অবসর

অবসর

ভুবনবাবু একটানা আটত্রিশ বছর ধরে স্যামরসন কোম্পানিতে কাজ করার পর আজ রিটায়ার করতে চলেছেন। দীর্ঘ আটত্রিশ বছর ধরে ভুবনবাবু ঠনঠনিয়ার দিকে একটা গলির একটা পুরনো বাড়ির একতলায় থেকেছেন। আর সেই অতীতের ইংরেজ শাসনের দিনগুলোকেও দেখেছেন কিছুটা। তখন ইংরেজের জমানা শেষ হয়ে আসছে। তবু প্রদীপ নেভবার আগে যেমন শেষবারের মতো প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে, তেমন ইংরেজের জমানা শেষ হবার আগেও ইংরেজদের দাপট টিকেই ছিল।

সে সময় ম্যাট্রিক পাশ করার পর দুবছর কলেজেও পড়েছেন ভুবনবাবু। তখন তরতাজা তরুণের দূর সম্পর্কের এক কাকা কাজ করতেন সেই সাহেবদের ফার্মে। ভুবনের বাবা আগেই মারা গেছেন। মা ভাইবোনদের নিয়ে কাকার সংসারে থাকতেন আশ্রিতের মতো। কাকাই সংসার টেনে এসেছে। আর তাই ভুবন বড় হতে কাকা-ই চেষ্টাচরিত্র করে ভুবনের একটা চাকরি করে দেন। তাতে কাকারও কিছুটা ভার কমে। তারপর কাকা তার নিজের অফিসের মেজবাবুকে বলে কয়ে ভুবনের জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করেন।

ভুবনের মনে পড়ে সেই চাকরির প্রথম দিনের কথাগুলো। সেই সাহেবি আমলে কলকাতায় এত ভিড় ছিল না। পথঘাটও ছিল সাফসুতরো। পথে হকাররা গিজগিজ করত না, ভিড়ও ছিল না। সুন্দর সাজানো অফিস, বড় হলঘর। সারবন্দি বাবুরা কাজ করছে—সবাই চুপচাপ। একটানা খটাখট টাইপ মেশিনের শব্দ ওঠে। লোকজন অত্যন্ত সাবধানে মার্জিতভাবে চলাফেরা করছে যাতে জুতোর শব্দ না ওঠে।

এমন সময় দেখা যায় লালমুখো এক সাহেবকে। সকলেই উঠে দাঁড়ায়। সাহেব গিয়ে ঢুকল ওর খাস কামরায়। ভুবনের কাকা বলে—ওই মিঃ হ্যাডারসন সাহেব।

ভুবনও এই প্রথম একজন সাহেবকে এত কাছ থেকে দেখল।

বড়বাবু বলে—কই হে শিবু। তোমার ভাইপোর দরখাস্তটা দাও। সাহেবের সই করিয়ে আনি।

ভুবনের কাকা ভুবনের সই করা দরখাস্তটা দেয়। বলে—দেখুন কাজটা যাতে হয়।

বড়বাবুও ভুবনের দিকে চেয়ে বলে—কী, মন দিয়ে কাজটা করবে তো?

ভুবন ঘাড় নাড়ে। বড়বাবু উঠে বড় সাহেবের ঘরে যান। ভুবন তখন বসে দুর্গানাম জপ করছে। সেদিনই তার চাকরি হয়ে গেল। অবশ্য একবার সাহেবের ঘরে ডাকও পড়েছিল। ভুবন মাকালী-মাদুর্গার নাম জপ করতে-করতে ওর ঘরে গিয়ে হাতজোড় করে নমস্কার করে। সাহেব একবার তাকে আপাদমস্তক দেখে জিজ্ঞাসা করেন—ডু ইউ নো ইংলিশ?

ভুবন ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। সাহেব বলেন—গো।

সেদিন থেকেই ভুবনবাবুর যাত্রা শুরু। তারপর কত বছর কেটে গেছে। কত জনস্রোতও বয়ে গেছে। ইতিহাসের বহু অধ্যায় পার হয়ে গেছে। দাঙ্গা-মন্বন্তর-দেশবিভাগ—ভারতের দীর্ঘ পরাধীনতার পর এসেছে স্বাধীনতা।

ভুবন সেসব দিনের সাক্ষী। ইংরেজরা চলে যাবার পর এদেশের অবস্থাও দেখেছে সে। দেশের মধ্যে এসেছে পরিবর্তন। আর পরিবর্তন এসেছে ভুবনের জীবনেও। মা আজ নেই, ভাইরাও চাকরি করে অন্যত্র থাকে। তার বোনেদের বিয়ে-থা হয়ে গেছে, তাদেরও বাড়বাড়ন্ত সংসার। ভুবনের দিনও বদলেছে। তার ছেলেরাও বড় হয়েছে। দুই ছেলেই এখন চাকরি করে। বড় ছেলের বিয়ে দিয়েছে। মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। দীর্ঘ এতগুলো বছর পর তার জীবনেও এসেছে অনেক পূর্ণতা। এখন আর ঠনঠনিয়ার দু-কামরার ভাড়াবাড়িতে থাকে না।

বরানগরের ওদিকে ভুবন নিজে বাড়ি করেছে আর সেখানেই থাকে সপরিবারে। সেখান থেকেই অফিসে যাতায়াত করেছে এতকাল। এবার তার ছুটি। ভুবন হিসাব করে দেখে যে, তার জীবন থেকে প্রায় আটত্রিশটা বছর কখন ওর অজান্তে পার হয়েছে। এখন ওই অফিসের কর্তৃত্ব আর সাহেবদের হাতে নেই। সেখানে অবাঙালি কোনো একটা গোষ্ঠী এই অফিস ব্যবসাপত্র চালাচ্ছে।

আগের সেই পরিবেশ আর নেই। মাঝে মাঝেই কর্মচারী মালিকদের মধ্যে পাওনাগণ্ডা-বোনাস—এসব নিয়ে ঝামেলা বাধে। অফিস চত্বরে স্লোগান ধ্বনিত হয়। গোবিন্দবাবু ওদের সহকর্মী, বলেন,—ভুবনদা, মানে মানে চলে যেতে পারছ এই ভালো। যা অবস্থা চলছে তাতে কখন বলতে কখন কোম্পানিই না উঠে যায়।

ভুবনকে আজ বিদায় সম্বর্ধনা জানানো হয় অফিসের স্টাফ রিক্রিয়েশন ক্লাব থেকে। ভুবনবাবু দীর্ঘদিন এই কোম্পানিতে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছে। অধঃস্তন কেরানি থেকে অফিসের বড়বাবু হয়েছিল। এতদিনের চাকরিতে ছুটিছাটাও বিশেষ নেয়নি সে। আর হাজিরা ছিল ঘড়িবাঁধা। সব কাজই করত নিষ্ঠার সঙ্গে। কোম্পানির বর্তমান মালিকানা যাদের সেই অবাঙালি বাবুরা কাজের লোক বলে শ্রদ্ধা করত। অফিসের স্টাফদের হয়েই ভুবনবাবু কথা বলত মালিকদের সঙ্গে।

কর্তারা ভুবনবাবুর কর্মনিষ্ঠা সততার মর্যাদা দিত। তাই আজ কর্তারাও বসেছে ওই বিদায় সভায়। ওই স্টাফেদেরই একজনের মেয়ে বিদায় সম্বর্ধনায় গান গায়, দু-চারজন সহকর্মী ভাষণ দেয়। সে যে একজন আদর্শ কর্মী এবং সুহৃদয় সহকর্মী তাও তারা ওই সভায় জানিয়ে দেয়। অফিসের এম. ডি. তাকে সম্বর্ধনা জানিয়ে প্রশংসাপত্র দিলেন। মালা-মিষ্টি-ঘড়ি-গীতা-লাঠি এবং একখানা শালও দেওয়া হয় তাকে। ভুবনবাবুকে তারা ঘটা করেই বিদায় জানাল। অর্থাৎ পাকাপাকিভাবে তারা তাকে জানিয়ে দেয় যে কাল থেকে সে অফিসের কেউ নয়। আজই তার পালা শেষ।

কোম্পানির গাড়িতে করেই আজ বাড়ি ফিরলেন ভুবনবাবু ওই সব উপহার ফুল মালা নিয়ে। বিসর্জনের আগে বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে ফুল মালায় সাজিয়ে প্রতিমাকে যেমন বিসর্জন দেওয়া হয় ঘটা করে, তেমন তারাও ভুবনবাবুকে বরানগরের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যায়। যাবার আগে দু-একজন সহকর্মী অবশ্য বলেন—মাঝে মাঝে আসবেন দাদা, একেবারে ভুল যাবেন না।

ভুবনের মনে পড়ে অতীতের কত কথা। এবার সে সব পরিণত হবে শুধুমাত্র স্মৃতিতে। সহকর্মীদের সঙ্গেও আর দেখা হবে না—সুখ দুঃখের সঙ্গীরা হারিয়ে যাবে। কিন্তু তাকে তো মেনে নিতেই হবে।

ভুবনবাবু পরদিন সকালে উঠে যথারীতি গঙ্গার ধারে একটা চক্কর দিয়ে আসেন। সকালটা বেশ অন্যরকম লাগে তাঁর। তখনও শহরের বহু লোকের ঘুম ভাঙেনি। লোকজনের কলরবও শুরু হয়নি। এদিকে এখনও গাছগাছালি কিছু আছে। তাই পাখিদের কলরব এখনও শোনা যায়। গঙ্গার বুকে হালকা কুয়াশার আস্তরণ। দু-একটা নৌকা যেন কোনো নিরুদ্দেশের পথে হারিয়ে যায়।

ক্রমশ দিনের আলো ফুটে ওঠে। গঙ্গার অন্য তীরে দেখা যায় বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দির। কেমন একটা প্রশান্তির স্বাদ পান ভুবনবাবু। এতদিন চাকরির ঘানিতে সে বাঁধা ছিল। এখন মুক্ত। এতদিন তাঁর পরিচিত জগৎটাকে ভালো করে দেখা হয়নি। সেখানে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনি কাজের মধ্যে ডুবে ছিলেন। এবার সে-ও যাবে মঠের শান্ত পবিত্র পরিবেশে। হয়ত-বা কোনো তীর্থে যাবে, হরিদ্বারে।

বেলা বাড়ে। পথে লোকজন গাড়ি রিক্সার ভিড় বাড়ছে। ব্যস্ত কেরানি বাবুরা থলি হাতে বাজারের পথে বেরিয়ে পড়েছে, কেউবা এরই মধ্যে বাজার সেরে ফিরছে। সেইসব মানুষগুলো ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল রেখে দৌড়চ্ছে। ভুবনবাবুও এখন সকালে ভ্রমণ সেরে ফেরার পথে বাজার সেরে ফেরেন। এখনও বাজারটা নিজে হাতেই করেন।

বড়ছেলে ন-টার মধ্যে বের হয়ে যায়। ছোটছেলে সরকারি অফিসে কাজ করে। দশটায় তার ডিউটি শুরু। অবশ্য তখন সে স্নান করতে ঢোকে। ধীরে সুস্থে খেয়ে-দেয়ে বারোটার আগেই অফিসে হাজির হয়। তার ঘুম ভাঙে ন-টায়। তাই বাজারটা ভুবনবাবুকে করতে হয়। তাছাড়া বাজারের দাম যা বাড়ছে তাতে হিসাব করে বাজার না করলে খরচা বেড়ে যাবে। ছোট ছেলে এখন মাঝে মাঝে বাজারে যায়। তাই ভুবনবাবু একটু সময় পান। আজ তাই একটু বেলা করেই বাড়ি ফিরেছেন তিনি। অফিসের তাড়া নেই। এখন তাঁর ছুটির মেজাজ। গিন্নি বলে—এত দেরি হল ফিরতে?

—আর তো অফিসের তাড়া নেই।

ভুবনবাবুর বড় বউমা চা নিয়ে এসে বলে—ছোটন কোনো বন্ধুর বাড়ি গেছে।

গিন্নি বলে—বাজার যেতে হবে। চা খেয়ে বাজারটা সেরে এসো।

ভুবনবাবু থলি নিয়ে বাজারে যান। পথে তখন অফিস যাত্রীর ভিড় শুরু হয়েছে। লোকজন-গাড়ি-বাস-অটো সবই তখন গাদাগাদি ভিড় শুরু হয়েছে। পাশের গলির নবীনবাবু বাসের জন্য দাঁড়িয়ে হঠাৎ ভুবনকে দেখে বলে— কী হে, আজ অফিস যাবে না ভুবন?

—অফিসের পাট চুকিয়ে দিয়েছি হে। কালই তো রিটায়ার করলাম।

—বেঁচে গেছ হে।

তারপরই নবীনবাবু চলন্ত বাস লক্ষ্য করে দৌড় শুরু করেন। কোনোরকমে বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলন্ত অবস্থায় লাফিয়ে পাদানিতে উঠে পড়েন, তারপরই হুস করে বেরিয়ে গেলেন। ভুবনের মনে হয় সত্যিই একটা দুর্বার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছে সে। অফিসের বাবুদের বাজারে যে কিছু কদর আছে অন্যদের চেয়ে, সেটা আজ বুঝেছেন ভুবনবাবু। অন্যদিন সকালে প্রাতঃভ্রমণ সেরে বাজারে আসতেন, তখন বিক্রেতারা মাঠে আনাজপত্র নিয়ে বসে। বেশ টাটকা। তরতাজা সবজি আনাজপত্র। দরও বেশি—ফড়ে বেপারিরাও জানে ওরা শাঁসালো খদ্দের। তাই আদরযত্ন করে জিনিসপত্র দেয়। ভালো জিনিস।

এখন অফিস বাবুদের ভিড় আর নেই। আনাজপত্র সবজির ভালোগুলো চলে গছে তাদের থলিতে। পড়ে আছে বাছাই করা বাতিল কিছু মাল। আর বাজারে এখন বাতিল কিছু মানুষ ওইসব বাতিল জিনিসপত্র হাতড়াচ্ছে। কোনোদিন এমন সময় বাজারে আসেননি ভুবনবাবু। আজ চমকে ওঠেন তিনি বুড়ো বাতিল মানুষের ভিড় দেখে। তারা রীতিমতো দরদস্তুর করে বেশ কম দামেই মাল কেনে। বেপারিরাও যেন জানে ওদের সামর্থ্যও সীমিত, তাই যেন দয়া করে কম দামে দিয়ে দেয় ওইসব মালপত্র। কে বলে—দাদু বলছেন যখন এত করে নিন—ঝিঙে দিচ্ছি পাঁচ টাকা কিলো, পটল ছ-টাকায় দিচ্ছি।

অবশ্য এতদিন ভুবনবাবু এসব মাল সকালে বেশি দামেই কিনতেন। ভুবনবাবু বাজারে ঘুরে অন্যদের মতো সস্তা দরেই জিনিস খুঁজছে। এতদিন টাকার জন্য তত ভাবনা চিন্তা ছিল না। তাঁর ছেলেরাও সংসারে টাকা দেয়। ইলেকট্রিক বিল, ফোনের বিল ওরা ভাগাভাগি করে দেয়। ভুবনবাবু নিজেও যা পেত অফিস থেকে তাও নেহাত কম ছিল না। কিন্তু এখন তো আর মাসে মাসে সে টাকাটা পাওয়া যাবে না। গ্র্যাচুইটি প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকায় হাত দেওয়া যাবে না। ওর সুদ থেকেই তাঁদের বুড়োবুড়ির দিন চালাতে হবে। ছেলেদের বোঝা হয়ে থাকতে চান না ভুবনবাবু। তাছাড়া হরিদ্বার বৃন্দাবন ঘুরে আসার ইচ্ছাও আছে। টাকার দরকার, তাই আজ থেকেই ভুবনবাবু অন্যদের মতো সাবধান হতে চান। বেলায় মাছওয়ালারাও তাদের কাটা মাছগুলো বিক্রি করে ফেলতে চায়। কম দামে তারা দিয়ে দেয়। ভুবনবাবু আজ আগেকার সত্তর টাকার বাজার প্রায় পঞ্চান্ন টাকায় সেরে গলদঘর্ম হয়ে বাড়ি ফেরেন। গিন্নি, বউমাও তাঁর বাজার দেখে খুশি। আনাজপত্র-সবজি ও মাছ এনেছে বেশি-বেশি। মাছওয়ালা মাছের মাথা একটু কম দামেই দিয়েছে। বউমা বলে— বাবা, আপনার বাজার আর তাঁদের বাজার? যা বলি আনে না, বলে যা দাম। আপনি তো দারুণ বাজার করেছেন।

গিন্নিও সায় দেয়।

—ছেলেদের দিয়ে হবে না। তুমিই বেলায় বাজারে গিয়ে বেশি করে মাছ আনবে। বউমা ফ্রিজে রেখে দেবে। পরদিন সকালে রমেন-নীরেনকে দেব।

ভুবনবাবু আগে বাজার সেরেই অফিসে যাবার জন্য স্নান করতে যেতেন। খেয়ে-দেয়ে ছুটতে হত অফিসে। আজ অফিস নেই। রান্নারও দেরি আছে। ছোট বউমা বলে—বাবা, চারটে মুড়ি আর চা দিই সঙ্গে আলুভাজা।

ভুবনবাবুর জীবনযাত্রার রুটিনটাই যেন বদলে যেতে শুরু করেছে একদিনের মধ্যে। গিন্নি বলে—শুকনো মুড়ি দাও মা। বয়স হচ্ছে, আলু কম খাওয়া ভালো। ওর আবার সুগারের ধাত। হ্যাঁ, চায়ে আজ থেকে চিনিও খেও না।

ভুবনবাবু বলেন—সে কি! চিনি আলু…

—রিটায়ার করেছ ওসব বন্ধ। এখন সাবধানে থাকতে হবে।

রিটায়ার করার পরদিন তাঁর জীবন থেকে সব মিষ্টতাকেও হারাতে হবে এটা ভাবেননি তিনি। অবশ্য ছোট বউমা বলে—মা, একেবারে ওসব বন্ধ করা ঠিক হবে না। কম করে দিচ্ছি।

বেলা বাড়ছে, নাতি-নাতনিরাও স্কুলে। গিন্নি-বউমারাও সংসারের কাজে ব্যস্ত। ছেলেরাও অপিসে। দুপুরে খাওয়ার অভ্যাস নেই ভুবনবাবুর। সপ্তাহে একদিন ছিল তাঁর ছুটি। তাছাড়া অন্য সময় তিনি ছুটি বিশেষ নেননি। আজ বেলা যেন কাটতেই চায় না। খবরের কাগজের সব খবর মায় বিজ্ঞাপন অবধি পড়া হয়ে গেছে। খেতে বেলা হয়ে যায়। দুপুরবেলাটা যেন কাটতে চায় না। মনে পড়ে কর্মব্যস্ত শহরের কথা। এসময় ভুবনবাবুর মুখ তোলারও সময় থাকত না। ফাইলের পর ফাইল জমত টেবিলে। সব চিঠির উত্তর দেখে-শুনে সব কোটেশনের দর যাচাই করে সব ফাইল পাঠাতে হত বড় সাহেবের ঘরে। বিকেল গড়িয়ে যেত হাতের কাজ শেষ করতে।

আজ বিছানায় তিনি বসে আছেন বেকার, তবু ঘুম আসে না। তখনও গিন্নি-বউমাদের দিবানিদ্রা চলছে। ওরা ঘুমোতে অভ্যস্ত। এর মধ্যে নাতি-নাতনিরা একে একে স্কুল থেকে ফিরছে। ভুবনবাবু বের হচ্ছেন। বিকেলের ছায়া নামছে। গঙ্গার ধারের গাছগাছালি ঘেরা মাঠে এদিক-ওদিকে বেশ কয়েকটা বেঞ্চও রয়েছে। বেশ কিছু বয়স্ক লোকজন এসে পড়েছে। বিকেলে কোনোদিন এখানে এসেছেন বলে মনে পড়ে না ভুবনবাবুর। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ছে। গঙ্গার বুকে আলো কমে আসছে। এখন গঙ্গার বুকে সিঁদুরের আভা ক্রমশ কালচে হচ্ছে। দু-একটা নৌকা অজানা লক্ষ্যে হারিয়ে গেল। ঘরে-ফেরা পাখিদের কলরব ওঠে। আকাশের অঙ্গনে দু-একটা করে ভীরু তারা ফুটে ওঠে। ওপারে মন্দির থেকে শঙ্খ ঘণ্টার সুর নদীর বিস্তারে কেঁপে কেঁপে ভেসে আসে। একটা দিন ফুরিয়ে গেল। ভুবনবাবুর খেয়াল হয় পার্কে লোকজনের ভিড় কমে এসেছে। তাঁকেও বাড়ি ফিরতে হবে। পায়ে পায়ে বাড়ির দিকে এগোতে থাকেন।

অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে দেরি হত। অফিস ছুটির পর জরুরি কাজ নিয়ে কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হয়। আজ সেসব নেই। সন্ধ্যার পরই বাড়ি ফেরেন ভুবনবাবু। সন্ধ্যাটা যেন তাঁর কাটতেই চায় না। নাতি-নাতনিরা পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। এসময় টিভিও খোলা যাবে না। এতদিন শুধু অফিস-চাকরি নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন তিনি। পাড়ার লাইব্রেরিতে বয়স্কদের দু-পাঁচজন যায় এসময়। ওসব আসরেও কোনোদিন যাননি ভুবনবাবু। সন্ধ্যাটা তাই বিশ্রী লাগে তাঁর।

ভুবনবাবু অবসর নেবার পরই কেমন যেন অসহায় বোধ করেন। মনে হয় ওই চলমান জীবন থেকে তিনি যেন ছিটকে পড়েছেন কোনো বাতিলের দলে। তাঁর কিছু করার নেই—সমাজে তাঁর দেবারও যেন কিছু নেই। এখন শুধু দিন গোনার পালা। তিনি দেখেছেন গঙ্গার ধারে পার্কে বসে থাকা ওই লাঠিতে ভর দিয়ে চলা বৃদ্ধদের। ওরা সবাই যেন এক একজন সমুদ্রের বুকে এক-একটা নির্জন দ্বীপ। ওদের চারপাশে জনসমুদ্র, ওরা স্থির স্থবির।

নিজেকে ওইভাবে ভাবতে ভয় লাগে ভুবনবাবুর। সংসারের মধ্যে থেকেও তিনি যেন নিঃসঙ্গ। ভুবনবাবুর মনে হয়, তিনি কাজ করুন না করুন কালই খেয়ে-দেয়ে অফিসে যাবেন। তবু চেনা মুখ অনেক দেখতে পাবেন। তাদের সঙ্গে কথাবার্তাও হবে। এইভাবে একা চুপচাপ থাকা অসম্ভব।

ভুবনবাবু সকালে উঠে প্রাতঃভ্রমণে বের হতে যাবেন গিন্নির আওয়াজ শুনে পিছনে চাইলেন। গিন্নি ওঁর হাতে দুধের ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে বলে—সেই বের হচ্ছ, ফেরার পথে পাউরুটি এনো। দুধের ডিপো থেকে দুধ এনো। কার্ডগুলো নিয়ে যেও। যা ভুলো মন তোমার, না হলে দুধই দেবে না।

সকালে গঙ্গার ধারে বেশ কয়েক পাক ঘুরে ফেরার পথে দুধের ডিপোর সামনে এসে দেখেন এর মধ্যে বিরাট লাইন পড়ে গেছে। দুধের ডিপোতে বিশেষ আসেননি। বাড়ির কাজের মেয়েটা কদিন ছুটি নিয়েছে তাই আসতে হয়েছে তাঁকে। দেখে মনে হয় দুধের ডিপোতে বোধ হয় ভোর থেকেই লাইন পড়ে আর সেই লাইন যেন নড়তে চায় না। লাইনটা এঁকেবেঁকে গেছে আর নড়ছে মৃদুমন্দ গতিতে। দুধের ডিপোতে প্রায় আধঘণ্টা কেটে গেল দুধ নিয়ে ফিরতে। ছোট বউমা চা আনে। ওদিকে গিন্নি বলে—চা খেয়ে বাজারটা সেরে এসো। বেশি বেলায় বাজারে গেলে সেই কুড়োনো মালপত্রই পাবে।

ভুবনবাবু সকালের দিকে বাজারে যান। এখন বাবুদের বাজার চলছে। আনাজপত্র তাজাই মেলে। ভালো মাছও তখন রয়েছে। বেলায় বাজারে সেই বাতিল হতাশাময় মুখগুলো দেখা যাবে। ভুবনবাবু তাঁর চারিদিকে তরতাজা থাকা মুখগুলোকে দেখেন। বাজার থেকে ফিরে একটু বসেন ভুবনবাবু। বেলা দশটা বাজে। দুই ছেলেই বেরিয়ে গেছে। জলখাবার পর এবার বড় বউমা বলে—বাবা গোপালের মা তো ক’দিন ছুটে নিয়েছে, মন্টু আর নিন্টুকে স্কুলে পৌঁছে দিতে হবে। এদিকে রান্নার কাজ না হলে আমিই যেতাম। গিন্নি বলে— বউমা, তুমি আবার ওদের দুজনের স্কুলে কখন যাবে। ভুবনবাবুকে বলে—তোমার তো অফিস নেই ঘরে বসে কী করবে। তুমিই বরং রিক্সা করে ওদের দুজনের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এসো। সাবধানে যাবে দুটোই একেবারে বাঁদর।

ভুবনবাবু সবে খবরের কাগজখানা নিয়ে বসেছিলেন। আগে খবরের কাগজ পড়ার সময়ও তাঁর হত না। ওই লোকের মুখেই খবর শুনতেন তিনি। এখন তারিয়ে তারিয়ে খবর কাগজটা পড়েন। এখন গিন্নির হুকুমে সে উপায়ও নেই। দুই দুরন্ত নাতিকে নিয়ে বের হতে হল ওদের স্কুলে পৌঁছে দেবার জন্য।

রিক্সায় চলেছে মন্টু আর নিন্টু। আজ দাদুকে কাছে পেয়ে ইস্কুলের গল্প। ইস্কুলের আন্টির গল্প—অন্য বন্ধুদের গল্প দাদুকে বলতে থাকে। এসব জগতের খবর, ওই শিশুমনের স্বপ্ন জগতের সন্ধান আগে জানতেন না ভুবনবাবু। গুলি খেলার নিয়ম-কানুনও ছিল তাঁর অজানা। কোন দোকানে ভালো টুনি মার্বেল সস্তায় মেলে এ খবরও জানতেন না। তাঁর জগৎ ছিল ফাইল আর বড় সাহেবের জগৎ। ফুল, পাখি, রঙিন মার্বেল ভুবনবাবুর অজানা ছিল।

মন্টু বলে—তোমাকে একদিন হরিয়াল, বুলবুলি পাখি দেখাতে নিয়ে যাব।

নিন্টু বলে—আর রঙিন প্রজাপতিও।

ওদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ফিরছেন ভুবনবাবু। বেলা হয়ে গেছে, বাড়ি ফিরতে বেশ বেলা হয়ে যায়।

গিন্নি বলে—এবার স্নান করে খেয়ে নিয়ে খবরের কাগজ পড়বে। ওঠো।

দুপুর নামে। সকাল থেকে ভুবনবাবুর বেশ ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে। বেলাও হয়েছে কখন টের পাননি। খাবার পর কেমন মিষ্টি আলস্যে তার শরীর ভেঙে আসে। ঘুম নামে চোখের পাতায়, অফিসের ঝামেলা নেই। তবু একটা বেলা কোনদিক দিয়ে কেটে গেল টেরও পান না। বিকেল নামছে। গিন্নির ডাকে উঠে বসেন ভুবনবাবু। গিন্নি বলে—কী আক্কেল গো তোমার। মন্টু-নিন্টুকে তো ও বেলায় ইস্কুলে দিয়ে এলে, ওদের আনতে হবে না? গোপালের মা নেই। বড় বউমা গেছে ওর মায়ের ওখানে। ছোট বউমাও নেই। কে আনবে ওদের?

ভুবনবাবুর খেয়াল হয় ওদের আনতে হবে তাঁকেই। আর তো কেউ নেই। বের হয়ে পড়েন তিনি। বিকেল নামছে। পথে ঘাটে আবার লোকজনের ভিড় বাড়ছে। পসারের লোকজনও ভাতঘুম সেরে আবার দোকান খুলছে। চলমান জীবনের প্রবাহ শুরু হয়েছে। ভুবনবাবু এই চলমান জীবনের প্রবাহে সামিল হয়েছেন। স্কুল থেকে মন্টু-নিন্টুদের নিয়ে ফিরছেন। নিন্টু বলে—দাদু ওদিকটা ঘুরে চলো না।

—তাই চলো দাদু। পার্কে এখন কত ছেলেমেয়ে খেলা করে। চলো।

ভুবনবাবু ওদের গঙ্গার ধারে পার্কে নিয়ে আসেন। বিকেলের মিষ্টি রোদের আভা ম্লান হয়ে আছেন। গাছে গাছে ঘরে-ফেরা পাখিদের কলরব জাগে। মন্টু-নিন্টুরাও খেলায় মেতে গেছে। আকাশে-বাতাসে ভেসে ওঠে কচিকাচা গলার খুশির কলরব।

ভুবনবাবুর কাছে পাখির ডাক—কচি কাচাদের কাকলিমুখর এই আলো-আঁধারের জগৎটা ছিল অচেনা। প্রজাপতির দল উড়ছে ফুলের মেলায়। কোনো শিশু টলমল পায়ে দৌড়চ্ছে সেই উড়ন্ত রঙিন প্রজাপতির দিকে। সন্ধ্যা নামছে। নদীর ওপারে বেলুড় মঠে আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। গঙ্গার জলের ছলছল শব্দ শোনা যাচ্ছে। ভুবনবাবু নতুন এক জগৎকে আবিষ্কার করে। নিন্টু-মন্টুদের খেলা শেষ। ওদের নিয়ে ঘরে ফেরেন তিনি। নিন্টু বলে—আইসক্রিম খাওয়াবে না দাদু? বাড়িতে মা একদম খেতে দেয় না।

মন্টুও আবদার করে—দাও না দাদু, বাড়িতে কেউ জানতে পারবে না।

ভুবনবাবু আজ সব বিধি-নিষেধ ভেঙে তিনটে আইসক্রিম কেনেন। ওদের খুশিটা ভুবনের মনেও সংক্রামিত হচ্ছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় একটু বিশ্রাম করে নিশ্চিন্তে খবরের কাগজটা পড়বেন তিনি। দেশের হালচাল সম্বন্ধে কিছু খবর রাখা দরকার। এসে পড়ে নিন্টু। হাতে বইখাতা। দুরন্ত মেয়েটা ভুবনবাবুর পাশে বসে বলে—দাদু, কাল স্কুলের টাস্কগুলো তৈরি করে নিয়ে যেতে হবে। মাকে বললাম, মা বলে, দাদুর কাছে নিয়ে যা। ট্রানস্লেশন গ্রামারগুলো একটু দেখিয়ে দাও না।

মাথার একরাশ চুল ঝাঁকান দিয়ে সরিয়ে খাতাটা খুলে ধরে দাদুর সামনে।

ভুবনবাবু বহুদিন পর আবার যেন স্কুল জীবনের সেই হারানো দিনগুলোতে ফিরে যান। নাউন-প্রোনাউন নিয়ে পড়েন। ভুবনবাবুর এখন আর সময় নেই। ভোর থেকে তাঁর কাজ শুরু হয়। একটার পর একটা কাজ। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে ওঠেন, ঘড়ি ধরে কাজ করতে করতে। বিকেলে নিন্টু-মন্টুদের নিয়ে পার্কে যান। সন্ধ্যার সময় গঙ্গার এপারের গাছগাছালি ঘেরা পার্কে বসে থাকেন। কচিকাচাদের খেলায় তিনিও সামিল হন। হারিয়ে যান পাখিদের কলরবে। নদীর ওপারে মন্দিরে যাবার কথা প্রথম দিনই ভেবেছিলেন তিনি। এখনও পর্যন্ত যাবার সময় হয়নি ওখানে।

সংসার—এই নাতিরা—সবাই যেন দু’হাত বাড়িয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। সারাদিন ওদের নিয়েই কাজে-ঠাসা চাকরি থেকে অবসর নেবার পর ভুবনবাবু যেন আরও বড় এক বাঁধনে বাঁধা পড়ে গেছেন। দিনগুলো কোন দিকে কেটে যাচ্ছে তা জানতেও পারেন না। সংসার যেন তাঁকে আরও নিবিড়ভাবে একটা বাঁধনে বেঁধে রেখেছে। সংসারের মধ্যেই যেন নদীর ওপারের মন্দিরের প্রশান্তি তাঁকে স্পর্শ করেছে। তার জন্য ভুবনবাবুকে ওপারে যেতে হয়নি। এপারেই তার স্পর্শ পেয়েছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *