সামনে সমুদ্র নীল – পরিচ্ছেদ ৪

০৪.

দিন দুই বাদে মালতী দেবী আবার এলেন কিরীটীর গৃহে। কিরীটী বললে, আসুন মিসেস চ্যাটার্জী, বসুন। আপনার কথাই ভাবছিলাম এ দুদিন।

মালতী আসন গ্রহণ করলেন।

কিরীটী বললে, মিসেস চ্যাটার্জী, আমরা যদি ধরে নিই যে আপনার স্বামী ক্ষিতীন্দ্রবাবু তিন বছর আগে পুরীর হোটেলে আত্মহত্যা করেননি, আজও বেঁচে আছেন এবং কোথাও আত্মগোপন করে আছেন, সেক্ষেত্রে স্বভাবতই যে প্রশ্নটা সর্বাগ্রে আমাদের মনে জাগে সেটা হচ্ছে, না-ই যদি মারা গিয়ে থাকেন তবে আত্মগোপন করে আছেন কেন? আচ্ছা, তার অতীত জীবনের এমন কোন ঘটনা কি আপনার জানা আছে যেটা বরাবর তিনি সকলের কাছ থেকে গোপন করে এসেছেন বলে আপনার মনে হয়?

না। আর সেরকম কিছু থাকলেও আমার জানা নেই। তা ছাড়া তিনি নিজের প্রয়োজন ছাড়া আমাদের কারও সঙ্গে বিশেষ কোন কথাই বলতেন না, নিজের জামাকাপড় আহার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছাড়া পৃথিবীর আর কোন কিছু ভাবতেন বলে আমার মনে হয় না।

টাকাপয়সার প্রতি কেমন আকর্ষণ ছিল আপনার স্বামীর?

ছিল, তবে সেটা এমন কিছু একটা উল্লেখযোগ্য নয়।

আচ্ছা মিসেস চ্যাটার্জী, আপনার স্বামীর এই ফিক্স ডিপোজিটের টাকাটা ছাড়া আর কোন টাকা ছিল না? অতদিন চাকরি করেছিলেন বলছেন এবং শেষের দিকে ভালই মাইনা পেতেন বললেন

মালতী কিরীটীর প্রশ্নের উত্তরে বললেন, মনে হয় ছিল। তবে সে সম্পর্কে আমি কিছুই কোনদিন জানতে পারিনি। এমন কি ঐ যে ফিক্স ডিপোজিটের টাকাটার কথা বললাম তাও তিনি যদি একদিন নিজের থেকে আমাকে না বলতেন তো জানতেও পারতাম না হয়ত।

কোন লাইফ ইনসিওরেন্স ছিল না ক্ষিতীন্দ্রবাবুর? কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন করে।

ছিল কিনা জানি না। আসলে ঐসব—মানে টাকাপয়সার ব্যাপারে কখনও আমি মাথা ঘামাইনি। উনি বরাবর ওর নিজের মর্জিমত চলতেন, আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে থাকতাম।

কেন?

পারিবারিক জীবনটা ক্রমশ ওঁর স্বার্থপর ব্যবহারে এমন বিষিয়ে তুলেছিলেন যে আমার কোন প্রবৃত্তি হয়নি দুজন একত্রে বসে দুদণ্ড কথা বলবার।

স্নেহমমতা কেমন ছিল? ভালবাসা—

সাধারণত এগুলি ওঁর ছিল বলে আমার মনে হয় না, থাকলেও তা নিজের ওপরেই—

কিন্তু বিবাহের পূর্বে তো আপনি–

তাঁকে জানতাম ঠিকই—কিন্তু পরবর্তীকালে আমার মনে হয়েছে, বিবাহের পূর্বে সেটা একটা অভিনয় ছিল বোধ হয়। ভালবাসার একটা অভিনয়। তাই প্রথমটায় না বুঝতে পারলেও, বলতে লজ্জা-ঘৃণা হয়, আমাকে তার বোধ হয় একমাত্র প্রয়োজন ছিল রাত্রে, কিছুক্ষণের জন্য আমার দেহটায়—

সংসারে তাহলে আপনাদের কোন শান্তি ছিল না বলুন!

কেমন করে থাকবে বলুন, এমন একটা মানুষের সঙ্গে ঘর করলে কোন শান্তি বা সুখ থাকে। কি?

মিসেস চ্যাটার্জী, এবারে বলুন তো, তিন বছর আগে পুরীর হোটেলে যে মৃতদেহটা আপনি সনাক্ত করেছিলেন, ভাল করেই ডেড বডিটা তো দেখেছিলেন, না কি স্বামীর প্রতি যে অবজ্ঞা ঘৃণা ও বিরক্তি দীর্ঘকাল পোষণ করে এসেছেন মনে মনে সেই সব নিয়েই, মানে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দেখেছিলেন—

মালতী দেবী চুপ করে রইলেন।

আমার কি মনে হয় জানেন, মৃতদেহটা সেদিন নিশ্চয় আপনি ভাল করে দেখেননি! দেখলে হয়ত চেনার মধ্যে আপনার সেদিন কোন ফাঁক থাকত না। মনে মনে যদি আমার বুঝবার না ভুল হয়ে থাকে ক্ষিতীন্দ্রবাবুর কাছ থেকে আপনি যে মুক্তি চাইছিলেন সেই আকাঙ্ক্ষিত মুক্তি যখন আপনার সামনে এসে অকস্মাৎ দাঁড়াল আপনি সেই মুক্তিকেই স্বাগত জানালেন—এমন কি আপনার বৈধব্য পরবর্তী জেনেও।

আমি—

নচেৎ সেদিনকার তাঁর সেই মৃত্যু আর পরবর্তী কালের এই চিঠি জানবেন কোনটাই বিশ্বাসযোগ্য নয়। ঠিক আছে মালতী দেবী, এ রহস্যের মীমাংসা কষ্টসাধ্য হবে না বলেই মনে হয়।

তাহলে কি মিঃ রায়, আপনি বিশ্বাস করেন সে আজও জীবিত?

তাই আমার মনে হচ্ছে—

তাহলে—আমি, আমি সকলকে কি বলব?

দেখুন স্বামীর ভয়াবহ মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে যে কোন স্ত্রীই ঐ ধরনের ভুল করতে পারে, অস্বাভাবিক কিছু না। তাছাড়া আপনি কেন একমাত্র আপনার দিকটাই ভাবছেন, ক্ষিতীন্দ্রবাবুর দিকটাও ভাবুন—same problem তো বেঁচে উঠলে তাকেও face করতে হবে। সেটা নিশ্চয় তার পক্ষে খুব একটা সুখের হবে না। কিন্তু তার মধ্যেও একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে অর্থাৎ তিনি যদি হঠাৎ আজ আবার সত্যিই বেঁচে উঠতে চান—তো কেন। আবার বেঁচে উঠবার নতুন করে তার কি কারণ থাকতে পারে, কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কেবলমাত্র ঐ ফিক্স ডিপোজিটের টাকাটার জন্য তিনি আজ আবার বেঁচে উঠতে চাইছেন, আমার মন মেনে নিতে পারছে না। নিশ্চয়ই আরও কোন কারণ আছে। সেটা কি, কি হতে পারে। তারপর একটু থেমে কিরীটী বলল, সে যাই হোক, আপনি জানতে চান সত্যি সত্যিই আজও আপনার স্বামী বেঁচে আছেন কিনা—মনে হয় আপনার সেই প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারব।

মালতী দেবী বললেন, আসল সত্যটুকু আমাকে জানতেই হবে মিঃ যায়। বলতে আমার কোন দ্বিধা বা লজ্জা নেই—যে মানুষটা দীর্ঘ একটা যুগ কেবল আমাকে মানসিক পীড়নই করে গিয়েছে, সে মরেও আবার বেঁচে উঠে আমাকে কেন যে অপদস্থ করতে চায় সেটা আমার জানা আজ খুব বেশী প্রয়োজন। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কত বড় দুঃখে কোন এক স্ত্রীর মুখ থেকে তার স্বামী সম্পর্কে এই কথাটা বের হতে পারে–

যদি সত্যিই তিনি বেঁচে থাকেন, আপনাকে তিনি অপদস্থ করতে চাইছেন তাই বা ভাবছেন কেন মিসেস চ্যাটার্জী?

কেন ভাবছি—তাই না? আমি মানে আমার মত করে তো কেউ ঐ মানুষটাকে চেনেনি— চিনবার সুযোগও পায়নি। যাকগে সে কথা, আজ আমি উঠি। আপনি তার একটা ফটো চেয়েছিলেন, এই নিন—বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার দিন দশেক আগে তোলা এই ফটোটা। চলিফটোটা কিরীটীর হাতে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মালতী দেবী।

আসুন—

মালতী চলে গেলেন।

কিরীটী মনে মনে মানুষটাকে কল্পনা করবার চেষ্টা করে ফটোটা সামনে ধরে। বেশ বোঝা যায়, মাথার সামনের দিকে বিস্তৃত টাক কিন্তু টাকা ঢাকা দেওয়া হয়েছে এক দিককার বড় বড়। চুল অন্য দিকে সযত্নে এনে।

চোখ দুটো ছোট ঘোট, বর্তুলাকার। চোখের চাউনি দেখে মনে হয়, যেন অত্যন্ত সহজ সরল মানুষটি, কিন্তু স্ত্রী মালতী যে পরিচয় তাঁর দিয়ে গেলেন সেটা ঠিক বিপরীত। চোখের দৃষ্টি থেকে মনের গতিবিধি বোঝা সত্যই অনেক সময় দুষ্কর।

কৃষ্ণা এসে কক্ষে প্রবেশ করল।

কার ফটো নিয়ে তন্ময় হয়ে আছে গো?

কিরীটী মৃদু হেসে ফটোটা স্ত্রীর দিকে এগিয়ে ধরলো। দেখ তো কৃষ্ণা, মানুষটিকে কেমন বলে মনে হয় তোমার এই ফটো দেখে।

কৃষ্ণা স্বামীর হাত থেকে ফটোটা নিয়ে দেখতে দেখতে বললে, সযত্নে চুল দিয়ে টাক ঢাকার চেষ্টা করা হয়েছে, আত্মসচেতন—মনে হয় চোখ দুটো মিথ্যা বলছে—আদৌ সহজ সরল নয় মানুষটি। বরং একটু লোভী। তা এ কে?

ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাল রাত্রে তোমাকে যার কথা বলছিলাম। লোকে জানে বৎসর তিনেক আগে পুরীর এক হোটেলে আত্মহত্যা করেছেন–

বাজে কথা, আত্মহত্যা করেনি, করতে পারে না। তার প্রমাণ তো ঐ চিঠিটাই—

চিঠিটা অন্য কারও লেখাও তো হতে পারে, হাতের লেখা নকল করে চিঠি দিয়েছে।

না, একই হাতের লেখা চিঠিগুলো, আমি হলফ করে বলতে পারি।

আমি তোমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত কৃষ্ণা। কিরীটী বলল।

তাহলে?

যদি অনুমান আমার না ভুল হয়ে থাকে, তাহলে এই তিন বৎসর চুপচাপ ছিল কেন ভদ্রলোক? কারণ কিছু একটা আছে নিশ্চয়ই ঐ নিস্তব্ধতার পিছনে, হয়ত যে হোটেলে তিন বৎসর আগে ঘটনাটা ঘটেছিল তারই সঙ্গে নিস্তব্ধতার কোন ঘনিষ্ঠ কার্যকারণ রয়েছে। তবে এটাও ঠিক, আজও যদি সে বেঁচেই থেকে থাকে, মালতী দেবীর কাছ থেকে দূরে থাকলেও তার সমস্ত খবরাখবর ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রাখতেন বরাবরই।

এ কথা বলছ কেন?

নচেৎ মালতী দেবী টাকা তুলবেন সে কথাটা জানলেন কি করে ক্ষিতীন্দ্রবাবু। না কৃষ্ণা, প্রথম দিকে সব শুনে ব্যাপারটা যত সহজ ভেবেছিলাম এখন মনে হচ্ছে হয়ত তত সহজ নয়, সমস্ত ঘটনার মূল শিকড়টা মাটির নীচে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। আমি যখন হাত দেব স্থির করেছি, বর্তমান রহস্যের গিট আমি খুলবই। শোন, সর্বাগ্রে আমাকে একবার জামসেদপুর যেতে হবে।

জামসেদপুর?

হ্যাঁ। ওখানে আমার এক বিশেষ পরিচিত ভদ্রলোক আছেন। অনুসন্ধান আমাকে টিসকো থেকেই শুরু করতে হবে।

বঙ্কিম সুর বহুকাল জামসেদপুর-নিবাসী। চাকরির শুরু থেকেই জামসেদপুরে, যদিও দেশ তার হাওড়ায়। বঙ্কিম সুর টিসকোতেই চাকরি করত, বছর চার-পাঁচ হল রিটায়ার করে ওল্ড সারকিট হাউস এরিয়াতে বাড়ি করে বসবাস করছে।

দুই ছেলে, দুটি ছেলেই কৃতী। একজন কলকাতায় চাকরি করে বিরাট একটা ফার্মে, অন্যজন টিসকোতেই চাকরি করছে। ছোটখাটো রোগা পাতলা মানুষটি। দিবারাত্র যেমন পান চিবাচ্ছে তেমনি টানছে সিগ্রেট একটার পর একটা, চেন-স্মোকার। হাসিখুশি রসিক মানুষ। তার কাছ থেকে অনেক সংবাদ পাওয়া যাবে আশা করা যায়।

ট্রেন থেকে নেমে একটা ট্যাক্সি নিয়ে কিরীটী সোজা নটরাজ-এ গিয়ে উঠল, হোটেলটা বেশ বড় এবং সব রকম ব্যবস্থাই আছে।

হোটেলের ঘরে বসেই ফোন করল কিরীটী বঙ্কিমকে।

কে বঙ্কিম, আমি কিরীটী—

কিরীটী! কোথা থেকে কথা বলছ হে? বঙ্কিম জানতে চান।

নটরাজ হোটেল। একবার চলে এস না।

তা তুমি আমার বাসায় না উঠে হোটেলে উঠতে গেলে কেন হে?

তুমি হোটেলে এস, সব জানতে পারবে।

আধঘণ্টার মধ্যে বঙ্কিম এল, মুখে একগাল পান, হাতে সিগারেট। বললে, উঃ, অনেক দিন পরে দেখা। তা খবর কি বল, হঠাৎ এখানে?

কিরীটী সংক্ষেপে তার আসার উদ্দেশ্য বলে গেল।

সব কথা মন দিয়ে শুনল বঙ্কিম। তারপর বললে, ক্ষিতীন্দ্রকে আমি বেশ ভাল করেই চিনতাম। তা সে তো বছর তিনেক আগে সুইসাইড করেছে পুরীর এক হোটেলে। ব্যাপারটা কি বল তো?

সেই ভদ্রলোক সম্পর্কে কি জান বল। তুমি তো তাকে চিনতে বললে।

হ্যাঁ, প্রায় সন্ধ্যাতেই একটা ভাঙা সাইকেল নিয়ে আমার বাসায় আসত তাস খেলতে।

তাস খেলার নেশা ছিল বুঝি?

তা ছিল।

অন্য কোন নেশা?

দেখ ভাই, নেশা করতে হলে একটা দিল চাই। নেশা কি সকলে করতে পারে। তাছাড়া লোকটা ছিল স্বভাব-কৃপণ, আর সে কৃপণতার জন্য সে পারত না দুনিয়ার এমন কোন কাজই ছিল না। তার উপরে ছিল মুখে সর্বদা বড় বড় বোলচাল। অনেকটা বলতে পার বোকা চালিয়াৎ, বোকা এইজন্য বলছি, নিজের ভালটা যেমন বুঝতে পারত না, তেমনি ঐ চালিয়াতির জন্য তার যে ক্ষতিটা হত সেটা বুঝবার কোন চেষ্টা করত না। কিন্তু মানুষটার অন্তরটা ছিল পরিষ্কার, কিন্তু ঐ যে বললাম, বোকা, সমস্ত গুণই তার সেটা নষ্ট করে দিয়েছিল তা কি ব্যাপার বল তো?

দেখ বঙ্কিম, এবার একটা সত্যি কথা বল তো, তুমি লোকটার যে চরিত্র বর্ণনা করলে, তাতে করে কি মানুষটা সুইসাইড করতে পারে বলে তোমার মনে হয়? তাও গলায় ক্ষুর চালিয়ে? গলায় দড়ি দেওয়া যায়, বিষপানও করা যায়, কিন্তু গলায় ক্ষুর চালানোর জন্যে অন্য এক ধরনের নার্ভের দরকার, তাই নয় কি!

তা ঠিক, তবে momentary insanity-তে মানুষ—

কিন্তু সেটাই বা হঠাৎ তার হবে কেন? চাকরি থেকে রিটায়ার করেছে, তারপর পুরীতে বেড়াতে গিয়েছে। ছেলেরা মানুষ হয়ে গিয়েছে, মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে—

সবই ঠিক, কিন্তু পারিবারিক শান্তি তো ছিল না একেবারেই—তাছাড়া কেবল স্ত্রী কেন, ছেলেমেয়েদের ভালবাসাও মানুষটা কোন দিন পায়নি।

কেন?

সেও তার নিজের চরিত্রের জন্য। অমন আত্মসর্বস্ব মানুষ হলে সন্তানদের শ্রদ্ধা ভালবাসা পাওয়া যায় না কিরীটী। সংসারে থেকেও তো সে সংসারের কেউ ছিল না। একেবারে একা যাকে বলে।

কি জান বঙ্কিম, কম তো বয়স হল না, কম দেখলামও না। বেশীর ভাগই দেখেছি মানুষ নিজের দুঃখ নিজেই তৈরী করে নেয়। সংসারে বাস করতে হলে একটা সততা বজায় রাখতে হয়।

তা ঠিক, বঙ্কিম সুর হেসে বলল, কিন্তু তুমি ক্ষিতি সম্পর্কে এত সংবাদ জানতে চাইছ কেন তা তো বললে না।

আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো ভদ্রলোক আজও বেঁচে আছেন।

কি বলছ তুমি!

বলছি তিন বৎসর পুরীর হোটেলে যে আত্মহত্যা করেছিল বা খুন হয়েছিল সে তোমাদের পরিচিত মালতী দেবীর স্বামী ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নন।

অসম্ভব। মালতী দেবী নিজে গিয়ে মৃতদেহ সনাক্ত করে এসেছিলেন।

তার ভুলও তো হতে পারে।

ভুল! স্ত্রী স্বামীকে চিনতে ভুল করবেন?

ইচ্ছা করেও তো ভুলটা করতে পারেন। কিরীটী মৃদু হেসে বললে।

ইচ্ছা করে। কিন্তু কেন?

সেই কেনর জবাবটা পেলেই তো সব কিছুর মীমাংসা হয়ে যায় বঙ্কিম। তুমি জান না বঙ্কিম, কিছুদিন আগে মালতী দেবী তার স্বামীর হাতের লেখা একখানা চিঠি পেয়েছেন।

চিঠি! মানে ক্ষিতি চিঠি লিখেছে তার স্ত্রীকে?

হ্যাঁ। সে চিঠি আমি দেখেছি। অন্য দুখানা চিঠির সঙ্গে মিলিয়েও দেখেছি, সব চিঠিই যে একই হাতের লেখা সে সম্পর্কে আমার কোন সন্দেহ নেই।

ব্যাপারটা যেন কেমন আমার গোলমেলে ঠেকছে–ক্ষিতি আজও বেঁচে আছে, তাছাড়া–কি?

এ ধরনের একটা ব্যাপার গড়ে তুলবার তার কি প্রয়োজন ছিল?

হয়ত ছিল কিছু একটা!

কিন্তু তার পরে আবার বেঁচে উঠবারই যখন ইচ্ছা ছিল তখন–

এই তিন বৎসর কেন সে চুপচাপ ছিল, তাই না?

হ্যাঁ।

নিশ্চয়ই হিমালয়ে সন্ন্যাসী হয়ে যায়নি।

না, সন্ন্যাসী হবার মত মানুষ সে নয়। তিনজনের খাবার না খেলে যেমন তার চোরা দ্বিতীয় পাকস্থলীটা ভরত না, তেমনি বড় বড় মিথ্যা বোলচাল না দিলে তার পেট ফাঁপে, মানে ফাপত—আচ্ছা, মালতী কি বলছেন?

মনে হল ব্যাপারটা তার পক্ষে মেনে নেওয়া একটু কষ্টকর হচ্ছে—

কেন, এ তো আনন্দের কথা, সত্যিই যদি ক্ষিতি আজও বেঁচে থাকে—

বমি, আমার তো মনে হয় সেটা আনন্দ সংবাদ বহন করে আনবে না। তুমি কি ভাবতে পার বঙ্কিম, ব্যাপারটা ক্ষিতীন্দ্রর পক্ষে কত বড় একটা নিষ্ঠুর পরিহাস!

সত্যি, মানুষটার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। সত্যিই বেচারা হতভাগ্য, যেটা হতে পারত সত্যিকারের একটা আনন্দ সংবাদ, সেটাই যদি–

তবু আমি মালতী দেবীকে কথা দিয়েছি বঙ্কিম, ঐ রহস্যের একটা মীমাংসা করে দেবার চেষ্টা করব, কারণ ব্যাপারটা জানতে তিনি অত্যন্ত উগ্রীব। যাক সে কথা, আমার আরও কিছু জানবার আছে ক্ষিতীন্দ্র সম্পর্কে।

বঙ্কিম বললেন, কি জানতে চাও বল?

প্রত্যেক মানুষেরই চরিত্রে কিছু দোষ ও গুণ থাকে, মানুষটার চরিত্রে কালো দিকটাই। তোমাদের কাছে শুনেছি, মানে তার স্ত্রী ও তোমার মুখ থেকে। তার চরিত্রে কোন ভাল দিকই কি ছিল না?

তোমার ঐ প্রশ্নের জবাবে একটা কথাই বলতে পারি কিরীটী, ওকে কেউ ভালবাসতে পারে না। এমন কি আমি যতদূর জানি, ওর নিজের বাপ-মাও বোধ করি ওকে কোন দিন ভালবাসতে পারেননি।

কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বললে, আচ্ছা, উনি তো শুনেছি, মানে ক্ষিতিবাবু মালতী দেবীকে ভালভাবেই বিবাহ করেছিলেন এবং মালতী দেবীও ভালবেসেছিলেন একদা ঐ মানুষটিকে–

গোড়ার কথাটা অবিশ্যি তাই। কিন্তু আমার মনে হয়, ক্ষিতিকে ঘিরে মালতী দেবীর স্বপ্ন ভেঙে যেতে দেরি হয়নি। আমার কি মনে হয় জান, ঘটনাকে তার নিজস্ব গতিতেই এগিয়ে যেতে দাও কিরীটী, তুমি দূরে সরে যাও।

কিন্তু আমি যে ভাই কথা দিয়েছি মালতী দেবীকে, কিরীটী বললে, তাছাড়া আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি সেখান থেকে বোধ হয় আমিও ফিরতে পারব না।

দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। বঙ্কিম একটু পরে উঠে দাঁড়াল, এবার আমি তাহলে চলি! রাত্রে তুমি কিন্তু আমার ওখানে খাবে কিরীটী।

না, বরং তুমিই হোটেলে এসো, একসঙ্গে ডিনার খাওয়া যাবে। ভাল কথা, একটা কথা বোধ হয় তোমার জানা প্রয়োজন কিরীটীকি বল তো? ক্ষিতি হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার দিন দশেক আগেই বোধ করি, এক সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে দুজনে তাস খেলছিলাম, ঐ সময় এক ভদ্রলোক ক্ষিতির খোঁজে আমার বাড়িতে এসে হাজির—পরনে একটা দামী স্যুট, চোখে কালো চশমা। বেশ দীর্ঘকায় ব্যক্তি। নাম বললেন জীমূতবাহন। ক্ষিতি কিন্তু আগন্তুক ভদ্রলোককে চিনতে পারল না।

জীমূতবাহন বললেন, সে কি রে? সত্যি সত্যিই তুমি মনে করতে পারছ না ক্ষিতীন্দ্র— জীমূতবাহন ঘোষালকে তোমার মনে পড়ছে না? রাজসাহী কলেজে একসঙ্গে দুবছর পড়েছি থাকতামও একই হোস্টেলে পাশাপাশি ঘরে–

না, আমি দুঃখিত। সত্যিই মনে পড়ছে না। ক্ষিতি বলে।

বঙ্কিম বলতে লাগল, যে কারণে তোমাকে ঘটনাটা বলছি কিরীটী—আমি কিন্তু তখন অপার বিস্ময়ে আগন্তুকের মুখের চেহারার দিকে তাকিয়ে আছি। এমন আশ্চর্য মিল দুজনার চেহারার মধ্যে। অবিশ্যি আগন্তুকের চোখে কালো চশমা থাকায় তার চোখ দুটো আমি দেখতে পাইনি।

চশমা চোখ থেকে খোলেনি সে?

না। কেবল বেশভূষায় দুজনের পার্থক্য, ভদ্রলোকের পরনে দামী স্যুট, যে ধরনের দামী স্যুট ক্ষিতি জীবনে কখনও পরা তো দূরে থাক, তার কল্পনারও বাইরে, এবং দুজনের গলার স্বর ও দাঁড়াবার ভঙ্গিটাও সম্পূর্ণ এক।

তারপর? কিরীটীর কণ্ঠস্বরে বেশ একটা কৌতূহল।

ক্ষিতির সে-সময়কার চোখমুখ দেখে আমার মনে হয়েছিল, ক্ষিতি বোধ হয় সত্যিই তাকে চেনে না। তার কথার মধ্যে মিথ্যা ছিল না! যাক তারপর যা বলছিলাম, মৃদু হেসে জীমূতবাহন বললেন, তাহলে আর কি হবে, চিনতেই যখন আমায় পারলে না, কি আর বলব। মিলিও হয়ত তোমারই মত আজ আমায় চিনতে পারবে না, আমি কিন্তু তোমাকে ভুলিনি ক্ষিতীন্দ্র, আর তাকেও না। আচ্ছা চলি ক্ষিতীন্দ্র, গুড নাইট।

জুতোর শব্দ তুলে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন আগন্তুক। এতক্ষণ আগন্তুককে একদৃষ্টে দেখছিলাম, এবার আমার সামনে চৌকির উপরে উপবিষ্ট ক্ষিতির দিকে তাকালাম। মনে হল ক্ষিতি যেন কেমন একটু অন্যমনস্ক, তার দুচোখের দৃষ্টি যেন বাইরের অন্ধকারে নিবদ্ধ।

বাইরে শীতের রাত তখন ঝিমঝিম করছে। আর জামসেদপুরে শীতও সেসময় প্রচণ্ড। একেবারে যাকে বলে হাড় কাঁপানো শীত।

খেলা তো আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাসগুলো তখনও সামনে তেমনি ছড়ানো পড়ে আছে। হঠাৎ ক্ষিতি উঠে পড়ল, চলি রে বন্ধু

বললাম, সে কি! খেয়ে যাবি না? কড়াইশুটির খিচুড়ি, ফুলকপি ভাজা করছেন তোর বৌদি।

না, আজ থাক।

আমার স্ত্রী সেদিন খিচুড়ি বেঁধেছিল, বাড়িতে এটা-ওটা রান্না হলেই আমার স্ত্রী ক্ষিতিকে বলত, ক্ষিতিবাবু, রাত্রে আজ খেয়ে যাবেন। ক্ষিতিও সানন্দে সম্মত হয়ে যেত। তাই সেদিন। অবাক হলাম, আশ্চর্য ব্যাপার, ক্ষিতির আহারের ব্যাপার ঔদাসীন্য কখনও আগে দেখিনি।

না, না, সেকি! চল্ খাবি চল, বললাম।

না, আজ চলি। আর একদিন খাওয়া যাবে কথাগুলি বলে ক্ষিতি আর দাঁড়াল না। ঘর ছেড়ে চলে গেল।

তারপর? কিরীটী শুধাল।

তারপর যা ইতিপূর্বে কোন দিন হয়নি তাই হল, দিন দশেক ক্ষিতি আর এলোই না। আমার স্ত্রী একদিন বললে, তোমার বন্ধুর ব্যাপার কি, আর যে আসেন না!

সেইদিনই আমি ক্ষিতির বাসায় গেলাম খোঁজ নিতে। মালতী দেবী বললেন, সে তো নেই!

নেই! কোথায় গিয়েছে?

আমার মনে হয় কলকাতাতেই গিয়েছেন—

কলকাতায়!

হ্যাঁ, তার দীর্ঘ দিনের বন্ধু শিশির গুপ্ত, বোধ হয় সেখানেই গিয়েছেন।

আমিও জানতাম-বঙ্কিম বলতে লাগলেন, ক্ষিতির দীর্ঘদিনের এক বন্ধু ছিল। ভদ্রলোক বোধ হয় সত্যিই ক্ষিতিকে ভালবাসতেন নচেৎ কতবার যে ভদ্রলোকের সঙ্গে ও ঝগড়া বাধিয়ে অকারণ অজুহাতে সম্পর্ক ছেদ করেছে তার গোনাগুনতি নেই। আবার নিজেই গিয়ে ভাব করেছে, কারণ বোধ হয় ক্ষিতি জানত ঐ একটিমাত্র মানুষ সত্যিই তাকে ভালবাসেন। এর দিন দুই পরেই ঐ দুঃসংবাদ পেলাম, ক্ষিতি পুরীর এক হোটেলে আত্মহত্যা করেছে গলায় ক্ষুর চালিয়ে—

কিরীটী থামল। দেবেশ অধিকারী এতক্ষণ একটা কথাও বলেননি। এবার ধীরে ধীরে বললেন; এ যে রীতিমত এক রহস্য রায়মশাই, আপনি তাহলে ঐ রহস্যের একটা কিনারা করতেই এসেছেন পুরীতে?

হ্যাঁ।

কিন্তু তিন বছর আগে যে ব্যাপার ঘটে গিয়েছে—

১৭নং, সেই ঘরের দেওয়ালে কান পাতলে আজও হয়ত অনেক কিছুই শোনা যাবে দেবেশবাবু! সেই রাত্রের সেই ঘটনার সাক্ষী ঐ ঘরের দেওয়ালগুলোই, আর সামনে ঐ সমুদ্র নীল!

এইসব আজগুবী আপনি বিশ্বাস করেন রায়মশাই?

করি বৈকি।

ঐ সময় গোপী এসে বললে, ১৭নং ঘর পরিষ্কার করে বেডিং পেতে দেওয়া হয়েছে। কিরীটীর সঙ্গে একটা সুটকেস ছাড়া বেশী কিছু মালপত্র ছিল না। সেটা গোপী হাতে তুলে নিল। কিরীটী তাকে অনুসরণ করল।

১৭নং ঘর। ঘরে পা দিতেই কিরীটীর কেমন যেন একটা বিচিত্র অনুভূতি জাগে মনের মধ্যে। একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে ঘরটার চারিদিকে দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল কিরীটী। তিন বৎসর আগে এই ঘরেই এক রাত্রে একজন নিহত হয়েছিল বা আত্মহত্যা করেছিল। মোট কথা একজনের দেহান্ত হয়েছিল। তারপর এই তিন বৎসরে জনা দুই ঘরে রাত্রিবাস করবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি। এবং ঐ ঘটনার পর এ ঘরে আর কোন যাত্রীকে রাখা হয়নি।

ভূতের ভয়?

ভূত ইতিপূর্বে কিরীটী দেখেনি বটে তবে তার উপস্থিতি অনুভব করেছে। এবং কিরীটীর একটা বদ্ধমূল ধারণা, ভূতেরা কারও কোন অনিষ্ট করে না। ঘরটা আকারে বেশ বড়ই। সমুদ্রের দিকে পর পর দুটো জানালা। জানালায় মোটা মোটা শিক বসানো, বেশ একটু ফাঁক ফাঁক করেই। খোলা জানালাপথে সমুদ্র সারাটা দৃষ্টি জুড়ে যেন এক আদিগন্ত বিস্ময়কর ছবির মত ভেসে ওঠে! নীল আকাশ চক্ৰবালে নীল সমুদ্রের ওপর ঝুঁকে নিজেকে নিজে দেখাচ্ছে আর দেখছে। দেখার বুঝি শেষ নেই। অজস্র সূর্যালোক। বহু মোচার খোলার মত দোদুল দুলছে ইতি উতি কয়েকটা জেলেডিঙি!

১৮নং ঘরে সরিৎশেখর জানালার কাছ থেকে সরে এল।

অনুরাধা দৃষ্টির বাইরে চলে গিয়েছে। সরিৎশেখর একটা সিগ্রেট ধরালো। খুব বেশী ধূমপান করে না সরিৎশেখর, মধ্যে মধ্যে এক-আধটা সিগ্রেট ধরায়, তাও শেষ পর্যন্ত অর্ধেকের বেশী থাকতেই ফেলে দেয়। ভাবছিল সরিৎশেখর, অনুরাধা তাহলে বিবাহিতা। ঐ সলিল দত্ত মজুমদারকেই বিবাহ করেছে।

অনুরাধা পরস্ত্রী, একজনের গৃহিণী!

সুখী হয়েছে কি অনুরাধা সলিলকে বিবাহ করে?

প্রশ্নটা কেন জানি সরিতের মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে লাগল। হাতে ধরা সিগ্রেটটা। পুড়ে যাচ্ছে একটু একটু করে।

অনুরাধা হেঁটে চলছিল।

পায়ের তলার বালি ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে। তপ্ত বালুকা থেকে যেন একটা তাপ বিচ্ছুরিত হচ্ছে, সমুদ্রের এলোমেলো হাওয়ায় গায়ের কাপড় ঠিক থাকে না।

আজ ২৯শে জুলাই। যেদিন প্রথম সরিতের সঙ্গে ওর আলাপ সেদিনও ছিল ২৯শে জুলাই, প্রচণ্ড বর্ষণ শুরু হয়েছিল সেদিন কলকাতা শহরে। চলতে চলতে অন্যমনস্ক ভাবে অনুরাধা একবার আকাশের দিকে তাকাল, কয়েকটা পাতলা মেঘ ভাসছে আকাশে। ঐ ধরনের মেঘে বৃষ্টি  হয় না। বৃষ্টি নামলে কিন্তু বেশ হত। নামবে কি বৃষ্টি কে জানে। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর চলে এসেছিল অনুরাধা।

কিন্তু তবু একবারও হোটেলে ফেরার কথাটা তার মনে হয় না।

কি হবে হোটেলে ফিরে? এতক্ষণে হয়ত মানুষটা ফিরে এসেছে। ঘরে ঢুকলেই তো তাকে সেই মানুষটার মুখখামুখি হতে হবে। অসহ্য-অসহ্য হয়ে উঠেছে যেন।

অথচ নিষ্কৃতি নেই তার, মুক্তি নেই ঐ মানুষটার বন্ধন থেকে। আজ বুঝতে পারছে যেন অনুরাধা, ঐ লোকটাকে কোন দিন সে কামনা করেনি। কোন দিন সহ্য করতে পারেনি, অথচ ওর হাত থেকে মুক্তিরও কোন পথও জানা নেই তার।

হোটেলের ম্যানেজার দেবেশ অধিকারী বড় একটা বাঁধানোে খাতায় ঝুঁকে পড়ে গত মাসের হোটেলের প্রত্যেক দিনের খরচ-খরচাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। রীতিমত লাভবান ব্যবসাটা, প্রতি বছর লাভের অঙ্কটা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। আজকাল প্রায়ই একটা চিন্তা দেবেশের মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করে—আর একটা হোটেল খুললে কেমন হয়। ছোট ভাই বারানসীতে এম. কম. পাস করে ব্যাংকে একটা চাকরি পেয়েছে বটে কিন্তু কি-ই বা এমন রোজগার করে, ও চাকরি ছেড়ে দিয়ে হোটেলে বসলে অনেক উপার্জন করতে পারবে।

দেবেশ ভাইকে কথাটা অনেকবার বলেছেন কিন্তু সে কান পাতেনি।

একটা জুততার শব্দে মুখ তুলে তাকালেন দেবেশ।

দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি সামনে দাঁড়িয়ে! হাতে একটা ছোট চামড়ার সুটকেস, অনেক দিনের পুরাতন। একমাথা ঝাকড়া পাকা চুল, একমুখ কাঁচা-পাকা দাড়ি। চোখে মোটা কালো সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা। পরনে একটা নোংরা টেরিলিনের প্যান্ট ও গায়ে অনুরূপ একটা টেরিকটের হলদে রঙের শার্ট।

কি চাই?

এ হোটেলে একটা আলাদা ঘর পাওয়া যাবে?

কোথা থেকে আসছেন?

কলকাতা থেকে ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরটা যেন কেমন ভাঙা ভাঙা, একটু কর্কশও।

কিন্তু এ সময় কলকাতা থেকে কিসে এলেন?

কেন ট্রেনে?

এসময় কোন্ ট্রেনে?

এত, প্রশ্ন করছেন কেন বলুন তো, জায়গা আছে কিনা তাই বলুন।

কদিন থাকবেন? ভবেশ অধিকারী আবার প্রশ্ন করেন।

এক মাস থাকতে পারি, সাত দিনও থাকতে পারি, এক দিন বা এক ঘণ্টাও থাকতে পারি, আপনি ফু চার্জ করবেন দেব-ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরে বিরক্তি।

দেবেশ অধিকারী তখনও তাকিয়ে আছেন আগন্তুকের দিকে। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে। ৬৪। ৬৫ তো হবেই—এক আধ বছর বেশী হওয়াও আশ্চর্য নয়। হাফহাতা টেরিটের শার্টের বাইরে দুটো রোমশ বাহুঁ। তামাটে বর্ণ, এককালে হয়ত ভদ্রলোকের গায়ের রঙ ফর্সাই ছিল, এখন পুড়ে গিয়েছে।

এক সপ্তাহের ভাড়া জমা দিতে হবে—শুধু থাকবেন না খাওয়া-দাওয়া করবেন?

রুম-সার্ভিসের ব্যবস্থা আছে?

আছে।

তাহলে ফুডিং লজিং এক সপ্তাহের জন্য কত চার্জ পড়বে?

ত্রিশ টাকা করে রোজ—সাত দিনে–

দুশো দশ তো—এই নিন—ভিতরের পকেট থেকে একটা বহু পুরাতন ম্যানিব্যাগ বের করল আগন্তুক এবং তার ভিতর থেকে একশো টাকার দুটো ময়লা নোট ও ততোধিক ময়লা দশ টাকার একটা নোট বের করে দিল।

মালপত্র আর নেই? খাতায় টাকাটা জমা করে ভবেশ অধিকারী বললেন।

না।

গোপী, এই গোপী—ভবেশ অধিকারী চিৎকার করে ডাকলেন।

গোপী রান্নাঘরে বসে আলু কাটছিল, এসে সামনে দাঁড়াল। কহন্তু—

এই ভদ্রলোককে ১৫নং ঘরটা খুলে দে।

গোপী আগন্তুকের দিকে তাকাল, তারপর বলল, আসুচি–গোপী চলে গেল।

নামধামটা এই খাতায় লিখে দিন স্যার।

লিখতে আমি পারি না—ভদ্রলোক বলেন।

পারেন না, না লেখাপড়া জানেন না?

জানি, কিন্তু লিখতে পারি না।

কেন?

নিউরস্থানিয়ায় ভুগছি, গত তিন বৎসর থেকে কলম ধরতে পারি না। লিখে নিন না—চন্দ্রকান্ত ঘাঁই। পুরী ফ্রম ক্যালকাটা টু ব্যাক ক্যালকাটা।

আগন্তুকের দিকে একবার তাকিয়ে খাতায় লিখে নিলেন দেবেশ অধিকারী।

গোপী এসে বললে, চল বাবু।

ভবেশ অধিকারী খাতায় সময় লিখলেন, বেলা বারোটা চল্লিশ।

চন্দ্রকান্ত গোপীকে অনুসরণ করল। মাঝখানের বাঁধানো চত্বরটা পার হয়ে বাঁদিক দিয়ে দোতলায় উঠবার সিঁড়ি—আগে আগে গোপী, তার পশ্চাতে চন্দ্রকান্ত সিঁড়িতে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দেবেশ অধিকারী কিন্তু তখনও ভাবছেন, কোন্ ট্রেনে ভদ্রলোক এলেন? জগন্নাথ এক্সপ্রেস খুব ভোরে এসে পৌছায়, পুরী এক্সপ্রেস সকাল আটটা সোয়া আটটায় পৌঁছায়, বড় জোর লেট থাকলে নটা। এখন পৌনে একটা বেজে গিয়েছে। ভদ্রলোক কি এ হোটেলে আসার আগে অন্যান্য হোটেলে ঢুঁ মেরে দেখছিলেন ঘর পাওয়া যায় কিনা।

সলিল দত্ত মজুমদার ১৬নং ঘরের মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারি করছিলেন আর বিরক্তির সঙ্গে চিন্তা করছিলেন।

ঐ সরিৎশেখর লোকটা হঠাৎ এখানে কেন এসে উঠল? অনুরাধার পূর্ব প্রণয়ী? ব্যাপারটা কি একান্ত আকস্মিক, না পূর্বের পরিকল্পনামতো লোকটা এখানে এসেছে, তাও রয়েছে ১৮নং ঘরে। অনুরাধা তো জানতই তারা পুরীতে আসছে, হয়ত অনুরাধাই জানিয়ে দিয়েছিল তাকে। এখন তো বোঝাই যাচ্ছে, এই দুই বৎসরেও অনুরাধা সরিৎশেখরকে ভোলেনি। আর সরিৎশেখরও অনুরাধাকে ভোলেনি।

একটা তিক্ত হিংসা যেন সলিল দত্ত মজুমদারের বুকের মধ্যে আঁচড়ে আঁচড়ে তাকে ক্ষতবিক্ষত করছে। এখনও সরিৎশেখরের ঘরেই অনুরাধা।

অনুরাধা যদি নাই জানত সরিৎশেখর আসবে—তবে তার ঘরে গেল কেন।

যাবে নাকি ১৮নং ঘরে, অনুরাধার চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে আসবে?