হরি ঘোষের গোয়াল – ৩

লিফটনের লাইনে ভেড়ার মতো দাঁড়িয়ে আছি। কতরকমের বাবু। তেল চুকচুকে কাঁচা চুল, ফুরফুরে শ্যাম্পু করা নায়ক চুল, কাঁচা—পাকা কট্টর আমলা চুল, জটপাকানো বিপর্যস্ত সংসারের হাতে মার খাওয়া চুল। কতরকমের মুখ! ওপর দিকে উঠবই উঠব মুখ, দ্রাক্ষা ফল টক মুখ, এত হাত হয়ে যাক মুখ, তুমি কে আমিই সব মুখ, সব টাইট দিয়ে ছেড়ে দেব মুখ, হ্যাঁ এই বেশ আছি মুখ, সোয়েটার দেখা দিয়েছে। প্রেমিকার হাতে প্রাণ ঢেলে বোনা অতি সূক্ষ্ম কাজের ফাঁস ফোস। তিতবিরক্ত স্ত্রীর হাতে ঢিলেঢালা ধ্যাড়া ধ্যাড়া যা হয় হল ফাঁসের ভুঁড়ি ঢাকা মাল। শৌখীনবাবুর মাথায় সাবেক কালের ফুলেল তেলের পুরোনো কলকাতার গন্ধ। কারুর মুখে সিগারেট। চোখ ঘেঁষে ধোঁয়া উঠছে। একটা চোখ তাই ভিলেনের মতো বোজানো।

প্যান্টের দু পকেটে দুটো বুড়ো আঙুল, বাকি চারটে আঙুল দু পাশে কানকোর মতো ছড়ানো, গায়ে দু পকেট অলা জামা, মুখে চুরুট, গটরমটর চলন, পেছনে শিমপাঞ্জির মতো দেখতে কুঁজো মতো একটি পিয়ন, হাতে তার ঝাড়নে বাঁধা ফাইল, ভারে মাটির সঙ্গে প্রায় মিশে যাবার মতো অবস্থা। দুজনে হেঁটে আসছেন। সায়েব আসছেন সায়েবের মতো। তাঁর পুষ্টি নিয়ে, ভিটামিন নিয়ে, সকালের আণ্ডা, বিকেলের বিয়ার আর ফিশফিংগারের তাগত নিয়ে। ট্রেনের ক্যানেডিয়ান ইঞ্জিনের মতো ধোঁয়া ফুঁসতে ফুঁসতে সদর্পে এগিয়ে আসছেন। বলবীর, উন্নত মম শির। চার ছেলের বাপ পঁচানব্বই টাকা মাইনের আকাশে বুড়িয়ে যাওয়া, একবেলা আধ পেটা খাওয়া পিয়নটি পারবে কেন এই চলনের সঙ্গে তাল রাখতে। তায় বোঝার ভারে অবনত। ধরতে তাকে হবেই। নয় তো মাস গেলে পঁচানব্বই টাকা আসবে কী করে। চাকরি চলে গেলে আধ বেলাও জুটবে না যে। আবার বউয়ের হয়তো টিবি। নিজের লাঙসেও হয়তো তিনটে ফুটো তাপ্পি দিয়ে চালাচ্ছে। দূর থেকে তারা এগিয়ে আসছেন। কি সুন্দর দৃশ্য। দেখলে বুক গর্বে স্ফীত হয়। বলতে ইচ্ছে করে দেখ, সোস্যালিজম অন দি মার্চ, পুষ্টি আর অপুষ্টি বঞ্চনা আর বঞ্চিত পাশাপাশি ছুটছে!

ভাব চটকে গেল। একি ব্যাপার! সেই গ্র্যানাইট সায়েব লাইন না দিয়ে, সোজা সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। এদিকে আমরা সেই কতদূর থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে পরের ক্ষেপে যাবার মতো অবস্থায় এসেছি। এই মালের ওঠা মানে শেষের লোকটির খয়ে যাওয়া। কেউ কিছু বলছেন না কেন? এটা কী ধরনের নিয়ম। পেছন দিকে ঘাড় কাত করে বুকটাকে সামনে ঠেলে দিয়ে দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়েছেন দেখ, যেন রক অফ জিব্রালটার।

লিফট নেমে এল। ঘড় ঘড় করে অটোমেটিক দরজা খুলে গেল। সামনের পাটাকে লম্বা করে বাড়িয়ে, গোড়ালি ঠুকে, ঊর্ধ্বযানটিকে দেহভারে আন্দোলিত করে তিনি সবার আগে ঢুকলেন। আমি প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলে ফেললুম, ‘এ কি লাইন দিলেন না।’

সঙ্গে সঙ্গে পেছনে যিনি দাঁড়িয়েছিলেন তিনি আমার ডান কানের কাছে মুখ এনে প্রায় উঠলেন চাপা স্বরে, ‘কাকে কী বলছেন?’

‘কেন?’ লাইন চলতে শুরু করলেও কথা চলছে আমাদের।

‘কত বড় অফিসার জানেন। সারা পশ্চিমবাংলার ছটা জেলার সমস্ত মানুষকে এক অর্ডারে ফাটকে ভরে দিয়ে, তিন মাস ঘানি টানিয়ে ছেড়ে দিতে পারেন।’

লিফটের দরজা বন্ধ হচ্ছে। ওই দুজন ওঠার ফলে আমরা দুজন কাটা পড়ে গেলুম। এক পলকের জন্যে সেই পিয়নটির মুখ দেখতে পেলুম। ঘোলা ঘোলা চোখ মেলে আছে যারা পড়ে রইল তাদের দিকে সে চোখে কি গর্ব? সায়েবের কোট এন্ডের ক্লীবগর্ব! পেছন পেছন সকলকে টেক্কা মেরে ওপরে উঠছে। ষাঁড়ের ল্যাজ ধরে স্বর্গে গমনের মতো। একটু আগে লোকটিকে দেখে করুণা হচ্ছিল। এখন মনে হচ্ছে আমাদের দেশের মানুষ এই ভাগ্যটাকেই পছন্দ করে।

পরের লিফটে ওপরে উঠে এলুম। যে ভদ্রলাক বড় বড় চোখ করে এতক্ষণ আমাকে সাবধান করেছিলেন তিনিও আমার সঙ্গে একই ফ্লোরে নামলেন। লিফট দরজা বন্ধ করে আরও ওপরে উঠে গেল। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি এই ফ্লোরে চাকরি করেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘কোন সেকশানে?’

‘রিসার্চে।’

‘আমি অ্যাকাউন্টসে। করিডরের শেষে ওই একটা দরজা দেখতে পাচ্ছেন তো ওইটাই হল ঘুঘুর ঘর।’

‘ঘুঘু কে?’

‘ওই যে বড়সায়েব, আমাদের ল্যাং মেরে আগের লিফটে উঠে এলেন, উনি আমাদের সমাজে ঘুঘু নামেই পরিচিত। বাস্তুঘুঘু। ওঁর অনেক খেলা আছে, আসবেন পরে শোনাব। ওই একটা খেলা দেখুন।’

তাকিয়ে দেখলুম। এলো চুলো বেশ লম্বা চেহারার এক মহিলা সেই ঘুঘুর দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। ‘ইনি কি ঘুঘু সায়েবের পি এ?’

‘দেখে রাখুন। এইরকম রোগা লম্বা বেঁটে মোটা, একগাদা ওই ঘরে ঠাসা আছে। ঘুঘুর হারেম।’

ভদ্রলোক হারেমের দরজাটা দেখিয়ে দিয়ে সরে পড়লেন। মহিলা আমাদের দিকে এলেন না, পাশের একটা ঘরে ঢুকে পড়লেন। স্বর্গ অনেক ওপরে জানতুম। মাত্র দুশো ফুট ওপরে তাত জানা ছিলনা।

ঘরে ঢোকার মুখেই হরেনদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তেমন হাসি—হাসি মুখ আর নেই। ঠোঁটের কোণে গোঁফের মতো ব্রাদার শব্দটি ঝুলে নেই। হুম করে ছোটখাটো একটা বাঘের ডাক ছাড়লেন। বিনয় মানুষের একটা বড় গুণ। বিনীতভাবেই জিজ্ঞেস করলুম, ‘কেমন আছেন দাদা!’ নতুন নতুন ন্যাতাজোবড়া ভাবটা আমার কেটে এসেছে। ঘাঘু বা ঘুঘু হতে না পারলেও, যে জলে সাঁতরাতে হবে সেই জল আমি চিনে গেছি।

হরেনবাবুর সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘যেমন রেখেছ।’

‘আমি রাখার কে হরেনদা, দুনিয়াকা রাঘবওয়ালাই আমাদের রাখবেন।’

‘দেখা যাক।’

‘হরেনদাদা চলে গেলেন। বড়বাবু চিৎকার করে তাকালেন, ‘মানব মানব।’

‘বলুন।’

‘আরে কাল তুমি কী করেছ হে ছোকরা। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে শত্রুতা কি ভালো? কাজটা তুমি ভেবেচিন্তে করনি হে। ঝোঁকের মাথায় বড় ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছ। সামলাতে পারবে তো?’

‘আপনারা আছেন।’

‘ছেলেমানুষ, ছেলেমানুষ। ললিপপ। এখানে বিপদের সময় কেউ কারুর নয়। তখন চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।’

ফোন বেজে উঠল। বড়বাবু কানে লাগিয়ে ‘হ্যালো’ বলেই নড়েচড়ে বসলেন, ‘হ্যাঁ স্যার, ইয়েস স্যার, এই তো আমার সামনে, ভীষণ ভালো ছেলে, হ্যা স্যার, মুখে একটা সাধু সাধু ভাব। হ্যাঁ স্যার কৌপীন ছাড়া, দিচ্ছি, হ্যাঁ হ্যাঁ দিচ্ছি।’

রিসিভারটা প্রসাদী ফুলের মতো আমার হাতে সসম্ভ্রমে তুলে দিলেন। দিতে দিতে ফিস ফিস করে বললেন, ‘মিনিস্টারের সি এ।’

‘হ্যালো, হ্যাঁ মানব!’

‘আমি হরিদাস। পাল নই চট্টোপাধ্যায়।’

‘নমস্কার।’

‘নিলাম। বাবাকে বলেছিলে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘শোনো, বিকেলে চলে যেও না, আমি যাব। কথা আছে। কেমন!’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

টেলিফোনটা নামিয়ে রাখতেই বড়বাবু, চোখ বড় বড় করে বললেন ‘সি—এ টু এম আই সি তোমার পরিচিত, এ কথা তুমি আগে বলনি? ছি ছি। কি কাণ্ড।’

‘কাকে ছিছি বললেন! পরিচয় থাকাটা নিন্দনীয় নাকি! ভয়ে ভয়ে বললুম, মনে ছিল না।’

‘আরে ছিছি, এ যে মারাত্মক ভুল। প্রাণ দয়ে টানাটানি, অ্যালারজিক রুগীকে না জেনে পেনিসিলিন ঠুকে দেবার মতো কেস। দরিদ্র ব্রাহ্মণের বেশে দেবতা দুয়ার থেকে ফিরে যায় তিরস্কৃত হয়ে। কাল থেকে তোমাকে কী কী বলেছি ভালো করে ভেবে দেখতে হবে। খারাপ কিছু বলিনি তো ভাই।’

‘না, বললেও মনে নেই।’

‘সায়েব ডাকছেন।’ ব্যানার্জি সায়েবের অর্ডারলি কানের কাছে হেঁকে গেল। থ্রু প্রপার চ্যানেল হল আর কি। এখানে সব কিছুই চ্যানেলে চলে। চললে কি হবে, সবই তো আবার বে—চ্যানেলে বেরিয়ে যায়।

টেবিলের ওপর একটা ম্যাপ, তার ওপর একটা লেনস, চেয়ারে ব্যানার্জি সায়েব, পেছনে আবার একটা ম্যাপ। সেই ম্যাপের জায়গায় জায়গায় আজ কিছু পতাকা উড়ছে আলপিনের মাথায়। যুদ্ধের ছবিতে একমাত্র মেজর জেনারেলদেরই এই অবস্থায় দেখা যায়। প্যানজার বাহিনী এগিয়ে চলেছে ফ্রান্সের দিকে!

‘এসো।’ গলাটা আজ আরও গম্ভীর। সকাল তো, রোদের তাপ লেগে এখনও বরফ গলেনি! হিমালয়ের মাথায় হাউলিং হিমেল হাওয়া।

‘আই হ্যাভ ডিসাইডেড টু কনস্টিটিউট এ কনফিডেনসিয়াল সেল ফর কেমিক্যাল র—মেটিরিয়ালস। তুমি থাকবে তার চার্জে। ওপন অফিসে বসবে না। তুমি বসবে আমার পি এ—র ঘরে। কাজ করবে ইন ফুল সিক্রেসি। তোমার ওপর যে দায়িত্ব দিচ্ছি, গার্ড ইট উইথ পার্সোন্যাল কেয়ার ফিয়ার অর ফেভার কারুর কাছে তুমি আত্মসমর্পণ করবে না। তোমাকে আমি ওথ অফ সিক্রেসি দিয়ে দিলুম। তোমার ডান হাত কি করছে, বাঁ হাতকে জানতে দেবে না। জাস্টিস, ইকোয়ালিটি, ফ্রেটারনিটি, গোও।’

গো বলায় বাইরে যাবার দরজার দিকে এগোচ্ছিলুম।

‘নট দ্যাট ওয়ে। গো টু মাই পি এজ রুম।’

সুইংডোর ঠেলে সেই দৈর্ঘ্যে বড় প্রস্থে ছোট ঘর এসে ঢুকলুম। মুণ্ডিত মস্তক, গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা পি এ ভদ্রলোক চেয়ারে, সামনে ডিকটেশানের খাতা পেনসিল, চোখ অর্ধ নিমীলিত।

পা টিপে টিপে একটা চেয়ারে বসলুম। জানি না এটা ধ্যান কিনা। যেই বসলুম ভদ্রলোক অমনি বললেন, ‘বোসো।’

এ অফিসে দেখছি আপনি টাপনি একেবারে অচল। চোখ অর্ধ নিমীলিত, এক হাত গলার তুলসীর মালায়। আবার তিনি, সরব হলেন, ‘ঠিকই বসেছ। ওইটাই তোমার সিট হবে। ড্রয়ারে কিছু জঞ্জাল আছে, পরে ক্লিয়ার করিয়ে দোব। পাশের ফাইলিং ক্যাবিনেটটাও তোমার। ফাইল হল কেরানির প্রাণ ভোমরা।’ খুব মাপামাপা কথা। শেষ হতে না হতেই তিনি পরমপদে তলিয়ে গেলেন।’

ধ্যানমগ্ন ভদ্রলোকের মাথার ওপর একটা লাল আলো লাফিয়ে লাফিয়ে বার কতক জ্বলল আর নিবল। নারায়ণদা পরমপদ ছেড়ে সায়েবকে ধরতে ছুটলেন। ব্যানার্জি সায়েবের গলা ভেসে আসছে। অল্পস্বল্প উত্তেজনার আভাস। একবার একটা গর্জন তেড়ে হল, ‘ব্রিং দ্যাট রাশকেল।’

কে রাশকেল, আমি নয়তো। এইবার একটু ভয় ভয় করছে। ইঁদুর কলের মতো এই ঘরে গন্ডা গন্ডা ফাইল, বস্তা বস্তা কাগজের মধ্যে বসে মনে হল, কি গেরোয় ফেললে প্রভু নারায়ণদা ঘরে এসে বললেন, ‘যাও তোমাকে ডাকছেন।’

‘ভয়ের কিছু?’

নারায়ণদা বরাভয়ের মুদ্রায় ডান হাত তুলে বললেন, ‘ভয়েরও নয়, ভরসারও নয়, ক্ষুরস্যধারা নিশিতা দুরত্বয়া। ব্রাহ্মণের ছেলে, দীক্ষা হয়েছে?’

‘না।’

‘আচ্ছা ঘুরে এসো। প্রেসার রানিং অ্যাট টু ফরটি।’

সকাল। সবে স্নান করেছেন। ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে ব্যানার্জি সায়েবকে। এই মুখে কেন যে রাশকেল—টাশকেল বলেন। সেই গানের কলি, করম দোষে আমারে পাটায়ে এ ঘোর সংসারে!

‘শোন মানব।’

‘বলুন স্যার।’ স্যারটা বেশ সুন্দর সড়াক করে বেরিয়ে এল।

‘এই নাও চারটে ফাইল। একে বলে কেস, ইমপোর্ট কেস। ফাইল চারটে ভালো করে পড়। তারপর অফিস থেকে বেরিয়ে পড়। চারটে ফার্ম ভিজিট করে সাবমিট ইওর রিপোর্ট। এঁরা যা চাইছেন সত্যিই তা ব্যবহার করেন কিনা। যতটা চাইছেন ততটাই লাগে কিনা। এর মধ্যে তিনটে ফার্ম পুরোনো, একটা নতুন। নতুনটাকে আমাদের সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। খাতাপত্তর, স্টক, কাজকর্ম দেখে তোমার সিদ্ধান্তে আসবে। বাঁ হাতটাকে গুটিয়ে রাখবে। মনে কর নেই। ওর মধ্যে ডক্টর দত্তর একটা কেস আছে। জেনুইন ফার্ম। শিক্ষিত বাঙালির শিল্পপ্রচেষ্টা। পনের মিনিটের মধ্যে তিনি গাড়ি নিয়ে আসছেন। ফার্স্ট ভিজিট হিম দেন আদার্স।’

ফাইল বগলদাবা করে নিজের আসনে চলে এলুম। নারায়ণদা আড়চোখে দেখলেন। ফোন কোঁ কোঁ করে উঠল। কাঁকানিটা হল ইন্টারকমের। ব্যানার্জি সায়েব বোধহয় বাইরের কোনও কানেকশান চাইলেন। নারায়ণদা রিসিভার তুলে ট্যাপ করতে লাগলেন। ও প্রান্তে ইন্টারন্যাল এক্সচেঞ্জ সাড়া দিয়েছে।

‘মা একটা লাইন দাও।’ নম্বরটা বললেন। বাবা! টেলিফোন বালিকারা এনার মা। কত বয়স তার কে জানে। যদি পঁচিশ কি তিরিশও হয় তা হলেও নারায়ণদা তার ধেড়ে ছেলে।

‘পেয়েছ মা?’ বার কতক মা মা করে লাইনটা বাগালেন। ব্যানার্জি সায়েবকে লাইনটা ঠেলে দিয়ে আমাকে বললেন, ‘কী দেখছ অবাক হয়ে, স্ত্রীয়া সমস্তা সকলা জগৎসু। তোমাকে আমি কাম জয়ের কায়দাটা শিখিয়ে দোব। কামনা, বাসনা, লালসা, ভোগ, ভাগ আমোদ—প্রমোদ নিয়ে মানুষ ল্যাজে গোবরে। সব মাছি মাছি, বুঝেছ। যেই পেটে কলিকপেন চাগাল, কি দণ্ডমূল হল তখন বাবুরা ক্ষণিকের জন্যে মাগো, বাবাগো করল। তাও সে মা হল যন্ত্রণার মা! হারামজাদা। সুস্থ শরীরে অহরহ মা বলতে হবে। খুব সাবধান।’

‘মা বলতেও সাবধান?’

‘আরে না না, মা তুমি ফ্রিলি বলে যাও। এখানে অনেক মা আছে। মা বলার এমন সুযোগ কোথাও পাবে না। এ হল মারণ্য। শব্দটা লক্ষ কর। সন্ধি করে হয়েছে মা প্লাস অরণ্য। সাবধান ওই ফাইলের জন্য। ও হল চিটে গুড়। বহু মাছি ওতে আটকে টেঁসে গেছে।’

‘খুব ডেনজারাস জিনিস নারায়ণদা?’

‘উরে—বাবা। দুটো মলাটের মধ্যে এক আধটা সৎ আছে বাকি সব গর্ভস্রাব।’

‘ইস শব্দটা বড় খারাপ।’

‘ওর চেয়ে খারাপ শব্দ যে আর জানা নেই গো। ফার্স্ট অ্যাডভাইস, চোর বলে চেপে ধরবে, সাধু বলে প্রমাণিত হলে তবেই ছাড়বে। যত বড় জায়গা থেকেই অনুরোধ আসুক নরম হবে না। এ হল তোপকল। তোমরা হলে মানুষ গোলা। ভেতরে পুরবে, বুদুম কর দেগে দেবে, দাঁত ছিরকুটে পড়বে গিয়ে ওই ফোর্টের র‍্যামপার্টে। যেখানে যাবে সেখানে এক গেলাস জলও খাবে না, চা মিষ্টি ত দূরের কথা। নো ওবলিগেশান, স্টেট সিডিসান অ্যান্ড ক্লিয়ার লোকোমোশান,রেলগাড়ির মতো হড়হড়িয়ে চলে যাও।’

ফোন বেজে উঠল। ‘হ্যাঁ, পাঠিয়ে দিচ্ছি স্যার।’ রিসিভার নামিয়ে বললেন, ‘যাও।’

ডক্টর দত্ত নিজেই গাড়ি চালাচ্ছেন। ছোট্ট একটা অস্টিন গাড়ি। নিজেকে এখন বেশ ইমপরটেন্ট মনে হচ্ছে। অহম মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে নাকি! মরেছে। নারাণদা বলেছেন পার্টি মানেই চোর। আমার পাশে যিনি বসে আছেন, গাড়ি চালাচ্ছেন তিনিও চোর। যাঃ তা কি করে হয়। অসৎ মানুষদের চোখে মুখে পাপের ছায়া পড়ে। সে মুখ আমি চিনি। ডক্টর দত্ত স্যুট পরে আছেন। গাড়ি চালাতে চালাতেই বাঁ হাতের কোটের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর একটা দেশলাই বের করে আমার দিকে এগিয়ে ধরলেন। হাত জোড় করে বললুম, ‘আজ্ঞে, আমি খাই না।’

আশ্চর্য হলেন, ‘সে কি? আপনার জন্যেই কিনলুম যে। আমিও ত খাই না। যাক নষ্ট হবে না। ফ্যাকট্রি ম্যানেজারকে দিয়ে দোব। খুশি হবেন।’

গাড়ি চলছে। আমরা দু’জনেই চুপচাপ। মাঝে মাঝে আড়চোখে ভদ্রলোককে দেখছি। আভরণ ভেদ করে চোরটাকে কি দেখা যাচ্ছে? কই না তো। হাসি হাসি স্বাস্থ্যবান মুখ। নম্র, ভদ্র ব্যবহার। হঠাৎ বললেন, ‘আপনার বয়েস খুব কম। মনে হয় অনেক ওপর দিকে উঠবেন।’

কথা শুনে লাজুক লাজুক মুখ হল। ‘আমাদের এই অফিসে শুনেছি কেউ ওপর দিকে ওঠে না। যে যেখানে ঢোকে সেইখানেই জীবন শেষ করে।’

‘না না, তা কেন হবে? যোগ্যতার স্বীকৃতি থাকবে না? দু—চারজন এদিক ওদিক থেকে টপকে যাবে হয়তো কিন্তু অনেস্টি এফিসিয়েনসি পুরস্কৃত হবেই।’

একটা বাঁক ঘুরে গাড়ি বাগানবাড়িতে ঢুকল। এক সময় বেশ সাজানো বাগান ছিল। এখন গোটাকতক মার্বেল স্ট্যাচু, লম্বা লম্বা সাম আর পাম—গাছ ছাড়া বাগানের সবই কালের গর্ভে চলে গেছে। অজস্র খালি ড্রাম আর ব্যারেল পড়ে আছে। একটা টিনের চালা তৈরি হয়েছে। সেইটাই কারখানা। কেমিকেলস তৈরি হয়। চিমনি উঠে গেছে আকাশের দিকে। বাগান বাড়িতে অফিস। গেটে একজন দারোয়ান। ঢুকতে ঢুকতে হঠাৎ চোখে পড়ে একটা বয়লার।

ডক্টর দত্ত বললেন, ‘আমার পূর্বপুরুষ প্রাণনাথ দত্তের শখের বাগানবাড়ি ছিল এটা। রিফ্যুজিরা আর একটু হলেই দখল করে নিত। কারখানাটা করে ফেলায় বেঁচে গেছে।’

সাবেক কালের উঁচু উঁচু ছাদ আর মোটা মোটা দেয়ালঅলা শীতলঘর। একটু অন্ধকার অন্ধকার হলেও বেশ গাম্ভীর্য আছে। দেয়ালে এখনও যে সব অয়েল পেন্টিং ঝুলছে, অস্পষ্ট হয়ে এলেও বোঝা যায়। সে যুগের মানুষের চেহারার সাজপোশাকের বেশ একটা চরিত্র ছিল, দাপট ছিল। এখানকার মতো সব প্যান্টালুনবাবু ছিলেন না। সেই সব পুরোনো আমলের ফার্নিচার। চেয়ারের ব্যাক—রেস্ট উচ্চতায় মাথা ছাড়িয়ে যায়। যে চেয়ারে বসেছি তার সামনের দেয়ালে প্রমাণ সাইজের অয়েল পেন্টিং—এ ব্রিচেস পরা সুন্দর এক মানুষ। ডক্টর দত্ত বলেন, ‘উনিই আমার ঠাকুরদা প্রাণনাথ। পোলো খেলতে গিয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মারা যান যোধপুরে। এই বাগানবাড়ি তিনিই তৈরি করিয়েছিলেন সায়েব আর্কিটেক্টকে দিয়ে। ইমপোর্ট, এক্সপোর্টের ব্যবসায় প্রচুর পয়সা করেছিলেন।’

উর্দিপরা এক বেয়ারা ট্রেতে করে চা—বিস্কুট নিয়ে এল। মরেছে, চা—বিস্কুট তো খাব না। ওবলিগেশান। এক ধরনের ঘুষ। অপ্রিয় হলেও বলতে হবে। কোনওরকম মানসিক দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। ওপর দেখে মানুষ চেনার চেষ্টা কোর না। সেই কবিতাটা উলটে নাও, ভেতরে সবার সমান রাঙা নয়, ওপরে সবার সমান চেহারা ভেতরে যত গার্দা। একে জমিদার বংশের ছেলে, তিন পুরুষে ব্যবসায়ী, ডবল ‘সাকার’।

‘ওসব আমি কিছু খাব না। নিয়ে যেতে বলুন।’

‘সে কি? এতটা এলেন, সামান্য একটু চা খাবেন না?’

‘আজ্ঞে না।’

‘চা কি আপনি খান না?’

‘হ্যাঁ খাই, তবে এখন খাব না।’ কথা কটা বেশ কড়াসুরেই বলতে হল।

‘আপনার বাড়িতে গেলে আপনি আমাকে চা খাওয়াবেন না?’

‘হ্যাঁ অবশ্যই খাওয়াব।’

‘তা হলে আমার বাড়িতে এসে চা খাবেন না কেন?’

‘প্রথমত এটা আপনার বাড়ি নয় ফ্যাকট্রি, দ্বিতীয়ত আমি অতিথি বা বন্ধু হিসেবে আসিনি।’

‘শত্রু হিসেবে এসেছেন। ছিঃ ছিঃ আপনি আমাকে ইনসাল্ট করছেন?’

‘ইনসাল্ট করব কেন?’

‘ইনসাল্ট নয়। এক কাপ চা, খানকয়েক বিস্কুট, সামান্য একটা ভদ্রতা, এর পেছনে আমার একটা সেন্টিমেন্ট, একটা ট্রাডিশান প্লে করছে, আপনি ভাবছেন আমি আপনাকে ওবলাইজ করতে চাইছি, পারচেজ করতে চাইছি, ঘুষ দিতে চাইছি। নট দ্যাট মিস্টার মুখার্জি। আপনি নতুন, আপনি জানেন না মিস্টার মুখার্জি লাস্ট থ্রি ইয়ারস আমি কোনও লাইসেনস পাইনি, কেন পাইনি জানেন, আপনাদের ওই হরেন ব্রাদার্সকে আমি ওবলাইজ করতে পারিনি। হোয়াই শুড আই? আমি বিদেশের মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে স্বদেশে শিল্প করতে এসেছিলুম কেমিকেল ইনডাসট্রির ফাদার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের অনুপ্রেরণায়। আমি কেন তোমাদের অন্যায় আব্দার শুনব! এ ফিউ বেবুনস। একসকিউজ মি। ফলে আমার ফাইল নড়ল না। আমি চোর নই বলেই আমাকে ভাতে মারার চেষ্টা হল। এবারও না হয় তাই হবে! আপনার ফাইল মুড়ে রাখুন। আপনি চা খান। চোরের চা নয়, সেন্টপারসেন্ট অনেস্ট এক বন্ধুর চা।’

ডক্টর দত্তর মুখ চোখ লাল হয়ে উঠছে। জেনুইন উত্তেজনা। ব্যাপারটা আমার হাতের বাইরে চলে গেল। ভদ্রলোকের আভিজাত্যে লেগেছে। এখন চা আমাকে খেতেই হবে।

‘হ্যাঁ দিন চা খাব। আমি আপনাকে চোর ভাবিনি। আমি একটা প্রিন্সিপল নিয়ে চলার চেষ্টা করেছিলুম। আমি যে পালকের পাখি সে পাখিদের স্বভাব আপনি জানেন। যত উঁচুতেই উঠুক চোখ সেই ভাগাড়ের দিকে।’

‘খুব সত্যি কথা। বাট ওয়ান থিং, সব ভ্যালুজ পৃথিবী থেকে এখনও নিঃশেষে মুছে যায়নি। আছে আছে, প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো এখানে ওখানে এখনও বেঁচে আছে। বাঁচিয়ে রাখতে হবে।’

চা চাওয়া শেষ হতেই ডক্টর দত্ত বললেন, ‘আপনি যদি মনে করেন তা হলে কাগজপত্তর বের করব তা না হলে গল্প করব। ব্যাবসার চেয়ে বন্ধু বড়।’

‘না আমি দেখব।’

কী দেখতে হয় তাও ত ভালো করে জানি না। বন্দুক ধরেই বাঘ শিকার। ডক্টর দত্তই সাহায্য করতে লাগলেন। মামুলি হিসেব—নিকেশ। ব্যালান্সশিট, স্টক রেজিস্টার, পারচেজ ভাউচার, ইস্যু রেজিস্টার, স্টোররেজিস্টার, অ্যাটেনডেনস রেজিস্টার। প্রথমে দেখতে হবে কারখানাটা কার! রাম জন্মালে তবেই রামায়ণ। ডক্টর দত্ত এক সময় বললেন, ‘হরেন ব্রাদার্স জানে না, আমি ইচ্ছে করলে সি এম কে বলে রাতারাতি কুবের হয়ে যেতে পারি। সে পুল আমার আছে। ডক্টর ব্যানার্জিও জানেন। তিনিও সাচ্চা মানুষ। ম্যান অফ প্রিন্সিপল। তিনি বলেছেন সাধারণ নাগরিক হিসেবে তুমি কতদূর কি করতে পার দেখ। দিস উইল বি অ্যান এক্সপিরিয়েন্স, ভারত একটি মহাদেশ, সে দেশের কোনটা তামাশা আর কোনটা আশা সেটা বুঝতে পারাও তো একটা মহা ঐতিহাসিক শিক্ষা। আমরা চেয়েছি পাইনি, আমরা সৎ হতে চেয়ে মরে গেছি, লেখা থাক ইতিহাসে পোস্টারটির জন্যে।’

ডক্টর দত্ত গাড়ি চালাচ্ছেন। আমরা ফিরে চলেছি। দুপুরের পথে লম্বা লম্বা বাড়ির ছায়া নেমে এসেছে। ভদ্রলোক হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠলেন। কিছু হয়তো মনে পড়েছে। নাকি আমার চা না খেতে চাওয়ার ভীষ্ম—প্রতিজ্ঞা ভঙ্গে ব্যঙ্গের হাসি। ভুল ভাঙল, যখন বললেন, ‘আপনাদের অফিসের জনৈক ভদ্রলাক গতবছর এই রকম এক ইনস্পেকশানে এসে যাবার সময় আমার পার্কার গোল্ডক্যাপ কলমটা ভুলে পকেটে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। জাস্ট এ মিসটেক কলমটা ভুলে পকেটে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। মানুষ মাত্রেরই ভুল হয় তো।’

পেন চুরির প্রসঙ্গটা না উঠলেই ভালো হত। নিজেকে এত ক্ষুদ্র আর নীচ মনে হত না। আমি তো ওই দলেরই একজন। সিগারেট দিলে পুরো প্যাকেটটাই লাইটার সমেত পকেটে পুরে নি। একই সঙ্গে ডাবের জল, কোল্ড ড্রিংকস, চা, বিয়ার হুইস্কি চালিয়ে দিন। আমি হয়তো দিচ্ছি না, আমার মতো আর একজন তো দিয়ে থাকে। এক আধজনের এই নীচতায় সকলেই কলঙ্কিত। ওই তো সেই ফাইল বগলে বাবু এসেছেন। সামাল, সামাল, বেটাকে চোখে চোখে রাখ। কিছু না পেলে টেবিলের ওপর থেকে পেতলের পেপার ওয়েটটাই হয়তো পকেটে পুরে নিয়ে যাবে। চিল যখন পড়েছে কুটো না নিয়ে যাবে না।

বউ বাজারে গাড়ি বাঁক নিল। মাঝামাঝি এসে ডক্টর দত্ত বললেন, ‘আপনার দ্বিতীয় জায়গায় এসে গেছেন। বাঁয়ে গলি। গাড়ি ঢোকাব না। আপনি হেঁটে চলে যান। নেমে পড়লুম। দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানের নাম অন্নপূর্ণা মেকআপ ফ্যাকট্রি। ঠিকানা হাড়কাটা ফার্স্ট লেন। রাস্তার নাম দেখ, হাড়কাটা। কত অদ্ভুত নাম যে কলকাতার রাস্তার।

সামনেই একটা ছোট মতো সোনারুপোর দোকান। ঘোর বেগুনা রঙের লুঙ্গি পরে একটি লোক ঠুক ঠুক করে সোনার বালার ওপর তন্ময় হয়ে ডিজাইন তুলছেন। মনে হল, জিজ্ঞেস করে নেওয়াই ভালো।

‘দাদা, হাড়কাটা ফার্স্ট লেন কোনটা?’

মাথা না তুলেই বললেন, ‘জানি না।’

উত্তর দেবার ধরন দেখেই মনে হল কোথাও কিছু গোলমাল আছে। হঠাৎ মনে পড়ল, রাস্তাটার নাম আমি আগে শুনেছি। রাস্তাটা ভালো নয়। কলকাতার যে কয়েকটি লাল আলোর এলাকা আছে হাড়কাটা তার মধ্যে আদি এবং বৃহত্তম। মনে পড়তেই ভেতরটা গুড় গুড় করে উঠল। কি সর্বনাশ! ব্যানার্জি সায়েব জেনেশুনে এইরকম একটা জায়গায় আসতে বাধ্য করলেন। ভর দুপুরবেলা। ভরসা এই, হাতে একটা ছাপমারা ফাইল আছে। হঠাৎ দেয়ালের দিকে নজর চলে গেল। নামের ফলক। আরে এইটাই তো হাড়কাটা লেন। অথচ দোকানের কর্মচারীটি বললেন, জানি না। রাস্তাটা পাপের, নামটাও কি পাপের! মুখে আনলে ধর্ম যাবে!

যাক, প্রধান রাস্তাটা যখন পেয়েছি, বাই লেনটাও পেয়ে যাব। সাহস না হারালেই হল। এদিকে গলা শুকিয়ে আসছে। কি আশ্চর্য মানুষের পাপবোধ! ভেতরে কোন অবচেতনে গমের দানার মতো একটি আদিম ইচ্ছা সুপ্ত হয়ে আছে, তারই নাড়াচড়ায় কর্তব্য কর্মে এসেও তালু শুকিয়ে আসছে। খোলা দরজার সামনে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন এলোচুলে। চোখ পড়ে যায় তাঁর দাঁড়াবার ভঙ্গির জন্যে, গায়ের রঙের জন্যে, সৌন্দর্যের জন্যে, পোশাকের জন্যে। গায়ে জামা নেই। সাদা শাড়ি। আঁচল গেল গেল। তিনি যে কাজটি করছেন সেটিও চোখে পড়ার মতো। দরজার পাশে রাস্তার দু ধাপ উঁচু থেকে একটি পানের দোকান উঠেছে। বেনারসী পানঅলা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে পান সাজছেন। আর সেই মহিলা পর্দাখাটাবার একটা গোল লাঠি দিয়ে পানঅলার কোমরের কাছে খোঁচা মারছেন। স্পর্শকাতর জায়গায় খোঁচা লাগার ফলে লোকটি এঁকেবেঁকে কেঁপে উঠলেন। মহিলা খিল খিল করে হাসছেন। অঙ্গভঙ্গি করছেন।

এই শুরু হল তা হলে! প্রথম নিদর্শন। এই রকম শত শত ঘরে ঘরে, পথের দু পাশে। এর মাঝেই হাড়কাটা ফার্স্ট লেন, সেখানে মেক আপ ফ্যাক্টরি। যা থাকে বরাতে। পানঅলাকেই জিজ্ঞেস করলুম,’ভাই হাড়কাটা ফার্স্ট লেনটা কোথায়?’

মহিলা লাঠিটাকে বাঁকে মতো দুকাঁধে রেখে শরীরের একটা বিশ্রী ভঙ্গি করে বললেন, ‘বলিহারি এই ভর দুপুরে : কচি খিদে বুঝি গো?

কানের পাতা দুটো অপমানে গরম হয়ে উঠল। ছিছি, বরাতে কি চাকরিই জুটল। ভদ্রলোকের ছেলে। পানঅলার বুদ্ধি আছে। মনস্তত্ত্ব বোঝে। ধমকে উঠল, ‘চোপরাও। দেখছিস না সরকারি লোক, ইসট্যাটিসটিকস নিতে এসেছে। তোরা কেমন আছিস, কেন ঘর ছেড়েছিস, কী ভাবছিস, লেখাপড়া করিস কিনা। ঠিক নেই বাবুসাব?’

‘হ্যাঁ, অনেকটা তাই।’

‘ব্যাস, ঠিক আছে। এই সামনে গলি।’

এগোতে এগোতে শুনলুম মহিলা বলছেন, ‘আ মর। কত আদিখ্যেতাই জানে মাইরি এই সরকার! কানুদের জন্যে রাধা ও সরকারিবাবু লিখে লাও।’

‘কি সাংঘাতিক অসভ্য! কোনওরকমে কাজ সেরে বেরোতে পারলে হয়। চতুর্দিকে থেকে প্রেতকণ্ঠের হি হি হাহা ভেসে আসছে। কতরকমের মূর্তি যে চারপাশে ঘুরছে। এপাড়ায় মেয়েদের চেহারা বুঝি কিন্তু ছেলেদের চেহরা এরকম কেন? বোধহয় পরগাছার পরগাছা বলে। এও এক ধরনের জীবিকা, মানুষের আদি ব্যাবসা। মাংস বেচে খাওয়া। অনেকটা আমাদের মতোই।

যাক নম্বরটা পাওয়া গেছে। লম্বা একটা তিনতলা বাড়ি। রাস্তা থেকে ভাঙা ভাঙা চার ধাপ সিঁড়ি ওপরদিকে উঠে গেছে। বিশাল একটা দরজা হাট খোলা। এ দরজা বোধহয় কখনও বন্ধ হয় না। সামনেই উঠোন। মাথার ওপর সূর্য আলোর একটা পাতকো তৈরি করেছে। সেই আলোকে কুৎসিত ব্যাঙের মতো প্রায় বিবস্ত্রা জনাকয়েক মেয়েছেলে এলোচুলে বসে বসে গটরা করছে। কি অদ্ভুত দৃশ্য। দশ হাত দূরে আর এক শহর শব্দে, গতিতে প্রাণময় হয়ে ভেসে চলেছে। ডানপাশে একটা সিঁড়ি ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠে গেছে।

উঠোনে পা রেখে জিজ্ঞেস করলুম, ‘এখানে একটা ফ্যাকট্রি আছে—অন্নপূর্ণা মেক আপ ফ্যাকট্রি?’

ওরই মধ্যে বয়স্কা একজন মহিলা হাসতে হাসতে আর একজনের গায়ে ঢলে পড়ে বললে, ‘এখানে তো একটা ফ্যাকট্রিই আছে, কি বল সুরো, সে তো রাতে চলে, মেক—আপ ফেকআপ জানি না বাবা।’

বড় অসহায় লাগছে। কী যে করি এখন। সিঁড়ি দিয়ে হাফপ্যান্ট পরা বাচ্চা একটা ছেলে দুদদাড় করে নেমে আসছে। একটা চোখ অন্ধ। হাতের কাছে ছেলেটিকে পেয়ে সেই একই প্রশ্ন করলুম।

‘মেকআপ কিনা জানি না তবে তিনতলার এক বাবুর কি যেন একটা আছে।’

মেয়েরা বললে, ‘নিয়ে যা না ছোঁড়া।’

ছেলেটি আবার উঠতে শুরু করল। আমি পেছনে পেছনে তিনতলার দরজার মুখে দাঁড়িয়ে সে যেন কাকে বললে,’ওই যে এক বাবু খুঁজছে।’

আমি বললুম, ‘বল ফ্যাকট্রি দেখতে এসেছি।’

ওপাশ থেকে, জবাব এল, ‘বলে দে নেই।’

হঠাৎ সাহস বেড়ে গেল। ছেলেটিকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললুম, ‘নেই বললে তো হবে না, আমি যে এসে গেছি।’ পা রেখেছি কি রাখিনি দুটো বাঘা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে একেবারে সামনের ঘর থেকে একজন মহিলা বেরিয়ে এসে কুকুর দুটোকে সামলালেন। মহিলার বেশ দেখে মাথা ঘুরে গেল। ময়লা ময়লা গায়ের রং। সায়াটাকে টেনে বুকের ওপর তুলে বাঁধা। অতিসংক্ষিপ্ত সরল পোশাক। কুকুরের হাত থেকে প্রাণটা একচুলের জন্যে বেঁচে গেল। এতক্ষণে দেখার অবকাশ পেলাম। লম্বা বারান্দায় শেষ মাথায় থলথলে চেহারার এক ভদ্রলোক নাভির নীচে গামছা পরে জলচৌকিতে গণেশ ঠাকুরটির মতো বসে আছেন। আর একজন মহিলা তাঁর গায়ে ঘটি ঘটি জল ঢালছেন। একেবারে বেদিং বিউটি।

ভদ্রলোক কিছুমাত্র বিব্রত না হয়ে বললেন,’ও এসে গেছেন, ঘরে বসুন। পদী বাবুকে বসা।’ পাশাপাশি দুটো ঘর। প্রথম ঘর ছেড়ে দ্বিতীয় ঘরে আমাকে ঢোকানো হল। ঘর জোড়া বিশাল একটা উঁচু খাট। ধবধবে সাদা চাদর। দুটো বালিশ। বালিশের পাশে মাথার কাঁটা, একটা থেঁতলান রজনিগন্ধার মালা। খোঁপা থেকে খুলে কেউ ফেলে গেছে। রাতটা রানীর কাজ। খাটের পাশের দেয়ালে জানালামুখী বিশাল একটা বেলজিয়ান কাচের আয়না। সেই আয়নায় বউবাজারের লাল এলাকা ভাসছে। খাটের তলায় ডুরে শাড়ি পরে একজন মহিলা বেহুঁস ঘুমোচ্ছে।

বাইরের জলচৌকি থেকে ভদ্রলোক হেঁকে বললেন, ‘বসুন, আমি আসছি।’

কোথায় বসব? ঘাট ছাড়া তো বসার জায়গা নেই। ও বিছানায় আমি বসতে পারব না। বসা উচিত নয়। গায়ে পাপ লেগে যাবে। এমনিই গা ঘিন ঘিন করছে। খুব ইনস্পেকশান হচ্ছে যা হোক। রোমান্টিক তদন্ত। বড় বড় জানালার বাইরে সারি সারি ছাদ। ছাদে ছাদে নানা বয়সের মহিলা। সারাদিন করার তো কিছু নেই। আমার অফিসের কর্মচারীদের মতো সাকার বেকার।

নীল লুঙ্গি, বুক খোলা পাঞ্জাবি পরে ভদ্রলোক ঘরে এলেন। চুলে জল। মিঠে তেলের গন্ধ। ‘একি দাঁড়িয়ে কেন স্যার, বসুন, বসুন। বিছানার চাদরটা হাত দিয়ে সমান করে দুবার চাপড় মারলেন। সব পাপ উড়িয়ে দিলেন।

‘আপনিই ব্রজবাবু?’

‘হ্যাঁ স্যার।’

‘আপনার ফ্যাকট্রি, যন্ত্রপাতি, তৈরি মাল, কাঁচামাল, কাগজপত্র সব কোথায়?’

‘সব আছে স্যার।’

‘চলুন দেখি।’

‘স্যার আজ যে আমার কারখানা বন্ধ। বাড়িতে একটা ডেথ হয়েছে। সবাই শ্মশানে চলে গেছে।’

‘তা যাক না। চাবি খুলে যন্ত্রপাতি, মেশিনপত্তর দেখান।’

‘চাবিটাও যে শ্মশানে গেছে স্যার।’

ভদ্রলোক হঠাৎ খাটের তলায় পা বাড়িয়ে মেয়েটিকে কায়দা করে একটা লাথি ঝাড়লেন। ধড়মড় করে উঠতে গিয়ে মেয়েটির মাথা খাটে ঠুকে গেল। হামা দিয়ে বেরিয়ে এল। অল্প বয়সে, ফরসা রং, চোখের কোণে কালি। দেখলে মায়া হয়। মেয়েটি চলে যেতেই ব্রজরাজ হামা দিয়ে খাটের তলায় ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ‘কিছু মেশিন এখানেই আছে, দেখাচ্ছি স্যার।

খাটের তলা থেকে কি একটা নিয়ে ভদ্রলোক পেছন দিকে হামা টেনে টেনে বিশাল একটি বালগোপালের মতো বেরিয়ে এলেন। ‘এই দেখুন স্যার। আমার মিকসিং মেশিন।’

আমাদের হেঁশেলে ডালে কাঁটা দেবার জন্যে যে জিনিস ব্যবহার করা হয় এটি তারই ক্ষুদ্র সংস্করণ। টিনের তৈরি। ফংফং করছে। পেটের কাছটা হাত দিয়ে ঘোরালে মুখের দিকের পদ্মফুলের মতো অংশটা ঘুরতে থাকে।

‘এর নাম মেশিন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ মিকসিং মেশিন। যা ঘোরে তাকেই বলে যন্তর।’

‘কী তৈরি করেন আপনি?’

‘আজ্ঞে থিয়েটারের মেকআপ স্যার। স্যামপল দেখবেন?’

ভদ্রলোক ঘরের বাইরে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই কুকুর সামলান মহিলা একটা প্লেটে বড় বড় চারটে রাজভোগ, কাচের গেলাসে জল নিয়ে ঢুকলেন। চোখে বাসি কাজল। ঠোঁটে পানের লাল অস্পষ্ট। মাথার দু একটা চুল খোঁপা ভেঙে উড়ু উড়ু। গালের একপাশে সূক্ষ্ম একটা আঁচড়ের দাগ। ড্রেসিং টেবিলের ওপর ডিশ আর গেলাস রেখে বুকের কাছে ব্লাউজের মধ্যে হাত চালিয়ে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে এনে মহিলা বললেন, ‘একটু মিষ্টি মুখ করুন স্যার। এই যে সিগারেট।’ আয়নার পেছন থকে একটা দেশলাই বেরোল। ভদ্রমহিলার মুখে মোহিনী হাসি। বুকের কাছে একটা সোনার লকেট দুলছে। কোমরের কাছ থেকে পাতলা শাড়ি নাচওয়ালীদের ঘাঘরার মতো নেমে গেছে। পায়ে আবার রুপোর মল।

ভীষণ গরম লাগছে। এই তলায় অনেক মহিলা। সব কজন এসে যদি আমাকে চেপে ধরে রেপ করে। তারপর কিছু না থাকা সত্ত্বেও ব্রজরাজ যদি একটা পঞ্চাশ হাজার টাকার লাইসেন্স রেকমেন্ড করতে বাধ্য করে। সেই ভয়টা আবার আসছে। চেপে আসছে। গলা শুকিয়ে কাঠ।

ভদ্রলোক ঘরে এলেন। হাতে একটা মাজনের কৌটো। ঢাকনাটা খুলতেই লাল মেঝেতে গুঁড়ো গুঁড়ো কি খানিকটা ছড়িয়ে পড়ল। ‘এই যে যে স্যার, মেকআপ, ফর্মুলা নাম্বার ওয়ান।’ আঙুলে খানিকটা গুঁড়ো তুলে মহিলার গালে ঘষে দিলেন।

‘কী করনা মাইরি।’ মহিলা নীচু হয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে আয়না দেখে মুখ ঘষতে ঘষতে বললেন, ‘জিনিসটা খুব ভালো হয়েছে।’ সোজা হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘দেখুন, মুখটা কেমন ফরসা হয়ে গেল।’

‘ব্রজবাবু আমি এখন যাই। আপনি কাগজপত্তর নিয়ে আমার অফিসে দেখা করবেন।’

‘সে কি স্যার! মিষ্টি মুখ না করিয়ে আপনাকে ছাড়ছে কে? বউদি, তুমি চাটা নিয়ে এস। জলদি।’

জীবনে এই প্রথম দেখলুম বউদির চেয়ে ঠাকুরপো বয়সে বড়। ঢাউস এক ঠাকুরপো ফিনফিনে বউদি। দাদাটি কোথায় কে জানে? মানুষ যে কত ভণ্ডামি জানে।

‘আমি কিছুই খাব না ব্রজবাবু। খাবার উপায় নেই।’

‘উপায় করে নিতে হবে স্যার। এ পাড়াটা বড় খারাপ। এটা আমার বউদির বাড়ি। আপনি নির্ভয়ে খান। না খেলে বউদি জোর করে ধরে খাইয়ে দেবে। সমস্ত মানুষকে বড় আপন করে নিতে জানে। ধরলে সহজে ছাড়বে না। তখন এক বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে।’

‘কি যা তা করছেন! বিপদে পড়ে যাবেন।’

‘কী রকম বিপদ স্যার?’

‘আপনার কেস আমার হাতে। এই ত আপনার কারবারের ছিরি।’

‘খুশি করে দোব স্যার। ঘাবড়াচ্ছেন কেন? পঞ্চাশ হাজারে পাঁচ হাজার। ক্যাশডাউন পাঁচশো।’

রাগে সারা শরীর জ্বলছে। লোকটা বলে কী? দরজার দিকে পা বাড়ালুম।

‘কুকুর দুটো ছাড়া আছে স্যার। মাঝে—সাঝে অচেনা লোকদের কামড়ায়।’

‘আপনি কী বলতে চাইছেন?’

‘নতুন কিছু না। বিজনেস ইজ বিজনেস। দুপুরটা খাসা এখানে কাটিয়ে যান। বউদি আছে, সুন্দরী আছে, ওই যে খাটের তলায় শুয়ে ছিল। গল্প করুন, গান শুনুন। পকেট ভারী করে বিকেলের দিকে আর একবার চা, চপ, কাটলেট খেয়ে রাস্তায় নেমে পড়ুন। বুদ্ধিমান লোক তাই করে।’

আদর্শ ফাদর্শ দিয়ে এই বস্তুটিকে পথে আনা যাবে না। একে রামে রক্ষে নেই দোসর লক্ষ্মণ। সেই রহস্যময়ী বউদি এসে গেছেন, হাতে চায়ের কাপ।

‘একি এখনও যে কিছুই খাননি!’

‘কিছু মনে করবেন না, মিষ্টি আমি খেতে পারব না। শুধু চা খাব।’

‘লক্ষ্মী ছেলে। একটা মিষ্টি।’

‘আজ্ঞে না।’

‘আচ্ছা, আচ্ছা, জোর করব না। আপনি অমন করে বসে আছেন কেন? বেশ আরাম করে বসুন। আমার কাছে ঘরের লোক, বাইরের লোক বলে কিছুই নেই।’

উপায় না দেখে কিছুক্ষণ আগে ওই অভিশপ্ত খাটেই পেছনটা একটু ঠেকিয়েছিলুম। এখন সেই খাটেই আমাকে শোয়াবার চেষ্টা। বউদি কাপ হাতে পাশে বসে পড়লেন।

ব্রজবাবু বললেন, ‘কী বলছিলুম স্যার।’

মহিলা প্রায় ঠেকে গেছেন শরীরে। চিৎকার করে ডাকতে ইচ্ছে করল, ব্যানার্জি সাহেব। তিনি বহুদূরে। এ যেন মুসলমানের হাতে জোর করে হিন্দুর জাত নষ্ট। তাড়াতাড়ি চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে খেতে শুরু করলুম। খাব কি। যা গরম। বউদি পাশে বসে দু হাত মাথার ওপর তুলে খোঁপা ঠিক করেছেন। অসহ্য ব্যাপার। তাও যদি ব্লাউজের হাতা থাকত। হঠাৎ মনে হল চায়ে কিছু মেশায়নি তো! মনে হওয়া মাত্র তেড়েফুঁড়ে উঠে পড়লুম। কোনওরকমে একবার রাস্তায় ফেলে দাও প্রভু। তারপর দেখ তোমার ইনস্পেকটর কীরকম ন্যাজমলা বলদের মতো দৌড় লাগায়।

‘চলি ব্রজবাবু।’

‘দাঁড়ান। সুন্দরী ও সুন্দরী।’

সেই মেয়েটি ঘরে এল। অল্প বয়েস। কোত্থেকে ধরে এনেছে কে জানে। দেখলে মায়া হয়।

‘সুন্দরী, স্যারকে দেখে রাখ। আমি থাকি না থাকি ইনস্পেকশানে এলেই সব দেখাবে। স্যারের প্রণামিটা দিয়ে দাও।’

সুন্দরী একটা খাম বাড়িয়ে ধরল সামনে। দু পা সরে এলুম, ভূত দেখার মতো। লক্ষ্য করিনি পেছনেই ছিলেন বউদি। বুকে, পিঠে নেপ্টে যেতেই সামনে এগোলুম। সেখানে সুন্দরী। এ যেন ডাঙায় বাঘ, জলে কুমির। ‘ওসব লাগবে না ব্রজবাবু। এমনিই হয়ে যাবে।’

‘তা কি হয় স্যার। প্রণামি না দিলে পাথরের দেবতাই অসন্তুষ্ট হন। আপনি তো রক্ত—মাংসের মানুষ।’

‘পরে হবে। আপনি পরে দেবেন।’ নিজের গলা শুনে মনে হল আর একটু হলেই কেঁদে ফেলব।

‘একবারে নাবালক। চলুন রাস্তাটা পার করে দিয়ে আসি।’

রাস্তায় বেরিয়ে স্পষ্ট দিনের আলোয় নীল লুঙ্গি আর কল্কা তোলা পাঞ্জাবি পরা ব্রজবাবুর মুখ দেখে মনে হল, লোকটা ডাইহার্ড ক্রিমিন্যাল, মেকআপের ব্যাবসা নয়, মেয়েছেলের ব্যাবসা করে। খুনখারাপিও করতে পারে। রাস্তার মোড়ে এসে বললেন, ‘কেসটা দেখবেন স্যার। বাঙালি হয়ে ব্যাবসায় নেমেছি। একটু সাপোর্ট করবেন। আমি দেখা করব অফিসে।’

লোকটার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলে বাঁচি। যেভাবে সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়েছিল। সতীত্ব নিয়ে নেমে আসতে পেরেছি এই আমার মহাভাগ্য। ট্রামে বসে মনে হল, সারা শরীর কাঁপছে।

দুপুরে ফাঁকা ট্রাম। প্রবীণ ট্রাম কনডাক্টর টিকিট চাইতে চাইতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাঁপছেন কেন?

‘ভীষণ শীত করছে। বোধহয় জ্বর আসছে।’

‘দুপুরে কেঁপে জ্বর আসছে, ম্যালেরিয়া হতে পারে। আর হবে না? শহরে যা মশার উপদ্রব বেড়েছে। যুদ্ধের সময় আমেরিকানরা সব মশা মেরে ঝাড়বংশ উৎখাত করে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর সব একে একে ফিরে আসছে।’

অফিস পাড়ার কাছাকাছি এসে কাঁপুনিটা একটু কমল। কী হয়েছিল কে জানে? কলকাতায় পাশাপাশি ক’টা জগৎ আছে। একটা বাইরের আবরণ হয়ে আছে, দৃশ্যমান, তারই ছায়ায় ছায়ায় কতরকমের স্যাডো ওয়ারলড। সেই কার কবিতায় যেন পড়েছিলুম :

 এইবারে আর এক পৃথিবীর খবর

 আমি দিতে পারি,

 এই গোলকেরই আদলে

 কায়ার পায়ে ছায়ার মতো

 মহাশূন্যে ভাসছে

 এই পৃথিবীরই এক ছায়া ছায়া

 বিষণ্ণ বীভৎস রূপ।

অফিসের বাইরে ফুটপাতে সার সার ফলঅলা কেরানিবাবুদের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্যে বসে আছে। আশা দেখি নীচু হয়ে লেবু বাছছে। আমা সঙ্গে পরিচয় নেই। অমূল্যদার পাশে বসে দু’—একবার চোখাচোখি হয়েছিল। মনে হয়েছিল ফচকে মেয়ে। অনেকটা আমার সেই ছাত্রজীবনের বান্ধবী নীতার মতো। নীতা আমার প্রায় খারাপ করে ফেলেছিল আর কি! আশা সোজা হয়ে দাঁড়াতেই আমাকে দেখতে পেল। আশার হাসিটা ভারি সুন্দর। পরিষ্কার হাসি।

‘লেবু খাবেন?’

‘লেবু! না। লেবু খাব কেন?’

‘কেন জাত যাবে?’

‘না, তা নয় হঠাৎ নেবু!’

‘নেবু কী? নেবু! বলুন লেবু। মুখটা ভীষণ শুকনো দেখাচ্ছে যে। কোথায় গিয়েছিলেন?’

‘আর বলবেন না, প্রাণ নিয়ে টানাটানি।’

আশা আমার হাতে জোর করে একটা লেবু ধরিয়ে দিল। কিরকম মিশুকে মেয়ে! অফিসের মেয়েরা বোধহয় এইরকমই হয়। এত ফ্রি! ছাত্রজীবনে কোনও মেয়ের সঙ্গে আলাপ করতে হলে যজ্ঞ করতে হত। হাঁদাগঙ্গারামের মতো আমার এক বগলে গোটাকতক ফাইল আর এক হাতে একটা লেবু।

‘চলুন চা খাই। আমি চা খেতে বেরিয়েছি।’ ফলঅলার দাম মিটিয়ে আশা বললে। চা খেলে মন্দ হয় না। শীত শীত করছে। কিন্তু যদি কেউ দেখে ফেলে! মেয়েছেলে গাবের আঠা। কখন কোথায় কীভাবে লেগে যাবে। ছাড়াতে চাইলেও ছাড়বে না। মন তুমি কি বল? কি আর বলব ভাই! তোমার ইচ্ছে তো ষোলো আনা। কেবল সাহসের অভাব। ভাবছ, একদিনের চা যদি রোজের চা হয়ে ওঠে। হলে মন্দ হয় না, তাই না? এমন একটা ফরসা টুকটুকে তাজা চনমনে মেয়ে। কিন্তু তারপর? অফিসে আওয়াজ দেবে। তোমার বাবার কানে গেলে লাফিয়ে উঠবেন। হায়রে! ছেলের বিবেকানন্দ এইভাবে ভেসে গেল। আরে ভাই, দেশের সর্বস্তর থেকেই তো তিনি এইভাবে ভেসে গেছেন।

আশা দশ বারো কদম এগিয়ে গেছে। পেছনে ফিরে তাকিয়ে বললে, ‘কি হল আসুন।’

সুড় সুড় করে চলতে আরম্ভ করলুম। ওই মিষ্টি ডাক যেন অজগরের নিশ্বাস। ভেড়া চলেছে, ভেড়া।

টিফিন কাফেতে সামনাসামনি বসলুম। দু গেলাস জল দুদিকে। টিফিনের সময় পেরিয়ে গেছে। কাফেতে মাছি উড়ছে।

‘বেশ ছেলে?’

‘কে?’

‘কে আবার, যার সামনে বসে আছি সে!’

‘কেন?’

‘বড় বড় দুটো গোরুর মতো চোখ। খাড়া একটা নাক। ভাবে ভোলা গৌরাঙ্গ!’

বয় এসে দাঁড়িয়েছে। আমি কিছু বলার আগেই আশা বললে, ‘দুটো কেক, দু কাপ চা।’

আমি বললুম, ‘পয়সা কিন্তু আমি দেব।’

‘মামার বাড়ি আর কি?’

‘তা হলে খাব না।’

‘গায়ে জল ঢেলে দেব।’

‘সে কি?’

‘হ্যাঁ আমি সব পারি। আমার নাম আশা বোস।’

‘আমার নামও মানব মুখার্জি।’

‘আর তার চেয়েও বড়, মানবের আশা।’ কথাটা বলেই জিভ কাটল। পরক্ষণেই জিভ টেনে নিয়ে চোখ নাচিয়ে বলল, ‘আই লাভ ইউ।’

শুনে হাত কেঁপে গেল। চা ছলকে ডিশে পড়ে গেল। আশা হাসতে হাসতে বললে, ‘আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি সার সার ইউক্যালিপটাস গাছ। ঢালু পথ। মানব আর আশা হাত ধরাধরি করে ছুটছে, ছুটছে, ছুটছে দিগন্তের দিকে, সূর্য অস্ত যাচ্ছে। ঝাঁক ঝাঁক পাখি উড়ছে। স্বপ্ন, স্বপ্ন। কী দেখছেন, অমন গোরুর মতো চোখ করে?’

আশা হঠাৎ কেঁদে ফেলল। এ কি মেয়েরে বাবা! মাথায় ছিট আছে না কি? চট করে চোখ মুখে আশা খিলখিল করে হেসে উঠল, ভয় পাবেন না, ভয় দেখাচ্ছি। ভয় ভীষণ ভালো জিনিস। ভয়ে সব ঠিক থাকে।’

ব্যাপারস্যাপার দেখে গলায় কেক আটকে গেছে। চা দিয়ে নামাতে হল।

‘আপনার চোখে জল কেন?’

‘ভালো অভিনয় করতে পারে মেয়েটা। তাই না? ডিরেক্টার হলে লুফে নিতেন।’

‘চোখে জল কেন? বলবেন তো?’

জল তো চোখেই থাকে, হাসি তো মুখেই থাকে, প্রেম তো হৃদয়েই থাকে, মার তো হাতেই থাকে, বিষ তো মনেই থাকে। দেখে নিলুম সব ঠিকঠাক জায়গায় আছে কি না।’

আমার মাথা ঘুরছে। একদিকে জীবনের বড় বড় দুটো ভোজ। দশ লাখ পেনিসিলিন যে রে বাবা!

আশা দাম চুকিয়ে মৌরি মুখে দিতে দিতে বললে,’ভাব হয়ে গেল। কেমন!’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘আজ্ঞে কী? আজ্ঞেটা কী? আমি কী গুরুজন?’

‘আমার মুদ্রা দোষ।’

রাস্তায় নেমে আশা বললে, ‘আমি আর অফিসে যাব না। কালীশালা মরুক।’

‘সে আবার কে?’

‘টাইপিস্টদের ইনচার্জ। বিটকেল, খিটকেল।’

‘শালা বললেন?’

‘আমি বলি। আপত্তি আছে?’

‘আজ্ঞে, না, সরি, এমনি না।’

‘আশা খিলখিল করে হেসে বললে, ‘গরম জিলিপি।’

‘কোথায়?’

‘ওই যে। ভীষণ খেতে ইচ্ছে করছে।’

‘চলুন খাইয়াই।’

‘কবে চলো হবে?’

‘সাম ডে।’

‘নো টু ডে।’

কনুইয়ের কাছটা খামচে ধরল।

‘আঃ লাগছে ছাড়।’

‘দ্যাটস রাইট।’

পর পর টপাটপ এক ডজন জিলিপি খেয়ে, আমার রুমালে হাত মুছে আশা চলে যেতে যেতে বলে গেল, ‘মনে থাকবে। চটচট করলেই মনে পড়বে, আশা, আশার হাত, পা, মাথা, মুণ্ডু, চুল, দাঁত, চোখ, কান, নাক।’

কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরে আশা চলে গেল। সোজা রাস্তা। আর দেখা যাচ্ছে না। গাড়ি, লোক, কোলাহল।

কী হল?

কার কী হল?

মানবের।

ও আমার কী হল? কিছুই বুঝলুম না। এমন হয় বুঝি? কি জানি। পিতৃদেব বলেছিলেন, তোমাকে শিক্ষা দিয়ে, সংস্কৃত দিয়ে, বংশমর‍্যাদা দিয়ে ছেড়ে দিলুম। নৌকো বাঁধা ছিল ঘাটে। খুলে দিলুম দাড়ি। মাঝি হুঁশিয়ার।

মরা বেলার ফাঁকা অফিস। কে যেন সেদিন বলছিলেন, দশটা—পাঁচটা অফিস মানে দশটায় বাড়ি থেকে বেরোব, পাঁচটায় বাড়ি ঢুকব। সেই অনুশাসনেই সবাই চারটে থেকে কাটতে শুরু করেছেন। নীচের তলায় সারা বাড়ির টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, অনুসন্ধান অফিস। র্অারও গোটাকতক এক—ঘরে অফিস। সদর দরজা দিয়ে ঢুকলেই বিশাল একটা লবি। লবির একপাশে আমাদের নারায়ণদা দাঁড়িয়ে। দূর থেকেই চেনা যায়। লম্বা—চওড়া চেহারা। মাথাটা সেই অ্যামেরিকান অভিনেতার মতো কামানো। বেশ মোটাসোটা এক ভদ্রমহিলার দু কাঁধে দুটো হাত রেখে কথা বলছেন। এই অবস্থাকে কি আমি কমপ্রোমাইজিং পজিশান বলতে পারি?

কাছাকাছি আসতেই নারাণদার কথা মনে হয় শেষ হয়ে গেল। আমার সঙ্গে লিফটে এসে উঠলেন। পায়ের কাছে কোঁচা লুটোপুটি খাচ্ছে। নারাণদা কৈফিয়ত দেবার মতো করে বললেন ‘মার সঙ্গে কথা বলছিলুম।’

মা! এ সেই ব্রজরাজের বউদি কেস। মহিলা সামান্য মোটা হতে পারেন তবে নারাণদার মা হতে গেলে পাঁচ বছর বয়সে গর্ভধারণ করতে হয়েছে। আমি বোকা। স্ত্রীলোক মাত্রই তো নারাণদার মাতৃদর্শন হয়।

‘টেলিফোনের বড়মা, বুঝলে? সামনের রবিবার তারাপীঠ যাচ্ছি। দু দিন ছুটি।’

লিফট আমাদের ফ্লোরে এসে থামল। নারাণদা করিডর ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘জীবন সংক্ষিপ্ত, বহু দূর পথ, হেঁটে যাও, খালি হেঁটে যাও, বসলে চলবে না, তাহলে পথও আর ফুরোবে না।’

ব্যানার্জি সাহেবের ঘর খালি। আও ওপরঅলার সঙ্গে মিটিং—এ গেছেন। বিরাট এক পরিকল্পনা নিয়ে নাড়াচাড়া চলছে। উত্তরবঙ্গে হিমালয় থেকে গাছগাছড়া তুলে এনে মেশিনে ফেলে চটকে চটকে রস বের করে, ডিসটিল করে ওষুধ বের করা হবে। কাগজে—কলমে পরিকল্পনা পাকা। তিরিশ টন গাছগাছড়া থেকে এক টন ওষুধ বেরোবে। সেই এক টন এক্সপোর্ট করে এক কোটি টানা বিদেশি মুদ্রা আসবে। দশ হাজার লোকের চাকরি হবে। একেবারে ফুলপ্রুফ পরিকল্পনা। ফাইভ এক্সপার্টস, ফাইভ ইয়ারস ধরে ফিফটি টাইমস মিটিং—এর বসে দুশো পাতার ঠাসা টাইপ করা পরিকল্পনা ছেড়েছেন। তিনবার ওয়ার্লড ট্যুর করে এসেছেন।

এ যেন সেই জোচ্চরের গল্প। এই তো শিমুল বীজ ছড়িয়ে দিলুম। চারা, চারা থেকে গাছ, গাছ থেকে ফল। তারপর চৈত্রে ফটাফট বীজ ফাটবে, আর তুলো উড়বে। আমি ধরছি থলেতে পুরছি, ধরছি আর পুরছি। সেই তুলো হাটে বেচে তোমার টাকা শোধ করব।

টাইপ মেশিনে কাগজ পরাতে পরাতে নারাণদা বললেন, ‘কেমন হল?’

‘ওঃ খুব হল। পুরো ঘটনাটাই নাকে কেঁদে কেঁদে বলার ইচ্ছে ছিল। হঠাৎ মনে হল, না নাকে কাঁদব না। ফাইল আছে, নোট শিট আছে, যা বলার কাগজে—কলমেই বলব। তারপর ব্যানার্জি সায়েব আছেন, তিনি বুঝবেন!

‘সব ক’টা হল?’

‘তিনটে ছিল। দুটো হয়েছে। আর একটা হল না।’

দরজা ঠেলে কল্যাণদা এলেন। ফিটফাট। গায়ে সুগন্ধ। ‘কী খবর মানব? সারাদিন দেখা নেই তোমার?’

‘ইনস্পেকশান।’

‘বাড়ি ফিরবে কী করে?’

‘কেন?’

‘শোন নি? বিরাট মিছিল বেরিয়েছে। বাস ট্রাম সব বন্ধ হয়ে যাবে।’

‘কীসের মিছিল?’

‘দাবির মিছিল। মহার্ঘ ভাতা বাড়াও, দ্রব্যমূল্য কমাও কালোবাজারি হঠাও। আমাদের অফিসের দুটো গেট বন্ধ করে নেতারা ফেসটুন হাতে দাঁড়িয়ে। পালানো চলবে না। ধরবে আর লাইনে দাঁড় করাবে। দপ্তর থেকে টেনে টেনে নীচে নামাচ্ছে। বাঁচতে যদি চাও ওই আলমারির পেছনে আধঘণ্টাটাক লুকিয়ে বসে থাক। অনেকে বাথরুমে ঢুকে বসে আছে। তারা হল দালাল। ওপাশে শ্লোগান দিচ্ছে, দালাল কো হালাল কর।’

‘আপনি কী করবেন?’

‘আমি তো গেজেটেড। ব্র্যান্ডেড দালাল। মিছিল হল ক্লাস ফোর আর থ্রিদের।’

‘আমি কোন শ্রেণির চাকর?’

‘তৃতীয় শ্রেণির।’

যখন চাকরি করতুম না তখন ছিলাম নাগরিক। কোন শ্রেণির তা জানি না। যেই চাকরি নিলাম প্রভুরা অমনি ছাপ মেরে দিলেন, ওহে তুমি তৃতীয় শ্রেণির। তোমার শিক্ষা, দীক্ষা, যোগ্যতাফোগ্যতা জানি না, এই তোমার মাইনে, এই তোমার পদ, কেতাব বলছে, তুমি ক্লাস থ্রি তোমার তলায় আর একদল, তারা পিয়ন, দে আর ক্লাস ফোর। তার তলায় কারা? কেউ নেই। আছে দলে দলে বেকার। আজ ওই ক্লাস ফোরে যে এম. এ, বি এ ঢুকে আছে। তা থাক না, ওয়ান, টু, থ্রিতে আর তখন আমরা ভেতরে হাত ঢুকিয়ে খামচাতে শুরু করলুম। পাশে একজন নর্মসহচরী বসেছিলেন, তিনি যেই বললেন, ওমা, বুড়ো বুড়ো লোক কি অসভ্য। তখন আমরা হাত বাড়িয়ে নাকটা খামচে দিলুম। খোঁপা থেকে একটা কাঁটা তুলে নিলুম। মনে হল, এই সেই অদৃশ্য কালো হাত। সামনের আসনের মানুষটি যখন বললেন, মব ভায়োলেনস, তখন আমরা তাঁর চোখের চশমাটা কেড়ে নিয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়ে—দালাল, দালাল বলে রণহুঙ্কার ছাড়লুম।

মনুমেন্টের তলায় ডায়াস পড়েছে। আলোয় ভাসছে মাইক্রোফোন। চারপাশে বৃত্তাকারে যতদূর দেখা যায় সব স্তব্ধ। গতিহীন। ডবলডেকার, সিঙ্গলডেকার, ট্রাম, ট্যাক্সি, প্রাইভেট পেটে মানুষ পুত্রের অজগরের মতো নিশ্চল। ন্যাজে রক্তচক্ষু। সেই বৃত্তের মধ্যে আমরা থার্ড ক্লাসরা থইথই করছি।

ডায়াসে ভারীমতো একজন কেউ উঠলেন। হাততালিতে আকাশ বাতাস চমকে উঠল। আমরাও চমকে দিতে পারি। মাইক্রোফোনে গলা ভেসে এল—বন্ধুগণ। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমরা কী পেয়েছি। পেয়েছি বড়, ছোট, মাঝারি একগাদা আমলা। আমলকি কিংবা হরিতকী পেলে তবু কাজ হত। লক্ষ লক্ষ ভুখা মানুষ পাকা হরিতকী খেয়ে পুঁজিবাদীদের জোয়াল টেনে যেত। এই সরকার আমাদের কী দিয়েছে? পরিকল্পনার গর্ভস্রাব দিয়েছে, দুর্ভিক্ষ দিয়েছে, বন্যা দিয়েছে, খরা দিয়েছে, বেকারি দিয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি দিয়েছে। স্বজনপোষণের জ্বলন্ত দৃষ্টান্তে মানুষের নৈতিকতা শিথিল হয়েছে। আজ আপনারা পথে কেন? বলুন আপনারা পথে কেন? কোথায় আমাদের সোনার স্বপ্ন? আপনারা হলেন শাসনযন্ত্রের শতশত হাত। সেই হাত আজ অসন্তুষ্ট। অসন্তুষ্ট হাত গঠন করতে পারে না। সে হাত সৃজনের নয় ধ্বংসের। ভেঙে ফেলুন এই শোষণের যন্ত্র। অক্টোপাসের এক একটি বাহু কেটে ফেলে উল্লাসে চিৎকার করে উঠুন, নিপাত যাক।

জনতা সমুদ্রের মতো গর্জন করে উঠল, নিপাত যাক। মনুমেন্ট দুলে উঠল।

দেশের মানুষ আজ ভুখা মরছে। খাদ্য চাইলে বুলেট মিলছে। আমরা দেখতে চাই, এই সরকারের অস্ত্রাগারে কত বুলেট আছে। আমরা অসংখ্য! আমরা রক্তবীজের ঝাড়। আমরা মরব না, আমাদের মেরে শেষ করা যাবে না। আমরা অমর।

চটাপট চটাপট প্রচণ্ড হাততালি। মনে হল, প্যাঁকাটির জঙ্গল ভেঙে লাখ লাখ হরিণ ছুটে আসছে। কালোবাজারি, মজুতদার, মন্ত্রী আর আমলাদের চক্রান্ত ব্যর্থ করার জন্যে আপনারা এক হয়ে এগিয়ে যান। গদি টলতে শুরু করেছে। চুন বালি খসতে শুরু করেছে। যে সরকার বন্দুক দিয়ে সোস্যালিজম চালাতে চায়, সেই সরকারের দিন ঘনিয়ে এসেছে। অস্তগামী সূর্যই আকাশে আগুন লাগায়। এই আগুন বন্ধুগণ, ভুখা মানুষের বুভুক্ষার আগুন, এই আগুন, ফ্যাসিস্ট সরকারের বুলেটে সন্তানহারা মায়ের চোখের আগুন, এই আগুন স্বামীহারা বিধবার প্রতিহিংসার আগুন। বলুন, এই সরকারকে আমরা গদিছাড়া করবই করব।

জনতা মহোল্লাসে চিৎকার করে উঠল—করবই করব।

এই সরকারকে আমরা ধাপার ডাম্পিং গ্রাউন্ডে ফেলবই ফেলব। ফেলবই ফেলব।

আমার গলায় আর আগের জোর নেই। সেই কখন খেয়েছি!

ভীষণ খিদে পেয়েছে! অমূল্যদার পাশে ফেস্টুন হাতে উবু হয়ে বসে আছি। সেই ফেস্টুনটাকেই মাটিতে গেড়ে শরীরের সামনের দিকটা হেলিয়ে রেখেছি। চারপাশে নন—বেঙ্গলিদের দুপুরে চিবানো আখের ছিবড়ে।

অমূল্যদা বললেন, ‘কেন খামোখা চেল্লাবার চেষ্টা করছো?’

‘কেন অমূল্যদা?’

‘কেন আবার কী? যত চেঁচাবে তত এনারজি লস হবে। এনরজিটাই আমাদের সবেধন নীলমণি। কেউ কিস্যু দেবে না হে, ওটাই ভাঙিয়েই করেকম্মে খেতে হবে।’

‘দেবে না মানে? দিতে হবে। ঘাড়ে ধরে আদায় করতে হবে।’

‘কার ঘাড়?’

‘সরকারের ঘাড়।’

‘সরকার কে?’

‘ওই যারা গদিতে!’

‘কারা বসিয়েছে?’

‘আমরা।’

‘আমরা কারা?’

‘জনসাধারণ।’

‘তারা কী?’

‘মানুষ। ম্যান।’

‘তোমার মাথা। তারা ছাগল। দুরকম ছাগল—হি গোট আর শি গোট। চল বাড়ি যাই।’

‘সে কি বাড়ি চলে যাব? এখনও অনেকে বলবেন যে!’

‘তাতে তোমার কি? তোমার অবস্থার, দেশের অবস্থার কোনও উন্নতি হবে? কাল বাজারে চালের নাম কমবে?’

‘একেবারে রাতারাতি কি কিছু হয়? ধীরে ধীরে হবে।’

‘তোমার মুণ্ডু হবে। শোন এরা হল সব প্রোফেশনাল। অ্যাকটার পলিটিসিয়ান। জেনুইন যাঁরা ছিলেন তাঁরা সাতচল্লিশের ম্যানুভারে সব আউট হয়ে গেছেন। মনুমেন্টের তলায় চিল্লে ব্রিটিশ শাসনকে ঠেকানো যাবে না।’

‘আপনি আবার এর মধ্যে ব্রিটিশ পেলেন কোত্থেকে?’

‘তুমি কি ভাবছ ইংরেজ দেশ ছেড়ে চলে গেছে? বোকা ছেলে। সব সেই রকমই আছে, শুধু রংটা পালটেছে। তোমার হাতের ফেসটুনে কী লেখা আছে দেখেছ?’

‘না।’

‘ঘুরিয়ে দেখ না।’

উঠে দাঁড়িয়ে দেখলুম। লেখা আছে ব্রাউনসাহেব বাংলা ছাড়ো। অমূল্যদা উবু হয়ে বসে বসেই বিড়ি ধরালেন। ‘বুঝলে মানব বাদামি সায়েবে দেশ ছেয়ে গেছে। রং পালটেছে মেজাজ পালটায়নি। সিসটেম পালটায়নি। সেই একই ঘৃণা, একই ক্লাস কনসাসনেস, একই ধরনের শোষণ, শাসন। দেশের টাকা সাগরপারে চলে না গেলেও কালো টাকা হয়ে সাধারণ মানুষের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। রিচ গেটিং রিচার পুওর গেটিং পুওরার!’ অমূল্যদা উঠে দাঁড়ালেন। মট করে কোমরে শব্দ হল।

‘তোমার বিবেকানন্দ কী বলেছিলেন মনে আছে তো—If everyone would see to his own reformation, how very easily you might reform a nation. একই কথা বহু আগে বলেছেন সক্রেটিস—Let him would move the world, move first himself. নিজেকে সংশোধন করার চেষ্টা কেউ করবে না, সমাজের উন্নতি, দেশের উন্নতি হবে কী করে!’

‘আপনি বলেছেন আত্মিক উন্নতির কথা?’

‘আরে বোকা আত্মা ছাড়া মানুষ তো পাখি ছাড়া খাঁচা। এক শাসন যাবে আর এক শাসন আসবে, যাবে আর আসবে, সাধারণ মানুষ যে তিমিরে সেই তিমিরে। নাও চলো।’

‘কী করে যাব অমূল্যদা। এই ফেস্টুন।’

‘ফেস্টুন? হাসল। ওটাকে শাসনক্ষমতার মতো হাত বদল কর। আর একজনকে ধরিয়ে দাও কিংবা প্রেসিডেন্টস রুল করে রাস্তার এক পাশে শুইয়ে রাখো।’

অমূল্যদার নির্দেশ মেনে ভালোই হল। বাস—ট্রাম সহজ হয়নি। আবার হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে হাওড়া। চিনেবাদাম চিবোতে চিবোতে, ভিড় ঠেলে, ঠেলা রিকশা, লরির ফাঁক দিয়ে জায়গা খুঁজে নিতে নিতে হাওড়ার ব্রিজ। ব্রিজে জিরোবার জন্যে জলের দিকে তাকাতেই দপ করে একটা কথা চোখের সামনে জাহাজের সার্চলাইটের মতো জ্বলে উঠল—ষড়যন্ত্র। কনসপিরেসি। ষড়যন্ত্রের দুনিয়া। পারিবারিক ষড়যন্ত্র। ভাই ভাইকে ল্যাং মারছে। এ চেষ্টা করছে ওকে ফাঁকি দিতে, ও চেষ্টা করছে একে। অজানা সব গর্ত তৈরি হচ্ছে। কার পা কখন খানায় পড়ে! সামাজিক ষড়যন্ত্র। কতরকমের দুষ্টচক্র প্রতিমুহূর্তে খসড়া তৈরি করে চলেছে, কী করে আরও ধনী হওয়া যায়, শাসনযন্ত্রকে কিনে ফেলা যায়, ঘোঁট পাকিয়ে অসহায় নির্বোধ মানুষদের তিলে তিলে মারা যায়, দেশটাকে চাকলা চাকলা করে নিজেদের দখলে আনা যায়। শাসকের ষড়যন্ত্র। দমন, পীড়ন দিয়ে মানুষের মনোবল কত দ্রুত ভাঙা যায়, প্রতিটি জীবনকে ভীত, সন্ত্রস্ত করে, নিরাপত্তার জমিটুকু কেড়ে নিয়ে জঙ্গলের হরিণের মতো সচকিত করে তোলা যায়। জাগতিক ষড়যন্ত্র। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, প্লাবন, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, ভূমিকম্প। প্রকৃতি প্রতি মুহূর্তে আমাদের অজ্ঞাতে হঠাৎ কি যে করে বসবেন কেউ জানে না। চাঁদের আলোয় ঘুমোতে গিয়ে বজ্রপাতে জেগে ওঠা। মহাজাগতিক ষড়যন্ত্র। সূর্য শীতল হয়ে আসছে। সৌরজগৎ ধীরে ধীরে মহাবিশ্বের আর একধারে সরে চলেছে। কত তারা পুড়ে ছাই হয়ে ব্ল্যাক হোল তৈরি করছে। নীহারিকা থেকে কত নতুন তারা জন্মাচ্ছে। কেউ জানে না কবে কখন এ জগৎ শেষ হয়ে যাবে। ওয়ার্লড মে এন্ড টু নাইট। মানুষই মানুষকে শেষ করে দিতে পারে। ওয়াশিংটন, ক্রেমলিন, ঠান্ডা লড়াই, গরম লড়াই গোটাকতক বিমান, গোটা দশেক অ্যাটম বোমা। হেডলাইন খবর—পৃথিবী উড়িয়া গিয়াছে। এ গ্রিন প্ল্যানেট কোল্যাপসড। কোন কাগজে ছাপা হবে জানি না।

অনেক রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ব্রিজর ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যাবার শব্দ শুনতে শুনতে মনে হল, বাঙ্কে শুয়ে দুলতে দুলতে ঘুমোতে ঘুমোতে পাঠানকোট চলেছি। হঠাৎ একটা ফিসপ্লেটের গোলমালে পুরো ট্রেনটা এই গভীর রাতে ইঞ্জিন বগিটগি নিয়ে ব্রিজের তলায় দুশো ফুট নীচে পড়ে চুরমার হয়ে যেতে পারে। আগে থেকে কেউ জানতে পারবে না। মৃত্যু ক্যাঁক করে গলা টিপে ধরবে। হাজার হাজার মাইল রেল লাইন, আর মানুষের জীবন সমান অরক্ষিত। চার দেয়ালের বাধা কিছুই নয়। খরগোশের আত্মরক্ষা। বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছি। কেমন একটা অলীক নিরাপত্তার বোধে নিশ্চিন্ত ঘুম আসছে। ওদিকে ষড়যন্ত্র হয়তো অনেক দূর এগিয়ে গেছে।

পাশের বিছানা থেকে বাবা বললেন—’শুনেছ, নলে সাকে ছেড়ে দিয়েছে। তোমাকে আমি কি বলেছিলুম! তোমার গুপীদার বাড়ি সার্চ করে পুলিশ প্রচুর মিল্কপাউডার পেয়েছে। সবই অ্যামেরিকান মাল। প্যাকেটে ক্যারিটাসের ছাপ।’ জানালার বাইরে হাওয়া ফিসফিস করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *