নয়
রজত অফিসের টেবিলে চুপ করে বসে আছেন, থুতনির নীচে দু’হাত রেখে। বাইরে তুমুল হট্টগোল। খাদ্য আন্দোলন উপলক্ষে বসিরহাট-কৃষ্ণনগরের হাঙ্গামা ক্রমশ সারা বাংলায় ছড়াচ্ছে, ডায়মন্ডহারবারেও তার ঢেউ এসে পৌঁছেছে। চেকপোস্টের পুলিশদের সঙ্গে বচসা থেকে শুরু হয়ে হঠাৎ আজ সকালে মারামারি বেধেছে। দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে চকিতে। বাস টার্মিনাস এবং রেলস্টেশনে পিকেটিং, পথে পথে অবরোধ। আজ শনিবার, কিছু লোক সকালের দিকে পিকনিক করতে এসেছিল ডায়মন্ডহারবারে, তারাও ভয় পেয়ে গেছে। নারী-পুরুষ ভর্তি দুখানি মোটর গাড়ি থেমে আছে রজতের অফিসের কম্পাউন্ডে। ওরা পুলিশের সাহায্য নিয়ে কলকাতায় পৌঁছোতে চায়।
খাদ্য আন্দোলন ছাড়াও আজকের দিনটি শিক্ষক আন্দোলন দিবস হিসাবে নির্দিষ্ট ছিল। গত দশদিন ধরে সমস্ত স্কুল-কলেজ বন্ধ। শিক্ষকদের মিলিত আন্দোলন। আজ জেলায় জেলায় বিক্ষোভ, আগামী সোমবার কলকাতায় শিক্ষকদের মিছিল বেরোবে। রজত এই অঞ্চলের মুখ্য সরকারি কর্মচারী বলে তাঁর অফিসের সামনে বিক্ষোভকারীরা জমায়েত হয়েছে।
ইন্সপেক্টর তারক দাসকে রজত ডেকে বলেন, বাইরে কত লোক হবে?
হাজার দেড়েক হবে, স্যার! আর শিক্ষকরা হবে জনা চল্লিশ।
বাইরে একডজন পুলিশ পোস্ট করে দিন। যতক্ষণ শুধু চ্যাঁচাবে, ততক্ষণ কিছু করার দরকার নেই। কিন্তু হাঙ্গামা করার চেষ্টা করলে প্রথমে মাইক্রোফোনে সাবধান করে দেবেন, তাতে না থামলে লাঠি চার্জ করবেন—কোনও রকম স্পেয়ার না করে! আর দেখবেন, শিক্ষকদের গায়ে যেন কিছু আঘাত না লাগে। তাদের আলাদা করডন করে রাখবেন। টিয়ার গ্যাস সেল কটা আছে?
সাতাশটা। কিন্তু স্যার—
এর মধ্যে কোনও কিন্তু নেই। খাদ্য সমস্যা মেটাবার ভার আমাদের হাতে নেই, কিন্তু শান্তি রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। সে দায়িত্ব আমাদের পালন করতেই হবে।
নিশ্চয়ই স্যার। আমি বলছিলুম, যে-রকম টেনশন তাতে খুব সহজে মিটবে না আজ। কিন্তু দুটো ইসু মিলে গেছে। এর মধ্যে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের যদি ডিসপার্স করে দেওয়া যায়—
শিক্ষকদের দাবি কী? ওঁরা আমার কাছে কী চান? আমি কী করতে পারি?
ওঁরা চান, আপনি বাইরে বেরিয়ে ওদের অভিযোগ শুনবেন।
রজতের মুখ আজ কঠোর, চোখ দুটো তীব্র উজ্জ্বল। ঈষৎ বিরক্ত ভাবে তিনি বললেন, এ কথা শিক্ষকরা জানেন, সবাই জানে, তাঁদের দাবি আদায় করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটকে ঘেরাও করা নিছক পলিটিক্স ছাড়া আর কিছুই নয়। আমার ক্ষমতা আছে ওঁদের মাইনে বাড়াবার? আমাদের স্ট্রাটেজি শুনুন! আপনি ওঁদের গিয়ে বলুন, আমি ওঁদের সঙ্গে দেখা করব ঘণ্টাখানেক পরে, আমার হাতের কাজ সেরে। এতে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কোনও গণ্ডগোল হয়তো বাধবে না। ততক্ষণে আমি টেলিফোনে রি-ইনফোর্সমেন্টের ব্যবস্থা করিয়ে রাখছি। আধ ঘণ্টা পর আপনি শিক্ষকদের সবাইকে কম্পাউন্ডের মধ্যে ডেকে আনবেন, কিন্তু কাউকে অফিসের মধ্যে ঢুকতে দেবেন না, ওঁদের আবার ডিটেন করাবেন। কিছুক্ষণ স্লোগান দিয়ে ওদের ক্লান্ত হতে দিন। ততক্ষণে ওয়াচ করবেন, ওঁদের মধ্যে বেশি ছটফটে, বেশি লিডার লিডার ভাব ক’জনের। তারপর তাদের বাদ দিয়ে, বাকি কয়েকজনকে বলবেন, আমি মাত্র চার-পাঁচজনের ডেলিগেশনের সঙ্গে দেখা করতে, ওঁদের অভিযোগ শুনতে কিংবা লিখিত দাবিপত্র নিতে রাজি আছি। এখন এই চার-পাঁচজন সিলেক্ট করার ব্যাপারে ওঁদের মধ্যে একটা মনোমালিন্য আর দলাদলি তৈরি হতে দিন। শিক্ষকদের মধ্যে কারা বেশি পলিটিক্যাল মাইন্ডেড, তাঁদের লিস্ট তৈরি করেছেন?
হ্যাঁ স্যার। এই যে।
লিস্টে গোয়েন্দা বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী সতেরো জন শিক্ষকের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় লেখা আছে। সেটায় চোখ বুলোতো বুলোতে রজত হঠাৎ কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। অস্ফুট ভাবে বললেন, অরুণ চ্যাটার্জি? ইনিও কি এ সবের মধ্যে……
ইনস্পেক্টর তারক দাস বলল, হ্যাঁ স্যার। উনি নিয়মিত স্টাডি সার্কল বসান। উনি অঙ্কের শিক্ষক, কিন্তু ছাত্রদের সঙ্গে পলিটিকস নিয়ে আলোচনা করেন। কমুনিস্ট পার্টির মেম্বার না হলেও সিমপ্যাথাইজার বলা যায়। আমাদের রিপোর্ট অনুযায়ী উনি গত দু মাসে তিনবার মিছিলে যোগ দিয়েছেন, আগে আসামে থাকতেন, সেখানে অবশ্য কোনও রেকর্ড পাওয়া যায়নি।
ঠিক আছে। যা বললাম, সেই মতো কাজ করুন। খবরের কাগজের করেসপন্ডেন্টরা এসেছে নিশ্চয়ই? শিক্ষকদের ডাকবার সময় তাদেরও ডাকবেন। এ ঘরে ক’টা চেয়ার আছে। এক, দুই….নটা? খানতিনেক এখন বাইরে নিয়ে রাখুন, আমি চাইলে দেবেন।
রজত কিছুক্ষণ টেলিফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রইলেন। তারপর ফাইল ওলটাতে লাগলেন, এবং শেষপর্যন্ত নিজের একখানা ছুটির দরখাস্ত লিখতে লাগলেন। ওপরওলার কাছে আবেদন করলেন, তাঁকে অন্তত একমাসের ছুটি দেওয়া হোক, এবং ছুটির শেষে তাঁকে যেন অন্য কোথাও ট্রান্সফার করা হয়। এ শহরে তাঁর নিজের, বিশেষত তাঁর স্ত্রীর স্বাস্থ্য টিকছে না।
ব্যবস্থা মতন পঞ্চাশ মিনিট বাদে ইনস্পেক্টর তারক দাস সাতজন শিক্ষকের একটি প্রতিনিধি দল এবং তিনজন কাগজের রিপোর্টারকে নিয়ে এ ঘরে ঢুকলেন। রজত অত্যন্ত ব্যস্তভাবে সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, আসুন, আসুন! বসুন চেয়ারে। এই, চেয়ার দাও! জমাদার, কুর্সি…রজত নিজেই চেয়ার আনতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই চেয়ার পৌঁছে গেল। রজতের হাতে প্রায় আস্ত একটা সিগারেট জ্বলছিল, শিক্ষকদের সম্মানে তিনি সেটা তক্ষুনি অ্যাসট্রেতে গুঁজে দিলেন। রজত জিজ্ঞেস করলেন, চা খাবেন নিশ্চয়ই? অথবা ঠান্ডা কিছু—
রজত যত সরল আন্তরিকতার আড়ম্বর দেখিয়ে অবস্থা জয় করবেন ভেবেছিলেন, তত সহজে সব কিছু মিটল না। শিক্ষকদের দলে তিনজন প্রৌঢ়ের সঙ্গে চারজন যুবাও এসেছিলেন। তাঁরা পরিষ্কার পরিকল্পিত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাঁদের অভিযোগ পেশ করতে লাগলেন। তাঁরা চা কিংবা শরবত প্রত্যাখ্যান করলেন। নির্ভুল যুক্তিতে সরকারি নীতির নিন্দা করে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পথ বর্ণনা করলেন। আবহাওয়া একটু উত্তপ্ত হয়ে উঠল। একজন এমনকী হাতের কাগজ আন্দোলিত করে রজতকে ব্যক্তিগত ভাবে আক্রমণ করে বললেন, রজতের যা বিদ্যাবুদ্ধি তার দ্বিগুণ বিদ্যাবুদ্ধি নিয়েও একজন কলেজের অধ্যাপক রজতের তিন ভাগের এক ভাগ মাইনে পান, এজন্য রজতের লজ্জা করে না? রজত আগাগোড়া মাথা ঠান্ডা করে রইলেন, বার বার শুধু বললেন, তিনি ওঁদের অভিযোগ সরকারের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন শুধু, এছাড়া তাঁর আর কিছুই করার নেই।
কথা বলতে বলতে রজত চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরের দিকের জানলার পাশে দাঁড়ালেন। অন্যমনস্ক ভাবে একবার চেয়ে দেখলেন। বাকি শিক্ষকরা কম্পাউন্ডে জমায়েত হয়ে আছেন, রজত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রত্যেকের মুখ লক্ষ করলেন। না, ওঁদের মধ্যে অরুণ চ্যাটার্জি নেই। রজত জানেন, অরুণ সেরে উঠেছে, হাঁটা-চলা করতেও শুরু করেছে। দু’দিন আগে রজতের সঙ্গে অরুণের দেখা হয়েছিল ডাক্তার সেনের বাড়িতে। এত কাণ্ডের মধ্যেও রজত মনে মনে একটা গোপন কৌতুক বোধ করলেন। এঁদের মধ্যে যদি অরুণও আসত? ওই যে অধ্যাপকটি হাতের কাগজ নেড়ে নেড়ে রজতকে ভর্ৎসনা করছেন, ঠিক ওই জায়গায় যদি অরুণ দাঁড়াত, তা হলে দৃশ্যটা কেমন হত! কিন্তু অরুণ এল নাই-বা কেন? এলেও তো পারত। রজত ব্যাপারটা উপভোগ করতেন।
এ শহরে ডাক্তার সেনই রজতের এখনও একমাত্র বন্ধু। প্রতিদিন ডাক্তার সেনের সঙ্গে একবার আড্ডা না দিলে রজতের তৃপ্তি হয় না। সেদিন সমস্ত ব্যাপার চুকল রাত আটটার পর। হাঙ্গামা বেশি ছড়াতে পারেনি। শিক্ষকরা ফিরে যাবার পরই বাকি জনতা বেশি উত্তেজিত হয়ে ওঠে। কিন্তু তাদের মধ্যে সাঁইত্রিশ জনকে গ্রেপ্তার করার পর মৃদু লাঠি চার্জ করতেই জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর এই সব শহরে কোনও কর্মকাণ্ডই জমে না, এমনকী হাঙ্গামা বা রাজনৈতিক আন্দোলনও না।
বাড়ি ঘুরে রজত চলে এলেন ডাক্তার সেনের কাছে। ডাক্তার সেন একটা জরুরি কলে বেরিয়ে গেছেন, রজত একটু বসলেন। ডাক্তার সেনের বসবার ঘরে হাওয়ার ঝাপটায় গোলাপের সুগন্ধ ছড়ায় বারে বারে, এতক্ষণ বাদে রজত খানিকটা আরাম বোধ করলেন। জামার বোতাম খুলে দিলেন একটা, সুগন্ধ বাতাসের স্পর্শে শরীরটাকে বন্ধনহীন মনে হল। রজত মালতীকে সঙ্গে আনবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু কয়েকজন উকিলের স্ত্রী এসেছে মালতীর সঙ্গে দেখা করতে। হঠাৎ তাদের যেতে বলা যায় না। রজতও ওদের মধ্যে বসতে অস্বস্তি বোধ করতেন।
প্রতিমা দেবী নীচে নেমে এলেন রজতের সঙ্গে গল্প করতে। মুখখানা তাঁর ঈষৎ ম্লান। নানান কথাতেও তাঁর অন্যমনস্কতা কাটছে না। সূক্ষ্ম প্রসাধনে প্রতিমা দেবীর মুখে বয়সের রেখাগুলো এখনও লুকোনো। এককালে তিনি অতীব রূপসি ছিলেন, এখনও তার পর্যাপ্ত চিহ্ন রয়ে গেছে। শুধু চোখের কোণে একটু একটু ক্লান্তির ছাপ। সম্প্রতি একটা বাংলা ফিল্মে তিনি অনেকগুলি প্লেব্যাক গান গেয়েছেন। সেই কারণে সপ্তাহে কয়েকবার তাঁকে কলকাতায় যাওয়া-আসা করতে হয়েছে, হয়তো সেই ক্লান্তি। প্রতিমা দেবীর গান রজতেরও খুব ভালো লাগে। সূক্ষ্ম মীড় আর টপ্পার কাজে মন-উদাস-করা গান তিনি যখন গেয়ে শোনান, তখন মনেই হয় না এই প্রৌঢ়া, ঈষৎ প্রগলভা নারীর মধ্যে ওরকম একজন শিল্পী রয়েছে।
রজত জিজ্ঞেস করলেন, মোমকে দেখছি না? কলকাতায় গেছে?
প্রতিমা দেবী অকারণে একটু চমকে উঠলেন। হয়তো সেই মুহূর্তে তিনিও মোমের কথাই ভাবছিলেন। বললেন, না, মোম রাগ করে শুয়ে আছে ওপরে।
রজত হেসে বললেন, রাগ করেছে? মোমকে তো আমি রাগ করতে দেখিনি!
আমি বকেছি ওকে। এমন সব আবদার করে মাঝে মাঝে! সব আবদার তো রাখা যায় না!
রজত কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে রইলেন প্রতিমা দেবীর দিকে। ভাবলেন, মোম কী আবদার তুলেছে সেটা প্রতিমা দেবী নিজে না বললে জিজ্ঞেস করা সমীচীন হবে কিনা। প্রতিমা দেবী কিছু বললেন না, রজতও জিজ্ঞেস করলেন না। একটুক্ষণ দু’জনেই চুপ করে রইলেন।
প্রতিমা দেবী আবার বললেন, মোমকে ভাবছি দিল্লি পাঠিয়ে দেব। ওঁর এক দাদা থাকেন দিল্লিতে, সেইখানে থেকে পড়াশুনো করবে।
দিল্লিতে? কিন্তু এখন পড়াশুনোর কোর্স বদলাতে অসুবিধে হবে না?
হয়তো একটা বছর নষ্ট হবে। কিন্তু ওকে কলকাতায় পড়াতে ভরসা হয় না। জানেন তো যা খেয়ালি মেয়ে! এই তো গত সপ্তাহের গোড়ায় কলেজ থেকে একা-একা এখানে চলে এসেছে কাউকে না বলে। দেখুন তো কী কাণ্ড! আমি কলকাতায় ছিলাম, যদি আসবার ইচ্ছে হয়, আমাকে বলে একসঙ্গে আসতে পারত। তা না, একা-একা ট্রেনে চেপে, ওই বয়সের মেয়ে—
তাতে কী হয়েছে? অনেকেই তো আসে।
না, না, আপনি ওকে ভালো জানেন না! জানেন তো, একবার ওর মাথায় একটু গণ্ডগোল হয়েছিল—এখন সেরে গেছে অবশ্য, কিন্তু খেয়ালে এক-একসময় যা কাণ্ড করে! হঠাৎ মাঝপথে কোনও স্টেশনে নেমে পড়া ওর পক্ষে কিছুই আশ্চর্য নয়। সত্যিই হয়েছিল একবার। আমরা সেবার পুরী গিয়েছিলাম, উনি যাননি—মানে, আপনাদের ডাক্তার সেন যাননি। আমার এক দাদা আছেন, সন্তুদা—তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলাম আমি আর মোম—সোমনাথ সে-বছরই বিলেত গেছে—তা মোম করল কী, খুর্দারোড স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে নেমে হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেল! ভাবুন দেখি, সতেরো বছরের মেয়ে, কখনও এরকম করে? আমরাও সেখানে নেমে পড়ি। তারপর দু ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেল।
কোথায় ছিল?
প্রতিমা দেবী কী বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। কথাটা এড়িয়ে যাবার ভঙ্গিতে বললেন, পুলিশের সাহায্য নিতে হয়েছিল, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিল, উঃ, কীভাবে যে কেটেছিল আমার সেই দু’ঘণ্টা। ও মেয়ে কখন যে কী করবে কিছু ঠিক নেই। এখন আবার মেতেছে অরুণ চ্যাটার্জিকে নিয়ে।
অরুণ?
হ্যাঁ, ওই যে কলেজের প্রফেসর, রোগামতন লোকটা—
হ্যাঁ, আমি তাকে চিনি।
ওই একটা সাধারণ লোকের মধ্যে কী দেখেছে, দিনরাত শুধু তার কথা। সে নাকি মোমকে কী অপমান করেছে। কী অপমান, তা জিজ্ঞেসও করতে পারি না, ভয় হয়। ওইসব আজে-বাজে লোক—
অরুণ চ্যাটার্জি তো খারাপ লোক নন। আমি জানি—
তা নাইবা হল, কিন্তু ওই মেয়ের মাথায় যদি ঝোঁক চাপে—মানে, এক-এক সময় ভয় হয়, ওর সেই রোগটা আবার দেখা দিচ্ছে কিনা—এমন চিন্তায় পড়েছি! কাল অরুণ চ্যাটার্জি চলে গেছে, একটু নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম, কিন্তু তবু ভরসা হচ্ছে না। মোম যদি কলকাতায় গিয়ে আবার লোকটার সঙ্গে দেখা করে!
অরুণ চ্যাটার্জি চলে গেছেন?
হ্যাঁ। ওই যে কাল তার বাড়িতে কী সব হই-হল্লা হল। চাকরি-টাকরি সব ছেড়ে পালিয়েছেন শুনলাম।
কীসের হই-হল্লা।
আমি সব জানি না। উনি জানেন। আমার আর এসব ভাবতে ভালো লাগে না! পরশুদিন আমার আর একটা রেকর্ডিং আছে, এইরকম অবস্থা থাকলে কেউ গান গাইতে পারে? মেয়েটাকে দিল্লি পাঠাতে পারলে ভাবছি নিশ্চিন্ত হব।
কিন্তু আপনাদের ছেলে বিলেতে, মেয়েকে দিল্লি পাঠাবেন, আপনাদের ফাঁকা-ফাঁকা লাগবে না?
বিয়ে দিলেও তো মেয়েকে দূরে পাঠাতেই হবে! তা ছাড়া, আমি ভাবছি কিছুদিন কলকাতায় গিয়ে একা থাকব। উনি প্রাকটিস ছেড়ে যেতে পারবেন না, কিন্তু আমার এ জায়গাটা এখন অসহ্য লাগছে। এই বার বার যাওয়া-আসা—কলকাতায় থাকলে আমি এর চেয়ে অনেক বেশি গানের কন্ট্রাক্ট পেতাম।
এ জায়গাটা আমারও আর ভালো লাগছে না। আমি ছুটি নিচ্ছি। ছুটির পরে হয়তো অন্য জায়গায় ট্রান্সফার নেব।
ভালো করেছেন। এখানে গঙ্গা থাক আর যাই থাক, মফঃস্বলে মন টেঁকে?
তারপর হয়তো আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে না, সেইটেই দুঃখ।
কেন দেখা হবে না? কলকাতায় তো আপনাকে আসতেই হবে।
দেখা না হলেও আপনার গান তো ঠিকই শুনতে পাব অন্তত।
ডাক্তার সেন এইসময় ফিরলেন। তাঁরও সতত প্রফুল্ল মুখখানি আজ একটু গম্ভীর। তবু রজতকে পেয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, কী রায়চৌধুরী সাহেব, আজকের সংকট কীভাবে কাটল? অধ্যাপকদের কাছে কী রকম শিক্ষা পেলেন?
চরম শিক্ষা। শুধু পিঠে বেতের বাড়ি পড়েনি, এই যা!
এখনও পড়তে পারে, সময় যায়নি। ধর্মঘট তো আরও চলবে?
হুঁ! আমি ভাবছি, আমিও এ চাকরি ছেড়ে এবার একটা অধ্যাপকের চাকরি নেব। বছরে আদ্ধেক ছুটি তো আছেই, বাকি আদ্ধেকটাও ধর্মঘট করে কাটিয়ে দেব। হয় নিজেরা ধর্মঘট করব, কিংবা ছাত্রদের ওসকাব। সারা বছরই ছুটি!
এখনও বেশ রেগে আছেন দেখছি!
রাগব না? আমাকে ওঁরা দেশের অবস্থা বোঝাচ্ছিলেন! যেন আমার জন্ম বিলেত কিংবা আমেরিকায়—আমি দেশের কিছুই জানি না! সরকারি চাকরি করি বলেই আমি পাষণ্ড হৃদয়হীন হয়ে গেছি!
তবুও একথা তো অস্বীকার করতে পারবেন না, সরকারের অবিচার আর অন্যায়গুলো আপনাদের হাত দিয়ে পালিত হচ্ছে। লোকে আপনাদের সামনে পাচ্ছে, আপনাদের ওপরেই তো রাগ দেখাবে।
রজত খানিকটা দুঃখিত স্বরে বললেন, সত্যিই হয়তো চাকরিটা আমি ছেড়ে দেব। যাক, আপনি নিশ্চয়ই ক্লান্ত, আমি তা হলে আজ উঠে পড়ি।
না, না, ক্লান্ত নয়। বসুন, বসুন, একটু গল্প করা যাক।
কতদূর গিয়েছিলেন?
এই মাইল পাঁচেক। বাদুড়িয়া বলে একটা গ্রাম আছে, এক পরিবারের দু’জনকে সাপে কামড়েছে। না গিয়ে পারলাম না—
দু’জনকে কামড়েছে? বাঁচল?
নাঃ! এজাতকে বাঁচাবার সাধ্য ভগবানেরও নেই। এই সময়টা সাপের উপদ্রব বেশি হয়। এক ধরনের মারাত্মক সাপ আছে জানেন তো, এদিকে বলে শিয়রচাঁদ—কেউটেরই একটা জাত—এদের ধারণা, মহাদেবের মাথায় এই সাপ থাকে, কামড়ালে আর নিস্তার নেই। তা নয়, চিকিৎসা করলে বাঁচানো যায়, কিন্তু বাঁচাব কী! ভোরবেলা সাপে কেটেছে। তা সারাদিন ধরে ওঝার ঝাড়ফুঁক, মন্তর-টন্তরের কেরামতি শেষ করে ডাক্তারকে খবর দিয়েছে বিকেল পাঁচটায়। স্বয়ং ধন্বন্তরি গেলেও বাঁচাতে পারতেন না।
দুজনেই পুরুষ মানুষ?
না, এক চাষার বউ, আর জোয়ান ছেলে। বাড়িসুদ্ধু সবাইকে যে কামড়ায়নি, ওদের ভাগ্য ভালো। শিয়রচাঁদ খুব আদুরে সাপ। বিছানায় এসে বালিশের তলায় লুকিয়ে থাকতে ভালোবাসে। দুর্ঘটনার পর সারা বাড়ি খুঁজে একসঙ্গে ওরকম পাঁচটা সাপ বেরিয়েছে! বাড়ির পাশেই খাল। রাত্রে ঘুমোবার সময় মশারি গোঁজবার আগে বিছানাটা একটু ভালো করে ঝেড়েঝুড়ে নেবে, সে খেয়ালটুকু পর্যন্ত থাকে না! ও, আসল মজার কথাটাই এখনও বলিনি।
প্রতিমা দেবী বললেন, এসব মজার কথা শুনতে আমার একটুও ভালো লাগে না। কাল আমাদের বাগানেও তো একটা সাপ বেরিয়েছিল।
ওটা জলঢোঁড়া! ও কিছু না। শোনো ব্যাপারটা। চাষার বউ মারা গেছে, সেজন্য কারওর কোনও দুঃখ নেই। সিঁথির সিঁদুর মাথায় নিয়ে গেছে, সে তো তার ভাগ্য। সবাই কাঁদছে জোয়ান ছেলেটার জন্য। কিন্তু কী বলে কাঁদছে জান? কোন জ্যোতিষ নাকি চাষাকে বলেছিল, চাষার এক ছেলে সাপের কামড়ে মারা যাবে, সেই কথাই ফলল। কিন্তু চাষার দুঃখ, মা মনসা তার জোয়ান ছেলেটাকে না নিয়ে যদি ছোট ছেলেটাকে নিত! ভেবে দেখুন রজতবাবু, ছোট ছেলেটা পাশেই দাঁড়িয়ে—দশ এগারো বছরের ছেলে—ছলছলে চোখে তাকিয়ে আছে—উঠোনে শোওয়ানো তার মা আর দাদার শব—আর তার বাবা তাকে শুনিয়েই বলছে, সে মরে গেলে কোনও দুঃখ ছিল না। আমি মড়া দুটোর দিকে ভালো করে তাকাইনি, আমি ওই জ্যান্ত ছেলেটার দিকেই তাকিয়েছিলাম। ইচ্ছে হচ্ছিল চাষাটাকে গুলি করে মারি!
প্রতিমা দেবী বললেন, থাক, তোমাকে আর গুলি করে মারতে হবে না। বেশি কিছু বলতে গেলে ওরাই তোমাকে মারবে। আজকাল তো ওদেরই রাজত্ব!
ডাক্তার সেন দুঃখিত গলায় বললেন, ওদের রাজত্ব হোক, তাতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু নিজেদের ভালো-মন্দটুকু বোঝার জ্ঞানও তো ওদের হয়নি এখনও।
ওদের ভালো-মন্দ আর আমাদের ভালো-মন্দের ধারণা আলাদা।
রজতের একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। একটু হেসে বললেন, ওরা আর আমরা কি আলাদা? আমরা এমন ভাবে কথা বলছি, যেন দুটো আলাদা জাত। এই রকম ভাবনাটাই কিন্তু ভুল।
প্রতিমা দেবী কোনও আলোচনার মধ্যে যেতে চাইলেন না। একটু ক্ষুণ্ণ গলায় উত্তর দিলেন, যাই বলুন, আজকাল আর খোলাখুলি সব কথা বলার দিন নেই। উনি যাকে-তাকে যা ইচ্ছে বলে ধমকান। আমার ভয় করে। হঠাৎ খেপে উঠে দলবল মিলে ঘিরে ধরলেই তো হল। তখন আপনার পুলিশও কিছু সামলাতে পারবে না। দেখলেন তো, ওই অরুণ ছেলেটাকে নিয়ে কী কাণ্ড হল!
রজত সচকিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, ডাঃ সেন, অরুণের কী হয়েছে?
ডাক্তার সেন রজতের দিকে ফিরে নিঃশব্দে হাসলেন। তারপর বললেন, আহা, বেচারা! আপনার জন্যই ছেলেটাকে এত দুর্ভোগ সইতে হল।
আমার জন্য? আমি কী করেছি?
ডাক্তার সেন পুনশ্চ হেসে বললেন, ব্যাপারটা আমাদের আগেই বোঝা উচিত ছিল। আজকাল বিপ্লবীরাও কম ক্লাস-কনসাস নয়। বসুন, একটু হাত-মুখ ধুয়ে আসি, তারপর বলছি।
ডাক্তার সেন উঠে দরজার দিকে এগোতে গিয়ে প্রতিমা দেবীকে মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, মোম আজ কী রকম আছে?
এখন চুপচাপ শুয়ে আছে। বিকেলে খুব চ্যাঁচাচ্ছিল। একটা কিছু ব্যবস্থা করো!
এখন কিছু করার নেই। এমনিতেই কমে যাবে।
তা বলে একেবারে চুপচাপ থাকা যায়!
তা ছাড়া আর তো কিছু করার নেই। তুমি এখন কয়েকদিন ওর সামনে বেশি যেয়ো না, বেশি কথা-টথাও বোলো না।
আমি ওর সামনে যাব না, কেন?
একটা নিশ্বাস লুকিয়ে ডাক্তার সেন বললেন, তোমাকে দেখলেই ওর উত্তেজনা বেড়ে যায়। কয়েকদিন যাক না, আস্তে আস্তে আপনিই সব কমে যাবে।
প্রতিমা দেবী স্বামীর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন।
অরুণের খবর জানবার জন্য রজত ছটফট করছিলেন! ডাক্তার সেন ফিরে আসতেই প্রথম সেই কথা জিজ্ঞেস করলেন। ডাক্তার সেনের মুখে সেই চাপা হাসি। নানা ধরনের বিষাদ ভুলতে গেলেই মানুষ এরকম হাসি হাসে। বললেন, আপনার উচিত ছিল অরুণের সঙ্গে বেশি মেলামেশা না করা।
কেন?
কারণ, আপনি রজত রায়চৌধুরী, এখানকার এ.ডি. এম—বিশেষভাবে এই জায়গাটার শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য আপনাকে আনা হয়েছে। আপনার কি মানায় একজন অধ্যাপকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা।
আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না। অধ্যাপক হলেই সামান্য কেন হবেন? তা ছাড়া, আমার স্ত্রীর সঙ্গে ওঁর আগে থেকেই পরিচয় ছিল।
তাই নাকি? তা তো আমি জানতাম না। কিন্তু ওরা বোধহয় জানত।
ওরা কারা?
ওরা মানে জনগণ। তারা অরুণের বাড়ি কাল ঘেরাও করেছিল। এই শহরে হঠাৎ রটে যায়, অরুণ পুলিশের দাদাল, স্পাই!
ছি ছি, কী অসম্ভব কথা! ওরকম একজন ভালো মানুষ সম্পর্কে এরকম একটা মিথ্যে গুজব উঠল কী করে?
ঠিক মিথ্যে তো?
রজত আহত ভাবে বললেন, সেকী, আপনিও এটা বিশ্বাস করেছেন? আপনিও আমাকে এরকম সন্দেহ করেছেন?
ডাক্তার সেন বললেন, আমি কিছুই বিশ্বাস করিনি। বিশ্বাস-অবিশ্বাস করা আমার কাজ নয়। রোগের লক্ষণ দেখলে চিকিৎসা করাই আমার কাজ। কিন্তু অরুণ যে কিছুই বলতে চাইল না। তার শুধু এক জেদ। লোকগুলো যখন চিৎকার করছে, তখনও সে বলছে, আমি কিছু বলব না। আপনারা যা খুশি করতে পারেন! ট্যাকটলেস।
কিন্তু এরকম একটা বিশ্রী গুজব রটল কী করে?
গুজব কী করে রটে, কেউ জানে না। তবে, টুকরো টুকরো যা শুনলাম, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তাকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খাওয়ান—তার সামান্য সর্দি-জ্বর হলে তিনি তাঁর বউকে নিয়ে পর্যন্ত দেখতে আসেন।
সর্দি-জ্বর?
লোকে তো তাই বলছে। ওর নাকি অসুখ-টসুখ কিছুই হয়নি, অসুখের ভান করে পড়েছিল—এই গণ্ডগোলের সময় যাতে রাস্তায় বেরোতে না হয়!
হঠাৎ একদিনে লোকে এসব জেনে গেল? আগে তো কখনও অরুণের নামে এরকম কিছুই শুনিনি!
কাল একদল অধ্যাপক গিয়েছিলেন অরুণের বাড়িতে! আজকের মিছিলে ও যাতে যোগ দেয় সেইজন্য। অরুণ রাজি হয়নি। সেই নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। এমন বোকা ওই অরুণ, যদি জোর দিয়ে বলত যে, ওর শরীর খারাপ, ও যেতে পারবে না, তাহলেও মানে থাকত। তার বদলে বলেছে, আপনার অফিসে গিয়ে বিক্ষোভ দেখাবার ব্যাপারে ও অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তাতেই তো হল গণ্ডগোল। কে একজন আপনার নামে কী যেন একটা কুৎসিত কথা বলেছিল, অরুণ প্রতিবাদ করে বলে, রজতবাবুর সম্পর্কে কোনও খারাপ কথা সে শুনতে চায় না। তখন একজন মন্তব্য করে বসল, তা শুনবেন কেন! আপনি তো রজতবাবুর দালাল। ব্যাস! একজনের কথাটা উচ্চারণ করাই তো যথেষ্ট।
শুনতে শুনতে রজতের মুখখানা কঠিন হয়ে এসেছিল। চোখ নিচু করে বললেন, আমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযানে ও যোগ দিতে চায়নি, এর নিশ্চয়ই কোনও ব্যক্তিগত কারণ ছিল ওর। আমি কিন্তু এতে কিছুই মনে করতাম না।
মুশকিল হচ্ছে কী, অরুণ এর আগে দু-একটা রাজনৈতিক ব্যাপারে মাথা গলিয়েছে। ছেলেদের কাছে বক্তৃতা-টক্তৃতা দিয়েছেও শুনেছি। কিন্তু আপনার সঙ্গে পরিচয় হবার পরই ও কেমন যেন গুটিয়ে যায়। তাতেই তো লোকে ভাবছে—
রজত অন্যমনস্ক ভাবে একবার বাইরের জানলার দিকে তাকালেন। হঠাৎ অনেকদিন আগের একটা ছবি তাঁর মনে পড়ল। মালতীদের বাড়ি থেকে তিনি বেরিয়েছেন, একটু দূরেই অরুণের সঙ্গে দেখা। শুকনো, লাজুক মুখ, খানিকটা উদভ্রান্ত দৃষ্টি। রজতকে দেখে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছিল, রজত ডেকে বলেছিলেন, অরুণবাবু, আপনি কি মালতীদের বাড়িতে যাচ্ছেন? একটু আগেই ডাক্তার তাকে ইঞ্জেকশান দিয়েছে—এখন ঘুমোচ্ছে। বেশ ভালোই আছে মালতী, শিগগিরই সেরে উঠবে মনে হয়। অরুণ খুব ব্যস্ততার সঙ্গে বলে উঠেছিল—না, না, আমি ওদের বাড়ি যাচ্ছিলাম না। তারপর ভারী অদ্ভুতভাবে অরুণ তাকিয়েছিল রজতের দিকে। সেই চাউনিটা রজতের মনে পড়ল। তিনি ভাবলেন, আমি ওর প্রেমিকাকে ছিনিয়ে নিয়েছিলাম, সেজন্য অরুণ কি আমার ওপর রাগ করেনি! রাগ না করা অসম্ভব। রাগ ছিল বলেই হয়তো সে কোনও রাজনৈতিক আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে আমার বিরুদ্ধে কোনও কিছু করার চেষ্টা করেনি। সেটাকে হয়তো সে ভেবেছে কাপুরুষতা। কিন্তু অরুণের তো রাগের কোনও চিহ্ন কখনও দেখিনি! কিংবা আমি মালতীর স্বামী বলেই ও দয়া করে আমার বিরুদ্ধে যেতে চায়নি?
রজত জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এসব কী করে জানলেন?
অরুণ চলে যাচ্ছে শুনে ভাবছিলুম দেখা করতে যাব। তারপর ও নিজেই এসেছিল বিদায় নিতে। বেশ কিছু চড়-চাপড় খেয়েছে, কপাল কেটে গেছে, চোখ ফোলা—বেশ মধুর স্মৃতি নিয়েই ডায়মন্ডহারবার ছেড়ে গেল বলতে হবে।
মার খেয়েছে? আমায় তো কেউ খবর দেয়নি!
খবর দেবার কেউ ছিল না। দুপুরের দিকে অধ্যাপকদের সঙ্গে ওইসব তর্ক হয়। আর সন্ধ্যার দিকে একদল লোক ওর বাড়ি ঘিরে ফেলে চেঁচাতে থাকে, পুলিশের স্পাই। শাস্তি চাই! জানেন তো, স্পাই কথাটা শুনলে সকলেরই রাগ আর ঘেন্না হয়, আর কারওর সম্পর্কেই ও কথাটা মানুষ পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে পারে না। স্পাইরা তো কত রকম ছদ্মবেশ ধরে! গোলমাল শুনে রতন গিয়েছিল। সে সব শুনেছে, কিন্তু ইচ্ছে করেই সে পুলিশে খবর দেয়নি। ভালোই করেছে। অরুণ দরজার সামনে মুখ বুজে দাঁড়িয়েছিল আর শ’দুয়েক লোকের জনতা তাকে উদ্দেশ্য করে যা-তা গালাগাল দিয়েছে। জুতো ছুঁড়েছে—
তাও পুলিশে খবর দেয়নি রতন? একটা লোক মার খাবে—
একটা লোককে পুলিশের স্পাই বলে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে, আর সেই সময় যদি চটপট পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে, তা হলে লোকের সন্দেহ আরও দৃঢ় হবে। তা ছাড়া, এজন্য রতনের ওপরেও হয়তো হামলা হত। যাই হোক, বেশি কিছু হয়নি, কয়েকজন নেতা গিয়ে অরুণকে আগলে দাঁড়ায়। তারাই ঠিক করে দেয়, অরুণ সেই রাত্তিরেই ডায়মন্ডহারবার ছেড়ে চলে যাক, নইলে তার প্রাণ বিপন্ন হতে পারে! লাস্ট ট্রেনে চলে গেল ছেলেটা। একটুও মচকায়নি। ওরকম অপমান আর মারধোর সয়েছে, কিন্তু মুখখানা তখনও কঠিন। ওকে দেখে আমার মতন নীরস মানুষেরও বুকটা মুচড়ে উঠেছিল রজতবাবু!
রজত মনোযোগের সঙ্গে নিজের হাতের রেখা দেখছেন। সেই দিকে তাকিয়েই প্রায় অস্ফুট গলায় বললেন, আমি একটা অত্যন্ত ব্যক্তিগত কারণেই অরুণকে বন্ধু হিসেবে পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এজন্য তাকে এত ক্ষতি সইতে হবে, আমি সত্যই কল্পনা করতে পারিনি।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইলেন। তারপর সিঁড়িতে কারওর দ্রুত পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। দড়াম করে দরজা ঠেলে মোম এসে ঢুকল। তার শাড়িখানা এলোমেলো, উসকোখুসকো চুল। চোখ দুটি লালচে। সে সোজা এসে ডাক্তার সেনের কাঁধের ওপর ঝুঁকে পড়ে কান্না-কান্না গলায় বলল, বাবা, তুমিও আমাকে ভালোবাস না? আমায় কেউ ভালোবাসে না। তুমিও আমাকে—
ডাক্তার সেন মোমের মাথায় চুলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে বললেন, হ্যাঁ রে পাগলি। আমি এ পৃথিবীতে একমাত্র তোকেই ভালোবাসি।