সুখ অসুখ – ৪

চার

বাড়ি পৌঁছোতে রজতের প্রায় আটটা বাজল। এসে দেখলেন, ডাঃ সেন তাঁর স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। ক্লান্তিতে রজতের চোখ এলিয়ে আসছিল, এখন ইচ্ছে ছিল কোনওরকমে স্নান সেরে আরাম-চেয়ারে হাত-পা ছড়ানো। এ সময় অন্য যে-কোনও ব্যক্তিকে দেখলে রজত অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করতেন, কিন্তু ডাঃ সেনকে তাঁর ভালোই লাগল। গেট দিয়ে গাড়ি ঢোকার শব্দ পেয়েই মালতী এবং অন্যরা দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। ডাঃ সেন চেঁচিয়ে উঠলেন, আসুন রায়চৌধুরী সাহেব, কতক্ষণ আপনার জন্য বসে আছি। দেশের সব খুন-ডাকাতি একদিনে থামাবেন নাকি? কতদূর গিয়েছিলেন?

রজত দোতলায় উঠে এসে সহাস্যে হাত বাড়িয়ে বললেন, বসুন, বসুন, সারাদিন বিশ্রী ঝঞ্ঝাটের মধ্যে গেছে, এখন একটু প্রাণ খুলে আড্ডা মারা যাবে।

মালতী বলল, তুমি দুপুরে কিছু খেয়েছিলে? মুখ এত শুকিয়ে গেছে কেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, খেয়েছিলুম। কাঁচা রাস্তা দিয়ে ড্রাইভ করা তো, সেই একজারশান।

ডাঃ সেনের স্ত্রী প্রতিমা দেবী বললেন, সেই পীরপুর গিয়েছিলেন? তা হলে আপনার এখন বিশ্রাম দরকার—আমরা এবার উঠে পড়ি।

না, না, এক্ষুনি উঠবেন কেন? বসুন ম্যাডাম।

অনেকক্ষণ এসেছি। শুনুন, আমরা এসেছিলাম নেমন্তন্ন করতে। কাল মোমের জন্মদিন—বিকেলবেলা আপনারা দুজনে আসবেন। কাল আর কোনও কাজ রাখলে চলবে না কিন্তু।

আচ্ছা, সে-কথা পরে শুনব। বসুন, আমি চট করে একটু মুখে-চোখে জল দিয়ে আসি। যা ধুলো! মালতী, টাওয়েলটা দাও তো।

এ অঞ্চলে ডাঃ সেনদের বহুদিনের বাস। ওঁদের বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যে-কোনও নতুন পথিককে একমুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে বলতে হয়, বাঃ কী সুন্দর! চৌকো ধরনের বিশাল বাড়ি, সামনে অনেকখানি কম্পাউন্ড—ঠিক ডায়মন্ডহারবার রোডের ওপর—বাগান ভর্তি শুধু গোলাপ ফুল—আর বাড়ির রং গোলাপি, বাউন্ডারি ওয়ালের রং গোলাপি, এমনকী লোহার গেটের রংও গোলাপি। বাড়ির নাম ‘গোপাল কুঞ্জ’। ডাঃ সেনের বাবা জানকীনাথ সেন ছিলেন শৌখিন পুরুষ। পাটের ব্যবসায় প্রভূত ধন অর্জন করেছিলেন—সেই ধন ভোগও করেছেন এক জীবনে যতখানি সম্ভব, কারওর ওপর রাগ করলে তাকে খুন করে ফেলার হুকুম দিতেও নাকি তিনি কুণ্ঠিত হতেন না—আবার সেই মানুষই মৃত্যুকালে রামকৃষ্ণ মিশনকে দান করে গেছেন আড়াই লক্ষ টাকা। তিনি জীবিত থাকতে প্রত্যেক নব বৎসরের দিনে ডায়মন্ডহারবারের সমস্ত সম্ভ্রান্তলোক তাঁর বাগানের একগুচ্ছ করে গোলাপ উপহার পেত।

শৌখিন জানকীনাথ সেনের সম্পত্তি এখন অবশ্য ভাগ হয়ে গেছে। কারণ, তাঁর সন্তান সংখ্যা—তিন মেয়ের বিয়ে তিনিই দিয়ে গিয়েছিলেন—বাকি এগারো জন ছেলে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সম্পত্তি ভাগ করে নেয়। সর্ব কনিষ্ঠ ডাক্তার নিশানাথ সেন বাবার সম্পত্তির সামান্য অংশ পেলেও, রুচি ও শখ পেয়েছেন পুরোপুরি। বিলেত থেকে এফ.আর.সি.এস হয়ে আসা ডাক্তার, কিন্তু মানুষের চিকিৎসা করে অর্থোপার্জনের মোহ তাঁর নেই। তাঁর শখ পিতার সেই গোলাপ বানানের পরিচর্যা করা। এ ছাড়া যখন তখন ডিটেকটিভ বই হাতে নিয়ে সময় কাটানো। চিকিৎসক হিসেবে তাঁর সুনাম আছে, কিন্তু বড়ই খামখেয়ালি মানুষ। কোনও গোয়েন্দা গ্রন্থের শেষ পরিচ্ছেদ পড়ার সময় যদি কোনও জরুরি কলও আসে তিনি যেতে চান না। চাকরকে ডেকে নির্দেশ দেন, বলে দে, ডাক্তারবাবুর এখন মন খারাপ। মন খারাপ থাকলে কি আর মন দিয়ে রুগি দেখা যায়? ডিসপেনসারিতে যেতে বলে দে!

স্টেশনের কাছে ডাক্তার সেনের একটি ডিসপেনসারি ও ওষুধের দোকান আছে। সেখানে তিনি মাইনে করে একজন ছোকরা ডাক্তারকে রেখেছেন। তার ওপর নির্দেশ আছে, গরিব লোকদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করবে। নিজের আলস্য ও খামখেয়ালের জন্য নিজের বিবেককে তিনি এই ভাবে সান্ত্বনা দেন।

ডাক্তার সেনের স্ত্রী প্রতিমা দেবীর মাঝারি ধরনের সুনাম আছে গায়িকা হিসেবে। অতুলপ্রসাদের গানে তাঁর কণ্ঠ ও আবেগ সত্যিই সাড়া দেয়। মাঝে মাঝে রেডিয়োতে প্রতিমা দেবীর প্রোগ্রাম থাকে। কিছু কিছু জলসাতেও আজকাল রবীন্দ্রসংগীত ও অতুলপ্রসাদের গান চালু হওয়ায় ওঁর ডাক পড়ে, একটি ফিল্মেও তিনি কণ্ঠ দান করেছেন। প্রতিমা দেবী প্রায় মাসের মধ্যে পনেরো দিনই এখানে থাকেন না, কলকাতায় কাটান। ওঁদের ছেলে সোমনাথ কলেজে পড়ার সময় খুব কমুনিস্ট পার্টি নিয়ে মেতেছিল, তাই তাকে টেকনোলজি পড়তে বিলেতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেয়ে মোম ডায়োসেশান থেকে পাশ করার পর এখন মামাবাড়িতে থেকে ব্রেবোর্নে বি.এ পড়ছে।

মোমের ভালো নাম মালবিকা। সে ভারী অদ্ভুত ধরনের মেয়ে। ছিপছিপে লম্বা চেহারা, মাকে ছাড়িয়ে এই উনিশ বছরেই সে প্রায় বাবার মাথা ছুঁয়েছে। অত্যন্ত উজ্জ্বল ফরসা রং, টানা-টানা দুই চোখে চোখের পাতা পড়ে একটু ঘন ঘন। মোমকে নিয়ে ওরা বাবা-মা’র একটু সমস্যা আছে। বারো-তেরো বছর বয়েসে মোমের মাথা খারাপ হবার লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। হিস্টিরিয়া রোগীর মতন হঠাৎ অসম্ভব হাত-পা ছুঁড়ত, অজ্ঞান হয়ে যেত, তারপর অনেক চিকিৎসার পর তাকে সারানো হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ সেরেছে কিনা সন্দেহ। সে যখন তখন হেসে ওঠে খিলখিল করে। শিশুর মতন সরল তার ব্যবহার—সে সভ্য সমাজের অনেক নিয়মই মানে না। হয়তো বাইরের কোনও লোকের কাঁধে হাত দিয়েই কথা বলতে লাগল। কোথায় গম্ভীর হতে হবে, কোথায় অহংকার দেখিয়ে উদাসীন সাজতে হবে—ধনী পরিবারের রূপসি তরুণী মেয়েসুলভ, এসব জ্ঞানই এখনও তার হল না। বাইরের লোকরা মোমকে যে দেখে তারই ভালো লাগে। মনে হয় কী সুন্দর আর নিষ্পাপ সরল একটি মেয়ে, কিন্তু মোমের বাবা-মা, বিশেষত ওর বাবা নিজেও অত্যন্ত সরল ও সৎ মানুষ হওয়া সত্বেও জানেন, মোমের ব্যবহার সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নয়।

বাগানে টেবিল পাতা হয়েছে। সেই টেবিল ঘিরে নিমন্ত্রিতরা সকলে, আর তাদের ঘিরে আছে কেয়ারি করা গোলাপ গাছ। মনোরম বিকেলবেলা। মালবিকার জন্মদিনে ডায়মন্ডহারবারের মেঘগুলোকে সরিয়ে নিয়ে সুবাতাস পাঠিয়েছেন, সূর্য দেরি করে ডুবছেন। কলকাতা থেকে একঝাঁক বান্ধবী এসেছে মালবিকার। তারা বিবেকহীন ভাবে গোলাপ ফুল ছিঁড়ছে যত খুশি। একজন বলল, গোলাপের পাপড়িগুলো দ্যাখ কী তুলতুলে, ঠিক ভেলভেটের মতন। ইস, মানুষের চামড়া যদি এরকম হত। আরেকজন বলল, সব মানুষের হলে ভালো লাগত না! ছেলেদের গালে যদি কড়া দাড়ি আর খরখরে না হয়, আমার ভালো লাগে না! আর একজন তাকে ধাক্কা মেরে বলল, ইস, কী অসভ্য! কত যেন—

গোলাপের কত রকম রূপ। ডাঃ সেন সাত-আটজন প্রৌঢ়ের সঙ্গে খুব পলিটিকসের আলোচনায় মেতে উঠেছেন। তারও সূত্রপাত ওই গোলাপ থেকে। টকটকে লাল গোলাপ। নেহরু যখন এখানে এসেছিলেন, তখনও তাঁর কোটের বাটন-হোলে এইরকমই গোলাপ ছিল। সে ফুল তো নেহরুকে এ বাড়ি থেকেই উপহার দেওয়া হয়েছিল। নেহরু ভারতবর্ষের কী কী ক্ষতি করেছেন। দেশবিভাগ উচিত হয়েছে কি না? মহাত্মা গান্ধীর জন্য….এখন ওঁরা ত্রিপুরী কংগ্রেসে আছেন। ওদের মধ্যে চুপচাপ বসে আছে অরুণ।

মালতী, তোমার কত্তা কোথায়?

মালতী ঘুরে তাকাল। গেঞ্জির কল যাঁদের, সেই আচার্য বাড়ির বড় বউ সাবিত্রী। প্রায় এক বিঘৎ চওড়া জরি পাড়ের সাদা শাড়িতে ভারী চমৎকার মানিয়েছে তাঁকে। মালতী চায়ে চুমুক দিয়েছিল, কাপটা নামিয়ে বলল, সাবিত্রীদি, কখন এলেন?

এই তো একটু আগে। এসে অবধি তোমাকে খুঁজছি—অনেকদিন যাওয়া হয়নি তোমাদের ওখানে। বলতে নেই, তোমার শরীরটা তো বেশ সেরেছে মনে হচ্ছে!

হ্যাঁ, একদম ভালো হয়ে গেছি। এ যাত্রা বেঁচেই গেলাম।

রজতবাবু কোথায়?

এক্ষুনি এসে পড়বে হয়তো। সকালে জরুরি ডাক পেয়ে আলিপুর গেছে। বিকেলেই ফেরার কথা।

তাই বুঝি অমন ঘন ঘন রাস্তার দিকে তাকাচ্ছ? গাড়িতে গেছে না ট্রেনে?

মালতী স্মিতহাস্যে উত্তর দিল, গাড়িতে। সোজা এখানেই চলে আসবে—কথা আছে।

আবার নাকি দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হবে? তুমি কিছু শুনেছ?

না, শুনিনি। তবে বলা তো যায় না। সব জিনিসের এত অভাব—

কত্তাটিকে সাবধানে রেখো। ওঁর যা দায়িত্ব—

মোম ছুটতে ছুটতে এসে মালতীর হাত ধরে টানতে টানতে বলল, মালতীদি, আমরা একটা খেলা খেলছি, আপনিও খেলবেন আসুন!

কী খেলা?

গানের খেলা। আসুন না, খুব মজার। একজন গানের একটা লাইন গাইবে, তার শেষ অক্ষরটা দিয়ে আর একটা গান আরম্ভ করতে হবে। সাবিত্রী মাসি আপনিও আসুন।

সাবিত্রী হাসতে হাসতে বললেন, ওরে, আমি কি আর গান জানি! চলো, দেখি গিয়ে তোমাদের খেলা!

মালতী বলল, ও খেলায় তো অনেক গান জানতে হয়। আমিও তো বেশি গান জানি না!

মোম বলল, আহা-হা, আর চালাকি করতে হবে না! আসুন!

প্রতিমা দেবীকে ঘিরে বসেছে মোমের বান্ধবীরা। প্রতিমা দেবী এমন ঝলমলে সাজ করেছেন যে, ওঁকে মোমের মা মনে হয় না, মনে হয় বড় বোন। সাবিত্রী বললেন, ডাক্তার গিন্নি, গত রবিবারে রেডিয়োতে তোমার গানগুলো বড় দরদ দিয়ে গাওয়া। গানগুলো নতুন না! আগে তো শুনিনি!

হ্যাঁ, সবাই তো বাঁধা-ধরা কয়েকখানা গানই গায়। অতুলপ্রসাদের আরও যে কত ভালো ভালো গান আছে। আচ্ছা, বসে পড়ুন। সবাই গোল হয়ে বসে পড়ুন। ছেলেরা কেউ খেলবে না? ছেলেদের না জব্দ করতে পারলে মজা লাগবে না। রতনকে ডাকো না, রতন তো ভালো গান গায়। সাবিত্রীদি, আপনার দেওর আসেনি? এল না কেন? আচ্ছা, ওকেও ডাকো না; ওই যে নতুন প্রোফেসর এসেছে, অরুণ, অরুণ চ্যাটার্জি।

মোম আবার ছুটে গেল। এল তরুণ ডাক্তার রতন সেনগুপ্ত, মুনসেফ প্রাণেশ চক্রবতী। প্রৌঢ়দের জমায়েতে প্যাটেল বেঁচে থাকলে ভারতের কী চেহারা হত—এই পর্যায় চলছে, মোম এসে বিনা দ্বিধায় অরুণের হাতখানা ধরে বলল, উঠুন! চলুন!

অরুণ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছে, তবু জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

আমাদের সঙ্গে খেলবেন। গানের খেলা।

গানের খেলা? আমি একটুও গান জানি না।

মোম ধমকে উঠল, কেন গান জানেন না?

কেন গান জানি না? তাও তো জানি না? তবে গান শুনতে ভালোবাসি।

তাতেই হবে, আসুন।

অরুণের হাত ধরে টেনে এনে মোম বলল, মা, তোমার এই নতুন প্রোফেসর গান জানেন না বলছেন! শুধু শুনতে ভালোবাসেন।

প্রতিমা দেবী বললেন, তাতেই হবে। গুনগুন করে একটু যা হয় গাইবেন—এটা তো গানের প্রতিযোগিতা নয়—কে কত গানের লাইন মুখস্থ বলতে পারে, সেই খেলা। বসে পড়ুন, এখানকার সবার সঙ্গে আলাপ আছে তো? ইনি হচ্ছে সাবিত্রী আচার্য—আচার্য হোসিয়ারির….আর ইনি মালতী রায়চৌধুরী, এ.ডি.এম রজত রায়চৌধুরীর স্ত্রী, আর ওর নাম ঝরনা….

প্রতিমা দেবী এত দ্রুত বলে গেলেন যে অরুণ মাঝপথে কোনও কথা বলার সময়ই পেল না। সুতরাং সবার দিকে হাত জোড় করে নমস্কার করার সময় মালতীকেও নমস্কার করতে হল। মালতী তখন অরুণের দিকে তাকায়নি।

যে কেউ যে-কোনও এক লাইন গান গাইবে। মোটামুটি জানা বাংলা গান, তারপর আমি যার নাম বলব, সে সেই লাইনটার শেষ অক্ষর দিয়ে আরম্ভ করে অন্য একটা গানের লাইন গাইবে—এক মিনিট মোটে সময়…

প্রতিমা দেবী একটু থামলেন। তারপর আবার বললেন, আমিই আরম্ভ করছি। ‘আমারে ভেঙে ভেঙে করো হে, তোমার তরী—’ এখন রী’ কিংবা ‘র’ দিয়ে আরম্ভ করতে হবে। কে বলবে…..ঝরনা, তুমি বলো—

ঝরনা সামান্য একটু ভেবেই গেয়ে উঠল, ‘রহি রহি, আনন্দ তরঙ্গ বাজে।’

সকলেরই মুখ উদগ্রীব। ঝরনার গাওয়া শেষ হতেই অনেকে চেঁচিয়ে উঠল, এবার ‘জ’ দিয়ে…

প্রতিমা দেবী বললেন, রতন, রতন বলো।

রতন মাঝখান থেকে শুরু হওয়া রেকর্ডের মতন সঙ্গে সঙ্গে গেয়ে উঠল—’জীবনের পরম লগন, কোরো না হেলা, কোরো না হেলা, হে গরবিনী।’

রতনের গান গাওয়ায় ছটফটে ভঙ্গিতে সবাই হেসে উঠল। প্রতিমা দেবী বললেন, একেবারে তৈরিই ছিল। কী রতন, কারওর উদ্দেশে এই গান রোজ গাইছ নাকি?

রতন অপ্রতিভ ভাবে বলল, সব মেয়েকে উদ্দেশ্য করেই এ গান গাওয়া যায়। গরবিনী তো সবাই!

‘ন’ দিয়ে। তুমি বলো সুচন্দ্রা!

‘ন’ দিয়ে? ‘ন’ দিয়ে তো? দাঁড়ান, এক্ষুনি বলছি।

সুচন্দ্রার মুখখানা জলে ডোবা মানুষের মতন উদভ্রান্ত। প্রাণপণে খুঁজছে—হাত তুলে আবার বলল, ‘ন’ দিয়ে তো? দাঁড়ান দাঁড়ান, আচ্ছা গাইছি, ‘না বোলো মেরে সঁইয়া’।

সবাই চেঁচিয়ে উঠল, না, না, হিন্দি গান চলবে না, হিন্দি চলবে না।

প্রতিমা দেবীও বললেন, না, এ খেলায় হিন্দি গান চলে না। সুচন্দ্রা, তোমাকে আবার সুযোগ দিচ্ছি।

সুচন্দ্রা আরও একটুক্ষণ চোখ কপালে তুলে রইল। দু’-একটা সুর ভাঁজার চেষ্টা করে বলে উঠল, দূর ছাই, কিছুতেই মনে আসছে না।

আবার এক দমক হাসি। তার পাশের মেয়েটি নিজে থেকেই বলল, ‘ন’ দিয়ে আমি গাইছি, ‘নীরবে থাকিস, সখী ও তুই নীরবে থাকিস! তোর প্রেমেতে আছে যে কাঁটা, তারে আপন মনে লুকিয়ে রাখিস, নীরবে থাকিস, সখী ও তুই’—মেয়েটি আপন মনে পুরো গানটাই প্রায় গেয়ে যাচ্ছিল, তার কণ্ঠস্বর এমন সুন্দর-সুরেলা যে মালতী একদৃষ্টে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে ওর গানটা শুনতে লাগল।

থাকিস ‘স’ দিয়ে। সাবিত্রীদি, আপনি বলুন।

না, না বাপু, আমি না….আমি পারব না।

মোম, মো, তুই বল।

‘স্বপ্নে আমার মনে হল, তুমি ঘা দিলে আমার দ্বারে, হায়।’

‘য়’ দিয়ে কী করে হবে? ‘য়’-দিয়ে তো কথা আরম্ভ হয় না?

তা হলে ‘হ’ দিয়ে হোক! প্রাণেশবাবু আপনি—

‘হ’ দিয়ে! আমার ভাগ্যেই সবচেয়ে শক্তটা? ‘হ’ দিয়ে…’হ’ দিয়ে? যাঃ, ‘হ’ দিয়ে কোনও গান হয় না!

কেন হবে না। অনেক আছে।

আচ্ছা এটা হবে? ‘হুঁকো মুখো হ্যাংলা, বাড়ি তার বাংলা, মুখে তার হাসি নাই—’

না, না, ওটা তো কবিতা। গান বলতে হবে—

কবিতা তো, সুর বসিয়ে দিলেই গান হয়ে যাবে।

ঠিক আছে, আপনি সুর দিয়ে গেয়ে দেখান।

ঠিক আছে, আর একটা পেয়ে গেছি, এটায় তো সুর অছে, ‘হুন হুনারে হুন হুনা! পালকি চলে, পালকি চলে, পালকি চলে গগন তলে।’

এবার ‘ল’ দিয়ে, কে কে বাকি? গায়ত্রী তুমি?

খুব সোজা! ‘লহ, লহ, তুলে লহ নীরব বীণাখানি—’

‘ন’—অরুণবাবু আপনি বলুন।

আমার কিন্তু গলায় সুর ঠিক হয় না।

তা না হোক। লাইনটা ঠিকমতো হলেই হল।

অরুণ একটু ভাবল। তারপর চাপা ভরাট গলায় ধরল, ‘নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমা নিশীথিনী সম—তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম’।

মালতী একপলক অরুণের দিকে তাকাল। অরুণ তীব্র চোখে তার দিকে তাকিয়েই গাইছে—সেই দৃষ্টিতে যেন খানিকটা ক্রোধ। মালতী এর আগে একবারও অরুণের সঙ্গে চোখাচোখি করেনি, একবারও ওর দিকে তাকায়নি। এখন মনে হল, অরুণ বোধহয় সর্বক্ষণ মালতীরই দিকে তাকিয়েছিল। অস্বস্তিতে চোখ ফিরিয়ে নিল মালতী। ‘তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম’—লাইনটা বারবার গাইতে লাগল অরুণ।

ঝরনা, তুমি এবার…

‘মালা হতে খসে পড়া ফুলের একটি দল, মাথায় আমার পরতে দাও….’

মালতী! ওমা, মালতীকে তো একবারও বলা হয়নি। মালতী, তুমি—

মালতীর মুখ নিচু, মাটির দিকে চোখ রেখে বসে আছে। প্রতিমা দেবী বললেন, মালতী, এবার তোমার—’ও’ দিয়ে, খুব সোজা তো—

মালতী তবু চুপ। আরও অনেকে তাড়া দিল, মালতীদি, এবার আপনার টার্ন।

মালতী মুখ তুলল, মুখে সামান্য হাসি। বলল, গাইছি, গাইছি, একমিনিট তো সময়, একটু ভেবে নিই। তারপর খুব আস্তে আস্তে ধীর ‘লয়ে’ মালতী গাইল, ‘ও কেন দেখা দিল রে, না দেখা ছিল যে ভালো, ও কেন দেখা দিল রে—’

একটু একটু অন্ধকারের সন্ধ্যা নেমেছে। সকলের মুখ এখন আর তেমন স্পষ্ট দেখা যায় না। গানটা শুরু করে লাইনের মাঝখানে মালতী সোজাসুজি অরুণের দিকে তাকাল, না দেখা ছিল যে ভালো। মালতীর মুখে তখনও সেই সামান্য হাসি।

রতন, তুমি!

রতন এবারও প্রস্তুত। এক মুহূর্তও ভাবল না, সঙ্গে সঙ্গে গেয়ে উঠল, ‘লুকিয়ে থাকি আমি পালিয়ে বেড়াই, ভয়ে ভয়ে কেবল তোমায় এড়াই—’

এবার কেউ হাসল না। রতনের গানে সবাই হাততালি দিয়ে উঠল।

খেলা বেশিক্ষণ চলল না। মালতী যখন গাইছে, ‘ওলো রেখে দে, সখী রেখে দে, মিছে কথা ভালোবাসা’—সেই সময় ডাঃ সেন একটু ব্যস্ত ভাবে এসে বললেন, তোমাদের ডিসটার্ব করছি, খুব দুঃখিত। রতনকে একটু উঠতে হবে। রতন, একদল লোক এসে গেটের ওপর ভিড় করেছে। একটা মেয়েকে সাপে কামড়েছে, তুমি যাবে, না আমি যাব?

আমিই যাচ্ছি, স্যার।

গেটের কাছে একটি ছোট্ট জনতা। গান থামিয়ে সবাই সাপে কামড়াবার গল্পটা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। রান্নাঘরে ভাতের হাঁড়ির মধ্যে সাপটা ঢুকে বসেছিল। সবে তিনমাস বিয়ে হয়েছে নতুন বউয়ের। হাঁড়িতে যেই হাত দিয়েছে—

প্রতিমা দেবী বললেন, এই একটা ব্যাপার তো এখানে লেগেই আছে। লোকগুলোও এমন, সাপ দেখলেও মারবে না। বলে, মা মনসার জীব….সাপে কামড়ালে বলবে মা মনসার দয়া—তা হলে আবার ডাক্তার ডাকা কেন বাপু?

মোমের কলকাতার বান্ধবীদের মধ্যে থেকে একজন একটু ভয়ার্ত ভাবে বলল, রাত্তির হয়ে গেছে, এখন আর সাপ বলবেন না। বলুন লতা—

কে রে মেয়েটা? একেবারে কাঠ বাঙাল দেখছি।

এরপর আর গান জমে না। রতন ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে চলে গেল। অনেকে নানান সাপের গল্প শুরু করল। নানান ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গেল আবার আড্ডাটা। মালতী উঠে গিয়ে একটু দূরে সাবিত্রীর সঙ্গেই কথা বলছিল। সাবিত্রী বেশ বিদূষী মহিলা। সংস্কৃত আর বাংলা বই অনেকে পড়েছেন, দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বেশ ধারণাও আছে। সাধারণ বড়লোকের ঘরের বউরা যেমন হয়, আমুদে, হুজুগে, নিজের আত্মীয়-বন্ধু আর সিনেমাজগৎ ছাড়া কোনও বিষয়েই উৎসাহ নেই, সাবিত্রীকেও সেই রকমই ভেবেছিল মালতী, কিন্তু এখন কথা বলে অবাক হয়ে গেল। সাবিত্রী বলছিলেন, জানো ভাই, ছেলেবেলা থেকেই আমার একটা বদ অভ্যেস, খুব সাদা ধপধপে সরু চালের ভাত না হলে আমি খেতে পারি না। মোটা কি কাঁকর থাকলে আমার মুখে কিছুতেই রোচে না। এখনও আমার জন্য বাড়ির কত্তারা সেই চালই যোগাড় করে আনে, কিন্তু আমার কী রকম অপরাধী অপরাধী লাগে। কত মানুষ একবেলা একমুঠো ভাতও পাচ্ছে না এখন—তাদের নিশ্বাস কি আমাদের গায় লাগছে না? সামনে আরও দুর্দিন আসছে, আমি বুঝতে পারি, এইসব মানুষগুলো হয়তো একদিন মরিয়া হয়ে উঠবে। সেদিন আমার দেওরের সঙ্গে অরুণবাবু তর্ক করছিলেন।

কে তর্ক করছিলেন?

ওই যে অরুণ চ্যাটার্জি, নতুন প্রোফেসর—আমার দেওরের সঙ্গে কলেজে পড়ত, আমি ওদের তর্ক শুনছিলুম। অরুণবাবু বলছিলেন আরও দুর্দিন আসবে, আরও মানুষ মরবে, তারপর মরতে মরতে মানুষ যখন মৃত্যুটাকে তুচ্ছ করে দেখতে শিখবে, সেই সময়ই সবাই এক সঙ্গে মিলে রুখে দাঁড়াবে। তখন যে ঝড় উঠবে, তাতে আমরা কোথায় ভেসে যাব তার ঠিক নেই, রাশিয়ায় যেমন হয়েছিল।

অরুণবাবু কি কমুনিস্ট নাকি?

কেন, তা হলে তোমার বরকে বলে ওকে গ্রেফতার করাবে নাকি?

মালতী হাসতে হাসতে বলল, আমার বর এসব ব্যাপারে আমার কথা একদম শোনে না। আমার কথায় কেউ গ্রেফতারও হবে না, কেউ ছাড়াও পাবে না। আমি ভাবছিলুম, আমার স্বামী যদি হঠাৎ ওকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হন, তা হলে ব্যাপারটা কী রকম হবে! এমনিতে চেনাশুনো, অথচ চাকরির জন্য—

আজকাল কে কমুনিস্ট নয়? ক’জনকে গ্রেফতার করবে? তা ছাড়া অরুণ ছেলেটি ভালো। ওর কথা আমার তো বেশ মনে লেগেছে।

ও কী, আপনিও বুঝি কমুনিস্ট হচ্ছেন?

আমি তো ক্যাপিটালিস্টের বউ গো! আমায় কি আর ওরা দলে নেবে? সাবিত্রী ঘাড় ঘুরিয়ে কাছেই অরুণকে দেখতে পেলেন। তাকে ডেকে বললেন, কী, একা-একা ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন? এদিকে আসুন না!

অরুণ ওদের দিকে এগিয়ে এল। এসে বলল, আপনি আমাকে আপনি বলছেন কেন? আমাকে তুমি বলবেন। আপনি বরুণের বড় বউদি। বরুণ আর আমি তো এক বয়সি।

আচ্ছা বেশ। এই মালতীকে তোমার কথাই বলছিলুম। তুমি কিন্তু এদের কাছ থেকে দূরে দূরে থেকো।

অরুণ চমকে উঠে বলল, কেন?

তুমি যে-সব কথাবার্তা বল, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব কোনদিন তোমায় গ্রেফতার করেন, তার ঠিক কী! আগে থেকে ম্যাজিস্ট্রেট আর তার গিন্নির সঙ্গে বেশি ভাব হয়ে গেলে তখন আরও কষ্ট হবে!

অরুণ হাসতে হাসতে বলল, না, না, তা কেন? রজতবাবু খুব ভালো লোক।

ভালো লোক হলেই বা, ওঁর কর্তব্য তো ওঁকে করতেই হবে। মালতী তো বলেই দিয়েছে, তোমাকে গ্রেফতার করা হলে মালতী তোমায় ছাড়াতে পারবে না।

মালতী আর্তভাবে বলল, ও কী? ও কথা আমি কখন বললুম?

অরুণ সঙ্গে সঙ্গে হেসে বলল, সে রকম দায় আমি চাইবই বা কেন?

এই সময় মোম এসে বলল, সাবিত্রী মাসি, তোমার বাড়ি থেকে তোমাকে টেলিফোনে ডাকছে।

সাবিত্রী ঘুরে ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা গল্প করো, আমি আসছি। মোম তোদের টেলিফোনটা কোন ঘরে? চল, দেখিয়ে দিবি।

মালতী আর অরুণ এবার একা। দুজনে চুপচাপ। অরুণ ভাবল, সে কি এখান থেকে চলে যাবে এক্ষুনি, আর একটিও কথা না বলে? মালতী ভাবল, দুজনের এরকম দাঁড়িয়ে থাকা কি খারাপ দেখাচ্ছে না? সে কি এখান থেকে সরে যাবে, আর একটিও কথা না বলে? দু’জনের কেউই কিন্তু গেল না, দু’জনেই দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে—অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে। অতীব অস্বস্তিকর এই দাঁড়িয়ে থাকা। মালতীই প্রথম কথা বলল, আপনার ছাতাটা আমাদের বাড়ি ফেলে এসেছেন।

অরুণ সংক্ষেপে বলল, হ্যাঁ।

আপনি নিজেই গিয়ে নিয়ে আসবেন? না, কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব?

কাউকে দিয়ে পাঠালেও হয়, কিংবা আমিই কোনও লোক পাঠিয়ে আনিয়ে নেব।

আপনার মা এখন কেমন আছেন?

মা গতবছর মারা গেছেন।

ও।

আবার সেই নিস্তব্ধতা। আবার সেই চোখ ফিরিয়ে থাকা অস্বস্তি। বাগানভর্তি মানুষ। সবাই দল বেঁধে গল্প করছে, হাসছে। সবাই সহজ স্বাভাবিক, শুধু এই দু’জন মুখোমুখি নীরবে দাঁড়িয়ে। এবার অরুণেরই প্রথম কথা বলা উচিত। মালতী সেখান থেকে চলে যাবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছে, সেই সময় অরুণ বলল, তোমরা এখানে আছ জানলে আমি এখানকার চাকরিটা হয়তো নিতাম না।

মালতী অরুণের দিকে এবার তাকাল। একটুও বদলায়নি। সেই ফরসা লম্বাটে মুখ, চোখের দৃষ্টি সেই রকম উজ্জ্বল, ঠিক সেই রকম অভিমানী কণ্ঠস্বর, এমনকী চশমাটাও সেই তখনকার। মালতীর সবই খুব চেনা। মালতী বলল, তাতে কী হয়েছে! তাতে কোনও দোষ হয়নি।

না, তুমি যে বললে—

কী বললুম!

আমার সঙ্গে দেখা না হলেই তোমার ভালো হত।

কখন বললুম?

ওই গানের মধ্যে!

গান কি কেউ মনে ভেবে গায়? তা হলে তুমি যেটা গাইলে?

অরুণ উত্তর দিল না। মালতী আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি আমার ওপর এখনও অভিমান করে আছ?

না।

রাগ?

না।

এই তো ভালো। আমি তো আর সেই মালতী নেই, আমি বদলে গেছি, আমি এখন অন্য একজন। আমি তো সেই অসুখে মরে যেতেও পারতাম। মনে করো, আমি মরেই গেছি—এ একটা অন্য মেয়ে।

অরুণ এবার কোনও উত্তর দিল না। মালতী উত্তরের প্রতীক্ষায় তাকিয়ে আছে একটু যেন বেশি উৎসুক ভাবে। মালতী আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি আমার একটা কথার উত্তর দেবে? একেবারে সত্যি উত্তর?

কী কথা?

এদিকে মোম আবার ফিরে এসেছে। ছেলেমানুষি অভিমানের সুরে বলল, সবাই আলাদা আলাদা গল্প করছে, আমার সঙ্গে কেউ কথা বলছে না। অথচ আমারই তো আজ জন্মদিন!

মালতী হাসতে হাসতে বলল, ওমা, সে কী! তোমার সব বন্ধুরা কোথায় গেল?

ওরা তো চলে গেল। ওদের কলকাতায় ফিরতে হবে না?

ইস, কখন গেল? ভালো করে আলাপ করাই তো হল না। ওদের মধ্যে একটি মেয়ে কী সুন্দর গান গাইছিল ‘নীরবে থাকিস, সখী—’ এই গানটা!

মানসী তো? ও সত্যিই খুব ভালো গায়, সুচিত্রা মিত্র’র কাছে গান শেখে।

তুমিও গান শেখ না মোম?

উঁহু। আমার ভালো লাগে না।

এবার অরুণ বলল, কিন্তু তুমিও তো ভালো গাইছিলে। তোমার বেশ সুরেলা গলা।

প্রশংসায় ভ্রূক্ষেপ করল না মোম। ঠোঁট উলটে বলল, ধুৎ! আমার ইচ্ছে ছিল নাচ শেখার।

তাই শিখলে না কেন?

শিখেছিলুম তো কিছুদিন, তারপর মন বসল না। তারপর পাগল হয়ে গেলুম।

তার মানে?

ওমা, আপনাদের কেউ বলেনি বুঝি? আমি তো একবছর পাগল হয়ে ছিলুম! ছ’মাস কালিম্পং-এর একটা মেন্টাল হোমে ছিলুম।

যাঃ, কী বাজে কথা বকছ।

সত্যি! হায়ার সেকেন্ডারি দেবার ঠিক আগে, মাথাটা একদম খারাপ হয়ে গিয়েছিল—লোককে কামড়াতে যেতুম, চেঁচাতুম—

ধ্যাৎ! পাগল হলে সেরে যাবার পর আবার ওসব কথা কারওর মনে থাকে নাকি?

আমার কিন্তু সব মনে আছে।

মালতী বলল, চলো মোম, আমরা বাড়ির ভেতরে যাই। এখানে এখন একটু শীত-শীত লাগছে।

দাঁড়ান না, এখানেই তো বেশ ভালো লাগছে।

তা হলে তুমি অরুণবাবুর সঙ্গে গল্প করো, আমি ভেতরে যাই। অরুণবাবু, আপনি একটু এখানে থাকুন।

না মালতীদি, তুমিও দাঁড়াও।

মোম দু’হাতে মালতীকে জড়িয়ে ধরেছে যাতে সে না চলে যায়। মালতী হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা, আচ্ছা, দাঁড়াচ্ছি। অরুণও স্মিত হেসে মালতীকে বলল, এমন কিছু ঠান্ডা নেই, আপনি একটু এখানে দাঁড়িয়েই যান।

মালতী বলল, মোম, আজ তোমার জন্মদিন, আজ তোমার কত বছর বয়স হল?

একুশ।

একুশ? বাবাঃ, তা হলে তো তুমি সাবালিকা হয়ে গেছ।

সাবালিকা হলে কী হয়?

অরুণ হঠাৎ হেসে উঠল। ওরা দুজনেই তাকাল অরুণের দিকে। মালতী জিজ্ঞেস করল, আপনি হাসলেন কেন?

অরুণ হাসতে হাসতেই উত্তর দিল, এর আগে আমি কোনও সাবালিকা মেয়েকে এ প্রশ্ন করতে শুনিনি যে, সাবালিকা হলে কী হয়? মোমকে বয়সের তুলনায় কিন্তু অনেক ছোট দেখায়। মনেই হয় না ওর একুশ বছর বয়স।

মোম বলল, বুঝেছি, বুঝেছি, আপনি কী বলতে চান! আপনি বলতে চান বয়সের তুলনায় আমি এখনও খুব ছেলেমানুষ, এই তো?

আশ্চর্য, এটা তো ঠিক বুঝতে পেরেছ!

ইয়ার্কি হচ্ছে আমার সঙ্গে? আমাকে ছেলেমানুষ বলা হচ্ছে?

আচমকা মোম অরুণের একটা হাত চেপে ধরে সেটা মোচড়াতে শুরু করে। অরুণ বেশ ব্যথা পায়, তার থেকেও বেশি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মোমের ছিপছিপে লম্বা শরীর, মসৃণ সুচারু মুখ, সদ্য প্রস্ফুটিত যুবতী, কিন্তু আয়ত চোখ দুটিতে সম্পূর্ণ শিশুর চাহনি। হলদে আর কালো ডোরাকাটা একটা শাড়ি পরেছে মোম। তাতে তাকে হঠাৎ অরণ্যের সাবলীল চিতাবাঘ বলে এক-একবার ভ্রম হয়। অরুণের হাতখানা মুচড়ে ধরে সে তাকে অসহায় করে ফেলেছে। তার হাতের পাঞ্জাটা প্রায় মোমের বুকের কাছে। অরুণ অসহায় ভাবে মালতীর দিকে তাকাল। মালতী তখন সে জায়গা থেকে চলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। মোম বলল, এবার, এবার কেমন লাগে?

অরুণ বলল, ছাড়ো, ছাড়ো ছেলেমানুষ হওয়া তো ভালোই—ওই দ্যাখো তোমার মালতীদি চলে যাচ্ছেন।

সঙ্গে সঙ্গে হাত ছেড়ে দিয়ে মোম ছুটে গিয়ে মালতীকে ধরল, ও কী, চুপি চুপি চলে যাচ্ছেন যে?

মালতী হাসিমুখে বলল, তোমরা দুজনে গল্প করো না, আমি একটু ভেতরে যাই।

না!

মালতীকে ফিরে আসতেই হল। অরুণ নিজের হাতকে যত্ন করতে করতে বলল, ইস, ব্যথা করে দিয়েছ একেবারে।

আর আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করবেন?

সত্যিই আমি ইয়ার্কি করিনি। ছেলেমানুষ থাকা তো কত ভালো। আমরা কত তাড়াতাড়ি বুড়োটে হয়ে যাই।

এখন চালাকি করা হচ্ছে। ওসব আমি খুব বুঝি। আমি মোটেই ছেলেমানুষ নই। রেগে গেলে আমি এমন কাণ্ড করি! একবার আমাদের বাড়ির একটা চাকরের চোখ কানা করে দিয়েছিলুম।

সে কী?

সরল নিষ্পাপ মুখ তুলে মোম বলল, সেটাও শোনেননি বুঝি? সেটা নিয়ে তো এখনও সবাই এখানে গল্প করে! এই তো সেদিনও বিকেলবেলা আমি গঙ্গার পাড়ে গিয়েছিলুম। কয়েকটা ছেলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছিল, ওই যে সেই মেয়েটা, চোখ কানা করে দিয়েছিল।

কেন করেছিলে কেন? তখন কি তুমি…

না, তখন আমি পাগল ছিলুম না। তখন আমি ভালো হয়ে গেছি। এই তো দেড় বছর আগে আমাদের একটা চাকর ছিল, নিতাই….ভারী অসভ্য! আমি বাথরুমে চান করতে গেলে রোজ ফুটো দিয়ে দেখত….একদিন দু’দিন না, প্রত্যেক দিন।

অরুণ আর মালতী চোখাচোখি করল। দু’জনেই এক সঙ্গে বলল, চলুন, এবার ভেতরে যাওয়া যাক।

দাঁড়ান না, তারপর শুনুন…..

মালতী এবার একটু জোর দিয়েই বলল, না মোম, আমাকে ভেতরে যেতে হবে। বাড়িতে একটা টেলিফোন করে দেখি উনি এলেন কিনা, এখনও কলকাতা থেকে ফিরলেন না।

শুনতে এক মিনিট লাগবে।

মোম এসব ব্যাপার নিয়ে বেশি লোকের কাছে গল্প করতে নেই।

মোম মুখভরা হাসির সঙ্গে বলল, এ শহরের সব্বাই জানে! খুব হইচই হয়েছিল তখন। আপনারা নতুন তো, তাই জানেন না। বেশি লোককে তো বলছি না, শুধু আপনাদের দুজনকে….নিতাইটা রোজ ওই রকম ফুটো দিয়ে দেখত তো—-

অরুণ বলল, মোম, আমি আর শুনতে চাই না।

মোম দু’হাত দিয়ে মালতীকে আর অরুণকে ধরে হুকুম করা গলায় বলল, হ্যাঁ, শুনতেই হবে!….তারপর আমি একদিন উলবোনার কাঁটা নিয়ে গিয়েছিলুম বাথরুমে। তারপর—

অরুণ বলল, তারপর সেই কাঁটাটা নিতাইয়ের চোখে ফুটিয়ে দিলে, এই তো? বুঝতে পেরেছি। চলো, এবার ভেতরে যাই।

মা পরে বলেছিলেন, ওরকম না করে নিতাইয়ের নামে নাকি আমার নালিশ করা উচিত ছিল। তাতে কী হত, বলুন? এক চোখেও তো মানুষ দেখতে পায়। নিতাইয়ের মতো পাজি লোকের একটা চোখ থাকাই যথেষ্ট নয়? তা ছাড়া আমার মুখের কথা কি কেউ বিশ্বাস করত? সন্তুমামা যেদিন আমায় জড়িয়ে ধরে…

অরুণ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ওটা কী এখানে? সাপ?

মালতী আর মোম দুজনেই চমকে ছটফটিয়ে উঠল। অরুণ হাসতে হাসতে বলল, না, সাপ নয় দড়ি। আমাদের গল্প তা হলে আজ এই পর্যন্তই থাক। মোম, তোমার জন্মদিনে কিছু খাবার দেবে না? আমার তো বেশ খিদে পেয়েছে।

ইস, ওরকম ভয় দেখান কেন?

আমি সত্যিই সাপ ভেবেছিলুম। যা সাপের গল্প শুনি এখানে।

মোম বলল, অনেক খাবার আছে, চলুন। আপনি আইসক্রিম ভালোবাসেন?

তিনজনে বাড়ির দিকে এগোল। বাগান প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে, অনেকেই বাড়ির মধ্যে চলে গেছেন। প্রতিমা দেবীও ওদের ডাকতে আসছিলেন। বারান্দা থেকে তিনি মোমের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বললেন, মোম, তোর সন্তুমামা এসেছে, তোকে খুঁজছে। দ্যাখ, কী সুন্দর মুক্তোর দুল প্রেজেন্ট এনেছে তোর জন্য।

মোম একবার ইঙ্গিতময় চোখে অরুণ আর মালতীর দিকে তাকাল। না-বলা গল্পের জন্য বেদনা যেন রয়ে গেছে সেখানে, পরমুহূর্তেই আনন্দে উদ্ভাসিত মুখে বলল, মুক্তোর দুল? দেখি তো! মোম ছুটে এগিয়ে গেল।

ধীর পায়ে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে অরুণ খুব নিচু গলায় বলল, তুমি আমাকে কী জিজ্ঞেস করবে বলছিলে?

এখন আর হবে না।

আর কখনও কি হবে?

না হয় নাই হল। আমাদের দুজনের আর দেখা না হওয়াই ভালো। আমি তো আর সে মালতী নই। তুমি আর আমার সঙ্গে দেখা করার কোনও চেষ্টা কোরো না।

একটা জিনিস তুমি ভুল কোরো না মালতী। তোমার বিয়ের পর তোমার সঙ্গে আমি কোনও দিন নিজে থেকে দেখা করতে চাইনি। কোনওদিন জোর করে দেখা করতে চাইবও না, তুমি আমায় ক্ষমা করো।

মালতী আহতমুখে অরুণের দিকে চাইল। অরুণ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আছে, মালতী বলল, আমারই তো তোমার কাছে ক্ষমা চাইবার কথা।

অরুণ বলল, থাক ও কথা।

বারান্দায় প্রতিমা দেবী তখনও দাঁড়িয়েছিলেন। ওরা দুজনে উঠে আসতেই তিনি বললেন, কই, রজতবাবু এখনও এলেন না?

ভাবছি, বাড়িতে একটা টেলিফোন করব, যদি কোনও খবর দিয়ে থাকেন, হয়তো আজ ফিরবেন না।

আরে, ওই তো!

গেটের কাছে একখানা জিপগাড়ি এসে দাঁড়াল, রজত নামলেন তার থেকে। মালতী সেদিকে তাকিয়েই চকিতে একবার অরুণের মুখের দিকেও দেখে নিল। অরুণের মুখখানা একটু থমথমে। অরুণ আর দাঁড়াল না, বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।

রজতের চেহারা ক্লান্ত, বিধ্বস্ত; তবু ক্ষমাপ্রার্থী। হাসিমুখে বললেন, মাপ করবেন প্রতিমা দেবী, ঠিক সময় আসতে পারলুম না। সারাদিন বড্ড ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে, একটা হেকটিক ডে গেল। সোজা আপনার এখানে আসছি—আপনার বাথরুমটা একটু ব্যবহার করব, হাত-পা না ধুলে…..তারপর যা খিদে পেয়েছে, বেশি করে রেখেছেন তো! না সব শেষ?

আপনি মুখ-টুক ধুয়ে আসুন। এখনও আরম্ভই হয়নি। আপনার জন্যই সবাই অপেক্ষা করছে।

কী সৌভাগ্য আমার! মালতী, কখন এসেছ?

সেই বিকেলবেলা! পাঁচটার সময়। তুমি চট করে ঘুরে এসো।

ভেতরে হলঘরে দু-তিনটে টেবিল জোড়া করে তার ওপর নানান খাবার সাজানো। খালি প্লেট রাখা আছে, যার যা ইচ্ছেমতন তুলে নিচ্ছে। এখানেও ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সবাই গল্পে মত্ত। অরুণ আর কোনও দলে গিয়ে মিশল না, খাবারও নিল না। একটা সিগারেট ধরিয়ে বাইরের দিকের জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। দেখার তো কিছু নেই। খানিকটা ঝাপসা নীল আকাশ, ক্যানালের এক অংশ, রাস্তা দিয়ে ক্বচিৎ মানুষের আনাগোনা—অরুণ সেদিকেই চেয়ে রইল। তার মুখের চামড়া আর চোখের চারপাশ জ্বালা করছে। মাঝে মাঝে তার এই রকম হয়। তখন শরীরটা ঝাঁ-ঝাঁ করতে থাকে—অনবরত চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিলেও কমে না। অনেকক্ষণ মরুভূমির মধ্যে দিয়ে একলা মানুষ হাঁটলে হয়তো তার এই রকম হয়। অরুণ রুমাল বার করে মুখ মুছল—রুমালের স্পর্শে যেন আগুন, আর জ্বালা। অরুণ জানলার আরও কাছে মুখ এনে ঠাণ্ডা হাওয়া লাগাতে চাইল।

পিছন থেকে মোম এসে বলল, বাইরে কী দেখছেন? এদিকে দেখুন।

অরুণ ফিরে তাকাল। কানে মুক্তোর দুল দুখানি পরে এসেছে মোম। একটা হাত তুলে দেখিয়ে বলল, সন্তুমামা দিয়েছে। খুব সুন্দর না? আমাকে মানিয়েছে?

অরুণ নম্র গলায় বলল, খুব ভালো মানিয়েছে। মোম, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *