সামনে সমুদ্র নীল – পরিচ্ছেদ ৮

০৮.

১৫নং ঘরের দরজা বন্ধ তখনও।

সাহুই বন্ধ দরজার গায়ে কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে চেঁচালেন, দরজাটা খুলুন, শুনছেন মশাই, দরজাটা খুলুন!

কিন্তু সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। সাহু আবার ধাক্কা দিলেন আরও জোরে।

প্রায় মিনিট তিনেক ধাক্কাধাক্তির পর ঘরের দরজা খুলে গেল।

কে? কি চাই? কিন্তু ঐ পর্যন্তই—আর কথা বেরুল না চন্দ্রকান্তর গলা থেকে!

একমাথা ঝাকড়া আঁকড়া কাঁচাপাকা এলোমেলো চুল, মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি, পরনে একটা মলিন স্ন্যাকস ও গায়ে একটা ততোধিক ময়লা ও ছেড়া গেঞ্জি। গেঞ্জিটা যে কতদিনের পুরানো ও ময়লা কে জানে!

সাহুই প্রশ্ন করলেন, কি নাম আপনার?

আপনার নাম দিয়ে কি হবে?

সাহু এবার বেশ একটু কড়া গলাতেই বললেন, যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দিন বলে চন্দ্রকান্তকে আর জবাবের অবকাশ না দিয়ে তাকে ঠেলেই যেন একপ্রকার সকলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ঘরের মধ্যে এলোমেলো একটা শয্যা, গোটা দুই ধেনো মদের শূন্য বোতল মেঝেতে গড়াচ্ছে, এখানে ওখানে মেজেতে আধপোড়া সিগারেটের টুকরো ছড়ানো।

একপাশে মেঝেতে একটা ছোট সুটকেস, দেওয়ালের আলনায় একটা ময়লা হাফ হাতা হলদে রংয়ের টেরিকটের শার্ট ঝুলছে।

সাহু আবার প্রশ্ন করলেন, কি নাম আপনার?

চন্দ্রকান্ত ঘাই। ভাঙাভাঙা কর্কশ কণ্ঠে জবাব এল।

কোথা থেকে আসেছেন?

কলকাতা থেকে।

তা কি করা হয়?

কাজকর্ম কিছু করি না, তবে পেলে করি—

কিছু করেন না!

রিটায়ার করেছি বছর কয়েক হল, রিটায়ার করার পর থেকে এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে বেড়াই।

কিরীটী একদৃষ্টে চন্দ্রকান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।

একমুখ কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ থাকলেও কেন যেন তার মনে হচ্ছিল ঐ মুখের সঙ্গে কোথায়। একটা ক্ষীণ সাদৃশ্য আছে তার দেখা কোন একটা মুখের। কিন্তু কিরীটী ঠিক যেন স্মরণ করতে পারে না ঐ মুহূর্তে।

চন্দ্রকান্ত বললে এবারে, কিন্তু এভাবে ডাকাডাকি করে আমার ঘুমটা ভাঙালেন কেন দারোগা সাহেব, বলবেন কি?

আপনার ঠিক পাশের ঘরেই একজন ভদ্রলোক ও একজন স্ত্রীলোক থাকতেন, নিশ্চয়ই জানেন মিঃ ঘাই? সাহুর প্রশ্ন।

না।

জানেন না?

না। হোটেলে উঠেছি, আজ না হয় কাল চলে যাব, আমার পাশের ঘরে কে আছে না আছে। সে খবর জেনে আমার কি হবে—আর তার দরকারটাই বা কি!

আপনার পাশের ঘরের মহিলাটিকে কাল রাত্রে কেউ হত্যা করেছে—

কি–কি বললেন—খুন?

হ্যাঁ, খুন। নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে, কিরীটী বললে। কথাটা বলে কিরীটী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চন্দ্রকান্তর মুখের দিকে। চন্দ্রকান্তর দুচোখের তারায় একটা স্পষ্ট ভীতি।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল চন্দ্রকান্ত, তারপর একটা ঢোক গিলে বলল, তা আমার কাছে কেন এসেছেন আপনারা?

কাল রাত্রে আপনি তো পাশের ঘরেই ছিলেন—

দোহাই আপনাদের, আমি কিছু জানি না।

কিরীটী ঘরের এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে, হঠাৎ প্রশ্ন করল, ঐ সুটকেসটা আপনার?

হ্যাঁ, আমার—

কি আছে ওটার মধ্যে?

জামাকাপড়, বোধ হয় একটা রামের বোতল, আর কিছু টুকিটাকি জিনিস।

দেখতে পারি?

হ্যাঁ, দেখুন না।

কিরীটী এগিয়ে গিয়ে সুটকেসের ডালাটা খুলতেই থমকে দাঁড়াল। জামা কাপড়ের ওপরে একটা তীক্ষ্ণধার রক্তমাখা ভোজালি।

এটা কার?

ভোজালি! সে কি? ওটা কোথা থেকে এল আমার সুটকেশের মধ্যে।

কিরীটী রুমাল বের করে সন্তর্পণে ভোজালিটা তুলে নিল। মিঃ সাহু, দেখুন! হেমন্ত সাহু কিরীটীর হাতের দিকে তাকালেন। মাঝারি সাইজের সুন্দর চমৎকার হরিণের শিঙেয়ের তৈরি বাঁটওয়ালা একটা ভোজালি।

কিরীটী বললে, দেখুন, এখনও রক্তের কালো দ্রাগ শুকিয়ে আছে ভোজালিটার গায়ে। আর দেখছেন–

হ্যাঁ, একটা কালো লম্বা চুল। সাহু বললেন।

আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়, তো—কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে, এই ভোজালিটার সাহায্যেই হত্যাকারী অনুরাধা দেবীকে হত্যা করেছিল।

সাহু চন্দ্রকান্তর মুখের দিকে এবার যেন পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।

চন্দ্রকান্ত স্থির পাষাণের মত দাঁড়িয়ে আছে। বিস্ফারিত দুটি চোখের দৃষ্টি স্থির, ঠোঁটটা যেন ঝুলে পড়েছে নীচের দিকে।

চন্দ্রকান্তবাবু—সাহু প্রশ্ন করলেন, এটা কার?

জানি না। শুকনো গলায় যেন ফিস ফিস করে জবাব দিল চন্দ্রকান্ত।

জানেন না?

না। একটু–একটু জল–

সাহুই এগিয়ে গিয়ে এক কোণে ছোট্ট একটা টুলের উপরে রাখা কাঁচের জাগ থেকে গেলাসে জল ঢেলে চন্দ্রকান্তর সামনে ধরলেন।

কম্পিত হাতটা বাড়িয়ে জলের গ্লাসটা নিয়ে এক চুমুকে চো চো করে সবটুকু জল পান করে নেয় চন্দ্রকান্ত, এবং তার পরমুহূর্তেই চন্দ্রকান্তর কম্পিত শিথিল হাত থেকে শূন্য কাঁচের গ্লাসটা মাটিতে পড়ে ঝনঝন করে ভেঙে গেল।

চন্দ্রকান্ত কেমন বোকা বিহুল দৃষ্টিতে তাকাল ওদের মুখের দিকে।

তা যেন হল, কিন্তু অস্ত্রটা আপনার সুটকেসের মধ্যে কোথা থেকে এল?

কি করে বলব। আমি কিছুই জানি না।

আপনি তো ঘরের দরজার চাবি নিয়ে শুয়েছিলেন?

চাবি।

হ্যাঁ হ্যাঁ, চাবি। দরজার গডরেজের তালার চাবিটা কোথায়?

কোথায় চাবিটা! কতকটা যেন স্বগতোক্তির মত চন্দ্রকান্ত উচ্চারণ করলে।

দেখুন তো, আপনার পকেটেই হয়তো আছে।

পকেটে হাত দিয়ে চন্দ্রকান্ত বললে, পকেটে? কই পকেটে তো নেই।

আরে এই তো চাবিটা, বলতে বলতে হেমন্ত সাহু দরজার একপাশে মেঝে থেকে গডরেজের চাবি তুলে নিলেন, দেখুন তো মিঃ রায়, এই চাবিটা বোধ হয়!

পরীক্ষা করে দেখা গেল ঐ চাবিটাই দরজার চাবি।

কিরীটী আবার বললে, তাহলে চন্দ্রকান্তবাবু, আপনি বলতে পারছেন না, আপনার সুটকেসের মধ্যে এই ভোজালিটা কি করে এল?

আমি আগে কখনও এটা দেখিনি, বিশ্বাস করুন। বিশ্বাস করুন আপনারা! চন্দ্ৰকান্তের গলার স্বরে করুণ মিনতি।

সাহু কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি স্থিরনিশ্চয় করে বলতে পারি মিঃ রায়, এই লোকটিই কাল রাত্রে কোন এক সময় পাশের ঘরে গিয়ে অনুরাধা দেবীকে হত্যা করেছে।

চন্দ্রকান্ত হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, না না, আমি কাউকে খুন করিনি।

সাহু উচ্চকণ্ঠে দরজার বাইরে প্রহরারত জমাদারকে ডাকলেন। রঘুনন্দন জমাদার ঘরের মধ্যে ঢুকে সেলাম দিল।

ইসকো হাতমে হাতকড়া লাগাও।

কেন কেন—আমার হাতে হাতকড়া পরাবে কেন, আমি কাউকে খুন করিনি। চন্দ্রকান্ত প্রতিবাদ জানাবার চেষ্টা করে কিন্তু তার প্রতিবাদে কর্ণপাত করা হয় না। পকেট থেকে একজোড়া হাতকড়া কথা বের করে চন্দ্রকান্তর হাতে পরিয়ে দিল জমাদার রঘুনন্দন!

যাও, একে নিয়ে নীচে অফিসঘরে গিয়ে অপেক্ষা কর রঘুনন্দন, আমরা আসছি। চন্দ্রকান্তকে নিয়ে রঘুনন্দন নীচে চলে গেল।

ভাগ্যে আপনি ছিলেন মিঃ রায়—হেমন্ত সাহু গদগদ ভাবে বললেন, খুনের ফয়সালা এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল—ঐ সুটকেস দেখার কথাটা কখনও আমার মনেই হত না।

কিরীটী বললে, আপনি সুটকেসটা ভাল করে লক্ষ্য করেননি, করলে নজরে পড়ত বন্ধ ডালাটার ওপাশ থেকে একটু কাপড়ের অংশ বের হয়েছিল—কিরীটী এগিয়ে গিয়ে একটা রক্তমাখা রুমাল তুলে বলল, এই দেখুন, এই রুমালের একটা অংশ আমার নজরে পড়েছিল।

এটা তো দেখছি একটা লেডিজ রুমাল।

কিরীটী রুমালটা পরীক্ষা করতে করতে বলল, হ্যাঁ, লেডিজ রুমাল, দেখুন এর এক কোণে ইংরেজী অক্ষর এ লাল সুতো দিয়ে লেখা আছে।

কার এই রুমালটা বলুন তো?

‘এ’ অনেকেরই নামের আদ্যক্ষর হতে পারে। কিরীটী বলল, অনুরাধা দেবীরও হতে পারে। একটা সূক্ষ্ম সেন্টের গন্ধ এই রুমালটা থেকে পাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

চলুন তো একবার পাশের ১৬নং ঘরে।

হেমন্ত সাহু ও কিরীটী এসে আবার পাশের ঘরে ঢুকল। ঘরের সামনে একজন সেপাই দাঁড়িয়ে ছিল, সে সরে দাঁড়াল ওদের ঘরে ঢুকতে দেখে।

কিরীটী এগিয়ে গিয়ে সমুদ্রের দিকের জানালা খুলে দিতেই এক ঝলক রৌদ্র এসে ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।বাইরে ইতিমধ্যে মেঘ কেটে গিয়ে যে সূর্যের আলো প্রকাশ পেয়েছে। তা ওরা জানতে পারেনি।

কিরীটী আর একবার ঘরের চারপাশে তাকাল।

পাশাপাশি দুটো চামড়ার সুটকেস, দুটোই তালাবন্ধ। একটা সাইজে বেশ বড়, অন্যটি মাঝারি। সাইজের। ছোট সুটকেসটার গা-তালার সঙ্গে একটা চাবির রিং ঝুলছে। চাবি ঘোরাতে গিয়ে দেখা গেল চাবিটি খোলা। ডালা তুলতেই নজরে পড়ল কিছু দামী দামী শাড়ি, আরও কিছু স্ত্রীলোকের ব্যবহার্য টুকিটাকি, একপাশে একটা দামী সেন্টের সুদৃশ্য শিশি। সেটার ছিপি খুলে নাকের কাছে ধরতেই রুমালের গন্ধটা পাওয়া গেল। তার পাশে একটা লেডিজ ব্যাগ। ব্যাগটা খুলল কিরীটী।

একটা কমপ্যাক্টের সুদৃশ্য কৌটো-ছোট মিরার, একটা চিরুনি, একটা লেডিজ রুমাল, বেশ কিছু একশো টাকার নোট, খুচরো কয়েন।

কিরীটী অনুরাধার মতৃদেহটার দিকে তাকাল। বীভৎস, নৃশংস।

ডেড্‌ বডিটা এবার মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন মিঃ সাহু।

হ্যাঁ। চলুন এবারে থানায় যাওয়া যাক। হেমন্ত সাহু বললেন।

সরিৎশেখর আর সলিল দত্ত মজুমদারকে আরও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার আছে মিঃ সাহু–কিরীটী বলল।

চলুন না ওদের থানায় নিয়ে যাই, যা জিজ্ঞাসা করবার সেখানেই করবেন। তারপর না হয় ছেড়ে দেওয়া যাবে—খুনীই যখন ধরা পড়ে গিয়েছে!

আপনার তাহলে ধারণা ঐ চন্দ্রকান্ত ঘাই—

নিশ্চয়ই। ঐ ভদ্রলোকই মার্ডারার। কেন, আপনার কোন সন্দেহ আছে নাকি তাতে? কথাটা বলে হেমন্ত সাহু কিছুটা যেন গর্বিত ও উদ্ধত দৃষ্টিতে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে—এখন পর্যন্ত যে সব এভিডেন্স আমরা পেয়েছি, সেটাই কি প্রমাণ করে না!

তা হয়তো করে, কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন কি মিঃ সাহু, ১৫ নং ঘরের মেঝেতে দুটো ধেনোর শূন্য বোতল গড়াগড়ি দিচ্ছিল!

ধেনোর বোতল। কিছুটা যেন বিস্ময়ের সঙ্গেই মিঃ সাহু তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।

দু-বোতল ধেনো গিলে একটা মানুষের অবস্থা কি হতে পারে, নিশ্চয়ই আমাদের কথাটা একবার ভাবতে হবে–

নিশ্চয়ই ভেবেছি বৈকি। সাহু জবাব দিলেন, যা-তা ব্যাপার তো নয়, একটা লোককে মার্ডার করা—মনটাকে সেজন্য প্রস্তুত করবার জন্যই হয়তো দু-দুটো বোতলের প্রয়োজন হয়েছিল! .

তা বটে—কিরীটী মৃদু হাসল।

বুঝতে পারছেন না মিঃ রায়, লোকটা একটা কোল্ড-ব্লডেড মার্ডারার।

আমার কিন্তু মনে হল–কিরীটী বলল, লোকটা অসম্ভব ভীতু–

ভীতু লোকেরা কি খুনখারাপি করে না মিঃ রায়? আমি তিন-তিনটে কেস জানি—অসম্ভব ভীতু—অথচ নৃশংসভাবে খুন করেছিল।

ঠিক আছে, আপনি লোকটাকে অ্যারেস্ট করুন, তবে একটা কাজ যদি করতে পারেন আপনি, মনে হয় আপনার identification-এর খুব সুবিধা হবে।

বলুন না কি করতে হবে?

একটা নাপিত ডাকিয়ে, থানায় নিয়ে গিয়ে লোকটার দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে মাথার চুলগুলো ছোট ছোট করে হেঁটে দিতে পারেন?

কয়েকটা মুহূর্ত সাহু হাঁ করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, মনে হল ব্যাপারটা যেন তিনি আদৌ হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি।

দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে দেব। তার মানে কি বলতে চাইছেন আপনি?

মনে হচ্ছে ওটা ওর স্বাভাবিক ব্যাপার নয়, সযত্নে রক্ষিত ও বর্ধিত, এবং সেই সযত্ন প্রয়াসের মধ্যে কোন বিশেষ অভিসন্ধি–

ঠিক আছে, বলছেন যখন–

কি জানেন মিঃ সাহু, ভাল করে চেয়ে দেখবেন ওর মুখের দিকে, লোকটাকে ঐ দাড়িগোঁফ যেমন কুৎসিত দেখাচ্ছে ঠিক তেমনটি হয়তো লোকটা দেখতে নয়।

অতঃপর মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করে থানা থেকে জীপ আনিয়ে চন্দ্রকান্তকে হাতকড়া পরিয়ে হেমন্ত সাহু প্রস্থান করলেন।

কিরীটী এসে অফিস-ঘরে ঢুকল। সলিল দত্ত মজুমদার একটা চেয়ারে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল। সারামুখে তার বিরক্তি।

ভবেশ অধিকারী তার চেয়ারে বসে একটা বিড়ি ধরিয়ে নিঃশব্দে টানছিলেন। কিরীটীর পিছনে আট-দশজন বোর্ডার এসে ঘরে ঢুকলেন।

একসঙ্গে সবাই বলে ওঠেন, আমাদের বিল দিন, আমরা আর এ হোটেলে এক মুহূর্ত থাকব না।

ভবেশ অধিকারীর ধূমপান সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়। জ্বলন্ত ও অর্ধদগ্ধ বিড়িটা মুখে চেপে ধরে থাকেন।

কিন্তু এই মুহূর্তে তো আপনাদের কারোরই এ হোটেল থেকে যাওয়া হবে না কথাটা শান্ত গলায় বললে কিরীটী।

যাওয়া হবে না! কেন? অনেকগুলো কণ্ঠস্বর যেন একঝাক তীরের মত কিরীটীর প্রতি বর্ষিত হল।

১৬নং ঘরে একজন ভদ্রমহিলা খুন হয়েছেন, দাবোগাবাবুর হুকুম, তার এনকোয়ারি শেষ হওয়া পর্যন্ত হোটেল ছেড়ে কেউ যেতে পারবেন না।

একজন বলে উঠলেন, দারোগাবাবুর কি ধারণা, আমাদের মধ্যে তাকে কেউ খুন করেছে।

সেটা আপনারা দারোগাবাবুকেই জিজ্ঞাসা করবেন, কিরীটী বললে।

কোথায় দারোগাবাবু?

থানায়।

চল হে, আমরা তাহলে থানায় যাই—একজন আবার বললেন।

কিন্তু এ অন্যায়, বেআইনী জুলুম–বললেন সলিল দত্ত মজুমদার।

কিরীটী সলিল দত্ত মজুমদারের কথায় কান না দিয়ে দোরগোড়ার সমাগতদের দিকে তাকিয়ে। বললে, থানায় আপনাদের কাউকেই যেতে হবে না। মনে হয় কাল-পরশুর মধ্যেই দাবোগাবাবুর। তদন্ত শেষ হয়ে যাবে, তারপর আর উনি আপনাদের যেতে বাধা দেবেন না। একটা বা দুটো দিন হঠাৎ একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে, ম্যানেজারবাবু তো কিছু ইচ্ছা করে আপনাদের অসুবিধা সৃষ্টি করছেন না। তাছাড়া দেখছেন তো, উনি নিজেও কম বিব্রত হননি!

সমাগতদের একজন তীক্ষ্ণকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, জানতে পারি কি আপনি কে মশাই এ হোটেলে?

কৃষ্ণকায় এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন, চিনতে পারছেন না—উনি কিরীটী রায়।

কিরীটীবাবু! অন্য একজনের প্রশ্ন।

হ্যাঁ, বিখ্যাত সত্যসন্ধানী—শোনেননি ওঁর নাম—

ধীরে ধীরে ভিড় পাতলা হয়ে গেল।

সলিল দত্ত মজুমদার তাঁরই সোনার সিগ্রেট কেসটা পকেট থেকে বের করে একটা লাইটারের সাহায্যে একটা সিগ্রেটে অগ্নিসংযোগ করলেন।

সরিৎশেখর ঐ সময় অফিস-ঘরে এসে প্রবেশ করল। সলিল দত্ত মজুমদার ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সরিশেখরের দিকে তাকালেন।

বসুন বসুন ডঃ সেন, আপনি এসেছেন ভালই হল, ভাবছিলাম আপনার ঘরে যাব।

ডঃ সেন একটা চেয়ার টেনে বসল। তারপর বললে, আমিও আপনাকে কিছু বলব বলেই এসেছি মিঃ রায়।

সলিল দত্ত মজুমদার সহসা উঠে দাঁড়াল, ম্যানেজারবাবু, আমার জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিন।

নীচের তলায় সিঁড়ির কাছে ১১নং ঘরটা খালি আছে—

থাকতে যখন হবে, যেখানেই হোক থাকবার একটা ব্যবস্থা করুন। আর কলকাতায় আর্জেন্ট একটা ট্রাংককল বুক করুন, বলে নম্বরটা বললেন সলিল দত্ত মজুমদার।

কিরীটী বললে, উনি তো আই. জি.–

হা মিঃ গুপ্ত, আমার বন্ধু-সলিল দত্ত মজুমদার গর্বিত কণ্ঠে বললেন, আপনারা আমাকে নিয়ে খেলা করবেন আর আমি তাই সহ্য করে যাব যদি ভেবে থাকেন তো ভুল করেছেন! আমি একটা বিরাট কনসার্নের জি. এম.!

মিথ্যে আপনি রাগ করছেন মিঃ দত্ত মজুমদার। কিরীটী বললে।

মিথ্যে? আমার কোন প্রেসটিজ নেই বলতে চান?

আচ্ছা মিঃ দত্ত মজুমদার, হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করল, আপনাদের কোম্পানির কাজে আপনি জামসেদপুরে নিশ্চয়ই গিয়েছেন কখনও না কখনও?

বহুবার গিয়েছি, তাছাড়া আমার বাবা আর এল দত্ত মজুমদার টিসকোর একজন বড় অফিসার ছিলেন। রাঁচিতে আমি আই. এস-সি পড়েছি, তারপর বি. এস-সি পাস করে বিলেত যাই। তা হঠাৎ ও কথা কেন?

আপনি ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নামে জামসেদপুরের কাউকে চেনেন?

ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়! কেমন যেন একটু চমক দত্ত মজুমদারের গলার স্বরে। কিন্তু কথায় সেটা প্রকাশ পেল না।

হ্যাঁ, টিসকোতেই কাজ করতেন, পরে রিটায়ার করেন–কিরীটী বললে।

না, ঠিক মনে করতে পারছি না। কিন্তু কেন বলুন তো?

না ভাবছিলাম, আপনার বাবা তো ওখানেই থাকতেন আর আপনারও সেখানে যাতায়াত ছিল। জামসেদপুর বিহারের কতটুকুই বা একটা টাউন—চিনলেও হয়ত ভদ্রলোককে চিনতে পারেন। আরও একটা কথা, সেই ভদ্রলোক তিন বৎসর আগে এই হোটেলেই আত্মহত্যা করেছিলেন ঐ দোতলার ১৭নং ঘরে—

গোপী এসে দাঁড়াল দরজার সামনে, বললে, ১১ নং ঘর ঠিক করে দিয়েছি ম্যানেজারবাবু।

যান মিঃ দত্ত মজুমদার গোপীর সঙ্গে যান—ভবেশবাবু বলেন।

সলিল দত্ত মজুমদার আর মুহূর্তও দেরি করেন না। গোপীর সঙ্গে সে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন একটু যেন দ্রুতপদেই।

কিরীটী যেন কেমন অন্যমনস্ক। মনে হল সে যেন কি ভাবছে।

মিঃ রায়।

সরিশেখরের ডাকে কিরীটী ফিরে তাকাল।

গতকাল অনুরাধার সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়েছিল, আমার মনে হচ্ছে আপনার সব কথা জানা প্রয়োজন।

কিরীটী উঠে দাঁড়াল। চলুন ডঃ সেন, আমার ঘরে চলুন। ভবেশবাবু দুকাপ চা পাঠিয়ে দেবেন আমার ঘরে ১৭ নম্বরে।