সুখ অসুখ – ১১

এগারো

সিঁড়ির পাশে রানি একটি উনিশ-কুড়ি বছরের ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে অন্তরঙ্গ ভাবে কথা বলছিল। মালতীকে দেখে চকিতে দুজনে দু’পাশে সরে গেল। রানি চেঁচিয়ে উঠল, বড়দি, সত্যি তুমি?

মালতী ক্লান্ত ভাবে হেসে বলল, হ্যাঁরে, এলাম। এবার কিন্তু বেশ কয়েকদিন থাকব। থাকতে দিবি তো?

তুমি আমার ঘরে শোবে। মানে, তোমার ঘরেই আমরা দুজনে এবার—

নারে, ও তোরই ঘর। আমি শুধু কয়েকদিন থাকব।

বড়দি, আলাপ করিয়ে দিই। এর নাম সঞ্জয়, আমার বন্ধু রত্নার দাদা, একটা বই দিতে এসেছিল।

মালতী ভালো ভাবে ছেলেটিকে দেখল। হাত-পায়ের হাড়গুলো চওড়া-চওড়া, কিন্তু রোগাটে লম্বা ধরনের ছেলেটা। এখনও দাড়ি কামাতে শুরু করেনি, নাকের নীচে গোঁফের নীলচে রেখা। মালতীর মনে পড়ল, তার বয়স যখন এই রানিরই প্রায় সমান, তখন ঠিক এই সঞ্জয়ের বয়সি একজন তার কাছে আসত। সে এবং মালতীও ওই রকম সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করত। মালতী বুঝতে পারল রানি যেন তার আড়াল থেকে চোখের ইশারায় সঞ্জয়কে কী বলার চেষ্টা করছে। মালতী ক্ষীণ ভাবে হেসে বলল, আচ্ছা ভাই, তোমার সঙ্গে পরে আলাপ করব, আজ আমি বড্ড ক্লান্ত। তোমরা গল্প করো—

রানি কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সিঁড়ি দিয়ে মালতীর পিছনে উঠে এল। মালতীর গায়ে হাত রেখে বলল, বড়দি, রজতদা এবারও এলেন না? তুমি জোর করে নিয়ে আসতে পারলে না?

মালতী সে কথার উত্তর দিল না। জিজ্ঞেস করল, বাবা কেমন আছেন রে?

বাবা একই রকম আছেন, মাও একই রকম….দাদাও একই রকম।

বস্তুত, এই পৃথিবীতে এই ক’দিনে যেন কিছুই বদলায়নি। শুধু মালতীর জীবনেই আকাশ আর পাতাল জায়গা বদলা-বদলি করেছে।

মালতী নিজের সেই পুরনো ঘরে এসে পুরনো জীবনটা ফিরে পেতে চাইল। এই ঘরে একা-একা শুয়ে যে মাথার বালিশকে কতদিন কত গোপন কথা বলেছে। আলমারিটায় কত গোপন সম্পদ জমিয়ে রেখেছিল। ড্রেসিং টেবিলের ওই আয়না তার কত হাসি-অশ্রু-ক্রোধ-অভিমানভরা মুখ দেখেছে। কিন্তু সে-সব মধুর স্মৃতি মালতীর কিছুই মনে পড়তে চায় না, শুধু বার বার অসুখের ভয়াবহ দিনগুলোর কথা মনে আসতে থাকে। ওই খাটটা তার প্রায় মৃত্যুশয্যা হয়ে উঠেছিল। ওই খাটে একা শুলেই এখন মালতীর কেমন গা ছমছম করে। মনে হয়, সেই সব অসুখ যেন ফিরে আসবে। শরীরে তার আভাসও যেন দেখা যাচ্ছে। প্রায় সর্বক্ষণই এখন মালতীর আবার শরীর খারাপ লাগে।

মালতী দু’-একদিন একা-একা ঘুরল পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। কেউই আর আগের মতন নেই। অনেকের বিয়ে হয়ে গেছে। যাদের বিয়ে হয়নি, তাদের উচ্ছলতা চলে গিয়ে কথাবার্তায় একটা তিক্ত স্বাদ এসেছে।

সিঁদুরের রেখা মুছে ফেলেনি মালতী, কিন্তু এখন রোজ নতুন করে সিঁদুর পরে না। সাজগোজ করতেও তার ইচ্ছে করে না, কিন্তু রানি তাকে জোর করে সাজায়। তার সুন্দরী বড়দিকে দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে যাবে, রানির এই ইচ্ছে। রানিই মালতীকে বলে, আজকাল সিঁথিতে কেউ ড্যাবডেবে সিঁদুর দেয় না কলকাতায়, বুঝলে বড়দি!

বন্ধুদের বাড়িতে যখন যায়, তখন মালতী মনে মনে প্রত্যাশা করে, অরুণের সঙ্গে হয়তো পথে হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে। আগে যেমন হত, কলেজ থেকে কিংবা গানের ইস্কুল থেকে ফেরার পথে মালতী জানত অরুণের সঙ্গে দেখা হবেই। এখন পথে পথে অজস্র মানুষ, কিন্তু ঠিক মানুষের সঙ্গে আর দেখা হয় না। অরুণ কোথায় আছে মালতী জানে না, কিন্তু কলকাতাতে নিশ্চয়ই আছে। বন্ধুরা মাঝে মাঝে অরুণের কথা তোলে। জয়া একদিন বলছিল, ক’দিন আগে অরুণদাকে দেখলুম, জানিস! সত্যিই তুই বেচারাকে বড্ড কষ্ট দিয়েছিস, মালতী!

মালতী হাসতে হাসতেই বলেছিল, আর অরুণদা বুঝি আমাকে কষ্ট দেয়নি। ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই বেশি কষ্ট পায়।

তবু অরুণের সঙ্গে নিজে গরজ করে দেখা করার চেষ্টা করে না মালতী। কেমন যেন ভয় ভয় করে, কেমন যেন অপরাধী মনে হয় নিজেকে। অরুণের প্রচণ্ড অভিমানের সামনে সে যেন খুবই ছোট আর সামান্য হয়ে যাবে। আমার মনের খুব ভেতরে মালতী এ কথাও জানে, একবার যদি অরুণের হাতে হাত রেখে সে দাঁড়ায়, মিনতি চোখে তাকায়, অরুণের সমস্ত অভিমান সে ভাসিয়ে দিতে পারবে। সাত-আট দিন এই রকম ভাবেই কেটে গেল। রজত আর একবারও খোঁজ করেনি।

পার্টির কাজে মুর্শিদাবাদ গিয়েছিল শশাঙ্ক, হঠাৎ একদিন ফিরে এল। দীর্ঘকাল পরে দাদার সঙ্গে দেখা হল মালতীর। শশাঙ্কর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এক সময় হাসিখুশি উচ্ছল মানুষ ছিল। এখন অনেক রোগা হয়েছে, শরীরটা ভেঙে গেছে, কিন্তু কথায় ও ব্যবহারে এসেছে অসম্ভব দৃঢ়তা। আগের মতোই হাসি-ঠাট্টা করে, কিন্তু একটু দেখলেই বোঝা যায়, ও জীবন-যাপনের একটা উদ্দেশ্য পেয়ে গেছে, এবং সে উদ্দেশ্যটা নৈর্ব্যক্তিক।

শশাঙ্ক মালতীকে বাড়িতে দেখে কোনও বিস্ময় প্রকাশ করল না। হয়তো সে মালতীর আগের বারের আসার কথা শুনেছিল। আলগা ভাবে বলল, কীরে, ম্যাজিস্ট্রেটের গিন্নি হয়ে তো খুব মুটিয়ে যাবি ভেবেছিলুম, কিন্তু চেহারাটা আবার খারাপ হয়েছে কেন?

দাদার সঙ্গে একসময় বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল মালতীর। হঠাৎ একরাশ অভিমান এসে জড়ো হল তার গলায়। বলল, দাদা, আমি মরে গেছি কি বেঁচে আছি, একবার তো খোঁজও নিলে না।

মরবি কেন? মরা কি অত সোজা?

একবার তো মরতেই বসেছিলুম, যখন জেলে ছিলে তুমি।

ভাগ্যিস আমি জেলে ছিলুম, তাই তোর বড়লোকের সঙ্গে বিয়ে হতে পারল, আমি বাড়িতে থাকলে কি আর হত! তুই যে এ বাড়িতে এলি, রজত আপত্তি করল না। পুলিশের খাতায় আমার নাম আছে, আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকা তো তার পক্ষে অসম্মানজনক।

তুমিই তো অসম্মানজনক মনে করো!

তোর কাছে মিথ্যে কথা বলব না, আমি ওকে পছন্দ করি না।

কেন?

সে কথা আজ আর তোর শুনে লাভ নেই।

দাদা, অনিতাদি এখন কোথায়?

কী জানি। পাটনা-ফাটনার দিকে কোথায় যেন থাকে শুনেছি।

তুমি খোঁজ রাখ না? অনিতাদি তো তোমায় ছাড়া….

যার চাল-চুলোর ঠিক নেই, যে জেলের বাইরে কতদিন থাকবে তার ঠিক নেই, তার খবর রাখতে তোর অনিতাদির বয়ে গেছে!

দাদা, এসব করে কী লাভ হচ্ছে?

তুই বড়লোকের বউ হয়েছিস, তুই আর এখন এসব বুঝবি না। আগে তো বুঝতিস।

মোটেই আমি বড়লোকের বউ নয়। দাদা, তুমি নিজের চেহারাটার দিকে কখনও দেখেছ? এ কী চেহারা হয়েছে তোমার?

যা, ভাগ। পাঁচ বছর বাদে উনি এলেন আমার চেহারা সম্পর্কে মায়া দেখাতে? আমার স্বাস্থ্য বেশ ভালোই আছে।

অরুণদার সঙ্গে তোমার এখন দেখা হয়?

শশাঙ্ক একমুহূর্ত থমকে মালতীর মুখের দিকে ভালো ভাবে তাকাল। তারপর নীরস গলায় বলল, কেন, তার খবরে তোর আর কী দরকার?

আমার ভীষণ দরকার!

ওসব ন্যাকামি আর করতে হবে না।

দাদা, সত্যিই বিশ্বাস করো—

দ্যাখ মিলু, তোদের মেয়েদের এইসব ব্যাপারগুলো আমার একদম ভালো লাগে না। সব কিছুই ছেলেখেলা নয়।

দাদা, আমি ছেলেখেলা করছি না। মানুষ কি একবার ভুল করে না? ভুল করলে আর সেটা সংশোধনও করা যাবে না?

শশাঙ্ক আবার তীক্ষ্ণ ভাবে তাকাল মালতীর দিকে। তারপর মালতীর আরক্ত মুখের দিকে চোখ রেখেই হো-হো করে হেসে উঠল। বলল, বুঝেছি, রজতের সঙ্গে ঝগড়া করে চলে এসেছিস। এই প্রথম ঝগড়া, না আগেও হয়েছে?

সত্যিই বিশ্বাস করো, ঝগড়া করে আসিনি। একটুও ঝগড়া হয়নি।

ঝগড়া হয়নি তো ভালো কথা? কিন্তু অরুণের সঙ্গে তোর আর দেখা করার দরকার নেই।

আমার ভীষণ দরকার। ওর সঙ্গে দেখা না হলে আমার চলবেই না। তুমি ওর ঠিকানাটা যোগাড় করে দাও।

ওসব বাজে ব্যাপারে মাথা ঘামাবার আমার সময় নেই।

মালতী যে-মুহূর্তে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করল যে, অরুণের সঙ্গে ওর দেখা না হলে চলবেই না, তখন থেকেই ওর সমস্ত দ্বিধা কেটে গেল। এ ক’দিন ও মনে মনেও অরুণের মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছিল। এখন সমস্ত মনে-প্রাণে ফিরে এল পুরনো সুগন্ধের আমেজ। এখন আর কারওর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না। প্রতিটি মুহূর্তেই মনে পড়ে অরুণের সঙ্গে ওর এক-একটি সন্ধ্যার দিনগুলোর কথা। শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার পথে, ট্রেনের কামরায় মুখোমুখি বসেছিল ওরা দু’জন—দলের আর সবাইকে এড়িয়ে এসেছিল—সেদিন রাত একটা থেকে ভোর পর্যন্ত শুধু গল্প করেছে, একপলকের জন্য ঘুম আসেনি কারওর। আর সেই সন্ধ্যাবেলা বালি ব্রিজে দাঁড়িয়ে, অরুণের হাত ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল—মালতীর শরীরটা ঝনঝন করে ওঠে। বার বার মনে হয়, জীবন অন্যরকম হবার কথা ছিল। হ্যাঁ অন্যরকম। কেন যে এমন ভুল করেছিল। মালতী মনে মনে জেনে গেছে, অরুণের সঙ্গে তার দেখা হবেই। শুধু মাঝে মাঝে একটা অস্পষ্ট ভয়ের আভাস ভেসে আসে, যদি অরুণ আর তাকে গ্রহণ না করতে চায়? অত নিষ্ঠুর কি ও হবে? ডায়মন্ডহারবারে শেষ যেদিন দেখা হল, সেদিন যে অত রাগ আর অভিমান—ভালোবাসা নষ্ট হয়ে গেলে কি রাগ আর অভিমানও আর অত তীব্র থাকে?

কিন্তু যেদিন সত্যিই অরুণ এল, সেদিন মালতীর জীবনটা আবার সম্পূর্ণ বদলে গেছে।

শশাঙ্ক আবার নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, বেশির ভাগ দিনই সকালে বেরিয়ে যায়। দুপুরে খেতে আসার ঠিক থাকে না, মালতীর সঙ্গে কথাও হয় না বিশেষ। তবু একদিন অপ্রত্যাশিত ভাবে সকালবেলা চায়ের সঙ্গে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে, খবরের কাগজ থেকে চোখ না সরিয়েই শশাঙ্ক মালতীকে বলল মিলু, আজ দুপুরে কোথাও বেরোবি নাকি?

মালতী একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল কেন? কোনও দরকার আছে?

আজ দুপুরে বাড়িতে থাকিস। আজ অরুণকে আসতে বলেছি। ও এলে তোকে ডেকে দেবো’খন….তিনটে আন্দাজ।

মালতী উৎকণ্ঠিত ভাবে জানতে চায়, দাদা, তুমি ওকে আমার কথা বলেছ? ও শুনে কী বলল?

শশাঙ্ক আবার কাগজে মনোযোগ দিয়ে বলল, না, বলিনি কিছু ওকে। ও জানে না।

তখনও মালতী আবেগে কেঁপে উঠেছিল, বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন দ্রুত হয়েছিল। কিন্তু একটু পর থেকেই তার শরীর খারাপ হতে লাগল। সারা শরীরেই যেন পাকিয়ে পাকিয়ে বাতাস ঘুরছে। কোনও জিনিস শক্ত করে ধরবার মতো জোর পাচ্ছে না হাতে। বেশিক্ষণ শরীরটাকে বহন করার মতন জোর পায়েও নেই।

দুপুরবেলা খাবার সময় মাঝপথেই অসমাপ্ত ভাতের থালা রেখে মালতী বাথরুমে ছুটে গেল। তারপর সেখানে হুড়হুড় করে বমি করল। রানিও পিছন পিছন এসেছিল, তাড়াতাড়ি মাকে ডেকে আনল। বিরজা বাথরুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে দেখলেন, ব্যস্ত বা বিচলিত হলেন না। বললেন, ভালো করে ঘাড়ে মাথায় জল দে, ও প্রথম প্রথম কয়েকদিন বমি হবেই। ক’মাস?

বিরজার গলার সুর শুনেই দারুণ চমকে উঠেছিল মালতী? আচ্ছন্নের মতন জিজ্ঞেস করল, কী?

বিরজা এবার একটু হেসে বললেন, ক’মাস বন্ধ?

দু’মাস! মা—

তুই আগে বুঝিসনি? আমি তো দেখেই বুঝেছিলাম, পোয়াতি! চোখের কোণে ওরকম কালি, সব সময় ঘুমঘুম ভাব।

মা! কী বলছ?

ঠিকই বলছি। আমাদের ওসবে ভুল হয় না। রজত জানে?

তারপর বিরজা রানিকে সেখান থেকে চলে যেতে বলে ফিসফিস করে মালতীকে আরও কিছু কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন।

দুপুর সাড়ে তিনটে আন্দাজ শশাঙ্ক এসে মালতীকে বলল, যা নীচে ঘুরে আয়। অরুণ এসে বসে আছে।

মালতী তখন শুয়েছিল। বিষম আলস্য, আর ঘুম পাচ্ছে। এখন আবার উঠতে হবে ভেবেই তার কষ্ট হল। দাদাকে বলল, যাচ্ছি, একটু বাদে যাচ্ছি। তারপর বিছানায় আরও একটু গড়িয়ে নিল মালতী। চোখ বুজতেই ঘুম এসে যাচ্ছিল, জোর করে উঠে পড়ল। মাথার চুলে চিরুনি দিল না, শাড়িটাকে ঠিকঠাক করে নিল না, সেই রকম আলুথালু ভাবেই নীচে নেমে এল।

দরজার দিকে পিছন ফিরে বসেছিল অরুণ। পায়ের শব্দে ঘুরে তাকিয়ে দেখে দৃশ্যত চমকে উঠল। তারপর মুখভঙ্গি খানিকটা আড়ষ্ট করে প্রশ্ন করল, তুমি কবে এলে?

কপালের কাটা দাগটা মেলায়নি এখনও অরুণের। সে আর একটু রোগা হয়েছে। মালতী দু’-এক মুহূর্ত অপলক চোখে অরুণকে দেখল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরমুহূর্তেই মুখে হাসি ফোটাল। চেয়ারে বসে মালতী হালকা সুরে বলল, বাবাঃ! যখনই দেখা হয়, তখনই মুখ গোমড়া! একটু হেসেও কথা বলতে পার না, আমি এতই খারাপ হয়ে গেছি?

অরুণ উত্তর দিল না, তাকিয়ে রইল মালতীর দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি আজ আমাকে এখানে ডেকে এনেছ?

হ্যাঁ।

কেন?

কেন? মালতী চোখ বুজে একটুক্ষণ যেন সেই কেন’র উত্তর খুঁজে দেখল। কিন্তু পেল না। তখন বলল, এমনিই, তোমাকে একটু দেখতে ইচ্ছে করল! ডায়মন্ডহারবারে তোমাকে যা অপমান করেছে—

সেইজন্যই আমাকে সান্ত্বনা কিংবা দয়া দেখাতে এসেছ?

আবার রাগের কথা? একটু ভালোভাবে কথা বলা যায় না বুঝি?

তুমি কেন আমাকে ডেকে আনিয়েছ?

তোমাকে দেখার জন্য।

মিলু, তুমি আমাকে নিয়ে রসিকতা করে আনন্দ পেতে দাও?

রসিকতা করব? তোমার মতন রাগী-বাবু’র সঙ্গে? তা হলে কখন হয়তো রাগের চোটে আমাকে মেরেই ফেলবে। এত রাগ তো তোমার ছিল না।

তোমার ওপর আমার কোনও রাগ নেই। আমার রাগ নিজের ওপর।

তুমি অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছ কেন? আমার মুখের দিকে তাকাও।

মিলু, তুমি আমাকে কী বলতে চাও?

অনেক কিছু বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন আর কিছুই মনে পড়ছে না। রাগ, দুঃখ, অভিমান, লোভ—সব কিছু যেন আজ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। সব কিছু হালকা লাগছে।

এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়।

এবার তুমি বুঝি আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছ। অরুণদা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, তুমি সত্যি সত্যি উত্তর দেবে? তুমি আমাকে এখনও ভালোবাস?

হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?

তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ। বলো—

কেন, আজ এ কথা জেনে কী হবে? তোমাকে তো আমি বলেছি, আমি গোপনে কিছু চাই না, চুরি করে কিছু নিতেও চাই না। আমি তোমার সঙ্গে আর কখনও দেখা করতেও চাইনি।

তবু তুমি এড়িয়ে গেলে। বললে না। আমি বলছি, শোনো। আমি তোমাকে এখনও ঠিক আগের মতনই ভালোবাসি। তোমাকে আমি একটুও ভুলতে পারিনি। কিন্তু ভালোবাসার আকর্ষণটা এখন অন্যরকম। এখন তোমাকে পেতে আর আমার লোভ হচ্ছে না। আজ আর ইচ্ছে হয় না, সব কিছু ছেড়ে তোমার কাছে ছুটে যাই। আমি তোমার কাছে সেই প্রতিজ্ঞা রাখতে পারিনি, এজন্যও আর আমার অনুতাপ হয় না। প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী কি জীবন চলে? জীবনের কতগুলো নিজস্ব নিয়ম আছে।

অরুণ কথা না বলে চুপ করে রইল। মালতীর মুখখানায় কোনও কপটতা সে খুঁজে পেল না। এবার অরুণও একটু হাসল। বলল, বেশ, এই তো ভালো।

কিন্তু তুমি কেন সেই ছেলেমানুষি দিনের কথা ভেবে জীবনটা নষ্ট করছ?

আমি জীবন নষ্ট করছি? কে বলল?

যাই বল, তোমার চেহারার মধ্যে একটা দুঃখী-দুঃখী ভাব ফুটে উঠেছে।

সেটা তোমাকে না-পাবার জন্য নয়। তোমাকে হারাবার জন্য।

তার মানে?

মানে, আমি তোমাকে আর পাবার জন্য প্রতীক্ষায় বসে নেই। আমার দুঃখটা এই, তোমাকে আর পাওয়া সম্ভব নয়, এই কথাটা জেনে গেছি। আমি ভালোবেসেছিলুম সেই পুরনো দিনের মিলুকে। কিন্তু সে তো আর নেই। সেই অসুখে তার মৃত্যু হয়েছে। এখন তুমি সম্পূর্ণ বদলে গেছ। তুমি অন্য একটা মেয়ের মতন, এমনকী এখন তোমাকে পেলেও আমি আর সেই মিলুকে পাব না। আমি আসলে সেই মিলুকে ভুলতে পারছি না, এইটাই আমার একমাত্র অসুখ। এটা অসুখ কিংবা ভালোবাসা, যা-ই বল।

মালতী চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। মেয়েরা ঘন ঘন বদলায়। তারা বদলাতে বাধ্য। একথা কি আমিও আগে জানতাম? যখন তোমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম—

থাক, প্রতিজ্ঞার কথা তুলো না। দেখি তোমার হাতটা।

মালতী ডান হাতটা অসংকোচে বাড়িয়ে দিল। অরুণ সেই হাত তুলে নিল নিজের দু’হাতে। নাকের কাছে এনে গন্ধ শুঁকল। তারপর আবার ফিরিয়ে দিয়ে বলল, আমি জানতাম, এ অন্য মেয়ের হাত। মিলু, শশাঙ্ককে ডাকো। কিংবা আমি আজ যাই। তোমার সঙ্গে আমার দেখা না-হওয়াই ভালো।

মালতী উদাসীন ভাবে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সত্যিই অন্য মেয়ের হাত, তাই না? আমি শুধু ভাবছি, যদি আজকের বদলে গতকাল তোমার সঙ্গে আমার দেখা হত, তা হলে কী ভয়ংকর ব্যাপার হত, ভাবতেও পারছি না।

কী হত কাল দেখা হলে?

কিছু না। থাক।

রজত বদলি অফিসারকে চার্জ বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। এই সময় টেলিফোন এল। রিসিভার তুলে অন্যমনস্ক গলায় জিজ্ঞেস করলেন, হ্যালো? ওপার থেকে আলতো গলা শোনা গেল, আমি কথা বলছি।

রজত টেলিফোনের মুখে হাত চাপা দিয়ে ঘরের উপস্থিত তিন ব্যক্তির দিকে একবার চাইলেন। বললেন, আপনারা দু’-তিন মিনিটের জন্য আমাকে একটু ক্ষমা করুন। আমি একটু প্রাইভেটলি টেলিফোনে কথা বলতে চাই। নতুন অফিসার ও বাকি দুজন সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে বাইরে দাঁড়ালেন।

টেলিফোন মুখের কাছে এনে রজত নিবিড় ভাবে বললেন, মিলু? তুমি কোথা থেকে কথা বলছ? ডায়মন্ডহারবারে ফিরে এসেছ?

না, কলকাতায়। তুমি কেমন আছ?

খুব খারাপ। খাওয়া-দাওয়ার যাচ্ছেতাই কষ্ট হচ্ছে, দেখার কেউ নেই।

তোমার সঙ্গে আমার একবার দেখা করা দরকার। তুমি একবার আসবে?

অরুণের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল?

হ্যাঁ। আজই তোমার সঙ্গে আমি একটা কথা বলতে চাই। তুমি আসবে? অন্তত আজ এসো। এই শেষবার তোমাকে বিরক্ত করছি।

পাগলামি কোরো না। তোমার টাকাকড়ি কিংবা জিনিসপত্র কিছু লাগবে?

না। শুধু তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।

তুমি সোজা ছোটমাসির ওখানে চলে যাও, আমি ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই আসছি।

রজত আড়াই ঘণ্টা আগেই এসে পৌঁছে গেলেন। মালতীকে তুলে নিয়ে রজত চলে এলেন ময়দানে। রজতের মুখে কোথাও মলিনতা নেই, ক্রোধ নেই। একটা প্রশান্ত ভাব আগেরই মতন ছড়িয়ে আছে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছাকাছি একটা নিরালা জায়গায় গাড়ি পার্ক করে রজত মালতীর দিকে ফিরে বললেন, এবার বলো!

মালতী মৃদুভাবে বলল, আমি অরুণদা সম্বন্ধে ভুল ভেবেছিলাম। অরুণদাকে আমি যতখানি ভালোবাসি ভেবেছিলাম, দেখা হবার পর বুঝতে পারলুম, সেটা আমার মনের ভুল। অরুণদা সম্পর্কে সেরকম টান আমার নেই।

রজত সিগারেটে টান দিয়ে বললেন, আমি এ কথাও জানতুম।

কী জানতে তুমি?

অরুণ সম্বন্ধে যে তোমার একটা দুর্বলতা রয়ে গেছে, সেটা আমি বরাবরই জানতুম। আমি এ কথাও জানতুম, ও রকম ভালোবাসার টানে মানুষের জীবন বদলায় না।

তুমি ভুল জানতে।

না, আমি ঠিকই জানতুম। সেইজন্যেই অরুণকে ডেকে এনেছিলুম। অরুণের সঙ্গে যদি তুমি সহজ ভাবে মিশতে, এমনকী গোপনে একটু-আধটু প্রেমও করতে আবার, তা হলে অনেক আগেই তোমার ভুল ভেঙে যেত। ছেলেবেলার প্রেম ছেলেবেলাতেই মানায়, সারাজীবন তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া যায় না।

তুমি ভুল জানতে।

এখনও ভুল বলছ? আমার কথা মিলে গেল না?

মালতী ও কথার আর কোনও উত্তর না দিয়ে বলল, এবার আমি কী করব? আমার তো আর কিছুই রইল না। আমি তোমাকেও হারালুম, অরুণদাকেও—এখন আমি…

আমাকে হারালে? পাগল? তুমি আজ রাত্তিরেই আমার সঙ্গে ফিরে যাবে। আমি এ কথাও জানতুম, তোমাকে ফিরে আসতে হবেই।

কী হিসেবে ফিরে যাব?

যে হিসেবে আগে ছিলে সেখানে।

অরুণদার ব্যাপারটা জেনেও তুমি…..

রজত এবার হো-হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, মালতী, তুমি ভেবেছিলে সবার জীবন বুঝি স্বচ্ছ, নির্মল, পবিত্র হবেই। জীবনে আসলে তা হয় না। সবার জীবনেই কিছু লুকোচুরি, দু-একটা মিথ্যে, একটু ছলনা এ সব থাকেই। এ সবের জন্য জীবন বদলায় না। কত শক্ত দুরারোগ্য অসুখের কথা শুনেও কত নারী-পুরুষ বিয়ে করে। আর আমি সামান্য একটা বাল্যপ্রেম সহ্য করতে পারব না?

কিন্তু আমাকে খুব খারাপ আর মিথ্যেবাদী মনে হবে না তোমার?

রজত ঝুঁকে মালতীর হাত ধরে বললেন, অরুণ সম্পর্কে শেষপর্যন্ত যে মিথ্যে কথা আমাকে বলতে পারনি, সেটাই তো হল মুশকিল। সেইজন্যই তোমাকে এত মানসিক কষ্ট করতে হয়েছিল। আমি তো সব জানতুমই। এর বদলে তুমি দু’-একটা মিথ্যে কথা বললেই ভালো করতে। বেঁচে থাকতে হলে ওরকম দু’-চারটে মিথ্যে কথা বলার খুবই দরকার হয়।

দরকার হয়?

নিশ্চয়ই। চলো, আমরা এক্ষুনি ফিরে যাই। তোমার নিজের সাজানো সংসারে তুমি ফিরে এসেছ, সেখানে নিজের অধিকারে তুমি রানির মতন আবার ফিরে যাবে।

মালতী এক ধরনের শুকনো ভাবে হাসল এবার। অশ্রুহীন কান্নাও একে বলা যায়। বাইরের অন্ধকারের দিকে একবার তাকাল। গাড়ির জানলায় রাখা ওর হাতে এসে পড়েছে রাস্তার পোস্টের আলো। সেই হাতের দিকে তাকিয়ে মালতী ভাবল, এটা অন্য মেয়ের হাত। তারপর বলল, চলো, ফিরে যাই। ফিরে যাবার আর একটা নতুন অধিকারও জন্মেছে আমার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *