স্বপ্নবাসবদত্তা – পঞ্চম অঙ্ক
(পদ্মাবতীর পরিচারিকা পদ্মিনিকার প্রবেশ)
পদ্মিনিকা—মধুকরিকে! মধুকরিকে! শীগির এস!
(দ্বিতীয় পরিচারিকা মধুকরিকার প্রবেশ)
মধুকরিকা—ওগো, এই যে আমি! কী করতে হবে শুনি?
পদ্মিনিকা—কেন, তুমি কি জান না, প্রভুপত্নী পদ্মাবতী শিরঃপীড়ায় ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন?
মধুকরিকা—ওমা, তাই নাকি! কি সর্বনাশ?
পদ্মিনিকা—ওগো তুমি শিগগির যাও। আর্যা আবন্তিকাকে খবর দিয়ে এস। শুধু প্রভুপত্নীর মাথার যন্ত্রণার কথাটি বোলো, তাহলে তিনি নিজেই আসবেন।
মধুকরিকা—এসে তিনি কী করবেন?
পদ্মিনিকা—তিনি সুন্দর গল্প বলে যন্ত্রণা দূর করতে পারবেন।
মধুকরিকা—ঠিক বলেছ তুমি! কিন্তু প্রভুপত্নীর শয্যারচনা কোথায় করা হয়েছে?
পদ্মিনিকা—সমুদ্রগৃহে। তুমি এখন যাও, আমিও প্রভুকে সংবাদ দেবার জন্য আর্য বসন্তকের খোঁজ করি!
মধুকরিকা—তবে তাই হোক্।
(প্রস্থান)
পদ্মিনিকা—আর্য বসন্তককে এখন কোথায় পাই?
(বিদূষক বসন্তকের প্রবেশ)
বিদূষক—বাসবদত্তার বিয়োগে সখার যে-হৃদয় ছিল বেদনার্ত, পদ্মাবতীর সঙ্গে এই মধুর মিলনোৎসবে আজ সেখানেই জ্বলে উঠেছে কামানল! (পদ্মিনিকাকে দেখে) এ যে পদ্মিনিকা, ব্যাপার কী?
পদ্মিনিকা—আর্য বসন্তক, প্রভুপত্নী পদ্মাবতী দারুণ শিরঃপীড়ায় কাতর হয়ে পড়েছেন?
বিদূষক–ভদ্রে, আমি সত্যই জানি না।
পদ্মিনিকা—তাহলে প্রভুকে খবর দিন। আমি ততক্ষণ মাথার প্রলেপ নিয়ে আসি!
বিদূষক—যাও তুমি—আমিও সখাকে সংবাদ দিই।
প্রবেশক সমাপ্ত
(উভয়ের প্রস্থান)
(রাজার প্রবেশ)
রাজা—(স্বগত) কালক্রমে আবার পত্নীভার গ্রহণ করেছি, কিন্তু লাবাণকের সেই অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূতা গৌরবময়ী অবন্তী-রাজকন্যাকে আমি কিছুতে ভুলে থাকতে পারছি না। হিমাহতা পদ্মিনীর মতোই সে আমার স্মৃতিতে জেগে আছে!
বিদূষক—সখা, শীগগির চলে এস।
রাজা–কেন?
বিদূষক—আর্যা পদ্মাবতী মাথার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েছেন।
রাজা—কে বলেছে এ-কথা?
বিদূষক—পদ্মিনিকা বলেছে!
রাজা—কী দুঃখের কথা! রূপময়ী এবং গুণবতী প্রিয়া লাভ করে আমার পূর্বেকার দুঃখের দাহ কিছু যেন কমে গিয়েছিল। একবার দুঃখ ভোগ করেছি, পদ্মাবতীও যেন বাসবদত্তার মতোই আমার দুঃখের কারণ হয়ে উঠল। আচ্ছা, পদ্মাবতী এখন কোথায় আছেন?
বিদূষক—সমুদ্রগৃহে শয্যা রচনা করা হয়েছে।
রাজা—তাহলে পথ দেখিয়ে নিয়ে চল।
বিদূষক এস সখা, এস। (দুজনে অগ্রসর হলেন)
বিদূষক—এই যে সমুদ্রগৃহ। প্রবেশ করুন!
বিদূষক—বেশ, তবে তাই হোক! (প্রবেশ করল)
ওরে বাপরে, কী সর্বনাশ! মহারাজ, যাবেন না, একটু দাঁড়ান!
রাজা—কেন?
বিদূষক—মাটিতে একটা সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে।
(রাজা পরীক্ষা করেই হেসে উঠলেন)
রাজা—হায়রে, মূর্খের সর্পজ্ঞান! ওরে মূর্খ! গৃহের তোরণে সজ্জিত একটি সরল মালা মাটিতে খসে পড়েছে, তুমি তাকেই ভেবেছ সৰ্প! অবশ্য মৃদু বায়ুতে নড়ে- নড়ে উঠছে, অনেকটা সর্পের মতোই দেখাচ্ছে বটে!
বিদূষক–(ভালো করে দেখে) হ্যাঁ, এটা সাপ নয়, আপনি ঠিকই বলেছেন!
(ভিতরে গিয়ে চারদিক দেখে)
দেবী পদ্মাবতী এখানে এসে আবার চলে গেছেন।
রাজা—সখা, আমার মনে হচ্ছে তিনি আসেননি।
বিদূষক—কী করে জানলেন?
রাজা—জানাজানির কিছু নেই এতে। চেয়ে দেখ, শয্যা কোথাও কুঞ্চিত হয়নি, সমানভাবেই বিছানো আছে। উপরের চাদরটিও তাই! বালিশ পরিচ্ছন্ন, মাথাব্যথার ওষুধ লেগে তো মলিন হবার কথা। রোগহেতু চক্ষের আরামদায়ক কোনো শোভা করা হয়নি। তাছাড়া রোগের জন্য যে একবার শয্যার আশ্রয় নেয় সে কি অত শীগির তা ছেড়ে চলে যেতে পারে?
বিদূষক—তাহলে আপনি কিছুকাল এই শয্যায় বসে তার জন্য অপেক্ষা করুন।
রাজা—বেশ।
(রাজা শয্যায় উপবেশন করলেন)
কিন্তু সখা, আমার ঘুম পাচ্ছে—একটা গল্প বল।
বিদূষক—বেশ আমি বলছি, আপনি হুঁ দিয়ে যান—
রাজা—বেশ তাই হবে।
বিদূষক—উজ্জয়িনী নামে একটি নগরী আছে। শোনা যায়, সেখানকার ‘উদকস্নান’ অত্যন্ত বরণীয়—
রাজা—উজ্জয়িনীর কথা কেন?
বিদূষক—যদি আপনার অপছন্দ হয় তবে অন্য একটি গল্প বলি।
রাজা—সখা, এই গল্প যে অপছন্দ তা নয়। কিন্তু আমার প্রস্থানকালে অবন্তী- রাজপুত্রী যে নয়নকোণে পুঞ্জীভূত অশ্রুধারায় আমার বক্ষ প্লাবিত করেছিলেন তাই মনে পড়ে। তাছাড়া, বীণাশিক্ষার পাঠ গ্রহণের সময় আমার দিকেই চেয়ে থাকতেন বলে হাত থেকে বীণার ছড় পড়ে যেত আর তিনি খালি হাতেই শূন্যে বাজাতে থাকতেন, সেই কথাও আমার মনে পড়ে।
বিদূষক—আচ্ছা, থাক। আমি অন্য গল্প বলছি—ব্রহ্মদত্ত নামে এক নগর ছিল, সেখানকার রাজার নাম কাম্পিল্য।
রাজা—কী, কী বললে?
(বিদূষক বাক্যটি পুনঃ উচ্চারণ করল)।
রাজা—মূর্খ! বলো, রাজা ব্রহ্মদত্ত, নগর কাম্পিল্য।
বিদূষক—কী? রাজা ব্রহ্মদত্ত আর নগর কাম্পিল্য?
রাজা—হ্যাঁ।
বিদূষক—তাহলে একটু অপেক্ষা করুন, আমি ওটা মুখস্থ করে নিচ্ছি—
(বিদূষক বহুবার বাক্যটি আবৃত্তি করল)
–‘রাজা ব্রহ্মদত্ত—নগর কাম্পিল্য’। হ্যাঁ, এইবার শুনুন! আরে, আপনি যে ঘুমিয়ে পড়লেন। যাক, আমার গায়ের চাদরটা নিয়ে আসি, এখানে বড় ঠাণ্ডা!
(প্রস্থান)
(আবন্তিকা বেশধারিণী বাসবদত্তা ও চেটীর প্রবেশ)
চেটী—আসুন, আসুন। প্রভুপত্নী শিরঃপীড়ায় কাতর হয়ে পড়েছেন।
বাসবদত্তা—খুবই দুঃখের কথা। কোথায় পদ্মাবতীর শয্যা রচিত হয়েছে?
চেটী—সমুদ্রগৃহে।
বাসবদত্তা–আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চল।
(দুজনে অগ্রসর হলেন)
চেটী—এই সমুদ্রগৃহ। আপনি প্রবেশ করুন। আমি ততক্ষণ কপালের প্রলেপ নিয়ে আসছি।
(প্রস্থান)
বাসবদত্তা—(স্বগত) হায় দেবতারা কী নিষ্ঠুর! বিরহক্লিষ্ট আর্যপুত্রের বিশ্রামস্থান এই পদ্মাবতী! তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়লেন? যাই হোক, আমি প্রবেশ করি। (প্রবেশ করে চারদিক চেয়ে দেখলেন) পরিজনেরা কী অসতর্ক! অসুস্থা পদ্মাবতীর সাহায্যের জন্য একটিমাত্র দীপ রেখে সবাই চলে গেছে? এই যে পদ্মাবতী! ঘুমিয়ে পড়েছেন! এইখানে বসি। অন্য আসনে বসলে পদ্মাবতীর প্রতি আমার অনাদর প্রকাশ পাবে, আমি বিছানার ধারেই বসি। (বাসবদত্তা শয্যায় বসলেন) কিন্তু এঁর কাছে বসতে আমার হৃদয় এত উৎফুল্ল হয়ে উঠছে কেন? খুবই ভাগ্যের কথা, এঁর নিশ্বাস বেশ ধীরে এবং অবিচ্ছিন্নভাবেই পড়ছে। মনে হয়, রোগ আর নেই। শয্যার এক পাশে শুয়ে আছেন, এঁর ইঙ্গিত যেন এই—‘আমাকে আলিঙ্গন করে থাক।’ বেশ তাহলে পাশেই শুয়ে থাকি!
(বাসবদত্তা ‘পাশে শয়ন করলেন; রাজা স্বপ্ন দেখছেন—স্বপ্নের ঘোরেই বলে উঠলেন—)
রাজা—হায় বাসবদত্তা!
(চমকিতা বাসবদত্তা উঠে পড়লেন)
বাসবদত্তা—একি, আর্যপুত্র। পদ্মাবতী তো নয়! আমাকে ইনি দেখলেন না তো? তাহলে যে আর্য যৌগন্ধরায়ণের পবিত্র শপথ ব্যর্থ হয়ে যাবে!
রাজা—(স্বপ্নের ঘোরে) হায় অবন্তী রাজপুত্রী!
বাসবদত্তা—আর্যপুত্র স্বপ্ন দেখছেন, ভাগ্যের কথাই বলতে হবে। এখন আর কেউ নেই। একটু থেকে আমার চক্ষু আর হৃদয় তৃপ্ত করি!
রাজা—হায় প্রিয়ে! হায় প্রিয় শিষ্যে! আমার কথার উত্তর দাও!
বাসবদত্তা—আমি বলছি।
রাজা—তুমি কি রাগ করেছ?
বাসবদত্তা—না, না, রাগ করিনি, আমি দুঃখ পেয়েছি।
রাজা—যদি রাগ না করে থাক তাহলে অলঙ্কার পরনি কেন?
বাসবদত্তা—এর চেয়ে কাম্য আর কী হতে পারে?
রাজা—আচ্ছা, তুমি কি বিরচিকার কথা ভাবছ?
বাসবদত্তা—(সরোষে) আহ্ যাও! এখানেও বিরচিকা?
রাজা—তাহলে বিরচিকার জন্য তোমাকে প্রসন্ন করি—
(হাত বাড়ালেন)
বাসবদত্তা—(স্বগত) অনেকক্ষণ এখানে আছি, হয়তো কেউ দেখে ফেলতে পারে! তাহলে এখন যাই। ওঁর হাতখানি ঝুলে পড়েছে বিছানা থেকে, তুলে রেখে যাই।
(বাসবদত্তা হাত তুলে রাখলেন তারপর তাঁর প্রস্থান; প্রস্থান করতেই ঘুম থেকে জেগে উঠলেন রাজা)
রাজা—যেয়ো না বাসবদত্তা, দাঁড়াও! হায়, ছুটে বেরোতে গিয়ে আমিই দরজার কাঠে আহত হলাম। এটা সত্য না মনের কল্পনা? কী করে বুঝব?
(বিদূষকের প্রবেশ)
বিদূষক—এই যে আপনি জেগে উঠেছেন?
রাজা—সখে, একটি প্রিয় সংবাদ তোমাকে দিচ্ছি, বাসবদত্তা জীবিত আছেন।
বিদূষক—হায় বাসবদত্তা? কোথায় বাসবদত্তা? অনেকদিন আগেই তো তার মৃত্যু হয়েছে!
রাজা—না, সখা তা হতে পারে না। আমি ঘুমিয়েছিলাম শয্যায়, আমাকে জাগিয়ে দিয়ে তিনি চলে গেছেন। তিনি অগ্নিতে দগ্ধ হয়েছেন এই কথা প্রচার করে রুমন্বান্ আমাকে প্রতারিত করেছেন!
বিদূষক—আহ্! এটা তো অসম্ভব নয়! কিন্তু আমার কাছে উজ্জয়িনীর উদকস্নানের কথা শুনেছিলেন আপনি হয়তো তাকে স্বপ্নেই দেখে থাকবেন।
রাজা—স্বপ্ন? আমি তাহলে স্বপ্ন দেখেছি? যদি স্বপ্ন হয় তবে কেন জেগে উঠলাম? যদি ভুল হয় এ-ভুল আমার চিরকাল হোক্!
বিদূষক—সখে! এই নগরে এক যক্ষিণী থাকে, নাম অবন্তিসুন্দরী; আপনি হয়তো তাকেই স্বপ্নে দেখেছেন।
রাজা—না, না। আমি যখন জেগে উঠলাম তখন তার মুখ আমি দেখতে পেয়েছিলাম; কাজলহীন দুই চোখ! দীর্ঘ অলকে শোভিত সেই মুখ! এই দেখ বয়স্য, তিনি যে স্বপ্নে আমার বাহু নিপীড়ন করেছিলেন সেই রোমাঞ্চের চিহ্ন এখনও রয়েছে!
বিদূষক—আপনি এখন আর এইসব অনর্থ চিন্তা করবেন না। আসুন, আমরা চতুঃশালার দিকে যাই।
(কঞ্চুকীর প্রবেশ)
কঞ্চুকী—জয় হোক আর্যপুত্রের! মহারাজ দর্শক আপনাকে বলে পাঠিয়েছেন—‘আপনার মন্ত্রী রুমন্বান্ অনেক সৈন্য-সামন্ত নিয়ে আরুণিকে১৪ বধ করবার জন্য উপস্থিত হয়েছেন। আমার হস্তী, অশ্ব, পদাতিক প্রভৃতি জয়লাভের সকল উপকরণই সুসজ্জিত। সুতরাং আপনি উদ্যোগী হোন্। আপনার শত্রুদের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করা হয়েছে, আপনার গুণমুগ্ধ পুরবাসীরাও আশ্বস্ত হয়েছে শত্রুদমনের জন্য যা যা প্রয়োজন সবই আমি করেছি। গঙ্গা পার হয়ে এসেছে সৈন্যদল—বৎসদেশ এখন আপনার হস্তগত।
রাজা—(উঠে দাঁড়ালেন) বেশ! আমিও তাহলে শ্রেষ্ঠ হস্তী ও অশ্বপূর্ণ রণাঙ্গনে আরুণির বিরুদ্ধে অভিযান করে তাকে বিনাশ করব—সেই রণক্ষেত্র উৎক্ষিপ্ত এবং তীরে তীরে তরঙ্গায়িত এক মহাসমুদ্রের মতোই উদ্বেল হয়ে উঠবে ।
(সকলের প্রস্থান)
[পঞ্চম অঙ্ক সমাপ্ত]