স্পাই মেয়ে – ৪

চার

সেদিন হাসপাতালে ফিরে এসে আমি এতই অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম যে ডিউটি-সার্জেন দু’ দু’বার আমার কাজের খুঁত ধরলেন।

ওবার্তাজ বললেন—অত্যধিক পরিশ্রম করে তোমার শরীরটা হয়তো আজ ভাল নেই! তুমি বরং এক ডোজ মিকশ্চার তৈরি করে খেয়ে নাও!

ওবার্তাজ-এর কাছে ছুটি নিয়ে সেদিন একটু তাড়াতাড়িই বাড়ী ফিরে গেলাম। বাড়ীতে গিয়ে আমি একখানা কাগজে সাংকেতিক ভাষায় ঐ স্পেশাল ট্রেনের সব খবর লিখে ফেললাম! তারপর একট, অন্ধকার হতেই সে কাগজখানা নিয়ে তেষট্টি নম্বরের হাতে পৌঁছে দিতে চললাম আমি।

“এরপর কি হবে?” এই চিন্তাই তখন আমার কাছে সব চেয়ে বড় হয়ে উঠলো।

খবরটা পৌঁছে দিয়ে বাড়ীতে ফিরেই দেখি আমাদের দরজার সামনে একজন মিলিটারী পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখেই আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার উপক্রম!

“ওরা কি তাহলে জানতে পেরেছে আমার কীর্তিকলাপ?

“এখনই কি আমাকে গ্রেপ্তার করবে?

“কাল সকালেই হয়তো আমাকে দাঁড়াতে হবে ‘ফায়ারিং স্কোয়ার্ড’ এর সামনে! “

“ফ্রাউলিন নোকার্ট!”

লোকটার মুখে আমার নাম শুনেই আমার হাত পা যেন অবশ হয়ে এলো।

ও আবার বললো—তোমাকে এখনই আমার সঙ্গে আমাদের অফিসারের কাছে যেতে হবে।

আমার মনে হলো “এই আমার শেষ,” মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হ’লো না আমার। কলের পুতুলের মত আমি চলতে লাগলাম লোকটার সঙ্গে সঙ্গে।

ও আমাকে সঙ্গে করে মিলিটারী পুলিশের দপ্তরে নিয়ে গিয়ে একজন অফিসারের সামনে হাজির করলো।

অফিসারটি আমার দিকে একবার তাকিয়ে দেখে বললো- বসুন ফ্ৰাউলিন!

নিঃশব্দে একখানা চেয়ারে বসে পড়লাম আমি।

আমি বসবার পর কোন ভূমিকা না করেই অফিসারটি জিজ্ঞাসা করলো—লাসেল ডেলডস্ক কোথায়?

আমি চুপ করে রইলাম।

অফিসারটি বললো—চুপ করে থেকে লাভ নেই ফ্ৰাউলিন নোকার্ট! আমরা জানতে পেরেছি লাসেল আপনাদের পরিবারের একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু। সে এখানে এসেছিল এবং আপনাদের সঙ্গে দেখা করেছিল এ খবরও আমরা জানি। বলুন সে কোথায়?

আমি বললাম——লাসেল কোথায় আছে আমি তার কিছুই জানি না। যুদ্ধ যখন আরম্ভ হয় সেই সময় ওয়েষ্ট রুজবেক থেকেই লাসেল নিরুদ্দেশ। আমাদের ধারণা ছিল যে লাসেল বেঁচে নেই কিন্তু আজই প্রথম আপনার কাছে শুনছি যে, সে বেঁচে আছে।

অফিসারটি বললো—লাসেল যে স্পাই এ খবর আপনি তাহলে জানেন না বলতে চান?

—লাসেল স্পাই! আমি যেন একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম এই রকম ভাব দেখিয়ে বললাম—নাঃ! এ অসম্ভব! লাসেলের মত একজন অৰ্দ্ধশিক্ষিত স্ত্রীলোক স্পাই হয়েছে একথা বিশ্বাস হয় না।

অফিসারটি বললো—সে যে স্পাই এ খবর আপনি জানেন না বলছেন?

আমি বললাম—লাসেল কখনও স্পাই’য়ের ঘৃণ্য কাজ করবেনা, নিশ্চয়ই আপনাদের লোক ভুল শুনেছে।

একটু হেসে পুলিশ অফিসারটি—বললো—আমরা ভুল শুনিনি ফ্রাউলিন! যাই হোক, আপনাকে এই রাত্রে ডেকে এনে কষ্ট দিলাম বলে আমি দুঃখিত। আপনাকে আমাদের দরকার নেই, আমরা চাই লাসেলকে, আচ্ছা, আপনি তা’হলে যেতে পারেন।

আমার মাথার উপর থেকে যেন ঘাতকের উদ্যত খাঁড়া নেমে গেল।

সে রাত্রিতে আর আমার ভালো ঘুম হলো না।

পরদিন সময়মতই আমি হাসপাতালে গেলাম বটে কিন্তু কাজে মনোযোগ দিতে পারলাম না। প্রায়ই কাজে ভুল হতে লাগলো আমার।

ওবার্তাজ বললেন আজকের দিনটা তুমি বরং বিশ্রাম নাও। যে রকম পরিশ্রম করছো তাতে বিশ্রাম নেওয়া দরকার তোমার।

একটু সকাল করেই হাসপাতাল থেকে বাড়ী ফিরলাম সেদিন। তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়লাম। রাত তিনটে পর্যন্ত আমাকে জেগে থাকতেই হবে!

দশটা! এগারটা!! বারটা!!!

ক্রমে একটাও বেজে গেল।

আমাকে বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে দেখে মা বললেন—তোমার কি হয়েছে মার্থা? ঘুমোচ্ছো না কেন?

আমি বললাম—ঘুম পাচ্ছে না মা! রাত দুটো বাজলো।

এই সময় একটু তন্দ্রার মত আসতে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে চোখে-মুখে জল দিয়ে এলাম।

এখন ঘুক এলে কিছুতেই চলবে না।

মাঝে মাঝে ট্রেন আসা যাওয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি।

রাত তিনটে বাজলো—

এইবার হয়তো স্পেশাল ট্রেনখানা আসবে!

উত্তেজনায় বুকের মধ্যে টিপ্ টিপ, করতে লাগল আমার।

কিন্তু ঘুমে চোখ বুজে আসতে চায় যে!

বোধ হয় একটু ঘুমিয়েই পড়েছিলাম।

হঠাৎ মায়ের ডাক শুনে ঘুম ভেঙে গেল—

আমাকে ধাক্কা দিয়ে মা বললেন—শীগগীর সেলারে চলো মার্থা, বিমান আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে!

বিছানার উপরে উঠে বসলাম আমি। মাকে বললাম বিমান আক্রমণ দেখবে বসো!সেলারে যাবার দরকার হবে না।

‘এ্যান্টিএয়ারক্র্যাফট্ গান’গুলে। গর্জে উঠলো। রূপোর ছুরীর ফলার মত সার্চলাইটের তীব্র রশ্মিগুলো কালো আকাশের বুক চিরে এদিক ওদিক করতে লাগলো। একটু পরেই আকাশে এরোপ্লেনের আওয়াজ শুনতে পেলাম।

একটা বোমা ফাটলো।

নিশ্চয় ঠিকমত ফেলতে পারে নি!

অনেকগুলো বাড়ীর ছাদ থেকে মেসিনগানের গুলীবৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল।

এরোপ্লেনখানা চিলের মত ছোঁ মেরে নীচে নেমে আসছে-

একি! মাত্র একখানি এরোপ্লেন পাঠিয়েছে ওরা!

কি ভেবেছে ওরা? মূর্খের দল!

.

-”গুড়ূম—গুড়ূম! হাই এক্সপ্লোসিভ বোমা ফাটবার শব্দ। এরপর একটুখানি নিস্তব্ধতা। . কিন্তু তারপরেই যা আরম্ভ হ’লো সে এক অভাবনীয় ব্যাপার। হাজার বজ্র নির্ঘোষের মত ষ্টেশনের দিক থেকে বিস্ফোরণ আর সেল ফাটবার শব্দ আসতে লাগলো। আকাশ লাল হয়ে উঠলো, আগুনের শিখার আলোয়। আমাদের বাড়ীখানা কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো, প্রত্যেকবার বিষ্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে।

এই সময় হঠাৎ নজরে পড়লো যে ব্রিটিশ এরোপ্লেনখানা লেজের দিক দিয়ে আগুন ছাড়তে ছাড়তে উল্কার মত বেগে মাটির দিকে ছুটে আসছে। ভয়ানক শব্দ করে এরোপ্লেনখানা ষ্টেশনের কিছু দূরে এসে ছিট্‌কে পড়ে চুরমার হয়ে গেল।

বেচারা পাইলট! ও হয়তো জানে না যে ওর মৃত্যুর কারণ একমাত্র আমি—আমি মার্থা নোকার্ট।

ষ্টেশনের সেই প্রেমিক অফিসারটির কথা মনে হলো। ওর জীবনে সেই সাধের “শুক্রবার” আর কখনও আসবে না!

হঠাৎ কান্নায় বুক ভরে উঠলো আমার। বালিশে মুখ গুঁজে হু হু করে কেঁদে উঠলাম আমি। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলেন—কি হয়েছে মাথা?

ধরা গলায় বললাম—এতগুলো মানুষ আজ আমারই জন্য মারা গেল মা!

এই ঘটনার পর থেকেই শহরে আরম্ভ হলো ত্রাসের রাজত্ব। তৎপর হয়ে উঠলো জার্মাণ মিলিটারী পুলিশ আর বার্লিন ভ্যামপায়ারের দল। মোড়ে মোড়ে বহু রকম প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কারো পক্ষেই পথ চলা সম্ভব হতো না। আমি সব সময়ই এক অজ্ঞাত আশঙ্কায় ভীত হয়ে থাকতাম। আমার অবস্থা দেখে ওবার্তাজ আমাকে কয়েকদিন বাড়ীতে বিশ্রাম নিতে উপদেশ দিলেন। কিন্তু আমি ভেবে দেখলাম যে, বাড়ীতে একা একা থাকার চাইতে কাজের মধ্যে ডুবে থাকা বরং ভাল। আমার সেই সময়কার মানসিক অবস্থায় একা থাকা মোটেই নিরাপদ নয় বলে মনে হলো আমার।

ওবার্তাজকে জানালাম যে ও কিছু নয়, সামান্য একট খানি শারীরিক দুর্বলতা, দুদিনেই ঠিক হয়ে যাবে; এর জন্য ছুটির দরকার হবে না আমার।

এই সময় একদিন বিকালবেলা কি একটা কাজে আমি ওবার্তাজের অফিসের সামনে যেতেই শুনতে পেলাম, তিনি কাকে যেন বলছেন—”তিন নম্বর এ্যাডভান্স ড্রেসিং ষ্টেশনের সার্জেন আহত হয়েছেন শুনে দুঃখিত, কিন্তু এখান থেকে পাঠাবার মত তো কেউ নেই এখন! এখানকার দু’জন ডাক্তার–’ওয়ারেজ’ আর ‘ন্যাগল’ আজ সকালেই আট নম্বর হাসপাতালে চলে গেছে। ডক্টর সার্দারম্যানের নিউমোনিয়া হয়েছে। এখানে এখন আমি ছাড়া আর কোন ডাক্তারই নেই, কিন্তু আমার পক্ষেতো আর হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়!”

অন্য একজন “লোককে বলতে শুনলাম—”একজন আণ্ডার- অফিসারও কি দিতে পারেন না, ডাক্তার না আসা পর্যন্ত ঠেকা আজ চালাতে? ওবার্তাজ বলছেন শুনলাম—”আণ্ডার অফিসার ভাল ড্রেসার হ’তে পারে কিন্তু ডাক্তারী শাস্ত্রে ওর তো কোন জ্ঞানই নেই। তাছাড়া কোন অপারেশন দরকার হলেও ওর দ্বারা হবে না।”

এইসব কথাবার্তা শুনেই বুঝতে পারলাম যে, তিন নম্বর এ্যাডভান্স ড্রেসিং ষ্টেশনে তখনই একজন ডাক্তার বা অন্ততঃপক্ষে ডাক্তারী শাস্ত্রে কিছুটা জ্ঞানসম্পন্ন একজন লোকের দরকার। এই সুযোগ নিতে পারলে একেবারে যুদ্ধ ক্ষেত্রের ঠিক পেছনে যাওয়া যেতে পারে—হয়তো অনেক দামী খবরও যোগাড় করা যায় ওখানে যেতে পারলে!

আমি তখন কালবিলম্ব না করে ওবার্তাজ এর ঘরে ঢুকে বললাম আমি এখানে আসবার সময় আপনাদের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পেরেছি যে, তিন নম্বর এ্যাভান্স ড্রেসিং ষ্টেশনে একজন ডাক্তার এখনই দরকার। আমি যেতে রাজী আছি ওখানে। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী হিসাবে ডাক্তারী শাস্ত্রেও কিছুটা জ্ঞান আমার আছে, সুতরাং ডাক্তার না আসা পর্যন্ত আমি ঠিকই কাজ চালিয়ে নিতে পারবো।

ওবার্তাজ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন- এ হ’তে পারে না! কিছুতেই হ’তে পারে না। হাজার হলেও তুমি স্ত্রীলোক।

আমি বললাম—তাতে কি হয়েছে? সেখানে এই রকম ‘এমার্জেন্সী’ ব্যাপার আর আমিও যখন স্বেচ্ছায় যেতে চাচ্ছি, এতে আমি মেয়ে বলে কি আসে যায়?

ওবার্তাজ বললেন—কিন্তু এ্যাভান্স ড্রেসিং ষ্টেশন কাকে বলে জানো?

আমি বললাম—’ওয়েষ্ট রুজবেক’ এ কাজ করবার সময় সে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। আপনার হুকুম পেলেই আমি ওখানে যেতে প্রস্তুত।

ওবার্তাজ—তোমাকে কি বলে ধন্যবাদ দেবো জানি না। স্বেচ্ছায় যে বিপদ তুমি আজ মাথায় তুলে নিলে, এর কথা আমি উচ্চ কর্তৃপক্ষকে জানাবো।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমি একটা লম্বা ‘মিলিটারী গ্রেটকোট’ পরে তৈরী হয়ে এম্বুলেন্সে উঠে বসলাম।

এম্বুলেন্স চলতে লাগলো যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে।

কামানের আওয়াজ ক্রমশঃ নিকটবর্তী হ’তে লাগলো। আমাদের গাড়ী থেকে একটু দূরেই একটা শেল ফাটলো প্রচণ্ড শব্দে। ড্রাইভার হেসে বললো—শত্রুর গোলা আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে ফ্রাউলিন!

আরও একটু যেতেই দেখতে পেলাম একখানা কাঠের ফলকে লেখা—”৩নং এ্যাভান্স ড্রেসিং ষ্টেশন—এই দিকে!”

ড্রাইভার গাড়ী থামিয়ে বললো—আমরা এসে গেছি ফ্রাউলিন। ষ্টেশনের ‘মেডিক্যাল ফিল্ডওয়েবল’ এসে শুভেচ্ছা জানিয়ে বললেন—রুলার্স হাসপাতাল থেকে হের ওবার্তাজ টেলিফোনে আপনার আসবার কথা জানিয়েছেন আমাকে। কিন্তু এ একটা নরক, তবুও দেখছি কি করতে পারি আপনার জন্য।

ক্যাম্পের ভিতরের অবস্থা দেখে শিউরে উঠলাম। চারটি মৃতদেহকে ওভার কোট চাপা দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে মেঝের এক কোণে। সেই মৃতদেহগুলির পাশেই বসে তিনজন আদালী নিশ্চিন্ত মনে ধূমপান করেছে। একজন ব্রিটিশ সৈনিক বুকে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা অবস্থায় মেঝের উপর পড়ে আছে, আর তার পাশেই মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধা একজন জার্মাণ সৈনিক কাত হয়ে আছে।

ফিল্ডওয়েবল একটা প্যাকিং বাক্স আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন—একটু বিশ্রাম করে নিন ফ্রাউলিন! হয়তো এখনই আমাদের কাজ আরম্ভ করতে হবে।

আমি বসলে ফিল্ডওয়েবল আবার বললেন—আসুন! এখনই বরং কিছু খেয়ে নেওয়া যাক! পরে হয়তো আর সময়ই পাওয়া যাবে না। এই বলে এক টুকরো রুটি আর খানিকটা শুকনো মাংস একখানা প্লেটে করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে আর একখানা প্লেটে নিজে নিয়ে একজন আর্দালীকে বললেন দুই মগ চা আনতে।

এই অপরূপ খানা দেখেই আমার খিদে কোথায় পালিয়ে গিয়েছিলো।

আমি বললাম—ধন্যবাদ! আমার এখন মোটেই খিদে নেই।

একটু হেসে সেই রুটি আর মাংস মুখে তুলতে তুলতে ফিল্ড- ওয়েবল বললেন, কিছু খেয়ে নিলে ভালই করতেন….

তার কথা শেষ হবার আগেই বাইরে অনেক লোকের জুতোর শব্দ শোনা গেলে তিনি বললেন—আর যেতে হবে না! এসে গেছে ওরা।

দেখতে দেখতে আহত সৈনিকে ভরতি হয়ে গেল ঘরখানা। একজনের অবস্থা দেখলাম খুবই খারাপ–হয়ত ‘এমপুটেশন’ করতে হবে।

লোকটাকে টেবিলের উপর শুইয়ে দিতেই আর একজন চীৎকার করে উঠলো—শীগগির ‘মরফিয়া’ দাও—সহ্য হচ্ছে না আর এই যন্ত্রণা!

লোকটা মরফিয়ার কথা বলতেই চারদিক থেকে চীৎকার উঠলো—মরফিয়া চাই। আমরাও মরফিয়া চাই!

মরফিয়া আছে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই ফিল্ডওয়েবল চুপি চুপি বললেন—কোথায় পাব এতো মরফিয়া! সবাইকে মরফিয়া দিতে গেলে তো ট্যাঙ্ক ভরতি মরফিয়া দরকার। আমাকে এই কথা বললেন বটে কিন্তু পরক্ষণেই দেখি যে তিনি একটি হাইপো-ডারমিক সিরিঞ্জ নিয়ে একটি বোতল থেকে খানিকটা তরল পদার্থ ভরতি করে এলোপাথারি সবাইকে ইনজেকসন করে চলেছেন। বোতলের উপরে লেবেল আঁটা—”মরফিয়া”।

ইনজেকসন দেবার সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেল সবাই।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম—কি ইন্‌জেকসন দিলেন?

ফিল্ডওয়েবল বললো—”ডিসটিল্ড ওয়াটার!”

কি ভাবে যে সেই রাত্রে কাজ করেছিলাম সে কথা আজও মনে আছে আমার। অপারেশনের পর অপারেশন—এ ছাড়া এমপুটেসনও করতে হয়েছিল কয়েকটা কেস। সত্যিকারের অপারেশন বা এমপুটেসন যে কোনদিন নিজে হাতে করতে হবে এ ধারণাও আমার ছিল না। ছুরি, কাঁচি আর অপারেশনের অন্যান্য যন্ত্রপাতিগুলো ষ্টেরিলাইজ করাতো দূরের কথা ভাল করে পরিষ্কার করাও হয় নাই। সে যেন এক আসুরিক চিকিৎসা।

ফিল্ডওয়েবল এক গ্লাস মদ এনে আমাকে দিয়ে বললেন- সাদা চোখে এ কাজ করা সম্ভব নয়। এতো চিকিৎসা নয়, এ হচ্ছে কসাইখানার কাজ।

নেশার ঘোরে কাজ করে চলেছিলাম। চারিদিকে শেল ফাটবার শব্দ। যে কোন সময় ড্রেসিং ষ্টেশনটি উড়ে যেতে পারে। সে এক অভাবনীয় অনুভূতি। কাজ করতে করতে সত্যিই প্রচণ্ড ক্ষিদে পেয়ে গেল আমার। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম কেন ফিল্ডওয়েবল সেই রুটি আর শুঁটকে মাংস খেয়ে নিতে বলেছিলেন আমাকে। তখন খেয়ে নিলে ভালই করতাম।

সারারাত এইভাবে কাজ করে পরদিন সকালে আহতদের এম্বুলেন্স-এ বোঝাই করে বেলা প্রায় ন’টার সময় আমি ও একজন অফিসার হাসপাতালে ফিরে চললাম। কালকের সেই ড্রাইভারও ওখানেই ছিল সেই রাত্রে। সে-ই চালাতে লাগলো গাড়ী।

কামানের গোলা এসে পড়ছে—ডাইনে, বাঁয়ে, সামনে ও পিছনে, আর সেই গোলাবৃষ্টির ভিতর দিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ী। হঠাৎ একটা প্রচণ্ড আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গাড়ীখানা উল্টে পড়লো রাস্তার পাশের ড্রেনের ভিতর। মুহূর্তের মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম আমি।

এম্বুলেন্সের ড্রাইভারের নাম ছিল ‘এলফন্স’ (পরে এর আরও পরিচয় পাবেন)। লোকটা জাতিতে এ্যালসেসিয়ান। এলফন্স আমাকে টেনে তুলে বসিয়ে দিল। ষ্ট্রেচার কুলীদের একজন মারা গেছে শুনলাম। গাড়ীখানা ভেঙে গিয়েছিল সুতরাং রাস্তার ধারে বসে থাকা ছাড়া আর কোন উপায়ই ছিল না আমাদের।

কিছুক্ষণ পরে একদল সৈন্যকে মার্চ করে আসতে দেখলাম। আমাদের অবস্থা দেখে ব্যাটালিয়নের এডজুট্যান্ট তখনই একজন সাইক্লিষ্টকে পাঠালেন হাসপাতালে খবর দিতে।

রাত প্রায় আটটার সময় হাসপাতাল থেকে আর একখানা এম্বুলেন্স এসে আমাদের তুলে নিলো। আমার বাঁ হাতে ভীষণ আঘাত লেগেছিল! রক্তে ভেসে যাচ্ছিলো আমার বাঁ-হাতখানা। হাসপাতালে গিয়ে ভাল করে ড্রেসিং করবার পর কিছুটা আরাম বোধ করলাম।

এই সময় হঠাৎ দু’জন মিলিটারী পুলিশ একজন মরণাপন্ন লোককে হাসপাতালে নিয়ে এলো। লোকটার গলার অর্দ্ধেকের বেশী কাটা। কোন ধারাল অস্ত্রের দ্বারা আঘাত করা হয়েছে বলে মনে হলো আমার। বেচারার মৃত্যুর আর বেশী দেরী ছিল না। নাইট সার্জেনকে খবর পাঠিয়ে দিলাম; তিনি না আসা পর্যন্ত ওর ভার আমাকেই নিতে হলো। লোকটাকে ধরে শুইয়ে দিতে চেষ্টা করতেই ওর কোটের কলারের ভাঁজটা উল্টে গেল। আমি সবিষ্ময়ে লক্ষ্য করলাম যে সেখানে দুটো সেপটিপিন—কিন্তু পিন দুটো গুণচিহ্নের মত নয়।

মার্চের মাঝামাঝি আমাদের আর্থিক কিছুটা অবস্থার উন্নতি হবার সুযোগ এসে গেল। রুলারস এ ‘ক্যরিলন কাফে’ নামে একটা রেস্তোঁরা আর আবাসিক হোটেল ছিল। এ কাফের মালিক রুলারস ছেড়ে চলে যাওয়া ঠিক করে একরকম মাটির দরেই ওটা বিক্রী করে দেয় বাবার কাছে।

‘কাফে’টার অবস্থিতিও ছিল অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। পাশেই ছিল একটা উঁচু গীর্জা। তাছাড়া গীর্জাটি যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে থাকায় গোলার আঘাতে ধ্বংস হবার ভয়ও ছিল কম।

‘কাফে’টা হাতে আসায় আরও অনেক কিছু সুবিধা হয়েছিল আমাদের। ঘরের অভাবে বাবা এতদিন ইচ্ছা থাকলেও আমাদের কাছে এসে থাকতে পারছিলেন না। ওটা হাতে আসবার সঙ্গে সঙ্গেই সে অসুবিধা আর থাকলো না। মালিকের বসবাসের জন্য একটা আলাদা ফ্ল্যাটও ছিল ‘কাফে’র সঙ্গে। আমরা তাই আর কালবিলম্ব না করে ওখানে চলে এলাম।

কাজের জন্য নূতন দুটি মেয়েকেও রাখা হলো।

আমার নিজের কাজের পক্ষেও ‘কাফে’টা বেশ খানিকটা সুযোগ এনে দিয়েছিল। আমার মনে হলো যে ওখানে যে সব জার্মাণ অফিসার খানাপিনা করতে আসবে আমি যদি তাদের উপরে নজর রাখি তাহলে মদের মুখে ওদের মুখ থেকে অনেক গোপন কথা নিশ্চয়ই শুনতে পাবো। আমার অসুবিধাও যে ছিল না তা নয়। ওখানে যারা আসবে তাদের মধ্যে জার্মাণ মিলিটারী পুলিশ আর গোয়েন্দাও নিশ্চয়ই থাকবে। আমি মালিকের মেয়ে বলে ওদের বিশেষ দৃষ্টি আমার উপরে পড়বেই। এতে আমার গোপন কাজের পক্ষে বেশ কিছুটা অসুবিধা হবে বলে মনে হয়েছিল আমার।

যা ভয় করেছিলাম হ’লও তাই। সেদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতেই খবর পেলাম যে—তিনজন জার্মাণ অফিসার কাল থেকে উপরের ঘরগুলোতে থাকবে—বলে গেছে!

‘না’ বলবার উপায় ছিল না, কারণ ঘর খালি থাকতেও জার্মাণ অফিসারদের থাকতে না দিলে তার ফল মোটেই ভাল হতো না।

.

পরদিনই ওরা এসে গেল! ওদের মধ্যে একজনের বয়স ছিল খুবই অল্প—দেখতে কলেজের ছাত্রের মত। চেহারাও বেশ। তাছাড়াও কথাবার্তা চালচলন সব কিছুতেই সে ছিল ফিফা আর কেতাদুরস্ত। ব্যবহারও ছিল তার অত্যন্ত মার্জিত ও ভদ্র। সুযোগ পেলেই ও আমার সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা করতো।

একদিন গল্প করতে করতে ও আমাকে বললো যে যুদ্ধের আগে ও ‘প্যারী’ থেকে কলেজে পড়তো। বেলজিয়ামেরও অনেক জায়গা সে ঘুরছে। যুদ্ধের বীভৎসতা আর দেশের অবস্থার কথা খুবই দরদ দিয়েই বর্ণনা করতো ও। ওর দরদী মনের পরিচয় পেয়ে আমিও কিছু আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম ওর দিকে। কথায় কথায় ও সেদিন আমাকে বলে বসলো যে জার্মাণদের চরম বিজয়ের দিন নাকি আসন্ন।

বোকা সেজে প্রশ্ন করলাম আমি—জয় যে হবেই এতটা দৃঢ়নিশ্চয় কি করে হলেন আপনারা?

ও বললো—আপনি দেখে নেবেন ফ্রাউলিন! আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমার কথার সত্যাসত্য বুঝতে পারবেন আপনি।

অন্য অফিসার দু’জন এই সময় হঠাৎ ওখানে এসে পড়ায় গল্পে বাধা পড়লো আমাদের। আমি তখন ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলাম বটে, কিন্তু মনটা ভারী হয়ে থাকলো খবরটা বের করতে না পেরে।

পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে এ্যাডভান্স ড্রেসিং ষ্টেশনে কাজ করবার সময় ওখানে একজন ইংরেজ সৈন্যকে দেখেছিলাম আহত অবস্থায়। ঐ রকম দু’জন ইংরেজ সৈন্য আমাদের হাসপাতালেও ছিল তখন। “ওদের পালাবার সহায়তা করা যায় কিনা” এই চিন্তাটা আমার মনে এসেছিল অনেকবার। যে দু’জন ইংরেজ সৈন্য তখন আমাদের হাসপাতালে ছিল তাদের একজনের নাম ‘জিমি’ আর একজনের নাম ‘আর্থার’।

আমি দেখলাম যে, ওদের যদি কিছু পথ খরচার টাকা আর অসামরিক পোষাক জোগাড় করে দেওয়া যায় তাহলে সহজেই ওরা হাসপাতাল থেকে পালিয়ে হল্যাণ্ড সীমান্ত পৌঁছে নিরাপদ হতে পারে। আমি তখন গোপনে কিছু টাকা আর দু’জনের মত পোষাক জোগাড় করে একদিন ওদের পাশের ঘরের টেবিলের নীচে পোটলা করে রেখে ওদের ওয়ার্ডে গিয়ে আর্থারকে জিজ্ঞাসা ক’রলাম—কেমন বোধ হচ্ছে আজ?

এই কথা বলেই চুপি চুপি ওকে জানালাম—”পাশের ঘরে টেবিলের তলায় দু’জনের মত পোষাক আর কিছু টাকা আছে, সুবিধামত সদ্ব্যবহার করো। হল্যাণ্ড সীমান্ত এখান থেকে বেশী দূরে নয়।”

চুপি চুপি এই কথা ক’টা বলে তখনই আবার বললাম— আজ তাহলে ভালই আছো? বেশ, বেশ! শীগগিরই ভাল হয়ে যাবে।

আমার ডিউটি শেষ হয়ে এসেছিলো। ওয়ার্ড থেকে বাইরে এসে ঘড়ি দেখলাম—পৌনে ছ’টা। ছ’টায় আমার ডিউটি শেষ হবে।

একখানা মাসিক পত্রিকা পড়তে চেষ্টা করলাম। কিন্তু পত্রিকার ছাপানো অক্ষরগুলো আমার চোখের সামনে কেমন যেন ঝাপসা মনে হ’তে লাগলো।

রাত বোধ হয় তখন আটটা। হঠাৎ হাসপাতালের ‘এলার্ম বেল বেজে উঠলো। চারদিকে ছুটাছুটি আর চীৎকার। আমি ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে ওয়ার্ডের দিকে যেতেই একজন সার্জেন্ট বলে উঠলো—দু’জন ব্রিটিশ সৈন্য তোমার ওয়ার্ড থেকে পালিয়ে গেল! এ কি ব্যাপার নার্স?

—আমি তা কি করে জানবো? আশ্চর্য হয়ে বললাম আমি–আমার ডিউটি তো ছ’টায় শেষ হয়ে গেছে। পৌনে ছটায় আমি ওয়ার্ডে গিয়েছিলাম। তখনও আমি দেখে এসেছি ওরা শুয়ে আছে।

এরপর আর আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করলো না সার্জেন্ট।

রাত্রে বাড়ী ফিরে এসে দেখি যে আমাদের বসবার ঘরে দু’জন লোক বসে আছে। কাছে গিয়ে দেখি ওরা দু’জনেই আমার পরিচিত। শুধু পরিচিত বললেও ঠিক বলা হয় না—ওরা দুজনেই আমার সহকর্মী—এলফন্স আর ষ্টিফেন।

এলফন্সএর কথা আগেও একবার বলেছি। তিন নম্বর এ্যাডভান্স ড্রেসিং ষ্টেশনে যাবার সময় এলফন্সই ছিল আমাদের এম্বুলেন্সের ড্রাইভার।

ওদের ঐসময় ওখানে দেখে কিছুটা আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম আমি—কি ব্যাপার! আবার হাসপাতালে যেতে হবে নাকি?

ভয়ও পেয়েছিলাম বেশ! ওরা কি তাহলে ইংরাজ সৈন্যদের পালাবার ব্যাপারটা জানতে পেরেছে নাকি?

ষ্টিফেন বললো—হঠাৎ ছুরীতে আমার আঙ্গুল কেটে গেছে। তাই এলফন্স বললো যে, চলো নার্সের ওখানে ব্যাণ্ডেজ করিয়ে আনা যাক।

আমি বললাম—বেশ তো! আমি এখনই ব্যাণ্ডেজ করে দিচ্ছি।

মুখে এ’কথা বললাম বটে কিন্তু মনে মনে ভাবলাম যে সামান্য একটু খানি ছুরীর কাটা, সে তে| এলফন্স নিজেই ব্যাণ্ডেজ করতে পারতে।। আমার সন্দেহ আরও ঘনীভূত হ’য়ে উঠলো।

—কোথায় কেটেছে দেখি? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

ষ্টিফেন হঠাৎ বলে বসলো-আপনার দু’মুখো কাজ বেশ ভালই চলছে তাহলে? কি বলেন ‘সিষ্টার’?

ভয়ানক ঘাবড়ে গেলাম আমি ওর এই কথায়। কিন্তু পরক্ষণেই আমার সব ভয় আনন্দে রূপান্তরিত হয়ে গেল যখন ওকে বলতে শুনলাম “ব্যাণ্ডেজ” বাঁধতে সেফটিপিন দরকার হবে তো সিষ্টার?’

আনন্দের আতিশয্যে বুকের মধ্যে টিপ টিপ করে উঠলো আমার।

বললাম—সেফটিপিন আছে আপনার সঙ্গে?

“দেখি পাই কিনা।” বলে ষ্টিফেন ওর কোটের কলারটা উল্টে ধরলে। দেখতে পেলাম—দুটি সেফটিপিন গুণচিহ্নের মত করে আঁটা।

একটু হেসে আমিও আমার ইউনিফর্মের একটা বোতাম খুলে ভাঁজটা উল্টিয়ে দেখালাম! এলফন্সও।

এলফন্স বললো—তাহলে দেখা যাচ্ছে আমরা সবাই একই পথের পথিক।

আমি বললাম—কিন্তু আমার খবর কার কাছে পেলেন আপনারা?

—ক্যান্টিনের সার্জেন্ট মেজর আমাদের বলেছেন আপনার কথা—বললো এলফন্স।

—কী সর্বনাশ! ঐ জার্মাণটা আমার…

আমার কথায় বাধা দিয়ে এলফন্স বললো—উনি জাৰ্মাণ নন। যুদ্ধের আগে উনি ইংলণ্ডে স্যাণ্ডহার্ষ্ট মিলিটারী কলেজের একজন ক্যাডেট্‌ ছিলেন। যুদ্ধের আগেই জার্মাণীতে আসেন। তারপর..

আমি বললাম—কিন্তু আমার খবর ইনি জানলেন কি করে?

—সেই কথাই তো বলছি। এলফন্স বলে চললো——গতকাল পর্যন্তও উনি ছিলেন আমাদের খবর পাঠাবার ‘মিডিয়াম’ কিন্তু দুখের বিষয় যে আজই উনি বদলি হয়ে চলে যাচ্ছেন। যাবার আগে উনিই আমাদের বলে যান যে, এরপর থেকে আমাদের কোন খবর থাকলে তা ‘লুরা’র হাতে হবে। তারপর যখন জানতে পারলাম যে আমাদের ‘সিষ্টারই হচ্ছেন এই ‘লুরা’ তখন আর দেরী না করে সোজা এলাম।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম—কিছু আছে নাকি পাঠাবার মত?

ষ্টিফেন বললো—সে কথা পরে হচ্ছে; এর আগে আমি জিজ্ঞাসা করছি, আপনাদের এখানে “অটোভন প্রমট” বলে কোন লোক থাকে কি না?

অটোভন হচ্ছে সেই মার্জিতরুচি জার্মাণ যুবকটি—যার কথা এর আগেও বলেছি।

আমি বললাম—-কেন বলুন তো?

ষ্টিফেন—থাকে কিনা বলুন না।

বললাম—হ্যাঁ।

—ওকে কি রকম মনে হয় আপনার? ওকে পছন্দ করেন কি আপনি?

নিতান্ত ব্যক্তিগত এই প্রশ্নে একটু বিরক্তই হই আমি।

আমি বললাম—পছন্দ অপছন্দের কথা ওঠে না। তবে লোকটা ভাল বলেই আমার ধারণা।

—কিন্তু ঐ ভাল লোকটির কাছ থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করবেন সিষ্টার। লোকটা জার্মাণ সিক্রেট সার্ভিসের একজন এজেণ্ট।

ভয়ানক ঘাবড়ে গেলাম আমি এই কথা শুনে। বললাম— বলেন কি! ওরা কি তাহলে আমাকেও সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছে?

এলফন্স বললো–আপনাকে কেন, প্রত্যেক বেলজিয়ানকেই ওরা সন্দেহের চোখে দেখে।

ষ্টিফেন বললো—শুনুন সিষ্টার, সেন্সার অফিসে চাকরির সুযোগে আমি মাঝে মাঝে জার্মাণদের কিছু কিছু চিঠিপত্র পড়ে দেখবার সুযোগ পাই। কিছুদিন আগে অটোভনের এই রকম একখানা চিঠি পড়ে দেখবার সুযোগ হয়েছিল আমার। ও ওর মাকে লিখেছিল যে, “কোন একটা বিশেষ দায়িত্বপূর্ণ কাজের ভার নিয়ে ও এখানে আছে।” ওর এই বিশেষ দায়িত্বপূর্ণ কাজটা যে কি আপনাকে সেই খবরটা বের করতেই হবে।

আমি বললাম—খবর জানিয়ে আপনি আমার বিশেষ উপকার করলেন। এর জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ দিচ্ছি আপনাকে!

ষ্টিফেন বললো—বেশ, এইবার তাহলে অন্য কাজের কথা হোক।

এই বলেই একখানা ছোট্ট ভাঁজ করা কাগজ বের করে আমার হাতে গুঁজে দিয়ে চুপি চুপি বললো – আজই পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন এটাকে।

কাগজখানি চুলের মধ্যে রাখতে রাখতে আমি বললাম—আজ রাত্রেই যাবে।

এরপরই ওরা আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে আমি ঐ কাগজখানা যথারীতি তেষট্টি নম্বরের সেই নির্দিষ্ট জানালায় পৌঁছে দিয়ে এলাম।

এই ঘটনার কয়েকদিন পরে ‘ক্যান্টিন মা’ একদিন আমাকে বলে গেল যে, জার্মাণরা সবাই মত্ত হয়ে উঠছে একটা বিরাট জয়ের আশায়। কিন্তু কিসের জন্য ওদের আশা বহু চেষ্টাতেও সে খবর জানতে পারে নাই সে।

ষ্টিফেনের কাছে খবর পেলাম যে, ‘রিচম্যান’ নামে যে লোকটা আমাদের কাফেতে থাকে সে নাকি প্রায়ই আবহাওয়া আর বায়ু প্রবহনের গতি সম্বন্ধে গ্রাফ আর রিপোর্ট পাঠাচ্ছে নিয়মিত ভাবে।

রিচম্যান সম্বন্ধে খবরাখবর নিয়ে জানতে পারলাম যে লোকটা বৈজ্ঞানিক। যুদ্ধের আগে সে ছিল কোন কলেজের কেমিষ্ট্রির অধ্যাপক। যে সব সাময়িক পত্রিকা আসতো তার নামে, সেগুলির সবই ছিল বৈজ্ঞানিক পত্রিকা।

সব ব্যাপার মিলিয়ে আমার কেমন যেন সন্দেহজনক বলে মনে হ’লো! খবরটা আমি তেষট্টি নম্বরের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। তিনদিন পরে ক্যান্টিন মা’র হাত দিয়ে উত্তর পেলাম —

“আবহাওয়ার রিপোর্ট নিয়ে ব্যস্ত হবার দরকার নেই। সৈন্যদলের গতিবিধি, ট্রেন চলাচল বা ঐ জাতীয় কার্যকরী খবর দিতে চেষ্টা করবেন।“

ওরা তাহলে আমাকে ‘মাথাখারাপ’ মনে করেছে?

এর দু’দিন পরেই এলফন্স খবর দিল যে কয়েকদিন যাবৎ হাজার হাজার ‘ক্লোরিন’ লেবেল দেওয়া লোহার ‘সিলিণ্ডার’ এনে জমা করা হচ্ছে ‘সাপ্লাই ডিপো’তে।

একদিকে কেমিষ্ট্রির অধ্যাপক ও আবহাওয়ার ‘রিপোর্ট’ আর অন্যদিকে ক্লোরিন! ব্যাপারটা কেমন যেন রহস্যজনক মনে হ’লো আমার। লাসেলের সেই কথা মনে হ’লো—”তোমার কাছে যে সংবাদ নিতান্ত অকেজো মনে হ’বে মনে রেখো তারও অসামান্য সামরিক মুল্য থাকতে পারে।” ওরা যাই মনে করুক—আমি আবার খবর পাঠালাম এই ব্যাপারটা জানিয়ে।

ঠিক তিনদিন পরে আবার উত্তর এলো—

“এরকম অনুমান সাপেক্ষ খবর না দিয়ে কাজের খবর দিতে চেষ্টা করুন।”

এই উত্তর পাবার পর ওবিষয়ে আর কোন খবর আমি নিতে বা পাঠাতে চেষ্টা করলাম না।

এপ্রিল মাস পড়তেই লক্ষ্য করলাম যে আমাদের হাসপাতালে হঠাৎ কেন যেন বিশেষ ব্যবস্থা আরম্ভ হয়ে গেল।

উপর থেকে হুকুম এসেছে যে একমাত্র সিরিয়াস কেস ছাড়া অন্য সব রুগীকেই অন্যত্র সরিয়ে দিতে হবে। অসামরিক রুগীদের জন্যও আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে। কয়েকদিনের মধ্যেই টাউনের ভিতর আর একটা সামরিক হাসপাতাল খোলা হলো অসামরিক লোকদের জন্য।

এই খবরটাও আমি ‘তেষট্টি নম্বর’ এর হাতে দিয়ে এলাম।

একটা ব্যাপারে কিন্তু আমি বিশেষ রকমে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ব্যাপারটা এই যে, এতো যেখানে তোড়জোড়, উদ্যোগ আয়োজন, হাসপাতালে নয়া ব্যবস্থা, সেখানে এক কোম্পানী সৈন্যও তো বেশী আমদানী হচ্ছে না, বা সাধারণতঃ যা আসে তার চেয়ে বেশী গোলা বারুদও আসছে না?

কিছুতেই এ সমস্যার সমাধান করতে পারছিলাম না আমি।

তেইশে এপ্রিল ১৯১৫ সন। সেদিনের কথা আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে। হাসপাতাল থেকে জরুরী খবর পেয়ে ছুটে গেলাম। হাসপাতালে ঢুকতেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম আমি।

সে কি হৃদয়বিদারক দৃশ্য!

দলে দলে ফরাসী বন্দীরা আসছে।

ওদের চোখ দিয়ে অবিরত জল পড়ছে। হাত মুখ ফুলে ঢোল হয়ে উঠেছে ওদের। বন্দীর যেন আর শেষ নেই। আসছে তো আসছেই। শত শত হাজার হাজার।

গ্যাস আক্রমণ চালিয়েছে জার্মাণরা

এতোদিনে আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল ঐ বায়ু, প্রবহনের রিপোর্ট, কেমিষ্ট্রির অধ্যাপকের গ্রাফ, আর ক্লোরিন ভরতি সিলিণ্ডারের গুপ্ত রহস্য।

কিন্তু ওরা কি করলো! আমার কাছে সময় মত খবর পেয়েও মুর্খের দল কিছুই বুঝতে পারলো না! উল্টো আমাকেই পাগল মনে করে ধমকানি দিলে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *