নয়
শরৎকাল আরম্ভ হয়ে গেল। ওয়েষ্ট রুজবেকের সেই চার্চ প্যারেডের ঘটনার পরে অনেকদিন তেমন কোন খবর পাঠাতে পারিনি। হাসপাতালে যাই আসি, রুটিন মাফিক ডিউটি করি, কিন্তু আসল কাজের কিছুই হচ্ছিলো না। কোথায় কি খবর পাওয়া যায় রোজই এই কথা ভাবি। এই সময় হঠাৎ একটা সুযোগ এসে গেল আমার রুজবেক এরো ড্রামে যাবার।
সেদিন এলফন্স এসে বললো— এরোড্রোমে যাবেন, সিষ্টার? একটা চমৎকার সুযোগ এসে গেছে।
আমি আগ্রহের সঙ্গে বললাম—কি রকম সুযোগ বলুন তো?
এলফন্স বললো—রুজবেক ‘এরোড্রোম’ এর ‘মেডিক্যাল হাট থেকে কিছু জিনিসপত্র চেয়ে পাঠিয়েছে। আপনি হয়তো চেষ্টা করলে যেতে পারেন জিনিসগুলি নিয়ে।
এ সুযোগ নষ্ট হতে দিলাম না আমি। ওবার্তাজকে বললে তিনি সহজেই সম্মতি দিলেন। যথাসময়ে আমি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলাম।
এরোড্রোমের ‘মেডিক্যাল হাট’ এ গিয়ে ঢুকেই দেখতে পেলাম যে, আমার পূর্বপরিচিত ফিল্ড ওয়েবল্ সোয়েজার নিবিষ্টমনে কি যেন লিখছে টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে। আমার পায়ের শব্দ শুনে টেবিল থেকে মুখ না তুলেই খেঁকিয়ে উঠলো সে “আমি না বারণ করেছি যে এ সময় কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে” 1 এই বলে ও মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়েই হঠাৎ গলার স্বরকে একেবারে পরিবর্তিত করে অতি মোলায়েম সুরে বললো—এ-কি ফ্রাউলিন, আপনি? কি সৌভাগ্য! আমি ভেবেছিলাম… যাকগে, হাসপাতাল থেকে জিনিসপত্র নিয়ে কি আপনিই এসেছেন নাকি?
আমি হেসে বললাম—সে রকমই তো মনে হচ্ছে।
ও তখন আমাকে বসতে অনুরোধ করলো ওর পাশের এক খানা চেয়ার দেখিয়ে। আমি বসতেই শুরু হয়ে গেল ওর বক্কানি। গল্পের যেন আর শেষ নেই ওর! এ কথা ও কথা বলতে বলতে হঠাৎ ও বলে বলো—যুদ্ধ খতম হতে আর বেশী দেরী নেই ফ্রাউলিন।
আমি বললাম—সে কি! সন্ধির কথা হচ্ছে নাকি?
আপনি দেখছি কিছুই জানেন না। সন্ধি হতে যাবে কিসের দুঃখে? যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে মানে আমাদের চূড়ান্ত জয়লাভের দিন এগিয়ে এসেছে।
-কি করে বুঝলেন? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
ও বললো—আমাদের “ম্যাথি” এবার ইংরেজদের এমন শিক্ষা দেবে যে যুদ্ধের সাধ চিরদিনের মত মিটে যাবে বাছাধনদের।
-”ম্যাথি” কে? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
–কি আশ্চর্য! আপনি গ্রেট ম্যাথির নাম শোনেন নি? ম্যাথি হচ্ছে আমাদের ‘জ্যাপিলীন লিডার।’
একটু দম নিয়ে ও আবার বললো—’পয়লা অক্টোবর,’ হ্যাঁ, তারিখটা পয়লা অক্টোবরই ঠিক হয়েছে; ঐ দিন লণ্ডন শহরের উপরে যে জ্যাপিলীন আক্রমণ হবে তার ফলে গোটা লণ্ডন শহরের —বুঝতে পারলেন ফ্রাউলিন—একেবারে ধূলো!—এই বলে হাতে একটা তুড়ি মেরে ও আবার বললো—ঐ দিন এগারখানা জ্যাপিলীন আক্রমণ চালাবে। দু’খানা “বাজ” থেকে আর বাকিগুলো যাবে ‘ফাদারল্যাণ্ড’ থেকে। এবারের বড়দিনের আগেই আমরা বাড়ী ফিরে যাবো। এই পর্যন্ত বলেই হঠাৎ কি ভেবে ও চুপ করে গেল। বললো—এই দ্যাখো, যতসব বাজে কথা বলে আপনার সময় নষ্ট করছি আমি। আপনি একটু কাছে এসে বসুন না।
আমি বললাম—এই তো বেশ আছি।
সোয়েজার যেন হঠাৎ বদলে গেল একেবারে। ও ওর চেয়ার খান। টেনে এনে আমার একেবারে কাছে ঘেঁসে বসে বললো— সে কি হয় সুন্দরী! এতদিন পরে আজ যখন তোমাকে হাতের কাছে পেয়েছি, সুযোগ ছেড়ে দেবো এত বোকা আমি নই।
আমি কিছু বলবার আগেই ও চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে উঠে আমাকে একেবারে জাপটে ধরে চেয়ার থেকে টেনে তুলে ফেললো। আমি প্রাণপণে বাধা দিতে চেষ্টা করতে লাগলাম কিন্তু ও যেন ক্ষেপে গিয়েছিল তখন। ও আমাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গিয়ে একখানা ষ্ট্রেচারের উপরে চিৎ করে ফেলে আমার বুকের উপরে চেপে শুয়ে পড়লো। ওর দেহে যেন অস্থরের মত শক্তি এসে গেছে তখন। আমাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে অন্য হাত দিয়ে আমার স্কার্ট’এর বোতাম খুলে ফেলতে চেষ্টা করতে লাগলো ও।
উপায়ান্তর না দেখে আমি তখন প্রাণপণে চীৎকার করে উঠলাম
হঠাৎ দরজা খুলে একজন অফিসার সেই ঘরে ঢুকলো সেই সময়। আমাদের ঐ অবস্থায় দেখে গর্জন করে উঠলো সে-
“এসব কি হচ্ছে এখানে?”
অফিসারের গলা শুনেই সোয়েজার আমাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
অফিসারটি চীৎকার করে হুকুম করলো—
—’এ্যাটেনশান্’!
সোজা হয়ে ‘এ্যাটেনশান’ হয়ে দাঁড়াতেই অফিসারটি জিজ্ঞাসা করলো—কি করছিলে তুমি এই মেয়েটার সঙ্গে? ডিউটিতে কোন লোক নেই কেন?
হঠাৎ আমার দিকে নজর পড়তেই সে বলে উঠলো– ‘গুড লাক্’! ফ্রাউলিন আপনি?
আমি বললাম হাসপাতাল থেকে সাপ্লাই নিয়ে এসে আমার এই দশা হের লেফ্যান্ট!
অফিসারটি বললো আপনি আমার সঙ্গে আসুন। সোয়েজারের দিকে তাকিয়ে সে আবার বললো—কালই তোমার নামে রিপোর্ট করছি আমি। তোমার যাতে উচিৎ শাস্তি হয় সে আমি দেখবো।
সেই লেফট্ওন্যাণ্টের সঙ্গেও আমার হাসপাতালেই পরিচয়। লোকটা নাকি সুদক্ষ পাইলট। একবার সাংঘাতিক আহত হয়ে প্রায় মাসখানেক হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল ওকে। তখন থেকেই আমাদের পরিচয়।
চলতে চলতে লেফট্ন্যাণ্ট বললো—অনেকদিন পর আপনার সঙ্গে দেখা! তা এসেছেন যখন আমার ওখানে ডিনার-এর নিমন্ত্রণ আপনার।
আমি বললাম—ডিনারে অবশ্য আপত্তি নেই তবে বেশীক্ষণ দেরী করতে পারব না আমি।
ও বললো—আচ্ছা তাই হবে।
চলতে চলতে রাস্তার একদিকে লাইনবন্দী কতকগুলো ছোট প্লেন দেখতে পেয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম এগুলো কি জাতীয় প্লেন লেফট্ন্যাণ্ট?
ও বললো—এগুলো এক নূতন ধরণের “বাই-প্লেন। “ সবেমাত্র কারখানা থেকে এসেছে, এখনও গ্যারাজে তোলবার সময় পাইনি। কমাণ্ডান্ট—এগুলোর চালচলন জানতে চেয়েছেন আমার কাছে? আমি এইমাত্র এগুলোর সম্বন্ধে আমার রিপোর্ট লেখা শেষ করে বাইরে বেরিয়েছিলাম। বেশ ভালই হয়েছে প্লেনগুলো। এই রকম ছোট্ট আর দ্রুতগামী প্লেন আমাদের ছিল না বলেই ইংরেজরা এতদিন খুব ফুটফাট করেছে, এইবারে আমরাও লাল ঘুঘু দেখাবো ওদের।
কথা বলতে বলতে ওর কামরায় এসে ঢুকলাম।
ও বললো—ডিনারের নিমন্ত্রণ তো করলাম আপনাকে, কিন্তু কি যে খাওয়াবো তাই ভাবছি। সব জিনিসেরই অভাব এখানে। তবুও দেখছি কতদূর কি করা যায়।
একজন ব্যাটম্যানকে ডেকে দু’জনের ডিনারের ব্যবস্থা করে দিতে হুকুম করলো ও।
ডিনার টেবিলে বসে ও মদের গ্লাসটাকে আমার দিকে উঁচু করে ধরে বললো—আপনার স্বাস্থ্য পান করছি ফ্রাউলিন! এই পাণ্ডববর্জিত এরোড্রোমেও যে আপনার মত সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বসে ডিনার করতে পাবো এ কথা স্বপ্নেও ভাবি নি।
টেবিলের উপরে দুখানা ঠিকানা লেখা খাম দেখে আমি বললাম—ওগুলো পাঠালেন না?
–ও পাঠালেই চলবে এক সময়। বিশেষ কিছু জরুরী নয় ওগুলো, একটা আমার মঞ্জুর হয়ে যাওয়া ছুটির দরখাস্ত আর একটা ঐ বাই-প্লেনের রিপোর্ট।
—আপনি বুঝি ছুটিতে যাচ্ছেন? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
—হ্যাঁ। ছুটি অনেকদিন আগেই পাওনা হয়েছিল। আজই দরখাস্ত মঞ্জুর হয়ে এসেছে। তবে যেতে এখনও কয়েকদিন দেরী হবে কারণ “পয়লা অক্টোবর” “ম্যাথির” সঙ্গে একবার লণ্ডন যেতে হবে আমাকে। একটু খানি খেল দেখাতে হবে ঐ দিন।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম—ছুটির দরখাস্ত যখন মঞ্জুর হয়ে এসেছে তখন আবার কোথায় পাঠাচ্ছেন ওখানা?
ও বললো—আমাদের যা কিছু খবর সবই ব্রিগেড মেজরের অফিসে পাঠাতে হয়। কেউ ছুটিতে থাকলে ও কোন্ অফিসার কোথায় যাবে, কতদিনের ছুটি, এ সবই ব্রিগেড মেজরের জানা থাকার নিয়ম।
আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে ‘ষ্টিফেন’ আছে ব্রিগেড মেজরের অফিসে। ভাবলাম যে, ঐ ছুটির দরখাস্তের বদলে যদি কোনক্রমে এরোপ্লেনের রিপোর্টটা ওখানে পাঠানো যায় তা হলে ষ্টিফেনকে দিয়ে সহজেই রিপোর্টখানা হাত করা যায় হয়তো! যদি একটু ঘরের বাইরে যায় তাহলে আমি সেই সুযোগে চিঠি দু’খানি বদলাবদলি করে রাখতে পারি।
সুযোগও এসে গেল। ব্যাটম্যানকে কি একটা কথা বলতে লেফ্টন্যান্ট উঠে ঘরের বাইরে চলে গেল। আমিও এই সুযোগে চিঠিখানা বদলাবদলি করে রেখে দিলাম।
ও ফিরে এসে খেতে খেতে গল্প শুরু করে দিল।
খাওয়া শেষ হতেই ও হঠাৎ উঠে গিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এলো।
আমি বললাম—ও কি! দরজা বন্ধ করলেন যে?
ও বললো—তাতে কি হয়েছে?
-হয় নি কিছু, তবে কিছুক্ষণ আগেই সোয়েজারের ব্যাপারটা ঘটেছে কি না, তাই!
ও বললো—সোয়েজার! ও তো একটা শুয়োরমুখো ইডিয়ট। তাছাড়া ঐ ইডিয়টটার হাত থেকে আমিই আজ আপনাকে বাঁচিয়েছি; ঠিক কি না?
আমি বললাম—তা তো ঠিকই।
ও হঠাৎ আমার একখানা হাত ধরে ফেলে বললো—কিন্তু ফ্রাউলিন, আমাদের দুজনের মিলনে বাধা কি? আজকের দিনটিকে আমার জীবনে স্মরণীয় করে রাখতে চাই আমি।
—কি ফ্যাসাদ! যেখানেই যাই ঐ একই ব্যাপার। নাঃ জ্বালালে দেখছি!
বললাম—কি ছেলেমানুষী করছেন হের লেফট্ন্যান্ট—ছিঃ!
ছিঃ কেন প্রিয়া! আমার সাধ আজ মিটাতেই হবে তোমাকে।
এই বলে ও হঠাৎ উঠে এসে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে— কপালের উপরে একটা চুমো দিয়ে ফেললো।
আমি এই সময় লক্ষ্য করলাম যে ঘরের চাবিটা ওর চেয়ারের পায়ার কাছে মেঝের উপরে পড়ে আছে। বোধ হয় পকেটে রাখবার সময় পড়ে গিয়ে থাকবে। আমি আস্তে আস্তে পা দিয়ে চাবিটাকে টেনে এনে চট্ করে তুলে নিয়েই ছুট্ দিলাম দরজার দিকে। দরজা খুলে বাইরে গিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বললাম – কেমন জব্দ? এরপর কোন বান্ধবীর সঙ্গে ডিনারে বসলে ঘরের চাবি যেখানে সেখানে ফেলে রাখবেন না হের লেফট্ন্যান্ট! চাবিটা আমি সেন্ট্রি’র কাছে জমা দিয়ে আপনার গুণের কথা সব বলে দিয়ে যাচ্ছি, কেমন?
ঘরের ভেতর থেকে ও তখন অনুনয় শুরু করেছে—খুলে দিন ফ্রাউলিন! দয়া করে খুলে দিন।
আমি বললাম—আর এ রকম করবেন না তো?
ও বললো—আবার? খুব শিক্ষা হয়ে গেছে আমার।
আমি দরজা খুলে দিতেই ও বাইরে এসে বলল—খুব বোকা বানিয়েছ আমাকে।
আমি বললাম—নিজের দোষেই বোকা বনেছেন আপনি।
ও বললো—সত্যি আমারি দোষ ফ্রাউলিন। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।
চলতে চলতে আমি বললাম—বিদায় বন্ধু!
পরদিনই আমি “পয়লা অক্টোবর”এর সেই সম্ভাব্য জ্যাপিলীন আক্রমণের খবরটা পাঠিয়ে দিলাম।
ছুদিন পরে ষ্টিফেনের মারফৎ সেই বাইপ্লেনের রিপোর্টটারও নকল পেয়ে গেলাম আমি। ওটাকেও আমি পাঠিয়ে দিলাম সঙ্গে সঙ্গেই।
ঐ রিপোর্টে ‘পপারিংগি’ আক্রমণের জন্য যে দিনটা ধার্য করা হয়েছিল সে খবরও ছিল। যে রাত্রে সেই আক্রমণ হবার কথা ছিল সেই রাত্রেই ব্রিটিশ এয়ারক্রাফট থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বিমান রুজবেক এরোড্রোম আক্রমণ করতে এলো। ওদের হয়তো আসতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল, তাই আকাশেই দেখা হয়ে গেল দুই দলের এরোপ্লেনগুলির। রুলার্স সহরের ঠিক উপরেই চললো দুই পক্ষের বিমান যুদ্ধ। সে এক ভয়ানক যুদ্ধ। ‘এন্টি এয়ারক্রাফট’ কামান থেকে গুলীও ছুড়তে পারছিল না জার্মাণরা নিজেদের বিমানে লেগে যাবার ভয়ে।
দু’খানা ব্রিটিশ বিমান আর দুখানা জার্মাণ বাইপ্লেন ধ্বংস হলো সেই যুদ্ধে! আমার সেই লেফটন্যান্ট বন্ধুর জীবনও ঐ যুদ্ধেই অবসান হয়ে গেল। ছুটিতে যাওয়া আর ঘটে উঠলো না তার।
[নিচের ১১৬ নং পাতাটির বাম দিকের কিছু অংশ মিসিং]
সেই পয়লা অক্টোবর। সন্ধ্যার আগেই
র বিকট আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেল। উপরের দিকে
খতে পেলাম যে মেঘের উপর দিয়ে উড়ে চলেছে
পিলীনগুলো। হয়তো সোয়েজারের কথামত এগার
পলীন সমবেতভাবে আক্রমণ চালাবে আজ লণ্ডনের
হয়তো ‘ম্যাথি’ চলেছে ঐ জ্যাপিলীন বাহিনীর
!
আক্রমণের ফলাফল কি হয়েছিল তা আমি এক বৎসর
তে পারি নি। পরে অবশ্য শুনেছিলাম যে, প্ৰসিদ্ধ
লীডার ‘ম্যাথি’ সেই যুদ্ধেই নিহত হয়েছিল। ইতিহাস
যে ঐ দিন লণ্ডন সহরকে রক্ষা করতে ইংরেজরা কি
ব্যবস্থার আয়োজন করেছিল। ঐ বিশেষ রাতটাতেই
কর লেফটন্যান্ট টেম্পেষ্ট ‘এল ৩১’ নম্বরের জ্যাপিলীনখানা
রের উপরে গুলী করে নামিয়ে ফেলেছিল। ঐ ভাবেই
ক অসীমসাহসী বৈমানিকের জীবনাবসান হয়েছিল।
স’এর আকাশে সেই বিমানযুদ্ধের কয়েকদিন পরের
দিন এলফন্স এসে আমাকে বলল—সেই যে আপনি
ডাম্প’ উড়িয়ে দেবার কথা বলেছিলেন না! সেটা
ম্ভব হবে।
করে? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
ন্স বললো—আপনি হয়তো জানেন না যে অনেক দিন
টা ‘হাই এক্সপ্লোসিভ’ বোমা পড়েছিল ‘হাসপাতাল
এর ভেতরে। ঐ বোমার আঘাতে একটা বিরাট গর্তের
***
সৃষ্টি হয়েছিল। গর্তটা দেখে আমরা সবাই তখন খুব আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম, কারণ গর্তটা মাটির নীচের একটা সুড়ঙ্গের সঙ্গে মিশেছিল। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি যে, গ্যাস আক্রমণের সময় সিভিলিয়ান ক্লিনিকের জন্য যে কাঠের ঘরটা তৈরী হয়েছিল, ঐ ঘরের ঠিক নীচেই রয়েছে সেই গর্তটা।
—কিন্তু তার সঙ্গে এ্যামুনিশন ডাম্পের সম্বন্ধ কি?
এলফন্স বললো—শুনুনই আগে সবটা! কয়েকদিন আগে লাইব্রেরীতে আমি রুলার্সের একখানা পুরোনো ইতিহাসের বই পাই। ঐ বইয়ের শেষের দিকে টাউন প্ল্যান আঁকা একখানা নক্সাও ছিল। নক্সাটায় মাটির নীচের ঐ সুড়ঙ্গটি এঁকে দেখান আছে। আমি বিশেষভাবে লক্ষ্য করে দেখেছি যে, বর্তমানে যেখানে ঐ এ্যামুনিশন ডাম্পটা হয়েছে, ওর ঠিক নীচে দিয়েই গেছে সেই সুড়ঙ্গটা।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম—এখন তাহলে কি করতে চান?
এলফন্স বললো—আমি এর মধ্যেই কিছু যন্ত্রপাতি জোগাড় করে ঐ ঘরে রেখে এসেছি। এই বলে একটু হেসে এলফন্স আবার বলল—আমার এ মাসের মাইনের প্রায় সব টাকাই খরচ হয়ে গেছে ঐ সব জিনিষপত্র কিনতে 1
আমি বললাম—সে তো হলো, কিন্তু ঐ সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে কতটা পথ গেলে যে ডাম্পের তলায় যাবো তা বুঝবো কি করে? এমনও তো হ’তে পারে যে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে আমরা একেবারে সেন্ট্রি দের পাহারা দেবার জায়গায় উঠে পড়েছি!
এলফন্স বললো—হতে তো অনেক কিছুই পারে। এমনকি আমরা টাউন কমাণ্ডাণ্টের অফিসের
অফিসের ভেতরও গিয়ে উঠতে পারি। কিন্তু আমরা যদি সাবধান হয়ে কাজ করি তাহলে কোন বিপদই হবে না।
—কি করে?
-মনে করুন আমরা যদি আগে থেকেই মেপে ঠিক করে নিলাম ঐ কাঠের ঘর থেকে এ্যামুনিশন ডাম্পের দূরত্ব। পরে একগাছা দড়ি মেপে ঠিক করে নিয়ে সেই দড়ি ধরে সুড়ঙ্গ পথে মাপ করতে করতে গেলে আমার মনে হয় যে আমরা ঠিক জায়গা মতই যেতে পারবো। মনে করুন আমাদের তিন ‘কিলোমিটার’ দূরে যেতে হবে আমাদের দড়িগাছা যদি একশো ‘মিটার’ লম্বা হয় তাহলে ত্রিশ বার ঐ দড়ির মাপ ধরে এগিয়ে গেলেই তিন কিলোমিটার দূরত্বে পৌঁছাতে পারবো। যাকগে ও সব কথা—এখন আপনার মত কি তাই বলুন।
আমি বললাম—আমি রাজী আছি। কবে কাজ করতে চান বলুন!
এলফন্স বললো—তাহলে আর দেরী করে লাভ কি! কাল রাত্রেই কাজ হাসিল করা যাক্। আপনি রাত ঠিক ন’টার সময় ঐ কাঠের ঘরে আসবেন। আমি আগেই ওখানে যাবো। যা কিছু জোগাড় করা দরকার সে সবও আমিই করে রেখে দেবো। আপনি শুধু ডিনামাইট ষ্টিক দুটো সঙ্গে নিয়ে আসবেন আসবার সময়।
বলতে ভুলে গেছি, এডমণ্ডের সেই ডিনামাইট ষ্টিক দুটোর কথা আমি এলফন্সকে জানিয়েছিলাম একবার।
.
পরদিন রাত ন’টা বাজতেই আমি অন্যের অলক্ষ্যে হাসপাতালের পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে সেই কাঠের ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। দেখতে পেলাম যে, এলফন্স তখন জানালার – সার্সিগুলোতে আঠা দিয়ে কাগজ আঁটতে ব্যস্ত!
—এ কি হচ্ছে?
এলফন্স বললো—ঘরে আলো জ্বাললে যাতে বাইরে থেকে কেউ দেখতে না পায় তার ব্যবস্থা করছি।
এরপর একখানা শাবল-এর সাহায্যে ঘরের মেঝের দু’য়ানা তক্তা তুলে ফেললাম আমরা কিছুক্ষণের চেষ্টাতেই। ঐ ফাঁক দিয়ে লাফিয়ে মাটিতে নেমে পড়ে, অল্প একটু খুঁজতেই গর্তটা পেয়ে গেলাম আমরা। এলফন্স আগে থেকেই তক্তা আর পেরেক জোগাড় করে রেখেছিল। সেই তক্তা দিরে আমরা একটা সিড়ির মত তৈরী করে সেটাকে নামিয়ে দিলাম গর্তের ভেতরে। আমরা তখন টর্চলাইট, ছেনি হাতুড়ি, ডিনামাইট ষ্টিক, ফিউজ আর দড়ি নিয়ে নেমে পড়লাম সেই সুড়ঙ্গের ভেতরে।
সুড়ঙ্গের ভেতরটায় অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে ছিল। টর্চ জ্বেলে দেখলাম যে সুড়ঙ্গটি বহুদিন তৈরী হলেও ওর গাঁথুনিটা তখনও বেশ মজবুত। তবে বহুদিন ধরে ময়লা জমে আর গাঁথুনি চুইয়ে জল এসে নীচেটা ভয়ানক পিচ্ছিল হয়ে আছে। ময়লা আর ঝুল লেগে অমাদের পোষাক পরিচ্ছদ সব নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু সে দিকে লক্ষ্য করবার মত সময় তখন আমাদের ছিলনা। দড়ি মেপে মেপে আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম। অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে কত কি থাকতে পারে— সাপখোপ থাকাও বিচিত্র নয়।
বহু টিকটিকি সপরিবারে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিল ঐ সুড়ঙ্গের মধ্যে। হঠাৎ আমাদের শব্দ পেয়ে ছুটে পালাতে লাগলো সেগুলো। দু’চারটে আমাদের গায়েও পড়তে লাগলো পালাতে গিয়ে।
এলফন্সের মনের অবস্থা তথন কেমন হয়েছিল জানি না কিন্তু আমার বুকের ভেতরে যেন ক্রমাগত হাতুড়ীর ঘা পড়ছিল।
.
কিছুক্ষণ এই ভাবে চলবার পর এলফন্স বললো—থামুন! এসে গেছি আমরা।
আমি দাঁড়াতেই ও বললো—আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি সিঁড়িটা নিয়ে আসছি।
এই বলেই আমাকে সেই অন্ধকারে দাঁড় করিয়ে রেখে ও গেল সিঁড়িটা নিয়ে আসতে। আমি তখন একা সেই নিঃশব্দ পাতালপুরীর ভয়াবহ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সিঁড়িটা টানতে টানতে নিয়ে এলো এলফন্স। ওটাকে ভাল করে তলায় আর উপরে লাগিয়ে দিয়ে হাতুড়ী আর ছেনি নিয়ে এলফন্স উঠে গিয়ে গাঁথুনি কাটতে আরম্ভ করলো। কয়েকটা ঘা দিতেই একটা বড় চাঙড় খসে পড়লো উপর থেকে। আমি চট্ করে সরে না গেলে আমার মাথার উপরেই পড়তো চাঙড়টা। ওটা পড়তেই লক্ষ্য করলাম যে উপরে বেশ একটা গর্তের মত হয়ে গেছে।
এলফন্স তখন নেমে এসে বললো–আপনার শরীর হাল্কা আছে, ঐ গর্ত দিয়ে উপরে উঠে দেখুন আমরা কোথায় এসেছি।
আমি তখন সিঁড়ি বেয়ে উঠে সেই গর্ত দিয়ে মাথা গলিয়ে দেখতে পেলাম যে একটা ঘরের মেঝের এক কোণে রয়েছে গর্তটা। মাথা নীচু করে এলফন্সকে ডেকে ফিস্ ফিস্ করে বললাম—ঠিক জায়গা মতই এসেছি মনে হচ্ছে। আমি উপরে উঠছি ‘ডিনামাইট’ ফিট্ করতে।
ঘরের মধ্যে উঠে দেখতে পেলাম বহু পিপে, টিন আর প্যাকিং কেস গাদা করা ঘরময়। কোথায় ডিনামাইট ফিট্ করা যায় দেখতে গিয়ে হঠাৎ অসাবধানে আমার পা লেগে একটা খালি টিন উল্টে পড়ে গেল। ঝন্ ঝন্ করে শব্দ হ’তেই ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম আমি। এই বুঝি ধরা পড়লাম। আমি তৎক্ষণাৎ সেই গর্তের ভেতরে নেমে পড়ে মাথাটা উপরে রেখে দেখতে লাগলাম কেহ আসে কিনা।
একটু পরেই দুজন সেন্ট্রি রাইফেল বাগিয়ে ধরে ঘরে ঢুকে বলে উঠলো—কে এখানে?
কোন উত্তর না পেয়ে একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে একজন বললো—ড্রামটা হয়তো এমনিতে উল্টে গেছে—ঠিক মত রাখা হয়েছিল না বোধ হয়।
তার সঙ্গীটি বললো—তাই হবে চলো।
ওরা চলে যেতেই আমি আবার উঠে পড়লাম। এবারে কিন্তু বিশেষ সাবধান হলাম আমি। একটা বারুদ বোঝাই বাক্সের ঢাকনি তুলে ‘ডিনামাইট ষ্টিক’ দুটো তার মধ্যে গুঁজে দিয়ে ‘ফিউজ’ তারের কয়েলটা গর্তের মধ্যে ফেলে দিলাম আমি। ফিউজটা খুব বেশী লম্বা ছিল ন!। কিন্তু কি করা যায়! ওতেই কাজ চালাতে হবে তো! আমি নেমে এলে এলফন্স হাতুড়ী, শাবল, আর সিঁড়িটাকে টেনে নিয়ে দূরে রেখে এসে বললো—আপনি দূরে চলে যান, আমি ফিউজ’এ আগুন দিয়ে এখনই আসছি।
বোধ হয় দু’শো গজ মত গিয়েছি, এই সময় দেখতে পেলাম যে এলফন্স টর্চ জ্বেলে ছুটতে ছুটতে আসছে।
হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে আমাদের পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠলো। আমরা দুজনে তখন প্রাণপণে ছুটছি। ছুটতে ছুটতেই শুনতে পেলাম আর একবার বিস্ফোরণের আওয়াজ। এর পরেই শুরু হলো ক্রমাগত বিস্ফোরণ। আমাদের ভয় হ’তে লাগলো এই বুঝি সুড়ঙ্গ ভেঙ্গে পড়ে।
আমরা যখন সেই কাঠের ঘরে ফিরে এলাম তখন দেখতে পেলাম যে, সহরের ভেতরে যেন বাজী পোড়ানোর উৎসব চলছে। ‘এ্যামুনিশন ডাম্প’টা তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে। তাড়াতাড়ি জামাকাপড় বদলে যন্ত্রপাতিগুলো আর ময়লা জামাকাপড়গুলো সুড়ঙ্গের মধ্যে ফেলে দিয়ে ঘরের মেঝের তক্তা দুখানা আবার লাগিয়ে ফেললাম আমরা। বাইরে আসবার আগে সার্সির কাগজগুলোও তুলে ফেলে দিয়ে এলাম।
অনেক রাত্রে বাড়ীতে এসে স্নান করতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম যে আমার “সোনার রিষ্টওয়াচটা” খোয়া গেছে।
আমি খেতে বসলে মা বললেন—কি হয়েছে মার্থা? আমি চুপি চুপি বললাম— ‘এ্যামুনিশন ডাম্প’ উড়ে গেছে আজ।
মা বললেন—এ কাজ নিশ্চয়ই কোন বেলজিয়ানের?
আমি বললাম—তা তো বটেই, তবে সেই বেলজিয়ানদের মধ্যে তোমার মেয়েও একজন।