স্পাই মেয়ে – ৩

তিন

এখন থেকে আমি পুরোদস্তুর “স্পাই”। সব সময়ই আমি লক্ষ্য করতে চেষ্টা করি কাজের খবর কিছু পাওয়া যায় কিনা! কিন্তু তেমন কিছু আমার নজরেই পড়ে না যার খবর আমি পাঠাতে পারি “তেষট্টি নম্বর” এর হাত দিয়ে।

এই ভাবে কয়েকটা দিন কেটে যেতেই একটা ব্যাপার আমার কাছে কেমন যেন আশ্চর্য মনে হলো। প্রত্যেক সপ্তাহেই দেখতাম যে, সপ্তাহের একটা বিশেষ দিনে সহরের ট্রামগাড়ীগুলো খুব তৎপর হয়ে ওঠে। সারা সপ্তাহ ধরে ট্রামগুলি কেবল যাত্রী নেওয়া-আনার কাজই করতে। কিন্তু ঐদিনটিতে দেখতাম যে প্রায় বার ঘণ্টা ধরে ট্রামগাড়ীগুলো যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম আর গোলাগুলী এনে সাপ্লাই ডিপোতে পৌঁছে দেয়।

এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করবার পর আমি ষ্টেশানে ট্রেন চলাচলের দিকে দৃষ্টি রাখতে আরম্ভ করলাম। কয়েকদিন লক্ষ্য করেই জানতে পারলাম যে ট্রামগুলির কর্মতৎপরতার সঙ্গে একখানা স্পেশাল ট্রেন আসবার যোগাযোগ আছে। ঐ স্পেশাল ট্রেনখানা যে রাত্রে আসে তার পরদিন সকাল থেকেই ট্রামগুলো তৎপর হয়ে ওঠে।

আমার তখন মনে হলো যে, আমি যদি কোন উপায়ে ঐ স্পেশাল ট্রেনখানার আসবার তারিখটা আগে থেকে জানতে পারতাম তাহলে সেই খবরটা তেষট্টি নম্বরকে দিয়ে যথাস্থানে পাঠিয়ে ট্রেনখানাকে ধ্বংস করবার ব্যবস্থা করা যেতো। ‘ব্রিটিশ এয়ারক্রাফট’ যদি সময়মত এই খবরটা পায় তাহলে মাত্র কয়েকটা ‘হাই-এক্সপ্লোসিভ বোমা ফেলেই গোটা ষ্টেশনকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে ফেলতে পারতো।

কিন্তু মুস্কিল হলো যে, এই ‘ষ্টেশন ষ্টাফ’ এর সঙ্গে ভাব জমাতে না পারলে ট্রেনের খবর পাওয়া সম্ভব নয়। হাসপাতালের কাজে আমাকে অবশ্যই প্রায়ই ষ্টেশনে যেতে হতো এ্যাম্বুলেন্স করে আহত জার্মাণ সৈন্যদের গাড়ী থেকে নিয়ে আসতে। আমি তাই মনে মনে ঠিক করলাম যে এবার থেকে আমি ষ্টেশনের কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ঐ স্পেশাল ট্রেনটা সম্বন্ধে খবর নিতে চেষ্টা করবো।

সুযোগ অচিরেই এসে গেল। পরদিন বিকালেই আমাকে এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ষ্টেশনে যেতে হলো। যে ট্রেনে আহতদের আসবার কথা, সেখানা আসতে তখনও দেরী ছিল। আমি প্লাটফর্মে পায়চারি করতে আরম্ভ করলাম।

ষ্টেশনের একজন জার্মাণ অফিসার সেই সময় প্লাটফর্মে দাঁড়িয়েছিল। লোকটার সঙ্গে কি করে আলাপ করা যায় ভাবছি, এই সময় দেখি যে সে নিজেই আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে এসে লোকটা বললো—গুডে ফ্রাউলিন! আপনি বুঝি প্রায়ই ষ্টেশনে আসেন?

মৃদু হেসে আমি বললাম–হ্যাঁ, আহত সৈন্যদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে আমাকে প্রায়ই আসতে হয় এখানে।

লোকটা তখন পকেট থেকে সিগারেট কেস বের করে বললো—ধুম পান করবেন কি?

আমি বললাম—ধন্যবাদ! সদরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানা আমি পছন্দ করি না।

লোকটি বললো—তাহলে আসুন না আমার কামরায়! আপনার ট্রেনের তো এখনও অনেক দেরী! ওখানে একটু চা’ও খেয়ে নেওয়া যাবে, কি বলেন?

আমি এই রকম সুযোগই খুঁজছিলাম। বললাম——বেশতো! চলুন না! তবে বেশীক্ষণ দেরী করতে পারবো না কিন্তু আমি।

কামরায় এসেই একজন কুলীকে ডেকে চা আনতে হুকুম করলো লোকটা। লক্ষ্য করলাম যে ও ওর চেয়ারখানা আমার একেবারে কাছে টেনে এনে বসলো। একটু পরেই চা নিয়ে এলো কুলীটা। চা খেতে খেতে লোকটা শুরু করলো বক্‌কানি ওর সেই বক্রক্ যেন থামতে চায় না। কথায় কথায় ওর স্ত্রী যে মারা গেছে সে কথাটাও জানালো আমাকে।

ওর একখানা হাত এসে কখন আমার হাতের উপর পড়েছে লক্ষ্য করলাম।

বাধা না দিয়ে বললাম—যুদ্ধ ব্যাপারটা বড় করুণ, তাই না?

এই সময় সেই কুলীটা আবার এসে বললো——টেলিফোন এসেছে স্যার!

বেচারা প্রেমের পায়তারা করতে শুরু করবার আগেই কি রকম ঝামেলা দেখুন!

বিরক্ত হয়ে চেয়ার থেকে উঠে পড়লো ও।

যাবার সময় অনুনয় করে বলে গেল আমাকে—আপনি কিন্তু চলে যাবেন না ফ্রাউলিন! আমি দু’মিনিটের মধ্যেই আসছি!

সত্যিই মিনিট দু’য়ের মধ্যেই ফিরে এলো ও।

আমার পাশে বসেই ও প্রস্তাব করে বসলো—আর একদিন আপনার সঙ্গে দেখা হয় না ফ্রাউলিন? সেদিন আমরা দু’জনে— নিভৃতে…

ওর উচ্ছ্বাসে সায় দিয়ে বললাম—তাতে আর বাধা কি! তবে কি জানেন? হাসপাতালের ডিউটি ছেড়ে তো আসতে পারি না। আচ্ছা দাড়ান ভেবে দেখি কবে আসতে পারি—এই বলে একটু চিন্তা করবার ভান করে আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম—-তার চাইতে আপনিই বলুন না, কবে আপনি ফ্রী আছেন, আমি বরং ঐ দিন কোন না কোন বাহানা করে চলে আসতে চেষ্টা করবো!

প্রেমিকপ্রবর তখন একেবারেই গলে গেছে। দিগ্বিদিক

জ্ঞানশূন্য হ’য়ে আমার সামনেই ও ওর নোট বইখানা খুলে দেখতে লাগলো! আমিও এই সুযোগে নোটগুলো পড়ে দেখতে লাগলাম।

বুধবার তারিখের নীচে লেখা আছে অর্ডন্যান্স স্পেশাল আসবে—রাত তিনটেয়—ছাড়বে পরদিন বেলা তিনটেয়। “হেভি ক্যালিবার সেল—লোকাল ডাম্প, লাইট ক্যালিবার সেল, বুলেট ইত্যাদি—ট্রামে আপ লাইন।”

লোকটি তখন হিসাব করে বললো—শুক্রবার বেলা তিনটের পর থেকে আমি ফ্রী।

আমি বললাম—বেশ সে কথাই তাহলে থাকলো। শুক্রবার বিকেল চারটে আমি আসছি।

আনন্দে বেসামাল হয়ে ও আমার একখানা হাত টেনে নিয়ে তাতেই একটা চুমো দিয়ে ফেললো।

হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমি বললাম—আজ এই পর্য্যন্তই! শুক্রবার চারটেয় আসছি; গুড বাই।

ওর কামরা থেকে বাইরে আসতে আসতে ভাবলাম “আমার প্ল্যান যদি ঠিকমত খাটে তাহলে ঐ শুক্রবার আর তোমার জীবনে কখনো আসবে না!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *