হরি ঘোষের গোয়াল – ৫

সকালের কাগজে ফলাও করে খবরটা বেরিয়েছে। হেডলাইন নিউজ হল, কৃষ্ণনগর অচল। কারফিউ, গুলি। সরকারি অফিস ভাঙচুর। মানুষ খাদ্য চায়। কাজ চায়। ভেতরের পাতায় খবর, আমলা ঘেরাও। দপ্তর দুর্নীতির পীঠস্থান। স্লেভ ট্রেড এখনও বেঁচে আছে। মদ্য ও মহিলাসক্ত তালেবরের মুখোশ খুলে গেছে। ঊর্ধ্বতন মহলে তদন্তের দাবি। কোনো কর্মচারী পুলিশের হাতে গ্রেফতার বা সাসপেন্ড হননি।

যাক কান্তদাকে তা হলে অ্যারেস্ট করেনি। আর একটা আশার খবর সীমান্তে দুই দেশের যুদ্ধ বন্ধ। প্রধানমন্ত্রী যাবেন তাসখন্দে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সই করতে। সমস্ত কাগজটা উলটে পালটে মনে হল, আমরা বারুদে বসে আছি। একটু স্ফুলিঙ্গেই বিরাট বিস্ফোরণের সম্ভাবনা। বিরোধীরা বাংলা বন্ধের ডাক দিয়েছেন।

অক্ষয়কাকা চা খেতে খেতে বললেন, ‘যৌবনটা থাকলে কোমর বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়তুম।’

বাবা হুঁ হুঁ করে হাসলেন, ‘যৌবন থাকলে কিছুই করতে না, সংসারেই ন্যাতাজোবড়া হয়ে পড়ে দাসত্ব করতে আর নাকে কাঁদতে। নিরাপদ দূরত্বে বসে জীবন বিপন্ন করে অন্যের পেড়ে এনে দেওয়া ফলে ভাগ বসাতে চাইতে। আমরা যে মধ্যবিত্ত, অক্ষয়। আমাদের সব কিছুই শৌখিন। একটু বক্তৃতা, একটু অনশন, দু—চারটে প্রবন্ধ, বাছাবাছা শব্দের এডিটোরিয়াল, তাতে কি আর সেচ হয়? তাতে কি উৎপাদন বাড়ে? তাতে কি বেকারের চাকরি হয়! চেরীকাঠের ছড়ি দুলিয়ে, পাঞ্জাবি আর পামশু পরে বাঘ শিকার। যা এতকাল হয়ে এসেছে। অন্য জিনিস চাই অক্ষয়, অন্য জিনিস চাই। এন্টায়ারলি ডিফারেন্ট ব্রিড অফ মেন। আমাদের রক্তে সে বীজ নেই।’

‘আসছে, আসছে, সেই সব মানুষ আসছে। পবনপুত।’

‘হ্যাঁ আসছে। তারাই আসছে যারা মশাল জ্বেলে দাবানল বলে চিৎকার করে। নাও চল, আপাতত যা করা যায় তাই করি চল। বাত আর পরিপাক যন্ত্রের সেবা।’

অক্ষয়কাকা বেরোতে বেরোতে বললেন, ‘আই অ্যাম ভেরি মাচ অপটিমিস্টিক। চেঞ্জ একটা আসছে। চেঞ্জ ফর দি বেটার।’

সকালের অফিস যেমন শান্ত হওয়া উচিত তার চেয়েও যেন বেশি শান্ত। ফাঁকা লবি লিফটের লাইন আঁকাবাঁকা সরীসৃপের নয়। লিফট আসছে। খুস করে দরজা খুলে গোটা কতক লোক ভরে নিয়ে হাওয়ায় ভেসে ওপরে উঠে যাচ্ছে। দারোয়ান দেউড়িতে বসে খইনি ডলছে। বাইরে পাথর বাঁধানো রাস্তায় ট্রাম চলছে ঝড়ঝড়, খটাংখটাং করে। দিনের গর্ভে আজকের জন্যে কি মণিমুক্ত ছড়ান আছে কে জানে! ডুব না দিলে জানা যাবে না।

আজ আর হল ঘরে নয়, সোজা আমার ঘরে। চাকরিটা আছে না গেছে। ব্যানার্জি সাহেব বললেন, ‘এসো মানব, বোসো!’

বেশ বন্ধু বন্ধু ভাব। ক্ষমতার ঘূর্ণায়মান চেয়ারে বসে আছেন বলে মনেই হচ্ছে না। শান্ত, স্নিগ্ধ, সাত্ত্বিক।

‘এখনও আছে না গেছে স্যার।’

‘আছে। তবে তোমার আমার দুজনেরই যাবে। যে সম্ভাবনার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলাম, তুমি সেটাকেই অনুঘটকের মতো তাড়াতাড়ি ঘটিয়ে দিলে। একটি পরিবর্তন আসছে মানব। সামনেই নির্বাচন। দুর্নীতি প্রশাসনকে ফালাফালা করে ফেলেছে। ক্ষমতাপুষ্ট কিছু মানুষ বাড়তে বাড়তে ফ্রাঙ্কেস্টাইন হয়ে উঠেছে। এই ইমারত এবার ভেঙে পড়বে।’

‘এতদিনের স্ট্রাকচার?’

‘যত বড়, যত দিনেরই স্ট্রাকচার হোক, তলা থেকে পিলার সরে গেলে খাড়া থাকতে পারে কি? জানবে বুলেটের শাসন বেশিদিন চলতে পারে না। কোল্যাপসিং স্টেজে এসে গেছে।’

‘তা হলে?’

‘তা হলে ভয় নয়, সাহস চাই। এসো যাবার আগে আমরাও আর একটু নাড়া দিয়ে যাই। আমার কাছে শ’ দেড়েকের মতো কেস রয়েছে। সব ক’টাই চোর। সব ক’টাই মাথাঅলা। ওপরতলার টিকি ধরে আছে। লাখ লাখ টাকার চোরা কারবার। সব ক’টাকে আমি ভিজিলেনসে পাঠাব। কিছু হোক না হোক ঝুলে থাক কিছুদিন। ততদিন জমানা পালটে যাবে। খুঁটির জোরে ম্যাড়া লড়ে। খুঁটি সরে গেলে জোর কমে যাবে। এর সঙ্গে যে ক’জন ঘুষখোর কর্মচারী জড়িয়ে আছে তারাও একটু নড়বড়ে হয়ে যাক।’

‘ভিজিলেনস নাড়াচাড়া করবে!’

‘একটু নাড়াচাড়া করবে। একটু তাপ সৃষ্টি করবে। হ্যাঁ এই কাজে তুমি আর কল্যাণ আমাকে একটু সাহায্য করবে। যাবার আগে একটু কামড় দিয়ে যাওয়া ভালো, কি বল?’

‘হ্যাঁ স্যার।’

‘তবে লেগে পড়। ভয় করছে?’

‘না স্যার। কীসের ভয়?’

‘কীসের ভয় জানতে পারলে ভয়টাকে জয় করে মানুষ অভী হতে পারত। অজানাটাই ভয় হয়ে ওঠে।’

সারাটা দিন আমাদের আর মাথা তোলার অবকাশ মিলল না। কল্যাণদার বাইরেটা দেখে ভুল ধারণা করেছিলাম। সামান্য অহংকার আছে হয়তো, সে হল সৎ—এর অহংকার। কাজ জানার অহংকার। সারাদিন নারাণদাও খুব ব্যস্ত রইলেন। পাতার পর পাতা নোট টাইপ। চোরেদের চৌর্য কর্ম আবিষ্কারের ফিরিস্তি তৈরি।

শেষ বেলার অ্যাডমিনিসট্রেটিভ অফিসার এসে ব্যানার্জি সায়েবকে বললেন, ‘স্যার, আপনার ঘরের খানিকটা অংশ আপনাকে ছেড়ে দিতে হবে।’

‘কেন?’

‘সেনগুপ্ত সায়েবের ঘরটাকে একটু বড় করার হুকুম এসেছে ওপর মহল থেকে। ওঁর একটা কনফারেন্স রুমের ভীষণ প্রয়োজন।’

‘বেশ তো, ওঁর ঘরটাকে আপনারা ওদিকে বাড়ান।’

‘দ্যাট আই ক্যান নট। আমার ওপর হুকুম হয়েছে, আপনার চেম্বারের হাফ অ্যানেকস করার। আজ্ঞে কর্তার ইচ্ছের কর্ম। আমরা নিমিত্তি মাত্র।’

নিমিত্তের—ভাগী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ব্যানার্জি সায়েব বললেন, ‘কি বুঝলে?’

‘দাবার চাল পড়ল।’

‘এ চালে তো হারতেই হবে।’

‘আপনার কোনও চাল জানা নেই!’

‘হ্যাঁ আছে। যে মহল থেকে এই হুকুম এসেছে তারও ওপর মহল থেকে একটা হুকুম এনে এটাকে নাকচ করা। সে মহলে আমার অ্যাকসেস আছে। একে বলে লবি। তবে এখনই আমি সে মহলে যাব না। আমি গড়াতে দেব। লেট ইট রোল ডাউন। আরও কিছু লোক জড়িয়ে পড়ুক। জালে জড়াক। তারপর ধরে টান মারব।’

‘যাঁর জন্যে ঘর বড় করা হচ্ছে তিনি কে? তিনি কত বড়?’

‘বড়, ছোটর ব্যাপার নয়। ব্যাপারটা হল অ্যালাইনমেন্টের। রাজনীতি ছায়া ফেলেছে প্রশাসনে। গোটা চারপাঁচ দল আছে মানব এই অফিসে। এ দল লেগেছে ও দলের পেছনে, ও দল লেগে আছে সে দলের পেছনে। মানুষ হল খুঁটি। যে শক্তি যখন যেভাবে চালায়, সেইভাবে চলে। ওপাশেরটাকে তুলে এপাশে চালা হয়েছে। দেখা যাক চালটা কত শক্তিশালী।’

ব্যানার্জি সায়েব গুম হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। পড়ন্ত আলোয় মনে হল একক যোদ্ধা। হাসি পায়, কীসের যে যুদ্ধ? আসল যুদ্ধ পড়ে রইল অর্থনীতির সীমান্তে। এঁরা শক্তিক্ষয় করে চলেছেন নিজেদের সঙ্গে কোঁদলে। পিঠের গায়ের গোঁদো পিঁফড়ে ছাড়াতে ছাড়াতেই জীবন শেষ হয়ে যাবে, খাওয়া আর হবে না।

যে সব ফাইল ভিজিলেনসে যাবে তার একটা লট প্রস্তুত। খামে ভরে সিল করা হয়েছে। কাল সকালেই চলে যাবে। হরেনদা কয়েকবার ঘরে ঢোকার চেষ্টা করে তাড়া খেয়ে পালিয়ে গেছেন। তাঁর স্বার্থই সবচেয়ে বেশি। কত দিক থেকে কত টাকা খেয়ে বসে আছেন। হরেন ব্রাদার্সের বড় অসুবিধা হয়ে গেল।

দিন তখন শেষ হতে চলেছে। কৃষকরা হয়তো ফসলের খেত থেকে লাঙল কাঁধে ফিরছে। আর যারা বসে আছেন বহু দূরে তাদের ভাগ্য নিয়ে, তারা ছিনিমিনি খেলছেন ফাইলে, কাগজে। সাঁঝের বাদুড়ের মতো ঘরে এসে ঢুকলেন হরিদাস চট্টোপাধ্যায়। মানসিক অবস্থা যাই থাক ব্যানার্জি সায়েব যথোচিত সম্মানেই তাঁকে বসতে বললেন।

নারাণদার টেবিলে এখনও যা চিঠির তাগাড় জমে আছে তুলতে রাত আটটা বাজবে। কল্যাণদা একটা লবঙ্গ মুখে ফেলে বললেন, ‘আমাদের এত সাহস কিসে বলত?’

‘কি জানি কল্যাণদা।’

‘আমরা চারটে ব্যাচেলার ভাগ্যক্রমে এক জায়গায় জড়ো হয়েছি। সংসার থাকলে এত সাহস হত না। স্ত্রী, পুত্র, পরিবারের চিন্তায় কুকুরের মতো প্রভুদের পায়ের তলায় ন্যাজ নাড়তে হত।’

টাইপরাইটারে নারাণদার হাত চলছে ঝড়ের গতিতে। সেই অবস্থাতেই বললেন, ‘মানবকে তাই আমি শেখাই ডাল রোটি খাও হরিকে গুণ গাও। সব ছেড়ে ঈশ্বরকে আঁকড়ে ধর, পৃথিবীর সব বাঁকা জিনিস সোজা হয়ে যাবে।’

নারাণদার মাথার ওপর লাল আলোটা লাফিয়ে লাফিয়ে বারকতক জ্বলে উঠল। নারাণদা কানে পেনসিল গুঁজে হাতে খাতা নিয়ে দৌড়লেন। পরক্ষণেই ফিরে এসে বললেন, ‘মানব, তোমার ডাক পড়েছে।’

ঘরে ঢুকতেই হরিদাসবাবু বললেন, ‘মানব, তোমাকে নিয়ে আমি একটু বেরোব।’

ব্যানার্জি সায়েবের দিকে তাকালুম। এ আবার কি? হঠাৎ আমাকে নিয়ে কোথায় যাবার ইচ্ছে। মেশিনে ফেলে পেষাই করবেন নাকি। ব্যানার্জি সায়েব বললেন, ‘যাও। যা রইল কাল হবে।’

হু হু করে ট্যাকসি ছুটেছে চৌরঙ্গী ধরে পার্ক স্ট্রিটের দিকে। কোথায় চলেছি জানি না। বসে আছি পেছনের আসনে। হরিদাসবাবুর গায়ে পাটভাঙা খদ্দরের পাঞ্জাবি। মোলায়েম, লালচে সাদা। ধুতিটাও মনে হয় খদ্দরের। এ যেন খেলোয়াড়দের জার্সি। এ টিম অফ ব্র্যান্ডেড পলিটিসিয়ানস। মুখে মোটা চুরুট। পার্কস্ট্রিটের কাছে এসে হরিদাসবাবু বললেন, ‘সিধা চলিয়ে সর্দারজি।’ গাড়ি সোজা চলতে লাগল।’

‘আমরা কোথায় চলেছি?’ প্রশ্ন না করে পারলুম না।

‘নার্সিং হোমে।’

‘নার্সিং হোমে কেন?’

‘তোমাকে সিট অফ পাওয়ারের কাছাকাছি আনতে চাই মানব। তুমি বিভূতির ছেলে। তোমার প্রতি আমার একটা কর্তব্য আছে। শুধু এডুকেশন আর এফিসিয়েনসিতে এ বাজারে মানুষের ভাগ্য ফেরে না চিপ আন্দোলন, ফিউটাইল স্লোগান শাউটিং—এর কোনো দাম নেই, পলিটিক্যাল কাউ—এর হিউম্যান ফডার হলে, ফডারের ভাগ্য ফেরে না, গোরুর পেট ভরে। ক্ষমতার কাছাকাছি আসতে হয়। প্রিয়পাত্র হতে হয়। হাত পাতবে রাজার কাছে, বেগারের কাছে নয়।’

‘সিট অফ পাওয়ার কি এখন নার্সিং হোমে? পাওয়ার কি অসুস্থ?

‘আ, মাই বয়। ঠিক বাপের মতো বাঁকা বাঁকা স্যাটায়রিক্যাল কথা। ডোন্ট ট্রাই টু ফলো ইওর ফাদার। হি ইজ এ ফেলিওর। সে যদি সূর্য বন্দনা করে আসত তা হলে তোমার এ অবস্থা হত না আজ। এই পেটি থার্ড ক্লাস চাকরি। তবে হ্যাঁ ইউ আর লাকি। তুমি সাম হাও চ্যানেলে পড়ে গেছে। আমি তোমাকে ধীরে ধীরে ওপর দিকে তুলব?’

‘কেন?’

‘ইডিয়েট। তোমার মাথায় কী আছে? তুমি আমার লোক বলে তোমাকে তুলব। আমরা পলিটিসিয়ানরা হলুম অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বাইরের লোক। অথচ পলিসি নড়বে অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ঘাড়ে চেপে। সেই যন্ত্রটাকে নিজেদের আয়ত্তে রাখতে হলে সর্বত্র নিজেদের লোক বসিয়ে রাখতে হবে। উই নিড হেঞ্চ মেন। আমি বলব, তুমি করবে? কী করবে? আমি যা বলব তাই করবে। পুরস্কার? উন্নতি, ক্রমোন্নতি। উঠতে উঠতে তুমি…বাঁয়া সর্দারজি, বাঁয়া ঘুমিয়ে।’

ট্যাকসি সার্কুলার রোডে ঢুকে গেল। হরিদাসবাবু বললেন, ‘বি প্র্যাকটিক্যাল। ডোন্ট বি এন আইডিওলজিক্যাল ফুল।’

‘কিন্তু নার্সিং হোমে কী আছে?’

‘নার্সিং হোমে তোমার কিছু নেই। আমার কাছে। আমি যাঁর সিএ তাঁর মেয়ে এই নার্সিং হোমে। ডেলিভারি কেস। তোমাকে সঙ্গে এনেছি ফর ব্রেন ওয়াশিং। ডু ইউ নো, তোমার নামে মন্ত্রীর কাছে কমপ্লেন গেছে। তুমি একটা হট মিলিট্যান্ট, ড্যামেজিং দি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। এর পরিণাম কী হতে পারে তুমি জান? শুধু চাকরিই যাবে না, তুমি জেলে যাবে, অ্যান্ড দ্যাটস এ হরিবল প্লেস। রোককে, সর্দারজি।’

গাড়ি থেমে পড়ল। সায়েবি কায়দার বাগানবাড়ি। সাদা ধবধবে রং। ভাড়া মিটিয়ে হরিদাসবাবু আমাকে নিয়ে নেমে পড়লেন। খুব কায়দার নার্সিং হোম। উর্দি পরা দারোয়ান লাফিয়ে উঠে সেলাম করল। চারদিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কোথাও কোনো শব্দ নেই। জানা ছিল না বড়লোকদের ছেলে মেয়ে এইরকম মনোরম পরিবেশে জন্মায়। কেন তারা ঠান্ডা ঘরে বসে দেশ শাসন করবে না! গ্রামের চাষা সিংহাসনে বসবে। মামার বাড়ি!

নীচের তলায় কী আছে বোঝা গেল না। পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। দোতলার বারান্দায় গোটাকতক ঝকঝকে বসার জায়গা। হরিদাসবাবু বললেন, ‘তুমি এইখানে বোসো। আমি আসছি।’ সামনের দিকে চলে গেলেন। সারি সারি ঘর। প্রতিটি ঘরের বাইরে আলোর অক্ষরে সংখ্যা লেখা। সাদা ধবধবে পোশাকের নার্স মাঝে মাঝে আসা যাওয়া করছেন। কখনও হাতে ট্রে। কারও হাতে হটওয়াটার ব্যাগ। এনামেলের গামলায় গরম জল। জাফরি ঘেরা বারান্দা। কি একটা লতানে গাছ ফুলে ভরে ওপরে উঠে গেছে। চুপ করে বসে আছি। কতরকমের ফ্যাসাদে যে মানুষ পড়তে পারে। জীবনে আনন্দের অংশের চেয়ে নিরানন্দের অংশই বেশি। পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থলের মতো।

স্বাস্থ্যবান, শ্যামবর্ণ একজন নার্স এসে মিষ্টি গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কার জন্যে বসে আছেন?’ রং ময়লা হলেও মুখশ্রী, চেহারা দুটোই চোখে পড়ার মতো।

‘আমি হরিদাস চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এসেছি। আমাকে বসিয়ে ভেতরে গেছেন।’

কি জানি বাবা, বসে থাকাটা অপরাধ কিনা! যাঁরা আসছেন, যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁদের হাবভাব, চালচলন দেখলে মনে হয় সব ভিন্ন জগতের মানুষ।

‘ও হরিদাসদা এসেছেন?’

ভদ্রমহিলা ডগমগ হয়ে চলে গেছেন। হরিদাসবাবুর কত খাতির। পৃথিবীতে বাঁচতে হলে এইভাবেই বাঁচা উচিত। দাপটে। কার কাছে কীসের দাপট! দেশ তো বিশাল! একদল লেনেঅলার কাছে, দেনেঅলার দাপট। কি বস্তাপচা কথা, স্বদেশে পূজ্যতে রাজা বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে। ঠিকই, সাধাসিধে, হাবাগোবা মানুষের দিন ফুরিয়েছে। নতুন ক্ষমতা, নতুন বিত্ত প্রতিপত্তি জন্মেছে। উডুক্কু মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। স্বদেশের সবটাই শহরে এসে জড়ো হয়েছে, ক্ষমতার পাদপ্রদীপের সামনে। ফোকাস পড়ছে, ফোকাস।

সেই ভদ্রমহিলা এক কাপ চা এনে সামনে ধরলেন, ‘এই নিন।’

‘চা, আমি চা।’

‘হ্যাঁ, আপনি চা। খেয়ে নিন।’ মহিলা হাসতে হাসতে অদৃশ্য হলেন।

নার্সিং হোমের চা। যেমন ফ্লেভার, তেমনি লিকার। কাপের কি বাহার!

হরিদাসবাবু আসছেন। সঙ্গে ফুট ছয়েক লম্বা টুসটুসে এক যুবক। পেছনে আসছেন সেই নার্স মহিলা। পোশাক পালটে ফেলেছেন। হালকা রঙের গাড়ি, ব্লাউজ। মাথায় সেই টুপিটাও নেই। এখন একেবারে ঘরোয়া চেহারা।

তিনজনের সেই দল আমার সামনে এসে থমকে গেল। ছ’ফুট যুবক হরিদাসবাবুকে বললেন, ‘বাবাকে বলবেন, আমি কালকের মর্নিং ফ্লাইটেই চলে যাচ্ছি। সুষমারা তো এখন ভালোই আছে। আমি অফ দি মানথে ফিরব।’

‘তুমি কি জুরিখে যাচ্ছ এবার?’

‘হ্যাঁ ইচ্ছে আছে।’

‘তা হলে মনে করে ইঞ্জেকশনটা এনো।’

‘হ্যাঁ আনবে, তবে কাকাবাবু আমার মনে হয় অপারেশন করিয়ে নেওয়াই ভালো।’

‘দেখিনা কি হয়। ওষুধে যদি হয়ে যায় সার্জারিতে আর যাব না।’

হরিদাসবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এসো।’

সিঁড়ি দিয়ে আগে আগে নামছেন সেই যুবক। পেছনে হরিদাসবাবু। তার পেছনে সেই ভদ্রমহিলা, সবার শেষে মানব মুখার্জি। একজন মিসফিট। মহিলা নামতে নামতে একটু থেমে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার নাম?’

‘মানব মুখার্জি!’

‘আমার নাম নির্মলা। আপনি কী করেন?’

‘আমি ওঁদের দপ্তরে কাজ করি।’

‘উনি কে হন?’

‘আমার বাবার বন্ধু।’

‘উনিই চাকরি করে দিয়েছেন?’

‘না না। এমনি ইন্টারভিউ দিয়ে পেয়েছি।’

‘দেখুন না আমার বড় ভাইটার চাকরির জন্যে হরিদাসদাকে কত করে বলছি। আপনি একটু বলবেন?’ কথা বলতে বলতে দুজনেই পাশাপাশি নামছি। মহিলা কেমন যেন মরিয়া হয়ে উঠেছেন। উঃ বাঁচতে হবে বাঁচতে। একার রোজগারে বোধহয় সংসার চলে না। যেমন করেই হোক ভাইয়ের চাকরি হওয়া চাই। তা না হলে এইভাবে একজন অপরিচিতকে কেউ চাকরির কথা বলে। সিঁড়ির শেষধাপে একটা আলোআঁধারি তৈরি হয়েছে। মহিলা হাত বাড়িয়ে আমার হাতটা খপ করে চেপে ধরে বললেন, ‘সাবধান। সারা গায়ে কেমন যেন ওষুধ ওষুধ গন্ধ হয়ে গেল। লাইজলের গন্ধ। পৃথিবীতে যাঁরা মানুষের সন্তান আনেন হাতে করে তাঁদের হাতে বোধহয় এইরকম গন্ধই থাকে। আতরের নয়, গোলাপের নয়। কান্নার শব্দে, ওষুধের গন্ধে কে এলে হে তুমি? মন্ত্রী, মন্ত্রী সি—এ, আমলা, গোমস্তা, ঝাড়ুদার, বিরোধী দলের নেতা, ঘুষখোর দালাল, সাধু সন্ত? কে এলে?

ছোট্ট একটা বিলিতি গাড়ি চেপে মন্ত্রীর জামাই চলে গেলেন। হরিদাসবাবু খুব বাবাজি, বাবাজি করে বিদায় জানালেন। রাস্তা ফাঁকা। পেছনের লাল আলো দৃষ্টি পথের বাইরে যেতেই আমাদের চোখে পড়ল।

‘হ্যাঁ এবার চল।’ হরিদাসবাবু নির্মলার কাঁধে হাত রাখলেন। পাঞ্জাবির ফুলোফুলো হাতায় হাওয়ায় ঝাপটায় মহিলার গায়ের ওষুধ ওষুধ গন্ধ আর আর একবার ঘুলিয়ে উঠল। দুজনেই উচ্চতায় সমান। বেশ মানিয়েছে কিন্তু। দূর থেকে দেখলে যে কেউ মনে করতে পারেন স্বামী—স্ত্রী। অন্ধকার অন্ধকার রাস্তা। দুদিক থেকেই আলো ছুটে ছুটে আসছে হারিয়ে যাচ্ছে। আলোর লাইন টানাটানি চলছে। হরিদাসবাবু হাত তুললেন, একটা ট্যাকসি থেমে পড়ল।

‘পার্ক স্ট্রিট।’

গাড়ি চলতে শুরু করল। পেছনের আসনে আমরা এখন তিনজন। নির্মলা মাঝখানে। সেই হাসপাতাল, হাসপাতাল গন্ধটা কিছুতেই যেতে চাইছে না।

‘আমরা এখন খাব।’ হরিদাসবাবু নড়েচড়ে বসলেন।

নির্মলা বললেন, ‘আমার দেরি হয়ে যাবে!’

‘দেরি? তুমি একটা যুবতি মেয়ে। রাত ত সবে শুরু হল। অ্যাঁ কি বল? রাত ত সবে শুরু হল।’

হরিদাসবাবু কাঁধ দিয়ে নির্মলাকে ধাক্কা মারলেন। সেই ধাক্কার মাংসল ঢেউ আমার দিকে চলে এল। অন্ধকার রাত। অন্ধকার গাড়ি। ড্যাশবোর্ডের আলো। পেছনের আসনে তিনটে মানুষের শরীর প্রায় একাকার।

হরিদাসবাবু বললেন, ‘ভয় নেই তোমাকে আমি পৌঁছে দিয়ে আসব। হ্যাঁ তোমার আবার ভয় কি? নাইট ডিউটি করো না?’

নির্মলার উড়ো চুল আমার গালের বাঁপাশে খেলা করছে। ঠ্যালা খেয়ে সেই যে আমার দিকে সরে এসেছে আর সরে বসার চেষ্টা করেনি। ডানদিকের দরজার সঙ্গে পিষে গেছি। এ ত আশা নয় নির্মলা। কেমন যেন অপবিত্র, অপবিত্র লাগছে। হরিদাসবাবু কি এই সবেও অভ্যস্ত।

পার্ক স্ট্রিটের আলো ঝলমলে রেস্তোরাঁর সামনে গাড়ি থামল। জীবনে এসব জায়গায় আসিনি। কৌতূহল ছিল, সাহস আর সামর্থ্য ছিল না। ভেতরটা অন্ধকার অন্ধকার। নরম সুরে বিলিতি বাজনা বাজছে। একদিকের দেয়ালটা অ্যাকোয়ারিয়াম। ঝাঁঝি, পাথর, বগবগ করে ঠেলে ওঠা বুদ্বুদের মধ্যে নানা বর্ণের মাছ খেলে বেড়াচ্ছে। এক একটা মাছের চেহারা মতলববাজের মতো, চালচলন সন্দেহজনক, আততায়ীর মতো।

রাজার মতো পোশাক পরা এক ভদ্রলোক হরিদাসবাবুকে দেখতে পেয়ে ছায়াছায়া, সংগীতমুখর গর্ভ গৃহ থেকে ছুটে এলেন। হাতে স্টেনোগ্রাফারদের মতো ছোট একটা খাতা পেনসিল।

‘আসুন স্যার। আসুন স্যার।’

সর্বত্রই স্যার। স্যারের সংখ্যা আর গতিবিধি এত বেড়েছে সাধারণ মানুষ দেখছি লোপাট হয়ে যাবে। কোণের দিকের সবচেয়ে ভালো টেবিলে নিরিবিলিতে আমাদের বসানো হল। পাশেই সেই মৎস্যাধার বুড়বুড় করছে।

‘কী দিয়ে শুরু করবেন স্যার?’

বিয়ার দিয়ে করা যাক।’

সর্বনাশ বিয়ার! ‘আমি ওসব খাই না।’

‘ও হ্যাঁ, তোমরা দুজনে ত ওসব খাবে না। আচ্ছা ওয়েটার তুমি ওদের দুজনের জন্যে খুব ভালো করে দুটো জনকলিনস তৈরি করে দাও!’

‘ঠিক আছে স্যার।’

জনকলিনস আবার কী জিনিস! ‘জনকলিনস জিনিসটি কী?’

‘প্লেন অ্যান্ড সিম্পল সরবত। লেবুর জল। বিলিতি নিম্বুপানি।’

নির্মলা মাঝখানে, ওপাশে হরিদাসবাবু এপাশে আমি। সামনে আর একটা বড় বসার জায়গা। তবু আমরা তিনজনে ঠাসাঠাসি। উনি জমিয়ে বসতে চান। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা নাকি নিবিড় সান্নিধ্যের ব্যাপার। ক্রমশই আমার কৌতূহল বাড়ছে। লোকটা আসলে কেমন। পিতৃবন্ধু, প্রবীণ ক্ষমতাশালী সবই ঠিক কিন্তু আর একটা দিক! সেদিকটা কি চাঁদের উলটো পিঠ? দেখাই যাক কোথাকার জল কোথায় গড়ায়!

বিরাট একটা পেতলের মগে হরিদাসবাবুর বিয়ার এল। গাঁজলা উঠছে। প্লেটে চানাচুর, আদার টুকরো। আমাদের দুজনের সামনে নামল দুটো লম্বা গেলাস। বরফ শীতল। কাচের গায়ে শিশির জমেছে। চোখে কালো রিংঅলা পেটমোটা সেই মাছটা সন্দেহের চোখে আমাদের দেখছে।

নির্মলা সরবতে চুমুক দিকে গেলাসটা নামিয়ে রেখে বললে, ‘কি রকম ঝাঁজ ঝাঁঝ, কি রকম একটা গন্ধ। এতে মদ মিশিয়ে দেয়নি তো হরিদা।’

‘বাঙালদের মতো কথা বলিসনি নির্মলা। সরবত, সরবত, খেয়ে, নে। এক গেলাসের দাম দশ টাকা।’

ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফুড।’

‘হ্যাঁ ফুড। ভীষণ খিদে পেয়েছে। ভালো ভালো যা আছে সব আজ খাব।’ ওয়েটার চলে যাচ্ছিলেন, হরিদাসদা ডেকে বললেন, ‘এইবার হুইস্কি।’

পানভোজন বেশ ভালোই এগোচ্ছে। হরিদাসবাবুর ফরসা মুখে লালের আভা। অকারণে হাসছেন। নির্মলার ঘাড়ে হাত দিচ্ছেন। খোঁপায় খোঁচা মারছেন। হঠাৎ হঠাৎ এমন সব জায়গায় হাত ঠেকাচ্ছেন যাতে নির্মলার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। জনকলিনস পদার্থটি খুব নিরীহ বলে মনে হল না। এই শীতের দিনেও শরীরে একটু উত্তাপের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হল। কেমন যেন একটা হালকা খুশি—খুশি ভাব। নির্মলার তো বেশ গরমই লাগছে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মাঝে মাঝে মুখ মুছছে। ছটফট করছে। উঃ উঃ শব্দ করছে। হরিদাসবাবুর নেশা হয়েছে। কোনও সন্দেহই নেই। এমন সব কথা বলছেন যা কোনও মহিলার সামনে বলা উচিত নয়।

টেবিলের ওপর কনুইয়ের ভর রেখে হরিদাসবাবু বললেন, ‘তোমার দপ্তরে একটা অফিসারের পোস্ট খালি হয়েছে খবর রাখো?’

‘আজ্ঞে না।’

‘সেই পোস্টে আমি তোমাকে বসাব।’

‘কেন?’

হরিদাসবাবু একটা গালাগাল দিয়ে বললেন, ‘হয় তুমি বেহেড না হয় তুমি শয়তান। তোমার বাবার স্কুলিং—এ মানুষ চালকলা বাঁধা পুরুত হয়, রাজসিক মানুষ হয় না। এটা কী?’

নির্মলার ডানহাতের ওপর বাহুটা হ্যাঁচকা টান মেরে তুলে দেখালেন। টেবিলের ওপর কাঁটা চামচ গেলাস সব ঝনঝন করে উঠল। ভাগ্যিস আমরা কোণের দিকে বসেছি নইলে ন্যুইসেন্স বলে ম্যানেজার ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতেন।

‘এটা কী?’

‘আজ্ঞে হাত।’

‘তোমার মুণ্ডু। এটা কী?’ বুকে হাত দিলেন।

‘ব্রহ্ম দেশ!’

‘ব্রহ্ম দেশ!’ ভিঙচি কাটলেন। ‘কেন বুক বলতে লজ্জা করছে, ভণ্ড তপস্বী। এই এল নারী শরীর, মেয়েছেলে রাশকেল। এটা কী?’ এটা লাল জলের গেলাস।

‘আজ্ঞে মদ।’

‘হ্যাঁ মদ, খাস বিলিতি স্কচ! এক পেগের দাম কুড়ি টাকা। অলরেডি তিন পেগ আমি খেয়েছি। এটা কী?’

‘আজ্ঞে মুরগির ঠ্যাং।’

‘ইয়েস ঠ্যাং, তন্দুরি চিকেন। তোমার হবিষ্যান্ন, কাঁচকলা ভাতে নয়। জীবনকে ভোগ করতে হলে টাকা চাই, টাকা। চারশো টাকা মাইনেতে মদ হয় না, মেয়েছেলে হয় না, এমন কি বিয়ে টেঁপাটেঁপি নিয়ে সংসারও হয় না। একটু আগে কাকে দেখলে?’

‘কার কথা বলছেন?’

‘ড্যাম ফুল। নার্সিং হোমে যাকে দেখলে, এ সিক্সফুটার জায়েন্ট, মন্ত্রীর মেয়েতে যে ছেলে তৈরির সাহস রাখে। হি ইজ অ্যা বিগ ইঞ্জিনিয়ার আর্নিং সিক্স থাউজেন্ড এ মানথ। তোমার ইচ্ছে করে না বড় হতে?’

‘করে। তবে আমার বড় হওয়ার ধারণা অন্যরকম।’

‘ও জপের মালা, হরিনাম, ক্লাস থ্রি হয়ে ঘষটাতে ঘষটাতে জীবন কাটান? ফুল। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। বীর হতে হবে, ভোগ করতে হবে। ভোগ না করলে ত্যাগ হয় না। কে বলেছিলেন?’

‘স্বামীজি।’ কার মুখে কীসের ব্যাখ্যা!

‘শোনো মানব, মর‍্যালিটি, ধর্ম এসব হল দুর্বলের আশ্রয়। দ্রাক্ষাফল মোটেই টক নয়। ভেরি ভেরি সুইট।’

হরিদাসবাবু তন্দুরি চিকেনের ঠ্যাং কামড়াতে লাগলেন। নির্মলা যতটা সম্ভব আমার দিকে সরে এসে কাত হয়ে বসে আছে। বেচারা শরীরটা নিয়ে বড় লজ্জায় পড়েছে। ভাইয়ের চাকরি মাথায় উঠেছে।

‘তোমার কাছে দুটো কেস আছে।’

‘কী কেস?’

‘ইমপোর্ট কেস। একটা হল অন্নপূর্ণা মেকআপ, আর একটা পরিমল পেন্টস।’

‘কী করে জানলেন?’

‘কী করে জানলুম, সিলি, ফুল। আমি কে জান?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘তবে বোকার মতো প্রশ্ন করছ কেন? কেস দুটো তুমি রেকমেন্ড করে দেবে। যা চেয়েছে, যতটা চেয়েছে, কাটাকুটি না করে পুরোটাই করে দেবে।’

‘ওদের কিছু নেই। চোর।’

‘ওরে আমার সাধুর বাচ্চা। ওদের একটা জিনিস আছে যা থাকলে সব থাকা হয়, সেটা হল পুল। ওরা আমাদের লোক। ওরা চোর বলেই আমরা খেতে পাই, এই মদ, এই মাংস। নির্মলা তুমি একটুও খাচ্ছ না। রাগ করেছ? তোমারও হবে। মাইরি বলছি হবে। আর একটু দাও, আর একটু খাও। আমাকে উপোস করিয়ে রেখো না, নিজেও উপোসী থেক না। যৌবন কি ফিক্সড ডিপোজিটে রাখার জিনিস, সবসময় কারেন্ট অ্যাকাউন্টে ফেলে রাখবে মাই ডার্লিং। হাওয়াগাড়ি চাপবে, ভাইয়ের ভালো চাকরি হবে। কৃপণ হলে চলে। দাতা হও, দাতা। ওই বাচ্চা ছেলেটাকে অমন করে ঠেসে ধরেছ কেন! স্তন্যপায়ী জীবটিকে। সরে এসো আমার দিকে সরে এসো। খাও খাও চিকেন লেগ খাও।’

নির্মলা ফিস ফিস করে বলল, ‘কি বিপদে পড়লুম মানববাবু।’

আমার মনে হল লোকটা কি বোকা? এসব কাজ কাউকে সাক্ষী রেখে করতে আছে! আমি যে স্বরূপ জেনে ফেললুম। না এঁরা এমনই বেপরোয়া! নাক কাটা, কান কাটা।

‘ওয়েটার আর এক পেগ। তুমি জল মেশাচ্ছ রাশকেল?’

‘না স্যার! আপনার জিনিস জল। আমার চাকরি চলে যাবে।’

হ্যাঁ, মনে রেখো। ডোন্ট বি ডিজনেস্ট। ডিজনেস্টি করে দেশটা গোল্লায় গেল। সব শালা চোর।’

যা খেয়েছেন, ভেবেছিলুম হরিদাসবাবু টলে পড়ে যাবেন। না, বেশ স্ট্রং লোক। গটগট করে হেঁটে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। এত খাওয়ার এক পয়সা দিতে হল না। দয়া করে খেয়েছেন এইতেই মালিক কৃতার্থ। নির্মলা যেন কি রকম হয়ে গেছে। ডুবন্ত মানুষ কুটো আঁকড়ে ধরে। আমাকেই ধরতে চাইছে। আমিই যেন এই মদ্যপায়ী মানুষটির হাত থেকে তাকে বাঁচাতে পারব।

রাত অনেকটা গড়িয়ে গেছে। শীত পড়েছে এখন মালুম হচ্ছে।

‘ট্যাকসি।’

ট্যাকসি ঘুরে আসছে। নির্মলাকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘কী করবেন? উঠবেন?’

‘আমার না উঠে উপায় নেই। আমার চাকরিটাও এঁর কৃপাতেই হয়েছে। যদি একবার কমপ্লেন করে দেন না খেয়ে মরতে হবে। বাপ, মা, ভাই, বোন। থাকি কলোনির জমিতে। কি করব বলুন!’

‘উঠুন তা হলে!

‘আপনি সামনে চলে যাবেন না। প্লিজ। আমার পাশে থাকুন!’

হরিদাসবাবু দরজা খুলে ধরে বললেন, ‘ঢুকে পড়! তোমাদের একে একে নামিয়ে দিয়ে আমি ফিরে আসব। আমার একটা কর্তব্য আছে। হি ইজ মাই ফ্রেন্ডস সান। তোমাকে আমি দক্ষিণেশ্বরে নামাব। ক্রস দি ব্রিজ অ্যান্ড গেট ইওর ফাদারস টেম্পল।’

সেই আগের মতোই আমরা বসে আছি পেছনের আসনে। গাড়ি ছুটছে। সারা দেশটা ভাতে মরে আছে। যে যেখানে আছে সকলেই পেটটা বাঁধা দিয়ে বসে আছে। মাথা তুলে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই! ভাতকাপড়ে মারা পড়তে হবে!

হরিদাসবাবু নির্মলার কোল থেকে তার হাতব্যাগটা তুলে নিয়ে বললেন, ‘কী আছে?’

‘পয়সা, আর একটা রুমাল।’

‘কেন সেই নেই। তোমার ব্যাগে সেই থাকে না।’

‘যাঃ কি যে অসভ্যতা করেন।’

‘অসভ্যতা! তোমার কাছে সভ্যতা শিখতে হবে! তোমাদের আমি চিনি না। বিয়ে না করে এতখানি শরীর নিয়ে এতদিন আছ কী করে? আমি বুঝি না ভাব!’

নির্মলা আমার দিকে ভয়ে সরে এল। আমার ভীষণ প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করছে।

‘কী করছেন আপনি?’

‘শাট আপ। তুমি কি আমার মর‍্যাল গার্জেন। আই অ্যাম ইওর ফাদারস ফ্রেন্ড, নট ইউ আর মাই ফাদারস ফ্রেন্ড। তোমার চাকরি আমার হাতে, তোমার ফিউচার আমার হাতে। ডোন্ট ফরগেট। কেস দুটো কালই ক্লিয়ার করে দেবে। এক মাসের মধ্যে তোমার প্রোমোশান হবে, চেম্বার হবে, ঘণ্টা হবে, অর্ডারলি পিয়ন হবে। রাঙা বউ আসবে ঘরে! তুমি কি ভাব এইসব মেয়েরা কোনোদিন কারুর ঘরের বউ হবে? নো নেভার। তা বলে কি এরা স্টার্ভ করবে? নো নেভার। আমাদের কি একটা দায়িত্ব নেই।’ নির্মলা চিৎকার করে আমার দিকে ছিটকে সরে এল, আর সেই ভারী শরীরের চাপে কী হল বোঝার আগেই আমি গাড়ির ডান দিকের দরজা খুলে ছিটকে রাস্তায় গিয়ে পড়লুম। কানে এল অসংখ্য ব্রেকের শব্দ, হাওয়ার ঝাপটা। পরক্ষণেই সব অন্ধকার। ফুটফুটে কলকাতার সমস্ত আলো যেন একসঙ্গে দপ করে নিভে গেল। সব শব্দ যেন অতল নৈঃশব্দে তলিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *