কার্তিকের নবরূপ

কার্তিকের নবরূপ

কার্তিকপুর নামটা এসেছে কার্তিক ঠাকুরের নাম থেকেই। বেশ বড় গঞ্জই। এককালে এই এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ধান-পাট-আনাজপত্রের বড় আড়ত ছিল এখানে। খুবই উর্বর এলাকা। গঙ্গার ধারেই তাই নৌকাতেই ব্যবসা বাণিজ্য চলতো মহাজনদের। ইংরেজ কেন তার আগেও ডাচ বণিকরা এখানে তাদের কুঠি গড়েছিল। তখন থেকেই এখানে কার্তিক পূজার প্রচলন করে এখানের গঞ্জের দেহ পসারিনির দল। কার্তিক পূজা করলে নাকি কার্তিকের মত সুপুরুষের আবির্ভাব হয়। দেব সেনাপতি কার্তিক বীরত্ব-পৌরুষের জন্য খ্যাত। তাই কার্তিক পূজার প্রচলন করে এককালে এরাই।

তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। কার্তিকপুরের রূপ বদলও হয়েছে দিনবদলের সাথে সাথে। সেই গঞ্জের চেহারাও বদলেছে। এখন গঙ্গার ধারে গড়ে উঠেছে বিশাল এলাকা জুড়ে ইংরেজদের পাটকল, অন্যসব বড় বড় কলকারখানা। এসেছে বহু মানুষ। এখানে এখন হাওয়ায় টাকা ওড়ে। পাটের ব্যাপারী—কারখানার কনট্রাক্টর-সাহেব-সর্দার হাজার হাজার মজুর তাদের বাসা বেঁধেছে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। হাটে বাজারে চমকও এসেছে। এখন হুস হুস করে গাড়ি ছোটে। বাতাসে ভাসে বিদেশী না হয় চটুল হিন্দী গানের সুর। ঝাঁ-চকচকে রেস্তোরাঁ জমে সন্ধ্যার পর।

দিন বদলেছে—রূপ বদলেছে। এখন সেই দেহপসারিনিদের তত দাপট আর নেই। এখন দেহ-পসারিনিদের জন্য স্বতন্ত্র পাড়ার অস্তিত্বও কোনমতে টিকে আছে নামে। তাদেরও রূপান্তর ঘটেছে।

কিন্তু একটা ট্রাডিশন বদলায়নি। কার্তিকপুরের কার্তিক পূজার ট্রাডিশন সমানে চলেছে। বরং সেদিনের গ্যাসের লাইট-হ্যাজাকের আলোর বদলে এসেছে এখন লাখো বিজলিবাতির ঝলকানি। কার্তিকেরও রূপান্তর হয়েছে। এখন কার্তিকপুরের অলিতে গলিতে কার্তিকদের পূজা হয় মহা ধূমধামে। আর এক একটা ক্লাব তো লাখ লাখ টাকা এই কার্তিকের পূজাতেই উড়িয়ে দেয় পাল্লা দিয়ে, গেট-ব্যাণ্ডপার্টি-তাসাপার্টি তার সঙ্গে আরও আনুষঙ্গিক নানা কিছুই আসে। দুদিন ধরে কার্তিকের পূজার নামে মহোৎসবের শুরু হয় কার্তিকপুরে।

চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী—বারাসতের কালী—কলকাতার দুর্গাপূজার পরই কার্তিকপুরের কার্তিক পূজার নাম করা যেতে পারে। কার্তিকপুরের ন্যাশনাল পূজা এই কার্তিক পূজা। অন্য সব পূজাই এখানে নমো নমো করে সারা হলেও কার্তিকের পূজাতে এখানে কোনও ত্রুটি হয়না। কার্তিকপূজাকে কেন্দ্র করে তাই কার্তিকপুরে যেন বৎসরের দু’দিন জাগ্রত হয়ে ওঠে।

দত্তপাড়ার কার্তিকবাবুর পিতৃপুরুষের বাস এই কার্তিকপুরেই। ওর ঠাকুরদার ছিল বিরাট পাটের ব্যবসা। তখনকার দিনে সাহেবরা ওর আড়ত থেকেই বেশী পাট কিনতো তাদের পাটকলের জন্য। ফলে কার্তিকবাবুদের পূর্বপুরুষ বেশ ফুলে-ফেঁপেই উঠেছিল। গঞ্জের মধ্যে বিশাল বাড়ি। ওদিকে বিশাল এলাকা জুড়ে আড়ত, অফিসঘর, গুদাম। বাজারেও তাদের ছিল দোকানপত্র। কিছু জমিদারীও ছিল। তাই সেই কার্তিকপুরের ট্রাডিশন মেনে তাদের আড়তেও হতো কার্তিকপূজা। সাহেবরাও আসতো কলকাতা থেকে। বাঈ নাচও হতো। আর ছিল দু’দিন ঢালাও ভোজের ব্যাপার সকলের জন্য। কার্তিক ঠাকুরও ওদের পুজোতে প্রীত হয়ে দয়াও করেছিল। ওদের বংশে কার্তিকের অভাব হয়নি। তাদের শেষ বংশধর আজকের ওই কার্তিককুমার।

অবশ্য সেই আড়ত-ব্যবসাবাণিজ্য-দোকান পশার আজ আর নেই। তিন পুরুষের মধ্যে এক পুরুষ ছিলেন কেনারাম। তিনি ব্যবসাপত্র করে বিষয়সম্পত্তি কিনে সাম্রাজ্য গড়ে গেছিলেন। দ্বিতীয় পুরুষ ছিলেন ভোগারাম। তাঁরা এই বিষয় আশয় নাড়াচাড়া করে ভোগই করে গেছে। কেনাকাটার দিকে আর যাননি। তাদের পর যারা এলেন তারা ঈষৎ বিপদে পড়লেন। কেনাকাটা দূর অস্ত, ভোগবিলাসও ঠিকমত করতে পারেন না। বেঁচে থাকার জন্য বিক্রীবাট্টাই শুরু করলেন। কলসীর জল গড়াতে গড়াতে শেষ হয়ে যায় প্রকৃতির নিয়মে। তাই ওদের সর্বস্বও বিক্রী হতে হতে এখন তলানিতে ঠেকেছে। কার্তিকবাবু সেই বেচারামবাবুদেরই একজন। অবশ্য তাতে তার কিছু আসে যায় না। তার মনকে শক্ত রাখার জন্য কার্তিকবাবু বিলাতী মদই সেবন করতে শুরু করেন দেব কার্তিককে নিবেদন করে। তারপর সেটার পরিমাণ বাড়তে থাকে। ওদিকে দু’চারজন বন্ধুও মধুর লোভে এসে জোটে। তাদেরও প্রসাদ দিতে হয়।

ওদিকে তার ভাগের জমি-জায়গাও এক এক করে বিক্রী হয়ে চলেছে। বাড়িতে স্ত্রীও এবার ক্রমশঃ মুখরা হয়ে ওঠে। ফলে পয়সায় টান পড়তে এবার বিলাতী ছেড়ে কার্তিকবাবু স্বদেশী দ্রব্যের দিকেই আকৃষ্ট হন। দিশী মদই এখন তার বন্ধু। তবে এবার বন্ধুদের তিনি ত্যাগ করেননি। ওদের ক্লাবের এখনও প্রধান পৃষ্ঠপোষক আর বনেদী ধসে পড়া বাড়ির সন্তান। তাই অভাব-অনটন সত্বেও কার্তিকের মত কোচানো ধুতি-গিলে করা পাঞ্জাবী পরেই বের হন সন্ধ্যায়। আর বাড়ি ফেরেন রাতে। তখন দ্রব্যগুণে রূপই বদলে যায়। দু-চারবার রাস্তায় বেসামাল হয়ে গড়াগড়ি খাবার ফলে ধুতি-পাঞ্জাবীর চেহারাও চটকে যায়—ধুলো কাদাও লাগে। ওর টালমাটাল মূর্তি দেখে গিন্নিও গর্জে ওঠে;

—পথে পড়ে থাকলেই তো পারো বাড়ি ফেরো কেন?

এর মধ্যে বেসামাল হয়ে দু-একদিন কার্তিকবাবুকে থানা থেকেই বাড়িতে আনা হয়। অবশ্য ওসব রাতের ব্যাপার। দিনের বেলায় কার্তিকবাবু অন্য লোক। ক্লাবের কর্মকর্তা মানী লোক; নাইবা থাকলো সেই পয়সা, তবু বনেদী দত্ত বাড়ির ছেলে। নামডাক তো আছে।

এবার কার্তিকপূজার আয়োজন শুরু করা হয়েছে কার্তিকপুরে। মাসখানেক আগেই পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন ক্লাব-সংস্থা-বারোয়ারী দল মেতে ওঠে পুজোর মিটিং নিয়ে। এছাড়া বাড়ির পুজোও কম হয়না। আর কার্তিক যে কতরকমের হতে পারে সেটা কার্তিকপুরে না এলে সঠিক জানা যাবেনা। ছোট কার্তিক-বড় কার্তিক-মেজ কার্তিক, ধেড়ে কার্তিক, ছেলে কার্তিক-জামাই কার্তিক-লাড্ডু কার্তিক-লড়াকু কার্তিকও দেখা যাবে এখানে কারগিলের পাহাড়ের ব্যাকগ্রাউণ্ডে। গতবার তো কার্তিকবাবুর ক্লাব ওই মেজর কার্তিক করে তাদের থিমের জন্য গাড়াকল জুটমিলের ফার্স্ট প্রাইজই পেয়েছিল। এছাড়াও আছে ছাত্র কার্তিক-নেতা কার্তিক মায় ক্যাডার কার্তিককেও যেখা যাবে যেন মণ্ডপে জনতার সামনে বক্তব্য রাখছে। আর তাদের মুখের আদল, পোজও বদলাচ্ছে। মিস্টার ঋত্বিক রোশন-অক্ষয়কুমার-শাহরুখ খানের মুখও এসে গেছে। মাঠকল ক্লাব তো সেবার খালি গায়ে জিনস পরে সলমন খান গড়ে ড্যান্সিং কার্তিক করে চমক লাগিয়েছিল।

এবার দুর্গাপুজোয় কলকাতায় মূর্তি ছাড়াও থিম না কি একটা হজপজ ব্যাপার দিয়েই পুজো মাত করেছেন অনেকে। এবার কার্তিকপুরও কার্তিককে নিয়ে সেই বিশেষ কথাই ভাবছে। এ নিয়ে অনেক আলোচনা গবেষণা চলছে। কেউ নানা সাইজের মাটির ভাঁড়, কেউ ঠেলাগাড়ি ভর্তি গাঁজার কলকে। কোন ক্লাব ট্রেন ভর্তি খালি বোতল আর কেউ বস্তা ভর্তি আলু পটলও এনেছে মণ্ডপ সাজানোর জন্য।

ভাবনাতে পড়েছে এবার কার্তিকবাবুদের মার-কৈলাস ক্লাব। মগজেরও একটা সীমা আছে। প্রতিবারই কার্তিক পুজোতে মগজ থেকে এক একটা আইডিয়া বের করে কার্তিক দত্ত। সেইমত প্যাণ্ডেল করা হয়। কার্তিকও নবরূপে হাজির হয়। ইদানীং কার্তিকের আরও টানাটানি চলছে। বাজার দরও সব বেড়ে গেছে। বেঁচে থাকার জন্যই খরচা এখন অনেক। তার উপর সংসারও বাড়ছে। তাই সরকারী দিশি মালেরও দাম বাড়ছে, বিলাতী তো ধরাছোঁয়ার বাইরে। পালা আর পার্বণে জোটে। তাই নিত্য সঙ্গী দিশী মাল ছেড়ে এখন লাইনের ধারে ঝোপের পাশে তৈরি ‘কটেজ প্রডাক্ট’ প্লাস্টিকের প্যাকেট বন্দী চুল্লুই ভরসা।

কার্তিক চুল্লু গিলেও এতদিন যাবৎ কার্তিকপুজোর নানা থিমই সাপ্লাই করেছে মার-কৈলাস ক্লাবকে। আর সেই সব বিচিত্র থিমকে কাজে লাগিয়ে ওরা কার্তিকের রূপদান করে নাম ফাটিয়েছে। কিন্তু মানুষের মগজের একটা দূর পর্যন্ত এগোবার সীমানা আছে। তারপর তার স্টকও ফুরিয়ে যায়। তাই কার্তিকেরও মনে হয় তার মগজের স্টক যেন ফুরিয়ে আসছে।

ওদিকে কার্তিকপুজোর দিনও সমাগত। বহু ক্লাবের প্যাণ্ডেল শুরু হয়ে গেছে। এদিকে শশী পাল, নটবর, রূদ্র পাল অন্যসব কারিগরদেরও অর্ডার নেবার সাধ্য আর থাকবে না। মূর্তির অর্ডার দিতে হবে। প্রতিবারই তাদের কার্তিকের রূপ বেশ সবই বদলায়। নতুন রূপে পুজো হয় আগের মত একই ছাঁচের পুজোর কার্তিক তারা আনে না। তাই ক্লাবের সকলেই তাড়া দেয়।

—কেতো দা—এবার ঠাকুর প্যাণ্ডেল কি হবে বলো? এখনও কাজ শুরু করা গেল না।

অবশ্য এর মধ্যে চাঁদা আদায়ের কাজ শুরু হয়ে গেছে। ওদিকের বড় রাস্তায় ক্লাবের স্বেচ্ছাসেবকের দল পথচলতি গাড়ি-ট্রাক লরি থামিয়ে মোটা টাকার বিল বাঁচিয়ে আমদানীও শুরু করেছে। তারপর রুটের বাস-অটোওয়ালাদের অবশ্য এককালীন চাঁদা আছে। এরপর পাবলিক দোকানদার, বাজারের ফড়ে ব্যাপারীদেরও প্রণামী দিতে হচ্ছে। তারা এখন দেবসেনাপতি কার্তিকের চ্যালাদের ভয়ে সিধিয়ে গেছে। অবশ্য লোকাল থানা পুলিশ মাঝে মাঝেই বাধা দেয় ওদের কাজে। তবে সরে গেলেই আবার শুরু। সারা কার্তিকপুর আর তার আশপাশের মানুষ এখন চাঁদার ভয়ে মুখ ঢেকে চলে। তবুও রেহাই নেই। সেই আমদানী থেকেই কে একটা বিলেতীর বোতল এনে কার্তিককে দেয়। কার্তিক এহেন বস্তু দেখে বলে,

—হবে-হবেরে। এবার নতুন একটা আইডিয়া দোব। একেবারে আজকের মডার্ন কার্তিকদের ওপর নতুন সামাজিক দায়বদ্ধতার থিম। পুজো মানে শুধু পুজো নয় সমাজের রোগটাকেও তুলে ধরতে হবে সাহসের সঙ্গে।

ক্লাবের অনেকেই কার্তিকদার বিশ্বস্ত অনুচর। তাদের কেউ মাছের ব্যবসা করে। কেউ এখন দাদাদের ধরে তাদের বেনামীতে ঠিকাদারী। কারখানায় চটকলে মাল সাপ্লাই করে ভালোই কামায়, কেউ চটকলে স্রেফ হাজিরা দিয়েই ভালো টাকা পায়। তারাও এক আধটু খায় দায়। এখনতো বেশ রঙীনই আছে তারা, তাই তারাও বলে,—ঠিক কথা কেতো দা। তাহলে তোমার এসটক থেকে জব্বর একটা থিমই বের করছ। আমরা দ্যাখ কি করি তারপর? শালা মাটির মূর্তিকে এই পরিবেশে জীবন্ত করে তুলবো।

কার্তিক তখন বিলেতী গিলে নতুন থিমের কথাটা প্রকাশ করে। চ্যালারা তো তখন বেশ রঙিন হয়ে উঠেছে দ্রব্যগুণে। কার্তিকের থিমটা শুনে দু’ একজন ইতিউতি করে। কে বলে,

—এটা কি চলবে? মানে—

ওদের সেক্রেটারী বাজারের হোলসেল ফিশ মার্চেন্ট কানু তখন রঙীন চোখে স্বপ্ন দেখছে। সে একাই পুজোতে হাজার পঞ্চাশ টাকা তুলে দেয়। কানু বলে— চোপবে। কেতোদা পায়ের ধুলো দাও মাইরি। যা থিম একখানা দিয়েছ একেবারে আপ-টু-ডেট। যুগ যুগ জিয়ো গুরু।

কেলোকে খুশী করতে চায় অনেকে। তাই কেলেকে গ্রীণ সিগন্যাল দিতে দেখে অন্যদের অনেকেই জড়িত কণ্ঠে বলে,

—সাবাস গুরু। কোন শালা এই আইডিয়া দিতে পারে না। ফটকে নিমাই কাল থেকেই কাজ চালু করে দে।

কানু বলে—টাকার জন্য নো চিন্তা তবে এসব আইডিয়া ভালো করে শুনে ঠিক তেমন কাজ করতে হবে। আর শশী পালকেই বলে দেবে গুরু যে পোজে যেভাবে কার্তিক বানাতে বলবে তাই বানাবে। একেবারে ফুলসাইজ। ফুট ঢাকা। নাও গুরু—

কেলো খুশী হয়ে কার্তিককে আর একটা দ্রব্য এগিয়ে দেয়। কার্তিক বলে,— তবে হ্যাঁ। এসব থিম-এর কাজ চলবে খুব গোপনে। কেউ যেন টের না পায়। লিক হয়ে গেলে মুস্কিল হবে।

পচা ক্লাবের ক্যাশিয়ার। পাড়ার কোন দাদার ডান হাত। পচা বলে—কাক পক্ষীতেও টের পাবে না। সবাইকে চমকে দোব পুজোর রাতে। দেখবে তারপর মার কৈলাস ক্লাবের খেল।

ওরা এবার নতুন উদ্যমে কাজে নামে।

কার্তিকপুর এখন আর গঞ্জ নয়। পুরোদস্তুর জাতে ওঠা নগর। এখন এখানে পুরসভা হয়েছে। গ্রামীণ পঞ্চায়েত আর নেই। পথঘাটেও পিচ পড়েছে। অবশ্য ভেঙেচুরে একাকার তবু এইসব উপলক্ষ্যে পুরসভাও রাস্তাঘাট মেরামত করেছে। বিজলি বাতি জ্বলে পথে। দোকান বাজারের রূপ বদলেছে। পুজোর জন্য কেনাকাটাও বেড়েছে। আর শুরু হয়েছে অলি-গলি-মাঠে-ময়দানে ছোট মাঝারি বিশাল আকারের প্যাণ্ডেল। চন্দননগরের কারিগররা টুনি বালবের আলোয় কেরামতি দেখানোর কাজে ব্যস্ত। ওদিকে পুলিশকে এই সময় সজাগ হতে হয়। চাঁদার জুলুম মস্তানের উৎপাত সবই বেড়ে যায়। এরপর আছে দর্শনার্থীদের ভিড়ের মধ্যে টুকটাক ঘটনা।

পুজোর উদ্বোধনও শুরু হয় দু-একদিন আগে। নেতা-মন্ত্রী-খেলোয়াড় মায় তিন চারখানা চটি কবিতার বইওয়ালা কবি সাহিত্যিকদেরও আসতে হয়। দেশের সুরশক্তির প্রতীক ওই দেবসেনাপতি কার্তিকের মূর্তি উদ্বোধন করে, ভাষণ দেয়। কলকাতার টিভিওয়ালাও ক্যামেরা ঘাড়ে এ হেন জাতীয় সংহতি যুবশক্তির ছবি তুলতে আসে।

এতদিন ধরে মার কৈলাস ক্লাব প্যাণ্ডেলের প্রবেশদ্বার চট টিন দিয়ে আটকে রেখে নিজেদের বিশ্বস্ত লোক দিয়ে প্যাণ্ডেলের কাজ করেছে। আর তাদের মূর্তি এই এলাকাতে গড়তে দেয়নি। গঙ্গার ওপারে কোন শহরের নামী কারিগরদের দিয়ে করিয়েছে। আর রাতারাতি সেই মূর্তি ঢাকাচাপা দিয়ে এনে তুলেছে প্যাণ্ডেলে।

ওদের থিম নিয়ে অন্য অনেক ক্লাবের চিন্তার অন্ত নেই। কারণ ওই কার্তিকবাবুর মগজ খুবই উর্বর। ওরা প্রতিবারই নতুন কিছু করে চমকে দেয় সকলকে। এবার কি করবে তাই নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। মার কৈলাস ক্লাবের কেউই মুখ খোলেনি। তবে সাংঘাতিক সামাজিক একটা অবক্ষয়ের একটা ছবিই যে তুলে ধরবে সেটাই ঘোষণা করেছে। তাই অনেকেই উদগ্রীব।

অনেকের উদ্বোধন হয়ে গেছে। রকমারি জিনিসের প্যাণ্ডেল রকমারি বস্ত্রের তৈরি বহু বিচিত্র কার্তিকের রূপও প্রকাশিত হয়েছে। এবার মার কৈলাস ক্লাবের উদ্বোধনে তাই ভিড়ও হয়েছে প্রচুর। ওরা কলকাতা থেকে কোন নামী ফিল্মী হিরোকেই এনেছে— সঙ্গে এসেছে কলকাতার টিভিওয়ালারাও। স্থানীয় নেতারাও এসেছে। যে দাদার এলাকা এটা সেই দাদাও এসেছেন। পকেটে ভাষণও রয়েছে তার।

প্যাণ্ডেলের চারপাশে মাদকবিরোধী নানা মণ্ডপ। শুধু মদই নয়, ড্রাগ আরও সব নেশায় বস্তু ব্যবহার করলে কি সর্বনাশ হতে পারে তারই কথা বলা হচ্ছে—নানা মডেলের সাহায্যে। ধন্য ধন্য পড়ে যায়। সত্যিই আজকের সামাজিক অবক্ষয়ের ছবিটাই সাহসের সঙ্গে তুলে ধরেছে মার কৈলাস ক্লাব। পটাপট ছবি উঠছে টিভি ক্যামেরাতে। এদিকে কার্তিকবাবু গুম হয়ে বসে আছে বেশি নেশা হলে তার কথা বন্ধ হয়ে যায়।

ফিস মার্চেন্ট কানু কন্ট্রাকটর পিন্টুও ঈষৎ টলছে। ক্লাবের সকলের অবস্থা ঈষৎ এলোমেলো। তবু তারা ওই মাদক বিরোধী নাম কুড়িয়েছে। এবার মূর্তি উদ্বোধন করেন সেই ফিল্মি হিরো, তুমুল হাততালি-শাঁখের শব্দ, আর সিটির মধ্যে মূর্তির সামনের পর্দা সরে যায়—দর্শক স্তব্ধ।

দেখা যায় কার্তিক ঠাকুরকে—তার মূর্তিটাও যেন টলছে। জামাটার বোতাম খুলে ঝুলছে—এক পায়ে টকটকে পাম সু। অন্য পায়ের জুতো ছিটকে পড়েছে দূরে—হাতে মদের বোতল—চুলগুলো উস্কোখুস্কো। চোখের দৃষ্টিটাও আবছা। নেশার ঘোরে চোখও ঢুলুঢুলু। শিল্পী যে মূর্তি গড়েছে সে ওই মাতালের রূপটা একেবার যেন জীবন্ত করে তুলেছে ওই মূর্তির মধ্যে।

নতুন আইডিয়াই বটে—মাতাল কার্তিক। দেব সেনাপতি কার্তিকের যুগের বিবর্তনের সঙ্গে এহেন রূপান্তর দেখে চমকে গেছে দর্শকরা। প্রথম নীরবতা —তারপর গুঞ্জন—আর তা পরিণত হয় ক্রমশ প্রতিবাদে। কে বলে,

—ঠাকুর দেবতাদের নিয়ে এইসব অনাছিষ্টি কাণ্ড। দেশ-ধর্ম কী নেই?

একজন প্রবীণ লোক বলে—এসব ধর্মবিরোধী অসামাজিক কাজ—এসব বন্ধ করতে হবে। অনেকেই ওই উত্তরের প্রতিধ্বনি তোলে। আর কার্তিকের এহেন খবর পেয়ে মজা দেখার জন্য পিলপিল করে মানুষ অন্য সব প্যাণ্ডেল ছেড়ে এখানেই ছুটে আসে। ক্রমশ ভিড়ে ভিড়ে ছয়লাপ।

ওদিকের মাঠে এর মধ্যে কোন দলের লোকজন মাইক লাগিয়ে তারস্বরে ঘোষণা করছে—এসব অনাচার-অত্যাচার বন্ধ করতে হবে। নাহলে অবরোধ শুরু করবে তারা।

এদিকে জনসমারোহ। ওদিকে প্রতিবাদ শেষে পুলিশকেই আসতে হয় শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য। অবশ্য মার কৈলাস ক্লাবের অন্য সভ্য কর্মকর্তারাও খবর পেয়ে আগেই সরে গেছে। পুলিশ এসে দেখে ওই মাতাল কার্তিকের মূর্তির পাদদেশে আর এক জীবন্ত কার্তিক গড়াগড়ি খাচ্ছে। দ্রব্যগুণে অর্ধ-চৈতন্য অবস্থায়। পুলিশ দুই মূর্তিকেই ট্রাকে তোলে। প্রকাশ্যে কার্তিকের এই রূপকে তারা দেখাতে চায় না জনতাকে।

জীবন্ত কার্তিককে ট্রাকে তোলা হল। কার্তিক বিড়বিড় করছে।—ওই মূর্তিটাকে বিসর্জন দিতে চাও দাও। আমাকে বিসর্জন দিও না পুলিশ কর্তা। তাহলে সত্যিই মরে যাবো।

অফিসার গর্জে ওঠে—চোপ!

ওরা দুই কার্তিককে নিয়ে চলে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *