স্বপ্নবাসবদত্তা – প্রথম অঙ্ক
স্থাপনা
(নান্দীপাঠের শেষে সূত্রধারের প্রবেশ)
সূত্রধার—বলরামের দুই বাহু তোমাদের রক্ষা করুক; ওই দুই বাহু উদীয়মান নতুন চন্দ্রের ন্যায় বর্ণযুক্ত, মদ্যপানহেতু বিশেষ শক্তিমান এবং বসন্তের আবির্ভাবে অপরূপ শ্রীসম্পন্ন!
সভ্যগণকে একটি কথা জানাই—কিন্তু কী আশ্চর্য! জানাবার আগেই যেন কোথাও শব্দ শুনতে পাচ্ছি! একটু দেখতে হচ্ছে—
(নেপথ্যে চিৎকার শোনা গেল—‘সরে যান, সরে যান, ভদ্রমহোদয়গণ সরে যান!’)
সূত্রধার—বুঝতে পেরেছি মগধ রাজকন্যা এসেছেন তপোবনে, তাই রাজভৃত্যেরা অশোভনভাবে আশ্রমের লোকদের সরিয়ে দিচ্ছে!
(নিষ্ক্রান্ত)
স্থাপনা সমাপ্ত
.
প্রথম অঙ্ক
(প্রহরীদ্বয়ের প্রবেশ)
প্রহরীদ্বয়—সরে যান, ভদ্রমহোদয়গণ, সরে যান।
[মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন পরিব্রাজকবেশী যৌগন্ধরায়ণ। সঙ্গে আছেন বাসবদত্তা—তাঁর সঙ্গে অবন্তীনারীর ছদ্মবেশ]
যৌগন্ধরায়ণ—(কান পেতে শুনলেন) কী আশ্চর্য! এখানেও কেন লোকজন সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে? এরা বল্কলধারী, বনফলে তুষ্ট, শান্ত, আশ্রমবাসী। এরা সম্মানের যোগ্য, এদের মধ্যেও ত্রাস সৃষ্টি করা হচ্ছে কেন? চঞ্চলভাগ্যে গর্বিত কে এমন উদ্ধত অবিনয়ী পুরুষ যে আদেশ প্রচারে এই শান্ত তপোবনকে কোলাহলময় গ্রামে পরিণত করতে চায়?
বাসবদত্তা—আর্য! এই লোকজন সরিয়ে দিচ্ছে কে?
যৌগন্ধরায়ণ—যে ধর্মপথ থেকে নিজেকেই সরিয়ে নিচ্ছে!
বাসবদত্তা—আমি তা বলিনি। আমি বলতে চেয়েছিলাম, আমাকেও কি সরে যেতে হবে?
যৌগন্ধরায়ণ—ভদ্রে, দেবতারাও অজ্ঞাতসারে এইভাবেই অনাদৃত হয়ে থাকেন। বাসবদত্তা—আর্যা, পথশ্রমে আমার দুঃখ হয়নি কিন্তু এই অবজ্ঞা আমার অসহ্য!
যৌগন্ধরায়ণ—একদিন আপনি সৌভাগ্য ভোগ করেছেন পরে স্বেচ্ছায় তা ত্যাগও করেছেন। এখন এসব কথা ভাববেন না। ভেবে দেখুন, আগে আপনিও তো জীবন ইচ্ছেমতোই ভোগ করেছেন, সেই গৌরবের পদ স্বামীর বিজয়লাভের পরেই আপনি ফিরে পাবেন। চক্রনেমির মতোই ভাগ্যেরও পরিবর্তন হয়ে থাকে।
(দুইজন প্রহরীর প্রবেশ)
প্রহরীদ্বয়—সরে যান, সরে যান! (কঞ্চুকীরঃ প্রবেশ)
কঞ্চুকী—না না, সম্ভষক, সরিয়ে দিও না। রাজার যাতে নিন্দে হয় এমন কাজ কেন করবে? নগরের গ্লানি থেকে মুক্ত হবার জন্যই তো এইসব মনস্বী বনে এসে বাস করছেন।
প্রহরীদ্বয়—বেশ, তাই হোক! (উভয়ের প্রস্থান)
যৌগন্ধরায়ণ—একে দেখে মনে হয় ইনি জ্ঞানী—বৎসে, চলো কাছে যাই!
বাসবদত্তা—তাই হোক! (দুইজনে কঞ্চুকীর কাছে এলেন)
যৌগন্ধরায়ণ—এই লোকজন সরাবার কারণ কী?
কঞ্চুকী—তপস্বিন্!
যৌগন্ধরায়ণ—সম্বোধনটি গৌরবের কিন্তু পরিচয় নেই বলে মনে ঠিক লাগছে না।
কঞ্চুকী—শুনুন! আমাদের মহারাজ সার্থকনামা দর্শকের ভগিনী পদ্মাবতী এসেছেন মহারাজ জননী আশ্রমবাসিনী মহাদেবীকে দেখতে। আজ তিনি তপোবনে বাস করবেন, এই তাঁর ইচ্ছে; পরে রাজমাতার অনুমতি নিয়ে রাজগৃহে ফিরে যাবেন। আপনারা তীর্থজন, যজ্ঞীয় কাষ্ঠ, পুষ্প, কুশ এইসব উপকরণ ইচ্ছেমতো সংগ্রহ করুন। তপস্বীদের পূতকর্মে কোনো বাধা সৃষ্টি হোক, তা ধর্মপ্রিয়া রাজকন্যার ইচ্ছে নয়।
যৌগন্ধরায়ণ—(স্বগত) বটে, ইনিই সেই মগধরাজপুত্রী পদ্মাবতী! পুষ্পকভদ্ৰ প্ৰভৃতি দৈবজ্ঞগণ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ইনিই হবেন আমার প্রভু বৎসরাজ উদয়নের দ্বিতীয় মহিষী। তাই দেখছি, মনের ভাবনা অনুযায়ী বিদ্বেষ বা প্রীতি জন্মে থাকে; প্রভুপত্নীরূপে একে পেতে চাই বলেই একে আমার পরমাত্মীয় বলে মনে হচ্ছে।
বাসবদত্তা—(স্বগত) ‘ইনিই রাজকন্যা” এই কথা শুনে এর প্রতি আমারও ভগিনী-স্নেহ জেগে উঠেছে।
(পরিজনসহ পদ্মাবতী প্রবেশ করলেন, সঙ্গে চেটী)
চেটী—ভদারিকে, আসুন! আসুন! এই তো আশ্রম; আপনি প্রবেশ করুন।
(জনৈকা তাপসীর প্রবেশ)
তাপসী—স্বাগত, রাজপুত্রী!
বাসবদত্তা—(স্বগত) ইনিই সেই রাজকন্যা! এর রূপ বংশের যোগ্যই বটে।
পদ্মাবতী—আর্যে! আপনাকে প্রণাম করি
তাপসী—চিরজীবী হও! এস বৎসে এস; তপোবন অতিথিদেরই নিজের গৃহ।
পদ্মাবতী—তাই হোক তাই হোক—! আমি আশ্বস্ত হলাম; এই সম্মান-বাক্যে আমি ধন্য হলাম!
বাসবদত্তা—(স্বগত) কেবল রূপ নয়, এর কথাও মধুর!
তাপসী—আচ্ছা, দর্শক রাজার এই ভগিনীকে কোনো রাজা কি বরণ করেননি?
চেটী–উজ্জয়িনীর রাজা প্রদ্যোৎ তাঁর পুত্রের জন্য দূত পাঠাচ্ছেন।
বাসবদত্তা–(আত্মগত) আহা, তাই হোক। তাহলে ইনি আমার আত্মীয়া হতে চলেছেন!
তাপসী—এর রূপ এই সমাদরের যোগ্য। শুনেছি দুই রাজবংশই মহৎ!
পদ্মাবতী—আর্য! আমাকে অনুগ্রহ করতে পারেন এমন কোনো মুনি আপনি দেখেছেন কি? কে কী পেতে ইচ্ছে করেন তা জানবার জন্য তপস্বীগণকে বলুন, আমি তাঁদের ঈপ্সিত বস্তু দান করব।
কঞ্চুকী–আপনার যেমন ইচ্ছে। ‘হে আশ্রমবাসী তপস্বীগণ! আপনারা শুনুন—শুনুন! মাননীয়া মগধরাজপুত্রী দানের দ্বারা ধর্ম অর্জন করতে ইচ্ছুক হয়ে জানাচ্ছেন, কার কী প্রয়োজন তা বলুন। কার কলস চাই, কার বস্ত্র চাই? দীক্ষিত ব্যক্তিগণ গুরুকে কি দান করতে ইচ্ছুক? কাকে কী দিতে হবে, আপনারা বলুন!”
যৌগন্ধরায়ণ—(স্বগত) এইবার পথ খুঁজে পেয়েছি! (প্রকাশ্যে) আর্য! আমি একজন প্রার্থী!
পদ্মাবতী—ভাগ্যবশত আমার তপোবনে আসা তাহলে সার্থক হল!
তাপসী—এই আশ্রমের তপস্বীগণ তো সকলেই সন্তুষ্ট! ইনি নিশ্চয়ই কোনো আগন্তুক হবেন!
কঞ্চুকী—বলুন, আপনার জন্য কী করতে হবে?
যৌগন্ধরায়ণ—(বাসবদত্তাকে লক্ষ্য করে) ইনি আমার ভগিনী; এর স্বামী এখন প্রবাসী। আমার প্রার্থনা, রাজকুমারী কিছুকাল এর প্রতিপালনের ভার গ্রহণ করুন। আমার অর্থে, ভোগে বা বস্ত্রে কোনো প্রয়োজন নেই, আমি জীবিকার জন্য এই কাষায় ধারণ করিনি। আমি মনে করি এই ধীরা ও ধর্মপ্রিয়া রাজপুত্রীই আমার ভগিনীর চরিত্র রক্ষা করতে পারবেন।
বাসবদত্তা—(স্বগত) দেখছি, আর্য যৌগন্ধরায়ণ আমাকে এই রাজকন্যার হাতে তুলে দিতে চান। যাই হোক, বিচার না করে তিনি নিশ্চয়ই কিছু করবেন না।
কঞ্চুকী—ভদ্রে, এঁর প্রার্থনা বেশ গুরুতর; কীভাবে কথা দেব? কেননা, অর্থ, প্রাণ বা তপস্যা অনায়াসে দান করা চলে। অন্য সবকিছু দানেই সুখ, কিন্তু গচ্ছিত বস্তুর রক্ষা অত্যন্ত দুঃখজনক!
পদ্মাবতী—আর্য! প্রথমে ঘোষণা করলেন—কে কী চান! তারপর এখন এভাবে ভাবা অন্যায়। ইনি যা বলছেন তাই করুন।
কঞ্চুকী—একথা আপনারই যোগ্য!
চেটী—সত্যবাদিনী রাজপুত্রী চিরজীবী হোন!
তাপসী—ভদ্রে, আপনার দীর্ঘ জীবন কামনা করি।
কঞ্চুকী—ভদ্রে, তবে তাই হোক! (কাছে গিয়ে) মাননীয়া পদ্মাবতী আপনার ভগিনীর পরিপালনে সম্মত হয়েছেন!
যৌগন্ধরায়ণ—আমি অনুগৃহীত হলাম। বৎসে, এর কাছে যাও।
বাসবদত্তা—(স্বগত) তাছাড়া আর উপায়? আমি মন্দভাগিনী, তাই আমাকে যেতে হচ্ছে।
পদ্মাবতী—আচ্ছা আচ্ছা, ভালোই তো হল; এখন থেকে ইনি আমাদের আত্মীয়া হলেন।
তাপসী—এর যা রূপ, একেও রাজকন্যা বলেই মনে হচ্ছে।
চেটী—আপনি ঠিকই বলেছেন; আমারও মনে হচ্ছে ইনি পূর্বে রাজসুখ ভোগ করেছিলেন।
যৌগন্ধরায়ণ—(স্বগত) যাক, ভগবানের আশীর্বাদে অর্ধেক ভার নেমে গেল। মন্ত্রীদের সঙ্গে যেমন পরামর্শ করেছিলাম সেইভাবেই ঘটনা ঘটে যাচ্ছে! প্ৰভু রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হবার পর যখন দেবীকে নিয়ে যাব তখন তাঁর চরিত্র সম্পর্কে সাক্ষী থাকবেন এই মগধরাজপুত্রী। মহারাজের বিপদ দেখে যাঁরা বলেছিলেন, পদ্মাবতী তাঁর মহিষী হবেন তাঁদের কথায় বিশ্বাস করেই এই কাজ করলাম। দৈব কখনো সুপরীক্ষিত সিদ্ধ বাক্যকে লঙ্ঘন করে না।
(একজন ব্রহ্মচারীর প্রবেশ)
ব্রহ্মচারী—(আকাশের দিকে তাকিয়ে) মধ্যাহ্ন উপস্থিত। আমি অত্যন্ত ক্লান্ত! কোথায় গিয়ে বিশ্রাম করব? (পরিক্রমণ করে) এই তো দেখতে পেয়েছি! চারদিক দেখে মনে হচ্ছে এটি একটি তপোবন, কেননা হরিণগুলো গভীর বিশ্বাসে অচকিতভাবে বিচরণ করছে। পুষ্পফলে সমৃদ্ধ, শাখায় শোভিত বৃক্ষগুলো এখানে সযত্নে রক্ষিত; কপিল বর্ণের বহু গাভী এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, চারদিকে চাষ না-করা জমি! বহুস্থানে বহ্নি থেকে ধূম নির্গত হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটি তপোবন। তাহলে এখন প্রবেশ করা যেতে পারে।
(ব্রহ্মচারী অগ্রসর হলেন)
এটি দেখে মনে হয় আশ্রম বিরুদ্ধ! (অন্যদিকে তাকিয়ে) তাইতো, এখানে যে তপস্বীও আছেন, তাহলে কাছে যাওয়া নিশ্চয়ই দোষের হবে না! বটে! স্ত্রীলোকও আছেন দেখতে পাচ্ছি!
কঞ্চুকী—আপনি স্বচ্ছন্দভাবে আসুন, আশ্রম সর্বসাধারণের।
(বাসবদত্তা অসম্মতিসূচক অভিনয় করলেন)
পদ্মাবতী—আর্য পরপুরুষের দর্শন এড়িয়ে যাচ্ছেন। গচ্ছিত বস্তুর রক্ষণ সহজেই হবে বলে মনে হচ্ছে!
কঞ্চুকী—আমরা এখানে আগে এসেছি। আমাদের আতিথ্য গ্রহণ করুন।
ব্রহ্মচারী—বেশ বেশ তাই হোক্। (জলে আচমন করে) যাক, শ্রম অনেকটা দূর হল!
যৌগন্ধরায়ণ—আপনি কোথা থেকে আসছেন, কোথায় যাবেন? আর আপনার বাসস্থানই-বা কোথায়?
ব্রহ্মচারী—শুনুন, আমি আসছি রাজগৃহ থেকে! বেদপাঠের জন্য বৎসদেশে লাবাণক গ্রামে বাস করতাম।
বাসবদত্তা—(স্বগত) লাবাণক! গ্রামের নামেই যেন আমার দুঃখ নতুন করে জেগে উঠল।
যৌগন্ধরায়ণ—আপনার বিদ্যাগ্রহণ শেষ হয়েছে?
ব্রহ্মচারী—আজ্ঞে না, এখনও হয়নি।
যৌগন্ধরায়ণ—কিন্তু বিদ্যাগ্রহণ যদি না শেষ হয়ে থাকে তবে এখানে এলেন কেন, জানতে পারি কি?
ব্রহ্মচারী—নিশ্চয়ই। সেখানে এখন ভীষণ এক বিপদ—
যৌগন্ধরায়ণ—(উৎসুক কণ্ঠে) কীরকম?
ব্রহ্মচারী—সেখানে উদয়ন নামে এক রাজা বাস করতেন-
যৌগন্ধরায়ণ—হ্যাঁ, রাজা উদয়নের কথা শুনেছি বটে! তার কী হয়েছে?
ব্রহ্মচারী—অবন্তীরাজপুত্রী বাসবদত্তা তাঁর প্রিয়তমা পত্নী-
যৌগন্ধরায়ণ—তা হবে! কিন্তু তারপর?
ব্রহ্মচারী—একদিন রাজা মৃগয়া উপলক্ষে বাইরে যাবার পর গ্রামের একটি অগ্নিকাণ্ডে বাসবদত্তা প্ৰাণত্যাগ করেন।
বাসবদত্তা—(স্বগত) মিথ্যে, সব মিথ্যে! হতভাগিনী তো এখনও বেঁচে আছে! যৌগন্ধরায়ণ—তারপর কী হল বলুন—
ব্রহ্মচারী—তারপর তাঁকে উদ্ধার করতে গিয়ে রাজমন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণ সেই অগ্নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন!
যৌগন্ধরায়ণ—সত্যি? তারপর?
ব্রহ্মচারী—তারপর রাজা ফিরে এলেন, সব কথা শুনে তিনি তাঁদের মৃত্যুশোকে অধীর হয়ে অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জন দিতে উদ্যত হলেন, কিন্তু মন্ত্রীগণ তাঁকে বাধা দিলেন।
বাসবদত্তা—(স্বগত) জানি, আমার প্রতি আমার স্বামীর অনুকম্পার কথা আমি জানি বই কি!
যৌগন্ধরায়ণ—তারপর কী হল বলুন!
ব্রহ্মচারী—তখন মহিষীর ব্যবহৃত সেই দগ্ধাবশিষ্ট অলঙ্কারগুলো আলিঙ্গন করে রাজা মূৰ্চ্ছিত হয়ে পড়লেন!
সকলে—আহা! তারপর?
বাসবদত্তা—(স্বগত) এখন তাহলে আর্য যৌগন্ধরায়ণের অভিলাষ পূর্ণ হোক!
(বাসবদত্তার দুই চোখে দেখা দিল অশ্রুবিন্দু)
চেটী—রাজপুত্রী! দেখুন, আর্যা কাঁদছেন!
পদ্মাবতী—নিশ্চয়ই, পরের দুঃখে অনুকম্পাই এর কারণ!
যৌগন্ধরায়ণ—হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার ভগিনী পরের দুঃখ একেবারেই সইতে পারেন না। কিন্তু তারপর?
ব্রহ্মচারী—তারপর ধীরে ধীরে তাঁর জ্ঞান ফিরে এল—
পদ্মাবতী—তিনি বেঁচে উঠেছেন, খুবই ভাগ্যের কথা! মূৰ্চ্ছার সংবাদে খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম!
যৌগন্ধরায়ণ—তারপর কী হল?
ব্রহ্মচারী—জ্ঞান ফিরে আসার পর তিনি উঠে দাঁড়ালেন, ভূমিতে লুণ্ঠনের জন্য তাঁর দেহ ধূলায় ধূসরিত! হায় বাসবদত্তে, হায় অবন্তীরাজপুত্রী, হায় প্রিয়ে, হায় প্রিয়শিষ্যে তুমি কোথায়—এই বলে তিনি কতভাবে বিলাপ করতে লাগলেন। বেশি কী আর বলব? এখন চক্রবাকও তাঁর চেয়ে বেশি বিরহকাতর নয়। গুণবতী পত্নীর মৃত্যুতে আর কাকেও এমন শোক করতে দেখা যায় না! স্বামী যে পত্নীকে এই চোখে দেখবেন—সেই স্ত্রী তো ধন্য। পত্নীপ্রেমের গুণে ইনি দগ্ধ হয়েও দগ্ধ হলেন না।
যৌগন্ধরায়ণ—তাঁকে প্রকৃতিস্থ করার জন্যে কোনো মন্ত্রীই কি চেষ্টা করেননি?
ব্রহ্মচারী—হ্যাঁ—রুমন্থান্ নামে এক মন্ত্রী সুস্থ করে তুলতে খুবই চেষ্টা করেছিলেন। তিনি দিবারাত্র সযত্নে রাজার সেবা করছেন। রাজার মতোই তিনিও অনাহারী; সকল সময় অশ্রুপাতের ফলে তাঁর মুখ শীর্ণ, রাজার দুঃখে সহানুভূতির ফলে তিনিও দেহের সংস্কার করেন না। যদি রাজার মৃত্যু হয়—তাঁরও মৃত্যু হবে।
বাসবদত্তা—আর্যপুত্র সুজনের হাতে পড়েছেন এটি ভাগ্যের কথা।
যৌগন্ধরায়ণ—(স্বগত) রুমন্বান্ গুরুভার বহন করছেন। আমি যে বাসবদত্তার ভার নিয়েছি তাতে তো বিশ্রাম আছে। কিন্তু রুমন্নানের কাজে কোনো বিরাম নেই। রাজা যার অধীন, সকলেই তার অধীন, একথা মানতেই হয়। (প্রকাশ্যে) রাজা কি এখন প্রকৃতিস্থ?
ব্রহ্মচারী—ঠিক বলতে পরব না। লাবাণকে তাঁর মুখে শুধু একটি বিলাপই শোনা যেত- ‘এখানে তাঁর সঙ্গে হেসেছিলাম, এখানে কথা বলেছিলাম, এখানে রাগ করেছিলাম, এখানেই একসঙ্গে বাস করেছিলাম, একসঙ্গে শুয়েছিলাম!’ যখন রাজার এই বিলাপ চলতে থাকল তখন মন্ত্রীগণ বহু চেষ্টায় তাঁকে গ্রাম থেকে নিয়ে গেছেন। রাজা চলে যাবার পর মনে হল লাবাণক নক্ষত্রহীন আকাশের মতোই শ্রীহীন—আমিও সেই গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছি।
তাপসী—এই আগন্তুক যাঁকে এত প্রশংসা করছে, নিশ্চয়ই সেই রাজা গুণবান!
চেটী—রাজপুত্রী! আপনার কি মনে হয় রাজা অন্য এক স্ত্রী গ্রহণ করবেন?
পদ্মাবতী—(স্বগত) ঠিক আমার মনের কথাই বলেছে!
ব্রহ্মচারী—আমাকে বিদায় দিন! এখন আমি যাই!
উভয়ে—আচ্ছা, আসুন; আপনার ইষ্টসিদ্ধি হোক।
ব্রহ্মচারী—তাই হোক্! (প্রস্থান)
যৌগন্ধরায়ণ—রাজপুত্রীর অনুমতি পেলে আমিও যেতে চাই।
কঞ্চুকী—(পদ্মাবতীর প্রতি) ইনি যাবার অনুমতি চান।
পদ্মাবতী—আপনি চলে গেলে আপনার ভগিনী যে উৎকণ্ঠিতা হবেন।
যৌগন্ধরায়ণ—ওকে আপনার হাতে রেখে গেলাম, উৎকণ্ঠার কারণ নেই। (কঞ্চুকীর প্রতি) আমি যাই!
কঞ্চুকী—আচ্ছা আসুন। আবার যেন দেখা হয়।
যৌগন্ধরায়ণ—তাই হোক্! (প্রস্থান)
কঞ্চুকী—এখন ভিতরে যাবার সময় হয়েছে!
পদ্মাবতী—আর্যে আপনাকে প্রণাম করি।
তাপসী—বৎসে, তুমি তোমার যোগ্য স্বামী লাভ কর।
বাসবদত্তা—আর্যে! আমিও অভিবাদন জানাই।
তাপসী—অচিরে পতির সঙ্গে মিলিত হও।
বাসবদত্তা—আমি কৃতার্থ হলাম।
কঞ্চুকী—তবে আসুন ভদ্রে, এইদিকে—এদিকে! পাখিরা কুলায় ফিরেছে, মুনিগণ স্নানে রত; উজ্জ্বল শিখায় জ্বলেছে অগ্নি, ধূমরাশি ছড়িয়ে পড়েছে তপোবনে; সূর্যদেবও মধ্যগগন থেকে সরে গিয়ে কিরণ সঙ্কুচিত করেছেন এবং রথ ফিরিয়ে অস্তাচল শিখরে অবতরণ করতে উদ্যত হয়েছেন।
[প্রথম অঙ্ক সমাপ্ত]