হড় খানগে পেড়া

হড় খানগে পেড়া

হড় খানগে পেড়া অর্থাৎ মানুষ মাত্রেই অতিথি। এটাই সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর দর্শনের মূল কথা। তাঁদের এই দার্শনিক চিন্তাধারা নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বই লেখা যায়, কিন্তু তাঁরা তাঁদের দার্শনিক চিন্তাধারাকে কেবলমাত্র এক কথায় তিনটে মাত্র শব্দ দিয়ে অভূতপূর্ব মুন্সিয়ানায় প্রকাশ করে দিয়েছেন। হড় কথাটার দুটো অর্থ হয়। এক অর্থে শুধুমাত্র সাঁওতালদের বোঝায়। যেমন, তৎকালীন বিহার সরকার কর্তৃক সম্পাদিত ‘হড় সম্বাদ’ সাহিত্য পত্রিকা। তাই কেউ কেউ হড় সম্বাদের হড় অবতারণা করে বিতর্কের সৃষ্টি করতেই পারেন, কিন্তু সাঁওতালরা হড় শব্দটাকে সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার না করে, ব্যাপক অর্থেই ব্যবহার করে। তাঁরা যে মানুষকে অতিথি এবং অতিথিকে নারায়ণ জ্ঞান করেন তার সমর্থনে আমি গুটিকয় যুক্তির অবতরণা করব। প্রথম যুক্তি হিসেবে আমি, ‘The Annals of Rural Bengal এর লেখক ডাবলিউ. ডাবলিউ হান্টারের মন্তব্য উপস্থিত করব। তাঁর কথায় :

‘Unlike the Hindu, he never thinks of making money by a stranger, scrupulously avoids all topics of business, and feels pained if payment is pressed upon him for milk and fruits which his wife brings out. When he is at last prevailed upon to enter upon business matters, his dealings are off hand. He names the true price at first, which a lowlander never does, and politely waives all discussion of beating down’ (পৃষ্ঠা-১৪৯/১৫০)

অর্থাৎ, ‘হিন্দুদের মত অপরিচিতদের কাছ থেকে সে টাকা নেওয়ার কথা চিন্তাই করে না। অর্থের বিনিময়ে লেনদেনের রাস্তা সে পরিহার করে। দুধ এবং কাঁচা সবজি যেটা তার বউ বাইরে এনেছে তার জন্য টাকা নেওয়ার জন্য চাপ দিলে সে যন্ত্রণা অনুভব করে। অবশেষে যখন সে কারবার করতে ঢোকে তখন সে ঝাড়া হাত পা হয় এবং প্রথমে সে সঠিক মূল্যই বলে যেটা সমতল ভূমিতে বসবাসকারীরা কোনওদিন করে না এবং শান্ত ভাবে দরদামের সমস্ত রাস্তাই পরিহার করে।’

আমার দ্বিতীয় উদাহরণ, ছোটনাগপুর মালভূমি, যেখানে আদিবাসীরা অতীতেও ছিল এখনো বহাল তবিয়তে আছে। এই ছোটনাগপুর মালভূমিতে সাঁওতালরা ছাড়াও আছেন অন্য সম্প্রদায়ের, অন্য ধর্মাবলম্বীর লোকজন যারা বাপ ঠাকুরদার আমল থেকেই এতদঞ্চলে বসবাস করে আসছেন। পাশাপাশি বসবাসের ফলে অনেকের সঙ্গেই সাঁওতালদের পরিচয় আছে, অনেকের সঙ্গে মধুর সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। সাঁওতালরা কৃষিজীবি। মাঠে ধান বোনা ছাড়াও বাস্তু জমিতে প্রচুর পরিমাণে শাক সবজি উৎপাদন করে থাকে। সাঁওতালদের আশে পাশে বসবাসকারী অন্য সম্প্রদায়ের প্রতিবেশী লোকজন প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে যদি সাঁওতালদের বাড়িতে এসে পড়ে—যদি তারা পরিচিত হয় তাহলে ত কথাই নেই, কিন্তু অপরিচিতদের মধ্যেও যদি কেউ আগ্রহ দেখায় তবে সাঁওতালরা তাদের বাস্তু জমিতে উৎপাদিত কাঁচা সবজি এমনিতেই দিয়ে দেয়, তার জন্য তারা কোনো পয়সা দাবী করে না।

পরিশেষে আসছি ফুল পেড়ার কথায়। নির্দিষ্ট দু একটা মহানগরের কথা বাদ দিলে ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, গ্রামে গঞ্জে এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে অন্য কোনো সম্প্রদায়ের আত্মীয়তার বন্দনে আবদ্ধ হওয়া কঠোর ভাবে নিষিদ্ধই শুধু নয় আত্মীয়তার বন্ধন সৃষ্টিকারীকে সামাজিকভাবে এক ঘরে করা হয়। তাই ছোটনাগপুর মালভূমিতে বসবাসকারী অধিবাসীদের মধ্যে অদ্ভূত এক আত্মীয়তার বন্ধন চালু আছে, সাঁওতালি ভাষায় যাকে বলে ফুল পেড়া যার বাংলা মানে হয় সই পাতানো। সাঁওতালদের ছেলেমেয়ের সঙ্গে অন্য সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের বয়স অথবা চেহারা যে কোনো একটায় সাদৃশ্য অর্থাৎ মিল যদি থাকে তখন সেই দুজনের মধ্যে ফুল অর্থাৎ সই পাতানো হয়। তারা নিজেরা একে অপরকে ফুল, ও ফুল বলে সম্বোধন করে আবার মা, বাবাকেও ফুল মা ফুল বাবা বলে ডাকে। এই ফুল পেড়ার বাহ্যিক উদ্দেশ্য যদিও আত্মীয়তার বন্ধন তৈরি করা, কিন্তু আসলে বা অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হচ্ছে কলাটা, মুলোটা হাতিয়ে নেওয়া। সত্য কথা বলতে কি সাঁওতালরা ফুলের মতই নিষ্পাপ, গঙ্গার মতই পবিত্র। কিন্তু তাদের এই সরলতা, উদারতাকে দুর্বলতা মনে করে, পুঁজি করে তার প্রতিবেশীরা তাকে এতদিন ধরে ঠকিয়েছে, শোষণ করে এসেছে। তাই সাঁওতালরাও এখন সচেতন হয়েছে, চালাকি করতে শিখেছে কারণ ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাবেইতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *