সামাজিক অনুষ্ঠান

সামাজিক অনুষ্ঠান

নিত্যদিনের একঘেয়েমি জীবনে বৈচিত্র আনার জন্যেই মেলার পরিকল্পনা বা পালাপার্বণের সূচনা। আজকে এই একবিংশ শতাব্দীতে বিনোদনের কত রকমের উপকরণই না প্রত্যেকটা পরিবারেই দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু সুদূর অতীতে এসব ছিল না। তখন মানুষের জীবনে মেলাই ছিল সব। মেলাকে সাঁওতালি ভাষায় বলে পাতা। মেলা বলতে যেমন বোঝায় অসংখ্য বা অনেক, পাতা বলতেও তাই। মেলা বলতে যেমন অসংখ্য লোকের সমাগমকে বোঝায়, পাতা বলতেও তেমনি বোঝায় এমন একটা অনুষ্ঠান যেখানে সহজে কারওর পাতা বা হদিশ পাওয়া সহজ নয়। সাঁওতালদের প্রায় সব পাতাই ছিল গ্রামকেন্দ্রিক অর্থাৎ গ্রামকে কেন্দ্ৰ করেই অনুষ্ঠিত হত বিনোদনের জন্য অনুষ্ঠান। এবং এই সব সামাজিক অনুষ্ঠান প্রায় এক সঙ্গে অনুষ্ঠিত করার বিধান থাকায় নিজের গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে কেউ খুব একটা যেতেন না। নিমন্ত্রিতদের কথা আলাদা, তাদের কথা বাদ দিলে আমজনতার অংশগ্রহণ ছিল না বললেই চলে।

৩৬৫ দিনে মিৎ সেরমা বা এক বছর। গণনার সুবিধার জন্য সেরমাকে বারো মাস বা চাঁদয় ভাগ করা হয়েছে। সেগুলি হল চাইত, বাইশাখ, ঝেট, আসাড়, শান, ভাদর, দাঁশায়, সহরায়, আঁঘাড়, পুস আর ফাগুন। সূর্যের দিক পরিবর্তনের ফলে বারো মাস একরকমের হয় না। কখনো বেজায় রোদ লাগে আবার কখনো প্রচণ্ড শীত, তাই বারোটা মাসকে ঋতুতে ভাগ করা হয়েছে। বাংলায় ঋতুর সংখ্যা ছয় যেমন, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত এবং বসন্ত। কিন্তু ইংরেজীতে ‘ঋতুর’ সংখ্যা চার। সেগুলি হল, (Summer) গ্রীষ্ম, (Rainy) বর্ষা, (Autumn) শরৎ এবং (Spring) বসন্ত। সাঁওতালী ভাষায় মাস এবং দিনের মত ‘ঋতুর ও নিজস্ব নামকরণ আছে। তবে সাঁওতালি ভাষায় বাংলার মত ছয় ঋতু নেই, আছে ইংরেজীর মত চারটে ঋতু। আমি এখানে তিনটের কথা উল্লেখ করলাম একটার কথা জোর দিয়ে বলতে পারছি না তাই উল্লেখ করলাম না। পরে নিশ্চিত হলে তারও উল্লেখ করব। সেই ঋতুগুলি হল নিরন (গ্রীষ্ম), জাপুৎ (বর্ষা) এবং রাবাং (শীত)। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনেও পরিবর্তন আসে তাই মানুষের ভাষা, গানের সুর পালটে যায় বলেই বারো মাসে তেরো পার্বন অনুষ্ঠিত হয়। আমি প্রথমে দুটো মূল অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করে অন্যদের কথা বলব। সেই দুটোর একটা হল সহরায় এবং অন্যটা বাহা। প্রথমে আসছি সহরায় পরবের কথায়। সাঁওতাল পরগণার কথা বাদ দিলে সাঁওতালি সহরায় বঙ্গা বা কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে এই মহোৎসব সংঘটিত হয়। নীচে উল্লেখিত সহরায় গান কেথাই সমর্থন করে :

নি চাঁদ কুনামী
দারায় চাঁদ আসাবাইশা।
হাতি লেকান সহরায় দাই না সেটেরেনারে।

(গানটির রচয়িতা সম্ভবত গোমস্তা প্রসাদ সরেন।)

সাঁওতালদের সমাজ জীবনে সহরায় পরবের গুরুত্ব যে কতখানি তা এই দু লাইনের সহরায় সেরেঞ (গান) থেকে পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠেছে। এখানে সহরায় পরবকে হাতির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। স্থলচর প্রাণীদের মধ্যে হাতি যেমন সবার বড়, তেমনি সাঁওতাল আদিবাসীদের জীবনে বারো মাসে তেরো পার্বণ ত আছেই—দং আছে, কারাম, লাঁগড়ে, ডাণ্টা রিনঝা আছে। এছাড়া আরো অনেক আছে কিন্তু সহরায়?—তার গুরুত্বই আলাদা।

হেমন্তের নীল আকাশে বর্ষার ঘনঘটা থাকে না। মাঠের চতুর্দিক তখন সবুজ চাদর দিয়ে মোড়া থাকে। ঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু শিশির সকালে সূর্যের আলোয় চিক চিক করে ওঠে আর ঠিক তখনই সাঁওতাল পল্লীতে পল্লীতে মাদলের ধিতাং তিং আর নাগড়ার দ্রিমি দ্রিমি আওয়াজে ছেলে মেয়ে বুড়ো বুড়ি সবাই মাদলের তালে তালে হাতে হাত জড়িয়ে কোমর দোলাতে থাকে আর সুর করে গাইতে থাকে :

বারো বছর সহরায় আয়ো
গ(অ)চ সারেচ জিউঙ্গতিঞ
কুলহি দাঁড়ান দগ আয়ো
আলম মানাঞা।

(প্রচলিত)

বছর দিনের সহরায় পরব মাগো
বাঁচা মরা জীবন মোর গ্রামের রাস্তায় যেতে মাগো
বারণ কর না।

হ্যাঁ। সাঁওতাল আদিবাসীদের জীবন দর্শন এটাই। মাত্র কটা দিনের ত জীবন। তার মধ্যে আবার অসুখ বিসুখ আছে। অতএব মানুষে মানুষে বিভেদ নয়। সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে হানাহানি নয়। খাও, পিয়ো আর মোজ ওড়াও। এই সঙ্গে স্মরণ যোগ্য এই গানটা।

রাহা-দং
জম আবন, ঞই আবন
রা(ই)স্কা রেবন তাঁহেনা
নওয়া হাসা হড়ম বারসিঞ লাগিৎ।।

(প্রচলিত)

খাব দাব স্ফূর্তিতে থাকব
এই মাটির দেহ দুদিনের জন্য।।

পাঁচ দিনের উৎসব সহরায়। কালীপুজোর দিন এই মহোৎসবের শুভ সূচনা হয়। তবে কালীপুজোর সঙ্গে সহরায়ের মৌলিক পার্থক্য আছে। উদ্বোধনের দিন গ্রামের প্রত্যেকটা বাড়ি থেকেই মুঠো চাল ও একটি করে মুরগী সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত হয়ে গেলে ছেলে বুড়ো সবাই গ্রামের শেষ প্রান্তে গ্রামের পুরোহিতকে সঙ্গে নিয়ে জড়ো হয়। সেখানে পুরোহিত মারাং বুরুর উদ্দেশ্যে মুরগি উৎসর্গ করেন। তারপরে মুঠো চাল দিয়ে উৎসর্গীকৃত মুরগীদের খিচুড়ি রান্না করা হয়। সেই খিচুড়ি উপস্থিত সকলের মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করা হয়। বয়স্করা হাঁড়িয়াও পান করে। পুজো সমাপ্ত হয়ে গেলে সমবেতদের মধ্যে একদল পুরোহিতকে বাড়ি পৌঁছে দেয় এবং অন্য দল মাদল এবং নাগড়া নিয়ে গোয়ালের গরু জাগাতে চলে যায়। স্থানীয় ভাষায় এদের ধেঁগুয়ান বলে। এরা প্রত্যেকটা বাড়িতে যায় এবং গোয়ালঘরের সামনে অহিরা গান পরিবেশন করে :

আশ্বিন যাইতে
কার্তিক পড়ইতে বাবু হো
আজই তো লাগো গেল
আমাবস্যার রাত।
না কাঁন্দ, না খিজ
সিরমনি গাইয়া গো
তোরী গুলিন দেয় ত দুবো ধান।।

(গানটি প্রচলিত এবং স্থানীয় কথ্য ভাষায় রচিত। জলধর কর্মকারের সৌজন্যে)

বিনিময়ে এরা বাড়ির মালিকের কাছ থেকে সামান্য কিছু পয়সা এবং যদি থাকে তবে গুঁড়ির তৈরি পিঠে পায়।

গ্রামের পুরোহিত এই পাঁচদিনের উৎসবের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন। উদ্বোধনের দিন কোনো নাচগান হয়না। সেদিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে কেবল অহিরা গান পরিবেশন করা হয়। দ্বিতীয় দিন থেকে ঐ যে শুরু হয় নাচ গান, উৎসবের শেষ দিন পর্যন্ত সেটা মোটামুটি অব্যাহত থাকে। এই চারটে দিন আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। এই কটা দিন নাওয়া, খাওয়া ভুলে সবাই

গ্রামের রাস্তায় পড়ে থাকে। তখন ছেলেমেয়েরা নাচতে নাচতে একবার গ্রামের রাস্তা ধরে উপরে উঠে যায় আবার নাচতে নাচতে নীচে নেমে আসে। উৎসবে হয়ত কারো গায়ে নতুন কিছু ওঠে আবার অনেকের গায়ে ওঠে না কিন্তু তার জন্যে আনন্দে কোন ভাঁটা পড়ে না।

ঠিক কতদিন আগে সহরায় পরবের সূচনা হয়েছিল সেটা বলা মুস্কিল। সহরায় সম্বন্ধে কথিকাগুলি থেকে জানা যায় যে :

সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় কৃষিকাজই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মূল উপজীবিকা। এই কৃষিকাজের ক্ষেত্রে আবার গরু মহিষের অবদান ছিল অপরিসীম। ট্রাকটর, পাওয়ার টিলার তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করে জল সেচের ব্যবস্থার সরকারি প্রচেষ্টাও তখন ছিল না। তখন আকাশের মেঘ থেকে বৃষ্টির জলে গরু মহিষের লাঙ্গল দিয়ে কৃষিকাজ হত। এর ফলেই মাঠে সোনা ফলত। চাষীর ঘরে গোলাভর্তি ধান উঠত। কৃষিকাজে গরুমহিষের এই অসীম অবদানের কথাই বছরের কটা দিনে স্মরণ করা হয়।

সহরায় সম্বন্ধে প্রচলিত আর একটি কথিকা থেকে জানা যায়।

সাঁওতালরা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করবার আগে যাযাবরের মত ঘুরে বেড়াত। ঘুরতে ঘুরতে তারা সপ্তসিন্ধুর দেশ চাই চাম্পায় উপস্থিত হল। এই চাই চাম্পায় অবস্থান কালে তাদের মহারাজা আদেশ জারি করলেন যে, মেয়ে জামাই, ভগ্নী এবং ভগ্নীপতিকে বছরে একবার নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে হবে। মেয়ে জামাই, ভগ্নী এবং ভগ্নীপতিকে নেমন্তন্ন করতে করতেই অনেকটা সময় কেটে গেল এবং কালক্রমে এই উৎসবটাই সহরায় রূপান্তরিত হল এবং এটা চাষীর গোলায় ধান উঠে যাবার পর অনুষ্ঠিত হতে লাগল।

এ প্রসঙ্গে ডাবলিউ. ডাবলিউ হান্টারের কথা বিশেষভাবে প্রণিধান যোগ্য :

‘The santal rejoices and sacrifices to his gods when he commits the seed to the ground (the Ero-Sim festival) when the green blade has sprouted (the Hariar Sim) When the ear has formed (the Horo) gathering of the rice crop forms the occasion of the crowning festival of the year (sohorai)’.

অর্থাৎ, সাঁওতাল যখন মাঠে ধান বোনে দেবতার (এরঃকসিম) উদ্দেশ্যে মুরগী উৎসর্গ করে এবং আনন্দ করে, যখন ধানের চারায় নবোদগম (হারিয়াড় সিম) হয় এবং যখন ধান পাকে (হুডু), যখন ধান গোলায় তোলে তখন বছরের বড় উৎসব (সহরায়) উদযাপন করে।

তিনি আরো মন্তব্য করেছেন :

“The staple food of the Beerbhoom highlanders in Indian corn (Santali Janora), and three small inferior grains called Janhe, gundli and iri which I have not seen cultivalid by the low land Hindus. The Beerbhoom Santal looks upon rice the universal food of the lowlanders, as rare luxury; but he successfully rears the small hardy barly (bajra) which is common through out Bengal. In the sounthern country, the word Janhe is used to designate a wild grass.”

অর্থাৎ, ‘বীরভূমের পার্বত্য উপজাতির প্রধান খাদ্য ভারতীয় শস্য (সাঁওতালি জঁড়রা) এবং তিনটি নিকৃষ্ট শস্য যাদের বলা হয় জানহে, গুঁদলি এবং ইড়ি নিম্ন- বঙ্গের হিন্দুর মধ্যে যাদের চাষ আমি দেখিনি। নিম্নবঙ্গের অধিবাসীদের প্রধান খাদ্য চালকে সাঁওতালরা মোটামুটি বিলাস দ্রব্য হিসেবেই দেখে, কিন্তু তারা বার্লির মত ছোট দানা বিশিষ্ট শস্য (বাজরা) দক্ষতার সঙ্গে চাষ করে, যা বাংলার সর্বত্র পাওয়া যায়। দক্ষিণ দেশে জানহে বন্য ঘাস হিসেবেই পরিগণিত হয়।’

এ কথা থেকে এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে হয় যে বাংলায় যাকে নবান্ন বলা হয় সাঁওতালি ভাষার সহরায় নব্বান্নের অবিকল প্রতিমুর্তি। এবং সহরায় কার্তিক মাসেই অনুষ্ঠিত হবার কথা কারণ উপরোক্ত শস্যগুলি তার আগেই চাষীর গোলায় উঠে যায়। নিম্নে বর্ণিত এল. এস. এস. ও. ম্যালির মন্তব্য আমার আশঙ্কাকেই সত্য বলে প্রমানিত করে :

‘In the Santal villages there is a succession of festivals throughout the year, nearly all, connected with agricultural operations The chief of these is the saharae of harvest festival, celebrated in Pus (December-January) after the rice crop of the tear has been harvesyed. It used to be celebrated in the month of Asin formerly they had gathered their principal crop by that time. The Santals indeed still call Asin the month of Soharae a name probably corrupted from Dasahara.’

অর্থাৎ, ‘সাঁওতাল গ্রামগুলিতে সারা বছরই কোনো না কোনো উৎসব সংঘটিত হয়। যাদের অধিকাংশই কৃষির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সাঁওতালদের প্রধান উৎসব সহরায় বা ধান কাটার উৎসব পৌষ-মাঘে (ডিসেম্বর-জানুয়ারী)-র বছরের শেষে ধান কাটার অব্যবহিত পরেই অনুষ্ঠিত হয়। পূর্বে এই উৎসব আশ্বিনে তাদের প্রধান শস্য সংগৃহীত হবার পরেই অনুষ্ঠিত হত। সাঁওতালরা সম্ভবত আশ্বিন মাসকে সহরায় চাঁদ বলে ডাকে—যা কিনা দশহরারই বিকৃত রূপ।’

সাঁওতালদের জীবন জীবিকার একটা বড় অবলম্বন ছিল বন জঙ্গল পাহাড় ডুংরি ইত্যাদি। সেখান থেকে কাঠ লতা পাতা এবং দাঁতন সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করত। অপর দিকে জঙ্গলে ছিল বিভিন্ন রকমের ফলের গাছ। তাই খাবার চিন্তা তাদের ছিল না। বর্তমানে অনেক জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষাবাদের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সামান্য যেটুক জঙ্গল অবশিষ্ট আছে সেখানে জঙ্গল রক্ষার নামে গার্ড, ফরেস্টাররা আছে। তারা ট্রাকের পর ট্রাক মাল রাতের অন্ধকারে পাচার করে দিচ্ছে। সাঁওতালদের বেলায় যত সব বাধা নিষেধ। অরণ্য রক্ষার নামে সাঁওতালদের ধরে নিয়ে জেলে পুরে দিচ্ছে। মোটা টাকা জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। এতসব বাধা ডিঙিয়ে যারা সামান্য কিছু নিয়ে যাচ্ছে তারা দাম পাচ্ছে না। কারণ এখন লোকে কাঠের পরিবর্তে কয়লা পোড়াচ্ছে। লতা পাতার পরিবর্তে কাগজের ঠোঙ্গা এবং প্লাস্টিক ব্যবহৃত হচ্ছে। দাঁতনের পরিবর্তে ব্রাশ কলগেটের ব্যবহার হচ্ছে। অপরদিকে আবার নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি জমি সামান্য যা কিছু ছিল তাও মদ হাঁড়িয়া খাইয়ে চালাক লোকেরা ঠকিয়ে নিয়েছে। লেখাপড়ার ক্ষেত্রেও খুব বেশি কিছু করতে পারেনি। তাই এদের মধ্যে দারিদ্রতা এখন তীব্র আকার নিয়েছে। এই সব কারণে পাঁচ দিনের সহরায় উৎসবকে বর্তমানে নমঃ নমঃ করে কোনো রকমে দু একদিনে পার করে দিচ্ছে।

রেডিয়ো, টিভি এবং সিনেমার দৌলতে লাড়েলাপ্পা সংস্কৃতি এখন সাঁওতাল পল্লীতেও ঢুকে পড়েছে। সাঁওতাল ছেলেমেয়েরা এখন হিন্দি সিনেমার নায়ক নায়িকাদের অনুকরণ করছে। এখন ছেলেরা মেয়েদের মত লম্বা চুল রাখছে এবং ঢোলা জামা প্যান্ট পরছে। অপরদিকে আবার মেয়েরাও হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের অনুকরণ করছে। এইসব ছেলেমেয়েরা নিজেদের ঐতিহ্যমণ্ডিত নাচগানের পরিবর্তে হিন্দি সিনেমার সস্তা চটকদারি গান গাইছে আর ঢংয়ে ঢংয়ে নাচছে।

সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে করতে পৃথিবী দূরে সরে যায় আবার এক সময় কাছাকাছি চলে আসে বলে পৃথিবীতে দিন রাতের তারতম্য ঘটে। আষাঢ় মাসের ৭ তারিখে পৃথিবী সূর্যের খুব দূরে চলে যায় বলে সেদিন দিন সব থেকে বড় হয়। পরদিন থেকে দিন বদলাতে থাকে অর্থাৎ ছোট হতে থাকে। এইভাবে ক্রমশ ছোট হতে হতে পৌষমাসের ৭ তারিখ দিন সব থেকে ছোট হয় এবং রাত্রি বড় হয়। তারপরে দিন আবার ক্রমশ বড় হতে থাকে সঙ্গে সঙ্গে হাড় কাঁপানো শীত বা ঠাণ্ডা কমতে থাকে। ইতিমধ্যে ঋতু পরিবর্তিত হয়। শীত চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই ঋতুর রাজা বসন্তের আগমন ঘটে। অঙ্গ, বঙ্গ এবং কলিঙ্গর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সাঁওতাল অধ্যুষিত গ্রামগুলির চতুর্দিকে অবস্থিত বিশ্বপ্রকৃতির বাহ্যিক গঠনেও আসে পরিবর্তনের ঢেউ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শরৎ’ কবিতার অংশবিশেষ ধার করে বলি :

আমলকী বন কাঁপে যেন তার
বুক করে দুরু দুরু,
পেয়েছে খবর পাতা খসানোর
সময় হয়েছে শুরু।।
শিউলির ডালে কুঁড়ি ভরে এল
টগর ফুটিল মেলা,
মালতী লতায় খোঁজ নিয়ে যায়
মৌমাছিরা দুই বেলা।।

বসন্তের আগমনে গাছের ডাল পালা থেকে পুরোনো বিদায় নিয়ে নতুন পাতা গজায়, ফুল ফোটে। শাল পলাশের রঙে রাঙ্গা হয়ে ওঠে প্রকৃতির অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। ফুলের সৌরভ ভ্রমরের গুঞ্জন সাঁওতালদের মনের মণিকোঠায় মদিরতা জাগায় তাই সাঁওতাল পরগণার গ্রামগঞ্জে বাহা (ফুল) অর্থাৎ বসন্ত উৎসবের ধূম পড়ে যায়। দিন ধার্য হয়। তার পরে নির্ধারিত দিনে সন্ধ্যায় মাঝি রাচা অর্থাৎ পুরোহিতের বাড়ির উঠোনে সবাই জড়ো হয়। সমবেত জনতার মধ্যে থেকে তিনজনকে বাছা হয়। তারা উঠোনে পাতা পাটিয়া বা মাদুরে গিয়ে বসে অর্থাৎ আসন গ্রহণ করে। পুরোহিত তাদের তিনজনের জন্য বেতের বোনা ধামা কুলোয় করে আতপ চাল এবং দুব্বো ঘাস এনে তাদের সামনে রাখে। তারা আতপ চাল এবং দুব্বো ঘাস হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে আন্দোলিত হয়ে ওঠে। পুরোহিত তখন তাদের গায়ে ঘটির ঠাণ্ডা জল ছিটিয়ে দেয়। ঠাণ্ডা জলের সংস্পর্শে এসে তাদের আন্দোলন থামে তবে স্বাভাবিক হয় না। পুরোহিত এক্ষণে তাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করে। তাঁরা কেউ মারাং বুরু ত কেউ জাহের এরা আবার কেউ মড়েক তুরুইক বলে পরিচয় দেয়। তাঁদের পরিচয় জানার পরেই পুরোহিত তাঁদের মর্ত্যে আসার হেতু বা কারণ জিজ্ঞেস করে। পুরোহিতের কথায় বঙ্গারা পুনরায় আন্দোলিত হয়ে ওঠে এবং মর্ত্যে অবতরণের কারণ দর্শায়। এখানে যেটা বিশেষভাবে উল্লেখনীয় সেটা হচ্ছে গ্রামে যাই কিছু ঘটুক না কেন তার পেছনে কারণ থাকে। কার্যকারণ ছাড়া কোনা কিছুই সংঘটিত হয় না। গ্রামের যারা হর্তা কর্তা বিধাতা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তাদেরই। যদি তারা ব্যবস্থা নিয়ে থাকে তাহলে কথাই নেই, কিন্তু যদি না নেয় তাহলে তার কৈফিয়ত তলব করে, রীতিমত জবাব দিহি করতে হয়। সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারলে বলার কিছু নাই। কিন্তু না পারলে পরবর্তী কালে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস পেলে তবেই মুক্তি। স্বাভাবিক হওয়ার আগে বঙ্গারাই ঐ দিনের জন্য একজনকে কুডাম নায়কে (সহকারী) হবার জন্য ধরে নিয়ে আসে। তারপরেই স্বাভাবিক হয় এবং ভিড় ভাঙ্গে। সাঁওতালদের রীতি নীতি কিন্তু সব জায়গায় সমান নয়। তাই এটাকে সার্বজনীন বলে দাবী করা বাতুলতা মাত্র। বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কোনো এক বিশেষ অঞ্চলে এটা প্রচলিত আবার কোথাও কোথাও দেখেছি জনগণ রাত্রে ডিনার খাওয়া দাওয়ার পর মাঝির উঠোনে জড়ো হয়। বঙ্গা বা দেবতাদের উদ্দেশ্যে স্তব স্তুতি করে। উদাহরণ হিসেবে এখানে দু একটির কথা উল্লেখ করছি। গান দুটি গুরু মাদরাজ মাড্ডির কাছ থেকে সংগৃহীত। রাহা–বাহা

(১) তেহেঞ দব উম আকান হো,
তেহেঞ দব নাড়কা আকান।।
তেহেঞদ নায়কে রাচাবণ,
দুডুস আকান।।
তোহঞদ নায়কে রাচাবন
সিদুপ আকান।।

(২) নায়কে মায় উম আঁড়গন
সুচ দাঃকরে।
নায়কে এরায় নাড়কা হসর
ডাডি দাঃক রে।।
নায়কে মায় উম রাকাপ এন
সোস ঘাটিরে।
নায়কে এরায় বহেল রাকাপ
মেরাল ঘাটিরে।।

(১) আজ আমরা স্নান করেছি
সাবান দিয়েছি গায়।
কাল নববর্ষরেভাই
জড়ো হয়েছি তাই।।
পুরোহিতের আঙিনায়
আমরা সবাই।।

(২) নায়কে ঠাকুর নাইতে যাবে
সঙ্গে যাবে কে?
পুরোহিতের (নায়কে) পত্নী যাবে
আবার যাবে কে?
স্নান করবে কাপড় ধোবে
কাজল কালো জলে।
কাপড় ছেড়ে উঠবে ঘাটে
সোসঘাট আর মেরাল ঘাটে
নাওয়া ধোওয়া সারা হলে
উঠবে হেলে দুলে।।

এইভাবে ক্রমশ চলতে থাকে। ক্রমে রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়। মানুষের কোলাহল একসময় সম্পূর্ণরূপে থেমে যায়। নিস্তব্ধ নিশীথে একসময় বঙ্গারা তড়ে সুতাম বেয়ে ইহ জগতে নেমে আসে। তারা সবাই নিজের নিজের হাতিয়ার হাতে নিয়ে পূজাবেদীর উদ্দেশ্যে ছুটতে ছুটতে রওনা হয়। তাদের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত পূজা বেদী পরিদর্শনের জন্য। পরিদর্শন শেষে পুনরায় পুরোহিতের বাড়ির উঠোনে ফিরে আসে। পুরোহিত তাঁদের পা ধুইয়ে দেয় তখন তাঁরা স্বাভাবিক হয়। সমবেত জনতা তখন উঠোন ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে, মাদল এবং নাগড়ার তালে তালে নাচ গানে মশগুল হয়ে ওঠে। সকালের অপেক্ষায় থাকে। তারপর একসময় ভোর হয়, মোরগ ডাকে। পুরোহিত তৈরি হয়, আয়োজন শুরু করে। তারও পরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে নায়কে বা পুরোহিত ডান হাতে ঘটি জল এবং বাঁ হাতে বেতের বোনা নতুন ধামা কুলোয় পুজোর সামগ্রী নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। বাদ্যের তালে তালে মেয়েরা নাচতে নাচতে শোভাযাত্রা সহকারে নায়কে বা পুরোহিতকে পথ দেখিয়ে জাহেরে নিয়ে যায়। জাহেরে পৌঁছেই নায়কে পুজোয় বসেন। পুজোর বেদীতে গোবর দেন, চালের গুঁড়ি দিয়ে খুঁড় তৈরি করেন, সেই খঁড়ের ভিতরে বলি দেবার উদ্দেশ্যে আনা মুরগীকে খাওয়াবার জন্য আতপ চাল রাখে। তারপরে মুরগীকে চরিয়ে মারাং বুরু, জাহের এরা এবং মড়েক তুরুইকর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে। ওদিকে জাহেরে ভিড় করে থাকা লোকজন নাচগানে জায়গাটাকে আন্দোলিত করে তোলে। সমবেত জনতার মিলিত আওয়াজ এবং বাদ্যযন্ত্রের ঢক্কা নিনাদ গ্রাম ছাড়িয়ে দূরে বহু দূরে চলে যায়। ইতিমধ্যে মুরগি বলি দেওয়া হয়ে গেলে মুরগীর মাংস দিয়ে খিচুড়ি রান্না করা হয়, সেই খিচুড়ি উপস্থিত সকলের মধ্যেই ভাগ করে দেওয়া হয়। ততক্ষণে মাঝ আকাশের সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ে, অস্ত যায়, তখন পুনরায় ডান হাতে ঘটি জল এবং বাঁ হাতে বেতের বোনা ধামা কুলো নিয়ে গ্রামের শেষ প্রান্তের শেষ বাড়িতে এসে দাঁড়ায়। বাড়ির মেয়েরা ঘটিতে করে জল আনে, পিঁড়ি মাটিতে পেতে পা ধুইয়ে দেয় এবং এইভাবে নায়কে একের পর এক বাড়িতে যেতে থাকে এবং বাড়ির মেয়েরা পিঁড়ি মাটিতে পেতে পা ধুইয়ে দিতে থাকে। অবশেষে নিজের বাড়ি পৌঁছোয়। নায়কে এরা অর্থাৎ বুড়ি নায়কে হাড়ামকে পা ধোওয়ার পর বরণ করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায়। অনুষ্ঠান তখনকার মত এখানেই শেষ। নাচগান সাময়িকভাবে বন্ধ থাকার পর পুনরায় শুরু হয় রাত্রে, খাওয়া দাওয়ার পর। তবে ইদানীং বাহা নাচ আর সেরকম ভাবে দেখতে পাওয়া যায় না, এখন বেশির ভাগ গ্রামেই যেটা হয় সেটা হল লাঁগড়ে, যে লাঁগাড়ের নির্দিষ্ট কোন দিন তারিখ নাই। যেটা নাগাড়ে বা লাগাড়ে হয় তাকেই বলে লাঁগড়ে।

বাহা শুরু হওয়ার দিনকে বলে উম। উম নাড়কা অর্থাৎ তেল, সাবান দিয়ে স্নান করা অর্থাৎ পবিত্র হওয়া। সংস্কৃত ওঁ শব্দের সঙ্গে ‘উম’ এর কোথায় যেন একটা সাদৃশ্য আছে। দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ যে দিন পূজা পাঠ হয় সেদিনকে বলে ‘সারদি’ অর্থাৎ জোয়ার। জোয়ারের পরে ভাঁটা তাই শেষ দিনকে বলে বাসকে অর্থাৎ বাসি। এই বাসকে থেকেই বাসকেয়া:ক (Baskeyak) কথাটা এসেছে। যার অর্থ পান্তা ভাত। এ থেকে সহজেই বোঝা যায় যে পাত্তা খাওয়ার রেওয়াজ সাঁওতালদের মধ্যে আদি থেকেই ছিল। এই বাসকে দিনেই সাঁওতালদের মধ্যে রং খেলার রেওয়াজ একসময় চালু ছিল, এখন সে সব পাট উঠে গেছে। আগেকার দিনে ফুলের নির্যাস দিয়ে রং তৈরি হত এবং রং খেলা হত। এখন বেশীর ভাগ লোকই রং খেলে না, যারা খেলে তারা গোবর গোলা জল, কাদা অথবা হাঁড়ির কালো রং দিয়ে মুখ কালো করে দেয়। ‘বাহার’ মতন মহৎ উৎসব এখন ভাঁড়ামোয় পরিণত হয়েছে।

সাঁওতালদের সব উৎসবই ছিল গ্রামকেন্দ্রিক এবং যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল জাহের। প্রকাশ্য কোনো ময়দানে উৎসবের আয়োজন সাঁওতালদের মধ্যে আদিতেও প্রচলিত ছিলনা এখনো নাই। সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে যে সব পাতা বা ছাতা দেখা যায় তাদের সব কটারই প্রধান পৃষ্ঠপোষক তাদের বিজাতীয় মুরুব্বিরা। মধ্য যুগে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে এক বিশেষ সুবিধাবাদী শ্রেণীর উদ্ভব হয়, যাদের জমিদার, ঘাটোয়াল ইত্যাদি বলা হত। এদের অধীনে নির্দিষ্ট এলাকার খাজনা আদায়ের দায়িত্ব ছিল। সেই দায়িত্ব এরা অধীনস্থ কর্মচারীর ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেরা বিলাস ব্যসনে দিন যাপন করতেন। এদের বিশেষ কিছু কাজ ছিল না, জীবনের সবটাই এদের অবসর ছিল। এইসব সুবিধাবাদী শ্রেণী বিনা পরিশ্রমেই প্রচুর ধন সম্পদের মালিক হয়ে গেলেন। নাচনী নাচ, বাঈজি নাচের পেছনে দু হাতে পয়সা উড়িয়েও এরা শেষ করতে পারতেন না। সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলের পাতা এবং ছাতা এদেরই মস্তিষ্ক প্রসুত। এ সব তাদের অবসর বিনোদনের মধ্যেই পড়ে। উদাহরণ হিসেবে শিখর ভুঁই এর অন্তর্গত চাকোলতোড় ছাতা পরবের কথা উল্লেখ করা যায়। এখানে পশ্চিম বাঙলার বরাহভূম, মানভূম বাঁকুড়া, মেদিনীপুর ছাড়াও সিংভূম থেকে বহু লোকের সমাগম হয়ে থাকে, এখনও হয়। কিন্তু এত সব করেও তাদের মন ভরত না, অবসর বিনোদন সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়ে উঠত না, তাই ছাতা এবং পাতাকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করে তুলবার জন্য প্রতিবেশী সাঁওতালদের ডাক পড়ল। তারাও অপেক্ষায় ছিল, তৈরি হয়েই অপেক্ষা করছিল। ডাক পাবার সঙ্গে সঙ্গেই বউ, ছেলে মেয়ে নিয়ে মাদল বাজাতে বাজাতে গান গাইতে গাইতে পাতা দেখার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। কিন্তু গোল দেখা দিল এক জায়গায়, তাদের মাতৃভাষা সাঁওতালি কিন্তু তাদের পৃষ্ঠপোষক, মুরুব্বি তাদের স্বজাতি নয়, বিজাতীয়। সাঁওতালি ভাষার গান তিনি ত বুঝতে পারবেন না তাই তাকে বোঝাবার জন্য স্থানীয় কথ্য ভাষায় গান রচিত হল। এই কারণেই আগেকার দিনের পাতা এবং লাঁগড়ে গানের অধিকাংশই স্থানীয় কথ্য ভাষায় রচিত। আমি এখানে উদাহরণ হিসাবে দু একটার কথা উল্লেখ করব :

রাহা—পাতা
ই বছর যেমন তেমন
আ(ই)সছে বছর নামাল চলিব।

বাংলা নাবাল থেকেই সাঁওতালি নামাল শব্দের উৎপত্তি। নাবাল কথার অর্থ নীচু জমি। বর্ধমান, মেদিনীপুরের কিছু অংশ, দুই চব্বিশ পরগণার প্রায় সবটাই সমতল ভূমি হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশ নীচু। পশ্চিম- বঙ্গের দক্ষিণে অবস্থিত পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার অর্ধাংশ, পশ্চিম মেদিনীপুর, অধুনা ঝাড়খণ্ডের অন্তর্গত সিংভূম, সাঁওতাল পরগণার দুমকা অঞ্চলে বসবাসকারী সাঁওতালি আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন বছরের দুটো মরশুমে বাসে চেপে অথবা গাড়ীতে বোঝাই হয়ে নামালে আসে জন মজুর খাটতে। উপরে উল্লেখিত পাতা সেরেঞ সেই বাস্তব সত্যকেই তার বিষয় বস্তু করেছে। দুটো মরশুম নামালে কাটিয়ে মজুরি নিয়ে পুনরায় যে যার দেশে চলে যায়। সাঁওতালদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মরশুমে ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এই সব ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানের নাচগানও ভিন্ন ভিন্ন রকমের। পাতা নাচ এবং গান কেবলমাত্র পাতা উপলক্ষেই গাওয়া হয় তবে লাঁগড়ের যেহেতু নির্দিষ্ট কোনো দিন তারিখ নেই, মরশুম নেই তাই মেলায় লাঁগড়ে নাচগান নিষিদ্ধ নয়। আর মেলায় লাঁগড়ে নাচগান হয় বলেই লাঁগড়ের কিছু কিছু গান স্থানীয় কথ্য ভাষায় রচিত। যেমন এই গানটির কথা উল্লেখ করা যায় :

রাহা-লাঁগড়ে
আখাড়া হি গে ধনি ঝাঁট দে
আখাড়া হি গে ধনি
গোবর দে
আর পাবি গে ধনি এমন সময়?

লাঁগড়ে নাচের জন্য প্রত্যেকটা গ্রামেই আসর নির্দিষ্ট করা থাকে। কিন্তু লাঁগড়ে নাচের জন্য নির্দিষ্ট কোন দিন তারিখ নেই। অবসর পেলেই লাঁগড়ে নাচের আসর বসে তার জন্য উপলক্ষ্যের দরকার হয় না। আবার সাঁওতালদের প্রত্যেকেই বাড়িতে এবং বাড়ির উঠোনে প্রায় দিনই গোবর দিয়ে থাকে। গোবর দিয়ে বীজানুমুক্ত করে। সাঁওতাল লোককবিদের রচিত আলোচ্য লাঁগড়ে সেরেঞ বা গান আমাদের সেই কথাই বলে। রচনার মান বেশ উন্নত। তাই তাদের দক্ষতা সম্বন্ধে কোন সংশয় থাকা অনুচিত। তবে, এসব গান এখন অচল। এখনকার ছেলেমেয়েরা এ সব গান গায় না। পরিচর্যার অভাবে যেমন কোনোকিছুই বাঁচে না, এদের অবস্থাও তাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *