স্পাই মেয়ে – ১০

দশ

‘এ্যামুনিশন ডাম্প’ ধ্বংসের কিছুদিন পরে হাসপাতালে চার পাঁচজন নার্স আর একজন মেট্রন এসে কাজে লাগল। ওরা সবাই ছিল জার্মাণ মেয়ে। আমার সঙ্গে প্রথম থেকেই কেন যেন খারাপ ব্যবহার করতে আরম্ভ করলো ওরা। হয়তো হাসপাতালে আমার প্রতিপত্তি দেখে ওদের ঈর্ষা হয়ে থাকবে। ওদের প্রত্যেকেই ছিল আনাড়ী। সব সময়ই ওরা কাজে ভুল করতো আর নিজেদের দোষ ঢাকতে সব দোষ আমার উপরে চাপাতে চেষ্টা করতো!

একদিন ওবার্তাঙ্গ আমাকে ডেকে বললেন—ওরা তোমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার আরম্ভ করেছে, না?

আমি চুপ করে রইলাম।

ওবার্তাজ বললেন—আমি সত্যই দুঃখিত যে আমার দেশের মেয়েদের কাছে খারাপ ব্যবহার পাচ্ছো তুমি। আমার কাছেও ওরা – তোমার নামে লাগাতে আরম্ভ করেছে এরই মধ্যে, কিন্তু আমি তো তোমাকে জানি। যাই হোক তুমি একটু সাবধান থেকো।

ক্রমশঃ অবস্থা এমন অসহনীয় হয়ে উঠলো যে, আমি হাসপাতালের কাজ ছেড়ে দেবো ঠিক করলাম। ওবার্তাজের কাছে আমার সিদ্ধান্তের কথা বলতেই তিনি বললেন—যাও মা, ভগবান তোমার মঙ্গল করুন। তোমাকে আমি নিজের মেয়ের মতই দেখতাম কিন্তু এখানে আমার কিছু করবার নেই কারণ তুমি বেলজিয়ান। তোমার হয়ে কিছু বলতে গেলেই নানা কথা উঠবে।

ওবার্তাজকে আর দেখতে পাবো না মনে হওয়ায় আমার চোখে জল এসে গেল। আমি বললাম—হাসপাতাল ছেড়ে চললাম বটে কিন্তু আপনার কথা কখনও ভুলবো না আমি। আপনি যখনই আমাকে ডাকবেন তখনই আমি ছুটে আসবো আপনার কাছে।

নভেম্বরের মাঝামাঝি আমি হাসপাতাল ছেড়ে এলাম।

নভেম্বরের শেষদিকে একদিন বিকেলে আমি কি একটা কাজে ‘টাউন কমাণ্ডান্ট’ এর অফিসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বাইরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা একটা বিজ্ঞাপনের উপরে নজর পড়লো আমার। বিজ্ঞাপনটি ছিল এ রকম :

হারানো জিনিষের বিজ্ঞাপন!”

নিম্নলিখিত চোরাই মালগুলো পাওয়া গেছে। মালিক উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে যে কোন দিন বেলা ১০টা থেকে ১২টার মধ্যে এসে তার জিনিস নিয়ে যেতে পারে।” তালিকার ৪নং দফায় লেখা ছিল—”একটা সোনার হাতঘড়ি। কেস’এর তলা এম, সি, অক্ষর দুটো খোদাই করা আছে।”

কি আশ্চর্য! এটা যে আমার সেই ঘড়ি। সেই সুড়ঙ্গ পথে ঢোকবার পর থেকেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না! ‘ব্যাণ্ডটা’ একটু ঢিলে হয়ে গিয়েছিল তাই হয়তো কোথাও পড়ে গিয়ে থাকবে। তাছাড়া চুরিও যেতে পারে।

ঘড়িটা ফিরে পাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলাম আমি।

লাসেলের উপদেশের কথা ভুলে গেলাম।

তার সেই কথা—”যদি কখনও ধরা পড়, জানবে তোমার নিজের দোষেই পড়েছো!”

পরদিন বেলা দশটায় আমি টাউন কমাণ্ডান্ট-এর সঙ্গে দেখা করলাম। কমাণ্ডান্ট আমাকে দেখে সুপ্রভাত জানিয়ে বললেন—কি ব্যাপার ফ্রাউলিন, এখানে কোন কাজ আছে কি?

আমি তখন আমার ঘড়িটার কথা বললাম তাঁকে।

আমার কথা শুনে তিনি যেন প্রথমে একটু অবাক হয়ে গেলেন। পরে বললেন—ওহো! তাই হবে—এম, সি, মানে মার্থা নোকার্ট (Martha Cnockart) ঠিক তো!

এই বলেই তিনি তাঁর টেবিলের টানা খুলে ঘড়িটা বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন দেখুন তো! এইটা আপনার কিনা?

ঘড়ি ফিরে পাবার আনন্দে আমি তখন এমনই আত্মহারা যে চোরাই মাল অন্য সব জিনিষের সঙ্গে না থেকে কমাণ্ডাণ্টের টানার ভেতরে থাকবার অর্থ কি, এই সহজ ব্যাপারটাও বুঝতে পারলাম না।

ঘড়িটা হাতে নিয়ে বললাম—হ্যাঁ, এটা আমারই ঘড়ি। ঘড়িটা আবার ফিরে পেলাম এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

এই বলে ঘড়িটাকে হাতব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে বেশ একটু উৎফুল্ল হয়েই বাড়ী ফিরলাম আমি।

বাড়ীতে আসতেই মা বললেন—জার্মাণ মিলিটারী পুলিশ এসেছিল তোমার খোঁজে।

আমি বললাম—ও কিছু না।

সেদিনই বেলা প্রায় তিনটের সময় আমার এক বান্ধবী ছুটতে ছুটতে আমার কাছে এসে বললো—এই মাত্ৰ জাৰ্মাণ ডিটেকটিভরা এসে তোমার সম্বন্ধে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করছিল আমাকে।

ব্যাপারটা ক্রমশঃই যেন রহস্যজনক হয়ে উঠেছিল। আমার ধারণা হ’ল যে হয়তো হাসপাতালের সেই নার্সরা আমার নামে যা তা বানিয়ে বলেছে, তাই ওরা একটু খোঁজ-খবর নিচ্ছে আমার সম্বন্ধে।

বেলা প্রায় চারটের সময় দরজার বাইরে রাইফেলের কুঁদো ঠুকবার আওয়াজ পেয়ে ঘাবড়ে গেলাম। দরজা খুলতেই একদল মিলিটারী পুলিশ বাড়ীর ভেতরে ঢুকে পড়লো। ওদের মধ্যে একজন অফিসারও ছিল।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম—আজ আপনারা দুবার এলেন! কি ব্যাপার?

অফিসারটি বললো—আমি বাড়ী সার্চ করবো। আপনাদের চাবিগুলো সব এনে আমাকে দিন।

আমি বললাম—সার্চ করে কিছুই পাবেন না এখানে, আমাদের এখানে আপত্তিকর কিছু থাকে না।

অফিসারটি বললো–আমিও তাই আশা করি ফ্রাউলিন

নীচের তলার সার্চ শেষ করে ওরা যখন আমার দোতালার শোবার ঘরে গেল সেই সময় হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল যে রাত্রে পাঠাবার জন্য একটি খবর লেখা রয়েছে আমার ঘরে।

সর্বনাশ! কথাটা যদি আর কিছুক্ষণ আগেও মনে হতো!

ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো আমার।

একটু পরেই পুলিশ অফিসারটিকে সিঁড়ি দিয়ে দুমদাম করে নেমে আসতে দেখলাম। আমার সামনে এসে পকেট থেকে সেই মারাত্মক কাগজখানা বের করে সে জিজ্ঞাসা করলো-—এটা কি?

চেয়ে দেখি ওটা আমার মৃত্যুর পরোয়ানা।

আমি চুপ করে আছি দেখে অফিসারটি গর্জন করে উঠলো— তোমাকে এখনই টাউন কমাণ্ডাণ্টের অফিসে যেতে হবে।

ওরা আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে চললো।

টাউন কমাণ্ডান্ট গম্ভীর হয়ে গেলেন আমাকে দেখে!

তিনি শুধু বললেন—জার্মাণ আইরণক্রসধারিণী নার্স মার্থা নোকার্ট তাহলে স্পাই।

ওঁর অফিসেই আমাকে আইনগত ভাবে চার্জ করা হল স্পাই বলে। আমাকে বিচারাধীন বন্দী হিসাবে রুলার্স মিলিটারী জেলখানায় বন্দী করে রাখবার পরোয়ানা সই করে দিলেন তিনি।

মিলিটারী জেলে গিয়ে দেখতে পেলাম যে রুজবেক এরোড্রোমের সেই ফিল্ড-ওয়েবল সোয়েজার ওখানকার জেলার। আমায় দেখে সোয়েজার বললো—বন্ধু ফ্রাউলিন নোকার্ট তাহলে একজন ‘স্পাই’?

লোকটা হয়তো বা একটু, দুঃখিতই হলো আমার জন্য।

এক অপরিসর সেলের মধ্যে থাকতে দেওয়া হলো আমাকে। সেল’এর ভেতরে ঢুকে আমার মনে হতে লাগল “এইবারই আমার স্পাই জীবনের শেষ। কাল ভোরেই হয়তো আমাকে গুলী করে মেরে ফেলা হবে।”

প্রাণের মায়ায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম আমি।

কয়েকদিন পরেই আমাকে ‘ঘেণ্ট লিটারী জেল’এ বদলি করা হলো। ওখানে আমার উপরে চললো নানাভাবে নির্যাতন। এক নাছোড়বান্দা ডিটেকটিভ আমাকে দিনরাত বিরক্ত আরম্ভ করলো স্বীকারোক্তি আদায় করতে। কখনও ভয় দেখিয়ে, কখনও অনুকম্পা লাভের প্রলোভন দেখিয়ে আবার কখনও বা সারা দিনরাত ধরে ঠায় বসিয়ে রেখে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে জ্বালিয়ে মারলো আমাকে।

এই ভাবে একটানা প্রশ্ন করবার জন্য ভাড়াটে লোক ছিল ওদের।

এই উৎপাত সহ্য করতে না পেরে খাওয়া বন্ধ করে দিলাম আমি। ওয়ার্ডাররা দিনের শেষে যখন খাবারগুলো ফেরৎ নিয়ে যেতো আমার সেল থেকে, তখন ওরা দুঃখিত হতো বলেই মনে হ’তো আমার!

এত দুঃখের মধ্যেও একটা কথা ভেবে শান্তি পেতাম আমি যে, আমার বন্ধুরা কেউ ধরা পড়ে নাই। কারণ, ওরা ধরা পড়লে গোয়েন্দা-প্রবর এভাবে আমার পেছনে লাগতো না স্বীকারোক্তি আদায় করতে।

ডিটেকটিভ মশাই যখন বিশেষ সুবিধা করতে পারলেন না, তখন তিনি এক নূতন কায়দা শুরু করলেন। একদিন একটি বেলজিয়ান মেয়ে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে বললো যে সে নাকি আমাকে দেখাশুনা করতে মিলিটারী থেকে নিযুক্ত হয়েছে। কথায় কথায় মেয়েটি জানালো যে ঐ ডিটেকটিভটি একটি সাংঘাতিক লোক তাই ওকে যেন কোন কথা না বলি আমি। ওর মুখ বন্ধ করা যায় এইভাবে দু’একটি খবর মেয়েটিকে বললে সেই তা থেকে গুছিয়ে নিয়ে ডিটেকটিভকে একটা গল্প বানিয়ে বলবে।

মেয়েটি জানতো না যে ওকে আমি আগে থেকে চিনতাম। ঐ ভ্ৰষ্টা দেশদ্রোহিণী মেয়েটা ছিল ঐ ডিটেকটিভেরই শয্যাশায়িনী।

আমি বললাম—আমাকে তুমি বিরক্ত করো না, আমি কোন কথা বলবো না!

মেয়েটি বললো—তুমি বুঝতে পারছ না, সব কথা খুলে বললে ওরা তোমাকে ছেড়ে দিবে।

আমি বললাম—এখানে বক্ বক্ করে কোন লাভ হবে না তোমার, তার চেয়ে বরং তোমার ডিটেকটিভ উপপতির কাছে যাও যাতে কাজ দেবে।

মেয়েটি হঠাৎ ক্ষেপে উঠে বললো—কি আমাকে অপমান? এর কি ফল তা তুমি কালই টের পাবে।

আমি বললাম—তোমার মত দেশদ্রোহিণী কুলটার সঙ্গে কথা বলতেও আমি ঘৃণা বোধ করি। তুমি এক্ষুনি চলে যাও আমার সামনে থেকে।

ও তখন আমাকে শাসিয়ে গেল যে এর জন্য আমাকে ভুগতে হবে।

আমার অবস্থা ক্রমশঃই খারাপ হয়ে পড়তে লাগলো। এমন কি সব সময় আমার জ্ঞানও থাকতো না ঠিকমত।

এই সময় একদিন জেলখানার ডাক্তার এসে আমাকে বললো যে আমি ‘হাঙ্গার ষ্ট্রাইক’ বন্ধ না করলে আমাকে নাকি জোর করে খাওয়ানো হবে।

ডাক্তার আরও বললো যে, না খেয়ে খেকে শুধু শরীরকে কষ্ট দেওয়া ছাড়া আর কোন সুবিধে হবে না। বিচারে যা হবার তাতো হবেই।

আমিও ভেবে দেখলাম যে কথাটা সত্যিই। আমি না খেয়ে থাকলেও তো বিচার বন্ধ হবে না। তাই আমি সেইদিনই লেবুর রস পান করে উপবাস ভঙ্গ করলাম।

উপবাস ভঙ্গ করলেও আমার অবস্থা কিন্তু খারাপের দিকেই যেতে লাগলো। জামা কাপড় পরিষ্কার করতে না পারায় বিশ্ৰী আর দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে পড়েছিল বলে একখানা সাবান চেয়ে নিয়ে আমি ওগুলো সাফ করতে চেষ্টা করতেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম সেদিন।

অবস্থা দেখে ওরা আমাকে বাইরের অসামরিক হাসপাতালে স্থানান্তরিত করলো! ওখানকার নার্সরাও কিন্তু আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করে দিল ভর্তির দিন থেকেই। ওরা হয়তো ভেবেছিল যে আমি একজন চরিত্রহীনা অপরাধিনী মেয়ে

এই সময় মা আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন একদিন। ওঁর মুখে শুনলাম যে দেখা করবার হুকুম জোগাড় করতে নাকি অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছিল।

মা আমাকে দেখেই কেঁদে ফেললেন।

আমার চোখও অবশ্য শুকনো থাকলো না।

কাঁদতে কাঁদতেই মা বললেন—ভগবানের কাছে কি এমন অন্যায় আমি করেছি যে আমার প্রত্যেকটি ছেলে-মেয়েকে আমার কোল থেকে টেনে নিচ্ছেন তিনি!

মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললাম—কেঁদো না মা, আমার মৃত্যু তো গৌরবের মৃত্যু! মরতে তো একদিন না একদিন হ’তোই—এ কেবল দুদিন আগে যেতে হচ্ছে।

শোকে প্রথম বেগটা সামলে নিয়ে মা বললেন—তোমার শরীরে যে আর কিছু নেই মার্থা?

-অসুখ করছিল যে মা! তবে এখন ভালই আছি।

‘হাঙ্গার ষ্ট্রাইক’ এর কথাটা ইচ্ছা করেই বললাম না মাকে।

—ওরা সব কেমন আছে মা?

কাদের কথা জিজ্ঞেস করছি মা বুঝতে পারলেন।

গলা খাটো করে মা বললেন—কালই এলফন্স আর ষ্টিফেন এসেছিল। ওদের উপরে এখনও কেউ সন্দেহ করেনি। ওরা তোমার জন্য খুবই দুঃখিত—কিন্তু করবার তো কিছু নেই।

—ওবার্তাজ কিছু বলেছেন কি?

—হ্যাঁ, তিনিও তোমার জন্য খুবই দুঃখিত হয়েছেন বললো এলফন্স।

“সময় হয়ে গেছে, আর থাকতে দিতে পারি না”—যে অফিসার ‘ইন্টারভিউ কণ্ডাক্ট’ করছিল সে হঠাৎ বলে উঠলো এই সময়।

—এই যে হয়ে গেছে—বলে আমাকে বুকে টেনে নিয়ে ছোট্ট শিশুর মত মুখে, মাথায়, গালে চুমো দিতে দিতে মা বললেন—তাহলে যাই মা, এই বোধ হয়…

গলা দিয়ে আর কোন কথা বের হলো না তাঁর। ঝর ঝর্ করে দুই চোখ দিয়ে জল পড়লো মার!

কি মর্মান্তিক! কি করুণ সেদিনের সেই বিদায়!

মা চলে যেতেই হাসপাতালের নার্সরা এলো আমার কাছে। বললাম—কি? আরও কিছু গালাগাল দেবার ইচ্ছে আছে নাকি? দিয়ে যাও—যে ক’টা দিন বেঁচে আছি, সবার গালাগাল খেয়েই যাই।

এবারে কিন্তু ওরা গালাগাল দিল না।

তার পরিবর্তে মেট্রন আমার পাশে বসে আমার একখানা হাত ধরে বললো—আমাকে আপনি ক্ষমা করুন। সারা বেলজিয়াম আজ যাকে পূজা করছে, সেই মার্থা নোকার্ট আপনি! চিতে না পেরে আপনার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছি সেজন্য আমরা অনুতপ্ত। আমরা সবাই আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।

আমি বললাম—এতে ক্ষমা চাইবার কি আছে বোন! আমাকে দেখে সবাই যা ভাবে, তোমরাও তাই ভেবেছিলে। এতে তোমাদের কোনই দোষ নেই।

এর পর থেকে নার্সরা আমার সঙ্গে একেবারে আত্মীয়ের মত ব্যবহার করতে লাগলো। সময় পেলেই ওরা কেউ না কেউ এসে আমার কাছে বসে গল্প করতো। আমার জামা কাপড় ময়লা দেখে ওরা নিজেরাই একদিন পরিষ্কার করে দিল সেগুলো। ওরা এতই ভালবেসে ফেলেছিল আমাকে যে, হাসপাতাল থেকে চলে যাবার দিন ওদের সে কি কান্না!

শরীর একট, সেরে উঠতেই আমাকে আবার জেলখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো। আবার সেই নির্জন সেল! সেই কারারক্ষীদের আনাগোনা। বসে বসে ভাবি আমি। কত কথাই মনে হয়। বাইরের কথা, মা বাবার কথা, ওবার্তাজ’এর কথা, এলফন্স, ষ্টিফেন, ক্যান্টিন’ মা, তেষট্টি নম্বর……আরও কত এলোমেলো চিন্তা।

‘কোর্ট মার্শাল’ এর কথাও মনে হয়।

“কি ভাবে মারবে আমাকে?”

“নিশ্চয়ই গুলী করে!”

“হাত বেঁধে দাঁড় করিয়ে দেবে আমাকে—”

“সামনে একসার সৈন্য—হাতে তাদের উদ্যত রাইফেল—

“ফায়ার”—

“আর ভাবতে পারি না।”

দিন যায়। দিনের পর রাত আসে। রাত শেষে আবার ফুটে ওঠে দিনের আলো। এমনি করেই কাটতে থাকে আমার কারাগার-এর দিনগুলি।

সেদিন দুপুরে খটখট্ শব্দে চমকে উঠে বসলাম। এ সময় তো কারো আসবার কথা নয়!

-তবে কি?

একজন ‘লেফট্‌ন্যান্ট’ আমার ‘সেল’ এর দরজার সামনে এসে দাড়ালো। পকেট থেকে একখানা কাগজ বের করে পড়ে শোনাতে লাগলো “জার্মাণ দখলি এলাকার অফিসার কমান্ডিংএর নির্দেশ অনুযায়ী তোমাকে জানানো হচ্ছে যে আগামী সপ্তাহের কোন এক তারিখে জার্মাণ ‘কোর্ট মার্শাল’ এ তোমার বিচার হবে।”

হুকুম শুনিয়ে দেবার পর কাগজখানা ভাঁজ করে পকেটে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে সে আবার বললো—আপনার যদি ‘ডিফেন্স’ করবার ইচ্ছা থাকে তাহলে আপনার যা বলবার আমাকে বলতে পারেন।

“আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করবো না” সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম আমি।

লেফট্‌ন্যাণ্ট বললো—আপনি হয়তো আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। যাই হোক—আপনি যদি চান তাহলে ‘সিভিল এ্যাডভোকেট’ এর সহায়তাও পেতে পারেন।

আমি বললাম— ধন্যবাদ! আমার কোন উকিল দরকার হবে না। যাবার সময় লেফটন্যান্ট বললো—মিলিটারী আইনে যাই থাক, ব্যক্তিগত ভাবে আমি প্ৰণতি জানিয়ে জানিয়ে যাচ্ছি আপনাকে, আপনার দেশপ্রেমের জন্য।

মানুষ সবার মধ্যেই আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *