পাখিরা আর নেই
সকাল থেকেই কিচিরমিচির শুরু হয়। সকাল বলি কেন, ভোর থেকেই জেগে ওঠে আমার বাড়ির সামনের গাছের চড়ুইগুলো। রাস্তার ওপারে মাথা তুলেছে একটা আকাশমণি গাছ। সবুজ ডালপালা মেলে আকাশে মাথা তুলেছে। সবুজ পাতার ফাঁকে থোকা থোকা হলুদ ফুলের সমারোহ থাকে বারোমাসই। আর ওই গাছের ডালে কয়েকশো চড়ুই পাখির আস্তানা। গাছটার ডালগুলো রাস্তা পার হয়ে আমার ছাদের মাথায় চলে এসেছে।
ওদিকে একজন রিটায়ার্ড জজসাহেবের বাড়ি। অবশ্য এখানে এসে অবধি জজসাহেবকে দেখিনি। তিনি অনেক আগেই মারা গেছেন। তখন এদিকে খুব ঘন বসতিও ছিল না। শহরের একপ্রান্ত বলে ছিল অনেকগুলো বাগানবাড়ি আর গাছগাছালি। ক্রমশ জনবসতির চাপে গাছগাছালি কমে গেছে। উঠেছে বেশ কিছু বাড়ি। বড় বড় ফ্ল্যাটবাড়িও তৈরি হচ্ছে। বিচিত্র মানুষের ভিড়, মালবাহক গাড়িওয়ালাদের ভিড়ে জায়গাটার নীরবতাও খানখান হয়ে গেছে। তবু আমার বাড়ির উল্টোদিকে ওই জজসাহেবের বাড়ির কল্যাণে কিছুটা সবুজ এখনও রয়েছে।
বেশ অনেকখানি জায়গার ওপর তৈরি বাড়িটার সামনে বাগান। বিদেশী কিছু গাছের সঙ্গে কয়েকটা আম-কাঁঠাল গাছও রয়েছে। বাড়িটায় থাকেন জজসাহেবের বিধবা স্ত্রী। তাঁর একমাত্র ছেলে নাকি মুম্বাই-এ কোন নামি কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার। সেখানেই থাকেন।
ওই বয়স্কা মহিলাকে দেখেছি। সৌম্য চেহারা। বাড়িটাতে একটা বাচ্চাদের স্কুল করেছেন। উনি ছাড়া কয়েকজন মহিলা শিক্ষিকাও আছেন স্কুলে। শুনেছি মিসেস রায়কে তাঁরা বড়মা বলে ডাকেন।
ভোরে সেই বাগানের গাছগাছালিতে শুরু হয় পাখিদের কলরব। কিছুক্ষণ কলরব করার পর পাখিগুলো চলে যায় অন্যত্র, খাবারের সন্ধানে। বাগানে স্তব্ধতা নামে। এরপরই শুরু হয় বাচ্চাদের কলরব। দলে দলে আসে কচিকাঁচার দল। রিকশায়, ভ্যানে। হৈচৈ করতে করতে নামে। বাগানটা ভরে যায় ওদের ভিড়ে।
সকালে অফিস বের হবার আগে পর্যন্ত দেখি বাচ্চারা প্রার্থনা সঙ্গীতের পর ক্লাশে চলে যায়। কয়েকটা বাচ্চা থাকে বাগানে। খেলা করে দিদিমণির পাহারায়।
মানসী বলে, ভোর থেকে পাখির কিচিরমিচির। বেলা হলে বাচ্চাদের হৈচৈ। কী জ্বালাতন!
বলি, বেশ তো আছ নিরিবিলিতে।
সন্ধ্যার পর স্তব্ধতা নামে। তখন এদিকের পথে লোক চলাচলও কমে যায়। গাছগাছালি ঘেরা পথে দু’একটা আলো জ্বলে, তাতে মিশে থাকে আবছা অন্ধকার। আমের বোলের সময় বাতাসে ভাসে তার সুরভি। কাঁঠাল ফুলের মাদকতাময় সুবাস রাতের রহস্যময়তাকে যেন বাড়িয়ে তোলে।
মানসী বলে, রাতে এই জায়গাটা সত্যিই সুন্দর।
ছুটির দিন বিকেলে ব্যালকনিতে চা নিয়ে বসি। তখন রাস্তার ওপারের গাছ, বিশেষ করে পথের ধারে ওই অপেক্ষমাণ গাছের ডালে ডালে কয়েকশো চড়ুই এসে বসেছে।
মানসী বলে, ওদের ইস্কুলের তো ছুটি নেই।
সূর্যের আলো ম্লান হয়ে আসে। অন্যদিন স্কুলের ডে সেকশনের ছুটি হতে বিকেল হয়ে যায়। ছুটির মুখে বাচ্চাদের খুশির কলরবে মুখর হয়ে ওঠে ওই বাগান-ঘেরা বাড়িটা—পথ। ওরা চলে যাবার পরই শুরু হয় ওই আকাশমণি গাছটায় চড়ুইদের পাঠশালা। দিনশেষে ঘরে ফেরা মানুষের মতো ওরাও ফেরে ওই গাছের ডালে। হয়তো জায়গার দখল নিয়ে—না হয় অন্য কারণে শুরু হয় ওদের কলরব। ওদের মধ্যে অনেক চড়ুই যেন চেনা হয়ে গেছে। কেউ চোখ পাকিয়ে অন্যদের দিকে তাকায়। কেউ বা ভিড়ের মধ্যে থেকে প্রিয়াকে খুঁজে পেয়ে উড়ে যায়। প্রেয়সী তখন অন্য প্রেমিকের সঙ্গে রসালাপে মত্ত। অন্যজন এসে ধমকে তাকে তাড়িয়ে নিজের দখল কায়েম করে। না হয় নিজেদের মধ্যে ইচ্ছে করে ঝগড়া বাধায়। মানসী বলে, ওই বড় চড়ুইটা খুব হিংসুটে।
আমি দেখছি ওটা অন্যকে সরিয়ে প্রেমিকার পাশে বসল। ডানা ঝাপটায়। বলি, তোমার সঙ্গে কাউকে প্রেমালাপ করতে দেখলে বাধা দেব না? সিওর দেব। ও তাই করেছে। কোনো অন্যায় করেনি—
মানসী বলে, পুরুষরা সত্যিই হিংসুটে। কি মানুষ কি পাখি—
মাঝে মাঝে কোনো চড়ুই দম্পতি ওই ভিড় থেকে সরে এসে নিভৃতে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে। আমাদের দোতলার ভেনটিলেটরের খোপে খোপে ওদেরই কয়েকজন ঘর বেঁধেছে কুটোকাটা দিয়ে। মাঝে মাঝে নোংরাও পড়ে মেঝেতে।
মানসী বলে, দেব একদিন ঝুলঝাড়া দিয়ে সব বাসা ভেঙে।
কিন্তু সেদিন বাসা ভাঙতে গিয়ে মানসী দেখে কয়েকটা ডিমও রয়েছে আর তাতে বসে তা দিচ্ছে মাদী চড়ুইটা। মানসী অবাক হয়। ওমা! দ্যাখো কাণ্ড—একেবারে গিন্নী হয়ে বসেছে।
ক’দিন পরই টক টক শব্দও শোনা যায়। মা চড়ুইটা ঠোঁটে করে খাবার এনে ওদের খাওয়াচ্ছে। চোখ ফোটার পর বাচ্চাগুলো ভীরু চাহনিতে দেখছে এই জগৎটাকে। তারপর একদিন ডানা মেলে তারাও গিয়ে ওই গাছের পাঠশালার পড়ুয়ার দলে নাম লেখায়।
দিনভর পাখির কলরব, বাচ্চাদের কলরব, কান্না, চেঁচামেচিতে দিন কাটে। বাচ্চাদের কারও প্যান্ট খুলে গেছে—তাই কান্না। তার কাছে এটা খুবই অপমানের ব্যাপার। কেউ হয়তো কারও প্যান্ট ধরে টেনেছে। সেও প্রতিবাদের আর কোনো পথ না পেয়ে তার হাতেই কামড় দিয়েছে অর্ধ দিগম্বর অবস্থাতে। কখনও দেখা যায় উড়ন্ত কোনো রঙিন প্রজাপতির পিছনে ছুটেছে কলরব করে।
মানসী বলে, তুমি তো অফিসে। সকাল থেকে রাত অবধি আমার ওই কচিকাঁচাদের দেখেই কেটে যায়। এমনই চলছিল আমাদের দিন। ছুটির দিনটায় সকাল-সন্ধ্যা আমাদেরও চড়ুইপাখির জগতে শান্তিতে কেটে যায়। কাতর আর্তনাদ, মানুষের যুদ্ধ গর্জন—সভ্যতার বিষ ধোঁয়া নেই। এ এক শান্তির জগৎ। শহরের মধ্যেও এমন শান্তির জগতে থেকে খুশিই হয়েছি। বন্ধুবান্ধবরাও এসে বলে, দারুণ আছিস রে। সুন্দর পরিবেশ।
ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাত্রী মিসেস রায়কে আগেই দেখেছি। মানসীও চেনে ওঁকে। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার পর যায় ওঁর বাড়িতে। মানসী বলে, বড়মায়ের ওই স্কুল নিয়েই দিন কাটে। একা থাকেন। ছেলে, ছেলের বৌ সবাই বাইরে, এখানে আসতেও চায় না। বড়মা বলেন, আমি চলে যাবার পর স্কুলটা যদি থাকে আমার আত্মা খুশি হবে। ওদের নিয়েই তো থাকি।
মানসী বলে, দিনভর আমিও ওদের কাণ্ডকারখানা দেখি। যা বিচ্ছু সব!
বড়মা বলেন, বাচ্চারা তো দুষ্টু হবেই। তবু কি জানো ওরা ফুলের মতো পবিত্র। ওদের সঙ্গে থাকতে আমার কষ্ট হয় না। দ্যাখো না, ছুটির দিনগুলো আমার কাটতেই চায় না।
মাঝে মাঝে বিকেলে ওঁকে বাগানে পায়চারি করতে দেখি মালির সঙ্গে। তখন ছেলেরা নেই তবু রয়েছে পাখিদের কলরব। এ যেন এক স্বতন্ত্র জগৎ।
মাঝে মাঝে কিন্তু ওই শান্ত পরিবেশেও দু’একটা ধূর্ত বাজপাখিকে দেখা যায়। ওরা ওদিকে রেললাইনের ধারে কয়েকটা নারকেল আর তাল গাছে থাকে। মাঝে মাঝে এদিকের আকাশে এসে পাক খায় বড় বড় ডানা মেলে। ওদের ধারালো নখ, বাঁকা খঞ্জরের মতো ঠোঁট দিয়ে দু’একটা হরিয়াল, বড় ঘুঘুকে ধরে নিয়ে উড়ে যায়, তখন শোনা যায় পাখিদের আর্তনাদ। চড়ুইগুলোর কলরব থেমে যায়।
ছাদে এসে দেখি পায়রাগুলোও এখানে-ওখানে ঢুকে পড়েছে। ওদের সুখের সংসারে লোভী কোনো জানোয়ার রক্তপিপাসা নিয়ে এসে পড়েছে। যখন তারা চলে যায় তখন আবার এদের জগতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে।
মানসী বলে, বেশ শান্তিতে থাকে এরা, কোথা থেকে ওই বাজাপাখিগুলো আসে বলো তো?
জবাব দিই, ওরা শান্তি বিঘ্নিত করতেই আসে। ওই ওদের কাজ।
ক’দিন বড়মাকে বাগানে আর দেখি না। অবশ্য এখানের জীবনযাত্রা তেমনটাই চলছে। পাখি আর বাচ্চাদের জগৎ নিয়ে আমিও প্রায় সময় কাটাই। ইদানীং দেখি মানসী মাঝে মাঝে বের হয়। সে বলে, একা ঘরে বোর ফিল করি। একটা চাকরি করব ভাবছি।
চাকরি! এ বাজারে চাকরি কে দেবে?
আমার কথায় মানসী বলে, যোগ্যতা থাকলে চাকরি মিলে যাবেই।
মানসী আর্টস গ্রাজুয়েট, গানও জানে। গানের ডিগ্রি আছে। মাঝে মাঝে রেওয়াজ করে। বাড়িতে দু’চারজন ছাত্রীও আসে গান শিখতে। মানসী শহরের কোন স্কুলে চাকরিও পেয়েছে। আমরা দু’জনই ন’টা নাগাদ বেরোই। বাড়িতে তখন তালা পড়ে যায়। আমি বিকেল নাগাদ ফিরি। মানসী তার মধ্যে চলে আসে।
ইদানীং মাঝে মাঝে মানসীর ফিরতে দেরি হয়। একাই চা নিয়ে বসি ব্যালকনিতে। চড়াই পাখিদের সংসারে তাদের কলরব শুনি, সন্ধ্যা নামে। সারা পরিবেশ কেমন নির্জন হয়ে আসে। সন্ধ্যার পর বাতাবি ফুলের সুবাসে অস্থির হয়ে ওঠে বাতাস। মানসীর দেখা নেই। ফেরে যখন, তখন রাত প্রায় ন’টা।
এত দেরি!
মানসীর প্রসাধনও এখন বেড়েছে। ও নিজেকে আরও সোচ্চার করে তুলতে চায়। ওর লুপ্ত প্রায় যৌবনের দিকেই এখন বেশি নজর দিতে চায় সে।
মানসী বলে, স্কুলের দু’তিনজন শিক্ষিকা মিলে লাইট হাউসে নতুন একটা ছবি দেখতে গেছিলাম। খেয়ে নাও—এস খাবার গরম করে দিচ্ছি।
তুমি?
মানসী বলে, ওদের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় খেয়েছি।
মানসী কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। সেই পরিবর্তনের ছবিটা আমার চোখে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। সেদিন ছুটির দিন বাড়িতেই রয়েছি। মানসীর আজ কি একটা জরুরি মিটিং আছে, সে দুপুরেই বেরিয়েছে। মিটিং-এ যেতে এত সাজগোজ, উগ্র সেন্ট, দামি একটা শাড়ি পরতে হবে জানা ছিল না। দেখি কাকে দু’তিনবার ফোনও করল। তারপর বেরিয়ে গেল। বলল, খাবার করা আছে। খেয়ে নিও। আমার দেরি হবে।
মানসীকে বাধা দেবার চেষ্টা করতে মন চায়। কিন্তু ওই পাখিদের শান্তির জগতে বাস করে আমিও যেন ওদের মতো নিরীহ শান্তিপ্রিয় হয়ে উঠেছি। হঠাৎ দেখি বড় বাড়িটার সামনে লোকজনের ভিড়, গাড়ির আনাগোনা। ছুটির শান্ত পরিবেশ ওদের আসা-যাওয়াতে ব্যাহত হয়। বের হয়ে আসি। বড় বাড়ির দারোয়ান বলে, বড়মা ক’দিন থেকে অসুস্থ হয়ে নার্সিং হোমে ছিলেন। আজ সকালে মারা গেছেন। ওঁর ছেলে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এসেছেন।
দেখি এক মাঝবয়সী স্যুটপরা ভদ্রলোক আর তার অবাঙালি স্ত্রীকে। ছেলেমেয়েরাও এসেছে। এরমধ্যে শববাহী গাড়িও এসে গেছে। বেশ কিছু গাড়ির ভিড়। সুবেশধারী লোকজনও রয়েছে। তবে বড়মার স্কুলের কয়েকজন শিক্ষিকা ছাড়া চোখের জল ফেলার মতো আর কেউ-ই নেই।
তখন সন্ধ্যা নামছে। পাখিদের কলরবও থেমে গেছে। বাতাসে ওঠে ঝরা বকুলের বেদনাময় সুবাস। বড়মাকে নিয়ে যায় ওরা ফুল ছিটিয়ে। স্তব্ধতা নামে। রাত ঘনায়—দু’একটা রাতজাগা পাখির কলরব ওঠে।
গাড়ির শব্দে প্রথমে ভেবেছিলাম বড় বাড়ির ওরা বোধহয় শেষকৃত্য সেরে ফিরছে। কিন্তু তা নয়—মানসী ফিরেছে। সঙ্গে একজন ভদ্রলোক। মানসীকে নামিয়ে দিয়ে হাত নেড়ে শুভরাত্রি জানায়। মানসীও খুশিতে হাত নাড়ে। গাড়িটা চলে যায়, পিছনের টেল ল্যাম্পের দুটো লাল আলো জ্বলছে, যেন আমার দিকে চেয়ে শাসনের রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে।
মানসী হয়তো ভেবেছিল আমিই নানা প্রশ্ন করব। তার উত্তরগুলোও হয়তো মনে মনে তৈরি করেছে। কিন্তু ওসব প্রশ্ন না করে বলি, বড়মা মারা গেলেন!
মানসী তখন অন্য জগতের সুখচিন্তায় মগ্ন। তাই বলে, বড়মা! কে বড়মা!
ওই যে বড় বাড়ির বড়মা। …আমি জবাব দিই।
মানসী তেমন কোনো গুরুত্ব দেয় না। নিস্পৃহ কণ্ঠে বলে, তাই নাকি!
ও চলে যায় ওঘরে। তখনও ওর মনে সেই খুশির সুর। বড়মার ব্যাপারে আজ ওর কোনো আগ্রহ নেই। যেন আগ্রহ নেই এই সংসারের জন্যও। অন্য কারও জন্য।
কিন্তু বড়মার মৃত্যুর পর ওই বড় বাড়ির বুকে নেমে এল একটা পরিবর্তন। আর সেই পরিবর্তনটা সহজেই চোখে পড়ার মতো। মানসী তার জগৎ নিয়েই ব্যস্ত। ছুটির দিনও সে প্রায়ই বের হয়। একদিন প্রতিবাদ করি, সপ্তাহে একটা দিন ছুটি, সেদিনও তোমাকে বের হতে হবে?
আমার কথার সুরে হয়তো আমার অজান্তেই একটা অধিকারের সুর ফুটে ওঠে। মানসী সেটা বুঝেই কঠিন গলায় বলে, আজীবন শুধু তোমার সেবা করার জন্য দাসখত নিশ্চয়ই লিখে দিইনি। আমারও নিজের কাজ থাকতে পারে।
আর জবাব দিইনি। ও যথারীতি বের হয়ে যায়।
ব্যালকনিতে বসে আছি। এখন বড় বাড়িটাও স্তব্ধ। বড়মা মারা যাবার পর থেকেই দেখছি সেই পরিবর্তন। স্কুল আর বসে না। ভোর থেকে সকাল অবধি পাখিদের কলরব চলে গাছগাছালির বুকে—তারপর ওরাও উড়ে যায়। স্তব্ধতা নামে এখানে। কচিকাঁচাদের কলরব আর শোনা যায় না। সব চুপচাপ। আবার পাখিদের কলরব ফিরে আসে বিকেলে। দিনভর এখানে থাকে স্তব্ধতা— শূন্যতা।
এবার অবাক হই। কয়েকটা গাড়ি থেকে লোকজন নামে। ওরা বাড়িটাকে দেখছে। ফিতে দিয়ে গেট থেকে মাপজোখও করে। এদিক-ওদিক ঘুরে দেখে। সঙ্গের কিছু লোকজন এখানে-ওখানে খোঁটা পোঁতে। দড়ি দিয়ে খোঁটাগুলোকে বেঁধে চুনের দাগ দিতে থাকে। ফুলগাছগুলোকে মাড়িয়ে চলেছে ওরা। ওরা চলে যাবার পর দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করি, ওরা কারা? কী করছিল এখানে?
দারোয়ান বলে, বাবুজী, কিছু শোনেননি?
না তো?
আমার কথা শুনে দারোয়ান বলে, বড়মা মারা যাবার পর ওঁর ছেলে কোনো প্রোমোটারকে এই বাড়ি-জমি সব বাগান বিক্রি করে দিয়েছেন।
সব স্বপ্নের, সব সুখের যেন শেষ হয়ে গেল। কচিকাঁচাদের কলরব, ওদের প্রার্থনা সঙ্গীতের সুর ভরিয়ে দিত আমাকেও। আর সেই সুর কোনোদিন উঠবে না এখানে। সব স্তব্ধ হয়ে গেল। দারোয়ান বলে, সেই প্রোমোটারের লোকজন এসেছিল। ওরা নাকি এখানে হাইরাইজ, বাজার এসব তৈরি করবে।
ফিরে আসি। সন্ধ্যা নামছে। বাগানের গাছে পাখিদের কলরব ওঠে। পথের ধারে আকাশমণি গাছের নীচে হলুদ সোনালি ফুলের পাপড়ির বিস্তার। ডালে ডালে হাজারো চড়ুই পাখিদের কলরব ওঠে। এই গাছটা যেন ওদের দখলে। কে কোথায় থাকবে, এই নিয়েই চলে নিত্য বচসা।
ক’দিনের মধ্যেই ওই প্রোমোটারের লোকজন সদলবলে এসে হানা দেয়। কুঠার করাত নিয়ে হাজির হয় ওই বাগানে। তখন গাছে গাছে আমের মুকুল থেকে এসেছে ফলের সম্ভাবনা। কোনো কোনো গাছে ছোট ছোট আমও ধরেছে। সবই বেশ ভালো জাতের শৌখিন আমের গাছ। বিশাল কাঁঠাল গাছের ডালে এসেছে অসংখ্য কাঁঠাল ফুল। সন্ধ্যার বাতাস ওদের ব্যাকুল সুরভিতে অস্থির হয়ে ওঠে। ওই নিষ্ঠুর লোকগুলোর যেন দয়ামায়াও নেই। ওরা ওই ফলন্ত গাছগুলোকে কেটে ফেলছে। কাঁঠাল গাছের কাণ্ডটাতে করকর শব্দে করাত চলছে। কুঠারের আঘাতে কেঁপে কেঁপে উঠছে অন্য গাছগুলো। আকাশে বাতাসে ওদের আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে। তবু মাটি কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে তারা। কিন্তু পারে না। ওদের কুঠারের ঘায়ে বাঁচার ব্যর্থ সংগ্রাম করে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। কাঁঠাল গাছটাও ফুলের রাশ বুকে নিয়ে আছড়ে পড়ে।
বাতাসে পাখিদের অস্থিরতার চিৎকার ওঠে। ওরা এতদিন ধরে ওই গাছের ডালেই রাত্রিবাস করেছে। ঘর বেঁধেছে। আশ্রয় নিয়েছে, প্রেমপর্বও চালিয়েছে। আজ সব কিছুই শেষ হয়ে গেল। হারিয়ে গেল ওদের আশ্রয় কিছু লোভী স্বার্থপর মানুষের আশ্রয়ের জন্য।
রাস্তা থেকে চেয়ে দেখি সন্ধ্যার ম্লান আলোয় ওই আশ্রয়চ্যুত পাখিদের দল হাহাকার করছে। গাছগুলো তখনও মাটিতে পড়ে আছে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায়।
অবশ্য পথের ধারে আকাশমণি গাছটা ওদের কুড়ুলের আঘাত থেকে বেঁচে গেছে। চড়ুইগুলো প্রতিদিনের মতো আজও ওখানেই রয়েছে। তবে ওরাও যেন অন্য পাখিদের হাহাকার শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে কোনো আতঙ্কে। রাত নামে, আশ্রয়চ্যুত পাখিগুলো অন্ধকারে কে কোথায় হারিয়ে গেল কে জানে! মানসীর পথ চেয়ে থাকি—রাত বাড়ে। মানসী তখনও ফেরেনি।
ব্যালকনির সামনের চেহারাটাই এখন বদলে গেছে, কয়েক মাসের মধ্যে। সেই কচিকাঁচাদের কলরব আর নেই। এখন ও জায়গাটায় উঠেছে বিশাল সব ফ্ল্যাটবাড়ি। এতটুকু সবুজও নেই। নেই সেই স্তব্ধতা। সেই আমের বোল— কাঁঠাল ফুল—বাতাবি লেবু ফুলের সুবাস। ওখানে ওঠে না পাখিদের কলরব।
ঐ জায়গাটায় এখন সারবন্দী পাঁচতারা ফ্ল্যাটবাড়ি। পাখিদের তাড়িয়ে এসেছে হাজারো মানুষ। কয়েকশো গাড়ি। ডিজেল-পেট্রলের ধোঁয়ার গন্ধে এখানের বাতাসও কলুষিত। আমার সেই জগৎ, সেই পরিবেশ। স্তব্ধতার প্রশান্তিও আর নেই। বাতিল চুন বাড়ি ভাঙা ইঁটের বাতিল আবর্জনা। প্লাস্টিকের ছেঁড়া ব্যাগের স্তূপ জমেছে ওই আকাশমণি গাছটার নীচে। তার ডালে সবুজ পাতাগুলোও বিবর্ণ হয়ে গেছে, হলুদ সোনালি ফুলও আর ফোটে না।
সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা—ভোরে, সন্ধ্যায় যে হাজার চড়ুই পাখির পাঠশালা বসত ওই গাছে, সেই চড়ুইগুলোও আর আসে না।
রোদ-পোড়া দিন শেষ হয়। বিকেলের ম্লান আলো নামে, শূন্য ডালে আর কেউ আসে না কলরব করতে। আমার ঘরের মতোই শূন্যতা বিরাজ করে ওই গাছে। মানসীও আর ফেরেনি। আমার ঘর তার পছন্দ হয়নি। সে এখন নতুন করে ঘর বেঁধেছে অন্য কারো সঙ্গে।
এখন রাতের অন্ধকারে আর রাতজাগা পাখির কলরব ওঠে না। মুছে গেছে সব সুবাস। ওই বড় বাড়ির কোনো খোপ থেকে মদ্যপ কণ্ঠের চিৎকার ওঠে, কানে আসে ইংরাজী অশ্রাব্য গালিগালাজ, কাচের গ্লাস, শার্সি ভাঙার শব্দ। নয়তো কখনো উন্মত্ত নরনারীর উন্মাদ কণ্ঠের হাসির তীক্ষ্ণ শব্দ আসে কানে।
এই কামনা বিলাসের বিকৃত জগতে সব সুন্দরই হারিয়ে যায়। মানসীও হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে সব পাখির দল। একদিন হঠাৎই দেখলাম ওই টিকে থাকা আকাশমণি গাছটাও বিবর্ণ পত্রশূন্য হয়ে প্রাণরস হারিয়ে কঙ্কালসার দাঁড়িয়ে আছে। এবার ওটাও আছড়ে পড়বে মাটিতে। প্রকৃতির সবকিছু মুছে যাবে। টিকে থাকবে ওই আকাশছোঁয়া বাড়িগুলো। যেখানে কোনো সবুজ থাকবে না, সৌরভ থাকবে না। পাখিরাও নেই। আজ মানসীর কথা মনে পড়ে— সেও নেই। হারিয়ে গেছে।