সামনে সমুদ্র নীল – পরিচ্ছেদ ১১

১১.

ক্ষিতীন্দ্রর সুটকেসের মধ্যেই একটা দীর্ঘ চিঠি পাওয়া গেল।

চিঠিটা দিনদশেক আগে তার স্ত্রী মালতী দেবীকেই লেখা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পোস্ট করা হয়নি।

মালতী,

আমি বেঁচে আছি। তিন বৎসর পূর্বে পুরীর হোটেলে যে মৃতদেহকে তুমি তোমার স্বামী বলে সনাক্ত করেছিলে পুলিসের সামনে, সে আমি নই। আমার বৈমাত্রেয় ভাই জীমূতবাহন চট্টোপাধ্যায়।

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দেখ, আমরা দুভাই একই রকম দেখতে হয়েছিলাম। দুই মায়ের গর্ভে জন্মালেও। তুমি তো তাকে কোন দিন দেখইনি, আমিও ছোটবেলায় মাত্র একবার দেখেছিলাম তাকে!

দাদাকে তার মামারা আসতে দেননি কোন দিন বাবার কাছে, দাদাও আসেননি, মনের মধ্যে একটা ঘৃণা তার মামারা বাবার প্রতি সঞ্চার করেছিল।

আর তুমি হয়তো জান না দাদার এক বোনও ছিল।

তার নাম মুকুল। দাদার থেকে ১৮ মাসের ছোট, তার জন্মের পরই আমাদের সেই মা মারা যান। সেই মার জীবনের শেষের একটা বছর বাবার কাছ থেকে তিনি দূরেই ছিলেন, ছোট বোন, মুকুল তখন মার গর্ভে। বাবাও জানতেন না কথাটা, মা তো তাকে কথাটা জানতেই দেননি।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হওয়ায় দুজনে পৃথক হয়ে যান। মনোমালিন্যের কারণ যতদূর জানা যায়, বাবার অত্যধিক মদ্যপানের অভ্যাস।

আমি তোমাকে অতীতের সব কথা জানাচ্ছি, কারণ তাহলেই তুমি বুঝতে পারবে, কেন তিন বৎসর পূর্বে জীবিত থেকেও আমাকে মৃত্যুর মিথ্যা সংবাদকে মেনে নিতে হয়েছিল। কেন এই দীর্ঘ তিন বৎসর আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে আমাকে।

আমি আবার সংসারে তোমাদের সকলের মাঝখানে ফিরে যেতে চাই মালতী। নতুন করে আবার তোমাদের নিয়ে বাঁচতে চাই। তাই কিছুই গোপন করব না, সব বলব অকপটে।

সলিল দত্ত মজুমদার নামে এক ভদ্রলোককে মুকুল ভালোবাসে, এবং তাদের বিয়েও হয়। মুকুলের সঙ্গে সলিলের বিবাহে অবিশ্যি দাদার পূর্ণ মত ও সহযোগিতা ছিল। দাদা আর সলিল উভয়ে ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সূত্রেই মুকুলের সঙ্গে সলিলের আলাপ।

দাদা আমারই মত ম্যাট্রিক পাস করে আই. এ. পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে দেয়। মামারা তখন তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়, কারণ ঐ বয়সেই দাদা স্মাগলারদের দলে ভিড়ে গিয়েছিল।

আর ওই স্মাগলিংয়ের সূত্রেই সলিল দত্ত মজুমদারের সঙ্গে দাদার আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা। সলিল দত্ত মজুমদার বিলাতফেরত ও একজন বড় অফিসার হওয়া সত্ত্বেও স্মাগলিংয়ে জড়িত ছিল।

লোকটার টাকার নেশা ছিল প্রচণ্ড। মুখোশ ছিল তার বড় একটা কোম্পানিতে বড় একটা পোস্টের চাকরি। তার অন্ধকারের জীবনটা বোধ করি ঐ চাকরি ও পজিশনের দরুণই ধরাছোঁয়ার বাহিরে ছিল।

বিবাহের পর মুকুল যখন তার ঘরে এল সে কিন্তু ঘুণাক্ষরেও এই সব কিছু না জেনেই এসেছিল।

আগেই বলেছি মুকুল ছিল সত্যিই সুন্দরী। দলের একজন হোমরাচোমরা ছিল ইসমাইল খান, লোকটা জাতিতে পাঠান, একদিন মুকুলকে দেখে সে পাগল হয়ে উঠল।

সোজাসুজিই সে সলিলকে কথাটা বললে। সলিল দত্ত মজুমদারকে ইসলাইমের প্রস্তাবে রাজী হতে হল, কারণ তা ছাড়া তার উপায় ছিল না। এক রাত্রে ঘুমন্ত মুকুলের শয়নকক্ষে ইসমাইলকে ঢুকিয়ে দিল সলিল।

কিন্তু ইসমাইল খান জানত না মুকুল কি প্রকৃতির মেয়ে, সে ধর্ষিতা হল বটে কিন্তু তাকে শেষ পর্যন্ত মুকুলের হাতেই প্রাণ দিতে হল পিস্তলের গুলিতে।

তারপর সেই পিস্তলের সাহায্যেই মুকুল আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। অবশেষে তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে। সব ব্যাপারটা ঘটে সলিল দত্ত মজুমদারের দেওঘরের বাড়িতে।

রাতারাতি ইসমাইলের মৃতদেহটা সলিল দত্ত মজুমদার পাচার করে দিল। আর মুকুলকে পাঠিয়ে দিল রাঁচীর পাগলা গারদে। সে এখন বদ্ধ উন্মাদ।

কোন প্রমাণই ছিল না। সলিল দত্ত মজুমদার রটিয়ে দিল মুকুল নিরুদ্দিষ্টা।

দাদা কিন্তু খুঁজে বেড়াতে লাগল মুকুলকে।

ঐ সময় অনুরাধা এল আকস্মিক ভাবে সলিল দত্ত মজুমদারের জীবনে। অনুরাধা একজনকে ভালবাসত কিন্তু সলিল দত্তর চাতুরিতে কিছুটা এবং কিছুটা একটা সাচ্ছল্যের জীবনের জন্য সে ভুলে গেল সব কিছু।

দাদা বরাবরই সলিল দত্তর উপর নজর রেখেছিল, হঠাৎ সে সংবাদ পেল সলিল দত্ত পুরীতে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে দাদা স্থির করে সে পুরীতেই যাবে এবং তার সঙ্গে শেষবারের মত দেখা করবে। মুকলের ব্যাপারে একটা হেস্তনেস্ত করবে। কিন্তু একা সম্ভব নয়, তাই সে জামসেদপুরে গিয়েছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি সেরাত্রে বঙ্কিমের গৃহে তাকে চিনেও না চেনবার ভান করলাম। দাদা সেখান থেকে বের হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমিও উঠে পড়লাম। আমি বুঝেছিলাম আমার সঙ্গে দেখা না করে ও কথা না বলে দাদা যাবে না। ঠিক তাই হল, মাঝপথেই তার সঙ্গে আমার দেখা হল।

ক্ষিতি!

কে? দাঁড়ালাম আমি। থমথমে অন্ধকার রাত। পথে জনমিনিষ্যি নেই।

দাঁড়া। আমি জীমুত—

কি চাই? কেন এসেছ? আমি শুধালাম।

মুকুলের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।

কোথায় সে? বেঁচে আছে তাহলে?

হ্যাঁ, বদ্ধ উন্মাদ। আছে রাঁচীর পাগলা গারদে।

কি করে জানলে?

ইসমাইল খানের ব্যাপারটা আমাকে বলে গেল জীমূতবাহন।

শুধালাম, কি করে এসব কথা জানলে?

দলের লোকেদের কাছ থেকেই জেনেছি। শোন যেজন্য এসেছি, আজ শুক্রবার, সামনের বুধবার তুই চলে আয় পুরী। আমি ঐদিনই পুরী পৌছাব। সলিল পুরীতে যাচ্ছে, মুখোমুখি একটা মোকাবিলা করতে হবে ঐ শয়তানটার সঙ্গে। আমি একা থাকলে হবে না—তুইও আসবি।

আমি রাজী হয়ে গেলাম। আর তিন দিন বাদেই পুরী রওনা হলাম।

হোটেলে পাশাপাশি ঘরে আমরা ছিলাম। আমি ও দাদা ১৭নং ঘরে, আর ১৮নং ঘরে সলিল দত্ত মজুমদার। যে রাত্রে পুরীতে পৌঁছাই, সেই রাত্রেই ঘটনাটা ঘটল।

সলিলের হাতে ঘুমের মধ্যে জীমূতবাহন নিহত হল।

পিছন থেকে তার গলায় ধারাল অস্ত্র চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।

সেরাত্রে খুব বেশী মদ্যপান করে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম, দুই ভাইয়ে মিলে দুবোতল প্রায় শেষ করেছিলাম। তখনও জানি না, সলিল পাশের ঘরেই আছে। আমি জানতাম সে তখনও হোটেলে এসে পৌঁছায়নি।

শেষরাত্রের দিকে ঘুমটা ভেঙে যেতে দেখি ঐ বীভৎস দৃশ্য। দাদা নিহত।

ভয়ে পালালাম আমি। পাছে আমাকেই পুলিস খুনী বলে ধরে।

দাদার কথা শুনে পুরীতে এসে ভুল করেছিলাম, আবারও ভুল করলাম পালিয়ে গিয়ে সেই শুরু হল আমার অজ্ঞাতবাস। এই তিনটে বছর যে আমার কিভাবে কেটেছে বেঁচেও মরে আছি আমি।

শেষ পর্যন্ত এই ব্যাপারের একটা হেস্তনেস্ত—

ব্যাস, ঐখানেই চিঠি শেষ। চিঠিটা ঐ পর্যন্তই লেখা—আর লেখা হয়নি।

চিঠিটা হাতে করে কিরীটী বসে রইল অনেকক্ষণ। তারপর একসময় চিঠিটা পকেটে নিয়ে বের হয়ে এল। রাত তখন প্রায় সোয়া নটা।

১৭নং ঘরে মালতী ছিলেন। কিরীটী তার ঘরেই থাকবার ব্যবস্থা করেছিল মালতীর এবং নিজে নীচের একটা ঘরে শিট করেছিল।

দরজা বন্ধ দরজার গায়ে টোকা দিতেই সাড়া এল।

কে?

মালতী দেবী, আমি কিরীটী রায়–দরজাটা খুলুন।

মালতী দরজা খুলে দিল।

ঘরে আসতে পারি?

আসুন। দরজা ছেড়ে দিলেন মালতী।

এই চিঠিটা পড়ে দেখুন।

কার চিঠি? কিসের চিঠি? মালতী শুধালেন।

চিঠিটা আপনার স্বামীর লেখা আর আপনাকেই লেখা–চিঠিটা শেষ করতে পারেননি, তাই হয়তো পোস্ট করেননি।

কোথায় পেলেন এটা?

আপনার স্বামীর সুটকেসে। পড়ে দেখুন–আপনার সমস্ত প্রশ্নেরই উত্তর এর মধ্যে পাবেন।

 মালতী হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলেন।

মালতী কিরীটীর হাত থেকে চিঠিটা নিলেন বটে কিন্তু মনে হল তার জন্য যেন মনের মধ্যে। কোন তাগিদ ছিল না। কোন ইচ্ছা বা আগ্রহও না।

কিরীটী আর দাঁড়াল না।

কিরীটী স্থির করেছিল পরের দিনই সে চলে যাবে। মালতী দেবীর কাজটুকু যখন শেষ হয়ে। গিয়েছে, পুরীতে থাকা তো আর প্রয়োজন নেই।

কেবল একটা কাজ বাকি। হোটেলের বোর্ডারদের গতিবিধির উপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল, হেমন্ত সাহুকে বলে তার একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া। হোটেল থেকে এখনও কেউ যাননি।

রাত্রে আহারাদির পর নিজের ঘরে বসে বসে কিরীটী সেই কথাটাই ভাবছিল। রাত তখন গোটা দশেক হবে।

থানা থেকে হেমন্ত সাহুর লোক এল তার একটা চিঠি নিয়ে।

সাব, হুজুর আপনাকে একবার থানায় যেতে বলেছেন।

কিরীটী আর দেরী করে না। উঠে পড়ল। লোকটা একটা সাইকেল-রিকশা এনেছিল। উঠে বসল কিরীটী সাইকেল-রিক্‌শায়।

শ্রাবণের আকাশটা আজ পরিষ্কার, কোথাও কোন মেঘের চিহ্নমাত্রও নেই। ঝকঝক করছে। আকাশভরা একরাশ তারা।

সমুদ্রের একটানা গর্জন, বাতাস হু-হু করে ভেসে আসছে। কালো কালো ঢেউগুলো শুভ্র। ফেনার মুকুট মাথায় বালুবেলার ওপরে ভেঙে ভেঙে পড়ছে।

থানার অফিসঘরেই হেমন্ত সাহু বসেছিলেন, আর তার সামনে মুখখামুখি বসেছিল যে লোকটা তাকে দেখে কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে একটা ক্ষীণ হাসির রেখা জেগে ওঠে-সলিল দত্ত মজুমদার।

এই যে আসুন মিঃ রায়, হেমন্ত সাহু বললেন।

কিরীটী একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।

আমি জানতে চাই দারোগাবাবু-সলিল দত্ত মজুমদার বললে ভুবনেশ্বরের হোটেল থেকে আমাকে এখানে এভাবে ধরে আনা হল কেন?

জবাব দিল কিরীটীই, দাবোগাবাবুর কঠিন নির্দেশ সত্ত্বেও আপনি গতকাল কাউকে কিছু না। বলে হোটেল থেকে পালিয়েছিলেন কেন?

পালিয়েছিলাম। কে আপনাকে বললে?

যেভাবে চলে গিয়েছিলেন সেটা পালানো ছাড়া আর কি!

আমি কারও হুকুমের চাকর নই।

কিন্তু আইন যে কোন সময় আপনার গতি রুখতে পারে–

অন্যায় আইন—

ন্যায়-অন্যায়ের বিচারটা পরে হবে, আপনি পালিয়েছিলেন কেন তাই বলুন?

আবারও বলছি, আমি পালাইনি—চলে গিয়েছিলাম।

কিন্তু আপনার বোঝা উচিত ছিল ঐভাবে চলে গেলেই আইনের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না। শুনুন, আপনাকে অ্যারেস্ট করে আনা হয়েছে।

অ্যারেস্ট। শুনতে পারি কি কিজন্য?

আপনার বিরুদ্ধে তিন-তিনটি হত্যার অভিযোগ!

কি পাগলের মত আবোলতাবোল বকছেন?

তিন বৎসর আগে পুরীর হোটেলে এক রাত্রে জীমূতবাহন চট্টোপাধ্যায়কে হত্যা করেন আপনি, এবং তিন বৎসর পরে আরও দুজনকে পর পর হত্যা করেন—প্রথমে অনুরাধা দেবী ও পরে ক্ষিতীন্দ্রবাবুকে–

মশাই গাঁজা-টাজা সেবন করেন নাকি?

আপনি বলতে চান আপনি ঐ হত্যাগুলি করেননি?

নিশ্চয়ই না–সলিল দত্ত মজুমদারের কণ্ঠস্বরে এতটুকু কোন দ্বিধা বা সংকোচমাত্রও নেই, শান্ত, নিরুদ্বিগ্নতা ঐ অদ্ভুত আজগুবি চিন্তাটা আপনাদের উর্বর মস্তিষ্কে কি করে এবং কেনই বা এল জানতে পারি কি?

নিশ্চয়ই। কিরীটীও অনুরূপ শান্ত গলায় জবাব দিল, জানতে পারেন বৈকি।

বক্র হাসি দেখা গেল সলিল দত্ত মজুমদারের ওষ্ঠপ্রান্তে, আমিই যে তাদের হত্যা করেছি তার কোন প্রমাণ কি আপনাদের কাছে আছে?

প্রমাণ ছাড়া কি দাবোগাবাবু আপনার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেছেন?

তাই নাকি? তা কি প্রমাণ আছে আপনাদের হাতে বলুন তো?

মোটামুটি যে চারটি প্রমাণ—

চারটি প্রমাণ।

 হ্যাঁ। কিরীটী শান্তগলায় বললে, যে রাত্রে অনুরাধা দেবীকে হত্যা করা হয়–

সেরাত্রে তো হোটেলের ত্রিসীমানায়ও আমি ছিলাম না। আমি ভুবনেশ্বরে গিয়েছিলাম, ম্যানেজার ভবেশবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারতেন।

সে অ্যালিবাইটা আপনার ধোপে টিকবে না, কারণ সেরাত্রে আপনি আদৌ ভুবনেশ্বরে যাননি। আর জগন্নাথ পাণ্ডাই সে সাক্ষ্য দেবে। মনে হল আপনি যেন একটু চমকে উঠলেন : মিঃ দত্ত মজুমদার, আপনার একটা কথা জানা প্রয়োজন, জগন্নাথ পাণ্ডা আপাতত নিরাপদ জায়গাতেই অবস্থান করছে—আদালতেই যা বলবার সে বলবে; তারপর ২ নং প্রমাণ আপনার ব্যবহৃত বিলেত থেকে আনা রেইনকোট, মানে ওয়াটারপ্রুফটা—যেটা আপনি সেরাত্রে জলঝড়ের মধ্যে ব্যবহার করেছিলেন—তারপর আপনার কাজকর্ম চুকে যাবার পর হোটেল থেকে বের হয়ে গিয়ে সমুদ্রতীরে একটা কাঁটাঝোপের মধ্যে ফেলে দিয়ে এসেছিলেন। সেটার স্থানে স্থানে এখনও যথেষ্ট রক্তচিহ্ন আছে—যে রক্ত কেমিক্যাল অ্যানালিসিসে প্রমাণ করবে অনুরাধা দেবীরই রক্ত, সেটা এখন সেরাত্রের হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রমাণ হিসাবে থানায়-ই আছে।

শেষের কথাগুলো শুনতে শুনতে কিরীটীর মনে হল যেন সলিল দত্ত মজুমদারের মুখের চেহারাটা কেমন পালটে যাচ্ছে।

এবার আসা যাক তৃতীয় প্রমাণে—আপনার পিস্তলটা, যেটার সাহায্যে তৃতীয় দিন রাত্রে আপনি আপনার হতভাগ্য নির্বোধ সম্বন্ধী ক্ষিতীন্দ্রবাবুকে হত্যা করেছিলেন, সেই পিস্তলটা আজ শেষরাত্রে একজন জেলে সমুদ্রের কাছে কুড়িয়ে পেয়েছে—ঐ পিস্তলের নম্বরটাই প্রমাণ দেবে, ঐ পিস্তলের লাইসেন্স হোল্ডার কে!

কিরীটীর মনে হল, সলিল দত্ত মজুমদারের থুতনীটা যেন ঝুলে পড়েছে।

বলছিলাম না চারটি প্রমাণ আপাতত আমাদের হাতে আছে, চতুর্থ প্রমাণ হল ক্ষিতীন্দ্রবাবুর অসমাপ্ত একখানা চিঠি। সারাটা জীবন ধরে নির্বুদ্ধিতা করে করে বোধ হয় মৃত্যুর আগে ঐ একটিমাত্র বুদ্ধির কাজ করতে উদ্যত হয়েছিলেন ক্ষিতীন্দ্রবাবু তার স্ত্রী মালতী দেবীকে ঐ চিঠিটা লিখতে বসে—এখন বুঝতে পারছেন দত্ত মজুমদার সাহেব, গরল আর পাপ কখনও চাপা থাকে না, তিন বৎসর আগেকার চাপা পাপও আজ এতদিন পরে প্রকাশ হয়ে পড়ল!

সলিল দত্ত মজুমদার একেবারে চুপ। কেমন যেন অসহায় বোবাদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কিরীটীর মুখের দিকে।

সেইদিনই হয়তো আপনি ধরা পড়তেন, যদি না নির্বোধ ক্ষিতীন্দ্রবাবু প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আত্মগোপন করে থাকতেন। অবিশ্যি আপনাকে পরোক্ষভাবে ক্ষিতীন্দ্রবাবুর অতি চালাক ও বুদ্ধিমতী স্ত্রী মালতী দেবীও কিছুটা সাহায্য করেছিলেন। তার নিজের স্বামী বলে জীমূতবাহনের দেহটা identify করে। যাক গে সেকথা, সে রাত্রে জীমূতবাহনের মুখ বন্ধ করবার জন্য তাকে কি ভাবে হত্যা করেছিলেন তা আমরা জানতে চাই না, জানবার আর প্রয়োজনও নেই, যে দুটি হত্যার প্রমাণ আমাদের হাতে আছে তাই যথেষ্ট। কিন্তু আমার প্রশ্ন : আপনি তো ভাল করেই জানতেন, অনুরাধা দেবীকে ডঃ সেন ভালোবাসেন। তা জানা সত্ত্বেও ভদ্রলোকের কাছ থেকে অনুরাধাকে অমন করে ছিনিয়ে এনেছিলেন কেন?

হঠাৎ ঐ সময় সলিল দত্ত মজুমদার হাঃহাঃহাঃ করে উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠলেন।

মিঃ দত্ত মজুমদার–কিরীটী ডাকল।

কিন্তু দত্ত মজুমদার তখনও হাসছে হাঃ হাঃহাঃ! থানার ঘরের দেওয়ালগুলোতে যেন সেই হাসির শব্দ প্রতিহত হয়ে ঠিকরে ঠিকরে যেতে লাগল।