”

“না, ভুল দেখবে কেন? নীল-সাদা মেশানো ট্রাকসুট পরে বাবলু দৌড়য়। সেইভাবেই দেখেছে।”

“শেষ কে দেখেছে?”

“তা বলতে পারব না।”

কিকিরা সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “কৃষ্ণকান্তবাবু, ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত! ভোরবেলায় লোকজনের সামনে থেকে একটা জোয়ান ছেলেকে কেউ তো চুরি করে নিয়ে যেতে পারে না। অসম্ভব! আর নেবেই বা কেন?…আপনাদের সঙ্গে কারও শত্রুতা আছে?”

“জ্ঞানত না।”

“কোনো জ্ঞাতি কুটুম…?”

“মনে করতে পারি না।”

“বাবলুর বন্ধুবান্ধব, যাদের সঙ্গে ও পড়াশোনা করত, তাদের কারও সঙ্গে–”

“না না। ওর বন্ধুবান্ধবরাও ওকে আজ কদিন ধরে নানা জায়গায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। কাগজে আমি একটা সন্ধান চাই বিজ্ঞাপনও ছাপিয়েছি। দুদিন হল পর পর বেরিয়েছে।”

কিকিরা ভাবছিলেন। পরে বললেন, “আমরা আপনার ছেলেকে খোঁজ করার দায়িত্ব নিচ্ছি। পারব কিনা জানি না। সময় লাগবে।..তার আগে আমি একবার আপনাদের বাড়ি যেতে চাই। কাল সন্ধের আগেই যাব। আপত্তি নেই তো?”

“কিসের আপত্তি, মশাই! আপনারা কাল আসুন। আমি বাড়িতেই থাকব।”

.

০২.

পরের দিন চন্দনকে পাওয়া গেল না, কাজে আটকে গিয়েছে।

কিকিরা তারাপদকে সঙ্গে নিয়েই বেরিয়ে পড়লেন, লেক গার্ডেন্স যাবেন। তখনো ঝাপসা হয়নি চারপাশ। গ্রীষ্মের বিকেল কি সহজে ফুরোতে চায়! রোদ নেই, আলোও পুরোপুরি মুছে যায়নি।

ট্যাক্সিতে যেতে-যেতে তারাপদ বলল, “স্যার, কাল মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। যা গরম! পাখাটাও আর বাড়ানো যাচ্ছে না। জল খেয়ে শুলাম আবার। ঘুম আর আসে না। কৃষ্ণকান্তবাবুর ছেলের কথা ভাবছিলাম। মাথায় কিছু ঢুকছিল না। অদ্ভুত ব্যাপার!”

কিকিরা বললেন, “আমার অবস্থাও তোমার মতন। ভেবেই যাচ্ছি, কোনো আলো দেখতে পাচ্ছি না।”

“আমার বারবার একটা কথাই মনে হচ্ছে। বাবলু সকালে দৌড়তে যাওয়ার সময় কেন একটা অচল ঘড়ি সঙ্গে নেবে?”

কিকিরা ট্যাক্সির জানলা দিয়ে রাস্তাঘাট, মানুষজন দেখতে-দেখতে অন্যমনস্কভাবে বললেন, “নাও তো পারে।”

তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “বাবলুর বাবা তো বলছেন।”

“সেটা তাঁর অনুমান। কেউ কি দেখেছে?”

“না। উনি তা বললেন না।”

“তবে? এমন তো হতে পারে, আগের দিন বাবলু ঘড়িটা নিয়ে বেরিয়েছিল। তারপর হারিয়ে এসেছে। “

“হারিয়ে এসেছে! কী করে বুঝলেন?”

“বুঝিনি। কথার কথা বলছিলাম।…ধরো, এমন যদি হয় আগের দিন বাবলু ঘড়িটা নিয়ে তার বন্ধুবান্ধবদের দেখাতে গিয়েছিল। আগের দিন বলছি এইজন্যে যে, বাবলুর বোন সেদিনই তার দাদার কাছে ঘড়িটা দেখেছিল তার মানে এই নয় যে, বাবলুও আগেই আলমারি থেকে ঘড়িটা নেয়নি।

“বন্ধুবান্ধবদের ঘড়িটা দেখাতে যাবে কেন?”

“খেয়াল! শখ! বাড়িতে একটা পুরনো দেখার মতন জিনিস রয়েছে, বন্ধুদের দেখাতে হবে! এই আর কী! ছেলেমানুষি বলতে পারো, বলতে পারো সাধ। এমন তো আমাদের হয় সকলেরই। আমিই তো কোনো পুরনো জিনিসপত্র কিনে আনলে তোমাদের দেখাই।”

তারাপদ কথাটা অস্বীকার করতে পারল না। বলল, “ঘড়িটা বরাবর তাদের বাড়িতে আছে। হঠাৎ সেদিন বাবলুর বন্ধুদের ঘড়ি দেখাবার শখ চাগাল কেন?”

কিকিরা চুপ করে থাকলেন প্রথমটায়। তারপর বললেন, “একথার জবাব এখন আমি তোমাকে দিতে পারছি না, তারা। সবই অনুমান। হয়ত বাবলু সত্যি-সত্যিই ঘড়িটা নিয়ে তার বন্ধুদের দেখাতে যায়নি। হারিয়েও ফেলেনি।”

“তবে?”

“জানি না। আমার ধারণা, ওই ঘড়ির কোনো রহস্য আছে। থাকতে পারে। আর ওই লেখাটাও আমি বাতিল করতে পারছি না। অক্স, ফক্স আর বক্স। বাবলুর টেবিলের ওপর যেটা পাওয়া গিয়েছে।”

তারাপদ কোনো জবাব দিল না।

 আলো এবার আরও ময়লা হয়ে আসতে লাগল। আবছা অন্ধকার নেমে আসছে। আলো জ্বলে উঠেছিল রাস্তায়। আগেই। গাড়ির ভিড়, মানুষের ভিড়। হরেক রকম শব্দ, হল্লা, গাড়ির হর্ন, বাস, মিনিবাসের গর্জন, ধোঁয়া। কিকিরাদের ট্যাক্সিটা রাস্তা সে রাস্তা দিয়ে ল্যান্সডাউন রোড ধরে নিয়ে এগুতে লাগল।

দু’জনে খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর কিকিরা বললেন, “কৃষ্ণকান্তবাবুকে দেখে তোমার কেমন লাগল কাল?”

তারাপদ অন্যমনস্ক ছিল। খেয়াল হল কিকিরার কথায়।

 “কিছু বললেন?”

“কেমন লাগল কৃষ্ণকান্তবাবুকে?”

“ভালই। ভদ্রলোক খুবই আপসেট। ভয় পেয়ে গিয়েছেন। স্বাভাবিক। অত বড় ছেলে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেলে কে না ভয় পাবে! কার না মাথা খারাপ হবে!”

“মানুষটি কিছু লুকোচ্ছেন বলে মনে হল?”

তারাপদ কিকিরার দিকে তাকাল। “ও কথা কেন বলছেন?”

“মনে এল, বলছি।”

“আমি ওভাবে ভেবে দেখিনি। একজন বাবা তাঁর ছেলেকে পাচ্ছেন না–মানে ছেলে হঠাৎ নিখোঁজ হয়েছে–এই কথাটা আমাদের জানাতে এসেছেন। এর মধ্যে লুকোবার কী আছে?”

“তা ঠিক। …যাক যে, আগে তো ভদ্রলোকের বাড়ি চলো, তারপর দেখা যাবে।”

“আপনি স্যার দিন-দিন গোয়েন্দাই হয়ে যাচ্ছেন, তারাপদ একটু হেসে বলল, “সব ব্যাপারেই সন্দেহ!”

“না স্যার, আমি গোয়েন্দা নই। গোয়েন্দাদের তিনটে চোখ সামনে, একটা মাথার পেছনে। আমার মাত্র দুটো। ওনলি টু।”

“বাঃ! আর আমাদের চোখ–আমার আর চাঁদুর। এই চারটে আপনার সঙ্গে অ্যাড করুন।” তারাপদ মজার গলা করে বলল।

কিকিরা হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন, “তা বটে; আমার তবে ছ’টা চোখ। সিক্স আইজ!…কিন্তু কথাটা কী জানো তারাবাবু, আমাদের হল আনাড়ি-চোখ, ওদের হল নাড়ি-চোখ। “

“মানে, নাড়ি থেকে উঠে এসেছে বলছেন?” ঠাট্টার গলাতেই বলল তারাপদ।

“না-ড়ি! হ্যাঁ, তা বলতে পারো। ওদের পেশাদারি ব্যাপার ছাড়াও একটা বড় জিনিস আছে, তারাপদ। ইনটুইশান। ওটা ভেতরের ব্যাপার। কারও কারও থাকে। সকলের থাকে না।”

“আপনার আছে স্যার। আপনি কিকিরা দ্য গ্রেট।” তারাপদ হাসতে লাগল।

কিকিরা মাথা নাড়লেন। “না, কোথায় আর!”

.

কৃষ্ণকান্তর বাড়ি এসে পৌঁছতে আরও খানিকটা সময় লাগল। গাড়িঘোড়ার ভিড়, তার ওপর কিসের এক ব্যান্ড পার্টি চলেছে বাজনা বাজাতে বাজাতে, সামনে-পেছনে মাথায় আলো নিয়ে একদল লোক। কিসের বাদ্য কে জানে।

সন্ধের মুখে কিকিরারা লেক গার্ডেন্সে পৌঁছে গেলেন।

জায়গাটা কিকিরার তেমন চেনা নয়, তারাপদরও নয়। কিকিরা আগে দু-চারবার এদিকে এলেও তখন যা দেখেছিলেন এখন একেবারে আলাদা। বাড়িতে বাড়িতে ঠাসা। গিজগিজ করছে লোক। কত দোকান।

কৃষ্ণকান্ত আগেভাগে বুঝিয়ে না দিলে বাড়ি খুঁজে পেতে দেরি হত, অসুবিধেও হত। খুব একটা অসুবিধে কিকিরাদের হল না।

কৃষ্ণকান্ত অপেক্ষাই করছিলেন। বললেন, “আসুন।”

বাড়ি দোতলা। বাইরের দিকে গ্যারাজ। গেটের সামনে কৃষ্ণকান্ত। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।

নিচের তলায় বাঁ পাশে বোধ হয় কৃষ্ণকান্তের নিজস্ব দফতর। ডানদিকে বসার ঘর। বাইরের লোকজন এলে বসে। ঘরটি মোটামুটি বড়। সাজানো-গোছানো। সোফাসেটি, বইয়ের আলমারি, বাহারি আলো, সুন্দর পরদা, দেওয়াল র‍্যাকে শৌখিন জিনিসপত্র সাজানো মস্ত এক ফুলদানি। খুবই চমৎকার দেখতে। কয়েকটা ছবি দেওয়ালে।

কিকিরা আর তারাপদ ঘরটা দেখছিলেন।

 “বসুন!”

“হ্যাঁ, বসছি। বেশ বাড়ি করেছেন, মশাই!” কিকিরা বললেন।

“নিজে বিল্ডিং কনট্রাকটার। একটু দেখেশুনে করেছি” কৃষ্ণকান্ত বললেন বিনয় করে।

“কত দিন হল বাড়ির?”

“বছর দশেক।”

“নতুনই। হালে রং করিয়েছেন নাকি?”

“এই তো করলাম। মাসখানেক হল। ভেতরের খুচরো কাজ কিছু বাকি আছে। তবে ইচ্ছে করে আটকে রেখেছি। আর এখন তো বাড়ি নিয়ে ভাবতেই পারি না। কাজকর্মও নিজে দেখতে পারছি না ব্যবসার।”

কিকিরা বসে পড়েছিলেন। তারাপদও।

 “নতুন কোনো খবর পেলেন ছেলের?” কিকিরা বললেন।

 “না,” মাথা নাড়লেন কৃষ্ণকান্ত। “নতুন খবর কিছুই পাইনি। কাল রাত ন’টা নাগাদ একটা ফোন এসেছিল। বাবলুর এক বন্ধু করেছিল। আমার স্ত্রী প্রথমে ধরেছিলেন। পরে আমি কথা বললাম। বাবলুর বন্ধু বলল, ওদের এক কলেজের বন্ধু বাবলুর মতন একজনকে দুপুরবেলায় জিপিও-র সামনে দেখেছে।”

কিকিরা তাকিয়ে থাকলেন। তারাপদও কৃষ্ণকান্তকে দেখছিল।

কিকিরা বললেন, “কলেজের বন্ধু! বাবলুর মতন দেখতে! তাকে ধরতে পারল না?”

“না। শুনলাম, বাবলুর ও ক্লোজ ফ্রেন্ড নয়। চেনে। তবে বাবলুর কথাটা সে শুনেছে কমন ফ্রেন্ডদের কাছে। কাগজেও দেখেছে। আমরা বাবলুর ছবি দিয়ে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম।…তাও ছেলেটি ডাকার চেষ্টা করেছিল। যাকে ডেকেছিল সে শুনতে পায়নি হয়ত। চলন্ত মিনিবাসে লাফিয়ে উঠে চলে গেল।”

তারাপদ কী ভেবে বলল, “যাক, একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। বাবলুর কথা অনেকেই জেনে গিয়েছে। হয়ত ওর কোনো ক্ষতি হয়নি।”

“দেখুন ভাই, আজকাল যা অবস্থা তাতে করে কার কখন কী ঘটে, এখানে বসে বোঝা মুশকিল। বাবলুর কোনো ক্ষতি হবে–আমিও ভাবতে পারি না। তার স্বভাব এত ভাল, সকলের সঙ্গেই ভাল সম্পর্ক ছেলেটার। পরোপকারী, ভদ্র ছেলে! কোনো সাতে পাঁচে থাকে না। কে তার ক্ষতি করবে, কেনই বা করবে! না, সেদিক থেকে আমি তার ক্ষতি হওয়ার কথা এখনো ভাবিনি। তবে হ্যাঁ, কোনো অ্যাকসিডেন্ট যদি হয়–সেটা তো আমাদের হাতের মুঠোয় নয়। তা আজ পর্যন্ত থানা পুলিশ, হাসপাতাল–কেউ আমাদের জানায়নি যে বাবলুর মতন কোনো ছেলেকেইয়ে–মানে খারাপ অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে।”

কিকিরা নিজের মাথার চুলে হাত বোলাতে-বোলাতে কিছু ভাবছিলেন। শান্তভাবে বললেন, “যে-ছেলেটি বাবলুর মতন একজনকে দেখেছে বলছে, সে ভুল দেখেনি তত?”

কৃষ্ণকান্ত যেন দ্বিধায় পড়লেন। “তা আমি কেমন করে বলব।”

“না, আমি বলছিলাম–অনেক সময় আমাদের চোখের ভুল হয়।”

“তা হয়।”

“যাক, এ নিয়ে পরে ভাবা যাবে,” কিকিরা বললেন তার পরই কথা পালটালেন, “কৃষ্ণকান্তবাবু, আমি একবার বাবলুর ঘরটা দেখব। তার বোন আর মায়ের সঙ্গে কথা বলব। বাড়ির কাজের লোকজনের সঙ্গেও। তার আগে একটা কথা বলি, কিছু মনে করবেন না।”

“বলুন?”

“আপনাদের পুরনো পৈতৃক বাড়ি চারু অ্যাভিনিউতে বলেছিলেন। সেখানে আপনার দাদা থাকেন সপরিবারে। দাদার সঙ্গে আপনাদের

“মাপ করবেন। এ ব্যাপারে দাদাকে না টানাই ভাল। আমার দাদা সরল মানুষ। ধর্মকর্ম নিয়ে থাকেন। চাকরিবাকরি ভালই করতেন। রিটায়ার করছেন বছর দুই হল। দাদার একবার হার্ট অ্যাটাক হয়। সিরিয়াসই হয়েছিল। ওই অ্যাটাকের পর দাদা খানিকটা আগে-আগেই চাকরি থেকে রিটায়ার করলেন।”

“আপনাদের সম্পর্ক তা হলে ভাল।”

“খুবই ভাল। চারু অ্যাভিনিউ এখান থেকে আর কতটা! ভেতর দিয়ে রাস্তা আছে। রিকশা করেই যাওয়া-আসা যায়। এবাড়ি ওবাড়িতে সবসময়েই খোঁজখবর চলে।”

“বাবলুর কথা দাদা নিশ্চয় শুনেছেন?”

“শুনবেন না, কী বলছেন! ভীষণ ভেঙে পড়েছেন। বাবলুকে দাদা একসময় কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন। তখন আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি।”

“এ তো সুখের কথা। ওঁর ছেলেমেয়ে?”

“বাবলুর বড় একজন, বাবলুর সমবয়েসী একজন। বাবলুর ভাই আর বন্ধু। সে তো আজ কদিন বাইরে বাইরে টো-টো করে বেড়াচ্ছে বাবলুর খোঁজখবর করতে।”

“কী নাম?”

“আমরা কাবলু বলে ডাকি। ভাল নাম শরৎ। বাবলুর ভাল নাম রজত। ওই দুই ভাইয়ের নাম মিলিয়ে রাখা।”

বাড়ির ভেতর থেকে চা এল। চা আর মিষ্টি।

“নিন, একটু চা খান, কৃষ্ণকান্ত সৌজন্যবশে নিজেই চা এগিয়ে দিলেন কিকিরাকে।

চা খেতে-খেতে কিকিরা বললেন, “আপনার কাছ থেকে আমি কিছু কিছু ঠিকানা নেব। বাবলুর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের। সে যাদের সঙ্গে নাটক করত সেই দলের। আপনার দাদার সঙ্গেও একবার দেখা করতে চাই। আর আপনার ভাইপো শরৎকে আমার দরকার। কথা বলব।”

“কাবলু–মানে শরৎকে আপনার বাড়িতেই পাঠিয়ে দিতে পারি।”

“ভালই তো। দেবেন।”

 চা-খাওয়া শেষ হলে কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন। “চলুন, বাবলুর ঘরটা একবার দেখি।”

“চলুন।”

 দোতলায় বাবলুর ঘর। একেবারে একপাশে।

তারাপদ লক্ষ করলে কৃষ্ণকান্তের বাড়ির সবই তকতকে। প্রয়োজন বুঝে এবং রুচিমতন ঘরদোর করা হয়েছে। টাকা আছে বলে, লোক-দেখানো চটক বা বাহুল্য নেই। ভালই লাগে। নতুন করে রং হয়েছে বলে আরও ঝকঝকে দেখাচ্ছিল।

বাবলুর শোওয়ার ঘরেই তার পড়াশোনার ব্যবস্থা। খাট, আলমারি, টেবিল, বুকর্যাক ছাড়াও এক্সারসাইজের কয়েকটা খুচরো জিনিস রাখা আছে একপাশে। গোটা দুয়েক স্টিকার দেওয়ালে লটকানো। দুজনেই খেলোয়াড়। সুনীল গাওস্কর আর মারাদোনা। বাবলু ক্রিকেট, ফুটবল দুইয়েরই অনুরাগী বোধ হয়। আলনার তলায় জুতোর বাক্স, গামবুট।

কিকিরা ঘরের চারপাশ দেখতে-দেখতে বললেন, “এই টেবিলের ওপর আপনি ওই কাগজের টুকরোটা পেয়েছেন? ওই যাতে ফক্স, অক্স আর বক্স লেখা ছিল?”

“হ্যাঁ। টেবিলের ওপর একটা কাগজে ওগুলো লেখা ছিল। রঙিন লেখা। ফেল্ট পেনে বোধ হয়।”

“কীভাবে ছিল?”

“টেবিলের মাঝখানে। ওর পকেট ক্যালকুলেটার চাপা দেওয়া।”

“ও যেন কী পড়ে?”

“কমার্স। অ্যাকাউটেন্সি…”

“আপনি কি বলতে পারেন, কাগজে ফক্স, অক্স, বক্স লেখার কী মানে?”

“না,” মাথা নাড়লেন কৃষ্ণকান্ত।“

“এরকম অদ্ভুত নামে কাউকে কি আপনারা ডাকতেন ঠাট্টা করে?”

“মানে?”

“মা-নে! মানে যেমন ধরুন, আমরা ঠাট্টা করে খুব মোটাসোটা কাউকে “পিপে বলি, খায় দায় চরে বেড়ায় কাউকে বলি ষাঁড়’..এইরকম আর কী!”

“না, আমি জানি না। আমার তো মনে পড়ছে না।”

কিকিরা কথা বলতে বলতে ঘরের এপাশে-ওপাশে সরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন। জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাচ্ছিলেন। ডানপাশে এক দরজা, খানিকটা সরুমতন। খোলাই ছিল। দরজা দিয়ে বাইরের ছোট ব্যালকনি চোখে পড়ছিল। বাড়ির পিছন দিক ওপাশটা।

কিকিরা ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন। ফিরেও এলেন সামান্য পরে।

“পেছনে এখনো ভারা বাঁধা আছে দেখছি।”

“হ্যাঁ, দু-চারটে বাঁশ বাঁধা হয়েছিল আবার। রং কমবেশি করে ফেলেছিল জায়গাটায়। ড্যাম্পের ছাপের মতন দাগ দেখাচ্ছিল। রং মিস্ত্রিদের কাণ্ড। নতুন করে মিলিয়ে দিতে হয়েছে।”

“ও! আপনার মেয়েকে একবার ডাকবেন?”

“ডাকছি। কাছেই আছে।” কৃষ্ণকান্ত বাইরে গেলেন মেয়েকে ডেকে আনতে।

তারাপদ বলল, “বাড়ির পেছনে কী দেখলেন, কিকিরা?”

“পেছনেও বাড়ি। তবে এবাড়ির কম্পাউন্ড ওয়ালের গায়ে ওবাডির ড্রাইভওয়ে আর গ্যারাজ। রং মিস্ত্রিদের ভারার বাঁশ আর পাশের বাড়ির গ্যারাজের ছাদের মধ্যে তফাতটা বেশি নয়।”

তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “আপনি কি বলতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছি না। পাশের বাড়ির গ্যারাজের মাথায় চড়ে এ বাড়ির ছারার বাঁশ বেয়ে না হয়। চোর আসতে পারে। কিন্তু এটা তো চুরির কেস নয় স্যার।”

“তাই ভাবছি।…দাও তো একটা সিগারেট দাও।”

সিগারেট ধরানো শেষ হয়নি কিকিরার, কৃষ্ণকান্ত একটি মেয়েকে সঙ্গে করে ঘরে এলেন। “আমার মেয়ে খুকু।”

কিকিরা দেখলেন মেয়েটিকে। গোলগাল গড়ন, ফরসা রং গায়ের, বছর যোলা-সতেরো বয়েস। পরনে সালোয়ার কামিজ। মোটা বিনুনি ঝুলছে পিঠে। মেয়েটিকে দেখেই বোঝা গেল, খানিকটা আগেও সে কাঁদছিল। হয়ত দাদার কথা মনে হচ্ছিল বলেই।

কিকিরা সহজভাবে বললেন, “তোমার নাম খুকু! বাঃ। ভাল নাম কী তোমার?”

ক’ মুহূর্ত চুপ করে খুকু বলল, “রমলা।”

“তুমি এখন কী পড়ছ?”

“হায়ার সেকেন্ডারি দেব।”

“ভেরি গুড। …আচ্ছা, আমি তোমায় ক’টা কথা জিজ্ঞেস করব। একটু ভেবেচিন্তে জবাব দেবে। কেমন?”

খুকু মাথা নাড়ল।

“তোমার দাদার কাছে তুমি ঘড়িটা কবে দেখেছিলে?”

“আগের দিন। দাদাকে যেদিন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না তার আগের দিন।”

“কোথায় দেখেছিলে? ড্রয়ারে?”

“না, দাদার হাতে। দাদা ওটা দেখছিল।”

“সেটা কখন? সকালে, না বিকেলে? সন্ধেবেলায়?”

“বিকেলে।”

“ও! তোমার দাদা তখন বাড়িতেই ছিল?”

“বেরিয়ে যাওয়ার আগে। বিকেলে দাদা বেরিয়ে যায়। খেলাধুলো করে, আড্ডা মারে।”

“দাদার সঙ্গে তোমার ঝগড়া হয়েছিল ঘড়ি নিয়ে?”

“হ্যাঁ। এমনি ঝগড়া।”

“কেন?”

“সোনার ঘড়িটা বার করে খেলা করছিল বলে। বারণ করেছিলাম।”

“ঠিকই তো করেছিলে! দাদা তোমার কথা শোনেনি?”

“না। উলটে আমার মাথায় চাঁটি মেরে বলল, চুপ কর, নিজের চরকায় তেল দে। যা, তোর গানের ক্লাসে যা, পাকামি করতে হবে না।”

কিকিরা মুচকি হাসলেন, “দাদারা ওইরকমই হয়।…তা সেদিনের পরে আর তুমি দাদার কাছে ঘড়ি দেখোনি?”

“দাদার সঙ্গে আর আমার কথাই হয়নি। আমার খুব রাগ হয়েছিল।”

“তা তো হবেই।…আচ্ছা, একটা কথা মনে করে বলো তো! ঘড়িটা তুমি দেখেছ বাবলু নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন।…তার আগে আর তার কাছে দেখোনি?”

“কই! না!”

“তোমার দাদা ঘড়ি নিয়ে আর কিছু বলেনি তোমায়?”

“না।” বলেই মাথা নাড়ল খুকু। “একবার শুধু বলেছিল, মা বাবাকে লাগাবি না। লাগালে তোর ঠ্যাং ভেঙে দেব।”

 কিকিরা হাসলেন। তারাপদও মুচকি হাসল।

সামান্য পরে কিকিরা বললেন, “আচ্ছা খুকু, তুমি কি বলতে পারো বাবলু একটা কাগজে কেন অক্স, ফক্স আর বক্স লিখে টেবিলের ওপর রেখেছিল?”

খুকু মাথা নাড়ল। সে জানে না।

ও কিকিরা আর দাঁড় করিয়ে রাখলেন না খুকুকে। যেতে বললেন।

কৃষ্ণকান্ত নিজেই বললেন, “আপনি কি খুকুর মায়ের সঙ্গে কথা বলবেন? আজ তাঁর শরীর একেবারেই ভাল নেই। প্রেশার খুব বেড়ে গিয়েছে। শুয়ে আছেন।”

“থাক, তাঁকে আর কষ্ট দেব না। চলুন, আমরা নিচে যাই। আমি ওর সঙ্গে দুটো কথা বলব। কী নাম যেন ওর, যে সকালে সদর খুলে দিয়েছিল বাবলুকে?”

“সিধু। সিদ্ধেশ্বর। আমাদের বাড়িতেই থাকে। সাত-আট বছর হয়ে গেল।”

“চলুন, নিচেই যাই।”

 নিচে নেমে এসে আর বসার ঘরে ঢুকলেন না কিকিরা। বাড়ির সদরে গিয়ে দাঁড়ালেন।

তারাপদ সদর দেখছিল। আলাদা কোনো ব্যবস্থা নয়, প্রায় সব বাড়িতেই যেমন দেখা যায়, কোলাপসিবল গেট, ভারি দরজা। দরজার ভেতর দিকে ওপরে-নিচে ছিটকিনি, মাঝ-মধ্যিখানে লক। আগে সদর খুলতে হয়, তারপর কোলাপসিবল গেট। গেটের পর কয়েক ফুট প্যাসেজ, তারপর রাস্তা। গাড়ি রাখার গ্যারাজ একপাশে। রাস্তা ঘেঁষেই।

সিদ্ধেশ্বরকে ডাকা হল।

লোকটি সামনে আসতেই কিকিরা বুঝতে পারলেন, নিরীহ ধরনের মানুষ সিদ্ধেশ্বর। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়েস হয়ত। রোগাটে গড়ন। মুখে কালচে দাগ। দাড়ি প্রায় নেই, সামান্য গোঁফ চোখে পড়ে। চোখ দুটি বড়-বড়।

“তোমার নাম সিদ্ধেশ্বর?” কিকিরা বললেন।

 “হ্যাঁ বাবু। সিদ্ধেশ্বর দাস।”

“তুমি সেদিন দাদাবাবুকে দরজা খুলে দিয়েছিলে?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। রোজই আমি সদর খুলি। বন্ধও করি রাতের বেলায়। আমার কাছেই চাবি থাকে।

“সকালে ক’টা নাগদ দরজা খুলে দিলে?”

“সময় বলতে পারব না। রোজ যেমন খুলি। ভোরবেলায়।”

“দাদাবাবু কী পরে বেরিয়ে গেলেন?”

“রোজই যা পরে যায়, সেই জামা।”

“হাতে কিছু ছিল?”

“না। দেখিনি।”

তারাপদ হঠাৎ বলল, “রাস্তায় তখন লোক ছিল?”

“আজ্ঞে দু-একজন ছিল বইকি! এই পাড়ার অনেকেই ভোরে বেড়াতে যান।”

“যারা ছিল–দু-একজন–তাদের তুমি চেনো?”

“চিনি। এগারো নম্বর বাড়ির বাবু ছিলেন। পালবাবু ছিলেন?”

 কিকিরা বললেন, “নতুন কাউকে দেখোনি?”

“ন-তু-ন!” সিদ্ধেশ্বর যেন ভাবছিল, চেষ্টা করছিল মনে করার। মাথা নেড়ে না বলতে গিয়েও হঠাৎ তার কিছু মনে পড়ে গেল। বলল, “আমি লোহার ফটক খুলে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দাদা বেরিয়ে গেল। খানিকটা তফাতে এক বাৰু হাঁটছিলেন। তাঁর সঙ্গে একটা কুকুর ছিল। বাঘের মতন কুকুর।”

কৃষ্ণকান্ত বললেন, “রায়মশাই, এই পাড়ার অনেক বাড়িতেই কুকুর আছে। সকালে কুকুর নিয়ে বেড়াতে বেরুনোর লোকও আছে।”

সিদ্ধেশ্বর মাথা নাড়ল। “না বাবু, এই কুকুরটা যেন বাঘ। আগে আমার চোখে পড়েনি।”

“কুকুরের মালিক ভদ্রলোককে তুমি দেখেছ? চিনতে পারলে?”

“তফাত থেকে দেখেছি। চিনতে পারিনি।”

“আন্দাজ বয়েস?”

“ছোকরা নয়। খাটো প্যান্ট আর মোটা গেঞ্জি পরা। এক হাতে লাঠি। অন্য হাতে কুকুরটার শিকলি।”

“ভদ্রলোককে তুমি চিনতে পারোনি বলছ। কুকুরটাও তুমি আগে কোনোদিন দেখোনি?”

“আজ্ঞে।”

 কিকিরা কৃষ্ণকান্তের দিকে তাকলেন। “আপনাদের পাড়ায় নতুন কেউ এসেছে?”

“আসতে পারে। আসে মাঝে-মাঝে। তা ছাড়া নতুন ফ্ল্যাট হচ্ছে, বাড়িও দু-একটা হচ্ছে ওপাশে..”

তারাপদ কিকিরাকে বলল, “এ আর কঠিন কী! খোঁজ নিলেই কুকুর আর ভদ্রলোকের খবর বেরিয়ে পড়বে। কিন্তু…”

কিকিরা তারাপদকে কথা শেষ করতে দিলেন না। “চলল, যাওয়া যাক।”

 কৃষ্ণকান্ত বললেন, “আমার গাড়ি আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসুক।”

 কিকিরা আপত্তি করলেন না।

.

০৩.

দু-তিনটে দিন কেটে গেল।

সেদিন সকাল থেকেই আকাশ খানিকটা ঘোলাটে দেখাচ্ছিল। গুমোট দিন। বিকেলে মেঘলা হল। তারপর দমকা ঝড় উঠল। বৃষ্টিও হল একপশলা। আধ ঘন্টার মতন বৃষ্টি, তবে জোরেই নেমেছিল। সারাদিন গুমোটের পর এই বৃষ্টি যেন অনেক আরাম এনে দিল শহুরে মানুষজনকে।

তারাপদ আর চন্দন বৃষ্টি থামার পরই কিকিরার কাছে হাজির।

 কিকিরা তাঁর বসার ঘরে–যেটা জাদুঘরের চেয়ে রহস্যময়বাতি জ্বালিয়ে বসে-বসে একটা চটি মতন বই বা ওই ধরনের কিছু দেখছিলেন।

চন্দনই কথা বলল প্রথমে, “আর খানিকক্ষণ হলে পারত; কী বলুন, স্যার! যা অবস্থা যাচ্ছিল। মরে যাচ্ছিলাম।..কলকাতার ক্লাইমেট নাকি পালটে যাচ্ছে, বুঝলেন। সেদিন কাগজে একটা লেখা দেখছিলাম, তাতে লিখেছে–এই শহরে শীত কমছে, গরম বাড়ছে। প্রতি দশ বছরের হিসেবে কমপক্ষে দেড় থেকে দু ডিগ্রি।”

তারাপদ মজা করে বলল, “লোক বাড়ছে, ঘরবাড়ি বাড়ছে, ট্রামবাস গাড়ি বাড়ছে–গরম তত বাড়বেই।”

চন্দন বসতে বসতে কিকিরাকে বলল, “কী পড়ছেন?”

 কিকিরা বললেন, “ক্যাটালগ।”

“ক্যাটালগ? কিসের ক্যাটালগ?”

“ঘড়ির।”

চন্দনের বিশ্বাস হল না। কিকিরা নিশ্চয় ঠাট্টা করছেন। বলল, “হঠাৎ ঘড়ির ক্যাটালগ কেন?”

কিকিরা হাতের বইটা কোলের ওপর রাখলেন। বললেন, “চোরবাজারের সুরবাবুর কাছে পাওয়া গেল। ইউ নো সুরবাবু?”

“না স্যার, চোরবাজারই চিনি না তত সুরবাবু! চোরবাজারে আপনার কত যে বন্ধু?”

“চোরে-চোরে হাফ-ব্রাদার। আমি কখনো কখনো চোরবাজারে মার্কেটিং করতে গেলে দুই ভাইয়ে মিলে চা-টা খাই, গল্পগুজব হয়। সুররা ভেরি ওল্ড কনসার্ন। ওরা পুরনো শখের জিনিস বিক্রি করে। বনেদি বড়লোক–ওয়ান্স আ আপঅন এ টাইমে রাজাগজা ছিল–এখন শরিকি-ভাঙাবাড়ির বংশধর, টানাটানির মধ্যে থাকে–দু-চারশো টাকায় ভাল-ভাল জিনিস বেচে দেয়। কোনো-কোনোটা আবার হাতফেরতা হয়ে আসে। সেকালের কাচের জিনিস, ঝাড় থেকে সেজবাতি, আসলি বেলজিয়াম মিরার, বিউটিফুল ফুলদানি, ছোট-ছোট কার্পেট, রুপোর গড়গড়া, ছবির ইংলিশ ফ্রেম- কতরকম জিনিস। চলো একদিন, দেখাব।”

তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “সে-না হয় বুঝলাম। কিন্তু ঘড়ির ক্যাটালগ?”

“ওই তো! ওটা তো তোমরা বুঝবে না।” কিকিরা পকেট হাতড়ে চুরুট বার করতে করতে বললেন, “সুরদের কাছে দু-চারটে পুরনো মডেলের ঘড়িও আছে। আগে আরও ছিল, এখন নেই। দু-একটা মাত্র। পুরনো শৌখিন জিনিস কেনার লোক এখন কমে গিয়েছে তারাবাবু। লোকে আর পয়সা খরচ করে ওসব কিনতে চায় না।”

“ভালই করে। …তা আপনি”

“আমি সুরকে বললাম, একটা সোনার পকেট ঘড়ির কথা শুনেছি। তার মধ্যে কম্পাস আছে। সে এই ধরনের ঘড়ির কথা আগে শুনেছে কিনা? বা, কোথাও যদি দেখে থাকে?”

তারাপদ এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পারল। চন্দনের দিকে তাকাল। চন্দনও এবার আন্দাজ করতে পেরেছে।

চন্দন হঠাৎ বলল, “কিকিরা, কাগজে মাঝে-মাঝে বিজ্ঞাপন দেখি–অমুক ঘড়ি তমুক ঘড়ির অত নম্বর মডেল যদি কারুর কাছে থাকে তবে যেন..”

 “হ্যাঁ, কাগজে বিজ্ঞাপন থাকে। এখনো থাকে।…সেটা আলাদা। তা সূর্ণ। বলল, ওরা বেশিরভাগই আগে যা বিক্রি করেছে সেগুলো বড় ঘড়ি। হয় ওয়াল ক্লক, না হয় টেবল ক্লক–মানে ছোট দেরাজ, কিংবা ভারি টেবিলের ওপর রাখার মতন ঘড়ি। রিস্ট ওয়াজও এক-আধটা বিক্রি করেছে অবশ্য, তবে সেগুলো সোনাটোনার নয়।”

তারাপদ বলল, “বুঝেছি। আপনি বাবলুর ঘড়িটার ব্যাপারে জানতে গিয়েছিলেন।”

মাথা নাড়লেন কিকিরা। চুরুট ধরালেন। “তোমার মাথা এতক্ষণে প্লে করেছে।”

চন্দন হেসে ফেলল। “তারার মাথা লেটে প্লে করে।

তারা গায়ে মাখল না কথা। বলল, “আপনার ক্যাটালগ প্লে করল?”

“না। এটা পুরনো ঠিকই। অনেক খুঁজেপেতে হাতড়ে বার করল সুর। কাগজগুলো একেবারে লাল হয়ে গিয়েছে। অনেক পুরনো ঘড়ির নাম দেখলাম। ডেসক্রিপশানও রয়েছে। কিন্তু সোনার ঘড়ি যা রয়েছে সবই ফোরটিন ক্যারেট। কোথাও দেখলাম না, সোনার কাঁটা আর কম্পাসের কথা আছে।”

চন্দন বলল, “স্যার, এই ক্যাটালগ কিসের কাজে লাগে?”

“পুরনো ওয়াচ ডিলার্সদের কাজে লাগত একসময়। এখন লাগে বলে শুনিনি।”

“তা এর জন্য ক্যাটালগ ছাপানো?” চন্দন বলল।

মাথা হেলিয়ে কিকিরা বললেন, “হ্যাঁ। ব্যাপারটা কী জানো? আগেকার দিনে যারা পুরনো শৌখিন জিনিস বিক্রি করত, তাদের একটা সার্কেল ছিল। কার কাছে কী আছে জানাবার জন্যে ক্যাটালগ ছেপে নিজেদের মধ্যে বিলি করত। সারা দেশ জুড়ে এই ব্যবসা চলত। দিল্লির ডিলার জানতে পারত কলকাতায় কার কাছে কোন জিনিসটা পাওয়া যাবে, কলকাতার ডিলার জানতে পারত জয়পুরের ডিলারের কাছে কী পাওয়া যাবে। তারপর কাস্টমার জুটলে লেনদেন হত। এখন আর এ-সব বড় পাবে না। ব্যবসাই উঠে গেল, তা ক্যাটালগ!”

তারাপদ জায়গা ছেড়ে উঠে এসে হাত বাড়াল। “দিন তো একবার, চেহারাটা দেখি।”

কিকিরা ক্যাটালগের চটি বইটা দিলেন।

 তারাপদ বইটা নিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে পাতা ওলটাতে লাগল।

চন্দন বলল, “নতুন কোনো খবর পেলেন?”

“খবর তো তোমাদের দেওয়ার কথা।”

চন্দন বলল, “আমি একেবারেই সময় পাইনি, স্যার। কটা দিন আমার ঘাড়ে চাপ পড়েছে। আমার এক মামাতো ভাই এসেছিল। তাকে নিয়ে খানিকটা ব্যস্ত ছিলাম। তারপর আমাকে কলকাতার অন্য হাসপাতালে ট্রান্সফার করে দেবে বলছিল। রাইটার্সে ধরনা মারলাম গতকাল।..তবে হ্যাঁ, তারা আমায় বলেছিল –আপনি বলেছেন, লেকের আশেপাশে আমার কোনো বন্ধু আছে কিনা খোঁজ করতে। সেটা করেছি। লেক গার্ডেন্সেই আমার এক পুরনো বন্ধু আছে। সে এখন চোখের ডাক্তারি করছে। আই স্পেশালিস্ট। বিদ্যুৎ নাম। তার ঠিকানা নিয়ে ফোন করেছিলাম।”

“ কিছু বলেছ?”

“না। এমনি একদিন যাব বলেছি।”

“কালই যাও।”

চন্দন বলল, “একলা?”

“হ্যাঁ; একলাই যাবে।”

“গিয়ে কী করব?”

“কৃষ্ণকান্ত দত্তরায় মশাই আর তাঁর ফ্যামিলি সম্পর্কে খোঁজখবর করবে।”

“আপনি কি দত্তরায় সম্পর্কে…?”

“না, তা নয়। তবু অন্যদের কাছ থেকে খোঁজখবর করা ভাল। আমরা যা শুনেছি সবই একতরফা, কৃষ্ণকান্ত যা বলেছেন। তাঁর বলার বাইরেও তো কিছু থাকতে পারে।”

“আর কিছু?”

“হ্যাঁ। বাবলু সম্পর্কেও জানবে, যতটা পারা যায়।” কিকিরা একটু থেমে আবার বললেন, “আরও একটা কাজ তোমার থাকল। বাবলু যেদিন হারিয়ে যায় সেদিন ভোরবেলায় সে যখন দৌড়ে বেড়াচ্ছিল, তখন পাড়াকে-কে তাকে দেখেছে? কোথায় দেখেছে? কী অবস্থায় দেখেছে? মানে, সে একাই ছিল, না, তার সঙ্গেও কেউ দৌড়চ্ছিল? সে দাঁড়িয়ে পড়ে কারও সঙ্গে কথা বলছিল কিনা! আশেপাশে রাস্তায় লোকজন ছিল কিনা! মানে, যা-যা সম্ভব সবই জানার চেষ্টা করবে।”

চন্দন মাথা নাড়ল। বুঝতে পেরেছে। বলল, “আপনি যে রকম ফিরিস্তি দিচ্ছেন–একদিনে কি এত কাজ করা যাবে।”

“একদিনে হবে কেন? দু-তিনদিন যদি লাগে–তোমাকে ঘুরে-ফিরে এই কাজটা করতে হবে। ইট ইজ মোস্ট ইমপর্টেন্ট।”

“এত সময় পাব কেমন করে স্যার?…ভদ্রলোক আপনাকে পাড়ার লোকের কথা বলেননি?”

“বলেছেন দু-চারজনের কথা। আমি ওঁকে বলেছিলাম–আপনি আমাদের নামগুলো দিন,যারা বাবলুকে সেদিন সকালে দেখেছে। তা ছাড়া ওর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ওর থিয়েটারের দলের নাম-ঠিকানা দিন।”

“দিয়েছেন?”

“হ্যাঁ, কাল বাবলুর জেঠতুতো ভাই কাবলু এসেছিল। সে একটা লিস্টি দিয়ে গিয়েছে।” বলতে বলতে কিকিরা তাঁর ছোট টেবিলটা দেখালেন। “ওখানে ড্রয়ারের মধ্যে কাগজটা আছে। নিয়ে যেয়ো।”

বগলা চা নিয়ে এল।

চা এগিয়ে দিয়ে চলে গেল বগলা। জানলা দিয়ে মাঝে-মাঝে দু-এক দমক ভিজে বাতাস আসছিল। পাখা চলছে।

চা খেতে-খেতে তারাপদ হঠাৎ বলল, “কিকিরা স্যার, আপনার এই ক্যাটালগের যা বহর! যেমন ছাপা, তেমনই কাগজ। একেবারে রদ্দি।’

“ওগুলো ওইকমই হয়,” কিকিরা বললেন, “বাজারে বিলি করার জন্যে নয়, নিজেদের জন্যে…”

“প্রাইভেট ইউজ।”

“হ্যাঁ।“

“এই ক্যাটালগের শেষের দিকে একটা রাবার স্ট্যাম্পের ছাপ আছে দেখেছেন? খুব অস্পষ্ট। ভাল করে কালি লাগিয়ে ছাপ মারা হয়নি।”

“দেখেছি।”

“এর মানে কী স্যার? রাবার স্ট্যাম্পের ছাপে ইংরেজিতে লেখা BoxY & Co, বসিটা কী?” তারাপদ বলল, “ধর্মতলা স্ট্রিটের ঠিকানা।”

কিকিরা চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “মানে বকসি কোম্পানি।”

“বকসি কোম্পানি। বাঙালি! তা হলে এরকম অদ্ভুত বানান BOXY কেন?”

কিকিরা মুচকি হাসলেন। “সেকালের সাহেবি কেতা। তখনকার দিনে কেউ-কেউ এরকম করত, সাদামাটা নামধামকে একটু ইংলিশ কায়দায় সাজাত। কেন, তুমি বোনার্জি শোনননি? ব্যানার্জি হত বোনার্জি, প্রাল হত পল্। দাঁ হত ডন, পালিত হত পলিট।”

তারাপদ কপালে হাত দিয়ে বলল, “সাংঘাতিক। বকসি হল BOXY! ভাবা যায় না।’

“তারাবাবু, একে বলে রেওয়াজ। সেকালের কোনো-কোনো ব্যবসাদার এরকম করত, কোম্পানির কদর বাড়াবার জন্যে। বকসি কোম্পানি ছিল পুরনো ওয়াচ ডিলার।”

“তাই নাকি? কে বলল?”

“সুরবাবু। সুরবাবুর বাবার আমলে ধর্মতলা স্ট্রিটে বকসি কোম্পানির দোকান ছিল”

“আচ্ছা।“

“আচ্ছা নয়। ধর্মতলা স্ট্রিট তখন আজকের দিনের ধর্মতলা নয়। তখন ওটা সাহেব-মেমসাহেবদের মার্কেটিং করার জায়গা। বড় বড় নামকরা দোকান ছিল। বুঝলে।”

“বুঝলাম। অবশ্য স্যার, আমার তো মনে হয় না, আপনি সেই ওল্ড ধর্মতলা দেখেছেন?” ঠাট্টা করেই বলল তারাপদ।

“আমি কোথ থেকে দেখব হে! শ’বছর আগের কথা। তা ছাড়া আমি বাপু বাইরের লোক। আমার বাপ-ঠাকুদাও দেখেননি।“

“গল্প শুনেছেন?”

“তা শুনেছি।…যাক সেকথা। ওই BOXY থেকে একটা ধোঁকা পাগছে।”

“মানে?”

“বাবলুর ফক্স, অক্স, বক্স-এর বক্সের সঙ্গে এই BOXY-র কোনো সম্পর্ক আছে কিনা কে জানে!”

তারাপদ চমকে উঠল। চন্দনও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।

 কিকিরা চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বললেন, “ক্যাটালগটা সুরবাবুদের নয়। সুরবাবুদের ব্যবসা পৈতৃক হলেও তাঁরা ওয়াচ ডিলার নন। ক্যাটালগটা বকসি কোম্পানির কাছ থেকে তাঁদের হাতে এসেছিল। বোধ হয় সুরবাবুর বাবার আমলে। দোকানে পড়ে ছিল ধুলোর মধ্যে।”

“বকসি কোম্পানি এখন নেই?”

“না। কোনকালে উঠে গিয়েছে।”

“তা হলে?”

“বকসিদের মেজো ছেলে, এন্টালি বাজারের দিকে থাকেন। সুরবাবুর চেনাজানা। ভদ্রলোকের বয়েস ষাট বাষট্টি। এখন ওঁদের ব্যবসা ইলেকট্রিকাল গুড়-এর।”

“আপনি স্যার সব খবরই নিয়ে ফেলেছেন?”

“সুরবাবুর সঙ্গে গল্প করতে করতে নিয়ে ফেললাম আসলে ওই রাবার স্ট্যাম্পের ছাপে BOXY না দেখলে হয়ত অত খোঁজ নিতাম না। কী জানি, ওটা আমারও চোখে লেগে গেল। খোঁজ নিলাম।”

চন্দন সিগারেট বার করল। মাথা গোলমাল হয়ে যাচ্ছি। দু-চার টান ধোঁয়া দরকার। বলল, “আপনি কীভাবে এগুতে চাইছেন, আমি বুঝতে পারছি না, স্যার। আমাদের কাজ বাবলুর খোঁজ করা, ঘড়ি আর ফক্স, বক্স নিয়ে আমরা কী করব?”

কিকিরা বললেন, “ওই ঘড়ির সঙ্গে বাবলুর নিরুদ্দেশ হওয়ার সম্পর্ক আছে। আমার তাই মনে হয়। “

তারাপদ বলল, “কিন্তু কিকিরা, ঘড়ি নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতে গিয়ে সময় নষ্ট করলে যদি বাবলুর কিছু হয়ে যায়। অবশ্য তার যে কিছু হয়নি এতদিনে–তাই বা আমরা জানছি কেমন করে?”

কিকিরা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। পরে বললেন, “ভগবান করুন, ছেলেটার কিছু না হয়। তবে তারা, তেমন কিছু খারাপ হলে এতদিনে জানা যেত। “

“স্যার, এটা কলকাতা শহর। এখানে সব কিছু জানার উপায় থাকে না।”

চন্দন বলল, “বাবলুকে খুঁজে বার করাই আমাদের আগে দরকার।”

কিকিরা কোনো জবাব দিলেন না।

খানিকটা সময় চুপচাপ কাটল।

তারাপদর খেয়াল হল হঠাৎ। বলল, “কৃষ্ণকান্তবাবুর সঙ্গে আপনার কথাবার্তা হয়নি আর?”

“হয়েছে। গত পরশু এসেছিলেন। কাল ওঁকে ফোন করেছিলাম বাড়িতে।”

“নতুন কিছু জানতে পারলেন?”

“ওই ভদ্রলোক কুকুর নিয়ে সেদিন সকালে যিনি বেড়াতে বেরিয়েছিলেন, তাঁর কথা শুনলাম।”

“কে তিনি?”

“রাজেন সিনহা। নিউ কামার। সবেই ওই পাড়ায় এসেছেন। কৃষ্ণকান্তবাবুদের বাড়ি থেকে খানিকটা দূরেই নতুন ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন ভদ্রলোক। পাড়ার লোকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় বিশেষ একটা হয়নি। বাড়িতে একাই থাকেন। কাজের একটা লোক আছে পুরনো। “

“কী করেন?”

“তা কাজকর্ম করেন বইকি! কলকাতার একটা মাঝারি হোটেলের ম্যানেজার। আধা-আধি মালিকও হতে পারেন।”

“এখানকারই লোক?”

“বলতে পারছি না।”

“সিনহার সঙ্গে বাবলুর কেসের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে?”

“এমনিতে তো মনে হয়, না। তবে কৃষ্ণকান্তবাবু বললেন তিনি পাড়ার লোক–যারা সেদিন থেকে লেকে বেড়াতে বেরিয়েছিল ভোরবেলায়–তাদের মধ্যে দুএকজন সিনহার সঙ্গে বাবলুকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখেছে।”

চন্দন বলল, “কোথায় দেখেছে?”

“রোয়িং ক্লাবের দিকে।”

কী ভেবে চন্দন বলল, “সাসপেক্ট করার মতন কারণ নেই, তবু খোঁজ করতে হবে।”

কিকিরা মুচকি হাসলেন।

.

০৪.

বাবলুদের নাটকের দলের দুটি ছেলের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্য নিয়েই বেরিয়েছিল তারাপদ।

প্রথম ছেলেটিকে তার দোকানেই পেয়ে গেল।

গড়িয়াহাটের কাছকাছি ছোট্ট একটা দোকান ছেলেটির। বইপত্র বিক্রি করে। হাত কয়েকের ঘর। বুক স্টলের মতনই দেখতে। মোটামুটি সাজানো। বাংলা বই-ই বেশি, কিছু ম্যাগাজিনও রয়েছে।

দোকানে ভিড় ছিল না। দু-একটা খদ্দের।

তারাপদকে খদ্দের ভেবে কিছু বলতে যাচ্ছিল ছেলেটি, তারাপদ মাথা নাড়ল। বলল, “আপনার সঙ্গে দুটো কথা বলতে এসেছি, ভাই। প্রাইভেট।”

“আমার সঙ্গে প্রাইভেট কথা! কোথ থেকে আসছেন?” ছেলেটি অবাক হয়ে বলল। তারপরই কী ভেবে বলল আবার, “আমাদের গ্রুপের কেউ পাঠিয়েছে? কল্ শো বুকিং?”

“না। আমি কৃষ্ণকান্তবাবুর কাছ থেকে আসছি।”

“মেসোমশাই! বাবলুর বাবা?”

“হ্যাঁ।”

কী যেন ভাবল ছেলেটি। তারাপদকে দেখল খুঁটিয়ে। “একটু ওয়েট করুন।”

খদ্দের দু’জন বিদায় হলে ছেলেটি তারাপদকে বলল, “বসুন। বাইরে টুলে বসবেন? ভেতরেও আসতে পারেন। “

ছোট কাউন্টারের ওপাশে বসার জায়গা নামমাত্র। তারাপদ বাইরে একটা টুলের ওপরই বসল। “বাইরেই বসি। আমার নাম তারাপদ

“আমার নাম পবন। পবন গোস্বামী।”

“জানি। নাম জেনেই তো এসেছি।”

“বলুন, কী বলবেন?”

“আমরা বাবলুর খোঁজখবর করে বেড়াচ্ছি।”

পবন তাকিয়ে থাকল। “পুলিশের লোক! লালবাজার থেকে আসছেন।”

“না,” তারাপদ মাথা নাড়ল। হাসল। “লালবাজার নয়, পুলিশও নয়।”

 পবন অবাক হয়ে কয়েক মুহূর্ত দেখল তারাপদকে। “তা হলে?”

“প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশান।”

“প্রাইভেট ডিকেটটিভ?”

তারাপদ মজার মুখ করে হাসল। “না, তাও ঠিক নয়। আমাদের একজন মাথাঅলা আছেন। বস্ বলতে পারেন। তিনি প্রাইভেটলি কিছু কাজ করেন। আমরা তাঁর লোক।”

“কী নাম বসের?”

“কিকিরা।”

“কিকিরা–কি-কিরা! অদ্ভুত নাম। বাঙালি, না, জাপানি?”

তারাপদ হেসে ফেলল। “বাঙালি। পুরো নাম কিঙ্কর কিশোর রায়। ছোট করে কিকিরা।”

পবন এবার মজা পেয়ে গিয়েছিল যেন। বলল, “দারুণ নাম, দাদা।”

“ভাই, আমি কয়েকটা কথা জানতে এসেছি। যদি আমায় বিশ্বাস করে বলেন, বলবেন। আর যদি অবিশ্বাস করেন, বলবেন না। আমি ফিরে যাব।”

“আরে না না, অবিশ্বাস করব কেন! আমি কখনো প্রাইভেট ডিটেকটিভ দেখিনি তো, তাই অবাক হচ্ছিলাম। বাবলু আমাদের ছোট ভাইয়ের মতন। আমরা সবাই তাকে ভালবাসি। জানেন, আমরা ঘটনাটা জানার পর থেকে নিজেরাই তার কত খোঁজ করছি। মেসোমশাইয়ের কাছেও গিয়েছিলাম আমরা।…অদ্ভুত ব্যাপার, দাদা। একটা ছেলে বেমালুম উধাও হয়ে গেল! কেন হল? কেন তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।”

“সেটাই তো কথা। আমরা…”

“চা খাবেন?”

 “খেতে পারি।”

পবন দোকানের বাইরে এসে গলা চড়িয়ে কাকে যেন হাঁক মারল। চায়ের কথা বলল চেঁচিয়ে। ফিরে এসে আবার দোকানে ঢুকল।

“আমাদের ভয় হয়, বাবলুকে কেউ খুনটুন করল কিনা!”

“খুন? খুন করবে কেন?”

“জানি না। কলকাতায় রোজই দু-চারটে খুনখারাবি, হয়। কাগজে দেখি।”

“মিছেমিছি খুন করবে। কারণ নেই, তবু!”

 “কী জানি!”

“যাক গে, সে পরের কথা।…আচ্ছা, আপনি কবে বাবলুকে শেষ দেখেছেন?”

“কেন, আগের দিনই দেখেছি; ও বেপাত্তা হওয়ার আগের দিন। সন্ধের দিকে এই দোকানে এসেছিল। সাতটা নাগাদ ও চলে গেল। বলল, ধীরাজদার সঙ্গে দেখা করে বাড়ি ফিরে যাবে।”

“ধীরাজদা-”

“আমাদের গ্রুপের সেক্রেটারি। কাঁকুলিয়ায় থাকেন।”

তারাপদর কাছে যে চার-পাঁচজনের নামের লিস্ট আছে বাবলুদের গ্রুপের ছেলেছোকরা, বন্ধু বাবলুর–তার মধ্যে ধীরাজের নাম আছে। নামটা তারাপদর মনে পড়ল।

পবন বলল, “দাদা, এই একই কথা আমি মেসোমশাইকে বলেছি। পুলিশের একজন খোঁজে এসেছিলেন–তাঁকেও বলেছি। একই কথা কতবার বলব।”

তারাপদর নিজেরই যেন খারাপ লাগছে বলতে, তবু সে নাচার–এমন গলা করে বলল, “না ভাই, ব্যাপার তা নয়; আমাদের সব জানা নেই তাই জিজ্ঞেস করছি। ডোন্ট মাইন্ড।.তা ইয়ে, বাবলু এখানে অনেকক্ষণ ছিল?”

“ঘণ্টাখানেকের বেশিই হবে। আড্ডা দিল।”

“ও এখানে আড্ডা মারতে আসে? তাই না?”

“আসে। বন্ধুরা অনেকেই আসে।”

“আচ্ছা, সেদিন ওকে কেমন দেখাচ্ছিল? মানে অন্যদিনের তুলনায়।”

“বরাবর যেমন দেখায়।”

“এমন কোনো কথা বলেছিল যাতে মনে হয় ওর…মানে আমি বলতে চাইছি, বাবলুর মুখে আপনি কোনো নতুন কথা শুনেছিলেন?”

“মনে পড়ছে না। নতুন কী বলবে?”

“বাবলু আপনাকে কিছু দেখিয়েছিল? বা বলেছিল?”

“কী দেখাবে?”

“কিছুই দেখায়নি? পুরনো একটা ঘড়ি? পকেট ঘড়ি?”

পবন হঠাৎ মনে করতে পারল। বলল, “না, ঘড়িটড়ি দেখায়নি। তবে আগের দিন কথায়-কথায় বলছিল, ওদের কাছে বাড়িতে একটা সোনার ঘড়ি আছে। দারুণ দেখতে। ঘড়ির ওপর যে ঢাকনাটা আছে, সেটার ওপর কাজ করা। তাতে মুখের ছবি আছে। মুখগুলো তাসের রাজারানীর মুখের মতন দেখতে। চারপাশে গোল করা লতাপাতার নকশা।”

চা এল। ছোট-ছোট কাপ। দুধ কম। গুঁড়ো ভাসছে চায়ের ছেলেটা চা দিয়ে চলে গেল।

তারাপদ যেন সাধারণভাবেই কথা বলছে, বেশি আগ্রহ দেখাল না, চঞ্চলতাও নয়, বলল, “আগের দিন মানে? আপনার সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার আগের দিন?”

পবন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। এমন সময় এক মহিলা এলেন। কী একটা বইয়ের খোঁজ করলেন। পবনের কাছে ছিল না। তিনি চলে গেলেন।

তারাপদ বলল, “তা হঠাৎ সেদিন ঘড়ির কথা উঠল কেন?”

পবন বলল, “সে এক মজা হয়েছিল! সেদিন আমাদের গ্রুপের ক্লাবে সন্ধের সময় আড্ডা হচ্ছিল। আমি গিয়ে হাজির। খবরের কাগজের ওপর মুড়ি বাদাম ছড়িয়ে মুড়ি খাওয়া চলছে। ভাঁড়ের চা। মুড়ি যে শেষ, হঠাৎ কে যে কাগজটার দিকে তাকিয়ে বলল, আরে দ্যাখ, একটা ঘড়ির জন্যে কেমন বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে।”

“বিজ্ঞাপন?”

“হ্যাঁ। ইংরিজি খবরের কাগজ, তাতে একপাশে রুল দিয়ে ঘেরা একটা বড় মতন বিজ্ঞাপন। এক ভদ্রলোক পুরনো এক ঘড়ির খোঁজ করছেন। লিখেছেন, ঘড়িটার জন্যে ভাল দাম দেওয়া হবে।”

“কার বিজ্ঞাপন? ঠিকানা?”

“তা জানি না। আমি বিজ্ঞাপনটা দেখিনি। ওরা কেউ-কেউ দেখল। মজা করল। তখন বাবলু বলল, তাদের বাড়িতে একটা দারুণ পুরনো সোনার ঘড়ি আছে। পকেট ঘড়ি। তার ঠাকুরদার।”

চা খেতে-খেতে তারাপদ বলল, “ঘড়িটা কেমন দেখতে, তাও বলল।”

“হ্যাঁ। নয়ত আমরা জানব কেমন করে?”

“তা তো বটেই!…আচ্ছা ভাই, সেই খবরের কাগজটা কি বাবলু নিয়ে নিল?”

পবন সামান্য ভেবে বলল, “তা বলতে পারব না। আমি বেশিক্ষণ ছিলাম না। ওরা ছিল। ধীরাজদা, সুব্রত, বঙ্কিম…।”

তারাপদ একটু চুপ করে থেকে বলল, “আচ্ছা, বাবলু তো ভাল ছেলে। স্বভাব-টভাব–”।

“কী বলছেন আপনি! বাবলু ভীষণ ভাল ছেলে! ওর স্বভাব দারুণ।”

“আপনার আর কিছু মনে পড়ছে?”

পবন মাথা নাড়তে-নাড়তে হঠাৎ কী মনে পড়ায় বলল, “ও যেদিন আমার দোকানে এল, সেদিন কথায় কথায় একটা জায়গার নাম বলল। জিজ্ঞেস করল, আমি জানি কিনা! আমি না বললাম।”

“কী নাম? কলকাতার মধ্যে?”

“কলকাতা। না, কলকাতার মধ্যে বোধ হয় নয় বাইরে হবে, মফস্বল। তবে কলকাতাতেই কত জায়গা। কে তার খোঁজ রাখে।…কী যেন বলল নামটা? “জ দিয়ে হবে! নাকি, ব’ দিয়ে? উঁহু মনে পড়ছে না।”

“একটু চেষ্টা করুন ভাই।”

“মনেই পড়ছে না।”

“ঠিক আছে, আমি পরে আসব, যদি আপনার মনে পড়ে। আজ আর বসব, আমায় এক জায়গায় যেতে হবে। তার আগে একবার আপনাদের ধীরাজদাদের সঙ্গে দেখা করে যাই। পাব তো তাঁকে এ সময়?”

“ধীরাজদাকে আজ পাবেন না। ধীরাজদা কলকাতায় নেই, খঙ্গাপুর গিয়েছে, বাড়িতে। মায়ের অসুখ। পরশু নাগাদ পাবেন।”

“আজ উঠি,” তারাপদ উঠে পড়ল। সে এখন গোলপার্কের কাছে একটা জায়গায় যাবে, চন্দনের সেখানে অপেক্ষা করার কথা।

দোকান থেকে বেরিয়ে আসতে-আসতে তারাপদ বলল, “আপনার কী মনে হয়? বাবলুকে কেউ জোর করে তুলে নিয়ে যেতে পারে রাস্তা থেকে?”

পবন মাথা নাড়ল। “একলা কেউ পারবে না, সাধারণ মানুষ হলে! হিন্দি ছবির পাক্কা গুণ্ডা বদমাশ হলে পারতে পারে।” পবন একটু হাসল। বলল, “বাবলু দারুণ দৌড়তে পারে, গায়ে জোর আছে, তা ছাড়া ও কিছুদিন ক্যারাটেও শিখেছিল। ওকে চট করে কাবু করা মুশকিল।”

তারাপদ তার ঘড়ি দেখল। আর দেরি করা যায় না।

.

চন্দন ঠিক জায়গায় অপেক্ষা করছিল।

তারাপদ এসে বলল, “কীরে! তোর খবর কী? কিছু জানতে পারলি?”

চন্দন বলল, “বন্ধুর সঙ্গে সেই বিকেল থেকে লেগে থাকলাম। দেখাও করলাম দু-তিনজনের সঙ্গে। সবাই বলল, বাবলুকে তারা লেকে দেখেছে। চোখে পড়েছে। কেউ আগে দেখেছে, কেউ পরে। মোট কথা, বাবলু যে সেদিন জগিং করছিল, সেটা ঠিকই। “

“আর ওই ভদ্রলোকের খোঁজ নিতে পেরেছিস?..রাজেন সিনহা?”

“চল, বলছি। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে পা ব্যথা হয়ে গেছে।”

“চায়ের দোকানে বসবি?”

“না, বাড়ি ফিরব। কোয়াটারে। চল, ট্যাক্সি নিই।”

 কাছাকাছি ট্যাক্সি পেয়ে গেল চন্দন।

ধুলোর ঘূর্ণি উঠল হঠাৎ। ট্যাক্সিতে উঠে জানলার কাঁচ বন্ধ করল চন্দন। রুমালে চোখ-মুখ মুছতে মুছতে বলল, “বিকেলের আগে এসেছি, আর এখন ক’টা বাজল?”

“সাতটা বেজে গিয়েছে।”

ট্যাক্সি চলতে শুরু করেছিল। গড়িয়াহাট হয়েই সোজা যাবে পার্ক সার্কাস ময়দান হয়ে সি আই টি রোড, তারপর মৌলালি ধরবে।

“তোর বন্ধুকে বাড়িতে পেলি?” তারাপদ বলল।

“হ্যাঁ। বলা ছিল আগেই। বিদ্যুৎ পাঁচটা থেকে চেম্বার করে যোধপুর পার্কে। আজ ওর দেরি হল। ছ’টায় বসবে।”

ধুলোর ঘূর্ণি কেটে গিয়েছে। জানলার কাঁচ নামিয়ে দিতে দিতে চন্দন বলল, “বাবলুকে সেদিন সকালে লেকের কাছে যাঁরা দেখেছেন–তাঁদের একজন হলেন নিরাপদ চ্যাটার্জি। সত্তরের মতন বয়েস। রিটায়ার্ড প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি রোজই মর্নিং ওয়াক করেন। অন্য ভদ্রলোক হলেন সজল দত্ত। এঁরও বয়েস হয়েছে। খবরের কাগজের অফিসে পঁয়ত্রিশ বছর প্রেস ম্যানেজারি করেছেন। তিন নম্বর ভদ্রলোকের নাম মধুময় সরকার। বয়েস চল্লিশ ছাড়িয়েছে। কিন্তু হাই ব্লাড সুগার। ডাক্তার রোজ সকালে হাঁটতে বলেছে, জোরে-জোরে! এই তিনজনের সঙ্গেই আমার দেখা করিয়ে দিয়েছে বিদ্যুৎ। দু’জনকে বাড়িতেই পেয়ে গিয়েছিলাম। মধুময়কে পেলাম রাস্তায়। অফিস থেকে ফিরছেন।”

“কোনো ক্লু–?”

“কিস্যু না। নাথিং। বাবলুকে এঁরা দেখেছেন, এই পর্যন্ত।”

“রাজেন সিনহা?”

“দেখা হয়নি। তবে ইনফরমেশন পেলাম কিছু।”

“কী?”

“সিনহা সাহেব নাকি একসময় আন্দামানে ছিলেন। জাহাজেও কাজ করেছেন। পরে ভদ্রলোক মাদ্রাজে চলে আসেন। সেখান থেকে কলকাতায়।”

“কোথাকার লোক?”

“বলেন, এইদিককার। চব্বিশ পরগনার।”

“হোটল ম্যানেজারি?”

“আন্দামান থেকেই। মাদ্রাজে বছরখানেক। তারপর কলকাতা।”

“এখন যে হোটেলের ম্যানেজারি করেন, সেটার তিনি শুধুই ম্যানেজার? না, মালিকও?”।

“হাফ মালিক হতে পারেন। কিংবা পার্টনার?”

“আর কিছু?”

“পাড়ায় নতুন এসেছেন। ফ্যামিলি বলে কিছু নেই। কাজের লোক একজন, আর ওই কুকুর। কুকুরটার জাত বোঝা যায় না। বাঘের মতন লম্বা-চওড়া। তবে ভীষণ ট্রেন্ড। মনিবের হুকুম মতন চলে।”

“রাস্তায় দু-চারটেকে কামড়ে দিলেই হুকুম মেনে চলা বেরিয়ে যাবে।“

 “মুখ গার্ড করা থাকে। কামড়াবার চান্স নেই।”

তারাপদ বুঝতে পারল, চাঁদুর বিকেলটাই বৃথা গিয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বাবলুকে সেদিন সকালে লেকে দেখা গিয়েছে এটা কোনো নতুন খবর নয়। আর সিনহা সাহেবের ব্যাপারেও মামুলি খবর যা পাওয়া গিয়েছে তাতেও কাজের কাজ হয়নি কিছু।

“দে, একটা সিগারেট দে।” চন্দন সিগারেট চাইল।

 ট্যাক্সি পার্ক সার্কাস ময়দানের কাছে পৌঁছে গেল।

সিগারেট ধরিয়ে হতাশ গলায় চন্দন বলল, “তুই কিছু জানতে পারলি?”

“পারলাম। তবে–”

“বল, শুনি।”

তারাপদ পবনের সঙ্গে দেখা হওয়ার বৃত্তান্ত বলতে লাগল।

চন্দন মন দিয়ে শুনল। শেষে কী ভেবে বলল, “তারা, ঘড়িটা একটা বড় ফ্যাক্টার মনে হচ্ছে। না কিরে?”

“বুঝতে পারছি না! ঘড়ি নিয়ে একটা রহস্য থেকেই যাচ্ছে। তবে বাবলু তো সেদিন ঘড়িটা পবনকে দেখায়নি। হয়ত সঙ্গে ছিল না।”

“সন্ধেবেলায় ছিল না। পরের দিন সকালে দৌড়তে যাওয়ার সময়ই বা পকেট ঘড়ি সঙ্গে থাকবে কেন?”

তারাপদ পাঁচ কথা ভাবতে-ভাবতে বলল, “আমার কিছু মাথায় ঢুকছে না।”

“হবে না। বুঝলি! বাবলু-কেস সভ করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। ছেলেটা বেঁচে আছে কিনা–তাই বা কে জানে?”

.

বকসি কোম্পানির মেজোবাবু ননী বকসি–মানে ননীলাল বসিকে পেতে অসুবিধে হল না। এন্টালি বাজারের কাছাকাছি তাঁর বাড়ি।

ননী বকসির চেহারা, সাজপোশাকের মধ্যে পুরনো কলকাতার বনেদিয়ানার একটা ছাপ যেন আছে। ভদ্রলোকের বয়েস পঁয়ষট্টির কাছাকাছি হবে। স্বাস্থ্য এখন ততটা মজবুত নয়, তবু বোঝা যায় একসময় স্বাস্থ্যবানই ছিলেন। গায়ের রং ফরসা। প্রায়-গোল মুখ। মাথার মাঝখানে সিঁথি। সব চুলই সাদা। পরনে ভাল লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি, গেঞ্জির বুকের কাছে বোতাম। ভদ্রলোক পান-জরদার ভক্ত।

কিকিরা খবর দিয়ে গিয়েছিলেন।

 নিচের বৈঠকখানা ঘরে কিকিরাদের বসিয়ে ননী বকসি বললেন, “বসুন, সুর আমায় লোক পাঠিয়েছিল। চিঠি দিয়ে।”

কিকিরার সঙ্গে তারাপদ ছিল।

কিকিরা বললেন, “ভেবেছিলাম, দোকানে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করব। শুনলাম, আপনি দোকানে যাচ্ছেন না।”

“শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। বয়েস হয়েছে। প্রেশারের গোলমাল। মাঝে-মাঝেই যাই; ইচ্ছে না হলে যাই না। ছেলেরাই কারবার দেখে। আমি ওপর-ওপর। “

কিকিরা একটু হেসে বললেন, “ওপর-ওপরটাই কী কম বকসিমশাই। মাথা থাকলে শুধু ধড় কি কাজ করে!”

ননী বকসি হাসলেন। তারপর বললেন, “বলুন, আমি কী করতে পারি?”

অল্প অপেক্ষা করে কিকিরা বললেন, “সুরবাবু কি চিঠিতে আমার পরিচয় আপনাকে জানিয়ে দিয়েছেন?”

“হ্যাঁ। জানিয়েছে খানিকটা।”

“আমি আপনার কাছে কয়েকটা কথা জানতে এসেছি।”

“বলুন?”

“আপনার বাবার আমলে যে ঘড়ির দোকান ছিল সেই দোকানে আপনি আসা-যাওয়া করতেন?”

“করতাম বইকি! আমাদের ঘড়ির দোকান হয়েছিল উনিশ শো এক সালে। নাইনটিন হানড্রেড ওয়ান। আমাদের দোকানের বেশ নাম ছিল তখন বড়বড় কোম্পানির ঘড়ি রাখতাম। রেয়ার ঘড়িও। রিপেয়ারিং হত।”

“আপনারা তো কোম্পানির নাম রেখেছিলেন Boxy & Co?”

“হাঁ।”

“Boxy লিখতেন কেন?

“বাবা লিখতেন। তখনকার দিনে এরকম চল। বাবা বরাবরই নিজের নামের উপাধি ইংরিজিতে BOXY লিখতেন। আমাদের স্কুলের খাতায় BAKSHI লেখা হত।”

“আপনি ঠিক কোন বয়েস থেকে দোকানে যেতেন?”

“আমার জন্ম নাইনটিন থারটিতে। আমার দাদা ছিল আমার চেয়ে তিন বছরের বড়। আমি মেট্রোপলিটান স্কুলে পড়তাম। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই মাঝে-মাঝে দোকানে যেতাম। এমনি বেড়াতে। মানে যুদ্ধের সময়। কলকাতায় যখন জাপানি বোমা পড়ল, আমরা ক’জন আমাদের দেশের বাড়িতে গিয়ে ছিলাম। বাবা কলকাতায় থাকতেন।”

“আপনাদের দেশের বাড়ি কোথায়?”

“বর্ধমানের এক গ্রামে। জিরেনপুর।”

তারপর কানে লাগল কথাটা। বাবলু না জ’ দিয়ে একটা জায়গার কথা বলেছিল পবনকে। জ’ বা “ব হতে পারে বলেছিল। অবশ্য সঠিকভাবে নয়। সে কিকিরার দিকে তাকাল। কিকিরা তারাপদর মুখে শুনেছেন জবই।

কিকিরা একটুও চঞ্চল হলেন না।

ননী বকসি নিজেই বললেন, “যুদ্ধটুদ্ধ থামল। একদিন আমিও স্কুল থেকে বেরিয়ে কলেজে ঢুকলাম। কিন্তু কলেজটা শেষ করতে পারলাম না। বাবা মারা গেলেন। দাদা হঠাৎ ঘরবাড়ি ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে গেলেন। আগে থাকতেন বিন্ধ্যাচলের দিকে। পরে কাশী। শেষে কাটোয়ার দিকে আশ্রম করেছিলেন। সেখানেই দেহরক্ষা করেন।” ননী বকসি একটু থামলেন। নিজেই আবার বললেন, “আমাদের ফ্যামিলিতে একটা অভিশাপ নেমে এল। বাবা যাওয়ার পর-পরই। বাবা গেলেন, মা চলে গেলেন, দাদা সংসার ছাড়ল, দিবু–আমার ছোট ভাই গয়ায় তর্পণ করতে গিয়ে অদ্ভুতভাবে ডুবে গেল।”

কিকিরা শুনলেন কথাগুলো। কী আর বলবেন! সহানুভূতি জানাতেও কেমন যেন লাগে!

সামান্য সময় চুপচাপ থাকার পর কিকিরা বললেন, “আমি একটা ঘড়ির খোঁজ করছি। পুরনো ঘড়ি। আপনি কি বলতে পারেন?”

“বাবার ঘড়ির ব্যবসা আমি নিজে বড় একটা দেখতাম না। সে বয়েসেও হয়নি। পরে তো দোকানই উঠে গেল। তবু বলুন, কোন ঘড়ির খোঁজ করছেন?”

“সোনার ঘড়ি। সুইস মেড। পকেট ঘড়ি।”

ননী বকসি রীতিমতন অবাক! তাকিয়ে থাকলেন। “সোনার পকেট ঘড়ি। ক্যানটন?”

“ক্যানটন?”

“ঘড়ির নাম ক্যানটন। ক্যানটন গোল্ড। এ ঘড়ির কথা আপনারা কোথ থেকে জানলেন? শ’খানেক বছর আগেকার মডেল। বাবার মুখে শুনেছি। “

কিকিরা আর তারাপদ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। কিকিরা বললেন, “বসিদা, আপনি নিজে এই ঘড়ি দেখেছেন?”

“আলবাত দেখেছি। অমন জিনিস দেখা যায় না। রেয়ার ঘড়ি। সারা পৃথিবীতে মাত্র পাঁচটা ক্যানটন গোল্ড পাওয়া গিয়েছিল। ওই ঘড়ি নিয়ে গল্প আছে। “

“কী গল্প?”

“কোনো কোটি-কোটিপতি এক ইটালিয়ান অডার দিয়ে ক্যানটন গোল্ড তৈরি করিয়েছিলেন। কিন্তু ঘড়ি নেওয়ার আগেই মারা যান। পরে যে চারজন বিদেশি ধনী ওই ঘড়ি কিনেছিলেন তার একজন জাহাজডুবি হয়ে মারা যান, একজন পাহাড় থেকে খাদে পড়ে গিয়ে মারা যান। বাকি দুজনের মধ্যে একজন আত্মহত্যা করেন নিজের মাথায় পিস্তল চালিয়ে, অন্যজনের প্রাণ যায় বুনো জন্তুর হাতে পড়ে। “

“এ তো গল্প!”

“তা হতে পারে। হয়ত দু-একজন সত্যি-সত্যি মারা গিয়েছিল, বাকিগুলো বানানো গল্প। তবে এটা ঠিক, ক্যানটন গোল্ড রেয়ার ঘড়ি। ভৈরি রেয়ার।”

কিকিরা বললেন, “ওই ঘড়ি নিজের চোখে আপনি দেখেছেন?”

“হ্যাঁ।”

“একটু বলবেন কেমন দেখতে?”

 ননী বকসি চোখ বন্ধ করে যেন মনে করতে লাগলেন ঘড়ির কথা।

বাড়ির ভেতর থেকে চা, মিষ্টি এল।

 “নিন, একটু চা খান” ননী বকসি বললেন, “ঘড়িটার কাঁটা সোনার। দাগগুলো রোমান নম্বর। ডায়াল প্লেট ব্রাইট অ্যান্ড কালারফুল। আলাদা কম্পাস আছে। সেকেন্ডের কাঁটা ছিল না। বোধ হয় হারিয়ে গিয়েছিল।”

“আপনি দেখেননি?”

“না। ঘড়ির ওপর কভার ছিল। ডালা। সব পকেট ঘড়িতেই থাকত তখন। ডালাটা দেখতে সুন্দর। অতি চমৎকার। চারপাশে এনগ্রেভিং। ডিজাইন। মাঝখানে দুটো মাথা। ডালাকভারের পেছনদিকে কোম্পানির নাম। আরও কী কী খোদাই করা ছিল। মনে পড়ছে না। ..তবে হ্যাঁ। পেছনদিকে বাবাও আমাদের কোম্পানির নাম স্যাকরাকে দিয়ে খোদাই করিয়ে নিয়েছিলেন।”

“BOXY & CO?”

“হ্যাঁ।”

“ঘড়িটা আপনারা পেলেন কেমন করে, কিছু জানেন?”

“ভাল জানি না। বাবার মুখে শুনেছি একজন সেলার–মানে জাহাজি সাহেব-ঘড়িটা বেচে দিয়ে যায় দোকানে।”

“বলেন কী! অমন সোনার ঘড়ি-”

“আরে মশাই, জাহাজ থেকে অমন চুরিচামারি করা জিনিস সেলাররা নেশার ঘোরে কতই বিক্রি করে দিয়ে যেত।”

“কত দামে কিনেছিলেন আপনারা বাবা? জানেন?”

“না। তবে সাহেব-বেটা হয়ত ওটাকে ক্যারেট গোল্ড ভেবেছিল, তাই বেশি দাম হাঁকতে পারেনি। তবু তখনকার দিনেই হাজার কয়েক টাকা তো নিয়েছিল নিশ্চয়।”

চা খাওয়ার ফাঁকেই কিকিরা বললেন, “আপনার বাবা কি ক্যানটন ঘড়ির কথা জানতেন?”

“বাবা অনেক রেয়ার ঘড়ির খোঁজখবর রাখতেন। তাঁর ব্যবসাও ছিল রেয়ার ঘড়ি বিক্রি করা। তবে, ওই ঘডিটার সম্পর্কে ভাল করে খোঁজখবর পরে নিয়েছেন বলেই আমার মনে হয়।”

“ঘড়িটার শেষপর্যন্ত কী হল? বিক্রি হয়ে গেল?” তারাপদ হঠাৎল।

ননী বকসি মাথা নাড়লেন। বললেন, “না, তা আর হল কোথায়! আমরা যখন কলকাতায় বোমা পড়ার সময় দেশের বাড়িতে পালিয়ে যাই, তখন বাবা কয়েকটা রেয়ার ঘড়ি আমাদের সঙ্গে সরিয়ে ফেলেন। ভেবেছিলেন, বোমাটোমা পড়ে কলকাতার কী হবে কেউ তো জানে না। ভবিষ্যতের কথা ভেবে কয়েকটা সরিয়ে ফেলেন। ঘড়িটা আমাদের কাছেই ছিল দেশের বাড়িতে। শেষে আর পাঁচটা জিনিসের সঙ্গে একদিন চুরি হয়ে গেল।”

“দেশের বাড়ি থেকে?”

“হ্যাঁ। চোর-ছ্যাঁচড়ের উৎপাত তখন গাঁ-গ্রামে। রোজই এটাসেটা যায় এর-ওর বাড়ি থেকে। আমাদেরও গেল।”

কিকিরা চা-খাওয়া শেষ করে বললেন, “ও-রকম একটা রেয়ার ঘড়ি চলে গেল, আপনারা খোঁজখবর করেননি?”

“বাবা নিশ্চয় করেছিলেন। লাভ হয়নি।” ননী বকসি পান-জরদা মুখে দিলেন। পানের ডিবে এগিয়ে দিলেন কিকিরার দিকে। “তা মশাই, আপনারা হঠাৎ এই ঘড়ির খোঁজখবর করতে এসেছেন কেন–তা তো বললেন না!”

কিকিরা পানের ভক্ত নন। তবু একটা পান নিলেন। বললেন, “কেন এলাম শুনতে চাইলে আপনাকে অনেক কথা বলতে হয়।”

“বলুন, শুনি। আপত্তি আছে?”

“না, না।”

কিকিরা যথাসম্ভব সংক্ষেপে কৃষ্ণকান্তর কথা বললেন। বাবলুর নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ায় পুরো বিবরণ জানালেন।

ননী বকসি অবাক হয়ে কিকিরার কথা শুনছিলেন। দু-একবার জিজ্ঞেসও করলেন একথা সে কথা।

কিকিরার কথা শেষ হল। তিনজনেই চুপচাপ।

 কিছুক্ষণ পরে ননী বকসি বললেন, “ঘড়িটার ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। ওটা আমাদেরই ঘড়ি। ওরম দ্বিতীয় ঘড়ি অন্য কারও কাছে ছিল বলে আমি জানি না, মশাই। …তবু, আমি একজনের খবর দেব, আপনি একবার সেখানে খোঁজ করে দেখুন।” বলে পান চিবোতে চিবোতে জড়ানো জিভে ননী বকসি বললেন, “আমি এক জুয়েলারকে দেখেছি। বাবার কাছে আসতেন। বাবা যখন অসুস্থ, বাইরে বেরোতে পারেন না, তখনো তিনি বাবাকে দেখতে আসতেন। এঁরা সে-সময় বড় জুয়েলার ছিলেন। অবাঙালি, ফতেচাঁদ জুরাভাই। কলকাতার বনেদি বাড়ির অনেকের সঙ্গে কারবার ছিল। ভদ্রলোক বাবার চেয়ে বয়েসে ছোট ছিলেন। বাবাকে “দাদাজি’ বলতেন। বাংলা বলতে পারতেন পরিষ্কার। ফতেচাঁদবাবুর কাছেও দামি ঘড়ি থাকত। খবর রাখতেন।..ওঁর দোকান ছিল লালবাজারের কাছে। বাড়ি ভবানীপুরে। উনি এখনো বেঁচে আছেন কিনা জানি না। যদি বেঁচে থাকেন, একেবারেই বুড়ো হয়ে গিয়েছেন। আশির ওপর তো হবেই। উনি বেঁচে থাকলে আপনারা হয়ত কিছু জানতে পারেন।”

কিকিরা মন দিয়ে বসিবাবুর কথা শুনছিলেন।”ভবানীপুরে কোথায় বাড়ি?”।

“রাস্তার নাম জানি না। জগুবাবুর বাজারের আশেপাশে থাকতেন।…দোকানেই খোঁজ করে দেখুন না! সেটা সহজ হবে।”

“দোকান আছে তো?”

 মাথা নাড়তে-নাড়তে ননী বকসি বললেন, “তা বলতে পারব না। পুরনো জুয়েলাররা অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে শুনি।”

তারাপদ উসখুস করছিল। তার মনে হচ্ছিল, এবার উঠে পড়া ভাল। নতুন করে আর কিছু জানার নেই।

কিকিরা উঠি-উঠি ভাব করে বললেন, “আপনাকে অনেকক্ষণ বিরক্ত করলাম। কী করব বলুন, একটা জোয়ান ছেলে বাড়ি থেকে হঠাৎ নিরুদ্দেশ। মা-বাবার মনের অবস্থা বুঝতেই পারেন!”

“পারি বইকি, ভায়া। কলকাতা শহরটাও তো আজকাল ভয়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

কিকিরা উঠে পড়লেন। তারপর আচমকা বললেন, “ঘড়িটার দাম এখন কত হতে পারে, বকসিদা? ওই রেয়ার সোনার ঘড়িটার?”

ননী বকসি তাকিয়ে থাকলেন কয়েক পলক। পরে বললেন, “বলতে পারব।। আমার কোনো আইডিয়া নেই। শখের জিনিস কিনে টাকা নষ্ট করবে, এমন লোক এখন কোথায়?”

“সোনা…?”

“ওতে আর কতটুকু সোনা আছে। বিদেশি হলেও পাকা সোনা হবে বলে মনে হয় না। আমাদের হিসেবে ভরি তিনেক হতে পারে। কিন্তু মশাই জুয়েলগুলো কস্টলি।”

“আচ্ছা, চলি..! পরে একদিন আসব গল্পগুজব করতে। আপনি ভাল থাকুন।” কিকিরা নমস্কার করে বেরিয়ে আসছিলেন, ননী বক্সীর কথায় দাঁড়িয়ে পড়লেন।

ননী বকসি বললেন, “ছেলেটির খোঁজ পেলে আমায় জানাবেন। একটা ফোন করলেও হবে। আমাদের ফোন নম্বর…” বলে উনি বাড়ির ফোন নম্বর জানালেন।

.

বাইরে এসে কিকিরা তাঁর চুরুট ধরালেন। মুখে কথা নেই। হাঁটতে লাগলেন। সন্ধে হয়ে গিয়েছে কখন।

তারাপদও পাশে-পাশে হাঁটছিল কিকিরার। অনেকক্ষণ পরে বলল, “স্যার, এ তো বড় ঝামেলায় পড়া গেল! ঘড়ি চুলোয় যাক। বাবলুর একটা খবর যদি পেতাম।”

কিকিরা বললেন, “পেলে তো ভালই হত। কিন্তু ঘড়ি বাদ দিয়ে বাবলুকে কি পাওয়া যাবে! যাবে না।”

“আমি বুঝতে পারছি না, ওই ঘড়ি নিয়ে বাবলু কী করবে?” ধরে নিলাম, ঘড়িটা বেচে দিলে পাঁচ-দশ হাজার টাকা সে পেতে পারে। কিন্তু বাবলু বেচবে কেন? আর পাঁচ-সাত হাজার টাকা ওর বাবার কাছে কিছুই নয়।…যদি বাবলুর টাকার দরকারই হত, মা বাবার কাছেই পেতে পারত।”

কিকিরা ভিড়ের মধ্য দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে বললেন, “পাঁচ-সাত কি দশ হাজারের ব্যাপার নয়, তারাবাবু।” মাথা নাড়লেন কিকিরা। তারপরই কী মনে করে বললেন, “আমি কৃষ্ণকান্তবাবুকে বারবার জিজ্ঞেস করেছি ঘড়ির কথা। তিনি একই কথা বলেন, তাঁর বাবার ঘড়ি। অচল। স্মৃতি হিসেবে বাড়িতে পড়ে ছিল। ও নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। বাবলুর জেঠামশাইবাবলুর বাবার সঙ্গেও চারু অ্যাভিনিউর বাড়িতে আমি দেখা করেছি। তিনিও ঘড়ি নিয়ে গরজ দেখালেন না। ওঁরও সেই একই কথা, বাবার ঘড়ি, কৃষ্ণ রেখে দিয়েছিল স্মৃতি হিসেবে।”

“তবে?”

“আমার মনে হয়, বাবলুর বাবা-জেঠা-ঘড়িটার ভেতরের কথা জানেন না। হয় জানেন না, না হয় জানতে চান না। প্রথমটাই হয়ত ঠিক।”

“বাবা-জেঠা জানেন না, বাবলু জানতে পারল! এটা কেমন করে হয়?”

“বলতে পারব না। কোনোরকমে জেনেছে।”

“আপনি সেটা ভাবতে পারেন। কিন্তু কেমন করে জেনেছে, কার কাছ থেকে জেনেছে, ধরবেন কেমন করে?”

অন্যমনস্কভাবে কিকিরা বললেন, “দেখি।…ভাল কথা, টেলিফোন ডিরেক্টরি ঘেঁটে আমি একটা ফক্স পেয়েছি।”

তারাপদ দাঁড়িয়ে পড়ল। অবাক হয়ে বলল, “ফক্স?”

“ফক্স অ্যান্ড মল্লিক।”

“অদ্ভুত! কিসের কোম্পানি?”

“জানি না। লেখা নেই। ডালহাউসির দিকে অফিস। স্ট্র্যান্ড রোড।”

তারাপদর কেমন হাসি পেয়ে গেল। বলল, “স্যার, আপনি BOXY থেকে বক্স পেলেন। আবার ফক্সও পেলেন দেখছি!” ফক্স যখন পেয়ে গেলেন, একটা অক্সও পেয়ে যেতে পারেন।”

কিকিরা হাসলেন না। বললেন, “হাসবার কিছু নেই, তারাবাবু; এরকম তুমি অনেক পাবে। আগে সাহেবসুবোর ব্যবসা ছিল, পরে দিশিবাবুরা ব্যবসা কিনে নিয়েছে। কিন্তু ওই যাকে গুড উইল বলে, পুরনো কোম্পানির গুডউইলটা কাজে লাগায়। আমার মনে হয় এটাও তাই।…কাজে লাগুক না লাগুক কাল-পরশু একবার ফক্স অ্যান্ড মল্লিকের খোঁজ করতে হবে।

তারাপদ চুপ করেই থাকল।

.

০৬.

কৃষ্ণকান্ত দুপুরে তাঁর ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের অফিসে ছিলেন। এটিই তাঁর আদি অফিস, বাড়িতে যে-অফিস আছে সেটি অনেকটা ব্যক্তিগত।

ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের নানা অফিসের ভিড়ে কৃষ্ণকান্তর অফিসকে আলাদা করে চিনে নেওয়ার উপায় নেই। তেতলা পুরনো এক বাড়ির দোতলায় অন্য দু-তিনটি অফিসঘরের একপাশে কৃষ্ণকান্তর দু কামরার অফিস।

কিকিরা এসেছিলেন দেখা করতে।

কাঠের পার্টিশান করা ঘরের মধ্যে কৃষ্ণকান্তর মুখোমুখি বসে কথা হচ্ছিল। ঘরে তাঁরা মাত্র দু’জন। পাশের ঘর থেকে সাড়া-শব্দ আসছিল। অফিসের কাজকর্ম চলছে।

কৃষ্ণকান্তকে যেন আরও শুকনো, ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল। চিন্তায়-চিন্তায় চোখের তলা কালচে হয়ে গিয়েছে, দৃষ্টি হতাশ, অন্যমনস্ক। গায়ের জামাটাও আধ-ময়লা, কোঁচকানো। কোনো ব্যাপারেই গা নেই, উৎসাহ নেই মানুষটির। অফিসেও এসেছেন যেন আসতে হয় বলে, বা নিজেকে খানিকক্ষণ ভুলিয়ে রাখার জন্য।

সামান্য কথাবার্তার পর কিকিরা বললেন, “পুলিশ থেকে আর কোনো খবর পেলেন না?”

মাথা নাড়লেন কৃষ্ণকান্ত। “না। ওরা মশাই এখন আমাকেই চার্জ করছে। বলছে, ছেলের সম্পর্কে আপনি কারেক্ট ইনফরমেশন দেননি। ছেলের খোঁজখবরও ভাল করে রাখতেন বলে মনে হয় না। আপনার ছেলে খুব ভাল ছিল কে বলল আপনাকে! আজকাল এইসব ছোকরা ড্রাগ পেডলারদের সঙ্গে কেমন দহরম মহরম করে–জানেন আপনি?”

কিকিরা অবাক হয়ে বললেন, “সে কী!”

“কী আর বলব, রায়মশাই। আমার ছেলেকে আমি চিনলুম না, ওরা চিনে ফেলল! পুলিশের কথা থেকে মনে হল, ওরা মনে করছে বাবল নিজেই গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে। ওদের কথায়, যে-কোনো অ্যাডাল্ট যদি নিজে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে চায় এই কলকাতা শহরে, তবে পুলিশের সাধ্য কী–তাকে খুঁজে বার করা।”

“বলল?”

“হ্যাঁ। …আমি বললাম, তা হলে আপনারা ক্রিমিনালদের খোঁজ করেন কেমন করে? ওরা বলল, ক্রিমিনালদের কথা আলাদা। তাদের ঠিকুজি আমাদের কাছে থাকে। খোঁজ রাখি। আপনার ছেলে কি ক্রিমিন্যাল!..এসব শুনে আমি আর কী বলব বলুন! চুপ করে গেলুম। “

কিকিরা একটু সময় চুপ করে থাকলেন। অন্যমনস্কভাবে অফিসঘরের চারপাশে তাকালেন। মামুলি অফিস। টেবিল, দু তিনটি চেয়ার, ফোন, ক্যালেন্ডার, দুটো বাড়ির ছবি, লোহার আলমারির মাথায় একরাশ কাগজ, গোল করে পাকানো, বোধ হয় ঘরবাড়ির প্ল্যান।

কিকিরা বললেন, “আমি দু-একটা কথা জানতে এসেছি।”

“বলুন। আর নতুন কী জানাব, রায়বাবু!”

“আপনি বকসি কোম্পানির নাম শুনেছেন? বসি বানানটাই ইংরিজিতে BOXY বলে লেখা!”

বকসি কোম্পানি! বসি তো অনেক আছে। …আমি ব্যবসায়ী মানুষ, কতজনের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয়–তার মধ্যে বসিও আছে। এক বকসি আমার কনস্ট্রাকশানের কাজে লোহার ছড় সাপ্লাই করে। কে, বকসি কোম্পানি। আরেকজন আমার কাছেই কাজ করে। সুপারভাইজ করে।”

“আমি BOXY –বি ও এক্স ওয়াই দিয়ে BOXY বলছি।”

“না।”

“আপনাদের বাড়িতে যে সোনার ঘড়িটা ছিল, তার ওপরকার ডালার তলায় যে বকসি কোম্পানির নাম খোদাই করা ছিল…! সেই বকসি। দেখেননি?”

কৃষ্ণকান্ত অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক পলক। পরে বললেন, “হ্যাঁ, দেখেছি। কেন বলুন তো?”

“বকসি বানানটা খেয়াল আছে?”

“আছে। আপনি যা বলছেন–সেইরকমই। BOXY। তবে ওটা যে আমাদের বকসি–”

“কোম্পানির নামের তলায় ঠিকানা ছিল ধর্মতলা স্ট্রিটের?”

“ছিল। তবে শুধু ধর্মতলা ছিল। ক্যালকাটা। একেবারে খুদে-খুদে হরফে।”

“ওই কোম্পানির কাউকে আপনি চিনতেন?”

“না।”

“ননী বকসি?”

“না।”

“কোনোদিন সেই দোকানের খোঁজও করেননি?”

“না, মশাই! কী জন্যে খোঁজ করব?”

কিকিরা পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছলেন। আজ বড় গুমোট, সকাল থেকেই। ঘামে সর্বাঙ্গ ভিজে জল হয়ে যাচ্ছে। মুখ মুছতে মুছতে কিকিরা বললেন, “আচ্ছা কৃষ্ণকান্তবাবু, আপনার কি একবারও ইচ্ছে হয়নি, আপনার বাবার স্মৃতি হিসেবে যে-ঘড়িটা তুলে রেখে দিয়েছিলেন, সেটা একবার সারাবার চেষ্টা করা! হাজার তোক ঘড়িটা তো সুন্দর দামি।”

মাথা নেড়ে কৃষ্ণকান্ত বললেন, “না মশাই, মনে হয়নি। কী হবে সারিয়ে? কেই বা সারতে পারবে! লাভের মধ্যে যা আছে তাও থাকবে না। সারাবার হলে বাবাই সারাতেন। …আপনি বার বার আমায় ঘড়ির কথা বলছেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, সোনার ঘড়ি হলেও বাবার স্মৃতি হিসেবেই আমরা ওটা রেখে দিয়েছিলাম। অন্য কিছু মনে হয়নি।”

কিকিরা জল খেতে চাইলেন।

জল আনতে বললেন কৃষ্ণকান্ত বেয়ারাকে ডেকে।

“ঘড়ির কথা আমি বারবার তুলছি কেন জানেন?” কিকিরা বললেন, “আমার বিশ্বাস ওই ঘড়ির জন্যেই বাবলুর কিছু হয়েছে। বাবলুর বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ আর ঘড়িটা হঠাৎ খোয়া যাওয়া–একই সঙ্গে–এই দুটোর মধ্যে বড় সম্পর্ক রয়েছে। …যাক গে, আপনি কি জানেন আপনার বাবা কবে ঘড়িটা কিনেছিলেন?”

“না, মনে নেই।”

“বছর পঞ্চাশ বাহান্ন আগে?”

“কেমন করে বলব! আমার তখন কতটুকু বয়েস। বড়জোর দু তিন বছর। দাদা আমার চেয়ে দু বছরের বড়। দাদাও বলতে পারবে না।”

জল এল।

কিকিরা জল খেলেন। কৃষ্ণকান্ত সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার এগিয়ে দিলেন কিকিরাকে।

সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে কিকিরা বললেন, “ওই ঘড়ির যারা মালিক ছিল বকসি কোম্পানি, তাদের নাম জোগাড় করতে আমায় কষ্ট করতে হয়েছে। ভাগ্য ভাল, পেয়ে গেলাম। বসিদের দোকান কবেই উঠে গিয়েছে। মালিকের মেজো ছেলে ননী বকসি এখনো আছেন। বয়েস হয়েছে। তাঁর সঙ্গে আমি দেখা করেছিলাম। কথা হল। শুনলাম, ঘড়িটা একচল্লিশ-বিয়াল্লিশ সাল নাগাদ ওঁদের গ্রামের বাড়ি থেকে চুরি গিয়েছিল। ওঁরা তখন কলকাতা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। ইভ্যাকুয়ি হিসেবে।” বলে কিকিরা পুরো ঘটনাটাই বললেন কৃষ্ণকান্তকে।

কৃষ্ণকান্ত শুনলেন। মনে হল না, তিনি এসব কথা আগে শুনেছেন। শেষে বললেন, “আমার বাবাকে নিশ্চয় আপনারা চোর ঠাওরাবেন না!”

কিকিরা জিব কেটে বললেন, “ছি, ছি, এ আপনি কী বলছেন! …চোরাই জিনিস কবে কার হাত-ফেরতা হয়ে একসময় যদি আপনার বাবার হাতে এসে থাকে, তিনি কিনেছিলেন। এতে দোষ কোথায়?”

 “বাবা বেঁচে থাকলে এব্যাপারে যা বলার বলতে পারতেন। আমি কিছু জানি না, কী বলব!”

“যাক গে, বাদ দিন ওকথা। আচ্ছা মশাই, আপনি তো ঘরবাড়ি কনস্ট্রাকশানের কাজ করেন। আমায় একটা কথা বলুন। ফক্স অ্যান্ড মল্লিক বলে একটা কোম্পানি আছে। আমি আজ সেখানে গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই আপনার কাছে আসছি। ওখানে গিয়ে খোঁজখবর করে শুনলাম, ওরা কলকাতার পুরনো ঘরবাড়ি ভাঙার পর ভাঙা বাড়ির দরজা, জানলা, টালি, মার্বেল, কাঁচ, বাথরুমের ফিটিংস..”

“হা।” কিকিরাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই কৃষ্ণকান্ত বললেন, “জানি। ওরা–যাকে আমরা সাহেববাড়ি বলি, সেই সব বাড়ি ভাঙার পর দরকারি যা কিছু কিনে নেয়। কলকাতার আশেপাশেও এমন বাড়ি আছে। আবার পুরনো বনেদি বাড়ি ভাঙার পরও নানা জিনিস কেনে। আসবাব, থানা, ঝাড়–অনেক কিছু।”

“নিলামে কেনে?”

“সবসময় নয়। সরাসরিও কিনতে পারে। ওরা খোঁজ রাখে। এটাই ওদের কারবার। ওদের এজেন্টও থাকে। সত্যি বলতে কী, পুরনো ভাঙা বাড়ির কাঠকুটোর বাজার দর বেশ চড়া। কেন হবে না বলুন! এখন ওসব কাঠ আপনি পাবেন কোথায়! কোথায় পাবেন ইটালিয়ান মার্বেল, জয়পুরি টালি।” কৃষ্ণকান্ত নিজে এবার একটা সিগারেট ধরালেন। কথা বলতে বলতে হয়ত খানিকার মতন একটু অন্যমনস্ক হয়েছেন। নিজেই আবার বললেন, “আমার এক ক্লায়েন্ট তাঁর বাড়ির অর্ধেক জিনিসপত্র এইভাবে কিনেছিলেন। একটা বাথটব পেয়েছিলেন ফুট পাঁচেক লম্বা, অ্যানামাল, যাকে বলে কলাই করা–সেই জিনিস। ড্যামেজ সামান্যই। কী দেখতে।”

“আপনিও বাড়ির কাজে এ-সব কেনেন?”

“না, আমি কিনি না। ক্লায়েন্ট যদি কিনে আনেন, আমরা কাজে লাগাবার মতন করে নিই। অন্তত কাঠটা দরজা-জানলার কাজে লাগাই। টালিও নিই বেছেবুছে।”

“ও!…আপনি ওই ফক্স মল্লিকদের কাউকে চেনেন?”

“না। ওদের নাম জানি। পুরনো কোম্পানি। আগে বোধ হয় ওদের নাম ছিল ফক্স অ্যান্ড কলিন্স। পরে নাম পালটেছে।”

“বাবলুর সঙ্গে মল্লিকবাড়ির কারও ভাবসাব ছিল?”

কৃষ্ণকান্ত যেন কথাটা শুনতেই পাননি। বোকার মতন তাকিয়ে থাকলেন। পরে বললেন, “বাবলুর সঙ্গে ভাবসাব! তা কেমন করে হবে! আমি নিজেই যাদের চিনি না, বাবলু তাদের কেমন করে চিনবে?”

কিকিরা হেসে বললেন, “তা কেন হবে না! আপনি না চিনতে পারেন, তা বলে বাবলু চিনবে না! তার বন্ধুবান্ধব, চেনাজানা ছেলে, কলেজের ছেলেদের আপনি কি সবাইকে চেনেন?”

কৃষ্ণকান্ত চুপ করে থাকলেন। কথাটা ঠিকই। বাবলুর সঙ্গীসাথীদের কজনকেই বা তিনি চেনেন! চুপ করে থাকতে-থাকতে হঠাৎ বললেন, “ওরা থাকে কোথায়? বাড়ি কোথায় মল্লিকদের?”

“মুদিয়ালি।”

“তাই নাকি! ..তবে তো আমাদের বাড়ি থেকে দূরে নয়।”

“না। আমার ওদিকে আসা-যাওয়া নেই। কমই চিনি। টালিগঞ্জ রেল। ব্রিজ অবশ্য চিনি।”

“ও বাড়ির কোনো ছেলে কি বাবলুর বন্ধু?”

“সেটা এখনই বলতে পারছি না। তবে, বাবলু যেদিন যে-সময় থে ঘরছাড়া, ঠিক সেদিন সেই সময় ওই লেকের কাছে বড় রাস্তায় একটা গাি একটি ছেলেকে ধাক্কা মেরে পালায়। ছেলেটি মল্লিকদের পাশের বাড়ির। বেচারি জখম হয়েছে। হাত ভেঙেছে, পায়ে চোট। তার চেয়েও বড় কথা, ছিটকে পড়ে গিয়ে মুখে এমন লেগেছে যে, গালের চোয়ালের হাড় ফেটে গিয়েছে। বেচারি নার্সিংহোমে পড়ে আছে আজ ক’দিন। কপাল ভাল, মাথাটা বেঁচে গিয়েছে।”

কৃষ্ণকান্ত কেমন হতবাক! “আপনাকে এ-সব কথা কে বলল?”

“আমি তো আপনাকে আগেই বললাম, এখানে আসার আগে আমি মল্লিকদের অফিসে গিয়েছিলাম। আলাপ করে কথাবার্তা বলতে বলতে ঘটনাটার কথা শুনলাম।”

 “আপনি বাবলুর কথা বলেছেন?”

“বলেছি। ওঁরা কাগজেও দেখেছেন নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপনটা। কিন্তু এই দুটো ঘটনার মধ্যে কোনো যোগাযোগ আছে ভাবেননি। তা ছাড়া ওঁদের কেউ বাবলুকে চেনেন না। দেখেছেন বলেও মনে করতে পারলেন না।”

কৃষ্ণকান্ত সিগারেটের টুকরোটা নিভিয়ে দিয়ে মাথায় হাত দিলেন। অল্পসময় চুপচাপ। পরে বললেন, “ছেলেটি এখন কেমন আছে?”

“আগের চেয়ে ভাল।” বলে কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন। “এই দুটো ঘটনার মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা তা এখনই বলতে পারছি না কৃষ্ণকান্তবাবু! থাকলে আমি বলব, বাবলুকে কেউ বা কারা তুলে নিয়ে গিয়েছে। …দেখি, খোঁজ নিই। আচ্ছা চলি!”

.

০৭.

সন্ধেবেলায় কিকিরার ঘরে বসে কথাবার্তা হচ্ছিল।

কিকিরা যেমন সারা দুপুর স্ট্র্যান্ড রোডের ফক্স অ্যান্ড মল্লিকদের অফিস ঘুরে কৃষ্ণকান্তর কাছে গিয়েছিলেন, তারাপদও তার অফিস থেকে মাঝ দুপুরে বেরিয়ে লালবাজারের কাছে ফতেচাঁদ জুয়েলারের খোঁজ করেছে। কোনো লাভ হয়নি তারাপদর; ফতেচাঁদের দোকান আর নেই, অনেক আগেই উঠে গিয়েছে। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে শুধু এইমাত্র জানা গেল যে, বাবুজি মারা যাওয়ার পর তাঁর ছেলেরা কারবার গুটিয়ে দিল্লি চলে গিয়েছেন।

তারাপদ বলল, “স্যার, ফতেচাঁদের ব্যাপারটা বাদ দিয়ে দিন।”

 কিকিরা যে খুব কিছু আশা করেছিলেন ফতেচাঁদদের কাছ থেকে, তা নয়। তবু দু এক কথা যদি জানা যেত, খারাপ হত না। আসলে এই ধরনের কাজই হল, কোথাও কোনো গন্ধ পেলে শুঁকে বেড়ানো। কিকিরা ঠাট্টা করে বলেন, দ্যাখো হে তারা আর স্যান্ডেল উড–সেই যে কথা আছে যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন….।

কথাবার্তার মধ্যে একসময় কিকিরা বললেন, “এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে, বাবলুকে সেদিন কেউ তুলে নিয়ে গিয়েছে। কিডন্যাপ…!”

চন্দন বলল, “কীভাবে?”

তারাপদ বলল, “কিকিরা, বাবলুর বন্ধু পবন যা বলেছিল তাতে মনে হয়, ওকে ঝপ করে তুলে নিয়ে যাওয়া সহজ কর্ম নয়। বাবলুর স্বাস্থ্য ভাল, স্পোর্টসম্যান, ক্যারাটের প্যাঁচ-পয়জার জানে একটু-আধটু..”

কিকিরা বললেন, “সবই ঠিক। তবু ধরো কেউ যদি আচমকা তাকে ধরে অজ্ঞানটজ্ঞান করে…”

কিকিরার কথা শেষ হতে দিল না চন্দন, বলল, “শুনুন স্যার, অত সহজে কাউকে অজ্ঞান করা যায় না। ওই যে আমরা গল্পের বইয়ে পড়ি, রাস্তাঘাটে ভিড়ের মধ্যে কেউ রুমালে ক্লোরোফর্ম ঢেলে একজনের মুখের কাছে চেপে ধরতেই সে সঙ্গে-সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে গেল, তা কিন্তু হয় না বাস্তবে। এর অনেক অসুবিধে আছে।.. তবে হ্যাঁ, দু-তিনজনে মিলে একটা লোকের হাত, পা, মাথা চেপে ধরেছে, তাকে নড়তে দিচ্ছে না, অন্য একজন তার মুখের কাছে ক্লোরোফর্ম দেওয়া রুমাল জোরসে চেপে ধরল, তবে লোকটা অজ্ঞান হতে পারে। কিন্তু মনে রাখবেন এ-ভাবে ক্লোরোফর্ম অ্যাপ্লাই করা ভীষণ রিস্কি। এতে মানুষ মারাও যেতে পারে। এভরি চান্স।”

কিকিরা শুনলেন, বললেন, “চাঁদু, তুমি ডাক্তার; তোমার কথা মানলাম। কিন্তু ধরো দু-চারজনের একটা গ্যাঙ- বাবলুকে বাগে পেয়ে কাছাকাছি একটা গাড়িতে তুলে নিয়ে হাত-মুখ চেপে ধরে অজ্ঞান করার চেষ্টা করে তবে?”

“করতে পারে,” চন্দন বলল।

 “আর সেই গাড়ি পালাবার সময় রাস্তার মধ্যে কাউকে ধাক্কা মেরে পালায়?”

“পালাতে পারে।… আপনি কি ওই মল্লিকদের প্রতিবেশী ছেলেটির কথা বলছেন?”

“ভাবছি। দুটো ঘটনাই ঘটেছে একই দিনে, মোটামুটি একই সময়ে, আর কাছাকাছি জায়গায়।”

তারাপদ কান চুলকোতে-চুলকোতে বলল, “বাবলু আর জখম-হওয়া ছেলেটির মধ্যে জানাশোনা ছিল বলে তো আপনি কোনো প্রমাণ পাননি।”

“না, মাথা নাড়লেন কিকিরা, “এখনো পাইনি। হয়ত জানাশোনা ছিলও না। তাতে কিন্তু একথা প্রমাণ হয় না যে, ছেলেটি কিছু দেখেনি? ধরো সে কিছু দেখেছে? বা তার নজরে পড়েছে?”

“আপনি কি বলতে চান, রাস্তা থেকে একটা ছেলের কিছু নজরে পড়েছিল বলে গাড়িটা তাকে চাপা দিয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিল?”

“না, তা হয়ত নয়। পালাতে গিয়েও ধাক্কা মারতে পারে। ছেলেটির সঙ্গে দেখা না করলে আমরা তা জানতে পারছি না।”

চন্দন বলল, “ওদের বাড়ির লোক আমাদের দেখা করতে দেবে ছেলেটির সঙ্গে? তার ওপর সে এখন নার্সিং হোমে।”

“দেবে। মল্লিকদের বড় ভাই মানুষটি ভাল। আমি তাঁর কাছে কিছুই লুকোইনি। কেমন করে তাঁদের কোম্পানির নাম পেলাম, কেনই বা ফক্স নিয়ে মাথা ঘামালাম, সবই বলেছি। বাবলুর কথা বলেছি। তার মা, বাবা, বোনের কথা। বলেছি, ওঁরা দুশ্চিন্তা, দুভাবনায় প্রায় মরে আছেন। কোনো ভাবে, যে কোনো লোকের কাছ থেকে একটু সাহায্য পেলে যদি আমাদের সামান্য উপকার হয়–” কিকিরা কথা শেষ না করে হাই তুললেন। তাঁকে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। নিজেই আবার বললেন, “ভদ্রলোককে আমার খুবই সিমপ্যাথেটিক মনে হল। হাজার হোক, তিনিও তো ছেলের বাবা।”

“ওঁর কোনো ছেলে কি পাশের বাড়ির জখম-হওয়া ছেলেটির বন্ধু?”

“ছোট ছেলের বন্ধু।”

“চলুন, তবে দেখা করতে যাই,” চন্দন বলল।

“ভাবছি, কাল যাব। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে।… তুমি আমি যাব নার্সিং হোমে, আর তারাপদ যাবে বাবলুদের ড্রামা ক্লাবের সেক্রেটারি ধীরাজের কাছে।”

“ধীরাজ খড়্গপুর থেকে ফিরলে তো?” তারাপদ বলল।

 “এখনো ফেরেনি? কতদিন গিয়ে বসে থাকবে খঙ্গাপুরে?”

“দেখি। মার অসুখ শুনে বাড়ি গিয়েছে। ফিরেছে কিনা কে জানে! খোঁজ করব।”

সামান্য সময় চুপচাপ। পাখার শব্দ, নিচে থেকে ভেসে আসা টুকরো-টাকরা অস্পষ্ট কথা, বড় রাস্তায় গাড়ির হর্ন কানে আসছিল।

চন্দন হঠাৎ বলল, “আচ্ছা কিকিরা, আপনি ঘড়ির ব্যাপারটা বাদ দিয়ে ভেবেছেন কিছু?”

“না,” মাথা নাড়লেন কিকিরা, “দু-একবার ভাবার চেষ্টা করেছি। পারিনি। মাথার মধ্যে ঘড়িটাই টিকটিক করছে।” ও

“ওটা অচল ঘড়ি। টিকটিক করবে না,” চন্দন ঠাট্টা করেই বলল।

 কিকিরা আবার হাই তুললেন। “ভেরি মাচ টায়ার্ড হে। এই বয়েসে রোদে এত ঘোরাঘুরি পোয়! …কী বলছিলে! ঘড়ির কথা! না, ঘড়ি বাদ দিলে বাবলুর হঠাৎ অদৃশ্য হওয়ার কোনো কারণ আমি দেখি না। ঘড়ি মাস্ট।”

“বেশ, ঘড়ি মাস্ট। কিন্তু আপনি বলুন, একটা অচল ঘড়ি, হোক না সোনার, তবু সেটা এমন কী লক্ষ টাকা দাম যে, তার জন্যে…”

“সেটাই তো বুঝতে পারছি না চাঁদু। সোনার ঘড়ি বলেই তার দাম আজকের বাজারেও লক্ষ টাকা নয়। হতে পারে না। রেয়ার ঘড়ি হলেও অত দাম হবে বলে আমার মনে হয় না। আমি আমার জুয়েলার বন্ধু দত্তকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে সোনার যে হিসেব দিল তাতে মনে হয়, অল গোল্ড হলেও, ওই ঘড়িতে আড়াই-তিন ভরির বেশি সোনা থাকার কথা নয়। হাজার পনেরো টাকা হতে পারে বড়জোর এখনকার বাজার দরে। তবে সোনার সঙ্গে পান না মিশিয়ে এ কাজ করা যায় না। বিদেশি ব্যাপার, তাও অনেক পুরনো। ওরা কীভাবে করেছিল, কে বলতে পারে!”

তারাপদ বলল, “সবই হল কিকিরা, শুধু একজনের কাছে এখনো যাওয়া হয়নি।”

“কে? সিনহাসাহেব! হোটেল ম্যানেজার?”

“হ্যাঁ। ওই ভদ্রলোক আর বাবলু সেদিন দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন। ওঁর কাছে যাওয়া উচিত একবার।”

“যাব। …আগে, মল্লিকদের পাড়ার ছেলেটির সঙ্গে কথা বলে নিই একবার।”

তারাপদ আর কিছু বলল না।

.

০৮.

মল্লিকদের পাশের বাড়ির ছেলেটির নাম বিষ্ণু। বছর কুড়ি একুশ বয়েস। বাবলুর সমবয়েসিই হবে। ছেলেটিকে দেখতে বেশ। ছিপছিপে গড়ন। মাথার চুল কোঁকড়ানো। সামান্য কটা রঙের চোখের মণি। গায়ের রংটি ধবধবে ফরসা।

নার্সিং হোমের এক সরু মতন কেবিনে সে শুয়ে ছিল। ডান চোয়ালে থুতনির দিকে জখম হয়েছিল তার; মাথার দিক থেকে পাক মেরে মুখ-চোয়াল জড়িয়ে ব্যান্ডেজ। ডান হাতের হাড় ভেঙেছে। প্লাস্টার করা। পায়ের দিকেও অল্পস্বল্প জখম।

বিষ্ণু এখন অনেকটাই ভাল। দু-চারদিনের মধ্যে নার্সিং হোম থেকে ছেড়ে দেবে। বাড়ি চলে যাবে বিষ্ণু। তবে তার চিকিৎসা এখনো চলবে। মাসখানেকের কম তো নয়ই।

বিষ্ণুর বাড়ির লোকজনরা চলে গেলেন। একটু তাড়াতাড়িই আজ। বিষ্ণুর বাবাই তাদের সরিয়ে দিলেন। তারপর কিকিরা আর চন্দনকে ছেলের কেবিনে ডেকে আনলেন। আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন মল্লিকমশাই বিষ্ণুর বাবাকে বলে। ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে আসার পরও কিকিরারা কিছুক্ষণ থাকতে পারবেন, অসুবিধে হবে না।

ছেলেকে বলে রেখেছিলেন ভদ্রলোক আগেই, শুধু পরিচয় করিয়ে দিলেন কিকিরার সঙ্গে।

কিকিরা কিছু ফুল এনেছিলেন হাতে করে। রাখলেন। নরম মুখ করে দেখলেন বিষ্ণুকে। চন্দন যেন খুঁটিয়ে দেখে নিল ছেলেটিকে। আন্দাজ করে নিল কী ধরনের চোট-জখম হতে পারে বিষ্ণুর।

কিকিরা বিষ্ণুর বাবাকে বসতে বললেন।

“আপনারা?”

“বসব। আপনি চেয়ারটায় বসুন। আমি টুলটা টেনে নিচ্ছি। চন্দন বিছানাতেই বসতে পারবে।”

বিষ্ণুর বাবা নিজেই ছেলের বিছানায় বসলেন। “আপনারা বসুন। আমি এখানেই বসলাম।”

কিকিরারা বসলেন।

ভদ্রলোক বললেন, “ওর কথা বলতে কষ্ট হয়। আগে তো মুখ নাড়তেই পারছিল না। এখন পারছে। যা জিজ্ঞেস করার অল্প কথায় করবেন। আপনাদের সব কথা বলতে হবে না, আমি আপনাদের কথা মল্লিকদের মুখে শুনে ওকে বলে রেখেছি। শুধু আপনাদের যা জানার, জেনে নিন।”

কিকিরা বললেন, “ভালই করেছেন। আমরা সামান্য কটা কথা জেনেই চলে যাব।”

বিষ্ণু তাকিয়ে থাকল।

কিকিরা বিষ্ণুকে বললেন, “সেদিন তুমি কী দেখেছিলে একটু বলতে পারবে?”

বিষ্ণু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “বলছি।” কথা বলতে তার কষ্টই হচ্ছিল। ভাল করে মুখ নাড়তে পারছে না। তবু থেমে-থেমে, মাঝে-মাঝে ব্যথার দরুন কষ্টের মুখ করে যা বলল তাতে বোঝা গেল, সেদিন সকালে সে রোজকার মতন রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামের দিকে যাচ্ছিল। সে ফুটবল প্লেয়ার। সকালে ঘণ্টাখানেক ছোটাছুটি, প্র্যাকটিস করে সে যখন প্রায় স্টেডিয়ামের কাছাকাছি পৌঁছেছে, তখন দেখে একটি ছেলেকে দু-তিনজনে মিলে ঠেলতে ঠেলতে এনে একটা গাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে।

“কী গাড়ি?”

“মারুতি ভ্যান।”

“রং?”

“কালচে মতন। নেভি ব্লু হবে।”

“নম্বর?”

“জানি না। দেখার কথা মনে হয়নি।”

“যাকে ঠেলতে-ঠেলতে আনছিল তার পোশাকআশাক?”

“ট্রাকসুট পরা।”

“হঠাৎ ঠেলতে-ঠেলতে এনে গাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দিল?”

“না, না, মানে, আগে তো আমি নজর করিনি। খেয়ালও করিনি। আমার মনে হল, ট্রাকসুট-পরা ছেলেটির পাশে-পাশে, পেছনে ওরাও জগিং করছিল। আচমকা তারা ওকে ঘিরে ফেলে, তারপর ঠেলে নিয়ে কাছের গাড়িতে তুলে দেয়।”

“তুমি একেবারে ঠিক যা দেখেছ তাই বলছ?”

“হ্যাঁ। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, ছেলেটি যখন ছুটছিল তখন পাশ থেকে বা পেছন থেকে অন্য দুজনের কেউ তাকে ল্যাং মেরেছিল, বা পুশ করেছিল। ছেলেটি হোঁচট খাওয়ার মতন মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছিল, তখন তাকে ওরা ধরে ফেলে। তারপর গাড়ির দিকে…”

“বুঝেছি।… তুমি ছেলেটিকে চেনো?”

 “না। তবে তাকে আমি মাঝে-মাঝে ওদিকে দৌড়তে দেখেছি।”

“তোমাকে ওই গাড়িঅলারা ধাক্কা মারল কেন?”

“জানি না। আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে ওদের দেখছিলাম। … শেষে এক-দু’বার চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। ওরা গাড়ির মুখ ঘুরিয়েই রেখেছিল। সঙ্গে-সঙ্গে পালাল। যে গাড়ি চালাচ্ছিল, সে হয় আনাড়ি, না হয় তাড়াতাড়ির মধ্যে পালাতে গিয়ে আমায় ধাক্কা মেরেছে।”

“তারপর?”

“আমি রাস্তার পাশে ছিটকে পড়লাম। … আর আমার কিছু মনে নেই।”

বেশ কষ্ট করেই কথাগুলো বলছিল বিষ্ণু। কথাও স্পষ্ট নয়। জড়িয়ে, যাচ্ছে।

বিষ্ণুর বাবা তাকালেন। যেন বলতে চাইলেন, আর নয় এবার শেষ করুন।

কিকিরা মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ, তাঁরা উঠে পড়বেন এবার। চন্দনের দিকে তাকালেন কিকিরা।

চন্দন কী ভেবে বিষ্ণুকে জিজ্ঞেস করল, “ঘটনাটা যখন ঘটে আশেপাশে লোক ছিল না?”

“অত ভোরে ওখানে লোক কমই থাকে। তফার্তেছিল নিশ্চয় দু-একজন। নজর করেনি। করলেও বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা। হঠাৎ চোখে পড়লে মনে হবে, ছেলেটি হয়ত অসুস্থ হয়ে পড়েছে দৌড়তে- দৌড়তে তাকে অন্যরা তুলে নিয়ে গিয়ে বসাচ্ছে কোথাও।”

“গাড়িটার জানলা…?”

“বন্ধ ছিল।”

“কাছাকাছি কোনো ভদ্রলোক কি কুকুর নিয়ে বেড়াচ্ছিলেন?”

“লক্ষ করিনি।”

“গাড়িটা কোন দিকে গেল?”

“সোজা বেরিয়ে গেল। যেটুকু চোখে পড়েছিল মনে হল শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডের দিকে।”

কিকিরা উঠে পড়লেন। বললেন, “ঠিক আছে ভাই। তোমার সঙ্গে কথা বলে উপকার হল। … নাও, তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে ওঠো। আমরা চলি।” তারপর ভদ্রলোককে বললেন, “আপনাকে আর কী বলে ধন্যবাদ জানাব! যথাসাধ্য সাহায্য করলেন আমাদের।”

বিষ্ণুর বাবা উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, “না না, এ আর এমন কিসের উপকার! ওই হারানো ছেলেটির খোঁজ পেলে একবার জানাবেন।”

“চলি।” ভদ্রলোক কিকিরাদের সঙ্গে কেবিনের বাইরে বেরিয়ে এলেন। “আপনারা এগোন, আমি একটু পরে আসছি। নমস্কার।”

কিকিরারা কয়েক পা এগিয়ে সিঁড়ি ধরলেন। ছোট্ট নার্সিং হোম। দোতলা বাড়ি। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই আলো চলে গেল। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পড়তে হল চন্দনদের। লোডশেডিং নাকি?

না, লোডশেডিং নয়; আবার আলো এসে গেল। ভেতরে কোনো গণ্ডগোল হয়ত!

রাস্তায় এসে কিকিরা বললেন, “চাঁদু, আমার এইরকমই সন্দেহ হচ্ছিল, কিডন্যাপিং। কিন্তু কেন? হোয়াই?”

“ঘড়ির জন্যে। আর কী হতে পারে?”

“মানতেই হবে। তবে কথা হল, ঘড়িটা যদি বাবলুর কাছে থাকে তবেই তাকে কিডন্যাপ করার মানে হয়। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, সাত সকালে বাবলু কেন একটা অচল পকেট ঘড়ি সঙ্গে নিয়ে বেরুবে! ব্যাপারটা কি আগে থেকে ঠিক করা ছিল। প্রিঅ্যারেঞ্জড? যদি তাই হয়, বাবলু কাকে ঘড়িটা দিতে বেরিয়েছিল। কেন? সেই লোকটা কোথায় গেল? প্রিঅ্যারেঞ্জড না হলে যারা বাবলুকে তুলে নিয়ে গেল তারাই বা জানল কেমন করে বাবলুর কাছে ঘড়ি আছে?”

চন্দন বলল, “লোকটাই হয়ত বলেছে।”

কিকিরা চুপ। অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে একটা সিগারেট চাইলেন চন্দনের কাছে। ধরালেন। “কটা বাজে?”

“সাড়ে সাত।”

“একবার বাবলুদের বাড়ি যাবে নাকি? মাত্র সাড়ে সাত–!”

“কী করবেন গিয়ে?”

“করার বিশেষ কিছু নেই, শুধু বিষ্ণুর খবরটা ডিটেলে কৃষ্ণকান্তকে জানাতে পারি।”

“ওটা তেমন জরুরি নয়, স্যার। কাল ফোন করে জানাতে পারেন অফিসে।”

“তা হলে বাড়ি ফিরতে হয়।”

“তাই চলুন।”

কিকিরা বলতে যাচ্ছিলেন, তাই চলো; হঠাৎ কী মাথায় এল, বললেন, “চাঁদু, একবার সেই ড অ্যান্ড দি ম্যান সিনহার বাড়িতে গেলে কেমন হয়! আমরা তো কাছাকাছিই রয়েছি।”

চন্দন অবাক! বলল, “এখন যাবেন? বাড়িতে পাবেন তাঁকে! হোটেলের ম্যানেজার মানুষ, এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবেন?”

“চেষ্টা করা যেতে পারে। এমনিতে ভেবেছিলাম, তাঁর হোটেলেই যাব। ভাবছি, কাছাকাছি যখন এসে পড়েছি একবার চেষ্টা করতে দোষ কোথায়?

চন্দনের তেমন গা ছিল না। বলল, “বিষ্ণু যা বলল, তাতে কুকুরঅলা ভদ্রলোককে সে সেদিন ওই সময়ে কাছাকাছি দেখেনি।”

“তাই তো বলল! … তবু চলো, একবার আলাপ করে দেখা যাক। নাও একটা গাড়ি ধরো।”

.

রাজেন সিনহাকে বাড়িতেই পাওয়া গেল।

টিভি দেখছিলেন। নিজেই বাইরে এসে কোলাপসিবল গেটের ফাঁক দিয়ে দেখলেন কিকিরাদের।

“কী চাই?”

“আপনার কাছেই এসেছি।”

“আমার কাছে? আপনারা?”

“আমরা বেপাড়ার লোক। আপনি চিনবেন না। দুটো কথা বলতে এসেছি।”

“কী ব্যাপারে?”

“কৃষ্ণকান্তবাবুর ছেলে বাবলুর ব্যাপারে।”

রাজেন সিনহা যেন ভাবলেন কয়েক মুহূর্ত। “আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন? আসুন।”

“আপনার কুকুর? কুকুরে আমার ভীষণ ভয়, স্যার।”

“কুকুর পেছনের দিকে বাঁধা আছে। ভয় নেই।”

নিজের হাতে গেটের ভেতর দিকের তালা খুলে দিলেন সিনহা। “আসুন।”

চার-ছ’ পা এগিয়ে ডানদিকে বসার ঘর সিনহাসাহেবের। সাজানো-গোছানো। তবে পুরোপুরি সাজানো নয় বলেই মনে হল। নতুন এসেছেন।

টিভি বন্ধ করে দিলেন ভদ্রলোক। “বসুন।”

কিকিরারা বসলেন। নিজের এবং চন্দনের পরিচয় দিলেন। হাসি-তামাশা করলেন না।

রাজেন সিনহার বয়েস বছর বাহান্ন-চুয়ান্ন। মাথায় বিশেষ লম্বা নয়। সামান্য মেদবহুল চেহারা। হাত-পা খাটো ধরনের, শক্ত। মাথার টাকটি চোখে পড়ার মতন। পরনে পাজামা, গায়ে খাটো পাঞ্জাবি, ফতুয়া বললেও চলে। গোল মুখ। চোখ উজ্জ্বল। থুতনির তলায় কাঁচাপাকা দাড়ি।

“বলুন?”

“আপনার কুকুর হঠাৎ এসে পড়বে না তো?”

“না। ঘুমিয়ে আছে। বাঁধাও আছে।”

কিকিরা বিনয় করে বললেন, “আমরা বাবলুর খোঁজখবর করে বেড়াচ্ছি। মানে কৃষ্ণকান্তবাবুর কথামতন…”

“আপনারা প্রাইভেট ডিটেকটিভ?”

“না স্যার, আমাদের সঙ্গে গোয়েন্দাগিরির কোনো সম্পর্ক নেই। বলতে পারেন, আমরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো পার্টি।”

“ও! তা দরকারটা বলুন?”

“বলছি। এক গ্লাস জল পাব?”

“জল! নিশ্চয়। পাহাড়ি পাহাড়ি।”

ডাক শুনে পাহাড়ি এল। বেঁটেখাটো তাগড়া মাঝবয়েসি নেপালি কাজের লোক। রাজেন সিনহা ইশারায় জল দিতে বললেন। ঠাণ্ডা জল। পাহাড়ি চলে গেল।

কিকিরা বললেন, “আপনি এ-পাড়ায় নতুন মিস্টার সিনহা!”

“হ্যাঁ, নতুন। সবেই এসেছি।”

“বাবলুকে আপনি দেখেছেন?”

“দেখেছি। আগে ওর নাম জানতাম না। পরে শুনলাম।”

“বাবলুকে কি আপনি সেদিনই প্রথম দেখলেন?”

“কবে?”

“যেদিন থেকে ওকে আর পাওয়া যাচ্ছে না?”

“না, তার দিন দুই আগে প্রথম দেখেছি। … কথা হয়নি।”

“কথা হয়নি। শুনলাম যেদিন”

“যেদিন থেকে ছেলেটিকে পাওয়া যাচ্ছে না সেইদিনই সকালে তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়। ও দৌড়তে বেরিয়েছিল, আমি আমার টোটো আই মিন কুকুরকে নিয়ে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলাম। রেল লাইন পেরিয়ে খানিকটা এগোতেই লেকের কাছে ওর সঙ্গে আলাপ। ছেলেটি আমাকে টোটোর কথা জিজ্ঞেস করছিল। তারপর যে যার মতন চলে যাই। … কেন, মিস্টার দত্তরায়কে তো আমি সে-কথা বলেছি। উনি কয়েকদিন আগে আমার কাছে এসেছিলেন।”

পাহাড়ি ঘরে এল। গোল বাহারি ট্রে করে প্লেটের ওপর কাচের গ্লাস বসিয়ে কোল্ড ড্রিঙ্কস এনেছে দু’জনের জন্য। নামিয়ে রাখল।

কিকিরা বললেন, “আরে, এ-সব আবার কেন! প্লেইন জল হলেই চলত।”

“এটাও জল! নিন। “

 কিকিরা আর চন্দন গ্লাস তুলে নিল।

দু-চার চুমুক কোল্ড ড্রিঙ্কস খেয়ে কিকিরা বললেন, “আপনি সেদিন পরে আর বাবলুকে দেখেননি?”

“খেয়াল করতে পারছি না। কেন?”

“আমরা শুনলাম, তার খানিকটা পরে বাবলুকে কিন্ন্যাপ করা হয়েছে। এমনভাবে ঘটনাটা ঘটানো হয়েছে যাতে চট করে বোঝা না যায় একটা গ্যাং তাকে কিডন্যাপ করছে।” কিকিরা খানিকটা আগে শোনা বিষ্ণুর কথাগুলো বুঝিয়ে বললেন সিনহাকে।

চন্দন একটাও কথা বলছিল না। রাজেন সিনহাকে দেখছিল। ভদ্রলোকের কথাবার্তা, আচার-আচরণের মধ্যে সাজানো-গোছানো ভাব আছে। গলার স্বর খানিকটা গম্ভীর, অথচ রুক্ষ নয়। হোটেল ম্যানেজার বলেই হয়ত কেতাদুরস্ত আচরণ।

সিনহা মন দিয়ে কিকিরার কথাগুলো শুনছিলেন। ভাববার চেষ্টাও করছিলেন।

“আপনি গাড়িটাড়ি কিছু দেখেননি?” কিকিরা বললেন।

“গাড়ি! … দেখুন, কলকাতার রাস্তায় গাড়ি দেখা যায় না এমন হয় না, সে ভোরেই হোক কি মাঝ রাতে! এক-আধটা গাড়ি নিশ্চয় দেখা যাবে। তবে আমি নজর করে গাড়িটাড়ি দেখিনি। যদি দেখতাম, দু-তিনটে লোক মিলে ছেলেটিকে ঠেলতে-ঠেলতে কোনো গাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, বাধা দিতাম।”

“আপনি?”

“হ্যাঁ,” সিনহা একটু হাসলেন, “আমার গায়ে খানিকটা জোর এখনো আছে। তবে তার দরকার হত না। টোটোকে ছেড়ে দিতাম।”

“টোটো!”

“ভীষণ ট্রেইন্ড ডগ। অ্যান্ড ফেরোসাস। ওকে আমি এমনভাবে ট্রেই করেছি যে, যদি ইশারা করেও বলি, ওই লোকটার টুটি চেপে ধরো গে যাও টোটো সত্যি-সত্যি চোখের পলকে দৌড়ে গিয়ে তার টুটি চেপে ধরবে।”

চন্দন বলল, “ওটা কোন জাতের কুকুর? অ্যালশেসিয়ান?”

মাথা নাড়লেন সিনহা, “না, অ্যালশেসিয়ান, টেরিয়ার, বুল ডগ, ম্যাসটিফ, গ্রেট টেন– এসব নামীদামি কুকুরের কোনোটাই নয়। বুনো কুকুর, ওয়াইল্ড ডগ। ওকে আমি চার-ছ’ মাস বয়েস থেকে নিজের কাছে রেখেছি। এখন টোটোর বয়েস পাঁচ বছর। একটু বুড়ো হয়ে গিয়েছে। দেখবেন টোটোকে?”

কিকিরা যেন আঁতকে উঠলেন, “না স্যার, দেখে দরকার নেই। কুকুরকে আমি ভীষণ ভয় পাই। কেষ্টর জীব, শান্তিতে ঘুমোচ্ছে ঘুমোতে দিন।”

সিনহা হেসে ফেললেন। “ওর ঘুম বড় পিকিউলিয়ার। এমনিতে যখন ঘুমোয় কুম্ভকর্ণ; কিন্তু চোর-ছ্যাঁচোড় এলে সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ছুটে যায়। একটা আন্ডার কারেন্ট কিছু আছে। …তবে আপনাদের ভয়ের কারণ নেই। টোটো তার নিজের জায়গায় বাঁধা আছে। ঘুম ভাঙলেও আসতে পারবে না। তা ছাড়া অকারণ চেঁচানো অভ্যেসটা ওর নেই।”

কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়া শেষ।

কিকিরা এবার উঠে পড়বেন বলে মনে হল। বললেন, “আপনাকে ফ্র্যাঙ্কলি বলছি সিনহাসাহেব, আমরা সাধ্যমতন চেষ্টা করেও বাবলুর কোনো খোঁজ করতে পারলাম না। ওকে কিডন্যাপ করা হয়েছে, কিন্তু কারা করল, কোথায় নিয়ে গিয়ে ধরে রেখেছে, ছেলেটা কী অবস্থায় আছে- কিছুই বুঝতে পারছি না। আর যদি খুনটুন করে ফেলে!”

“অসম্ভব কী! তবে অতটা ভাববার আগে হাল ছেড়ে দেবেন না। আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারলে সুখী হতাম। ছেলেটিকে যেটুকু দেখেছি, কথা বলেছি, আমার বেশ লেগেছিল, ব্রাইট ইয়াং বয়। “

কিকিরা উঠে পড়লেন। দেখাদেখি চন্দনও।

সিনহাও উঠে দাঁড়ালেন। কোলাপসিবল গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে তালা খুলে দেবেন ফটকের।

কিকিরা বললেন, “আপনার হোটেলটা তা হলে..”

“সাকার্স রেঞ্জ।”

“ওদিকে গেলে যাব একদিন।” কিকিরা হালকা ভাবেই বললেন।

“আসবেন। মিড ডে বা ওইরকম সময়ে। সন্ধের পর আমি থাকি না। … ভাল কথা, আমার টোটোর একটা অদ্ভুত গুণের কথা আপনাদের বলা হয়নি। এমনিতেই কুকুরদের গন্ধের নাক ভাল, কোনো-কোনো জাতের কুকুররা আবার ওই ব্যাপারটায় পয়লা নম্বর। যেমন পুলিশদের কুকুর আমার টোটো– একেবারে বুনো বলেই হোক বা ওর কোনো স্পেশ্যাল কোয়ালিটির জন্যেই হোক গন্ধের ব্যাপারে এক্সসেপশনাল। মনে হবে, ওর কোনো সিক্সথ সেন্স আছে। আনবিলিভেল! ওই যে সেদিন ছেলেটির সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় ও তার ট্র্যাকসুটের গায়ের গন্ধ শুঁকেছে, সেটা কিন্তু ভুলে যাবে না। নেভার। অন্তত এত তাড়াতাড়ি নয়। যদি এমন কিছু হয় মিস্টার রায়, টোটোকে কাজে লাগাবার দরকার হয় আমায় বলবেন। আমি আমার সাধ্যমতন সাহায্য করব।”

কিকিরা শুনলেন। মাথা নাড়লেন। “ধন্যবাদ স্যার।”

“আচ্ছা, নমস্কার।”

বাড়ির বাইরে এসে কিকিরা ঘাড় ঘুরিয়ে চন্দনকে দেখলেন। চন্দন চুপচাপ।

হাঁটতে-হাঁটতে কিকিরা বললেন, “সিনহাসাহেবকে কেমন মনে হল, চাঁদু?”

অন্যমনস্ক ছিল চন্দন। রাত হয়ে যাচ্ছে। আকাশ পরিষ্কার। কোথাও একটু মেঘ নেই। হাওয়াও না থাকার মতন। একটু বৃষ্টি বাদলা আবার না হলে বাঁচা যাবে না! এবারের গরমটা যেন একনাগাড়ে জ্বালাচ্ছে।

“কী গো চাঁদুবাবু! কথার জবাব দিলে না?”

“কিছু বললেন?”

“কেমন লাগল সিনহাসাহেবকে।”

“ভালই লাগল। ওঁকে সন্দেহ করার কোনো কারণ দেখছি না।”

“হু! ..ইয়ে, কুকুররা কখন ঘুমোয়?”

“মানে?” চন্দন অবাক!

 “আমি বলছি, কুকুররা কি খাস সাহেবদের মধ্যে সন্ধেয় সন্ধেয় ডিনার সেরে নেয়। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে! আর্লি টু বেড অ্যান্ড আর্লি টু রাইজ! আটটা বাজবার আগেই খেয়েদেয়ে ঘুম! নো সাড়াশব্দ! ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোয় নাকি!”

“এ আপনি কী বলছেন?”

“বাড়িতে কি কুকুরটা ছিল?”

“তার মানে?”

“ধরো যদি না থাকে!”

“না-থেকে যাবে কোথায়?”

“তা বলতে পারব না। … তবে হ্যাঁ, পাড়ার লোক যদি দেখে থাকে– সিহাসাহেব রোজ সকালে কুকুর নিয়ে মর্নিং ওয়াক করতে বেরুচ্ছেন– তবে কুকুর নিশ্চয় ওবাড়িতে আছে। থাকে। অন্তত সকালে। … সন্ধের পর– কথাটা আর শেষ করলেন না কিকিরা।

চন্দন বুঝতে পারল না, কিকিরা কী বলতে চাইছেন।

.

০৯.

ধরে আনতে বললে বেঁধে আনার মতন করে ধীরাজকে পাকড়াও করে নিয়ে এল তারাপদ কিকিরার কাছে। এনে বলল, “এই নিন স্যার, বাবলুদের গ্রুপের ধীরাজদাকে নিয়ে এসেছি।”

কিকিরার ফ্ল্যাটের চেহারা দেখে হয়ত অতটা নয়, কিন্তু বসার ঘর দেখে রীতিমতন ঘাবড়ে গিয়েছিল ধীরাজ। এরকম বিচিত্র ঘর বোধ হয় আগে সে দেখেনি। যতরকম অদ্ভুত আর পুরনো জিনিস সব কি এখানে? তারাপদর কথা শুনে সে ভেবেছিল, বেশ সাজানো-গোছানো কোনো অ্যামেচার ডিটেকটিভের সঙ্গে সে দেখা করতে যাচ্ছে। খানিকটা কৌতূহলও হয়েছিল। এখন সে বুঝতে পারছে, যার সঙ্গে সে দেখা করতে এসেছে সেই ভদ্রলোক গোয়েন্দার “গ’-ও নয়। এই কি গোয়েন্দার চেহারা! রোগা, ঢ্যাঙা, আধবুড়ো, গর্তে-ডোবানো চোখ, লম্বা-লম্বা উসকোখুসকো চুল–এই মানুষ কখনোই গোয়েন্দা, পেশাদারি বা শখের–কোনো জাতেরই গোয়েন্দা হতে পারেন না! ধীরাজের মেজাজই বিগড়ে গেল।

কিকিরা ধীরাজকে বসতে বললেন। আজকের দিনটা মন্দের ভাল। শেষ রাত থেকে সকাল পর্যন্ত দু-এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। দুপুরেও মেঘলা-মেঘলা ছিল। গরম কমেছে সামান্য।

কিকিরা ধীরাজের চোখমুখ দেখে আন্দাজ করতে পারছিলেন, বেচারি বেশ হতাশ হয়েছে। তা তিনি আর কী করবেন! তিনি তো তারাপদকে বলেননি, ধীরাজকে ধরে আনো–দড়ি বেঁধে।

তারাপদ বলল, “স্যার, ধীরাজবাবুর গত পরশু খঙ্গপুর থেকে ফিরেছেন। কাল আমি আমার পাড়ার লাইব্রেরিতে সারা সন্ধে কাগজ ঘেঁটে কটিয়েছি। আর ওঁর কাছে গিয়েছিলাম কাঁকুলিয়ায়। অনেক বলে কয়ে ধরে এনেছি।”

ধীরাজের বয়েস চল্লিশের তলায়। ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ হবে। দেখতে সাধারণ, তবে বাহারি করে দাড়ি রেখেছে।

কিকিরা আলাপি ঢঙে বললেন, “কী বলব ভাই আপনাকে! আপনি, না তুমি? বয়েস তো বেশি নয়।”

“তুমিই বলুন। আমি বুঝতে পারিনি”।

“পারবে কেমন করে! আমরা তো ওই ক্লাসের নয়। মানে গোয়েন্দা ক্লাসের। আমরা হলাম, কী বলব কী বলা যায়–ফেউ ক্লাসের। আমি ভাই একসময় ম্যাজিক নিয়ে মাতামাতি করেছি। এখন ওন্ড। বাতিল। আর তারাপদ আর চন্দন হল আমার ফ্রেন্ড, ফিলোজফার অ্যান্ড ব্রাদার।

ধীরাজ বলল, তারাপদর কাছে সে শুনেছে পরিচয়গুলো

কিকিরা আর হাসি-তামাশা করলেন না। বললেন, “কৃষ্ণকান্তবাবু, আমাদের একটা বড় দায়িত্ব দিয়েছেন। বাবলুকে খুঁজে বার করার।”

“তাও শুনেছি। গতকাল পবনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আর আজ উনি তো আমার বাড়িতেই গিয়েছিলেন।

“ভাল কথা। আগেই জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল! তোমার মায়ের অসুখ–কেমন আছেন তিনি?”

“এখন ভালই আছেন।”

“কী হয়েছিল?”

“বুকে ব্যথা। প্রথমটায় ওখানকার ডাক্তার ঘাবড়ে গিয়েছিল। পরে বোঝ গেল, আলসারের কেস। মা বড় অত্যাচার করে।”

কিকিরা হাসলেন। “মায়েরা ওইরকমই।…তা মা যখন ভাল আছেন, তোমারও মন ভাল থাকা দরকার। নয় কী এবার একটু কাজের কথা বলি।”

“বলুন?”

“তুমি বাবলুর পুরনো বন্ধু?”

“হ্যাঁ, বন্ধু কেন, দাদার মতন বলতে পারেন।”

“ওকে ভাল করেই চেনো? কেমন ছেলে?”

“খারাপ কিছু দেখিনি। লাইভলি, মজাদার, ভাল স্বভাব…”

তারাপদ বলল, “বাবলুর সম্পর্কে যাকেই জিজ্ঞেস করছি, সবাই তার প্রশংসা করছে। ও নিশ্চয় ভাল ছেলে, স্যার। তবু বেচারি”

কিকিরা তারাপদকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ধীরাজকে বললেন, “আচ্ছা, ওই যে শুনলাম, একটা খবরের কাগজে কী বেরিয়েছিল–”

তারাপদ বলল, “স্যার, দ্যাটস কারেক্ট। …আমি দুদিন লাইব্রেরিতে রাখা খবরের কাগজের ফাইল হাতড়েছি। কালই ইংরিজি কাগজে বিজ্ঞাপনটা দেখতে পেলাম। ধীরাজবাবুকে বলেছি সেকথা।”

কিকিরা মাথা নাড়লেন। মানে, ঠিক আছে। ইশারায় তারাপদকে বললেন, বগলাকে একটু চা-টায়ের কথা বলে আসতে।

তারাপদ উঠে গেল।

কিকিরা বললেন, “আমাদের মধ্যে লুকোচুরির কোনো ব্যাপার নেই।…এবার আমায় একটু বলো তো, বাবলু যেদিন থেকে নিরুদ্দেশ–তার কি কদিন আগে খবরের কাগজের ব্যাপারটা ঘটে?”

ধীরাজ বলল, “ও নিরুদ্দেশ হওয়ার দু দিন আগে। মানে আগের আগের দিন। “

“ঠিক কী হয়েছিল?”

“কী আর হবে, আমরা প্রায়ই যেমন আড্ডা মারি, আমাদের ক্লাবে আজ্ঞা মারছিলাম সন্ধেবেলায়। পুরনো খবর কাগজ ছড়িয়ে তার ওপর মুড়ি বাদাম, কাঁচা পিঁয়াজ ছড়িয়ে খাচ্ছিলাম সকলে। ভাঁড়ের গা ছিল। গল্প হচ্ছিল। আমাদের নাটক নিয়েই। গ্রুপের টাকাপয়সা নেই, হাজার কয়েক টাকা দেনা। দু-পাঁচটা কল শো অ্যারেঞ্জ করতে পারলে খানিকটা মেকআপ হয়। এইসব গল্প।”

তারাপদ ফিরে এল। চোখমুখ ধুয়ে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে এসে নিজের জায়গায় বসল।

কিকিরা বললেন, “মুড়ি খেতে-খেতে কাগজের বিজ্ঞাপনের দিকে নজর পড়ল?”

“খাওয়া তখন শেষ। মুড়ি প্রায় সাফ। কাগজটা ঝেড়েঝুড়ে আমরা দলা পাকিয়ে ফেলেই দিতাম। হঠাৎ কার যেন নজরে পড়ল।”

“বিজ্ঞাপনটা?”

“হ্যাঁ। খুব বড় নয়, আবার ছোটও নয়। কত হবে, ইঞ্চি চারেক মতন লম্বা। চারপাশে রুল দেওয়া।”

“তোমরা সবাই পড়লে?”

“না। কে একজন পড়ল। দু-একজন দেখল। বাবলুও দেখল।”

“তারপর?”

“আমরা একটু মজার কথাবার্তা বললাম। কাগজটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামালাম না।”

“বাবলু কি কাগজটা নিল?”

“ঠিক মনে নেই। হতে পারে সে কাগজের পাতা ছিঁড়ে পকেটে রেখেছিল। …তবে ও বলল, ওদের বাড়িতে ওর ঠাকুরদার একটা পকেট ঘড়ি পড়ে আছে। সোনার ঘড়ি।”

তারাপদ কিকিরাকে বলল, “পবনও একই কথা বলেছে, স্যার। ঘড়িটার একটা মোটামুটি ডেসক্রিপশানও বাবলু দিয়েছিল।”

ধীরাজ মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ।”

“তুমি নিজে কাগজের ওই বিজ্ঞাপনটা দেখেছিলে?”

“এমনি দেখেছি। ভাল করে দেখিনি। আমার মাথায় ওসব ঢোকে না। আর মন দিয়ে দেখে করবই বা কী! আমার কাছে তো ঘড়ি নেই।”

“তবু, কী লেখা ছিল?”

ধীরাজ মনে করে দু-একটা কথা বলা সঙ্গে সঙ্গেই তারাপদ পকেট থেকে একটা কাগজের টুকরো বার করে এগিয়ে দিল। বলল, “স্যার, আমি কাগজ ঘেঁটে-ঘেঁটে এই বিজ্ঞাপন বার করেছি। এটা সেই ঘড়ির বিজ্ঞাপন। আলগা কাগজে পুরো বিজ্ঞাপনটাই টুকে নিয়েছি।” কাগজটা দিয়ে আবার বলল, “ধীরাজবাবুকে আমি দেখিয়েছি এটা। উনি বললেন, হ্যাঁ, এটাই সেদিন পড়েছিলেন।”

কিকিরা হাতে-টোকা বিজ্ঞাপনের নকলটা পড়তে লাগলেন।

বগলা চা নিয়ে এল। চায়ের সঙ্গে পাকা পেঁপের টুকরো আর নোতা বিস্কিট।

তারাপদ ধীরাজকে চা নিতে বলল।

 হাতের কাগজটা পড়তে-পড়তে একবার আড়চোখে কিকিরা ধীরাজের দিকে তাকালেন। হালকা গলায় বললেন, “আগে পেঁপেটা খাও, ভাল জাতের পেঁপে, পেঁপে খেলে লিভার ভাল হয়। খাও!”

ধীরাজের প্রথমদিকে যে ইতস্তত ভাব ছিল, সেটা কেটে গিয়েছে অনেকটা। এখন সে অত আড়ষ্ট নয়।

কাগজ দেখা হয়ে গেলে কিকিরা বললেন, “তাই দেখছি, বাবলুদের ঘড়িরই ডেসক্রিপশান। তবে একেবারে পুরো ডিটেলে নয়। ঘড়ির নামও বলে দিয়েছে, ক্যানটন। ক্যানটন গোল্ড। পকেট ওয়াচ।…এটা কোন কাগজে বেরিয়েছিল? কত তারিখে?”

তারাপদ দলল, “নিচে লেখা আছে। টুকে নিয়েছি।”

দেখলেন কিকিরা। “এই বিজ্ঞাপন তো এপ্রিলে বেরিয়েছে। বাইশে এপ্রিল। আর এখন মে মাসের আট-ন’ তারিখ।”

তারাপদ বলল, “বিজ্ঞাপনটা আগে বার তিনেক রিপিট হয়েছে। এটাই লাস্ট।”

“বাবলু কবে থেকে যেন ঘরছাড়া?”

ধীরাজই কথা বলল, “আমার সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার পরের দিন। তার পরের দিনই সন্ধেবেলায় আমি খঙ্গপুরে চলে যাই। সেটা ছিল আটাশে এপ্রিল। ওকে পাওয়া যাচ্ছে না সাতাশে এপ্রিল থেকে।”

কিকিরা চায়ে চুমুক দিতে দিতে হাতের কাগজটা দেখছিলেন। ভাবছিলেন। বাইশে এপ্রিলের পুরনো কাগজের পাতায় মুড়ি বাদাম ছড়িয়ে রেখে বাবলুরা পরে একদিন মুড়ি খেয়েছে। হতেই পারে! শেষে বললেন, “তলার ঠিকানাটা, যেখানে কনট্যাক্ট করতে বলেছে সেটা তো দেখছি সাবেকি ঠিকানা : লাজোস, LAJOS। লাজও হতে পারে। বিলেতিগুলোর এইরকম নামও হয় নাকি, তারা। যাক গে, রাস্তাটা হল পার্ক স্ট্রিট। ফোন নম্বরও দেওয়া আছে।”

তারাপদ বলল, “ওখানে গিয়ে খোঁজ করতে অসুবিধে কোথায়?”

“কিছুই নয়। কালই যাওয়া যেতে পারে।”

ধীরাজ কোনো কথা বলছিল না। চা খাচ্ছিল।

অল্পক্ষণ চুপচাপ থাকার পর কিকিরা পকেট হাতড়ে চুরুট বার করলেন। মাথার চুলে আঙুল চালালেন বার কয়েক। চুরুট ধরালেন। শেষে ধীরাজকে বললেন, “ব্যাপারটা তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে?”

ধীরাজ তাকিয়ে থাকল।

 কিকিরা বললেন, “ব্যাপারটা এখন এই দাঁড়াচ্ছে যে, সেদিন তোমাদের আড্ডাখানা থেকে ফেরার পর–মানে মুড়ি বাদাম খাবার দিনের কথা বলছি–বাবলু পুরনো খবরের কাগজ থেকে লাজোস-এর বিজ্ঞাপনের পাতাটা ছিঁড়ে নিয়ে বাড়ি চলে যায়। সেটা তবে পঁচিশে এপ্রিল পড়ছে! তাই না?”

ধীরাজ হিসেব করে বলল, “তাই। ছাব্বিশ তারিখেও ও আমার কাছে এসেছিল। সাতাশ তারিখ সকালের পর ওকে আর পাওয়া যাচ্ছে না।”

“ছাব্বিশ তারিখে তবে ও পবনের দোকানে গিয়েছিল, সেখান থেকে আপনার কাছে যায়।” তারাপদ বলল।

“হ্যাঁ।”

“পবনকে কিন্তু ঘড়ি দেখায়নি। হয়ত সঙ্গে ছিল না। আপনাকেও কি দেখিয়েছিল?”

“না।”

কিকিরা বললেন, “এখন আমার মনে হচ্ছে, বাবলু বাড়িতে গিয়ে আলমারি খুলে ঘড়িটা বার করেছে। করে বিজ্ঞাপনের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছে। দেখেছে একই ঘড়ি। তারপর কিকিরা চুপ।

অপেক্ষা করে তারাপদ বলল, “তারপর কী?”

“সেটাই তো ধরতে পারছি না। ও কি লাজোস-এর ঠিকানায় গিয়েছিল দেখা করতে? না, ফোন করেছিল?”

তারাপদ বলল, “স্যার, বাবলুর বোন খুকুর কথামতন, আগের দিনই ঘড়িটা তার কাছে দেখা গিয়েছে। মানে ছাব্বিশ তারিখে।”

কিকিরা ধীরে-ধীরে মাথা নাড়লেন ধীরাজের দিকে তাকিয়ে। বললেন, “না, ঘড়ি নিয়ে বাবলু বাইরে যায়নি। তোমার কাছে নয়। তা হলে দেখাত তোমায়। আমার ধারণা, ও ছাব্বিশ তারিখে হয় লঞ্জেসচুষ–মানে লাজোসের কাছে যায়, বা তাদের অফিসে ফোন করে।…কিন্তু কেন করবে?”

“টাকার জন্যে নিশ্চয় নয়। আবার শুধু-শুধু ওদের জানাবার জন্যেও ফোন করবে না। ঘড়িটা তাদের কাছে আছে জানিয়ে ফোন করার একটা মানে থাকবে তো!”

“কী জানি! ছেলেমানুষের কাণ্ড!” বলে কিকিরা ধীরাজের দিকে তাকালেন। “আচ্ছা ভাই, একটা রহস্য উদ্ধার করে দিতে পারো? বাবলু বেপাত্তা হওয়ার পর তার টেবিলে একটা কাগজে বড় বড় করে ইংরিজিতে FOX OX BOX লিখে রেখেছিল। এর কোনো মানে বলতে পারো?”

ধীরাজ অবাক চোখেই তাকিয়ে থাকল। দাড়ি চুলকে নিল অন্যমনস্কভাবে। আকাশ-পাতাল খুঁজল যেন! তারপর বলল, না। আমি তো জানি না।”

“তা হলে কী আর কথা যাবে! যাক গে, কাল আমরা ওই লাইমজুস, লঞ্জেচুষ–মানে লাজোস-এর কাছে যাচ্ছি।” কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন, উঠে দাঁড়িয়ে পিঠ কোমরের আড়ষ্ট ভাবটা ভাঙার জন্যে বার কয়েক শরীর হেলালেন, বেঁকালেন, হাত ওঠালেন, নামালেন। শেষে বললেন, “তারাপদ, তিনটে জিনিস খেয়াল করো।”

“কী?”

“এক নম্বর হল, বাবলু যেদিন খবরের কাগজে লাজোস-এর বিজ্ঞাপনটা দেখেছে, সম্ভবত সেদিন রাত্রে বা তার পরের দিন বাড়িতে আলমারি খুলে ঘড়িটা বার করেছিল। করে মিলিয়ে নিতে গিয়েছিল বিজ্ঞাপনের ডেসক্রিপশানের সঙ্গে। খুকু বাবলুর কাছে ঘড়িটা দেখেছিল ছাব্বিশে এপ্রিল। তাই তো!”

“হ্যাঁ।”

“দু’ নম্বর হল, ঘড়িটা নিয়ে সে পবন বা ধীরাজের কাছে যায়নি। মানে ঘড়ি পকেটে নিয়ে সে পথে বেরোয়নি। যদি ঘড়ি তার কাছে থাকত-ধীরাজকে দেখাত। তাই না?”

“আমারও তাই মনে হয়।”

“তিন নম্বর হল, আমার যতদূর মনে হয় ব্যাপারটা যাচাই করতে সে বাড়ি থেকে লাজোসে ফোন করেছিল। নিজে নিশ্চয় যায়নি। গেলে পবন ধীরাজদের বলত।”

“বলুন!”

“হতে পারে বাবলু বিকেল বা সন্ধেবেলায় লাজোসে ফোন করেছিল। বাড়ি থেকেই। সেটা হয়ত জানা যাবে না। কেননা, বাড়ির ছেলেমেয়ে কোথায়। কাকে কখন ফোন করছে, বাড়ি থেকে কে আর তার দিকে নজর রাখে!…তবে একটা কথা পরিষ্কার, বাবলু আগের দিন ঘড়ি নিয়ে পথে বেরোয়নি। পরের দিন সকালে যদি সে ঘড়ি নিয়ে বেরিয়ে থাকে, তবে মাঝখানে কিছু একটা ঘটেছিল। কী ঘটেছিল, কাল আমরা হয়ত জানতে পারব। আজকের মতন এখানেই ইতি।” কিকিরা চুরুটে টান মারলেন। চুরুট নিভে গিয়েছে।

.

১০.

পরের দিন লাজোস খুঁজতে গিয়ে কিকিরারা অবাক! পার্ক স্ট্রিটের ওপরে ঠিক নয়, বড় রাস্তা থেকে এক গলি ধরতে হবে। গলির মুখে, কনার প্লটে এক ঝকঝকে, তকতকে দোকান। আশেপাশে ভাল-ভাল দোকানেরও অভাব নেই। কোনোটা ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন; কোনোটা টিভির; কোনোটা বা টাইপ মেশিনের। সাজসজ্জার দোকানও আছে। দু-একটা চমৎকার রেস্টুরেন্ট। নিচে দোকানপত্র, ওপরে অফিস, ফ্ল্যাট।

 চন্দন আর তারাপদ সঙ্গে ছিল কিকিরার। তারাপদ অফিস পালিয়েছে।

বাইরে থেকে দেখেই বোঝা যায় লাজোস একটা দোকানের নাম। ছিমছাম দোকান। বাইরে কাচের আড়াল। দোকানটা দেখেই চন্দন বলল, “স্যার, এখানে তো ডাক্তারি জিনিসপত্র বিক্রি হয়। মেডিক্যাল অ্যাপ্লায়েন্স।”

কিকিরা বললেন, “তাই দেখছি। চলো, ভেতরে তো যাই!”

তারাপদ বলল, “আমি বাইরে আছি। বেশি ভিড় করে দরকার নেই।”

 কিকিরা আর চন্দন কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন।

দোকান খুব বড় নয়। তবে পরিপাটি। মাইক্রোস্কোপ, ব্লাড প্রেশার মাপার যন্ত্র থেকে আরও পাঁচটা ডাক্তারি যন্ত্রপাতি বিক্রি হয়।

ভিড়টিড় নেই। কর্মচারী জনা চারেক। দু জন অবাঙালি।

চন্দন ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে চাইল।

ম্যানেজার বসেন আলাদা। তাঁর ঘর একপাশে। ভেতরের দিকে।

 ম্যানেজার অবাঙালি। পাঞ্জাবি।

চন্দনই কথা শুরু করল।

ম্যানেজার শুনলেন খানিকটা। তারপর যা বললেন তার মর্মার্থ হল, এই দোকান বা কোম্পানিটা হল এক হাঙ্গেরিয়ান সাহেবের নামে। তিনি এ-দেশে থাকেন না। “লাজোস’-এর ব্যবসা আছে বিদেশেও। ভারতে চার জায়গায়। দিল্লি, বম্বে, কলকাতা আর বাঙ্গালোরে। তাঁর কোম্পানির এটা অফিস। অফিস অ্যান্ড এজেন্সি।

বিজ্ঞাপনের কথা তুললেন কিকিরা।

ম্যানেজার ইংরিজিতেই বললেন, “হ্যাঁ, আমাদের এখানকার ঠিকানাতেই ওটা ছাপতে দেওয়া হয়েছিল। সেভাবেই অ্যাডভাইস করা হয়েছিল আমাদের। সাহেবের একজন লোক এখানে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি এখন এখানে নেই। বাঙ্গালোর গিয়েছেন। উনি এখানে ফিরে আসতেও পারেন, নাও পারেন। ওঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে আমাদের থু দিয়ে করতে হবে। আমাদের ফ্যাক্স অ্যারেঞ্জমেন্ট আছে।”

ম্যানেজারের কথা শুনে মনে হচ্ছিল, ভদ্রলোক অনেকদিনই কলকাতায় আছেন। ইংরিজি-হিন্দি, মাঝে-মাঝে বাংলাও বলছিলেন ভাঙা-ভাঙা ভাবে।

কিকিরা বললেন, “বাইরে জানাতে হবে?”

“আমরা ওঁকে জানিয়ে দেব। ওভারসিজ লিঙ্ক আমাদের আছে বিজনেস পারপাজে।”

কিকিরা বেশ বিনয় করে বললেন, “আপনি যদি আমাদের আরও একটু সাহায্য করেন, স্যার। আপনাদের সাহেবের ইন্টারেস্টেই বলছি।

“কীরকম হেল্প?

“ঘড়িটা সম্পর্কে আরও একটু ডিটেল জানতে পারলে? নিউজ পেপারে যা আছে, সেটা বড় শর্ট। মোর ডিটেল”।

ম্যানেজার ভদ্রলোক কী ভাবলেন যেন। তারপর নিজের অফিস টেবিলের নিচের ড্রয়ার থেকে কাগজপত্র হাতড়ে একটা খাম বার করলেন। বড় খাম। খামের মধ্যে থেকে একটা কাগজ বার করে এগিয়ে দিলেন কিকিরাকে।

কাগজটা নিলেন কিকিরা। ইংরিজিতে টাইপ করা কাগজ। ডুপ্লিকেট।

 ম্যানেজার বললেন, “টে ইট। দ্যা উইল সার্ভ ইওর পারপাজ।”

কিকিরা আর চন্দন উঠে দাঁড়াল। “থ্যাঙ্ক ইউ।“

“নেভার মাইন্ড!…বাই দ্য ওয়ে– বি ভেরি কেয়ারফুল!” বলে ভদ্রলোক সাবধান করে দিলেন। বললেন, “অনেক টাকার ব্যাপার মিস্টার, কাগজটা নষ্ট করবেন না, পড়লে বুঝতে পারবেন।”

“কত টাকা?”

“এ লটু অব মানি। লাখ-সওয়া লাখ।”

ভেতরে-ভেতরে যেন চমকে উঠলেন কিকিরারা। লাখ-সওয়া লাখ!

 চলে আসার সময় কিকিরা বললেন, “আপনাদের দোকান কখন বন্ধ হয়?”

“সেভেন ও ক্লক। সাত বাজে ক্লোজ হয়। মাগর, আট সাড়ে আট পর্যন্ত দুগার থাকে। আউট স্টেশন কল, অডার করপনডেন্স, ফোন রিসিভ…। উসকো বাদ টোটালি ক্লোজড!”

“দুগার কে?”

“হীরা দুগার। আমার অ্যাসিসটেন্ট।”

ধন্যবাদ জানিয়ে কিকিরারা ম্যানেজারের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাকালেন আশেপাশে। কর্মচারীরা কাজকর্ম করছিল। আন্দাজ করবার চেষ্টা করলেন হীরা দুগারকে।

রাস্তায় নেমে তারাপদকে দেখতে পেলেন না। গেল কোথায়?

দু-চার পা এগিয়ে খুঁজছিলেন তারাপদকে।

তারাপদ খানিকটা তফাতে গাড়িবারান্দার তলায় আড়ালে দাঁড়িয়ে কোল্ড ড্রিঙ্কস খাচ্ছিল একটা দোকানের সামনে। খাওয়া শেষ করে পয়সা মেটাল। সিগারেট ধরাল।

কিকিরারা তাকে দেখতে না পেলেও সে ওঁদের দেখতে পেয়েছিল। হাত নাড়তে যাবে; হঠাৎ চোখে পড়ল, কিকিরারা দোকান থেকে রাস্তায় নামার পর-পরই একজন দোকান থেকে বেরিয়ে এসে কিকিরাদের নজর করতে লাগল। কেমন যেন লাগল লোকটাকে! তারাপদ স্পষ্ট বুঝল না, কিন্তু তার খারাপ লাগল। সন্দেহ হল।

কী মনে করে তারাপদ আরও একটু আড়ালে সরে গেল। কিন্তু নজর রাখল লোকটার ওপর। প্যান্ট-শার্ট পরা তাগড়া চেহারা। কিকিরাদের লক্ষ করছে।

সামান্য পরেই লোকটা দোকানের পাশের গলি ধরে চলে গেল।

তারাপদ তাড়াতাড়ি আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে হাত নেড়ে ইশারা করল কিকিরাদের।

কিকিরারা এগিয়ে আসার আগেই তারাপদ এগিয়ে গেল। কাছাকাছি আসতেই তারাপদ বলল, “স্যার, আপনারা ওই ওপারের ফুটপাথে রেস্টুরেন্টে ঢুকে যান। আমি আসছি। একটা লোককে ফলো করে আসছি আমি।” বলতে বলতে তারাপদ গলির দিকে এগিয়ে গেল।

গলি ধরে সামান্য এগিয়ে তারাপদর মনে হল, কে বলবে এই গলি পার্ক স্ট্রিটের গায়ে-গায়ে। অনেক নিরিবিলি। বাড়িগুলো বড় বড় হলেও একেবারে নতুন নয়। পাঁচমেশালি লোকের ফ্ল্যাট বাড়িগুলোয়। খানিকটা এগিয়ে ছোট্ট তেকোনা ফাঁকা নেড়া মাঠ। পার্ক। তারই পেছন দিকে পুরনো এক হতশ্রী চেহারার বাড়ি। বাড়ির লাগোয়া ভাঙাচোরা শেডের গ্যারাজ। বাড়িটার ফটকের মাথায় মরচে-ধরা ভাঙা লোহার ক’টা অক্ষর। পড়াও যায় না। এক্স সেলারস হোম গোছের কিছু হবে।

তারাপদ দেখছিল। বাড়িটার জানলাগুলো খড়খড়ির। রং আর চেনা যায় না! দোতলা বাড়ি। বাইরের দিকে বারান্দা বলে কিছু নেই। দেওয়ালের ফাটাফুটি জায়গা দিয়ে জল পড়ে-পড়ে শ্যাওলা ধরেছে, গাছের সরু ডাল, পাতা।

তারাপদ দেখছিল। চোখে পড়ল হঠাৎ সেই লোকটা ফিরে আসছে আবার বাড়িটার দিকে।

নিজেকে আড়াল করার উপায় ছিল না। তারাপদ ফিরে আসতে লাগল। লোকটা এবার তার পেছনে।

বড় রাস্তায় এসে লোকটা দাঁড়াল। তাকাল চারপাশ। তারপর দোকানে ঢুকে গেল।

তারাপদ রাস্তা পেরিয়ে কিকিরাদের খোঁজে রেস্টুরেন্টের দিকে পা বাড়াল।

.

কিকিরারা তখনো চা পাননি। মিনারেল ওয়াটারের বোতল, গ্লাস টেবিলে পড়ে আছে।

তারাপদ এসে বলল, “কিকিরা, আপনারা ওই দোকান থেকে বেরিয়ে আসার পর একটা লোকও বেরিয়ে এল। আপনাদের দেখছিল। তারপর গলির মধ্যে চলে গেল। লোকটাকে দেখে আমার সন্দেহ হল। তাকে ফলো করলাম।” তারাপদ যা যা দেখেছে, বলল কিকিরাদের।

কিকিরা হাতের কাগজটা আগেই পড়েছেন। চন্দনও। তবু কাগজটা হাতে দিল কিকিরার। বললেন, “লোকটা নিশ্চয় হীরা দুগার।”

চন্দন বলল, “বুঝলেন কেমন করে?”

“মন বলছে।”

“মন বললেই কি সত্যি হয়?”

“কখনো কখনো হয়। … আমি বলছি। বাবলু সেদিন তার নিরুদ্দেশ হওয়ার আগের দিন সন্ধেবেলায় নিশ্চয় লাজোসে ফোন করেছিল। যে-সময় ফোন করেছিল তখন দুগার আর দরোয়ান ছাড়া কারও থাকার কথা নয়। দরোয়ান দোকানের বাইরে বা ভেতরেও থাকতে পারে। তাতে কিছু আসে যায় না!”

 “দুগার দোকানে ছিল, আপনি জানলেন কেমন করে?”

“কেন, ম্যানেজার সাহেবই তো বললেন যে, দুগারই একলা আটটা-সাড়ে আটটা পর্যন্ত থাকে। “

চন্দন মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, ম্যানেজার তাই বলেছেন বটে! তবু বলল, “যদি অন্য কেউ থেকে থাকে!”

“সেটা পরে চেক করে নেব। ম্যানেজার সাহেব নিশ্চয় জানেন।”

তারাপদ বলল, “লোকটার ব্যাপার-স্যাপার আমার ভাল লাগল না, স্যার। কেমন যেন চোর-চোর ভাব। …আমার মনে হচ্ছে, ওই পুরনো বাড়িটা সন্দেহজনক। কে বলতে পারে বাবলুকে ওখানে আটকে রাখা হয়নি। …পুলিশকে বললে হয় না?”

কিকিরা মাথার চুলে আঙুল চালাতে-চালাতে ভাবলেন যেন। শেষে বললেন, “পুলিশ পরে। আগে সিনহা। সিনহা না বলেছিলেন, তাঁর কুকুরের গন্ধের নাক আবিলিভেবল। দেখা যাক, ভদ্রলোকের কুকুর এখন কী করে? উনি তো বড় মুখ করে বলেছিলেন, কোনো সাহায্যের দরকার হলে উনি অবশ্যই করবেন। সেটা সত্যি না মিথ্যে, পরখ করতে হবে। …চাঁদু, সিনহার হোটেলে যাওয়া যাক। এখন উনি নিশ্চয় থাকবেন।”

.

১১.

এই সময়টায় সচরাচর যেমন হয়। হঠাৎ-হঠাৎ বিকেলে ধুলোর ঝড় ওঠে, আকাশ কালচে দেখায়, এক-আধ পশলা হালকা বৃষ্টিও হয়ত হয়ে যায়– অনেকটা সেইভাবে শেষ বিকেলে ধুলোর ঝড়টড় উঠেছিল, একপশলা রাস্তা ভেজানো বৃষ্টিও হয়ে গেল। তারপর যেমন-কে-তেমন, আকাশ পরিষ্কার, বাতাসেও ঠান্ডা ভাব নেই।

সন্ধের আগেই রাজেন সিনহা আর কিকিরা বেরিয়ে পড়েছিলেন লেক গার্ডেন্স থেকে।

সিহাসাহেবের গাড়ি আছে হোটেলের। তাঁকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসে, আবার পৌঁছেও দেয়। নিজের ব্যক্তিগত দরকার কিংবা অন্য কাজকর্মে তিনি হোটেলের গাড়িই ব্যবহার করেন। কিকিরাদের কাছে খবরটা শোনার পর তিনি সঙ্গে-সঙ্গে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। বাড়ি যাবেন। তাঁর কুকুর টোটোকে নিয়ে ফিরে আসবেন জায়গা মতন।

তাঁর পরামর্শ মতন তারাপদ আর চন্দন সন্দেহজনক বাড়ি আর পুরনো গ্যারাজের আশেপাশে থেকে গেল। তারা নজর রাখবে বাড়িটার দিকে। বলা যায় না, দুগার বা তার লোকজন যদি বিপদ বুঝে বাবলুকে বাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করে তবে তারাপদরা দেখতে পাবে! অবশ্য, আসল কথাটা হল, বাবলুকে ওই বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছে কি না সেটা জানা? আর তার সঙ্গে দুগারের সম্পর্ক আছে কি না! কিকিরার অনুমান আর সন্দেহ সত্যি হতেও পারে, নাও পারে।

টোটোর মুখে স্ক্র্যাপের গার্ড পরিয়ে, তার গলায় বাঁধা চামড়ার মোটা বকলস পরিয়ে চেইন-কর্ডটা হাতে নিয়ে সিনহাসাহেব গাড়িতে উঠলেন।

“আপনি সামনে বসুন, কুকুরে আপনার বড় ভয়”, সিনহা বললেন গাড়িতে উঠতে উঠতে।

 কিকিরা সামনের দিকে বসলেন। সিনহা কুকুর-সমেত পেছনের সিটে।

তখন আর ধুলোর ঝড়, আচমকা হালকা বৃষ্টির চিহ্ন নেই। আলো সরে গিয়েছে। ঘোলাটে, আবছা ভাব। প্রায় সন্ধে।

গাড়ি ছাড়তেই সিনহা হঠাৎ বললেন, “একটা কাজ করুন তো! মিস্টার দত্তরায়ের বাড়ির সামনে গাড়িটা দাঁড় করাই। ও বাড়ির লোক আপনাকে দেখেছে। চেনে। আপনি ওই বাড়ি থেকে ছেলেটির একটি শার্ট-প্যান্ট চেয়ে আনুন।”

“বাবলুর জামা প্যান্ট?”

“হ্যাঁ। আফটার অল, টোটো মাত্র একদিনই মিনিট আট-দশ বাবলুর সামনে ছিল। যদি তার গন্ধের নাক ভুল করে। করার কথা নয়, তবু আরও শিওর হওয়া ভাল। বেটার, আপনি একটা ইউজড় জামা-প্যান্ট নিয়ে আসুন ছেলেটির। টোটোকে শুকিয়ে নেব।

কৃষ্ণকান্তর বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াল।

কিকিরা বললেন, “কৃষ্ণকান্তবাবুকে হয়ত এখন বাড়িতে পাব না। তিনি ফিরেছেন বলে মনে হয় না। জামা-প্যান্ট যা হোক একটা আমি আনছি। কিন্তু এখন কাউকে কিছু বলব না।”

“কোনো দরকার নেই।“

কিকিরা নেমে গেলেন গাড়ি থেকে।

সামান্য পরে ফিরে এলেন। খুকুর কাছ থেকে তার দাদার একটা জামা নিয়ে এসেছেন। উনি বসলেন গাড়িতে। জামাটা সিনহাকে এগিয়ে দিলেন।

.

তেকোনা নেড়া ছোট পার্কের একপাশে গাড়িটা দাঁড়াল।

ততক্ষণে সন্ধে হয়ে গিয়েছে। গলির মধ্যে আলো কম। বরং অন্ধকারই বেশি। জায়গাটা অদ্ভুত! সাড়াশব্দ কম। লোক চলাচলও তেমন নয়। মাঝেসাঝে একটা গাড়ি চলে যায়, সাইকেল, স্কুটার। গ্যারাজটা পুরনো, ভাঙাচোরা চেহারা, তার গায়ে মস্ত এক নিমগাছ, গাছের প্রায় গায়গায় সেই পুরনো বাড়ি। এক্স সেলাস হোমই হয়ত। বাড়িটার চেহারা, এই ঝাপসা অন্ধকারেও জরাজীর্ণ মনে হল। কেউ যে ওবাড়িতে থাকে তাও মনে হয় না। তবু ছিটেফোঁটা আলো চোখে পড়ছিল।

তারাপদ আর চন্দন এসে হাজির।

 তারাপদ বলল, “দোকানের লোকটা এখনো আসেনি।”

রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন কিকিরা। সিনহা তখনো নামেননি। তিনি সারাটা পথই প্রায় টোটোর নাকের সামনে বাবলুর পুরনো জামাটা ধরে ছিলেন।

চন্দন বলল, “স্যার, বাড়িটার ফটক দিয়ে না গিয়ে আমরা বরং গ্যারাজের পেছন দিয়ে দিয়ে যেতে পারি।”

“কেন?”

“ওদিকে বাড়ির পাঁচিল ভাঙাচোরা। আমি দেখে এসেছি।”

সিনহা নেমে পড়লেন টোটোকে নিয়ে। বললেন, “ভাল সাজেশান। গোলমাল না করে ঢুকে পড়াই ভাল।”

গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে সিনহা তাঁর কুকুর নিয়ে এগিয়ে চললেন। জামাটা আর হাতে নেই। এক সাইকেলঅলা আসছিল। বিরাট কুকুর দেখে ভয়ে তফাতে সরে পালিয়ে গেল।

গ্যারাজ চুপচাপ। এখন বন্ধ। সামনের দিকে বোধ হয় দরোয়ান গোছের কেউ থাকে। সে নিজের মনে উনুন জ্বালিয়ে রান্নাবান্না শুরু করেছে। চারটে লোক আর বাঘের মতন এক কুকুর দেখে ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

কিকিরা কী মনে করে তার দিকে এগিয়ে গেলেন। কথা বললেন তার সঙ্গে।

“তুম দরোয়ানজি?”

“জি।“

“উয়ো মোকান?”

“মালুম নেহি।” দরোয়ানের ভয় আর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল, সে ধরেই নিয়েছে এই লোকগুলো নিশ্চয়ই পুলিশের লোক, নয়ত কুকুর নিয়ে এমন

সময় আসে!

কিকিরা ধমক দিলেন। “ঝুটা মত্ বোলো! ঠিক সে বাতাও”

এর পর লোকটা যা বলল, তাতে বোঝা গেল, বাড়িটা প্রায় পরিত্যক্ত। দু-চারজন যারা থাকে, তারা হয় আজেবাজে লোক, না হয় মাতাল। বাড়িটায় গুন্ডা-বদমাশের আসা যাওয়া আছে। জুয়াখেলা চলে। হল্লাও হয় কখনো কখনো। একটা খুনও হয়েছিল বছর দুয়েক আগে।

সিনহা বললেন, “আমরা ওবাড়িতে যাব।”

দরোয়ান বলল, “ইয়ে কারখানাকো ভিতর সে চলে যাইয়ে, সাব।”

কারখানার ভেতর দিয়ে ভাঙা পাঁচিল টপকে বাড়িটার মধ্যে যাওয়া যায়।

 সিনহা এগিয়ে গেলেন।

 ভাঙাচোরা দু-একটা গাড়ি, একটা মিনিবাসের খাঁচা, দু-একটা সারাই গাড়ি, লোহার জঞ্জাল, আরও কত আবর্জনা পেরিয়ে ভাঙা পাঁচিলের ফাঁক-ফোঁকর পাওয়া গেল।

কিকিরারা ঢুকে পড়লেন বাড়িটার ভেতর।

সামান্য খোলা জায়গা, আগাছায় ভরতি। দুটো গাছ। বাড়িটা ভূতের মতন দাঁড়িয়ে। টিমটিমে আলো দু-চার জায়গায়। ভাঙা টিউবওয়েল। বড় একটা পাথরের পাশে একটা কল।

সাড়াশব্দ বিশেষ নেই।

 সিনহাসাহেব টোটোকে এগিয়ে দিলেন।

টোটোই টেনে নিয়ে চলল। কাঠের ভাঙা সিঁড়ি। শুঁটকি মাছের মতন এক গন্ধ। ধুলো, ময়লা। ছেঁড়া কাগজ। একটা মাতালের চিল্লানি।

দোতলার শেষদিকের ঘরের কাছে এসে টোটো ঝাঁপিয়ে পড়ল।

 দরজা তালাবন্ধ।

দরজায় ধাক্কা দিয়ে সিনহা ডাকলেন, “বাবলু! বাবলু!”

ভেতর থেকে সাড়া এল।

“একটু দাঁড়াও, আমরা আসছি।” বলে কিকিরাদের দিকে তাকালেন। “তালাটা ভাঙতে হবে।” টোটো অনবরত দরজার গায়ে আঁচড়াচ্ছে, ধাক্কা মারছে, মুখে চামড়ার স্ট্যাপের গার্ড পরানো, তবু আওয়াজ করছিল চাপা।

কিকিরা ভাবলেন, পকেট হাতড়ালেন। বাড়িতে তাঁর কাছে কতরকমের চাবি আছে। হ্যান্ড কাপ খোলারও চাবি পাওয়া যাবে এখনো। ম্যাজিশিয়াস “কী। কিন্তু এখন পকেটে কিছুই নেই। তাঁর চাবির রিংয়ের সঙ্গে দাঁত খোঁটার একটা ছোট আঁকশি অবশ্য আছে। মেটাল টুথ পিক। ছোটখাট একটা স্ক্রু ড্রাইভার পেলে হত। অন্তত একটু শক্ত তারের টুকরো।

“সবাই মিলে ধাক্কা মেরে দরজাটা ভাঙব?” তারাপদ বলল।

“না না,” কিকিরা বারণ করলেন। “শব্দ হবে। যারা এখানে দু-চারজন আছে, ধাক্কাধাক্কি শুনে এসে পড়বে। দাঁড়াও দেখি, কী করা যায় বলে কিকিরা দেশলাই বা লাইটার জ্বালাতে বললেন। “একটা টর্চ থাকলে ভাল হত। তারা, দেখো তো আশেপাশে যদি তারের টুকরো কিবা সরু মতন কিছু কুড়িয়ে পাও। .নিন, সিনহাসাহেব, ওকে একটু সরান, আর লাইটারটা চন্দনের হাতে দিন।”

“আপনি তালা খুলবেন?”

“চেষ্টা করে দেখি। আপনার টোটোর নাক আছে মানতেই হবে। আমি ম্যাজিশিয়ান, ওল্ড অ্যান্ড রিটায়ার্ড, তবু আমার হাত আছে, ম্যাজিশিয়ান্স হ্যান্ড…!” কিকিরা রসিকতা করে বললেন।

চন্দন লাইটারটা জ্বেলে ধরে থাকল তালার সামনে। এক নাগাড়ে বেশিক্ষণ জ্বালিয়ে রেখে ধরে থাকা যায় না, আঙুলে তাত লাগে। নিভিয়ে ফেলতে হয়। আবার জ্বালতে হয় সামান্য পরে।

কিকিরা চেষ্টা করেই যাচ্ছিলেন। তার পাওয়া গেল না কোথাও, একটা পুরনো পেরেক পাওয়া গেল। দাঁত খোঁচানো আঁকশি আর পেরেক দিয়ে চেষ্টা করতে-করতে শেষপর্যন্ত তালাটা খুলে গেল। কিকিরা বললেন, “জয় মা তারা।”

দরজায় ধাক্কা মারতেই পাল্লা দুটো দু পাশে যেন ছিটকে গেল। কিকিরা ঢুকে পড়লেন ঘরে।

অন্ধকার ঘর। কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। খোলা জানলা দিয়ে যেটুকু আলোর আভা আসছে ঘরের বাইরে থেকে, তাতেও কিছু দেখা যায় না।

“বাবলু?”

বাবলু বুঝি আশাই করেনি এভাবে আচমকা তাকে কেউ বাঁচাতে আসবে! বিহ্বল হয়ে থাকল। মুখে কথা আসে না।

“বাতিটা জ্বেলে দিন। …আজ বাতি জ্বালতেও লোক আসেনি।” বাবলু শেষমেশ বলল।

লাইটারের আলোয় আধভাঙা সুইচ খুঁজে বাতিটা জ্বেলে দিল চন্দন। বাতি জ্বালার পর বাবলুকে চোখে পড়ল।

হাসপাতালের লোহার খাটের মতন একটা খাট একপাশে, তার ওপর মামুলি শতরঞ্জি, চাদরটাদর নেই। খাটের পায়ার সঙ্গে বাবলুর একটা পা নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা। এমনভাবে চালাকি করে বাঁধা যে, গিটটা খোলা যাবে না সহজে। জলের একটা জা মাটিতে নামানো। ঘরের এককোণে একটা এঁটো থালা, টিফিন কেরিয়ার।

বাবলুর পরনে বেখাপ্পা ময়লা পাজামা, গায়ে হাফহাতা বুশ শার্ট, সেটাও ময়লা। ওর চোখমুখ অসম্ভব শুকনো, নোংরা দেখাচ্ছিল। গালে দাড়ি গজিয়েছে ক’দিনে। রুক্ষ চুল মাথায়।

বাবলু সিহাকে চিনতে পারল। অন্য কাউকে সে চেনে না। অবাক হয়ে বোকার মতন তাকিয়ে থাকল। যেন তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না এত লোক তার ঘরে আসতে পেরেছে! টোটোকে সামলানো যাচ্ছে না। সিনহা ধমক দিলেন।

সিনহাই কথা বললেন, “বাবলু, এঁরা তোমার বাবার পাঠানো লোক। তাঁর হয়ে তোমায় খুঁজে বেড়াচ্ছেন ক’দিন। কী হয়েছিল তোমার?”

বাবলু জল খেতে চাইল। জাগে আর জল নেই। কোনো রকমে গলা ভেজানো গেল।

বাবলু বলল, “অন্যদিন সন্ধেবেলায় একটা লোক এসে আলো জ্বেলে দিয়ে যায়। জল দেয়, খাবার। আজ আসেনি।”

“খেতে দেয় না?”

“দেয়। দু বেলাই দেয়। চা-পাউরুটি দিয়ে যায়। আজ বিকেলে এসে চা দিয়ে গেল। আর এই..” বলে নাইলন দড়ির বাঁধন দেখাল।

ছোট ঘর। একটিমাত্র জানলা। লোহার শিক দেওয়া জানলা। শিকগুলো মোটা। বাইরের দিকে ভাঙা খড়খড়ি।

তারাপদ সরে গিয়ে ঘরের লাগোয়া বারান্দার দিকে গেল। সরু একটু বারান্দা। লোহার তারের জালি দিয়ে ঘেরা। ছোট্ট একটু কলঘর। বালতিতে জল নেই। ফুরিয়ে গিয়েছে।

কিকিরা বাবলুর বাঁধন খুলে দিতে লাগলেন। দিতে-দিতে মনে মনে হাসলেন। ভাল ম্যাজিশিয়ানরা বিশরকমের নট মানে গিঁট দেওয়া আর খোলা জানে। এ তো নেহাতই ছেলেখেলা তাঁর কাছে!

সিনহা কিকিরাকে বললেন, “এখানে আর দাঁড়িয়ে কাজ নেই, জায়গা ভাল নয়; চলুন আমরা চলে যাই। ফিরে গিয়ে যা শোনার শোনা যাবে।”

কিকিরা রাজি।

বাইরে এসে সিঁড়ি নামার মুখেই দেখা গেল দু-তিনটে লোক। তার মধ্যে হীরা দুগারও রয়েছে। লোক দুটো পাকা গুন্ডা গোছের। বোঝাই যায়, দুগার কোনো মতলব নিয়ে এসেছে। হয়ত সরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে বাবলুকে।

সিঁড়ির মুখে এত লোক আর কুকুর দেখে দুগাররা হকচকিয়ে গিয়েছিল। তারপর তারা আচমকা পিছু হটে পালাবার চেষ্টা করল।

দুগার পালাতে পারল না। সিনহা টোটোকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। চোখের পলকে সে দুগারের গায়ে গিয়ে ঝাঁপ মারল। অন্যজন গড়িয়ে পড়ল সিঁড়ি দিয়ে। একজন পালিয়ে গেল।

আচমকা হট্টগোল শুনে দু-চারজন– যারা ওই বাড়িটায় মাথা গুঁজে থাকে, তারা বেরিয়ে পড়েছিল।

দুগার আর এক-পাও নড়তে পারছিল না। টোটো তার বুকের সামনে দু পা তুলে দাঁড়িয়ে। অন্য দুটো পা দুগারের কাঁধে।

কিকিরা বললেন, “সিনহাসাহেব, এই সেই দুগার। হীরা দুর্গার। …বাবলু, এই লোকটা তোমাকে ধরে এনেছিল না?”

বাবলু মাথা নাড়ল। বলল, “না। ও গাড়িতে ছিল। গাড়ি চালিয়েছে ও। অন্য দুটো গুন্ডা আমাকে আচমকা ধরে ফেলে গাড়ির মধ্যে নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। তারপর একজন আমায় ওষুধ শুকিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে।”

দুগার কিছু বলবার চেষ্টাও করল না। কুকুরটার বিশাল মুখ যেন দুগারের নাক ছুঁয়ে আছে।

“এই লোকটা তোমাকে এখানে এনে আটকে রেখেছিল না?” কিকিরা বললেন।

“হ্যাঁ” বাবলু বলল। “ও আমাকে প্রথমে অন্য এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছিল। তারপর এখানে এনেছে।”

“এরা তোমায় মারধোর করত?”

“করেছে বার কয়েক।”

 সিনহা বললেন, “ঠিক আছে। এর ব্যবস্থা হবে। জায়গাটা ভাল নয়। গুড়ার দল এসে বোমা ছোঁড়াছুড়ি করতে পারে। এখন বাড়ি চলল।” বলে টোটোকে ডাকলেন।

টোটো তার শিকার যেন ছাড়তেই চায় না। শেষে ছেড়ে দিল।

দুগার আর পালাবার চেষ্টা করল না।

.

১২.

কৃষ্ণকান্ত যেন ভাবতেই পারেননি এইভাবে ছেলেকে তিনি ফেরত পাবেন। বাড়ির মধ্যে হট্টগোল পড়ে গেল। চুপচাপ বিমর্ষ বাড়ি জেগে উঠল আবার।

কৃষ্ণকান্তর বসার ঘরে ওঁরা সকলেই বসে : কিকিরা, তারাপদ, চন্দন এমনকি সিহাসাহেবও। কৃষ্ণকান্ত বসে আছেন। আবেগে, কৃতজ্ঞতায় তাঁর চোখে জল জমে আছে। জল, মিষ্টি খাওয়া শেষ। চা-সিগারেট খেতে-খেতে কিকিরা সময় জানতে চাইলেন। সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছে। কৃষ্ণকান্ত বললেন, “বাবলু আসছে; আর-একটু বসুন দয়া করে। রাত হলেও ভাববেন না; আমার গাড়ি গিয়ে আপনাদের পোঁছে দিয়ে আসবে। মিস্টার সিনহার তো কোনো তাড়াই নেই, কাছেই বাড়ি।”

সিনহাসাহেব বাবলুদের নামিয়ে দিয়ে বাড়ি ঘুরেই এসেছেন। রেখে এসেছেন টোটোকে।

বাবলু এল। তাড়াতাড়িতে স্নান সেরে এসেছ। তবু তাকে বেশ অবসন্ন দেখাচ্ছিল।

কিকিরা ডাকলেন বাবলুকে। বললেন, “এসো৷ বসো ওখানে।…কদিন ধরে ভোগালে খুব! কী হয়েছিল বলো তো, বাবা।” 

বাবলু বসল না। কেমন যেন কুণ্ঠিত। অপর ঘটনাগুলো বলতে লাগল।

প্রথম দিকের ঘটনা সবই মিলে গেল। নিজেদের ক্লাবে বসে চা-মুড়ি খাওয়া, খবরের কাগজের পাতায় একটা বিজ্ঞাপন দেখা–সবই ঠিক। এটাও ঠিক যে, বাবলু বিজ্ঞাপনের পাতার টুকরোটুকু ছিঁড়ে নিয়ে এসেছিল। কারণ সে দেখতে চাইছিল, তাদের বাড়িতে ঠাকুরদার যে পকেট ঘড়িটা পড়ে আছে–সেই ঘড়ি আর এই কাগজের লেখা ঘড়িটা একই কিনা!

পরের দিন সে আলমারি থেকে ঠাকুরদার ঘড়িটা বার করে নেয়।

“দেখলে একই ঘড়ি?” কিকিরা বললেন।

“হ্যাঁ। কিন্তু কাগজে যা বেরিয়েছিল তাতে পুরোটা–ডিটেল ছিল না অত। মোটামুটি ছিল। বোঝা যায় একই ঘড়ি।”

“তবু পুরোপুরি শিওর হওয়া যায় না!”

“খটকা থাকে।”

“তোমাদের ক্লাবে আড্ডাখানায় চা-মুড়ি খেতে-খেতে হঠাৎ বিজ্ঞাপনটা তোমাদের চোখে পড়ায় তুমি বন্ধুদের বলেছিলেএরকম একটা ঘড়ি তোমাদের বাড়িতে আছে?”

“বলেছিলাম। ওরা তেমন কেউ কান দেয়নি।”

“পরের দিন ঘড়িটা বার করলে। দেখলে। কাগজের সঙ্গে মিলিয়ে নিলে। খুকু সেদিনই দেখল তোমার কাছে ঘড়িটা। সেদিনই আবার তুমি পবনের কাছে গিয়েছিলে বিকেলের দিকে, ধীরাজের সঙ্গেও দেখা হয়েছিল। তখন আর ঘড়ির কথা বলোনি?”

“না।”

তারাপদ কিছু জিজ্ঞেস করবে ভাবছিল। করল না। চন্দনও চুপ। সিহাসাহেব আরও একটা সিগারেট ধরালেন।

“তারপর?”

“সেদিন সন্ধের দিকে বাড়ি ফিরে এসে আমি একটা ফোন করি। কাগজে ফোন নম্বর ছিল। নিচে, পাশের অফিস ঘর থেকে ফোন করেছিলাম। ভেবেছিলাম, কাউকে পাব না। পেয়ে গেলাম। একটা লোক ফোন ধরল।”

কিকিরা তাকালেন তারাপদদের দিকে। এই পর্যন্ত তিনি ঠিকই অনুমান করেছিলেন।

বাবলু নিজেই পরের ঘটনাগুলো বলে চলল। ফোনে যাকে পেল, সে স্পষ্ট বাংলা বললেও তার কথায় একটু অন্যরকম টান ছিল। লোকটার কথাবার্তা বলার ভঙ্গি থেকে বাবলুর কেমন সন্দেহ হচ্ছিল। মনে হল, লোট্টা ধূর্ত; ভালও নয়।

“কী বলল সে?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।

“বলল, জিনিসটা আগে দেখা দরকার। আরও দু-একজন যোগাযোগ করেছিল, পরে দেখা গেছে, তাদের কথা ঠিক নয়। কাজেই আগে জিনিসটা দেখতে হবে। অযথা কথাবার্তা বলার জন্যে ওই ঠিকানায় দেখা করে লাভ নেই।”

“তোমার নাম-ঠিকানা জানতে চেয়েছিল?”

“হ্যাঁ। আমি আমাদের ঠিকানা দিলাম না, শুধু বললাম লেক গার্ডেন্সে থাকি। নাম বলেছিলাম। …ও তখন বলল, ঘড়িটা আগে একবার দেখা দরকার। তাতে অসুবিধে হবে না ওর পক্ষে, ও নিজেও কাছাকাছি থাকে। একসময়ে জিনিসটা দেখতে পারে।” বলে বাবলু একটু যেন ইতস্তত করল, দেখল বাবাকে। পরে নিচু গলায় বলল, “আমার একটু ভুল হয়ে গেল। আমি লোকটাকে দেখতে চাইছিলাম। ভাবছিলাম, ওকে বাজিয়ে দেখতে হবে, ধরব ওকে।”

“বুঝেছি! তুমি ওকে দেখা করতে বললে সকালবেলায়, লেকের কাছে?”

“বললাম, আমি রোজ সকালে লেকে দৌড়তে যাই। আমার গায়ে নীল-সাদা ট্রাকসুট থাকে। কাল সকাল সওয়া ছটা নাগাদ আমি স্টেডিয়ামের দিকে দৌড়ব। ঘড়ি আমার কাছে থাকবে সে যদি চায়, দেখতে পারে। তবে ঘড়ি যদি মিলে যায় বাকি কাজটা আমার বাবা ঠিকানামতন জায়গায় গিয়ে করবেন। ও রাজি হয়ে গেল। ভাবল, সত্যি-সত্যি ঘড়িটা আমার কাছে পাবে।…আমি বুঝতে পারিনি, লোকটা আমার চেয়েও বেশি চালাক। সে আমাকে ওইভাবে তুলে নিয়ে যাবে, গুণ্ডা এনে! ভীষণ ভুল হয়ে গিয়েছিল!”

“ছেলেমানুষের মতন কাজ করেছিলে, হঠকারিতা।”

 বাবলু মুখ নিচু করে থাকল। বলল, “কী করে বুঝব, আমার পাড়ায় এসে ও আমাকে ওভাবে তুলে নিয়ে যাবে! আমি ভাবতেই পারিনি। আমার মনে হয়েছিল লোকটা ভাল নয়। চি। বদমায়েশ। হয়ত লোক ঠকিয়ে বেড়ায়। ওকে ধরব।”।

“তোমার সঙ্গে সিনহাসাহেবের দেখা হয়েছিল সকালে খানিকটা আগে; তাঁকেও তো একবার বলে রাখলে পারতে যে, তুমি…”

“না, আমি বলিনি।”

“ওভার কনফিডেন্ট ছিল আর কী!” সিনহাসাহেব বললেন।

 কিকিরা বললেন, “যাক গে, ঘড়িটা কোথায়?

বাবলু মাথা চুলকে বলল, “আমার ঘরেই আছে। পলিথিনের ব্যাগে মোড়া আমার ছোট গামবুটের মধ্যে।”

কৃষ্ণকান্ত অবাক হয়ে বললেন, “সে কী রে! আমরা এত খুঁজলাম। গামবুটের মধ্যে ঘড়ি রাখবি, ভাবতেই পারিনি!..ওখানে কেন রেখেছিলি?”

“খুকুর ভয়ে। ও আমার ঘরে সব জিনিস হাতড়ায়। ওর হাতে পড়লে তোমাদের দিয়ে দেবে। গামবুটের মধ্যে ঘড়ি! ওর মাথায় অত বুদ্ধি হবে না যে, জুতো হাতড়াবে।”

কৃষ্ণকান্ত আর কী বলবেন! কিকিরা হাসলেন।

 “যারা তোমায় ধরে নিয়ে গিয়েছিল,” কিকিরা বললেন, “তার মধ্যে ওই লোকটার নাম হীরা দুগার। জানো তুমি?”

“পরে জেনেছি। আগে জানতাম না।…ফোনে ও আমায় ওর নাম বলেনি, বলেছিল, নাম জেনে কী হবে, ও অফিস-এজেন্ট, আমায় খুঁজে নেবে আমার ট্রাকসুট দেখে।”

“তোমায় ওরা সোজা ওই বাড়িটায় নিয়ে যায়!”

“না। প্রথমে তিনদিন অন্য জায়গায় রেখেছিল। তারপর ওই বাড়িটায় নিয়ে যায়।” বলে বাবলু নিজেই বলল, “আমায় ওরা ভয় দেখাত। বলত, খুন করে ফেলবে। চড়চাপড়, ঘুষি মারত। ওরা চাইত, আমি একটা কাগজে লিখে দিবাবা যেন ঘড়িটা নিয়ে হীরার কথামতন জায়গায় তার সঙ্গে দেখা করে। আমি লিখে দিতাম না।…তবে ওরা যেমন আমায় নজরে-নজরে রাখত সব সময়, স্নান খাওয়াও করতে দিত।”

বাবলু চুপ করে গেল।

কৃষ্ণকান্ত বললেন, “একটা সোনার অচল ঘড়ির জন্যে এত! কী এর দাম! দশ-পনেরো হাজার। ব্যাঙ্ক লুঠ নয়, লাখ দু লাখ টাকার গয়না চুরি নয়–মাত্র দশ বারো হাজার টাকার জন্যে ছেলেটাকে কিডন্যাপ করল! মানুষ যে। আজকাল কী হয়ে গিয়েছে!”

কিকিরা মাথা নাড়লেন ধীরে ধীরে, চন্দনের দিকে তাকালেন। তারপর পকেটে হাত ডুবিয়ে একটা কাগজ বার করলেন। কৃষ্ণকান্তর দিকে তাকালেন এবার। বললেন, “না কৃষ্ণকান্তবাবু, দশ-পনেরো হাজারের ব্যাপার নয়। টাকার দিক থেকে লাখ সওয়া লাখও হতে পারত। তবে টাকাটাও এখানে বড় কথা নয়। অন্য ভ্যালু আছে ঘড়িটার। এই কাগজটাটাইপ করা কাগজটা–আজ লাজোস কোম্পানির ম্যানেজারসাহেব আমায় দিয়েছেন। এতে ঘড়িটার কথা মোটামুটি লেখা আছে। দেখবেন?”

“আপনিই বলুন।”

কিকিরা কাগজের লেখাটা দেখে-দেখে বলতে লাগলেন :

“ঘড়িটার মালিক ছিলেন আদতে এক ইটালিয়ান ধনী। ভদ্রলোক পরে হাঙ্গেরিতে চলে যান। ১৯১৪ সালে ভদ্রলোক বুদাপেস্ট শহর থেকে নিখোঁজ হন। কেউ তাঁকে খুন করে। পরে এক জাহাজের বরফঘরে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়। জাহাজটা ভারতের দিকে আসছিল। ভদ্রলোকের নাম ফিলিপপো। তাঁর স্ত্রী এবং মেয়ে ছাড়া আর কেউ ছিল না। স্ত্রী হাঙ্গেরিয়ান। স্ত্রী এবং মেয়ে মিলে “লাজোস কোম্পানি চালাতে থাকেন। মেয়ের ছেলেমানে নাতির নাম লাজোস এজরি। এই পরিবার একসময়, হাঙ্গেরির জুবা ইহুদিদের মধ্যে গোপনে অনেক কাজ করত। সাঁইত্রিশ সালের আগেই অনেক ইহুদিকে এরা বিদেশে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করেছিল। পরে, হিটলারের সময় গোটা পরিবারকে হাঙ্গেরি থেকে তাড়িয়ে, আরও হাজার হাজার ইহুদির সঙ্গে লেবার ক্যাম্পে রেখে, অত্যাচার করে মেরে ফেলা হয়। মাত্র একজন পালিয়ে বেঁচে গিয়েছিল। তিনিই এখন লাজোস কোম্পানির মালিক। এঁর নাম মোর। লাজোসদের পারিবারিক সংগ্রহে অনেক কিছুই একে-একে জোগাড় করা হয়েছে খুঁজে পেতে। আদিপুরুষের ঘড়িটার খবর পেয়ে এখন তাঁরা সেটি ফেরত পেতে চান।”

 সিনহার যেন বিশ্বাস হল না। বললেন, “আশ্চর্য ব্যাপার, মিস্টার রায়। ঘড়িটা কলকাতায় আছে এ-খবর ওরা পাবে কেমন করে?”

“কলকাতাতেই আছে তা হয়ত পায়নি। তবে এদেশের কোনো বড় শহরে রেয়ার ওয়াচ ডিলারদের কাছে আছে, জানতে পেরেছিল। সব বড় শহরের কাগজে বিজ্ঞাপনটা বেরিয়েছে–এ কথা ম্যানেজার সাহেব আমাদের বলেছেন। আরও বলেছেন, দিল্লির এক রেয়ার কালেকশা ডিলারের কাছ থেকে বোধ হয় ওঁরা শুনেছেন ঘড়িটা কলকাতায় থাকতে পারে।” কিকিরা বললেন।

সকলেই চুপ করে থাকল।

 রাত হয়ে যাচ্ছে। কিকিরা ওঠার জন্য প্রায় দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। কী মনে করে বাবলুকে বললেন, “তোমার ওই ফক্স, অক্স, বক্স লেখার মানে কী, বাবা?”

বাবলু বলল, “কাগজটায় লেখা নেই?”

কিকিরা হাসলেন। “আছে। বলব? এই কাগজ দেখে বলছি। বলি। ঘড়ি যদি আসল হয় তবে তার পেছনে একেবারে খুদে-খুদে অক্ষরে একটা মনোগ্রাম খোদাই করা আছে। গায়ে-গায়ে জড়ানো। তাতে এফ. ও. বি লেখা। মানে সেই মৃত বৃদ্ধের পুরো নামের আদ্যাক্ষর ফিলিপপো ও.বি। তুমি সেটা সাঁটে ফক্স, অক্স, বক্স করেছ?”

বাবলু মাথা দুলিয়ে বলল, “মাথায় এল, করে ফেললাম।” অত ভাবিনি। ফক্স, অক্স, বক্স মিলে যাচ্ছিল–তাই!”

রাত হয়ে যাচ্ছিল। কিকিরা এবার উঠে দাঁড়ালেন।

“এবার আমাদের যেতে হয়, কৃষ্ণকান্তবাবু। চলুন সিনহাসাহেব! আপনাকে স্যার ধন্যবাদ। আপনার টোটো সত্যিই ওয়ান্ডারফুল।”

তারাপদরাও উঠে দাঁড়াল।

চন্দন সিনহাসাহেবকে বলল, “ওই দুগারের কী হবে?”

সিনহা বললেন, “আজকের মতন তো তাকে আমার হোটেলের দরোয়ানদের জিম্মায় দিয়ে এসেছি। কাল দুগারের অফিস আর থানা-পুলিশ করতে হবে।”

ওঁরা বাইরে এলেন। কৃষ্ণকান্ত গাড়ি দাঁড় কক্কিয়ে রেখেছেন বাইরে। কিকিরাদের বাড়ি পৌঁছে দেবে গাড়ি।

“চলি মশাই, নমস্কার।”

“নমস্কার। আপনাদের কী বলে ধন্যবাদ দেব, জানি না। “ কৃষ্ণকান্ত বললেন, কৃতজ্ঞতার যেন শেষ নেই তাঁর। “আমি আপনার সঙ্গে কালই দেখা করব।”

সিনহা মজা করে বললেন, “উপায় নেই, দেখা করতেই হবে।”

কিকিরা, তারাপদরা গাড়িতে উঠে পড়লেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *