নারী, পুরুষের সহযোদ্ধা

নারী, পুরুষের সহযোদ্ধা

সাঁওতাল সমাজে নারীর স্থান কোথায়? সেই আলোচনায় যাবার আগে আমি ছোট্টো অথচ গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করব। অনেকদিন আগের ঘটনা, আমি তখন খুব ছোটো তাই তখন সেই কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পারিনি। কিন্তু এতদিনে সেটা বুঝতে পেরেছি। পশ্চিমবাঙলায় তখনো বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে নি, ক্ষমতায় আসার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। ইতিপূর্বে দেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতার আলো সাধারণের পর্ণ কুটিরে প্রবেশ করেনি, তাই, “ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়” শ্লোগানও উঠতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে পশ্চিমবাঙলা গণ আন্দোলনের পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে। অনেকেই সাম্যবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কমিউনিষ্ট পার্টিতে যোগ দিচ্ছে। আমার বাবা এবং কাকাও তাদের অনুসরণ করে কমিউনিষ্ট পার্টিতে নাম লিখিয়েছে। সেই সূত্রেই আমাদের মাটির বাড়িতে কমিউনিষ্টদের আনাগোনার সূত্রপাত (তখন কমিউনিষ্টরা পরষ্পর পরষ্পরকে আত্মীয় জ্ঞান করতেন, যাওয়া আসাও করতেন)। আমাদের অবস্থা তখন এমন কিছু ছিল না যে, তাদের জন্য আলাদা কিছু করব, তাই আমরা যা খেতাম ওরাও তাই খেত, আমাদের মতই মাটিতে খড় বিছিয়ে শুয়ে পড়ত।

সাম্যবাদ নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হত, বিতর্কও হত। সেই আলোচনার অংশবিশেষই এখানে তুলে ধরছি। একজন পার্টি কমরেড আমার বাবা দীনবন্ধু টুডু এবং কাকু টিকারাম বাস্কেকে বোঝাচ্ছেন, আমরা সাম্যবাদে বিশ্বাসী। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনে অঙ্গীকারবদ্ধ, তাই সাম্যবাদ কাকে বলে জানা দরকার। কিন্তু তার জন্য রাশিয়া কিম্বা চীনে যাবার দরকার নাই। আমাদের চারপাশে যে সব সাঁওতালদের বসবাস আছে সেখানে গেলেই হবে। আমাদের চারপাশে যে সব সাঁওতাল গ্রাম আছে সেখানে গেলেই সাম্যবাদ সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা জন্মাবে। সাঁওতাল নারী পুরুষকে দেখলেই সাম্যবাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে। আমি হলফ করে বলতে পারি তিনি যদি সাধারণ কমরেড না হয়ে অসাধারণ কেউ হতেন অথবা বিখ্যাত কেউ হতেন তবে নিশ্চয় তার এই কথা খবর কাগজের হেডলাইন হত। কারণ তিনি যেটা বলেছেন সেটা কথার কথা নয়। অক্ষরে অক্ষরে সত্য। সাঁওতাল সমাজে নারীর স্থান অনেক উঁচুতে। তিনি কেবল পুরুষের শয্যা- সঙ্গিনী, সন্তান উৎপাদন এবং লালন পালনের যন্ত্র নন, তিনি দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামের বা লড়াইয়ের ময়দানের সহযোদ্ধা। সর্বত্রই নারী পুরুষের পাশে থেকে পুরুষকে উৎসাহ যুগিয়ে আসছে। তথাকথিত সভ্যরা যখন নারীকে ঘরের চার দেওয়ালে বন্দী করেছে, আপদমস্তক কাপড়ে মুড়ে অনেকটা কাপড়ের পুঁটুলির মত করে বাইরে এনেছে তখন সাঁওতাল নারীকে অর্গল মুক্ত করে দিয়ে স্বাধীনতা দিয়েছে। তবে স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার নামে যা কিছু করা এক নয়। নারী আর যাই হোক তার কাছে সে বাজারের সস্তা কোনো পণ্য নয়। তাই নারীর মর্যাদা, সম্ভ্রম তার কাছে মূল্যবান। তাকে রক্ষা করতে সে সর্বদাই তৎপর। এ সম্বন্ধে সাঁওতালদের পুরাণে উল্লেখিত এক পৌরাণিক কাহিনীর অবতারনা করব।

সাঁওতালরা তখনো স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেনি। যাযাবরের মত জীবন যাপন করছে। এক জায়গায় কিছু কাল অবস্থান করার পর অন্যত্র চলে যাচ্ছে। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় তারা চাই চাম্পায় এসে পৌঁছাল। জায়াগাটা তাদের পছন্দ হল। মনোরম পরিবেশ তাদের আকৃষ্ট করল। তাই বসবাসের উপযোগী করে তোলা হল। সম্ভাব্য বহিরাক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য তাঁরা অনেকগুলি গড় বা দুর্গের পত্তন করলেন। তারা এখানে সুখেই ছিলেন। কিন্তু সেই সুখ তাদের সইল না। তাই চাই চাম্পার মায়া ত্যাগ করে পালিয়ে আসতে হল। কিস্কুরা ছিলেন তাদের রাজ্যের মহারাজা। তাঁর ছিল এক আদরের কন্যা, আলালের ঘরে দুলাল। তার বিয়ে থা হয়নি। মহারাজ একদিন জঙ্গলে ঘুরতে বেরিয়ে লতাপাতায় ঢাকা এক সদ্যজাত পুত্র সন্তান কুড়িয়ে পেলেন। তিনি সেই সদ্যজাতকে নিয়ে এলেন এবং তাঁর একমাত্র কন্যার হাতে তাকে তুলে দিলেন (আবার কারো কারো মতে সেই পুত্র সন্তানের জন্মদাত্রী মহারাজেরই আদরের একমাত্র কন্যা। অবিবাহিত ছিলেন বলেই তাকে কুড়িয়ে পাওয়া বলে পরিচয় দিলো)। তাকে পেয়ে রাজকন্যা আহ্লাদে আটখানা। পরম স্নেহে কোলে পিঠে করে তাকে বড় করতে লাগলেন। তার নাম দিলেন মাধো সিং। এই মাধো সিং যখন বড় হলেন, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করলেন তখন তার বিয়ে করার ইচ্ছে হল, কিন্তু যেহেতু তার বংশ পরিচয়ে গণ্ডগোল ছিল তাই কেউ তাকে বিয়ে করতে রাজি হল না। কথাটা মাধো সিং রাজার কানে তুললেন এবং বলে দিলেন কিছুদিনের মধ্যে যদি তার বিয়ে না হয় তবে সে রাজ্যের সমস্ত যুবতী মেয়ের মাথায় সিঁদুর ঘসে তাদের সতীত্ব নষ্ট করে দেবে। মহারাজ সমাজপতিদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করলেন। কিন্তু কোনো সমাধান খুঁজতে ব্যর্থ হলেন, তাই ঠিক হল মাধো সিংকে না জানিয়ে রাতের অন্ধকারে চাই চাম্পার মায়া ত্যাগ করে সবাই চলে যাবেন। তাই হল। তারা চাই চাম্পা ছেড়ে রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিলেন। মাধো সিং পরে এ কথা জানতে পেরে তাদের পিছু নিয়েছিলেন, কিন্তু তারা এতদূরে চলে এসেছিলেন যে, মাধো সিং আর তাদের নাগাল পান নি। নারীর সম্ভ্রম সাঁওতালদের কাছে মূল্যবান। তার জন্য তারা সব কিছু ত্যাগ করতে পারে। কিন্তু নারীর সম্ভ্রম কোনো কিছুর বিনিময়েই বিসর্জন দিতে পারে না। সতীদাহর মত জঘন্য প্রথা ভারতবর্ষে একসময় ছিল। কুলীনদের কৌলিন্য বজায় রাখার জন্য মৃত্যুপথ যাত্রীর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে মৃত স্বামীর চিতায় তুলে মেয়েকে সহমরণে বাধ্য করা হত। রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ নিবারণের জন্য আইন প্রণয়নের উপযোগিতা অনুভব করে সতীদাহ আইন প্রণয়নের দাবী জানান। কিন্তু সতীদাহ নিবারণের জন্য আইন প্রণীত হলেও সতীদাহ নিবারণ হয় নি, তাই রূপ কানোয়ারদের এখনো সহমরণে যেতে হয়।

নারী সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তার সক্রিয় অংশ গ্রহণ ছাড়া সমাজ উন্নত হতে পারে না, এগিয়ে যেতে পারে না। তাই যে কোনো ক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ স্বাগত। হাটে বাজারের কথা দিয়েই শুরু করা যাক। পুরুষ হাটে বেরিয়েছে স্ত্রী তার সঙ্গে, মেলায় চলেছে বউ তার পাশে। স্বামী মাঠে লাঙ্গল দিচ্ছে তার বউ ধানের চারা তুলছে, লাঙ্গল দেওয়া হয়ে গেলে সেখানে ধানের চারা পুঁতবে বলে। তাদের অংশগ্রহণ এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। তাদের উপস্থিতি সর্বত্র, সর্বক্ষেত্রে। ইটভাঁটায় অথবা গ্রীষ্মের প্রখর রোদ্রে মাঠের ধু ধু প্রান্তরে তারা পাশাপাশি জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত। তারপরে দিনান্তে কাজের শেষে মাঝি আখড়ায় গিয়ে মরদ নাগড়া মাদল কাঁধে নিয়েছে আর তার বউ হাতে হাত ধরে গান ধরেছে, কোমর দোলাতে শুরু করে দিয়েছে। সমাজে নারী তার নির্ধারিত আসনে অবস্থান করে স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আমি যখন কলকাতায় ছিলাম তখন একবার কোনো এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে অমিতাভ চৌধুরির ভাষণ শুনবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তিনি তাঁর ভাষণে খেদোক্তি করে বলেছিলেন, বাঙালীর সংস্কৃতি খুব বেশি দিনের নয় এবং সংস্কৃতি সম্বন্ধে উল্লেখ করার মত বিশেষ কিছুই নাই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমল থেকেই বাঙালীর সংস্কৃতির সূত্রপাত। তথাকথিত সভ্যদের কাছে নারীর নাচগানে অংশগ্রহণ সমাজিক অপরাধ বলে গণ্য হত। কেবল তাই নয় সমাজপতিরা অংশগ্রহণকারীকে সমাজচ্যুত বলে ঘোষণা করতেন। অন্যদিকে সাঁওতালি সমাজে নাচে গানে নারীর অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে নাচগানের আখড়া বা আসর অধরা থাকে।

পৃষ্ঠপোষক ছাড়া কোনো সংস্কৃতিই উন্নত হতে পারে না। নিছক ভালোবেসে সংস্কৃতির চর্চা পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। হিন্দি বাংলার এত রমরমার পেছনে আছে রাজা মহারাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা। একসময় তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল বলেই হিন্দি এবং বাংলা এত উন্নত হতে পেরেছে। দেরিতে হলেও পশ্চিমবাংলার সরকার এটা বুঝতে পেরেছেন এবং পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেছেন। যদিও সেটা প্রয়োজনের তুলনায় যৎ সামান্য। হিন্দি এবং অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার সংস্কৃতির পেছনে যে পরিমাণ টাকা ঢালা হয় সাঁওতালির পেছনে তার ভগ্নাংশও খরচ করা হয় না। ইদানীং আকাশবাণী এবং দূরদর্শনের মাধ্যমে সাঁওতালি ভাষায় সম্প্রচারের ব্যবস্থা হলেও অবস্থার তেমন কিছু হেরফের হয়নি। কারণ এখানে যারা কর্মরত তারা কেবল অযোগ্যই নয়, অপদার্থ। এদের কারা নির্বাচিত করে? এখানে নির্বাচিত হবার যোগ্যতাই বা কী? কে জানে! সাঁওতালি অনুষ্ঠানের বয়স ত কম হল না কিন্তু তারা কি দাবী করতে পারবে, অমুক শিল্পী আমাদের সৃষ্টি। অথচ সরকারের কাছে কিম্বা কেন্দ্র অধিকর্তার কাছে দাবী জানালে তারা বলবে, কেন? আমরা ত সময় বরাদ্দ করে দিয়েছি অর্থাৎ বরাদ্দ করেই তাদের দায়িত্ব শেষ, তারা হাত পা গুটিয়ে বসে পড়েছেন। এইভাবে সীমাহীন বঞ্চনা ও অবহেলার ফলে সাঁওতালদের কিছু কিছু Traditional, ঐতিহ্যমণ্ডিত নাচগান ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে, যেগুলো অবশিষ্ট আছে তাদের অবস্থাও ভালো নয়, তারাও পা বাড়িয়ে রেখেছে। সেদিন হয়ত আর বেশি দূরে নেই যেদিন সাঁওতালদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যমণ্ডিত সংস্কৃতিকে জানতে হবে ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে অথবা আকাশবাণী ও দূরদর্শনের প্রোগ্রামের মারফতে বাড়ির ড্রইংরুমে বসে। একজন সংস্কৃতি প্রেমী হিসেবে কথাটা ভাবতেই শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *