ছয়
মালতী, আমাকে এক্ষুনি কলকাতায় যেতে হবে।
আবার আজ কলকাতায় যাবে?
হ্যাঁ, এইমাত্র টেলিফোন পেলাম। চিফ মিনিস্টার ডি.এম.দের জরুরি মিটিং ডেকেছেন। এদিকে আলিপুরের মিঃ চৌধুরী অসুস্থ, সুতরাং আমাকে যেতেই হবে।
কখন ফিরবে?
খানিকটা দেরি তো হবেই। যদি রাত্তিরে ফিরতে না পারি, তোমার ভয় করবে একা থাকতে?
একা তো কখনও থাকিনি।
ভয় কী? দু’জন কনস্টেবলকে বলে যাব, গেটের সামনে পাহারা দেবে।
না, আমি একা থাকতে পারব না।
তা হলে ফিরে আসতেই হবে। হয়তো একটু বেশি রাত হবে।
তার চেয়ে আমাকেও সঙ্গে নিয়ে চলো না।
মিলু, আমি যে সারাদিন ব্যস্ত থাকব। তুমি তা হলে কী করবে?
আমি কলকাতা শহরে ঘুরে বেড়াব। টুকিটাকি কেনাকাটি করব। এখন একদম ভালো হয়ে গেছি, কলকাতার জন্য মন কেমন করে। তুমি তো আমাকে আর নিয়েই যাও না!
ইস, ছোট মেয়ের মতন ঠোঁট ফোলাচ্ছ যে! আচ্ছা চলো, চলো। কিন্তু সারাদিন তো দোকানে-দোকানে ঘুরতে পারবে না? কার বাড়িতে যাবে বলো? আমার কাকার বাড়িতে, কিংবা তোমার বন্ধু সুদীপ্তার কাছে যাবে?
না। আমি একটু আমাদের বাড়িতে যাব।
তোমাদের বাড়িতে?
রজত অবাক হয়ে তাকালেন। পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের বাড়িতে?
মালতী ক্ষমাপ্রার্থী ভঙ্গিতে বলল, হ্যাঁ। অনেকদিন বাবাকে দেখিনি।
কিন্তু ও বাড়িতে ওরা যদি তোমাকে অপমান করে?
কেন অপমান করবে? ওটা কি আমারও বাড়ি নয়? আমার বাবা কি বেঁচে নেই?
তোমার বাবা বেঁচে আছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর কোনও জ্ঞান নেই। ওকে ঠিক বেঁচে থাকা বলেও না।
এই, আমার বাবার সম্পর্কে ওরকম ভাবে কথা বলবে না, তা বলে দিচ্ছি!
কী ব্যাপার? হঠাৎ যে পিতৃভক্তি জেগে উঠল? এতদিন তো শুনিনি।
এসব ব্যাপার হঠাৎই মনে পড়ে। ক’দিন ধরেই মনে হচ্ছে, কতদিন বাড়িতে যাইনি, কাউকে দেখিনি, অথচ ওই বাড়িতেই তো জীবনের তেইশটা বছর কাটিয়েছি।
তোমার দাদা নিশ্চয়ই আমার সম্বন্ধে গালাগাল শুরু করবেন। তিনি তো শুনেছি একজন রাজনৈতিক পাণ্ডা।
পতি নিন্দা শুনলে তক্ষুনি সতীর মতন দেহত্যাগ করব।
ওরে বাবা! তারপর আমি শিবের মতন তোমায় মাথায় নিয়ে নাচতে পারব না।
কেন পারবে না শুনি?
তোমার মৃত্যুর পর এ পৃথিবী ধ্বংস হল কি না, তাতে আমার কিছুই আসবে যাবে না। তুমিই তো আমরা একমাত্র পৃথিবী।
সত্যিই নিয়ে যাবে না! বেশিক্ষণ না, দু’একঘণ্টা থাকব। বাবার জন্য এক বাক্স মিষ্টি কিনে নিয়ে যাব। দাদা কিছু বলবে না আমি জানি। দাদা ছেলেবেলায় আমায় কত ভালোবাসত!
ছেলেবেলার মালতী আর তুমি তো এখন এক নও। তুমি যে স্বেচ্ছায় গৃহত্যাগ করে আমার মতন এক পাষণ্ডকে বিয়ে করেছ।
যেতে দেবে না তা হলে!
মিলু, আমি তোমার কোনও কথায় কখনও আপত্তি করেছি? কিন্তু আমার একটা অনুরোধ শুনবে?
কী?
তুমি যাও, আমার কোনও আপত্তি নেই।…..সত্যিই কোনও আপত্তি নেই। আমি তো জানি, ‘বাপের বাড়ি’ মেয়েদের কাছে একটা কত বড় ব্যাপার? তুমি বছরের পর বছর সেখানে যাওনি—এমনকী তোমার শ্বশুর-শাশুড়িও নেই যে বাবা-মা’র জায়গা পূর্ণ করবে—থাকার মধ্যে আছে শুধু একটা স্বামী।
আমি আর কিচ্ছু চাই না। আমি সত্যিকারের স্বাধীন, এই আমার ভালো লাগে। কিন্তু তোমার কী অনুরোধ বলছিলে?
তুমি যাও, কিন্তু আমাকে যেতে বোলো না। তোমাদের বাড়িতে আমার একটুও যেতে ইচ্ছে করে না।
মালতী একটু থেমে রইল। তারপর বলল, আচ্ছা, তুমি যেয়ো না। ঠিকই তো, আমি যাচ্ছি আমার বাবার বাড়িতে, আর তুমি….তোমাকে যদি প্রাণখুলে অভ্যর্থনা না করা হয়—
না, না, অভ্যর্থনার কথা নয়, আমি জামাই আদর চাইছি না। তবু মানে, বুঝলে—
বুঝেছি, তোমাকে একটুও অসম্মান করলে সেটা আমারই সবচেয়ে বেশি লাগবে। তুমি আমাকে বরং তোমার শান্তি মাসির বাড়ি পৌঁছে দাও, ওখান থেকে তো কাছেই।
ঠিক আছে, খুব কুইক তৈরি হয়ে নিতে পারবে তো?
পাঁচ মিনিট সময় দাও!
.
আজ জিপ চালাবার সময় রজতের সেই লঘুতা নেই। কপালে কয়েকটি চিন্তার সিঁড়ি। মানুষজন ক্রমশ খেপে উঠছে। কেরোসিনের কোনও সমাধান হয়নি। সেই এলাকা থেকে একেবারে উধাও হয়ে গেছে কেরোসিন। মধ্যরাত্রে বেড-সুইচ টিপে অনায়াসে নিজের ঘরের ইলেকট্রিক আলো জ্বালাতে গিয়ে রজতের মনে পড়ে, অসংখ্য গ্রাম জুড়ে সন্ধ্যা থেকেই নিবিড় অন্ধকার। চালের দাম বাড়ছে হু-হু করে। শিক্ষক আন্দোলন শুরু হয়েছে। আগামী মঙ্গলবার থেকে স্কুল-কলেজে ধর্মঘট চলবে। বামপন্থী নেতারা কৃষক আন্দোলনেরও হুমকি দিচ্ছে। রজত জানেন, এই সব সমস্যা সমাধানের কোনও উপায় তাঁর হাতে নেই। কিন্তু উত্তপ্ত আবহাওয়ায় অশান্ত মানুষদের শান্তি রক্ষার দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হবে।
খানিকটা বাদে আত্মস্থ হয়ে রজত মালতীকে বললেন, ক্রমশ দিনকাল খুব খারাপ হয়ে আসছে, মিলু। দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধাও বিচিত্র নয়। আমারও ভালো লাগছে না, খুব ক্লান্ত লাগছে!
তোমার আর ছুটি পাওনা নেই?
আছে। কিন্তু এ সময় ছুটি নেওয়া যায় না!
বাঃ, তোমার যদি অসুখ করে, তা হলেও ছুটি পাবে না?
রজত হাসতে হাসতে বললেন, কিন্তু আমার তো সত্যিই অসুখ করেনি! এসব চাকরিতে মিথ্যে কথা বলা যায় না। বরং, আমি তো চমৎকার সুখেই আছি।
আমি মিথ্যে বলতে বলিনি! কিন্তু তোমার যে ক্লান্তি লাগছে, এটা কি অসুখের চেয়েও বড় কারণ নয়?
ক্লান্তি লাগার কথাটা তো অন্য কেউ বিশ্বাস করবে না! সবাই ভাববে ঝঞ্ঝাট এড়িয়ে আমি শুধু নিজের আনন্দ নিয়েই মত্ত থাকতে চাই। আমি দায়িত্বজ্ঞানহীন।
ছুটি পেলে খুব ভালো হত কিন্তু। আমরা কোথাও পাহাড়ে চলে যেতাম দু’-একমাসের জন্য। খুব ইচ্ছে করছে, এমন কোথাও যাই, যেখানে তোমাকে-আমাকে আর কেউ চেনে না। খুব ছেলেমানুষের মতন ছুটোছুটি করতাম।
অসুখ সেরে গিয়ে তোমার মধ্যে খুব ছটফটে ভাব এসেছে, না? একটা প্রবল প্রাণশক্তি—
হ্যাঁ, ঠিক কলেজে পড়ার দিনগুলোর মত লাগছে।
ইস, আর এই সময়টাতেই আমার ঘাড়ে যত দায়িত্ব। অথচ এইটাই ছিল আমাদের আসল হনিমুন করার সময়।
রজত কলকাতায় এলে কখনও কখনও শান্তি মাসির বাড়িতে ওঠে। মালতীও একবার এখানে দিন তিনেক থেকে গেছে। ল্যান্সডাউন রোডে শান্তি মাসির বাড়িতে রজত মালতীকে নামিয়ে দিয়েই চলে গেলেন।
শান্তি মাসির বাড়িতে অনেক লোক। সব সময় বেশ একটা জমজমাট ভাব। শান্তি মাসিরা বহুকাল দিল্লিতে কাটিয়ে এসেছেন। কথাবার্তা সবারই খুব খোলামেলা, বেশ একটা আমুদে ভাব। এ বাড়িতে এলে মালতী খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করে।
শান্তি মাসির ননদের মেয়ে সুতপার সঙ্গে মালতীর বেশি ভাব। সুতপা মালতীর চেয়ে বছর তিনেকের ছোট। এম.এ. পাস করে সে এখন প্রাক-গুপ্তযুগের ইতিহাস নিয়ে রিসার্চ করছে। সুতপার কথাবার্তায় চালচলনে সব সমময় একটা অনুসন্ধিৎসু ভাব।
সুতপাকে নিয়ে মালতী নিউ মার্কেটে কয়েকটা ছোটখাট জিনিস কেনার জন্য বেরোল। কলকাতার সমস্ত রাস্তাঘাট সুতপার নখদর্পণে। বাড়িতে যথেষ্ট স্বাধীনতা আছে বলে সে যখন ইচ্ছে যেখানে খুশি যেতে পারে। সুতপা খুব রূপসি নয়, কিন্তু চেহারায় যথেষ্ট জৌলুস আছে। এক-একটা মেয়ে আছে, বাড়িতে সাধারণভাবে যখন থাকে, তখন খুবই সাধারণ দেখায়, কিন্তু বাইরে বেরোবার আগে আধঘণ্টা প্রসাধন করে নেবার পর চোখে পড়ার মত সুন্দরী দেখায়—সুতপা মেয়েটি সেইরকম। সুতপার একটি মাত্র ব্যধি, ঘন ঘন প্রেমে পড়া। তার প্রেমিকের অন্ত নেই, ঘন ঘন তারা পালটায়। এর আগে মালতীর সঙ্গে সুতপার যতবারই দেখা হয়েছে, মালতীকে সুতপার প্রেমিকদের গল্প শুনতে হয়েছে। এবার ব্যাপারটা হল অন্য রকম। সুতপা বলল, জান বউদি, আমার এক বন্ধু তোমাকে চেনে! কী নিয়ে যেন কথা হচ্ছিল, তোমার কথা উঠল! ও, হ্যাঁ, কে যেন বলছিল, মেয়েদের বিকোলাই হলে আর সহজে সারে না। আমি তখন তোমার কথা বললুম, তখন বলল, হ্যাঁ, আমি চিনি ওকে।
কে তোমার বন্ধু? নাম কী?
গীতা। গীতা সোম। লেক ভিউ রোডে থাকে।
মালতী এক মুহূর্তেরও শতাংশ দ্বিধা করে সঙ্গে সঙ্গে বলল, কী করে চিনল আমাকে?
ঠিক চেনে। ওই তো বলল আমাকে, তুমি কলেজের থিয়েটারে রক্তকরবীতে নন্দিনী সেজেছিলে।
ও আমার থিয়েটার দেখেছে, সেই থেকে আমাকে চেনে?
না, তোমার যে অসুখ হয়েছিল তাও জানে।
তাই নাকি? আমি তো তা হলে খুব বিখ্যাত ছিলাম একসময়!
বউদি, তুমি গীতাকে চেন না? ও যে বলল—
ঠিক মনে পড়ছে না! হয়তো কখনও আলাপ হয়ে থাকবে।
তুমি ওদের বাড়িতেও একদিন গিয়েছিলে, সে দারুণ এক ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।
সত্যি? কবে বলো তো?
বউদি, অরুণ চ্যাটার্জির কথা তোমার মনে পড়ে?
মালতী এবার হাসল। বলল, হ্যাঁ, মনে পড়ে। কিন্তু তার সঙ্গে গীতার কী সম্পর্ক?
সুতপাও হাসল। বলল, বউদি, তোমার সব আগেকার গল্প শুনেছি। গীতার দিদি নমিতাদির সঙ্গে অরুণবাবুর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বিয়ে হয়েছে। তুমি একদিন ওদের বাড়িতে যেতে বাধ্য হয়েছিলে, তোমার মনে নেই ঘটনাটা?
মালতী অধর দংশন করে তখনও কৌতুক হাস্য করছে। বলল, না নেই। বলো দেখি, তুমি কী শুনেছ?
তুমি একদিন অরুণবাবুর সঙ্গে সন্ধ্যাবেলা লেকে বেড়াচ্ছিলে, তারপর খুব বৃষ্টি আসে। তোমরা ইচ্ছে করেই বৃষ্টিতে ভিজলে। কেন না, তখন লেকটা একদম ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। তোমরা দুজনেই শুধু ছিলে, অনেকক্ষণ বেড়াবার পর যখন তোমাদের খেয়াল হল, তখন তোমার শাড়ি ভিজে জবজব করছে। তার ওপর একটা মোটর গাড়ি কাদা ছিটকে তোমার সারা গায়ে হোলি হ্যায় করে দিয়েছে। সেই অবস্থায় বাড়ি ফিরতে তোমার ভয় করছিল। আর সেইজন্যেই তোমায় শাড়ি বদলাবার জন্য অরুণবাবু তোমাকে গীতাদের বাড়ি নিয়ে আসেন। নমিতাদিরা তখন বাড়ি ছিলেন না, সেইজন্য অরুণবাবু কাঁচুমাচু হয়ে গীতার কাছেই শাড়ি চেয়েছিলেন। কী, সত্যি নয়?
হ্যাঁ, সত্যি! এখন মনে পড়েছে।
বউদি, তুমি কী লাকি?
কেন বলো তো?
একজন কবির সঙ্গে তোমার প্রেম হয়েছিল। আমার এতজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হল, কিন্তু একজনও কবির সঙ্গে পরিচয় হল না!
মালতী এবার সরবে হেসে উঠে বলল, কেন কবিরা কি আলাদা কিছু নাকি?
গীতা তো অরুণবাবুর দারুণ অ্যাডমায়ারার। আচ্ছা বউদি, একটা সত্যি কথা বলবে? আমার জানতে ভীষণ ইচ্ছে করে, সত্যি কথা বলবে বলো?
কী কথা আগে বলো!
সত্যি কথা বলবে কিন্তু। আচ্ছা, এই যে তোমার বিয়ের আগে একজনের সঙ্গে প্রেম হয়েছিল, তারপর আরেক জনের সঙ্গে বিয়ে হল, এতে তোমার এখন কোনও অসুবিধে হয় না….মন কেমন করে না?
সুতপা এমন উৎসুক আগ্রহে মালতীর দিকে তাকিয়ে রইল যে মালতী হাসতে হাসতে ওর পিঠে একটা কিল মারল। সুতপা দমে না গিয়ে বলল, না বউদি, তুমি বলো, চেপে যেয়ো না।
সত্যি কথা বলব? আমি তোমার মতন অত লাকি ছিলাম না মোটেই। বিয়ের আগে আমার একজনের সঙ্গেই প্রেম হয়েছিল। আর আমি তাকেই বিয়ে করেছি।
যাঃ! তুমি চেপে যাচ্ছ! তুমি কী বউদি? একটুও স্মার্ট হতে পার না! এতে কী আর দোষ আছে! আমি কাউকে বলব না, রজতদাকে বলব না, আর রজতদা সে রকম সন্দেহপ্রবণ লোকই না। তুমি আমাকে ননদ বলে না ভেবে বন্ধুর মতো বলো না! আমার নিজের জন্য কথাটা জানা দরকার!
সত্যি কথাই তো বললুম। তোমার রজতদার সঙ্গেই আমার প্রথম প্রেম হয়েছিল, আর কারওর সঙ্গে না। প্রেমে না পড়লে তোমার রজতদাকেই বা আমি বিয়ে করব কেন?
মিথ্যে কথা! অরুণবাবুর সঙ্গে তুমি লেকে বেড়াতে, কলেজের পর রোজ দেখা করতে। একবার তোমরা শান্তিনিকেতনেও গিয়েছিলে। আমি গীতার কাছ থেকে সব শুনেছি। অরুণবাবুর সঙ্গে তোমার প্রেম ছিল!
না, ওটা প্রেম নয়। প্রেমের রিহার্সাল। আসল প্রেমটা একবারই হয়েছে, সেটা তোমার রজতদার সঙ্গে।
রিহার্সাল মানে কী বলতে চাও?
তখন ছেলেমানুষ ছিলুম, সব কিছু দেখেই মুগ্ধ হতুম। একটা যে কোনও রাস্তা দেখলেই মনে হত, বাঃ, কী চমৎকার, এরকম আর জীবনে দেখিনি! তেমনই একটা গাছ কিংবা একটা চলন্ত ট্রেন—সব কিছু। সুতরাং যে মানুষটা খুব কাছে আসে, তাকেই মনে হয় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। আসলে তখন দৃষ্টিটা খুব ছোট থাকে, জীবন বলতে এক্ষুনি বা আজকের দিনটাই মনে হয়।
কিন্তু তখন তুমি এমন কিছু ছেলেমানুষ ছিলে না?
একুশ বছরের আগে মেয়েদের আবার বয়স হয় নাকি! তখন সব কিছুই রিহার্সাল।
আচ্ছা, অরুণবাবুর সঙ্গে তোমার কী করে ছাড়াছাড়ি হল? উনি নিজেই, না তুমি—
আমি হঠাৎ খুব অসুখে পড়লুম, বাড়ির দোতলার ঘরে একা শুয়ে থাকতুম। অরুণবাবু সেখানে আসতে পারতেন না, অনেক অসুবিধে ছিল। অনেকদিন দেখা না হবার ফলে যা হয়—টান কমে যেতে লাগল। এই সময় এলেন তোমার রজতদা। সত্যিকারের প্রেমের মধ্যে খানিকটা দৈব ঘটনাও থাকে। অরুণবাবুর পক্ষে আমার অসুখের কাছে আসাটা খুব অস্বাভাবিক ছিল না, উনি আমার দাদার বন্ধু ছিলেন। কিন্তু তোমার রজতদা, তাঁকে আমি আগে কখনও দেখিওনি, উনিও আমাকে আগে দেখেননি। ওঁর এক ডাক্তার বন্ধুর মুখে আমার কথা শুনেছিলেন, আমার ঠিক মতো চিকিৎসা হচ্ছে না—ঠিক শুশ্রূষা হয় না—আমি অবহেলায় মরতে বসেছি—এরকম তো আমাদের দেশে কত মেয়েরই হয় বলো! তবু উনি যে সেই ডাক্তারবাবুর সঙ্গে আমাকে দেখতে এলেন, এটাকে তো দৈব ঘটনাই বলা চলে। তোমার রজতদা আমাকে পুনর্জন্ম দিয়েছেন। আমি আর সেই আগের মালতী নেই, আমি এখন অন্য একজন। আর আমার এই নতুন জন্মে তোমার রজতদাই একমাত্র পুরুষ!
অরুণবাবুর জন্য তোমার একটু মন কেমনও করে না? একবারও আর দেখা করতে ইচ্ছে হয় না।
ওঁর সঙ্গে তো আমার তিন-চারবার দেখা হয়েছে। এই তো কয়েকদিন আগে, কিছুই মনে হয়নি। আগের জন্মের কথা কি আর মানুষের কিছু মনে থাকে?
কী জানি বাবা! তোমার ব্যাপারটা বেশ নতুন রকম! আমার কী মুশকিল হয়েছে জান, তুমি তো শৈলেনকে দেখেছ আগের বার। ও আমাকে বিয়ে করতে চায়। প্রায় রোজই বলে, আমার ওকে খুব পছন্দ। কিন্তু সিদ্ধার্থ! সেই যে ক্রিকেট খেলে—একবার খুব ঝগড়া হয়েছিল বলে আর কথা বলি না। ওর জন্যও আমার মন কেমন করে। আমার মনে হয়, শৈলেনকে বিয়ে করলেও আমি সিদ্ধার্থকে ভুলতে পারব না! কী করি বলো তো?
তুমি ওদের দুজনের কাউকেই বিয়ে কোরো না। আমার মনে হয়, তোমার এখনও রিহার্সালের পালা চলছে!
বিকেলের দিকে মালতী গেল নিজের বাড়িতে। প্রায় সাড়ে চার বছর বাদে এ বাড়িতে আবার ঢুকেছে। সেই একদিন ভোরবেলা একটা সুটকেশ হাতে নিয়ে দুর্বল পায়ে জল-ভরা চোখে বেরিয়ে এসেছিল, তারপর এই প্রথম।
ট্যাক্সি থেকে মিষ্টির বাক্স নিয়ে মালতী যখন নামল, তাকে কেউ দেখল না। সদর দরজাটা হাট করে খোলা। মালতী একবার বাইরে থেকে বাড়িটার দিকে তাকাল। এই ক’বছরে বাড়িটা আরও জরাজীর্ণ হয়েছে, দেয়ালে পলেস্তারা পড়েনি বহুদিন। দোতলার যে-ঘরে মালতী থাকত, সেই ঘরের একটা খোলা জানলা কবজা ভেঙে কাত হয়ে আছে। ডানদিকের স্টেশনারি দোকানটার বুড়ো মালিক কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মালতীর দিকে। সেই বাচ্চা বয়স থেকে মালতী ওই দোকান থেকে লজেন্স আর চুলের রিবন কিনেছে।
সিঁড়িতে পা দিয়েই মালতীর বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল। একটা কান্নার মতন ভাব। এই দরজা, এই সিঁড়ি দিয়ে তার জীবনের তেইশটা বছর পেরিয়ে এসেছে। কোনওদিন ভাবেনি, একদিন বড় মমতায় এই সব কিছুর দিকে তাকাতে হবে। স্কুলে যাবার সময় প্রায় প্রত্যেক দিনই মালতীর দেরি হত, বাস এসে হর্ন দিত—ছুটতে ছুটতে সে সিঁড়িগুলো ডিঙিয়ে যেত। ডাক-বাক্সটা বহুকালের পুরনো। আগে ওটাতে তালা দেওয়া থাকত। প্রত্যেক দিন কলেজ থেকে ফেরার সময় মালতী কাচের ফাঁক দিয়ে দেখত, তার কোনও চিঠি এসেছে কিনা। আসত, আগে প্রায়ই মালতীর নামে চিঠি আসত।
দেয়ালের গায়ে মাঝে মাঝেই প্লাস্টার উঠে গেছে। আগে দেয়ালের একটা ভাঙা জায়গায় তাকালে ঠিক মনে হত যেন তিনটে বুড়ো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গল্প করছে। সেই জায়গাটা এখনও সে রকমই আছে।
ছোট বোন রানিই প্রথম দেখতে পেল মালতীকে। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে আপন মনে খুব ব্যস্ত ভাবে নেমে আসছিল রানি। হঠাৎ মালতীকে দেখে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল, তারপর বেশ লাজুক ভাবেই চেঁচিয়ে উঠল, ওমা, বড়দি! সত্যি!
মালতীও প্রথমটায় রানিকে চিনতে পারেনি। শেষ যখন দেখে গিয়েছিল, তখন রানির বয়স বারো, কিন্তু বয়সের তুলনায় শরীরটা ভরন্ত ছিল না। ফ্রকের বাইরে ওর রোগা রোগা পা দুটো অনেকটা শালিক পাখির কথা মনে পড়াত। স্বভাবটাও খিটখিটে ছিল একটু। ওই বয়েসেই আপন বোন আর সৎ বোনের পার্থক্যটা জেনে গিয়ে মালতীকে ঠিক দিদির মতন সম্মান দেখাত না।
সেই রানি এখন কত বদলে গেছে। ভোজবাজিতে যেন হঠাৎ একটা রোগা হেঁজিপেজি মেয়ের মধ্য থেকে বেরিয়ে এসেছে এক অনিন্দ্যনীয়া যুবতী। ভরাট স্বাস্থ্য, চোখে-মুখে লজ্জা, রানি একটা হালকা গোলাপি-রঙা শাড়ি পড়েছে। সিঁড়ি থেকে তরতর করে নেমে এসে অকপট আনন্দ আর বিস্ময়ে রানি বলল, বড়দি, সত্যি তুমি এসেছ?
মালতী রানির কাঁধে একহাত ছুঁইয়ে হাসতে হাসতে বলল, হ্যাঁরে, হ্যাঁ। বিশ্বাস হচ্ছে না? ইস, তুই কত বড় হয়ে গেছিস রে, রানি?
রানি এবার সারা বাড়ি ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, মা, বড়দি এসেছে! চলো—
মালতী বলল, যাচ্ছি রে যাচ্ছি, অত টানাটানি করিসনি। বাবা কেমন আছে রে রানি? দাদা কোথায়? বাড়িতে আছে? টুবলু কোথায়?
রানির ছোট ভাই টুবলু, সাড়া পেয়ে প্রথম এল সিঁড়ির মুখে। নাক দিয়ে সিকনি গড়াত যে টুবলুর, তার নাকের নীচে এখন গোঁফের রেখা। সেও এখন খুব লাজুক, দিদিকে দেখে একটাও কথা বলতে পারল না। মা বিরজা দেবীর শরীরটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। রোগা হয়েছেন খুব, এই কবছরে অনেকগুলো চুল পেকে গেছে। সদ্য বাথরুম থেকে বেরিয়ে ভিজে কাপড়েই তিনি দাঁড়িয়েছিলেন, মালতীর দিকে অপলক ভাবে চেয়ে রইলেন। মিষ্টির বাক্সটা মালতী বাবার কথা ভেবেই কিনে এনেছিল। এখন কী মনে করে, মালতী মিষ্টির বাক্সটা টুবলুর হাতে দিয়ে বিরজা দেবীকে প্রণাম করে বলল, মা, অনেকদিন তোমাদের কোনও খবর নিতে পারিনি! প্রায়ই আসব ভাবি—
অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে বিরজা দেবী হঠাৎ কেঁদে ফেললেন। প্রথমে চোখের পাতা দুটো ভিজে উঠল। তারপর আঁচল চাপা দিলেন, তারপর সত্যিকারের ফুঁপিয়ে উঠলেন। মালতীরও চোখ জ্বালা করে উঠল। বিরজা দেবী যখন এ সংসারে নতুন বউ হয়ে আসেন, মালতীর বয়স তখন মাত্র সাত বছর। নিজের মাকে মনে নেই মালতীর। তার শোবার ঘরে মা আর বাবার একসঙ্গে তোলা একখানা খুব বড় বাঁধানো ছবি ছিল। দার্জিলিং-এ তোলা, বাবা সেই ছবিতে শিকারির পোশাক পরা—একসময় বাবার খুব শিকারের শখ ছিল। মায়ের সেই ছবি দেখে দেখে মালতী মাকে অনেকবার মনে করার চেষ্টা করেছে, পারেনি। তার আড়াই বছর বয়সে মা মারা যান, মায়ের গলার স্বর কিংবা চেয়ে থাকার ভঙ্গি, কিছুই মালতী মনে করতে পারে না। মা বললে বিরজার কথাই মনে পড়ে। প্রথম বেশ কয়েক বছর বিরজা সত্যি মালতীর মায়ের অভাব ভুলিয়ে রেখেছিলেন। বিমাতৃসুলভ কোনও ব্যবহারই প্রকাশ পায়নি। রানির জন্মের পর থেকেই তিনি যেন অন্যরকম হয়ে গেলেন। মালতীকে আর সহ্য করতে পারতেন না। এমনকী রানি যখন খুব ছোট, মালতীর কত ইচ্ছে করত রানিকে কোলে নিয়ে আদর করতে, বিরজা কিছুতেই তা হতে দিতেন না। তখন থেকেই তিনি মালতীকে আলাদা ঘর করে দিয়েছিলেন। মালতী কখন খায়, কখন ঘুমোয়, কী পোশাক পরে, লেখাপড়া কখন করে—এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে গেলেন। মালতী আর শশাঙ্ক দুজনেই হয়ে গেল বাড়ির অবহেলিত সন্তান। শশাঙ্ক মেতে উঠল রাজনীতি নিয়ে, বাড়ির প্রতি তার আর কোনও টান রইল না। আর মালতী….
বিরজার যেন অতীতের সে-সব কথা কিছুই মনে নেই, কিংবা আরও সুদূর অতীতের কথা মনে পড়ছে। মালতীকে পাশে বসিয়ে তিনি অনেক কথা জিজ্ঞেস করলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। মালতীর অসুখ কবে সারল, সে কী রকম বাড়িতে থাকে, শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন কি না, রজত ছেলে কেমন, কী রকম মাইনে পায় ইত্যাদি। সব শুনে হঠাৎ একসময় রেগে উঠে বললেন, ও, তুই মোটে কয়েক ঘণ্টার জন্য এসেছিস? আজই চলে যাবি? বুঝেছি, আমাদের কথা ভেবে মোটেই আসিসনি, এসেছিস তোর বাবার সঙ্গে দেখা করতে! দ্যাখ, তোর বাবা তোকে চিনতে পারে কিনা!
সোমনাথ সত্যিই মালতীকে চিনতে পারলেন না। আগে যে ঘরটায় সারাবাড়ির লেপ তোশক ইত্যাদি রাখা হত, সিঁড়ির কাছের সেই ছোট ঘরটাকে এখন সোমনাথ সারাদিন বসে থাকেন। সোমনাথের স্বাভাবিক জ্ঞান সমস্ত লুপ্ত হয়ে গেছে, কিন্তু উন্মাদ দশার কোনও ভয়ংকর হিংস্রতা বা অস্বাভাবিকতা নেই। চার-পাঁচটা ডিকশনারি আর কিছু কাগজ আর পেনসিল নিয়ে তিনি চুপচাপ আপন মনে থাকেন সারাদিন। কয়েকটি পুরনো পত্রিকার ক্রসওয়ার্ড পাজলের পৃষ্ঠা খোলা থাকে চোখের সামনে। দেখলে কে বলবে এককালে এই মানুষটা দুর্ধর্ষ শিকারি ছিলেন। ছ’ফুট দু ইঞ্চি লম্বা সুপুরুষ, হাসির আওয়াজে ঘর ফাটাতেন যৌবনে। তখনও ধানবাদের কোলিয়ারিটা বিক্রি হয়ে যায়নি—বেশ সচ্ছল ছিল এই পরিবারের অবস্থা। হঠাৎ কোলিয়ারি থেকে ফেরার পথে হরিণ শিকার করে মাঝরাত্রে এসে বাড়ি পৌঁছোতেন, সেই রাত্রেই হই চই করে রান্না চাপানো হত। এই সেই মানুষ। টেবিলের ওপর ঝুঁকে কুঁজো হয়ে বসে আছেন। কপালের মাঝখানে শিরা দুটি ফুলে উঠেছে, চিবুকে হাত, গভীর চিন্তামগ্ন। যে সমস্যা পৃথিবীর কারও জীবন বিন্দুমাত্র অদল-বদল করবে না, সেই সমস্যায় তিনি বিব্রত।
মালতী নিচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, বাবা, আমি মিলু।
সোমনাথ চোখ তুললেন না, মুখে শুধু বললেন, হুঁ।
মালতী চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। দরজার আড়ালে রানি আর টুবলু কৌতুকের দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছে। এতদিন বাদে বড়দি এসেছেন, বাবা হয়তো কোনও মজার কাণ্ড করবেন। সোমনাথ কিন্তু কিছুই করলেন না, তাকালেনও না মালতীর দিকে। মালতীর বুকের কাছটা চাপা ভারী হয়ে এল। হঠাৎ ইচ্ছে হল ছেলেবেলার মতন চেঁচিয়ে কেঁদে উঠতে। ধানবাদ থেকে বাবা একদিন তাকে পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে গিয়েছিলেন। মালতীর তখন দশ বছর বয়েস। পাহাড়ে উঠতে উঠতে মালতী হাঁপিয়ে গিয়েছিল, আঙুল মুচকে গিয়েছিল একটা—আর চলতে পারছিল না। সোমনাথ কৌতুক করে বলেছিলেন, এতবড় মেয়েকে আমি কোলে করব নাকি! নিজে নিজে হাঁটতে না পারলে, তোকে এখানে ফেলে রেখে চলে যাব কিন্তু! মালতী ভেবেছিল সব ভুলে যাবে, কিন্তু ভোলা যায় না। মালতী আরও এগিয়ে এসে বলল, বাবা, আমি তোমাকে না বলে চলে গিয়েছিলাম, আমি অন্যায় করেছি তোমার কাছে।
সোমনাথ এবারও কোনও কথা বললেন না, শুধু পেনসিল দিয়ে টেবিলে আওয়াজ করলেন টক টক করে। মালতী বাবার সেই হাতখানা চেপে ধরে বলল, বাবা, আমার দিকে তাকাবে না? বাবা, আমি মিলু। সোমনাথ তবুও মালতীর দিকে তাকালেন না, নিজের হাতের ওপর মালতীর মকরমুখো বালা-পরা নরম হাতখানার দিকে চেয়ে রইলেন এবং একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পাশের ক্যাম্প খাটটায় চিত হয়ে শুয়ে পড়লেন, দু’হাতে চোখ ঢাকলেন। মালতী চুপ করে আরও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, সোমনাথ আর চোখ খুললেন না।
বাইরে এসে মালতী টুবলুকে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁরে, বাবা কি কাউকেই আর চিনতে পারেন না? মাকেও না!
টুবলু তো আর বাবার যৌবনের চেহারা দেখেনি। তার স্মরণকাল থেকে সে বাবাকে ওই রকম দেখছে, সুতরাং তার কণ্ঠস্বরে কোনও দুঃখ নেই। সে বলল, উঁহু! মাকে তো একদমই চিনতে পারেন না! মার সঙ্গে একটাও কথা বলেন না। মাঝে মাঝে শুধু দু’একটা কথা বলেন দাদার সঙ্গে। তাও খুব কম!
মালতীর ঘরটায় এখন রানি আর টুবলু শোয়। সেই বড় খাটটা ঘরের এখন সেই জায়গাতেই আছে, সরানো হয়নি অন্যদিকে। চলে যাবার আগের তিন মাস মালতী ওই খাটটায় দিন-রাত শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করেছে। ঘরটার বিশেষ কিছুই বদলায়নি, শুধু জানলার একটা পাল্লা ভেঙেছে। সেই ভাঙা পাল্লাটায় ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ। দেয়ালের ছবিগুলো পুরনো জায়গায় ঝুলছে। এমনকী আলনায় তার একটা শাড়ি রয়েছে এখনও—হয়তো রানি পরে। মাথার কাছে পুরনো আমলের আলমারিটা দাঁড়িয়ে আছে প্রহরীর মতন। রজতও এ ঘরে এসে মালতীর বিছানায় তার মাথার পাশে বসত। বিরজা ঘরে ঢুকে গজগজ করতেন। রজত তবু নড়েনি। প্রথম যেদিন রজত তার কপালে হাত রাখে, ঘরে কেউ ছিল না, মালতী সেদিন চোখের জলে বিছানা ভিজিয়েছিল। কত অসহায় ছিল সেদিন মালতী। কোথা থেকে দুটো বেহিসেবি অসুখ এসে জীবনটা তছনছ করে দিয়েছিল। বিরজার দুর্ব্যবহারে মালতী তখন দ্বিতীয়বার মাকে হারিয়েছিল। অনেক চেষ্টা করেছিল বিরজার সঙ্গে মানিয়ে নেবার, কিন্তু বিরজা সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন মালতীর দিক থেকে। বাবার ওই রকম পরিবর্তনে মালতী দারুণ আঘাত পেয়েছিল। দাদা ছিল ছেলেবেলা থেকে বন্ধুর মতন। সেই শশাঙ্কও হঠাৎ রাজনীতি নিয়ে মত্ত হয়ে উঠে কত দূরে চলে গেল। তবু মালতী একেবারে ভেঙে পড়েনি। এর বদলে সে পেয়েছিল বাইরের জগৎ। কলেজে গেলেই দারুণ হই-হই আর আনন্দ। ক্লাসের মেয়েরা তাকে ভালোবাসত, অনেকে তার ভক্ত ছিল। পর পর দু’বছর মালতী ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি হয়েছিল। নাটকের অভিনয়, গান, পিকনিক—এই সব কিছুর মধ্যে ছিল মুক্তির হাওয়া। কলেজের বাইরেও ছিল তার মুক্তি। কেউ তার জন্য ভাবত, কেউ তার জন্য অপেক্ষা করত। লেকে, বালি ব্রিজে, ময়দানে লঘু পায়ে বেড়াতে বেড়াতে মালতী অনায়াসে বাড়ির আবহাওয়া ভুলতে পারত। বি.এ পরীক্ষাও হয়ে গিয়েছিল। আর দু-তিন মাস বাদে রেজাল্ট বেরোলে সে ইচ্ছা মতন একটা চাকরি খুঁজে নিয়ে হয়তো বাড়ি থেকে দূরে চলে যেতেও পারত। কিন্তু পাতাল থেকে উঠে এল দুটো ভয়ংকর কালো অসুখ, বাইরের জগৎটা তার কাছে আবার আড়াল হয়ে গেল। এমনকী অসুখ দুটো দুই যমদূতের মতন তাকে পৃথিবী থেকে নিয়ে যেতেও পারত। শশাঙ্ক তখন জেলে, বাড়িতে একটা মানুষ নেই, যে তাকে বাঁচাবে। আর একজন বাড়ির সামনে এসে পায়চারি করত। ওপরে ওঠার সাহস ছিল না। সাহস সঞ্চয় করে দু’-একবার এলেও তার কিছু করার সামর্থ্য ছিল না। কিংবা সে অসুখ দুটোর গুরুত্ব তেমন বুঝতে পারেনি। সেই সময় মালতী সত্যিকারের অসহায় হয়ে পড়েছিল, চোখ বুজলেই দেখতে পেত মৃত্যুর জগৎ। বিছানা ছেড়ে ওঠারও শক্তি নেই, শিশুর মতন কান্না ছাড়া আর তার কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু তার কান্না দেখারও তো ছিল না কেউ। সেই সময় হঠাৎ বাইরের জগতের সম্পূর্ণ রূপ নিয়ে এল রজত।
মালতী রানিকে জিজ্ঞেস করল, আলমারির চাবিটা কোথায় রে?
রানি বলল, ওটাতে চাবি দেওয়া নেই, খোলাই আছে।
আমার একটা কাঠের বাক্স ছিল ওটার মধ্যে। সেটা আছে?
হ্যাঁ। নীচের তাকে রাখা আছে, দ্যাখো না!
ওটা তোরা খুলিসনি?
না, ওটায় তো চাবি দেওয়া। মা একবার বলেছিলেন, চাবিওলা ডেকে খুলবেন, কিন্তু দাদা বারণ করে দিয়েছে। দাদা বলে দিয়েছে সবাইকে, মিলুর জিনিস কেউ হাত দেবে না! খবরদার!
রানি এমন ভঙ্গি করে বলল যে, এতক্ষণে মালতী হেসে ফেলল। বলল, দাদা এখন বাড়িতে থাকে একটুও?
মাঝে মাঝে সাতদিন-দশদিন এসে থাকে, আবার চলে যায়। কালকেও তো ছিল। জান বড়দি, দাদা এবার ভোটে দাঁড়াবে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। দাদা আমাদের বলেছে ভলান্টিয়ার হতে।
এমনি এমনি খাটিস না। তার বদলে দাদার কাছ থেকে কিছু আদায় করে নিস।
আলমারিটা মালতীই একা ব্যবহার করত। আজ সেই আলমারি খুলতে তার লজ্জা করছে। সেই এক ভোরবেলা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার সময় মালতী শুধু একটা সুটকেস নিয়ে গিয়েছিল, বিশেষ কিছুই নিতে পারেনি। তার নিজস্ব অনেক জিনিস এখনও সারাবাড়িতে ছড়ানো। এই বাড়ির মালিকানাতেও তার একটা অংশ আছে, তবু মালতীর লজ্জা করছে কোনও কিছু করতে। সে এ বাড়িতে যেন বেড়াতে এসেছে বাইরের লোকের মতন। মালতী রানিকে বলল, কাঠের বাক্সটা একটু বার করে দে তো, দেখি কী আছে ওর মধ্যে।
কাশ্মীর থেকে বাবা ওই কারুকাজ-করা বাক্সটা এনে দিয়েছিলেন। ওটার মধ্যে মালতী তার গোপন সামগ্রী রাখত। চাবিটা মালতীর সঙ্গে এখনও আছে। বাক্সটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে সেটার ভেতর থেকে পুরনো কালের গন্ধ বেরিয়ে এল। একটা লিপস্টিক, একটা সোনার মেডেল—গানের প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হয়ে পেয়েছিল, একজোড়া ঝুমকো দুল—তার একটা হারিয়ে গিয়েছিল বারাসতের পিকনিকে। কয়েকটা ছবি, তার নিজের মায়ের ব্যবহার করা সিঁদুরকৌটো, লাল রিবনে বাঁধা এক তাড়া চিঠি, আর একেবারে নীচে একটা শুকনো বকুল ফুলের মালা। খয়েরি রঙের চ্যাপটা চেহারা হয়ে গেছে ফুলগুলোর, কিন্তু মালাটা অবিকৃত আছে। হাত দিয়ে তুলতেই সেটা ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ল। শান্তিনিকেতনের খোয়াই-এর ধারে একটা বকুলগাছ—ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে এই ফুলগুলো অরুণ কুড়িয়ে এনে দিয়েছিল। নিজের হাতে মালা গেঁথেছিল মালতী, তারপর অরুণ—
রানি গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, বড়দি, তুমি এখন দেখতে কী সুন্দর হয়েছ!
তাই নাকি? তবে তুই আমার থেকে আরও অনেক সুন্দর।
যাঃ! তুমি এখন থেকে এ বাড়িতে এসে থাকবে তো? অন্তত মাসে একবার?
হ্যাঁ, আসব। তুই একটু চা করে নিয়ে আয় তো। গলাটা শুকিয়ে গেছে। এতদিন বাদে এলুম, একটু চা-ও তো খাওয়ালি না!
অন্ধকার হয়ে এসেছে। জানলার কাছে চিঠির তাড়াটা হাতে নিয়ে মালতী দাঁড়াল। অরুণের সাতাশখানা চিঠি। কোনওটা তিন-চার লাইনের, কোনওটা পাঁচ-ছ’ পাতা। অনেকদিনের হাতের কাঁপন, বুকের দুরুদুরু, চোখের শঙ্কা মিশে আছে চিঠিগুলোর সঙ্গে। ফিতের বাঁধন খুলে মালতী একটা একটা করে চিঠিগুলো পড়তে লাগল। যেন একটা অন্য পৃথিবীর কথা, অন্য জীবনের কথা। শুধু দুজন, আর কিছু নেই—আর কোনও মানুষ নেই। আর কোনও ইতিহাস নেই। পড়তে পড়তে ক্ষণে ক্ষণে মালতীর মুখের অভিব্যক্তি বদলাতে লাগল। এর আগে এই চিঠিগুলো বহুবার পড়া হয়ে গেছে, মালতী কিছুই তো ভুলতে পারেনি, এখনও প্রায় মুখস্থ হয়ে আছে। একপাতা শেষ হলে, অন্য পাতা ওলটাবার আগেই মালতীর মনে পড়ছে পরের লাইন কী আছে। কোনদিন কোন সময় চিঠিটা পেয়েছিল সে, সে কথাও মালতীর মনে পড়ে যায়। অনেক চিঠি অরুণ দিয়েছে মালতীর হাতে হাতে। দেড়ঘণ্টা কথা বলার পর বিদায় নেবার সময় অরুণ হঠাৎ বলেছে, এই নাও তোমার একটা চিঠি—বাড়ি পৌঁছোবার আগে কিছুতেই পড়বে না! নীরব হাস্যে চিঠিখানা নিয়ে মালতী তার ব্লাউজের ফাঁকে একেবারে বুকের মধ্যে রেখেছে। সেই সব চিঠি কত রাত্রির ঘুম নষ্ট করেছে মালতীর। এখন আর চিঠিগুলোতে বুকের গন্ধ লেগে নেই। মালতী ঘ্রাণ না নিয়েও বুঝতে পারে।
চিঠিগুলো পড়া শেষ হলে মালতী ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলল। তার মনে হল, এসব যেন অন্য একজন মালতীর কথা। তার নিজের না। যেন কোনও প্রিয় লেখকের লেখা একটা প্রেমের কাহিনী। মালতীর নতুন জীবনে এই চিঠিগুলোর কোনও মূল্য নেই। চিঠিগুলো ছিঁড়ে জানলা দিয়ে উড়িয়ে দিল। হাওয়ায় ঘুরতে ঘুরতে সেগুলো নেমে গেল নীচে। কেউ যদি এগুলো পড়তে চায় কিছুতেই আর এক টুকরোর সঙ্গে অন্য টুকরো মেলাতে পারবে না।
মায়ের সিঁদুরের কৌটো আর সোনার মেডেলটা নিজের হাতব্যাগে পুরে মালতী বাকি সব কিছু সমেত কাঠের বাক্সটা রানিকে দিয়ে দিল। আর বেশিক্ষণ দেরি করা যাবে না। রজত ওর মাসিমার বাড়িতে ঠিক আটটার সময় আসবে।