হরি ঘোষের গোয়াল – ২

গুপীর চায়ের দোকানে নির্মল বসে আছে। কখন চা খেয়েছিল, সামনে পড়ে আছে খালি কাপ। চায়ের তলানিতে সর পড়ে আছে। খাওয়া সিগারেটের টুকরো ফেলেছে। সরাদিনের বিধ্বস্ত কাগজের ওপর হাতের কনুই। চোখ দুটো দোকানের বাইরে, রাস্তার দিকে খোলা। নির্মল আমি দুজনে একই সঙ্গে দৌড় শুরু করেছিলুম। আমার যা হয় একটা কিছু জুটেছে, নির্মলের এখনও ঝুলে আছে। প্যানেলে নাম, তিন জন না চার জনের পর। প্যানেল বেঁচে থাকবে এক বছর। তার মধ্যে হল ভালো। না হলে আবার দৌড় শুরু।

‘বোস। কেমন গেল চাকরির প্রথম দিন।’

‘দাঁড়া, তার আগে চা বলি।’ দু কাপ চা বলে, একটু গুছিয়ে বসলুম। বড় আপন দোকান। তেলচিটে বেনচি, ধোঁয়া কালো, দেওয়াল, ছোঁড়া ছেঁড়া ক্যালেন্ডার, খালি সিগারেটের প্যাকেট। এই দোকানে আমার ছাত্রজীবন পড়ে আছে। তর্কবিতর্ক, গান গল্প, ঝগড়া, মারামারি। আমাদের অদ্ভুত স্বাধীনতার সেই সব ভারমুক্ত দিন ঝরাপাতার মতো ছড়িয়ে আছে এখানে। পা রাখলেই মচমচ শব্দ শোনা যায়।

নির্মল আর আমি চোখাচোখি হয়ে বসে আছি। কারুর মুখেই কথা নেই। জানি নির্মল কী ভাবছে। বন্ধুত্বের শেষ জুটি ভেঙে গেল এতদিনে। দিনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সময়টা আমার রোজই বিকিয়ে যাবে গোলামখানায় সামান্যমাত্র মূল্যে। নির্মল অফুরন্ত সময়ের স্বাধীন মালিক হয়ে বসে থাকবে একা। ও ভাবছে বড় দুঃখে আছে। আজ আমি জানি ও কত সুখী। এখনও সুখী। নিজেকে বিকিয়ে দুঃখ আমি জানি।

‘কি রে কিছু বল। বোবা হয়ে গেলি যে!’ নির্মল এতক্ষণে কথা বলল।

‘হেল। নরক একগাদা ফ্রাসট্রেটেড লোক পরস্পর পরস্পরের ওপর লাঠি ঘুরিয়ে চলেছে। কাজ কি জানি না, অকাজের খেলা চলেছ। ওপর দিকে ওঠার পথ নেই, নীচের দিকে নামার পথ খোলা পড়ে আছে।’

চায়ে চুমুক দিয়ে নির্মল বললে, ‘তার মানে উপরি টুপরির বেশ ঢালাও সুযোগ, র—মেটিরিয়াল, লাইসেন্স, পারমিট, পারচেজ। ভালোই ত রে, চট করে গুছিয়ে নিতে পারবি। ওই বাড়িটা দেখতে পাচ্ছিস?’

‘কোনটা? ওই মোড়ের মাথায়? অমৃতবাবু না কি যেন নাম?’

‘হ্যাঁ অমৃতবাবু। নীল রঙের গাড়ি চাপেন। অমৃতবাবু যে জায়গায় চাকরি করেন সেই জায়গা থেকে গাড়ির পারমিট, লাইসেন্স বেরোয়। রবরবাটা দেখেছিস? পাড়ার পুজোয় দেড় হাজার টাকা চাঁদা দিয়েছেন।’

‘অমৃতবাবুদের মতো হতে গেলে অতীত ভুলতে হবে, ভবিষ্যৎও ভুলতে হবে। শুধু বর্তমান নিয়েই থাকতে হবে। এগজিসটেনসিয়ালিস্ট। পাপ নেই,পুণ্য নেই শুধু ভোগ আর বিলাস। খাও দাও, ফুর্তি কর।

‘বুকের পাটাফাটা বাজে কথা। আসল কথা হল সারকামস্ট্যানসেস মেক এ ম্যান। সুযোগ পেলে তুইও হয়তো ওইরকমই হয়ে যাবি।’

‘বলতে পারি না, তবে আমার বাবা বলেন, যাঁরা ওইভাবে সুখের মুখ দেখতে চান তাঁরা দুঃখই পেয়ে থাকেন। কারুর বউ পাগল হয়ে যায়। কারুর ছেলে মারা যায়। মেয়ে পালিয়ে যায়। নিজের থ্রম্বোসিস হয়ে পক্ষাঘাতে পড়ে থাকে। অ্যাকসিডেন্টে পা কাটা যায়। একটা না একটা কিছু হবেই। বাবা জীবনে এসব অনেক দেখেছেন।’

‘এ ত সেই ধর্মের কল বাতাসে নড়ে গোছের ব্যাপার। তুই এসব বিশ্বাস করিস। অমৃতবাবুর কিন্তু এখনও কিচ্ছু হয়নি। বেশ শাঁসে জলে চেহারা। মুখে ঢলঢলে হাসি। দুবেলা তুইও ত দেখিস। নলে সাকেও ত দেখছিস। সরষের তেল, চাল, ডাল, মশলা, বেবিফ্রুট ব্ল্যাক করে পাহাড়ের মতো চেহারা। সোনা দিয়ে মোড়া কেলে বউ। ও সব বাজে কথা রে। পাপও নেই, স্বর্গও নেই, নরকও নেই।’

‘হতে পারে ভাই। যে যেমনভাবে নেয়। তবে আমার বাবার থিওরি ধর্মের ঘরে পাপ সহ্য হয় না।’

‘হয়, হয়, মন্দিরে গিয়ে দেবতার পায়ে ফুল চড়াতে হয় । দেখিসনি ওপারে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে ভণ্ডের সংখ্যা দিন দিন কেমন বাড়ছে।

নিতু হাঁপাতে হাঁপাতে দোকানে এসে ঢুকল। চোখে মুখে উত্তেজনা। ‘খবর শুনেছিস? যুদ্ধ বেধে গেছে। গুপীদা তোমার রেডিয়োটা খোল না।’ নিতু আর তর সইল না। নিজে গিয়েই রেডিয়োটা খুলে দিল। খবর বলা সবে শুরু হয়েছে। ছাম্ব আক্রমণ করেছে পাকিস্তান। সামনে মার্কিন ট্যাঙ্ক, সাজোয়া গাড়ি, পেছনে তিন চার হাজার পাকিস্তানী সৈন্য। ভারতীয় এলাকায় ঢুকে পড়েছে। আমাদের বিমান আক্রমণ প্রতিহত করছে। সংবাদ—পাঠক উত্তেজিত কণ্ঠে যুদ্ধের খবর পড়ছেন। ভারতীয় জওয়ানদের বীরত্বের কাহিনি বলছেন। প্রধানমন্ত্রী বিভেদ ভুলে দেশের মানুষকে এক হতে বলেছেন। অসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বলেছেন।

নির্মল বলল, ‘নাও শালা গোদের ওপর বিষ ফোঁড়া। জিনিসপত্রের দাম এমনই আকাশছোঁয়া, যুদ্ধের মওকায় সব উধাও করে এমন এক আর্টিফিসিয়াল স্কেয়ারসিটি তৈরি করবে আমাদের মতো লোকের আর দিন চলবে না। ওদিকে ব্যবসায়ীবাবুরা ফুলে ফেঁপে ঢোল হবেন। আর চাকরিটাও যাও বা হবার আশা ছিল যুদ্ধের নামে সরকার বলবেন, নো ফারদার রিক্রুটমেন্ট। খেল খতম, পয়সা হজম। আমার প্যানেল গঙ্গায়ৈ নমঃ।’

নিতু বললে, ‘ঘাবড়াচ্ছিস কেন? তুই আর আমি বিজনেসে নেমে পড়ব।’

‘কী বিজনেস করবি? ক্যাপিটাল কোথায়।’

‘বিনা ক্যাপিটেলেই হবে। চোরাই মালের বিজনেস। সত্যটাকে দেখেছিস। ব্যাটা খেতে পেত না, এখন লাল হয়ে গেছে। মাল খেয়ে ভুঁড়ি নেমেছে। এদিকে আবার পলিটিকস করছে। নেকস্ট ইলেকশনে এম এল এ।’

‘সত্য কী করে জানিস?’

‘ওয়াগন ব্রেকিং।’

‘আমরা পারব?’

‘দলে ভিড়ে যাব।’

‘তারপর গুলি খেয়ে মরব।’

‘আরে শালা এমনি না খেয়ে মরবি, তার চেয়ে গুলি খেয়ে মরা ঢের ভালো। হিরোস ডেথ।’

নিতু বলল, ‘একটু চা খাও মাইরি। মানব তুই খাওয়া। চাকরি পেলি। সেই বেলা তিনটে থেকে গাধা ঠেঙিয়ে গলা ভেঙে গেল। কি যন্ত্রণার কাজ মাইরি এই টিউশানি। মাইনে পনেরো কুড়ি তাও তিন কিস্তি, চার কিস্তিতে মাল ওগরাবে।’

দোকান থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথ ধরেছি, বাতাসে বেশ উত্তেজনা। সকলের মুখেই যুদ্ধের কথা। বিজয়দার নতুন বাড়ি হচ্ছে। এক—তলার গাঁথনি হয়েছে, ছাদ ঢালাই বাকি। বিজয়দা মিস্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলছেন, ‘হয়ে গেল। ছাদ আর ঢালাতে হচ্ছে না। সিমেন্টও উধাও হবে, লোহা হবে সোনা। ওই তেরপল লাগিয়েই বাকি জীবনটা কাটাতে হবে।’

রাতে খাওয়াদাওয়ার পর বাবাকে সেই হরিদার কথা বললুম। ভেবেছিলুম পুরোনো পরিচিতের কথা শুনে খুশি হবে। অনেক স্মৃতি মনে পড়বে। মুখটা মনে হল গম্ভীর হয়ে উঠেছে।

‘হরি ওখানে কী করছিল?’

‘আমাদের বড়কর্তার ঘরে বসেছিলেন। তাঁর সামনেই আপনার খুব প্রশংসা করতে লাগলেন।’

‘বি কেয়ারফুল ব্যাপারটা দ্যাট ম্যান। আই নো হিম ফর এ লং টাইম। কলেজে আমাদের জুনিয়র ছিল। কলেজ—টলেজ ছেড়ে স্বদেশি করতে গেল। তারপর যা হয়। এদেশের যেমন রেওয়াজ। যারা রিয়েল ফাইটার ছিলেন হয় তারা ইংরেজের জেলে পচে মরলেন, না হয় চলে গেলেন আধ্যাত্মিকতার পথে, না হয় সাইফার হয়ে বিস্মৃতির অতলে। কিছু করিতকর্মা চুনোপুঁটি ম্যানিপুলেট করে চলে এলেন ক্ষমতার ছাতার তলায়। বাঘের জায়গায় হায়না। অ্যান্ড হি বিলংস টু দ্যাট লট। শুনেছি সি এ না কি একটা হয়েছে। আসল হি ইজ এ টাউট। বহুবার দিল্লিতে আমার কাছে গেছে নানা কেস নিয়ে। সবই কোনও না কোনো ব্যবসায়ীর জন্যে অন্যায় তদবির। প্রথমে সেই কলেজের বন্ধুত্বের সুবাদে, তারপর ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে আমাকে, অ্যাডমিনসট্রেশানকে পারচেজ করতে চেয়েছে। বাট অ্যাজ ইউ নো, ফিয়ার অর ফেভার কোনোটাকেই আমার চাকরি—জীবনে আমি পরোয়া করিনি। হরি কোনও দিন আমাকে কাবু করতে না পেরে এখন হঠাৎ প্রশংসা করতে শুরু করেছে। শুনে অবাক হচ্ছি। হয় এটা তার কোনও চাল, না হয় ফ্যাগ এন্ড দি লাইফে সত্যিই হয়তো সে শুধরেছে। তবু তুমি কেয়ারফুল হবে। বলা যায় না আমার ভেনজেনস নিতে না পেরে মেকসিকান ফুয়েডের কায়দায় তোমাকেই হয়তো কাবু করে দিলে। সাপের দাঁত থেকে বিষ নামিয়ে দিলেও আবার বিষ জমতে থাকে। স্নেকস আর স্নেকস।’

সারাদিনের পর বিছানায় শুয়ে পড়েছিলুম। একপাশে আমার বিছানা, আর একপাশে বাবার। নিস্তব্ধ রাত। আমাদের এদিকটায় মানুষের উত্তাপ তাড়াতাড়ি জুড়িয়ে আসে। গাছপালা একটু বেশি। তাই রাতের দিকে বোঝা যায় শীত আসছে। ব্রিজের ওপর দিকে মালগাড়ি যাচ্ছে, গুম গুম শব্দ করে। বহু দূরের কোনও আকাশে এখন যুদ্ধে আমাদের রেখা। বিমান উড়ছে তলপেটে বোমা নিয়ে। মহাশূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে মানুষের পাঠানো উপগ্রহ, লুনা, ম্যারিনার। মানুষের ইতিহাস জয়ে পরাজয়ে। একদিকে সংকীর্ণতা, নীচতা, আর একদিকে মহত্ত্ব, উদারতা। দু কদম দূরেই বেলুড়মঠ। আমাদের ঘরের দেয়ালে স্বামী বিবেকানন্দের পরিব্রাজক মূর্তির ছবি। কতদিন রোদ ঝলমলে দুপুরে নিজের ঘরে ওই উজ্জ্বল মূর্তির দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে ঠোঁট দুটো কাঁপছে, তিনি বলেছেন,

If the Sun by the cloud hidden a bit,

If the welkin shows that gloom

Still hold on yet a while, brave heart

The victory is sure to come.

আশায় বলীয়ান হয়ে বসে পড়েছি কমপিটিটিভ পরীক্ষার প্রস্তুতিতে। মাঝে মাঝে মনে বড় অবিশ্বাস, বড় ভয় এসে যায়। শ্রীকৃষ্ণ, গীতা, ভগবান চৈতন্য, বুদ্ধ, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, এসেছেন চলে গেছেন, তবু দেশের কেন এই অবস্থা। সত্যর বাবা বড় সাত্ত্বিক মানুষ ছিলেন, সত্য হল ওয়াগন ব্রেকার। নলে সাহার বাবাকে দেখেছি। সামান্য মুদিখানার দোকান ছিল। গলায় তুলসীর মালা। পরম হরিভক্ত। বাড়িতে ভাগবত পাঠ। তার ছেলে নলে সা শিশু মেরে বড় লোক। বেবিফুড চেপে রাখা মানেই শিশু হত্যা। তেলে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল, সর্বত্র মানুষ মারার ব্যাবসা চলেছে। এরা দেখছি স্বামীজিকে অন্যভাবে নিলেন This is your cup—the cup assigned to you ঠিকই এই আমাদের পেয়ালা। of fault and passion, I made the stones that never give you rest.

বাবা শুয়ে পড়েছিলেন। মশারির ভেতর থেকে বললেন, ‘যুদ্ধটা তা হলে বেশ ভালো করেই বাঁধল।’

‘আজকের রেডিয়োর খবর শুনে তো তাই মনে হচ্ছে।’

‘দেশটা ছারখার হয়ে গেল। কাদের পাল্লায় যে পড়া গেল। কোনও জিনিসে তো হাত দেবার উপায় নেই। আগুন দাম। অদ্দেক জিনিস ত পাওয়াই যায় না। কোন মহাপ্রভু আবার ঠান্ডা ঘরে বসে দেশের মানুষকে কাঁচকলা খাবার উপদেশ ঝাড়ছেন। শহরে মানুষের এই অবস্থা, ভেবে দেখ গ্রামের মানুষ তা হলে কী ভাবে বেঁচে আছে। এর নাম স্বাধীনতা। তস্কর ধরেছে, রাজার বেশ। এই বুড়ো রক্তেও মাঝে মাঝে আগুন ধরে যায়।’

রাতেও বাবার ভালো ঘুম হয় না। তার ওপর এই সব উগ্রচিন্তা। রিটায়ার করার পর জীবনযাত্রার মান অনেক নেমে গেছে। ভেবেছিলেন ছেলে হয়তো কেউকেটা হবে। ঘোড়ার ডিম হয়েছে। যেমন করেই হোক এ চাকরি থেকে সরতে হবে। না আছে প্রোমোশান, না আছে জব স্যাটিসফ্যাকশন। বাড়ির সামনে দিয়ে বেশ একটা ভারী ধরনের গাড়ি চলে যাবার শব্দ হল। মনে হল গাড়িটা কিছু দূরে গিয়ে থামল। অ্যামুনিশাল বুটের শব্দ তুলে এক দল লোক যেন দৌড়োদৌড়ি করছে। এত রাতে এ আবার কি ব্যাপার।

বাবা বললেন, ‘এ আবার কি ব্যাপার। মনে হচ্ছে পুলিশ রেড। কার আবার কি হল কে জানে। দেশটাতো মাণিকে ভরে গেছে। চতুর্দিকে হীরের টুকরো ছড়ানো।’

রাস্তাঘাটে আজকাল আর আলো জ্বলে না। মানুষ সবই যখন মেনে নিতে পারে অন্ধকারও গা সহা ব্যাপার। দেশের সাধারণ মানুষ আর ছাগলে খুব একটা তফাত নেই। ওই ঘাসটাস খেয়ে ছানাপোনা নিয়ে দিন গত পাপক্ষয় করে যাও। বেশি আদর দিলে মাথায় চেপে বসবে। পায়ের তলায় দুশো বছর ছিলে, এখনও তাই থাকবে। রক্তে চলে গেছে কেঁচোর স্বভাব।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে তেমন স্পষ্ট না দেখতে পেলেও পাড়ায় একটা বড় রকমের উত্তেজনা ঢুকে পড়েছে, বেশ বোঝা যাচ্ছে। ঢাউস একটা কালো ভ্যান। পুলিশ নলে সার গোডাউনটা ঘিরে ফেলেছে। টর্চের আলো জ্বলছে নিবছে। শুনেছি নলে সার অনেক বড় জায়গায় সুতো বাঁধা আছে। পুলিশ—টুলিসের ক্ষমতা নেই তার কিছু করে। তবু এ খেলা কেন? নিশ্চয়ই লোক দেখানো। না কি অন্য কোনও কারণ আছে!

অন্ধকারে একটা আলো চমকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে শব্দ। একটা বোমা পড়ল। নলের অনেক পোষা গুন্ডা আছে। তারাই বোধহয় আরও জল ঘোলা করতে চাইছে। গাছের ঝোপঝাড়ের মাথায় টর্চের আলোয় ধোয়ার একটা তাল জমাট হয়ে ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে। কিছু পুলিশ ওই দিকে দৌড়ল।

‘ঘরে চলে এস।’ বাবার গলা। ‘কী আর দেখবে ওসব। শেয়ালে শেয়ালে লড়াই হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষকে এক হয়ে বিদেশি শত্রুর মোকাবেলা করতে বলেছেন। এই ভাবেই কর।’

পর পর কয়েকটা গুলির শব্দ হল। পুলিশ বন্দুক ধরেছে। একগাদা পাখি শব্দে চমকে উঠে ডাকছে, ঝটাপটি করছে। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ। পাক ভারত যুদ্ধ একেবারে বাড়ির পাশেই।

‘অর্থ আর লোভ কী জিনিস দেখেছ। মানুষ যত পায় তত চায়। রাম দত্ত মশাইয়ের সেই গানটা তোমার মনে আছে, ভিখারি বাসনা করি হইতে চায় লক্ষপতি, লক্ষপতি হলেও সে হইতে চায় কোটিপতি। ঐশ্বর্যের সঙ্গে অপরাধের হলায় গলায় সম্পর্ক। সে—যুগের জমিদার, ওই যুগের ব্যবসাদার, পলিটিস্যান, সব এক মাটিতে তৈরি। আজকাল সর্বত্রই তুমি শুনতে পাবে সৎ মানুষের স্থান নেই। তারা সব এক ঘরে। দে আর উইকলিংস। তারা মার খাবে না। না খেয়ে মরবে। মাথা তুলে দাঁড়াতে লজ্জা পাবে। এই সব ব্যভিচারীরা দয়া করে আমাদের খেতে দেবে, আমাদের ছেলেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢোকার সুযোগ দেবে, আমাদের ছেলেদের মেরিট থাকা সত্ত্বেও দয়া হলে ফার্স্টক্লাস দেবে, নয়তো সেকেন্ড ক্লাসে ঠেলে দেবে, দয়া করে চাকরি দেবে, দয়া করে প্রোমোশান দেবে। পথ চলায় ওদের দয়া, দু বেলার আহারে ওদের দয়া, রাতের ঘুম ওদের দয়া। এর নাম স্বাধীনতা। ফ্রিডাম অফ স্পিচ, এক্সপ্রেসান, এডুকেশান, অপারচুনিটি, রিলিজান। রাবিশ!’

রাবিশ বলার সঙ্গে সঙ্গে আর একটা বোমা। আও দু রাউন্ড গুলি। বৃদ্ধমানুষ, ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। একেই ঘুমোতে পারেন না, তার ওপর মাঝরাতে এই হল্লা। টিনের ওপর হাতুড়ি পেটানোর শব্দ হচ্ছে। নলের গুদামের দরজা ভাঙা হচ্ছে। পাড়ায় যেন উৎসব লেগে গেছে রে। যেমন অন্ধকার রাত, মনে হয় অমাবস্যা, তেমনি হাওয়া ছেড়েছে ভূতুড়ে। ঠাস করে আবার একটা গুলির শব্দ। একটা আর্তনাদ ভেসে এল। পুলিশের হাতে একটা মানুষ শিকার হল। কী করতে চাইছে ওরা। নলের নুনের এত জোর? তাজা তাজা ছেলেরা চারপাশ থেকে বাধা দেবার চেষ্টা করছে। এ যেন ক্রিমিন্যালদের আমেরিকান ক্রাইম সিন্ডিকেট।

আর্তনাদ শুনে বাবা বললেন, ‘অমাবস্যার রাত কাপালিকদের তন্ত্র সাধনা হচ্ছে। আমাদের তো যাবার সময় হল। কোনওরকমে চলে যাব। তোমাদের অবস্থা যে কী হবে। দেশের এইটটি পার্সেন্ট মানুষই এরপর অপঘাতে মরবে। নাও এবার ঘুমোবার চেষ্টা কর।’

অনেক রাতে পুলিশের গাড়িটা চলে গেল। শুয়ে শুয়ে শুনলুম। চড়চাপড়ের শব্দও কানে এল। মনে হল নলে সাহার গলা।

ভোরবেলা অক্ষয় কাকাবাবু আর বাবা বেড়াতে বেরোন চা খেয়ে। চা তৈরির দায়িত্ব আমার। পিতা—পুত্রের সংসারে দ্বিতীয় কোনও প্রাণী নেই। একটা মিনি বেড়াল আছে। ভোর থেকেই পায়ে পায়ে ঘোরে। মিউ মিউ করে। ঘুরতে ফিরতে বাবা বেড়ালটার সঙ্গে কথা বলেন। মাঝে মাঝে সহবত শেখান। সাদা তুলোর পুঁটলির মতো মেঝেতে থেবড়ে বসে আধবোজা চোখে সব শোনে। কতই যেন ভালো মেয়ে নাম আবার গৌরী। আমার বড় বোনের নাম ছিল গৌরী। আমি আসায় সে মাকে নিয়ে সরে পড়েছে। বাবার কথার য পলায়তি স জীবতি।

অক্ষয়কাকার কাশি হয়েছে। খুক খুক করে কাশছেন। গলায় একটা কমফার্টার জড়িয়েছেন।

‘বুঝলে বিভূতি কল্যই আমার শেষ রজনী হচ্ছিল। এতক্ষণ শ্মশানে!’

‘কেন হে! কাশি?’

‘বলতে পার কাশি। কাশি ইনভাইট করে আনছিল গুলি কিংবা বোম।’

‘কেন? এত কাশছিলে যে ব্রাহ্মণী শেষে বোমা মেরে ঠান্ডা করতে চাইছিলেন? মাঝ রাতে কাশি খুব ইরিটেটিং। অনবরত শুনতে শুনতে মাথায় খুন চেপে যায়। আমার হলে মানবকে পাশের ঘরে শুতে বলি।’

‘কাল রাতে তুমি কি জেগেছিলে?’

‘লাস্ট ফাইভ ইয়ারস আমি জেগেই থাকি। নট এ উইঙ্ক অফ স্লিপ।’

‘তা হলে জান না কাল রাতে কি হয়ে গেছে?’

‘খুব জানি।’

‘ওই বোম, একটা আমার জানালায় ঝেড়েছিল। তারপরই গুলি! জানলা ফাঁক করে বুড়ো মড়া দেখতে গিয়েছিলুম ব্যাপারটা কী? ছাম্ব ত বহু দূরে। হঠাৎ আবার কী হল। কে একটা ভূতের মতো ছুটছিল। কাশি চাপতে পারিনি। অন্ধকারে প্রথমে একটা গালাগাল ছুঁড়ল তারপর ঝেড়ে দিলে বোম। খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছি বিভূতি। এসো আজ দু কাপ চা দিয়ে সেলিব্রেট করি।’

‘শেষ অবধি কী হল? প্রথমটা আমরা জানি।’

‘খড়খড়ি খাঁক করে দেখলুম, ঘর অন্ধকার করে। নলে সার বেলুন চুপসে গেল। গোডাউন থেকে এতদিনের জমানো সব মাল বের করল টেনে টেনে। নলের কোমরে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে গেল। নলে শালা…’

‘স্টপ। মাইন্ড ইয়োর ল্যাংগোয়েজ।’

‘ল্যাংগোয়েজ। এতদিনের রাগ বিভূতি! তুমি জান ওই নলে ছুঁতো থেকে চোখের সামনে হাতি হয়ে গেল। তবে ভেরি স্যাড, ভেরি ভেরি স্যাড। গঙ্গার ধারে নাকি একটা ডেড বডি পড়ে আছে।’

‘ডেড বডি? কার ডেড বডি? ভেসে এসেছে বুঝি?’

‘ভেসে এসেছে, কি, কাল গুলি খেয়ে ওখানে লটকে পড়েছে, বোঝা যাচ্ছে না। পুলিশ এখন বের করুক। আজ আর গঙ্গার ধারে না যাওয়াই ভালো বিভূতি।’

‘অ্যাজ প্রোপোসড।’

‘তুমি যে দেখছি আমাদের টার্মস ইউস করছ!’

‘সারাজীবন যে আমলাগিরিই করে এসেছি ভাই। জীবন কেটেছে সেরেস্তায়। ফাইল তলার দিক থেকে ওপরে ওঠে। শেষ বড় সাহেব ফাইল ছাড়েন অ্যাজ প্রোপোসড বলে সই মেরে। বিপদে কেউ চোপ ধরতে পারবে না। তোমরা প্রোপোজ করেছ আমি ডিটো মেরেছি। ধরতে হয় তলার লোকটিকেই ধর। ওপর আনটাচড! একেই বলে পাকাল মাছের টেকনিক।’

দুই বৃদ্ধ ঠুকঠুক করে বেড়াতে বেরিয়ে গেলেন। আমার সকালের সবচেয়ে বড় কাজ বাজার করা। বাড়িতে যত কাপ চা—ই খাওয়া হোক না কেন সকালে সংবাদপত্র সহযোগে গুপীদার দোকানে এক কাপ চা না খেলে দিন ঠিকমতো শুরু হয়েছে বলে মনেই হয় না। কিন্তু একি! গুপীদার দোকান একেবারে এয়ারটাইট বন্ধ। সামনে দু—চার জন জটলা করছে। সেই দলে নির্মল আর নিতুও রয়েছে। নির্মল বললে, ‘শুনেছিস গুপীদার বড় ছেলেটা মারা গেছে।’

‘কী করে?’

‘গুলি খেয়ে।’

‘সে কি রে?’

‘হ্যাঁ রে? কাল রাতের পুলিশ ফায়ারিং—এ। গঙ্গার ধারে লাশ পড়ে আছে। গুপীদা মাইরি পাগলের মতো হয়ে গেছে।’

গুপীদার ছেলেকে কিছুদিন আমি পড়িয়েছিলুম। চোখের সামনে মুখটা ভাসছে। পড়াশোনা করার ছেলে সে ছিল না ঠিকই তবে গুলি খেয়ে মরবে ভাবতেও পারিনি।’

‘ওই সময় চাঁদু কোথায় ছিল রে? ঘটনা ত অনেক রাতে ঘটেছিল।’

‘চাঁদু মনে নলে সার গুন্ডার দলে নাম লিখিয়েছিল। ইদানীং ওর চালচলন কীরকম হয়ে গিয়েছিল লক্ষ্য করেছিস?’

কথাটা শুনে মনটা কি রকম হয়ে গেল। একটু আগে চাঁদুর জন্যে মন খারাপ হচ্ছিল এখন কি রকম ঘৃণা হচ্ছে। মানুষ মনুষ্যত্ব হারালে তার বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার কোনও তফাত নেই। রাগ হচ্ছে গুপীদার ওপর। বাবা হয়ে ছেলেকে যে সু—পথে রাখতে পারে না তার আবার শোক কীসের। লোকটা পাগল হয়ে যাক। ছেলের রোজগারে নিশ্চয়ই ভাগ বসাত। কোনওদিন গুপীর দোকানে আর চা খাব না।

গুপীর দোকানের সামনে দিয়ে একটা রাস্তা সোজা পশ্চিমে গঙ্গার দিকে চলে গেছে। সার সার লোক চলেছে। মহিলারা চলেছেন হাঁপাতে হাঁপাতে। যেন মেলা বসেছে গঙ্গার ধারে। মা ছোট ছেলের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলছেন, ‘আয়, আয় শিগগির আয় উনুনে ভাত বসিয়ে এসেছি।’

কোথায় চলেছেন এঁরা? একটি যুবকের মৃত্যু দেখতে। মৃত্যু এত দর্শনীয়। পশ্চিম থেকে ভোরের ঠান্ডা গঙ্গার হাওয়া ফুরফুর করে উড়ে আসছে। সে হাওয়ায় মৃত্যুর গন্ধ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *