সুমিতার স্বপ্ন
সুমিতা হলঘরে বাবার ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অফিসে বের হবে। ড্রাইভারও জানে এটা। এ বাড়ির অনেকেই জানে। সুমিতার ছোট বোন অমিতা বলে, তুই কি ওখানে দাঁড়িয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলিস দিদি?
সুমিতা হাসে। ছোট ভাই সুজিত বলে, দিদি আমাদের নামে বাবার কাছে নালিশ করে, আমরা দিদিকে কত জ্বালাতন করি।
সুমিতা বলে, তাই যদি জানিস, তবে জ্বালাতন করিস কেন? তোদের জ্বালাতে সত্যিই আমি জ্বলে পুড়ে মরছি রে। অমিতা তুই কলেজেও ঠিকমতো যাস না। বন্ধুবান্ধবদের সাথে কলেজ পালিয়ে ঘুরিস। সিনেমায় যাস। আর সুজিত তুইও যা করিস সব আমার কানে আসে। তোকে কলেজের পড়া শেষ করে এবার আমার সঙ্গে হাত মেলাতে হবে। ওদিকে কারখানার এক্সটেনশন হচ্ছে। নতুন ইউনিট বসছে। আমি একা কতদিক সামলাই বল? তোদেরও এগিয়ে আসতে হবে। জানিস অমিতা, মেয়েরাও আজকাল অনেক প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে। তুইও অফিসের কাজ দেখাশোনা করবি। সুজিত বলে, ওসব যখন করার করব, এখন তো তুই আছিস, মামাবাবু আছে, পড়াশোনাটা করি।
সুমিতা বলল, সেটা ঠিকমতো করলে তো কথাই ছিল না, কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। সুজিত চুপ করে যায়, সেও জানে দিদির কাছে খবর দেওয়ার জন্য লোকও আছে, এতবড় প্রতিষ্ঠান যে চালায় তার চর-অনুচরও আছে তারাই সুজিত অমিতার সব খবর দিদির কাছে পৌঁছে দেয় ঠিক সময় মতো। তাই সুজিত, ব্যাপারটাকে আপাতত চাপা দেওয়ার জন্য বলে, ঠিক আছে। এখন থেকে দেখবি একদম মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করছি।
সুমিতা বলে, তাই কর। আমি বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে রোজ প্রার্থনা করব। জানিস বাবাকে কথা দিয়েছিলাম, ওর কারখানাকে আমি আরও বড় করব। ঠিকমতো চালাব। মা, ভাই-বোনকে সুখী করব। তোদের মনের মতো করে বড় করব। তোরা আমার মুখ রাখিস ভাই।
সুমিতার কণ্ঠস্বর আবেগে ভরে ওঠে, ভাই বোনকে সে কাছে টেনে নেয়। সে তাদের কাছে বড় দুর্বল, বড় বেশি আবেগপ্রবণ। ঘড়ির কাঁটা তখন দশটার ঘরে। বিদেশি ঘড়িটায় সাধারণ আর পাঁচটা ঘড়ির মতো ঢংঢং করে দশটা বাজছে। খেয়াল হয় সুমিতার। সে এই জগতে ফিরে আসে। বলে, ইস দশটা বেজে গেল। অফিসে যেতে হবে। তোরাও তৈরি হয়ে নে। ঠিক সময় কলেজে যাবি। কোনও ক্লাস মিস করবি না। সুজিত, তোকে ফিজিক্স অনার্স পেতেই হবে। কারখানার কাজ জানতে হলে বিজ্ঞানের এসব জ্ঞান থাকা দরকার।
সুমিতা বের হয়ে যায়। ওদিকে উর্দি পরা ড্রাইভার রাম সিংও তৈরি। সে জানে মেমসাহেবের মেজাজের কথা। প্রতিদিন সকালে সুমিতা আগে দেখে নেয় রাম সিংকে। তার বাবার আমলের ড্রাইভার রাম সিং। সুমিতাকে ছোট থেকেই দেখছে। তখনই দেখেছে ওই ছোট মেয়েটার একটা কঠিন ব্যক্তিত্বকে। সেটা বেড়েছে সুমিতার বয়সের সঙ্গে সঙ্গে। সুমিতা, রাম সিংকে যেন তার সন্ধানী দৃষ্টিতে জরিপ করে চলেছে। ওর সাদা পোশাকে ইস্ত্রি ঠিকঠাক আছে কিনা। পোশাকে ফাঁকি থাকলে লোকটা যে কাজেও ফাঁকি দেবে এ ধারণা সুমিতার। তাই রাম সিং সর্বদা পোশাক আর কাজে টিপটপ থাকে। গাড়িটাকেও ঝকঝকে করে রাখতে হয়। আর গাড়ি সামান্য গড়বড় করলে সেটাকে সে বদলে ফেলে। গাড়ি বদলাবার মতো ক্ষমতা তার আছে। সুজিত মটরবাইকে বেশি পছন্দ করে। কারণ, ওর মতে একটা গাড়ির চেয়ে একটা মটর বাইকে চাপলে তার মতো হ্যান্ডসাম ছেলে, মেয়েদের চোখে বেশি পড়বে। সেজন্য সে ওই মোটর বাইকেই বেশি ব্যবহার করে। যদিও সুমিতার আপত্তি সেখানেই কারণ, ওতে বিপদের ঝুঁকি থেকে যায়।
সুমিতা রাম সিংকে দেখে নিয়ে গাড়িতে ওঠে। সোজা অফিস যাবে। লাঞ্চের আগে পর্যন্ত অফিসের কাজকর্ম দেখে তারপর সপ্তাহে তিন দিন যায় তাদের ডানকুনির কারখানায়। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ থেকে যাবে দু’নম্বর ইউনিটে। ওখান থেকে কোনও পার্টি বা মিটিং থাকলে সেখান থেকে হয়ে অফিসে ফেরে। সেখানে কাজ চুকিয়ে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। তার সারাটা দিন কাটে কাজের মধ্যে।
সুমিতার জীবনে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই এই রুটিন চালু হয়েছে। সে এখন যেন একাই এক কঠিন যুদ্ধক্ষেত্রে নিঃসঙ্গ সৈনিকের মতো লড়াই করে চলেছে। তার আগে সুমিতার জীবনটা ছিল অন্য ছন্দ অন্য সুরে সুরময়।
সুমিতার বাবা বিধানবাবুর বাবার একটা ওষুধের কারখানা ছিল। তখনকার দিনে নামকরা ডাক্তার, তবে আয়ুর্বেদশাস্ত্র তার পড়া ছিল। ফলে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের সাথে তিনি ভারতের করিরাজিশাস্ত্রে উল্লিখিত বহু গাছ গাছড়া, মূল, ফুল, ফল থেকে বেশ কিছু কবিরাজি ওষুধের পেটেন্ট নিয়ে তিনি ওই সব ওষুধ তৈরির কাজ শুরু করেন। আর সে সব ওষুধের বিক্রি বাড়তে থাকে। বিশুদ্ধ ওই কবিরাজি ওষুধগুলোর পাশাপাশি কিছু অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ তৈরিও শুরু করেন। তারপর ডাক্তারি পাশ করে বিধানবাবু প্র্যাকটিসে না গিয়ে বাবার কারখানা দেখাশোনা করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেও বেশ কিছু কেমিষ্টদের আনিয়ে আরও আধুনিক যন্ত্রপাতি বসিয়ে অনেক ওষুধ তৈরি করার অনুমতি নিয়ে কারখানা বাড়ান। আর নিজেও বৈজ্ঞানিকভাবে মার্কেটিংয়ের কাজ শুরু করেন।
বাবা মারা যাওয়ার পর বিধানবাবু এই কারখানাকে আরও বড় করে তোলেন। তাদের তৈরি ওষুধের গুণগত মান বেশ উৎকর্ষ। তাই বাজারে তার চাহিদাও অনেক। বিধানবাবুর শ্যালক ভবদেববাবুও বিধানবাবুর কারখানাতে কাজ করেন। অনেকদিন থেকেই ভবদেববাবু রয়েছেন বিধানবাবুর সঙ্গে। সেই ছোট কারখানা যখন ছিল তখন বিধানবাবু ও ভবদেববাবু দু’জনে বিভিন্ন এলাকায় ডাক্তারদের কাছে ওষুধের অর্ডার আনতেন।
নিজেরাই কারখানাতে অন্যদের সাথে পরিশ্রম করে মাল উৎপাদন করতেন। এই ভাবে ক্রমশ আরও বড় বাজার দখল করেন আর বিধানবাবুও ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে এই কারখানাকে বাড়ান। একে জনপ্রিয় করে তোলেন। বিধানবাবুর স্ত্রী যখন মারা যান, সুমিতা তখন কলেজে পড়ছে। এমনিতে সুমিতা সুন্দরী, বুদ্ধিমতী। অবসর সময়মতো বাবার সঙ্গে কারখানা ঘুরে দেখে। কোন মেশিনে কী তৈরি হয়, কোন ওষুধ কীভাবে তৈরি হয় এসমস্ত খবরও নেয়। ভবদেববাবু বলেন, বিধানদা তোমার মেয়ে কারখানার ব্যাপারে আমাদেরও টেক্কা দেবে।
বিধানবাবু ভবদেবকে বলেন, আজকালকার মেয়েদের এসব জানা দরকার যে, আমাদের পর তো ওদেরই এসব সামলাতে হবে। অমিতা, সুজিত তো ছোট। আর সুমিতা মেয়ে হলে কী হবে, ও আমার ছেলের মতো।
সুমিতা অবশ্য খেলাধুলায় চৌকস। এর মধ্যে নিজে গাড়ি চালাতে শিখেছে। মাঝে মাঝে ছুটির দিনে নিজের কারখানাতে চলে আসে।
কারখানার শ্রমিক কর্মচারীরাও তাদের এই খুদে মনিবকে চেনে। তারাও চায় ছোট মেমসাব কারখানায় আসুন। সে বার বোনাসের দাবি নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে কিছুটা অসন্তোষও দেখা যায়।
অবশ্য বিধানবাবু এটা জানেন না। অফিসের কাজে তিনি দিল্লি-মুম্বাই-চেন্নাই-দক্ষিণ ভারতে ঘুরে বেড়ান। সেখান থেকে তাদের বহু কাঁচামাল আসে—তৈরি ওষুধও যায়। তাই ওদিকে প্রায়ই যেতে হয় বিধানবাবুকে। তিনি ওখানে দু’একবার সুমিতাকেও নিয়ে গেছেন।
দক্ষিণের গহন বনে, পর্বত ঘেরা উপত্যকায় সুন্দর শহরে গেছে সুমিতা। সেখানের এজেন্টদের সঙ্গে কথাও বলেছে। দেখেছে বহু কোম্পানি কবিরাজি গাছ-লতা-মূলের জোগানদারদের সঙ্গে বাবা কাজ নিয়ে বাইরে বাইরে ঘোরেন। কারখানা চালায় সুমিতার মামা ভবদেববাবু। তিনি মাঝে মাঝে নিজের প্রভুত্ব দেখাতে চান। তা নিয়ে শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে মনোমালিন্য শুরু হয়েছে।
শ্রমিকদের দাবি, কোম্পানি তাদের পরিশ্রমের দ্বিগুণ মুনাফা করেছে, তাই এবার তাদের বোনাসও কিছু বাড়াতে হবে। আর তাদের এই দাবি জানাতে ভবদেববাবুও জানিয়েছেন, বেশি বোনাস দেওয়া সম্ভব নয়। বিধানবাবু বাইরে। তিনি এসব খবর জানেন না। অবশ্য সুমিতার সঙ্গে তার ফোনে কথা হয়। সেদিন সুমিতা কারখানায় এসে দেখে, শ্রমিকদের তখন আন্দোলন চলছে পুরো দমে। কাজও বন্ধ হয়ে আছে কারখানায়।
সুমিতা ব্যাপারটা দেখে শ্রমিকদের দু-তিনজন নেতাকে তার ঘরে ডেকে এনে, ওদের বসিয়ে আন্দোলনের কারণটা জানতে চায়। শ্রমিকরাও সুমিতাকে চেনে। তারাই বলে, মেমসাহেব, ম্যানেজারবাবু আমাদের দাবি এক কথায় নাকচ করে দিয়েছেন। আমরা দেড় মাসের বোনাস চেয়েছি। আর ম্যানেজারবাবু আমাদের কোনও কথাই শোনেননি। বাধ্য হয়ে আমরা আন্দোলন শুরু করেছি।
সুমিতা নিজেও এবছরের ব্যালেন্সসিট দেখেছে। সে জানে যে, শ্রমিকদের অনেকেই সৎ, কাজে ফাঁকি দেয় না। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই আজ কারখানার এত উন্নতি। তাই এইটুকু দাবি করা তাদের পক্ষে অন্যায় নয়।
সুমিতা বলে, আমি মামাবাবুর সঙ্গে কথা বলেছি। দরকার হলে বাবার সঙ্গে আজই ফোনে চেন্নাইতে কথা বলে কাল আপনাদের জানাব। আমি বিশ্বাস করি আপনাদের দাবি কোনও অন্যায় দাবি নয়। এটা যাতে পূরণ হয় আমি সেই চেষ্টা করব। আপনারা আজ মিটিং বন্ধ রেখে দিন। কাল আপনাদের জানাব, তারপর যা ভাল বোঝেন করবেন।
শ্রমিক নেতারাও ওর কথা মানে। সুমিতা মাঝে মাঝে শ্রমিকদের কোয়ার্টারে যায়। শ্রমিকদের কলোনিতে গিয়ে ওদের পরিবার পরিজনের সঙ্গে কথা বলে। তাদের অভাব অভিযোগের কথাও শোনে। আগে কলোনিতে পানীয় জলেরও সুব্যবস্থা ছিল না। দু’একটা টিউবওয়েল ছিল যা থেকে সকলে ঠিকমতো জলও পেত না। তাই নিয়ে প্রায়ই নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি অশান্তির সূত্রপাত হত। সুমিতা একদিন এরকম পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিল। শ্রমিকদের মধ্যে হইচই চলছে। সুমিতা সেই সব দেখে সাত দিনের মধ্যে ওখানে ডিপটিউবওয়েল, জলের ট্যাঙ্ক ইত্যাদি বানিয়ে দেয়, এখন আর জলের অভাব নেই কলোনিতে।
ওদের ওখানে একটা ছোট হাসপাতালও ছিল। কিন্তু সেখানে ডাক্তার বসত না। ওষুধপত্র ঠিকমতো পাওয়া যেত না। সুমিতা দেখে কোম্পানির খাতায় কলমে ডাক্তার ও ওষুধপত্রের জন্যে খরচ ঠিক হয়েছে, কিন্তু রহস্যজনকভাবে সেই টাকা কোথায় যায় তা জানা যায় না। সুমিতাই এবার ভবদেববাবুকে ওই নিয়ে প্রশ্ন করাতে ভবদেববাবুও যেন আকাশ থেকে পড়েন। তিনি বলেন, সেকি! আমি তো এসব জানতাম না। কেউ আমায় এসব কথা বলেওনি। এ তো খুবই অন্যায়, আমি দেখছি।
সুমিতা বলে, ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। টাকাটা ঠিকমতো স্যাংশন করেছিলেন অথচ তা ঠিকমতো কাজে লাগানো হয়েছে কিনা তা আপনার জানা উচিত ছিল। এখন থেকে ওটা আমিই দেখব।
ভবদেববাবুও এই জেদি মেয়েটাকে সমীহ করেন। বলে, তাহলে তো ভালই হয় মা, বিধানদা তো বাইরের কাজে ব্যস্ত। একা আমি কারখানার লেবার প্রোডাকশন সামলাতে ব্যস্ত। এ সব দিকটা যদি তুমি দ্যাখো তাহলে তো খুব ভালই হয়।
সুমিতাই এবার কলোনিতে হাসপাতাল নতুন করে চালু করে। আর শ্রমিকরাও দেখে এই মেয়েটাই তাদের জন্য ভাবে। কলোনির প্রাইমারি স্কুলের অবস্থাও একইরকম। শিক্ষক আছে তিনজন অথচ আসে একজন। অন্যেরা আসেন মাঝে মাঝে। দুপুরে ছেলে-মেয়েদের খাবার দেওয়ার কথা। কিন্তু তাও ঠিকমতো দেওয়া হয় না। চাল, ডাল, আনাজ সব কিছুই কোনও অদৃশ্য হাতে পাচার হয়ে যায়। ছাত্ররা বলে, মাসে তিন কেজি করে চাল দেয় তাও পচা, খাওয়া যায় না। সুমিতা নিজে একদিন এসে দেখে চাল বিলির প্রহসন। সুমিতা নিজেই এবার স্কুলের হাল ফিরিয়েছে। এখন তিনজন শিক্ষককে রোজই আসতে হয়। আর ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যাও বেড়েছে। তারা খেতেও পাচ্ছে।
এ সমস্ত ঘটনাগুলো শ্রমিকদের মনে একটা নির্ভরতা এনেছে। এতদিন তাদের পাশে কেউ ছিল না। কোম্পানি পয়সা দিয়ে খালাস। শ্রমিক-মালিকদের মধ্যে কোন আত্মিক সম্পর্ক ছিল না।
বিধানসাহেব এখানে থাকলে তবু তিনি শ্রমিকদের খবর নিতেন। ভবদেববাবু এদিকে আসেন না। তার অনুগত কিছু লোকই এসব দেখাশোনা করে। তারাই এসব টাকাপয়সার হিসাব করত। সুমিতাই তাদের অত্যাচার থেকে শ্রমিকদের বাঁচিয়েছে। তাদের প্রাপ্য সুবিধা দিয়েছে। বিপদে-আপদে তাদের পাশে দাঁড়ায়। তাই আজ বোনাসের ব্যাপারে সুমিতাকে ওই সব কথা বলতে দেখে শ্রমিকরা বলে, তাই হবে। আপনি বড় সাহেবের সাথে কথা বলুন। আমরাও চাই না আমাদের কারখানায় কোনও অশান্তি হোক। আমরা যে যার কাজে যাচ্ছি।
ভবদেবের চ্যালারা কারখানায় এইসব করছে। তারাই ভবদেবকে সব খবর দেয়। ওরা সুমিতা মেমসাহেবের উপর খুশি নয়। কারণ, ওদের রোজগারে টান পড়বে। সুমিতা কারখানায় এসে ক্রমশ ওসব খবর জেনে গেছে ওদের অনেক দুর্নীতি ফাঁস হয়ে গেছে। তারাই ভবদেবকে বলে, কালকের মেয়েটা আপনাকেও টেক্কা দিতে চায় স্যার। শ্রমিকরাও মহা শয়তান। আপনার জবাব শুনেও ওই দিদিমণির কাছে নালিশ করতে গেছে। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে চাইছে। বলেন তো দিই ওদের লিডারটাকে পিটিয়ে ঠাণ্ডা করে।
ভবদেব চতুর সাবধানি লোক। সে জানে জল কতদূর গড়াতে পারে। তাই বুদ্ধি করেই এতদিন সে বিধানবাবুকে সামলেছে। সুমিতাকেও আজ সামলাতে না পারলে ভেঙে পড়বে না। ভবদেব বলে, আরে আজকালকার মেয়ে, একটু তো উড়বে, পরে টাকার গন্ধ পেলে আবার পথে আসবে। এখন খেলতে দে।
সুমিতা সেই রাতেই বিধানবাবুকে সব কিছু জানিয়ে বলে, মামাবাবু শ্রমিকদের এই সামান্য দাবি না মেটালে শ্রমিকরা বিগড়ে যাবে। তাদের এটুকু দিলে কোনও ক্ষতিই হবে না। বরং লাভই হবে কোম্পানির। তুমি না বলো না বাবা।
বিধানবাবুও সবদিক ভেবে দেখেন। তিনি ব্যবসায়ী লোক, শ্রমিকদের হাতে রাখতে হবে। আর সুমিতাও কাজে উৎসাহ পাবে। শ্রমিকরা তাকে সহযোগিতা করবে। তাই বলেন, তাহলে বল আমি ওদের বোনাস স্যাংশন করছি। আমি ভবদেবকে ফোনে বলে দিচ্ছি। এ নিয়ে বেশি গোলমাল করিস না। ভবদেবও বিধানবাবুর ফোন পেয়ে বলে, তুমি যখন বলছ ঠিক আছে, তাই দেব।
পরদিন সুমিতাই শ্রমিকদের জানিয়ে দেয়, তাদের দাবি কোম্পানি মেনে নিয়েছে। সেই মতো বোনাস পাবে সকলে। শ্রমিকদের মধ্যে আনন্দ উচ্ছ্বাস জাগে। সে বার ওদের প্রোডাকশনও প্রচুর বেড়ে যায়। বিধানবাবু সে বার ভবদেবকে বলেন, ভবদেব মেয়েটার বুদ্ধি আছে ও দেখবে কারখানা ঠিকঠাক চালাতে পারবে। প্রোডাকশন বিজনেসও বাড়িয়েছে। ও নিজে এজেন্টদের সাথে কথা বলে সে সব দেখাশোনা করছে। ভবদেব বলেন, তা সত্যি!
সুমিতা নিজের লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে কারখানার কাজও দেখছে। এর মধ্যে বিজনেস ম্যানেজমেন্টের কোর্সও করছে। ওখানেই একটা ছেলের সাথে তার পরিচয় হয়েছে। ছেলেটার নাম সৌরভ। একেবারে সাধারণ ঘরের ছেলে। ওর বাবা স্কুল শিক্ষক। ছেলেবেলা থেকেই সৌরভ মিশুকে আর প্রাণ খোলা প্রকৃতির ছেলে। পড়াশোনায়ও মেধাবী বিজ্ঞানের ছাত্র। তবু বিএসসি পাশ করে সে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে ভর্তি হয়। এক সঙ্গে ক্লাস করার সুবাদে ওদের দু’জনের আলাপ-পরিচয় ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। অবশ্য এ সব কলেজের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে একটা ব্যবসায়িক আর প্রতিযোগীসুলভ মনোভাবের প্রকাশই পায়। তাই স্কুল-কলেজের সহপাঠীদের মধ্যে যে নিঃস্বার্থ আন্তরিকতা গড়ে ওঠে। সেটা এখানে গড়ে ওঠে না। কিন্তু সৌরভ দেখে সুমিতাকে। মেয়েটার সাফল্যের ঋজুতা আর ব্যক্তিত্ব তাকে মুগ্ধ করে। সুমিতার মধ্যে কর্তৃত্ব করার যেন একটা সহজাত প্রবৃত্তি আছে। তাই এর মধ্যে সে ক্লাসের জনপ্রিয় ছাত্রী হয়ে উঠেছে।
বিধানবাবুর সংসারের হাল এতদিন ধরেছিল তাঁর স্ত্রী কল্যাণীদেবী। বিধানবাবু ব্যবসার কাজ নিয়েই ব্যস্ত। ব্যবসার কাজে তাকে ভারতের যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতে হয়। সুমিতা তার ভাই-বোনকে দেখত। ও দু’জনের থেকে স্বতন্ত্র। সুমিতার পোশাক পরিচ্ছদ সাধারণ। প্রসাধনের বাহারও নেই। তার ব্যক্তিগত কোনও চাওয়া নেই। নিজের পড়াশুনো নিয়েই ব্যস্ত। মায়ের চেয়ে বাবার সাথেই তার ঘনিষ্ঠতা বেশি। সে দিক থেকে অমিতা, সুজিতের রুচি আলাদা। সুজিতও অভিজাত স্কুলে পড়ে। সেখানে পড়ে তাদের মতো অর্থবান ঘরের ছেলেরা। আর তাদের মধ্যে বৈভবের যেন একটা প্রদর্শনীই চলে। তাদের চাওয়ার শেষ নেই। কল্যাণী বলে, সুমিতার তো এসব ঝামেলা নেই। সেও পড়াশোনা করে। কত সাধারণ পোশাক। কোনও কোনও দিন বাসেই যাতায়াত করে। অমিতা-সুজিতের গাড়ি না হলে চলে না। তাতে নাকি মান ইজ্জত থাকে না। ওদের হাত খরচে চাই অনেক টাকা। পোশাকের চাহিদাও রকমারি। বিধানবাবু বলেন, সুমিতা কিছু করতে চায়। আর তোরা? তোদের জীবনের লক্ষ্যটা কী বলতে পারিস? সুমিতা সকলের জন্য ভাবে। আর তোদের নিজের কথা ছাড়া আর কারও কথা তো মনে পড়ে না। কল্যাণী বলে, তাই দেখছি।
এইভাবেই সংসার চলে। কিন্তু সবকিছুই একভাবে কোনওদিন চলে না। মাঝে মাঝে প্রকৃতির নিয়মেও ছন্দপতন ঘটে। তার প্রভাব পড়ে মানুষের জীবনেও। বিধানবাবুর সংসারের ছন্দটাও হঠাৎ একদিন কেটে যায়। কল্যাণীর শরীরটা কিছুদিন থেকে ভাল যাচ্ছিল না। জ্বর, বুকে ব্যথা এ সব তো ছিলই। হঠাৎ সেদিন কল্যাণী অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিধানবাবুর বাইরে যাওয়ার প্রোগ্রাম ছিল। কিন্তু আর যাওয়া হয়নি। সুমিতা সবে তার বিজনেস ম্যানেজমেন্টের পরীক্ষা দিয়েছে। দু’দিন পরই কল্যাণী মারা গেল। অবশ্য বিধানবাবু তার চিকিৎসার কোনও ত্রুটি রাখেননি। বড় নার্সিংহোমেও স্ত্রীকে ভর্তি করেছিলেন।
কিন্তু কিছুতেই কিছু করা গেল না, কল্যাণী মারা যেতে ওদের সংসারে যেন একটা শূন্যতা নামে। হালভাঙা নৌকার মতো অবস্থা হয়। সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়।
বিধানবাবুকে ব্যবসার কাজে মাঝে-মধ্যে বাইরে যেতে হয়। সুজিত, অমিতাও বড় হয়েছে। ভবদেববাবুর স্ত্রীও আসে এ বাড়িতে।
মহিলা খুবই হিসাবি।
ভবদেব তার স্ত্রী মণিমালাকে নিয়ে ওদিকে একটা বাড়িতে থাকে। সেই বাড়িটাও বিধানবাবুদের দেওয়া। আর বিধানবাবু থাকেন তার পৈতৃক এই বড় বাড়িটাতে। সামনে পিছনে বেশ খানিকটা বাগান, বাড়িটাও বেশ বড়।
ভবদেবের স্ত্রীও ঘোলা জলে মাছ ধরতে চায়। সে চায়, তাদের বাড়ি ছেড়ে এই বড় বাড়িতে এসে, এ বাড়ির কর্ত্রী হতে। যাতে ভবিষ্যতে তারাই এই বিধানবাবুর আরও অনেক কিছু দখল করতে পারে। ভবদেব স্ত্রীর কথামতো বলে। বিধানদা, এখন তো এই সংসারের ডামাডোল অবস্থা। দিদিও নেই। তুমি তো বাইরে যাবে, ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করা দরকার। তাই যদি বলো, আমরাই এ বাড়িতে থাকতে পারি। মণিমালা এ সংসারের হাল ধরুক।
সুমিতা কথাটা ভেবেছে। দেখেছে যে কদিনই মামা-মামি এ বাড়িতে এসে বাড়ির কাজের লোকের ওপর তাদের কর্তৃত্ব ফলাবার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে সংসারের হিসাব-কিতাব নিয়েও সরকারের সঙ্গে কথা কাটাকাটি শুরু হয়েছে।
সুমিতাই বলে, ওর জন্যে আপনাদের আর কষ্ট দেব না মামাবাবু। আমিই সব সামলে নিতে পারব। তাছাড়া এ বাড়ির পুরনো কাজের মেয়ে সরলা মাসি ও সরকার মশাই আছেন। ওরাই সব সামলে নেবে। তোমাদের কষ্ট করে এখানে থাকতে হবে না। দরকার হলে আমিই খবর দেব মামিমাকে।
ভবদেব মণিমাল দু’জনেই চুপ করে যায়। তারাও বুঝেছে সুমিতার দৃষ্টি একেবারে মর্মভেদী। ও যেন তাদের সব মনের কথা এক নিমিষেই জেনে ফেলেছে। ভবদেববাবু অবশ্য এর আগেও দেখেছেন সুমিতার এই ব্যক্তিত্বকে। মেয়েটা এর মধ্যে ভেসে যাওয়া সংসারের অবস্থাও বদলে ফেলেছে। নিজেই হাল ধরেছে। সুজিত-অমিতার জন্যও গাড়ির ব্যবস্থা হয়েছে। তাদের হাতখরচাও দেয়। কিন্তু ওদেরও দিদির কাছে জানাতে হয় ওদের দৈনন্দিন প্রোগ্রামের কথা। সন্ধ্যার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হয়। সন্ধ্যায় সুমিতা নিজে বাড়ি ফিরে দেখতে চায় ওরা যেন সকলেই ফিরেছে। সুমিতা বলে অমিতাকে, কলেজে পড়ছিস। বন্ধু-বান্ধব তো থাকবেই। আড্ডা দিতে ওদের বাড়িতে ডাক। এখানে আড্ডা দে। ওদের খাওয়া, হইচই কর, বাইরে মাঠে ঘাটে কেন?
সুজিত ওর বন্ধুদের নিয়ে আসে বাড়িতে। সুমিতাও ওদের চা স্ন্যাক্স ইত্যাদির ব্যবস্থা করে। বিধানবাবুও অবাক হন বাড়ির হাল চাল দেখে। আর দেরি হলে সুমিতা বলে, কোথায় গেছিলে বাবা? বলে যাবে তো? ক’দিন থেকেই তোমার শরীর ভাল যাচ্ছে না। প্রেসার-সুগার বেড়েছে। বিধানবাবু বলেন, পার্টি ছিল মিস্টার আগরওয়ালের, তাই দেরি হল। সুমিতা বলে এবার পার্টিতে যাওয়া কমাও। আর গেলে আগে বলবে।
বিধানবাবুও বুঝেছেন এবার কড়া পাল্লাতেই পড়েছেন তিনি।
আর এই শাসনও তাকে মানতে হয়। বিধানবাবু দেখছেন সুমিতা এর মধ্যে বাড়িতে একটা নিয়মানুবর্তিতা এনেছে। অমিতা-সুজিতরা এবার পড়াশোনা করেছে।
অমিতা এর মধ্যে কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে হইচই করে ক্লাব-রেস্তোরাঁতে যেত। বন্ধুদের মধ্যে দেখেছিল প্রবীরকে। ছেলেটা কলেজের ভাল ছাত্র। পড়াশোনাতেও ভাল। অমিতা দেখেছে কলেজের অনেক ছেলেই তার সঙ্গে ভিড়তে চায়। সে গাড়িতে করে কলেজে আসে বড় লোকের মতো। আর ভগবান তাকে রূপের সঙ্গে পয়সাও দিয়েছে। সেই যৌবনের প্রথম স্পর্শে অমিতা যেন মোহময়ী হয়ে উঠেছে। তাই তার চারপাশে বেশ কিছু ছেলেও ভিড় করে।
তাদের মধ্যে এই এলাকার দু’একজন উঠতি নেতার ছেলেও আসে। বিশেষ করে ওদের মধ্যে প্রকাশই যেন অমিতাকে দখল করতে চায়, তার বাবা এখানকার নেতা। সহজেই সে ভোটে জিতে অনায়াসেই অনেক কিছু পেয়ে গেছে। তাই নেতার সুপুত্রও সেই আশা রাখে।
সেদিন অমিতা কলেজে এসেছে। কলেজের ক্যাম্পাস বেশ বড়। ওদিকে পুকুর গাছ-গাছালি রয়েছে। ছেলে-মেয়েরা অবসরে সেখানে গিয়ে বসে। প্রকাশ এর মধ্যে অমিতার ঘনিষ্ঠ হবার জন্য অনেক চেষ্টাই করেছে, কিন্তু অমিতা জানে প্রকাশকে। ওর বাবা কিছুদিন আগেও ছিল সামান্য একজন ঠিকাদার। অমিতাদের বাড়িতেও ওর বাবা যাতায়াত করত। তারপর হঠাৎ নেতা হয়ে গেছে। তার ছেলে প্রকাশ এখন মোটর বাইক নিয়ে কলেজে আসে। এর মধ্যে কিছু চ্যালাও জুটেছে। প্রকাশ অমিতাকে একা নির্জনে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে।
অমিতা ওর দিকে চাইল। প্রকাশ বলে, তোমার জন্যই এলাম অমিতা। চল আজ মেট্রোতে দারুণ একটা ছবি এসেছে, দেখে আসি। তোমার সঙ্গে কিছু কথাও আছে।
অমিতা প্রকাশকে চেনে। তাই ওর প্রস্তাবে চটে উঠে বলে, আমার সময় নেই, আর তোমার সঙ্গে আমার কোনও জরুরি কথাও থাকতে পারে না। যাও তো। ওসব মতলবে এখানে এসো না। তার জন্য অন্য কাউকে খোঁজ গিয়ে।
প্রকাশ হেসে বলে, আরে প্রকাশ যা ভাবে তাই করে। পৃথ্বীরাজ-সংযুক্তার চেপটার পড়েছ তো। জোর করে সংযুক্তাকে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল। আমিও…
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই অমিতা সপাটে প্রকাশের গালে থাপ্পড় মারে। এবার চটে ওঠে প্রকাশ। এভাবে তাকে কেউ চড় মারবে, তা জানা ছিল না প্রকাশের। সে তাই অমিতার হাত ধরে টান দিয়ে বলে, আমাকে চড় মারার তোমার সাহস হয়? তাহলে এবার জরিমানা দিতে হবে চল।
অমিতা বিপদে পড়েছে। প্রকাশের দলও এবার এসে পড়ে। ওরাই বলে, তুলে নিয়ে চল গুরু।
অসহায় অমিতার কাছে এসে পড়ে প্রবীর। তার অতর্কিত ঘুসিতে প্রকাশ ছিটকে পড়ে। প্রকাশ দেখছে প্রবীরকে। আর প্রকাশের দলও এ বার তাদের গুরুকে ধরাশায়ী হতে দেখে, একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রবীরের উপর। কিন্তু প্রবীর একাই ওদের ক’জনকে বেশ জমিয়ে প্রহার করতেই তারা তাদের গুরুকে ফেলে রেখে পালায়। প্রবীর বলে, প্রকাশ, কলেজে পড়াশোনা করতে আসি আমরা।
অমিতা দেখে ওই প্রকাশের অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে একা প্রবীর। তাই ছেলেটাকে তার ভাল লাগে। ক্রমশ অনিতা, প্রবীরের ভক্ত হয়ে পড়ে। ভাল লাগে ছেলেটার নির্লোভ আর সততা দেখে। প্রকাশ এরপর ওই ঘটনার পর অমিতার দিকে এগিয়ে আসার চেষ্টা করেনি।
তারপর থেকে অনিতাই প্রবীরের ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। অনিতা তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। সুমিতাও দেখে ছেলেটাকে, সুন্দর বুদ্ধিদৃপ্ত চেহারা। অমিতা বলে, জান দিদি বাবার কলেজের সেরা ছাত্র প্রবীর। আর এই আমার দিদি, বাবার কারখানার ডেপুটি ম্যানেজার।
প্রবীর সুমিতাকে দেখছে। সুমিতা বলে, তোমরা কথা বল। আমায় একটু বেরতে হবে। অমিতা রবিবার দুপুরে প্রবীরকে লাঞ্চে আসতে বল।
অমিতা বলে, শুনলে প্রবীর, আমাদের বাড়িতে দিদির কথাই শেষ কথা। প্রেসিডেন্ট আমাদের বাবাও কথাটা জানেন।
প্রবীর বলে, অতএব আমাকেও মানতে হবে। আসব রবিবার।
বিধানবাবুর শরীরটাও কিছুদিন ধরে ভাল যাচ্ছে না। এতদিন তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই কারখানা আর ব্যবসাপত্র বাড়িয়েছেন। সারা ভারতে বহু শহরে ঘুরে, সেখানে সাপ্লাই দিয়ে এখন কারখানার প্রোডাকশনও চারগুণ করেছেন। এখন তাঁর শরীর ভেঙে পড়েছে। তাছাড়া স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বিধানবাবুও কেমন অসহায় হয়ে পড়েছেন। প্রেসার-সুগার দুই বেড়েছে, তার সঙ্গে আরও নানা উপসর্গ দেখা দিয়েছে। সুমিতা তাদের হাউস ফিজিসিয়ানকে খবর দেয়। তিনিও দু-তিন জন বড় ডাক্তারকে এনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না।
সুমিতাও ভাবনায় পড়ে। ওদিকে তার কারখানার কাজ রয়েছে। বাবার অসুখে সেও ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অবশ্য ভবদেব মানে মামাবাবুও আসে রোজ অফিসের পর। সুজিতও দেখছে বাবার এই অসুখ। অমিতাও এখন কিছু কিছু কাজ নিজেই করে। ওদের ছত্রভঙ্গ পরিবার বুঝেছে, তাদের সামনে এসেছে বিপদের সংকেত। তাই সুজিত, অমিতারাও সুমিতার পাশে এসে দাঁড়ায়। বাবাকে সুস্থ করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে। ভবদেব ও তার স্ত্রীও আসে। সুমিতা এ বাড়ির কর্তৃত্ব ও অফিসের কর্তৃত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। আর সেসব চালাচ্ছে অত্যন্ত নিপুণভাবে। এটা দেখে ভবদেবের স্ত্রী মণিমালা মোটেই খুশি হতে পারে না। তাই সুমিতার বিপদের দিনে ওরা মৌখিক সমবেদনা জানাতে মনে মনে অন্য কথা ভাবে। ভবদেব জানে বিধানবাবুর একটা কিছু হয়ে গেলে কারখানা আর অফিসের দায় ঠিকমতো সামলাতে পারবে না সুমিতা। তখন সবকিছু ভবদেববাবুর হাতেই এসে পড়বে। আর তখনই ভবদেব নিজের খেলাটা দেখাবে। সেই সুযোগের অপেক্ষাতে আছে ভবদেব। আর সেই সুযোগও এক দিন এসে পড়ে, ডাক্তারদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে বিধানবাবুর অসুখটা বেড়েই চলে। বিধানবাবু বুঝতে পেরেছেন তাঁর দিন ফুরিয়ে এসেছে। এবার তাই তিনি সুমিতাকে বলেন, সুমি! আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে। আমায় এবার যেতে হবে। তোর উপরই কারখানা অফিসের ভার দিয়ে যাচ্ছি। এই সংসারের দু’টো অসহায় প্রাণীর ভারও। অমিতা, সুজিতেরও কেউ রইল না তুই ছাড়া।
সুমিতা বলে, এসব কথা কেন বলছ বাবা?
বিধানবাবুর কথা বলতে কষ্ট হয়, তবু তাকে সব কথা বলতেই হবে। তিনি বলেন, মা তুই কথা দে, আমার বংশের এই কারখানাকে যে কোনভাবে টিকিয়ে রাখবি। অমিতা, সুজিতকে দেখবি। কথা দে মা। কথা দে আমায়।
সুমিতা বলে, এ নিয়ে তুমি ভেব না বাবা। আমি তোমায় কথা দিচ্ছি, তোমার কারখানাকে আমি বাঁচিয়ে রাখব, আরও বড় করব। আর অমিত, সুজিতকেও দেখব।
বিধানবাবু বলেন, তুই আমায় নিশ্চিন্ত করলি মা। জানি তুই এ কাজ পারবি। ঈশ্বর তোকে শক্তি দিন।
সেই রাতেই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে চলে যান পরলোকে। সুমিতা সেদিনগুলোর কথা আজও ভোলেনি। ভোরেই খবর পেয়ে ভবদেববাবু আর তার স্ত্রী এসে পড়েন। সুমিতা, সুজিত এতদিন বুঝতে পারেনি যে তাদের মাথার ওপর একাট বটগাছ ছায়া মেলে ছিল। তাদের আশ্রয় দিয়েছিল। আজ সেই ছায়াটুকু সরে গেছে।
ভবদেববাবু অবশ্য মনে মনে খুশি হয়েছেন। বিধানবাবু নেই। এখন সেই হবে এতবড় কোম্পানির সর্বেসর্বা। আজ সে মহা ব্যস্ত। বিধানবাবুর শেষ সৎকারের দায় তার উপর। কারখানা, অফিসের কর্মীরাও এসেছে। এসেছে প্রেসের লোকজন। টিভি ক্যামেরা নিয়ে এসেছে বিভিন্ন চ্যানেলের লোকজন। বিধানবাবু যে একজন মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন সেটাই ভবদেব সকলকে জানাতে চায়।
কয়েকটা দিন সুমিতার জীবনে, এ বাড়ির মানুষদের জীবনে যেন একটা ঝড়ের নিশানা রেখে দিয়ে যায়, সেই ঝড়ও থেমেছে। এর মধ্যে ক’দিন ভবদেব ও তার স্ত্রী এ বাড়িতে ছিল। বিধানবাবুর কাজকর্ম চুকে যেতে ভবদেব ভেবেছিল সুমিতাই হয়তো তাদের এখানে থাকার কথাটা বলবে। তাহলে ভবদেবও তাদের পরিবারের উপর কর্তৃত্ব ফলাতে পারবে। আর ওর স্ত্রীও এর মধ্যে অমিতার সঙ্গে আলাপটা আরও ভাল জমিয়ে তুলেছে। সুজিতকেও হাতে আনার চেষ্টা করে।
সুমিতাও বুঝেছে তাকে এ বার হিসাব করে পা ফেলতে হবে। তাই সুমিতা এর মধ্যে প্রবীরকেও এ বাড়িতে দু’চারবার ডেকে এনেছে। তাতে খুশিই হয়েছে অমিতা ও সুমিতা কারণ, তারা মানুষ চেনে। সে প্রবীরকে দেখেছে। সাধারণ ঘরের ছেলে। এবার অনার্স নিয়ে বিএসসি পাশ করেছে। এমএসসি পড়ার কথা ভাবছে। কিন্তু প্রবীরের সংসারের অবস্থাও তেমন ভালো নয়। বাবাও রিটায়ার করেছে। বাড়িতে একটা আইবুড়ো বোনও আছে। সংসারের খরচও আছে। তাই পড়া হয়তো হবে না। আর চাকরির বাজারে যা অবস্থা, তাতে ভাল চাকরি পাওয়া মুশকিল।
সুমিতা চায় কারখানায় এ বার কিছু যোগ্য লোককে কাজে লাগাতে। এতদিন ধরে ভবদেববাবু তার পছন্দমতো লোককে রেখেছিল কারখানায়। এখন সুমিতা তার পছন্দমতো টিম নিয়ে কাজ করতে চায়। তার কয়েকজন তরুণ-তরুণীর দরকার। সে চায় যোগ্য শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। এছাড়া একজন ওয়ার্কার্স ম্যানেজারেরও প্রয়োজন তার। ভবদেববাবু অবশ্য বলেন, সুমিতা, সমস্ত স্টাফদের দেখেশুনে নিতে হবে। নইলে যাকে তাকে কাজে নিলে শেষে বিপদে পড়বে। আমি যোগ্য ক্যান্ডিডেটদের তোমার সামনে হাজির করব, দেখবে সবাই কাজের লোক।
সুমিতা জানে মামাবাবু এতদিন বাবাকে না জানিয়ে এমনই বেশ কিছু কাজের লোক এখানে ঢুকিয়েছেন। আর তারা কাজের চেয়ে অকাজই বেশি করে।
সুমিতা সেদিন প্রবীরকে বলে, প্রবীর কেমিস্ট্রি নিয়ে অনার্স পাশ করলে, এ বার কী করবে ভাবছ? প্রবীর ইদানীং এ বাড়িতে যাতায়াত করে সুমিতাকে চিনেছে। সুমিতাও রয়েছে ঘরে।
প্রবীর বলে, তাইতো ভাবছি দিদি। ইচ্ছা ছিল এমএসসিটা করার। কিন্তু সংসারের অবস্থা তেমন নয়। পড়া আর হবে না। চাকরির চেষ্টাই করছি।
সুমিতা বলে, তাহলে আমাদের ফার্মে জয়েন কর কেমিস্ট হিসাবে। ল্যাবে কাজ করবে। আর দু’একমাস কাজ দেখলে বুঝে যাবে। তোমার যোগ্য মাইনেই পাবে। দরকার হলে কোয়ার্টারও। প্রবীর ভাবেনি যে তার সমস্যাটার এইভাবে সমাধান করে দেবে সুমিতা। সে বলে কোয়ার্টারের দরকার এখনই হবে না। বাবা-মা-কে ছেড়ে আসতে চাই না। তবে চাকরিটা খুবই দরকার। তাহলে কালই তোমার বায়োডাটা এবং তিন কপি ছবি দিয়ে একটা দরখাস্ত দিয়ে এস অফিসে। দেখি কী করা যায়। অমিতাও খুশি হয়েছে।
সন্ধ্যায় সুমিতা ফিরেছে কারখানা থেকে। অমিতাও এসেছে দিদির ঘরে। সুমিতা অফিসের জরুরি ফাইল বাড়িতে এনেও কাজ করে। অমিতাকে দেখে বলল। কিরে?
অমিতা কাছে আসে। অমিতা বলে, প্রবীরের চাকরির খুব দরকার ছিল রে দিদি। ওকে চাকরি দিয়ে খুব ভাল কাজ করেছ। খুব খুশি হয়েছি আমি। সুমিতা বলে তোদের খুশিতেই আমার খুশি রে। তাছাড়া প্রবীর তো সৎ নিষ্ঠাবন ছেলে।
ব্যাপারটা দেখে সুজিতও। এখন সে কলেজে পড়ছে। বেশ ডাকাবুকো ধরনের ছেলে। পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে তাই কিছুটা খেয়ালি। ইদানীং সে কলেজের এক সহপাঠীর বোন তনুশ্রীর প্রেমে পড়েছে। তনুশ্রীর বাবা সচলবাবুরও ছোটখাটো একটা ওষুধের দোকান আছে। সচলবাবু অবশ্য জেনেছে সুজিতের পরিচয়।
তনুশ্রীও কলেজে পড়ে। নম্র শান্ত মেয়েটা। প্রথম প্রথম সচলবাবু তনুশ্রীকে সুজিতের সাথে মিশতে দেখে মেয়েকে শাসন করে, ওসব বড় লোকের ছেলেদের সঙ্গে মিশিস না। ওদের খেয়াল খুশির জন্য তোকে চরম মূল্য দিতে হবে। ও তোকে ঠকাবে রে।
তনুশ্রীকে সুজিত এ বাড়িতে এনেছে। অবশ্য দুপুরের দিকেই এনেছে। কারণ এ সময় বড়দি বাড়িতে থাকে না। অমিতার সঙ্গে তনুশ্রীর পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছে।
অমিতারও ভাল লাগে তনুশ্রীকে। সুন্দর গান গায়। বেশ হাসিখুশি সাধারণ একটা মেয়ে। তবু অমিতা বলে, সুজিত, বাড়িতে তনুশ্রীকে আনছিস। ওকে নিয়ে ঘুরছিস, এ সব খবর যদি দিদির কানে ওঠে তখন কি হবে জানিস? সুজিতও দিদিকে সমীহ করে। অথচ দিদিকে ভয় পায়। সুজিত বলে তুই একটু ম্যানেজ করে দে ছোটদি। খুব কঠিন কাজ রে। প্রবীর এ বাড়িতে আসে দিদি ম্যানেজ করেছে অনেক কষ্টে। তবু দিদি ঠিক আমাদের ব্যাপারটা জানে না। এখন ভাবছি যদি জেনে ফেলে প্রবীরের কী হবে কে জানে? আমাকেও ছাড়বে না, যা কড়া মহিলা। সুজিত বলে, আচ্ছা দিদির জীবনে ওরকম প্রেম ট্রেম কিছু নেই? আমিও খবর নিয়েছি কিন্তু ক্লু পাইনি। ওই তো ভয়রে, আমিতো ভাবনায় পড়েছি, সুজিত দেখেছে দিদি নিজেই অমিতার ওই প্রেমের সমস্যাটার অনেকটা সমাধান করে দিয়েছে। প্রবীরও এখন তার গুড ইমেজটা বজায় রেখেছে। কাজ নিয়ে প্রায়ই সে এ বাড়িতে যাতায়াত করে। কারখানার ব্যাপারেও আলোচনা করে। অমিতার সঙ্গে তার মেলামেশাটা অনেক সহজ তাই অমিতাকে বলে, তোর কেস তো ম্যানেজ করে ফেলেছিসরে ছোড়দি। এ বার আমার কেসটা একটু দ্যাখ। প্লিজ! অমিতা বলে, দিদিদের অফিসে বেশ কিছু কর্মী নেওয়া হবে। তুই তনুশ্রীকে দরখাস্ত করতে বল। দরখাস্ত জমা দিক তারপর দেখি কী করা যায়।
সুজিত বলে, ঠিক আছে বলছি তনুশ্রীকে। পরে কেসটার তুই একটু তদ্বির করিস। প্রবীরদাকেও বল। ও তো এখন দিদির কাছের মানুষ। দ্যাখ না যদি ওর একটা হিল্যে হয়।
ভাইবোনের এ সব কথাবার্তা অবশ্য সুমিতা জানে না। তার সামনে এখন কারখানার নতুন ইউনিট গড়ার কাজ। ব্যাঙ্কও লোন দিয়েছে অনেক টাকা। সুমিতাও এ বার নতুন বেশ কিছু ওয়ার্কার্স ম্যানেজার নিতে চায়।
ভবদেব এতদিন এই সব কাজগুলো করেছে। তার ওই পথে সে নিজের লোকেদের ঢুকিয়েছে। তার জন্য অনেকের কাছ থেকে মোটা টাকাও নিয়েছে। কারখানাতে এতদিন তারই প্রাধান্য ছিল। কিন্তু এখন ওসব কাজ নিজেই দেখাশোনা করে সুমিতা। স্টাফদের সঙ্গে, শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে নিজেই কথা বলে। আগে ভবদেব শ্রমিকদের বঞ্চিত করার জন্য নেতাদেরই টাকা দিয়ে খুশি করত আর ওই টাকার অনেকটাই যেত তার পকেটে। এখন তাও বন্ধ। ফলে ভবদেবও চটেছে।
সুমিতা এখন ওকে প্রোডাকসনে রেখেছে। মাল যাতে বেশি তৈরি হয়, গুদামজাত হয় ঠিকমতো সেসব কাজ করতে হয় ভবদেবকে। এসব কাজে সে মোটেই খুশি নয়, তবে মাঝে মাঝে সুমিতা তাকে নিজের চেম্বারে ডাকে পরামর্শ নেয়। ব্যস, ওই পর্যন্ত যা করার তা সুমিতা নিজেই করে। ভবদেব তবু হাল ছাড়েনি। তারই পরিচিত একজন ওয়ার্কার্স ম্যানেজারকে সে এখানে আনতে চায়। এ নিয়ে চার-পাঁচ জনের নাম এসেছে সুমিতার কাছে। তাদের ডেকেছে সুমিতা। ভবদেববাবুকেও রেখেছে সিলেকশন কমিটিতে।
সুমিতা দু-তিনটি ইন্টারভিউ নিয়েছে। এর মধ্যে ভবদেবের প্রার্থীরও ইন্টারভিউ নিয়েছে। এর মধ্যে ভবদেবের ক্যান্ডিডেটও রয়েছে। সুমিতা বায়োডাটা দেখেছে। সাধারণ গ্রাজুয়েট—এর আগে দু-তিনটে কোম্পানিতে কাজও করেছে কিন্তু তার কোনও সার্টিফিকেট নেই। আর সেসব কারখানা উঠে গেছে। একটা কারখানার মালিক, ম্যানেজার ভেজাল ওষুধ তৈরির অপরাধে হাজত বাসও করেছে। ভবদেব বলে, এর অভিজ্ঞতা অনেক। আর কাজের লোক। একেই নাও।
সুমিতা বলে, দেখি আর দু-তিনজনকে—তারপর ডিসিশন নেব।
পরের ক্যান্ডিডেটকে ডেকে পাঠায় সে, একটা তরুণ ছেলে ঢোকে, পোশাকে মার্জিত রুচির ছাপ। বর্ধমানে একটা বড় কোম্পানিতে আছে কিন্তু মালিকের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না। কারণ, তারা চায় ওষুধের মান কিছু নামিয়ে এনে বেশি মুনাফা করতে। তার আপত্তি সেখানেই। বাংলার কোনো মফঃস্বল শহরের ছেলে সে। তাই কলকাতায় চাকরি হলে তারও সুবিধা হয়। সুমিতা ছেলেটাকে চেনে। ওর সাথে জোকায় বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কোর্সও করেছে। ছাত্র হিসাবে ব্রিলিয়ান্ট ছিল বলেই, ক্যাম্পাসেই ওকে ওই নামী কোম্পানি রিক্রুট করে নিয়েছিল। এখন সেখানেই কাজ করছে। সুমিতা এখন কারখানার মালিক তাই সেই পরিচিতিটাকে সে প্রকাশ করে না। আর সৌরভ জানে মালিকদের উচ্ছ্বাস বা আবেগ কোনোটাই দেখাতে নেই। সে এখানে কর্মপ্রার্থী হয়ে এসেছে। তাই সৌরভও ওর সামনে অতীতের পরিচয়টাকে তুলে ধরতে পারে না।
সুমিতা দু-একটা প্রশ্ন করে তাকে বিদায় দেয় তখনকার মতো। ভবদেব এবার বলে, সুমিতা সব ক্যানডিডেট তো দেখলে। তাহলে ওই বিপুলকেই নাও।
সুমিতা বলে, কাল না হয় ডিসিশন নেব। আজ অন্য কাজ আছে মামাবাবু।
ভবদেব বলে, তাই ভাল। চলি ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে।
সৌরভ ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরছে। এমন সময় বেয়ারা এসে ডাকে, সাব! মেমসাব আপকো সেলাম দিয়া, আইয়ে। অন্যরাও ব্যাপারটা দেখে। বিশেষ করে ওই ভবদেবের লোক বিপুলও ব্যাপারটা দেখেছে, তার ধারণা ছিল ভবদেব যখন তার সঙ্গে রফা করেছে, আর টাকার অঙ্ক ঠিকঠাক হয়ে গেছে তখন ওই পাবে চাকরিটা, কিন্তু ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিজে সৌরভকে ডেকে পাঠাতে বিপুলও এ বার প্রমাদ গোনে। তক্ষুনি সে ভবদেবের চেম্বারে গিয়ে ব্যাপারটা ভবদেবকে জানাতে হাজির হয়। ভবদেববাবু ইন্টারভিউ নিয়ে ফিরছেন। তার চেম্বারে এসময় বিপুলকে দেখে বলে, কাল তুমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাবে। তাহলে আমার পঞ্চাশ হাজার টাকা কালই আনবে। চিঠি পাবে টাকা দেবে বিপুল বলে তা আর হবে না ভবদেববাবু। কেস গড়বড় হয়ে গেছে।
ভবদেব বলে, মানে? কি বলছ হে?
বিপুল এ বার খবরটা দিতে ভবদেবও চমকে ওঠে, তাই নাকি? ওই সৌরভ না ফৌরভ তাকে ডেকে পাঠিয়েছে? কি ভেবে ভবদেব আবার বলে, তুমি একটু বসো আমি ব্যাপারটা দেখছি।
সুমিতা, সৌরভকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠিয়েছে? ওর অফিসের পাশে একটা এসি প্রাইভেট রুম আছে সঙ্গে কিচেনও। সেখানে রিলাক্সের সবকিছু ব্যবস্থা রয়েছে। সৌরভকে এতদিন পর দেখে সুমিতা খুশি হয়। সৌরভও বলে, তুমি যে এই কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর তা তো জানতাম না।
সুমিতা বলে, কেন তাহলে কি আসতে না?
সৌরভ হাসে, বলে, না-না, কলকাতার কোনো কোম্পানিতে কাজ পেলে আর বাইরে-বাইরে কাটাতে হবে না, সেই ভেবেই দরখাস্ত দিয়েছি এখানে। সুমিতা বলে, ওখানে তুমি কি পাও জানি না। তবে আমাদের এখানে নতুন ইউনিটের কাজ তুমি জান, তাই আমাদেরও সুবিধা হবে, যদি তুমি এখানে জয়েন কর। তোমার জন্য মাসে কুড়ি হাজার টাকার অফার রইল। পরে যদি ইউনিট লাভজনক হয় তখন তোমার বরাতেও কিছু জুটবে। তাছাড়া গাড়ি বাংলোতো আছেই। তুমি এখানে থাকলে আমিও ভরসা পাব সৌরভ। অন্তত বুঝব আপদে বিপদে আমার পাশে একজন বন্ধু আছে, তাই আমি চাই, তুমি এখানে জয়েন কর।
কিন্তু আগের কোম্পানিতে তো রেজিগনেশন লেটার দিতে হবে।
সুমিতা বলে, তুমি এখানে বসেই ওটা লিখে দাও। আমি ওদের হেড অফিসে ফ্যাক্স করে দিচ্ছি।
সৌরভ বলে, চাকরি তাহলে এখানেই করতে হবে? সুমিতা বলে, ধর তাই। লাঞ্চ করেছ? ওদের সেই কলেজের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। ওরা দু’জনে এই অফিসের কর্মব্যস্ততার মাঝেও অতীতের হারানো দিনে ফিরে যায়। ভবদেবকে ঢুকতে দেখে সুমিতা বলল, মামাবাবু! হঠাৎ ভবদেবও বুঝতে পারেনি সুমিতা কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়ে একজন নতুন ক্যান্ডিডেটের সঙ্গে বসে লাঞ্চ করবে। তাহলে বিপুলের কথাটা সত্যিই।
ভবদেবও সাবধানি লোক। সে বুঝেছে বিপুলের ব্যাপারে আর কথা বলে কোনো লাভই হবে না, তাই ওই প্রসঙ্গে না গিয়ে সে পারচেজের একটা ফাইল এনেছিল, সেটা দেখিয়ে বলে, লাঞ্চের পর ফাইলটা দেখ। ওই কোম্পানির সাপ্লাই করা একলাট মালের কোয়ালিটি ঠিক নেই। সেই লাটের কী হবে?
সুমিতা বলে, আপনার যদি মনে হয় মালের কোয়ালিটি ঠিক নেই, ওই লাটের মাল ফেরত পাঠিয়ে দিন। নেবেন না। তার জন্য আমার অর্ডারের দরকার নেই। আপনিই ওটা ফেরত দেবেন। ঠিক আছে।
ভবদেব কোনও মতে জবাব দিয়ে বেরিয়ে গেল।
সুমিতা শুধোয়, উনি আমাকে চিনবেন। উনি আমার মামা। বাবা ওকে কারখানাতে রেখেছিলেন। এখন প্রোডাকশন দেখেন এক নম্বর ইউনিটের।
সুমিতা যে মামাবাবুর ব্যাপারে খুব একটা খুশি নয়, এটা তার কাজেই প্রকাশ পায় আর সেটা সৌরভেরও নজরে এড়ায় না। তাছাড়া ভবদেব যেভাবে সৌরভকে দেখছিল, সেটা সৌরভ দেখেছে। সে বলে ওর কি কোনও ক্যান্ডিডেট ছিল? ওসব কথা জানে তো।
সুমিতা বলে, তোমাকে বলেছি না আমাকে অনেক বাধার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে, আমি আমার বাবার মৃত্যুর সময় কথা দিয়েছিলাম এই কারখানাকে আমি বাঁচিয়ে রাখব। তাই আমার মতো করেই আমি কারখানা চালাতে চাই। আর সেজন্য তোমার দরকার।
প্রথম দিনেই সৌরভ বুঝেছে এখানে গোপনে একটা চক্র কাজ করছে। আর সুমিতা তাদের সব ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করতে চায়। ভবদেববাবুও বুঝেছেন এবার সুমিতা ক্রমশ তাকে কোণঠাসা করে নিজেই এই কারখানায় সর্বেসর্বা হতে চায়। ভবদেব এ বার গোপনে সুমিতাকে চরম আঘাত দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে।
সৌরভ এখন এই কারখানার কাজকর্ম রপ্ত করে নিয়েছে। এমনিতে কাজের ছেলে সে। আর খুবই বুদ্ধিমান। এর আগে বাইরের বড় কারখানায় কাজ করেছে, তাই লেবারদের নিয়ে কাজ করতে জানে সে। আর অতি আধুনিক এই ইউনিটে সে অল্প লোক নিয়েই কাজ করতে শুরু করেছে। প্রোডাকশনও শুরু হয়েছে আশাতীত ভাবেই। সুমিতাও খুশি।
প্রবীরও এখন কারখানায় কাজ করছে। আর সেও এর মধ্যে সৌরভের ভক্ত হয়ে উঠেছে। ভবদেব অবশ্য চেষ্টা করছে প্রবীরকে তার দলে আনতে। আর তার দলে এলে প্রবীরের যে লাভ হবে সেটাও বুঝিয়েছে ভবদেব।
সুমিতাকে শ্রদ্ধা করে প্রবীর। সুমিতাও দেখেছে অমিতাকে দিয়ে কোনও কাজটাই হবে না। সুমিতা নিজে মেয়ে হয়ে এই কারখানা চালাচ্ছে। সেও চেয়েছিল তার কারখানায় মেয়েরা আসুক। মেয়ে কর্মীদের নিয়েই সে বেশ কয়েকটা বিভাগের কাজ চালাচ্ছে।
ভবদেবের আপত্তি ছিল সেখানেই। ছেলেদের সহজে হাতে আনা যায় কিন্তু সেখানকার মালিক যখন মহিলা, তাই মহিলা কর্মচারীরা সহজেই মহিলা মালিককে সমর্থন করবে। তাই মহিলাদের চাকরিতে আনার ব্যাপারে ভবদেব বলে, ছাগল দিয়ে কি যব মাড়াবে সুমিতা? সুমিতা বলে, আজকালকার মেয়েদেরও সাবলম্বী হতে হবে। তারাও কাজ করতে পারে যে কোন পুরুষের মতো, সেইটা দেখাতে চাই।
ভবদেব ওই উত্তর শুনে চুপ করে যায়। তারপর সুমিতা বেশ কিছু মেয়েকে কাজে নেয়। তাদের মধ্যে তনুশ্রীও রয়েছে। তনুশ্রী এখানে কাজের মধ্যে ডুবে গেছে। অমিতাও কয়েকদিন এসেছিল। কিন্তু অমিতা কয়েকদিন কাজ করেই হাঁপিয়ে ওঠে। বলে ওই যন্ত্রপাতির শব্দ আর হইচইয়ের মধ্যে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসেরে দিদি।
অবশ্য প্রবীর বলে, প্রথম-প্রথম ওসব একটু খারাপই লাগে। তারপরে সব সয়ে যাবে। অমিতা বলে, না বাবা ওসব পারব না।
সুমিতা দেখছে সকলেই কারখানায় থাকলে বাড়ি যেন শূন্য পুরী হয়ে উঠবে। তাই সুমিতা বলে, তাহলে বিয়ে-থা করে ঘর-সংসার দ্যাখ। প্রবীরকে বলি?
এই কথাটায় অমিতা খুশি হয়। তবু খানিক সঙ্কোচ করে বলে, বড় বোন থাকতে ছোটর বিয়ে?
সুমিতা বলে, আমার ঘাড়ে তো অনেক দায়রে। আমি এক কারখানা নিয়েই হাবুডুবু খাচ্ছি। আগে তোদের থিতু করি। বাবাকে কথা দিয়েছিলাম, কারখানাটা ঠিকমতো চালাব। তোদের ঘর সংসার করে দিয়ে নিজের কথা ভাবব, তারপর যদি সময় পাই।
ভবদেব ব্যাপারটা দেখে। বোধহয় প্রবীরকে সে হাতে আনতে পেরেছে। ভবদেব এর মধ্যে গোপনে একটা বিরাট কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে কারখানায়। সে ভেবেছিল, কারখানাকে বিধানবাবুর মৃত্যুর পর সে গ্রাস করবে। কিন্তু সুমিতা তা হতে দেয়নি। পদে পদে সুমিতা ভবদেবকে বাধা দিয়েছে। তাই এবার ভবদেবও সুমিতাকে উচিত শিক্ষা দিতে চায়।
এমন দিনে প্রবীরের বিয়ে হয়ে যায় অমিতার সঙ্গে। ভবদেববাবুও খুশি হয়। কারণ, এবার প্রবীরও তার স্ত্রী অমিতার জন্যই ওই কারখানার অংশীদার হবে। আর তাকে হাতে আনতে পারলে সুবিধা হবে ভবদেবের। সুজিত এখন কারখানায় কাজ করছে। আর এখন সে ঠিক সময়মতো কাজে আসে। তাকে দু-তিনটে বিভাগের কাজও দেখতে হয়। বিশেষ করে লেবেলিং সেকশনের কাজ। তনুশ্রীও এই বিভাগেই কাজ করে, সৌরভও এই দু’নম্বর ইউনিটের ম্যানেজার। প্রোডাকশন থেকে লেবেলিং প্যাকিং হয়ে স্টিটিংয়ের কাজও তাকে দেখতে হয়। সৌরভও বিভিন্ন বিভাগে ঘোরে। সুজিতও তাকে চেনে।
সুমিতা এমনিতে কড়া মেজাজের মালিক। সব দিকে তার নজর আছে। অফিসে খুবই গম্ভীর হয়ে থাকে। একমাত্র সৌরভ সহজেই তার চেম্বারে যাতায়াত করে। সৌরভের কেউ নেই। এখানে একলা একটা বাংলোয় থাকে। তাই সুমিতা ওকে মাঝে মাঝে চেম্বারে ডাকে লাঞ্চের জন্য। দু’জনে হাসি-তামাশাও হয়। তখন সুমিতা অন্য মানুষ। সুজিত ব্যাপারটা লক্ষ রেখেছে।
প্রবীরের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে অমিতার, অমিতাও খুশি হয়েছে ঘর-সংসার নিয়ে। সুমিতার কথাতেই প্রবীরও রয়েছে এই বড় বাড়িটাতে। শূন্য বাড়িটাকে আবার সাজাচ্ছে অমিতা। সুমিতা বলে, সত্যি অমিতা তোরা আছিস তাই বাড়িটা ভরে আছে। নইলে এই শূন্যপুরীতে আমি আর সুজিত দু’জনে থাকতে পারতাম না রে।
প্রবীর জানায়, দিদি এ বার সুজিতের বিয়ে-থা দিন। ওতো এখন মন দিয়ে কারখানার কাজকর্ম করছে।
সুজিতও রয়েছে। সন্ধ্যার পর ওদের পরিবারের আসর বসে বাড়িতে। অমিতা বলে, তাই দাও দিদি। অবশ্য সুজিত অবশ্য এর মধ্যে মেয়ে পছন্দ করেছে। আর মেয়েটাকে তুমি দেখেছ।
সুমিতা বলে, তাই নাকি? সুজিতও তাহলে সাবালক হয়ে উঠেছে। তা মেয়েটা কে রে?
সুজিত চুপ করে থাকে। প্রবীরও হাসছে। অমিতাই বলে, কিরে সুজিত। তাকে যখন আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলি তখন তো বীরত্ব দেখালি, এখন চুপ করে আছিস কেন? জানিস দিদি প্যাকিং সেকশনে ওর কথাতেই সৌরভবাবু ওকে কাজ দিয়েছেন। ওর নাম তনুশ্রী।
সুমিতা তার কর্মচারীদের প্রায় সকলকেই চেনে। মনে পড়ে তার সেই শান্ত মিষ্টি মুখের মেয়েটাকে। এ বার সুমিতা বলে, তাহলে আমাকে না জানিয়ে ব্যাপারটা এতদূর গড়িয়েছে। ঠিক আছে, এখন মন দিয়ে কাজ কর। তারপর আমিও ভেবে দেখি।
সুজিত দিদিকে সমীহ করে। জানে দিদি অন্যায় কিছু করবে না।
প্রবীর বলে, আশা হারিও না সুজিত। সবুর করো, সবুরে মেওয়া ফলে।
হঠাৎ এমন দিনে সুমিতাই চমকে ওঠে। ছ’মাসের কাজের রিপোর্ট দেখে, তার কারখানায় লাখ লাখ টাকার মাল তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেসব মালের বেশির ভাগের কোনো হদিশ নাই। স্টোরেও যায়নি। অথচ স্টোর থেকে দেখা যাচ্ছে চালান বিল করে লাখ লাখ টাকার মাল বাইরে গেছে। স্টোরেও এন্ট্রি নেই।
এইভাবে দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিতভাবে কারখানার মাল চলে গেছে। তাই এবার কারখানা প্রচুর টাকা লোকসানে পড়েছে। এতদিনের নামী কারখানা হঠাৎ এইভাবে চরম বিপদে পড়বে তা ভাবতে পারেনি সুমিতা। সৌরভও আসে সুমিতার চেম্বারে। প্রবীরও এসেছে। আর সবার আগে এসেছে ভবদেববাবুও। তার চিন্তাই বেশি। সে বলে, কোম্পানির এতবড় লোকসান সামলাবে কি করে? এবার তো সর্বনাশ হবে। সামনে বোর্ড মিটিং। শেয়ার হোল্ডাররাও জেনে গেছে যে এ বার আমাদের কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। তারপর ব্যাঙ্কও তাদের টাকা ফেরত চাইবে। এতটাকা কোথা থেকে দেব। হয়তো ওরা কারখানাই জামানত করে নেবে।
সুমিতা কথাটা ভাবছে। মনে পড়ে মৃত্যুশয্যায় বাবাকে কথা দিয়েছিল যেভাবে হোক কারখানা সে চালাবে। আরও বড় করবে, এতদিন ধরে সে তাই করে এসেছে। ভাই-বোনদের বিয়ে দিয়ে সংসারী করেছে, কখনও নিজের ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেনি।
তার চিরন্তন নারী মনও মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু সুমিতা জানে এখনও তার সে সময় আসেনি। হয়তো একদিন তারও সময় আসবে। কিন্তু হঠাৎ সামনে এই দুর্বার বাধা তার মনের সব সুরকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। আজ কারখানা যেতে বসেছে।
ভবদেববাবু তার গোপন খেলা খেলে আজ সুমিতাকে চরম বিপদে ফেলেছে। এই কারখানার দিকে শহরের এক শ্রেণীর লোকের নজর ছিল। তারা চায় এই কারখানাকে যেভাবে হোক গ্রাস করতে। তাই তারা ভবদেবের মতো লোভী মানুষকেই হাতে এনে এইভাবে নানা অপকর্ম করে কারখানার বিপদ ডেকে এনেছে। এ বার তারাই ভবদেবকে সামনে রেখে উঠে পড়ে লেগেছে, সুমিতাকে সরিয়ে নিজেরাই এই কারখানার দখল নিতে। তাই বোর্ড মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়েছে।
সুমিতার এই বিপদে প্রবীর, সুজিতও চেষ্টা করে সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু তারাও পারে না। ভবদেবও হইচই করে মাত্র, কাজের কাজ কিছু হয় না। সৌরভ সবই শুনেছে। এর মধ্যে সেও ভবদেবের সঙ্গে সুমিতার কথাও জেনেছে। সুমিতা বলে, এখন কী হবে সৌরভ!
সৌরভ ভাবতে থাকে। সে বলে একটা কিছু করতেই হবে, তুমি ভেব না।
ক’দিন সৌরভের দেখা নেই। ভবদেব বলে, সৌরভ আসার পর থেকেই এই কারখানায় এতবড় কাণ্ড ঘটে গেল। আমার মনে হয় এসব ওরই কাজ। তাই পালিয়েছে।
সুমিতাও ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারে না। বোর্ড মিটিং এসে গেছে। কালই ডিরেক্টররা ঝাঁপিয়ে পড়বে সুমিতার উপর। ভবদেব এ বার সাধু সাজতে চায় সে বলে, এসব তো মালিকদেরই দেখতে হবে। আমি তো কর্মচারী মাত্র।
সুমিতা আজ সম্পূর্ণ একা। বোর্ড মিটিংয়ে ডিরেক্টররাও তৈরি হয়ে এসেছে। যে সব ব্যাঙ্ক তাদের টাকা দিয়েছে তারাও এসেছে। টাকা ফেরত দিতে না পারলে আইনের পথে যাবে তারা। সুমিতা নিজেকে অসহায় মনে করে। বাবাকে দেওয়া কথা সে রাখতে পারেনি। আজ ওকে ঘিরে ধরে অন্য ডিরেক্টররা। তারা প্রস্তাব আনে এ কারখানার ম্যানেজমেন্ট তাদের হাতে দেওয়া হোক। তারা ব্যাঙ্কের টাকা ফেরত দেবে ছ’মাসের মধ্যে।
মিস্টার আগরওয়াল বলেন, আমি কারখানার ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব নিতে রাজি আছি। সব দেনাও মিটিয়ে দেব।
ভবদেবও রয়েছে। সেও এই প্রস্তাবে সমর্থন করে বলে, তবু কোম্পানি যদি যাঁচে কোম্পানির স্বার্থ শ্রমিকদের জন্যই এই নতুন প্রস্তাব মেনে নেওয়া যেতে পারে।
সুমিতার চোখে জল আসে। আজ তার সব হারিয়ে গেল। এমন সময় ঝড়ের মতো এসে পড়ে সৌরভ। তার সঙ্গে ডেপুটি পুলিশ কমিশনার, কিছু পুলিশ অফিসার। সৌরভ বলে, ওই উনি ভবদেববাবু। আর উনি মিস্টার আগরওয়াল। অ্যারেস্ট করুন ওদের।
সকলেই হতবাক হয়ে যায়। পুলিশ অফিসার বলে, মিস্টার আগরওয়াল আপনার রিভার সাইড গুদামে এই কোম্পানির কোটি টাকার ওষুধ পাওয়া গেছে।
সুমিতা চমকে উঠে। সৌরভ বলে, ওরা কোম্পানির ছ’মাসের প্রোডাকশনের বেশির ভাগ মাল ভবদেববাবুর সই করা। চালান নিয়ে ওই গুদামে পাচার করে রেখেছে। ওখান থেকেই আরও প্রচুর মাল ওরা বাজারে ছেড়ে লাখ লাখ টাকাও তুলেছে।
—সেকি! সুমিতা চমকে ওঠে।
এ বার অন্যান্য ডিরেক্টররাও হতবাক। পুলিশ অফিসার বলেন, ভবদেববাবু আপনি এই কারখানাকে শেষ করে দেবার জন্যেই মিঃ আগরওয়ালের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই জঘন্য কাজ করেছেন। আপনাদের দু’জনকে অ্যারেস্ট করা হল। বাকিদেরও খুঁজে বের করবই।
এবার সুমিতাও নিশ্চিত হয়। কারখানার এইসব মাল ফেরত পেলে কোম্পানি তার লোকসান পুষিয়ে লাভই করবে। আবার পুরোদমে চলবে তাদের কারখানার কাজ। আর এ বার সুমিতা কিছু বলার আগে সৌরভ কোম্পানির এই ছয় মাসের সব হিসাব পেশ করে বোর্ডের সামনে। নিখুঁতভাবে। সুমিতা জানে সৌরভ বিজনেস ম্যানেজমেন্টের কৃতী ছাত্র ছিল। তার এ সব বিষয়ে জ্ঞান কিছু কম নয়। সে কয়েক মিনিটের মধ্যে কোম্পানির বর্তমান অবস্থার নিখুঁত ছবিটা সংখ্যাতত্ব দিয়ে তুলে ধরে, বোর্ডের মেম্বার বা ব্যাঙ্কের অফিসারদের সামনে। ওই ভবদেববাবু, আগরওয়ালের গুদামে ধরাপড়া সব মালের হিসাব আর ওদের অন্যসব বিক্রির হিসাব দিয়ে বলে, কোম্পানি প্রচুর লাভ করেছে বর্তমান ম্যানেজিং ডিরেক্টর-এর অক্লান্ত নিঃস্বার্থ পরিশ্রমে। এত পরিবারের অন্ন সংস্থান হয়েছে। কিন্তু ওই লোভী স্বার্থপর দু-তিনজন লোক একটা দুষ্টচক্র তৈরি করে এইভাবে ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে সরিয়ে নিজেরা এই কারখানার দখল নিতে চায়। আপনারা কি এটা সমর্থন করেন?
এবার ডিরেক্টর শেয়ার হোল্ডাররা ব্যাঙ্কের লোকদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে। তারাই এ বার এতবড় ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে বলে, না, এ ব্যবস্থাই বহাল থাকুক। এই কারখানার মালিকানা থাকবে সুমিতাদেবীর হাতেই।
পুলিশ ভবদেব, আগরওয়ালদের ধরে নিয়ে যায়।
সন্ধ্যা নেমেছে বড় বাড়িটায়। আজ সেখানে খুশির আলোয় ঝলমল করে চারিদিক। আজ সুমিতা তার হারানো কারখানাকে আবার ফিরে পেয়েছে। প্রবীর, অমিতা, সুজিত, তনুশ্রীরাও খুশি। সুমিতার মনেও কি যেন স্বপ্নের আভাস জাগে। সৌরভ তার জীবনে যেন নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন আনে।
—