মুখোমুখি

মুখোমুখি

কলিং বেলটা হঠাৎ বেজে ওঠে। আজ সুমিতা একাই রয়েছে ফ্ল্যাটে। স্বামী সুদীপ অফিসে। একমাত্র মেয়ে বর্ষাকে স্কুলের বাসে তুলে দিয়ে এসে সবে স্নান সেরেছে সুমিতা। এমন সময় বেলটা বেজে উঠল কর্কশ শব্দে। বর্ষা কি স্কুল থেকে ফিরে এল? স্কুলে ধর্মঘট কিনা, কে জানে! নাকি সুদীপই ফিরে এল অফিস থেকে! কিন্তু ওর বেল বাজানোর ধরনটা তার চেনা। এই শব্দটা কেমন অচেনা ঠেকে। সমিতা ভিজে চুলগুলো টাওয়েলে জড়িয়ে ফ্ল্যাটের দরজার কি-হোলে নজর করে দেখল, একটি যুবক ওদিকে দাঁড়িয়ে বেল টিপছে। বয়স আঠারো-উনিশ হবে বোধহয়। বেশ সুন্দর চেহারা। মুখে একটা কোমলতা। ঠিক চিনতে পারে না। কে জানে, এই হাউজিং কমপ্লেক্সে নতুন এসেছে কিনা? ছেলেটাকে দেখে কেমন নিরীহ মনে হয় সুমিতার। তাই অনেক ভেবেচিন্তে দরজাটা খুলে চাইল ওর দিকে।

”এটাই তো সুদীপ সেনের বাড়ি?”

”হ্যাঁ।”

সুমিতা দরজা আগলেই দাঁড়িয়ে থাকে যাতে ও সহজে ভিতরে ঢুকতে না পারে। ছেলেটি এবার সুমিতাকে প্রণাম করে চাইল। সুমিতা অবাক হয়ে দেখছে ওকে। ছেলেটার পরনে স্মার্ট পোশাক, আধুনিক বলা যেতে পারে। ওইরকম স্মার্ট একটা ছেলে তাকে প্রণাম করবে, এ কথা সে ভাবেনি।

”তুমি?” সুমিতা ওকে তুমিই বলে। বয়সে তার তুলনায় ছোটই হবে বোধহয়।

এবার ছেলেটা বলে, ”আমাকে চিনতে পারছ না মা?”

হঠাৎ যেন বহু দূর থেকে একটা চেনা কণ্ঠস্বর ফুটে ওঠে, তার সঙ্গে অনেক স্মৃতির তুফান যেন ধেয়ে আসে সুমিতার মনে।

ছেলেটা বলে, ”মা! আমি সুনির্মল।”

”নির্মল!” অস্ফুট কণ্ঠে বলে ওঠে সুমিতা, ওই নামটা তার একদিন ছিল খুব চেনাজানা, আপন। ক’বছর ধরেই সুনির্মলকে সে নির্মল বলেই ডাকত। তাই আজও ওকে নির্মল বলেই ডাকে সুমিতা। তারপর কী ভেবে ওকে দরজা থেকেই ফিরিয়ে দিতে চেয়েও পারে না। বলে, ”ভিতরে এসো।”

দরজা বন্ধ করে সুনির্মলকে বসার জায়গায় এনে বসতে বলে। যেন সুনির্মলের উপস্থিতিটা আর কাউকে জানাতে চায় না। সুনির্মল বলে, ”অনেকদিন তোমাকে দেখিনি। মাঝেমাঝে মন কেমন করে। এবার বি.এসসি পাস করলাম ফিজিক্স-এ অনার্স নিয়ে, এম.এসসিতে ভর্তি হয়েছি। তোমায় প্রণাম করতে এলাম।” সুমিতা স্তব্ধ হয়ে শুনছে ওর কথা। দেখছে ওই যুবকটিকে, একদিন সে ছিল তার আত্মজ, নিজের। যাকে সে জন্ম দিয়েছিল, এইটুকু থেকে মানুষ করছিল। একদিন যাকে অস্বীকার করে আবার নতুন ঘর বেঁধেছিল। সেই ছোট ছেলেটা আজ কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবনে পা দিয়েছে। দীর্ঘদিনের বিচ্ছেদে সেই আপনজন আজ অচেনা পর হয়ে গেছে। আজ মা-ছেলে একে অপরের কাছে অচেনা, অন্য মানুষ।

সুমিতা ফ্রিজ থেকে একটা প্লেটে দুটো সন্দেশ বের করে আনে। তখন বেলা প্রায় এগারোটা বাজে। জলের বোতল থেকে জল দিয়ে বলে, ”নাও।”

সুনির্মল সন্দেশ দুটো খাচ্ছে। দেখছে সুমিতার সাজানো সংসার। দু’জনেই স্তব্ধ। যেন সব কথা ফুরিয়ে গেছে ওদের।

সুমিতা স্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলে, ”টাকাকড়ির দরকার?”

টাকাটাই সুমিতার কাছে একমাত্র মূল্যবান প্রয়োজনীয় বস্তু। ওর জন্যই সুমিতা আজ অতীতকে অস্বীকার করে নতুন করে ঘর বেঁধেছে। আর জানে, এর প্রয়োজনেই মানুষ একে অপরের কাছে আসে।

সুনির্মল বলে, ”না, না। টাকার জন্য আসিনি। তোমায় কতদিন দেখিনি, মনখারাপ লাগছিল, তাই খুঁজে খুঁজে চলে এসেছি।”

”এখানকার ঠিকানা পেলে কোথায়?” সুমিতা জেরা করার ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে।

”তোমাদের ও বাড়ির মেজবাবুর ছেলে আমায় চেনে। সেই-ই দিয়েছে।”

সুনির্মল দেখছে সুমিতার মুখচোখে কঠিন ভাবটা। সেখানে প্রফুল্লতার কোনও চিহ্নই নেই। সুনির্মল বলে, ”আজ চলি মা।”

উঠে পড়ে সে। বের হয়ে যেতে সুমিতা বেশ জোরে দরজাটা বন্ধ করে। সামনের আয়নাটার দিকে চোখ পড়ে তার। নিজেকে অচেনা মনে হয়। মনে হয়, কয়েকমিনিট নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে সে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে।

