হরি ঘোষের গোয়াল – ৬

না; মরিনি। সবে ভোর হচ্ছে। জায়গাটা অবশ্যই কোনও হাসপাতাল। কোন হাসপাতাল? মাথাটা ভারি। সর্দারজীদের পাগড়ির মতো বিশাল এক ব্যান্ডেজ পরতে পরতে জড়ানো। ওপরের দিকে হাতের শিরায় একটা নল ঢুকেছে! পাশেই একটা বোতল ঝুলছে। ডান পা, ডান হাত দুটোই অকেজো হয়ে গেছে। খুটুস, খুটুস করে জুতোর আওয়াজ। দেবদূতের মতো পোশাক পরা নার্স চোখ চাইতে দেখে এগিয়ে এলেন।

‘আমি কোথায়?’

‘মেডিকেল কলেজে।’

এঁকে নির্মলার মতো দেখতে নয়, আশার মতো নয়, আমার কলেজ জীবনের বান্ধবীদের মতো নয়। ফরসা, পাতলা, রাগী রাগী মুখ।

‘আমার কী কী গেছে?’

‘সব ঠিক আছে।’

‘হাত, পা, নাক, কান?’

‘হ্যাঁ যেখানকার যা সেইখানেই আছে, পুরু পুরু ব্যান্ডেজের তলায়। কী হয়েছিল?’

‘জানি না।’

‘গাড়িটার নম্বর মনে আছে।’

‘দেখিনি।’

‘কাঁচা কাজ।’

‘আমার বাড়ি, বাবা!’

‘সব বসে আছেন বাইরে, সারারাত।’

‘দেখা?’

‘এইবার হবে।’

বেশি কথা বলতে পারছি না। মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। হেড ইনজুরি। মেমারি ঠিক আছে তো? মানব মুখার্জি। পিতা বিভূতি মুখার্জি। উত্তরপাড়া। আশা। বোট্যানিকস। হরেন। অন্নপূর্ণা মেক আপ। অমূল্যদা, কল্যাণদা, নারায়ণদা, কান্ত ঘাঘু, ব্যানার্জি সায়েব। আর কি? হ্যাঁ নির্মলা, সি—এ, এ সিকস ফুটার পরিমল পেন্টস। না, অতীত স্পষ্ট ভাসছে। বর্তমান, বিছানায়। ভবিষ্যৎ! জানি না। চিন্তা আবার আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। কেমন যেন শীতল গভীর জলের তলায় মরা মাছের মতো তলিয়ে যাচ্ছি। কি শান্তি! দূরাগত ক্ষীণ শব্দ। কতক্ষণ, কতক্ষণ এইভাবে কেটেছে জানি না!

এখন দেখছি ঘরের দরজা খুলে গেছে। বাইরে কত দর্শক। দর্শক আর দ্রষ্টব্য। বাবা, ব্যানার্জি সায়েব, অক্ষয় কাকা, কল্যাণদা, অমূল্যদা, নারায়ণদা, আশা। সবাই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন কারণ নার্স একটা গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলেছেন। গাড়ির ওপর এনামেলের ট্রে, জলে তুলো দুলছে, একটা ঝকঝকে কাঁচি থেকে আলো ঠিকরে আসছে। ঠেলাগাড়ি চলে যেতেই প্রথমে ছুটে এল আশা।

‘তুমি, তুমি কেমন আছ মানব?’

আমি তেমন কথা বলতে পারছি না। মাথায় লাগছে। ফিকে হাসতে পারছি। তোমার চোখে জল আমার মুখে মৃদু হাসি। ডান হাত তুলতে পারছি না। বাঁ হাতটাই তুলি। ঠিক আছি। বেশ আছি।

অক্ষয়কাকা আসছেন। ‘উঃ খুব বাঁচা বেচে গেছে হে। রাস্তা সব সময় দেখে ক্রশ করবে। লুক টু দি রাইট, দেন টু দি লেফট……’

বাবা এসেছেন, ‘কেমন বুঝছেন আপনারা, কেমন বুঝছেন?’

ব্যানার্জি সায়েব মাথার সামনে, ‘কোনও ভয় নেই ক্রাইসিস ইজ ওভার।’

একজন পুলিশ ইনস্পেকটার। পুলিশ ইনস্পেকটার কেন? উনি এখন কি কোনও স্টেটমেন্ট দেবার মতো অবস্থায় আছেন?’

‘আজ্ঞে না।’

‘আরে কান্তদা যে। কি বলছেন আপনি? ‘যা সত্য ঘটনা, সাহস করে বলে ফেল। তাতে আমাদের হাত আরও শক্ত হবে!’

ব্যানার্জি সায়েব গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ডোন্ট বি এ পলিটিক্যাল ব্রেসিয়ার।’

কিন্তু আমার যে অনেক কথা বলার আছে। আমি যে কিছু জেনে ফেলেছি। কান্তদাদের কাজে লাগাতে পারে। এই চলাটা পেলে ব্যানার্জি সায়েব পালটা চাল দিতে পারবেন।

ব্যানার্জি সায়েব বললেন, ‘পলিটিকসের চেয়ে জীবন বড়। ক্ষমতার চেয়ে আদর্শ বড়। এখন কোনও গোলমাল নয়। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’

চারপাশ থেকে আবার কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। অমূল্যদা সেই কতদূরে ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। থার্ড ক্লাসের দর্শক। মঞ্চের কাছে আসতে পারছেন না। অপেক্ষা করুন। চাকা ঘুরছে। আশা আমার বাবাকে পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করছে। বাবা বলছেন, এসো মা।

অক্ষয়কাকা বলছেন, ‘মেয়েটি কে?’

‘আমাদের অফিসে কাজ করে।’ নারাণদার গলা।

‘এ গুড সোল।’ কার গলা!

বাইরে যেন গুলির শব্দ হচ্ছে। দমকলের ঘণ্টা। কি হচ্ছে কি বাইরে! অ্যাডমিনিস্ট্রেশন খেপে গেছে। শব্দ, এক রাউন্ড, দু রাউন্ড।

‘মানব?’

‘বলুন স্যার।’

‘আমি আশা।’

‘কি বলছ?’

‘তোমার বাবাকে আমি বাবা বলেছি। তিনি আমাকে মা বলেছেন।’

‘চলো, তা হলে চলে যাই।’

‘কোথায় যাবে তুমি?’

শাসনের বাইরে। সবুজে, শ্যামলে, জলাশয়ে, অসীমের অসীমে।’

উস দারুণ বলেছি। ঠিক যেন কবিদের মতো। নিজের মাথাটাকে মনে হচ্ছে সিমেন্টের বস্তা। তবু কেমন ন্যাকা ন্যাকা ভাব আসছে। সিনেমার নায়িকার মতো আশা সামনে বসে আছে। মাথার দিকে দরাজ জানালা। কত বড় বড় মানুষ উৎকণ্ঠা মাখানো মুখে জিজ্ঞেস করছেন, কেমন আছ হে ছোকরা। পুলিশ মুখিয়ে আছে স্টেটমেন্টের জন্যে। আমি ইচ্ছে করলেই বিরাট একজন মানুষকে এক্সপোজ করে দিতে পারি। অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে টলিয়ে দিতে পারি। গাড়ি থেকে দুম করে রাস্তায় ছিটকে পড়ে নিমেষে হিরো বনে গেছি। ইচ্ছে করলে ইলেকশানেও হয়তো দাঁড়াতে পারি। এম এল এ থেকে মন্ত্রী। পৃথিবীতে সাকসেসের পথ কত সহজ। সামান্য একটু রিস্ক নিতে পারলেই হইহই ব্যাপার। ওপরে উঠবে মানব? সেখানে হাওয়া কত পরিষ্কার। ধুলো নেই, ধোঁয়া নেই, শব্দ নেই। মিনারের গবাক্ষ খুললেই ঝকঝকে নীল আকাশ। কে বলেছে প্রভু? সেখানে হরিদাস বসে বসে মাল খাচ্ছে। যৌবনের বিনিময়ে বার্টার সিস্টেমে চাকরি বিলোচ্ছে। সেখানে ঘুষের টাকায় হরেন ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার করছে। প্রয়োজন হলে বড়সায়েবের পায়েরতলায় হামা দিচ্ছে। এই পৃথিবীর ছায়ার আর এক পৃথিবী পনপন করে ঘুরছে। সে হাওয়ায় গাছ বাঁচে না। নিরালম্ব মৃত্তিকা চ্যুত অর্কিড বাঁচে। বিষাক্ত অর্কিড।

‘আশা?’

‘বলো?’

‘একে কি প্রেম বলে?’

‘জানি না।’

‘তোমার চাকরি কখনও রেপ করে নি?’

‘সুযোগ দিই নি।’

‘এই দেখ আমাকে কিন্তু করেছে। আমি কাল অন্য একটা জগতে চলে গিয়েছিলুম। অন্য ডাইমেনশানে। দিনের মানুষ থেকে সেখানে রাতের মানুষ বেরিয়ে আসে। মেক আপ, জানো মেক আপ ফ্যাকট্রি চাই। ওই লোকটার লাইসেন্স দিয়ে দাও। রাতকে মেক আপ দিয়ে দিন করতে হবে। হাওয়ায় সুবাস ছড়াতে হবে। তোমার কি মনে হচ্ছে আমি খুব নাটকীয় হয়ে উঠছি?’

‘মনে হচ্ছে।’

‘তাহলে শোনো,

পর্যটক ঘুরে ঘুরে সবই দেখেছে

পৃথিবীতে আর কোনো স্থান নেই

যেখানে কলম্বাস দিতে পারে পাড়ি

এইবারে আর এক পৃথিবীর খবর

আমি দিতে পারি।

এই গোলোকেরই আদলে

কায়ার পাশে ছায়ার মতো

মহাশূন্যে ঘুরছে

এই পৃথিবীরই এক ছায়া ছায়া

বিষণ্ণ বীভৎস রূপ।

‘কপালে হাত দিয়ে কী দেখছ আশা?’

‘তোমার জর এসেছে। ভীষণ জ্বর। তুমি ভুল বকছ।’

‘তোমার চোখে জল? তুমি কাঁদছ? কার জন্যে আশা?’

‘তোমার জন্যে।’

‘আমার জন্যে কেঁদ না। বরং ওদের জন্যে কাঁদ যাদের ক্ষমতার দিন শেষ হয়ে এল। যাদের পালের হাওয়া সরে গেল। যাদের পালের হাওয়া সরে গেল। কৈসি চলি হৈ অবকে হবা তেরে শহর মেঁ। বন্দে ভি হো গায়ে হে খুদা তেরে শহরে মেঁ। চললে কোথায় আশা?’

‘সিস্টারকে ডেকে আনি। তুমি ভুল বকছ।’

কয়া জানে ক্যা হুয়া কে পরেশান হো গয়ে। টকটক করে ঘোড়া ছুটে আসছে। ঘোড়া নয় সিস্টার। মানব দুম করে মরে যেও না যেন! আখ মাজাইয়ের কল চলছে। আখ চাই, আখ। মধ্যবিত্তের দুঃখসুখের রসে জ্বাল দিয়ে দিয়ে তৈরি হবে দানা দানা চিনি। হাসি পাচ্ছে! অভিমন্যুর মতো হাত পা ছড়িয়ে চিত হয়ে পড়ে আছি। চারপাশে বড়, ছোট, মাঝারি মানুষের ব্যুহ। কি, হে! কুরুক্ষেত্রে গিয়েছিলে বুঝি? আহা সেই পুরোনো ঘটনা। সপ্তরথীতে কাত করে দিয়েছে। হাওয়া বদলায়নি ভাই। সেই হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *