১. উচ্চ শিক্ষার জন্য পাড়ি জমালেন যুক্তরাষ্ট্রে। পড়াশোনা শেষে কর্মজীবনেও প্রবেশ করলেন সেখানেই। কিন্তু ১৯৯৪ সালে দেশে ফিরে এসে শুরু করলেন নতুন জীবন_ কোনো বিশেষ স্বপ্ন বা বোধ দ্বারা তাড়িত হয়েছিলেন কি?
* অনেকেই আমাকে এই প্রশ্নটি করে এবং আমার মনে হয় আমি কাউকেই বিষয়টি বোঝাতে পারি না। ‘কোনো বিশেষ স্বপ্নবোধ দ্বারা তাড়িত হয়ে’ আমি দেশে ফিরে আসিনি, আমি দেশে ফিরে এসেছি কারণ এটা আমার দেশ। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। একজন মানুষের মা যদি সাদাসিধে অশিক্ষিতা বৃদ্ধা একজন মহিলা হয়, তখন মানুষটি কিন্তু ফিটফাট সুন্দরী কমবয়সী একজন মহিলা খুঁজে বের করে না মা ডাকার জন্য! যখন মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করে সেই সাদাসিধে অশিক্ষিতা বৃদ্ধা মহিলার কাছে গিয়েই তার পায়ের কাছে বসে থাকে। এখানেও তাই, যুক্তরাষ্ট্রের হাইফাই পরিবেশে যত ভালো ভালো বিষয়ই থাকুক সেটা তো আমার দেশ নয়। আমার যদি আকাশ কালো করে আসা মেঘ, ঝমঝম বৃষ্টি, ব্যাঙের ডাক আর কালো শ্যামলা মানুষ দেখার ইচ্ছা করে, আমি কী করব?
কাজেই আবার একবার বোঝানোর চেষ্টা করি, আমি কোনো বড় উদ্দেশ্য বা স্বপ্ন নিয়ে দেশে ফিরে আসিনি। নিজের দেশে থাকার জন্য ফিরে এসেছি। অত্যন্ত চমৎকার একটা জীবনের লোভে নিজের দেশে থাকার আনন্দটুকু হারাতে আমি রাজি নই। আমি এত বেশি বোকা না।
২. সে স্বপ্ন পূরণে কতটা এগোলেন?
* যেহেতু স্বপ্ন নিয়ে আসিনি তাই স্বপ্ন পূরণ বিষয়টি আসে না। তবে দেশে ফিরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে করতে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, দিন চলতে চলতে নতুন নতুন পরিকল্পনা মাথায় এসেছে কিছু কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে, কিছু হয়নি! সবাইকে নিয়ে এখন নতুন নতুন স্বপ্ন দেখি কিছু পূরণ হবে, কিছু হবে না।
এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলে দেওয়া দরকার, স্বপ্ন পূরণ হতেই হবে সেটা কিন্তু সত্যি নয়। স্বপ্ন দেখতে হয় আর সেটার জন্য কাজ করতে হয় সেটা হচ্ছে সত্যি।
৩. স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আমাদের অর্জন নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে, হতাশাও কম নেই। এমন বাস্তবতাতেও আমরা যতটুকু দেখি, আপনি অসম্ভব আশাবাদী একজন মানুষ। এবং যে তারুণ্যকে কেউ কেউ সমাজের ঘুণে ধরা অংশ হিসেবে দেখতে চান আপনার পদচারণা সেই তারুণ্যকে কেন্দ্র করে_ লেখালেখি বা কর্মকাণ্ড সব সময় তাদের সঙ্গে কেন?
আমি আলাদাভাবে যুক্তিহীন বারাবাড়ি আশাবাদী মানুষ সেটি সত্যি নয়_ আমি যে জীবনের ভেতর দিয়ে এসেছি সেখানে অন্য রকম কিছু হওয়াটাই অস্বাভাবিক। ১৯৭১ সালে তাড়া খাওয়া পশুর মতো ছুটে বেড়িয়েছি, একটি দিন শেষ হওয়ার পর অন্য একটা দিন শুরু হবে কি-না জানতাম না! যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে বেড়িয়েছি, রক্ষীবাহিনী বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর রাস্তায় রাত কাটিয়েছি, পরের বেলা কোথা থেকে খাবার আসবে জানতাম না, এমন দিন গিয়েছে যে, বাসায় একটা শার্ট, সেটা পরে কখনও বড় ভাই বাইরে গেছে, সে ফিরে এলে সেই শার্ট পরে আমি বাইরে গেছি। আমাদের খুব সৌভাগ্য যে, আমরা একটা অসাধারণ মা পেয়েছি, যিনি আমাদের পুরো পরিবারটাকে ধরে রেখেছেন এবং আমরা টিকে গেছি। এই দেশে সেই দুঃসময়ে অসংখ্য পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই ভয়ঙ্কর পরিবেশে আমি কিংবা আমরা যারা বেঁচে এসেছি তাদের কে ভয় দেখাবে? কে হতাশ করবে?
সব বুড়ো মানুষই তারুণ্যকে ঘুণে ধরা বলে। এখন যারা তরুণদের গালাগাল করেন তারা যখন কম বয়সী ছিলেন তখন তাদের বাবা-চাচারা তাদের গালাগাল করেছেন! কাজেই এগুলোকে আমি সিরিয়াসলি নিই না। আমি বিশ্বাস করি, সবার ভেতরেই একজন ভালো মানুষ থাকে, তাকে ঠিকভাবে স্পর্শ করলেই সে বের হয়ে আসে।
আমার ‘পদচারণা’ বা কর্মকাণ্ড সব সময় তারুণ্যকে কেন্দ্র করে, কারণ আমার সেটাই ভালো লাগে। একজন বুড়ো মানুষকে নতুন করে কিন্তু শেখানো যায় না_ কিন্তু কম বয়সী তরুণরা কিন্তু নতুন কিছু শিখতে রাজি আছে। স্বপ্ন দেখতে রাজি আছে।
৪. তরুণদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আপনাকে দাঁড়াতে হয়েছে; দাঁড়িয়েছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতেও_ হুমকি-ধমকিও শুনতে হয়েছে, নিজেকে কখনও বিপন্ন মনে হয়েছে কি?
* না, নিজেকে কখনই বিপন্ন মনে হয়নি, প্রশ্নই ওঠে না। যখনই দুঃসময় এসেছে তখন চারপাশে আরও বেশি মানুষ এসে আরও নতুনভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। আজকাল ইন্টারনেটে তরুণরা অনেক বেশি সময় কাটায়_ আমি শুনেছি সেখানে কেউ যখন আমার বিরুদ্ধে [কিংবা আমার পরিবারের বিরুদ্ধে] একটা কুৎসিত কথা বলে তখন অসংখ্য তরুণ সেটাকে তাদের মতো করে প্রতিবাদ করে। মানুষের ভালোবাসা একটি অসাধারণ বিষয়, আমি সেই ভালোবাসাটুকু অনুভব করতে পারি। আমি সব সময় সৃষ্টিকর্তাকে বলি তিনি যেন আমাকে সেই শক্তিটুকু দেন যেন আমি কখনও কারও ভালোবাসার অমর্যাদা না করি।
৫. এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসা যাক- মাত্র ৭ বছর বয়সে সায়েন্স ফিকশন লেখা দিয়ে শুরু করে ছিলেন লেখালেখি পর্ব। সেখক হওয়ার ইচ্ছেটা এলো কিভাবে?
* মনে হয় এটা জেনেটিক। বাবা লিখতেন, মা লেখেন, ভাইয়েরা লেখে, বোনেরাও লেখে, এখন তাদের ছেলেমেয়েরাও লেখে! আমরা বইয়ের মাঝে বড় হয়েছি, কাজেই বই পড়তে পড়তে লেখার ইচ্ছে করবে সেটাই স্বাভাবিক। পরিবারে সেটা নিয়ে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে তাই লেখালেখি করেছি। সত্যি কথা বলতে কী, লেখালেখি না করাটাই হয়তো অস্বাভাবিক হতো। তবে লেখালেখি করে লেখক হিসেবে পরিচিতি হবে সেটা কখনোই মাথায় ছিল না, লেখালেখি করেছি মনের আনন্দে!
৬. দীপু নাম্বার টু’র দীপু বা কাজলের দিনরাত্রির কাজল কিংবা আমি তপু’র তপুর মধ্যে মুহম্মদ জাফর ইকবালের কৈশোরকে দেখার সুযোগ কতটুকু?
* কিশোর উপন্যাসের প্রায় সবগুলোতেই আমার [কিংবা আমার প্রজন্মের] কৈশোরের ছাপ পাওয়া যেতে পারে। তবে ‘কাজলের দিনরাত্রি’ বা ‘আমি তপু’ একটু ব্যতিক্রম_ এই বই দুটির চরিত্রগুলোর যে জটিলতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে আমার জীবনে কখনোই সেই জটিলতা ছিল না!
৭. কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখছেন, সে সময় শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। আপনার বাবা যুদ্ধে গেলেন, আপনি গেলেন না?
* আমার বাবা যে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে অস্ত্র হাতে পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন তা নয়। পুলিশ অফিসার ছিলেন, সেই হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন, যার জন্য পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে অনেক চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি। সবার কপালে সবকিছু থাকে না, আমার কপালে এটা ছিল না। সৃষ্টিকর্তা আমার সব ইচ্ছা পূরণ করেছেন, এটা করেননি, কেন করেননি জানি না! [কে জানত পাকিস্তানিরা এত ভীরু, কাপুরুষ আর দুর্বল যে, মাত্র নয় মাসে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাবে!]
৮. মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশ, ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে নতুন এক রাষ্ট্রের পথচলা এবং আপনি বিশ্ববিদ্যালয় পুড়ূয়া এক শহীদ পরিবারের সন্তান_ সে দিনের সংগ্রামটা বলবেন কি?
* সেটি ছিল খুব কঠিন সময়, খানিকটা আগেই বলেছি। তখন বুঝতে পারিনি, এখন যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন মাঝে মধ্যে অবিশ্বাস্য মনে হয় যে, কেমন করে আমরা টিকে ছিলাম। দুঃখ কষ্ট ঝামেলা দুর্বলতার কথা বলতে ভালো লাগে না, তাই সেগুলো আবার না বললাম। কিন্তু কেউ যেন মনে না করে সময়টুকু শুধু দুঃসময় ছিল_ একই সঙ্গে সেটি ছিল আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের মাথা তুলে দাঁড়ানোর সময়। ‘গেরিলা’ নামে যে অসাধারণ ছায়াছবিটি নাসিরুদ্দীন ইউসুফ তৈরি করেছেন তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নাসিরুদ্দীন ইউসুফের পরিচালিত, সেলিম আল দীনের লেখা নাটকে আমিও অভিনয় করেছিলাম, যেটি টিএসসিতে মঞ্চস্থ হয়েছিল। নির্মলেন্দু গুণের কবিতার বই প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশিত হলো, আমরা মুগ্ধ হয়ে সেই কবিতাগুলো পড়তাম। শাহাদত চৌধুরীর সম্পাদিত বিচিত্রা তখন একমাত্র সাময়িকী_ কী আধুনিক পত্রিকা! আমার লেখা প্রথম ছোটগল্প ‘ছেলেমানুষী’ প্রকাশিত হলো_ গর্বে মাটিতে আমার পা পড়ে না। গান, কবিতা, ছোটগল্প, নাটক, বিজ্ঞান সবকিছু নিয়ে সত্যিকারের রেনেসাঁ।
৯. পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন কলাম বা নিবন্ধে সমাজ এবং রাজনীতি সচেতন একজন প্রগতিশীল জাফর ইকবালকে আমরা পাই। এসব বিষয়কে উপজীব্য করে ঔপন্যাসিক হিসেবে আপনাকে আমরা পাই না…।
* পাবেন না! ছোট বাচ্চারা আমাকে খুন করে ফেলবে। তারা আমাকে বলেছে সবাই বড়দের জন্য লেখে, খবরদার আপনি বড়দের জন্য লিখতে পারবেন না। আমাদের দেশের সাহিত্যিকদের জন্য আমি অবশ্য একটু দুঃখ অনুভব করি, খুবই সীমিত কিছু বিষয়ে আরও সীমিত প্রকাশ ভঙ্গিতে তাদের লিখতে হয়। এই মুহূর্তে পৃথিবীর অন্য সাহিত্যিকরা যেভাবে লিখতে পারেন, তাদের যে অবিশ্বাস্য স্বাধীনতা আছে, আমাদের লেখকদের তার বিন্দুমাত্র নেই।
১০. বর্তমান প্রজন্ম মেধাবী, অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তবে, আপনাদের বেড়ে ওঠা এবং বর্তমান প্রজন্মের বেড়ে ওঠা- পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমস্যা কোথায় যে কারণে একটা পর্যায়ে এসে তাদের অনেককেই হতাশায় পেয়ে বসছে আর এগোতে পারছে না?
* তাই নাকি? আমি তো জানি না! যদি সত্যিই হয়ে থাকে তাহলে সম্ভবত সেটা একটা ফ্যাশন। আমি যখন ট্রেনে করে আসি এবং জানালা দিয়ে মাথা বের করে একটা কিশোর কিংবা কিশোরীকে কলা, ঝালমুড়ি, চিনা বাদাম, কিংবা খবরের কাগজ বিক্রি করতে দেখি, তাদের মাঝে বিন্দুমাত্র হতাশা দেখতে পাই না, তারা রীতিমতো যুদ্ধ করে যাচ্ছে। ভোরবেলা যখন গামেন্টের মেয়েরা হাসতে হাসতে কথা বলতে বলতে কাজ করতে যায়, তখনও আমি তাদের মাঝে কোনো হতাশা দেখি না। তারা কিন্তু সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
‘হতাশা’ নামের এই ‘বিলাসী’ শব্দটি শুধু সেই তরুণদের, যারা পরিবার সমাজ আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সব সুযোগ পেয়েছে। আমি এই দলটিকে নিয়ে সময় নষ্ট করতে চাই না। শত ঝামেলার মাঝে থেকেও যারা কখনও হতাশ হয় না, তারা হচ্ছে সমাজের আসল শক্তি_ আমি আসলে তাদের মুখ চেয়ে থাকি, তাদের জন্য কাজ করি।
১১. প্রচুর সায়েন্স ফিকশন, কিশোর উপন্যাস, গল্প, এমন কি ভূতের গল্পও লিখেছেন, এরপর আপনাকে আমরা দেখি ইতিহাসকার হিসাবে। লিখলেন ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’। মাত্র ২২ পৃষ্ঠায় এত বড় একটা ক্যানভাসকে ধারণ! ভেতরের গল্পটা বলবেন?
* ভেতরের গল্পটা সহজ। জোট সরকারের আমলের একটা শ্বাসরুদ্ধকর সময়, মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার, অবমাননা করার সব রকম চেষ্টা চলছে। আমরা সমমনা বেশকিছু মানুষ বসেছি কী করা যায় সেটা নিয়ে কথা বলতে। অনেক সুন্দর সুন্দর পরিকল্পনা এসেছে, আমি তার মাঝে বললাম, আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। নতুন প্রজন্ম যদি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটুকু জানে তাহলে তারা দেশের জন্য যে ভালোবাসা অনুভব করবে সেটি আর অন্য কোনোভাবে সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটুকু হবে ছোট, যেন এক কাপ চা খেতে খেতে পড়ে ফেলতে পারবে, বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে পড়ে ফেলতে পারবে কিংবা দুই ক্লাসের মাঝখানে পড়ে ফেলতে পারবে। প্রতিটি লাইনের রেফারেন্স থাকবে যেন কেউ এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে। ইতিহাসটি হবে এক ফর্মার নিউজপ্রিন্টের হ্যান্ডবিলের মতো, পড়ে ফেলে দিলেও ক্ষতি নেই। মূল্য হবে খুব কম যেন পয়সা খরচ না হয়!
যারা উপস্থিত ছিলেন তারা আমার প্রস্তাবটি লুফে নিলেন, কিন্তু নিউজপ্রিন্টের হ্যান্ডবিল করতে রাজি হলেন না সেটা যেন সংগ্রহ করে রাখে সেই রূপটি দেবেন বলে ঠিক করলেন। সেই ঘরটিতে একটি কম বয়সী বাচ্চা মেয়ে ছিল, সে ইতস্তত করে বলল, ‘যদি সেই ইতিহাসটি জাফর ইকবাল স্যার লেখেন তাহলে আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরাও সেটা পড়ে ফেলবে।’ তার কথাটা মেনে নিয়ে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো।
এই হচ্ছে ইতিহাস। এটা লিখতে আমাকে যে পরিশ্রম করতে হয়েছে সেই পরিশ্রম করে দশটা সায়েন্স ফিকশন লেখা যেত। শেষ পর্যন্ত এক ফর্মার মাঝে আটকানো যায়নি, একটু বড় হয়ে গেছে!
১২. বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়ার পর একাডেমি মাঠেই তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন- ভালো লাগছে কিন্তু একই সঙ্গে খারাপ লাগাও আছে। আহমদ শরীফ স্যারকেই এ পুরস্কার দেওয়া হয়নি? এ ব্যাপারে বলবেন?
* আমি আহমদ শরীফ বলিনি, যতদূর মনে আছে আহমদ ছফা বলেছিলাম। তার মতো এত বড় লেখক পাননি, কিন্তু আমার মতো একজন পাতি লেখক পেয়ে গেল সেটা খুব লজ্জার বিষয়। বাংলা একাডেমীর পুরস্কার পাওয়ার পর প্রতি বছরই এই পুরস্কারের মনোনয়ন দেওয়ার জন্য আমার কাছে চিঠি পাঠানো হয়। মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়ার প্রথা চালু করে আহমদ ছফাকে পুরস্কার দেওয়ার জন্য আমি অনেকবার প্রস্তাব দিয়েছি, আমার প্রস্তাবকে কেউ গুরুত্ব দেয়নি।
আমার পুরস্কারের ব্যাপারে একটা মজার তথ্য আছে। আমাকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে ‘ভাষা ও সাহিত্যে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের’ জন্য। আমি যখন পুরস্কার পেয়েছি, তখন আমি মাত্র দুটি পাতলা জিলজিলে বিজ্ঞানের বই লিখেছি, এর জন্য কাউকে এত বড় পুরস্কার দেওয়া ঠিক নয়। আমার খুব লজ্জা লেগেছে, তাই এখন প্রতি বছরই বিজ্ঞানের ওপর লিখতে চেষ্টা করি যেন পুরস্কারটা হালাল হয়।
আরও একটা বিষয় হয়তো বলা যায়, আগে জানতাম না এখন টের পেয়েছি পুরস্কার পাওয়ার জন্য অনেক লেখক নিজেরাই অনেক ধরাধরি করেন, সেটা দেখে আমার খুব অস্বস্তি হয়। অনেক বড় লেখক যেহেতু এই পুরস্কার পাননি তাই এই পুরস্কার না পাওয়াটাই তো অনেক সময় সম্মানজনক।
১৩. আমরা অনেক কিছুতেই প্রভাবিত হই_ ব্যক্তি, বিষয়, ঘটনা। আপনার জীবনে তেমন কিছু আছে কি?
* অবশ্যই আছে, অনেক কিছুই আছে। সেই ঘটনাগুলো আমি আমার লেখালেখিতে উল্লেখও করেছি। যেহেতু এই মুহূর্তে লেখালেখি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেই বিষয়েই বলি।
জাহানারা ইমাম নিউইয়র্ক গেছেন, আমার তার সঙ্গে খুব পরিচিত হওয়ার শখ। আমি তাই খুব কুণ্ঠিতভাবে তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘আপনি আমাকে চিনবেন না, আমার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের খুব বড় লেখক, আমি তার ছোটভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল।’
জাহানারা ইমাম আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাকেও চিনি। আমি তোমার সায়েন্স ফিকশন কপোট্রনিক সুখ দুঃখ পরেছি’ তারপর আমার লেখালেখি নিয়ে খুব দয়ার্দ্র কিছু কথা বললেন। শুনে আমি একেবারে হকচকিয়ে গেলাম।
আমি তখন আমেরিকায় থাকি। দুই-চারটা বই দেশে ছাপা হয়েছে, সেগুলো আমার হাত পর্যন্ত পৌঁছায় না, দেখতে কেমন, পড়তে কেমন জানি না। কেউ পড়ছে কি-না তাও জানি না। জাহানারা ইমামের কথা শুনে আমার ভেতরে ম্যাজিকের মতো কিছু একটা ঘটে গেল, আমার মনে হলো তার মতো একজন মানুষ যদি আগ্রহ নিয়ে আমার বই পড়ে থাকেন তাহলে এখন থেকে আমি নিয়মিতভাবে লিখব।
সেই থেকে আমি নিয়মিতভাবে লিখে আসছি। সব দায়দায়িত্ব শহীদ জননী জাহানারা ইমামের।
১৪. পরিবারের বাইরেও আপনার অনেক পরিচয়- শিক্ষক, লেখক, তথ্য প্রযুক্তিবিদ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংগঠক-সক্রিয় কর্মী। কোন কোন পরিচয়টা দিতে আপনার ভালো লাগে?
* শিক্ষক।
১৫. আপনার নিজের রচনার মধ্যে কোনগুলো আপনার প্রিয়?
* আমি ঠিক জানি না এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব কি-না! আমার স্মৃতি খুব দুর্বল, তাই আগে কী লিখেছি মনে থাকে না। [খুব আশঙ্কা আছে, আগে লেখা কোনো একটা কাহিনী আবার লিখে ফেলব!] কিছুদিন আগে হঠাৎ করে আমার পুরনো একটা বই পড়তে পড়তে মনে হলো, ‘আরে, ভালোই তো লিখেছিলাম!’
কাজেই বলা যেতে পারে, যে লেখালেখিগুলো আমি ভুলে গেছি সেগুলো যথেষ্ঠ প্রিয়।
১৬. নিজের লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
* আমাদের বাচ্চাদের বিজ্ঞান এবং গণিতের পাঠ্যবইগুলোর ভাষা খুবই কটমটে বিজ্ঞানের সহজ বিষয়গুলোও জটিল করে লেখা হয়। আমার দুটি ইচ্ছা এবং পরিকল্পনার একটি হচ্ছে তাদের জন্য সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের বইগুলো লিখে দেওয়া। [কাজ শুরু করেছি!]
১৭. আপনি যতই বলুন না কেন, আপনি শুধু কিশোরদের জন্য লিখে থাকেন; তারপরও বড়দের জন্য লেখা ‘একজন দুর্বল মানুষ’ কিংবা ‘রঙিন চশমা’ ইত্যাদি গ্রন্থে আমরা পরিণত বয়স্ক পাঠকের রচয়িতাকেই পাই। পরিণত পাঠকদের জন্য লিখতে আপনার দ্বিধা কেন?
* আমার কোনো দ্বিধা নেই, ভয় আছে। ছোট বাচ্চারা তাহলে আমাকে খুন করে ফেলবে। তারা যদি আমাকে অনুমতি দেয় তাহলে মুক্তিযুদ্ধের ওপর আমার একটা বড় উপন্যাস লেখার ইচ্ছা আছে। এটি হচ্ছে আমার জীবনের দ্বিতীয় ইচ্ছা। এটা যদি শেষ করতে পারি তাহলে আমি মনে করব আমার দায়িত্বের একটা ধাপ শেষ হলো। তখন পরের ধাপ নিয়ে কাজ শুরু করব।
১৮. আপনার প্রিয় লেখক কারা?
* এই প্রশ্নেরও মনে হয় উত্তর নেই। লেখকদের নাম বলে শেষ করা যাবে না। কোনো কোনো লেখক হয়তো শৈশবে বা কৈশোরে খুব প্রিয় ছিলেন, এখন বড় হয় গেছি বলে তার লেখা পড়ি না, কিন্তু আমার প্রিয় লেখকের তালিকায় অবশ্যই তার নাম থাকতে হবে। আবার এই মুহূর্তে যে লেখকের লেখা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছি তার নামটিও থাকতে হবে, কাজেই তালিকাটি শেষ করতে পারব না।
তবে প্রিয় কবির বেলায় কাজটি খুব সহজ। আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ। আগে সবসময় আমার ব্যাকপেকে তার একটা বই থাকত, এখন আমি আমার Kindle ই-বুক রিডারে তার বই রাখি! [যারা Kindle ই-বুক রিডার বলতে কী বোঝায় জানেন না তাদের জন্য বলছি : পৃথিবীতে বই প্রকাশনার যুগে একটা বিপ্লব ঘটেছে, মানুষ আজকাল কাগজের বই না পড়ে ই-বুক রিডারে বই পড়া শুরু করেছে। এর মাঝে সেটা প্রায় বইয়ের মতো হয়ে গেছে, একটু অভ্যাস হয়ে গেলে কোনো সমস্যাই হয় না। শরহফষব একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড, তাদের ই-বুক রিডার থেকে যে কোনো সময় যে কোনো বই কিনে এক মিনিটের মাঝে পড়তে শুরু করা যায়। আগে বই কিনে রাখতাম পরে পড়ব বলে, পড়া হতো না। এখন বই কিনি আর পড়ি। কী মজা!]
১৯. কোন কোন লেখকের লেখায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন?
* যার লেখাই পড়ে আনন্দ পেয়েছি তার লেখাতেই অনুপ্রাণিত হয়েছি। একটি বই যদি আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় তাহলে সেটা মার্ক টোয়েনের লেখা টম সয়ার। কৈশোরে সেই বই পড়ে আমার মাথা ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল_ সেই থেকে আমি তার মতো করে লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
২০. সমকালের পক্ষ থেকে আপনাকে ৫৯তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
* দিলেন তো মনে করিয়ে। মনে ছিল না ভালোই ছিলাম! এই বয়সে কে জন্মদিনের কথা মনে করতে চায়?