রাস্তায় নেমে সুনির্মলও বেশ আশ্বস্ত বোধ করে। দীর্ঘ প্রায় আট-দশ বছর মায়ের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। তার বাবা বিমলবাবুও খোঁজ রাখেনি। সুনির্মল শেষবার মাকে দেখেছিল এক ঝলক, কয়েকবছর আগে। তখন সে স্কুলে পড়ে। মায়ের কথা বারবার মনে পড়ে তার। ওর বাবা বিমলবাবু তখন একটা বেসরকারি অফিসে কাজ করত। সুমিতা ওই ছোট সংসারে অনেক স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল। সুমিতা প্রথম থেকেই এ বিয়েটাকে মেনে নিতে পারেনি। সে ভাল গান গাইত। অনেক অনুষ্ঠানে ও তখন গাইছে। তার স্বপ্ন ছিল বড় শিল্পী হওয়ার। কিন্তু মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের উপরে ওঠার অনেক বাধা। সুমিতার বাবা রিটায়ার করে মেয়ের বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু টাকার অভাবে সুপাত্র জোটানো মুশকিল হয়ে পড়ে। এমন সময় বিমলই এগিয়ে আসে। সৎপাত্র, সুচাকুরে। বেশ হইচই করা ফুর্তিবাজ তরুণ। নাটক নিয়েই থাকে। অন্য কোনও নেশা নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা, ছেলেটার কোনও পিছুটান নেই। বাবা-মা ভাইবোন, কারও বোঝা টানতে হবে না। একেবারে ন্যাড়া তালগাছ, ডালপালার বালাই নেই, মেয়ে স্বাধীনভাবে ঘর করবে।

সুমিতা বাবা-মায়ের অনুরোধ এড়াতে পারে না। বিয়ে করে নতুন সংসারে আসে। অবশ্য বিমলের সংসার তার কাছে পাখির বাসা। একটু হাওয়াতে নড়ে ওঠে। অনেক হিসেব করে মাস মাইনেতে চালাতে হয়। একটু ওদিক-এদিক হলেই টলমল করে ওঠে। সুমিতার শখ দামি শাড়ি গয়নার। একটু আরাম, একটু স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার স্বপ্ন দেখত সে। কিন্তু বিমলের সংসারে এসে স্বপ্নগুলো কেমন বিবর্ণ হয়ে ঝরে পড়ে। আর ও গানও গাইতে পারে না ঠিকমতো। সাজগোজ করার সঙ্গতি নেই। তাই নিয়ে সুমিতার মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

এমন সময় একদিন আবিষ্কার করে সুমিতা, সে বিমলের সন্তানের মা হতে চলেছে। এ যেন এক নিষ্ঠুর পরিহাস। যে সংসার থেকে সে মুক্তি পেতে চেয়েছিল, সেই সংসারে আজ সে বন্দি হয়ে গেল। তবু মুক্তি খোঁজে সুমিতা। তাদের অভাবের সংসারে আসে তাদের সন্তান সুনির্মল, সুমিতার জীবনের সব স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটল তখনই। ওই সুনির্মল আর বিমল এজন্য দায়ী। তবু সুমিতা ভেবেছিল চলে যাবে সে বাবার কাছে। সে মুক্তি পেতে চায়। কিন্তু তার বাবাও মারা গেছে। সেখানেও তার ঠাঁই নেই। তাই অসহায় সুমিতা এই বন্দি জীবনকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। সুনির্মল মাকে কাছে পেতে চায় সন্তানের দাবিতে। সুমিতা যেটুকু করার সেটুকু মাত্র করে। সুনির্মল বা বিমলকে কাছে টেনে নিতে পারে না সে। ছোট-ছোট তুচ্ছ কারণে চটে ওঠে। ছেলেকে মারধর করে।

বিমল বলে, ”ওকে মারছ কেন? ছেলেমানুষ, দুষ্টুমি করেছে।”

গর্জে ওঠে সুমিতা, ”হবে না? বাঁদর ছেলে। বাপ যেমন।”

বিমল জানে সুমিতার বুকভরা অতৃপ্তির কথা। এটা যেন তারও অক্ষমতা। তাই চুপ করে যায় সে। সুনির্মল পড়াশোনায় ভাল মেধাবী ছেলে। মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত। এমন দিনে এ বাড়িতে আসে সুদীপ। আহিরীটোলার ওদিকে কোনও বনেদি পরিবারের ছেলে। সুমিতা তাকে চেনে। বিমলদের ক্লাবে থিয়েটার করে। সেই সুবাদে বিমলের বন্ধু।

সুদীপ বনেদি বাড়ির ছেলে। আগের অবস্থা এখন নেই। তবু বড় বাড়ি ঠাট-বাট রয়েছে। আর নিজেও ভাল চাকরি করে। সুদীপের ওই চাকরিতে আমদানিও ভাল। বড় কোম্পানির পারচেজের চাকরি। কোম্পানির এক্সপোর্টের ব্যবসা, নানা পার্টির কাছে নানা ধরনের মালপত্র পাঠাতে হয়। আর পারচেজ অফিসারের আমদানিও ভালই হয়। তাই সুদীপও দরাজ হাতে খরচ করে।

সেজন্যই সুমিতার আরও বেশি ভাল লাগে সুদীপকে। সুদীপ আসে বিমলের বাড়িতে। ক্রমে তার আসা-যাওয়া বাড়তে থাকে। সুদীপ সুনির্মলের জন্য দামি চকোলেট, কখনও নামী কোম্পানির পেস্ট্রি আনে।

বিমল বলে, ”আবার এতসব কেন?”

সুদীপ হাসে, সুমিতার সন্ধেটা কোনদিক দিয়ে যে কেটে যায়। বিমল সংসারের চাপে অফিসে প্রায়ই ওভারটাইম করে থাকে। সংসারের সুরাহা হয়। শুধু ওইটুকু মাইনেতে সংসার, সুনির্মলের পড়ার খরচ চলে না। তাই আজকাল তাকে গাধার খাটনি খাটতে হয়। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে রাত দশটায় বাড়ি ফেরে সে। সন্ধ্যাটা সুমিতার যেন কাটতে চাইত না। সুদীপ অফিস ফেরত এখানে আসে। সুমিতাও ওর পথ চেয়ে থাকে। ওর সামনে নিজেকে বেশ সাজিয়েগুছিয়ে তৈরি করে। সন্ধ্যায় হারমোনিয়াম নিয়ে বসে। তার গলায় আবার সুর ফিরে এসেছে। সুদীপও গান ভালবাসে, সে বলে, ”আমাদের অফিসের অনুষ্ঠানে তোমাকে গাইতে হবে এই শুক্রবার।”

খুশি হয় সুমিতা। সুদীপ আসার পর থেকে তার স্বপ্নগুলো আবার ফিরে আসছে। তবু সুমিতা বলে, ”ওমা! গান তো প্রায় ছেড়েই দিয়েছি।”

”কই, বেশ তো গাও। চর্চাটা রাখো, এখন গান গেয়েও একজন ভালভাবে বাঁচতে পারে।”

এই স্বপ্নই তো দেখেছিল সুমিতা। কিন্তু বিমলের সংসারে এসে এই স্বপ্নগুলো হারিয়ে গেছে। সুদীপ আবার তার মনে নতুন আশার সুর জাগিয়েছে।

সুদীপের অনুষ্ঠানে গেয়েছে সুমিতা। তার রূপ-যৌবন আর সুর দর্শকদের মন জয় করে। সুমিতাও যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে। কর্মকর্তারা তাকে একটা দামি বিষ্ণুপুরী শাড়ি উপহার দেয়।

বিমল ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে। দেখে সুনির্মল একাই রয়েছে। সুমিতা নেই। সুনির্মল বলে, ”মা অনুষ্ঠানে গেছে সুদীপকাকুর সঙ্গে।”

বিমল বলে, ”তোকে একা ফেলে অনুষ্ঠানে গেছে?”

সুনির্মলের শিশুমনেও একটা নীরব অভিমান জমছে। সে এর আগেও দেখেছে, মা যেন তাকেও কেমন এড়িয়ে চলে সুদীপকাকু এলে। মা বলে, ”এ ঘরে পড়ো।”

নির্মলকে এ ঘরে আটকে রেখে ওই ঘরে ওদের হাসিখুশির পরিবেশ গড়ে ওঠে। সুনির্মলও দেখেছে, বাড়িতে বাবা থাকলে মা কেমন গম্ভীর হয়ে থাকে। বাবার সঙ্গে, তার সঙ্গে বেশি কথাও বলে না। কিন্তু সুদীপকাকু এলে মা কেমন বদলে যায়।

সুনির্মলের ও-ঘরে এখন যাওয়ার হুকুম নেই। ওদের আনন্দের জগৎ থেকে সুনির্মল, বিমল সকলেই নির্বাসিত। ওটা যেন সুদীপ-সুমিতার স্বতন্ত্র এক জগৎ। বিমল নিজেই হাতমুখ ধুয়ে বলে, ”খেয়ে নে নিমু।”

সুমিতা রাত্রে কাজও করে না। সকালের রান্না যা থাকে, আর বিমল দোকান থেকে রুটি কিনে আনে। ওরা ওই ঠাণ্ডা তরকারি আর রুটি খায়। সুমিতা-সুদীপ দু’জনে একসঙ্গে বাড়িতে ঢোকে। বিমলকে দেখে সুদীপ বলে, ”সুমিতা দারুণ গেয়েছে রে বিমল।”

সুমিতা সেই দামি শাড়িখানা দেখায়, পাঁচহাজার টাকা দাম হবে। সেই সঙ্গে দামি কেটারারের খাবারের প্যাকেট দুটোও টেবিলে নামিয়ে দেয়। বিমল চুপচাপ দেখছে। সুদীপ বলে, ”আজ চলি।” চলে যায় সুদীপ।

সুমিতা বলে, ”খাবারগুলো খেয়ে নিও। আমি খেয়ে এসেছি।”

সে ভিতরে চলে যায়। ফিরে এসে দেখে বিমল, সুনির্মলের খাওয়া হয়ে গেছে। ওরা ওই দামি খাবার স্পর্শও করেনি। সুমিতার মনে হয় যে, তার কৃতিত্বের খবরটা ওরা মেনে নিতে পারেনি।

সুদীপই আরও দু’এক জায়গায় সুমিতার প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করে।

বিমল বলে, ”ওসবের কী দরকার?”

সুমিতা বলে, ”তোমার তো ওই রোজগার। লোকে সেধে ডেকে নিয়ে যায় গান গাইতে, টাকা দেয়। কেন যাব না?”

বিমলও বুঝেছে, সুমিতা এবার যেন নিজের কথাটাই বেশি করে ভাবছে আর সেই ভাবনাটাকে উসকে দিয়েছে সুদীপই। ওর সঙ্গে এখন সন্ধ্যার পর বের হয়। সুনির্মল দেখে মাত্র। সেদিন সুনির্মলও বলে, ”একা বাড়িতে থাকতে ভাল লাগে না। তোমাদের সঙ্গে যাব।”

”না। বাড়িতে থাকবি। পড়াশোনা করবি। একদম জেদ করে না।” ধমকে ওঠে সুমিতা। সুনির্মল দেখে, মা যেন ক্রমশ তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আর এর জন্য দায়ী ওই সুদীপই। তাই সেদিন সুদীপের আনা চকোলেটের বাক্সটা ছুড়ে ফেলে সুনির্মল, ”না, এসব চাই না।”

সুমিতা ছেলের এই বিদ্রোহে চমকে ওঠে, একটা চড় মারে সে, ”বাঁদর ছেলে, কাকে কী বলছ?” সুনির্মল এবার ফেটে পড়ে, ”কেন, কেন আসে ও? ও আমাদের কে?”

সুমিতা আরও একটা চড় মারে। ”চোপ! অসভ্য কোথাকার!”

ও যেন ওই কিশোরের প্রতিবাদকে কঠিন শাসনে স্তব্ধ করে দিতে চায়। বিমলও দেখে ব্যাপারটা। প্রকাশ্যেও কিছু বলতে না পারলেও এবার মনে মনে ফুঁসতে থাকে।

ক’দিন ধরেই সুনির্মলের শরীর ভাল নেই। জ্বর। সেদিন সুমিতা, সুদীপের সঙ্গে কোথায় অনুষ্ঠান করতে যাবে। বিমল অফিসে।

সুনির্মল বলে, ”আজ যেও না, মা।”

সুমিতা বলে, ”পাশের ঘরে মাসিমাকে বলেছি। ওষুধপত্র দেবে। চুপচাপ শুয়ে থাক, আমরা এসে পড়ব।”

সুমিতা সেজেগুজে চলে যায় অনুষ্ঠানে। ওই জীবন তাকে একটা মুক্তির স্বাদ দিয়েছে। বিমল ফেরে রাত দশটায়। দেখে দরজাটা ভেজানো। দমকা হাওয়ায় জানলাটা খুলে গেছে আর বিছানায় জ্বরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে সুনির্মল। বাড়িতে কেউ নেই।

বিমল নিজেই ডাক্তার-ওষুধের ব্যবস্থা করে। সুমিতা-সুদীপ ফিরছে। ওদের হাসির শব্দ শুনে হঠাৎই রেগে যায় বিমল। বলে ফেলে, ”লজ্জা করে না, নিজের অসুস্থ ছেলেকে ফেলে রেখে এইরকম ঘুরে বেড়াতে? পাড়ার লোক কী বলে শোনো না? আর সুদীপ, তুমি তো ভদ্রঘরের ছেলে, এসব করতে বাধে না?”

সুমিতাও এখন নতুন জীবনের স্বাদ পেয়ে বদলে গেছে। এখন তার সামনে নতুন জগতের স্বপ্ন। সে বলে, ”থামো, কাকে কী বলছ?”

”ঠিকই বলছি। সুদীপকে আগেও কথাটা জানাবার চেষ্টা করেছি। আজ বলছি, এখানে আর কোনওদিন এসো না।”

সুমিতার কাছে এই জীবন আজ অর্থহীন হয়ে গেছে। তাই সেও এবার মনস্থির করে ফেলেছে। এবার নতুন করেই বাঁচবে সে। তাই বলে, ”এই জীবনে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি বিমল। এই জীবন থেকে আমি মুক্তি পেতে চাই।”

বিমল চমকে ওঠে, ”সুমিতা!”

সুনির্মল দেখছে মাকে। এ যেন অন্য কোনও রূপ। সুমিত্রা বলে, ”কথাটা যখন জেনেছ, তখন ভালই হয়েছে। আমি এ বাড়ি থেকে চলেই যাব। তোমরা তোমাদের মতো করে বাঁচো, আমাকেও আমার মতো করে বাঁচতে দাও।” সুমিতা ওই রাতেই চলে গেল সুদীপের সঙ্গে। বিমল স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। এতদিনের চেষ্টায় গড়া সংসারের সব মায়া তুচ্ছ করে চলে গেল সুমিতা। সুদীপের সঙ্গে। সুনির্মলের চোখে জল নামে।

”মা চলে গেল বাবা, আর কোনওদিন আসবে না?”

বিমল এর উত্তর জানে না। সুমিতার কথা সে ভোলার চেষ্টা করে। বিমলই সুনির্মলকে সঙ্গ দেয় বেশি করে। তার আর টাকা বেশি দরকার নেই। তাই বিমল সন্ধ্যাতে বাড়ি ফেরে, সুনির্মলকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়। ছুটির দিন নিজেরাই কোনওমতে সংসারের কাজ করার চেষ্টা করে। বাবা-ছেলে দু’জনে যেন এই নিঃস্ব পৃথিবীতে দু’জনকে অবলম্বন করে বাঁচতে চায়। সুদীপই এর মধ্যে চেষ্টা করে ডিভোর্সের ব্যবস্থা করে। বিমল বাধা দেয় না, সে তার জীবনের ওই অধ্যায়টাকে ভুলে থাকতে চায়। সুনির্মল তবু ভুলতে পারে না। মাঝে মাঝে চোখের সামনে ভেসে ওঠে মায়ের মুখ। স্কুলের বন্ধুদের বাড়িও যায়। তাদের মায়েদের দেখে তার কিশোর বুক বিদীর্ণ করে একটা হাহাকার জাগে। তবু সময় থেমে থাকে না। দিন বয়ে যায়।

বেশ কয়েকবছর কেটে গেছে। সুমিতাও তার অতীত জীবনকে ভুলে যেতে চায়। এখন তাদের সংসারে এসেছে তাদের সন্তান, বর্ষা। ফুলের মতো সুন্দর মেয়ে। সুদীপ ওর অন্নপ্রাশনেও বেশ খরচ করেছে। বাড়িটাকে আলোয় সাজিয়েছে। এসেছে অতিথির দল। সুদীপের বন্ধুরাও এসেছে। উৎসবের সাজে সেজেছে সুমিতা। সানাইয়ের সুর ওঠে। সুমিতা আজ তার অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে তৈরি হয়েছে। বাড়ির সামনে রাস্তায় লোকজনের ভিড়। পথচারীরাও দেখে এই উৎসবমুখর পরিবেশ। সেই পথ দিয়ে সেদিন যাচ্ছিল বিমল-সুনির্মল। ওরা বাজার থেকে ফিরছে। সুনির্মলের নজর পড়ে হঠাৎ ওই নতুন সাজে সেজে ওঠা সুমিতার দিকে। তার মাকে দেখতে পায়। স্মৃতি-জড়ানো মুখ। সুদীর্ঘ তিন বছর কেটে গেছে, সে তার মায়ের থেকে দূরে। বারবার মায়ের মুখখানা তার চোখের সামনে ফুটে উঠত। যেন দূর আকাশের তারা আজ কাছে এসেছে। বিমলের হাত ছাড়িয়ে সুনির্মল ছুটে যায় ওই আলো-ঝলমলে পরিবেশে সুবেশ অতিথিদের সামনে, তার মায়ের কাছে। ”মা, মা গো, ও মা।”

সুমিতার কানে যায় ওই ডাকটা। যেন দূর অতীতের তীর থেকে এসে পৌঁছয়। চমকে উঠে চাইল সুমিতা। দেখল, দামি পোশাক পরা অভিজাত অতিথিদের সামনে ময়লা একটা শার্ট আর রংজ্বলা একটা বিবর্ণ প্যান্ট পরে ব্যাকুল করুণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে একটি কিশোর। চোখে মুখে সরল ব্যাকুল প্রতীক্ষা। এই বুঝি মা তাকে কাছে ডেকে নেবে। আদর করবে তাকে। সুমিতাও নিমেষের মধ্যে ভেবে নেয় তার আজকের নতুন পরিচয়ের কথা। আর ওই ছেলেটা তার ভুলে যাওয়া বিকৃত পরিত্যক্ত অতীত, যাকে সে এড়িয়ে চলতে চায়। ভুলে যেতে চায়। সুমিতা তাই ওই ডাকে কান দেয় না। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক হাসির ঝলকে নিজেকে উদ্ভাসিত করে। আলো-ঝলমলে প্যান্ডেলে ঢুকে যায়। পথে পড়ে রইল এক অপরিচিত কিশোর। সুমিতার অতীত।

এত আলোর রোশনাই তবু কিশোর সুনির্মলের মনে নামে অতল অন্ধকার। এক মুহূর্তের জন্য দেখে সুদীপকে। সরে আসে সুনির্মল। বিমল ওর জন্যই দাঁড়িয়ে আছে। ফিরে আসে সুনির্মল, ওর চোখে জল। বিমল শুধোয়, ”কোথায় গিয়েছিলি?”

সুনির্মল জানাতে পারে না সেই চরম অবজ্ঞার কথা। এই দুঃসহ বেদনা তার একান্ত নিজস্ব। তাই হাত দিয়ে চোখের জল মুখে নীরবে পথ চলতে থাকে ছেলেটা। সেদিন থেকেই সে বুঝেছিল, তার পৃথিবী একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। এই শূন্যতার বোঝা বইতে হবে তাকে একা।

সুমিতাও আজ হঠাৎ ওই তরুণকে দেখে চমকে উঠেছে। তাকে দেখেছিল সে বর্ষার অন্নপ্রাশনের উৎসবমুখর রাতে। সেদিন তাকে চিনতে চায়নি সুমিতা। তাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। তারপর কেটে গেছে এতগুলো বছর। সুদীপ এখন আহিরীটোলার বাড়ি ছেড়ে দক্ষিণের এই নতুন এলাকায় ফ্ল্যাট নিয়ে নিজের সংসার পেতেছে। সুমিতা আজ এখানকার এক সংস্থার কর্ণধার। অসহায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাদের সংস্থা কাজ করে। তাদের জন্য অনাথ আশ্রমও করেছে। লেখাপড়া শিখিয়ে তাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার কাজ করে। আর এখন সুমিতার মেয়ে বর্ষাও বড় হয়েছে। কোনও নামী স্কুলে পড়ে। সুদীপও এখন ধাপে ধাপে চাকরিতে প্রমোশন পেয়েছে। এখন নিজের গাড়ি, ফ্ল্যাটও করেছে। সুখী সংসার সুমিতার। সমাজেও সে এখন সুপ্রতিষ্ঠিত।

হঠাৎ সেই পিছনে ফেলে আসা জীবনের একটা কালো দাগ যেন আজ ফুটে উঠেছে সুমিতার সামনে। ঈশান কোণে একটু কালো মেঘ দেখা দেয়। তার জীবনে ঝড়ের পূর্বাভাস। তার শান্তির সংসারে এসে হানা দিয়েছে। কে জানে এই ঝড় তার সাজানো সংসারে কী সর্বনাশ করবে। তার নামডাক ধুলোয় মিশে যাবে সুনির্মলের জন্য।

বেলটা বাজছে। চমক ভঙে সুমিতার, কতক্ষণ সে এইসব কথা ভাবছিল খেয়ালই হয়নি। বেলের শব্দে খেয়াল হয়। উঠে দরজাটা খুলে দেয়।

নিস্তব্ধ ঘরটায় কলরব তুলে একরাশ খুশির ফোয়ারার মতো ঢোকে বর্ষা। সঙ্গে তার স্কুলের এক বান্ধবী।

”কী করছিলে মা? তখন থেকে বেল বাজাচ্ছি, খেয়ালই নেই। ভুতোর মা-ই বা গেল কোথায়?” তারপর মায়ের দিকে চেয়ে একটু থামে বর্ষা। মায়ের চেহারা কেমন বিধ্বস্ত। বর্ষা শুধোয়, ”কী ব্যাপার মা, শরীর ঠিক আছে তো?”

অতীত জীবনের সেই অধ্যায়টাকে সযত্নে সুমিতা লুকিয়ে রেখেছে এতদিন। সুদীপ-সুমিতা দু’জনেই তাদের সেই জীবন কাহিনীটা আজকের প্রতিষ্ঠার আড়ালে অপ্রকাশিত রেখেছে। কারণ আজকের সমাজের অনেকেই তাদের এই সম্পর্কটাকে মেনে নেবে না। সমাজে যতই অগ্রগতি হোক, দিন পরিবেশ যতই বদল হয়ে যাক না কেন, মানুষ তার চিরন্তন মূল্যবোধকে, আদর্শকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। সেই নিরিখে ওদের সেই কাজগুলোর যদি কেউ কোনওদিন সঠিক মূল্যায়ন করে, তাদেরই অসুবিধের পড়তে হবে। নিজের মেয়ের কাছে ছোট হতে পারবে না সুমিতা। সেখানে সে আদর্শ মা হয়েই থাকতে চায়। তাই বলে, ”না-না, ঠিকই আছে।”

বর্ষা বলে, ”মা, এ আমার বন্ধু শিপ্রা। সকাল সকাল ছুটি হয়ে গেল, ওকে নিয়ে এলাম। তোমাদের সমিতির নাম শুনে ও-ই নিজে পরিচয় করতে এল, শিপ্রাও সোশাল ওয়ার্ক করে মা।”

শিপ্রা বলে, ”মাসিমা, আজ দেখে গেলাম। পরে আসব। বিকেলে বাড়িতে পড়াতে আসবেন স্যার, তাই আজ বেশিক্ষণ থাকতে পারব না।”

”তবু একটু মিষ্টিমুখ করে যাও। প্রথম এলে আমাদের বাড়ি, বোসো।”

সুমিতা সমস্ত দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে এবার সংসারের কাজে ডুবে যেতে চায়।

সুনির্মল ফিরছে। বেলা হয়ে গেছে। তার জীবনটা এখন নতুন খাতে বইছে। শুধু বইছে মাত্র, তার জন্য নির্দিষ্ট কোনও খাত নেই। সমাজ, আপনজন বলতে তার কিছুই নেই। সেও এক-এক সময় ভাবে পৃথিবীতে তার আসাটা একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু এর জন্য সে তো দায়ী নয়। এই পৃথিবী থেকে সে শুধুমাত্র জীবনধারণের উপাদানগুলো পেয়েছে। এতটুকু স্নেহ-ভালবাসা পায়নি। তাই তার জীবনটা মরুভূমির মতো শুকিয়ে যাচ্ছে। মা তাকে কৈশোরেই ছেড়ে গেছে। সেই বেদনাময় স্মৃতি তার মনে একটা স্থায়ী ক্ষত রেখে গেছে।

তবু বাবার স্নেহ, ভালবাসা, শাসনে বড় হচ্ছিল সুনির্মল। সুখে-দুঃখে দিন কেটেছে তার। তারপর সেই সুখের দিনগুলোও হারিয়ে গেল। মায়ের বঞ্চনা ছিলই, পাশাপাশি তার বাবাও কেমন বদলে যেতে লাগল। মাঝে মাঝে বাড়িও ফেরে না।

তখন উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে সুনির্মল। এখন সে কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবনে পা দিয়েছে। কিন্তু তার কোনও স্বপ্ন নেই। কঠিন বাস্তব তার জীবনকে এক নতুন আঙ্গিকে গড়েছে। এমন সময় সুনির্মল আবিষ্কার করে কঠিন সত্যটাকে। বিমল আবার বিয়ে করেছে, সংসার করেছে। তার শূন্য জীবনে আবার একজন মেয়ে এসেছে। সেও আবার নতুন করে বাঁচতে চায়। ক্রমশ সুনির্মল এই সংসারে নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে করে। সে বুঝতে পারে, এবার তাকে এই আশ্রয়টুকু ছাড়তে হবে। তার জীবনে মা আগেই গেছে। এবার বাবাও তাকে দূরে সরিয়ে দিতে চায়। কোনও এক বিত্তশালী মহিলাকে বিয়ে করে নিশ্চিন্ত জীবনের লোভেই বিমল এবার সুনির্মলকে দূরে সরিয়ে দিতে চায়।

বিমল বলে, ”দ্যাখ নির্মল, বাড়িতে পড়াশোনা ঠিক হচ্ছে না। আমি চাই তুই অনেক বড় হবি। তাই ভাবছি তোকে রেসিডেনশিয়াল কলেজেই পড়াব। সেখানেই থাকবি, সব খরচ আমিই দেব।”

কারও উপর সুনির্মলের কোনও দাবি নেই। সে নীরবে বাড়ি ছেড়ে চলে আসে একটা হস্টেলে। অবশ্য বাবা খরচপত্র সব ঠিকঠাক পাঠিয়ে দিত। তার টাকার অভাব সে হতে দেয়নি। মা তাকে অন্ধকারে ফেলে গেছে, বাবা তবু টাকা দিয়ে তার দায় সেরেছে। সুনির্মল বুঝেছে, এত বড় পৃথিবীতে সে নিঃসঙ্গ, একা। সমাজ তাকে এতটুকু স্নেহ-ভালবাসা দেয়নি। তবু সমাজের কাছে সে কাঙালের মতো হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু শূন্য অঞ্জলি তার শূন্যই রয়ে গেছে।

বেলা বাড়ছে। খিদেও পেয়েছে। মা-বাবার স্নেহ মাখানো খাবারের স্বাদ সে ভুলে গেছে। ক্ষুধা তার জীবনে একটা জৈবিক প্রয়োজন মাত্র। সে ওদিকে একটা রেস্তরাঁয় ঢোকে। কিছু খেয়ে নিয়ে তাকে টিউশনি পড়াতে যেতে হবে। সুনির্মল চায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে। বাবার কাছে সাহায্য নিতে তার বাধে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি দু’একটা টিউশনি করে সে।

শিপ্রার বাবার একটা ফেব্রিকেশন কারখানা। শিপ্রার মা চায় মেয়ে পড়াশোনা করে বাবার ব্যবসা দেখুক। শিপ্রা বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছে। সেইজন্যই শিপ্রার মা বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র সুনির্মলকে রেখেছে তার গৃহশিক্ষক হিসেবে। শিপ্রাও এই তরুণ ছাত্রটিকে শিক্ষক হিসেবে মেনে নিয়েছে। আজও ওর স্যার পড়াতে আসবে, ওকে বর্ষাদের বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসতে হবে।

বর্ষা বলে, ”কী রে, স্যারের জন্য ছটফট করছিস! ব্যাপার কী বল তো? তোর স্যারটাকে তো একদিন দেখতে হচ্ছে। কেসটা কেমন গড়বড় ঠেকছে।”

”তোর যতসব বাজে কথা।” শিপ্রা হাসে, ”স্যার ইয়ং হলে কী হবে রে, পড়াশোনা, অঙ্ক ছাড়া কিছুই জানে না। আর কী জানিস…”

বর্ষা কৌতূহল দেখায়, ”কী রে?”

”মেয়েদের সম্বন্ধে ওর কোনও আকর্ষণই নেই মনে হয়। কে জানে, কোথাও ঘা খেয়েছে বোধহয়।”

বিকেল হয়ে আসছে। সুনির্মল রেস্তরাঁ থেকে বের হয়েছে। মন-মেজাজ ভাল নেই। একটু আশা তবু ছিল, হয়তো মা তার সঙ্গে সহজভাবে কথা বলবে। কীভাবে আছে জানতে চাইবে। কিন্তু মা ওসব কথাই তোলেনি। হস্টেলে ফিরতে ভাল লাগে না। তাই ছাত্রীর ওখানেই গেছে। শিপ্রা দেখছে সুনির্মলকে। কেমন উসকোখুসকো চেহারা, শিপ্রা জানে ও কোনও হস্টেলে থাকে। কিন্তু ওর মুখে ওর মা-বাবা, ভাইবোনের কথা শোনেনি কোনওদিন। ও যেন কোনও দূরের মানুষ, অধরা থাকতে চায়। আজ বর্ষাও এসেছে শিপ্রার সঙ্গে। শিপ্রার কেমন ভয়। তার মনের অতলে ওই বিচিত্র রহস্যময় তরুণটির জন্য বিশেষ, একটা ঠাঁই গড়ে উঠেছে। সুনির্মলও শিপ্রার বেশ কিছু প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করে। বাবাই ওকে ফ্যাক্টরিতে নিয়ে গেছে কয়েকবার। শিপ্রার বাবা-মাও ওই নিঃসঙ্গ ছেলেটাকে ভালবাসে। আর সুনির্মলও তাদের ভালবাসার স্বীকৃতি দেয়।

সুনির্মলকে দেখে শিপ্রা বলে, ”এ কী, আবার আপনার শরীর খারাপ নাকি স্যার।”

দিনভর আজ পথে ঘুরেছে সুনির্মল। মনের হতাশার ছাপও তার চোখে মুখে। তবু বলে সে, ”না না, ঠিকই আছে।”

শিপ্রাই পরিচয় করিয়ে দেয়, এই আমার বন্ধু, বর্ষা সেন, ও ভাল ছাত্রী।”

সুনির্মল দেখছে ওকে। শান্ত মুখশ্রী, দু-চোখের চাহনিতে যেন স্নিগ্ধতার আভাস।

বর্ষা বলে, ”ওকে কিছু নোট দিয়েছিলাম। সেগুলো নিতে এসেছি। আপনার কথা শুনেছি, তাই আলাপ করতে এলাম।”

শিপ্রা বলে, ”নোট তো নিবিই। আজ ম্যাগনেটিজম পড়াবেন স্যার। তুইও থাক না।”

বর্ষা বলে, ”তা হলে তো ভালই হয়। ওই ব্যাপারটা আমার মগজে ঢোকে না।”

সুনির্মল বলে, ”ঠিকমতো পড়লে ঠিকই ঢুকবে।”

বর্ষা সেদিন বাড়িতে মাকে বলে শিপ্রার ওই গৃহশিক্ষকের কথা, ”মা, ভদ্রলোক দারুণ পড়ান। শিপ্রার রেজাল্ট সেজন্যই ভাল হয়। ওঁর কাছে পড়লে আমার রেজাল্টও ভাল হবে।”

একমাত্র মেয়েকে কৃতী দেখতে চায় সুদীপ। তাই বলে, ”বেশ তো তাঁকেই বলে দ্যাখ, যদি তোকে পড়ান।”

”ওরে বাবা। ওই ভদ্রলোক নাকি সহজে পড়াতেই চান না। ওঁর নিজের পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত। তা ছাড়া আমার কথার কোনও গুরুত্বই দেবেন না। মা, তুমি যদি বলো, হয়তো রাজি হতে পারেন।”

সুদীপও বলে, ”তা হলে তুমিই গিয়ে বলো না একদিন।”

বর্ষাও বলে, ”তাই চলো মা। শিপ্রাদের বাড়িতে এই রবিবার বিকেলে।”

সুনির্মল নিজের কাজেই ডুবে থাকতে চায়। তার সমস্ত আঘাতগুলো ভুলতে চায়। সে জানে, একদিন নিজের পরিচয়েই সে পরিচিত হবে। তার মাতৃকুল, পিতৃকুলে কেউ নেই। তার পরিচয় তাকে নিজেকেই অর্জন করতে হবে। তার বন্ধুদের বাড়িঘর, পরিবার-পরিজন রয়েছে। তারা যেন একসূত্রে বাঁধা। কিন্তু সুনির্মলের বাবা নেই। তার জন্য ভাবারও কেউ নেই। সে তার নিঃসঙ্গতার মধ্যে কাজ নিয়ে থাকে।

সেদিন সুমিতা এসেছে শিপ্রাদের বাড়িতে বর্ষাকে নিয়ে, সেই শিক্ষক ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতে। যদি সে বর্ষাকে পড়াতে রাজি হয়। সুমিতা নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে। তবু মেয়েটার পড়াশোনার সুব্যবস্থা করতে পারবে। হঠাৎ সুমিতা ওই বাড়িতে সুনির্মলকে দেখে চমকে ওঠে। এভাবে ওকে এখানে দেখবে, ভাবতেই পারেনি সুমিতা। সে ভুলে থাকতে চায়, এড়িয়ে থাকতে চায় সুনির্মলকে। কিন্তু এখানে এসে তাকেই দেখতে হবে! তার সঙ্গে কথাও বলতে হবে!

বর্ষাও খুশি। সেই পরিচয় করিয়ে দেয়, ”মা, ইনিই সুনির্মলবাবু। শিপ্রার টিউটর।”

সুনির্মল দেখছে সুমিতাকে। সেদিন অনেক আশা নিয়ে মায়ের কাছে গিয়েছিল। কিন্তু সুমিতা তাকে সন্তানের স্বীকৃতি দেয়নি। তার কারণটাও জানে সুনির্মল। তার মেয়ের কাছেও সুমিতা তার অতীত জীবনের সব কলঙ্কময় ঘটনাগুলোকে চেপে রেখে মহীয়সী মাতৃরূপে প্রতিষ্ঠিত।

বর্ষা বলে, ”মা, তুমি বলো সুনির্মলদাকে।”

সুনির্মল বর্ষাকে দেখতে থাকে। এর আগে ওকে দেখেছে, কিন্তু ওর আসল পরিচয়টা জানত না সে। আজ জানতে পেরেছে সে, ও সুমিতার সন্তান। সুনির্মল দেখছে সুমিতাকে, ওর মুখে পরিচিতির কোনও লক্ষণই নেই। সহজভাবে বলে, ”ঠিক আছে।”

সুমিতা বলে, ”তুমি একদিন যদি আমাদের বাড়িতে আসো।”

সুনির্মল কিছু বলার আগেই সুমিতা একটা কার্ড বের করে দেয়। তাতে তার সামাজিক পরিচয়ের অনেক তকমা-সহ নাম ঠিকানা সবই রয়েছে।

বর্ষা বলে, ”তাই আসুন। মায়ের সঙ্গে কথা হবে। যদি আমাকে সপ্তাহে দু’দিন পড়ান, তা হলেই হবে।”

সুমিতা ওকে এড়াবার জন্যই বলে, ”আমার জরুরি মিটিং আছে। আজ চলি। এসো একদিন ফোন করে।”

ওরা চলে যায়। সুনির্মলও শিপ্রাকে পড়ানোর পর হস্টেলে ফিরছে। তার মনের অতলে একটা আশার সুর জাগে। আজ যেন তার মা তাকে বাড়িতে যেতে বলেছে, হয়তো তার প্রতি কোথাও একটু সহানুভূতি, স্নেহ, মায়া রয়েছে। সুনির্মল এও জেনেছে, তার একটা ছোট বোন আছে। সেও তাদের পাশে থাকবে। বাঁধা পড়বে সাংসারিক বাঁধনে। তার মনে হঠাৎ সুর বাজে, খুশির সুর।

সুমিতা তার কর্তব্য স্থির করে ফেলেছে। যত কঠিনই হোক, তাকে এই সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। ফোন করেছিল সুনির্মল, আর সুমিতাও তাকে আসতে বলেছে। সুদীপ জেনেছে ব্যাপারটা। তাই সুমিতার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছে সে। কারণ এ ছাড়া আর পথ নেই। সুদীপ তখন অফিসে। বর্ষাও কলেজে গেছে। সুমিতা এসব ভেবেই সুনির্মলকে এই সময় এখানে আসতে বলেছে। সুনির্মল এসেছে এক নতুন আশা, স্বপ্ন নিয়ে।

দুপুর বেলায় এসব কমপ্লেক্স একেবারে নিস্তব্ধ থাকে। লোকজনও কম। বেশিরভাগ মানুষই বাইরে কাজে ব্যস্ত থাকে। যারা আছে তারাও গেটে তালা দিয়ে দুপুরে বিশ্রাম নিচ্ছে। সুমিতা ফ্ল্যাটে একাই রয়েছে। বেলটা বেজে ওঠে। সুমিতা ওর আসার অপেক্ষা করছিল। দরজা খুলতেই ঘরে ঢোকে সুনির্মল। মাকে প্রণাম করে। ঘামছে সুনির্মল, বসার ঘরের দরজা জানলাগুলো রোদের জন্য বন্ধ। সুনির্মল এই ছায়াশীতল ঘরে নিশ্চিন্ত বোধ করে। সুমিতা কদিন ধরেই ভেবেছে। আজ বলে, ”সুনির্মল, তোমাকে সেদিন বলার সময় পাইনি, আজ তাই ডেকেছি সেই কথা বলার জন্য।”

”বলো মা। সুনির্মল ব্যাকুল কণ্ঠে আবেদন জানায় মায়ের কাছে।”

সুমিতা বলে, ”তুমি বুদ্ধিমান। আশা করি আমার কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারবে।”

সুনির্মল হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, সুমিত্রা বলে, ”যা অতীত, তা অতীতই থাক। আজ তাকে নতুন করে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আর তা সম্ভবও নয়।”

চমকে ওঠে সুনির্মল, ”মা!”

”ওই পরিচয়টা তুমি ভুলে যাও সুনির্মল। আমিও সেই চেষ্টাই করব। তুমি দয়া করে আর কোনওদিন আসবে না। বর্ষার সামনেও আর আসবে না। ও যেন আমাদের সম্পর্কটা জানতে না পারে। তুমি যাও আর এই চেকটা রাখো। এক লাখ টাকা আছে। আরও দরকার পড়লে জানিও।”

সুনির্মলের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। সে মিথ্যে আশা নিয়ে এখানে এসেছিল। তাকে কেউই স্বীকৃতি দেবে না। উঠে পড়ে সে। বর্ষার কলেজে আজ কী গোলমাল হওয়ার জন্য ক্লাস হয়নি। তাই তাড়াতাড়ি ফিরছে কলেজ থেকে। ওদিকে সুমিতাও ফ্ল্যাটের দরজাটা ঠিকমতো লক করেনি। আলগা ভেজানো ছিল, বর্ষাও এসে পড়েছে। আর ও পরদার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনছে সুনির্মল আর তার মায়ের কথা। অবাক হয়েছে সে। তার মা আর সুনির্মলের মধ্যে সম্পর্কটা কী, তাও আবিষ্কার করেছে। এতদিন মায়ের অন্য রূপ দেখেছে সে। সমাজে তার প্রতিষ্ঠা। আজ মায়ের নতুন রূপ দেখে সে বিস্মিত। সে মাতৃত্বকে অস্বীকার করেছে নিজের সামাজিক প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য। বর্ষা দেখছে সুনির্মলের বেদনাহত পাংশু মুখচোখ, সে আজ শূন্য হাতে ফিরে গেল।

সুমিতা হঠাৎ বর্ষাকে দেখে চাইল, ”তুই? কখন এলি?”

বর্ষা দেখছে মাকে। মায়ের এই হীন স্বার্থপরতা, কর্তব্যহীনতা সে সমর্থন করতে পারে না। তাই বলে, ”তোমাদের সব কথাই শুনেছি। সুনির্মলদা যে তোমার ছেলে, তা তো আগে বলোনি?”

সুমিত্রা ধরা পড়ে গেছে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে, ”কী যা তা বলছ?”

বর্ষা এবার টেবিলে পড়ে থাকা চেকটা তুলে নিয়ে বলে, ”আর সেই সম্পর্কটা মুছে ফেলার জন্য দাম দিতে চেয়েছিল এক লাখ টাকা। তা হলে মা আমাকেও এ সম্পর্ক মুছে ফেলার জন্য কত দাম দেবে? বলো…”

সুমিতা তাকাল মেয়ের দিকে। আজ মনে হয় অতীতের সব ভুলকে সে চাপা দিয়ে সমাজে মুখোশ পরে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু আজকের উনিশ-কুড়ির যৌবনের কাছে সেই মুখোশ খুলে পড়েছে। সব পাপ-কলুষ থেকে কালিমামুক্ত হয়ে নতুন সুখী সমাজ গড়তে চায় ওরা। তাই সুনির্মলকে ওদের চাই। ওরা সবাই একসঙ্গে মিলে এবার নতুন করে বাঁচবে।

__

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *