হরি ঘোষের গোয়াল – ৪

পিতার বক্ষে রেখেছ মোরে, বেঁধেছ সখার প্রণয় ডোরে। মধুর সকালে এমন সব প্রাচীন কবিতাই মনে পড়ে। ভোরের পাখি এখনও গান গায়। সকালে মানুষ এখনও হরিনাম নিতে নিতে গঙ্গাস্নান যায়। এখনও মধুপালোয়ান আখড়ায় কুস্তি করে। রাস্তায় খুব সোরগোল। যেন টেলিগ্রাম বেরিয়েছে।

নিতু ডাকছে—মানব, মানব।

‘কী হল রে?’

‘শুনেছেন, গুপীদা পুলিশ লকআপে নিজের কাপড়ে গলায় দড়ি দিয়েছে।’

‘সে কী রে!’

‘হ্যাঁ মাইরি, কি কাণ্ড দেখ। বউ, ছেলে, মেয়ে সব পড়ে রইল। লোকটা কাপুরুষের মতো পালাল।’

‘এক ছেলেতেই গুপীদাকে কাত করে দিলে। ছেলেটা মরে না গেলে সেই পাপের ভাগী হত। জেলটেল খাটত। গুপীদাটা তো নিভাঁজ, নিরীহ ভদ্রলোক ছিল। কোথা থেকে সে চোরাই মিল্কপাউডার এল, কে জানে!’

‘এর আর জানাজানি কি? নলে সার মাল।’

‘তুই মানব বেশি আর নলে সা, নলে সা করিসনি। লোকটা ইমিউনিটি নিয়ে ফিরে এসেছে। পকসের টিকে। কে কোথায় শুনে ফেলবে। ছোট মতো একটা ঝেড়ে দিলেই তোর খেল খতম।’

‘অত ভয় পাসনি তো নিতু। আমরাও এককাট্টা হলে নলেফলে সব ভেসে বেরিয়ে যাবে।’

‘এক কাট্টা হলে। বাইশ মণ তেলও পুড়েছে তোর রাধাও নেচেছে।’

নিতু চলতে লাগল। ‘কোথায় চললি রে রয়টার?’

‘চায়ের খোঁজে। গুপীদা গিয়ে কি অসুবিধেই যে হয়েছে। এক মাইল হাঁটলে তবে এক কাপ চা জুটবে।’

পাড়া ক্রমশই বেশ গরম হয়ে উঠছে। গলিতে ঘুঁজিতে, বাড়িতে বাড়িতে নিত্য নতুন ষড়যন্ত্র তৈরি হচ্ছে। কার ঘাড়ে কখন যে কোপ পড়বে! বাবা আর অক্ষয়কাকা বেড়াতে চলেছেন। অক্ষয়কাকা কাশতে কাশতে বললেন, ‘বুঝলে বিভূতি অতিলোভে তাতি নষ্ট। সংসারটাই ছারকার হয়ে গেল।’

বাবা বললেন, ‘দিস ওলড ওয়ার্লড ইজ পুলিং অ্যাপার্ট। আমাদের দিন ত শেষ হয়ে এল, ভয় এই সব উঠতি বয়েসের ছেলেদের নিয়ে। কোথায় কোন ফাঁদে পা দিয়ে বসবে?’

অক্ষয়কাকা আমার দাড়িটা নেড়ে দিয়ে বললেন, ইয়াংমান, তোমার বাবার স্পিরিট তুমি ইনহেরিট করবেই। বাট বি কেয়ারফুল, যুগ দ্রুত পালটাচ্ছে। উটের কাছে শিক্ষা নাও, ঝড় উঠলেই বালিতে মুখ গুঁজে আত্মরক্ষা করতে শেখ।’

‘না, অক্ষয়, না ডোন্ট অ্যাডভাইস হিম টু বি এ কাওয়ার্ড অর কমপ্রোমাইজিং। ফেস লাইফ অ্যাজ ইট ইজ। উই আর ইন এ কলড্রন। বিশাল কড়ায় ফুটন্ত তেলে মধ্যবিত্তদের ফ্রাই করা হচ্ছে। পালাবে কোথায়। বি এ ফ্রায়েড ম্যান। শুধু দু হাত দিয়ে সৈনিকদের বন্দুকের মতো নিজের আদর্শকে মাথার ওপর তুলে ধরে থাক।’

ট্রেনে যেতে শুনলাম, কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, শান্তিপুরে মানুষ খাদ্যের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে। সরকারি অফিস, রেল স্টেশান, ট্রেন হাতের কাছে যা পাচ্ছে সব পুড়িয়ে দিচ্ছে। সারা পশ্চিমবাংলা বারুদ হয়ে আছে। বিরোধীরা বাংলা বন্ধের ডাক দিয়েছেন। অমূল্যদা কাল বলছিলেন, অস্তগামী সূর্য আকাশে আগুন ছড়ায়। তবু মানুষ ট্রেনে বসে সুখী সুখী মুখে পান চিবোচ্ছে। চার হাঁটুর মাঝখানে ঝাড়ন বিছিয়ে তাস পিটছে। বর্ধমানের সেই কীর্তন পার্টি খচাখাঁই খচাখাঁই, করে তারস্বরে গান গেয়ে চলেছে। কেউ কেউ ভাতের আমেজে ঢুলে ঢুলে পাশের যাত্রীর ঘাড়ে পড়ে যাচ্ছে। সব ব্যাপারটাই কেমন যেন ভাসাভাসা। হাওয়ায় উড়ে আসা শিমুলের বীজের মতো।

স্টেশানে নেমেই আমরা দলে দলে হোঁত হোঁত করে ট্রামের দিকে দৌড়তে শুরু করলাম। পায়ে পায়ে, গায়ে গায়ে, কাঁধে কাঁধে। অফিসের খাতা কান ধরে টানছে। লাল পেনসিল হাতে ঢেরা মারার জন্যে দপ্তরে দপ্তরে বড়বাবু নামক এক পদার্থ বসে আছেন। দেরি হলেই তিনি পৈশাচিক উল্লাসে একটি লাল ক্রশ এঁকে দেবেন। মেরেছি ঢ্যারা।

দূর থেকে মনে হল, টিফিন কাফের সামনে ফুটপাথে গাড়িবারান্দার তলায় হরেনদা আর অন্নপূর্ণা মেকআপ ফ্যাকট্রির সেই ব্রজবাবু দাঁড়িয়ে। হরেনদা হাসি হাসি মুখে খুব হাত পা, মাথা নাড়ছেন। ব্রজ ভসভস করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছেন। গায়ে সার্জের পাঞ্জাবি। ঘি ঘি রং। কাঁধে দামি শাল। চোখে সোনালি ফ্রেমের নীলচে কাচের চশমা। ছায়া পড়ে চোখের কোল দুটো কালচে দেখাচ্ছে। অসংযমীর চেহারা। দৃশ্যটা খুব ভালো লাগল না। উলটো ফুটপাথ ধরে হন হন করে হেঁটে অফিসে ঢুকে পড়লাম। হরেনদার মুখ দেখে মনে হল, শ’ পাঁচেক পকেটে ঢুকেছে। আজ খুব রাধাবল্লভী আর কড়া পাক উড়বে। কৃষ্ণনগরে মানুষ মরুক। আমি তো বাঁচি। বড় হলঘরে একবার ঢুকতেই হয়। হাজিরা খাতা বড়বাবুর টেবিলে।

‘মানব যে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘কাল পালালে কোথায়? তোমার সায়েব, সি এ খুব খোঁজাখুঁজি করছিলেন।’

‘মিছিলে গিয়েছিলাম।’

‘ও আবার রাজনীতিতে জড়ালে?’

‘রাজনীতি কেন? এ তো আমাদের দাবিদাওয়ার আন্দোলন।’

‘আরে পোলাপান! তুমি দেখি সবই সরল করে নাও। শোনো দুটো রাজনীতি সব সময় প্যারালাল চলে। একটা গদির আর একটা রাস্তার। ছেলেবেলায় পড়েছ তো দুয়ে পক্ষ। কৃষ্ণপক্ষ আর শুক্লপক্ষ। চাঁদ আছে, চাঁদ নেই। গদি হল শুক্লপক্ষ। রাস্তা হল কৃষ্ণপক্ষ। এটাকে ঘুরিয়ে ওটাতে ফেল ওটাকে ঘুরিয়ে এটাতে ফেল। যশোদার ননী ঝুলছে শিকেতে। বাল গোপালকে পিঠে পিঠ পেতে দাও। নবনী হরণ পালা। সেই পিঠটা নাইবা পেতে দিলে। এ ত আর সখা কৃষ্ণ নয় যে, তোমাকে নবনীর ভাগ দেবে। মাঝখান থেকে পিঠটা যাবে। ট্র্যান্সফার হয়ে যাবে কুচবিহারে। ওই সি এ—টিকে ধরেছ, ভাল করে জাপটে ধর, ন্যাজ ধরে বৈতরণী পার হয়ে যাবে।’

বড়বাবুর এক পশলা উপদেশ শুনে চলে আসছিলাম, আশা দূর থেকে হাত নেড়ে ডাকল। সেরেছে! রাস্তায়, রেস্তোরাঁয় কথা, কেউ দেখবে না। কটকটে দিনের আলোয় অফিস হলে জোড়া জোড়া চোখের সামনে ব্যাপাটার অন্য মানে হবে না তো! ডাকছে যখন সামনে যেতেই হবে।

আশা বললে, ‘আজ টিফিনে মোগলাই খেতে যাব।’

‘টিফিন কটায়?’

‘ও মা তাও জানেন না। দুটো।’

‘থাকলে যাব।’

‘আপনি খাওয়াবেন।’

‘তথাস্তু।’

অমূল্যদা সামনে বসেন। শুনতে পেয়েছেন মনে হয়। মুচকি হাসলেন। অমূল্যদা আমার ফ্রেন্ড। শুনলেও কিছু এসে যায় না। চলে আসছি, আবার বাধা। কান্তবাবু কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘মাইনে পেয়ে ইউনিয়ানের চাঁদা দশ টাকা দিও।’

‘সে তো এখনও দেরি আছে।’

‘তোমাকে বলে রাখলুম। সুদর্শনও চাইতে পারে। সুদর্শন কোন দলের জান তো?’

‘না।’

‘খাজা পার্টির। স্ট্রেট বলে দেবে মুখের ওপর, দালালদের আবার ইউনিয়ান কি?’

বাইরের করিডরে বিশাল হইহই শোনা গেল। কী হল আবার! লিফটটা ছিঁড়ে পড়ে গেল নাকি? কান্তবাবু আমি দুজেনই দৌড়লুম। অন্যান্যদের মধ্যে যাঁরা পোড়খাওয়া জিনিস তাঁরা বসেই রইলেন, কেউ কেউ ছুটলেন মজার গন্ধ পেয়ে।

গোলমালটা সেই ঘাঘু সায়েবের হারেমের বাইরে। একটি লোক বাইরে দাঁড়িয়ে। কপালের পাশ বেয়ে রক্তের ধারা নেমেছে। দুজন তাঁকে ধরে দাঁড়িয়ে খুব চিৎকার করছে। ঘাঘু সায়েব পাইপ মুখে দিয়ে গর্জন করছেন, ‘গেট আউট, আই সে গেট আউট!’

কান্তদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’

‘মেরেছে স্যার!’

‘মেরে কপাল ফাটিয়েছে?’

‘না, কপাল ফেটেছে পড়ে গিয়ে! সায়েবের টেবিলের মাথার ওপর আলোর পয়েন্ট ঠিক করতে ঘড়াঞ্চিতে উঠেছিল। হঠাৎ শক খেয়ে প্লায়ার আর স্ক্রুড্রাইভার নিয়ে টেবিলের ওপর পড়ে যায়। টেবিলের কাচ ভেঙে গেছে। সায়েব বলছেন পাঁচশো টাকা দিয়ে কাচ কিনে দিতে হবে। গরিব মানুষ কোথায় পাবে টাকা। সায়েব বাপতুলে গালাগাল দিয়েছেন প্লাস এই জখম লোকটার গালে চড় মেরেছেন?’

কথা শুনে আর লোকটির অবস্থা দেখে রক্ত গরম হয়ে গেল। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘আপনি মানুষ?’

ঘাঘু সায়েব তোপের মতো ফেটে পড়লেন, ‘হোয়াট? কে এই বালখিল্য।’

‘মুখ সামলে। আপনি অন্যায় করেছেন। এই ভদ্রলোক ইচ্ছে করে আপনার কাচ ভাঙেনি। অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট।’

‘আই সে, হু আর ইউ?’ অগ্নিশর্মা সায়েবের পাইপ ধরা হাত কাঁপছে।

হরেনদা কখন পেছন এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি মিঠে মিঠে গলায় বললেন, স্যার এই ছেলেটি আমাদের রিসার্চ সেকসানে নতুন এসেছে। এর নাম মানব মুখার্জি।

‘মিস্টার ব্যানার্জির স্টাফ? অলরাইট আই উইল টিচ হিম এ লেসন।’ ঘাঘু সায়েব গট গট করে ব্যানার্জি সায়েবেরে ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। পেছনে দাঁড়িয়ে যারা মজা দেখছিলেন, তাদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলেন, ‘নাও এইবার মর। সাপের গর্তে হাত দেবার ঠেলা বোঝ!’

হরেনদা হাসি হাসি মুখে ফিসফিস করে কাকে যেন কী বলছেন। মনে হয় বলছেন, কাঁটা দিয়ে কাঁটা ওপড়ান। আশ্চর্য কান্তদা ইউনিয়নের নেতা তিনি একটাও কথা বললেন না। ‘আপনি একটু প্রোটেস্ট করলেন না কান্তদা?’

‘তুমি তো করলে ভাই।’

‘আপনারা সকলে করলে আরও জোরদার হত।’

‘অন্যের কথা জানি না। আমার স্ট্র্যাটেজি আলাদা। আমার এই ভাবে ইনভলভড হওয়া চলবে না। ব্ল্যাক লিস্টেড লোক। হঠাৎ ট্রান্সফার করে দিলে সংগঠন সাফার করবে। আমার কাজ তো এই একটা লোককে নিয়ে নয়। সারা পশ্চিমবাংলার কর্মীদের স্বার্থ আমাকে দেখতে হবে।’

‘ও তাই নাকি? এই মানুষটি তাহলে আপনার সেই স্বার্থের বাইরে?’

‘এককভাবে বাইরে কিন্তু সংঘবদ্ধভাবে ভেতরে।’

যুক্তিটা বোঝা গেল না। মনে হল, শেয়ালের যুক্তি। আরও দু’একটা প্রশ্ন ছিল। করা গেল না। ব্যানার্জি সায়েবের ঘরে ডাক পড়ল। যেতে যেতে মনে হল, ভিড়ের একপাশ থেকে সেই ব্রজরাজ টুক করে লিফটে গিয়ে উঠলেন।

ব্যানার্জি সায়েব মুখটা ভীষণ ভারী করে বসে আছেন। ঘাঘু সায়েব চেয়ারে বেঁকে বসে আছেন। পাইপ থেকে ভসভস করে ধোয়া বেরোচ্ছে। এর নাম পৃথিবী। বিভূতি মুখোপাধ্যায়ের ছেলে মানব মুখোপাধ্যায়। সাকিন উত্তরপাড়া। তাকে এখন কৈফিয়ত দিতে হবে—কেন সে একজন তালেবর ব্যক্তির অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। যাঁদের হাতে অরগানাইজেশান রয়েছে তারা ক্রীতদাসদের যা খুশি তাই করার অধিকার রাখেন। কে বলেছে আঙ্কল টমরা মুক্তি পেয়েছে। পিতা কিছু না বললেও এই সব পরম পিতারা তোমাকে ছেড়ে দেবে না। সার্ভিস কনডাক্ট রুল আছে, ডিসিপ্লিনারি অ্যাকসান আছে, চার্জশিট আছে। খপ্পর কাকে বলে জান মানব? জান না তো? এইবার ম্যাও সামলাও।

ব্যানার্জি সায়েব তিক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘মানব তুমি একজন সিনিয়ার এ ক্লাস গেজেটেড অফিসারের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় জান না? এঁকে তুমি অপমান করেছ।’

‘অপমান তো করিনি স্যার। অত্যন্ত নিষ্ঠুর, অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদ করেছি।’

‘প্রতিবাদ? তুমি জান না, এঁদের কোনো আচরণই প্রশ্নযোগ্য নয়। হেভন বরন সার্ভিস। এঁরা যা করবেন, যে ভাবে করবেন, সেইটাই হবে স্ট্যান্ডার্ড। আনকোয়েশ্চেনেবল।’

‘একটা লোক ইলেকট্রিকের কাজ করতে গিয়ে শক খেয়ে ছিটকে টেবিলের কাচের ওপর পড়ে গিয়ে আহত হলে, সহানুভূতি না জানিয়ে তাকে জুতো পেটা করে বলতে হবে, কেন কাচ ভেঙেছিস পাঁচশো টাকা দে। এটা হেভেনলি আচরণ স্যার! এর নামই কি হামাকা অফিসার!’

‘হোয়াট ইজ হামাকা।’

‘হাতে মাথা কাটা অফিসার স্যার।’

ঘাঘু সায়েব মুখ থেকে পাইপ খুলে বললেন, ‘এর পুলিশ ভেরিফিকেশান হয়েছে?’

ব্যানার্জি সায়েব বললেন, ‘না। সেটা হবে পার্মানেন্ট হবার সময়।’

‘হি ইজ এ পার্টি ম্যান। চাক হিম আউট।’

ব্যানার্জি সায়েব বললেন, ‘নস্ট অন ইওর অ্যাডভাইস। দেয়ার উইল কি অ্যান ইনভেসটিগেশান। বলা যায় না, ইউ মে বি অন দি রং সাইড।’

‘হোয়াট। ইউ আর গিভিং শেলটার টু অ্যান ইনসোলেন্ট ইভিলডুয়ার! আই ডাউট ইওর ইনটেগরিটি। আই উইল ক্যারি দিস ইস্যু টু সি এম।’

সব কথা চাপা পড়ে গেল। বাইরে খুব হট্টগোল হচ্ছে। স্লোগানের শব্দ—’জবাব দাও, জবাব দাও।’

ঘাঘু সায়েব তেড়েফুঁড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। যেন ফিউড্যাল লর্ড বাঘ শিকারে চলেছেন। সায়েবের দরজার বাইরে জনা পনেরো উত্তেজিত কর্মচারী! কারুরই নাদুসনুদুস চিকন চেহারা নয়। নেয়াপতি ভুঁড়ি প্যান্ট ঠেলে ব্লাডারের মতো উঠে নেই। চোয়াল উঁচু, রুক্ষ চেহারার সমাবেশ। ঘুঘু সায়েব একটু থমকে দাঁড়ালেন। হাতে হান্টার নেই, কাঁধে বন্দুক নেই, মুখে শুধু পাইপ, এক হাতে পাইপ খোঁচা মারার তার। তার দিয়ে তো বাঘ খোঁচানো যায় না।

গলাটাকে যথাসম্ভব উচ্চগ্রামে তুলে জানতে চাইলেন, ‘হোয়াট ইজ দিস। কি হচ্চে কি।’

জনতা গর্জন করে উঠলেন, ‘জবাব চাই, জবাব চাই।’

‘সিলি।’ সায়েব ইংরিজিতে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। নিজের চেম্বারের দরজার সামনে যাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ইমিডিয়েটলি কল পুলিশ।’

পনেরোজন মানুষ হেরেরেরে বলে শব্দ তুলে সায়েবকে গোল করে ঘিরে ফেললেন। সকলেরই হাতে কিছু না কিছু অস্ত্র। স্ক্রুড্রাইভার, প্লায়ার, রেঞ্জ, হাতুড়ি। হঠাৎ সেই দল চিৎকার করে উঠল মানব মুখার্জি জিন্দাবাদ! এঁরা কেউই কান্তর দলের নয়। ক্লাস ফোর স্টাফ। কান্তদা অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে। তার সাইকোলজি বোঝা গেছে। তিনি ভিড়ের মধ্যে থেকে ঢিল ছুঁড়বেন। বিপদ হলে সকলের হবে। একা কোনও ঝুঁকি নেবেন না! এ ব্যাপারে তাঁর নীতি বোধ হয়—সবে মিলি করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ। ঘাঘু সায়েব ঘেরাও। বিব্রত মুখের চেহারা। দলের মধ্যে যাঁর নেতা নেতা চেহারা তিনি বললেন, ‘মানববাবু। আমরা ঠিক গুছিয়ে বলতে পারব না, আমাদের একটাই দাবি, এঁকে ক্ষমা চাইতে হবে, তবেই আমরা ঘরে ঢুকতে দোব, নয়তো এইভাবে ঘিরে রাখা হবে। খবর দিয়েছি, আরও আসছে। আজ এসপার ওসপার যাই হয় একটা কিছু হয়ে যাবে।’

কথা শেষ হতে না হতেই লিফট থেকে একদল মহিলা নেমে এলেন। বড়, ছোট, মাঝারি। একজন খুব স্মার্ট। সাজপোশাকে একেবারে আধুনিকা। মুখের রঙের সঙ্গে হাতের রঙের মিল নেই। অন্নপূর্ণা মেকআপের জীবন্ত বিজ্ঞাপন। তিনি খরখর করে এগিয়ে এসে ছোটখাটো একটা ভাষণ দিয়ে ফেললেন।

এই অফিসারের অসভ্যতায় আমরা টেলিফোনের কর্মীরা মান—সম্মান দিয়ে চাকরি করতে পারি না। এঁর ধারণা টেলিফোনে যাঁরা কাজ করেন তাঁর সকলেই চরিত্রহীনা। পরশুদিন ইনি লাইন তুলে অশ্লীল, অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দিয়েছেন। তার আগে আমাদের একজনকে কুপ্রস্তাব দিয়েছেন। এই অন্যায়ের প্রতিকার চাই।’

আমরা সমস্বরে চিৎকার করে উঠলাম, ‘প্রতিকার চাই, জবাব চাই।’

প্রতিবার গর্জনে আমাদের রক্ত টগবগ করে উঠেছে। কারার এই লৌহ প্রাচীর, ভেঙে ফেল, ভেঙে ফেল, কারার এই লৌহ প্রাচীর। কান্তদার হঠাৎ কি মনে হল কে জানে। কুড়িয়ে বাড়িয়ে তাঁর দলের কিছু লোকজন জড় করে এগিয়ে এলেন। বোধহয় মনে হল, এমন একটা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন হাতছাড়া হয়ে যাবে। পাশেই একটা বেঞ্চ ছিল! তড়াক করে সেটার ওপর লাফিয়ে উঠলেন।

‘বন্ধুগণ, এইসব সার্ভিসের লোকেরা মানুষ নন। এঁরা অমানুষ। অবশ্য সবাই নয়, ভালো মানুষও আছে। সংখ্যায় কম। এই সিনিয়র, রেসপনসিবেল অফিসারের দৌরাত্ম্য, দুর্ব্যবহার ভদ্রতার সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করেছে। এঁকে আর বাড়তে দেওয়া উচিত নয়।’

ফ্যাঁচাত করে একটা শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা আলো চমকে উঠল। ভয়ে চোখ বুজিয়ে ফেলেছিলুম। পরে বুঝলুম গুলি নয় ক্যামেরা। ফিসফিস করে একজন বললেন, ‘নিউজ—পেপার এসে গেছে।’

আর একজন বললেন, ‘এইবার তো পুলিশ আসবে।’

আবার একবার আলো ঝলসে উঠল। প্রথমবার তোলা হল কান্তদার ছবি! দ্বিতীয়বারে ঘেরাও ঘাঘু সায়েবের। রিপোর্টার এসেছেন দেখে কান্তদার তেজ ভীষণ বেড়ে গেল।

‘বন্ধুগণ, আপনাদের সামনে পাইপ মুখে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি অফিসার নন, জনসেবক নন, মোগল বাদশা। দেশের সেবা নয় নিজের সেবাটাই ভালো বোঝেন। শুধু চেম্বার হলেই চলবে না, চেম্বারের মধ্যে চেম্বার চাই! পা ডুবে যাওয়া কার্পেট চাই। খাওয়া চাঁদের মতো ঝকঝকে টেবিল চাই। তার ওপর কাচ চাই। মাথার ওপর ঝাড়লণ্ঠন চাই। চুনকাম করা সাধারণ দেয়াল হলে চলবে না। নানা রঙের প্ল্যাস্টিক রং লাগানো দেয়াল চাই। সেই দেয়ালে কী ঝুলবে?’ কান্তদা নেচে নেচে অঙ্গভঙ্গি করে বললেন, ‘মেয়েছেলের ছবি ঝুলবে, মেয়েছেলের ছবি। সকাল থেকেই যিনি লাল চোখে, গরম মেজাজে, সখী নিয়ে বসে থাকেন তিনি এই নিরন্ন, দরিদ্র, ভারতবাসীর কী উপকার করবেন? ভারতীয় জীবনে এঁরা হলেন শ্বেতহস্তি। এঁদের সামনে এগোন যায় না, এঁদের ধারে কাছে আমরাই যেতে পারি না, ধুলো পা দরিদ্র গ্রামের মানুষ এই ধরনের ব্রাউন সায়েবদের থেকে কত দূরে একবার ভেবে দেখুন। এঁদের জীবন চালচলন, চরিত্র…।’

কান্তদা আড়চোখে একবার দেখে নিলেন, পুলিশ আসছে। করিডর ধরে গটমট করে এগিয়ে আসছেন একজন অফিসার, জনাকয়েক হাবিলদার। কান্তদার গলা আরও চড়ে গেল, ‘বন্ধুগণ চালচলন, চরিত্র, জীবনযাত্রার ধরন দেশ সেবকের নয়, দেশের শত্রুর।

পেছন থেকে জামার কলার ধরে ব্যানার্জি সায়েব আমাকে এক ঝটকায় তাঁর চেম্বারে টেনে নিলেন। ‘তুমি একটা ইডিয়েট, মূর্খ। কার সঙ্গে লড়াই করতে গেছ? এটা রাস্তা নয়, মনুমেন্টের তলা নয়, অফিস। পদাধিকার বলে দ্যাট রোগ তোমাকে এখুনি অ্যারেস্ট করিয়ে দেবে। পুলিশের ধোলাই জান? কোনদিন দেখেছ? রাজনীতি আন্দোলন, নেতাগিরি সরল নিরীহ মানুষের কাজ নয়। মধ্যবিত্তের বস্তাপচা আদর্শ ক্ষমতার সিংহাসনে যাঁরা বসে আছেন তাঁদের কাছে সম্পূর্ণ অচল। তুমি ওই পেছনের দরজা দিয়ে ইমিডিয়েটলি অফিস লিভ করে চলে যাও। কাল সকালে তোমার সঙ্গে দেখা হবে।’

নারাণদা আপন মনে টাইপ করে চলেছেন। বাইরে এত কাণ্ড গ্রাহ্যই নেই। গীতা বোধহয় মানুষের এই অবস্থাকেই বলেছেন ব্রাহ্মস্থিতি। যতই টাইপ করুন, আমাকে ঠিক লক্ষ্য করেছেন।

‘দাঁড়াও। খালি হাতে বেরিও না। খানকতক ফাইল নিয়ে যাও। ধীরে ধীরে হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যাও। সেখান থেকে লিফটে করে সোজা নীচে। দুটো লিফট। একটা জোড় নম্বরে থামে আর একটা থামে বিজোড়ে। আমাদেরটা বিজোড়। একটা ফ্লোর ওপর উঠে লিফট নিলে সে লিফটের দরজা এ ফ্লোরে খুলবে না। নির্ভয়ে নেমে যাও।’

খটাখট, খটাখট টাইপের শব্দ। দরজা খুলে করিডরে বেরিয়ে কর্তব্যপরায়ণ কর্মচারীর মতো মুখ নীচু করে বাঁক ঘুরে ওপরে ওঠার সিঁড়ি পেয়ে গেলুম। সিঁড়ি নির্জন। লিফট ছাড়া কেউ চলাফেরা করে না। তার ওপর এত বড় একটা হুজ্জোত। সকলেই মজা দেখতে ছুটছেন। কোনও মানুষ বিপদে পড়লে সভ্য মানুষেরা বড় আনন্দ পান। এইটাই বোধহয় মানুষের ধর্ম। হিন্দুধর্ম।

পেছনের দরজা দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসে বড় অবাক হয়ে গেলুম। আশা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কার অপেক্ষায় কে জানে? সামনেই দাঁড়িয়ে আছে পুলিশের প্রিজন ভ্যান। আশা আমাকে দেখতে পেয়েই হন হন করে এগিয়ে এল।

‘তোমার অপেক্ষাতেই আমি দাঁড়িয়েছিলুম মানব।’

‘তুমি কি করে জানলে আশা আমি পালিয়ে যাচ্ছি?’

‘আমি যে দেখলুম তুমি সিঁড়ির দিকে যাচ্ছ ফাইল বগলে।’

‘আমি কাপুরুষ আশা। আমি পালিয়ে এসেছি ভয়ে।’

‘আর একটাও কথা নয়। চল ওই ট্রামরাস্তার দিকে যাই।’

‘তুমি কোথায় যাবে?’

‘যে চুলোয় তুমি যাবে, আমিও সেই চুলোয় যাব।’

‘আমি হাওড়ায় যাব।’

‘আমিও যাব।’

‘তোমার অফিস?’

‘ছুটি। ক্যাজুয়াল লিভ।’

কী যে বলতে চায় মেয়েটা। কী যে করতে চায় মেয়েটা? হাওড়ার ট্রামে দুজনে উঠে পড়লাম। তেমন ভিড় নেই। দুজনে পাশাপাশি বসেছি। মনের অবস্থা এতই আচ্ছন্ন মনে হচ্ছে যা কিছু ঘটে চলেছে সবই স্বপ্ন। এত আলো, এত গতি, কোলাহল, কোনোটাই সত্য নয়। সবই মায়া। প্রপঞ্চ। আশাই দুটো টিকিট কাটল!

‘কি কাণ্ড বাঁধালে মানব?’

‘আমি কেন বাঁধাব আশা। জীবনের যত কাণ্ড সব আগে থেকেই সাজানো থাকে, অদৃশ্য হাত আমাদের ঠেলে দেয় এক অধ্যায় থেকে আর এক অধ্যায়ে। আমার অন্তত সেই ধারণা।’

‘ওসব শক্ত কথা আমার মাথায় ঢুকবে না। তোমার ভয় করছে না?’

‘কই না তো।’

‘তোমার চাকরি যাবে।’

‘যায় যাবে। চাকরির স্বাদ আমি বুঝিনি এখনও। এটা গেলে আর একটা জুটবে। তবে আমার দ্বারা চাকরি হবে না। এক জ্যোতিষী অনেকদিন আগে আমাকে বলেছিলেন তুমি চাকরি পাবে তবে চাকর হতে পারবে না। তোমার সে কোয়ালিফিকেশান নেই। কথাটা বোধহয় অক্ষরে অক্ষরে সত্য!’

‘তুমি কী বলে বাঘের খাঁচার দরজা খুলতে গেলে?’

‘বাঘ? কে বাঘ?’

‘ওই তোমাদের ঘাঘু সাহেব।’

‘একদিকে একটা অত্যাচারী, স্বেচ্ছাচারী লোক, আর একদিকে আমরা সবাই। কী করবে, কী করতে পারে ওই অসভ্য লোকটা আশা।’

‘অনেক কিছুই করতে পারে। ওর হাতে বিশাল একটা যন্ত্র রয়েছে। পুলিশ রয়েছে। ওপর মহল রয়েছে! একটা কলমের খোঁচায় আমাদের যত হাঘরেদের পিষে ফেলতে পারে।’

‘তার আগে আজ নিজেই পেশাই হোক। এতদিন কোনও প্রতিবাদের মুখোমুখি হতে হয়নি। তাই সাহস বাড়তে বাড়তে দুঃসাহসী হয়ে উঠেছিলেন ভদ্রলোক! আমার খুব ইচ্ছে ছিল এক হাত লড়ে যাবার। ব্যানার্জি সায়েব জোর করে তাড়িয়ে দিলেন।’

‘ভালো করেছেন। তা না হলে এতক্ষণ তুমি লকআপে। আরও ভালো হয়েছে ঘটনাটা ঘটছে একজন রিপোর্টারের সামনে।’

‘একেই বলে আশা, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।’

হাওড়া স্টেশানে নেমে মনে হল এইবার কী হবে! এতক্ষণ তবু কোথাও একটা যাবার ছিল। এইবার কোথায় যাব! আশা বললে, ‘তুমি এই সাতসকালে সত্যি ইত্যিই বাড়ি যাবে নাকি?’ এতক্ষণ খেয়াল করিনি আশা ত বেশ তুমি তুমি করছে। মেয়েরা কত সহজে সরতে সরতে একেবারে গায়ে লেগে যায়।

‘কী করব, কোথায় যাব নিজেই জানি না।’

‘তাহলে চল বোটানিকসে যাই। মনটা বেশ ভালো হবে।’

‘কার মন?’

‘তোমার মন, আমার মন। তোমাকে কেমন যেন দিশেহারা মনে হচ্ছে!’

‘দিশেহারা বলতে পার তবে মনে তেমন ভয় বা দুঃখ এই মুহূর্তে নেই।’

‘চল তা হলে!’

‘আমি কিন্তু জীবনে বোটানিকসে যাইনি। কোনদিকে কীভাবে যেতে হয় তাও জানি না।’

‘আমি জানি।’

‘বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাছে বাস থেকে নামতে গিয়ে আশার চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেল। সে এক মহা সমস্যা। কাছাকাছি কেউ নেই যাকে দিয়ে সারানো যায়। কোনও রকমে পা টেনে টেনে গেট অবদি এল। এই জন্যেই বলে, পথে নারী বিবর্জিতা। নীচু হয়ে বসে একটা ইটের টুকরো দিয়ে অনেকক্ষণ ঠোকাঠুকি করে বললে, ‘নাঃ সস্তার তিন অবস্থা। কতকালের চটি! আর চলে?’

‘এখন কী করবে?’

‘দূর করে ফেলে দিয়ে শুধু পায়ে ঘুরব।’

‘যাঃ তা আবার হয় নাকি?’

‘খুব হয়। আমি উত্তরবঙ্গে চা—বাগানের মেয়ে আমাকে তুমি জুতো দেখিও না।’ আশা সত্যিসত্যিই চটি দুপাটি টান মেরে ঝোপে ফেলে দিল। ফরসা ধবধবে নরম নরম পা। পথের কাঁকর কি সহ্য করতে পারবে। ভীষণ অদ্ভুত লাগছে। আশা কেন এল? তার এত মাথা ব্যথা কীসের। আমি কে? কেন আমার সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চাইছে? আশা বোধহয় একটু বেশিমাত্রায় রোমান্টিক।

বিশাল বটগাছের তলায় আমরা দুটি ক্ষুদ্র প্রাণী পাশাপাশি হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। কি বিরাট! কত প্রাচীন! অসংখ্য ঝুরি নেমেছে সময়ের ধারার মতো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, সময় যেন স্তব্ধ হয়ে আছে। বিশাল এক ঋষি তার জটাজাল নিয়ে সামনে বসে আছেন। বলতে চাইছেন, মানব, তোমার সেই অহঙ্কারী, অসভ্য প্রভুদের এনে এখানে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দাও, নিজেদের ক্ষুদ্রতাকে একবার চিনে নিক। পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে ক্ষুদ্র জীব আর নেই।

আশা দুহাত দুদিকে ডানার মতো ছড়িয়ে দিয়ে বোঁ বোঁ করে তিন চার পাক ঘুরে নিয়ে আমার বুকে মাথা রেখে বললে, ‘সব বাঁই বাঁই করে ঘুরছে। কি মজা! মনে হচ্ছে ছাত্রজীবন আবার ফিরে এসেছে। কি বল?’

‘ঠিক বলেছ। সেই হারিয়ে যাওয়া জীবনটার জন্যে এখন ভারি দুঃখ হয়।’

‘ওই তো মজা। যাহা যায়, তাহা যায়। শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয় ফিরে আয়, ফিরে আয়।’

‘বাঃ তুমি তো ভালো গান গাইতে পার আশা।’

‘নাচতেও পারি। দেখবে?’

‘থাক আর নাচতে হবে না। পায়ে কাঁটা ফুটবে।’

‘কি সবুজ বল তো?’

সত্যি চারপাশ সবুজে জমজম করছে। বিশাল বিশাল গাছ। শীতের নরম রোদ। অনেক গাছেই নতুন পাতা এসে গেছে। চিরতরুণ প্রকৃতি। গাছ কেমন বছরে বছরে যৌবন ফিরে পায়। মানুষের মতো নয়। মানুষ কেবল বুড়োতেই থাকে। ক্ষইতেই থাকে।

ঘাসে ঢাকা জমির ওপর একটা ঝোপ ঘেঁষে আমরা বসেছি। কোথাও কিছু নেই। শুধু গাছ আর গাছ। পাখির ডাক। সবুজ রোদ। কাঠবেড়ালির ছোটাছুটি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে আমি এক লিভিংস্টোন আফ্রিকায় বসে আছি। অযোধ্যাও হতে পারে। বলা যায় না এখনি হয়তো ওই ছায়াছায়া পথ ধরে রাম, লক্ষ্মণ, সীতা হেঁটে আসবেন।

সামনের দিকে দুটো পা ছড়িয়ে দিয়ে আশা আত্মভোলা বাউলের মতো বসে আছে। কোথা থেকে একটা গাছের ডাল জোগাড় করে সামনে ছিপের মতো ফেলে রেখে আপন মনে মাঝে মাঝে নাচাচ্ছে। ফড়িং উড়ছে কেঁপে কেঁপে। আশার পায়ের গোড়ালি দুটো কি সুন্দর। মোমের মতো। ফাটা নেই, চিড় নেই। হঠাৎ আশা বললে, ‘প্রেম করবে?’

‘সে আবার কী?’

‘কেন, কোনওদিন করনি? তোমার কোনও বান্ধবী নেই?’

‘না, দুজন বন্ধু আছে। তাও আজকাল তেমন আড্ডা হয় না’।

‘আমার কোলে মাথা রেখে চিৎ হয়ে শোও।’

‘হ্যাঁ আমার খেয়েদেয়ে কাজ নেই তোমার কোলে মাথা রেখে শুই। তোমার কোলটা বালিশ নাকি?’

‘তাহলে আমিই শুই।’

আশা শুয়ে পড়ল। সর্বনাশ? শুধু মেয়ে নয়, সুন্দরী মেয়ে। মাথায় লম্বা লম্বা ফুরফুরে চুল, আমার এত কাছে? প্রথম যেদিন সাইকেল চেপেছিলুম সেদিনও আমি সিটে এইরকম কাঠ হয়ে, সিঁটিয়ে বসেছিলুম। বেশিক্ষণ অবশ্য বসতে হয়নি। খানায় পড়ে গিয়ে বেঁচে গিয়েছিলুম সেদিনের মতো। আশা হাত দিয়ে গলার পেছনদিকটা জড়িয়ে ধরে আমার মুখটাকে ধীরে ধীরে সামনের দিকে নামিয়ে আনতে লাগল। আমার মুখটা যত কাছাকাছি হতে লাগল আশার মুখ ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অসম্ভব ফরসা। টানটান মুখের চামড়া। রোদের ভাষায় গোলাপি হয়ে উঠেছে। পাতলা নাক। কুচকুচে কালো, ধনুকের মতো ভুরু। ছোট্ট কপাল, রেশমের মতো চুলে ঢাকা। খয়েরি টিপ। লাল ঠোঁট। মানুষ যেমন কুৎসিত হয়, তেমনি সুন্দরও হয়। এত সুন্দর। ছবির চেয়েও সুন্দর। কোনদিনে কী মুহূর্ত এসে যায়। মরতে মরতে, জেলে যেতে যেতে, পুলিশের ধোলাই খেতে খেতে বেঁচে এসে একবারে নন্দন কাননে। মুখটা অনেক নীচে নেমে এসেছে। আশার মিষ্টি গরম নিশ্বাস নাকে এসে লাগছে। চরাচর ব্যাপ্ত করে চোখের সামনে আর কিছুই নেই কেবল পূর্ণিমার চাঁদের মতো একটি মুখ, টিপ, নাক, চোখ, ভুরু, ঠোঁট, সারিসারি মুক্ত।

কী হল? জীবনের ঘড়ি কিছুক্ষণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মনে হয়। আবার শুনতে পাচ্ছি পাখির ডাক, গাছের পাতায় বাতাসের শব্দ। সেই ভাবে বলতে ইচ্ছে করল, মন, চেয়ে দ্যাখ এই হল নারী। মানুষের দাসত্বের আর একটি শৃঙ্খল। এতে কি আছে! যা প্রকৃতিতে নেই, অসীমে নেই, জ্ঞানভাণ্ডারে নেই, ঈশ্বর চিন্তায় নেই।

আশার চোখ দিয়ে আবার জল বেরোতে শুরু করেছে। চোখের কোনো দোষ নাকি? প্রতিমার মতো ঘাম তেল মাখা মুখের গাল বেয়ে কাচের টুকরোর মতো জলের দানা নেমে এসেছে। এখন এই অবস্থায় কেউ যদি আমাকে দেখে ফেলে আমার পিতাঠাকুরের কাছে হাজির হন, বিভূতিবাবু দেখে এলুম, সে এক দৃশ্য মশাই! সিনেমাকে হার মানায়।

‘আশা, আবার তোমার চোখে জল!’

‘এ দুঃখের নয়, সুখের। আনন্দে আমার চোখে জল এসে যায়, চাপতে পারি না।’

‘কীসের আনন্দ!’

‘ভালো কিছু পাবার আনন্দ, কাছাকাছি আসার আনন্দ।’

‘ভালো কিছু মানে?’

আশা উঠে বসল। ‘জান, আমরা এখন পৃথিবীর এমন এক অংশে আছি, যেখানে নোংরামি নেই, শত্রুতা নেই, লোভ নেই, ভয় নেই। চারপাশ রোদে তাপে লেপের গরম, সবুজ গাছের বিছানা পাখির ডাক, সেই পাখি যার পায়খানাও মানুষের মতো দুর্গন্ধময় নয়। সবার ওপরে তুমি।’

‘আমি? আমি দেবতা নাকি?’

‘তবে শোন। তোমাকে প্রথম যেদিন দেখলুম সেদিন মনে হল, একটু অন্যরকম। চোখ, মুখ, নাক। মনে হল ভালো ভাবনা এখনও নষ্ট হয়ে যায়নি। আশেপাশে যারা ঘোরে তাদের মতো নয়। ছেলেদের যেমন মেয়েদের ভালো লাগে, মেয়েদেরও তেমনি ছেলেদের ভালো লাগে। তা জান কি!’

‘ও রহস্যের আমি কিছুই জানি না। অন্য রহস্যে এতই মশগুল।’

‘তুমি কখনও মেয়েদের পেছনে ছিপ নিয়ে ঘোরনি!’

‘না, নেভার।’

‘তাই তুমি পবিত্র আছ। মন্দিরের মতো পবিত্র।’

‘এবার বলবে, আমি কথা বললে, ‘তুমি আরতির কাঁসরঘণ্টা শুনতে পাও।’

‘তুমি জান না মানব পৃথিবীটা কী ভীষণ নোংরা জায়গা! আর আমি ভীষণ একা। আমার কেউ নেই! কেউ নেই। তোমাকে আর কেউ ধরার আগে আমি ধরে ফেলেছি।’

‘ধরে ফেলে কী করবে? খাঁচায় ভরবে?’

‘সুখ দোব।’

‘মানুষ দিতে পারে না।’

‘ভালোবাসা।’

‘বড় সাময়িক। শিশিরের মতো।’

‘আমরা দুজনে সরে যাব দূরে দূরে। সমস্ত নোংরামি থেকে নীচতা থেকে বহু দূরে।’

‘পারা যায় না। সবটাই যে পাঁক।’

‘তা হলে পদ্ম।’

সাধনা সাপেক্ষ।’

‘তা হলে?’

‘জীবন হল মুহূর্ত পুঁতির মালা। লাল, নীল, সবুজ, কালো। এই মুহূর্ত ভেসে চলে যাবে। আবার হয়তো আসবে কোনোদিন। আবার ভেসে যাবে। কোনো কিছুই ধরে রাখা যায় না আশা। জীবন বড় বিচিত্র। পাপ আসে, পুণ্য আসে। পুড়তে পুড়তে, দগ্ধ হতে হতে একদিন কয়লা হয়ে যায়। কালো কয়লা। সমস্ত রং যে জিনিস শুষে নেয় তার রংই কালো।’

‘তোমার কাছে ক’টাকা আছে?’

‘দাঁড়াও দেখি।’

‘আমিও দেখি।’

‘আমার পাঁচ—’

‘আমার দশ। দশ আর পাঁচ পনেরো। ওঃ অনেক টাকা। চল এক কেজি চীনেবাদাম কিনে নৌকোয় বসে খেতে খেতে চাঁদপাল ঘাটে যাই।’

বোট্যানিকস থেকে চাঁদপাল। সূর্য পশ্চিমে সরে এসেছে। দাঁড়ে জলের কুচুরকুচুর আওয়াজ। বিশাল গাছ নিয়ে বনানী পিছলে পিছনে সরে যাচ্ছে। একটু আগে আমরা ওখানে ছিলাম। জীবন ছেঁড়া কিছু মুহূর্ত ওখানে পড়ে রইল ফেলে আসা রুমালের মতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *