সুখ অসুখ – ১০

দশ

রজতের ছুটির দরখাস্তের উত্তর এসে গেছে। সামনের মাসের দু-তারিখে তিনি রিলিজড হবেন। এখনও ন-দিন বাকি, কিন্তু মহা উৎসাহে মালতী এর মধ্যেই জিনিসপত্র গুছোতে শুরু করেছে। মালতীর পরিকল্পনা, প্রথমে কলকাতায় গিয়ে দিন তিনেক থাকবে, তারপর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়বে জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, ত্রিপুরার দিকে। অনেকদিন সমুদ্র আর নদী দেখেছে, এবার তার পাহাড় আর জঙ্গল দেখার ইচ্ছে। বিয়ের পরই পুরীতে গিয়েছিল কিছুদিন, তারপর এই নদীর পাড়ে অনেকদিন কাটল, নদীপাড়ের জীবন তার আর ভালো লাগছে না, জঙ্গলের রহস্য আর পর্বতের উচ্চতা দেখার জন্য তার মন ছটফট করছে।

শরীরটায় আবার একটু গোলমাল যাচ্ছে কদিন ধরে। রজতকে কিছু বলেনি, রজত তা হলে আবার ব্যস্ত হয়ে উঠবে। শরীরটা কিছুদিন এত ভালো হয়ে উঠেছিল যে, রক্ত চনমন করে লেগেছে সারা দেহে। হঠাৎ আবার এই মন্থরতায় তার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। তার অসুখ কি আবার ফিরে আসবে? আবার অসুখ হলে মালতী ঠিক আত্মহত্যা করবে, মালতী ঠিক করে রেখেছে। আগে থেকেই শরীর খারাপের কথা বলে সে রজতের মন খারাপ করতে চায়নি। শরীর উপেক্ষা করে সে মনের খুশি বজায় রাখতে চায়।

ছুটির পর ডায়মন্ডহারবারেই আবার ফিরতে হবে কিনা, তা এখনও ঠিক হয়নি। তবু মালতী কিছু কিছু পুরনো ফার্নিচার বিদায় করতে চায়। সে বইগুলো প্যাক করে কলকাতায় পাঠাতে শুরু করেছে। কয়েকটা পুরনো শাড়ি দান করে দিচ্ছে ধোপানি আর মালির বউকে। রেকর্ড প্লেয়ার খারাপ হয়ে আছে কদিন ধরে, ওটা আর সারাবার দরকার নেই। মালতীর ইচ্ছে, ওটাকে বাতিল করে এবার একটা রেডিয়োগ্রাম কিনবে।

অরুণ চলে যাবার পর রজত কয়েকদিন একটু বিমর্ষ হয়েছিলেন। একটা অকারণ অপরাধ-বোধ তাঁকে পেয়ে বসেছিল। মালতীকে তিনি সব বলেছিলেন। মালতী আন্তরিক ভাবে রজতের হাত ধরে বলেছিল, ঘটনাটা খুব দুঃখের, কিন্তু এতে তোমার সত্যিই কোনও দায়িত্ব নেই, তুমি মন খারাপ করছ কেন?

রজতের কাজের চাপ একটু কম। যেমন হঠাৎ হয়েছিল গণ্ডগোল, তেমনই হঠাৎ আবার শান্ত হয়ে গেল সব। স্কুল-কলেজ আবার খুলছে, স্বাভাবিক হয়ে গেছে জীবন। কদিন সন্ধ্যাতেই ওদের দুজনকে ভদ্রতা রক্ষা করার জন্য বেরোতে হচ্ছে। ওরা চলে যাবে শুনে পরিচিতরা প্রতিদিনই নেমন্তন্ন করে খাওয়াচ্ছে।

সেদিন বিকেল-বিকেলেই রজত অফিস থেকে বাড়ি এলেন। মালতীকে বললেন, চলো, আজ একটু গঙ্গা দর্শন করে আসি।

মালতী আলমারির সব জিনিস বার করে ফেলে আবার নতুন করে গোছাচ্ছিল। বলল, হঠাৎ তোমার ধর্ম করার দিকে মন গেল নাকি।

রজত বললেন, তা ধর্ম নিয়ে মাতলেও মন্দ হয় না। এতকাল গঙ্গার পাড়ে রইলুম, একদিনও কিন্তু গঙ্গা স্নান করা হল না।

তুমি এই বিকেলবেলা গঙ্গায় নামবে নাকি?

পাগল হয়েছ! চলো, একটু বেড়িয়ে আসি। গঙ্গার পাড়ে বেড়াতে কিন্তু আমার বেশ ভালোই লাগে। চলো, চলো, শিগগির তৈরি হয়ে নাও।

এক্ষুনি যাব কী? সব কিছু এলোমেলো ছড়ানো।

ওসব এসে হবে। আর সময় পাব না। কাল নেমন্তন্ন, পরশু নেমন্তন্ন—আর সময়ই পাব না। চলো, দুজনে মিলে আজ একটু বেড়িয়ে আসি নিরিবিলিতে।

শহর ছাড়িয়ে গাড়ি এসে পড়ল ফাঁকা রাস্তায়। মালতীর শরীরটা একটু ম্যাজম্যাজ করছে, কিন্তু হু-হু করা বাতাসে শরীর ধুয়ে নিয়ে মনটাকে উন্মুক্ত করে দিল। একটু নির্জন দেখে সে মাথা হেলাল রজতের কাঁধে। রজত বললেন, তুমি গাড়ি চালানোটা শিখে নিলে পারতে। যদি কখনও হঠাৎ দরকার হয়—

হঠাৎ আবার কী দরকার হবে?

ধরো, মাঝ রাস্তায় যদি কখনও আমার খুব শরীর খারাপ হয়।

তোমার তো কখনও শরীর খারাপ হতে দেখিনি।

কথাটা বলেই মালতী সিট ছুঁয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, টাচ, উড। খুব শখ বুঝি তোমার শরীর খারাপ করার?

দু-একবার অসুখ হলে খুব খারাপ হত না। তোমার হাতের সেবা অন্তত পেতুম।

এই, আমি বুঝি কখনও তোমার সেবা করি না। কে তোমার জামা ইস্তিরি করে দেয় শুনি?

ওসব বাদ দাও, নিজে থেকে কখনও আমাকে একটু আদর করেছ?

করিনি?

কোনওদিন না!

মালতী চেঁচিয়ে উঠল, এই, এই, কী করছ, সামনে তাকাও! অ্যাকসিডেন্ট করবে এক্ষুনি। কী অসভ্যতা করছ ছেলেমানুষের মতন!

রজত স্টিয়ারিং ছেড়ে দু’হাতে মালতীকে জড়িয়ে ধরেছেন। গাড়িটা মাতালের মতন লটপট করতে লাগল। মালতীকে ভয় দেখিয়ে রজত অত্যন্ত মজা পেতে লাগলেন।

একটা ছাতার মতো সুন্দর পাকুড় গাছের পাশ দিয়ে গাড়িটা যাবার সময় মালতী বলল, এইখানে থামাও, এখানে একটু বসি। বেশ সুন্দর জায়গাটা!

জায়গাটা সত্যি মনোরম। গঙ্গা এখানে খুব চওড়া হতে হতে মাঝপথে বাধা পেয়েছে, মাঝখানে একটা দ্বীপের মতন ভেসে উঠেছে। দূর থেকে জলের ওপর একটা ছড়ানো সবুজ আলোয়ানের মতন সেটাকে দেখায়। পাকুড় গাছটার নীচে একটা বড় পাথরের চাঁই—বেশ পরিচ্ছন্ন, তকতকে, সিংহাসনের মতন মনে হয়। কাছেই একটা কেয়া গাছের ঝোপ। রোদ্দুরের তেজ মরে গেছে, কিন্তু আলো এখনও স্পষ্ট। দুজনে ওই পাথরটার ওপরে বসল গঙ্গার দিকে মুখ ফিরিয়ে। বহুদূরের সমুদ্র থেকে এই নদীপথ ঘুরে হাওয়া আসছে। এই হাওয়ায় একটা বিচিত্র মাদকতা, যেন বহুদূরের গন্ধ পাওয়া যায়। একটু বাদেই সন্ধ্যা হবে। নদীর পশ্চিম দিকে তাকালে এখনই বিশাল সূর্যাস্ত দেখা যাবে। কিন্তু নদী তীরের সূর্যাস্ত মালতী আর দেখতে চায় না, সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসল। আশেপাশে অনেক দূরে কোনও বাড়ি-ঘর নেই, শুধু মাঝে মাঝে বড় রাস্তা দিয়ে বাস আর গাড়ি যাচ্ছে। যাত্রীরা ওদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, যতক্ষণ দেখা যায়।

রজত বললেন, মিলু, একটা গান করো না আস্তে আস্তে।

কী গান বলো?

‘তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম’—অনেকদিন গাওনি।

ওই গানটার কথা শুনে মালতী একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। তারপর বলল, না, ওটা নয়। ও গানটা পুরুষদের গলাতেই ভালো মানায়। তার চেয়ে বরং সেইটা—কোনটা বলো তো?

রজত মালতীর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন। তারপর হেসে আর গানের কথাটা উচ্চারণ করলেন না, নিজেই গুনগুন করে সুর ধরলেন। সেই সুরের সঙ্গে মিলিয়ে মালতী একটু উঁচু স্কেলে গাইল ‘চিরসখা হে, ছেড়ো না।’ গানটা শেষ হতে রজত বললেন, এটা তোমার খুব প্রিয় গান, না? এটা কবে শিখেছিলে?

কলেজে যখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। রাজেশ্বরী দত্তর মুখে একবার শুনেছিলাম। এই গানটা গাইলেই আমার কী রকম যে কান্না-কান্না পায়। খুব সুখেও মানুষের কান্না পায়, তাই না! তবে, এই গানটা আমার আর সে-রকম গাইতে ইচ্ছে করে না, এটা আমার গত জন্মের গান!

গত জন্ম আবার কী?

তোমার সঙ্গে দেখা হবার আগে আমার যে জন্মটা ছিল। তারপর তো তুমি আমাকে নতুন একটা জন্ম দিয়েছ।

আর ওকথা বোলো না। এটা যেন কী রকম কৃতজ্ঞতা কৃতজ্ঞতা শোনায়!

মালতী বিচিত্রভাবে হেসে রজতের দিকে চাইল। রজত দুষ্টুমি করে মালতীর দিকে একটা চোখ টিপে দিলেন। তারপর হাত বাড়িয়ে ওর কোমরটা জড়িয়ে ধরতে যেতেই মালতী ছটফট করে উঠে বলল, আঃ, তুমি কী যে করো! রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে! তোমার ব্যবহার দেখলে কে বলবে আমরা স্বামী-স্ত্রী! লোকে ভাববে আমরা গোপনে প্রেম করতে এসেছি।

আমরা কোনওদিন টিপিক্যাল স্বামী-স্ত্রী হব না। আমরা প্রেমিক-প্রেমিকাই থাকব।

রজতের হাত ছাড়িয়ে মালতী উঠে দাঁড়াল। ঢালু পাড় দিয়ে একটু নেমে গিয়ে বলল, তুমি বোসো, আমি একটু জলের ধার পর্যন্ত ঘুরে আসি। একটু হাত দিয়ে জল ছুঁতে ইচ্ছে করছে।

কেন, মাথায় জল ছিটিয়ে পুণ্য সঞ্চয় করবে নাকি?

না, পুণ্যে-টুণ্যে আমার লোভ নেই। এমনিই নদী দেখলেই আমার জল ছুঁতে ইচ্ছে করে।

পারবে না যেতে শেষপর্যন্ত, ভীষণ কাদা।

থাক না কাদা, পায়ে লাগুক না।

মাঝে মাঝে পাড়সুদ্ধু ভেঙে পড়ে। যেও না মিলু, কী দরকার।

কিছু ভাঙবে না। একবার আমি বেঁচে উঠেছি, আর আমি সহজে মরব না।

শাড়িটা একটু উঁচুতে তুলে মালতী পা টিপে টিপে অনেকখানি এগিয়ে গেল। রজত উৎকণ্ঠিতভাবে তাকিয়ে রইলেন। ভাবলেন, না যেতে দিলেই ভালো হত! সত্যি পাড়-টাড় ভেঙে পড়তে পারে।

জল থেকে তখনও মালতী অনেকটা দূরে, এই সময় রজত চেঁচিয়ে উঠলেন। মালতী পিছন না ফিরেই হাসি হাসি গলায় বলল, কিছু হবে না, বেশি কাদা নেই, মাটি শক্ত আছে।

রজত আবার চেঁচিয়ে উঠলেন। মালতী এবারও তাকাল না, মৃদু ধমকের সুরে বলল, আঃ, শুধু শুধু তুমি ভয় পাচ্ছ, এই তো পৌঁছে গেলুম। আরে, কী সুন্দর ছোট ছোট লাল কাঁকড়া!

রজতের এবারের ‘মালতী’ ডাক এমনই অসম্ভব ভয়ার্ত এবং তীব্র, আর করুণ যে, দশদিক ঝনঝন করে একেবারে কেঁপে উঠল। নদীর ঢেউয়ের শব্দ, বাতাসের শব্দ, সব কিছু ছাপিয়ে রজতের সেই আকুল ডাক। মুহূর্তে মালতী মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। এতটা দূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় না। শুধু দেখা গেল, রজত দু’হাত তুলে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। কোনও কারণে অসম্ভব ভয় পেয়েছেন, মাথার চুলগুলোতে পর্যন্ত ভয়ের চিহ্ন। মালতী প্রথমে একটু অবাক হয়ে দাঁড়াল। তারপর, রজত আর একবার চেরা আড়ষ্ট গলায় তার নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠতেই সে দ্রুত ফিরে আসতে লাগল।

রজতের পায়ের কাছ থেকে তিন-চার হাত মাত্র দূরে একটা সাপ ফণা তুলে আছে। একটুও নড়ছে না, স্থির ভাবে চেয়ে আছে রজতের দিকে। কালো মিশমিশে শরীর, বুকের কাছটা সাদাটে। ওইটুকু সাপের এতবড় ফণা, দেখলেই সাক্ষাৎ যমদূত বলে মনে হয়। শেষ সূর্যের আলো পড়েছে সাপটার দেহে। রজত নড়তে পারছেন না, চোখ ফেরাতে পারছেন না, তাঁর সমস্ত জীবনীশক্তি যেন হঠাৎ শুষে নিয়েছে। গলার ভেতরটা শুকিয়ে আসছে। এরকম অসম্ভব তৃষ্ণা জীবনে কখনও বোধ করেননি।

রজত একটু নড়ার চেষ্টা করলেন, সাপটা সঙ্গে সঙ্গে দুলে উঠল। রজতের সারা শরীর সঙ্গে সঙ্গে আড়ষ্ট হয়ে গেল। অনিচ্ছা সত্বেও মুখটা কুঁকড়ে আসছে তাঁর, বুকের মধ্যে দুম দুম শব্দ। নিজেরই বুকের শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে যেন! এই কি সেই শিয়রচাঁদ?…. কত বড় ফণা! মাথা দোলানোই রাগের লক্ষণ….একটু নড়লেই….কামড়ালে আট ঘণ্টার বেশি মানুষ বাঁচে না। প্রতি মুহূর্তে রজত আরও অবশ হয়ে পড়তে লাগলেন, মুখ দিয়ে একটু কুঁ-কুঁ ধরনের বিশ্রী শব্দ বেরোতে লাগল। রজতের ইচ্ছে হল চেঁচিয়ে উঠতে, মালতী বাঁচাও! সারা পৃথিবীর কাছে আবেদন পাঠাতে চান, যে কেউ বাঁচাও, অন্তত এই একবার বাঁচার সুযোগ দাও, কিন্তু গলা দিয়ে আর স্বর বেরোচ্ছে না।

গঙ্গার বিপুল স্রোত পিছনে রেখে মালতী এগিয়ে আসছে। মালতী প্রথমটা কিছুই বুঝতে পারেনি। আসতে আসতে চার পাশে আর কোনও মানুষজন না দেখে, রজতের ওই রকম অস্বাভাবিক অবস্থায় জিজ্ঞেস করছিল, কী হয়েছে? নাকি ঠাট্টা করছ না তো?

রজতের কাছে কোনও উত্তর না পেয়ে মালতী আরও তাড়াতাড়ি আসছিল। মাত্র হাত দশেক দূরে এসে সাপটাকে দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে সেও দাঁড়িয়ে পড়ল। মুখের কাছে হাত চাপা দিয়ে কেঁদে উঠল, একী! না, না!

রজত মালতীর দিকে তাকাতে পারছেন না। সাপটার থেকে চোখ সরাতে পারছেন না। শরীরটা ঝিমঝিম করছে, মনের জোর আনার চেষ্টা করছেন, কিন্তু একটুও নড়ার সাহস পাচ্ছেন না। সাপের সঙ্গে দৌড়ে পারা যাবে না। রজতের চোখ দুটো টনটন করছে।

মালতী নিজেকে একটু সামলে নিয়ে চেঁচিয়ে বলল, নোড়ো না। একটুও নোড়ো না! আমি আসছি। মালতী এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল চকিতে। সাহায্য পাবার মতন কিছুই নেই। মালতী নিজেই এক-পা এক-পা করে এগিয়ে যেতে লাগল, আর বলতে লাগল, তুমি নোড়ো না, যেমন আছ তেমনি থাকো, আমি আসছি।

হঠাৎ রজত নড়ে উঠলেন। সাপটার দিক থেকে একমুহূর্তের জন্য মালতীর দিকে চোখ ফেরাতেই যেন তাঁর চৈতন্য একটু ফিরে এল। মালতীরও তখন যেন চৈতন্য নেই। শুধু সাপটার দিকে তাকিয়ে ভূতে-পাওয়া মানুষের মতন এক-পা এক-পা করে এগিয়ে আসছে। এতক্ষণ কোনও শব্দ শুনতে পাননি। এইবার রজত দু-তিনবার ফোঁস-ফোঁস আওয়াজ শুনতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে আবার চোখ ফেরালেন সাপটার দিকে। সমস্ত বিশ্বসংসার যেন সেই এক সাপের ফণা ও নিশ্বাসে ছেয়ে গেল। গলার একটুখানি জোর ফিরে পেয়ে রজত কোনওক্রমে চেঁচিয়ে উঠলেন, মালতী, তুমি আর এগিয়ো না, আর এগিয়ো না।

তক্ষুনি রজত পিছন ফিরে দৌড় লাগাবার চেষ্টা করলেন। মালতী কেঁদে উঠল, না, না…

রজত বেশিদূর যেতে পারলেন না। দ্রুত পেছন ফেরার ঝোঁকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। সাপটা সড়াৎ করে এগিয়ে গেল। মালতী আবার চিৎকার করল না, না….

তারপর মালতী লাফ দিয়েছিল কিংবা শূন্য দিয়ে উড়েছিল তার মনে নেই। সে চোখের পলকে ঝাঁপিয়ে পড়ে চেপে ধরেছিল সাপটার ফণাসুদ্ধু মাথা, তারপর এক ঝটকায় ফেলে দিয়েছিল দূরে। সাপটা পাকুড় গাছের নীচে পাথরের চাঁইটার ওপরে গিয়ে পড়ল। মালতী যেন সেই মুহূর্তে রজতের কথাও ভুলে গেল। তার সমস্ত জীবনের ধ্রুব শত্রুকে যেন সে চোখের সামনে দেখছে। মালতীর চোখের দৃষ্টি পাগলের মতন। এক টুকরো পাথর তুলে নিয়ে সে আবার ছুটে গেল সাপটার দিকে। সাপটা তখন পালাতে চাইছিল, যেন বুঝতে পেরেছিল, সে এক অসম প্রতিযোগিতায় নেমেছে। মালতী সেই কান্না মাখানো চিৎকারে তেড়ে গেল, পাথরের টুকরোটা দিয়ে মারল সাপটার মাথায়। সাপটা লকলকিয়ে উঠল, কালো চাকুকের মতন দেহটা বাঁকাতে লাগল অনবরত, ফণাটা তোলার চেষ্টা করল, আর মালতী হাঁটু গেড়ে বসে পাথরটা দিয়ে ওর সারা শরীরটা থেঁতলাতে লাগল, আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগল, না, না, না—

রজতই এসে মালতীকে তুললেন। মালতীর হাতটা চেপে ধরে বললেন, মিলু, কী করছ কী! ওটা তো অনেকক্ষণ থেঁতলে গেছে….মরে গেছে।

আচ্ছন্নের মতন চোখ তুলে মালতী বলল, মরে গেছে?

হ্যাঁ, অনেকক্ষণ মরে গেছে।

তোমার কিছু হয়নি তো?

না। আমায় কামড়াতে পারেনি। একবার আমার পায়ে লেগেছিল, কিন্তু বোধহয় ছোবল মারতে পারেনি। মিলু, তুমি আমায় নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছ।

বাঁচিয়ে দিয়েছি?

কী সাংঘাতিক সাপটা? ওঃ! সাক্ষাৎ যম। এগুলোর নামই শিয়রচাঁদ। ডাক্তারের কাছে পৌঁছোবার আগেই শেষ হয়ে যেতুম। মিলু, তুমি মাটিতে বসে পড়েছ কেন, ওঠো!

রজত মালতীকে টেনে তুলে জড়িয়ে ধরলেন। দুজনেরই শরীর তখন কাঁপছে। রজতের কাঁপছে একটু আগের ভয়ে, মালতীর কান্নায়। খানিকক্ষণ দুজনেই চুপ। তারপর রজত আস্তে আস্তে বললেন, বেঁচে থাকব সত্যি ভাবিনি। একটু আগে আমার মনে হয়েছিল, আজই আমার শেষ দিন।

তুমি দৌড়োতে গেলে কেন?

কী জানি! আমার মাথার ঠিক ছিল না। তা ছাড়া, না দৌড়েই বা কী হত, ও ঠিক আমাকে কামড়াতই!

না, না, না….

আছাড় খেয়ে পড়ে যাবার পর আমার ঠিক যেন মনে হল, সাপটা আমাকে কামড়ে দিয়েছে। একবার আমার পায়ে ওর ছোঁয়াও লেগেছিল। আমি মরে যাবার জন্য তৈরিও হয়েছিলাম, তারপর চোখ মেলে সেই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখলাম। মিলু, তুমিও কি মরতে চেয়েছিলে?

আমি? কেন?

ওই রকম ভাবে কেউ সাপ মারে? ওই রকম হাঁটু গেড়ে সাপটার মুখের সামনে বসে? সাপটাকে ছুঁড়ে দেবার পর মারারই বা কী দরকার ছিল? আমরা তো তখন বেঁচে গেছি! তুমি খালি হাতে সাপ ধরেছিলে! এর আগে কেউ কোনওদিন ওরকম খালি হাতে সাপের মাথা চেপে ধরতে পেরেছে বলে শুনিনি। একটা সাপ একবার একজনের বেশি দুজনকে কামড়াতে পারে না। তুমি আমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের মরার জন্য—

সত্যিই আমি ওসব কিছু ভাবিনি।

সাপটা আমাকে কামড়াতই। আমি সব বুদ্ধি বিবেচনা হারিয়ে ফেলেছিলাম। একমুহূর্তের ওদিক—আমাকে তুমি বাঁচিয়ে দিলে—আমাকে বাঁচাবার জন্য তুমি….

শুধু তোমাকে বাঁচাবার জন্য নয়, আমরা দুজনে বেঁচে থাকার জন্য….

সত্যি আমি ভাবিনি, আমি আবার বাঁচব। আগে সাপের সম্বন্ধে কত গল্প শুনেছিলাম, কিন্তু সত্যিই যে এরকম হয় বিশ্বাসই করিনি কখনও। হঠাৎ অত কাছে সাপটাকে ফণা তুলে দাঁড়াতে দেখে এমন আড়ষ্ট হয়ে গেলাম, বাঁচার কোনও পথই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তুমি এত সাহস পেলে কী করে?

কী জানি! আমারও কোনও কিছু চিন্তা করার ক্ষমতা ছিল না। শুধু ভেবেছিলাম, সাপটা তোমাকে কামড়াতে পারে না। অসম্ভব, অসম্ভব! তা হলে আমি কী করব?

মিলু, তোমাকে একবার আমি বেঁচে ওঠায় সাহায্য করেছিলাম। কিন্তু তার সঙ্গে এর তুলনাই হয় না। আমাকে তো জীবন বিপন্ন করতে হয়নি। আমার কিছু ভয় ছিল না। কিন্তু তুমি আমাকে নিজের মৃত্যুর রিসক নিয়ে—

থাক, আর বলতে হবে না।

তোমার কাছে আমি সারা জীবনটা, মানে এ জীবন এখন তোমারই। আমার পুনর্জন্ম হল আজ বলা যায়। আমি তোমার জীবন বাঁচিয়েছিলুম বলে তোমার মধ্যে একটা কৃতজ্ঞতা বোধ ছিল, কিন্তু সেটা আজ তুচ্ছ হয়ে গেল। তার সঙ্গে এর তুলনাই হয় না। এ তো আর ডাক্তার ডেকে আনা নয়! তোমার আর কোনও ঋণ নেই, আমিই ঋ ণী।

থাক। ওসব কথা আর বোলো না।

না বলে আমি পারছি না। হাত দিয়ে দ্যাখো, আমার বুকের মধ্যে এখনও কী রকম ঢিপঢিপ করছে! আমার যে এত মৃত্যুভয়, আমি জানতুম না। মিলু, তুমি আমায় কেন বাঁচালে? এতদিন তবু মনে মনে আমার একটা অহংকার ছিল, আমি তোমাকে বাঁচিয়েছি, আমি নিজের হাতে যেন তোমার নতুন প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছি, আজ কয়েক মিনিটে সে-সব কোথায় ভেসে গেল। এখন তোমার কাছেই আমি—

মালতী রজতের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল। তার চোখ দুটো কেঁপে উঠল, ঠোঁট কেঁপে উঠল, মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এল। হঠাৎ মালতী অযৌক্তিক ভাবে আবার কেঁদে উঠে মাটিতে বসে পড়ে মুখ ঢাকল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, কেন ওসব কথা বলছ? কেন…….

রজত ব্যস্ত হয়ে বললেন, ও কী, ওঠো, ওঠো! চলো, এখান থেকে চলে যাই। কেয়া ঝোপের পাশে বসা আমাদের ভুল হয়েছে? আরও দু’একটা সাপ-টাপ থাকতে পারে। ও কী মিলু, তোমার আবার শরীর খারাপ হল নাকি?

মালতী দু’হাত মুখ ঢেকে বসে রয়েছে, নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল ফুলে ফুলে। রজত তার হাত ধরে টেনে তুললেন। মালতীর সমস্ত মুখখানা কুঁকড়ে গেছে, বদলে গেছে একেবারে। শুধু বলল, আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে গো! বুকের মধ্যে খুব কষ্ট হচ্ছে এখন।

রজত বিভ্রান্তের মতন একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর মালতীর শরীরের ভার নিজের হাতে নিয়ে বললেন, ডাক্তারের কাছে যাবে? চলো, এক্ষুনি যাই!

মালতী মাথা নেড়ে শুধু বলল, না।

গাড়িতে বসেও মালতী আর কোনও কথা বলল না। শুধু মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল। রজতের নানান প্রশ্নে শুধু একবার উত্তর দিল, আমার বুকের মধ্যে খুব কষ্ট হচ্ছে। শিগগির বাড়ি চলো!

বাড়িতে ফিরে মালতী সটান এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। রজত এসে বসলেন তার মাথার কাছে। চুলে হাত দিয়ে বললেন, তোমার শরীর খারাপ লাগছে? ডাক্তার সেনকে ডাকি না টেলিফোনে। একবার এসে দেখে যান!

মালতী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না, না। রজত চুপ করে বসে রইলেন।

একটু বাদে মালতী খানিকটা শান্ত হল। চোখ মুছে রজতের দিকে তাকাল। মালতীকে যেন আর চেনা যাচ্ছে না। তার দৃষ্টি, তার মুখের সবকটি রেখা এখন অন্যরকম। অদ্ভুত ধরনের গলায় সে জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাকে ও কথাটা কেন বললে?

কোন কথাটা, মিলু?

জীবন বাঁচানোর ঋণ শোধ করা যায়?

ঋণ হিসেবে অবশ্য দেখা উচিত নয়। আমরা দুজনে দুজনের—

তুমি ও কথাটা বলার পরই হঠাৎ আমার কষ্ট হতে লাগল। আমার অনেক কথা মনে পড়ে গেল। অরুণদার কথা…..তোমাকে একটা সত্যি কথা বলব? আমি অরুণদাকে ভুলতে পারিনি। আমি বোধহয় অরুণদাকেই শুধু ভালোবাসি। আমি ভুলে থাকতে চেয়েছিলুম….

রজত ধাতু-মূর্তির স্থির ভাবে চেয়ে রইলেন। কোনও কথা বললেন না। মালতীর চোখ আবার জলে ভিজে গেল। বলল, আমি যে তোমাকে এতদিন শুধুই ঠকিয়েছি, তা নয়। বিশ্বাস করো, আমি অরুণদাকে ভুলে যাবার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলুম। আমি তাকে জীবন থেকে বাদ দেবার চেষ্টা করেছিলুম, আমি তোমাকেই আন্তরিক ভাবে….কিন্তু বটগাছের শিকড়ের মতন অরুণদার ভালোবাসা আমার জীবনে জড়িয়ে আছে। আমি পারছি না, পারছি না!

রজত ধীর স্বরে বললেন, আমি জানতুম। আমি অনেকদিন আগে থেকেই জানতুম!

মালতী হাহাকার করে উঠল, আমার মরে যাওয়াই উচিত ছিল তখন! কেন তুমি আমায় বাঁচিয়েছিলে? আমি অরুণদাকেও ঠকিয়েছি, তোমাকেও ঠকিয়েছি! আমি এখন কী করব, আমাকে বলে দাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *